নিশির ডাকে

নিশির ডাকে

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে উনিশ শ’ সাতষট্টি একটা বিস্ময়ের বছর। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসের সাধারণ নির্বাচনে বিশ বছরের কংগ্রেস-শাসনের অবসান হল রাজ্যে। গঠিত হল অভূতপূর্ব চোদ্দ পার্টির কোয়ালিশন সরকার যার সদস্যদের মধ্যে ছিল মস্কোপন্থী সি পি আই এবং চীন-পন্থী সি পি এম দলও। এই অদ্ভুত অঘটনঘটনে পশ্চিমবাংলার জনসাধারণ আনন্দাশ্রু ফেলল। যৌথ পরিবার প্রথায় আস্থাশীল জনগণমানসে বোধহয় ব্যাপারটা দীর্ঘ বিবাদের পর ভাইয়ে ভাইয়ে মিল হয়ে যাবার মতো একটা আনন্দের ঘটনা বলে প্রতিভাত হয়েছিল। যদিও বাঙালিকে রাজনৈতিক নাবালকত্ব-দোষ শত্রুতেও দেবে না। আসলে রোম্যান্টিক আবেগ ও ভাবালুতার বাড়াবাড়ি এই নিয়েই বঙ্গবাসীর পাপ এবং পুণ্যও।

প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের জোয়ারের জল সরে গেলে আদর্শগত পার্থক্যের ধুধু চড়া যখন দেখা দিল মনোমালিন্য আর গোপন করা সম্ভব হল না। পুলিসের ভূমিকা, শ্রমিক এবং ভূমিনীতি নিয়ে মার্কসীয় এবং অমার্কসীয় দলগুলির মধ্যে বচসা শুরু হল। বার বার ভাঙল, বার বার গড়ল সরকার।

ঊনসত্তর সালের অন্তর্বর্তী নির্বাচনের পর রাজ্যে এখন দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। সেই সাতষট্টি থেকে রাজ্যের লোক আশানিরাশার নাগরদোলায় দুলছে, ‘নুন-আনতে-পান্তা-ফুরনো’ নিম্নমধ্যবিত্ত যেমন দোলে লটারির টিকিট কেটে। ট্রামে-বাসে এখনও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে লোকে। রাজা-উজির মারার অভ্যাসও যায়নি। বছর-ভর রাষ্ট্রপতির শাসনের নিয়ামক অভিজ্ঞতার পরও।

আলিপুরগামী বাসে মোটাসোটা থলথলে ভুঁড়িঅলা এক ভদ্রলোক গাল কাত করে পাশের যাত্রীকে বললেন—‘কি দাদা, এবারে টিকবে তো?’

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ভারি গলায় বললেন—‘ভগাই জানে দাদা, তবে নাড়াচাড়া খাচ্ছে খুব, এটাই ভরসার কথা।’

পেছনের সীট থেকে একজন উৎসাহী ব্যক্তি বেশ খবরাখবর রাখেন মনে হল। চেঁচিয়ে বললেন—‘আর কি, পশ্চিমবঙ্গ আর ফ্রান্সে কোনও তফাত রইল না। কলকাতাও এবার প্যারিস হবে। কত মুলিন রুজ চান?’

রোগাটে খিটখিটে চেহারার একটি বুড়ো মানুষ বোধহয় মুল্যাঁ রুজের উল্লেখে বিরক্ত হলেন, নাকের সামনে দিয়ে মাছি তাড়াবার মতো একটা ভঙ্গি করে নস্যি-নেওয়া খোনা গলায় বললেন—‘অজয় মুখুজ্জে কি পারব্যা? প্রফুল্ল সেনের মতো দাপুটে তো আর নয়।’

‘জ্যোতি বোসই কি পারবে?’ অন্য দিক থেকে পাল্টা প্রশ্ন এলো, আরে বাবা যারা অ্যাদ্দিন পুলিসের প্যাঁদানি খেতে খেতে বড় হল, তাদেরই হাতে পুলিস মিনিস্ট্রি। লাও ঠ্যালা। সাপে-নেউলে কোনদিন একত্রে বাস করেছে?’

এই মার্কা-মারা বাস-সংলাপ শুনতে শুনতে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল মুন্নি আর বিবি। অসমবয়সী দুই বন্ধু। মুন্নি বড়। চোখে পড়ার মতো জ্বলজ্বলে চেহারার মেয়ে, বাহারি ছাপা শাড়ি আর ম্যাচ-করা ভ্যানিটি ব্যাগে বেশ আধুনিকাও। বিবি হিলহিলে লম্বা, খুব ছেলেমানুষ অথচ গম্ভীর মুখ। মুন্নি নিচু গলায় বলল—‘এদের কোনদিন বয়স বাড়বে না, বুঝলি? চিরদিন মায়ের রান্না মাছ-ভাত খাবে, বউয়ের সাজানো টিফিন কৌটো হাতে পাবে। পান চিবোতে চিবোতে লেটে অফিস যাবে আর ট্রামে বাসে রাজা-উজির মারবে।’

বিবি বলল—‘কি করবে বলো, ওদের ক্ষমতা হয়ত ওইটুকুই।’

মুন্নি মৃদু তপ্ত গলায় বলে উঠল—‘এই পাতি-বুর্জোয়ারাই আসল শ্রেণীশত্রু। স্রেফ এই প্যাসিভ, নেগেটিভ অ্যাটিচুডের জন্য। চতুর্দিকে স্ট্যাটাস কো টিকে রয়েছে স্রেফ এদেরই জন্যে।’

কলকাতার প্রান্তিক অঞ্চলে মেয়েদের হোস্টেলে যাবার পথ। ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি, আলিপুর চিড়িয়াখানা সবই এদিকে পড়ে। এখন বরাবর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় বনস্পতি। ছায়ায় ছায়া মিশিয়ে। হঠাৎ এদিকটায় এলে ধুলোর শহর, ভিখিরির শহর কি মিছিলনগরী কলকাতার এসব নাম আদৌ মনে আসে না। মনে হয় কলকাতা এক ছায়াময়ী বীথিকানগরী। এখন বসন্ত সমাগমে শিমূলে মাদারে আগুন, কালচে সবুজ ঝিরিঝিরি পাতার কোল ঘেঁসে রাধাচূড়ার দীর্ঘ হলুমঞ্জরী। কোনও কোনও বসতবাড়ির ফটকের পাশ থেকে মাথা তুলেছে গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবী। যেদিকেই চাও খালি লাল আর হলুদ। রক্তের মতো লাল আর আগুনের মতো হলুদ। এই হল বসন্তের রঙ। বসন্তের রঙ কাঁচা সবুজও। নানান বর্ণছায়ের সবুজের কোলে লাল হলুদের খুনখারাপি হোরিখেলা খোলে খুব। এই রকম রক্তসবুজের যৌবনকেই স্পর্ধা মানায়। অন্য বয়সে যাকে হঠকারিতা মনে হতে পারে, যৌবনের কাছে তাই-ই অমিতবীর্য, তাই-ই দুর্জয়। সাহস।

এপ্রিল মাসের দুপুর। সূর্য এতোক্ষণ মাথার ওপর ছিল। এখন সামান্য পশ্চিমে হেলেছে। সকালবেলাকার শিরশিরে ভাবটা শিশির শুকিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই উধাও। দুই মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়াল। দারোয়ান ফটকে নেই। নিজের আস্তানায় খানা পাকাতে পাকাতে বোধহয় তুলসীদাসী সুর চড়িয়েছে। সুরের সঙ্গে রুটি সেঁকার সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। দুপুরবেলাকার হোস্টেল মনে হচ্ছে একেবারে পরিত্যক্ত। সামনের কমপাউণ্ড পার হয়ে ভেতরে গিয়েও ওরা জনপ্রাণীর সাড়া পেল না। মেট্রন খুব সম্ভব নিজের ঘরে দুপুর-ঘুমে তলিয়ে আছেন। ছাত্রীরা ইউনিভার্সিটিতে, কিম্বা ইউনিভার্সিটির নাম করে অন্য কোথাও। হোস্টেলে কেউ থাকলেও সাড়া-শব্দ দিচ্ছে না।

নিজের ঘরের দরজা খুলে মুন্নি বলল—‘তুই একটু বোস। আমি দেখে আসি আমার জন্যে কিছু রেখেছে কিনা। দারুণ খিদে পেয়ে গেছে। সকালে ভাত খাইনি আজ।’

বিবি খাটের পাশে টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারের ওপর পা ঝুলিয়ে বসল। এপ্রিল হলে কি হবে ভীষণ গরম লাগছে। পাখাটা ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে। হাওয়া বিশেষ দিচ্ছে না। হোস্টেলের পাখাগুলো বোধহয় এইরকমই হয়। শুকনো গরম। ঘরের কড়িকাঠের একপাশে লম্বা একটা ফাটল। অন্য দিকে একটু একটু ঝুল জমেছে। দুজনের ঘর। দুজনেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী। বিছানা দুটো পরিপাটি। তবে মুন্নির বিছানার কভারটা ভেলভেটের মতো মহার্ঘ কোনও বস্তুর। চকচক করছে। খুব নরম এবং আরামের মনে হয়। হোস্টেলের দেওয়া টিনের চেয়ারটার পিঠে একটা এমব্রয়ডারি করা ঢাকনা। সীটের ওপর ডানলোপিলোর কুশন। টেবিলেও কাট-ওয়ার্কের কাজ করা একটা সুন্দর ঢাকা। বই খাতাগুলো প্রত্যেকটা বাঁধানো একই রকম ব্রাউন পেপার দিয়ে। দুদিকে দুটো কাঠের হাতির মাঝখানে সেগুলো এক সারিতে সাজানো। মাঝখানে একটা চীনেমাটির পেটমোটা ফুলদানির মধ্যে কলম-পেন্সিল-ডটপেন-কাগজ কাটার ছুরি।

জানলাগুলো খুলে দিল বিবি। হুহু করে হাওয়া এসে মুন্নির রুমমেটের বিছানার চৌখুপ্পি-নকশার চাদর ওলট পালট করে দিয়ে গেল। আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি অন্য টেবিলটার ওপর কাগজপত্রের স্তূপে একটা মোটা ডিকশনারি-জাতীয় বই চাপা দিল বিবি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকল মুন্নি।

বিবি বলল—‘এরই মধ্যে তোমার খাওয়া হয়ে গেল, মুন্নিদি?’

‘উঁহু’ মুন্নি বলল, ‘দ্যাখ না, মিটসেফের মধ্যে রেখেছে ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত, আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। আজকে মাছের দিন ছিল। তা ছোট ছোট সেই কাঁটা অলা রুই না মৃগেলের বাচ্চাগুলোর ধড়টা খেয়ে মুণ্ডুটা আমার জন্যে রেখে দিয়েছে। কে খাবে? আয় দুজনে মিলে অন্য কিছু খাই।’

ঘরের কোণে স্টোভ জ্বেলে নিমেষের মধ্যে কফি তৈরি করে ফেলল মুন্নি। কনডেন্সড মিল্ক ঢালল দরাজ হাতে। সুদৃশ্য সব কৌটো-টোটো খুলে বার করল ছোট ছোট বিস্কুট, কাজু, মেওয়া। বলল—‘খেতে আরম্ভ কর বিবি। তোরও নিশ্চয় খিদে পেয়ে গেছে।’

বিবি হেসে বলল—‘আমি আসছি বাড়ি থেকে, মায়ের কাছে পেটপুজো করে। আমার কি এতো তাড়াতাড়ি খিদে পাওয়ার কথা? আমার আসলে দরকার ছিল একটু চানের।’

মুন্নি চোখ পাকিয়ে বলল—‘আবার?’

বিবি হাসতে হাসতে বলল—‘আবার।’

—‘আচ্ছা স্নানপাগল তো তুই? যতবার এখানে আসবি, স্নান করবি? দাঁড়া, কফিটা করে ফেলেছি। খেয়ে ফ্যাল। তারপর দুজনে মিলে স্নান করতে যাবো। ফিরে এসে আর এক রাউণ্ড হবে। কি বল?’ একমুঠো মেওয়া মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে মুন্নি বলল—‘এগুলোই আসল সৈনিকদের খাদ্য। আমাদের প্রত্যেকের অভ্যেস থাকা উচিত। যেমন পুষ্টিকর, তেমনি পেটভরা।’

খাটের তলা থেকে সুটকেস টেনে ভেতর থেকে দুটো পরিষ্কার তোয়ালে বার করল মুন্নি, ড্রয়ার থেকে সাবান, তারপর বলল—‘চল, কত স্নান আজ করতে পারিস দেখব।’

দুটো বাথরুমের মাঝখানে একটা উঁচু দেয়াল। সীলিং থেকে হাত তিনেক ফাঁক। দুটো শাওয়ার থেকে জল পড়ার শব্দ প্রতিধ্বনিতে কোনও অশ্রুত-পূর্ব বাজনার মতো শোনাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সাবানমাখা একজোড়া হাত ঝিলিক দিচ্ছিল ওদিক থেকে।

—‘সাবানটা লোফ।’ মুন্নির কণ্ঠস্বর সরু, একটু তীক্ষ্ণ, কিন্তু খুব চনমনে।’

ছিটকে আসা সাবানটাকে নিপুণহাতে ধরে ফেলতে ফেলতে বিবি বলছিল—‘তোমাদের হোস্টেলের সেরা ঘর এই স্নানঘর, যাই বলো মুন্নিদি। এমন একখানা ধারা-স্নানের জন্য অনেক কিছু দেওয়া যায়।’

—‘যায় বলছিস? তাহলে দে।’

—‘দিচ্ছি দিচ্ছি বাব্‌বাঃ তর সয় না।’

—‘কি দিবি?’

—‘দোব নয়, দিলুম—“সারা দিনের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা···”। অর্থাৎ ঘাম এবং শরীরে জমা সারা দিনের ময়লা···

—‘উঁহু উঁহু। ও সব ঘুমপাড়ানি, ঘ্যানঘেনে পদ্য মাথা থেকে বার করে দে।

বল্ “অস্ত্র ধরেছি এখন সমুখে শত্ৰু চাই

মহামারণের নিষ্ঠুর ব্রত নিয়েছি তাই;

পৃথিবী জটিল, জটিল মনের সম্ভাষণ

তাদের প্রভাবে রাখিনি মনেতে কোনো আসন,

ভুল হবে জানি তাদের আজকে মনে করাই।”

প্রাণ খুলে বল—খুন ঔর পসিনা।’

—‘খুন আউর কি বললে?’

—‘পসিনা। পসিনা। রক্ত এবং ঘাম, বুঝলি বুদ্ধু?’

—‘রাষ্ট্রভাষায় আমার ভক্তি নেই, জানোই তো মুন্নিদি। আমি পুরোপুরি ২১শে ফেব্রুয়ারির দলে।’

—‘আচ্ছা আচ্ছা! সেন্টিমেন্টের বন্যাতেই এরা ভেসে যাবে দেখছি।’

—‘তোমার, তোমাদের বুঝি সেন্টিমেন্ট নেই?’

—‘সেন্টিমেন্ট? বানান জানি না, বুঝলি? কঠিন বাস্তব নিয়ে কারবার। কত যুগের সঞ্চিত পাপ তোদের এই সো-কলড পুণ্যভূমিতে। এখনও মিথ্যে দলিলে টিপসই দিইয়ে নেয় এখানে মহাজন। হরিজন পোড়ে, এখনও এখানে বণ্ডেড লেবার। শহর থেকে বেশিদূরেও যেতে হবে না দেখতে হলে। এই ঈজিয়ান স্টেবল পরিষ্কার করার ভার পড়েছে যাদের ওপর তাদের ডিকশনারিতে সেন্টিমেন্ট থাকলে চলে? যাক ও সব কথা। তুই কিন্তু কথা দিয়েছিস। আগামী দিনের মুক্তিস্নানের জন্য যার শরীরে যে ক’ছটাক রক্ত জমা আছে দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

জলের আওয়াজ থেমে গেছে। বিবি হঠাৎ স্পষ্টগলায় বলে উঠল—‘আচ্ছা মুন্নিদি যাদবপুরের গান্ধী সেন্টারে যে ওইভাবে ভাঙচুর হল, বুর্জোয়া নায়কদের মুখে কালি লেপে দেওয়ার কথাও তোমরা বলছ। কিন্তু এতেই কি এতদিনকার সিসটেমটা পালটে যাবে?’

—‘যাবে, আমি বলেছি?’

—‘তবে?’

—‘চীনে কালচ্যারাল রেভলিউশন পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকেই শুরু হয়েছিল বিবি। সব ছাত্র-কিশোর তরুণ, যুবক কলেজ, ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দলে দলে বেরিয়ে এসেছিল। আগে পুরনো সব কিছু ভেঙে ফেলতে হয়। ভেঙে চুরমার করে দেখিয়ে দিতে হয় সিসটেমের ঘৃণ্য অসারতা। “নির্বিঘ্ন সৃষ্টিকে চাও? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে, উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে দাও চারিদিকে।” বুঝলি কিছু?’

—‘নতুন সিসটেমের দরকার। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি—মুন্নিদি, কিন্তু কোথায় সেই সিসটেমের ব্লু-প্রিন্ট? কি তার চরিত্র? কোথায় এখনকার সিসটেমের সঙ্গে তফাত?’

—‘শ্রেণীহীন সমাজে পীপল ওরিয়েন্টেড এডুকেশন আমাদের লক্ষ্য। মানুষের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে। চাষী, মজুর, মেহনতি মানুষকে ভিন্ন শ্রেণী ও গোত্রের বলে গণ্য করতে শেখাবে না।’

—‘খালি থিয়োরিটাই বলছ মুন্নিদি, কি ধরনের সিসটেম তা তো বলছ না।’

—আমাদের দেশে বিপ্লব নেহাত কম হয়নি বিবি। ১৮৫৭র বিপ্লব, তেলেঙ্গানা আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ। কিন্তু কোনোটাই শেষ পর্যন্ত টেম্পো ঠিক রাখতে পারেনি, কেন জানিস? পেছনে একটা পরিষ্কার তত্ত্বের জোর ছিল না। তত্ত্বের দিকটা তাই প্রত্যেকটি ক্যাডারের কাছে জলবৎ হওয়া চাই। তাই-ই এতো বক বক করছি। আমাদের প্রাথমিক কাজ বিপ্লবকে সফল করে তোলা। তারপর শিক্ষানীতির নয়া ব্লু-প্রিন্ট হাতে পাবো। তোর জানার নেশা বেশি বলেই তো আজ তোকে একজনের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। দেখবি সব সংশয় কিভাবে উড়ে যায়। আচ্ছা এবার বেরো তো।’

ছিটকিনি খোলার শব্দ নির্জন দুপুরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলো। যেন একই সঙ্গে অনেক মানুষের বুকের ঘরে অনেক অর্গল শব্দ করে খুলে গেল।

চওড়া বারান্দায় বেরিয়ে এলো দুজন। বিবি সাধারণ বাঙালি মেয়ের তুলনায় বেশ লম্বা। পরিষ্কার আয়নার মতো গায়ের চামড়া। এমনিতেই গালে, কপালে একটু লালচে ভাব আছে; এখন কমলালেবুর রঙের ধনেখালি শাড়ির প্রতিফলনে অদ্ভুত সুন্দর একটা অরুণিমা সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় সোজা ভুরুর তলায় দীর্ঘ চোখের দৃষ্টি স্তিমিত। চিন্তাশীল। যেন যা দেখছে তার ভেতরে আরও কিছু দেখছে। যা শুনছে তার ভেতরে আরও কিছু শুনতে চাইছে। মুন্নি লম্বায় ওর চেয়ে খাটো। টকটকে ফর্সা। চুল ভিজিয়ে স্নান করেছে এই দুপুরে। কিন্তু চুল এতো কোঁকড়া যে বোঝা যাচ্ছে না। চুলগুলো ছোট নিখুঁত মুখটাকে ঘিরে ফুলে ফেঁপে আছে। আলগা একটা ড্রেসিং গাউন পরেছিল সে।

—‘কি ভাবছিস বিবি? কিছু মনে করেছিস?’

—‘মনে করার প্রশ্ন উঠছে কেন?’

—‘অনেক কথা বলে ফেলেছি বোধহয়। তোর মুখটা কেমন বদলে গেছে। আমি তোর ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। কিন্তু তোকে আমাদের দরকার। তোদের মতো মেয়েরা যদি পিছিয়ে থাকে, নিশান ধরবে কে?’

—‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব মুন্নিদি?’

—‘স্বচ্ছন্দে। একটা কেন? হাজারটা কর না।’

সামনের কম্পাউণ্ডে এখন রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে। বারান্দার মাঝে মাঝে আগুনের জিভের মতো এক আধ চিলতে এসে পড়েছে কোথাও কোথাও। বিবি বারান্দায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই বিনুনি দুটো বাইরে ঝুলে পড়ল। বিবি মাথায় মৃদু ঝাঁকানি দিয়ে মাথাটা একপাশে হেলিয়ে বলল—‘খুব সুন্দর লাগছে জায়গাটা। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে অসুবিধে আছে?’

—‘একেবারেই না। তবে ভেতর দিকে মুখ করে বল। নিচের বারান্দায় না চলে যায় কথাগুলো।’

—‘আমার প্রশ্ন—তুমি কেন?’

—‘আমি কেন? মানে?’ অবাক হয়ে বলল মুন্নি।

—‘আর কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। মানেটা বুঝে নিতে তোমায় এক মিনিট সময় দিচ্ছি। ইশারায় কথা বলার অভ্যেস থাকা উচিত তোমাদের।’

—‘বুঝেছি বোধহয়। তুই কি আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ডের কথা বলছিস?’

—‘হ্যাঁ।’

মুন্নির মুখ একটু একটু করে কঠিন হচ্ছিল। বলল—‘আমাদের মতো ছেলে-মেয়েদের বাবা-মাদের সত্যি কথা বলতে কি ক্রিমিন্যাল বলে মনে করি আমি। যে দেশে চার ভাগের তিন ভাগ লোক অর্ধাশনে অনশনে দিন কাটায়, সেখানে আমার মা দুধে গন্ধ লাগত বলে ভ্যানিলা স্ট্রবেরি কি রোজের গন্ধ মিশিয়ে আমাকে দুধ খেতে দিতেন রুপোর গ্লাসে করে দুবেলা। হীট ওয়েভে যে দেশে গরমকালে মানুষ মারা যায় সেখানে তাঁরা এয়ারকুলার লাগানো ঘরে মানুষ করেছেন আমায়। সর বাদাম-বাটা মাখাতেন রোজ যাতে আমার গায়ের রঙে আমার স্বদেশের মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা ফুটে না বেরোয়। তা ছাড়াও, তুই যদি ভেবে থাকিস এ বিপ্লব শুধু হ্যাভ নটসদের, তাহলে ভুল করেছিস। নকশালবাড়িতে যেসব সাঁওতাল, ওঁরাও মুণ্ডা রাজবংশী জোতদারদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, চা-বাগানের সশস্ত্র রক্ষীদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমেছিল তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল, কারা? কমরেড সান্যাল, কমরেড মজুমদার পূর্ণদা এঁরা কেউ সর্বহারা নন। কিন্তু সর্বহারার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেবার মহান ব্রতে তাঁরা তাঁদের বুর্জোয়া অতীতকে মুছে ফেলে এগিয়ে এসেছেন। শোষণ-পীড়ন আর বঞ্চনা ছাড়া অন্য কিছু যারা কোনদিন দেখেনি তাদের ঠিক পথে চালিত করতে আমরা যদি এগিয়ে না যাই তো কে যাবে, বল? এটা তো প্রথম স্টেজ। তারপর সত্যিকার প্রোলেতারিয়েত নেতা ওদের মধ্যে থেকে ঠিকই উঠে আসবে। ততদিন, শুধু ততদিন, আমাদের হাতে নিশান।

বিবি ছেলেমানুষি মুখে ভারিক্কি চিন্তার আদল এনে বলল—‘তুমি কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করো আমাদের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আছে? আমাদের কথা ওরা শুনবে? আমরা ওদের ভাষা জানি না, আচার জানি না। মুন্নিদি, তোমার এই সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরা দারুণ সাফস্টিকেটেড চেহারাটা কোনও সাঁওতাল গাঁওবুড়োর পাশে মনে মনে দাঁড় করিয়ে আমার কিন্তু হাসি পাচ্ছে।’

মুন্নি বলল—‘আমাদের ইউনিট তো আর কিষাণদের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে না। সেখানে উপযুক্ত লোকই যাবে। কিন্তু এখানে যাদের মধ্যে অপারেট করতে হবে তাদের ভাষাও আমাদের থেকে আলাদা, বিবি। বাংলা হলে কি হবে? আমাদের দেশে জনগণকে মার্কসীয় তত্ত্ব বোঝানো খুব মুশকিল। ওদের যে ল্যাণ্ড-রিফর্মের দিকে না গিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল নিতে হবে, টোটাল রেভলিউশনই যে একমাত্র পথ, সেটা ওদের মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। তবে কি জানিস? ভেতরের কনভিকশন আর আত্মপ্রত্যয় এ দুটোই আসল। তুই তো দারুণ ডিবেট করিস, তোর এক্সটেম্পোর বক্তৃতাও সেদিন শুনলুম। লীডারশিপ নেবার মতো ব্যক্তিত্ব তোর আছে বলেই আমার বিশ্বাস। আমি কতদূর এগোবার অনুমতি পাবো জানি না। তুই কিন্তু কদম কদম এগিয়েই যাবি।’

রোদ-ঝলমল কমপাউণ্ডটায় যখন বিকেলের ছায়া ঘনিয়ে এলো, তখনও বিবির ক্লাস চলছিল। একজন অধ্যাপিকা একজনই ছাত্রী। বারান্দা থেকে সরে এসে ঘরে। কফির পট আর কাজুবাদামের প্লেট মাঝখানে রেখে।

স্কুল থেকেই বিবি বরাবর তার ক্লাসের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। ডিবেট, আবৃত্তি, অভিনয়, হেড-মিসট্রেসের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করা। সব ব্যাপারেই বন্ধুরা ওকে সামনে ঠেলে দিত। স্কুল থেকে যখন কলেজে উৎরোলো, নানান অঞ্চল, জেলা, প্রদেশ থেকে আসা ছেলেমেয়েদের ভিড়ে ও ঘাবড়ায়ওনি, হারিয়েও যায়নি। খুব স্বাভাবিকভাবে প্রথম সারিতে থেকে গেছে। ফলে শুধু নিজের ক্লাস এবং কলেজের নয়, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটের অনেক ছেলেমেয়ের কাছেও ও আগ্রহের বস্তু। ওরা অনেক সময়ে খুঁজে খুঁজে ওর সঙ্গে ভাব করে। মুন্নির সঙ্গেও আলাপ এইভাবেই। কলেজ স্ট্রীট কফি-হাউসে পাশের টেবিলে সদ্য কলেজে ঢোকা মেয়েটির মুখে নকশালবাড়ির উল্লেখ শুনে অবাক হয়ে মুন্নি উঠে এসেছিল : —‘একটু বসতে পারি তোমাদের টেবিলে?’ চোখে বিস্ময়, কিছুটা সম্ভ্রম, বিবির সঙ্গী ফিসফিস করে বলেছিল—‘ইউনিভাসিটি ইউনিয়নের কালচ্যারাল সেক্রেটারি।’

—‘তুমি দেখছি বেশ খবরটবর রাখো, তোমার বয়স এবং ব্যাকগ্রাউণ্ডে ব্যাপারটা খুব স্ট্রাইকিং, তাই আলাপ করতে এলুম।’

আজ কলেজে একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। লাইব্রেরির পাশে ছোট ছোট কিউবিকলগুলোতে অনার্সের কিছু কিছু ক্লাস হয়। খুব গাম্ভীর্য এবং সম্ভ্রমের সঙ্গে পড়া চলছিল। হঠাৎ একটি ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘একটা কথা বলব সার?’

অনেকটা অবাক এবং খানিকটা বিরক্ত হয়ে অধ্যাপক বললেন—‘বলো, কিন্তু লেকচারের মাঝখানে এই সব বলাবলি আমি পছন্দ করি না। পরে বলতে পারতে।

—‘না। মানে কথাটা খুব জরুরি, প্রাসঙ্গিক···।’

—‘ঠিক আছে বলো।’

—‘আচ্ছা, এই রূপকথাটা কেন পড়ানো হচ্ছে সার? কোন মান্ধাতার আমলে এক সায়েব কতকগুলো ছ্যাবলামি আর নাকে-কান্না পাঞ্চ করে যত্ত আজগুবি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে বোতলে ভরেছিল। সেইগুলো আমাদের ভক্তিভরে গিলতে হবে? যাচ্ছলে।’

একটু একটু করে গরম হচ্ছিলেন অধ্যাপক। এবার বললেন—‘গেট আউট ফ্রম মাই ক্লাস।’

—‘অ্যায়। এইটেই আশা করছিলুম। উত্তর দিতে না পারলেই গেট আউট ফ্রম মাই ক্লাস।’

অধ্যাপক রাগটা গিলে নিয়ে বললেন—‘তুমি সাহিত্য পড়তে এসেছ, এগুলো কেন পড়তে হয় সে উত্তরটা তোমারই জানা উচিত শিবনাথ। দ্বিতীয়ত, যে মেজাজ ও ভঙ্গি নিয়ে তুমি কথা বলছ সেটা—’

—‘কেন সার। আমার মনের কথা আমি নিজের মতো করে বলতে পারব না? সাজিয়ে গুছিয়ে ধূপধুনো বেলপাতা দিয়ে শুদ্ধু করে নিতে হবে? ক্লাসরুমটা কি ঠাকুরঘর? ক্যাপিট্যালিস্ট মার্কিন দেশে পর্যন্ত ছাত্ররা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ক্লাস করে, দেদার প্রশ্ন করে, আপনাদের এই একতরফা বক্তিমে-সিসটেম হোল ওয়ার্ল্ডে কোথাও নেই।’

অধ্যাপক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—‘ঠিক আছে। আই অ্যাম গেটিং আউট।’

বিবি এই সময়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল—‘সার একটা কথা। ‘টুয়েলফ্‌থ্‌ নাইট’টা কেন পড়ানো হবে, তার উত্তরটা সত্যিই আমাদের পাওয়া দরকার।’

শিবনাথ আস্কারা পেয়ে বলল—‘বল্‌ বিবি বল্! একটা রদ্দি মাল। আমাদের বোকা পেয়ে ইউনিভার্সিটির সিলেবাস-কমিটি সেটা গছাচ্ছে। যেহেতু ইউসফুল কিছু পড়বার সুযোগ দিতে পারেনি। তারপর এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ বলবে—অ, অনার্স পাশ করে এয়েচো, তা তোমাদের শেক্সপীয়র, মিক্সমূলর তো এখানে কোনও কাজে লাগবে না চাঁদ, বিড়লা কি টাটাকে অ্যাড্রেস করে বরং বেশ করে একখানা বিজনেস লেটার লিখে ফেলো।’

অধ্যাপক বললেন—‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগোয়েজ অ্যান্ড ম্যানার্স, শিবনাথ।’

শিবনাথ বলল—‘আপনাদের শেক্‌স্‌পীয়রই তো এইরকম করে কথা বলতে আমাদের শিখিয়ে দিলেন। ওই যে আঙ্কল টোবি না কি! ওয়াক থুঃ। ওয়া ওয়া সার, শেক্‌স্‌পীয়রের বেলা আঁটিসুঁটি আর আমাদের পুওর ফেলোদের বেলাতেই খালি দাঁতকপাটি!’

শিবনাথের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে অধ্যাপক বেরিয়ে গেলেন। বাকি ছেলেরা হঠাৎ খুব খুশি হয়ে ডেস্কের ওপর প্রাণপণে তবলা বাজাতে লাগল। অপসংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি বলে একটা রব উঠল। শিবনাথ গিয়ে অধ্যাপকের চেয়ার আর টেবিল দুটো উল্টে রেখে দিল। বলল—‘এই দ্যাখ, গণেশ উল্টোচ্ছে।’

শিবনাথকে কাঁধে নিয়ে বন্ধুর দল ঘরে ঘরে ঘুরছিল এরপর। কাঁধে শিবনাথ, দরজায় টোকা, দরজা খুলতেই জোর গলায় হাঁক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি—নিপাত যাক, নিপাত যাক।’ ক্লাসের মধ্যে ঢুকে পড়ে জনে জনে ধরে ওরা বলতে লাগল—‘আর কেন, গণেশ তো উল্টেছে, বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো।’ প্রত্যেক ক্লাস থেকে কিছু কিছু ছাত্র সংগ্রহ করে পুষ্ট হয়েছিল ছাত্রদল। তারপর প্রিন্সিপ্যালের ঘরে হানা। কাঁধে শিবনাথ, ওই অদ্ভুত শোভাযাত্রা ঘরে ঢুকতে যেতেই বাধা পেল। প্রিন্সিপ্যাল বোধহয় আগেই খবর পেয়েছিলেন। বেরিয়ে এসে বললেন—‘এসব রাউডিজ্‌ম্‌ এখানে চলবে না। বাইরে গিয়ে করো। এখানে নয়।’

—‘অবশ্যই এখানে। কারণ অপসংস্কৃতিগুলো এখান থেকেই ফিট করা হচ্ছে।’

তর্কাতর্কি থেকে সামান্য উত্তেজনা ক্রমে চণ্ডাল রাগে পরিণত হল। বিবি এর অনেক আগেই ওখান থেকে সরে এসেছিল। আসলে ও কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে শিবনাথের কথায় সায় দেয়নি। সত্যি কথা বলবার সৎ-সাহস ওর চিরকালই আছে। শেক্‌স্‌পীয়রের ‘টুয়েলফ্‌থ্‌ নাইট’ সম্পর্কে ওর প্রশ্নটা একেবারে আন্তরিক। কী অর্থহীন ভাঁড়ামো, কী ই বা গল্প? কী তার প্রাসঙ্গিকতা! শিল্পের উদ্দেশ্য যদি এন্টারটেনমেন্ট হয় তাহলেই কি চারশ বছর আগেকার অশিক্ষিত জনতাকে যা খুশি করতে পারত, সেই মিউজিয়াম-পীস সাহিত্য হিসেবে প্রাসঙ্গিক? পড়ে তো রিসার্চস্কলাররা পড়ুক গিয়ে! আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছাত্রদের সিলেবাসে জিনিসটা একেবারেই অচল। ক্লাসের ছেলেরা এই সুযোগে ওকে হিরোইন বানাতে চাইছিল। পারলে, শিবনাথের মতোই কাঁধে তুলে নেয়। বেগতিক দেখে ও বড় বড় পা ফেলে ইউনিভার্সিটির দিকে চলে গিয়েছিল। মুন্নিদির সঙ্গে পাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

এসপ্লানেড ট্রামগুমটির মাথায় মাথায় বিকেলের শেষ আলোটুকু সরে গেল। বিবি বলল—‘এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি, মুন্নিদি?’

মুন্নি বলল—‘অ্যামহার্স্ট স্ট্রীটের কাছে। বউবাজারের ট্রাম ধরব। তোর বাড়ির কাছে হবে, টুক করে চলে যাবি। তোর কি ভয় করছে?’

—‘ভয়?’ বিবি হাসল।

—‘আমিও তাই ভেবেছিলুম। ভীতু হলে কি আর এতো কাণ্ড করতে পারতিস?’

—‘আমি কিন্তু কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করিনি। কোনদিন রাজনীতি করার অভিজ্ঞতাও নেই, মুন্নিদি।’

—‘শুনে রাখ বিবি। অভিজ্ঞতা আমারও ছিল না। আমি যে কলেজে পড়েছি সেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর ন্যাকা ন্যাকা হিরোইন তৈরি হয়, কথায় কথায় যারা চোখ বড় বড় করে হাসতে শেখে, ছলে বলে কৌশলে শাঁসালো বর যোগাড় করাই যাদের শিক্ষা-দীক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য। সেই আবহাওয়া থেকে এসে আমি যদি পারি, তো তুই পারবি না কেন?’

সরু গলির মধ্যে আবর্জনার দুর্গন্ধ। বাজারের ভিড়, নোংরা, স্টেশনের ভিড় ঘেয়ো কুকুর, কেঁদো বেড়াল। গলির একটু ভেতরে ঢুকতেই কিন্তু শুনশান। বোধহয় গত শতাব্দীর বাড়ি। ভেঙে ভেঙে পড়ছে। মানুষ থাকে কি না বোঝা গেল না। বিজলি নেই। নিচের তলায় একটা খুপরি জানলা দিয়ে অল্প আলো আসছে। ভেজানো দরজা ঠেলে ওরা ঢুকল। গোটা তিন চার লণ্ঠন জ্বলছে। দু একজনের বেশি কেউ মুখ ফিরিয়ে তাকাল না। ঘর-ভর্তি। কয়েকটা চেনা মুখ। মেয়ে অল্পই। ছেলে বেশির ভাগ। কাউকে কাউকে কফি হাউসে, ইউনিভার্সিটির লনে, কলেজের করিডরে দেখেছে। এক ইন্দ্রদা ছাড়া কারো সঙ্গে সোজাসুজি আলাপ নেই। সকলেই চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে কিছু পড়ছে। মুন্নিদি বলল—‘ওরা বোধহয় ‘লিবারেশন’-এর যে সংখ্যাগুলো হাতে পেয়েছে, পড়ে নিচ্ছে।’ কেউ একজন মুন্নিদিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিল।

আধো-অন্ধকারে একটা গম্ভীর গলা। ঘরের ও প্রান্তে একজন উঠে দাঁড়িয়েছে : ‘কমরেড, আমরা আজ এক মহান যুগসন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি। বহুশতাব্দীব্যাপী ক্যাপিটালিস্ট রাজ আজ শেষ হতে চলেছে। এ শুধু ‘পীপলস ডেলি’ বর্ণিত বসন্তকালীন বজ্রের গর্জন নয়। নকশালবাড়ির লাল সম্ভাবনাকে আজ আমরা এ শহরের বুকের ওপর রূপ দিতে চলেছি। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ আমাদের হাতে যে ঝুটো আজাদি তুলে দিয়ে গেছে তার ফলস্বরূপ আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চক্রের দাসত্ব করতে করতে আমাদের শৃঙ্খলিত বাইশ বছর কেটে গেছে। এখন আমাদের শোষক তালিকায় আরও যুক্ত হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং সোভিয়েত-সোশ্যালিস্ট-সাম্রাজ্যবাদ। ভারতবর্ষের পাঁচশ কোটি মানুষ এখন নিষ্ঠুরতম অত্যাচার ও শোষণের হাতে অসহায় বলির পশু। রুজিহীন, নিরাশ্রয়, নিঃস্ব, নিরন্ন।

‘আমাদের সামনে এখন একটাই পথ—চীনের পথ। আমাদের হাতে এখন একটাই হাতিয়ার—চীনের হাতিয়ার। যে নেতারা শোধনবাদের পথে বুর্জোয়া-শক্তির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছেন, আমরা তাঁদের বর্জন করি। কমরেড লিন-পিয়াওয়ের মতে একমাত্র গেরিলা-যুদ্ধই ভারতের কোটি কোটি মানুষের আত্মশক্তি জাগ্রত করে তাদের দিয়ে অসাধ্যসাধন করাতে পারে। জনগণকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো ক্ষিপ্র, ভয়াল। কোনও শক্তির সাধ্য থাকবে না তার অগ্রগতিকে রোধ করে। আমাদের লক্ষ্য হবে গ্রামে, শহরে, মফঃস্বলে ছোট ছোট মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি করে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামকে ক্রমশ জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে পীপল্‌স্ লিবারেশন আর্মি তৈরি হতে পারে। শ্রেণিশত্রুদের ঘায়েল করে এই পীপল্‌স্‌ আর্মিই ছুঁড়ে ফেলে দেবে প্রতিক্রিয়াশীল এই শাসনব্যবস্থাকে। প্রতিষ্ঠিত করবে কিষাণ-মজদুরের স্বরাজ।

‘মনে রাখতে হবে বিপ্লবের পথ রক্তে পিচ্ছিল। ভুলে গেলে চলবে না ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক রীতিতে শিক্ষিত পুলিশ সম্প্রদায় আজও আমাদের নিরাপত্তার দখলদার। ভুলে গেলে চলবে না, সামান্যতম অজুহাতে তারা কী অত্যাচার আমাদের ওপর চালাতে প্রস্তুত। ছেষট্টি সালের খাদ্য-আন্দোলনের কথা স্মরণ করুন। সাতষট্টি সালে ইডেন গার্ডেনে দর্শকদের ওপর পুলিসি হামলার কথা স্মরণ করুন। তার কিছুদিন আগে ঊনষাট সালে গ্রামাঞ্চলের লোক কতকগুলো দাবি-দাওয়া নিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে এলে আশি জন নিরস্ত্র চাষীকে ওরা মেরে ফেলে। এই পুলিসবাহিনীর মোকাবিলা করবার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

‘কমরেড, আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলুন “বন্দুকের নলই—”।’

ঘরের মধ্যে যেন মেঘগর্জন হল—‘শক্তির উৎস।’ ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’—‘নিপাত যাক।’ ‘চীনের চেয়ারম্যান’—‘আমাদের চেয়ারম্যান।’ ‘নকশাল বাড়ি’—‘লাল সেলাম।’

পাশাপাশি ফিরে যাচ্ছে দুজনে। মুন্নিদি একটাও কথা বলছে না। অন্ধকারে ওর মুখের আদল চিন্তামগ্ন, গম্ভীর। হঠাৎ একটা হাওয়ার মতো উঠল। আকাশের এ প্রান্ত নীল, ওদিকে বিশাল মেঘ। পেছন থেকে কে ডাকল—‘মুন্নি!’

মুন্নিদি দমদেওয়া পুতুলের মতো থেমে গেল। পেছনের স্বর পাশে এসে দাঁড়ালে বিনা ভূমিকায় মুন্নিদি বলল—‘বিবি, অন্তুদার সঙ্গে আলাপ কর।’ তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে বিবির কাছ থেকে অনেক দূর।

বিবি দেখল ক্ষুরধার একটা তরোয়াল। অন্ধকারে দুর্মূল্য ধাতু চমকাচ্ছে। স্থির একটা বিদ্যুতের রেখা নিমেষের মধ্যে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

—‘তোমার মনে অনেক প্রশ্ন, মুন্নি বলছিল।’

বিবি চুপ।

—‘বুদ্ধিমানরাই প্রশ্ন করে। সংশয়ীরা সাধারণত বুদ্ধিমান হয়।’

বিবি সাগ্রহে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল—‘আমার প্রশ্নগুলোর আপনি জবাব দেবেন?’

জলদ গম্ভীর স্বরে জবাব এলো—‘না।’

বিবি চমকে তাকাল। পাশের মুখ ভাবলেশহীন।

আলোকিত কলেজ স্ট্রীট। অনেক রাস্তা হাঁটা। ঝড় উঠছে, উঠল। চোখে-মুখে ধুলোর ঝাপটা। ট্রাম-বাসের চেহারা অস্পষ্ট।

—‘তোমার ট্রাম আসছে বিবি, উঠে পড়ো। এক একটা সময় আসে যখন প্রশ্ন করার সময় থাকে না। জবাব দেবারও না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *