১০. আসমানি মঞ্জিলের সামনে

১০

আসমানি মঞ্জিলের সামনে দিয়ে যে সরু বাঁধানো গলিটি দক্ষিণ দিকে গঙ্গার ঘাট বরাবর চলে গিয়েছে, সেখানে রয়েছে ভিন্ডিখানা।

সেই ভিন্ডিখানার সামনে এখন পতঙ্গবাজি জমে উঠেছে।

দুটো পেল্লাই আকারের ঘুড়ি দু’পাশ থেকে ওড়ানো হয়েছে আকাশে। লাটাইয়ের সুতো হু-হু করে ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে’দুটো অনুকূল বাতাসে পতপত করে উড়ে যাচ্ছে অদূরে গঙ্গার দিকে।

প্রায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ উৎসাহের সঙ্গে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে।

একজন আচকান পরা কালো লোক চোঙা মুখে অনবরত বলে যাচ্ছে, ‘খুশ খবর! খুশ খবর! খুশ খবর! এখুনিই হাজির হবেন মেটিয়াবুরুজ কি শান বাদশাহ সালামত নবাব জনাব ওয়াজেদ আলী শাহ। যে পতঙ্গবাজ জিতবে, তার জন্য ইনাম ভি রয়েছে, বিশ হাজার রুপেয়া। আপলোগ আইয়ে, উন দোনোকো হোসলা বড়াইয়ে!’

বেশ কিছু মানুষ কথাগুলো শুনে হর্ষধ্বনি করে উঠল।

চন্দ্রনাথ দাঁড়িয়েছিল একপাশে। আজ সকাল থেকেই ঘুড়ির লড়াই চলছে। তাই তার বিশেষ কাজ নেই। নবাব খুবই খামখেয়ালি। যখন মন চায়, টানা সাতদিন তিনি গান শুনে যান। আবার যখন মনে হয়, মুর্গিবাজি, ভেড়ার লড়াইয়ে সপ্তাহভর মেতে ওঠেন।

অদূরেই একটা পালকি দাঁড়িয়ে ছিল। সেই পালকির সামনে অপেক্ষা করছিলেন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। পরনে ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি। মাঝে মাঝে পাশের ছায়াসঙ্গীটি তাঁর দিকে সুদৃশ্য হুঁকোটা এগিয়ে দিচ্ছিল। লোকটি নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তামাক সেবন করে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন।

চুস্ত, চাপকান, আচকানের ভিড়ের মধ্যে নিজের পোশাকের সঙ্গে সাদৃশ্য পেয়েই বোধ হয় সেই ভদ্রলোক কৌতূহলী হয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন চন্দ্রনাথের দিকে।

কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘হিঁদুর পো মনে হচ্চে?’

চন্দ্রনাথ আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে ঘুড়িদুটোকে দেখছিল। হঠাৎ সম্ভাষণ শুনে চমকে তাকাল, ‘আজ্ঞে। আমার নাম চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নমস্কার।’

‘বামুন?’ ভদ্রলোক বাঁ-হাতটি সামান্য ওপরে তুললেন। তারপর বললেন, ‘একেনে কী মতলবে?’

চন্দ্রনাথ কিছু বলার আগেই ভোজবাজির মতো এসে আবির্ভূত হল বুলবুল মিয়াঁ। সেই লোকটা যে প্রথম দিন চন্দ্রনাথকে ফেরিঘাট থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল মেটিয়াবুরুজে। এই কয়েকদিনে সেভাবে তার সঙ্গে চন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়নি।

বুলবুল মিয়াঁ বলল, ‘দত্তজি, এ হল চন্দরনাথ। চন্দরনাথ ভট্ট। গাঁও থেকে এসেছে। খুব নামকরা কলাকার। নবাব ওর গান শুনে বহত কদরদানি করেছেন। এখন সুলতানখানার গাইয়ে।’

‘তাই নাকি?’ মুহূর্তে ভদ্রলোকের অভিব্যক্তি বদলে যায়। হুঁকোটা সহচরের হাতে দিয়ে বলেন, ‘নমস্কার। আমার নাম নবকিশোর দত্ত। আমি এই মেটেবুরুজে পাখির ব্যবসা করি। থাকি কলকেতায়, কিন্তু আদি নিবাস চাণক গাঁয়ে। হে হে। আপনার?’

চন্দ্রনাথ বলল, ‘আমার বাড়ি অনেক দূর।’

‘অ!’ নবকিশোর বুলবুল মিয়াঁর দিকে তাকালেন, ‘নবাব কখন দ্যাকা দেবেন ভায়া? আর যে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্চে না।’

‘তা এসেছেন এসেছেন, এত জলদিবাজির কী আছে?’ বিরক্ত বুলবুল মিয়াঁ কর্কশকণ্ঠে উত্তর দিল।

‘আহ না জেনে কতা কোয়ো না তো বুলবুল!’ বিরক্ত নবকিশোর বললেন, ‘অ্যাদ্দুর উজিয়ে আজ এলুম শুদু মোতিবিবির কাচে যাব বলে। কাল একটা বে’ করিচি, দিনকয়েক সেইসব তালেগোলে এদিকে পা বাড়ানো হয়নি, আর এই মাগি গোঁসা করে বসে রয়েছে। আরো দেরি করে গেলে সে আর কতাই কইবে না।’

‘না বললে দূর করে দেবেন আপনার ভাড়া কোঠি থেকে, মিটে গেল।’ বুলবুল মিয়াঁ বলল।

‘সে না-হয় হল। ভালো কথা, নবাব নাকি কাল মহল্লার এক ঝাড়ুদারনিকে শাদি করেচেন?’ চোখে ঝিলিক দিয়ে বললেন নবকিশোর, ‘আবুলের মুখে শুনলুম। শুনে পেত্যয় হল না যদিও।’

‘এ আর নতুন কথা কি?’ মাটিতে লাল পিক ফেলে একটা বড় হাই তুলল বুলবুল, ‘মেটেবুরুজের কমসে কম দো-তিনশো জেনানা নবাবের কোনো না কোনো মুতআ বেগম। ওই ঝাড়ুদারনির নতুন নাম হয়েছে মুসফফা বেগম। কয়েকদিন সুলতানখানায় থাকবে, তারপর ভিড়ে যাবে কোনো না কোনো নাচের দলে। এই তো চলছে।’

কথার মাঝে হঠাৎ সামনের শান বাঁধানো জায়গায় তিন-চারটে লোক আট-দশটা ভেড়া নিয়ে এসে রাখতে লাগল। ভেড়াগুলোর ডাকে নবকিশোর সচকিত হয়ে বললেন, ‘এই রে। এবার কি ভেড়ার লড়াই শুরু হবে নাকি?’

‘সেরকমই মনে হচ্ছে। দেখছ না গুলচাঁদ এসে হাজির হয়েছে? ও তো এইসব কসরতই দেখায়।’

‘নাহ, তবে আমি চল্লুম মোতিবিবির কাছে। আমার এইসব রক্তারক্তি একদম ভালো লাগে না।’ নবকিশোর এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে গেলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দ্রনাথকে দেখে স্বজাতি বলেই বোধহয় স্নেহ উথলে উঠল তার, ‘তুমিও চলো হে আমার সঙ্গে। এট্টু নাচ দেকে আসবে’খন।’

‘কোথায়?’ চন্দ্রনাথ প্রথমে বুঝতে পারে না, ‘কোথায় যাব?’

‘আহ, কোতায় আবার যাবে? আমার মোতিবিবিকে এট্টু দেকে আসবে চলো। অ্যাতো টাকা দিয়ে পুষছি, লোকজনকে না দ্যাকালে ঠিক সুখ হয় না।’

‘ও আচ্ছা।’ চন্দ্রনাথ অন্যমনস্কভাবে পা বাড়ায় নবকিশোরের সঙ্গে। এখন তার কোনো কাজ নেই। এই লোকটির সঙ্গে কিছুক্ষণ ঘুরে আসাই যায়।

মেটিয়াবুরুজে আসার দিন সে ছিল শুধুই সহায়সম্বলহীন এক কর্মপ্রার্থী। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গেঁজেতে সামান্য কিছু অর্থ ও একটি পত্র নিয়ে সে এতদূর এসেছিল। তার পিতা তার জন্য সঙ্গীতপ্রতিভা ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারেননি। সেদিন চন্দ্রনাথ ছিল অনিশ্চয়তার সমুদ্রে দোদুল্যমান।

পরমেশ্বরের কৃপায় মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে সে নবাবের প্রাসাদের অদূরেই একটি কোঠাবাড়িতে থাকার অধিকার অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, পেয়েছে সর্বক্ষণের একটি ভৃত্য। বছর তেরো-চোদ্দো বয়স। নাম ফণি। ফণি রসুই থেকে শুরু করে ঘরদোর পরিষ্কার, সবই সামলায়।

এছাড়াও কুয়ো থেকে জল তোলা ও নানা টানা কাজের জন্য রয়েছে বাঘা বলে এক বয়স্ক ভৃত্য। সে অবশ্য দিনে দু’বার আসে। কাজ করে। চলে যায়।

নবাবের হুকুমত অনুযায়ী চন্দ্রনাথের জন্য একজোড়া করে নতুন সেতার ও মৃদঙ্গ দেওয়া হয়েছে। নবাব চান চন্দ্রনাথ শুধু সারাদিন সঙ্গীতচর্চা করুক আর তাঁকে শোনাক।

আশ্চর্য জায়গা এই মেটিয়াবুরুজ। ততোধিক আশ্চর্য এই নবাব! সাম্রাজ্য নেই, নবাবি নেই, তবু অদ্ভুত এক জাদুবলে তিনি আচ্ছন্ন করে রেখেছেন গোটা মেটিয়াবুরুজকে।

চন্দ্রনাথের কোঠাবাড়ি যে গলিতে, সেখানে নবাবের সব হিন্দু কর্মচারীদের বাস। তাও পঞ্চাশঘর তো হবেই। অধিকাংশই নবাবের চিড়িয়াখানার সঙ্গে যুক্ত। কেউ আবার নবাবের সেপাই কিংবা মুহুরি।

বাঘা একদিন বলছিল, গোটা তল্লাটের লক্ষাধিক মুসলিম জনসংখ্যার মাঝে এই দেড়-দুশো হিন্দু সংখ্যালঘু হয়ে বাস করে। তা সত্ত্বেও মেটিয়াবুরুজ শিয়া-সুন্নির সংঘাতে মাঝেমধ্যেই উত্তাল হলেও হিন্দু মুসলমানে নাকি কোনোদিন ঝামেলা বাধেনি। নবাব এই বিষয়ে খুব কড়া। তাঁর কাছে সবাই সমান।

নবকিশোরের পালকি যে ছোট মাটির বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, সেটা সিব্যয়তনাবাদ ইমামবাড়ার কিছু পেছনে। এই কয়েকদিনেই চন্দ্রনাথ লক্ষ করেছে, মেটিয়াবুরুজের সবকিছুই যেন ঝকঝকে তকতকে, কোথাও একফোঁটা মালিন্য নেই। সার দিয়ে এত ইমারত, কিন্তু কোনোটার গায়ে নেই অপরিচ্ছন্নতা।

পালকিবাহকদের শব্দেই কিনা কে জানে, একটা কিশোরী মেয়ে এসে কৌতূহলী মুখ বাড়াল দরজা দিয়ে।

নবকিশোর অমনি হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘কিরে ছুটকি! মোতি কোথায়?’

মেয়েটা উত্তর দিল না, শুধু ফিক করে হেসে দরজাটা খুলে রেখে পালিয়ে গেল ভেতরদিকে।

নবকিশোর হাসি হাসি মুখে চন্দ্রনাথের দিকে তাকালেন, ‘ভেতরে আসুন।’

বাড়ির বাইরেটা যতটা আলোকিত, ভেতরটা ততটাই অন্ধকার। সদর পেরিয়ে কিছুটা সরু ভিতরদালান। নাকে ভেসে আসছে মিষ্টি আতরের সুবাস। ভেসে আসছে নারীকণ্ঠের সুরেলা গানও।

নবকিশোরের এই বাড়ির প্রতিটি রন্ধ্র পরিচিত, তিনি অবলীলায় গিয়ে ঢুকলেন সামনের একটা ঘরে। চন্দ্রনাথ একটু ইতস্তত করছিল। কিন্তু নবকিশোরের বারংবার পীড়াপীড়িতে সেও প্রবেশ করল।

অন্ধকারে কিছুক্ষণ থাকার পর চোখ নিজে থেকেই আলো খুঁজে নেয়।

ঘরটির একদম মাঝখানে মাটিতে বসে গুনগুন করছে একটি মেয়ে। বয়স উনিশ কুড়ি। স্বল্প আলোয় গায়ের রঙ বোঝা যাচ্ছে না।

মেয়েটা নীচু স্তরে একটা গান গাইছে। গানের আবেশে তার চোখদুটো বোজা। হাতের আঙুলগুলো ইতস্তত কাঁপছে কোলে রাখা সেতারের তারে।

নবকিশোর আলতো করে ডাকলেন, ‘এ মোতিয়া!’

মেয়েটা চমকে উঠে চোখ খুলল। চন্দ্রনাথকে যেন সে দেখতেই পেল না, নবকিশোরের দিকে একঝলক তাকিয়েই মুখ ভার করে উঠে যেতে উদ্যত হল।

নবকিশোর দ্রুত গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন, ‘কী হল। এত রাগ কেন?’

‘ছোড় দিজিয়ে মুঝে!’ মেয়েটা ছদ্মরাগে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল, ‘সাতদিন দেখা নেই, আর এখন মাগরিবের নামাজ পড়ার সময় হতে চলল, উনি এলেন।’

‘আরে কী করব বলো?’ নবকিশোর অসহায় মুখে বললেন, ‘ক’দিন ধরে বাড়িতে যা যাচ্চে। রাগ করিস না, এই দ্যাক কাকে নিয়ে এসেচি। তোর গানের বড় সমঝদার।’

মেয়েটা এতক্ষণে যেন চন্দ্রনাথকে দেখতে পেল। প্রগলতা থামিয়ে কিছুক্ষণ বড় বড় চোখের পাতা স্থির করে বলল, ‘ইয়ে কৌন? আপকি ইয়ার?’

‘আরে আমার ইয়ার কেন হবে। তোদের এই মেটেবুরুজের নতুন কলাকার রে পাগলি! খোদ নবাব এর গানে খুশি হয়ে চাকরি দিয়েছেন।’ নবকিশোর মেয়েটার কোলে শোয়ানো বাদ্যযন্ত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দারুণ তানপুরা বাজায়।’

‘ওটা তানপুরা নয়।’ দ্রুত বলল চন্দ্রনাথ, ‘সেতার।’

‘ওই হল। আমরা কি আর ওসব বুজি? আমাদের কাছে তানপুরা যা সেতারও তাই।’ নবকিশোর মেয়েটার চিবুক ধরে নাড়িয়ে দিলেন, ‘আমি মুখ্যুসুখ্যু বেনিয়া মানুষ। বুজি খালি পয়সা আর আমার মোতিকে। নে, ভালো একটা গান ধর দিকি।’

চন্দ্রনাথ লক্ষ করল, মেয়েটা নিজেকে সুকৌশলে আলগোছে ছাড়িয়ে নিল। তারপর সামনের জাজিম বিছানো তক্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে চন্দ্রনাথকে বলল, ‘বৈঁঠিয়ে জনাব!’

নবকিশোর আগেই বসে পড়েছিলেন, চন্দ্রনাথ একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসল তাঁর পাশে।

মেয়েটা চোখ বুজে বাম হাত কানে চেপে ধরে শুরু করল একটা ধ্রুপদী চৌতাল। হাতের আঙুলে সেতারে তুলল মূর্ছনা।

‘পুরো মন ধন ধন মধকা কলাসে

ভগমগাওত গাওয়ে চরাওত

কিষণ কুয়ার কানা বনোয়ারী…’

চন্দ্রনাথ শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গেল। মেয়েটার গানের গলাই যে শুধু সুমিষ্ট তাই নয়, সুর তাল ও ছন্দজ্ঞান অপরূপ। মন দিয়ে শুনতে শুনতে এক জায়গায় সে হঠাৎ পরিস্থিতি ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘উঁহু, সেতারে সুর লাগল না যে!’

মুহূর্তে মেয়েটা গান থামিয়ে দিল। লজ্জিত চোখ নামিয়ে বলল, ‘সেতার অতটা ভালো পারি না জনাব!’

‘আরে পারিস না তো কী আছে, পারবি।’ নবকিশোর তড়িঘড়ি বললেন, ‘এই তো উস্তাদ এসে গ্যাচে। চিন্তা কী! সময়সুযোগ পেলে এসে তোকে শিখিয়ে যাবে’খন।’

মেয়েটা চকিতে তাকাল চন্দ্রনাথের দিকে। তারপরই দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

১১

সকাল থেকে ডিপোয় সাজো সাজো রব। কৃষ্ণসুন্দরদের জাহাজে ওঠার দিন উপস্থিত হয়েছে।

রামবিলাস দারোয়ানের লোকেরা দালানে বসে আছে। নারী পুরুষের দুটি সারি শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে একে একে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের সামনে। তারা একে একে কাগজে টিপসই করাচ্ছে, খাবারের একটা করে ছোট থলে দিচ্ছে আর সবশেষে গলায় পরিয়ে দিচ্ছে টিনের চাকতি।

সঙ্গে চলছে সাবধানবাক্য, ‘ইয়ে খোনা নেহি। আগার খো দিয়া তো উধার যা কে কামকাজ কুছু মিলেগা নেহি। মাহিনা, রেশন, দাওয়াইয়া তো দূর কি বাত হ্যায়। সমঝা ক্যা বুরবক? হোশিয়ার রহনা।’

প্রত্যেক শ্রমিকের মুখ পাংশুবর্ণ। ডিপোর এই বদ্ধ বন্দি জীবন যতই দুঃসহ হোক, তার কঠোরতা ইতিমধ্যেই সকলের কাছে জ্ঞাত। অজানা দেশে শ্রমিকের জীবনের চিন্তা আরো অনেক বেশি ভয়ের।

কৃষ্ণসুন্দর লাইনের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে অন্যদের মতোই জামা, খাকি হাফপ্যান্ট, টুপি। এক হাতে ঝোলা, তাতে পরিধেয় বস্ত্রাদি। পাশে ম্লানমুখে দণ্ডায়মান দিব্যসুন্দর ডিপোর সুউচ্চ প্রাচীরের ওপর বসে থাকা একটা পাখিকে দেখছিল।

পাখিটাকে দূর থেকে দেখলে টিয়া বলে ভ্রম হয়। কিন্তু দিব্য দেখেই চিনতে পারল যে পাখিটা চন্দনা। এরকম এক জোড়া চন্দনা পাখি তাদের গ্রামের বাড়িতে ছিল যে! তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল তারই ওপর ন্যস্ত।

ও রক্ষীদের কর্কশ হাঁকডাকের মাঝে একটু বেলাইন হয়ে চাপা স্বরে মুখে হাত দিয়ে একটা আওয়াজ করল, প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ!

পাখিটা অমনি চমকে তাকাল ওর দিকে। লালচে চোখ মেলে কিছুক্ষণ দেখল। তারপর ডানা ঝাপটে উড়ে গেল দূরে।

দিব্যসুন্দরের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। সে এখনো বালক, জগতের জটিলতা এখনো তার বোধগম্য হয়নি। কিছুক্ষণ পাখিটার জন্য অপেক্ষা করে বিফলমনোরথ হয়ে সে টান দিল বাবার জামায়।

‘চলো না বাবা, আমরা গ্রামে ফিরে যাই?’

কৃষ্ণসুন্দর কোনো কথা বললেন না।

তাঁর সমান্তরালেই মহিলাদের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্রহ্মময়ী ও ভুবনমণি। ব্রহ্মময়ী যেন পাষাণপ্রতিমা, এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি। শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে।

লাইন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। গলায় টিনের চাকতি পরে, ঝোলা কাঁধে একেকজন গিরমিটওয়ালা বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রহরী তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে ডিপোর বাইরে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরো চারজন শক্তপোক্ত প্রহরী। তাদের জিম্মায় রেখে আসা হচ্ছে গিরমিটওয়ালাদের। দশজনের দল হলেই তাদের নিয়ে হাঁটা লাগাচ্ছে প্রহরীরা।

ডিপো থেকে জাহাজে ওঠার বালুঘাট প্রায় আড়াই ক্রোশ।

তা হোক, তাই বলে কি মালিক এদের জন্য ছ্যাকরা গাড়ি করবেন নাকি? শখ তো কম নয় বাপু!

নারী ও পুরুষের লাইনদুটি একেবারেই কাছাকাছি হওয়ায় পুত্রের সরল প্রশ্নটি সম্ভবত ব্রহ্মময়ীর কর্ণগোচর হয়েছিল। মুখ তুলে সেদিকে তাকাতে যেতেই তাঁর চোখাচোখি হয়ে গেল স্বামীর সঙ্গে। মুহূর্তে যেন মন দুর্বল হয়ে এল, চোখে অশ্রু এল বন্যার স্রোতের মতো।

কৃষ্ণসুন্দরও তাকালেন তার দেড়যুগ পুরনো স্ত্রীর দিকে। সেই কোন এক আষাঢ়ের দিনে ব্রহ্মময়ীকে তার পুতুল খেলার সঙ্গীসমেত নিয়ে এসেছিলেন নিজের গৃহে, এখন সেই স্মৃতি রোমন্থন করলে মনে হয় পূর্বজন্ম। তখন কৃষ্ণসুন্দর তেরো আর ব্রহ্মময়ী নয়। সেই অতটুকু বয়স থেকে পাশাপাশি বড় হয়ে উঠেছেন দুজনে। একইসঙ্গে অতিক্রম করেছেন কৈশোর। পা দিয়েছেন যৌবনে। সেই যৌবনও এখন কালের নিয়মে, নানা অভিজ্ঞতায় জরাজীর্ণ। এরই মধ্যে জীবনাকাশে এসেছে নানা ঝঞ্ঝা। শ্রদ্ধাসন থেকে আকস্মিক কৃষ্ণসুন্দর গ্রামের মধ্যে পতিত হয়েছেন ভূতলে। ব্রহ্মময়ীর জীবনে এসেছে একের পর এক দুর্যোগ। কোলছাড়া হয়েছে প্রাণাধিক দুই কন্যাও।

তবু সবকিছুর পর তাঁরা এখনো একসঙ্গে আছেন। হোক বা আলাদা ঘর, দৈনিক সাক্ষাতের সুযোগ তো রয়েছে। কৃষ্ণসুন্দর বেদ রোমন্থন করেন। ঋকবেদের প্রথম মন্ডলে ছিল এক যজমান দম্পতির যৌথভাবে অগ্নিকে আহুতি দেওয়ার সুন্দর বর্ণনা।

বি ত্বা ততস্রে মিথুনা অবস্যবো ব্রজস্য সাতা।

সেই সুক্তের মতোই কৃষ্ণসুন্দর ও ব্রহ্মময়ীও যৌথভাবে সামলে এসেছেন সাংসারিক ঝড়ঝঞ্ঝা। আহুতি দিয়েছেন বিপদাগ্নিকে।

কিন্তু এরপর যেখানে যাবেন? সাগরপাড়ের সেই অজানা দেশে একই ইক্ষুখেতে যদি দুজনের থাকার সুযোগই না মেলে? তখন?

কৃষ্ণসুন্দরের বুকের ভেতরটা কেমন দলা পাকিয়ে উঠল। ব্রহ্মময়ী তাঁর পাশে না থাকলে তিনি সত্যিই অসহায়।

ব্রহ্মময়ী ইঙ্গিতে স্বামীকে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পাশে দণ্ডায়মান ভুবনমণি কাতরস্বরে বলে উঠল, ‘উঃ মাগো! লোকটাকে কী মারচে দ্যাখো বউদিদি!’

সামনে গোলমাল ততক্ষণে জোরালো হচ্ছে। কৃষ্ণসুন্দর চমকিত হয়ে সেদিকে তাকাতেই শিহরিত হয়ে উঠলেন।

তিন-চারজন প্রহরী মিলে জিতু পাগলাকে নির্দয়ভাবে প্রহার করছে। প্রহরীদের সবার হাতেই ধারালো বর্শা, সেই বর্শার পেছনদিকের ভোঁতা ধাতব অংশ দিয়ে তারা যথেচ্ছভাবে আঘাত করছে জিতু পাগলার পেটে, পায়ে, সর্বত্র।

আশ্চর্য ব্যাপার। যে জিতু পাগলার মুখে অকারণে গালাগালের তুবড়ি ছোটে, তার ঠোঁটের একপ্রান্ত কেটে রক্ত পড়ছে, কপালেরও একাংশ ফেটে গিয়েছে, অথচ মুখে সে একটা রা-ও কাটছে না। বরং তার মুখে খেলা করছে একটা অদ্ভুত নির্বিকার ভাব।

অপরিসীম ক্রোধে কৃষ্ণসুন্দরের মাথায় যেন শিরাগুলো ফেটে রক্ত ছলকে উঠল। লাইন উপেক্ষা করে তিনি হনহন করে হেঁটে গেলেন সামনে। প্রহরীদের হাত থেকে জিতু পাগলাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘কী করছ কী তোমরা? এইভাবে কাউকে মারে? এখুনি ছেড়ে দাও ওকে।’

অন্য কোনো শ্রমিক হলে তাকে প্রহরীরা রেয়াত করত না, উল্টে তার কপালেও জুটত উত্তম মধ্যম। কিন্তু হাজার হোক, কৃষ্ণসুন্দর হলেন ডিপোমালিকের শ্বশুরমশাই। সে যতই ‘ডিপোর বিয়ে’ হোক, যতই নবকিশোর দত্ত নিজের এই কুটুম্বকে গুরুত্ব না দিক, আত্মীয়তাটুকু তো অস্বীকার করা যায় না। অন্তত এই দারোয়ান সম্প্রদায় সেটাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না।

স্বভাবতই তারা থমকে দাঁড়াল। মোহন নামের এক প্রহরী বলে উঠল, ‘আপ হঠ যাইয়ে ঠাকুরজি। উসকো থোড়া সবক শিখানা হোগা।’

কৃষ্ণসুন্দর আগে এক ফোঁটাও হিন্দি জানতেন না। কিন্তু এখানে আসা ইস্তক ডিপোর প্রহরীদের হিন্দি বুলি আর সর্বোপরি সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যে তিনি এখন হিন্দি বুঝতে পারেন। তিনি বললেন, ‘কাকে সবক শেখাতে চাইছ তোমরা? ওর কি বাহ্যজ্ঞান আছে? একটা অবোধ পাগলকে এইভাবে মারধোর করে কী সুখ হচ্ছে তোমাদের?’

মোহন বলল, ‘পাগল কিসকো বোল রহা হ্যায় আপ ঠাকুরজি? উসকো হামনে বোলা কি ইয়ে কাগজ পর অঙ্গুঠা ছাপ লাগা দে। দের হো রহা হ্যায়। লেকিন ইয়ে হারামজাদা নেহি শুন রহা হ্যায়।’

কৃষ্ণসুন্দরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই জিতুপাগলা সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলল, ‘মুই পাগল লয় পণ্ডিতমশাই। উ কাগজে ছাপ আমি দেবক লাই। উ কাগজ সর্বনাশের কাগজ। মানুষরে শ্যাষ করার কাগজ!’

কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘জিতু, তুমি পড়াশুনো জানো?’

‘সামান্যি।’ জিতু শান্তস্বরে বলল, ‘তবে আপনের মতো লয়। আর জেনেই বা কী হবেক? কিছু করতি তো পারবক লাই। তাই মুই পাগল থেইকাই ভালো থাকি।’

কৃষ্ণসুন্দর লাইন বহির্ভূত হয়ে এসে কাগজটা চেয়ে নিলেন। বারতিনেক ভালো করে পড়লেন। সাধারণ একটা চুক্তিনামা। যে শ্রমিক সাগরপারে কাজ করতে যাচ্ছে, তার নাম, বয়স, ঠিকানা, বিবরণ, স্বেচ্ছা-অঙ্গীকার। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না, সেই স্বীকারোক্তি। কাগজের নীচের দিকে বেশ স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে, চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর।

লোকে বলে, এই মেয়াদ নাকি ওইসব দেশের খামারমালিকেরা পাত্তাই দিতে চায় না। ক্রীতদাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও তারা সেই চোখেই দেখে এইসব চুক্তির গিরমিটদের। একবার তাদের গুহায় প্রবেশ করলেই হল, বেরনোর পথ নাকি চিরতরে বন্ধ।

কৃষ্ণসুন্দর এক ঝলক সবার দিকে তাকালেন। ডিপোর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সকলের চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। গরিষ্ঠভাগেরই অক্ষরপরিচয় নেই। তাদের প্রতিবাদ করার সাহস নেই, দৃঢ়তা নেই। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যত ভয়ই তাদের মধ্যে থাকুক, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রতিবাদী বুদ্ধি তাদের নেই। তারা তাই ডিপোর এই পণ্ডিতমশাইয়ের মুখ থেকে নির্ভরযোগ্য কিছু শুনতে চায়।

কৃষ্ণসুন্দর কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে স্পষ্টস্বরে বললেন, ‘আমরা কেউ যদি এতে না সই করি, না টিপছাপ দিই? তাহলে কি করবে তোমরা? জোর করে নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে পারবে না, সরকার বাহাদুরের কড়া নিষেধ রয়েছে।’

মোহন সর্দার হকচকিয়ে গেল। বর্শা হাতে সে কয়েকমুহূর্ত তাকাল আশপাশের সাঙ্গোপাঙ্গোর দিকে। বিভ্রান্ত গলায় বলল, ‘আপ ইয়ে ডিপোমে আ গিয়া তো সহি আপকো করনা হি পড়েগা।’

‘কেন? সই করাচ্ছ আজকে, জাহাজে ওঠার কয়েক ঘণ্টা আগে। সই আমি না-ই করতে পারি।’ কৃষ্ণসুন্দর দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘জোর করে সই নিতে গেলে দেশে থানাচৌকি আছে, সেটা ভুলে যেও না।’

মোহন সর্দার কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইল। তার সুবিশাল শরীরটা স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

স্পষ্টতই সে ঘাবড়ে গিয়েছে। সে প্রথমে ছিল নবকিশোর দত্তর বাড়ির দারোয়ান। কয়েকমাস হল তার পদোন্নতি হয়েছে ডিপোয় এসে। আসার পর তার উপার্জন খুব বেশি না বাড়লেও ফুর্তি অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। কারণ ওটা ছিল গৃহস্থ বাড়ি, চাইলেই কাউকে প্রহার করা যেত না, নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ করা ছিল বেশ কঠিন। এখানে যাকে যত খুশি পেটাও, যে মেয়েকে খুশি তাকে নিয়ে ফুর্তি করো, কেউ কিছু বলার নেই।

রামবিলাস প্রধান প্রহরী হলেও নিজের দৈহিক শক্তিতে মোহন এর মধ্যেই দ্বিতীয় প্রধান পদটি দখল করেছে। মাথা তার বেশি না চললেও সেই খামতি সে তার দেহবল দিয়েই মেটায়।

কিন্তু এমন প্যাঁচে সে এর আগে কখনো পড়েনি।

বস্তুত, ওই কাগজে কী আছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণও তার জানা নেই। সে শুধু জানে, এক দল করে আসে, কিছুদিন বাদে জাহাজে উঠে চলে যায়। যাওয়ার দিন সকালে নিয়ম মোতাবেক এই কাগজে টিপছাপ দিয়ে নিতে হয়।

ডিপোয় এখন বড় মাথা কেউ নেই। সবাই রয়েছে বালুঘাটের জেটিতে। ওই ঘাট থেকে প্রধানত শ্রমিকবোঝাই জাহাজই ছাড়ে। তাই সেঘাটের এখন লোকমুখে নাম হয়ে গিয়েছে সুরিনাম ঘাট।

গোমস্তা মধুসূদন থেকে প্রধান প্রহরী রামবিলাস, সবাই এখন সেখানে জাহাজে একে একে লোক ওঠানোর তদারকি করছে। সেখানে উপস্থিত সরকারি প্রতিনিধিকে উত্তম জলযোগ ও উৎকোচসহ বুঝিয়ে দিচ্ছে। সব কাজ হচ্ছে আইন মোতাবেক।

এখানকার দায়িত্ব রয়েছে মোহনের ওপর।

ডিপোর বিশাল দালানটায় থমথম করছে নিস্তব্ধতা। সবাই প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কৃষ্ণসুন্দর ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণের আগে অযাচিতভাবে এক সুযোগ এসে উপস্থিত হয়েছে তাঁর কাছে। এইসব অসহায় মানুষগুলো মাটির তালের মতো, তাদের ঠিকমতো বোঝাতে পারলে তারাও গর্জে উঠবে।

তিনি গলা চড়িয়ে বললেন, ‘কেউ সই কোরো না। চলো, আমরা সবাই বেরিয়ে থানায় যাই।’

একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তোতারাম আর পরেশ কৈবর্ত। তোতারাম কৃষ্ণসুন্দরের উদাত্ত আহ্বান শুনে গলা চড়িয়ে বলল, ‘হ। মোরা কিছুতেই ছাপ দিমু না। ঠাউরমশাই সঠিক কইসেন! কেউ ছাপ দিবা না।’

শ্রমিক নরনারীর মধ্যে গুঞ্জন ক্রমেই জোরালো হতে শুরু করল। মহিলাদের দল থেকে একজন বিগতযৌবনা মহিলা বেরিয়ে এল। তার নাম চামেলি। চালচলন বেশভূষা দেখলেই বোঝা যায় সে প্রাক্তন রূপোপজীবিনী।

ডান হাত কোমরে দিয়ে মুখ নাড়িয়ে চামেলি কর্কশস্বরে বলল, ‘আমি তো পেত্থম থেকেই বলে আসচি, যে আমি যাবুনি। দুদিনের একটা ছোঁড়া এসে যাহোক তাহোক করে বুঝিয়ে আমারে একানে দে চলে গেল। আমি কত বলচি যে আমি ঘরে যাব, কেউ শোনে না।’

‘পণ্ডিতমশাই স্বয়ং আমাদের সঙ্গে আছেন।’ পরেশ কৈবর্তের মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল, ‘এবার সবাই শুনবে। চলো সবাই গেটের দিকে। আমরা সবাই বেরিয়ে যাই।’

নারীপুরুষ মিলিয়ে বন্দীর সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ আর ডিপোর প্রহরীর সংখ্যা এই মুহূর্তে সাকুল্যে কুড়ি। মধুসূদন গোমস্তা বা রামবিলাস না থাকায় মোহন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা বর্শা উঁচিয়ে ধরলেও তাদের মুখে সেই আত্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি অনুপস্থিত। বরং বিভ্রান্তভাবে তারা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে।

‘ধইরা মার এই আবাগির পোলাগুলারে! ঘিলু ফাটায়া দে।’ তোতারাম চিৎকার করে উঠেই একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীর মুহূর্তের অন্যমনস্কতার সুযোগে তার বর্শাটা কেড়ে নিল।

তারপর বর্শার ধারালো সূচাগ্র দিয়ে পরক্ষণেই এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে গেল প্রহরীটিকে।

তৎক্ষণাৎ প্রহরীটি নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় তার প্রাণরক্ষা হল বটে, কিন্তু বর্শা এসে বিঁধল তার ডানপাঞ্জায়। রক্ত ঝরতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে।

মুহূর্তের মধ্যে গোলমাল বেধে গেল। মোহন ও তার সঙ্গীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্দিদের ওপর। বন্দিরাও কম যায় না। এতদিনের বন্দীদশা, কথায় কথায় বর্শার খোঁচা তাদের বেপরোয়া করে তুলল।

কৃষ্ণসুন্দরও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইলেন না। একজন প্রহরীর হাত দুটি পেছন থেকে চেপে ধরলেন, তারপর চেষ্টা করতে লাগলেন তার হাতের বল্লমটি নেওয়ার।

মেয়েরা সরে গিয়েছে এক কোণে। তাদের অধিকাংশেরই মুখে ফুটে উঠেছে ভয়ের ছাপ। দু-একজন চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে বন্দীদের। চামেলির মতো দু-তিনজন মাটি থেকে ছোট ছোট ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ছে প্রহরীদের লক্ষ্য করে।

কয়েকমুহূর্তের লড়াই মাত্র। তারপরেই গেটের কাছে একখানা বাজখাঁই কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘এসব কী হচ্ছে এখানে? রামবিলাস?’

কণ্ঠের তীব্রতায় সবাই চমকে তাকাল সেদিকে এবং থেমে গেল।

মাথায় বেনিয়া টুপি, পরনে ধোপদুরস্ত পিরান-ধুতি। উপস্থিত হয়েছেন ডিপো মালিক নবকিশোর দত্ত স্বয়ং।

পাশে ছত্রধর হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর সহচর গণেশ।

নবকিশোর দত্ত পোড় খাওয়া ব্যবসায়ী। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ মুহূর্তকাল জরিপ করেই বুঝে গেল, এখানে একটি ছোটখাটো বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছে। শ্রমিক রপ্তানির দিন তিনিও ফেরিঘাটে যান, আজও সেখানেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথমধ্যে বিশেষ এক কারণবশত তিনি নিজের ডিপো পরিদর্শনে এসে পড়েছেন। ভাগ্যিস!

তাঁর চোখের ইঙ্গিতে উল্কার গতিতে পেছন থেকে এসে ডিপোর দালানে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর সশস্ত্র লাঠিয়ালরা। পলকের মধ্যে মোহন ও তার দলও মনে বল পেল। নিরস্ত্র বন্দীদের কবজায় আনতে তাদের আর অর্ধেক দণ্ডও সময় লাগল না।

লড়াই শেষ যখন হল, তখন কৃষ্ণসুন্দর বসে পড়েছেন মাটিতে। প্রভুর শ্বশুরমশাই বলে নবকিশোর দত্তর লাঠিয়ালরা রেয়াৎ করেনি, তাঁর বামগাল দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে। অন্যান্য বন্দীরা সবাই আহত। ওদিকে তোতারামের অবস্থা শোচনীয়। তার পায়ে এমন মেরেছে লাঠিয়ালরা, যে সম্ভবত হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। কাটা ছাগলের মতো পরিত্রাহি চিৎকার করছে সে।

‘থাম। ছেড়ে দে। এর চেয়ে বেশি মারলে ওর দাম পাব না।’ নবকিশোর দত্ত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বললেন। তারপর নাগরা মসমসিয়ে এগিয়ে এলেন বসে থাকা কৃষ্ণসুন্দরের দিকে।

থেমে থেমে বললেন, ‘আপনি যদি আমার কুটুম না হতেন, আপনাকে আজ আস্ত রাখতুম না। আমার ব্যারাকপুরের বাগানবাড়ির ষণ্ডা ডালকুত্তাগুলোকে দিয়ে খাওয়াতুম। লোকদের খেপিয়ে নেতা হতে চাইচেন? আপনি এখানে একটুও কিছু বেগরবাই করলে ওদিকে আপনার দু-দুটি কন্যে আস্ত থাকবে?’

কৃষ্ণসুন্দর কোনো উত্তর করলেন না। তরী তীরে এসেও ডুবে যাওয়ার ব্যর্থতায় তিনি মনে মনে আফসোস করছেন। নবকিশোর দত্তর শেষ বাক্য শুনে তিনি চমকে উঠলেন। এই দিকটা তিনি একেবারেই ভেবে দেখেননি। এখানে কিছুমাত্র প্রতিবাদ করলে সেই শাস্তি ভোগ করতে হবে অপালা ও লোপামুদ্রাকে। যে মানুষ নিজের স্ত্রীর পিতা-মাতাকে বেচে দিতে পারে, তার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।

মোহন সর্দারের যে প্রহরীকে তোতারাম আঘাত করেছিল, সে এখন পরিস্থিতি অনুকূল পেয়ে এগিয়ে এসে তোতারামের আহত রক্তাক্ত পায়ে বর্শার ভোঁতা দিক দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। এত বড় সাহস, বন্দি হয়ে তার গায়ে হাত দেয়!

‘আহহ!’ বিরক্ত নবকিশোর দত্ত হিংস্রনাদ ছাড়লেন, ‘বলচি না ওটাকে ছেড়ে দিতে? পঙ্গু হয়ে গেলে দাম পাব? আর দেরি না করে ঝটপট সবাইকে বের কর দিকি। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্চে।’

যুদ্ধশেষে পরাজিত বন্দিরা বিনাবাক্যব্যয়ে একে একে চুক্তিনামায় ছাপ দিয়ে বেরোতে থাকে ডিপোর গেট দিয়ে।

কৃষ্ণসুন্দর ক্লান্ত মনে পুত্রের হাত ধরে ডিপোর গেটের দিকে পা বাড়ালেন। নারীপুরুষের পৃথক দল এতকিছু ডামাডোলে ইতিমধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল, চুক্তিনামায় ছাপ দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, গলা থেকে ঝুলছিল সেই চাকতি।

দিব্যসুন্দর ফিসফিস করে বাবার কানে বলল, ‘আমরা কি আর কোনোদিনও দিদিদের দেখতে পাব না, বাবা?’

 কৃষ্ণসুন্দর ইদানীং পুত্রের সিংহভাগ প্রশ্নের উত্তরেই মৌন থাকেন, এখনো তার অন্যথা হল না। তার ওপর একটু আগে পুত্রের সামনে নিজের এত বড় বেইজ্জতি, অপমান তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।

আর কত? আর কত যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা সহ্য করলে এই ধরাধাম থেকে মুক্তি ঘটবে? সত্যিই কি শুভশক্তি অশুভের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী হয়?

ডিপোর গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক প্রাকমুহূর্তে পেছন থেকে নবকিশোর দত্ত ডাকলেন, ‘পণ্ডিতমশাই, শুনুন।’

কৃষ্ণসুন্দর পেছন ফিরতেই নবকিশোর দত্ত এতক্ষণ যেন কিছুই হয়নি এইভাবে বললেন, ‘আপনারা এগিয়ে যান। ভুবনমণি যাবে না।’

ভুবনমণি চমকে তাকাল নবকিশোর দত্তর দিকে। উপর্যুপরি অপ্রত্যাশিত আঘাতে সে ‘ঘরপোড়া গরু’র মতো ত্রস্ত চোখে চেপে ধরল বৌঠান ব্রহ্মময়ীর আঁচল।

কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘ও যাবে না? কেন?’

নবকিশোর দত্তর জন্য ইতিমধ্যে একটা বড় রেকাবি করে ডাবের জল এনে দেওয়া হয়েছে। ডিপোর বাগানে অনেক নারকেল গাছ, তাই ডাব অঢেল। বেশিরভাগই ঝুনো নারকেল হয়ে পচে যায়। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কোনো বন্দি খেয়ে ফেললে তার সাজা হয় অন্তত একশো ঘা বেতের বাড়ি।

কিছুটা ডাবের জল এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিয়ে বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে নিলেন নবকিশোর দত্ত। তারপর সহজসুরে বললেন, ‘আহা, একটু পরে যাবে। আপনারা এগোন।’

কৃষ্ণসুন্দর ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকিয়ে থাকেন। নবকিশোর দত্তর সহজ কথার পেছনে কি গূঢ় অভিসন্ধি লুকিয়ে রয়েছে, তার তল পাওয়া দুষ্কর। সকলে যেখানে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে, পদব্রজে এগিয়ে চলেছে জাহাজঘাটের দিকে, সেখানে ভুবনমণি এখন যাবে না-ই বা কেন?

এক প্রহরী এসে কৃষ্ণসুন্দরকে মৃদু টোকা দেয়, ‘আপলোগ যাইয়ে। দের হো রহা হ্যায়।’

ভুবনমণি কেঁদে ওঠার উপক্রম করে।

নবকিশোর দত্ত এবার স্বভাববিরুদ্ধ নরম গলায় বলেন, ‘আহ আপনি কাঁদবেন না, পিসিমা।’

নিজের চেয়ে প্রায় দেড়কুড়ি বছরের বড় লোকটির গলায় ‘পিসিমা’ ডাক শুনে ভুবনমণি প্রথমে বিস্মিত হয়ে যায়, কিন্তু অপালার সুবাদে সদ্যস্থাপিত কুটুম্বিতা ও ‘মা’ ডাকের সঙ্গে যে পবিত্রতাটুকু জড়িয়ে আছে, তা চিন্তা করে কিঞ্চিৎ আশ্বস্তও হয়।

দ্বিধাগ্রস্থ দাদা ও বউঠানকে সে-ই বলে, ‘তোমরা এগোও। আমি আসচি।’

‘তাড়াতাড়ি এসো পিসিমণি।’ দিব্যসুন্দর ছুটে এসে পিসিমার কপালে চুম্বন দেয়। তারপর বাধ্য সন্তানের মতো পিতার হাত ধরে এগিয়ে যায়।

ভুবনমণির চোখ জলে ভরে ওঠে। প্রাণপণে নিজেকে সংবরণ করে অবগুণ্ঠনের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে।

কৃষ্ণসুন্দররা চোখের আড়াল হতেই নবকিশোর দত্ত হাঁকডাক করে নিজের ছ্যাকড়া গাড়ির কোচোয়ানকে হাজির করেন। তারপর একটুও সময় অপচয় না করে ভুবনমণিকে নিয়ে উঠে বসে নিজের ছ্যাকরা গাড়িতে।

শহরের পথ দিয়ে গাড়ি চলে টগবগিয়ে। ভুবনমণি কিছুই বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। হঠাৎ তার ওপর নবকিশোর দত্তর এত স্নেহবর্ষণের হেতু কী, যে অন্যান্যদের মতো পদব্রজে না রওনা করে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গাড়িতে করে?

ভুবনমণি জীবনে প্রথমবার ছ্যাকরাগাড়িতে চেপেও সেই অনুভূতি উপভোগ করতে পারে না, অজানা আশঙ্কায় প্লাবিত হতে থাকে তার মন।

অপেক্ষার অবসান হয় দণ্ডকাল পরেই। গাড়ি হঠাৎ থেমে যায়। ভুবনমণির কৌতূহলী কিশোরী মন কোনোদিনও ফেরিঘাট প্রত্যক্ষ না করলেও ভেবেছিল নিশ্চয়ই চারপাশ থেকে হাঁকডাক, ব্যস্ততা ভেসে আসবে। কিছুক্ষণ অন্তরই বেজে উঠবে জাহাজের ভোঁ। কোনোদিনও না শুনলেও ঠিক চিনতে পারবে সে।

কিন্তু তাকে বিস্মিত করে আশপাশের পরিবেশ সম্পূর্ণ নীরব দর্শক হয়ে থাকে। পাখিদের কূজন ছাড়া কিছুই শোনা যায় না।

নবকিশোর দত্ত গাড়ি থেকে সাবধানে অবতরণ করেন। তারপর বলেন, ‘পিসিমা। আপনি নেমে আসুন।’

আবার সেই ‘মা’ ডাক! বাড়ির একমাত্র জামাই বাবাজীবনের ডাকে আশ্বস্ত হয়ে ভুবনমণি নেমে আসে গাড়ি থেকে। এবং তারপরেই অবাক হয়ে যায়।

কোথায় জাহাজ আর কোথায় কি! এ তো শহরের সাধারণ একটি গলি। সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি দ্বিতল পাকাবাড়ি। নবকিশোর দত্ত সেই বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাডতে নাড়তে বললেন, ‘পিসিমা, আপনাকে একেনে রেখে যাচ্চি। নতুন জীবন শুরু করুন। ভাইঝিদের কথা কইতে যাবেন না, খবর পেলে তাদের দুটোকেই কেটে ফেলব। নব দত্ত বাজে কথা বলে না। মনে থাকবে?’

ভুবনমণি কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কোনো প্রহরীও আসেনি তাদের সঙ্গে, গাড়ির কোচোয়ান নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পথের দিকে।

বারকয়েক কড়া নাড়ার পর দরজাটি খুলে যায়। ভুবনমণির ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে পায়, এক বয়স্কা পরিচারিকা উঁকি মারে, ‘কাকে চাই?’

‘তোমার বাবু নেই?’ নবকিশোর দত্ত জিগ্যেস করেন।

‘আজ্ঞে না। মা আচেন।’ পরিচারিকা জবাব দেয়, ‘কী নাম বলব?’

‘কিচু নাম বলতে হবে না।’ নবকিশোর দত্ত জেব থেকে একটা কাগজ বের করেন, ‘এই চিঠিটা গিয়ে তোমার মা’কে দেবে। আর একে নিয়ে যাও।’ নবকিশোর দত্ত ইঙ্গিতে ভুবনমণিকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে বলেন।

ভুবনমণি বজ্রাহতা হয়ে যায়। এ কী হচ্ছে? ফেরিঘাটে দাদা-বউঠানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর জাহাজে ওঠার পরিবর্তে তাকে এক গৃহস্থবাড়িতে পদার্পণ করতে হচ্ছে কেন!

কিন্তু সেই ‘কেন’-র উত্তর খোঁজার মতো অবকাশ দেওয়া হয় না তাকে। একরকম জোর করেই নবকিশোর দত্ত পরিচারিকার পেছন পেছন তাকে ঢুকিয়ে দেন বাড়ির ভেতর।

তারপর আর কোনদিকে না তাকিয়ে দৃঢ়পদে গিয়ে উঠে বসেন নিজের গাড়িতে। যেন সন্তর্পণে অনেক কষ্টে বেড়াল পার করে এসেছেন, এইভাবে হুকুম করেন, ‘জলদি চলো বালুঘাট। দেরি হয়ে যাচ্চে।’

ভুবনমণি ঘটনার আকস্মিকতায় কী করবে ভেবে পায় না, পুতুলের মতো পরিচারিকাটির অনুগামিনী হয়।

দেখতে ভুলে যায় চারপাশ। ঠিকমতো লক্ষ্য করলে সে দেখতে পেত, দ্বিতল বাড়িটির প্রবেশদ্বারের একপাশে নেমপ্লেটে ইংরেজি হরফে লেখা রয়েছে গৃহস্বামীর নাম। সে অবশ্য ইংরেজি পড়তে পারে না।

নামটি বেশ দীর্ঘ এবং ভারিক্কি। শ্রীযুক্ত দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

অপালার জীবন নিঃসন্দেহে করুণ। তবে বিরল নয়।

রজোদর্শনের আগেই তাকে ধ্বজদর্শন করতে হল। জন্মরহস্যের গূঢ় তত্ত্বটি তার জানা ছিল না, হয়ত বা কৃষ্ণসুন্দরের বিদ্যোৎসাহী স্বভাবের জন্যই কন্যাকে বৈবাহিক বিষয়ে জ্ঞানী করে তুলতে তিনি তেমন উদগ্রীব হননি। ব্রহ্মময়ীও সেই পথে হেঁটেছেন।

কিন্তু সেই মাশুল দিতে হল তাঁর কন্যাকে। প্রথম রাতে এক শয্যায় শুয়ে স্বামীর এই অস্বাভাবিকসম আদিম রূপ দেখে সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

সেই চিৎকারের প্রাবল্য এতটাই যে ঘরের বাইরে দণ্ডায়মান দত্তবাড়ির প্রহরী-দুজন প্রথমে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণ অশ্লীল রসিকতা করলেও আর্তনাদের তীব্রতায় বধিরতার ভান করে দাঁড়িয়ে রইল।

অপালার সপত্নী দয়াময়ী ও পরেশমণির মহল অন্যদিকে হলেও উমাতারার মহল পাশেই। অপালার পরিত্রাহী আর্তনাদ তার কানেও পৌঁছল।

‘মাগি কেমন বেহায়ার মতো চেঁচায় দ্যাকো, ছ্যা ছ্যা! আমরা কি আর সোয়ামির সঙ্গে শুইনি নাকি, না সোয়ামি আমাদের সোহাগ করেনি? হাঘরের বেটি হলে যা হয়।’ সব জেনেবুঝেও উমাতারা মুখ বেঁকাল।

সোয়ামীর সোহাগে অপালা কতটা তৃপ্ত হল তা সে-ই জানে, কিন্তু তার অপরিণত প্রায় শিশু শরীর এক মধ্যবয়স্ক কামাতুর বহু-অভিজ্ঞ শিশ্নকে সেভাবে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে পারল না। পরিত্রাহী আর্তনাদ অন্তে ক্রমাগত রক্তক্ষরণে সে ঝিমিয়ে পড়তে লাগল।

নবকিশোর দত্ত বহু নারীতে উপগত হয়েছেন, কিন্তু এমন অঘটনের সম্মুখীন কখনো হতে হয়নি। রতিক্রিয়া তাঁর মাথায় উঠল। ভীত চোখে তিনি দেখলেন, রক্তস্রোত ক্রমাগত বেরিয়ে গোটা ‘ফুলশয্যা’কে রক্তাক্ত করে তুলছে। তিনি পালঙ্কের পাশের কুলুঙ্গিতে থাকা জলের পাত্র নিয়ে বারকয়েক জলের ছিটে দিলেন পত্নীর মুখে। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হল না। অপালার চোখের পাতা সামান্য কেঁপে উঠলেও সে নিঃস্পন্দ হয়ে পড়ে রইল।

প্রচুর আর্তনাদ শেষে অপালা যখন প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে, তখন নবকিশোর দত্ত আর ঝুঁকি না নিয়ে অন্ধকার রাতে ঘরে নিবু নিবু হয়ে জ্বলতে থাকা হ্যাজাকটা নিয়ে ডেকে আনলেন নববধূর জন্য নিয়োজিত দাসী বাদলের মা’কে।

বাদলের মা দত্তবাড়িতে রয়েছে তা আজ প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল। এই বাড়ির ঘাঁতঘোত সবই তার নখদর্পণে।

নবকিশোর দত্ত অন্ধকারে গিয়ে চুপিসাড়ে ফিসফিস করে ডাকতেই বাদলের মা ধড়মড় করে উঠে বসল। এমনিতে সে বাড়ির পরিচারিকা, কিন্তু প্রয়োজনে ধাত্রীও বটে। সে ঘরে ঢুকে এক ঝলক দেখেই পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। কোথা থেকে একটা পাত্রে করে গরম জল নিয়ে এল। তারপর নিজের সাদা থানের একপ্রান্ত ফস করে ছিঁড়ে জলে ডুবিয়ে নিয়ে অপালার রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগল।

নবকিশোর দত্তের গলা কাঁপছিল। কালাপানির ওপারে খামারমালিকরা কোনো গিরমিটওয়ালাকে পিটিয়ে মারল, সে জন্মের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, সে একরকম। তার দেশোয়ালি কেউ এসে টাকাপয়সা চাইল, নবকিশোর মিটিয়ে দিলেন।

কিন্তু, দত্তবাড়ির বউ যদি সহবাসে মারা যায়, ছি ছি! সে বড় লজ্জার কথা হবে। খবর চাপা রাখলেও বাড়ির কাজের লোকদের জন্য ঠিকই চাউর হয়ে যাবে।

একেই নবকিশোর এখন সমাজের মান্যগণ্য মহলে একটু একটু করে ঢুকতে চাইছেন।

ঢুকতে গেলে শুধু ভুরিভুরি অর্থ জোগান দেওয়ার মানসিকতা থাকলেই চলবে না, প্রয়োজন শিক্ষার কৌলীন্য। আর এখানেই নবকিশোর বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। জোড়াসাঁকোর জমিদারি সভা থেকে শুরু করে কেশব সেনের ভারত সভা। কোথাওই যেন তিনি কল্কে পাচ্ছেন না। যাও বা আগেরবছর কেশব সেন মারা যেতে ভারতসভায় ঢোকার পথ একটু হলেও সুগম হয়েছিল, ওদের নেতাদের মাথায় দেশাত্মবোধের ভূত চাপতে নবকিশোর সভয়ে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যায়? বিদেশে তাঁর চিড়িয়া সাপ্লাইয়ের ব্যবসা-ই হোক বা মানুষ সাপ্লাইয়ের, ইংরেজরাই তো হর্তা কর্তা।

চিন্তার সাগর থেকে গাত্রোত্থান করে নবকিশোর আবার বাস্তবে ফিরে আসেন।

অপালা এখনো অচৈতন্য। তার ঠোঁটের একপ্রান্তে সামান্য রক্ত কালচে হয়ে শুকিয়ে রয়েছে। বুকের আবরণ উন্মুক্ত। সেখানে যে যুগ্মবিল্ব দেখা যাচ্ছে, তারা এখনো কালিদাসের ভাষায় ‘পুষ্পস্তবক স্তনাভ্যঃ’ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু এর মধ্যেই সেই অপরিপক্ক কিশোরী বক্ষদেশ কামড়ানো ও আঁচড়ানোর বীভৎস ক্ষতচিহ্নে ভর্তি।

বাদলের মা কোনো কথা বলছিল না। কর্তামশাইয়ের এইরকম বিকারের কথা সে আগে কানাঘুষোয় দাসীমহলে শুনেছিল, কিন্তু সেই রূপ যে এমন কদাকার তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। আহা গো! এইটুকু দুধের মেয়ে, একটা রাত্তিরে যেন নিংড়ে পিষে ফেলেছে।

বাদলের মা বেশ কিছুক্ষণ সেঁক দেওয়ার পর ক্ষতস্থানে ভালো করে পট্টি বাঁধল।

অপালার জ্ঞান ফিরল প্রায় অর্ধপ্রহর পরে। চেতনাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সে কেঁদে উঠল যন্ত্রণায়। নবকিশোর প্রকাণ্ড কক্ষের এক প্রান্তে একটি কেদারায় বসেছিলেন। বাদলের মা একটা বড় রেকাবিতে করে গরম দুধ নিয়ে এসে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই অপালা মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগল। বারংবার চেষ্টায় অপালার হাতের আঘাতে সেই পাত্রটা ফসকে গিয়ে পড়ল নবকিশোরের পায়ের কাছে।

দুধে মাখামাখি হয়ে গেল গোটা কক্ষ।

পরদিনই জরুরি তলব পেয়ে ধনঞ্জয় পণ্ডিত এলেন। অন্দরমহলে অপালা তখনও শয্যাশায়ী। নবকিশোরের অপরাধী মুখের সামনে বসে মিষ্টান্ন সেবন করতে করতে বললেন, ‘এইসবে এত উতলা হলে তো চলবে না দত্তমশাই। আমি পূর্বেই বলেছি আপনার অদৃষ্টে লেখাই রয়েছে লুপ্তপিণ্ডোদক হয়ে ধরাধাম ত্যাগ করা। আমি আমার সাধ্যমতো একটা দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির সাহায্যে সেই ভবিতব্যকে খণ্ডানোর চেষ্টা করছি। নিজের ক্ষমতাবলে পাল্টে দিতে চাইছি আপনার বিধির বিধান। এবং তার জন্য আপনার দিক থেকে বজ্রকঠিন সংকল্পের প্রয়োজন। এইসব ছোটখাটো ঘটনায় যদি আপনি মুষড়ে পড়েন, তবে তো সমস্যা।’

‘না না মুষড়ে পড়িনি ঠাকুরমশাই।’ নবকিশোর দ্রুত বলে উঠলেন, ‘আপনি যা বলচেন আমি তো সবই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলচি। বামুনের দশ বছরের মেয়েকে বে’ করেচি, তাতে উপগতও হইচি। কিন্তু ভয় পাচ্চিলাম যদি মরে-টরে যায়, তবে জানাজানি হয়ে গেলে বদনামের ভাগীদার হব। যত যাইহোক, কাজটা অন্যায্য! দেকচেন তো, আজকাল প্রায়ই ফুলসজ্যের রাতে ছুঁড়িগুলো মারা যাচ্চে। এই নিয়ে কিছু লোক আবার আন্দোলনও শুরু করেছে।’

ধনাপণ্ডিত এবার মিষ্টান্ন ভোজন বন্ধ করে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নবকিশোর দত্তর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘বটে? দশ বছরের কন্যায় উপগত হওয়া অন্যায্য? তা আপনি নিজেই যখন এত কিছু জেনে গিয়েছেন, আমাকে এই দায়িত্ব অর্পণ করলেন কেন?’

নবকিশোর ধনাপণ্ডিতের এই আকস্মিক কূপিত হয়ে ওঠাতে প্রমাদ গুণলেন। আধবিঘত জিহ্বা বের করে বলতে গেলেন, ‘না না ঠাকুরমশাই, আপনি পণ্ডিত মানুষ, আমি কতটুকু জানি…!’

কিন্তু ধনাপণ্ডিতের কর্ণকুহরে সেকথা প্রবেশ করল না, তিনি একইভাবে স্থিরলয়ে বলে যেতে লাগলেন, ‘আপনাকে কে বলেছে যে ঋতুমতী না হওয়া কন্যায় উপগত হওয়া অন্যায়? দেশবিদেশের কতটুকু সংবাদ রাখেন আপনি? জানেন, আদিম যুগে যুদ্ধকালে তলোয়ারকে আরো তীক্ষ্ন করার জন্য কুমারীর ঋতুর প্রথম রক্ত মেশানো হত? আপনি কি পিরামিডের দেশ মিশরের নাম শুনেছেন?’

নবকিশোর সভয়ে দু’পাশে মাথা নাড়লেন। মিশর আবার কোথায়? নবাবের আবদারে একবার কী একটা পাখি আনার জন্য অযোধ্যায় লোক পাঠাতে হয়েছিল। মিশর কি তার চেয়েও দূরে?

‘মিশর দেশে নীল নদ আছে। আমাদের মা গঙ্গার মতো। সেই নদীর জল বৃদ্ধির জন্য কুমারী বলি দেওয়া হত। শুনুন দত্তমশাই, কুমারী হল এক প্রচণ্ড সৃষ্টিশক্তি। কাপালিকরা কুমারীরক্তে তন্ত্রসাধনা করে। দেহরসের সাধনা। আর কৌমার্যই সেই সাধনার মূল ধারক। তন্ত্রে কুমারী-সহবাস কতটা ভয়াবহ, তার বর্ণনা যমালতন্ত্রে রয়েছে। সেসব কিছু তো আপনার চতুর্থ পক্ষকে সহ্য করতে হচ্ছে না। শুধুমাত্র স্বামীর বংশবিস্তারে তাকে সাহায্য করতে হচ্ছে। আর ওই যে বললেন আজকাল মেয়েরা মারা যাচ্ছে, সে তো কলেরাতেও মরছে লোক। কারুর যদি রোগের সঙ্গে যুঝতে পারার ক্ষমতা না থাকে, সে তো মরবেই।’

নবকিশোর আর কিছু না বলে শুধু সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

‘প্রথমবার এমন ঘটনা অনেকেরই হয়। ভয় পাবেন না। এরপর আর কোনো সমস্যা হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।’

নবকিশোর চুপ করে রইলেন। এই পণ্ডিত কতদিনে তাঁকে পুত্রদান করতে পারবেন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। ধৈর্য হারালে চলবে না। যাইহোক না কেন, লুপ্তপিণ্ডোদক হয়ে তিনি কিছুতেই মরবেন না।

ধনঞ্জয় পণ্ডিত আবার বললেন, ‘তবে হ্যাঁ । স্বামীসহবাসে বারবার এমন অবস্থা হলে বিকল্প পরিকল্পনাও করে রাখতে হবে। একান্তই যদি চতুর্থ পত্নী পুত্রোৎপাদনে অক্ষম হন, সেক্ষেত্রে পঞ্চম পত্নীর সাহায্য নিতে হবে।’

‘অর্থাৎ…!’ নবকিশোর দত্তের বাক্যস্ফূর্তি হয় না, ‘আবার বিবাহ?’

‘অসুবিধা কোথায়?’ স্বর্গীয় হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেললেন ধনাপণ্ডিত, ‘আরেকটি ব্রাহ্মণকন্যা তো রয়েইছে। এই মা-জননীর ভগ্নি? সেদিনই তো দেখে এলাম! একইরকম সুলক্ষণা।’

‘তাকে যত্নে রাখবেন। প্রয়োজন হলে কাজে লাগানো যাবে।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত সামনে রেখে যাওয়া লোচিকাপূর্ণ পাত্রটি নিজের দিকে টেনে নিলেন।

ধনঞ্জয় পণ্ডিতের কাজের শর্ত হল, যতদিন না তাঁর ‘খদ্দের’ পুত্রবান হচ্ছেন, মাসিক ভিত্তিতে একটি হৃষ্টপুষ্ট পারিশ্রমিক অন্যান্য উপঢৌকন সহযোগে প্রদান করতে হবে।

নবকিশোরের বাড়ির তত্ত্বাবধানে থাকা গোমস্তামশাই ভূপেন মিত্র পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। পণ্ডিত ভোজনের দিকে মনোনিবেশ করামাত্র তিনি দ্রুতপদে চলে গেলেন সেই উপহার নিয়ে আসতে।

ওদিকে ততক্ষণে অন্দরমহলে কথাটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বাদলের মা দায়িত্ব নিয়ে সব দাসীর কানে কানে কথাটা বলে দিয়েছে। সঙ্গে অবশ্য এও বলেছে, ‘খবরদার। কাউকে বলবি নি!’

সেই দাসী ঘাড় নেড়েই পরক্ষণে সেই একই কথা পৌঁছে দিয়েছে পরেরজনের কাছে। সেই পরেরজন আবার তার পরেরজনকে।

মোট কথা, নবকিশোরের প্রথমা পত্নী দয়াময়ী যখন অপালার মহলে তাকে দেখতে এল, তখন দত্তবাড়ির চিলেকোঠায় বসে থাকা কাকটিও কা কা করে যেন বলছে, ‘ছ্যা ছ্যা! আরে বাবা সোয়ামির সোহাগ যদি না সইতে পারিস, মেয়েছেলে হয়ে জন্মানো কেন? জানিস নে, সোয়ামির সোহাগে নারীজন্ম সার্থক হয়?’

উমাতারা পাশের মহলে থাকলেও সকাল থেকে সে বা তার মা কেউই আসেনি এই ‘আদিখ্যেতা’ দেখতে। তাই হঠাৎ দয়াময়ীর আগমনে সবাই বেশ অবাকই হল। সতিনে সতিনে ঠোকাঠুকি দেখতেই লোকে অভ্যস্ত, দরদ দেখলে বিস্ময় তো জাগেই।

দয়াময়ী ঘরে ঢুকেই অপালার পালঙ্কের পাশে বসে থাকা দাসীটিকে বলল, ‘বাইরে যা।’

দাসীটি প্রস্থান করতে দয়াময়ী চোখ মেলে তাকাল অপালার দিকে।

একটা শীর্ণদেহী বালিকা ক্লান্তভাবে শুয়ে আছে বিছানায়।

দশবছরের বালিকাটির অসহায় কাতর চোখদুটির মধ্যে দয়াময়ী যেন খুঁজে পেল বহুবছর আগের নিজেকে।

সেই কতকাল আগে সে এসেছিল এই বাড়িতে। ছোট্ট এগারোবছরের মেয়েটির সীমন্তে তখন উজ্জ্বল সিঁদুর, নাকে তিরতির করে দুলছে সোনার নথ। ঋতুমতী হওয়ার পর পক্ষকালও তিষ্ঠোয়নি তার বাড়ির লোক।

দয়াময়ী এমনিতেই ছিল ধনীকন্যা, তার ওপর জন্মাবধি অসুখে ভোগায় বাবা-মা বা বাড়ির লোকেরা একটু বেশিই স্নেহ করতেন তাকে। মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা পেতে পেতে দয়াময়ীর ধারণা হয়ে গিয়েছিল, ওই ‘খিঁচুনি’ রোগের জন্যই বুঝি তার ভাগ্যে এত ভালোবাসার বহর। আর এই পুনরাবৃত্তি বিবাহের পরেও চলবে।

কিন্তু তার ভুল ভেঙেছিল অচিরেই। পিত্রালয়ে যে কারণ তাকে করে তুলেছিল ‘আলালের ঘরের দুলালি’, সেই কারণই তার শ্বশুরগৃহে হয়ে উঠল ধারালো শূলসম। সঙ্গে করে সে যতই ভারী যৌতুক নিয়ে আসুক, যতই তার স্বামী তার ভাগ্যে হয়ে উঠুন ঐশ্বর্যশালী, ‘খুঁতো বউ’ হওয়ার গঞ্জনা তো সহ্য করতেই হবে।

তখন নবকিশোরের মা ছিলেন বহাল তবিয়তে বেঁচে। বছর দুয়েক তিনি অপেক্ষা করলেন, হাজার হোক, কলকাতার অন্যতম সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। আশ্চর্যজনকভাবে এই দুই বছরের মধ্যে দয়াময়ীর বহু পুরোনো সহচরী ‘মৃগী’ও দেখা দিল না।

নবকিশোরের মায়ের ধৈর্যচ্যুতি হতে সময় লাগল না। ছেলে বাবার মতো ভোলা স্বভাবের নয়, সে চূড়ান্ত বৈষয়িক। এবং সেই কারণেই সে ‘মৃগীরুগি’কে ঘরে এনেছে। এই অবধিও তিনি মেনে নিতে পারেন, কিন্তু বন্ধ্যা পুত্রবধূকে তিনি কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নন।

অতঃপর দয়াময়ীর ভাগ্যে শুরু হল গঞ্জনা এবং পরোক্ষ কটূক্তি। সংসারে দাসদাসী অসংখ্য, কাজ বলতে শুধু দোতলার জানলার খড়খড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে পেছনের দালানে পালোয়ানদের কুস্তি দেখা কিংবা দাসীকে দিয়ে কলাই বা বেসন দিয়ে রূপচর্চা। সেসবই নিজের খেয়ালে হতে থাকল, কিন্তু দয়াময়ীর মানসিক সুখ উধাও হয়ে গেল।

শ্বাশুড়ি উঠতে বসতে তার বন্ধ্যাত্ব নিয়ে খোঁটা দিতে থাকেন। বাড়ির প্রৌঢ়া আশ্রিতাদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ করেই উদাস হয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘এজন্মে এত পয়সা দেকলুম, এত সুখ করলুম, কিন্তু নাতি’র মুখ দ্যাকার সৌভাগ্যি হল না রে কমলা!’

কমলা নামের সেই প্রৌঢ়া সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয়দাত্রীর ‘হ্যাঁ ‘ তে ‘হ্যাঁ ‘ মেলালেন। দয়াময়ী হয়ত ঘরেরই এক কোণে বসে কোনো শখের সেলাই করছে, তাকে উপেক্ষা করেই বলে উঠলেন, ‘তাই তো! তার ওপর তোমার ছেলে তো রাজপুত্তুর গো! আরেকবার ছাদনাতলায় গেলেই তো হয়। একজন বাঁজা হয়েচে বলে তো আর সবাই হবে না। দেকবে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোমার নাতি আসবে গো!’

দয়াময়ী সেলাই থামিয়ে ভাবত, নাতি আসবে কিনা সে জানে না, তবে আরো একটা মেয়ের শরীর ক্ষতবিক্ষত হবে, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু কামনাবৃত্তি নয়, তার স্বামীর সুখ হয় শারীরিক নিপীড়নে।

ধনীকন্যা হয়েও দয়াময়ী ছিল নেহাতই নিরক্ষরা, তাই সে বোঝেনি, তার স্বামীর যৌনবিকৃতিটির নাম ধর্ষকামিতা। সঙ্গিনীকে দৈহিক নির্যাতন করে অপরিসীম তৃপ্তি মেলে তার। স্বামীসহবাস তাকে আর করতে হয় না, কিন্তু স্বামীর সেই অমানুষিক অত্যাচার চিরকালের জন্য আগুনের ছ্যাঁকার দাগ হয়ে বসে রয়েছে তার শরীরে।

সপত্নী আসতে দয়াময়ী সবদিক থেকেই খুশি হল। একদিকে তার পুত্রবতী হওয়ার আশা শাশুড়িমাতা ত্যাগ করলেন, ফলে দোষারোপ, গঞ্জনা, বক্রোক্তি বন্ধ হল। অন্যদিকে সে রেহাই পেল স্বামীর দৈনন্দিন অত্যাচারসম সোহাগ থেকে।

এভাবেই সেই যন্ত্রণার তরঙ্গ প্রবাহিত হয়েছে দয়াময়ী থেকে উমাতারায়, উমাতারার থেকে পরেশমণিতে। নবকিশোরের মা পৌত্রের মুখ দেখার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ওপারে পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু এদের মুক্তি মেলেনি।

শেষমেশ এখন পালা অপালার।

দয়াময়ী আবার ভালো করে তাকাল অপালার দিকে। মেয়েটার মুখটা কেমন পাণ্ডুরবর্ণ হয়ে উঠেছে। চোখ কোটরাগত, ছলছলে। ও বলল, ‘নতুনবউ! তুই নাকি সকাল থেকে কিচু মুকে দিসনি শুনলাম। এমন করলে শরীর টিকবে? শরীর না টিকলে ছেলে বিয়োবি কী করে আর রাতের বেলা মারই বা খাবি কী করে?’

অপালা আধশোয়া হয়ে তাকিয়ে ছিল জানলার দিকে। শেষ বাক্যটা কানে যেতে মুখ ফিরিয়ে তাকাল দয়াময়ীর দিকে। শ্বশুরগৃহে আসা ইস্তক এমন কথা সে এই প্রথম শুনল।

দয়াময়ী আরো কাছে ঘনিয়ে এল। মেয়েটার বুকে কিছু একটা পাতার রস লাগানো হয়েছে, তাই তার ওপরে আলগা করে কাপড় চাপা দেওয়া। সেই স্বচ্ছ কাপড় গতকাল রাতের সেই বীভৎস অত্যাচারকে লুকিয়ে রাখতে পারছে না। নিম্নাঙ্গের রক্তক্ষরণ আটকাতে সেখানে জড়ানো হয়েছে মোটা কাপড়, কিছুক্ষণ অন্তর বিছানা ভিজে যাওয়া আটকাতে সেই কাপড় পরিবর্তন করে দিতে হচ্ছে।

অপালা তার মলিন চোখদুটো মেলে অসহায়ভাবে বলল, ‘তলপেট থেকে ব্যথা কেমন গুলিয়ে উঠছে ওপরের দিকে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে গো দিদি! হাত-পা ঝিমিয়ে আসছে।’

‘ঠিক হয়ে যাবে।’ দয়াময়ী বিছানার পাশের কুলুঙ্গিতে রাখা দুধের পাত্রটা নিয়ে এসে বাড়িয়ে দেয়, ‘শিগগির এইটুকু খেয়ে নে, নাহলে আরো বেশি দুর্বল লাগবে। কোনো কতা শুনতে চাইনে আমি।’

দয়াময়ীর স্নেহার্দ তিরস্কারকে অপালা উপেক্ষা করতে পারে না।

দুধের বাটিটি নিয়ে কয়েক চুমুক দেয়। কিন্তু কয়েক মুহূর্তমাত্র। তারপর হড়হড় করে বমি করে দেয়। কাতরস্বরে চিৎকার করতে থাকে, ‘ও মাগো! কী ব্যথা করছে। আমি আর পারছি না! আর পারছি না সহ্য করতে। মা-মাগো!’

দয়াময়ী প্রাণপণ চেষ্টা করছিল নিজেকে নিরাসক্ত রাখতে। কিন্তু ‘মা’ ডাকটা কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র আর পারল না। চোখ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল।

এইটুকু একটা মেয়ে। ঠিকসময় মা হলে এর চেয়েও বড় ছেলেপিলে হত তার।

একচিলতের জন্য দয়াময়ীর মনে উদয় হল, নতুন বউ বামুনের মেয়ে। তা হোক, মেয়ে তো!

সে আর ইতস্তত করল না। নতুন বউয়ের মাথাটা চেপে ধরল নিজের সন্তানলোভী বুকের মাঝে।

অপালা অনেকদিন পর মাতৃসম বক্ষে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি মরতে চাই না দিদি। আমি মরতে চাই না!’

দয়াময়ীর বুকের ভেতর থেকে কান্না ঠেলে উঠতে লাগল। সে আরো জোরে আঁকড়ে ধরল অপালাকে। ফিসফিস করে বলল, ‘মরেচিস তো সেদিন যেদিন মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেচিলি মুখপুড়ি! আবার নতুন করে কী মরবি!’

১৩

হালকা গোলাপি রঙের একটা আটপৌরে ডুরেপাড় শাড়ি। কিন্তু পরিপাটি করে সামনে কুচি দিয়ে পরা। ঊর্ধাঙ্গে নাভিমূল পর্যন্ত একটা সুতির জামা, খুব আঁটসাঁট নয়, আবার খুব ঢিলেঢালাও নয়। সেই জামার হাতা নেমেছে কনুইয়ের নীচ অবধি, সেখানে রেশমের কুচি দেওয়া নকশা। শাড়ির আঁচলটা একটার পর একটা সুন্দর ভাঁজ ফেলে বাঁ দিকের কাঁধের ওপর ফেলে রাখা। সেই আঁচল যাতে মুহূর্তের অসতর্কতায় খসে না পড়ে, তার জন্য কাঁধের কাছে একটা গোল চাকতি আঁটা।

ভুবনমণি খসখসের পর্দার আড়াল থেকে বিপুল আগ্রহে সামনের টেবিলে বসে থাকা নারীটিকে লক্ষ করছিল। যতই দেখছিল, তার বিস্ময়ের পারদ চড়ছিল।

তাদের মশাট গ্রামের জমিদার সূর্যনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ির অন্দরমহলে তার ছিল অবাধ আনাগোনা। সেই বাড়ির মহিলা থেকে শুরু করে কন্যারা বাড়িতে তো অলঙ্কার পরে থাকতই, উৎসবে পার্বণে তাদের রতনচূড়, মানতাসা, সীতাহারের ঝলকে তাক লেগে যেত সবার। জমিদারগিন্নী থেকে শুরু করে ছোট্ট মেয়েটিকেও যেন মনে হত সাক্ষাৎ স্বর্গের অপ্সরা, পুজোয় তুষ্ট হয়ে মর্ত্যে নেমে এসেছে। ভুবনমণি তাদেরও অপলকে দেখত, কিন্তু সেই মুগ্ধতার সঙ্গে এখনকার বিস্ময়ের কোনো তুলনাই চলে না।

তার কত সৌভাগ্য এমন একজন নারীকে সে ‘বউদিদি’ বলে ডাকার সুযোগ পেয়েছে! কোনো বহুমূল্য অলঙ্কারের বাহুল্য নেই, অথচ কত সুন্দর!

ঘরের ভেতরের মাঝারি আয়তনের পালঙ্কে বসে থাকা নারীটি তার বাম হাতে ধরে আছে মোটা একটা বই। সেটি আধখোলা। আর ডানহাতে ধরা একটা সরু কঞ্চি।

সেই কঞ্চি তাক করে রয়েছে…ওরে বাবা! ভুবনমণি চোখ বুজে ফেলল। দু’কান চাপা দিয়ে কী যেন বিড়বিড় করতে লাগল।

‘কীরে, তখন থেকে উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন? আয়। ভেতরে আয়।’

নারীটির স্নেহার্দ আহ্বানে ভুবনমণির ভেতরে যেতে ইচ্ছে হলেও সে এক পা এগোতে পারল না।

‘আসবি না যখন, তবে উঁকিঝুঁকি মারিস কেন? রোজ সন্ধেবেলা দেখি এই কাণ্ড করিস। ভাল আপদ জুটল তো!’

কী মুশকিল! নতুন বউদিদি কি রাগ করছেন নাকি? না না, সে কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। ভুবনমণি এই বাড়িতে এসেছে সাতদিন হয়ে গেল, প্রথম দিন থেকে উনি ভুবনমণিকে বুঝতেই দেননি যে ভুবনমণি এই বাড়ির একজন সদ্য আগত আশ্রিতা মাত্র। বলেছেন, ভুবনমণি যেন ওকে বউদিদি বলে ডাকে।

ভুবনমণি যাকে বউদিদি বলত, তিনিও ওকে কোনোদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। হলই বা ব্রহ্মময়ী এখন অনেক দূরে, সে-ই তো তার আসল বউদিদি। ভুবনমণি তাই অনেক ভেবেচিন্তে এই বাড়িতে ‘নতুন বউদিদি’ বলা শুরু করেছে।

নতুন বউদিদি মানুষটা যতই অদ্ভুত হোন, এমনিতে বড় ভালো। প্রথমদিনেই যত্ন করে বসে ওকে খাইয়েছেন, ডিপোয় পরে পরে জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়া দু’খানা থান জোর করে ফেলে দিয়ে দেরাজ থেকে বের করে দিয়েছেন দুটো পাটভাঙা থান আর একটা গরদ। সেগুলো নাকি ওঁর পরলোকগতা এক মাসির।

ভুবনমণি চিঁ-চিঁ করে বলল, ‘আমার ভয় করচে নতুন বউদিদি। একে তুমি চারমাসের পোয়াতি, ওই ভূত যদি তোমার ঘাড়ে চেপে বসে? কী অনাছিস্টি কাণ্ড মাগো! রাম রাম!’

‘তোর মতো একজন থাকতে খামোখা আমার ঘাড়ে উঠতে যাবে কেন রে মুখপুড়ি। উঠলে তোর ঘাড়েই উঠবে।’ পালঙ্কে বসে থাকা কাদম্বিনী এবার হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন বিছানার ওপর। এবার আর কঞ্চি দিয়ে নয়, নিজের হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেন পালঙ্কের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কঙ্কালটাকে। মানবস্পর্শ পেয়েই বোধ হয় কঙ্কালটা নড়ে উঠল।

হাড়ে হাড়ে লেগে যাওয়ার শব্দ হল। খটখট।

কী সর্বনেশে কাণ্ড! ভর সন্ধেবেলা গৃহস্থ বাড়িতে…ভুবনমণি আবার ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।

কাদম্বিনী ওর রকম সকম দেখে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘দূর বোকা! কঙ্কাল দেখে কেউ ভয় পায় নাকি? ও তো শুধু হাড়ের তৈরি। শিগগির এদিকে আয়।’ তারপর একটু থেমে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন, ‘না-হলে আমি কিন্তু তোর সঙ্গে কথা বলব না।’

মহা বিপদ! ভুবনমণি বাধ্য হয়ে আড়ষ্ট পায়ে এগিয়ে আসে। কঙ্কালটার সঙ্গে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায় পালঙ্কের বাজু ধরে।

কাদম্বিনী আবার হেসে ফেলেন। ‘কী হাবা মেয়ে রে বাপু! বলি তুই কি আরশিতে নিজেকে দেখেও চমকে উঠিস নাকি? ওই কঙ্কাল তো তোর আমার সবার মধ্যে আছে।’

ভুবনমণি নতনেত্রে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, ‘আমরা তো মানুষ। তেনারা তো তা নন। তেনারা হলেন অপদেবতা। গেরস্থ বাড়ি, তায় পোয়াতির ঘর। রাতের বেলা যদি…!’

ভুবনমণি কথাটা শেষ করতে পারল না, তার আগেই কাদম্বিনী আবার হেসে ফেললেন, ‘যত সব কুসংস্কার! তোকে বলেছি না ভুবন, এই বাড়িতে ভূতপ্রেত, দত্যিদানো এইসব কথা বলবি না? ওগুলো সব বুজরুকি।’

‘বুজরুকি! তাহলে আমাদের গাঁয়ের সুদাম ওঝা কী করে ভূত ধরত? জোলাপাড়ার একটা বউকে ভূতে ধরেচিল, আমি নিজে গিয়ে দেখেচিলুম। বউটার মুখ দিয়ে সাদা গ্যাঁজলা বেরুচ্চিল, চোখের মণিদুটো দেখা যাচ্চিল না। মাথা ঝাঁকাচ্চিল জোরে জোরে। সুদাম ওঝা গিয়ে মন্তর পড়ল, ঝাঁটা দিয়ে খুব পেটাল, তখুনি তো ভূতটা বেরিয়ে গিয়ে গাঁয়ের বাইরের নারকেল গাছটায় চলে গেল। বউটাও ঝিমিয়ে পড়ল।’ ভুবনমণি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল।

কাদম্বিনী এবার একটু রুষ্ট হলেন। ধনুকের মতো বাঁকানো সুন্দর ভ্রু’দুটো বেশ কুঞ্চিত করে বললেন, ‘তোরা এমন কুসংস্কারে ডুবে আছিস বলেই তো সহজে বোকা বনে যাস। বউটার হয়ত কোনো অসুখ করেছিল, সেই অসুখের চিকিৎসা না করে তাকে মেরে মেরে অচেতন করে দিলি। এমন শহরেই আকছার হচ্ছে, গ্রাম তো কোন ছার!’

কুসংস্কার? তা হবে। ভুবনমণি ভাবল। এই কথাটা ওর নিজের বউদিদিও বলত। বৈধব্যের পর শ্বশুরালয় থেকে কঠোর নির্দেশ এসেছিল, ও যেন নিষ্ঠাবান বিধবার সমস্ত আচার পালন করে। একাদশী, ত্রয়োদশী, ফলাহার তো বটেই, প্রতিদিনই যেন থাকে একাহারী।

তখন ওর নিজের বউদিদি এভাবেই প্রতিবাদ করে উঠেছিল।

‘আমরা সোমত্থ মানুষ দিনে তিনবার করে খাব, আর ভুবন এইটুকু মেয়ে দিনে একবার মুখে ফলমূল গুঁজে পড়ে থাকবে? এমন করলে কারুর শরীর টেকে নাকি? না, সে হবে না। শোনো ঘরের ভেতরের ব্যাপার তোমায় পাঁচকান করতে হবে না। ঠাকুরঝি’কে আমি ঠিক বুঝেশুনে রাখব’খন।’

তারপর এই ক’দিন আগে? যখন ওর ওপর হওয়া সেই অত্যাচারের ‘কাটা ঘা’-এর ওপর নুনের ছিটে দিতে গ্রামের গোপী লাহিড়ী, রামচন্দ্র ন্যায়তীর্থরা নিয়ে এসেছিলেন কামাতুর পাঁচকড়ি মুখুজ্জেকে? কেউ কিছু না বললেও ঘরের ভেতর থেকে ও সেদিন স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল বউদিদি দাদাকে বলছে, ‘তেমন হলে অপা, লোপার বিয়ে হবে না। কিন্তু ভুবনকে আমি কিছুতেই ওই বুড়োর কাছে পাঠাব না।’

ওর নিজের দাদা, নিজের বউদিদি, দিব্য এখন কোথায়? জাহাজের খোলের মধ্যে কীভাবে দিন কাটছে ওদের? আর অপা, লোপা? লোপাটা তো ভীষণ ন্যাওটা ছিল, পিসিমা না খাইয়ে দিলেই কিছুতেই খেতে চাইত না। কে খাওয়াচ্ছে তাকে?

 ‘কিরে? কোথায় হারিয়ে গেলি?’ কাদম্বিনী নরম স্বরে বললেন, ‘দাদা-বউদির জন্য মন কেমন করছে?’

ভুবনমণি বাস্তবে ফিরে আসে। চটকা ভেঙে বলে, ‘না। যাই, খাবার বানাই। হিমু এখুনি উঠে পড়বে। যা মেয়ে তোমার, উঠলেই সারা পাড়া জড়ো করে চেঁচাবে।’

কাদম্বিনী হাসেন। এলোচুলে একবার হাত চালিয়ে পরমুহূর্তে মনোনিবেশ করেন বইয়ে, ‘আচ্ছা। যা। দরজাটা টেনে দিয়ে যাস।’

ভুবনমণি ঘর থেকে বেরনোর আগে কঙ্কালটাকে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম ঠুকতে ভোলে না। যত যাই হোক, অপদেবতা বলে কথা। নতুন বউদিদির চোখ এড়ায় না। তিনি আবার হেসে গড়িয়ে পড়েন।

ভুবনমণি দাঁড়ায় না, দ্রুত পায়ে এগোয় রান্নাঘরের দিকে। নিজের ভাইঝি লোপা যেমন ওর ন্যাওটা ছিল, তেমনই এই বাড়িতেও ওর একটা ন্যাওটা জুটেছে। বউদিদির মেয়ে হিমু, ভালো নাম হিমানী। মোটে দেড় বছর বয়স তার, কিন্তু এর মধ্যেই বড় বড় চোখ মেলে সে যখন আদো আদো স্বরে ‘পিছি’ ডাকে, ভুবনমণির বুকের ভেতরটা আনন্দে দুলে ওঠে।

আর মাত্র কয়েক মাস, তারপর আরো এক নতুন অতিথির আগমন ঘটবে এ’বাড়িতে। তাকেও ভুবনমণি নিজের স্নেহ ভালোবাসা উজাড় করে দেবে।

দুধ একটু আগেই ফুটিয়েছিল, রান্নাঘরে গিয়ে হিমুর ছোট্ট বাটিতে ও এবার তাতে একটু চিঁড়ে মাখল। তারপর আধখানা কলা চটকে এগলো ভেতরের ঘরের দিকে।

ওদিক থেকে বিধুমুখী আসছিল। ওকে দেখে বলল, ‘পিসিমা, হিমু এর মধ্যেই কান্না জুড়েছে তোমায় না দেখতে পেয়ে। শিগগির যাও।’

বিধুমুখী এবাড়ির বড় মেয়ে। এই বাড়ির কর্তা অর্থাৎ ভুবনমণির মাসতুতো দাদা দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের কন্যা। প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন বহুকাল আগে। রেখে গিয়েছেন কন্যা বিধুমুখী ও পুত্র সতীশকে। নতুন বউদিদি দাদার দ্বিতীয়া পত্নী।

বিধুমুখীও বেশ অন্যরকম মেয়ে। তার বিবাহ হয়েছে বেশ কিছুদিন হল, কিন্তু এখনো সন্তানাদি হয়নি। তাই নিয়ে সে ভাবিতও নয়। ঘরের আবশ্যক কাজগুলো সেরে নিয়ে সে দিনরাত বই নিয়ে পড়ে থাকে। কখনো আবার দোয়াতে কলম ডুবিয়ে কী সব লেখে। কখনো আবার রান্না করতে করতে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে গান।

তার তরুণ স্বামীটিও বেশ। নাম উপেন্দ্রকিশোর। সেও এই বাড়িতেই থাকে। তারও খুব সাহিত্যপ্রীতি। মাঝে মাঝেই স্বামী-স্ত্রীতে কাব্য নিয়ে আলোচনা চলে। ভুবনমণি তখন সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তার সেই বিস্ময় কঙ্কালদর্শনের চেয়ে কিছু কম নয়।

‘কিগো, যাও?’ বিধুমুখী আবার তাড়া দেয়।

‘এই যে যাচ্ছি।’ ভুবনমণি যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, ‘হ্যাঁ রে বিধু, ওরকম একটা ভূতকে বউদিদি ঘরে রেখে দিয়েছেন, তোর ভয় করে না?’

মায়ের স্বভাব মেয়ে পায় জানা কথা। কিন্তু সৎ-মা আর মেয়েতে এত মিল হয় জানা ছিল না ভুবনমণির।

বিধুমুখীও ঠিক তার বিমাতার মতোই হেসে উঠল, ‘ধুর! কী যে বলো পিসিমা! ভয় করবে কেন? ওটা তো মায়ের পড়ার কাজে লাগে। মা তো কালেজে যান, সেখানে ওরকম শয়ে শয়ে রাখা আছে।’

‘শয়ে শয়ে?’ বিস্ময়ে চোখ প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয় ভুবনমণির।

‘তা নয়তো কি?’ বিধুমুখী গ্রাম থেকে সদ্য আসা তার এই সহজ সরল পিসিমাটিকে আরো ভয় দেখানোর সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করে না, ‘কঙ্কাল ছাড়ো। মা মড়া কাটে জানো? ধরো একটা লাশ, তাকে মুখের নীচ থেকে একটা লম্বা ছুরি দিয়ে চিরে ফেলে নীচ পর্যন্ত। তার ওপর ঝুঁকে পড়ে ভেতরের হাড় মাংস সব দেখে।’ বিধুমুখী কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে বর্ণনা করেও দেখায়।

সন্ধেবেলা। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে চওড়া উঠোনখানায় কোনো আলো নেই, শুধু একেবারে শেষের এক প্রান্তে দপদপ করে জ্বলছে একটা প্রদীপ। ভুবনমণি ভয়ে হাত চেপে ধরে বিধুমুখীর। ফিসফিসিয়ে শক্ত গলায় বলে, ‘ঠাট্টা করচিস আমার সঙ্গে?’

‘বাহ, ঠাট্টা করব কেন!’ বিধুমুখী বলে, ‘ভেতরের জিনিসপত্র ডাক্তারদের দেখতে হয় জানো না? কোথায় কী আছে তা না জানলে রুগির চিকিৎসা করবে কী করে? মা যে আর একবছর পরেই ডাক্তার হয়ে যাবে।’

‘এই তোরা ওখানে কী করছিস দুজনে?’ উঠোনের একেবারে বিপরীত প্রান্তে কাদম্বিনীর উচ্চকিত কণ্ঠস্বর শোনা যায় এবার, ‘ওপরের ঘরে সতীশের জলখাবার পৌঁছনো হয়েছে? রাধুর মা কোথায়?’

বিধুমুখী এবার সাড়া দেয়, ‘হ্যাঁ মা। রাধুর মা ভাইয়ের খাবার দিয়ে আসতে গিয়েছে ওপরে।’

‘দিয়ে এলে কী হবে?’ কাদম্বিনী এগিয়ে আসতে থাকেন এদিকে, ‘তোকে বলেছি না বিধু, ভাইকে একা খেতে দিবি না, ওর এমনিই হাত কাঁপে, ঠিকমতো খেতেও পারে না। কাল কলেজ থেকে ফিরে দেখি মুখটা একেবারে শুকিয়ে রয়েছে। ওইভাবে কি পেট ভরে নাকি? তুই ব্যস্ত থাকলে বল, আমি যাচ্ছি নাহয়।’

‘না না। আমি ওপরে যাচ্ছি মা।’ বিধুমুখী একরকম ছুটে চলে যায় ওপরে।

কাদম্বিনী সোজা হেঁটে এসে ঢোকেন রান্নাঘরে। একটু আগের খুলে রাখা এলো চুল এখন কষে খোঁপা বাঁধা, শাড়ির আঁচলের এক প্রান্ত গুঁজে নিয়েছেন কোমরে।

রাধুর মা তরকারি কুটে রেখে গিয়েছিল, সেইসব হাতের কাছে নিয়ে তিনি রান্নার জোগাড় করতে থাকেন।

রান্নাঘরের বাইরে ভুবনমণি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে।

এই বাড়ির কোনো মানুষকেই তার স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। মা বই পড়ছেন, কলেজ যাচ্ছেন, কঙ্কাল ঘাঁটছেন, লাশ চিরছেন। মেয়ে দিনরাত বই মুখে নিয়ে বসে আছে। জামাই কবিতা লিখছে। কোনো সাংসারিক আলোচনা নেই, পরনিন্দা পরচর্চা নেই।

তাদের নিজেদের বাড়িও কিছুটা এমন ছিল। তবে এতটা নয়।

তাও তো এখনো এই বাড়ির কর্তাকে সে প্রত্যক্ষ করেনি। ভুবনমণির সেই দাদা নাকি খুব বিখ্যাত। কাগজে লেখালিখি করেন। এবাড়িতে তার আগমনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই তিনি নাকি রয়েছেন আসাম বলে একটা দেশে। সেদেশে অনেক চা বাগান। আর চা বাগানের শ্রমিকদের অনেক কষ্ট। তিনি তাদের সেই দুঃখ দূর করতে গিয়েছেন। ফিরবেন আরো কিছুদিন পরে।

হাতে ধরে থাকা হিমুর জলখাবারের পাত্রটি নিয়ে ভুবনমণি রওনা দেয় ভেতরের ঘরের দিকে।

রসুইঘরে ব্যস্ত রমণীটিকে তার আর কোনো লৌকিক মানুষ বলে মনে হয় না। যিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়েও সংসারের সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সকালবেলা প্রকাশ্য রাস্তায় পায়ে হেঁটে রওনা দেন কলেজে, যিনি হাসতে হাসতে ধরেন কঙ্কালের হাত, যিনি অবলীলায় চিরে ফেলেন মানব শরীর, যিনি নিজের পেটের মেয়ের থেকেও বেশি সচেতন থাকেন স্বামীর আগের পক্ষের অসুস্থ রুগ্ন পুত্রকে নিয়ে, তিনি আর যাই হোন, মানবী নন।

গ্রামের মেয়ে হলেও দাদা কৃষ্ণসুন্দরের আগ্রহে ভুবনমণি নিরক্ষরা নয়। থেমে থেমে হলেও অক্ষর ধরে বাংলা পড়তে পারে। দাদার মুখে শুনে শুনে তার বেশ কিছু কাব্যও মুখস্থ ছিল।

চকিতে তার মনে পড়ে যায় অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনির সেই স্বগতোক্তি! বড় প্রাসঙ্গিক যেন।

‘এ মেয়ে মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়!’

নূর মঞ্জিলের সামনে দিয়ে চলে গিয়েছে ইস্পাতের প্রাচীরবেষ্টিত একটি প্রশস্ত পথ। তার ভেতরের বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণটি আবার ছোট ছোট ক্ষেত্রে ইস্পাতের প্রাচীর দিয়ে বিভক্ত। সেইসব ক্ষেত্রের কোনোটায় অবাধে বিচরণ করছে চিতাবাঘ। কোনোটায় হরিণ। কোনোটায় অন্য কোনো বন্য জন্তু। এক আধটা নয়। শয়ে শয়ে।

মধ্যভাগে শ্বেতপাথরে বাঁধানো একটি ঝকঝকে পুষ্করিণী। তাতে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো টলটল করছে জল। সেই জলে কিলবিল করছে ফীলমুর্গ, সারস, কায়া, বগলা, চকোর, শুতুরমুর্গ। পুকুরপাড়ে অলসভাবে বসে রয়েছে চার পাঁচটা অনিন্দ্যসুন্দর ময়ূর। উদ্ধত গ্রীবা উঁচিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে শ্বেতপরীর মতো কয়েকটি রাজহাঁস।

তাদের কোলাহলের মাঝেই শান্তিতে রোদ পোহাচ্ছে দুটি কচ্ছপ।

শ্বেতাঙ্গ ইংরেজটি সবিস্ময়ে সামনের নৈসর্গিক দৃশ্যটি দেখছিলেন। একসময় তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অকৃত্রিম বিস্ময়।

‘আনবিলিভেবেল!’

‘এতেই এত অবাক হচ্ছেন?’ নবাব স্মিত হেসে বললেন, ‘আমি কিন্তু আংরেজি অল্পস্বল্প বুঝি সাহেব। লক্ষ্নৌতে যখন সত্যিকারের নবাবি ছিল, গার্ডনার বলে এক সাহেব ছিল আমার পরম বন্ধু। সে ব্যাটাও মুসলিম বিবিকেই শাদি করেছিল।’

শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে বললেন, ‘আমি সত্যিই অবাক নবাব বাহাদুর! আমরা সরকারি টাকায় ‘জু’ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি আর আপনি একার উদ্যোগে এত ধরনের জন্তুজানোয়ার, চিড়িয়া…রিয়্যালি কমেন্ডেবল!’

চন্দ্রনাথ বলল, ‘এখনো তো কিছুই দেখেননি সাহেব। চলুন, পুকুরের ওইধারে যাই।’

কলকাতায় সরকারি উদ্যোগে চিড়িয়াখানা খোলা হয়েছে আট-নয় বছর হল। শহর থেকে খানিকটা দূরে গাছপালায় ছাওয়া আলিপুরে। সোয়েন্ডলার নামে এক জার্মান সাহেব ভারতে রেলপথ নির্মাণে কাজ করতে এসে গড়ে তুলেছিলেন নিজের শখের চিড়িয়াখানা। দেশে ফেরার সময় তিনি নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ অকাতরে দান করে গিয়েছেন আলিপুর চিড়িয়াখানাকে। প্রধানত তাঁর সংগ্রহতেই শুরু হয়েছে আলিপুর জু। এছাড়াও কিছু দেশীয় রাজা জমিদার কিছু পশুপাখি দিয়েছেন।

ইংরেজদের তৈরি করা ব্যারাকপুরের সেই প্রথম চিড়িয়াখানা প্রায় বিলুপ্তির পথে হলেও সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে সামান্য কিছু সংগ্রহ।

আলিপুর চিড়িয়াখানার ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে সম্প্রতি এসেছেন জর্জ কিং নামের এক তরুণ সাহেব। তিনি পেশায় উদ্ভিদবিদ, গঙ্গার ওপারে অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রধান। তরুণ, কর্মোদ্যমী। কমিটিতে ঢুকেই তিনি মনোযোগ দিয়েছেন কীভাবে পশুপ্রাণী আরো বাড়ানো যায়। সংবাদ পেয়েছেন, অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ একেবারে নিজের প্রচেষ্টায় মেটিয়াবুরুজে গড়ে তুলেছেন সুবিশাল চিড়িয়াখানা।

খবর পেয়ে কিং সাহেব আর দেরি করেননি। তাঁর সমমনস্ক ছাত্র তথা সাকরেদ রামব্রহ্ম সান্যালকে নিয়ে সটান চলে এসেছেন নবাবের চিড়িয়াখানা সরেজমিনে চাক্ষুষ করতে।

নবাব যথোপযুক্ত আপ্যায়ন করেছেন তাঁদের। বাদশাহি খানা সহযোগে উত্তম ভোজন অন্তে তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছে চিড়িয়াখানায়। তদারকির ভার পড়েছে চন্দ্রনাথের ওপর। সে পালকির ব্যবস্থা করলেও কিং সাহেব আর রামব্রহ্ম সান্যাল সম্মত হননি। তাঁরা নাকি বহুদিন ধরে নাম শুনেছেন এই আজব নগরীর। তাই তাঁরা পদব্রজেই ঘুরতে চান।

এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা কোথাও দেখেছেন নাচের তালিম চলতে, কোথাও তরজা লেগেছে বড় বড় কবিদের মধ্যে, চলছে কবির লড়াই ‘মুশাইরা’। কোথাও দেখেছেন আফিমচির জমায়েতে বসেছে গল্পের আসর, কনক্যওয়ার ময়দানে ধরা হচ্ছে বাজি। কোথাও এদিক সেদিক বাড়ির দেউরিতে পর্দার আড়ালে সুন্দরীদের মুখ, কোথাও লালকানাতওয়ালা পাগড়ি মাথায় হুডে রূপোর মাছ ঝুলিয়ে প্রতীক্ষারত পালকি-কাহারেরা।

চন্দ্রনাথ তাঁদের যত্নসহকারে সব বুঝিয়েছে।

ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা অনুভব করেছেন, সত্যিই মেটিয়াবুরুজ যেন এক স্বপ্ননগরী। কোনো জাদুকাঠির ছোঁয়ায় এই শহরের প্রতিটি কোনায় রয়েছে জীবনের মুখ, রয়েছে স্বপ্ন ধরার আনন্দলড়াই। এই শহরের বুকে কোথাও নেই একফোঁটা বিষাদ। বিনোদনই এখানে শেষ কথা।

সন্দেহের অবকাশ নেই, সেই জাদুকাঠি নবাব স্বয়ং।

অবশেষে তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছেছেন চিড়িয়াখানায়।

অন্যদিকে নবাবও তাঁর ‘সুখপাল’ বাদশাহি পালকি চড়ে চিড়িয়াখানায় এসেছেন সুলতানখানা থেকে।

নবাবের এখন বয়স হয়েছে। শরীর আগের চেয়েও ভারী হয়েছে। পায়েও ব্যথা। তা সত্ত্বেও এখানে এসে পালকি ছেড়ে দিয়েছেন। লাল নরীর সালিমশাহী জুতো মসমসিয়ে, সলমা চুমকির বহুমূল্য ঝুমকোখচিত আচকানে ঢেউ তুলে হেঁটে হেঁটে তিনি অতিথিদের দেখাচ্ছেন নিজের সৃষ্টি। নিজের গর্বের সম্পদ। সঙ্গে চলেছে চন্দ্রনাথ আর চিড়িয়াখানার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক কেরামত মিয়াঁ।

পুকুরের ওধারে যেতেই কিং সাহেব চমকে উঠলেন।

‘ওহ গড! টাইগার?’

ওদিক থেকে বোঝাই যায়নি, পুকুরের এইধারে খাঁচার মধ্যে বসে রয়েছে প্রমাণ আকারের একটি বাঘ। মনুষ্য আনাগোনা টের পেয়েই সে খরচোখে তাকাল এদিকে।

বাঘের খাঁচা থেকে নিরাপদ দূরত্বে সার দিয়ে রয়েছে লোহার রেলিং দেওয়া ছোট ছোট ঘর। সেই ঘরগুলোয় রয়েছে নানাজাতের বাঁদর। তাদের ডাকাডাকিতে মাঝে মাঝেই ব্যাঘ্রদেব অপাঙ্গে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন সেদিকে।

হাঁটতে হাঁটতে সবাই এগোলেন সামনের শ্বেতশুভ্র ইমারত শাহানশাহ মঞ্জিলের দিকে। মঞ্জিলের সামনে একটি দীর্ঘ ও সুগভীর জলাশয়। জলাশয়ের চারদিকের পাড় ইচ্ছাকৃতভাবে পিচ্ছিল করে রাখা।

জলাশয়ের ঠিক মধ্যিখানে সামনের দিকে ঝুঁকে নম্র হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি কৃত্রিম পাহাড়। এপাড় থেকেই দেখা যাচ্ছে, সেই পাহাড়ের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য সরু নালি। কোনো কোনো স্থানে ওপর থেকে কৃত্রিম জলস্রোত প্রবাহের আয়োজন করে রাখা। পাহাড়ের সরু নালির মধ্য দিয়ে যখন সেই জলস্রোত লাফিয়ে নামছে, তার সৌন্দর্য পাহাড়ি কোনো খরস্রোতা জলপ্রপাতের চেয়ে কম কিছু নয়।

রামব্রহ্ম সান্যাল সরু চোখে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন দূরের সেই পাহাড়টিকে। একসময় বললেন, ‘ওখানে কীসব প্রাণী নড়াচড়া করছে যেন মনে হচ্ছে?’

কেরামত মিয়াঁ বলল, ‘জি, সাঁপ হুজৌর!’

সাপ?

রামব্রহ্ম সান্যাল বিস্মিত চোখে কিং সাহেবের দিকে তাকালেন।

পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন নবাব। তিনি মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘কেরামত মিয়াঁ ঝুট নেহি বোলতা হ্যায়। উস উঁচাইপে হাজারো সাঁপ বসতে জানাব! উয়ো লোগ খেলতে কুঁদতে ভি হ্যায়। কাভি কাভি তো উপড় চড় যাতে হ্যায়। আউর কাভি কাভি নীচে ভি আ জাতে হ্যায়। লোগ দূর সে দেখতে হ্যায়।’

জর্জ কিং দ্রুত তাঁর নোটবুকে খসখস কিছু লিখলেন। তিনি পণ্ডিত মানুষ, পশুপাখি প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। বড় বড় শহরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে চিড়িয়াখানা বানাচ্ছে। কিন্তু তিনি হলফ করে বলতে পারেন, বিশ্বের কোথাও এভাবে মুক্তাঙ্গনে সাপ পোষা হয়নি।

নবাবের চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখতে সময় লেগে গেল তিন ঘণ্টারও বেশি। আফ্রিকার জিরাফ, কোহানের বাগদাদী উট থেকে শুরু করে গাধাও রয়েছে নবাবের সংগ্রহে। রয়েছে লক্ষ লক্ষ পাখি।

সব দেখেশুনে কিং সাহেব আর রামব্রহ্ম সান্যাল মুগ্ধ। অভিভূত। বেশ ভয়ে ভয়ে তাঁরা কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য পাখি ও প্রাণীর বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।

নবাব যেন আজ কল্পতরু। তক্ষুনি কেরামত মিয়াঁকে ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিলেন।

সব মিটতে মিটতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। চন্দ্রনাথ প্রস্তুত হয়েই ছিল। আজ সারারাত নবাব গান লিখবেন। সুর দেবেন। আর সেটা তৎক্ষণাৎ সেতারে তুলে গেয়ে শোনাবে চন্দ্রনাথ। সঙ্গে থাকবে মেটিয়াবুরুজের সবচেয়ে সরেস পুঁথিলেখক হাফিজ নুরুল্লা। সে তার মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে লিখে ফেলবে সেই গান ও স্বরলিপি।

এমন আরো এক রাত হয়েছিল। পূর্ণিমার সেই রাতে নবাবের হুকুমে সেতার মৃদঙ্গ নিয়ে চন্দ্রনাথ চলে গিয়েছিল সুলতানখানার ছাদে। নবাব, হাফিজ নুরুল্লা আর তবলচি মির্জা জাফর ছাড়া কেউ ছিল না সেখানে। ছিল না একজনও নাচনেওয়ালি কসবি।

সেদিন সত্যিই নবাবের সম্পূর্ণ অন্য একটি রূপ দেখার সুযোগ হয়েছিল চন্দ্রনাথের।

সুলতানখানার প্রকাণ্ড ছাদে সেদিন গঙ্গা থেকে ফুরফুরে হাওয়া ভেসে আসছিল। গোটা ছাদেই প্রায় গদি বিছানো। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিল কয়েকটা মখমলে মোড়া কামদার তাকিয়া।

সেখানেই অর্ধশয়ান ছিলেন নবাব। এক হাতে আলবোলার ফরসি। অন্যহাতে একটা সুগন্ধী ফুলের মালা।

নবাব দূর আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন, আর গেয়ে উঠছিলেন গানের একেকটা কলি। প্রথমে লিখে তারপর সুর বসানো নয়, তিনি প্রথমেই সুর দিয়ে দরদ দিয়ে গাইছিলেন।

শেষ হওয়ামাত্র চন্দ্রনাথকে গেয়ে উঠতে হচ্ছিল পুরো গানটা। আর সমান্তরালে গানটা লিখে নিচ্ছিল হাফিজ নুরুল্লা। মেটিয়াবুরুজের নিজস্ব ছাপাখানা থাকলেও যাকে দিয়ে নবাব নিজের একের পর এক কাব্যগ্রন্থ হাতে লিখে ‘খুশনবিসি’ করান।

প্রায় ঘণ্টাদুয়েক এইভাবে চলেছিল। তারপর রাত যখন কালো মিশমিশে, জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলো যখন নরম তাপে আলোকিত করে তুলেছে নবাবের মুখ, দু-হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো হু-হু করে কেঁদে উঠেছিলেন নবাব।

‘ক্যা হুয়া খোদাবন্দ? ক্যা হুয়া আপকা? কোই তকলিফ হো রহা হ্যায়?’ তবলচি মির্জা জাফর দ্রুত উঠে গিয়েছিল নবাবের কাছে।

নবাব কাঁদতে কাঁদতে এক হাত তুলে বারণ করেছিলেন তাকে, কিন্তু কান্না থামাননি। দুই চোখ দিয়ে জল অবিরাম গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। বলেছিলেন, ‘রুক যা জাফর! মেরে তনমে কোই তকলিফ নেহি হ্যায়।’

চন্দ্রনাথ এবার আর থাকতে পারেনি। বলেছিল, ‘তবে আপনি কাঁদছেন কেন?’

নবাব এবার থমকে তাকিয়েছিলেন ওর দিকে। সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল, চন্দ্রনাথ সামান্য হলেও ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল, রাজারাজড়ার কি খেয়াল চাপল, হয়ত চন্দ্রনাথের এই প্রশ্ন মনঃপুত হয়নি।

নবাব কিছুক্ষণ পর থেমে থেমে বলেছিলেন, ‘দর্দ মেরে মন মে হ্যায় বেটা! আমি যখন লক্ষ্নৌ ছেড়ে এসেছিলাম, মহল মহল বেগম রোঁয়ে। গলি গলি রোঁয়ে পাথুরিয়া। সে কতদিন হয়ে গেল। সেসব মনে পড়লে আখতার পিয়ার মন আনচান করে ওঠে।’

পাশ থেকে খুশনবিস হাফিজ নুরুল্লা ফিসফিস করে চন্দ্রনাথকে বলেছিল, ‘নবাবের তখল্লুশ হল আখতার পিয়া।’

নবাবের ছদ্মনাম আখতার পিয়া, তা চন্দ্রনাথ আগে থেকেই জানত। কিছু না বলে সে মৃদু ঘাড় নেড়েছিল।

নবাব আপন মনে বলে চলেছিলেন, ‘মনে পড়ে আমার আকলিল বেগমের পায়ের বাঁকা চাঁদের মতো নখ। মনে পড়ে বেগম খুজিস্তামহলের মেঘের মতো চুল। তুই জানিস বেটা, সেই চুল আমি বহুদিন অবধি নিয়ে শুয়েছি আমার বুকের কাছে? দিলদার বেগমের মিঠা পানের মতো মুখ, জাফরি বেগমের গুলাবি আঁখে, আঃ! তারা সব কোথায় হারিয়ে গেল বেটা। আমিও একদিন চলে যাব। ইয়ে মেরা মঞ্জিল, মেরা চিড়িয়াখানা, মেরা মেটিয়াবুরুজ ছোড়কে ম্যায় চলা জাউঙ্গা। জাহান্নামপে।’

‘জাহান্নামে কেন যাবেন আপনি?’ চন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘আপনি এত ভালো মানুষ, আপনি বেহেস্তে যাবেন।’

‘সাচ? তু একদম তেরা বাপ জ্যায়সা হ্যায়। তেরা বাপ ভি মুঝকো বহত সমঝতা থা।’ নবাব এবার সটান এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তারপর সশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘হাম আচ্ছা ইনসান, ইস বাত মুঝকো কোই নেহি বোলা বেটা। আংরেজনে মুঝকো ঝুটা বোলা, মুঝে নফরত করনে শিখায়া লোগোকো।’

‘আপনার ভেতরের যে মানুষটা এত নরম, তার কথা কতজন জানে নবাব?’ চন্দ্রনাথ বলেছিল, ‘আপনি বলুন, তবে তো লোকে জানবে।’

‘অউর ক্যায়সে বলু?’ নবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন, ‘কিতনা গানা, কিতনা শায়েরি লিখা ম্যানে।’

‘কবিতা, গান এসব কি দেশের লোক অত পড়ে নবাব? তাও আবার উর্দুতে? আপনি আপনার কথা বলুন।’ চন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে যেন অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিল, ‘আমি বাংলায় লিখব। বাংলার মানুষেরা জানুক নবাব ওয়াজেদ আলী অপদার্থ শাসক ছিলেন না, ওঁকে অপদার্থ সাজিয়ে রাখা হয়েছিল!’

নবাব ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘সচ?’

সেই রাতে যে কী হয়েছিল, ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে ওর। মোহাচ্ছন্নের মতো কথাগুলো ও বলেছিল নবাবকে। আর তারপর থেকেই নবাব যেন ওকে একেবারে আঁকড়ে ধরেছেন। নিজের আত্মীয় পরিজনদের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন তাকে।

ভাবতে ভাবতে চন্দ্রনাথ প্রস্তুত হচ্ছিল। সেতারটা নিয়ে বেরোতে যাবে, এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল কাফি খাঁ। চন্দ্রনাথের জন্য নতুন কোঠাবাড়ি বহাল হওয়ার পরেও সে মাঝে মাঝে এই বাড়িতে আসে।

পিতৃবন্ধু এই বয়স্ক মানুষটি তার জন্য অনেক করেছে। নবাবের কাছে তাকে উপস্থিত করা থেকে শুরু করে সমস্ত বিষয়ে অকুণ্ঠ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কাফি খাঁ। এখনো মেটিয়াবুরুজের সব হাল হকিকত চন্দ্রনাথ বুঝে উঠতে পারে না, সেক্ষেত্রে তার অন্ধের যষ্টি কাফি চাচা-ই।

কিন্তু আজ কাফি খাঁ বেশ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘সুলতানখানায়। আজ রাতভোর জলসা হবে।’

কাফি খাঁ সরুচোখে তাকাল, ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।’

‘কী চাচা?’

কাফি খাঁ চোখ সরিয়ে নিয়ে কিছুটা উদ্ধতস্বরে বলল, ‘মোতি বলে কসবিটার সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি কেন?’

চন্দ্রনাথ থমকে গেল। এই প্রশ্নের জন্য ও একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বলল, ‘মাখামাখি কেন হতে যাবে? আমি ওকে সেতার শেখাতে যাই।’

‘থামো! তুমি কি সেতারের মাস্টার নাকি? তুমি হলে নবাবের বাঁধা ওস্তাদ।’ কাফি খাঁ হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল, ‘আর কখনো যাবে না।’

‘কেন?’ চন্দ্রনাথ বিস্মিতচোখে বলল।

‘মোতি নবাবের এক পুরনো মুতআ বেগমের মেয়ে।’ কাফি খাঁ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘নবাব তোমার সঙ্গে ওর মেলামেশা ভালো চোখে দেখবেন না। তুমি আর যেও না।’

মোতি নবাবের এক মুতআ বেগমের কন্যা! তার মানে নবাবের ঔরসেই জন্ম মোতির? চন্দ্রনাথ হতভম্ব হয়ে গেল। হোক জারজ অবৈধ সন্তান, মোতি নবাব-নন্দিনী তো বটে। তবু তাকে এইভাবে নবকিশোর দত্তের মতো বাবু ধরে দেহব্যবসা করে জীবন নির্বাহ করতে হচ্ছে?

কাফি খাঁ কথাটা বলে নিশ্চুপভাবে ওর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল। এবার নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘এত অবাক হোয়ো না। এই মেটিয়াবুরুজের প্রায় প্রতিটি ঘরেই নবাবের মুতআ বেগম বা তাদের ছেলেপিলে রয়েছে। তুমি এখানে নতুন, তাই জানো না। মেটিয়াবুরুজ আনন্দের নগর। নাচ দেখো, রগড় দেখো, মুর্গিবাজি দেখো। দিলের কারবার করতে যেও না। সমঝে?’

চন্দ্রনাথ চুপ করে রইল। দিল অর্থাৎ হৃদয়ের কারবার? তেমন কিছু কি সে সত্যিই করেছে মোতির সঙ্গে?

হ্যাঁ এটা ঠিক, মেয়েটা যখন কারণে অকারণে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, তখন চন্দ্রনাথের মনে পড়ে যায় চিড়িয়াখানার মধ্যিখানের পাহাড়ের সেই ঝর্ণাটার কথা। অজান্তেই তার বুকের ভেতরে কেমন দোলা দেয়। নবকিশোর দত্ত যেদিন আসেন, চন্দ্রনাথকে মাঝপথে চলে আসতে হয়। আর ঠিক সেইসময়েই কেন জানে না ওর চোখের সামনে তুলসীর মুখটা ভেসে ওঠে।

মনে হয়, খাদাকুঁড়ি গ্রামের তুলসী হোক বা মেটেবুরুজের মোতি, এরা সবাই কী অসহায়!

‘কী? উত্তর দিচ্ছ না কেন?’ কাফি খাঁ আবার বলল, ‘তুমি এতল্লাটের সবচেয়ে বড় নাচনেওয়ালি পিয়াজুর কাছে গিয়েছ?’

চন্দ্রনাথ দু-দিকে মাথা নাড়ল। পিয়াজুবাঈয়ের নাম সে শুনেছে।

‘কেন? নাচ দেখতে চাও তো পিয়াজুর কাছে না গিয়ে ওই নবিশ মোতিয়ার কাছে ছুটছ কেন?’ কাফি খাঁ বিরক্ত স্বরে বলল, ‘আমাদের এখানে একটা কথা আছে। জব তক ইনসান কো রন্ডিয়ো কী সোহবত না নসিব হো, আদমি নহি বনতা।’

কাফি খাঁ একটা বড় নিঃশ্বাস নিল। তারপর ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ‘ওসব ঝুটা মোতিকো ছোড়ো। আসলি মোতি পিয়াজুর কাছে যাও। আদমি বনো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *