২. মন চলো যাই ভ্রমণে

এবার মন চলো যাই ভ্রমণে, বাসুদেবের অঙ্গনে। ঠিকানা কী? দ্বারকানগরী। ইতিবৃত্তে বাসুদেব একজন থাকারই কথা। যিনি যেখানেই গমন করতেন, গমনের আগে তাঁর রীতি ছিল, শঙ্খ নিনাদের দ্বারা জ্ঞাতি বান্ধব আর নগরবাসীদের জানানো। যদুবংশের কয়েক শরিকের মধ্যে যিনি বৃষ্ণি গোষ্ঠীর নেতা বার্ষ্ণেয় সেই বাসুদেব তাঁর যাত্রার ঘোষণা এভাবেই করতেন। তার আগেই তাঁর রথের যিনি সারথি, তিনি দুর্মদ অরি নিধনকারী কৃষ্ণের আয়ুধাগার থেকে, রথে তুলে রাখতেন তাঁর ব্যবহারের বিশেষ অস্ত্র গদা শার্ঙ্গ এবং চক্র।

বংশপরম্পরার তালিকা, সে ভারী জটিল জালের বিষয়। তবু একটা ধরতাই থাকা ভাল। যে-পথে ভ্রমণ করছি, এ-যাত্রায় এ-সবের কিছু কিঞ্চিৎ দরকার। যদুকে পেলে, যদুবংশের একটা হিল্লে হয়। মন খোলসা করে, ব্যক্তিকে নির্ণয় করা যায়। অতএব এবারে খোঁজ করি, যদু কে? যাত্রা পথের ধুলা উড়িয়ে দেখছি, যযাতি শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর গর্ভে যদু আর তুর্বসুর জন্ম দিয়েছিলেন। শর্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রস্থ্য; অনু আর পুরুকে। এঁদের নিয়ে আপাতত আমার দরকার নেই। দেখছি, ইতিবৃত্তের ধূলার নীচে লেখা রয়েছে, যযাতির জ্যেষ্ঠ পুত্র যদু। তারপরের জটিল। বংশমালা দেখে আমার মাথা ভিরমি যাচ্ছে। যাত্রার আগে যদুকে নিয়েই দু’-এক কথায় বংশপরিচয় সাঙ্গ করি।

দেখছি, এই যদুরই বংশধরেরা কালে কালে সাত্বত, বৃষ্ণি যাঁদের বলে, অন্ধক, ভোজ নানা শাখায় ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। একে বোধহয় শরিকানার ভাগাভাগিও বলা যায়। এঁরা নিজেদের মধ্যে বিস্তর ঝগড়া বিবাদ করেছেন। সে-কথা আপাতত যাক। বরং তার চেয়ে বলা ভাল বিভিন্ন শাখার এই যদুবংশ দীর্ঘকাল নিজেদের মধ্যে সম্ভাব বজায় রেখে চলতে পেরেছিলেন। নিশ্চয়ই আমাদের কালের প্রবাদ কাহিনীর সেইরকম জ্ঞানী বৃদ্ধরা যদুবংশে ছিলেন যাঁরা উপদেশ দিয়েছিলেন, এক গাছি কঞ্চিকে অনায়াসে একজন ভাঙতে পারে; একগুচ্ছ কঞ্চিকে পারে না। অতএব ওহে যদুগণ এককাট্টা হয়ে থাকো। এ ক্ষেত্রে বয়সে বৃদ্ধ না হয়েও যদুবংশের রাজসিংহাসনে আরোহণ না করেও যিনি সমগ্র গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ সংহত করে রাখতে পেরেছিলেন, তৎকালের লোকেরা তাঁকে বিশেষণ দিয়েছিলেন বৃষ্ণিসিংহ। যিনি আমাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ নামে পরিচিত।

নাম তাঁর বহুতর। ছেলেবেলায় আসন্ন ভোরের বিছানায় শুয়ে মায়ের মুখেই তাঁর শতাধিক নাম উচ্চারিত হতে শুনেছি। ইনি অগাধ কীর্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। পুরনো ঐতিহ্যের কথা কে ভোলে? আমরা ভুলি না। আমি ভুলি না। ইলাবৃতবর্ষে দেবতা জাতির যে-সব কীর্তিশালী ব্যক্তিরা বীর যোদ্ধা মেধাবী শ্রেষ্ঠ ছিলেন তাঁদের যেমন দিবি আরোহণ ঘটত, রূপান্তরিত হতেন ভগবানে, কৃষ্ণেরও সেই দিবি আরোহণ ঘটেছিল। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

কিন্তু তাঁর এই অগাধ কীর্তির একটা পশ্চদপট ছিল। সাত্বতদের— অর্থাৎ বৃষ্ণিকুল সম্পর্কে ইতিবৃত্ত দেখছি অতি মুখর। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন কীর্তন করছেন, সাত্বতগণকে কেউ পরাজিত করতে সমর্থ না। বৃষ্ণি বংশীয়রা যুদ্ধে লব্ধলক্ষ্য হয়ে অসাধারণ যুদ্ধকৌশল প্রদর্শন করেন।… এঁদের তুল্য বলবান ব্যক্তি দৃষ্টিগোচর হয় না। এঁরা জ্ঞাতিদের অবজ্ঞা করেন না, বৃদ্ধগণের আজ্ঞা পালন করেন।… সত্যবাদী, ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠানরত মহাত্মা, প্রচুর বিত্তশালী হয়েও অহংকার করেন না।… বিপদের সময়ে সমর্থ ব্যক্তিদেরও উদ্ধার করে থাকেন। এঁরা দেবপরায়ণ, দাতা… এইসব গুণের জন্যই তাঁদের সঙ্গে কেউ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন না।’

কীর্তিমানদের গুণের কথা এখানেই ইতি করা যেত। আর একটু যোগ করলে, একটি বিশেষ সংবাদের সঙ্গে আশ্চর্য একটি চিত্রও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। শূরসেনদের মথুরাবাসী বলা হয়। জ্ঞানী বৃদ্ধরা বলেছেন, ‘এঁরা দীর্ঘদেহী, ক্ষিপ্রকারী আর নৌচালনাপটু। এঁদের সর্বদা যুদ্ধের অগ্রভাগে স্থাপন করবে।’…

আমার চমকটা লাগল ‘নৌচালনাপটু’ শব্দটিতে। নৌচালনা? তা হলে মহেন-জ-দরো-র “অনার্য-কীর্তি” যুক্তিগুলো টেকে কেমন করে? না, আমি এ-সব পণ্ডিতি তর্কে নেই। ওতে বিস্তর ফাঁদ পাতা। কে কোথা দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেবেন, কে জানে। আন্‌ কথায় কী কাজ? কাজের কাজ করো। তবে তোমাদিগের নিকট যাচ্ঞা করি, এই নৌচালনাপটু সংবাদটির কথা মনে রেখো। দ্বারাবতী গমনের সময় সংবাদটির গুরুত্ব বোঝা যাবে।

কিন্তু যে-কথা বলতে গিয়ে এত কথার উৎপত্তি, সে-এক ঝকমারি। কারণ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের অনুমতি দিতে গিয়ে কৃষ্ণের মুখ থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে, বঙ্গ পুণ্ড্র কিরাতদেশের অধিপতি, জরাসন্ধের অনুগত, তার নাম আর আমার নাম এক। কিন্তু সে নিজেকে কেবল বাসুদেব বলেই ক্ষান্ত নেই। যে বিশেষণের দ্বারা তোমরা আমাকে ভূষিত করেছ, সে নিজেকে সেই পুরুষোত্তম বিশেষণে ভূষিত করে থাকে। এমনকী মোহবশত সে আমার চিহ্নসমূহও সর্বদা ধারণ করে থাকে। আসলে ভূমণ্ডলে তার প্রকৃত পরিচয়, মহাবলপরাক্রান্ত পৌণ্ড্রক।

এই বিষয়টিকেই আমি ঝকমারি বলছিলাম। ঘটনাটা ইতিবৃত্তীয় সত্য। এখন দেখছি, কীর্তিমানদের অনুকরণ করার ইচ্ছা আর অভ্যাসটা নিতান্ত একালের না। রুপোলি পরদার অমুক কুমারকে আপাদমস্তক নকল করার মতো স্পৃহা হাজার হাজার বছর আগেও ছিল। রকমফেরটা অবিশ্যিই মানতে হবে। আমাদের কালে, রুপোলি পরদার নায়ক নকলবাজরা নিজেদের সাচ্চা বলে চালাবার চেষ্টা করে না। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সেই রোগটি ছিল, কারণ সে কৃষ্ণের বীরত্ব বুদ্ধি আর কৌশলকে ঈর্ষা করত। অতএব শঙ্খ গদা চক্র তারও থাকতে হবে। কৃষ্ণের মতো মণিকুণ্ডল তারও চাই। উপরন্তু প্রচার করা চাই, সে নিজেই পুরুষোত্তম বাসুদেব।

ঈর্ষা নামক ইন্দ্রিয়টি একবার মস্তিষ্কে বিঁধে গেলে, তখন রক্তক্ষরণের পালা শুরু হয়। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সেই অবস্থা হয়েছিল। কারণ সে ছিল প্রাগজ্যোতিষপুরের অসুররাজ নরকের বন্ধু। কৃষ্ণের অপরাধ, তিনি সেই দর্পী প্রাগজ্যোতিষপুরের অধিপতি নরককে হত্যা করেছিলেন। নরকের লালসালয় থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন ষোলো হাজার রমণীকে। পুরাণকাররা হিসাবটাকে কেউ কেউ ষোলো হাজার একশো বলেছেন। প্রাচীন ইতিবৃত্তে প্রক্ষিপ্ত কিছু থাকাটা আশ্চর্যের না, ইতিপূর্বেই স্বয়ং সূত আমাকে এ-কথা শুনিয়েছেন। তবে ষোলো হাজারের সঙ্গে একশো জোড়া আর না জোড়াটা, যাহা বাহান্ন তাহা তেপান্নর মতোই মনে হয়। তেমন একটা ইতর বিশেষ নেই। কিন্তু নরকের ভোগগুহা থেকে মুক্ত ষোলো হাজার রমণীকে সহসা ব্রজরমণীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না। ওখানে হিসাবের একটু খটোমটো আছে। বৃষ্ণিসিংহ বাসুদেবের সঙ্গে গোপরমণী রাধার কথায় আমি আদৌ নেই। সেই তো আমার কথা, ‘কথা কইতে জানলে হয়, কথা ষোলো ধারায় বয়।’ কৃষ্ণ বলে কথা! বহু ধারায় তাঁর যাতায়াত।

একটা কথা এ সময়েই কবুল করে রাখি। দ্বারাবতী আমার যাত্রা বটে। বাসুদেবেরই সান্নিধ্যে। কিন্তু যে-উদ্দেশ্যে আমার যাত্রা, সেই উদ্দেশ্যের তিনি একটি পার্শ্বচরিত্র মাত্র। কিন্তু তিনিই দ্বারকানগরীর প্রতিষ্ঠাতা স্রষ্টা, তাঁর জীবিতকালের মধ্যে তিনিই প্রধান পুরুষ, সেইজন্য তাঁকে ছেড়ে আমার উদ্দেশ্যকেই প্রতিষ্ঠা করতে পারি না যে। অতএব বাসুদেবায়ঃ শরণং। রাধা অন্য ধারায় আছেন, আমি অন্য ধারায়।

আমি যে-ধারায় চলেছি, সেখানে বাসুদেব শ্রী ও কীর্তিসম্পন্ন অতিমাত্র শত্রু সংহারক, বন্ধুদের ইষ্টাকাঙ্ক্ষী, ঐক্যবদ্ধকারী সংগঠক। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের কথা। শেষ করি। নরককে কৃষ্ণ হত্যা করেছিলেন বলে পৌণ্ড্রক খেপে উঠেছিল। বলতে গেলে, তখন থেকেই যদুবংশের যশস্বী বার্ষ্ণেয়কে নিয়ে তার মোহের সঞ্চার, নামের অনুকরণ, আয়ুধ আর চিহ্নসমূহ ধারণের পাগলামি। অথচ রাজাকে যে-সম্মান দেওয়ার রীতি ছিল, সব ক্ষেত্রেই তা তার প্রাপ্য ছিল। আর সেগুলোকে সে কাজে লাগাত একমাত্র বাসুদেবের বিরুদ্ধাচরণে। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় পাঞ্চালে আসছেন। পৌণ্ড্রকও গেল। ধুলা উড়িয়ে পরতে পরতে লেখা দেখছি, উদ্দেশ্য একমাত্র, কোনওরকমে একটা গোলমাল লাগাতে পারলে কৃষ্ণের সঙ্গে লেগে যাওয়া। কিন্তু দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে দরিদ্র ব্রাহ্মণবেশী তৃতীয় পাণ্ডব, সব ভেস্তে দিয়েছিলেন। মাঝখান থেকে লাভ, হায়! সেই কৃষ্ণের। জীবনে যাঁদের কখনও চোখে দেখেননি, অথচ কানাঘুষা শুনছিলেন, পাণ্ডবেরা জতুগৃহে দগ্ধ হয়ে মারা যাননি, আর মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, যেন কোনওরকমে তাঁদের দেখা পান, সেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটি এসে গেল দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভাতেই। পৌণ্ড্রকের জানা উচিত ছিল ‘গোলেমালে গোলেমালে পিরিত কোরো না।’ অর্থাৎ কার্যসিদ্ধি করতে যেয়ো না। কৃষ্ণ গোলমাল থেকে দূরে ছিলেন, আর তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিই তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধিলাভ করিয়ে দিল।

কিন্তু সে-কথার জালবিস্তার আপাতত না। পৌণ্ড্রক জরাসন্ধের অনুগত হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, উপস্থিত হয়েছিল। ইতিবৃত্তকার ঘটনা লেখেন, সূত বলেন, তুমি তোমার ধারণা মতো ইঙ্গিত ও সংকেতগুলো চিনে নাও। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের প্রধান অন্তরায় কে ছিলেন? জরাসন্ধ। আর এই জরাসন্ধের প্রবল পরাক্রমের ভয়েই তো স্বয়ং কৃষ্ণের মথুরা ছেড়ে পশ্চিম সমুদ্রোপকূলে আশ্রয়ের সন্ধান। অতএব জরাসন্ধের মতো যারা কৃষ্ণ বিদ্বেষী ছিলেন তাঁরাও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে আসতে পারেন একটি মাত্র উদ্দেশ্যেই। কৃষ্ণ বিরোধী প্রচার, কৃষ্ণের নিন্দা, কৃষ্ণকে অবজ্ঞা দেখানো এবং সুযোগ পেলে কৃষ্ণ নিধনেও আপত্তির কোনও কারণ ছিল না।

রাজসূয় যজ্ঞে যাঁরা এসেছিলেন, জরাসন্ধ হত্যাকাহিনী তাঁদের অজানা ছিল না। জরাসন্ধ জীবিত থাকতে, যুধিষ্ঠিরের পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা কি সম্ভব ছিল? কৃষ্ণের অভিমত, কখনওই না। আগে জরাসন্ধ বধ, তারপরে রাজসূয় যজ্ঞ।

কেন কৃষ্ণ এ-পরামর্শ যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন? সূত বলেন, ঋষি লেখেন, তুমি ইঙ্গিত আর সংকেতগুলো চিনে নাও। কেবল শ্রবণ আর পাঠে পুণ্য নেই, পুণ্য অনুভবে। পুণ্য-ভাবনা, আমার কাছে জীবন-জিজ্ঞাসা। মহাবল জরাসন্ধ কৃষ্ণবধে কৃতসংকল্প ছিলেন। এইরূপ প্রচার ছিল, তিনি ছিয়াশিজন রাজাকে কারাগারে বন্দি করেছেন। একশো পূরণের জন্য আর চৌদ্দজন বাকি। যদুবংশে কৃষ্ণ কখনওই রাজসিংহাসনের অধিকারী ছিলেন না। যদুর বংশপরম্পরায় ভোজক শাখার উগ্রসেনই রাজা হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে কংস, তাঁকে বন্দি করে রাজা হয়েছিলেন, আর জরাসন্ধের দুই মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।

না, বরং বলা যায় জরাসন্ধই যদুবংশকে আপন শক্তির সীমায় রাখার জন্য, কংসের সঙ্গে অস্তি আর প্রাপ্তি নামে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বুদ্ধিটা কাজে লেগেছিল। জরাসন্ধের মতো মহাবল শ্বশুর পেয়ে কংসের মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। তিনি পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত করে কারারুদ্ধ করেছিলেন। আর যদুবংশের রথী মহারথীদেরও পীড়ন করে পায়ের তলায় রেখেছিলেন।

উগ্রসেনের ভাই দেবকের মেয়ে দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে হয়েছিল। বসুদেবের ছেলে, বাসুদেব। তাঁর কংসবধের ঘটনায় আমি যাব না। যদিও যাব না যাব না করে দ্বারাবতীর পথের অলিগলি ঘাঁটতে বিস্তর ধুলাবৃত কাহিনী এসে পড়ছে। বলতে চেয়েছিলাম, জরাসন্ধের বাকি চৌদ্দজন শত্রুর মধ্যে, একজন অন্তত রাজা ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুকুটবিহীন সাম্রাজ্যের অধিপতি বৃষ্ণি সিংহ। জরাসন্ধ জামাই হত্যার প্রতিশোধ নেবেন, অতি দুরন্ত শক্তিশালী, দুর্ধষ বুদ্ধিমান কৃষ্ণকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কৃষ্ণ তা জানতেন, অতএব যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ করার ইচ্ছাকে সমর্থন করেছিলেন। কেবল সমর্থনই করেছিলেন? পাণ্ডবদের ক্রমে বলীয়ান হয়ে ওঠার মূলে তার অবদান অনেকখানি। অর্জুন যে-মুহূর্তে পাঞ্চালীকে লাভ করে, ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে কামারশালায় গিয়ে উঠেছিলেন, কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ বলরামকে সঙ্গে করে সেখানে গিয়েছিলেন। প্রথমেই পরিচয় কুন্তীকে— তুমি আমার পিসিমা। যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন আমার পিসতুতো ভাই।

যদুবংশের জ্ঞানী ও বীর, বন্ধু ও কর্মী বাসুদেবের আত্মীয়তাও কম নয়। সেই থেকে শুরু। ক্রমবর্ধমান বলশালী বিত্ত ও ক্ষমতাশালী পাণ্ডবদের অন্তরের ভাষা তিনি পড়তে পেরেছিলেন। সেই কারণেই তিনি মহান। ইতিবৃত্তের প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে আমি দেখছি, লিখিত ভাষার গভীরে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বাসুদেবের মহিমময় ভবিষ্যকীর্তির ইঙ্গিত। মুখ ফুটে না বললেও, যুধিষ্ঠিরের অন্তরে রাজসূয় যজ্ঞের বাসনা তিনিই জাগিয়েছিলেন। অতএব অনুমতি প্রার্থনামাত্রই, যজ্ঞের সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে জরাসন্ধ বধ নিশ্চিত হতে হবে।

দুর্মদ শক্রুনিধনকারী কৃষ্ণ কি আগে থেকেই ভেবে রাখেননি, জরাসন্ধকে মহাসমরের সুবিশাল প্রাঙ্গণে ডেকে নিয়ে এসে নিধন করা, সসাগরা ধরণীর সকলের পক্ষেই অসম্ভব ছিল? ভেবেছিলেন। ইতিবৃত্তের লেখায় তা প্রচ্ছন্নরূপে রয়েছে। কিন্তু জরাসন্ধ বধ কাহিনীতে কী দরকার?

দরকার একটি সংশয়িত জিজ্ঞাসার জন্য। মহাসমরের বদলে, কৃষ্ণ জরাসন্ধকে, ভীমের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছিলেন? না কি তিনি, ভীম এবং অর্জুনসহ নিতান্ত স্নাতকের বেশে, মগধ রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন? এবং তারপরে গুপ্তহত্যা?

না, প্রাচীন ইতিবৃত্তকে আমি এতটা অপরিচ্ছন্ন বিক্ষিপ্ত ভাবতে পারি না। সংশয়টা এই কারণে জাগে, যে-ধুরন্ধর মহাবল জরাসন্ধের ভয়ে স্বয়ং কৃষ্ণকে সকল যদুবংশের প্রধানগণকে নিয়ে মথুরা থেকে সুদূর পশ্চিমের দ্বীপান্তরে চলে যেতে হয়েছিল, তাঁকে হাতের কাছে পেয়েও জরাসন্ধ ছেড়ে দিলেন কেমন করে? স্পষ্টতই তিনি জরাসন্ধের রাজপুরে প্রবেশের জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ভীম অর্জুনকে নিয়ে স্নাতকের ছদ্মবেশে জরাসন্ধপুরীতে প্রবেশ করেছিলেন। কাছে গিয়ে পরিচয় দিয়ে, তিনজনের যে-কোনও একজনের সঙ্গে জরাসন্ধকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন।

দেখছি, দ্বন্দ্বযুদ্ধের রীতিটা প্রাচীন ভারতেও ছিল। সাহেবরাই কেবল দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতেন না। কৃষ্ণের সকল মহানুভবতাকে মেনে নিয়েও এই মুহূর্তে জরাসন্ধকে আমার সত্যবদ্ধ রাজা বলে মনে হচ্ছে। তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধে স্বীকৃত হয়েছিলেন। বীরের যা ধর্ম। ভীমকেই তিনি প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন। অবিশ্যি ভীমই প্রথম এবং শেষ। জরাসন্ধ অর্জুন আর কৃষ্ণের সঙ্গে লড়বার অবকাশ পাননি, নিহত হয়েছিলেন ভীমের হাতেই। কৃষ্ণ কি এ-কথাও জানতেন, জরাসন্ধ ভীমকেই প্রথমে বেছে নেবেন?

তবে হে বাসুদেব, তোমার তুলনা তুমিই! অন্যথায় যে-কোনও ছদ্মবেশেই হোক কোন সাহসে তুমি জরাসন্ধপুরীতে প্রবেশ করেছিলে? যাঁর ভয়ে তুমি সুদূর পশ্চিমে চলে গিয়েছিলে? সবই দেখছি, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা, পাণ্ডবগণের পরিচয় লাভ, তোমার দূরদৃষ্টি, তোমার মাহাত্ম্যকেই বৃদ্ধি করেছিল। শত্রুকে তো নিধন করাই শ্রেয়ঃ!

দ্বারাবতীর পথ ক্রমে দুর্গম হয়ে উঠছে। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের আখ্যানটুকু শেষ করি। সে জানত কৃষ্ণবিদ্বেষী রাজা মহারাজা বলবান ব্যক্তিরাও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে যাবেন। শৃঙ্গ দিয়ে তৈরি ধনুক, যার নাম শার্ঙ্গ সেই শার্ঙ্গপাণি, গদা-চক্রধারী কৃষ্ণই নিশ্চয় যজ্ঞস্থল রক্ষা করবেন। যুধিষ্ঠির পূজা ও পাদ্যঅর্ঘ্যও নিশ্চয় কৃষ্ণকে দেবেন। তখন একটা গোলমালের সম্ভাবনা নিশ্চিত!

আবার সেই গোলেমালে গোলেমালে…। ঘটেছিল সেইরকমই। যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসার জবাবে ভীষ্ম বলেছিলেন, পূজা পাবার ক্ষেত্রে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ। তিনি নিখিল বেদ বেদাঙ্গ পারদর্শী, নিরহংকারী, জ্যোতিষ্ক মধ্যে উজ্জ্বলতম।… অনেকের সঙ্গে সব থেকে বেশি বাদ সাধলেন চেদিরাজ শিশুপাল। তাঁর মতো মহীপতি থাকতে, কৃষ্ণ কেন পূজা পাবেন? তিনি কৃষ্ণের নামে অতিমাত্রায় কুৎসা গীত করলেন, বাসুদেবকে নীচাশয় থেকে শুরু করে, কোনওরকম খারাপ কথা বলতেই বাদ রাখলেন না। যজ্ঞস্থলে গোলমাল লেগে যাবার দাখিল।

কিন্তু যজ্ঞস্থলে কি হত্যার প্রচলন ছিল? ছিল। অন্যথায় কৃষ্ণ তাঁর আয়ুধসকল নিয়ে যজ্ঞস্থলে যেতেন না। শিশুপাল যখন যজ্ঞে এবং কৃষ্ণপূজায় বাধা দিয়ে সব ভেস্তে দেবার তাল করলেন, তখন কৃষ্ণ রুখে রেগে ওঠেননি। বরং উপস্থিত সকলের সামনে শিশুপালের পূর্ব অপরাধের কাহিনীগুলো বলেছিলেন। তার মধ্যে সব থেকে বড় অপরাধ যাদবগণের অশেষ অনিষ্টসাধন। বিচিত্র এই, শিশুপালও ছিলেন সম্পর্কে কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। কৃষ্ণ যখন প্রাগজ্যোতিষপুরে নরককে হনন করতে গিয়েছিলেন শিশুপাল সেই অবকাশে দ্বারকা আক্রমণ করেছিলেন। দ্বারকাপুরী পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

শিশুপালের অপরাধ বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। মৃত্যু তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে এসেছিল। তিনি অন্যান্য মহীপালদের প্ররোচনায় নিজের ক্ষমতার প্রতি অতি বিশ্বাসে, রাগে অহংকারে এতই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, প্রকৃত সংগ্রামের ক্ষমতা তিনি হারিয়েছিলেন। কৃষ্ণ অবিশ্যি বলেছিলেন, শিশুপালের মা তাঁকে তাঁর পুত্রের শত অপরাধ ক্ষমা করতে বলেছিলেন। যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞস্থলে সেই শত অপরাধ অতিক্রান্ত হয়েছিল, অতএব কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে তীক্ষ্ণ চক্র দ্বারা শিশুপালের মস্তকটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কথা হচ্ছিল মেকি বাসুদেবকে নিয়ে। পৌণ্ড্রক বাসুদেব, কৃষ্ণবিদ্বেষী। নামের ফের নিয়েই বিষয়টার সূত্রপাত হয়েছিল। শিশুপাল হত্যা দেখেই সে বুঝে নিয়েছিল, গোলেমালে গোলমাল। কৃষ্ণের ক্ষতি করা গেল না। কিন্তু সে নিজেকে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চায়, পুরুষোত্তম বাসুদেব বলে। কৃষ্ণের চিহ্ন এবং আয়ুধ সেও ধারণ করে বেড়াত।

কৃষ্ণ এ ব্যাপারে রুপোলি পরদার কুমারদের মতোই নির্বিকার ছিলেন। কাকেরা ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করলে কী করা যায়? কিছু করা যায়? পৌণ্ড্রক বাসুদেব নিষাদরাজ একলব্যকে এবং আরও কিছু কৃষ্ণবিদ্বেষীকে নিয়ে দ্বারকার আশেপাশে তক্‌কে তক্‌কে রইল, কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে দ্বারাবতী ধ্বংস করবে। এই নকল বাসুদেব দেখছি সব বিষয়েই নকল করতে চায়। কৃষ্ণ যখন নরককে হত্যা করতে গিয়েছিলেন, শিশুপাল সেই অবসরে দ্বারকা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। নকল বাসুদেবও তাই করেছিল। কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে সে গভীর রাত্রে দ্বারকা আক্রমণ করেছিল। দ্বারকার যাদবেরা সারা রাত্রি লড়াই করেছিলেন। যুদ্ধটা খুব ছোটখাটো হয়নি। কিন্তু কৃষ্ণ এসে পড়েছিলেন রাত পোহাতেই। নকল বাসুদেব এবার আর রেহাই পেল না। সে কৃষ্ণের হাতেই নিহত হয়েছিল। একলব্য পালিয়ে বেঁচেছিল, অবিশ্যি পরে একলব্যও কৃষ্ণের হাতেই নিহত হয়েছিল।

কিন্তু নামের ফেরে মানুষ ফেরে, এও কোথা দেখি নাই। নকল বাসুদেব থাক। এখন আসল বাসুদেবের দ্বারাবতী যাত্রা ত্বরা করো হে। যাত্রা ত্বরা করো। ঠিকানা খোঁজো। ধুলা উড়িয়ে চলো।

চলব, কিন্তু পথ বড় গহন। এ যাত্রা কাঁধে ঝোলা চাপিয়ে ঠেলাঠেলি করে রেল গাড়িতে যাওয়া না। যদিও এ যাত্রায়ও দেখছি বাঁশি বাজে, নিশান ওড়ে, তবে সেটা এই আমলের ভেক পাতলুন পরা গার্ড সাহেবের নিশান বাঁশি কিছু না। এ বাঁশি প্রাণের কোথায় যেন বাজে, সুরে ডাক দিয়ে ঘরের বাহির করে নিয়ে যায়। নিশানাটা চোখের সামনে চিত্রের মতো ভাসে। রৈবতক পর্বতের কৃষ্ণনীল মহীরূহের মাথা ছাড়িয়ে যেন সেই নিশান পতপত করে ওড়ে।

না, রেলগাড়ির ঝুকঝুক শব্দে কিংবা মোটর গাড়িতে এমনকী হাওয়াই জাহাজেও আমার গন্তব্য দ্বারাবতী যাওয়া যাবে না। আমাকে পথ পরিক্রমা করতে হবে স্বয়ম্ভূব মনু কাল থেকে রচিত ইতিবৃত্তের বর্ণনা থেকে। কারণ আগেই সূতের মুখে শুনে এসেছি স্বয়ম্ভূব মনুকালই আদি কালবিন্দু গণ্য করা হয়েছে। বিলেতের ঐতিহাসিকরা যেমন যিশু জন্মের তারিখকে আদি কালবিন্দু ধরে বি সি আর এ ডি-র হিসাব কষেছেন।

আমাদের প্রাচীন ইতিবৃত্তের ব্যাখ্যাকার পণ্ডিতগণ স্বয়ম্ভূব মনুকাল থেকে অনায়াসেই যিশুর জন্মসালকে হিসাবে আনতে পেরেছেন। সন্দেহ আর তর্ক? শ্রম করে করে এসো গিয়ে। দ্বন্দ্বে আহ্বান করতে এলে ক্ষমতা থাকার দরকার। কোনও কোনও সাহেবিয়ানার হিসাব যথার্থ, বাকিরা সব ধুলায় যাবে তা হয় না।

কৃষ্ণের জন্মকাল আমাদের সুবিধাজনক প্রচলিত মানের হিসাবে এক হাজার চারশো আটান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকাল এক হাজার চারশো ষোলো খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই হিসাবে দেখছি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কৃষ্ণের বয়স বিয়াল্লিশ বৎসর। আদি কালবিন্দু থেকে একে একটি যুগকাল বলা হয়েছে। যুগকাল মানেই, এক একটি যুগের সংক্রান্তি। যাওয়া আর আসার মধ্যবর্তী সময়।

এইখানটিতে এসে আমার মনে একটা খটকা লাগছে। আমি যে-সূতগণের ইতিবৃত্তকে অনুসরণ করছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শ্রীমদ্‌ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য মহাশয় আমার অপেক্ষা অনেকগুণ অধিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন, ইতিহাসের বিচারক। তাঁর সূক্ষ্ম বিচারের দ্বারা তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন, এই উনিশশো আটাত্তর খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরলে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল ৫০৭৮ বছর আগে। এ ক্ষেত্রে মনে করি, সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়, সূতগণের ইতিবৃত্তীয় সংকেতকে আমার থেকে অনেক বেশি সম্যক অনুমান করেছিলেন। তাঁর মতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকালে যুধিষ্ঠিরের বয়স ৭২, ভীম ৭১, অর্জুন ৭০, নকুল সহদেব ৬৯। কৃষ্ণকে যদি অর্জুনের সময়বয়সি ভাবা যায়, বা অন্য মতে এক বছরের কনিষ্ঠ, তা হলে সেই সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল সত্তর অথবা ঊনসত্তর।

ইতিবৃত্ত রচনা আমার লক্ষ্য না। কিন্তু ইতিবৃত্তীয় লক্ষণগুলো আবশ্যক। অতএব উভয় মতই বলে রাখলাম। পাঠকদের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে আমি শ্রদ্ধা করি।

কৃষ্ণের জন্মকালে পুরাণকাররা দেখছেন দ্বাপরের অংশে ক্ষয় ধরেছে। এই সময়টিকে বলা হয়েছে কলির সন্ধ্যাকাল। তবে তখনও সন্ধ্যাসন্ধ্যাংশমধ্যবর্তী কলিযুগ পড়েনি। কৃষ্ণের জীবিতকালের মধ্যেই কলিযুগ এসেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু যদুগণের কীর্তিবর্ধনকারী বাসুদেবের জীবিতকাল পর্যন্ত কলির প্রাদুর্ভাব স্পষ্টত ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। এ-কথায় কি একটু বেশি গৌরব প্রকাশিত হয়নি? সূতেরা এবং ঋষিরা মানুষ ছিলেন। ইতিবৃত্তের ক্ষেত্রে তাঁরা যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ থাকবারই চেষ্টা করছেন। সেইজন্যই ইতিবৃত্তের বর্ণনার গভীরে প্রচ্ছন্ন সংকেত আর ইঙ্গিতগুলোর কথা আমি বারে বারে বলেছি।

কৃষ্ণ যে কলির যাবতীয় লক্ষণগুলোকে প্রকটিত হতে দেখেছিলেন, ইতিবৃত্তে নানাভাবে তা প্রকাশ পেয়েছে। বেদব্যাস কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অনেক আগেই তাঁর মা সত্যবতীকে ঘোষণা করেছিলেন, ‘যুগক্ষয়ের সমস্ত লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, অমঙ্গলের ছায়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ঘোর দুর্দিন আসন্ন। যে-সব পশুপক্ষীরা দিনের আলোয় নিজেদের স্বর ও আকৃতি গোপন রাখত তার ব্যতিক্রম ঘটছে। লোকক্ষয় অনিবার্য। মানুষের, বিশেষত সদ্‌বংশীয় রাজপুরুষদের চরিত্র নষ্ট হতে বসেছে। জ্ঞাতিগণ পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এ-সবই ধ্বংসের লক্ষণ।’

একদিকে যখন বৃষ্ণিসিংহের অশেষ গুণকীর্তন হচ্ছে, তখনই যুগক্ষয়ের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু আপাতত আমি ইতিবৃত্তের সে-পথে যাত্রা করতে চাই না। যদি মনে করি দ্বাপরের অংশক্ষয়ের কালে, কৃষ্ণই দ্বাপরের শেষ পুরুষ, তবে তাঁর আলোর বৃত্তেই যাত্রা করি। সেই আলোর বৃত্তের ঠিকানা দ্বারাবতী।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় যদি কৃষ্ণের বয়স বিয়াল্লিশ হয়, তাঁর বয়সের হিসাবে বয়সটাকে যুবকাল বলা যায়। তা হলে মথুরা থেকে রাজ্যপাট গুটিয়ে নিয়ে পশ্চিম উপকূলে চলে যাওয়ার ঘটনা তার মধ্যেই ঘটেছিল। এ ক্ষেত্রে আমি কৃষ্ণের বয়স হিসাব করতে যাব না। কারণ অন্য মতের কথা আগেই বলেছি। বিয়াল্লিশ না হয়ে ঊনসত্তর হলেও আমার সার বক্তব্যের ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। আমি ইতিবৃত্তের আশ্রয় নিয়েছি মাত্র। নির্ঘাত ইতিবৃত্ত লিখতে বসিনি। একে কি ইতিবৃত্তাশ্রয়ী কাহিনী বলে? যা বলার তোমরা বলো, আমি পথ চলি। দেখছি, মথুরা থেকে কৃষ্ণ সহজে নড়েননি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনীর মিলিত সৈন্যসংখ্যা ছিল আঠারো অক্ষৌহিণী। সম্রাট জরাসন্ধের একলারই ছিল কুড়ি অক্ষৌহিণী সেনাবাহিনী। আর যদুকুলে তখন ছিল আঠারো হাজার বীরপুরুষ। কৃষ্ণসহ কিছু রথীবৃন্দ। জরাসন্ধ বেশ কয়েকবার মথুরা অবরোধ করে যাদবদের ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণের হাতে তাঁর পরাক্রমশালী যোদ্ধা হংস, ডিম্বক, এমনকী কালবনের মতো বীরও মারা পড়েছিলেন।

কিন্তু এভাবে কতকাল কাটানো যায়? প্রতি মুহূর্তে শত্রুসৈন্যের অবরোধ আর আক্রমণে, সকল যাদবেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা গোটা যদুবংশের ক্ষয়ের আশঙ্কা করেছিলেন। অতএব, তাঁদের একটি মন্ত্রণাসভা নিশ্চয় বসেছিল, সেখানে স্থির হয় যাদবরা তাঁদের বিপুল সম্পত্তি ভাগাভাগি করে যা পারেন, সব নিয়ে পশ্চিম উপকূলে চলে যাবেন। সন্দেহ নেই, এর নেতৃত্ব নিয়েছিলেন বাসুদেব স্বয়ং।

তিনি কি আগেই পশ্চিমের সমুদ্রকূলে রৈবতক পর্বতের সেই দেশটি দেখে এসেছিলেন? নির্বাচন করেছিলেন সেই স্থান? কোথায় সে দ্বারকা? কাথিয়াবাড় উপদ্বীপের জুনাগড় রাজ্যের যে শহরকে এখন জুনাগড় বলা হয়, সেখানেই কি? গিরনারের পর্বতমালাই কি রৈবতক? রৈবতক পাহাড়ের ওপরে কুশস্থলী নামক যে সুদৃঢ় পুরী তৈরি করেছিলেন সে স্থান কি আজকের গুজরাটের দ্বারকা?

সন্দেহ আছে। এই সন্দেহটি খণ্ডনের সংকেত পুরাণেই আছে। পুরাণকারের প্রলয়ংকর ভূমিকম্প, নদীসমূহের গতি পরিবর্তন ইত্যাদি সবই প্রত্যক্ষ করেছেন। এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে, এ তো আমরা একালেও কম দেখলাম না। তা প্রলয়ংকর না হতে পারে, কালে কালে, অতি ধীরে ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এ অভিজ্ঞতা প্রাচীন ইতিবৃত্তের সঙ্গে আজকের ভৌগোলিক স্থানগুলোর প্রভেদেই আমরা পেয়েছি।

পুরাণ বা ইতিবৃত্তের মতামতগুলো তাঁদের নিজস্ব ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। দধীচির কথা আমি ইতিপূর্বেই শুনেছি। জলাশয়ের বিশাল প্রাণীটি মুনি নামে আখ্যাত হয়েছিলেন। ধ্বংস বা সৃষ্টি সব কিছুর কারণকেই একটি রূপ দান করা হয়েছে। চোখের সামনে যে-রূপে দেখা গিয়েছে, সেই রূপের ওপরেই তাকে একটি বিশেষ মূর্তির পরিকল্পনায় তুলে ধরা হয়েছে। পাতালসমূহের শেষভাগে বিষ্ণুর শেষনামা তামসী মূর্তিকে অনন্ত বলা হয়েছে। এই অনন্তর শক্তি ও বীর্যের বর্ণনা দেবতারাও দিতে সমর্থ ছিলেন না।

কেমন দেখতে সেই অনন্ত? তিনি সদাঘূর্ণিত লোচন, অগ্নিযুক্ত শ্বেত পর্বতের ন্যায় শোভা পান। তিনি (যেন) মদনোন্মত্ত। পরিধানে নীলবাস (সমুদ্র?)। তাঁর এক হাতে লাঙ্গল, আর এক হাতে মুষলের কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর মুখ সমূহ থেকে উজ্জ্বল বিষানলশিখাযুক্ত সংকর্ষণনামা রুদ্র নির্গত হয়ে ত্রিভুবন ভক্ষণ করেন। তিনি যখন সদাঘূর্ণিতলোচনে জৃম্ভা পরিত্যাগ করেন, তখন সমুদ্রসলিলে কাননসমূহের সহিত এই ভূমি কম্পিত হয়। এঁর অগ্নিময়ী সহস্র ফণা আছে।

তা হলে ইনি ভূগর্ভস্থ অগ্নি? ঋষিগণ ভূগর্ভস্থ অগ্ন্যুৎপাত দেখেই এই কল্পনা করেছিলেন। তাঁদের মতে, এই অগ্নিজাত শক্তিই পৃথিবীর উপরিভাগস্থ কঠিন স্তর ধারণ করে আছে। অভ্যন্তর অগ্নিময়। সেই আগুনের হাজার জিহ্বার সংকোচন প্রসারণেই ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির উৎপাত ঘটে। বাসুকি নাগের কল্পনার সঙ্গে এর কোনও অমিল নেই। আগ্নেয়গিরি থেকে ভস্মরাশি ছড়িয়ে যায়, তাকেই স্তবের গৌরবে বলা হয়েছে, সুবাসিত হরিদ্রা বা কপিলবর্ণের হরিচন্দনের রেণু। এসব তুলনা। ভূকম্প আর অগ্ন্যুৎপাতের আনুষঙ্গিক বজ্রধ্বনিকে সংকর্ষণের স্বস্তিক চিহ্নের দ্বারা উপলক্ষিত হয়েছে। মাটি ফেটে চৌচির হওয়া ধ্বংসকে, লাঙল আর মুষলের ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা।

দেখছি ‘যাঁহাকে আরাধনা করিয়া পুরাণর্ষি গর্গ জ্যোতিঃতত্ত্ব আর সকল নিমিত্ততত্ত্ব অবগত হয়েছিলেন,’ সেই গর্গই ছিলেন ভূকম্পবিৎ। কিন্তু পুরাণের ব্যক্ত করার ভঙ্গি ও ভাষা এইরকম, তিনি সেই অনন্তের আরাধনা করেই, সংকর্ষণের আরাধনা করেই জ্যোতিঃতত্ত্ব আর নিমিত্ততত্ত্ব লাভ করেছিলেন।

আমাদের আধুনিক ভাষায় কী বলা যায়। বিজ্ঞানী প্রকৃতিকে জয় করলেন। পুরাণে অবতার কল্পনা একটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। কৃষ্ণতা বলরামকে তেমনই একজন অবতার রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কেন? এই প্রকৃতির সঙ্গে কি তাঁর প্রকৃতির কোনও মিল ছিল? ছিল। বলরামও সর্বদাই সদাঘূর্ণিতলোচন মদোন্মত্ত থাকতেন। লাঙল মুষলও তাঁর হাতে থাকত, হয়তো তাঁর আয়ুধ ছিল সেইরকম। তিনি যে প্রায় সময়েই মদিরাপানে লিপ্ত থাকতেন, তা তো দেখাই গিয়েছে। ক্রোধে হুংকারপ্রবণতা ছিল। তাঁর বিক্রমকে সবাই ভয় করতেন।

এখন বৃন্দাবনের ধারেই যমুনা। বর্তমান মথুরা থেকে বৃন্দাবনে যেতে মোটরযানে সময় লাগে এক ঘণ্টারও কম। কিন্তু কংস-দূত অক্রূরের সঙ্গে কৃষ্ণ আর বলরাম যে বৃন্দাবনে ও মথুরায় গিয়েছিলেন, তার ইতিবৃত্তীয় বর্ণনা অন্য এক ভৌগোলিক চিত্রের পরিচয় দেয়। বিমল প্রভাতে, অক্রূরে সঙ্গে কৃষ্ণ আর বলরাম অতি বেগবান অশ্বসমূহযুক্ত রথারোহণে যাত্রা করলেন। মধ্যাহ্নে এসে উপস্থিত হলেন যমুনার ধারে। সেখানে স্নানাদি সেরে আবার রথে উঠলেন। অক্রূর বায়ুবেগবান অশ্বগণকে অতি দ্রুত চালিয়ে, অতি সায়াহ্নে অর্থাৎ সায়াহ্ন অতীত হলে, তাঁরা মথুরায় পৌঁছুলেন।

বেগবান অশ্বযুক্ত রথ ঘণ্টায় সাত-আট মাইল যেতে পারে। এটা আমার হিসাব না, ব্যাখ্যাকারের। তা হলে বিমল প্রভাতে বেরিয়ে মধ্যাহ্নে যমুনার ধারে পৌঁছুতেই চল্লিশ মাইল ছুটতে হয়েছিল। তারপরে অতি সায়াহ্নে মথুরা মানে আরও চল্লিশ মাইল। একুনে আশি মাইল দূরত্ব! আরও একটা কথা এখানে অনিবার্য ভাবেই অনুমান করা যাচ্ছে, অশ্বযুক্ত রথসমূহ নিশ্চয়ই নৌকাযোগে পারাপার করার ব্যবস্থা ছিল। নৌচালনাপটু কথাটা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। মনে রেখো।

তা হলে যমুনা তীরে বৃন্দাবন এল কী করে? নাকি যমুনাই বৃন্দাবনের তটে এসে ঝাঁপ দিয়েছিল? কারণ কী? ভূমিকম্প?

হ্যাঁ, ভূমিকম্প। পুরাণকারেরা তা দেখেছিলেন, আর এইভাবে তা ব্যক্ত করেছেন। একদা বলরাম বৃন্দাবনে মদিরাপানে বিহ্বল আর ঘর্মাক্ত হয়ে স্নান করতে চাইলেন। তিনি যমুনাকে ডেকে বলেন, হে যমুনে, তুমি এইখানে এসো। বলভদ্রের মাতলামিতে কান না দিয়ে যমুনা আপন মনে নিজের প্রবাহেই চললেন। তখন লাঙ্গলী বলদেব রেগে আগুন হয়ে, লাঙল দিয়ে যমুনাকে আকর্ষণ করে বললেন, রে পাপে, আসবে না? এবার যাও দেখি, কেমন যেতে পারো? যমুনা আসতে বাধ্য হলেন।

বলভদ্রের বর্ণনাটা কীরকম? তিনিও সংকর্ষণের মতো নীল বাসযুক্ত, এক কুণ্ডল, মালা, মুষল ও হলধারী। বলরামকে সংকর্ষণের অবতার রূপে কল্পনাটা পরবর্তীকালে। ভূমিকম্পটা ঘটেছিল আগেই। পুরাণকার পরবর্তীকালে বলরামের প্রকৃতি, আচরণ আর বীরত্বের সঙ্গে একটি তুলনা দিয়েছিলেন। ওটাই তাঁদের বৈশিষ্ট্য।

বিষয়টি উল্লেখ করলাম এই কারণে, জানা গেল, এ-বৃন্দাবন সে-বৃন্দাবন নয়। যমুনার গতি পরিবর্তনের সঙ্গে সেই বৃন্দাবন যমুনাগর্ভে গিয়েছিল। এ বৃন্দাবন পরবর্তীকালে মথুরার কাছে প্রতিষ্ঠিত। এ-সবেরই উদ্দেশ্য অবিশ্যি দ্বারাবতী যাত্রাপথের হদিশ করে নেওয়া। তা হলে, এই মুষল ও হলধারী প্রমত্ত বলরামকে নিয়ে আর একটি ঘটনাও বলে নিই।

কৃষ্ণের ছেলে জাম্ববতীতনয় বীর শাম্ব দুর্যোধন-কন্যা লক্ষাণাকে বলপূর্বক হরণ করেন। ফলে যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। কর্ণ, দুর্যোধন আরও অনেক কুরুবীরেরা শাম্বকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে পরাজিত করে বন্দি করেছিলেন। যদুবংশের সন্তান শাম্ব। বলভদ্র নিজে শাম্বকে ফিরিয়ে দেবার জন্য দুর্যোধনকে অনুরোধ করেছিলেন। জবাবে, দুর্যোধন তাঁকে নানা কটু কথা শুনিয়ে অপমান করেছিলেন। তখন হলায়ুধ ক্রোধে মত্ত ও আঘূর্ণিত হয়ে পায়ের গোড়ালি দিয়ে বসুধা বিদারিত করেন। তিনি মদলোলাকুলকণ্ঠে বললেন, কুরুকুলাধীনা হস্তিনানগরীকে, কুরুগণসহ উৎপাটিত করে ভাগীরথী মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেব। বলে মুষলায়ুধ বলরাম কর্ষণাৰ্বোমুখ লাঙ্গল হস্তিনাপুরীর প্রাকারে বিঁধিয়ে টান দিলেন।

নগরী সহসা আঘূর্ণিত হতে দেখে কৌরবগণ, ‘হে রাম, রক্ষা করো’ বলে চিৎকার জুড়ে দিলেন। তাড়াতাড়ি শাম্বকে ফিরিয়ে দিয়ে তবে নিস্তার। কেবল শাম্বকে না, তাঁর বলপূর্বক হরণ করা গিন্নি লক্ষণাসহ মুক্তি দিলেন। সেই থেকে হস্তিনা নগরীকে যাঁরাই দেখেছেন, দেখেছেন গোটা নগরীটি যেন মোচড়ানো। ইঙ্গিত একটাই, সেই ভূমিকম্প! যদুবীর বলরামকে সেই কাহিনীর সঙ্গে গ্রথিত করা।

কিন্তু আমি ভাবছি শাম্বর কথা। বন্দি অবস্থায় হঠাৎ ভূমিকম্প! বোধহয় ভাবতেই পারেননি, লক্ষ্মণাকে লুঠ করে আনতে গিয়ে, কুরুদের সঙ্গে এরকম একটা লড়াই লেগে যাবে, আর তারপরেই সেই ভূমিকম্প! তখন কি তিনিও ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছেড়েছিলেন? লক্ষ্মণা থাক, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! না, আসলে বোধহয় শাপে বরই হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি নগরী বেঁকেচুরে মোচড় খেয়ে গেল, লোকেরা হা রাম! করে দিকে দিকে দৌড়। চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা। এদিকে যদুবংশের বীরেরাও এসে পড়েছিলেন। অতএব শাম্বর মুক্তি পেতে আর বাধা কোথায়?

হিন্দু চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এমনও হতে পারে, কুরুরা ভেবেছিলেন শাম্বকে বন্দি করার মধ্যে কোনও অশুভ ইঙ্গিত ছিল। এইক্ষণেই একটি কথা বলবার অবকাশ এল। বলেছিলাম, যাত্রা আমার দ্বারাবতী, কিন্তু কৃষ্ণ আমার পার্শ্বচরিত্র। আমি শাম্বকে দর্শনেই বেশি ব্যাকুল। পিতা পুত্রকে একসঙ্গেই দেখতে চাই। বেশি চাই, অপরূপকান্তি এবং বীর শাম্বকেই। কৃষ্ণ ছাড়া নাম নেই, কিন্তু শাম্ব আমাকে আকর্ষণ করছেন বেশি।

ত্বরা করো হে; ত্বরায় চলো। চলব তো, অনেক প্রস্থ ধুলা উড়িয়ে পথের সন্ধান নিতে হচ্ছে। তার আগে একটা নির্ঘাত বিষয় বলা দরকার। বলভদ্র যে হস্তিনানগরীকে ভাগীরথীতে ছুড়ে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলেন, ঘটনাটা ঘটেছিল তা-ই। যুধিষ্ঠিরের সাত পুরুষ পরে, রাজা নিচস্থর রাজ্যকালে হস্তিনাপুরী গঙ্গাগর্ভেই চলে যায়।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ প্রতিষ্ঠিত দ্বারকায়, দ্বারকার কুশস্থলী সুদৃঢ় পুরী? সেই রমণীয় রৈবতক পর্বত, কাননাদি ও সুমিষ্ট মনোহর জলাশয়, কোথায় ছিল সে-সব? প্রভাসতীর্থও তো কাছাকাছিই ছিল মনে হয়। পাণ্ডবগণ তীর্থ করতে বেরিয়ে যখন প্রভাসতীর্থে গিয়েছিলেন, তখন যাদবেরা তাঁদের সঙ্গে সেখানে দেখা করেছিলেন। কৃষ্ণ তো বটেই!

ইতিবৃত্তের এক স্থানে দেখছি রৈবত ককুদ্মি নামে এক রাজা কুশস্থলী পুরীর স্রষ্টা ছিলেন। পরবর্তীকালে কৃষ্ণ সেখানেই দ্বারকাপুরী স্থাপন করেছিলেন। রৈবত রাজবংশ কোনও কারণে রাজ্যচ্যুত অথবা বংশহীন হয়েছিল। বলা হয়েছে রাজ্যচ্যুত রৈবতগণ সংগীত ললিতকলা নিয়েই কালযাপন করতেন।

আমার এতে কোনও অসুবিধা নেই। আমার যাত্রা কৃষ্ণের দ্বারকায়।

আমি হালের ভারতীয় ম্যাপে, মথুরা থেকে, বর্তমান দ্বারকার একটা দূরত্বের হিসাব কষেছি। না, রেলপথ বা আধুনিক রাস্তা ধরে না। মথুরা থেকে একেবারে সোজা দক্ষিণ পশ্চিমে নেমে যাওয়া। তার মধ্যে পাহাড় পর্বত নদনদী আছে। রেখাটা টেনেছি সরল রেখায়, তার ওপর দিয়েই। হিসাবে পাচ্ছি সাড়ে ছ’শো মাইলের মতো। কিন্তু এ-দ্বারকাকে সেই দ্বারকা বলে জানি না। প্রাচীন বৃন্দাবনের মতোই সেই নগরীকে খুঁজে নিতে হবে পশ্চিম সাগরের জলের তলায়। মাউন্ট আবু বলো, আর গিরনারের পর্বত বলো, আসল রৈবতক এখন কচ্ছের কাছাকাছি কোথাও হেথা হোথা কিঞ্চিৎ মাথা তুলে থাকতে পারে। সিন্ধুদেশে অনেকবার প্রলয়ংকর ভূমিকম্প হয়েছে। পুরাণকাররা সে-কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। মহর্ষি উতঙ্ক বলেছিলেন, ‘সংবৎসরান্তে ধুন্ধু অত্যাচার করে।’ এই ধুন্ধু ছিলেন বলরামেরও আগে অনন্তের অবতার। উতঙ্কের আশ্রম সিন্ধুদেশেই ছিল, এবং তিনি একটি বিশাল তপ্ত বালুকারাশিপূর্ণ অগ্নিময় স্থল দেখেছিলেন আর সেখান থেকেই আগুন বালি ভস্ম পাথর ধোঁয়া নির্গত হয়ে, মহীতল আঘূর্ণিত করত। উতঙ্কের কথায়, তৎকালীন রাজা কুবলয়াশ্ব (৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একুশ হাজার লোক দিয়ে, সেই ভূকম্পনপীড়িত কেন্দ্রটিকে উৎখাত করবার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে, প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সকলেই মারা যায়।

আধুনিক কালের আঠারোশো উনিশ খ্রিস্টাব্দে দেখছি, কচ্ছপ্রদেশের দু’হাজার বর্গমাইল সমুদ্রের গর্ভে চলে গিয়েছিল, আর প্রায় পঞ্চাশ মাইল লম্বা, দশ মাইল চওড়া ভূমি নতুন করে জেগে উঠেছিল। কচ্ছের রান বা রন বলে বিশাল এক জলাভূমি রয়েছে। রান বা রন গুজরাতি ভাষার একটি শব্দ। যার অর্থ নোনা জলময় অস্বাস্থ্যকর স্থান।

এই ভৌগোলিক পরিবর্তনটি আধুনিক হলেও, আমাকে একবার স্মরণ করতেই হল। কেননা, আমার যাত্রাটা একেবারেই অত্যাধুনিক কালে। কৃষ্ণ এবং যাদবগণের প্রতিষ্ঠিত দ্বারকাপুরীর সঠিক স্থান নির্ণয়ে এই ঘটনাটি আমার যাত্রাপথকে সুদৃঢ় করছে। কিন্তু আধুনিক কালের এই দু’হাজার বর্গমাইল সমুদ্রের গর্ভে চলে যাওয়ার অনেক আগেই নিশ্চয় প্রাচীন দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে ডুবেছিল। সিন্ধু এবং কচ্ছ প্রদেশের এইসব অঞ্চল প্রায়ই প্রলয়ে ওঠা নামা করেছে, এটা বোঝা যায়। তবে কৃষ্ণ জীবিত থাকতে তাঁর দ্বারকা এবং রৈবতক পর্বতের ওপর সুদৃঢ় কুশস্থলীপুরী সমুদ্রগর্ভে যায়নি। গেলে পুরাণকারের লেখনীতে তা নিশ্চয়ই পাওয়া যেত।

কত বৎসর কৃষ্ণ দেহধারণ করেছিলেন? এখানে একটা ধন্দ রয়েছে। এক মতে, তিনি বেঁচে ছিলেন একশো পাঁচ বছর। আর এক মতে একশো এক বছর। চার বছরের সমস্যা। সমস্যাটা তেমন একটা বড় না। কোনটা বিক্ষিপ্ত কোনটা বিক্ষিপ্ত না, এইটি ভাববার বিষয়। যে-হিসাব থেকে কৃষ্ণের জন্মকাল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকাল পেয়েছি, সেই হিসাব বলছে, বাসুদেব একশো পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। পুরাণের এই মতটিই আমি গ্রহণ করছি।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকাল থেকে এই উনিশশো সাতাত্তরে দাঁড়াচ্ছে, তিন হাজার তিনশো তিরানব্বুই বছর। সিন্ধু দেশে কুবলয়াশ্বের ভূমিকম্পজনিত সংবৎসরের প্রলয়কাল তিন হাজার ছ’শো খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই বর্তমান বছর ধরলে পাঁচ হাজার পাঁচশো সাতাত্তর বছর। কৃষ্ণের দ্বারকার অনেক আগে। পুরাণকার বলছেন, কৃষ্ণের দেহাবসানের পরে অবশিষ্ট অক্ষম যাদবগণ, রমণীগণ, বালকগণ এবং মূল্যবান অলংকারাদিসহ সম্পত্ত্যাদি নিয়ে অর্জুন দ্বারকা ত্যাগ করেছিলেন। কৃষ্ণের দেহে যখন অস্তগামী আসন্ন ছায়াপাত ঘটেছে, তখন তিনি নারদকে এক সময়ে বলেছিলেন, জ্ঞাতিদের অর্ধেক ঐশ্বর্য দান করে, তাঁদের কটুবাক্য শুনে তাঁদেরই দাসের ন্যায় রয়েছি। যাদবদের আত্মকলহ পরস্পরের সংঘর্য তিনি দেখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে অর্জুন ভোজকুলের কামিনীগণ ও তনয়দের মার্তিকাবতনগরে পাঠিয়েছিলেন। অন্যান্য বালক বৃদ্ধ আর স্ত্রীগণকে, সাত্যকিপুত্রসহ সরস্বতী নগরীতে পাঠিয়ে, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার কৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার মানে, একদা কৃষ্ণের নেতৃত্বে যাদবেরা যেভাবে মথুরা ত্যাগ করে দ্বারকায় চলে গিয়েছিলেন, সেটা ছিল নিরাপদ সুদৃঢ় আশ্রয়ের সন্ধান। তারপরে সম্ভবত সত্তর-পঁচাত্তর বছরের মধ্যেই আত্মকলহে ধ্বংসপ্রাপ্ত, অবশিষ্ট যাদবেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। দ্বারকা পরিত্যক্ত হয়েছিল।

শুধুই এক পরিত্যক্ত নগরী? না, সিন্ধুদেশের ভূমিকম্পপ্রবণতাই কৃষ্ণের দ্বারকাকে গ্রাস করেছিল? তা না হলে সম্ভবত কৃষ্ণের কুশস্থলী পুরীর কোনও না কোনও নিদর্শন, কাথিয়াবাড়ে, গিরিনগরে (গিরনারে) বা জুনাগড়ে খুঁজে পাওয়া যেত। অনুমিত হয়, জরাসন্ধের পক্ষে অগম্য কিংবা আক্রমণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব কৃষ্ণের দ্বারকা ছিল, মূল ভূমিখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সমুদ্রের কোনও রমণীয় দ্বীপে। নৌচালনাপটুত্বের কথাটা এ সময়েই বিশেষ করে মনে আসে। অশ্বসমূহযুক্ত রথসমূহ নিয়ে, যে কোনও সময়েই মূল ভূখণ্ডে পৌঁছে দেবার জন্য নৌবাহিনী তৈরি থাকত।

আঠারোশো উনিশ খ্রিস্টাব্দে কচ্ছপ্রদেশের সমুদ্রগর্ভে যাবার আগের কোনও সাক্ষীর বিবরণ আমার গোচরে নেই। তা হলে হয়তো কৃষ্ণের দ্বারকার কোনও সংবাদ পেলেও পাওয়া যেতে পারত। তবে যাদবগণ যে ভারতের কোনও কোনও অঞ্চলে এখনও যদুবংশের পরিচয়েই ছড়িয়ে আছেন, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

এখন কেবল দ্বারকাবৃত্তান্ত। নারদ মুনি দ্বারকায় চলেছেন। পশ্চিম সমুদ্রের উপকূলে, প্রভাসতীর্থেই ভ্রমণে এসেছিলেন। এত কাছে এসে, দ্বারকায় গিয়ে একবার যাদবদের সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাওয়াটা তাঁর যথার্থ মনে হল না। না, তিনি আদৌ ঢেঁকিতে চেপে ভ্রমণ করছিলেন না। নিজের রথেই তিনি ভ্রমণ করছিলেন।

নারদ নামে কি একজন মুনিই ছিলেন? অথবা একাধিক ব্যক্তি? নারদ নামে কি কোনও বিশেষ সম্প্রদায় আছে? নারদীয়গণ যাঁদের বলা হয়, তাঁরাই হয়তো সেই সম্প্রদায়ের। তাঁদের মধ্যে যাঁরা জ্ঞানে গুণে শ্ৰেষ্ঠ ছিলেন, বিভিন্ন রাজা এবং গোষ্ঠীপতিদের দ্বারা তাঁরা পূজিত হতেন। এই মন্তব্য ইতিবৃত্তের একটি সংকেত। তবে পুরু বংশীয় কৌরবদের ও যাদবদের, উত্থান পতনের কালের মধ্যে নারদ মুনি একজনই। ইনিই সেই নারদ। ইনিই যুধিষ্ঠিরকে রাজনীতি, অর্থনীতি, ভেদনীতি, সমাজনীতি, গার্হস্থ্যনীতিসমূহ বিষয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন। ইনিই বিধান দিয়েছিলেন কুরুবংশীয়, পাণ্ডুতনয় পাণ্ডবদের, পাঞ্চালীর সঙ্গে পাঁচ ভাই কোন প্রথায় দাম্পত্য জীবন কাটাবেন। ইনি অশেষ গুণশালী, চিন্তাশীল অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ইনি সমগ্র বর্ষগুলো পরিভ্রমণ করেছেন। কিম্পুরুষবর্ষ, ইলাবৃতবর্ষ, মধ্যস্থল, অন্তরীক্ষ, ভদ্রাশ্ববর্ষ, কৈলাস কোনও জায়গা বাদ নেই। দেবতা, অসুর, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, সর্প, মানুষ সকলের সঙ্গে মিশেছেন, জীবনযাত্রা ও ধারণপ্রণালী দেখেছেন। এই সবই তাঁকে অশেষ জ্ঞানী ও গুণী করেছিল। যে-কোনও বিষয়েই তাঁর প্রীতিভাজন রাজা ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদিগকে উপদেশ দিতে সক্ষম, কেবল যুদ্ধবিদ্যা ছাড়া। তিনি নিজে ক্ষত্রিয় নন, অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ নন, কিন্তু শত্রুদমনের কৌশল, নগররক্ষা, গুপ্তচরাদি বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সীমান্তরক্ষা, পাত্রমিত্রে ভেদাভেদ, প্রয়োজনে ছলনা ও চাতুরি, রাজকোষে অর্থাগমের বিধি, ব্যয়ের নিয়ম, নগরের বেশ্যা ও অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে আচরণের সঙ্গতি অসঙ্গতি, এমনকী গৃহে ও অন্তঃপুরে পরিচারক পরিচারিকাদের সম্বন্ধে যথার্থ খবর রাখা, যাবতীয় বিষয়েই সম্যক উপদেশ দানের জ্ঞান ছিল তাঁর।

পরবর্তীকালে মগধের নন্দবংশ ধ্বংসের যিনি নেতৃত্ব করেছিলেন, সেই কৌটিল্যের মধ্যেই নারদের গুণাবলী প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। সেই অর্থে মহর্ষি নারদও কুটিল। কুটিলতা এ ক্ষেত্রে নীচতা না। ন্যায় এবং অন্যায় বিষয়ে দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা। যার পক্ষে যা অনাচরণীয়, তার প্রতিই নারদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে এবং সে-সব তাঁর কাছে অন্যায় প্রতীয়মান হলে, তিনি ক্ষুব্ধ হতেন।

এরকম ব্যক্তিকে কি রগচটা বলা চলে? বোধহয় না। রগচটা বলতে গোঁয়ার বোঝায়। মহর্ষি আদৌ তা নন। কিন্তু তাঁর কাছে যা অন্যায় বলে বোধ হয়, তার বিহিত না করে ছাড়েন না। এ-কথাটা সর্বজনে বিদিত ছিল বলেই, নারদ বা নারদ ঋষিদের সম্পর্কে সকলেরই মনে একটা ভয়ের ভাব ছিল। কেবল সাধারণ মানুষের না, সমস্ত রাজা এবং অমাত্যগণেরও। আর কুটিল হলেই ভেদবুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

মহর্ষি প্রভাসতীর্থ ভ্রমণের মধ্যেই, যাদবদের গূঢ়পুরুষদের সম্যক চিনে নিতে পারছিলেন। গুপ্তচরদের আচার আচরণ চলাফেরা ভঙ্গি দেখলেই তিনি বুঝতে পারেন। এখন অবিশ্যি যাদবদের বাইরের শত্রুর ভয় আর নেই। তথাপি রাজ্য পরিচালনায় সর্বদাই সাবধানতা অবলম্বন দরকার। যাদব গুপ্তচরদের দেখে, তিনি মনে মনে তাঁদের প্রশংসাই করলেন। খুশি হলেন, বিনা পরিচয়েই তারা সকলে অতি ব্যাকুল ব্যস্ততায় মহর্ষির পদধূলি গ্রহণ করে, নিজেদের ধন্য ঘোষণা করল। মহর্ষির পরিচয় অতি ব্যাপক, অতএব প্রভাসতীর্থে তিনি ভক্তদের কাছ থেকে সহজে নিস্তার পেলেন না।

মহর্ষি মনে মনে সুখীবোধ করলেন। সবাইকে যথাবিহিত আশীর্বাদ জানিয়ে দ্বারকায় যাত্রা করলেন। সময় মতো পৌঁছুলেন দ্বারাবতীতে। যে-নৌকারোহণে তিনি ও তাঁর শকট দ্বারাবতী পৌঁছুলেন সেই নৌচালকেরা চিৎকার করে তীরবর্তী যাদবগণকে তাঁর আগমনবার্তা জানিয়ে দিল। মহর্ষি তীরে পা দিতে না দিতেই, ভোজক, অন্ধক ও বৃষ্ণি শাখার যাদবদের গৃহে গৃহে সাড়া পড়ে গেল। কুশস্থলীপুরী আর রৈবতক পর্বতের বিভিন্ন হর্ম্যতলে, কাননে কাননে, ক্রীড়াভূমিসমূহে সর্বত্র তাঁর আগমনবার্তা পৌঁছে গেল। তাঁর আসা মানেই, নানা দেশের নানা সংবাদ জানা, বিবিধ বিষয়ে জ্ঞানলাভ করা। অন্তরে বাহিরে কোনও সংকট থাকলে তাঁর উপদেশ লাভে তার নিরসন করা। সেইজন্য তিনি সর্বত্র পূজিত নিমন্ত্রিত।

পার্বত্য নগর প্রাকারের এবং প্রবেশদ্বারের রক্ষীরা সকলেই তাঁকে আভূমি নত হয়ে অভিবাদন করল। মহর্ষি দু’হাত তুলে সবাইকে আশীর্বাদ করলেন। অন্ধক ভোজক বৃষ্ণি গোষ্ঠীর অনেকেই নানাদিক থেকে প্রণাম ও সমাদর করতে ছুটে এলেন। মহর্ষি খুশি আর আনন্দিত চিত্তে সকলের মস্তক আঘ্রাণ করে আশীর্বাদাদি জানিয়ে নানা কুশল জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে এগিয়ে চললেন।

কালের একটা হিসাব দরকার। মহর্ষির এই আগমন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কত বছর পরে? যুদ্ধের পরেও তিনি ইতোমধ্যে কয়েকবার দ্বারাবতী ভ্রমণ করে গিয়েছেন। এই ক্ষণের কালটি ঠিক কখন? কৃষ্ণের বয়স আচরণ ইত্যাদি দিয়েই হিসাব করে বলা যায়, ভারত যুদ্ধের দশ বছরের বেশি বোধহয় না। তা হলে কৃষ্ণের বয়স এখন প্রায় বাহান্ন কিংবা সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়ের বিচারে ঊনআশি। তবু এখনও তাঁর নীলোৎপল দেহে জরা বা বার্ধক্যের কোনও লক্ষণ নেই। তার জীবনসায়াহ্নের অস্তরাগে, এখনও সেই বিমর্ষ ম্লানতার কোনও ছায়া পড়েনি। যে-সময়ে তিনি নারদকে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘জ্ঞাতিবর্গকে ঐশ্বর্যের অর্ধেক দান করে, সর্বদা তাঁদের কটুবাক্য শুনে তাঁদের দাসের মতো বেঁচে রয়েছি।’…

আমার বলতে ইচ্ছা করছে, জীবন এইরকম। আমাদের জীবিতকালের মধ্যেই তো বিশ্বের কত রথী মহারথীর অতি ভয়ংকর আর বিষাদজনক পরিণতি দেখলাম! তুলনা আমি কারও সঙ্গেই কারওর করব না। কারণ, আমি মনে করি, এই সব অতিমানুষ ব্যক্তিগণ সকলেই আপনিই আপনার একমাত্র তুলনা। একজনের চরিত্রের আলোকে আর একজনকে বিচার করা যায় না।

কিন্তু এখন এ-সব কথা থাক। মহর্ষিকেই অনুসরণ করি। যদুবংশে যদিও ভোজক কুলের উগ্রসেন বংশধরেরাই রাজসিংহাসনে আরোহণের অধিকারী তথাপি ন্যায়াধীশ বীর এবং কুশলী, সব বিষয়েই শ্রেষ্ঠ হলেন, বৃষ্ণিবংশাবতংসাবতার বাসুদেব। অতএব মহর্ষি কুশস্থলীপুরীতে, আগে কৃষ্ণ সমীপে যাওয়াই স্থির করলেন। অতি রমণীয় পর্বতের ওপর কুশস্থলীপুরীর যে-অংশে কৃষ্ণ বাস করেন, সেই অংশের কাছাকাছি হতেই বৃষ্ণিবংশীয় সকল বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সন্তানসন্ততিরা মহর্ষিকে অভ্যর্থনা করতে ছুটে এলেন। অবিশ্যি একটা কথা সব সময়েই মনে রাখা দরকার, মহর্ষি সচরাচর একলা কোথাও তেমন যেতেন না। তাঁর সঙ্গে সর্বদাই কিছু জ্ঞানী ঋষিগণ থাকতেন। তাঁরা মহর্ষির শিষ্য এবং জ্ঞানমুগ্ধ। মহর্ষির সঙ্গে নানাস্থানে ঘুরে বেড়ানো, একটি অতি আনন্দজনক বিষয়।

মহর্ষি কি তা বলে কখনও একলা কোথাও যেতেন না? নিশ্চয়ই যেতেন। সেরকম বিশেষ প্রয়োজন হলে তিনি ঋষিগণ সহ বিহার করতেন না। মহর্ষি কৃষ্ণ-অঙ্গনে আসামাত্র, প্রদ্যুম্ন এবং আর আর যুবক বৃষ্ণি যাদবেরা তাঁদের নানা বিলাস, আলাপন, ক্রীড়া, অন্তঃপুরে ও বাইরের কানন ছায়ায় নারীগণের সঙ্গে নানা হাসিমুখর চতুর বাক্যালাপাদি ত্যাগ করে দ্রুত মহর্ষি সমীপে এসে তাঁকে যথাযোগ্য সমাদরসহ প্রণাম করলেন। কৃষ্ণও অন্তঃপুরে সংবাদ পাওয়ামাত্র, ত্বরিত গতি উত্তাল জলস্রোতের ন্যায় নানা সম্ভাষণ করতে করতে ছুটে এলেন। তাঁকে যথাযোগ্য সমাদর ও পূজা করার জন্য নতশিরে হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে বললেন, ‘মহর্ষি, আমার অশেষ সৌভাগ্য বিশ্ববিহারী আপনি আমাকে দয়া করে দর্শন দিয়েছেন। আসুন, উপযুক্ত আসন গ্রহণ করুন।’

মহর্ষি এবং তাঁর সঙ্গীরা বাসুদেবের এবং অন্যান্য বংশধরগণের আচরণে সত্যি খুব খুশি হলেন। কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণ ভ্রূকুটি চোখে একটি জিজ্ঞাসা জেগে উঠল। বাঁ দিকে, কিছু দূরেই একটি ছায়াঘন, বিবিধ বর্ণাঢ্য ফুলের কেয়ারি ও লতাপাতায় কিছুটা আচ্ছন্ন, কানন মধ্যে অপরূপ রূপবান কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে দেখলেন, তিনি একবারের অধিক মহর্ষির দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলেন না। কেন, এত ব্যস্ততা কীসের?

শাম্ব সত্যি আর দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলেন না, কারণ তখন তাঁর কাননবিহারিণী সহচরীদের মধ্যে একজনের মদির চোখের দিকে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। দেহসম্ভোগ বিষয়েই আমোদজনক নানা কূট তর্ক হচ্ছিল, যে-তর্কের মধ্যেও মনে স্ফূর্তি জাগে, প্রাণ হিল্লোলিত হয়। বিশেষত কৃষ্ণপুত্রদের মধ্যে শাম্ব সর্বাপেক্ষা অধিক রূপবান পুরুষ। কাঞ্চনের অধিক উজ্জ্বল বর্ণে, তাঁর দেহে যেন, পারিপার্শ্বিক সকলেই প্রতিবিম্বিত হয়। তা সে কানন কুঞ্জ জলাশয় আকাশ পর্বত নারী যাই হোক। তাঁর অতি আয়ত চোখে সর্বদা কামনার বহ্নি অনল প্রজ্বলিত হয় না, কিন্তু তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টিতে এমন একটি চিত্তজয়ী দুর্বার আকর্ষণ আছে, রমণীমাত্রেই তাঁর দর্শনে মিলন আকাঙক্ষায় কাতর হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, পুরুষ হিসাবে তাঁর রূপ এমনই অসামান্য, তিনি নগরের পথে বের হলে, মাতা ও মাতৃপ্রতিম দুই চারি মহিলা ছাড়া সকল যাদবরমণীগণই, প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্ন যে-কোনও অলিন্দে গবাক্ষে বা সোপানে তাঁকে একবারটি দেখবার জন্য ছুটে আসেন।

দ্বারকার রমণীকুলে শাম্ব সম্পর্কে বহুতর কৌতূহল, নানা আকাঙ্ক্ষা। সকলেই জানেন, প্রণয়োদ্দীপ্ত ভাষণে ও আলাপে তিনি তুলনাহীন। অথচ কোনও ইতর ভাষা তিনি উচ্চারণ করেন না। তাঁর রতিকলাকুশলতা বিষয়ে রমণীগণ নানা কাহিনী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, অতি কামনায় অবশাঙ্গ ও মূৰ্ছিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি সকল রমণীগণের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে অবহিত আছেন। যথাস্থানে যথাযোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকেন। ভ্রাতৃবধুদের প্রতি প্রীতি, কনিষ্ঠ কুলরমণীগণকে স্নেহের দ্বারা সুখী করেন। পুরুষরাও সকলেই প্রীত, কারণ শাম্বর আচরণ, আলাপাদি শ্রদ্ধা প্রীতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষের মন! শাম্বর পুরুষোচিত রূপ যৌবনে অনেক যাদবগণের অবচেতনেই ঈর্যা প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

শাম্ব এখন যে সহচরীটির মদির চোখের দিকে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে আছেন, সম্ভবত সে একজন গোপবালা। সর্বজনবিদিত, যাযাবর গোপরমণীরা অন্যান্যদের তুলনায় স্বাধীনচেতা। তাদের স্ব-ইচ্ছাগমন বিষয়ে সকলেই অবগত আছে। প্রণয়-সহচরীরূপে তাদের ভূমিকা অদ্বিতীয়। শাম্ব কুঞ্জ মধ্যে সেই রমণীটির দিকে কেবল অভিভূত হয়ে তাকিয়ে নেই, যেন হতবাক বিস্ময়ে, অথচ কামনাবিহ্বলতায় স্তব্ধ হয়ে আছেন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে আরও কয়েক যুবতী, যারা পীনবক্ষ, ক্ষীণকটি, গুরুনিতম্ব এবং সুগৌরী। সকলেই অবিন্যস্ত, বস্ত্রাদি স্খলিত, সকলেই অপরূপদেহধারী শাম্বের অঙ্গ স্পর্শে ব্যাকুল হয়ে তাঁর নানা অঙ্গ নিজেদের হাতে ধারণ করে আছে। শাম্বের সঙ্গে সকলেই সুরাসব পান করেছে। এখনও করছে।

শাম্ব খালি গা। তাঁর অতি উজ্জ্বল দেহে বক্ষভাগ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। গলায় কবচযুক্ত মুক্তাহার, কানে কুণ্ডল, দুই নিবিড় আয়ত চোখ সুরাসবের গুণে রক্তিম। সকলের সঙ্গেই তিনি নানা প্রণয়সম্ভাষণে লিপ্ত ছিলেন। তার মধ্যে দেহ সম্ভোগের নানা গূঢ় রহস্য ও চাতুর্যপূর্ণ প্রশ্নোত্তরের খেলা চলছিল। বেণীবন্ধনহীন আলুলায়িতকেশ পীনোদ্ধত বুকের ওপর লুটিয়ি, যে-রমণী এখন নাসারন্ধ্র কাঁপিয়ে ঠোটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মদির চোখে শাম্বকে দেখছে সে সহসা একটি কূট প্রশ্ন করেছে। বাসনাতড়িতা রমণী যদি উড়ন্ত মরালীর মতো চক্রাকারে উড়তে উড়তে পূর্ণ বৃত্তাকারে অবস্থান করে শাম্ব-সঙ্গলাভে অতিপ্রার্থিী হয়, তা হলে শাম্ব কীরূপ আসন গ্রহণ করবেন?

এক গন্ধর্বী সুন্দরী মাথার ওপর হাত তুলে দেহকে অর্ধচক্রাকারে রেখে ভূমিতে হাত রেখেছিল। উদ্দেশ্য শাম্বকে বৃত্তকার কৌশলি দেখাবে। প্রশ্নকর্ত্রী বাধা দিয়েছে। অন্যান সহচরীরাও বাধা দিয়েছে। রমণীর সেই বৃত্তকার দেহকে কল্পনা করুন এবং আপন আসনের কল্পনা ব্যাখ্যা করুন।

সহচরীদের সুরাসব পানে ও হাস্যে কুঞ্জ মুখরিত। তারাও যেন অতিপ্রার্থিনী হয়ে, সকলেই নিজেদের বৃত্তাকারে কল্পনা করে শাম্বসঙ্গলাভে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। শাম্ব কয়েক মুহূর্ত ভেবেই, সহসা প্রণায়াকুল হয়ে প্রশ্নকর্ত্রী সহচরীকে দু’হাতে বুকে টেনে নিলেন, চুম্বন সোহাগে স্পর্শের দ্বারা তাকে আহ্লাদিত করে বললেন, তুমি প্রকৃতই চতুরা। শুনলে মনে হয়, তোমার প্রশ্ন অতিশয় কঠিন ও কূট। আসলে সহজ। ঘুরিয়ে বলেছ।

সকল সহচরীরাই শাম্বর জবাবের প্রত্যাশায় তাঁকে সর্বাঙ্গে ঘিরে ব্যূহ রচনা করল। তাঁর পত্নী লক্ষ্মণাও সহচরীদের মধ্যেই রয়েছে। শাম্ব বললেন, রমণীর বৃত্তাকার দেহধারণ আগে নয়, পরে। বলো ঠিক বলেছি কি না?

প্রশ্নকর্ত্রী আলুলায়িতকেশিনী পীনোদ্ধত সুগৌরীবালা ভুরু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু তার ঠোঁটের তটে নিটুট হাসি তরঙ্গে ঢেউ তুলল। চোখের কালো তারা দ্রুতসঞ্চরণশীল ভ্রমরের মতো ঝিলিক দিল। কিন্তু কোনও জবাব দিল না। শাম্বর মুখ থেকেই সে এবং সকলেই জবাব শুনতে চায়।

শাম্ব বললেন, আমি যে-রমণীকে ধারণ করি, একমাত্র সে-ই তখন সেই অবস্থায় নিজের কোমল অঙ্গে বৃত্তাকার রূপ ধারণ করতে পারে।

প্রশ্নকর্ত্রী তৎক্ষণাৎ নত হয়ে, শাম্বর জানুদেশে মাথা রাখল। অন্যান্য রমণীরা সোল্লাসে হেসে উঠল। কিন্তু এই সব প্রণয়োদ্দীপ্ত রঙ্গ খেলায়, শাম্ব এই মুহূর্তে কার কোপে পড়লেন, তা জানতে পারলেন না। দূরান্তের সমুদ্রমধ্যে পর্বতবেষ্টিত এই রমণীয় নগরে যাদবেরা এখন নিশ্চিন্তে জীবনধারণ করছেন। শত্রুর আক্রমণ বা যুদ্ধবিগ্রহের কোনও সম্ভাবনা নেই। বলতে গেলে পাঞ্চালরাজ, পাণ্ডব, যাদবরাই এখন ভূভারত শাসন করছেন। তাঁদের মধ্যে ঐক্যের কোনও অভাব নেই। পরাজিত রাজন্যবর্গ সকলেই আত্মসমর্পণ করে স্ব স্ব রাজ্যে এঁদেরই নেতৃত্বে বাস করছেন। কোথাও কোনওরকম ষড়যন্ত্র বা বিদ্রোহের সংবাদ নেই। বড়রকমের কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেনি। সারা দেশে এখনও আকাশে বাতাসে শোকের যেটুকু চিহ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে, তা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিশাল ক্ষয় ও ক্ষতি। এখন চারদিকে শান্তি ও স্বস্তি। একা শাম্ব না, সকল যাদব সন্তানেরাই এখন নানা ক্রীড়াকৌতুকে সময় অতিবাহিত করেন।

কিন্তু প্রদ্যুন্মের মতো, শাম্বর দৃষ্টি ও চিন্তা যদি জাগ্রত হত তা হলে তিনি মহর্ষির আগমনকে কখনও ভুলে থাকতে পারতেন না। সকল যাদব শ্রেষ্ঠগণের মতোই ছুটে আসতেন। শাম্ব আচরণবিধি জানেন না, এমন না। তবু ভুলে গেলেন। প্রেম প্রণয়লীলা এমন ভুলের সৃষ্টিও করে। মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। আর মানুষ মাত্রকেই তার মূল্য দিতে হয়।

শাস্ত্র প্রণয়-লীলা করুন। মহর্ষিকে দেখি।

মহর্ষি, কৃষ্ণ, পুত্র প্রদ্যুম্ন ইত্যাদি সকলের দ্বারা আপ্যায়িত ও পূজিত হয়ে নানা কুশল জিজ্ঞাসা ও আশীর্বাদ করলেন। কৃষ্ণ নানাস্থানের সংবাদ জিজ্ঞেস করলেন। মহর্ষি সবই তাঁকে বললেন। কিন্তু শাম্বর আচরণে তাঁর অন্তরে আগুন জ্বলছে। তাঁর প্রতিটি নিশ্বাস যেন বিষানলশিখাযুক্ত হয়ে, শাম্বকে আঘাত করতে চাইছে। সেই মুহূর্তেই তা প্রকাশ না করে নানা দেশ জনপদ আশ্রম তপোবন রাজা ও ঋষিদের বহুতর সংবাদ বললেন। কিন্তু নিজেকে তিনি অপমানিত বোধ করে ভাবতে লাগলেন, বৃষ্ণিকুলের এই রূপবান বংশধরটিকে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়।

মহর্ষি নারদ কৃষ্ণের আতিথেয়তায় যৎপরোনাস্তি সন্তোষ প্রকাশ করে অন্যান্য যদুবংশীয়দের গৃহে গমন করলেন। ভোজ এবং অন্ধকবংশীয়দের কাছে শাম্ব সম্পর্কে দু’-একটি প্রশ্নও করলেন। শাম্বর নিন্দা কেউ করেননি। কিন্তু মহর্ষির ক্ষুব্ধ চিত্ত তাতে বিন্দুমাত্র শান্ত হল না। দ্বারকাত্যাগ করার আগেই, শাম্বকে একটা কোনও শিক্ষা দিতে না পারলে, তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হচ্ছিল না। তিনি বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তাৎক্ষণিক উপায় উদ্ভাবনে বিশেষ পটু। ভেবে দেখলেন, একমাত্র কৃষ্ণকে বিচলিত করতে পারলেই শাম্বকে যথোচিত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। পুত্রের বিরুদ্ধে পিতাকে কুপিত ক্রুদ্ধ করে তুলতে পারলেই এক্ষেত্রে মহর্ষির মনস্কামনা সিদ্ধ হতে পারে। সমগ্র দ্বারকায় যাদবগণের মধ্যে শাম্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত। শাম্বর বিরুদ্ধে যদুবংশকে বিবাদে প্রবৃত্ত করা সম্ভব না। বিরোধ সৃষ্টি করতে হবে পিতা পুত্রের মধ্যেই। আর তার হেতু স্বরূপ, শাম্বর অসামান্য রূপই যথেষ্ট।

মহর্ষি কি কৃষ্ণচরিত্র জানতেন না? খুব ভালই জানতেন। পাণ্ডবদের সংগঠিত করে সমগ্র দেশে শত্রুদের বিনাশসাধনে গভীর ভেদবুদ্ধির প্রয়োগ, বিশেষ করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আত্মীয়ক্ষয়ে বিমুখ, আচ্ছন্ন ম্রিয়মাণ অর্জুনকে শত্রুরূপী জ্ঞাতিহত্যায় উদ্‌বুদ্ধ করে তোলার অসামান্য কীর্তি এই সব কিছু সত্ত্বেও কৃষ্ণ কি পরিপূর্ণ অসূয়াহীন? অতি কীর্তিমান মহামানবও মানুষ! জীবধর্মের এইটি একটি বিশেষ লক্ষণ। তাঁরও কতকগুলো সুপ্ত বোধ থাকে, অসূয়া অহংকার সম্ভোগেচ্ছা, আপনশক্তিতে বিশ্বাসী নিশ্চিন্ত কালাতিপাত। আঘাত সেখানেই হানতে হবে।

মহর্ষি দ্বারকাত্যাগের আগে, কৃষ্ণের সঙ্গে একান্তে একবার সাক্ষাৎ করলেন। বললেন, ‘বাসুদেব, আপনার বংশে একটি গ্লানিময় পাপের ছায়া দেখে আমি বড় বিচলিত বোধ করছি।’

প্রশান্ত কৃষ্ণ উদ্‌বিগ্ন বিস্ময়ে বললেন, ‘আমার বংশে গ্লানিময় পাপের ছায়া? আমার চোখে পড়েনি?’

মহর্ষি হেসে বললেন, ‘চোখে পড়লে তো আপনি জানতেই পারতেন। ওপরে শান্ত জলরাশি, অথচ তলের গভীরে খরস্রোতের মতো সেই পাপের ধারা বহে চলেছে। তির্যগযোনিসম্ভুত অনার্যরাজের কন্যা, জাম্ববতী তনয় শাম্ব তার কারণ।’

কৃষ্ণ অধিকতর বিস্ময়ে বললেন ‘শাম্ব? তার বিষয়ে যদুবংশে কোনও মালিন্য নেই। আমার এই রূপবান সন্তানটি সকলের প্রিয়।’

মহর্ষি বিদ্রূপে কুটিল হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, শাম্ব সকলের প্রিয়, কিন্তু সে প্রিয়তম পুরুষ আপনার ষোলো হাজার রমণীর! যে-ষোলো হাজার রমণীকে উদ্ধার করে, আপনি ভর্তাস্বরূপ তাদের গ্রহণ করেছেন, যাদের প্রতি প্রেমবশত স্যমন্তক মণি আপনি ধারণ করতে পারেননি, সেই ষোলো হাজার রমণী শাম্ব সঙ্গলাভে ব্যাকুল। শাম্বই তাদের ধ্যানজ্ঞান। এ কি পাপ নয়?’

কৃষ্ণ এক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পরমুহূর্তেই দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, পাপ, কিন্তু আপনার অভিযোগ সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। মহর্ষি, আপনি ত্রিভুবনখ্যাত, সীমাহীন আপনার অভিজ্ঞতা। তবু বলি, আমার পুত্র ও প্রেয়সীদের বিষয়ে এই অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না। শাম্বর সদাচার বিশ্বস্ততা পিতৃভক্তি প্রশ্নের অতীত। আমার ষোলো সহস্র স্ত্রী সহচরী রমণীদের বিষয়েও আমার মনে কোনও দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই।’

মহর্ষি গম্ভীর হয়ে উঠলেন, তাঁর অন্তরের কোপানল বর্ধিত হল। বললেন, ‘আমি ত্রিভুবনখ্যাত, আমার অভিজ্ঞতা সীমাহীন। কিন্তু বাসুদেব, আপনার অন্তর্দৃষ্টি গভীর ও ব্যাপক, অতুলনীয়। যে-কোনও বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সকলের সাধনার বস্তু। রমণীর চরিত্র আর মন সম্পর্কে আপনি এমন দ্বিধাহীন হচ্ছেন কেমন করে?’

‘কারণ আমি সত্যাশ্রয়ী।’ কৃষ্ণ বললেন, ‘মহর্ষি, আপনি জানেন, এই ষোলো হাজার রমণী দ্বারকার যদৃচ্ছ বিচরণকারিণী। আমাদের বংশের পুত্রগণ ব্যতীত, যাদবশ্রেষ্ঠগণের অনেকেই এই রমণীদের প্রার্থনা করে থাকেন, যথোচিত সমাদরের দ্বারা সঙ্গলাভও করে থাকেন। তা কোনও দূষণীয় বিষয় না। এদের মধ্যে আপনি বাদ দেবেন, রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, গান্ধারী (ধৃতরাষ্ট্র-পত্নী নন), হৈমবতী, শৈবা, প্রস্বাসিনী, ব্ৰতিনী এই আটজনকে। এই রমণীরত্নগণ আমার মহিষী। ষোলো হাজার রমণীরত্নও স্বর্গের অপ্সরাতুল্য একান্ত আমার দ্বারাই রক্ষিত। তাদের রক্ষণাবেক্ষণের সকল দায় দায়িত্ব আমার। আমি তাদের গতিবিধি আচরণ সবই জানি।’

মহর্ষি বিমর্ষ মুখে বললেন, ‘আপনি যা বললেন, সবই আমারও জানা আছে। আপনি পুত্রগণ ব্যতীত বললেন। কিন্তু শাম্ব আপনার পুত্রই।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘অবশ্যই। সেই জবাব তো আপনাকে আগেই দিয়েছি। শাম্ব এবং ষোলো হাজার রমণী বিষয়ে আপনার অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না।’

মহর্ষির মুখ শক্ত হয়ে উঠল, বললেন, ‘প্রমাণ পেলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?’

কৃষ্ণ হেসে বললেন, ‘প্রমাণ পেলে, তখন আর বিশ্বাস অবিশ্বাসের কী আছে? চাক্ষুষ ঘটনাই তো বিশ্বাস।’

মহর্ষি কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বললেন, ‘তবে তাই হবে। প্রমাণের সুযোগ এলে, আবার আপনার কাছে আসব। আজ বিদায় নিচ্ছি।’

কৃষ্ণ মহর্ষিকে প্রণাম করলেন। মহর্ষি কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে, মস্তক আঘ্রাণ করে বিদায় নিলেন।

কৃষ্ণের চিত্তে কোথাও সন্দেহের কোনও ছায়া ছিল না। অবিশ্বাসও তাঁর হৃদয়কে কিছুমাত্র বিচলিত করেনি। মহর্ষি নারদের অভিযোগ তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তবু মনটা যে বিচলিত না হল, তা না। কারণ মহর্ষি সহসা কোনও কথা বলবার পাত্র নন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য থাকে। কেন তিনি শাম্ব এবং ষোলো সহস্র প্রিয়দর্শিনী প্রণয়শীলা রমণীগণকে কেন্দ্র করে এমন একটি অমূলক অভিযোগ করলেন? শাম্ব কি কোনও কারণে তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেজাজি মহর্ষির বিরক্তি উৎপাদন করেছে? অথবা রমণীগণ কেউ তাঁকে দেখে কোনওরকম হাস্যপরিহাসাদি করেনি তো?

কিন্তু কৃষ্ণ কারওকেই মহর্ষির অভিযোগের বিষয়ে কিছু বললেন না। কৌতূহলবশত শাম্বকে কয়েকদিন লক্ষ করে দেখলেন। ব্যতিক্রম বা বৈশিষ্ট্য কিছুই চোখে পড়ল না। শাম্ব একজন যুদ্ধবিশারদ দৃঢ়কলেবর মহাবীর। এক্ষণে নারীসঙ্গ, প্রণয়লীলা ও নানা রঙ্গরস ক্রীড়াকৌতুকে শাম্বর আসক্তি কিঞ্চিৎ বেশি। সে তার স্ত্রী ও রমণীদের সঙ্গে যেমন ক্রীড়াকৌতুকে কাল কাটিয়ে থাকে, তার অতিরিক্ত কিছু চোখে পড়ল না।

কৃষ্ণ কি ষোলো সহস্র রমণীর অন্তরের কথা জানবার প্রয়াসে, তাদের মধ্যে উৎকর্ণ ও সজাগ দৃষ্টি নিয়ে বিচরণ করেছিলেন? করলেও, তিনি কি কিছুই অনুমান করতে পেরেছিলেন? তিনি দুরন্ত মহাবল অরিনিধনকারী বাসুদেব। নরককে বধ করে তিনি এই রমণীদের কেবল উদ্ধার করেননি, জাম্ববানের কাছ থেকে স্যমন্তক মণি উদ্ধার করেছিলেন। সত্রাজিৎ কন্যা সত্যভামাকে বিবাহ করেছিলেন। স্যমন্তক মণি যে-কোনও পুরুষের ধারণের অতি আকাঙক্ষণীয়। কিন্তু ষোলো হাজার রমণীকে নরকের পীড়ন থেকে উদ্ধার করে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন বলেই স্যমন্তক মণি ধারণ করতে পারেননি। ইচ্ছা ছিল সত্যভামা করুন। কিন্তু তিনি কৃষ্ণের বিবাহিতা স্ত্রী। যা কৃষ্ণ পারেন না, তা তিনিও পারেন না। সেই ষোলো সহস্র রমণী কি কখনও কৃষ্ণপুত্র শাম্বের প্রতি আসক্তিবোধ করতে পারে?

কৃষ্ণের একমাত্র সিদ্ধান্ত, এমন ঘটনা কদাচ ঘটতে পারে না। সংগীতাচার্য মহর্ষি নারদের অভিযোগ তিনি কোনওরকমেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। বিশ্বাস করলেন না, এবং তিনি স্থিরনিশ্চিত ছিলেন, মহর্ষি কখনওই তাঁর অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন না। অতএব জনার্দন অল্পকালের মধ্যেই মহর্ষির অভিযোগের কথা বিস্মৃত হলেন। যথাবিহিত নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযাপনে কাল কাটাতে লাগলেন। যদিচ তাঁর এই কাল ক্রমশ বার্ধক্যের দিকে ঢলে পড়ছিল, আর সেই সঙ্গে যদুবংশের মধ্যে নানারকম বিবাদ বিরোধ দেখা দিচ্ছিল।

কৃষ্ণ নিজে বিশ্বাস করতেন, জীবনকালের মধ্যে দুইটি ভাগ সর্বাপেক্ষা শ্রেয়স্কর। বনবাসে জীবনধারণ, অথবা রাজ্য ও সমৃদ্ধিলাভে পরাক্রান্ত সৌভাগ্যশালী হওয়া। এর মধ্যবর্তী ইন্দ্রিয়ভোগে কাল যাপন মানুষকে অধঃপতিত করে। বনবাসে নিরিবিলি সামান্য ধনে জীবনযাপনে শান্তি থাকে। রাজ্য-সমৃদ্ধি ইত্যাদি লাভের মধ্যে মানুষের বলবিক্রম নানা নীতি ও কূটকৌশল যুদ্ধকর্মাদিতে ব্যাপৃত থাকা, ক্রিয়াশীল জীবনের লক্ষণ। এই দুই জীবন প্রবাহের মধ্যে, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। মধ্যপন্থা মানুষকে কিছুই দেয় না। অলস বিলাস ব্যসন এবং নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের ক্ষেত্রে, ইন্দ্রিয়ভোগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তখন আর নতুন করে বিকাশের কিছু অবলম্বন থাকে না। মানুষের বলবিক্রম বা তপশ্চর্যা সব কিছুই সৃষ্টিশীল। নব নব রূপে তা উদ্‌ভাসিত হয়।

কৃষ্ণ কি যদুবংশের মহাবল পরাক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে সেই মধ্যপন্থা অবস্থা লক্ষ করছিলেন? যখন সকলেই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছিল, নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ দলাদলি পরাক্রম বিষয়ে প্রতিযোগিতা ও আস্ফালন করছিলেন? গৌরব বর্ধিত হচ্ছিল না। অতএব সম্পদও বর্ধিত হচ্ছিল না। কৃষ্ণই সর্বাপেক্ষা ভাল জানতেন, ক্ষয় ও লয় অবশ্যম্ভাবী। তিনি কি তারই অশুভ ছায়া, যদুবংশে দেখতে পেয়েছিলেন?

কিন্তু সে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

নারদ দ্বারকা ত্যাগ করলেও শাম্বের অবহেলা তিনি ভুলতে পারেননি। কৃষ্ণের অবিশ্বাস তাঁর মর্মমূলে গাঁথা ছিল। কিন্তু কেন? তিনি কি সত্যি বিশ্বাস করতেন তাঁর অভিযোগ সত্য? অসামান্য রূপবান পুরুষ শাম্বর মনে হয়তো নিজের সম্পর্কে কিছু অহংকার থাকতে পারে। সে-অহংকার কিছু কিঞ্চিৎ প্রদ্যুম্ন বা চারুদেষ্ণ, কার মধ্যেই বা না ছিল? এবং মহর্ষির এ-অনুমানও হয়তো আদৌ মিথ্যা না, বাসুদেব একান্তরূপে অসূয়াহীন ছিলেন না। মহামানবের গৌরবও চিরকাল তাঁকে আঁকড়িয়ে থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে শাম্ব প্রণয়লীলায় কখনওই অতি আসক্ত নন। কিন্তু তাঁর প্রণয়-সম্ভাষণ, কৌতূহলোদ্দীপক প্রেমলীলা, প্রণয়িনীগণের সঙ্গে তাঁর প্রণয়োদ্দীপক নানা ক্রীড়াকৌশল যা একান্ত অনায়াসসাধ্য নয়, বিবিধ আচার অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াদির অপেক্ষা রাখে তা যাদব রমণীগণের মধ্যে সুখকল্পনায় গুঞ্জরিত হত। সেটা তাঁর কোনও অপরাধ না। কিন্তু মহর্ষি ক্রুদ্ধ হয়ে, এত বড় একটা গুরুতর অভিযোগ তুললেন কেমন করে? তাও পিতার রমণীগণ বিষয়ে পুত্রকে অভিযুক্ত এবং সে অভিযোগ পিতাকেই! মহর্ষির কি কোনও বাস্তব ভিত্তি ছিল এই অভিযোগের?

সম্ভবত ছিল। দ্বারকায় ইতিপূর্বে তিনি অনেকবার এসেছেন। যাদবদের বিভিন্ন গৃহে গমন করেছেন। এবং এমন একটি ধারণা করবার মতো সঙ্গত কারণ তাঁর ছিল, রূপবান শাম্ব যাদবরমণীগণের অতি প্রিয় পুরুষ। তিনি কি কখনও কারওর মুখে শুনেছেন, কৃষ্ণের ষোলো সহস্র রমণীগণ শাম্বকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে অভিলাষপূর্ণ প্রণয়ালাপ করছে?

মহর্ষি নিশ্চয়ই কিছু জ্ঞাত ছিলেন। অথবা কেবলমাত্র রমণীর মন বিষয়ে, নানা দেশের অভিজ্ঞতাই তাঁকে এমন একটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত দান করেছিল, কৃষ্ণকে সেই গুরুতর অভিযোগ করতে তিনি দ্বিধা করেননি। তিনি দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, সর্প, মানব সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের স্ত্রীলোকগণের আচরণের নানা রীতি ও বৈপরীত্য বিষয়ে অবগত আছেন সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

মহর্ষি আবার দ্বারকায় ফিরে এলেন। দ্বারকা ত্যাগ করে গেলেও আদৌ কি তিনি দূরান্তরে কোথাও গমন করেছিলেন? মনে হয় না। সম্ভবত নিকটে থেকেই তিনি একটি বিশেষ মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন। নানা শ্রেণীর ঋষিগণের মধ্যে তাঁর কোনও সংবাদদাতা ছিলেন না, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। তিনি এ যাত্রায় দ্বারকায় এসেই আগে গেলেন রৈবতকের পর্বতের গহনে কৃষ্ণের প্রমোদকাননে। রৈবতকের সেই প্রমোদকাননে নানা বৃক্ষে বর্ণাঢ্য ফুলের সমারোহ। ভূমিসকল নানা পুষ্পপল্লবিত বীথি ও মনোহর সবুজ ঘাসে আস্তীর্ণ। প্রমোদকাননে বিশাল সুমিষ্ট স্বচ্ছ জলাশয়।

নারদ দূর থেকে দেখলেন, কৃষ্ণ তাঁর মহিষী ও ষোলোসহস্র রমণীগণসহ জলকেলিতে সুখে মগ্ন। বাসুদেবকে ঘিরে জল মধ্যে নানা রমণী নানা ক্রীড়াকৌতুকে, মরালীর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ কৃষ্ণকে স্পর্শের জন্য ব্যাকুল, কেউ জলমধ্যে বিহার আকাঙক্ষায় মীনসমূহ যেমন জলমধ্যে নিমগ্ন বৃক্ষের চারপাশে খেলা করে সেইরূপ করছিল। কেউ কেউ সুরাসব পানে অতি প্রমত্তা হয়ে নানারূপ প্রণয় কথা উচ্চারণ করছে। অন্যান্য বান্ধবীদের পৈষ্ঠী ও সুরাসবের পাত্র এগিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বাসুদেবকে অনুভব করছে। স্বভাবতই প্রমোদকানন ও জলাশয়ে রমণীরা উচ্চহাস্যে প্রগল্‌ভ কথাবার্তায় প্রমত্তা। জলাশয়ও তাদের কেলি উদ্দামে অতি উচ্ছ্বাসে তরঙ্গায়িত।

কৃষ্ণ স্বয়ং অতি উদার ও প্রমত্ত বাঞ্ছায় প্রিয় রমণীগণের সহবাসে সকলের ইচ্ছাপূরণ ও আহ্লাদিত করছেন। এই অতি প্রেমোচ্ছল জলকেলিতে বৃক্ষের পাখিরা নানা স্বরে রব করছে। বিচিত্র বর্ণের পতঙ্গসমূহ কাননের শোভা বর্ধন করছে। রমণীগণের সঙ্গে মরালীরাও জলাশয়ের অন্যপ্রান্তে নিজেদের মধ্যে কেলি করছে।

নারদ দেখলেন, সুরাসব পানে অতি প্রমত্তা রমণীগণের অঙ্গের বসনভূষণ সকলই শিথিল ও স্খলিতপ্রায়। নিজেদের নগ্নতা বিষয়ে তাদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। থাকবার কথাও না। কারণ রৈবতকের এই প্রমোদ কাননে ও জলাশয়ে একমাত্র পুরুষ কৃষ্ণ ছাড়া কারওরই উপস্থিতির কোনও উপায় নেই। কৃষ্ণের প্রমোদকানন ও জলকেলি স্থান কৃষ্ণ ছাড়া সকলের অগম্য এ-কথা দ্বারকায় সর্বজনবিদিত। কিন্তু তার অর্থ এই না, কৃষ্ণ কোনও প্রয়োজনে সেখানে কারওকে ডেকে আনতে পারবেন না। বিলাস অবকাশেও অনেক সময় কর্মজীবনের জরুরি প্রয়োজন ঘটতে পারে।

নারদ দেখলেন, এই তাঁর সেই প্রকৃষ্ট সুযোগ উপস্থিত। রমণীরা সুরাসব পানে ও যৌবন সম্ভোগেচ্ছায় অতি প্রমত্তা, হাস্যে লাস্যে কৌতুকে কেলিতে প্রমোদকানন মুখরিত। তিনি নগরের প্রাসাদে ফিরে গেলেন। প্রাসাদের কাছাকাছি কুঞ্জমধ্যে শাম্বকে তাঁর সহচরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় খুঁজে পেলেন। রূপবান শাম্বকে রমণীর সোহাগে অধিকতর রূপবান দেখাচ্ছিল। নারদ কিছুটা দ্বিধা ও সংকোচ করে বললেন, ‘শাম্ব, তোমাকে সুখে বাধা দিতে চাই না। বাসুদেব এখনও তাঁর রৈবতকের প্রমোদকাননে রয়েছেন। সেখানে তিনি তোমাকে স্মরণ করেছেন।’

শাম্ব তৎক্ষণাৎ সংবিৎ ফিরে পেলেন। মহর্ষি বাক্য কখনও মিথ্যা হবার না। পিতা স্মরণ করেছেন শোনামাত্র তিনি দ্রুতগতি হয়ে, প্রমোদকাননে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ এমন অসময়ে, তাঁর প্রমোদকাননে কেলিস্থলে শাম্বকে দেখে অবাক হলেন। কিন্তু তাঁর ষোলোসহস্র রমণীগণ, রূপবান শাম্বকে দেখে উল্লাসে মেতে উঠল। তাদের সকলের আরক্ত সিক্ত চোখ মুখ কামনায় উদ্‌বেল হয়ে উঠল। কামোচ্ছ্বাসে তারা সকলে নির্বাক হয়ে থাকতে পারল না। কৃষ্ণের উপস্থিতি সত্ত্বেও শাম্বের রূপ নিয়ে তারা প্রগল্‌ভ গুঞ্জনে মেতে উঠল।

নারদ বুঝলেন, এটা প্রথম ধাপ। রমণীরা এখনও তাদের যৌবনপ্রস্ফুটিত দেহ জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। অবিশ্যি সকল রমণীর মধ্যে তিনজন কৃষ্ণের নিকটবর্তী হয়ে অধোবদন ছিলেন। তাঁরা জাম্ববতী, রুক্মিণী, সত্যভামা। তাঁরা অবাক ও গম্ভীর হয়ে ছিলেন। মত্ততা দূরের কথা, কোনও প্রকারের বিকার তাঁদের ছিল না। নারদ এতক্ষণ অন্তরালে ছিলেন। এবার কৃষ্ণের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।

মহর্ষিকে দেখামাত্র তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সকল নারী জল থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত। নারদকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে রমণীগণ শাম্বকে তাদের প্রস্ফুটিত যৌবন দেখাতেই অত্যুৎসাহী হয়ে উঠল। তাদের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ বিবিধ ভঙ্গিসহকারে শাম্বর সামনে এমনভাবে উচ্ছ্রিত হল যে, সকলের কামোচ্ছ্বাস অত্যন্ত প্রকটিত হল। অতিমাত্রায় সুরাসবপানে, মত্ততাপ্রসূত, তারা শাম্বর প্রতি অতিপ্রার্থিনী হয়ে তাদের উজ্জ্বল রূপলাবণ্যরাশি অনাবৃত করল।

নারদের সঙ্গে কৃষ্ণের একবার দৃষ্টিবিনিময় হল। পরমুহূর্তেই মর্মাহত বাসুদেব ক্রোধে ও গ্লানিতে জ্বলন্ত চোখে রমণীদের দিকে তাকালেন। নারদকে তাঁর আর কিছুই জিজ্ঞেস করার ছিল না। বলবারও ছিল না। মহর্ষি যা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তা তিনি অতি নির্মম ভাবেই করেছেন। এখন তিনি পরিণতি দেখবার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কৃষ্ণ রমণীদের প্রতি কঠিন দৃষ্টিপাত করে ধিক্কার দিয়ে অভিশাপবাণী উচ্চারণ করলেন, ‘তোমরা আমার রক্ষিত হয়েও অতি নিকৃষ্ট আচরণ করেছ। অতি প্রমত্তা হয়ে তোমরা যেমন পণ্যাঙ্গনাদের ন্যায় ব্যবহার করেছ, আমার মৃত্যুর পরে, তোমরা তস্করদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হবে।’

কৃষ্ণের অভিশাপ যাঁদের ওপর বর্ষিত হল না তাঁরা জাম্ববতী, রুক্মিণী এবং সত্যভামা। অন্য সমস্ত রমণীগণ মুহূর্তে তাদের অপরাধ অনুভব করে আর্তস্বরে বাসুদেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। প্রমোদকাননের জলকেলি, হাস্য মুখরিত লীলাক্ষেত্র সকলই বিষাদে ডুবে গেল। কৃষ্ণ রমণীদের বললেন, ভবিষ্যতে দালভ্য ঋষির কাছে তোমাদের সম্যক জীবনধারণের উপায় জানতে পারবে।

কৃষ্ণ অতঃপর তাকালেন বজ্রাহত বিস্মিত ভীত অধোমুখ শাম্বর দিকে। শাম্বর অসামান্য রূপের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তাঁর ক্রোধানল প্রজ্বলিত হল। পুত্রকে তিনি অভিসম্পাত করলেন, ‘তোমার এই রমণীমোহন রূপ নিপাত যাক। কুষ্ঠরোগের কুশ্রীতা তোমাকে গ্রাস করুক।’

শাম্বর সর্বাঙ্গ আতঙ্কে শিহরিত হল। তিনি করজোড়ে নতজানু হয়ে বাসুদেবের পায়ের কাছে ভেঙে পড়ে, কাতর স্বরে বললেন, ‘পিতা, আমি স্বইচ্ছায় কখনওই আপনার প্রমোদকাননে আসিনি। আমি আমার জন্মমুহূর্ত থেকে আপনার আজ্ঞাবাহী সেবক। পিতা, আপনি জগদ্‌বিখ্যাত বাসুদেব। হে পুরুষোত্তম জনার্দন, হে বৃষ্ণিসিংহাবতার, এই জগতীতলে, কী বা প্রকৃতি কী বা মানুষ, আপনি সকলের অন্তর্যামী। বিশ্বচরাচরের যা কিছু অমোঘ পরিবর্তনশীলতা অথবা মানুষের অন্তরের কথা কিছুই আপনার অগোচরে থাকে না। আপনাকে কোনও কারণে অসুখী দর্শনের চেয়ে আমার পক্ষে মৃত্যুও শ্রেয়ঃ। কিন্তু আপনি জানেন আমি নিষ্পাপ। আমি আপনার ঔরসজাত সন্তান, সংসারে এর তুল্য সুখ ও অহংকার আমার আর কিছুই নেই। আপনার অন্যান্য পুত্রদের ন্যায় আমার দ্বারা কখনও কোনও নীতিবিগর্হিত কাজ সম্ভব না। আপনার সন্তাপ হতে পারে, এমন কোনও কুরুচিপূর্ণ আচরণের সাহস আমার কদাপি মনে ছায়াপাতও করেনি। হে সর্বজ্ঞ পিতা, আপনি আমাকে কেন এই নিদারুণ অভিসম্পাত করলেন?’

কৃষ্ণ সেই মুহূর্তে কোনও জবাব দিতে পারলেন না। বজ্রপাতের পরমুহূর্তে যেমন স্তব্ধতা নেমে আসে, তিনি সেইরূপ মৌনতা অবলম্বন করলেন। মহর্ষি, পুত্র, রমণীগণ, প্রমোদ কানন কোনও কিছুর প্রতি কারও প্রতিই যেন তাঁর দৃষ্টি নেই। অথচ তাঁর বিশাল চক্ষুদ্বয়ের দৃষ্টি শূন্য না। তিনি যেন স্থাণুর গভীর ধ্যানমগ্নতায় ডুবে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *