নিশীথিনীর রসিকতা

নিশীথিনীর রসিকতা

সনাতন নামটা আজকালকার দিনে যেমন পুরনো পুরনো লাগে, সনাতন আসলে কিন্তু সেরকম নয়। বরং একটু আধুনিকই বলা যেতে পারে। মানে দাঁড়িপাল্লায় ফেললে হয়ত আধুনিক সনাতনের দিকটা একটু বেশিই মাটির দিকে যাবে। সে ফেসবুক করে, ইউ টিউবে উত্তেজক দৃশ্য দেখে আবার বউকে নিয়ে শপিং মলেও বেড়াতে যায়। ক্রেডিট কার্ডে জিনিসপত্র কেনে। নেগেটিভ পয়েন্ট বলতে সে মাঝেসাঝে শনিবারে বড় ঠাকুরের মন্দিরের সামনে গিয়ে নমো নমো করে। বছরে দুয়েকদিন উপোস করে। এটাকে প্রাচীন বলা নাও যেতে পারে।

তার বউ পুজো আচ্চা করে। বরং সে একটু প্রাচীনপন্থী। তার নাম সহেলি। সহেলি ফেসবুক কি বস্তু জানে না। শুধু কখনো সখনো বরকে মোবাইল ঘাটতে দেখলে একটু বিরক্ত হয়। ঠিক যেই সময়টা হয়ত সে চাইছে সনাতন পিছন থেকে এসে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আগুন টাগুন লাগাক তখনই দেখা যায় সনাতন গম্ভীর হয়ে মোবাইল ঘাঁটছে।

বিরক্ত হয়ে বলে, “কি করছ?”

সনাতন গম্ভীর হয়ে বলে “অফিসের কাজ”।

সহেলি অবাক হয়, “অফিসের কাজও আজকাল মোবাইলে হয়?”

সনাতন ততোধিক গম্ভীর হয়ে বলে “হ্যাঁ, এখন টেকনোলজি উন্নত, আমাদের বেশির ভাগ কাজই মোবাইলে করা যায়”।

সহেলি চাপ খেয়ে আর বেশি ঘাটায় না। সে নিজেও একটু শিটিয়ে থাকে। সনাতন অনেক কিছু জানে। তার তুলনায় সে নিতান্তই ইলেভেন ব্যাক।

ওদিকে সনাতন হয়ত গড়িয়াহাটার তমালিকার সাথে গভীর আলোচনায় মগ্ন। তমালিকা বাসন্তী দেবী কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। ইংরেজি অনার্স। সনাতন কেন এখনও বিয়ে করেনি এই বিষয়েই তাদের আলোচনা চলে।

ওদিকে সহেলি সনাতনকে খাইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আর প্রতিরাতে সনাতন গম্ভীর হয়ে ফেসবুক করে যায়।

#

চলছিল এভাবেই মসৃণভাবে। কিন্তু সিনেমা আর গল্প যদি মসৃণভাবে চলে, তাহলে গল্পকার গল্প লেখে কেন আর পাঠকই বা পড়বে কেন? বাংলা সিরিয়ালের মত বেশ একটা গোদা বাঁক এল সনাতনের জীবনে। কিন্তু সেটা জানতে তার বেশ দেরী হয়ে গেল।

ঘটনা হল সহেলি বাপের বাড়ি যেতে তার এক বন্ধু তানিয়া তাকে চমকে দিয়ে বলল “হ্যাঁ রে, সনাতনদা কি ফেসবুকে আছে?”

সহেলি ফেসবুক খায় না মাথায় দেয় না বুঝে তানিয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। অগত্যা তানিয়া পূর্ণ দায়িত্ব সহকারে তাকে ফেসবুকের এ বি সি ডি শিখিয়ে দিল।

এবং

হ্যাঁ এবং-টি হল সহেলি সনাতনের একটি পুরনো স্মার্টফোন ব্যবহার করত। তানিয়া তাকে ওটা থেকেই সব শিখিয়ে দিল। কিন্তু সহেলি ইলেভেন ফেল হলে কি হবে, বুদ্ধিতে আর সব মেয়েদের মতোই তুখোড়। সে ফেসবুকে নিজের নাম নিল নিশীথিনী। তার সাথে একটি কালো বাঁশঝাড়ের(মানে অন্ধকারে তোলা বাঁশঝাড়ের) ছবি।

#

ফেসবুকে সনাতনকে আবিস্কার করা গেল সহজেই। একটা সানগ্লাস পড়া ফটো, রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিঙ্গল, এবং একটু উঁকি দিতেই ফ্রেন্ডলিস্টে প্রচুর মেয়ের ছবি পাওয়া গেল। সহেলি আগেই সনাতনকে তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল না। সনাতনের ফ্রেন্ডলিস্টের মেয়েদের একের পর এক রিকোয়েস্ট পাঠাতে থাকল।

ইতিমধ্যে মেয়ে ফেসবুকে একা দেখে প্রচুর ছেলের ঝাক ঝাকের কইয়ের মত সহেলিকে যোগ করা শুরু করল। সহেলিও বেশি চাপ ফাপ না নিয়ে সবাইকে কনফার্ম করে নিল। কেউ চ্যাটে এসে জিজ্ঞেস করে যায় “হাই সুইটি কি খবর?” কেউ বা “হায় বেব, অয়াটস আপ?” ইত্যাদি ইত্যাদি। সহেলিও সাধ্যমত জবাব দেয়।

তার মেয়েবন্ধুদের সুন্দর ছবিতে নিশীথিনীকে কমেন্ট করতে দেখে সনাতনও খুব শিগগিরি সহেলিকে অ্যাড করে নিল।

এই ঘটনাগুলি সবই ঘটল দুপুরবেলা। রাত্তির বেলা নিশীথিনী অনলাইন থাকে না। সে তখন শান্ত মেয়ের মত রোজকার রুটিন ফলো করে যায়। তবে সামান্য চেঞ্জ। মাঝরাত অবধি সনাতন ফেসবুক করে যায়। আগে সহেলি শুয়ে পড়ত। এখন ঘাপটি মেরে থাকে।

#

নিশীথিনীঃ তুমি এখনও বিয়ে করনি কেন?

সনাতনঃসেরকম মেয়ে পেলাম আর কোথায়? লাইফ ইজ টোটাল ডাল হিয়ার।

নিশীথিনীঃ কিরকম মেয়ে পছন্দ তোমার?

সনাতনঃ এই ধর তোমার মত, রহস্যময়ী… নিজের ছবি দাও না দেখি একটু সোনাকে।

নিশীথিনীঃ দেব দেব, সময় হলে ঠিকই দেব।

সনাতনঃ আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করে তোমাকে। তুমি নিশ্চয়ই খুব সেক্সি হবে। আচ্ছা তোমার হাইট কত?

নিশীথিনীঃ হুম, ওই পাঁচ ফুট ছয় টয় হবে।

সনাতনঃ ওয়াও। দারুণ হাইট তো। তোমার ব্রার সাইজ কত?

নিশীথিনীঃ অসভ্য।

সনাতনঃ এই বল না, প্লিস।

নিশীথিনীঃ জানি না যাও।

সনাতনঃ আরে বলই না, কি হবে, আমি আর তুমিই তো চ্যাট করছি, সবার সামনে বলছি না। আচ্ছা তুমি কখনো সেক্স করেছ? তুমি মাস্টারবেট কর?

আরে কোথায় গেলে? অফ হয়ে গেলে কেন? এহ…

#

এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত।

এইভাবেই একদিন কথা বলতে বলতে গোলপার্কের কাছের একটি রেস্টুরেন্টে নিশীথিনীকে যেতে বলল সনাতন। নিশীথিনী এক রহস্যময় নারী। তার সাথে দেখা করার জন্য উত্তেজনায় ফুটছিল সে।

বাড়িতে সহেলিকে বলে গেছিল সনাতন তার ফিরতে দেরী হবে। অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সনাতন বেরোতে বাড়ির কাজ টাজ সেরে দুপুরের পর সাজতে বসল সহেলি। খুব সাজল। দেখতে সে অসামান্যা সুন্দরী না হলেও বেশ চটক আছে একটা তার মধ্যে। সেজে টেজে সে দেরী করল পৌছতে।

রেস্টুরেন্টে পৌঁছে সনাতন আর সে মুখোমুখি হল।

#

তারপর অনেককিছুই হতে পারে, তার দায়িত্ব আমি নিলাম না। পাঠক, আপনি চিন্তা করে নিন, আপনি যা ভাববেন সেটাই ঠিক।

Scoundrel

বড়াল ছেলেটা আমার জুনিয়র। একটু ভিতু ভিতু।

প্রথমে ভাবতাম ছেলেটা বুঝি মুখচোরা। পরে জানলাম তা বটে কিন্তু মদের ঠেকে বসলে দু তিন পেগ পরে বাচাল হয়ে যায়।

আমার পরে জয়েন করলেও বিয়ে আগেই করে এসছে। বিবাহিত ছেলে। কিন্তু হাবে ভাবে সেটা বোঝা যায় না। বিয়েবাড়ি গেলে আমাদের থেকে ওর দেখি মেয়েদের প্রতি ছুকছুকানি বেশি। পারলে যেন চোখ দিয়ে গেলে।

অবশ্য ওর বউকে দেখে বোঝা যায় সেটার কারণ। একটা থলথলে টাইপ চেহারা। যদিও থলথলে চেহারার বউ থাকলেই যে রোগা বরেরা অন্য মেয়েকে ছক করার লাইসেন্স পেয়ে যায় এরকম কোন ব্যাপার নেই।

এর মধ্যেই উৎপলের বিয়ে গেল। উৎপল আমাদের ব্যাচের ছেলে। বিয়ে করব করব ভাব ছিল। করল কিছুদিন পর। একটা টাটা সুমো ভাড়া করে আমরা সব ব্যাচেলার ছেলেগুলি গেলাম ওর বিয়েতে। বড়াল বলল ওর বউ নেই, ও আমাদের সাথে যাবে। আমরা বেশি আপত্তি করলাম না, গাড়ি ভাড়া যত বেশি লোক হবে আমাদের তত কম টাকা দিতে হবে। গাড়ির পেছনে আমি আর বড়াল বসলাম। গাড়ি চলতেই একটা হুইস্কির বোতল খোলা হল। খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে আর আমি বড়াল ঢুক ঢুক শুরু করেছি।

দুটো পেগ পরেই ব্যাটার নেশা উঠে গেল। আমায় বলল “শান্তনুদা, আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল”।

আমিও নেশার ঘোরে। মাথা টলটলায়মান। ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “হ্যাঁ ভাই আমারও”।

বড়াল আমায় ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ কী যে বল। তোমার? তুমি শালা কপালওয়ালা ছেলে। এখনও বিয়ে করনি। তোমার চিন্তা কি?”

আমি বুঝলাম ছেলেটার ফ্রাস্ট্রু আছে। বললাম “কেসটা কি বল?”

নেশার ঘোরে বড়াল যা বলল তা শুনে আমার নেশা নেমে গেল। ও নাকি বিয়ের পরে জানতে পেরেছে ওর বউয়ের আগে একটা পেট ক্লিয়ার হয়েছে। পেট ক্লিয়ার মানে অ্যাবরশান।

কি বলব আমি! সান্তনা জানানোর কোন ভাষা নেই। তার উপরে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে আমার চোখে নাকে মুখে। নেশাটা একবার ধরছে একবার ছাড়ছে বড়ালের কথা শুনে। কি বলব কি বলব চিন্তা করতে করতে শেষে বললাম “তাহলে একটা এখন আর তো কিছু করার নেই।মেনে নে, আর কি করবি?”

একটা খিস্তি দিয়ে বড়াল বলল “মেনে নেব কি বলছ? আমি ছাড়াছাড়িতে নেই। আমিও অ্যাফেয়ার করব”।

শুনে বুঝলাম চড়েছে বেশ। নেশা হলে তখন আর আমার মাথা কাজ করেনা। আমিও ওকে উৎসাহ দিলাম, কর কর। চাপ কিসের ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরেরদিন অফিসে দেখলাম বড়াল আমায় একটু এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। আমি বুঝলাম ব্যাটা কালকে সব বলে কেস খেয়ে গেছে।

আমিও আর বেশি ঘাঁটালাম না। কাজে মন দিলাম।

এর প্রায় এক মাস বাদে বড়াল আমার কাছে এল। ভীত সন্ত্রস্ত মুখ। বলল “শান্তনুদা তোমার কোয়াটারে দুদিন থাকতে দেবে”?

আমি থাকি একা। চিন্তা ভাবনা নেই। বললাম “দেব কেন তোর বউ নেই?”

বড়াল বলল “না, ও বাপের বাড়ি গেছে”।

বুঝলাম না সমস্যাটা কি। চিন্তা করে দেখলাম ভালই হল, সন্ধ্যেগুলি প্রেমিকার সাথে ফোনে আর ফেসবুক করে ঠিক জমছে না, বড়ালের সাথে একটু আধটু ঢুক ঢুক করা যাবে আর ওর ক্রিটিকাল কেস কি সব আছে সেগুলিও জানা যাবে।

রাত্তিরে বড়াল আমার কোয়াটারে এসে বলল “শান্তনুদা, মহা কেস খেয়ে গেছি”।

আমি বললাম “কেন রে? কি কেস?”

বড়াল কাচুমাচু মুখে আরও একটা যা তা গল্প শুনিয়ে দিল। ও নাকি বউয়ের উপর খচে টচে কোন এক মেয়ের নম্বর যোগার করে তার সঙ্গে চুটিয়ে দুদিন ফোন করে, একদিন দেখা করে। কচি মেয়ে, ক্লাস টেনে পড়ে। সিনেমাহলের অন্ধকারে হাত ধরাধরি অবধি করে হঠাৎ ওর খেয়াল হয় ও যা করছে তা ঠিক নয়। টয়লেটে যাবার নাম করে ওখানেই মেয়েটাকে রেখে চলে আসে। মেয়েটা ওকে ফোনে বারবার ট্রাই করে। ও ফোন ধরেনি। কাল রাতে মেয়েটার দিদি অন্য এক নাম্বার থেকে ওকে ফোন করে জানিয়েছে মেয়েটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। এখন ওর নামে থানায় কেস করা হয়েছে।

সারারাত বড়ালকে ফোন করা হয়েছে আননোন সব নম্বর থেকে। ঘুম টুম মাথায় উঠেছে। বলা হয়েছে আজ নাকি পুলিশ আসবে ওকে ধরতে।

আমি মনে মনে বললাম “খাইসে”। মুখে বললাম, “ঠিক আছে, চাপ না নিয়ে ঘুমা দেখা যাবে”।

সে রাতটা, আরও দুরাত বড়াল আমার কোয়াটারেই ঘুমাল। আমারও একটু ভয় ভয় হচ্ছিল ওকে আশ্রয় দিয়ে তবু কলিগ বলে কথা। মনে মনে অবশ্য দু পাঁচবার ওকে স্কাউন্ড্রেল বলে ফেলেছি। নিজের বউয়ের উপর রাগ করে অন্যের জীবন নষ্ট করার কোন মানে হয় না।

ওকে একবার বললাম বসকে সব জানিয়ে রাখতে। বারণ করল। কারণ তাহলে অফিসে জানাজানি হয়ে যাবে, প্রেস্টিজের ব্যাপার ইত্যাদি।

তিনদিন পরে ওর বউ ফিরল বাপের বাড়ি থেকে। ওকেও অগত্যা ফিরতে হল নিজের কোয়াটারে। ব্যাপারটা যে খুব ঘেঁটে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম তবু আমার ঘাড় থেকে নামল বলে আমিও খানিকটা স্বস্তি পেলাম।

এক সপ্তাহ পর বড়াল আমায় নেমন্তন্ন করল। অবশ্যই মদ খাবার। শুনে বুঝলাম ঝামেলা মিটেছে হয়ত।

সুসজ্জিত বারে তন্দুরি চিকেন, বিফ স্টেক আর স্কচ অর্ডার করে বেয়ারা যখন সব জিনিসপত্র টেবিলে সাজাচ্ছে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে এত খাওয়াচ্ছিস যে? সব মিটল নাকি?”

বড়াল বিরাট একটা হাসি দিয়ে বলল “মিটল মানে ভালভাবেই। বউকে সব বললাম। বউ ওর এক উকিল দাদাকে দিয়ে কোর্টে একটা কেস করিয়ে দিয়েছে মেয়েটা আর মেয়েটার দিদির নামে। এই ভাবে কেস করানো হল যে মেয়েটা আমার সাথে দেখা করে জোর করে আমায় বিয়ে করার জন্য ব্ল্যাকমেল করে এবং আমার থেকে কিছু টাকা নেয়। এখন ঘুমের ওষুধের নাটক করে আরও টাকা চাওয়ার ধান্ধা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার বউটা খুব ভাল বুঝলে। কি সুন্দর সব কিছু মিটিয়ে দিল। আমি এখন খুব খুশি। ঠিক করে নিয়েছি সারাজীবন বউয়ের সাথে আর কোন ঝামেলা করব না”।

অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর বলে একটা কথা হয়। এতদিন কাতর ছিলাম, আজকে একেবারে প্রস্তরীভূত হয়ে গেলাম।

তবে সেটা হবার পূর্বে আর মনে মনে নয়, মুখেই একবার “স্কাউন্ড্রেল” শব্দটা উচ্চারিত হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *