বোবা রাজপুত্র – সৈকত মুখোপাধ্যায়

বোবা রাজপুত্র – সৈকত মুখোপাধ্যায়

জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল মুনিয়া ৷ ঘরে এখন সে একা ৷ কৌশিক বিকেল হতেই সেই যে কোথায় টহল মারতে বেরিয়েছে, এখনও ফেরার নাম নেই ৷ অবশ্য বিয়ের পর থেকে গত চারবছরে একা থাকতেই সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ৷ রাতে শোয়ার সময়টুকু ছাড়া কৌশিকের সঙ্গে তার দেখা হয় না, তা সে আসানসোলে নিজের বাড়িতেই হোক বা এই তুষকাঠি গ্রামের বাপের বাড়িতে ৷ কৌশিক এইরকমই ৷ নির্মম ৷ ধান্দাবাজ ৷

 জানলা দিয়ে অজয় নদের বালির চড়া দেখতে পাচ্ছিল মুনিয়া ৷ রাত বেশি হয়নি, হয়তো সন্ধে সাতটা হবে ৷ তবু এর মধ্যেই নদীর বুকে ঘন হয়ে উঠেছিল কুয়াশার চাদর ৷

 হঠাৎ কানের কাছে বীভৎস এক চিৎকারে মুনিয়ার বুকটা কেঁপে উঠল ৷ উঃ, বাবা গো, বলে সে তাড়াতাড়ি জানলার সামনে থেকে পিছিয়ে এল ৷ খুব কাছেই কোথাও ডাকছে শিয়ালগুলো ৷ এখন জন্তুগুলোকে দেখা যাচ্ছে না, তবে কাল ওদের দেখেছিল মুনিয়া ৷ কাল গভীর রাতে ৷

 সেই কথা মনে পড়তেই আবার একটা তীব্র অস্বস্তি তার বুকে পাথরের মতন চেপে বসল ৷ কাল পাশের বাড়ির রঞ্জুদা শিবাভোগ দিচ্ছিল ৷ এই জানলায় দাঁড়িয়েই মুনিয়া চাঁদের আলোয় ওকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল ৷ মুনিয়ার বাড়ি আর রঞ্জুদাদের বাড়ির মাঝখানে যে বাগানটা, সেটার বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে রঞ্জুদা প্রসাদের মন্ড ছুড়ে দিচ্ছিল অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা শেয়ালগুলোর দিকে ৷ হুটোপাটি লেগে গিয়েছিল জন্তুগুলোর মধ্যে ৷ জোড়ায় জোড়ায় জ্বলন্ত চোখ ছুটে বেড়াচ্ছিল ওকে ঘিরে ৷ আজকেও রঞ্জুদা শিবাভোগ দেবে নিশ্চয় ৷ রাতচরা জন্তুগুলো ওর প্রতীক্ষাতেই ঘোরাফেরা করছে ওদের বাড়ির আশেপাশে, আর মুনিয়ার বুক কাঁপিয়ে দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ডেকে উঠছে উল্লাসে ৷

 জানলার ধার থেকে সরে গিয়ে বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মুনিয়া ৷ চোখটা বার বার জলে ভরে উঠছিল তার ৷ মনে মনে সে ভাবছিল— এ কী হল! রঞ্জুদা সন্ন্যাসী? খ্যাপা? উদাসীন? রঞ্জুদা পাগল হয়ে গেছে?

 মুনিয়ার মনে পড়ল, ছোটবেলায় তার ঠাকুমাকে প্রায়ই একটা কথা বলতে শুনত ৷ মেয়েরা বিয়ের পর প্রথমবার বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় যে আকুল কান্নাটা কাঁদে, তার মধ্যে না কি আসলে অনেকগুলো কান্না আলাদা-আলাদাভাবে মিশে থাকে ৷ একদম ঠিক ৷ মুনিয়া যখন এই তুষকাঠি ছেড়ে কৌশিকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আসানসোলের দিকে রওনা হয়েছিল, তখন সে-ও কেঁদেছিল ৷ মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে ফুলে ফুলে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ ধরে ৷ আর কেউ না জানুক, সে নিজে তো জানে, সেই কান্নার মধ্যে অনেকটাই ছিল রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মুখচোরা ছেলের জন্যে, যে কোনোদিন তাকে সাহস করে বলে উঠতে পারল না, ভালোবাসি ৷ সেই ছেলেটার নাম রঞ্জন ভট্টাচার্য, ডাকনাম রঞ্জু ৷

 মুখচোরা রঞ্জুদা সময় থাকতে তাকে বলতেই পারল না ভালোবাসার কথা ৷ না বললে মুনিয়া বুঝবে কেমন করে? অথচ কত সুযোগ ছিল ওর ৷ একদম পাশের বাড়ির ছেলে, তাই ছোটবেলা থেকেই মুনিয়াদের বাড়িতে রঞ্জনের অবাধ যাওয়া-আসা ৷ গাঁ-গঞ্জে একটা কাঁচা-বয়সের মেয়ের কাছাকাছি পৌঁছনোর মধ্যে যে হাজারটা বিধি নিষেধ থাকে, রঞ্জনের ক্ষেত্রে তা তো একবারেই ছিল না ৷ তবু ও কিছু বলতে পারল না ৷

 এত কেয়ারিং ছিল রঞ্জুদা ৷ এত আগলে আগলে রাখত মুনিয়াকে ছোটবেলা থেকে ৷

 আর তার বদলে ও কী করেছে?

 এত দুঃখের মধ্যেও ছোটবেলার সেই সব বদমায়েশির কথা ভেবে মুনিয়ার ঠোঁটে একটা আলগা হাসি ফুটে উঠল৷ রঞ্জুদার সঙ্গে তার মেলামেশার ইতিহাস আসলে লাগাতার অ্যাডাম-টিজিং-এর ইতিহাস ৷ খুব ছোটবেলায় পিঠে কালি ছিটিয়ে দেওয়া, চুলে বাঘনখ ফল কিংবা চুইংগাম চিপকে দেওয়া ৷ আর একটু বড় হলে, গ্রামের অন্য মেয়েদের সামনে ওকে আজেবাজে নাম ধরে ডাকা, কিংবা সাইকেলের পাম্প খুলে দেওয়া ৷ ও কিন্তু কোনোদিন মুনিয়ার নামে কাউকে নালিশ করেনি ৷ বরং মুনিয়াই করেছিল ওর নামে নালিশ ৷ অতিচালাকের ছদ্মবেশের আড়ালে সে নিজে যে আসলে কী ভীষণ কী ভীষণ বোকা, সে কথা ভেবে আজ এতদিন বাদেও কানদুটো লাল হয়ে উঠল মুনিয়ার ৷

 নালিশ করেছিল কেন? রঞ্জুদা তার ফোটো চুরি করেছিল বলে ৷ একটা গ্ৰুপ ফোটো ৷ বন্ধুদের সঙ্গে কলেজ পিকনিকে গিয়ে তোলা ৷ খাটের ওপর রেখে গিয়েছিল, তারপর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছিল না ৷ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ফোটোটার কথা ৷ হঠাৎই একদিন রঞ্জুদার পড়ার ঘরে ঢুকে দেখে সেই ছেলে টেবিলে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে মন দিয়ে কী যেন দেখছে ৷ পেছন থেকে পা টিপে টিপে গিয়ে উঁকি মেরে মুনিয়া দ্যাখে তাদের সেই গ্ৰুপ ফোটোটা ৷ মুনিয়া তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে তাদের বাড়ি এবং রঞ্জনদের বাড়ি দুটো বাড়িই মাথায় তুলেছিল ৷

 রঞ্জন সে দিন ওর হাতে পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিল ৷ কিন্তু মুনিয়া ছাড়বে কেন? সে অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছিল ওর বন্ধু তপতীর প্রতি রঞ্জুদার বেশ একটু দুর্বলতা আছে ৷ এইবার হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়া গেছে ৷ ওই গ্ৰুপ ফোটোর একদম মাঝখানেই তো তপতী দাঁড়িয়ে আছে, তাই না? ইসস! কী বকুনি আর প্যাঁক-ই না সেদিন খেতে হয়েছিল রঞ্জুদাকে!

 অনেকদিন বাদে মুনিয়ার খেয়াল হয়েছিল, শুধু তপতী কেন, সে নিজেও তো ছিল ওই ফোটোটার মধ্যে ৷ তখনই জীবনে প্রথমবার সে রঞ্জনের চোখের দিকে সত্যিকারের চোখ মেলে তাকিয়েছিল, আর সেখানে যা দেখেছিল তাতে তার মন অসাড় হয়ে গিয়েছিল ৷ কোনো মানুষের চোখে এতটা কষ্ট জমে পাথর হয়ে থাকতে পারে?

 কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে ৷ বাবা আসানসোলের ব্যবসায়ী-পাত্র কৌশিকের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছেন ৷ অন্যদিকে রঞ্জন এক অল্পশিক্ষিত বেকার ৷

 স্মৃতি থেকে হঠাৎই মুনিয়াকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল অদ্ভুত এক আওয়াজ ৷ চিৎকার নয়, শেয়ালগুলো এখন খুশিতে মুখ দিয়ে কেমন একটা কুঁক কুঁক শব্দ করছে ৷ মুনিয়া বিছানা ছেড়ে আবার জানলার কাছে গিয়ে দেখল যা ভেবেছিল, ঠিক তাই ৷ রঞ্জন শিবাভোগ দিচ্ছে ৷ কী ভীষণ রোগা হয়ে গেছে মানুষটা! সাদা ধুতি আর সাদা উড়নিতে একটুকরো জমাট বাঁধা জ্যোৎস্নার মতনই মনে হচ্ছিল ওকে ৷

 কাজ শেষ করে রঞ্জন ফিরে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে ৷ হঠাৎ কী মনে হতে চোখ তুলে তাকাল পাশের বাড়ির দোতলার জানলার দিকে ৷ দেখল মুনিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ অনেকক্ষণ নড়তে পারল না রঞ্জন ৷ তার পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেল ৷ মুনিয়ার বুকটা ধক করে উঠল ৷ এ তো সন্ন্যাসীর দৃষ্টি নয় ৷ উন্মাদের তো নয়ই ৷ মুনিয়া পরিষ্কার বুঝতে পারল, রঞ্জনের দুটো চোখের কাজলকালো মণি ওকে আদর করছে ৷ বলছে, কতদিন বাদে এলি মুনিয়া!

 মুনিয়া রঞ্জনের চোখ থেকে চোখ সরাল না ৷ সেও মনে মনে বলল, আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম রঞ্জুদা৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, আমিও ভালো নেই ৷ একদম ভালো নেই ৷ আমার বরটা মানুষ নয় ৷

 বলল, তোমাকে সব কথা বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তুমি কী বুঝবে?

 বলল, কত ভালো হত, যদি আমাদের দুজনের বিয়ে হত? সে তো এজন্মে আর হবে না, তাই না রঞ্জুদা?

 কিছুক্ষণ মুনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রঞ্জন নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল ৷ মুনিয়া শুনল কাজের মাসি কমল তাকে নিচ থেকে ডাকছে ৷ ও দিদি, রাতে কী রান্না হবে একটু বলে দিয়ে যাও না ৷

 আঁচল দিয়ে ভালো করে চোখদুটো মুছে নিয়ে মুনিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল ৷

.

 কৌশিক হালদারের স্নায়ুগুলো কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিল ৷ মাথার মধ্যে নানান চিন্তা তালগোল পাকিয়ে একাকার ৷ এখানে খবরের কাগজ পৌঁছয় বিকেলে ৷ সেই কাগজ পড়বার জন্যই দেড় কিলোমিটার হেঁটে সে পাণ্ডবেশ্বরের বাসরাস্তায় গিয়েছিল ৷ সেখানে একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকানে বসে চায়ের ভাঁড়টা সামনে রেখে কাগজের দ্বিতীয় পাতাটা ওল্টাতেই তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল ৷ কেসটা রাজ্য পুলিশ ট্রান্সফার করেছে সি আই ডি-কে ৷

 তার মানে মেয়েটার সেই পলিটিশিয়ান জ্যাঠা আসরে নেমে পড়েছেন ৷ সুতো টানছেন পেছন থেকে ৷ ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল কৌশিক ৷

 এমনিতে ব্যাপারটা যে বেশিদূর গড়াত না, সে ব্যাপারে কৌশিক নিশ্চিত ছিল ৷ জেট-এজের এই একটা সুবিধে ৷ কেউ বেশিদিন কিছু মনে রাখে না ৷ মিডিয়া মনে না রাখলে পুলিশের দায় পড়েছে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি নাড়াঘাটা করার ৷ আর এ ক্ষেত্রে দেবযানীর বাবা-মাও বোধহয় চাইত স্ক্যান্ডালটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধামাচাপা পড়ুক, কারণ ওদের আরেকটা মেয়ে আছে ৷ কিন্তু এখন ব্যাপারটা সহজে মিটবে না ৷

 যদিও কৌশিক যতটা সম্ভব পেছনের সমস্ত প্রমাণ লোপাট করতে করতে এগিয়েছে, তবু, কোথাও কি সে কোনো সূত্র ফেলে আসেনি?

 বেকার এই টেনশন নিতে গেল সে ৷ শালা, শয়তান ভর করেছিল মাথায় ৷ চায়ের খালি ভাঁড়টাকে এক লাথিতে ছিটকে দিয়ে রাস্তায় নামল কৌশিক ৷ কোনো ক্ষতি তো করেনি তার দেবযানী ৷ কেন যে শুধু শুধু দেবযানীকে সে . . . ৷

 বুকের ভেতর একটা ছোট্ট কাঁটার খোঁচা টের পায় কৌশিক ৷ ও ছিল মেয়েটার প্রথম প্রেম ৷ ওঃ! ভাবা যায়? কী আকুলতা, কী তীব্র প্যাশন সেই আঠেরো বছরের হৃদয়ের! কৌশিককে দেখলেই ওর মুখে যেন একশো – আট প্রদীপের আলো জ্বলে উঠত ৷

 কৌশিক আবার ভাবল, কেন অমন পাপ সে করল? সে কি রাগের মাথায়?

 নাঃ ৷ দালালি করে যাকে পয়সা রোজগার করতে হয় তার রাগলে চলে না ৷ যে তাকে শুয়োরের বাচ্চা বলে, তাকেও কৌশিক সেলাম বাজায়, যদি সে তার ক্লায়েন্ট হয় ৷ কাজেই রাগের অনুভূতিটা তার অনেকদিন আগেই ভোঁতা হয়ে গেছে ৷

 তাহলে?

 এই তাহলে’র জবাবটা কৌশিক খুব ভালো করে জানে ৷ ইচ্ছে করলেও সেটাকে সে এড়িয়ে যেতে পারছে না ৷ উত্তরটা এই যে, সেদিন কৌশিক যা করেছে, নেশার ঝোঁকে করেছে ৷

 খুব বেশিদিন কোডেনের শট নিলে যে নিজের অ্যাকশনের ওপর থেকে কন্ট্রোল চলে যায় এই কথাটা সে এতদিন কানে শুনেছিল ৷ রিসেন্টলি, তার নিজের কেসে ঠিক সেটাই হচ্ছে ৷ হরদম নানান বাওয়ালি করে ফেলছে সে ৷ কৌশিক জানে আর কিছুদিন পরে বাওয়ালিগুলোকে বাওয়ালি বলে চেনার ক্ষমতাটুকুও তার চলে যাবে ৷ তারপর? তারপর সে একটা ঘুমতা-ফিরতা লাশ হয়ে যাবে, যেরকম জ্যান্ত-লাশ মাঝে মাঝে দেখা যায় পার্কস্ট্রিট কবরখানার সামনে কিংবা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফুটপাথে — আকাশের দিকে ফাঁকা চোখ তুলে বসে আছে ৷

 আপাতত চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে কৌশিক দেখল তাঁর হাতের আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে ৷ কিছুতেই সে সেই কাঁপুনি থামাতে পারছে না ৷ কৌশিক নিজের মনেই হাসল ৷ সে জ্ঞানপাপী, তাই জানে যে এই কাঁপুনিকে পাতাখোরদের ল্যাঙ্গুয়েজে বলে ‘টার্কি’ ৷ বেশিক্ষণ ড্রাগ না পেলে নার্ভের এই খিঁচুনি শুরু হয়ে যায় ৷

 আর যদি বেশ কয়েকদিন অ্যাডিক্টদের হাতে ড্রাগ দেওয়া না হয়?

 কৌশিক শুনেছে রিহ্যাবিলিটেশন- সেন্টারের দেয়াল নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে দশটা আঙুল রক্তাক্ত করে ফেলে সেখানকার ইন-মেটস-রা ৷ দেয়ালে মাথা খুঁড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে এক পুরিয়া চরস কিংবা হেরোইনের একটা শট-এর জন্যে ৷

 কৌশিক বুঝতে পারে তার জন্যেও সেই দিন আর খুব বেশি দূরে নেই ৷ কিন্তু আপাতত মাথার ভেতরের ধোঁয়াটে ভাবটা কাটাবার জন্যে চাই… ৷

 কৌশিক রাস্তার ধারে একটা রাঙচিতার ঝোপের পেছনে গিয়ে বসল ৷ তারপর কাঁধের ব্যাগ থেকে একে একে বার করল ট্যাবলেট, জলের বোতল, তুলোর টুকরো ৷ ট্যাবলেটটা অল্প জলে গুলে তুলোর টুকরোর মধ্যে দিয়ে ছেঁকে নিল৷ সবশেষে বার করল ছোট একটা ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ৷ অভ্যস্ত হাতে সল্যুশনটাকে কনুইয়ের একটু ওপরে মাসলের মধ্যে ইনজেক্ট করে দিল ৷

 আঃ! এবার শান্তি ৷ ক্রমশ কৌশিকের হাতের কাঁপুনি থেমে গেল, কিন্তু বুকের কাঁপুনিটা তখনই থামল না ৷ খবরের কাগজে যা পড়ল, তাতে সে বেশ বুঝতে পারছে, এখন কিছুদিন তাকে এখানেই থাকতে হবে ৷ শ্বশুর যতক্ষণ আছে খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে হবে না ৷ কিন্তু খাওয়াদাওয়ার চিন্তা সে করেও না ৷ যত দিন যাচ্ছে তার খিদে কমে আসছে৷ সব রকমের খিদে ৷ ভাত দেখলে গা গুলোয় ৷ মেয়েমানুষ দেখলেও গা গুলোয় ৷ শুধু একটা জিনিসের জন্যেই মনপ্রাণ আকুল হয়ে থাকে ৷ ট্যাবলেট ৷ কিন্তু বড় দাম শালা ট্যাবলেটের ৷ পয়সা থাকলে এই অজগ্রামেও সাপ্লাই ঠিক চলে আসবে ৷ ওই পাণ্ডবেশ্বর মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালে আসানসোল থেকে হকার এসে মাল দিয়ে চলে যাবে ৷ কিন্তু পয়সাটাই তো ফুরিয়ে আসছে ৷ মুনিয়ার কাছে চাইবে? বলবে, তোমার বাবাকে বলো ধার দিতে? হারগিস দেবে না মুনিয়া ৷ মহা ঠ্যঁাটা মেয়েছেলে ৷ তার ওপর এখন নিজের জায়গায় আছে ৷

 কিন্তু আর বেশিক্ষণ এসব জাগতিক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে পারল না কৌশিক ৷ তার মাথার ভেতর রঙিন আলোর নাচানাচি শুরু হয়ে গেল ৷

 বেসামাল পায়ে কৌশিক উঠে দাঁড়াল, তারপর ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে পা দিল রাস্তায় ৷ আকাশে এখনো আলো আছে ৷ এখনই বাড়ি ফেরার কোনো মানেই হয় না ৷ বাড়ি ফেরা মানেই তো সেই মুনিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো ৷

 নিজের বউ হলেও এই মেয়েটাকে দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি হয় কৌশিকের ৷ ও পরিষ্কার বুঝতে পারে মুনিয়া তাকে ঘেন্না করে, ভীষণ ঘেন্না করে ৷ মুশকিল হচ্ছে, মুনিয়া ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই করে না ৷ ও যদি চিৎকার করত, ঝগড়া করত, গড়পড়তা মেয়েরা যেমন করে, তাহলে কৌশিকও একটা প্রতিক্রিয়া দেখাবার সুযোগ পেত ৷ সে মুনিয়ার কব্জি মুচড়ে দিতে পারত, চুলের গোছা টেনে ছিঁড়ে দিতে পারত, এমনকী তার পিঠে সিগারেটের ছ্যাঁকাও দিতে পারত ৷ কিন্তু কৌশিক কিছুই করতে পারে না ৷ মুনিয়া তাকে কোনো সুযোগ দেয় না ৷

 কৌশিক তাই যতক্ষণ পারে মুনিয়াকে এড়িয়ে চলে ৷

 আর সেইজন্যেই কৌশিক তখনই বাড়ি ফিরল না ৷ সে হাঁটা লাগাল নদীর দিকে ৷ কিছুটা যাবার পর তার চোখে পড়ল নদীর চরে সারি সারি হোগলা আর দরমার ছোট ছোট ঝুপড়ি ৷ নেশার ঘোরে পুরো ব্যাপারটাই তার একটা স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছিল, যেন একটা রূপকথায় পড়া বামনের দেশ ৷ ওটা কী? কারা থাকে ওখানে?

 কিছু না বুঝেই মেলার দিকে হাঁটা লাগাল কৌশিক ৷

 কৌশিক বাড়ি ফিরল রাত বারোটায় ৷ মুনিয়া দরজা খুলে দিল ৷

 নেশা করে এসেছে ৷ সেটা নতুন কিছু নয় ৷ আসানসোলেও ও প্রতিদিন ড্রাগ নিয়েই বাড়ি ফিরত ৷ মাঝে মাঝে কাঁদত, মাঝে মাঝে হাসত, তবে ঘুমিয়ে পড়ত খুব তাড়াতাড়ি ৷

 এ সব নোংরা ব্যাপার নিয়ে খুব বেশিক্ষণ মাথা ঘামাতে চায় না মুনিয়া ৷ সত্যি কথা বলতে কি, কৌশিক নামে ওই লোকটার অস্তিত্বই সে ভুলে যেতে চাইছে ৷

 এমনিতে তাতে খুব একটা অসুবিধে ছিল না, কারণ কৌশিকের সঙ্গে তার সারাদিনে কতবার দেখা হয়, ক’টা কথা হয়, তা হয়তো হাতের একটা আঙুলে গুনেই বলে দেওয়া যায় ৷ কিন্তু কৌশিকের অস্তিত্ব ভুলতে দেয় না তার পাওনাদারেরা ৷ সারাদিনের মধ্যে চোদ্দোবার তাদের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজে আর মুনিয়া দরজা খুলে পাওনাদারদের গালাগাল শোনে ৷ রান্না নয়, খাওয়া নয়, সেলাই নয়, ফোঁড়াই নয়, সংসারের কোনো কাজই নয়— একেকদিন নির্জন দুপুরে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মুনিয়া ভাবে— তার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাওনাদার ঠেকানো ৷ কী বিচ্ছিরি কথা যে বলে যায় গুন্ডার মতন লোকগুলো সে বলার মতন নয় ৷ যাবার সময় তারা প্রায় সকলেই দেয়ালকে শুনিয়ে বলে যায়, শুয়োরের বাচ্চা হালদার যদি এমনিতে টাকার জোগাড় না করতে পারে তো এমন ছমকছল্লু বউটাকে বাজারে নামিয়ে দিক না ৷ দুদিনে ধার শোধ হয়ে যাবে ৷

 বিয়ের আগে মুনিয়ারা শুনেছিল, কৌশিক ইঞ্জিনিয়ার ৷ বিয়ের পরে শুনল ঠিকাদার ৷ আরো পরে জানল, জমি-বাড়ির দালাল ৷ কিন্তু আসলে কৌশিক হালদার নামে লোকটা যে কী, তা মুনিয়া এই চার বছরেও বুঝতে পারল না ৷ যেটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় তা হল সে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট, জুয়াড়ি এবং সপ্তাহে অন্তত দুবার লছিপুরের ঢালে না গেলে তার চলে না ৷ বেশ্যাবাড়ি যাওয়ার অভ্যেসটা অবশ্য ক্রমশ কমে আসছে ৷ মুনিয়া বুঝতে পারে পাতা খেয়ে খেয়ে কৌশিক ক্রমশ ঢোড়া হয়ে যাচ্ছে ৷ আরো একটা ব্যাপার বুঝতে পারে মুনিয়া ৷ এইসব কাজে যে টাকার দরকার হয় তা জোগাড় করবার জন্যে কৌশিক ভিক্ষে থেকে শুরু করে যে-কোনো পথ নিতে পারে ৷ লোকটা কতটা নিচে নামতে পারে তার কোনো লিমিট নেই ৷

 মুনিয়া নিজের এই হীন জীবন নিয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছিল ৷ কাউকে কিছু বলত না, কোথাও যেত না ৷ বিয়ের একবছরের মধ্যে মা মারা গেল ৷ তাতে একদিক দিয়ে সুবিধেই হল ৷ মা যতটা খুঁটিয়ে সন্তানের খোঁজ নেয়, তার মুখের রেখা থেকে খুঁজে বার করে সুখ-দুঃখের কথা, তেমনটা তো আর কেউ পারে না ৷ অতএব মুনিয়া আসানসোলের সেই দু-কামরার ফ্ল্যাটেই বন্দিজীবন বেছে নিয়েছিল ৷ তুষকাঠি যেত বছরে একবার, পুজোর পরে ৷ যেদিন যেত সেদিনই ফিরে আসত ৷ বাবা হাজার বললেও থাকত না বেশিক্ষণ ৷ আর কৌশিক তো বিয়ের পর থেকে কোনোদিনই শ্বশুরবাড়ির রাস্তা মাড়ায়নি ৷

 তাই দুদিন আগে কৌশিক নিজেই যখন তুষকাঠি যাবার কথা বলল, তখন মুনিয়া দারুণ অবাক হয়েছিল ৷ সাধারণত যে সময়ে ও বাড়ি ফেরে সেদিন তার থেকে অনেক আগেই কৌশিক বাড়ি ফিরে এল ৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল অসম্ভব টেনশনের মধ্যে রয়েছে ৷ ঘরে ঢুকেই মুনিয়ার পা দুটো জড়িয়ে ধরে আর কি ৷ খালি বলে, ‘তুষকাঠি যেতে হবে ৷ চলো, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি ৷

 ব্যাপারটা কী? ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুনিয়া ৷ শ্বশুরবাড়ির ওপর হঠাৎ এত টান?

 এখানে থাকলে মারা পড়ে যাব ৷

 কেন? জিজ্ঞেস করল মুনিয়া ৷

 ন্যাটা দুলাল-কে অনেকদিন ধরে ঘোরাচ্ছি ৷ এইমাত্র শুনলাম ও সুপারি কিলার ফিট করেছে আমাকে মারার জন্যে৷ পালাই … চলো পালাই ৷ হাঁফাচ্ছিল কৌশিক ৷

 ওর কথাটা বিশ্বাস করেছিল মুনিয়া ৷

 আধঘণ্টার মধ্যে ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে, স্টেশন থেকে একটা প্রাইভেট-কার ভাড়া করে বর্ধমান আর বীরভূম জেলার সীমানায় গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই গ্রামে পৌঁছেছিল ওরা ৷

 তুষকাঠি পৃথিবীর সেই বিরল কয়েকটা জায়গার মধ্যে একটা, যেখানে মোবাইলের টাওয়ার নেই ৷ আসলে মাইল মাইল বালিয়াড়ির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাত্র দু-তিনটে গ্রামের কয়েকশো মানুষের জন্যে অত হাঙ্গামা করে টাওয়ার বসানোর ব্যাপারটা কোনো সার্ভিস প্রোভাইডারই বাণিজ্যসফল মনে করেনি ৷

 বলাই বাহুল্য, তুষকাঠিতে বিদ্যুতও পৌঁছয়নি ৷

 বছরের মধ্যে তিনশো পঞ্চান্ন দিন তুষকাঠি তার নিজের অন্ধকার একাকিত্বে ডুবে থাকে, আর দশদিন অদ্ভুত আদিম এক জনসমাগম ঘটে এখানে ৷ সময়টা হেমন্ত মাসের শুক্লপক্ষের শেষ দশদিন ৷ তুষকাঠির ধর্মবাবার থানে সেই ক’দিন এক মেলা বসে, ধর্মরাজের মেলা ৷

 ধর্মরাজ অনার্য দেবতা ৷ তার ভক্তরাও অন্ত্যজ ৷ এই মানুষগুলো নিজেদের জন্যে তৈরি করে নিয়েছে ভারী গোপন সব সাধনপদ্ধতি ৷ দেখা যায়, যে মানুষটা সারাবছর অজয়ের ধু ধু বালুর চরে একা একা চাষ করে, তারও রয়েছে এক বীজমন্ত্র ৷ যে অল্পবয়সি বিধবাটি নদীর স্রোতে সারাদিন মাছ খোঁজে, রাত হলে সে-ই এলোচুলে শ্মশানচারিনী ৷ এরকম হাজার হাজার তান্ত্রিক, উদাসী, অবধূতের জন্যে তীর্থের সার তীর্থ হল তুষকাঠি নামে এই গ্রাম, যা নাকি আসলে এক কূর্মপীঠ ৷ গোপন সাধকদের গোপন তীর্থ ৷

 হেমন্তের শুক্লপক্ষের ওই ক’দিন সারা রাত ধর্মরাজের থানে পুজোআচ্চা চলে ৷ কুয়াশা এবং তারার আলোর নীচে কিছু ছায়াশরীর অজয়ের জলে অবগাহন সেরে নিয়ে মিলিয়ে যায় তীরভূমির জঙ্গলে ৷ কে জানে, সেখানে কেমন তাদের হঠযোগ?

 ওই ধর্মরাজের যানকে ঘিরেই মেলাটা বসে ৷ একেবারেই গ্রামীণ মেলা ৷ চারিপাশে চোদ্দোমাইলের মধ্যে তেমন পয়সাওলা লোকজন নেই বলে বড় বড় দোকানিরা কোনোদিনই এই মেলায় আসতে আগ্রহ বোধ করেনি, আজও করে না৷ বিদ্যুৎ নেই বলে বৈদ্যুতিক নাগরদোলা বসে না, আলো ঝলমল সার্কাসের তাঁবুও দেখা যায় না ৷ আসে কেবল কাঠ আর লোহার গেরস্থালি জিনিস, খাজা আর কদমার হালুইকর, মাটির বেহালা, তালপাতার পাখা, জলভরা রঙিন হাঁস, মাটির পুতুল, টিনের কামান — বছর বছর বাংলার অতীত ফিরে আসে এই মেলায় ৷

 কাকতালীয়ভাবে মুনিয়ারা এখানে এসে পৌঁছেছে সেই মেলার মাঝখানে ৷

 যেদিন এখানে পৌঁছল তার পরদিন সকালের দিকে মুনিয়া হাতে একটা ঝাড়ন নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাপের বাড়ির ফার্নিচারগুলো থেকে ধুলো ঝাড়ছিল আর গুনগুন করে গান গাইছিল ৷ হ্যাঁ, সত্যি ৷ কী যে রয়েছে তুষকাঠির এই লাল ধুলোর পথ, ক্যানালের ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সোনাঝুড়ির সবুজ বন আর মৌরির শরবতের মতন সোনালি মিষ্টি রোদ্দুরের মধ্যে, কী যে ম্যাজিক রয়েছে বাবার ওই মুন্নি-মা ডাকটার মধ্যে, মুনিয়ার বুকের ভেতর জমে থাকা পাথরটা এক রাত্তিরেই একটু হালকা হয়ে এসেছিল ৷

 মুনিয়া ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মেলার কথাই ভাবছিল ৷

 কোনো এক সিদ্ধপুরুষের পত্তন করা এই মেলার বয়েস না কি দেড়শো বছরের কাছাকাছি ৷ ক্রেতা এবং বিক্রেতা সকলেই বহু বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এখানে আসছে ৷ আজ যে ছেলেটা নাগরদোলার বাঁ পাশে বসে মাটির বেহালা বিক্রি করছে, পঁচিশ বছর আগে ওর বাবা ঠিক ওইখানটাতেই বসে মাটির বেহালা বিক্রি করেছিল ৷ আজ যে বাচ্চাটা ছেঁড়া প্যান্টুলুনের পকেট থেকে পয়সা বার করে ওর কাছ থেকে বেহালা কিনল, পঁচিশ বছর আগে তার বাবা ওইখানে দাঁড়িয়ে, ঠিক ওইভাবে বেহালা কিনেছিল ৷

 মুনিয়াও জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মেলার জন্যে সারাবছর হাঁ করে তাকিয়ে থাকত ৷ এত আনন্দ আর কিছুতেই ছিল না ৷ ছোটবেলায় ওদের মতন কমবয়সি ছেলেমেয়েরা ঘুরে ঘুরে বড়দের কাছ থেকে চারআনা আটআনা পার্বণী আদায় করত ৷ তারপর সেই পয়সা নিয়ে দৌড় দিত মেলার দিকে ৷ মাটির বেহালা, চুলের ফিতে, বাদামতক্তি, জলভরা কাচের হাঁস কিনত ৷ নাগরদোলা ঘোরদোলায় চাপত ৷

 তবে মুনিয়ার সবচেয়ে ভালো লাগত পুতুলনাচ ৷

 বড় হয়ে মুনিয়া এদিক-ওদিক আরো অনেক মেলা দেখেছে — রানিগঞ্জে পিরবাবার মেলা, জয়দেবের মেলা, পৌষমেলা ৷ কিন্তু তাদের তুষকাঠির মেলায় যে পুতুলনাচের দল আসে, এমনটা সে আর কোনো মেলায় দেখেনি ৷

 প্রচলিত পুতুলনাচ থেকে একটু অন্যরকমের এই নাচ ৷ এরা ওপর থেকে সুতোর টানে ছোট ছোট পুতুলকে নাচায় না; মানুষপ্রমাণ বড় বড় পুতুলকে কোমরের নীচ থেকে তুলে ধরে ঘোরায় ফেরায় ৷ নিজেরা থাকে মঞ্চের নীচে টিনের শিট দিয়ে আড়াল করা অংশে ৷ সেখান থেকে পুতুলগুলোকে মাথায় ওপর তুলে ধরে নাচায় ৷

 পুতুলগুলো বোধহয় হালকা কাগজের মণ্ডের মতন কোনো জিনিস দিয়ে তৈরি, অনেকটা জামাকাপড়ের দোকানের প্লাস্টিকের ম্যানিকিনের মতন করে বানানো ৷ চরিত্র অনুযায়ী সেইসব ন্যাড়া বোঁচা পুতুলের মুখে চুল দাড়ি লাগানো হয় ৷ রাজা সাজালে বাবরি চুল আর পাকানো মোচ ৷ ঝলমলে শেরোয়ানি চুড়িদার ৷ একই পুতুলকে অন্য পালায় প্রয়োজন মতন জটাজুট লাগিয়ে গেরুয়া পোশাক পরিয়ে সন্ন্যাসী বানিয়ে দেওয়া যায় ৷ এমনকী শাড়ি, লম্বা পাটের চুল আর বুকে দুটো নারকোলের মালা ফিট করে রানি ৷

 পুতুলের কোমরের নীচে একটা বাঁশের লাঠির মতন কিছু গোঁজা থাকে, যেটা ধরে তাদের নাচানো যায় ৷ দর্শকরা সামনে থেকে দেখতে পায় টিনের শিটের ওপরে জেগে থাকা কোমরের ওপরে অংশটুকু ৷

 পুতুলদের হয়ে কথাবার্তা গান টান যা কিছু, সেসব ওই বেদেরাই আড়াল থেকে চালিয়ে যায় ৷

 নিতান্তই গ্রাম্য বিনোদন ৷ এক কালে যখন টিভি সিনেমা এইসব ছিল না তখন এই পুতুলনাচ লোক টানত ৷ এখন শহরাঞ্চলে নিশ্চয় পাত্তা পায় না ৷ তবে তুষকাঠির মতন অজ গ্রামে এখনো কিছুটা চাহিদা আছে এই সমস্ত বিনোদনের ৷

.

 এ সব দুদিন আগের কথা ৷

 আজ কৌশিক রাত দুপুরে বাড়ি ফিরে আসার পর মুনিয়া ওকে জিজ্ঞেস করেছিল কিছু খাবে কি না ৷ ও মাথা নেড়েছিল ৷ আসানসোল হলে মুনিয়া হয়তো কিছু বলত না ৷ কিন্তু এটা তুষকাঠি বলেই সে আর দুয়েকবার কৌশিককে খাওয়ার জন্যে সাধাসাধি করল ৷ কৌশিক সে-সবের উত্তর না দিয়েই বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ৷ পাশে শুয়ে মুনিয়ার ঘুম আসছিল না ৷ বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে পায়ের কাছের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল নদীর তীরে মেলার সারি সারি গ্যাসের আলো টিপ টিপ করে জ্বলছে ৷ পৃথিবীটা এখন কেমন মায়াময় হয়ে আছে ৷ অনেকদিন বাদে আবার তার মনে হচ্ছে কী সুন্দর এই বেঁচে থাকা! সে কি ওই সাদা ধুতি আর উড়নি গায়ে মানুষটার জন্যে, লোকে যাকে ইদানীং খ্যাপা সাধু বলে?

 বহুক্ষণ ধরে একটা কথা মুনিয়া মনে মনেও উচ্চারণ করতে পারছিল না ৷ এখন তার বুক ভেঙে সেই কথাটা বেরিয়ে এল ৷ মুনিয়া ফিস ফিস করে বলল, ও কি আমার জন্যেই পাগল হয়ে গেল?

 প্রশ্নটা সে কাকে করল, কে উত্তর দেবে, কিছুই জানে না মুনিয়া ৷

.

 আসানসোল সদর থানার পেছন দিকের একটা নির্জন ঘর ৷ ঘরটার সবক’টা জানলার পাল্লা শক্ত করে আঁটা ৷ দরজার সামনেও সজাগ পাহারায় একজন কনস্টেবল ৷

 ঘরের মধ্যে একটা ছোট টেবিল ৷ তার ওপরে ফাইলপত্র বিশেষ কিছু নেই, কেবল একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার ৷ সি.আই.ডি-র সাইবার-ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার মৃদুল মুস্তাফি সেই কম্পিউটারটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে গুম হয়ে বসেছিলেন ৷ তার দুই হাতের মুঠো শক্ত, কপালে বিনবিনে ঘাম জমেছে ৷

 মৃদুলবাবুর বয়েস সাতান্ন ৷ পুলিশের চাকরিতে বেশ নীচুতলা থেকে ঘষটে ঘষটে এতদূর উঠেছেন ৷ স্বাভাবিকভাবেই মানবশরীর নিয়ে বীভৎসতা তিনি কম দেখেননি ৷ বোমা বিস্ফোরণে হাত পা উড়ে যাওয়া মৃতদেহ দেখেছেন, রেপ-ভিকটিমের ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখেছেন, অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ মৃতদেহের সারি দেখেছেন ৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি ল্যাপটপের স্ক্রিনে যা দেখছেন, তা বোধহয় বীভৎসতায় ওই সমস্ত দৃশ্যকে হার মানায় ৷

 অথচ তা কোনো মৃত্যুদৃশ্য নয়, বরং নিরপেক্ষ বিচারে তাকে জীবনের উৎসবই বলা যায় ৷ একটি অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল কিশোরীর নগ্ন শরীর — ‘ভিডিও ক্যামেরা নানান অ্যাঙ্গেল থেকে ঘুরে ঘুরে সেই শরীরের ছবি দেখাচ্ছে ৷

 এই ছবি দেখে যে মৃদুলবাবুর মতন দুঁদে পুলিশ অফিসারেরও গা গুলোচ্ছে তার কারণ, এটা কোনো সাধারণ ব্লু-ফিল্ম নয় ৷ ওই মেয়েটিও নয় কোনো প্রস্টিটিউট ৷

 ‘মেয়েটার বাড়ি এই আসানসোলেরই মহিশীলা পার্কে ৷ ওর নাম দেবযানী মিত্র ৷ বয়েস আঠেরো বছর সাত মাস ৷ সবেমাত্র বি এ ফার্স্ট ইয়ারে অ্যাডমিশন নিয়েছিল ৷

 দেবযানী তিনদিন আগে সুইসাইড করেছে ৷ কারণ ওর ওই ছবিগুলো কেউ একটা জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অ্যাটাচ করে দিয়েছিল ৷

 দেবযানী কোনো সুইসাইড নোট লিখে যায়নি ৷ সেটাই স্বাভাবিক ৷ সম্ভবত কোনো বান্ধবীর কাছ থেকে নেটে ছবি চালাচালির খবর পাওয়ামাত্রই সে আগে নিজের ল্যাপটপে খবরটার সত্যতা যাচাই করেছিল ৷ ওর সার্চ- মেশিনের হিস্ট্রি মেনুতে এখনো স্ক্রল করলে দেখা যাচ্ছে সেই ছবি ৷ নিজের গোপনতম মুহূর্তগুলোকে এইভাবে বাজারের মাল হয়ে যেতে দেখে মেয়েটা প্যানিকড হয়ে পড়েছিল ৷ যে-ই এ কাজটা করে থাকুক সে যে কতবড় শয়তান তার একটা প্রমাণ যে, সে শুধু ভিডিয়োগুলো অ্যাটাচ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার সঙ্গে দেবযানীর পুরো প্রোফাইল দিয়ে দিয়েছিল — ওর নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সব ৷ ফলে সঙ্গে সঙ্গেই দেবযানীর মোবাইলে ফোন আসতে শুরু করেছিল ৷ ভাষা বিভিন্ন হলেও কলগুলোর বক্তব্য মোটামুটি এক ৷ তোমার শরীর খুব সুন্দর ৷ তোমাকে বিছানায় পেতে চাই ৷ রেট কত?

 এরপরেই মেয়েটা ওদের ফ্ল্যাটের সাততলার ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরেছিল ৷ এ ক্ষেত্রে গুছিয়ে লেখা সুইসাইড- নোট আশাই করা যায় না ৷ তাছাড়া এটা কি নিছক সুইসাইড? এর চেয়ে নিষ্ঠুরভাবে কোনো মেয়েকে খুন করা যায় কি?

 অতএব প্রশ্ন থেকেই যায়? কে সেই খুনি? কী ছিল তার মোটিভ?

 মৃদুলবাবু শখের গোয়েন্দা নন, পুলিশ ৷ তাই তিনি খুব প্রথাগত পথে তদন্ত শুরু করলেন ৷ প্রথমে জানবার চেষ্টা করলেন, কোন মেল-অ্যাড্রেস থেকে ওই নগ্ন ছবিগুলো নেটে ছড়ানো হয়েছে ৷ উত্তর এল, আসানসোলেরই একটা সরকারি অফিসের ই-মেল অ্যাড্রেস থেকে ৷ সময়টা রাত সাতটার পর, যখন ওই অফিস তালাবন্ধ থাকে ৷ স্পষ্টতই অ্যাড্রেসটা হ্যাক করে বার করা হয়েছে ৷ ইন্টারন্যাশনাল পাসওয়ার্ডটাও ওই অফিসের ৷ অতএব ওইদিকে তদন্তের পথ বন্ধ হয়ে গেল ৷

 এরপর মৃদুল মুস্তাফি দেবযানীর বাবা-মা এবং দিদির সঙ্গে দেখা করলেন ৷ তাদের যা যা প্রশ্ন করলেন, এবং যা উত্তর পেলেন তার সারমর্ম হচ্ছে পরিবারটার মধ্যে কোনো বাঁধন বা শৃঙ্খলা কিছুই নেই ৷ দেবযানীর বাবা, মা আর দিদি তিনজনেই চাকরি করেন ৷ বাবার চাকরিটা কর্পোরেট ম্যানেজারের, কোটিপতি লোক ৷ দেবযানী কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তার ওপরে কারুরই নজর রাখার সময় ছিল না ৷ ভিডিওতে যে ঘর, যে বিছানা দেখা যাচ্ছে তা দেবযানীর নিজের ঘর, নিজের বিছানা ৷ এই কথাটা জানার পর মৃদুলবাবু লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ৷ হোটেল হলে খোঁজখবর নেওয়া যেত ৷ হোটেলের কর্মচারীদের কাছে মেয়েটার ছবি দেখিয়ে পুরুষ-সঙ্গীটির একটা ডেসক্রিপশন বার করে নেওয়া যেত ৷ কিন্তু আপাতত সে আশাতেও চিটেগুড় ৷

 দেবযানীর মোবাইলের কলবুকে একটা নম্বর থেকে প্রচুর কল এবং এস.এম.এস এসেছে ৷ সেই নম্বরটাতেই দেবযানীও অনেক কল করেছে ৷ স্পষ্টতই এই সেই প্রেমিকের নম্বর ৷ সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নম্বরটা সিকিমের ৷ সেন্ডুপ লামা নামে জনৈক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর নামে সিমকার্ডটা কেনা হয়েছিল ৷ শিলিগুড়ির পানের দোকানগুলোতে পয়সা দিলে যে এরকম জাল নাম-ঠিকানার সিমকার্ড পাওয়া যায় সে কথা মৃদুলবাবুর জানা ছিল ৷ অতএব ওদিকেও তিনি আর পণ্ডশ্রম করলেন না ৷ আরো একটা জিনিস জানা গেল — কলগুলো সব এই আসানসোলের টাওয়ার থেকেই করা ৷ তবে এটা তো আন্দাজ করাই যাচ্ছিল ৷ এমন শারীরিক প্রেম তো দূরে বসে করা যায় না ৷ অতএব সেই গোপন প্রেমিক এই আসানসোলেরই বাসিন্দা, পার্মানেন্ট অথবা টেম্পোরারি ৷

 দেবযানীর মা একটা তথ্য দিলেন ৷ যেদিন দুর্ঘটনাটা ঘটেছে তার থেকে ঠিক একসপ্তাহ আগে দেবযানী কলেজ-এক্সকার্সনের নাম করে ওনার কাছ থেকে চারহাজার টাকা নিয়েছিল ৷ দেবযানীর নিজস্ব একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলেন ওর বাবা, যাতে ওনাদের অনুপস্থিতিতে হঠাৎ কোনো প্রয়োজনে দেবযানী ডেবিট কার্ডে টাকা তুলে নিতে পারে ৷ সেখানে প্রায় হাজার পঁচিশেক টাকার ব্যালেন্স সবসময়ইে থাকে ৷ তবু মেয়ে তার কাছে টাকা চাইছে কেন ভেবে ওর মা একটু অবাক হয়েছিলেন ৷ মেয়েকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন সে কথা ৷ তাতে দেবযানী না কি উত্তর দেয়, এ টি এমে বড় নোট, মানে পাঁচশো হাজার টাকার নোটে পেমেন্ট দেয় ৷ অথচ কলেজ কর্তৃপক্ষ ওদের বলেছে একশো টাকার নোটে ফিজ জমা দিতে ৷ ওর মা আর কিছু না বলে টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলেন ৷

 দেবযানীর কথাটা একটা তাড়াতাড়িতে বানানো হাস্যকর মিথ্যে অজুহাত সেটা বুঝতে মৃদুলবাবুর অসুবিধে হল না৷ তিনি দেবযানীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে খোঁজ নিলেন এবং যখন দেখলেন যে সেখানে এক পয়সাও ব্যালেন্স নেই তখন একটু নিশ্চিন্ত হলেন ৷ তাহলে ব্ল্যাকমেইলড হচ্ছিল মেয়েটা ৷ এবং যে মুহূর্তে ছেলেটাকে আর টাকা জোগাতে পারেনি, সেই মুহূর্তেই ছেলেটা ওর সর্বনাশ করে দিয়েছে ৷ মোটিভ পাওয়া গেল ৷ কিন্তু কালপ্রিটকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে তো এখনো হাতে রইল পেন্সিল … থুড়ি, কি-বোর্ড ৷

 থানার বাইরের চায়ের দোকানের ছেলেটা গ্লাসে চা দিয়ে গিয়েছিল ৷ সেই চায়ে একটা চুমুক দিয়ে মৃদুলবাবু আবার নতুন করে ভিডিও-টা দেখতে বসলেন ৷ একটা অদ্ভুত চিন্তা তার মাথার মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল ৷ মানুষের যৌনতা ব্যাপারটা কী ভীষণভাবে মনের সঙ্গে জড়িত ৷ তিনি যেহেতু জানেন যে মেয়েটা মরে গেছে, সুইসাইড করেছে, তাই তার নগ্ন ছবি তাকে এতটুকুও উত্তেজিত করছে না ৷ যদি না জানতেন, তাহলে বাকি যে একলক্ষ কতহাজার পুরুষ যেন ভিডিওটায় লাইক দিয়েছ তিনিও নিশ্চয় তাদের মতনই ওটাকে চোখ দিয়ে চাটতেন ৷

 কম্পিউটারের কিছু অ্যাডজাস্টমেন্টের ফলে ছবিগুলো এখন খুব ধীর গতিতে একটার পর একটা ফ্রেম হিসেবে তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ৷ প্রত্যেকটি ফ্রেমকে তিনি খুঁটিয়ে দেখছেন, যদি কোনো তথ্য পাওয়া যায় ব্ল্যাকমেইলারটার সম্বন্ধে ৷ নাঃ ৷ অত্যন্ত ধূর্ত এই ফোটোগ্রাফার ৷ কোথাও সে নিজে ধরা দেয়নি ৷ একটা রুমাল, একটা সানগ্লাস, ছেড়ে রাখা জামা, এমন কিচ্ছু নেই কোনো ফ্রেমের মধ্যে যার থেকে তাকে কোনোভাবে আইডেন্টিফাই করা যায়৷ ক্রমশ হতাশা গ্রাস করছিল সি.আই.ডির পোক্ত অফিসারটিকে ৷ হঠাৎ একটা ফ্রেম তার চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতেই খাড়া হয়ে বসলেন মৃদুলবাবু ৷ মাউসের একটা ক্লিকে আবার ফ্রেমটাকে ফিরিয়ে আনলেন মনিটরে ৷ তারপরে ফ্রিজ করে দিলেন সেটাকে ৷

 আঃ, এই তো! এই তো তিনি যা চাইছিলেন ৷ একটা হাত ৷ পুরো হাতও নয়, কব্জির ওপর থেকে বাহু অবধি সামান্য অংশ ৷ ডানহাতে ভিডিও ক্যামেরাটা ধরে বাঁ হাত দিয়ে লোকটা নিশ্চয় মেয়েটার অবস্থান ঠিক করতে গিয়েছিল ৷ সেই সময়েই বাড়িয়ে ধরা বাঁ হাতের কিছুটা অংশ এই ফ্রেমটার মধ্যে চলে এসেছিল ৷ মৃদুলবাবু মনিটরের ওপর ঝুঁকে পড়লেন ৷ পাওয়া যাবে না? কোনো সূত্রই কি পাওয়া যাবে না এই ছবিটা থেকে? কোনো আইডেন্টিফিকেশন মার্ক? কোনো ক্ষতচিহ্ন? জরুল?

 নাঃ, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না ৷ মৃদুলবাবু ফ্রেমটাকে জুম করে শুধু হাতটাকে অনেকগুণ বর্ধিত করে তুললেন ৷ আরেঃ! ওই দাগগুলো কীসের? কনুইয়ের একটু ওপরে খুব ছোট ছোট লালচে ফোটাগুলো? আশেপাশে একই রকম ছোট ছোট দাগ, একটু কালো হয়ে এসেছে ৷ সিরিঞ্জের পাংচার মার্ক ৷ কোনো ভুল নেই এতে ৷ বার বার ছুঁচ ফোটানোর ক্ষতচিহ্ন ওগুলো ৷ কোনোটা টাটকা, আবার কোনোটা লুকিয়ে এসেছে ৷ ছেলেটা ড্রাগ অ্যাডিক্ট ৷

 মৃদুলবাবু টেবিল থেকে ফোনটা তুলে এক্সটেনশন নাম্বার ডায়াল করে সদর থানার ও.সি. বিপুল সরকারকে ডাকলেন ৷ একটা জিনিস দেখে যান মিস্টার সরকার ৷ মজার জিনিস ৷ তার গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল এখন তিনি অনেক রিল্যাক্সড ৷

 সন্ধের মধ্যে সদর থানার লক-আপে শহরের ন’জন ড্রাগ পেডলারকে ঘাড় ধরে বসিয়ে দিলেন বিপুল সরকার ৷ হাতে দেবযানীর একটা ছবি নিয়ে সেখানে ঢুকলেন মৃদুল মুস্তাফি ৷

 ন’জনের মধ্যে তিন জন পেডলার ফোটো দেখে দেবযানীকে চিনতে পারল ৷ বলল, মেয়েটাকে একজন খরিদ্দারের সঙ্গে ঠেকে আসতে দেখেছে ৷ সেই তিনজনের কাছ থেকে যা ডেসক্রিপসন পাওয়া গেল তাতে খরিদ্দারটি লম্বা, রোগা, গায়ের রং ফর্সা ৷ বয়েস চৌত্রিশ- পঁয়ত্রিশ হবে ৷ তবে তাকে চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় মাথার চুল ৷ একদম স্প্রিং-এর মতন কোঁকড়া চুল ছিল ছেলেটার ৷

 আরো জানা গেল, গত তিন দিন ছেলেটা মালের সাপ্লাই নিতে আসেনি ৷

 মৃদুল মুস্তাফি পেডলারদের থেকে যা জানবার জেনে নিয়ে বিপুলবাবুকে বললেন, এদের ছেড়ে দিন মিস্টার সরকার ৷ তারপর একটু আমার সঙ্গে বেরোবেন ৷

 জিপটাকে থানার বাইরে বার করে ও.সি. বিপুল সরকার বললেন, কোনদিকে যাবেন স্যর?

 ছেলেটা যদি ট্রেনে বা বাসে করে কোথাও পালিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে লোকেট করতে সময় লাগবে ৷ তবে যদি গাড়ি ভাড়া করে গিয়ে থাকে … আচ্ছা এখানকার ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটা কোথায়?

 স্টেশনেই ম্যাক্সিমাম গাড়ি দাঁড়ায় ৷

 তাহলে চলুন, স্টেশনের দিকেই যাই ৷

 ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের ঘরে অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি রতন কোঙার দুই পুলিশ অফিসারকে মহা সমাদর করে ডাবের জল টল খাওয়ালেন ৷ মেম্বারদের কাছে কোঁকড়া চুল ফর্সা মতন প্যাসেঞ্জারের খোঁজটাও তিনিই করে দিলেন ৷ পনেরো মিনিটের মধ্যে বছর পঁচিশের একজন ড্রাইভারকে নিয়ে মৃদুলবাবুদের সামনে হাজির করলেন সেক্রেটারিসাহেব ৷ মুখে সাপল্যের হাসি ৷ বললেন, এই যে স্যার শ্যামল ৷ উনচল্লিশ শূন্য ছয় গাড়িটা চালায় ৷ ওই-ই নিয়ে গিয়েছিল ৷ কী জিজ্ঞেস করবেন ওকে জিজ্ঞেস করুন ৷ না, না, কিচ্ছু লুকোবে না স্যর ৷ ওর কী স্বার্থ বলুন ৷

 একটু পরে থানার দিকে ফিরতে ফিরতে মৃদুলবাবু বললে, আজ রাত হয়ে গেছে ৷ কাল সকালেই তাহলে আমরা রওনা হয়ে যাব তুষকাঠি ৷ শ্যামল, তুমি আজ তোমার গাড়ি নিয়ে থানা কম্পাউন্ডেই থাকো ৷ আর তোমার মোবাইল ফোনটাও আমাকে দিয়ে দাও ৷ কিছু মনে কোরো না, সামান্য সাবধানতা আর কী?

.

 হেমন্তের পূর্ণিমা আজ ৷ মেলার শেষদিন ৷

 মুনিয়া দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পরে কিছুক্ষণ নীচে বাবার কাছে বসেছিল ৷ বাবা চেয়ারে, ও লাল সিমেন্টের মেঝের ওপর থেবড়ি কেটে ৷ বাবা ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, এত রোগা হয়ে গেছিস কেন বল তো মুন্নি-মা? তারপরে একটু ইতস্তত করে এমন একটা প্রশ্ন করেছিলেন, যেটা বাবাদের নয়, মায়েদের প্রশ্ন ৷ — কৌশিকের সঙ্গে তোর মিলমিশ আছে তো?

 মনের দুঃখ মনে লুকিয়ে রেখে মুনিয়া বাবার হাঁটুতে চিবুক রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, হঠাৎ এই কথা?

 না, দুজনে কীরকম যেন ছাড়া ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছিস ৷

 ওসব কিছু না, বর-বউয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে মন কষাকষি তো হবেই ৷ তোমাকে অত ভাবতে হবে না ৷

 বিপত্নীক, হৃদরোগে জর্জরিত মানুষটাকে কোনো দুঃখের কথাই জানাবে না মুনিয়া ৷ এ ব্যাপারে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ৷ জানালে মানুষটা বাঁচবে না ৷

 একটু বাদে বাবা ঘুমিয়ে পড়লে মুনিয়া দোতলায় নিজের ঘরে উঠে এসেছিল ৷ কৌশিক যথারীতি কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ একবার ফিরেছিল ৷ স্নান করল না ৷ ভাতের থালার সামনে নাম কে ওয়াস্তে একবার বসল ৷ মুখে প্রায় কিছুই তুলল না ৷ মুনিয়ার বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ৷ এই মানুষটাকে সে কিন্তু ভালোবাসার কম চেষ্টা করেনি ৷ একে জড়িয়ে ধরেই রঞ্জনের শোক ভুলতে চেয়েছিল ৷ কিন্তু কিছুই হল না ৷ বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে মুনিয়া ভাবছিল, তার মতন কপাল ক’টো মেয়ের হয়? একদিকে এক সন্ন্যাসী, আর এক দিকে মাদকাসক্ত ৷ দুজনের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার সমস্ত অস্তিত্ব ৷

 বালিশের নীচে কী যেন গোঁজা আছে, শক্ত জিনিসটা মুনিয়ার গালে বিঁধছিল ৷ সে হাত গলিয়ে বুঝল কৌশিকের সেল-ফোন ৷ মুনিয়া ওটাকে বালিশের নিচ থেকে বার করে আনল ৷ এই তুষকাঠি গ্রামে জিনিসটার কোনো উপযোগিতা নেই ৷ সেইজন্যেই কৌশিক এটা ফেলে গেছে ৷ বালিশে মাথা রেখে মুনিয়া অন্যমনস্কভাবেই ফোনটার মেনু বাটন-এ হাত দিল ৷ সে অন্যমনস্কভাবেই ক্লিক করল ক্যামেরা অপশনে ৷ সেখান থেকে আর এক ক্লিকে পৌঁছে গেল ফোটো অ্যালবামে ৷ মোবাইলে স্টোর করে রাখা ছবিগুলো এক এক করে দেখতে লাগল ৷

 বেশিরভাগ ছবিই নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটের ছবি ৷ ক্লায়েন্টদের দেখাবার জন্যে বোধহয় তুলে রেখেছে কৌশিক ৷ একটা ছোট হাই তুলে ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল মুনিয়া ৷ হঠাৎ শেষ ছবিটায় চোখ পড়তেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল ৷ মনে হল তাকে যেন সাপে ছোবল মেরেছে ৷ আরে! এই মেয়েটার মুখটা তো চেনা ৷ কে যেন? কে যেন?

 দেবযানী ৷ দেবযানী মিত্র ৷ সেদিন দুপুরে কৌশিক যখন ঝড়ের মতন ঘরে ঢুকেছিল, বলেছিল প্রাণ বাঁচাতে ও তুষকাঠিতে গিয়ে লুকোবে, সেই মুহূর্তে টেলিভিশনের প্রত্যেকটা চ্যানেলে ব্রেকিং-নিউজ হিসেবে এই মেয়েটার আত্মহত্যার খবর দেখাচ্ছিল ৷

 হ্যাঁ, কোনো ভুল নেই ৷ সেদিন আরো লক্ষ লক্ষ মানুষের মতন শোকে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে অনেকক্ষণ ধরে এই মুখ দেখেছে মুনিয়া ৷ মনে মনে ভেবেছে, কী ভুল যে করতে পারে এই অ্যাডেলোসেন্ট মেয়েগুলো! আর পুরুষগুলোও কম জানোয়ার হতে পারে না ৷ অনেকক্ষণ ধরে অনেক আগ্রহ নিয়ে দেখেছিল বলেই মুনিয়ার বুকের মধ্যে মেয়েটার ছবি আর তার করুণ পরিণতি গাঁথা হয়ে গিয়েছিল ৷ এই মুহূর্তে তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে সেই মেয়েটারই অন্য একটা ছবি, একটু পাশ থেকে তোলা ৷ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে আছে দেবযানীর মুখ ৷ বেপরোয়া প্রাণশক্তি যেন উপচে পড়ছে মুখের প্রত্যেকটা রেখা থেকে ৷ ও জানত না, ওই বেপরোয়া স্বভাবের জন্যেই ও মরবে ৷

 দেবযানীর মৃত্যু আর কৌশিকের ঊর্ধ্বশ্বাসে আসানসোল ছেড়ে পালানো — এই দুটো ঘটনাকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলতে ঠিক এক সেকেন্ড সময় লাগল মুনিয়ার ৷ কৌশিক … কৌশিকই তার মানে দেবযানীর হত্যাকারী ৷

 মুনিয়া তারপর অনেকক্ষণ ধরে ভাবল, সে কী করবে? সে কি সকলকে জানিয়ে দেবে ওই খুনিটার স্বরূপ? তাহলে তার নিজের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে ৷ সেটা বড় কথা নয় ৷ শেষ হয়ে যাবে বেচারা বাবা-ও ৷ সেটা মুনিয়া ভাবতে পারে না ৷

 তাহলে কি সে গোপন করে যাবে পুরো ব্যাপারটাই? তার বদলে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত এক খুনি বদমাইশের সঙ্গে দিনযাপনের যন্ত্রণা সহ্য করবে?

 কে তাকে বলে দেবে কোনটা ঠিক রাস্তা?

 একজনের কথাই মনে পড়ল মুনিয়ার ৷

.

 রঞ্জন আজকাল খুব শান্তি খোঁজে, কিন্তু পায় না ৷ তার মাথার ভেতরটা সবসময়ে কেমন যেন জ্বালা করে ৷ কখনো কখনো সে তুষকাঠি গ্রাম পেরিয়ে চলে যায় অজয়ের তীরে ৷ সেখানে গভীর রাতে যারা আসে তারা কেউ মুনিয়াকে চেনে না ৷ তারা কেউ মানুষী ভালোবাসার কথা বলে না ৷ বলে অনেক দূরের রহস্যময় জগতের কথা ৷ তারা রঞ্জনকে নিয়ে তন্ত্রের মণ্ডলের ধারে বসিয়ে রাখে ৷ সেখান থেকে রঞ্জন আবার উঠে যায় অন্য কোনো ছায়াশরীরের কাছে, সেখান থেকে আবার আর এক জায়গায় ৷ কেউ একা বসে থাকে, আবার কোথাও দুজন নারীপুরুষ ৷ দলবদ্ধভাবেও সাধকেরা দাঁড়িয়ে থাকেন কোথাও কোথাও ৷ কেউ নারী নিয়ে সাধনা করে, কেউ শবদেহ নিয়ে ৷ নিভন্ত হোমের কুণ্ডের মধ্যে ফটাস শব্দ করে ফেটে যায় শ্মশান থেকে তুলে আনা করোটি ৷ কোথাও আগুনে দেশি মদের আহুতি পড়লে দপ দপ করে জ্বলে ওঠে নীল শিখা ৷

 এই সবই রঞ্জনের ভারী পছন্দ ৷ তার মাথার মধ্যে নিরন্তর অর্থহীন যে ছবিগুলো ভেসে যায়, তাদের সঙ্গে অজয়ের তীরের এই কায়াসাধকদের সাধনপদ্ধতির ভারী মিল ৷ এদের মনের ভেতরেও তার মতন একটা জ্বালা আছে ৷ এরাও মনে হয় শান্তির খোঁজেই এত সব করে বেড়াচ্ছে ৷ এরাই তাহলে তার আত্মীয় — ভাবে রঞ্জন ৷

 সে খুব একটা ভুল ভাবে না ৷ ওইসব হঠযোগীরাও রঞ্জনকে ভালোবাসে, কাছে ডাকে ৷ কেউ কেউ বলে, তুমি বাবা আমাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছ ৷ তারাই কেউ কেউ রঞ্জনকে নানারকম ক্রিয়াকরণের কথা বলে ৷ রঞ্জন ঘরে বসে হোম করে, শিবাভোগ দেয় ৷ কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও থেকে থেকে তার মনকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায় অলকা-তিলকায় সাজানো মিষ্টি এক কনেবউয়ের মুখ — মুনিয়ার মুখ ৷

 ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ওই মেয়েটা ৷ বাড়ির পেছনের বাগানে ছায়াচ্ছন্ন এক কোণে বসে রঞ্জন ভাবে, মুনিয়াকে ভুলতে না পারলে সে পরম আনন্দকে পাবে কেমন করে?

 লেবুগাছের ঘন ডালপালার আড়ালে চিড়িক-পিড়িক করে একটা টুনটুনি ডেকে চলে ৷ আর কোথাও কোনো শব্দ নেই ৷ রঞ্জন ভাবে পুতুলনাচ দেখানো সেই বেদেদের দলটার কথা ৷ তার মুখ থেকে দুর্ভাবনার মেঘটা একটু একটু করে সরে যায় ৷ সে ভাবে, বেদেরা যদি পারে তাহলে আমিই বা পারব না কেন? ওরাও তো সাধক ৷ তাই বলে কি সংসার ছেড়েছে? সংসারকে সঙ্গে নিয়েই ওরা কেমন গ্রাম থেকে গ্রামে, দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়ায় ৷ তাহলে?

 বেদেদের ব্যাপারে রঞ্জনের ভাবনাটার ভেতরে পাগলামি নেই ৷ সত্যিই এই পুতুলনাচ দেখানোটা একইসঙ্গে বেদেদের জীবিকা এবং ধর্ম ৷ ধর্মীয় নিষ্ঠায় ওরা এই কাজ করে ৷

 হাজার জমিজিরেত দিলেও ওরা চাষ করবে না, পাকা ঘর বাঁধবে না; ওরা যাযাবরের জীবনই যাপন করবে ৷ মেলা থেকে মেলায় ঘুরে ঘুরে খেলা দেখিয়ে বেড়াবে ৷

 বছরের পর বছর কেটে যায়, যুগের পরে যুগ ৷ কত লোকশিল্পে কতরকমের বেনোজল ঢুকে যায় ৷ কিন্তু ওদের পুতুলের পালাগানে কোনো বদল আসে না ৷ বদল আসে না পুতুলগুলোর চেহারায় কিংবা সাজপোশাকেও ৷ অদ্ভুত কিছু প্রেম, প্রতিহিংসা আর পুনর্মিলনের গল্প ৷ নায়ক-নায়িকাদের নামগুলো হিন্দু পুরাণ বা রূপকথার কোনো চরিত্রের সাথে মেলে না ৷

 যাঁদের পড়াশোনা বেশি, তাঁরা বলেন ইরানী তুরানী লোককথার গল্প ওসব ৷ এই বেদেরাও আদিতে ইরানী ৷ মনে হয় কথাটা সত্যি ৷ এত দারিদ্রের মধ্যেও এই বেদে নারী-পুরুষদের শরীরের সৌন্দর্য দেখবার মতন ৷ ওদের পাকা গমের মতন গায়ের রং, টানা টানা নাক চোখ, আর ঈষৎ বাদামি চুলের মধ্যে মধ্য-এশীয় লক্ষণাবলি ভারী স্পষ্ট ৷ অবশ্য ওদের এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে, ওরা না কি রাজা ভোজের বংশধর — সেই রাজা ভোজ, যাঁর নাম থেকে ম্যাজিকের আরেক নাম ভোজবাজি ৷ সেই অর্থে পুতুলনাচ দেখানোটা ওদের ধর্ম ৷ ওরাও একধরনের সাধক ৷ এবং তুষকাঠিতে আগত অন্যান্য গৌণ ধর্মের লোকেদের মতন ওরাও ভারী রহস্যময় ৷

 যেমন ধরা যাক এই ব্যাপারটাই যে, শরীর নিয়ে ওদের কোনো ছুঁৎমার্গ নেই ৷

 বেদে পরিবারের যুবতীরা মেলায় আগত রসিক পুরুষদের কাছে বহুদিন ধরেই আনন্দের উৎস ৷ অবশ্য শুধু রসিক হলেই হবে না, অর্থবানও হতে হবে ৷ সুন্দরী এবং কামকলায় নিপুণা ওই মেয়েদের একধরনের স্বর্গবেশ্যা বলা চলে৷ ওদের জন্যে বিগত যুগে বহু শ্রেষ্ঠী এবং সামন্তরাজা রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে মেলায় এসেছে বলে শোনা যায় ৷ যারা সোনার মোহরে তাদের মূল্য চোকাতে পারে তেমন কেউ কেউ আজও আসে ৷

 রঞ্জন অবশ্য শরীরের টানে আসে না, আসে মনের টানে ৷ তার ভালো লাগে, বসে বসে বেদে বুড়োর মুখে অস্পষ্ট ভাষার নানান অলৌকিকের কথা শুনতে ৷ শুনতে শুনতে তার মনে হয় এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে সমান্তরাল অন্য এক জগৎ আছে ৷ এই দুই জগতের মধ্যে বেদেদের হামেশাই যাতায়াত ৷ মাঝে মাঝে রঞ্জন সন্ধেবেলা অবধি থেকে যায় বেদেদের তাঁবুতে ৷ পালা শুরু হলে সেও বেদে পুরুষদের সঙ্গে পুতুলগুলোকে মাথার ওপর চাগিয়ে তুলে এদিক-ওদিক ছুটে ছুটে তাদের নাচিয়ে বেড়ায় ৷ তখন তার মধ্যে পাগলামির কোনো লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় না ৷ এই সব কারণে রঞ্জন বেদেদের দলের দারুণ প্রিয় ৷ সাধারণত ওরা গৃহী সমাজকে এড়িয়ে চলে ৷ তবে রঞ্জনকে দেখেই ওরা বোঝে যে এ ঘরে থাকলেও গৃহী নয় ৷ এর ঘর পুড়ে গেছে ৷ নেহাত দুবেলা দুমুঠো ভাতের টানে বাঁধা পড়ে আছে তুষকাঠিতে ৷ না হলে এই ছেলেটাও মনে মনে তাদেরই মতন যাযাবর ৷

 হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন রঞ্জনের কাঁধে হাত রাখে ৷ রঞ্জন চমকে ওঠে ৷ ফিরে তাকায় ৷ দেখে, যার কথা ভাবছিল সে-ই এসে দাঁড়িয়েছে—মুনিয়া ৷

 রঞ্জন দেখে, মুনিয়ার মুখটা কাগজের মতন সাদা ৷ চোখদুটো বিস্ফারিত ৷ এক মুহূর্তে রঞ্জনের মাথার মধ্যে থেকে মেঘ কেটে যায় ৷ সে লাফ দিযে দাঁড়িয়ে উঠে মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরে ৷ বুঝতে পারে, মুনিয়া থরথর করে কাঁপছে ৷ রঞ্জন দুহাতে মুনিয়াকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে মুনিয়া? এত ভয় পেয়েছিস কেন? কী হয়েছে?

 মুনিয়া তার আঁচলের আড়াল থেকে কৌশিকের সেল-ফোনটা বার করে ৷ তারপর দেবযানীর ছবিটা রঞ্জনকে দেখায় ৷ বলে যায় কৌশিক নামে এক অমানুষের কাহিনি ৷

 শুনতে শুনতে রঞ্জনের মাথার মধ্যে মেঘটা আবার ফিরে আসে ৷ তার চিন্তাশক্তি আবিল হয়ে যায় ৷ এত জটিলতা তার ভালো লাগে না ৷ তার ভালো লাগে অজয়ের বিস্তীর্ণ বালুচরে দুটো কাদাখোঁচা পাখির ভালোবাসাবাসি দেখে দুপুর কাটাতে ৷ তার ভালো লাগে রাতের অন্ধকারে তুষকাঠির কূর্মপীঠে ঘুরে ঘুরে হঠযোগীদের ক্রিয়াকলাপ দেখতে ৷ কিন্তু এসব কোন পৃথিবীর কথা বলে যাচ্ছে এই মেয়েটা? ল্যাংটো ছবি! আত্মহত্যা! রঞ্জনের মাথার মধ্যে এক জ্বলন শুরু হয় ৷ সে বেশ জোরেই বলে ওঠে — মুক্তি চাস? মুনিয়া, তুই কি তোর বরের হাত থেকে মুক্তি চাস?

 এ প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে মুনিয়াকে এক মুহূর্তও ভাবতে হল না ৷ সে উত্তর দিল — চাই ৷

.

 রাতের মেলার সঙ্গে দুপুরবেলার মেলার চেহারার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ৷

 আলোয়, গানে, হাজার গলার চিৎকারে, নাগরদোলার ক্যাঁচকোঁচ শব্দে, ভেঁপুর ফুঁ-য়ে, জিলিপির কড়াই থেকে ওঠা সস্তা তেলের গন্ধে, কার্বাইড ল্যাম্পের গ্যাসের গন্ধে, আর সর্বোপরি মানুষের পায়ে পায়ে ওড়া ধুলোর মেঘে সন্ধে থেকে রাত যে মেলা ভরে থাকে, এখন এই দুপুরে তার কিছুই নেই ৷

 মুনিয়ার শেষ কথাটা মাথায় নিয়ে ভরদুপুরের সেই ঘুম-ঘুম মেলার মাঠ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল রঞ্জন — একাই ৷

 একটা উন্মাদ ক্রোধ তাকে একরকম ছুটিয়ে নিয়ে চলেছিল ৷ মনে মনে সে জপছিল — খারাপ লোক, খারাপ লোক ওই কৌশিক হালদার ৷ ও আমার মুনিয়াকে কষ্ট দিচ্ছে ৷ ও মুনিয়াকে মেরে ফেলবে ৷

 কীভাবে সে কৌশিকের হাত থেকে মুনিয়াকে রক্ষা করবে, তার কোনো ধারণা রঞ্জনের ছিল না ৷ তবে যে-কোনো সংকটে সে যার কাছে যায়, এখনও সে তার কাছেই চলেছিল ৷ তার হয়ে যা কিছু করার সেই করবে ৷ সেই মুনিয়াকে রক্ষা করবে, মুক্তি দেবে সব অপমান আর কষ্টের হাত থেকে ৷

 রঞ্জনের হেঁটে যাওয়াটা তাই দিশাহীন ছিল না ৷ দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল, লক্ষ্য স্থির রেখেই সে হাঁটছে ৷

 হাজার পাগলামির মধ্যেও সে যেমন জল খেতে ভোলে না, খিদে পেলে ভাত খেতে ভোলে না, সেরকমই ভোলে না এই মেলার পথঘাট ৷

 অতএব নির্ভুলভাবে সে হেঁটে চলল মেলার পূর্ব-সীমানার দিকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল বিরাট এবং অদ্ভুত এক তাঁবুর সামনে ৷ এমন নানান রঙের কাপড়ে বোনা তাঁবু গোটা মেলায় আর একটাও নেই, যদিও বয়সের ভারে রংগুলো জ্বলে গেছে ৷ তাঁবুটার বাইরে, সামনের দিকে, উঁচু একটা স্টেজ বাঁধা রয়েছে ৷

 রঞ্জনের ডাকে দুজন মানুষ তাঁবুর দরজার পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এল ৷ একজন বুড়ো, মুখের চামড়ায় তার অজস্র ভাঁজ, চুলগুলো তুলোর মতন সাদা, কিন্তু শরীরটা পাকা বাঁশের মতন ছিপছিপে আর সটান ৷ আরেকজন বুড়ি ৷ বুড়োর সম্বন্ধে যা যা বলা হল সেই সবই এর সম্বন্ধেও বলা যায় ৷ অর্থাৎ বয়েস হয়েছে প্রচুর, কিন্তু বয়সের ভার কাবু করতে পারেনি ৷

 দুজনেরই জামাকাপড় নানা রঙে ছোপানো ৷ বুড়ির পরনে ঘাঘরা জাতীয় পোশাক ৷ বুড়োর লুঙ্গি আর ফতুয়া ৷ দুজনেরই গলায় ছড়ার পর ছড়া রঙিন পাথরের আর পুঁতির মালা ৷ বুড়োর কানে মাকড়ি, বুড়ির গায়ে মোটা মোটা রুপোর গয়না ৷ উপরন্তু বুড়ির হাতে, পায়ে এমনকী গালে আর চিবুকে অবধি অজস্র উলকির ছাপ ৷

 ওরা বেদে আর বেদেনি ৷ বেদেদের তাঁবু এটা ৷

 বুড়ো আর বুড়ি দলের সর্দার সর্দারনী ৷ রঞ্জনকে যেমন আদর করে ওরা তাঁবুর ভেতরে নিয়ে গেল, তাতে বেশ বোঝা গেল ওদের আলাপ এক-আধ বছরের নয় ৷

 বাইরের উজ্জ্বল আলো থেকে তাঁবুর ভেতরে অন্ধকারে ঢুকেই রঞ্জনের চোখে ধাঁধা লেগে গেল ৷ কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে দৃষ্টিকে সইয়ে নেওয়ার পর সে দেখতে পেল ভেতরের সুপরিসর মাটির মেঝেয় ছেঁড়া কার্পেটের ওপর শুয়ে আছে আরো আট-ন’জন নারী-পুরুষ ৷ সকলেই নিদ্রাতুর ৷ এদের পক্ষে এত বেলা অবধি ঘুমনোটা অস্বাভাবিক নয় ৷ ওরা পেশাগত কারণেই অনেক রাতে ঘুমোয় ৷

 রঞ্জন ভয়ঙ্কর উত্তেজিত গলায় বেদেবুড়োর কাছে বলে চলল মুনিয়ার কথা, কৌশিকের বদমাইশির কথা ৷ বুড়ো রঞ্জনের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে প্রশ্ন করল, তুমি কি মুনিয়াকে চাও?

 রঞ্জন সংক্ষেপে সম্মতি জানাল ৷

 বেদেবুড়ির মুখ হাসিতে ভরে উঠল ৷ সে বলল, চিন্তা কোরো না ৷ ব্যবস্থা হয়ে যাবে ৷

.

 রঞ্জন বেদেদের তাঁবুতেই রয়ে গেল ৷ সন্ধে নামল ৷ আগামী বছরের তিনশো পঞ্চান্নখানা অন্ধকার একঘেয়ে সন্ধের কথা ভেবেই যেন মেলার শেষ সন্ধ্যায় দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠল হ্যাজাক বাতি, গ্যাসের আলো, কুপি আর লণ্ঠন ৷ তবু হেমন্তের কুয়াশা আর পান্ডুর জ্যোৎস্না সমস্ত আলোকেই কেমন যেন নিষ্প্রভ করে দিল ৷ আলোর চেয়ে অনেক বেশি ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল মেলার মাঠ জুড়ে — মানুষের ছায়া, গাছের ছায়া, দোকানঘরের চতুষ্কোণ ছায়া, নাগরদোলার ঘূর্ণ্যমান ছায়া ৷

 সেই অগণিত ছায়ার মধ্যে ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কৌশিক হালদার ৷ সে খুঁজছিল রঞ্জন নামে ওই গাধাটাকে, যে তার বউয়ের সঙ্গে আজ দুপুরে আশনাই করছিল ৷ বাগানের লেবুগাছের নীচে কেমন জোড়া-পায়রার মতন বসেছিল দুটোতে ৷ ওর কাঁধে মাথা রেখে বসেছিল মুনিয়া ৷ কী আমার সাধের নাগর রে! শালা চুমুটা খেল না কেন? সাহস পেল না?

 কৌশিক পকেট থেকে হাতের মুঠোর মাপের ছোট্ট ডিজিটাল-ক্যামেরাটা বার করল ৷ তারপর একটু ফাঁকা জায়গা খুঁজে নিয়ে চোখ রাখল স্ক্রিনে ৷ পেছনদিক থেকে তোলা মুনিয়া আর রঞ্জনের ছবি ৷ আঃ, চুমুটা খেলে কত চমৎকার হত গল্পটা ৷ কপালটাই খারাপ ৷

 কৌশিক ভিডিও রেকর্ডিং-এর সাউন্ডটা একটু বাড়িয়ে কানের সঙ্গে স্পিকারটা সেঁটে ধরল ৷ পরিষ্কার শুনতে পেল কথোপকথন—মুনিয়া, তুই কি কৌশিকের হাত থেকে মুক্তি চাস?

 — চাই ৷

 খ্যাঁক করে কিছুক্ষণ আপনমনে হাসল কৌশিক হালদার ৷ আরে বাবা, মুক্তিপণ না দিয়েই মুক্তি চাইবি? তাই কি হয়?

 এই কথাটাই ওই রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করবে বলে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কৌশিক ৷ তার বউয়ের প্রেমিককে ৷ সে একটা প্রস্তাব দেবে রঞ্জনকে …

 কিছুক্ষণের মধ্যেই কৌশিক রঞ্জনকে দেখতে পেল ৷ বেটা একটা বড় রংচঙে তাঁবুর পেছনদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ সঙ্গে অবিকল আরব্যরজনীর বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা একটা হুরি ৷ সেইরকমই ঢোলা পাজামা, যার পায়ের গোছের কাছটা চাপা; সেইরকমই খাটো কামিজের নীচে বেরিয়ে থাকা সরল তলপেট আর গভীর নাভি; সর্বোপরি সেইরকমই ছুরির ফলার মতন ঝিকমিকে দুই চোখের মণি ৷

 কৌশিক নিজের মনে বলল, ওরে বাবা! গুরুদেব তো দেখছি অনেক ওপর তলার মাগিবাজ ৷ দুপুরে মুনিয়া, সন্ধেবেলায় ইরানী বুলবুলি!

 আরে, গুরুদেব নিজেই তো আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে দেখছি ৷ সঙ্গে মেয়েটাও চোখ মারল মনে হল না? জয় গুরু ৷ দেখা যাক লাক আজকে কোথায় নিয়ে যায় ৷ — কৌশিক ওই বেদে মেয়েটা আর রঞ্জনের পেছনে পেছনে মাথা নিচু করে তাঁবুর ভেতরে ঢুকল ৷

 তাঁবুতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো একটা গন্ধ যেন হিংস্র জন্তুর মতন কৌশিকের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ৷ এ যাবৎ চেনা সমস্ত গন্ধের থেকে আলাদা সেই গন্ধ ৷ কীসের গন্ধ এটা? কোনো ফুল? আতর? যাই হোক, সেই গন্ধের দাপটে কৌশিক কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ল ৷ যেভাবে রঞ্জনকে খেলিয়ে ডাঙায় তুলবে বলে ভেবেছিল, কৌশিক সেভাবে কথা শুরু করতেই পারল না ৷ সে সরাসরি ভিডিও ক্যামেরার স্ক্রিনে রঞ্জন আর মুনিয়ার ছবিটা দেখিয়ে রঞ্জনকে প্রশ্ন করল, এই ছবিটা তুষকাঠির লোকেরা দেখলে তোমাকে আর সাধক বলে ভক্তি করবে?

 না ৷ করবে না ৷ — ঘাড় নাড়ল রঞ্জন ৷

 কৌশিক বুঝতে পারল কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে ৷ রঞ্জনের তো এতটা নির্বিকার থাকবার কথা নয় ৷ তার তো ভয় পাবার কথা ছিল ৷ তার জায়গায় ওর চোখে মুখে যে ভাবটা ফুটে উঠেছে সেটা ঘেন্নার, রাগের ৷

 অপ্রস্তুত ভঙ্গিতেই কৌশিক রঞ্জনকে ফের প্রশ্ন করল, কিনতে চাও এই ভিডিও ক্লিপ টা?

 কৌশিকের এই কথার উত্তর না দিয়ে রঞ্জন তার দিকে প্রতিপ্রশ্ন ছুড়ে দিল — ওই ক্যামেরাতেই আরো একটা ক্লিপ রয়েছে, তাই না কৌশিকবাবু?

 রঞ্জনের এই আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল কৌশিক ৷ মুখে জবাব এল না ৷ রঞ্জন একই সুরে বলল — দেবযানী বলে একটা মেয়ের ছবি? রয়েছে না ওই ক্যামেরার মেমারিতে?

 কৌশিকের কান থেকে সহসাই মেলার সমস্ত চিৎকার মুছে গেল ৷ মনে হল আকাশ ফাটিয়ে রঞ্জন তাকে প্রশ্ন করছে — সুযোগ পেলে নিজের স্ত্রীর নগ্ন শরীরের ছবিও তুমি বিক্রি করতে পারো, তাই না?

 একটা সরু ফিতে পেছন থেকে কৌশিকের গলাকে ঘিরে ধরল ৷ একটা ফাঁস পড়ল রেশমি ফিতেটায় ৷ কৌশিকের চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল সেই আরব্য-রজনীর হুরি তার চুলের ফিতের দুটো প্রান্ত দু-হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ৷ ফিতের আচমকা এক টানে কৌশিকের মাথাটা পেছনদিকে হেলে পড়ল ৷

 পৃথিবীতে কৌশিকের শেষ মুহূর্তগুলো ভালো কাটেনি ৷

.

 সেই সন্ধেবেলায় মুনিয়া দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল ৷ তার ঠোঁটের কোণে একটা তেতো হাসি ৷

 সে ভাবছিল, আজ দুপুরে কে তাকে মুক্তির কথা জিজ্ঞেস করল?

 না, রঞ্জন ভট্টাচার্য ৷ যার নিজেরই আচার-আচরণের কোনো স্থিরতা নেই ৷

 কিন্তু কত ভালো হত যদি সত্যিই ওই কৌশিক হালদার নামের ঘৃণ্য লোকটাকে কেউ হাপিশ করে দিত ৷

 এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মুনিয়ার চোখে পড়ল কতগুলো মোটরগাড়ি তুষকাঠি গ্রামে ঢুকছে ৷ চারটে গাড়ির আটটা হেড-লাইটের আলো লাফাতে লাফাতে দুলতে দুলতে ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে তাদের বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে ৷ রেলিং দিয়ে ঝুঁকে পড়ে মুনিয়া দেখল একদম প্রথমে যে কালো টাটা-সুমোটা আসছে সেটা তার চেনা ৷ ওই গাড়িটায় চড়েই সেদিন তারা আসানসোল থেকে তুষকাঠিতে এসেছিল ৷ পরের তিনটে গাড়িই জিপ ৷ পুলিশের জিপ ৷ প্রত্যেকটাতেই কয়েকজন করে খাকি পোশাকের মানুষ বসে আছে ৷

 মুনিয়ার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না ৷ সে প্রায় পাখির মতন উড়ে নীচে নামল, এবং দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে রাস্তার মোড়েই পুলিশের কনভয়ের সামনে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ৷

 দ্বিতীয় জিপে ড্রাইভারের পাশেই বসেছিলেন মৃদুল মুস্তাফি ৷ তিনি গাড়ি থেকে নেমে এলেন ৷ মুনিয়া তার সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি সব জানি ৷ আগে জানতাম না ৷ আজ একটু আগেই জেনেছি ৷ আপনারা ওকে ধরুন, যা ইচ্ছে তাই করুন ৷ কিন্তু দোহাই আপনাদের, আমার বাবা যেন কিছু জানতে না পারেন ৷ মুনিয়া মৃদুলবাবুকে তার বাবার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগল ৷

 মৃদুল মুস্তাফির চোখের দৃষ্টি সমবেদনায় নরম হয়ে এল ৷ তিনি বললেন, তাহলে আপনার হাজব্যান্ডকে চুপচাপ বেরিয়ে আসতে বলুন ৷ ও গন্ডগোল না করলে আমরাও করব না ৷

 কিন্তু ও তো এখন বাড়িতে নেই ৷

 মৃদুল মুস্তাফি এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ও.সি. বিপুল সরকার দুজনেই মুনিয়ার এই কথায় সচকিত হয়ে উঠলেন ৷ প্রশ্ন করলেন, বাড়িতে নেই? কোথায় পালাল?

 মনে হয় মেলার দিকে গেছে ৷ সন্ধের পর ওখানেই ঘোরাঘুরি করে তো ৷

 দ্রুত পায়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে মৃদুল মুস্তাফি ও.সি.-কে বললেন, কাজটা ডিফিকাল্ট হয়ে গেল মিস্টার সরকার৷ মেলার মধ্যে থেকে একটা মানুষকে খোঁজা এবং পাকড়াও করা … এর চেয়ে তো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা সহজ ছিল ৷

 বিপুল সরকার একটু ইতস্তত করে বললেন, কাজটা অতটা কঠিন হবে না স্যার ৷

 কেন? একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন মৃদুলবাবু ৷

 আমি আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই একটা কাজ করে ফেলেছিলাম ৷ গতকালই দুজন প্লেন ড্রেসের ইনফর্মারকে তুষকাঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কৌশিক হালদারকে শ্যাডো করবার জন্যে ৷ আসলে আমি ভেবেছিলাম আমরা আসার আগেই যদি স্কাউন্ড্রেলটা এখান থেকে ভাগবার চেষ্টা করে … ৷

 মৃদুল মুস্তাফি নিজের বিরাট হাতের মুঠোর মধ্যে বিপুল সরকারের হাতটা জড়িয়ে ধরে বললেন, ওঃ, বাঁচালেন ভাই ৷ কীভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব ৷

 মুনিয়াদের বাড়ির সামনে থেকে রওনা হয়ে পুলিশের গাড়িগুলো মেলার পরিধি ধরে ধীরে এগিয়ে চলল ৷ চলতে চলতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে বিপুল সরকার বললেন, দাঁড়ান স্যার ৷ গোষ্ঠ আর শিবু আমাদের দেখতে পেয়েছে ৷ ওই যে, হাত নেড়ে ডাকছে ৷ তারপরে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে তিনি দৌড়লেন বেদেদের তাঁবুর দিকে ৷ পেছন পেছন বাকি আটজন পুলিশ এবং মৃদুল মুস্তাফি ৷ একজন রোগা মতন লোক উল্টোদিক থেকে দৌড়ে এসে বিপুল সরকারকে স্যালুট করে কিছু বলবার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল ৷ তারপর জিজ্ঞাসু চোখে মৃদুলবাবুর দিকে তাকাল ৷

 বিপুল সরকার তার ইশারা বুঝে বললেন, আরে গোষ্ঠ, উনিই সি. আই. ডি.র অফিসার, মুস্তাফিসাহেব ৷ যা বলবে ওনার সামনেই বলো ৷

 স্যর, অদ্ভুত ব্যাপার ৷ সেই সন্ধের মুখে আমাদের পাখি ওই তাঁবুতে ঢুকেছে ৷ তা প্রায় তিন ঘণ্টা হয়ে গেল ৷ তখন থেকে আমি এই তাঁবুর সামনে আর শিবু পেছনে পাহারা দিয়ে বসে আছি ৷ পাখির কিন্তু বেরোবার নামটি নেই ৷

 এইরে ৷ তাঁবুর ফাঁকফোকর দিয়ে পালাল না তো?

 কী যে বলেন, স্যার? পেছনে তো ধু ধু মাঠ ৷ ওই মাঠ পেরিয়ে মানুষ কেন, একটা বেড়াল হেঁটে গেলেও নজরে পড়ে যাবে ৷ আর শিবু তো ঠায় ওই পেছনের মাঠের দিকে তাকিয়ে বসে আছে ৷

 বিপুল সরকারের ইশারায় আটজন কনস্টেবল তাঁবুর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল ৷ বিপুল আর মৃদুল মুস্তাফি ঢুকলেন তাঁবুর ভেতরে ৷ দেখা গেল বুড়ো আর বুড়িই কেবল বসে বসে তামাক টানছে ৷ বাকি সবাই পুতুল নাচাতে ব্যস্ত ৷ বুড়ো আর বুড়ি বহুদর্শী ৷ দুই প্লেনড্রেসের অফিসারকে দেখে চিনতে পারল এবং সম্মান জানিয়ে বসতেও বলল ৷ তবে খুব একটা যে ভয় পেয়েছে এমন ভাব দেখাল না ৷

 কৌশিক হালদার বলে একটা ছেলে এই তাঁবুতে ঢুকেছিল ৷ সে গেল কোথায়? সরাসরি প্রশ্ন করলেন মৃদুল মুস্তাফি ৷

 বেদে বুড়ো শান্তভাবে জবাব দিল, আমাদের দলের বাইরে আর একজন লোকই এখানে আছে ৷ তার নাম কৌশিক নয়, রঞ্জন ৷ ওই যে, বোবা রাজপুত্রের পুতুল নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে ৷ এ ছাড়া আর কোনো বাইরের লোক এই তাঁবুতে ঢোকেনি ৷ আপনি ইচ্ছে করলে সার্চ করে দেখে নিতে পারেন ৷

 অগত্যা তাই-ই করতে হল দুই পুলিশ অফিসারকে ৷ তারা দুজনে মিলে তন্ন তন্ন করে তাঁবুর প্রতিটি কোণা, প্রতিটি প্যাকিং বাক্সের অভ্যন্তর, পর্দার আড়াল খুঁজে দেখলেন ৷ তাঁবুর ভেতর থেকে সরাসরি টিনের ঘেরাটোপের ভেতরেও ঢোকা যায় — যেখানে দাঁড়িয়ে আটজন বেদে আর রঞ্জন পুতুল নাচাচ্ছে ৷ সেখানেও ঢুকলেন দুই অফিসার ৷ ভালো করে চেয়ে দেখলেন প্রত্যেকের মুখের দিকে ৷ না, কোথাও নেই কৌশিক হালদার ৷

 মৃদুল মুস্তাফি বাইরে বেরিয়ে এলেন ৷ দর্শকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে কিছুক্ষণ পুতুলনাচ দেখলেন ৷ অদ্ভুত এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে এই মঞ্চের সামনে ৷ হেমন্তের মাঠের মধ্যে থেকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ঘন কুয়াশা ৷ সেই কুয়াশা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে মঞ্চের ওপরে ৷ হ্যাজাকের হালকা সবুজ আলোয় সেই কুয়াশা এক অতল দিঘির সবুজ জলের মতন নড়াচড়া করছে; মনে হচ্ছে জলের নীচেই যেন অভিনীত হচ্ছে ইরানী রাজকুমারীর দুঃখের পালা ৷

 সবথেকে আশ্চর্য লাগছে পুতুলগুলোকে ৷ বার্নিশ দিয়ে পালিশ করা তাদের মুখ হ্যাজাকের আলোয় চকচক করছে৷ নিষ্পলক চোখগুলো সুখে-দুঃখে হর্ষে-বিষাদে সমান বিস্ফারিত ৷ যেহেতু বেদেদের তেমন কারিগরি দক্ষতা নেই তাই পুতুলদের হাত পায়ের জোড়ও ভালো করে বানাতে পারেনি ওরা ৷ অতএব নাচের পুতুলদের মুভমেন্ট বলতে কেবল দেহকাণ্ডের ঝটকা মেরে ঘুরে যাওয়া — যেভাবে নিচ থেকে তাদের ঘোরানো হচ্ছে আর কি ৷ তারা ঠোঁট না নেড়েই কথা বলে ৷ টিনের আড়াল থেকে তাদের হয়ে কথা বলছে বেদে নারী- পুরুষেরা ৷

 শুধু বোবা রাজপুত্রের কোনো ডায়ালগ নেই ৷ আড়ষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে, বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি নিয়ে, ঝলমলে আলখাল্লা আর একমাথা কোঁকড়া চুলের বোঝা নিয়ে সে কেমন করুণভাবে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে মঞ্চের একটা কোনায় ৷ তার মানে দাঁড়িয়ে রয়েছে রঞ্জন নামে সেই ছেলেটাও, যার হাতে ওই পুতুলের শরীর ৷ মৃদুল মুস্তাফি তার লোকেদের হাতের ইশারায় গাড়িতে ফিরে যেতে বললেন ৷ মুখে বললেন, চলো গোষ্ঠ ৷ এখানে কেউ নেই ৷ তোমরা ভুল লোককে ঢুকতে দেখেছ ৷

.

 দুদিন বাদে বিকেলবেলায় মুনিয়ার আসানসোলের ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং- বেল বেজে উঠল ৷ দরজা খুলে মুনিয়া দেখল, মৃদুল মুস্তাফি দাঁড়িয়ে রয়েছেন ৷ সে তাঁকে ভেতরে এনে বসাল ৷

 রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে মৃদুলবাবু একবার ছন্নছাড়া ঘরটাকে চোখ দিয়ে জরিপ করলেন ৷ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কৌশিক হালদার কোথায় গিয়েছে আপনি জানেন?

 মুনিয়া ঘাড় নাড়ল ৷

 সত্যিই জানেন না? রঞ্জনবাবু আপনাকে কিছু বলেননি?

 মুনিয়া সচকিত হয়ে তাকাল মৃদুল মুস্তাফির দিকে ৷ তারপর আবার ঘাড় নাড়ল ৷

 মৃদুলবাবু তার অ্যাটাচির মধ্যে থেকে একটা ছোট ডিজিটাল-ক্যামেরা বার করলেন ৷ বললেন, সেদিন বেদেদের তাঁবুর ভেতর থেকে এটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম ৷ কাউকে জানাইনি ৷ তবে এখান থেকেই জানলাম, আপনি রঞ্জনবাবুর কাছে মুক্তি চেয়েছিলেন ৷

 মুনিয়া মাথা নিচু করল ৷

 রঞ্জনবাবু আপনাকে মুক্তি এনে দিয়েছেন ৷ কৌশিক হালদার আর কোনোদিনই ফিরবে না ৷ জানেন সেকথা?

 মুনিয়া দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল ৷ বলল, আমি জানি না, সত্যিই কিছু জানি না ৷

 মৃদুলবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি বিশ্বাস করি আপনার কথা ৷ সেই মুক্তি কীভাবে এসেছে তা রঞ্জনবাবু কোনোদিনই আপনাকে জানাবেন না ৷ জানাবার মতন নয় সে কথা ৷ বড় বীভৎস … বড় বীভৎস … ৷

 মৃদুলবাবুর কথা মাঝপথেই থেমে গেল ৷ তিনি হঠাৎই যেন মনে-মনে অন্য কোনো জায়গায় চলে গেলেন ৷

 নিস্তব্ধ ঘরে শুধু মুনিয়ার ফোঁপানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল ৷

 মৃদুলবাবু একটু বাদে গা-ঝাড়া দিয়ে বসলেন ৷ তারপর বললেন, এই কেসটা আমি ক্লোজ করে দিচ্ছি ৷ রিপোর্টে বলব, দ্যা কালপ্রিট ইজ অ্যাবস্কন্ডিং ৷ দুটো জীবন নষ্ট হয়েছে ৷ এখন এটাকে নিয়ে নাড়াঘাটা করা মানে আপনার জীবনটাও নষ্ট করা ৷ আশা করি আপনি তুষকাঠিতে ফিরে যাবেন ৷ চারবছর আগে যে ভুলটা করেছিলেন সেটাকেও এবার শুধরে নেবেন ৷ মনে হচ্ছে রঞ্জনবাবুর সন্ন্যাসের পথ খুব সহজেই ঘরের দিকে ফিরে আসবে ৷ আর আমার একটা পরামর্শ মনে রাখবেন ৷ কৌশিক কোথায় সেটা কখনোই জানার চেষ্টা করবেন না ৷ আপনি সহ্য করতে পারবেন না ৷

 হতবাক মুনিয়াকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে মৃদুল মুস্তাফি আসানসোলের ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় নেমে এলেন ৷ আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন, এই মুহূর্তে বেদেদের দল হয়তো পৌঁছে গেছে কোনো ধু ধু প্রান্তরের মধ্যে এক জলার ধারে ৷ সন্ধে নামছে ৷ শরঘাসের জঙ্গলের আড়ালে, কালো নরম মাটির বুকে, বেদে যুবকদের কোদালের কোপে কোপে একটা কবর খোঁড়া হচ্ছে ৷

 সেই কবরে ওরা শুইয়ে দেবে বোবা রাজপুত্রের পুতুলটাকে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *