সবর্ণ

সবর্ণ

সবেমাত্র আলোটা জ্বেলে দিয়ে সারাদিনের পর একটা পত্রিকা হাতে একটু গা এলিয়েছেন সুমিত্রা, ঝপ করে বিদ্যুৎ পিঠ-টান দিল। সদর দরজার কড়াটাও সঙ্গে সঙ্গে যেন ষড়যন্ত্র করেই খটাখট নড়ে উঠল। বাইরে ধোঁয়াশার পিঠে ভর দিয়ে উঁচিয়ে আছে মধ্য পৌষের দমচাপা, হিমেল সন্ধে। কাজের লোক, মুনমুনের বাবা কেউ এ সময়টা বাড়ি থাকেন না, শুধু তিনি আর মেয়ে। এই পরিস্থিতিতে দরজার কড়া নড়া-টড়া একেবারেই মনঃপূত নয় তাঁর। বহুবার শিবনাথকে বলেছেন একটা ম্যাজিক-আইয়ের ব্যবস্থা করতে। সন্ধে হোক আর যাই হোক, কড়া-নাড়া মানুষটার আবছা আদলও তো বোঝা যায়! তা এসব তুচ্ছ বৈষয়িক কথাবার্তায় সে ভদ্রলোক কান দিলে তো! মাইক্রো অথবা ম্যাক্রো এই দুই চরম জগতেই তাঁর ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়াকলাপ সীমাবদ্ধ। মধ্যবিত্ত ব্যাপার চট করে শ্রুতিগোচর হয় না।

অগত্যা জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালেন সুমিত্রা। —‘কে?’ গলার আওয়াজে যদি জানান দেয়।

—‘আমি!’ নিচ থেকে উত্তর এল।

—‘কোন আমি রে?’

—‘আমি পার্থ, কাকিমা।’

গলা শুনে বুঝতেই পেরেছিলেন। তবু নিশ্চিন্ত হয়ে নিলেন। বাইরে এখন নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। সাবধানের মার নেই।

আজ সন্ধেতেই পার্থ এমন হুড়মুড়িয়ে এসে পড়বে ভাবেননি সুমিত্রা। সকালবেলা কলেজ যাবার মুখে কাগজটা দিয়ে গিয়েছিল। গুণাবলীর বিস্তৃত বিবরণ। ওর নিজের। একটা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দরকার। দেবেন ওর কোন মাস্টারমশাই। লিখে, টাইপ করে নিয়ে যেতে বলেছেন, দস্তখৎ করে স্ট্যাম্প বসিয়ে দেবেন। তাই সুমিত্রার দ্বারস্থ হয়েছিল। ভালো করে গুছিয়ে লিখে দিতে হবে জিনিসটা। তা এখনও কাগজটা ভালো করে দেখবার সুযোগই পাননি তিনি। চারটে ক্লাস ছিল পরপর। তারপর মাঝখানে একটা মাত্র অফ দিয়ে আরও একটা। ডিপার্টমেন্টে লোক কম। এ সময়টা বিদায়ী সেকেন্ড ইয়ার আর প্লাস টু নিয়ে তাঁরা নাস্তানাবুদ হচ্ছেন। মুনমুনকে চেঁচিয়ে বললেন দরজাটা খুলে দিতে তারপর হারিকেনের আলোয় খুব ক্লান্ত চোখে কাগজটা মেলে ধরলেন।

হায়ার সেকেন্ডারিতে স্টার মার্কস। অঙ্ক এবং দুটো বিজ্ঞানে লেটার। এম টেক-এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। এদিকে আবার মাউন্টেনিয়রিং-এ ট্রেনিং নিয়েছে। সাঁতারে সার্টিফিকেট আছে। বাব্বাঃ, এতো সব এরা করে কখন? ছেলে ভালো জানতেন, ডিবেটে স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করেছে বহুবার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে আরও এত গুণ তা সত্যিই জানা ছিল না। এতোটা চৌখস দেখলে মনে হয় না। লম্বায় বেশ ছাড়ালো হলেও ছেলেটার মুখে চোখে একটা মেয়েলি লাবণ্য, কর্কশকান্তি হয়নি এখনও। যুবক নয়, বরং যেন সেইসব কাকপক্ষধর কিশোর স্নাতকের মতই দেখায় ওকে—ডিগ্রিলাভের আগে আচার্যের প্রসাদ-লাভের আশায় যারা গুরুগৃহের সবরকম আবদার-অত্যাচার হাসিমুখে সহ্য করত। অথচ ফাইন্যাল পরীক্ষা পাশ করেছে তাও আজ বছরখানেকের ওপর হয়ে গেল। নিজের ছেলে নেই বলেই কি এ ছেলেটার ওপর কেমন একটা ঝোঁক সুমিত্রার?

মুনমুনের সঙ্গে কথা বলতে ঘরে ঢুকলো পার্থ। এশিয়ান গেমসের ফলাফল নিয়ে খুব উত্তেজিত দুজনেই। সুমিত্রা বললেন—‘তোর কাজটা এখনও হয়নি রে! দেখবার সময়ই পাইনি সারাদিন। পাঁচ-পাঁচটা ক্লাস ছিল।’

—‘তাতে কি হয়েছে?’ অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠল পার্থ। ‘আমি আপনাকে তাড়া দিতে আসিনি কাকিমা, কাল কিংবা পরশু হলেও চলবে।’

—‘কি কাজ রে?’ মুনমুন জিজ্ঞেস করল। এবং শুনেই ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল কাগজটা। পরক্ষণেই চোখ বড় বড় করে বলল—‘আরিস্ সাবাস। তোর নম্বর দেখে যে আমার মাথা ঘুরছে? লেটারই মেরেছিস তিন-তিনটে? অঙ্কেতেও? নাঃ গুরুদেব লোক তুই, পায়ের ধুলো দে।’

—‘আঃ মুনমুন!’ আজকালকার মেয়েদের এইসব চ্যাংড়া-চ্যাংড়া পুরুষালি বুলি একদম পছন্দ হয় না সুমিত্রার।

পার্থ বলল—‘কেন, তুই কত পেয়েছিলি?’

—‘শুনলে তোরও মাথা ঘুরবে, তবে উল্টো বাগে।’

—‘বল না কত?’

সুমিত্রাই বললেন—‘কত আবার পাবে, পঞ্চান্ন না ছাপান্ন।’

পার্থ বলল—‘বাঃ বাঃ। চমৎকার পেয়েছিস ত! মেয়েরা অঙ্কে একটু কাঁচাই হয়, বাংলা-টাংলা হিষ্ট্রি-টিস্ত্রি পড়বে, ক্ষতি কি?’

মুনমুন রেগে বলল—‘আর আমাদের ফার্স্ট গার্ল যে বিরানব্বই পেয়েছে, তার বেলা? আমি কাঁচা বলেই অমনি সমস্ত মেয়ে-জাতটাই অঙ্কে কাঁচা হয়ে গেল? সাধে কি তোকে হাঁদা বলি!’

পার্থ বলল—‘রাগ করছিস কেন! কথাটা আমার না, সমাজবিজ্ঞানীদের। রীতিমত স্ট্যাটিস্‌টিক্স নিয়ে দেখা গেছে। আমি শুধু কোট করছি, বুঝলি বুদ্ধু!’

ঝগড়া করতে করতেই বেরিয়ে গেল দুজনে। মুখে একটু অন্যমনস্ক হাসি নিয়ে অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন সুমিত্রা। এ তো ভালো! ছেলেবেলায় ওরা রীতিমত চুলোচুলি করত। এখন আর পার্থর মাথায় মুনমুনের হাত পৌঁছয় না। অন্তত এক হাত উঁচু। তাই-ই বোধহয় সম্পর্কটা খুনসুটিতে দাঁড়িয়েছে। সুমিত্রারা ছিলেন চার ভাই বোন। চুলোচুলি করবার লোকের অভাব ছিল না বাড়িতে। ছোটবেলার মারামারির চিহ্ন এখনও তাঁর হাতে আর পিঠোপিঠি ভাইয়ের গালে রয়ে গেছে। ভাইবোনের এইসব বাল্যকালীন চুলোচুলির স্মৃতিও যে কতো গুপ্তসুখের বন্ধ দরজা মন্ত্রবলে খুলে দিতে পারে তা তাঁর অজানা নেই। চেষ্টা-চরিত্র করেও মুনমুনের একটা সঙ্গী জোটাতে পারেননি তিনি। প্রথম সন্তানই বহু কষ্টের। ডাক্তার বলেই দিয়েছিলেন আর আশা নেই। তা নয়ত গড়পড়তা মায়ের মতো একটি পুত্রসন্তানের আকাঙক্ষা তাঁর ছিল বইকি! মুনমুনের বাবা অবশ্য বলেন—‘ভালোই হয়েছে। বিয়ে দিয়ে দোব, চুকে যাবে। বদসঙ্গে পড়ল কি-না, পলিটিক্সের খপ্পরে পড়ল কি-না দেখতে হবে না।’ যেন মেয়েরা আর বদসঙ্গে পড়ে না, রাজনীতি করে না।

কতই আর বয়স হবে পার্থর। মুনমুনের চেয়ে জোর বছর তিনেকের বড়। শক্ত হাত পা। চ্যাটালো বুক। কিন্তু মুখটা বড় সুকুমার। র‍্যাফেলের দেবদূতদের মতো অপাপবিদ্ধ। পরদিন অফ পিরিয়ডে বসে যত্ন করে সার্টিফিকেটটা লিখে ফেললেন সুমিত্রা। ছেলেটা বড় হবে মনে হয়, হোক। ক্ষমতা আছে, উচ্চাশা আছে, চেষ্টাও আছে। ওর উত্তরোত্তর উন্নতির নাটকে তাঁর এইটুকু পরোক্ষ ভূমিকা থাক। কাকিমা কাকিমা করে। সেই এতটুকুনি বয়স থেকে দেখছেন। মাঝে হোস্টেলে থাকতে কিছুটা চোখ-আড়াল হয়েছিল। কিন্তু এখন যেন সেই ফাঁকিটুকু উশুল করে নিতেই এ-বাড়িতে দিবারাত্র গতায়াত। সব কিছু শলা-পরামর্শ, আলাপ-আলোচনা—হয় কাকাবাবু, নয় কাকিমা। নিজের বাড়িতে মানসিক রসদের যোগান পায় না, এ সন্দেহও নেহাত অমূলক নয়।

মুনমুনকেই বললেন বিকেলবেলা—‘দিয়ে আসবি এটা?’ এক ঝটকা দিল মেয়ে—‘আমি পারব না।’

—‘কেন গানের স্কুলে তো যাবিই?’

—‘সে তো উল্টো দিকে! তা ছাড়া আমার ভাল লাগে না। নিজে এসে নিয়ে যাক না।’

সুমিত্রাকেই উঠতে হল অগত্যা। মুনমুন আছে আছে বেশ আছে। কিন্তু ও মেয়ের ‘না’কে ‘হ্যাঁ’ করা কোনও যন্ত্রের কর্ম নয়। তা নয়ত তাঁর সংসার মাথায় করে রাখে মেয়ে। ঘরদোর গুছোনো, সব টিপটপ। কাজের লোক না এলে অর্ধেকের ওপর কাজ ও একাই করে দেয়। স্বভাবটাই সুগৃহিণীর। কিন্তু এই এক দোষ। বড্ড জেদী। কিন্তু মুখে না বললেও পার্থর দরকারটা জরুরিই। প্রতিদিন তাড়া দিতে আসতে ওর সঙ্কোচ হতেই পারে। বাইরে যাবার খুব চেষ্টা করছে বলছিলেন শিবনাথ। দুটো তিনটে ভালো চাকরির অফার ছেড়ে দিয়েছে। স্বাভাবিক। এ বয়সে ভালো কেরিয়ারের ছেলে সবাই বাইরে যেতে চায়। ইন্টারভিউও বোধহয় দিয়েছে দু-একটা।

পার্থর মায়ের সঙ্গে ভালোই আলাপ আছে তাঁর। সঙ্গী না হলেও প্রতিবেশিনী। ছেলেবেলায় যখন পার্থ সারাক্ষণ সুমিত্রাদের বাড়িতেই পড়ে থাকত এবং অনেক সময় রাত্তিরেও বাড়ি যেতে চাইত না, তখন উনি এসে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যেতেন। সেই সূত্রেই আলাপ। তা নয়তো দুজনের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। সুমিত্রার থেকে বয়সেও বেশ বড়। বড় তিন মেয়ের বিয়েই হয়ে গেছে। পার্থ সবার ছোট।

গেলে খুব খাতির-যত্ন করেন পার্থর মা। এত বেশি যে সময়ে সময়ে অস্বস্তির কারণ হয়। আজকেও যেতে যেন হাতে চাঁদ পেলেন ভদ্রমহিলা—‘আসুন আসুন, কি সৌভাগ্য, কার মুখ দেখে উঠেছিলুম আজ?’

আপ্যায়নের ধ্রুপদী ধরনে হেসে ফেলে সুমিত্রা বললেন—‘আমি তো মাঝে মাঝে আসিই। আপনিই বরং…’

—‘কোথায় আসেন দরকার ছাড়া? সে ভাগ্যি কি আর করেছি! আর আমি! আমার কথা বাদ দিন। সংসারের ঘানি ঘুরিয়ে যাচ্ছি। জ্ঞাত-গুষ্টি নিয়ে সংসারটি তো নেহাত ছোট নয়। সময় কোথায়? অভ্যাসও নেই। উনি তো আবার ওই একরকম। জানেনই তো! পছন্দ-অপছন্দ সব সেই একশ বছর আগে গিয়ে বসে আছে।’

এঁর এই উনিটিকে দেখলে সত্যিই বড় আশ্চর্য লাগে। পার্থ, শুধু পার্থ কেন, তার দিদিদেরও জনক বলে মনে হয় না। ছেলেমেয়েরা বোধহয় সব মাতুলক্রম হয়েছে। একতাল ভুঁড়িসুদ্ধু চলন্ত পান্তুয়ার মতো আকৃতি। ঠোঁটের কোণ দিয়ে সদাসর্বদা পানের কষ গড়াচ্ছে। পড়াশোনা খুব সম্ভব এ-পাশ ও-পাশ। কাজকর্মও কিছু করেন না। তিন ভাই মিলে দিদিমার বিষয় পেয়েছেন, তারই আয়ে চিরকাল চলে এসেছে। পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা নিত্যগোপাল নাম বদলে রেখেছে নাড়ুগোপাল। জনান্তিকে এই নামই চালু।

কাগজটা পার্থর মা’র হাতে দিয়ে সুমিত্রা বললেন—‘আপনার সন্তানভাগ্য কিন্তু সত্যিই ঈর্ষা করবার মতো!’

মুখটা মুহূর্তে উদ্‌ভাসিত হয়ে গেল ভদ্রমহিলার। —‘এ কথা সত্যি। আমি হাজার মুখে স্বীকার করছি ভাই। আমার ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত বাপ-মা আমরা নই।

—‘ছি, ছি, এসব কি বলছেন।’

—‘সবাই বলে। না বললেও আমরা জানি কিন্তু আপনারই বা সন্তানভাগ্য খারাপ কিসে? অমন ঢলঢলে ঢোলকলমি ফুলের মতো মেয়ে আপনার? গলা কি, যেন মধু ঝরছে! যার বাড়ি যাবে, আলো করবে।’

—‘তবেই হয়েছে। কথাবার্তা যদি শুনতেন! যে শুনবে আর ও পথ মাড়াবে না।’

—‘বিনয়ী বাপ-মায়ে এটুকু বলেই থাকে ভাই।’ পার্থর মা হাসলেন।

সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। চা না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়লেন না উনি। গুচ্ছের দুধ এবং চিনি দেওয়া প্রায় বড়োবাজারি চা। সঙ্গে কচুরি, রসগোল্লা। খাবার জন্য এমন ঝুলোঝুলি করতে লাগলেন যেন ব্যাপারটার ওপর ওঁর জীবনমরণ নির্ভর করছে।

বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতেই আশপাশ থেকে শাঁখের ফুঁ শুনতে পেলেন সুমিত্রা। মধ্য-কলকাতার এ অঞ্চলে এখনও লোকে সন্ধ্যার মঙ্গলশঙ্খ ভোলেননি। তাঁদের বাড়িতে শাশুড়ি যাবার পর থেকে বেকার পড়ে আছে শাঁখটা। তার মনে থাকে না। ঠাকুরদেবতার সাবেক ছবিও সব তুলে ফেলেছেন। ভেতরের কোনও তাগিদ নেই। শুভাশুভের ধর্মাধর্মের সাবেক ধারণাগুলো পুরনো পাঁজির মতো ধীরে ধীরে বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু শুনলে ভালোই লাগে। ঠাকুরদালানের কোলে দাঁড়িয়ে ভটচায্যি বাড়ির এমনি কত শত সন্ধ্যার মুখ শঙ্খ বাজিয়ে গেছে। চৌকাঠে পড়েছে স্বপ্ন-সাধের মাঙ্গলিক জলছড়া। অনুষঙ্গ সবই সুখবহ নয়। তবু ভালো লাগে। ব্যথা-মিশ্রিত কেমন এক ধরনের শান্ত ভালো-লাগা। অভিজ্ঞতার রসায়নে ভালো-মন্দ সব সংহত হয়ে যাওয়ার ভালো-লাগা।

সদর দরজা ভেজানো ছিল। ঢুকতে ঢুকতে বাইরের ঘরে পার্থর গলা শুনে চমকালেন সুমিত্রা। গলায় ঝাঁঝ।

—‘কিসের এতো ডাঁট তোর?’

—‘কিসের, তুই-ই বল না,’ মুনমুনের ধারালো গলা।

—‘তবে শুনে রাখ, তোর ও ডাঁট আমি আইডেনটিফাই করতে পেরেছি, ওটা জাতের ডাঁট। তুই মধ্য ভারতের ঠাকুরসাহেবদের সগোত্র। এখনও যে মেন্টালিটি থেকে এদেশে মানুষ হরিজন পোড়ায় তোর মধ্যেও সেই একই মেন্টালিটি।’

—‘তাই নাকি? সবই তো জেনে গেছিস তা হলে। যা ভাবিস ভাব। ডাঁট তো আমি ইচ্ছে করে কাউকে দেখাতে যাইনি। তুই কেন খোঁচাচ্ছিস?’

—‘শিবকাকার থেকে আমি কম কিসে রে?’

—‘বাবার কথা তুলছিস?’ মুনমুনের গলায় সক্রোধ বিস্ময়। ‘তুললি ভালোই করলি। আমার বাবার মতো বাবা, আমার মায়ের মতো মা আর ক’টা আছে এ পাড়ায়?’

—‘দ্যাখ মুনমুন, শিক্ষা-দীক্ষা, স্ট্যাটাস দিয়ে বাবা-মার বিচার করতে নেই। বাবা-মা আমাদের সবারই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জিনিস।’

—‘কর গে না শ্রদ্ধা। আমি কি তোকে বারণ করেছি?’

—‘তোর ওই ডাঁট আমি ভাঙব।’

সুমিত্রা যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকেই নিঃশব্দে ফিরে গেলেন। যেন পরের বাড়ির দোরগোড়া থেকে। এদের এতো বাগ্‌-বিতণ্ডা কিসের? কিসের লড়াই? বাবা মা এসব কি? যাই-ই হোক, ব্যাপারটা যে একান্ত ব্যক্তিগত এটা তিনি বুঝেছেন। এবং বুঝে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। আর, ব্যক্তিগত কোনও ব্যাপারের ওপর চড়াও হতে তাঁর রুচিতে বাধে। সে নিজের মেয়ে হলেও। উনিশ-কুড়ি বছর বয়স তো হল। ও-ও তো এখন একটা পরিপূর্ণ মানুষ!

একটু বাদে বাড়ি না ফিরলে উভয় পক্ষই অপ্রস্তুতে পড়বে। কি দরকার! মোড়ের দোকান থেকে বেশ সময় নিয়ে কয়েকটা মশলা-দেওয়া মিঠে পান সাজালেন তিনি। সেগুলো সংগ্রহ করে খুব বিলম্বিত লয়ে বাড়ি ফিরে দেখলেন সদর খোলা। পার্থর গলা আর শোনা যাচ্ছে না। মুনমুন বসবার ঘরের সোফায়, হাতে একটা বই। বললেন—‘সন্ধের মুখে দরজা খুলে রেখেছিস যে বড়? কতবার বারণ করেছি না?’

জবাব দিল না। উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল। আড়চোখে দেখলেন মুখটা থমথম করছে। বইটা আদৌ পড়ছে বলে মনে হল না। একটু পরে সেটাকে র‍্যাকে যথাস্থানে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিঃশব্দে ওপরে চলে যেতে দেখলেন। সম্ভবত নিজের ঘরে। একটু পরে শিবনাথ যখন ফিরলেন তখন বাড়িটা এতো অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা যে ভদ্রলোক জিজ্ঞেসই করে ফেললেন—‘আজ এতো চুপচাপ যে!’ সুমিত্রাই উত্তর দিলেন—‘হই হই করবার কে আছে বলো।’ কথাটায় একটা আলতো খোঁচা। যেন হই হই করে সন্ধের ঝোঁকে বাড়ি জমিয়ে রাখবার ভারটা শিবনাথই নিত্য নিয়ে থাকেন। হই হই করবার কেউ না থাকার জন্যে তিনিই দায়ী। কিন্তু বাবার ঠিকই নজরে পড়েছে মেয়ের মুড ভালো না। এক সন্তানের বাবা-মার অনুভবশক্তি আর পাঁচজনের চেয়ে প্রখর হবেই।

—‘বকাঝকা করেছ নাকি?’ রাত্রে শুতে এসে বললেন সুমিত্রাকে। নীল আলোর বাল্‌বটার দিকে চেয়ে জবাবের অপেক্ষা না রেখেই বলে গেলেন একটানা—‘বকাঝকা করে কোনও লাভ হয় না, বুঝলে? এক জিনিস নিয়ে খিটখিট করাটা ঠিক না। আরও বিতৃষ্ণা এসে যাবে। আর ছেলে-মেয়ে যে বাবা-মার প্রোটোটাইপই হবে এমন কোনও কথা নেই, বুঝলে?’

সুমিত্রা শুধু ঘাড় হেলিয়ে বুঝিয়ে দিলেন বুঝেছেন। এ ভদ্রলোক ধরেই নিয়েছেন পড়াশোনা নিয়ে মায়েতে-মেয়েতে কথা-কাটাকাটি হয়েছে। মেয়ে বকুনি খেয়েছে। সুতরাং…কথা বাড়িয়ে আর লাভ কি! এ ভদ্রলোক সারা জীবন ধরেই অনেক কিছু ধরে নিচ্ছেন। এ ভাবেই চলে আসছে। চলুক। ছেলেমেয়ে মানুষ করার ব্যাপারে ইঁয়ুঙের মত কি বিড়বিড় করে সেইসব আওড়াতে আওড়াতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন শিবনাথ। অনেক সাংসারিক কর্তব্য করা হয়েছে আজ। একটি নিটোল নিদ্রাসুখ উপার্জন করে ফেলেছেন।

এভাবেই ঘর-বার, ভিতর-বাহির, জটিল-সরল সব অঙ্ক মেলাবার দায় সুমিত্রারই। সংশয়, উদ্বেগ, দ্বিধা, বেদনা কোন কিছুর কথাই বলার কেউ নেই। নিষ্প্রদীপ মঞ্চে, শূন্য প্রেক্ষাগৃহে নির্জন সংলাপ।

কাজে-কর্মে সচেতন মন থেকে প্রায় মুছেই গিয়েছিল ঘটনাটা। মুনমুনও মোটামুটি স্বাভাবিক। কলেজ যাচ্ছে, গানের পরীক্ষা দিয়ে এল। পার্থর মা আর বড়দি হঠাৎ এসে উপস্থিত। এ কথা সে কথার পর পার্থর মা বললেন—‘ছেলের বিদেশ যাওয়া তো প্রায় ঠিক। যাওয়ার আগে মুনমুনের সঙ্গে বিয়েটা চুকিয়ে দিতে চাই আমরা। তারপর ও বউকে সঙ্গেই নিয়ে যাক। কি পড়াশোনা শেষ করবার জন্য এখানেই রেখে যাক, সে ওদের অভিরুচি।’

একেবারে চমকে উঠলেন সুমিত্রা। এ সম্ভাবনাটার কথা তো কখনও মনে হয়নি! প্রস্তাবটা তো খারাপ না। কিন্তু ইনি এমনভাবে কথাটা বলছেন যেন বিবাহ ব্যাপারের লক্ষ কথার নিরানব্বই হাজার ন’শো নিরানব্বইটা কথা হয়েই গেছে। শেষ কথাটা আজ এইমাত্র হল। তাঁকে নীরব দেখে পার্থর বড়দি বলল—‘আজকাল তো জাতপাত কেউ তত মানে না, বিশেষ আপনাদের মতো উচ্চশিক্ষিত পরিবারে, না কি বলুন কাকিমা! পার্থর ওকে বড্ড পছন্দ। আর আপনি তো জানেনই ও আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতো নয়।’

সুমিত্রার এবার মনে হল ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট-টিকেট সব বাজে। আসলে পার্থ নিজের গুণপণার কথা কাকিমাকে কৌশলে জানাবার জন্যেই দিয়ে গিয়েছিল কাগজটা। বা রে ছেলে! ভারি চালাক তো! দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না, কিন্তু কার্যসিদ্ধির উপায়-টুপায়গুলো ভালোই জানা মনে হচ্ছে। মনে মনে ঈষৎ প্রশ্রয় এবং তারিফের হাসিই হাসছিলেন, সহসা আগের দিনের সংলাপটা মনে পড়ে গেল। ঠিক ধরতে পারেননি, কিন্তু কোথাও যেন একটা চড়া বেসুর বেজেছিল। অন্যমনস্কভাবে বললেন—‘পার্থকে আমি খুবই পছন্দ করি। কিন্তু মেয়ের তো নিজস্ব মতামত হয়েছে; জিজ্ঞাসাবাদ করি। ওর বাবাকেও বলা দরকার।’ উত্তরে পালগিন্নি তাঁর বড় মেয়ের দিকে চেয়ে যেন কি এক গোপন রসিকতায় হাসলেন, মুখে বললেন—‘তা করবেন বইকি। আমিও তো তাকে বলিনি এখনও।’

মুনমুন ফিরল ওঁরা চলে যাবার বেশ খানিকটা পরে। সুমিত্রা তখনই কিছু বললেন না। এখন মেয়ে অন্য মুডে আছে। গুনগুন করে তিল্‌ঙ-ঠুংরী ভাঁজছে। এইভাবেই গুনগুন করতে করতে এঘর-ওঘর করবে খানিক, বাবার টেবিল গোছাবে, ধূপ জ্বালবে গোছ গোছা, ফুলদানির জল পাল্টাবে, এটা নাড়বে, ওটা টানবে। এখন থাক। ঘণ্টাখানেক পর জিজ্ঞেস করলেন কথাটা—‘তোর সঙ্গে পার্থর কোনও কথা হয়েছে?’

ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল মুনমুন। কানের সোনার মাকড়ি দুটো দুলে উঠল। কপালের ওপর কোঁকড়া চুলের গুছি বিদ্রোহের ভঙ্গিতে উড়ছে। —‘কেন?’

—‘ওর মা আর দিদি মানে সীমা আজ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল।’

—‘ইস্‌স্‌স্‌স্‌।’

—‘তোরা যদি ঠিক করে থাকিস, আমার দিক থেকে কোনও আপত্তি হবে না।’

—‘তুমি কি পাগল হয়েছ মা?’

—‘কেন বল তো? পাগলের কি হল?’ বিমূঢ় হয়ে বললেন সুমিত্রা—‘ছেলে তো ভালোই। খুবই ভালো।’

তিনি আশা করেছিলেন অশ্রু, লজ্জা, স্বস্তি। কিন্তু মেয়ে বলল—‘তুমি ভাবতে পারো ওদের ওই তিন শরিকের বাহান্ন ডালপালার বাড়িতে আমি ঘোমটা মাথায় সবার বউমা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি!’

—‘না ভাবার কি আছে? পরিবেশ তো জীবনে বারবার বদল হয়ই, আর হওয়াটাই স্বাস্থ্যকর, কার চরিত্রের কোথায় জোর, পরিবেশ না পাল্টালে তো বোঝা যায় না মুনমুন। মানুষ তো আর সাজিয়ে রাখার কাচের পুতুল নয় যে এক আলমারি থেকে আর একটা আলমারিতে যাওয়াই তার ভালো!’

—‘তাই বলে নাড়ুগোপাল শ্বশুর?’

—‘ছি! এ ভাবে ভাবা ঠিক নয় মুনমুন?’

—‘আর কি ভাবে ভাবব তা হলে?’

সে কথার জবাব না দিয়ে সুমিত্রা বললেন—‘এতো ভালো ছেলে কিন্তু পাওয়া মুশকিল। শুধু কেরিয়ারের জন্য নয়, যুগ পাল্টে যাচ্ছে, ছেলেরা আজকাল বিশ্বাসের যোগ্য প্রায়ই হয় না। আর তা ছাড়া ও তো বাইরেই চলে যাচ্ছে, যদিও কারও জন্যেই মা-বাবাকে ত্যাগ করার কথা আমি ভাবতে পারি না।’

—‘নাড়ুগোপাল পালের ছেলেকে বিয়ে করলে আমার বাবার মানটা কোথায় থাকবে শুনি?’

মেয়ের কথার ধরন শুনে অবাক হলেন সুমিত্রা। মেয়ে তো নয় যেন মেয়ের ঠাকুমা। কোত্থেকে এতো জ্যাত্যভিমান হল এর এই যুগে, এই বয়সে! খুব সম্ভব পিতামহীর প্রভাব। নিষ্ঠাবতী, রক্ষণশীল ব্রাহ্মণঘরের বিধবা ছিলেন শাশুড়ি। যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনি কর্মঠ। কিন্তু বংশ আর বিদ্যার অভিমান ছিল বড্ড। মুনমুনকে কি তিনিই এমনি করে ভাবতে শিখিয়ে গেছেন? স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তো বেরিয়ে যেতেন। নাতনিকে তো ঠাকুমাই এক রকম মানুষ করেছেন।

দু দিন পর একটু লাজুক লাজুক মুখে এল পার্থ। মুনমুন অদৃশ্য। সুমিত্রাই গল্পগাছা করলেন, চা দিলেন, যেন মাঝখানে অন্যরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। একটু হতাশের মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে শুকনো মুখে ছেলেটা চলে গেল।

সমস্ত ব্যাপারটাই সুমিত্রার কাছে রহস্যময়। এই এতো ভাব! এতো ঘনিষ্ঠতা! এই বয়স! পরিবার, সমাজ তাদের রক্তচক্ষুর শাসন উঠিয়ে নিয়েছে। বিচারে-ব্যবহারে প্রায় সিকি শতাব্দী আগে যখন ওকে জোর করে পিঁড়িতে তোলা হয়েছিল তখনকার সঙ্গে কত তফাত! মুনমুনকে বললেন—‘পরিবার, জাত ইত্যাদি ছাড়া আর কিছু আপত্তি আছে তোর?’

—‘ক্যাবলা।’

—‘তাই বুঝি ডিবেটে প্রাইজ পায়, পাহাড়ে চড়ে!’

—‘মাকুন্দ।’

—‘তোদের দুজনে তো বেশ ভাব ছিল।’

—‘বন্ধু হিসেবে মেশা এক, বিয়ে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস মা।’

—‘আমি ভালো বুঝি না, আর একটু বুঝিয়ে বল মুনমুন।’

—‘বড়দির ছেলের পৈতে হবে, মিন্টুর ছেলের পৈতে হবে, আমার ছেলের হবে না, না? বাপের বাড়ির কাজে-কর্মে কি পরিচয় হবে আমার? পালেদের বাড়ির ছোট বউ? তোমার কি এতটুকুও প্র্যাকটিক্যাল সেন্স থাকতে নেই মা? আর এতো কথা বলছই বা কেন? পার্থ কি তোমাকে তার উকিল রেখেছে?’

কথাগুলো ঝড়ের মতো বলে মুনমুন চোখ-মুখ লাল করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যেসব কথা একদিন অভিভাবকদের মুখ থেকে নিরুপায় শুনেছেন, সেইসব হতাশাজনক, মনুষ্যত্বের সত্য মূল্য নিরূপণে পরাঙ্মুখ, মানবতাবিরোধী কথাবার্তা আজ এক যুগ পরে আত্মজার মুখে পুনরাবৃত্ত হতে দেখে কেমন আতঙ্কিত, বিহ্বল হয়ে মুখ ঢাকলেন সুমিত্রা। কোন মন্ত্রে এক প্রজন্মে ভূমিকা এমন পালটে যায়! মুনমুন তবে কার মেয়ে হল? আচারান্ধ পিতৃপুরুষের? তাঁর নয়?

যাক, যারই হোক, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন তিনি, ভালোবাসলে কখনও এমন কাটা কাটা, হিসেবী কথাবার্তা বলতে পারত না। কথাটা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করা যায়নি। যতই আধুনিক মা হন। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এতো প্রশ্ন করা। যাক আচরণেই বোঝা যাচ্ছে। প্রশ্ন বাহুল্য। ব্যাপারটা একতরফাই।

নিজমুখে কোন কথা জানাতে খারাপ লাগল। মুনমুনের মত নেই জানিয়ে একটা চিঠি ছেড়ে দিলেন। শিবনাথকে কিছু বলবার দরকার মনে করলেন না।

পার্থর সঙ্গে দেখা হল দু’দিন পরই। একই পাড়ার এ-মোড় ও-মোড়ে থাকা, দেখা না হওয়াই আশ্চর্য। তাঁকে দেখেই উল্টোদিকের ফুটপাথে চলে গেল। সুমিত্রা তা সত্ত্বেও রাস্তা পার হলেন, কাছাকাছি গিয়ে খুব কোমল গলায় বললেন—‘কি রে পার্থ, কাকিমাকে কি ভুল বুঝলি?’ মাটির দিকে চোখ রেখে শুকনো ঠোঁট দুটোকে শুধু প্রসারিত করল পার্থ। উত্তর দিল না। গালে ওর র‍্যাফেল-তুলির সে ডৌল যেন ভেঙে গেছে। মাথার উড়ো চুলের বাবুই-বাসায় একবার হাতটা ছোঁয়াবার প্রচণ্ড পিপাসা পেল সুমিত্রার। কিন্তু সব পিপাসাই কি মেটে? কোনও পিপাসাই কি মেটে?

আজ সীমার অর্থাৎ পার্থর বড়দির চিঠি এসেছে। লিখেছে: ‘আমার ভাই মুনমুনের চেয়ে অনেক চৌখস মেয়ে পেতে পারত কাকিমা। কিন্তু ভালোলাগার ওপর তো কারও হাত নেই! পার্থ তো বোকা নয়! কারও ওপর জোর করার ছেলেও ও নয়! মুনমুনকে ও কি এতোই ভুল বুঝল? ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখবেন তো? অনেকেই অনেক কিছুর সাক্ষী আছে, কাকিমা। আর, এই সিদ্ধান্তই যদি ও নেবে, আর একটু সংযত আচরণ করলেই কি ঠিক হত না? পার্থ চাকরি নিয়ে কানাডা চলে যাচ্ছে। আঠাশে জানুয়ারি। বড় সিরিয়াস ছেলে। জানি না আর ফিরবে কি-না। ভায়ের এই খামখা কষ্টটা আমাদের বুকে বড় বেজেছে। মুনমুন কি ভালো করল? আপনারা কি ভালো করলেন?’

চিঠিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন সুমিত্রা। কেন এতো মন খারাপ লাগছে তিনি জানেন না। তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকায় ওরা বিশ্বাস করেনি, তাই কি? মুনমুনকে তিনি কতটুকু চেনেন? জননী বলেই হয়ত সবার চেয়ে কম। ওকি তবে পার্থকে ডাক দিয়ে মুখ ফেরালো? না না তা নয়। অন্তত তা নিশ্চয়ই নয়। যৌবনই যৌবনকে এমন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভুলিয়ে নিয়ে যায় মিথ্যে আশার আলেয়া দেখিয়ে কাদা জলায়, জল ঝাঁঝির দামে। তারপর দপ করে নিবে যায়। কারণটা প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক। আর কিছু নয়। মুনমুন কিছু করেনি, জ্ঞাতসারে কিছু করেনি।

মাথার ওপর একটা জেট প্লেনের আওয়াজ পেয়ে ছেলে-মানুষের মতো জানলার কাছে ছুটে গেলেন সুমিত্রা। যেন তিনি ফিরে গেছেন বহুকাল আগেকার সেই ব্যাকুল কৈশোরে। আজই যে সেই তারিখ! আঠাশে জানুয়ারি। খুব নিচু দিয়ে যাচ্ছে প্লেনটা। ওতেই কি পার্থ আছে? চলে যাচ্ছে। অভিমান করে চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছে?

পার্থ কি তাঁর জীবন থেকে এই দ্বিতীয়বার বিদায় নিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *