পদাতিক পদক্ষেপ

পদাতিক পদক্ষেপ

উত্তর কলকাতার যে ঘনবসতি অঞ্চলে বাপ্পাদের বাস একসময়ে সেটা কলকাতার খুবই বনেদি অংশ ছিল। এখন বেশির ভাগ বাড়িই নিয়মিত সংস্কারের অভাবে জীর্ণ। বাপ্পাদের বাড়িটা শেষবার সারানো হয়েছিল বছর চল্লিশ আগে। বাড়ির গাঁথুনি খুব পোক্ত হওয়ায় এতদিনকার অবহেলার ছাপ কমই পড়েছে। লাল ইঁটের বাড়ি। যতবার বর্ষা যায়, রঙ ধুয়ে আরও উজলে ওঠে। অন্তত বাড়ির বাসিন্দাদের তাই মনে হয়। পাড়ার অন্যান্য বাড়ির তুলনায় তাদের পাঁচ নম্বরের অবস্থা ভালোই। এক ডানদিকের একেবারে কোণে অপূর্ব মিত্তিরের বাড়ি ছাড়া বাকি সবগুলোই ছ্যাতলা-পড়া। বহু বর্ষার জল পেয়ে ইঁদুরের গায়ের মতো কালচে রঙ্‌ ধরেছে, আসলে গোলাপি, হলুদ যাই থেকে থাক না কেন। বাপ্পাদের আর অপূর্ব মিত্তিরের—এই দুটো ছাড়া আর সবগুলোই ভাড়াবাড়ি। বাড়িওলাও সারিয়ে দেয় না, ভাড়াটেরও গরজ নেই নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে কিছু করার। বাপ্পাদের বাড়ির পেছন দিকটা ভাড়া দেওয়া। নইলে বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যাবার পর চার ভাইবোন এবং মা একেবারেই জলে পড়তেন।

সদর দরজা খুলেই লম্বাটে উঠোন। দরজার সোজাসুজি কয়েকটা চওড়া ধাপ উঠে ভেতরে যাবার দরজা। উঠোনের একদিকে ইঁট ঘিরে মাটি ফেলে একটা পেয়ারা গাছ করা হয়েছে। বাপ্পা উঠোনের ধাপের ওপর বসেছিল। ধাপটা ইঁট বার করা। ফাঁকে ফাঁকে আগাছা এবং শ্যাওলা জন্মেছে। বাপ্পার বয়স উনিশ টুনিশ হবে। সরু সরু পাকানো তারের মতো দাড়ি গোঁফে মুখটা ভরা। ওর দুপাশে দুটো পাতাবাহারের গাছ। এক সময়ে মাটির টবগুলো পেতলের আধারে বসানো ছিল। কোনও সময়ে অভাবের সংসারে কাজে লেগেছে সেগুলো। পেতলের এই বড় বড় টবগুলোর ওপর বাপ্পার ভীষণ একটা ঝোঁক ছিল। বাবা ছিলেন শৌখীন মানুষ। গাছপালার শখ ছিল। ঠাকুর্দাদার আমলের এই পেতলের টবগুলো বাপ্পার কাছে বড়মানুষির একটা প্রতীকের মতো ছিল বোধহয়। যেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখল ওগুলো নেই, সেদিন খুব কান্নাকাটি করেছিল। মা, দাদা কেউই সদুত্তর দিতে পারেনি।

বাপ্পার সামনে দাঁড়িয়ে যে ছেলেটি সরু সরু হাত-পা নেড়ে, উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল তার নাম অষ্টা। অষ্টা বাপ্পার একসময়ের সহপাঠীও বটে, পাড়ার বন্ধুও বটে। এই সেদিন পর্যন্ত অষ্টার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল গ্র্যাজুয়েট হয়ে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রেলওয়ের কেরানিগিরিতে ঢুকে পড়া। কিন্তু এখন নানা কারণে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা মার খেয়ে গেছে। অষ্টা বলল—‘দুজনে মিলে ওয়ার্ক আউট করবি। বাচ্চুকেও ডেকে নে। নাহলে সময়মতো পৌঁছবে না। ছেলেগুলো কি ততক্ষণ কলম চিবোবে?’

কিছুক্ষণ আগে এ বছরের হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষার ঘন্টা পড়েছে। আজ অঙ্ক। তারই প্রশ্নপত্র এখন অষ্টার হাতে। বাপ্পা একটা কাগজে অঙ্ক কষতে কষতে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল—‘ঠিক পৌঁছে দিতে পারবি তো : ওপর থেকে নেমে আসা যত সহজ, নিচ থেকে ওপরে ওঠা তত সহজ নয় কিন্তু।’

অবহেলার স্বরে অষ্টা বলল—‘ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। তুমি আগে দাও তো গুরু। বাচ্চুকে ডেকে নিচ্ছো না কেন?’

বাচ্চু নিজেই এই সময়ে বৈঠকখানার মুখে এসে দাঁড়াল। হাতে খবরের কাগজ। নিচের ধাপের ওপর দাদাকে খাতা কলম হাতে ব্যস্ত এবং সামনে অষ্টাকে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাচ্চু বলল—‘কি ব্যাপার রে অষ্টাদা? কি করছিস?’ অষ্টা গম্ভীর মুখে বলল—‘সোশ্যাল ওয়ার্ক।’

—‘মানে?’

—‘মানে গুষ্টির পিণ্ডি। দাদার পাশে বসে পড়ে আঁকগুলো কষে দাও দিকি!’

মুখ ভেঙচে বলল অষ্টা।

—‘দেখি, দেখি,’ বাচ্চু এবার এসে কাগজটা তুলে নিল—‘এ যে দেখছি এইচ এস-এর পেপার! আজকের! কি করে পেলি অষ্টাদা?’

অষ্টা চোখ নাচিয়ে বলল—‘বাহান্ন নং সেন্টারের পাশের গলি থেকে পাঞ্চজন্য বাজালুম’— মুখে দুই আঙুল পুরে তীব্র সিটি দিয়ে উঠল অষ্টা, বলল—‘তারপর ঢিলের সঙ্গে বাঁধা পেপার সুড়সুড় করে হাতে নেমে এলো।’

বাচ্চু বলল — ‘এটা কি ঠিক হচ্ছে?’

—‘কি ঠিক হচ্ছে না?’ অষ্টার মুখের চেহারা মুহূর্তে ভয়ঙ্কর হয়ে গেল,—‘জানিস এই পেপার সেন্ট্রাল ক্যালকাটা, সাউথ ক্যালকাটা সব জায়গায় আউট হয়ে গেছে! মাস্টারস বোর্ডের লোকেরা সব টাকা খেয়েছে! আমরা নর্থের ছেলেরাই শুধু ফেরেব্বাজির ভিকটিম হবো ভালোমানুষ সেজে?’

বাচ্চু দুর্বল গলায় বলল—‘তোরা পেপার ক্যানসেল করাবার জন্যে কিছু করতে পারতিস! ‘কপি করতে প্রশ্রয় দিবি তাই বলে?’

বাপ্পা গরম গলায় বলল—‘এই সব প্রশ্নপত্র উত্তর করা আর না করায় কোনও তফাত আছে বলে আমি মনে করি না বাচ্চু। পরীক্ষা ক্যান্সেল করানো অত সহজ! প্রমাণ, সাক্ষী, কোর্ট অনেক ব্যাপার আছে। অষ্টা ইজ রাইট। অনেক দিন ফেরেব্বাজি সয়েছি। আর না, পুরো এডুকেশন সিসটেমটাই ইংরেজ আমলের শিক্ষানীতির দুর্গন্ধ উদ্‌গার। মেকলে নামে লোকটা কেরানি আর দালাল বানাতে এ জিনিস চালু করেছিল। আজও টিচাররা সেই ব্যাকডেটেড সিলেবাস, সেই একই নোটস ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হেড সারের ইংরিজি নোটস্‌ এর খাতাটাই মনে কর না! পচা কতকগুলো আদর্শবাদ শিক্ষার নামে ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। নিজেরা করছে ক্যাপিটালিস্টদের নির্লজ্জ দালালি, আর ছাত্রদের শেখাচ্ছে সদা সত্য কথা বলিবে, আর পরের দ্রব্য না বলিয়া লইলে চুরি করা হয়।’

বাচ্চু বলল—‘ঠিকই বলছিস দাদা, কিন্তু এর সঙ্গে এইচ এস-এর প্রশ্ন টোকাব কি সম্পর্ক!’

–‘তুই জানিস বাচ্চু, কোন স্কুল কি পোজিশনে আসবে সব আগে থেকে ঠিক হয়ে থাকে। কোনও কোনও বিশেষ স্কুল কলেজ বরাবর প্রশ্ন জেনে পরীক্ষা দেয়। এই পরিস্থিতিতে সুবোধ বালকের মতো পরীক্ষা দেবার কোনও মানে হয়? বোস, এরিথমেটিক পোর্শনটা কষে দে তো!’

—‘বলছিস? তুই সীরিয়াস?’

দু ভাইয়ের বাদানুবাদের মাঝখানেই অষ্টা বেরিয়ে গিয়েছিল। এই সব যুক্তিতর্কর মধ্যে সে নেই। তার প্রতিভা হল অ্যাকশনে। অ্যালজেব্রা অংশটার উত্তর হয়ে গেছে—এখুনি সেটা মজুমদারদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে, সেখানে টাইপ করার লোক বসে আছে। অষ্টা মোট তিনবার এইচ এস ফেল করেছে এই অঙ্ক পেপারের জন্যেই। এবার নিজে না বসে অন্যদের পাশ করাতে সে বদ্ধপরিকর।

দুজনে মিলে অঙ্কের প্রশ্নটা পুরোপুরি সমাধান করে ফেলল ঘন্টা খানেকের মধ্যেই। অষ্টা সেটা নিয়ে দৌড়লো সেন্টারের দিকে। মজুমদারবাড়ির দরজা খুলে রেখেছে ওর বন্ধু গোপাল। গোপালই টাইপ করছিল। দোতলার জানলা থেকে ঢিল-নোঙ্গর করা হল কাগজটা। ঘরের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। ইনভিজিলেটর বৃদ্ধ শিক্ষক উঠে দাঁড়ালেন।

—‘কি ব্যাপার? কি ওটা? ব্যাকবেঞ্চে তোমরা ছেলেরা কি করছো?’

নড়বড় করতে করতে তিনি পৌঁছে গেলেন শেষ বেঞ্চে। সেখানে দুই ছাত্র তখন মোড়া কাগজটা ভালো করে ডেস্কের ওপর বিছিয়ে খাতায় কপি করছে। সামনের বেঞ্চের দুজনও ঘুরে বসেছে। অনেক ছেলেই উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন। পেছন থেকে ভারী ভাঙা গলার আশ্বাসবাণী শোনা গেল—‘ব্যস্ত হবেন না বন্ধুগণ। সবাই পাবেন। আপনাদের সুবিধের জন্য টুকরো টুকরো কাগজে উত্তরগুলো করা হয়েছে। প্রয়োজনমতো নিয়ে যাবেন।’

ইনভিজিলেটরকে ছেলেরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না। একে এক্‌স্‌টারন্যাল সেন্টার। তার ওপর এরা কোনদিন এ স্কুলের ছাত্র ছিল না। থাকলেও কি হত বলা যায় না।

ইনভিজিলেটর জীবনবাবু বলে উঠলেন—‘টুকলি করছিস? ধেড়ে গোবিন্দ ছেলে। লজ্জা-শরম নেই আবার পাত পেতে সবাইকে ডাকা হচ্ছে? দে খাতা, দে বলছি! জীবনবাবু খাতার কোণা ধরলেন। হাত ছোঁয়াবার সঙ্গে সঙ্গে লিকলিকে ধারাল একটা ছুরি উঠে এলো তাঁর পেটের কাছে—‘ভালো চান তো রঙ বাজি করতে আসবেন না দাদু, ভুঁড়ি ফড়কে কাঁটালের ভুতি বেরিয়ে যাবে।’

চমকে হঠে গেলেন বৃদ্ধ শিক্ষক। তারপর কাঁপতে কাঁপতে নিজের জায়গায়। সাদা মুখ নিচু করে নিজের জায়গায় বসে কাঁপা হাতে একটা বই তুলে নিলেন তিনি। চোখের সামনে সরষে ফুল। একষট্টি বছর বয়স হল। দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে অনেক বেত চালিয়েছেন, রক্তচোখ দেখিয়েছেন, ভুঁই-পটকার মতো জোরালো গাঁট্টা বেরিয়ে এসেছে হাত থেকে। এরকম অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। পরের ঘন্টায় তাঁর জায়গায় আর একজন এলে, জীবনবাবু সোজা চলে গেলেন হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে।

—‘সার!’

—‘আসুন জীবনবাবু, কি হল?

—‘ব্যাপার ভয়ানক। ন’ নম্বরে ছেলেরা টুকলি করছে। বাইরে থেকে আনসার আসছে। আমাকে ছুরি দেখাল।’

—‘কি দেখাল?’

—‘ছুরি সার, ছুরি। অশ্লীল গালিগালাজ করল।’

—‘বলেন কি? চলুন তো দেখি!’

—‘দাঁড়ান সার। ভেবে-চিন্তে কাজ করুন।’

—‘পুলিস ডাকছি। একটা ব্যবস্থা তো করা দরকার! আগে আমি দেখে আসি। আপনি আসুন। দেখিয়ে দেবেন কোন ছেলে আপনাকে ছুরি দেখিয়েছিল।’

—জীবনবাবু ঘামতে লাগলেন, বললেন—‘ওরে বাবা, আমি পারব না সার, হার্টের অসুখ, বুক ধড়াস ধড়াস করছে।’

—‘জীবনবাবু।’ হেডমাস্টারমশাইয়ের গম্ভীর গলার ধিক্কার। জীবনবাবু কোঁচার খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এগোলেন।

—সেকেণ্ডপেপারটা প্রাণপণে কষে যাচ্ছে বাপ্পা। শক্ত এসেছে। জিভটা ইঞ্চিখানেক বেরিয়ে কলমের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। মাথার ওপর রোদ। বাচ্চু ভেতরে গেছে আপাতত। খোলা দরজা দিয়ে দুজন মানুষ ঢুকল। ছায়াহীন দুপুর। দুপাশ থেকে দুজনে ওর কীর্তি দেখছে বাপ্পার হুঁশ নেই।

—‘কি ব্যাপার বাপ্পা? তোমার কি আবার এইচ, এস, দেবার দরকার পড়ল নাকি?’ বাপ্পা চট্‌ করে কাগজটা চাপা দিল। রিফ্লেক্‌স্ অ্যাকশন। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি হেসে উঠল। ছেলেটি বলল—

—‘হাসির কথা নয় বিবি। যে-ছেলেটি ন্যাশনাল স্কলারশিপ নিয়ে ফিজিক্সে অনার্স পড়ছে, সে হঠাৎ এপ্রিলের গরম দুপুরে নিজের বাড়ির উঠোনে বসে চলতি হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষার অঙ্ক কষবে কেন?’

বিবি চট করে প্রশ্নপত্রটা টেনে নিল। দরজা ঠেলে বাড়ি ঢুকলো অষ্টা।

—‘হয়েছে? আরে···’ বলেই একটু বিদ্রোহী মুখে থেমে গেল সে। হতবুদ্ধির মতো সমস্ত দৃশ্যটা একবার দেখে নিয়ে বিবি বলল—‘তোরা বুঝি এইচ, এস, এর কোয়েশ্চন পেপার চুরি করে এনে উত্তর সাপ্লাই দিচ্ছিস, বাপ্পা?’

ওদের গলা পেয়ে বাচ্চু এসে দাঁড়াল।

—‘অন্তুদা, আপনি এ সময়ে?’ বাচ্চুর চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছে।

—‘তোমাদের খুব অসুবিধে করলুম এসে?’ ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে ছেলেটি বলল।’

—‘না মানে তা নয়।’

বিবি তখনও জবাব পাবার আশায় তাকিয়ে আছে বাপ্পার দিকে। বাপ্পার শরীরে স্টীলের ফিতের মতো একটা নমনীয় শক্তি। হাতের মুঠি সামান্য তুলতেই বাইসেপস্ ফুলে উঠল। শূন্যে মুঠো ছুঁড়ে কঠিন মুখে বলল—‘এটাই আমাদের প্রতিবাদের প্রথম স্টেপ।’

—‘কিসের প্রতিবাদ?’ অন্তুদা বলল।

—‘কিসের নয়? রাজনীতি, শিক্ষানীতি, সমাজব্যবস্থা— যা কিছু আমাদের অনন্তকাল দুর্ভোগের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে।’

বিবি কিছু বলতে যাচ্ছিল, অন্তুদা ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল—‘অষ্টা, তোমার যেখানে যাবার ছিল, যাও, বাপ্পা তোমার কি দেরি আছে? একটু কথা ছিল। ভেতরে চলো।’

বাচ্চু বলল, ‘আমি নয়?’

অন্তুদার সোনালি চশমায় ঝিলিক দিল। ঠোঁটে দুর্লভ হাসি। ভেতরে যেতে যেতে বলল—‘নিশ্চয়ই। শুধু একটু পরে।’

বিবি বলল—‘মা কোথায় রে বাচ্চু?’

—‘মাঝের ঘরে। কাগজ-টাগজ পড়ছে বোধহয়।’

হাত পা ধুয়ে বিবি মায়ের ঘরে ঢুকল। বিছানার ওপর উঠে খুব লক্ষ্মী মেয়ের মতো মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। মা চোখ থেকে চশমাটা নামালেন, কাগজটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন, তারপর বললেন, —‘মুন্নির হোস্টেলেই ঠিক ছিলি তো?’

—‘তাই তো তোমায় বললুম কাল!’

—‘না রে বিবি, যা বলবি আমাকে অন্তত ঠিক বলবি। না হলে বিপদ আছে। অন্তুর সাড়া পেলুম যেন!’

—‘এসেছে তো!’

—‘তোর সঙ্গে কোথায় দেখা হল?’

—‘মুন্নিদির ওখানেই।’

—‘এতদিন কোথায় উধাও হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিলি?’

—‘না। জিজ্ঞেস করলেও জবাব দেয় না মা।’

মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে বললেন—‘ওকে না হয় বল রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া করে যেতে। তাড়াতাড়ি করে দোব এখন।’

—‘বলব।’

মা যতক্ষণ না ঘুমোলেন বিবি মায়ের কপালে তারপর পায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বিবি জানে এই সময়ে মায়ের মাথা টিপ টিপ করে, কাজ কর্মের শেষে শুলেই পায়ে ভীষণ যন্ত্রণা হয়। এক এক সময়ে মা পায়ে ছেঁড়া শাড়ির পাড় বেঁধে রাখে যন্ত্রণায়। হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে কিছুটা ভালো আছে এখন। পা টিপতে টিপতে আরামে মার চোখ বুজে আসছে। তবু কক্ষনো মুখে বলবে না। গভীর মমতা বিবির চোখে, যেন মা নয়, সে-ই এখন তার মায়ের মা।

ঘন্টা দুয়েক পর বাপ্পা দরজার কাছে এসে ইশারায় ডাকল। বিবি দেখল বাপ্পা তার দিকে একটা অন্যরকম উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মুখে শুধু বলল—‘আমাদের কথা হয়ে গেছে, অন্তুদার কি দরকার। ডাকছে তোকে।’

বাপ্পার পড়ার ঘরে, টেবিলের ওপর কনুই রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা অঙ্কের বই পড়ছিল অন্তুদা। বিবি চৌকাঠ থেকে বলল—‘মা আপনাকে রাত্তিরে খেয়ে যেতে বলছে অন্তুদা।’ অন্তুদা যেন শুনতেই পায়নি। বিবি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে বলল—‘বাপ্পার মাথাটা খেলেন তো?’

—‘অর্ধর্ভুক্তই ছিল।’

—‘বাকিটা চিবিয়ে শেষ করে দিলেন?’

—‘বিবি, বিপ্লবের মাটি যে কতটা তৈরি, তার হাতে-হাতে প্রমাণ কিন্তু তুমি নিজের বাড়িতে বসে পেলে। শুধু তোমাদের শ্যামপুকুরে নয়, এই জিনিস আমি শিবপুরেও দেখে এসেছি। কারুর কাছ থেকে কোনও নির্দেশ এরা পায়নি। আমাদের সঙ্গে বাপ্পা আর তার বন্ধুদের কোনও যোগ নেই। জিজ্ঞাসা করে জানলুম ওরা নিজেরাই জনা পনের ছেলে, তার মধ্যে অষ্টার মতো স্কুল-ড্রপ-আউটও আছে, বাপ্পার মতো ব্রিলিয়ান্ট স্কলারও আছে—ওরা নিজেরাই ঠিক করেছে, পরীক্ষার এই প্রহসন ওরা চলতে দেবে না। শিক্ষার নামে এই চর্বিত-চর্বণ, এই ভুলে-ভরা পরীক্ষার সিসটেম কিছুতেই মানবে না। বুঝতে পারছো কিছু?’

—‘কি?’

—‘স্বাধীনভাবেই, কারো অপেক্ষা না রেখেই, ওরা বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছে। ওরা তত্ত্ব জানে না। রাজনীতিও কোনদিন করেনি। জিনিসটা স্বতঃস্ফূর্ত। কমরেড মজুমদারের কথার সত্যতা আমি ষোল আনা বুঝতে পারছি।’ অন্তুদার চোখ জ্বলতে লাগল। সে চুপ করে সামনের দিকে চেয়ে রইল। বিবি বলল—‘বাচ্চুটাকে বাদ দিলেন কেন?’

—‘বাচ্চু আমার সবচেয়ে দামী ঘোড়া। ওর প্রস্তুতি অন্যরকম। ওকে আমায় শীগগিরই অ্যাকশন স্কোয়াড কম্যাণ্ড করতে পাঠাতে হবে। পীপল্‌স্‌ কোর্টও পরিচালনা করবে ও।’

বিবি হঠাৎ আকুল হয়ে বলে উঠল—‘অন্তুদা, আমি একাই কি যথেষ্ট ছিলুম না?’

—‘কি আশ্চর্য!’ গলার স্বর পাল্টে গেল, ‘তুমি এবং আমি, বাপ্পা, বাচ্চু এবং অন্যান্য আরও এক্‌স, ওয়াই, জেড্‌, কেউই একা একা তো যথেষ্ট নয়ই। সবাই মিলেও যথেষ্ট কিনা সন্দেহ আছে বিবি। আপামর সাধারণকে আমাদের সঙ্গে পেলে তো কথাই ছিল না। এখনও পর্যন্ত পাতি-বুর্জোয়ার নৈতৃত্বই চলছে, চলবে। জঙ্গল সাঁওতালের মতো দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। অনেক স্যাক্রিফাইস আরও অনেক স্যাক্রিফাইস আমাদের সামনে অপেক্ষা করে রয়েছে’ গলা খাদে নামিয়ে বলল—‘গোপীবল্লভপুরে শেষ পর্যন্ত ওরা তো পিছিয়ে গেল, কেন এখনও বুঝতে পারিনি, অ্যানালিসিস দরকার। খুব সম্ভব শহরের ছেলেদের অধীনে কাজ করতে ওদের ভালো লাগেনি। তাছাড়াও, আমরা রাজনৈতিক অধিকার দখলের ওপর জোর দিয়েছি, ওরা চায় নগদ লাভ। ব্যাপারটা বোধহয় ওরা ঠিক বুঝতে পারে না। আসলে কাজে নামলে বোঝা যায় থিয়োরি দিয়ে বেশিদূর এগোনো যায় না।’

—‘অন্তুদা, আপনার এই উপলব্ধির কথা পার্টিকে তো জানানো দরকার। ফার্দার অ্যাকশনের আগে অ্যানালিসিস করে নেওয়াই তো ভালো।’

—‘সময় নেই, সময় নেই। পশ্চাত্তাপের সময় এ নয় বিবি। বারবার ভুল করতে করতে ঠেকে শেখা ছাড়া গতি নেই। সব কাজগুলো যুগপৎ করতে হবে। তুমি কাজ না করলে কাজ তোমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে। কি ব্যাপার বলো তো? তোমাকে দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে?’

বিবি আস্তে আস্তে বলল—‘যেখানে নেতৃত্ব এত র‍্যাশ, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার সুযোগ এতো কম, সেখানে আমরা তিনজনেই যদি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ি, কে আমাদের মাকে দেখবে বলুন? নিশ্চয়ই সুনীলদা, আর আরতিদিদের মতো করে আপনিও বলবেন না আগে বিপ্লব, পরে মা। পরে অন্য সব।’

—‘দাদাকে বাদ দিয়েছি তো বিবি।’

—‘কেন দিয়েছেন ভালো করেই জানেন। দাদা নিরীহ, ভালোমানুষ। ওকে দিয়ে আপনাদের কাজ হত না। কিন্তু আমাদের তিন ভাই বোনকে বাদ দিয়ে শুধু দাদা মায়ের সান্ত্বনা হবার পক্ষেও যে বড্ড দুর্বল, এটা আপনার জানা উচিত।’ অন্তু টেবিলে টোকা মারতে মারতে বলল—‘বিবি, তোমার মতো ধীর স্থির, বিপদে অচঞ্চল এরকম নির্ভরযোগ্য ক্যাডার আমাদের আর আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু তুমি কিছুতেই মশালের মতো দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠতে পারো না, তুষের আগুনের মতো বোধহয় ধিকি ধিকি জ্বলো। আচ্ছা, তোমার এরকম ডিফিটিস্ট মনোভাব কেন? কেন বিশ্বাস করতে পারো না, আমরা জয়ী। সমস্ত দুর্নীতি, বিবৃতি, নষ্টামি, ধাষ্টামির ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে জয়ের নিশান হাতে এগিয়ে চলেছি!’

নিশ্বাস ফেলে বিবি বলল—‘এখনও পর্যন্ত আপনাদের টোটাল প্ল্যানের কোনও হদিশ পেলুম না। লীডারশিপ সম্পর্কেও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। প্রথমে ভেবেছি—আপনি, আপনিই সব। এখন দেখছি আপনিও শুধু কয়েক গজ দূরত্ব অবধি দেখতে পান। তারপর অন্ধকার।’

অন্তুদা বলল—‘হদিশ পাবার দরকার কি? আরব্যান গেরিলা ওয়রফেয়ারের ভিত্তিই হল গোপনীয়তা।’

বিবি বাধা দিয়ে বলল—‘আপনারা কি বই দেখে যুদ্ধ করবেন অন্তুদা। এতো গোপনীয়তা, এ তো বাতিক।’

—‘শোনো বিবি, গোপনীয়তা বাতিক নয়। অ্যাবসলিউট নেসেসিটি। যা জানো না, তা কখনও কাউকে বলতেও পারবে না, হাজার প্রেশারেও না।’ শিউরে উঠে মুখ তুলল বিবি—‘শুধু যদি কিছু সংশপ্তক সেনারই দরকার ছিল তাহলে চিন্তা করবার, প্রশ্ন করবার মন যাদের আছে, তাদের বাছলেন কেন? চিন্তা শক্তি এবং কল্পনার ব্যবহার হারিয়ে কোনও অদৃশ্য নেতার হাতের পুতুল, হয়ে কাজ করে যাওয়া যে ঈশ্বর আর মানুষের সম্পর্কের চেয়েও অতৃপ্তিকর!’ অন্তু একটু চুপ করে রইল, মুখ দেখে বোঝা যায় একটা প্রচণ্ড ঘা খেয়েছে। তারপর বলল—‘অল রাইট বিবি, তোমাকে আজ থেকে মুক্তি দিলাম। আর কোনও কাজের ভার তোমাকে দেবো না। শুধু শুধু তোমাকে বড় ভারাক্রান্ত করেছি।’

বিবি দুচোখে কুয়াশা নিয়ে বলল—‘মুক্তি দিলেই কি আমি মুক্তি পাবো? আপনি কি ফিরবেন?’

চকিতে ঘুরে দাঁড়াল অন্তুদা, বলল—‘আমার সঙ্গে কি মরতে চাও, বিবি?’ বিবি বলল—‘যদি নিয়তি তাই হয় তো তাই-ই।’

অন্তু নিচু গলায় বলল—‘আমায় মালগুলো এবার দাও। আমি খেয়ে যেতে পারছি না। রাত্তিরে অ্যাকশন আছে। মাসিমাকে ন্যাচার‍্যালি বুঝিয়ে বলবে।’

বিবি উঠে গিয়ে কাপড়ের আলমারি খুলল। তিনটে ভারি প্যাকেট অন্তর হাতে তুলে দিল, বলল—‘এইটে এক নম্বর-জন্মদিনের উপহারটা, এইটে বিয়েবাড়ির দু-নম্বর, আর এইটে তিন নম্বর—অন্নপ্রাশনের। ঠিক আছে তো?’

প্যাকেট তিনটে একটু টিপে-টুপে দেখে অন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াল—‘বিবি?’

—‘কি!’

—‘আমার দিকে একবার স্পষ্ট করে তাকাও। যাচ্ছি কিন্তু। রাগ নয়, ভয় নয়, শুধু সাহস আর বিশ্বাস। মনে রেখো, তুমি আমাদের অস্ত্রাগার আর···তুমি লীডারের কথা বলছিলে না? জেনে রেখো, তোমার জন্য তোমাদের জন্য আমি, শুধু আমিই যথেষ্ট।’

সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মা ঘরে ঘরে চৌকাঠে জল দিয়ে শাঁখ বাজালে।। কত কালের পুরনো সান্ধ্য অনুষ্ঠান। পাড়হীন সাদা কাপড় কাঁধের ওপর খসে পড়েছে। মুখশ্রী শান্ত। মা সারাজীবন যে দুঃখ ভোগ করেছে তা এ দেশের এ সমাজের সংস্কৃতিরও অন্তর্গত। নিদারুণ শোষণ, নিপীড়নেও মা বিদ্রোহ করেনি, সে কি উপায় ছিল না বলে? বিদ্রোহ কি উপায়ের প্রতীক্ষা করে? বিদ্রোহ না করুক, মা প্রতিশোধ নিতে পারত। যে শাশুড়ি মার অল্পবয়সে খাওয়া-পরা, শোয়া-বসা নিয়ে উৎখাত করে দিয়েছেন তিনিই যখন সাত বছর প্যারালিসিস হয়ে শুয়েছিলেন, তাঁকে কিন্তু মা মায়ের মতোই সেবা করেছেন। বাবা মারা যাবার পর দীর্ঘ দুঃসময় গেছে। মা জমা টাকার আয় আর সামান্য বাড়ি ভাড়া থেকে কিভাবে সব চালিয়েছে, ভাবতে গেলে থই পাওয়া যায় না।

—‘সন্ধে হল, চুল বাঁধিসনি, মুখ ধুসনি, সেই কোন সকালের কলেজের কাপড় পরে এখনও বসে আছিস! ওঠ!’

মায়ের কথায় বিবি উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে। ঘরে এতোক্ষণ অন্ধকার ছিল, মা এক্ষুনি আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আলনা থেকে কাপড় নিয়ে চলতে চলতে ফিরে দাঁড়াতে হল। অস্থির গলায় মা বলছে—‘তোদের সব আজ কি হয়েছে বল তো?’

—‘কাদের মা?’

—‘কাদের আবার? তোর, বাপ্পার, বাচ্চুর? কি যেন পাকাচ্ছিস একটা!’

—‘কি আবার পাকাবো?’

—‘আমি তোর পেটে হইনি বিবি, তুই-ই আমার পেটে হয়েছিস। মনে রাখিস। সব সময়ে ভাববি তুই আমার বড় মেয়ে, বাপ্পা-বাচ্চুর দিদি, তোর অনেক দায়িত্ব। পয়সা-কড়ির দায়িত্ব নিতে বলিনি। তোর আসল দায়িত্বটা ওদের ঠিক পথে রাখবার। বয়সটা খারাপ বিবি। আর একটা কথা। অন্তুর বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নেই। খুবই ভালো ছেলে। কিন্তু বেশি ঘনিষ্ঠতা করো না, বিপদে পড়বে। ঘর-গেরস্থালি করবার ছেলে ও নয়। তাদের অভাবটাই বা কিসের বিবি?’

বিবি বলল—‘কি যে বলছো মা। আচ্ছা মা, তুমি কি মনে করো ‘নিজেরা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকলেই আমাদের দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়?

—‘কার দায়িত্ব? কিসের দায়িত্ব?’—মা অবাক হয়ে বললেন।

—‘ধরো সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি!’

—‘সে কি কথা রে! এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন তোদের নিয়েই তো সমাজ! তোরাই তো দেশ! তোরা মানুষের মতো মানুষ হলেই তো দেশের প্রতি দায়িত্ব সবচেয়ে ভালোভাবে পালন করা হয়।’

মা সরল মনে কথাটা বলল, খানিকটা বিমূঢ় হয়ে। বিবির বুকের মধ্যে কথাটা বিঁধে রইল। কথাটা তো একরকম সত্যই। মায়ের ওই সরল সত্য কথনের উত্তর অন্তুদা কি দেবে? বলবে—সত্য ঠিকই, তবে বড় লং-টার্ম সত্য। প্রত্যেকটি ব্যক্তিমানুষ আলাদা আলাদা করে সৎ, নিঃস্বার্থ, কর্মবীর এককে পরিণত হবে আর সেই একক জুড়ে জুড়ে তৈরি হবে আদর্শ সমাজ! এ অন্তত লক্ষ বছরের প্রোগ্রাম। তা-ও অনিশ্চিত। এই সব শোধনবাদের পথ একেবারে ত্যাগ করতে হবে। না হলে ধনতন্ত্র কোনদিন নড়বে না, কোনদিন শেষ হবে না মানুষের হাতে মানুষের শোষণ, কোনদিন রাজনৈতিক ক্ষমতা মেহনতি মানুষের হাতে আসবে না। ভেঙে ফেলো কাঠামোটা। অকেজো অঙ্গগুলো নির্মমভাবে ছাঁটাই করে ফেলে দাও।’

ঘামে-ভেজা শরীরটার ওপর চৌবাচ্চার ঠাণ্ডা জল ঢালতে ঢালতে হঠাৎ বিবির মনে হল কতদিন মুন্নিদির দেখা নেই। মা মুন্নিদিকে জানে বলেই ওর হোস্টেলে রাতটা থাকবার কথা বলে গিয়েছিল মাকে। আসলে ও ছিল আরতিদির বাড়ি। বহু স্লোগান লেখার ছিল। মুন্নিদি মিটিঙ্‌-এ আসে না, ইউনিভার্সিটিতেও দেখতে পাওয়া যায় না। অথচ কি ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে ওকে দীক্ষিত করেছিল মুন্নিদি। চোখ বুজলেই চৌবাচ্চার জল সমুদ্রের চেহারা নেয়। এমন একটা ঢেউয়ে ভেসে চলেছে সে যেখানে সাঁতার কাটা না কাটা সমান। একদম গা ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ফিরে আসারও পথ নেই। বুকের ভেতর অনেক গোপন দলিল। না জেনে-জেনেও অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে। ঢেউ যদি কোন দিন নিজের খেয়ালে ফিরিয়ে দিয়ে যায়, তবেই। তবে কি অনুশোচনা? ভয়? না, তা-ও ঠিক নয়। মহৎ কিছু করার উদ্বেল আনন্দটা সব সময় ঘিরে থাকে না। সেই সময়গুলো বড় কঠিন। বুক হিম হয়ে যায়, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা সাপ নামে, ভয়ের নয়, সংশয়ের।

বাথরুম থেকেই হঠাৎ বাইরে একটা গোলমাল শুনতে পেলো বিবি। কারা যেন চেঁচাতে চেঁচাতে রাস্তা দিয়ে ছুটে গেল। কোথায় কারা দরজা-জানলা বন্ধ করে দিচ্ছে। ঝড় অথচ ঝড় নয়। গোলমালটা ওদের বাড়ির দরজার কাছে এসে ঢুকে পড়েছে বলে মনে হল। বিবি ভিজে গায়ের ওপরেই জামা কাপড় কোনরকমে চাপিয়ে বেরিয়ে এলো।

দালানে মাকে ঘিরে পাড়ার কয়েকটি ছেলে নিতাই, অষ্টা, নীলু, কেশব। মা আতঙ্কিত গলায় বলছেন—‘বলছিস কি?’ নিতাই বলল—‘ঠিকই বলছি, মাসিমা।’

বিবি বলল—‘কি হয়েছে রে?’

নীলু বলল—‘জীবনবাবু, আমাদের স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই, ওই যে যাঁর হাত দিয়ে কমপিট করা ছেলে বার হত—খুন হয়েছেন বিবিদি।’

নিতাই বলল—‘আজ সকালে এইচ-এস পরীক্ষায় টোকাটুকি হচ্ছিল তো, সার ধরিয়ে দিয়েছিলেন, শোনেননি? জীবনবাবু আমাদের পাশের গলিতেই পড়াতে আসছিলেন। তেলিপাড়াটা ভীষণ ঘুপচি অন্ধকার মতো তো! চার পাঁচটা ছেলে লাফিয়ে পড়েছিল ঘাড়ের ওপর। স্ট্যাব করে করে শেষ করে দিয়েছে। দুটো একটা ঘা হলে বেঁচে যেত স্যার। ছুরি মারছে তো মারছেই। রক্তগঙ্গা হয়ে গেছে চারদিকে। আঁ আঁ করে উঠেছিল একবার। তারপরেই সার মরে কাঠ হয়ে গেছে।’

অষ্টা পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। গোমড়া মুখে বলল—‘প্রতিক্রিয়াশীল, পাতি-বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রু এইরকম ভাবেই শেষ হয়।’

মা শিউরে উঠে বললেন—‘কি বলছিস রে অষ্টা! ছি ছি! চুপ কর। জীবনবাবু বুড়ো মানুষ আহা! বাড়িতে তিনটে আইবুড়ো মেয়ে। ছেলেটা বোধহয় বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। মরে যাই!’

স্কুলমাস্টার জীবনধন রক্ষিতের হত্যা দিয়ে শুরু হল কলকাতার পুব, পশ্চিম, উত্তরে বৃহত্তর কলকাতা ও মফঃস্বলে এক নতুন অধ্যায়। ট্র্যাফিক কনস্টেবল হারাধন বারি, পুলিস ইন্‌সপেক্টর রবিন বসু, হেড-মিসট্রেস রুণু ভৌমিক, ছোট ব্যবসাদার মৃগাঙ্ক বসাক, ডাক্তার হরমোহন পাল। হত্যার ধরন এক। পেছন থেকে, অনেক সময়ে বাড়ির সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে চার পাঁচ জন ঝাঁপিয়ে পড়ে পাইপগানের গুলি বর্ষণ কিম্বা ছোরা বা দা দিয়ে আঘাতের পর আঘাত। ধড় থেকে মাথা আলাদা, পেট ফাঁসানো, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে। হত ব্যক্তির রক্ত দিয়ে লেখা ‘চেয়ারম্যান মাও—যুগ যুগ জিও।’ নকশালবাড়ি—লাল সেলাম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *