যখন চাঁদ

যখন চাঁদ

সম্বিৎ

সামনে সবুজ রেক্সিনে মোড়া সেক্রেটারিয়েট টেবিল। পেছনে ফাইল ক্যাবিনেট। হাতের কাছে টেলিফোন। কলমদানিতে কলম, ঘরের অঙ্গসজ্জাই নিছক। কাচে মোড়া চারপাশ। যেন কাচের কফিন কারণ ভেতরে নিহত মানুষ সম্বিৎ গুম হয়ে বসেই থাকে। সোম মঙ্গল বুধে গড়ায়। বৃহস্পতির বারবেলা কাটে। শুক্র। তারপর শনি। সম্বিৎ নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। যেভাবে নিহত সেইভাবেই রাইগর মর্টিস ধরেছে। সই সাবুদ করবার সময়ে শুধু অনিচ্ছুক আঙুল নড়ে কয়েক পলক। তারপর আবার যে-কে সেই। অন্ধকার মুখখানার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অবশেষে একসময় রবি উঠে আসে, মনোজিৎকে চোখের ইশারায় ডাকে, উঠে আসে দুজনেই। একই অফিসে বন্ধু সম্প্রতি অফিসার, নিজেরা এখনও অভিজাত কেরাণী, তাই এদিক ওদিক তাকিয়ে কঠিন ব্রোঞ্জ মূর্তির ঘাড়ে একটা থাবড়া মেরে রবি বলে— ‘চমৎকার একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে রে।’

সুইং ডোরের তলা দিয়ে দু জোড়া পরিচিত ট্রাউজার্স-পরা পা ঢুকতে দেখেও তৎপর হয়নি সম্বিৎ। নিরুৎসুক গলায় সাড়া দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে। মনোজিৎ বলে— ‘প্ল্যানটা অবিকল তোকে নিয়ে।’ ভুরু কুঁচকোয় সম্বিৎ। রবি বলে— ‘ডিসেম্বরের কটা দিন ছুটি নিয়ে সবাই মিলে, মানে আমরা কজন ঘুরে আসি চল। কাছে পিঠে। ধর পুরী-টুরী, ঘুরব খুব, হই-চই করা যাবে।’

মনোজিৎ বলে— ‘একদম যাযাবর-কায়দায়, যে কটা দিন ভালো লাগে, বুঝলি? বুকিংগুলো হয়ে গেছে।’

সম্বিতের মৃত মুখ হঠাৎ নড়ে ওঠে— ‘প্ল্যানটা সবে মাথায় এসেছে বলছিলে না? এদিকে বুকিং টুকিং শেষ।’

মনোজিৎ সোৎসাহে বলে ওঠে— ‘এই তো গুরু, অ্যালার্টনেস, রেসপন্স সব যে যার খোপে মাপসই হয়ে রয়েছে। তবে কেন মিছিমিছি ভুরু-টুরু কুঁচকে পাবলিককে ভড়কে দেওয়া!’

সম্বিৎ জানে ওকে নিয়ে অনুগত বন্ধুর দল খুব বিপাকেই পড়ে গেছে। ওর সহযোগিতার অভাবে এতদিনের যূথবদ্ধ উদ্যোগ সব নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। প্রথম সিগারেট খাওয়ার বয়স থেকেই রবি, মনা, আর সে, কখনও কখনও জয়, প্রীতম এবং গোস্বামীও পুজোর কটা দিন ঘুরতে বেরোয়। ছুটি প্রসারিত করে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত, পিঠে ব্যাগ, হাতে সুটকেস, কোমরে জীন্‌স, বুক পিঠ ভর্তি টী-শার্ট বেদুইনের দল। বেশ ক বছর ধরে হচ্ছে না। ওরা যেতে পারত অনায়াসেই। কিন্তু যায় না। একটা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা যেন আছে, কেন্দ্রীয় থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের মধ্যে একজন কোনও অনিবার্য কারণে আটকে পড়লে বাকিরা যায় না। বছর পাঁচেক আগে মনার টাইফয়েড হয়েছিল কেউ যায়নি। সম্বিৎ শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ থেকেও এই মরসুমি যাযাবরবৃত্তিকে পঙ্গু করে রেখেছে কয়েক বছর। স্বাভাবিক হয়ে ওঠা দরকার, খুব শীগগিরই। কাজে-কর্মেও গাফিলতি হচ্ছে। নেহাত আধা সরকারি ব্যাপার তাই চলছে। কিন্তু এ ভাবে চললে কেরিয়ার এখানেই শেষ। শেষ হলেও কিছু এসে যেত না। কিন্তু যে কোনও ব্যর্থতাই অবিকল বিপদের মতো। কখনো একলা আসে না। অপমান, অবজ্ঞা, হীনম্মন্যতা…এই সব নিয়ে আসবে সঙ্গে সঙ্গে। এতোগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে বেঁধে মার সহ্য করা সম্ভব না। ব্যর্থতাকে সামনে দেখে অন্তত এইজন্যেও হাত পা কোলে করে বসে থাকা ঠিক নয়।

বাড়িতেও একলা তার জন্যে আবহাওয়া মেঘলা থাকছে বারোমাস। মা-বাবা যতটা বিষন্ন, তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন। বাবার উদ্বেগের সঙ্গে আরও কিছুর মিশেল আছে কিনা সম্বিৎ জানে না। ছোট ভাইবোন দুটো নিজেদের হাসি ঠাট্টা, খুনসুটি, বাবার কাছে মায়ের কাছে আবদার সব কিছু এক নিশ্বাসে গিলে নিচ্ছে দাদাকে আশেপাশে দেখলে। যেন কৈশোরের ধর্মে হাসি খুশি হওয়াটা ওদের মস্ত অপরাধ। জানে সবই সম্বিৎ। কিন্তু সে পারছে না। চেষ্টা করছে, পারছে না। সবচেয়ে বড় কথা আগের মতো আচরণ যে সে করছে না তা নয়, কিন্তু কিসের অভাবে যেন সেটা আর আগের মতো লাগছে না। এই তো কদিন আগেই পেল্লাই দুটো চকোলেট নিয়ে বাড়ি ঢুকেছিল। দোতলার দালানে ঢুকে ডাকতে চেষ্টা করল আগেকার মতো, ঠিক আগেকার মতো— ‘বিলু⋯অপাই শুনে যা।’ গলার ভেতর থেকে এমন একটা খ্যাসখেসে আওয়াজ বেরোল যে ওর মনে হল এই গলায় ডাকাডাকি করলে ভাইবোন দুটো নির্ঘাত ঘাবড়ে গিয়ে খাটের তলায় ঢুকবে।

চুপচাপ ওদের ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখল চকোলেট দুটো। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকাল অপালা, ছোট ভাইয়ের দিকে আড়চোখে চেয়ে ইশারা করল। মুখের উদ্‌গত হাসির ভাবটা জোর করে চাপা দিয়ে রাখল দুজনেই। পড়াশোনা বা পড়াশোনার নামে দুষ্টুমিই করছিল বোধ হয় ওরা। চুপচাপ মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল যেন দু মিনিট নীরবতা পালনের জন্যে। কিংবা সম্বিৎ কড়া মাস্টারমশাই, কানটান মুলে দিতে এসেছে। নিজের হাতে কোথায় বেতটা আছে সম্বিৎ দেখতে পাচ্ছিল না, তাই গলার কাছটা ব্যথায় চিনচিন করছিল। বিলুর চুলগুলো ও ঘেঁটে দিল, মুখে কথা নেই। অপু হায়ার সেকেন্ডারি ফাইন্যাল ইয়ার, বিলু মাধ্যমিক। গলা পরিষ্কার করে বলল— ‘কি রে অপাই স্ট্যাটিকস্ ডিনামিক্স বুঝছিস তো ঠিক! বিলু তোর হিস্ট্রি?’ মনে হল অন্য কেউ কথা বলল। অপু ঠোঁট দুটো ফাঁক করল। বিলু ঢোঁক গিলছে। হিসট্রি নিয়ে দাদার কাছে ওর নালিশের অন্ত ছিল না। সম্বিতের বুকের ভেতরটা হু হু করছে। ভাইবোনের কাছে সে আর পুরনো দাদাভাই নেই। কোন দৈত্যের বিষাক্ত নিশ্বাসে প্রাণহীন পাথর হয়ে গেছে। পাথরও নয়। মমি। বিকট, প্রেতাকৃতি, কেউ তার দিকে তাকাতে পারে না।

রাত্তির প্রায় নিঝুম হলে মা ডাকাডাকি করে। খাবার টেবিলে মা একা। বাবা বসেন না। শুধু রাত বলে নয়। সম্বিৎ জানে বসছেন না বেশ কিছুদিন। খুব সম্ভব নিজে হাতে মনের মতো করে মানুষ করেছেন যে ছেলেকে, যাকে নিয়ে গর্ববোধ ছিল, তাকে আর ইদানীং সহ্য করতে পারছেন না। ছোটগুলোর খাওয়া অনেক আগেই চুকে বুকে গেছে। ঢংঢং ন’টায় খাবার টেবিলের সেই জমজমাট হাসি-গল্পের আড্ডা হঠাৎই যেন রূপকথা হয়ে গেছে।

সম্বিৎ বলে উঠল—‘মা, আমি ভাবছি অন্য কোথাও চলে যাবো।’

মায়ের মুখ থেকে ভাতের গরস পড়ে গেছে, স্খলিত গলা, বললেন— ‘বলছিস কি তুই? কোথায় যাবি?’

সম্বিৎ বলল— ‘কোথাও একটা পেয়িং গেস্ট অ্যাকোমোডেশন নিয়ে নেবো। এ চাকরিটাও ছেড়ে দেবো ভাবছি, অন্য কোথাও অন্য কোনও স্টেটে⋯দেখি।’

মার দু চোখ এবার জলে ভরে গেছে। কপালের ওপর সিঁদুরের টিপটা কেটু ধেবড়ে গেছে। সম্বিৎ দেখছে। মসৃণ কপালে দুটো ভাঁজ। মায়ের সামনের দিকের চুলগুলো একেবারে পেকে গেছে। মুখটা সেই তুলনায় টুলটুলে আছে। একটু বসা, দীর্ঘ চোখ। বাইফোক্যাল এঁটে বিস্তর পড়ে মা। তাই-ই বোধ হয় এতোটা বসে গেছে। ঠোঁটে খুব সুন্দর ঢেউ, দাঁত সমান, হাসলে মাকে বড় সুন্দর দেখায়। চোখ এরকম টলটল করতে থাকলে অতি বড় পাষাণ হৃদয় সন্তানও বোধ হয় সৎপথে আসতে বাধ্য হবে।

—‘কি বলছিস নিজেই জানিস না খোকা’, মা বলল, ‘আমাদের ছাড়া অত সহজ? তুই এখন যেখানেই যাবি এই মন নিয়েই যাবি। শান্তি পাবি না। বরং তুই…’ একটু ইতস্তত করে মা বলেই ফেলল অন্য দিকে তাকিয়ে ‘মত কর, তোর নিজের ইচ্ছে মতো বিয়ে কর একটা…।’

ক্লিস্ট চোখে চেয়ে সম্বিৎ বলল—‘ফের ওই কথা!’

নিশ্বাস ফেলে মা বলল—‘সত্যিই! চারদিকে এত লোক থাকতে আমাদের ভাগ্যেই বা এমন কেন হল? কোনদিন কারো অমঙ্গল চিন্তা করিনি, দীনদুঃখী এ বাড়ি থেকে ফিরে যায়নি কোনদিন। বেড়ালটা, কুকুরটা। আমার অন্ন আমি সবার সঙ্গে ভাগ করে খাই। ছেলে আমার এমন সর্বংসহ, বিশ্বম্ভর। হায় ভগবান, তুমি কি নেই?’

বিস্বাদ লাগছে জিভে সব। সম্বিৎ অস্বাভাবিক গলায় বলল—‘মনে হয় তোমরা সবাই আমাকে পতিত করে রেখেছ মা। মনে হয় অফিসে সব সময়ে আমায় নিয়ে কানাকানি হচ্ছে। হাসছে লোকে পেছন থেকে।’

—‘ওটা শুধু মনে হওয়া, বিশ্বাস কর খোকা। তুই যেমন ভুলতে চাইছিস, আমরাও তেমনি ভুলতেই চাইছি। আর লোকের কথা যদি বলিস— ভুলে যেত কোনকালে। তুই সব সময়ে ওরকম চোর-চোর মুখ করে ঘুরিস বলেই…বরং তুই কিছুদিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আয়…’

আচম্বিতে বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। পেছনে। বোধ হয় সব সময়েই এমনি যবনিকার অন্তরাল থেকে সন্তর্পণে মা-ছেলের কথা শোনেন। পিতার সহজাত নাড়িজ্ঞানে বুঝে নেবার চেষ্টা করেন কোথায় ব্যাধি, কী কী তার লক্ষণ…বললেন— ‘ঠিকই বলছে তোমার মা খোকা, তুমি ছুটি নিয়ে বেশ ভালো করে ঘুরে এসো। নইলে যা দেখছি, মানসিক ব্যাধিতে পড়বে।’

বাবা ‘খোকা’ বলে ডাকলেন কতদিনের পর সম্বিতের হিসেব নেই। বাবা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন ঘৃণায় না অস্বস্তিতে বোঝে না সম্বিৎ। ছেলে বড় হয়ে গেলেই বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব কেন যেন গড়ে ওঠে। সেই দূরত্ব অতিক্রম করে আশু জিজ্ঞাস্য কিছু প্রশ্ন করতে পারেন না বলেই কি অস্বস্তি! সম্বিৎ চেয়ারটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, বাবার দিকে সোজা না তাকিয়ে বলল—‘আপনি বলছেন? ভালো হবে তাতে?’ —‘নিশ্চয়ই বলছি। তোমার একটা চেঞ্জ অফ প্লেস দরকার হয়ে পড়েছে।’ —‘যদি না ফিরি!’ —সম্বিতের গলায় কি অভিমানের সুর, যা তার বারো তের বছর বয়সে মানাতো!

মা বলল— ‘তুই কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলি খোকা! চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাবি?’

সামান্য কাঁপা গলায় বাবা বললেন— ‘আশীর্বাদ করছি, নিজের মনের জোর, মা-বাপের জোর, শিক্ষার জোর সব কিছুর ওপর ভরসা রাখো, তোমার এ গ্রহ কেটে যাবে।’

সম্বিৎ বলল—‘দেখি।’

তীর্থযাত্রী

ট্রেন সাঁতরাগাছি ছাড়াতেই শান্তা বউঠান সীটের ওপর পা মুড়ে শিফন শাড়ির আঁচলটা ঘটা করে কোমরে গুঁজলেন। কানের ঝুমকো দুলছে, মাথা নেড়ে বউঠান বললেন— ‘আমি এবার খাবার দাবারগুলো বার করে ফেলি চটপট…রাত হল…এই মিলু তোরা দুটোতে বাঙ্কে উঠবি,’ জাঁদরেল দুটো হট কেস মাঝখানে বার করে রাখলেন বউঠান, আবারও বললেন—‘হাত ধুয়ে আয় মনা, রবি, মিলু সবাই যাও। সম্বিৎ শীগগীরই।’

শুকনো মুখে সম্বিৎ বলল— ‘আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি বউঠান, এত রাতের ট্রেন…’

—‘তাতে কি? লুচি দিয়ে ফুলকপির ছেঁচকি আর কষা মাংস মুড়ে খাবার জন্যেই তো ট্রেনে চড়া ⋯। ঢুলতে ঢুলতে যাওয়া আর দুলতে দুলতে ঘুম! নইলে মজা কি? তুমি ভবানীপুর থেকে নিশ্চয়ই সাতটায় খেয়ে, সাতটা কুড়ি-টুড়ি নাগাদ বেরিয়ে পড়েছ জ্যামের ভয়ে। সে খাবার বহুক্ষণ তোমার ডুওডেনামে পৌঁছে গেছে ভাই। যাও। জলদি করো বলছি’— বউঠান চোখ পাকালেন।

—‘সত্যি বলছি আমার খিদে নেই।’

—‘মেয়েদের মতো করো না তো!’ মত প্রকাশ করে কঠোরভাবে শান্তা বউদি খাবার গোছাতে লাগলেন। ট্রেন স্পীড নিয়ে নিয়েছে। তারই মধ্যে তোয়ালে পেতে কাগজের প্লেটে খাবার গোছাচ্ছেন বউদি। যে কোনও পরিবেশকে নিজের অভ্যাস, স্বভাব, রুচির সঙ্গে মানানসই করে নিতে এদের জুড়ি নেই। আসলে নিজের পরিবেশ আঁচলে বেঁধেই এরা ঘোরাফেরা করে। খুব নিরাসক্তভাবে প্লেটটা নিয়ে নিল সম্বিৎ। মনা, রবি, মিলুর হই হল্লা আর শান্তা বউদির টিপ্পনির সন্তুর-বাদনের মাঝখানে যেন অন্য দ্বীপে বসে টুকটুক করে খেয়ে নিল, খাবারগুলো যে তারই জঠরে গেল এ সম্পর্কে অনিশ্চিত সে। প্লেটের দিকে তাকিয়ে বউদি বললেন— ‘এই তো দিব্যি খেয়ে নিলে, খিদে আবার পাবে না। কোন সাতটায়⋯এই এষা, বাঁ হাতে মিষ্টির বাক্সটা বার কর তো!’ নিজের বুড়ো আঙুলটা নিখুঁতভাবে চাটতে লাগলেন বউদি।

সম্বিৎ প্লেটটা মুড়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিতে দিতে বলল— ‘আমার পেটে সামান্যতম জায়গাও নেই। তাছাড়া মিষ্টি আমি পছন্দ করি না, প্লীজ বউদি,’ বলতে বলতে শরীর ভরা ফরাসী সুবাস নিয়ে শান্তা বউঠান উঠে এসেছেন।

—‘হরি ঘোষ স্ট্রীটের পরিতৃপ্তি সন্দেশ সম্বিৎ মিত্তির খাবে না, না? দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাঁ হাতের দু আঙুল দিয়ে গাল টেপার ভঙ্গিতে গাল ধরেছেন— ‘গত বছর মুকুলদার জন্মদিনে কটা খেয়েছিলে মনে আছে?’ হাঁ করে সন্দেশটা মুখে নিয়ে বউদির হাতের চাপ কমলে সন্দেশ গদগদ গলায় বিরস মুখে সম্বিৎ বলল—‘এ এক রকমের অত্যাচার বউঠান, সত্যি বলছি, এরকম করবেন না।’

মনা বলল— ‘রমণীয় অত্যাচার, কি বল রবে, অ্যাঁ? অত্যাচারটা বউদি আমার ওপর করলে তো পারে! শী ইজ মোস্ট ওয়েলকাম।’ মুখ নেড়ে শান্তা বউদি বললেন—‘অত্যাচার তোমার ওপর? বলে শ্যামবাজার টু হাওড়া আমি তোমার হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ার সামলাতে সামলাতে আসছি!’

সকলে মিলে গলা মিলিয়ে হাসছে। শুধু সম্বিৎ বাদে। ও জানে ওর গলা একদম বেসুরে বাজবে। সামান্য কথায় এই সম্মিলিত হাসি, ট্রেনে বসে খাওয়া শুধু খাওয়া, রবির মতন অমন চোখ বড় বড় করে কিম্বা মিলুর মতো অমন টুকে টুকে, সবাই যেন চূড়ান্ত রকমের অশ্লীল! অরুচিকর! এত বিতৃষ্ণা সম্বিতের পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের দেহটার মধ্যে আপাদমস্তক জমা ছিল!

এই কুপেতে মেয়েরা। পাশেরটাতে ওদের তিন বন্ধুর জায়গা। এক দিকের ওপরের বাঙ্কটা এখন খালি। খড়গপুর থেকে গোস্বামী উঠবে। জয় আর প্রীতম ছুটি পায়নি। সম্বিৎ ভুরু কুঁচকে বলল— ‘এত লোক হবে, মানে এত মেয়ে-টেয়ে, মনা এসব তো আমায় বলিসনি।’

—‘বলবার সুযোগ দিলি কোথায়?’ সিগারেট ধরিয়ে, আয়েস করে ধোঁয়া ছেড়ে গায়ে জ্বালা ধরিয়ে মনোজিৎ বলল।

রবি বলল ‘মেয়ে-টেয়ে তুই কাকে বলছিস? ঠিক করে বল তো?’

মনা বলল, যেমন কথার পিঠে কথা বলা ওর অভ্যেস— ‘কি করব বল? বউদিটা অ্যায়সা ধরল! ছেলেপুলে নেই, দাদা জাহাজে, ওর সময় কাটে না, কি রকম রাম-হুজুগে জানিসই তো? আর মিলুর কথা যদি বলিস, রবি গেলে মিলু তো যাবেই! যা সন্দেহবাতিক!’

রবি বলল— ‘ক্‌কি! ক্‌কি ; কি বললি শালা ছোটলোক!’

মনা বলল— ‘যা বলছি ঠিকই বলছি, মিছিমিছি মুখ খারাপ করছিস, কেন? রোজ দুপুরবেলায় অফিসে ফোন করে কার বউ বাবা! প্রায়ই তো দেখি একেবারে মেন গেটের গোড়া থেকে তোকে ধরে নিয়ে যায়! তোমার ফর্সা ফর্সা লালটু মলাট দেখলে যে আর কোনও মেয়ে ভুলবে না, মেয়েরা যে আজকাল টল, ডার্ক, রাগেড্‌ চেহারা পছন্দ করছে আলুর দম টাইপের একদম না, এ কথা তোমার বউকে যদ্দিন না সমঝাতে পারছো তদ্দিন ও বেচারা তোমার পেছনে ফেউ লেগে থাকবে, অবোলা জীব আহা!’

রবি পকেট থেকে লাইটার বার করতে করতে থেমে গিয়েছিল, এখন মারমুখী হয়ে তেড়ে গেল,— পরক্ষণেই বলল— ‘যাগগে যাগগে এবারের মতো ছেড়ে দিলুম, গপ্পো বানিয়ে আনন্দ পাস তো পা। মিলু রোজ ফোন করে সংবাদটা তোকে চুপি চুপি কে দিলে রে! তমাল, না রামদীন।’

মনা চোখ বড় বড় করে বলল— ‘মিলু নয়! অন্য কেউ! তবে তো জরুর মিলুকে জানাতেই হচ্ছে ব্যাপারটা!’

সম্বিৎ তখনও বিরক্ত সপ্রশ্ন চোখে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারছিল দুজনেই। চাউনিটা গা পেতে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। তাই মনা বলল- ‘যাক গে, আমার আর কি? হ্যাঁরে সম্বিৎ, কী বলছিলি যেন? মেয়ে-ফেয়ে, না? যা বলেছিস। এষাটা ফালতু জুটে গেল। বউদির মাসতুতো বোন। বাড়িতে এসে রয়েছে কদিন। ফেলে যাওয়াটা কি ভালো দেখায়? তুই-ই বল! আসলে কি জানিস, বউদিটা আমার সঙ্গে লাগাবার তালে আছে।’ উদাস মুখ করে মনা বলল- ‘দেখি লাগে কিনা! যা টেটিয়া মেয়ে। বাব্ বাঃ। লেগে গেলে লাইফ হেল করে দেবে।’

রবি বলল— ‘কেন এষা তো চমৎকার মেয়ে! অত ভালো গান গায়। দেখতেও খাসা। বেশি কথা বলে না। লেগে গেলে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা হবে।’

শেষের কথাটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মনা বলল— ‘চমৎকার মেয়ে! ভালো গান গায়? বাতিক জানো? যেখানে যে ওস্তাদ আসছেন উনি নতুন বন্দিশ নিতে ছুটছেন অমনি, পকেট ফর্সা করে দেবে মাইরি, অথচ গান গাইতে বলো। ট্যাঁক করে বলবেন রবীন্দ্রসদনে টিকিট কেটে শুনে আসবেন। গান শুনতে বলো, টেপ চালালেই ফরফর করে উঠে চলে যান। বউদির মতো বক বক করে না ঠিকই, কিন্তু টিপলে ঠিকই গাইবে। সোশ্যাল-ওয়ার্ক করা, উইমেনস লিব-এর বাতিকগ্রস্ত মেয়ে আবার চমৎকার! কাশীতে আবার কি এক ফাউন্ডেশনে—পড়াশোনা করত। রবীন্দ্রনাথ কি বিবেকানন্দের কম পুরুষ মানুষকে গেরাহ্যিই করে না।’

রবি বলল— ‘তবে তুই লাগাবার চেষ্টাটা হতে দিচ্ছিস যে বড়!’

মনোজিৎ চোখ নাচিয়ে বলল— ‘তুইও যেমন! দেখি না শেষ পয্যন্ত কি হোয়। এখনও হামি কুছু বোলছে না।’

‘—গাঁটছড়া বাঁধা শেষ হয়ে যাওয়া পয্যন্ত শালা চুপ থাকবি তুই, তোকে আমি চিনি না?’

মনা বলল— ‘দ্যাখ রবে, তোকে তো আর ফিরে ছাঁদনাতলায় বসাচ্ছি না, আমার ব্যাপারে তুই কেন নাক গলাচ্ছিস মিছিমিছি? জানিস ঘটকালিটাই বউদির একমাত্তর হবি। ভদ্রমহিলার মনে কি দুঃখু দিতে পারি। একে তো বছরে সাত আট মাস করে বিরহী থাকে! তাছাড়া লেগে গেলে, এষা উইল লেট মী অ্যালোন, তোর বউয়ের মতো পেছনে চব্বিশ ঘণ্টার লেজুড় হয়ে থাকবে না। বউয়েদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কি চাইবার থাকতে পারে রে?’

শান্তির ওষুধ খেয়ে ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বহু রাত পর্যন্ত দু বন্ধুর শখের ঝগড়ার আওয়াজ যেন ঘোরের মধ্যে অন্য পৃথিবীর আওয়াজের মতো শুনতে লাগল সম্বিৎ। এষা⋯মিলু⋯ বউঠান⋯ লেজুড়•• কাশী⋯ লিব⋯ বউঠান⋯ এষা⋯ মিলু•• এষা⋯ আরে গোঁসাইজী! আসুন প্রভু, আসতে আজ্ঞা হোক⋯ মঙ্গল হোক বৎসগণ⋯সব শুভ তো? সব কটি মাল গুদামজাত হইয়াছে? ঘুমে লাল চোখ মেলে একবার ভূপাল গোস্বামীর নধর চেহারাটা দেখে নিয়ে সম্বিৎ পাশ ফিরল। অতঃপর⋯ রাতের ট্রেন ‘গোঁসাই এলেন, গোঁসাই এলেন, মিলু বউঠান, এষা বউঠান মিলু বউঠান এষা বউঠান’ বলতে বলতে ঘুমন্ত প্রাণী কটিকে পেটে পুরে নিয়ে চলল।

আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই গরম কফি, পরিচিত পূরী স্টেশন⋯ বাবু পণ্ডা নিবে? নিবে ত? পণ্ডা অছে? না’ কওন? ভগবান-অ? না’ কওন? ভগবান-অ? অ ত ছড়িদার! পণ্ডা কবে হল-অ! অ বাবু!

চারখানা সাইকেল রিকশায় স্টেশন রোডের বালি ভাঙতে ভাঙতে সহসা বাঁক ফেরা। দিগ্‌বলয়ে টলটলে আঙুর রঙের বিশাল জলধি হেলছে দুলছে। আকাশে আঁকা খিলি টুপি মাথায় কালোপাথরের নুলিয়া। রূপকাহিনীর কলার খোলার নৌকা ঢেউয়ের এপার, ঢেউয়ের ওপার, এবং বীচভর্তি বিদঘুটে দর্শন হোটেলের সারি।

এষা

এই সমুদ্র কারো কারো কাছে খুব একঘেয়ে। দিবারাত্র ধপড় ধাইঁ ধপড় ধাইঁ ঢেউ ভাঙছে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল, জোয়ারে সবেগে, ভাটায় মৃদুমন্দ, ব্রেকার ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে। কোনও কোনও সন্ধেয় ফসফরাস, ফের ভোরে মেঘের কিনারা রঙিন করে টাটকা কমলালেবু সুর্যের দড়িলাফ, তিন কোণা সাদা পালেরা দূরে, ছটা সাতটার মধ্যে ঝাঁক ঝাঁক জেলে-ডিঙির প্রত্যাবর্তন এবং খোলাভর্তি টাটকা সার্ডিন মাছের সদ্যোমৃত রুপোলি টাকা স্তূপীকৃত দেখে দেখে, সন্ধে-সকাল সমুদ্দুরের বালিল জলে পা ভিজিয়ে অথবা ওলটপালট খেয়ে, মোটা ওড়িশি চালের ভাতের সঙ্গে উড়িয়া পাচকের গোড়ায় জিভে-জল, ক্রমশ একঘেয়ে হাত-থাকা রান্না খেতে খেতে তিন থেকে চার দিনের মাথায় জাত-ট্যুরিস্ট বলবে—‘ওঃ, চারদিনের বেশি পুরী ভালো লাগে না।’ প্রথম দিন অন্নপ্রাশন, দ্বিতীয় দিন উপনয়ন, তৃতীয়দিন বিবাহ, চতুর্থ দিনেই নির্ঘাৎ মৃত্যু এই শখের বেড়াতে যাওয়ার। বীচ ভর্তি মরচে ধরা গজাল, লোহার রড, কাগজের টুকরো, মুড়ির ঠোঙা, শামুক ঝিনুকের ভাঙা খোল, বিষ্ঠা— কুকুরের ও মানুষের। ভূ-ভারতে এমন বীচ আর কোত্থাও নেই। এত নোংরা, এত অস্বাস্থ্যকর! হেথা নয় বাপু, অন্য কোথা চলো, অন্য কোনখানে। দেখো নি কি গোয়া কী অপরূপ সুন্দরী, প্রসাধন সেরে তোমার জন্য বসে আছে! এক এক জায়গায় এক এক সাজ! পরিচ্ছন্ন, বিস্তৃত বেলাভূমি। স্নান করো, শুয়ে শুয়ে স্রেফ সমুদ্দুরের আদর খাও, কালাংগুটে তোমাকে একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো দোলনায় দোলাবে, কোলবার রুপোলি বালু, রুপো চকচক আরবসাগর সারা দুপুর তোমায় নিশির গলায় ডাক দেবে। কিংবা চলে যাও না নারকেলছায়াঘন নবনীল কোভালম্‌-এ, বিপদ নেই আপদ নেই। দিব্যি থাকবে। এই সবজেটে বঙ্গোপসাগরে একঘেয়েমি ছাড়া কিছু নেই। ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধের মত খালি একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে বারবার, একই ভঙ্গিতে। তার ওপর এই সাগর ছেঁড়া চটিজুতোর মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায় দুঃসাহসী টুরিস্টের লাশ। কার্তিকের এই মরসুমে। কোন মায়ের জোড়া ছেলে গেল সেদিন। আবার আজ সোনালি চুলে কানাডার কুমার জালে পড়ল, নুলিয়াদের। কামট ভেবেছিল, উঠলে দেখল সাগরে খাওয়া কোন সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারের দেশের নওজোয়ান। অথচ সাগর খলখল, খলখল করে হেসেই যাচ্ছে, হেসেই যাচ্ছে।

কেউ কেউ কিন্তু ফিরে আসে। বারবার। কেন, তারা স্পষ্ট করে জানে না। আসল কথা এই সাগরের টান বড় টান। চোরা স্রোতের টান। সঙ্কর্ষণে টেনে আনে। ছুটির ঘণ্টা কানে বাজলেই অনুষঙ্গে চোখের সামনে দুলতে থাকে হাওয়ায় ফোলা সবুজ সিল্কের চাদর, বাদলার কাজ করা, অথই কালোয় সাদা ফুলের গোড়ে মালা টানা ভাসছে পুব থেকে পশ্চিমে। একটা, দুটো, তিনটে, জায়গায় জায়গায় টান পড়ে ছিঁড়ে গেলে মালা। আবার জুড়ে যাচ্ছে। তোমরা কেন ফিরে যাও? যে যেখানে থাকো যে শহরে, যে সমাজে তাকে বুক পকেটে খাম, অথবা কাঁধ আঁচলে চাবি করে নিয়ে, ঝাপসা সন্ধ্যায় সিলুয়েৎ ছবিতে চুল উড়িয়ে কেন তোমরা ফিরে যাও? যদি নিতান্তই যেতে হয়, তবে আবার এসো। আবার, আবার। এই ডাকে দ্যাখো ওই প্রান্তিক হোটেলের তিনতলার কোণের ঘরটি প্রতি গ্রীষ্মে একই প্রৌঢ়ের জন্য বুক হয়ে থাকে। গোয়া নয়, গোপালপুর, চাঁদিপুর-টুর কিছু নয়, অনেক দিনের পুরনো পুরীধাম। জগন্নাথ দর্শন না হয় নাই হল, ঠাকুর দূর থেকে প্রণাম নিন, শুধু সমুদ্রের সঙ্গে কটা দিন একত্র বাস। আরও দ্যাখো মাঝখানে ওই আধখানা চাঁদের মতো বারান্দায় কে মিথুন বসে। যেন মন্দিরের গায়ে খোদা! বারবার তিনবার তারা এই সমুদ্রের কাছেই ফিরে এসেছে মাত্র পাঁচ বছরের যুগলবন্দীতে। এরকম কত আছে!

নীল সবুজের টানাপোড়েনে বোনা সেই বঙ্গোপসাগরের দিকে চেয়ে বারোটার পর থেকে সারাটা অপরাহ্নবেলা মোহগ্রস্ত, মুহ্যমান মুমুর্ষ থাকে এষা মেয়েটি। পিতৃমাতৃহীন বারাণসীর হোস্টেলে মানুষ, বড় কঠিন সংকল্প সাধনার মেয়ে এষা, স্বাধীন, বহু অর্থের উত্তরাধিকারিণী অথচ যে কখনও সমুদ্র দেখে নি। প্রথম দেখার উদগত বিস্ময় আনন্দ বুকের মধ্যে জমাট দুধের মতো। খুব সহজে তরল, গলিত হতে চাইছে না, এ অলৌকিক আনন্দের ভার। শুধু সামনের কাচের মধ্যে দিয়ে পলকহীন চেয়ে আছে। এত বিশালতা, এ গভীর, চঞ্চল শান্তি হে হিমবান বোধ হয় তোমাতেও নেই। কিংবা আছে। একমাত্র তোমাতেই আছে। অন্য রূপে।

ঘরের ভেতরে হুল্লোড়। ভি. সি. আর ভাড়া করে ওরা ফিল্ম দেখছে। কারণ তিন দিন ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। একবার উঁকি মেরে দেখে এসেছে। সাঙ্ঘাতিক ভেনডেটা। তিনপুরুষ ধরে চলছে। ভীষণ জটিল অঙ্ক, কে কার স্মৃতি হারা ভাই, কে ডাক্তার কে পুলিস ইন্সপেক্টর—একই লোকের কত ভিন্ন পরিচয়। তবে অঙ্কের উত্তর সরল। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে তিনপাতার সরলের উত্তর যেমন ‘এক’ তেমনি। শেষকালে শলমাচুমকির শাড়ির সঙ্গে নীল পাগড়ির বিয়ে। জোড়ায় জোড়ায় নাচ, ঝুমুর আর বল ডান্সের মিক্সি। এষা দেখল মিলু আর রবি হাঁ করে ছবি গিলছে। মিলুর মুখে পোকা না ঢুকে যায়। মনোজিতের হাতে পিটার স্কট। গোস্বামীর বোধ হয় ইতিমধ্যেই প্রচুর হয়ে গেছে, কেন না কেমন ভোম মেরে আছে। মনার প্রকৃতি অন্যরকম। দাপটে রানিং কমেন্টারি করে যাচ্ছে। সম্বিৎ ঘুমোচ্ছে দেয়ালের দিকে কাত হয়ে। এত চেঁচামেচি, গান, মারামারির দমাদ্দম ঠাঁই ঠাঁই আওয়াজ, কিছুতেই তার যোগনিদ্রা ভাঙছে না। ওর দিদি একবার এর, একবার ওর, একবার তার পেছনে লাগছে। এমন কি ঘুমন্ত সম্বিতেরও। এষাকে উঁকি মারতে দেখে টুক করে বেরিয়ে এল, এষার সেই দিদি যে নাকি ভরপুর স্বাস্থ্য এবং প্রাণোচ্ছলতার অন্য নাম। চার মাস যে জামাইবাবু মুকুলদাকে দেয়, অন্য ক মাস জাহাজী স্বামী বাইরে গেলে উদার হাতে বিলিয়ে দেয় ভাই বোন, দেওর ননদ, বন্ধুবান্ধব এমন কি শাশুড়ি-টাশুড়িদেরও।

শান্তা বলল- ‘কী গরম লাগছে রে! বেরিয়ে এলুম তাই। বারান্দাটা দারুণ, না? একটু বসি, কি বল্‌?’

এষা দিদির পাশে চেয়ারটা টেনে নিয়ে এলো। দিদির রাশিকৃত চুলে দারুণ মিষ্টি গন্ধ। সমস্ত শরীরেই। মহার্ঘ বিদেশী প্রসাধন দ্রব্য ছাড়া দিদি ব্যবহার করে না, সুগন্ধটা এইসব দ্রব্যেরই। তবু এই মৃদু মিঠে গন্ধটা এষার কাছে দিদিদিদি লাগে। যেন দিদিত্বেরই সৌরভ। নাকভরে সুগন্ধটা টেনে নিয়ে এষা ঝুঁকে পড়ল সেইসঙ্গে ওর চুল এবং আঁচলও। ‘হ্যাঁরে দিদি, এর জন্যে পুরী-টুরী কিংবা অ্যাট অল কোথাও আসার দরকার কি?’

—‘কিসের জন্যে রে পাগলী?’

—‘এই ভিডিও দেখার জন্যে দরজা জানলা বন্ধ করে, কিংবা মদ্যপান, কিংবা ঘুমোবার জন্যে? এতো বাড়ি বসেই দিব্যি হতে পারে।’

—‘ঠিক বলেছিস। আমিও এক্ষুনি তাই ভাবছিলুম। ’

‘অমনি তুইও তাই ভাবছিলি? ফের বাজে কথা! মনোজিৎকে ভি. সি. আর ভাড়া করবার জন্যে কে নাচাল রে? গোস্বামীদা বোতল বগলে ঘরে ঢুকলে তাড়িয়ে দিতে পারলি না?’

—‘কি করি বল্‌? ওটাই আমার দুর্বলতা! যে যাতে মজা পায়। সব্বার ভালো লাগায় আমি সায় দিয়ে যাই।’

–‘বেতসবৃত্তি!’ এষা বলল

—‘সংস্কৃতে গালাগাল দিলি, না রে? আচ্ছা এই দ্যাখ, তুই বিনি রোদ চশমায় চকচকে জলের দিকে তাকিয়ে আছিস তো আছিসই যেন তোকে ভূতে পেয়েছে, আমি কিচ্ছু বলছি না। সম্বিৎটা তিন থেকে চার ইনস্টলমেন্টে ঘুমোচ্ছে, তাতেও বাধা দিচ্ছি না। দিচ্ছি?’

—‘আমার কথা আলাদা। আমি তো সমুদ্রটা এনজয় করছি, যেটা করতে এখানে আসা। অন্যরা কি করছে? ঘরের ফুটো-ফাটাগুলোসুদ্ধু বন্ধ করে দিয়েছে, সমুদ্রের গর্জন তো দূরের কথা, এক্সট্রা অক্সিজেনটুকুও ঢোকবার পথ পাবে না। অক্সিজেনের পুলের পাশে বসে ওরা কার্বন ডায়োক্সাইডে সাঁতার কাটছে। তুই তো দলনেত্রী। ওদের বাধা দেবার হক তোর আছে। আর ও ভদ্রলোক কি ঘুমোবার জন্যেই এসেছে?’

যেন ভীষণ একটা বুদ্ধির কথা শুনেছে, এমনভাবে দিদি বলল— ‘হতে পারে রে এষা। তুই একদম ঠিক বলেছিস। সম্বিৎটা ঘুমোবার জন্যেই এসেছে বোধ হয়। ওখানে ওর নির্ঘাত ঘুম হত না। সমুদ্দুরের হাওয়ায় ওজোনে ফুসফুস ভর্তি করে ঘুমোবে বলেই হয়ত বেচারা এসেছে।’

—‘ঘুমকাতুরে হলেই তাকে বেচারি বলতে হবে? তুই যে কী! যত রাজ্যের তামসিক অভ্যেস!’

—‘আরে ও ছেলেটার কেস খুব গড়বড়। তুই কিচ্ছু জানিস না তাই বলছিস।’

—‘কী কেস? তোরা কলকাতার লোক যে দিন দিন কী ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করেছিস!’

শান্তা বলল —‘আমাদের ঘরে চ। গড়াতে গড়াতে তোকে বলি।’

—‘কেন এখানেই বল না। আবার গড়াবি কেন?’

—‘একটু গড়িয়ে নিতে দে না রে।’ মিনতির সুর খেলছে শান্তার গলায়, ‘তাছাড়া বলতে বলতে আমার হুঁশ থাকবে না, পেছনে এসে দাঁড়ালে টাড়ালে বুঝতেই পারব না। কেলেঙ্কারি হবে একটা।’

—‘সেটা অবশ্য ঠিক। ভদ্রলোক খুব নিঃশব্দে চলাফেরা করেন।’

সমুদ্র

পৌনে ছটায় সূর্য ওঠে। পাঁচটায় মধ্যরাতের অন্ধকার। ধীরে ধীরে ব্রাহ্ম মুহূর্তের প্রস্তুতিতে তরল হতে আরম্ভ করে। বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। দূর থেকে দেখা যায় বালুবেলায় কালো কালো মূর্তি জমছে। সমুদ্র দেবতা। ব্রাহ্ম মুহূর্তে দেববন্দনার প্রস্তুতিপর্ব। আঁচলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয় এষা। পুবদিকে মুখ।এই বারান্দা থেকে সূর্যোদয়ের প্রতিটি খুঁটিনাটি দেখা যায়। পাশের চেয়ারে আরেকজন এসে বসল। সূর্য পরিপূর্ণ উদিত হওয়া পর্যন্ত, সমুদ্রের কুঞ্চিত কালো বুক গলিত স্বর্ণ হওয়া পর্যন্ত এষা রুদ্ধবাক।

পার্শ্ববর্তীর উপস্থিতি সম্পর্কে যেন সে সম্পূর্ণ অচেতন। জলে সোনা ঝলকানো শেষ হলে বলল—‘এরই মধ্যে ঘুম থেকে উঠলেন যে!’

সম্বিৎ বলল —‘একটা মানুষ আর কত ঘুমোতে পারে? তিন দিন চাররাত নাগাড়ে ঘুমিয়েছি। এবার চোখ ফটফট করছে।’

—‘এই প্রথম ভোর দেখলেন বোধ হয়।’

সম্বিৎ্ হাসল— ‘আমি চিরকাল আর্লি-রাইজার। ভোরবেলা উঠে ডন বৈঠক, ব্যায়াম এসব ছিল— ভোর আমার খুব অন্তরঙ্গ সময়। শিশুকাল থেকে।’

—‘কৌশানিতে সূর্যোদয় দেখেছেন?’

একটু শিউরে উঠল সম্বিৎ। জবাব দিল না।

এষা বলল —‘টাইগার হিলের সূর্যোদয় আমি দেখিনি। তবে কৌশানি দেখেছি। একটা তেকোণা আকাশের পট থেকে উঠে আসে। দেখলে আর জীবনে ভুলতে পারবেন না।’

সম্বিৎ আস্তে আস্তে বলল— ‘দেখেছি। আর কোনদিন দেখব না। ভুলতে চেষ্টা করলেও পারি কই?’

আশ্চর্য হয়ে সম্বিতের মুখ দেখল এষা। প্রশ্ন করল না, বলল— ‘চলুন বীচের ধার থেকে একটু ঘুরে আসি।’

—‘আপনি যান না। আমার ইচ্ছে করছে না।’

—‘চলুন। গেলেই ইচ্ছে করবে। এই সময়ে সমুদ্রের রঙটা কাঁচা সবুজ থাকে, কচি শশার মতো। তার ওপর লাল সোনালি। আকাশটাও নিখাদ নীল। দু এক টুকরো মেঘ আর নৌকোর পালে তফাত ধরতে পারবেন না। চলুন।’

সম্বিৎ গায়ের শাল সামলে উঠল। অগত্যা।

ভোরবেলাটা বেশ ঠাণ্ডা। সমুদ্রের ধারে হু হু ভোরালো হাওয়ায় আরও। সম্বিৎ বেড়াতে বেড়াতে বলল ‘আপনি কি কবি টবি নাকি?’

এষা বলল—‘না। ছবি আঁকি। জল রং, প্যাস্টেল, জাস্ট শখ।’

‘আপনি কি বুড়ো নাকি?’

—‘কেন বলুন তো?’

—‘শাল গায়ে দিয়েছেন। শীতের নাম নেই।’

—‘আমার চট করে ঠাণ্ডাটা লেগে যায়। আপনি কাশীতে মানুষ। কলকাতাইয়াদের ঠাণ্ডা লাগার ব্যাপারটা বুঝবেন না।’

—‘এই যে বললেন ব্যায়াম করেন!’

—‘ব্যায়াম করে শরীরটা তৈরি করেছি, গায়ে জোর খুব, প্যাঁচ-ট্যাঁচও জানা আছে বেশ, কিন্তু ঠাণ্ডাটা সহ্য করতে পারি না। গঙ্গোত্রী যেতে গিয়ে, শুনলে হাসবেন, উত্তরকাশী থেকে ফিরে এসেছি।’

—‘ইস্‌ স্‌ স্‌! কী যে হারিয়েছেন জানেন না।’

—‘জানি, উপায় নেই। আপার হিমালয়ের সব কিছুই ফিলমের মারফত দেখতে হবে— এই আর কি। তা আপনি এরকম হুট করে বেরিয়ে এলেন শান্তা বউঠান ভাববেন না?’

এষা বলল— ‘আপনার বয়স কত? আমার চব্বিশ পার হয়ে পঁচিশ চলছে।’

—‘কিসের উত্তরে কী বলছেন।’ সম্বিৎ হেসে ফেলল।

এষা হেসে ফেলল এক ঝলক। বলল–‘বলুনই না। আপনি তো আর মেয়ে নন! আমি দেখুন মেয়ে হয়েও বলে দিলুম।’

সম্বিৎ হাসতে হাসতে বলল—‘একত্রিশ।’

—‘তবে?’

—‘মানে?’

—‘তবে দিদি ভাববে কেন? আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ, সো ক্যান য়ু। আসুন হোটেলের সীমানা এবার পেরিয়ে গেছে, স্নানার্থী আর পুণ্যার্থীরা দূরে, বীচটা পরিষ্কার, একটু বসা যাক।’

—‘বসবেন?’ একটু ইতস্তত করে সম্বিৎ বলল।

এষা হাসল, দাঁতের ঝিলিক দিল, ডানদিকে একটা গজদাঁত, উড়ন্ত চুল সরাতে সরাতে বলল— ‘গতকাল মনোজিৎকে নিয়ে বেরিয়েছিলুম, আপনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন, তার আগের দিন মিলুকে। প্রথম ভোর দেখেছি গোস্বামীদা আর আমি। পারিনি এখনও রবিদা আর দিদিকে। একটু থেমে এষা মুখ সমুদ্রের দিকে ফেরাল, বলল— ‘আমি প্রত্যেকের বন্ধু। আলাদা আলাদা করে। হট্টগোলে যোগ দিতে পারি না। আপনার সঙ্কোচের কারণ নেই।’

সম্বিৎ খুব লজ্জা পেল। কিছু একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করল। মুখ ফুটল না। পকেট থেকে রুমাল বার করে বিছিয়ে দিল এষার বসার জন্য। এষা সেটা সরিয়ে দিয়ে বালির ওপর বসে পড়ে বলল— ‘আপনি শুচিতা রক্ষা করুন। আমি এই বালির কোলেই বসি।’

ভোরের আলোয় আলোকিত মুখ মেয়েটির। না তাকিয়েও বুঝতে পারা যায়। চোখের পল্লব জলকণায় ভিজে স্নিগ্ধ হয়ে গেছে। ঠোঁটে নিশ্চয় নোনতা স্বাদ। কুয়াশার আড়ালে যেমন সূর্য, হালকা মাদ্রাজি শাড়ির অন্তরালে তেমনি এষা। এবং সেই এষার ভেতরেও আরেক এষা বাস করে। হঠাৎ সেই তৃতীয় এষাকে দেখবার জন্য সম্বিৎ একটা তীব্র কৌতূহল অনুভব করল।

এক ঝাঁক সমুদ্দুরের কাক উড়ে যাচ্ছে। নিচু হয়ে ঢেউয়ের মাথায় ছোঁ মারতে মারতে। ঠোঁটে মাছ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ওদের এইসব অপূর্ব সুন্দর ওড়াউড়ি, ডাইভ খাওয়া, এসবই যে শিকার সংগ্রহের মতো একটা নিষ্ঠুর গদ্যময় কর্মের জন্যে কে বুঝবে? ধরনধারণ দেখলে মনে হয় কোনও মহৎ ব্যালে-শিল্পী সী-গালদের নানারকম ভঙ্গি শেখাচ্ছেন, ওরাও শিখছে অতন্দ্র মনোযোগে। তিন চারটে নৌকা পাড়ে এসে ভিড়ল। নৌকাগুলোকে বালিসই করে, আকাশে কালো কালো বল্লম-হাত তুলে ওরা যেন কী বলাবলি করছে।

এষা বলল— ‘আপনি কিভাবে সময় কাটান? অফিসের কাজের বাইরে?’

সম্বিৎ হেসে বলল— ‘আপনি তো জানেন, ঘুমিয়ে।’

এষা বলল— ‘আমি সীরিয়াসলি বলছি।’

—‘সত্যি কথাই বলছি। ওষুধ-ফষুধ খেয়ে ঘুমোই। আর কিছু ভাল লাগে না।’

—‘আপনি আমাদের ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স’-এ যোগ দিন না।’

—‘সেটা কী ব্যাপার? ক্রিশ্চান-ট্রিশ্চান না কি?’

—‘উঁহু। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দিন গেছে, ওরা আর নতুন পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। সেইজন্যেই চতুর্দিকে ওদের এত লম্ফঝম্প। আমাদেরটা সমাজসেবামূলক একটা প্রতিষ্ঠান। কাজ-কর্ম খুব ইন্টারেস্টিং। নাচ, গান, নাটক, অন্যান্য শিল্প⋯এসবেরও স্থান আছে। সবটাই কুষ্ঠরোগীর ব্যান্ডেজ বাঁধা নয়।’

সম্বিৎ হেসে ফেলল, বলল—‘আপনার বুঝি মনে হল সমাজসেবার সঙ্গে কুষ্ঠরোগীটা আমি সঙ্গে সঙ্গে ইকোয়েট করে ফেলব!’

—‘শুধু আপনি নয়। সকলেই করে। উই অ্যাক্ট অ্যাজ ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স টু এভরিবডি। আপনি যদি রাজি থাকেন আমাদের রিজিওন্যাল সেক্রেটারির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করিয়ে দেবো। প্রতিষ্ঠানের হয়ে একটা সার্ভের কাজে আমি কলকাতা এসেছি। কলকাতায় আমাদের বেস এখনও ভালো করে তৈরি হয়নি। ফিরে গিয়েই আগে আমায় একটা বাড়ি খুঁজতে হবে, কলকাতা ব্রাঞ্চের জন্য। আসুন না। এই কাজে আমায় সাহায্য করুন। মানুষের সেবার কাজ যে কত বিচিত্র হতে পারে আপনার ধারণা নেই।’

সম্বিৎ দূরের দিকে চেয়ে বলল—‘কী হবে?’

আহত গলায় এষা বলল— ‘মানে?’

—‘দেখুন এষা, জীবনের অঙ্কে কোথাও একটা জিরোর গোলমাল আছে। শূন্য দিয়ে যে সংখ্যাকেই গুণ করুন না কেন, শূন্যই পাবেন।’

—‘ভাগ করলে কিন্তু ইনফিনিটি। আমরা ভাগের অঙ্কটা কষি সম্বিৎ। দুঃখ ভাগ, হতাশা ভাগ, শ্ৰম ভাগ, সম্পদ ভাগ এবং ভাগফল অপরিসীম আনন্দ। ইঁট ইজ টোয়াইস ব্লেস্ট, ইট ব্লেসেথ হিম দ্যাট‌ গিভ্‌স্‌ অ্যান্ড হিম দ্যাট টেকস। কাজে না নামলে বুঝতে পারবেন না⋯’ বলতে বলতে এষা উঠে দাঁড়াল। শাড়ি থেকে বালি ঝেড়ে ফেলে বলল—‘কপালে রোদ লাগছে বড্ড, চলুন ফেরা যাক।’

এরা উঠছে। ওরা স্নান করতে নেমে আসছে। মনা, মিলু, শান্তা, গোস্বামী, রবি। মনা রবিকে পেছন থেকে টেনে ধরল, ফিসফিস করে বলল— ‘কি রে লেগে গেল মনে হচ্ছে।’ রবি মুখ দিয়ে একটা চুকচুক আওয়াজ করল, মনা বলল- ‘ওটা কার জন্য করলি?’

—‘তোর জন্য, আর কার?’ মুখের দুপাশে হাত জড়ো করে মনোজিৎ চেঁচিয়ে বলল— ‘আমরা নামছি। তোরা আয় শীগগীরই। সম্বিৎ-ৎ। এষা-আ। একটা এক্সট্রা তোয়ালে আনিস-স্‌!’ বলতে বলতে মনা ধাঁই করে লাফ মারল। বউদি বলল— ‘এই মনা, তুই খামোখা ডিগবাজি খাচ্ছিস কেন রে?’

—‘ব্রেকার এলে লাফিয়ে উঠতে হয় বউদি, জানো না?’

—‘ব্রেকার কই? এতো জাস্ট ভিজে বালি?’

—‘আরে বাবা ; ব্রেকার-ভাঙার রিদ্‌ম্‌ হিসেব করে নিয়েছি। লাফ⋯ ডুব⋯ লাফ⋯ ডুব। সম্বিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যদি ব্রেকার আমায় পেড়ে ফেলে?’

মিলু বলল— ‘তুমি আর ভাঁড়ামি করো না মনাদা, যা শুরু করেছ এরপর রসগোল্লার ভাঁড় ভেবে সবাই তোমার মাথায় চাঁটি মারতে থাকবে।’

হাত-পা ছেড়ে কথা বলতে বলতে মিলু শাঁ করে সমুদ্রের কোলের ভেতর চলে গেল। গোস্বামী ততক্ষণে লাইফ-বেল্ট নিয়ে অনেক দূর। মনা বলল— ‘ধর ধর রবে, তোর বউ গেল’, মিলুকে ঢেউ তখন দুতিন গজ দূরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ফিরে গেছে। শান্তা বউদি মাথায় রবার-ক্যাপ এঁটে লুটোপুটি খাচ্ছিলেন, বললেন— ‘কি সুখেই যে তোরা সমুদ্রে চান করিস, বালির ঝাপটা খেতে খেতে প্রাণ গেল।’

মিলু বলল— ‘পাড়ের ওপর সিন্ধুঘোটকের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলে সমুদ্রের হাতে ওইরকম বালির থাপ্পড়ই খেতে হবে। এগিয়ে চলো।’ রবি একদিক থেকে মনোজিৎ অন্যদিক থেকে বউদির হাত ধরে প্রবল টানাটানি করতে শান্তা বললেন— ‘বাপ রে, তোদের মুকুলদাই বলে আমাকে নিয়ে যেতে পারল না, আর তোরা—সেদিনের ছেলে এসেছিস আমাকে জলে নামাতে?’

বিশাল আয়তনের একটা ঢেউ হুড়মুড় করে মাথার ওপর ভেঙে পড়ল তক্ষুনি। জল সরে যেতে হাঁসফাঁস করতে করতে চারজনে সমুদ্রের চড়াই-উৎরাই ভাঙছে, মিলু বলল ‘কি বউদি এবার?’ নাকের জলে চোখের জলে এক করে, হাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে বউদি বললেন—‘এত বড় সমুদ্দুর নিজে এসে পাকড়াও করলে শান্তা রক্ষিত আর কি করে বল?’

মনোজিৎ দেখল হাঁসের পাখার মতো হালকা, চকচকে শাদা শার্ট পরে প্যান্টের পা গুটিয়ে, এষা টান মেরে সম্বিৎকে জলে নামাচ্ছে। এক মাথা ধূমল চুল প্রচণ্ড উড়ছে, এষার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মিলু খুশীতে হাততালি দিয়ে উঠল। সম্বিৎ চান করতে আসেনি, ঘুমোতে এসেছিল, তাই একমাত্র সম্বল জীন্‌স্‌ পরেই, আঁটো মেরুন টী-শার্ট গায়ে অনিচ্ছুক মুখে এষাকে অনুসরণ করছে।

ঢেউয়ের মাথায় চড়ে এগিয়ে যাচ্ছে এষা, যেন জন্মান্তর থেকে সাগরের কোলে মানুষ।

অবশেষে যতই স্মার্ট হোক, মস্ত ব্রেকারের হাতে অনভিজ্ঞ নাজেহাল হতে হতে এক সময়ে সমুদ্রের ইচ্ছায় পোল ভল্ট খেল, তখন স্ফীত, মাস্‌ল, হাত পা থাকলে সক্রিয় হতেই হয়। সবুজ জলের তলায় ভারহীন মানুষটিকে দু হাতে সংগ্রহ করে সোজা করে দেয় সম্বিৎ। গর্জনের ওপর গলা তুলে, সংক্ষিপ্ত ‘নো-হাউ’ দেয়। এবং আস্তে আস্তে সিন্ধুর বিপুল পেশীময় বিস্ফারিত বক্ষের নিষ্পেষণে দলিত, মথিত হতে হতে, গাত্রত্বকেরও যেন অভ্যন্তরে জলের তরল আদর খেতে খেতে কুমারীর শামলা মুখে অকস্মাৎ আলতো লালের ছোঁয়াচ লাগে ; শীতের হাওয়ায়, নরম রোদ-ওলা লহরীশীর্ষে সে ছবি অন্যরকমের সুন্দর, সেজান-এর পাইন গাছদের মতো। ঢেউয়েদের মাঝখানে সন্তরণরত সম্বিতের অনুভব হয় খুব অন্তরঙ্গ, আশ্লেষকামী নারী তাঁর ঠোঁটের কাছে, বুকের কাছে, কোলের কাছে থরথর করে কাঁপছে। রোমকূপে স্পন্দিত হয় বিদ্যুৎ-জিহ্ব নতুন জীবন। বিপুল আবেগে সিন্ধুর বুকে বুক রেখে ঢেউয়ের তলায় আকাঙক্ষার শঙ্খধ্বনি অনেক দিন পর চিৎকৃত হতে শুনে তড়িৎস্পৃষ্ট দেহে সম্বিৎ গায়ত্রী উচ্চারণের মতো করে বলে—‘হে সমুদ্র, তোমাকে অগ্রে রাখলাম, তুমি আমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হও, শুষ্কতোয়া শরীরের নদীতে উচ্ছ্রিত করো জীবনরস, অনন্তকারুণিক হে বরুণ, হে পসাইডন, তুমি আমার হৃত সম্পদ ফিরিয়ে দিলে, আমাকে আবার জাগিয়েই দিলে! আমিও তবে প্রবাহিতই হবো! আকাশ ছাড়িয়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে, কী বিপুল মহিমায় আমি দাঁড়িয়ে আছি!’

সৈকত

পেছনে চাঁদ। সামনে এখন দিগন্ত পর্যন্ত তরল কালি, আকাশে অবধি ছিটকে উঠেছে। তারপর তারার আকাশ। স্পন্দমান। সৈকতময় টুরিস্ট। খালিপায়ে বালুবেলায় বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে দলে দলে। দপদপ করে মশাল জ্বলছে হকারের ঝুড়িতে, শাঁখ বাজছে। কফি হেঁকে যাচ্ছে। ডেকচির ওপর ডেকচি বসিয়ে কাঁধে বাঁক, কাঁধে পাথরের চাকি, চন্দনপিড়ি, শঙ্খের মালা, চাবির রিং নিন না, চাবির রিং, বন্ধুবান্ধবকে দিতে, এই যে পুরীর মন্দির⋯ লিঙ্গরাজ টেম্পল⋯ কোনারক⋯ সব আসল কুচিলা পাথরের নির্মাণ⋯ লিবেন, লিন

সম্বিৎ বলল— ‘আপনি আমার ইতিহাস জেনে বলছেন তো এষা।’

—‘জানি আপনার একটা ডিভোর্স হয়েছে, এতে এত ভেঙে পড়বার কী আছে? কী এলো গেলো তাতে? বাইরে থেকে মিলিয়ে দিলে হৃদয়ের জোড় সব সময়ে মেলে না— এ তথ্য আমি জানি।’

—‘আপনি কিছুই জানেন না। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই শুধু বাইরের ঘটনা জানে। ঘটনার পূর্বাপর অভিজ্ঞতা আমার একলার।’

—‘বেশ তো শুনবো, তবে তাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে কোনও পরিবর্তন হবে।’

—‘ইন স্পাইট অফ মাই পাস্ট হিসট্রি সম্মত হচ্ছেন তাহলে?’

—‘হচ্ছি। এতে এত আশ্চর্য হবার কি আছে? আমার আপনাকে ভীষণ ভালো লেগে গেছে। প্রস্তাবটা আপনার দিক থেকে না এলে আমাকেই করতে হত।’

কথা শুনে সম্বিতের পেট থেকে গলা পর্যন্ত শিউরে উঠল। বালির ওপর এষার হাত। তার ওপর ওর। ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে। ঘাম দিচ্ছে হাতের পাতায়। আলতো করে মুঠোর মধ্যে নিয়ে আবার ছেড়ে দিয়ে সম্বিৎ বলল— ‘সত্যি!’

—‘সত্যি বলছি। আচ্ছা, আপনি হার্মিসকে চেনেন?’

হেসে সম্বিৎ বলল —‘হার্মিস কে? সেই গ্রীক যুদ্ধের দেবতা? আপনি এমন অসংবদ্ধ কথা বলেন!’

—‘এই তো চেনেন। বীরপুরুষ, কিন্তু ঠিক যুদ্ধের দেবতা নয়। হার্মিসের মূর্তি কিছু কিছু পাওয়া যায়। অ্যাপলোর মতো অত পূজা পাননি। তবুও হার্মিস আমার ধ্যানের দেবতা।’ একটু লাজুক হেসে এষা বলল— ‘আপনার সঙ্গে মিল আছে। কন্যা বরয়তে রূপম। জানেন তো?’ তবে আসল কথা কি জানেন, অনেক আচরণই ভেতরটাকে প্রকাশ করে দেয়। ডিভোর্স করার পরও আপনি এত বিষণ্ণ থাকেন! জীবনের প্রত্যেকটি ইস্যুকে বোধ হয় এমনি করেই যথেষ্ট মূল্য দিয়ে থাকেন। ⋯আমাদের প্রতিষ্ঠানেও কেউ কেউ আছে যারা কতকটা আপনার মতো, কিন্তু তারা ভাইয়ের মতো করে আমায় টানে। আপনি..’ এষা আর বলতে পারল না।

আবেগবিপন্ন সম্বিৎ শান্তা বউঠানকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকল— ‘বউঠান, এদিকে। মিলু, রবি, গোস্বামী—ই—ই।’

ওরা সবাই মন্দিরে গিয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় কাছের দর্শন বছরে দু মাস। সম্বিৎ যায়নি। তাকে ওরা তুলতে পারে নি আদৌ। এষা গেছে তিনবার। জগমোহন থেকে জগন্নাথ দর্শন করে এসেছে। মন্দির দেখেছে আদ্যোপান্ত। মূল থেকে বাইশ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত প্লাস্টার খুঁড়ে খুঁড়ে ভেতরের অপূর্ব কারুকার্য এবং খোদাই মূর্তি সব বার হয়েছে। উত্তরের দরজা দিয়ে ঢুকে দেয়ালে ধর্মচক্র মুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি দেখে ভীষণ উত্তেজিত। চৈনিক ড্রাগন এবং বুদ্ধমূর্তি দুই-ই ওর কাছে সমান রোমাঞ্চকর, ঐতিহাসিক দিক থেকে। চন্দ্রভাগার তীরবর্তী শাম্বপূজিত রবিনারায়ণ যিনি ভগ্ননাসিক হয়ে এখন অষ্টধাতুর সূর্য মূর্তির পেছনে লুকিয়ে রয়েছেন, তাঁকেও দেখে এসেছে এষা পাণ্ডাদের কাকুতি-মিনতি করে।

সম্বিতের ডাক ক্ষীণ হতে হতে ওদের কানে পৌঁছে গেল শেষে। বালির ওপর দিয়ে অদ্ভুত এক ভগ্নজানু ভঙ্গিতে দৌড়ে এসে মিলু এষার পাশে বসে পড়ল।

—‘কি ভাগ্যিস যাসনি এষা, বাপ রে! অন্তত দশ লাখ লোক। আমার শাড়ির কুঁচি খুলে গিয়েছিল। কী ঘেমেছি, দ্যাখ— এখনও শুকোয়নি। একেবারে রেড়ির তেলের মতো।’

মনোজিৎ ধুপ করে বসে পড়ে বলল— ‘সমুদ্রের ব্রেকার কিছুই না রে সম্বিৎ। মানুষের ঢেউ যদি দেখতিস! ওরে বাবা। গোস্বামী প্রভু তো বেরিয়েই “বার”-এ চলে গেল।’

রবি বলল— ‘জন্মের শোধ জগন্নাথ দর্শন হয়ে গেল বাবা। আর আমি ওদিক মাড়াচ্ছি না। এত লোকের বউ থাকতে আমার বউয়ের বস্ত্রহরণ!’

শান্তা বউদি বললেন—‘যেমন আমার কথা না শোনা। তিন শো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে তিন শো দিন চুড়িদার পরে ঘোরে যে মেয়ে সে কেন লাখ লোকের ভিড়ে ফসফসে সিনথিটিক শাড়ি সামলাতে পারবে? আমিও তো ছিলুম বাবা। আমার তো কই পাট পর্যন্ত ফসকায়নি।’

—‘সত্যি কী ভুল করেছি!’ মিলু বলল, ‘আমি ভেবেছিলুম পুজো-টুজোর ব্যাপার তো, সিল্‌ক‌ জাতীয় কিছু, তা ছাড়া শাড়িই পরা উচিত! জানেন সম্বিৎদা আমি আজ স্ট্যামপিড্‌-এ মারা পড়তুম। কুঁচি খুলে যেতেই ককিয়ে কেঁদে উঠেছি। পাণ্ডাটা এক ধমক দিয়ে আমার কুঁচি তুলে দিল, দু হাত বেড়ে আগলাতে আগলাতে নিয়ে চলল। তার শক্তি যদি আপনি দেখতেন! আমার তো ওখানেই বিশ্বরূপ দর্শন হল।’

মনা বলল— ‘কম্মো সারল রে, রবে! তোর একমাত্তর বউ ভগবানদাস বড়ু মহাপাত্তরের প্রেমে পড়ে গেল।’

মিলু বলল—‘গেছিই তো। এখন বুঝতে পারছি পঞ্চ স্বামী থাকতেও কেন দ্রৌপদী বারবার কৃষ্ণকে ডাকাডাকি করতেন। ডিপেন্ড করতে পারা চাই! আপনার বন্ধু তো চোখ কপালে তুলে নিজেই ভিরমি যাচ্ছিল।’

সন্ধ্যা আরও গাঢ় হলে ওরা ফিরছিল। এষা সবচেয়ে সামনে দিদির সঙ্গে। চাঁদ প্রায় মাথার ওপর। চুলে পড়ে মাথাগুলো সব রূপোলি। এষার সোজা ঝাঁকড়া চুলে, মিলুর বেণীতে, শান্তা বউঠানের আলগা খোঁপায়। সম্বিৎ কেন কে জানে এই জ্যোৎস্নায়-রূপোলি-চুল নারীদের দিকে তাকিয়ে একটা অলৌকিক অনুভূতিতে পাথর হয়ে যাচ্ছিল। কী অপার্থিব! ওরা সত্যিই মানুষ তো! না এইমাত্র সব সমুদ্র থেকে উঠে এলো? সমুদ্রের প্রত্যেকটি ঢেউ কি একটি করে আফ্রোদিতের জন্ম দিচ্ছে? প্রতিদিন? জাত হয়েই অলৌকিক শরীরিণী সেই সব আফ্রোদিতে বাতাসে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে? সদ্য কিশোরীদের রোমরন্ধ্র দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাসা নিচ্ছে নাকি বাষ্পবাহিনীরা?

মনা বলল—‘কী হল? চল্।’

সম্বিৎ বলল—‘তোরা এগো। আমি আর একটু পরে যাচ্ছি।’

—‘খাবার ঘণ্টা আরম্ভ হয়ে গেছে কিন্তু। জায়গা পাবি না এরপর।’

—‘তোরা খেয়ে নে। আমি পরে।’

—‘এষাটা তোকে কী জ্ঞান দিচ্ছিল রে! আমাকে তো একেবারে ধোপার গাধা বানিয়ে দিয়েছে জ্ঞান বোঝাই করে করে।’

সম্বিৎ অন্ধকারে হাসল।

মনা বলল— ‘ওর গলায় “গঙ্গা বইছ কেন” শুনেছিস? দারুণ গায়। গলার জোর কি! আর একটা কি “বাঢ়ে চলো, বাঢ়ে চলো” শোনালো। চমৎকার! তোকে শুনিয়েছে না কি?’

সম্বিৎ বলল—‘না।’

—‘মেয়েরা এত সুগন্ধ, এত সুর, এত যাদু কোত্থেকে পায় বল তো? বিয়ে-টিয়ের পরেও এগুলো থাকে?’ যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল মনা।

সম্বিৎ উত্তর দিল না। দেবে না বলে নয়। তার নিজেরও ওই এক প্রশ্ন, আরেকজন করল বলে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে। যদিও প্রশ্নের দ্বিতীয় পর্বটার উত্তর তার দিতে পারার কথা, সে খানিকটা বিমূঢ় হয়ে ভাবল সত্যিই কি সে জানে?

কোণার্ক

প্রস্তাবটা স্বভাবতই ছিল এষার। কেন না, আড্ডা জমিয়ে রাখবার মজলিশি স্বভাব মনার, গোস্বামী যেখানেই যাক তার আনন্দের উপকরণ বদলায় না, মিলু শুধু বর্তমানটাকে উপভোগ করতে এত ব্যস্ত যে পরের দিনের চিন্তাও তার নেই। রবির পরিকল্পনা ট্যুরিস্ট গাইডকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে। আর শান্তা বউদিকে শুধু জানিয়ে দিতে হবে কোথায়⋯কবে। ঘরকন্নাটা একাই সামলে নিতে পারবেন। ওদিকে সম্বিৎ একদম শিব, সুতরাং শব হয়ে আছে। এষা যেটুকু প্রাণসঞ্চার করেছে তা একেবারেই নির্জনচারী। দলের সাক্ষাতে একেবারে নিষ্ক্রিয়। কল্পনাশক্তি, বিস্ময়বোধ, অ্যাডভেঞ্চার প্রবণতা এষারই। কনডাকটেড ট্যুর-এ কোণার্ক, ধৌলি, লিঙ্গরাজ মন্দির, মুক্তেশ্বর সব দেখে এসে ধূলিধূসরিত হয়ে ফিরছে ওরা, মিলু আর রবি বাঘেদের দুর্ধর্ষ প্রণয় কাহিনী যা নন্দনকাননে গাইড ভদ্রলোকের মুখে শুনে এসেছে, তার আলোচনাতেই মশগুল। কানন বলে এক বন্য বাঘিনী নাকি নন্দনকাননের প্রথম বাঘ প্রদীপের ফেরোমনের গন্ধে গন্ধে এক রাতে এসে হাজির হয় এবং ষোলো না কত ফুট ওপর থেকে ঝাঁপ খায় প্রদীপের কাছে পৌঁছবার জন্যে। কিন্তু হায়, প্রদীপ তাকে প্রত্যাখ্যান করে। অতঃপর কাননকে ভিন্ন সংরক্ষণীতে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সে পাগলিনী হয়ে যায়। মিলু বেচারি বাঘেদের এই করুণ কাহিনী শুনে করুণায় একেবারে আপ্লুত হয়ে গেছে। এষা বলল- ‘পূর্ণিমায় তাজমহল দেখেছ মিলু?’ কোথায় বাঘ আর কোথায় তাজমহল!

মিলু ঘাবড়ে গিয়ে বলল— ‘না, পূর্ণিমায় না, তুই কাঁচা সিমেন্টের ওপর কাননের পায়ের ছাপটা দেখেছিলি? একেবারে পস্ট, না?’

মনা বলল— ‘ওটাও ওরা তুলে রেখে দিলে পারে, ছোটখাটো মন্দিরে-টন্দিরে, লোকে প্রণামী দেবে, পুজো দেবে।’

এষা বলল— ‘পূর্ণিমায় কোণার্ক দেখি চলুন, সরকারি পান্থশালা রয়েছে সামনেই।’

গোস্বামী বলল— ‘দারুণ জম্‌বে‌, এষাটার আইডিয়া আছে। মনা তুই একবার ‘অ্যারিস্টোক্র্যাট’-এ ঘুরে আয়, নতুন কিছু যদি মেলে।’

এষা রাগ করে বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

সেই কোণার্কের রাত। অর্কক্ষেত্র কোণার্ক। সেই মন্দির যা শেষ হওয়ামাত্র পরিত্যক্ত। যেখানে দেবতা কোন দিন পূজিত হলেন না। বাংলোর লন থেকে দেখা যায় কৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত ইংরেজদের ব্ল্যাক প্যাগোডা। মাথার সোনার কলসটা হাপিস করে, চুম্বকের গল্প বানিয়েছে। লনে বসে মাত্র দুজন। রবি, মনা আর গোস্বামী আবারও ভ্যাট সিক্সটি নাইনের বোতল খুলে বসেছে ঘরে। শান্তা বউদি ঘুমোতে চলে গেছেন। মিলুও ছেলেগুলোর সঙ্গে হুল্লোড় করছে। মনা ঠিকই বলে, রবিকে ও এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে পারে না। দূরে সূর্যের রথ, ভগ্নাশ্ব, ভগ্নচক্র ; যেন সূর্য নয় সূর্যপুত্রেরই রথ, অন্তিম মুহূর্তে মাটিতে বসে গেছে।

বেতের চেয়ারের ভেতর থেকে গাঢ় গলায় সম্বিৎ বলল, ‘এদের কোনও সেনস্ নেই, এমন চাঁদের আলো, এখনও বিজলী জ্বালিয়ে রেখেছে।’

এষা কথা বলল না। মিনিট দশেকের মধ্যে হঠাৎ মন্দির চত্বরের আলো নিবে গেল, রাস্তারও। সঙ্গে সঙ্গে ভোর। ভোর না সন্ধে এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে যেন আকাশ থেকে অর্ধস্বচ্ছ রহস্যের মসলিন নেমে এলো। চরাচর-ঢাকা কুহকে পূজাপ্রাপ্তিহীন, ক্ষুধিত মন্দির দেখা-না-দেখায়-মেশা এক গন্ধর্বপুরীর মতো দূরে, মন্দির গাত্রের তাবৎ অপ্সরী-কিন্নরী এবার অনায়াসেই শুরু করতে পারে অসমাপ্ত সেই সঙ্গীতসভা যা ভাস্করের ছেনি-বাটালির শব্দে চকিত হয়ে একদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

নির্জনতা, শব্দহীন যেন তার প্রবল অর্থময় অস্তিত্ব টের পাইয়ে দিচ্ছিল। দুজনেই চুপ। গলায় সামান্যতম আওয়াজেও বুঝি রাতের সুর কেটে যাবে। এই সব রাতে মানুষ খুব সন্তর্পণে নিজেকে গোপন করে স্তরান্তরের জীবন বুঝি দেখে নিতে পারে। হঠাৎ কোথায় ঝনঝন করে একরাশি কাচের চুড়ি ভাঙল। ভয়চকিত যক্ষী তার বিশাল বক্ষে ঝল্লরী নিয়ে পলকে ফিরে গেল মন্দির চূড়ায়। পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিণীরা যে যার দিব্যমুহূর্তে স্থির। ভগ্নহস্ত অশ্বারোহী সূর্যদেবের নীলবর্ণ মুখ মলিন, বিষন্ন। সুর কেটে গেছে। ঝনঝন করে তার ছিঁড়ে গেছে, তার বিপুল বেদনায় টনটন করছে রাতের বুক। বারান্দার শেষপ্রান্তের ঘর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এলো এক রমণী। যেন সহস্র আরব্য রজনীর এক রাত থেকে। অন্ধকারে চমকাচ্ছে ঘাগরার জরি, কাঁচুলির কাচখণ্ড, কালো ওড়নার চুমকি উড়ছে শতাধিক জোনাকির মতো, স্পষ্টই কোনও ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। বাঁধভাঙা বন্যার হাসি। পেছন পেছন রাত পোশাক পরা এক বিপুলকায় মধ্যবয়স্ক। হাসতে হাসতে রমণী পা ফেলছিল যেন তার সংজ্ঞা পুরোপুরি নেই। অর্ধোন্মাদ।

টলতে টলতে এগিয়ে এলো ‘ওই তো⋯ওই তো তোমার সাকি⋯’ বলতে বলতে আরব্যরজনীর সেই পরীবানু স্খলিত ভঙ্গিতে বসে পড়ল, এষার হাত ধরে বলল, ‘চলো না সাকি, চলো না, আমি কি একলা এত রসের যোগান দিতে পারি!’

হঠাৎ সম্বিতের দিকে ফিরল। চোখে আগুন⋯মাতাল রমণী হাতের সুদৃশ্য কাটগ্লাসের পানপাত্রটা সজোরে ছুঁড়ে দিল সম্বিতের কপালে, তারপর পাগলের মতো আক্রমণ করল তাকে। চুল টেনে ছুঁড়ে ফেলল, গায়ের শাল টেনে দলা পাকিয়ে ফেলে দিল, দু হাতের রক্তরঙা নখ মেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুখের ওপর। প্রৌঢ় ভদ্রলোক ছুটে এলেন জোর করে ছাড়িয়ে নিলেন, অ্যালকোহলিক আলগা গলায় বললেন, ‘কুত্তী একটা! কুছু মাইণ্ড করবেন না দাদা। এ শালী হাই হয়ে গিয়েছে বহুত্‌।’ মেয়েটাকে ক্ষ্যাপা কুকুরীর মতো টানতে টানতে অবশেষে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেল লোকটি। তার গলায় অদৃশ্য চেন লনের ওপর লুটোচ্ছিল। শেষদিকে শুধু থুতু ছুঁড়ছিল মেয়েটি। শূন্যে। চারপাশে। মুখে একটা অব্যক্ত গোঙানি। দিগ্‌ভ্রষ্ট‌‌‌ থুতু তার নিজের মুখেই পড়ছিল। বুমেরাং-এর মতো।

দু তিন মিনিটের মধ্যেই এমন একটা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড ঘটে গেল। এষা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তার ক্ষিপ্র স্বাভাবিক সপ্রতিভতাও যেন মার খেয়ে গিয়েছিল। ভদ্রলোক সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলে সে জ্ঞান ফিরে পেল। কোমর থেকে রুমাল টেনে অসীম মমতায় সম্বিতের মুখ মুছিয়ে দিল। আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করে দিল। মৃদুস্বরে বলল, ‘আপনার শার্টের বোতাম পটিটা অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। একটা চেঞ্জ এনেছেন তো?’

সম্বিৎ মাথা হেঁট করে ছিল। মুখ তুলতে এষা দেখল, সে মুখ নখের আঁচড়ে জায়গায় জায়গায় ফালা ফালা এবং মানুষটি আপাদমস্তক কালিমাড়া। এষা বলল, ‘শীগগিরই চলুন, আমার কাছে সব সময় কিছু ফার্স্ট-এড থাকে, আমি এখুনি ঠিক করে দিচ্ছি।’

সম্বিৎ নড়ল না। এষা বলল, ‘ঠিক আছে, ও ঘরে দিদি আছে, মিলুও হয়ত এতক্ষণে এসে গেছে, আমি বরং জিনিসগুলো এখানেই নিয়ে আসছি।’

অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে আঁচড়গুলোর মুখে স্টিকিং প্লাস্টারের পটি আটকে একটু দূর থেকে এষা খুব আস্তে বলল, ‘রাতবিরেতে, মন্দিরের দিকে যাবার চেষ্টা করেছিলেন, হঠাৎ পড়ে গেছেন, তাই তো? অত যদি লজ্জা পান তা হলে এ গল্পটাও চলবে।’ তারপর গলা বদলে বলল, ‘মেয়েটি শুধু মাতাল নয়, ভীষণ দুঃখীও। হতাশার প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, বুঝতে পেরেছিলেন?’

সম্বিৎ যেন ঘুম ভেঙে উঠল, বলল, ‘আপনি কী করে বুঝলেন?’ সম্বিতের মাথায় তখনও এষার হাত, বলল, ‘বোঝাই যে আমার কাজ! না বুঝলে চলবে কি করে?’

—‘এষা, আমি আপনাকে একটা নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ইতিহাস শোনাতে চেয়েছিলুম, মনে আছে?’

—‘হ্যাঁ। আমি শুনতে চাইনি।’

—‘না শুনলে আপন হবেন কি করে?’

—‘বেশ তো। বলবেন এক সময়ে, তাড়া কি?’

—‘এখনই। এইখানে।’

—‘এখনই? এইখানে? বেশ।’

সম্বিতের ইতিবৃত্ত

আমি আদর্শবাদী ছেলে। যেসব আদর্শবাদ পুরনো হয়ে গেছে সন্দেহে লোকে পরিত্যাগ করেছে আমি তাদের পরম আদরে বুকে তুলে নিয়ে তাদের একটা আধুনিক চেহারা দিয়েছিলুম। অর্থাৎ বিবেকানন্দকে মনে মনে অনুসরণ করলেও গেরুয়া পরিনি, কিংবা প্রকাশ্যে রাজযোগ আলোচনা করে কফি হাউস-টাউসকে বিব্রত করিনি কখনও। আদর্শ মেনে চলার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ফ্রি উইল থেকে এসেছিল, বাবা অথবা কোনও শিক্ষক আমার ওপর চাপিয়ে দেননি। কায়, মন এবং বাকসংযমে বিশ্বাস করতুম তাই কোনও প্রলোভনেরই পরোয়া করিনি কোনদিন। এবং যখন অফিসার গ্রেডে যাবার পর বিয়ের কথাবার্তা হল তখন সোজাসুজি বলে দিলুম কন্যার বাবার দেওয়া কন্যাটি ছাড়া আর কিছুই নেব না। বিয়ে হবে শুদ্ধ বৈদিক মতে। পুরোহিত থাকবেন সত্যিকার বেদজ্ঞ এবং অব্রাহ্মণ। জলযোগ ছাড়া খাওয়া-দাওয়াও যেমন হবে না উপহার নেওয়াও তেমনি একেবারে নিষিদ্ধ।

এই সমস্ত শর্তে খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেলেন কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া এক কন্যাপক্ষ। পক্ষ বলতে অবশ্য কেউই নেই। শুধু মা আর মেয়ে। বাবা অনেকদিন গত! কুমিল্লার দিকের কোন জমিদার বংশ। একবস্ত্রে পেট-কাপড়ে কিছু গিনি নিয়ে পালিয়ে আসতে হয় তরুণ স্বামী-স্ত্রীকে, পঞ্চাশের দশকে। দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে সন্তানের জন্ম দেবেন না ভীষ্ম-প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাই একটু গুছিয়ে বসবার পর প্রায় যৌবন পার করে মেয়ে হল। জমিদার বংশের রঙ রূপ যা উত্তরাধিকারসূত্রে তার পাওনা ছিল বিশেষত কোন বৃদ্ধ প্রপিতামহী পর্তুগীজ হওয়ায়, দেখা গেল তা সে পুরোপুরি আদায় করে নিয়েছে। বাবা বেশি দিন রইলেন না। কাজেই স্কুল-ফাইন্যালের বেশি আর লেখাপড়া শেখাতে পারলেন না মা। গিনি ভেঙে ভেঙে মা-মেয়ের চলছে।

বাবা সব দেখেশুনে বললেন, ‘খোকন, মেয়ে সবার খুব পছন্দই হয়েছে। তবে ভেবেচিন্তে কথা দাও। যাদবপুরের ওই ভদ্রাসনটুকু বাদে এঁদের কিছু নেই, কেউ নেই। কাকাটিও নিজের নয়, জ্ঞাতি। শাশুড়ির ভার স্কন্ধে চাপতে পারে।’

মা তখন রূপে, নম্রতায়, সৌজন্যে মুগ্ধ। বললেন, ‘নিতে হলে নেবে। মানুষই তো মানুষকে সাহায্য করে, না কী?’

শাশুড়ি কিন্তু বললেন, ‘মনেও করবেন না, আপনার ছেলেটিকে কেড়ে নেবার ইচ্ছা।কর্তা যা রেখে গেছেন, বাকি দিন কটা দিব্যি চলে যাবে, যদি বিয়ের অবান্তর খরচ-খরচা বেঁচে যায়।’

আমি বললুম, বিয়েতে কোনও খরচই কাউকে করতে হবে না। হল ভাড়া করে রিসেপশন হলো। দু পক্ষের লোক একসঙ্গে হাই-টি খেল। ও পক্ষের যাত্রী খুবই কম। তিরিশও পোরেনি। আমার সাট-আট বছরের চাকরিতে যা জমেছিল, তার থেকেই খরচ। বাবা-মা গা ভর্তি অলঙ্কার দিলেন, শাড়ি দিলেন, সকলেই খুব খুশি। আমার মা তার মায়ের মতো। বাবা আপন বাবার মতো ব্যবহার দিলেন, ছোট দু ভাইবোন তারা আমার চেয়ে অনেক ছোট, বউদিকে আনুগত্য দিল, ভক্তি দিল। নরম তুলতুলে বউ। খুবই সুখী হয়েছিলুম। আমার শুধু একটাই খেদ ছিল লেখাপড়ার দিকে ওর একদম ঝোঁক ছিল না। যদিও দিব্যি টুকটাক ইংরেজি বলত, সব বিষয়ে কাজ চালানোর মতো কথাবার্তায় ওর জুড়ি ছিল না। সাজেগোজে একদম রুচিশীলা, আধুনিকা। কিন্তু আমি বেশি ঘনিষ্ঠ বলেই বুঝতে পারতুম সমস্ত বিদ্যেই ওর ওপর-ভাসা। কলেজে ভর্তি করবার কথা তুললেই বলত, ‘দাঁড়াও, দুদিন জিরিয়ে নিই।’

একদিন খুব জোর করলুম, স্কুলের নাম জেনে নিলুম কথায় কথায়। তারপর অফিস থেকে সময় করে দক্ষিণ কলকাতার ওই পুরনো স্কুলে চলে গেলুম। ডুপ্লিকেট ডিপ্লোমার জন্যে দরখাস্ত স্কুল মারফতই দিতে হবে। স্কুলে গত দশ বছরে ওই নামের কোনও মেয়ে ফাইনাল পরীক্ষা দেয়নি। উদভ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলুম। মুখ নীচু করে জানাল পরীক্ষা ও কোনকালেই দেয়নি। ক্লাস এইটের পর মা আর পড়াতে পারেননি। পাছে বিয়ে ভেঙে যায় বলে মিথ্যে বলেছে। খুব অপ্রস্তুত হলুম, রাগও হল। কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখলুম সত্যি ক্লাস এইট পর্যন্ত বিদ্যের মেয়ে, যত সুন্দরই হোক বিয়ে করতে আমি ইতস্তত করলুম। চব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেছে। একটা পাসের সার্টিফিকেটও না থাকলে ফারদার পড়ানো, যা দিনকাল পড়েছে, অসম্ভব।

অগত্যা, ভালো ভালো বই এনে দিয়ে শিক্ষিত করবার চেষ্টা চালালুম। কিছু কিছু মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কোর্সের বই। কিছু ভালো উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ। মন ছিল না। কোনরকমে উলটে-পালটে টপকে টপকে পড়ে ফেরত দিয়ে দিত। রাগ করলে করুণ মুখে বলত, ‘অভ্যেস নেই। কি করি বলো। চেষ্টা করছি তো!’ ওর আসল নেশা ছিল হিন্দি সিনেমার আর গুচ্ছের খরচ করে হোটেলে খাওয়ায়। পুরনো ফিলমগুলো নাকি সব ওর দেখা। বলতুম, ‘এত সিনেমা দেখতে মায়ের পয়সা খরচ করতে পেরেছো আর স্কুল-কলেজের বেলাই ঢুঁ ঢুঁ?’ ভীষণ চঞ্চল ছিল, মজা পেলেই হু হু করে হাসত।

বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারতুম না। রাস্তায় বেরোলেই হুট করে দোকানে ঢুকে যাবে, এটা সেটা কিনে বসবে। একদিন পার্ক স্ট্রিটের এক দোকান থেকে একটা শাড়ি পছন্দ করল— সাড়ে সাত শো টাকা দাম। এমনি বেড়াতে বেড়িয়েছিলুম, ইচ্ছে ছিল ওয়ালডর্ফ থেকে খেয়ে বাড়ি ফিরে যাবো। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়েছিলুম, সেলস্‌ম্যান ডেকে নিয়ে গেল— জিনিস প্যাক করা। অত টাকার নাম-গন্ধও পকেটে ছিল না। ভীষণ অপ্রস্তুত হলুম। বলল—‘পুরুষমানুষ তো মেয়েদের গিফ্‌ট কিনে দেবার জন্যেই ; না কি?’ আর একদিন গড়িয়াহাটের মোড়ে রোল খেল স্টল থেকে, কাবাব খেল, পরক্ষণই টানতে টানতে কোয়ালিটির দিকে নিয়ে চলল। বলল— ‘আচ্ছা মেয়ে তো তুমি! এই খেলে আবার তোমার হোটেলে খাওয়ার নেশা!’ হঠাৎ বলল— ‘দু-তিন দিনেরটা একসঙ্গে খেয়ে নেওয়া যায় না?’ বলেই কী ভেবে একদম চুপ করে গেল। চুপ তো চুপই। ভাবলুম এবার লজ্জা পেয়েছে।

এমনি করেই চলছিল। যখন তখন রাজ্যের শখের জিনিস কিনছে, আবার মায়ের কাছে এমন আদর কাড়ছে, ভাইবোনের কাছে বাবার কাছে এমন লক্ষ্মী বউদি, লক্ষ্মী মেয়ে যে মা পর্যন্ত বললেন—‘তোর দরকার হলে বাবার কাছ থেকে টাকা নিস খোকন, ওর অনেক সাধ বোধ হয় মেটেনি।’ দুম করে একদিন বলল— ‘আমায় কিছু হাত খরচ দিতে হবে।’ বললুম ‘কত বলো!’— ‘এই সাত শো, আট শো, হাজার!’ আমি অবাক এবং আহত হয়ে বললুম— ‘বলছ কি? এত টাকা তোমার হাত-খরচ দিতে হলে আমি সংসারে দেবো কি? এত টাকা তোমার দরকারই বা কিসের?’ চুপ করে গেল। আমার কেমন খটকা লেগে গেল। যাদবপুরে ওদের ছোট্ট বাড়ি সাজানো যেন ছবির মতো। মা মেয়ে দুজনেরই আকৃতি যেন সত্যিকার অবসরভোগী ক্লাস। এত টাকা হাত-খরচের কথা অভাবী ঘরের মেয়ে চিন্তা করে কী করে? কোথাও যেন একটা অঙ্কের গোলমাল আছে। আমার মনে সাঙ্ঘাতিক অশান্তি। তারপর একটা ঘটনা ঘটল, তাইতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলুম— হঠাৎ-ই। মা একদিন বললেন ‘বউমা দশগাছি চুড়ি খুলে রেখে বালা পরে ঘুরছে ক’দিনই দেখছি। খোকন, কিছু মনে যদি না করিস, জিজ্ঞেস করিস তো একটু।’ মায়ের ভুরুর ওপর ভাঁজ, চোখে সংশয় এবং সংশয়ের লজ্জা। জিজ্ঞেস করলুম, বলল—‘খুলে রেখেছি। এক জিনিস পরে থাকতে ভালো লাগে না। তা ছাড়া ভীষণ ভারী।’

মায়ের সংশয় তখন আমাকেও আক্রমণ করেছে, বললুম—‘কোথায়?’

—‘আলমারিতে।’

আলমারি তন্ন তন্ন করেও চুড়ি পাওয়া গেল না। তেরিয়া হয়ে বলল—‘তুমি পুরুষমানুষ, তোমার অত গয়নার খোঁজে দরকার কি?’ বললুম— ‘দরকার হত না। কিন্তু চুড়িগুলো আমার মায়ের নিজের হাতের জিনিস। অত সোনা আজকালকার দিনে রীতিমত ধনী না হলে কেউ করাতে পারে না। মা আদর করে তোমায় দিয়েছেন। কিন্তু তোমার যা উড়নচণ্ডী স্বভাব!’

তখনই দুম করে বলল—‘বিক্রি করেছি। উপহারের জিনিস আমার নিজের, খুশি হয়েছে বেচে দিয়েছি।’ প্রচণ্ড রাগ উঠে গেল। সেই ক্রোধের চেহারা দেখে সত্যি কথা বেরিয়ে এলো। বিক্রি করে টাকাটা নিজের মাকে দিয়েছে। মায়ের অবস্থা এখন খুব খারাপ। সঞ্চয় তলানির দিকে, তারপর নানা রকম রোগের বাসা শরীর। চিকিৎসার খরচও অনেক।

স্তম্ভিত হয়ে বললুম—‘তুমি আমায় বললে না কেন?’

—‘হাত খরচের টাকা চেয়েছিলুম তো।’

—‘তুমি বলতে পারতে মাকে আমার দেখাশোনা করতে হবে।’

—‘মোহর ভেঙে বাকি দিন চলে যাবে বড় মুখ করে মা বলে দিয়েছে, এত তাড়াতাড়ি কি করে জামাইয়ের অন্নভোগী হবে?’

—‘অন্নভোগী হবার লজ্জা কি চুবির লজ্জার চেয়েও বড়?’

হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলল। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ধার করে মায়ের হাতের চুড়ি অবিকল সেই রকম গড়িয়ে দিলুম, মার হাতে দিয়ে বললুম—‘তোমার কাছে রাখো মা।’

মা বললেন—‘সে কি! এ তো আমি বউমাকে দিয়ে দিয়েছি।’

—‘দিয়েছ তো খোঁজ করলে কেন?’

মায়ের চোখ ছলছল করতে লাগল। চুড়িতে মা হাত দিলেন না। লকারে রেখে দিলুম নিজের নামে।

আস্তে আস্তে রাগ, ক্ষোভ, লজ্জা কমে এলো। ওর মুখ যেন পুড়ে গিয়েছিল। মুখের হাসি গেল, ঘুরতে ফিরতে পটুর পটুর কথা গেল, চোখের চাউনি ভীরু, আস্তে চলে, কখন আসে, কখন উঠে যায় আমি টের পাই না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। নৈনিতালের টিকিট কাটলুম। যা হয়েছে হয়েছে, মনের দুঃখ ওর ভোলাতে হবে।

নৈনিতালে বোটিং। মাথায় লাল রুমাল। চোখে সান গ্লাস, লাল স্ন্যাকস, বাসন্তী রঙের কার্ডিগ্যান। গোছা গোছা বাহারি চুড়ি হাতে। তবু চঞ্চল চোখ ওর স্থির, মুখ মলিন।

কৌশানিতে সূর্যোদয় দেখার পর বললুম— ‘দেখো টুটুল, তোমার আমার জীবনেও যেন এই সূর্যোদয় সত্য হয়। আর ঝগড়াঝাঁটি নয়। যা হয়ে গেছে, গেছে। এখন থেকে আমরা নতুন করে বাঁচব।তোমার মাকে আমি চার শো টাকা করে প্রতিমাসে পাঠাব। চিকিৎসার খরচ প্রেসক্রিপশান দিলেই আমি দিয়ে দেবো। এর মধ্যেই চালিয়ে নিতে হবে ওঁকে বলো। উনি যেন সঙ্কোচ না করেন। কোনদিন যেন না ভাবেন জামাইয়ের অন্নভোগী উনি। আমিও তো ওঁর ছেলেই।’

কৌশানি থেকে রাণীক্ষেত, আলমোড়া। আমার সঙ্গে নীরবে, কখনও হেসে, কখনও কেঁদে পথ চলল সেই মেয়ে। তারপর রাণীক্ষেতের এক তুষারমৌলি অলৌকিক রাতে বলল—‘তোমাকে আমি এত শ্রদ্ধা করি, এত ভালোবাসি যে তোমার কাছ থেকে কিছু গোপন রাখতে আমার ইচ্ছে করে না গো!’

—‘কেনই বা রাখবে?’

—‘মা বলে দিয়েছে যে! কোনও কোনও কথা স্বামীর কাছ থেকেও চিরকাল গোপন রাখতে হয়।’

হেসে বললুম— ‘ব্যাপার কি বল তো? ফেলটুস মেয়ে নাকি তুমি! কবার ফেল করেছ?’

গম্ভীর হয়ে বলল— ‘ফেল তত করিইনি। ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ডের মধ্যে হতুম বরাবর। অদম্য আগ্রহ ছিল পড়াশোনায়।’

—‘তা হলে থামলে কেন? সত্যিই তো তোমার আই-কিউ অ্যাভারেজের চেয়ে বেশি বলে মনে হয় আমার। আর পড়াশোনা করবার ইচ্ছে থাকলে কিন্তু টাকার অভাবটা কোনও বাধা নয়।’

—‘কী করব? একেবারে নিঃসম্বল অবস্থা। মায়ের রাজরাণীর মতো চেহারা দেখে কেউ বাড়িতে রান্নার কাজটাজও দিতে চাইত না। শেষে গিরীশ কাকা আমাকেই একটা চাকরি ধরিয়ে দিলেন। হোটেলে গিয়ে লাউঞ্জে বসে থাকা, তারপর ঠিকঠাক পার্টি এলে কোনদিন ভিক্টোরিয়া, কোনদিন সিনেমা⋯।’

—‘কি বলছ কি তুমি টুটুল?’ আমি চিৎকার করে ওর মুখ চেপে ধরলুম। হাত কাঁপছে।

—‘ঠিকই বলছি। পেটে বিদ্যে নেই। ঈশ্বর গিল্টি করা চেহারা দিয়ে পাঠিয়েছেন, কাকা বললেন— এমনিতেই তোর কপালে প্রচুর দুঃখ আছে। কাকে বকে ঠোকরাবেই। তবে রোজগার করে নিজেরটা গুছিয়ে নিবি না কেন? সাবধানে থাকবি। সময় হলে আমরা বিয়ে দিয়ে দেব।’

আমি মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলুম, টুটুল বলল— ‘কি হল? তুমি এত জানো, আর কপর্দকহীন সুন্দরী মেয়ে কত অসহায় সেই সামান্য তথ্যটুকু জানো না?’

রুদ্ধ কণ্ঠে বললুম—‘তাই বলে তুমি কলগার্ল? টুটুল তুমি সরো, প্লীজ সরো।’ বুকের ওপর থেকে ওকে ছিঁড়ে নামালুম। সোফায় গিয়ে বসলুম। হতাশ গলায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল- ‘ইস্! কী ভুল করলুম। মা অনেক করে বারণ করে দিয়েছিল।’

হৃদয়, মন, শরীর জ্বলে যাচ্ছিল বললুম—‘লজ্জা করছে না তোমার। এই ভাবে আমাকে ঠকাবার কথা চিন্তা করছো ’

—‘আমি না বললে তো তুমি জানতে পারতে না।’

এইভাবে বৃশ্চিক দংশনে সমস্ত রাত ভোর। বিশাল হিমালয় দূরে দেখা দিল শ্রেণীবদ্ধ চূড়াসহ। কুয়াশার সমুদ্র ঠেলে সূর্যোদয় কিছু দেখলুম না, শুনলুম না। ফিরে এলুম যত শীগগীরই সম্ভব। বললুম—‘ টুটুল, তুমি বাড়ি যাও,’

—‘আমাকে কি ত্যাগ করছ?’

—‘এখনও জানি না।’

হঠাৎ ও আমার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল।

—‘তুমি যদি ত্যাগ করো আমায় আবার সেই জীবনে ফিরে যেতে হবে। আর কোনও উপায় নেই। বাঁচাও আমাকে বাঁচাও। ঘেন্নায় লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলুম, পুরুষজাতের সম্পর্কে সমস্ত ধারণা আমার বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, মাঝখানের দুঃস্বপ্নের অধ্যায়টা উল্টে গেছে, কতদিন বিশ্বাস করতে পারিনি। সবে আমি নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করেছিলুম। তুমি আমাকে দয়া করো।’

বললুম—‘ঠিক আছে। তুমি থাকো। তোমার ভরণ পোষণ আমি করবো। কিন্তু আলাদা।’

বাবা মা বুঝতে পারলেন। ও বলল—‘এভাবে চলে না।’

আমি বললুম—‘তা হলে চলে যাও। ছেড়ে দাও আমাকে। তোমাকে দেখলে আমার কেমন একটা ঘৃণা হয়।’

—‘আমাকে তুমি ঘেন্না করো?’ ও যেন স্বপ্নের ঘোরে বলল,—‘ইস্‌ কেন বলতে গেলুম, না বললে তো কিছু হত না।’ পরদিন দেখলুম ও চলে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স হয়ে গেল। ও-ই আমাকে মুক্তি দিল, স্বামী পুরুষত্বহীন এই অভিযোগে। সব মেনে নিয়ে মুক্তিপত্র নিলুম।’

সম্বিৎ চুপ করল।

—‘অ্যালিমনি দিতেন তো?’ এষা ছোট্ট প্রশ্ন করল।

—‘দিতে গিয়েছিলুম। যাদবপুরের বাড়িও ওদের নিজেদের ছিল না। খোঁজ করতে গিয়ে দেখি মা-মেয়ে কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না।’

—‘আর খোঁজ পাননি?’

—‘পেয়েছি,’ সম্বিৎ বলল— ‘আজ একটু আগে। ওই মাতাল মেয়েটিই টুটুল।’

কতক্ষন চুপ করে আছে দুজনে। রাত কত হল? চাঁদ বোধ হয় অস্ত গেল। কোণার্কের বিজলিবাতি দেখা যাচ্ছে। ফিকে হয়ে আসছে আকাশ। লাল, কমলা, সোনালি, সাদা।

মনোজিৎ এসে থাবড়া মারল পিঠে—‘বাহাদুর ছেলে! এই পাগলীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোটা রাতটা লনে বসে কাটালি? ⋯একি রে? এ কি হয়েছে?’

—‘একটি মাতাল হঠাৎ ওঁকে আক্রমণ করেছিল’ এষা সাবধানে বলল।

—‘বলিস কি? কখন? কি ভাবে?’

—‘রাতে।’

—‘কোনারকের এ হোটেল তাহলে সেফ নয়?’ মনা বড় বড় চোখ করে বলল।

‘কী করে সেফ হবে?’ এষা বলল, ‘আপনারা তিন বন্ধু সারা রাত কী করেছেন? জেনেশুনে বিষ পান করেন আপনারা। এক এক জনের এক এক রকম রি-অ্যাকশান হয়।’—এষা চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল।

—‘খেপেছে রে’ মনা বলল— ‘আমরা দ্যাখ, নিপাট ঘুমিয়েছি তিন বন্ধু গলা জড়াজড়ি করে। গোস্বামী প্রভু তো খেলেই গুম মেরে যান, আর আমি বড় জোর একটু বেশি ভাঁড়ামি করি। তোকে মাতালটা একেবারে ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিয়েছে যে রে!’

সম্বিত উঠে পড়ল। যন্ত্রচালিতের মতো ঘরে ঢুকল। দাড়ি কামিয়ে, চান করে তৈরি হতে হবে। আটটার মধ্যে পুরীর বাস ধরার কথা।

সংবিৎ

থিয়েটার রোডের এই ছোট্ট রেস্তোরাঁ এই সময়ে একেবারে খালি। এষা পরেছিল ঢলঢলে একটা হাতির দাঁতের রঙের টপ, একই রঙের জীন্‌স্‌। কোমরের বেল্টটা সরু লাল। চুলগুলো একটা লাল হেয়ার-ব্যাণ্ড দিয়ে সামলানো ছিল। হাতে কোনও অলঙ্কার নেই। বাঁ হাতে বড় ডায়ালের ঘড়ি। দেখতে দেখতে সম্বিতের শরীর ব্যথায় ভরে যাচ্ছে। ব্যথার মতে উত্তেজনা, উত্তেজক আনন্দ ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে, সে যেন কিসের ঘোরে বুঁদ হয়ে আছে। কত, কত কাল পরে এই তোলপাড় ; এই সফেন মদিরা! এষার গলায় দুলছে লম্বা চেনের সঙ্গে লকেটে একটা মোটিফ। সেটাকে টেনে তুলে ধরে বলল— ‘এই দেখুন, আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের সিম্বল। কিছু না শুদ্ধু একটা তারা। এই তারা দেখে দেখে অন্ধকারে পথ চলবে পথহারা মানুষ, নিশিদিন ভরসা রেখে যাবে, ওরে মন হবেই হবে। হতেই হবে।’ সম্বিৎ বলল— ‘সিম্পল বাট সাবলাইম। সিম্‌বল এবং আপনি।’

এষা বলল— ‘আপনি নিজেই তো বলেছেন আপনি আদর্শবাদী ছেলে। বিবেকানন্দকে অনুসরণ করেন। আপনার জীবনের ব্রতই তো হওয়া উচিত দুঃখীর সেবা। তাই না?’

সম্বিৎ বুঝতে পারছিল না এষা তাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে যেতে চায় কিনা। সন্তর্পণে বলল— ‘ইট ডিপেন্ডস্‌।’

—‘যে সেবার প্রবর্তনা কিছুর ওপর নির্ভর করে তা কি আর সেবা থাকে? আপনার জীবনে সেবার এক মহৎ সুযোগ এসেছিল, ছেড়ে দিলেন কেন?’

সম্বিৎ চুপ করে রইল।

—‘আমার অনুরোধ’ নরম অথচ দৃঢ় গলায় এষা বলল— ‘আপনার ভুল আপনি শুধরে নিন। ও বাঁচতে চায়। ওকে ডেকে নিন—প্লীজ।’

সম্বিতের গলা খসখসে হয়ে উঠেছে, চোখে ভয়, বলল— ‘এষা সব ফর্মুলা নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। আমি একত্রিশ বছর নিজের কৌমার্য রক্ষা করেছি। সে কি এই জন্যে?’

—‘ঠিক এই জন্যেই। আপনি জানেন না। অনেকে মিলে পাপ করে, কিন্তু পাপ স্খালন করে অপাপবিদ্ধ একজন। মাত্র একজন। ইতিহাস এ নজির বারবার আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। তখন তার গায়ে আমরা ঢিল ছুঁড়ি, থুতু ফেলি, কিন্তু পরে তাহারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে⋯ |’

সম্বিতের তালু শুকিয়ে উঠেছে, বলল— ‘আপনাকে বলেছি আমার পরিচিত জনেরা শুধু ঘটনাটা জেনেছে। পূর্বাপর আর কিছুই জানে না। আপনি যা বলছেন, তা করতে গেলে আস্তে আস্তে জেনে যাবে অনেকে। ওকে চিনে ফেলতে পারে বহু লোকে!’

—‘নট নেসেসারিলি। সবাইকে সব কথা ঘোষণা করে বলবার তো দরকার নেই! আর যে দু বছর একসঙ্গে ছিলেন, কেউ তো চেনেনি। আপনার সার্কল মনে হয় আলাদা। তা ছাড়াও সম্বিৎ, লোকভয় আমাদের অনেক বড় বড় সর্বনাশ করে। সেই সত্যিকার আধুনিক যে লোকভয় করে না। আপনি মান দিলেই ও মান পাবে। এই তুচ্ছ কারণে একটা মানুষের জীবন নষ্ট করা যায় না। কিছুতেই না।’

—‘তুচ্ছ নয় এষা।’ সম্বিৎ বলল— ‘আপনি সমাজে-সংসারে আমাদের মতো করে বাস করেন না তাই বোঝেন না। একটা সীমা পর্যন্ত যাওয়া যায়। একবার অত্যাচারিত হল, কি ছেলেমানুষ পা ফসকে গেছে⋯কিন্তু⋯।’

এষা ছোট ছোট চুমুকে কফির পেয়ালা প্রায় শূন্য করে আনল। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে হাতের আংটি ঘোরাতে লাগল। তারপর বলল —‘কাজটা যদি করতে না পারেন, তা হলে আপনার জীবনের প্রায় সমস্তটাই কিন্তু মিথ্যে হয়ে যায় সম্বিৎ। আপনি আর আধুনিক তো থাকেনই না, আ ম্যান অফ প্রিন্সিপ্‌ল্‌-ও, বলতে পারি না আর আপনাকে। আর কিছু না হোক, আমার একমাত্র এবং শেষ অনুরোধ হিসেবেও কি কথাটা রাখতে পারেন না?’—এষার চোখে আন্তরিকতা, ঈষৎ ফাঁক বঙ্কিম ঠোঁটে মিনতি ফুটে উঠেছে, চুম্বনের চেয়ে তার মাদকতা কম নয়।

—‘আপনি বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা,’ সম্বিৎ কেঁপে উঠে বলল—‘ওর ভরণপোষণ করতে তো আমি চেয়েছি। কোনও হোস্টেলে বা প্রতিষ্ঠানে রেখে পড়াশোনার সুযোগ করে দিতেও আমার ইচ্ছে ছিল। ও-ই তো রাজি হল না। সহানুভূতি তো আমারও বিন্দুমাত্র কম নেই। ’

এষা হেসে বলল—‘ওরও তো মর্যাদা বোধ আছে। ও কেন নেবে? ওই প্রকৃত অর্থে আধুনিক। স্ত্রীর সম্মান না দিলে আপনার কাছ থেকে ও কিছুই নেবে না।’

বিপন্ন মুখে সম্বিৎ বলল— ‘আপনাকে বোঝানো মুশকিল। কিন্তু ও ভাবে ভাবতে⋯আমার একটা জৈব রিপালশন হয় এষা। শেষ পর্যন্ত এই শারীরিক বিবমিষা আমি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারি না। আমার পক্ষে সম্ভবই না। ও যে গ্রাউন্ডে ডিভোর্স করেছে সেটা সত্যি হয়ে ওঠে এ সব সময়।’ মাথা নীচু করে সম্বিৎ বলল, ‘এই রিপালশন একটা বিরাট আকার ধারণ করেছিল। যে কোনও মেয়ে, সব মেয়েকেই আমার এতদিন ঘৃণ্য মনে হত। এবার সমুদ্র স্নানের পর সত্যি বলতে কি নীরোগ হয়েছি⋯।’

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে এষা বলল— ‘ও।’ দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনালো। ঠাণ্ডা হয়ে-যাওয়া কফির পাত্রটা আস্তে দূরে সরিয়ে দিল। মাথা ঝাঁকিয়ে সামনের চুলগুলো পেছনে ফেরত পাঠাল। তারপর টেবিলের ওপর এক হাতের ভর রেখে উঠে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ একভাবে বসে বসে পা ধরে গেছে।

সম্বিৎ বলল— ‘আপনি তা হলে আমাকে আর⋯’

এষা নরম সুরে বলল—‘ভালোবাসি কি বলেছিলুম একবারও। বলেছিলুম ভালো লেগেছে।’

—‘এখন কি ঘৃণা?’

এষা মৃদুস্বরে বলল— ‘আমি যে কাউকেই কখনও ঘৃণা করতে পারি না, এটা কি আপনি এখনও বুঝতে পারেননি? আপনার ভালোবাসার উল্টো পিঠে ঘৃণা বলেই আমারও যে তা হতেই হবে তার কোনও মানে আছে?’

—‘তবে কি করুণা?’

—‘ঠিকই ধরেছেন। করুণাই। করুণার হাত বহুদূর পৌঁছয়। একেও ভালোবাসাই বলুন। না বললে অপমান করা হয়। কিন্তু সম্বিৎ তা আপনার জন্যে নয়, টুটুলের জন্যে। শোনেননি, কী অদ্ভুত ভাষায়, অদ্ভুত ভঙ্গিতে ও আমার শরণ নিয়েছিল। ভালোবাসা যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন আমরা করুণার কাছেই যেতে চাই, তাই না? আমার সামনে এখন অনেক কাজ। কলকাতার আশেপাশে ইদানীং কত মেয়ে শুধু পয়সা আর অভিজ্ঞতার অভাবে বিপথে চলে যাচ্ছে তার সার্ভে করতেই আমাকে কলকাতা পাঠানো হয়েছিল। আপনার মাধ্যমে আমি এমন একজনের সন্ধান পেলুম, এমন একজনের দুর্গতি চোখের সামনে নাটকের মতো প্রত্যক্ষ করলুম যা আমার অভিজ্ঞতার, এমন কি দূরতম কল্পনার বাইরে।’ এষার চোখ টলটল করছে, বলল— ‘লোকটার গাড়ির নম্বরটা সেদিন দেখে রেখেছি। সন্ধান পেয়ে যাবো ঠিক। আপনি বসুন। আমি তাহলে যাই।’

অগত্যা, এই কাহিনীর পুরুষ সম্বিৎকে কৃত্রিম-আলো-জ্বলা একটা বদ্ধ প্রকোষ্ঠে ক্লান্ত, মলিন, হতাশ বসিয়ে রেখে এগিয়ে চলুক এষা। আমরা দেখি। কেন না এগিয়ে চলার এই দৃশ্য আক্ষরিক অর্থেই অ-পূর্ব। কেন না এই ত্রিকোণে মেয়েটির জন্য মেয়েটি চোখের জল ফেলছে এবং সেই পুরাতন গঙ্গা কত যুগ ধরে নিস্ফল বইতে বইতে হঠাৎ আজ এমন এক চাঁদের জন্ম দিয়ে ফেলেছে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের পেছন থেকে উদিত হতে হতে যা কুলভাসানো কোটালের টানে আমাদের বুকের ভেতর আরেক গঙ্গাকে টানছে। প্রকৃত পতিতোদ্ধারী এই গঙ্গাই। এই গঙ্গায় তাবৎ কল্মষ ধুয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *