ছুটি

ছুটি

আজ আমাকে লিখতে বলা হয়েছে। কিন্তু লেখার আগে আমাকে এও বলা হয়েছে আমি আগের কথা যেন কিছু লিখি। আমার কি হয়েছিল, কি করলাম সব। চেষ্টা করছি যা মনে আসছে লিখতে।বেশি গুছিয়ে লিখতে পারি না আমি।

আমি ছেলেটা ভীষণ ভাল ছেলে। কেউ আমাকে খারাপ কিছু বললে, আমাকে খ্যাপালে আমি তাকে কিছু বলতে পারি না। কোথায় যেন বাঁধে। আমি অফিস যাই ভাল ছেলের মত। আমার বউ আমাকে টিফিন দিয়ে দেয়। পাঁচতলা স্টিলের টিফিন বাক্স। তার দুটো তলায় ভাত থাকে। একটা তলায় থাকে মাছ বা ডিম, একটায় তরকারি, একটায় ডাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতে টিফিনের ব্যাগ নিয়ে দশ মিনিট হাঁটি। তারপরে বাস ধরি। ভিড় বাসে আমার হাতে টিফিন বাক্স দেখে কেউ কেউ বাজে কোন ব্যঙ্গ করলে আমি না শোনার ভান করি।

কোনভাবেই আমি লেডিস সিটের কাছাকাছি দাঁড়াই না। কনুইয়ের পাশে ভাল বুক পেলে আমার কনুই কোনদিন ওঠে না। অফিসে রোজ টাইমে পৌঁছোই। বস আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। তিনি আমাকে যতক্ষণ বলেন আমি ততক্ষণ কাজ করি। অফিসের সবাই বাড়ি চলে গেলেও আমি কোনকোনদিন দশটা পাঁচটার অফিসে রাত আটটাও বাজিয়ে ফেলি। আমার বউও কোন অনুযোগ করে না। যেদিন দেরী হয়ে যায় দেখি চুপচাপ বসে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে গরম জল করে দেয়। আমি হাত পা ধুয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসি। ও আমার জন্য মুড়ি এনে দেয়, আমার বিলাসিতা বলতে গরম মুড়ি চানাচুর। একটা ঝাল লঙ্কা।

 আমার বিয়ের পাঁচবছর হয়ে গেলেও কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। কিন্তু আমার যৌন জীবন স্বাভাবিক। রাতে শোবার পরে বিয়ের শুরু শুরুতে রোজই বউকে জড়িয়ে ধরতাম। এখনও দু তিন দিন পর পর আমরা মিলিত হই। কিন্তু এখনও কোন বাচ্চা হল না। আমার দেশের বাড়িতে মা থাকে। বাড়ি গেলে মা বউকে আলাদা করে ডেকে কিসব কথা বলে। আমি জানি না কি বলে। তবে বুঝতে পারি এ সংক্রান্তই কিছু। বউ মাথা নিচু করে উত্তর দেয়। মা কিছু পরে ইতস্তত করে আমাকে ডাকে। জিজ্ঞেস করে বউমার সাথে আমি ঝগড়া টগরা করি নাকি।

আমি ভাল ছেলের মত উত্তর দিই। ডাক্তার দেখানোর কথা বলে মা। আমি তাও দেখাই। ডাক্তার সব দেখে শুনে কত রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বলে দুজনই ঠিক আছে। এরকম তো হবার কথা নয়। বউ মাথা নিচু করে শোনে। আমি মাথা নিচু করে শুনি। কেউ কোন কথা বলি না। ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে ভাল হোটেলে যাই। রুটি মাংস খেয়ে দুজনে বাসে উঠে বাড়ি আসি।

অফিসে আমি দু একদিন ছুটি নিলে সহকর্মীরা বিরক্ত করে। কেউ কেউ বলে “কি দাদা, কিছু হবে হ্যাঁ?” আমি হাসি। তাতে তারা আরও সন্দিগ্ধ হয়। আমি একটু চুপচাপ থাকি বলে তারা আমাকে মাঝে মাঝেই বড্ড উত্ত্যক্ত করে। আমি হাসিমুখে শুনি। কেউ কেউ আমার চেয়ারে চুইং গাম লাগিয়ে রাখে। আমার প্যান্ট চ্যাট চ্যাট করে। আমি কিছুই বলি না। বস আমাকে পছন্দ করে বলে এরা বেশি ঘাটায় না আমাকে। তবে ঈর্ষাও করে। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলে “আমাদের তো ভাই ঘর সংসার আছে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সম্ভব না, আমরা ভাই ও সব পারব না। অত তেল মারামারি ভাই আমাদের দ্বারা হবে না”। আমি সবই বুঝি ওরা আমার রাত করে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে টোন করছে। তবু আমি কিছু বলি না।

আমি চিরকালই লাজুক স্বভাবের। নিজেকে জাহির করতে পারি না। বাথরুমে হলেও আমি ভাল গান গাইতে পারি। কলেজে যখন পড়তাম কত অগা বগা দেখতাম একটু গান করতে পারলেই বন্ধুমহলে কত রকম কায়দা করত। আমি রোজই ভাবতাম গান শোনাব ওদের। কিন্তু কোনদিনই পারিনি। রাতে শুয়ে শুয়ে কল্পনা করতাম, হঠাৎ দু লাইন গুনগুন করেছি, কেউ শুনে বলে ফেলবে, বাঃ, সুরথের তো দারুণ গলা রে। কিন্তু বাস্তবে আমি কোনদিনই গাইতে পারলাম না সবার সামনে।

অফিসে চাকরিটাও পেলাম হঠাৎ করে। এ চাকরিটা আমার পাবার কথা না। এই অফিসে আগে আমার বাবা কাজ করত। এই অফিসে একটা আইন ছিল চাকুরিরত অবস্থায় কেউ মারা গেলে তার ছেলে মেয়ে অথবা স্ত্রী চাকরি পাবে। আমাদের বাড়িতে বাবা মারা যাবার পরে অফিস থেকে চিঠি এসে পড়েছিল দীর্ঘদিন। আমরা কেউই দেখিনি। একদিন মা ঘর ঝাড় দিতে গিয়ে খুঁজে পেল। হয়ত আমাদের কাজের লোক চিঠিটা পেয়ে আমাদের দেয় নি। আমি তখন বি এ পাস করে বেকার। চাকরির কোন আশাই ছিল না। চিঠিটা পেয়ে মা আমায় বলল বাবু শিগগির যা। কালই যা। আমি আবার একটু অলসও বটে। ইচ্ছা করছিল না যেতে। সেদিন কলকাতা যাবার নাম করে কলকাতা ঘুরে চলে এলাম। মা জিজ্ঞেস করল কিরে হল? আমি বললাম কাল যেতে বলেছে। এরকম আজ কাল করে করে সাতদিন পরে গেলাম। এখন আমাদের যিনি বস, ইনি ছিলেন তাঁর বাবা। আর দু তিন মাস পরে তিনি ছেলের হাতে সব দিয়ে ঘরে বসে যান। আমি যেতে আমায় দেখে বললেন “তুমি প্রদীপের ছেলে?” আমি মাথা নাড়লাম। উনি চেঁচিয়ে বললেন “কথা বলতে পার না নাকি? বোবা কি তুমি?” আমি বললাম “হ্যাঁ পারি। আমি প্রদীপের ছেলে”। উনি আমার কথায় হেসে ফেললেন। বললেন “এতদিন কোথায় ছিলে?”

আমি মিথ্যা করে বললাম আমার মা যেটা শিখিয়ে দিয়েছিল “আমার কাছে চিঠি এসেছে তিন দিন আগে”। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “ঠিক আছে, প্রদীপের সুনামে তোমাকে নেওয়া হল আশা করব তুমি সে সুনাম রাখবে”।

আমার বাবা আমাদের মফস্বল থেকে যাওয়া আসা করত। আমি দু একদিন ডেলি প্যাসেঞ্জারির চেষ্টা করে দেখলাম এ আমার দ্বারা হবে না। মাকে বললাম। মাও বলল কলকাতায় যদি একটা ঘর পাওয়া যায়। তারপর মা বলল একা একা কি খাবি না খাবি একটা বিয়ে কর। মা-ই মেয়ে টেয়ে সব দেখে দিল। চাকরিতে জয়েন করার তিন মাসের মধ্যে আমার বিয়ে হল। আমাদের স্টেশান থেকে তিনটে স্টেশান বাদে আমার শশুরবাড়ি। বাসরঘরে বউকে কিছু করি নি। তার আগে স্কুল লাইফে বা কলেজে সব ছেলেরা যখন যৌন মিলনের বইটই দেখত আমি ওসব থেকে দূরেই থাকতাম। বাসরে ঢোকার আগে আমাকে কয়েকজন বন্ধু অনেককিছু শিখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পরে আমি কিছুই পারি নি। বউকে বললাম তুমি কোনদিকে শোবে। ও গুটিসুটি মেরে ছিল। ভেবেছিল হয়ত আমি গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ব। চুপচাপ বলল তুমি শোও না যেদিকে শোবে। আমি ক্লান্ত ছিলাম। শুতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার সে অর্থে বাসর হয়েছিল ওদের বাড়ি গিয়ে দ্বিরাগমনে। পাঁচ দিন কিছু না করে রোজই ভাবতাম কিছু করতে হবে। শেষে ওদের বাড়িতে ও শোয়ার পর ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। অনেকক্ষণ ধরে পরস্পরের শরীর আবিষ্কার করে যখন ঘুমোই সেদিনটা আমি কখনও ভুলি নি। তারপর থেকে এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এখনও সেরকমটাই আছে।

এই নতুন বস আসার পরে আমার ভাল হয়েছে কি খারাপ হয়েছে জানি না। আমার দুটো ইনক্রিমেন্ট দিয়েছে তাড়াতাড়ি। কিন্তু যেহেতু আমি সাত চড়ে রা কাড়ি না এবং ছুটি ছাটা বস বললে ক্যান্সেল করে দিই তাই ভালবাসা আমার প্রতি যেন বেশিই বেড়েছে। শুধু আমার বাড়ি ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে।

আমার অফিসে আমার বন্ধু বলতে একজনই আছে। অর্ণব। ওকে অন্তত কখনও দেখিনি আমার নামে কিছু বলতে। ও প্রায়ই বলে অফিস শেষের পরে একটু মদ টদ খেতে। আমি মদ খাই না। তবে যেহেতু আমি ভীষণ ভাল ছেলে আর কাউকে না বলতে পারি না অর্ণবের জোরাজুরিতে না করতে পারলাম না। ও নিয়ে গেল আমাকে একটা বারে। বারে আমি এর আগে কোনদিন যাই নি। অন্ধকার অন্ধকার ঘর। একটা মদ মদ গন্ধ। মদের গন্ধ আমি আগে পেয়েছি। আমার বাবা মদ খেয়ে আসত মাঝে মধ্যে। মার সাথে তখন ঝগড়া লাগত। আমি চুপ করে দেখতাম। খুব ভয় লাগত তখন। এখানে দেখি সেই গন্ধ। অর্ণব একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল হুইস্কি খাবি? আমি তো কিছুই বুঝি না। বললাম যা তুই খাবি সেটাই বল। কি একটা নাম বলল ও বেয়ারাকে। কাঁচের গ্লাসে করে দিল। সামনে চানাচুর। আমি চানাচুর বেশি করে খেতে লাগলাম। অর্ণব সোডা জল ঢেলে দিল আমায়। এক ঢোক খাবার পর একটু কেমন লাগল। তাড়াতাড়ি সব খেয়ে নিলাম। অর্ণব হাসতে লাগল। বলল পাগল, এই ভাবে খায় কেউ?

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতে লজ্জা লাগছিল। তবু ফিরলাম। বউ আমার দিকে তাকিয়ে বুঝল। চুপচাপ খেতে দিল। খেয়ে দেয়ে আমার আর হুঁশ ছিল না। মরার মত ঘুমালাম।

সমস্যাটা হল পরের দিন অফিসে পৌঁছে। কাজ করতে করতে তিন চারবার পায়খানায় ছুটতে হল। অফিসের রিসেপশনিস্টের কাছে ওষুধ থাকে। আমায় একটা কড়া antibiotic দিল। খেয়ে আমার আরও শরীরটা খারাপ লাগছিল। জীবনে যেটা করিনি সেটা করতে বাধ্য হলাম। বসকে বলে বাড়ি ফিরলাম।

বাড়ি ফিরে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর বউ এসে দরজা খুলল। আমায় দেখে মনে হল একটু ঘাবড়ে গেছে। আমার কি একটা সন্দেহ হল যে সন্দেহটা আমার কোনকালে ছিল না। আমার ঘরে একটা ভাঁড়ার ঘর মত আছে। আমি দৌড়ে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখি একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমারই বয়েসী। আমি একে শ্বশুরবাড়িতে দেখেছি। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমি চিরকাল মারপিট ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকা লোক। চুপচাপ ঘরে গিয়ে বসলাম। বউকে কিছু বললাম না। ছেলেটাকেও না। শরীরটা খারাপ লাগছিল। ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার ঘুম ভাঙল গভীর রাতে। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম পাশে বউ ঘুমিয়ে আছে। আমার অদ্ভুত লাগছিল। একটা শীত শীত ভাব। তার সাথে একটা রাগ। এত রাগ আমার কোনদিন হয় নি। আমি মেয়েলি ব্যাপার বুঝি কম। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম কেন আমার বাচ্চা হচ্ছিল না। বউ নির্ঘাত কোন ওষুধ খাচ্ছিল। আলমারির ভেতর ওর লকার কোন কালে ধরি না। আলমারিটা শোয়ার ঘরে থাকে না। বসার ঘরে থাকে। আমি ধড়মড় করে উঠে ওর লকার খুলে দেখলাম এক গাদা ওষুধ। বুঝতে পারলাম এগুলিই সেই ওষুধ। আমার কি হল জানি না, আমি সে রাতে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মিটসেফ থেকে দাঁ বের করে বউকে কোপালাম। আমার এটুকু মনে আছে কোপানোর সময় আমি খুব শব্দ করে চিৎকার করছিলাম আর কাঁদছিলাম। আমার হাতে নাকে মুখে রক্ত ছিটকে ছিটকে এসে লাগছিল। আমার তা সত্ত্বেও কোন জ্ঞান ছিল না। আমার চিৎকার শুনে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায়। সবাই দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সব দেখার পর আমার উপর সবাই কিল চড় ঘুষি যা পারে মারতে শুরু করে। তারপরে আর আমার কিছু মনে নেই।

আজ সকালে আমার জ্ঞান ফিরল। আমি এখনও কিছু কথা বলতে পারছি না। চেয়ে দেখছি সামনে ডাক্তার নার্স সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন ডাক্তার মত লিখে দিল আমার সম্পর্কে সব জানাতে। এখন আমার এর চেয়ে বেশি কিছু মনে পড়ছে না। আমার বাবার নাম মায়ের নাম ঠিকানা মনে আসছে। কবে বিয়ে হয়েছিল বউয়ের নাম মনে আসছে। কিন্তু এখন যা লিখলাম এর চেয়ে বেশি কিছু মনে আসছে না। মাথা বড্ড ব্যথা করছে।

 আমার মা এসেছিল লেখার সময়। মনে হল কাঁদছিল। ডাক্তার জোর করে নিয়ে গেল মাকে। পুলিশও ছিল সাথে। আমি জানি আমি যা করেছি তাতে আমার ফাঁসি বা জেল কিছু একটা হবেই। কিন্তু আমি এটুকু জানি, সেদিন যখন পাড়ার লোক আমায় যথেচ্ছভাবে মারছিল তখন বউয়ের রক্ত আমার রক্তের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। সেই রাগটা সেদিন এসেছিল। সেদিনই চলে গেল। এখন আমি আবার ভাল ছেলে। কাল যদি আমি অফিস যাই, আবার বস যদি বলে রাত আটটা অব্দি থেকে কাজ করে যেতে আমি করব। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে যদি দেখি বউ গরম জল করে দিয়েছে সেই জলে পা ধোব। এখন বউয়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। জানি না কেন। আর লিখতে পারছি না। খুব ঘুম পাচ্ছে। এবার অন্তত ওরা আমায় মার সাথে দেখা করতে দিক…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *