পাগলাবাবার কুঠি – শুভমানস ঘোষ

পাগলাবাবার কুঠি – শুভমানস ঘোষ

চিতাবাঘটা এল রাত এগারোটা নাগাদ ৷ ছাদের ওপর থেকে ক্ষয়া চাঁদের আলোয় শঙ্খ স্পষ্ট দেখল, লেজ নাড়াতে নাড়াতে কাঁটাতারের বেড়া টপকে বাঘটা হুশ করে চলে এল পাগলবাবার কুঠির হাতায় ৷ বাঘ নয়, বাঘিনী ৷ এর ভয়ে কিছুদিন হল আশপাশের গ্রামের আদিবাসীদের চোখ থেকে ঘুম উবে গেছে ৷ গৃহপালিত প্রাণীর সংখ্যা বাদ দিলেও এ পর্যন্ত কাচ্চাবাচ্চা সমেত হাফডজন মানুষ এর পেটে গেছে ৷ চোখের পলকে শঙ্খদ্যুতি হেভি রাইফেলখানা তুলে নিল ৷ ৩৭৫ ম্যাগনাম রাইফেল ৷ ঠিকমতো লাগাতে পারলে এক গুলিতে হাতিকে পর্যন্ত শুইয়ে দেওয়া যায় ৷

 শঙ্খদ্যুতি সরকারি শিকারি ৷ শু্যটিংয়েও তার নাম আছে ৷ এখানকার বিট অফিসার শুভ্রকান্তি শঙ্খর বন্ধু ৷ চিতাটাকে গুলি করে মারার সরকারি অনুমতিপত্র নিয়ে কাল সকালে সে আসছে ৷ কিন্তু তার আগেই এটাকে নিকেশ করে কাজ হালকা করে ফেললেই তো হয় ৷ ট্রিগারের ওপর আস্তে আস্তে বেঁকে যাচ্ছিল শঙ্খর হাতের আঙুল ৷ কিন্তু ট্রিগারের ওপর তা চেপে বসার আগেই আচমকা একটা চাপা গর্জন করে বাঘটা নেমে গেল খাদের মধ্যে ৷

 মিনিট দুই ৷ হাতে হ্যাজাক নিয়ে পাগলাবাবা দেখা দিলেন ৷ নীচে থেকে গলা তুলে শঙ্খকে বললেন, দেখলে তো? এ বার নেমে এসো বাছাধন ৷ তোমার দৌড় বোঝা গেছে ৷

 উত্তেজনায় শঙ্খর হাত দু’টো তখনও থরথর করে কাঁপছিল ৷ বাংলোর হাতার নীচেই খাদের বিকট গড়ান ৷ জঙ্গলের শুরু সেখান থেকে ৷ স্থানীয় লোকেরা বলে চৈতলবিলের জঙ্গল ৷ এক সময় দুর্ভেদ্য ছিল ৷ এখনও ফুরিয়ে যেতে যেতে যা আছে তা বিশাল ৷ একটু আগে চিতাবাঘটা ওখান থেকেই উঠে এসেছিল ৷

 সিঁড়ির নীচে আলো ধরলেন পাগলাবাবা ৷ এ সব এলাকায় ইলেকট্রিক লাইন থাকলেও সারাদিন এক ঘণ্টাও কারেন্ট থাকে কি না সন্দেহ ৷ পাগলাবাবা এই রাতে মাথায় একখানা তালপাতার টুপি পরে বসে আছেন ৷ গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ৷ কোটরের ভেতর ধকধক করছে একজোড়া চোখ ৷ হট করে দেখলে ভয় ধরে যায় ৷ লোকটি নিদ্রাহীনতার ক্রনিক পেশেন্ট ৷ রোগের জ্বালা থেকে বাঁচবার জন্য তিন-তিন বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু প্রতিবারই অবিশ্বাস্যভাবে প্রাণে বেঁচে যান ৷ একবার তো লাইনের মধ্যে শুয়ে পড়েছিলেন, এক্সপ্রেস ট্রেন চলে যায় ওপর দিয়ে, গায়ে আঁচড়টি লাগেনি তাঁর ৷

 পাগলাবাবা হ্যাজাকটা ঘরের দেওয়ালের শিকে ঝুলিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন চেয়ারে ৷ শঙ্খকে দেখতে দেখতে বললেন, শোনো হে ছোকরা, আসল কথাটা তোমায় খুলেই বলি ৷ যাকে দেখলে, ও কিন্তু মোটেই বাঘ নয় ৷ ও আমার ফিয়াসেঁ ৷ ফিয়াসেঁ মানে জানো তো?

 আবার শুরু হল পাগলামি ৷ এই জন্যই এখনকার লোকেরা এঁকে পাগলাবাবা নাম দিয়েছে ৷ সেই সূত্রে এটার নাম পাগলাবাবার কুঠি ৷ পাগলামির সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক কিছু কিছু সমাজসেবাও করে থাকেন ৷ রোগে-অসুখে গ্রামবাসীদের তাবিজটা-কবজটা ধরে দেন, এক-আধ দাগ ওষুধও মেলে ৷

 শঙ্খ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল ৷ হাই উঠছে ৷

 পাগলাবাবার নাক কুঁচকে গেল, হাই তুললে হবে না, ব্রাদার ৷ সোজা কথা, ও রাক্ষসীকে মারা তোমার কর্ম নয় ৷ তবে তুমি যদি আমার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে বসো, আমি নেই ৷ চ্যালেঞ্জের নাম করে আর একটা রাত এখানে থেকে যাবে সেটি হচ্ছে না, বাবা ৷

 পাগলাবাবা অনেক দিন হল কলকাতার পাট চুকিয়ে দিয়ে এই আধাপাহাড়ি জঙ্গলে ডেরা পেতেছেন ৷ ভদ্রলোকের ছেলেপুলে নেই, স্ত্রীও মারা গেছেন ৷ একজন আদিবাসী বুড়ো তাঁর দেখাশোনা করে ৷

 —বাঘটা কি আপনার এখানে রোজ আসে? বন্দুকটা বিছানায় শুইয়ে শঙ্খ প্রশ্নটা ছুড়ে দিল ৷

 পাগলাবাবা খুকখুক করে হাসলেন, না এসে যাবে কই সোনা? আসলে ওই রাক্ষসীর স্বভাবচরিত্র ভালো ছিল না ৷ বটে তুমি আমার অনেক জুনিয়ার, তবু তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, তাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম ৷ তার একটু সুখের জন্য কী না করেছি আমি? উদয়াস্ত মুখে রক্ত তুলে খেটে মরেছি ৷ ঘরে ক’দিন থাকতাম? এক মাস, দু’ মাস, কখনও কখনও টানা তিন মাস বাইরেই পড়ে আছি ৷ কী চমৎকারই না তার প্রতিদান দিয়েছিল মহিলা!

 মনে মনে বিরক্ত হলেও শঙ্খ না বলে পারল না, আমি আপনার ছকটা ঠিক ধরতে পারছি না ৷ চিতাবাঘিনীটা আপনার আগের জন্মের কেউ ছিল?

 —এগজ্যাক্টলি! পাগলাবাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, তবে মাইন্ড ইট, আমার নয়, ওর ৷ মরে গিয়ে আমার বউ চিতাবাঘ হয়ে জন্মেছে ৷ হবে না? খিদের তো শেষ ছিল না মহিলার ৷ এত এত এনে দিয়েছি, তবু তার খিদে মেটেনি ৷ তাই মরে ডাইরেক্ট বাঘ ৷ নে, এ বার কত খাবি খা ৷ পেট ভরে রক্ত খেয়ে মর ৷

 বলতে বলতে গলার স্বর বদলে গেল পাগলাবাবার, ইয়াংম্যান, ওটাকে যে করে হোক নিকেশ করতে হবে তোমায়৷ আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে ৷

 —আমি? শঙ্খ মাথা দোলাল, এই তো বললেন, কেউ ওকে মারতে পারবে না ৷

 —বলেছি না কি, অ্যাঁ? পাগলাবাবার চেহারা বদলে গেল চোখের নিমেষে, বেশ করেছি বলেছি ৷ আমার সঙ্গে চালাকি? বাড়াবাড়ি করবে তো ঘাড়টি ধরে বাইরে বের করে দিয়ে আসব ৷

 সর্বনাশ, যত রাত বাড়ছে ভদ্রলোক তত ফেরোসাস হয়ে উঠছেন ৷ ইশ, কী কুক্ষণে যে আজ সকালে এখানে একটা আস্তানা খুঁজতে বেরিয়ে বেছে বেছে এই বাড়িটাই তার পছন্দ হয়ে যায়! পছন্দ হওয়ার কারণ, পাগলাবাবার কুঠির ছাদটা ৷ একটা মানুষখেকো বাঘকে জন্মের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিতে একজন শিকারির কাছে এর চেয়ে লোভনীয় জায়গা আর হয় না ৷

 সকালে ভদ্রলোককে তো ভালোই লাগছিল ৷ মন দিয়ে তার প্রস্তাব শুনে মুচকি হেসে বলেছিলেন, আমার এখানে? বেশ তো ৷ কিন্তু আগেই বলে রাখছি, আমি লোক সুবিধের নই ৷ এখানকার কেউ তোমায় বলেনি?

 —বলেছে ৷ আমি কেয়ার করিনি ৷

 —বটে? ব্রেভ ইয়ংম্যান, তুমি স্বচ্ছন্দে এখানে থেকে যেতে পারো ৷ তোমায় আমার ভালোই লাগছে ৷ মোর ওভার, কেমন চেনা চেনাও ঠেকছে ৷

 শঙ্খ একদৃষ্টে দেখছিল পাগলাবাবাকে ৷ ঘাড় দুলিয়ে বলল, আমারও ৷ আপনাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি ৷

 —বটে? পাগলাবাবা অন্য কথা পেড়েছিলেন, তবে মাইন্ড ইট ব্রেভ ইয়ংম্যান, তুমি কত বড় শিকারি আজ রাতে তার পরীক্ষা দিতে হবে তোমায় ৷ রাজি?

 —আনন্দের সঙ্গে ৷ বুক ঠুকে বলে দিয়েছিল শঙ্খ ৷

 একে পরীক্ষায় ডাহা ফেল, তার ওপর পাগলাবাবাকেও দিল চটিয়ে ৷ শঙ্খ জড়সড় হয়ে গেল ৷ বাইরে খটাস করে একটা আওয়াজ হল ৷ পাহাড়ে-জঙ্গলে অনেক ঘুরেছে শঙ্খ, তবু চমকে গেল ৷

 পাগলাবাবা একটু যেন নরম হলেন ৷ গলা নামিয়ে বললেন, ও পাতা পড়ার আওয়াজ ৷ তুমি শিকারি না ছাই ৷ খালি বড় বড় কথা ৷

 শঙ্খ চেয়ে রইল ৷ আর মুখ খুলছে না ৷

 পাগলাবাবার গলার স্বর খাদে নেমে এল, বললাম তো, ও রাক্ষসী পিশাচিকে মারা তোমার সাধ্য নয় ৷ আমাকে না খাওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই ৷ সারারাত ধরে দরজা আঁচড়ায়, বারান্দায় ওত পেতে বসে থাকে ৷ একদিন রাতে দরজাটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল আর কী! পরের দিন কোলাপসিবল গেট লাগিয়ে তবে হাঁফ ছাড়ি ৷

 শঙ্খ তা-ও মুখ খোলার দিকে গেল না ৷ তবে যত অদ্ভুতই লাগুক, পাগলাবাবার কথাগুলো শুনতে মন্দ লাগছে না৷

 —একটা পুরোনো হিসেব মেটানো এখনও বাকি আছে ৷ বলতে বলতে হঠাৎ পাগলাবাবা কেমন উদাস হয়ে গেলেন, তার জন্যই বেটি এখনও ছোঁকছোঁক করে মরছে ৷ হয় ও মরবে, নয় আমি ৷

 আচমকা ফোঁস করে হ্যাজাকের আলোর পিণ্ড থেকে একটা আগুনের জিব বেরিয়ে এসে মিলিয়ে গেল ৷ সঙ্গে সঙ্গে পাগলাবাবা আবার বদলে গেলেন ৷ এগিয়ে এসে শঙ্খর হাত চেপে ধরে ভেঙে পড়লেন, তুমি আমায় বাঁচাও! আমার এক্ষুনি মরে যেতে ইচ্ছা করছে না ৷ বলো বাঁচাবে আমায়? বলো বলো!

 —আরে, এ কী করছেন! মুখ খুলতেই হল শঙ্খকে, হাত ছাড়ুন!

 —না, ছাড়ব না ৷ আমার কী দোষ? চোখের সামনে ওরকম একটা দৃশ্য দেখলে কার মাথার ঠিক থাকে?

 —দৃশ্য!

 —হ্যাঁ ৷ সেদিন আমি হঠাৎই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম ৷ ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি৷ একটা হাতুড়ি দিয়ে—৷

 থেমে গেলেন পাগলাবাবা ৷ পরক্ষণেই শঙ্খকে ছেড়ে ছিটকে গিয়ে গলা চড়িয়ে দিলেন আবার, অ্যাই অ্যাই এ কী কাণ্ড, একফোঁটা ছেলে, হাঁ করে বসে বসে বড়দের কথা গিলছ? আবার বলছ, দৃশ্য? কেমন ছেলে হে তুমি? খবরদার, যা শুনেছ শুনেছ, কারুর কাছে বলেছ কি, একদম খুন করে ফেলব ৷

 প্রলাপ! পাগলের প্রলাপ ৷ কিন্তু সবটাই কি প্রলাপ? শঙ্খর কেমন চেনা চেনা লাগছে কথাগুলো ৷ এই লোকটা যে সত্যি সত্যি খুন করে ফেলতে পারে সেটাও যেন বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ৷ কিন্তু কেন?

 শঙ্খ হঠাৎ বন্দুকটা টেনে নিল কোলে ৷

.

 অনেক রাতে পাগলাবাবার ঠেলায় ঘুম ভেঙে গেল শঙ্খর ৷ বাইরে সোঁ সোঁ আওয়াজ হচ্ছে ৷ খটাখট করে পাতা ঝরে যাচ্ছে ৷ সেই সঙ্গে বিশ্রী একটা আঁশটে গন্ধ ৷ টেনে ধরা গার্টারের মতো বিছানায় সিধে হয়ে বসল শঙ্খ ৷ তার পর খুব সাবধানে জানলার একটা পাল্লা ফাঁক করে একেবারে আঁতকে উঠল ৷

 এসব এলাকায় কারেন্ট থাকাটাই আশ্চর্য ৷ সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটিয়ে দিয়ে বাইরের বারান্দার ডুমটা জ্বলছে ৷ বারান্দার ঠিক সিঁড়ির নীচে গুটিসুঁটি মেরে বসে আছে চিতাবাঘিনীটা ৷ কানদুটো তার খাড়া হয়ে আছে ৷ জ্বলজ্বলে চোখ দরজার দিকে স্থির ৷ যেন কারুর বাইরে বেরোনোর অপেক্ষা, চক্ষের নিমেষে তুলে নিয়ে চলে যাবে মুখে করে ৷

 —সাহসখানা দ্যাখো একবার! আবার এসেছে ৷ পাগলাবাবা ফিসফিস করে উঠলেন ৷

 কাল রাতে একটু বিগড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত মহা গোলমাল কিছু করেননি ভদ্রলোক ৷ তবে বকবক করে গেছেন অনেক রাত অবধি ৷ পাগলের কথার তো মাথামুন্ডু নেই ৷ একবার এই বলছে, পরক্ষণে আর এক ৷ তবে তার মধ্যে একটা কথা শুনে শঙ্খ ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল ৷ স্ত্রীকে রিয়েলি ভালোবাসলেও তাকে পাগলাবাবা নিজের হাতেই খুন করেছিলেন ৷ যে ভালোবাসার জন্য তিনি মুখে রক্ত তুলে খেটে মরেছিলেন, সেখান থেকে এত বড় আঘাত তিনি সহ্য করতে পারেননি ৷

 —মার মার! চালিয়ে দে! সোজা চালিয়ে দে! পাগলাবাবা শঙ্খর কাঁধ চেপে ধরলেন ৷

 শঙ্খ কেঁপে উঠল ৷ যতই লোকটা পাগল সেজে থাকুক, আদতে তো একটা খুনি ৷ ফেরারি আসামি ৷ বন্দুকটা খপ করে আঁকড়ে ধরে চট করে সরে গেল সে ৷

 —আরে কী করছ! পাগলাবাবা হুমড়ি খেয়ে পড়ে শঙ্খর রাইফেলের নল চেপে ধরলেন, দাও ৷ আমায় দাও বন্দুকটা ৷

 সর্বনাশ, এ লোক দেখছি একটা অঘটন না ঘটিয়ে ছাড়বেন না ৷ তাড়াতাড়ি বন্দুকটা পাগলাবাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শঙ্খ নলটা দিয়ে জানালার পাল্লাটা পুরো খুলে দিল ৷ হু হু করে ঠান্ডা ঢুকছে ভেতরে ৷ ঝিঁকি ডাকছে অবিশ্রাম ৷ বাঘটা আগের মতোই হাঁ করে তাকিয়ে বসে আছে দরজার দিকে ৷

 হঠাৎ তড়াক করে উঠে পড়ল বাঘটা ৷ গন্ধ পেয়েছে নির্ঘাত ৷ আর এক সেকেন্ড দেরি করা যায় না ৷ নিপুণ হাতে ক্যাচটা সরিয়ে ট্রিগারটা টেনে দিল শঙ্খ ৷ লেগেছে ৷ বাঘিনীটা বিকট গর্জন করে ছিটকে গেল দূরে ৷ কিছুক্ষণ ফোয়ারার মতো ধুলোবালি উড়িয়ে কাঁটাতারের বেড়া ছিঁড়েখুঁড়ে গড়িয়ে পড়ল খাদে ৷ গাছে গাছে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা পাখিদের চিৎকারে মুখর হয়ে উঠল পাগলাবাবার কুঠি ৷

 শঙ্খ বিছানা থেকে নেমে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল ৷ এবার সে পরীক্ষায় পাশ করেছে ৷ কিন্তু এ কী! পাগলাবাবা যে মাথার চুল ছিঁড়তে আরম্ভ করেছেন!

 —ওরে শয়তান, এ কী সর্বনাশ করলি আমার! পাগলাবাবা চিৎকার করে উঠলেন, কেন মারলি ওকে? ও তোর কী ক্ষতি করেছিল? আমার জন্য বেচারি ঘুরে ঘুরে আসত, আর আসবে না ৷

 পাগলাবাবা টান মেরে ছিঁড়ে ফেললেন গলার রুদ্রাক্ষের মালা ৷ হাহাকার করে বলতে থাকলেন, কতদিন ভেবেছি দরজাটা খুলে চলে যাই, সাহস হয়নি ৷ যদি না ও আমাকে মারতে পারে, আবার যদি বেঁচে যাই ৷ এ পাপের বোঝা নিয়ে দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে আমি বাঁচতে চাই না ৷

 পাগলাবাবা চোখের পলকে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে তুলে নিলেন বন্দুকটা ৷ তখনও তার নল থেকে সরু সুতোর মতো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে ৷ আবার সেই পাগলামি ৷

 শঙ্খ ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরল পাগলাবাবার হাত ৷ তৎক্ষণাৎ অদ্ভুত একটা অনুভূতি তার সারা শরীরে কাঁটার মতো বয়ে গেল ৷ এইরকম রোমে ভরা হাত আর একবার সে চেপে ধরেছিল না? সে হাতে রাইফেলের বদলে ছিল বড় একটা হাতুড়ি ৷

 শঙ্খ থরথর করে কেঁপে উঠল ৷ সঙ্গে সঙ্গে আলগা হয়ে গেল তার হাতের আঙুলগুলো ৷ রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে পাগলাবাবা ছিটকে গেলেন দূরে ৷

 —আরে কী করছেন? দিন ওটা! শঙ্খ চেঁচিয়ে উঠল ৷

 পাগলাবাবা নিঃশব্দে রাইফেলের নলটা ঘুরিয়ে দিলেন শঙ্খর দিকে ৷ দেখতে দেখতে বদলে যাচ্ছিল তাঁর চেহারা ৷ চোখের ভেতরে গনগন করে উঠল আগুন ৷ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, দৃশ্য, অ্যাঁ? কাল জানতে চাইছিলে না? তোমাকে কাল দেখেই দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ৷ আমার ঘরে বিছানায় তুমি শুয়ে আছ আমারই স্ত্রীর সঙ্গে ৷

 শঙ্খর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল ৷ হুঁ, মনে পড়েছে এতক্ষণে ৷ অনেক দিন আগের কথা ৷ শঙ্খ তখন স্কুলের পাট চুকিয়ে কলেজে ঢুকেছে ৷ কাছেই থাকতেন পাগলাবাবারা ৷ ফিল্ম কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে পাগলাবাবা বছরের অর্ধেক সময় বাইরে বাইরেই ঘুরতেন ৷ মাঝে মাঝে পাশ দিতেন শঙ্খকে ৷ তা দিয়ে সে বিনা পয়সায় হল থেকে ছবি দেখে আসত বন্ধুবান্ধব নিয়ে ৷

 পাগলাবাবার স্ত্রীর বয়েস খুবই কম ছিল ৷ বাচ্চাকাচ্চাও হয়নি তার ৷ ফলে শেষের দিকে সময় কাটানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিল মেয়েটির ৷ তারই সুযোগ নিয়েছিল শঙ্খ ৷ সেই দুপুরে পাগলাবাবার হাত থেকে শঙ্খ পালাতে পারলেও তাঁর স্ত্রী পারেনি ৷ হাতুড়ি দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে পাগলাবাবা ফেরার হয়ে যান ৷

 শঙ্খর গলা কাঁপতে আরম্ভ করল, হুঁ, মনে পড়েছে ৷ আপনি ফিল্মবাবু ৷

 —অ্যাই অ্যাই এতক্ষণে হয়েছে! পাগলাবাবা প্রচণ্ড জোরে হেসে উঠলেন, বেড়ে একখানা নাম আমায় দিয়েছিলে ৷ আমার বউও আমায় এই নামে মাঝে মাঝে ডেকে ফেলত ৷ বয়েসটা নেহাতই কাঁচা ছিল, একদম ইনোসেন্ট ৷ অথচ তাকেই কিনা আমি টাকা দিয়ে ভোলাতে চেয়েছিলাম! একজন নারী তো পুরুষের কাছে কেবল টাকা চায় না ৷

 পাগলাবাবার বন্দুকের নল আস্তে আস্তে নেমে এল ৷ গলা বুজে আসছিল তাঁর, আমি আমার স্ত্রীকে শুধু প্রাণে মারিনি, আমারই জন্য সে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ আমি জানি আমাকে না মারা পর্যন্ত সে জন্মজন্মান্তর আমাকে তাড়া করে ফিরবে ৷

 পাগলাবাবা বন্দুক ফেলে দিলেন ৷ বসে পড়ছেন নীচে ৷ আবার মাথা কুটছেন ৷ পাগল পাগল! একেবারে বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে লোকটা ৷

 —উঠে পড়ুন ৷ শঙ্খ এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত রাখল তাঁর, মিছিমিছি আপনি কষ্ট পাচ্ছেন ৷ মেন কালপ্রিট তো আমিই ৷ আমিই আপনার স্ত্রীকে নীচে নামিয়েছিলাম ৷ মহাপাপ মহাপাপ ৷ আমার জন্য আপনার স্ত্রী অকালে প্রাণ হারিয়েছিল শুধু নয়, আপনার জীবনটাও নষ্ট হয়ে গেছে ৷ দেখছি তো কী কষ্টে আছেন আপনি!

 পাগলাবাবা কেঁদে ফেললেন, বড় কষ্ট, বড় কষ্ট! স্ত্রীকে খুন করে বছরের পর বছর তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো আমি পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি, অনুশোচনায় জ্বলেপুড়ে মরেছি দিনের পর দিন ৷ সুইসাইড করতে গিয়েছি, সেখানেও ব্যর্থ হয়েছি বারবার ৷ কেন মারলে ওকে? ও-ই হয়তো আমাকে চিরমুক্তি দিতে পারত ৷

 এর পরেই একটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা ঘটল ৷ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ছেয়ে গেল ঘর ৷ লোডশেডিং ৷ অন্ধকারে ঠান্ডাটা কি একটু বেশিই লাগে? গা’টা শিরশির করে উঠল শঙ্খর ৷ পাগলাবাবা তো তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত শেষ করেই এনেছেন একরকম ৷ কিন্তু তার নিজের তো এখনও পর্যন্ত শুরুই হল না ৷ ওই মহাপাপের তো একটাই বেতন হয়, মৃত্যু ৷

 —পাগলাবাবা, পাগলাবাবা, আপনি কোথায়? শঙ্খ চিৎকার করে উঠল, হ্যাজাকটা একবার জ্বালান না!

 পাগলাবাবার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না ৷ বাইরে সমানে পাতা খসে পড়ার খটাস খটাস শব্দ ৷ কিন্তু তার মধ্যে ও কীসের শব্দ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে? চিতাবাঘিনীর গলার ৷ ও কি চৈতলবিলের জঙ্গল থেকে আবার উঠে আসছে? গুলিটা ঠিক মতো লাগাতেই পারেনি শঙ্খ, অ্যাঁ?

 বন্দুকটা কোথায় গেল? কোথায়? শঙ্খ বসে পড়ল ৷ পাগলের মতো হাতড়াচ্ছে সারা ঘর ৷ বন্দুকও নেই, পাগলাবাবাও নেই ঘরে ৷ কোথায় গেলেন ভদ্রলোক? দরজা খুলে বাইরে চলে গেলেন না তো? চিরমুক্তির জন্য সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গিয়েছিল লোকটা ৷

 পাগলাবাবার কুঠি কাঁপিয়ে বাইরে হুঙ্কার দিয়ে এসে পড়ল চিতাবাঘিনী ৷ আগের জন্মে চরম সুখের মুহূর্তে তাকে মাথায় করে নিতে হয়েছিল হাতুড়ির ঘা ৷ তাই পাগলাবাবা নয়, আসলে সেই অসমাপ্ত সুখকে পূর্ণ করবার জন্যই সে আবার ফিরে এসেছে ৷ কিন্তু একটা জখম নরখাদকের জন্মান্তরের অতৃপ্ত খিদে একটা ছাব্বিশ বছরের যুবকের পক্ষে মেটানো কি সত্যি সম্ভব?

 শঙ্খর গায়ের লোম একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *