প্রফেসার ইয়াকোয়ার মৃত্যুরহস্য – অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

প্রফেসার ইয়াকোয়ার মৃত্যুরহস্য – অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

কলকাতায় জানুয়ারি মানেই বইমেলা। আমাদের শনিবারের আসরে তাই সবার মুখেই বইমেলা। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মিলন বলল, —বই—এর যা দাম হচ্ছে, তাতে গল্পের বই আর কেনা যাবে না।

আমরা সবাই তাতে সায় দিলাম।

সবিতা বলে উঠল,—এক অনিলিখাদিই আমাদের ভরসা।

আমরা সবাই হেসে উঠলাম। অনিলিখা বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে বলে উঠল,—তবে, আজ আর কোনো গল্প নয়। আজ প্রফেসার ইয়াকোয়ার কথা বলব।

—প্রফেসার ইয়াকোয়া?

—সে কী! ইয়াকোয়ার নাম শুনিসনি? ইয়াকোয়া জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং—এ পৃথিবীর প্রথম সারির একজন বিজ্ঞানী। সারা পৃথিবী ওনাকে চেনে।—অনিলিখা বলতে থাকে—ইয়াকোয়ার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় রোজারম্যানের মাধ্যমে। হার্ভার্ডে আমাদের ইকনমিক্সের ক্লাস নিতেন রোজারম্যান। ইয়াকোয়ার বাড়ি ছিল আমার হোস্টেল থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে। ওনার বাড়িতে ছিল বিশাল ল্যাবরেটরি। কেন জানি না, আমার ওই ল্যাবরেটরিতে যেতে খুব ভালো লাগত। যদিও পরীক্ষা—নিরীক্ষার কিছুই বুঝতাম না, তবুও ভালো লাগত।

লোক হিসাবে ইয়াকোয়ার কোনো তুলনা হয় না। প্রচণ্ড আপনভোলা লোক। কোনো কিছুতেই লক্ষ নেই। শুনেছি, একবার হার্ভার্ডে পথ ভুলে পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সেখানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং—এর ক্লাস নিয়ে চলে এসেছিলেন।

ইয়াকোয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল ডলসম্যান। ডলসম্যানও কথাবার্তায়, আচার—ব্যবহারে খুবই অমায়িক। ইয়াকোয়ার সব কাজে সহকারী হিসাবে থাকত ডলসম্যান। অথচ আমি গেলেই ডলসম্যান দেখি কোথায় উধাও হয়ে যেত।

সেদিনও ইয়াকোয়ার বাড়িতে গেছি। রাত তখন আটটা হবে। দেখি ইয়াকোয়া আর ডলসম্যান খুব মনোযোগ দিয়ে একটা মাইক্রোস্কোপে ছোট টিউবের ভেতরের তরল দেখছে।

আমি ‘গুড ইভিনিং’ বলতেই প্রফেসার ইয়াকোয়া আমার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলেন, —এটা এক ধরনের ব্যাকটিরিয়া যা কোনও গাছে নিজের জিন ইনজেকট করে জীবনধারণ করে। আমরা এর সাহায্যে একটা দ্রবণ তৈরি করেছি, যা যে—কোনো গাছে স্প্রে করলে সেই গাছে ফুল ফুটবে।

—সে আবার কী করে সম্ভব? ঝোপঝাড়েও ফুল ফোটাবেন নাকি?

ইয়াকোয়া ঘাড় না ঘুরিয়ে বললেন, —হ্যাঁ, ঠিক তাই। লিফি আর অ্যাপাটেলা ওয়ান বলে দু’ধরনের জিন আছে, যা যে—কোনো গাছে ফুল ফোটাতে সাহায্য করে। এই জিন ফুল ফোটে না এমন কোনো গাছে ঢোকালে, সে গাছেও ফুল ফুটবে। তাই আমি ব্যাকটিরিয়ার মাধ্যমে ওই জিন গাছে ইনজেকট করে দেখব। আমার পরীক্ষার গাছ কোনটা জানো তো? ওই দেখো।

বলে ইয়াকোয়া ল্যাবরেটরির এককোণে রাখা একটা গাছের চারার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।

ওটার নাম সান—ডেসমোডিয়ান গাইরানস—অর্থাৎ এক বিশেষ ধরনের টেলিগ্রাফ প্ল্যান্ট যাতে ফুল ফোটে না, —ইয়াকোয়া ফের বলে উঠলেন।

—তা আপনি এ গাছটা পছন্দ করলেন কেন?

—খুবই সেনসিটিভ গাছ হওয়ার জন্য এর প্রতিক্রিয়া অন্যান্য গাছের তুলনায় তাড়াতাড়ি হবে আশা করি।

ইয়াকোয়ার কথার মধ্যে চা নিয়ে বাড়ির চাকর চ্যাপম্যান ঢুকল। ইয়াকোয়া আমাকে বললেন, —যাও, চ্যাপম্যানের সঙ্গে গল্প করো।

বুঝতে পারলাম ইয়াকোয়ার কাজে অসুবিধা হচ্ছে। আমি আর কী করি, চ্যাপম্যানের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলে বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ালাম।

এর দিন দশেক পরে একদিন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে শুনি সেদিন সকালে ইয়াকোয়াকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। বিস্তারিত যা শুনলাম তা হল, কয়েকদিন আগে ইয়াকোয়ার কাছে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা আসেন। ওনার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া। ইয়াকোয়া এমনিতে ডাক্তার। তাই ওনার কাছে ওই ভদ্রমহিলা এক বিশেষ অসুখের চিকিৎসার জন্য আসেন।

ভদ্রমহিলার হঠাৎ করে স্মৃতিশক্তি কমে গেছে। বুদ্ধি, চেতনা, অনুভূতিও একই সঙ্গে প্রচণ্ড মাত্রায় কমে গেছে। স্নায়ুকোষের হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে যাওয়াই এর কারণ। এককথায় একে ‘অ্যালজাইমার ডিজিজ’ বলে।

ইয়াকোয়া কী একটা ইঞ্জেকশন দেন, এবং দেবার আধ ঘণ্টার মধ্যেই ভদ্রমহিলা মারা যান। ইয়াকোয়ার ছ’মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। নেহাত অত নামকরা বিজ্ঞানী, তাই আদালত অপেক্ষাকৃত হাল্কা শাস্তি দিয়েছিল।

—কেন, ভুল চিকিৎসাতেই যে মারা গেছে তার প্রমাণ কী? ইয়াকোয়ার ছ’মাস সশ্রম কারাদণ্ড বিনা বিচারেই ঠিক হল নাকি?— সুরজিৎ বলে ওঠে।

—না, সেটা আদালত থেকেই ঠিক হয়েছিল। ওখানে বিচার অনেক তাড়াতাড়ি হয়। তাছাড়া ইয়াকোয়া অকপটে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

পরে আমি জেলে ওনার সঙ্গে দেখা করি। উনি বলেন যে উনি দুটো সলিউশন তৈরি করেছিলেন—একটা গাছে ফুল ফোটানোর জন্য, অন্যটা ওই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার স্নায়ুকোষ উজ্জীবিত করার জন্য। ভুলবশত দুটোর প্রয়োগ উল্টে যায়। অর্থাৎ গাছের জন্য তৈরি করা দ্রবণটা উনি ইনজেকট করেন ভদ্রমহিলার শরীরে। এবং তাতেই ওঁর মৃত্যু হয়। আরেকটা জিনিস জেনেছিলাম, সলিউশন দুটো ইয়াকোয়ার হাতে ডলসম্যানই তুলে দিয়েছিল।

এর পরের ছ’মাস ইয়াকোয়ার ল্যাবরেটরিতে আমি আর যাইনি। আসল লোকই নেই, তো কার জন্য যাব?

ইয়াকোয়া ছাড়া পাওয়ার পরের দিন আমি আবার ওনার বাড়ি যাই। আমাকে দেখেই ইয়াকোয়া স্বভাবসুলভ হাসিঠাট্টা শুরু করলেন। কথায় কথায় উনি সেই গাছের কথা তুললেন। গাছের ওপরেও তো ভুল ইঞ্জেকশান প্রয়োগ করা হয়েছিল। গাছটা কিন্তু বেঁচে গেছে। বলে উনি আঙুল তুলে ঘরের কোণে রাখা টবটার দিকে দেখালেন।

সত্যিই, গাছটা বেশ বড় হয়ে গেছে। বেশ সবল, সতেজ চেহারা। পাতার রং লালচে সবুজ। সাত—আটটা ডাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ডলসম্যান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ইয়াকোয়া ডেকে পাশে বসালেন।

আজ ইয়াকোয়ার কাজের ব্যস্ততা নেই। মার্ক টোয়েন থেকে শুরু করে পিকাসোর আঁকার সম্বন্ধেও আলোচনা হল। খালি একটা জিনিস লক্ষ করলাম, মাঝেমধ্যেই ইয়াকোয়া উঠে গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। আবার ফিরে আসছেন।

খানিকক্ষণ বাদে আমি যে প্রশ্নটা করব ভাবছিলাম, ডলসম্যানই সেটা করে বসল,—কী দেখলেন স্যার?

—এ গাছটাকে আমি আসা থেকেই লক্ষ করছি। ইতিমধ্যে কতকগুলো আশ্চর্য জিনিস আমার নজরে এসেছে। গাছটা কিছু আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। তোমাদের চোখে পড়েনি?

—সে আবার কীরকম?

—আমার মনে হচ্ছে গাছটার বুদ্ধি আছে। বোঝার ক্ষমতা আছে। আর সেটা এর ডাল—পাতার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে। এখন গাছটা মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছে। পাতাগুলো তাই শান্তভাবে রয়েছে। খানিকক্ষণ আগে আমার কথায় তোমরা যখন হাসছিলে, তখন আমি গাছটার দিকে তাকিয়েছিলাম। অদ্ভুতভাবে ডালগুলো দুলছিল। সেতারের তারে টান দিলে যেরকম কম্পন সৃষ্টি হয়, ঠিক সেরকমই হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছিল ডালের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।

কালকে আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে একটা ডাল ধরে মচকাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল গাছটার দিকে। সারা গায়ে যন্ত্রণার চিহ্ন। কুঁচকে ওঠা গাছের পাতায় অভিমানের ছাপ। আধমচকানো ডালটায় বেশ খানিকক্ষণ হাত বোলালাম। মনে হল গাছটা আমার ভুল বুঝতে পেরেছে।

হেসে উঠে বলে উঠলাম,—প্রফেসার, এটা কিন্তু আপনার সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার। আমি এ গাছে অসাধারণ কিছু—

কথা থেমে গেল গাছের দিকে চোখ পড়তে। সত্যি সত্যিই গাছের পাতায় যেন একটা তরঙ্গের ছোঁয়া।

—প্রত্যেকটা জিনিস লক্ষ করার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হয়—ইয়াকোয়া একটু যেন অসন্তুষ্ট হয়েই বলে উঠলেন।

সেদিন আরও খানিকক্ষণ গল্পগুজব চলল। জেলের অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা, জেলের খাওয়াদাওয়া, কীভাবে ওখানে সময় কাটত—সেসব নিয়ে কথা হল। আমার চোখ ছিল গাছের উপর। টিউবলাইটের আলোয় মাঝে মাঝে দু—একটা পাতা চকচক করা ছাড়া দেখার মতো তেমন কিছুই চোখে পড়ল না।

এরপরে আমি যখনই গেছি, প্রফেসারকে দেখতাম হয় কোনো পরীক্ষা—নিরীক্ষা করছেন, না হয় ওই গাছের পাশে বসে আছেন। মাঝে মাঝেই বলতেন,— তুমি এলে গাছটা বেশ খুশি হয়।

আমি যতটা সম্ভব গম্ভীর হয়ে ওনার কথা শুনতাম। কথার বিষয়বস্তু খালি একটাই—তা হল এ গাছ।

ডলসম্যাস ওই গাছ নিয়ে প্রফেসারের মাতামাতিটা আদৌ পছন্দ করত না। গাছের কথা উঠলেই দেখতাম ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইছে।

ওদিকে ইয়াকোয়া আর ইয়াকোয়ার গাছ সবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রফেসার ক্লাস নিতে না এলে ছাত্ররা বলত, —স্যার গাছে জল দিচ্ছেন। গল্প শোনাচ্ছেন।

রাস্তায় জোরে হাঁটতে দেখলে প্রতিবেশীরা বলত—বোধ হয় গাছের ভারী খিদে পেয়েছে। উনি তাই বাজারে চলেছেন।

কথাগুলো অবশ্যই অতিরঞ্জিত, তবে এটা ঠিক যে ইয়াকোয়ার বেশির ভাগ সময়ই কাটত ওই গাছটাকে নিয়ে। আমাকে আর ডলসম্যানকে ডেকে ডেকে দেখাতেন কীভাবে গাছের পাতায় পাতায় রাগ ফুটে ওঠে, কীভাবে খুশিতে দুলে ওঠে, কীভাবে পাতা ধরে টানলে বিরক্তি প্রকাশ করে। এমনকী পাশের আরেকটা গাছে জল দিলে কীভাবে এ গাছে ঈর্ষার ভাব ফুটে ওঠে, তা—ও উনি দেখাতেন। আমিও আশ্চর্য হয়ে তাই দেখতাম। বেশ সময় কেটে যেত।

এর কয়েকদিন বাদে ইয়াকোয়া হঠাৎ আমার হোস্টেলে এসে হাজির। মুখে চোখে উত্তেজনার চিহ্ন। ঘটনা এই যে ইয়াকোয়া ওই গাছের ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৬ পেয়েছেন। এ—ব্যাপারে ওনার বক্তব্য, কি উদ্ভিদ—কি প্রাণী, যে—কোনো দুই ভিন্ন জীবের ক্রোমোজোম সংখ্যাও ভিন্ন হতে বাধ্য। মানুষের দেহে ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৬, তা আমরা সবাই জানি। কাছাকাছি ক্রোমোজোম সংখ্যার উদ্ভিদ বলতে, সোলানাম টিউবারসাম—যার ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৮। আর কফি অ্যারাবিকা—যার ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৪। তাই ৪৬ ক্রোমোজোম সংখ্যাবিশিষ্ট এই গাছ ওনার মতে বিজ্ঞানের কাছেও এক বিস্ময়। এছাড়া উনি এ—ও বললেন যে ৪৬ ক্রোমোজোম সংখ্যাবিশিষ্ট উদ্ভিদও যে মানুষের মতোই বুদ্ধিমান হবে, এতে আর আশ্চর্য কী!

—আচ্ছা অনিলিখা, গাছের ক্রোমোজোম সংখ্যা কীভাবে গোনা হয়?—সত্যেনদা প্রশ্ন তুলল।

—প্রফেসার ইয়াকোয়া থাকলে আমি কাল—পরশুর মধ্যে ব্যাপারটা জেনে বলতে পারতাম। এটা তো আর আমার সাবজেক্ট নয়।

—থাকলে মানে? ইয়াকোয়া মারা গেছেন বুঝি?

—হ্যাঁ, এর কয়েকদিনের মধ্যেই হঠাৎ ইয়াকোয়া মারা যান। স্বাভাবিক মৃত্যু। যেদিন মারা যান, তার আগের দিনই ওনার বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। বেশ হাসিখুশি সুস্থ দেখে এসেছি। তবে কার জীবনে কখন যে কী হয় বলা মুশকিল। তবু আমার মন মেনে নিতে পারছিল না মৃত্যুটাকে।

ইয়াকোয়ার বাড়ি গিয়ে দেখি সেখানে অনেক লোক। বিশ্বের বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সমাবেশ ঘটেছে। প্রত্যেকের মুখেই এক কথা—ইয়াকোয়াকে হারানো সারা বিশ্বের কাছে এক অপূরণীয় ক্ষতি।

ডলসম্যান ঘরের এককোণে মাথা নিচু করে বসে আছে। খুব ভেঙে পড়েছে। হাজার হোক বহুদিন ইয়াকোয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করেছে। ওকে সান্ত্বনা দিলাম।

ওর সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় চোখ পড়ল গাছটার উপর। এতক্ষণ গাছটার কথা ভুলেই গেছিলাম। গাছটার পাতায় পাতায় পরিষ্কার একটা মুষড়ে পড়া ভাব। গাছের পাতাগুলো যেন কীরকম রাগী রাগী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্তত ইয়াকোয়া থাকলে তো তাই বলতেন।

ডলসম্যানকে দেখালাম। ডলসম্যান আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিল। উঠে চলে গেল অন্য ঘরে।

আমার সামনেই বসেছিলেন মিঃ বার্টরান্ড। উনি বোস্টন পুলিশের একজন হর্তাকর্তা ব্যক্তি। উনি ডলসম্যানের হঠাৎ করে এভাবে উঠে যাওয়া লক্ষ করেছিলেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন—কী ব্যাপার?

আমি গাছের এই পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করলাম। ইয়াকোয়ার সূত্রে এই গাছের কথা শুনতে কেউ বাকি রাখেনি। যদিও চোখে দেখেছি শুধু আমরা তিন—চারজন।

উনি গাছের পরিবর্তনটা দেখাতে বললেন। দেখাতে গিয়েই দেখলাম, গাছের পাতাগুলো আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই দেখি গাছের পাতাগুলো ফের সামনের দিকে বেঁকে যাচ্ছে। ডগার দিকটা ছুঁচালো হয়ে উঠেছে। রেগে যাওয়ার ছাপ। মাথা ঘুরিয়ে দেখি ডলসম্যান ঘরে ঢুকছে। নেহাতই ইয়ার্কি ছলে বলে উঠলাম, —কী হে ডলসম্যান, তোমাকে দেখলেই যে গাছটা বেঁকে বসছে, কিছু অপকর্ম করেছ নাকি?

কথাটা আমি হাল্কাভাবেই বলেছিলাম। কিন্তু ডলসম্যান দেখি গর্জে উঠল,—ইউ আর এ লায়ার। গাছের এরকম পরিবর্তন মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে। রেগে যাওয়া, মুষড়ে পড়া, খুশি হওয়া—এ সব আষাঢ়ে গল্প। তুমি আর এ—বুড়োটা প্রত্যেককে বোকা বানিয়ে এসেছ। একটা সাধারণ গাছকে অসাধারণ করে তুলেছ।

এরকম আচমকা চেঁচামেচি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ডলসম্যান। পিছু পিছু দেখলাম বার্টরান্ডও বেরিয়ে গেল।

এতটা বলার পর অনিলিখা উঠে দাঁড়ল,—এবার বাড়ি যেতে হবে।

আমরা সবাই হইচই করে উঠলাম—গল্পই তো শেষ হল না!

একেবারে ক্লাইম্যাক্সে এসে হঠাৎ করে ইতি টানার প্রবণতা আগেও অনিলিখার মধ্যে দেখেছি। তাই আমরা প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম, —তারপর?

—বাকি যেটা বলব, সেটা নিশ্চয়ই তোরা অনুমান করে নিয়েছিস। তার পরেরদিন আমিও সেই খবরটাই শুনলাম, যেটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। ডলসম্যানের হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে ওঠা বার্টরান্ডের মতো অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারের চোখ এড়ায়নি।

সেদিন সন্দেহের বশে বার্টরান্ড ডলসম্যানকে জেরা করতে নিয়ে যায়। লাই ডিটেক্টরের সামনে ডলসম্যান স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, ইয়াকোয়ার মূল্যবান রিসার্চ পেপার হাতানোর জন্য ডলসম্যান ইয়াকোয়াকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। ডলসম্যান ইয়াকোয়াকে সম্পূর্ণ নিঁখুতভাবে হত্যা করেছিল। এমনকী একটা বিশেষ ইঞ্জেকশনও পরে দিয়েছিল, যাতে শ্বাসরোধে মৃত্যু বলে মনে না হয়। কিন্তু একটা সাক্ষ্য ওর অলক্ষ্যে রয়ে গিয়েছিল। তা হল ইয়াকোয়ার ওই গাছটা—সান—ডেসমোডিয়ান গাইরানস।

এতটা বলার পর পাশের টেবিলে রাখা জলের গেলাসটা এক চুমুকে শেষ করে অনিলিখা উঠে দাঁড়াল।

—আচ্ছা, ওই গাছটার কী হল?—মিলন আমার প্রশ্নটাই তুলল।

মুচকি হেসে অনিলিখা বলে,—আশা করি, গাছটা এখনও আছে।

—তা, ওইরকম অসাধারণ গাছ নিয়ে হইচই পড়েনি?

—না।

—কেন?

অনিলিখা একইরকম মুখে বলে ওঠে, — ডলসম্যানের কথাই ঠিক। পরে প্রমাণ পাওয়া যায় যে গাছটার মধ্যে কোনওরকম বিশেষত্বই ছিল না। হ্যাঁ, ডাল—পাতার মধ্যে কিছু সময় অন্তর পরিবর্তন হত বটে, তবে সেটা যে—কোনো সান ডেসমোডিয়াম গাইরানসেই হয়। ইয়াকোয়ার মতো প্রতিভাবান ও পণ্ডিত লোক গাছটাকে কেন যে ওভাবে দেখেছিলেন বা আমাদেরকে দেখিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার মনে হয় উনি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘরে আরেকটা প্রাণের অস্তিত্বকে তৈরি করেছিলেন, যার উপর ভরসা করা যায়। উনি চাইছিলেন, এমন কারো সঙ্গ, যার বোধ আছে, বুদ্ধি আছে—যার কোনো ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকার ক্ষমতা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *