লিখন

লিখন

ব্রজকিশোরবাবু মধ্যম দৈর্ঘ্যের গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার মানুষ। বেশ গোঁফ আছে। চাপ গোঁফ। বেশি কথাও বলেন না। আবার কম কথাও বলেন না। অর্থাৎ কারো কারো সঙ্গে বেশ কথা বলেন, কারো কারো ব্যাপারে হুঁ হাঁ করে সেরে দ্যান। আপিসে বড়বাবু ছিলেন। কোনও কোনও সমবয়সী সহকর্মী, কোনও কোনও অধস্তন ছেলে-ছোকরার সঙ্গে বেশ জমাট আলাপ ছিল। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে—‘ভালো আছো তো? জামাই বাবাজী এলো না কেন? কাজ পড়েছে? ভালো ভালো।’ নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ‘কি দাদুভাই পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’ ‘দিদি-ভাই একটু সকাল-সকাল করে বড় রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরবে।’ গিন্নির সঙ্গে অবশ্য সম্পর্কটা একটু আলাদা রকমের। চল্লিশের আগে পর্যন্ত ব্রজকিশোরবাবু গিন্নির সঙ্গে দোলনায় দুলেছেন। এক পানের বাটা থেকে দুজনে এ ওকে ও একে পান খাইয়েছেন। রঙ্গ-রসিকতা করেছেন আর দুলে দুলে হেসেছেন। খেলাধুলোর জন্যে লুডো, তাস আর চাইনিজ চেকার সদাসর্বদা ঘরে মজুত থাকত। সাপ লুডোটাই যদিচ সবচেয়ে পছন্দ ছিল দুজনের। তিন মাস অন্তর মাইনের টাকা থেকে জমিয়ে ব্রজকিশোরবাবু গিন্নিকে একটি জব্বর শাড়ি কিনে দিতেন। হাতি পেড়ে, কি গঙ্গা যমুনা পাড়, কি পাছা পেড়ে। গিন্নি বেঁটে মানুষ, রঙ টকটক করছে, নাকটি বড়ির মতন, চুল কালো কুচকুচে তৈলাক্ত মসৃণ। সেই খাটো, মোটাসোটা শরীরটিতে লাল-কালো গঙ্গা যমুনা পাড় শাড়িখানা পরে ঝনাৎ করে যখন পিঠের ঝলকে পেছনে চাবিটি ফেলতেন, নাকের হীরেটিতে আলো ঝলকে উঠত, তখন ব্রজকিশোরবাবুর ভেতরটা কি করত তা একমাত্র ব্রজকিশোরবাবুই জানেন। আমরা জানি না।

বয়স পশ্চিমে হেলতে থাকল, ব্রজকিশোরবাবুর ব্রজকিশোরীও ক্রমশ বৌমাদের রান্নাঘরে, আঁতুরঘরে সেঁদোতে লাগলেন। দোলনায় ছেলে বউকে টপকে নাতি-নাতনিরা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দুলতে লাগল। পান খাওয়া কমে এল। খেলাধুলোয় গিন্নি ক্রমশই আরও খেলুড়ি সংগ্রহ করতে লাগলেন। বড় নাতি দুলাল বলে, ‘আমি কিন্তু লাল নেবো।’ নাতনি শীলু বলবে, ‘আমি, নীল।’ সবাই সব নিয়ে-টিয়ে ব্রজকিশোরবাবুর পড়ে থাকবে ম্যাটমেটে, অলুক্ষুণে হলদে। রোজ। রোজ। একদিনও তো মানুষ বুড়োমানুষটাকে লাল দেয়। তাঁর ঘর। তাঁর লুডো। হয় নাতি, নয় নাতনি লাল নিয়ে বসে আছে। তার ওপরে কোথা থেকে শিখে এসেছে কেঁচে খেলা। ঘুঁটি উঠে গেল। তারপর আবার সেখান থেকে দান মতো নেমে কুচ কুচ করে দাদুর ঘুঁটি কাটছে। যা। কয়েক দিন খেলে খেলায় জন্মের মতো বীতশ্রদ্ধ হয়ে ব্রজকিশোরবাবু বললেন, ‘দুত্তোর ছাই, খেলব না, তোরা খেল গে যা।’

‘তিনজনে খেলা হয় না কি? অ দাদু এসো না!’

‘নাঃ।’

গিন্নি কটাক্ষে চেয়ে বললেন, ‘বাবুর বুঝি রাগ হল?’

‘হ্যাঁ রাগ হল।’ ব্রজকিশোরবাবু বারান্দায় পাতা বেতের চেয়ারে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। হাতে খবরের কাগজ।

আশা করি আমি বোঝাতে পেরেছি এই ব্রজকিশোরবাবুর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করতে হলে কিংবা স্ত্রী বিয়োগ হলে কি বিপদ হবে। তাই হল। এবং একসঙ্গে হল। সেপ্টেম্বর মাসে তিন বছর এক্সটেনশনের পর ব্রজবাবু রিটায়ার করলেন। মালা ও চন্দন, ছাতা-ছড়ি, ধুতি-পাঞ্জাবি, শাল নিয়ে। শালটি ঈষৎ বেগুনি আভার। আসল পশমিনা। আদর করে গিন্নির গায়ে জড়িয়ে দিলেন। অক্টোবর মাসে পুজোর সপ্তমীর দিন অষ্টমীর বাজার করে আনলেন স্বামী-স্ত্রীতে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, কড়াইশুঁটি, কুমড়ো, টোম্যাটো, প্যাকেটের ময়দা, ভালো ঘি, নৈনিতাল আলু, এক নম্বর ছোলার ডাল, কিসমিস, বেগুন। সন্ধেবেলায় গৃহিণী ঘুরে পড়লেন। পড়লেন তো পড়লেন। আর উঠলেন না। নার্সিংহোম ঘুরে একেবারে কেওড়াতলা চলে গেলেন।

সব কিছু চুকে-বুকে গেলে, বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত, মাথা ঝুঁকিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন দেখে, বড় বউমা, মেজ বউমা, ছোট বউমা এসে বলল—‘বাবা, বাবা, আমরা তো আছি।’ একটু দূরে তিন ছেলে। বড় হয়ে অবধি বাবার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলা অভ্যাস নেই—কী ইশারা করল যে যার বউকে। বড় বউ বলল—‘বাবা, আপনি আরাম করুন,’ মেজ বলল—‘কোনও ভাবনা নেই।’ ছোট বলল—‘আমরা সবাই আছি।’

ব্রজকিশোর বললেন—‘হুঁ।’ বলে ঘরে চলে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। থাকো বাবা, সবাই থাকো। কিন্তু ওইখানে থাকো। ওই চৌকাঠের বাইরে। ঘরে যদি থাকি তো আর কাউকে মনোমত না পেলে আমি আমাকে নিয়েই থাকবো। তোমরা তোমাদের সংসারে। আমি আমার সংসারে। চারবেলা চাট্টি খেতে দিও। ব্যস।

বাড়িখানি ব্রজকিশোরবাবুর ঠাকুর্দার করা। তাঁর বাবা, তিনি, ছেলেরা, যে যেমন পেরেছে বাড়িয়েছে, সারিয়েছে। ব্রজবাবুর ঘর বরাবরই দক্ষিণ-পশ্চিমে, দেওয়ালগুলোতে কি মশলা কি ইঁট ব্যবহার করেছিল মিস্তিরি কে জানে, বর্ষার পর দেওয়াল বিশেষত পশ্চিমের দেওয়াল কেমন ভেপসে ওঠে, চুনকাম অসমান, ছোপ ছোপ হয়ে যায়। ঘরের একদিকে একটি সেকেলে পালঙ্ক। পালঙ্কের তলায় গিন্নির সেলাই মেশিন, গরম জামা-কাপড়ের ট্রাঙ্ক বাক্স। ঘরের উল্টোদিকে কাজ-করা আয়নাঅলা মেহগনির আলমারি, পাশে আলনা, তার পাশে টেবিলে আয়না বসানো। সামনের চেয়ারে বসে কাজ-কর্ম করাও চলে, আবার দাড়ি কামানো, চুল বাঁধা, সাজগোজ এসবও চলে, চলে মানে চলত। ড্রয়ারের মধ্যে এখনও একটাতে গৃহিণীর ফিতে-কাঁটা-চিরুনি মজুত। আরেকটাতে চিঠি লেখার সাজসরঞ্জাম—খাম, পোস্টকার্ড, লেটার প্যাড, কলম, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরের একদিকের দরজা দিয়ে দোতলার দালানে যাওয়া যায়, আরেক দিকের দরজা দিয়ে সরু জাল ঘেরা বারান্দায় যাওয়া যায়। বারান্দায় একটি কাপড়ের ইজিচেয়ার পাতা আছে। .একটি টিয়ার খাঁচা থাকে, আর একটি আড়াআড়ি তারে ব্রজবাবুর জামা-কাপড় অর্থাৎ লুঙ্গি, ফতুয়া, গেঞ্জি, রুমাল, গামছা শুকোয়।

এই ঘরেই, এই পালঙ্কেই পূর্বে মাথা পশ্চিমে পা ব্রজবাবু শোয়ার সময় শুয়ে থাকেন। কাজের মানুষ। আলস্য, কুঁড়েমি, কোনদিনও অভ্যেস নেই। কিন্তু মুখ ফুটে বৌমাদের বলতে পারেন না—আমাকে বাজারটা করতে দাও। এক-এক দিন এক-এক ছেলে—চা খেয়েই পাঁই পাঁই করে বাজারে ছোটে। ঘড়ি দেখতে দেখতে উদ্বিগ্ন মুখে ফিরে আসে কুড়ি পঁচিশ মিনিটের মাথায়। সরু চিলতে বারান্দায় নিজের কাপড়ের আরাম-চেয়ারে বসে বসে তিনি দেখেন। এক দিন দেখলেন, দু দিন দেখলেন, সাত দিন দেখলেন, তারপর আর পারলেন না। অষ্টম দিনের সকাল সাতটায় বড় বউমা চান করে কাপড় মেলছে। মেজ বউমা ভাত বসাবার চাল ধুচ্ছে, ছোট চা ঢালছে কাপে কাপে, ব্রজবাবু থলি হাতে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলেন। মেজ বউ চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ব্রজবাবু গলা খাঁকারির মানে ‘আমায় বাজারের টাকাটা দাও বউমা।’ মেজ বউমা বলল, ‘ওকি বাবা, আপনি কেন থলি হাতে?’ ছোট বউমা বলল—‘এখনও চা খাওয়া হল না!’ বড় বউমা বলল—‘বাবা, আপনি ওপরে যান। শিবু আপনাকে চা দিয়ে আসছে, ছি ছি, রিনি। কত দেরি করলি বল্‌ তো!’ ব্রজকিশোরবাবুর এদের সঙ্গে এত কথা বলা সাত জন্মেও অভ্যেস নেই। তবু বললেন— ‘বাজারটা আমিই করে দিচ্ছি। ওদের তাড়া আছে। চা খেয়ে যাচ্ছি।’

ছোট ছেলে রবি ছুটে এলো। থলেটা হাত থেকে একরকম কেড়ে নিয়ে বলল—‘না, না, আপনি কেন ব্যস্ত হচ্ছেন? বলুন আপনার কী খাওয়ার ইচ্ছে, আমি নিয়ে আসব।’

ব্রজকিশোর বুঝলেন, এরা তাঁর বাজার করার উৎসাহের অন্য ব্যাখ্যা করেছে। মনে করেছে তাঁর বিশেষ কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। তাই বাজার যেতে চাইছেন। তিনি একবার কেশে নিয়ে বাজারের থলি ছোট ছেলের হাতে সমর্পণ করে প্রস্থান করলেন। চিলতে বারান্দায় বসে বসে চা খেতে খেতে বুঝলেন এ সংসারে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তিনি আর কারো কোনও কাজে লাগবেন না। বেচারি অবসরপ্রাপ্ত বিপত্নীক। সেদিন দুপুরে ভাত পাতে কচুর শাক, ভেটকি মাছের কাঁটা চচ্চড়ি এবং ধোকা একসঙ্গে দেখে তাঁর মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। এইসব খাদ্যগুলি তাঁর প্রিয়। তাই এরা ভেবেছে তাঁর এগুলি খেতে মন গেছে। বহু কষ্ট করে সবগুলো এক দিনে জড়ো করেছে। বেচারি ওপারের নোটিশ পাওয়া বুড়ো শ্বশুর! কদ্দিন আর বাঁচবে? খাইয়ে-মাখিয়ে নাও যে ক’টা দিন বাঁচে। পাতে খাবার পড়ে রইল। কচুর শাক রাঁধা প্রথমত একেলে কলেজে পড়া মেয়ের কর্ম নয়, কাঁটা চচ্চড়িও তাই। এতো ঝাল দিয়েছে যে, নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা। ধোঁকাটা করেছে ভালোই, কিন্তু গিন্নির নানারকম নিজস্ব তাগ-বাগ ছিল। ধোঁকায় সামান্য একটু কুমড়ো কি বাঁধাকপি, কি ফুলকপি মিশিয়ে দিতেন, জিনিসটা নরম এবং সুস্বাদু হত। এ ধোঁকা সে ধোঁকা নয়। কিন্তু ব্রজকিশোরবাবু এতো হৃদয়হীন নন যে, সব তাতেই এরকম দোষ ধরবেন। তাঁর আসলে বড্ড লেগেছিল এই জন্য যে, এরা তাঁকে অকেজো, লোভী, পেটসর্বস্ব বৃদ্ধের দলে ফেলে দিচ্ছে।

সেইদিন বিকেলবেলাই ব্রজবাবু প্রথম লেকের ধারে গেলেন। বাড়ির থেকে দু-এক গলি পেরিয়ে বড় রাস্তার ওপারে দিব্যি পার্ক। তার মধ্যে টলটলে জলের লম্বা একটি পুকুর। পাড়ে কয়েকটি বেঞ্চি ফেলা। এই হল লেক। ব্রজকিশোরবাবু লুঙ্গি বদলে ফর্সা ধুতি পরলেন, গেঞ্জি পাঞ্জাবি, একটি হালকা দেখে চাদর গায়ে ফেললেন, হাতে ছড়িটি নিলেন, জলের ধারে একটি বেঞ্চি পুরো বুড়োদের দখলে। ব্রজকিশোর গিয়ে একটু গলা খাঁকারি দিলেন। নড়ে-চড়ে বসে অবিনাশবাবু বললেন—‘আরে ব্রজ এসো এসো, খাঁকরাচ্ছো কেন, আমাদের পাটিতে ভর্তিতে হবে তো মুখ ফুটে বললেই তো হয়। কি বল বিভূতি!’

বিভূতিবাবু বললেন—‘তাই তো, আচ্ছা ব্রজ, তুমি চিরকেলে রসিক না হয় মানছি, তা রস কি এখানেও পকেটে করে আনবে? আমাদের বুড়ো হাড়ে আর কত সয়?’ বিভূতিবাবু চোখ টিপলেন। তাঁর চোখের ইঙ্গিত অনুসরণ করে ব্রজবাবু দেখলেন অদূরে বটগাছের ঝুরির আড়ালে একটি আঁচল ও একটি পাঞ্জাবির পাশ পকেট দেখা যাচ্ছে। ব্রজবাবু মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বিভূতি, অবিনাশ এবং তৃতীয় ব্যক্তি রাসু এমন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল যে বটগাছের আড়াল থেকে ছেলে-মেয়ে দুটি হঠাৎ উঠে চীনেবাদাম খেতে খেতে সামনে দিয়ে চলে গেল। ছেলেটি মেয়েটিকে বলল—‘কালে কালে হল কি রে মন্দিরা, ঘাটের মড়াতেও প্যাঁক দ্যায়?’

ব্রজবাবু সবচেয়ে ধারে বসেছিলেন, তাঁর দিকে চেয়েই ছেলেটি বলল। ছেলেটি মুখ-চেনা। মনের ভাব মুখে দেখাবার পাত্র ব্রজবাবু নন, কিন্তু মনে মনে তিনি মরমে মরে গেলেন। এরপর ছেলেটির সঙ্গে রাস্তায়-ঘাটে দেখা হলে সে যে এই ধরনের তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য আবার করবে না, তার কোনও স্থিরতা আছে!

রাসু বলল—‘যাক বাঁচা গেল। তারপর তোমার বাড়ির খবর বলো। ছেলেরা কবে ভেন্ন হচ্ছে? অ্যাদ্দিন তোমাতে-গিন্নিতে টেনেছো। তিনি হেঁসেল টেনেছেন, তুমি বাজার টেনেছ। এবার তো ভাই হাতা-বেড়ি উঠেছে হাতে, তোমার পেনশনটুকু বই সঞ্চয় নেই। কী? আছে?’

ব্রজবাবু উঠে পড়লেন। একটু কেশে, মুখে বললেন, ‘ঘুরে আসি।’

‘হ্যাঁ, এসো, তাই এসো গে। বয়সটা তো খারাপ ভায়া। ষাটের গাঁটটি উতরেছো। পঁয়ষট্টিতে আর একটি গাঁট চলছে। চলে ফিরে যন্তরগুলোকে সচল রাখো। নইলে…’

ততক্ষণে ব্রজবাবু হনহন করে হাঁটা দিয়েছেন। এর দু-এক দিনের মধ্যেই ব্রজবাবু লাইব্রেরিতে ভর্তি হলেন, মানে সদস্য হলেন, কড়কড়ে কুড়ি টাকার নোটখানি দিয়ে। লাইব্রেরিয়ান মানুবাবু ‘প্রিয় বান্ধবী’ বলে একখানা বই দিলেন, মুখ গম্ভীর করে ব্রজবাবু বললেন অন্য একখানা দেখি, মানুবাবু এবার দিলেন। ‘তন্ত্রাভিলাষীর সাধু সঙ্গ’, ব্রজবাবু এবার বললেন—‘ছেলেদের বই নেই?’

মানুবাবু বললেন—‘না দাদু, ছেলেদের বই মেয়েদের বই আমরা আলাদা করি না। ওসব একসঙ্গেই থাকে।’

ব্রজবাবু বললেন, ‘ছেলেমানুষদের বই নেই? বাচ্চা-কাচ্চার?’

মানুবাবু বললেন, ‘তাই বলুন। ভুটুর জন্যে নেবেন, আচ্ছা এই দুখানা নিয়ে যান। আগেকারের পুজোবার্ষিকী সব, সমান ওজনের সোনার দাম দাদু।’

মানুবাবুর পুরো গোঁফ পেকে গেছে। তা সত্ত্বেও তিনি ব্রজবাবুকে দাদু বললেন। যাঁর নাকি গোঁফ কাঁচা, মাথার পাকা চুল হাতে গোনা যায়, দাঁত, পানের ছোপ ধরা হলেও পুরো পাটি আস্ত। ভালো। বলো বাবা বলো। বিপত্নীক হয়ে পড়েছেন তার ওপরে রিটায়ার, এরা তাঁকে জোরজার করেই রওনা করিয়ে দেবে মনে হচ্ছে।

ক্ষুন্ন মনে ব্রজবাবু বই দুখানা প্যাকেটে ভরে বাড়ি ফিরলেন। রাতের রুটি তরকারি খেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ব্যাস। নিজের ঘর, নিজের সংসার। দরকার নেই তোর বাজার। দরকার নেই অমন বুড়োটে কুচুটে ছ্যাঁচড়া আড্ডার। ব্রজবাবুর যদি মনোমত সঙ্গী না-ই মেলে তো ঘরের মধ্যে তিনি থাকবেন তাঁর নিজেকে নিয়ে। দূর করো যত্ত বাজে জঞ্জাল।

দু-একখানা গল্প পড়তে পড়তে কখন মজে গেছেন ব্রজবাবু নিজেই জানেন না। সারাদিন শুয়ে বসে থাকা, এমনিতে ঘুম আসতে চায় না। গল্প পড়তে পড়তে ব্রজবাবুর ঘুম আরও পালিয়ে গেল। ভূতের গল্প, মজার গল্প, ইতিহাসের গল্প, আচ্ছা আচ্ছা গল্প বানিয়েছে তো এরা। রাত দুটো পর্যন্ত পড়ে, বইটিকে মুড়ে ব্রজবাবু এক গ্লাস জল খেয়ে পাশ ফিরে শুলেন। মাথার মধ্যে কিলবিল করছে গপ্পো। সেই সব গপ্পোই তাঁকে সে বাত্তিরে মাথা চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াল।

এমনি নেশা লেগেছে যে পরদিন বারোটা থেকেই ব্রজবাবু চান-টান সেরে নিয়ে গলা খাঁকারি দিচ্ছেন।

বড় বৌ বলল—‘বাবার সময়জ্ঞানটা গেছে।’

মেজ বৌ বলল—‘এইভাবেই সব যাবে আস্তে আস্তে।’

ছোট বৌ নিঃশ্বাস ফেলে বলল—‘আমার দাদুরও ঠিক এইভাবে গিয়েছিল দিদিভাই। সব থেকে আগে সময়জ্ঞানটাই যায়। এরপর দেখো খেয়ে বলবেন খাইনি তো। রাতে বলবেন, সকাল হল চা দিলি না? এ আমার নিজের চোখে দেখা আছে গো।’

বড় বউমা নিজে হাতে করে ভাত নিয়ে এলো। কোনমতে খাওয়া সেরে, আঁচিয়ে ঘরে দোর দিলেন ব্রজকিশোর।

আয়নার সামনে টেবিলের ওপর বই পেতে গালে হাত দিয়ে বিভোর হয়ে পড়তে লাগলেন। আজ ব্রজবাবু একখানা গল্প পড়ছেন, তার নাম ‘হৃদয় রঞ্জনের সর্বনাশ’। লেখক বুদ্ধদেব বসু। পড়া শেষ হয়ে গেলে তিনি আরেকটা আরম্ভ করলেন না। উঠে পায়চারি শুরু করলেন। এই হৃদয় রঞ্জনটি অদ্ভুত মানুষ তো! তাঁর মতো একলা। মেসের ঘরে থাকতো—ঘরের দেয়ালে স্যাঁতা ধরে নানান ছবি হত হৃদয় রঞ্জন সে দেখে সময় কাটাত, একবার কোথায় গেছে। এসে দ্যাখে মেস ম্যানেজার ঘর চুনকাম করিয়েছে, দেয়ালের ছবি সব অদৃশ্য। মেস ম্যানেজারকে সে এই মারে তো সেই মারে। ভাবতে ভাবতে ব্রজবাবু শুয়ে পড়লেন। অদ্ভুত লোক তো এই হৃদয় রঞ্জনটা। একাচোরা টাইপের। দেখতে পেলে তিনি ভাব করতেন ঠিক। দেয়ালের হাল? অ্যাঁ দেয়ালের…বলতে বলতে তাঁর দৃষ্টি চলে গেল তাঁর নিজের ঘরের পশ্চিম দেয়ালে। আচ্ছা তাঁর ঘরেও তো ছাপ-ছোপ রয়েছে। দেখা যাক তো কোনও ছবি ছাবা হয় কিনা। ইলেকট্রিক ওয়্যার সমকোণে বেঁকে গেছে সিলিং-এর দিকে। কৌণিক বিন্দুতে একটি পোর্সিলেনের লাইট-শেড, ষাট পাওয়ারের বাল্‌ব ঝুলছে। তার ওপর দিকটায় সিলিং ঘেঁষে একটা বেশ বড় ছোপ, নীল-নীল, সাদা-সাদা যেমন হয়। দেখতে দেখতে ব্রজবাবু আপন মনেই বললেন—‘ধুর।’ আর সঙ্গে সঙ্গে সিলিং থেকে অদ্ভুত দর্শন একটা লোক তাঁর দিকে কটমট করে তাকাল। লোকটার নাক প্রকাণ্ড। ধনেশ পাখির ঠোঁটের মতো। ঠোঁট জোড়া আড়াআড়ি শোয়ানো একটা বাংলার পাঁচ। চোখের চারপাশ নীল। মাঝখানে মস্ত বড় মণি জেগে রয়েছে। মাথাটা টাকে ভরা খালি কিনারে কিনারে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল সাদা চুল।

লোকটা কটমট করে তাকিয়ে আছে দেখে ব্রজবাবুর হাসি পেল। বললেন—‘দূর টাকলু।’ বলে লক্ষ্য করলেন লোকটার এইরকম চেহারা হলে কি হবে—যাকে বলে রাম বোকা। চোখটা ভেড়ার চোখের মতো। কেমন মায়া হয়। তিনি বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। প্রায় সমবয়স্ক, কিন্তু রাম বোকা একটা লোক যদি ঘরের মধ্যে সারারাত জেগে থাকে তো কিছু করার নেই। কাল আবার দেখা হবে।

খুব ভোরবেলায় ব্রজকিশোরবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। বেশ ঝরঝরে তরতরে লাগছে শরীরটা। সূর্য এখনও ওঠেনি। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। ব্রজবাবু উঠে পড়ে মুখ-টুখ ধুয়ে ফেললেন। জামা-কাপড় পরে বেরিয়ে পড়লেন। এত ভোরে পার্কে কেউ কেউ বেড়াচ্ছে বটে, কিন্তু আড্ডা দেবার মেজাজে কেউ নেই। হনহন করে হাঁটছে সব। প্রাণের দায়ে। ব্রজবাবুও হাঁটতে লাগলেন, ধীরে সুস্থে, পাখির ডাক শুনতে শুনতে, ভোরের হাওয়া খেতে খেতে, গাছের পাতার আড়ালে সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে। রোদ একটু চড়া হতেই তিনি পকেট-ঘড়ি বার করে দেখলেন সাড়ে ছ’টা, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে খিলটি তুলে দিলেন। ছেলে-বউরা জাগলেও এখন সব যে যার বাথরুমে। কারুর নজর পড়েনি, বাইরের দরজা খোলা ছিল। ব্রজবাবুর মনে হল পরদিন তিনি তালা দিয়ে বেরোবেন।

সকালবেলাই তাঁকে এমন ভব্যিযুক্ত দেখে বড় বউ মুখ তুলল, ‘বাবা কি কোথাও বেরিয়ে ছিলেন?’

—‘হ্যাঁ এই মানে একটু দরকার ছিল।’ ব্রজবাবুর স্বভাবটাই এমনি। যা সত্য কথা, সেটাকে কিছুতেই বলতে পারেন না। পারেন না মানে, এদের কাছে পারেন না। একটু ঘুরিয়ে বলেন।

‘বেড়াতে বেরিয়ে ছিলুম, প্রাতর্ভ্রমণে গিয়েছিলুম’ এ ধরনের কথা বলতে যেন ভীষণ লজ্জা।

তবে দু-চার দিনের মধ্যেই বাড়ির সবাই ধরে ফেলল। মুখ টিপে হেসে মেজ বউ বলল, ‘বাবা এরকম গুজগুজে স্বভাবের কেন বলো তো দিদি?’

বড় বউ বলল—‘মা ছাড়া আর কাউকে বাবা ঠিক কথাটা বলতে অভ্যস্ত নন। লক্ষ্য করে দেখো। স্বভাব।’

পান মুখে ব্রজবাবু বিছানায় কাত হয়েছেন। পুবে মাথা পশ্চিমে পা। হাতে বই। আগের বই দুটি আদ্যোপান্ত শেষ হয়ে গেছে। ফেরত দিয়ে ব্রজবাবু আরও দুটি ‘ছেলেদের’ বই এনেছেন। এনেছেন ভুটুকে লুকিয়ে। ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রাখেন। নইলে ও ছেলের হাত থেকে আর বই উদ্ধার করতে পারবেন না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ব্রজবাবু হাসি হাসি মুখে পশ্চিমের দেয়ালে সীলিং ঘেঁষে তাকালেন,—‘কি হে টাকলু, রামপাখি!’ ওমা, টাকলুটা তো নেই। তার গাধা-বোকা চোখ নিয়ে টাকলুটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে, চশমা মুছে, এদিক-ওদিক চারদিক থেকে ঘাই মেরে মেরেও ব্রজবাবু লোকটার হদিশ করতে পারলেন না। তারপর হঠাৎ শক খেয়ে ব্রজবাবু বিছানায় চিত হয়ে পড়লেন। সীলিং-এর কোণ থেকে এক সাঙ্ঘাতিক মেয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছে। টিকোলো নাক, ইয়া লম্বা লম্বা চোখ, চোখের পাতা। লম্বা নিটোল ঘাড়। ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক, চোখে কটাক্ষ, ঠোঁটে কৌতুকের হাসি। ঘাড় পর্যন্ত স্পষ্ট বোঝা যায়, তারপর আস্তে আস্তে সব কেমন আবছা হয়ে গেছে। ব্রজবাবু কোনদিন গিন্নি ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাননি। এখন গিন্নি নেই। জানতে পারলে তিনি কি মনে করবেন? কিন্তু ব্রজবাবুর উপায় নেই। চোখ খুললেই সামনে ঘাড় বেঁকিয়ে হাসছে মেয়েছেলেটি। আ গেল যা কি বেহায়া রে বাবা। ব্রজবাবু বেশ শব্দ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন, পাশ বালিশটি জড়িয়ে। এক মিনিট, দু মিনিট, পাঁচ মিনিট। তিনি আবার চিত হলেন। বইটি তুলে পড়তে আরম্ভ করলেন। তারপর যেই পাতা উল্টে ওপর দিকে তাকিয়েছেন অমনি দেখলেন মেয়েটা নাচছে। গলার তলায় যেখানটা আবছা আবছা মতো ছিল সেখানটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। মুখটা চেনা চেনা। অনেক ভেবে তিনি মনে করতে পারলেন গিন্নি যে কি সব সিনেমা পত্রিকা নিতেন তারই কোনটাতে মেয়েটিকে দেখে থাকবেন তিনি। গিন্নি ঘরে না থাকলে ড্রয়ার থেকে বার করে উল্টেপাল্টে দেখতেন, পায়ের শব্দ শুনলেই ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতেন আবার। খুব কৌতূহল হল। চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে মেয়েটাকে দেখতে থাকলেন তিনি। ঝিরি ঝিরি বাকলের মতো গাছের পাতা দিয়ে করা একটা খাটো ঘাগরা পরেছে। নিটোল পা দুটি নাচের ভঙ্গিতে বেরিয়ে আছে। হাতে কি একটা মুদ্ৰামতো। ঠিক নাচ নয়, অঙ্গভঙ্গি, এমন অঙ্গভঙ্গি, নাঃ। ব্রজবাবুর রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। তিনি চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন, ভালো করে দেখতে দেখতে কেমন একটা অসহ্য পুলকে অবশ হয়ে আসতে লাগলেন। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন জানেন না।

কিছুদিন এমন হল ব্রজবাবুর আর ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছে করে না। দালানে ভাত খেতে যান, বারান্দায় একটু রাস্তা দেখেন বসে বসে, কিন্তু ওই পর্যন্ত। কতক্ষণে ঘরে ঢুকবেন, কতক্ষণে দরজা বন্ধ করবেন, যেন তিনি হা-পিত্যেশ করে বসে থাকেন। এতো আগ্রহ, এত পুলকও যে তাঁর সাতষট্টি বছরের শরীরে মনে ছিল তা তিনি জানতেন না। বউরা বলাবলি করতে লাগল, ‘বাবাকে ডাক্তার দেখানো দরকার।’ ছেলেরা বলল—‘কোন নির্দিষ্ট কমপ্লেন নেই, ডাক্তারে কি করবে?’ বউরা বলল, ‘নাই থাক। থাকলেও তো বলবেন না। আমরা বাবা পরের বাড়ির মেয়ে, লোকে পাঁচ কথা বলবে কিছু হয়ে গেলে।’ অগত্যা ডাক্তার এলেন। একগলি পরে বসেন। ছোট ছেলে ডেকে আনল।

ব্রজবাবু বিকেলে বারান্দায় বসে আছেন। ডাক্তার এলো। —‘কি খবর দাদু?’

এই ডাক্তার তাঁর ছেলের বয়সী ঠিকই। মেসোমশাই বললে আপত্তি ছিল না। কিন্তু আজকাল কেউই তাঁকে দাদু ছাড়া ডাকছে না। ডাক্তারের কোল কুঁজো চেহারার দিকে তাকিয়ে ব্রজবাবুর হাসি এলো। এরপর তাঁর নিজের ছেলেরাই না তাঁকে দাদু ডাকে।

ব্রজবাবু বললেন—‘তুমি এদিকে কি মনে করে? এদের কারো শরীর-টরীর খারাপ না কি?’

ডাক্তার বলল—‘খারাপ? না, না। আপনাকেই একটু চেক আপ করতে এলুম।’

‘চেক আপ? আমাকে? কেন? আমার হয়েছেটা কি?’

‘চেক আপের আবার হওয়া-হওয়ি কি?’

ভালো করে দেখে শুনে ডাক্তার বলল—‘বাঃ। ভালো আছেন তো! খুব চনমনে। খিদে হয়?’

‘দিব্যি।’

‘ঘুম?’

‘চমৎকার।’

‘কোনও অসোয়াস্তি?’

‘উহু।’

‘ঠিক আছে। প্রেসারটা একেবারে মার্জিনে আছে। ও কিছু না। পাতে নুনটা খাবেন না।’

যাবার সময় কোলকুঁজো ডাক্তার ছেলেদের ডেকে হেসে বলে গেল—আপনাদের বাবা ‘আপনাদের চেয়ে অনেক ভালো আছেন।’

ক’দিন ধরে ব্রজবাবু সীলিং-এ আর সিনেমার মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছেন না। মনটা খারাপ হয়ে রইল দু-তিন দিন। তারপর হঠাৎ নিজেই নিজেকে বললেন, ‘ধুত্তেরি’ এই বয়সে আর অত ধকল সয় না। গেছে তো বেঁচেছি।’

ব্রজবাবু আবার ভোরবেলা উঠে, সদরে তালা দিয়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোতে লাগলেন। ছেলেরা নিঃশ্বাস ফেলল। বউরা বলল যাক।

দুপুরে ঘুমোলে আজকাল আর ব্রজবাবু রাতে ঘুমোতে পারেন না। তাই দুপুরটা প্রাণপণে বই নিয়ে, পত্র-পত্রিকা নিয়ে জেগে থাকেন। যদিও ভাত খাবার পর একটা ঢুল আসে। যাই হোক, দুপুরে জেগে থাকার জন্যেই বলা যায়, রাতের ঘুমটা নিশ্ছিদ্র হয়। ঠিক দশটা থেকে পাঁচটা। সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। ব্রজবাবু বাথরুম গেলেন, জল, খেলেন তারপর চটিটি পাপোশের ওপর খুলে চিত হয়ে শুলেন। পুবে মাথা পশ্চিমে পা। চোখ তুলতেই ব্রজবাবু ভিরমি গেলেন। পশ্চিমের দেয়ালে এক ভয়ঙ্কর পুরুষ, ইয়া গোঁফ, ইয়া বুকের পাটা, ঝাঁকড়া চুল, তার শেষ কোথায় দেখা যায় না। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে ভীষণ রুষ্ট চোখে। ভয়ে ব্রজবাবু চোখ বুজলেন। কিন্তু বুজলে কী হবে? সেই মুখ সারাক্ষণ ভাসছে চোখের মধ্যে। ব্রজবাবু উঠছেন, জল খাচ্ছেন, শুচ্ছেন, বসছেন, স্বস্তি পাচ্ছেন না। বারান্দার দিকের দরজা খুলতে সাহস হচ্ছে না। যদি ওইরকম রাক্ষসের মতো কোনও চোর বা ডাকাত…। হঠাৎ মনে পড়ল, বারান্দা তো রটআয়রনের জালি ঢাকা। ব্রজবাবু তড়াক করে উঠে বারান্দায় চলে গেলেন, ঘরের দরজাটিতে শেকল দিলেন। আরাম চেয়ারটা পাতলেন। বাকি রাত সেখানেই আধশোয়া হয়ে কাটিয়ে দিলেন।

সকালবেলা তাঁকে বারান্দায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে, বড় বউ বলল—‘কাল যা গরম গেছে, দিল্লি লখনউকে হার মানায়।’

কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনও ব্রজবাবু বারান্দায় রাত কাটালেন। দুপুরবেলা ঘরের দরজা খোলা রাখেন, বই পড়েন, কোনদিকে তাকান না কিন্তু রাত্তিরে শুনশান, প্রচণ্ড ভয়ে ব্রজবাবুর মতো লোকও দিশেহারা হয়ে যান। চতুর্থ দিন মাঝরাত্তিরে বৃষ্টি এলো। পুবে ছাট। জালের মধ্যে দিয়ে ছাট এসে ব্রজবাবুর জামাকাপড় ভিজিয়ে দিতে লাগল। বুড়ো বয়সে কি ব্রজবাবু শেষে নিউমোনিয়ায় পড়বেন? বুক ভর. একটা দম নিয়ে ব্রজবাবু বীরপুরুষের মতো ঘরে ঢুকলেন, গামছা দিয়ে গায়ের জল মুছলেন, ফতুয়া বদলালেন, তারপর শুয়ে পড়লেন, প্রথমে তাকালেন না, মনে মনে বললেন—‘হ্যাঃ। একটা ছায়া, তার চেয়েও কম, একটা ছোপ,—ক’দিন পরই পাল্টে যাচ্ছে, তাকে আবার ভয়! তুমিও যেমন।’

পুরো চোখ খুলে সিলিং-এর দিকে তাকালেন ব্রজবাবু। কিছু নেই। সিলিং দিয়ে লম্বা রেখার জল পড়েছে। ভয়ানক মুখ মুছে গেছে। কিছু সাদা, কিছু নীল, অর্থহীন দেয়াল। ব্রজবাবু খুব নিরাশ হলেন। কিছু না থাকার চেয়ে কি ভয় থাকাও ভালো? সেই রাত্তিরে ব্রজবাবু ঘুমোতে পারছেন না কারণ সব শূন্য, দেয়ালে। তাঁর দেয়ালে কোনও লিখন নেই। অবশেষে তাঁর ঘরের ভেতর থেকেই কে যেন তাঁকে প্রশ্ন করল—‘বেশ তো ব্রজ, কী তুমি দেখতে চাও? বলো? ওই দানব, ওই সিনেমার মেয়ে, না ওই বোকা? না কি আর কিছু বল বল, বলে ফ্যালো।’

ব্রজবাবু বললেন—না না। ওসব তো দেখা হয়ে গেছে। নতুন কিছু দেখাও। নতুন কোনও মুখ। আমার নিজের মুখ, সেটা আমি এখনও দেখিনি। আয়নায় একরকম দেখি। গিন্নির চোখে একরকম দেখতুম। ছেলে-বউ, নাতি-নাতনিদের চোখে আবার আরেক রকম দেখি। বাইরের লোকের ডাকে আমি সাড়া দিতে পারি না। তারা কাকে ডাকে আমি আদৌ বুঝতে পারি না। দেয়ালের ওপর যদি একবার আমার সঠিক মুখটি ফুটে উঠত।’

ঘরের মধ্যে থেকে স্বর বলে উঠল—‘এতোদিন তো তাই-ই তোমায় দেখাচ্ছিলুম।’

ব্রজবাবু চমকে ওঠলেন—‘কে? কে ওখানে? কে একথা বললে? সাড়া দাও।’

কেউ সাড়া দিল না। ব্রজবাবু খাটের তলা, আলমারির পেছন, টেবিলের তলা সব ভালো করে খুঁজে এলেন। কোথাও আবার কেউ না লুকিয়ে থাকে। নাঃ। নেই কেউ। তখন তিনি আবার চটি খুলে, পা মুছে, ফতুয়াটি দ্বিতীয় বার বদলে, কেন না খোঁজাখুঁজিতে ফতুয়া ঘামে ভিজে গেছে, পালঙ্কে এসে শুলেন। পুবে মাথা। পশ্চিমে পা। বললেন—‘তা হলে তোমাকেই দেখাও। তুমি কে! তোমাকেই দেখি।’

ব্রজবাবু কী দেখেছিলেন জানি না। কিন্তু পরদিন মুখের মৃদু মধুর হাসিটি দেখে সবাই বলল—‘বেশ গেছেন। সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতেই গেছেন। পুণ্যবান লোক তো সব সময়ে জীবন দিয়ে চেনা যায় না, মৃত্যু দিয়েও কখনও কখনও চিনতে হয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *