ভোরবেলার আজান

ভোরবেলার আজান

ট্রেনের আওয়াজের সঙ্গে অনেক সময় মনের আওয়াজ মিলে যায়। ট্রেনের গতির সঙ্গে মনের গতি। আবার উল্টোটাও হয়। ট্রেন যত দ্রুতগ, মন তত মন্থর। ট্রেন যত অস্থির, মন ব্যস্তানুপাতে ঠিক তত শান্ত। সৌম্যর মনের ভেতর দারুণ গ্রীষ্মে ঠাণ্ডা জল খাওয়ার মতো একটা অবর্ণনীয় শান্ত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল। অনেক অনেক কাল পর বুঝি দেশে ফিরেছে সে। রাজারহাট বিষ্ণুপুর। মুখে-মুখে লোকে বলে বিষ্টুপুর। হাফ-প্যাণ্ট পরা ছোট্ট ছেলেটি হয়ে। মিত্তিরদের বারো কাঠা জুড়ে ভদ্রাসন, পাঁচিলে বট অশথ রীতিমত বৃক্ষ হয়ে উঠেছে। ফাটা রকে ছোট ছোট ব্যাঙ লাফিয়ে যাচ্ছে। রোগামতো একটি ছেলে আপনমনে কাঁইবিচি নিয়ে খেলে যাচ্ছে একা একা। ছোট্ট সৌম্য জিজ্ঞেস করল —‘তোমার নাম কি?’ ভাব জমাবার ইচ্ছে। ছেলেটা মুখ ভেঙ্‌চে জবাব দিল, ‘বাঁশবিহারী কঞ্চিচরণ বাঁকারি’ বলেই দে ছুট দে ছুট, কিছুটা যাচ্ছে আর একবার করে থেমে মুখ ভেঙ্‌চে নিচ্ছে। বুকভরা রাগ আর অভিমান নিয়ে সৌম্য চলেছে খেজুরবাগান, ভোমরাবাগান, মিত্তিরপুকুর, ঢেঁকির বাগান···। দুপুর গড়াতে গড়াতে খেজুরবাগানে জম্বুগাছের ছায়ায় ধু ধু বিকেল। কারা যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে। ঢোল শহরৎ করে কারা যেন খুঁজে বেড়ায়। চারদিকে বাঁশঝাড়। সবুজ পানা দুহাতে সরিয়ে পুকুরের জলে ও ডুব দিয়েছে। স্নান শুধু স্নান। অতল জলে হাত পা ছেড়ে শুধু ভেসে থাকা। কসরত নয়। শুধু ভেসে থাকা। ওপরে বাঁশের কঞ্চি ভেদ করে দেখা যাচ্ছে অথই আকাশ। চাঁদ ওঠেনি। তাই কালো। এ কৃষ্ণতা ভয়ের নয়, অমঙ্গলের নয়। শান্তির কৃষ্ণতা। গহন, গভীর শান্তি। ঠিক মাথার ওপর দুই পা ফাঁক করে, ধনুতে জ্যা রোপণ করে দাঁড়িয়ে আছে কালপুরুষ। সৌম্য ভেসে আছে। ভাসতে ভাসতে দেখছে। কালপুরুষ। কোমরে বক্র তলোয়ার, হাতে নিপুণ ধনুক। পায়ের কাছের লুব্ধক নক্ষত্রটা চোখের কাছে হওয়া উচিত ছিল। আকাশপুরুষের ওইখানে একটা ভুল হয়ে গেছে। তবে দৃষ্টিতে উজ্জ্বলতা নেই বলে কালপুরুষকে যেন কেউ অন্ধ না ভাবে। অতিমাত্রায় চক্ষুষ্মান, অতিমাত্রায় সতর্ক এবং বিবেকী।

সকালের রোদ চারদিকে ছড়াতে ছড়াতে চলেছে ট্রেন, ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে বৃক্ষলতার মায়াময় সংসার। ভেতরে যেন সবুজ অন্ধকার, ক্রমেই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। সামনের সীটে সেই সবুজ আঁধারের শয্যায় শুয়ে শীর্ষ ঘুমোচ্ছে। ট্রেনে উঠেই দুটো ট্রাংকুইলাইজার খাইয়ে দিতে হয়েছে ওকে। সারা রাত কাল ছটফট করেছে। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রা এসেছিল। সেটাও ছিঁড়েখুঁড়ে গেল অতর্কিত উৎপাতে। ঘুমো, শীর্ষ ঘুমো। বহুদিন জেগে ছিলি, চরাচরে সবাই যখন তামসিক নিদ্রায় অভিভূত তখন একলা জেগেছিলি পাহারা দিবি বলে। সেই রাতজাগার কি দামটাই না দিয়েছিস! ঘুমো শীর্ষ ঘুমো। স্বপ্ন দেখিসনি। বাস্তবের দিক থেকেও মুখ ফিরিয়ে থাক। ভাবতে কষ্ট হয়— শীর্ণ, অষ্টাবক্র, এই তুই একদিন দুই আড়াই জ্বর নিয়ে বিনা দ্বিধায় মাঠে নেমে গিয়েছিস শ্রাবণের উপর্ঝুরন্ত বাদল দিনে, শুধু ক্লাবের মানরক্ষার জন্য। ভাবতে অবাক লাগে তুই আজ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিস না, অথচ বাসে কোন মেয়ের অপমান দেখে অনায়াসে দুই ছুরিকাধারী মস্তানের মহড়া নিয়েছিলি। একা। পরে তারা খুঁজে খুঁজে পাড়ায় বদলা নিতে এলে সিনেমার স্টান্টম্যানদের মতো একেক জনকে একেক দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলি। মহা শক্তিধর হয়েও নিজেকে অনায়াসে সমর্পণ করতে পারতিস ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের কাছে। দাম দিয়েছিস। এখন ঘুমো। সময়টা অফিস-টাইম। দুএকটা স্টেশনে ভিড় বাড়তে কোনও কোনও যাত্রী হঠাৎ খেঁকিয়ে তেড়ে এসেছে— ‘ভিড়ের মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছেন মশাই? দিনের বেলায়?’ সৌম্য তার পুরো দৈর্ঘ্য মেলে উঠে দাঁড়িয়েছে—‘বসুন দাদা, বসুন। আমি দাঁড়াচ্ছি।’ হঠাৎ হাত-জোড় করে তেড়ে-আসা লোকটি বলে উঠেছে, —‘ছি ছি, কিছু মনে করবেন না দাদা। ইস্‌স্‌স্‌!’

নেহাত ঘুমোচ্ছে তাই। নইলে এসব কৃপার কথা বিষের ছোবল দিত শীর্ষর গায়ে। তাই-ই ও পারতপক্ষে কোথাও যেতে চায় না। পাবলিকের কৃপাও এক রকমের কাপর্ণ্যই! অন্তত ফলাফলের দিক থেকে।

সৌম্য বলে— ‘বসে বসে তুই কূপ মণ্ডূক হয়ে যাচ্ছিস রে শীর্ষ!’

বই থেকে মুখ তুলে শীর্ষ জবাব দেয়— ‘তাহলে তোর এখনও ধারণা পৃথিবীটা কুয়োর চেয়ে বড়? এবং যেসব বিগ বসরা, পলিটিশিয়ানরা আজ হেলসিংকি, কাল প্রাগ পরশু মেলবোর্ন করে বেড়াচ্ছে, তারা সব বড় বড় থপথপে ব্যাঙ্‌ নয়?’

—‘তাদের কথা বাদ দে। তারা নিজেদের উদ্দেশ্যের বাইরের জগতটা দেখে না। কিন্তু ধর্‌, যারা অভিযাত্রী। অভিযাত্রী হতে হলে অ্যান্টার্কটিকা যেতে হবে এমন কোনও কথা নেই!’

—‘তারা সব ঘাসের ওপর একটি শিশিরবিন্দু দেখে বেড়ায় বলছিস? দুয়ার হতে অদূরে? পরিযায়ী পাখির মতো বিশ্বময় দিয়েছো তারে ছড়ায়ে? তবে শোন ছোড়দা আমাদের কাব্যালংকার টংকার গুলো সব বিলকুল ভুল তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পরিযায়ী পাখিও যে হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনোখানে করে তা কয়েকটা প্রাকৃতিক স্বভাবজ নিয়মকে মেনেই। তারাও দেখে, শোনে শুধু সেটুকুই, যেটুকু তাদের দরকার। খাল বিল ছাড়া কোথাও নামে না। ওদের নিজস্ব বিচরণক্ষেত্র ওইটুকুই। সে ভারতবর্ষেই হোক আর ভারখোয়ানস্কেই হোক। পৃথিবীটা কুয়োই। এবং আমরা সবাই, যে যত বড় বুলিই কপচাই না কেন, নিজেদের উদ্দেশ্যের বাইরের জগতটা একেবারেই দেখতে পাই না, সুতরাং মণ্ডূক ছাড়া কি?’

সৌম্য তবুও বলে— ‘বাড়ি থেকে বেরোলে মনটাও ভালো লাগে, সেটা তো স্বীকার করবি?’

—‘তাহলে তোর এই বেতসী-বাণিজ্যটা একটু বড় কর। একটা কনটেসা ফনটেসা কেন। তুই ড্রাইভ করবি, পাশে একজন মেকানিক কাম ড্রাইভার নিবি, সেকেন্ড ইন কমান্ড। পেছনের সীটে তোর ক্রীশ্চানের পুঁটলি থাকবে।’

—পুঁটলি সীটে থাকতে যাবে কেন? তার জন্য গাড়ির বুটে যথেষ্ট জায়গা থাকবে, পেছনের সীটে তুই আরাম করে শুয়ে বসে থাকবি।

—‘আরে, আমার কথাই তো বলছি! আমিই তো তোর ক্রীশ্চানের পাপের বোঝা রে!’

শীর্ষ ঘুমোচ্ছে। ট্রেনের চলার ঝাঁপতালে ভীষণভাবে দুলছে ওর শরীর। কোমরের ওপরে সৌম্যর বাঁ হাত। যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে, যাত্রীদের চোখে কৌতূহল আর কৃপার অযাচিত বরাভয় না দেখে ততক্ষণই ভালো। সৌম্য অপেক্ষায় থাকে কবে ও একেবারে ঘুমোবে। কবে ওর মুক্তি। দরদ, ভালোবাসা, সেবা, আত্মত্যাগ— সব দিলেও তো জীবন দেওয়া যায় না। ওর মতো সতর্ক, কর্মবীর সংযমী যুবককে যখন এমনি তামসিক নিদ্রায় কাল কাটাতে হচ্ছে তখন চিরঘুমই ভালো। আজকের দিনটা সুন্দর ছিল। সবুজ অন্ধকারের দিন। কালপুরুষের বিবেকী চোখের নিচে একটা সত্যিকার শান্তির দিন। যদি মার্সিকিলিং-এর ব্যবস্থা থাকত আইনে তাহলে সৌম্য আজ ওকে বলত— ‘কিরে, দোব না কি ডোজটা বাড়িয়ে?’ শীর্ষ সম্মতি দিলে তাই হত। কিন্তু আইন বহু চেষ্টা করেও মানবমুখী হতে পারেনি। ব্যক্তিমানুষের বিচিত্র পরিস্থিতির সামনে সে আজও দ্বিধাগ্রস্ত। এবং শীর্ষর ছোড়দা, যে নাকি একদিন বলবান, বুদ্ধিমান, হৃদয়বানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দেখে মানব কল্যাণের নিজস্ব মন্ত্রে তাকে দীক্ষিত করেছিল, সে এখন প্রায় একেবারে চুপ। মাঝে মাঝে পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তৃতা শোনে। কিম্বা মাণ্ডূক্যোপনিষদ!

বর্ধমান থেকে একটু ভালো করে ব্রেকফাস্ট করে নিল সৌম্য। শীর্ষকে ডাকল। ঘুমচোখে সেদ্ধ ডিমে কামড় দিতে দিতে শীর্ষ জড়ানো গলায় বলল—‘কি রে এইসব ফিশ-ফ্রাই-টাই ভালো তো? সত্যি সত্যি খাবো?’

সৌম্য হেসে বলল, ‘উর্দিপরা রেলওয়ে ক্যানটিন থেকে আসছে, ধরে নেওয়া যাক ভালো।’

একজন যাত্রী বললেন, অন্ততপক্ষে গরম তো মশাই! খেয়ে নিন। ঠোঙার মধ্যে পোরাও রয়েছে যখন ধরে নিন মাছি-টাছি বসেনি।

শীর্ষ বলল, ‘দিদিটা বোধহয় ফ্রিজ ভরে আয়োজন করে রেখেছিল। কপালে জুটল না! তুমি যাও বঙ্গে, তোমার কপাল যায় সঙ্গে।’

খাওয়াতে-টাওয়াতে ভালোবাসে দিদিটা। অনেকদিন থেকে যেতেও বলছে। ফেরবার সময়ে কোম্পানির গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবে বলেছিল অরণ্যদা। কোনও একটা গাড়িকে কলকাতার হেডআপিসে পাঠালেই হবে। ভেস্তে গেল। জীবন এমনিই। সৌম্যর ইচ্ছে ছিল ব্যাঙ্গালোর ঘুরে নাসায় যাবে, আর শীর্ষ? পাইলট না প্লেয়ার না প্রোফেসর বলা শক্ত। লেখাপড়ায় ভালো হলেও ওর ঝোঁকটা বহির্বিশ্বের দিকেই ছিল বরাবর। ওই পরিযায়ী পাখিদের মতোই।

শীর্ষকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে হাঁটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। ওকে বেঞ্চিতে বসিয়ে একটা চেয়ারের ব্যবস্থা করল আগে সৌম্য। ট্যাক্সিটাও সহজে পাওয়া গেল। খুব সম্ভব শীর্ষর জন্যই। কলকাতা শহরের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের যতটা নির্মম মনে করা হয়, ততটা নির্মম তারা নয়। স্ট্র্যান্ড রোডে পড়ে ট্যাক্সি বাঁ দিকে বাঁক নিচ্ছে দেখে শীর্ষ বলল, —‘কি ব্যাপার?’

সৌম্য বলল, ‘দরকার আছে শ্রীর সঙ্গে।’

শ্রীকে দরকারি কথাটা বলে নিতে হবে। শীর্ষকে গাড়িতে বসিয়ে ভেতরে ঢুকবে। রোববার। আশা করা যায় সন্তোষ শ্রী দুজনেই থাকবে। সন্তোষ না থাকলে ওদের বাড়ি যাওয়াটা যথা সম্ভব এড়াতে চায় সৌম্য। সন্তোষ যারপরনাই ভালো ছেলে। ওদের কারুর মধ্যে কোনও লুকোছাপাও নেই। কেউ অবাস্তব রোম্যান্সের জগতে বাস করে না। তবু সাবধানের মার নেই। কার জীবনে কখন কিভাবে কীট প্রবেশ করে কে বলতে পারে! শ্রীময়ী খুব-ই অসাধারণ মেয়ে। এক দিদি ছাড়া আর কারুর মধ্যে ওইরকম কলঙ্কহীন শিখার ঔজ্জ্বল্য দেখেনি সৌম্য। সন্তোষ হচ্ছে পোষা বাঘ। শ্রীময়ীর এবং সৌম্যরও। কোথাও ভুলচুক না ঘটে যায়।

সুখের কথা, গলির মুখেই সন্তোষকে পাওয়া গেল। দু’ হাত ভর্তি বাজার করে ফিরছে। মুখ বাড়িয়ে সৌম্য একটা ডাক দিল। ছুটতে ছুটতে দরজার মুখে থলিদুটো নামিয়ে সন্তোষ চিৎকার করে বলল— ‘কি দাদা, আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলুম? ওকি ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে রাখলে কেন? ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!’

সৌম্যর সমস্ত আপত্তি নস্যাৎ করে দিয়ে সন্তোষ সাত তাড়াতাড়ি এসে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে শীর্ষকে পাঁজাকোলা করে নামিয়ে নিল। সৌম্যকে বলল ‘হাত জোড়া, থলিদুটো তোলো দাদা।’ তারপরেই চিৎকার জুড়ে দিল— ‘কই বিশ্রী, কোথায় গেলে? দেখে যাও কারা এসেছে।’

সৌম্য বলল— ‘এমন করছো যেন মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম এলুম!’

শ্ৰী বোধহয় রোববারের বাজারে কিছু পরিষ্কার-টরিষ্কার করছিল। নীল রঙের ধনেখালি শাড়ি কোমরে জড়িয়ে হাতে একটা ঝাড়ন নিয়ে বেরিয়ে এলো। ওর চুলে ধুলো, ময়লা, মুখে-হাতে শাড়িতে কালো কালো ছোপ।

শীর্ষকে দেখেই ওর মুখ হাসিতে ভরে গেল। শীৰ্ষরও। শীর্ষ বলল— ‘কড়া করে এক কাপ লিকার খাওয়াও তো বাবলিদি! ঘুমটা কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না। অথচ আমি ছাড়াতে চাইছি। এই ছোড়দাটা···’

সৌম্য চমকে ওর দিকে তাকাল। বলল, ‘সকালে বললেই পারতিস, ওষুধটা দিতুম না।’

শীর্ষ কেমন একরকম করে হাসল, বলল, ‘কখন যে ঘুমোতে চাই, কখন যে জাগতে চাই···’

শ্রী সৌম্যর দিকে ফিরে বলল—‘তুমিও চা তো?’

সন্তোষ বলল—‘দাদাও, আম্মো। এক যাত্রায় কি আর পৃথক ফল হয়?’

ঘুম-জড়ানো গলায় শীর্ষ বলল— ‘হয় সন্তোষদা হয়, জানতি পারো না।’

সৌম্য আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ট্যাক্সিটা হুট করে ছেড়ে দিলে সন্তোষ এখন কোথায় পাই বলো তো?’

সন্তোষ যেন আকাশ থেকে পড়ল, ‘রোববারের বাজারে তোমরা অন্য কোথাও ফিস্টি করবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পকেটে পুরে সন্তোষ মিত্তিরের ঠেকে এসেছো! ছি ছি! কাঁকড়া এনেছি দাদা। বড় বড় কাঁকড়া। ইয়া ইয়া দাঁড়া। দাঁড়ার মধ্যে মিষ্টি গোলাপি শাঁস। দুরমুশ পিটিয়ে রাঁধবে। উঁহু উঁহু শ্রী নয় শ্রী নয়। তা’লেই মাটি। রাঁধবেন যমুনা দেবী। মানে আমাদের রান্নার মা-জননীটি। দেখবে খেয়ে কি জিনিস!’

চা নিয়ে শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ হাত সাবান দিয়ে ধুয়েছে। শাড়িটা বদলেছে। কপালে জল চিকচিক করছে, টেবিলের ওপর স্টীলের থালাটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘কি ব্যাপার সৌম্যদা? তোমাদের এখন দিদির কাছে থাকার কথা না?’

—‘ছিলুম তো। ওখান থেকেই তো ফিরছি! আজকে তোদের বাড়িতে নামবার আমার আদৌ দরকার ছিল না, ইচ্ছেও ছিল না। সন্তোষটা গায়ের জোর দেখাল। তোকে শুধু জানাবার ছিল বৃহস্পতিবার আসাম যাচ্ছি। প্রতিবারের মতো এবারেও শীর্ষকে রেখে যাবো।’

সন্তোষ বলল, ‘বউটিকে আগেই গছিয়েছো। এবার ভাইটিকেও গছাবার তালে আছো নাকি দাদা?’

সৌম্য গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তোমার অসুবিধে আছে?’

শ্রী চোরা কটাক্ষ হানল। সন্তোষ একেবারে শুয়ে পড়ে সৌম্যর পা জড়িয়ে ধরল— ‘ওরে বাবা, বাণবিদ্ধ হয়ে গেলুম দাদা, মাপ করে দাও এবারের মতো। হিউমারটা আমার একটু জোয়ারের বেগে আসে, জানোই তো!

শ্রী বলল— ‘ওটা হিউমার নয়, ভাঁড়ামি।’

সন্তোষ বলল, ‘অসুবিধে কি? আমার তো সুবিধেই। সন্ধে হলেই আমার শ্রীমানটি হোম-টাস্ক দেখিয়ে দেবার জন্যে ঝুলোঝুলি করতে আসবে না। বাদুড়ঝোলা হয়ে আপিস থেকে ফিরি, ওসব কি আর তখন ভালো লাগে? শ্রীমানটি বোধহয় স্কুলের যাবতীয় কাজ মায় আঁকা-টাঁকা সবই শীর্ষকাকুকে দিয়ে···”

শ্রী বলল—‘এবার তোমার শীর্ষকে দিদির ওখানে রেখে যাওয়ার কথা ছিল না? তাই-ই আমি অবাক হচ্ছি।’

সৌম্য চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘ওখানে একটা খুব আনফরচুনেট ঘটনা ঘটে গেল আজ সকালে। সকালে মানে রাত্তিরেই। সকালে জানা গেল ব্যাপারটা।’

শ্রী বলল— ‘কি আবার হল?’

সৌম্য বলল, ‘অরণ্যদাদের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকেন চীফ এঞ্জিনিয়ার। বছরখানেক মতো এসেছেন। তিনি হঠাৎ আত্মহত্যা করেছেন। সে এক বিশ্রী ব্যাপার। ইলেকট্রিক ওয়্যার জড়িয়ে জড়িয়ে।’

শীর্ষ হাই চাপা দিতে দিতে বলল— ‘নাম সুমন্ত সেনগুপ্ত। স্যাড ব্যাপার।’

সন্তোষ বিষম খেয়ে বললে, ‘ক্‌কি? ক্‌কি বললে?’

শ্ৰী এক মিনিট একদম চুপ করে রইল। তারপর সাদা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের জলের না ঘামের ফোঁটাগুলো মুছতে মুছতে শুধু বলল ‘ও।’

কাপগুলো স্টীলের থালার ওপর রেখে, থালাটা দু’হাতে তুলে নিল শ্ৰী, দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘খুব ভালো করেছ চলে এসেছ। ওই পরিস্থিতিতে থাকতে ইচ্ছে না হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এসে গেছো যখন শীর্ষকে আর নিয়ে যেও না। ও আজ থেকেই যাক। তোমাদের আজ খুব ভালো খাওয়াবো। ভাগ্যক্রমে বাজারটা আজ ভালো করেছে। কি রে শীর্ষ, আপত্তি নেই তো?’

শীর্ষ দুহাতের আঙুল জড়ো করে মন্দিরের চুড়ো করতে করতে বলল— ‘শালগ্রামের ওঠাই বা কি আর বসাই বা কি? অন্ধের কিবা রাত্রি কিবা দিন!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *