বৃত্ত

বৃত্ত

১।

“বনে বনে ওড়ে তোমার রঙিন বসনপ্রান্ত”

বিন্দিয়া যখন এই অংশটা নাচে তখন সব থেকে ভাল লাগে অরিত্রর। অফিস থেকে এসে রোজই দেখে দিদির ক্লাসে মেয়েরা নাচে। তাদের মধ্যে বিন্দিয়া যেন একটু অন্যরকম। সুনেত্রার সাথে বিচ্ছেদের পর আজকাল মেয়ে দেখলে একটু ছুকছুকানি বাড়ছে তার। সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছে। এই মেয়েটার বয়স বেশি নয়। ভরাট যৌবন। এত সুন্দর ফিগার অনেকদিন দেখেনি সে। দেখলে অস্বস্তি হয়। উত্তেজনা আসে। ভাবতেই হেসে ফেলল অরিত্র।

এ মেয়ে তার হাঁটুর বয়সী। প্রায় বারো বছরের ছোট। রাতে ফিরে এসে দুটো বড় পেগ নাহলে আজকাল চলছে না তার। সে কি অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছে? হবে হয়ত। তাতে কার কি আসে যায়? সুনেত্রার যদি অফিসের বস প্রিয় হয় তার কেন হুইস্কি প্রিয় হবে না? এই বিন্দিয়াটা আজকাল তার নেশা হয়ে যাচ্ছে। কোন দিক থেকে যে ঢুকে পড়ছে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ঢুকে পড়েছে। বিচ্ছেদের পর পর সুনেত্রার চোখ বড় জ্বালাতন করত তাকে। বিন্দিয়া সে জ্বালাতন থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছে। এখন একটু নেশা হলেই বিন্দিয়ার মুখ তার কল্পনায় চলে আসে। তখন এক হাজার আলোকবর্ষের মধ্যে সুনেত্রাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এরকমই তো চেয়েছিল সে। হাঠাও বাঁশের গাড়ি। পুরনো স্মৃতিরা ভিড় না করলেই হল।

২।

শীতের বৃষ্টি এমনিতে ভাল লাগে না অরিত্রর। কিন্তু আজ লাগছিল। এক পেগ শেষ হবার পর যখন বিন্দিয়াকে বাড়িতে দিয়ে আসার কথা বলল দিদি। নরম রঙের একটা সালোয়ার পড়েছে মেয়েটা। অরিত্র গাড়িটা স্টার্ট করেই ওকে জিজ্ঞেস করল “কোথায় যেন বাড়িটা আপনার?”

মেয়েটা হাসল “আমাকে আপনি বলছেন কেন? তুমি বলুন, আমি অনেক ছোট”।

নেশার ঝোঁকে ভালই লাগছিল মেয়েটার গলার স্বর। মায়াবী। অরিত্র বলল “ছোট বলছ, আগেকার দিনে তো এই বয়সে বিয়ে হত মেয়ে ছেলের”।

একটু থতমত খেল যেন। পরক্ষণেই সামলে নিল। স্মার্ট মেয়ে আজকালকার। দক্ষিণ কলকাতার নামকরা কলেজে পড়ে। এরা এত সহজে কাবু হয় না। ওই অবস্থাটা দিব্যি সামলে নিয়ে বলল “হ্যাঁ হয় হয়ত, কিন্তু আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন?”

নাও সামলাও এবার। গড়িয়াহাটার বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় গাড়ি হাকাতে হাকাতে কিছুক্ষণ আগে পান করা হুইস্কিও তাকে কোন রকম সাহায্য করতে পারল না। অপ্রস্তুত হতে হল। তবু একটু সাহসী উত্তর ছুড়ল সে “কেন করব না? তোমার মত মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার তো!” বিন্দিয়া হাসল “ভাগ্যের ব্যাপার তো বটেই। মোবাইলে প্রচুর ফোন আসে আননোন নম্বর থেকে”।

ঈর্ষা হল অরিত্রর। সুনেত্রার ফোনেও প্রচুর আসত। সে রেগে যেত। আরও রেগে যেত যখন দেখত সুনেত্রা ওগুলিকে প্রশ্রয় দিত। জিজ্ঞেস করলে বলত “কি করব? আমার সময় কাটে বেশ। আর অচেনা কোথায়? ফেসবুকে চেনা তো সব”।

অরিত্রর ইচ্ছে হত সব টান মেরে ছুঁড়ে দেয়। দিতও মাঝে মধ্যে। সুনেত্রা অভিযোগ করত অরিত্র তাকে স্পেস দিচ্ছে না। অরিত্র পরিষ্কার বলে দিয়েছিল তার ঘর করতে গেল এই ফেসবুক টুক ফোন ছেনালি করা চলবে না। তার মধ্যেই একদিন নাটকীয় ভাবে সুনেত্রা জানিয়ে দেয় মিত্রের সাথে থাকবে সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দিব্যি মিত্রের সাথে লিভ ইনও শুরু করে দেয়। মিত্র ওদের অফিসের বস। হ্যান্ডসাম। আর বস হবার সুবাদে সব রকম সুযোগ সুবিধাও পাওয়া যাবে। মন্দ কি। অরিত্র বাঁধা দেয় নি। মিউচুয়াল ডিভোর্স মেনে নিয়েছে। কষ্ট হত কিছুদিন। ঘুম আসত না। কিন্তু মানতে বাধ্য হয়েছে।

বিন্দিয়ার কথায় পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। সে জিজ্ঞেস করল “ফেসবুকে কত বন্ধু তোমার?”

বিন্দিয়া চোখ বড় বড় করে বলল “৫০০০ কমপ্লিট। সাথে ১২০০০ সাবস্ক্রাইবার”।

বুঝল না অরিত্র। “মানে সাবস্ক্রাইবার মানে কি?”

উত্তেজিত হল বিন্দিয়া “মানে হল আমি যা বলব যা ফটো দেব তা আমার বন্ধু ছাড়াও ওই লোকেরা দেখতে চাইছে।“

হতাশ হল অরিত্র। তার কি হবে আর। এ মেয়েকে তো সবাই চায়।

৩।

“এগুলো বিশ্বাস হতে পারে না।

ওই যে বাড়ির পাশের গাছপালার কথা বার্তা,

বুড়োটার দেয়াল ধরে হাঁটা

কিংবা তোমার ফিরে দেখা।

পারে না।

বিশ্বাস করো।

এগুলো ফিরে আসতে পারে না…”

অফিস থেকে বেরোতে ফোন এল।

“কি করছেন”?

বিন্দিয়া।

অপ্রত্যাশিত ফোনটা। নাম্বারটা কোত্থেকে পেল কে জানে। দিদির থেকেই হবে হয়ত। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাচ্ছিল। কোনমতে ম্যানেজ করে তুলল “এই তো অফিস থেকে বেরলাম”।

“ফোরামে আসতে পারবেন?”

“সে তো অনেক দূর। কেন?”

“দূর? তবে থাক।“ ঈষৎ ভারী শোনাল কি গলাটা?

“ তুমি কোথায়? আছ?”

“এই আপনার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা করল। ফোরাম কি অনেকদূর?”

হার্ট বিট মিস করল বোধ হয় একটা। এই বয়সে এসব হচ্ছেটা কি। একটা বিয়ে তো গেল। এখন এসব বুক ধড়াস ধড়াস হবার তো কথা নয়। একটু হাসতে চেষ্টা করল সে। “আচ্ছা তুমি রুবির দিকে আসতে পারবে? তাহলে তোমায় গাড়িতে পিক আপ করে নিতাম”।

ওপাশে গলাটা একটু উচ্ছল হল “আচ্ছা তাই আসুন, দেরী করবেন না যেন। দিদির ক্লাস আছে সাতটায়”।

হাসল অরিত্র “হ্যাঁ হ্যাঁ, একসাথেই বাড়ি ফিরব না হয়”।

৪।

“তোমাকে ফোন করলে পাওয়া যায় না আজকাল।“

“তাতে তোমার কি ছেঁড়া গেল?”

“তোমাকে অনেকদিন বলেছি আমাকে গালাগাল দিয়ে কথা বলবে না।“

“এই তুই কি আমার বউ? যখন ছিলি তখন সম্মান দিয়েছি। ইউ বিচ। আরও গালাগাল দেব তোকে। খানকি মাগী। ভাল ছেলে দেখে চলে গেলি আমাকে ছেড়ে। তুই কি ভেবেছিলি আমি ঘরে বসে ফেলব?”

“শিট। এসব কি বলছ তুমি? কি হয়েছে তোমার?”

“প্রেম হয়েছে। বুঝলি? তোর মত ছেনালি মাগির সাথে না। ভাল মেয়ের সাথে। তোর মত আমাকে ছেড়ে যাবে না। ফোট ফোট শালী”।

সুনেত্রা ফোন করলে এভাবেই কথা বলবে ঠিক করে রেখেছে অরিত্র। কোনদিন ফোন করে না সে। এরকম হৃদয়হীন হতে পারে কেউ সুনেত্রার মত?

৫।

“একটা ফুল দিও

আর একটা গন্ধ

একটা ভালবাসা

আর কিছু শব্দ।

তোমার চোখে দিও

ইচ্ছের কারুকার্য

আমার ঠোঁটে দিও

নোনা পাতার আস্বাদ”।

বিন্দিয়ার পিঠে মুখ ঘষতে ঘষতে অরিত্র ডুবে যাচ্ছিল এক তৃপ্তির মধ্যে। আহত পুরুষ তার বহুদিনের অব্যবহৃত পুরুষত্ব প্রমাণের সুযোগ পেয়েছে। বিন্দিয়ার ঊরুসন্ধি, নাভি, স্তনে সে আগুন জ্বালাচ্ছিল। বিন্দিয়ার শীৎকার তার আগুনে ঘি যোগান দিচ্ছিল। অনেকদিন পর পৌরুষ প্রমাণের সুযোগে হোটেলের ঘরে বিন্দিয়াকে জয় করল সে।

অনায়াসে।

৬।

সুনেত্রার সাথে দেখা হল তার। বহুদিন পরে। হাইল্যান্ড পার্কে। বিন্দিয়াকে নিয়ে বেরচ্ছিল সে। দুজনকে এক সাথে দেখল সুনেত্রা। ভাবলেশহীন ভাবে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অরিত্র আরেকটু বেশি আশা করেছিল। সে এগিয়ে গেল। হাসল গিয়ে। “কেমন আছ?”

সুনেত্রা বিন্দিয়াকে দেখে হাসল “ভাল তুমি কেমন?”

অরিত্র সুনেত্রা কে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে বলল “এ হল বিন্দিয়া। লাস্ট মাসে বিয়ে করেছি। ফেসবুকে ওর ৫০০০ বন্ধু, ১৪০০০ সাবস্ক্রাইবার”।

সুনেত্রা অবাক চোখে তার দিকে তাকাল। বিন্দিয়া অরিত্রর কথা শুনে লজ্জা পেল একটু। বলল “এই তুমি চুপ কর তো। কিসব বলছ”।

অরিত্র বিন্দিয়ার দিকে তাকাল হাসি মুখে “তুমি একে চেন? আমার আগের বউ। আমাকে ছেড়ে দিয়ে গেছিল ওর বসের সাথে থাকবে বলে”।

দুজনই অপ্রস্তুত হল। অরিত্র বিন্দিয়ার হাত ধরে গটগট করে এগিয়ে গেল। সুনেত্রা বিড়বিড় করল “সিক। কমপ্লিটলি সিক”।

৭।

বিন্দিয়া বাপের বাড়ি গেলে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে অরিত্রর। সুনেত্রার বাপের বাড়ি কেউ থাকত না। বাপ মা মরা মেয়ে। তবে ও থাকলেও সারাদিন কম্পিউটার আর আননোন কল নিয়ে ব্যস্ত থাকত। বিন্দিয়া সারা রাতে একবার বসে। আর আননোন কল বিয়ের পর রেস্পন্ড করে না। অরিত্র সুখী।

৮।

“হ্যালো, আপনি কি মিস্টার অরিত্র ঘোষাল বলছেন?”

“হ্যাঁ বলছি। কে বলছেন আপনি?

“আমি শিবপুর থানা থেকে বলছি। আপনার স্ত্রী কি মিসেস বিন্দিয়া ঘোষাল?”

“হ্যাঁ। কেন কি হয়েছে?”

“উনি আর ওনার এক বন্ধু গাড়ি করে কোন একটা জায়গা থেকে ফিরছিলেন। রাত দুটো নাগাদ ওনাদের গাড়ি প্রচন্ড গতিতে একটা ডিভাইডারে ধাক্কা মারে। দুজনেই হস্পিটালাইজড।“

“আরেকজনের নাম কি?”

“রাজর্ষি চ্যাটার্জি। আচ্ছা উনি কি আপনার পরিচিত।“

“না”। ফোনটা নামিয়ে রাখল অরিত্র।

৯।

দিদি কাঁদছে। “তুই মন খারাপ করিস না। তোর কপালটাই খারাপ। কি করবি বল?”

অরিত্র পাষাণের মত বসে রইল। জবাব দিল না কোন।

১০।

“এক অলস বিকেলে

একটা ভালবাসার মৃত্যু হয়।

আধমরা সরীসৃপের মত

ভালবাসারা হেঁটে বেড়ায় তোমার চারপাশে…”

শোনা যায় অরিত্রের মৃতদেহ দেখে ফেরার সময় পাড়ার লোকেরা মুখ টিপে হেসেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *