৩০. লালমুখো সাহেবটা

৩০

লালমুখো সাহেবটা চিৎকার করে কিছু একটা আদেশ করা মাত্র ময়লা খেটো ধুতি পরা দেশীয় লোকটা ছুটতে ছুটতে এদিকে এগিয়ে এল। সে অনেককাল আছে এখানে, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে দোভাষীর কাজ করে থাকে। তার নাম ইসমাইল।

ইসমাইল বলল, ‘হেঁইয়ো! ওরা তেড়ে এলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। লাঠি তো রয়েইচে, তেমন বুঝলে কাটারি দিয়ে একেবারে দু-টুকরো করে দেবে। ডরাবে না। সাহেব আচেন তোমাদের সঙ্গে।’

কথাটা শুনে শ্রমিকের দল মাথায় কষে ফেট্টি বেঁধে লাঠি হাতে অপেক্ষা করতে লাগল।

চুক্তিনামার শ্রমিক আমদানি শুরুর পর থেকে এদেশে সাহেবদের দল ভারী হতে শুরু করেছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভোলও বদলে গিয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনে কয়েকমাস আগেও যে কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে কাজ করার জন্য তারা অনুরোধ করেছিল, এখন মাঝে মাঝেই তাদের একটা করে খেত অন্যায়ভাবে দখল করে ফেলছে নিজের শ্রমিকদের দিয়ে।

আজও তেমনই এক দিন। রোদ ঝলমলে সকালে প্রায় চারক্রোশ হাঁটিয়ে কৃষ্ণসুন্দরদের প্রায় পঞ্চাশজনকে নিয়ে আসা হয়েছে চোখ জুড়নো এক সবুজ খেতে। এটা কৃষ্ণাঙ্গদের খেত, সবে গর্ত খোঁড়া হয়েছে আখ বসানোর জন্য। পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে ছোট্ট এক নদী। সেই নদীর জল এতটাই স্বচ্ছ, যে রোদের আলোয় ঝলমল করছে।

নদীর ওপারে কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রাম। সেখানকার ছোট ছোট মাটির বাড়িগুলো দূর থেকে খেলনাবাটির মতো দেখাচ্ছে। বাড়িগুলোর সামনের সবুজ ঘাসে চরছে গরুছাগল। মেয়েরা উবু হয়ে বসে কাজ করছে। কারুর কোলে শিশু। তাদের পরনে বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত আবৃত পোশাক। মাথায় মোটা করে বাঁধা কাপড়।

কৃষ্ণসুন্দরদের খামারমালিক মুন সাহেবের স্পষ্ট আদেশ, যত দ্রুত সম্ভব সব গর্তে বীজ ছড়িয়ে খেতটা দখল করে নিতে হবে। বীজ ছড়িয়ে দু’দিকে মুন সাহেবের নিশানা পুঁতে কয়েকজন শ্রমিককে এখানে পাহারাদার করিয়ে দিলেই কাজ হাসিল।

কৃষ্ণসুন্দর বলাইকে বললেন, ‘কিন্তু এটা তো অন্যায়! ওদের পরিশ্রমের খেত আমরা দখল করব কেন? ওদের তবে চলবে কী করে? এমনিতেই তো ওরা খুব কষ্টে থাকে শুনেছি! আর তাছাড়া এই দেশটা তো ওদেরই। সাহেবরাই বরং জোর করে দখল করেছে।’

‘ওইসব নীতিকথা শুনায়ে লাভ নাই ঠাউরমশাই। এখানে জোর যার মুলুক তার। অ্যাদ্দিন সাহেবরা দলে কমজোরি ছিল, চুপচাপ ছিল, যেই আমরা এসে পড়ছি, অমনি তারা ঝাঁপায়ে পড়ছে।’ বলাই মাথা দোলাল।

কৃষ্ণসুন্দর কিছু বলার আগেই দূরে ক্যানেস্তারার আওয়াজ শোনা গেল। নদীর ওপারের মানুষগুলো টের পেয়ে গেছে এই লুণ্ঠন। নদী বরাবর কিছুদূর হাঁটলে একটা গাছ কেটে বানানো সেতু আছে, সেখান দিয়েই তারা আসা-যাওয়া করে। কিন্তু এখন আর সেই সময়টুকুও তারা অপচয় করছে না।

ঝপাঝপ নদীর ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে তারা। তাদের ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় গ্রাম্য ধুতি পরার আদলে জড়ানো। প্রাণপণ সাঁতরানোর পাশাপাশি অজানা ভাষায় তারা চিৎকার করে চলেছে অবিরত।

ইসমাইলের নেতৃত্বে এদিকের দলের সবাই সেনাবাহিনীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পাড়ে এসে ওঠা মাত্র লাঠি দিয়ে আঘাত করা শুরু হবে।

কিছুটা দূরে নিজের ঘোড়ার পিঠে বসে গোটা ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করছেন খামারমালিক মুন সাহেব। তাঁর মুখে জ্বলন্ত চুরুট, হাতে চাবুক। মাঝে মাঝেই তিনি ইংরেজিতে চিৎকার করে উঠছেন।

ইসমাইল উদাত্ত গলায় বলে যাচ্ছিল, ‘জান লইড়া দিবা। ইসব কালো মানুষগুলানরে এক্কেরে শ্যাস কইরা ফেলতি হবে। বুইলা তো? ভয় পাবা না।’

লোকগুলো যখন পাড়ে উঠব উঠব করছে, কৃষ্ণসুন্দর দেখতে পেলেন, সর্বাগ্রে একটা কালো দশাসই মানুষ, অন্যরা দীর্ঘদেহী, কিন্তু এর চেহারার কাছে তারা কিছুই নয়।

তিনি কিছু প্রশ্ন করার আগেই বলাই চাপা স্বরে বলল, ‘ওই লোকটার নাম ওলবা। ওদের সর্দার। একটা আস্ত দৈত্য ঠাকুরমশাই। ওর কাছাকাছি যাবেন না!’

ওলবা অত বড় চেহারার হয়েও অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে পাড়ে উঠল। তার প্রকাণ্ড শরীরটা যেন লোহার মতো শক্ত, সেখানে নানাস্থানে পুরনো আঘাতের ক্ষতচিহ্ন। একঝলক দেখলে মনে হয় সে কোনো প্রাচীন উপকথার পৃষ্ঠা থেকে উঠে এসেছে।

বিকট শব্দে ওলবা চিৎকার করে উঠল। তারপর সবাইকে নিয়ে ছুটে আসতে লাগল এদিকে। সব মিলিয়ে প্রায় চোদ্দ-পনেরো জন লোক।

কৃষ্ণসুন্দর চিৎকার করে উঠলেন, ‘দাঁড়াও! কেউ এগোবে না।’

আজকের দলের প্রায় সবাই বাঙালি, তাই সবাই থমকে তাকাল তাঁর দিকে।

বলাই ফিসফিস করে বলল, ‘কী করতাছেন ঠাকুরমশাই। থামেন! মুন সাহেব রাগী মানুষ, বাছবিচার করেন না! আপনার ইজ্জত সামলে রাখেন।’

কৃষ্ণসুন্দর বলাইয়ের কথায় ভ্রুক্ষেপ করলেন না। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তীক্ষ্নকণ্ঠে বললেন, ‘আমরা কেউ এগোব না। আমরা এখানে চাষ করতে এসেছি। লড়াই করতে নয়। ওরাও চাষি, আমরাও চাষি!’

দলের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল। মুন সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কিছুটা দূরে, তাই তাঁর কাছে এই কথা তর্জমা করে এখনো পৌঁছয়নি।

পরেশ কৈবর্ত আর তোতারাম চিরকাল কৃষ্ণসুন্দরকে সাথ দিয়ে এসেছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।

পরেশ কৈবর্ত বলল, ‘ঠিকই তো। আমরা শ্রমিক। আমরা খেয়োখেয়ি করব কেনে? তারা তো আমাটো জমিতে হাত দেয় লাই। তবে আমরা কেনে দিব?’

‘এটা অন্যায়। আমাদের চুক্তিতে কোথাও লেখা ছিল না যে এইভাবে অন্যের জমির দখল নিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। আমরা ক্ষেতে কাজ করবো, মজুরি পাব। ব্যস!’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘সবাই ফিরে চলো আমাদের খেতে।’

দলের সবাই চুপ করে দেখছে। প্রত্যেকেরই মনে ভয়। প্রহারের ভয়। একটু দূরের কোঠায় রেখে আসা বাড়ির মেয়ে বউদের সম্মানহানির ভয়। প্রাণনাশের ভয়।

তবু একজন ভাঙা গলায় বলল, ‘ঠাকুরমশাই হক কথা বলতাসেন। আগেরবারও আমরা মিছিমিছি মারামারি করছিলাম। শুধুশুধু ওদের শত্তুর বানিয়ে কী লাভ আমাদের?’

পাশের জন সামান্য ঘাড় হেলিয়ে তাকে সমর্থন করল।

ধীরে ধীরে একটা মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তে লাগল দলটার মধ্যে। সবার বিবেক, নীতিবোধ, মূল্যবোধ যেন জাগ্রত হয়ে উঠছে খুব মৃদু লয়ে।

ইসমাইল বলে দোভাষীটা এতই বিস্মিত হয়ে গিয়েছে যে সে তার সাহেবের কর্ণকুহরে কথাটা পৌঁছনোর গুরুদায়িত্বটুকুও সম্ভবত বিস্মৃত হয়েছে।

ওলবা বলে ওদের নেতাটা আড়াআড়ি হাত মুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখেও দ্বিধা। সে আক্রমণের প্রত্যাশা করছিল, তা না ঘটতে বোধ হয় সে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ।

কৃষ্ণসুন্দর আবার বললেন, ‘চলো। আমরা ফিরে যাই নিজেদের জমিতে। সেখানে দিনের শেষে নব্বইটা গর্ত না হলে তখন আবার চাবুক খেতে হবে।’

সবাই সচকিত হয়ে উঠল। তাই তো! এইদিকটা তো কেউ ভেবে দেখেনি! কী হবে এখানে সময় অপচয় করে?

কৃষ্ণসুন্দরের পেছন পেছন দলটা ফিরে যেতে লাগল।

মুন সাহেব এখন কিছুটা বোধ হয় আন্দাজ করেছেন, তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হেই! হোয়াট ইজ গোইং অন? গো অ্যাটাক দেম!’

ইসমাইল সম্বিত ফিরে পেয়ে ছুটে গেল প্রভুর দিকে। বুঝিয়ে বলতে লাগল সবকিছু।

কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। ভারত থেকে আসা একদল প্রতারিত শ্রমিকের দল দ্রুতপদে হেঁটে চলেছে মাঠ বেয়ে। তারা অন্যের জমি অন্যায়ভাবে অধিকার করবে না।

ওলবা বলে লোকটা কোমরে হাত দিয়ে সবটা দেখছিল। দৃষ্টিপথের বাইরে যাওয়ার আগে কৃষ্ণসুন্দর একবার তাকালেন তার দিকে।

চোখাচোখি হতে তিনি হাসলেন।

ওলবা নিষ্প্রাণ মাছের মতো তাকিয়ে রইল এই দুর্বোধ্য ভিনদেশীর দিকে।

কৃষ্ণসুন্দর মুখে কিছু বললেন না। কেউ কারুর ভাষা বুঝবে না। তিনি ডান হাতটা শূন্যে দু’বার নাড়িয়ে হাসলেন।

ওদিকে মুন সাহেবের তর্জন গর্জন চলছে। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারছে না। এখানে ওভারসিয়াররা আসেনি, তারা অন্য শ্রমিকদের কাজ দেখভালে ব্যস্ত, এখানে মুন সাহেব আর ইসমাইল শুধু দুজন।

ওলবা তার গ্রীক দেবতার মতো শরীর নিয়ে আরো কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল কৃষ্ণসুন্দরের দিকে।

অনেকক্ষণ পর তার খয়েরি পুরু ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠল সামান্য হাসি।

তার ডান হাত নাড়া দেখতে দেখতে কৃষ্ণসুন্দর হেঁটে চললেন।

৩১

চৈত্রমাসের শুক্লা অষ্টমী। মেঘমুক্ত রোদঝলমলে আকাশ। এখনো সেভাবে গ্রীষ্মের প্রকোপ বাড়েনি। দত্তবাড়ির ঠাকুরদালানে বাড়ির দেড়মানুষ উঁচু প্রাচীরের গায়ে যে লম্বা আমগাছটা রয়েছে, তাতে এরমধ্যেই আমের মুকুল উঁকি দিচ্ছে।

আজ নবকিশোর দত্তের বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজো। সকাল থেকে ঢাক ঢোল কাঁসরঘণ্টার ধ্বনিতে বাড়ির ঠাকুরদালান মুখরিত হয়ে উঠেছে। উমাতারা, পরেশমণি ও বাড়ির অন্যান্য এয়োস্ত্রী রমণীরা পুজোর জোগাড় করছে দালানে বসে। পরিচারিকারা হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে প্রয়োজনীয় উপাচার।

দয়াময়ীর শরীর ভালো নেই। সে তাই নীচে নামেনি। সে ইদানীং সবসময়েই অসুস্থ থাকে। তাই বাড়ির বড়বউয়ের অনুপস্থিতি সবার কাছে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।

বৈঠকখানার ঘরে বসে ধনঞ্জয় পণ্ডিত চুপচাপ গড়গড়ায় তামাক সেবন করছিলেন। তাঁর তামাকপ্রীতি সুবিদিত, তাঁর নিয়মিত আগমনের পর থেকেই দত্তবাড়িতে তামাকের প্রতি মনোযোগ বেড়েছে।

নবকিশোর দত্তের নির্দেশে এখন দত্তবাড়িতে তামাক পাতা আসে বিহার থেকে। উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্নৌ, জৌনপুর, গাজিপুর থেকে আসে সুগন্ধি তেল, আতর, জল। সুগন্ধি মশলা অবশ্য কলকাতারই।

সেই তামাকপাতা বাড়ির পেছনের ঢেঁকিতে কুটে চালুনিতে চেলে গুঁড়ো করা হয়। তারপর সেই তামাকগুঁড়োয় মেশানো হয় গুড়, লবঙ্গ, এলাচ, জায়ফল, সুগন্ধী তেল, আর নানারকম মশলা। তারপর সেই মণ্ডকে ভালো করে চটকে তৈরি করা হয় তামাক।

বৈঠকখানা ঘরের বাইরে এক কোণে বাদলের মা উবু হয়ে বসে সেই মণ্ড পাকিয়ে পাকিয়ে মোলায়েম করছিল। তার হাতে তামাক মাখনের মতো মোলায়েম হয়ে ওঠে, তাই ধনঞ্জয় পণ্ডিতের তামাকের জন্য তাকেই অন্দরমহল থেকে প্রতিবার নিয়ে আসা হয়।

নবকিশোর হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে ঢুকে বললেন, ‘পণ্ডিতমশাই, ভালো খবর আচে। নতুন বউ গেল হপ্তায় ঋতুমতী হয়েচে।’

‘সে তো জানা কথাই।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন, ‘ওকে দেখেই বুঝেছিলাম যে বেশি দেরি নেই। দিদির মতো সে রোগাভোগা নয়, উন্নত গড়ন স্বাস্থ্যবতী। তাই তো তড়িঘড়ি বিয়েটা দিলাম।’

নবকিশোর উল্লসিতচোখে বললেন, ‘এবার যদি আজ্ঞা করেন একটা ভালো দিনক্ষণ দেখে …।’

ধনঞ্জয় পণ্ডিত ডান হাতটা তুললেন, ‘না। একেবারেই না। সেই বিষয়েই কথা বলতে এসেছি।’ কথাটা বলেই ইঙ্গিত করলেন, ‘দোরটা ভেজিয়ে দিন।’

গণেশ যুক্তকরে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল। নবকিশোরের চক্ষুহেলনমাত্র সে দ্রুতপদে গিয়ে বৈঠকখানার দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তারপর নিজে ওখানেই দাঁড়াল দ্বাররক্ষীর মতো।

ঘরের মধ্যে স্থবির নিষ্প্রাণ আসবাব, নবকিশোর আর ধনঞ্জয় ছাড়া কেউ নেই।

শুধু সবার অলক্ষে দক্ষিণের জানলার ওপাশে বসে তামাক পাকানো বাদলের মা’র কানদুটো উৎকর্ণ হয়ে উঠল।

‘দেখুন দত্তমশাই, আমি সোজা কথা সোজাভাবে বলতে পছন্দ করি।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন, ‘আমার মনে হয় আপনার উৎপাদনক্ষমতা যদি কোনোকালে থেকেও থাকে, তা এতদিনে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নাহলে আপনার চার পত্নীরই বন্ধ্যা হওয়াটা সম্ভব নয়।’

তেল ফুরনো প্রদীপের মতো নবকিশোর দত্তের গোলগাল চকচকে মুখখানা দপ করে নিভে গেল। তিনি বললেন, ‘অ্যাঁ ! তবে যে আপনার কথায় এত কাণ্ড করে বে করলুম?’

‘ধনঞ্জয় পণ্ডিত অকারণে কাউকে কিছু করার নির্দেশ দেয়না দত্তমশাই। আপনার উৎপাদন ক্ষমতা না থাক, লুপ্তপিন্ডোদক হওয়ার ভয় আপনার থাকবে না। পুত্রসন্তানের পিতা আপনি হবেন।’

নবকিশোর দত্তর মুখে আর কথা সরে না। এ কী হেঁয়ালি করছেন ধনাপণ্ডিত। পরাগরেণুর সক্রিয়তা ছাড়া কি গাছে অঙ্কুরোগ্মম হয়?

নবকিশোর দত্তকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন, ‘আপনাকে বিনিয়োগ প্রথার সাহায্য নিতে হবে। একমাত্র ক্ষেত্রজ পুত্রই আপনাকে নরকবাস থেকে বাঁচাতে পারে। আপনার হয়ে কোনো সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণ আপনার স্ত্রীর গর্ভে বীজস্থাপন করবেন।’

ধনঞ্জয়পণ্ডিত আরো ব্যাখ্যা করলেন, ‘বজ্রাহত হবেন না। এই বিনিয়োগ প্রথার মাধ্যমে ক্ষেত্রজপুত্র লাভ শাস্ত্রসিদ্ধ। মহাভারতে পাণ্ডবরা সকলেই ছিলেন ক্ষেত্রজ পুত্র। স্বামী পাণ্ডুর অনুমতিক্রমে কুন্তী বিভিন্ন দেবতার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। এছাড়াও পুরাণে বিভিন্ন কাহিনিতে রাজারা নিজেদের অক্ষমতা মেটাতে অর্থের বিনিময়ে গুণবান ব্রাহ্মণকে বিনিয়োগ করতেন।’

নবকিশোর দত্ত স্বকর্ণে শুনেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি বৈষয়িক মানুষ, শাস্ত্র অধ্যয়ন করেননি। কিন্তু নিজের পত্নীর সঙ্গে অন্য কেউ মিলিত হবেন, এ তো চিন্তারও অতীত! ঘরের বউ অন্যের সঙ্গে শোবে, ঘরেরও তো অকল্যাণ হবে।

পণ্ডিতমহাশয়ের কথা অনুযায়ী কুন্তীর মতো সতীসাধ্বী স্ত্রী এইভাবে পুত্র উৎপাদন করেছিলেন?

তিনি অস্ফুটে বললেন, ‘কিন্তু সেই পুত্র তো আমার প্রকৃত পুত্র হবে না!’

ধনাপণ্ডিত মৃদু হেসে বললেন, ‘ক্ষেত্রজ পুত্র শাস্ত্রবলে আপনারই হবে দত্তমশাই! মন্ত্রবলে তাকে আপনার করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিন। সে আপনার মুখাগ্নিলাভেরও অধিকারপ্রাপ্ত হবে। যুগে যুগেই এই বিনিয়োগ প্রথা চলে আসছে। আর প্রকৃত পুত্রের সংজ্ঞা তো চাণক্য দিয়ে গিয়েছেন। পিত্রোরাজ্ঞানুসারী স্যাৎ সুপুত্রঃ কুল পাবনঃ। যে পিতার আদেশ পালন করেন, সে-ই হল প্রকৃত সুপুত্র। তার দ্বারাই বংশ গৌরবান্বিত হয়। সে ঔরসজাতই হোক বা ক্ষেত্রজ। আর আপনার স্ত্রী যেমন পবিত্র ছিলেন, তেমনই থাকবেন।’

নবকিশোর দত্ত কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোড়হাতে বললেন, ‘যদি অভয় দেন তো একটা কথা নিবেদন করি আপনার চরণে পণ্ডিতমশাই।’

ধনঞ্জয় পণ্ডিত সামান্য মস্তকহেলনে সম্মতি দিলে নবকিশোর বললেন, ‘তবে আপনিই সেই দায়ভার গ্রহণ করুন পণ্ডিতমশাই। আপনার চেয়ে সদ্বংশজাত উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ আর কে আছে!’

‘সে দেখা যাবে।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন, ‘আপাতত আপনাদের জগন্নাথধামে যেতে হবে। সেখানে আমার একটি আশ্রম আছে। এইসব গুহ্য ব্যাপার এই ম্লেচ্ছশহরে বসে হয় না। যাদের কোনোভাবেই পুত্রলাভ হয় না, তাদের শেষ ভরসা আমার ওই আশ্রম। সেখানে সপত্নী আপনার উপস্থিতিতে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন করব আমি। প্রণামী এবং অন্যান্য উপাচার যা লাগবে, আমার সহকারী আপনাকে সেই তালিকা দিয়ে দেবে।’

‘জগন্নাথধাম? মানে পুরী?’ নবকিশোর দত্ত ভ্রু কুঞ্চিত করলেন, ‘পঞ্চম পক্ষকে নিয়ে আমায় এখন ওখানে যেতে হবে?’

‘হ্যাঁ । ভয় নেই। আমিও আমার লোকলস্করসহ যাব আপনাদের সঙ্গে।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন।

‘কিন্তু সে তো বহুদিনের পথ! মেদিনীপুরের ঘন জঙ্গল পার হয়ে যেতে হয় শুনিচি। পালকি করে গেলেও সে পথে অনেক বিপদ। নতুন বউ কি পারবে?’

ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন, ‘ও পথে যাবেন কেন? চাঁদপাল ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়ে কটক যাওয়ার। অনেক কম সময়ে এবং আরামে পৌঁছনো যাবে। তারপর সেখান থেকে পদব্রজে জগন্নাথধাম। আপনাদের জন্য পালকি থাকবে। আমার আশ্রমের সঙ্গে লাগোয়া অতিথি আবাসও রয়েছে। সেখানেই আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে।’

নবকিশোর দত্ত চুপ করে ভাবছিলেন। এই তবে ধনঞ্জয় পণ্ডিতের প্রকৃত নিদান? যজ্ঞ-টজ্ঞ সবই বাজে কথা তবে? আসল ওই বিনিয়োগ প্রথা?

‘আর হ্যাঁ , পুত্রেষ্টি যজ্ঞ কিন্তু সম্পন্ন করতে হয় অত্যন্ত গোপনে। খেয়াল রাখবেন, কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত সতর্কভাবে বললেন।

‘সে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পণ্ডিতমশাই।’ নবকিশোর বললেন, ”কিন্তু জাহাজে করে যাবে বাড়ির বউ? আর কটক পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে আবার হাঁটাপথ কেন? সরাসরি পুরীতে জাহাজ যাবে না?’

‘আপনি দেখছি এসবের খবর কিছুই রাখেন না দত্তমশাই। পুরী সমুদ্রতীরে বটে, কিন্তু সেখানে কোনো বন্দর নেই। জাহাজ নোঙর করা যায় না ওখানে। তাই কটকের বন্দরে নেমে সেখান থেকে একাম্রকানন, সাক্ষীগোপাল, কমলপুর হয়ে পৌঁছতে হয় শ্রীক্ষেত্রে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। মা জননীর জন্য সেখানে উপযুক্ত শিবিকা হাজির থাকবে। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ উত্তমভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর আমার পরিচিত ভালো পাণ্ডা আছে, জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরতে পারবেন।’

‘কতদিন লাগবে?’ নবকিশোর জিগ্যেস করলেন।

‘এভাবে নির্দিষ্ট করে তো কিছু বলা সম্ভব নয়! তবে ধরে রাখুন তিনমাস। তার কমে হবে না।’

 বাদলের মায়ের তামাকের মণ্ড পাকানো হয়ে গিয়েছিল। সে মার্জারপায়ে উঠে চলে গেল অন্দরমহলের দিকে।

নবাব যখন তাঁর কিংখাবে মোড়া পালকিতে চেপে সুলতানখানার সামনে এসে পৌঁছলেন, তখন মধ্যরাত। মেটিয়াবুরুজ আলোয় ঝলমল করলেও নিদ্রায় তাঁর চোখ ধীরে ধীরে জুড়ে আসছে।

নবাবের পালকির একেবারে পেছনেই ঘোড়ায় চড়ে আসছিল আসগর আলী ও খুশনবিস হাফিজ নুরুল্লা।

কাহাররা পালকি ভূতলে নামানো মাত্র তারা গিয়ে স্ফিতবপু নবাবকে নীচে নামাতে লাগল। নবাবের আজকাল হাঁটুতে বড় ব্যথা, পালকি থেকে নামতে কষ্ট হয়।

নবাব নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাঁপালেন। দিনদিন তাঁর শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দিনে দু-বেলা হাকিম আসেন। হাজাররকম দাওয়াই। কিন্তু কিছুই সুবিধা হচ্ছে না। বুকের ব্যথাটা দিনদিন বাড়ছে। আজকাল সামান্য পরিশ্রমেও তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

কিছুক্ষণ পর সুস্থবোধ করতে তিনি ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন দরজার দিকে।

হাফিজ নুরুল্লা নবাবের পাশে পাশে চলছিল, ‘আজ উয়ো উস্তাদনে মাত কর দিয়া মজলিশ, হ্যায় না হুজুর?’

আসগর আলী বলল, ‘উয়ো তো বহতই বড়া কলাকার হ্যায়। পেহলে ভি আয়া থা। তব তু নেহি থা। শায়েদ পয়দা ভি নেহি হুয়া।’

হাফিজ নুরুল্লা কপট রাগ করে বলল, ‘হাঁ, তেরে জ্যায়সা বুঢঢা থোড়ি না হু। এমনভাবে বলছিস যেন তুই এখানে একদম শুরুয়াতসে রয়েছিস।’

‘আমাকে তো শুরুয়াতসে থাকতেই হবে, নইলে খোদাবন্দের তহবিলের হিসেব কে রাখবে?’ আসগর আলী তর্ক জুড়ল।

অন্যসময় নবাব কর্মচারীদের এইসব লঘু কথোপকথনে যোগ দেন। যখন তিনি অযোধ্যার নবাব ছিলেন, তখনও তাঁর মধ্যে নবাবসুলভ আত্মম্ভরিতা ছিল না, আজও নেই। তেমন গুণী সঙ্গীতশিল্পী হলে তিনি নিজে উঠে দাঁড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন, তারপর সসম্মানে তাঁকে বসিয়েছেন নিজের পাশে, এমন নজিরও রয়েছে ভুরি ভুরি। শিল্পের স্থান তাঁর কাছে সবার ওপরে।

কিন্তু আজ তাঁর মেজাজ কিছুটা গম্ভীর। আজ পূর্ণিমার রাত, শাহ মঞ্জিলে বড় জলসা বসেছিল। আসরে মুরাদ আলী, সাজ্জাদ মহম্মদের মতো সঙ্গীতজ্ঞ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন যদুভট্ট। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নামী গায়ক যদুভট্টকে নবাব খুবই পছন্দ করেন। এর আগেও তিনি এসেছেন মেটিয়াবুরুজে। অন্যবারের মতো আজও গভীররাত পর্যন্ত তাঁর অসাধারণ সুরমূর্ছনায় মুগ্ধ করেছেন শ্রোতাদের।

তারপর নবাবের জুড়িগাড়ি তাঁকে সাদরে নিয়ে রওনা দিয়েছে জোড়াসাঁকোর দিকে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আগে সঙ্গীতশিক্ষক ছিলেন যদুভট্ট, আজও তিনি সেখানেই রাত্রিবাস করবেন।

জলসা যতক্ষণ চলেছে, ততক্ষণও নবাব বেশ গম্ভীর ছিলেন। বেচাল কিছু না করলেও খুব বেশি উৎফুল্ল ছিলেন না তিনি, মনে পড়ল আসগর আলীর।

সে বলল, ‘জাহাঁপনা, আপনার কি আজকের গানা পসন্দ হয়নি?’

হাফিজ নুরুল্লা সামান্য আগেই যদুভট্টের গুণকীর্তন করছিল, এখন সহসা সে ঘুরে গেল। বলল, ‘আমি তো সেটাই বলছিলাম। ভট্টজি বুঢঢা হো গয়া! আচ্ছা নেহি গায়া।’

নবাব কোনো উত্তর দেন না। চুপচাপ হাঁটতে থাকেন অন্দরমহলের দিকে।

সুলতানখানার দ্বিতলে পৌঁছে নিজের প্রকাণ্ড শয়নকক্ষে ঢোকার পূর্বমুহূর্তে বলেন, ‘হাফিজ, ওই চন্দরনাথ কোথায় গেল, পতা হ্যায় তুঝকো?’

‘চন্দ্রনাথ?’ হাফিজ নুরুল্লা বিস্মিত।

‘হ্যাঁ । যে তোর সঙ্গে ছাদে বসে আমার জীবনের কথা লিখত, সেই চন্দরনাথ।’

‘সে লেখা তো কবেই হাফিস! চোখেও দেখলাম না আর!’

‘লেখার কথা বলছি না। চন্দরনাথ কোথায় গেল? উয়োহ ভি বহত বড়া কলাকার থা!’ নবাব বলতে বলতে কেমন উদাস হয়ে যান, ‘অল্প ক’দিনে আমার দিলের অনেক করিব এসে গিয়েছিল লেড়কা। কাহাঁ গয়ে উয়ো? আজ এক হফতে হো গিয়া নেহি দেখা! উসকো লে আ মেরে সামনে!’

বিষণ্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বলে নবাব নিজের ঘরে ঢুকলেন। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়লেন।

কিন্তু তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জেগে উঠল সুলতানখানার লোকেরা। আসগর আলী আর হাফিজ নুরুল্লা গিয়ে তাদের কানে প্রশ্নটা তুলে দেওয়ামাত্র তারা চন্দ্রনাথের সন্ধান করতে শুরু করল।

পরদিন সকালে নবাবের ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। পেস্তামালাইয়ের পাত্র হাতে তিনি প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনতিদূরের নদীশোভা দেখছিলেন। সকালের মেটিয়াবুরুজ জেগে উঠেছে, বাড়িতে বাড়িতে পতপত করে উড়ছে অযোধ্যার পতাকা। যে পতাকার কোনো দাম নেই। নবাব জানেন। এই তল্লাটের সবাই জানে। তবু সবাই হয়ত ভালোবেসেই এই পতাকা লাগায়।

নবাব নিজেও জানেন, তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিনই হয়ত থাকবে এই মেহফিল, গানবাজনা, আনন্দ। তারপর সব মুছে যাবে ধীরে ধীরে। তলিয়ে যাবে মহাকালের গর্ভে।

এক খানসামা এসে লম্বা সেলাম ঠুকল, ‘আদাব জাহাঁপনা। চন্দ্রনাথ চলা গয়া। ওর মকানও খালি।’

‘চলা গয়া?’ নবাব বিস্মিতচোখে প্রশ্ন করেন, ‘কিঁউ?’

খানসামা জবাব দেয়, ‘নেহি মালুম হুজুর। উসকা যো এক বাচ্চা নকর হ্যায়, উয়ো বোলা কি চন্দ্রনাথ পাঁচদিন সে গায়েব হ্যায়।’

‘আজব ব্যাপার!’ নবাব বলে ওঠেন, ‘কেউ কিছু বলতে পারছে না, একটা জলজ্যান্ত ছেলে আমার মুলুক থেকে ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে গেল?’

খানসামা নতনেত্রে অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে।

নবাব ছটফটিয়ে ওঠেন। এই কয়েকমাসেই চন্দ্রনাথের ওপর তাঁর একটি অদ্ভুত মায়া পড়ে গিয়েছে। ছেলেটি তাঁর পুরনো বন্ধু সঙ্গীতজ্ঞ হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পুত্র, নিজেও সঙ্গীতে পারদর্শী।

মহল্লায় সে কলাকার হিসেবেই নিজের জায়গা করে নিয়েছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে নবাবের এক অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিও হয়ে উঠেছিল। চিড়িয়াখানা থেকে নিজের আত্মজীবনী, নবাব সব বিষয়েই তাকে বড্ড কাছের করে নিয়েছিলেন।

ছেলেটা বেশি কথা বলত না। কিন্তু ওর ছেলেমানুষ মুখটার মধ্যে কী যেন এক অদ্ভুত সারল্য মাখানো থাকত, যেটা দেখলেই নবাবের মনটা দ্রবীভূত হয়ে যেত। ইচ্ছে হত চুপ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে।

কিন্তু মিতবাক হলেও নিশ্চয়ই সে এখানে অখুশি ছিল না, নাহলে এতগুলো মাস থাকবেই বা কেন, আর নিজেকে এতসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করবেই বা কেন!

নবাব এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। গঙ্গা থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে দু-হাতে মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে ফেললেন তিনি। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। স্বল্পপরিচিত সেই যুবকটিকে তিনি যেন বড্ড নিজের করে ফেলেছিলেন।

তিনি তো তাকে কোনো কটু কথা বলেননি, তবু সে কেন এইভাবে তাঁকে না বলে চলে গেল?

অন্তরের মনঃকষ্টে নবাবের অশ্রুপাতের সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে কাতর শব্দ বেরিয়ে এল, ‘সব মুঝে ছোড়কে চলা যাতা হ্যায়! ক্যা ম্যায় ইতনা বুড়া হু?’

খানসামাটি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ছুটল আসগর আলীর কাছে।

আসগর আলী তখন বুলবুল মিয়াঁর সঙ্গে দু’জোড়া দাঁড়কাকের দাম নিয়ে দরকষাকষি করছিল।

‘চারটে দাঁড়কাকের কিমত দশ হাজার? উল্লু পায়া হ্যায় মুঝে?’

‘আরে এ যে দেখি বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়!’ বিরক্ত বুলবুল মিয়াঁ বলে, ‘নবাব নিজে বলেছেন ওই দাম দেবেন, তুমি কোথাকার কে হে?’

‘নবাব অমন বলেন। ওঁকে তো তহবিল চালাতে হয় না!’ আসগর আলী গজগজ করল, ‘আমাদের বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরলে দশখানা দাঁড়কাক এনে দেব, তা জানো?’

‘তাই নাকি?’ বুলবুল মিয়াঁ বলল, ‘তা এনে দাও দেখি। এমন দাঁড়কাক যার পায়ের পাতাগুলো গোলাপি আর গলার কাছটা তুলোর মতো নরম? দশখানা চাই না, একখানা হলেই চলবে। বুলবুল মিয়াঁ ঠকিয়ে ব্যবসা করে না।’

‘থামো। তোমার দত্তজী এক ঠগবাজ, আর তুমি আরেক!’

‘দত্তজি ঠগবাজ? মানে?’ হাঁ হয়ে গেল বুলবুল মিয়াঁ।

 আসগর আলী বলল, ‘ভুল বললাম। ঠগবাজও এর চেয়ে ভালো। শালা শয়তান…আমাদের নবাব হলে এখুনি ওকে শূলে চড়াতেন!’

‘কেন, কী করেছেন দত্তজি?’

আসগর আলী সামনে ভাঁজ করে রাখা খবরের কাগজটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘এই তো, দ্যাখো না। নবকিশোর দত্ত ক’মাস আগে নাকি তার ডিপোর একটা দশবছরের বামুন মেয়েকে বিয়ে করেছিল।’

‘বামুন?’

‘হ্যাঁ । ছেলে ছেলে করে দত্তজি পাগল হয়ে যাচ্ছিল, তাই কোনো পণ্ডিত ওই বামুনের মেয়েকে শাদি করার দাওয়াই বাতলে ছিলেন। তো, সেই মেয়েটা সুহাগ রাতের পরপরই মারা যায়। শালা জানোয়ারের বেওসা করতে করতে নিজে জানোয়ার হো গিয়া। ছোটি বাচ্চিকো ভি নেহি ছোড়া!’

‘ক্যা বোল রহে হ্যায় আপ!’ বুলবুল মিয়াঁ সত্যিই বিস্মিত হচ্ছিল।

‘যো বোল রহা হু, সাচ বোল রহা হু মিয়াঁ।’ আসগর আলী বলল, ‘এই কাগজটায় কলকাত্তার সব রইস আদমির কাছা খুলে দেয়। যে লেখে, তার নাম থাকে না, কিন্তু বহত সাচ্চা বাত লেখে। ভাগ্যিস আমি বাংলা পড়তে পারি।’

‘উসকা কোঈ সাজা নেহি হুয়া?’

‘কিসিকো পতা হি নেহি হ্যায়, সাজা তো দূর কি বাত!’ আসগর আলী ‘নির্ভীক নারী’ কাগজের প্রথম পৃষ্ঠা তুলে ধরে, ‘এই দ্যাখো। লিখেছে মশাট নামে এক গাঁও থে, উধারকা এক পূজারি, নাম কৃষ্ণসুন্দর, উসকা বেটি থা উয়োহ বেচারি। উয়ো পূজারি বেচারা আব চলা গয়া সাগর পার কাম করনে।’

বুলবুল মিয়াঁ শুনতে শুনতে হঠাৎ কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখদুটো খুব দ্রুত করমচার মতো লাল হয়ে যায়। পানের রসে রাঙানো ঠোঁটদুটো কেমন কাঁপতে থাকে।

আসগর আলী তা লক্ষ করে বলে, ‘ক্যা হুয়া? বুখার আ রহা হ্যায় ক্যা?’

‘নেহি।’ বুলবুল মিয়াঁ কোনোমতে বলে, ‘আমি এখন যাচ্ছি। পরে কথা হবে। খুদা হাফিস।’

আসগর আলী বুলবুল মিয়াঁর এই আকস্মিক পরিবর্তনে বিস্মিত হয়ে আরো কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাল কেটে যায় খানসামার আগমনে।

খানসামার কথা শুনতে শুনতে আসগর আলীর ভ্রু যতক্ষণে কুঞ্চিত হয়েছে, ততক্ষণে বুলবুল মিয়াঁ চলে গিয়েছে দৃশ্যপটের অন্তরালে।

আসগর আলী সব শুনে সত্যিই অবাক হচ্ছিল। পোষা পায়রার মৃত্যুতে, লক্ষ্নৌতে ফেলে আসা কোনো বেগমের কথা মনে করে নবাবের হাহুতাশ স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু একজন সাধারণ কর্মচারীর বিরহে কেঁদে ফেলাটা বেশ আশ্চর্যের বইকি। আর ছেলেটিও তো অদ্ভুত। নবাবের জীবনীর পাণ্ডুলিপিটিও সে রেখে যায়নি।

চন্দ্রনাথ যে মেটিয়াবুরুজে কাজ পেয়েছিল কাফি খাঁ-র সুবাদে, তা সুবিদিত। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই কাফি খাঁর তলব পড়ল সুলতানখানায়।

কাফি খাঁ এসে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আসগর আলীর ক্রমাগত পীড়াপীড়িতে কিছুটা রুষ্টস্বরে বলল, ‘ও শায়েদ ভাগ গয়া।’

‘সেটাই তো প্রশ্ন। হঠাৎ ভাগল কেন?’ আসগর আলী জিগ্যেস করল।

‘মুঝে ক্যা মালুম?’ কাফি খাঁ ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘এক মুতআ বেগমের লেড়কির সঙ্গে আশনাই করছিল, আমি সাবধান করেছিলাম। তাতেই হয়ত গুসসা করে…।’

‘সমঝ গিয়া!’ আসগর আলী বিড়বিড় করল, ‘মাসের কিছু তো পয়সা বাঁচল তহবিলের। ঠিক হ্যায়। আপ যাইয়ে। নবাবকো ম্যায় সামহাল লুঙ্গা।’

কাফি খাঁ তবু দাঁড়িয়ে রইল। তার ভ্রু কুঞ্চিত, মুখ গম্ভীর। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘শায়েদ উয়ো মর গয়া আসগর!’

‘মর গয়া?’ আসগর আলী এবার চমকে উঠল, ‘কিঁউ?’

‘পতা নেহি।’ কাফি খাঁ বলল, ‘এমনিই মনে হল। খুদকুঁশি করে নিলে কে জানছে?’

একটা ঝকঝকে গুণী শিল্পী হঠাৎ আত্মহত্যা করবে কেন?

আসগর আলী কাফি খাঁ-র কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না। হাঁ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

কাফি খাঁ গুরুত্ব দিল না। এই তল্লাটের অনেক ওঠাপড়া সে দেখেছে। তারপরেও সে আজও বটগাছের মতো অবিচল রয়েছে। তাই তার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলেও তার কিছু যায় আসে না।

৩৩

হাওড়ার চাঁদপাল ঘাট আজ লোকে লোকারণ্য। শহরের জাহাজবন্দরের মধ্যে অন্যতম ব্যস্ত ও বৃহদায়তন এই ঘাট। অন্যান্য দিনও যথেষ্ট ভিড় থাকে। কিন্তু আজ সকাল থেকেই জনসমাগম অনেকগুণ বেশি।

তার কারণ আর কিছুই নয়, একটি দানবাকৃতি বাষ্পীয়পোত। ক্লাইভ ঘাট স্ট্রিটে যে ম্যাকমিলন জাহাজ কোম্পানির সদর দপ্তর, সেই কোম্পানির একখানা বিশাল জাহাজ চাঁদপাল ঘাট থেকে ছাড়বে আজ। গন্তব্য বালেশ্বর হয়ে কটক।

বাষ্পচালিত সেই জাহাজের নাম স্যার জন লরেন্স। ভারতের প্রাক্তন ভাইসরয়ের নামে নাম। প্রায় মাসখানেক ধরে এই জাহাজের শুভযাত্রা নিয়ে শহরে বেশ আলোড়ন পড়েছে। জাহাজটি যেমন বড়, তেমনই বিলাসবহুল। ভেতরে নাকি এমন সব অন্দরসজ্জা রয়েছে, তা দেখলে তাক লেগে যাবে। সংবাদ বিচিত্রা তো লিখেইছে, রানির অন্দরমহলের আদলে সাজানো হয়েছে জাহাজের প্রথম শ্রেণীর কামরা।

খবরটা হয়ত অতিরঞ্জিত, কিন্তু সাধারণ মানুষের উৎসাহে তাতে ভাঁটা পড়েনি।

অন্য কোম্পানির আরো দুটো জাহাজ একইসঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘাটে, একটার নাম রিট্রিভার, অন্যটার নাম গডিভা। সেই দুটোরও গন্তব্য বঙ্গোপসাগরের ওপারে। কিন্তু তাদের নিয়ে মানুষের এত উৎসাহ নেই।

যাত্রা শুরুর আগেই স্যার জন লরেন্স জাহাজের জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছনোর কারণ অন্য।

আসলে ম্যাকমিলান কোম্পানি গত দেড়মাস ধরে এই জাহাজের বিজ্ঞাপনে প্রচুর খরচ করেছে। ইংরেজি, বাংলা কোনোরকম সংবাদপত্র তারা বাদ তো দেয়ইনি, এমনকী শিয়ালদা স্টেশনের সামনেও বিলি করেছে।

তাদের বিজ্ঞাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, যে হিন্দু রমণীরা প্রতিবছর দলে দলে পুরীধামে তীর্থ করতে যান, তাঁদের প্রলোভিত করা। জাহাজের ভেতরে প্রতিটি পুণ্যার্থী কীভাবে প্রাত্যহিক পুজো-উপাচার করতে পারবে, কেমনভাবে বিশুদ্ধ গঙ্গাজলে পুজো করার ব্যবস্থা রয়েছে, অন্যান্য জাতের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হওয়ার সম্ভাবনা যে এই সমুদ্রসফরে একেবারে শূন্য, এইসব নানা চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট করা হয়েছে জনসাধারণকে।

ফল পাওয়া গিয়েছে আশাতীত। যে হিন্দু মহিলারা গো-যানে করে অনেক বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে শ্রীক্ষেত্রে যেতেন, তাঁদের পরিবারের পুরুষরা এই বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়েছেন।

তাই যাত্রা শুরুর বেশ কয়েকদিন আগেই জাহাজের অধিকাংশ টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। টিকিটের দাম তিন টাকা, এত চড়া মূল্যেও এত ভালো যাত্রীসমাগমে ম্যাকমিলন কোম্পানি খুবই খুশি।

অবশিষ্ট টিকিট এখন বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশি মূল্যে। ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের মূল্য যাত্রীপিছু বেড়ে ছয় টাকায় পৌঁছেছে, তবু তা নিঃশেষিত হচ্ছে খুব দ্রুত লয়ে।

চাঁদপাল ঘাটের এক কোণের টিকিট কাউন্টারে বসা লোকদুটো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। জাহাজে মোট লোক ধরবে সাতশো পঁচিশজন, কিন্তু সেই সংখ্যা কখন অতিক্রান্ত, ম্যাকমিলন কোম্পানির সদর দপ্তরের নির্দেশে তারা টিকিট বিক্রি করেই যাচ্ছে।

দ্রুত হাত চালাতে চালাতে প্রথম কর্মচারী দ্বিতীয়জনকে বলল, ‘আজ সকালে কাগজে পড়লুম, সাগরে বিশাল ঝড় উঠবে। এত মেয়েমানুষ যাচ্চে, ভালোয় ভালোয় গেলে হয়। কী দরকার এত বেশি লোক নেওয়ার, বুঝি না বাপু!’

‘বুঝলে তো তুই-ই ক্লাইভ ঘাট স্ট্রিটের আপিসে বসে থাকতিস, আঙুল ব্যথা করে এখানে টিকিট বিক্রি করতিস না! কোম্পানি বোঝে ব্যবসা, বুঝলি? নে। তাড়াতাড়ি হাত চালা।’ দ্বিতীয়জন বলল।

স্যার জন লরেন্স জাহাজ গর্বোদ্ধত তিমির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘাটে। পিঁপড়ের মতো তার পেটের মধ্যে ঢুকছে যাত্রীদের সারি। তাদের সিংহভাগই অবগুণ্ঠিতা শ্বেতবসনা। বৈধব্যজীবনে জগন্নাথদর্শনের পুণ্যলাভের জন্য গোটা বাংলার নানা প্রান্ত থেকে হিন্দু রমণীরা এসে জমায়েত হয়েছেন চাঁদপাল ঘাটে। অধিকাংশই অভিজাত পরিবারের।

একের পর এক পালকি ঢুকছে, পালকি থেকে বেরিয়ে তাঁরা ভিরু হরিণীর মতো আড়ষ্টপায়ে হেঁটে উঠছেন জাহাজে। আশপাশের অগণিত পুরুষ যেমন তাদের দিকে চেয়ে রয়েছে, তেমনই চূড়ান্ত সংকোচের মধ্যে তারাও কেউ বহির্জগতটাকে একবার চোখ মেলে দেখে ফেলা থেকে নিজেকে নিরস্ত করতে পারছেন না।

সঙ্গে উঠছে নামাবলী গায়ে ফোঁটা কাটা বামুন থেকে শুরু করে তাদের চ্যালাচামুণ্ডারাও। পুরী মন্দিরের অনেক পাণ্ডা নানাকাজে এসেছিলেন কলকাতায়, তারাও আছেন অনেকে।

কথক ঠাকুরদেরও কমতি নেই। এতগুলো মহিলা যাচ্ছেন, সমুদ্রপথে তাদের ঈশ্বরকথা শুনিয়ে উপার্জনের সুবর্ণসুযোগ কি কেউ হাতছাড়া করে? তাদের জন্য টিকিটের দামও কম। যে যত যাত্রী ধরে আনতে পেরেছে, ম্যাকমিলন কোম্পানি তাকে তত কমিশন দিয়েছে।

সব মিলিয়ে চাঁদপাল ঘাট কোলাহলে মুখর।

গঙ্গা থেকে জাহাজের পাটাতনের জমির উচ্চতা প্রায় কুড়ি বিঘত। একপাশে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে তিনখানা ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। সেগুলো জাহাজের সঙ্গে ভেসে পড়বে জলে।

তিনটে জাহাজের সামনের দিকে একদল শ্রমিকস্থানীয় লোক জটলা করছিল। তারা হল জাহাজের স্টোকার। তাদের কাজ হল যতক্ষণ জাহাজ চলবে, বাষ্পচালিত ইঞ্জিন চালু রাখার জন্য বয়লারে কয়লা চালান দেওয়া। অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য কাজ।

আবদুল লতিফ নামে যে স্টোকার রিট্রিভার জাহাজে কাজ করে, সে তার পাশেই দাঁড়ানো লোকটিকে বলল, ‘রামু, তোদের কি মজুরি বেশি? নতুন জাহাজ, কোম্পানি এত লাভ করেচে! আমাদের তো মোছলমান বলে নিল না।’

‘সেগুড়ে বালি আবদুল চাচা!’ রামু নামক স্টোকারটি মুখ বেঁকিয়ে পিচ করে একদলা থুতু ফেলল, ‘ম্যাকমিলন কোম্পানির মতো পিচাশ আচে নাকি কোথাও? গোটা মাসে মাত্তর চারদিন ছুটি, হাড়ভাঙা খাটুনির পরে সেই পনেরো টাকা বরাদ্দ! এদিকে ঘরে পাঁচ-পাঁচটা পেট, বউটাও পোয়াতি। আধপেটাও জোটে না ঠিকমতো।’

আবদুল লতিফ তার হলদে দাঁত বের করে হাসল, ‘দ্যাখ, ফিরে আসার পর হয়ত মজুরি বাড়িয়ে দেবে। নতুন জাহাজ বলে কথা!’

খুব কাছে হঠাৎ বেজে ওঠা ভোঁ-তে রামু জাহাজ কোম্পানিকে উদ্দেশ্য করে কী গালাগালি দিল, শোনা গেল না।

স্যার জন লরেন্স পরপর তিনবার ভোঁ বাজাল। এবার ছাড়বে। রামু তার মাথার টুপি ঠিক করতে করতে এগিয়ে গেল জাহাজের দিকে।

আবদুল লতিফ তার ডান হাত ওপরে তুলল, ‘পরশু সকালে বালেশ্বরে দেখা হবে রামু!’

‘একদম চাচা!’ রামু হাত নাড়তে নাড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল জাহাজের ভেতরে।

স্যার জন লরেন্স জাহাজের ভোঁ শেষ হতেই ঘাটে দাঁড়ানো জনতা উল্লাসে হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠল। বেশ জোরে জোরে শাঁখও বাজতে লাগল কোথায় যেন।

জাহাজের খোলের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় ছুটতে ছুটতে এল এক তরুণ। খালাসির সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘একটু দাঁড়াও।’

‘এতক্ষণ কী করচিলেন?’ খালাসি যারপরনাই বিরক্ত। ওদিক থেকে গাঙ সারেঙ পীতাম্বর মিত্তির তাড়া দিচ্ছে। বেলাবেলি যাত্রা শুরু করতে না পারলে মুশকিল। এমনিতেই আজ নাকি ঝড় হওয়ার কথা আছে।

সৌরেন্দ্র বলল, ‘একটু দেরি হয়ে গিয়েছে ভাই। কিছু মনে করো না। ওই যে আসছে!’

খালাসি সৌরেন্দ্রর দেখানো দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে দেখল, এক অবগুণ্ঠিতা বিধবা রমণী আসছেন বটে। সে বিনাবাক্যব্যয়ে টিকিটদুটো চেয়ে নিল। প্রথম শ্রেণীর টিকিট দেখে তার মুখের বিরক্তিভাব উধাও হয়ে গেল, নিয়মমাফিক লম্বা সেলাম ঠুকল দু’বার।

সৌরেন্দ্রর পিছু পিছু উঠে এসেছেন আরো একজন, এক ফোঁটাকাটা ব্রাহ্মণ। তিনি একগাল হেসে বললেন, ‘হরে কৃষ্ণ! আমারও একটু দেরি হয়ে গেল।’

অবগুণ্ঠিতা ভুবনমণির সেই অচেনা কণ্ঠস্বর কেমন চেনা লাগল। শুনে বুকটা দুলে উঠল। ঘোমটার আড়াল থেকে সে উদগ্র কৌতূহলে দেখা চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে ব্রাহ্মণ ঢুকে গিয়েছেন ভেতরে।

ওরাও ঢুকে গেলে খালাসি বন্ধ করে দিল ঝাঁপ।

প্রবল জয়ধ্বনির মধ্য দিয়ে স্যার জন লরেন্স যাত্রা শুরু করল।

এখান থেকে দক্ষিণমুখে কালীঘাট, ছত্রভোগ পেরিয়ে সন্ধের মধ্যে পৌঁছনো হবে কুলপিতে। রাতে জাহাজ চলে না, তাই সেখানেই নোঙর করা হবে। আগামীকাল ভোরে সেখান থেকে রওনা দেওয়া হবে সাগরে, কপিলমুনির আশ্রম অভিমুখে।

মোহনায় পৌঁছনোর পর গাঙ সারেঙ পীতাম্বর মিত্র জাহাজের ভার তুলে দেবে ক্যাপ্টেন জন আরভিং-এর হাতে। ক্যাপ্টেন এবং তাঁর অফিসাররা তারপর জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবেন বালেশ্বর পেরিয়ে কটকের দিকে। সব মিলিয়ে লাগবে তিনদিন।

এই জাহাজের খোল দোতলা। একতলায় সাধারণ কামরা, ওপরে প্রথম শ্রেণী। সেই প্রথম শ্রেণীর থেকে সামান্য উচ্চতায় জাহাজের ডেক। ফলে প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের পক্ষে সন্ধ্যায় ডেকে আনন্দভ্রমণ খুবই সহজ।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঘোমটার আড়াল থেকে ভুবনমণি ফিসফিস করল, ‘আপনি নিশ্চিত, ওরা এই জাহাজেই যাচ্ছে?’

‘একদম।’ সৌরেন্দ্র বলল, ‘যত গোপন রাখারই চেষ্টা করুক, প্রশান্ত বলে মোক্তারটা অত টাকা খেয়ে মিথ্যে বলবে না। তোমার ভাইঝি যাচ্ছে ফার্স্ট ক্লাসে, মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ওয়ার্ডের একটা কামরায়। তার সঙ্গে রয়েছেন দয়াদিদি আর নবকিশোর দত্তের এক বুড়ি পিসি। আর নবকিশোর দত্তও প্রথম শ্রেণীতেই রয়েছে, ওর দলবল নিয়ে। তবে অন্য ওয়ার্ডে। ধনাপণ্ডিতই বলেছে এই যাত্রাপথে আলাদা থাকতে, তাই এই ব্যবস্থা।’

ভুবনমণি বিষ্ময়ে হতবাক। স্বামী তার পঞ্চম পক্ষকে নিয়ে তীর্থক্ষেত্রে যাচ্ছে তাকে অন্যপুরুষের কাছে ধর্ষিতা হতে বাধ্য করতে। আর সঙ্গত করার জন্য নেওয়া হয়েছে প্রথম পক্ষ দয়াময়ীকে!

মেয়েরা কি এই সমাজে কুকুরবিড়ালের চেয়েও তুচ্ছ এক জাতি?

আগে এই সব বিসদৃশ বিষয়গুলো তার চোখে আলাদা করে ধরা পড়ত না। কিন্তু আজকাল যত সে বই পড়ছে, যত সে ব্রাহ্মসমাজে মিশছে, তত তার চোখে পরানো ঠুলিদুটো খুলে যাচ্ছে।

ও বলল, ‘আমি কোথায় থাকব? ওই মহিলাদের সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ । দয়াদিদি আর লোপামুদ্রা যে কামরায় রয়েছে, তুমি থাকবে তার পাশেরটাতেই। তোমাকে নবকিশোর দত্ত চেনে, কিন্তু তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে না। দৈবাৎ সামনে পড়লেও তৎক্ষণাৎ ঘোমটা টেনে নেবে।’ সৌরেন্দ্র বলল, ‘আর আমি থাকব নব দত্ত, ধনাপণ্ডিতদের লাগোয়া কামরায়। আজ সন্ধেবেলায় জাহাজ কুলপি পৌঁছবে। কাল ভোরের আগে সেখান থেকে নড়বে না। তাই আজ গোটা রাতের মধ্যেই যা করার করতে হবে।’

নদীপথে জাহাজ দোলেনা তেমন। মোহনা পেরিয়ে সাগরে পড়ার পর নাকি শুরু হবে দুলুনি।

কিন্তু সবেমাত্র যাত্রা শুরুর জন্যই বোধ হয় একটা আচমকা ঝাঁকুনিতে ভুবনমণি টাল সামলাতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল সামনের লোহার শলাকাটার ওপর।

সৌরেন্দ্র চেপে ধরল ভুবনমণির হাত, সজোরে না টেনে ধরলে এখুনি একটা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটত!

ভুবনমণি সামলে উঠেই সসংকোচে ছাড়িয়ে নিল হাত, তার চুল আলুথালু হয়ে গিয়েছে, ঘোমটা খসে এলিয়ে পড়েছে সৌরেন্দ্রর কাঁধে!

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর এই সরু লম্বা করিডরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। আর দুপাশে সব বন্ধ দরজা। কেউ নেই।

ভাগ্যিস!

ও আড়ষ্টগলায় বলল, ‘ধন্যবাদ সৌরেন্দ্রবাবু!’

সৌরেন্দ্র সহজসুরে বলল, ‘ঠিক আছে। দয়াদিদি আর তোমার ভাইঝির সঙ্গে প্রকাশ্যে অচেনার মত হাবভাব করো। বলা যায় না, দেওয়ালেরও কান আছে।’

খালাসি আগেই নির্ধারিত কামরার চাবি দিয়ে দিয়েছিল, দরজা খুলে ভুবনমণির বিছানা প্যাঁটরা আর ঝোলাটা নামিয়ে রাখল সৌরেন্দ্র।

ছোট্ট ঘর হলেও বেশ সাজানো গোছানো। ভুবনমণি ঘোমটা খুলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। ইংল্যান্ডের রানির মতো আসবাব কিনা জানে না, তবে ছোট বড় তৈলচিত্র, বেশ কিছু আসবাবপত্রে সুন্দরভাবে সজ্জিত করা ঘর। একপাশে ছোট করে জানলা। সেই জানলায় কোনো হুড়কো নেই, বন্ধ করা কাচ। চাইলেও খোলা যাবে না।

ভুবনমণি এগিয়ে গিয়ে জানলায় চোখ রাখল। ওপাশে অনন্ত জলরাশি, আর পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ।

এরমধ্যেই জাহাজ বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে চাঁদপাল ঘাট থেকে। ঘাটের মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে ছোট ছোট পিঁপড়ে। দূরে হাওড়া ব্রিজ, আজই এক্কাগাড়িতে আসার সময় তা দেখার প্রথম সৌভাগ্য হয়েছিল ওর।

দেখতে দেখতে ওর রোমকূপ শিহরিত হয়ে উঠল। একপলকে মনে পড়ে গেল, দাদা কৃষ্ণসুন্দর, বউদি ব্রহ্মময়ী, ভ্রাতুষ্পুত্র দিব্যসুন্দরের কথা। মনে পড়ে গেল নতুনদাদা দ্বারকানাথ, নতুন বউদিদি কাদম্বিনীর কথা।

নিজের দাদাবউদির জন্য ওর সারাক্ষণ মনকেমন করে। কিন্তু এখন ও অনুভব করল, নতুন দাদাবউদির জন্য তার থেকে কিছুমাত্র কম মনঃকষ্ট হচ্ছে না ওর।

হিমানীর কচি পাণ্ডুর মুখটা মনে পড়তেই ওর চোখদুটো ভিজে উঠল। কাল রাতেও মেয়েটা সারারাত কেঁদেছে যন্ত্রণায়। ভুবনমণি ওর ওই অবস্থা দেখে আসতে চাইছিল না।

কিন্তু কাদম্বিনীই ওকে বুঝিয়েছেন, জোর করে রাজি করিয়েছেন। বলেছেন, ‘ভুলটা আমিই করেছিলাম। যখন তোকে একা পাঠিয়েছিল, তখনই যদি চেপে ধরতাম, ঠিক কাজ হত। দিয়ে যেত ওদের। তুইও ভয়ে কিছু বলিসনি। তুই যা ভুবন। লোপামুদ্রাকে তোকে বাঁচাতেই হবে। আমি, বিধু তো রয়েছি। হিমু ঠিক ভালো হয়ে যাবে, দেখিস!’

ও ছলছলে চোখে বলেছিল, ‘আমি কি পারব নতুন বউদিদি?’

‘তুইই পারবি ভুবন!’ ওর চোখে চোখ রেখে সাহস দিয়েছিলেন কাদম্বিনী, ‘আমরা আইনি জোর খাটাতে গেলে ওরা ঠিক প্রমাণ করে দেবে ওর দশ পূর্ণ হয়েছে। তুই-ই একমাত্র পারবি ওকে ভুলিয়েভালিয়ে সরাতে।’

‘বিল কি পাশ হবে না বউদিদি?’ ছলছলে চোখে বলেছিল ভুবনমণি।

 কাদম্বিনী দাঁতে দাঁতে চেপে বলেছিলেন, ‘হবে ভুবন। নিশ্চয়ই পাশ হবে এজ অফ কনসেন্ট বিল। আমরা জয়ী হবই।’

সৌরেন্দ্রর কথায় ওর চিন্তার ঘোর ভেঙে গেল।

‘কুলপিতে সন্ধ্যাবেলা নোঙর করার পর জাহাজে হরিসংকীর্তন শুরু হবে। খোলকরতালের মধ্যেই লোপামুদ্রাকে নিয়ে তুমি পালাবে।’ সৌরেন্দ্র ফিসফিস করল, ‘তোমার নতুন দাদা চিঠি পাঠিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। নিতে আসবে আমাদের ব্রাহ্ম সমাজের দুটো ছেলে। তারা যমজ, নাম মধু আর যদু। আমিই সব ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু আমি যাব না। জাহাজে থাকব। নাহলে আমার ওপর সন্দেহ আসবে। বুঝেছ?’

ভুবনমণি মাথা নাড়ল। তার বুক ঢিবঢিব করছে, কিন্তু তা সে প্রকাশ করল না। মুখে বলল, ‘তারপর?’

‘কুলপিতেই মধু যদুর বাড়ি। তাদের মায়ের কাছে গিয়ে তোমরা আশ্রয় নেবে। কোনো অসুবিধা হবে না। নতুন দাদা নিজে কাল বজরা নিয়ে এসে তোমাদের নিয়ে যাবেন।’ সৌরেন্দ্র বলল।

ভুবনমণি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আর আপনি? আপনি পুরী চলে যাবেন?’

সৌরেন্দ্র এবার হাসল, ‘নাহ। এখনই অত পুণ্য করার ইচ্ছে নেই ভুবন। সামনে কত কাজ! আমি বালেশ্বর পৌঁছেই আবার ফেরত চলে আসব। ততক্ষণে নবকিশোর দত্তের আর কিছু করার থাকবে না। বউ হারিয়ে সে যখন কলকাতায় ফিরবে, তখন চাঁদপাল ঘাটে তার জন্য পুলিশ অপেক্ষা করবে। লোপামুদ্রা আর তুমি নিজে সাক্ষী দেবে, কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে না।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ভুবনমণি। তারপর নিজের বাক্স খুলে বের করল একটা বই।

দ্বারকানাথেরই লেখা। নামটা দেখেই পড়ার অদম্য আগ্রহ জেগেছিল ওর। ‘বীর’-এর মতো একটি পুরুষালী শব্দের সঙ্গে ‘নারী’র মেলবন্ধন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল ওকে। তবু পড়া হয়নি এতদিন নানা কাজে।

সৌরেন্দ্র একবার বইটার দিকে তাকাল। দেখল, সেটা ওর প্রিয় বই।

বীরনারী।

ওর মনে হল, এতদিনে বইটা তার মনুষ্য সংস্করণের হাতে পৌঁছল।

মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল, আমি যাই। তুমি বিশ্রাম করো। এখনই দয়াদিদির ঘরে যাওয়ার দরকার নেই। লোপামুদ্রা চমকে যেতে পারে। তেমনই বলা আছে। দুপুরে খাওয়ার সময় দেখা করো। সন্ধ্যাবেলা হরিনামের সময় আমি ঠিক ডেকে নেব। তৈরি থেকো।’

ভুবনমণি মাথা হেলাল।

সৌরেন্দ্র নিষ্ক্রান্ত হলে দরজাটা বন্ধ করে দিল ও। একমুহূর্তের জন্য করিডরের দিকে চোখ পড়ল ওর। দেখল, একটু আগের সেই ব্রাহ্মণ হেঁটে যাচ্ছেন করিডর দিয়ে। অনাবৃত ঊর্ধাঙ্গ, নীচে শ্বেতশুভ্র ধুতি।

কোথাও কোনো সাদৃশ্য নেই। তবু তাঁর হাঁটার ধরনটা যেন ভীষণ চেনা লাগল ভুবনমণির। কোথায় কবে দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারল না ও।

বিব্রত মুখে ফিরে এসে ও বিছানায় বসল। তারপর কাচের এপাশে হেলান দিয়ে ও ‘বীরনারী’ বইটা খুলল।

একঝলকের জন্য ওর মনে হল, হ্যাঁ । বীর নারী হয়। তার নতুন বউদিদি কাদম্বিনীই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

বীর নারী হয়। নবকিশোরের প্রথমা পত্নী দয়াময়ী, যিনি জন্মাবধি দেখেনননি বহির্জগতের আলো, যিনি অসুস্থ থাকেন অধিকাংশ সময়, তিনি কোথা থেকে পেলেন নিজের সপত্নীকে বাঁচানোর এমন উদগ্র ইচ্ছা? বীরনারী তিনিও। নাহলে মৃত্যুর আগে নিজের শেষ তীর্থযাত্রা এবং স্বামীকে পুত্রবান হতে সাহায্য করা যে স্ত্রীর পরম কর্তব্য, সেসব বলে স্বামীকে প্রভাবিত করতে পারতেন না।

ক্ষণিকের জন্য ওর মনে হল, বীর নারী হয়ত ঘুমিয়ে রয়েছে তার মধ্যেও। অপালা যেভাবে অকালে ঝরে গেছে, সেভাবে সে কিছুতেই চলে যেতে দেবে না লোপামুদ্রাকে। তাই তো এক অনমনীয় জেদে সৌরেন্দ্রকে সঙ্গে করে সে চলেছে এই গোপন অভিযানে।

অদ্ভুত জাহাজ এই সেন্ট লরেন্স! এর কোনো যাত্রী চলেছে পুত্রবান হওয়ার আশায়, আবার কেউ চলেছে প্রিয়জনকে বিপদ থেকে উদ্ধারের সংকল্প নিয়ে!

ভুবনমণি দাঁতে দাঁত চিপল। প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়েও সে রক্ষা করবে লোপামুদ্রাকে। তবু কিছুতেই তাকে হারিয়ে যেতে দেবে না গহীন কালো আঁধারে।

জানলা দিয়ে তখন এসে পড়েছে রোদের নরম আলো। সেই আলো ভিজিয়ে দিচ্ছে ভুবনমণিকে।

কাছের মানুষ কাছে থাকলে তার অভাব বোঝা যায় না। বোঝা যায় তার অনুপস্থিতিতে। নিশুতি রাতে তাই চাঁদের অভাব বড় বেশি করে উপলব্ধ হয়। নিকষ কালো অন্ধকারে তখন চোখ খোঁজে একবিন্দু আলোকে, যে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে প্রকৃতি।

তোতারাম ফিসফিস করে বলল, ‘কামডা ঠিক হইল তো ঠাউরমশাই? ওই দত্যিডারে বিশ্বাস নাই, যুদি আমাগোরে হেই জলার মাঝখানে পুইত্তা ত্থোয়, কেউ টের পাইবো না কইলাম!’

‘পুঁতে দিলে তো জ্বালা জুড়োবে তোতা!’ কৃষ্ণসুন্দর অস্ফুটে বললেন, ‘এখনই বা কীভাবে বেঁচে আছি আমরা?’

‘তবু ঠাউরমশাই!’ তোতারাম বকে চলেছিল, ‘যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ! ওদের মতলবটা কী সেটাই মালুম হইতাছে না!’

আরো সে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, শুকনো পাতায় খরচমচর শব্দে চুপ করে গেল। সন্তর্পণে হাতের লাঠিটা সে চেপে ধরল সজোরে।

কিন্তু কেউ নয়। কোনো বন্যপ্রাণী বোধহয় ছুটে পালাল দূর দিয়ে।

খেতের মধ্যে অপেক্ষমান কৃষ্ণসুন্দর একভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। এখান থেকে ক্রোশখানেক দূরে এখন কোঠার ছোট্ট ঘরে ঘুমিয়ে আছেন ব্রহ্মময়ী আর দিব্যসুন্দর। তারা জানেও না যে কতটা দোলাচলের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণসুন্দর এখন যাচ্ছেন।

ওলবা এল আরো প্রায় তিনদণ্ড পর। এই কিছুদিনে ওলবার সঙ্গে এক অদ্ভুত সখ্যতা তৈরি হয়েছে কৃষ্ণসুন্দরের। যেদিন ওলবা’র দলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে কৃষ্ণসুন্দর সবাইকে নিষেধ করেছিলেন, সেদিনের পর থেকেই ওরা কেমন এক অন্যচোখে দেখছে তাঁকে। কেউ কারুর ভাষা বোঝে না। অথচ অনুভবের শব্দহীন কম্পন যেন দুজনের কাছেই পৌঁছে দিয়েছে বন্ধুত্বের বার্তা।

সেদিন খেতে ফেরার পর মুন সাহেবের আদেশে তাঁর পিঠে গুণে গুণে পঞ্চাশ ঘা চাবুক মারা হয়েছিল। চামড়া ফেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল, তবু তিনি একটা শব্দও করেননি। দলের সবাই আতঙ্কে মূক হয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মময়ী চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য।

সেই সংবাদ হয়ত কোনোভাবে পৌঁছেছিল ওলবার কাছে। পরের দিন একটি ছেলেকে দিয়ে গোপনে সে পাঠিয়ে দিয়েছিল অচেনা এক পাতার রস। আঘাত অনেকটা উপশম হয়েছিল তাতে।

তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় দু’সপ্তাহ। আজ যখন ওলবা লোক পাঠিয়ে জানিয়েছিল, সে দেখা করতে চায় রাতের অন্ধকারে, কৃষ্ণসুন্দর দু’বার ভাবেননি। কাউকে সেভাবে কিছু জানানও নি, রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন। তারপর মধ্যরাতে উঠে তোতারামকে নিয়ে চলে এসেছেন।

ওলবার সঙ্গে যে লোকটি এল, তাকে কৃষ্ণসুন্দর অন্ধকারে প্রথমে চিনতে পারলেন না। কিন্তু পরক্ষণেই তার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলেন।

এ যে দোভাষী ইসমাইল! ইসমাইল ইংরেজি জানে, বাংলা জানে। এতদিন এখানে থেকে সে রপ্ত করেছে ওলবাদের আঞ্চলিক ভাষাও। কিন্তু সে তো সাহেবদের দলে, ওলবা’র সঙ্গে কী করছে?

ইসমাইল নিচু গলায় বলল, ‘ওলবা আপনার কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে ঠাকুরমশাই!’

‘প্রস্তাব?’

‘হ্যাঁ ।’ ইসমাইল চাপাস্বরে বলে গেল, ‘কয়েকমাস ধরে পারামারিবো বন্দরে একটা জাহাজ মেরামতি হচ্ছিল। ঝড়ে সেটার অনেক ক্ষতি হয়েছিল। কাল সকালে সেটা বন্দর ছাড়বে। ওলবা ওদের দলের হয়ে সেই জাহাজটা ওলন্দাজদের থেকে কিনেছে। সে চায়, আপনি ওই জাহাজে করে দ্যাশে ফিরে যান! সব ব্যবস্থা তারা করে দিবে। কেউ টের পাবে না।’

কথাটা শুনে কৃষ্ণসুন্দর চমকে উঠলেন। তিনি কিছু বলার আগেই তোতারাম পরিবেশ বিস্মৃত হয়ে একটা ছোট লাফ দিয়ে উঠল। তারপরই বলল, ‘আমাগো নিবেন তো দলে? ঠাউরমশাই! আপনার পায়ে পইড়া থাকুম, আমাকে ছাইড়া যাবেন না!’

‘আহ তোতারাম শব্দ কোরো না!’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ইসমাইল। হঠাৎ আমার প্রতি এত বদান্যতার কারণ?’

‘আপনি ভালো মানুষ তাই!’ ইসমাইল বলল, ‘ওরা আপনাকে বন্ধু ভাবে। আপনাদের ঠকিয়ে মিছে কথা কয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এই ভিনদেশে। তাই আপনাকে এই নির্বাসন থেকে ওরা মুক্তি দিতে চাইছে। ওলবার লোক ওই জাহাজে থাকবে। তারাই আপনার পরিবারকে তুলে নিবে!’

‘কিন্তু শুধু আমাকে তুললে কী করে হবে!’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘আর অন্যান্যরা? তারা তো একই যন্ত্রণাভোগ করবে! অসম্ভব। আমরা পঞ্চাশজন একসঙ্গে কলকাতার ডিপো ছেড়েছিলাম। বেঁচে আছে আটচল্লিশজন। তারা আমার ভাইবোন। এই প্রস্তাবে আমি স্বীকৃত নই।’

ইসমাইল কিছুক্ষণ স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল, তারপর ওলবাকে ফিসফিস করে বলল সবকিছু।

ওলবা সব শুনে বড় বড় চোখে তাকাল কৃষ্ণসুন্দরের দিকে। হাতদুটো চেপে ধরল সজোরে। তারপর ইসমাইলকে প্রত্যুত্তরে অজানা ভাষায় বলে যেতে লাগল।

তোতারাম ফিসফিস করল, ‘এই সুযোগ হারায়েন না ঠাকুরমশাই! আপনি বাঁচলে পরে তবে বাপের নাম। শুধু আমাদের চাকর করে নেন, আপনার দুই পায়ে পড়ি!’

‘থামো তোতারাম!’ কৃষ্ণসুন্দর মৃদুকণ্ঠে তিরস্কার করলেন। নির্লজ্জ এই স্বার্থপরতা তাঁর কাছে অসহ্য। অথচ দীর্ঘ সহাবস্থানের পরেও, একই সুখ দুঃখের অংশীদার হওয়ার পরেও তোতারাম কি হেলায় শুধু নিজেকে এই পঙ্কিল দশা থেকে উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

এই হল মনুষ্য প্রকৃতি!

ইসমাইল ওলবা’র সঙ্গে কথা শেষ করে এদিকে তাকাল, ‘ওলবা রাজি আছে। আপনারা সবাই চলে গেলে সাহেবরা ফের প্যাঁচে পড়বে। ওদের কাছে গিয়ে কাকুতিমিনতি করবে। ওরা পাত্তা দেবে না। এতেই ওদের তৃপ্তি। আপনারা যাবেন?’

কৃষ্ণসুন্দর এবাব ভ্রু কুঞ্চিত করেন, ‘এতজন গেলে তো ওরা বুঝতে পেরে যাবে!’

ইসমাইল মাথা নাড়ল, ‘সামনের সপ্তাহে মুন সাহেবের বিবি আসবেন দ্যাশ থেকে। সাহেব বিবিরে লইয়া ব্যস্ত থাকবেন। আর ওভারসিয়ারগুলান তো মোষের মতো ঘুমায়। রাতের অন্ধকারে বন্দর অবধি চলি যাতি পারলেই…যখন বুঝতি পারবে, ততক্ষণে আপনারা পগারপার!’

‘কী ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ইসমাইল! তুমি তো কাজ করো মুন সাহেবের হয়ে। ভালো থাকো। ভালো পরো। হঠাৎ আমাদের প্রতি তোমার এই দরদ কেন?’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন।

ইসমাইলের চোখদুটো অন্ধকারে যেন দপ করে জ্বলেই আবার নিভে গেল। বলল, ‘সাহেবের লগে কাম করা তো শুরু করসি একমাস হল ঠাউরমশাই। আর তার আগে যে আমার ভাইডারে সাহেব রাতের বেলা জোর করি ধরি নিয়া গেল?’

কৃষ্ণসুন্দর চমকে উঠলেন। ইসমাইলের ভাই ছিল, একথা তাঁকে কেউ বলেনি।

‘পরপর সাতদিন নোংরামি করসে ওর সঙ্গে। আমার ছোট ফুলের মতো ভাইডা কারেও কিছু বলেনাই। যেদিন জঙ্গলের মধ্যে গাছের ডালে ঝুলতাসিল, সেদিন ওর গোটা দেহে দাগ। ওলবা-ই আমারে খবর দ্যায়। সেইদিন প্রতিজ্ঞা করি, সাহেবের লগে থেকেই ওরে তিলে তিলে মারুম!’ ইসমাইলের গলা কাঁপছিল, ‘সাহেবের এখন নজর পড়সে আপনার ছেলের উপর ঠাউরমশাই।’

কৃষ্ণসুন্দরের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। শিশু ক্রীতদাসদের সমকামে বাধ্য করানোর অত্যাচারের কানাঘুষো তাঁর কানে এই ক’দিনে এসেছে। তাঁর নিজের পুত্রকে সেই জায়গায় ভাবতেই বুকের ভেতর রক্ত ছলকে উঠল তাঁর।

ইসমাইল খরচোখে তাকাল, ‘সময় থাকতি পালান। আপনারা যাচ্ছেন, দলে লোক আরো কমবে। তারপর এক রাতে ওলবা আসবে, আমি দরজা খুলি দিব। সাহেবডারে মারার আগে ন্যাংটো করে পিটাইব, বড় শখ আমার ঠাউরমশাই! তক্কে তক্কে আসি তাই। শত্তুরের কাছাকাছি থাকার অনেক সুবিধা।’

সেদিন রাতে কোঠাঘরে ফিরে এসে কৃষ্ণসুন্দর ব্রহ্মময়ীকে জাগালেন না। স্ত্রী ও পুত্রর শীর্ণ ক্লিষ্ট মুখদুটো দেখতে দেখতে তিনি ভাবলেন, যা ঘটছে তা কি সত্যি? দীর্ঘ সাতমাস পর সত্যিই কি তিনি আবার নিজের দেশে যেতে পারবেন? গন্ধ নিতে পারবেন নিজের দেশের সোঁদা মাটির?

পুলকে, রোমাঞ্চে তাঁর গোটা শরীরে কাঁটা দিচ্ছিল। কতদিন পর তিনি দেখবেন তাঁর ছোট্ট অপালাকে? সে কেমন আছে? বণিক বাড়ির গিন্নী হয়ে কেমন সামলাচ্ছে সংসার?

নাকি দ্বারকা তাকে নিয়ে গিয়েছে নিজের কাছে। ভুবনমণি, লোপামুদ্রা আর অপালাকে গড়ে তুলছে নিজের মনের মতো করে! নিজের স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করছে তাদের!

আহা! তাই যেন হয়!

আনন্দে কৃষ্ণসুন্দর চোখ বুজে ফেললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *