একটি দুর্ঘটনার গল্প

একটি দুর্ঘটনার গল্প

১।

অসীমের স্কুটারটা বেরিয়ে গেলে সুমিতা রান্না বসাল।এই সময়টা তার ব্যস্ততা তুঙ্গে থাকে। কদিন ধরে তুতানটার পেট ঠিক নেই। যত দামই হোক শিঙি মাছের ঝোল খাওয়াতে হবে। বাড়িওয়ালা বুড়িটা পাম্প নিয়ে খুব জ্বালাতন করে। দশ মিনিটের বেশি পাম্প চললেই উপর থেকে নেমে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। সুমিতা পাম্প চালিয়ে তুতানকে রেডি করে নিল। পুলকারটা আসতে দেরী হচ্ছে। তুতানকে রেডি করতে করতেই বাড়িওয়ালীর চিৎকার, সুমিতা পাম্প বন্ধ কর, টাইম হয়ে গেছে। সুমিতা একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। পুরো দশ মিনিটও হয় নি। তবু পরের বাড়ি। সে চেঁচাল হ্যা মাসিমা করছি বন্ধ। তুতানের গাড়ি এসে গেছে। ওকে নিয়ে বেরোতে যেতেই ফোনটা বাজতে শুরু করল। তাড়াহুড়োয় ধরা হল না। তুতানকে গাড়িতে তুলে ফিরতে আবার বাজতে লাগল। সুমিতা বিরক্ত হয়ে ফ্রিজের ওপর থেকে ফোনটা তুলল।

অসীমের ফোন। কি হল আবার। “হ্যালো,বল।“

“হ্যালো আপনি কে বলছেন?”

“হ্যা কে বলছেন”?

“দেখুন আপনার নম্বর এই ফোন থেকে পেলাম। এখানে এই মাত্র একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছেন। ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওনার স্কুটার একটা বাসের সাথে ধাক্কা মেরেছে। আপনি পারলে মিশনে চলে আসুন”।

সুমিতার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।

২।

-আপনার বিবাহিত জীবন কদিনের?

-পাঁচবছর।

-আপনার স্বামী কোথায় কাজ করতেন?

-সিনপ্সিস কন্সট্র্যাকশানে।

-আপনাদের বাড়ি কি এখানেই?

-না, আমাদের বাড়ি চন্দনপুর।

-কোথায় ওটা?

– বীরভূমের একটা গ্রামে।

-আপনার স্বামীর স্কুটার কত দিনের?

-ওই তিন বছর হল। সেকেন্ড হ্যান্ড কিনেছিল।

-এখন কি করবেন?

-বাড়ি ফিরব। এখানে আর থেকে কি হবে।

বউটা কান্না চাপতে পারল না। সরে এল কৌস্তভ।

 এ সব কেস খুব বাজে। সাধে কি আর মিত্রদা তাকে বলে “এখনও নাক টিপতে দুধ বেরোয় আর এসছিস পুলিশের চাকরি করতে।“ কে আর মিত্রদাকে বোঝাবে কে চেয়েছিল পুলিশে চাকরি করতে। বিএসসি করে বেকার হয়ে বসেছিল এক বছর। ভাগ্যিস বেরিয়েছিল ওপেনিংটা। ট্রেনিং ফেনিং সেরে এই গঙ্গাপুরে পোস্টিং। মা বাবা সব গর্ব করে বলছে ছেলে পুলিশ হয়েছে। আর তার কিছুই ভাল লাগছে না। দিনভর চোর ডাকাত এসে ভিড়ছে এই ঝাড়খন্ড বর্ডারের এলাকায়। প্রাইমারিলি তার কাছেই পাঠাচ্ছে সব মিত্রদা। এ যেন এক ধরণের র‍্যাগিং। এক কয়লা মাফিয়াকে ধরল সেদিন। ট্রাকে করে পালাচ্ছিল। মিত্রদা ঘেটি ধরে এনে ঢোকাল হাজতে। তারপর তাকে পাঠানো হল। সেই মাফিয়ার নাম মিন্টু সিং। তাকে দেখে ফিক ফিক করে হাসে। বলে বাবু আপ কো তো কলেজ মে হোনা চাহিয়ে থা। ইধার কা করতে হো।

মিত্রদা এক ধমক দিয়েছিল মিন্টু সিংকে। কিন্তু তারপর থেকে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা আরও বেড়ে গিয়েছিল। আজ ডিউটি করছিল চৌমাথার মোড়ে। হেলমেটহীন চালকদের পাকড়াও সহ তাদের গাড়ির কাগজপত্র দেখছিল সে। হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পেল একটা স্কুটার জোরে আসতে আসতে একটা বাসকে ওভারটেক করেই হঠাৎ থেমে গেল। লোকটার অসহায় দৃষ্টি সে আজও ভুলবে না। মুহূর্তের মধ্যে পিছনের বাসটা উড়িয়ে দিল লোকটাকে। চোখের সামনে এই দৃশ্য নিতে পারছিল না কৌস্তভ। হড় হড় করে বমি চলে এল। তার কনস্টেবলরা দৌড়ে গেল লোকটার দিকে। এখনও ভাবলে কেমন একটা গা গুলোচ্ছে। একটু আগেই ডাক্তারবাবু বলে গেলেন অসীম দাস এক্সপায়ার করে গেছেন। মহিলা দিশাহারা ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। তাকে দেখে একবার বললেন “আমার ছেলেটা স্কুল থেকে ফিরবে”।

কৌস্তভ সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাড়িওয়ালার সাথে কথা হয়েছে। তার কাছেই ছেলেটা থাকবে। আপাতত কতগুলি ঝামেলা আছে। পোষ্টমরটেম আছে। মিত্রদা আজ আবার ছুটি নিয়ে কলকাতা গেছে। কি যে সমস্যা। মহিলাকে তার ফোনটা দেওয়া আছে। সব জায়গায় ফোন করছেন উনি।

৩।

-বহুত পুরানা স্কুটার সাব। ইস কা ক্যা করেগা?

কৌস্তভ মানল না। এরা স্কুটার বেঁচে খাওয়ার ধান্দা করছে। আজকাল পাবলিক পুলিশকে ইয়ার দোস্ত ভেবে বসছে। কোথায় একটা এত বড় দুর্ঘটনা হল, স্বাভাবিকভাবেই গাড়িটা থানায় যাবে, এই খোট্টাগুলো ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছে। ও তারাকে ডাকল। তারা ভাল চিৎকার করতে পারে। এসেই এদের উপর চেঁচামেচি শুরু করল। পালাল। ক্রেন এসে থানার দিকে রওনা দিল স্কুটার নিয়ে।

৪।

“কিরে বিয়ে থা করবি না? ভাল চাকরি পেলি, এবার বাবা মার সেবা কর”।

মামা ফোন করলেই কৌস্তভের বিরক্তি লাগে। এত ফালতু বকে। এখন কে বিয়ে করবে! এমনিতেই মৌ এখনও গ্রাজুয়েশন করেনি। ও বলেই দিয়েছে গ্রাজুয়েশন না করে বিয়ে করতে পারবে না। মৌ সবে সেকেন্ড ইয়ার। তার মানে এখন তো কোন প্রশ্নই নেই।রাত দেড়টা দুটো অবধি কথা হয়। পোষ্ট পেড করে নিয়েছে সে মোবাইল। নইলে টাকা থাকেই না। কতবার আর রিচার্জ করবে।সারাদিন যা ঘটে তাই মৌকে না শোনান পর্যন্ত তার শান্তি নেই। মৌও তাই। তার সব কথা মন দিয়ে শোনে। অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটা ওকে পুরো বলতে পারে নি কৌস্তভ। তার নিজেরই ঘুম আসেনি। সুমিতাকে যখন গাড়ি করে নামিয়ে দিতে গেছিল বাড়ির দোতলায় ছোট ছেলেটার উৎকণ্ঠিত মুখ এখনও চোখের সামনে ভাসছে তার। মৌ শুরুটা শুনেই বলল “থাক থাক, আর বোল না। আহারে।“

সুমিতাকে নামিয়ে বাড়িওয়ালার ঘরে কিছুক্ষণ বসেছিল সে। এরা নীচে থাকে একতলায়। সাধারন মধ্যবিত্ত ঘর। বসার ঘরেই টি ভি। পাড়ার কিছু লোক ছিল। সুমিতার তিরিশের মত বয়স। কিছুটা চটক আছে চেহারায়। বাচ্চাটা একমনে খেলে যাচ্ছিল। কৌস্তভ বসেছিল কিছুক্ষন। বাড়িওয়ালাটা একটা হৃদয়হীন পাষণ্ড। এরকম দিনে কেউ বলতে পারে, “আমার ছেলে এন আর আই, বিদেশে থাকে। সামনের মাসে বাড়ি ফিরবে।একটা বিয়ে দিলে শান্তিতে থাকি।“ এসব বলল তাও ঠিক আছে, এরপরে বলে বসল “ওই তো অসীমের গাড়িটা খারাপ হয়েছিল মাঝে। আমার ছেলে তখন এদেশে। ওই তো মেকানিক ঠিক করে দিয়েছিল। খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল।“ বিচ্ছিরি লাগছিল তার। একী? সামনে একজন সদ্য স্বামীহারা বসে আছেন তার মধ্যেই এসব চর্বিত চর্বণ এখন না করলেই নয়?

 কৌস্তভ কিছু বলেনি আর। এ’কদিনে কম লোক দেখতে হল না তাকে। পুলিশে এসে মনে হচ্ছে জগৎ দর্শন হচ্ছে তার।

তার চেয়ে এই যে রাতে মৌ-র সাথে এই ঘণ্টা দুয়েক কথা তাতে কিছুটা আত্মার শান্তি হয়। মৌ ক’দিন ধরেই বলছে কলকাতায় যেতে। একটু ঘুরবে, একটু শপিং, একটা সিনেমা দেখবে অনেক প্ল্যান করে ফেলেছে মেয়েটা। যেতে হবে। ছুটি চেয়েছে। মিত্রদা এখনও দুদিন ফিরতে। তারও ইচ্ছে করছে অ্যাকসিডেন্টটা দেখার পর কিছুদিন হাওয়া বদলে আসতে। এমনিতেই এই কোলফিল্ড এলাকায় তার একেবারেই মন বসছে না। এখানে অপরাধ এত বেশি যে কখনও বসে থাকা যায় না। মিনিটে মিনিটে ফোন। কোথাও ছিনতাই, কোথাও চুরি লেগেই আছে। এখান থেকে বেরোতে পারলেই শান্তি। আর মৌ কাছে থাকলে আর কিছু ভাল লাগে না। এর আগে একটা সিনেমা হলে মৌয়ের ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে প্রথম চুমুটা খেয়েছিল কৌস্তভ। তারপর থেকে সবসময়েই মনে হয় কখন যাওয়া যাবে মৌয়ের কাছে। ফোনে কথা হতে হতে সে যখন বলে ফেলে “এবার গিয়ে তোমায় কিন্তু ছাড়ব না মৌ, এবার কোন হোটেলে ঘর ভাড়া করলে কেমন হয়?”

মৌ রেগে বলেছে “আমায় সেরকম মেয়ে মনে কর নাকি?” অগত্যা ব্যাক গিয়ার টানতে হয়েছে তাকে। আদতে কৌস্তভের অনেকবারই মনে হয়েছে দু একটা চুমুটুমু না খেয়ে সব কিছু একবারে হয়ে গেলেই হত। কিন্তু প্রতিবারই মানা করেছে মৌ।

মেয়েটাকে ভাল করে বুঝতে পারে না সে। অথচ সেদিন সিনেমা হলে মৌ-ই প্রথম হঠাৎ তার গালে একটা চুমু খায়। কি যে চায় মেয়েটা!

৫।

-কারবুরেটর কা তার কাটা হুয়া হ্যায় সাব।ইস কে লিয়েহি অ্যাক্সিলেটর ফেইল হুয়া থা।

-তো কা করে?

-ইহা পর হি রাখ দিজিয়ে সাব। কাল লেকে যানা।

এ এক সমস্যা হয়েছে তার। রাস্তার মাঝখানে হেলমেটহীন এক চালকের পিছু করতে গিয়ে গাড়িটাই গেল বিগরে। সাধারণত সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কনস্টেবলগুলোই চেক করে গাড়িটা। আজ একটা বাইকে তিনজন যাচ্ছিল। ওরা দাঁড়াতে বলায় শো করে বেরিয়ে গেল বাইকটা। ওটা দেখে রোখ চেপে গেছিল কৌস্তভের। তাড়া করে কিছুটা যেতেই গেল দুম করে থেমে গেল গাড়িটা। একটা বিচ্ছিরি জায়গা এটা।রাস্তা খারাপ। লরি চলছে সারে সারে। তারসাথে এত ধুলো যে দম আটকে আসছে তার। একটু ডাস্ট অ্যালার্জি মত আছে তার। এই ধুলোয় হাঁচির পর হাঁচি শুরু হল তার। মোবাইল বের করে তারাকে ফোনে ডেকে নিল সে।

৬।

ট্রেনটা গঙ্গাপুর ছেড়ে যেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল কৌস্তভ। এমনিতেই এ জায়গাটা তার বড় বিচ্ছিরি লাগে। তার উপরে এক’দিন একটার পর একটা এমন সব ঘটনা ঘটল যে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। মিত্রদা ফেরার পর সে চারদিন ছুটির অ্যাপ্লাই করেছিল। গ্রান্ট হতে প্রায় পনেরো দিন লাগল।এই ঝামেলা সে ঝামেলা। তারপরেই পালাল সে গঙ্গাপুর থেকে। মুখে সকালবেলার হালকা হাওয়া এসে লাগছে। এখনও ভাল করে রোদ ওঠেনি। মৌ তার অপেক্ষায় আছে। আহ। ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে গেল কৌস্তভের।এটা একটা লাইফ হল! আজই ধর্মতলার কে সি দাশের মিষ্টির দোকানের সামনে আসতে বলে দিয়েছে মৌকে। নেমেই দৌড়তে হবে তাকে। পাশে বসা বিহারি পরিবার, তাদের বাচ্চাটার জানলা দিয়ে পেচ্ছাপ করানো কোনটাই স্পর্শ করছিল না তাকে। মৌ যেন তার অন্তিম স্টেশান। ওর জন্যই সবকিছু এত ভাল লাগছিল তার।

 ধর্মতলা পৌছতে মৌকে দেখে এগিয়ে গেল সে। এবার সে আর পুলিশ অফিসার নয়। এক বন্য প্রেমিক।

৭।

এককালে ডায়েরী লিখত কৌস্তভ। আজ আবার লিখতে বসল সে। মনটা আজ খুব ভাল লাগছে। মৌকে নিয়ে সে অনেকক্ষণ গঙ্গার তীরে বসেছিল। তারপর দুজনে মিলে সিনেমা দেখল। সিনেমা দেখল কথাটা বলা ভুল কারণ কিছুই দেখল না। দুজনে দুজনকে আদর করে ভাসিয়ে দিল। মৌ বলছিল “তুমি ছুটি পেতে এত দেরী করলে? যদি আমি অন্য কারও সাথে চলে যেতাম?” কৌস্তভ ওর আঙুল দিয়ে মৌএর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল “অত সাহস নেই। বুঝলে? তুমি আমাকে ছাড়বে বা ছেড়ে অন্য কারও সাথে পালাবে সেই সাহস তোমার নেই।”

মৌ বলল “সেই সাহস নেই কেন, কাছে পিঠে যাকে পাব তার সাথেই পালাব যদি ছুটি না পাও”।

 সেই কথাই লিখছিল ডায়েরীতে হঠাৎ সে যেন একটা শক খেল।

শুয়ে শুয়ে লিখছিল সে। ঈশ। সে এত বোকা! চোখের সামনে সব দেখল, সব শুনল কিন্তু একটুও সন্দেহ হয় নি তার। ফোনটা খাটের পাশেই থাকে তার। লাফিয়ে উঠে কল হিস্টরি দেখা শুরু করল সে। হতাশ হল। আবার মিইয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকল। আবার উঠে ফোন করল কাস্টমার কেয়ারে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রাখল সে। মৌএর চারটে মিসড কল এর মধ্যে।

৮।

-আপনি এখনও যাননি সুমিতা দেবী?

-না মানে আমার ছেলের স্কুলের টি সিটা নেওয়া হয় নি এখনও।

-ও। আচ্ছা। কিন্তু আপনাকে যে একবার থানায় যেতে হবে।

-কেন বলুন তো?

-আপনি আর আপনার প্রেমিক আপনাদের এন আর আই বাড়িওয়ালার ছেলে মিস্টার অরিন্দম হালদার আপনার স্বামী শ্রী অসীম দাস মার্ডার কেসে মূল আসামী।

-এ সব কি বলছেন আপনি?

-ওই তো অরিন্দমবাবু এসে গেছেন । বসুন।

সুপুরুষ চেহারার অরিন্দম হালদার অবাক চোখে তাকালেন কৌস্তভের দিকে। “কি ব্যাপার অফিসার?”

কৌস্তভের একটা চাপ আসছিল। মানসিক চাপ।বাড়িওয়ালা বুড়ো আর বুড়ি চেচিয়ে পাড়া মাত করছে। কেন ওর ছেলেকে ধরতে এসছে।পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছে বাড়ির বাইরে। বাড়িটা পুলিশ দিয়ে ঘেরা পাশে মিত্রদা থাকা সত্ত্বেও চাপটা তার যাচ্ছিল না। তবে সে আজ এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে কোন কিছুই তাকে টলাতে পারছিল না। নাক দিয়ে দুধ পড়া অফিসারটির হঠাৎ যেন উত্তরণ ঘটে গেছে। সেই আত্মবিশ্বাসের সাথেই সে বলল, “আপনার সাথে সুমিতা দাসের সম্পর্কটা ক দিনের অরিন্দমবাবু? আমি তো ইনভেস্টিগেট করে দেখলাম আপনারা অনেকদিন ইভেন সুমিতাদেবীর বিয়ের আগে থেকেই একে অপরকে ভালবাসতেন। আর সুমিতাদেবীর বাবা যে রিটায়ারমেন্টের আগে অবধি এখানেই থাকতেন সে কথাও বেমালুম চেপে গেছিলেন।“

সুমিতা একটু চমকালেন। কিন্তু তবুও চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছেন। অরিন্দমের এন আর আই কাঁধটা একটু ঝুঁকলেও মুখে একটা বাঁকা হাসি দেখা দিচ্ছিল মাঝে মধ্যেই। বললেন “তাতে অফিসার কি প্রমাণ হয়? আমি ছিলাম আমেরিকা, সুমিতা ছিল বাড়িতে আর অসীম ছিল স্কুটারে। এতে প্রমাণ হয় কিছু?” কৌস্তভ হাসল “আপনি কি করে বুঝলেন আমি আপনার নামে মার্ডার চার্জ আনব? আমি তো সুমিতাদেবীকে বলেছিলাম।“ অরিন্দমের আত্মবিশ্বাস তবু টলানো যায় না, “হ্যা কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অফিসার। আপনি বলুন না কি করে প্রমাণ হয় আমি ওকে খুন করেছি?”

কৌস্তভ বলল, “ফিরোজ মেকানিকের নাম শুনেছেন অরিন্দম? যাকে আপনি অসীমের স্কুটার ঠিক করতে দিয়েছিলেন? ফিরোজ আমাদের বলে দিয়েছে অরিন্দমবাবু যে আপনার নির্দেশে ঘটনার আগের দিন স্কুটারের অ্যাক্সিলারেটার কেবল চেঞ্জ করে দিয়েছিল ও। অসীমবাবু সেদিন অফিস থেকে ফিরতেই ফিরোজ আসে ঘরে। অসীমবাবুকে বলে আরও কাজ বাকি ওনার স্কুটারের। অসীমবাবু জানতেন না কিছুই। বাড়ির গ্যারেজে গাড়ির পুরো বডি খুলে কেবল চেঞ্জ করে ফিরোজ। ইনকম্প্যাটিবল কেবল, তাও হালকা লুজ করা। হয় তারটা পুড়বে, গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দেবে, নয়ত কিছুটা গিয়ে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে, আর সেটা যদি রাস্তার মাঝখানে গাড়িটাকে বন্ধ করে দেয় তবে তো কথাই নেই কোন। আমার গাড়িটাও কিছুদিন আগে বিগড়েছিল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন মাথায় আসে নি। আপনারা ভেবেছিলেন কিছু হলে হল, না হলে আরও ওয়েট করতেন। ফুলপ্রুফ প্ল্যান। কার বাপের ক্ষমতা ধরবে এটা স্রেফ একটা ঠাণ্ডা মাথায় খুন? আর আপনার কপাল দেখুন, আর যদি দু তিন মাস পরে দেশে ফিরতেন তাহলে অ্যাটলিস্ট জেলের হাওয়াটা খেতে হত না। আর সুমিতাদেবী আপনিও কম যান না। অসীমবাবু মারা যাবার পর আমার ফোন থেকেই আই এস ডিটা করে কল অরিন্দমকে “সুসংবাদ” দিয়ে কি ঠাণ্ডা মাথায় কল রেকর্ড থেকে ফোন নাম্বারটা মুছে দিলেন। ভাগ্যে আমার সার্ভিস প্রোভাইডার আমার আগের মাসের কল লিস্টটা আমায় দিতে পারল।“

এন আর আই আর তার প্রেমিকার মুখটা ঝুলে গিয়েছিল। মিত্রদার অ্যাকশান স্কোয়াড কাজ আরম্ভ করে দিল। হাতকড়া পড়ান থেকে শুরু করে সবকিছু।

বাড়িওয়ালা বুড়ো বুড়ির চেঁচামেচিও থেকেছে। কৌস্তুভের টায়ার্ড লাগছিল। গত কালই চলে এসেছিল সে গঙ্গাপুরে। এদিক সেদিক সব জায়গায় যেতে হয়েছে ইনভেস্টিগেশানের জন্য। ফিরোজ মেকানিক থেকে শুরু করে সব খবর বের করা সম্ভব হয়েছে খালি কালকের দিনটায়। একদিন তাকে খুব বড় করে দিল। সেই ছোট ছেলেটা যেন আর সে নেই। মিত্রদাও কাঁধ চাপড়ে দিল পরে। বলল “ওপর মহল থেকে ভাল প্রাইজ পাবি। কিপ ইট আপ”।

তবু তার মন খারাপ লাগছিল। বাচ্চাটার জন্যে। ঘরের কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কোনদিন হয়ত জানা যাবে এই বাচ্চাটাও অরিন্দমের কিন্তু তাতে এর দোষ কি? জীবনের প্রথম রহস্য উদ্ঘাটন কোন আনন্দই দিতে পারল না তাকে। চুপচাপ বেরিয়ে গেল হালদার বাড়ি ছেড়ে।আবার ছুটি লাগবে। ফিরতে হবে মৌ-এর কাছে। এ চাকরি কি না করলেই নয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *