৩. মহর্ষি মনে মনে হাসছিলেন

মহর্ষি মনে মনে হাসছিলেন আর মনে মনেই উচ্চারণ করছিলেন, অসূয়া অসূয়া! হে বাসুদেব, আপনার জ্ঞানই আপনাকে সর্বজ্ঞ করেছে। জ্ঞানী হয়েও রমণীর চরিত্র ও মন আপনি এই বয়সে আর একবার অনুধাবন করলেন। অতি নির্মমরূপে অনুভব করলেন রূপবান আত্মজের সামনে নিজের রমণীগণ কামনায় ব্যাকুল হয়ে উঠলে কী দুঃসহ ঈর্ষায় অন্তর বিদীর্ণ হয়। হে পুরুষোত্তম, আপনিও তখন আপন প্রিয় পুত্রকে নির্মম অভিশাপ না দিয়ে পারেন না। আপনি প্রমাণ চেয়েছিলেন, আমি প্রমাণ দিয়েছি। আমি মিথ্যা কথা বলে শাম্বকে এখানে ডেকে নিয়ে এসেছি, তা ছাড়া চাক্ষুষ প্রমাণের আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু শাম্ব নিরপরাধ আপনি জানেন। জেনেও এই অভিশাপ। অমোঘ এই অন্তরের বিকার, হে বাসুদেব। আমি আর ক্ষণকাল এখানে অপেক্ষা করব। শুধু সেই পরিণাম দেখে যাব, পুত্রের কাতর প্রার্থনায় আপনার অভিশাপ থেকে মুক্তিদান করেন কি না। যদি করেন তা হলে আমার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। শাম্বকে আমি যে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম, তা ঘটবে না।

শাম্ব তখন কৃষ্ণের পদতলে পড়ে কাতর প্রার্থনা করে চলেছেন, ‘পিতা, আপনার কোনও পুত্রই কখনও আপনার অবাধ্যতা করেনি, আমিও করিনি। শৈশব থেকে আপনার ও আমাদের বংশের অন্যান্য অস্ত্রবিদদের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছি। যুদ্ধবিশারদরূপে আমার যদি কোনও খ্যাতি থেকে থাকে, তবে তা আপনারই দান। আপনার নির্দেশ ও নেতৃত্বে, জরাসন্ধের মহাবল সেনাপতিদের সঙ্গে সংগ্রাম করেছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, আপনার অনুপস্থিতিতে এই দ্বারকানগরী যতবার শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, যদুবংশের সকল বীরদের সঙ্গে আমিও প্রাণপণ যুদ্ধ করেছি। প্রদ্যুম্ন আর আমি অতিবলশালী শাল্বর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে দ্বারকার দূরপ্রান্তে তাড়িয়ে এসেছি। আপনার মহিমময় কীর্তি, সৌভনগরে গিয়ে সেই শাল্বকে আপনি নিজের হাতে হত্যা করেছিলেন। রাষ্ট্র সমাজ পরিবার বিষয়ে যাবতীয় শিক্ষা আপনার কাছেই পেয়েছি। রমণীদের কার প্রতি কী আচরণ করতে হয়, সেই সুনীতিজ্ঞান আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। পৃথিবীতে আপনি সেই পুরুষ, যিনি বিশাল রমণীকুলের ভর্তা ও ত্রাতা। আমাকে ক্ষমা করুন পিতা, আমাকে অভিশাপ দেবেন না।’

কৃষ্ণের স্তব্ধ মৌনতা ভাঙল, তিনি তথাপি কয়েক মুহূর্ত তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘শাম্ব, আর তা সম্ভব না।’

শাম্বর অতি উজ্জ্বল কান্তি স্বেদসিক্ত হয়ে বারে বারে প্রকম্পিত হল। নারদ তৎক্ষণাৎ সে-স্থান পরিত্যাগ করলেন। শেষ কথা যা শোনার, তা তাঁর শোনা হয়ে গেল। তিনি প্রমোদকানন ছেড়ে, নগরীর দিকে চলে গেলেন। কৃষ্ণ একবার সেদিকে দেখলেন। বিষাদের ছায়া তাঁর মুখে। জাম্ববতী রুক্মিণী ও সত্যভামার চোখে জল। অন্যান্য রমণীগণ দ্বারকানগরীর অনন্ত বিলাস ব্যসন ও সুখের পরিবর্তে, অভিশাপ ভয়ে কাতর হয়ে তখন কেবল সেই ভয়াবহ অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় মগ্ন। আর মনে মনে দালভ্য ঋষির নাম জপ করছে।

কৃষ্ণের চোখে, মুখে, বক্ষে, বর্ণের উজ্জ্বলতায় কোথাও কোনওরকম ক্রোধের অভিব্যক্তি নেই। তিনি বললেন, ‘শাম্ব, একমাত্র অভিশাপ দিয়ে যদি সকল সংকটের মুক্তি হত তা হলে আমাকে গদা আর চক্র ধারণ করে শত্রু নিধন করতে হত না। অভিশাপ কেবলমাত্র মনস্তাপ থেকে স্ফুরিত হয় না। সাধারণ মানুষ পরস্পরকে যে-রকম অভিশাপ দিয়ে থাকে, আমার অভিশাপ তদ্রূপ না। যা ঘটে যায়, যা ভবিতব্য তা-ই অভিশাপরূপে উচ্চারিত হয়। তোমার জন্মলগ্নেই এই কুৎসিত ব্যাধি তোমার ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে। আমি অতি ক্রোধে তা উচ্চারণ করেছি মাত্র। তোমার কোষ্ঠীর কাল অনুযায়ী, তোমার ব্যাধির প্রকটরূপ প্রকাশের সময় আসন্ন। বিম্ব ফলের ন্যায় তোমার দেহের এই রক্তাভ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে স্ফীতি, কিছুই আর স্বাভাবিক নেই। শরীরের এই লক্ষণগুলো তোমার চোখে পড়েনি। তথাপি আমি স্বীকার করি, তোমাকে দেখে রমণীদের যৌবনোচ্ছ্বাসে ক্রুদ্ধ হয়েই তোমাকে অভিসম্পাত দিয়েছি।’

শাম্বের স্বেদসিক্ত কলেবরের কম্পন কিছু স্থির হল। তিনি তাঁর নিজ দেহের প্রতি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিতা, তাই যদি সত্য তবে বলুন আমার আরোগ্যের উপায় কী?’

কৃষ্ণ এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, ‘এখন আমি বুঝতে পারছি, মহর্ষি নারদকে তুমি রুষ্ট করেছ। তুমি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেখাওনি। আমার মনে হয়, তোমার ব্যাধি প্রকটিত হলে তাঁর কাছেই তোমার যাওয়া উচিত। তিনি দেবভূমি থেকে সর্বত্র ভ্রমণ করেছেন। বহু বিচিত্র স্থান ও সম্প্রদায়কে তিনি চাক্ষুষ করেছেন। একদিক থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা আমাদের থেকে অনেক ব্যাপক। সম্ভবত তিনিও চান, তুমি তাঁরই দ্বারস্থ হবে। আমিও তোমাকে সেই উপদেশই দিচ্ছি, তুমি যথাসময়ে মহর্ষির সন্ধানেই যেয়ো।’

শাম্ব এখন অকম্পিত স্বরে ঘোষণা করলেন, ‘পিতা, যা অমোঘ এবং অনিবার্য হয়ে জীবনে নেমে আসে, তাকে আমরা ভাগ্য বলে মানি। এই অভিশাপ আমার অদৃষ্ট। এই বয়সের মধ্যেই আমি ভাগ্যের উত্থানপতন কম দেখিনি। এককালে যদুবংশকে মহাবল সম্রাট জরাসন্ধ সংখ্যাল্প করেছিলেন, ভীত ও সন্ত্রস্ত করেছিলেন। আজ কোথায় জরাসন্ধ। যদুবংশ সগৌরবে অবস্থান করছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অতি যুদ্ধার্থী কৌরবগণ প্রায় নিশ্চিহ্ন। পাণ্ডবেরাও লোকবলে ক্ষীণপ্রাপ্ত হয়েছেন। তথাপি কেউ নিশ্চেষ্ট বসে থাকেননি। আমার ভাগ্যের এই অমোঘ অনিবার্য পরিণতি জেনেও, আমিও নিশ্চেষ্ট থাকব না। প্রয়োজন হলে, মুক্তির জন্য আমি এই সসাগরা পৃথিবী, দেবলোকে, অন্তরীক্ষে সর্বত্র যাব। আমাকে আপনি বিদায় দিন।’

শাম্ব পিতার পদধূলি নিয়ে মাথায় ঠেকালেন। কৃষ্ণ শাম্বর মস্তক আঘ্রাণ করে মুখ ফিরিয়ে জাম্ববতীর দিকে তাকালেন। জাম্ববতী তখন অশ্রুজলে ভাসছিলেন। শাম্ব নিজে কাছে গিয়ে, মা জাম্ববতীকে প্রণাম করলেন। রুক্মিণী এবং সত্যভামাকেও প্রণাম করলেন। জাম্ববতী শাম্বর মস্তক আঘ্রাণ করে তাঁকে শিশুর ন্যায় বক্ষে গ্রহণ করলেন। পুত্ৰস্পর্শে মায়ের স্তনধারা যেন সন্তানের জন্য অজস্র ধারায় বিগলিত হল। তিনি আশ্রুরুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘বৎস, আশীর্বাদ করি, তুমি শাপমুক্ত হও। তোমার সেই জনচিত্তবিমোহিতকারী রূপ আবার লাভ করো।’

অভিশাপ ভয়ে ভীতা ষোলো সহস্র রমণীগণও এই দৃশ্য দেখে অশ্রুমোচন করল। যে-কারণে তারা বাসুদেবের দ্বারা অভিশপ্ত, তাদের সেই রমণীচিত্ত শাম্বদর্শনে এখনও বিমোহিত। রূপবান পুরুষের প্রতি রমণীর চির আকাঙক্ষা, এই অভিশাপের দ্বারাই চিরস্থায়ী হল। শাম্ব প্রমোদকানন থেকে বিদায় নিলেন।

শাম্ব ফিরে এলেন নগরীতে। এখন তাঁর অঙ্গ স্বেদকম্পিত না। অভিশপ্ত পুরুষ এখন আত্মমগ্ন হয়ে, মুক্তির কথা ভাবছেন। গৃহ সন্নিকটে অদূরে রমণীয় কুঞ্জমধ্যে সহচরীরা তাঁর জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। তিনি সেইদিকে ভগ্নহৃদয় বিষাদ দৃষ্টিতে দেখলেন। কিন্তু সেদিকে গেলেন না। যুদ্ধবিশারদ শাম্ব, রতিবিশারদ শাম্ব, আপন বাহু তুলে নিরীক্ষণ করলেন। সত্যি, তাঁর যে-অঙ্গে চতুস্পার্শ্বস্থ সকলই প্রতিবিম্বিত হয়, তা এখন অধিকতর রক্তাভ দেখাচ্ছে। তিনি গৃহমধ্যে গমন করলেন।

গৃহমধ্যে বহু দাসদাসী বিচরণ করছে। শাম্ব কারও প্রতি দৃষ্টিপাত না করে, অন্তঃপুরে গমন করলেন। সেখানে নানা সুবর্ণের আভরণ নানা সময়ে প্রাপ্ত বিবিধ মণি, কক্ষে কক্ষান্তরে, রমণীয় শয্যা ও বিবিধ গৃহসামগ্রী নানাদেশীয় মহার্ঘ বসন, কোনও কিছুর প্রতিই দৃষ্টিপাত করলেন না। অথচ এ সকলই ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়।

শাম্বকে অন্তঃপুরে গমন করতে দেখে রমণীগণ পাথর স্খলিত প্রস্রবণের ন্যায় সেদিকে ধাবিত হলেন। শাম্ব কপাট বন্ধ করে অতিকায় সুবর্ণদর্পণ হাতে তুলে নিলেন। নিরীক্ষণ করলেন আপন প্রতিবিম্বকে। আশ্চর্য, পিতা মিথ্যা কিছু বলেননি। লক্ষ করে দেখলেন, তাঁর নাসা, কর্ণ, ভ্রূ ইত্যাদির স্থানে স্থানে স্ফীতিলাভ করেছে। এ কি বাসুদেবের অভিশাপমাত্রই ঘটল? নাকি তাঁর কথায় এখন চোখে পড়ছে। তিনি কোষ্ঠীর ভবিতব্যের কথা উল্লেখ করেছেন। হয়তো অভিশাপের বাস্তব ভিত্তি তাই। কিন্তু শাম্ব এই ঘটনাকে পিতার অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না।

শাম্ব সুবর্ণদর্পণ রেখে দিয়ে কপাট খুলে দিলেন। রমণীগণ মধ্যে কেবল লক্ষ্মণাকেই প্রবেশ করতে বললেন। এই সেই দুর্যোধন আত্মজা লক্ষ্মণা, যাঁকে শাম্ব হরণ করে বিবাহ করেছিলেন। লক্ষ্মণা সর্বাঙ্গসুন্দরী, সর্বালংকারশোভিতা। কিন্তু শাম্ব কর্তৃক সখী ও সহচরীদের কক্ষ প্রবেশে বাধাদানে অবাক হলেন। অবাক হল প্রণয়সঙ্গিনীরা। ম্লান মুখে তারা ফিরে গেল। লক্ষ্মণার হৃদয় শুভ আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। তিনি শঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

শাম্ব ব্যস্ত কৌতূহলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন দেখাচ্ছে আমাকে লক্ষ্মণা?’

লক্ষ্মণা প্রশ্ন আশা করেননি। শাম্বর জিজ্ঞাসায় এক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্ত হলেন, তারপর বললেন, ‘তোমার চোখ মুখ শুষ্ক। পীড়িত, বিষণ্ণ, দুঃখিত দেখাচ্ছে তোমাকে। মহর্ষি নারদ তোমাকে কোথায় ডেকে নিয়ে গেছলেন? কিছুক্ষণ আগেও তুমি সুখী ছিলে। এখন এত করুণ আর বিমর্ষ কেন?’

শাম্ব লক্ষ্মণাকে সব কথাই বললেন। লক্ষ্মণা অস্ফুট ক্রন্দনে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘অভিশাপ! কেন? তুমি যে রমণীমোহন, এ-কথা দ্বারকায় সর্বজনবিদিত। তবে কেন অভিশাপ?’

শাম্ব বললেন, ‘লক্ষ্মণা, অভিশাপ জিজ্ঞাসার অতীত। এ অমোঘ এবং অনিবার্য। এ ভাগ্যের পরিহাস না, নির্দেশ। একে অমান্য করা চলে না। আমি এখন থেকে তোমাদের কাছ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকব। নগর প্রকারের বাইরে কিছুকাল অপেক্ষা করে মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর নির্দেশ নেব। তিনি যা বলবেন তাই করব।’

লক্ষ্মণা আসন্ন বিচ্ছেদব্যথায় কাতর হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘না না, আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। তুমি যেখানেই যাও আমি তোমার সঙ্গে যাব।’

শাম্ব শান্ত স্বরে বললেন, ‘লক্ষ্মণা, মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই একমাত্র এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তিনি যদি নির্দেশ দেন, তা হলে তুমি আমার সঙ্গে যাবে। তবে, খুব দ্রুতই ব্যাধি আমাকে গ্রাস করবে, আমি অনুভব করছি। পূর্ণ গ্রাসের পূর্ব পর্যন্ত আমি নগরের বাইরে থাকব। তারপরে মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাৎ করব।’

লক্ষ্মণার কান্না হৃদয়বিদারক হল। তিনি শাম্বকে আলিঙ্গন করে তাঁর প্রতিটি অঙ্গ নিরীক্ষণ করে সন্দিগ্ধ অবিশ্বাসের স্বরে বললেন, ‘প্রিয়তম, সুবর্ণদর্পণের ন্যায় উজ্জ্বল তোমার অঙ্গে, আমি কিছুমাত্র পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম দেখি না। এ সকল তোমার পিতার অভিশাপগ্রস্ত মনের ও চোখের বিকার। আমি এখনও তোমার বুকে আমার প্রতিবিম্বকে দেখতে পাচ্ছি। তুমি এখনও বিশ্বের সকল পুরুষের ঈর্ষণীয় সেই বলিষ্ঠ রূপবান পুরুষই আছ। পিতার অভিশাপ পুত্রের প্রতি স্নেহেরই এক বিপরীত সম্ভাষণ। ব্যাধির আশঙ্কা, গৃহত্যাগের বাসনা তুমি মন থেকে ত্যাগ করো।’

শাম্ব মনে মনে হাসলেন, করুণ আর মর্মান্তিক সেই হাসি। বললেন, ‘লক্ষ্মণা, পিতার অভিশাপ না, বৃষ্ণিসিংহাবতার পুরুষের অপমানিত মর্মাহত অন্তরের অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে আর এক পুরুষের প্রতি। এক্ষেত্রে পিতা পুত্রের সম্পর্কজনিত কপট উষ্মা বা ক্রোধের বিষয় কিছু নেই। তোমাকে তো সব ঘটনাই বললাম। বাসুদেবের মতো ব্যক্তির পৌরুষে যদি আঘাত লাগে, তবে তাঁর সংহারমূর্তি কী ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তুমি কল্পনা করতে পারো! অন্য পুরুষের তো কোনও কথাই নেই। তা ছাড়া, তুমি আমার মনের ও চোখের যে-বিকারের কথা ভাবছ, তা সত্যি না। পিতা কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না। আমি কখনওই নিজেকে দেখতে ভুল করিনি। বিকার বা মায়া, কিছুই আমাকে গ্রাস করেনি। পিতার ষোলো সহস্র রমণীর প্রমত্ত উৎকট কামতাড়িত আচরণ আমি নিজেই লক্ষ করেছি। বৃষ্ণিসিংহের ক্রোধবহ্নির সম্যক কারণ আমি অনুভব করেছি।’

লক্ষ্মণার আসন্ন স্বামী-বিচ্ছেদ-কাতর প্রাণ কোনও যুক্তি মানতে পারছে না। অশ্রুসজল চোখে, ব্যথায়, অভিমান স্ফুরিত স্বরে বললেন, ‘রতিকোশাস্ত্রবিদ হে দ্বারকামোহন, সেই রমণীদের কামোচ্ছ্বসিত আচরণের অপরাধই বা কী? আমি জানি তুমি কদাচ সেই রমণীদের নিজের রূপের দ্বারা কামোদ্রেক করোনি। কিন্তু সর্বজ্ঞ বৃষ্ণিসিংহ কি জানতেন না, মাতৃগণ ব্যতীত দ্বারকার সকল রমণীকুলের তুমি অতি আকাঙিক্ষত পুরুষ? এই ষোলো হাজার রমণীকে নির্বিচারে গ্রহণের জন্য তিনি নিজেকে অনাচারীজ্ঞানে অতি পুণ্যের স্যমন্তক মণি ধারণ করতে পারেননি। মুষল ও লাঙ্গলধারী দুর্দান্ত যদুবীর বলভদ্রকেও তিনি সেই স্যমন্তক মণি ধারণ করতে দেননি, কারণ বলভদ্রও সর্বদাই সুরাসবপানে প্রমত্ত থাকেন। তবে তোমাকে কেন তিনি কামোচ্ছ্বসিত রমণীদের কারণে অভিশাপ দিলেন?’

শাম্ব গম্ভীর হলেন, বললেন, ‘লক্ষ্মণা, সুলক্ষণা প্রিয়তমে, তোমাকে আগেই বলেছি মহাপুরুষের অভিসম্পাত প্রশ্নের অতীত। তা ছাড়া যদুকুলের কুমারগণ তাঁদের পিতার সমালোচনা শুনতে অভ্যস্ত না। পিতার অভিশাপ অলঙ্ঘনীয়। তিনি আমাকে মুক্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখন সেই পথেই আমার যাত্রা।’

লক্ষ্মণা ক্রন্দনোচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন, ‘আহ্‌, হায় কী দুর্ভাগ্য আমার, যে-পুরুষের মুহূর্তের দর্শন ছাড়া থাকতে পারি না, যিনি আমাকে হরণ করার সময়ে পিতার বাধা দানের ফলে হস্তিনানগরী ভূমিকম্পে আকুঞ্চিত হয়েছিল, যাঁর কণ্ঠলগ্ন হয়ে ছাড়া দিনযাপন করিনি, তিনি পিতার দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে আজ আমাকে পরিত্যাগ করে যাচ্ছেন।’

শাম্ব লক্ষ্মণাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘লক্ষ্মণা, অভিশাপমুক্ত হয়ে আমি আবার ফিরে আসব।’

রমণীর মন এইসব সান্ত্বনা বাক্যে প্রবোধ মানে না। শাম্বর দেহলগ্ন হয়ে তিনি নানা রূপে নিজের ব্যথা প্রকাশ করতে লাগলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নগর প্রাকারের বাইরে কেন যাবে?’

শাম্বর বিশাল বক্ষ দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠল। কিন্তু কাতরতা প্রকাশ না করে বললেন ‘লক্ষ্মণা, ব্যাধি আমাকে পূর্ণরূপে গ্রাস করবার আগেই আমি আমার প্রিয়জনদের লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতে চাই।’

লক্ষ্মণা এই কথা শুনে অতি শোকাকুল হলেন। কারণ তিনি এই বলীয়ান রূপবান পুরুষের অন্তরের বেদনা অনুভব করলেন। যিনি নগরের পথে বের হলে রমণীগণ ব্যাকুল হয়ে তাঁকে দেখতে ছুটে আসেন, তিনি কুৎসিত বিকলাঙ্গ দেহ নিয়ে কেমন করে সেই নগরী মধ্যে বাস করবেন? তখন লক্ষ্মণা স্বামী সান্নিধ্যে বসনভূষণ পরিত্যাগ করে, যুগপৎ কান্না ও আবেগকম্পিত স্বরে বললেন, ‘হে পরম সুন্দর মহাভুজ রমণীবিশারদ, এই দারুণ দুঃখেও আমি অতিপ্রার্থিনী হয়ে তোমাকে কামনা করছি। তোমার দুই বিশাল বাহু ও বক্ষ ও তেজ দ্বারা আমাকে মর্দিত করো।’

শাম্ব শান্ত ও অবিকৃতভাবে লক্ষণাকে আপন অঙ্গে গ্রহণ করলেন। কিন্তু মনে মনে বললেন, ‘হায় অভিশাপ! কুরুকুলের এই অবিস্মরণীয় রমণীরত্নের সঙ্গে সঙ্গম প্রমোদেও কোনও সুখানুভূতির লেশ নেই। জীবনপ্রবাহ কি আশ্চর্য স্বপ্নবৎ! যে-আত্মা অতি দুর্জ্ঞেয়, সেই আত্মানুসন্ধানেই জীবনকে আহরণ করতে হয়। আমার সমগ্র ধারণা এখন এই ধারণার বশবর্তী।…’

শাম্বর নগর প্রকারের বাইরে সকলের চোখের অন্তরালে সমুদ্রোপকূলবর্তী বালুবেলায়, বৎসরান্ত বাসের আগেই, পিতার অভিশাপ এবং ভবিতব্য সমগ্র দেহে অতি উৎকটরূপে প্রকটিত হল। তিনি দিনের আলোয় সচরাচর বালুবেলায় আত্মপ্রকাশ করতেন না। উপকূলবর্তী পর্বতের গুহান্দকরে দিনযাপন করতেন। পর্বতের বুকে, আশেপাশের বৃক্ষে ও ভগ্নপ্রস্তর মৃত্তিকায় যে সমস্ত ফলমূলাদি সংগ্রহ করতে পারতেন তা দিয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি করতেন। পর্বতের ক্ষীণ প্রস্রবণধারায় যে মিষ্ট জল পেতেন, তা দিয়ে তৃষ্ণা মেটাতেন।

নগররক্ষীরা যখন অশ্বচালনা করে, নগরের বাইরে টহল দিতে বেরোত, শাম্ব কখনওই তাদের সামনে যেতেন না। সূর্যাস্তের পর তিনি যখন বালুবেলায় বেরিয়ে আসতেন তখন নগর দ্বারপালদের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেতেন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠত, রৈবতক পর্বত নগরীর আলোকমালা। নাগরীদের গুঞ্জন ও হাসি, নাগর পুরুষদের দেখে, চোখের ঝিলিক হানা নানা প্রকারের অঙ্গভঙ্গি। সুরাসবপানে সুখী ও প্রমত্ত রাজপুরুষগণের নাগরী পণ্যাঙ্গনাদের অতি রুচিশীল সংগীত ও নৃত্য মুখরিত অঙ্গনে গমন। প্রবাসী ইন্দ্রপ্রস্থবাসী বা পাঞ্চালের অধিবাসীরা বা অন্যান্য দেশের নাগরিকগণ, দ্বারকানগরীর নৈশ প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। গৃহে গৃহে মন্দিরে মন্দিরে, মঙ্গল শঙ্খ ও ঘণ্টা বাজছে। শাম্ব শুনতে পেতেন সবই। দূরের অন্ধকার বালুবেলা থেকে দেখতে পেতেন না কিছুই। কিন্তু সবই তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠত।

শাম্বর নিজের গৃহাঙ্গনে ও অন্তঃপুরের কী অবস্থা? তিনি নির্বিকার থাকবার চেষ্টা করলেও সমুদ্রের জোয়ার ভাঁটার মতোই সে-সব বিষয় তাঁর অন্তর মধ্যে তরঙ্গায়িত হত। তাঁর গৃহাঙ্গনে ও অন্তঃপুরে আলো জ্বলছে তো? রমণীর প্রতি রাত্রের মতোই সুখে বিচরণ করছে তো? লক্ষণা অন্ধকারে মুখ ঢেকে বসে নেই তো? মাতৃগণ মনোকষ্টে নেই তো? পিতা বিচলিত ও বিমর্ষ হয়ে নেই তো? ভ্রাতা ও বন্ধুগণ তাঁর অদর্শনে ভগ্নমনোরথ হয়ে নেই তো?

এইভাবে বৎসর পূর্তির পূর্বেই শাম্বর দেহ কুষ্ঠরোগের গ্রাসে অতি কুৎসিত ও বিকলাঙ্গ রূপ ধারণ করল। পিতার নির্দেশ তাঁর মনে পড়ল। মহর্ষি নারদের কাছে তাঁকে যেতে হবে। তাঁর কাছে যাবার সময় হয়েছে। তিনিই ব্যাধি মুক্তির উপায় বলে দেবেন। কিন্তু তিনি এখন কোথায়? শাম্ব তাঁকে কোথায় পাবেন? মহর্ষি সর্বব্যাপী। ঋষিগণসহ নানা বর্ষগুলোতে পরিভ্রমণ করে বেড়ান। অথচ তাঁকে না পেলে চলবে না। তাঁর প্রতি অসঙ্গত আচরণের মূলেই নিহিত রয়েছে এই অভিশাপের কারণ। সেইজন্য হয়তো পিতা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তির উপায় জানতে বলেছেন।

শাম্বর সহসা মনে হল, পিতার কাছে যাওয়া উচিত। একমাত্র তিনিই হয়তো বলতে পারেন মহর্ষি এখন কোথায় অবস্থান করছেন। রাত্রে তিনি এই কথা ভাবলেন এবং পরের দিন প্রভাতেই নগর দ্বার উন্মুক্ত হবার পরে নগরের উদ্দেশে গমন করলেন। না, এখন আর শাম্বকে দেখে কেউ যদুবংশের সেই রূপবান যুদ্ধবিশারদ পুরুষকে চিনতে পারবে না। নগর ও দ্বাররক্ষীরা সহজেই অনুমান করে নেবে, তিনিও একজন ব্যাধিগ্রস্ত অসহায় ভিক্ষার্থী। ভিক্ষা শেষে যথাসময়ে নগরের বাইরে নিজের আশ্রয়ে চলে যাবেন।

শাম্ব ভুল ভাবেননি। দ্বাররক্ষীরা তাঁর দিকে কৃপাদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেদের বিশাল গুল্ফে মোচড় দিল। কেউ তাঁকে বাধা দিল না। নানা কার্যব্যপদেশে, নগরের অধিবাসীর পথে ভিড় করে, নানা কথায় মুখরিত করে চলেছেন। কেউ শাম্বর কুষ্ঠ কুৎসিত চেহারার দিকে ফিরেও তাকালেন না। বরং কেউ কেউ যুগপৎ ঘৃণা ও কৃপাবশে, তাঁর প্রতি দূর থেকে মুদ্রাদি নিক্ষেপ করলেন এবং শাম্বকে তা সাগ্রহে সংগ্রহ না করতে দেখে তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন।

শাম্ব দ্রুত গতিতে পথ অতিক্রম করে রৈবতকে কুশস্থলীতে গমন করলেন। বিভিন্ন স্থানে চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, সাত্যকি ইতাদি ইত্যাদি যাদবশ্রেষ্ঠগণকে দেখতে পেলেন। তাঁরা কেউ তাঁকে চিনতে পারলেন না, তাঁর প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টিপাতও করলেন না। সৌভাগ্যবশত তিনি সেই অনায়াসেই বাসুদেবের সাক্ষাৎ পেলেন, এবং অধিকতর সৌভাগ্যের বিষয়, তিনি দৃষ্টিপাতমাত্র পুত্রকে চিনতে পারলেন। তাঁর অভিশাপের জাজ্বল্যমান প্রমাণ স্বরূপ কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মূর্তি দেখে কৃষ্ণ মুহূর্ত মধ্যে অত্যন্ত বিচলিত ও বিষণ্ণ হলেন। সেই মুহূর্তে গান্ধারীর অভিশাপের কথা তাঁর মনে পড়ল। গান্ধারী শোকে ও মনস্তাপে অতীত বিস্মৃত হয়েছিলেন। যুদ্ধের পূর্বে তাঁর পুত্রের আস্ফালন, যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলা, কৃষ্ণের বহু অনুরোধ, যুদ্ধজনিত জ্ঞাতি ও লোকক্ষয় বিষয়ে কৃষ্ণের সাবধানবাণী, শান্তি ও সম্প্রীতি বিষয়ে কৃষ্ণের দৌত্য সে-সবই তখন শোকাকুলা গান্ধারী বিস্মৃত হয়ে কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণ জানতেন, কালের অমোঘ নিয়মে যা অনিবার্য গান্ধারী অভিশাপ দিতে গিয়ে সে-কথাই উচ্চারণ করেছিলেন। কৃষ্ণের প্রতি তা কখনওই অভিশাপরূপে বর্ষিত হয়নি।

কিন্তু এখন কৃষ্ণ নিজ মুখে উচ্চারিত অভিশাপেরই পরিণতি, কুষ্ঠ জর্জরিত আত্মজকে দেখে মর্মান্তিক বেদনা অনুভব করলেন। তিনি শাম্বকে নিয়ে কুশস্থলীর এক কক্ষে দ্রুত গমন করলেন। শাম্ব পিতাকে যথাবিহিত প্রণাম ও পাদ্যার্ঘ্য প্রদান করে বললেন, ‘পিতা, আপনার মনে কোনও প্রকার দুঃখ সঞ্চার করতে বা আপনাকে বিচলিত করতে আমি আসিনি। আপনার অভিশাপে আমার সর্বাঙ্গে ব্যাধি। আপনি বলেছিলেন, আরোগ্যলাভের উপায় একমাত্র মহর্ষি নারদ আমাকে বলতে পারবেন। কিন্তু তিনি এখন কোথায় আছেন, আমি জানি না। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।’

কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ আশ্চর্য ও চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘শাম্ব, এ বিচিত্র যোগাযোগ! মহর্ষি আজই দ্বারকায় এসে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। তাঁকে আমি এখনই তোমার সংবাদ দিচ্ছি, তুমি অপেক্ষা করো।’

শাম্বও মনে মনে বিস্ময় ও স্বস্তি বোধ করলেন। ললেন, ‘এ আমার এক পরম সৌভাগ্য!’

কৃষ্ণ কক্ষত্যাগ করে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হলেন এবং ক্ষণপরেই মহর্ষি নারদসহ, সেখানে আবার উপস্থিত হলেন। মহর্ষি নারদকে দেখে শাম্ব এগিয়ে এসে কষ্টের সঙ্গে নতজানু হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। মহর্ষি আশীর্বাণী ও স্বস্তিবচন উচ্চারণ করে, কৃষ্ণের দিকে ফিরে বললেন, ‘আমি শাম্বর ব্যাধিমুক্তি বিষয়ে আলোচনা করব।’

কৃষ্ণ মহর্ষির ইঙ্গিত উপলব্ধি করে সে-স্থান ত্যাগ করলেন। মহর্ষি শাম্বকে বললেন, ‘বসো, আমি তোমাকে এক স্থানের কথা বলব।’

মহর্ষি অগ্রে আসন গ্রহণ করলেন। শাম্ব অদূরে উপবেশন করলেন। বললেন, ‘হে পরমপূজনীয় মহর্ষি, আমার বিষয়ে আপনার অজ্ঞাত কিছুই নেই। নিতান্ত চপলতাবশত আমি আপনার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করেছিলাম, কিন্তু আপনি অনুমান করতে পারেন, যদুবংশের পুত্র হয়ে আমি কখনওই ইচ্ছাকৃতভাবে তা করিনি। এখন যা অনিবার্য তাই ঘটেছে। পিতার দ্বারা আমি অভিশপ্ত হয়ে কুৎসিত ব্যাধিতে আক্রান্ত। আপনি তুষ্ট হন, আমার প্রতি প্রসন্ন হন। আপনি সুরলোক, অসুরলোক, গন্ধর্বলোক অন্তরীক্ষ যাবতীয় লোকে গমনাগমন করে থাকেন। আপনার অভিজ্ঞতা সীমাহীন। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে উপদেশ দিন এখন আমার কী কর্তব্য? পিতা বলেছেন, আপনি আমার আরোগ্যলাভের উপায় বলে দিতে পারেন।’

মহর্ষি শাম্বর কথা শুনলেন, তারপরে সম্বোধন করলেন, ‘হে বৃষ্ণিব্যাঘ্র! তোমার প্রতি আমার পরম সন্তোষ জ্ঞাপন করছি।’

মহর্ষির মুখে ‘বৃষ্ণিব্যাঘ্র’ সম্বোধন শুনে, শাম্বর প্রাণের মধ্যে অতি ব্যথাতুর একটি আনন্দানুভূতি হল। মনে হল, এখনই তাঁর পুচ্ছহীন রক্তগর্ভ চোখ জলপূর্ণ হয়ে উঠবে। তিনি হৃদয়ের আবেগকে দমন করে মহর্ষির উদ্দেশে প্রণাম জানালেন।

মহর্ষি আবার বললেন, ‘আমি জানি, তোমাকে অতি কষ্টের মধ্য দিয়ে কাল যাপন করতে হবে। কিন্তু তার কিছুই বৃথা যাবে না। এবার মন দিয়ে শোনো। আমি একদা একবার সূর্যলোকে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, সূর্যদেবকে দেবতারা বেষ্টন করে আছেন। দেবতা, যক্ষ, গন্ধর্ব এবং অপ্সরাবৃন্দ তাঁর চারপাশে অবস্থান করছেন। ঋষিগণ সেখানে বেদপাঠ করছেন এবং সূর্যের স্তব করছেন, পূজিত হচ্ছেন ত্রিসন্ধ্যা দ্বারা। সেখানে সূর্যকে ঘিরে রয়েছেন আদিত্যগণ, বসুগণ, মারুতগণ, অশ্বিনীগণ। তাঁর পার্শ্বেই রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র তাঁর দুই পত্নী রজনী ও নিক্ষুভা। রয়েছেন পিঙ্গলা, যিনি সদাসর্বদা মঙ্গল অমঙ্গল বিষয়ে লিখে চলেছেন। দ্বারপাল রূপে রয়েছেন দণ্ডনায়ক, রজনা, স্তোশা, কালমাস এবং পক্ষী। কথুশৃঙ্গে রয়েছেন ভিওমন এবং নগ্নদিণ্ডি।’

শাম্ব স্তব্ধ বিস্ময়ে মহর্ষির মুখ থেকে এই বর্ণনা শুনলেন। মহর্ষি আবার বললেন, ‘ইনি একমাত্র অনাবৃত দর্শিত ঈশ্বর, যিনি সকল দেবতা ও পিতৃগণেরও ঊর্ধ্বে। ইনিই সকল শক্তির উৎস। ইনি বিশ্বের রক্ষাকর্তা ও নিয়ন্তা, ইনিই স্রষ্টা ও সময়ে ধবংসকারী। তোমার একমাত্র পূজ্য দেবতা এই সূর্য। ইনি সমস্ত অমঙ্গল ও ব্যাধিকে ধ্বংস করেন, সেইজন্য সকল দেবতাগণ তাঁকে মান্য করেন। তুমি সেই সূর্যলোকে যাও।’

শাম্ব বিনীত নম্রস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কখনও এই সূর্যলোকের কথা শুনিনি। আপনার অশেষ করুণা, আপনি আমাকে শোনালেন। কিন্তু কোথায় এই সূর্যলোকের অবস্থান, আমি তাও জানি না। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে পথের সন্ধান দিন, আমি যে-কোনও প্রকার নিগ্রহ সহ্য করে তাঁর করুণাভিক্ষা করতে সেখানে যাব।’

মহর্ষি বললেন, ‘যথার্থ বলেছ, তুমি এখান থেকে উত্তর সমুদ্রতীরে গিয়ে, উত্তর পূর্বে গমন করো। তুমি যাবে মহানদী চন্দ্রভাগা তীরে, সেখানে মিত্রবনে সূর্যক্ষেত্র বর্তমান। সেখানে তিনি পরমাত্মারূপে অত্যুজ্জ্বল পুরুষ রূপ নিয়ে রয়েছেন। তুমি সেইখানে গমন করো।’ এই কথা বলে, মহর্ষি গাত্রোত্থান করে আবার বললেন, ‘কোনও কারণে কোনও সংকটে পড়লে, তুমি আমার সন্ধান কোরো, আমি তোমার সংকটমোচনের উপায় বলব।’

শাম্ব করজোড়ে নতজানু হয়ে আবার মহর্ষির পদধূলি গ্রহণ করলেন। মহর্ষি চলে যাবার কিছু পরেই কৃষ্ণ এলেন। মহর্ষি শাম্বকে কোনও কথা পিতাকে বলতেই নিষেধ করেননি। অতএব তিনি মহর্ষি বর্ণিত মহানদী চন্দ্রভাগা তীরে সূর্যক্ষেত্র মিত্রবনের কথা পিতাকে বললেন, এবং তখনই যাত্রা করার জন্য পিতার অনুমতি চাইলেন।

কৃষ্ণ বললেন, ‘একমাত্র মহর্ষিই এ বিষয়ে অবগত আছেন। চন্দ্রভাগা মহানদী দেবলোক থেকে অতি বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, আমি জানি। কিন্তু সূর্যক্ষেত্র মিত্রবনের সন্ধান আমার জানা নেই।’

শাম্ব বললেন, ‘মহর্ষি আমাকে পথের নির্দেশ দিয়েছেন। যথাস্থানে পৌঁছুতে আমার কতদিন লাগবে, তা আমি জানি না। অতএব যত শীঘ্র সম্ভব, আমি যাত্রা করতে ইচ্ছুক। আপনি আমাকে বিদায় দিন।’ এই বলে তিনি নতজানু হয়ে পিতার পদযুগল স্পর্শ করে মাথায় ঠেকালেন।

পুরুষোত্তমের অন্তর বিচলিত হল। তিনি তাঁর ঔরসজাত সেই অত্যুজ্জ্বল রূপবান বংশধরের দিকে করুণ চোখে তাকালেন। দেখলেন, তাঁর নাসিকা মধ্যস্থল দুই গিরিশৃঙ্গের ন্যায় ভগ্ন। তাঁর ভ্রূযুগল কেশহীন, সমস্ত মুখমণ্ডল মলিন কালিমালিপ্ত এবং তাম্ৰাভ, কোথাও রক্তাভ শুষ্ক ঘা এবং অতি পলিত। বিশাল চক্ষুদ্বয়ের কৃষ্ণপুচ্ছ। সকল পতিত হয়েছে, ফলে চোখ অতি রক্তাভ দগদগে দেখাচ্ছে। তাঁর সমগ্র দেহের চর্ম স্ফীত, বিবর্ণ, হাত পা বিকলাঙ্গের ন্যায়। কেবলমাত্র চোখের দৃষ্টি অতি করুণ অসহায়। কৃষ্ণ বললেন, ‘এই দূর পথের যাত্রায় তুমি কী কী গ্রহণযোগ্য মনে করো।’

শাম্ব বললেন, ‘কিছুই না। আমি অভিশপ্ত, মুক্তির সন্ধান ছাড়া কিছুই আমার গ্রহণীয় না।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘এত দূরবর্তী পথ তুমি অশ্বচালিত রথ অথবা অশ্বারোহণ ব্যতিরেকে কেমন করে যাবে? ক্ষুধা তৃষ্ণা ছাড়াও পথ চলতে আরও নানা রকমের প্রয়োজন থাকে।’

শাম্ব বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘এখন আর আমার সে-সবে কোনও প্রয়োজন নেই। কবচ কুণ্ডল অঙ্গুরীয়াদি সবই আমি খুলে রেখেছি। সর্বাঙ্গে জড়াবার বস্ত্র আমার আছে। এমনকী পাদুকাও আমি ত্যাগ করেছি, কারণ পাদুকা পায়ে চলতে পারি না। আমার এই বিকট মূর্তি নিয়ে এখন রথারোহণ, গ্রাম জনপদে বিস্ময় ও অবিশ্বাস উৎপাদন করবে। অশ্বারোহণে গেলে, লোকে আমাকে নানাপ্রকার ব্যঙ্গবিদ্রূপ করবে। এখন আমাকে ও-সবে খুবই বেমানান লাগবে। সপারিষদ অথবা সৈন্যসামন্তসহ আমি যেতে পারি না। আমার এ-যাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যাধিগ্রস্ত হতদরিদ্র লোকেরা যেমন অন্যান্যদের সাহায্যে বা কৃপায় গ্রামজনপদে গমনাগমন করে থাকে, আমাকেও সেইভাবেই যেতে হবে। ক্ষুধা তৃষ্ণা? ভাববেন না। গাছে বা মাটিতে ফলমূলের অভাব হবে না। তৃষ্ণার জলও নদনদী জলাশয় প্রস্রবণ থেকে সংগ্রহ করতে পারব। আপনি কোনওরকম দুশ্চিন্তা করবেন না।’ শাম্ব পিতার সামনে আর উচ্চারণ করবেন না: তিনি একজন অভিশপ্ত মানুষ। পূর্ব জীবনের সঙ্গে এখন তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি আর এখন যদুবংশের রূপবান কুমার নেই। গ্রামজনপদের ভিক্ষান্নে তিনি দিন যাপন করতে পারবেন।

কৃষ্ণ নিজেও যে সে-কথা বোঝেন না, এমন নয়। তবু আত্মজর কথা শুনে, কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইলেন। তারপরে বললেন, ‘তোমার গর্ভধারিণীর সঙ্গে দেখা করবে না?’

শাম্বর চোখের সামনে মাতৃমূর্তি জাম্ববতী ভেসে উঠলেন। পুত্র দর্শনে তাঁর খুশি মুখের আকস্মিক আহত আঘাতপ্রাপ্ত অভিব্যক্তি যেন শাম্ব দেখতে পেলেন। বললেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকেই অনুমতি নিয়ে যাত্রা করছি। মাতৃগণকে আপনিই সমস্ত বৃত্তান্ত বলবেন, আমার প্রণাম জানাবেন। আপনি আমাকে যাত্রার অনুমতি দিন।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘এসো। তোমার যাত্রা সফল হোক।’

শাম্ব আর একবার পিতার পদধূলি নিয়ে যাত্রা করলেন। লক্ষ্মণার কথা কি তাঁর মনে পড়ছে না? তাঁর নিজের অন্তঃপুর, বিলাস সামগ্রীতে সাজানো গৃহের সৌন্দর্য, রমণীরত্নাদি, যাদের সঙ্গে নানা ক্রীড়া কৌতুকে, ভোগে বিলাসে দিনগুলো কেটে যেত, সে-সব কিছুই কি তাঁর মনে পড়ছে না? কোনও মানুষের পক্ষেই সে-সব ভোলা সম্ভব না। কিন্তু অভিশাপমুক্ত না হয়ে শাম্ব আর সেখানে তাদের সামনে যাবেন না। শাম্বকে দেখলে এখন তাদের দৃষ্টি আহত, বিস্ময়ে ও ঘৃণায় কুঞ্চিত হবে। চিত্তবিকার ঘটবে। লক্ষ্মণারও কি একই অবস্থা হবে না?

শাম্ব কোনও দিকে দৃষ্টিপাত না করে দ্রুত নগরীর পথে বেরিয়ে পড়লেন। রৌদ্রকরোজ্জ্বল নগরীর পথে পথে নগরবাসীরা চলাচল করছে। যদুবংশের বালক এবং কুমারগণ অশ্বারোহণে নানাদিকে ভ্রমণ করছে। নগররক্ষীদের এই শান্তির সময়ে তেমন ব্যস্ততা নেই। নানা শ্রেণীর শ্রমজীবী ও অন্যান্যদের সঙ্গে ওরাও, পথিমধ্যে শুণ্ডিণীর ভাণ্ডারের সামনে মক্ষিকার ন্যায় জড়ো হয়েছে। সকলের দৃষ্টি যে কেবল শুণ্ডিণীর পৈষ্ঠী ও মাধ্বীপূর্ণ পাত্রের দিকে, এমন বলা যায় না। রসিকা যুবতী শুণ্ডিণীর প্রতিও অনেকের লক্ষ্য। তার অবিশ্যি কেউ পর না, সবাই আপন। সে সবাইকেই তার হাসির দ্বারা আপ্যায়ন করছে, সবাইকেই দৃষ্টির ঝলক হানছে, এবং সবাইকেই তার সুঠাম অঙ্গের নানা ভঙ্গি দ্বারা জানিয়ে দিচ্ছে, তার তৈরি সুরাপানে সকলেই কেমন উল্লাস বোধ করে থাকে।

শাম্ব নগরীর প্রাসাদসমূহের অলিন্দে ও গবাক্ষে রমণীদের কারওকে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। যদুবংশের কুমারগণকে কেউ কেউ কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করছে এবং একে অপরকে অঙ্গুলিদ্বারা বিশেষ কারওকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে হাস্য পরিহাস করছে। শাম্বকে তারা কেউ চিনতে পারছে না। একজন কুষ্ঠরোগীর প্রতি তাকিয়ে, কেউ তার দৃষ্টিকে অকারণ বিঘ্নিত করতে চায় না।

শাম্ব অকারণ অতীতের কথা ভেবে, মনস্তাপ ভোগ করতে চান না। কারণ সে-মনস্তাপের কোনও মূল্য নেই। তিনি দ্বারকার নানা পথ দিয়ে, পূর্বদিকের প্রধান দ্বারের দিকে এগিয়ে চললেন। যদিও আগের মতো স্বাভাবিক দ্রুতগতিতে চলতে তিনি আর সক্ষম নন। তাঁর সর্বাঙ্গের বহিরঙ্গ এখন প্রায় সম্পূর্ণ অসাড়। হাত ও পায়ের গ্রন্থিসমূহে রক্তাভ ক্ষত ও স্ফীতির জন্য পদক্ষেপ সহজ নেই। সহসা দ্রুতগতি অশ্বচালিত রথ অথবা কোনও অশ্বারোহী দ্রুতবেগে ছুটে এলে, তিনি অনায়াসে পথের পাশে ছিটকে চলে যেতে পারেন না। স্বভাবতই রথারোহী ও অশ্বারূঢ় বিরক্ত হন। এই নগরীর পথও সর্বত্র মোটেই সমতল না। সমুদ্রমধ্যে পার্বত্যদ্বীপ বিশিষ্ট এই ভূমির অধিকাংশ রাজপথই চড়াই উতরাইয়ে বন্ধুর।

শাম্ব মনে মনে পুণ্যভূমি মিত্রবনের কল্পনা করতে করতে, ব্যাধির দুঃখ কষ্ট ভোলবার চেষ্টা করতে লাগলেন। প্রায় দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত করে তিনি নগরীর পূর্ব দ্বারে পৌঁছুলেন। এই সময়ে যদুবংশের কুল-রমণীগণ সর্বালংকার শোভিতা হয়ে সহচরীদের সঙ্গে কোনও পূজা সাঙ্গ করে ফিরছিলেন। উপবাসক্লিষ্ট হলেও পূজাশেষে তাঁদের মন প্রফুল্ল ছিল। তাঁরা দরিদ্র ও প্রার্থীদের পথে ফল ও মিষ্টান্ন বিতরণ করতে করতে যাচ্ছিলেন। শাম্বও ক্ষুধার্ত ছিলেন। তিনি হাত না পেতে পারলেন না। পূজারিণীরা তাঁকে বিমুখ করলেন না, কিন্তু তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাতে সকলেই আকুঞ্চিত মুখে শিহরিত হচ্ছিলেন। স্পর্শের আশঙ্কায় দূর থেকে মিষ্টান্ন নিক্ষেপ করছিলেন।

শাম্ব দুঃখ ও মনস্তাপ থেকে নিজেকে নির্বিকার রাখলেন। মনে মনে কেবল উচ্চারণ করলেন, “আমি অভিশপ্ত।” তিনি পূজারিণীদের আচরণে কোনও দোষ খুঁজে পেলেন না। এরকম না ঘটলেই তিনি বরং অবাক হতেন। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ আত্মজিজ্ঞাসার দ্বারা, জবাব পাচ্ছেন, তাঁর দৃষ্টি ও মন এইসব রমণীদের তুলনায় উদার ছিল না। অতীতে সুস্থাবস্থায় কুষ্ঠরোগীর বীভৎস চেহারা দেখে, তাঁর মনেও বিকার ঘটত, দৃষ্টি আহত ঘৃণায় শিহরিত হত এবং সংস্পর্শ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতেন।

শাম্ব ফল ও মিষ্টান্ন খেয়ে, পথের ধারে জলাশয়ে সকলের কাছ থেকে দূরে জলপান করলেন। সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট নৌকায় আরোহণ করে, মূল ভূখণ্ডে পৌঁছুলেন। অবিশ্যি সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট নৌকোয়ও তাঁকে যাত্রীদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হল। স্বভাবতই তাঁর মতো একজন ব্যাধিগ্রস্তের কাছ থেকে খেয়া-পারানির অর্থ কেউ দাবি করেনি।

মূল ভূখণ্ডে পৌঁছুতে অপরাহ্ন হয়ে গেল। যাত্রীরা দলবদ্ধ হয়ে যে-যার পথে চলে গেল। শাম্ব সমুদ্রের তীর ধরে উত্তর দিকে চলতে লাগলেন। কোন সীমানা থেকে পূর্ব-উত্তরে গমন করতে হবে, মহর্ষি নারদ স্থির করে তা বলে দেননি। অধিক উত্তরে সিন্ধুদেশ কুবলয়াশ্ব বংশধরদের রাজত্ব। ভূমিকম্পপ্রবণ সেই দেশে ঋষি উতঙ্কের আশ্রম ছিল। শাম্ব অনুমান করলেন, সমুদ্রতীর ধরে ততোধিক উত্তরে তাঁকে যেতে হবে না।

আকাশ ক্রমে রক্তাভ হল, এবং অতি দ্রুত সেই রক্তাভায় কৃষ্ণছায়া ছড়িয়ে পড়ে, সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে লাগল। বহু দূর দিগন্ত পর্যন্ত বালুকারাশি এখনও তপ্ত। শাম্বর অশক্ত পদযুগল প্রতি পদক্ষেপেই সেই তপ্ত বালুতে ডুবে যাচ্ছে। গতি হয়ে উঠছে মন্থরতর। সমুদ্র সর্বদাই গর্জমান, বহু দূর পর্যন্ত তরঙ্গরাশি উৎক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে আসছে, আবার বেগে নেমে যাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে নামতেই সমুদ্রের বুক থেকে অতিবেগে বায়ু উত্থিত হল। সমুদ্রের গর্জনের প্রচণ্ডতার সঙ্গে বালুকারাশি উড়তে লাগল। চোখ খুলে রাখা দায় হল। সারা গায়ে অজস্র তীক্ষ্ণমুখ সুঁচের মতো বালুকা বৃষ্টি হতে লাগল। নাসারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে, বালুকণা গলনালী ও মুখের মধ্যে ঢুকে গেল।

শাম্ব দেখলেন, পাহাড়ের মতো বালুকারাশি ও সমুদ্রতীরে তিনি একলা। এতক্ষণ যাত্রীরা যারা তাঁর কাছাকাছি চলছিল, তারা ভিন্ন পথে নিকটবর্তী কোনও গ্রামে চলে গিয়েছে। তিনি দেখলেন, এক শ্রেণীর অনতিদীর্ঘ সাপ অনায়াসেই বালুরাশি ঠেলে চলে যাচ্ছে। তিনি জানেন, এই সাপ অতি বিষাক্ত, কিন্তু সর্বদাই উদ্যত আক্রমণশীল না। শাম্ব এই প্রথম অনুভব করলেন, তিনি নিরস্ত্র। কোনও মানুষ বা শ্বাপদের দ্বারা আক্রান্ত হলে, তিনি কিছুই করতে পারবেন না। একমাত্র আশা, মানুষ তাঁকে কিছু করবে না। তাঁর কাছে এমন কিছুই নেই, যা দস্যু বা তস্করেরা লুণ্ঠন করতে পারে। কিন্তু কোনও শ্বাপদ সরীসৃপ তাঁকে শত্রুজ্ঞানে আক্রমণ করলে তিনি নিরুপায়।

বাতাস যেন হাজার বেগবান অশ্বচালিত হয়ে ছুটে আসছে, বিশাল বালুবেলায় দাপাদাপি করছে। অথচ আকাশে মেঘ নেই। সূর্যাস্তের পরেই নক্ষত্ররাজি ঝিকিমিকি করে উঠেছে। এই বাতাসের বেগ দেখলে, মনে হয় পৃথিবীও যেন অতিবেগে ঘূর্ণিত হচ্ছে। বালুকারাশির স্তুপ আশ্চর্য শব্দে ফেটে যাচ্ছে, এবং সেই ফাটলের গহ্বর দিয়ে, বাতাস সাপের মতো এঁকে বেঁকে, সোঁ সোঁ শব্দে ছুটে চলেছে। অন্ধকারে সমুদ্রের তরঙ্গে তীক্ষ্ণ ধারালো ঝকঝকে দাঁতের হাসি খলখলিয়ে বাজছে।

‘হে অভিশপ্ত, কোনও দিকে দৃকপাত কোরো না।’ শাম্ব মনে মনে উচ্চারণ করলেন, এবং চলতে লাগলেন। সমুদ্র, বায়ুর তাণ্ডব, কোনও কিছুই তাঁর অধীন না। অতএব প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনিবার্য জেনে, নিজের কর্ম করাই শ্রেয়। এই সময়েই, পূর্ব দিগন্তে এক ফালি তাম্রাভ চাঁদ দেখা গেল। আর শাম্ব মাছের আঁশটে গন্ধ পেলেন। গন্ধ পাওয়ামাত্র তিনি দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সমুদ্রতীরের চারদিকে লক্ষ করলেন। এবং যা আশা করেছিলেন, তা দেখতে পেলেন। তাম্রাভ চাঁদের ম্লান আলোয়, দীর্ঘ ঋজু ঝাড়ালো কতগুলো গাছ, খানিকটা অঞ্চল জুড়ে নারকেল বীথির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র থেকে কিছুটা পুবে, সেই গাছপালার মধ্যে, কতিপয় কুটিরের অবয়ব ও দু’-একটি আলোর বিন্দু দেখতে পেলেন। মাছের আঁশটে গন্ধের ইঙ্গিতে তিনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন, কাছেপিঠেই কোথাও নিশ্চয় ধীবরপল্লি আছে। শাম্ব স্বস্তি বোধ করলেন। এই মহাসমুদ্রের ঝটিকাপ্রবাহিত বিশাল বালুবেলায় তিনি অত্যন্ত একাকী বোধ করছিলেন। তাঁর অন্তরে কোনও ভয় উৎপাদিত হয়নি। অভিশপ্ত মানুষ তার অভিশাপের বোঝা একাই বহন করে। শাপমোচনের প্রয়াসে একাই সংগ্রাম করে। তবু জগৎ সংসারে তাঁর পরিচয়, তিনি মানুষ। মানব জীবধর্মের এই নিয়ম, সংসারের বাইরে একাকী থেকেও সংসারের সীমান্তে দাঁড়িয়ে জীবনের ঘ্রাণ গ্রহণ করে।

শাম্ব ধীবরপল্লির সীমানায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ঝড়ো বাতাসের ঝাপটায় গাছপালা যেন আভূমি নত হয়ে পড়ছে। কুটিরগুলো কাঁপছে। কিন্তু ধীবরপল্লির কেউ ভয়ে ভীত না। শিশুরা কুটিরের ভিতরে ঘুমোচ্ছে। রমণী এবং পুরুষরা এখনও ঘরকন্না, জাল সেলাই, গোটানো এবং নানা ক্রীড়া-কৌতুক করছে। ঝড়ো বাতাসকে আড়াল করে কোনও কোনও ধীবর রমণী রান্না করছে। কিন্তু শাম্ব পল্লি মধ্যে প্রবেশ করতেই, তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটল, শান্তি বিনষ্ট হল। তাঁর সেই অতি বিকট মূর্তি দেখে, অনেকেই ভয়ে ও অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়াল। রমণীরা কুটিরে ঘুমন্ত সন্তানদের আড়াল করার জন্য দরজায় দাঁড়াল। গৃহপালিত কুকুরেরা শাম্বকে দূর থেকে চারদিকে ঘিরে প্রচণ্ড চিৎকার জুড়ে দিল।

কুকুরের চিৎকার, ঝড়ে গাছপালার সোঁ সোঁ এবং সমুদ্রের গর্জন, সব মিলিয়ে, একটা তাণ্ডবের মাঝখানে যেন ভূতসহ নরনারী দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিঙ্গল আবছা জ্যোৎস্নায়, গাছপালা নরনারীদের ছায়াগুলো কিম্ভূত দেখাচ্ছে। শাম্ব সহজেই অনুমান করতে পারেন, তাঁকে কীরকম দেখাচ্ছে। তিনি ঝড়ের এবং কুকুরের চিৎকার ছাপিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন, ‘ভাই বন্ধুগণ, আমি সমুদ্র থেকে উত্থিত কোনও জলচর প্রাণী নই। আমি মানুষ, ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ। ব্যাধিই আমাকে এরকম কুরূপ কুৎসিত করেছে। তোমাদের নারী পুরুষ সবাইকেই বলছি, আমাকে ভয় পেয়ো না। আমার দ্বারা তোমাদের কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।’

শাম্ব দেখলেন, তাঁর কথায় কাজ হল। ধীবর রমণী পুরুষদের চোখ মুখের ভীতির ভাব অনেকটা অপসারিত হল। তারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল এবং বারে বারে শাম্বর দিকে দেখল। একজন পুরুষ তাদের নিজেদের লোককে স‌ম্বোধন করে বলল, ‘আসলে আমি এই প্রাণীটিকে কোনও নরখাদক রাক্ষস ভেবেছিলাম। কিন্তু এর কথা আমাদের থেকেও ভাল। যেন কোনও উচ্চবংশজাত ব্যক্তির ন্যায় শালীনতাপূর্ণ। রাজরাজড়া বা ঋষিগণ যেভাবে কথা বলেন, এর কথাবার্তা সেইরকম।’

একজন রমণী সন্দিগ্ধ ভয়ে বলল, ‘কিন্তু নরখাদক রাক্ষসেরা অনেকরকম মায়া জানে। কে বলতে পারে এর এরকম কথা মায়া ছাড়া কিছুই না?’

শাম্ব নিজেই রমণীর কথার জবাব দিলেন, ‘তুমি যথার্থ বলেছ, কিন্তু রাক্ষসদের আচার আচরণ বিভিন্ন রূপ হয়। তারা হুংকার ছাড়ে, আবির্ভূত হয়েই তাণ্ডব করে, বাক্যবিনিময়ের কোনও চেষ্টাই করে না। দ্বারকা এখান থেকে খুব বেশি দূরে না। এ অঞ্চলে যদি কোনও রাক্ষসের বাস থাকত, তা হলে বাসুদেব অথবা যদুবংশের কোনও বীর নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করতেন, তোমাদের জীবনকে নিরাপদ করতেন। আমি একজন নিতান্ত হতভাগ্য, দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ।’

শাম্বর কথা শুনে, সকলেই যেন অনেকখানি আশ্বস্ত এবং সহজ হল। কয়েকজন কুকুরগুলোকে হাত তুলে প্রহারের ভঙ্গিতে তাড়া করে দূরে সরিয়ে দিল। একজন বর্ষীয়ান রৌদ্রদগ্ধ তাম্রবর্ণ দীর্ঘদেহী পুরুষ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ, কোথায় যাবে?’

শাম্ব বললেন, ‘আমি এখন দ্বারকা থেকে আসছি। পূর্বোত্তরের চন্দ্রভাগা নদীর ধারে মিত্রবনে আমি যাব।’

শাম্ব জানেন, তাঁর পরিচয় দেওয়া বৃথা। তা অবিশ্বাস্য শোনাবে, তেমনি এদের কাছে তাঁর অভিশাপের বিষয় বলাও নিরর্থক। তিনি আবার বললেন, ‘আমি আজ সারা দিনই চলছি। সহসা বাতাস ওঠায়, বালুর ঝড়ে, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত আর পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছি। যেখানে আমাকে যেতে হবে, সেই পথ আমার জানা নেই। দিক ঠিক না করে, রাত্রের অন্ধকারে আমি চলতে পারছি না। শুকনো মাছের গন্ধে টের পেলাম, এখানে নিশ্চয়ই কোনও বসতি আছে।’

শাম্বর কথাবার্তার উচ্চারণে ও ভঙ্গিতে সকলেই সহজ হয়ে গেল। তাদের অবিশ্বাস ভয় সন্দেহ দূর হল। সেই ধীবর পুরুষটি বললে, ‘কিন্তু চন্দ্রভাগা নদীই বা কোথায়, মিত্রবনই বা কোথায়?’

শাম্ব বললেন, ‘শুনেছি, সিন্ধুনদের থেকে উৎপন্ন একটি বেগবতী শাখার নাম চন্দ্রভাগা। তারই তীরে কোথাও মিত্রবন আছে। সবই আমাকে খুঁজে নিতে হবে।’ এই পর্যন্ত বলে শাম্ব প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, ‘আমি আজ তোমাদের পল্লির উপান্তে কোথাও রাত্রিটা শুয়ে কাটিয়ে দেব। এখন এই সমুদ্রকূলের অন্ধকারে কোথাও মিষ্ট জলের সন্ধান করা আমার পক্ষে দুরূহ। আমি তোমাদের কাছে কয়েক গণ্ডূষ পানীয় জল আর কয়েক গ্রাস খাদ্যের প্রত্যাশী।’

ইতোমধ্যে ধীবর রমণী পুরুষরা শাম্বকে দেখিয়ে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, তিনি যেরকম কুৎসিত ও বিকলাঙ্গ দেখতে, তাঁর কথাবার্তা মোটেই সেরকম না। তাঁর কথা শুনলে, ধীমান ও শ্রীমান মনে হয়।

বর্ষীয়ান ধীবরটি বলল, ‘তুমি খাদ্য পানীয় সবই পাবে। তুমি এখন বসো। আমরা প্রথমে ভয় পেলেও, এখন আর তা নেই।’

শাম্ব নিশ্চিন্ত হয়ে একটি নারিকেল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসলেন।

শাম্ব ক্রমাগত এইভাবে দিনের পর দিন চলতে লাগলেন। উত্তর সমুদ্রের তীর ধরে চলতে চলতে এক সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি সিন্ধুদেশের অভ্যন্তরে গমন করছেন। একটা নদী অতিক্রম করতে গিয়ে, এক ঋষিতুল্য ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। শাম্ব তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন চন্দ্রভাগা নদীতীরে মিত্রবন কোথায়, তাঁর জানা আছে কি না।

সেই ঋষিতুল্য ব্যক্তি বস্তুতপক্ষে একজন তপস্বীই ছিলেন। তিনি শাম্বকে বলেছিলেন, ‘এই নদী অতিক্রম করা তোমার ঠিক হয়নি। আমি শুনেছি, মিত্রবণ নামে এক সূর্যক্ষেত্র পঞ্চনদীর দেশে আছে। আরও শুনেছি, অন্তরীক্ষের পাদদেশে কোথাও সেই স্থান বর্তমান। তোমার ন্যায় চর্মরোগীরা সেখানে যায় আরোগ্যলাভের জন্য। বস্তুতপক্ষে সেখানে কী আছে, কেমনভাবেই বা চর্মরোগীরা আরোগ্যলাভ করে, আমার কিছুই জানা নেই। তবে আমার মনে হয়, তোমাকে সেই পঞ্চনদীর দেশেই যেতে হবে। তুমি নদী পার না হয়ে, ফিরে যাও।’

তপস্বীর মুখে চর্মরোগের কথা শুনে, শাম্বর মনে আর কোনও সন্দেহ ছিল না, তাঁর গন্তব্য মিত্রবনের কথাই তিনি বলেছেন। শাম্ব অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে তপস্বীকে প্রণাম করেছিলেন। তপস্বী তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন, ‘তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হোক।’

শাম্ব বহু নদনদী অতিক্রম করে, অরণ্যের ভিতর দিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে পূর্বোত্তর বরাবর চলেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে তিনি সহনীয় করে তুলেছিলেন। ক্রমেই অশক্ত হয়ে পড়া শরীরকে চালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন। অরণ্যমধ্যে শ্বাপদকে ভয় করেননি। কিন্তু গ্রাম ও জনপদের সর্বত্র প্রায়ই তাকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। বয়স্ক নরনারীরা যতখানি ঘৃণা প্রদর্শন করে ততখানি বিতাড়নের দ্বারা নিগ্রহ করে না। কিন্তু গ্রাম জনপদের বালকগণ, সারমেয়কুল সর্বত্র একইরকম। বালকেরা তাঁর গতিভঙ্গির বিকৃতিকেই কেবল অনুকরণ করেনি, প্রস্তরাদি নিক্ষেপ করে তাড়া করেছে। তাদের সঙ্গে সারমেয়কুলও এক মুহূর্ত স্থির হতে দেয়নি।

শাম্ব অতি দুঃখের সময়ে কেবল মনে মনে উচ্চারণ করেছেন, ‘তুমি অভিশপ্ত। শাপমোচনেই তোমার জীবনের মোক্ষলাভ। ভাগ্য অমোঘ। তাকে মেনে নিয়েই, দুর্ভাগ্য থেকে উত্তরণের সন্ধান করতে হয়। আমার কেন এমন দুর্ভাগ্য হল, অপরের কেন হল না, এইরূপ প্রশ্ন বাতুলতামাত্র। নিজের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে অপরের তুলনা করে, আত্মাকে ক্ষুব্ধ করা এবং কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না। নিজের কষ্টের জন্য কারওকে দোষারোপ করাও অবিমৃশ্যকারিতা ছাড়া আর কিছু না। কেন জরা আছে, ব্যাধি আছে, মৃত্যু ঘটে, এইসব নিয়ে মানুষ বিলাপ করে, শোকাকুল হয়। অথচ এ-সবের আক্রমণ থেকে কারওরই রেহাই নেই। বলবীর্যের দ্বারা শত্রু নিধন মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তিস্থাপন যেমন ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম, তেমনি ব্যক্তির দুর্ভাগ্যের জন্য, তাকে একাকী সংগ্রাম করতে হয়।’

শাম্ব গ্রামে জনপদে যখনই নিগৃহীত লাঞ্ছিত হয়েছেন, তখনই সহ্য করবার শক্তি সংগ্রহ করেছেন। কখনও কখনও তাঁর চোখ ফেটে জল এসেছে, কিন্তু কদাপি ক্রুদ্ধ হননি। প্রতি-আক্রমণ কিংবা উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করেননি। সুখ এবং দুঃখকে একত্রে গ্রথিত করে, সর্বদাই নির্বিকার থেকেছেন। অতীতের কথা বা বর্তমানের কথা ভাবেননি। শুধু ভবিষ্যতের কথাই ভেবেছেন। গন্তব্যের দিকেই এগিয়ে চলেছেন, এবং মহর্ষি কথিত সেই অত্যুজ্জ্বল পুরুষের মূর্তিই কেবল কল্পনা করেছেন।

এইভাবে সাতটি ঋতু অতিক্রমের পরে, তিনি এক আসন্ন সন্ধ্যায় চন্দ্রভাগা তীরে পৌঁছুলেন। নৌকায় যারা নদী পারাপার করছিল, তারা কেউ কেউ নদীটিকে মহানদী বলেও উল্লেখ করছিল। শাম্ব দেখলেন, অতি বেগে পূর্ব-দক্ষিণগামিনী নদীটির বুকে রক্তাভ শার্ঙ্গাস্ত্রের মতো বঙ্কিম স্রোত ঝকঝক করছে এবং শৃঙ্গ দ্বারা প্রস্তুত ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তিরের মতো এক-একটি তীক্ষ্ণ রেখা ছুটে চলে যাচ্ছে। নদীর তীর বালুকারাশি পূর্ণ না, বরং সবুজ ঘাসে শক্ত মৃত্তিকা আচ্ছাদিত। ঋজু বিশাল মহীরূহসমূহ ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে। যেন নদীকূলে এসে ক্লান্ত পথিকদের আশ্রয়দানের জন্য, আকাশবিদ্ধ বনস্পতিরাজিসমূহ দাঁড়িয়ে আছে। আসন্ন সন্ধ্যার রক্তাভা যেমন নদীর বুকে, তেমনি বনস্পতির শীর্ষে। কাছেপিঠে ঘন বসতি চোখে পড়ে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু কুটির। নদী থেকে তীরভূমি বেশ উচ্চে। তথাপি, সম্ভবত বর্ষায় এ নদীতে বন্যা হয়, সেইজন্যই তীরে কোনও লোকালয় নেই। অথচ কর্ষিত ক্ষেত্রে ফসল ফলানো হয়েছে।

শাম্ব এই নদী দর্শনমাত্র, তাঁর অন্তরে গভীর আনন্দের সঞ্চার হল। নদীর এপারে ওপারে গমনাগমনকারী প্রতিটি পুরুষকেই তিনি, মনের সামান্যতম সন্দেহও মোচনের জন্য বারে বারে ব্যগ্র স্বরে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘সিন্ধুনদ থেকে উৎপন্ন এই কি সেই চন্দ্রভাগা নদী?’

অনেকের কাছ থেকেই তিনি জবাব পেলেন না। অধিকাংশ লোকই তাঁকে এড়িয়ে গেল, যেন তাঁর প্রশ্নের অর্থ বুঝতেই পারেনি। আসলে তাদের বিরাগ ও বিতৃষ্ণা গোপন থাকছিল না। কেউ কেউ জবাব দিল, ‘কোথা থেকে উৎপন্ন, সেসব জানি না। এই নদীর নাম চন্দ্রভাগা।’

চন্দ্রভাগা! শাম্ব যেন বারে বারেই নামটি শুনতে চাইছিলেন। কিন্তু মিত্রবন কোথায়? নদীর এপারে না, ওপারে? এইটিই পঞ্চনদীর দেশ তো? সন্ধ্যার ছায়া যত ঘন হতে লাগল, খেয়া যাত্রীদের সংখ্যাও দ্রুত স্বল্প হয়ে উঠল। শাম্ব শেষ পর্যন্ত মাঝির শরণাপন্ন হলেন। স্থানীয় অধিবাসী পুরুষ ও স্বল্প সংখ্যক রমণীদের সকলেরই দেহের গঠন দীর্ঘ। আপাতদৃষ্টিতে তাদের চোখে মুখে রুক্ষতা থাকলেও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় সকলেই বেশ রসিক ও আমুদে। অপরূপ নদীতীরে সুবিমল বাতাসে, তাদের সুখী দেখাচ্ছিল, এবং প্রায়ই প্রাণের স্ফূর্তিতে গান গেয়ে উঠছিল। তাদের গানের ভাষা অনেকটা পৈষ্ঠীপাত্রের গায়ে লেগে থাকা মক্ষিকার মতো, অশ্লীল ও ইতরতাপূর্ণ, কিন্তু নির্দোষ মনে হচ্ছিল। কারণ তারা কোনও ব্যক্তিবিশেষের নামে কিছু বলছিল না, নিজেদের কামোচ্ছ্বাসকে ব্যক্ত করছিল, এবং গান শুনে সকলেই হইহই করে হেসে উঠছিল।

শাম্বকে দেখেই মাঝির ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হল, চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠায়, দাড়ি কুঁকড়ে উঠল। বলল, ‘ওহে, তোমাকে আমি শেষ খেয়ায় পার করব, এখন নিতে পারব না।’

শাম্ব বললেন, ‘ভাই, সেটা তোমার করুণা। আগে বা শেষে, যখনই তুমি আমাকে পার করো, পার হতে পারলেই আমি সার্থক জ্ঞান করব।’

শাম্বর বিনীত বাক্যে মাঝি যেন একটু অবাক হল। আসলে শাম্বর ভাষায় বিন্দুমাত্র অর্বাচীনতার স্পর্শ নেই। ধীমান ও জ্ঞানীর মতো তাঁর কথা শুনে, আরও কয়েকজন যাত্রী তাঁর দিকে তাকাল। কিন্তু প্রথম দর্শনেই সকলের মুখে বিমুখতা ফুটে ওঠে। শাম্ব আবার বললেন, ‘এ দেশে আমি কখনও আসিনি। এই নদীর তীরে মিত্রবন নামক স্থানে আমি যেতে চাই। আমি শুনেছি, সে-স্থানকে সূর্যক্ষেত্র বলা হয়। সে-স্থান কি নদীর পরপারে?’

মাঝি চমৎকৃত হয়ে বলল, ‘পরপারে বটে, কিন্তু এ-ঘাটে পার হয়ে তোমাকে নদীর উত্তরদিকে সারাদিনের পথ যেতে হবে। তার চেয়ে রাত্রিটা তুমি এপারেই অতিবাহিত করে, নদীর উজানে তীর ধরে চারটি অতিকায় বাঁক পাবে। ভোরে রওনা হলে, সন্ধ্যাকালের মধ্যে তুমি সেখানে পৌঁছুতে পারবে, আর সেখানেই খেয়া পার হবে।’

শাম্ব কৃতার্থ হয়ে বললো, ‘ভাই, পঞ্চনদীর দেশের মাঝি, তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

মাঝি শাম্বর কথায় খুবই প্রসন্ন হল, এবং তার চোখে মুখে করুণার অভিব্যক্তিও ফুটল। সে বলল, ‘এপারে কোনও গ্রাম নেই, ওপারে গেলে, ঘাটের অদূরেই তুমি একটি গ্রাম পাবে। আমার মনে হয়, এপারে রাত্রে থাকা তোমার ঠিক হবে না। গভীর রাত্রে এপারে যক্ষগণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়, নানারকম গান বাজনা করে। সে এক রকমের ইন্দ্রজালের মায়া। সেই মায়ায় তুমি ঘুমিয়ে পড়লে, হিংস্র জন্তু তোমাকে খেয়ে ফেলতে পারে। তারা মানুষের রোগ ব্যাধি মানে না। তুমি অপেক্ষা করো, শেষ খেয়ায় আমি তোমাকে ওপারে নিয়ে যাব।’

শাম্ব কৃতজ্ঞতায় কোনও কথা উচ্চারণ করতে পারলেন না। মাঝির কথায় তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠল। নৌকা ছেড়ে যাবার পরে, শাম্ব সাবধানে নদীর জলে অবতরণ করলেন। অবগাহন স্নানে যেন তাঁর সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা নদীতীরের এক স্থানে এসে তিনি উপস্থিত হয়ে দেখলেন, ছোট ছোট টিলার গায়ে একটি কিংবা দুটি মানুষ কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকতে পারে, এমনি ধরনের মানুষের তৈরি কতগুলো গুহা। তার আশেপাশে, ঝোপঝাড়ের মুণ্ডসকল লতাগুল্মের দ্বারা শক্ত করে বেঁধে, একটি প্রবেশমুখ রেখে, এক ধরনের কুটির তৈরি করা হয়েছে, যার ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করা ছাড়া উপায় নেই, এবং ভিতরে নিশ্চয়ই মাথা সোজা করে বসাও যায় না। আশেপাশে কয়েক জায়গায় কাঠের আগুন জ্বলছে। তারই লেলিহান শিখার আলোয়, শাম্ব সেইসব গুহা ও কুটিরের সামনে কিছু মানুষকে নড়েচড়ে বেড়াতে দেখলেন। পুরুষ এবং রমণীর কণ্ঠস্বরও তাঁর কানে এল।

শাম্ব মনে মনে অবাক হয়ে ভাবলেন, এরা কারা? কোনও যাযাবর জাতির গোষ্ঠীভুক্ত, অথবা অরণ্যবাসী কিরাতগণ? ভাবতে ভাবতে তিনি সেইসব গুহা ও কুটিরের সামনে এগিয়ে গেলেন। কাঠের আগুনের আলোয় তাঁর মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠতেই কয়েকজন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। শাম্বর বুকে যেন বিদ্যুতের ঝলক হেনে গেল। দেখলেন, তাঁর সামনে যে-ক’জন এসে দাঁড়িয়েছে, তারা সকলেই তাঁর মতো কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত। শাম্ব এবং তাদের মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় হল। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল, কয়েকজন কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত রমণীও সামনে এসে দাঁড়াল। যাদের দু’-একজনের কোলে শিশু! আশ্চর্য, শিশুরা কেউ রোগগ্রস্ত না।

শাম্ব মুহূর্তেই অনুমান করতে পারলেন, এ অঞ্চলই মিত্ৰবন। যে-কথা তিনি মহর্ষি নারদের কাছে শুনেছিলেন, এরাও নিশ্চয় সেরকম ভাবেই কারও কাছ থেকে শুনে, এখানে আরোগ্যলাভের জন্য এসেছে। তিনি সন্দেহ মোচনের জন্য প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই স্থানের নাম কি মিত্রবন?’

একজন পুরুষ জবাব দিল, ‘তাই তো শুনেছি।’

শাম্বর মনে পড়ল, মহর্ষি নারদের সূর্যক্ষেত্রের সেই বিস্ময়কর বর্ণনা, যেখানে গ্রহরাজ সূর্যকে ঘিরে অষ্টাদশ দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, অপ্সরাগণ, দণ্ডনায়ক ও দিণ্ডি দণ্ডায়মান রয়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই সূর্যক্ষেত্র কোথায়, যেখানে গ্রহরাজ পরমাত্মন অবস্থান করছেন?’

শাম্বর কথা শুনে, সবাই হেসে উঠল। কেউ বলল, ‘এর কথাবার্তা বেশ রাজপুরুষদের মতন চৌকস।’

কেউ বলল, ‘ঋষির মতনও বলা যায়।’

শাম্ব অবাক হয়ে শুনলেন, এদের কথাবার্তা রীতিমতো অর্বাচীন, ইতর শব্দে ভরা। এদের কী পুরুষ, কী রমণী, সকলেই এমনভাবে গ্রহরাজের কথা শুনে হাস্যপরিহাস করছে, যেন তারা ব্যাধিগ্রস্ত নয়। একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘তোমার মত আমরাও অনেক কথা শুনে এখানে এসেছি। কিন্তু ওই যেসব গ্রহরাজ-টাজ কী সব বলছ, ওসব আমরা কিছুই দেখিনি। তবে মান্ধাতা আমলের একটা মন্দির আছে। ওটাকেই সবাই সূর্যক্ষেত্র বলে।’

শাম্বর অন্তর একরকমের অশান্তি ও অস্বস্তিতে ভরে উঠল, জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই মন্দিরে কোন দেবতার বিগ্রহ আছে?’

সবাই আবার পরিহাস করে হেসে উঠল, এবং একজন বলল, ‘সেটা মন্দিরই কি না, আমরা জানি না। মাথার ওপরে ছাতা, আর রাজার মতন জুতো জামা পরা একটা মূর্তি আছে। ও-ই নাকি সূর্যমূর্তি। আমরা রোজ তাকে একবার করে গড় করি।’

অনেকে প্রতিধ্বনি করল ‘হ্যাঁ, আমরা চন্দ্রভাগার জলে রোজ চান করে, সেই মূর্তিকে একবার গড় করি। তার আশেপাশে আরও অনেক মূর্তি আছে, ওরাও নাকি সবাই দেবতা। এদেরও গড় করি।’

একজন পুরুষ বলল, ‘অপ্সরা মূর্তি বেশ সুন্দর, আমি রোজ তার গায়ে গা ঘষি।’

আর একজন বলল, ‘আমরা রোজ সকালে চন্দ্রভাগায় নেয়ে, মন্দিরে গড় করে ভিক্ষে করতে বেরোই। আর এ সময়ে এসে ভিক্ষার অন্ন ফুটিয়ে খাই।’

অন্য একজন বলল, ‘আমরা সংসারও করি। এইসব মেয়েছেলেরা প্রতি বছরই পোয়াতি হয়, আর বাচ্চা বিয়োয়।’

ভগ্নকেশ, বিকলাঙ্গ, বিবর্ণ, পুচ্ছহীন রক্তচক্ষু রমণীরা সবাই হেসে উঠল, এবং একজন বলল, ‘আমাদের বাচ্চাগুলো প্রথমে খুব ফুটফুটে হয়ে জন্মায়। চার-পাঁচ বছর বয়স হলেই ওরা আস্তে আস্তে আমাদের মতন হয়ে যায়।’

একটি রমণী তার বুকের ফুটফুটে শিশুটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এই দ্যাখো, এখন কেমন সুন্দর দেখতে। ও আমার পেটেই জন্মেছে। ওর বাবারও কুষ্ঠ ছিল, দু’দিন হল মরে গেছে। আমার এই ছেলে যখন একটু বড় হবে, তখন ওরও কুষ্ঠ হবে। কিন্তু সেসব নিয়ে আমি ভাবি না। রাত হলেই পুরুষের সঙ্গে ছাড়া আমি থাকতে পারি না। তুমি নতুন এসেছ, এখন থেকে আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।’

সবাই হইহই করে সমর্থন করল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন থেকে তুমিই ওর সঙ্গে থাকবে। মেয়েদের মধ্যে ও এখন সব থেকে বয়সে ছোট। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি আগে বেশ সুপুরুষ ছিলে।’

পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখে, শিশু কোলে রমণীটি শাম্বর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।

একজন চিৎকার করে বলল, ‘এখানে সবাই রোগ সারাতে আসে, কিন্তু এমন কোনও দিব্য ব্যাপার নেই যে, রোগ সারে। চামড়া ভেদ করে আমাদের হাড়ে দুব্বো গজিয়ে যায়, আর আমরা মরে যাই। আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকে, তার আগের জন্মিত ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যায়, আর তোমার মতন নতুন নতুন লোক এখানে রোগ সারাতে আসে।’

শাম্বর মনে হল, কোনও মায়ার দ্বারা তিনি আবিষ্ট হয়েছেন। তাঁর কোনও বাহ্যজ্ঞান নেই। অচৈতন্য অবস্থায় তিনি কোনও নরকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। এ স্থান কখনওই মিত্রবন হতে পারে না। এদের সকলের পরিহাসের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে একটি অসহায় অবিশ্বাসই ধ্বনিত হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন, নানা স্থান থেকে এরা এখানে এসেছে, সংঘবদ্ধভাবে জীবনযাপনের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করেছে। এদের কারও সঙ্গেই কারওর কোনও সম্পর্ক নেই। বংশপরম্পরা বলেও কিছু নেই। সমাজ ও সংসার থেকে বহিষ্কৃত এক ব্যাধিগ্রস্ত বাহিনী, যারা আরোগ্যের আশা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু আরোগ্যলাভ দূরের কথা, ব্যাধিতে ভুগে মৃত্যুকেই এরা অবধারিত জেনে কিছুদিনের জন্য যদৃচ্ছা জীবন ধারণ করে যাচ্ছে। এদের কোনও আশা নেই, অতএব, কোনও বিশ্বাসও নেই। অথচ এরা অবিশ্বাসী ছিল না। তা হলে এখানে আসত না।

শাম্ব সহসা দেখলেন, তাঁর চারপাশে ছায়ার মতো সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। একজন চিৎকার করে বলল, ‘ওহে, তুমি যে একেবারে মুনি-ঋষিদের মতন দেবতায় পাওয়া লোক হয়ে গেলে! জিজ্ঞেস করছি, কোথা থেকে আসছ?’

শাম্ব সংবিৎ ফিরে পেয়ে, সকলের দিকে তাকালেন। দেখলেন সেই শিশুবুকে যুবতী কুষ্ঠ রোগিণীটি তাঁর গায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি জবাব দিলেন, ‘কোথা থেকে এসেছি, সে-কথায় আর কী কাজ? অতীতকে ভুলে যাওয়াই শ্রেয় নয় কি?’

অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘ঠিক ঠিক! কিন্তু তোমার কথাবার্তার ধরন-ধারণগুলো বড্ড জ্ঞানীগুণীদের মতন লাগছে। বলি, তোমার কি ক্ষুধা তেষ্টা বলে কিছু আছে? থাকলে আমরা দিতে পারি।’

শাম্ব প্রকৃতই ক্ষুধার্ত ছিলেন। সেই ভোরে, নদীতীরের নরম মৃত্তিকার জঙ্গল থেকে, কয়েকটি মূল তুলে জলে ধুয়ে চিবিয়েছিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি ক্ষুধার্ত। তোমাদের সকলের সংকুলান হলে, আমাকেও কিছু খেতে দাও।’

শাম্ব এই কথা বলামাত্র, তাঁর পার্শ্ববর্তিনী সেই রমণী তার শিশুটিকে তাঁর বুকের উপর প্রায় নিক্ষেপ করে বলল, ‘তা হলে তুমি আমার ছেলেকে ধরো, আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।’

সকলেই সমর্থন করে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নীলাক্ষিই আমাদের নতুন সঙ্গীকে খেতে দিক।’

শাম্ব মনে মনে উচ্চারণ করলেন, ‘নীলাক্ষি!’ নাম শুনে বোঝাই যায় না, এই রমণীও একদা নীলাক্ষি ছিল। অবিশ্যি, কাকেই বা বোঝা যায়? এ চিন্তা বাতুলতা। কিন্তু শিশুটিকে নিয়ে তিনি অস্বস্তিতে পড়লেন। নতুন মানুষের কোলে সে কিছুতেই থাকতে চাইছে না, চিৎকার কান্না জুড়ে হাত-পা ছুড়তে আরম্ভ করেছে। তিনি অসহায় চোখে, উদ্ধারের প্রত্যাশায় আশেপাশের সকলের দিকে তাকালেন। কিন্তু বৃথা। তাঁর প্রত্যাশা পূর্ণ করার জন্য উপস্থিত পুরুষ বা রমণীগণের মধ্যে কেউ এগিয়ে এল না, হাত বাড়িয়ে দিল না। বরং তাঁকে শিশুটি নিয়ে বিব্রত ও উদ্‌ব্যস্ত হতে দেখে, সকলেই যেন বিশেষ কৌতুক বোধ করে নিজেদের মধ্যে হাস্যপরিহাস করতে লাগল। কেউ কেউ বলল, ‘নীলাক্ষির ছেলে নতুন বাপকে এখনও চিনতে পারছে না। ওহে ছেলের বাপ, ছেলেকে একটু আদর করছ না কেন?’

কেউ বলল, ‘তোমার ঘরে কি বউ ছিল না? তোমার কি ছেলেমেয়ে ছিল না? তুমি কি গৃহস্থ ছিলে না? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি যেন মোটেই ঘরকন্না করা জানো না। কেন হে, তুমি কি রাজ-রাজড়ার ছেলে নাকি?’

শাম্ব মনে মনে বললেন, ‘আমার একটাই মাত্র পরিচয়, আমি অভিশপ্ত।’ তিনি শিশুটির অবস্থা সম্যক উপলব্ধি করলেন, তাঁর মনে করুণা ও স্নেহের উদ্রেক হল। শিশুটিকে নানা ক্রীড়া কৌতুকের ভঙ্গি করে, শান্ত করতে চেষ্টা করলেন। বুকে চেপে, শূন্যে দুলিয়ে তাকে খুশি করবার বিবিধ কৌশল অবলম্বন করলেন। শিশুটি এখনও আশ্চর্য উজ্জ্বল, স্বাস্থ্যবান এবং নিষ্পাপ। সে শাম্বর আচরণে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হল। কান্না থামল। জন্মাবধি সে কুষ্ঠরোগগ্রস্তদের দেখে অভ্যস্ত, অতএব শাম্বর মুখের প্রতি কৌতূহলবশে তাকিয়ে সে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল না। রোগাক্রান্ত কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে সে স্নেহ ও সোহাগ সন্ধান করে নিতে পারে। শিশুটির চোখের বর্ণ নীল। নীল আকাশ প্রতিবিম্বিত চন্দ্রভাগার রৌদ্রচকিত জলের ন্যায় উজ্জ্বল। নীলাক্ষির চোখ দুটিও কি একদা এইরকম ছিল?

শাম্ব দেখলেন, তাঁর চারপাশে পুরুষ ও রমণীদের মধ্যে কিছু বালক-বালিকা রয়েছে, যারা ইতিমধ্যেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরা সকলেই সুস্থ দেহে জন্মগ্রহণ করেছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ব্যাধি এদের আক্রমণ করেছে। এরাও কি অভিশপ্ত? অন্যথায়, কী অপরাধ এইসব বালক-বালিকাদের, যাদের অসহায় চোখে মুখে হতাশা ও অবিশ্বাস? এদের যদি কোনও অপরাধ থেকে থাকে, তার একমাত্র কারণ, তারা এইসব পুরুষ ও রমণীদের ঔরস ও গর্ভজাত সন্তান। এ কি কোনও পূর্ব জন্মের পাপের ফল? অমোঘ ভবিতব্য?

শাম্ব নিজেও ব্যাধিগ্রস্ত, কিন্তু পিতার দ্বারা অভিশপ্ত। অমোঘ তাঁর পরিণতি। তাঁর অন্তর কাতর হল, ব্যথায় দ্রবীভূত হল, এইসব রমণী-পুরুষ বালক-বালিকা আর শিশুদের দেখে। এদের মুক্তির কি কোনও উপায় নেই? তাঁর নিজের মুক্তিরই বা কী উপায়? মহর্ষি নারদোক্ত বৃত্তান্ত তো কখনও মিথ্যা হবার না। তিনি কি প্রকৃতই মহর্ষি কথিত সেই সূর্যক্ষেত্র মিত্রবনেই এসেছেন? অথচ এই স্থান, এইসব হতমান অবিশ্বাসী ব্যাধিগ্রস্তদের দেখে তা মনে হয় না।

শিশুটি আবার হাত-পা ছুড়ে কান্নাকাটি শুরু করল। সৌভাগ্য; নীলাক্ষি নাম্নী রমণীটি খাদ্য নিয়ে এল। শাম্বর সামনে খাদ্যের মৃত্তিকাপাত্র রেখে, ছেলেটিকে নিজের কোলে নিয়ে বলল, ‘বসো, খাও।’

শিশুটি মায়ের কোল পেয়ে যেন ইন্দ্রজালের দ্বারা বশীভূত ও শান্ত হল। শাম্ব পার্শ্ববর্তী একজন পুরুষকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হাত ধোয়া আর কুলকুচার জন্য জল পাওয়া যাবে?’

লোকটি হইহই করে উঠল, ‘দ্যাখো দ্যাখো, এ নিজেই বলছিল, অতীতের কথায় কাজ কী? কিন্তু এ নিজেই এখনও আগের জীবনের কথা ভুলতে পারেনি। খাবার আগে হাত ধুতে চায়, মুখ ধুতে চায়।’

আর একজন বলল, ‘আমরা তো এখন হাতে কোনও সাড়ই পাই না। জল দিয়ে ধুলেও টের পাই না, আগুনে পোড়ালেও টের পাই না। ভিক্ষের অন্ন ফুটিয়ে খাব, তার আবার হাত ধোয়াধুয়ি কীসের?’

অন্য আর একজন বলল, ‘এর কথাবার্তা ভাবভঙ্গি সবই যেন আমাদের থেকে আলাদা।’

এক কুষ্ঠরোগগ্রস্ত বৃদ্ধ গলিত দন্ত, রক্তাভ হাঁ-মুখে হাস্য করে বলল, ‘কিছুদিন যেতে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবে ও আমাদের মতোই হয়ে গেছে।’

এই সময়ে সদ্য রোগাক্রান্ত একটি বালিকা, জলপূর্ণ একটি মৃত্তিকার পাত্র শাম্বর খাদ্যের পাত্রের সামনে এনে রাখল। শাম্ব কৃতজ্ঞ চোখে বালিকাটিকে দেখে, মৃদু হাসলেন। জলের পাত্র নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খাদ্যের পাত্রের সামনে বসলেন। সকলকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমি একলাই খাব? তোমরা?’

নীলাক্ষি বলল, ‘আমরা ভিক্ষা শেষে ফিরে এসেই, ফুটিয়ে নিয়ে খেয়েছি। ওই দেখছ না, এখনও রান্নার আগুন জ্বলছে।’

একজন পুরুষ বলল, ‘আমরা সারাদিন দূরদূরান্তরে ভিক্ষে করি, ফিরে এসেই আগে পেটের জ্বালা মেটাই। যা তণ্ডুল থাকে, কিছু খাই, বাকিটা কাল সকালের জন্য রেখে দিই। সকালে খেয়েই আবার বেরিয়ে পড়ি।’

শাম্ব নীলাক্ষির দিকে ফিরে বললেন, ‘এই খাদ্য তুমি আগামী সকালের জন্য রেখে দিয়েছিলে? রাত পোহালে তুমি কী খাবে?’

নীলাক্ষি তার রক্তিম ক্ষতযুক্ত স্ফীত অধরোষ্ঠ বিস্ফারিত করে হেসে বলল, ‘ওহে প্রাণ, তোমাকে যা দিয়েছি, তা খাও। আমার এখনও কিছু রাখা আছে, সকালে তাই খাব। তোমার খিদে না মিটলে যেটুকু রেখে দিয়েছি, তাও তোমাকে দিয়ে দেব।’

একজন রমণী বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি খাও। নীলাক্ষি তোমাকে পেয়ে খুশি, তোমাকে খাইয়ে ও আরও খুশি। তুমি তোমার দানটা রাত্রে ভাল করে দিয়ো, নীলাক্ষিকে সুখী কোরো।’

সবাই হইহই করে উঠল। আগুনের শিখার আলোয়, তাদের সবাইকেই অতি ভয়ংকর প্রেতমূর্তির ন্যায় দেখাল। নীলাক্ষি খিলখিল করে হেসে, শাম্বর হাঁটুতে একটা চাপড় মারল, এবং তার পৃচ্ছহীন রক্তাভ চোখে অতিপ্রার্থিনীর উল্লাসে ইশারা করল। শাম্ব যেন অন্তরে শিহরিত হলেন। এই শিহরনে কোনও সুখ বা কামোচ্ছ্বাস নেই। এই শিহরন তাঁর কাছে পূর্ব জীবনের স্মৃতিযুক্ত, অথচ ভয়জাত। তিনি অভিশপ্ত, কারণ তিনি রমণীমোহন ছিলেন। সেই অভিশাপের ফল তিনি বহন করছেন। গৃহ থেকে বিদায়ের পূর্বে, লক্ষণার অতি কাতর প্রার্থনায়, পত্নীর ধর্মরক্ষার্থে, তিনি জীবনের শেষবারের জন্য রমণ করেছেন, অথচ তা কামোদ্দৃপ্ত ভোগের উচ্ছ্বাসে তৃপ্ত হবার জন্য না। এখানে নীলাক্ষির আশাও তিনি পূরণ করতে পারবেন না।

শাম্বর মনে স্বতঃই একটি বিরোধ সৃষ্টি হল। যার সারা দিনের আহরিত অন্ন তিনি গ্রহণ করবেন, সে একটি বিশেষ প্রত্যাশায় তা পরিবেশন করছে। অথচ তার প্রত্যাশা পূর্ণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। অতএব খাদ্যপাত্র স্পর্শ না করে তিনি নীলাক্ষিকে বললেন, ‘আমি তোমার প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারব না, তোমার সঙ্গে সহবাস আমার দ্বারা সম্ভব না। কিন্তু আমি ক্ষুধার্ত, আমি কি তবু এই অন্ন খেতে পারি?’

নীলাক্ষি হেসে উঠল এবং শাম্বর কথা যারা শুনতে পেল, সবাই হইহই করে হেসে উঠল।

একজন বলল, ‘ওহ নয়া মানুষ, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের নীলাক্ষি ও-বিষয়ে অনেক তুকতাক জানে। যা করবার সে-ই করে নেবে।’

সবাই উল্লাসে হেসে উঠল। নীলাক্ষিও তাদের মতো হেসে শাম্বকে বলল, ‘আমি বলছি তোমাকে, এখন পেটের খিদে তো মেটাও। অন্য খিদের কী হয়, তা পরে দেখা যাবে।’

নীলাক্ষির কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত সকলেই বুঝতে পারল, এবং সবাই একসঙ্গে নীলাক্ষিকে সমর্থন করল। শাম্ব দেখলেন, বালক-বালিকারাও বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা শুনে, নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। তাদের চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখলেই বোঝা যায়, বয়স্কদের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাদের ক্রীড়া কৌশলের কোনও কিছুই তাদের অজ্ঞাত না। যখন মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যায় তখন তার জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। থাকে কেবল শিশ্নোদরপরায়ণতা। এদের দেখে, শাম্ব তাঁর জীবনে এই অভিজ্ঞতাই অর্জন করলেন। কিন্তু মুক্তির কী উপায়? ব্যাধি থেকে আরোগ্যই মুক্তি। মুক্তিই দেয় নতুন জীবনের সন্ধান।

শাম্ব এইসব হতমান অবিশ্বাসীদের সামনে বসেও, অন্তরের অটুট বিশ্বাসকে অনুভব করলেন। তিনি যদি ভুল স্থানে এসে থাকেন, তবে আবার মহর্ষি নারদের সন্ধানে যাবেন। এই কল্প গ্রহণ করে তিনি নীলাক্ষির দেওয়া খাদ্য খেলেন। বিভিন্ন প্রকারের তণ্ডুলের সহযোগে, নানা শাক ও মূল সিদ্ধ করা খাদ্য। শাম্ব অতি উপাদেয় জ্ঞানে এই খাদ্য খেলেন। জলপান করে তৃপ্ত হলেন। তারপরে, তাঁর চারপাশে যারা উপবিষ্ট ছিল, তাদের উদ্দেশ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা বললে এখানে একটি মন্দির আছে, সেই মন্দিরের মধ্যে এক বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছেন।’

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে আছে। আমরা রোজ তাকে গড় করি।’

শাম্ব হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বললেন, ‘মন্দিরে বিগ্রহ থাকলেই তাঁর নিত্য পূজাদি হয়। এই মন্দিরের বিগ্রহের পূজার কী ব্যবস্থা আছে?

সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, যার ফলে শাম্ব কোনও কথাই উদ্ধার করতে পারলেন না। তিনি সবাইকে নিরস্ত করে একজন বৃদ্ধকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তুমি বলো, তোমার কাছ থেকে শুনি।’

বৃদ্ধের অঙ্গ এখন গলিত-প্রায়। নাসিকার হাড় সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত, দুইটি ছিদ্র ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে সানুনাসিক স্বরে বলল, ‘আমি ওই মন্দিরে কখনও পূজা হতে দেখিনি। তবে মন্দিরের পুবদিকে একজন মুনিপুরুষের আশ্রম আছে। সে কখনও মন্দিরের বিগ্রহের পূজা করে না।’

‘কিন্তু আমাদের বেহ্মচয্যি পালন করতে বলে।’ একজন ব্যঙ্গের স্বরে বলে উঠল।

আর একজন বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই মুনি ব্যাটা আমাদের উপোস করতে বলে। বেহ্মচারি হতে বলে। রোজ ভোরবেলা চান করে, সূর্যের দিকে মুখ করে বসে থাকতে বলে।’

‘সে আরও অনেক কিছু বলে।’ আর একজন বলে উঠল। ‘তার কথার মাথামুন্ডু আমরা কিছুই বুঝি না। আমরা জানতাম এখানে এসে চন্দ্রভাগায় নাইলেই আমরা ভাল হয়ে যাব। কিন্তু সবই ফক্কিকারি। আমরা যদি তপস্যাই করব, তবে ভিক্ষে করব কখন? আমাদের খেতে দেবে কে? মুনিটা বলে, তোমরা এই নদীর ধারে চাষ আবাদ করো। আমরা কি এখানে ঘর-সংসার করতে এসেছি? আমরা সবাই একদিন পচে-গলে মরে যাব। রোজই একটু একটু করে আমাদের হাত-পা খসে যাচ্ছে।’

লোকটির কথা শুনে কেউ কেউ আর্তনাদ করে উঠল। আহত পশুর ন্যায় সেই আর্তনাদে, নদীকূলের বিস্তৃত অন্ধকার ভূমি, ঝোপঝাড়, গাছপালা, এখনও অবশিষ্ট কয়েকটি আগুনের শিখায় যেন এক ভয়ংকর নরক সদৃশ হয়ে উঠল। অচিরাৎ মৃত্যুভয়েই যেন কেউ কেউ নিজেদের আলিঙ্গন করে ক্রন্দন করতে লাগল। অন্যদিকে অন্ধকারে চলে গেল কেউ। শাম্ব গম্ভীর আর চিন্তিত হয়ে পূর্বদিকে তাকালেন। কে মুনি ঋষি এখানে আশ্রম করে আছেন? অথচ তিনি মন্দিরের বিগ্রহের কোনও পূজা করেন না। কিন্তু এদের নানা প্রকার উপদেশ দান করেন? এদের কথাবার্তা থেকে সম্যক কিছুই বোঝার উপায় নেই। শাম্বর কাছে এ স্থান অপরিচিত। এই রাত্রের অন্ধকারে এখন মন্দির প্রাঙ্গণে বা মুনির আশ্রমে যাওয়া উচিত হবে না। যদিও সেই স্থানে যাবার জন্য তিনি ব্যাকুলতা বোধ করছেন, কাল এবং স্থান চিন্তা করে চিত্তকে দমন করলেন।

শাম্ব দেখলেন, প্রায় সকলেই যে যার মৃত্তিকা গহ্বরে বা পাতা ঝোপের কুটিরে গমন করেছে। দু’-একজন রমণী পুরুষ বালক-বালিকা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বসে আছে। প্রায়-নিভন্ত দু’-একটি ক্ষীণ আগুনের শিখা এখনও জ্বলছে। নীলাক্ষি এখনও ঘুমন্ত শিশু কোলে নিয়ে তাঁর পাশে বসে রয়েছে। শাম্ব স্মরণ করতে পারেন না, কতক্ষণ পূর্বে শৃগাল প্রহর ঘোষণা করেছে। কিন্তু করেছে, তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। এখন মাঝে মাঝে মাথার ওপর দিয়ে কালো পাখা বিস্তার করে রাত্রিচর পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। নদীর কলকল শব্দের মধ্যেও পাখিদের পক্ষ সঞ্চালনের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। সন্ধ্যাতারা পূর্ব দিগন্ত থেকে অনেকখানি উঠে এসেছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল ও বিভিন্ন নক্ষত্ররাশি, কৃষ্ণ আকাশে অতি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

শাম্ব নীলাক্ষির দিকে তাকালেন? নীলাক্ষি তার পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখে শাম্বর দিকেই তাকিয়ে ছিল। সহবাস কামনার অতি ব্যাকুলতা তার চোখে নেই, কিন্তু গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সে বসে আছে। শাম্ব কোমল স্বরে বললেন, ‘সকলেই যে যার আশ্রয়ে চলে গেছে। তুমিও তোমার ছেলেটিকে নিয়ে ঘুমোতে যাও।’

নীলাক্ষি আশাহত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আর তুমি? তুমি কী করবে? কোথায় থাকবে?’

শাম্ব বললেন, ‘আমি যেখানে আছি, সেখানেই রাত্রিটা কাটিয়ে দেব।’

নীলাক্ষির পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলল, ‘কী করে তুমি সারা রাত বাইরে থাকবে? এখনই নেকড়েরা ছুটে আসবে। তারা কুষ্ঠ রোগীদের রেহাই দেয় না। আমাদের মাটির গর্তের ঝাঁপে আর পাতার ঘরেও তারা হামলা করে, নখ দিয়ে আঁচড়ায়। তুমি বাইরে থাকলে, ওরা তোমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।’

শাম্ব মুহূর্তেই ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমি এখনই অগ্নিকুণ্ডের আগুন উসকে তুলব, আগুনের পাশে বসে থাকব। নেকড়ের দল এলে আমি আগুন নিয়ে তাদের তাড়া করব।’

নীলাক্ষি শাম্বর কথা বুঝতে পারল, তিনি যা বলছেন, তা করবেন। সে বলল, ‘কিন্তু আমি তোমার আশায় বসে আছি। আমি একলা থাকতে পারি না। একজন পুরুষ না থাকলে আমার সবই ফাঁকা লাগে।’

শাম্বর কাছে এই সরল স্বীকারোক্তি মর্মন্তুদ বোধ হল। তিনি কৌতুহলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে-পুরুষ দু’দিন আগেও তোমার সঙ্গে থাকত, তার জন্য তোমার শোক-দুঃখ কিছু নেই? তাকে কি তুমি ভুলে গিয়েছ?’

নীলাক্ষি মাথা নেড়ে বলল, ‘কেন ভুলে যাব? তাকে আমার ভালই মনে আছে। আমি তার জন্য অনেক কেঁদেছি। কিন্তু আমাদের জীবনে ওসব শোক-দুঃখের কী দাম আছে? তুমি শুনলে না, আমরা রোজই একটু একটু করে পচে-গলে মরে যাচ্ছি? তোমার মতন নতুন যারা আসে তারা সবাই কয়েকদিন এইরকমই ভাবে। আলাদা আলাদা দূরে সরে থাকতে চায়। তারপরে যখন বুঝতে পারে, ওতে কোনও লাভ নেই, তখন সকলের সঙ্গে মিশে যায়। তুমিও যাবে। তবে মিছে কেন দেরি করছ? আমাদের ঘর সমাজ বলে এখন কিছুই নেই। মরতে মরতেও আমরা আমাদের নিয়েই থাকব। আমাদের এখন কোনও পাপও নেই পুণ্যও নেই। পুড়ে-যাওয়া-পাখা মৌমাছি যেমন ফুলের গায়ে লেগে থেকে মরে যায়, আমরা সেইভাবেই মরতে চাই। যেটুকু সুখ মেটে তাই মিটিয়ে নিই। তুমি আমার সঙ্গে চলো। তোমাকে আমি সুখী করব।’

শাম্ব অনুভব করলেন, নীলাক্ষির প্রতিটি কথাই অতি নিষ্ঠুর বাস্তব। ব্যাধি ও নিশ্চিত বীভৎস মৃত্যু আশাহীন জীবনের কথা। কিন্তু তিনি বিচলিত নন, এখনও মুক্তির অভিলাষী। তিনি কোনও যুক্তি দেখালো না, বললেন, ‘নীলাক্ষি, আমি তোমার কথা বুঝেছি। তুমি আমাকে মার্জনা করো, আমাকে ত্যাগ করে তুমি তোমার শিশুটিকে নিয়ে আশ্রয়ে যাও।’

নীলাক্ষি তথাপি বলল, ‘আমার যদি রোগ না হত, আমি যদি সমাজ সংসারে থাকতাম, তুমিও যদি সুস্থ থাকতে, তবে কখনওই আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারতে না। তোমার কথা থেকেই বোঝা যায়, তুমি রাজরাজড়া ঋষিদের মতো সবই জানো। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারো না, আমার এই যে শরীরটা, এর বাইরে কোনও সাড়ই এখন আর নেই। তুমি যদি আমার বুকেও হাত দাও, আমি টের পাব না। এখন শুধু শরীরের ভেতরেই সাড় আছে। যেমন জিভ দিয়ে এখনও খাবারের স্বাদ পাই। হয়তো মরার আগে পর্যন্ত এই সাড়ই থাকবে। এই সুখটুকু তুমি কেন আমাকে দেবে না?’

শাম্ব বুঝলেন, নীলাক্ষির এইসব উক্তি অধিকতর বাস্তব ও মর্মন্তুদ। সে কোনও কথাই প্রচ্ছন্ন রাখেনি। কিন্তু কী করে বললেন, তিনি পিতার দ্বারা অভিশাপগ্রস্ত। শাপমোচনের জন্যই তিনি গৃহত্যাগ করেছেন। তাঁর জীবনে সে-ই ধ্রুব ও মোক্ষ। তিনি করজোড়ে বললেন, ‘নীলাক্ষি, আমাকে ক্ষমা করো। তোমাকে সামান্য সুখী করতে পারলেও আমি সুখী হতাম। আমাকে অক্ষম জ্ঞানে তুমি ক্ষমা করো।’

নীলাক্ষির পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখ হতাশায় ও ক্ষোভে জ্বলে উঠল। তার ভগ্ন নাসা, ক্ষয়-ক্ষত ঠোঁট, স্ফীত পাংশু মুখ শক্ত হল। শিশু কোলে সে উঠে দাঁড়াল, ‘তুমি অক্ষমই থাকো। তোমাকে ধিক! আমি যখন সুস্থ ছিলাম, তখন ঋষি পুরুষরাও আমার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হত। এখানে এখন যত পুরুষ আছে, আমি যাকে ডাকব, সে-ই আমার কাছে ছুটে আসবে। এর পরে তুমি আমাকে চাইলেও আর পাবে না।’ এই বলে সে ঝোপঝাড়ের অন্তরালে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

শাম্ব নতমুখে বসে রইলেন। তিনি জানেন, নীলাক্ষির অভিশাপ তাঁকে স্পর্শ করবে না, কারণ তিনি অভিশপ্ত হয়ে এখন এক কল্প গ্রহণ করেছেন। কিন্তু নীলাক্ষির জন্য তাঁর অন্তর দুঃখে দ্রবীভূত হল। কিছুক্ষণ এইভাবে অধোবদনে বসে থাকবার পরেই তিনি ঘ্রাণে হিংস্র পশুর উপস্থিতি টের পেয়ে চকিত হলেন। দেখলেন, এখন আর কেউ বাইরে নেই। তিনি একলা। দূরে অন্ধকারে তাকিয়ে শ্বাপদের প্রজ্বলিত চক্ষু দেখতে পেলেন। তৎক্ষণাৎ উঠে, অগ্নিকুণ্ডের কাছে গিয়ে, খুঁচিয়ে আগুনের শিখা উসকিয়ে তুললেন। জ্বলন্ত একটি কাঠের টুকরো নিয়ে তিনি চারপাশে তাকালেন। অগ্নিশিখার প্রভায় জ্বলন্ত শ্বাপদ চক্ষুগুলো দূরান্তরে আত্মগোপন করেছে। কিন্তু তারা প্রত্যাশায় আশেপাশেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। শাম্ব আশপাশ থেকে কাঠের টুকরো নিয়ে, অগ্নিকুণ্ড বিস্তৃত করলেন। জ্বলন্ত কাঠ ছড়িয়ে, নিজের চারপাশে ব্যুহের সৃষ্টি করলেন, এবং নিশ্চিন্ত হয়ে উপবেশন করলেন। এখন শুধু নক্ষত্ররাজি অতি ধীরে আকাশের কক্ষপথে গমন করছে। নদীস্রোতে নক্ষত্রেরই রেখা মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে, আর কলকল ধ্বনি ভেসে আসছে।

শাম্ব নদীর দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন।

অতি প্রত্যুষে, অন্ধকার বিদায় নেবার আগে, যখন গাছে পাখির প্রথম স্খলিত জিজ্ঞাসু ডাক শোনা গেল, শাম্ব তখন চন্দ্রভাগার বেগবতী শীতল স্রোতে অবগাহন করলেন। জলের ধারা যেন তাঁর দেহের গভীরে প্রবেশ করে, অন্তর-স্থল পর্যন্ত ধৌত করে দিল। তাঁর মন ও প্রাণ যেন গভীর এক আনন্দানুভূতিতে ভরে উঠল। স্নানের শেষে তাঁর একমাত্র সম্বল দ্বিতীয় বস্ত্রখণ্ডখানি দেহে জড়িয়ে, ভেজা বস্ত্র নিংড়ে, গা মাথা মুছলেন।

আকাশের পুব দিগন্ত ক্রমে রক্তিম হয়ে উঠছে। শাম্ব দেখলেন, পাতার কুটিরে বা মৃত্তিকা গহ্বরের কেউ এখনও জাগেনি। তিনি এদের সঙ্গে এখন আর দেখা করতে চাইলেন না। বরং তারা জেগে ওঠে, এই আশঙ্কায় তিনি দ্রুত পূর্বদিকে গমন করলেন।

অনতিঘন অরণ্যানী ও বনস্পতির ফাঁকে ফাঁকে একটি মন্দিরের আকৃতি দেখা গেলেও, তার দূরত্ব যে কিছু কম, তা মনে হল না। সেই মন্দিরের কিঞ্চিৎ দর্শনে, শাম্ব তাঁর হৃদয়ে একরকমের ব্যাকুলতা বোধ করলেন, এবং যথাসম্ভব দ্রুত অগ্রসর হলেন। ক্রমেই পাখিদের স্খলিত স্বর স্পষ্ট ও সরব হয়ে উঠতে লাগল। দেখলেন, যে অঞ্চলকে নিতান্ত অরণ্যানী মনে করেছিলেন, তা নানা ফুলে ফলে সুশোভিত এক সুবিশাল রমণীয় কানন। তাঁর মনে হল জীবনের বাকি দিনগুলো এমন রমণীয় কাননে কাটিয়ে যেতে পারলেও, তাঁর অভিশপ্ত প্রাণ অনেক শান্তিতে মৃত্যুকে বরণ করতে পারবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *