১. ধ্যান জ্ঞান প্রেমশাম্ব-কাহিনী

শাম্ব – কালকূট
প্রথম সংস্করণ: বৈশাখ ১৩৮৫

.

শ্ৰীযুক্ত শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ মহাশয়
শ্রীচরণেষু

সংস্কৃত মহাসিন্ধুর অকূলে বসে এই
সামান্য বিন্দুকে সাহিত্যে উপস্থিত
করা আমার পক্ষে অতি দুঃসাহসের কাজ
হয়েছে। আপনার মত সংস্কৃত সিন্ধু
বিশারদ থাকতে এই কাজ আমার
মনকে প্রতি মুহুর্তে সঙ্কুচিত করছে।
তথাপি আমার এই সামান্য রচনা
আপনার পাদস্পর্শে ধন্য হোক— এই
প্রার্থনা।

.

ধ্যান জ্ঞান প্রেমশাম্ব-কাহিনী—বিশেষত তাঁর পিতার দ্বারা অভিশপ্ত হওয়া, শাপমোচন ও মুক্তি, বহুবিধ ঘটনা তত্ত্ব তথ্যের জালে আবৃত। আমি তার অনেক বিষয়ই বাহুল্যবোধে ত্যাগ করেছি। কেবল তাঁর প্রতি পিতার অভিশাপের কারণ এবং শাপমোচন বিষয়কেই আমি যথাসম্ভব সহজভাবে বলতে চেয়েছি। কৃষ্ণ যেমন আমার কাছে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ মহামানব, তেমনি শাম্বকেও আমি প্রাচীনতম কালের একজন আশ্চর্য প্রতিভাশালী, ত্যাগী, “বিশ্বাসী” উজ্জলতম ব্যক্তিরূপে দেখেছি।

ইতিহাসে অনেক সময়েই, পরবর্তীকালে অনেক ঘটনা স্থূলহস্তাবলেপে প্রক্ষিপ্তভাবে প্রবেশ করে। যেমন শাম্বর সৌর উপাসনার মধ্যে অনেকে “তন্ত্র”-এর সন্ধান পেয়েছেন বা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। আমি তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করিনি। মুল-প্রসব বা পর্ব এবং যদুবংশের ধ্বংসের সঙ্গে তার যোগাযোগ কতখানি যুক্তিযুক্ত, আমি সে-বিষয়ও এই কাহিনীতে উপস্থিত করা প্রয়োজন বোধ করিনি।

আমি একটি ব্যক্তির কথাই বলতে চেয়েছি, যিনি অতি দুঃসময়েও বিশ্বাস হারান না, যিনি দৈহিক ও মানসিক কষ্টের ভিতর দিয়েও, নিরন্তর উত্তীর্ণ হবার চেষ্টা করেন। শাম্ব আমার কাছে এক “সংগ্রামী” ব্যক্তি, “বিশ্বাস” এখানে আমার বক্তব্য বিষয়, এবং এক বিপন্ন ব্যক্তির উত্তরণকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখাতে চেয়েছি, দেখতে চেয়েছি কালের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

কালকূট ॥ ১লা বৈশাখ ॥ ১৩৮৫

.

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, কথাটা আজ অন্য একটা কথার খেই ধরিয়ে দিল। ধরিয়ে দেওয়া খেই কথাটা অবিশ্যি বিপরীত। না-তে আছে হ্যাঁ। ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে। অনেকবার শোনা, আর অনেকবার বলা সেই কলিটাই তাই ফিরে আসে বারে বারে, মন চলো যাই ভ্রমণে। কিন্তু কোন ভুবনে?

এরকম একটা ধন্দ কখনও কখনও আমাকে পেয়ে বসে। তবে সচরাচর না। ভুবনের কথা এল যে! না, লোটা কম্বল নিয়ে, আর কপনি এঁটে— যাকে বলে ‘আপনি আর কপনি’ সেইরকম, সংসারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, ‘ব্যোম ভোলানাথ!’ হেঁকে আমি কদাপি দৌড় মারিনি। কেননা, ওটা আমার কাছে দৌড় মারার মতোই। বুলি হল, আপনি বাঁচলে বাপের নাম!

না, পিতা পিতৃপুরুষের নাম, আমি আমার বাঁচার থেকে ছোট করে ভাবি না। ভাবিওনি। ক্ষয় লয় মৃত্যু, অনিবার্য বলে তাকে জেনেছি। এই জানাটা যে কেবল নিজের এই জীবনকালের মধ্যে, তা যেমন সত্যি, তার থেকেও গভীরতর সত্যের কথাটা না বলে থাকতে পারছি না। ক্ষয় লয় মৃত্যুর সে-এক মহিমময় বর্ণনা, বিষ্ণুপুরাণের ধরণীগীতায় উক্তি করেছেন পরাশর। বলছেন:

তপ্তং তপো যৈঃ পুরুষপ্রবীরৈ-
রুদ্বাহুভির্ব্বর্ষগণাননেকান্‌।
ইষ্টাচ যজ্ঞা বলিনোহতিবীর্য্যাঃ
কৃতাস্তু কালেন কথাবশেষাঃ॥

আহ্‌, ওহে জীবন, তুমি আবার আমাকে দিয়ে পুরাণের শ্লোক আউড়িয়ে নিচ্ছ কেন। এ ভাষা আমার অর্জিত না। চলো যাই পণ্ডিতের পদতলে, যিনি ভাষার সিংহদ্বার ভেঙে, গম্য স্রোতে ভাসিয়েছেন পরাশরের সেই মহিমময় বেদনাভিভূত বাণী, বাংলা কথায় ধরণীগীতার সেই সব উক্তি:

‘যে-পুরুষপ্রধানগণ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে অনেক বর্ষ যাবৎ তপ আচরণ করেছিলেন, অতি বীর্যশালী যে বলবান ব্যক্তিগণ যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন, কাল তাঁদের সকলকেই কথাবশেষ করেছেন। যে-পৃথু অব্যাহত পরাক্রমে সমস্ত লোকে বিরাজ করতেন, যাঁর চক্র শত্রুদের বিদারিত করত, তিনি কালবাতাহত হয়ে, অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত শিমুল তুলার মতো বিনষ্ট হয়েছেন। যে-কার্তবীর্য সমস্ত দ্বীপ আক্রমণ করে, শত্রুমণ্ডল বিনাশ করে রাজ্য ভোগ করেছিলেন, এখন কথাপ্রসঙ্গে তাঁর নাম উত্থাপিত হলে, সন্দেহ হয়, তিনি বাস্তবিক ছিলেন কি না। ধিক! দশানন অবিক্ষিত রাঘব প্রভৃতি দিঙ্‌মুখ উদ্ভাসিতকারী রাজগণের ঐশ্বর্যও কি কালের ভ্রূভঙ্গপাতে ক্ষণমাত্রেই ভস্মসাৎ হয়নি! মান্ধাতা নামে যে-ভূমণ্ডলের চক্রবর্তীরাজ কথাশরীর প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁর কাহিনী শুনে, কে এমন সাধু ব্যক্তি আছেন, যে মন্দচেতা হয়ে নিজের প্রতি মমত্ব করবেন। ভগীরথাদি নৃপতি, সগর, ককুৎস্থ, দশানন, রাঘব, লক্ষ্মণ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদি সকলেই ছিলেন, এ-কথা সত্য। মিথ্যা না। কিন্তু এখন তাঁরা যে কোথায়, (হায়!) আমরা জানি না।’ … জানি না, কিন্তু ছিলেন— এই সত্যের বিনাশ নেই। পরাশরের লোটা কম্বল কপনি ছিল কি না, এতে আমারও বেজায় ধন্দ। কারণ, জানি না। তথাপি দেখছি, সেই প্রাচীন পুরুষপ্রধানদের তিনি ভুলতে পারছেন না। আপনি বাঁচো, বাপের নাম ভোলো, আর আপনি কপনি করে দৌড় মারো, আর ধুনি জ্বালিয়ে বেল-কাঠ বেহ্মচারীর মতো গায়ে মাখো ছাই, তিনি যে তা ছিলেন না, তার প্রমাণ তাঁরই উক্তি। যাঁদের অস্তিত্বের নশ্বরতা বিষয়ে তিনি উক্তি করেন, তাঁদের স্মরণের, তাঁরা ছিলেন, এ দায় থেকে মুক্তি পান না।

মুক্ত আমিও না। যদিও জানি, আমার বাঁচার থেকে পিতৃপুরুষগণকে ছোট করে ভাবতে পারি না, কিন্তু অবিমিশ্র সুখ কেউ রেখে যাননি এই বংশধরটির জন্য। সংসারকে নিরঙ্কুশ দুঃখের আগার ভাবি না। আর সুখ? প্রয়াগের সেই ঘর-ছাড়া পাগলাবাবার কথা মনে পড়ে যায়। যে-কথা এমন স্পষ্ট করে কোনও গীতায় উচ্চারিত হয়নি। তার আগে একটা কথা কবুল না করলে, নিজেকে যেন কেমন ছলনাকারী লাগছে। সংসারের বাইরের পথে যাঁরাই কপনি এঁটে বেরিয়েছেন, মাথায় জটা উঁচিয়ে, গায়ে ছাই মেখে খ্যাপা হয়ে ফিরছেন, তাঁদের সবাইকে আমি কখনও দৌড় মারার রঙিলা ব্রহ্মচারী বলিনি। তা হলে আমার জীবনে অনেক দর্শন, অনেক বচনবাচন দেখা আর শোনা হত না।

প্রয়াগের সেই জটা খোলা, উদলা গা, হাসকুটে মানুষটি আমাকে শুনিয়েছিলেন, ‘সুখ দুঃখটা কেমন জানিস? প্রয়াগে তীর্থ করলে, আর পকেট ভরে পুণ্যি নিয়ে গেলেই সব শেষ না। সুখদুঃখের মাপ জ্ঞানটা থাকা দরকার। পৃথিবীটাকে দেখে নিয়েছিস। আহ্, সেই দেখার কথা হচ্ছে না, ঘরে বসে ভূগোল ম্যাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছ তো। তার তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। কেমন কি না। ওটাই হল সুখ দুঃখের ভাগ। তিন ভাগ জলের মতো দুঃখ, স্থলের এক ভাগ সুখ।’

কত কাল আগের কথা? তেইশ-চব্বিশ বছর তো হল প্রায়। তখন পশ্চিমের ‘মিথ অফ সিসিফাস’ জানা ছিল না। কথাটা এমন করে মরমে বিঁধেছিল, জীবনের কত জায়গায়, কত ভাবে যে কথাটা বলেছি, নিজেরই কোনও হিসাব নেই। কথাটা এই কারণে মরমে বেঁধেনি, জীবনটা একান্তই দুঃখের অকূল সমুদ্র। বড় অসহায় বোধ করেছিলাম। জীবনকে দেখার সেই দৃষ্টিভঙ্গি, নিদারুণ মনে হয়েছিল। তখনও সুখ বিষয়ে মনের মাত্রাজ্ঞানে আকাঙ্ক্ষার ভাগটা ছিল অনেক বড়। কথাটা শুনে মনে হয়েছিল, জীবন হল দুঃখের দ্বারা বেষ্টিত। তাকে পাশ কাটিয়ে যাই, এমন কোনও পথ ছিল না। ব্রহ্মাণ্ডের অনিবার্যতার প্রমাণটা একটা প্রতীক। তিন ভাগ জলের ধারা প্রবাহিত স্থলের অভ্যন্তরে নানা নদ ও নদী। তার ওপরে, পন্থ বড় বন্ধুর হে, পন্থ বড় বন্ধুর। তিন ভাগ জল ছিল এক গভীর অর্থবহ সংবাদ। দুঃখ জীবনের সমগ্রতায় অনতিক্ৰমণীয়। সুখ থাকে দুঃখের কুণ্ডলীতে। নাম তার ঝলকিত দ্যুতি। সামান্য জীবনকালের কয়েকটি স্বপ্নময় মুহূর্ত মাত্র।

পরবর্তীকালে পশ্চিমের ‘মিথ অফ সিসিফাস’ পড়ে, তিন ভাগ জলের প্রতীকটাকে সমার্থক মনে হয়েছিল। আরও পরে বুঝেছিলাম, দুটো ধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুটো বিশ্বাস আলাদা, অভিজ্ঞতা ভিন্নতর। অভিশাপ আর বিশ্বের নিয়মের অনিবার্যতায় বেবাক ফারাক।

প্রয়াগের সাধু আমাকে শুনিয়েছিলেন, বিশ্ব নিয়মের একটি অনিবার্যতার কথা! পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। জীবনের তিন ভাগ দুঃখ, এক ভাগ সুখ। এর নাম মন্ত্র তন্ত্র না। দার্শনিকতা? কেউ দাবি করেনি। ভারতের ঘাটে মাঠে গাছতলায়, এক শ্রেণীর সর্বত্যাগীর (সর্বহারা বলা যায় কি?) মুখে মুখে জন্ম নেয়। এখন বোঝো হে কথা, যে জানো সন্ধান। কারওর মাথার দিব্যি নেই।

কিন্তু তথাপি মনে একটা খটকা, প্রাণে লাগে একটা ধন্দের দোলা। এই যে কেবল ভারত ভারত করি, কেবল কি ভারতের মাঠে ঘাটে গাছতলাতেই এমন কথার জন্ম হয়। জগতের আর কোথাও না? ঘাড় ঝাঁকাতে পারি না। শিরে টান ধরে। প্রয়াগের গাছতলা কি প্রাগে নেই? প্রাগের ঘাট সাইবেরিয়ায়? সাইবেরিয়ার মাঠ সাংহাইয়ে? কাসপিয়ানের কূলে কিংবা অতলান্তিকের বেলাভূমে?

সত্যি মিথ্যা জানি না। অবুঝ মন বলে, আছে। বোঝদার বললে কেউ ‘অংখারি’ ভাবে, তাই। তবে নিতান্ত অবুঝ মনের কথা না। সেই মহান মেষপালক, গায়ে ছেঁড়া আলখাল্লা, আর এক মুখ দাড়ি নিয়ে মাঠে ঘাটেই তাঁর কথার জন্ম দিয়েছিলেন।

খেই হারালাম নাকি? না। কথা হচ্ছিল, ‘মরিতে চাহি না…।’ বলতে চাইছিলাম, না-তে আছে হ্যাঁ, অন্য কথায়। ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে: কিন্তু কোন ভুবনে? ভুবনের কথাটা এল, আমার ধন্দটাও, অতএব। সেই কারণেই লোটা কম্বল কপনির প্রসঙ্গ। কথাটা অনেকবার অনেকভাবে বলেছি, ভ্রমণে যাব। কিন্তু সংসারটাকে ছাড়িয়ে যাবার কথা কখনও মনে হয়নি। তিন ভাগ জলের সত্যকে জেনেছি বটে, উপলব্ধি অন্য কথা। সেই জানা থেকেই, আমার এক কথা, আমি লোটা কম্বলধারী না। পরিব্রাজক যাঁদের বলে, প্রব্রজ্যা যাঁদের পরিভ্রমণ, আমার মন চলো যাই ভ্রমণের সঙ্গে তার মিল নেই কোথাও। বৈরাগ্য যে কখনও অন্তরকে গ্রাস করে না, সে-কথা বলা কঠিন। বৈরাগী হতে গেলেই, সংসারের ধিক্কারটা বড় কঠিন হয়ে বাজে।

তাই কি? আসলে বৈরাগী যে হতেই চাইনি কখনও। সন্ন্যাস আমার জন্য না। লোটা কম্বল নিয়ে যদি দৌড় দিতে পারতাম, তবে আমার থেকে কার বিবেক আর বেশি সাফ সুরত থাকত? মনের কথাটা তো গোড়াতেই বলেছি। ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে। কথাটা আরশিতে ফেলে দেখতে গিয়ে তাজ্জব। দেখি, লেখা রয়েছে, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ এই চাওয়া আর না চাওয়ার মধ্যে, যদি আনন্দের ধ্বনি বেজে থাকে, বাজুক না কেন। আরও কি বাজে কোনও আর্তস্বর? অথবা এরই মধ্যে জীবনের অলঙ্ঘিত বিধি, সম্যক জ্ঞানের ধারায় নিয়ে চলে?

না না না, এ বড় পয়জার হে৷ মনের নানা ব্যাজ। উসব থাকুক গা মনের রাংচিতের বেড়ায় ঢাকা। আমার এক কথা, ভ্রমি অনুরাগে। আমার হল অনুরাগের ভ্রমণ। কিন্তু ওই ভুবনে এবার আমার ঠেক লেগেছে। মন নিয়ে কথা। ঠেক ধন্দ যে কত, আজতক বলে বলে তার ইতি করতে পারলাম না।

একটা মজার কথা বলি। ছেলেবেলার কৃষ্ণযাত্রার কথা, মন তখনও কুসুমকলি। বিরহিণী রাধার কাছ থেকে কৃষ্ণ বিদায় নেবেন। কিন্তু বিদায় নেবার ইচ্ছা নেই। মানভঞ্জনটা হয়েছে। রাধার দুই সখী দু’পাশে। কৃষ্ণ বললেন, ‘এবার তা হলে যাই।’ বলে পা বাড়ালেন।

সখী বললেন, ‘যাই নয়, আসি।’

কৃষ্ণ ফিরে এসে দাঁড়ালেন। রাধা এবং সখীরা অবাক! কী হল? কৃষ্ণ বললেন, ‘বললে যে যাই না আসি। তাই এলাম।’

সখী হেসে বললেন, ‘যাই বলতে নেই, যাবার বেলায় আসি বলতে হয়।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘তাই বুঝি? এবার তা হলে আসি।’ যাবার জন্য পা বাড়ালেন।

সখী বললেন, ‘এসো।’

কৃষ্ণ আবার ফিরে এলেন। রাধা এবং সখীরা আবার অবাক! কৃষ্ণ বললেন, ‘এসো বললে, তাই এলাম।’

রাধার অনুরাগ আর বিরহ কাতরতা যুগপৎ বাড়ে। সখীরা হাসেন। কৃষ্ণযাত্রার কেষ্টঠাকুরটি বরাবরই চতুর রসিকলাল। আমাদের ক্ষেত্রে বিটলেমি। বুঝতে পারছি না, আমাকে সেই বিটলেমিতে পেল কি না। ভুবনের ঠেক লাগল এই কারণে, ভ্রমণে যাব কোন ভুবনে। হিসাবে দেখেছি, ভুবন তিনটি। ত্রিভুবন যাকে বলে।

অনুরাগের ভ্রমণের একটা বৈশিষ্ট্য, ডানায় কাঁপন লেগে যায়। নিষ্পত্র গাছপালা আর বরফের দেশ ছেড়ে পাখিরা যেমন পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় চিরবসন্তের দেশে। তা বলে কি আমার ভ্রমণ কাসপিয়ানের কূল থেকে কুরু পাঞ্চালে? ইস! টিকিটবাবুরা হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেই? মনের পাখায় কাঁপন যতই লাগুক, আকাশযান জলযান স্থলযান, ব্যতিরেকে উড়ব কীসে? আর সেইসব যানবাহী হলে ফুঁকো ট্যাঁকে মনের পাখনায় মরণ ধরে। সবাইয়ের এক বুলি, ফ্যালো কড়ি মাখো তেল, তুমি যে আমার বড় আপন গো!

না, অমন দূর দূরান্তের ভ্রমণ আমার কপালে নেই। আমার হল, দশজনকে নিয়ে ঘর করতে, হঠাৎ গুনগুনিয়ে ওঠা “মন চলো যাই ভ্রমণে/ কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে।” কৃষ্ণ হেথায় প্রতীক, এক অরূপ রূপের ঠাঁই। তার কোনও ব্যাখ্যা নেই, নগর পুরী জনপদের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে ঘরের হাতায় মাঠ থেকেই মোটর বাসে চেপে বসে, ঘরেরই আর এক পিঠে গিয়ে নামো। কোনও এক গাঁয়ের পথে, নয় তো কোনও এক খোয়াইয়ের ঢালুতে। কুন্তী নামেও তো এক নদী আছে, অথবা ক্ষীণধারা সরস্বতীর কূলে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় ভ্রমণে চলে যাও। নানুরের পুকুর ধারে, নয়তো ছাতনার ঝোপ ঝাড়ের জঙ্গলে। সোনামুখীতে না গিয়ে, পাঁচমুড়ার গাঁয়ে গিয়ে বসো। থেলো হুঁকোয় ভুড়ুক ভুড়ুক করে, পোড়ামাটির শিল্পী কারিগরদের উঠোনে বসলে কেউ তোমাকে ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করবে না। গুলবাজি? না। কসম? কসম! এমন অনেক জায়গার নাম করতে পারি। সবই মনে হবে কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগান।

যে যায় এমন ভ্রমণে।

কৃষ্ণ থাকেন তার সনে।

আবার কৃষ্ণ? আবার কেন, বারে বারে। বললাম না, ওই নাম হল প্রতীক। পাবার আশায় সেখানে কেউ যায় না। নিজেকে একটু ধোয়া মোছা সাফসুরত করতে যাওয়া। এত কথা কীসের। বলছি, প্রাণের লক্ষ কক্ষে বায়ুর ভারী চাপ। প্রাণে বায়ু চালাচালির নামই ভ্রমণ।

‘তা যেন হল।’ তিনি বলেছিলেন, ‘ভ্রমণে তোর সঙ্গে না যেতে পারলেও মনটা হালকা হল। কিন্তু খাস কী?’

‘খাই কী?’

‘হ্যাঁ, খাস কী?’

একে বলে জিজ্ঞাসা! প্রাণের লক্ষ কক্ষে বায়ু চালাচালি তো করছ বাপু, মহাপ্রাণীটির ব্যবস্থা কী? দাঁতকপাটি? যে তাঁর বচন শোনেনি, সে বুঝবে না, জিজ্ঞাসায় ঝাঁজ কেমন। তারপরেই আবার পালটা জিজ্ঞাসা, ‘গেরস্তের বাড়িতে পাত পাতিস?’

‘আজ্ঞে সে কখনও সখনও। সব জায়গায় সব গেরস্ত তো সমান না। আশেপাশের দোকান থেকে চিড়ে মুড়ি মুড়কি কেনা যায়। ময়রার দোকান থাকলে তো কথা নেই। দই মণ্ডা মেঠাইও কিছু মেলে।’

‘তুই একটা আস্ত গাধা।’

‘আজ্ঞে?’

‘হ্যাঁ, বইলছি, তুই একটা কুড়ের বাদশা। ওতে না আছে মজা, না ভরে পেট। খেটে খেতে পারিস না?’

সেটা কী রকম? জিজ্ঞাসা করিনি, চোখে জিজ্ঞাসা নিয়েই তাকিয়েছিলাম।

‘রেঁধে খেতে পারিস না?’

‘রেঁধে?’

‘হ্যাঁ রে বাঁদর, রেঁধে। তোর বয়সে আমি ওরকম অনেক, ঘর করতে উঠবন্দি প্রজার মত বেরিয়ে পড়তাম। সেইজন্যই তোর বেরিয়ে পড়ার খবরে আমি খুশি। কিন্তু আমি তোর মতন ওরকম চিড়ে মুড়ি মণ্ডা মেঠাইতে ছিলুম না, বুঝলি?’

‘কীসে থাকতেন?’

‘ক্যানে, দোকানে চাল ডাল মেলে না? নুন লঙ্কা তেল? হাঁড়ি মালসা, গেরস্তের বাগানে কলাপাতা?’

‘তা তো মেলে।’

‘মেলে মানে? মিলবেই। তোকে তো আর কেউ শিল নোড়ায় বাটনা বাটতে বলেনি। বলেছে কি? ত? যা, সব কিনে কেটে জোগাড়জাত করে, গাঁয়ের বাইরে গাছতলায় যেয়ে বস। গাছের শুকনো পাতা ডাল কুড়িয়ে আন। কিছু না পাস মাটির ঢ্যালা বসিয়েই উনোন সাজা। জল নিয়ে টিপটিপিনি আছে নাকি?’

‘আজ্ঞে?’

‘বইলছি পেট রুগিদের মতন, এ-জল খাব না, সে-জল খাব, ওসব হ্যাপা নাই ত?’

‘না।’

‘ওইটেই বাঁচোয়া। তবে যা, কাছেপিঠে যেখানে পুকুর টিউবকল যা পাবি, হাঁড়িতে করে জল নিয়ে আয়। চালে ডালে বসিয়ে দে। মালসায় তেলের ছিটা দিয়ে, লঙ্কা ভেজে নে, হাঁড়িতে ঢেলে দে। গাছের ডাল দিয়ে হাঁড়িতে নাড়। ঠিক মতন ফুট খেয়েছে? তা হলে এবার গরম গরম কলাপাতায় ঢাল, আর খা। কেমন লাইগছে?’

‘আজ্ঞে জিভে জল এসে যাচ্ছে।’

‘তব্যা? তা না চিড়া মুড়ি মেঠাই মণ্ডা। এখন তোর আশেপাশে কারা আছে বল। দিকিনি?’

‘আজ্ঞে, কই? কেউ নেই তো।’

‘গাধা! নিদেনপক্ষে চার-পাঁচটা গায়ের অনাহারী কুকুর তোকে ঘিরে বসে নেই? কাক শালিকের কথা বাদই দিলাম।’

‘ইস! সত্যিই তো, মনেই ছিল না দাদা।’

‘মনে না রাখলে লিখবি কেমন করে? এবার নিজে খা, ওদের দে। তারপর কী করবি?’

‘গাছতলায় শোব?’

‘তা শুবি না আরামখোর! শোবার জন্যে তখন একটা জাজিমের কথা মনে পড়বে, তারপরে একটি দাসী।’ মনে আছে, হেসে জিভ কেটেছিলাম। কিন্তু তিনি তাঁর মনে, ‘ঢ্যালা মেরে উনোন ভেঙে হাড়ি মালসা ভেঙেচুরে, আর পেছনে তাকানো নয়, চলে যা, নিজের পথে। তোর বয়সে আমি যখন বেরিয়ে পড়তাম, এইরকম করতাম। বেরিয়ে পড়লেই, গায়ে গতরে খাটবি না, পোকা পড়বে যে! তবে ওই দিনান্তে একবার। হাত পুড়িয়ে খাবি, মুখে অমৃতের স্বাদ পাবি। চড়ুইভাতি কি কেবল দঙ্গলে হয়? জঙ্গলে একা হয় না?’

হয় না আবার? হাতে কলমে পরখ করে দেখেছি। কেবল কি অমৃতের স্বাদই পেয়েছি? আর কিছু না? আরও কিছু। একলা সেই অনুষ্ঠান, এক যজ্ঞের মতো। সেই যজ্ঞের মধ্যে নিজেকে যেন অনেকখানি চিনে নেওয়া যায়। আহা, জানি তোমরা কী ভাবছ। আর তা জেনে আমার এমনি করে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘পাঠক! তোমাদিগের মনের অবস্থা আমি অনুমান করিতে পারিতেছি। যে-ব্যক্তির সঙ্গে আমার উক্ত প্রকার আলাপাদি হইয়াছিল, তাঁহার পরিচয় জানিবার জন্য তোমাদিগের কৌতুহল অতি তীব্র হইয়াছে।’ বচনদারের বচনেও যদি না বোঝা গিয়ে থাকে, তবে বলি, তিনি কথাশরীর প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি দিঙ্‌উদ্ভাসিত সাহিত্য রচয়িতা তারাশঙ্কর— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কথাশরীর প্রাপ্ত হওয়া মানে কী? পণ্ডিতমশাইয়ের কাছ থেকে যথার্থরূপে জেনে নেওয়া হয়নি। কথাশরীর প্রাপ্ত কি কেবল মৃত্যু? সম্ভবত না। যিনি এখন ইতিহাস তিনি কথাশরীর প্রাপ্ত হন। দাদা (এই নামেই তাঁকে ডাকতাম। দাদার আগে নাম ধরবার, অন্তত তাঁর ক্ষেত্রে, জিভ আড়ষ্ট হয়ে যেত। সেটা তাঁর বয়স এবং ব্যক্তিত্ব।) এখন সৃষ্টি জগতের ইতিহাস।

কিন্তু ‘আমার সাধ না মিটিল/ আশা না পুরিল।’ বড় ইচ্ছা ছিল, তাঁর সঙ্গে একবার ভ্রমণে যাই। গ্রামের বাইরে গাছতলায় চাল ডাল হাঁড়ি মালসা নুন তেল জোগাড়জাত করে গিয়ে বসি, মাটির ঢ্যালায় উনোন সাজিয়ে, হাঁড়ি চাপিয়ে দিই। আমি শুকনো কাঠ পাতায় আগুন উসকে তুলব, তিনি গাছের ডাল দিয়ে হাঁড়িতে নাড়বেন। আর তখন কি গুনগুন করবেন, ‘জীবন এত ছোট ক্যানে?’

এই দেখো, আমার প্রাণের বায়ুর ঘরে কেমন হাহাকার করে উঠেছে। ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। কারণ, সে-উপায় যে আর ছিল না। সাধ মেটাতে পারিনি। কালের স্রোত তখন তাঁকে অন্যদিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। একলা চড়ুইভাতির দিন শেষ অভিজ্ঞতাগুলোকে হৃদয়ের জারিত রসে রূপায়ণের একনিষ্ঠ শিল্পী। কর্তব্য আর বয়সের দায় তাঁকে ঘরবন্দি করেছে।

তা-ও বা কতটা? ঘরে বন্দি হবার লোক কি তিনি ছিলেন। আর একটা ঘটনা বলে নেব নাকি? এই দেখো, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, কথায় বলে। আমার সেই অবস্থা। আমি খেই হারাতে বসেছি। তবু মন বলছে, খেদ রেখো না বাপু, যা বলবার ঝটপট বলে ফ্যালো।

হ্যাঁ, তাই বলি। একবার দাদার সঙ্গে গিয়েছি সাঁওতাল পরগনার শিমুলতলায়। আরও অনেকে ছিলেন। কেন, কী বৃত্তান্ত, সে-সব কথা থাক। আবহাওয়াটা দঙ্গলের চড়ুইভাতির মতোই। দুপুরবেলা খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করে, ঠিক হল তিন মাইল দূরে তিলুয়াবাজারের হাটে যাওয়া হবে বাজার করবার জন্য। আসলে সেও এক ভ্রমণ।

হাটে একটি সাঁওতাল মেয়ে, খাঁচায় পুরে নিয়ে এসেছিল কয়েকটি পায়রা। নতুন পাখনা গজানো নধর পায়রা। সচকিত ভীরু পায়রাগুলো, খাঁচার মধ্যে হাটের ভিড় দেখে ছটফট করছিল। হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল, অনেককাল পায়রার মাংস খাওয়া হয়নি। দাদাকে বললাম, ‘পায়রা ক’টা কেনা যাক, মাংস খাব।’

দাদা তাঁর মোটা লেন্সের চশমায়, খয়েরি উজ্জ্বল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘পায়রার মাংস খাবি?’ তারপরে পায়রাগুলোর দিকে তাকালেন। পায়রাদের থেকে চোখ তুলে সাঁওতাল মেয়েটির দিকে। আমাকে বললেন, ‘তা হলে কিনে ফ্যাল।’

কিনে ফেলেছিলাম। দাম শুনে তো নিজেকে মনে হয়েছিল, ‘ড্যানচিবাবু’। দাদা হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দেখি।’

খাঁচাটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম তাঁর দিকে। তিনি খাঁচার দরজাটি খুলতে খুলতে বলেছিলেন, ‘পায়রার মাংস খাবি?’ খা!’ বলে একটি একটি করে পায়রাকে ধরে বাইরে, আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন।

আমি হাহাকার করতে গিয়ে দেখেছিলাম, সাঁওতাল পরগনার হেমন্তের আকাশে পড়ন্ত বেলার রোদে, চিত্রগ্রীবের দল কেমন রং বাহারে উড়ে গিয়েছিল। দাদা তাকিয়ে ছিলেন আমার মুখের দিকে। না, অনুশোচনার কিছুমাত্র অভিব্যক্তি ছিল না তাঁর চোখে মুখে। বরং মিটিমিটি হাসি। বলেছিলেন, ‘আরও পায়রা কিনবি নাকি? চল দেখি, হাটে নিশ্চয় আরও পায়রা এসেছে।’

বিক্ৰয়িত্রী সাঁওতাল কন্যাটি, আর তার আশেপাশে, ইস্তক আমাদের অন্যান্য সঙ্গীরাও তখন হাসতে আরম্ভ করেছে। ভ্রমণে এলাম আমি। আকাশ বিহারে গেল কবুতরেরা! কিন্তু হাসিটা তখন আমার ভিতরেও সঞ্চারিত হয়েছে। সেই হল আর এক রকমের কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে ভ্রমণ!

সত্যি খেই হারালাম নাকি? কথা হচ্ছিল, ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে। ভুবনের কথা এসে গেল, গোলমালটা সেখানে। ত্রিভুবনের কোন ভুবনে যাব? ঝোলা কাঁধে নিয়ে, রেলগাড়িতে বা মোটর বাসে চাপলেই কি ত্রিভুবনের কোনও এক ভুবনে যাওয়া যায়? এবারে আমার ঠেক লেগেছে সেইখানে। এই ত্রিভুবনের সংজ্ঞাটা একটু ভিন্ন রকমের। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল, ভ্রমণের এই ত্রিভুবন এবার আমাকে ডাক দিয়েছে। আর এই ত্রিভুবনে যেতে হলে, ঝোলা কাঁধে নিয়ে কোনও যানবাহনে চেপে যাওয়া একেবারে অসম্ভব।

বুঝতে পারছি, স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নামেই অনেক বাংরেজ বাবাজির মাথায় লগুড়াঘাত লাগল। অথবা কালকূটের মস্তিষ্কের সুস্থতা বিষয়ে অনেকে উদ্‌বিগ্ন হয়ে উঠছে। নয় তো হাসি পাচ্ছে। পেতে পারে। তাতেও, হাসতে গেলে কপাল ব্যথার আশঙ্কা আছে, নিবেদন করে রাখছি।

ভেবেছিলাম সরাসরি যাত্রা করব দ্বারাবতী, যে-স্থানকে লোকে জানে দ্বারকা নামে। স্থান যদি দ্বারাবতী, কাল তবে কলি-সন্ধ্যা, অর্থাৎ দ্বাপরান্তর। কিন্তু কাল এবং যুগের এই বিচারটা বোধহয় অনেকেরই হালে পানি পাবে না। আধুনিক ইতিহাসের কাল গণনার বিচারটা, আমার অনেক আগের পুরুষ থেকেই ভিন্ন পথগামী। যদি বলি পৌরাণিক মতে অষ্টাবিংশ যুগ, তবে এই নিশ্চিত ও অমোঘ কাল গণনা অনেকের কাছে ধাঁধার মতো লাগবে। কারণ দোষ কারও নয় গো মা/ আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা। সাহেবরা যে আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন, পুরাণ মানে মাইথলজি, ইতিহাস না। অতএব সে-কাল গণনা অনেকটা রূপকথার মতো। হ্যাঁ, মিথ্যার স্বর্গবাসেও সুখ আছে বই কী! সুখ এই, মেনে নিলে আর পরিশ্রম করতে হয় না।

কিন্তু এ তো হল তর্কের কথা। ইতিহাস প্রমাণ চায়। তাই প্রমাণ দিই। কাঁধ থেকে ঝোলাটা রেখে, এবার মন চলো যাই দ্বারাবতী। সেখানে কে আছেন? বাসুদেব। যাদবশ্রেষ্ঠ, তিনি কেবল নরপতি নন, কালান্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কালের হিসাবটা কী? তাঁর জন্মকালের হিসাবে সময়টা এক হাজার চারশো আটান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই হিসাবটা আধুনিক ঐতিহাসিক কাল গণনা। পুরাণের অষ্টাবিংশ যুগ, কলির সন্ধ্যা। কেউ বলেছেন দ্বাপরান্তর। যিশুখ্রিস্টের মতো যদি কৃষ্ণ জন্মাব্দ বা কৃষ্ণাব্দ গণনা হত, তা হলে এই যিশু জন্মের উনিশশো সাতাত্তর সালকে বলা যেত তিন হাজার চারশো পঁয়ত্রিশ সাল।

বিশেষ কাল নির্দেশে আরও কিছু অতীতে যাব নাকি? কিন্তু পণ্ডিত মশাইদের ভ্রূকুটি আর তর্ককে যে বড় ভয় লাগে! এই সেদিনই তো রাম-রামায়ণ নিয়ে তর্ক বিতর্কের ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছিল। ধুন্ধুমার! কথাটা কত সহজেই না আমরা কাজে লাগিয়ে ফেলেছি। আসলে ধুন্ধু নামক দৈত্যের যিনি নিধনকারী, তাঁরই নাম ধুন্ধুমার। ধ্বনির গুণ বটে। বিশেষণকে লাগিয়ে দিলাম ক্রিয়াবাচক শব্দে। তবে আমার প্রণাম সদ্য স্বর্গত আচার্য সুনীতিকুমারকে। প্রণাম রমেশচন্দ্র ঐতিহাসিক মহাজনকে এবং আরও সকলকে। কিন্তু আমি তর্কে নেই। বিদগ্ধজনের রচনার পথ ধরে আমার এবারের যাত্রা।

দেখছি, শ্রীরাম ছিলেন দুই হাজার একশো চব্বিশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তা হলে রামাব্দ ধরতে হয় চার হাজার একশো এক সাল। আর রামের থেকে কৃষ্ণ ছিলেন ছ’শো ছেষট্টি বছরের ছোট। কিন্তু কী লাভ আমার এই গণনায়? আমি অযোধ্যায় যাব না। আমার যাত্রা দ্বারাবতীর পথে।

এই যাত্রার আগে, আমাকে আর একবার সেই বাউলের গানে ফিরে যেতে হবে। গানে দেখছি, কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে, ‘বাগানে পাঁচজনা মালী/ যে যাঁর ঠাঁইয়ে বস্যে আছেন/ পাঁচ মাথার মোড় আগুলি।’..এখন এই বুঝহ রসিকজন, এই পাঁচজনা মালী কারা, পাঁচ মাথার মোড় আগলিয়ে বসে আছেন? কথায় ধন্দ আছে বটে, কিন্তু দ্বন্দ্ব নাই, এঁয়ারা হলেন বাউলের প্রতীক পঞ্চেন্দ্রিয়। দেহতত্ত্বে এমন প্রতীক বিস্তর। আমার এক কলসিতে নয়টি ছিদরি/ কেমনে জল ধরি ভরা কলসির ভিতরি।… এও বোধহয় সেই নবম দলের নয়টি নাড়ির প্রতীক। এমন প্রতীক কথায় কথায়। ষোলো ঘর থেকে চৌষট্টি ঘরও মেলে। আবার ত্রিবেণীতে ডুব দিয়ে, মীন ধরবার জালও বাঁধে।

আসলে, এ-সব হল, মূলে যাবার প্রস্তুতি। সিদ্ধির প্রমাণ-পথের দ্বারের যথাযথ খোলা বন্ধ। বলব নাকি, সাধনার মুখবন্ধ? তা হলে আমার গীত গাইবার সুবিধা হয়। ইতিহাস-প্রসিদ্ধ দ্বারাবতী যাবার আগে, পুরাণ যে ইতিহাস, তার যুক্তির ধন্দ কিঞ্চিৎ কাটানো দরকার। কাটান করবার আমি কেউ না, স্বয়ং পুরাণকাররাই তার কাটানদার। পুরাতনস্য কল্পস্য পুরাণানি বিদুৰ্বধাঃ। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ পুরাণকে প্রাচীনকালের বিবরণ জ্ঞানেই অবগত আছেন।

জ্ঞানীর সঙ্গে আমার মতো অর্বাচীনের ফারাক হল, আমি সংশয়ী। আমার যুক্তি চাই। প্রমাণটা চাই আগে নিজের। খুঁজতে গিয়ে দেখছি, খ্রিস্টজন্মকালকে যাঁরা কালবিন্দু হিসাবে ধরেছেন, কৃষ্ণজন্মকালকে তারা খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভাবতে আপত্তি করছেন। এ আপত্তিটা কুসংস্কার, কারণ পুরাণকার দেখছি যুগমানের দ্বারা কাল নির্ণয় করেছেন। ফলে তাঁদের বি-সি এ-ডি নেই। একজন বলেন এক হাজার ছেষট্টি খ্রিস্টাব্দে রাজা উইলিয়ম ছিলেন। আর একজন বললেন কৃষ্ণ অষ্টাবিংশ যুগে ছিলেন।

সৃষ্টি, প্রলয়, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত পুরাণের কাছে এই পাঁচ বিষয় ইতিহাসের মূল উপাদান। তার বিশ্বাস, যে দেশ প্রথম সৃষ্ট হল, তখন থেকেই তার হিস্টরি (পুরাণ) বা ইতিবৃত্ত লেখা হওয়া উচিত। ইংল্যান্ডের ইতিবৃত্ত কেউ কেউ নিওলিথিক ও পোলিওলিথিক অধিবাসীদের দিয়ে শুরু করেছেন। তারও আদিমকালের অতীতে যেতে হলে, ভূতত্ত্বের কথা আসে। ওয়েলস তাঁর ইতিবৃত্ত সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন। অনেকটা পুরাণের মতোই। কিন্তু হিসাবের কালবিন্দু যিশু জন্মকাল। পুরাণের কি কোনও কালবিন্দু নেই? নেই। তার আদিবিন্দু আছে, তাকে বলা হয়েছে মানবকল্পের আদিবিন্দু। স্বয়ম্ভূর মনুকাল, পাঁচ হাজার ন’শো আটান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই আদিবিন্দুর অতীতে আর-কিছু নেই। থাকলেও তা ইতিবৃত্তে আসেনি।

মুশকিল! বলে তো যাচ্ছি ইতিবৃত্ত। বিষয়টা কী? পণ্ডিত বলছেন, ইতিবৃত্ত শব্দের অভিধা ইতিহাস শব্দের অনুরূপ হওয়ায়, তা হিস্টরি অর্থে অচল। হিস্টরির সংস্কৃত অর্থ ইতিবৃত্ত। ইতিহাস শব্দের অর্থ, সংস্কৃতে আর বাংলায় ভিন্ন। পুরাণের বিচারে ভুলের সম্ভাবনায় ভরা। ইত অর্থে যা গত হয়েছে, বৃত্ত অর্থে বর্ণনা। ইতিবৃত্ত, এই পারিভাষিক প্রয়োগে ভুলের সম্ভাবনা নেই।

দ্বারাবতী ভ্রমণে যাবার দেখছি বিস্তর ঝকমারি। পথঘাটের নিশানা পাওয়া ভারী দুষ্কর। পথ চিনে যাওয়ার হাজার হাজার বছরের কাঁটা। কাঁটা না, কালের স্তর। অথচ ঠিক ঠিক পথে যাচ্ছি কি না, সে-সংশয়ে হোঁচট খাচ্ছি বারে বারে। কিন্তু সংশয় না ঘূচিয়ে উপায় নেই। দিঙ্‌নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে অতএব পথ বন্ধন করো। যার নাম যুক্তিতে হদিশ।

আমি নৈয়ায়িক না, ন্যায়শাস্ত্রের কূট চালেও নেই। পুরাণের ইতিবৃত্তের পথই আমাকে খুঁজে নিয়ে যেতে হবে। পুরাণকারের কথা আগেই বলেছি, তাঁদের ইতিবৃত্তের লক্ষণ বা উপাদান সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত। সৰ্গ বোঝায় বিশ্বের সৃষ্টি, প্রতিসর্গ প্রলয়। রাজা ঋষি প্রধান ব্যক্তিগণ দেবতা দৈত্যগণের বংশের উৎপত্তি স্থিতি বিলোপ আর বংশানুক্রম। বংশ শব্দের অর্থ ইংরেজিতে কি ডাইনাস্টি? হ্যাঁ একেবারে সম্যক বংশ বর্ণনা। মন্বন্তর এখানে ‘দুটো ভাত দাও মা’ দুর্ভিক্ষের অর্থে না। মন্বন্তর মনুকাল। কাল গণনার জন্যই যুগকাল আর মনুকাল পুরাণকারেরা ধরে নিয়েছেন।

এই ইতিবৃত্তকারগণ কারা? দেখছি, পুরাকালে প্রত্যেক রাজার নিজের ইতিবৃত্তকার থাকতেন। এঁদের বলা হত মাগধ। এঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন রাজবংশের বিবরণ সংগ্রহ করতেন সূতগণ। এই সূতেরাই হলেন খাঁটি লোক, কোনও বিশেষ বংশের পোঁ ধরা ছিলেন না। মিথ্যাকে কাট-ছাঁট করতে জানতেন। তাঁদের বিবরণ পুরাণের মূল ভিত্তি। তাঁরা এক একজন ছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার। সূত ঋষিগণকে বলছেন, আপনাদের দ্বারা পুরাণ কথনে প্রণোদিত হয়ে আমি নিজেকে পবিত্র আর অনুগৃহীত বোধ করছি। আমার স্বধর্ম, দেবতা আর ঋষিগণের, অমিততেজসম্পন্ন রাজাদের, খ্যাতনামা মহাত্মাদের বংশবৃত্তান্ত জানা এবং ধারণ করে রাখা। কিন্তু বেদে আমার কোনও অধিকার নেই। অথচ পুরাণ বেদসস্মিতম্‌।

বেদের আগে পুরাণ। আমি আদি পুরাণে যা শুনেছি, মহাত্মা ঋষিগণ যা বলেছেন, পরাশরপুত্র গুরু দ্বৈপায়ন অতি কষ্টে যা নির্ণয় করে গিয়েছেন, ঠিক যেমনটি শুনেছি, তেমনটি আপনাদের শোনাই। আমাকে (আমাদের) বলা হয়েছে, অতিশয় বিশ্বাসভাজন বিদ্বান লোমহর্ষণ সূত। আমি যে-কথা যেমনভাবে শুনেছি ঠিক সেইভাবেই বলি। আমার স্বধর্মের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য সত্যব্রতপরায়ণতা, বিশ্বস্ততা। আমি নির্ভীক, ক্ষমতাবানদের ভয় করি না। রাজনৈতিক কারণে, কোনও নেতা রাজা বা বংশের কাছ থেকে ঘুষ খাই না।

আমি সাধারণের উপযোগী আর লোকহিতার্থে, ভাষাকে যথাসম্ভব সরল করি।

আহা, বুঝেছি হে! পুরাণের অতিরঞ্জন আর অত্যুক্তির কথা বলবে তো? ভ্রূকুটি সন্দেহ দেখেই তা বুঝতে পেরেছি। দেখো, পক্ষপাতবশে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ‘ইতিহাস’ লেখকগণ যে-সব অতিরঞ্জন কথা বলেন, এঁদের বলার গুণে মিথ্যা সহজে ধরা পড়ে না। আমাদের অতিরঞ্জন একেবারে জ্বলজ্বল করে, ধরিয়ে দিতে হয় না। সেইজন্যই এত সন্দেহ। কিন্তু আমাদের বৈশিষ্ট্যগুলো মানবে তো? আমাকে তুমি চসার সাহেব বলে ধরে নিলে সব গোলে হরিবোল হয়ে যাবে। ধরো, আমি বললাম, রাম পনেরো বছর বয়সে সীতাকে বিয়ে করলেন, সাতাশ বছর বয়সে বনে গেলেন, বিয়াল্লিশ বছর বয়সে অযোধ্যায় ফিরে রাজ্যে অভিষিক্ত হলেন। তারপর? তারপরেই বললাম, রাম একাদশ সহস্র বৎসর রাজত্ব করে স্বর্গারোহণ করলেন।

তোমার যত সন্দেহ আর অবিশ্বাস, এই শেষের কথায়, কেমন নাকি? বিয়াল্লিশ বছর পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। তারপরেই একেবারে এগারো হাজার বছর! কেন, তোমরা কি কীর্তিমানকে আশীর্বাদ বা গৌরব করে বলো না, ‘হাজার বছর পরমায়ু হোক!’ পশ্চিমের লঙ্‌লিভ-কে তোমরা তোমাদের প্রিয়জন অমুক গান্ধী আর তমুক বসুকে, খুশির উত্তেজনায় বলো, যুগ যুগ জিও। ভালই জানো হাজার বছরের পরমায়ু নিয়ে কেউ জন্মায় না, যুগ যুগ জিইয়েও কারওকে রাখা যায় না। তবু তো বলা। তার বলাটা শিখিয়েছি আমরাই। মহত্ত্ব বীরত্ব সুকৃতি অতুলনীয় কীর্তির গৌরব করতে হলে, আমরা এমনই অতিশয়োক্তি করি। তা হলে রামের মতো একজন রাজার এগারো বছরের রাজত্বের আশ্চর্য ঘটনাবহুল কীর্তিকে এগারো হাজার বলতে দোষ কী?

‘পুরাণের অতিরঞ্জনের এটি একটি চাবিকাঠি বলে জানবে। এই ‘হাজার’ হল উপলক্ষণ প্রয়োগ। যেমন আরও দু’-একজনের কথা বলি। কার্তবীর্যার্জুন পঁচাশি হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। অলর্ক ছেষট্টি হাজার বছর রাজত্ব করেছিলেন। হাজারের উপলক্ষণ সরিয়ে দেখবে, কার্তবীর্যার্জুন পঁচাশি বছর বেঁচে ছিলেন। অলর্ক ছেষট্টি বছর রাজত্ব করেছিলেন। এও কীর্তিরই গৌরব। যে-দেশে, যাদের যেমন। পৃথিবীর আর কোনও দেশে তুমি এমন আশীর্বাদ শুনেছ, হাজার বছর বাঁচো। শত পুত্রের জননী হও।

‘আর একটা কথা তোমাদের শোনাই। ‘দিবি আরোহণ’ বলে একটা কথা আছে। এসব শুনলে, তোমার কুসংস্কার ঘুচবে, সত্যকে জানতে পারবে, পুরাণকে বিস্মিত শ্রদ্ধায় প্রণাম জানাতে শিখবে। এর নাম জ্ঞান। দিবি আরোহণ, মানুষেরই দেবত্বলাভের কথা। উত্তম মানুষ প্রতিলোম ক্রিয়ায় দেবতা হন। প্রতিলোম ক্রিয়ার আশ্চর্য সূত্র হল, উত্তম মানুষ প্রথমে মানুষ রূপেই পূজিত হন, তারপরে তিনি দেবতা হন, তারপরে তাঁকে জ্যোতিস্ক রূপে কল্পনা করা হয়।

‘যেমন ইন্দ্ৰ একাধিক এবং সকল ইন্দ্ৰই প্রথমে মানুষ ছিলেন, পরে দেবতা তারপরে সূর্য। দিবি আরোহণের এই সূত্র না মানলে ঋক্‌বেদের ইন্দ্র বিষয়ক সমস্ত সূক্তগুলোর সরল অর্থ পাওয়া যাবে না। মানুষ দেবতা আর সূর্য এই তিনরকমেই ইন্দ্রের কীর্তিকলাপ ঋক্‌বেদে বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণ মানুষ, কৃষ্ণ নারায়ণ, কৃষ্ণ সূর্য। ধ্রুব মানুষ, ধ্রুবই আবার জ্যোতিষ্ক। সূক্তগুলোকে যিনি জ্ঞান আর বুদ্ধির দ্বারা সূক্ষ্মভাবে পাঠ করেন, তিনিই দেবতার মনুষ্যত্ব নির্ণয় করতে সক্ষম।

‘তোমার যাত্রা দ্বারাবতী। তোমাকে আমি কয়েক হাজার শ্লোক শোনাব না। দেবতা কারা, স্বর্গ কোথায়, এই পথ বন্ধন করে নিতে পারলে তোমার যাত্রা যথার্থ হবে। আগে দেবতার পরিচয় হোক। আমি প্রাকৃতিক শক্তির অভিমানিনী দেবতার কথা বলেছি। এখন যে-দেবতার কথা বলছি, তাঁরাই দেব দৈত্য ইত্যাদি নামে পরিচিত। তোমরা এখন সকল জাতিকেই মানুষ বলো। আমি মানুবংশীয়দের প্রতি একমাত্র মানুষ শব্দ প্রয়োগ করেছি। আন্যান্য জাতি হলেন, দেবতা অসুর গন্ধর্ব সর্প নাগ সিদ্ধ যক্ষ রক্ষ ইত্যাদি। অসুরেরা ছিলেন দেবতাদের জ্ঞাতি ও বন্ধু। ‘সিসৃক্ষোৰ্জঘানাৎ পূর্বমসূরা জাজ্ঞিরে ততঃ, ততঃ পুরা।’ স্বয়ম্ভূব মনুর আদিবিন্দু থেকে আমরা ব্রহ্মাকেই সৃষ্টিকর্তা বলে জেনেছি। তিনি প্রথমে অসুরদের সৃষ্টি করেছিলেন, শ্লোকটা তাই শোনালাম। তারপরে দেবতা, পরে পরে পিতৃগণ, মানুষ, যক্ষ রক্ষ সর্প গন্ধর্ব। ঋক্‌বেদে কোনও কোনও জায়গায় ইন্দ্রকে অসুর বলা হয়েছে। অনেকটা, তোমরা যখন কারওকে বলো, লোকটা অসুর সেইরকম ভাবে। অসুরেরা ছিলেন অতি শক্তিশালী জাতি। দেবতাদের কোনও কোনও জ্ঞাতিবর্গ পরবর্তীকালে নিজেদের অসুর বলেই পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। কিন্তু দেবতাদের দায়াদ বন্ধু বললেও অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের ইন্দ্ৰত্ব নিয়ে বিবাদ বিসংবাদ প্রায়ই লেগে থাকত।

‘আমি কী বলি জানো? পুরাণের সাহায্য ছাড়া বেদের অর্থ কখনও সুগম হয় না। আমি সূত, আমি যদ্দৃষ্টং বর্ণনা করি, যথাশ্রুতি বলি, ঋষি লেখেন। আমি বলি, যে পুরাণ জানে না, বেদ তার কাছে প্রহৃত হবার আশঙ্কা করেন।

‘আমি তোমাকে একজন ইন্দ্রের কাহিনী বলব। বিভিন্ন ইন্দ্রের কীর্তি এঁর ওঁর ঘাড়ে চেপে অনেক সময়েই গোল বাধিয়েছে। আমি যাঁর কথা বলছি এঁকে বলা হত, বৃএহন্তা বজ্রধারী, পুরন্দর ইন্দ্র। বিরাট যোদ্ধা ছিলেন। পুরন্দর অর্থে যিনি পুরী ধ্বংসকারী। অসুরদের অনেক নগর ইনি ধ্বংস করেছিলেন।

‘ঝটিতি তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। তোমাদের কালে কোনও কোনও পণ্ডিত মহেন-জ-দরো সভ্যতাকে প্রাক আর্য দ্রাবিড় সভ্যতা বলে দাবি করেছেন। না জেনে করেছেন, আসলে ভিত্তিহীন অনুমান এবং আন্দাজ। অনুমানে প্রমাণসিদ্ধি হয় না। মহেন-জ-দরো আবিষ্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল। তখন স্বর্গ এবং ইন্দ্রদের ইতিবৃত্ত আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। আরও বলে রাখি, দেবতারা মানুষ ছিলেন। কথাটা আগেও বলেছি। পুরন্দর ইন্দ্রও একজন বীর মানব। জাতিতে দেবতা।

তোমাদের একজন সুবিখ্যাত পণ্ডিত, ঋকবেদসংহিতার অনুবাদক রমেশচন্দ্র দও, মানুষ ইন্দ্রের দেবত্ব বিষয়ে অনেকগুলো ঋকের অনুবাদ করেছেন। আমি কয়েকটি তোমার সামনে তুলে ধরছি:

‘হে অশ্বযুক্ত ইন্দ্র, ত্বরান্বিত হয়ে স্তোত্র গ্রহণ করতে এসো। এই সোম অভিষবযুক্ত যজ্ঞে আমাদের অন্ন ধারণ করো।’

‘হে সোমপায়ী ইন্দ্র, আমাদের অভিষবের নিকট এসো, সোম পান করো। তুমি ধনবান, তুমি হৃষ্ট হতে গাভী দান করো।’

‘হে শতক্রতু, এই সোম পান করে তুমি বৃত্র প্রভৃতি শত্রুদের বিনাশ করেছিলে। যুদ্ধে (তোমার ভক্ত) যোদ্ধাদের রক্ষা করেছিলে।’

‘হে ইন্দ্র, দৃঢ় স্থাপনে ভেদকারী এবং বহনশীল খরুৎদের সঙ্গে তুমি গুহায় লুকিয়ে রাখা গাভী সমুদয় খুঁজে উদ্ধার করেছিলে।’

‘যুবা মেধাবী প্রভূতবলসম্পন্ন সকল কর্মের ধর্তা বজ্রযুক্ত বহুস্তুতিভাজন ইন্দ্র (অসুরদের) নগরবিদারকরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।’

‘বজ্রধারী ইন্দ্র প্রথমে যে পরাক্রমের কাজ করেছিলেন, তাঁর সেই সব কাজের বর্ণনা করি। তিনি অহিকে (মেঘকে) হনন করেছিলেন, পরে বৃষ্টিবর্ষণ করেছিলেন, বহনশীল পার্বতীয় নদীসমূহের (পথ) ভেদ করে দিয়েছিলেন।’

‘সব সূক্তগুলো শোনাতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। দ্বারাবতী যাত্রার জন্য তুমি অতি ব্যস্ত হয়েছ। এবার আমি আর কয়েকটি সূক্ত শোনাব, তারপরে ব্যাখ্যা করব এসব সূক্তের অর্থাগুলো। এবার শোনো, ইন্দ্রও নিজের বজ্র নিজে হেনে, কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।’

‘হে ইন্দ্র, অহিকে হনন করার সময় যখন তোমার হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হয়েছিল, তখন তুমি অহির কোন হন্তার জন্য অপেক্ষা করছিলে, যে ভয় পেয়ে শ্যেন পাখির মতো নবনবতি নদী ও জল পার হয়ে গিয়েছিল।’

‘তুমি শুষ্ণ (অসুরের) সঙ্গে যুদ্ধে কুৎস ঋষিকে রক্ষা করেছিলে, তুমি অতিথিবৎসল (দিবাদাসের রক্ষার্থে) শম্বর (নামক অসুরকে) হনন করেছিলে। তুমি মহান অর্বুদ (নামক অসুরকে) পদদ্বারা আক্রমণ করেছিলে, অতএব তুমি দস্যুহত্যার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছ।’

‘ত্বষ্টা তোমার যোগ্য বল বৃদ্ধি করেছেন, এবং তার পরাভবকারী বল দ্বারা বজ্র তীক্ষ্ণ করেছেন।’

‘ইন্দ্র পৃথিবীর ওপরে স্থাপিত মধুর উদকপূর্ণ যে-চারটি নদী জলপূর্ণ করেছেন, তা সেই দর্শনীয় ইন্দ্রের অতিশয় পূজ্য ও সুন্দর কর্ম।’

‘তিনি বৃত্রকে বধ করে তন্নিরুদ্ধ বারি নির্গত করেছিলেন।’

‘তিনি সুদর্শন, সুন্দর নাসিকাযুক্ত ও হরি নামক অশ্বযুক্ত, তিনি আমাদের সম্পদের জন্য দৃঢ়বদ্ধ হাতে লৌহময় বজ্র স্থাপন করলেন।’

‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দ্র দধীচির (মূলে ঋষি নামের উল্লেখ নেই) অস্থি দ্বারা বৃত্রগণকে নবগুণ নবতিবার বধ করেছিলেন।’

‘নদীসমূহ যার নিয়মানুসারে বহে যায়।’

‘যিনি মহতি সেনার নায়ক তিনিই ইন্দ্র।’

‘তিনি বজ্রের দ্বারা নদীর নির্গমদ্বার সকল খুলে দিয়েছিলেন।’

‘ইন্দ্র নিজ মহিমায় সিন্ধুকে উত্তরবাহিনী করেছেন।’

‘তুমি বদ্ধ সিন্ধুগণকে উন্মুক্ত করেছ।’

‘আমি সূত, পুরাণকারের একমাত্র বাহন। আমি বলি, এই যে আশ্চর্য বলবীর্যশালী পুরুষ, স্বাভাবিক দিবি আরোহণের ফলে, ইনিই আন্তরীক্ষ দেবতা কল্পিত হন। যেমন তাঁদের অনেকের পরে রাম বা কৃষ্ণ ভগবান হয়েছিলেন। যেমন পরে তোমরা দেখেছ, নবদ্বীপের নিমাই মিশ্র নিজ মহিমায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য হয়েছিলেন। এখন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভগবান। আমি তো দেখি, ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমী উৎসবের তুলনায় গান্ধী রবীন্দ্রনাথ সুভাষ বসুর জন্মদিনের উৎসব আয়োজন পূজা কিছুমাত্র কম নয়।

‘এখন এই পুরন্দর ইন্দ্রের বিষয় বুঝতে পারলে? তাকে বিশেষভাবে বৃত্রহন্ত বলা হয়। এই বৃত্রকে বলা হয়, হিরণ্যকশিপুর কন্যা রমা ও মহর্ষি ত্বষ্টার ছেলে। আমি জানি, ত্বষ্টা নামে একাধিক গুণী ব্যক্তি ছিলেন। যদিও ঋক্‌বেদে বলা হয়েছে, ত্বষ্টাপুত্র বৃত্রকে ইন্দ্র নিহত করেছিলেন। কিন্তু তার আগে বৃত্র তদানীন্তন ইন্দ্রকে আঠারোবার পরাজিত করেছিলেন। স্বর্গের সম্রাটদের ‘ইন্দ্র’ বলা হয়, অতএব তাঁর কাছে এই পরাজয় ছিল অত্যন্ত অসম্মানজনক ও হৃদয়বিদারক

‘আমার মনে হয়, পুরন্দর ইন্দ্রের বিশেষ কীর্তিসমূহ শোনাবার আগে তোমাকে স্বর্গের অবস্থানটা জানানো দরকার। আমি সূত, স্বর্গের ঠিকানা আমার জানা আছে। ভারতের উত্তরে হিমালয়। হিমালয়ের উত্তরে হেমকূট, তার দক্ষিণে কিম্পূরুষবর্ষ। হেমকুটের উত্তরে হরিবর্ষ। হরিবর্ষের উত্তর সীমা নিষধ পর্বত। নিষধের উত্তরে “ইলাবৃতবর্ষ”। ইলাবৃতের উত্তরসীমা নীলাচল।

‘এই ইলাবৃতবর্ষ, তোমাদের এখনকার মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। আধুনিক পামির পূর্বতুর্কিস্থান ইলাবৃতবর্ষের অন্তর্গত। এই ইলাবৃতবর্ষেরই অপর নাম “স্বর্গ”। তোমাদের কে একজন কবি যেন লিখেছেন, “কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দুর/ মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেই সুরাসুর।” আসলে এই কবিও স্বর্গ নরকের একটা কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু ভৌম স্বর্গের ভৌগোলিক অবস্থান জানতেন না।

‘পুরাকালে এই ইলাবৃতবর্ষ অতি সমৃদ্ধ স্থান ছিল। পরে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে, নদনদী শুকিয়ে থাকার সভ্যতা লুপ্ত হয়। আরও একটা কারণ, আমি অনেকবার বলেছি, তেত্রিশ কোটি দেবতা। তার মানেই, স্বর্গ অত্যন্ত জনাকীর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। অতএব ভারতবর্ষে আগমন।

‘আমি জানি যেখানে বলি যজ্ঞ করেছিলেন, সেই সুবিস্তৃত প্রদেশের নাম ইলাবৃতবর্ষ। এই স্থান দেবগণের জন্মস্থান। তাঁদের বিবাহ, যজ্ঞ, জাতকর্ম, কন্যাদান প্রভৃতি যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ এই প্রদেশেই অনুষ্ঠিত হয়। দেবগণ আধুনিক তুর্কিস্থান থেকে কাশ্মীরের পথে পাঞ্জাব, পাঞ্জাব থেকে বিন্ধ্যাচলের উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত অধিকার করেন। তারপরে বিন্ধ্যের দক্ষিণেও অগ্রসর হন। বলতে গেলে, আস্তে আস্তে তাঁরা সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আমি এইভাবে ভাগ করি, ইলাবৃতবর্ষ কাশ্মীর বিন্ধ্যোত্তর ভারত এবং দক্ষিণাপথ পর্যায়ক্রমে স্বর্গ, অন্তরীক্ষ, মর্ত, পাতাল নামে পরিচিত। ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে কাশ্মীর বা অন্তরীক্ষে এসে বাস করেন তাই তার অপর নাম পিতৃলোক।

‘দেবগণ যখন প্রথমে ভারতে এলেন, তখন তাঁরা ইন্দ্রের অধীন ছিলেন। ভারতে তখন কেউ রাজা ছিলেন না। দেবগণ ভারতে এসে মানব জাতি হলেন, কারণ ইন্দ্রের প্রতিভূর নাম হল মনু বা প্রজাপতি। পরে ভারতে রাজা হয়ে, বেণরাজা প্রথম ইন্দ্রের বশ্যতা অস্বীকার করেন। ইলাবৃতবর্ষই যেহেতু আদি বাসস্থান, অতএব পবিত্র তীর্থভূমি বিবেচিত। যুধিষ্ঠিরের সময়েও স্বর্গে তীর্থযাত্রার প্রচলন ছিল। স্বর্গের পথ ক্রমেই দুর্গম হয়ে পড়ে। আর দিবি আরোহণের ফলে, স্বর্গ মৃত পুণ্যাত্মাদের বাসস্থান কল্পিত হয়েছে, দেবযান পরিণত হয়েছে নক্ষত্রবীথিতে। এখন স্বর্গপ্রাপ্তি মৃত্যুর নামান্তর। আমি মৎস্যপুরাণে একজন ইন্দ্রকে “হীনচেতা” বলেছি, কারণ সে সামরিক কারণে, যখন থেকে বজ্র দ্বারা স্বর্গপথ রোধ করে, তখন থেকে লোক সকলের স্বর্গমার্গ নিবারিত হয়। তার মানে পাহাড় ধসিয়ে পথরোধ করা হয়। এই পথ ছিল মধ্য এশিয়া আর ভারতে যাতায়াতের বণিকপথ। কিন্তু স্বর্গ দর্শনের আকাঙক্ষা অমর, অতএব দেবযান পথ বন্ধ হয়ে গেলেও বদরিনারায়ণ আর মানস সরোবরের পথে অনেকে স্বর্গে যেত। যুধিষ্ঠিরকে এই পথেই যেতে হয়েছিল। এই সেই কৈলাসপতি রুদ্র— অর্থাৎ শিবের রাজত্ব। তিব্বতে চিরকালই ভূত প্রেতের নাচ প্রসিদ্ধ। এরা শিবের অনুচর। ইন্দ্রের অনেক পরে শিবও ঋষিদের যজ্ঞভাগী হন।

‘মনে রেখো স্বর্গেরও উত্তর কুরুতে ছিল ব্রহ্মলোক আর বিষ্ণুলোক। আর ভারতীয়দের মতোই, স্বর্গের দেবতাদের আকাঙক্ষণীয় তীর্থ ছিল ব্রহ্ম ও বিষ্ণুলোক। দেবতারা নিজেদের সেই লোকেরই অধীন মনে করতেন। এখন তুমি এই দুই লোকের সন্ধানে কাসপিয়ান সাগরের কূলে কিংবা সাইবেরিয়ায় যেতে পারো, সন্ধান মিললেও মিলতে পারে। স্বর্গের নেতা অধিপতি ইন্দ্রগণ বিপদে পড়লে বিষ্ণুর পরামর্শ নিতেন। একাধিক ইন্দ্রের মতো, বিষ্ণু বরুণ মিত্রও একাধিক।

‘ভারতের বিন্ধ্যাচলের উত্তর ভাগের নাম পৃথিবী বা মর্ত। পৃথু রাজার রাজ্যই পৃথিবী। বিন্ধ্যাচলের দক্ষিণভাগ পাতাল। পাতালকে আমি ভূবিবর বলেছি, দক্ষিণদেশও বলেছি। পাতালেরও সাত ভাগ আছে। আমি পাতালের সাত ভাগে দেখেছি বহু সুন্দর নদ নদী উপবন আর নগর। নারদ বলেছেন, পাতাল স্বর্গাপেক্ষাও মনোরম।

‘দ্বারাবতীর কোন উপাখ্যান তুমি বলবে, জানি না, কিন্তু পাতালের বর্ণনা শুনে রাখো। অতল— ময়পুত্র মহামায়ার রাজত্ব। বিতল— হাটকেশ্বর হর। সুতল— বৈরোচন বলি। তলাতল— ময় ত্রিপুরাধিপতি। মহাতল— সর্পজাতি! রসাতল— দানবজাতি। পাতাল— নাগজাতি। অঙ্গ-বঙ্গ কলিঙ্গ— সুতল। আমি পাতালের অধস্তন প্রদেশে সংকর্ষাগ্নি দেখেছি। যবদ্বীপের আগ্নেয়গিরির কথা মনে রেখো। একটা হিসাব দিয়ে রাখি, বলির রাজ্যকাল, তিন হাজার চারশো সাতান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কপিল পাতালবাসী ছিলেন।

‘পুরাণের ইতিবৃত্ত প্রমাণের একটি আশ্চর্য ঘটনা এখানে শোনাই। সগরের বংশধর ছেলে অসমঞ্জ এবং আরও যাট হাজার ছেলে পাতালে কপিল শাপে বিনষ্ট হয়, এ আমারই কথা। ষাট হাজার অশ্ববাহিনীকে আমি যজ্ঞীয় অশ্ব বলি। সগর অশ্বচোরের সন্ধানে যাদের পাঠালেন, তারা ঘোড়ার খুরের চিহ্ন দেখে দেখে, কপিলের কাছে উপস্থিত হয়ে, তাকেই চোর ভেবে ধরতে গিয়ে কপিলের অগ্নিপিঙ্গল বর্ণের দিকে তাকিয়েই অভিশপ্ত হয়ে মারা গেল। তখন সগর পৌত্র অংশুমানকে অশ্বের সন্ধানে পাঠালেন। অংশুমান সাবধানী, তিনি কপিলকে খুশি করে যজ্ঞীয় অশ্বসকল নিয়ে পিতামহকে ফিরিয়ে দিলেন। অংশুমানের ছেলের নাম দিলীপ। দিলীপের ছেলের নাম ভগীরথ।

‘জানো তো ভগীরথ গঙ্গা আনয়ন করেছিলেন। আসলে, তোমাদের ভঙ্গিতে বললে, বলতে হয়, ভগীরথ একজন ইরিগেশনের বীর ইঞ্জিনিয়ার যিনি গঙ্গাকে খাল কেটে সুদীর্ঘ পথে সাগরে মিশিয়েছিলেন। সগর বংশের এইটি একটি মহান কীর্তি। সগর খাল কাটিয়ে গঙ্গাকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করতে চেয়েছিলেন। সেই জন্য প্রথমে বংশধর পুত্র অসমঞ্জ এবং আরও যাট হাজার অশ্বারোহী পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন। লক্ষ রেখো, অসমঞ্জ ‘বংশধর পুত্র’, বাকিরা কেবলই ‘পুত্র’। এটাই আমাদের— সূতদের বৈশিষ্ট্য। ষাট হাজার খননকারী কর্মীকেও আমরা সগর পুত্র বলে উল্লেখ করলাম, কিন্তু বংশধর পুত্র বললাম না।

‘তা হলে দেখা যাচ্ছে, অসমঞ্জ, তারপরে অংশুমান। তারও পরে অংশুমানের পৌত্র ভগীরথ আবার সেই খাল খননের কাজে লাগলেন। কিন্তু কে কপিল। কীসে এত বিস্তর লোক মারা গেল?

‘কৃষ্ণ একবার বলরাম আর প্রদ্যুম্নকে সঙ্গে করে বাণরাজ্য থেকে অনিরুদ্ধকে উদ্ধার করতে গিয়ে মাহেশ্বর জ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। বাণরাজ্য আধুনিক আসাম। মহেশ্বর জ্বর শুনলেই ব্যাধির নাম মনে আসে আর সেই ব্যাধি অতি ভয়াবহ দৈত্যের থেকেও ভয়ংকর।

‘বাঙালিরা দক্ষিণে ম্যালেরিয়ার কথা কখনও ভুলবে না। যকৃতের দোষ, চোখ হলদে আর বিভীষিকাময় জ্বর। পিঙ্গলবর্ণ কপিলের ইঙ্গিত সেখানেই। ঘোড়াগুলো চরে বেড়াচ্ছিল, ষাট হাজার খননকারী মরে পড়ে ছিল। অতএব কপিলকে সাধনা করেই সাধ্যায়ত্ত করতে হয়। অসমঞ্জ থেকে ভগীরথ তিন পর্যায়কাল ব্যবধান— আমার হিসাবে পঁচাশি বছর সময় লেগেছিল। তাই আমি গঙ্গাকে একটি নতুন নাম দিলাম ভাগীরথী। সগরের নামানুসারে, সমুদ্রকে সাগর। এই বিশাল আর পুণ্য কর্মের জন্য গঙ্গাসাগর বিন্দুকে তীর্থ বোধ করলাম, আনন্দে অবগাহন করলাম। কিন্তু কপিলের স্থান তাই দুরন্ত শীতে পৌষ সংক্রান্তির দিন ধার্য। তান্য কোনও ঋতুতে নয়, কপিল ক্ষুব্ধ হতে পারেন।

‘মনে রেখো, এই কপিল, সাংখ্যকার কপিল মুনি নন। ব্রহ্মা তাঁকে জন্মাতে দেখেছিলেন সৃষ্টির আদিতে। ইনি মানুষ নন। সৃষ্টির আদিতে যে হিরন্ময় অণ্ড জন্মেছিলেন আমরা তাঁকে তারই অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলেছি। এক এক অস্বাস্থ্যকর সংক্রামক রোগের স্থানে, সগর সন্তানদের মতো অনেক মৃত্যুর খবর তোমরাও জানো। মিরজুমলার দুই লক্ষেরও বেশি সৈন্য আসামে গিয়ে জ্বরে মারা গিয়েছিল।

‘আমি জানি, পুরাকালে অনেক ব্যক্তি খাল খনন পূর্তাদি কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। জানি, গঙ্গাকে খনিত খাল ভাবতে তোমার বিশ্বাসে আঘাত লাগছে। কিন্তু মানুষের কীর্তিই পূণ্য, তাঁর দিবি আরোহণ সেখানেই। এই বিশাল কর্মকে প্রণাম করি, পুণ্যাবগাহন করি।

‘তোমার দ্বারাবতী যাত্রা আর সবুর সইছে না। অথচ এসব না জেনে, যাত্রাটাও ঠিক হবে না। আসলে তোমার বাইরে ত্বরা, অন্তরে তুমি তন্ময়। এবার তোমাকে পুরন্দর ইন্দ্রের কয়েকটি কথা বলি। বৃত্রের সঙ্গে ইন্দ্র যুদ্ধে বারবার পরাজিত হয়ে খুবই শান্তি বোধ করেছিলেন। বৃত্র যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। তিনি ইন্দ্র আর তাঁর প্রজাবর্গকে উৎপীড়ন করার জন্য, পাহাড় ধসিয়ে চারটি নদীপথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইন্দ্র বৃত্রকে হনন করে বজ্রাঘাতে পর্বতকে বিদীর্ণ করে রুদ্ধ নদীপথ খুলে দিয়েছিলেন। তাই তিনি পর্জন্যদেব, জলমোচনকারী। সূক্তগুলোর কথা মনে করো।

‘কিন্তু মানুষ কেমন করে বজ্রকে ধারণ করবেন? না, প্রাকৃতিক বজ্রকে কেউ ধারণ করতে পারেন না। তথাপি আমি দেখছি, বজ্র ইন্দ্রের আয়ুধ। এই বজ্র তোমাদের বন্দুকের মতোই এক অস্ত্র ছিল। এই বজ্র সুদূরপাতী। এই অস্ত্রটির জন্য ইন্দ্ৰ হতাশ হয়ে বিষ্ণুর কাছে গিয়েছিলেন। বিষ্ণু বললেন, ‘এই বৃত্র অস্থিময় বজ্রের দ্বারা নিহত হবে।’ ইন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন জীবের অস্থি দিয়ে এই বজ্র তৈরি হবে? গজ, শরভ বা অন্য কোন জন্তুর অস্থি আবশ্যক আমাকে তা বলুন।’

বিষ্ণু বললেন, ‘সুরাধিপ, সেই জীব শত হস্ত প্রমাণ, মধ্যে ক্ষীণ দুই পার্শ্বে স্থূল ছয় কোণ অর্থাৎ পলযুক্ত ভীষণাকৃতি হওয়া চাই।’ ইন্দ্র হতাশ হয়ে বললেন, ‘আমার পরিচিত ত্রৈলোক্য মধ্যে এমন কোনও প্রাণীই যে দেখি না।’

‘আমি তোমাকে এখন আর রূপকের কথা বলব না। সরাসরি বলব। বিষ্ণু বললেন, ‘সরস্বতী তীরে যে বিশাল দধীচি আছেন তিনি এর দ্বিগুণ। ইন্দ্র সরস্বতী তীরে গিয়ে দধীচির দেখা পেলেন। আমি অবিশ্যি এখানে দধীচিকে বিপ্র বলেছি, এটাই আমার বৈশিষ্ট্য। ইন্দ্র গিয়ে তাকে বললেন, ‘হে বিপ্র, আপনি ভিন্ন এত বিশাল প্রাণী আর দেখি না।’ অতএব ইন্দ্র দধীচির অস্থি গ্রহণ করলেন। তাঁর করোটি অশ্বমস্তকের ন্যায় দেখতে ছিল। অস্থির অন্য অংশ না মস্তকটি চাই, আর তার জন্য ইন্দ্রকে, পাহাড়ে লুকানো শরণাবতে সরোবরে তা খুঁজে পেতে হয়েছিল।

‘তোমার চোখের সামনে কি প্রাচীন প্রাণী ডাইনোসোরাসের ঘোটক জাতীয় করোটি ভেসে উঠছে? উঠলেও আমি কোনও মন্তব্য করব না। কিন্তু অস্থি পেলেই তো হবে না। বারুদ চাই, নির্মাণ করা চাই সেই ভয়ংকর আয়ুধ। তখন ইন্দ্র গেলেন আর একজন ত্বষ্টা নামক জ্ঞানীর কাছে। ইনি বৃত্রের পিতা ত্বষ্টা নন। এই ত্বষ্টার বারুদ বিষয়ে জ্ঞান ছিল। আর বারুদ তৈরি করতে জানতেন, ইলাবৃতবর্ষের সংলগ্ন ভদ্রাশ্ববর্ষে, তোমরা এখন যাকে চিন বলো, সেই দেশের বিশিষ্ট গুণধরগণ।

‘তোমাদের আধুনিক ভূবিজ্ঞানীরা, পূর্বতুর্কিস্থান আর তার নিকটবর্তী প্রদেশসমূহে, প্রাগৈতিহাসিক জীবের কঙ্কাল, কিছুকাল আগেও আবিষ্কার করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক কাল বলতে, আমি সর্বদাই স্বয়ম্ভূ মনুকালের পূর্বের কথা বলি। বিলিতি বি-সি এ-ডি ইত্যাদির কথা বলি না। যে-প্রাণীর দ্বারা দেব ও মানবজাতির ইষ্ট হয়, আমরা সেই প্রাণীকেও ঋষিতুল্য জ্ঞান করি। আধুনিককালের ইতিহাস লেখকগণের সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মূলত তফাত এইখানে।

‘যাই হোক, বজ্ৰায়ুধ সৃষ্টিকারী ত্বষ্টা ভদ্রাশ্ববর্ষ থেকেই বারুদ তৈরি করতে শিখেছিলেন। তিনি দধীচির অশ্ব করোটির ন্যায় সুবিশাল মস্তক দিয়ে যে বজ্ৰাস্ত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা ছিল দীর্ঘ নালিক অস্থির সঙ্গে যুক্ত। বারুদ ধাতুখণ্ড প্রস্তুরাদি ঠাসা সেই বিশাল অস্ত্রের বর্ণনায় বেদ বলেছেন, বজ্রটি প্রকাণ্ড, শতপর্ব, চারপলযুক্ত।

‘তোমার নিশ্চয়ই খুব কৌতুহল হচ্ছে, বৃত্র কোন কোন নদীপথ, কোথায় অবরোধ করে, ইন্দ্রকে এবং তেত্রিশ কোটি দেবতাগণকে কষ্ট দিচ্ছিল? স্বাভাবিক। আমি সে-কথাও বলেছি। মানস সরোবরের কাছে বৃত্র দুটি নদীপথ অবরুদ্ধ করেছিল। বিপাশা আর শুতুদ্রী। আমি নদীদ্বয়ের মুখ দিয়েই বলিয়েছি, ‘নদীগণের পরিবেষ্টক বৃত্রকে হনন করে বজ্রবাহু ইন্দ্র আমাদের খনন করেছেন। জগৎপ্রেরক, সুহস্ত, দ্যুতিমান ইন্দ্র আমাদের প্রেরণ করেছেন, তাঁর আজ্ঞায় আমরা প্রভূত হয়ে গমন করছি।’ এই নদী দুটির তোমরা আধুনিক নাম দিয়েছ, বিয়াস আর সটলেজ।

‘অবিশ্যি পরবর্তীকালে অর্বাচীন সূতগণের দ্বারা এই দুটি নদীই চারটি হয়েছে, তারপরে সাতটি। এ-সবই গৌরবে বহুবচন। অর্বাচীনেরা চিরকালই ছিল, এখনও আছে, আর জ্ঞানী তার ভিতর থেকেই সত্যকে অনুসন্ধান করে আত্মসাৎ করেন।

‘এইবার সেই সূক্ত মনে করো, যখন বজ্ৰবাহু সেই বজ্র বৃত্রের প্রতি নিক্ষেপ করলেন, তার শব্দ এমনই বিশ্বপ্রকম্পিত, অগ্নি ও ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছিল, পর্বত ধসিয়ে দিয়েছিল, অবরুদ্ধ নদীদ্বয় আকাশের মতো উঁচু হয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, স্বয়ং ইন্দ্র ভয়ে বহুদূর পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও ভেবেছিলাম, স্বর্গ লয় পেতে বসেছে। কিন্তু নদী দুটির প্রবল বহমানত, বৃত্রের অনুচরগণসহ মৃত্যুর সকলই যখন প্রত্যক্ষ হল, সবাই গিয়ে ইন্দ্রকে খবর দিলেন। এই জন্যই ইন্দ্রকে আমরা বলি, জলমোচনকারী। এই কারণেই তাঁর দিবি আরোহণের পরে তিনি জলবর্ষণকারী, অন্তরীক্ষ দেব হয়েছেন। বৈদিক দেবতাই হলেন শত্রুবিমর্দক পরাক্রান্ত যোদ্ধা।

‘আমরা সকলেই সেই স্বর্গের অধিবাসী, কোনওকালেই সেখানকার দেবদেবীদের, সেই সুন্দর স্থানের কথা ভুলতে পারি না। তোমাদের এখন যেমন বিশিষ্ট ব্যক্তির সংবর্ধনা সভা হয়, আমরাও সেইরকম সভা উৎসব করতাম। আমরা তাকে বলতাম যজ্ঞ। সেই যজ্ঞে ইন্দ্রকে আহ্বান করা হত। তাকেই প্রথম পাদ্যঅর্ঘ্য সোম ও অন্ন নিবেদন করা হত, এবং সকলেই সেই যজ্ঞে শামিল হয়ে, তাঁর স্তুতি করতাম। এক সময়ে গৃৎসমদ বলছেন, ‘লোকে এখন ইন্দ্রকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে।’ অতএব জনগণের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য তিনি বলছেন, ‘যিনি মহতী সেনার নায়ক তিনিই ইন্দ্র। যিনি অহিকে (বৃত্রকে) বিনাশ করে সপ্তসংখ্যক (দুই) নদী প্রবাহিত করেছিলেন, যিনি গো উদ্ধার করেছিলেন, যিনি শত্রু বিনাশ করেন, যিনি বিশ্ব নির্মাণ করেছেন, তিনিই ইন্দ্র।’ এ কথাগুলো থেকে বুঝতে পারবে, ইন্দ্রগণ লুপ্ত হবার পরে তাঁদের নরত্ব কী করে আস্তে আস্তে অদৃশ্য দেবত্বে পরিণত হয়েছে। অতএব আমরা এখনও যজ্ঞভূমিতে তাঁকেই আহ্বান করি, তাঁর উদ্দেশেই সোম ও অর্ঘ্য নিবেদন করি।

‘জানি, তোমার দ্বারাবতী যাত্রার ভূমিকা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হল। কিন্তু তোমার যাত্রা দীর্ঘতর, তুলনায় এ-ভুমিকাকে দীর্ঘ বলা যাবে না। পুরাণের ইতিবৃত্তীয় সংকেত ও ইঙ্গিতগুলো পেলে, মানুষ ও তার দিবি আরোহণের ফলে দেবত্বের সংবাদ পেলে।

‘তোমার যাত্রার আগে, আর একটু সহজ কথা বলি। পৃথিবীতে সব দেশের, সব জাতির নিজেদের কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। আন্তর্জাতিকতা সেখানেই মহিমময় যখন সকলের সব বৈশিষ্ট্যগুলো পরস্পরের যোগসূত্রে বিশাল ও বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে। প্রাচীন ভারতীয়দেরও নানন বৈশিষ্ট্য ছিল, এখনও আছে। আমি একজন সূত হিসাবে দেখলাম, ভারতীয়রা যা প্রাণ ধরে রক্ষা করে, তার সঙ্গে ধর্মের একটা সম্পর্ক থাকে। পুরাণ তাদেরই জাতীয় ইতিবৃত্ত, কিন্তু আমি যদি কেবলমাত্র ‘ইতিবৃত্ত’ বলি, তা হলে তারা তা রক্ষা করবে না। অতএব আমি বললাম, পুরাণ ধর্মপুস্তক। এই পুস্তক প্রতিদিন পাঠ করা, লিখে দান করা, পাঠ করে অপরকে শোনানোর মতো পুণ্য আর কিছু নেই। সেইজন্যই পুরাণ এখনও বর্তমান আছে।

‘কিন্তু কালের প্রবাহকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। গৃৎসমদ ঋষি কতকাল আগেই বলেছিলেন, ‘লোকে এখন ইন্দ্রকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে।’ ভারতীয়রাও সেইরকম বহু বহিরাগতদের শাসনে, শিক্ষায়, প্রলোভনে আপন জাতীয় ইতিবৃত্তকে ভুলতে বসেছে। হাম্পটিডাম্পটির ড্যাডরা তো পুরাণকে জানেই না, বিশ্বাসও করে না। তোমার এই দ্বারাবতী যাত্রার উদ্যমে আমি হৃষ্ট, কারণ তুমি জাতীয় ইতিবৃত্তেরই একটি অধ্যায় তুলে ধরতে যাচ্ছ। প্রকৃত ইতিবৃত্ত, নর ও দেবের ইঙ্গিত, তোমার দরকার ছিল। এখন তোমার দৃষ্টি স্বচ্ছ ও সহজগম্য হবে। আমার মনে হয়, পরেও আমাকে তোমার দরকার হবে। ডেকো, আসব। তোমার যাত্রা শুভ হোক।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *