ছায়ার পাশে

ছায়ার পাশে

মর্নিংওয়াক সেরে ফিরেছেন পরমার্থ। মোটাসোটা থাইয়ের ওপর খাকি শর্টস! খানিকটা জগিংও করেন উনি ফি সকালে। এখন ঘামে চকচক করছে বাদামি চামড়া। জানলার ধারে দোলনা চেয়ারে বসে আরাম করে লেবু চা খাবেন। কোথায় পড়েছেন লেবু চা, লেবুর শরবত, লেবুর সব কিছু চর্বি কমাতে সাহায্য করে। খালি গায়ের ওপর একখানা মোটা তোয়ালে, মাঝে মাঝে নিচু হয়ে ভুঁড়ির থাকগুলো খামচে ধরছিলেন পরমার্থ। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। এতো করেও থাকগুলো সংখ্যায় কমছে না। জয়ন্তী শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন —‘তোমার ফোন। মুখার্জি করছে।’ ফোনটা শোবার ঘরে থাকে। জয়ন্তী খাটের ওপর বেড কভার ঢাকা দিতে দিতে শুনলেন পরমার্থ বলছেন —‘কি, কি বললে? ওহ গড্‌।’ রিসিভারটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। জয়ন্তী তাড়াতাড়ি এসে ধরে না ফেললে চৌচির হয়ে যেত জিনিসটা।

পরমার্থর চোখ ঠিকরে আসছে। বললেন—‘শীগগিরই এক গ্লাস জল দাও। শরীরটা কেমন করছে।’

জয়ন্তী সহজে ঘাবড়ান না। আজ ঘাবড়ে গেলেন। ফ্রিজ থেকে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল ভরে এগিয়ে দিলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন —‘কি ব্যাপার?’

এক চুমুকে ঠাণ্ডা জলটা শেষ করলেন পরমার্থ। জয়ন্তী বললেন—‘তোমার কপালে ঘাম দিচ্ছে। কতবার বলেছি ওভাবে জল খেয়ো না। হয়েছে টা কি?’

পরমার্থ বললেন—‘মুখার্জিদের ওপরে সেনগুপ্ত…’

—‘কে সেনগুপ্ত?’

—‘আহা, সুমন্ত সেনগুপ্ত! চীফ এঞ্জিনিয়ার! আত্মহত্যা করেছে।’

—‘কি করেছে?’ প্রায় খিঁচিয়ে উঠলেন জয়ন্তী।

পরমার্থ এখন একটু সামলে উঠেছেন। ‘স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললেন —‘সুইসাইড। বুঝলে এবার? তুমি কি মেমসায়েবি ইস্কুলে পড়েছ বলে সরল বাংলাটাও বোঝ না! মুখার্জি পুলিসে ফোন করছে। এতক্ষণে করা হয়েও গেছে। আমি চললুম। একটা শার্ট দাও শিগগির।’

হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন পরমার্থ। প্রথম আলাপের পর সুমন্ত সেনগুপ্তর সঙ্গে রায় পরিবারের ঠিক হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

জয়ন্তী বলেন,—‘অত আড়ষ্ট লোক নিয়ে সামাজিকতা চলে না।’

ওরা নিজেরাও কখনও আসেনি। সে নিয়ে পরমার্থর একটা ক্ষোভই থেকে গেছে মনে। তিনি নিজে হাসিখুশি দিলখোলা লোক। অত মেপেজুপে চলতে পারেন না। জয়ন্তী তাঁকে প্রায়ই দোষ দেন এ জন্যে।

আয়নায় জয়ন্তীর ছায়া পড়েছিল। চোখদুটো বিস্ফারিত। আতঙ্কিত। ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁকা। কাঁপছে। শোবার ঘর থেকে বসবার ঘরে তাড়াতাড়ি চলে এলেন তিনি। সামনে গোল আয়না। মুখের ছবি আরও স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। ঘন নিঃশ্বাসের তালে তালে মুখের ছোট ছোট মাংসপেশীগুলো থরথর করে কাঁপছে। জয়ন্তী প্রাণপণে চেঁচিয়ে ডাকলেন—‘রামশরণ!’

—‘কি মা?’

—‘মিমি-মিন্টু কি এখনও ঘুমোচ্ছে?’

—‘ওরা বাগানে গেছে মা। মাটি কোপাচ্ছে।’

—ওদের শিগগির ডেকে দাও।’

একটু পরে হাতে কাদা-মাখা খুরপি নিয়ে হাসি-হাসি মুখে ছেলে-মেয়ে এসে দাঁড়ালো, দুজনকে আঁকড়ে ধরে ওদের ঘরে ঢুকে গেলেন জয়ন্তী। প্রাণপণে আত্মসংবরণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও ঠোঁট দুটো কেঁপেই যাচ্ছে, কেঁপেই যাচ্ছে।

কান্তিভাইয়ের গাড়ি পৌঁছেছে প্রায় পুলিসের গাড়ির আধঘণ্টা পরেই। কান্তিভাই ভীতু মানুষ। অকুস্থল একবার দেখে এসে বসে আছেন। ম্যানেজারের নিজস্ব চেম্বারে। ঘনঘন কফি খাচ্ছেন, আর কপালের ঘাম মুছছেন। রায় ওঁকে চেনেন ভালো করেই। ভরসা দিয়ে গেছেন। কাছাকাছি মার্কেটিং ম্যানেজার এবং একজন এঞ্জিনিয়ার দেখভাল করবার জন্য ঘুরঘুর করছেন। ছোট মালিক স্বয়ং। কখন কিসে ত্রুটি ধরেন। তবে কান্তিভাইয়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, ত্রুটি ধরবার মেজাজ আছে তাঁর। পাঁচ মিনিটে অন্তত সাতবার ‘ওহ্‌ গড্‌’ বললেন। চৌধুরী এবং ঘোষাল বৃথাই পাশের ঘরটায় বসে সিগারেট টেনে যাচ্ছে।

—‘ইলেকট্রিসিটির এ রকম অভিনব অ্যাপ্লিকেশন ইতিপূর্বে আমি তো অন্তত দেখিনি’— স্থানীয় থানার ও সি দ্বারিকা মৈত্র বললেন, ‘ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার বলছিলেন না?’

—‘উঁহু। মেকানিক্যাল। মেনটেনান্স ডিজাইনিং সব কিছুরই মাথার ওপরে’— ম্যানেজার রায় জবাব দিলেন।

‘এভাবে মৃত্যু, মানে এরকম ইল্যাবোরেটলি মরার কারণ কি বলে মনে হয় আপনার? খানিকটা শকই তো যথেষ্ট, না কি?’ —ডাক্তার গুপ্তকে জিজ্ঞেস করলেন দ্বারিকাবাবু। ম্যানেজার রায়ও তাঁর প্রশ্নের পরিধির বাইরে নয়।

ডাক্তার বললেন—‘সুইসাইডের সাইকলজি কি বলব বলুন। হয়ত ইন্সট্যানটেনিয়াস, পেনলেস এবং শিওর ডেথ চেয়েছিল।’

—‘ব্যাপারটা কি তাই?’

—‘শিওর তো বটেই। অন্যগুলো সম্পর্কে সন্দেহ আছে। ব্লাড সেলগুলো ইলেকট্রোলাইজড হতে কিছুটা সময় লাগে। মে বী জাস্ট এ কাপল অফ সেকেন্ডস। বাট দোজ সেকন্ডস আর অ্যান ইটারনিটি। কষ্টর দিক দিয়ে বললাম।’

দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা আওয়াজ হল কোথাও।

পরমার্থ রায় পুলিসি রঙ্গ রসিকতায় যোগ দিতে পারেননি। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বললেন— ‘এ কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার? একেবারে আমার ফ্যাক্টরি এরিয়ার ভেতর…এ তো কল্পনাই করা যায় না।’

—‘তা না যাক।’ দ্বারিকা মৈত্র নীরস মন্তব্য করলেন—‘সত্য সব সময়েই কল্পনাকে এক কাঠি ছাড়িয়ে থাকে। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। এখন ব্যাপারটা খুলে বলুন দেখি। কোনও অফিসিয়্যাল কেলেঙ্কারি!’

রায় বললেন—‘কি আশ্চর্য! আউট অফ দা কোয়েশ্চেন। বছর খানেক মাত্র কাজে যোগ দিয়েছিলেন। অত্যন্ত কাজের লোক এবং নির্বিরোধী। কারো সঙ্গে মনোমালিন্যেরও প্রশ্ন ওঠে না। তা ছাড়া এখানে স্টাফের মধ্যে রিলেশন খুব ভালো। জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখতে পারেন। এটা আমি কনশাসলি প্রোমোট করার চেষ্টা করি। ফিলিপিনসে থাকতে—’

পুলিশ কন্সটেবল শর্মা ড্রয়ারগুলো খুলে খুলে খোঁজাখুঁজি করছিল। বলল—‘কাগজ-উগজ তো কুছু মিলছে না সাব। জেনানা লোগের নেল-পালিশ, লিপস্টিক এই সোব চীজ কুছু কুছু আছে।’

দ্বারিকাবাবু বললেন— ‘ও সব কাগজ ড্রয়ারে থাকে না শর্মা। তোমার চাকরিটা যাবে মনে হচ্ছে। আশেপাশেই খোঁজো।’

কাগজটা অবশেষে অ্যাশট্রে চাপা পাওয়া গেল। পুড়ে যায়নি ভাগ্য ভালো। কারণ খাটের সাইড-টেবিলের ওপর সিগারেটের টুকরো অ্যাশট্রে থেকে উপছে চতুর্দিকে পড়েছে। সাইড-টেবিলের সানমাইকার ওপর পর্যন্ত দাগ পড়ে গেছে; তলায় কার্পেট ফুটো। খুব মনোযোগ দিয়ে দাগটাগগুলো পরীক্ষা করলেন দ্বারিকাবাবু। বললেন— ‘সুইসাইডকে আপনারা মোমেন্টারি ইনস্যানিটি বলেন ডাঃ গুপ্ত, কিন্তু এ ভদ্রলোক বহু ভেবেচিন্তে কাজটি করেছেন। ক’ প্যাকেট সিগারেট খরচ হয়েছে স্টাবগুলো গুনলে পাওয়া যাবে। শুধু চিন্তা না। ভাবতে ভাবতে একেবারে বেভুল হয়ে গেছিলেন ভদ্রলোক। কিভাবে উপছে পড়েছে। স্টাবগুলো দেখুন। দামী কার্পেট ফুটো হয়ে গেছে, ঘরে আগুন লেগে যেতে পারত…।’

স্তূপীকৃত সিগারেটের টুকরোর তলা থেকে পাওয়া গেল কাগজটা। অ্যাশট্রের চীনেমাটি—ওটাকে রক্ষা করেছে খুব সম্ভব। একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে দ্বারিকা মৈত্র বললেন— ‘এটা না পেলে আপনাদের ··· মানে ফ্যাক্টরির এমপ্লয়িজ ··· বিশেষ করে ··· কি যেন নাম বললেন এঁর? অরণ্য মুখার্জি? এঁকে একটু অসুবিধেয় পড়তে হত।’

শুকনো গলায় অরণ্য বলল— ‘কি যে বলেন মিঃ মৈত্র। সেনগুপ্ত টেকনিক্যাল স্টাফ। আর আমি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে····কোনও যোগাযোগই····’

দ্বারিকাবাবু হাত নেড়ে বললেন—‘তাতে কিছু ইতরবিশেষ হয় না মিঃ মুখার্জি। কত রকমের পার্সন্যাল গ্রাজ-টাজ’, এই ধরুন আপনি এতো দিনের স্টাফ নিচে, উনি ওপরে। একটা ডিসক্রিমিনেশন তো? সামান্য হলেও সামান্য নয়। এরকম অনেক আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ ব্যাপার থেকে অপরাধের মানসিকতা গড়ে ওঠে। যাক আপনাদের ঘাবড়াবার কিছু নেই’— তিনি দু হাত তুলে সবাইকে আশ্বস্ত করলেন— ‘কাগজটা তো পাওয়াই গেছে। একবার খালি রুটিন চেক ··· সেনগুপ্তর হাতের লেখা কিছু পাওয়া যাবে তো আপনাদের অফিস ফাইলে? ব্যাপারটা অবশ্য আনডাউটেডলি সুইসাইড, কোনও দ্বিমত হবে না এ ব্যাপারে। এভাবে ইলেকট্রিক ওয়্যার জড়িয়ে জড়িয়ে কেউ কাউকে খুন করতে পারে না।’ চোখ দুটো সরু করে দ্বারিকা মৈত্র তাকালেন রায়ের দিকে, তারপর অরণ্যর দিকে— এনিওয়ে উই শুড রিজার্ভ আওয়ার জাজমেন্ট টিল পোস্ট মর্টেম···। তবে মিঃ রায়, আপনার ঝামেলা খুব কমছে না। অফিসের রেকর্ড-টেকর্ড একটু দেখতে হবে। এঁর ফ্যামিলি-ট্যামিলি কি এবং কোথায়? ব্যাচেলার না কি! নেল-পালিশ, লিপস্টিক এসব কার? চরিত্র-টরিত্র?’

রায় বিরক্ত গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন— ‘ম্যারেড। মা-বাবার খবর ঠিক দিতে পারছি না। তবে স্ত্রীর বাপের বাড়ির ঠিকানা পার্ক সার্কাস। আনতে এখুনি গাড়ি পাঠাচ্ছি।’

ডাক্তার গুপ্তর দিকে ফিরে পরমার্থ বললেন— ‘আমাদের এখানকার সব কিছু এবং সবাই ক্লীন। যদ্দূর সম্ভব। এটা আমাদের এখানে চাকরির একটা কন্ডিশন বলতে পারেন।’

দার্শনিকের মতো হেসে ডাক্তার বললেন —‘তবু তো এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল।’

রায় বিমূঢ়ভাবে অরণ্যর দিকে তাকালেন, যেন বলতে চান— ‘দ্যাখো কাণ্ড! এঁরা কি মনে করেন যে পরিচ্ছন্নতা আমরা দাবী করছি তা আমাদের নেই!’ কিন্তু অরণ্য তখন সেখানে ছিল না। অরণ্য মুখার্জি রায়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। এতো সৎ এবং সব-সময়ে এক-পায়ে-খাড়া মানুষ খুব কম দেখেছেন রায়। তার প্রতিও দ্বারিকা মৈত্রর ব্যবহার দেখো! কথাবার্তার কি শ্রী! অনেকের মধ্যে একজনকে সিঙ্গল আউট করে···। এখন মনে হচ্ছে মুখার্জির বাড়ির ওপরে সেনগুপ্তকে পাঠানো ঠিক হয়নি। প্রতিবেশী হিসেবে ভদ্রলোক কারোরই আশা পূরণ করতে তো পারেননি, উপরন্তু বিপদে ফেলে গেলেন। আর মুখার্জি তলায়, সেনগুপ্ত ওপরে, এটা আদৌ কোনও ডিসক্রিমিনেশন নয়। কি হাস্যকর চার্জ! এগুলো সবই এ-টাইপ কোয়ার্টার্স। টপ্‌ অফিসিয়ালদের জন্য তৈরি। মুখার্জিরা বরাবর ওই কোয়ার্টার্সে থাকতে ভালোবাসে। ব্রততী কলকাতা যায় রোজ, মেনগেটের কাছে বলে ওইটেই ও পছন্দ করে। দ্বারিকা মৈত্র লোকটিকে হঠাৎ দেখলে খুব করিৎ-কর্মা মনে হয়, আসলে ঢুণ্ডু গণেশ। মুখেন মারিতং জগৎ। ডিসক্রিমিনেশন! হুঁঃ।’

অরণ্য নিচে নেমে এসে দেখল সামনের ঘর খালি। রাত্রে সৌম্যরা শুয়েছিল, তার কিছু কিছু চিহ্ন এখনও ঘরে রয়ে গেছে, কুশনগুলো সোফার ওপর পর পর সাজিয়ে রাখা, গালচে পাট করা। চাদর পাট করা। এগুলো বোধ হয় দু ভাই মিলে করেছে। ব্রততী করলে এগুলো এতক্ষণ এখানে থাকতই না। যথাস্থানে ঢুকে যেত। অর্থাৎ ব্রততীর এখনও প্রাত্যহিক কাজে নামবার সুস্থতা আসেনি। স্বাভাবিক। শোবার ঘরের পর্দা সরাতেই ব্রততীকে দেখা গেল। জানলার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। এদিকে পেছন। অরণ্যকে দেখতে পেল না। ওর শোয়ার ভঙ্গি থেকে এখনও ভয়ের সেই জড়সড় ভাবটা যায়নি। মাথার ওপর হাত রাখতে মুখ ফেরালো। চোখে একটা শূন্য ভাব। মুখটা ফ্যাকাশে।

অরণ্য একটু ইতস্তত করে বলল— ‘একটা শক্ত কাজ না জেনেই করে ফেলেছো ব্রততী। আরেকটা শক্ত কাজ কিন্তু জেনে করতে হবে। সেনগুপ্তর স্ত্রীকে আনতে গাড়ি যাচ্ছে। সে এলে তো যা হবে বুঝতেই পারছি। তুমি একটু এগিয়ে যেও, হেলপ্‌-টেলপ্‌ করো, নয়ত জিনিসটা শুধু শকিং নয়, সাঙ্ঘাতিক বিশ্রী দেখাবে। পারবে তো?’

ব্রততী মুখ নিচু করে ঘাড় নাড়ল। এমনিতে ও খুব শক্ত মেয়ে। বুদ্ধিও ধরে। কিন্তু অত্যন্ত চাপা। কখনও কখনও কেমন ভেঙে পড়ে। কারণ অরণ্যর জানা নেই, কিন্তু লক্ষণগুলো ও নির্ভুল চেনে। কেদার-বদ্রীর পথে যেখানে ওদের প্রথম আলাপ সেখানে অরণ্য ওকে দেখেছে ওর মা-কে সামলাতে। এমনিতে বেশ আছেন, আছেন। মাঝে মাঝে মাথা সম্পূর্ণ গণ্ডগোল হয়ে যেত ভদ্রমহিলার। ব্রততী কোনদিন তাঁর গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি। কোনও যাত্রী বা ট্রাভল এজেন্সির কর্তা-ব্যক্তি তদারকি যাঁদের করার কথা তাঁদেরও কোনভাবেই বিরক্ত করেনি। দারুণ ক্ষমতা ধরে। অরণ্য জানে এই পরিস্থিতিতে সেনগুপ্তর স্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যদি কেউ পারে তো ব্রততী-ই পারবে। কিন্তু এখন ওর সংশয় হচ্ছে। ব্রততী উঠে বসেছে। ওর মাথাটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে, অরণ্য নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করল— ‘কি, পারবে তো?’

ঘাড় নাড়ল ব্রততী।

অরণ্য বলল—‘তুমি একটু রেডি-টেডি হও তা হলে। সমস্ত ফ্যাক্টরির লোক জড়ো হবে ওইখানে। আমি চা-ফা করে দিচ্ছি। তোমাকে এখন আর গ্যাসের ধারে যেতে-টেতে হবে না। কি কি করতে হবে বলো, আমি সৌম্যকে নিয়ে করে নিচ্ছি। রামের মা-কে নিশ্চয়ই আর পাওয়া যাবে না।’

ব্রততী শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ল। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সৌম্য নিশ্চয়ই ভাইকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে। অচেনা জায়গা, যদি পড়ে-উড়ে যায়, সামলাতে না পারে, বাঁ হাতে একদম জোর নেই, ডান পা-ও তাই। সৌম্য তাই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে। তার মানে এক ঘণ্টা। ওর নিজের শোবার ঘরের সঙ্গেও একটা টয়লেট আছে। কিন্তু কিছুদিন হল তার শাওয়ার এবং বেসিনের কলের ওয়াশারটা গেছে। মিস্ত্রি এখনও আসেনি। নিচের কলটা দিয়েও ভালোভাবে জল পড়ে না। সামান্য একটু অস্থির-অস্থির লাগল অরণ্যর। কতকগুলো সময় আছে, পরিস্থিতি আছে, যখন মানুষকে নির্বিকারভাবে রুটিন কাজ করতে দেখলে ব্যাপারটা অযৌক্তিক জেনেও মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ে। অরণ্য রান্নাঘরের দিকে গেল। খুব নোংরা-টোংরা করে চা করল। নিজেই খেয়ে দেখল বেশ কড়া। বোধ হয় বেশি পাতা দিয়ে ফেলেছে। আগে ব্রততীকে এনে দিল এক কাপ। ওদের তবু একবার করে চা পান হয়েছে। ব্রততী বেচারির একেবারেই হয়নি। ওর ফেলে যাওয়া চায়ের ওপর একটা পাতলা সর পড়েছে। চা পেটে পড়লে হয়ত খানিকটা ধাতস্থ হবে।

সুমন্ত সেনগুপ্ত অরণ্যর থেকে কিছু জুনিয়র। চল্লিশের সামান্য নিচে না ওপরে, অরণ্যর জানা নেই। এ কোম্পানিতে মালিকই সব। তারপর আছেন ম্যানেজার স্বয়ং। টেকনিক্যাল স্টাফ-নিয়োগের ব্যাপারে তাকে ইন্টারভিউ-বোর্ডে ডাকা হয় না। পরামর্শ তো দূরের কথা। সুমন্তর বায়ো-ডেটা তার জানা নেই। ওর ব্যাপারে ম্যানেজার সাব যে রকম গোপনীয়তা রক্ষা করেন, মনে হয় সুমন্ত তাঁর নিজস্ব লকারে আনডিক্লেয়ার্ড সোনার বাঁট। শুনেছে প্রচণ্ড কোয়ালিফায়েড। কিন্তু এই ধরনের ডিগ্রি বা অভিজ্ঞতা-কৌলীন্য থাকলে যুবকরা যে রকম ডোন্ট-কেয়ার টাইপের হয়, সুমন্ত আদৌ সে রকম ছিল না। এখন চিন্তা করলে মনে হচ্ছে একটু চুপচাপই। গম্ভীর। যে বিষণ্ণতার খোলসের মধ্যে কাজ ছাড়া অন্য সময়ে ও ডুবে থাকত তাকে অনায়াসেই অহঙ্কারের নির্মোক বলে ভুল হতে পারে। বউটি খুবই সুন্দরী। চোখ-মুখ-নাক-ফিগারের বিচারে। স্মার্ট। কনভেন্টে শিক্ষিত। এ ধরনের সফল যুবকরা যে রকমের বউ চায় বা পায়। একটিই ছেলে। শুনেছে বাইরে কোথাও পড়ে। চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। সেনগুপ্ত দম্পতি অরণ্যদের ওপরে থাকত বটে, কিন্তু থাকত নিঃশব্দে। সামাজিক মেলামেশায় ব্রততীর খুব একটা উৎসাহ ছিল না। একদিন ডেকে খাওয়াবার কথা অরণ্য বলে বলে হেরে গেছে। খালি তা না না না। ইদানীং আর বলা ছেড়ে দিয়েছিল। ও পক্ষ থেকেও ভদ্রতা ছাড়া আর কিছু কখনও পাওয়া যায়নি। সুমন্তর একার সঙ্গে ক্লাবে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে। একেবারে ফর্ম্যাল। ড্রিঙ্কস-এর গ্লাস হাতে ধরে খুব সাবধানে আলগোছে। কথাবার্তা। এসব প্রাইভেট কনসার্নে— অনেকের মধ্যে একজন, জাস্ট একজন হয়ে থাকতে পারলে ভালো। অনেক ঘাটের জল খাওয়া হয়েছে। বয়স চল্লিশ পার। এখন যথাসম্ভব নিরিবিলিতে কলকাতার কাছাকাছি সে থাকতে চায়।

এক চুমুক খেয়ে ব্রততী বলল— ‘আর খাবো না।’

—‘খুব বাজে হয়েছে, না?’

—‘সে জন্য নয়। কি রকম বিস্বাদ লাগছে।’

—‘তা হলে একটু শরবৎ-টা করে খাও ব্রততী। কত বেলা হবে এসব মিটতে কে জানে। তোমার পেটের ব্যথা আরম্ভ হলে এর মধ্যে কে দেখবে?’

ব্রততী নিঃশব্দে উঠে গেল।

পারমিতাকে নিয়ে মিলের গাড়ি যখন এসে পৌঁছলো তখন বেলা খুব বেশি না হলেও ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ। এসব জায়গা খোলামেলা হওয়ার দরুন প্রকৃতির দাক্ষিণ্য যত, অত্যাচারও তত। প্রত্যেকটি ঋতুতে তার ভালোমন্দ সমেত হাড়ে হাড়ে চিনিয়ে ছাড়ে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। কদিন পরেই মহালয়া। এখনও বাতাসে আগুনের আঁচ। লাল ইটের কোয়ার্টার্সগুলো, লালচে রাস্তা, তার ওপর সূর্যের আগুনে রং— যত বেলা বাড়বে ততই মস্ত ফার্নেসের মতো দেখাবে।

অরণ্যদের বাড়ির সামনেটা এখন লোকে লোকারণ্য। খবর রটতে দেরি হয়নি। মিলের ওয়ার্কার, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং ওপর মহলেরও অনেকে ভেঙে পড়েছে। কান্তিভাইয়ের গাড়ি চলে গেল, মিনিট পনের হল।

খর রোদ আর সেই পাঁচ মিশালি জনতার সামনে ওরা পারমিতাকে নামাল। মেরুন রঙের জরিপাড়, বুটিদার শাড়ি। ঠোঁটে ঘোর রঙের লিপস্টিক, মুখে চড়া না হলেও বেশ ভালোই প্রসাধন। রঙিন চশমায় চোখ ঢাকা। ওকে নাকি গানের ক্লাস থেকে তুলে আনা হয়েছে। সঙ্গে এসেছেন বাবা। বেশ রাশভারি গম্ভীর চেহারার মানুষ। বয়স হয়েছে। মাথায় টাক। ধারে ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ পাকা চুল। সিঁদুরে আমের মতো রঙ।

পারমিতা শূন্যের দিকে চেয়েছিল যেন। সম্বিত নেই। ব্রততী একটু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো ধরতেই ওর কাঁধে ঢলে পড়ল। ওর বাবা ধরে না ফেললে দুজনেই পড়ে যেত।

অরণ্যই এগিয়ে গিয়ে ম্যানেজারকে বলল কথাটা। মিসেস সেনগুপ্তকে যেন ডেডবডি দেখতে দেওয়া না হয়। শনাক্ত করার ব্যাপার তো আর নেই। যদি জোর না করে, দেখতে না দেওয়াই ভালো। ততক্ষণে মৃতদেহ কারেন্টমুক্ত এবং তারমুক্ত করা হয়ে গেছে। বিছানার ওপর শোয়ানো। গলা অবধি লম্বা চাদরে ঢাকা। ঘরের মধ্যে যা যা দ্রষ্টব্য মনে করছেন বোধ হয় নোট করে নিচ্ছেন দ্বারিকাবাবু। কনস্টেবল শর্মা এবং আরও দু একজন কনস্টেবলকে কি সব নির্দেশ দিলেন। অরণ্যর অনুরোধে রায়ই গিয়ে বললেন কথাটা। ভদ্রলোক অবশ্য মেনে নিলেন সঙ্গে সঙ্গেই। পারমিতার বাবা যখন দৃঢ়স্বরে জানালেন এ অবস্থায় তাঁর মেয়েকে জেরা-টেরাও করা চলবে না, সেটাতেও কেন কে জানে আপত্তি তুললেন না। ভবিষ্যতে কথাবার্তার দিনক্ষণ ঠিক হল। তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল সুমন্তর বিধবা দিদি আঁটপুরের দিকে কোন গ্রামে থাকেন। নিকট আত্মীয় বলতে তিনিই একমাত্র, জমি-জমা বিষয়-সম্পত্তি কিছু আছে।

মৃতদেহ পুলিশের গাড়িতে মর্গে চলে গেল। মিসেস সেনগুপ্ত একবারও দেখতে চাইল না। মুখ ফেরাল না। কাঁদল না। পাথরের প্রতিমার মতো ড্রইংরুমের একটা সোফায় বসে রইল সারাক্ষণ। বাড়ি খালি হয়ে যাওয়ামাত্র বাবার হাত ধরে গাড়িতে গিয়ে উঠল।

ব্রততীকে নিয়ে অরণ্য নিচে এলো যখন তখন বারোটা বেজে ক’ মিনিট হয়েছে।

ব্রততী বলল— ‘ওদের কিছু খেতে দেওয়া হয়নি এখনও পর্যন্ত।’

অরণ্য বলল—‘সৌম্য কি আর বুদ্ধি করে কিছু করে-টরে নেয়নি। ওর এসব অভ্যেস আছে। তোমার স্টকে তো সবই মজুত?

ব্রততী ঘাড় নাড়ল।

‘—সোম।’ একটু আস্তে গলাতেই ডাকল অরণ্য। বাড়ির যা পরিস্থিতি তাতে হাঁকডাক করা ভালো দেখায় না। মনটাও বিশ্রী হয়ে আছে। সাড়া পেল না। বাথরুমের দরজা এখনও তেমনি বন্ধ। সে কি! এখনও ওরা বাথরুম থেকেই বেরোয়নি? ধাক্কা দিল অরণ্য বাথরুমের দরজায়—‘শীর্ষ!’

দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। কেউ নেই। খোলাই ছিল কি সারাক্ষণ? এ বাথরুমের দরজাটা একটু আঁট হয়েই বসে। সৌম্য শীর্ষ কেউ নেই। ব্রততী রান্নাঘরটাও দেখে এলো। কেউ কোথাও নেই। সৌম্য শীর্ষ চলে গেছে। ঠিক কখন, ওরা জানে না। কাউকে না বলেই গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *