অব্যক্ত – অমিতাভ সমাজপতি

অব্যক্ত – অমিতাভ সমাজপতি

সমস্ত পৃথিবী এখন চলছে। ছুটে চলেছে কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম—লাইন। শান্তনু কোনওরকমে কলেজ স্কোয়ারের গেটটা দিয়ে ঢুকে দুলতে দুলতে বাঁধানো একটা চত্বরে এসে বসে পড়ে। আজ একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। আর বাড়ি যাওয়া যাবে না।

রাত আটটা অবধি কফি হাউসে সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছে। তারপর সুমন্ত আর শান্তনু হাঁটতে হাঁটতে হাড়কাটা গলির সেই ঝুপড়িতে বসে মদ খেয়েছে। গ্যাসট্রিকের ব্যথাটা কয়েকদিন ধরে আবার ভোগাচ্ছিল। অ্যালকোহল এখন পেনকিলারের কাজ করছে।

রাত একটা বাজে বোধহয়। কলেজ স্কোয়ারে একটিও জাগা—মানুষ নেই। শুধু সিমেন্টের বেঞ্চে কয়েকজন শয্যাশায়ী। গরমে এই পার্কের হাওয়া, গরিবের এয়ারকন্ডিশন। ঘুমিয়ে নেওয়া সহজ।

শান্তনু পাথরের মসৃণ দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে। নেশা এখন তুঙ্গে। তবুও খেয়াল করে, বিদ্যাসাগরের মূর্তিটার বেদিতে বসে রয়েছে ও। লজ্জা পায় শান্তনু। ওঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে বোঝে হাত—পা প্রায় অচল। ধীরে ধীরে বেদিটাকে ধরে উঠতে চায়।

তুমি বইস। লজ্জার কিছু নাই।

চমকে ওঠে শান্তনু। কে যেন কথা বলল। চারপাশটা ভালো করে দেখে। না, কেউ নেই তো! মাথাটা দু—তিনবার ঝাঁকিয়ে নিতে নিতে মা—বাপ তুলে গালিগালাজ করে সুমন্তকে। ব্যাটা পাঁড় মাতাল…আমায় গলা অবধি খাইয়ে কখন কেটে পড়েছে।

তুমি দোষারোপ করিও না। ব্যক্তি নিজকর্মে কেবলই অজুহাত খোঁজে। যেন সমস্ত অপরাধসূচক কর্মে অপরের হস্ত।

শান্তনু এবার ভয় পেয়ে যায়। নেশাগ্রস্ত হলেও মাথাটা এখনও কাজ করছে ঠিক। শেষ পেগটা গেলার সময় নিজের কবিতা গড়গড় করে আউড়ে গেছে। কথাটা এল কোথা থেকে? এদিক—ওদিক তাকাল শান্তনু।

দিশাহারা হইবার কিছু নাই। আমিই কহিতেছি। তোমরা যাহাকে বিদ্যাসাগর বলিয়া থাকো।

শান্তনু অবিশ্বাসের চোখে ধীরে ধীরে উপরের দিকে তাকায়। পাথরের মূর্তিটা যেন মুচকি হাসছে। কাঁপতে কাঁপতে শান্তনু হাতজোড় করে নমস্কার করে, বলে আপনি!

ঈশ্বরচন্দ্র। তুমি আমাকে ঈশ্বর বলিতে পারো।

কী বলছেন কী! আপনি! শান্তনুর কাঁপুনি বাড়ে।

আপনি বিদ্যা…সা…

প্রয়োজন নাই। তুমি কবি? আমি কোনওদিন কাব্য লিখি নাই। সে প্রতিভা আমার ছিল না। অনুবাদ করিয়াছি মাত্র। তুমি প্রতিভাবান। অতএব নমস্য।

শান্তনুর জোড়হাত যেন আটকে গেছে। বলে, কী বলছেন আপনি! কুড়ি বছরে বিদ্যাসাগর উপাধি। একত্রিশে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল আপনি…।

বিদ্যাসাগর খলখল করে হেসে উঠলেন, বললেন—লজ্জা দিও না। পাঠ্য—পুস্তক লেখক ছাড়া নিজেকে কিছুই ভাবি না আজ। তুমি ওইভাবে দাঁড়াইয়া কেন? বইস। কত বৎসর ধরিয়া আমি এভাবে বসিয়া আছি। আমার হাতটা ধরো। একটু নামিয়া তোমার সঙ্গে বসি।

শান্তনু দ্বিধাগ্রস্তভাবে হাত বাড়ায়। বিদ্যাসাগর বেদিটা থেকে ছোট লাফ দিয়ে শান্তনুর পাশের জায়গাটায় বসেন। শান্তনুর মুখ থেকে দেশি মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। লজ্জায় খানিকটা সরে যায় ও। বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরে হেসে ওঠেন—লজ্জা পাইও না। না, না, লজ্জার কিছু নাই। আমার অভ্যাস ছিল। সময়কালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মধুর পাশে বসিয়া থাকিতাম। তুমি জানো বোধহয় শেষদিকে জল ছাড়া শুধু হুইস্কি খাইয়া নিজেকে শেষ করিল তোমাদিগের মধুসূদন।

শান্তনু মাথা নাড়ে। জানি। তাঁর উপর আপনার দয়ার কথা সর্বজনবিদিত। আপনি তাঁকে বড় অসময়ে সাহায্যের হাত…।

বিদ্যাসাগর হাত দিয়ে শান্তনুকে নিবৃত্ত করলেন—দয়া নয়। সম্মান বলো। আমি উহাকে সম্মান করিতাম প্রতিভার জন্য। যেমন এক্ষণে তোমাকে করিতেছি।

সহস্রবার চেষ্টা করিলেও কোনওদিনও মেঘনাদ বধ লিখিতে পারিতাম না। এমনকী প্রথমে তো তাহার ছন্দ—ই ধরিতে পারি নাই। তুমি জানো বোধহয় আমি আর দ্বারিকানাথ, রাজনারায়ণের কাছে ইংরেজি শিক্ষা করিতে গিয়েছিলাম। তখনই বুঝিয়াছিলাম মধু কী অসাধারণ পণ্ডিত!

আপনি তাঁর এই উচ্ছন্নে যাওয়া আটকালেন না কেন? ইচ্ছে করলেই তাকে বাঁচানো যেত।

বিদ্যাসাগর হো—হো করে হাসলেন। বললেন—তুমি সত্যি করিয়া বলো তো তোমাকে কে সুরা পান করাইয়াছেন। তোমার কোনও বান্ধব নিশ্চয়ই?

শান্তনু মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, সুমন্ত।

দেখো, এখন তিনি হয়তো তোমাকেই দোষারোপ করিতেছেন। তাহার স্ত্রী তাহাকে বকিতেছেন। তিনি বমি করিতেছেন এবং তোমাকে অভিসম্পাত করিয়া তৃপ্ত হইতেছেন। আসলে আমরা যাহা করি স্ব—ইচ্ছায়ই করিয়া থাকি। পরে কুফল লাভে অন্যকে দোষারোপ করিয়া শান্তি পাই। তাহা ছাড়া তোমরা কবি, তোমাদের ভাবের জগতে বিচরণ। অতএব শাসন, বাঁধন তোমাদিগের জন্য নহে। মধুসূদনকে বাঁচাইয়া অদ্যকার সভায় কী লাভ হইত? যাহার হয় অষ্টমবর্ষেই হয়, আশির প্রয়োজন নাই।

শান্তনু কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নেড়ে যায়। তারপর একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসে, আপনার যন্ত্রণা হয় না? এই যে অবক্ষয় চলেছে বছরে বছরে, এতে আপনার ক্রোধ হয় না? আপনি তো ক্রোধের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

বিদ্যাসাগরের মুখটি যেন কেমন পাংশুবর্ণ হয়ে উঠল মুহূর্তে। কিছুক্ষণ উদাসভাবে তাকিয়ে থাকলেন সামনের দিকে। দৃষ্টিতে ইউনিভার্সিটির দেশলাই মার্কা বাড়িটি। তারপর অদ্ভুত গলায় বলেন—জানো, আমি একদিন একদিন করিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকলাপ দেখিতেছি। তোমাদের মধ্যে কে যেন বলিয়াছিলেন—বিশ্বের বিদ্যা যেখানে লয় হয় তাহাই বিশ্ববিদ্যালয়। কথাটি সত্য। তোমরা কেন যে প্রতিবাদ করিতেছ না জানি না। রাজনীতি করিতে করিতে ইহাকে এখন কোথায় লইয়া ফেলিয়াছ। জানো, আমি সাহেবের টেবিলে পা তুলিয়াছিলাম। আজ বিংশ শতাব্দীতে তোমরা পদলেহন কী করিয়া শিখিলে বুঝিলাম না। অথচ কত কী শিখিবার ছিল।

শান্তনু লজ্জা পেয়ে বলে, আমরা আজ রাজনীতি—সর্বস্ব এক আধখেচড়া জাতি। জন স্ট্র্যাচির মতে জনপিণ্ড।

বিদ্যাসাগর মৃদু হেসে বললেন, যথার্থই বলিয়াছ। তা তোমার পড়াশোনার বহর তো বেশ ঠেকিতেছে।

শান্তনুর গর্ব হল এবার। বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে কমপ্লিমেন্ট। ভাবা যায়? নম্রভাবে বলল, আচ্ছা আপনাদের সময়ের সঙ্গে এখনকার বেসিক তফাতটি ঠিক কী? মানে আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি, না এগোচ্ছি?

গম্ভীরভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। শান্তনু ডাক দিতে গিয়েও থেমে যায়। একসময় বিদ্যাসাগরই বলে ওঠেন, তোমরা পিছাইয়া পড়ো নাই বরং অনেকটাই অগ্রসর হইয়াছ। ইতিহাস বিস্মৃত হইয়া শুধু সামনে অগ্রসর হইয়া খেই হারাইতেছ।

বিদ্যাসাগর হঠাৎ উঠে পড়লেন, শান্তনু অবাক হয়ে দেখে ওঁকে। এত কম উচ্চচতার লোকের এত তেজ!

তুমি বোধহয় আমার খর্বকার শরীর দেখিয়া বিস্মিত হইতেছ?

শান্তনু থতমত খেয়ে যায়। মানে আপনার ছবি দেখেছি…

উহা তো বক্ষ অবধি। আসলে আমি আমার এই আকৃতির জন্য চিরকালই হীনম্মন্যতায় ভুগিয়াছি। আইস জলের কিনারে বসি।

শান্তনু উঠে দাঁড়ায়।

নির্জন কলেজ স্কোয়ার। আকাশে চাঁদ। জলে তার ছায়া পড়ে চকচক করছে। অদ্ভুত একটা দৃশ্যপট। নিঃশব্দ চরাচর। পাশে বসে আছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। একেবারে বন্ধুর মতো। জমি থেকে ঘাস তুলে ছিঁড়ছেন আঙুল দিয়ে। যে মানুষটা রূঢ়, স্পষ্ট কথার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, আজ যেন কেমন বিষণ্ণ। মনের ভিতরে কেমন যেন অব্যক্ত অবসন্নতার ছোঁয়া। বিদ্যাসাগর একটি ঢিল ছুড়ে মারলেন জলে, টুপ করে আওয়াজ হল। জলের চাঁদ নড়ে উঠে আবার ধীরে ধীরে স্থির হল।

আমি জলে ইস্টক ছুড়িলাম কেন বলো দেখি? শান্তনু না বুঝে মাথা নাড়ে, ওটা হয়তো স্বভাব। জলের কাছে এলেই ঢিল ছুড়তে ইচ্ছে হয়। আপনিও দেখছি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন।

—না, আমি কোনওদিনই ব্যতিক্রম ছিলাম না। খানিকটা দৃঢ়চেতা হওয়াই কি ব্যতিক্রম?

শান্তনুর গা থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে গরমে। ঠান্ডা জলে স্নান করে নিলে ভালো লাগত। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, স্নান করবেন?

বিদ্যাসাগর যেন সংকুচিত হয়ে উঠলেন—না—না, আমি সন্তরণ জানি না।

শান্তনু চমকে ওঠে। ঠাট্টা করছেন বোধহয়। বাঙালি সাঁতারের অনুপ্রেরণা তো আপনার কাছ থেকেই পেয়েছে। সেই বিখ্যাত গল্প! মা—মা বলে দামোদর পেরোনো সাঁতরে? এটা কোন লোকে না জানে?

বিদ্যাসাগর যেন লজ্জিত হলেন, বললেন,—না, ওটি সর্ব্বৈব মিথ্যা। আমি সত্যিই সন্তরণ জানি না।

তা হলে ওই গল্পটা?

ওটি রটনা। সাহেব আমাকে ছুটি দিলেন না। আমার ভ্রাতার বিবাহের পত্র পাইয়া ছুটি চাহিয়াছিলাম।

শান্তনু একেবারে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সন্দেহে মুখে ভাঁজ পড়ল ওর। চাঁদের আলোয় বিদ্যাসাগর যেন সেটা লক্ষ করলেন, বললেন, আসলে দামোদর সেইসময় শুষ্ক। অর্থাৎ যখন আমার ভ্রাতার বিবাহ হয়, তখন জ্যৈষ্ঠ মাস। গবাদিপশুরা হাঁটিয়া পার হয়। আমি তাহাই করিয়াছিলাম…।

শান্তনু বাধা দিয়ে বলে, কেন? আপনি মায়ের আদেশ তো কখনওই অমান্য করেননি। তাঁর ডাকে সেই ভয়াল নদীতে ঝাঁপ দেননি?

না, কখনওই নহে। আর একটা কথা…

বিদ্যাসাগর চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ।

আমি কেন সেইরাতে বাড়ি আসিয়াছিলাম—জানি শুধুই আমি। আর কেহ নহে। তবে একজন বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তিনি মুখে কিছুই বলেন নাই। বিদ্যাসাগর আবার চুপ করে গেলেন।

বলতে কি আপত্তি আছে? তাহলে থাক। শান্তনু প্রসঙ্গ পালটাতে চেষ্টা করে। একটা কথায় আটকে রাখলে চলবে না। যতটা পারা যায় জেনে নেওয়া যাক। এই সুযোগ আর আসবে না। রাত অনেক হল। প্রায় মধ্যরাত তো বটেই।

বিদ্যাসাগর ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে সোজাসুজি শান্তনুর চোখের দিকে তাকালেন তারপর হঠাৎ আনমনে বলেন, তুমি যাহা দেখিতেছ তাহা ঠিক নহে। তুমি যা দেখিতে চাও তাহাই হয়তো ঠিক। আমি সেই রাত্রে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম বলিলে ঊনবিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ্যাটি রচনা হইবে। সত্যটি হইল তখন নতুন বিবাহিত জীবন। গিয়েছিলাম নববধূর অব্যক্ত ডাকে, মায়ের ডাকে নহে।

এই অবধি বলেই বিদ্যাসাগর একটা ঢিল খুঁজে নিয়ে আবার ছুড়ে মারলেন জলে। জলের চাঁদ আর একবার নড়ে উঠল। বিদ্যাসাগর বললেন, আমি তখন এবং এই মুহূর্তে কেন ইস্টকখণ্ড ছুড়িলাম জানো? কারণ, এই জল যতদিন থাকিবে ততদিন ইহার ভিতর চাঁদ দেখা যাইবে। কিন্তু ইহা—তো আসল চাঁদ নহে। চাঁদের প্রতিবিম্ব। দেখিতে অবিকল হইলেও সত্য চাঁদ দেখিতে হইলে স্কন্ধ উপরের দিকে তুলিয়া দেখিতে হইবে। সত্যের দিকে তাকানো এক্ষণে স্কন্ধ ভারাক্রান্ত করা। মানুষমাত্রেই ইহার অবহেলা করে। তাই নকল চাঁদে ইস্টক ছুড়িয়া আমার মোহমুক্তি ঘটাইতেছিলাম। যেমন আজ তোমাকে পাইয়া এতদিনকার মোহমুক্তি ঘটানো গেল।

শান্তনু অবাক হয়ে বলে, কিন্তু এই মিথ্যেটা প্রায় এক শতাব্দী ধরে সত্যি হিসেবে চলে আসছে।

বিদ্যাসাগর হাসলেন। প্রগাঢ় হাসি। জ্ঞানী লোকের অবজ্ঞা নেই সেই হাসিতে। মনের মধ্যে জমে থাকা গভীর দুঃখের একটুকরো ঝলক যেন হাসি হয়ে ঝরল, বললেন, দেখো, শতাব্দীর সব রটনাই তো সত্য নহে। সত্য হইলে পৃথিবীটা আরও অর্থপূর্ণ হইত। তুমি কি জানো, চলিয়া যাওয়া সময়ের অনেকটাই ফাঁকির মধ্যে নিমজ্জমান। ইহার অধিকাংশটাই অসত্য অথবা সত্যের অপলাপ?

শান্তনুর অপ্রস্তুত ভাবটা এখনও কাটেনি। এই মহান ব্যক্তিত্ব কত যুগ ধরে ঘরে ঘরে মহামানব হয়ে আছেন। তাঁর এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি!

বিদ্যাসাগর শান্তনুর অবাক হওয়াটা যেন ধরে ফেললেন। কাপড়ের খুঁটটি জড়িয়ে বাবু হয়ে বসলেন, বললেন, তুমি সংকুচিত হইও না। এসকল কথা কেহই জানে না। আমার জীবনের আরও কয়েকটি অসত্য আজ উদ্ঘাটিত হইতে পারিত কিন্তু তোমার চিত্তবৈকল্য দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি না সকল কথা তুমি কেমনভাবে লইবে।

শান্তনু হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। নিজের জীবনের একরাশ অব্যক্ত কথা যেন ওর চারপাশ ঘিরে নাচতে শুরু করেছে, যে কথা কাউকে বলা হয়নি। হবেও না বোধহয়। দেড় শতাব্দী পরে এমনভাবে বলার সুযোগ পাবে কি ও! চমক ভাঙল বিদ্যাসাগরের ডাকে।

কী ভাবিতেছ?

কিছু না। আপনি বলুন, আমি শুনব।

বিদ্যাসাগর যেন খুশি হয়ে গায়ের চাদরটা এবার একেবারে ভালোভাবে জড়িয়ে নিলেন। কপালটা চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওর। বেশ উঁচু, কিছুটা কামানো। ওটাই বোধহয় স্টাইল ছিল তখনকার দিনের পণ্ডিতদের। তবে চটি জুতোর ব্যাপারটা ওর নিজস্ব স্টাইল। অসাধারণ স্টাইলিস্ট ছিলেন।

শান্তনু কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও চুপ করে যায়। বিদ্যাসাগর জলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আনমনা মনটি যেন কথার খেই ধরতে চাইছে। গোপন কোনও দুঃখের কথা বলবার আগে প্রত্যেক মানুষ কিছুটা থম মেরে যায়। উনিও এখন সেইরকম রয়েছেন। খানিক পরে বললেন, তোমার সন্তান কয়টি?

দুই,—দুটোই মেয়ে।

তুমি দেখিতেছি বেশ ভাগ্যবান।

শান্তনু অবাক হয়ে বলল, সেকী? ভাগ্যবান বলছেন কেন? ছেলে নেই তাতে আমি আক্ষেপ করি না, তবে এ ব্যাপারে আমার স্ত্রী অবশ্যই দুঃখিত। কিন্তু এতে ভাগ্যবানের কী দেখলেন!

কেন বলিতেছি জানো? তোমার পুত্র থাকিলে কখনওই তোমার সদৃশ হইত না। ইহা হয় না। কখনও কখনও অবশ্য হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপরীত হয়। সেক্ষেত্রে আক্ষেপ আর, দুঃখ করা ছাড়া কী—ই বা করিবার থাকে। যেমন আমি। লোকে বিদ্যাসাগর নাম দিয়াছে, অথচ আমার পুত্রটি…। শান্তনু এই ঘটনাটি জানে। তাই অন্যপ্রসঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য আগের কথাটারই খেই ধরে বলে, আপনি সাংসারিক জনপ্রিয়তার কথা বলছিলেন।

হ্যাঁ, ঠিকই বলিয়াছ। জনপ্রিয়তা, অর্থাৎ সবাকার মনে তুমি ভেদ্য এবং হাঁ—বাচক থাকিবে, অথবা না বলিবে না। এমনভাবে চলিতে পারিলে তুমি জনপ্রিয় হইবে। ইহাতে তোমার নিদারুণ ক্ষতি হইলেও তোমার মাথাটি হ্যাঁ—র দিকে থাকিবে। যেমন মদীয় মস্তকটি যদি তোমাদিগের ভগবতীদেবীর বিরুদ্ধে লইতে পারিতাম তাহা হইলে আমার পুত্র কলিকাতাতেই থাকিত। শিক্ষা লাভ করিত। পিতার মৃত্যুর পর উইল লইয়া মামলা করিত না, বংশের নাম মসিলিপ্ত করিত না। তাহা আর হইল কোথায়।

শান্তনু বলল, এটা এমন কিছু দোষের হত না। এ ব্যাপারে আপনি যে একেবারে উদাসীন ছিলেন সেটা ভাবছেন না কেন?

বিদ্যাসাগর বাধা দিলেন, না—ইহা সত্য নয়। আমি চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু তখন আমার মাতৃভক্তি সুপরিচিত। সেই মোহ ভাঙিতে পারি নাই। একদিক রাখিতে হইলে অন্যদিক ছাড়িতে হয়। আমি জনপ্রিয়তাই গ্রহণ করিয়াছিলাম। সংসারে এবং জগৎসংসারে।

কিন্তু আপনার দয়ার কথা সর্বজনবিদিত, বাঙালি এখনও আপনার উদাহরণ দেয়। শুধু মধুসূদন নয়, আমরা সবাই। এটা নিছক জনপ্রিয়তার জন্য—তা তো নয়।

তুমি আবার লজ্জা দিতেছ।

সত্যি বলছি। আপনার বিধবা বিবাহ আইন ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সমাজসেবা। আমি আশ্চর্য হই আপনার সাহস দেখে। কত আধুনিক ছিলেন সেই যুগে। ভাবা যায় না। ব্যাপারটা মাথায় এল কীভাবে?

আসলে এক চৌদ্দবর্ষীয় বালিকার বৈধব্য আমাকে পীড়িত করিয়াছিল তাই হয়তো…

আপনি কি মার্কস—এ বিশ্বাস করেন?

কেন? একথা বলিতেছ কেন?

কারণ এটি হল তাঁর মতবাদ।

যদি বিষয়টি পরিষ্কার করিয়া বলো তবে বুঝিতে চেষ্টা করিব।

শান্তনু তার প্রিয় সাবজেক্ট পেয়ে খুশি হয়ে বলল, আপনি আগে বিধবার কষ্ট দেখেছিলেন তারপর তার প্রতিকার। এটি হল কার্ল মার্কসের একটি থিয়োরি, আগে বস্তু দেখি, তারপর মন তার উপর কাজ করে।

বিদ্যাসাগর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, বললেন, কিন্তু কখনও কখনও মনও আগে কাজ করে। পরে কার্য সমাধা হয়। দুইটিই সমানভাবে মনুষ্যের উপর কাজ করিয়া থাকে। শান্তনু মাথা নাড়ে—হয়তো ঠিকই—আপনি বলছেন হেগেলও তাহলে সঠিক।

হ্যাঁ, আমি হেগেল পাঠ করিয়াছি তিনি যেমন অর্ধসত্য, তোমার কার্ল মার্কসও অর্ধমিথ্যা।

কিন্তু মার্কস তো বলেছিলেন হেগেলের থিয়োরি ঠিকই আছে। শুধু পা উপরে মাথা নীচে।

বিদ্যাসাগর হা—হা করে হাসলেন—আসলে দুইজনকেই পাশাপাশি রাখিতে হইবে। ঠোকাঠুকি করিলে চলিবে না। আমি একবার এই পাশাপাশি চিন্তা না করিয়া জীবনে এক বিশাল পাপ করিয়াছিলাম যাহা জীবনে কাহাকেও বলিতে পারি নই।

কীরকম?

তোমার নিশ্চয়ই আমার সেই বিখ্যাত গল্পটি মনে আছে।

কোনটা বলছেন? কারমাটারে ভুট্টা বিলিকরণ?

না—না, সেই যুবকটি—জ্ঞানদানের নিমিত্তে যাহার আমি বাক্স বহন করিয়াছিলাম।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা কে না জানে? ছোটবেলায় কতবার ট্রানস্লেশন করেছি। গল্পটায় আপনি ‘কুলি কুলি’ করে চিৎকার করে ওঠা যুবকের হাত থেকে বাক্স নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ইতিহাস সেই অবধি জ্ঞাত রহিয়াছে, তাহার পরের ইতিহাস নাই। তাহার পরদিন সেই সময় স্টেশনে যাইতেই প্রায় অনাহার—ক্লিষ্ট এক বৃদ্ধ আমাকে চিৎকার করিয়া ভর্ৎসনা করিয়াছিল। আমি অপ্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেই সে বলিল, সেই রাত্রিতে সে ওই যুবকের বাক্সটি বহন করিতে পারিলে দুই আনা পয়সা পাইত, সে আসিবার আগেই আমি তাহার গ্রাস কাড়িয়াছিলাম। আমি বারংবার তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াও পারি নাই। সেই রাত্রে তার পরিবারের কোনও খাবার জুটে নাই। তৎক্ষণাৎ তাহাকে চারি আনা পয়সা দান করিয়াছিলাম।

শান্তনু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে এর মধ্যে পাপের কী আছে? আপনি তো তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগর হাসলেন, বললেন, না আমি স্বনির্ভরতার শিক্ষা দিতে গিয়া প্রথমত একটি সর্বহারার রোজগারে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছিলাম। কারণ, যে যুবক একটি ব্যাগ বহিবার জন্য দুই আনা দিতে রাজি সে নিশ্চয়ই প্রয়োজনের অপেক্ষা অধিক উপায় করে। সে কখনওই পরনির্ভর নহে। অতিরিক্ত উপায়ী। স্বনির্ভরতা শিক্ষা দিতে গিয়া একজন সত্যিকারের উপায়ী লোককে ভিখারি করিয়া ছাড়িয়াছি, ইহা শুধুমাত্র অন্যায় নহে সততই পাপ, যাহা এখনও ভুলিতে পারি নাই।

শান্তনু আশ্চর্য হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। কী অদ্ভুত সৎ হলে এসব কথা বলা যায়। আত্মবিশ্লেষণের কী অসাধারণ প্রচেষ্টা! এর নাম বিদ্যাসাগর।

ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা জায়গা নিয়ে নেয় দুজনের মাঝখানে। কেউ কোনও কথা বলে না আর।

শান্তনুর মনের মধ্যে নিদারুণ এক লজ্জাবোধ চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরতে শুরু করছে। এতদিনকার সব অহংকার যেন তালগোল পাকিয়ে গলার ভিতর থেকে উগলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জীবন বড়ই ভয়ানক নাটক। কত স্মৃতি—বিস্মৃতি দিয়ে তৈরি এই মানবজীবন। কত কথা মনের কুঠুরিতে আটকে থাকে। কাউকে বলা যায় না। কতবার স্ত্রীকে, সুমন্তকে বলতে চেষ্টা করেছে ও। পারেনি। পারা যায় না।

তখন কত বয়স হবে? বারো—তেরো—মেজদার গল্প লেখার খাতা থেকে দশ—বারো পাতা ছিঁড়ে কুচো কুচো করে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল ও। কেউ জানতে পারেনি কার কাজ। পরদিন গল্প জমা দেবার শেষ তারিখ। মেজদা সারারাত কেঁদেছিল। তিনদিন পর শান্তনু প্রাইজ পেল। প্রথম পুরস্কার। মেজদা হাসতে হাসতে বলেছিল ভালোই হল বল, আমি তো প্রত্যেক বারই পাই এবার তুই পেলি।

এক—একটি স্মৃতি সিনেমার ছবির মতো এক—এক করে উঠতে শুরু করছে চোখের সামনে—উনিশশো সত্তর সাল। প্রবীর বাগবাজার থেকে গভীর রাতে দেখা করতে এসেছিল অশোকনগরে। ছেঁড়া জামা, চুলগুলো অবিন্যস্ত। কাঁধে একটি ঝোলা। দরজার কড়া নাড়তেই বুক কেঁপে উঠেছিল। আবার হয়তো এনকাউন্টারের খবর। হয়তো আবার কেউ নেই। বুকের ভিতর হাতুড়ির শব্দ অনুভব করতে করতে খুলে দিয়েছে দরজাটা।

অন্ধকার ঘরে নিঃশব্দে ঢুকেছিল প্রবীর। দেশলাই জ্বালিয়ে, হ্যারিকেনটার খোঁজ করতে যেতেই হাত দিয়ে আটকে দিয়েছিল প্রবীর।

থাক আলো জ্বালাস না। সময় নেই। খবর আছে।

শান্তনু বালিশের তলায় সিগারেটের প্যাকেট হাতড়ায়। একটা প্রবীরকে দেয়। আবার দেশলাই জ্বালিয়ে দেখে নেয় প্রবীর কিনা। গত চারমাস কোনও খোঁজখবর নেই। বাঁকুড়ায় এক প্রত্যন্ত গ্রামে সংগঠনের কাজে ছিল।

দেশলাইয়ের আলোতে ওর গালে কাটা একটা দাগ দেখে শান্তনু।

শান্তনু বলে, আয় খাটে এসে বোস। গালে কীসের দাগ?

প্রবীর পাত্তা দেয় না কথাটার। সিগারেটে দু—চারটে জোরে টান মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলে খেতে দে কিছু, খিদে পেয়েছে।

অন্ধকারে প্রবীরের উপস্থিতি প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ফেলেছিল শান্তনুকে। খাটের তলা হাতড়ে দুটো রুটি আর গুড়ের ঢেলা হাতে করে দিল ওকে। গোগ্রাসে গিলে ফেলল ও। ওর খাওয়ার মধ্যে এমন একটা আদিমতা ছিল যে শান্তনু ভয়ানক ভয় পেয়ে যায়। যেন প্রবীর এরপর ওকেই খাবে। অন্ধকারে চোখ দুটো ওর জ্বলছিল।

জল খেয়ে আবার সিগারেট চায় প্রবীর। কয়েক মিনিট নীরবতা। যে—কোনও মুহূর্তে কোনও সাংঘাতিক সংবাদ বেরিয়ে আসতে পারে ওর মুখ থেকে। তাই হল। হিসহিস শব্দে বেরিয়ে এল…প্রদীপ…।

শান্তনু স্নায়ুতে ধাক্কা খেল জোর।

কী হয়েছে?

বেলেঘাটার এনকাউন্টারে শেষ…

শান্তনুর সমস্ত হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে গলা অবধি উঠে এল। কোনওরকমে হাত দিয়ে গলা চেপে ধরল ও।

প্রবীর খাটে এসে বসল। হাত দুটো শান্তনুর হাতে রেখে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ব্যাড লাক। তুই যদি খবরটা ঠিকসময় পৌঁছোতে পারতিস…

কিন্তু আমি…

জানি—সেদিন অশোকনগর রেড হয়েছিল, তুই পালাতে পারিসনি।

এক লাফ দিয়ে প্রবীর নেমে কোমর থেকে বার করে রিভলভারটা। হাতে দেয় শান্তনুর। এটা দীপঙ্করের। শেষ দেখা হওয়ার সময় তোকে দিয়ে গিয়েছিল। ওর লাস্ট প্রেজেন্ট। তোকে খুব ভালোবাসত।

আর একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে প্রবীর বেরিয়ে গিয়েছিল দরজা খুলে।

শান্তনু খাটে বসে রিভলভারটা নিয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছে সেদিন। সত্যি কথাটা কেউ জানে না। প্রবীরকে বলা যায়ানি। সেই রাতেই প্রবীরের দেহটা লাইনের ধারে পড়েছিল। সত্যি কথা কেউ জানবে না। কাউকে বলা হয়নি। দীপঙ্করের সেই রিভলভারটা গুলি ভর্তি এখনও শান্তনুর কাছে আছে। মাঝে মধ্যেই রাতে একা ছাদে চলে যায় শান্তনু। যখন ঘুম আসে না। যন্ত্রটায় হাত বুলোয়। এইখানে ঘুমিয়ে আছে প্রবীর, প্রদীপ, দীপঙ্কর। একসময় বুকে ঠেকিয়ে ইচ্ছে হয় ট্রিগারে চাপ দিতে। পারে না শান্তনু। চিৎকার করে কী যেন বলে দিতে ইচ্ছে হয়। আপন মনে আউড়ে যায়, অল মাই কনসেন্স হ্যাজ থাউজেন্ডস অব লেগস…।

তুমি শেক্সপিয়র খুব ভালোভাবে পড়িয়াছ বোধহয়?

চমকে ওঠে শান্তনু—এ আমি কোথায়! কলেজ স্কোয়ারের জলের ধারে কুড়ি বছর পর।

সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। বিদ্যাসাগর স্মিত হেসে সন্তর্পণে জায়গা ছেড়ে উঠলেন। গায়ের চাদরটা ঠিক চির পরিচিত ভঙ্গিতে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

শান্তনু অনুনয় করল—আপনি বসুন। আমার কিছু কথা আছে।

বিদ্যাসাগর জোরে হেসে হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, অব্যক্ত কথা?

হ্যাঁ, আপনাকে শুনতে হবে। আমি কুড়ি বছর ধরে মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছি। আজ বলব। আপনি বসুন প্লিজ। শান্তনু এবার যেন আদেশ করল…

বিদ্যাসাগর মাথাটা ধীরে নাড়তে নাড়তে এগিয়ে গেলেন বেদিটার দিকে—না, অদ্য নহে। পরে বলিও।

শান্তনু চিৎকার করে ওঠে, না আজ, টু নাইট। আমার মনের কথা সব বলতে দিন। প্লিজ, দশ মিনিট।

না বৎস তাহা হইতে পারে না।

কেন? কেন হতে পারে না? আমি কত বছর ধরে জমিয়ে রেখেছি আজ অন্তত বলতে দিন—অন্তত একজনকে বলে দেব আমি—

বিদ্যাসাগর হা—হা করে হাসতে হাসতে বেদিটার উপর উঠে বললেন, দেড় শত বৎসর ধরিয়া ভাবিও, আমার মতো—যে তুমি ঠিক না…ভুল, কুড়ি বৎসর যথেষ্ট কি?

শান্তনু বিকট চিৎকার করে এগিয়ে যায় বেদিটার দিকে। বিদ্যাসাগর নড়তে নড়তে স্থির হয়ে গেলেন।

শান্তনু সমানে চিৎকার করে যায়, প্লিজ বিদ্যাসাগর, প্লিজ ঈশ্বরচন্দ্র—প্লিজ আমি আর কাউকে বলতে পারব না…পারিনি…

খানিকক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে আসে ওর। পাথরের মূর্তিটাকে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে একসময় ক্লান্ত হয় শরীরটা। ধীরে ধীরে নেমে আসে বেদিটা থেকে।

চিৎকার করে মূর্তিটাকে বারবার বলে — আমাকে বলতেই হবে। এইবারেই বলতে হবে।

পেটের ভিতরে একরাশ গ্লানি পুষে রয়েছে কত বছর। শান্তনু গলায় আঙুল ঢুকিয়ে যেন বের করে দিতে চায়। হড়হড় করে বমি বেরোয়। মাথাটা ভোঁ করে ঘুরতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে জলের দিকে এগিয়ে যায় ও। মার কথা মনে পড়ে বিপন্নতায়। মা বলতেন, রাতে জলের কাছে পাপের কথা বলতে হয়। পাপ দূর হয়।

শান্তনু জলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চিৎকার করে বলে—শোনো সেদিন অশোকনগরে আমি ছিলাম না। আমি জয়ার কাছে গিয়েছিলাম। জয়াদের বাড়িতে কেউ ছিল না। সারারাত গান শুনে শেষরাতে একসঙ্গে শুয়েছিলাম। ও এখন আমার স্ত্রী। সেদিন প্রেমিকা ছিল। এক বিছানায় আমি যখন সম্ভোগে উত্তাল তখন প্রদীপ, দীপঙ্কর ওরা মরে পড়ে আছে রাস্তার ধারে। ইচ্ছে করলে প্রয়োজনীয় সংবাদ পৌঁছোতে পারতাম আমি। যাইনি।

জলের ভিতর থেকে কে যেন হা—হা শব্দে হেসে উঠল। চমকে উঠল শান্তনু। জলে চাঁদটা নেই। ঝুঁকে পড়ে আবার দেখার চেষ্টা করল ও। নেই। অথচ আলো চকচক করছে। ঘাবড়ে গিয়ে আকাশের দিকে তাকায় শান্তনু। পুব আকাশে তখন সূর্য উঠে গেছে। প্রথম আলো কলেজ স্কোয়ারের জলে চকচক করে রাত্রির মৃত্যু ঘটিয়েছে।

হল না। রাতের জলের কাছে বলা হল না। ডুকরে কেঁদে ওঠে শান্তনু। সূর্যের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, তুমিও বিশ্বাসঘাতক—আমারই মতো…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *