১৫. তপতী বাহাত্তর নম্বর ঘরে হাজির হলো

খুঁজে খুঁজে তপতী আধঘণ্টার মধ্যে কানোরিয়া কোর্টের বাহাত্তর নম্বর ঘরে হাজির হলো। সোমনাথ অন্য কোথাও তাকে আসতে বলতে পারতো। অন্তত মেট্রো সিনেমার তলায় দাঁড়ালে ওর অনেক সুবিধে হতো। কিন্তু ইচ্ছে করেই সোমনাথ এখানকার কথা বলেছিল। তপতীকে ঠকিয়ে লাভ নেই। সে নিজের চোখে সোমনাথের অবস্থা দেখুক।

দুর থেকে তপতীকে কাছে আসতে দেখে সোমনাথের বকটা অনেকদিন পরে দলে উঠলো।

তপতীর ডানহাতে বেশ কয়েকখানা বই। একটা ছাপানো-মিলের শাড়ি পরেছে তপতী। সঙ্গে সাদা ব্লাউজ। ওর শ্যামলিমার সঙ্গে হঠাৎ যেন অন্য কোনো ঔজল্য মিশে এই কদিনে। তপতীকে অসামান্য করে তুলেছে। ওর মাথার সামনের চুলগুলো তেমনি অবাধ্যভাবে কপালের ওপর এসে পড়েছে। আজ তপতীকে সত্যিই বিদষী সন্দরী মনে হচ্ছে।

তপতীর চোখে চশমা ছিল না আগে। একটা কালো ফ্রেমের আধুনিক ডিজাইনের চশমা পরেছে সে। চশমাটা সত্যি ওর মুখের ভাব পাল্টে দিয়েছে। ওকে অনেক গভীর মনে হচ্ছে, ওর যে বয়স হচ্ছে, ও যে আর কলেজের ছোট মেয়ে নেই, তা এবার বোঝা যাচ্ছে।

সোমনাথ বোধহয় একটু বেশিক্ষণই তপতীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ঘরে সেনাপতি ছাড়া কেউ নেই। তপতী নিজেও বোধহয় এই পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করছে।

সোমনাথ এবার স্তব্ধতা ভাঙলো। গাঢ়স্বরে বললো, “তোমাকে চিনতেই পারছিলাম না। কবে চশমা নিলে।

তপতী ওর দিকে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে রইলো। তারপর পুরানো দিনের মতো, সহজভাবে বললো, “দু’মাস হয়ে গেল। ভীষণ মাথা ধরছিল। ডাক্তার দেখাতেই বললেন, বেশ পাওয়ার হয়েছে।”

“খুব পড়াশোনা করছো বুঝি?” সোমনাথ সস্নেহে জিজ্ঞেস করে।

“যা কমপিটিশন, না পড়ে উপায় কি?” তপতীর কথার মধ্যে এমন একটা কিশোরী মেয়ের বিস্ময় আছে যা সোমনাথকে মুগ্ধ করে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনেক মেয়ের জীবন থেকে বিস্ময় চলে যায়। তপতী এখনও এই ঐশ্বর্য হারায়নি।

সোমনাথ এবং তপতীর মধ্যে এখন অনেক দূরত্ব। তবু এই মুহূর্তে সেই অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করতে পারছে না সোমনাথ। সে ভাবলো এখনও তারা দুজনে কো-এড়ুকেশন কলেজের ছাত্রছাত্রী। সোমনাথ উষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তপতীকে আর-একবার নিরীক্ষণ করলো—ওর টিকলো নাক, টানা-টানা চোখ, দীর্ঘ গ্রীবা। তারপর কোনোরকমে বললো, “চশমায় তোমাকে সুন্দর মানিয়েছে তপতী।”

তপতী অন্য অনেক মেয়ের মতো ন্যাকা নয়। মিষ্টি হেসে বিনা প্রতিবাদে অভিনন্দন গ্রহণ করলো। সোমনাথের দিকে তাকালো তপতী। চোখের পাতা কয়েকবার দ্রুত বন্ধ করে নিজের আনন্দ প্রকাশ করলো এবং বললো, “থ্যাংকস।” তারপর হাতের কলমের মুখটা খুলতে এবং বন্ধ করতে করতে তপতী বললো, “ফ্রেম করবার সময় আমার ভয় হচ্ছিলো তোমার আবার পছন্দ হবে তো।”

তাহলে তপতী আজও সোমনাথের পছন্দ-অপছন্দের ওপর গুরুত্ব দেয়—নিজের চশমা কেনার সময়েও সোমনাথের কথা মনে পড়ে।

“তোমার জন্যে একটু চা আনাই তপতী?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

তপতী একটা অস্বস্তি বোধ করলো। বললো, “কি দরকার?”

“এ-পাড়ায় আমরা কী-রকম চা খাই, দেখবে না?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

তপতী সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেল।

 

চা শেষ করে সোমনাথ বললো, “চলো, বেরিয়ে পড়ি।”

“বারে! তোমার কাজের অসুবিধা হবে না? তপতী জিজ্ঞেস করে। ওর মনটা বড় খোলা। বাংলার বাইরে ছোটবেলা কাটিয়েছে বলে, কলকাতার অনেক নীচতা ও সংকীর্ণতা ওকে স্পর্শ করতে পারেনি।

গভীর সোমনাথ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “কাজ থাকলে তো অসুবিধা? আপাতত আমার কোনো কাজ নেই।”

তপতীর একটা সুন্দর স্বভাব আছে, কখনও গায়ে পড়ে কোনো জিনিসের ভিতর ঢুকতে যায় না। অহেতুক কৌতূহল দেখায় না। যা জানতে পায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। ওর মানসিক স্বাস্থ্য যে এদেশের অসংখ্য মেয়ের আদর্শ হতে পারে তা সোমনাথ ভালোভাবেই জানে। তপতী বললো, “তাহলে চলো।”

এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে চড়ে ওরা গঙ্গার ধারে চাঁদপাল ঘাটের সামনে নেমে পড়লো।

“অতগুলো বই তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে—আমাকে কিছুক্ষণ ভার বইতে দাও,” সোমনাথ দু-একখানা বই নেবার জন্যে তপতীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।

বইগুলো আরো জোর করে আঁকড়ে ধরলো তপতী। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে সে হেসে ফেললো। কিন্তু হাসি চাপা দিয়ে তপতী বললো, “তোমার সঙ্গে আজ ঝগড়া করতে এসেছি সোম।”

এইরকম একটা কিছু আশংকা করেছিল সোমনাথ। তবু সাহস সঞ্চয় করে বললো, “বইটা হাতে দিয়েও ঝগড়া করা যায় তপতী।”

তপতী বললো, “ভীষণ ঝগড়া করতে হবে যে!” ওর মেঘলা মখের আড়ালে আবার হাসির রৌদ্র উঁকি মারছে।

গ্র্যান্ড রোড ধরে ওরা দুজন মন্থর গতিতে দক্ষিণ দিকে হাঁটছে। এই দুপরে এখানে তেমন ভীড় থাকে না। মাঝে মাঝে দরে কলেজের খাতাপত্র হাতে দু-একটি ছাত্রছাত্রীর জোড় দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপারে ইডেন গার্ডেন। পশ্চিমে ধীর প্রবাহিণী গঙ্গর দিকে ওরা দুজনেই মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে।

তপতী এবার নিস্তব্ধতা ভাঙলো। জিজ্ঞেস করলো, “তোমার খোঁজখবর নেই কেন?”

সোমনাথ কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে কোনো উত্তর না-দিয়েই হাঁটতে লাগলো।

তপতী বললো, “যে খবর চায় সে যদি খবর না পায় তাহলে তার মনের অবস্থা কেমন হয়?”

“খুব কষ্ট হয়। তাই না?” সোমনাথ বেশ অস্বস্তি বোধ করছে।

“তুমি তো কবি। তুমিই উত্তর দাও।” তপতী সরলভাবে দায়িত্বটা সোমনাথের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো।

কবি! পৃথিবীতে একমাত্র তপতীই এখনও তাকে কবি বলে মনে রেখেছে। কবিতার সঙ্গে বেকার সোমনাথের এখন কোনো সম্পর্ক নেই।

আজকের এই জনবিরল নদীতীরে দাঁড়িয়ে, হারিয়ে যাওয়া অতীতের অনেক কথা সোমনাথের মনে পড়ে যাচ্ছে।

হাওয়ায় অবাধ্য চুলগুলো সামলে নিয়ে সোমনাথ বললো, “অনেকদিন আগে প্রথম এখানে এসেছিলাম, সেদিনকার কথা মনে আছে তোমার?”

হাসলো তপতী। বললো, “তারিখটা ছিল ১লা আষাঢ়।”

“তারিখটা তোমার মনে আছে তপতী!” অবাক হয়ে গেল সোমনাথ। “ইতিহাসের ছাত্রী। পুরানো সব কথা মনে না রাখলে পাস করবো কী করে?” সহজভাবেই উত্তর দিলো তপতী।

তপতীর মুখের দিকে তাকালো সোমনাথ। ওর জন্যে ভীষণ মায়া হচ্ছে সোমনাথের। একবার ইচ্ছে হলো, ওর নরম হাত দুটো ধরে সোমনাথ বলে, “তপতী, ভালোবেসে তুমি আমাকে ধন্য করেছে। কিন্তু তোমার নির্বাচনের জন্যে সত্যি আমার দুঃখ হয়। একজন সহপাঠী হিসেবে আই জেনুইনলি ফিল স্যরি ফর ইউ।”

কিন্তু তপতীকে কিছু বলতে পারছে না সোমনাথ। মেয়ে হয়েও ওর আত্মবিশ্বাস আছে। তপতী নরম, কিন্তু লতার মতো পরনির্ভর নয়।

অনেকগুলো চেনা মুখ মনে পড়ছে। সোমনাথ বললো, “পুরানো দিনগুলোর কথা ভাবতে বেশ লাগছে তপতী।”

নদীর বেপরোয়া হাওয়ার অশোভন উৎপীড়ন থেকে নিজের শাড়ি সামলে নিয়ে তপতী বললো, “ইতিহাসের ছাত্রী, আমরা তো দিনরাতই অতীত নিয়ে পড়ে আছি—তাই মাঝে মাঝে ভবিষ্যতের দিকে উঁকি মারতে লোভ হয়।”

সোমনাথ ভাবলো একবার বলে, “তাতো মনে হচ্ছে না তপতী। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তোমার একবিন্দ মায়া-মমতা থাকলে বেকার সোমনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে তুমি এইভাবে ঘরে বেড়াতে না।”

“দীপঙ্করকে মনে আছে তোমার?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলে তপতীকে।

“খুব মনে আছে। ভীষণ চ্যাংড়া ছিল।” তপতী উত্তর দিলো।

“শুনলাম, আই-এ-এস পেয়েছে। আলিপুরের এ-ডি-এম হয়ে আসছে।” সোমনাথ খবর দিলো।

তপতী কোনো আগ্রহ দেখালো না। সোমনাথের মনে পড়লো, এই দীপঙ্কর কলেজে তপতীর সুনজরে আসবার জন্যে কত চেষ্টা করেছে ফার্স্ট ইয়ারে। কিন্তু তপতী একেবারেই পাত্তা দেয়নি দীপঙ্করকে। পড়াশোনায় ভালো বলে দীপঙ্করের একটু দম্ভ ছিল। তপতী এই ধরনের ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেনি। দীপঙ্কর শেষপর্যন্ত লম্বা চিঠি লিখেছিল তপতীকে। সেই দীর্ঘ চিঠি তপতীকে আরও বিরক্ত করেছিল। উত্তর না দিয়ে চিঠিটা নিজের হাতে দীপঙ্করকে ফিরিয়ে দিয়েছিল তপতী।

তপতী, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যদি তোমার একটুও মমতা থাকতো তাহলে আজ দীপঙ্কর রায়ের ওয়াইফ হতে পারতে, সোমনাথ মনে মনে বললো।

কলেজ থেকে পালিয়ে সেই যেদিন ওরা প্রথম এই নদীর ধারে এলো, সেদিনটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সোমনাথ। শ্রীময়ী, সমর, তপতী—জন্মদিনে ওদের সামান্য খাওয়াবে ঠিক করেছিল সোমনাথ।

কমলা বউদির কাছ থেকে সেদিন সকালেই তিরিশ টাকা নগদ জন্মদিনের উপহার পেয়েছিল সোমনাথ।

সোমনাথের জীবনে তখন কত রঙীন স্বপ্ন। নিত্যনতুন অনুপ্রেরণায় কবি সোমনাথ তখন অজস্র কবিতা লিখে চলেছে। সেই সব সষ্টির তখন দুজন নিয়মিত পাঠিকা—কমলা বউদি ও তপতী। তপতী সবে তখন মীরাট থেকে এসে ওদের কলেজে ভর্তি হয়েছে। ইংরিজী মিডিয়ামে পড়েছে এতদিন। ভালো বাংলা জানে না বলে ভীষণ লজ্জা। বাংলা সাহিত্য এবং বাংলার লেখক সম্বন্ধে তার বিরাট শ্রদ্ধা। সোমনাথের জন-অরণ্য তার খুব ভালো লেগেছিল।

কবির সঙ্গে তার পরিচয় সেই থেকে ক্রমশ নিবিড় হয়েছে। তপতীর জন্যে এবার সোমনাথ সুদীর্ঘ এক কবিতা লিখেছিল। নাম—আঁধার পেরিয়ে। উচ্ছসিত তপতী বলেছিল, “কলম কেনার টাকাটা আমার উসল হয়ে গেল। জন-অরণ্য কবিতায় আপনি মানুষকে ভালোবাসতে পারেননি, এবার মানুষের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছেন।”

“সমালোচনা কিছু থাকলে বলবেন,” সোমনাথ অনুরোধ করেছিল।

খুব খুশী হয়েছিল তপতী। আঙুলের নখ কামড়ে বলেছিল, “আমার ঘাড়ে মস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছেন আপনি।” একটু ভেবে তপতী বলেছিল, “সবসময় গরুগম্ভীর হবেন না। কবিদের তো হাসতে মানা নেই।”

তপতীর সমালোচনা অনুযায়ী সোমনাথ লিখেছিল হাল্কা মেজাজের কবিতা ‘বনলতা সেনের বয়ফ্রেন্ডের প্রতি। সেই কবিতা পড়ে কমলা বউদি খুব হেসেছিলেন। বলেছিলেন, “এ-যেন নতুন ধরনের কবিতা দেখছি। কারও বয়-ফ্রেন্ড হবার চেষ্টা করছো নাকি, সোম?” সোমনাথ মুখ টিপে হেসে উত্তরটা এড়িয়ে গিয়েছিল। কবিতা পড়ে তপতী বলেছিল, “যদি কোনোদিন বই প্রকাশিত হয় লিখে দিতে হবে ‘তপতী রায়ের পরামর্শ অনুযায়ী লিখিত। না হলে, অ্যাডভাইস ফি দিতে হবে।”

তপতীর কি এসব মনে আছে? সোমনাথের জানতে ইচ্ছে করে।

নদীর ধারে হাওয়ার দৌরাত্ম যেন বাড়ছে। সোমনাথের হাতে বইপত্তরের বোঝাটা দিয়ে তপতী আবার আঁচল সামলে নিলো। তারপর নিজেই জিজ্ঞেস করলো, “প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম, সেদিন কি জায়গাটা আরও সবজ ছিল?

“তখন আমাদের মন সবুজ ছিল,” সোমনাথ শান্তভাবে বললো।

তপতী বললো, “তুমি তখনও খুব চাপা ছিলে। মনের ভিতর তোমার কী চিন্তা রয়েছে তা অন্য কাউকে বুঝতে দিতে না। সেদিন কলেজে যাবার পথে বাস স্ট্যান্ডেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে শ্রীময়ী ছিল। তুমি বললে, আপনাদের দুজনকে আজ খাওয়াবো, মাঝে মাঝে ঘষ না দিলে কবিতা পড়ার লোক পাওয়া যাবে না।

“আমার মতো শ্রীময়ীও খুব ফরওয়ার্ড ছিল। মুখে কোনো কথা আটকাতো না। তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘খাওয়াবেনই যখন, তখন নদীর ধারে চলুন। জায়গাটা গ্র্যান্ড শুনেছি। তুমি রাজী হয়ে গেলে। হেসে বললে, ‘তিনজনে যাত্রা নিষেধ! সুতরাং চতুর্থ ব্যক্তিকে আমরা দুজনে যেন মনোনয়ন করি। আমি ভেবেছিলাম, ললিতাকে আমাদের সঙ্গে যেতে বলবো। কিন্তু ফচকে শ্রীময়ী বললো, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। আমি বাংলা জানতাম না। প্রথমে বুঝতে পারিনি যে শ্রীময়ী বলতে চাইছে, ললিতাকে দলে নিলে ছেলে এবং মেয়ের প্রপোরশন নষ্ট হয়ে যাবে।

“শ্রীময়ী আমাকে গোপনে জিজ্ঞেস করলো, “তোর নমিনি কে?’ আমি হেসে বলেছিলুম, তিনিই তো খাওয়াচ্ছেন! শ্রীময়ীর ইচ্ছে দেখলাম, সমরকে সঙ্গে নেয়। সুতরাং তুমি ওকেই নেমন্তন্ন করলে।”

সোমনাথ হেসে বললো, “সমরকে নির্বাচনের পিছনে সেদিন যে তোমাদের এত চিন্তা ছিল তা আমি জানতাম না। তবে সমর ছোকরা যে অত চালু তা আন্দাজ করিনি।”

অতীত রোমন্থন করে সোমনাথ বললো, “তোমার মনে আছে তপতী, সেদিন আমরা যখন এখানে এসে পৌছলাম তখন দুপুর বারোটা। পনেরো মিনিট এক সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করবার পরে সমর হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর বললো, নদীর ধারে রেস্তরাঁয় আমরা পৌনে একটার আগে যাচ্ছি না। সুতরাং কিছুক্ষণের জন্যে বিচ্ছেদ। যত মত তত পথ। আমাদের সামনে দুটো চয়েস হয় ইডেন গার্ডেন, না হয় নদীর ধার। শ্রীময়ী একটা সিকি দিয়ে হেড-টেল করলো। ওরা চলে গেল ইডেন গার্ডেনের ভেতর—আমরা দুজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম নদীর ধারে।”

“তুমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলে সেদিন, সোমনাথ।” তপতী মনে করিয়ে দিলো।

“ঘাবড়াবো না? তোমার জন্যেই চিন্তা হলো। তুমি যদি ভাবো, আমরা দুই পুরষ বন্ধ, একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র অনুযায়ী তোমাদের আলাদা করে দিলাম।”

সুদর্শনা তপতী ওর নতুন চশমার মধ্য দিয়ে সোমনাথের দিকে স্নিগ্ধ প্রশান্ত দৃষ্টিপাত করলো। “কবিরা যে ষড়যন্ত্ৰী হয় না তা আমার চিরদিনই বিশ্বাস ছিল, সোমনাথ।”

“তপতী, সেদিন তোমাকে খু-উ-ব ভালো লেগেছিল। বাদল দিনের প্রথম কদম ফলের মতো!”

“তুমি কিন্তু বড় সরল ছিলে, সোমনাথ। শ্রীময়ী ও সমর রাস্তার ওপারে অদশ্য হয়ে যাওয়া মাত্র বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছিলে। তারপর বলেছিলে, “আপনি যদি চান, আমি এখন ওদের ডেকে নিয়ে আসছি!” আমি বাধা না দিলে, হয়তো তুমি ওদের খোঁজ করতে যেতে। আমি পশ্চিমে মানুষ। মীরাটের রাস্তায় সাইকেল চালিয়েছি। জিমনাসিয়ামে যুযুৎস, শিখেছি। ছেলেদের অত ভয় পাই না। বললাম, ওদের ডিসটার্ব করবেন কেন শুধু শুধু? তুমি তখনও নার্ভাসনেস কাটাতে পারোনি। উত্তেজনার মাথায় গোপন খবরটা প্রকাশ করে ফেললে। বললে, আজ আমার জন্মদিন। বউদি তিরিশটা টাকা দিয়ে বললেন, যেমনভাবে খুশী খরচ করতে।”

সোমনাথ মৃদু হাসলো। বললো, “এরপর তুমি কিন্তু আমাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তপতী। গম্ভীরভাবে তুমি জিজ্ঞেস করলে, ‘সোমনাথবাবু জন্মদিনে পাওয়া টাকাটা অনেকভাবেই তো খরচ করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের ডাকলেন কেন?’”

সেদিনের কথা ভেবে এতদিন পরেও তপতী মুচকি হাসলো। বললো, “তোমার মুখের অবস্থা দেখে তখন আমার মায়া হচ্ছিলো। তুমি ঘাবড়ে গিয়ে বললে, “আপনি জন-অরণ্য কবিতাটা পছন্দ করে নিজের কাছে রেখে দিলেন। আমার পরের কবিতাগুলোকে কষ্ট করে পড়লেন। তাই কৃতজ্ঞতার ঋণ স্বীকার করতে ইচ্ছে হলো না।”

সোমনাথ অবিন্যস্ত চুলগুলোকে শাসন করতে করতে তপতীর কথায় কৌতুক বোধ করলো। “তুমি যে আমার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসছো, তা কিন্তু তখন বুঝতে দাওনি। বেশ সহজ হয়ে বলেছিলে, ‘কৃতজ্ঞতা পাঠিকার দিক থেকেই সোমনাথবাব। একটা পুরো অপ্রকাশিত কবিতা আমাকে দিয়ে দিলেন। তারপর তুমি রাগ দেখিয়েছিলে, তপতী। বলেছিলে, “আপনার জন্মদিনে আমাকে এইভাবে বিপদে ফেললেন কেন? কিছু উপহার নিয়ে আসবার সুযোগ দিলেন না?”

তপতী বললো, “তোমার অসহায় অবস্যাটা তখন বেশ হয়েছিল। আমার মায়া হচ্ছিলো, যখন তুমি বললে, “জন্মদিনের খবরটা শুধু আপনাকেই দেবো ঠিক করে রেখেছিলাম। শ্রীময়ী ও সমর যেন না জানতে পারে।”

সোমনাথ একটও ভোলেনি। তপতীকে বললো, “তুমি রাজী হয়ে গেলে, আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তুমি যখন বললে, “জন্মদিনে অভিনন্দন জানাতে হয়, সোমবাব! আপনি অনেক বড় হেনি—অনেক নাম করুন। এবং মেনি হ্যাপি রিটারনস, অফ দি ডে,’ জানো তপতী, সেই মুহূর্তে তোমাকে হঠাৎ ভীষণ ভালো লেগেছিল। একবার ভাবলম, মনের এই আনন্দের কথা তোমাকে বলি। কিন্তু সাহস হলো না।”

তপতী চুপ করে রইলো। তারপর গম্ভীরভাবে বললো, “তোমার এই স্বভাবটাই তো আমাকে ভাবিয়ে তোলে সোম। তোমার আনন্দ, তোমার দুঃখ—কোনো কিছুতেই ভাগ বসাতে দাও না আমাকে।”

সোমনাথ কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। দরে সেই পরিচিত রেস্তরাঁটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ওখানকার দোতলায় বসেই একদিন ওরা অকস্মাৎ পরস্পরকে আবিষ্কার করেছিল।

সোমনাথ বললো, “মনে আছে তোমার? আমরা পশ্চিমদিকে কোণের টেবিলটা দখল করেছিলাম।”

সোমনাথ নিজের মনেই বললো, “বিরাট কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে গঙ্গার জল দেখা যাচ্ছিলো। আমি অস্ফটভাবে উচ্চারণ করলাম, পতিত উদ্ধারিণী গঙ্গে। তুমি মুখ ফটে কিছুই বললে না। শুধু অধাক হয়ে একবার আমার দিকে তাকালে। আমিও গঙ্গার শোভা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হলো, চোখের আলোয় দেখা হলো, এই প্রথম আমরা নিজেদের চিনলাম।”

তপতী গম্ভীরভাবে বললো, “তুমি তাহলে মনে রেখেছো? আমি ভাবছিলাম,..” এবারে চুপ করে গেল তপতী।

“কী ভাবছিলে? বলো না তপতী।” সোমনাথ অনুরোধ করলো।

অভিমানিনী তপতী বলেই ফেললল, “আমি ভাবছিলাম—অতীতকে তুমি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিয়েছে।”

সোমনাথ নির্বাক হয়ে রইলো। সে কী বলবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছে না।

স্নেহময়ী তপতী খুব মিষ্টি স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, “রাগ করলে?”

“না, তপতী। রাগ করবো কেন?” সোমনাথ নার্ভাস হয়ে উঠছে। “জানো তপতী,” সোমনাথ আবার কিছু বলবার চেষ্টা করলো।

“বলো,” তপতী করুণভাবে অনুরোধ করলো।

“জীবনটাকে কিছুতেই গুছোতে পারলাম না।” সোমনাথ অকপটে স্বীকার করলো। তপতীর কাছে এসব বলতে তার লজ্জা লাগছে কিন্তু আজ কিছুই সে চেপে রাখবে না। “তুমি, বাবা, বউদি, দাদারা সবাই অধীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারছি না। তোমাদের সবাইকে আমি নিরাশ করছি। কোথাও নিশ্চয় আমার একটা সিরিয়াস দোষ আছে।”

তপতী এ-বিষয়ে মোটেই বিব্রত নয়। বললো, “তুমি বড্ড বেশি ভাবো সোম। অবশ্য তোমার মধ্যে কবিতা রয়েছে, তুমি ভাববেই তো! অনেকে একদম ভাবে না–না নিজের সম্বন্ধে অপরের সম্বন্ধে।”

“তারা বেশ সুখে থাকে। তাই না?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

“তা হয়তো থাকে কিন্তু তাদের আমার মোটেই ভালো লাগে না। দীপঙ্করের কথা বলেছিলে তুমি। ছেলেটা ঐ ধরনের। আই-এ-এস হতে পারে, কিন্তু নিজেকে নিয়েই সব সময় ব্যস্ত।”

সোমনাথ চুপচাপ রইলো। তারপর দূরে একটা নৌকার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার মনে আছে? শ্রীময়ী এবং সমর আমাদের কী বিপদে ফেলেছিল। পৌনে একটার সময় রেস্তরাঁয় ফেরবার কথা—আমরা দুজনে হাঁ করে বসে আছি, ওরা এলো দেড়টার সময়। বকুনি দিতে ফিক করে হেসে সমর বললো, “ঘড়িতে গোলমাল ছিল। শ্রীময়ীর মুখেচোখেও কোনো। বিরক্তির ভাব দেখা গেল না।”

তপতী নিজের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। এখন সোয়া একটা। তপতী বললো, “একটা কথা বলবো? রাগ করবে না?”

“আগে শুনি কথাটা,” সোমনাথ উত্তর দিলো।

“তোমাকে লাঞ্চে নেমন্তন্ন করছি।” তপতী বেশ ভয়ে ভয়ে বললো।

সোমনাথ আপত্তি করলো না। কিন্তু ওর মুখে কালো হয়ে উঠলো।

পশ্চিম দিকের সেই পরিচিত সীটটায় বসলো ওরা। কলেজের সেই পুরানো সোমনাথ কোথায় হারিয়ে গেছে। যে-সোমনাথ আজ তপতীর সামনে বসে রয়েছে সে প্রাণহীন নিষ্প্রভ। ঝকঝকে সুন্দর কবিতার ভাষায় যে কথা বলতে পারতো, সে এখন চুপচাপ বসে থাকে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে মুখ খোলে না। অথচ একে কেন্দ্র করেই তপতীর সব স্বপ্ন গড়ে উঠেছে।

সোমনাথ এই মুহূর্তে প্রেমের মধ্যেও অর্থের বিষ দেখতে পাচ্ছে। এখানে এই গঙ্গার তীরে প্রিয় বান্ধবীকে নিয়ে বার-বার আসবে এমন স্বপ্ন সোমনাথ অবশ্য দেখেছিল। কিন্তু তাই বলে তপতী খরচা দেবার প্রস্তাব করবে এটা অকল্পনীয়।

তপতী বুঝতে পারছে হঠাৎ কোথাও ছন্দপতন হয়েছে। সে যা সহজভাবে নিয়েছে, সোমনাথ তা পারছে না।

“রাগ করলে?” তপতী জিজ্ঞেস করলো।

সোমনাথ প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো। বললো, “না।”

সোমনাথ ভাবছে ১লা আষাঢ়ের সেই প্রথম আবিষ্কারের পর এই নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ভাটার টানে সোমনাথ ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে আর তপতী জোয়ারের স্রোতে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। সেই সেদিন যখন প্রথম দেখা হলো তখন দুজনেই কলেজের প্রথম বছরের ছাত্রছাত্রী। সদশন সোমনাথ সচ্ছল পরিবারের ভদ্র সন্তান। উপরন্তু সে কবি—সাধারণ মেয়ের সাধারণ দঃখ থেকে জন-অরণের মতো কবিতা লিখে ফেলতে পারে। আর তপতী সাধারণ একটা সুশ্রী শ্যামলী মেয়ে। স্বভাবে মধর, কিন্তু এই বাংলায় নতুন। ভালো করে বাংলা উচ্চারণ করতে পারে না—কবিতা লেখা তো দুরের কথা। সোমনাথকে শ্রদ্ধা করতে পেরেছিল বলেই তো তপতী নিজের হৃদয়কে অমনভাবে দিয়েছিল।

কিন্তু তারপর? তপতী পড়াশোনায় ভালো করেছে। ছাত্রী হিসাবে নাম করেছে। আর সোমনাথ অর্ডিনারি থেকে গেছে। তপতী অনেক নম্বর পেয়েছে, সোমনাথ কোনোরকমে ফেলের ফাঁড়া কাটিয়েছে। তপতী সুন্দর ইংরিজী লিখতে পারে, বলতে পারে আরও ভালো। সোমনাথ ইংরিজীর কোনো ব্যাপারেই তেমন সুবিধে করতে পারে না। সোমনাথ পাস কোর্সের বি-এ, তপতীর অনার্সে ভালো ফল পেতে কোনো অসুবিধে হয়নি। এরপর প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে সোমনাথ আর তাল রাখতে পারেনি। তপতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর এম-এ ডিগ্রিটা নিতান্ত সহজভাবেই সে ভ্যানিটি ব্যাগে পরে ফেলেছে। সোমনাথ এই আড়াই বছর ধরে ডজন ডজন চাকরির আবেদন করেছে এবং সর্বত্র ব্যর্থ হয়েছে। এখন তপতী রায় রিসার্চ স্কলার। সোমনাথের কবি হবার স্বপ্ন কোনকালে শুকিয়ে ঝরে পড়েছে। তার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ কার্ডের নম্বর দু’ লক্ষ দশ হাজার সতেরো।

এসব তপতীর যে অজ্ঞাত তা নয়। কিন্তু কোনো এক ১লা আষাঢ়ে সে যাকে আপন করে নিয়েছিল, হৃদয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাকে সে আজও অস্বীকার করেনি। সোমনাথের জীবনের পরবতী ঘটনামালার সঙ্গে তপতীর ভালোবাসার যেন কোনো সম্পর্ক নেই। তপতী এর মধ্যে আরও প্রস্ফুটিত হয়েছে। ভারী সুন্দর দেখতে হয়েছে তপতী-ফার্স্ট ইয়ারে বরং এতোটা মনোহারিণী ছিল না সে।

সোমনাথ ভাবলো যৌবনের প্রথম প্রহরে অনেকে অনেক রকম আকর্ষণে মদ্ধ হয়—ক্ষণিকের জন্য অযোগ্য কাউকে মন দিয়েও ফেলে। কিন্তু বর্ধিমতীরা সেইটাই শেষ কথা বলে মেনে নেবার নিবন্ধিতা দেখায় না। সমরের সঙ্গে শ্রীময়ী তো কত ঘুরে বেড়িয়েছে। ইডেনে নির্জন প্যাগোড়ার ধারে ১লা আষাঢ়েই তো ওরা দুজনে ইচ্ছে করে দেড় ঘণ্টা বসেছিল। চুম্বনেও আপত্তি করেনি শ্রীময়ী। তারপর সপরিষ সমরের হাত ধরে শ্রীময়ী তো কত দিন লেকের ধারে, বোটানিকসে এবং ব্যান্ডেল চার্চের প্রাঙ্গণে ঘরে বেড়িয়েছে। কিন্তু যেমনি সমর পড়ায় পিছিয়ে পড়তে লাগলো, যেমনি বোঝা গেলো ওর ভবিষ্যৎ নেই, অমনি শ্রীময়ী ব্রেক কষেছে, আর বোকামি করেনি।

সোমনাথ ভাবলো, ভালোই করেছে শ্রীময়ী। নিজের মতামতের পুনর্বিবেচনার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে। না হলে, শ্রীময়ী আজ কষ্ট পেতো—সিঁথির লাল রংয়ের জোরে অফিসার অশোক চ্যাটার্জির নতুন ফিয়াট গাড়িটায় অমন সুখে বসে থাকতে পারতো না।

শুধু শ্রীময়ী কেন? কলেজের কত মেয়ে তো ক্লাসের কত ছেলের সঙ্গে ভাব করেছে, একসঙ্গে সিনেমা থিয়েটার দেখেছে, অন্ধকারে অধৈর্য বন্ধুদের একটু-আধটু দৈহিক প্রশ্রয় দিয়েছে। অরবিন্দর মতো যেসব ছেলে চাকরি পেয়েছে, তারা বান্ধবীদের গলায় মালা পরাতে পেরেছে। বাকি সব সঙ্গিনী কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। যার জীবনসঙ্গিনী হবার অভিলাষ ছিল তাকেই এখন পথে দেখলে মেয়েরা চিনতে পারে না। বেকারদের সঙ্গে প্রেম করবার মতো বিলাসিতা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের নেই। তাদের আর্থিক নিরাপত্তা চাই। নিজের বোন থাকলেও সোমনাথ তাই খুঁজতো।

“তুমি ভীষণ রেগে গেছ, মনে হচ্ছে। একটাও কথা বলছে না,” আবার অভিযোগ করলো তপতী।

ছোট ছেলের মতো হাসলো সোমনাথ। ওর হাসিটা তপতীর খুব ভালো লাগে। সে বলেই ফেললো, “তোমার হাসিটা ঠিক একরকম আছে, সোম। খুব কম লোক এমনভাবে হাসতে পারে।”

“হাসি দিয়ে মানুষকে বিচার করা আজকের যুগে নিরাপদ নয়, তপতী,” সোমনাথ হাসি চাপবার চেষ্টা করলো।

“যারা মানুষ ভালো নয়, তারা এমন হাসতে পারে না!” সোমনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভভাবে তপতী উত্তর দিলো। এই সহজ নির্মল হাসি দেখে বহু সহপাঠীর ভিড়ের মধ্যে সোমনাথকে তপতী খুঁজে পেয়েছিল।

খাবারের অর্ডার দিয়েছে তপতী। সোমনাথ কী খেতে ভালোবাসে সে জানে।

খেতে খেতে সোমনাথ বললো, “খুব ঝগড়া করবে বলেছিলে যে?”

হেসে ফেললো তপতী। “করবোই তো। কিন্তু খাওয়ার সময় ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই।”

“পারমিশন দিচ্ছি,” সোমনাথ বললো।

এবার তপতী বললো, “সোম, তুমি আমাকে এমনভাবে দূরে সরিয়ে রাখছো কেন?” অনেক কষ্ট করে তপতী যে কথাগুলো বলছে তা সোমনাথের বুঝতে বাকী রইলো না।

মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে রইলো সোমনাথ। তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি যেসবের যোগ্য নই তুমি অকাতরে তাই আমাকে দিয়েছো, তপতী। কিন্তু আমি অমানুষ নই। তোমার ক্ষতি করতে পারবো না।”

শান্ত তপতী গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কারও সঙ্গে কথা বললে, চিঠি লিখলে, দেখা করলে, বুঝি তার ক্ষতি করা হয়?”

“আমাদের এই দেশে মেয়েদের ক্ষেত্রে হয় তপতী। তোমার কোনো ভালো করতে পারিনি, তোমার যোগ্য করে নিজেকে তৈরিও করতে পারিনি—কিন্তু তোমার ভবিষ্যৎটা নষ্ট করবো না,” সোমনাথের গলা বোধহয় একটু কেঁপে উঠলো।

তপতী কিন্তু সহজভাবে সোমনাথের দিকে তাকালো। তারপর প্রশ্ন করলো, “মেয়েরা যে ছেলেদের সমান, এটা তুমি স্বীকার করো সোম?”

“ওরে বাবা! অবশ্যই করি। সংবিধানসম্মত অধিকার, স্বীকার না করে উপায় আছে? সামনেই হাইকোর্ট।” দরে কলকাতা হাইকোর্টের চুড়োটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে।

তপতী বললো, তাহলে আমাকে নাবালিকা ভাবছো কেন? তুমি তো আমার কাছে কিছই চেপে রাখোনি।”

“আমার নিজের কনসেন্স তো চেপে রাখতে পারি না, তপতী। আমার সম্মান নেই, চাকরি নেই—তোমার সব আছে।”

তপতী জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে আমার নিজের কোনো অধিকার নেই? আমার কাকে পছন্দ করা উচিত তা আমি ঠিক করতে পারবো না? চাকরি ছাড়া পুরষ মানুষের অন্য কিছুই মেয়েরা ভালোবাসতে পারবে না? বিদেশে তো এমন হয় না। ইংলন্ড আমেরিকায় তো কত মেয়ে চাকরি করে স্বামীকে পড়ায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে।”

গম্ভীর হয়ে উঠলো সোমনাথ। বললো, “তুমি এবং আমি বিদেশে জন্মালে বেশ হতো তপতী।”

তপতীর মনোবলের অভাব নেই। বললো, “যেখানেই জন্মাই—যা মন চায় তা করবোই।”

চুপ করে রইলো সোমনাথ। সে ভাবছে, বিদেশে জন্মালে কোনো সমস্যাই থাকতো না— সেখানে কেউ এমনভাবে বেকার বসে থাকে না।

“কী ভাবছো?” তপতী জিজ্ঞেস করলো।

বিষণ্ণ অথচ শান্ত সোমনাথ বললো, “তুমি দিচ্ছে বলেই যদি আমি গ্রহণ করি তাহলে কেউ আমাকে ক্ষমা করবে না, তপতী। ভাববে জেনেশুনে এই বেকার-বাউণ্ডুলে একটা শিক্ষিত সুন্দরী সরল মেয়ের সর্বনাশ করেছে। জানো তপতী, আড়াই বছর দোরে-দোরে চাকরি ভিক্ষে করে দুনিয়ার কাছে ছোট হয়ে গেছি—কিন্তু এখনও নিজের কাছে ছোট হইনি। নিজের কাছে ছোট হতে আমার ভীষণ ভয় লাগে।”

তপতী কিছু না বলেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েরা অনেক বড় বড় ব্যাপারে কত সহজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেলেরা পারে না, তাদের মধ্যে কত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে যায়।

সোমনাথ বললো, “তুমি এবং কমলা বউদি হয়তো বিশ্বাস করবে না—কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে ভয় হয়, শেষ পর্যন্ত আমি নিজের কাছে যেন ছোট না হয়ে যাই।”

বেয়ারা বিল দিয়ে গেলো। সোমনাথ বিলটা নিতে গেলে, তপতী অকস্মাৎ ওর হাতটা চেপে ধরলো। এই প্রথম তপতীর উষ্ণ অঙ্গের কোমল স্পর্শ পেলো সোমনাথ। ঘন সান্নিধ্যের এক অনাস্বাদিত শিহরণ মুহূর্তের জন্য অনুভব করেও পরমুহূর্তে সে হাত ছাড়িয়ে নিলো। সোমনাথের মনে হলো নিজের কাছে সে এবার সত্যিই ছোট হয়ে যাচ্ছে।

তপতী গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলো, “তোমাকে নিয়ে এলো কে?”

সোমনাথ বললো, “সব জিনিসের একটা নিয়ম আছে, তপতী। ছেলেদের ছোট করতে নেই।”

তপতী বললো, “প্লিজ সোমনাথ। আমার কথা শোনো। আজ প্রথম ইউ-জি-সি স্কলারশিপের আড়াইশ’ টাকা পেলাম। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল প্রথম মাসের টাকা পেয়ে তোমার কাছে আসবো।”

তপতী এবার কোনো কথা শুনলো না। বিলের টাকাটা মিটিয়ে সে বেরিয়ে এলো।

বাস স্টপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সোমনাথ বললো, “তুমি বিশ্বাস করলে না। আমার কাছে টাকা ছিল। আজ হঠাৎ দেড়শ’ টাকা রোজগার হয়ে গেলো।”

তপতী বললো, “এই তো শুরু। আমি জানি, বিজনেসে তুমি অনেক টাকা রোজগার করবে। এবং তখন…”

কথাটা শেষ করছে না তপতী। ইতিমধ্যে তপতীর বাস এসে গেছে সে ভবানীপুরে যাবে। সোমনাথ ফিরে যাবে অফিসে।

বাসে তপতীকে তুলতে তুলতেই সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, “তখন?”

“তখন কোনো কথাই শুনবো না—সারাজীবন তোমার অন্ন খাবো।”

তপতীর শেষ কথাগুলো অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে এক অনির্বচনীয় সুরের ঝঙ্কারে সোমনাথের কানে এখনও বাজছে। সোমনাথকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। সংসারে পরগাছা হয়ে সোমনাথ কিছুতেই আর সময়ের অপচয় করবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *