ধোঁয়া

ধোঁয়া

এজলাসে বসেছিল বিপ্লব। পুরো জজসাহেবের ধড়াচুড়োয়। সওয়াল জবাব চলছে। হঠাৎ যেন মনে হল রামগতিবাবু ঢুকলেন। বৃদ্ধ, বিশীর্ণ, হাতে ছাতাখানা লাঠির মতো করে ধরা রামগতিবাবুও ঢুকলেন—পুলিশ শশব্যস্তে তাঁকে প্রায় আলিঙ্গন করে বাইরে নিয়ে গেল। দায়ভাগ আর মিতাক্ষরার ধানাই-পানাই শুনতে শুনতে হুট করে অন্যমনস্ক হয়ে গেল বিপ্লব। রামগতিবাবুই ত! নাকি রামগতিবাবুর মত কেউ। রামগতিবাবুকে শেষ যা দেখেছে তার সঙ্গে এই বৃদ্ধের অল্পই মিল। তবু এঁকে রামগতিবাবু বলেই তার একদা-ব্যারিস্টারি অধুনা-জজসাহেবি চোখ শনাক্ত করেছে যখন, তখন ব্যাপারটা দেখতেই হয়। তবে পরিস্থিতিটা নিশ্চিতভাবে কৌতুকজনক। বিপ্লব ঘোষ উচ্চাসনে এবং রামগতি স্যার জবুথবু হয়ে ঘরে ঢুকছেন। চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার নাটক বুঝি উল্টো-পাল্টা হয়ে আবার এক রজনী অভিনয় হয়ে গেল! বারে মজা! বারে জীবন! ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে তো!

লাঞ্চ আওয়ার! শুনানি মুলতুবি। একদিকে বাঙালি হয়ে যাওয়া মারোয়াড়ি পরিবার, আর একদিকে দায়ভাগ আর মিতাক্ষরা। দু’ পক্ষের উকিল এখন মনে মনে তর্কাতর্কি করুক। বিপ্লবের মাথায় খালি একটাই চিন্তা—রামগতিবাবুই তো! জগৎপতি ইন্সটিট্যুশনের ডাকসাইটে অঙ্কর মাস্টারমশাই রামগতি চাটুজ্যে—যাকে ছেলেরা নিজেদের মধ্যে ডাকত যমগতি বলে! ওরে বাপস্‌ রে, কী মার! কী মার! কুড়িটা অঙ্ক টাস্ক ছিল পনেরটা করেছিস? মার। এক্সট্রা পারিসনি? মার। আঁক কষতে কষতে জানলার দিকে তাকিয়েছিস? মার! ডাস্টারের বাড়ি, আঙুলের গাঁটের বাড়ি, দু আঙুলের মাঝে পেন্সিল, বিশাল বিশাল মুগুর ভাঁজা শক্ত হাতে চটাস, খটাস, দুমদাম। ওরে ব্বাপ রে! পড়াতেন দুর্দান্ত, বোঝাতেন নির্ভুল, কিন্তু ভয়ে ছেলেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেত। অভিভাবক যতই রামগতিবাবুকে টিউটর ঠিক করতে চান না কেন, ছাত্ররা নাম শুনলেই ‘ওরে বাবারে পিসিমারে’ বলে ডাক ছাড়ত। সেসব দিনে মাস্টারমশাইদের নামে কমপ্লেন চলত না। আর কার নামেই বা কমপ্লেন করবে? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। একেকটি মাস্টারমশাই একেক রকমের ঠেঙাড়ে। কেউ ডাস্টার স্পেশালিস্ট, কেউ থাপ্পড় স্পেশালিস্ট, কেউ বেত স্পেশালিস্ট। একজন তো ছাতার বাঁটের বাঁকানো দিকটাও অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। বাঁকানো জায়গাটা দিয়ে গলা ধরে শিকারকে টেনে আনতেন, তলার দিকে চেপে বসিয়ে দিতেন। আবার ওপর দিকে চাপ দিয়ে ওঠাতেন। একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে, একবার ওপরে একবার নিচে। সে যেন চরকিনাচন। যাই হোক এইসব ঠেঙাড়ের মধ্যেও রামগতিবাবু ছিলেন বিশিষ্ট ঠেঙাড়ে। অত জোর আর কারো চড়ে ছিল না। অত শব্দও কারো গাঁট্টায় হত না, অত লঘু পাপে অত গুরুদণ্ডও কেউ দিতেন না। রামগতিবাবু যেন ক্লাসে ঢুকেই ক্ষেপে যেতেন। কিংবা ক্ষেপেই ক্লাসে ঢুকতেন। ডিম আগে, না মুরগি আগের মতোই রামগতিবাবুর ক্ষেপা এবং ক্লাসে ঢোকার পারম্পর্যে অগ্রাধিকারটি কার এ কথা চিরকালই রহস্যের অন্তরালে থেকে যাবে।

কোনও ছেলেই রামগতিবাবুর শাসন থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল না। কিন্তু বিপ্লবের ভাগে শাসনটা যেন ষোল আনার জায়গায় আঠার আনা ঘটে যেত। স্কুলে এক দফা, বাড়িতে এক দফা। বাড়িতে কখনও কখনও মোক্ষম সময়ে অকুস্থলে মা এসে হাজির হতেন। হাতে চিঁড়ে ভাজা আর চা। তখন মাস্টারমশাইয়ের হাত কান থেকে নামত। বাবা ছিলেন—পিঠে বেঁধেছি কুলো, আর কানে গুঁজেছি তুলো। ধারণা—মার না খেলে ছেলে মানুষ হবে না। কিন্তু স্কুলে? সেখানে মা-ও নেই, চিঁড়ে ভাজাও নেই। বরং আছে রামবিচ্ছু একদল নিষ্ঠুর—‘ঘুঁটে হাসে গোবর পোড়ে’র প্রবচনের ঘুঁটে-স্বভাব বালখিল্যদল। এরা কখনও অন্যের সঙ্গে একাত্ম হতে পারত না। অন্যে মার খেলে বরাবর এদের স্বর্গীয় আনন্দ হ’ত। তাদের সমক্ষে তুলো ধোনা হতে হত বিপ্লবকে। কখনও বিপ্লব বলতেন না মাস্টারমশাই। সব সময়ে বিপুল। বিপুলচরণ, বিপুলচন্দ্র, বিপুলগতি, এমনকি বিপুলবন্ধু, কিন্তু কদাপি বিপ্লব নয়। নামের বাচ্যার্থ বোধহয় পছন্দ ছিল না ভদ্রলোকের। অধিকন্তু নাম বিকৃত করার মধ্যেও একটা বেশ স্থূল রকমের অপমান আছে।

‘কি হে বিপুলচন্দর, কালকেই যে এই ষোল নম্বর উপপাদ্যের এক্সট্রা কখানা করিয়ে এলুম। বারো ঘণ্টার ব্যবধানেই ভুলে মেরে দিয়েছো? বেশ করেছো। কালকে আসলে মুখস্থ করেছিলে, আজকে এ বি সি ডি-র জায়গায় এক্স, ওয়াই, জেড—দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে গেছো। এটা কোনমতেই আমার প্রত্যাশার বাইরে নয়। এমনটাই আমি প্রত্যাশা করেছিলুম। এসো, আমার প্রত্যাশা পূরণের পুরস্কারটা নিয়ে যাও। এই নাও, এই নাও, এই নাও।’

মাথার তিনটি মোক্ষম জায়গায় গুণে গুণে টোকা মারলেন রামগতিবাবু, সঙ্গে সঙ্গে তিনটি টেপারি বেরিয়ে গেল জায়গাগুলোয়।

—‘ওরে তোরা উলু দে।’ অমনি ক্লাসশুদ্ধু ছেলে হো-হো করে হেসে উঠল, পরক্ষণেই অবশ্য সবচেয়ে জোরালো হাসির মালিকের ডাক পড়বে,—‘কি ব্যাপার সমরেশ রাম, তোমার খাতায় অত কালির দাগ কেন? জোমেট্রির খাতায় কালির দাগ?’

জোমেট্রির জি ও যে শেখোনি সে তো এই কালিঝুলি দেখলেই টের পাওয়া যায়! আবার হাসি! হাসি! অ্যাঁ? হাসি!’

এক-একটা কথার পুনরাবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে রামগতিবাবুর হাত উঠছে, নামছে।

সুইংডোর ঠেলে বেয়ারা ঢুকল। একটা স্লিপ দিচ্ছে। ‘রামগতি চ্যাটার্জি রিটায়ার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট মাস্টার, জগৎপতি হাইস্কুল, বি এস-সি বি টি।’ অঙ্কের মাস্টারমশাই হাইস্কুলকেই বি এসসি বি টি বানিয়ে দিয়েছেন। ট্রান্সফার্ড এপিথেট।

‘আসুন মাস্টারমশাই—আসুন—’ উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করল বিপ্লব। রামগতিবাবুই। উনিই ধোঁয়াটে চশমার ভেতর থেকে অবাক হয়ে বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে,—‘ত্‌ তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ?’ রামগতিবাবুর চোখ দিয়ে ধারা নামছে। বরাবরই আবেগপ্রধান ধাতের মানুষ। যৌবনে তার প্রকাশ ছিল রাগ, বার্ধক্যে কান্না।

বিপ্লব বলল—‘আরে আমি তো আপনাকে চিনতে পারবোই। সে আর বেশি কথা কি? আপনিই বরং আমাকে চিনলেনই কি করে আর এতদূর আমার কাছে এলেনই বা কি করে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।’

রামগতিবাবু—চোখ থেকে চশমা নামিয়ে চশমা, চোখ সব ভালো করে মুছলেন। তার পরে বললেন—‘হেড ক্লার্ক সরসীকে মনে আছে কি তোমার? সেই সরসীই বলল, আপনার বিপুল যে এখন জজ হয়েছে। তার কাছেই যান না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।… তা…তুমি আমাকে চিনতে পারবেই একথা বললে কেন বাবা?’

বিপ্লবের চোখে হাসি চিক চিক করছে, বলল—‘বাঃ, আপনি আমার প্রাইভেট টিউটর ছিলেন, স্কুল ফাইনালটা আপনার হাত ধরেই পার হলুম, আর আপনাকে চিনবো না?’

—‘সত্যি? তুমি তাই মনে করো? স্কুল ফাইনালে অঙ্কের লেটারটা…’

—‘নিশ্চয়ই মাস্টারমশাই, ও লেটার আমার নয়, ও আপনার লেটার।’

—‘কি জানি’, কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন রামগতিবাবু তারপর একটু ক্ষুন্ন স্বরে বললেন, ‘সত্যি কথাটা কিন্তু আমার কাছে গোপন করে গেলে যেন!’

—‘কি সত্যি কথা! কি গোপন কথা!’

‘আমাকে মনে রাখবার আসল কারণ…’

বিপ্লব বলল—‘কি আশ্চর্য, মিথ্যা বলার কি আছে? টানা সাত বছর স্কুলে পড়েছি আপনার কাছে, তিন বছর না চার বছর বাড়িতে, আমার অঙ্কে মেধা কম হলেও, এমনি স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ নয় মাস্টারমশাই।’ বলল, কিন্তু তার চোখের হাসি গাঢ়তর হল।

রামগতিবাবু বললেন—‘যাক, একটা অসুবিধেয় পড়ে তোমার কাছে আসা, দ্যাখো বাবা যদি কিছু করতে পারো। তোমার তো অনেক জানাশুনো!’

বিপ্লব বলল—‘হ্যাঁ। আসল কথাটা বলুন! কি অসুবিধেয় পড়েছেন!’

‘জনগণের অসুবিধে দূর করার একটা মেশিনারিই তো আমরা! এত লোকের করছি আর আপনারটা করব না? আপনার তো অগ্রাধিকার।’

কাঁধের ঝোলা থেকে কাগজপত্র বার করলেন রামগতিবাবু। রিটায়ার করে গেছেন, ছ-সাত মাস হয়ে গেল, অথচ দশ-এগার বছরের একটা বাড়তি ইনক্রিমেন্টের টাকা আজও পাননি। এখন সেসব ফাইল বহু কাগজপত্রের তলায় চলে গেছে, স্কুল, সরকার কেউ আর গা করছে না।

—‘অনেকগুলো টাকা বাবা, জমা রাখতে পারলে সুদে-আসলে কত হয়ে যেত বলো তো।’

বিপ্লব ওর বন্ধু এক এডভোকেটকে ডাকল। বলল—‘এই বিশ্বাসসাহেবই আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন কি করবেন। সেরকম বুঝলে আপনি গভর্মেন্টের বিরুদ্ধে কেস করবেন, প্রাপ্য টাকা খেসারত সমেত আদায় করে দেবো। আপনার এক পয়সাও লাগবে না।’

বিশ্বাসের সঙ্গে চলে গেলেন রামগতিবাবু। মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে, বিপ্লব আবার এজলাসে যাবার জন্য উঠছে উনি বিদায় নিয়ে গেলেন।

—‘করে দিতে পারো যদি চিরকাল মনে রাখবো বাবা।’

বিপ্লব হাসল—‘বাঃ, আপনার ঋণ শোধ করতে হবে না?’

হঠাৎ ফিরে দাঁড়ালেন রামগতিবাবু—‘আমার মারের কথা আজও ভুলতে পারোনি, বিপুল, না?’

বিপ্লব হাসিমুখে বলল—‘সে কি ভোলা যায়, মাস্টারমশাই? তা সে যাই হোক তার জন্য অনুশোচনা করবেন না। আমাদের ভালোর জন্যেই তো মারতেন? তখন খুব কষ্ট হলেও সে কথা বুঝতুম। এখন তো বুঝিই!’

—‘কী বোঝ? তোমাদের ভালোর জন্য মারতুম?’ রামগতিবাবু কি রকম একরকম করে বললেন।

বিপ্লব বলল—‘কতদিনকার কথা সব মাস্টারমশাই। ছাড়ুন ওসব।’

রামগতিবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন—‘না বিপুল, তোমাদের ভালোর জন্য মারতুম না। কেন মারতুম এই কথাটা তোমরা এখন দশের এক হয়েছ তোমাদের জানা দরকার। আমার বাড়ি একদিন সময় করে আসবে? আমি বুঝিয়ে বলব!’

বিপ্লব ভাবল, মাস্টারমশায়ের মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। বলল—‘একদিন যাবো, নিশ্চয় যাবো। আপনার কৈফিয়ৎ শোনবার জন্য নয়। এমনিই যাবো।’

যাক, টাকাটা ভালোভাবেই আদায় হয়ে গেছে। রামগতিবাবু নিজে কোর্টে এসে বিপ্লবকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। বললেন—‘আমি বসছি বিপুল, আজ তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো। তোমার যা কাজ আছে সেরে এসো।’

—‘আরেকদিন হবে মাস্টারমশাই। আজ থাক।’ বিপ্লব বলল।

—‘তবে আর তুমি গিয়েছো! তোমাদের ওই আরেকদিন আরেকদিনই থেকে যাবে বাবা।’ হতাশ গলায় রামগতিবাবু বললেন।

—‘আচ্ছা, আচ্ছা চলুন’—বিপ্লব তাড়াতাড়ি বলল। মাস্টারমশাইয়ের মনে সে দুঃখ দিতে চায় না। এই মাস্টারমশাই তাকে তিনটে লেটার পাইয়ে নামকরা কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাবার দরকার হয়নি। নিজের ছেলের জন্যও এতটা করতে পারেননি মাস্টারমশাই।

—‘তুমি নিজে ড্রাইভ করতে পারবে না?’ হঠাৎ রামগতিবাবু বললেন।

অনেকটা রাস্তা, ট্রাফিকের অবস্থা কি তা জানা নেই, ড্রাইভার থাকলে ভালো হত কিন্তু আজ মাস্টারমশাই যা বলেন তাই হবে। ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে বিপ্লব নিজে স্টিয়ারিং-এ বসল। পাশে রামগতিবাবু। এককালের দশাসই মানুষটি এখন খুবই শীর্ণ। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, মাথার চুলগুলি কাঁচা-পাকা, একটু বড় হয়ে গেছে। দাড়ি রেখেছেন। গলা ঢেকে আর সামান্য নিচে নেমেছে দাড়ি। গেরুয়া রঙের খাদির পাঞ্জাবি। বেশি নীল দেওয়া মিলের ধুতি।

এসপ্ল্যানেডের জ্যাম এড়িয়ে স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাওড়া ব্রিজে উঠল বিপ্লব। কি ভাগ্য আজ ব্রিজ ফাঁকা। বাকল্যান্ড ব্রিজে উঠতে উঠতে বলল—‘মাস্টারমশাই আপনি এক সময়ে বক্সিং করতেন না?’

—‘বক্সিং নয়, কুস্তি, ফ্রিস্টাইল, গোবরবাবুর কাছে শিক্ষা।’

—‘আমাদের যখন পড়াতেন তখনও করতেন? আপনার ইয়া চেহারা ছিল।’

—‘তোমাদের যখন পড়াচ্ছি, তখন সবে ছেড়ে দিচ্ছি ওসব শখ-টখ, কোচিং করতে হত, তা ছাড়া কুস্তিগীরের শরীর স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখতে অনেক হ্যাঁপা বাবা। দু-আড়াই সের পাঁঠার মাংস একাই উদরসাৎ করতে পারতুম।’

—‘আগেকার লোকেদের হজম শক্তির কথা হচ্ছে না বাবা, কুস্তিগীরের প্রয়োজনের কথা হচ্ছে। সাধারণ লোক যে পরিমাণ খায়, সেটুকু তার পেটে তলিয়ে যায়। কোথায় যে যায় টের পাওয়া যায় না।’ রামগতিবাবু হাসলেন।

জি টি রোড ধরে এগোতে এগোতে বাঁদিকে মোড় নিচ্ছিল বিপ্লব। রামগতিবাবু বললেন,—‘ওদিকে না, ডাইনে ডাইনে।’

—‘বাড়ি পাল্টেচ্ছেন মাস্টারমশাই?’

—‘আমি পাল্টাইনি বাবা, আমার ছেলে শশাঙ্ক পাল্টেছে। এইবার এই, অ্যায়, এইখানে গাড়ি থামাও।’

গলিটা খুব সরু। রামগতিবাবু ঠিকই বলেছেন এখানে গাড়ি ঢুকত না। হঠাৎ যেন ঝপ করে সন্ধে হয়ে গেল। গলির ঠিক মুখেই বহুতল বাড়ি উঠেছে দুটো। ঠিক যেন দু’দিকে দুই দানব প্রহরী। দরজার হুড়কো সামান্য একটু ঠেলতেই আপনি খুলে গেল। রামগতিবাবু বললেন—‘এসো বিপুল ভেতরে এসো।’

তিন-চারটি বালক-বালিকা উঠোনের ওপর ছুটোছুটি করে কানামাছি খেলছিল। আর দু’জন দাওয়ার ওপর বসে মুড়ি খাচ্ছে। একজনের তলার দিকটা খুব শীর্ণ। হয় রিকেট, নয় পোলিও। একজন বিধবা যুবতী বার সাবান দিয়ে কাচা মোটা একখানা সেলাই করা চাদর উঠোনের তারের ওপর মেলে দিয়ে চলে গেল। কোথাও থেকে উনুনে রুটি পোড়ার তীব্র গন্ধ হাওয়ায় ভেসে আসছে। কোণের ঘর থেকে খ্যানখেনে গলায় কে বলল—‘রুটিগুলো যে খাক হয়ে গেল হারামজাদী!—বাড়ির দ্বিতীয় ঘর থেকে কস্তাপেড়ে শাড়িপরা এক মহিলা সঙ্গে গলায় স্টেথো দীন চেহারার এক ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ডাক্তারটি বললেন—‘এ মারাত্মক হাঁপের টানের উপশম করি আমার ডাক্তারি বিদ্যের এ সাধ্যি নেই মা জননী। শশাঙ্ক। তোমরা বাপু বাড়ি বদলাও।’ তিনটি শিড়িঙ্গে যুবক রাস্তার দিকের দরজা ঠেলে ঢুকে এসে বলল—‘ভিজিল্যান্স পার্টির এ মাসের চাঁদাটা দাদু দিয়ে দেবেন তাড়াতাড়ি। গত মাসের মতো যেন চেল্লাচেল্লি করতে না হয়।’

‘কোচিনে তো মন্দ কামান না।’

হঠাৎ চতুর্দিক থেকে কারা একটার পর একটা ধোঁয়ার বল ছুঁড়ে দিতে লাগল। বড় বড় বল, শব্দহীন বোমার মতো তারা ফেটে যায় আর উঠোনটাকে গিলে ফেলে, ভয়ানক কাশির আবহসঙ্গীত পেছনে নিয়ে সেই ধোঁয়ার উর্ধ্বস্রোত হঠাৎ যেন আরব্য উপন্যাসের কলসীর ধোঁয়া হয়ে যায়। হতভম্ব আরবী ধীবরের মতো বিপ্লব ধোঁয়ার মধ্যে থেকে বিষণ্ণ দৈত্যের গলা শুনতে পায়—‘বলেছিলুম না বিপুল। বাড়ি এলেই তোমায় বুঝিয়ে দেবো। তখন কেন এত মারতুম। চল্লিশ বছর ধরে এই ধোঁয়ায় বন্দী হয়ে আছি বাবা, তোমাদের ভালোর জন্যে মারতুম, মনেও করো না। মারতুম এইজন্যে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *