মোহানা

মোহানা

সুরম্য ঘোষাল এবার বড়দিনের পর বহু নববর্ষের চিঠির মধ্যে একটা চিঠি পেলেন সেটা একটু অন্যরকম। গতানুগতিক কার্ড নয়, প্রীতি শুভেচ্ছা নমস্কার ইত্যাদিও নেই। আছে আই আই টি খড়গপুরের কনভোকেশন উপলক্ষে একটি ছাপানো নিমন্ত্রণপত্র। সেই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একটি লাইন বাংলায়—‘সুরম্য, এলে স্বভাবতই তুই আমার এখানেই থাকবি।’ ঠিকানা রয়েছে একটি এ-টাইপ কোয়ার্টার্সের, সই ডক্টর কান্তিময় উপাধ্যায়ের। চিনতে খুব দেরি হল না। দেরি হবার কথা নয়। কারণ আই আই টি জীবনে কান্তি বা কান্তিময়ই ছিল সুরম্য ঘোষালের সবচেয়ে সহৃদয়, সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। যদিও আই আই টি ছাড়ার বছরখানেকের মধ্যেই দুজনের কে কোথায় ছিটকে পড়েছিলেন তার ঠিক নেই। বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা, দেখা-শোনা তো দূরের কথা, সামান্যতম যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না।

এতদিন পর এই নিমন্ত্রণপত্র এবং এক লাইনের চিঠি সুরম্যকে খুবই বিধুর এবং বিব্রত করল। বিধুর কেননা, মনে পড়ে যায়, সব মনে পড়ে যায়। বিব্রত কেননা, জানুয়ারি মাসের যে সময়ে কান্তি তার নিমন্ত্রণটা পাঠিয়েছে সে সময়ে তাঁর বম্বে যাওয়ার কথা। ডিরেক্টার্স-মিটিং। তাঁকে কাগজপত্র নিয়ে হাজির থাকতে হবে। তিনি যদি না যান বোসকে পাঠাতে হবে, তার জন্য বোসকে এখন থেকেই ব্রীফিং করা দরকার। কান্তি যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে, অভিজ্ঞতা এবং কাণ্ডজ্ঞান আছে তাই বেশ খানিকটা সময় হাতে রেখে নিমন্ত্রণটা পাঠিয়েছে। কিন্তু ঠিকানাটা পেলো কি করে? গত তিরিশ বছরে তো স্থান-বদল মন্দ হয়নি। তেত্রিশের এক বম্পাস রোড় কলকাতা থেকে, মহাত্মা গান্ধী রোড় বাঙ্গালোর, চিন্তামননগর পুনা, জওহরলাল নেহরু মার্গ ভুবনেশ্বর হয়ে এখন কোশি রোড জামসেদপুর।

সত্যি, দিনগুলো কিভাবে উড়ে যায়! না উবে যায়। সামান্য একটু গন্ধ রেখে। সুরম্য চিঠিটা পেয়েছিলেন দুপুরে খাওয়ার সময়ে বাড়ি এসে, স্ত্রী-ই ধরিয়ে দিয়েছিলেন খামটা। তখন লনের ছায়া-পড়া দিকটায় কাঁটালগাছের তলায়, স্টীল ফ্রেমের ইজি-চেয়ার পেতে সুরম্য দু মিনিটের জন্য চোখ বুজেছেন কি বোজেননি। এই সময়টা আজকাল বড়ো ঘুম পায়। ঘুমটা দশ মিনিটের মধ্যে বন্দী থাকলে ক্ষতি ছিল না। কিন্তু তা থাকছে না। দশ ছাড়িয়ে পনের, পনের ছাড়িয়ে কুড়ি মিনিট। আধ ঘণ্টার দিকে ঝুঁকছে। যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্নর মতো যা আধ ঘণ্টা তাই এক ঘণ্টা হয়ে যাবেই একটু সাবধান না হলে। মাঝে মাঝে নিজের নাক-ডাকা নিজেই শুনে চমকে জেগে ওঠেন সুরম্য। আজ মনে করলেন স্ত্রীকে বলবেন দুপুরেও রুটিই দিতে। এই ভাত-ঘুম বন্ধ করতেই হবে। কল্যাণী এসে চিঠিটা হাতে দিতে অর্ধ-নিমীলিত চোখ পুরো খুলে মনের বাসনাটা ব্যক্ত করলেন সুরম্য।

ভুরু কুঁচকে উল বোনা থামিয়ে কল্যাণী বললেন—‘কেন? ভাত-ঘুম বন্ধ করবে কেন?’

—‘সে কী! ভাত-ঘুম ভালো? চালিয়ে যাবো?’

—‘পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছ, সারাদিন কোম্পানি অস্থি মজ্জা শুষছে। দুপুরে এক ঘণ্টা ঘুমোলে কি বড়সাহেব খুবই রাগ করবেন?’

—‘ওঃ তুমি যে একেক সময়ে কী বলো! বড়সাহেবের রাগ-অনুরাগের ওপর আমার জীবনযাত্রা নির্ভর করছে নাকি?’

—‘তা ছাড়া আর কি? আজ তোমার ঘুম নির্ভর করছে, কাল তোমার খাওয়া-দাওয়া শোওয়া-বসাগুলোও করবে। অমন চাকরি আর এ বয়সে না-ই করলে?’

—‘ভুঁড়ি হয়ে যাবে কল্যাণী, বোঝো না?’

স্ত্রী যেমন স্বামীর দুর্বল স্থানে আঘাত করতে জানেন, স্বামীও তেমনি স্ত্রীর দুর্বল স্থানটির খোঁজ রাখতে ভোলেন না। এবং সে স্থান হল ভুঁড়ি। কল্যাণী নিজে যোগ-ব্যায়াম করে চেহারাটি মোটের ওপর একহারা রাখতে পেরেছেন। ভুঁড়িয়াল স্বামী। তাঁর দু চক্ষের বিষ। কিন্তু সুরম্যকে অবাক করে দিয়ে কল্যাণী বললেন—‘এমন করছ যেন ভুঁড়ি হতে আর বাকি আছে! আর এই বয়সে একটু-আধটু ভুঁড়ি ভালোই দেখায়। যে সময়ের যা। প্রধানমন্ত্রীকে আজকাল টাকে কেমন সুন্দর মানিয়ে যাচ্ছে দেখছ না?’

সুরম্য অবাক হতে হতে চিঠিটা পড়ছিলেন। চিঠিটা পড়তে পড়তে অবাক হচ্ছিলেন। আই আই টি খড়গপুর। কোথায় সে? কখন? দেশকালের কোন বিন্দুতে? ছেলেকে শান্তিনিকেতনে ভাস্কর্য শিখতে পাঠানো হয়েছিল। বাবা-মার অনেক ইচ্ছা সত্ত্বেও সে মহাজন পন্থা অনুসরণ করেনি। এখন কাঁথা সেলাইয়ের পাঞ্জাবি পরে ললিতকলা আকাদমি ও কলাভবনের মধ্যে যাতায়াত করে। তার সঙ্গেই সম্পর্ক কমে আসছে, আর আই আই টি খড়গপুর! তারপরে আবার ক্ষুদ্র এক লাইনের অন্তরঙ্গ বাংলা—‘এলে তুই স্বভাবতই আমার এখানেই থাকবি—কান্তি।’

ঘাস থেকে রোদ্দুর আরও সরে গেছে। উলকাটার থলি সংগ্রহ করে কল্যাণী ভেতরে চলে গেছেন। সম্ভবত দুপুর ঘুম ঘুমোতে। সুরম্য জেগে উঠেছেন। খুবই জাগ্রত। হাতে চিঠি ধরা। চোখ খুলে, চোখ বুজে সুরম্য দেখছেন, দেখছেন, দেখছেন।

একদল হিংস্রমুখ ছেলে। অল্প বয়স। শাণিত বুদ্ধি। কিন্তু সামান্যতম সুযোগে ভেতরের রাক্ষসগুলো বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং একদল ছেলে নয়। একদল রাক্ষস আসলে।

—‘কী হল? একশবার ওঠ-বোস করতে বললুম করলে না?’

—‘করলুম তো?’

—‘করলে? মাত্র পঁচিশবার করে বলছ একশ? শটকে জানো না এঞ্জিনিয়ার হতে এয়েচ, অ্যাঁ? করো বলছি আরও পঁচাত্তর বার।’

‘আমি গুনে গুনে একশবার করেছি।’

—‘দেখেছিস সৌমিত্র, তখনই বলেছিলুম ছেলেটা ত্যাঁদড়। অল্পের ওপর দিয়ে ছেড়ে দেবো ভেবেছিলুম। এই ব্লাডি বাস্টার্ড, পাঁচশবার কর।’

সুরম্য অন্ধের মতো দৌড়ে গিয়ে বড় রাক্ষসের মুখ খিমচে দিয়েছে। তিনজন তিন পাশ থেকে ছুটে এসে তাকে ছাড়িয়ে নিল। বড় রাক্ষস রাগে কাঁপছে।

—‘এতো সাহস! অ্যাত্তো সাহস! এই তোরা ওকে নিয়ে যা। ওর ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল।’

সতের বছরের পেটের অসুখে ভোগা, মাদুলি-তাবিজ পরা, মা-বাপের একমাত্র আদুরে রোগা-পাতলা ছেলে ঠক ঠক করে কাঁপছে। সুদ্ধু একটা জাঙিয়া পরে।

সবাই মিলে তিনতলার ছাদে নিয়ে গেল ঠেলেঠুলে। বৃষ্টির জলের পাইপ দু’হাতে ধরিয়ে দিল।

—‘নাও। এবার কত বড় বাপের ব্যাটা তুমি দেখি, এই পাইপ বেয়ে নিচে মাটিতে নামতে হবে, তবে বুঝব শালা তোর বাপ আছে।’

পাইপটা দু’হাতে শক্ত করে ধরে সুরম্য ছাদের কোণে উপুড় হয়ে রয়েছে। দেহে সাড় নেই। মুখ ফ্যাকাশে। নিচে নিশ্চিত নিষ্ঠুর মৃত্যু।

কে একজন বলল—‘ও নিজে যাবে না। পা ধরে হ্যাঁচকা মেরে ঝুলিয়ে দে।’

দৌড়ে ছুটে আসছে ওরা।

‘না।’ তীব্রস্বরে একটা চিৎকার। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়িয়েছে। কালো। ষণ্ডামার্কা। সুরম্য গতকালই ওকে দেখেছে। ওর পাশের বেড। এসেছে বীরভূম না বর্ধমানের গ্রামাঞ্চল থেকে।

—‘আরে এটা তো সেই জংলিটা না? কি চাঁদ, তোমার দাওয়াই তো আগেই হয়ে গিয়েছে, আবার এয়েচ কেন? ব্যাধি বেড়েচে?’

—‘ওকে পাইপ ধরে নামতে বলছেন, যদি পড়ে যায়? যদি কেন? ও যাবেই পড়ে, তখন?’

—‘যাব্বাবা, পড়ে যাবার জন্যেই তো ওকে নামাচ্ছি।’

—‘বা চমৎকার! এই আপনাদের শহুরে কালচার? আমি এক্ষুনি থানায় যাচ্ছি।’

—‘যাও, যাও, প্রাণ যদি তাই চায় তো যাও।’

—‘তার মানে? আপনাদের প্রাণে ভয়-ডরও নেই?’

‘ভয় কিসের? নিজেই চড়ল ছাদে। কত করে বললুম ন্যাড়া ছাদ, এখনও পাঁচিল ওঠেনি। উঠিসনি, উঠিসনি। শুনল না। চড়ে নিজে নিজেই শূন্যে ঝাঁপ খেল। পাখি হতে সাধ গিয়েছিল বোধহয়। পাখি হয়ে কলকাতাতে যে কচি প্রিয়াকে ফেলে এয়েচে তারই কাছে যেতে যাচ্ছিল বেচারা। কেস এক্কেবারে সিধে সরল। যাকে জিজ্ঞেস করবে সাক্ষী দিয়ে দেবে। —খুদ খুশি কর লিয়া হ্যায় ইয়ে বেচারা।’

—‘কি করলে ছাড়বেন ওকে?’ বলতে বলতে ছেলেটি এসে হ্যাঁচকা টানে সুরম্যকে ছাদের কোণ থেকে রাক্ষসগুলোর মাঝখানে ফেলে দিল। সুরম্যর পুরোপুরি জ্ঞান নেই। স্বপ্নে দেখার মতো দেখল রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে দেখতে দেখতে ছেলেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েকজন রাক্ষস নিচে ছুটেছে—’আশিস আশিস, কি ডেঞ্জারাস ছেলে! তোরা শিগগিরই দোতলার বারান্দায় পজিশন নে।’

—‘প্রিয়াঙ্কুর তুমি তেতলায় চলে যাও। আর কেউ নেই জোরালো চেহারার?’ রাক্ষসের দলে ভীষণ চঞ্চলতা, ত্রাস, সাড়া পড়ে গেছে।

প্রায় মাঝ রাত্তির, তারা জ্বলজ্বল করছে কালো কুচকুচে আকাশে। হস্টেলের পেছনে ঘাসের ওপর বহাল তবিয়তে দণ্ডায়মান সেই ছেলেটি কান্তিময়। তাকে ঘিরে সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ারের দাদারা।

‘আরে বাস। শাবাশ ভাই। শাব্‌বাশ। ফর দা অ্যাক্ট অ্যান্ড দা স্পিরিট!’

—‘আমাদের একটু সময় দিলে না ভাই! কী যেন নাম বললে? কান্তি? এই, কান্তিতে একটা ট্রীট দে। সুরম্যকেও ইনক্লুড কর। সুরম্য, লেটস বী ফ্রেন্ডস। শেক হ্যান্ডস। থ্রী চিয়ার্স ফর কান্তি উপাধ্যায় হিপ হিপ হুররে। থ্রী চিয়ার্স ফর সুরম্য ঘোষাল হিপ হিপ হুর রে।

প্রোসেশন করে ডর্মে নিয়ে আসা হল কান্তি আর সুরম্যকে। সুরম্যর পরনে তখনও খালি জাঙিয়া। প্রিয়াঙ্কুরদা বলল—‘ছি ছি সুরম্য, তুমি না বালিগঞ্জে মানুষ! এতগুলি দাদার মাঝখানে এই বেশে দেখা দিতে লজ্জা করল না তোমার? ছি, ছি ভাই। শত ধিক্কার তোমাকে।’

জনকদা বলল—‘ধরো আমরা যদি কেউ মেয়ে হতাম? ওমা, কী লজ্জা গো!’ বেডকভারের খুঁট মাথায় চাপিয়ে মুহূর্তে জনকদা ঘোমটা-দেওয়া-বউ হয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল ত্রিভঙ্গ হয়ে।

চারদিক থেকে অমনি জামা-কাপড় বর্ষণ হতে লাগল সুরম্যর মাথায়। বর্ষণ হয় আর দাদারা বলে—‘পরে নে সুরম্য, দেরি করলেই চাঁটা।’ মিনিট পাঁচেক পরে সুরম্যর সাজগোজ শেষ হল। প্যান্ট ফোর্থ ইয়ারের নিমাইদার যার কোমরের মাপ জলহস্তীর, শার্ট গিদওয়ানিদার, হাতাগুলো সুরম্যর হাত থেকে আরও এক ফুট মতো ঝুলছে, জুতো প্রিয়াঙ্কুরদার, সাইজ এগারো, সবাই বলে ইয়েতির পা, মোজাও তথৈবচ, তার ওপরে কোথা থেকে এক খুন-খারাপি রঙের টাই আর খোকাবাবুর মাপের স্ট্র-হ্যাটও হাজির হল।

মাঝরাতের ডিনারটা ভালোই হল। বাসমতীর ভাতের মধ্যে রুটির কুচো, লুচির কুচো, কড়াইশুঁটি, আলু গাজর, বাঁধাকপি, পালংশাক, স্কোয়াশ, টোম্যাটো স-ব। মুখে তুলতে তুলতে জনকদা বললে—‘হরি হে মা-ধব, চান করব না গা ধোব? কে রেঁধেছ মানিক, ছুপকে ছুপকে না থেকে আমার নাকের গোড়ায় একটু এসে দাঁড়াও না বাবা, এ যে বিশ্বরূপের খাদ্য সংস্করণ রে শালা।’

গিদওয়ানিদা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—‘শালা, বাঞ্চোৎ, হুজ্জোৎ, ইজ্জৎ, কেলো, ব্যাটাচ্ছেলে, শুয়ার কী বাচ্চা, খচ্চর, গিদ্‌ধড় আউর কুছ বাংলা গালি আছে?’

‘আছে বই কি রে। একখানা আস্ত গালাগালাই যে বাকি রেখে দিলি ব্রাদার—‘এলাটিং, বেলাটিং সই লো, কী খবর আইল, রাজা একটি বালক চাইল’ বলতে বলতে সুরম্যকে নিয়ে মাঝরাতে সে কী হুজ্জোতি রে বাবা!

সুরম্য চিঠিখানাকে যথাযথ ভাঁজ করে লেফাফায় পুরলেন। তিরিশ বছর আগেকার উত্তেজনায়, উষ্ণতায়, বন্ধুত্বে হাত থরথর করে কাঁপছে। হরিহরাত্মা। তিনি হরি, কান্তি হর। তিনি ক্ষীণকটি, গৌরাঙ্গ, শ্রীমান। কান্তি লম্বা, চওড়া, কালো। মুখে নিখাদ প্রশান্তি, বুদ্ধি, ভালোমানুষি। ভালো মানুষ। কান্তিময় উপাধ্যায়। না তিনি যাবেন। অবশ্যই যাবেন।

তখন ওঁরা বলতেন হিজলি। হিজলি জেলে কয়েকজন রাজবন্দীকে গুলি করে মারা হয়েছিল। প্রতিবাদে আরও কিছু রাজবন্দী অনশন আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। সেই হিজলি জেলভবনই খড়গপুরের প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুট অফ টেকনলজি। দূর থেকে টাওয়ারটা দেখা যেত। খড়গপুর রেল কলোনি পেছনে ফেলে হিজলি যেতে কখনও পথের ডাইনে, কখনও বাঁয়ে, কখনও দু দিকেই বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে খোয়াই। লাল লাল হাঁ করা খোঁদল। গাছপালা ছেড়ে তৃণ পর্যন্ত নেই একটুকরোও। জায়গাটার একটা ভীষণ সৌন্দর্য আছে। সূর্যাস্তের রঙের সঙ্গে খোয়াইয়ের রঙ মিলে গেছে। এমনিতে সূর্যাস্তের রঙে যে রাঙা, গোলাপি, কমলা আভা থেকে তাকে নম্র, পেলব রকমের সুন্দর করে এই খোয়াইয়ের সংস্পর্শে এসে সে রঙ কেমন পালটে গেছে। যেন যুদ্ধক্ষেত্র, শোণিতস্রোত। কলিঙ্গ যুদ্ধ হয়ে গেছে। শবদেহগুলি এই সব খোঁদলের আশ্রয়ে লুকিয়েছে। ধৌলিশৃঙ্গ থেকে অশোক দেখছেন রক্ত রক্ত রক্ত। সব রক্ত এখন শুকিয়ে কালচে হয়ে আসছে। সাইকেল রিকশায় করে বাবার সঙ্গে সেই পথ দিয়ে স্বপ্নে দেখা উচ্চাশামহল খড়গপুর আই আই টি-তে আসা হয়েছিল। সেই স্মৃতির হাত ধরে যাবেন বলে কান্তিকে টেলিগ্রাম করেননি। একা যাবেন। একা একা।

বাবা বলছেন—‘কি রে খোকা, এখনও ভেবে দ্যাখ, থাকতে পারবি তো? না হলে এখনও বল ফিরে যাই। ন্যাশনাল মেডিকেলে অ্যাডমিশন নিয়ে নিবি। বাড়ি থেকে কলেজ যাবি আসবি। তোর মাও নিশ্চিন্ত। তুইও।’

—‘আমি যাবো বাবা। আই আই টি-তে পড়ব। মেডিক্যাল পড়ব না। ডেডবডিতে সেকশন করতে হবে ভাবলে আমার ভীষণ গা গুলোয় বাবা।’

—‘সে তো জানি। ওসব সয়ে যায় রে। সয়ে যায়।’

—‘না আমি এঞ্জিনিয়ার হবো।’

—‘সে তো অনেক দিন ধরে শুনছি। টিকতে পারবি তো? শুনেছি ভীষণ র‍্যাগিং করে। সইতে না পেরে ফিরে এলে খুব অসুবিধে হবে রে!’

ভাবলে এখনও হাসি পায়। কেউ আদেশ করেনি। সুরম্য নিজে নিজেই বাবাকে চিঠি লিখেছিল—‘শ্রীচরণেষু বাবা, তুমি মিথ্যে ভয় পেয়েছিলে। শীতের রাত্তিরে খালি গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনরকম অত্যাচার ওরা করেনি। উপরন্তু আমার সিনিয়র ছেলেদের সবার সঙ্গে এতো ভাব হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে পড়াশোনার জন্য সব ক্লাসে না গেলেও চলবে। অবশ্য তুমি ভেবো না আমি লেকচার ফাঁকি দেবো। ওয়ার্কশপ খুব ভালো লাগছে। বাবা, এবার তুমি এলে কান্তিময়ের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেবো। আমার বিশেষ বন্ধু।’

কান্তিময়, কান্তিময়, কান্তি। মুখে সিগার, ঢিলে-ঢালা একটা পায়জামা আর ধবধবে পাঞ্জাবি পরা দশাসই চেহারার কান্তি এগিয়ে আসছে লনের মাঝখানে সিঁথির মতো পথটা দিয়ে। পথের পাশে মেহেদির বেড়া, দূরে ঝাউয়ের সারি। কান্তি আসছে। চুলে সামান্য সাদা ছোপ, চোখে সেই ভাবালু দৃষ্টি, সেই তীরের মতো হাঁটা।

রিকশা থেকে নামছেন সুরম্য। স্যুটকেস ঠিক নয়, ওভারনাইট ব্যাগের মতো তাঁর লাগেজটা কান্তি রিকশাওয়ালার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিচ্ছেন। অন্য হাতে ঠোঁট থেকে সিগার নামিয়ে কান্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। এক সেকেন্ড। পরক্ষণেই মুখ ফেটে যাচ্ছে, চৌচির হয়ে যাচ্ছে হাসিতে।

—‘সুরম্য, সুরম্য পাগলাটা! এসে গেছিস! আমাকে তো জানালি না কিছু। ভাবছিলুম হয়ত আসবিই না। ভারি অবাক করে দিলি তো। ভারি দুষ্টু হয়ে গেছিস তো আজকাল!’

—‘জানাবার কী আছে? আছেটা কী? এক আধবুড়ো আর এক আধবুড়োর কাছে আসছে। এঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ডীনের বাড়ি বললে কেউ চিনিয়ে দিতে পারবে না? ঠিকানা মিলিয়ে না হয় না-ই আসতে পারলুম।’

—‘আরে ঠিক আছে। ঠিক আছে। বেশ করেছিস। আয়, আয়। যুগল! এই যুগল, ইধর আও। মেরা দোস্ত। বুঝলি? জিগরি দোস্ত। দুজনের লাঞ্চ দিবি ব্যাটা। ঠেসে পুর ভরবি তোর টোম্যাটোর দোরমায়। ঠেসে ঠেসে। হ্যাঁরে সুরম্য। সেই পাতলা পাগলা-পাগলা ভাবটা তো তোর একদম নেই! পাঁচ ছটা বছর টিকিয়ে রাখতে পারলি, আর…।’

—‘তুই কি এখনও ডন বৈঠক দিস নাকি? মুগুর-টুগুর ভাঁজিস?’ একটু হাঁপ ধরে আজকাল সুরম্যর। সাবধানে থেমে থেমে বললেন।

—‘মুগুর না ভাঁজলে এই সব হাড়-বিচ্ছু আই আই টি-র মালদের সামলানো যায়? তু-ই বল না, তোর তো এক্সপিরিয়েন্স আছে। কারিয়া পিরেত বা হয়ে যাচ্ছিলি তো আরেকটু হলে…’

দুজনেই হাসতে থাকলেন।

কান্তিময় বিয়ে করেননি। এমন সুন্দর বাড়িখানাকে তছনছ করে রেখেছে যুগলকিশোর আর তার মনিব। বড় হলঘর ভর্তি কান্তিময়ের কম্প্যুটারের কাণ্ডকারখানা, কম্প্যুটার-বাগিং তিনি নাকি বন্ধ করবেনই। শোবার ঘরে বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবল। কাচে সূক্ষ্ম লাল ধুলোর আস্তর। তার ওপর ফাইলের পাহাড়। বইয়ের পাহাড়, খোলা পেন, ব্লটারে প্রচুর কালি শুকিয়ে রয়েছে। বিছানার চাদর পালটানো হয়নি কতদিন, তার ওপরও বই, ম্যাগাজিন, কান্তির কোট, প্যান্ট পাতলুন।

ঘরে ঢুকে কান্তি এক হাড়-কাঁপানো ডাক দিলেন—‘যোগলো। এই ব্যাটা যুগলকিশোর।’

—‘কি সাহেব’, যুগলকিশোর এসে দাঁড়িয়েছে।

—‘আবার সা-হেব! না রে সুরম্য আমি ওকে মোটেই সাহেব-টাহেব ডাকতে শেখাইনি। নিজে-নিজেই পিক-আপ করেছে। হ্যাঁ রে গো-খোর, এত কিছু পিক-আপ করতে পারিস আর এই বিছানা থেকে জামা-কাপড়গুলো পিক-আপ করতে পারিস না। অ্যাঁ! এ যে একেবারে কাপড়ের এগজিবিশন সাজিয়ে রেখেছিস? বলি, মানুষ বসবেই বা কোথায় আর শোবেটাই বা কোথায়? তোমার মাথায়?’

চেয়ারের দিকে এগোলেন কান্তি। সেখানে আর এক পাঁজা বই। যুগলকিশোর তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বইগুলো দু’হাতে ধরল, সুরম্যর দিকে তাকিয়ে বলল—‘জানেন না সাহেব, আমার এ সাহেব মহা ধুর্তু আছেন। নিজেই আমাকে বলবেন—“খবর্দার, আমার জিনিসে হাত দিবি না, একটা কাগজ এধার থেকে ওধার করলে ব্যাটা তোমার আমি পিঠের ছাল তুলে নেবো।” এই তো? তারপর বাড়িতে লোক এলেই আমার ওপর ত্যাণ্ডাই ম্যাণ্ডাই। অতিথ চলে গেলে আমারই লাভ। সাহেবই দু-দশ টাকার নোট হাতে ধরিয়ে দেবেন। “রসগোল্লা খাস যুগল”। আমারই ভালো।’

মারমুখী হয়ে যুগলের দিকে দু’পা তেড়ে গেলেন কান্তি।

—‘আমায় তুমি ধূর্ত বলো, তুমি নিজে কী? তুমি ব্যাটা বদমাশ, তোমার সঙ্গে আমি বুদ্ধিতে আঁটব? সুরম্য খুব সাবধান, টাকা-পয়সা না হোক মারে রে, লাল হয়ে গেল ব্যাটাচ্ছেলে আমার টাকা মেরে মেরে। আমার মেরে আবার আমাকেই কথা শোনাবে। টাকা-পয়সা ঠিক করে রাখতে পারেন না তো রোজগার করা কেন?”

সুরম্য কান্তির হাতের মোটা বইখানা ধরে ফেললেন। বইটা তিনি যুগলের মাথা টিপ করে ছুঁড়তে যাচ্ছিলেন।

—‘আরে আরে করিস কী কান্তি? যুগল, তুমি এখন যাও তো বাবা, ভালো করে রান্নাটা করো, আমার খুব খিদে পেয়ে গেছে।’ যুগল চলে গেল, গজগজ করতে করতে গেল—‘আপনি ধরলেন কেন বইটা? যুগলও লুফতে জানে। সরতে জানে। মেঝেয় পড়লে অমন বইগুলো চৌচির হয়ে যাবে বলেই না লোফা।’ সুরম্য অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তিনি কাজের লোকের সঙ্গে অনায়াসে কেমন কথা বলে ফেললেন। এটা তাঁর অভ্যাসের মধ্যেই নেই। প্রথমত তাঁর বাড়ির কাজ করে সব মেয়ে লোক। তেলেঙ্গি মেয়ে সব। তাদের কল্যাণীই সামলান। গাড়ি ধোয়া-পোঁছার যে ক্লীনারটি সে এক বিহারী যুবক। তাকে সম্বোধন করে সামান্য কতকগুলো শব্দ, তার বেশির ভাগ অব্যয়, তাঁকে উচ্চারণ করতেই হয়। এ বাদে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতে তিনি আদৌ অভ্যস্ত নন। তিনি আরও অবাক হয়ে দেখলেন যে কখন কান্তির সঙ্গে হাত লাগিয়ে বিছানার ওপরটা, চেয়ার, সব খালি করে ফেলেছেন। বইতে বইতে টেবিলটা ছোটখাটো একটা পাহাড়ের আকৃতি নিয়েছে। দু’হাত ঝেড়ে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে কান্তিময় বললেন—‘বাঁচা গেল বাব্বা; সাত সকালে বিছানা ঝাড়ো, চেয়ার ঝাড়ো, বই ঝাড়ো, কাজ কি কম? এই সুরম্য, বিছানার চাদরটা টান মেরে ফেলে দে তো! চিটচিটে ময়লা রে, শুতে ঘেন্না করে, বালিশের ওয়াড়টাও দিয়ে দিবি ওই সঙ্গে। ন্যাড়া বোঁচা বিছানা থাকলে যদি ব্যাটাচ্ছেলের চৈতন্য হয়, যদি ফ্রেশ চাদর ওয়াড় পাই। সবই তো দয়াময়ের দয়া কিনা?’

কনভোকেশন হয়ে গেছে। হিজলির রাস্তা দিয়ে দলে দলে ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রযুক্তিবিদ্‌রা চলে গেছে। হাতে ছাড়পত্র। ভারতবর্ষের যে কোনও এক নম্বর প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি মর্যাদার পদলাভের ছাড়পত্র। এদের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ শেষ পর্যন্ত চলে যাবে বিদেশে। আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য। দু’দিন ধরে সন্ধেবেলায় ঘুরে ঘুরে সুরম্য দেখেছেন বন কেটে সেই বসত যা তাঁরা সদ্য এসে দেখেছিলেন, তা এখন কেমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কলোনি শহরই হয়ে গেছে। কলেজ বিল্ডিং-এর শাখাপ্রশাখা, ছাত্রদের হস্টেল, ছাত্রীদের হস্টেল, রাস্তাঘাট, বিভিন্ন টাইপের কোয়ার্টার্স হ্যালোজেন-জ্বলা রাতে আলোর গায়ে লেপটে-থাকা রাতপোকা। ন’টা নাগাদ যুগলকিশোর খাবার দিয়ে দিল। খেয়ে-দেয়ে কান্তিময় বললেন—‘চল পাগলা, বেড়িয়ে আসি। কালই তো চলে যাবি।’

যুগল বল—‘সেই ভালো সাহেব, আপনারা একটু বাইরে গেলে বিছানা-টিছানা একটু গুচ্ছে-গাচ্ছে রাখতেও আমার সুবিধে হয়।’

কান্তি বললেন—‘নোটিস দিল রে। ঘরের বউও এমনটা দ্যায় না। এমন মাল আর দেখেছিস?’

সুরম্য বললেন—‘চল, আজ আমাদের পুরনো ফেভারিট জায়গাগুলো ঘুরব, বসে থাকবো। যদিও সেসব জায়গা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা বলা শক্ত।’

কান্তি বললেন ‘যেতো না, তুই চিনতে পারতিস না। আমি মাঝের পাঁচ বছর পশ্চিম জার্মানিতে বাদে টানা রয়ে গেছি এখানে, আমি জানি। আমি বলে দিতে পারি। চল্।’

গায়ে সোয়েটার। তার ওপর শাল জড়িয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লেন। ‘চিনতে পারছিস জায়গাটা?’

—‘একেবারেই নয়। কোনও ল্যান্ডমার্ক আছে?’

—‘আছে, তবে সেটা এখনই বলছি না। এটা হল সেই ধূধূ তেপান্তরের মাঠ যার ওদিকে সে সময়ে উদ্বাস্তু কলোনি বসেছিল।’

—‘সেই মাঠের এই চেহারা হয়েছে? বলিস কী? মাঠ বলে যে আর চেনাই যায় না!’

—‘সেই মাঠের এই চেহারাই হয়েছে। ল্যান্ডমার্ক হল ওই বট-অশত্থ, দুটো গাছ একসঙ্গে একই স্পট থেকে বেরিয়েছে। মনে পড়ছে? দ্যাখ!’

সুরম্য ভালো করে দেখলেন গাছ দুটো। অন্ধকারেও ভিন্ন ভিন্ন পাতার গড়ন বোঝা যাচ্ছে। বট একদম জমাট অন্ধকার। কিন্তু অশত্থের পাতা দুলছে। ফাঁক দিয়ে দিয়ে আকাশের আলো গলে পড়ছে। বললেন—‘ঠিকই। সেই গাছ। এখন মনে হচ্ছে এর অন্ধিসন্ধি চিনি আমি। ঠিক এর ধারে ছিল ফিজিক্সের ডেমনস্ট্রেটর উধম সিংজীর কোয়ার্টার্স। পাজি ছেলেরা ওঁর নাম দিয়েছিল উদোম সিং, তোর মনে আছে? কোয়ার্টার্সটা এইচ-টাইপ। ওঁর স্ত্রী সব সময়ে একটা সেমিজ পরে থাকতেন। আঁটসাঁট মোটা, যখনই দেখা হত ‘এ কিষণ’ বলতে বলতে বাগান পেরিয়ে রাস্তায় জঞ্জাল ফেলতে চলে যেতেন। আমরা চোখ তুলে তাকাতে পারতুম না।’

কান্তি বললেন—‘ইয়া। এবং ওঁদের কিষণ ছাড়াও একটি মেয়ে ছিল। প্রাণচঞ্চল, সুন্দর। তুই তাকে দেখলেই সে সময়ের একটা পপুলার গান গাইতিস—বনময়ূরের নাচ দেখতে যাবো; মনে আছে? মেয়েটা বেড়া ধরে সামনে পেছনে দুলত আর হাসত!’

—‘খুব মনে আছে,’ সুরম্য হাসি হাসি মুখে বললেন।

—‘শুনলে আশ্চর্য হোস না, সেই মেয়েটি সন্তোষ এখন এখানকারই এক লেকচারারের স্ত্রী। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টেরই। মোটা যা হয়েছে, ইয়া খাড়াই, ইয়া ছাতি, তোর সাধারণ ফিতেতে কুলোবে না।’

—‘বলিস কী? বনময়ূরী আর বনময়ূরী নেই?’

—বনময়ূরী ছেড়ে, বনমুরগী, বন-হরিণী, বন-বাঘিনী কিছুই নেই। নিতান্ত এক ঘরপোষা দুধেল গাই-গরু বনে গিয়েছে। এমনিই পৃথিবীটার অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্‌সের ধরনধারণ রে পাগলা!’

বলতে বলতে কালভার্টের ওপর বসলেন কান্তিময়। পাশে বসতে বসতে সুরম্য বললেন—‘তুই কি আমার মতন হাঁপিয়ে গেলি নাকি রে?’

—‘উঁহু। হাঁপাতে আমার এখনও দেরি আছে। একটু বসাই যাক না। একটু বসলেই বুঝতে পারবি ঠিক এইখানটায় আমরা বসতে ভালোবাসতুম। সাইকেল দুটো ও-ই গাছটার গায়ে ঠেসানো থাকত। আমরা বসতুম যেন ঘোড়া থেকে নেমে রাজপুত্তুর। মন্ত্রীপুত্তুর।’

বেশ শীতের রাত। চারদিক শুনশান। পাতাটি কাঁপছে না কোথাও। পৃথিবীর যেন কেমন ঘোর লেগে গিয়েছে। নক্ষত্র দেখতে ওপর দিকে চাইতে হয় না। তারা গোল হয়ে ঘিরে ধরেছে দুজনকে। অগণ্য তারা, তারামণ্ডল, ক্যাসিওপিয়া কালপুরুষ, লঘু সপ্তর্ষি, পারসিউস। রাজপুত্তুর, মন্ত্রীপুত্তুর। অনেক অনেক ক্ষণ পরে সুরম্য বললেন।

—‘কিসের গন্ধ রে? কী ফুল?’ যেন ঘুম ভাঙা স্বর।

—‘পাচ্ছিস? পাচ্ছিস তা হলে?’ চাপা উত্তেজনা কান্তিময়ের গলায়।

—‘পাচ্ছি। পাচ্ছি। কী ফুলের গন্ধ বল তো?’

—‘ফুল নয় ফুল নয় রে সুরম্য, এ সময়ে ঘর সাজানো রঙিন ফুল ছাড়া আর কী পাবি, বল? এ হল মউল আর শাল, ছাতিম আর বকুল গাছের শরীরের গন্ধ, অন্তত আমার তাই ধারণা। গত তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর, তারও অনেক অনেক বেশি কতকগুলো ভীষণ ব্যক্তিত্বশালী, অহঙ্কারী গাছ এই রাস্তার আশেপাশে, কোণে-টোনে কোথাও নিজেদের অস্তিত্ব সদর্পে টিকিয়ে রেখেছে রে পাগলা। সেই এক গাছ, এক গন্ধ যা আমরা ছাত্রকালে পেতুম। সেই এক। মনে কর সুরম্য কী আশ্চর্য! কী পরমাশ্চর্য! এই সব ইঁট কাঠ, রাস্তাঘাট বদলে গেছে, মানুষজন, আমরা যারা যৌবন বাউল ছিলুম কাঁচা বয়সের, তারা এখন পরিপক্ক প্রৌঢ়, তোর মাথায় টাক আমার রগে সাদার ছিট, তোর পেটে ভুঁড়ি, আমার পায়ে কড়া। দ্যাখ তবু সেই এক গাছ, এক বৃক্ষগুচ্ছ, একই গন্ধ সুরম্য, সেই একই গন্ধ। কিছু কি অনুভব করছিস? কিছু কি মনে পড়ছে? মনে পড়ে? এখন? এইখানে? এমনি করে?’

মন্ত্রমোহিতের মতো সুরম্য বললেন—‘পড়ে কান্তি। পড়ছে। পঁচিশ বছর আগে কনভোকেশনের পর এখানে এই কালভার্টে তুই আর আমি। আমি আর তুই।’

—‘আর এই অন্ধকার। এই গাছ। এই গন্ধ।’

—‘এই গাছ। এই গন্ধ কান্তি, এই-ই গন্ধ।’

—‘মনে আছে আমরা সেদিন কিরকম যেন হয়ে গিয়েছিলুম—’ কান্তি বললেন।

—‘স্পষ্ট মনে পড়ছে আমার,’ সুরম্য বললেন—‘কান্তি তুই রুদ্ধ গলায় বলছিলি, “সুরম্য, বন্দরের কাল শেষ হল রে। এবার আমরা এক একজন এক এক দিকে পাল তুলে ভেসে পড়ব।” আমি বললুম—‘জাহাজ আবার পুরনো বন্দরে ভেড়ে, ফিরে আসে। কান্তি আমরা কোনদিন এ বন্দরে ভিড়ব না। ফিরব না।”

কান্তিময় বললেন—‘আমি বললুম—“সুরম্য কথাটা খুব মেয়েলি শোনাচ্ছে কিন্তু আমি তোকে ছেড়ে থাকব কী করে? আমার এই আসল বড় হওয়ার কাল, বালক থেকে যুবক। আর কেউ নয়, তুই, তুই-ই থেকেছিস আমার পাশে। দেখেছিস আমার সব দুঃসহ ঘাম দেওয়া কষ্ট, আমার সব শির ছেঁড়া দপদপে আনন্দ। কেউ জানে না, শুধু তুই জানিস। আমি চিন্তাই করতে পারছি না কী ভাবে আমি তোকে ছেড়ে…’

সুরম্য বললেন—‘আজ বলছি, সেদিন তোকে বুঝতে দিইনি। আমি ভেতরে ভেতরে ঠিক এই একই কারণে কাঁদছিলুম। কাঁদছিলুম রে কান্তি। অথচ আমি পুরুষ, আই আই টি-র কঠিন বছরগুলো আমাকে অনম্র পুরুষ করে গড়েছে, তাই সে কান্না দেখানো যায় না। প্রেমিকাকে ছেড়ে চলে যেতে হলে যে দুঃসহ যাতনা হয়, সেই যাতনা তখন আমার মনে।’

কান্তি বললেন—‘আমারও মনে। জানি কোনমতেই প্রকাশ করতে পারব না। লোকে ভুল বুঝবে। ভুল ব্যাখ্যা দেবে। অথচ একজন যুবক ছাড়া আর একজন সদ্য যুবককে কেউ বুঝতে পারে না। বোঝার কথা না। সুরম্য সেদিন কি আমরা আবেগের মাথায় কোনও প্রতিজ্ঞা করেছিলুম?’

—‘না রে কান্তি,’ সুরম্য বললেন—‘প্রতিজ্ঞা করার পক্ষে, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পক্ষে অনেক পরিণতমনস্ক, প্রাজ্ঞ, আমরা হয়ে গিয়েছিলুম। আমাদের প্রাজ্ঞ মন আবেগকে সারাক্ষণ বলছিল—“স্থিরো ভব। স্থিরো ভব। এই কাঁচামি ভালো না।” তাই দুজনের একজনও অন্যজনকে কোনও প্রতিশ্রুতি দিইনি।’

—‘কিন্তু মনে মনে? মনে মনেও কি না?’

—‘তা নয়। মনে মনে আমরা অবিরাম প্রতিজ্ঞা করছিলুম এই ক’বছরের বিচিত্র অভিজ্ঞতা বৃথা হতে দেবো না। এই অনুপম বন্ধুত্ব নষ্ট হতে দেবো না। এই বিদ্যা ব্যর্থ হতে দেবো না। আমি কি ঠিক বলছি?’

—‘ঠিকই বলছিস রে রাজপুত্তুর, একদম ঠিক। তোর কি মনে আছে সেই সময়ে, ঠিক সেই সময়ে যখন আমরা আসন্ন বিচ্ছেদে ভারাক্রান্ত দুটি বিভ্রান্ত হৃদয় তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল!’ সুরম্য বললেন, গাঢ় গম্ভীর স্বরে বললেন—‘এতো মনে আছে, আর এই চূড়ান্ত ঘটনাটা, ক্লাইম্যাকসটা মনে থাকবে না? আমরা মৃদু গলায় কথা বলছি। আমাদের ডান দিকে যেখানে এখন প্রফেসরদের কোয়ার্টার্স, দূরে কিছু প্রাইভেট বাড়িও উঠেছে, ওইখানে ছিল তখন সালোয়ার জঙ্গল। বেশ ভালো জঙ্গল। রাতেরবেলায় শেয়াল ডাকত। সেই জঙ্গলের মধ্যে থেকে হঠাৎ মেয়েলি গলার, খুব মৃদু, মধুর মেয়েলি গলার একটা কান্না উঠল। আমরা দুজনেই সটান উঠে দাঁড়িয়েছি। তীরবেগে ছুটে যাচ্ছি।’

কান্তি বললেন—‘দু হাতে গাছের ডাল, ছোট ছোট ঝোপ সরাতে সরাতে এগোচ্ছি। তোর শার্টের কাঁধ ছিড়ে গেল, আমার চাদর কাঁটায় আটকে যাচ্ছে। মুখে দুজনেই বলছি কে? কে ওখানে? কে কাঁদলে, সাড়া দাও।’

সুরম্য বললেন—‘আমি বলছিলুম—“ভয় নেই, আমি আছি। আসছি।” দেখলুম একটা বিরাট গাছ। শিরিষ কি তেঁতুল হবে। রাতের অন্ধকারে ভালো করে চেনা যাচ্ছে না। তার তলায় সাদা কালো ছিট-ছিট শাড়ি পরে একটি মেয়ে পড়ে আছে, যেন হতচেতন।

কান্তি বললেন—‘দুজনেই দৌড়লুম। পড়ি-মরি করে। তারপর?’

—‘তারপর দেখলুম গাছতলায় শুধু একটা ছায়া পড়ে আছে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরম্য চুপ করলেন।

অনেকক্ষণ পর কান্তিময় বললেন—‘নিজেদের তখন যতই প্রাজ্ঞ মনে করি এখনকার তুলনায় তখন তো বালকই ছিলুম। এই ঘটনাটার সঠিক ব্যাখ্যা দেবার পরিপক্কতা আজ হয়েছে। তুই এটার কী ব্যাখ্যা দিস সুরম্য?’

—‘প্রাকৃতিক ঘটনা। মানসিক আবেগের ফলে একটা ভুল, ভ্রান্তি, ভ্রান্তদর্শন, ভ্রান্ত শ্রুতি এ ছাড়া কি?’ সুরম্য বললেন।

—‘আর কিছু নয়?’ কান্তি বললেন—‘প্রকৃতি হয়ত হাওয়া তুলেছিল, ডালপালার মধ্য দিয়ে তাকে বইয়েও ছিল, প্রকৃতি হয়ত ছায়া ফেলেছিল, কিন্তু দুজনেরই এক ভুল হল কী করে? কেন? তার কারণ আমাদের মনে। সেই কান্না, সেই ছায়াময়ী সে আমাদের মনস্তত্ত্বের একটা সূত্র। আয় আজ তার ব্যাখ্যা করি। তুই চেষ্টা কর প্রথমে।’

সুরম্য বললেন—‘কান্তি আমরা তখন জীবনের একটা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি। বৃহত্তর জীবন আমাদের ডাকছে। সমস্ত দেহমন দিয়ে আমরা এই জীবনের টান অনুভব করতে পারছি। নদী যেমন অনুভব করে সমুদ্রের টান। কিন্তু সেই জীবন অজানা, অজানা বলেই যেমন আকর্ষক তেমন রোমাঞ্চক। ওই কান্না, নারীকণ্ঠের কান্না, আমাদের সাড়া, ছুটে যাওয়া এবং নারীমূর্তি দেখা সবই সেই ভয় ও আকর্ষণের মিশ্র প্রতিফলন হতে পারে।’

কান্তি বললেন—‘তুই তা হলে বলছিস ওই নারীমূর্তি বৃহত্তর জীবনের প্রতীক? বিপন্ন জীবনের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা ছুটে গিয়েছিলুম! ভালো, ভালো সুরম্য, হতে পারে। আমি সঠিক জানি না, কিন্তু হতে পারে।’

সুরম্য বললেন—‘তোর যেন ব্যাখ্যাটা পছন্দ হল না মনে হচ্ছে? তুই যেন ঠিক স্যাটসফায়েড নোস। তোরও নিশ্চয় তা হলে একটা আলাদা ব্যাখ্যা আছে।’

—‘আছে রে পাগলা আছে। তোর ব্যাখ্যাটার থেকে আরও অনেক সাকার, সাবয়ব সে ব্যাখ্যা। তুই শহরের ছেলে ছিলি। বরাবর সাহেবি ইস্কুলে পড়েছিস। তার ওপরে বাবা অধ্যাপক, মা অধ্যাপিকা। তোর চিন্তাধারায় দার্শনিকতা বরাবর ছিল। আমি দ্যাখ গাঁইয়া। বর্ধমানের গণ্ডগ্রামে আমার বাড়ি। সাত মাইল জঙ্গুলে পথ ঠেঙিয়ে জেলা স্কুলে পড়েছি। প্রাণ কণ্ঠাগত করে স্কলারশিপ জোগাড় করেছি, আই আই টি-তে জায়গা করে নেওয়ার জন্যে আমায় অনেক দাম দিতে হয়েছে। আমার কাছে এই সব আকাশ মাটি গাছপালা কবিতা নয়, এসব বায়োস্ফিয়ার। ওই অদ্ভুত, অলৌকিক ঘটনাটারও আমার কাছে আরও স্পষ্ট, শরীরী ব্যাখ্যা আছে।’

সুরম্য আগ্রহে সোজা হয়ে বসলেন। কান্তি বললেন—‘সুরম্য, তোর মনে আছে বনময়ূরীদের কোয়ার্টার্স যে রাস্তায় তার সমান্তরাল আরেকটা রাস্তায় আমরা অনেক সন্ধেবেলায় বেহালা শুনতে যেতুম!’

সুরম্য বললেন—‘মনে আছে। বেহালার ভাঙা ভাঙা গলায় কর্ণাটকী মার্গ সঙ্গীত।’

কান্তিময় বললেন—‘আহা, সে যে কী অপূর্ব! কী অপার্থিব! সেখানে, সেই রাস্তাতেও এমনি বকুল, মউলের তীব্র মদগন্ধ ছিল, তার সঙ্গে মিশে সেই ঐশী আকুতি আমাদের কিভাবে আলোড়িত করত তোর মনে আছে?’

—‘আছে।’

—‘তবে নিশ্চয়ই এ-ও মনে আছে বেহালা বাজাতেন ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রোফেসর রামানুজ বিনায়ক নায়ারের বোন। কেরালা থেকে সদ্য সদ্য এসেছিলেন। চট করে বাইরে বেরোতেন না। দু-এক দিন শুধু প্রফেসরের বাড়ি গিয়ে চকিতের জন্য দেখা হয়ে গিয়েছিল।’

সুরম্য বললেন—‘নায়ারের স্ত্রীর কী অসম্ভব শুচিবাই ছিল তোর মনে আছে? বড় বড় বেড-কভার, পর্দা, সোফা কভার প্রতিদিন, প্রায় প্রতিদিন কাচতেন আর বাগানময় ঝোপের ওপর মেলে মেলে শুকোতে দিতেন।’

কান্তি বলতেন, ‘আমরা সেসব দেখতুম না, প্রফেসর নায়ারও ছিলেন খুব স্থূল প্রকৃতির মানুষ। তাঁকেও আমরা পছন্দ করতুম না। তবু তাঁর বাড়ি যেতুম, দুজনে যুক্তি করেই যেতুম, নায়ারের বেহালাবাদিনী বোনকে যদি কোনমতে দেখতে পাই। একদিন আমাদের কফি দিয়ে গেল মেয়েটি, সেদিন তাকে ভালো করে কাছ থেকে দেখি। তোর মনে আছে সেই প্রথম দেখা?’

—‘আছে। তবু তোর মুখে শুনি। শুনতে বড়ো ভালো লাগছে রে কান্তি।’

—‘আমরা তার চোখ দেখলুম না, নাক দেখলুম না, মুখ হাত পা কিছু দেখলুম না। শুধু দেখলুম সে তার ওই বেহালাটার মতোই একহারা, ওইরকম মেহগনি রঙের। এবং ওই ভাঙা ভাঙা কর্ণাটকী সুরের মতোই সে করুণ এবং অপার্থিব। আমরা জেনেছিলুম, গোঁড়া নাম্বুদ্রি পরিবারে একমাত্র বড় ছেলেরই বিবাহ করার অধিকার আছে। বাকি সব ছেলেদের বিবাহ সিদ্ধ নয়। তাদের স্ত্রীরা বিবাহিত স্ত্রীর সামাজিক এবং শাস্ত্রীয় মর্যাদা পায় না। অন্যান্য ছেলেদের এই বিবাহ নায়ার পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে হয়। প্রফেসর নায়ারের বোন এইরকম এক বিয়ের প্রহসনকে পেছনে ফেলে পালিয়ে এসেছে দাদার কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে এই কুলপ্রথার কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হবেই, এইরকম যেন আমরা কানাঘুসোয় শুনেছিলুম। কেন না মেয়েটির দাদার, অর্থাৎ আমাদের প্রফেসর নায়ারের এ ব্যাপারে বোনের ওপর সহানুভূতি ছিল না। তাঁর স্ত্রীর তো নয়ই। সুরম্য, আমার ধারণা আমাদের ছাত্র-জীবনের সেই অন্তিম রাত্রে অরণ্যের মধ্যে সেই কান্না, মেয়েলি কান্না, এবং গাছের ছায়াকে নারী বলে ভুল করার পেছনে ছিলেন প্রফেসর নায়ারের সেই বোন। তাকেই আমরা সেদিন অরণ্যের ছায়ায় দেখেছিলুম।’

সুরম্য বললেন—‘খুবই অভিনব ব্যাখ্যা। হতে পারে কান্তি। খুবই সম্ভব।’

‘তবু, তা সত্ত্বেও’, কান্তি বলে চললেন—‘আমরা কেউই এই মেয়েটির ব্যাপারে একটুও এগোইনি, তার কারণ ছিল, দুজনেই জানতুম আমরা উভয়েই তার প্রেমে পাগল, একজন তাকে উদ্ধার করলে সে অপরজনের কাছে মহাপাতকি বলে গণ্য হবে। আমাদের মধ্যে এই অলিখিত সমঝোতা ছিল। সেও এক রকমের প্রতিশ্রুতিই।’

সুরম্য চিন্তিত মুখে চুপ করে রইলেন। কান্তি বললেন—‘আমি তোকে কোনও আদালতে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের দায়ে সোপর্দ করতে পারব না সুরম্য। কিন্তু তুই কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাত তাড়াতাড়ি চাকরি জোগাড় করে প্রফেসর নায়ারের বোন সাবিত্রী কল্যাণী নায়ারকে রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ করলি, কলকাতা ছাড়লি আমাকে এড়াতে, এটা করে তুই প্রতিশ্রুতিভঙ্গের মহাপাপ করেছিস সুরম্য। কিন্তু কী করে এটা তুই সম্ভব করলি? তুই কি আগে থেকেই কল্যাণীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলি, আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করে? এর তুই কী জবাব দিবি বল?’

অনেকক্ষণ বসে আছেন, পা ধরে গেছে, সুরম্য আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন—‘যোগাযোগ আমি করিনি রে কান্তি। কল্যাণীই করেছিল। সে তার নায়ার নিয়তির থেকেই শুধু মুক্তি চায়নি, তোর কাছ থেকেও মুক্তি চেয়েছিল। কল্যাণী আমাকে সমস্তই বলেছে। কিভাবে তুই তার ভোরবেলা জঙ্গলে বেড়াতে যাবার সুযোগ নিতিস। কিভাবে একদিন শেয়ালে আক্রমণ করলে তুই তাকে বাঁচিয়েছিলি কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে একা পেয়ে তুই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে খুবই অসংযত ব্যবহার করেছিলি। কাউকে কিছু না বলবার প্রতিজ্ঞা করলেও কল্যাণী এসব কথা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেনি কান্তি। তোর পাছে কষ্ট হয় তাই আমি এতকাল এ সবই তোর কাছ থেকে গোপন রাখতে চেয়েছিলুম। প্রতিশ্রুতিভঙ্গ তুই-ই আগে করলি। পরে আমি তার চক্রে জড়িয়ে গেলুম।’

কান্তি দু হাতে মুখ ঢেকে বসে ছিলেন। ভাঙা গলায় বললেন, ‘সুরম্য, সুরম্য, কল্যাণী আমার অসংযত আচরণটাই দেখল, তার পেছনে আমার উন্মত্ত ভালোবাসাকে দেখল না? সুরম্য, তুই আমার কথা মনে করেও নিজেকে কল্যাণীর থেকে দূরে রাখতে পারলি না? তুই যে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলি! যা পেয়েছিলুম দুজনে একসঙ্গে পেয়েছিলুম, যা পেতুম না দুজনেরই না পাওয়া থেকে যেত!’

সুরম্য শান্ত, মৃদু, নম্র কণ্ঠে বললেন—‘কান্তি, আমাদের সেই ছাত্রজীবনের অন্তিম রাত্রির ঘটনার যে ব্যাখ্যা তুই দিলি তা-ও যেমন সত্য, আমার দেওয়া ব্যাখ্যাটাও তেমনই সত্য। আসলে সাবিত্রী কল্যাণী নায়ার ছিল আমাদের কাছে সেই মোহানা, সেই বৃহত্তর জীবনের প্রতীক যা বিরাট, তীব্র, আকাঙক্ষাময়, করুণ, আর্ত। সেই জীবন, সেই প্রার্থী ধরিত্রীকে আমরা আমাদের রক্ত দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছি। আমি একভাবে করেছি। কল্যাণী আমার ঘরণী হয়েছে, তাকে আমি পেয়েছি। এবং পেয়েছি বলেই অনিবার্যভাবে আস্তে আস্তে খসে গেছে তার অবয়ব থেকে সেই মোহ, সেই সুদূরতা, সেই গভীর কারুণ্য যার নিবেদন মানুষকে চিরকাল প্রাণিত, স্পন্দিত করে রাখে। আমি প্রৌঢ় হয়েছি। মাংসপেশী শিথিল হয়েছে, হাইপ্রেসার, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, যান্ত্রিকভাবে মেপে মেপে জীবনযাপন করি। সম্পন্ন হয়েছি। কিন্তু সাধারণ। খুব সাধারণ। কান্তি, তুই জিইয়ে রেখেছিস সেই প্রাণ যা এখনও শক্তিতে টগবগ করে, সেই মন, সেই হৃদয় যা এখনও মননে অক্লান্ত, যা এখনও চাইতে পারে, এখনও জীবনের কাছ থেকে অনেক আশা করে, অনেক অনেক আশা, এখনও বেদনায় মুহ্যমান হয়, জীবনে গল্প সাজাতে পারে, ছুটে যায় একটার পর একটা শিখরে। কান্তি, আমার বিশ্বাস সেই ছায়াময়ী যার অন্য নাম জীবন তাকে যদি কেউ পেয়ে থাকে তবে তুই-ই পেয়েছিস।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *