রোচনা

রোচনা

ঋত্বিকের ‘রোচনা’ চলছে রমরম করে। আসল বাড়িটা শেষ হওয়ার আগেই এক দিকে একতলা সাময়িক হস্টেল খাড়া করা হয়েছে। কিছুটা জমি একেবারে নিরঙ্কুশ খেলার মাঠ হিসেবে পিটিয়ে সমান করা। পুকুরটা চতুর্দিক থেকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাদের দোলনা, স্লাইড ইত্যাদি হয়েছে একটা আলাদা পার্কে। পঞ্চাশজন বোর্ডার দিয়ে শুরু হয়েছিল রোচনা। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এদের। নানান বয়সের ছেলেমেয়ে। ঠিক কারা কোন কোন জায়গা থেকে আসবে এ নিয়ে মুকুটের সঙ্গে ঋত্বিকের একটু মতভেদ হয়। ঋত্বিকের মতে শুধু ছ’ বছরের বেশি, এবং বারো বছরের কম বয়সি ছেলেমেয়েদের রাখা হোক। যত জনকে বিনা বাছাবাছি রাখা যায় ততই ভাল, এ বিষয়ে অবশ্য দুজনেই একমত ছিল। কিন্তু জায়গা সীমিত, একটা না-একটা মানদণ্ড স্থির করতেই হয়। মুকুটের ইচ্ছে ছিল দশ বছর থেকে শুরু করে ওপরের দিকে যত দূর পর্যন্ত পারা যায়, রাখা। তার যুক্তি এই বয়সটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। মেয়েগুলোকে এই সময়ে ব্যবসায় নামানোর তোড়জোড় শুরু হয়। এবং কী মেয়ে, কী ছেলে এই সময়টায় সচেতন হয়ে ওঠে। তারা কে, তাদের অবস্থান কী, সমাজ তাদের কী চোখে দেখে, এসব সম্পর্কে জ্ঞান টনটনে হয়ে উঠতে থাকে এই সময়টাতেই। কিছু কিছু মা মেয়ের জন্য ভিন্ন ভবিষ্যৎ চায় বই কী। কিন্তু সেখানেও একটা ‘বিয়ে’ বাদে আর কিছু দেখতে পায় না। মেয়ে বিয়ে করে ঘরসংসার করবে এটাই তাদের সবচেয়ে বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা। স্থানীয় ছেলে, অর্থাৎ বারাঙ্গনাদেরই পুরুষ সন্তানদের সঙ্গে এদের তথাকথিত বিয়ে যে হয় না, তা নয়, কিন্তু শেষোক্তদের বলতে গেলে কোনও উপার্জনই নেই। তারা বউকে খাটিয়ে, তার রোজগারেই খায়, আর মস্তানি করে। এই অপেক্ষাকৃত বড়দের কিন্তু ঋত্বিক ‘রোচনা’য় স্থান দিতে একেবারেই ইচ্ছুক নয়। সে বলে—আমরা এখানে রিফর্মেটরি স্কুল খুলছি না মুকুট। পুনর্বাসনও আমাদের লক্ষ্য নয়। যদিও রিফর্মেটরি ও রিহ্যাবিলিটেশনের গুরুত্ব আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাকে ঠিকঠাক দক্ষভাবে কাজ করতে হলে আমার লক্ষ্যবস্তু স্থির করে নিতে হবে আগে; তারপর সেই লক্ষ্যবস্তুর চারপাশের অনাবশ্যক বাহুল্য ছেঁটে ফেলে দিতে হবে। আমার লক্ষ্যবস্তু হল এই যাচ্ছেতাই আবহাওয়া থেকে বাচ্চাগুলোকে বাঁচানো। কে কোথায় জন্মাবে সেটা যখন বেচারিদের হাতে নেই, তখন যে-শিশুরা দৈবাৎ বারোয়ারি মাতৃগর্ভে জন্মেছে, তাদের জীবনগুলো যাতে অভিশপ্ত হয়ে না ওঠে, সেটা দেখাই আমাদের লক্ষ্য। ওদের একটা চান্স পাওয়া উচিত। ছয় থেকে দশের মধ্যে ছেলেমেয়েগুলোকে এখানে এনে শিখিয়ে পড়িয়ে যদি স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তা হলেই যথেষ্ট। এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে আরও কাজ হতে পারে, কিন্তু সেটা হবে আলাদা। তোদের প্রজেক্টে তোরা এরকম কিছু করার চেষ্টা কর না, সাহায্য করব। কিন্তু আমার কাজ হল—এইটা।

পঞ্চাশটা বাচ্চার জন্য আপাতত পাঁচটা ছোট ছোট ডর্মিটরি হয়েছে। প্রত্যেক ডর্মে একজন করে সুপার বা দিদি থাকেন। এই দিদিরাই এদের খাওয়াদাওয়া খেলাধুলো পড়াশোনা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন। রান্না ও অন্যান্য কাজের জন্য মোট চারজন লোক আপাতত রাখা হয়েছে। আর আছে বন্দুকধারী দারোয়ান। সকালে একজন, বিকেলে একজন। মাস্টারমশাইরা বাইরে থেকে যাতায়াত করেন। প্রতি মাসে একবার করে ঋত্বিক নিজে এদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। রবিবার এদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। একটা বাস কিনে দিয়েছেন একজন শুভার্থী। বেড়াতে যাবার দিনে এদের সঙ্গী হন পরিচালন-সমিতির সভ্যরা, নিজেদের ইচ্ছে এবং সুবিধামতো, বাচ্চাদের মায়েদেরও পালা করে তাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবার সুযোগ দেওয়া হয়।

বাচ্চাদের এখানে নেবার আগে প্রত্যেক পল্লিতে ঋত্বিকরা ঘুরে ঘুরে প্রচার করে। সেই প্রচারের ফলে, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় যারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের ‘রোচনা’র অভিভাবকত্বে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে, তাদেরই নেওয়া হয়েছে। অল্পস্বল্প প্রতিবন্ধী বাচ্চাদেরও ফেরায়নি ঋত্বিক। একটি মেয়ে আছে কুশ পা, একটি ছেলের মাত্র তিনটি আঙুল। একটি আছে বামন। কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে স্বাভাবিক। এদের যথাসাধ্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও সে করেছে। বলা বাহুল্য, আরও অনেক আবেদন এসেছিল। তাদের মধ্যে থেকে প্রথম পঞ্চাশটি গ্রাহ্য হয়েছে।

ভালভাবে চালু হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠান। একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল। এইসময়ে দুটি স্থানীয় মস্তানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি মেয়ে তাদের এক ‘বাবু’র নেতৃত্বে এসে হাঙ্গামা শুরু করল।

—কী ব্যাপার? কী চান আপনারা?

—আপনি যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েদের হস্টেলের নাম অনাথ আশ্রম দিয়েছেন কেন? ওরা তো অনাথ নয়।

‘রোচনা’র পরিচয় হিসেবে প্রচারপত্রে বলা আছে এটি একটি পরীক্ষা ও গবেষণামূলক উচ্চশ্রেণীর অনাথ আশ্রম।

ঋত্বিক জবাব দেয়, স্ট্রিক্‌টলি স্পিকিং, ওরা অনাথই। নাথ কথাটার মানে এখানে বাবা। শিশুদের দায়িত্ব বাবারই নেবার কথা। সেই হিসেবে…

বাবুটি বলল, বাবা নেই, কিন্তু মা আছে। আমি একজন যৌনকর্মীর ছেলে। বুক বাজিয়ে বলব— ইয়েস, আমি যৌনকর্মীর ছেলে, তো হয়েছে কী?

—কিছু হয়নি। ঋত্বিক বলল, আবার হয়েছেও।

—কী বলতে চান আপনি? এখন উন্নত দুনিয়ায় ‘সিঙ্গল পেরেন্ট’ সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। শুধু মায়ের পরিচয়েই পরিচয় গ্রাহ্য হচ্ছে। আর এখন আপনি বলছেন এরা অনাথ!

—দেখুন, সিঙ্গল পেরেন্ট বলতে যা বোঝায় এদের সেরকম কিছুও নেই। এদের মায়েরা এদের রক্ষণাবেক্ষণ, পালন করতে পারে না। এরা স্রেফ রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়, পড়ে থাকে।

—সে তো পালন অনেকেই করে না। আপনাদের বড় বড় চাকুরে বিবিরা কে কত বাচ্চা দেখে তা জানা আছে।

—অনেকে দেখতে পারে না ঠিকই। কিন্তু তবু বাচ্চাটার তো একটা আশ্রয় থাকে! সন্ধে থেকে তো তাকে ঘর থেকে বার করে দেয় না মা। দেয়? দেখাশোনা করার জন্য কাউকে না কাউকে মাইনে দিয়ে হলেও রাখা হয়। অনেক সময়ে হস্টেলেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

—বেশ তো সেইসব হস্টেলের নাম কি অনাথ আশ্রম?

—তা অবশ্য নয়। তবে যদি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অবৈতনিক, দান-নির্ভর হয়, তাকে তো ‘অরফ্যানেজ’ ই বলবে। যেমন অনেক ক্রিশ্চান ‘অরফ্যানেজ’ আছে। বহু দরিদ্র মা, বাবা, বা দুজনেই সেখানে ছেলেমেয়েদের অনাথ পরিচয় স্বীকার করেই দিয়ে আসে।

—ও, চ্যারিটি বলেই এত অছেদ্দা?

—অছেদ্দাফেদ্দা নয় মশাই। আর শুনুন চ্যারিটি করছি বলে নয়। কিন্তু দেহ-ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এই পরিচয়ে বড় হলে ওদের পরবর্তী জীবনে কাজকর্ম পেতে অসুবিধে হবে, বড় হলে পরিচয়টার মানে যখন জানবে, তখন নিজে দেরই হয়তোছোট চোখে দেখবে।

—কেন দেখবে? আমি তো দেখি না! ইন ফ্যাক্ট, আমি গর্বিত!

ঋত্বিক এবার বিরক্ত হয়ে বলল, যাচ্চলে, গর্বিত হবার তো কোনও কারণ দেখি না। হ্যাঁ, এই পরিস্থিতিতে জন্মেও আপনি যদি বড় কিছু করতে পারেন, তখন গর্বটর্ব করতে পারবেন। না হলে জন্ম নিয়ে গর্ব করবার মতো কী ঘটেছে? আপনার মতো সৎসাহসই বা কতজনের আছে? আপনি পাড়ার গণ্ডির বাইরে কাজটাজ করতে গেছেন কি? যাননি। ‘রোচনা’র ছেলেমেয়েদের আমরা নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। ছেলেরা যদি বা ওই পরিচয়ে বাঁচতেও পারে, মেয়েদের অসুবিধে হাজার গুণ। কেউ সুস্থভাবে বাঁচতে দেবে না।

—কেন? আমরা কি সুস্থভাবে বেঁচে নেই?

—একথার জবাব দিয়ে লাভ নেই। আপনি কি চাইছেন আপনাদের পাড়ায় যে মেয়েগুলো জন্মাচ্ছে, তারা ঘুরে-ফিরে এই ব্যবসাতেই আবার ফিরে আসুক?

পিছনে মেয়েগুলির মধ্যে একজন এইসময়ে বলে উঠল, আমাদের ব্যবসা খারাপ কী? ভিক্ষে তো করছি না। লোকে চাইছে তাই দিচ্ছি। এর মধ্যে আমরা অন্যায় কিছু দেখি না।

ঋত্বিক বলল, যাঁরা এরকম ভাবছেন, তাঁদের মেয়েদের আমরা রাখতে পারব না, তাদের এখান থেকে নিয়ে যান।

ছেলেটি বলল, কথাটার তো জবাব এড়িয়ে গেলেন। অন্যায় কী দেখলেন, বোঝান?

ঋত্বিক বলল, মাফ করতে হল ভাই, এ প্রশ্ন যে করতে পারে, তাকে ন্যায়-অন্যায় বোঝানো আমার কর্ম নয়। আর দেখুন একটা সময় ছিল, যখন এই মেয়েরা সহজ বুদ্ধিতেই বুঝতে পারত দেহ বিক্রি করে শুধু যৌনতা-সম্বল প্রাণী হয়ে থাকা অপমানকর, লজ্জাকর, অমানবিক, কিন্তু এখন আমাদের থার্ড ওয়ার্ল্ডকে গ্রাস করার জন্যে যে প্রচার আর চক্রান্ত চলেছে, তাতে এদের আপনাদের সহজ বুদ্ধিটি ঘেঁটে যাচ্ছে। এরপর তো বলবেন শিক্ষকরা বিদ্যা বিক্রি করেন, ডাক্তাররা চিকিৎসা বিক্রি করেন, লেখকরা কল্পনা বিক্রি করেন। সেক্স বিক্রিটা আলাদা কীসে? ওসব বহুৎ শোনা আছে আমার, আমি আমার নিজের শর্তে সুস্থ মানুষ তৈরি করব এখানে। যাঁরা এখানে ছেলেমেয়ে পাঠাচ্ছেন তাঁরা এই শর্তই পছন্দ করছেন। আপনারা এবার আসুন।

স্থানীয় মস্তানদুটির দিকে একবারও তাকাল না সে। খুব ভাল করেই তার জানা আছে কনট্র্যাক্টরের কাছ থেকে মোটা দর্শনী আদায় করে ছেড়েছে ছোকরাদুটি। এখন অন্য ফ্রন্টে ভিড়ে চাপ সৃষ্টি করার মানে কী? দুর্নীতিরও একটা নিয়ম আছে। সেটা পালন না করলে বিপদে পড়তে হয়। তারও ওপরমহলে কিছু মামা-কাকা আছে। বেশি ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে সে এদের দেখে নেবে।

মুকুট জিনাকে নিয়ে সেদিন সামান্য আগে ঢুকেছিল। গোলমাল দেখে একপাশে দাঁড়িয়েছিল। দলটা ক্যাচরম্যাচর করতে করতে চলে গেল। মেয়েগুলোর দাপট ছেলেটির দ্বিগুণ। চোখ ঘুরছে, হাত নড়ছে, মুখ নড়ছে।

ঋত্বিকের ভুরু কুঁচকে ছিল। মুকুটের সঙ্গে তার বান্ধবীকে দেখেও সোজা হয়নি। রুক্ষ স্বরে বলল, কী রে? বসতে বলতে হবে নাকি?

মুকুট মিটিমিটি হেসে বলল, এত মেজাজ খারাপ করলে হবে?

—দেখ মুকুট—ঋত্বিক বলল, এটা আমার কেরিয়ার ঠিকই। কিন্তু মিশনও। আমি আমার স্বার্থের জন্যে কালোকে সাদা আর সাদাকে কালো বলতে পারব না। অন্য কেউ বলবার চেষ্টা করলে, কেন বলছে বুঝতে তো আমার বাকি থাকে না। দাবড়ানি খাবেই।

—ধৈর্য! ধৈর্য ধরে না বোঝাতে পারলে তোর কাজটাই মার খাবে।

—রাখ তো! অন্ধকে তুই আলো চেনাতে পারবি? জন্মান্ধকে যদি বলিস এই যে ভাই এই ফুলটা লাল, এখন চাঁদ উঠেছে, খুব সুন্দর দেখাচ্ছে চারদিক, সে বুঝতে পারবে? তাকে প্রথমে মেনে নিতে হবে। মেনে নিয়ে এবার সে তার অন্য বোধগুলো দিয়ে ধরবার চেষ্টা করুক চাঁদ ওঠাটা কেমন, ফুলের লাল রংটা কেমন…। নিজের মতো করে বুঝুক। এখন যদি কেউ তাকে বোঝায়—ও হে, ওসব চক্ষুটক্ষু কিছু নেই, পৃথিবীটাকে তুমি যেরকম বুঝছ পৃথিবীটা সেরকমই। আর এই যে তোমার চারপাশে অন্ধকার এটা নিয়ে দুঃখু করবার কিছু নেই, এটা একটা চমৎকার অবস্থা। তা হলে সেই লোকগুলোকে কী বলতে ইচ্ছে করে বল!

জিনার দিকে তাকিয়ে ঋত্বিক গলা নিচু করে বলল, স্যরি। তারপর মুকুটের দিকে তাকিয়ে বলল, যা না তোরা যা, আমি একটু পরে আসছি।

মাঘের রোদ বাসন্তী রঙের। ঘাসের রং গাঢ় সবুজ। ইংরেজি বড় হাতের ই-শেপ বিল্ডিংটার ঢালাইয়ের কাজ হয়ে গেছে। কাজেকর্মে, মিস্ত্রিদের জটলায় ওদিকটা সরগরম হয়ে আছে।

জিনা আগে যখন এসেছে কাজ এতটা এগোয়নি। এখন ব্যাপারটা কত বড় ভাল করে বোঝা যাচ্ছে। শ’তিনেক বাচ্চার ব্যবস্থা থাকছে। বারোজন অ্যাসিসট্যান্ট সুপার, একজন চিফ।

সকলকেই তো মহিলা-ই রাখতে হবে! —জিনা জিজ্ঞেস করল।

—এইটাই আমাদের খুব ভাবাচ্ছে রে জিনা… মুকুট বলল, ছেলেগুলোর একটু পুরুষ-অভিভাবক চাই-ই চাই। আর ছেলেমেয়ে সবারই একটা ফাদার ফিগার প্রচণ্ড দরকার। সেইজন্যেই মাস্টারমশাইদের সবাইকে পুরুষ রাখা হয়েছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারদের মধ্যে মেয়ে-পুরুষ মিলিয়ে রাখতে পারলে ভাল হত। কিন্তু তাতে বিপদ আছে বুঝিসই তো! হস্টেলে যেটা হয়, ছেলেদের হস্টেলে ছেলে, মেয়েদের হস্টেলে মেয়ে— এই ভাগটা এখানে করা যাচ্ছে না, বুঝলি?

—কেন? ছেলেদের আর মেয়েদের একদম আলাদা ব্যবস্থা করলেই তো পারতিস!

—সেটা সংখ্যার ওপর খানিকটা নির্ভর করছেই! ধর এখন যে পঞ্চাশজনকে নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে তাদের মধ্যে চল্লিশজনই মেয়ে।

—বলিস কী রে? এরকম কেন?

—এইরকমই রেশিও ছেলেমেয়েদের। এটা আমরা আগে বুঝিনি। কাজ করতে গিয়ে নজরে এসেছে। এ নিয়ে কোনও সার্ভে নেই। এখন সত্যিই রেশিও এই, না মেয়েগুলোকেই এরা হস্টেলে বেশি পাঠাচ্ছে, আমরা বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে বড় যাদের নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে মোটে তিনজন ছেলে। ধর, বারো বছর থেকে মোটামুটি ওদের মেল সুপারের কাছে থাকা দরকার বলে আমরা মনে করি। বছর তিনেক সময় হাতে পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ভেবে-চিন্তে ঠিক করতে হবে কী করা যায়। বিদেশি মডেলগুলো স্টাডি করতে হবে। মুশকিল কী জানিস? এসব কাজে ‘মেল’ পাওয়াও এখানে খুব দুষ্কর। মানে ‘কোয়ালিটি মেল’। তুই বিজ্ঞাপন দে, অজস্র দরখাস্ত পাবি, কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে, বিশেষত এই বাচ্চাদের সারাদিন দেখাশোনা করতে রাজি হবে এরকম ‘মেল’ তুই পাবি না। বকাটে ছেলে, কিংবা এক্কেবারে ভোঁদা, কোথাও কোনওরকম গতি হচ্ছে না, এরকম আছে। কিন্তু তাদের নিলে কাজের থেকে অকাজই হবে বেশি। অথচ তুই ফিমেল খোঁজ যথেষ্ট পেয়ে যাবি। ভদ্র, সভ্য, বাচ্চাদের ওপর একটা স্বাভাবিক মমতা আছে, দরকার হলে শাসন করতেও পারে, ডিসিপ্লিন্‌ড্‌, সবচেয়ে বড় কথা ইচ্ছুক, দক্ষতা যদি একশো ভাগ না-ও থাকে, কিছু এসে যায় না। শিখে নেয়।

—তা উপায় যখন নেই, ফিমেল দিয়েই চালা৷

মুকুট বলল, কী জানিস, ফ্যামিলির গঠনে পুরুষদের একটা মস্ত বড় ভূমিকা থাকে। যতই তুই ‘সিঙ্গল পেরেন্ট’ কনসেপ্ট চালু কর।

—সেটা তো নিরুপায় হয়েই করা, তাই নয় কি?—জিনা জিজ্ঞেস করল।

—তা তো বটেই। পরিবার হবে ব্যালান্সড্‌। নারী পুরুষ উভয়ে নিজের নিজের জায়গায় থাকলে ভারসাম্য থাকে। এইসব পল্লিতে পুরুষ-সংসর্গহীন যে ছেলেগুলো বেড়ে ওঠে তারা কেমন আধাপুরুষ মতো তৈরি হয়, এদিকে আধাপুরুষ, ওদিকে আবার অত্যাচারী শোষক টাইপ, মায়েরা খুব আশকারা দেয় তো! তো আমরা সেইজন্যেই টিচারদের সব পুরুষ রেখেছি। আর যখন ওরা বেড়াতে যায় তখনও মাস্টারমশাইদের ডিউটি দেওয়া হয়।

কথা বলতে বলতে দুজনে গাছের তলার দুটো ক্লাস পার হল। শীতের রোদ গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে গায়ে এসে পড়েছে। বছর আট-নয়ের জনা দশেক বাচ্চার দল। একটা দল নামতা মুখস্থ করছে, আর এক দল একসঙ্গে কবিতা বলছে—বাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস বাপু রে…। বাকি তিরিশজন ভেতরের ঘরে পড়াশোনা করছে। আপাতত ওদের ছবি আঁকার সময়। রং-পেনসিল আর কাগজ নিয়ে বসে গেছে।

জানলা থেকে দৃশ্যটা দেখছিল দুজনে। ব্রাউন আর সাদাতে পোশাক ওদের। পরিষ্কার ইস্ত্রি করা। চুলগুলো পাট করে আঁচড়ানো; ছেলেমেয়ে উভয়েরই চুল ছোট করে ছাঁটা। দেখতে দেখতে জিনা বলল, দেখলে একদম বোঝা যায় না।

—কী?

—এই…যে…বাবা নেই!

—বাবা তো একটা না-একটা আছেই—মুকুট হেসে বলল, তা ছাড়া সবাই কিন্তু পিতৃপরিচয়হীন নয়। কারও কারও পাড়াতেই বাবা রয়েছে, দালাল-টালাল। অনেকের আবার রেগুলার্স থাকে তো৷ ‘বাবু’ যাকে বলে। এদিকে আয়, ওই যে পুঁচকেটা বসে আছে দেখ…খাড়া খাড়া চুল, গোলচোখো…ওইটা তোর বনমালার ছেলে। বনমালার ভদ্রলোক বাবু আছে। তারই ছেলে।

—কী মিষ্টি বাচ্চাটা, বলতে বলতে জিনার মুখটা তালশাঁসের মতো সজল, ভারী হয়ে এল। সে বলল, দেখ মুকুট, কোনও কিছু নিয়েই খুব একটা হা-হুতাশ করবার অভ্যেস আমার নেই। যারা পালন করতে পারবে না, তাদের না-চাইতেই কেমন বাচ্চা, অথচ আমি চাই, একটা হলে বেঁচে যেতাম, অথচ কী অবিচার দেখ…

মুকুট বলল, দুর, তোর কি সময় চলে গেছে? কতটুকু বয়স তোর?

—না আর হবে না—গোঁয়ারের মতো বলল জিনা।

—কেন? ডাক্তার দেখিয়েছিস! ছোটখাটো অসুবিধে থাকলে সার্জারি করিয়ে নে। চিকিৎসা করা।

—কিচ্ছু নেই। ডাক্তার দেখিয়েছি। আর চান্স নেই। জাস্ট ব্যাড লাক।

—ডাক্তার বলেছেন?

—বলেননি। আমি বলছি।

—যাঃ, তুই তো এ রকম হতাশ-টাইপ ছিলি না!

—এখনও নেই, এই ব্যাপারটাই আমার কেমন ডিফিডেন্স এসে গেছে।

—তোর বর? বরকে দেখিয়েছিস?

—ওরে বাবা, তাকে কে বলবে? এক ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দেবে। বলবে আমাকে যে কিম্পুরুষ প্রমাণ করবে সে এখনও মায়ের পেটে।

—খুব দোর্দণ্ডপ্রতাপ নাকি রে, তোর বর?

—ওরে বাবা!

—তা সে যত দোর্দণ্ডই হোক, অনেক সময়ে অনেক কারণে হয় না। ডাক্তারের পরামর্শ নে। নিতে বল। এটা ঠিক করছিস না।

এইসময়ে ঋত্বিক পেছন থেকে এসে বলল, খালি সব্বাইকে ঠিক করছিস না, ঠিক করছিস না…ভেবেছিস কী বল তো!

ওরা চমকে পিছনে তাকাতে ঋত্বিক বলল, ঠিক করা না-করা বিষয়ে মুকুট নিজের সিদ্ধান্ত দিনে কতবার ঘোষণা করে জিজ্ঞেস করো তো জিনা…

সকাল দশটা নাগাদ নিখিল বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসেছে জিনা। বেশির ভাগ দিনই নিজের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রোচনায় আসবার সময় পেলেও সারাদিন কাটাতে পারে না। আজ সারাদিনের প্রোগ্রাম করে এসেছে।

ঋত্বিক বলল, আমাদের একজন মূল্যবান যোগ হয়েছেন!

জিনা বলল, মানে?

মুকুট বলল, ভ্যালুয়েবল অ্যাডিশন বলতে চাইছে রে।…দুজনে হেসে অস্থির।

ঋত্বিক অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, একজন নতুন সুপার এসেছেন। চমৎকার মানুষ, ঠিক আছে তো?

যেখানে বাচ্চাদের ডাইনিং রুমে সব লাইন করে নিজেদের স্টেনলেস স্টিলের খোপ খোপ থালি নিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে ইশারায় দেখাল ঋত্বিক। জিনা চাপা গলায় বলল, ইনি? তোমার মূল্যবান যোগ।

ঋত্বিক ঠাট্টা-ইয়ার্কি গ্রাহ্যই করল না। বলল, এঁর হিস্ট্রি শোনো। এক বৃদ্ধাশ্রমে তিন মাস ছিলেন। দুই ছেলে দুই বউ দুজনেই ছোট্ট ছোট্ট কৌটোর মতো ফ্ল্যাটে থাকে। ছেলেমেয়ে বড় হতে আর মায়ের জায়গা হতে চায় না। নিজের উইডো-পেনশন আর কিছু এফ.ডি-র সুদ হাতে ছিল, সেই সম্বল করে উনি বৃদ্ধাশ্রমে এসে উঠেছিলেন। ভাল লাগছিল না। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে একদিন সোজা এখানে এসে উপস্থিত। বললেন—গ্র্যাজুয়েট না হতে পারি, কিন্তু ফার্স্ট ডিভিশনে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছিলুম। হিস্ট্রি, ইকনমিক্স, লজিক ছিল, ফোর্থ সাবজেক্ট ম্যাথমেটিক্স। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র মুখস্থ, রবীন্দ্রনাথ সব পড়েছি বলতে পারব না, কিন্তু প্রায় সব। কত যে গল্প জানি তার ইয়ত্তা নেই। নাতি-নাতনিদের সমস্ত ভার ছিল আমার। তুমি আমাকে এক মাস রেখে দেখো।

মুকুট বলল, উনি এদের পরিচয় জানেন?

—অফ কোর্স।

—কী বললেন?

বললেন?—ঋত্বিক হাসতে হাসতে বলল, উনি ছড়া কেটে বললেন—শিশু হল শিশু, শিশু মানেই যিশু, আমার কোনও ইতর বিশেষ নেই।

—তারপর?

—তারপর…ওঁকে তো এরা দিদা বলে। ভীষণ পপুলার…রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর একটা গল্প বলার সেশন হয়। বাচ্চারাও শোনে, তাদের দিদিরাও শোনে। উনি আমার এক অমূল্য…

জিনা বলল, ‘যোগ’—না না—ঋত্বিক বলল—মনে পড়েছে ‘সংগ্রহ’—‘অমূল্য সংগ্রহ’। থ্রি-টিয়ার ফ্যামিলি স্ট্রাকচারের সবচেয়ে ওপরের স্তরটা না চাইতেই এইভাবে পেয়ে গেছি। এর মধ্যে উনি আবার বাচ্চাদের জ্বর, পেটের গোলমাল, কানব্যথা এ সব আমাদের সাহায্য ছাড়াই সারিয়ে দিয়েছেন। সারা অঘ্রাণ মাস বড়ি দিলেন, ছেলেমেয়েরাও ওঁর সঙ্গে বড়ির নাক তুলল টেনে টেনে। আচারও করেছেন প্রচুর। সরস্বতী পুজো আসছে, বলছেন—কিচ্ছু ভেবো না বাবা, সমারোহ করে সরস্বতী পুজো করব। রান্নার মেনু ঠিক করেন, কীভাবে কী করতে হবে বলে দেন। সব্বাই বলে মা। সব্বাই মেনে নিয়েছে। আমরা বলি সুধাদি।

জিনা যেখানে পড়াতে যায় আর ঋত্বিকের এই ‘রোচনা’ দুটোতে পরিবেশের দিক থেকে আকাশ-পাতাল তফাত। খুব লোভ হচ্ছিল এখানে কাজে যোগ দেবার। কিন্তু তার কাজটাও তো একটা চ্যালেঞ্জ! সে কি চেষ্টা করলে এই বাচ্চাদের মায়েদেরও এরকম একটা সুন্দর জীবন দিতে পারে না? সবাইকে না পারে, কয়েকজনকে সে এ প্রফেশন ছাড়াবেই! খুব ভাল প্রোগ্রেস করছে তার পূর্ণিমা আর বনমালা। রাখিও মন্দ করছে না। বাকিদেরও মন লেগেছে। পূর্ণিমার লেখাপড়ায় মাথা বেশি। বিশেষ করে অঙ্কে। এত তাড়াতাড়ি সে পাটিগণিতের যাবতীয় সমস্যা ধরে ফেলতে পারছে যে তার দিদিমণিই এক এক সময়ে বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে। তাকে অঙ্কগুলো নিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে বসতে হচ্ছে অনেক সন্ধ্যায়। বনমালা অত মেধাবী নয়। কিন্তু সে পড়তে ভালবাসে। গোয়েন্দাগল্প পড়ার শখ খুব। গান শিখেছে খুব ভাল। গলাটা অন্যদের মতো অমার্জিত নয়। বেশ একটা ঝঙ্কার আছে গলায়। কিন্তু জিনার জেদ, পূর্ণিমা আর বনমালাকে একসঙ্গে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসাবে। সিলেবাস ধরে ধরে একটু একটু পড়াতে শুরু করেছে সে। মুকুট অনেকবার বলেছিল—ওদের পরীক্ষা পাস করাবার কোনও প্রয়োজন নেই। নিজেদেরটা বুঝে নেবার মতো শিখলেই হল। কিন্তু জিনা তার কথায় কর্ণপাত করেনি। মুখে সে আজকাল কিছু বলে না। তর্ক করে তো কোনও লাভ নেই। কিন্তু তার নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী কাজে কারওই বাধা দেওয়ার অধিকার নেই বলে সে মনে করে। কল্যাণবাবুও মোটের ওপর তার সঙ্গে একমত। যদিও তিনি জিনার মতো অতটা আশাবাদী নন।

একটা সেবামূলক কাজের পথ ধরে যে জিনার জীবনে একটা লক্ষ্য এসেছে, স্থিতি এসেছে, এতে কল্যাণবাবু ভেতরে ভেতরে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করেন। তাঁর ধারণা যদিও জিনা খুবই ভদ্র মেয়ে তবু এই সন্তানহীনতার সূত্রে স্বামীর সঙ্গে তার একটা তিক্ততার সম্পর্ক হয়ে যেতে পারত। নিখিলের কোনও হেলদোল নেই। সে পিতা হতে পারল কি পারল না, তার স্ত্রী সুখী কি সুখী নয়, যদি না হয় সেজন্য কী করা দরকার, কিছু করা দরকার কি না, এ সমস্ত চিন্তাই যেন তার চরিত্রের বাইরে। সে আজকাল রাত দশটা-এগারোটা করে বাড়ি ফিরলে নিজের ঘর থেকেই কল্যাণবাবু অনেক সময়ে শুনতে পান জিনা সিঁড়ির ওপর থেকে অর্ধেক হাসি অর্ধেক অনুযোগের সুরে বলছে—এই যে ‘নমো যন্ত্র?’ এলেন? নমো যন্ত্র, নম টাকায়, নম অফিসায়, নম অফিসস্য চেয়ারায়, নমো নমঃ।

নিখিল বলছে, ছ্যাবলামি করো না রাতদুপুরে।

—রাতদুপুরে বাড়ি ফিরলে ছ্যাবলামিটা তো রাতদুপুরেই শুনতে হবে। আর কখন শোনাব?

যেদিন ওদের ক্লাবে বা অন্য কোথাও পার্টিতে যাবার থাকে, জিনা ক্লাস সেরে তাড়াতাড়ি ফেরে, কল্যাণবাবুকেও তাঁর ক্লাস তাড়াতাড়ি ছাড়তে হয়। ফিরতে ফিরতে জিনা বলে—আচ্ছা বাবা, ওদের ক্লাবের মিসেস কাপুর, মিসেস নায়ার, মিসেস কারনানিদের একদিন করে একটু অবিনাশ কবিরাজে ক্লাস নিতে বললে কেমন হয়? বেশ বলব—দুপুরের কিটি-পার্টিটার বদলে একদিন আপনাদের একটা দুর্দান্ত জায়গায় নিয়ে যাব। বলেটলে…সার সার ওপেল, এস্টিম, হোন্ডা সব থাকবে সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু-এর ওপর…বলতে বলতে জিনা তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হাসতে থাকে। এখন সে কল্যাণবাবুর সঙ্গে অনেক স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে। পুরনো শ্বশুর-ছেলেবউ সম্পর্কটা যেন একটা নতুন সমীকরণে এসে দাঁড়িয়েছে। নিখিলের থেকে জিনা তাঁর অনেক বেশি কাছের মানুষ। এমনকী কাকে তিনি বেশি চেনেন, কার সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্কটা এটাও অনেক সময়ে গুলিয়ে ফেলছেন কল্যাণবাবু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *