মরীচিকা – অনন্যা দাশ

মরীচিকা – অনন্যা দাশ

আমার নাম শৌভিক সেন। আমার একটা পরিচয় হল আমি একটা খুন করেছি, তবে আমার সেই পরিচয়টা কেউ জানে না, অন্তত আমি তাই মনে করি। আমার যে পরিচয়টা সবাই জানে সেটা হল আমি গার্মেন্টস ইন্টারন্যাশনালের মালিক। আমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সবাই আমাকে সমীহ করে। আসলে যে আমি খুব একটা হিংস্র প্রকৃতির তা কিন্তু নয়, তবে আমি একটু বেশি পরিমাণে স্বার্থপর। অনেকেই হয়তো সেটা মানতে পারবে না কারণ আমি বহু অনাথাশ্রম, মহিলা সংস্থা ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ দিই— কিন্তু সেটাও স্বার্থের কারণে। আসলে কাগজে আমার নাম বড় বড় হরফে বেরোলে আমার খুব ভালো লাগে। আর ছবি বেরোলে তো কথাই নেই! আমি একটা বিলাসবহুল বাড়িতে থাকি, অনেকেই আমাকে টাকার কুমির বলে। আমি অবশ্য তাতে রাগি না, বরং আমার ভালোই লাগে, কারণ অনেক কষ্ট করে এই অর্থ আমি উপার্জন করেছি!

আমার বাবা ছিল সাধারণ এক কারখানার কর্মী। মোটামুটি সংসার চলে যেত আমাদের। আমার যখন আট বছর বয়স তখন একদিন অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করতে গিয়ে মেশিনে বাবার ডান হাতটা কাটা যায়। ব্যস, তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় আমাদের চরম দুঃখের দিন। বাবা চাকরি তো হারালই এবং মানসিক দিক থেকেও এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল যে, আর কিছুই করতে পারত না। মা বাড়িতে বাড়িতে বাসন-মাজা, কাপড়-কাচা, রান্না-করা শুরু করল। যদিও মার এত কষ্ট সত্ত্বেও স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়নি আমার। মা বড়লোকদের বাড়িতে কাজ করতে যেত— কোনো কোনোদিন শরীর খারাপ হলে আমাকে দিয়ে বলতে পাঠাত। ওদের গাড়ি, আসবাবপত্র, ওদের ছেলেমেয়েদের খেলনা দেখে আমি মনে মনে ভাবতাম আমাকে বড় হয়ে এইরকম বাড়িতে থাকতে হবে, গরিবের জীবনে আমি বেশিদিন থাকব না। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বলত, ‘মন দিয়ে পড়াশোনা কর বাবা, তাহলেই অনেক দূর যেতে পারবি।’ আমি তাই করতাম। একটা বস্তিতে থাকতাম আমরা। আশপাশের অন্য ছেলেমেয়েরা যখন গালাগালি, খিস্তিখেউড় করত আমি তখন দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা করতাম। নিজেকে বারবার বলতাম, আমি ওদের মতো নই, আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। আর গেলামও, স্কুলে ভালো রেজাল্ট করে কলেজে ঢুকলাম। এম কম পাশ করে গার্মেন্টস ইন্টারন্যাশনালে চাকরিতে ঢুকলাম, আর সেটাই হল আমার জীবনের যাকে বলে ‘টার্নিং পয়েন্ট’। গার্মেন্টস ইন্টারন্যাশনাল একটা ছোট প্রাইভেট কোম্পানি ছিল। মালিক আলোময় সরকার নিজের হাতে সেটাকে গড়ে তুলেছিলেন। আমি প্রচণ্ড খাটতাম, রাতদিন এক করে ওখানেই পড়ে থাকতাম। খুব শিগগিরই আলোময়বাবুর নজরে পড়লাম আমি। আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা শুনে খুব খুশি হলেন উনি, নিজের বাড়িতেও নিয়ে গেলেন। সেখানেই আমার আলাপ হল শ্রেয়ার সঙ্গে।

শ্রেয়া আলোময় সরকারের একমাত্র মেয়ে। দেখতে মোটামুটি সুশ্রী কিন্তু আমার কাছে সে যেন জাদুর জগতের চাবিকাঠি। সেই থেকে শুরু হল আমার জীবনের আরেক অধ্যায়— প্রেমকে ঘাড় ধরে আমার জীবনে টেনে নিয়ে এলাম আমি। ফুল, কবিতা, চকোলেট সব কিছু দিয়ে শ্রেয়ার মন কাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। বেশিদিন লাগলও না, তিনমাসের মধ্যেই গলে গেল সে! আরও তিন মাস লাগল ওর মা-বাবাকে রাজি করাতে। শেষ পর্যন্ত তাঁরাও মত দিলেন, কিন্তু একটা শর্তে— বিয়ের পর আমাকে ঘরজামাই হয়ে ওনাদের বাড়িতেই থাকতে হবে। আমি এককথাতেই রাজি। আমার নিজের মা-বাবা ততদিনে গত হয়েছেন, ফলে পিছুটান বলতে কিছু নেই।

শুভ দিনক্ষণ দেখে আমার সঙ্গে শ্রেয়ার বিয়ে হয়ে গেল। শ্রেয়ার সঙ্গে ওদের বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম আমি। বিয়ের পর কিন্তু আমি থেমে যাইনি, ঠিক একইভাবে কাজ করে যেতাম আলোময়বাবুর কোম্পানিতে। শ্রেয়া প্রায়ই বলত, ‘এত খাটো কেন? মাঝে মাঝে তো বিশ্রাম নিতে পারো, বাবা কিছু বলবে না!’

আমি হেসে বলতাম, ‘বা রে! নিজেদের কোম্পানির জন্যে খাটব না তো কার জন্যে খাটব?’

দিন গড়িয়ে চলল। বিয়ের পাঁচ বছর বাদে একটা দুর্ঘটনায় শ্রেয়ার মা আর বাবা দুজনেই মারা গেলেন— না, আমার কোনো হাত ছিল না সেটাতে। আমি আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে রাজি ছিলাম। যাই হোক, উইলে দেখা গেল বাড়িটা শ্রেয়ার আর কোম্পানিটা আমার! উত্তেজনায় আমি সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারিনি! শ্রেয়া কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল আর আমি সারারাত জেগে ভেবেছিলাম, এখন কী করব!

পরদিন থেকে আমি গার্মেন্টস ইন্টারন্যাশনালের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। কিছু বয়স্ক লোক আমার নেতৃত্বটা ভালোভাবে নিতে পারছিল না। আমি তাদের সসম্মানে রিটায়ার করার প্রস্তাব দিতে তারা মেনে নিল। তাতে আমার লাভই হল, আমি আমার মতন উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকেদের চাকরি দিতে শুরু করলাম, চড়চড় করে বাড়তে লাগল কোম্পানিটা। খুব শিগগিরই আমরা ভারত ছেড়ে বিদেশেও মার্কেটিং শুরু করলাম। কাজের চাপ বেড়েই চলল। শ্রেয়াকে তাই খুব কম সময়ই দিতে পারতাম। ও কী সব ক্লাব, চ্যারিটি ইত্যাদি নিয়ে থাকত, ঠিক খেয়ালও করতাম না। তবে ও যখন যা চেয়েছে কখনও ‘না’ বলিনি। এইভাবেই চলছিল সবকিছু— এমন সময় একদিন স্বাগতার আবির্ভাব হল।

আলোময়বাবুর সময় থেকে মিসেস জোসেফ চেয়ারম্যানের সেক্রেটারি ছিলেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা, খুবই এফিশিয়েন্ট এবং নিখুঁত কাজ। ওনাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু ওনার ষাট বছর বয়স হতে উনি রিটায়ার করবেন ঠিক করলেন। ওনার মেয়ে নাকি বিয়ে হয়ে নাগপুরে সেটল করেছে, ওখানে কিছুদিন কাটাতে চান, ইত্যাদি ইত্যাদি! কী আর বলব? রাজি হলাম। তবে বললাম, ‘আপনাকে আমি যেতে দেব মিসেস জোসেফ, তবে নতুন সেক্রেটারি কিন্তু আপনাকেই ঠিক করে দিয়ে যেতে হবে। ওসব শ-য়ে শ-য়ে লোককে ইন্টারভিউ আমি করতে পারব না। স্মার্ট, চৌকশ একজন কাউকে আপনার জায়গায় বসিয়ে আপনার কাজগুলো শিখিয়ে দিলেই আপনার ছুটি!’

মিসেস জোসেফ আমার কথাতে রাজি হলেন। সত্যি বলতে কী আমাকে একেবারেই বিরক্ত করেননি। ওনাকে কথাটা বলার দু-মাস পর উনি স্বাগতার সঙ্গে আমরা আলাপ করিয়ে দিলেন। ভালোই লাগল ওর সঙ্গে কথা বলতে। স্বাগতা চলে যাওয়ার পর মিসেস জোসেফ আমাকে বললেন, ‘এই মেয়েটাকেই আমি বেছেছি— আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে একে অফার লেটার পাঠিয়ে দিতে পারি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার কোনো আপত্তি নেই, আপনি পাঠিয়ে দিন। আপনি যদি মনে করেন ও যোগ্য, সব কাজ হ্যান্ডেল করতে পারবে, তাহলে আজই ওকে অফার লেটার পাঠিয়ে দিন, ও জয়েন করলেই আপনার ছুটি!’

এইভাবেই স্মার্ট, সপ্রতিভ ঝকঝকে ছাব্বিশ বছরের স্বাগতা আমার সেক্রেটারি হয়ে আমার অফিসে ঢুকল।

স্বাগতা সত্যি খুব কাজের মেয়ে। মিসেস জোসেফের অভাব ও আমাকে একদিনের জন্যেও বুঝতে দেয়নি। সব সময় মুখে হাসি লেগেই আছে। ওর হাসি দেখলে যেন আমার দিনগুলো বেশি ঝলমলে হয়ে উঠত। কোনো কাজে ‘না’ বলত না স্বাগতা, সব কাজ শিখে নিতে রাজি।

শ্রেয়ার সঙ্গেও একদিন আলাপ করিয়ে দিলাম স্বাগতার। আমি কাজপাগল বলে দুর্নাম আছে, কিন্তু ব্যভিচারী দুর্নামটা নেই, কারণ আমি খুব সাবধানী, তাই শ্রেয়া স্বাভাবিকভাবেই স্বাগতার সঙ্গে কথাটথা বলল। ওহ, বলা হয়নি, এর মধ্যে আমার আরও অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি গাড়ি আর হেলিকপ্টার দুটোই চালাতে শিখেছি এবং নিজস্ব দুটো কার আর একটা হেলিকপ্টারও কিনেছি। যখন-তখন সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন ব্রাঞ্চে আর ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে যাই। লোকে বেশ চমকে টমকে যায়, তাতে আমার খুব মজা হয়। ওই যে কথায় আছে না, ‘দা সিপ অফ পাওয়ার ইজ ভেরি অ্যাডিকটিভ।’

স্বাগতার মায়াজালে আমি ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়তে লাগলাম। ওরও যে আমাকে ভালো লাগে সেটা ও বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিত। ওর মতন একজন সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে আমার মতন ছেচল্লিশ বছরের এক আধবুড়োকে পাত্তা দিচ্ছে সেটা ভেবেই আমি পুলকিত ছিলাম। মেয়েরা যে তাদের বসেদের সঙ্গে প্রায়ই এই রকমটা করে থাকে সেটা আমার জানা ছিল না। যাই হোক, এক ভ্যালেনটাইন্স ডে-তে স্বাগতা আমাকে একটা কার্ড দিল। সেদিন সারাদিন আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কার্ডটা নিয়ে ভাবলাম। বিকেল সাতটা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে কী মনে হল স্বাগতার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ফাইল হাতে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে, যদি দেখি ওর সঙ্গে কেউ রয়েছে তাহলে ওকে ফাইলটা ধরিয়ে দিয়ে চলে আসব। ওর বাড়িতে গিয়ে বেল দিতেই স্বাগতা এসে দরজা খুলল। আমাকে দেখে খুব আশ্চর্য হল, ‘স্যার আপনি? আসুন আসুন, কিছু দরকার আছে নাকি?’

‘না, না, তেমন কিছু নয়। এই ফাইলটা তোমাকে দিতে এলাম। তুমি এটা পড়ে রাখলে কালকের মিটিংয়ে তোমার সুবিধা হবে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পড়ে রাখব। তবে আপনাকে একবারটির জন্যে হলেও ভিতরে আসতে হবে, স্যার! আপনি দরজা থেকে চলে গেলে ভীষণ পাপ হবে আমার!’

‘নাহ, মানে আজ তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে— তোমার অন্য প্ল্যান ট্যান…’

‘আমার অন্য কোনো প্ল্যান নেই!’ বলে স্বাগতা আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে গেল বাড়ির ভিতর।

সুন্দর ছিমছাম বাড়ি। প্রচুর গাছপালা রয়েছে ঘরের মধ্যেই। স্বাগতা জল আর মিষ্টি নিয়ে এল আমার জন্যে। আমাকে বলল, ‘আমি কিন্তু আজকে চিংড়ি মাছ রান্না করেছি স্যার, আপনাকে খেয়ে যেতেই হবে!’

আমি এমনিতেও প্রায়ই ক্লায়েন্টদের সঙ্গে হোটেলে খেয়ে বা দেরি করে বাড়ি ফিরি, তাই শ্রেয়া আর আমার জন্যে অপেক্ষা করে না। ও খেয়ে আমার খাবার টেবিলে রেখে টিভি দেখতে চলে যায়— আর বেশি রাত হলে শুয়েও পড়ে। তাই আমি স্বাগতার হাতের রাঁধা চিংড়ি খেতে রাজি হলাম। আর সেইদিন থেকে স্বাগতার সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্কের সূত্রপাত হল। ওর রূপের মোহিনী ঢেউয়ে আমি একেবারে ভেসে গেলাম।

.

আমি রাতে রোজই দেরি করে ফিরতাম তাই সেটা আর নতুন কিছু নয় বলে শ্রেয়ার সন্দেহের কোনো কারণ ছিল না। অফিসে আমি আর স্বাগতা আগের মতন বস আর সেক্রেটারি হয়েই রইলাম। আমি ওকে সাবধান করে দিয়েছিলাম যে, অফিসের লোক আমাদের নিয়ে গসিপ করুক সেটা আমি চাই না মোটেই, তাই অফিসে এতটুকু অন্তরঙ্গতা দেখানো চলবে না! সেই কারণে অফিসের কেউ ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা জানতে পারেনি।

ভালোই চলছিল এইভাবে মাস ছয়েক, তারপরই গন্ডগোলটা হল।

স্বাগতাকে আমি খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলাম, ‘দেখো আমি কিন্তু কোনো কমপ্লিকেশান চাই না!’

ও আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে, ও বার্থকন্ট্রোল পিলস নিচ্ছে এবং আমি সে-ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আমিও তাই ওসব নিয়ে ভাবিনি। সেই ভ্যালেনটাইন্স ডে-র ছ’মাস পরে একদিন বিকেলে স্বাগতার বাড়ি গিয়ে দেখি ও বেশ লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরেছে, সঙ্গে গয়নাও পরেছে। এমনিতে বেশিরভাগ সময় ও সালোয়ার কামিজ বা জিন্স, অথবা স্কার্ট আর টপ পরে থাকে। খাবার ঘরে গিয়ে দেখি আমার পছন্দের সব রান্নাও করেছে। বড় বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃদু গানের শব্দে খেতে বসার সময় আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার, আজ এত আয়োজন? কারও জন্মদিন নাকি?’ আমার নয় সেটা অবশ্য জানতাম।

স্বাগতা অল্প হেসে বলল, ‘না, না, আমার জন্মদিন তো জানুয়ারি মাসে, কবে হয়ে গেছে! আবার আসছে বছর হবে।’

‘তাহলে এত সব?’

‘একটা ভালো খবর আছে।’

‘কী খবর?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘খেয়ে নাও তারপর বলছি।’

‘তুমি এখনও চিনলে না আমায়? যতক্ষণ না তুমি বলবে ততক্ষণ আমি খেতেই পারব না!’

স্বাগতা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আই অ্যাম প্রেগনেন্ট!’

আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম। পিছনের চেয়ারটা উলটে পড়ে গেল। রাগে আমার সারা শরীর তখন কাঁপছে।

‘তুমি বলেছিলে তুমি প্রিকশান নিচ্ছ!’

‘যখন বলেছিলাম তখন নিচ্ছিলাম, তারপর বন্ধ করে দিয়েছিলাম!’

‘হাউ ডেয়ার ইউ! এনিওয়ে, তোমাকে অ্যাবর্সন করাতে হবে।’

‘না!’

স্বাগতা ওই একটা কথা বলে নিজের ‘ডেথ ওয়ারান্টে’ সই করে ফেলল।

আমি আর খেলাম না। বাড়ি চলে এলাম। সারাটা পথ ভাবলাম, কী করব। শ্রেয়াকে ডিভোর্স করে স্বাগতাকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এত কিছু করে যে বাড়ি আর কোম্পানি আমার হাতে এসেছে তার একচুলও আমি ছাড়তে রাজি নই। বাড়িটা তো ইনফ্যাক্ট শ্রেয়ার নামে, আর ও কোনো চাকরি করে না বলে ওকে যে পরিমাণ খোরপোশ দিতে হবে সেটা ভাবলেই আমার মুখটা বিস্বাদ হয়ে উঠছিল। শুধু তাই নয়, যে স্ক্যানডালটা হবে সেটা কোম্পানির পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক হবে। শৌভিক সেন তার সেক্রেটারির সঙ্গে ফুর্তি করে বেড়িয়েছে— কাগজে ওইসবো বেরলে আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে! আর সবচেয়ে বড় কথা, স্বাগতার সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার করার কোনো বাসনাই আমার নেই।

পরদিন স্বাগতা অফিসে এল না। টেনশানে আমি সারাদিন কোনো কাজ করতে পারলাম না। তখনই ঠিক করে ফেললাম— নাহ, এভাবে চলতে পারে না! ওকে আরেকবার বুঝিয়ে দেখব, না বুঝলে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে, কারণ যত দিন যাবে লোক জানাজানি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

স্বাগতাকে ফোন করে ওর খবর নিলাম। ও বলল, ওর শরীরটা ভালো লাগছিল না তাই ও অফিসে আসেনি।

বিকেলে ওর বাড়িতে গিয়ে ওকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু মেয়েটা এতটাই বোকা যে, কিছুই শুনল না। এই প্রথম আমার স্বাগতাকে বুদ্ধিহীন মনে হল। খুব দৃঢ় গলাতেই ও বলে চলল, ‘অ্যাবর্শান আমি করাব না! তুমি শ্রেয়াদিকে ডিভোর্স করে আমাকে বিয়ে করবে কিনা সেটা তোমার ব্যাপার!’

‘ঠিক আছে, আমি একটু ভেবে দেখি। ও হ্যাঁ, কালকে একটা সাইট ভিজিট আছে। তুমি হেলিকপ্টারে যেতে পারবে, না অন্য কাউকে বলব?’

‘আমি পারব!’

‘ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে তুলে নেব সকাল সকাল।’

এর আগেও স্বাগতা অনেকবার আমার সঙ্গে সাইট ভিজিটে গেছে, তাই ও কিছু সন্দেহ করল না। ওকে যেটা জানালাম না সেটা হল এই ভিজিটে শুধু আমরা দুজন যাব, পিল্লাই বা শর্মা কেউ থাকবে না!

স্বাগতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার হেলিকপ্টারটাকে দেখতে গেলাম। জরুরি কিছু জিনিস হেলিকপ্টারে রেখে এলাম। রাতে যখন বাড়ি ফিরলাম দেখলাম শ্রেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। সারারাত আমার ঘুম হল না— প্ল্যানটা বারবার মাথায় ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম— কোথাও কোনো ফাঁকফোকর থেকে যাচ্ছে না তো?

পরের দিন, খুব ভোরবেলা অফিসে পৌঁছে স্বাগতাকে ফোন করলাম। ওকে বললাম, ওকে বাড়ি থেকে তুলতে একটু অসুবিধা হবে, তাই ও যদি সোজা যেখানে হেলিকপ্টার থাকে সেখানে চলে আসে তাহলে আমার খুব সুবিধা হবে।

স্বাগতা রাজি হল।

আমি অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা হেলিকপ্টারের হ্যাংগারে পৌঁছে গেলাম। সেটা আর কিছুই নয়, শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা খালি জায়গায় একটা গুদামঘর মতন। ঝড় বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে হেলিকপ্টারটা ওই গুদামঘরটার মধ্যে রাখি। জায়গাটার আশেপাশে কোনো লোকবসতি নেই।

কিছুক্ষণ পর স্বাগতা এল। স্কুটিটাকে বাইরে পার্ক করে গুদামের ভিতর চলে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে বলল, ‘পিল্লাই আর শর্মাজিরা যাচ্ছেন না?

আমি গ্লাভস-পরা হাত দুটোকে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললাম, ‘নাহ, আজ শুধু আমি আর তুমি!’

ও মনে হয় একটু ভয় পেল, কী একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই আমি পকেট থেকে তারটা বার করে ওর গলায় পেঁচিয়ে একটা টান মারলাম। জলজ্যান্ত সুন্দরী মেয়ে থেকে একটা কুৎসিত মৃতদেহে পরিণত হয়ে যেতে স্বাগতার বেশিক্ষণ লাগল না। কুৎসিত, কারণ, ওর মুখটা নীলচে-বেগুনি মতন হয়ে গিয়েছিল, জিভ, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল, নাঃ,আর তাকাতে পারছিলাম না আমি।

গাড়ির পিছন থেকে ত্রিপলটা বার করে সেটা দিয়ে ওর দেহটাকে গোল করে পাকিয়ে মুড়ে ফেললাম। স্বাগতার ত্রিপলে মোড়া দেহ, ওর হাতব্যাগ, ফোন, স্কুটি সব কিছু হেলিকপ্টারে তুলে রওনা দিলাম দার্জিলিংয়ে আমাদের ফ্যাক্টরির পথে। ফ্লাইট প্ল্যান? ওসব কে দেবে! আমি প্রায়ই কোনো ফ্লাইট প্ল্যান জমা দিই না— হেলিকপ্টার তো!

পথে হঠাৎ মনে হল, আমি একটা নয়, দুটো খুন করলাম! যদিও ওই রক্তমাংসের পিণ্ডের প্রতি আমার কোনো অনুভূতিই নেই।

ফ্যাক্টরি থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলের মধ্যে হেলিকপ্টার নামিয়ে স্বাগতা, ওর হাতব্যাগ, স্কুটি সব কিছু একটা গভীর খাদে ফেলে দিলাম। অতল গভীরে সব মিলিয়ে গেল। একবার মনে হল, স্বাগতা কি ওর কোনো আত্মীয় বা বন্ধুকে আমার কথা বলেছিল? ওর মা-বাবা নেই সেটা জানতাম, আর ও ছিল একমাত্র সন্তান…যাক, ওসব ভেবে এখন লাভ নেই।

ফ্যাক্টরি পরিদর্শন শেষ করে সব কিছু সেরে যখন বাড়ি ঢুকলাম তখন অনেক রাত। শ্রেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। মনটা বেশ হালকা লাগছিল।

.

পরদিন অফিসের কাজকর্ম দিব্যি চলছিল, এমন সময়, বিকেল পাঁচটার সময়, শ্রেয়া আমার অফিসে এসে হাজির হল। আমি একটু চমকেই উঠলাম— ও তো কোনোদিন এইভাবে অফিসে আসে না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার, তুমি এখানে?’

‘স্বাগতা বলেছিল অনাথ-আশ্রমের বাচ্চাদের দেখতে আজকে ও আমার সঙ্গে যাবে। ও বলেছিল, ও ভলেন্টিয়ারি করবে, তা কোথায় সে?’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘স্বাগতা তো দিন তিনেক হল আসছে না— জানি না শরীর খারাপ হয়েছে হয়তো।’

‘সে কী! একটা মেয়ে তিনদিন ধরে কাজে আসছে না আর তোমরা ওর কোনো খোঁজখবর নাওনি! কেমন অফিসের কলিগ তোমরা! দেখি, আমার কাছে ওর মোবাইল নম্বরটা আছে, আমিই কল করি?,’ বলে ডায়াল করতে শুরু করে দিল।

স্বাগতার মোবাইল ফোন তো পাহাড়ের অতল খাদে, তাই কারো তোলার কথা নয়। শ্রেয়া কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, ‘হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। যাই ওর বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে আসি।’

ওর বাড়িতে শ্রেয়া একবার গিয়েছিল কী একটা পুজোতে। আমি রাগ চাপতে চাপতে বললাম, ‘যাও, তবে যদি কারো শরীর খারাপ থাকে তাকে ডিস্টার্ব করা কি ঠিক?’

শ্রেয়া অকাট্য যুক্তি দিয়ে বলল, ‘যদি বেশি শরীর খারাপ হয়ে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে তাহলে? একা একা থাকে মেয়েটা!’

শ্রেয়া চলে গেল। আমি গোঁজ হয়ে বসে রইলাম। শেষে কিনা আমারই বউ পরোপকার করার ঠেলায় আমাকে ধরিয়ে দেবে? যাক, বেশি ভেবে লাভ নেই, এই ভেবেই বসে রইলাম।

শ্রেয়ার ফোন এল ঘণ্টা দুয়েক বাদে। বলল, ‘স্বাগতা মনে হয় বাড়িতে নেই। পাশের বাড়ির মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনিও কিছু জানেন না। আমরা দুজনে দরজা ধাক্কা দিলাম, কিন্তু কেউ খুলছে না দেখে আমি পুলিশে খবর দিয়েছি।’

‘সে কী!’ আমি আঁতকে উঠলাম, ‘ও যদি কয়েক দিনের জন্যে কোথাও গিয়ে থাকে তাহলে? ফিরে এসে দেখবে দরজা ভাঙা!’

‘কী জানি বাবা, আমার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। ও যদি অন্য কোথাও যেত তাহলে তো তোমাকে বলে যেত!”

‘কিন্তু তা বলে এখুনি পুলিশ!’ ঘটনার গতিপ্রবাহ দ্রুত আমার আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল।

‘তুমিও এখানে চলে এসো, কারণ, পুলিশ এলে ওদের অনেক প্রশ্ন থাকবে— আর আমি একা ওদের সামলাতে পারব না!’

অগত্যা আমি রোজকার মতো অফিস থেকে স্বাগতার বাড়ির দিকে রওনা হলাম। আগেই বলেছি, আমি বিশেষ সাবধানী, স্বাগতার পাড়াতে আমি ওই প্রথম দিন ছাড়া কোনোদিন গাড়ি নিয়ে ঢুকিনি। গাড়ি অন্য পাড়ায় রেখে হেঁটে আসতাম— তা-ও অন্ধকার নামার পর। পাড়ার কেউ যাতে আমাকে না দেখতে পায় সেই চেষ্টাই করতাম— টুপিও থাকত মাথায়। তাই গাড়ি নিয়ে স্বাগতার পাড়ায় ঢুকতে আমার ভয় ছিল না। আমার গাড়ি এখানে কেউ চিনতে পারবে না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

স্বাগতার বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন পুলিশ এসেছে। একজন বৃদ্ধ ইন্সপেকটর, যাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে এসেছেন। তাঁর মুখে অসংখ্য বলিরেখা আর বেশ ঝুলো একজোড়া পাকা গোঁফ। সঙ্গে একটা ছোকরা হাবিলদার। দরজার তালা ভাঙা হয়ে গেছে।

আমাকে দেখে বুড়ো ইন্সপেক্টার বলে উঠলেন, ‘আপনি কে?’

‘আমার নাম শৌভিক সেন। আমি স্বাগতার বস। আমার মিসেসই আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছে। আমি বারবার বলেছিলাম কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে— হয়তো কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি গেছে।’

‘আগেও কি এইরকম ভ্যানিশ হয়েছেন স্বাগতাদেবী?’ লোকটা বুড়ো হলে কী হবে, চোখের দৃষ্টি অসম্ভব তীক্ষ্ন। ‘না’ বলতে বাধ্য হলাম আমি।

‘দেখুন স্যার, আমার মনে হয় আরও কয়েকটা দিন দেখে তারপর…’

আমার মুখ থেকে কথা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে উনি বললেন, ‘আমার নাম অনিল শর্মা— আপনি আমাকে মিস্টার শর্মা বলে ডাকতে পারেন, আর এই হল অরিজিৎ কর্মকার, বাচ্চা ছেলে, নতুন কাজ শিখছে। ও, কী যেন বলছিলেন আপনি… ও হ্যাঁ, কিছুদিন অপেক্ষা করতে? সে না হয় করা যাবে। আমাদের সব কিছুতে এমনিতেই অনেক সময় লেগে যায়। ওই যে হিন্দি ফিলিমে দেখেন না সব কিছু হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ আসে— সেইরকম আর কী! তা স্বাগতা ম্যাডাম কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন কোথায় যাচ্ছেন বা কিছু?’

‘না, ও তিনদিন ধরে অফিসে আসছে না— আমাকে কিছুই বলেনি।’

‘সিঙ্কে দুধের গেলাস নামানো রয়েছে, খুব বেশি পুরনো তো মনে হচ্ছে না। হুঁ! আচ্ছা, উনি অফিসে যাতায়াত করতেন কীভাবে?’

‘ঠিক বলতে পারব না, বাসে-ট্রামে যেত মনে হয়। ও হ্যাঁ, একটা স্কুটিও ছিল ওর।’

‘ও আচ্ছা, সেটাকেও তো দেখছি না,’ বলে শর্মা চারিদিক দেখে বেড়াতে লাগলেন।

আমি ইচ্ছে করে এদিক-ওদিক চারিদিকে হাত দিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, যাতে পরে ফিঙ্গার প্রিন্টিং করে আমার হাতের ছাপ পেলে আমি আজ এখানে আসার ব্যাপারটা ব্যবহার করতে পারি!

শ্রেয়াও এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছিল। হঠাৎ কী মনে হল ইন্সপেক্টরকে বলল,’মিস্টার শর্মা, আমার একটু কাজ আছে, আমাকে যেতে হবে। এই আমার কার্ড, আমার মোবাইল নম্বর ওতে আছে। কিছু দরকার হলে ফোন করবেন, কেমন?’ বলে সে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে কেটে পড়ল।

সারা বিকেল ধরে মিস্টার শর্মা আমাকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করেই চললেন। আমি যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। এই ফাঁকে আমি দেখতে চেষ্টা করছিলাম যে, স্বাগতার ডায়েরি জাতীয় কিছু রাখার অভ্যাস ছিল নাকি— কিন্তু সেরকম কিছু চোখে পড়ল না।

.

বাড়ি যখন ফিরলাম তখন রাত এগারোটা। তখনও শ্রেয়া ফেরেনি দেখে একটু অবাক লাগল। যাই হোক, মিস্টার শর্মা স্বাগতার বাড়িতে কিছু খুঁজে পাননি, তাই কাল অফিসে আসবেন বলেছেন। সেই কারণে আমি একটু আগে অফিসে গিয়ে স্বাগতার ডেস্ক ড্রয়ার সব দেখে এসেছি, গ্লাভস পরতে ভুলিনি অবশ্য। কিছু নেই সেখানেও। আশ্চর্য, মেয়েটার দরকারি কাগজ, ঠিকানার বই কিছুই পাওয়া যায়নি। অবশ্য সেইসব হ্যান্ডব্যাগেও থাকতে পারে, সেটা তো আমি টেক কেয়ার করেছি। খুব খিদে পেয়েছিল। ফ্রিজ থেকে খাবার বার করে খেয়ে নিলাম।

বারোটা নাগাদ শ্রেয়া বাড়ি ফিরল। উদভ্রান্তের মতন চেহারা তার। ওর চোখের চাহনি দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে বলো তো? কোথায় গিয়েছিলে? এত রাত হল কেন?’

শ্রেয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমার সামনের সোফাটায় বসল। ব্যাগ থেকে কী একটা বার করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘এটা তোমার হেলিকপ্টার রাখার গুদাম থেকে পেয়েছি!’

আমি তাকিয়ে দেখলাম, এক পাটি মেয়েদের চটি! আমার মুখে ভূত দেখার মতন ভাব দেখে শ্রেয়া বলল, ‘স্বাগতা কোথায়? দেখো, মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই। আমি জানি ওর কিছু একটা হয়েছে।’

‘কী করে জানো?’ আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

শ্রেয়া কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল, তারপর বলল, ‘সুইসাইড বম্বার বোঝো?’

আমি কিছু বলছি না দেখে শ্রেয়া বলল, ‘স্বাগতা ছিল সুইসাইড বম্বারদের মতন একজন— যারা নিজেদের প্রাণের তোয়াক্কা না করে একটা উদ্দেশ্যের জন্যে প্রাণ দিতে রাজি হয়!’

আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। শ্রেয়া বলে কী!

‘মিসেস জোসেফের সাহায্যে স্বাগতাকে তোমার অফিসে আমিই ঢুকিয়েছিলাম। স্বাগতা আমারই চ্যারিটির অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া একটি মেয়ে। বাবার কোম্পানি হাতে পেয়ে তুমি যে নানান দু-নম্বরি পথে সেটাকে বাড়াচ্ছিলে, মিসেস জোসেফ সেসবই আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু ওনার বয়স হয়েছিল। ঝুঁকি নিয়ে প্রমাণ জোগাড় করার ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনোটাই ওনার ছিল না, তাই আমরা দুজনে মিলে স্বাগতাকে সব কথা জানাই। ও রাজি হতে ওকে কোচ করি আমরা দুজনে। ওর কাজ সহজ হবে না আমরা জানতাম। ঝুঁকিও প্রচুর—সেটাও ওকে বলেছিলাম। কিন্তু ওই বয়সে যা হয়, ওর ভয়ডর তেমন ছিল না।’

শ্রেয়ার কথায় আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল— মহিলা বলে কী! তার মানে আমি বেমালুম না বুঝে সুঝে ওদের ফাঁদে পা দিয়েছিলাম।

শ্রেয়া বলে চলল, ‘তাড়াতাড়ি কাজ সারতে গিয়ে ও তোমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়— হ্যাঁ, আমি সবই জানি। তোমাকে ঘেন্না করি আমি। ওর ওই বাড়ি, স্কুটি সব আমিই কিনে দিয়েছিলাম। ও অনেক প্রমাণও জোগাড় করে ফেলেছিল। তাই আমি ওকে বলেছিলাম ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে, কিন্তু ও বলেছিল যে, স্বার্থের জন্যে তুমি যে মানুষ খুনও করতে পারো সেটাও ও প্রমাণ করে ছাড়বে। প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ওর বানানো। ও অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মেয়ে— মা-বাবা ছাড়া বড় হওয়া যে কত কষ্টকর সেটা ও জানত। ও কোনোদিনই অবাঞ্ছিত কোনো বাচ্চার জন্ম দিত না। আসলে তুমি যে এত তাড়াতাড়ি কিছু একটা করে ফেলবে সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারিনি। আমাদেরই ভুল। প্রতিপক্ষকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিইনি আমরা! স্বাগতা তোমার ফন্দি ধরতে পারেনি, ও ভেবেছিল সত্যি বুঝি কাজ আছে সাইটে।’ শ্রেয়া থামল, ব্যাগ থেকে একটা জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেল। বোতলটা ব্যাগে রেখে ও যে জিনিসটা বার করল সেটা ওর হাতে দেখে আমি বেশ চমকে উঠলাম— একটা রিভলভার!

‘তোমাকে আমি সম্মানের সঙ্গে মরার একটা সুযোগ দিচ্ছি— এক্ষুনি একটা সুইসাইড নোট লেখো যে, তোমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়, আর তারপর এই রিভলভারটা দিয়ে গুলি করে আমি তোমাকে মুক্তি দেব। স্বাগতার কথা কারও মনে থাকবে না। আমি বলে দেব, ও চাকরি নিয়ে অন্য শহরে চলে গেছে। সাধারণ লোকেরা অতশত মনে রাখে না। কী? রাজি তো? নাহলে এক্ষুনি ইন্সপেক্টর শর্মাকে ফোন করে সব বলে দেব— আর চটির প্রমাণ তো আছেই! কোম্পানিতে অসৎ কারবার ধরে ফেলার জন্যে স্বাগতাকে খুন করার অভিযোগে তোমার দশ বছরের জেল তো হবেই। আর যা ঢিঢি পড়বে নামে সেটা না হয় আর নাই বা বললাম!’

শ্রেয়াকে আমি নিরীহ মেয়ে বলেই জানতাম, আর ওর পেটে পেটে কিনা এত বুদ্ধি!

‘তুমি দার্জিলিং ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলে তো? কাছাকাছি কোনো পাহাড়ের খাদে বেচারি মেয়েটার দেহ পড়ে রয়েছে নিশ্চয়ই। নাও, লেখো। তোমার মতো কীটের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! আর চালাকি করার চেষ্টা কোরো না— আমি কিন্তু রিভলভার চালাতে জানি, তোমার পায়ে গুলি করে পুলিশকে বলব যে স্বাগতার ব্যাপারটা বলতে তুমি আমাকেও খুন করার চেষ্টা করছিলে তাই আত্মরক্ষার জন্যে আমাকে গুলি চালাতেই হয়েছে!’

আমি কোথায় গন্ডগোলটা করে ফেললাম সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। হয়তো শ্রেয়াকে আমি তেমন সময় দিইনি বলে ওর মনে আমার প্রতি ক্ষোভ জন্মেছিল। নাকি ওর বাবার তৈরি কোম্পানিকে খানিক অসৎ উপায়ে অনেক বেশি বড় করে তুলছিলাম বলে— কী জানি! পেনটা হাতে নিয়ে একটা সুইসাইড নোট লিখে ফেললাম। শ্রেয়া কঠিন মুখে রিভলভারটা আমার কপালে ঠেকাল, ঠিক ডানহাতি মানুষ আত্মহত্যা করলে যেখানে গুলি লাগা উচিত সেখানে! তারপর…।

.

পুলিশকে ফোন করার আগে শ্রেয়া সরকার সেন আর একটা ফোন করল, ‘অনিল চাচা, তোমার পুলিশের অভিনয় ফাটাফাটি হয়েছিল। তুমি আর বাবলু বাড়তি বকশিশ পাবে। তবে কিছুদিন এদিকটায় এসো না, পুলিশের কারবার চলবে তো। আমি সময় সুযোগ মতন তোমার সঙ্গে দেখা করে নেব।

ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বার করা মেয়েলি জুতোর ওই একপাটি নিজের জুতোর র‌্যাকে অন্য পাটিটার পাশে রেখে দিল শ্রেয়া। ভাগ্যিস শৌভিক মেয়েদের জুতো-টুতোর প্রতি নজর দিত না! হ্যাংগারে আসলে তো কিছুই পড়ে ছিল না, তাই এই জুয়াটা খেলতে হল। একটা প্রচ্ছন্ন হাসি শ্রেয়ার ঠোঁটে খেলেই মিলিয়ে গেল কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *