ইতিহাসের এক ভীষণ চিল চিৎকার

ইতিহাসের এক ভীষণ চিল চিৎকার

শেষ দুপুর থেকেই সব থমথম করছে। আকাশের চোখ লাল। গুমোটটা হঠাৎ বেড়ে গেছে চতুর্গুণ। বিবি আজকাল মাকে ছেড়ে বড় একটা বেরোচ্ছে না। পরীক্ষা এসে গেছে। তৈরি হচ্ছে চুপচাপ। দালানে বেড়িয়ে বেড়িয়ে পড়তে পড়তে ও মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল। আজ প্রচও দুর্যোগ আসবে মনে হচ্ছে। কাছে যা অস্ত্রশস্ত্র ছিল সব দিয়ে দিয়েছে ইন্দ্রদার কাছে। ইন্দ্রদা যা বোঝে করবে, দরজার কড়া নড়ল না? খুট খুট করে কে যেন কড়াটা নাড়ছে! পড়তে পড়তে বিকেল হয়ে গেছে কখন। আকাশের মেঘের জন্যে অকালসন্ধ্যা নেমেছে। বিবির হঠাৎ কিরকম ভয়-ভয় করল। পরক্ষণেই তার মুখে কঠিন হাসি ফুটে উঠল। তার আর ভয় করলে চলে? তাদের জন্যে, তার জন্যে নির্দোষ নিরীহ দাদাকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে না? হঠাৎ মনে হল যদি বাচ্চু হয়? নিঃশব্দে নিচে গিয়ে দরজার খিলটা নামিয়ে রাখল বিবি, হাওয়ায় আপনা থেকেই ফাঁক হয়ে গেল দরজা। অন্ধকারে বেঁটেমতো একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকল না। বলল—‘আপনি বিবিদি? ইন্দ্রদা খবর পাঠিয়েছে পুরনো ঠিকানায় অনেকদিনের ফেরার একজন আসছে। আপনার যা করণীয়, করবেন।’

বিবি বলল—‘কে?’

—‘জানি না।’ তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে চলে গেল ছেলেটি।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল বিবি। ফাঁদ নয় তো? পুলিশ এখন গুণ্ডাদের সাহায্যে ধরছে ওদের। যে গুণ্ডারা নকশাল নামের আড়ালে যথেচ্ছ খুন করে গেছে তারাই এখন ওদের ধরতে এগিয়ে আসছে। পাড়ায় পাড়ায় প্রচণ্ড দলীয় মারামারি, খুনোখুনি। বাপ্পা থাকলে ভালো হত। পরামর্শ করার কেউ নেই। মাকেও একা রেখে যেতে হবে। দাদা মারা যাবার পর মা কেমন হয়ে গেছে। সংসারের কাজ-কর্ম বেশির ভাগ বিবিকেই করতে হয়, মা শুয়ে-বসে থেকেও কি এক ভেতরের আগুনে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন।

বিবি টিফিন ক্যারিয়ারে রাত্রের জন্য তৈরি রুটি, তরকারি, চাটনি ভরে নিল। টিফিন ক্যারিয়ারটা একটা ঝোলার মধ্যে। মায়ের ঘরে চৌকাঠের ওপর একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়াল। তারপর মনস্থির করে বলল—‘মা, আমি একটু বেরোচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দাও।’

মা ব্যাকুল হয়ে উঠে বসলেন—‘বিবি, ও বিবি, কোথায় যাবি? ঝড় আসছে মা, দিনকাল ভালো নয়, কোথাও যেও না।’

ছলছলে চোখে বিবি গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল—‘মা, আজ বোধহয় বাচ্চুর খবর পাবো। তাই যাচ্ছি।’

—‘বাচ্চু? তুই নিয়ে আসবি তাকে? বিবি?’

—‘নিয়ে আসতে পারব কিনা জানি না মা। তবে খবর পাবো। তুমি আমার জন্য ভেবো না। সাবধানে থেকো।’

দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে মা বলল—‘ভাবব না কি মা! সোমত্ত মেয়ে, সন্ধেবেলায় ঝড়ের মুখে বেরোচ্ছ? নারায়ণ, নারায়ণ।’

বিবি মাকে বলতে পারল না, বাচ্চুর নামে অনেকগুলো পুলিস ওয়ারেন্ট আছে। তাকে আনা সম্ভব নয়। কতদিন, কে জানে হয়ত চিরদিনই তাকে পালিয়ে থাকতে হবে। বাপ্পাকে পরিস্থিতি জানিয়ে গেলে ভালো হত। কিন্তু সময় নেই।

ট্যাক্সি ধরবার চেষ্টা করল বিবি প্রথমটায়। ওদিকে কেউ যাবে না। খানিকটা বাস, খানিকটা রিকশা, খানিকটা হাঁটাপথে যখন নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছলো, তখন ঝড় এসে গেছে। ঝড়ের প্রচণ্ড মত্ত হাওয়াই তাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল বাড়িটার মধ্যে। ঠিকানা বহুদিনের চেনা। মুক্তাঞ্চল বলে এটাকে ওরা। এখানে কমরেডরা মোটামুটি নিরাপদ। আশপাশের লোকেরা তাদের গতিবিধির কথা জানলেও বড় একটা বলে দেয় না। এ বাড়িটা তালাবন্ধ থাকে এখন। বাড়ির মালিক চাকরি করেন দিল্লিতে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভদ্রলোকের মা বেঁচে ছিলেন। তিনি সে সময়ে আশ্রয় দিয়েছেন অনেককে। কেন কে জানে অকৃত্রিম দরদ আর সহানুভূতি ছিল ভদ্রমহিলার ওদের ওপর। খুব সম্ভব বৃদ্ধা বাংলার টেররিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অল্প বয়সে। উনি মারা যাওয়াতে বাড়িটা তালা বন্ধ পড়ে থাকে। সদরে তালা, খিড়কির দরজার খিল বাইরে থেকে লোহার তার দিয়ে খুলে যাতায়াতের ব্যবস্থা সহজ করা হয়েছে। সরু মাটির গলি পার হয়ে দরজার ভেতরে এসে বিবি দেখল—ইন্দ্রদা, নিরঞ্জন, পৃথ্বীশ, জিতু। ওদের মুখে চাপা উত্তেজনা।

বিবি বলল—‘ইন্দ্রদা তুমি?’

—‘কুইক ভেতরে যাও।’ ইন্দ্রদা বলল, তারপর নিচুগলায় যোগ করল—‘বন্ধু-বান্ধবদের ফেলে কোথায় যাবো বিবি? আমাদের মুক্তি নেই। যাও শীগগিরই।’

ইদানীং ইন্দ্রদা একটু একটু করে সরিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। খবরাখবর দেওয়া-নেওয়া আগের মতোই করে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এই এলাকায় ইন্দ্রদাকে দেখে বিবি অবাক হয়েছিল খুব।

টিফিন-ক্যারিয়ারটা ঝোলার মধ্যে, ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে ও সরু প্যাসেজ দিয়ে ডানদিকের ঘরে ঢুকল। জানলাগুলো বন্ধ। আলো জ্বালবার উপায় নেই। মেঝেতে একটা মোমবাতি বসানো। ধুলো ভর্তি মেঝেতে একটা মাদুর, তার ওপর শুয়ে আছে বাচ্চু। পেছন ফিরে। খুব রোগা হয়ে গেছে। মাথা ভর্তি বড় বড় চুল, বাতির আলোয় আর বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। বিবি ঝোলাটা আস্তে মেঝেতে রাখল। নিচু গলায় ডাকল—‘বাচ্চু!’

শব্দে ও মুখ ফেরাল। বাচ্চু নয়। অন্তুদা।

বিবি এতো চমকে গিয়েছিল যে ওর হাতে-ধরা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। বলল—‘তুমি! তুমি কোথা থেকে এলে?’

গত ন মাস ধরে অন্তুদা একেবারে বেপাত্তা। বাচ্চুও প্রায় তাই। কেমন একটা ধারণা ছিল যেখানে আছে দুজনে একসঙ্গে আছে! অন্তুদাকে চেনা যায় না। মুখময় জঙ্গল। চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে, ঘাড়ের কাছে কুঁকড়ে পাকিয়ে আছে চুলগুলো। ফর্সা রঙ কালি-ঢালা। পরিষ্কার প্যান্ট-শার্ট পরণে, কিন্তু সেগুলো নিশ্চয়ই নিজের নয়। জামাটা অতিরিক্ত ঢলঢল করছে, প্যান্টটা খাটো। টিফিনবাটির ঢাকনা খুলে বিবি এগিয়ে ধরল, ফিসফিস করে বলল—‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও অন্তুদা। আমাকে অনেকটা পথ ফিরতে হবে। বাচ্চুর খবর কিছু জানো?’

—‘বাচ্চু ঠিক আছে।’

—‘অন্তুদা ইদানীংকার খুনগুলো কি তোমরা করেছ?’

অন্তুদা চমকে উঠল।

—‘কেন জিজ্ঞেস করছ, বিবি?’

—‘শ্রেণিশত্রু বলতে যে ছবি চোখের সামনে ভাসে—যে হাসি, চালচলন, কাজকর্ম, চরিত্র—তা এদের কারো নেই। আমার হিসেব কিছুতেই মিলছে না অন্তুদা। প্রশ্ন করার স্বাধীনতা আমি বরাবর ব্যবহার করে এসেছি, করে যাবো। উত্তর দাও আর নাই দাও।’

অন্তুদা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল—‘কোনটা আমাদের তালিকার, আর কোনটা তার বাইরের এখন আমিও বলতে পারব না বিবি। অবস্থা এমনি দাঁড়িয়েছে।’

বিবি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল—‘এবার আমায় মাপ করতে হবে অন্তুদা। আমি আর তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারব না। সংশয়ী বলে যদি হত্যা করো, তাতেও রাজি আছি। পেছন থেকে ছুরি বসিয়ে দিও। তারপর ছিন্নভিন্ন করে ফেলো····’

অন্তুদার মুখে খাবার আটকে গেছে। মুখটা ব্যথায় নীল। বলল— ‘আমাকে ফেলে চলে যাবে বিবি? সত্যি? এই তুমিই না আমার নিয়তি ভাগ করে নিতে চেয়েছিলে একদিন?’

—‘চেয়েছিলুম। সেই তুমি আর এই তুমি এক নয় অন্তুদা। আমিও পাল্টে গেছি। অভিজ্ঞতার হাতে সিদ্ধান্তের এই বিবর্তনকে আমি মনে প্রাণে শ্রদ্ধা করি অন্তুদা। আই উড নো লংগার অ্যাক্ট এগেনস্ট মাই কনভিকশন্‌স্‌। কারো জন্যেই না।’

—‘বিশ্বাস করো বিবি, সৌরর হত্যা একটা রাজনৈতিক চাল। আন্দোলনকে হেয় প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা সবচেয়ে মূল্যবান সদস্যদের চোখে। শহুরে লুম্পেনকে ঢুকতে দিয়ে সমস্ত বিপ্লবের চেহারা এরা পাল্টে দিয়েছে। আদর্শের সঙ্গে বাস্তবকে প্রাণপণ চেষ্টা করেও মেলাতে পারছি না আর আমিও।’

—‘তাহলে বেরিয়ে এসো! বাচ্চুকেও বার করে আনো।’

নীল শিরা ওঠা তামাটে হাতটা অন্তুদা বিবির হাতে রাখল। হাতটা গরম, ভারি, ঈষৎ কাঁপছে। বলল—‘অনেকগুলো ওয়ারেন্ট ঝুলছে আমার মাথার ওপর। কিছুদিন অপেক্ষা করো। ওরা আমাকে ধরবেই। তারপরে যেও।’

বিবির কোলের ওপর টপ্‌টপ্‌ করে জল পড়ছে। বলল—‘তোমার কি ফেরার কোনও পথ নেই!’

—‘না। বাচ্চুর কথা ভেবো না। আমার প্রাণের চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান ওর প্রাণ। গচ্ছিত রেখে এসেছি এমন জায়গায় যেখানে ওকে কেউ খুঁজে পাবে না। একদিন এই ঝড় থেমে যাবে। বর্ষণ শেষ হবে। তখন, সেই শান্তির দিনে পুলিস ওর কথা ভুলে যাবে। ও আস্তে আস্তে তোমাদের বৃত্তে ফিরে আসবে। আবার তোমাদের পৃথিবী আহ্নিকগতিতে ঘুরবে, বিবি। ভেবো না। আমি ছাড়া ওর ঠিকানা কেউ জানে না। কেউ না। সে ঠিকানা আমার প্রাণভোমরার কৌটোয় বন্ধ।’

বিবি বলল—‘অন্তুদা, আমি এবার যাই।’

—‘একটু দাঁড়াও বিবি, একটু। কতদিন পরে দেখা। আবার কখনও দেখা হবে কিনা তাও জানি না। খুব সম্ভব হবে না। খাবারগুলো বাচ্চুর কথা মনে করে এনেছিলে, না?

বিবি মুখ নিচু করে বলল—‘যদি তাই-ই হয়। তুমি যোদ্ধা, তোমার হাতে শ্রেণিশত্রুর রক্ত। ভাবালুতা, অভিমান এসব কি তোমাকে মানায়?’

—‘নাথিং ইজ ইমপসিব্‌ল্‌ ইন লাভ, বিবি।’

মহাবরষার রাঙা জল ভেতরে, বাইরে। দু কূল ছাপিয়ে ঢেউ। ঢেউয়ে ঢেউয়ে কত কাছাকাছি। আগুনের হলকার বদলে জল। চোখে জল। ব্যথায় নীল, আড়ষ্ট মুখ, দু চোখে অপার মমতা—বিবির কপালে, গালে নিঃশব্দ চুম্বন ঝরে পড়তে লাগল। শীতের শুরুতে পাতাঝরা গাছের বনে পাতারা যেমন ঝরে।

দরজায় মৃদু টোকা। ইন্দ্র মুখ বাড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বলল—‘পুলিসে সমস্ত এলাকা ঘিরে ফেলেছে। অন্তুদা, বিবি—যে যার মতো পালাও! আমাদের হাতে অ্যামিউনিশন বেশি নেই’, ইন্দ্রর মুখ সরে গেল।

খিড়কির দরজা দিয়ে অন্ধকার গলি। পাশের পাঁচিলের ভাঙা ইঁটের ওপর পা রেখে রেখে অন্তু উঠে গেল। পেছন পেছন টেনে তুলল বিবিকে। ঝুপ করে পড়ল ও পাশের উঠোনে। অনেকগুলো দরজা যেন শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। উঠোন পার হয়ে গৃহস্থ বাড়িতে ওঠবার রোয়াক। রোয়াকে মাজা বাসন উপুড় করা। অন্তু ছুটে গেল। বন্ধ দরজাগুলো ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সদরের উল্টোদিকের দরজাটার দিকে দৌড়লো অন্তু। বিবির হাত ছাড়ছে না একবারও। খুব সরু গলি, একজনের বেশি পাশাপাশি যাওয়া যায় না। মেথরের গলি-টলি হবে। দেয়াল ধরে ধরে পায়ে কাদা মেখে পাশের বিল্ডিংটাতে পৌঁছে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হল চোখ অন্ধ-করা তুমুল বৃষ্টি।

চারদিকে চারটে পিলার। কিন্তু মাথায় চাল নেই। জায়গাটা খোলা একটা ইয়ার্ডের মতো। চতুর্দিকে ভাঙা লোহা-লক্কড় ছড়িয়ে আছে। খুব কাছ থেকে বন্দুকের গুলির আওয়াজ শোনা গেল একটানা। বন্দুক নয়, বোধহয় স্টেনগান। রাস্তার আলোয় কেউ টিপ করে কিছু ছুঁড়লো। অমানিশির অন্ধকারে ডুবে গেল সব। উপর্যুপরি বোম পড়ার শব্দ।

অন্তু বলল—‘আমাদের অনেকই তো এখানে আজকাল বসবাস করছে। আজ সব শেষ হয়ে যাবে।’

ইয়ার্ডের এখানে ওখানে টর্চের আলো পড়ছে। যন্ত্রের মতো দুজনে গুঁড়ি মেরে আস্তে আস্তে উঠে এলো রাস্তায়। চারদিকে ছুটন্ত পায়ের শব্দ। অন্ধকারে ঝমাঝম বৃষ্টি বাজছে মাদলের মতো। দেয়াল ঘেঁসে এগোতে এগোতে একটা গলি মুখ। নিস্তব্ধ। এদিকটায় এখনও কেউ আসেনি। একটা দোকানের শাটার অনেকটা ফেলা। তলা দিয়ে আলো আসছে। খোলা জায়গাটা দিয়ে শরীর গলিয়ে দিয়েছে দুজনে। ঝুপ ঝুপ করে শব্দ হল। নিচু গ্যারাজ-ট্যারাজের মধ্যে দোকানটা। স্টেশনারি দোকান। অন্তুর হাতে রিভলভার। মাঝবয়সী ভদ্রলোক যেন একটা লিস্ট মেলাচ্ছিলেন। আওয়াজে পেছন ফিরেই স্থানু হয়ে গেলেন। রিভলভারটা আড়াল করে বিবি সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল—‘পেছনে পুলিস তাড়া করে আসছে, কিভাবে মারবে আমাদের বুঝতে পারছেন?’

ভদ্রলোকের মুখ থেকে ভয়ের ভাবটা আস্তে আস্তে চলে গেল। বললেন—‘আমি শাটার ফেলে দিয়ে যাচ্ছি মা, শেষরাতে সব চলে গেলে একবার এসে তুলে দেবো, নির্বিঘ্নে চলে যাবেন।’

অন্তু চাপা গলায় বলল—‘এখনই আলো নিভিয়ে শাটার ফেলে দিন। আপনাকেও থাকতে হবে আমাদের সঙ্গে।’

ভদ্রলোক বললেন—‘আমাকে আপনাদের বিশ্বাস করতেই হবে। আমি না ফিরলে বাড়ি থেকে তো আমার খোঁজ করতে দোকানে লোক আসবেই। তখন?’

বিবি বলল—‘আপনার সঙ্গে তাহলে আমিও বেরিয়ে যাই।’

অন্তু ওর হাত ধরে বলল—‘না বিবি, তা হয় না। তোমাকে ওরা আর কিছু না হোক, বাচ্চুর বোন বলে চেনে, দেখামাত্র গুলি করবে।’

বিবি আকুল হয়ে বলল—‘বাড়ি না ফিরলে আমার মা ভয়ে হার্টফেল করবে। আমাকে যেতেই হবে অন্তুদা। যেমন করে হোক, যত রিস্‌ক্‌ নিয়েই হোক।’

কানফাটা শব্দ করে বাজ পড়ল। তারপর বোম ফাটার বিকট আওয়াজ। ভদ্রলোক বললেন—‘দুর্গা শ্রীহরি, মা, আপনাকে আমার সঙ্গে দেখলে আমাকেও ছেড়ে কথা বলবে না পুলিস। দয়া করে আমাকে এবার ছেড়ে দিন। আর কথা বাড়ালে আপনারা ধরা পড়ে যাবেন। এসব পথে পা বাড়াবার আগেই বাপ-মায়ের কথা চিন্তা করে নিতে হয় মা।’

গড়গড় করে সামনের শাটার পড়ে গেল। কুপকুপে অন্ধকার। উঁচুতে দেয়ালে দু চারটে ঘুলঘুলি থেকে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনটুকু শুধু আসছে। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে বাইরে। ভারি বুটের শব্দ দৌড়তে দৌড়তে যাতায়াত করছে। বুকফাটা চিৎকার কার—‘মা-মা-বাঁচাও।’ গোঙানি। নিষ্ঠুর আঘাতের প্রতিক্রিয়ার গোঙানি। একবার থামে, একবার উচ্চকিত হয়। মাথার ওপরকার ঘরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তোলপাড় চলল। চেয়ার টেবিল সব দুমদাম করে উল্টে ফেলা হচ্ছে, মনে হল। অন্ধকারে হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ। দুটো হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ।

বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে থেমে গেল গোলমালের আওয়াজ। গুলির শব্দ দূর থেকে বেশ কিছুক্ষণ বিরতির পর পর ভেসে আসছে। বোমার শব্দ আর নেই। ওদের যা কিছু ছিল ফুরিয়ে গেছে। শেষ শক্তিবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করছে। অসম লড়াই। শেষ পর্যন্ত সেই প্রথম চিৎকার ‘মা, মা, মা।’

বৃষ্টি চলেছে একটানা। দোকানঘরের মধ্যে অন্ধকার। মাতৃগর্ভের মতো তরল, আঠাল অন্ধকার। বহমান সমুদ্রস্রোতের মতো। ভারি, দম-বন্ধ করা। না অন্তুদা না···বিবি তোমার কাছে জীবনের কাছে এই আমার শেষ ভিক্ষা। এ হয় না, এ হতে নেই····আমি আর পারছি না···। এ জীবনে আর ভালোবাসার সুযোগ পাবো না কোনদিন না, একবার ভেবে দ্যাখো কী ভীষণ শূন্যতা চারদিকে। বিবি এই শূন্যতা আমায় গ্রাস করে নেবার আগে আমাকে বাঁচতে দাও, একবার, জন্মের শোধ একবার। সারারাত ধরে চলে দামাল বৃষ্টির হুঙ্কার। ঝাঁপিয়ে পড়ে কঠিন ধাতুর গায়ে। প্রচণ্ড শব্দে। তারপর আবার ফিরে যায়। কখনও মৃদু কান্নায়। কখনও চাপা গোঙানিতে, কখনও আবার তীব্র, অনিচ্ছুক শীৎকারে বৃষ্টির আর ঝড়ের মাতন চলতে থাকে। সারা রাত। সারাটা রাত।

দুশ আড়াইশ সশস্ত্র পুলিস সেদিন চিরুনি আঁচড়ানোর মতো করে আঁচড়ে ফেলল বরানগর। কে উগ্রপন্থী কে নয়, বিচার করল না। মা বাবার চোখের সামনে গুলি করল ছেলেকে। গঙ্গায় ছুঁড়ে-ফেলা মৃত গলিত শবদেহ দু তিন দিন পর ভেসে ওঠে।

ঠিক তিন মাসের মাথায় অন্তুদার গ্রেপ্তারের খবর কাগজে পড়ল বিবি। আর তার ঠিক চতুর্থ দিনে পুলিস হানা দিল ওদের পাঁচ নম্বর বাড়িতে।

পুলিস ভ্যানে অচৈতন্য কয়েকটি তরুণীর শরীর। জীবিত না মৃত? রক্তমাখা ছেঁড়া কাপড় জড়ানো। তলায় নগ্ন। ঘাড়ে, বুকের ওপর, পেটে, গোপন অঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেটের, চুরুটের ছ্যাঁকার দগদগে ঘা। কয়েকদিন হাসপাতাল। চেতনা ফিরলেই আবার লালবাজার।

দু হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। টান মেরে শাড়ি খুলে ফেলে দিল। চারদিকে এত পুরুষ, এত পুরুষ কেন? লুঠেরার মতো খলখল করে হাসছে। চোখের মণির ওপর তীব্র আলোর ঝলক। দৃষ্টি অন্ধ। তর্জনীর নখের মধ্যে ছুঁচ ঢুকে যাচ্ছে। হা-হা-হা-হা করে উন্মাদের মতো হাসছে কে? তীব্র গর্জন পরক্ষণেই—

—‘কি হল? অগ্নিকন্যা? জবাব নেই কেন? হাসিটা কার চিনতে পারলে? পারলে না? নিজের ভাইয়ের গলা নিজেই চিনতে পারছো না? তোমার ফায়ার ব্র্যান্ড ছোট ভাই? কি করে পারবে? হাসিটা যে আমাদের কানেই স্বাভাবিক লাগছে না···ধরা পড়ে থেকে এমনি করে হেসে যাচ্ছে।’

—‘যে লিস্টগুলো দিয়েছি ঠিকানা মনে পড়ল? নাম বল্‌। ঠিকানা বল্। বলবি না? জানিস না? ফের মিথ্যে কথা?’

—‘কি রে নকশালী? ডাক্তার যে বলছে গাভীন! পেটে পেটে এতো? কলির কেষ্ট রাধা সব? আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলন! বিপ্লব পয়দা করবি না কি?

পেটের ওপর বুটের লাথি সশব্দে ফেটে পড়ল।

রক্ত! রক্ত! রক্ত! লাল অন্ধকার। লাল আতঙ্ক। সাদা আতঙ্ক। অসংখ্য নরবলি। ছিন্নমস্তার পুজো। অসংখ্য শিশু বলিপ্রদত্ত হচ্ছে। রক্তমাখা খাঁড়া ঊর্দ্ধে তুলে নাচছে কাপালিক। ডাকাতে কালীর পুরোহিত।—আর রক্ত নিবি মা? রক্ত চাই? আর রক্ত চাই? অন্ধকার। অন্ধকার। অন্ধকার থেকে অন্ধকারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *