মৃত্যুর সওদাগর

মৃত্যুর সওদাগর

পাড়ার এই বাড়িটাই সবচেয়ে ভব্যিযুক্ত। কোণের বাড়ি। তিন দিকেই খোলা রাস্তা। বাইরের চেয়েও ভেতরটা বেশি ফিটফাট। ফোন-টোন করতে হলে এ বাড়িতেই আসতে হয় পাড়ার বেশির ভাগ লোককে। বাড়িটা অপূর্ব মিত্তিরের। ভদ্রলোকের কেরিয়ার অদ্ভুত। পঁয়তাল্লিশ সালে যুদ্ধবন্দীদের বিচার হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে উনি স্টেনো হিসেবে গিয়েছিলেন। এক শিল্পপতির চোখে পড়ে যান সেখানেই। তখন উনি নেহাতই বাচ্চা ছেলে। সিঙ্গাপুরে কিছুদিন চাকরি করার পর ধাপে ধাপে ম্যানেজমেন্টের নানারকম পরীক্ষা দিতে দিতে কলকাতার কাছাকাছি এক নামকরা বিদেশি কম্প্যানিতে ছিলেন। রীতিমত উঁচু পদে। তারপর হঠাৎ ছেড়ে দেন। অপূর্বদার সঙ্গে বাপ্পাদের সম্পর্ক খুব ভালো। ওরা ভাইবোনেরা লেখা পড়ায় ভালো বলে অপূর্বদার কাছে ওদের খুব খাতির। বাবা মারা যাবার পরও নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন উনি। বাপ্পার দাদার এখনকার চাকরিটাও বলতে গেলে ওঁর প্রভাবেই হয়েছে।

আজ অপূর্বদা সাত সকালে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন বাপ্পা বুঝতে পারল না। বাড়ির দরজা খুলে দিল খুদে চাকর ভজু। বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসাল। ভজুকে দিয়েই ডেকে পাঠিয়েছিলেন অপূর্বদা। দিনটা রবিবার। রবিবার বলেই অনেক অতিরিক্ত কাজ থাকে। সারা সপ্তাহের পড়াশোনার গাফিলতি পুসিয়ে নিতে হয় একদিনে। পরীক্ষার সিসটেমের ওপর সেই পুরনো রাগটা থেকে গেলেও, সিলেবাসের সম্পর্কে ঝালটা মরে এসেছে বাপ্পার। ওদের কলেজের ল্যাবরেটরি খুব ভালো। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সময়ে আহার-নিদ্রা ভুলে যাবার অবস্থা হয় তার। কিন্তু পড়তেও হয় পর্বত প্রমাণ। সেগুলো রবিবার অনেক রাত পর্যন্ত করে। তাছাড়াও সংসারের কিছু কাজ থাকে। দাদা বেচারা সকাল দুপুর চাকরি, সন্ধেয় টুইশনি—আর কত করবে? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অন্দরমহলের দরজার কাছে গিয়ে বাপ্পা হাঁক দিল একটা, ‘অপূর্বদা!’ কেমন মনে হল অনেকেই আশপাশ থেকে, পর্দা-টর্দার পেছন থেকে, বন্ধ দরজার ফাঁক-টাঁক দিয়ে তাকে লক্ষ করছে। ভেতরের কোথাও থেকে চেঁচিয়ে সাড়া দিলেন অপূর্বর্দা—‘তাড়া আছে? তো ওপরে উঠে এসো।’ সিঁড়ির বাঁ দিকে অপূর্বদার মায়ের ঘর, ঘরের পর্দাটা সরিয়ে উনি কিরকম করে যেন তাকালেন বাপ্পার দিকে, ভজু সঙ্গে সঙ্গে ওপরে গেল।

অপূর্বদার ঘরে পা দিয়ে একটু অবাক হয়ে গেল বাপ্পা। ঘরটা অপূর্বদার একার। প্রায় অফিসঘরের মতো সাজানো। ঘরে যেন একটা পারিবারিক কনফারেন্স বসেছে। বউদি বসে আছেন একটা চেয়ারে, ছোট ছেলে বউদির হাঁটু জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড়টি আর একটা চেয়ারে বসে। মনে হল, বউদি কোন কারণে ওদের বসিয়ে রেখেছেন। অপূর্বদা দাড়ি কামাচ্ছেন। দেয়ালের ব্র্যাকেটের আয়নায় তাঁর আধকামানো মুখের ছায়া পড়েছে। অপূর্বদার মা এসে ঢুকলেন। বাপ্পাকে দেখে বউদির মুখ শক্ত হয়ে গেল। জোর করে একটু সহজভাব আনবার চেষ্টা করে অপূর্বদা বললেন—‘বাপ্পাকে একটু চা-টা খাওয়াও!’

বাপ্পা বলল—‘না, না। চা খাবো না। খেয়ে এসেছি। ব্যাপার কি বলুন তো?’

অপূর্বদা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন—‘তোমরা খেলাধুলো করোগে যাও। তুমিও যাও আলো। বাপ্পা না খায়, আমিই একটু চা খাবো।’ মা, তুমি কি বসেই থাকবে!’

—‘হ্যাঁ’—জ্যাঠাইমা কেমন শুকনো গলায় বললেন। বউদি ছেলেদের নিয়ে বাইরে যেতে অপূর্বদা চেঁচিয়ে বললেন,—‘ওরা যেন কোনমতেই বাড়ির বাইরে না যায়, ভজুকে দেখতে বলো!’

গালের শেভিং ক্রিম-টিম মুছে, রেজরটা ধুতে ধুতে অপূর্বদা বললেন—‘দাঁড়িয়ে কেন? বসো বাপ্পা, কথা আছে।’

—‘বলুন’—বাপ্পা অনুভব করছিল কোথাও কিছু একটা বিশ্রী রকমের গণ্ডগোল হয়েছে।

—‘তোমার মনে আছে বাপ্পা, গণেশ বলে আমাদের যে কাজকর্মের লোকটি ছিল, তাকে আমার ফ্যাক্‌টরিতে ঢুকিয়েছিলুম?’

—‘মনে আছে বইকি! নদীয়া জেলার লোক ছিল। খুব পরিষ্কার, মার্জিত কথাবার্তা, গণেশ তো এখন এক্সপার্ট হয়ে গেছে শুনতে পাই।’

—‘এক্সপার্ট অনেক রকমে হয়েছে ভাই। আমার বিরুদ্ধে আমার ওয়ার্কারদেরই খেপাচ্ছে। আমি নাকি শোষক। ওদের মজুরি কম দিই। রক্তচোষা বাদুড়। এখন গো-স্লো যাচ্ছে, এরপর একেবারে স্ট্রাইক। প্রোডাকশন নেই। নতুন অর্ডার তো নিতে পারছিই না, পুরনো যেগুলো পড়ে আছে শ্রীলঙ্কার, হংকং-এর সেগুলোও সাপ্লাই দিয়ে উঠতে পারবো কিনা সন্দেহ। অথচ আমার কাঁচামাল সব স্টক করা রয়েছে, বসিয়ে বসিয়ে মাইনেও দিতে হচ্ছে সবাইকে।’

—‘তাই নাকি?”

—‘হ্যাঁ ঠিক তাই। এই তো অবস্থা। তা তুমিও কি আমাকে শোষক, ভ্যাম্পায়ার, শ্রেণীশত্রু ইত্যাদি মনে করো?’

ছোটখাটো উজ্জ্বল চেহারার মানুষটি। মাথায় ঘন কালো চুল ব্যাক ব্রাশ করা। ধীর স্থির। চলনে বলনে একটু সাহেবি ধরন। অপূর্বদার বাদামি চোখের মণি বাপ্পার মুখের ওপর একেবারে অনড় অচল। চোখের পাতা পড়ছে না।

বাপ্পা আশ্চর্য হয়ে বলল—‘আমাকে একথা জিজ্ঞেস করছেন অপূর্বদা?’

বাপ্পার কথা যেন শুনতে পাননি এমন ভাবে অপূর্ব মিত্র বলতে লাগলেন —‘তোমরা খানিকটা দেখতে পাও, যেমন দেখো আমার একটা নতুন অ্যামবাসাডর গাড়ি আছে। ফ্যাক্টরির ম্যাটাডর-ভ্যানটাও মাঝে-মধ্যে ব্যবহার করি। একজন ড্রাইভারও রেখেছি সর্বক্ষণের। দেখো বোধহয় আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে দোকান থেকে চুল-টুল বেঁধে আসেন, আমার সঙ্গে পার্টিতে-টার্টিতে যান। ছেলে দুটিকে মিশনারি স্কুলে দিয়েছি, এদিকের স্কুলগুলোর থেকে এক্সপেনসিভ। আর কতটা দেখতে পাও, জানি না। কিন্তু কতকগুলো ব্যাপার আছে, যেগুলো একেবারেই দেখতে পাবার কথা নয়, কাজেই জানোও না। সেগুলো তোমাকে জানিয়ে রাখি। আমি ছিলুম একটা বিদেশি কম্প্যানিতে। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঠিক পরেই আমার স্থান প্রশাসনের ব্যাপারে। যে কারণেই হোক, নরওয়েজিয়ান কোল্যাবোরেটর ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেল, যাবার সময়ে শেয়ার ট্রান্সফার হল সব মারোয়াড়িদের হাতে। মারোয়াড়ি মালিকরা অমন চালু কম্প্যানিটাকে নিয়ে কি করবে তক্ষুনি বুঝতে পারি। ছিব্‌ড়ে করে দিয়ে চলে যাবে। সিক-ইনডাস্ট্রির দলে নাম লেখাবে কম্প্যানি। আমি চাকরি ছেড়ে শুধুমাত্র আমার পি এফ এবং তোমার বউদির সোনার গয়না বেচে নিজের ব্যবসা আরম্ভ করি। প্রিন্টিং ইঙ্কের নো-হাউ আমার ছিল। মার্কেটে গুড উইল ছিল, চলছিল খুব ভালোই। মোট সত্তরজন কর্মী আমার কম্প্যানিতে। কেমিস্ট, সুপারভাইজার, ম্যানেজার সব নিয়ে। ওয়ার্কারদের জন্য আমি চীপ ক্যানটিনের ব্যবস্থা করেছি, মেডিক্যাল ফ্রি, নিজের এবং পরিবারের। তাছাড়াও প্রতিমাসে ওয়ার্কারদের মেডিক্যাল চেক-আপ হয়। অসন্তোষের কোনও কারণই ছিল না। তারপর কিভাবে জানি না এক শ্রেণীর বিপ্লবীর ধারণা হল, আমি শোষক। গণেশকে তারা এই ধারণার প্রচারক হওয়ার উপযুক্ত পাত্র ঠাওরালো। কারণটা কি বলো তো? গণেশ আমার কাছে সবচেয়ে উপকৃত ব্যক্তি। নদীয়াতে এরই মধ্যে ওর জমিজমা হয়েছে বেশ। সম্পন্ন গৃহস্থ ঘরের মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়েটা পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছি।’

বাপ্পা কথা বলবার সুযোগ পাচ্ছিল না। এইবার বলল—‘অপূর্বদা, আপনি এতো কথা কেন বলছেন? এসব প্রশ্ন উঠছে কেন?’

অপূর্বদা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলেন, বললেন—‘রোববার সকালে অযথা নিজের গুণগান করবার জন্য আমি তোমায় ডাকিনি বাপ্পা। কারণটা কি তুমি সত্যিই বুঝতে পারছো না?’

বাপ্পা আশ্চর্য হয়ে বলল—‘আমার কি বুঝতে পারবার কথা? না কি বলুন তো!’

অপূর্বদা ডাকলেন—‘আলো!’ বউদি বোধহয় কাছাকাছি কোথাও ছিলেন এসে দাঁড়ালেন। মুখটা থমথম করছে। বাপ্পার দিকে একবারও তাকালেন না। অপূর্বদা বললেন—‘কাগজটা দাও।’ বউদি ভেতরে চলে গেলেন, এক মিনিট পরেই একটা খাম নিয়ে ফিরে এলেন। খামের মধ্যে থেকে একটা কাগজ বার করে অপূর্বদা বাপ্পার দিকে এগিয়ে দিলেন। বাপ্পা অবাক হয়ে দেখল—অবিকল ওরই হাতের লেখা একটা হুমকি চিঠি। পাঁচদিনের মধ্যে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা চাই। অন্যথায় অপূর্ব মিত্তিরের মাথা তাঁর স্ত্রী ও মার কাছে পৌঁছে যাবে ষষ্ঠ দিন। নিচে লেখা—‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম।’

বাপ্পা স্তম্ভিত হয়ে বলল—‘বিশ্বাস করুন অপূর্বদা এ আমার লেখা নয়।’

—‘হাতের লেখাটা তোমার। তুমি একসময় নন্দিতাকে পড়াতে, আমি ওর পড়াশোনায় ইনটারেস্ট নিতাম। লেখাটা আমার চেনা।’

—‘তা হোক। এটা জাল।’

—‘তলায় যে রাজনৈতিক দলের স্লোগান রয়েছে তুমি তার অ্যাকটিভ মেম্বার বাপ্পা।’

—‘আপনি কি করে জানলেন?’

—‘এসব কথা কি চাপা থাকে বাপ্পামাস্টার? তোমরা সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য এইভাবে টাকা যোগাড় করছো। তোমাদের সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। সবই বুঝলাম। মিথ্যা হুমকি, চুরি, জালিয়াতি, খুনোখুনির মধ্যে দিয়ে তোমরা কি অ্যাচীভ করতে চাইছো আমার জানা নেই বাপ্পা। আমার খুব সন্দেহ তোমাদেরও জানা নেই। বিপ্লব কি রকম জানো? কোটি-কোটি লোক দিনের পর দিন একদম না খেতে পেয়ে, মর্মান্তিক দুর্দশায় যখন সহ্যশক্তির শেষ প্রান্তে চলে আসে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধনীর গোলার ওপর। পার্ল বাকের ‘গুড আর্থ’-এ এইরকম একটা বিপ্লবের কথা পড়েছিলাম। ফ্রেঞ্চ রেভলিউশনও এমনি এমনি হয়নি।’

জ্যাঠাইমা এইসময়ে বলে উঠলেন—‘তুই অত কথা ওকে বলছিস কেন খোকা ও ওসব তোর চেয়ে অনেক ভালো জানে।’

অপূর্বদা বললেন—‘হ্যাঁ আমার বোধহয় এসব বলা ঠিক হচ্ছে না। মার্কসিজমের আমি কিই বা জানি। কমনসেন্স থেকে বলছি। এদেশে ইনডাস্ট্রির বয়স কত বাপ্পা? আর এই স্প্যোরাডিক বিপ্লবে কতকগুলো নির্দোষ লোকের প্রাণ যাওয়া ছাড়া আর কি হচ্ছে? শ্রেণিশত্রু বলে যাদের মারছো তারা তো স্মল-টাইমার, একটা গদীতেও হাত দিতে পেরেছো কি? ভেজাল আর কালো টাকাই যাদের ব্যবসার মূলধন, তাদের টাচ করবার সাহস কই তোমার কমরেডদের?’

বউদি এই সময়ে ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি বললেন—‘থামবে তুমি? থামবে? মা-ওকে থামতে বলুন না।’

অপূর্বদা বললেন—‘যাই হোক। অনেস্টলি বাপ্পা আই ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট কাইন্ড অফ মানি। সাঁইত্রিশ হাজার টাকা? ব্যবসায় টাকা সব সময়ে রোল করে জানবে। আই অ্যাম এ সেল্‌ফ্‌-মেড ম্যান। এরকম অনেক সময়ে হয় যে ঠিকমতো পেমেন্ট আসেনি বলে আমাকে সংসারের খরচা কার্টেল করতে হয়েছে। যা ইনকাম-ট্যাক্স হয়, পাই পয়সা মিটিয়ে দিই। আমার পক্ষে এই ডিমান্ড মীট করা আদৌ সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও আমি দিতাম না। যার পেছনে কোনও যুক্তি, কোনও হৃদয় নেই, আমি তাতে নেই।’

বউদি কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন—‘বাপ্পা, দাদার কথা শুনলে তো! আমার সোনার গয়নাগুলো পর্যন্ত ফ্যাক্টরির জন্য বিক্রি হয়ে গেছে। নইলে আমি টাকাটা দেবার চেষ্টা করতাম। তুমি একটু বোঝো, ওদের বোঝাও।’

বাপ্পা তখন অপূর্বদার কথা শুনছিল না। বউদির কথাও না। খালি ভাবছিল কিভাবে ব্যাপারটা ঘটল। বলল—‘কিভাবে টাকাটা ওদের দিতে হবে। স্পষ্ট করে বলছে না তো!’

—‘পাঁচদিন সময় দিয়েছে। তারপর কিভাবে নেবে ওরাই জানে। আমাকে টাকাটা রেডি রাখতে হবে এই আর কি! এখন প্রাণে বাঁচবার জন্য আমি একটিমাত্র কাজই করতে পারি, সেটা এই বসত বাড়িটা বিক্রি করা। কিন্তু তা আমি করব কেন? আর পাঁচদিনের মধ্যে পারবই বা কেন? বাপ্পা সী রীজন!’

বাপ্পা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল—‘অপূর্বদা, এ লেখা আমার না। আবারও বলছি। আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন। বউদি নার্ভাস হবেন না। একটা না একটা উপায় আমি বাব করবই।’

পেছন দিকে একবারও না তাকিয়ে দ্রুত সিঁড়ি নেমে এলো বাপ্পা। চট করে একবার চার দিকে দেখে নিল ধারে কাছে কে আছে। কেউ না। কোন দিকে চলেছে সশস্ত্র আন্দোলন! বড় বড় ব্যবসাদার যারা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে, জাল-জুয়াচুরি যাদের হাতের পাঁচ, ওয়ার্কারদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, পার্মানেন্ট কাজ পর্যন্ত দেয় না, তাদের কারও কাছে এই জাতীয় হুমকি গেছে বলে তো জানা নেই? এ জাতীয় হুমকি চিঠি আজ পর্যন্ত বাপ্পা নিজে কখনও লেখেনি। অথচ হাতের লেখা অবিকল তার। কাজটা কে করল? খুব কাছের মানুষদেরই সন্দেহ হয়। দিদি? না কি বাচ্চু? বাচ্চুটা নকল করতে ওস্তাদ। বেশ কিছুদিন হল অজ্ঞাতবাস করছে। মাকে বলে গেছে বিষ্ণুপুরে গিয়ে কিছুদিন থাকবে পড়াশোনার জন্য। কলেজে ক্লাস হয় না। অন্য সবাই তাই জানে। বাচ্চুই কি? কিছুক্ষণ এইভাবে চিন্তা করবার পর হঠাৎ শিউরে উঠল বাপ্পা। কি ভয়ানক! এইভাবে চললে তো শেষ পর্যন্ত কেউই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না! সত্যি কথাও কেউ কাউকে বলবে না।

অন্তুদাও আন্ডারগ্রাউন্ডে। ওর নামে ওয়ারেন্ট ঝুলছে। কারো সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। পাইকপাড়ায় ইন্দ্রদার বাড়ি চলে গেল বাপ্পা। দরজা খুলে দিয়ে ইন্দ্রদার মা ওর আপাদমস্তক তীব্র দৃষ্টিতে জরিপ করলেন। তারপর ঈষৎ কর্কশ গলায় বললেন—‘আর কেউ নেই তো?’

বাপ্পা বলল—‘না! ইন্দ্রদা আছে তো? আমি তাহলে ওপরে যাই? আপনি দরজাটা বন্ধ করে দিন।’

ইন্দ্রদার ঘরটা ছাদের ওপর। ঘরে ঢুকে বাপ্পা দেখল ইন্দ্রদা মাথা সুদ্ধু চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে। বাপ্পা গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠে বসল। একমুখ দাড়ি। চোখ কোটরে বসে গেছে। কিরকম অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রদা। ওর দৃষ্টি দেখে মাসিমার তীব্র চাহনিটার কথা মনে পড়ে গেল বাপ্পার। এইসব মায়েরা গোড়ায় গোড়ায় ওদের ওপর খুব খুশি ছিলেন। খবরের কাগজে ওদের সম্পর্কে বেরোত—‘দা ফ্লাওয়ার্স অফ বেঙ্গল’, ‘ক্রিম অফ দা বেঙ্গলি সোসাইটি,’ মায়েদের বুক গর্বে ভরে উঠত। ছেলেরা জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে দেশে নতুন সমাজ-ব্যবস্থা, শাসন-ব্যবস্থা আনবার জন্য ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে লাল-আতঙ্ক মাসিমাদের মুখের চেহারা পাল্টে দিয়েছে।

—‘কি হয়েছে তোমার?’ বাপ্পা জিজ্ঞেস করল।

—‘তুই কোত্থেকে আসছিস?’ জবাবে ইন্দ্রদা বলল।

—‘বাড়ি থেকে আসছি। আবার কোথা থেকে?’

—‘আমি জিজ্ঞেস করছি কার কাছ থেকে? মানে কে তোকে পাঠিয়েছে?’ বাপ্পা বলল—‘কে আবার পাঠাবে?’

ইন্দ্রদার হাত বালিশের তলায়, বলল—‘মেদিনীপুর থেকে ফিরেছি আজ সকালে, কারুর জানবার কথা নয়। মাসখানেক একেবারে ঠিকানাহীন ছিলুম। তুই কি করে জানলি?’

—‘না জেনেই এসেছি ইন্দ্রদা। একটা বিষয়ে তোমার পরামর্শ দরকার।’

—‘কোনও বিষয়ে কারুর পরামর্শ চাসনি—’ বলে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল ইন্দ্রদা।

—‘ইন্দ্রদা শোনো। আমার বড্ড দরকার!’ ইন্দ্র শুনবে না, তবু বাপ্পা জোর করে অপূর্বদার ব্যাপারটা ওকে শোনাল।

—‘নো কমেন্ট’—ইন্দ্রদা বলল।

—‘মানে?’

—ইন্দ্রদা আস্তে আস্তে বলল—‘জানি না, কোনও শপথের দাম আর আমাদের কাছে আছে কিনা, তবু তোর কাছে যা সবচেয়ে পবিত্র তার নাম করে বল তুই আমায় মারতে আসিসনি?’

বাপ্পা স্তম্ভিত হয়ে গেল।—‘বলছো কি ইন্দ্রদা?’

ইন্দ্র নিচু গলায় বলল—‘বিশ্বর বন্ধু নির্মল, আরও দু তিনটে ছেলে ওকে ডেকে নিয়ে গেল সিনেমায় যাবে বলে। ফেরার পথে পেছিয়ে পড়ল, সাইকেলের চেন দিয়ে পেছন থেকে ওকে খুন করল। ব্যাপারটা তুই জানিস না?’

—‘পুলিশের চর সন্দেহে চতুর্দিকে এরকম খুনোখুনি হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছি, এ ধরনের নির্মম খুন কার নির্দেশে হচ্ছে, জানি না। কিন্তু বাচ্চুর নামে শপথ করে বলছি ইন্দ্রদা, অপূর্বদাকে শাসানি-চিঠিও যেমন আমি লিখিনি, তেমনি তোমাকে মারতেও আমি আসিনি। এরকম নির্দেশ পালন করার আগে আমি নিজে মরব ইন্দ্রদা!’

গা থেকে চাদরটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ইন্দ্র বলল—‘বাপ্পা, ব্যাপার বড় ভয়ানক। আমাদের হাত থেকে লুম্পেন এলিমেন্টদের হাতে চলে যাচ্ছে বিপ্লব। শুনছি, তাতে না কি নেতাদের পুরোপুরি সায় আছে। ওঁরা নাকি কোনদিনই আমাদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেননি। বলছেন মিড্‌লক্লাস ইন্টেলিজেন্সিয়া বেশিদিন বিপ্লবের আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না। শোধনবাদের পথে চলে যায়। তাদের রোখ নেই, দুঃসাহস নেই, আমাদের ওঁরা বলেন ‘ইডিওলোগ’। সবচেয়ে ভয়ের কথা, এই অ্যান্টি-সোশ্যালদের চালনা করবার লোক খুব সম্ভব নেই। ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সব। শ্রেণিশত্রু বলে এখন ওরা যার যার ওপর রাগ আছে তাকে তাকে খুন করছে, নকশাল নামের শিখণ্ডীর আড়াল থেকে। মার্কস-এর, লেনিনের এমন কি মাওয়ের কোনও তত্ত্বই এই লুম্পেনরা জানে না, বোঝে না, নেতারা সেটা জানেন। খোলাখুলি খুনজখম, লুঠতরাজের সুযোগ পেলে গুণ্ডারা কখনও ছেড়ে দেয়! উন্মাদ, এরা বদ্ধ উন্মাদ! বেলেঘাটাতে নাবিক বলে যে লোকটাকে ওরা খুন করল একটা পেটি ব্যবসাদার ছিল লোকটা, বরাবর মস্তানদের তোলা দিত। ইদানীং নকশাল নাম নিয়ে সেই সেম গ্রুপ তোলা নিচ্ছিল। টাকার অঙ্কটা এবার বোধহয় বেশি চড়ে যায়। দিতে পারেনি। ব্যাস। তাইতেই সে শ্রেণিশত্রু, তাইতেই খুন! বারাসত, ব্যারাকপুর, বেলঘরিয়া—সর্বত্র তাই। এসব আমাদের কাজ তো নয়ই। আমার এ সন্দেহও হচ্ছে, কিছু কিছু রাজনৈতিক দলও নিজেদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যে নকশাল নামের আড়ালে যথেচ্ছাচার করে যাচ্ছে। আমাদের মুখে কালি লেপার কাজটাও এক ঢিলেই হয়ে যাচ্ছে।’

বাপ্পা বলল—‘এভাবে পিছিয়ে গেলেই চলবে ইন্দ্রদা? আমরা শুরু করেছিলুম, বিপ্লবের মোরাল ঠিক রাখার কাজে আমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে, দরকার নেই কাউকে জিজ্ঞেস করে, নিজেই যা করার করব।’

ইন্দ্র বলল—‘সাবধান বাপ্পা। সাবধান। কোনও গলি-টলি দিয়ে হাঁটবি না। আমি গিয়ে বেরোতে বললেও বেরোবি না। আমার পেছনে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে কেউ হয়ত তোকে শেষ করে দিতে বলবে। আমাদের সঙ্গে আর কে আছে বল তো? কিষাণরা আপাতত আর আমাদের সঙ্গে নেই। শহরে মজদুরদের সঙ্গে আমাদের কোনদিনই কোনও যোগাযোগ হল না। তাহলে রয়েছে কে? রয়েছে কয়েকজন ক্ষুদিরাম, কানাইলাল আর দলে দলে ভাড়াটে গুণ্ডা।’

বাপ্পা উঠে পড়ল। বিভ্রান্ত হয়েছিল মন। ইন্দ্রদার কাছে আসার পর একেবারে উদ্‌ভ্রান্ত লাগছে।

বুধবার অর্থাৎ তৃতীয় দিন সকাল সাতটায় অপূর্ব মিত্রর মা নাতিদের নিয়ে স্কুলে পৌঁছতে গেলেন, অপূর্বদার অ্যামবাসাডার-এ। আলোবউদিও সঙ্গে রয়েছেন, হাতে বাজারের ব্যাগ, প্লাস্টিকের ঝুড়ি। অদৃশ্য কতকগুলো চোখ যেন পাহারা দিচ্ছে বাড়িটাকে। হন্তদন্ত হয়ে এক ভদ্রলোক এসে বাড়ি ঢুকলেন। অপূর্ব মিত্র তখন অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। পায়জামা পরা। খালি গা। কথা কইতে কইতে হাতে রেজর নিয়েই এলেন অপূর্ব, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। একগালে কামানো তখনও বাকি, অপূর্ব বললেন—বলেন কি? কোন হাসপাতালে দিয়েছেন?

আগন্তুক ভদ্রলোক বললেন—‘চিত্তরঞ্জন। এক্সরে রিপোর্টটা পেলেই অপারেশন শুরু হবে। সম্ভব হলে আজই।’

—‘অপারেশনের কন্ডিশন আছে তো?’

—‘আমরা লে-ম্যান আর কি বুঝব। ডাক্তার বলছে ইমিডিয়েট অপারেশন দরকার।’

মোড়ের মাথা পর্যন্ত ওষুধ, ডাক্তার, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ‘ও’ গ্রুপের রক্ত নিয়ে উদ্বিগ্ন আলোচনা করতে করতে এগোলেন দুজনে। অপূর্ব মিত্তির বাড়ির হাওয়াই চপ্পল পরেই বেরিয়ে পড়েছেন। কপাল কুঁচকে আছে দুশ্চিন্তায় একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল। ভদ্রলোক বললেন—‘যায়গা সর্দারজী?’

—‘কিধর?’

—‘ভবানীপুর। চিত্তরঞ্জন হসপিট্যাল।’

—‘আইয়ে’—বড় করে দরজা খুলে ধরল সর্দারজীর অ্যাসিস্ট্যান্ট।

—‘চলি তাহলে’—ভদ্রলোক উঠে পড়লেন—‘তুমি সময় করে একবার····’ পায়জামা-পরা অপূর্ব মিত্তির বিদ্যুদ্বেগে উঠে পড়লেন। ট্যাক্সি দমকলের মতো লাগাতার হর্ন বাজাতে বাজাতে মুহূর্তে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে পড়ল। একটু পরে পেছনে পরপর দুটো বোম ফাটল। কিন্তু অপূর্ব মিত্তিরের ট্যাক্সি তখন অনেক দূর। অনেক রাত্তিরে অপূর্ব মিত্রের খোলা বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে এলো বাপ্পা।

এতদিনে একটা কাজ করা গেল যেটাকে তৃপ্তিকর বলা চলে। কিছুদিন আগে ইলেকশনের তিন সপ্তাহ আগে হেমন্ত বসুকে হত্যা করা হল। ফরোয়ার্ড ব্লকের হেমন্তবাবু এ অঞ্চলের একজন শ্রদ্ধেয় নেতা। ঠিক ইলেকশনের আগে তাঁকে কারা হত্যা করল এ নিয়ে জনান্তিকে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। সি পি আই এম-কে দোষ দেয় কেউ, কেউ নকশালপন্থীদের। কিন্তু যারাই হোক, বাপ্পাদের সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ নেই। এটাই সবচেয়ে ভয়ের কথা। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলে কিছু থাকবে না? অজস্র আলাদা আলাদা দল, নিজের নিজের ইচ্ছামতো কাজ করবে? কাজটা মানুষের প্রাণ নেওয়ার মতো সাঙ্ঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলেও? কনস্টেবল নাকি পুলিসি অত্যাচার আর দুর্নীতির প্রতীক, ডাক্তাররা মানুষের রোগ নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে, একজন ডাক্তার সে দফায় দফায় ফি বাড়িয়ে যাক না যাক, সেও ডাক্তারি লোভের প্রতীক; কিন্তু প্রতীক বলে কি হত্যা চলে? প্রতীকী হত্যা!

বিবি বাড়ি ফিরছে। ট্রাম-স্টপে নামতেই কাঁধে হাত পড়ল।

—‘বিবিদি এখন বাড়ি যেও না।’

—‘কেন রে সনু?’

—‘আমাদের বাড়ি এসো, বলছি।’

—‘তেমন কিছু যদি কারণ থাকে তো আমাকে যেতেই হবে।’

সনুর হাত জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল বিবি। বুকের ভেতরটা দুরদুর করছে। কেউ জানে না, শুধু সে আর বাপ্পা জানে, বাচ্চু ফেরার, ওর মাথার ওপর খাঁড়া। ও কি ধরা পড়ল? ওকে কি শেষ করে দিল? শ্যামপুকুর স্ত্রীটের প্রত্যেকটি বাড়ির সদর এবং জানলা বন্ধ। মনে হয় পাড়া থেকে সব্বাই অন্য কোথাও চলে গেছে। দূর থেকেই শিবমন্দিরটার কাছে প্রচুর পুলিস দেখতে পেল বিবি। পুলিস কর্ডন করে শিবমন্দিরের সামনেটা ঘিরে রেখেছে। বিবি আর একটু এগোতেই দুজন কনস্টেবল বাধা দিল।

—‘আমার বাড়ি এই পাড়ায়। বাড়ি যাবো।’

তৎক্ষণাৎ একজন ইন্সপেক্টর এগিয়ে এলেন—‘কত নম্বরে থাকেন?’

—‘পাঁচ নম্বর—’

—‘কি নাম আপনার?’

ইন্সপেক্টরের ইঙ্গিতে পুলিস কর্ডন ফাঁক হয়ে গেল। শিবমন্দিরের সামনে রক্তের পুকুর। একটা মৃতদেহ। মাথাটা ক্ষতবিক্ষত। তবু চেনা যায়। দাদা। আজ সকালে বিবির নিজের হাতে কাচা যে চেক-শার্টটা পরে বেরিয়েছিল, সেটাই এখনও পরণে। ছাই-ছাই রঙের টেরিলিনের প্যান্ট। এই প্রথম টেরিলিনের প্যান্ট করাতে পেরেছিল দাদা।

ইন্সপেক্টরটি ধরেছিলেন বিবিকে।

—‘দেখুন, ভালো করে দেখে নিন। এই হল আপনাদের আন্দোলনের আসল চেহারা। দেখেছি আমারই হাতে হয়ত নিহত ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে; জীবনানন্দ পড়েছেন নিশ্চয়ই’, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা শেষ করলেন ইন্সপেক্টর। নিজেই ধরে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন, বিবির চলবার ক্ষমতা ছিল না। বাচ্চুর কোনও খবর নেই। অন্তুদা উধাও। বাপ্পা বাড়ি নেই। শূন্য বাড়ির কলঘরে বুকফাটা কান্না কাঁদছিল মা। শোনবার কেউ ছিল না, সান্ত্বনা দেবারও না। সব বাড়ির জানলা-দরজা আটকাঠ বন্ধ।

দাদা বাড়ি ফিরছিল অফিসের পর ট্যুইশনি সেরে! শিবমন্দিরের চাতাল থেকে কারা ডেকেছিল? পরিচিত না হলে দাদা তো দাঁড়াত না? পাইপগানের জন্য খুব শর্ট রেঞ্জ চাই। কারা? কে? আশপাশের লোকে কি আর কিছু বুঝতে পারেনি? কিন্তু মুখে কুলুপ, চোখে কালো চশমা, কানে তুলো।

বাপ্পা পায়চারি করছিল উন্মত্তের মতো। দু চোখ লাল।

—‘ওরা কারা দিদি? কারা? অপূর্বদাকে ধরতে না পেরে ওরা আমার দাদাকে শেষ করে দিল? এ তো নোংরা খুনোখুনি! দিদি, ওরা কি পাঞ্জাবি ড্রাইভারের পাশে বসা আমাকে চিনতে পেরেছিল? দিদি, দিদি, কে লিখেছিল অপূর্বদাকে শাসানো চিঠিটা? অবিকল আমারই হাতের লেখা!’

বিবি ক্ষীণকণ্ঠে বলল—‘বাপ্পা, তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস? করাই স্বাভাবিক। আমরা তিন ভাই বোন তিনরকম কাজে লেগেছি। কারুর কথা কাউকে বলা বারণ। কিন্তু আমিও চিঠি লিখিনি। বিশ্বাস কর। ও চিঠির কথা আমি জানতুম না। অপূর্বদাকে বাঁচাতে তোর ভূমিকার কথাও না। এখন এইমাত্র জানছি।’

বাপ্পা বলল—দিদি, দিদি, আমরা এখন কি করব?

—‘যেমন করে হোক বেরিয়ে আসতে হবে, এ বাড়িটা বিক্রি হয় কিনা খোঁজখবর নে। অনেক দূর চলে যাবো। অন্যভাবে বাঁচব।’

বাপ্পা বিষণ্ণ, কঠিন, হতাশ গলায় বলল—‘উই আর ইন ব্লাড স্টেপ্‌ড্‌ ইন সো ফার দ্যাট, শুড উই ওয়েড নো মোর, রিটারনিং ওয়্যার অ্যাজ টিডিয়াস অ্যাজ গো ওভার। দিদি। বাচ্চুকে না নিয়ে আমরা কি করে ফিরব?’

—‘বাচ্চুকে আমি ফেরাবই। মায়ের কোলে ফিরিয়ে দোবই। যে কোনও মূল্যে।’ বিবি দুহাতে মুখ ঢাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *