গোলা – জয়ন্ত দে

গোলা – জয়ন্ত দে

নোটন মার্ডার হল ৷

 নোটনকে মার্ডার করল ছক্কারা ৷ ছক্কারা নোটনকে কীভাবে মেরেছিল এখন আমরা সবাই তা জানি ৷ আমরা মানে আলোদার ছেলেরা ৷ বা পাবলিকের ভাষায় বললে আলোর গ্ৰুপের ছেলেরা ৷

 কিন্তু নোটন যখন বেঁচে, আমরা তখনই আঁচ করতে পেরেছিলাম সে মরতে চলেছে ৷ এই মৃত্যুর আঁচ হয়তো আরও অনেকে করেছিল ৷ তারা আলোদার লোকজন নয় ৷ তারা নোটনকে চেনা বান্ধবনগরের পাঁচ পাবলিক ৷ তারা সাহসে ভর দিয়ে মুখে বলত না ৷ কিন্তু বলত, নির্ঘাত বলত, গিলতে গিলতে এবার লিভার ফেটে মরবে ছেলেটা ৷

 এই লিভার নিয়ে নোটনের নিজেরও চিন্তা ছিল ৷ তাই সকালের ভাতে পেঁপে সেদ্ধ তার চাই-ই ৷ সকালের ভাত মানে ন’টা নাগাদ ঘুম ভাঙার পর ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ কাম সারাদিনের বাড়ির খাবার এটাই ৷ নোটনের পেঁপে সেদ্ধ খাওয়ার মধ্যে লিভারের দর্শন ছিল ৷ সেদ্ধ পেঁপে লিভার চাঙ্গা রাখে ৷ তেমনই ওর অদ্ভুত যুক্তি ছিল এক বেলা ভাতের ৷ নোটন বলত, চার বেলা বাড়ির ভাত খেয়ে লোহা-লক্কড়ের কারবারি হওয়া যায় না ৷

 আমরা আলোদার উদাহরণ দিতাম ৷ বলতাম, এক নম্বর কারবারি তো আলোদা, নোটন হাসত ৷ বলত, আলোদা খোদ কোম্পানি ৷ আর আমরা হলাম লোহা লক্কড়ের খুচরো বিক্রেতা ৷

 তো এই এলাকার এক নম্বর কোম্পানি আলোদা বলত, লোহা লক্কড় কোমরে নিয়ে ঘুরলেই কেউ কারবারি হয় না৷ তোকে সবাই জানে— তুই মাতাল ৷ নেতা সেজেছিস মদো মাতালের ৷

 তবু আমরা সেই মদো মাতালরাও মিলে মিশে আলোদাকে ঘিরে প্রত্যহ নরক গুলজার করি ৷ আর এখানেই আমরা মাঝে মাঝে এঁকে ফেলি নোটনের মৃত্যুদৃশ্য ৷ আমাদের সামনের চেয়ারে নোটন ৷ সে তখন দাঁতে নখ খোঁটে ৷ মরণদৃশ্যটা আমরা এভাবে আঁকি, বান্ধবনগর পোস্ট অফিসের উলটো দিকের সেই গলি ৷ গলিটা এঁকে বেঁকে নোটনের বাড়ির দিকে গেছে ৷ নোটন মধ্যরাতে সেই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরে ৷ রাস্তার ধারে পর পর ক’টা ডোবা আর পুকুর ৷ আমরা বলেছিলাম, সেই পুকুরের কথা ৷ এঁকে ছিলাম, সেই পুকুর ভরা জলের ছবি ৷

 এটা ছিল স্রেফ সাদা কালো একটা দৃশ্য ৷ এখানে যে যেমন খুশি রং দিত ৷ রং ছেটাত ৷ কেউ বলত, জলে একবার পড়লে ও হাঁটু জলে হাবুডুবু খেয়েই শেষ ৷ কেউ বলত, পাঁকে মুন্ডু গুঁজে যাবে ৷ আর নেশার ভারে বাটখারা হয়ে ওই মুন্ডু টপ করে গেঁথে যাবে ৷

 নেশা করে করে নোটনের এখন হাত পা কাঁপে ৷ ও যদি পুকুরে পড়ে আর উঠতে পারবে? আমাদের কথা শুনে নোটন হাসত ৷ বলত, এখানকার সব পুকুরের দম আমি জানি— কেউ আমাকে হজম করতে পারবে না!

 এবার আমাদের আঁকা নোটনের মরণ দৃশ্যে রং দিল আলোদা ৷

 বলল, ছক্কার কথা ৷

 আলোদার কাছের ছেলে নোটন মানতে পারল না এ কথা ৷ ও কাঁপা হাত উঁচিয়ে বলল, ছক্কা ভালো হতে চায় আলোদা ৷

 আলোদা বলল, ছক্কা ক্রিমিনাল ৷

 আজ আমার নাইট ডিউটি ৷ অগত্যা সকালে আলোদার অফিসে ৷ খবরের কাগজ থেকে মুখ নামিয়ে আমি বললাম, এলাকার লোকে কিন্তু আমাদেরও ক্রিমিনাল বলে ৷

 আলোদা বলল, আমাদের বলছিস কেন? বল, তোমাদের!

 আমি বললাম, অবশ্য ক্রিমিনাল বলার আগে পলিটিক্যাল কথাটা জুড়ে দেয় ৷

 আলোদা বলল, ওই জন্যেই তো পার্টিটা ছাড়লাম ৷ সকলের মনে রাখা উচিত বয়েস বাড়ছে ৷ এখনও আমাদের চলতি আছে ৷ যে যেভাবে পারিস ব্যবসা ধান্দা করে গুছিয়ে নে ৷

 আমি চাকরি করি ৷ এমন চার-ছ’জন ৷ আর সবাই ধান্দা খুঁজছে ৷ আর ধান্দার তো এখন একটাই জাতীয় সংগীত— কনস্ট্রাকশন ৷ যে সংগীতের মুখড়া দালালি, অস্থায়ী ইট বালি সাপ্লাই, অন্তরা প্রমোটিং ৷

 আর এইসব কাজকারবার লাগলে ভালো, না লাগলে ছিঁচকে ! তো আমাদের সবার সব রকম ধান্দা ছিল ৷ হাতে কলমে না থাকলেও মনে মনে তো ছিলই ৷ কিন্তু নোটনের একটাই ধান্দা ছিল, সে মদ খাবে ৷ দিনে খাবে, রাতে খাবে, সারা দিন খাবে ৷ আমরা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম সারা দিন খাস না ৷ রাতে খা আর দশটা বাজার আগে বাড়ি ঢুকে যা ৷ নোটন আমাদের কথা শুনত এই পর্যন্তই ৷ পাত্তা দিত না ৷ বলত, এখন আমাদের ভালো টাইম ৷ কোনো ঝামেলা নেই ৷ যখন সাহেব বাগানের চিল্কা, কালী বাড়ির যিশু-নয়নরা ধরলেই দানা ভরে দিত তখনও আমি এমনই থেকেছি ৷

 নোটনের কথায় আলোদা চোখ বন্ধ করল ৷ তারপর আমাদের আঁকা নোটনের সেই মরণ-দৃশ্যের ওপর ভয়ঙ্কর এক পোঁচ কালি বুলিয়ে দিত ৷ বলত, ছক্কারা তোর জন্যে একটাও দানা খরচ করবে না ৷ সেরেফ একটা ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দেবে ৷ নোটন তোর নম্বর লেগে গেছে!

 নোটন দু’হাতের চেটোয় মুখ মুছে আমাদের কথাও মুছে ফেলত ৷ তবে এসব কথায় সব সময়ই ও কিছু একটা বলত বিড় বিড় করে ৷ যা আমরা শুনতে পেতাম না ৷

 এদিকটা আমাদেরই চলতি ৷ আগে আমরাই পার্টি ছিলাম ৷ পার্টির জন্যে ইলেকশন করতাম ৷ আর পার্টি আমাদের পুলিশটা দেখে দিত ৷ আমাদের যা ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি সব ওই ইলেকশনের আগে পিছে ৷ আর ইলেকশনের দিন আমরা খুল্লাম খুল্লা ওয়ান ডে খেলে দিতাম ৷ এতেই আমাদের বারো মাস চলে যেত ৷ পার্টি প্রশাসন আমাদের ৷ ফলে গড়িয়ে খেলেও ফুরোত না ৷ আর বাদবাকি যেটুকু হাত চালাতে হত তা কিছুটা সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায়, কিছু অন্য কোনও দাদা গজালে ৷ তারপর এত বড় টিম, এত বড় এলাকা— ঝামেলা তো আছেই ৷

 তবে ঝামেলা ইদানীং বেড়ে গিয়েছিল পার্টির মধ্যে ৷ পি.এস. পুলক সেনের সঙ্গে আলোদার চিরকেলে খিঁচ ৷ ইলেকশনের আগে আলোদাকে বলা হল, তোমরা বুথ নেবে ৷ ফ্রেশ ছেলে এলাকা চমকাবে ৷ তো ফ্রেশ ছেলেরা এল মহেশতলা থেকে ৷ তারা শেষ তিন দিন থেকে মাল মাংস ধ্বংস করে বুথ চিনল, এলাকার অলিগলি চিনল, বেছে বেছে দু-চারটে বাড়ি, ছ’-আট জন লোক চিনল ৷ ওদের মদ থেকে মেশিন সব দায়িত্ব আলোদার ৷ তারপর ওয়ান ডে ম্যাচ হয়ে গেল ৷ আর শেষে পার্টি ডেকে বলল, তোমাদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন্যে পার্টির দু’পার্সেন্ট ভোট কমেছে ৷

 আলোদা চোখ বন্ধ করে বলল, থার্টি পার্সেন্ট ছাপ্পা, টেন পার্সেন্ট চমকানো ৷ এক-একটা বুথে নাইন্টি সিক্স নাইন্টি সেভেন পার্সেন্ট পোল করিয়ে দিলাম, তবু টু পার্সেন্টের কেস! সমাজবিরোধী! ইদানীং সব ইলেকশন শেষেই এক গীত ৷ পুলক সেন হাসছে ৷

 আলোদা পার্টি ছেড়ে দিল ৷ আলোদার সঙ্গে আমরাও ৷

 তবু এ এলাকায় আলোদাই শেষ কথা বলে ৷ আর শেষ কথা বলার হক যেহেতু আলোদার, ফলে আমাদের কাছে কেসের অন্ত নেই ৷ প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে আমাদের কাছে ৷ তারা সবাই আমাদের দিয়ে আলোদাকে ধরতে চায়৷ তাই তারা প্রথমে আমাদের ধরে ৷ ফলে তারাই আমাদের স্পনসর ৷

 এছাড়া কাউকে না কাউকে পাওয়া যায় যে আমাদের মুরগি হয় ৷ তারপর ফাউয়ের টাকা আছে ৷ কেস মেটানোর ধান্দা আছে ৷ তারও পরে বৃষ্টি আছে, শীত আছে ৷ পকেটে ক্যাশ আছে ৷ নাহলে ধার আছে ৷ এবং সর্বক্ষণ বান্ধবনগর পোস্ট অফিসের সামনে নোটন আছে ৷

 আমি চাকরি করি ৷ খবরের কাগজের চাকরি ৷ দুপুরে বেরিয়ে মধ্য রাতে বাড়ি ফিরি ৷ মাঝে মাঝে রাতে বান্ধবনগরের মোড়ের মাথায় নোটনের দেখা পাই ৷ ও কোনোরকমে চোখ টেনে বলে, তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি পলু ৷ একটু খাবি তো ৷ চিকেন কষা বা রুটি তড়কা যা হোক আনিয়ে নে ৷

 আমি ঘাড় নাড়াই, খাব না ৷ নোটন বলে, তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি— না খেলে একশো টাকা দিতে হবে ৷

 আমি হাসি— আর খেলে?

 নোটনের সোজা হিসেব, ওই একশো ৷ তুই কি ভাবছিস খেলে বেশি নেব?

 শেষ পর্যন্ত অবশ্য রফা হয় ৷ তা এক-একদিন এক-এক রকম ৷ এর মধ্যে বেশির ভাগ দিনই ছিল প্রতিশ্রুতি ৷— আমি পুরো বোতল দেব ৷—আমি চায়না টাউনে নিয়ে যাব ৷ ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ তবে সব হিসেবপত্রের কথা মিটে গেলে প্রতিবার নোটন একটা প্রশ্ন করত ৷— তোর হাতে রোজ বই দেখি, সব বই তুই পড়িস পলু?

 — না, সব বই পড়া হয় না ৷ কিনে রাখলাম, পরে পড়ব ৷ তাছাড়া কখন কোন বই দরকার লাগে ৷ রইল হাতের কাছে ৷

 আমাদের নিয়ে আলোদা খুব বিব্রত ৷ বলত, এটা মদো মাতালের টিম ৷ আলোদার টিমের এরকম নানা ভাগ ৷ কোনোটা মদো মাতাল ৷ কোনোটা লোহালক্কড় মানে অ্যাকশনের ৷ কোনোটা লাফরা টিম ৷ এই লাফরা টিম বিভিন্ন জায়গায় শুধু ঝামেলা পাকায় ৷ আরও একটা টিম আছে, যাদের দেখিয়ে আলোদা বলে— ওদের দেখ, দেখে শেখ ৷ এরা ব্যবসায়ী ৷ আমরা বলি মুখোশ টিম ৷ ধান্দাবাজদের হাট্টিমা টিম টিম! কিন্তু নোটনের কদর সব টিমে ৷ কেন না নোটন হচ্ছে আলোদার টিমের হোল টাইমার ৷

 আসলে অ্যাকশন টিমের ছেলে নোটন ৷ সেই নোটন এখন মদো মাতাল টিমের অবিসংবাদিত নেতা ৷ এই টিমের পুরনো ছেলে দেবু সকালে খায় না ৷ রাত পর্যন্ত কোচিং ক্লাস ৷ ফলে রাতে সময় পায় না ৷ খেলেও মাপ বাঁধা ৷ আর এক পুরনো ছেলে অনু ৷ ও আগের মতো নেই ৷ মুখ চুন করে বলে— বউ ক্যাচাল করে ৷ ছেলেটা বড় হয়েছে ৷

 তবু পুরনো ছেলে অনেকই আছে ৷ যাবেটা কোথায়? আর নিত্য নতুন ছেলে আসছে ৷ ক’দিনে তারা পুরোনো হচ্ছে ৷ আসলে আলোদার ছেলেদের গ্ৰুপ সব সময় আলো করা ৷ কেউ না কেউ থেকেই যায় ৷

 ইদানীং আমরা কয়েকজন কিছুটা ছিটকে গেছি ৷ ছুটির দিন ছাড়া পারতপক্ষে ওদিকে যাই না ৷ গেলেও কোনো ঝামেলায় ঢুকি না ৷ হাবিজাবি গল্প করে কেটে আসি ৷ এখন মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, কী করতে চাইছে ওরা সবাই? শুধু কি একটাই কাজ— নিজেদের চলতি করা ৷ এলাকায় কায়েম রাখা?

 একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে নোটনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ৷ নোটন বলল, পলু একটা জিনিস দেখবি? আমি বললাম, কী?

 নোটন প্যান্টের পিছন কোমর থেকে একটা রিভলভার বের করল ৷ বলল, ফরেনের মাল ৷ জাপানি ৷ হেভি জিনিস ৷ পঁচিশ চাইছে ৷ ভাবছি রেখে দেব ৷

 আমি বললাম, আর এসবে কী হবে নোটন? লোহা লক্কড়ের গল্প ছাড় না ৷

 নোটন হাসল ৷ বলল, যদি কোনো সময় দরকার লাগে ৷ তারপর নোটন আরও হাসতে হাসতে বলল, তুই এত বই কিনিস কেন পলু? সব তো পড়িস না বললি ৷ তোর মতোই আমিও কিনে রাখছি, যদি কখনও দরকার পড়ে ৷ রইল হাতের কাছে ৷

দুই

নোটন মার্ডার হল ৷

 নোটনকে মার্ডার করল ছক্কারা ৷ মার্ডার করে ওরা সাত সকালেই চলে গেল পুলিশের কাছে ৷ ওদের কাছে পুলিশ হেপাজতই তখন সব থেকে নিরাপদ ৷ ওরা জানত আলোদার কাছের ছেলে নোটন ৷ আলোদা ওদের ছাড়বে না ৷ তবে পার্টি ওদের পিছনে ৷ পার্টি মানেই আইন প্রশাসন ৷ তাই আপাতত সেফ জেল কাস্টডি ৷ তারপর এলাকা ঠান্ডা হলে বেরিয়ে আসবে ৷

 জেল থেকে খবর আসছে— ওরা কীভাবে নোটনকে মেরেছে ৷ জেলে ওদের ফাইলের যে মেড তার থেকে খবর আসছে ৷ ওদের ফাইলের অন্য গ্ৰুপের ছেলে পত্তর নোটন খুনের গল্প শোনাচ্ছে ইন্টারভিউতে ৷

 আমরা শুনছি আর আশ্চর্য হচ্ছি ৷ —আরে এ যেন হুবহু আমাদের সেই বলে দেওয়া কথা ৷ আমাদেরই এঁকে ফেলা নকশা! সেই পোস্ট অফিসের উলটো দিকের গলি ৷ সেই মদ খেয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে যাওয়া মাতাল নোটন ৷ মধ্যরাত ৷ ওরা নোটনকে ডেকেছিল ৷ বলেছিল, নোটন এসো একটু খেয়ে যাও ৷

 মদলোভী নোটন ‘না’ ‘হ্যাঁ’ করে বসেছিল ওদের সঙ্গে ৷ তারপর সুযোগ বুঝে একজন ওকে জড়িয়ে ধরে ৷ আর একজন পরনের উইন্ডচিটার খুলে হাতা দিয়ে ফাঁস দিয়ে দেয় নোটনের গলায় ৷ তার আগে কী একটা ব্যাপার নিয়ে নোটনের সঙ্গে ঝামেলা লেগেছিল ওদের ৷ কী নিয়ে ওই ঝামেলা তা জানার আমাদের আগ্রহ নেই ৷ কারণ ঝামেলাটা ফালতু! ঝামেলাটা স্রেফ গেম প্ল্যান ৷ পোস্ট অফিসের গলিতেই নোটন মরেছে ৷ তারপর ওকে টানতে টানতে ফেলে দিয়েছে দূরে ৷

 কী আশ্চর্য আমরা— আলোদার কথা মিলে গেছে ৷ নোটনকে মেরেছে সেই ছক্কা ৷ আর মারতে একটাও দানা খরচ করেনি ৷ সেরেফ উইন্ড চিটারের ফাঁস, ব্যস!

 মদ খেতে খেতে মরে এসেছিল নোটন ৷ ওর হাত পা কাঁপত ৷ ওর কথা জড়িয়ে যেত ৷ ওর মুখের চামড়া তেলা আর লাল হয়ে গিয়েছিল ৷ আলোদা বলত, ওর নম্বর লেগে গেছে ৷

 আমরা হাসতাম ৷ নোটনও হাসত ৷ নোটন বলত, মদ খেয়েই তো অ্যাকশন করেছি— এখন অ্যাকশন নেই বলে মদ ছেড়ে দেব? আর যে দিন থেকে লাইনে এসেছি সে দিনই নম্বর লাগিয়ে এসেছি ৷

 এই লাইন কথাটা আলোদা বলত ৷ লাইন কথাটা নোটনও অবলীলায় বলতে পারত ৷

 নোটনের লাইনে কেমন যেন আলো আর আঁধার থাকত ৷ সেখানে কেমন যেন ঘোর ঘোর এতোল বেতোল পা ফেলা ৷ যেন উলটো দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ট্রেন ছুটে আসছে ৷ দু’চোখ অন্ধ করে দেওয়া তার আলো ৷ গম গম চাকার ঘষটানিতে মৃত্যুর গান ৷

 আগে লাইনের কথায় রোমাঞ্চ হত ৷ অ্যাকশন করতে পারতাম না ৷ কিন্তু অ্যাকশনের কথায় ছটফট করতাম ৷ মারপিটের গল্প পেলে হাঁ করে বসে গিলতাম ৷ কী ভয়ঙ্কর এক একটা গল্প! ওরা চিল্কাদের সঙ্গে লড়ছে ৷ কীভাবে আলোদা একা একা ওদের এলাকায় ঢুকছে, এ হাতে রিভলভার, ও হাতে বোম ৷ ওরা যিশু নয়নদের সঙ্গে লড়ছে ৷ রাত নামলেই এলাকা কুরুক্ষেত্র ৷ টান টান উত্তেজনা ৷ দিনে সবার দেখা পাওয়া যায় না ৷ সন্ধে নামলেই সবাই জড়ো হয় ৷ তারপর চিল্কা এলাকা ছাড়ল ৷ যিশু-নয়নও হাওয়া ৷ আলোদা বলে, পিসফুল এলাকা! আলোদা বলে, কিন্তু আমাদের লাইফ পিসফুল নয় ৷ যে-কোনওদিন যে-কেউ সদর দরজার সামনে মার্ডার হয়ে যাবে ৷ কে কোথায় আমাদের কী গেম সাজাচ্ছে আমরা জানি না ৷

 আলোদার কথায় আমার ভয় করত ৷ মনে হত আমারও যেন মৃত্যু বাঁধা ৷ ছুরি গুলি বোমা ৷ বোম গুলি ছুরি ৷

 এখন এসব কথা শুনলে গা গুলিয়ে ওঠে ৷ মনে হয় সব যেন অচেনা ৷ আমি ক্রমশ সরে আসছি ৷ চার বেলা বাড়িতে খাই ৷ ইদানীং অন্ধকারে ওদের মুখগুলো বড় অচেনা ঠেকে! আলোয় এলে ওদের চেনার চেষ্টা করছি ৷ ওরা কি আলো আর অন্ধকারে পালটে পালটে যায়? কেমন সবাই বলে আমারও কি তাই মনে হয়? তবু যাই ৷ ঘুরে ফিরে ওদের কাছাকাছি চলে যাই ৷ নাইট ডিউটি থাকলে সকালে যাই ৷ ছুটির দিনে রাতে ৷ পাড়ার মেয়ে গিতুর সঙ্গে প্রেম করি ৷ করি না করতাম— কে জানে? সারা সপ্তা ধরে গিতুকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি ৷ ভুলে যাই ৷ কিন্তু ছুটির দিন সন্ধেবেলা গিতু ঠিক টেনে নেয় আমাকে ৷ আগে ওকে নিয়ে বন্ধ ই সি এলের ভেতরে ঢুকতাম ৷ এখন গ্ৰুপের কারোর নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটবাড়িতে ঢুকে পড়ি ৷ মিস্তিরিদের কাছ থেকে মাদুর নিয়ে তিনতলা, চারতলায় উঠে যাই ৷ আমি ক’টা খবরের কাগজ নিয়ে আসি ৷ মাদুরে পেতে দারুণ বিছানা করে ফেলি ৷ গিতু আনে মশার জন্যে কয়েল ৷ আমি তখন ওর শরীরে মুখ রগড়াই ৷ গিতু আমাকে প্রশ্রয় দিতে দিতে বলে— এবার একটা ফ্ল্যাট কেনার ধান্দা করো ৷ চার তলায় নেবে ৷ টপ ফ্লোর৷ আমরা জানলা খুলে শোব ৷ অত ওপরে মশা থাকবে না ৷

 আমি গিতুর ওপরে শুয়ে হৈমন্তিকার কথা ভাবি ৷ ক্রেডিট কার্ডের চেক নিতে আসা হৈমন্তিকাকে ব্যাপক লাগে ৷ ফোনে গল্প করি ৷ ও মোবাইলে মেসেজ পাঠায় ৷ আমি কাজের ফাঁকে আঙুল আর নখে উত্তর দিই ৷ এমন উত্তর যাতে দু’রকম মানে হয় ৷ বন্ধু বললে বন্ধু, অন্য কিছু হলে অন্য কিছু!

 নীচে নামার সময় গিতুকে বলি, আগে যাও ৷

 গিতু ফুঁসে ওঠে, কেন আমরা কি চুরি করছি?

 — ফাঁকা বাড়ি থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে শুধু শুধু কেস খাবার কোনো যুক্তি নেই ৷

 গিতু তেড়িয়া হয়ে জবাব দেয়, যারা কেস দেবে তারা তো হয় ঝি নয় অন্যের বউ নিয়ে ঢোকে! তুমি কি তাই? আমরা সবার সামনে দিয়ে প্রেম করব ৷

 গিতু বোঝে না ৷ ও বড় রাস্তায়, আলোতে এসেও আমার শরীরের সঙ্গে মিশে হাঁটতে চায় ৷ অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে জোরে জোরে হাসে ৷ এটা খাওয়াবে? ওটা খাওয়াবে— করে বায়না জোড়ে ৷ টাকা দিয়ে কেটে আসি ৷

 এ সময় আমার মানি ব্যাগে বেশি টাকা দেখলে গিতু কেমন ভয় পায়! বলে, এত টাকা নিয়ে মাল খেতে যাচ্ছ? আমার কাছে রেখে দাও— কাল নিয়ে নেবে ৷

 আমি যে গিতুকে বলতে পারি না, কাল যে তোমাকে ভুলতে চাই! এই রাত থেকেই তোমাকে ভুলে যাওয়ার অভ্যেস করব! গিতু জানে না, আজ ওর নগ্ন পিঠে আমি একটা একটা আঙুল আর নখ ছুঁইয়ে হৈমন্তিকার জন্যে মেসেজ ভাসিয়েছি! এ সপ্তাহে আমার দুদিন নাইট ডিউটি ৷ নাইট ডিউটির সময় হৈমন্তিকার সঙ্গে দেখা হয় ৷ ও আমাকে ওর অফিসের অনেকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে ৷ আমি বুঝি ও কোথাও আলাপ করানোর সময় আমার আগে আমার অফিসের নামটা বলে ৷ খবরের কাগজের নামে কেমন এক জাদু আছে!

 ইদানীং আমার পাড়ার বন্ধুরাও তাই করে ৷ ওদের সঙ্গে তাল রেখে আমিও করি ৷ তাতে রেজাল্ট বেশ ভালো! আমার দিকে সবাই কেমন এক সম্ভ্রমের চোখে তাকায় ৷ এলাকার নতুন কেউ আমার সঙ্গে মিশলে, প্রথমে ঢোঁক গিলে, তারপর পারমিশন নিয়ে বলে— ওদের সঙ্গে কী করে মেশেন?

 ওরা মানে আলোদা? ওরা মানে আমার বন্ধুরা— আলোদার ছেলেরা ৷

 এসব কথায় এখন আমি দারুণ হাসতে শিখেছি ৷ হাসতে হাসতে প্রশ্নকারীকে এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিই! সে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা নিয়ে গোলকধাঁধায় ছোটাছুটি করে ৷ আমি হেসে যাই ৷ হাসতে হাসতে চেপে যাই ওদের সঙ্গে মিশে আমি বড় হয়েছি, বাঁচতে শিখেছি! এসব কথা চেপে আমি বলি— আমি কাজের স্বার্থে মিশি! আর তারা সাহস পেয়ে বলে, ওরা আপনার লেখার সোর্স— তাই বলুন! ঠিক সন্দেহ করেছি ৷

 যথারীতি আমি হাসি ৷ এ হাসিটা আমি আলোদার কাছ থেকে শিখেছি ৷ এই হাসিতে নিজেকে চেপে যাওয়ার কথাটাও আমি আলোদার কাছ থেকে রপ্ত করেছি ৷

 এ কায়দায় আলোদা ওদের মদো মাতালের টিম বলে ঘেন্না ঘেন্না করে ৷ অ্যাকশনের মারকুটে ছেলেদের লোহালক্কড়-এর টিম বলে নির্লিপ্ত মুখে তাকায় ৷ যেন এরা আলোদার কেউ নয় ৷ যেটুকু তা শুধু বিরক্তি ৷ এ চালে নতুন যারা তারা খুব ঘাবড়ে যায় ৷ আমরা আলোদার ডায়ালগে হো হো করে হাসি ৷

 আর অলোদা মুখোশ টিমকে দেখিয়ে বলে, ওদের কাছ থেকে শেখ ৷ আমরা বুঝি, ইদানীং এদের কাছ থেকেই আলোদা বেশি শেখে ৷ এটা অন্য ছেলেরা শিখবে কী করে, শিখতে গেলে যে বাবার টাকা লাগে ৷ আসলে আলোদা নিজেকে আড়াল করে ৷

 আমিও নিজেকে আড়াল করি ৷ পুরনো বন্ধুদের কাছে ভদ্র ভালো ছেলে হয়ে যাই ৷ অফিসে গুলি বোমা ছুরির গল্প করি ৷ হৈমন্তিকার কথা ভাবতে ভাবতে গিতুর শরীরে মুখ গুঁজে থাকি ৷

 আসলে আড়ালের ওপারে আমি ৷ আড়ালের এপারে আমি ৷ আমি নিজেকে দেখি ৷ কোথায় যেন একটা চোরা টান৷ ফলে অমাবস্যায় পূর্ণিমায় দিকভ্রান্তের মতো ফুলে ফেঁপে ছুটি ৷ মদো-মাতালের টিমে ভিড়ে গিয়ে গেলাসে মুখ থুবড়ে বসি ৷

 বোতল থেকে মদের সঙ্গে গেলাসে গেলাসে নোটনের কথা বিলি হয়ে যায় ৷ যথারীতি নোটনের কথায় গলা-বুক জ্বালিয়ে মদ ঢালি ৷ গেলাসে কালচে-লাল তরল ৷ ঝটকা মেরে দেখি নোটনের গলায় ফাঁস হয়ে বসা উইন্ডচিটারের রং কি এমনই ছিল? চিৎকার করি, গেলাসের রংটা ফিকে করে দে ৷ জল ঢাল ৷ তবু পেটের গহ্বরে চলে যেতে গিয়ে সে তরল গলা রুদ্ধ করে ৷ মনে হয় ফিকে লাল একটা উইন্ডচিটার! তবে কি নোটন একা নয় আমাদেরও শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে রংবেরঙা এক একটা উইন্ডচিটার ৷

তিন

এরকমই একটা ছুটির দিনে ঠেকে যাব না, যাব না করে চলে গেছি ৷ তার আগে সন্ধেবেলা গিতুর শরীরে শরীর রেখে হৈমন্তিকার দিকে মন উড়িয়ে দিয়েছি ৷ ফিসফিস করে গিতুকে বলেছি, আমাকে ছেড়ে দে ৷

 গিতু বলল, চলো বিয়ে করি ৷

 — আমার কিছু ভালো লাগছে না ৷

 গিতু বলল, তখন রোববারের জন্যে হা পিত্যেস করে বসে থাকতে হবে না, রোজ পাবে ৷

 আমি বললাম, আমি তোমায় ভালোবাসি না! খালি মনে হয় তুমি আমার গলা টিপে ধরেছ ৷

 গিতু আমাকে গা থেকে ঝটকা মেরে ফেলে লাথি ছুড়ল ৷ বলল, তবে রোববার হলেই এসে মুখ রগড়াও কেন? বিষ ওগরাতে!

 আমি কোনো কথা বললাম না ৷

 গিতু বলল, এবার বলো, কে কার গলা টিপল!

 ঠেকে এসে না না করেও নেশা চড়িয়ে ফেললাম ৷ উইন্ডচিটার-রঙা মদ! খাচ্ছি আর ভাবছি, কে কাকে গলা পেঁচিয়ে মারছি— গিতু আমাকে? না আমি গিতুকে?

 গলায় হাত বোলাতে বোলাতে ঠেক থেকে বাড়ি ফিরছি ৷ আমাদের বাড়ির সামনে লাফরা জগার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ৷ আমাকে দেখে লাফরা জগার ভাই দাঁত কেলিয়ে বলল, পলুদা ঠেক থেকে ফিরছ? নিশ্চয় পোগ্গাম ছিল?

 আমি দেখলাম জগার ভাইয়ের হাতে কালো রঙের ব্যাগ ৷ ব্যাগের ভেতর কী যেন ধড়ফড় করছে ৷ বুঝলাম কারও বাড়ি থেকে নির্ঘাৎ কিছু ঝেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ৷ আমি বললাম, ব্যাগে কী রে?

 ও আমার কথা শুনেই কেটে যেতে যেতে বলল, কাল বলব ৷

 আমি খপ করে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরি ৷— পেটে এক লাথি মারব ৷ কী নিয়ে যাচ্ছিস আগে দেখা ৷

 লাফরা জগার ভাই তেরিয়া হয়ে বলল, তুমি কিন্তু মাল খেয়ে বাওয়াল করছ পলুদা ৷

 —তুই আমার বাড়ির সামনে থেকে চুরি করে যাবি, আর আমি তোকে ছেড়ে দেব ৷ কথা শেষে ওর গালে একটা চড় কষালাম ৷

 চড় খেয়েই ও বলল, ঠিক আছে— তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, মাল খালাস করে দিচ্ছি ৷

 আমার সামনেই ও ফস করে ব্যাগের চেন টানল ৷ ব্যাগটা খুলতেই দেখলাম— ভেতরটা নিশ্চুপ অন্ধকার! জগার ভাই ব্যাগের মুখ হাঁ করে বলল, নিয়ে নাও ৷ ব্যাগটা আমার ৷

 ব্যাগের পেটের অন্ধকারে আমার কেমন গা শিরশির করছে ৷ আমাকে ভেতরে হাত দিতে বলছে, কী আছে ভেতরে? হাত দিলে কি কামড়ে দেবে? এ শালা আমাকে কামড় খাওয়াতে চাইছে!

 আমি দাঁত ঘষটে বললাম, চালাকি করছিস আমার সঙ্গে!

 জগার ভাই বলল, চালাকির কী আছে ৷ বলেই ও ব্যাগ উলটে দিল ৷ ব্যাগের ভেতর থেকে থস থস করে দুটো নিষ্প্রাণ পায়রা পড়ে গেল মাটিতে ৷ আর একটা মাটিতে পড়ে মুখ রগড়ে ঝটপট করে উঠল ৷

 আমি কিছু বলার আগেই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল জগার ভাই তারপর দুটো পায়রাকে হাতে নেড়ে চেড়ে বলল, মালগুলো মরে গেছে পলুদা ৷

 আমি বিড় বিড় করলাম, একটা বেঁচে!

 জগার ভাই বলল, প্যারাসুট কাপড়ের ব্যাগ— হাওয়া পাস করেনি, সব কেলিয়ে গেছে ৷

 ব্যাগটা ভাঁজ করে একটুখানি ৷ সেটা হাতের থাবার ভেতর নিয়ে জগার ভাই হাওয়া হয়ে গেল ৷

 দু’পা এগিয়ে বাড়ির গলিপথে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি ৷ ডাইনে বাঁয়ে এবাড়ি-ওবাড়ির দেওয়ালে, পায়ের নীচে কঠিন মাটি, মাথায় টুকরো করা আকাশ আর সামনে পিছনে নিরেট অন্ধকার ৷ আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম ৷ শুধুমাত্র শ্বাস নেওয়ার জন্যে বুকটা হাপরের মতো করে নাকটা মুখটা ওপরে তুলে ধরলাম ৷

 সকালে আলোদার ঠেকে যাওয়ার কথা ছিল না ৷ তবু গেলাম ৷ গিয়ে গড় গড় করে কাল রাতের কেসটা বললাম ৷

 আলোদা বলল, ফালতু ব্যাপার— ছাড় তো পলু ৷

 আমি বললাম, ফালতু ব্যাপার কী— দম বন্ধ হয়ে পায়রাগুলো মরে গেল!

 আমার কথা শুনে অনেকে হেসে উঠল ৷

 আলোদা বলল, ওগুলো গোলা পায়রা ৷

 আমি চমকে উঠে আলোদাকে দেখলাম ৷ দিনের আলোর মতো চেনা আলোদাকে ইদানীং চন্দননগর চন্দননগর লাগে ৷ আলোদার সব কিছু যেন এখন টুনি বালবের নকশা ডিজাইন করা ৷ জ্বলছে নিভছে ৷ নিভছে জ্বলছে ৷

 আমি বললাম, গোলা পায়রার জন্যে তোমার কোনো দুঃখ হয় না?

 আলোদা দু’হাতে মুখ মুছল ৷ তারপর খুব শান্ত গলায় বলল, তোর প্রতি আমাদের অনেক আশা পলু! আমি তো সবাইকে বলি, পলু আমাদের অনেক বড় হবে ৷ একদিন আমরা গর্ব করে বলব তোর কথা ৷ বলব, পলু আমাদের ছেলে! আজ কত বড় হয়েছে!

 আমি বললাম, কত বড় আলোদা? লক্কা হয়ে মেঘ ধরব, না হোমর হয়ে চাঁদ ধরব?

 ঠান্ডা চোখে আলোদা বলল, তুই কেন পায়রা হবি?

 — কেন হব না? হয় গোলা, নয় লক্কা, নয় হোমর ৷ উইন্ডচিটার, বা প্যারাসুট কাপড়ে তেমন কোনো তফাত নেই আলোদা ৷

 আলোদা কোনো কথা বলল না ৷ আলোদার গলায় ঘাম ৷ নাকের পাটা ফুলছে ৷ রগের চামড়ার নীচে সেই ঠেলে ওঠা রাগের পোকা ৷ দাঁতে দাঁত চেপে আলোদা কঠিন হয়ে বসে থাকল ৷

 বেলা গড়িয়ে যায় ৷ ঠেক ভাঙলে একসঙ্গে উঠি ৷ দোতলা থেকে একতলা নীচে নামার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আলোদা আমার কাঁধে হাত রাখল ৷ ফিসফিস করে বলল, তবে গোলা পায়রাকেও বেড়ালে খেলে আমার বড় জ্বালা! এই বয়সেও আবার বেড়াল শিকারে যেতে হবে ৷

 এক পা এক পা করে সিঁড়ি ভাঙি ৷ আমি কি এখন আলোদাকে বলতে পারি, ঠিকই তো বাঘের এলাকায় বিড়াল ঘুরবে তা হয় না! আমি কি এখন আলোদাকে বলতে পারি, বাঘ আর বেড়াল একই!

 না বলতে পারি না ৷

 আলোদার বাইক গর্জন করে ছুটে গেলে সাদা কালো ফিনফিনে ধোঁয়ায় দাঁড়িয়ে থাকি ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *