৪. দেবতা যক্ষ, গন্ধর্ব, অপ্সরাদের মূর্তি

শাম্ব যতই মন্দিরের নিকটবর্তী হলেন, ততই যেন কাননের শোভা অধিকতর রমণীয় হয়ে উঠতে লাগল। মন্দিরের আকৃতি ও বিবিধ দেবতা যক্ষ, গন্ধর্ব, অপ্সরাদের মূর্তি, প্রায়ই চোখের সামনে ভেসে উঠল। পূর্বের আকাশ ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর সিন্দূরের মতো লাল হয়ে উঠল। তাঁর ডানদিকে বেগবতী চন্দ্রভাগার বুকে যেন রুধিরের তরল স্রোত বয়ে চলেছে। নদীর কলকল, বাতাসের মৃদু শনশন, পাখির সুমিষ্ট ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। শাম্বর মনে হল, মানুষের সমাজ সংসার ছাড়িয়ে, তিনি যেন এক অপার্থিব মায়াময় স্থানে পৌঁছেছেন। এখানে কি প্রকৃতই সেই অত্যুজ্জ্বল পুরুষ পরমাত্মা অবস্থান করেন?

শাম্বর মনে এই চিন্তার উদয়মাত্রই তাঁর শরীর রোমাঞ্চিত হল। কারণ মহর্ষি কথিত সেই অত্যুজ্জ্বল মূর্তির এক কল্পনা তাঁর অন্তরে গ্রথিত হয়ে আছে। তিনি নদীর তীরবর্তী মন্দিরের দক্ষিণ দ্বারে এসে উপস্থিত হলেন।

যথার্থ দক্ষিণে বলা যায় না, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এবং একটি বৃহৎ রথের ন্যায় মন্দিরের গঠন। দ্বার আছে, কিন্তু কোনও প্রাচীরের দ্বারা মন্দিরটি বেষ্টিত নয়। রথের ন্যায় মন্দিরের চারদিকে চারটি দ্বার, পিঙ্গলা-দণ্ডনায়ক, রাজ্ঞা ও স্তোশ্রা, কালমাস-পক্ষীন, ভিওমান ও নগ্নদিণ্ডি, দ্বারপালগণ রয়েছেন। অপ্সরাগণ রথের বিভিন্ন অংশে নৃত্যে সংগীতে ও বাদ্যযন্ত্রাদি বাদনের অপরূপ ভঙ্গিতে রয়েছেন। তা ছাড়া দেবতাগণ, যক্ষ, গন্ধর্বগণ, আদিত্যগণ, বসুগণ, অশ্বিনীগণ, মারুতগণ সকলেই যথাস্থানে অবস্থান করছেন। মাথার ওপরে ছত্র, সেই আশ্চর্য পুরুষমূর্তি অবস্থান করছেন। শিরস্ত্রাণ তাঁর মস্তকে, কোমরবন্ধরূপে রয়েছে অভিয়ঙ্গ, পদতলের কনুইয়ের ঊর্ধ্ব পর্যন্ত পাদুকা শোভা পাচ্ছে।

শাম্বর অন্তরে গ্রহরাজের নানা বিস্ময়কর ও বিচিত্র কাহিনী উদিত হল। তিনি আভূমি নত হয়ে, সেই পুরুষমূর্তিকে প্রণাম করলেন, ভাবলেন, এই কি নারোদোক্ত সেই সূর্যক্ষেত্র? তবে কেমন করে এই সর্বদেবমান্য পরমাত্মাকে আমি আরাধনা করব? তাঁর তুষ্টিবিধান করে, শাপমুক্ত হব? তিনি কি মূর্তিমান রূপে আমার সামনে কখনও দেখা দেবেন? কেমন করে তাঁর আশীর্বাদ পাব? তিনি কি আমাকে সেই ব্রহ্মরূপ শব্দের দ্বারা, শাপমোচনের নির্দেশ দেবেন? এই চিন্তা ও জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে তাঁর অন্তরে যেন এক গভীর কল্পবোধ দৃঢ়তর হল। তিনি এই পরমাত্মার দুই পাশে তাঁর দুই পত্নী, রাজ্ঞি ও নিক্ষুভাকে দেখলেন। সকলেই যেন তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে আছেন। শাম্বর অন্তর বারে বারে শিহরিত হতে লাগল।

এইরূপ চিন্তার মধ্যে, শাম্ব চারটি দ্বার প্রদক্ষিণ করে আবার নদীতীরে এসে দাঁড়ালেন। এই সময়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তাঁর দৃষ্টিগোচর হল। দেখলেন, পূর্বাকাশব্যাপী রক্তাভার মধ্যে এক বিশাল সিন্দূর গোলকের ন্যায় সূর্য উদিত হচ্ছেন। একজন উজ্জ্বলবর্ণ পুরুষ, তাঁর সারা গায়ে জল, শুভ্র কেশ ও গুম্ফ ও শ্মশ্রু বিন্দু বিন্দু জলে চিকচিক করছে। সামান্য একখণ্ড সিক্ত ধুতি তাঁর পরিধানে। সদ্যোত্থিত সূর্যের আভায় সেই পুরুষের সর্বাঙ্গ যেন রক্তিম দেখাচ্ছে। তিনি নদীতীরে দাঁড়িয়ে, চোখ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে সূর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আছেন। তাঁর করজোড় দুই হাত সূর্যের প্রতি প্রসারিত। তিনি কি কোনও মন্ত্রোচ্চারণ করছেন? কিন্তু তাঁর ঠোঁট নড়ছে না। কী করে তিনি রক্তবর্ণ তেজোদৃপ্ত সূর্যের দিকে অপলক দৃষ্টিপাত করে আছেন? শাম্বর ধারণা, এইরূপে মানুষের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। অথচ এই সদ্যোস্নাত উজ্জ্বল পুরুষের চোখে কোনওরকমে বিকার দেখা যাচ্ছে না।

শাম্ব সহসা তাঁর সামনে গেলেন না। অপেক্ষা করতে লাগলেন। ভাবলেন ইনিই কি সেই ব্যক্তি, যাঁর কথা গত রাত্রে হতমান অবিশ্বাসী ব্যাধিগ্রস্তরা বলছিল? কে ইনি? প্রকৃতই কি একজন ঋষি, যিনি সর্বদা রক্তমাংসের দেহ ধারণ করে সূর্যকে বেদোক্ত ভাষায় বন্দনা করেন? মহর্ষি নারদ বলেছিলেন, ঋষিগণ সে স্থানে বেদোক্ত প্রার্থনাদি আবৃত্তি করেন।

শাম্বর এই ভাবনার মধ্যেই সেই পুরুষ দুই হাত দিয়ে তাঁর দুই চোখ ধীরে মার্জনা করলেন। তারপর তীরের উচ্চভূমিতে উঠে, মন্দিরের দিকে না এসে, উত্তরদিকে গমন করলেন। শাম্ব যেন চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণে সেই পুরুষের পশ্চাতে অনুসরণ করলেন। মৃদুমন্দ বাতাসে নানা ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। পাখিরা যেন সদ্যোত্থিত সূর্যকে বন্দনা করে গান করছে। কিছুদূর যাবার পরে রমণীয় কানন মধ্যে একটি কুটির ও তপোবন দেখা গেল। শাম্ব সেই পুরুষকে আর অনুসরণ করতে যখন দ্বিধাগ্রস্ত, তখনই তিনি পিছন ফিরে শাম্বর দিকে তাকালেন। শাম্বর মনে হল, রৌদ্রোলোক তাঁকে অত্যুজ্জ্বল করেছে। আর অগ্রসর না হয়ে সেখান থেকেই নতজানু হয়ে, সেই পুরুষকে আভূমি প্রণাম জানিয়ে বললেন, ‘হে মহাভাগে অত্যুজ্জ্বল পুণ্যদেহ! আপনি আমার অপরাধ নেবেন না। আপনাকে আমি নদীতীরে সূর্য নমস্কার করতে দেখেছি। অন্তরে যথেষ্ট দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও, আমাকে যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি আপনার প্রতি আকর্ষণ করল। আমি আপনাকে অনুসরণ না করে থাকতে পারলাম না। হে মহাতপাঃ, আপনি আমাকে মার্জনা করুন।’

সেই পুরুষ প্রস্তরমূর্তির মতো অপলক চোখে শাম্বর দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ কিছুই বললেন না। তাঁর অপলক চোখের দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ ও অন্তর্ভেদী। শাম্বর মনে হল, তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে এই পুরুষ যেন তাঁর সমুদয় বিষয় অবগত হলেন। তথাপি শাম্ব এই তপোধনের অসন্তুষ্টির আশঙ্কায় হাত জোড় করে আবার বললেন, ‘মহাত্মন, আপনাকে অশেষতেজঃপ্রভাযুক্ত দেখছি। আমি মহাব্যাধি আক্রান্ত অভিশপ্ত। এই মহাক্ষণে আপনার দৃষ্টিকে আমি হয়তো আহত করেছি। আপনার পবিত্র অন্তরের শান্তিকে বিঘ্নিত করেছি! আপনি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন না। আমি যেন এক অলৌকিক আকর্ষণের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে আপনাকে অনুসরণ করেছি। আপনি আমাকে অজ্ঞ জ্ঞানে ক্ষমা করুন।’

শাম্বর কথা শেষ হতেই অদূরে বহুকষ্ঠের কোলাহল শোনা গেল। পুরুষমূর্তি বললেন, ‘আমার সঙ্গে এসো।’

শাম্ব যেন নিজের শ্রবণকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। সদ্যোস্নাত উপাসক যে তাঁকে এক কথায় আহ্বান করবেন, এ কথা তিনি ভাবতে পারেননি। মহাপ্রভঃ ঋষি আবার পিছন ফিরে চলতে আরম্ভ করেছিলেন। শাম্ব তাঁর অন্তরে গভীর আস্থা অনুভব করে দ্রুত পায়ে ঋষিকে অনুসরণ করলেন। দূরে দক্ষিণের কোলাহল শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর সমব্যাধিগ্রস্ত সেইসব পুরুষ-রমণী বালক-বালিকারা বোধহয় নদীর জলে স্নান করছে। তারপরে মন্দিরে নমস্কার করে সদলে সবাই ভিক্ষে করতে বেরোবে।

ঋষি পুরুষ কুটির প্রবেশে উদ্যত হয়ে থমকিয়ে দাঁড়ালেন, পিছনে ফিরে তাকালেন। শাম্ব আগেই অনেকখানি দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রভাযুক্ত পুরুষ বললেন, ‘তুমি তপোবন মধ্যে মুক্ত রৌদ্রে কোথাও বসো। তুমি স্নান করে এসেছ, দক্ষিণ-পূর্ব হয়ে বসো। অল্পক্ষণেই আমার পূজা সাঙ্গ হবে। তারপরে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।’ এই বলে তিনি কুটির মধ্যে প্রবেশ করলেন।

শাম্ব প্রতিটি নির্দেশই যথাবিহিত পালন করলেন। তিনি ফুল-ফল সুশোভিত তরুবীথির ছায়া পরিত্যাগ করে দক্ষিণ-পূর্বে মুখ করে মুক্ত রৌদ্রে উপবেশন করলেন। এ স্থানমাহাত্ম্য কি না তিনি বুঝতে পারলেন না, যুগপৎ তাঁর অন্তরে এক অনুশোচনা ও অনির্বচনীয় আনন্দবোধ তরঙ্গায়িত হতে লাগল। অনুশোচনা এই কারণে, তিনি এমন আশ্চর্য রমণীয় তপোবনে কখনও একান্ত একলা বসেননি। এর মধ্যে যে এক মহত্তর আনন্দ ও সৌন্দর্যবোধ বিরাজ করছে, আগে কখনও অনুভব করেননি। ভোগ, বীরত্ব, শত্রুনিধন, ক্ষত্রিয় ধর্মপালন এ সবই তিনি জানতেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার স্বরূপ অনন্য। কেন তিনি আগেই এই অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেননি! এই অনুশোচনা তাঁর মনে জাগছে, এবং এক অনির্বচনীয় আনন্দের ধারা প্রতি মুহূর্তে তা ধৌত করে দিচ্ছে।

নারদোক্ত বৃষ্ণিব্যাঘ্র যেভাবে বসেছিলেন, সূর্য তাঁর মুখোমুখি ছিলেন না, অথচ সর্বাঙ্গে রৌদ্র স্পর্শ করছিল। তিনি নদী, পরবর্তী তীর এবং দূরের আকাশে তাকিয়ে রইলেন, এবং ক্রমে এক ভাবাবেশে তিনি চোখ মুদ্রিত করলেন। তাঁর চোখের সামনে কুসুমের বর্ণ দুলতে লাগল। কতক্ষণ তিনি এভাবে ছিলেন, অনুমান করতে পারেন না। হঠাৎ শুনলেন, ‘এই নাও, এই ফলমূলাদি খাও। যৎসামান্য মিষ্টি খেয়ে জলপান করো।’

শাম্ব সংবিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত গাত্রোত্থানে উদ্যত হলেন। সেই প্রভাযুক্ত ঋষি তাঁর সামনে জলপদ্মের পাতায়-ফলমূল মিষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাম্বকে গাত্রোত্থানে উদ্যত দেখে, নিরস্ত করে বললেন, ‘তোমাকে উঠতে হবে না। যেখানে বসে আছ, সেখানেই বসো। এই নাও, এই যৎসামান্য ফলমূলাদি খাও। তুমি নিশ্চয় ক্ষুধার্ত। তার আগে একবার গ্রহরাজকে প্রণাম করো।’

শাম্ব সূর্যকে আভূমি নত হয়ে প্রণাম করলেন। তারপরে ঋষির প্রতি হাত প্রসারিত করলেন। ভেবেছিলেন, প্রভাযুক্ত ব্রাহ্মণ নিশ্চয়ই জলপদ্মের পাতা তাঁর দিকে ছুড়ে দেবেন। কিন্তু তিনি তা আদৌ করলেন না। যেমনভাবে একজনকে পাতায় খাদ্য পরিবেশন করতে হয়, তেমনি ভাবেই শাম্বর সামনে তা ভূমিতে রাখলেন। তাঁর বাঁ হাতে ছিল একটি মৃত্তিকার জলপূর্ণ পাত্র। সেটিও পাতার পাশে রাখলেন, বললেন, ‘খাও। আমি বসছি। তোমার খাওয়া হলে, বৃত্তান্ত শুনব।’

শাম্বর হৃদয় অতি আকুঞ্চিত হয়ে, নিশ্বাস অতি গভীরে আবর্তিত হল, এবং মনে হল, তাঁর চোখ ফেটে জল আসবে। হতভাগ্যের মতো অনেকগুলো দিন অতিবাহিত করবার পরে এইরকম প্রভাযুক্ত একজন উজ্জ্বল ঋষি পুরুষ তাঁকে স্বহস্তে খাদ্য পরিবেশন করলেন, সুবাক্য বললেন, এবং তাঁর মুখের অভিব্যক্তিতে বিন্দুমাত্র ঘৃণার কুঞ্চন দেখা গেল না। তিনি যেন একজন বিকলাঙ্গ কুৎসিত কুষ্ঠরোগগ্রস্তের সামনে নেই, এমনই স্বাভাবিক, বরং তার অধিক, শান্ত সৌম্য তার মুখভাব, আচরণ আশ্চর্য অনায়াস ও ভব্যযুক্ত।

শাম্ব অতি কষ্টে তাঁর হৃদয়াবেগ দমন করলেন ও অশ্রুসংবরণ করলেন। দেখলেন তাঁর কপালে চন্দ্রভাগা তীরের মৃত্তিকারই একটি গোলাকার ফোঁটা চিহ্ন। মাথায় সুদীর্ঘ চুলে এক খণ্ড বস্ত্র জড়িয়ে চূড়ার মতো বাঁধা। তাঁর শুভ্র শ্মশ্রু যেন উজ্জ্বল রৌপ্যের ন্যায়, মুখমণ্ডলে সুবর্ণ দীপ্তিতে কোথাও বার্ধক্যের বলিরেখা পড়েনি। ইনিই প্রকৃত মহর্ষি নারদোক্ত অত্যুজ্জ্বল পরমাত্মা গ্রহরাজ নন তো? কায়ারূপ ধারণ করে শাম্বকে আচ্ছন্ন করছেন না তো?

প্রভাযুক্ত পুণ্যদেহধারী আবার বললেন, ‘খাও। খাওয়া হলে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব।’

শাম্ব আবার করজোড়ে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে, ফল মুখে দিলেন। কিন্তু তাঁর হৃদয় মধ্যে সেই আবর্ত বারে বারে আকুঞ্চিত হতে লাগল এবং চোখ জলে ভরে উঠতে চাইল। তিনি নিজেকে অতি কষ্টে সংবরণ করলেন, এবং অমৃতবৎ ফলমূলাদি খেতে লাগলেন। প্রভাযুক্ত ঋষি নিকটেই একটি আমলকী বৃক্ষমূলে উপবেশন করলেন এবং নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাম্ব দুগ্ধজাত মিষ্টি খেয়ে, জলপান করলেন। ঋষি তাঁর দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে আমি গতকাল এখানে দেখিনি।’

শাম্ব বললেন, ‘আমি গত সন্ধ্যায় এখানে এসে পৌঁছেছি।’

ঋষি পুরুষ বললেন, ‘তোমাকে দেখে, আমি সেইরকমই অনুমান করেছি। কিন্তু এখানে তোমার মতো যারা আসে, তারা সকলেই জীবনের প্রতি বিশ্বাসহীন বীতশ্রদ্ধ অসংযমী হয়ে যায়। তাদের কথাবার্তা আর পূর্বের সুস্থ জীবনের মতো থাকে না। আচরণও বদলে যায়। তোমাকে আমি তার ব্যতিক্রম দেখলাম।’

শাম্ব বললেন, ‘আমি সাত ঋতু অতিক্রম করে এখানে এসে পৌঁছেছি। আমি শত শত গ্রাম জনপদ ও নগরীর মধ্যে দিয়ে এসেছি। অধিবাসীদের আমাকে দেখে ভয় ও ঘৃণার জন্য, তাদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র রাগ হয়নি। আমি নিজেকে দিয়েই তাদের মনোভাব বিচার করেছি। তথাপি তারা আমাকে খেতে দিয়েছে। দুরন্ত বর্ষায়, তীব্র শীতে, খামারে গোয়ালের ধারে বহির্বাটির মাথাঢাকা দাওয়ায় থাকতে কোনও বাধা দেয়নি। সারমেয়কুল সর্বত্রই একরকম এবং অবোধ বালক-বালিকাগণও। তারা আমাকে নানাভাবে তাড়না করেছে, পীড়ন করেছে। কিন্তু আমি রাগ করিনি। পরমাত্মার কাছে তাদের সুমতির প্রার্থনা করেছি। তবে হে মহাত্মন, গৃহত্যাগ করার পরে, আপনার মতো দয়াময় ব্যক্তির সাক্ষাৎ আমি এই প্রথম পেলাম; তাতে আমার এই প্রত্যয় জন্মেছে, হয়তো আমি সিদ্ধিলাভ করতে পারব।’

‘সিদ্ধিলাভ? কীসের সিদ্ধিলাভ?’

‘শাপমোচন।’ কথাটি উচ্চারণ করেই, শাম্ব যেন সহসা বিব্রত বোধ করে আবার বললেন, ‘আরোগ্যলাভই আমার সিদ্ধি।’

প্রভাযুক্ত ঋষি কয়েক মুহূর্ত শাম্বর দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই স্থানের কথা তোমাকে কে বলেছে, কী বলেছে?’

শাম্ব এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন, ‘যিনি সকল বর্ষসমূহ ও অন্তরীক্ষ ভ্রমণ করেছেন, সেই মহর্ষি নারদ।’

‘নারদ!’ প্রভাযুক্ত পুরুষ বিস্মিত স্বরে উচ্চারণ করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় তোমার সঙ্গে মহর্ষির সাক্ষাৎ হয়েছিল? তোমার পরিচয়ই বা কী?’

শাম্ব মৌনাবলম্বন করে মাথা নত করলেন। প্রভাযুক্ত পুরুষ তীক্ষ্ণ চোখে শাম্বকে দেখলেন, কিন্তু তিনি ক্রুদ্ধ হলেন না, বরং কোমল স্বরে বললেন, ‘পরিচয় দিতে যদি কুণ্ঠা থাকে, তবে থাক। হয়তো এই তোমার উপযুক্ত কাজ।’

শাম্ব প্রকৃতই কুণ্ঠাবোধ করছিলেন। তিনি যে বাসুদেবতনয়, এই পরিচয় দেওয়ার অর্থ এক সুদূরপ্রসারী কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করা। একমাত্র বংশপরিচয়ের দ্বারা অপরের উৎসাহকে তিনি বৃদ্ধি করতে চান না। কিন্তু এই মহাত্মা এ-কথা কেন বললেন, ‘হয়তো এই তোমার উপযুক্ত কাজ?’ শাম্ব বললেন, ‘আপনি আমাকে মার্জনা করবেন, অসন্তুষ্ট হবেন না। এখন আমার একমাত্র পরিচয়, আমি অভিশপ্ত। শাপমোচনের দ্বারা মোক্ষ লাভই আমার লক্ষ্য।’

প্রভাযুক্ত ঋষি বললেন, ‘বুঝেছি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তবে মহর্ষি নারদ তোমাকে কী বলেছিলেন, কী নির্দেশ দিয়েছেন তা আমি শুনতে চাই।’

শাম্ব নির্দ্বিধায় নারদোক্ত সূর্যক্ষেত্র ও তার বর্ণনাদি এবং এখানে আগমন করে চন্দ্রভাগায় স্নান ইত্যাদি সব কথাই বললেন। তাঁর গতকাল অতিসায়াহ্নে আগমন, হতমান অবিশ্বাসী রোগগ্রস্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও রাত্রিবাসের বর্ণনা দিলেন এবং তারা এই প্রভাযুক্ত ঋষির বিষয়ে কী বলেছে, তাও বললেন। বর্ণনা দিলেন, আজ অতি প্রত্যুষে চন্দ্রভাগায় স্নান করে, সূর্যক্ষেত্র দর্শনের পর, মহাত্মার দর্শন, এই রমণীয় কানন ও তপোবন তাঁর মনে কী গভীর শান্তি ও অনির্বচনীয়তা এনে দিয়েছে। তিনি বারে বারে মহাত্মার প্রশস্তি করে বললেন, ‘আপনি যদি বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ না হন, তা হলে এক বিষয়ে আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’

প্রভাযুক্ত ঋষি প্রসন্ন মুখে বললেন, ‘একটা কেন, তোমার যা জিজ্ঞাস্য আছে, করো। আমি সাধ্যমতো জবাব দেব।’

শাম্ব বললেন, ‘আমি দেখলাম, আপনি সূর্যদেবকে নমস্কার করে, কুটিরে গমন করলেন। মন্দিরের বিগ্রহকে তো আপনি পূজা করলেন না?’

ঋষি হেসে বললেন, ‘তুমি গতকালই রাত্রে, আস্তানার কুষ্ঠরোগীদের কাছে শুনেছ, মন্দিরের বিগ্রহের পূজা হয় না। আমার ওই পরমাত্মা বিগ্রহকে পূজা করার কোনও অধিকার নেই। বেদ বলেছেন, গ্রহরাজ সূর্য সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য। বেদে আমার অধিকার থাকলেও বিগ্রহপূজা সকল শ্রেণীর দ্বারা সম্ভব না। বিশেষত আমি দেবলক ব্রাহ্মণ, আমার বিগ্রহ পূজা নিষেধ। কিন্তু আমি এই মিত্রবনে বাস করি, অতি প্রাচীনকাল থেকে এ স্থান সূর্যলোক নামে খ্যাত, আমি প্রতিদিন গ্রহরাজেরই পূজা করি। প্রাচীনতম কালে যখন এই গ্রহরাজের কোনও মূর্তি কল্পনা করা হয়নি, তখন একটি রক্ত মণ্ডলাকার অঙ্কন দ্বারা সর্বত্র তাঁর উপাসনার প্রচলন ছিল। আমি প্রতিদিন একটি মণ্ডলাকার অঙ্কন করে সবিত্রের উপাসনা করি।’

শাম্ব নতুন বৃত্তান্ত শুনে অবাক হলেন, তাঁর কৌতূহল বর্ধিত হল। তিনি বললেন, ‘মহাত্মন, মহর্ষির কথা শুনে আমি ভেবেছিলাম এখানে এসে আমি গ্রহরাজকে কায়ারূপে দর্শন করব। এখন বুঝতে পারছি, আমি মহর্ষির কথা অর্বাচীনের ন্যায় ভেবেছি। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে বলুন এই গ্রহরাজের মূর্তি কীভাবে, কবে থেকে মন্দিরে বিগ্রহের ন্যায় কল্পিত হয়েছিল?’

ঋষি প্রীত হয়ে বললেন, ‘যে সব মহাপুরুষগণ এই পৃথিবী নামক গ্রহকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থাপ্রাপ্ত হতে দেখেছেন, তাঁরা বলেছেন, এই গ্রহরাজ আদি ও অনন্ত। তিনিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, রক্ষাকর্তা এবং নিয়ন্তা। তিনি ভয়ংকর কিন্তু শান্ত। তিনি প্রচণ্ড অগ্নিময়, কিন্তু জীবের জীবনধারণের কারণ। আমরা বিভিন্ন রূপে তাঁকে পূজা করেছি, বিভিন্ন নামে তাঁকে অভিহিত করেছি। আমাদের স্বভাব এইরকম যে যাকে আমরা ঈশ্বর রূপে ধ্যান করি, তাঁকে নিজেদের মনোমতো একটি রূপ দিতে চাই। সেই রূপ হওয়া চাই অতি তেজোদৃপ্ত, মহাবলশালী, অতি ক্ষমতাসম্পন্ন। গ্রহরাজের এক নাম আমরা দিয়েছি, ‘বিবস্বান’। কে এই বিবস্বান, তুমি কি জানো?’

শাম্ব অতিশয় চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘আমি সূত মুখে এক অতি পরাক্রান্ত গন্ধর্বরাজ বিবস্বানের নাম শুনেছি। তিনি ছিলেন এই ভারতবর্ষ ও ইলাবৃতবর্ষের মধ্যস্থল পর্বতের অন্তরীক্ষবাসী। তাঁর সন্তানগণের নাম বৈবস্বত মনু, যম, যমী, সাবর্ণি মনু আর অশ্বিদ্বয়। আমি আরও শুনেছি, এই মহাবল গন্ধর্বরাজ চাক্ষুষ মন্বন্তরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইক্ষ্বাকু এই বিবস্বানেরই বংশধর ছিলেন। পরবর্তীকালে এই ইক্ষ্বাকু রাজের বংশধরেরা সূর্যবংশীয় নামে খ্যাত ছিলেন।’

ঋষিপুরুষ অতি প্রসন্ন ও বিস্মিত মুগ্ধ চোখে শাম্বর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি পরিচয় না দিলেও, আমি ঠিকই অনুমান করেছি, তুমি কোনও খ্যাতনামা সদ্‌বংশজাত; নিতান্ত অর্বাচীন নও। তুমি যা শুনেছ, আর মনে রেখেছ, তা অতীব সত্য। সেই গন্ধর্বরাজ বিবস্বান এমনই পরাক্রান্ত মহাবলশালী তেজোদৃপ্ত ছিলেন যে, সেই কালের লোকেরা তাঁকে গ্রহরাজ সূর্যের সঙ্গে তুলনা করতেন। কালে এমনই হল, বিবস্বান বললে সূর্যকে বোঝায়, আবার রাজাকেও বোঝায়। সেই কারণেই ইক্ষ্বাকুবংশকে সূর্যবংশ বলা হয়। কিন্তু আমরা গ্রহরাজকে বিবস্বান নামে অভিহিত করলাম। তাঁর বহু নামের মধ্যে এইটি একটি। গ্রহরাজের বর্তমান যে-মূর্তি কল্পিত হয়েছে, তা গন্ধর্বরাজ বিবস্বানের ন্যায় হওয়া বিচিত্র নয়। বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের শিল্পীগণ অতিশয় পরিশ্রমী ও গুণী। তাঁরাই এই কল্পনাকে মূর্তির রূপদান করেছেন। তাঁরা বিবিধ যন্ত্রের ব্যবহার জানেন। তাঁদের চাক্ষুষ সৃষ্টি মানুষের মনে মায়ার সঞ্চার করতে সক্ষম।’

শাম্ব বিস্মিত ও উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘আমি আপনার কথার সমুদয় অর্থ হৃদয়ঙ্গম করেছি। এখন আমি জানতে ইচ্ছা করি, এখানে কে এই সূর্যক্ষেত্র সৃষ্টি করলেন, মন্দিরই বা কার সৃষ্টি। এই পরম রমণীয় কাননই বা কে সৃষ্টি করেছেন?’

ঋষি বললেন, ‘আমি যাবৎকাল এখানে এসে বাস করছি, তখন থেকেই এ-সব দেখছি। আমাদের বংশে চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। আমি আমার পূর্বপুরুষগণের কাছে শুনেছি, এই স্থানকে গ্রহরাজের মূলস্থান বলা হয়। আরও শুনেছি, গ্রহরাজের এটি অস্তাচলমানস্থান। তিনি যখন এই ভূমণ্ডলের চক্রে অন্য পৃষ্ঠে আলোক দান করেন, তখন এখানে তাঁর শেষ কিরণের একটি গুণ কার্যকরী হয়।’

শাম্ব সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দয়া করে আমাকে বলুন, শেষ কিরণের সেই গুণ কী? অস্তাচলমানস্থানই কী? কাকেই বা মূলস্থান বলে?’

ঋষি বললেন, ‘এই ক্ষেত্রকে মূলস্থান কল্পনা করা হয়েছে। অস্তাচলমানস্থান বলা হয়, কারণ, গ্রহরাজ যখন ত্রিগুণ সীমাতিক্রান্ত হন তখন তিনি ‘পুরুষ’ রূপে অভিহিত হন। তাঁর সেই অস্তাচলাভাব বিবিধ চর্মরোগ, দেহের বিকৃতি বিনাশ করে। আমি অস্তাচলগামী গ্রহরাজের পূজা প্রতিদিন স্নানাদি শেষে করে থাকি।’

শাম্বর অন্তর আশার আলোয় উদ্ভাসিত হল। তিনি অধিকতর আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গ্রহরাজের কিরণের কি এরূপ আরও স্থান ও কাল বিভাগ আছে?’

ঋষি পুরুষ বললেন, ‘আছে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তোমাকে বলছি। এই মহাদেশের পূর্বাঞ্চলে লবণদধি তীরে উদয়াচলে তিনি প্রথম আবির্ভূত হন। সেখানে তিনি পূর্বোওর কোণে উদিত হন, সেজন্য তাঁকে সেখানে কোণাদিত্য বলা হয়। এই আদ্যস্থানে তিনি পশ্চিম-দক্ষিণে অস্তাচলে যান। যমুনার দক্ষিণ ভাগে দ্বারকার নিকটবর্তী স্থানে তিনি মধ্যাহ্নে তাবস্থান করেন। তখন তিনি কালপ্রিয় নামে অভিহিত হন। মহাব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য, এই তিন স্থানে, তিন কালে তাঁর প্রভা অঙ্গে ধারণ কর বিধেয়।’

শাম্ব মনে মনে সংকট অনুভব করে, ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এক উদয় থেকে অস্তকালের মধ্যে, এই সুদূরবর্তী তিন স্থানে তিন কালে কী করে মানুষের পক্ষে গমনাগমন সম্ভব?’

ঋষি শাম্বকে আশ্বস্ত করে হেসে বললেন, ‘সম্ভব না। সম্‌বৎসরে এই তিন কালকে ভাগ করে তিন স্থানে তোমাকে অবস্থান করতে হবে। আমিও করেছি।’

শাম্ব প্রভাযুক্ত ঋষিকে প্রণাম করে বললেন, ‘আপনাকে দর্শনমাত্রেই আমি অনুভব করেছিলাম, আপনি অশেষগুণসম্পন্ন উজ্জ্বল পুরুষ। আপনি জ্ঞানী, মুক্ত পুরুষ। আপনার সান্নিধ্য অতি আনন্দদায়ক। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন, যেন আমি এই ত্রিক্ষেত্রে গমন করতে পারি।’

ঋষি স্বস্তিবাক্য উচ্চারণ করে বললেন, ‘তোমার বিশ্বাসই তোমাকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাবে। তার আগে, তোমার আরও একটি বিশেষ পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে হবে।’

‘মহাত্মন, আমি শ্রমবিমুখ নই। আপনি আমাকে আজ্ঞা করুন, প্রাণপণে আমি তা পালন করব।’

‘আজ্ঞার বিষয় কিছু না, তোমারই কল্পকর্মের কথা আমি বলছি। যে-দ্বাদশ নামে গ্রহরাজ অভিহিত হয়ে থাকেন, আমি সেই নাম সকল বলছি। আদিত্য, সবিত্র, সূর্য, মিহির, অর্ক, প্রভাকর, মার্তণ্ড, ভাস্কর, ভানু, চিত্রভানু, দিবাকর, রবি। এই দ্বাদশ নাম এবং দ্বাদশ রূপে তিনি দ্বাদশ মাসে দ্বাদশ তীর্থ ও নদ নদীতে, অতি ক্রিয়াশীল থাকেন। দ্বাদশ মাসে, দ্বাদশ দিন সেই সব নদ নদীতে স্নান ও রশ্মিযুক্ত হলে, ব্যাধির আরোগ্য ঘটে।’

শাম্ব ব্যগ্র কৌতুহলে জানতে চাইলেন, ‘সেই দ্বাদশ তীর্থ ও নদ নদীর নাম আপনি দয়া করে বলুন।’

ঋষি বললেন, ‘এই চন্দ্রভাগা তার মধ্যে একটি। এ ছাড়া, তোমাকে যেতে হবে পুষ্কর, নৈমিষ্য, কুরুক্ষেত্র, পৃথুদক, গঙ্গা, সরস্বতী, সিন্ধু, নর্মদা, পয়স্বিনী, যমুনা, তাম্রা, ক্ষিপ্রা এবং বেত্রবতী। এই সমস্ত অঞ্চলই উত্তর অংশে, বিন্ধ্যপদে, দক্ষিণের উত্তরাঞ্চল সীমানায়। তুমি প্রত্যেক স্থানে একদিন অবস্থান করলেও, আমার মনে হয় ছয় ঋতু অতিক্রম করবে। সাত ঋতুতে তুমি এখানে পৌঁছেছ। আরও ছয় ঋতু এইভাবে পরিভ্রমণ করা তোমার পক্ষে সম্ভব কি না তোমারই বিচার্য।’

শাম্ব অতি উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘মহাভাগে, আপনি আশীর্বাদ করুন, আমি নিশ্চয়ই পারব। আপনি আমাকে আর কিছু নির্দেশ দেবেন?’

ঋষি বললেন, হ্যাঁ, আমি শুনেছি, প্রতি মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে গ্রহরাজের প্রভা উজ্জ্বলতর হয়। এই দিনটি উপবাস করা বিধেয়।’

শাম্ব দ্বিধাভরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহাত্মন, আপনি বলছেন, ‘আমি শুনেছি’, আপনি হৃষ্ট মনে আমাকে জবাব দিন, কোথায় কার কাছে শুনেছেন? আপনার পূর্বপুরুষদের নিকট?’

ঋষি হাস্য করে মাথা নাড়লেন, বললেন, ‘না। তুমি দ্বাদশস্থান পরিভ্রমণ করে আসার পরে, আমি তোমাকে নতুন বৃত্তান্ত বলব।’

শাম্ব করজোড়ে বললেন, ‘আমার মহাভাগ্য। আমি আপনাকে আর একটি কথা বলব। আমি গতকাল অতিসায়াহ্নে যখন এখানে এলাম, টিলার মৃত্তিকা গহ্বরে ও পাতার কুটিরে ব্যাধিগ্রস্ত হতাশ অবিশ্বাসীদের দেখে, আমার অন্তর বিষাদে পূর্ণ হয়েছে। আপনার উপদেশ ওরা গ্রহণ করেনি। আমি এক হতভাগ্য, ওরা যেন আরও অধিক হতভাগ্য। আমি ওদের জন্য এতই বিচলিত বোধ করছি, কেবলই মনে হচ্ছে, ওরাও কি দ্বাদশ স্থানে যেতে পারে না? আরোগ্য লাভ করতে পারে না? আমি কি ওদের সঙ্গে আহ্বান করতে পারি না?’

প্রভাযুক্ত ঋষি সহসা কোনও কথা বললেন না, অপলক নিবিড় চোখে শাম্বর মুখের দিকে তাকালেন। শাম্বর চোখের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। শাম্বর ব্যাধিগ্রস্ত বিশাল শরীরের প্রতি লক্ষ করলেন। শাম্ব অন্যায় আশঙ্কায় ক্ষমা প্রার্থনা করতে উদ্যত হলে, তিনি হাত তুলে তাঁকে নিরস্ত করে বললেন, ‘আমি তোমার কথায় বিরক্ত হওয়া দূরে থাক, অত্যন্ত বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছি। তুমি যে-ই হও, আমার বিশ্বাস, তোমার শাপমোচন ঘটলে, তার সঙ্গে কোনও মহৎ কর্মেরও সাধন হবে। অন্যথায় এ চিন্তা তোমার মনে উদিত হত না। ওই সব কুটিরের অধিবাসীদের প্রতি আমি বিমুখ নই। তোমাকে আমি যা যা বলেছি, ওদেরও তা বলেছি। হতভাগ্য অবিশ্বাসীরা মানেনি। তুমি যদি ওদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো, এক বিশাল জনসংখ্যা আস্তে আস্তে রোগমুক্ত হতে পারে। তুমি যদি ওদের সম্মত করাতে পারো, তা হলেই সার্থক।’ এই বলে ঋষি বৃক্ষমূল থেকে গাত্রোত্থান করে বললেন, ‘তুমি কাছেপিঠে যদৃচ্ছা ঘুরে বেড়াও। স্থানীয় অধিবাসীরা আমাকে তণ্ডুল ফলমূলাদি দেয়। এক গোপরমণী দুধ ও দুগ্ধজাত ক্ষীর মিষ্টান্ন দেয়। আমি দিনান্তে একবার স্ব-পাকে রান্না করি। অস্তগামী আদিত্যের পূজা ও মন্ত্রোচ্চারণ করে, অন্নগ্রহণ করি। তুমিও আমার অন্নের ভাগ গ্রহণ করবে।’

শাম্ব আবার আভূমি নত হয়ে ঋষিকে প্রণাম করলেন। ঋষি তাঁর কুটিরে গমন করলেন। শাম্বও গাত্রোত্থান করলেন, কিন্তু বেশি দূরে কোথাও গেলেন না। চন্দ্রভাগা তীরে গিয়ে, জলের সামনে বসে, ঋষির কথিত কর্তব্যকর্ম বিষয়ে ভাবতে লাগলেন। আর মনে মনে বললেন, ‘হে বিশ্বের স্রষ্টা, নিয়ন্তা, তুমি আমাকে শক্তি দাও, শক্তি দাও।’

শাম্ব সূর্যাস্তের পরে, ঋষির পূজা শেষে, তাঁর কাছ থেকে অন্ন গ্রহণ করে, রাত্রের মতো বিদায় চাইলেন। ঋষি তাঁকে বললেন, ‘তুমি এখন ওই টিলার গায়ে যাবে। সাবধানে থেকো। এই মিত্রবনের কোথাও তুমি একটি কুটির নির্মাণ করে থাকো এই আমার ইচ্ছা। তবে তার আগে তুমি দ্বাদশস্থানে ঘুরে এসো, এবং সেই অবিশ্বাসীদের যদি সম্মত করাতে পারো, তার চেষ্টা পাও।’

শাম্ব ঋষিকে প্রণামপূর্বক বিদায় নিয়ে, নদীতীরের সেই বিস্তৃত টিলা অঞ্চলে উপস্থিত হলেন। অন্ধকার নেমে এসেছে। অগ্নিকুণ্ডগুলো জ্বলছে, এবং সেই আলোয় দেখা গেল, পুরুষ-রমণীগণ বালক-বালিকাগণ ইতস্তত গুচ্ছ গুচ্ছ বসে আছে। দেখেই বোঝা যায়, তাদের রান্না খাওয়া সবে শেষ হয়েছে। তখনও কেউ কেউ খাচ্ছিল। শাম্বকে দেখে সবাই ব্যঙ্গবিদ্রূপপূর্ণ বাক্যে কলরব করে উঠল। একজন চিৎকার করে বলল, ‘নীলাক্ষি, গতকালের সেই লোকটা ভোর রাত্রেই কোথায় চম্পট দিয়েছিল, আবার এখন ফিরে এসেছে। নিশ্চয়ই ও আজ তোমার খাবারে আবার ভাগ বসাতে এসেছে।’

‘আজ হয়তো ও সারাদিন না খেয়ে বুঝেছে, নীলাক্ষির সঙ্গে থাকাই ভাল।’ আর একজন বিদ্রূপ করে বলল।

একজন কাছে এসে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কি ওই ঋষি লোকটার দেখা হয়েছিল? নিশ্চয়ই অনেক জ্ঞান দিয়েছে?’

শাম্ব বললেন, ‘উনি একজন প্রকৃত জ্ঞানী। তবে উনি আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছেন।’

শাম্বর আশেপাশে যারা ছিল, আর তাঁর কথা শুনতে পেল, সবাই হইহই করে উঠল, ‘হতেই হবে, হতেই হবে। ও ব্যাটা যাকে পায়, তাকেই গুচ্ছের উপদেশ দেয়। তোমরা শোনো, একেও সেই ঋষি লোকটা অনেক উপদেশ দিয়েছে।’

শাম্ব গম্ভীর অথচ দৃঢ়স্বরে বলে উঠলেন, ‘থামো। তিনি একজন প্রকৃতই জ্ঞানী। তাঁর সম্পর্কে তোমরা সংযত বাক্য উচ্চারণ করো।’

শাম্বর গম্ভীর অথচ দৃঢ় স্বরে এমনই একটি প্রত্যয় ছিল, সকলেই কেমন সচকিত বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা বলল না। কিছুক্ষণ পরে একজন বলে উঠল, ‘এ লোকটা রাজরাজড়া ঋষিদের মতো কথা বলে। এও নিশ্চয়ই আমাদের কোনও জ্ঞান দেবে।’

‘না, আমি তোমাদের কোনও জ্ঞান দেব না।’ শাম্বর স্বর যেন গম্ভীর শঙ্খের নিনাদে ধ্বনিত হল, ‘আমি তোমাদের একটিমাত্র অনুরোধ করব।’

সকলেই কিছুটা হতবাক বিস্ময়ে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এই সময়ে নীলাক্ষি তার শিশুটিকে বুকে নিয়ে শাম্বর সামনে এসে দাঁড়াল। তার ক্ষয়-ক্ষত স্ফীত ঠোঁটে বিস্ফারিত হাসি। শাম্ব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নীলাক্ষি, তোমার আজ ভিক্ষার ঝুলি পূর্ণ হয়েছে তো?’

নীলাক্ষি ঠোঁট কুঞ্চিত করে বলল, ‘ওসব পূর্ণটুর্ণ জানি না। ঝুলি কোনওদিনই ভরে না, লোকে ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করে আসে। কিন্তু তুমি কী যেন বলছিলে?’

‘ও আমাদের কী একটা অনুরোধ করবে।’ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল, ‘ওর ভাবগতিক মোটেই সুবিধের না। ও নিশ্চয়ই আমাদের জ্ঞান দেবার তালে আছে।’

শাম্ব দৃঢ় এবং কিছুটা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ‘না, আমি তোমাদের কোনও জ্ঞান দেব না। তোমরা ভুলে যাচ্ছ, আমিও তোমাদের মতোই মহাব্যাধিগ্রস্ত দুর্ভাগা অভিশপ্ত। তোমাদের সঙ্গে আমার কোনও প্রভেদ নেই, প্রভেদ শুধু একটাই—’

‘যে তুমি ঋষি রাজরাজড়াদের মতন কথা বলো।’ কয়েকজন বাধা দিয়ে বলে উঠল।

শাম্ব সেই কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না। প্রভেদ এই, তোমরা বিশ্বাস হারিয়েছ, আমি এখনও বিশ্বাস হারাইনি।’

‘কীসের বিশ্বাস? আমাদের আবার কীসের বিশ্বাস থাকতে পারে?’ সমস্বরে রমণী পুরুষ বলে উঠল।

শাম্ব কয়েক মুহূর্ত প্রায় সকলের মুখের দিকে যেন আলাদা আলাদা করে তাকালেন, বললেন, ‘আরোগ্যলাভের বিশ্বাস।’

‘তখনই বলেছিলাম লোকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা জ্ঞান দেবে!’ কয়েকজন লাফালাফি করে বলে উঠল, ‘ও আমাদের বিশ্বাস করতে বলছে, আমরা ভাল হয়ে যাব।’

সবাই নানা ইতর ভাষা উচ্চারণ করে, বিকৃত উচ্চ স্বরে হাসতে লাগল, আর ধিক্কারের ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘মিথ্যা স্তোর্ক, মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা।’…

শাম্ব শান্ত ভাবে অপেক্ষা করলেন। যখন ওরা কিঞ্চিৎ শান্ত হল, তখন তিনি বললেন, ‘একটু ধৈর্য ধরে শোনো, আমরা সমগোত্রীয়, সকলেই সমান। সংসারের সব মানুষ আমাদের কারওকে আলাদা চোখে দেখে না। আমার জীবনে যা সত্য, তোমাদের জীবনেও তা সত্য। তবে কেন তোমাদের আমি মিথ্যা কথা বলব। তোমরা ব্যাধিগ্রস্ত হয়েও যদি সম্পদশালী হতে, তা হলে আমি তস্করের ন্যায় মিথ্যা কথা বলতে পারতাম, ছলনা করতে পারতাম। এক্ষেত্রে তারও কোনও সম্ভাবনা নেই।’

সকলের মধ্যে একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব দেখা দিল। একজন বৃদ্ধা কাছ থেকে বলল, ‘এটা ঠিক, আমাদের ঠকাবার কিছুই নেই। আর ও আমাদের মতনই একজন কুষ্ঠরোগী।’

‘কিন্তু ও যে কী সব বিশ্বাস-ফিশ্বাসের কথা বলছে। ও-সব তো মিথ্যা। ছলনা।’ একজন বলে উঠল।

শাম্ব বললেন, ‘কখনওই না। যার বিশ্বাস হারায়, তার সবই হারিয়ে যায়।’

‘আমাদেরও সবই হারিয়ে গেছে।’ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল, ‘আমাদের আর কোনও কিছুতে বিশ্বাস নেই।’

শাম্ব বললেন, ‘আমার সঙ্গে তোমাদের এই প্রভেদের কথাই বলছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমার পাপই আমাকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছে, আর একমাত্র মুক্তির উপায়, দুস্কর প্রায়শ্চিত্ত। এই আমার বিশ্বাস।’

‘কী সেই প্রায়শ্চিত্ত?’ নীলাক্ষি জিজ্ঞেস করল।

শাম্ব বললেন, ‘আরোগ্যলাভের চেষ্টা। এসো, আমরা সবাই আরোগ্যলাভের চেষ্টা করি।’

সকলে সমস্বরে হইহই করে উঠতেই, নীলাক্ষি তীক্ষ্ণ স্বরে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘চুপ করো। ও আমাদের মতোই কুষ্ঠরোগী। ওর কথা আমাদের শোনা উচিত। ও কী বলে, আমরা শুনব।’

শাম্ব চমৎকৃত বিস্ময়ে দেখলেন, নীলাক্ষির প্রতিবাদে এক অবিশ্বাস্য আশাতীত প্রতিক্রিয়া ঘটল। নীলাক্ষির প্রতিবাদও যেন উপস্থিত সকলের কাছে আশাতীত বোধ হওয়ায়, তারা স্তম্ভিত স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেকে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। নীলাক্ষি শাম্বকে বলল, ‘এসো, তুমি বসো, আমরাও বসি। তুমি কী বলো, আমরা শুনি। তোমার কথা যদি আমাদের মনে লাগে, ভাল। নইলে তোমাকে আর তোমার কথা আমরা ছুড়ে ফেলে দেব।’

শাম্বর মনে হল, এ যেন সেই গত রাত্রের কুষ্ঠরোগগ্রস্ত রমণী না, যে অতিপ্রার্থিনী হয়ে তাঁকে উত্তম যুক্তির দ্বারা রমণে প্ররোচিত করেছিল। উত্তম যুক্তি ছিল তার কথায়, কারণ এই ব্যাধি এবং দেহের বহিরাবরণ ও অভ্যন্তরের অনুভূতি আর মানসিকতা বিষয়ে ওর বক্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু এই রমণী যে এমন অঘটনঘটনপটিয়সী হতে পারে, তিনি অনুমানও করতে পারেননি। তার কথার মধ্যে এখনও তেজ ও যুক্তি লক্ষণীয়। শাম্ব এদের সম্পর্কে যতটা হতাশ হয়েছিলেন, ততটাই আশান্বিত হলেন। তিনি নীলাক্ষির সঙ্গেই একটি অগ্নিকুণ্ডের অদূরে বসলেন। দেখা গেল, অনেকেই সামনে এসে বসল। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে রইল। যেন বন্যহস্তীযূথ এখনও পুরোপুরি নতি স্বীকার করতে পারছে না, অথচ বিদ্রোহও করতে পারছে না, এইরকম তাদের অবস্থা। তার মধ্যেই তিনি শুনতে পেলেন, কেউ কেউ বলাবলি করছে, ‘নীলাক্ষি যখন বলছে, তখন শোনাই যাক, কী বলো হে! লোকটা আমাদের কেউ না হতে পারে, নীলাক্ষি তো আমাদের।’

শাম্ব দেখলেন, নীলাক্ষি এবং সকলেই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘আমার যা বলবার, তা তোমাদের বলেছি। তবু আমি আবার তোমাদের বলছি, আমাদের সামনে জীবনের আর কী অবশিষ্ট আছে?’

‘মরা মরা। পচে গলে মরা।’ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল।

শাম্ব দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘না। সুস্থ হয়ে বাঁচা। লয় ক্ষয় ও মৃত্যু অনিবার্য। স্বর্গলোকেও এই জীবনমৃত্যুর লীলা চলছে। যাঁরা মহৎ কর্মের দ্বারা দিবি আরোহণ করেছেন, তাঁরা নক্ষত্রলোকে বিরাজ করছেন। আমরা তাঁদের স্মৃতিচারণ করি, পূজা করি। কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য জেনেও আমরা সুস্থ সবল ভাবে বাঁচতে চাই। আমাদের সামনে জীবনের এইটাই একমাত্র অবশিষ্ট আছে।’ বলে তিনি নীলাক্ষির কোল থেকে তার শিশুটিকে নিয়ে তুলে ধরে দেখিয়ে বললেন, ‘এই সুন্দর শিশুটি কী অপরাধ করেছে যে, সে তার পিতামাতার ব্যাধি নিয়ে অকালে মরে যাবে? ওর অপরাধ কি এই, এই পৃথিবীতে ও জন্মেছে। নিজেদের আর ওকে, ওর মতো আমাদের এখানে আরও শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার কোনও দায়িত্ব কি আমাদের নেই?’

সহসা কেউ কোনও জবাব দিল না, কি প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠল না। শিশুটিও যেন বিশেষ কৌতুক ও আকর্ষণে শাম্বর দিকে তাকিয়ে রইল, কেঁদে উঠল না। শাম্ব আবার বললেন, ‘ব্যাধি হলে, আরোগ্যলাভের নানা উপায় আছে। আমাদের সেই উপায় অবলম্বন করতে হবে। এখনও আমাদের আশা আছে। মনে বিশ্বাস থাকলে আমরা আরোগ্যলাভ করতে পারব। এইসব শিশু বালক বালিকারাও সুস্থ হবে। বড় হয়ে ওরা তোমাদের জয়গান করবে।’

নীলাক্ষি বলল, ‘ভাল হওয়ার কী উপায়?’

শাম্ব বললেন, ‘হতাশ হয়ে, এক স্থানে পঙ্গুর মতো বসে থাকা না।’ বলে তিনি ঋষি কথিত দ্বাদশ স্থান ও নদনদীর কথা বললেন।

কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, ‘এ সেই ঋষি লোকটার কথাই বলছে।’

‘কিন্তু ও নিজে আমাদের মতোই একজন কুষ্ঠরোগী।’ নীলাক্ষি উচ্চ স্বরে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘ও সুস্থ লোকের মতন আমাদের কেবল উপদেশ দিতে আসেনি। ও আমাদের সঙ্গে যাবে, ও আমাদের মতন একজন। আমি ওর সঙ্গে যাব।’

তৎক্ষণাৎ কয়েকজন নীলাক্ষির কথার প্রতিধ্বনি করল, ‘হ্যাঁ, আমিও যাব, আমিও যাব। ও আমাদের মতনই একজন।’

একজন রুদ্ধ স্বরে শান্বকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওকে আমার ছদ্মবেশী যক্ষ বলে মনে হচ্ছে। কুষ্ঠরোগী সেজে এসেছে, আমাদের ভুলিয়ে নিয়ে যাবে।’

আর একজন মাটিতে লুটিয়ে কেঁদে বলল, ‘হা ঈশ্বর, আমি কি আবার সত্যি ভাল হয়ে যাব? এ কী আশ্চর্য কথা শুনছি?’

শাম্ব নীলাক্ষির কোলে তার শিশুটিকে তুলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভূলুণ্ঠিত ক্রন্দনমান লোকটিকে জড়িয়ে ধরে তুলে বলল, ‘আশা রাখো, বিশ্বাস রাখো। আমার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, সংসার প্রকৃতই বিস্ময়কর, ঘটনাবলী সকল আশ্চর্যজনক।’

‘তা নইলে কেন আমাদের এই মহারোগ হবে?’ নীলাক্ষি বলল, এবং শাম্বর দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ‘আমার মনে আশা জাগছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের মনেও আশা জাগছে। তোমাকে আমরা বিশ্বাস করি।’ অনেকে সমস্বরে বলে উঠল।

শাম্বর চারপাশে অল্পবয়স্ক বালক-বালিকারা এসে দাঁড়াল! শাম্ব সকলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রমণীরা তাদের শিশুদের শাম্বর দিকে এগিয়ে দিল। শাম্ব শিশুদের কপালে মাথায় তাঁর অসাড় হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। ফিরে তাকালেন নীলাক্ষির দিকে। নীলাক্ষি এগিয়ে এল। শাম্ব তার শিশুটিকে স্পর্শ করলেন। তাদের এই আচরণে যেন তাঁর কাছে আত্মসমর্পণের সংকেত। কিন্তু নীলাক্ষি বিষয়ে তাঁর মনে তখনও একটি দ্বিধা ও সন্দেহ ছিল। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, নীলশি হয়তো গত রাত্রের মতোই, অভ্যস্ত বাসনায় রমণেচ্ছা প্রকাশ করবে।

নীলাক্ষি সেই মুহূর্তেই বলে উঠল, ‘কাল রাত্রে আমি তোমার ওপর অন্যায় রাগ করেছিলাম। তোমাকে এই কারণেই আমি আরও বিশ্বাস করি, তুমি আমাদের মতন হয়েও আমাদের থেকে তোমার মনের জোর বেশি। তুমি যেন কাল রাত্রের কথা মনে রেখে আমার ওপর রাগ কোরো না।’

শাম্বর অন্তর মুহূর্তের জন্য দুর্বল হল। বহদিন তিনি কোনও রমণীকে স্নেহ ও সোহাগ করেননি। এখন মনে হল, নীলাক্ষিকে তিনি সোহাগ ও আদর করবেন, তার বাসনা পূর্ণ করবেন। আবার ক্ষণ পরেই তিনি মনের দুর্বলতা দমন করলেন, বললেন, ‘আমি কখনওই তোমার ওপর রাগ করিনি। বরং আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি দেখছি, তোমার মধ্যেও শক্তি আছে।’

নীলাক্ষির ভগ্ন নাসা, পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখ, ক্ষয়-ক্ষত ঠোঁট, স্ফীত মুখে সলজ্জ হাসি ফুটল। বলল, ‘না না, আমার কোনও শক্তি নেই। আমি তোমার কাছ থেকেই শক্তি পেয়েছি। এবার বলো আমরা কবে কখন যাত্রা করব।’

শাম্ব বললেন, ‘শুভ কাজে বিলম্ব করতে নেই। আমরা সকলেই কল্প গ্রহণ করে, আগামীকাল প্রত্যুষে চন্দ্রভাগায় স্নান করে যাত্রা করব।’

কেউ কেউ তাদের সংগৃহীত অতি সামান্য বস্তুর জন্য আর্তস্বরে বলে উঠল, সে-সব কেমন করে তারা ফেলে যাবে? শাম্ব বললেন, ‘এখানে সব যেমন আছে, তেমনই থাকবে। আমরা কেবল আমাদের এই দেহগুলো নিয়ে যাত্রা করব। আর নিতান্ত ব্যবহার্য বস্তু সকল বহন করব।’

‘আজও আমার কিছু বাড়তি খাবার আছে।’ নীলাক্ষি শাম্বকে বলল, ‘তোমাকে এনে দিই, খাও।’

শাম্বর হৃদয় এক অনাস্বাদিত ব্যথায় ও আনন্দে ভরে উঠল। বললেন, ‘নীলাক্ষি, তোমার হৃদয় অতুলনীয়। এখানে আসার আগে, তপোবনের ঋষিই আমাকে তাঁর স্বপাক অন্ন খেতে দিয়েছিলেন। তোমার বাড়তি খাবার তুমি কাল স্নানের পরে খেয়ো।’

‘কিন্তু তুমি আজও কি চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে সারা রাত জেগে বসে থাকবে?’ নীলাক্ষি উদ্‌বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল।

শাম্ব বললেন, ‘না। আমি এখন তপোবনে যাব। কাল প্রত্যুষে এসে তোমাদের জাগিয়ে তুলব।’

এক বৃদ্ধা বলল, ‘হ্যাঁ, তাই যাও। আমি শুনেছি ওই তপোবনে কোনও জন্তু জানোয়াররা হামলা করে না।’

শাম্ব রাত্রের জন্য সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তাঁর তপোবনে যাবার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, আগামীকাল প্রত্যুষেই সকলকে নিয়ে তাঁর যাত্রার কথা ঋষিকে জানানো। অবিশ্যি তিনি কুটির বন্ধ করে নিদ্রিত থাকলে তাঁকে জাগাবার কোনও প্রশ্নই নেই। তা হলে শাম্ব আজ রাত্রিটা মন্দির সংলগ্ন কাননে কোথাও কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু এই ঘটনায় তিনি এখনও বিস্ময় বোধ করছিলেন। তিনি একজন ক্ষত্রিয়। কোনও কার্য সমাধা করতে হলে অস্ত্র ও বাহুবলেই তিনি অধিকতর বিশ্বাসী। অথচ ঘটনাটি ঘটে গেল এক মানবিক আবেদনে। এ ক্ষেত্রে তিনি দেখলেন, নীলাক্ষিই তাঁর অস্ত্র স্বরূপ কাজ করল।

শাম্ব মন্দিরের নিকটবর্তী হতেই, অন্ধকারে ঋষির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন, ‘তুমি বোধহয় আমার সন্ধানে যাচ্ছ?’

শাম্ব থমকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এই রমণীয় কানন অন্ধকার হলেও সবই যেন আবছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে। ঋষির পিছনেই নদী ও নক্ষত্রখোচিত আকাশ। শাম্ব তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। করজোড়ে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে শাম্ব বললেন, ‘মহাত্মন, আপনিই যথার্থই অনুমান করেছেন।’

‘অনুমান না বৎস, আমি দূরের অন্তরাল থেকে সবই দেখেছি ও শুনেছি।’ ঋষি শাম্বর কথা শেষের আগেই বলে উঠলেন, ‘তোমার অভিপ্রায় শুনে, আমার অত্যন্ত কৌতূহল ও আগ্রহ জন্মেছিল। প্রকৃতপক্ষে আমার মনে গভীর সন্দেহ ছিল। কিন্তু তুমি যে-ই হও, অশেষ তোমার ক্ষমতা। আমি আবার তোমাকে আশীর্বাদ করি, তুমি শাপমুক্ত হও, তোমার অনুগামীরা সকলে আরোগ্যলাভ করুক। এখন আর বাক্যব্যয়ে প্রয়োজন নেই। এই কানন মধ্যে এক আশ্চর্য শাখাবিস্তৃত বৃক্ষ আছে। একজন মানুষ অনায়াসে নিশ্চিন্তে সেখানে শয়ন করতে পারে। কোনও হিংস্র শ্বাপদ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এসো, তোমাকে আমি সেই বৃক্ষ দেখিয়ে দিই। কাল প্রত্যুষে যাত্রাকালে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।’

শাম্ব বুঝলেন, ঋষিপুরুষও শুভ কাজের মধ্যে আর কোনও আলাপাদি বা বিলম্ব করতে চান না। তিনি ঋষিকে অনুসরণ করলেন।

অন্ধকারে পাখির প্রথম ডাকেই শাম্বর নিদ্রাভঙ্গ হল। এ ডাক রাত্রিচর পাখির, প্রভাতের প্রত্যাশায় ব্যাকুল স্খলিত জিজ্ঞাসু পাখির স্বর। শাম্ব দেখলেন, পূর্বাকাশে ঈষৎ রক্তাভা জেগে উঠেছে। তিনি সেই খট্টিকার ন্যায় প্রশস্ত ও বিস্তৃত শাখাযুক্ত বৃক্ষ থেকে অবতরণ করে আগেই গেলেন সেই টিলা অঞ্চলে। তখনও সকলেই নিদ্রিত। শাম্ব যদি জানতেন নীলাক্ষি কোন কুটিরে বা মৃত্তিকা গহ্বরে বাস করে, তা হলে প্রথমে তাকেই ডাকতেন। তা জানা না থাকায় তিনি প্রতিটি কুটিরের সামনে, মৃত্তিকা গহ্বরের কাছে গিয়ে সবাইকে ডেকে তুললেন।

মুহূর্ত মধ্যেই সমস্ত অঞ্চলটি কোলাহলে পূর্ণ হল। সকলেই প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করে চন্দ্রভাগার জলে স্নান করে নিল। শাম্বও তাদের সঙ্গে স্নান করলেন। পুবের আকাশে ক্রমেই অতি উজ্জ্বল রক্তাভা ছড়িয়ে যেতে লাগল। শাম্বর নির্দেশে সকলেই দ্রুত প্রস্তুত হল। ব্যবহার্য বস্ত্রাদি, খাবারের রন্ধনের পাত্রাদি ঝোলায় বেঁধে নিল। শাম্বর মনে পড়ে গেল, শাল্ব এবং অন্যান্য বীরদের সঙ্গে যুদ্ধের কথা, কুরুক্ষেত্রের সংগ্রামের চিত্র ভেসে উঠল চোখের সামনে। আজও যেন তিনি যুদ্ধযাত্রা করছেন। এ যুদ্ধের রূপ আলাদা। তিনি আগেই স্থির করে রেখেছিলেন, চন্দ্রভাগার তীর ধরে উত্তরে গমন করবেন এবং সিন্ধু ও চন্দ্রভাগার সঙ্গমে উপস্থিত হবেন। সিন্ধুর উৎপত্তিস্থল হিমালয়। চন্দ্রভাগা যে-স্থানে শাখা নদী রূপে অবতরণ করেছে, সে-স্থানও হিমালয়ের ওপরে।

নদীর তীর ধরে যাবার সময়ে, সেই প্রভাযুক্ত ঋষি, গতকাল যেখানে ভোরে দাঁড়িয়েছিলেন, এখনও সেখানেই প্রতীক্ষা করছিলেন। এখনও গ্রহরাজ উদিত হননি। শাম্ব তাঁর সামনে গিয়ে আভূমি নত হয়ে প্রণাম করলেন। তাঁর সঙ্গের দল কখনওই ঋষিকে কোনওরকম শ্রদ্ধা দেখায়নি। আজ তারা কপালে করজোড় স্পর্শ করে, নানা জনে নানারকম মন্তব্য করল। কেউ বলল, ‘তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হল হে ব্রাহ্মণ।’

কেউ বলল, ‘আমরা ভাল হয়ে আবার এখানে আসব।’

ঋষি দু’হাত প্রসারিত করে সকলের শুভযাত্রা ও মঙ্গলকামনা করলেন।

শাম্ব যাত্রার আগেই গণনা করেছিলেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ, নানা বয়সের নরনারী সর্বসাকুল্যে সত্তরজন ছিল। দ্বাদশ স্থানে ও নদনদীতে স্নান করে, দ্বাদশ মাস পরে তিনি যখন আবার চন্দ্রভাগাকূলে অস্তাচলমান স্থানে ফিরে এলেন, তখন তাঁকে বাদ দিয়ে চৌদ্দজন মাত্র জীবিত। বাকি কিছু সংখ্যক লোক ব্যতিরেকে, সকলেই পথিমধ্যে প্রাণত্যাগ করেছে। কেউ কেউ ব্যাধির অতি প্রাবল্যে মারা গিয়েছে। সুদীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করাও সকলের সাধ্যায়ত্ত ছিল না। বিশেষত অসুস্থ বালক-বালিকাগণ। কিছু সংখ্যক লোক নানা স্থানে থেকে গিয়েছে। কষ্ট স্বীকার করতে রাজি হয়নি। নীলাক্ষির শিশুটিও মারা গিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য মায়েরা তাদের শিশুকে হারিয়ে যেমন শাম্বকে অভিসম্পাত দিয়েছিল, নীলাক্ষি তা দেয়নি।

শাম্ব যে-চৌদ্দজনকে নিয়ে ফিরে এলেন, তাদের মধ্যে তিনজন রমণী, দুইটি বালক-বালিকা, বাকি সকলেই পুরুষ। তাদের সকলের বিকৃত দেহে একটি পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। শাম্ব যেমন অনুভব করেছেন, ক্ষীণতর হলেও তাঁর সম্পূর্ণ অসাড় দেহে, এই এক বৎসরের মধ্যে অনুভূতিবোধ ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে, বাকি চৌদ্দজনের অভিজ্ঞতাও তাঁর মতোই। ভ্রূ বা মস্তকের কেশের ভঙ্গুরতা ও পতন বন্ধ হয়েছে। তাঁর মতো, পুরুষদের সকলের গুম্ফ ও শ্মশ্রুও এখন অভগ্ন ও ঘন। দেহের ক্ষয় ও ক্ষতের বৃদ্ধিলাভ ঘটেনি। যদিও অনেক সঙ্গীকে হারাতে হয়েছে এবং সকলেই শোকার্ত, তথাপি সকলের মধ্যেই নবজীবন লাভের একটি উদ্দীপনা জেগেছে। অথচ সেই উদ্দীপনার মধ্যে কোনওরকম উচ্ছৃঙ্খল উচ্ছ্বাস নেই। আছে এক নতুন আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা, সকলের আচরণে এক প্রশান্ত গাম্ভীর্য লক্ষণীয়। শাম্বও অন্তরে এক গভীর আস্থা ও প্রশান্তি লাভ করেছেন। এই নবজন্মের সূচনায়, যেন একটি নতুন সংঘের স্থাপনা ঘটেছে।

রমণীদের মধ্যে এবং সকলের মধ্যেই নীলাক্ষিকে নেত্ৰীস্থানীয়া মনে হয়। সে হয়ে উঠেছে সর্বাপেক্ষা শ্রীময়ী, মন্দিরের অপ্সরাদের ন্যায় তার সর্বাঙ্গে যেন রূপ ও লাবণ্যের সঞ্চার হয়েছে, অথচ গ্রহরাজের প্রতি তদ্‌গত ভক্তিতে এক ধ্যানমগ্না পূজারিণী। তাকে দেখলে এখন আর বিশ্বাস করা যায় না, সে ছিল বিশ্বাসহীনা, প্রত্যহ যে-কোনও পুরুষের সহবাসে অভ্যস্ত কামতাড়িতা। সকলের মধ্যেই এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।

সর্বোপরি এক বিশিষ্ট ঘটনা এই, সিন্ধু ও চন্দ্রভাগা সঙ্গমের জলে, শাম্ব পেয়েছেন একটি দারুমূর্তি যাঁর সঙ্গে এই মিত্রবনের গ্রহরাজের মূর্তির আশ্চর্য সাযুজ্য বর্তমান। মাথায় শিরস্ত্রাণ, কপালের ওপর এসে পড়েছে যেন এক খণ্ড বস্ত্রের আবরণ, বিশাল চক্ষুদ্বয়, শিরস্ত্রাণের বাইরে বিন্যস্ত কেশপাশের অংশ, মনোহর গুম্ফ, কুঞ্চিত শ্মশ্রু, রাজকীয় পোশাকের কোমরে অভিয়ঙ্গ বন্ধন এবং চরণদ্বয় পাদুকাবৃত। দারুমূর্তিটি মোটেই খুব ছোটখাটো না, একজন দীর্ঘদেহ ক্ষত্রিয়ের ন্যায় এবং নিতান্ত হালকাও না। বর্ষসমূহে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ন্যায় শাম্বর মনও সেই মূর্তি প্রাপ্তিতে, যেন এক গভীর সংকেতময় আনন্দে উদ্‌বেল হয়ে উঠেছিল। জীবনের কিছুই নিরর্থক না। সকল প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির মধ্যে একটি অর্থপূর্ণ নির্দেশ বর্তমান।

শাম্ব মূর্তি প্রাপ্ত হয়ে, ব্যাকুলিত চিত্তে বক্ষে ধারণ করেছিলেন, আর কখনওই ত্যাগ করেননি। এই সমস্ত ঋতুগুলো এবং সমস্ত পথপরিক্রমায় দারুমূর্তিটি তিনি স্কন্ধে বহন করেছেন। একসঙ্গে স্নান করেছেন, এই মিত্রবনের ঋষি-উক্ত তিনটি বিশেষণের দ্বারা প্রত্যহ পূজা করেছেন, সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য।

মিত্রবনের ঋষি শাম্বর সঙ্গীগণসহ প্রত্যাবর্তনে, যেন পরিবার ও স্বজনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে শিশুর ন্যায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। প্রণামের জবাবে তিনি সকলকেই আলিঙ্গন করলেন, রমণীদের মস্তকে ও কপালে হাতের স্পর্শ দিয়ে স্বস্তিবচন উচ্চারণ করলেন। শাম্বর মূর্তিপ্রাপ্তিতেই তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি চমৎকৃত, বিস্ময়ে উদ্‌বেলিত ও চঞ্চল হলেন। শাম্বকে বললেন, ‘এই মিত্রবনেই, রমণীয় কানন মধ্যে তুমি এই মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করো। আমি দেখেই বুঝতে পারছি, এ মূর্তি কল্পবৃক্ষের দ্বারা তৈরি। এ নিশ্চয়ই কোনও নিপুণ বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। কিন্তু তোমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল।’

শাম্ব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দায়িত্ব!’

ঋষি তাঁকে এই প্রথম নিজের কুটিরের মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘বসো। তোমার সঙ্গে আমার একান্তে কিছু কথা আছে। তোমাকে এবার প্রস্তুত হতে হবে আর এক বিরাট পরিশ্রমসাধ্য কাজের জন্য।’

শাম্ব মৃত্তিকায় জোড়াসনে বসে বললেন, ‘আজ্ঞা করুন।’

ঋষি বললেন, ‘আজ্ঞা নয়, তোমার আরব্ধ কাজ সমাপ্ত করতে হবে। হয়তো মহর্ষি নারদ উপস্থিত থাকলে তিনিই তোমাকে বলতে পারতেন।’

শাম্ব বললেন, ‘আপনাকে মহর্ষির তুল্য অভিজ্ঞ মনে হয়। আপনিই আমার কর্তব্যের কথা বলুন।’

ঋষি মহর্ষির উদ্দেশে কপালে জোড় হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা জীবনের তাগিদে। মহর্ষি বিশ্বভ্রমণ করে জ্ঞানলাভ করেছেন। যাই হোক, তোমার নিশ্চয় মনে আছে, তুমি যখন আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে, কেন গ্রহরাজ বিগ্রহের কোনও পূজা হয় না, তোমাকে বলেছিলাম, আমার সে-অধিকার নেই। এখন তোমাকে বলি, সে-অধিকার আছে শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণদের। তোমাকে যেতে হবে সেই শাকদ্বীপে, সেখানকার ব্রাহ্মণদের তোমাকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসতে হবে!’

শাম্ব অজ্ঞতাবশত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কখনও শাকদ্বীপের নাম শুনিনি। সে-স্থান কোথায়, গমনযোগ্য কি না, আপনিই বা সে-স্থানের কথা কেমন করে জানলেন আমাকে সবই ব্যক্ত করুন।’

ঋষি বললেন, ‘সবই তোমাকে বলব। তোমরা এই যে দ্বাদশস্থান পরিভ্রমণ করলে, স্নান করলে, উপবাসাদি করলে এ সবই প্রাকৃতিক চিকিৎসা রূপে গণ্য হবে। শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা কেবল সূর্যোপাসক নন, এই ব্যাধিকে দেহ থেকে আমূল ধ্বংসের চিকিৎসাবিধি একমাত্র তাঁরাই জানেন। সূর্যালোকের বিবিধ স্থান ও কাল, তাঁরাই নির্ণয় করেছেন, কারণ তাঁরা জানেন, গ্রহরাজই এইসব ব্যাধির নিরাময় করতে পারেন। তাঁরা উপাসনা ও বিবিধ কর্মের দ্বারা এই গুণ আয়ত্ত করেছেন। আমার মনে হয় কখনও কখনও তাঁরা কোনও পরাক্রান্ত রাজার দ্বারা ভারতবর্ষে আনীত হয়েছিলেন, কিন্তু যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায়, আবার নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করেছেন। মিত্রবনের এই মন্দির দেখেই তা বোঝা যায়। কারণ একমাত্র শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণরাই গ্রহরাজবিগ্রহের পূজার অধিকারী।’

শাম্ব অতি কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে বললেন, ‘মহাত্মন, এ সকল সংবাদই আমার কাছে নতুন। আমি সেই ক্ষমতাশালী ব্রাহ্মণদের দর্শনের জন্য বিশেষ ব্যাকুল হচ্ছি, কারণ তাঁরাই একমাত্র এই ব্যাধি দেহ থেকে আমূল ধ্বংসের চিকিৎসাবিধি জানেন! এখন বলুন এঁদের কথা আপনি কেমন করে জানলেন, কোথায় এবং কোন পথেই বা শাকদ্বীপে গমন করা যায়। আমি তাঁদের আনয়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’

ঋষি বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, তোমার দ্বারাই তা সম্ভব। শোনো, আমি পূর্বপুরুষদের কাছে এই শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণদের কথা শুনেছিলাম। সেখানে মগ ও ভোজক দুই শ্রেণীর ব্রাহ্মণ আছেন, উভয় শ্রেণীই সূর্যোপাসক। শুনেছি ভোজক শ্রেণীর মধ্যে বিবাহাদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে, রক্তের সম্পর্ক মানামানি নেই। এই রীতি আমাদের দেশে সম্মানের চোখে দেখা হয় না, পরন্তু বিরাগ ও বিতৃষ্ণারই সৃষ্টি করতে পারে। তুমি সেখানে গেলেই সব চাক্ষুষ করতে পারবে। পথ নিঃসন্দেহে খুবই দুর্গম। এখান থেকে তোমাকে অন্তরীক্ষে গমন করতে হবে। অন্তরীক্ষ অতিক্রম করে দেবলোক ইলাবৃতবর্ষের নিকটবর্তী কোনও স্থানের নাম শাকদ্বীপ। সেখানে গমন করলে, অধিবাসীরা তোমাকে সম্যক শাকদ্বীপ চিনিয়ে দেবে। শাকদ্বীপ গমনের পূর্বে, তুমি গ্রহরাজ মূর্তিকে কানন মধ্যে স্থাপন করো। তথাপি একটি সমস্যা থেকে যাচ্ছে।’

‘কী বলুন। চেষ্টা করব, যাতে সমস্যা দূর করা যায়।’

‘বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়কে এখানে আনয়ন করে তোমার কল্পবৃক্ষমূর্তির জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সেই মহান শিল্পীরা বাস করেন। তাঁরা এখানে এসে কাজে হাত দিলে, তাঁদের ভরণপোষণের কী উপায়!’

শাম্ব কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, ‘মহাত্মন, অর্থানুকূল্য ব্যতীত এইরূপ এক বিশাল কাজ সম্ভব না। আমি একজন ক্ষত্রিয়। ক্ষাত্র ধর্মানুযায়ী আমি শত্রুকে নিধন ও পরাজিত করে, তাদের ধনসম্পত্তি সকল লাভ করেছি। এই কাজে কি আমি সেই সকল ধনসম্পদ ব্যয় করতে পারি না?’

ঋষি বিস্মিত ও অত্যুৎসাহী হয়ে বললেন, ‘তুমি এবং তোমার নিজের যা-কিছু সংগ্রহ, সকলই তুমি এ বিশাল যজ্ঞকাণ্ডে ব্যয় করতে পারো।’

শাম্ব এখন ঋষির নিকটে নিজের পরিচয় দিলেন এবং পিতার অভিশাপের বিষয়ের বর্ণনা করলেন। বললেন, ‘মহাত্মন, জন্মসূত্রে আমি বাসুদেবপুত্র, যদুবংশের বৃষ্ণিশাখার বংশধর। ক্ষাত্রবীর্যের স্পর্ধা, প্রণয়শীলা রমণীগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত সুখী ও বিলাসের জীবন এখন আমার কাছে অতীত স্মৃতিমাত্র। তা আমাকে আকর্ষণ করে না, বিচলিত করে না। যে কল্পারম্ভের দ্বারা আমি কর্ম ও মোক্ষলাভের পথে চলেছি আমার গৌরব তা ছাড়া আর কিছু নেই।’

ঋষি শাম্বকে আলিঙ্গন করে, চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘সাধু সাধু!’

শাম্ব ঋষিকে প্রণাম করে বললেন, ‘আমি এখন অশ্বচালনায় সমর্থ। এ অঞ্চল থেকে অশ্ব সংগ্রহ করে, আমি অবিলম্বে দ্বারকায় যাব। ধনসম্পদ নিয়ে পশ্চিম দক্ষিণাঞ্চলের বিশ্বকার্মাগণকে আমার অভিপ্রায় নিবেদন করব। এখানে ফিরে এসে, আমি কালমাত্র অপেক্ষা না করে, শাকদ্বীপে যাব। নীলাক্ষি এবং অন্যান্য সকলে এখানে থাকবে, প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম ও অন্যান্য সকল কাজের প্রতি লক্ষ ও যত্ন করবে।’

ঋষি বললেন, ‘মাত্র কয়েকদিন পরেই শুক্লা সপ্তমী তিথি। তুমি সেইদিন তোমার কল্পবৃক্ষমূর্তি কানন মধ্যে কোনও উৎকৃষ্ট স্থানে স্থাপন করে দ্বারকায় গমন করো। তোমার যাত্রা শুভ হোক।’

শাম্বর সঙ্গে ঋষির কথার পরে, এক নতুন কর্মযজ্ঞের সূচনা হল। শাম্ব তাঁর সঙ্গীদের সবাইকেই তাঁর পরিচয় দিলেন, ইচ্ছার কথা জানালেন। সকলের যা-কিছু কাজ সবই বুঝিয়ে দিলেন। সপ্তমী তিথিতে উপবাস করে, চন্দ্রভাগাকূলের কানন মধ্যে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। পরদিবসেই সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বেগবান অশ্বে আরোহণ করলেন। যাত্রার পূর্ব মুহূর্তে, নীলাক্ষির মুগ্ধ ও বিস্মিত চোখের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিবিনিময় হল। শাম্ব গম্ভীর হলেন, নীলাক্ষির সামনে গমন করলেন। বললেন, ‘নীলাক্ষি, তোমার চোখে এই মুগ্ধতা কীসের?’

নীলাক্ষি বলল, ‘মানুষের। তাকিয়ে দেখো, সকলেই তোমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে।’

শাম্ব দেখলেন, নীলাক্ষি মিথ্যা বলেনি। তথাপি নীলাক্ষির চোখে মুখে যেন প্রকৃতি লক্ষণ অতি গাঢ়তর মনে হল। এ কি নিতান্ত তাঁরই ভ্রম? নীলাক্ষির আবার বলল, ‘আমি তোমার শুভযাত্রা কামনা করছি। কাজ শেষ করে তুমি দ্রুত ফিরে এসো।’

শাম্ব নীলাক্ষির দিকে আবার তাকালেন। নীলাক্ষি হেসে বলল, ‘আমাকে ভুল বোঝার কোনও কারণ নেই।’

শাম্বও হাসলেন, বললেন, ‘আমরা সকলেই মানুষ, ভুল আমারও হতে পারে। কিন্তু আমাদের কল্প কর্ম শেষ হতে এখনও অনেক বিলম্ব আছে।’

নীলাক্ষি বলল, ‘অনর্থক চিন্তা কোরো না। তোমার শুভযাত্রা ত্বরান্বিত করো।’

শাম্ব আশ্বস্ত হয়ে অশ্বচালনা করলেন। এক পক্ষকাল মধ্যে তিনি দ্বারকায় পৌঁছোলেন। বাসুদেব পুত্র দর্শনে অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। জাম্ববতী শাম্বকে আলিঙ্গন করে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করলেন এবং মাতৃগণ সকলেই তাঁকে অশেষ সাধুবাদের দ্বারা স্নেহ ও সোহাগ জানালেন। শাম্বর নিজ গৃহে উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। কিন্তু শাম্ব একদিন মাত্র দ্বারকায় অবস্থান করবেন জেনে তাঁর অন্তঃপুরে যেন শোকের ছায়া নেমে এল। সংবাদ পেয়ে বাসুদেবও বিস্মিত উদ্‌বেগে দেখা করতে এলেন।

শাম্ব পিতা, মাতৃগণ, লক্ষ্মণা ও অন্যান্য অন্তঃপুরিকা রমণীগণের সামনেই তাঁর আগমনের কারণ ও আসন্ন কর্মের কথা সব ব্যক্ত করলেন। তিনি সকলের সম্মতি ও শুভাকাঙ্ক্ষা প্রার্থনা করলেন। বাসুদেব ম্রিয়মাণ হলেন, কিন্তু শাম্বর কল্পের কথা শুনে, তাঁকে বাধা দিতে পারলেন না, বরং সম্মান করলেন। জাম্ববতীর অন্তর বিদীর্ণ হল, তথাপি তিনি স্বামীর কথানুযায়ী সম্মতি দিলেন।

লক্ষ্মণা অতি কাতর হয়ে দুই হাতে শাম্বকে আকর্ষণ করে, কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘স্বামী, আমি কী নিয়ে এই দ্বারকায় থাকব? কেন থাকব? কতকাল থাকব?’

শাম্ব লক্ষ্মণাকে নানা বাক্যে সান্ত্বনা ও প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘কুরুকন্যা, শোনো, আমার ব্রত এখনও শেষ হয়নি। আমাকে দেখেই তুমি বুঝতে পারছ, আমার এখনও মুক্তি ঘটেনি। নিতান্ত অর্থের প্রয়োজনেই আমি এখানে এসেছিলাম। আমার অতীত জীবন আর কখনওই ফিরে আসবে না। তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে যে-কোনও সময় পঞ্চনদীর দেশে, চন্দ্রভাগাতীরে মিত্রবনে এসো। সেখানেই তোমার যদি বাস করতে ইচ্ছা হয়, বাস কোরো। আরও শোনো লক্ষ্মণা, জীবন কখনও এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে না, তা সতত সঞ্চরমাণ, পরিবর্তনশীল। তুমি তপোবনে গেলে, রৈবতকের এই হর্ম্যতলের বিলাসকক্ষের জীবন পাবে না। তোমার স্বামীকেও পূর্বের ন্যায় পাবে না। তোমাকে বলেছিলাম, অভিশাপ প্রশ্নের অতীত। এখন তুমি একমাত্র আমার অমোঘ নিয়তির সঙ্গেই মিলিত হতে পারো।’

শাম্ব দ্বারকায় এক রাত্রি বাস করলেন। যদুবংশের বিশিষ্ট পুরুষ জ্যেষ্ঠ ও ভ্রাতৃগণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। পরের দিন তিনি রথারোহণে তাঁর বিবিধ সুবর্ণ, মণিমুক্তা ইত্যাদি নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন। মিত্রবনের পথে যাত্রা করে তিনি বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার যাবতীয় রত্নাদি ও রথ তাদের পারিশ্রমিক হিসাবে দান করে মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রার্থনা জানালেন। বিশ্বকর্মা সম্প্রদায় প্রীতির সঙ্গে মিত্রবনে গিয়ে মন্দির তৈরি করতে স্বীকৃত হলেন।

শাম্ব আর এক পক্ষকালের মধ্যে অশ্বারোহণে মিত্রবনে পৌঁছে, একটি সপ্তমীতিথি পর্যন্ত অবস্থান করলেন। অষ্টমী তিথিতে সকলের সম্মতি নিয়ে পদব্রজে শাকদ্বীপ যাত্রা করলেন। পঞ্চনদীর দেশের সমতলভূমি অতিক্রম করে, হিমালয়ের পাদদেশে পৌঁছোতে তাঁর মাসাধিক কাল কেটে গেল। শুরু হল অন্তরীক্ষের পথ। অতি দুর্গম গিরিশিখর ও বনভূমির মধ্য দিয়ে গমনের সময় শাম্ব তাঁর জীবনে এক অনন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন। অন্তরীক্ষের পার্বত্যপথ অতি দুর্গম, কিন্তু শান্ত ও গম্ভীর। দৃশ্যাবলী অতি মনোমুগ্ধকর। ফলমূল এবং পার্বত্য ঝরনার জলই তাঁর খাদ্য ও পানীয়। তবে যতই অন্তরীক্ষ নিকটবর্তী হতে লাগল, সেখানকার অধিবাসী গন্ধর্বদের সাক্ষাৎ পেতে লাগলেন। গন্ধর্ব রমণী ও পুরুষরা সকলেই অতি মনোহর রূপ। ধবল গিরিশৃঙ্গে প্রথম আদিত্য কিরণপাতে যে বর্ণ ধারণ করে এদের গাত্রবর্ণ সেইরকম। কেশ এবং চক্ষু নিবিড় কৃষ্ণ। অশ্বযুক্ত রথ, অশ্ব ছাড়া কৃষ্ণবর্ণ বৃহৎ পার্বত্য ছাগ পৃষ্ঠে অনেকে গমনাগমন করে। প্রকৃত অন্তরীক্ষ পর্বত মধ্যস্থিত এক বিশাল উপত্যকাভূমি। সুদীর্ঘ হ্রদ ও একটি বেগবতী নদীতে গন্ধর্বরা নৌকারোহণেও চলাচল করে।

শাম্ব স্বভাবতই এই অপরিচিত জাতি সম্পর্কে শঙ্কিত ও চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর আশঙ্কার কোনও কারণ ছিল না। অন্তরীক্ষের অধিবাসীরা সকলেই তাঁর সঙ্গে ভাল আচরণ করেছে। তাঁর শারীরিক বিকৃতির জন্য কেউ ঘৃণা করেনি। খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছে। পথ দেখিয়ে দিয়েছে এবং সাবধান করে দিয়েছে, ইলাবৃতবর্ষের অধিবাসীদের সঙ্গে অসুরদের প্রায়ই যুদ্ধ চলছে। শাম্ব যেন সাবধানে গমন করেন।

শাম্ব এই বিচিত্র পার্বত্যদেশসমূহ ও তার অধিবাসীদের দেখে দুর্গম পথের ক্লান্তি অনেকখানি ভুলে থাকতে পেরেছেন। উত্তর পশ্চিমের নির্দিষ্ট পথে যেতে গিয়ে তিনি অসুর সৈন্যদের অনেকগুলো অবরোধ সৃষ্টিকারী স্কন্ধাবার দেখতে পেয়েছেন। তাঁকে সর্বত্রই নিজের পরিচয়, গন্তব্য ও গন্তব্যস্থলে গমনের কারণসমূহের বিবরণ দিতে হয়েছে। অসুরদের সীমানা অতিক্রমের পরে শাকদ্বীপে গমনের আগে সুরসেনাদের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। স্বর্গের প্রতিটি মানুষেরই তিনি পদধূলি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁদের ব্যবহার খুব ভাল ছিল না।

দশ ঋতু অতিক্রান্ত করে, শাম্ব শাকদ্বীপে পৌঁছুলেন। দেখলেন, সে স্থানের অধিবাসীদেরও উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দীর্ঘকান্তি। চোখের রং মিশ্রিত, কৃষ্ণ নীল এবং গোমেধ বর্ণ। অন্তরীক্ষের অধিবাসীদের তুলনায় স্বর্গলোকের দেবতাদিগের সঙ্গেই শাকদ্বীপের মানুষদের সাদৃশ্য বেশি। শাম্বকে সর্বাপেক্ষা বিস্মিত করল শাকদ্বীপ মগ ব্রাহ্মণদের বেশবাস। পুরুষদের কাঁধ থেকে পায়ের কনুই পর্যন্ত পোশাকের কোমরে। অভিয়ঙ্গের বন্ধন। পায়ে পাদুকা। মাথার ওপরে কপাল পর্যন্ত একখণ্ড বস্ত্রদ্বারা আবৃত। সকলেরই জটা ও শ্মশ্রু রয়েছে এবং প্রতিদান পুবঙ্ক ও বর্ম ধারণ করে থাকেন।

শাম্ব মগ সম্প্রদায়শ্রেষ্ঠ এক ব্রাহ্মণের পাদ্যার্ঘ্য গ্রহণ করে তাঁকে পরিচয় এবং আগমনের কারণ সকল ব্যক্ত করলেন। এবং করুণ ও বিনীতভাবে তাঁর প্রার্থনা জানালেন। তাঁর আচরণে মগশ্রেষ্ঠ প্রীত হলেন। বিভিন্ন পরিবারকে আহ্বান করে আলাপ আলোচনা করলেন। তাঁর আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, সুদূর ভারতবর্ষে তাঁদের যথার্থরূপে প্রতিষ্ঠা করা হবে কি না? এবং কতজনকে শাম্ব নিয়ে যেতে চান?

শাম্ব বললেন, ‘আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনাদের কেউ কখনও ভারতবর্ষে গমন করে থাকবেন। হয়তো আপনাদের প্রতিষ্ঠা ও যত্নের অব্যবস্থায় আপনারা বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু আমি এক কল্প করে আপনাদের আহ্বান করতে এসেছি। আপনাদের প্রতিষ্ঠা ও যত্নের কোনওরকম ত্রুটি হবে না। আমি আপনাদের গৃহ, গার্হস্থ্যজীবনধারণের সমস্ত ব্যবস্থাদি করব। কর্ষণযোগ্য ভূমি ও গাভী দান করব। আপনারা আঠারোজন ব্রাহ্মণ, আপনাদের পরিবারবর্গ নিয়ে চলুন। আমাদের বিশাল দেশে এই মহাব্যাধির অতি প্রাদুর্ভাব হয়েছে। আপনারাই একমাত্র এই মহাব্যাধির আমূল ধ্বংস করতে পারেন। আমার ব্যাকুল প্রার্থনা আপনারা রক্ষা করুন।

মগ ব্রাহ্মণগণ শাম্বর কথা বিবেচনা করলেন। শাম্ব বহু দূরদেশ থেকে অমানুষিক ক্লেশ সহ্য করে তাঁদের নিতে এসেছেন। শাম্বর ব্যবহার আচরণ কথাবার্তায় তাঁদের বিশ্বাস উৎপাদিত হল। পরিবারস্থ মহিলাগণ শাম্বর প্রতি প্রীত হলেন। মগ ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ অষ্টাদশ পরিবারকে শাম্বর সঙ্গে যেতে অনুমতি দিলেন, এবং তাঁদের গমনের প্রস্তুতিপর্বের মধ্যেই শাম্বর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বললেন।

শাম্বর শাকদ্বীপে যেতে যত বিলম্ব হয়েছিল, ফিরে এলেন তার থেকে দ্রুত। কারণ আঠারোটি পরিবার তাঁদের অশ্ব পার্বত্য গর্দভ ও বিরাটাকৃতি ছাগ, অর্ণবচালিত রথে ভারতবর্ষে এলেন। অস্তাচলমানস্থানের মিত্রবনে ফিরে শাম্ব দেখলেন, এক বিশাল রথের ন্যায় মন্দির অনেকখানি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অগ্নিহোত্র গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন তাঁর জন্য বাকি ছিল। তিনি ফিরে আসায় সে-কাজ দ্রুত সম্পন্ন হল।

মিত্রবনের ঋষি ও সকলেরই শাম্বর প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। তাঁর রূপের আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর উজ্জ্বলবর্ণে চারিপার্শ্বের প্রকৃতি, নদী, নরনারী সকলেই যেন প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। এই রূপই শাম্বর সেই প্রকৃত রূপ। তাঁর রূপদর্শনে সকলে মোহিত হয়ে তাঁকে স্পর্শ করার জন্য ব্যাকুল হল।

নীলাক্ষি শাম্বর পদধূলি নিয়ে বলল, ‘প্রণাম হে বিবস্বান।’

শাম্ব চমকিত হয়ে বললেন, ‘নীলাক্ষি, ওই নামে আমাকে কখনও সম্বোধন কোরো না। এক মহাপরাক্রান্ত রাজা ও গ্রহরাজ ছাড়া ওই নাম আর কারও হতে পারে না।’

‘কিন্তু তোমাকে দেখে আমার সেই রূপের কথাই মনে হচ্ছে।’ নীলাক্ষি বলল।

শাম্ব বললেন, ‘তুমি আমাকে শাম্ব নামে সম্বোধন করবে।’

নীলাক্ষি বলল, ‘না, তোমাকে আমি এখন থেকে বৃষ্ণিরত্ন বলে ডাকব।’

শাম্ব বললেন, ‘সেই ভাল।’

কিন্তু শাম্বর কার্য সমাধার অবকাশ কম ছিল। মিত্রবনের ঋষির সঙ্গে আলোচনান্তে তিনি মগদের ছয়টি পরিবারকে মিত্রবনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। বাকি বারোটি পরিবার ও বিশ্বকর্মা বংশধরদের নিয়ে প্রথমে যাত্রা করলেন, মথুরার সন্নিকটে যমুনার দক্ষিণ তীরে। সেখানে একটি অগ্নিহোত্র গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ছয়টি মগ ব্রাহ্মণ পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করলেন। বিশ্বকর্মা বংশধরদের, যাঁদের সঙ্গে এনেছিলেন, তাঁদের একাংশের কাছে প্রার্থনা করলেন, এই কালপ্রিয় স্থানে একটি মন্দির আপনারা তৈরি করুন।’

এক মহাযজ্ঞ যখন শুরু হয় তখন সকলেরই হৃদয়ে ও মনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। বিরোধ এবং আলস্য সেখানে কোনও বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। বিশ্বকর্মাগণ স্বীকৃত হলেন। অতঃপর শাম্ব, বাকি ছয়টি মগ ব্রাহ্মণ পরিবারকে নিয়ে উদয়াচলের ওড্রদেশে লবণদধির তীরে উপস্থিত হলেন। সেখানে প্রাচী নদীর একটি শাখা চন্দ্রভাগা নামে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। এখানে তিনি অবশিষ্ট ছয়টি মগ পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করলেন। শেষ বিশ্বকর্মা বংশধরগণ যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও সেখানে একটি মন্দির তৈরি করতে অনুরোধ করলেন। তাঁরা সম্মত হলেন। শাম্ব এখানেও একটি অগ্নিহোত্র গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন।

এক বছর পরে তিনি যখন মিত্রবনে ফিরে এলেন তখন দেখলেন, সেখানে একটি ছোটখাটো নগরী সৃষ্টি হয়েছে, সকলেই তার নাম দিয়েছে শাম্বপুর। শাম্ব বিন্দুমাত্র উৎসাহিত হলেন না, কারণ তাঁর এরকম কোনও অভিপ্রায় ছিল না। বরং তিনি দেখে সুখী ও চমৎকৃত হলেন, মগ ব্রাহ্মণদের চিকিৎসায় সকলেই পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করেছে। সকলেই যেন দিব্যমূর্তি ধারণ করেছে। এবং কল্পবৃক্ষ মূর্তির নিত্য পূজাদি অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন হচ্ছে।

মিত্রবনের ঋষির নির্দেশ মতো শাম্ব প্রতি চার মাসে তিন স্থানে বৎসরান্তে ভ্রমণ করতে লাগলেন। মূলস্থান-মিত্রবন, কালপ্রিয়-কালনাথক্ষেত্র, উদয়াচলের সমুদ্রতীরে কোণবল্লভ ক্ষেত্র। এই সময় তাঁর সঙ্গে আদি চৌদ্দজন তিন স্থানেই গমনাগমন করল।

দ্বাদশ বৎসর শেষে তিনটি মন্দির পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হল। নীলাক্ষি উদয়াচলের মন্দিরে আজীবন বাস করার প্রার্থনা জানাল। শাম্ব বললেন, ‘তুমি যেখানে থেকে গ্রহরাজকে সেবা করে সুখী থাকবে, সেখানেই থাকো।’

নীলাক্ষি বলল, ‘আমি এই সমুদ্র ও চন্দ্রভাগা তীরের মধ্যবর্তী স্থলেই থাকতে চাই। বৃষ্ণিরত্ন, আমি আজীবন কোণাদিত্যের পূজা করব, কিন্তু আমি নিতান্ত প্রস্তরের অপ্সরামূর্তি নই। আমি মানুষ, তুমি আমার মহামৈত্র। তোমার দর্শনের আশায় আমার প্রাণ ব্যাকুলিত হবে। বৎসরান্তে একবার দেখা দেবে তো?’

শাম্ব দেখলেন, নীলাক্ষির ঘনকৃষ্ণপক্ষ্মযুক্ত নীলচক্ষুদ্বয় অশ্রুকণায় চিকচিক করছে। শাম্ব হৃদয়ে অনুভব করলেন, এক অনাসক্ত অথচ কাতর আবেগ। বললেন, ‘নীলাক্ষি, মিত্রবনের প্রথম এবং দ্বিতীয় রাত্রের কথা আমি ভুলিনি। তুমিও আমার অতি শক্তিময়ী মমতাময়ী মৈত্র। তুমি বিনা আজ এ সার্থকতা সম্ভব ছিল না।’

নীলাক্ষি শাম্বর পদযুগল স্পর্শ করে বলল, ‘শক্তির কথা বোলো না, তুমিই আমার শক্তি। তবে আজ থেকে এই কোণাদিত্যক্ষেত্রের নাম হোক মৈত্রেয়বন।’

শাম্ব আনন্দিত হয়ে বললেন, ‘নীলাক্ষি, অপরূপ তোমার কল্পনা, এর অধিক ভাল নাম আর এ স্থানের হয় না।’

নীলাক্ষি বলল, ‘হে মৈত্রেয়, যে কারণে এ স্থানের নাম আজ থেকে মৈত্রেয়বন, সেই কারণ রক্ষা করো।’

শাম্ব নীলাক্ষির কপালে ডান হাত স্পর্শ করে বললেন, ‘মৈত্রেয় কখনও মৈত্রেয়কে মিথ্যা বা দ্বিধাসূচক কথা বলে না।’

নীলাক্ষি অশ্রুপূর্ণ চোখে হাসল। মৈত্রেয়বনে বাতাস শনশন নিস্বনে প্রবাহিত হচ্ছে। কোণাদিত্য যেন তাকেই স্নেহপূর্ণ লোচনে অবলোকন করছিলেন।

মহর্ষি নারদ এলেন মিত্রবনে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে শাম্বপুর নগরী এখন ক্রমবর্ধমান। শাম্ব নারদকে অভ্যর্থনা করলেন, পূজা করে পাদ্যার্ঘ্য গ্রহণ করলেন। মহর্ষি বললেন, ‘শাম্ব, তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি। তুমি কি আর কখনও দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করতে চাও না? সেখানে রাজকীয় সুখভোগ করতে চাও না?’

শাম্ব বললেন, ‘মহর্ষি, আমার আর ঐশ্বর্যপূর্ণ, দ্বারকায় রাজকীয় সুখভোগের কোনও বাসনা নেই। আমি এই মিত্রবনে, কালপ্রিয়ক্ষেত্র ও মৈত্রেয়বনে এক অপরূপ আনন্দে অতিবাহিত করছি। মগ ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় হয়েছে, ব্যাধিগ্রস্তরা চিকিৎসিত হচ্ছে এবং তিন স্থানের তিনকালের আলোকে স্নান করছে। অভিশাপ কী, ব্যাধি কী, আমি তা জেনেছি, অতএব এখন যা দেখছি, এর তুল্য আনন্দ আমার আর কিছু নেই।’

মহর্ষি মুগ্ধবিস্ময়াপন্ন চোখে শাম্বর মুখের দিকে দেখলেন, বললেন, ‘চলো, আমি তোমার প্রতিষ্ঠিত গ্রহরাজকে পূজা করব।’

‘চলুন।’ শাম্ব ব্যস্ত হয়ে পূজাদির নানা উপকরণ নিয়ে মহর্ষিকে অনুসরণ করলেন।

মহর্ষি চন্দ্রভাগার জল ও ফুলপত্রাদিসহ কৃতাঞ্জলিপুট হয়ে সেই কল্পবৃক্ষ মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি গ্রহরাজকে সম্বোধন করে উচ্চারণ করলেন, ‘হে সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য, হে শাম্বাদিত্য! আপনি সন্তুষ্ট হন, আমার পূজা গ্রহণ করুন।’

শাম্বর সারা শরীর শিহরিত হল। শাম্বাদিত্য! এ কী নামে মহর্ষি গ্রহরাজকে সম্বোধন করলেন?

মহর্ষি শাম্বকে স্পর্শ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আজ থেকে এই বিগ্রহের আর এক নাম শাম্বাদিত্য। এই নামেই তিনি এখানে পূজিত হবেন।’

শাম্ব তাঁর অভিশাপের দিনেও অশ্রুমোচন করেননি। আজ এই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে অশ্রুপাত রোধ করা কঠিন বোধ হল। তিনি দেখলেন মহর্ষির দুই চোখও অশ্রুপূর্ণ, মুখে অনির্বচনীয় হাসি। তিনি ধীরে ধীরে মন্দির থেকে বাইরে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *