৬. কি ফল লভিনু হায়

কি ফল লভিনু হায়

‘আমার পদমর্যাদার জন্যে কতোগুলো জিনিশ দরকার এবং তার জন্যে কিছু বিসর্জনও প্রয়োজন।’ ‘শিগগিরই আমার আবার টাকার টানাটানিতে পড়তে হবে। গাড়ি ভাড়া বাবদে রোজ আমার অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে। তা ছাড়া, আমার ভৃত্যরা মার্চ মাসের বেতন চাইছে। হোটেলের বিল অবশ্য এ মাসের শেষ অবধি ফেলে রাখা যাবে। হে ঈশ্বর, আমার কী হবে?’ পদমর্যাদার কথা কবি লিখেছিলেন বিলেতে থাকার সময়ে। কিন্তু যেমনটা ধারণা করেছিলেন, তার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কলকাতায় ফেরার মাত্র দু মাস পরে।

বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে যথাসময়ে টাকা পেয়ে জানুআরি মাসের (১৮৬৭) পাঁচ তারিখে ফ্রান্সের মার্সেই বন্দর থেকে তিনি ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ফেরার জন্যে। ততোদিনে তিনি রীতিমতো কল্পনার জাল বুনতে আরম্ভ করেছিলেন — দেশে ফিরে ব্যারিস্টার হিশেবে কাজ করবেন, সম্মান এবং খ্যাতি লাভ করবেন; আর সেই সঙ্গে দু হাতে টাকা রোজগার করবেন। সেই মুহূর্তে সরাসরি কলকাতার কোনো জাহাজ ছিলো না। অগত্যা তাই যাত্রা করেন বোম্বাই-এর জাহাজে। তারপর বোম্বাই থেকে কলকাতায়। জাহাজের যাত্রীদের তালিকা থেকে তাঁর কলকাতায় পৌঁছানোর তারিখ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেকালের বেশির ভাগ যাত্রী- তালিকা পূর্ণাঙ্গ হতো না। তাই তাঁর নাম খুঁজে পাইনি।

তিনি ঠিক কবে কলকাতায় পা রেখেছিলেন সেই তারিখটার চেয়েও যা জরুরী তা হলো: এ সময়ে তাঁর মনোভাব। তিনি বিলেত-ফেরত। ব্যারিস্টার। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন, এতো দিন জীবনকে উপভোগ করার জন্যে যে-রঙিন স্বপ্ন বুনছিলেন, এবারে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার সোনালি সুযোগ একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। বিশপস কলেজে পড়ার সময়ে মাঝেমধ্যে তিক্ততা হলেও পিতা তাঁকে বেশ দরাজ হাতে টাকা দিতেন। পিতা টাকা দেওয়া বন্ধ করার পর থেকে কুড়ি বছর ধরে নিরন্তর আর্থিক অনটনের সঙ্গে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে। অচিরে অনটনের হাত থেকে রক্ষা পাবেন — এটা চিন্তা করে তিনি উল্লসিত বোধ করেন। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের একটা নীল-নকশা এঁকে ফেলেন: নগরীর সবচেয়ে অভিজাতদের পাড়ায় তিনি বাস করবেন। ভালো গাড়ি হাঁকাবেন। খানসামা, খিদমদগারের দ্বারা পরিবৃত থাকবেন। রাজপথ দিয়ে তিনি যখন চলাফেরা করবেন লোকেরা যেন তাঁকে দেখে দূর থেকে সম্মান জানান আর তাঁর বিলাসিতা দেখে বিশ্বয় প্রকাশ করেন।

য়োরোপ থেকেই তিনি সংকল্প করে এসেছিলেন: তাঁকে একজন ব্যারিস্টারের উপযুক্ত জীবন যাপন করতে হবে। কিন্তু ‘আপনি আমার জন্যে যে-টাকা ধার করতে পারবেন, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি টাকা না-পেলে আমি অন্তত কিছু কালের জন্যে শানশওকতের সঙ্গে ব্যারিস্টারের জীবন শুরু করতে পারবো না।’ একজন ব্যারিস্টারের জন্যে মানানসই জীবন শুরু করতে পারবেন না — ডিসেম্বর মাসে (১৮৬৬) এ আশঙ্কা প্রকাশ করলেও, মাত্র দুমাস পরে তিনি যখন কলকাতায় পা রাখলেন, তখন আর এ জীবন শুরু করার ব্যাপারে কোনো বিলম্ব সহ্য করতে পারছিলেন না। সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন — যাকে পোশাকী ভাষায় বলে — বিক্তহস্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রথমেই নিজের থাকার জায়গা ঠিক করলেন কলকাতার সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্পেন্সেস হোটেলে। গভমেন্ট হাউসেব অদূরে অবস্থিত কলকাতার এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ হোটেলটি নির্মিত হয়েছিলো ১৮৩০ সালে। এই হোটেলে ওঠার পেছনে তাঁর যুক্তি ছিলো, একজন ব্যারিস্টার হিশেবে তিনি যে-সে পাড়ায় অথবা যে-সে জায়গায় বাস করতে পারেন না।

মাদ্রাসে অজ্ঞাতবাস শেষে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন, তখনও তাঁর হাত একেবারে বিক্ত ছিলো। তিনি ভবিষ্যৎকে তখন দেখতে পাচ্ছিলেন অনিশ্চিতভাবে। সেবার প্রথম কিছু কাল থাকতে হয়েছিলো বন্ধুদের বাড়িতে। নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্যে নিতে হয়েছিলো পুলিশ অফিসে কনিষ্ঠ কেরানির চাকরি — তাও এক বন্ধুর সৌজন্যে। তাঁর মতো অতো বড়ো একজন বিদ্বান এবং যোগ্য ব্যক্তিকে কেউ যে তখন যথোচিত আসনটি দিতে পাবেনি — চিন্তা করে বাঙালি সমাজকে অনুকম্পা করাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। সেবাবে তিনি বাড়ি ভাড়া করেছিলেন লোয়ার চিৎপুর রোড়ে। ছ নম্বর বাড়ি। (১৮৬১ সালের মাঝামাঝি তিনি এই বাড়ি ছেড়ে দিলে এ বাড়িতে বাস করতে আসেন এ. মার্টিন — জাহাজ থেকে মাল খালাশ করা যার পেশা। কোথায় ‘মহাকবি’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর কোথায় এ. মার্টিন!) বাড়িটি মন্দ না-হলেও, সে পাড়াটাকে ভদ্রলোকদের পাড়া বলে গণ্য করা শক্ত। পাঁচ নম্বর বাড়িটি ছিলো ব্রজনাথ মিত্রের সোড়া এবং লেমনেড তৈরির দোকান। অন্য পাশে সাত নম্বরে অল্পদিন আগেও ছিলো ঘোড়া আর গাড়ি ভাড়া দেবার দোকান। দশ এবং এগারো নম্বর তখনো গাড়ি আর ঘোড়া ভাড়া দেওয়ার দোকান। এ ছাড়া, তৈরি কাপড়-চোপড় এবং নানা ধরনের দোকান সেই রাস্তায়। বেশির ভাগ বাসিন্দাই হিন্দুস্তানী। দুর্ভাগ্যক্রমে এ হেন পাড়ায় তাঁকে সে সময়ে বাস করতে হয়েছিলো। এবারেও তাঁর হাতে যে টাকা আছে, তা নয়। তবে জানেন,এবারে ব্যারিস্টার হিশেবে তিনি অনেক অর্থ আয় করবেন। একজন সফল আইনজীবীর আয় কততা বাল্যকালে নিজেদের বাড়িতেই তিনি তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তা ছাড়া, তিনি আরও জানেন, বড়োবাজার এবং চোরবাজারের গদি আগলে যারা বসে আছে, তাদের অনেকের টাকা থাকলেও তারা তা ঠিকমতো ব্যয় করতে জানে না। তিনি দেখিয়ে দেবেন: কী করে টাকা ব্যয় করে যোরোপের লোকদের মতো পরিচ্ছন্ন এবং বিদগ্ধ জীবন যাপন করতে হয়। স্পেন্সেস হোটেলে তিনি যেন সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে উঠলেন। অথচ এর মাত্র দু মাস আগে লিখেছিলেন যে, তিনি এমন একটা বাড়ি ভাড়া নেবেন, যার ওপর তলায় তিনি থাকবেন, আর নিচের তলায় থাকবে তাঁর অফিস।

ওদিকে, মাইকেল ফিরে এসে স্পেন্সেস হোটেলে উঠেছেন — এই খবর পেয়ে প্রিয় বন্ধু বিদ্যাসাগর — কবির ভাষায়, ঈশ্বরের পরই যিনি তাঁকে তাঁর দুঃস্বপ্নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহায্য দিয়েছিলেন — সেই বিদ্যাসাগর এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। দেখা করতে এলেন বললে ভুল হয়, এলেন তাঁকে বরণ করতে। এর মাত্র সাত সপ্তাহ আগে — ১৪ ডিসেম্বর (১৮৬৬) তারিখে মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে উত্তরপাড়া থেকে ফেরার সময়ে গাড়ি উল্টে গিয়ে তিনি নিজে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। তখনো তিনি সে আঘাত পুরো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। (সত্যি বলতে কি, তিনি কোনো দিন আর পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেননি।) তবু তিনি অধীর হয়েছিলেন ব্যারিস্টার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। আর দুঃসময়ের বন্ধুকে দেখে কবিও কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা এবং প্রীতিতে উচ্ছসিত হন। তাঁকে জড়িয়ে ধরে অজস্র বার মুখ চুম্বন করেন। বিব্রত বিদ্যাসাগর তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ না-হয়ে পারেননি। যে-দুস্তব বাধা অতিক্রম করে কবি শেষ পর্যন্ত ব্যারিস্টার হতে পেরেছিলেন, তাতে তাঁর অবদান কম ছিলো না। কবির কৃতিত্ব এবং সাফল্যকে তিনি অনেকটা নিজের কৃতিত্ব এবং সাফল্য বলে গণ্য করে থাকবেন। সেই বিজয়ী এবং খ্যাতিমান বন্ধুর জন্যে তিনি তাঁর অনুগত সুহৃদ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের সহকারী অধ্যাপক রাজকৃষ্ণবন্দ্যোপাধ্যায়ের ২৩ নম্বর সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলেন। এ বাড়ি ছিলো কর্নওয়ালিস স্কোয়ারের ধারে। সুন্দর এলাকা, চমৎকার বাড়ি। সে সময় বাঙালিদের এমন বাড়ি কমই ছিলো। বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন, সাহেব হলেও এ বাড়ি মধুর পছন্দ না-হয়ে পারে না। কিন্তু রাজকৃষ্ণের বাড়িতে গিয়ে একদিন ভূরি ভোজ করে এলেও, কবি সে বাড়িতে থাকতে রাজি হলেন না। বিদেশে বিলাসিতার যে-ছবি তিনি কাছ থেকে দেখে এসেছিলেন, পটভূমি সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও, তিনি তাঁর মোহ কাটাতে পারলেন না। সেই মোহ তাঁকে স্পেন্সেস হোটেলেই বন্দী করে রাখলো।

কবির এই সিদ্ধান্ত জানতে পেয়ে বিদ্যাসাগর অপমানিত বোধ করেছিলেন কিনা, জানা নেই; কিন্তু নিঃসন্দেহে অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। একজন জীবনীকারের মতে, বিদ্যাসাগর নিজ মুখে এর জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এই সেই মধু, যাঁকে তিনি চরম দুরবস্থা থেকে বাঁচিয়েছিলেন অল্প দিন আগে? যে-মধু মাত্র কয়েক মাস আগে তাঁকে লিখেছিলেন যে, তিনি এসে উঠবেন তাঁরই বাড়ির একটি ঘরে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ডালভাত পেলেই খুশি হবেন? বিদ্যাসাগর তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কবি তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। দুঃসাহসী এবংহঠকারী সিদ্ধান্ত তিনি এই প্রথম বার নেননি। তবে বিলাসী জীবন যাপন করার উদ্দেশে হোটেলে থাকার যে-সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন, তার চেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত খুব কম নিয়েছিলেন। পরে এ সিদ্ধান্ত তাঁর চরম সর্বনাশ ডেকে এনেছিলো। ফেরার আগে তিনি বিদ্যাসাগরকে লিখেছিলেন যে, ভালো করে প্র্যাক্টিস করার আগে পর্যন্ত স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এবং এঁদের জন্যে ভার্সাইতে মাসে খরচ হবে মাত্র আড়াই শো/ তিন শশা টাকা। তার অর্থ, তাঁর মতো কল্পনাবিলাসীও তখন অবধি অদূর ভবিষ্যতে পরিবারের জন্যে মাসে আড়াই শো/ তিন শো টাকার চেয়ে বেশি ব্যয় করতে পারবেন বলে ভাবেননি। সেই মাইকেল মাত্র আট সপ্তাহের ব্যবধানে এবং ব্যারিস্টারি শুরু করার আগেই ফেব্রুয়ারি মাসের (১৮৬৭) গোড়ার দিকে কী করে স্পেন্সেস হোটেলে থাকার খরচ জোগাতে পারবেন বলে ভাবতে পারলেন, সেটা ঠিক বোঝা যায় না। মনে হয়, তিনি ঋণ করে ঘি খাওয়ার মহামন্ত্রটা শিখেছিলেন; কিন্তু মন্ত্রের বাকি অংশ — কী করে যাবৎ জীবন সুখে থাকতে হয় — সেটা শেখেননি।

যখনকার কথা বলছি, তখন পর্যন্ত তিনি একটি পয়সাও আয় করতে পারেননি। তখনো বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁকে হোটেলে থাকার বিলাসিতা করতে হয়। এ সময়ে তিনি কয়েক মাসের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মারফত অনেক টাকা ধার করেন। তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির দাম যতো ছিলো, তার চেয়েও বেশি পরিমাণ টাকা তিনি যোরোপে থাকার সময়েই ধার করেছিলেন। তবে ঘটনাচক্রে য়োরোপে এমন অবস্থায় পড়েছিলেন যে, ধারনা-করেতার উপায় ছিলো না। কিন্তু পরিবার গোরোপে রেখে এসে এবং নিজে ‘ব্যারিস্টারের জীবন’ যাপন করতে গিয়ে ঋণের যে-দুর্বহ বোঝা তিনি তুলে নেন, তা স্বেচ্ছাকৃত। তখন কলকাতায় ব্যারিস্টার ছিলেন মাত্র জনা চল্লিশ। আর বাঙালি ব্যারিস্টার তাঁকে নিয়ে মাত্র তিন জন। এমতাবস্থায় ব্যারিস্টার হয়ে ভাগ্যকে তিনি কমবেশি গড়ে তুলতে পারতেন — তাতে তাঁর মেজাজ যতোই অ-ব্যারিস্টারসুলভ এবং কবিত্বপূর্ণ হোক না কেন। কিন্তু বেহিশেবি মনোভাব দিয়ে তিনি নিজের ভাগ্যকে নিজেই তছনছ করেন। তবে এ তাঁর চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আগেই বলেছি, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই স্বকৃতভঙ্গ। বিদ্যাসাগর কি তাঁর লাগাম টেনে ধরতে পারতেন? মনে হয়, সেটা ছিলো তাঁর সাধ্যের অতীত। এ পর্যায়ে তিনি যদি ধার করতে সাহায্য না-করতেন, তা হলে নিজেই ধার করতে চেষ্টা করতেন। মাঝখান দিয়ে তাঁদের বন্ধুত্বে চিড় ধরতো। তাই বিরক্ত হলেও, বিদ্যাসাগর ঋণ করতে সাহায্য করেন তাঁকে।

অন্য কোথাও না-থেকে বিশেষ করে স্পেন্সেস হোটেলে তাঁর থাকার কারণ জানা না-থাকলেও অনুমান করা অসম্ভব নয়। তিনি কলকাতায় ফেরার মাত্র এক মাস আগে মনোমোহন ঘোষ হাই কোর্টে ব্যারিস্টার হিশেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর চেম্বাব করেছিলেন স্পেন্সেস হোটেলের ১৫ নম্বর কামরায়। মনোমোহনের সঙ্গে কবির লন্ডনে যে-ধরনেব ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো, তা থেকে মনে হয়, হোটেলে থাকার ধারণা হয়তো তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর বেহিশেবি মনোভাবের চূড়ান্ত পরিচয় দেন এই হোটেলে থাকার সময়ে নানা রকমের আতিশয্য দেখিয়ে। অন্যদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো ছাড়াও, নিজের ভোজনের ব্যাপারেও তিনি দারুণ অসংযমের পরিচয় দিয়েছিলেন। বাবুর্চি রেখেছিলেন এমন একজনকে যে এক সময়ে ছিলো দ্বারকানাথ ঠাকুর আর কিশোরীচাঁদ মিত্রের বাবুর্চি। তবে বাবুর্চি রাখার ঘটনাটা ঠিক এ সময়ের, না কিছু পরের, তা জানা যায় না। ধারণা করি, ভালো জুড়িগাড়িও হাঁকিয়েছেন। তা ছাড়া, একজনের জায়গায় রেখেছেন একাধিক খিদমতগার। মোট কথা, গাছে কাঁঠাল দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা উপভোগ করার নানা রকমের ব্যবস্থা করেছিলেন।

আসলে, ব্যারিস্টার হয়ে এসেছেন এবং প্র্যাক্টিস করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রভূত প্রতিষ্ঠা এবং খ্যাতি আসবে — এ বিষয়ে তাঁর মনে কোনো সংশয় ছিলো না। যাতে দ্রুত এই কাজে যোগ দিতে পারেন, তার জন্যে কলকাতায় আসার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে — ২০ ফেব্রুআরি — ব্যারিস্টার হিশেবে কাজ করার অনুমতি চেয়ে তিনি হাই কোর্টে আবেদন করেন। এই আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি গ্রেজ ইনে দশটি টার্ম লেখাপড়া করেছেন এবং আগের বছর মিকেলমেস টার্মে ব্যারিস্টার হয়েছেন। সুতরাং তাঁকে হাই কোর্টে ব্যারিস্টার হিশেবে গ্রহণ করা হোক। তাঁর প্রবাসের সময়ে ঠিকমতো টাকাপয়সা না-পাঠানোর জন্যে তিনি দিগম্বব মিত্রকে কতোটা দায়ী করেছিলেন, আগের অধ্যায়ে আমরা তা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এই আবেদনপত্রের সঙ্গে তিনি সেই দিগম্বর মিত্রের একটি প্রশংসাপত্র জুড়ে দেন। দিগম্বর মিত্রের প্রতি কবির ধারণা বদল করার ব্যাপারে বিদ্যাসাগর অবশ্য আগে থেকে চেষ্টা করেছিলেন। তার ফলে তাঁর মনোভাব খানিকটা নরমও হয়েছিলো। এ ছাড়া, আমার বিশ্বাস, তিনি কলকাতায় ফেরার পর দিগম্বর মিত্ৰ তাঁকে উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানিয়ে পুরোনো তিক্ততা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। নয়তো, কলকাতায় অতো পরিচিত লোক থাকা সত্ত্বেও কবি বিশেষ করে দিগম্বর মিত্রের প্রশংসাপত্র দাখিল করবেন কেন!

অতিসম্প্রতি ব্যারিস্টারি পাশ করলেও, কলকাতায় তিনি আদৌ আগন্তুক ছিলেননা। শ্বেতাঙ্গ সমাজও তাঁকে চিনতো। তাঁর সাহিত্য-খ্যাতির কথাও তাদের কাছে একেবারে অজানা ছিলো না। তাঁর এই পরিচিতি তাঁর জন্যে একই সঙ্গে ভালো এবং মন্দ ফল দিয়েছিলো। একদিকে দেখতে পাই, আবেদনপত্র পেশ করার দু সপ্তাহ পরে, ৬ মার্চ তারিখে — হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যর বার্নস পীকক তাঁকে ব্যারিস্টার হিশেবে গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তাঁর এই মত সমর্থন করেন বিচারপতি জি লখ, বেইলি, জে পি নর্মান আর এফ বি কেম্প। পরের দিন বিচারপতি এফ এ বি গ্লোভার এবং সিটন-কারও এই মতের প্রতি সমর্থন জানান। সিটন-কার বিশেষ করে উল্লেখ করেন যে, অল্প দিন আগেই মনোমোহন ঘোষকে গ্রহণ করা হয়েছে, যদিও তিনি মাত্র আটটি টার্ম আইন অধ্যয়ন করেছেন। তিনি আরও বলেন যে, মি দত্তের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। মাইকেলকে গ্রহণের পক্ষে শম্ভুনাথ পণ্ডিতও সমর্থন জানান। কিন্তু বিচারপতি এল এস জ্যাকসন লেখেন যে, তিনি মত দেবার আগে কিছু খোঁজ-খবর নিতে চান।১০ অন্যদিকে, ২৫ মার্চ তারিখে মাইকেলকে গ্রহণ করার ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা প্রকাশ করেন বিচারপতি এ জি ম্যাকফারসন।

আমার মনে হয় যতোদিন না আবো বেশি এবং আরো সন্তোষজনক প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনি অ্যাডভোকেট হবার মতো লোক, ততোদিন মিস্টার দত্তকে অ্যাডভোকেট হিশেবে গ্ৰহণ করা উচিত হবেনা। মিস্টার দত্তের অতীত এবং কলকাতা পুলিশ কোর্টের দোভাষী হিশেবে তীর চাকরির খতিয়ান থেকে মনে হয় যে, তিনি তেমন ব্যক্তি নন। তাঁর আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত কাগজপত্র এতোই অপ্রতুল যে, তা থেকেও মনে হয়, তিনি উপযুক্ত লোক নন। আমার জানা মতে, বাবুদিগম্বর মিত্রের মতামতের (যদি তার কোনো বিশেষ মূল্য থাকে) অন্য অনেকেই বিরোধিতা করেন। এটা বেশ লক্ষণীয় যে, মি দও ইংল্যান্ডের কারো চিঠিপত্র দাখিল করেননি। এমন কি, কোনো সরকারী কর্মকর্তার অথবা তিনি সেখানে যাবার আগে যাঁদের অধীনে কাজ করেছিলেন, তাঁদের কোনো চিঠিও নয়।

বিচারপতি ম্যাকফারসনের তীব্র বিরোধিতার মুখে বিচারপতি নর্ম্যান পরের দিন তাঁর সম্মতি প্রত্যাহার করেন। তা ছাড়া, বিচারপতি জন বাড ফিয়ার — দেশীয়দের যিনি মোটামুটি ভালো চোখে দেখতেন — তিনিও চৌঠা এপ্রিল তারিখে ম্যাকফারসনের প্রভাবে মাইকেলের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

মিস্টার দত্ত যতো কম টার্ম লেখাপড়া শিখেছেন এবং তাঁর বদনামের পরিপ্রেক্ষিতে, আমি তাঁকে হাই কোর্টে গ্রহণ করার পক্ষে সম্মতি দিতে পারছিনে — যতদিন না মিস্টার পুত্তের যোগ্যতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট শংসাপত্র এবং চরিত্র সম্পর্কে সন্তোষজনক প্রমাণ পাওয়া যায়।১১

দরখাস্ত করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কবি বুঝতে পারলেন, এবাবেও তাঁর প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি এক পথে গেলো না। ব্যারিস্টারি পাশ করে প্র্যাক্টিস করার অনুমতি চাইলে, তা পেতে কোনো অন্তরায় দেখা দিতে পারে — কল্পনাচারী কবি হওয়া সত্ত্বেও — এটা তিনি ভাবতে পারেননি। সে জন্যে, তিনি মনে মনে নানা রঙের যে-জাল বুনছিলেন, এক খোঁচায় তা ছিঁড়ে গেলো।

ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি কখনো তেমন প্রসন্ন ছিলেন না। তবে কবিও সহজে হার স্বীকার করার পাত্র ছিলেন না। আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস থাকায়, শত বিরোধিতার মুখেও তিনি লড়ে যেতেন। এবারেও সে বিষয়ে কুণ্ঠিত হলেন না। হাই কোর্টের একমাত্র দেশীয় বিচারপতি শম্ভুনাথ পণ্ডিতও সৌভাগ্যক্রমে তাঁর সহায় হলেন। তিনি কবির পক্ষে তদবির করতে আরম্ভ করলেন। তা ছাড়া, বিচারপতি জ্যাকসন এবং নর্ম্যান যে-খোঁজখবর নিচ্ছিলেন, তারও একটা অনুকূল প্রভাব পড়লো। চৌঠা এপ্রিল তারিখে বিচারপতি নর্ম্যান লিখলেন:

আমার মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, আমরা কি তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে এতোটা জানি — যাতে তাঁকে বাদ দেওয়া যায়? প্যাটারসন বরং তাঁকে রীতিমতো গ্রহণ করার পক্ষপাতী। মিস্টার দত্ত অমায়িক লোক নন এবং মাঝেমধ্যে মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়েন — এ ছাড়া প্যাটারসন তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেন না। তিনি বরং বলেন যে, মিস্টার দত্ত খুব বুদ্ধিমান লোক।১২

বিচারপতি নর্ম্যানের এ রকমের সম্মতি সত্ত্বেও, মাইকেলকে নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধায় প্রধান বিচারপতি স্যর বার্নস পীকক তাঁকে গ্রহণ করার পক্ষে যে-মত দিয়েছিলেন, তা প্রত্যাহার করেন।১৩ ওদিকে, বিচারপতি শম্ভুনাথ পণ্ডিত গোটা ব্যাপারটাকে বিবেচনা করেন দেশীয়দের বিরুদ্ধে ‘সাহেবদের’ একটা ষড়যন্ত্র বলে। তিনিই মন্তব্য করেন ‘এ বিষয়ে না জিতলে মান থাকবে না।’১৪ ১১ এপ্রিল তারিখে তিনি কবিকে উপদেশ দেন কলকাতার বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাঁর চরিত্র এবং যোগ্যতা সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশংসাপত্র জোগাড় করতে। মধুসূদন অমনি ত্রাহি বিদ্যাসাগর বলে চিঠি লেখেন:

আজ সকালে আমি পণ্ডিতজীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি বলেছেন যে, আমার একমাত্র উপায় হলো সবচেয়ে নাম-করা দেশীয় ব্যক্তিদের যতোগুলো সম্ভব প্রশংসাপত্র জোগাড় করা।… শম্ভুনাথ বলেছেন যে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আমাদের শত্রুরা বিচারপতিদের মন জয় করে নিয়েছে এবং সে কারণে যেমন বুনো ওল আমাদের তেমনি বাঘা তেঁতুল জোগাড় করতে হবে। তিনি চান, আপনি কলকাতায় চলে আসুন। আমি নিজে যে কী বলবো ঠিক বুঝতে পারছিনে। আমি ভালো করে জানি, এরই মধ্যে আমি আপনাকে অনেক ঝামেলা দিয়েছি। আমাদের কাগজপত্র নিয়ে আগামী সপ্তাহের গোড়াতেই হাজির হতে হবে, কারণ একটুও সময় নষ্ট করার উপায় নেই।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে রাজনারায়ণ দত্তেৰ পুত্র এবং সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি যে এক কালে ধূমকেতুর মতো উদিত হয়ে বাঙালি সমাজের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, গর্ব করার জন্যে বাঙালিদের একটা অবলম্বন দিয়েছিলেন — সেই সূত্র ধরে তাঁর বন্ধুরও অভাব ছিলো না। বিপদের সমযে বিদ্যাসাগর তো বটেই, কলকাতার নামজাদা লোক অনেকে তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। দিগম্বর মিত্রকে অপছন্দ করলেও, সেদিনই (১১ এপ্রিল) সকালের দিকে গিযে কবি তাঁর সঙ্গে দেখা কবেন। দিগম্বর মিত্র তাঁকে পাঠিয়ে দেন বাজেন্দ্রলাল মিত্রের কাছে — তাঁকে নিয়ে শোভাবাজারে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুরের কাছে যাবার জন্যে। রাজেন্দ্রলালের কাছ থেকে তিনি যান রামগোপাল ঘোষের কাছে। তিনি একটি প্রশংসাপত্র দেবার প্রতিশ্রুতি দেন পরের শনিবাবে — ১৪ এপ্রিল তারিখে।১৫ মোট কথা, বাধার সম্মুখীন হবার সঙ্গে সঙ্গে চিরদিনের সগ্রামী মাইকেল সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১১ থেকে ২২ এপ্রিলের মধ্যে তিনি তখনকার কলকাতার সবচেয়ে নাম-করা ব্যক্তিদের অনেকের প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। যে-মাইকেলকে এমনিতে মনে হয় অন্তর্মুখী, তিনি দরকার হলে কতোটা বহির্মুখী হতে পারতেন অথবা জনসংযোগে তৎপরতা দেখাতে পারতেন, আলোচ্য প্রশংসাপত্রগুলো তার একটা প্রমাণ। যাঁরা তার চরিত্র এবং ক্ষমতার প্রশংসা করে এ সময়ে লিখেছিলেন তাঁদের কয়েক জনের নাম দেখা যাবে পরের পৃষ্ঠার তালিকা থেকে।

এঁরা বেশির ভাগই তাঁর চরিত্র এবং ক্ষমতার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। অনেকে উল্লেখ করেছেন, তাঁর পিতা ছিলেন নাম-করা উকিল। আর তিনি নিজে যে নাম-কবা সাহিত্যিক সেটাও তাঁরা উল্লেখ করতে ভুলে যাননি। এটা অনুমান করা শক্ত নয় যে, শম্ভুনাথের মতো এঁরাও কবিকে হাই কোর্টে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না ইংরেজ এবং ফিরিঙ্গি ব্যারিস্টারদের স্বার্থ রক্ষার খাতিরে — এটা বিবেচনা করে থাকবেন। যাঁরা তাঁর পক্ষে শংসাপত্র দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন কলকাতার সুপরিচিত নাগরিক। ব্যবস্থাপক সভার দুজন সদস্য ছাড়াও, কলকাতার সবচেয়ে নামকরা চারটি জমিদার পরিবারের প্রতিনিধিরা, সুপরিচিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে তিনজন এবং আইনজীবীদের মধ্য থেকে ন জন খুব প্রবীণ সদস্য তাঁর পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। আইনজীবীদের মধ্যে দুজন — অনুকূল মুখোপাধ্যায় এবং দ্বারকানাথ মিত্র — আবার পরবর্তী দু বছরের মধ্যে হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। এতোজন বিশিষ্ট নাগরিকের জোরালো সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তাঁর আবেদনপত্র আর আটকে রাখতে পারছিলো না। এ আবেদনপত্র আটকে দিলে সেটা যে দেশীয়দের চোখে খুব দৃষ্টিকটু এবং বর্ণবৈষম্য-মূলক আচরণ বলে গণ্য হবে, এটা বিচারপতিরা চিন্তা করে থাকবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে, আবেদনপত্র দাখিল করার প্রায় আড়াই মাস পরে — তেসরা মে বৃহস্পতিবার বিচারপতিরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অ্যাডভোকেট হিশেবে গ্রহণ করা হোক।১৬ পরের সোমবার — ৭ মে তারিখে নবতম ব্যারিস্টার হিশেবে কবি নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।

এতো বছরের আশা শেষ পর্যন্ত সফল হতে যাচ্ছে দেখে সেদিন কবি কেমন উচ্ছসিত হয়েছিলেন এবং বিদ্যাসাগরসহ তাঁর বন্ধুরা কেমন খুশি হয়েছিলেন — তা আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। ঠিক চার বছর এগারো মাস আগে রাজনারায়ণ বসুকে তিনি নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন: আর কবি মধুসূদন নয় — অতঃপর এম এস ডাট ব্যারিস্টার অ্যাট ল। সেই লেখার মধ্যে কেবল স্বপ্ন ছিলো না, নিজেকে নিয়ে খানিকটা রসিকতাও ছিলো। আজ আর রসিকতা নয়, সত্যি সত্যি তিনি ব্যারিস্টার হয়েছেন। এতোকাল পরে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হযে (অনিদ্রায় অনাহারে সঁপি কায়মন) তিনি ব্যারিস্টার। এতো বড়ো সুখের দিনে কলকাতার এক কালের নাম-করা উকিল রাজনারায়ণ দত্তকে তাঁর কি মনে পড়েনি? (লন্ডন থেকে লিখেছিলেন তিনি তাঁর সম্মান রক্ষা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।১৭) জাহ্নবী দেবীকে স্মরণ করেতাঁর বড়ো বড়ো চোখ কি অশ্রুসিক্ত হয়নি। এমনকি, এদিনে

নামপরিচয়তারিখ
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরজমিদার১৩ এপ্রিল
রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর কুমার হরেন্দ্রকুমার বাহাদুরবঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য১৪ এপ্রিল
রাজেন্দ্রলাল মিত্রসম্পাদক এবং ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউটের পরিচালক১৪ এপ্রিল
কৃষ্ণকিশোর ঘোষ অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র চৌধুরী অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারকানাথ মিত্রহাই কোর্টের উকিল উকিল, পরে হাই কোর্টের বিচারপতি উকিল কলকাতার সবচেয়ে প্রবীণ উকিলদের অন্যতম উকিল, পরে হাই কোর্টের বিচারপতি১৫ এপ্রিল
প্যারীচাঁদ মিত্রএগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সাহিত্যিক১৫ এপ্রিল
রাজেন্দ্র মল্লিক দেবেন্দ্র মল্লিকজমিদার১৫ এপ্রিল
রমানাথ ঠাকুরবঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য১৬ এপ্রিল
গোলাম মুহাম্মদটিপু সুলতানের পুত্র১৬ এপ্রিল
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়সংস্কৃত কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যাপক২০ এপ্রিল
রমানাথ লাহা, গিরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজনাথ মিত্র, তারাবল্লভ চট্টোপাধ্যায়অ্যাটর্নিবিভিন্ন তারিখ
হরলাল শীল, যাদবকৃষ্ণ সিংহ, ও. সি. দত্ত, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরজমিদারবিভিন্ন তারিখ

হেনরিয়েটা, শর্মিষ্ঠা-মেঘনাদ, আর বহু যুগের ওপার থেকে রেবেকা-ব্যর্থা-ফিবি-জর্জকেও হয়তো মনে করেছেন। পরিশেষে আর একটা চিন্তাও এক টুকরো মেঘের মতো মনের এক কোণে উঁকি দিয়েছিলো কিনা কে জানে! — এ বৃক্ষে অভিপ্রেত ফল ফলবে তো? তবে সে চিন্তা দেখা দিয়ে থাকলেও, তাঁকে অভিভূত করতে পারেনি। কারণ তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিলো পর্বপ্রমাণ। তাঁর মতো লেখাপড়া জানা,তাঁর মতোভাষাবিদ, তাঁর মতো ধারালো বুদ্ধির লোক বাঙালি সমাজেকজন আছে? মনোমোহন ঘোষ (অথবা জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর) পারবে তাঁর মতো অনর্গল ইংরেজিতে জেরা করতে, বিচারকের সামনে আর্জি পেশ করতে? সফলতা আসবে কিনা — প্রশ্নটা তা নয়। প্রশ্ন হলো: সফলতা কতোটা দ্রুত আসবে! প্র্যাক্টিস জমিয়ে বসতে কতোটা সময় লাগবে!

মাইকেল বসস্থান হিশেবে বেছে নিয়েছিলেন স্পেন্সেস হোটেলকে। চেম্বারও খোলেন সেখানে।১৮ মনোমোহন ছাড়া অন্য কোনো ব্যারিস্টারের তখন এমন ব্যয়বহুল হোটেলে চেম্বার ছিলো না। ব্যয়বহুল বিবেচনা করে মনোমোহনও দীর্ঘদিন এ হোটেলে চেম্বাব রাখেননি। কিন্তু মাইকেল মনোমোহনের অনুকরণে অন্যত্র সরে যাওয়ার কথা ভাবেননি। ওদিকে, তিনি যেমনটা আশা করেছিলেন, সাফল্য তেমন মাত্রায় অথবা তেমন দ্রুত লয়ে এলো না। জুন মাসের শেষ পর্যন্ত ইংলিশম্যান পত্রিকায় হাইকোর্টের প্রধান মামলাগুলোর খবর পড়ে দেখেছি কোনো মামলার কৌঁসুলি হিশেবে এম এম

ডাটের নাম খুঁজে পাইনি। বাঙালি ব্যারিস্টার পেলে বাঙালি মক্কেলরা সব সার বেঁধে তাঁর দিকে ছুটে আসবেন — এ আশা তিনি করে থাকলে ভুল করেছিলেন। তবে এ সমযে বাঙালি উকিলদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, আশুতোষ ধর, দেবেন্দ্রনাথ দত্ত, বি. এন. দত্ত, উমেশচন্দ্র এবং যোগীন্দ্রচন্দ্র ব্যানার্জি, আর. এন. বসু, ডি. এন. বসু, এম. সি. চ্যাটার্জি, নরেন্দ্রনাথ সেন ইত্যাদি নাম ইংলিশম্যান পত্রিকায় বারবার উল্লিখিত হয়েছে। মাইকেল কেবল যে নতুন এবং অভিজ্ঞতাহীন, তাই নয়; যে-সামাজিক শুভেচ্ছার ওপর মক্কেল পাওযা অংশত নির্ভর করে তাও তাঁর সামান্যই ছিলো। ইংরেজ বনে গিয়ে বাঙালি সমাজ থেকে তিনি নিজেকে যথেষ্ট বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। আবার ইংরেজ সমাজও তাঁর ওপর নির্ভর করতে পারেনি। এর ফলে কোনো দিক থেকেই তাঁর কাছে দলে দলে মক্কেল এলো না।

তারপর ধীরে ধীরে তিনি কিভাবে মক্কেল পেতে আরম্ভ করেন , নিজের ব্যবসা ফেঁদে বসেন, সেই কাহিনী আমাদের জানা নেই। এমন কি, য়োবোপে জীবন উপভোগ করার ‘উন্নত’ দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করে দেশেফিরে কি কি উপকরণ দিয়ে নিজের জীবন উপভোগ করার চেষ্টা করেছিলেন — তারও বিবরণ তাঁর বন্ধু অথবা জীবনীকারেরা লিখে যাননি। কেবল জানা যায়, জীবনকে উপভোগ করতে গিয়ে তিনি টাকাপয়সা সব উড়িয়ে দিয়েছিলেন। একা মানুষ, কিন্তু হোটেলে ভাড়া নিয়েছিলেন তিনটি ঘর। সেখানে তিনি একটি দুটি নয়, প্রতি বেলায় নাকি ছটি ডিশ খেতেন। তা ছাড়া, বন্ধু-বান্ধবদের দেশীয় এবং বিদেশী খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। ভোজ দিতেন মাঝেমধ্যে। আর নিজের সুরাগারে রাখতেন শেরি, শ্যাম্পেন, হুইস্কি, বিয়ার — নানা রকমের শরাব এবং তা অকাতরে বিলাতেন বন্ধুদের।১৯ এভাবে অনেক টাকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তা নয়। কিন্তু তাঁকে কেবল এমন স্থূল উদর-পূজারী হিশেবে কল্পনা করা অসম্ভব। জীবনের গভীর আস্বাদ নেবার জন্যে তিনি অন্য কী উপাচার সাজিয়ে ছিলেন, আজ আর তা জানার উপায় নেই। সমসাময়িক অনেক নাম-করা লোকের মতো তিনি রক্ষিতা বাখেননি, এটা অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

প্রথম কয়েক মাস বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা বজায় ছিলো। বিপদে-আপদে প্রধানত তাঁর কাছেই সাহায্য চেয়েছেন। বিদ্যাসাগরকে লেখা তাঁর এ সময়ের সব চিঠি রক্ষা পায়নি। কিন্তু যে-চিঠিগুলো আমাদের হাতে এসেছে, তা থেকে অনেক খবর জানা যায়। বিশেষ করে তাঁর আর্থিক অবস্থার কথা। তা ছাড়া, জানা যায় জরুরী একটা বিষয় — তাঁর স্বাস্থ্যের সংবাদ। আলোচ্য চিঠিগুলোর অনেকটাতে কোনো তারিখ নেই। তবু আভ্যন্তরীণ প্রমাণ থেকে তাদের আনুমানিক তারিখ নির্ণয় করা একেবারে অসম্ভব নয়। এসব চিঠি থেকে দেখা যায়, ব্যারিস্টারি শুরু করার মাস ছয়েক পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে আরম্ভ করে।২০ সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়, নভেম্বর মাস (১৮৬৭) থেকে তাঁর গলার অসুখ শুরু হয়। পরে দেখা যাবে, এই রোগ শেষ পর্যন্ত তাঁর ব্যারিস্টারির কাজে একটা প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এ সময় থেকে তাঁর সাধারণ স্বাস্থ্যও খারাপ হতে শুরু করে। যেসব টুকরো খবর বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তা থেকে মনে হয়, স্বাস্থ্যে প্রতি তিনি কখনো খুব একটা সুবিচার করতেন না। কেবল অতিরিক্ত কারণবারি পান নয়, অপরিমিত এবং অখাদ্য খেয়ে তিনি উচ্চরক্তচাপ এবং হৃদরোগও অর্জন করেছিলেন। অব্যাহত আর্থিক অনটন নিয়ে তিনি যে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করতেন, তাও তাঁর স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ ফল ফেলেছিলো। জীবনে তিনি বিশ্রামও খুব কম করেছেন। ক্কচিৎ যখন অবসর পেয়েছেন, তখন মগ্ন হয়েছেন অধ্যয়ন এবং সাহিত্যচর্চায়। চরম প্রতিকূল অবস্থায়ও তিনি কেমন করে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারতেন, আগের অধ্যায়ে আমরা তা দেখতে পেয়েছি।

কলকাতায় এসেও প্রথম দশ মাস তিনি ব্যতিব্যস্ত ছিলেন প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে। তা সত্ত্বেও, সাহিত্যচর্চা অথবা লেখাপড়ার প্রতি প্রেম ভুলে যেতে পারেননি। হেক্টরবধ তিনি এ বছরই রচনা করতে আরম্ভ করেন — নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে।২১ এ রচনায় গদ্য নিয়ে তিনি যে-পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন তার ব্যাপকতা থেকে অনুমান করা সম্ভব, তিনি এ রচনার পেছনে প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন। মোট কথা, কলকাতায় ফেরার পর তাঁর অর্থ উপার্জনের মন্ত্র সাধন না-হলেও, বছর দুয়েকের মধ্যে দ্রুত তিনি শরীরের পতন ঘটিযেছিলেন এবং নিঃশেষ করে ফেলেছিলেন এক কালের অফুরন্ত জীবনীশক্তি।

বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরে টাকা ধার করা এবং তা শোধ দেবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তবে তার জন্যে তিনিই দায়ী ছিলেন, বিদ্যাসাগর নন। তাঁর চরম বেহিশেবী আচরণের দরুন এ সময়ে তাঁর ঋণের বোঝা জমতে থাকে। কারণ, তিনি মনে করতেন যে, একবার প্র্যাক্টিস জমিয়ে বসতে পারলে রাশি রাশি টাকা আসবে এবং সেই সাতেই তিনি ঋণ করতেন। কিন্তু কার্যকালে তিনি পুরোনো ধার পরিশোধ করতে পারেননি; বরং নতুন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। ধার এবং ধারের সুদ শোধ দেবার জন্যে আলোচ্য কালে তার ওপরে যে-চাপ আসে, তাতে তিনি কম বিব্রত বোধ করেননি, তবে তা সত্ত্বেও তিনি ধার করতে থাকেন। তিনি কলকাতায় পা দেবার দু মাসের মধ্যে –৮ এপ্রিল (১৮৬৭) তারিখে — প্রধান উত্তমর্ণ অনুকূল মুখোপাধ্যায় তাঁর ধার এবং বন্ধকের সুদ পরিশোধ করার জন্যে বিদ্যাসাগরকে তাগাদা দিয়ে চিঠি লেখেন।

এই মুহূর্তে আমার টাকার খুব প্রয়োজন। দয়া করে আমাকে তিন হাজার টাকা ফেরত দেবার এবং বন্ধকের বারো হাজার টাকার সুদ দেবার ব্যবস্থা করবেন। আপনি জানেন, এ বাবদে এ যাবৎ কোনো সুদ দেওয়া হয়নি। এখন মিস্টার মাইকেল যেহেতু এখানে, কোনো বিলম্ব না-করে তাঁর এসব ব্যাপার মিটিয়ে ফেলা উচিত।২১

কেবল অনুকূল মুখোপাধ্যায় টাকার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেননি, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যাবত্নও টাকার জন্যে চঞ্চল এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তা জানা যায় বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে। বিদ্যাসাগর এতে কেবল বিরক্ত হননি, রীতিমতো বিপন্ন বোধ করেছেন। শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে তিনি ধার করেছিলেন শিগগিরই সে টাকা শোধ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। প্রথম বিধবাবিবাহের বর হিশেবে বিদ্যারত্ন বাংলার সামাজিক ইতিহাসে পরিচিত ব্যক্তি। তাই বলে তিনি আদর্শবাদী বলে বিখ্যাত ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন বস্তুবাদী। অনেকে বলেন, দেশোদ্ধারের নিষ্কাম ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বিধবাবিবাহ করেননি, বরং এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন ইনাম হিশেবে মিলবে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ — এই লোভে।২২ যথাসময়ে টাকা ফেরত না-পাওয়ায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তাই বিদ্যাসাগরকে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁর কথায় তিনি এ টাকা ধার দিয়েছিলেন। এ কথা বলে তিনি বিদ্যাসাগরের আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিলেন — বিদ্যাসাগর নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার মতো লোক ছিলেন না। তাই কবি যাতে শ্রীশচন্দ্রের পাঁচ হাজার টাকা অবিলম্বে ফিরিয়ে দেন, এবং অনুকূলচন্দ্রের সুদ পরিশোধ করেন, তার জন্যে তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময়ে বিদ্যাসাগরের নিজের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। তখনো বইপত্র এবং সংস্কৃত প্রেস থেকে তাঁর আয় অব্যাহত থাকলেও, তিনি বিধবাবিবাহ নিয়ে ঋণজালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। শ্রীশচন্দ্রের ধার নিজে পরিশোধ করে দেবার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিলো না। কবিকে ধার শোধের ব্যাপারে জুলাই মাসের শেষে অথবা অগস্টেরশুরুতে (১৮৬৭) বর্ধমান থেকে যে-চিঠিটি লেখেন, তা থেকে তাঁর এই ব্যাকুলতা এবং তিক্ততা সহজে লক্ষ্য করা যায়। মাস আটেক আগে তিনি দুর্ঘটনায় আহত হবার পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্য আদৌ ভালো যাচ্ছিলো না। তিনি স্বাস্থ্য লাভের আশায় নানা রকমের সাধ্যসাধনা শুরু করেছিলেন। বর্ধমানেও গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। তাঁর সেই শারীরিক এবং মানসিক সংকটের দরুন তাঁর চিঠিতে কিছু অতিরিক্ত তিক্ততা দেখা দিয়ে থাকবে।

অনেকের এরূপ সংস্কার আছে, আমি যাহা বলি, কোনক্রমে তাহার অন্যথা ভাব ঘটে না, সুতরাং তাঁহারা অসন্দিগ্ধচিত্তে আমার বাক্যে নির্ভর করিয়া কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। লোন্ত্রে এরূপ বিশ্বাসভাজন হওয়া যে প্রার্থনীয় তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি অবিলম্বে সেই বিশ্বাসে বঞ্চিত হইব, তাহার পূর্বলক্ষণ ঘটিয়াছে।

যৎকালে আমি অনুকূল বাবুর নিকট টাকা লই, অঙ্গীকার করিয়াছিলাম, আপনি প্রত্যাগমন করিলেই পরিশোধ করিব; তৎপরে পুনরায় যখন আপনার টাকার প্রয়োজন হইল, তখন যথাকালে টাকা না পাইলে পাছে আপনার ক্ষতি বা অসুবিধা হয়, এই আশঙ্কায় অন্য কোন উপায় না দেখিয়া শ্রীশচন্দ্রের নিকট কোম্পানির কাগজ ধার করিয়া টাকা পাঠাইয়া দি। তাঁহার ধার ত্বরায় পরিশোধ করিব এই অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু উভয়স্থলে আমি অঙ্গীকারুভ্রষ্ট হইয়াছি এবংশ্রীশচন্দ্র ও অনুকুল বাবুসর টাকা না পাইলে বিলক্ষণ অপদস্থ ও অপমানগ্রস্ত হইব, তাহার কোন সংশয় নাই।

এক্ষণে কিরূপে আমার মানরক্ষা হইবেক, এই দুর্ভাবনায় সৰ্ব্বক্ষণ আমার অন্তঃকরণকে আকুল করিতেছে, এবং ক্রমে ক্রমে এত প্রবল হইতেছে যে রাত্রিতে নিদ্রা হয় না। অতএব আপনাদের নিকট বিনয়বাক্যে প্রার্থনা এই, সবিশেষ যত্ন ও মনোযোগ করিয়া ত্বরায় আমার পরিত্রাণ করেন। পীড়শান্তি এবং স্বাস্থ্যলাস্ত্রে নিমিত্ত পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়া এবং অন্ততঃ ছয় মাস কাল তথায় থাকা অপরিহার্য্য হইয়া উঠিয়াছে। আশ্বিনের প্রথম ভাগে যাইব বলিয়া স্থির করিয়াছি। কিন্তু আপনি নিস্তার না করিলে কোন মতেই যাইতে পারি না। এই সমস্ত আলোচনা করিয়া যাহা বিহিত বোধ হয় করিবেন….২৩

বিদ্যাসাগরেব এ চিঠি পেয়ে কবি ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি নিজে হিশেবী ছিলেন না বটে, কিন্তু যিনি তাঁকে চরম দুর্দিনের সময়ে বাঁচিয়েছিলেন এবং ধার করেছিলেন তাঁরই জন্যে, সেই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা তাঁর কম ছিলো না। তিনি বুঝতে পারলেন, এর পরে ঋণ শোধ দেবার জন্যে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেবার ব্যাপারে আর দ্বিধা করলে চলবে না।

কয়েক মিনিট আগে আমার হাতে আপনার যে চিঠি পৌছেছে, তা থেকে আমি দারুণ কষ্ট পেয়েছি। আপনি জানেন, এ পৃথিবীতে বলতে গেলে এমন কিছু নেই যা আমি আপনার জন্যে প্রতে পারবো না। আমার জন্যে যে-অপ্রীতিকর বোঝা আপনি তুলে নিয়েছেন, তা থেকে মুক্তি লাভের জেন্যে আপনি যে-কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন — তাতে আমার সম্মতি রয়েছে জানবেন।২৪

কবির চিঠি পাওয়ার কদিন পরে বর্ধমান থেকে ফিরে এসে বিদ্যাসাগরতার কথা মতো ব্যবস্থা নেবার চেষ্টা করেছিলেন কিনা, তা আমাদের অজ্ঞাত। কিন্তু এর চার-পাঁচ মাসের মধ্যেও ঋণ শোধ করা সম্ভব হয়নি, তা জানা যায়। ইতিমধ্যে টাকার জন্যে শ্রীশচন্দ্র আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করার হুমকি দেন। বিদ্যাসাগর তার পরিপ্রেক্ষিতে কবিকে কী লিখেছিলেন, সে চিঠি আমরা পাইনি, কিন্তু ডিসেম্বর মাসে কবি তাঁকে কী উত্তর দেন, তা আমাদের জানা আছে। তিনি লেখেন:

আপনি ভালো নেই জেনে দুঃখিত হলাম। এদিকে, আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছিনে। আমি শ্রীশচন্দ্র সম্পর্কে আর কী বলবো? সে আপনাকে আদালতে নিলে আপনার জন্যে সেটা হবে মর্মান্তিক আঘাত আর আমি তা হলে [ক্রোধে] উন্মাদ হয়ে যাবো। শ্রীশ নিশ্চয় অতোটা পাষণ্ডের মতো হবে না। আপনি জানেন আমার কোনো টাকা নেই। তাছাড়া, আমার গলা এবং সাধারণ স্বাস্থ্যের কারণে গত নভেম্বর মাস থেকে বেশ অসুস্থ আছি। আপনার কি মনে হয় না যে, অনুকূলকে কিছু একটা করতে রাজি করানো যাবে? আমি গত দু সপ্তাহ বের হইনি এবং কখন আবার উঠে দাঁড়াতে পারবো, তাও জানিনে। … যারা চায় না যে, আপনি আমার প্রতি সহৃদয় আচরণ করুন, তারা আমার বেহিশেবী ব্যয় এবং অন্যান্য বিষয়ে আপনার কাছে নিশ্চয় অনেক কথা বলে; কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন একটা অলৌকিক শক্তি ছাড়া প্র্যাক্টিস শুরু করার প্রথম বছরেই কারো পক্ষে পাঁচ হাজার টাকা ধার শোধ করা, ‘ভদ্রলোকের’ মতো বাস করা এবং স্ত্রী ও সন্তানদের মোরোপে রাখা সম্ভব নয়! .. আমি আরও জানতে পেরেছি যে, কোনো কোনো লোক আমার বিরুদ্ধে আপনাকে চটিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। আপনি বোকা নন এবং সেটাই আমার সান্ত্বনা। …নীলকমলকে আমি নিজেই লিখবো। … দেখি আসন্ন ছুটির সময়ে কিছু টাকা জোটাতে পারি কি না।২৫

কবির এই আবেদনে অনুকুল সাড়া দিয়ে অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর আরও টাকা ধার করেছিলেন কিনা, তা আমাদের জানা নেই। সম্ভবত করেননি। এমন কি, নিজেও ধার শোধ দেবার মতো টাকা জোগাড় করতে পারেননি। কিন্তু তিনি অনুভব করলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ধার পরিশোধ করে বিদ্যাসাগরকে দায়মুক্ত না-করলে চলবে না। তাঁকে তিনি আন্তরিকভাবে আপনজন বিবেচনা করতেন। এবং মনে করতেন যে, তাঁর কাছে তিনি আবদার করতে পারেন। সেই বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে অমন পত্রাঘাত পেয়ে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। নিশ্চয় খুব অভিমানও হয়েছিলো তাঁর ওপর। সেই অভিমান নিয়ে তিনি নিজের তালুক বিক্রি করার উদ্যোগ নেন। অনুকূল মুখোপাধ্যায়কে উপস্বত্বভোগী বন্ধক দিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি বাঁচানোর তিনি যে-পরিকল্পনা করছিলেন,২৬ তা আর বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যাসাগর উদ্যোগ নেননি। অনুকূল মুখোপাধ্যায়ও নতুন ঋণ দিতে সাহস পাননি। সুতরাং বিদ্যাসাগরকে চিঠি লেখার দু-এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি তাঁর তালুক বিক্রির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। বাকি থাকে কেবল একটা সিদ্ধান্ত — কাকে বিক্রি করবেন এ সম্পত্তি।

আগেই বলেছি, শ্রীশচন্দ্র এই সম্পত্তি একুশ হাজার টাকায় কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন — যদিও এই তালুক দুটির খাজনা ছিলো দেড় হাজার টাকা এবং তখনকার সহজ হিশেব অনুযায়ী এর দাম হবার কথা খাজনার কুড়ি গুণ অর্থাৎ তিরিশ হাজার টাকা। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরে ফেব্রুআরি মাসে (১৮৬৮) কবি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে (তাঁর স্ত্রী মোক্ষদা দেবীর নামে) এ সম্পত্তি বিক্রি করেন।২৭ শ্রীশচন্দ্রের কাছ থেকে একুশ হাজার টাকার প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে — যে-মহাদেব অতীতে তাঁকে এতো ভুগিয়েছেন, তাঁর কাছে কুড়ি হাজারে বিক্রি করলেন কেন, জীবনীকার তার ব্যাখ্যা দেননি। আমার বিশ্বাস, মহাদেব চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘকাল (রাজনারায়ণ দত্ত বেঁচে থাকার সময় থেকে) এই সম্পত্তি সরাসরি দেখাশোনা করেছিলেন এবং এর ফলে এই সম্পত্তিতে তাঁর দখলি স্বত্ব ভালোভাবে কায়েম করেছিলেন। আসল জমিদারের অনুপস্থিতিতে প্রজারা তাঁকেই গণ্য করতেন জমিদার হিশেবে। অন্য কেউ এ সম্পত্তি কিনলে সহজে এর দখল পেতেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিলো। এই পরিস্থিতিতে অন্য কোনো ক্রেতা এগিয়ে আসেননি। ফলে এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তিনি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শেষ পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হন। এবং মহাদেব তার পুরো সুযোগ গ্রহণ কবে যে-দাম দেবার প্রস্তাব দিলেন, তিনি সেই দাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন। অন্যায় সুযোগ নিয়ে মহাদেব কম দামে এই তালুক কিনেছিলেন — গৌরদাস বসাকও তাঁর স্মৃতিচারণে তা উল্লেখ করেছেন।২৮

এই সম্পত্তি থেকে তিনি যে-কুড়ি হাজার টাকা পেয়েছিলেন তার মধ্যে উনিশ হাজার টাকা দিতে হয়েছিলো অনুকূল মুখোপাধ্যায়কে। শ্রীশচন্দ্রকে টাকা দেবার কথা কোথাও উল্লিখিত হয়নি। বিদ্যাসাগরও এর পরে ধার শোধ দেবার জন্যে কবিকে প্রবল তাগাদা দেননি। এ থেকে অনুমান করি যে, সম্পত্তি বিক্রি করার আগেই শ্রীশচন্দ্রের ধার পুবো না-হলেও অংশত শোধ হয়েছিলো। কোন সূত্র থেকে টাকা পেয়েছিলেন, কার অথবা কাদের কাছ থেকে টাকা এনে এই পুরোনো ধাব শোধ দিয়েছিলেন, সে তথ্য অজ্ঞাত। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর কোনো বোঝাপড়া হয়েছিলো কিনা, তাও আমাদের অজানা।

অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের পুরো ধার এবং শ্রীশচন্দ্রের অন্তত আংশিক ধার শোধ হওযায় বিদ্যাসাগর নিঃসন্দেহে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। কিন্তু কবির প্রতি তাঁর আস্থা কতোটা ফিরে এসেছিলো, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বরং এ নিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সম্পর্ক যে খানিকটা তিক্ত হয়েছিলো, কবির চিঠি থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। অনেকের কথা থেকে বিদ্যাসাগরের ধারণা হয়েছিলো যে, মধু যতোটা আর্থিক অনটনে আছেন বলে দাবি করেন, আসলে তিনি অতোটা টানাটানির মধ্যে নেই। এবং তিনি যতো কম আয় করেন বলে দাবি করেন, তাঁর প্রকৃত আয়ও তার চেয়ে বেশি। এই ইঙ্গিতের কথা মনে রেখে কবি লেখেন:

অনেক লোক আছে ঈশ্বর যাদের পাওনা-আদায়কারী সরকারেব মনোবৃত্তি দিয়েছেন। [পারলে] টাকা বাঁচানোর জন্যে তারা নিজেদের স্ত্রী এবং কন্যাদের উলঙ্গ রাখতো। এ রকমের লোকেরা আপনার কাছে আমার সম্পর্কে যা খুশি তাই বলতে পারে। কিন্তু আপনাকে আমি বলছি, ‘জনরব’ থেকে যেমনটা মনে হয়, আমি তেমন সফল হতে পারিনি।২৯

তবে আগেই যেমনটা বার বার দেখা গেছে — সরল মানুষ হিশেবে তিনি কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ অথবা অভিমান দীর্ঘ দিন পুষে রাখতে পারতেন না। তাই এর পরেও অভিমান ভুলে গিয়ে চরম বিপদের মুখে তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্য চাইতে দ্বিধা বোধ করেননি। এবং তার জন্যে দীর্ঘদিন দেরিও করতে হয়নি। বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে দেখা যায়, পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করার মাত্র সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই কবি আর্থিক অনটনে পড়েন এবং তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন।

স্পেন্সেস হোটেল তাঁকে প্রথম দিকে খুব খাতির করেছিলো। কিন্তু ধার জমতে থাকায়, সেখানে ধীরে ধীরে তাঁর সম্মানে টান পড়ে। একটি চিঠিতে টাকা চেয়ে বিদ্যাসাগরকে তিনি যা লিখেছিলেন, তা থেকে বোঝা যায় আয়-ব্যয়ের হিশেব মেলাতে তিনি কি রকম ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং তাঁর অর্থ সংকট কেমন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছিলো। ‘এ মাসে আমি যা আয় করছি, তার সবটাই দিচ্ছি এই হোটেলে, কারণ এখানে ঋণী থাকার চিন্তাটা আমার ভালো লাগছে না।’৩০ কিন্তু সবচেয়ে টান পড়েছিলো য়োরোপে পাঠানোর টাকায়। এর প্রায় ন মাস আগে হেনরিয়েটা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন।৩১ তার অর্থ ফ্রান্সে তিনটি সন্তানের সংসার নিয়ে তাঁর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিলো। হেনরিয়েটা এ সময়ে কী অর্থকষ্টের মুখোমুখী হন, তা কবির একাধিক চিঠি থেকে প্রকাশ পায়।৩২ বিদেশে-বিভূঁইয়ে টাকাপয়সা না-থাকলে কি বিপদে পড়তে হয়, দুবছর আগে নিজেই তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে এসেছিলেন। এই বিপদের মুখে বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, তিনি যে সঙ্গতির চেয়ে বেশি বাবুগিরি করছেন, সে সম্পর্কে নিজেও জ্ঞানপাপীর মতো সচেতন ছিলেন: ‘আমি পূর্ব-পর বিবেচনা করিনি এবং ঠিকমতো সংসার চালাতে পারিনি।’ কাকুতি-মিনতি করে তিনি তাঁকে চিঠি অনেক বারই লিখেছেন, কিন্তু এ চিঠির তুলনা কমই মেলে:

আপনি যদি ইতর শ্রেণীর লোক হতেন অথবা হতেন আপনাকে যারা ঘিরে থাকে, সেই লোকদের মতো একজন সাধারণ মানুষ, তা হলে আমি আপনাকে আমার ব্যাপারে আবার জড়িয়ে পড়ার অনুরোধ জানাতে দ্বিধা করতাম, বিশেষ করে শ্রীশ লোকটা যখন যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়েছে। কিন্তু বাঙালি হলেও, আপনি একজন ‘মানুষ’,এবং আমি বিশ্বাস করি আমার মতো বিশ্বস্ত একজন লোককে বাঁচানোর জন্যে আপনি যেকোনো রকমের ঝুঁকি নিতে তৈরি থাকবেন। আমার বেচারী স্ত্রী খুবই আর্থিক অনটনের মধ্যে আছে-আপনাকে যখন আমি প্রথম লিখেছিলাম প্রায় তেমন খারাপ অবস্থায়, এবং আমি এ পরিস্থিতিতে একেবারে অসহায়। … আপনি স্বভাবতই একজন মহৎ লোক, এবং বাঙালি হলেও (আমি যদি খুব ভুল না-করে থাকি) আপনি আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন এবং আমার প্রতি সহানুভূতি বোধ করবেন। … আগামী ২৫ তারিখে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যে-ডাক যাবে, তার আগে আপনি এ টাকাটা আমাকে জোগাড় করে না-দিলে য়োরোপে বসে তারা প্রায় মরে যাবে।

এ যাবৎ আপনার মতো মহৎ কোনো বাঙালির জন্ম হয়নি। লোকেরা আপনার কথা বলে উচ্ছসিত হৃদয় নিযে আর সজল চোখে। এবং আমার সবচেয়ে বড় শত্রুও এ কথা বলতে সাহস পাবে না যে, আমি একটা খারাপ লোক। দয়া করে আমার দিকে নজর দিন এবং এমন একজন লোককে সাহায্য করুন যে আপনাকে ভালোবাসে এবং যার আপনি ছাড়া পরোয়া করার মতো কোনো বন্ধু নেই। নিজে গিয়ে এ কথা আপনার কাছে বলার মতো সাহস আমার নেই। সে জন্যে, আমাকে ডেকে পাঠাবেন না। বরং সেই দুঃসাহস এবং শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করুন, যা আপনাকে হাজার হাজার লাখপতির চেয়েও বেশি প্রিয়, বেশি সম্মানিত, বেশি শ্রদ্ধাভাজন করেছে। আপনি নিশ্চয় জানেন আমি প্রত্যাখ্যাত হবো না। অনুকূল আপনাকে এবং আমাকে যে-টাকা দেবার জন্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার মধ্য থেকে এক হাজার টাকা পাঠানোর জন্যে তাঁকে দয়া করে লিখুন। এটা-ওটা বলে এবং সবিনয়ে আমার প্রার্থনা না-মঞ্জুর করে একজন জঘন্য বাঙালির মতো আমাকে একটা বাজে চিঠি লিখবেন না। পরিশেষে আমি আমার বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে আবেদন জানাচ্ছি এবং এ রকমের পরিস্থিতিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন কাজ করতেন, তিনি তেমন করুন।৩৩

ভৃত্য-পরিবৃত স্পেলেস হোটেলের নরম শয্যায় শুয়ে অনিদ্রায় ছটফট করতে থাকা কবিকে অভ্রান্তভাবে দেখার জন্যে দ্বিতীয় কোনো চিঠির দরকার নেই। চরম বিলাসিতার কোট-পাতলুনের তলায় নিদারুণ দারিদ্র্যের লজ্জা তিনি কি রকম লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা বোঝার জন্যেও আর কোনো দলিল নিষ্প্রযোজন। এ চিঠির মধ্যে তাঁর কাতর অনুনয় এবং আন্তরিক তিক্ততা এক যোগে প্রকাশ পেয়েছিলো এবং তিনি নিজে তা ভালো করে জানতেন। সে জন্য চিঠির ওপর তিনি লিখে দিয়েছিলেন: ‘ব্যক্তিগত — আশা করি আপনি পড়ে এ চিঠিটি ছিড়ে ফেলবেন।’ বিদ্যাসাগর অবশ্য দয়া করে চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলে বিপন্ন কবির লজ্জা নিবারণ করেননি। সেটা তাঁর দয়ার সাগর নামের সঙ্গে কতোটা সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে, বলা শক্ত। তবে মাইকেল-জীবনীর একটি দিক জানার জন্যে এ চিঠিটি অমূল্য বলে বিবেচিত হতে পারে। সে কারণে বিদ্যাসাগরকে ধন্যবাদ।

একদিকে ব্যারিস্টার হিশেবে প্র্যাক্টিস করার অনুমতি লাভের উদ্দেশ্যে তদবির, অন্যদিকে পাওনাদারদের চাপ — দুই মিলে এম এম ডাট ব্যারিস্টার অ্যাট ল-এর জীবন আলোচ্য কালে খুব যে উপভোগ্য হয়েছিলো, তা মনে করার আদৌ কোনো কারণ নেই। যিনি উজান স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন এবং দেশে ফিরে এসেছিলেন জীবনকে উপভোগ করার স্বপ্ন নিয়ে, তীর কাছে বাস্তবতার এই রূঢ় আঘাত কতোটা হতাশাজনক মনে হতে পারে, পুরোটা না হলেও, তার খানিকটা অনুমান করা সম্ভব। এই কল্পনাতীত হতাশায় অনেকে সংকল্প হারিয়ে ফেলতেন। কিন্তু তিনি হারালেন না। হিন্দু কলেজের পড়ুয়া ছাত্রদের সঙ্গে, বিশপস কলেজে বর্ণবিদ্বেষী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে, অরফ্যান অ্যাসাইলামে নামহীন-গোত্রহীনদের অদ্ভুত পাঠক্রম পড়াতে গিযে, মাদ্রাস হাই স্কুলে গুণের আদর করতে না-জানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে, কলকাতায় পুলিশ কোর্টে ‘ইতরজনদের’ মধ্যে, লন্ডনে বর্ণবাদী সমাজে, ভার্সাইতে দারিদ্র্যের সঙ্গে — সর্বত্র তিনি সগ্রাম করে টিকে থেকেছেন, অনেক সময়ে সংগ্রাম করে বিজয়ীর বরমাল্য আদায় করেছেন। এখন ব্যারিস্টার হয়ে নিজের মাটিতে ফিরে তিনি হতাশ হবার পাত্র নন। এ সময়ে তিনি ভেবে থাকবেন যে, ঝড়ের মুখে কিছুক্ষণ হাল ধরে রাখতে পারলেই পালে লাগবে অনুকূল হাওয়া। আর — যতোই অমান্য করুন তাঁর উপদেশ এবং ইচ্ছা — দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর নিশ্চয় দৃঢ়ভাবে তাঁকে রক্ষা করবেন সর্বনাশের খর স্রোত থেকে।

কিন্তু নিচের চিঠির বয়ান থেকে দেখা যায়, দুঃখ এবংসহানুভূতি প্রকাশ করলেও, বিদ্যাসাগর কবিকে সাহায্য দিতে সম্মত হননি।

আমি এখনো খুব অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। ফলে আমার কোনো রকমের মানসিক অথবা শারীরিক পরিশ্রম করার সামর্থ্য নেই। সে জন্যে আপনার উদ্দেশ্য সফল করার ব্যাপারে আমার অপারকতা দয়া করে ক্ষমা করবেন। আপনি আবার আর্থিক অনটলে পড়েছেন জেনে আমি সত্যি খুব দুঃখিত হয়েছি।৩৪

পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি থেকে কবি এক হাজার টাকা পেয়েছিলেন। ব্যারিস্টারিও করছিলেন। তা সত্ত্বেও অতো অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আর্থিক অনটনে পড়ে — সম্ভবত ধার করার জন্যে — বিদ্যাসাগরের সাহায্য চাওয়ায় বিদ্যাসাগর বিবক্ত হয়েছিলেন। সে কারণে চিঠির শেষ বাক্যটি কেটে দিয়েছিলেন। কিন্তু এমনভাবে কেটেছিলেন যাতে বাক্যটা পড়তে অসুবিধে না-হয়। বিদ্যাসাগরের এ চিঠি থেকে মনে হয়, পুরোনো ঋণ শোধ করার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পর, তিনি আর নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু কবির প্রতি আন্তরিক প্রতিবশত তিনি তাঁর বিপদের মুখে নিরাসক্ত হয়ে বসে থাকতে পারেননি। কারণ, এর পরও যুদ্ধংদেহি শ্ৰীশচন্দ্রের ধার শোধ দিতে বিদ্যাসাগর তাঁকে নিশ্চয় সাহায্য করেছিলেন। তবে কিভাবে এ ঋণ শোধ হয়েছিলো তা পরিষ্কার জানা যায় না। বিদ্যাসাগরের এবং কবির কোনো কোনো জীবনী-লেখক বলেছেন যে, এই ঋণ শোধ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরকে মাত্র আট হাজার টাকায় সংস্কৃত প্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ বিক্রি করতে হয়েছিলো।৩৫ এই উক্তি সত্য কিনা, প্রমাণের অভাবে বলা শক্ত। বিদ্যাসাগর নিজে যদি শ্রীশচন্দ্রের পাঁচ হাজার টাকা শোধ দিয়ে থাকেন, তা হলেও তিনি সে কথা কোথাও লেখেননি অথবা অন্যদের বলেননি। মাইকেলকে লেখা তাঁর পরবর্তী চিঠিপত্রে অথবা তাঁকে লেখা মাইকেলের চিঠিপত্রে এর কোনো ইঙ্গিতও নেই। এর কারণ বোঝা যায় না। ১৮৬৯ সালে বিদ্যাসাগর যখন কাশিমবাজারের মহারানী স্বর্ণময়ীর দেওয়ান রাজীবলোচন রায়কে অনুরোধ জানিয়ে টাকা ধার করেন, তখনো চিঠিতে বিধবাবিবাহের কারণে তাঁর ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন, মাইকেলের ধার শোধ দিতে গিয়ে ঋণী হবার কথা বলেননি। তদুপরি, আরও মনে রাখা যেতে পারে যে, তিনি যদি মাইকেলের ঋণ নিজেই সবটা শোধ দিয়ে থাকেন, তা হলেও তার জন্যে সংস্কৃত প্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ বিক্রি করার দরকার ছিলো না।৩৬ কেবল শ্রীশচন্দ্রের ধার শশাধে সাহায্য নয়, মাস ছয়েক পরে — ১৮৬৮ সালের শেষ দিকে — বিদ্যাসাগরকে লেখা কবির দুটি চিঠি থেকেও জানা যায় যে, তখনো বিদ্যাসাগর কবির বৈষয়িক ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত। এই চিঠিতে কবি একটি দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্যে রেজিষ্ট্রি অফিসে যাবার কথা জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, বিদ্যাসাগর তারিখটাকে ১৮৬৮-র অক্টোবর থেকে

পরিবর্তন করে ১৮৬৮ সালের নভেম্বর করলে তিনি যেতে পারবেন।৩৭ এই দলিল কিসের তা জানা যায়নি। কিন্তু মনে হয়, নতুন কোনো ধার জোটানো অথবা পুরোনো কোনো আর্থিক সমস্যা মোচনের সঙ্গে এর যোগ ছিলো। এই দলিলের বিস্তারিত দিকগুলো জানা গেলে তাঁর টাকাপয়সা আদান-প্রদানের নতুন কোনো দিক উদ্‌ঘাটিত হতে পারে।

যে-ব্যারিস্টার হবার লোভে কবি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য এবং নাটক বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিতে পাবেননি, সেই ব্যারিস্টারি থেকে তিনি কি ফল লাভ করেছিলেন, এখানে সংক্ষেপে তার আলোচনা করা যেতে পারে। এ আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার কারণ এ নয় যে, এটা কিছু কম কৌতূহলের বিষয়। আসল কারণ, এ সম্পর্কে তথ্য সামান্যই পাওয়া যায়। আগেই একটি চিঠি থেকে লক্ষ্য করেছি, ব্যারিস্টারি শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যে তিনি মক্কেল পেতে আরম্ভ করেন। ব্যারিস্টার হিশেবে তিনি কেমন, সেটা তখনো মক্কেলদের জানা ছিলো না। এই অপরিচিতি একই সঙ্গে মক্কেল পাওয়ার ব্যাপারে সুবিধে এবং অসুবিধের সৃষ্টি করেছিলো। এ সময়ে তাঁর যে-আয় হতো , তা দিয়ে হোটেলের বিরাট খরচ এবং য়োরোপে টাকা পাঠানোর ব্যয় তিনি নির্বাহ কবেছেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত ব্যারিস্টারি-জীবন আরম্ভ করার বছর খানেকের মধ্যে — ১৮৬৮ সালের মাঝামাঝি নাগাদ — তিনি সবচেয়ে বেশি নাম করেছিলেন। ব্যারিস্টারি যে তাঁর কাজ নয়, এ দুর্নাম তখনো ছড়িয়ে পড়েনি। ১৮৬৮ সালে তিনি শ্রীরামপুরের জমিদার গোপীকৃষ্ণ গোসাঁই-এর মামলাসহ একাধিক মামলায় জয়ী হয়েছিলেন।৩৮ এ সময়ে আর-একটি উল্লেখযোগ্য মামলা — ঠাকুর বনাম ঠাকুর – এর সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন, যদিও এর প্রধান কৌঁসলি হিশেবে নয়।

হিন্দু কলেজে তাঁর সহপাঠী জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরকে তিনি কলেজ-জীবনে পছন্দ করেননি। পরেও না। এর পেছনে ঈর্ষা থাকা সম্ভব। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের পিতা প্রসন্নকুমার ঠাকুর রাজনারায়ণ দত্তের তুলনায় অনেক নাম-করা উকিল এবং বহু গুণে ধনী ছিলেন। আর আভিজাত্যের মাপে তাঁদের তুলনাই চলতো না। পড়ুয়া ছাত্র হিশেবেও জ্ঞানেন্দ্রমোহন মধুর চেয়ে বেশি সফল ছিলেন। (প্রসঙ্গত, ১৮৪২ সালে তাঁরা উভয়ে যে-পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তার ফলাফলের দিকে নজর দেওয়া যায়। মাইকেল ভালো ইংরেজি জানতেন — এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই পরীক্ষায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন মাইকেলের তুলনায় ইংরেজিতে অনেক ভালো ফলাফল করেছিলেন।৩৯) তবে খৃস্টান হওয়ায় দুজনই পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে মামলায় জড়িয়ে পড়েন। ১৮৬৮ সালের ৩০ অগস্ট প্রসন্নকুমার ঠাকুর মারা যান। তাঁর উইলে তিনি লেখেন যে, তাঁর তখনকার আয় ছিলো বছরে আড়াই লাখ টাকারও বেশি এবং এই আয় আরও বাড়ছিলো। এই বিশাল সম্পত্তি তিনি দিয়ে যান তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রদের, ভ্রাতুষ্পুত্রদের জীবিত এবং ভাবী সন্তানদের, পিতৃব্য পুত্র, নিজের দু কন্যা, দু কন্যার সন্তানদের এবং নিজের কর্মচারীদের। তা ছাড়া, প্রচুর অর্থ রেখে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাধিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্যে। এই উইল থেকে বিশেষভাবে লাভবান হন উপেন্দ্রমোহন ঠাকুর, রমানাথ ঠাকুর, দুর্গাপ্রসাদ মুখার্জি, ললিতমোহন ঠাকুর, সুরেন্দ্রমোহন ঠাকুর, প্রমথনাথ ঠাকুর প্রমুখ। কিন্তু সবচেয়ে লাভবান হন কবির এক সময়ের পৃষ্ঠপোেষক যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর।৪০ একমাত্র যাঁকে তিনি সম্পত্তির কানাকড়িও দেননি, তিনি তাঁর ধর্মচ্যুত পুত্র, জ্ঞানেন্দ্রমোহন। সম্পত্তির বর্ণনা দেবার পরই প্রসন্নকুমার তাঁর উইলে বলেন যে, একমাত্র পুত্রের জন্যে — তাঁর বিবেচনায় — যথেষ্ট ব্যবস্থা করার পর, তাঁর যে-সম্পত্তি আছে তা তিনি উপরে বর্ণিত ব্যক্তিদের এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে দান করছেন।৪১

তিনি এই উইল করেন ১৮৬২ সালের ১০ অক্টোবর তারিখে। তার কয়েক মাস আগে পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ব্যারিস্টার হয়েছেন। এরপর তিনি দুবার এই উইলের খানিকটা সংশোধন এবং সংযোজন করেন মারা যাবার অল্পদিন আগে — ২৩ মার্চ এবং ২৫ জুলাই (১৮৬৮) তারিখে। তিনি নিজে নাম-করা উকিল ছিলেন। তদুপরি তিনি এই উইল করিয়েছিলেন কলকাতার নাম-করা একাধিক ইংরেজ আইনজীবীকে দিয়ে।৪২ তা সত্ত্বেও, তিনি মারা যাবার ঠিক পরে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে মামলা শুরু হয়। মামলার বাদী ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন। মধুসূদন খৃস্টান হওয়ায়, রাজনারায়ণ দত্ত যতোটা আঘাত পেয়েছিলেন, জ্ঞানেন্দ্রমোহন খৃস্টান হওয়ায় প্রসন্নকুমার তার চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই। কিন্তু প্রসন্নকুমারের আরও সন্তান ছিলো। রাজনারায়ণের ছিলো না। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে রাজনারায়ণেরই আপাতদৃষ্টিতে বেশি কষ্ট পাওয়ার কথা। প্রসন্নকুমার যখন মারা যান, তখন জ্ঞানেন্দ্রমোহন যে (মাইকেলের মতো কলকাতা থেকে দূরে ছিলেন, তা-ও নয়। তখন তিনি কলকাতাতেই বাস করছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন তাঁর অভিযোগে বলেন যে, হিন্দু আইন অনুযায়ী তাঁর পিতা তাঁকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না। তিনি আরও যুক্তি দেখান যে, তাঁর পিতা যেহেতু তাঁর সম্পত্তির একটা অংশ পেযেছেন উত্তরাধিকার হিশেবে — সে কারণেও তিনি তাঁকে সম্পত্তি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করতে পারেন না। উইলে সম্পত্তির বর্ণনায় প্রসন্নকুমার স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি তাঁর পিতা গোপীমোহনের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে বেশ খানিকটা সম্পত্তি লাভ করেছিলেন।৪৩

জ্ঞানেন্দ্রমোহনের প্রধান আইনজীবী ছিলেন সেকালের খুব সফল উকিল আশুতোষ ধর। কিন্তু মাইকেলকেও তিনি কৌঁসুলি রেখেছিলেন। নিজের সম্পত্তি আদায় করতে গিয়ে ১৮৪৯ সালের চার আইনের বিষয়ে মাইকেলকে ভালো করে জানতে হয়েছিলো। সন্তান ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তিতে অধিকার থাকবে কিনা, এ আইন ছিলো সে বিষয়ে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন সম্ভবত সে কারণে তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন। মামলার শেষ আর্জির আগে তিনি জে. পিট কেনেডি, টমাস ইংগ্র্যাম এবং গ্রিফিথ এভান্সকেও নিয়োগ করেন।৪৪ এই মামলা ছিলো সেকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মামলাগুলোর একটি। ১৮৬৯ সালের ২২ মার্চ এই মামলা শেষ হয়। আর ২৬ মে তারিখে রায় প্রকাশিত হয়। মামলায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ঠিক জয়ী হতে পারেননি — যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বেঁচে থাকা পর্যন্ত তিনি সম্পত্তির কোনো অধিকার পাবেন না — এই রায় দেওয়া হয়।৪৫ মাইকেল এই মামলায় কৌঁসুলি থাকলেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। তাই পত্রপত্রিকায় এ মামলার যে-খবর প্রকাশিত হয়, তাতে তাঁর নাম উল্লিখিত হয়নি। দুঃখ করে সে কথা তিনি গৌরদাস বসাকের কাছে লিখেছিলেন।৪৬ (ইংলিশম্যান পত্রিকায় সংক্ষেপে তাঁর নাম উল্লিখত হয়েছিলো — মি দত্ত।৪৭) এই মামলার রায় লিখতে গিয়ে জাস্টিস ফিয়ার বহু জায়গায় কেনেডির উল্লেখ করেন। মাইকেলের নাম কোথাও লক্ষ্য করিনি। এ মামলার রায় বের হবার পর যখন আপীল করা হয়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন তখন আর মাইকেলকে আর রাখেননি। এ মামলা থেকে কবি নিঃসন্দেহে কিছু টাকা আয় করেছিলেন। কিন্তু পরিণামে তিনি তাঁর বন্ধু যতীন্দ্রমোহন এবং তাঁর সমর্থক রমানাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষণা হারিয়েছিলেন।

ব্যারিস্টার হিশেবে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করতে না-পারলেও, ১৮৬৮-৬৯ সালে মক্কেল তিনি মোটামুটি পেতেন। বিভিন্ন জনের সমসাময়িক রচনা থেকে মনে হয়, তিনি এ সময়ে মাসে দেড়-দুহাজার টাকা আয় করতেন।৪৮ মামলা তিনি কেবল হাই কোর্টে করতেন না, অনেক সময়ে যেতেন মফস্বলে। কখনো নকৃষ্ণনগর, কখনো বর্ধমান, কখনো যশোরে। একবার গিয়েছিলেন বারুইপুরে। তখন সেখানে হাকিম ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টাপাধ্যায়।৪৯ সুদূর ঢাকা এবং পুরুলিয়ায়ও তিনি গিয়েছিলেন। মফস্বলে তাঁকে যাঁরা নিয়ে যেতেন, তাঁরা ‘ব্যারিস্টার’ নিতেন বিচারককে প্রভাবিত করে মামলায় জয়ী হবার প্রলোভনে, অনেক ক্ষেত্রে একবারই। যতোদিন স্পেন্সেস হোটেলে ছিলেন, তখন কো মক্কেল পেতেন, সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু ভার্সাই থেকে পরিবার ফিরে আসার পর, তিনি যখন তাঁর চেম্বার সরিয়ে নেন ৭ নম্বর ও পোস্ট অফিস স্ত্রীটে, তখনকার একদিনের খবর থেকে জানা যায়, তাঁর কাছে মাঝেমধ্যে কতো মক্কেল আসতেন। ১৮৬৯ সালের ৩০ জুলাই এই চেম্বারে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন গৌরদাস বসাক। কিন্তু সেদিন মক্কেলদের নিয়ে তিনি এতো ব্যস্ত ছিলেন যে, তাঁর প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ পাননি।৫০ হতাশ হলেও, গৌরদাস তাতে ক্ষুণ্ণ হননি। তিনি আন্তরিকভাবে চাইতেন, তাঁর বন্ধু যাতে ব্যারিস্টার হিশেবে বিখ্যাত হতে পারেন এবং চুটিয়ে ব্যবসা করতে পারেন — যেমনটা এক সময়ে রমাপ্রসাদ রায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ মিত্র এবং অন্যান্য সফল আইনজীবী করেছেন। এমন কি, কবি যে আইনজীবী হবার জন্যে তাঁর সাহিত্য-জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তাতেও গৌরদাসের দুঃখ ছিলো না।৫১ কারণ পদ্য-লিখিয়ের চেয়ে একজন অর্থবান এবং নামকরা ব্যারিস্টার তখনকার সমাজের তুলাদণ্ডে অনেক বেশি সফল বলে গণ্য হতেন।

তবে কবির চেম্বারে ভিড়ের দরুন দেখা করতে না-পারার ঘটনা মোটেই প্রতিদিনের ঘটনা নয়। বরং কাজ কমে যাচ্ছে, সে কথাও কবিব চিঠিপত্র থেকে জানা যায়। এ বছরের (১৮৬৯) মার্চ মাসে লেখা একটি চিঠিতে তিনি যেমন গৌরদাসের কাছে দুঃখ করে লিখেছিলেন যে, হাই কোর্টের আপীল বিভাগে তেমন কাজ নেই। বিশেষ করে নতুন স্ট্যাম্প আইনের দরুন লোকে মামলা করতে পারছে না। এই কারণে আপীল বিভাগ ছেড়ে তিনি হাই কোর্টের অরিজিন্যাল সাইডে কাজ শুরু করেছেন। এ সময়ে মামলা-মকদ্দমা এতো কম পাচ্ছিলেন যে, লাখনৌ গিয়ে প্র্যাক্টিস করার কথাও ভেবেছিলেন।৫২ এর তিন বছর আগে এলাহাবাদ হাই কোর্ট স্থাপিত হয়েছিলো। সেখানে তখনো ব্যারিস্টারদের ভিড় জমেনি। আশা করেছিলেন, সেখানে গেলে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারবেন। বস্তুত, তিনি যেমনটা আয় করবেন বলে কল্পনা করেছিলেন, তা যে তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়, এটা তিনি প্র্যাক্টিস শুরু করার বছর দেড়েকের মধ্যে টের পেয়েছিলেন। সে কারণে, অন্য কিছু করা যায় কিনা, তিনিও তা-ও ভাবছিলেন। ১৮৬৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শুনতে পান যে, কোর্ট অব স্মল কজেজ-এর বিচারক জর্জ মৌন্ট ফ্যাগান অবসর নিয়ে বিলেতে চলে যাচ্ছেন এবং তাঁর জায়গাতে বিচারক নিযুক্ত হবার কথা হচ্ছে এন টমসনকে। এ খবর তিনি ফ্যাগানের কাছ থেকেই শুনে থাকবেন। এক সময়ে পুলিশ কোর্টে তিনি ফ্যাগনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং তাঁকে পছন্দ করতেন বলে উল্লেখ করেছেন। ফ্যাগান থাকতেনও মাইকেলের খিদিরপুরের বাড়ির একেবারে কাছে। এ খবর শুনেই কবি বিদ্যাসাগরের কাছে একটি চিঠি লেখেন। তাতে তাঁকে অনুরোধ জানান, এই চাকরিটা তাঁকে দেবার জন্যে লেফটেন্যান্ট গভর্নর উইলিয়াম গ্রের কাছে তদবির করতে। সেই সঙ্গে তিনি আরও জানান যে, সরকার এই পদের জন্যে চাইছে একজন ব্যারিস্টার। (ফ্যাগানও ব্যারিস্টার ছিলেন।) এর মাত্র কয়েক মাস আগে ধার শোধ এবং জমি বিক্রি নিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশ টক হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও, এখন এই পদের জন্যে তাঁকে অনুরোধ করা থেকে বোঝা যায়, এটা পাওয়ার জন্যে তিনি কতো আগ্রহী হয়েছিলেন। অতীতের তিক্ততার কথা মনে করে তিনি আরও লেখেন

ব্রাহ্মণ হলেও, আমি নিশ্চিত যে, আপনি সেই পুরা কালের ক্রুদ্ধ দুর্বাসার বংশধর নন। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনে যে, আমার কোনো আহাম্মুকির দরুণ আপনার মহৎ হৃদয় আপনার খুব ভক্ত কিন্তু হতভাগ্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাছ থেকে অন্য দিকে ফিরে যেতে পারে।৫৩

তখন প্রথম বিচারক ফ্যাগানের বেতন ছিলো আড়াই হাজার টাকা। দ্বিতীয় বিচারক এন এইচ টমসনের দেড় হাজার আর তৃতীয় বিচারক হরচন্দ্র ঘোষের বারো শো।৫৪ ব্যারিস্টার হয়ে আসার পর মাইকেল এক সময়ে মাসে ছ হাজার টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন আড়াই হাজার টাকার চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে রীতিমতো তদবির করতে আরম্ভ করলেন। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যারিস্টার হিশেবে তাঁর আপেক্ষিক ব্যর্থতার কথা তিনি নিজেও অনুভব করতে পারছিলেন। স্বাস্থ্যও এ সময়ে তাঁর উদ্বেগের কারণ হয়েছিলো। ভাঙ্গা গলা নিয়ে মামলায় আর্জি অথবা সওয়াল-জওয়াব করা অথবা বিচারকের মনোেযোগ আকর্ষণ করা যে শক্ত ব্যাপার, তাও তিনি অনুধাবন করে থাকবেন। তিনি আরও লক্ষ্য করেছিলেন যে, তিনি তাঁর কথা দিয়ে বিচারকদের মনে তেমন আস্থা স্থাপন করাতে পারেন না। আসলে, তিনি যে কেবল হাই কোর্টে প্রবেশ করার সময়ে বিচারকদের বিবোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাই নয়, পরবর্তী কালেও বিচারকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হয়নি। এ ব্যাপারে বিচারপতিদের তুলনায় তাঁদের প্রতি তাঁর মনোভাব বেশি দায়ী ছিলো বলে মনে হয়। জ্যাকসন, কেম্প, ম্যাকফারসন প্রমুখ বিচারপতিকে তিনি মোটেই প্রসন্ন মনে গ্রহণ করতে পারেননি। বিচারপতিদের প্রতি তাঁর এই মনোভাবের সূচনা একেবারে গোড়া থেকে, কারণ বিচারপতিরা তাঁকে যে একদিন ব্যারিস্টার হিশেবে গ্রহণ করতেও আপত্তি করেছিলেন, এটা তাঁর পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। তদুপরি, নিজের সম্পর্কে তাঁর যে-পর্বতপ্রমাণ উচ্চ ধারণা ছিলো, তার ফলে তিনি এই বিচারপতিদের বোধহয় শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেও পারেননি। মাঝেমধ্যে মামলা পরিচালনার সময়ে তিনি বিচারকদের ধারালো কথা শোনাতেন, এমন কি, ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতেন। একটি দৃষ্টান্ত থেকে এর স্বরূপ বোঝা যাবে। একবার বিচারপতি জ্যাকসন তাঁর আর্জি শুনে বিরক্ত হয়ে বলেন: ‘The Court orders you to plead slowly, the Court has ears.’ রসিক এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির লোক মাইকেল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন: ‘But pretty too long, my Lord.’৫৫ এরকমের উত্তর শুনে অনেকে নিশ্চয় তাঁর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করেছেন। কিন্তু জন্তুবিশেষের সঙ্গে তুলনা করায় বিচারপতি তাঁর প্রতি প্রসন্ন হতে পারেননি — এটা বলাই বাহুল্য।

অথচ একজন সফল ব্যারিস্টারের সঙ্গে বিচারকদের সম্পর্ক থাকা দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বন্ধুত্বের। হাই কোর্টে প্রবেশের ব্যাপারে যিনি তাঁকে সবচেয়ে সহায়তা করেছিলেন, সেই বিচারক শম্ভুনাথ পণ্ডিত মারা যান মাইকেল প্র্যাক্টিস করার (৭ মে ১৮৬৭) ঠিক তিরিশ দিন পরে — ৬ জুন তারিখে। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর মাধ্যমে অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং সম্পর্ক ভালো হতে পারতো। শম্ভুনাথের পর বিচারপতি হন অনুকূল মুখোপাধ্যায়। তিনি বিদ্যাসাগরের কথায় ধার দিলেও কবির প্রতি তাঁর বিশেষ কোনো সহানুভূতি ছিলো বলে মনে হয় না। মোট কথা, আইনজীবী হবার ব্যাপারে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী আদৌ আনুকূল্য করেনি। ব্যারিস্টার হিশেবে তাঁর আর-একটা দোষের কথাও আমরা জানতে পাই। তিনি অনেক সময়ে আইনের উল্লেখ না-করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে আওড়াতেন কবিতার পঙ্‌ক্তি।৫৬ মোট কথা, ব্যারিস্টার হিশেবে তিনি না বিচারকদের মধ্যে, না মক্কেলদের মধ্যে সুনাম অর্জন করতে পেরেছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন সেকালের বঙ্গদেশের সবচেয়ে লেখাপড়া-জানা লোকদের অন্যতম।

প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, তিনি যাঁদের সঙ্গে মিশতেন, তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন। কিন্তু সবার সঙ্গে মিশতেন না। তিনি যে ধনী এবং সুপরিচিত উকিলের পুত্র, লেখাপড়ায় ভালো, কবিতা লেখেন, প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পান, কলেজের ইংরেজ প্রিন্সিপাল তাঁকে বিশেষ স্নেহ করেন — ইত্যাদি তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড আত্মম্ভরিতার জন্ম দিয়েছিলো। তাঁর বিশপস কলেজের অধ্যাপক তাঁর এই আত্মম্ভরিতার কথা সেকালেই লিখেছিলেন।৫৭ তিনি জনতার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারতেন না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি এমন একটি পেশা বেছে নিলেন, যাতে জনতার সঙ্গেই তাঁর কাজ করতে হয়। ব্যারিস্টারি ছিলো তাঁর স্বভাবের একেবারে বিরোধী। সে জন্যে, ব্যারিস্টার হবেন বলে তিনি যখন সংকল্প করেছিলেন, তখনই নিজের সর্বনাশের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিলেন। বস্তুত, জীবন নিয়ে তিনি বারবার জুয়া খেলেছেন। এখন ব্যারিস্টারিতে সীমিত সাফল্য লক্ষ্য করে তিনি ভাবলেন যে, বাঁধা আয়ের জজিয়তি পেলে কল্পনায় বিলাসিতার যে-ছবি এঁকে-ছিলেন, তেমন জীবন যাপন করতে না-পারলেও, অন্তত সপরিবারে সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্য এবারেও তাঁর প্রতি স্মিতহাস্য করেনি। বিদ্যাসাগর ছোটো লাটের কাছে সুপারিশ করেছিলেন কিনা, জানা নেই। করে থাকলেও, সে চাকরি কবি পেলেন না। কারণ ফ্যাগান তখন অবসর না-নিয়ে তার বদলে য়োরোপে গেলেন কেবল ছুটি কাটাতে।

ব্যারিস্টারি থেকে তাঁর আর্থিক অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হতে পারেনি — এ কেবল মক্কেলের অভাবে নয়। মক্কেলদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার মতো কৌশল অথবা মনোবৃত্তিও তাঁর ছিলো না। তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকে বলেছেন যে, দুঃসহ অনটনের মধ্যেও তিনি পরিচিতদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারতেন না। যখন তাঁর আর্থিক অবস্থা খুব করুণ, তখনকার একটি গল্প থেকে তাঁর এই মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক পরিচিত ব্যক্তি এ সময়ে তাঁর এক আত্মীয়কে নিয়ে তাঁর কাছে যান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মামলা নিতে রাজি হন। কিন্তু, অনুরোধ করা সত্ত্বেও, তার কাছ থেকে টাকা নিতে রাজি হননি। তবে ভাঁড়ারের অবস্থা বিবেচনা কবে শেষে বাজার করার জন্যে পাঁচটি টাকা হেনরিয়েটাকে দিতে অনুরোধ করেন।৫৮ এ জাতীয় আরও একটি গল্প তাঁর জীবনীকারে উল্লেখ করেছেন। গান শুনে তিনি এক মক্কেলের মামলাবিনে পয়সায় করে দিয়েছিলেন।৫৯ এগল্প দুটি কতোটা সত্য বলা যাচ্ছে না। অতিরঞ্জন থাকা সম্ভব। কিন্তু এ থেকে কবির বিষয়বুদ্ধির অভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। বস্তুত, আর্থিক অবস্থা খারাপ হবার সবচেয়ে বড়ো কারণ তাঁর নিজের স্বভাবের মধ্যেই লুকানো ছিলো।

*

ব্যারিস্টার হিশেবে যকঞ্চিৎ সাফল্য আসা সত্ত্বেও, তাঁর অর্থকষ্টের আর-একটি কারণ পরিবার য়োরোপে রেখে আসার হঠকারী সিদ্ধান্ত। তীব্র অভাবের মধ্যে তিনি নিজে যখন ভার্সাইতে ছিলেন, পরিবারের জন্যে মোটামুটি সে রকমের ব্যয় হবে বলে তিনি গোড়াতে মনে করে থাকবেন। কিন্তু কার্যকালে ব্যয় হয়েছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি। একজন ব্যারিস্টারের স্ত্রী হিশেবে এই প্রথম বার হেনরিয়েটা ছুটি কাটানোর জন্যে দূরে কোথাও যাওয়া শুরু করেন। কনিষ্ঠ পুত্র অ্যালবার্ট নেপোলিয়নের জন্মের সাড়ে তিন মাস পরে যেমন তিনি এক মাসের জন্যে অবকাশ কাটাতে যান প্যারিসের উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্রবন্দর ডীয়েপে।৬০ তদুপরি, মোরপা সড়কের অভিজাত পাড়ায় ভদ্রলোকদের মধ্যে জীবন যাপন করতে গিয়েও তাঁর ব্যয় হচ্ছিলো যেমনটা ধারণা করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি। তিন বছর আগে রু দ্য শাঁতিয়ের গরিব পাড়ায় থাকার সময়ে যে-ধরনের জীবন যাপন করেছিলেন, এবারে তিনি তেমনজীবন যাপন করতে পারেন না! পাণ্ডিত্য এবং ধারালো বুদ্ধি সত্ত্বেও স্বামী যে ব্যারিস্টারিতে তেমন সফলতা অর্জন করতে পারছেন না — এ খবরও বোধ হয় তিনি দূর থেকে জানতেন না। সুতরাং তাঁর প্রত্যাশা এবং স্বামীর কাছ থেকে যে-টাকাপয়সা পাচ্ছিলেন, তার মধ্যে কোনো সঙ্গতি ছিলো না। অভিজাত পরিবেশেতাঁর পরিবার বাস করবে — এ ছিলো কবির চিরদিনের প্রত্যাশা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পরিবার যাতে সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে, তিনি তেমন টাকাপয়সা পাঠাতে পারেননি। সে জন্যে, তিনি নিজে যেমন বিলাসবহুল স্পেন্সেস হোটেলে বসেই আর্থিক অনটনে ছটফট করছিলেন, হেনরিয়েটাও তেমনি রাজপ্রাসাদের পাশে থেকেও এক দিকে নিঃসঙ্গতা, অন্য দিকে অব্যাহত আর্থিক অনটনের মধ্যে অত্যন্ত অসুখী সময় কাটাচ্ছিলেন।

এই পরিস্থিতিতে হেনরিয়েটা মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কবিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে মদ্যপান তিনি শুরু করেছিলেন কলকাতায় থাকতেই। কিন্তু ভার্সাই-বাসের সময়ে রীতিমতো আসক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর এ সময়কার একটি হোটেলের বিল রক্ষা পেয়েছে। তা থেকে দেখা যায়, হোটেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে রোজ দু বোতল ওয়াইন সরবরাহ করতো।৬১ এই সুরা তিনি একাই পান করতেন, না কি তাঁর কোনো বন্ধু তাঁকে সঙ্গ দিতেন, তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা অনায়াসে বলা যেতে পারে, তা হলো: দু বোতল ওয়াইন কোনো সুস্থ লোক রোজ পান করতে পারে না, অথবা পান করলে সুস্থ থাকতে পারে না। এ সময়ে হেনরিয়েটা শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এ সময়কার জীবনযাত্রা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু তিনি যে তিনটি ছোটো ছোটো সন্তান নিয়ে চরম সংকটের মধ্যে সময় কাটাচ্ছিলেন, তা বোঝার জন্যে গবেষণা নিষ্প্রয়োজন।৬২

সংকটে পড়ে মাতাল হলেও, হেনরিযেটা কাণ্ডজ্ঞান হারাননি। তিনি হঠাৎ এ সময়ে একটা সিদ্ধান্ত নেন — কলকাতায় ফিরে যাবার। ঠিক ছ বছর আগে তিনি এমনি আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কলকাতা ছেড়ে বিলেত যাবার। সেদিন যেমন চরম প্রতিকূল পরিবেশে মরিয়া হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এবারেও পরিস্থিতি ছিলো তেমনি চরম। বিলেত যাবার সময়ে অবশ্য একটা সুবিধে ছিলো — মহাদেবের কাছ থেকে টাকা আদায় করে জাহাজের ভাড়া জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু এবারে? এবারে সে সুযোগও ছিলো না। সে কারণে ১৩ মার্চ (১৮৬৯) তিনি এক পরিচিত ফরাসি ভদ্রলোকের কাছে ব্যাকুল একটি চিঠি লিখলেন, প্যারিসের স্টীম নেভিগেশন কম্পেনিকে প্রভাবিত করে তাঁকে কলকাতায় যাবার ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি লিখেছিলেন যে, তাঁর কাছে এমন টাকাপয়সা নেই যাতে তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে ফ্রান্সে বসবাস করতে পারেন। তিনি আরও লেখেন যে, তাঁর যেসব জিনিশপত্র আছে, তা বিক্রি করে তিনি ন শো কি এক হাজার ফ্রঁ জোগাড় করতে সক্ষম হবেন। এই টাকার বিনিময়ে জাহাজ কম্পেনি তাঁর দুটি ছোটো সন্তান এবং তাঁকে ভারতবর্ষে যেতে না-দিলে তিনি সন্তানদের নিয়ে খুব দুরবস্থায় পড়বেন।৬৩ এখানে লক্ষ্য করার একটি বিষয় হলো: তিনি জাহাজ কম্পেনির অনুকম্পা লাভের আশায় অনৃত ভাষণের আশ্রয় নিতেও দ্বিধা বোধ করেননি। তিনি লিখেছিলেন, তাঁর এবং তাঁর দুটি ছোটো সন্তানের যাবার ব্যবস্থা করার জন্যে। কিন্তু এ সময়ে তাঁর আসলে তিনটি সন্তান ছিলো। ছোটোটির বয়স এক বছর দশ মাস। অবশ্য হতে পারে, অতো কম বয়সী সন্তানের ভাড়া লাগবে না — এ কথা মনে করে তিনি তার কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তখন মার্সেই থেকে কলকাতা পর্যন্ত ভাড়া ছিলো প্রায় আড়াই হাজার ফ্রঁ। সুতরাং জাহাজ কম্পেনি মাত্র এক হাজার ফ্রর বিনিময়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং নয় ও সাত বছরের দুটি সন্তানকে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। তবে তারা ভাড়া খানিকটা কমাতে রাজি হয়েছিলো। পূর্বোক্ত চিঠিটি লেখার কদিন পরে সৌভাগ্যক্রমে তিনি টাকা পান (মাইকেলের কাছ থেকে)।৬৪ সঙ্গে সঙ্গে কম ভাড়ার টিকিট কিনে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ভারতবর্ষগামী প্রথম জাহাজে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

তিনি ঠিক কবে কলকাতা পৌছেছিলেন, জাহাজের যাত্রীদের তালিকা থেকে তার খবর জোগাড় করতে পারিনি। তবে মে মাসের প্রথমার্ধের মধ্যে এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কলকাতায় পৌছে তিনি দু বছর চার মাস পরে মাইকেলকে দেখতে পান। দেখতে পান শারীরিকভাবে তিনি কেমন আছেন; ব্যারিস্টার হিশেবে তাঁর কতোটা পার হয়েছে এবং তাঁর আয়ব্যয় কেমন। আগের বার কলকাতায় যখন ছিলেন, তখন স্বামীর আয় ছিলো সামান্য — বেতন এক শশা পঁচিশ টাকা। ৬ নম্বর লোয়ার চিৎপুর রোড অথবা ৬ নম্বর জেমস লেইনে সেই অল্প আয় দিয়ে সংসার চালানো তাঁর পক্ষে সহজ ছিলো না। তারপর ভার্সাইতেও সময় কেটেছে দুঃস্বপ্নের মধ্যে। কিন্তু তখন কষ্ট স্বীকার করেছেন স্বামী ব্যারিস্টার হয়ে একদিন সংসারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসবেন — এই আশায়। তা সত্ত্বেও, কলকাতায় ফেরার আগেকার দু বছরে সেই স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো নমুনা তিনি দেখতে পাননি। দু বছর আইন-ব্যবসা করেও স্বামী যে ঋণ ছাড়া অন্য কিছু সঞ্চয় করতে পারেননি, তা দেখে তিনি বিচলিত বোধ করে থাকবেন। তদুপরি, স্পেন্সেস হোটেলে পাশের কামরায় বসে স্বামী নানা লোকের ভিড়ে সময় কাটান আর কখনো কখনো মামলার সূত্র ধরে তাঁকে যেতে হয় মফস্বলে — এটা দেখে তিনি প্রসন্ন মনে তাকে মেনে নিতে পেরেছিলেন কিনা, বলা মুশকিল। তাঁর পক্ষে ভাবা অসম্ভব নয় যে, তাঁর এবং সন্তানদের কাছ থেকে স্বামী সরে গেছেন অনেক দূরে। তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখেও তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করে থাকবেন। কারণ ততোদিন কবি অসম্ভব মোটা হয়েছেন। ৪৫ বছর বয়সেই প্রৌঢ়ত্ব তাঁকে আপাদমস্তক অধিকার করেছে। ভাঙ্গা গলাও তাঁর এক কালের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একদম বেমানান। সাড়ে দশ বছর আগে এরই গলায় বরমাল্য পরাতে তিনি এসেছিলেন সুদূর মাদ্রাস থেকে!

বিদেশে থাকার সমযে মাইকেল একাধিক বার বিদ্যাসাগরেব কাছে হেনরিয়েটার সাংসারিক বুদ্ধির প্রশংসা কবেছিলেন।৬৫ সেই সাংসারিক বুদ্ধিব পরিচয় দিয়ে হেনরিয়েটা কবিকে হোটেল ছাড়তে রাজি করান। তবে তিনি যথেষ্ট সাংসারিক বুদ্ধির পরিচয় দিতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। হোটেলের বিলাসিতা ছেড়ে তিনি চেয়েছিলেন একটি ভদ্র বাড়িতে গুছিয়ে বসতে। সঞ্চয়ের মাধ্যমে নিজের এবং

সন্তানদের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করার স্বপ্নও দেখাও তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। এই আশা নিয়ে জুন মাসে (১৮৬৯) তাঁরা ৬ নম্বর লাউডন স্ট্রীটে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু তাঁরা এমন একটা বাড়ি নির্বাচন করলেন, যার ভাড়া ছিলো মাসে চার শো টাকা। সেকালের বিবেচনায় যা ছিলো খুবই ব্যয়বহুল। বাড়ি পছন্দ করার ব্যাপারে হেনরিয়েটা কবির বিলাসিতার লাগাম টেনে ধরতে পারেননি। অথবা তাঁদের যা আয়, তাতে তাঁরা এ বাড়ির ভাড়া জোগাতে পারবেন কিনা, সে ব্যাপারে তিনি যথোচিত উপদেশ দিতে পারেননি।

কবি এ বাড়ি সাজিয়েছিলেন অত্যাধুনিক আসবাবপত্র, চিত্র এবং বিলাসিতার নানা উপকরণ দিয়ে। বিদেশ থেকে তিনি কিনে এনেছিলেন তাঁর প্রিয় কবি এবং নাট্যকারদের আবক্ষ মূর্তি। সেসব তাঁর বসার ঘর অলঙ্কৃত করেছিলো। তাঁর বাড়ির বাগান ছিলো একেবারে বিদেশী স্টাইলের — এমন কথাও তাঁর জীবনীকারেরা বলেছেন।৬৬ তাঁর জুড়িগাড়িও ছিলো তাঁর ‘মর্যাদার সঙ্গে মাননসই’। যে-লাউডন স্ট্রীটে তিনি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, সে জায়গাটা ছিলো কলকাতার সবচেয়ে বিলাসবহুল পাড়াগুলোর পড়েছে এই বাস্তা। এ রাস্তায় তখন একজনও দেশীয় লোক থাকতেননা। ১নম্বরে থাকতেন বি ক্লার্ক, প্রকৌশলী। ২ এবং ৩ নম্বরে থাকতেন দুটি বিদেশী ব্যবসাযিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। ৪ নম্বরে থাকতেন ই ক্যামেবন, হংকং অ্যান্ড শাংহাই ব্যাংকের প্রতিনিধি। এ বাস্তার ৯ নম্বর বাড়িতে থাকতেন ক্যাপ্টেন হোয়াইট, নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা। আর ১২ নম্বরে কর্নেল বার্ন, ভারত সরকারের সামরিক সচিব। ৬ নম্বর বাড়িতে মাইকেল ওঠার আগে সেখানে থাকতেন ভারত সরকারের মিলিটারি অ্যাকাউন্ট বিভাগের সহকারী জেনরেল অ্যাকাউন্টেন্ট — একজন লেফটেনেন্ট কর্নেল।৬৮

স্পেন্সেস হোটেলে থাকার সময়ে হেনরিয়েটা লক্ষ্য করেছিলেন যে, মক্কেল হিশেবে কবিব কাছে অনেক সাধারণ মানুষ ভিড় করে। ব্যারিস্টারি করতে হলে এটা মেনে না-নিয়ে উপায় নেই। মনোমোহন ঘোষ প্র্যাক্টিস শুরু করার বছর খানেকের মধ্যে স্পেন্সেস হোটেল ছেড়ে দিয়ে ৪৮ নম্বর চৌরঙ্গি রোডে ব্যালার্ডস বিল্ডিং নামক চমৎকার বাড়িতে উঠেছিলেন।৬৯ একই বাড়িতে তিনি প্র্যাক্টিস করতেন এবং বসবাস করতেন। বছর দুয়েক পরে তিনি চলে যান ১৪ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে।৭০ সেখানেও তিনি কেবল বসবাস করতেন না, সেই সঙ্গে প্রাক্টিসও করতেন। মোট কথা, তিনি নিজের কাপড়ের মাপে কোট তৈরি করতে জানতেন। কিন্তু কবির এই কাণ্ডজ্ঞান ছিলো না। সুতরাং বিরাট দোতলা বাড়ি ভাড়া করলেও (এই বাড়িটা এতো বড়ো ছিলো যে, এক সময়ে এখানে থাকতো চারটি পরিবার।) সেখানে প্র্যাক্টিস না-করে, তিনি ওল্ড পোস্ট অফিস রোডের ৭ নম্বর বাড়িতে নিজের চেম্বার খোলেন। এই বাস্তা ছিলো ব্যারিস্টারদের পাড়া। সেকালের মোট জনা চল্লিশ ব্যারিস্টারের মধ্যে বারো জনের চেম্বাব ছিলো এই রাস্তায়।৭১ এভাবে স্পেন্সেস হোটেল ছেড়ে ব্যয়সংকোচের প্রয়াস চালানো হলেও, একই সঙ্গে ব্যবস্থা হলো বাড়তি ব্যযের।

বিলাসিতার উপকরণ এবং ভৃত্যপরিবৃত এই সংসার চালানোর জন্যে, বলা বাহুল্য, অনেক খরচ হতো। তাঁব ধারের খতিয়ান থেকে মনে হয় তিনি যতো টাকা আয় করতেন, তাঁর সংসার বাবদে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হতো। অথচ হেনরিয়েটা সম্পর্কে বারবার কবির অকুণ্ঠ প্রশংসা থেকে মনে হতে পারে, হেনরিয়েটা সুগৃহিণীর মতো মিতব্যয়িতার সঙ্গে সংসার চালাতে পারতেন। কিন্তু লন্ডন এবং লাউডন স্ট্রীটে তিনি যেভাবে সংসার পরিচালনা করেন, তাতে মনে হয় না, তিনি আয়ব্যয়ের সামঞ্জস্য ঘটাতে পারতেন। তিনি মাঝেমধ্যে দৃঢ় হাতে সংসারের লাগাম টেনে ধরার, স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা কি করতেন না? করতেন বলেই মনে হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে সক্ষম হতেন বলে মনে করা শক্ত। সে জন্যে ‘সুগৃহিণী’ হেনরিযেটার ব্যয়-সংকোচের পরিকল্পনা কল্পনাই থেকে যায়।

আলোচ্য কালে কবি ব্যারিস্টারিতে যকিঞ্চিৎ সাফল্য দেখালেও দুর্দিনের জন্যে কোনো সঞ্চয় করতে পারেননি। হোটেলে থাকার সময়ে কবি পরিচিতদের প্রায়ই ভোজ দিতেন, মদ্যপান করাতেন। হেনরিয়েটাকে নিয়ে লাউডন স্ট্রীটে বসবাসকরতে আরম্ভ করার পর এই পথে তাঁর ব্যয় কমে গিয়েছিলো মনে করা সঙ্গত। তবে তখন ব্যয়ের বিকল্প পথ খুলে যেতে সময় লাগেনি। পাশ্চাত্যে বছরে অন্তত একবার কাজকর্ম বন্ধ রেখে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে ছুটি কাটানোররীতি খুব জনপ্রিয়। ভার্সাই থাকার সময়ে হেনরিয়েটা এ রকম দূরে গিয়ে ছুটি কাটাতেন — আগেই তা উল্লেখ করেছি। তিনি কলকাতায় ফেরার পর মাইকেলের ব্যয় করার একটা নতুন পথ তৈরি হয়েছিলো এভাবে ছুটি কাটানোর মাধ্যমে। বাঙালিরা সেকালে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতো, কিন্তু ছুটি কাটানোর এই পাশ্চাত্য ধারণা তাদের মধ্যে তখনো অজ্ঞাত ছিলো। লাউডন স্ট্রীটের বাড়িতে ওঠার কয়েক সপ্তাহ পরে অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে জুলাই মাসে কবিসপরিবারে যান উত্তরপাড়ায়। এখানে তাঁরা ছিলেন প্রায় তিন মাস। তারপর উত্তরপাড়া থেকে যান চন্দননগরে।৭২ সাড়ে চার বছর ফ্রান্সে থাকা হেনরিয়েটা ফরাসি ভাষা ভালোই শিখেছিলেন। কন্যা শর্মিষ্ঠা এবং পুত্র (ফ্রেডারিক) মেঘনাদ ফরাসি ভাষা শিখেছিলো প্রায় মাতৃভাষা ইংরেজির মতো। আর স্বয়ং মাইকেলের ফরাসি ভাষা প্রধানত কেতাবী ভাষা হলেও, তিনি সে ভাষা বলতে পারতেন। ফ্রান্সের প্রতি নস্টালজিয়ার কারণেই ছুটি কাটাতে তাঁরা চন্দননগরে গিয়েছিলেন। সেখানে তখনো ফরাসি নাগরিকরা ছিলেন আর ছিলো ফরাসি সংস্কৃতির চর্চা। কিছু কাল পরে — সম্ভবত পরের বছর — শ্রীরামপুরের একটি বাগানবাড়িও তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন, সেখানে ছুটি কাটানোর উদ্দেশ্যে।৭৩

এই অবকাশ যাপন পরিবার এবং কবির স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো ফল দিয়ে থাকবে। কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে এটা দুভাবে তাঁর ক্ষতি করেছিলো। প্রথমত এবফলে তিনি সদ্য যে-ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তাতে ছেদ পড়ে। দ্বিতীয়ত, এটা ছিলো খুব ব্যয়বহুল। তিনি নিজেই সে কথা লিখেছিলেন গৌরদাসকে। ‘আমি এই মুহুর্তে শহরে আছি, কারণ শহরের বাইরে থাকা একটা বিলাসিতা, যা একজন নবীন ব্যারিস্টারের পক্ষে জোগানো সহজ ব্যাপার নয়।’৭৪ কিন্তু অতো ব্যয় করা সহজ নয় — জেনেও যিনি স্পেন্সেস হোটেলে থেকেছেন, চার শশা টাকা ভাড়ার বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, শহরের বাইরে অবকাশ যাপন করতে এসেছেন, দারিদ্র্যকে যিনি জেনেশুনে স্বেচ্ছায় বরণ করেছেন — তাঁকে দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচাবে কে? তদুপরি, তাঁর ভাগ্য অথবা পরিবেশও তাঁকে আনুকূল্য করেনি। তিনি যে নির্ভরযোগ্য ব্যারিস্টার নন — ১৮৭০ সাল নাগাদ এই অখ্যাতি দানা বাঁধতে থাকে। ফলে প্র্যাক্টিস কমে আসে। তা ছাড়া, স্ববভঙ্গ দেখা দেয় আরও গুরুতরভাবে। শারীরিক পটুত্বও হারিয়ে ফেলেন। এতো কাল যে অতিরিক্ত মদ্যপান এবং এবং অনিয়ম করেছেন, এখন সেই বিষবৃক্ষে ফল ধরে। যকৃতের অসহযোগ এ সময়েই শুরু হয়। তবুসংসার চালানোর জন্যে সেই ভাঙা স্বাস্থ্য নিয়েই তিনি মফস্বলে যেতে থাকেন। ওদিকে, মফস্বলে গেলে অনিয়ম ঘটে। স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়া হয়। স্বাস্থ্য খারাপ হলে কাজ করার ক্ষমতা আরও কমে যায়। এমন একটা আবর্ত চক্রকে পড়ে দ্রুত তিনি সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যান। এমন কি, এপর্যায়েও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না যে, আর মাত্র আঠারো মাসের মধ্যে তাঁর ভাগ্যে নেমে আসবে চরম দুর্দশা। তানাহলে তিনি আর-একটু সতর্ক হওয়ার সুযোগ পেতেন। হয়তো আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতেন।

নিজের শক্তি ফুরিয়ে এসেছে এবং ব্যারিস্টারি করে রাশি রাশি টাকা আসার সম্ভাবনা সদূর পরাহত — এটা অবশ্য তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৭০ সালে তিনি একটা চাকরি পেতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। দু বছর আগে স্মল কোর্টের বিচারক হতে না-পারলেও, এ বছর জুন মাসের গোড়ায় তিনি হাইকোর্টে একটা কাজ পান। কোনো নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি — নয় তাঁকে নিযুক্ত করা হয় প্রিভি কাউন্সিলের রেকর্ডসমূহের পরীক্ষক হিশেবে। ইংলিশম্যান পত্রিকায় তাঁর নিয়োগের পর যে-সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হয়, তা থেকে মনে হয়, প্রিভি কাউন্সিলে মামলার যে-নথিপত্র বাংলা থেকে তরজমা করা হতো, তিনি তার তদারকি করতেন।

হাই কোর্টের প্রিভি কাউন্সিল রেকর্ডের পরীক্ষক হিশেবে মিস্টার মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল-এর নিয়োগের ব্যাপারে কোনো দিক থেকে আপত্তির কারণ আছে বলে মনে হয় না। এই কাজের সঙ্গে যে-দায়িত্ব জড়িত আছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ; এবং এ কাজ ঠিকমতো করতে পারবেন এমন কোনো ব্যক্তি, যাঁর সন্দেহাতীতভাবে ক্ষমতা আছে এবং যাঁর পেশাদারী চরিত্র উন্নত শ্রেণীর। এর থেকে ভালো পছন্দ করা প্রায় অসম্ভব ছিলো। তা ছাড়া, এমন আর-একজন দেশীয় লোক খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না যিনি ইংরেজি ভাষার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।

তাঁর বেতন কতো ছিলো,অ্যাকাউন্টেন্ট জেনরেলের লেজার থেকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তাঁর বেতন দূরে থাক, লেজারে তাঁর নাম পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। অথচ হাই কোর্টের প্রতিটি বিচারক এবংসহায়ক কর্মচারীর বেতনেব খবর তাতে দেওয়া আছে। আসলে, তার কোনো নির্দিষ্ট বেতন ছিলো না এবং ইংলিশম্যান পত্রিকায়ও তার আভাস দেওয়া হয়েছে।

আমাদের যেমনটা জানা আছে, এ কাজের জন্যে কোনো নির্দিষ্ট বেতন নেই। কিন্তু তাঁরা সত্যিকার কতোটা কাজ করছেন, সেই অনুযায়ী বেশ দরাজ হাতে তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। কখনো কখনো এই টাকার পরিমাণ বেশ যথেষ্ট হতে পারে — মাসে এক হাজার টাকার কম নয়।৭৫

এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তিনি এই চাকরি থেকে অনেক টাকা পেতেন না। পেতেন মাসে বড়ো জোর হাজার খানেক টাকা। তা ছাড়া, এটা তাঁর সার্বক্ষণিক কাজও ছিলো না। তিনি এক যোগে পরীক্ষকের কাজ এবং আইন ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। তবে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ায় তিনি আইন- ব্যবসা থেকে খুব বেশি আয় করতেন বলে মনে হয় না। ইংলিশম্যান পত্রিকায় তাঁর নিয়োগ সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ায়, ধারণা হতে পারে যে, এই নিয়োগ বোধ হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী সিদ্ধান্ত এবং তাঁকে অভিনন্দন জানানোর জন্যে এই মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে, তাঁর নিযোগ ছিলো উপলক্ষ্য মাত্র, ইংলিশম্যানভিন্ন কারণে এই মন্তব্য প্রকাশ করে। এই পত্রিকা বলতে চেয়েছিলো যে, হাই কোর্টের আপীল বিভাগের যে-অনুবাদকরা আছেন, তাঁদের বেতন খুব সামান্য এবং সুনির্দিষ্ট। এর ফলে কোনো যোগ্য লোক এই কাজে আকৃষ্ট হন না। অযোগ্য লোকেরা যে-অনুবাদ করেন, তা অনেক সময়েই বিকৃত এবং মূলের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। সুতরাং সরকারের উচিত অবিলম্বে অনুবাদ বিভাগের সংস্কার করা।৭৬

কবি কতোদিন পরীক্ষকের কাজ করেছেন, তা ঠিক জানা যায় না। তবে বছর খানেকের বেশি নয়। ১৮৭১ সালের বেঙ্গল ডায়রেক্টরিতে মাইকেলের পরিচিতিতে তাঁকে পরীক্ষক বলে উল্লেখ করা হলেও, ১৮৭২ সালের পরিচিতিতে তাঁকে বলা হয়েছে তিনি ব্যারিস্টার এবংতাঁর চেম্বার হলো ঢাকায়।৭৭ ১৮৭১ সালের দ্বিতীয় ভাগে তিনি ৭ নম্বর ওল্ড পোস্ট অফিস রোডে তাঁর চেম্বার ছেড়ে দেন। কারণ, ভঙ্গস্বাস্থ্য মাইকেল তখন যে-কটি মামলা পাচ্ছিলেন, তা দিয়ে এই রাস্তায় চেম্বার খোলা রাখা যায় না। কিন্তু এ সময়েও তিনি লাউডন স্ট্রীটে তাঁর বাড়ি ছেড়ে দেননি এবং সংসার চালানোর জন্যে তখনো তাঁর অনেক টাকার দরকার হচ্ছিলো। আসলে ব্যারিস্টারিতে ব্যর্থ হবার পরেও বিলাসিতার জাড্য কাটিয়ে উঠতে তাঁর এবং জীবনসঙ্গিনী হেনরিয়েটার সময় লেগেছে। আবার ভালো সময় আসবে — এই মরীচিকা তখনো তাঁকে নিরাসক্ত চোখে তাকাতে দেয়নি। পরে যে দেনার বিপুল দায়ে ডুবে গেছেন, সেই দায়ের অনেকটা এ সময়ে তিনি নিজেই অর্জন করেছিলেন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে ‘সুগৃহিণী’ হেনরিয়েটা কেন অপেক্ষাকৃত কম খরচের বাড়িতে চলে যাননি, অথবা চলে যেতে কবিকে বাধ্য করেননি, সেটা একটা রহস্য। বেনিয়াপুকুরের মতো একটা জায়গায় সময়মতো চলে গেলে, ধারে অমন বিশাল পাহাড় জমে উঠতো বলে মনে হয় না। সংসার চালানোর জন্যে তাঁকে আলোচ্য কালে মফস্বলে যাবার এক-একটা বড় রকমের ঝুকি নিতে হয়েছে। তাঁর ঢাকা সফর ছিলো এমনি একটা অ্যাডভেঞ্চার।

তিনি ঢাকায় যান একটা মামলার কাজে। তখন কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়া সহজ ছিলো না। কবির স্বাস্থ্যও ছিলো খারাপ। এর আগে থেকেই যকৃৎ এবং প্লীহার রোগে তিনি কাতর হয়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসক ছিলেন তখনকার কলকাতার নাম-করা ডাক্তার — ডাক্তার পামার।৭৮ তাঁর চিকিৎসায় তিনি টিকে ছিলেন, কিন্তু স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছিলো না। কারণ, তিনি মদ্যপান একটুও কমাতে রাজি ছিলেন না। ধূমপানও করতেন। সেপ্টেম্বর মাসের (১৮৭১) গোড়ার দিকে তিনি ঢাকায় যান এবং সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় সেখানে দিন দশেক থাকতে হয়। নিজে এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন: ‘সেখানে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম!’৭৯ একটু ভালো হয়ে ঢাকা থেকে কলকাতায় ফেরেন। ঢাকায় তিনি কেবল একটি মামলায নগদ কিছু টাকা পাওয়ার জন্যে গিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর প্রত্যাশা ছিলো আরও বড়ো। কলকাতায় অনেক ব্যারিস্টার আছেন। এমন কি, বাঙালি ব্যারিস্টারই তিনি ছাড়া আরও তিনজন। সে কারণে তিনি সম্ভবত আশা করেছিলেন যে, ঢাকায় প্র্যাক্টিস করলে ব্যারিস্টার হিশেবে বিনা প্রতিযোগিতায় ব্যবসা করতে সক্ষম হবেন। বেঙ্গল ডায়রেক্টরিতে তাঁর চেম্বার লেখা হয়েছে ঢাকায় — এ থেকেও আভাস পাওয়া যায় যে, কবি আইন-ব্যবসা করার অভিলাষ ঘোষণা করে ঢাকায় গিয়েছিলেন।

তিনি যাওয়ার পর ঢাকার আদালতে কতোটা হৈচৈ পড়েছিলো, তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু মফস্বল শহব ঢাকায় যে স্বল্প সংখ্যক সাহিত্যামোদী ছিলেন, তাঁরা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। ‘মহাকবি’ মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁরা একটি সংবর্ধনা দেন।৮০ এই সংবর্ধনার উত্তরে কবি যা বলেন, তা থেকেও মনে হয়, তিনি কেবল একটি মামলার জন্যে সেখানে যাননি। তিনি ঢাকার কাছ অনেক কিছু প্রত্যাশা করেছিলেন। তিনি ঢাকাবাসীদের অভিনন্দনের উত্তরে বলেছিলেন, ঢাকার প্রতিটি ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা আছে আর সবস্বতী সেখানকার নিত্য-অতিথিনী। যে-দুই দেবীর তিনি সাধনা করেছিলেন, তাঁদের দুজনকেই তিনি যদি সেখানে প্রত্যক্ষ করে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে, বেদে অথবা পুরাণেতার উল্লেখ না-থাকলেও এই শহরই তাঁর জন্যে আদর্শ। তিনি ভাবলেন,অবশেষে ঢাকায় তাঁর ভাগ্য খুলে যাবে।

পীড়ায় দুর্বল আমি, তেঁই বুঝি আনি

সৌভাগ্য, অর্পিলা মোরে (বিধির বিধানে)

তব করে, হে সুন্দরি!

অতএব কবি ঢাকা-সুন্দরীর আনুকূল্য কামনা করেন।

বিপজ্জাল যবে

বেড়ে কারে, মহৎ যে সেই তার গতি।

কি হেতু মৈনাক গিরি ডুবিলা অর্ণবে?

দ্বৈপায়ন হ্রদতলে কুরুকুলপতি?

এই সনেটে কবি একদিকে নিজের অতি শোচনীয় অবস্থার কথা প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে প্রত্যাশা করেছেন নতুন করে জীবন শুরু করার। তিনি নিজের দুরবস্থা বোঝানোর জন্যে এতে দুটি ট্র্যাজিক উপমা দিয়েছেন। একটি হিমালয়-পুত্র মৈনাক গিরির সাগরে আত্মগোপন করার। অন্যটি যুদ্ধে পরাজিত ও ধ্বিধ্বস্ত দুর্যোধনের দ্বৈপায়ন হ্রদে পলায়নের মর্মস্পর্শী কাহিনীর। অহঙ্কারী মৈনাক গিরি দৈবশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশে কাপুরুষের মতো সাগরে লুকোতে বাধ্য হয়। আর নিজে মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধন জীবন বাঁচানোর জন্যে যুদ্ধের অষ্টাদশ দিনে একাকী আত্মগোপন করেছিলেন দ্বৈপায়ন হ্রদে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারেননি। যুধিষ্ঠিরের কথায় উত্তেজিত হয়ে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন সেই হ্রদ থেকে। তারপর গদাযুদ্ধে ভগ্নোরুহয়ে প্রাণত্যাগ করেন তিনি। মৈনাক গিরি এবং দুর্যোধন — উভয়ের ক্ষেত্রেই অহঙ্কার এবং দর্পের শশাচনীয় অপমান এবং পরাজয় লক্ষ্য করা যায়। কবিও তাঁর সীমাহীন অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে রাজধানী কলকাতার আড়ম্বরের বদলে আগ্রহভরে মফস্বল শহর ঢাকার আতিথ্য নিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। সকল উচ্চাশা জলাঞ্জলি দিয়ে কবি ঢাকার কাছে নিজের প্রার্থনা জানিয়েছেন:

করিও না ঘৃণা মোরে, তুমি ভাগ্যবতী!

কবি যে ঢাকার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, তার মধ্যেও আছে করুণ পরাজয় এবং মরিয়া হয়ে আত্মরক্ষা করার শেষ প্রচেষ্টা। কিন্তু আন্তবিক এবং সকরুণ প্রত্যাশা সত্ত্বেও তিনি ঢাকায় প্র্যাক্টিস করলেন না কেন, তার জবাব আমাদের জানা নেই। হতে পারে, সাহিত্যিক মহলে যতো সমাদর তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, আদালতে তা করেননি। হতে পারে, স্বাস্থ্য হঠাৎ খুব খারাপ হওয়ায় পরিবার থেকে এতোটা দূরে থাকতে ভরসা পাননি। কিন্তু কারণ যাই হোক, জীবনের একে-বারে পড়ন্ত বেলায় নতুন করে যাত্রা শুরু করার যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। অতঃপর দুর্বল দেহটাকে বহনকরেকলকাতায় ফিরে গেলেন পরিবার আর উত্তমর্ণদের ভিড়ে। নগেন্দ্রনাথ সোম উল্লেখ করেছেন যে, কয়েক মাস পরে — ১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে — তিনি আর-একবার ঢাকায় গিয়েছিলেন এবং ঢাকাকে নিয়ে সনেটটি সে সময়ে রচনা করেন।৮১ কিন্তু এর কোনো প্রমাণ নেই। বরং তিনি ঢাকার কাছে যে-আবেদন জানিয়েছিলেন, তা তাঁর প্রথম সফরের সময়কার হওয়াই স্বাভাবিক। কবির অন্য জীবনীকার — যোগীন্দ্রনাথ বসুর মতে, তিনি দ্বিতীয় বার ঢাকায় যান ১৮৭৩ সালের মার্চ মাসে।৮২

কবি ঢাকা যাবার আগেই — পয়লা সেপ্টেম্বর (১৮৭১) — তাঁর গদ্যগ্রন্থ হেক্টর-বধ প্রকাশিত হয়।৮৩ তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সে বই হাতে পেয়েছিলেন কিনা, সন্দেহ হয়। কারণ,গৌরদাসকে তিনি এই বই-এর কপি পাঠিয়েছিলেন ঢাকা থেকে ফিরে আসার পরে — সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে।।৮৪

হেক্টরবধ তাঁর একটি ব্যতিক্রমধর্মী রচনা। গ্রীক ধ্রুপদী সাহিত্যের তিনি বিশেষ অনুবাগী ছিলেন। বিশেষ করে ইলিয়াড তাঁকে খুব অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো। এই অনুপ্রেরণার স্বাক্ষর মেঘনাদবধ কাব্য-সহ তাঁর অনেক রচনায় অল্পবিস্তর লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ইলিয়াডের গদ্য-অনুবাদের প্রেরণা তিনি কোথায় পান? আগেই লক্ষ্য করেছি, আহত হয়ে ১৮৬৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি বেশ কিছু দিন শয্যাশায়ী ছিলেন। তার পর ১৮৬৮ সালের আগস্ট মাসে আবার অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন। বই-এর উপহারপত্র থেকে জানা যায়, এই দুই দফা দীর্ঘ অসুস্থতার সময়ে ইলিয়াড পড়তে গিয়ে তাঁর মনে হয়, যে-স্বদেশবাসীরা ইংরেজি ভাষা জানেন না, তিনি যদি তাঁদের জন্যে এই অপূর্ব কাব্য অনুবাদ করতে পারেন, তা হলে তাঁরা এর স্বাদ খানিকটা পেতে পারবেন। তিনি এ মহাকাব্যের আক্ষরিক অনুবাদ না-করে ভাবানুবাদ করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, বহু জায়গায় মূল ঘটনা তিনি বর্জন করেছেন, আবার বহু জায়গায় সামান্য পরিবর্তন করেছেন। এই স্বাধীনতা নেবার কারণ দেখিয়ে বলেছেন যে, স্বাধীনতা না-নিলে অনুবাদ করতে অনেকটা সময় লাগতো — যা তাঁর ছিলো না। কেবল সময়ের অভাবনয়, দৈহিক দিক দিয়েও তিনি খুব সমর্থ ছিলেন না। কতোটা শারীরিক অক্ষমতা এবং ব্যস্ততার মধ্যে তিনি এ অনুবাদের কাজ করেছিলেন, তা বোঝা যায় একটি ছোট্টো ঘটনা থেকে। — এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কয়েকটি পৃষ্ঠা হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, তিনি তা দ্বিতীয় বার লিখে দিতে পারেননি। (‘এক স্থলে কয়েক খানি কাপিব কাগজ হারাইয়া গিয়াছে; … সেটুকুও সময়াভাব প্রযুক্ত পুনরায় রচিয়া দিতে পারিলাম না। বোধ হয়, এতদিনের পর জনসমূহ সমীপে আমি হাস্যাস্পদ হইতে চলিলাম। …ইহার শোধনাৰ্থে ভবিষ্যতে কোন ক্রটি হইবে না।’৮৫) সর্বোপরি, তাঁর মনে একটা সংস্কার জন্মেছিলো যে, তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির নেশা এবং ক্ষমতা উভয় লোপ পেয়েছে। এসব কারণে, তিনি ইলিয়াডের কাব্যানুবাদ না-করে গদ্যে অনুবাদ করেছিলেন।

নিজের সাহিত্যিক ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁর নিজের ধারণা যেমনই হোক না কেন, হেক্টরবধ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা তখনো লুপ্ত হয়নি। আলোচ্য সময়ে লেখা তাঁর সনেট অথবা সনেট-সদৃশ কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলেও একই মন্তব্য করা যায়। এই কবিতাগুলো আদৌ কাব্যগুণ-বর্জিত ছিলো না এবং তিনি এগুলো লিখেওছেন দ্রুত গতিতে। তাঁর যে-কাব্যপ্রতিভা তাঁর সেবা করবে বলে ভূত্যের মতো অপেক্ষা করছিলো তাকে তিনি নিজে অবহেলা করে কাজে লাগাননি মাত্র। বস্তুত, নবছর আগে সাহিত্যের প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়ে লক্ষ্মী-লাভের উদ্দেশ্যে বিলেতযাত্রা করেছিলেন। সেখানে অসাধারণ জীবনসগ্রামের মধ্য দিয়ে লাভ করেছিলেন — যাকে তিনি অন্তত মনে করেছিলেন — সাফল্যের চাবিকাঠি। এর পর দেশে ফিরে পর্বতপ্রমাণ উচ্চাশা নিয়ে সরস্বতীর বদলে তিনি ফিরে তাকান আদালতের দিকে। তা না-হলে বিদেশে তিনি যে-আন্তর্জাতিক মানসিকতা স্বীকরণ করেছিলেন এবং যোরোপীয় সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদির যে-প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিলেন, তাতে এটাই ছিলো আরও শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনার সময়।

হেক্টরবধে তিনি যে-গদ্য লিখেছিলেন তার মধ্যেও তাঁর প্রতিভার অভ্রান্ত স্বাক্ষর আছে। গদ্যে লেখার ব্যাপারে কবির একটা আকর্ষণ আগে থেকেই ছিলো এবং গদ্যে লেখার সংকল্পও এক সময়ে ঘোষণা করেছিলেন।৮৬ এতো দিনে হেক্টরবধে তিনি তাঁর সেই আশা পূরণ করেন। এগ্রন্থের অনেক জায়গাতে তিনি যে-শব্দ এবং অনুবাক্য ব্যবহার করেছেন, বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে তখনো তার কোনো নজির ছিলো না, যেমন কাব্যে তাঁর বিচিত্র নাম-ধাতুর ব্যবহার ছিলো অভূতপূর্ব। বাক্যকাঠামোর ক্ষেত্রেও তিনি ইংরেজি রীতির অনুকরণে অনেক নতুনত্ব আমদানি করেছিলেন। আসলে মন-মেজাজের দিক দিয়ে তিনি ষোলো আনা কবি ছিলেন বলেই তিনি গদ্যচর্চা করেননি। নয়তো, গদ্যচর্চা করলে তিনি সেকালের প্রধান গদ্যরচয়িতাদের কারো থেকে পিছিয়ে থাকতেন বলে মনে হয় না। নাটক এবং কাব্যের ক্ষেত্রে তিনি যেমন নতুন পথের দিশারি হয়েছিলেন, গদ্যের বেলাতেও সেই অবদান রাখতে পারতেন, হেক্টরবধ থেকে তার আভাস মেলে।

পূৰ্ব্বকালে হেলাসৎ অর্থাৎ গ্ৰীশ দেশীয় লোকদের পৌত্তলিক ধর্মে আস্থা ও বহুবিধ দেবদেবীর উপর বিশ্বাস ছিল। তাঁহাদিগের দেবকুলের ইন্দ্র জুস লীড়া নাম্নী এক নবকূলনাবীর প্রতি আসক্ত হওতঃ রাজহংসের রূপ ধারণ করিয়া তাহার সহিত সহবাস করিলে, লীড়া দুইটি অণ্ড প্রসব করেন। একটী অণ্ড হইতে দুইটী সন্তান জন্মে; অপরটী হইতে হেলিনী নাম্নী একটী পরম সুন্দবী কন্যার উৎপত্তি হয়। লাকীডীমন্ দেশের রাজা লীড়াব স্বামী এই তিনটী সন্তানকে দেবের ঔবসজাত জানিয়া অতিপ্ৰযত্নে প্রতিপালন কবিতে লাগিলেন। যেমন কণ্ব ঋষির আশ্রমে আমাদেব শকুন্তলা সুন্দরী প্রতিপালিত হইয়াছিলেন, সেইরূপ হেলেনী লাকীডীমন্ রাজগৃহে দিন প্রতিপালিত ও পবিবর্ধিত হইতে লাগিলেন। আমাদিগের শকুন্তলা, দুর্ভাগ্যবশতঃ, খনিগর্ভস্থ মণির ন্যায় প্রতিপালক পিতার আশ্রমে অন্তর্হিত ছিলেন, কিন্তু হেলেনী রূপে যশঃসৌবতে হেলসি রাজ অতি শীঘ্রই পূর্ণ হইযা উঠিল।

এই ভঙ্গি বিদ্যাসাগরের কোনো কোনো রচনার কথা নিঃসন্দেহে মনে করিয়ে দেয়। অন্তর্নিহিত ছন্দ এবং প্রাঞ্জলতার কারণে এই গদ্য সেকালের শ্রেষ্ঠ গদ্যের মর্যাদা পেতে পারে। মাইকেলের স্বকীয়তার আর-একটি বিষয় হলো অনুবাদ কবতে গিয়ে তিনি মূল উপাদানের চরিত্র পরিবর্তন না-করেই দেশীয়করণ করেছিলেন। হোমারের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে রচনাটিকে যদ্দূর সম্ভব বাংলা ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা আদৌ সহজ ছিলো না এবং কবি নিজেও সে সম্পর্কে সচতেন ছিলেন।

বিদেশীয় একখানিকাব্য দত্তকপুত্ররূপে গ্রহণ করিয়া আপন গোত্রে আনা বড় সহজ ব্যাপার নহে, কারণ তাহার মানসিক ও শারীরিক ক্ষেত্র হইতে পর বংশের চিহ্ন ও ভাব সমুদায় দূরীভূত কবিতে হয়। এ দুরহ ব্রতে যে আমি কতদূর পর্যন্ত কৃতকার্য হইযাছি এবং হইব, তাহা বলিতে পারি না।

তাঁর কৃতকার্যতা সম্পর্কে এটুকু বলা যেতে পারে যে, বিদ্যাসাগরের ভ্রান্তিবিলাস ছাড়া তখনো পর্যন্ত এ রকম অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে কেউ করেননি। কেউ দেশীয় রূপ দিতে গিয়ে মূলের বৈশিষ্ট্য আমূল বিসর্জন দিয়েছেন, কেউ বা মোটেই, মাইকেলের ভাষায়, মূলের ‘গোত্রান্তর’ করতে পারেননি। কেবল বিষয়বস্তু নয়, তিনি যখন ইংরেজি ভাষার অনুকরণ করেছেন, তখন তার মধ্যে থেকে বিদেশী গন্ধ যথাসম্ভব দূর করেছেন। এক কথায় বলা যেতে পারে, তিনি বাংলা শব্দ ব্যবহার, এবং বাক্যকাঠামোর চরিত্র বজায় রেখেও বিদেশী উপকরণ দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ এবং অলঙ্কৃত করেছিলেন। হেক্টরবধ সে কারণে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে বিশিষ্ট আসনের দাবিদার।

*

সেপ্টেম্বর মাসের (১৮৭১) শেষ দিকে ঢাকা থেকে ফিরে এসে, তিনি আবার আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। দুর্দিনের জন্যে তাঁর কোনো সঞ্চয় ছিলো না। আর স্থায়ী আয়ের শেষ সম্বলটুকুও সাড়ে তিন বছর আগে মহাদেব চট্টোপাধ্যায়কে হস্তান্তর কবেছিলেন। কিন্তু সঞ্চয় না-থাকলেও, তাঁর দায় কম ছিলো না। এ সময়ে বাড়ির ভাড়া ঠিকমতো দিতে পারেননি, এমন কি যথাসময়ে দিতে পারেননি চাকর-বাকর, কেরানি, সহিস আর গাড়োয়ানের বেতন। এই কর্মচারীদের বেশির ভাগকে তাই একে- একে বিদায় দিতে হয়। অনেককে বিদায় দিতে হয় বকেয়া বেতন শোধ না-দিয়েই। যে-আসবাবপত্র দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে-ছিলেন দু বছর আগে, তার দাম তখনো পরিশোধ করতে পারেননি। বাড়িতে ফিরে এলে পাওনাদারেরা সার বেঁধে তাদের টাকার তাগাদা দিতে আসতেন। কোনো কোনো পাওনাদার ভাড়া করা লোক সঙ্গে নিয়ে আসতেন, যাতে তারা বাড়ির নিচ থেকে চেঁচিয়ে তাঁকে অপমান করতে পারে।

এ সময়ে কবি নিতান্ত অস্বস্তিতে সময় কাটিয়েছেন, তা অনুমান করা শক্ত নয়। কারণ তাঁর সামনে কোনো আশা ছিলো না, কোনো স্বপ্ন ছিলো না, উৎসাহ ছিলো না; ছিলো কেবল নীর অন্ধকার। কথা বলতে কষ্ট হতো, মাঝেমধ্যে জ্বরে কাতর হয়ে পড়তেন। স্থূল শরীরটাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নিয়ে যেতে হাঁফ ধরে যেতে। তবু তাঁর থামার জো ছিলো না। তাঁকে এক সময়ে আমরা দেখেছি শত প্রতিকূলতার মুখে লড়ে যেতে। দরিদ্র এবং সমস্যাসংকুল মাদ্রাসের সংসারে বসে বারো ঘণ্টা ভাষাচর্চা করতে তিনি পিছুপা হননি। ভাসাইতে অনাহার এবং অর্ধাহারের মধ্যেও নতুন ভাষা শেখার অথবা সাহিত্যচর্চার উৎসাহ হারাননি। অনাগত ভবিষ্যতের গোলাপি স্বপ্ন দেখে দুঃসময়ের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করেছেন। কিন্তু এতোদিনে সংগ্রাম করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ছিলো শুধু পরিবারের জন্য দায়িত্ব পালনের তাগিদ। এই দায়িত্ব লাঘব করতে পারতেন, তাঁর এমন কেউ ছিলেন না। তাঁর নিজের কোনো আত্মীয়স্বজন তো ছিলেনই না, এমন কি, হেনরিয়েটাও বহুকাল আত্মীয়-বর্জিত। তদুপরি, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এসময়ে ভগ্নস্বাস্থ্য। এমতাবস্থায়, ছোটা ছোটো তিনটি সন্তানের কি হবে? কে তাদের খাবার জোগাবে, কে তাদের শিক্ষা দেবে! শর্মিষ্ঠার বয়স ১২ বছর, তিনি মরে গেলে কে তার বিয়ে দেবে? কবি এসব চিন্তা করেন আর নির্ভেজাল মদ্যপান করেন। একদিন মনোমোহন ঘোষ এসে দেখলেন তিনি দিনের বেলায় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে নির্জল হুইস্কি খাচ্ছেন। তাঁর আত্মহননের প্রয়াস দেখেমনোমোহন আঁৎকে ওঠেন। কি করছেন? এতো আত্মহত্যার সামিল!’৮৭ কলকাতার প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষিত বাঙালি ডাক্তার সূর্য গুডিব চক্রবর্তী। এমন করে মদ্যপান করতে দেখে হুশিয়ার করে দিলেন কবিকে: ‘এভাবে মদ্যপান করলে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।’৮৮ তিনি নিজেও সচেতন সে সম্পর্কে। সে জন্যে মনোমোহনকে বলেছিলেন, ‘এ হলো আত্মহত্যার মন্থর কিন্তু নিশ্চিত একটি উপায়। তবে গলা কাটার মতো কষ্টের নয়।’৮৯ তিনি জানেন, তাঁর সমস্যার কোনো সমাধান নেই। সুতরাং নৈরাশ্য, হতাশা এবং বিষণ্ণতার সাগরে নিমজ্জমান কবি নেশার ঘোরে সব ভুলে থাকতে চান।

১৮৭২ সালের বেঙ্গল ডায়রেক্টরিতে ব্যারিস্টার হিশেবে কবির নাম থাকলেও, তাঁর কোনো ঠিকানা নেই। আগের বছর ঢাকায় যাবার আগে অথবা ঢাকা থেকে ফিরে আসার কদিন পরে তিনি চেম্বার ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িতে চেম্বার খোলেন হাই কোর্টেরনবীনতম ব্যারিস্টার তারকনাথ পালিত (১৮৩১-১৯১৫)। কবি ঢাকা থেকে ফিরে আসার মাস দুই পরে — ৩০ নভেম্বর তারিখে তারকনাথ হাই কোর্টে যোগ দিয়েছিলেন নতুন উদ্যম নিয়ে। অপর পক্ষে, ভগ্নমনোরথ ভগ্নস্বাস্থ্য মাইকেল ব্যারিস্টাবি থেকে প্রায় রণে ভঙ্গ দেন। মাঝেমধ্যে যখন ডাক এসেছে মফস্বল থেকে, তখন পরিবারের কথা ভেবে গেছেন সওয়াল করতে, আর্জি পেশ করতে। না-গেলে খাবার জোটানোর উপায় ছিলো না। কিন্তু তার ফলে স্বাস্থ্যের ওপর আরও চাপ পড়েছে। এ সময়ে প্রতিদিন তাঁর ধার জমে উঠেছে, যেমনটা একদিন ভার্সাইতে উঠেছিলো — দোকানদারদের কাছে, বাড়িওয়ালার কাছে, বন্ধু এবং পরিচিতদের কাছে। এই সময়ে তিনি বাধ্য হয়ে লাউডন স্ট্রীটের বাড়ি ছেড়ে দেন — যদিও সে বাড়ির ভাড়া বাকি থাকে বহু দিনের। কতো রঙিন স্বপ্ন নিয়ে এই বাড়িতে উঠেছিলেন প্রায় আড়াই বছর আগে। কতোভাবে সাজিয়েছিলেন উপভোগ করবেন বলে। কিন্তু স্বপ্নের মতো তা যেন মিলিয়ে গেলো।

‘বামুনপাড়াম্বর বাড়ি ছেড়ে উঠলেন গিয়ে তখনকার কলকাতার একটি ওঁচা পাড়ায় — ২২ নম্বর বেনিয়াপুকুর রোডে। সে বাড়ির এক পাশে ২১ নম্বরে একটি বাগান আর ২০ নম্বরে চালের গোলা। অন্য পাশে ২৩ নম্বরে একটি পুকুর আর ২৪ নম্বরে একটি কুঁড়েঘর। ১৯ নম্বরে থাকেন গুণমণি দাসী। ১৩ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত সবগুলো ছোটো ছোটো বাড়ি পঞ্জিকার ভাষায় কুঁড়েঘর।৯০ লাউডন স্ট্রীটের পরিবেশের সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায় কবি কোথা থেকে কোথায় গিয়ে আশ্রয় পেলেন।

তাঁর অভিজ্ঞতা চকিতে অনরে দ্য বালজাকের কথা মনে করিয়ে দেয়। লেখাপড়া নিয়ে তিনি টেবিলে সময় কাটতেন রোজ চোদ্দো থেকে যোলো ঘণ্টা। ২৮ বছর বয়সে তিনি দেউলে হবার মুখ থেকে কোনোক্রমে রক্ষা পান। তাঁর ছিলো বিলাসিতা করার এবং লোক দেখিয়ে ব্যয় করার অদম্য বাসনা। টাকা আসবে এই ভরসায় তিনি আগে থেকে ধার করে ব্যয় করতেন। প্রভূত পরিমাণে টাকা আয় করবেন — এই ছিলো তাঁর প্রধান আকাঙ্গা। অর্থ-পূজারী বলে তাঁর অনেক নিন্দাও হয়েছিলো। কিন্তু খরুচে হাত থাকায় সব সময়ে তিনি ঋণী হয়ে থাকতেন নানাজনের কাছে। এক সময়ে তিনি পাওনাদারদের তাড়ায় প্যারিসের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তা ছাড়া, তাঁকে যাতে আদালতের সমন জারি করতে না-পারে, তার জন্যে তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করতেন। শেষে তিনি যখন তাঁর বহু বছরের প্রিয়তমাকে বিয়ে করতে সমর্থ হন আর প্রিয়তমা তাঁর জন্যে নিয়ে এলেন অনেক সম্পদ, তখন আপাতদৃষ্টিতে নটে গাছটি মুড়ানোর মতো সুখে জীবন যাপন করার বর্ণাঢ্য মঞ্চ নির্মিত হলো। কিন্তু চল্লিশ বছর বয়স থেকে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে আরম্ভ করেছিলো। বিয়ের পর তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র কয়েক মাস।

বালজাকের সঙ্গে মাইকেলের জীবনের অনেক কিছুই মিলে যায়। কেবল একটি বড়ো পার্থক্য। বালজাক বহু কাল যে-রমণীকে ভালোবেসেছিলেন, মৃত্যুর ঠিক আগে হলেও, তাঁকে বিয়ে করতে পেরেছিলেন। তা ছাড়া, ক্ষণিকের জন্যে হলেও, অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের স্বাদ পেয়েছিলেন বিয়ের পরে। দু দিক দিয়েই তাঁর জীবন মিলনান্তক। অপর পক্ষে, মাইকেল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন দারিদ্র্য, দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা এবং চরম অযত্নের মধ্যে। তাঁর জীবনের শেষ দু বছর যেভাবে কেটেছিলো, অতি-দরিদ্র, অতি-অশিক্ষিত, অতি-অখ্যাত কেউই তাকে ঈর্ষা করবেন না। আর কুড়ি বছর ধরে ভালোবাসার এবং পনেরো বছর ধরে এক সঙ্গে বাস করার পরেও তিনি চার্চে গিয়ে হেনরিয়েটাকে বিয়েও করতে পারেননি।

কলকাতায় প্র্যাক্টিস কার্যত বন্ধ। এমন সময়ে ১৮৭২ সালের গোড়ার দিকে একটি মকদ্দমায় বাদী পক্ষের তরফে ডাক পেলেন নতুন শহর পুরুলিয়া থেকে। ফেব্রুআরি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি সেখানে যান। যাওয়া মোটেই সহজ ছিলো না। তখনো সেখানে রেল লাইন তৈরি হয়নি। সুরেশ মৈত্রের মতে, তিনি বরাকর থেকে কাঁচা পথে যান। বরাকর থেকে পুরুলিয়ার দূরত্ব ৪২ মাইল।৯১ এতোটা পথ পাল্কিতে যাওয়াও সুখের অভিজ্ঞতা নয়। পথে একমাত্র সুখের যে-অভিজ্ঞতা হয়েছিলো, তা হলো পরেশনাথ পাহাড় দেখার সৌভাগ্য। পরেশনাথ খুব উঁচু পাহাড় নয় — উচ্চতা মাত্র ৪৪৮০ ফুট। পুরুলিয়া থেকে পরেশনাথের আকাশপথে দূরত্ব প্রায় ৫০ মাইল। কিন্তু পরিষ্কার আকাশ থাকলে পুরুলিয়া শহরের বাইরে থেকে এই পাহাড় চোখে পড়ার কথা। পাহাড় এবং সাগরের প্রতি তাঁর আন্তরিক আকর্ষণ সত্ত্বেও, কাছ থেকে পাহাড় দেখার সৌভাগ্য তাঁর য়োরোপ যাবার আগে পর্যন্ত হয়নি। দেশে ফিরে এসে এই প্রথম পাহাড় দেখার ঘটনা। সুতরাং তাঁর পক্ষে খুশি হওয়া স্বাভাবিক। কেবল তাই নয়, পরে এই পাহাড় তাঁকে একটি কবিতা লেখার প্রেরণা জুগিয়েছিলো। আমার ধারণা, এ কবিতাটি তিনি এ যাত্রায় লেখেননি।৯২ লিখেছিলেন কয়েক মাস পরে তিনি যখন পঞ্চকোটে ছিলেন, সেই সময়ে। কাশীপুর থেকে পরেশনাথের দূরত্ব আরও কম। পরেশনাথ পাহাড় দেখে তিনি তাকে রহস্যময় এক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

ব্যোমকেশ তুমি কে হে, (এই ভাবি মনে)

মজি তপে ধবেছ ও পাষাণ-মূরতি?

এ হেন ভীষণ কায়া কার বিশ্বজনে?

তবে যদি নহ তুমি দেব উমাপতি,

কহ, কোন্ রাজবীর তপোব্রতে ব্রতী —

খচিত শিলার বর্ম কুসুম-রতনে

তোমার?

ব্যারিস্টার হিশেবে খুব সফল না-হলেও, তিনি যেখানে যেতেন, কবি হিশেবে সেখানকার সাংস্কৃতিক মহলে সমাদর পেতেন। তাঁর ঢাকা সফরের সময়েও আমরা তা লক্ষ্য করেছি। পুরুলিয়ায়ও তার অন্যথা হলো না। কবি তাতে খুশিও হন। কিন্তু পুরুলিয়ায় তিনি অপ্রত্যাশিত যা পেয়েছিলেন, তা হলো খৃস্টীয় সমাজের তরফ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা।৯৩ সেখানকার খৃস্টীয় সমাজ মাইকেলের মতো অ্যাংলিকান অর্থাৎ ইংল্যান্ডীয় চার্চের অনুসারীও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সেখানকার লুথারীয় চার্চের অনুসারীরা তাঁকে এই সংবর্ধনা দেন। কেবল তাই নয়, তাঁরা তাঁর জন্যে আরও একটা বিস্ময় জমা করে রেখেছিলেন। তাঁরা তাঁকে অনুরোধ জানান, সেখানকার সুপরিচিত একজন খৃস্টান নেতা, কাঙালিচরণ সিংহের পুত্র কৃষ্ণদাসের গড-ফাদার হবার জন্যে। তার ব্যাপটিজম হয় ২৫ ফেব্রুআরি (১৮৭২)।৯৪ মাইকেল কেবল যে এই প্রস্তাবে রাজি হন, তাই নয়, তিনি এই উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে ফেলেন।৯৫ ঠিক ২৯ বছর আগে — ৯ ফেব্রুআরি — তাঁর নিজের ব্যাপটিজম হয়েছিলো। সেই নস্টালজিক স্মৃতি হয়তো তাঁকে এ কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। নয়তো গড-ফাদার হবার অনুরোধ জানালেও, খৃস্টীয় সমাজ তাঁকে এ কবিতা লেখার সুনরোধ জানিয়েছিলো বলে মনে হয় না। এই কবিতায় তাঁর এক ধরনের আন্তরিকতা এবং খৃষ্ট ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তাঁর ধর্মপুত্র কৃষ্ণদাসকে সম্বোধন করে বলেছেন: জর্দানের নীরে স্নান করে তুমি আজ পবিত্রতর জন্মগ্রহণ করলে। তা ছাড়া

সুন্দর মন্দির এক আনন্দে নির্ষ্মিলা

পবিত্রাতা বাস হেতু ও তব শরীরে;

সৌরভ কুসুমে যথা, আসে যবে ফিরে

বসন্ত, হিমান্তকালে।

কবি মনে করেন, খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করায় কৃষ্ণদাস কী অমূল্য ধন পেয়েছে, তা সে অচিরে বুঝতে পারবে। তাঁর মতে, এর ফলে সে দৈববলে বলীয়ান হয়েছে। এ তার সৌভাগ্য। তাঁর নিজের দীক্ষা উপলক্ষে তিনি যে-হীম রচনা করেছিলেন, তাতেও কমবেশি একই রকমের মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। আগেই লক্ষ্য করেছি, ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না-দেখালেও, খৃষ্টধর্মকে হিন্দু ধর্মের তুলনায় তিনি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করতেন এবং খৃষ্টীয় য়োরোপের প্রতিও তাঁর ছিলো আন্তরিক শ্রদ্ধা। পুরুলিয়ায় লেখা এই কবিতায়ও খৃষ্টধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার আভাস পাওয়া যায়।

কবি এই ‘শহরে’ কদিন ছিলেন, সঠিকভাবে জানা যায় না। কিন্তু, সুবেশচন্দ্র মৈত্রের মতে, এখানকার জলবাযু তাঁর স্বাস্থ্যের উপকার করেছিলো। ফ্রেব্রুআরি মাসের শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।৯৬

ওদিকে, পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহ দেও কবি পুরুলিয়ায় এসেছেন — এই খবর পেয়ে তাঁকে নিজের ‘রাজধানী’ কাশীপুরে নিয়ে যাবার জন্যে লোক পাঠান। তবে তাঁর কর্মচারী যখন পুরুলিয়ার পৌছেন, ততোক্ষণে কবি কলকাতায়।৯৭ নীলমণি সিংহ তাতে উৎসাহ হারালেন না। অবিলম্বে নতুন প্রস্তাব নিযে দূত পাঠালেন কলকাতায়। তিনি কবিকে তাঁর ‘রাজ্যে’র ম্যানেজার নিযুক্ত করার প্রস্তাব দেন। কতো টাকা বেতন দেবার কথা বলেছিলেন, জানা যায় না। তবে এক হাজার টাকার চেয়ে কম। যে-মাইকেল মাত্র পাঁচ বছর আগে মাসে ছ হাজার টাকা আয় করার স্বপ্ন দেখেছেন এবং বাস্তবে অতো টাকা আয় করতে না-পারলেও কিছু কাল অন্তত মাসে হাজার দুয়েক করে আয় করেছেন, যে- মাইকেল তালুকের মালিক হলেও সামন্তদের দেখতেন কৃপার দৃষ্টিতে, যে-মাইকেল মনেপ্রাণে নাগরিক, যিনি একদা যোরোপীয় হয়ে গেছেন বলে নিজেকে নিয়ে গর্ব করতেন — সেই মাইকেল সামান্য বেতনে একান্ত গ্রাম্য রাজা নীলমণি সিংহ দেও-এব ম্যানেজার হলেন। অবশ্য তিনি একজন সামন্ত রাজার অধীনে চাকরি করার কথা কখনো ভাবেননি, তা নয়। তিনি যখন ব্যারিস্টার হবার কথা কল্পনাও করেননি, তেমন সময়ে — ১৮৬০ সালের শুরুতে — ইংলিশম্যান পত্রিকায় একজন সামন্ত রাজার বিজ্ঞাপন দেখে তাঁর রাজ্যে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হবার উদ্দেশ্যে দরখাস্ত করেছিলেন।৯৮ তখন অবশ্য তাঁর আয় ছিলো খুব কম — মাসে মাত্র ১২৫ টাকা। কাজেই বেশি বেতনেব একটা পদ — তা যেমনই হোক, তার দিকে তাঁর লোভ থাকা সম্ভব। সেবারে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পাননি। কিন্তু এবারে ম্যানেজাবেব কাজ পেয়ে কলকাতায় পরিবার রেখে, নিজে গেলেন স্বেচ্ছা-নির্বাসনে। সেখানে আশ্রয় পেলেন ‘রাজধানী’ কাশীপুরে বাঁধের ধারে একটি বাংলো বাড়িতে।৯৯ প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য, তা সত্ত্বেও এক অজ পাড়াগাঁয়ে এই চাকরি নিয়ে যেতে সম্মত হলেন কি করে? তার উত্তর খুব শক্ত নয়। আমরা আগেই একাধিক বার দেখেছি যে, অজানা জায়গায় গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করার একটা প্রবণতা তাঁর মধ্যে একেবারে তরুণ বয়স থেকেই ছিলো। পঞ্চকোটে যাওয়ার মধ্য দিয়েও তিনি তাঁর সেই চরিত্রের এবং মনোভাবের পরিচয় দেন। তা ছাড়া, চরম অর্থকষ্টের মধ্যে বাঁধা আয়ের প্রশ্নটিও নিশ্চয় বিবেচনা করেছিলেন।

তাঁর জীবনের বড় একটা সাধ ছিলো রাজকবি হবার। তাঁর প্রিয় কবিরা প্রায় সবাই ছিলেন রাজকবি। এটা তাঁর মনে এমন একটা মোহের মতো কাজ করেছে যে, নদিয়া- অথবা বর্ধমান-রাজের কবি হতে পারলেও তিনি খুশি হতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা-ও হতে পারেননি। এখন জীবনের একেবারে গোধূলি লগ্নে ক্ষুদ্র পঞ্চকোট রাজ্যের (মোট আয়তয় ২৭৭৯ বর্গ মাইল এবং প্রধানত জংলি এলাকা) ম্যানেজার হয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন কিনা, জানা যায় না। তবে তিনি এক ধরনের স্বস্তি লাভ করে থাকবেন। তাঁর মনোভাব বোঝা যায়, একটি কবিতা এবং পঞ্চকোটে তাঁর কার্যকলাপ থেকে। মাদ্রাসে পত্রিকা সম্পাদনা অথবা শিক্ষকতা এবং কলকাতার পুলিশ অফিসে কেরানির চাকরি — তিনি যখনই যে-কাজ করতেন, তা করতেন উৎসাহের সঙ্গে এবং তাতে নিজের দক্ষতা দেখাতে চেষ্টা করতেন। যে-পর্যায়ের কথা আমরা আলোচনা করছি, ততোদিনে তিনি জীবনীশক্তি প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছিলেন। তবু চাকরি নেবার পর হঠাৎ কোথা থেকে যেন নতুন উদ্যম পেলেন। সেই উদ্যম নিয়ে শুরু করলেন পঞ্চকোট সংস্কারের কাজ। সেখানে রাস্তাঘাট তৈরি করাবেন, পানীয় জলের ব্যবস্থা করাবেন, প্রজাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবেন।

ভাঙ্গা গড় গড়াইব, জলপূর্ণ করি

জলশূন্য পরিখায়; ধনুর্বাণ ধরি দ্বারিগণ

আবার রক্ষিবে দ্বার অতি-কুতূহলে।

পঞ্চকোট ছোটো রাজ্য হলেও এর ইতিহাস অনেক পুরোনো — বেশ কয়েক শতাব্দীর।১০০ পাহাড়ের গায়ে পঞ্চকোট নির্মাণের যে-কিংবদন্তী চালু আছে, তার মধ্যে পুরোনো আমলে রাজাদের প্রতিপত্তি এবংঐশ্বর্যের আভাস পাওয়া যায়। ‘ভাঙ্গা গড় গড়াই বম্ব-র মধ্যে সেই পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ইঙ্গিত দিযেছেন। ১৮৬০ সালে তিনি যখন সামন্ত রাজ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির জন্যে আবেদন করেছিলেন, তখন এক বছরের মধ্যে ইংরেজরা প্রশংসা করবে এমন একটি পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।১০১ সেবারে চাকরি না-পাওয়ায় তাঁর সাংগঠনিক যোগ্যতা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। এবারে অক্ষম শরীর নিয়েও তিনি যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্যে তৎপর হয়ে উঠলেন।

তবে তাঁর আশা যতোই মহৎ হোক না কেন, এবারেও ভাগ্য তাঁর ভালো ছিলো না। তিনি ম্যানেজার নিযুক্ত হবার আগেই নীলমণি সিংহ দেও একটা মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁরই এক পত্তনিদার শারদাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর বিরুদ্ধে জেলা আদালতে মামলা করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিলো: নীলমণি সিংহ তাঁর কাছ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা জোর করে আদায় করে নিয়েছেন। আগের বছর সেপ্টেম্বর মাসে (১৮৭১) কবি যখন মামলা পরিচালনার কাজে ঢাকায় গিয়েছিলেন, মোটামুটি তেমন সময়ে এই মামলার রায় প্রকাশিত হয়। তাতে নীলমণি সিংহ হেরে গিয়েছিলেন। তাঁকে আদেশ দেওযা হয় সুদসহ টাকা ফেরত দেবার। অতঃপর নীলমণি সিংহ এই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপীল কবেন।১০২ আর এর কয়েক মাসের মধ্যে — ১৮৭২ সালের মার্চেরমাঝামাঝি — মাইকেলকে ম্যানেজার করে তিনি নিজের ‘রাজ্যে’ নিয়ে যান। কবির নিয়োগের সঙ্গে এই মামলার সামান্য হলেও একটা যোগাযোগ ছিলো বলে মনে হয়। নীলমণি সিংহ ভেবে থাকবেন যে, কম খরচে একজন ব্যারিস্টারকে ম্যানেজার হিশেবে পেলে তিনি এই মামলা ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবেন। তা ছাড়া, ভবিষ্যতেও যখন কোনো মামলা আসবে — একজন জমিদাপেক্ষে-বিপক্ষে মামলা-মকদ্দমা লেগেই থাকে — তখনো তিনি তাঁকে পরামর্শ দিতে পারবেন। মোট কথা, এক ঢিলে দু পাখি মারা যাবে মনে করে তিনি কবিকে তাঁর ম্যানেজার নিয়োগ করেছিলেন বলে মনে হয়। নয়তো এক গ্রাম্য জমিদারের পক্ষে হঠাৎ একজন ব্যারিস্টারকে নিজের ম্যানেজার নিয়োগ করার আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ নেই।

আগেই বলেছি, প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ে গিয়ে কবি সামন্তরাজের ম্যানেজার হয়েছিলেন নিতান্ত প্রাণের দায়ে। বেতন সামান্য হলেও, মাসে মাসে নির্দিষ্ট আয়ের নিশ্চয়তা পেয়ে তিনি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। তাঁর স্বস্তির আর-একটা কারণ — পাওনাদারদের হাত থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা। যতো টাকা পাওনা থাক না কেন, তাঁর কোনো উত্তমর্ণ পঞ্চকোটে গিয়ে টাকা আদায় করতে চেষ্টা করেননি। তা ছাড়া, সেখানে থাকার সময়ে প্রচুর দেশীয় সুরা পান করলেও, তাঁর স্বাস্থ্যের খানিকটা উন্নতি হয়েছিলো। কিন্তু বিড়ম্বিত কবির কপালে এই সাধারণ সুখও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

ম্যানেজার হিশেবে পঞ্চকোটে আসার পর তাঁর একটা প্রধান দায়িত্ব ছিলো শারদাপ্রসাদের বিরুদ্ধে মামলায় তদবির করা। তিনি আর সে ব্যাপারে কোনো অবহেলাও করেননি। তিনি নিজে আইনজীবী হিশেবে নাম করতে পারেননি। তদুপরি এ সময়ে তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থাও ছিলো খুব খারাপ। সুতরাং নীলমণি সিংহের পক্ষে তিনি আইনজীবী নিয়োগ করেন তখনকার সবচেয়ে নাম-করা অ্যাটর্নিদের একজন — আর টি অ্যালেনকে। ১৮৫৫ সালের ফেব্রুআরি মাস থেকে তিনি কলকাতায় ওকালতি শুরু করেন। (তাঁর পিতাও ১৮৪০-এর দশকে কলকাতায় ওকালতি করেছেন। তাঁর চেম্বার ছিলো ৫২ নম্বর চৌরঙ্গীতে।১০৩ মাইকেল যেখানে থাকতেন তার কাছেই। আগে থেকে তাঁদের পরিচয় ছিলো। অ্যালেনকে সাহায্য করার জন্যে দুজন দেশীয় উকিলও নিয়োগ করেছিলেন — উপেন্দ্রনাথ বসু আর ভবানীচরণ দত্তকে।১০৪ অপর পক্ষে, শারদাপ্রসাদ তাঁর পক্ষে নিযোগ করেছিলেন নাট্যকার উপেন্দ্রনাথ দাসের পিতা শ্রীনাথ দাসকে।১০৫ আসলে, আইনের চোখে নীলমণি সিংহের মামলা দুর্বল ছিলো। তাই নাম-করা অ্যাটর্নি এবং উকিল দিয়েও তিনি তাঁর আপীলে জয়ী হতে পারেননি। জেলা আদালতের রায়ই বহাল রাখে কলকাতা হাই কোর্ট।১০৬ মাইকেলের আন্তরিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এই পরিস্থিতিতে নীলমণি সিংহ কাউকে দোষারোপ করে সান্ত্বনা পেতে চাইছিলেন। সেই সান্ত্বনা তিনি পেলেন অসহায় রুগ্ন কবির ওপর খড়গাঘাত করে। কবির জীবনীকারেরা এই প্রসঙ্গে একজন নাপিতের কথা উল্লেখ করেছেন।১০৭ রাজা নাকি এই নাপিতের বুদ্ধিতে কাজ করতেন। শোনা যায়, এই নাপিত রাজাকে কবির বিরুদ্ধে চটিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু অব্যবহিত কারণ যাই হোক, পঞ্চকোটে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করা দূরে থাক, তাঁর নিরাপত্তাও সেখানে বিপন্ন হলো। কবি অবশ্য সেই সংস্কৃত শ্লোকের সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন না — তাই কাউকে কিছুনা-জানিয়ে রাতের অন্ধকারে পঞ্চকোট থেকে পালিযে কেবল মাননয়, জীবন বাঁচান। কাশীপুর থেকে তাঁকে সদর রাস্তা অবধি পৌঁছে দেন রাজারই এক জ্ঞাতি — রাজার সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিলো না। তাঁর বিপদ কতোটা বাস্তবিক ছিলো তা বোঝা যায় একটি তথ্য থেকে — তিনি রাজার কাছে বেতন বাবদ ষোলো শশা টাকা পেতেন। দারুণ অর্থকষ্ট সত্ত্বেও, সে টাকার মায়া কাটিয়েই কাশীপুর থেকে পালিয়ে আসেন।১০৮ পঞ্চকোটের রাজার মামলার রায় দেওয়া হয়েছিলো দোসরা সেপ্টেম্বর (১৮৭২) তারিখে। অতএব অনুমান করা সঙ্গত যে, এর কদিন পরেই কবি কলকাতায় ফেরেন।

তাঁর কর্মচারী হলেও, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে বিখ্যাত ব্যক্তি এবং তাঁর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করলে দুর্নাম হতে পারে — এটা নীলমণি সিংহ দেও জানতেন। সে জন্যে, কবি পালিয়ে যাবার অল্পদিন পরেই তিনি তাঁর সঙ্গে যোগাযযাগ করতে চেষ্টা করেছিলেন। প্রাপ্য টাকা শোধ দিয়েছিলেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায় না। তবে রাজার অনুরোধে কবির পক্ষ থেকে কৈলাসচন্দ্র বসু ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে কাশীপুরে যান।১০৯ কবি যখন আইন-ব্যবসা করেছিলেন, তখন শেষ ক বছর তাঁর কেরানি ছিলেন কৈলাসচন্দ্র বসু। তাঁর সঙ্গে কবি সম্পর্ক ঠিক প্রভু-ভূত্যের ছিলো না।১১০ তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে ভিত্তি তৈরি হয়েছিলো পারস্পরিক সহানুভূতির ওপর। সেই সূত্রে তিনি কবির পক্ষ থেকে রাজার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। এবং রাজা যেহেতু নিজে তাঁকে যাবার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন, সে জন্যে মনে হয়, পাওনা টাকা তিনি শোধ দিয়ে থাকবেন।

কলকাতায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো সমস্যাগুলোও কবির সঙ্গে ফিরে আসে। ফিরে আসেন পাওনাদারেরাও। বস্তুত, পঞ্চকোট থেকে বিক্তহস্তে ফিরে আসায, তাঁর সমস্যা বরং আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বকেয়া বাড়ি-ভাড়া নিয়ে তিনি চরম বিপদে পড়েন। এ সময়ে তাঁর অনেক ধার ছিলো — এ কথা না-বলে, বলা উচিত: তিনি ধারের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। কৈলাসচন্দ্র বসু পুরোনো মনিবের দুর্দশা সম্যকভাবে উপলব্ধি করে তাঁকে উদ্ধার করার জন্যে বিদ্যাসাগরের কাছে সনির্বন্ধ আবেদন জানান।

মহাশয়ের শ্রীচরণকমলে বিনীতভাবে আমি এই প্রার্থনা কবি যে, যেরূপে পারেন, বিপন্ন দস্তুজাকে এবারে রক্ষা কবিয়া স্বীয় অপার করুণার আরও সুপরিচয় প্রদান করিবেন। ফলতঃমহাশয়ের অনুগ্রহ ভিন্ন বর্ত্তমানে দত্তজার আর উপায়ান্তর নাই।১১১

এই চিঠির সঙ্গে তিনি কবিব যে-ধাবের হিশেব পাঠান, তা থেকে দেখা যায়, তখন তাঁর কাছে বিভিন্ন জন যে-টাকা পেতেন, তার পরিমাণ ছিলো সেকালের মাপে প্রায় অবিশ্বাস্য — ৪২ হাজার টাকা। এই টাকার সবটাই তিনি সরাসরি ধার করেননি। তাঁর পাওনাদারদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর সাবেক কর্মচারী। তা ছাড়া, অনেকের কাছ থেকে তিনি জিনিশপত্র কিনে অথবা পরিসেবা নিয়ে সেসবের দাম শোধ করতে পারেননি। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে ধারে ঘোতে আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিলেন। এই অবস্থায় কৈলাসচন্দ্র বসুর চিঠি যথেষ্ট ছিলো না, স্বয়ং কবিকে সরাসরি হাত পাততে হয় পুরোনো বন্ধু বিদ্যাসাগরের কাছে। নিতান্ত বাধ্য না-হলে তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে নতুন করে দয়া ভিক্ষা করতেন না। কারণ তাঁদের সম্পর্ক তখন আগের মতো ঘনিষ্ঠ ছিলো না। তিনি অভিমান করে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছিলেন।

অপর পক্ষে, এক কালের দরদী বিদ্যাসাগরও মাইকেলের ব্যাপারে খুব তিক্ত এবং বিরক্ত হয়েছিলেন। বঙ্গ সমাজের অত্যুজ্জ্বল তারকা হলেও, বিষয়বুদ্ধি-বর্জিতকবিকে আর্থিক ব্যাপারে ভরসা করা যায় না এবং তিনি সকল সংশোধনের ঊর্ধ্বে — বিদ্যাসাগর এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। বিদ্যাসাগর তাঁর সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন, তা ভালো করে জানা সত্ত্বেও, কবি সেই অপমান গায়ে না-মেখে করুণ আবেদন জানালেন তাঁর কাছে। কারণ তাঁর এ সময়ের বিপদ এবং প্রয়োজন ছিলো মান-অপমানের ঊর্ধ্বে।

আপনি আমার সবচেয়ে বড়ো উপকারী এবং বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে মহান। আপনি নিজেই যখন অমন খারাপ অবস্থায় আছেন, তখন আপনাকে আমার বিষয় নিয়ে বিরক্ত করে স্বার্থপরতার পরিচয় দিচ্ছি। আমার এ অপরাধ ক্ষমা করুন। কিন্তু আপনি যাঁর নাম ধারণ করছেন, তিনি ছাড়া আমাকে সাহায্য করার মতো আর কেউ নেই। আপনার নাম শুনে এখন আমার বেশির ভাগ পাওনাদার আমার সুবিধের কথা বিবেচনার করার জন্যে একমত হয়েছেন। এখন প্রচণ্ড তুফানের মধ্যে বক্ষা পাওয়ার মতো এক টুকরো ভূমি আমি সামনে দেখতে পাচ্ছি। এই অবস্থায় আমি যখন চিন্তা করি যে, মাত্র দু হাজার টাকার জন্যে এসবই হারাতে হবে এবং আমাকে ডুবে মবতে হবে, তখন আমি মরমে মরে যাই। আমার পুরোনো বন্ধু এবং রক্ষাকর্তা হিশেবে আপনি কি চাইবেন যে, আমার সর্বনাশ হোক? আপনি যদি রাজীবের সঙ্গে দেখা করে আপনার প্রদীপ্ত বাকপটুতা দিয়ে আমার প্রতি তাঁর পুরোনো ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারেন, তা হলে তিনি আপনার কথা না-শুনে পাববেন না — যদিও জানি আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা এখন লজ্জা এবং দুঃখের কাছে নতি স্বীকার করেছে। তাঁর কাছে দু হাজার টাকার ধার কি? আমার বাড়িওয়ালা আর এক মুহুর্তও দেরি করতে রাজি নয়। তা ছাড়া, আমার ছোটোখাটো পাওনাদারেরাও আমার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। দু হাজার টাকা পেলে আমি বেচে যাবো। তা হলে আমি অবিলম্বে আরও ছোটো একটা বাড়িতে চলে যাবো এবং খুব কম টাকাতে সংসার চালাতে চেষ্টা করবো। আমার আগামী কাল বিকেলের মধ্যেই এই টাকাটা দরকার। তা না হলে আমার ভাগ্যে আছে পালানো অথবা তার চেয়েও খারাপ কিছু। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যে, আমার এই চিঠি যেন আপনার কোমল অন্তরে একটি অঙ্গহৃদয়ের আর্তির মতো শোনায়।১১২

এ চিঠিতে যে-রাজীবের কথা উল্লেখ করেছেন, আগেই লক্ষ্য করেছি, তিনি কাশিমবাজার মহারানী স্বর্ণময়ীর এস্টটের দেওয়ান। বিধবাবিবাহ বাবদে যে-ঋণে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে ১৮৬৯ সালে বিদ্যাসাগর এরই মাধ্যমে মহারানীর কাছে তিন বছরের জন্যে বিনা সুদে সাড়ে সাত হাজার টাকা প্রার্থনা করেন। রাজীবলোচনমহারানীর অনুমতি নিয়ে এই টাকা দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, বিদ্যাসাগর যখন পারবেন তিনি যেন তখন টাকা শোধ দেন।১১৩ রাজীবের দয়ালু হৃদয় এবং তার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠতার কথা মাইকেল জানতেন। সেই সূত্রেই তাঁর কাছ থেকে ঋণ জোগাড় করে দেবার অনুরোধ জানান।

চিঠির ভাষা থেকে সহজেই বোঝা যায়, কবি কী সীমাহীন বিপদে পড়ে এ চিঠি লিখেছিলেন। পাঁচ বছর আগে ধার শোধ নিয়ে যে-তিক্ততা হয়েছিলো, তিনি অথবা বিদ্যাসাগর কি তা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলেন? বস্তুত, মরিয়া হয়ে তিনি এ চিঠি লিখেছিলেন। কে জানে ধারের ভয়ে পালিয়ে যাবার কথা লেখার সময়ে চকিতে তাঁর মৈনাকগিরি এবং দুর্যোধনের পালানোর উপমা মনে পড়েছিলো কিনা! কে জানে মনে পড়েছিলো কিনা প্রথম যৌবনের সেই দর্পিত উক্তি — রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে টাকা গুনে ব্যয় করে না। সেই দিন আর এই দিন! আজ চরম শোচনীয় অবস্থায় মাত্র দুহাজার টাকা ধারের জন্যে কী আকুল আবেদন! কিন্তু তাঁর প্রযোজন আত্যন্তিক হওয়া সত্ত্বেও, এ চিঠি করুণাসাগর বিদ্যাসাগরেব হৃদয়ে কোনো করুণার উদ্রেক করতে পারেনি। বিদ্যাসাগর নিজেও এ সময়ে শারীরিক, সাংসারিক এবং আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। হতে পারে, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি সাহায্য দানের উদ্যোগ নিতে পারেননি। তবে তিক্ততা যদ্দুর সম্ভব ঢেকে রেখে কৰিকে তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর (১৮৭২) তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন — তাঁকে উদ্ধার করা তাঁর সাধ্যের বাইরে।

আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি এবং দুঃখের সঙ্গে এটা আমার মেনে নিতে হয়েছে যে, আপনার বিষয়টা একেবারে নৈরাশ্যজনক — আমি অথবা অন্য যে কেউ — তার যদি না অনেক টাকা থাকে — যতোই কঠোরভাবে চেষ্টা করিনে কেন, আপনাকে রক্ষা করা যাবে না। জোড়াতালি দিয়ে আপনার সমস্যার সমাধান করার পক্ষে বড্ডো দেরি হয়ে গেছে। আমার শরীর মোটেই ভালো নেই এবং আমি আর লিখতে পারছিনে।১১৪

বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে লেখাপড়া শিখলেও, ব্যক্তিগত চেষ্টায় ইংরেজি ভালো করে শিখেছিলেন। তবে সেকালের বেশির ভাগ নব্যশিক্ষিতদের মতো তিনি বাঙালিদের কাছে ইংরেজিতে চিঠি লিখতেন না। এমন কি, সাহেব মাইকেলকেও দু-একবারের বেশি ইংরেজিতে লেখেননি। কিন্তু ওপরের চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। সুরেশচন্দ্র মৈত্র হতো ঠিকই বলেছেন — এ চিঠিতে যে-নিষ্করুণ বক্তব্য ছিলো, তা যাতে যদুরকম মর্মান্তিক শোনায়, পরদেশী ভাষার ব্যবহার সেই উদ্দেশে।১১৫ কিন্তু ইংরেজি ভাষার আপাতমধুর প্রলেপ থাকলেও, চিঠি পেয়ে কবি কম মর্মাহত হয়েছিলেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং উল্টোটাই মনে হয়। বাল্যবন্ধুরা কেউ নন, এমন কি, গৌরদাস বসাকও নন — জীবনের শেষ দিকে একজন লোকই ছিলেন যাঁর কাছে কবি সব সংকোচ এবং আত্মমর্যাদা ভুলে গিয়ে সাহায্য চাইতে পারতেন — সেই বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে এই চিঠি পেয়ে তিনি আন্তরিকভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন। তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিলেন না — যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিলো না — বিদ্যাসাগরকে তিনি গণ্য করতেন তাঁর আত্মীয়রূপে। ভার্সাই থেকে তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, তা থেকে মনে হয়, তাঁর কাছে তিনি রীতিমতো আবদার করতে পারতেন। সেই বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মর্মান্তিক কষ্ট পাওয়াই স্বাভাবিক। এর পর অনাহারে, অর্ধাহারে এবং অযত্নে তিনি মারা গেছেন, কিন্তু আর কোনো দিন তাঁর কাছে সাহায্য চাননি। তিনি বিপজ্জালে আপদমস্তক আটকা পড়েছিলেন বটে, কিন্তু সামান্য আত্মসম্মান বোধ এবং অভিমান তখনো অবশিষ্ট ছিলো।

পঞ্চকোট থেকে ফেরার পর কবি আরও ন মাস বেঁচেছিলেন। এ সময়ে তিনি কী করতেন, পাঁচ সদস্যের সংসার কি করে চলতো, তাঁর বন্ধুরা কতোটা খোঁজ-খবর নিতেন — তার কোনো বৃত্তান্ত জানা যায় না। যোগীন্দ্রনাথ বসু তাঁর জীবনী লিখেছিলেন কবি মারা যাবার মাত্র কুড়ি বছর পরে। তখনো কবির স্মৃতি হারিয়ে যায়নি। তখনো তাঁর বন্ধুরা সবাই জীবিত। কিন্তু তাঁরজীবনের সবচেয়ে অন্ধকার এই অধ্যায়ের কোনো বিস্তারিত বিবরণ যোগীন্দ্রনাথ উত্তর কালের জন্যে রেখে যাননি। কেবল ছোটোখাটো মন্তব্য থেকে জানা যায়, তাঁর স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙ্গে পড়ছিলো। গলায় ঘা দেখা দিয়েছিলো। মাঝেমধ্যে রক্ত পড়তো গলা থেকে। জ্বর হতো কখনো কখনো। যক্ষ্মা অথবা গলার ক্যান্সার হয়েছিলো কিনা, জানা যায় না। যকৃতের সিরোসিস থেকেও এমন লক্ষণ দেখা দেওয়া সম্ভব। তবে যে-রক্তচাপ এবং হৃদবোগ আগেই দেখা দিয়েছিলো, এ সময়ে তার অবনতি হয়। ভালো করে নড়াচড়া করার ক্ষমতাও তাঁর লোপ পেয়েছিলো। পেটে এবং পাযে জল জমতে থাকে। কিন্তু শরীর যতো অপটুই হোক না কেন, ছোটোখাটো মামলা-মকদ্দমা হাতে এলে, এ সময়েও অনিবার্য কারণে তা না-নিয়ে পারতেন না। ওদিকে, বেনিয়াপুকুর রোডের যে-বাড়িতে ছিলেন, মাসের পর মাস ভাড়া শোধ করতে না-পারায়, সম্ভবত তা-ও ছেড়ে দিয়ে হয়। শুরু করেছিলেন স্পেন্সেস হোটেল দিয়ে, শেষ পর্যন্ত জায়গা হলো এন্টালির বস্তিতে। শুরু করেছিলেন ছহাজার টাকার আশা নিয়ে, শেষ করলেন সম্ভবত দু-এক শো টাকার ভরসা করে। য়োরোপ থেকে ফিরে কাজ শুরু করেছিলেন অফুরন্ত জীবনীশক্তি নিযে, সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে — মাত্র ৪৮ বছর বয়সে সেই জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে ফেললেন। কখনো বা তাঁর মনে পড়ে তরুণ বয়সে বিশ্ববিখ্যাত নাটকে পড়েছিলেন –

জীবন চলন্ত ছায়া — নির্বোধের উপাখ্যান এক-

আগাগোড়া লম্বক কোলাহলে ভরা –

অর্থ নেই কোনো

এতো আশা করেছিলেন, এতো স্বপ্ন দেখেছিলেন — বোঝার আগেই সব নিমেষে উবে গেলো! ডাক্তারের বলার আবশ্যক নেই — সময় যে ফুরিয়ে এসেছে — নিজে তা অনুভব করতে পারেন। মৃত্যুকে তিনি কি ভয় পান? একেবারে অন্তিম মুহূর্তে তিনি নাকি বলেছিলেন, ভয় পান না। কিন্তু জীবনকে যিনি অতো উপভোগ করতে চেয়েছিলেন, মৃত্যুর আশঙ্কা তাঁর জন্যে নিশ্চয় উল্লাসের কারণ ছিলো না। তদুপরি, নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে তিনি যেমনই অনুভব করুন না কেন, হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য দেখে নিশ্চিতভাবে ভয় পান –যতোটা হেনরিয়েটার জন্যে, তার চেয়েও বেশি সন্তানদের জন্যে। পঞ্চকোট থেকে ফিরে আসার কদিন পবেই কন্যা শর্মিষ্ঠার বয়স ১৩ বছর পুরো হয়। তার আগে জুলাই মাসে মেঘনাদের বয়স হয়েছিলো এগারো বছর। আর নেপোলিয়ানের বয়স প্রায় সাড়ে পাঁচ। এদের কে দেখাশোনা করবে? শর্মিষ্ঠা পৌছে গেছে বয়ঃসন্ধিতে — কে তার বিয়ে দেবে? অনুমান করা অসম্ভব নয় যে, নিদারুণ অনটন, রোগ-কাতর দেহ এবং সর্বোপরি সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ তাঁকে একান্তভাবে বিপন্ন করেছে। এ সময়ে তিনি সোনালি পর্বে তাঁরই লেখা কয়েকটি পঙ্‌ক্তি মনে করে থাকবেন:

বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে

একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে

নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ এ দুরন্ত রিপু

তেমতি দুর্বল দেখ কবিছে আমারে

নিরন্তর! হব আমি নির্ষ্মূল সমূলে

এর শরে!

এই পঙ্‌ক্তিগুলোর মধ্যে কেবল একটা কথা প্রাসঙ্গিক নয় — তাঁকে কোনো রিপু ধীরে ধীরে কিন্তু অব্যর্থভাবে দুর্বল করছিলো না, বরং স্বয়ংবিধাতাই যেন তাঁকে ঠেলে দিচ্ছিলেন চরম সর্বনাশের মুখে।

এই সর্বব্যাপী হতাশার মধ্যে বেঙ্গল থিয়েটার কম্পেনির তরফ থেকে একটি প্রস্তাব এলো তাঁর কাছে — একটি নাটক লিখে দেবার জন্যে।১১৬ বিনিময়ে কিছু টাকা পাবেন তিনি। সামান্য টাকা। কিন্তু তখন খুড়-কুটো যা পান, তাই আঁকড়ে ধরার মতো অবস্থা তাঁব। সুতরাং একেবারে অক্ষম শরীর নিয়ে রাজি হয়ে গেলেন নাটক লিখতে। অনেক বছর আগে কলকাতায় তাঁর সৃষ্টি-যজ্ঞের সময়েও তিনি কখনো কখনো মুখে মুখে বলে যেতেন আর তাঁর পণ্ডিত লিখে নিতেন। তবে তখন তার কারণ ছিলো ভিন্ন। এবারে লেখার জন্যে দরকারী ন্যুনতম শারীরিক শক্তিটুকুও অবশিষ্ট ছিলো না। সে জন্যে ডিকটেশন দিয়ে লেখাতে হলো মায়াকানন। এ নাটকের নাম বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। জীবন যে একটা মায়াকানন এবং সেখানে পূর্বনির্ধারিত কতোগুলো দৃশ্যে অভিনয় করাই মানুষের কাজ — এ পর্বে এসে তিনি তা ভালোভাবে অনুধাবন করেন। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য থেকে আরম্ভ করে তাঁর নাটক এবং কাব্যে তিনি যত্রতত্র বলেছেন নিয়তির অনিবার্য এবং অমোঘ গতির কথা। মায়াকাননে এসে আরও একবার দৈবশক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির বলিষ্ঠ সগ্রাম এবং পরিণতিতে তার অনিবার্য পরাজয়ের কথা বললেন। সুন্দ-উপসুন্দ, রাবণ-মেঘনাদের বিপুল বীরত্বও এই দৈবশক্তির কাছে হার মেনেছিলো। অজয় এবংরাজকুমারী ইন্দুমতী সেই অন্ধ নিয়তির কাছেই পরাজয় স্বীকার করে। যে-ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের পূজারী ছিলেন কবি নিজে, তা ধুয়ে-মুছে যায় অজয় এবং ইন্দুমতীর তাজা রক্তের ধারায়। ইন্দুমতী এবং অজয় উভয়ই পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের কাছে বিনা অপরাধে আত্মবিসর্জনে বাধ্য হয়েছিলো। যে- দেশে সেকালে বিয়ে হতো পিতামাতার ইচ্ছেয, সে দেশে মনোনীত পাত্রকে লাভ করার জন্যে পাত্রীর অথবা পাত্রীকে লাভ করার জন্যে পাত্রের আত্মাহুতি অসাধারণ ঘটনা। তবে মনোনীত জীবনসঙ্গী/ সঙ্গিনী লাভ কবার আদর্শ মাইকেলের কাছে ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র। এ নাটকের পাত্রপাত্রীরা তাই কোনো আপোশ মেনে নিতে পারেনি।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কৃষ্ণকুমারী রচনার এক যুগ পরে তিনি এই নাটক লেখার কাজ শুরু করেন। ততো দিনে তাঁর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিণতি এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এ নাটকে তাঁর প্রতিভার কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না। অবশ্য তার আংশিক কারণ তাঁর শারীরিক অক্ষমতা এবং মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা। যেভাবে তিনি এ নাটকের যবনিকা ফেলেছেন, তার মধ্যে কোনো রকমের সৃষ্টির সংযম লক্ষ্য করা যায় না। রাজকুমারী ইন্দুমতী এবং অজয়ের আত্মহত্যার পরেও নাটকের সমাপ্তি না-হওয়ায় মাইকেলের নাটকীয় বোধ সম্পর্কেই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কিন্তু শোনা যায়, এ নাটক তিনি নিজে শেষ করেননি। এই নাটক লেখার জন্যে তাঁকে যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে সেই থিয়েটার কম্পেনির কর্তারা নাটকটি নিজেদের ইচ্ছে মতো শেষ করেন। যেখানে শেষ করলে দর্শকরা সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন বলে তাঁরা ভেবেছিলেন, সেখানেই তাঁরা সমাপ্তি টেনেছিলেন। এ নাটকের ভূমিকায় লেখা ছিলো: ‘সংবাদ প্রভাকরে সহ-সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিশেষ পরিশ্রম করিয়া ইহার আদ্যোপান্ত দেখিয়া দিয়াছেন।’ তিনি কেবল নাটকের সমাপ্তিতে নয়, বানান এবং অন্যান্য ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করেছিলেন। এ নাটকে চলতি ক্রিয়াপদের বানান আগেকার বানান থেকে আলাদা। এই নাটকে কেবল একটি উজ্জ্বল দিক লক্ষ্য করা যায়: সে এই নাটকের ভাষা। তাঁর আগেরনাটক কৃষ্ণকুমারীর ভাষার সঙ্গে তুলনা করলেই মায়াকাননে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। মায়াকাননের সংলাপের ভাষা মুখের ভাষার কাছাকাছি। এমন কি, রাজা-মন্ত্রীর ভাষাও আগের মতো অতোটা গুরুচণ্ডালী মেশানো নয় — এনাটকে তা প্রায় আর-পাঁচজনের মতো সাধারণ। বস্তুত, এ নাটকে তাঁর পূর্ববর্তী বাংলা নাটকগুলোর সংলাপের আড়ষ্টতা অনেকাংশে অনুপস্থিত। তার বদলে এতে বেশ খানিকটা সাবলীলতা দেখা দিয়েছে। অবশ্য এ পরিবর্তন কবি নিজে এনেছিলেন, না কি ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপের ফল, তা জানার উপায় নেই। ভুবনচন্দ্র ভাষার এই পরিবর্তন করে থাকলে অবাক হবো না। কারণ, তিনি চলতি স্টাইলে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। অনেকে বলেন, কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁকে দিয়েই লিখিয়েছিলেন হুতোম প্যাঁচার নকশা।১১৭ কিন্তু এ ব্যাপারে সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রশ্নাতীত না-হলেও, ১৮৭০-এর দশকে তিনি সুরলোকে বঙ্গের পরিচয় গ্রন্থে যে-গদ্য লেখেন, তার সঙ্গে হুতোমের মিল অস্বীকার করা যায় না। অন্তত, তিনি যে হুতোম লিখতে পারতেন, এটা মেনে নিতে হয়। সেই যাই হোক, কৃষ্ণকুমারীর ভাষার সঙ্গে মায়াকাননের ভাষার তুলনা করলে মায়াকাননে এসে কবির ভাষা কতোটা সামনের দিকে এগিয়েছিলো তার অভ্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়:

কৃষ্ণকুমারী

রাজা। মহারাষ্ট্রের অধিপতির সঙ্গে একপ্রকার সন্ধি হবার উপক্রম হয়েছে। তিনি এই পত্রে অঙ্গীকার করেছেন, যে ত্রিশ লক্ষ মুদ্রা পেলে দেশে ফিরে যাবেন। দেবি, এ সংবাদে রাজা দুর্যোধনের মতন আমার হর্ষবিষাদ হলো। শক্রবলস্বরূপ প্লাবন যে এ রাজভূমি ত্যাগ কল্যে, এ হর্ষের বিষয় বটে; কিন্তু যেহেতুতে ত্যাগ কল্যে, সে কথাটি মনে হল্যে আমার আর এক দণ্ডের জন্যেও প্রাণ ধারণ কত্যে ইচ্ছা করে না। (দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া) হায়! হায়! আমি ভুবনবিখ্যাত শৈলরাজের বংশধর, আমাকে একজন দুষ্ট, লোভী গোপালের ভয়ে অর্থ দিয়া রাজ্যরক্ষা কত্যে হলো? ধিক্‌ আমাকে! এ অপেক্ষা আমার আর কি গুরুতর অপমান হতে পারে?

মায়াকানন

রাজা। (সজল নয়নে) মন্ত্রি! আমার মত অভাগা লোক এ পৃথিবীতে আর নাই। তুমি জানো যে, অজয়ের বিবাহ প্রসঙ্গ কবে আমি পঞ্চালপতিব সমীপে দূত প্রেরণ করেছি। জনরব রাজকন্যাকে নানা রূপে ও নানা গুণে ভূষিত করে। গত ল্য সায়ংকালে আমি অজয়ের নিকট এ প্রসঙ্গ করে সে একেবারে রাগান্ধ হয়ে আমায় বল্লে, ‘পিতা, আমার অনুমতি বিনা আপনি একৰ্ম কেন কল্লেন?’ অনুমতি! পিতারে কি কখনো এসব বিষয়ে পুত্রের অনুমতি নিতে হ্য? ইচ্ছা করে দুরাচারের মস্তকচ্ছেদন করে ফেলি? তা তুমি কি বল?

মায়াকানন লেখার কাছাকাছি সময়ে কবি তাঁর জীর্ণ দেহ নিয়ে আরও একটি কাজ হাতে নিয়েছিলেন। সে হলো: শিশুপাঠ্য কিছু কবিতা লেখার। ভার্সাইতে থাকার সময়ে তিনি লা ফঁতেনের কবিতার অনুকরণে যে-তিনটি কবিতা রচনা করেছিলেন, তাঁর এই শিশুপাঠ্য কবিতাগুলোও সেই ধরনের। হঠাৎ তিনি শিশুপাঠ্য কবিতা লিখলেন কেন, সে কৌতুহল অস্বাভাবিক নয়। এপর্যায়ে হঠাৎ তাঁর কবিত্ব তাঁকে বিশেষ করে প্রেরণা দিয়েছিলো, এমনটা মনে হয় না। তা হলে তিনি অন্য রকমের কবিতা লিখতেন। আমার ধারণা, মায়াকানলে মততা, কোনো প্রকাশক নগদ অর্থের বিনিময়ে এই কবিতা লিখে দেবার অনুরোধ করে থাকবেন। সেকালে বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার এবং দুর্গাচরণ গুপ্তের মতো অনেকে পাঠ্যপুস্তক লিখে প্রচুর টাকা করেছিলেন।১১৮ কবির পক্ষে সেই দৃষ্টান্ত দেখে উদ্বুদ্ধ হওয়া অসম্ভব ছিলো না। কিন্তু তিনি আগে এ পথে আসেননি। শিশুপাঠ্য কবিতা লিখে আর্থিকভাবে লাভবান হবার উদ্দেশে এই কবিতা রচনা করলে, তিনি তা আগেই করতেন। হতে পারে, তাঁর সাহিত্যিক অহঙ্কারের দরুন তিনি তখন এ পথে যাননি। কিন্তু অন্তিম সময়ে তিনি সেটুকুও ধরে রাখতে পারেননি।

১৮৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ কবির স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। যোগীন্দ্রনাথ বসু বলেছেন — ঢাকা থেকে ফেরার পর।১১৯ হেনরিয়েটার স্বাস্থ্যও। এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন, সত্যি সত্যি মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। অপরিমিত মদ্যপান করে মৃত্যুকে তিনি তরান্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পদধ্বনি শুনে, বিশেষ করে সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তিনি ব্যাকুল হযে থাকবেন। এতো আদরের দুই পুত্র এককালে বিলাসিতার মধ্যে মানুষ হয়ে শেষে কি অনাহারে মারা যাবে, অথবা ভিক্ষে করবে অন্যের দ্বারে? আর বয়ঃসন্ধিতে উপনীতা আদরের কন্যা শর্মিষ্ঠারই বা কি উপায় হবে? কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হেনরিয়েটাও শিউরে ওঠেন। এই পরিস্থিতিতে কবি মরিয়া হয়ে বালিকা কন্যার বিয়ে ঠিক করেন। যে-মাইকেল বিয়ের ব্যাপারে চিরদিন বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিস্বাল্ককে — মনোনীত জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনীকে বেছে নেবার নীতিতে, যে মাইকেল জীবনের একেবারে প্রান্তে উপনীত হয়েও নাটক রচনা করেছিলেন অজয় এবং ইন্দুমতীকে নিয়ে, তিনি এ পদক্ষেপ নিতে গিয়ে কতো বিচলিত বোধ করেছিলেন, তা কেবল অনুমান করা যায়। এ অসম্ভব প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন ছিলো। কিন্তু সম্মতি না-দেওয়া ছিলো আরও কঠিন। অভিভাবকহীন,সহায়-সম্বলহীন একটি কিশোরীর কি শোচনীয় পরিণতি হতে পারে, অবশ্যই তা বিবেচনা করে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। মে মাসের ৭ তারিখে মাত্র ১৩ বছর ৭ মাস ২২ দিন বয়সে একটি প্রতিশ্রুতিতে ভরা কিশোরীর বিয়ে হলো তার ঠিক দ্বিগুণ বয়সী একটি সামান্য-শিক্ষিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যুবকের সঙ্গে। বর এবং কনের বয়সের পার্থক্য বিবেচনা করেই বোধ হয় বিয়ের দলিলে পাত্রের বয়স লেখা হয়নি। তার বদলে লেখা হয়েছে — পরিণত বয়স্ক — of age।১২০ ছবি আঁকতেন এই যুবক। তবে ছবি এঁকে যেহেতু সংসার চালানো যায় না, সে জন্যে তিনি হাই কোর্টে অনুবাদের কাজ করতেন। (হাই কোর্টে তাঁর কোনো চাকরি ছিলো বলে মনে হয় না)। কোর্টেই কবির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়ে থাকবে। তা ছাড়া,ইনি বাস করতেন লাউডন স্ট্রীটের কাছেই। তাড়াহুড়ো করে যে-কিশোরীর বিয়ে হলো, তার পিতা একদিন অভিভাবক-মনোনীত একটি বালিকা-পাত্রীকে বিয়ে করার হাত থেকে বাঁচার জন্যে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, সমাজ, ধর্ম এবং আবাল্যের সুখের নীড় ত্যাগ করে পথে নামতে দ্বিধা করেননি। শর্মিষ্ঠার বিয়ে মাইকেলের পরাজয় স্বীকার করে নেবার চরম দৃষ্টান্ত।

মায়াকাননের নামপত্র

তিনি তখন নিতান্ত রিক্তহস্ত। কিন্তু নিজের শেষ সম্বল দিয়ে কন্যার বিয়ের আয়োজন করেছিলেন বলে মনে হয়। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রটি ছিলো ছাপানো। আর নিমন্ত্রণপত্রের শেষে ছিলো অতিথিদের জন্যে খাদ্য এবং পানীযের প্রতিশ্রুতি।১২১

শর্মিষ্ঠার বিয়ের ঠিক পর ভাঙ্গা মন আর অক্ষম দেহ নিয়ে সপরিবারে যান উত্তরপাড়ায়।১২২ প্রায় চার বছর আগে যেখানে উঠেছিলেন, এবারেও উঠলেন সেই একই জায়গায় — লাইব্রেরির ওপরতলায়। কিন্তু সেবার আর এবারের মধ্যে কতো পার্থক্য! সেবারে চোখে ছিলো অফুরন্ত স্বপ্ন! এবারে চোখে কেবল মৃত্যুপথযাত্রীর অন্তহীন হতাশার নিষ্প্রভ অলো। উত্তরপাড়ায় তাঁর আশ্রয়দাতাদের অন্যতম রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়। তিনি তাঁর স্মৃতি-কাহিনীতে জানিয়েছেন, এই যাত্রায় মাইকেল কতোদিন ছিলেন উত্তরপাড়ায়, কী করতেন সেখানে, তাঁর পরিবারের অবস্থা কেমন ছিলো। হেনরিয়েটার পারিবারিক পরিচয় বিষয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ করে তিনি যোগীন্দ্রনাথ বসুকে এবং তাঁর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে তিনসত্য দিয়ে বিভ্রান্ত করলেও, উত্তরপাড়ায় কবিকতোদিন ছিলেন, সে সম্পর্কে তাঁর স্মৃতি তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কবি সেখানে ছিলেন ছ সপ্তাহ।

এ সময়ে উত্তরপাড়ায় কবির জীবনযাত্রা এবংকার্যকলাপের যে-করুণবিবরণ পাওয়া তাতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তাঁর সেখানে না-গিয়ে প্রথমেই যাওয়া উচিত ছিলো আলিপুরের জেনারেল হসপিটালে। কারণ এ সময়ে তিনি এবং হেনরিয়েটা উভয়ই দারুণ অসুস্থ ছিলেন। কে বেশি, বলা মুশকিল। অনেক সময় তিনি আরাম কেদারায় বসে চোখ বুজে পড়ে থাকতেন।১২৩ বস্তুত, তিনি এ সময়ে মৃত্যুর দিন গুনছিলেন। তবে সেই সঙ্গে মনে মনে হয়তো একটা কঠিন হিশেব মেলাতে চেষ্টা করতেন — কী আশা করেছিলেন আর শেষ পর্যন্ত কী অর্জন করেছিলেন! তাঁর শারীরিক অবস্থা যে খুবই খারাপ — সে খবর তাঁর বন্ধুরা পেয়েছিলেন। এ বছরের গোড়ার দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিশেবে গৌরদাস বসাক বদলি হয়ে এসেছিলেন হাওড়ায়। তিনি এ সময়ে একাধিক বার উত্তরপাড়ায় গিয়ে মাইকেলকে দেখে আসেন। শেষ বার সেখানে তিনি যে-দৃশ্য দেখতে পান, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি তার বিবরণ দিয়েছেন:

মধুকে দেখতে যখন শেষ বার উত্তরপাড়া সাধারণ পাঠাগারের কক্ষে যাই, তখন আমি যে-মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখতে পাই, তা কখনো ভুলতে পারবো না। সে সেখানে গিয়েছিলো হাওয়া বদল করতে। সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিলো। মুখ দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছিলো। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়েছিলো। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মধু একটুখানি উঠে বসলো। কেঁদে ফেললো তারপর তার স্ত্রীর করুণ অবস্থা তার পৌরুষকে আহত করেছিলো। তার নিজের কষ্ট এবং বেদনা সে তোয়াক্কা করেনি। সে যা বললো, তা হলো: ‘afflictions in battalions.’ আমি নুয়ে তার স্ত্রীর নাড়ী এবং কপালে হাত দিয়ে তীরউত্তাপ দেখলাম। তিনিতীর আঙুল দিয়েতীর স্বামীকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিম্নকণ্ঠে ফুপিয়ে কেদে উঠলেন। বললেন, ‘আমাকে দেখতে হবে না, ওঁকে দেখুন, ওঁর পরিচর্যা করুন। মৃত্যুকে আমি পরোয়া করিনে।১২৪

বাল্যবন্ধুর অন্তিম দশা দেখে গৌরদাস স্বভাবতই বিচলিত বোধ করেন। তিনি যে তাঁর জন্যে বেশি কিছু করতে পারতেন, তা নয়। তবু তিনি তাঁকে অবিলম্বে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলেন। শুনলেন, পরের দিন–২০/২১ জুন (১৮৭৩) তারিখে কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা মধুনিজেই করে রেখেছেন। পরিবার নিয়ে কবি বজরায় করে পরের দিন কলকাতা যাত্রা করলেন।১২৫

হেনরিয়েটাকে ওঠানো হলো তাঁর জামাতা উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের বাড়িতে১২৬ — ইংরেজ আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ায় — ১১ নম্বর লিন্ডসে স্ত্রীটে।১২৭ আর কবি নিজের ওঠার মতো কোনো জায়গা ছিলো না। উত্তরপাড়ায় যাবার আগেই তিনি তাঁর এন্টালির বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। তিনি নিজে আশ্রয় পেলেন আলিপুরের জেনরেল হসপিটালে। দেশীয় ভদ্রলোকেরা তখনও হাসপাতালে ভর্তি হওয়াকে কালাপানি পার হওয়ার মতো শাস্ত্র-বিরুদ্ধ একটা অসাধারণ ব্যাপার বলে বিবেচনা করতেন। তাই এ হাসপাতাল ছিলো কার্যত বিদেশী আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জন্যে সংরক্ষিত। মনোমোহন ঘোষ এবং উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু তদবির করাতে এবং তাঁর নিজের সাহেবী পরিচয়ের দরুন তিনি এ হাসপাতালে শেষ কটা দিন কাটানোর অনুমতি পান।১২৮ তা ছাড়া, এ ব্যাপারে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক সূর্য গুডিব চক্রবর্তী এবং এই হাসপাতালের চিকিৎসক এবং এক সময়ে কবির ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডক্টর পামারের খানিকটা অবদান ছিলো বলে মনে হয়।

উত্তরপাড়ায় তিনি বিনা-চিকিৎসায় সময় কাটাচ্ছিলেন। নগেন্দ্রনাথ সোম লিখেছেন যে, হাসপাতালে আসার পর প্রথম দিকে শুশ্রুষা এবং ওষুধপত্রের দরুন তাঁর বোগ লক্ষণের খানিকটা উপশম হয়েছিলো।১২৯ তবে অচিরেই তাঁর স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির দিকে যায়। যকৃৎ, প্লীহা এবং গলার অসুখে তাঁর দেহ অনেক দিন আগেই জীর্ণ হয়েছিলো। কিন্তু যখন হাসপাতালে ভর্তি হন তখন যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিলো উদরী রোগ।১৩০ হৃদ্‌রোগও ছিলো তাঁর।

একদিন এক ‘সাহেব কবি’ গৌড়জনের জন্যে অকৃপণভাবে মধুচক্র নির্মাণ করেছিলেন — সেই মধুর স্বাদ তাঁরা পুরোপুরি গ্রহণ করতে অক্ষম হলেও, এই মধুচক্রের কথা বাঙালিদের কাছে অজানা ছিলো না। সেই কবি মারা যাচ্ছেন শুনেআলিপুরের হাসপাতালে মনোমমাহন ঘোষ, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সূর্য গুডিব চক্রবর্তী, এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকে এসেছিলেন তাঁকে দেখার জন্যে। তাঁর চরম দুরবস্থার খবর শুনেও এতো দিন যাঁরা খোঁজখবর নিতে পারেননি, তাঁদেরও অনেকে এসেছিলেন। রক্তের আত্মীয়তা সত্ত্বেও যাঁরা একদিন তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন, এ সময়ে তাঁদের মনেও করুণা দেখা দিয়েছিলো। শেষ কদিন তাঁকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের স্মৃতিচারণ থেকে মনে হয়, মারা যাচ্ছেন — এ কথা কবি ভালো করে অনুভব করতে পেরেছিলেন।১৩১ কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে তিনি ভালো হয়ে উঠবেন বলে স্বপ্ন দেখতেন। কল্পনা করতে ভালোবাসতেন বলে একেবারে অন্তিম দশায় পৌছেও যা অনিবার্য তাকে সহজে স্বীকার করে নিতে পারেননি। তাঁর ব্যয় করার — দরকার হলে — ধার করে ব্যয় করার এবং বদান্যতা দেখানোর প্রবণতাও তিনি এ সময়ে ত্যাগ করতে পারেননি। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন মনিরুদ্দীন। তাঁর এক সময়ের মুন্সি। সেই সুবাদে কবির কাছে তাঁর চার শশা টাকা পাওনা ছিলো। কবি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর কাছে কোনো টাকাপয়সা আছে কিনা। শুনলেন, আছে দেড় টাকা। সেই পয়সাই তিনি চাইলেন তাঁর কাছে। তারপর তা বকশিশ হিশেবে দান করলেন তাঁর শুশ্রষাকারিণী নার্সকে।১৩২ কেউ কেউ বলেন, টাকা তিনি চেয়েছিলেন মনোমোহন ঘোষের কাছে।১৩৩ কিন্তু যাঁর কাছেই টাকা চেয়ে থাকুন না কেন, ধার করে বকশিশ দেবার এই আচরণ সঙ্গতিপূর্ণ তাঁর সারা জীবনের আচরণের সঙ্গে।

হাসপাতালে তিনি ছিলেন সাত অথবা আটদিন। এ সময়ে তিনি কিছু সেবাযত্ন পেলেও, খুব মানসিক শান্তিতে ছিলেন বলে মনে করার কারণ নেই। পরিবার সম্পর্কে তাঁর দুশ্চিন্তা এবং হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ তাঁকে নিঃসন্দেহে খুব বিচলিত করেছিলো। এরই মধ্যে ২৬ জুন (১৮৭৩) তারিখে এক পুরোনো কর্মচারীর কাছে খবর পেলেন হেনবিযেটা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।১৩৪ তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩৭ বছর ৩ মাস ১৭ দিন। বয়ঃসন্ধিকালে মা মারা যাবার পর থেকে সুখে মুখ তিনি কমই দেখেছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত পরিবেশ ত্যাগ করে তিনি মাদ্রাস থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মাইকেলের ভালোবাসার টানে। চার্চে গিয়ে সেই ভালোবাসার কোনো স্বীকৃতি পর্যন্ত তিনি আদায় করতে পারেননি। বস্তুত, জীবনকে উপভোগ করার জন্যে তিনি যদি কবিকে জীবনসঙ্গী হিশেবে বরণ করে থাকেন, তা হলে মস্তো একটা ভুল করেছিলেন। তিনি অনেক দিন থেকে মুমূর্ষ ছিলেন। সুতরাং তাঁর মৃত্যুসংবাদ কবির কাছে খুব অপ্রত্যাশিত ছিলো না। তবু কবি ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন: বিধাতঃ, তুমি একই সঙ্গে আমাদের দুজনকে নিলেনা কেন?১৩৫ হেনরিয়েটার ভালোবাসা এবং নীরব ত্যাগের কথা অন্য সবার চেয়ে তিনিই ভালে করে জানতেন। তাই যতো অনিবার্য হোক না কেন, হেনরিয়েটার প্রয়াণে মৃত্যুপথযাত্রী কবি মর্মাহত এবং বিষণ্ণ হয়েছিলেন। এর ফলে তাঁর অসহায় যন্ত্রণা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি খুব উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন হেনরিয়েটার শেষকৃত্য নিয়ে। এর জন্যে যে-অর্থ লাগবে, তা কোথা থেকে আসবে? তাঁর তো কোনো সঞ্চয় নেই! কে আছে তাঁর, যে এই গুরু দায়িত্ব কাঁধে নেবে?

এরই মধ্যে মনোমোহন ঘোষ আসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কবি তাঁকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, ঠিকমতো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে কিনা। মনোনোহন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে দিয়ে জানান, সবই যথারীতি হয়েছে। জিজ্ঞেস করেন, বিদ্যাসাগর এবং যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এসেছিলেন কিনা। মনোমোহন তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, এদের খবর দেওয়া সম্ভব হয়নি।১৩৬ মনোমোহন নিজে দশ বছর ধরে হেনরিয়েটকে চিনতেন। যোরোপে থাকার সময়ে তাঁর কাছ থেকে অনেক সেবাযত্নও পেয়েছেন। সে জন্যে হেনরিয়েটার শেষকৃত্যের আয়োজন করাকে তিনি একটা নৈতিক দায়িত্ব বলে বিবেচনা করতেন। প্রবাসে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মাইকেল-পরিবারের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো।১৩৭ শেষ অবস্থায় তিনিও কবির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে কার্পণ্য করেননি। উত্তরপাড়ায় গিয়ে তিনি তাঁকে দেখে এসেছিলেন।১৩৮ মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত কবির আর-একটা প্রধান উদ্বেগের কারণ ছিলো তাঁর দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ। একটির বয়স বারো, অন্যটির ছয়। মনোমোহন এবং উমেশচন্দ্র সে সম্পর্কেও কবিকে আন্তরিকভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন। মনোমোহন বলেছিলেন, তাঁর সন্তানরা খেতে-পরতে পারলে কবির পুত্ররাও পারবে।১৩৯ এ প্রতিশ্রুতি মনোমোহন পরে যথাসম্ভব পালনও করেছিলেন।

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিলো না। জীবনের এই একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি এই আস্থার অভাব আর-একবার প্রমাণ করেন। তবে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কবির পারলৌকিক মঙ্গল নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে কবির চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা, বিশেষ করে চন্দ্রনাথ, তাঁকে এ সময়ে বার বার নাকি পরম ত্রাতা যীশু খৃষ্টের কথা মনে করিয়ে দেন।১৪০ পারলৌকিক মঙ্গলের ব্যাপারে তাঁদের এই উৎকণ্ঠা দিয়ে নিজেদের অজ্ঞাতে তাঁরা কবির প্রতি যথেষ্ট নিষ্ঠুরতা করেন বলেই মনে হয়। আঠাশে জুন তারিখে সমস্ত আশা-ভরসাহীন, রোগকাতর, বিন্ন কবি যখন মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে আছেন, তেমন সময়ে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন খৃস্টধর্ম অনুযায়ী তাঁর শেষ স্বীকারোক্তি আদায় করতে। তিনি কোন কোন পাপের কথা স্বীকার করে বিধাতার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, কেউ তা জানেন না। জীবনকে যিনি যদূর সম্ভব উপভোগ করতে চেয়েছিলেন, আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে সেই কবি কতোটা আকুল হয়েছেন তাও আমাদের অজানা। কিন্তু কৃষ্ণমোহন এবং চন্দ্রনাথ যখন তাঁকে জানান যে, তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং তাঁকে কোথায় সমাধিস্থ করা হবে, তা নিয়ে গোলযোগ দেখা দিতে পারে, তখন কবি যে-নির্ভীক উত্তর দিয়েছিলেন, তা আমাদের জানা আছে। তিনি বলেছিলেন:

মানুষের তৈরি চার্চের আমি ধার ধারিনে। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে তাঁর সর্বোত্তম বিশ্রাম-স্থলে লুকিয়ে রাখবেন। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্থ করতে পারেন — আপনাদের দরজার সামনে অথবা কোনো গাছ তলায়। আমার কঙ্কালগুলোর শান্তি কেউ যেন ভঙ্গ না-করে। আমার কবরের ওপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস।১৪১

কৃষ্ণমোহন এবং চন্দ্রনাথের আশঙ্কা অমূলক ছিলো, তা নয়। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করা কবির পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

২৯ জুন রোববার মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এলো। তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষী এবং সন্তানরা এলেন তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে। এমন কি, জ্ঞাতিদেরও একজন এসেছিলেন তাঁকে দেখতে।১৪২ জীবনের শেষ দু বছর তাঁর নিদারুণ দুর্দশায় সহায়তার হাত প্রসারিত না-করলেও, শেষ মুহূর্তে মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখে অনেকেই করুণায় বিগলিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্রামহীন এবং রোগজীর্ণ দেহ কবি আর ধরে রাখতে পারছিলেন না। বেলা দুটোর সময়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন চিরদিনের জন্যে।

কৃষ্ণমোহনদের আশঙ্কা অমূলক ছিলো না। তাঁর মৃত্যুর পর সত্যি সত্যি তাঁর শেষকৃত্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। কলকাতার খৃস্টান সমাজ তাঁর দীক্ষার ঘটনা নিয়ে ঠিক তিরিশ বছর আগে একদিন মহা হৈচৈ করলেও, মৃত্যুর পর তাঁকে মাত্র ছ ফুট জায়গা ছেড়ে দিতেও রাজি হলো না।১৪৩ ইংলিশম্যানের মতো পত্রিকাগুলো তাঁর মৃত্যুর খবর পর্যন্ত ছাপলো না — যদিও সে সপ্তাহে কলকাতায় মোট কজন দেশীয় এবং খৃস্টান মারা যান এবং আগের সপ্তাহের তুলনায় তা বেশি, না কম–সে পরিসংখ্যান নিয়েও আলোচনা করে।১৪৪ মিশনারিদের কাগজ — ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়ায় তাঁর মৃত্যুর খবর খুব সংক্ষেপে প্রকাশিত হলো। কিন্তু তাঁর কবিকৃতি নয়, বিশেষ করে যা এ পত্রিকার নজরে পড়লো, তা হলো — তাঁর জীবন যাপনে অভ্যাসগুলো ছিলো অনিয়মে ভরা আর তিনি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া, আর-একটি প্রসঙ্গ এ পত্রিকায় উল্লিখিত হয়েছিলো — তিনি তাঁর তিনটি সন্তানের জন্যে কিছু রেখে যেতে পারেননি।১৪৫ তাঁর প্রতি খৃস্টান সমাজ যে-মনোভাব দেখায়, তা অসাধারণ। বস্তুত, মৃত্যুর পরে মৃতের প্রতি এ বকমের আক্রোশের ঘটনা কৃচিৎ দেখা যায়। যাঁর সঙ্গে মাইকেলের কবিতার মিল না-থাকলেও, ব্যক্তিগত জীবনে অনেক মিল লক্ষ্য করা যায় — সেই বোদলেয়ারের মৃত্যুর পরেও তাঁর প্রতি অনেকের আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছিলো। তাঁর স্বীকারোক্তি নিয়ে, তাঁর কবিকৃতি নিয়ে অনেকে বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিকদের বেশির ভাগ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসেননি।১৪৬ কিন্তু কলকাতার খৃস্টানদের মতো ফরাসি সমাজ মৃতদেহ সৎকারে বাধা দেবার মতো এমন অসাধারণ এবং অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি।

দারুণ গ্রীষ্মের সময়ে তাঁর মৃত্যু হলেও, খৃস্টান সমাজের সৃষ্টি-ছাড়া আক্রোশের দরুন সেদিন এবং সেদিন রাতে তাঁর মরদেহ পড়ে থাকলো দুর্গন্ধ-ভরা নোংরা মর্গে।১৪৭ কৃষ্ণমোহন ছিলেন কলকাতার ধর্মযাজকদের মধ্যে একজন প্রবীণ সদস্য — যদিও তিনি এর অনেক বছর আগে থেকেই ধর্মযাজকের কাজ ছেড়ে দিয়ে বিশপস কলেজে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেছিলেন। মাইকেল মারা যাবার আগে অধ্যাপনা থেকেও তিনি অবসর নিয়েছিলেন। তিনি নিজে গিয়ে এ ব্যাপারে তদবির করলেন লর্ড বিশপ রবার্ট মিলম্যানের (১৮১৬-৭৬) কাছে।১৪৮ মিলম্যান এর ছ বছর আগে বিশপ হয়ে কলকাতায় আসেন। দেশীয়দের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। তিনি বাংলাসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় ভাষাও শেখেন। কিন্তু চার্চ প্রশাসন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তিনি আর্চবিশপসহ অনেকের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তা ছাড়া, তিনিতাঁর ধর্মযাজকদের কোনো বিতর্কিত বিষয়ে যোগদানে বাধা দিতেন। সুতরাং তিনি নিজে দুই খণ্ডে মাইকেলের প্রিয় কবি ত্যাসোর জীবনী লিখলেও (১৮৫০), পরের দিন সকালেও বিতর্কিত কবির মৃতদেহ খৃস্টানদের গোরস্থানে সমাহিত করার অনুমতি দিলেননা। ওদিকে, তাঁর স্বদেশবাসী তাঁকে গঙ্গার ঘাটে পোড়াবেন — তিনি তার পথ নিজেই রুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। সুতরাং আষাঢ় মাসের ভেপসা গরমের মধ্যে তাঁর অসহায় মরদেহ মর্গেই পচতে থাকে। তখন সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন একজন ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক। তিনি কবির মরদেহ সমাধিস্থ করার সংকল্প প্রকাশ করেন।১৪৯ প্রায় একই সময়ে অ্যাংলিকান চার্চের একজন সিনিয়র চ্যাপলেইন — রেভারেন্ড পিটার জন জার্বোও বিশপের অনুমতি ছাড়াই তাঁর দেহ সামাধিস্থ করার উদ্যোগ নেন।১৫০ ডক্টর জার্বো ছিলেন ৮৪ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে অবস্থিত সেইন্ট জেমসেস চার্চের প্রধান পাদ্রী। ১৮৬০ সালের জুলাই মাসে তিনি এই চার্চে তাঁর ধর্মযাজকের জীবন শুরু করেছিলেন। লর্ড বিশপের অপ্রসন্নতা পরোয়া না-করে তাঁর মৃতদেহ সৎকার করতে চেয়ে এই প্রবীণ এবং উচ্চশিক্ষিত ধর্মযাজক অসাধারণ সাহস দেখিয়েছিলেন।

৩০ জুন বিকেলে — মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে — কবির মরদেহ নিয়ে তাঁর ভক্ত এবং বন্ধুবান্ধবসহ প্রায় হাজারখানেক লোক এগিয়ে যান লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানের দিকে। সেকালের বিবেচনায় এই সংখ্যা কম নয়। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।১৫১ তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে কলকাতার বাইরে থেকেও অনেক লোক এসেছিলেন বলে জানা যায়। নানা ধর্মের এবং বর্ণের লোক ছিলেন এঁদের মধ্যে।১৫২ অবশ্য একদিন শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার নিদর্শন-স্বরূপ নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে কবি যাঁদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করেছিলেন, সেই বিখ্যাত লোকেদের কেউ এই ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন না।১৫৩ লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে এর চার দিন আগে হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো। কবির জন্যে কবর খোঁড়া হয় তাঁর কবরের পাশে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যখন নিশ্চিতভাবে হতে যাচ্ছে, মোটামুটি তেমন সময় লর্ড বিশপের অনুমতি এলো। কিন্তু অ্যাংলিকান চার্চের অন্য কোনো পাদ্রী অথবা নামকরা ধর্মীয় নেতা তাঁব শেষকৃত্যে এসেছিলেন বলে জানা যায় না। কৃষ্ণমোহনও নন। অনেক পাদ্রী বরং তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। ডক্টর জার্বোই তাঁব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা করেন। গোরস্থানের রেজিস্টারে তাঁর নাম লেখা হলেও, অ্যাংলিকান চার্চের বেবিয়াল রেজিস্টারে তাঁর নাম পর্যন্ত উঠলো না।১৫৪ (লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে যে-চার্চের কাগজপত্র আছে, তাতে কবিকে অথবা হেনরিযেটাকে সমাধিস্থ করার কোনো তথ্য নেই।) কিন্তু তাঁর ব্যাপটিজমের তথ্য এই রেজিস্টারে আছে।

কলকাতায় যে-ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজ বাস করতো, তাদের মধ্যে বিবেক বিসর্জন দিয়ে রাতারাতি ধনী হবার দৃষ্টান্ত থেকে আরম্ভ করে ধর্মহীনতার বিবিধ দৃষ্টান্ত কিছু কম ছিলো না। বাংলা গদ্যের অন্যতম পথিকৃৎ হেনরি পিটস ফরস্টার অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে এক দশকের বেশি ঘর করেছিলেন। তাঁর সন্তানরা সবাই এই পরস্ত্রীর গর্ভে জন্মেছিলো। আনুষ্ঠানিক ধর্মে তাঁর সামান্যতম আস্থা ছিলো, এমন কোনো প্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও, ১৮১৫ সালের সেপ্টেম্বরে১৫৫ তিনি যখন কলকাতায় মারা যান, তাঁকে সমাধিস্থ করার প্রশ্ন নিয়ে কোনো মতান্তর দেখা দেয়নি। খুনী, ধর্ষণকারী, অজাচারী, অধর্মাচারী, অবিশ্বাসী — কাউকে সমাধিস্থ করার জন্যে কোনো ধর্মযাজককে লর্ড বিশপের কাছে ধর্ণা দিতে হয়নি। এমন কি, কবি জীবনসঙ্গিনী শ্বেতাঙ্গিনী হেনরিযেটারকে সমাধিস্থ করার সময়েও কোনো বাধা আসেনি। তা হলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো একজন বিখ্যাত ব্যক্তির ভাগ্য এমন প্রতিকূল হলো কেন? তাঁর সম্পর্কে প্রাণনাথ বিশ্বাস অথবা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো যে-খৃস্টানদের স্মৃতিচারণ পাওয়া যায়, তা থেকে এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। তাঁরা বরং প্রমাণ করতে চেয়েছেন, মাইকেল শেষ পর্যন্ত কি রকম আন্তরিক যীশু-বিশ্বাস নিয়ে মারা যান। তা হলে? লর্ড বিশপ পর্যন্ত তাঁকে সমাহিত করার ব্যাপারে দ্বিধা করেন কেন?

ব্যারিস্টারি পাশ করার পর, তিনি যখন আইন-ব্যবসা শুরু করার জন্যে হাই কোর্টে আবেদন কবেন, তখন তাঁকে গ্রহণ না-করার জন্যে বিচারকদের মধ্যে প্রবল মনোভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজে নিশ্চয় আরও শত শত লোক ছিলেন, যাঁরা এই বিচারকদের মতো তাঁর প্রতি সমান অথবা আরও বেশি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। মাইকেল মদ্যপান করে মাঝেমধ্যে বেসামাল হয়ে পড়তেন, তিনি কখনো কখনো রূঢ় আচরণ করেন — বিচারকরা তাঁদের গোপন রিপোর্টে এ কথা লিখেছিলেন। কলকাতার হাজার হাজার ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্পর্কেও এই মন্তব্য কি করা যেতো না? তা হলে মাইকেল সম্পর্কে শ্বেতাঙ্গদের এ রকমের বিরূপতার মূল কারণটা কি?

আমার ধারণা, তাঁর বিরুদ্ধে অন্য যেসব অভিযোেগই থাক না কেন, তিনি যে-শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করেছিলেন অথবা শ্বেতাঙ্গিনীকে নিযে ঘর করেছিলেন — এটাকে শ্বেতাঙ্গরা বিবেচনা করতেন তাঁর অমার্জনীয় অপরাধ হিশেবে। সেকালে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে কেউ কেউ দেশীয় মহিলাদের বিয়ে করেছিলেন অথবা উপপত্নী রেখেছিলেন। সেটা যে ইংরেজরা ভালো চোখে দেখতেন, তা নয়। কিন্তু সেটা যদিও বা তাঁরা সহ্য করতে পারতেন, একজন শ্বেতাঙ্গিনীর পাণিপীড়ন করবে এক কালা আদমী — এটা তাঁবা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। ভূদেব মুখোপাধ্যায় এরকমের একটি ঘটনার উল্লেখ করেন তাঁর দিনলিপিতে। এতে তিনি লেখেন যে, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের এক মুসলমান বন্ধু একটি ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তার ফলে, এই বন্ধুর মতে, প্রতিটি ইংরেজ মনে করতো যেন, তিনি তাঁর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার সম্ভ্রমহানি করেছেন।১৫৬ মিশনারিরা, তাঁদের মতে, কৃষ্ণাঙ্গদের অন্তহীন আগুন থেকে বাঁচানোর জন্যে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাঁরা অন্তত বর্ণবিদ্বেষী হবেন না। কিন্তু বিশপস কলেজে থাকার সময়েও মাইকেল যথেষ্ট বর্ণবিদ্বেষ লক্ষ্য করেছিলেন — আগেই আমরা তা লক্ষ্য করেছি। লন্ডনে থাকার সময়েও তিনি সেখানে যে তীব্র বর্ণবিদ্বেষ লক্ষ্য করেছিলেন, হয়তো তারও অন্যতম কারণ ছিলেন হেনরিয়েটা! চতুর্থ অধ্যায়ে উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে বর্ণবিদ্বেষ সম্পর্কিত যে-গবেষণার উল্লেখ করেছি, তা থেকে দেখা যায়, মিশ্রবিবাহ সম্পর্কে সে সমাজের তীব্র বিরোধিতা ছিলো। তিনি এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করে, তারপর তাঁকে পরিত্যাগ করে অন্য একজন শ্বেতাঙ্গিনীকে নিয়ে ঘর কবছিলেন — এটাকে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজ আদৌ অনুমোদন করতে পারেনি। মৃতদেহের প্রতি কি কাবো বিদ্বেষ থাকে? না-থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু কবির মরদেহের প্রতি তাঁরা যে-অসাধারণ বিদ্বেষ দেখিয়েছেন, তা থেকে বোঝা যায, জীবিত মাইকেলকে তাঁবা আন্তরিকভাবে কতোটা ঘৃণা করতেন। তদুপরি, ঘটনাটা এতো তীব্র আকার নেয় শেষকৃত্যের দায়িত্বে নিযোজিত ধর্মব্যসায়ীদের জন্যে। যে-লোকটি চিরজীবন চার্চে যাননি, বরং চার্চের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছেন, এখন সুযোগ পাওয়া গেলো তাঁকে আচ্ছা ‘শিক্ষা’ দেবার।

সেকালের দেশীয় সমাজে তাঁর চারদিকে যাঁরা বাস করতেন, তাঁদের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক প্রতিভাবান। জনাবণ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে তাঁকে চোখে পড়ার মতো গুণাবলী তিনি প্রচুর পরিমাণে আয়ত্ত করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি একা যতোটা এগিয়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কেউ তা করেননি। বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব হিশেবেও তিনি জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দুতিন বছরে তিনি ঈর্ষার অযোগ্য যে-করুণ পরিণতি লাভ করেছিলেন এবং তাঁকে সমাধিস্থ করার ঘটনা নিয়ে যে-কুৎসিত নোংরামি দেখা দিয়েছিলো, তা থেকে তাঁর নিঃসঙ্গতার অভ্রান্ত প্রমাণ যাওয়া যায়। আগেই বলেছি, নিজের সমাজ থেকে নিজেকে তিনি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। তাঁর অসামান্য প্রতিভা এবংআকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস তাঁকে যে-সীমাহীন অহঙ্কার দিয়েছিলো, তাও তাঁর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। বিত্ত দিয়ে গত শতাব্দীতে অনেকেই জাতে উঠেছেন এবং সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছেন।১৫৭ যতোদিন মাইকেল সচ্ছল ছিলেন, ভোজ দিতেন, মদ্যপান করাতেন, বিনে পয়সায় মামলা করে দিতেন, ততোদিন দেশীয় সমাজে তাঁকে খাতির করার লোকের অভাব হয়নি। কিন্তু তিনি যখন নিঃস্ব রিক্ত হয়ে মৃত্যুর দিন গুনেছেন, তখন খুব কম লোকই তাঁর খবর নিযেছেন। তিনি যদি অনেক সঞ্চিত অর্থ বেখে মারা যেতেন, তা হলে সমাধিস্থ করার ব্যাপারে সম্ভবত এতোটা বিরোধিতা দেখা দিতো না।

*

নিঃসন্দেহে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে বড়ো কবি। এমন কি, এক শতাব্দীর ব্যবধানে আজও কবি হিশেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা কিছু হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মৃত্যুর ঠিক আগে এবং পরে তাঁর প্রতি বাঙালি সমাজ অবিমিশ্র প্রশংসা অথবা প্রীতি প্রদর্শন করেনি। সেকালের তিনজন সাহিত্য সমালোচক — রামগতি ন্যায়রত্ব, রাজরানারায়ণ বসু এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাইকেলের প্রতি অনুকূল এবংপ্রতিকূল মনোভাব অনুযায়ী তখনকার সমাজকে দুভাগে ভাগ করেছেন। এক দলকে বলেছেন মাইকেলের কট্টর অনুরাগী, যাঁরা কবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন; অন্য দলকে বলেছেন মাইকেলের গোঁড়া বিরোধী, যাঁরা কবির নিন্দায় মুখর হয়েছিলেন। তাঁদের বিবেচনায় কট্টর অনুরাগীরা বেশির ভাগ তরুণ এবং ইংরেজি-শিক্ষিত। আর গোঁড়া বিরোধীরা সমাজের রক্ষণশীল অংশ। রামগতি, রাজনারায়ণ এবং বঙ্কিমচন্দ্র — তিনজনই দাবি করেছেন যে, তাঁরা এই দু দলের কোনোটিতে পড়েন না।১৫৮ এ থেকে আমরা বুঝতে পারি — তাঁরা আসলে সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করে নিজেদের মধ্যপন্থী বলে চিহ্নিত করেছেন।

কিন্তু এই স্বঘোষিত মধ্যপন্থীদের মনোভাব বিশ্লেষণ করলেও দেখা যাবে যে, তা ছিলো যথেষ্ট প্রতিকূল। এই প্রতিকূলতা কেবল মাইকেলের ‘বিজাতীয়’ খৃস্টানি মনোভাবের জন্যে নয়, প্রতিকূলতার একটা বড় কারণ তাঁর সাহিত্যিক বিদ্রোহ। তিনি সাহিত্যব বাঁধা-ধরা পথে না-থেকে নতুন যে-পথ নির্মাণ করতে চেষ্টা করেন, অনেকেই তার সম্যক প্রশংসা করতে সমর্থ হননি। ভাষা এবং ছন্দ নিয়ে তিনি যে-পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন, তাঁরা তাকে নিন্দা করেছিলেন, কিন্তু ততোধিক নিন্দা করেছেন ভারতীয় পুরাণের তিনি যে-ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তাকে।

বঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর আগে। এতে রামগতি ন্যায়রত্ন মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা করে লেখেন:

ইহাতে কবি কবিত্ব, পাণ্ডিত্য, সহৃদয়তা ও কল্পনাশক্তির একশেষ প্রদর্শন কৰিছেন। আমি যে কবির তিলোত্তমা পাঠ করিতে বিরক্ত হইয়াছিলাম, সেই কবির সেই ছলোগ্রথিত মেঘনাদই যে কত আনন্দের সহিত পাঠ করিযাছি, তা বলিত পাবি না। … বর্ণনাগুলি পাঠ করিলে মনোমধ্যে দুঃখ, শোক, উৎসাহ, বিস্ময় প্রভৃতি ভাবেব কিরূপ আবির্ভাব হয়, তাহা বর্ণনীয় নহে। …ইনি কল্পনাদেবীব অক্লান্ত পক্ষের উপর আরোহণ করিয়া স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল — কোথাও বিরচণ করিতে ক্রটি করেন নাই। এই সকল গুণগ্রাম থাকায় মেঘনাল একটি উৎকৃষ্ট কাব্যমধ্যে গণ্য হইয়াছে।

এ পর্যন্ত প্রশংসা করে অতঃপর রামগতি মাইকেলে শব্দ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং ছন্দ ব্যবহারের নিন্দা করেছেন।

… দানিলু, চেতনিলা, অস্থিরিলা প্রভৃতি চক্ষুশলস্বরূপ নূতন ক্রিয়াপদের কিছুমাত্র ন্যূনতা নাই। তাহা ছাড়া, ‘দ্বরিদবদ-নির্ষ্মিত’, ‘মরি কিবা’, ‘হায়রে যেমতি’ ইত্যাদি কতকগুলি কথাব এত শ্রাদ্ধ হইযাছে, সেগুলি দেখিলে হাস্য সম্ববণ কবিতে পারা যায় না। … উৎকৃষ্ট কবিব রচনায যেরূপ কোমল এবং সর্বদা প্রচলিত শব্দেব প্রযোগ দ্বারা প্রাঞ্জলতা, মনোহারিতা, চিত্তাকর্ষকতা ও মধুরতা জন্মিয়া থাকে,ইহাতে তাহার কিছুই হয় নাই। কবি যতই গৰ্ব্ব করুন, এবংকৃতবিদ্যদল যতই তীহার সমর্থন করুন, অসঙ্কুচিত মনে বলিতে হইলে আমরা অবশ্যই বলিব যে, অমিত্ৰচ্ছন্দ আমাদের অথবা একটি বিশেষ দল ভিন্ন দেশেব কাহাবও প্রিয় হয় নাই।১৫৯

এই সমালোচনা থেকে বোঝা যায়, রামগতি কবির সাহিত্যিক বিদ্রোহ মেনে নিতে পারেননি। বিদ্যাসাগর-সহ সেকালের অনেক পণ্ডিতের পক্ষেই এটা মেনে নিতে সময় লেগেছিলো। এবং তা অস্বাভাবিক নয়। বস্তুত, রামগতির মতো অনেক সমালোচক, এমনকি সাধারণ পাঠক, তাঁর সাহিত্যের যথার্থ মূল্যায়ন করতে না-পারলেও, তিনি যে এক অসামান্য কবি — অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর কোনো কোনো রচনার — বিশেষ করে মেঘনাদবধ কাব্যের যতোগুলো সংস্করণ হয়েছিলো — তা থেকে এটা বোঝা যায়। সমকালীন সাহিত্যরুচির তুলনায় তাঁর সাহিত্য অনেক প্রাগ্রসর হওয়ায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছিলো।

কিন্তু রাজনারায়ণ বসুকবির ‘বিজাতীয়’ মনোভাব সম্পর্কে যে-সমালোচনা করেছেন, তা সাহিত্যক দৃষ্টিকোণ থেকে নয় এবং সাহিত্য সমালোচনায় তা প্রাসঙ্গিকও নয়। বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতায় রাজনারায়ণ কবির সামলোচনা করে বলেছেন: ‘জাতীয় ভাব বোধ হয় মাইকেল মধুসূদনেতে যেমন অল্প, অন্য কোন বাঙ্গালী কবিতে সেইরূপ হয় না।’ এই বিজাতীয় মনোভাবের জন্যে তিনি মাইকেলকে তখনকার বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবির আসন দিতেও কুণ্ঠিত বোধ করেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘তিনি বাঙ্গালা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি না হউন, তিনি একজন অসাধারণ কবি।’ ১৮৬০- এর দশকের শুরুতে তিনি যে কবির প্রশংসা করেছিলেন তাও তিনি প্রত্যাহার করেন — ‘যখন মাইকেল মধুসূদনের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়,… তখন তাঁহার অত্যন্ত পক্ষপাতী হইয়াছিলাম। কিন্তু এক্ষণে নব-প্রেমের মুগ্ধতা কমিয়াছে, এক্ষণে তাহার দোষসকল স্পষ্টরূপে অনুভব করিতে সমর্থ হইয়াছি।’১৬০

রাজনারায়ণের মতো ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ সমালোচক এবং পাঠকরা বিজাতীয় মনোভাব এবং আচার-আচরণের জন্যে কবিকে দু হাত বাড়িয়ে আপন বলে গ্রহণ করতে পাবেননি। এই জন্যেই তখনকার বাংলা পত্রপত্রিকাতাঁর প্রতি সীমিত শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলো। এসব সমালোচক তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়নে পুরোপুরি অথবা আশিংকভাবে ব্যর্থ হন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কারণকবিবস্বধর্মত্যাগ এবং বিজাতীয়’ মনোভাবও তাঁদের মূল্যায়ন এবং দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেছিলো।

‘সাহিত্যসম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র মাইকেল-বচনার সাহিত্যিক গুণাবলী বুঝতে পারেননি — এ কথা বলা যায় না। কবির মৃত্যুর দু বছর আগে Calcutta Review পত্রিকায় তিনি যে-মূল্যায়ন করেছিলেন, তাকে পুরোপুরি নিবাসক্ত মনে না-হলেও তাতে তিনি সসংকোচে মাইকেলকে বাংলা সাহিত্যে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু কবির মৃত্যুর পর বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তিনি যে-শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশ করেন, তাতে কবির প্রতি তাঁর যে-মনোভাব প্রকাশ পায় তাকে বড়ো জোর কবোষ্ণবলা যেতে পারে — যদিও তিনি এতে এক জায়গায় জয়দেবের পর মাইকেলকে সবচেয়ে বড়ো বাঙালি কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই যে-হৃদ্যতার অভাব তার কারণ কি কেবল কবির প্রতি সাহিত্যিক ঈর্ষা? নাকি মধুসূদন মাইকেল হয়ে সাহেবী পরিচয় বরণ করেছিলেন, সেই অপরাধও এর পেছনে কাজ করেছিলো? আসলে সেকালের সমাজ একজন ব্যক্তির মূল্য নিরূপণ করতো তার সঙ্গে আত্মীয়তা এবং/অথবা ধর্মীয়, জাতিগত, আঞ্চলিক- সম্পর্ক দিয়ে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের চেয়ে গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতাকে সে সমাজ বেশি মূল্য দিতো। এই সমাজ মাইকেলের গতানুগতিকতা-বিরোধী আচার-আচরণকেই বড়ো করে দেখেছিলো, তাঁর সত্যিকার কৃতির পরিমাপ করেনি। করার সাধ্যও তার পুরোপুরি ছিলোনা। কিন্তু কবির সৌভাগ্য, সমকালের অপ্রশস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্য সম্মান ষোলো আনা না-পেলেও কালজয়ী প্রতিষ্ঠা থেকে তিনি বঞ্চিত হননি।

মাদ্রাস থেকে কলকাতায় ফিরে তিনি যখন কলম হাতে তুলে নেন, তখন তাঁর যে-প্রস্তুতি ছিলো, সে রকমের বিশাল আয়োজন নিয়ে কোনো বাঙালি গত শতাব্দীতে সাহিত্য রচনা করেননি। এ শতাব্দীতেও করেছেন কিনা, সন্দেহ আছে। তিনি যা অর্জন করেছিলেন, তাও সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে অসামান্য। এক শতাব্দীর ব্যবধানে এখন নিবাসক্ত দৃষ্টিতে তাঁর সাহিত্যের দিকে তাকালে তাঁর অবদান পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্য মেঘনাদবধ রচনার সময়ে ছোটোখাটো মহাকাব্য লিখে হাত পাকাচ্ছেন বলে যে-মন্তব্য করেছিলেন, সেই পাকা হাতের মহাকাব্য তিনি বাংলা সাহিত্যকে দিতে পারেননি। সহজ বিজয় লাভ করে সোনার হরিণের লোভে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তিনি। নয়তো বাংলা সাহিত্যকে তিনি আরও কতোটা এগিয়ে দিতে পারতেন, আমরা তা কেবল অনুমান করতে পারি। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা আমরা দেখিনি। দেখেছি কেবল মানুষী দুর্বলতায় ভরা সেই সাহিত্যের রচয়িতাকে।

মধুসূদন জন্মেছিলেন এমন একটা সময়ে বঙ্গীয় সমাজে যখন চলছিলো ভাঙ্গাগড়ার প্রবল আন্দোলন। কে কতোটা নতুন যুগের বিত্ত এবং বিদ্যা অর্জন করে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে, তার জন্যে সেকালে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিলো। সেই যুগচিহ্ন বহন করেই তিনি মানুষ হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিভা এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশে সে যুগের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকেরই প্রবল প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর পরিপ্রেক্ষিতে যে-সব দোষগুণের কথা মনে পড়ে তার সবই অল্পবিস্তর তাঁর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিলো। রাজনারায়ণ দত্তও সেই সময়কার ফসল। গতানুগতিকতা তিনিও কম বিসর্জন দেননি। তিনিও চেয়েছেন, তাঁর পুত্র যেন নতুন যুগের ভোজে পুরোপুরি শরিক হতে পারেন। তার জন্যে যাবতীয় প্রাথমিক আয়োজন তিনিই করে দিযেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্য মূল্যবোধ পিতার চেয়ে মধু অনেক ভালো করে বুঝেছিলেন এবং আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। পুত্রের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস এবংপ্রত্যাশা সমসাময়িকতা থেকে এতো আলাদা ছিলো যে, পিতামাতা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি। বিদ্যাচর্চায় এবং আচার-আচরণে তরুণ বয়স থেকে তিনি তাঁর নিজস্বতা দেখিয়েছিলেন। জীবনযাপনে, ধর্মান্তর এবং বিবাহে, বিবাহোত্তর আচরণ এবং বস্তুবাদী ভোগলিপ্সায় তখনকাব সমাজ থেকে তিনি এভো স্বতন্ত্র ছিলেন যে, তাঁর চারদিকের লোকেরা তাঁকে প্রায় ভিন্ন গ্রহের মানুষ বলে বিবেচনা করতেন। আর কবি হিশেবেও তাঁর নিজের প্রত্যাশা ছিলো ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে ভিন্নতর। ‘রাজকণ্ঠের মালা’ নিযে তিনি আর তৃপ্ত থাকতে পারেননি। মালার সঙ্গে রাজকীয় ঐশ্বর্যও কামনা করেছেন।

উনিশ শতকের কলকাতা-কেন্দ্রিক উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে জাগরণের যে-জোয়ার এসেছিলো, ঐতিহাসিকরা তার নাম দিয়েছেন বঙ্গীয় রেনেসান্স — যদিও য়োরোপীয় রেনেসান্সের সঙ্গে এর অনেক কিছুতেই মিল ছিলো না। বৃহত্তব সমাজকেও এ রেনেসান্স প্রভাবিত করেছিলো সীমিত মাত্রায়। একদিক দিয়ে বিচার করলে মাইকেল ছিলেন এই রেনেসান্সের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফসল এবং মনেপ্রাণে হিউম্যানিস্ট। তিনি রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের মতো সংস্কৃত শাস্ত্র এবং সাহিত্য অনুবাদ করে সমকালীন সমাজ সংস্কার করার উদ্দেশে তাদের নতুন ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু তিনিও প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেছেন প্রগাঢ় আগ্রহ নিয়ে। সরাসরি অনুবাদ না-করলেও, পুরাণের ওপর ভিত্তি করে তিনি নির্মাণ করেছিলেন নতুন সাহিত্যের ইমারত। তাতে গতানুগতিক রীতিতে দেবতার মহিমা-কীর্তন ছিলো না। তার বদলে ছিলো দৈবশক্তির সঙ্গে অসহায় মানুষের অব্যাহত সগ্রামের কথা। সে সংগ্রামে মানুষ পরাস্ত হয় বটে, কিন্তু কবির সহানুভূতি থাকে সম্পূর্ণ মানুষের দিকে।

দুঃসাহস এবং হঠকারিতা দেখিয়ে তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন থেকে আরম্ভ করে মহাকাব্য, পত্রকাব্য, সনেট, নাটক এবং প্রহসন রচনা সবকিছুতে তাঁর এই মনোভাব প্রতিফলিত। এতে তিনি প্রচুর সাফল্যও লাভ করেছেন। ওদিকে, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি উজান পথে চলতে দ্বিধা করেননি। বরং প্রতিকূলতাকেই আহ্বান করেছেন সম্মুখ সমরে। কিন্তু খৃষ্টধর্ম গ্রহণ থেকে আরম্ভ করে শ্বেতাঙ্গিনী বিবাহ এবং ব্যারিস্টার হবার দুঃসাধ্য সাধনায় তিনি যখন তাঁর এই সহজাত ধৃষ্টতা এবং দুঃসাহস দেখিয়েছেন তখন সাফল্যের বদলে নেমে এসেছে করুণ ট্র্যাজেডি। তিনি পাশ্চাত্যের দিকে অসাধারণ মোহের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন এবং সেখানে দেখতে পেয়েছিলেন বারনের মতো গতানুগতিকতা-বিরোধী অসংখ্য দৃষ্টান্ত। তাঁদের আত্মঘাতী এবং জীবনকে নিবিড়ভাবে উপভোগ করার পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টান্ত তাঁর কাছে সবচেয়ে অনুকরণের যোগ্য বলে মনে হয়েছিলো। সে জন্যে তিনি এই পথে পা বাড়িয়েছিলেন দ্রুত তালে। বস্তুত, তাঁর চরিত্রের অন্তর্গত নিষাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দুর্ভাগ্যের যে-সলিলে তিনি ডুবে মরেছিলেন, সে তাঁর স্বখাত সলিল। নিয়তির কাছে তাঁর শোচনীয় পরাজয় তাঁর মহাকাব্যের নায়কের পরাজয়কেই মনে করিয়ে দেয়।

আরও একটা ব্যাপারে তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সুপরিচিত ব্যক্তিদের তুলনায় প্রাগ্রসর — তিনি ছিলেন দলছুট এবং আপোশহীন বিদ্রোহী। সবার থেকে আলাদা। সেকালের বহু শিক্ষিত ব্যক্তির মতো তিনি আধুনিকতা এবং গতানুগতিকতার মধ্যে আপোশ ঘটাতে চেষ্টা করতেন না। প্রথাবদ্ধতা — তা রীতিনীতি, আচার-আচরণ, ধর্মবিশ্বাস, মানবিক সম্পর্ক, পোশাক-পরিচ্ছদ যে বিষয়েই হোক না কেন, তিনি তা মেনে নিতে পারতেন না। এই প্রাগ্রসর চিন্তাধারা এবং ঐতিহ্য-বিরোধী আচার- আচরণের জন্যে সমকালীন সমাজকে তিনি আদর্শ হিশেবে গ্রহণ করতে পারেননি। অথবা সে সমাজও তাঁকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখেনি। সে সমাজ তাঁকে দেখেছিলো একটা বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব হিশেবে — মহাকাশে একটা বিশাল ধূমকেতুকে যেমন করে দেখে — কিন্তু আপন বলে বিবেচনা করেনি। সে কারণে, কলকাতাব অসংখ্য লোকের ভিড়েও তিনি নিতান্ত নিঃসঙ্গ এবং অসহায়। এই অসহায়তার মধ্যেই তাঁর প্রয়াণ।

উল্লেখপঞ্জী ও টীকাটিপ্পনী – কি ফল লভিনু হায়

পৃ ২৯৫

MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৩৭, HRP।

MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৩০, HRP।

পৃ ২৯৬

MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৮, HRP।

New Calcutta Directory for 1862, ‘Street Finder’.

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (৪র্থ সং; কলিকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষষৎ, ১৯৫৫), পৃ. ৭৪।

পৃ ২৯৭

বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর (দ্বিতীয় ওরিয়েন্ট সং; কলকাতা: ১৯৯১, প্রথম প্রকাশ ১৮৯৫), পৃ. ২৬৭।

পৃ ২৯৮

Bengal Directory for 1867, ‘Law’.

MMD to Sir Barnes Peacock, Cheif Justice, 30. 2. 1867, পত্রসংখ্যা ১২৯, HRP।

হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিশেবে যোগ দেওয়ার অনুমতি চেয়ে তিনি যে-আবেদন করেছিলেন, তাতে প্রথমেই জুড়ে দিয়েছিলেন দিগম্বর মিত্রের শংসাপত্র। বিদ্যাসাগরকে মার্চ মাসে যে-চিঠি লিখেছিলেন (পত্রসংখ্যা ১৩০, HRP) তাতে দিগম্বর মিত্র সম্পর্কে কোনো তিক্ততা নেই।

পৃ ২৯৯

১০ মাইকেলের আবেদন করা থেকে আরম্ভ করা থেকে আইন ব্যবসা করার অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত বিচারপতিদের মধ্যে যেসব আদানপ্রদান হয়, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রক্ষিত একটি নথিতে। “Documents in connection with application of Michael Madhusudan Dutt”, R319, Victoria Memorial, Calcutta.

১১ Justice J. B, Phear to Peacock, ঐ।

১২ Justice Norman to Peacock, ঐ।

১৩ ঐ।

১৪ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৩০, HRP।

পৃ ৩০০

১৫ lbid.

১৬ “Documents in connection with application of Michael Madhusudan Dutt”, R3197, Victoria Memorial, Calcutta. Also see MMD’s letters nos. 131 and 132 in HRP.

পৃ ৩০১

১৭ MMD to M. Ghosh, পত্রসংখ্যা ৯৩, HRP।

পৃ ৩০২

১৮ Bengal Directory for 1868, ‘Law’.

পৃ ৩০৩

১৯ মদ দিয়ে বন্ধুদের আপ্যায়নের ব্যাপারে তাঁর বিলাসিতার কথা তাঁর জীবনীকারেরা সবাই কমবেশি উল্লেখ করেছেন। কেউ গেলেই নাকি তিনি ভৃত্যকে “Give him a peg” বলে আদেশ দিতেন।

২০ যেমন, পত্রসংখ্যা ১৩৪। নিজেই বিদ্যাসাগরেব কাছে লিখেছেন যে, গলার এবং অন্য অসুখের কারণে শয্যাগত। তা ছাড়া ১৮৭১ সালে হেক্টর-বধের ভূমিকায় লিখেছেন যে, প্রায় চার বছর আগে অসুস্থতার কাবণে যখন কোনো কাজ করতে পারেননি, তখন এই গ্রন্থ রচনা করেন।

পৃ ৩০৪

২১ Onoocul Mukherji to Vidyasagar, ৪. 4. 1867. গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পূর্বোক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত, ৯৬৯।

২২ সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকায় বিয়ের সময়ে বলা হয় যে, টাকার লোভে এবং রাজদ্বারে প্রিয়পাত্র হওয়ার আশায় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিধবাকে বিয়ে করতে রাজি হন। — বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৬৬। কিন্তু এই তথ্য ঠিক নয়। শ্রীশচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের চাকরি পান বিয়ের এক বছর আগে। তদুপরি, মনে রাখা যেতে পারে যে, তিনি বিয়ে করেছিলেন মায়ের হুমকি সত্ত্বেও। তাঁর মা ভয় দেখিয়েছিলেন যে, শীশচন্দ্র বিয়ে করলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। আমার লেখা সমাজ সংস্কার ও বাংলা নাটক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য, পৃ. ৩৯-৪০।

পৃ ৩০৫

২৩ বর্ধমান থেকে মাইকেলকে বিদ্যাসাগর এই চিঠি লেখেন আনুমানিক ১৮৬৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে।

২৪ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৩৩, HRP।

২৫ Ibid, পত্রসংখ্যা ১৩৪, HRP।

২৬ পত্রসংখ্যা ১৩৩, HRP।

পৃ ৩০৬

২৭ দলিল নম্বর ১২, গিবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পূর্বোক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত, পৃ. ৯৭০-৭১।

২৮ গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৬৩।

২৯ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৩৪, HRP।

পৃ ৩০৭

৩০ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৩৭, HRP।

৩১ Versailles Municipal Archives, Ecclesiastical Document, no. , dated 25.4.1867.

৩২ পত্রসংখ্যা ১৩৭, HRP।

৩৩ ঐ।

পৃ ৩০৮

৩৪ মাইকেলকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি, তারিখ ৩ মার্চ ১৮৬৮।

৩৫ বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৯১।

পৃ ৩০৯

৩৬ বিদ্যাসাগর প্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ বিক্রি করেন আট হাজার টাকায়। – বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৯১।

৩৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৩৮, HRP।

পৃ ৩১০

৩৮ এ মামলার বাদী ছিলেন গোপীকৃষ্ণ গোসাঁই, বিবাদী গঙ্গাপ্রসাদ গোসই। বিস্তারিত বিবরণের জন্যে দ্রষ্টব্য: Bengal Law Reports, Vol. IV, 18679-70, ed. by H. Cowell and L. A. Goodeve (Calcutta: Thacker, Spink & Co., 1870).

৩৯ জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং মধুসূদন যখন হিন্দু কলেজে ছাত্র ছিলেন, তখন পড়ুয়া ছাত্র হিশেবে জ্ঞানেন্দ্রমোহন মধুসূদনের তুলনায় ভালো ফলাফল করতেন। ১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে মধু যে-শেষ পরীক্ষায় অংশ নেন, তাতে ইংরেজিতে ৫০এর মধ্যে মধু পেয়েছিলেন ৩০ নম্বর, কিন্তু জ্ঞানেন্দ্র পেয়েছিলেন ৪৯। মধু পেয়েছিলেন ৮ টাকার জুনিয়র স্কলারশিপ, কিন্তু জ্ঞানেন্দ্র ৩০ টাকার সিনিয়র স্কলারশিপ। – General Report on Public Instruction in the Bengal Presidency for 1842- 43 (Calcutta: G. H. Huttman, B. M. Orphan Press, 1843), p. vi.

৪০ এ মামলার বিবাদী ছিলেন উপেন্দ্রমোহন ঠাকুর। প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁর দৌহিত্র/দৌহিত্রাদের প্রত্যেকের জন্যে যথাক্রমে ৫০ হাজার এবং ২৫ হাজার টাকা রেখে যান। পিতৃব্য হরিমোহন ঠাকুরের পুত্রদের দেন ৬০ হাজার টাকা। ভ্রাতুষ্পুত্র যতীন্দ্রমোহন, সুবোধমোহন এবং ললিতমোহন ঠাকুর এবং তাঁদের জীবিত এবং ভাবী সন্তানদের জন্যেও অর্থ বরাদ্দ করেন। তাঁর কর্মচারীদেরও অর্থ দান করে যান। Ganedro Mohun Tagore Vs Upendo Mohun Tagore, in The Bengal Law Reports, Vol. IV, 1869-70, ed. by H. Cowell and L. A. Goodeve, pp. 103-28. Also see The Bengal Law Reports, Vol. IX, 1872 (Calcutta: Thacker, Spink & Co, 1872), pp. 377-416.

৪১ কলকাতা ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটিকে ১০ হাজার, কলকাতা নেটিভ হসপিটালকে ১০ হাজার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক পদের জন্যে ১০ হাজার টাকা রেখে যান।

৪২ এই আইনজীবীদের নাম: M, Wylie, A.G. Macpherson, C.W. Hatch and J.C. Michael.

পৃ ৩১১

৪৩ The Bengal Law Reports, Vol. IV, 1869-70, pp. 107-08.

৪৪ Ibid., pp. 127.

৪৫ Ibid., pp. 112-28.

৪৬ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৬, HRP।

৪৭ Englishman, 23 March 1869.

৪৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২১৫। যোগীন্দ্রনাথের মতে, এক থেকে দেড় হাজার টাকা, মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৩১২।

৪৯ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২০৩।

পৃ ৩১২

৫০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৮, HRP।

৫১ গৌরদাস বসাক ১০ অগষ্ট ১৮৬৯ তারিখে খুলনা থেকে কবিকে যে-চিঠি লেখেন,তা তেকে এই মনোভাব বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এতে তিনি লেখেন: I suppose your business leaves you little time for poetry; nothing will gladden me more than to hear your roaring success at the Bar like that of Dwarky, Sumboo or Ramapersaud. You have a greater genius and ought to take the shine out of them. – মধূ-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৩৫।

৫২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৬, HRP।

৫৩ MMD to Vidyasagr, পত্রসংখ্যা ১৩৯, HRP।

৫৪ Thacker’s Bengal Directory, 1868 (Calcutta: Thacker, Spink & Co., 1868), “Law Section.”

পৃ ৩১৩

৫৫ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২১৩।

৫৬ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২১৩। Hindoo Patriot পত্রিকায় তাঁর ব্যারিস্টারি সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়: nursed on the lap of poetry, he was not the man to suck the moisture of life from the dry bones of law. — মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪১২।

৫৭ Street to Fagan, 23.7. 1847, SPG Papers, C. Ind. 1/13/134.

পৃ ৩১৪

৫৮ মধসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪১৭।

৫৯ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২১৫।

৬০ হেনরিয়েটা ডীযেপে যে-হোটেলে ছিলেন, সেখানকার একটি বিল রক্ষা পেয়েছে এবং এই অসাধারণ বিলটির বয়ান নগেন্দ্রনাথ সোম তাঁর মধুস্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। (পৃ. ২০০) তা থেকে হেনরিয়েটা কিভাবে ছুটি কাটাতেন – সে সম্পর্কে আগ্রহব্যঞ্জক তথ্য পাওয়া যায়।

৬১ ঐ।

পৃ ৩১৫

৬২ উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি এ সময়ে তাঁকে ৮ পাউন্ড দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

৬৩ অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তিকে লেখা হেনরিযেটার পত্র, তারিখ ১৩. ৩. ১৮৬৯, মধুস্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৩৪।

৬৪ হেনরিযেটার পত্র, তারিখ ৩০. ৩. ১৮৬৯, মধুস্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৩৫।

পৃ ৩১৬

৬৫ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৮, HRP!

৬৬ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২০৬।

৬৭ ঐ, পৃ. ২৩৬; মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২০১।

পৃ ৩১৭

৬৮ Thacker’s Directory for Bengal, 1870, “Street Finder.”

৬৯ Thacker’s Bengal Directory, 1868, “Law Section.”

৭০ Thacker’s Directory for Bengal, 1870-এ তাঁর বাসস্থান এবং চেম্বারের ঠিকানা একই দেওয়া হয়েছে।

৭১ Thacker’s Directory for Bengal, 1870, “Law.”

৭২ উত্তরপাড়া থেকে চন্দননগরে যাবার কথা কবি নিজেই গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৮।

পৃ ৩১৮

৭৩ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২২৮।

৭৪ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৮, HRP।

পৃ ৩১৯

৭৫ Englishman, 13 June 1871.

৭৬ ঐ।

৭৭ Thacker’s Directory for Bengal, 1872, “Law.”

৭৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৭, HRP।

পৃ ৩২০

৭৯ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৯, HRP।

৮০ এই সংবর্ধনার খবর হিন্দু হিতৈষিণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। তারপর এই খববের ওপর ভিত্তি করে ২২ সেপ্টেম্বরের এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধুসূদন গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৯০।

পৃ ৩২১

৮১ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৫৭-৫৮।

৮২ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪২১।

৮৩ বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগে প্রদত্ত তারিখ, Oct.-Dec., 1871. মুদ্রণ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে এক হাজার।

৮৪ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪৯, HRP।

৮৫ হেক্টর-বধের উপহারপত্র।

পৃ ৩২২

৮৬ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৩, HRP।

পৃ ৩২৩

৮৭ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪১৯; মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৫২।

৮৮ এ সময়ে সূর্য গুডীব চক্রবর্তী মেডিকাল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।

৮৯ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৫২।

পৃ ৩২৪

৯০ Bengal Directory for 1872, “Street Finder.” .

৯১ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২১০।

পৃ ৩২৫

৯২ প্রথমবার কবি পুরুলিয়া পর্যন্ত যান। তাঁর সেই সংক্ষিপ্ত অবস্থানের সময়ে তিনি শহরের বাইরে গিয়ে পরেশনাথ পাহাড় দেখে কবিতা লিখেছিলেন — মনে করা শক্ত। কিন্তু তিনি যখন কয়েক মাস পঞ্চকোটে থাকেন, তখন এ কবিতা লেখা সম্ভব। তিনি এ সময়ে পরেশনাথ নিয়ে একটি এবং পঞ্চকোট গিরি নিয়ে দুটি কবিতা লিখেছিলেন। আগেই বলেছি, তিনি পাহাড় ভালোবাসলেও কখনো পাহাড় দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। সে জন্যে পরেশনাথ এবং পঞ্চকোট গিরিই তাঁর কল্পনাকে উস্কে দিয়েছিলো।

৯৩ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২১০-১১।

৯৪ ঐ, ২১১। এ বইতে সংশ্লিষ্ট ব্যাপটিজমের দলিলটিও ছাপা হয়েছে।

৯৫ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হযে জ্যোতিরঙ্গণ পত্রিকায় (নভেম্বর ১৮৭২) — ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন, পৃ. ৯৩।

পৃ ৩২৬

৯৬ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২১০।

৯৭ ঐ, ২১২-১৩।

৯৮ MMD to Raja Narendra Narayan Bhup, পত্রসংখ্যা ৫৩, HRP।

৯৯ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২১৫-১৬।

পৃ ৩২৭

১০০ পঞ্চকোটের নাতিদীর্ঘ বর্ণনা এবং কিংবদন্তী মেশানো ইতিহাস দেওয়া আছে তখনকার District Gazetteer-এ। H. Coupland, Bengal District Gazetteer, Vol. XXVIII (Calcutta: Bengal Secretariat Book Depot, 1911), pp. 53-54, 178-82, 187.

১০১ MMD to Raja Narendra Narayan Bhup, পত্রসংখ্যা ৫৩, HRP।

১০২ The Bengal Law Reports, Vol. 22, p. 532.

পৃ ৩২৮

১০৩ Thacker’s Bengal Directory, 1872, “Law Section.”

১০৪ এঁরা উভয়ে ছিলেন হাই কোর্টের প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ আইনজীবী।

১০৫ শ্রীনাথ দাস ছিলেন নাট্যকার উপেন্দ্রনাথ দাস, শিক্ষবিদ দেবেন্দ্রনাথ দাস এবং অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রনাথ দাসের পিতা। হাইকোর্টের নাম করা আইনজীবী। তাঁর যোগদানের তারিখ ১৮, ৪. ১৮৫৬।

১০৬ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২১৫।

১০৭ রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৭৫।

১০৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৫০; মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২১৬।

১০৯ বিদ্যাসাগরকে লেখা কৈলাসচন্দ্র বসুর চিঠি, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭২, বিহারীলাল সবকারের বিদ্যাসাগর গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৩৫-৩৬। এতে তিনি লেখেন: অদ্য রাত্রিতেই আমাকে পুরুলিয়ায় যাত্রা করিতে হইল।

১১০ ঐ, ২৩৬।

পৃ ৩২৯

১১১ ঐ।

১১২ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১৫৩, HRP।

১১৩ মহারানী স্বর্ণময়ীকে লেখা বিদ্যাসাগরের পত্র, বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৬৫। বিদ্যাসাগর এ চিঠি লেখেন মাহারানীর কাছ থেকে যে-ধার নিয়েছিলেন, তা শোধ দেবার সময়ে।

পৃ ৩৩০

১১৪ মাইকেলকে লেখা বিদ্যাসাগৱেব চিঠি, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৭২, মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২১৭।

১১৫ ঐ।

পৃ ৩৩২

১১৬ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪২২।

পৃ ৩৩৩

১১৭ সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড (১৪০১), পৃ. ৪৫০-৫১।

১১৮ বিদ্যাসাগরের প্রতিটি পাঠ্যপুস্তকের অনেকগুলো সংস্করণ হযেছিলো। ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত কয়েকটি বই এর সংস্করণের হিশেব এরকম: ১৮৭৪ সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে একত্রে লেখা শিশুশিক্ষার ৬৫তম সংস্করণ প্রকাশিত হয় (১০০০০ কপি); বিদ্যাসাগরের নিজের লেখা বোধোদয়ের ৪৬তম সংস্করণ (১০০০০ কপি); বর্ণপরিচয়ের ৪৩তম সংস্করণ (২০০০০ কপি); ভাষাবোধ ব্যাকরণের ৫৩তম সংস্করণ। জেমস লঙ লিখেছেন যে, ১৮৬৮ সালেও বিদ্যাসাগর প্রতি মাসে রয়্যান্টি বাবদ প্রায় এক হাজার টাকা পেতেন। -লঙের এই হিশেব কতোটা সঠিক, তা জানা নেই। তিনি সম্ভবত অন্যদের কাছ থেকে শুনে এই মন্তব্য করে থাকবেন। তবে এটাকে মোটেই অসম্ভব মনে হয় না। ১৮৬৬ সালের প্রথমার্ধে মাইকেল রয়্যান্টি বাবদ এক হাজার টাকা পেয়েছিলেন বলে বিদ্যাসাগরের কাছে লিখেছিলেন। মাত্র গুটি কতক কবিতা এবং নাটক থেকে তাঁর এ আয় হলে অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক থেকে মাসে এক হাজার টাকা আয় হওয়া অসম্ভব নয়। মদনমোহন বিদ্যালঙ্কারের লেখা পাঠ্যপুস্তরের সংখ্যা বিদ্যাসাগরের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু তিনিও পাঠ্যপুস্তক থেকে কম আয় করতেন না। দুর্গাচরণ গুপ্তের নিজের ছাপাখানা ছিলো। তিনি অভিধান-সহ কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরও প্রতিটি বই-এর অনেকগুলো সংস্করণ হয়েছিলো – গোলাম মুরশিদ, নারীপ্রগতির এক শো বছর (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩), পৃ. ৬১-৬২।

পৃ ৩৩৪

১১৯ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪২১।

১২০ 1.0. R., N/1/14/69

পৃ ৩৩৫

১২১ শর্মিষ্ঠার নিমন্ত্রণপত্র থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

১২২ যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন যে, এ সময়ে কবি উত্তরপাড়ায় গিয়ে দুতিন মাস ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪২৫! আর নগেন্দ্রনাথ সোমের মতে, মাইকেলে এপ্রিল মাসে উত্তরপাড়ায় গিয়ে সেখানে দেড় মাস করেন! – মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৫৯। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, কবি সেখানে যান এপ্রিল মাসে। – মধুসূদন দত্ত, পৃ. ৯৭। আসলে এই জীবনীকারেরা কেউই সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। কবি দুই পুত্র এবং হেনরিয়েটাকে নিয়ে উত্তরপাড়ায় যান ৭ মে তারিখে শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে দেবার দু-এক দিন পরে।

১২৩ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬১-৬২।

পৃ ৩৩৬

১২৪ গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৬৪।

১২৫ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২২১। নগেন্দ্রনাথ সোম (পৃ. ২৬৪) এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (পৃ.৯৭) ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, উত্তরপাড়া থেকে ফিরে কবি তিন সপ্তাহ নিজের বাড়িতে ছিলেন। এ তথ্য ঠিক নয়।

১২৬ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২২১।

১২৭ উইলিয়াম ফয়েডের ঠিকানা দেওয়া আছে Thacker’s Directory for Bengal, 1873-তে।

১২৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬৫।

১২৯ ঐ, পৃ. ২৬৬।

১৩০ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪১৯।

১৩১ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬৫-৬৬। বিশেষ করে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ এবং প্রাণনাথ বিশ্বাস এবং মনোমোহন ঘোষের স্মৃতিচারণের কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা যেতে পারে।

১৩২ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬৬।

পৃ ৩৩৭

১৩৩ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪২৮।

১৩৪ ঐ, পৃ. ৪২৭।

১৩৫ ঐ।

১৩৬ ঐ।

পৃ ৩৩৮

১৩৭ উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যাযের সঙ্গে কবি এবং তাঁর পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয় যোরোপে থাকার সময়ে। কবির যখন বারে ডাক পড়ে, তখন ক্ষেত্রমোহন দত্ত বেঞ্চারদের কাছে করিব বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তুলে তাঁর ক্ষতি করার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু উমেশচন্দ্র তাঁকে ভয় দেখানোয় ক্ষেত্রমোহন শেষ পর্যন্ত সে সাহস করেননি। (MMDto Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৭, HRP)। হেনরিয়েটা যখন ফ্রান্সে বাস করছিলেন এবং কবির কাছ থেকে অনিয়মিত টাকাপয়সা পাওয়ায় অভাবে সময় কাটাচ্ছিলেন, তখনো উমেশচন্দ্র তাঁকে ৮ পাউন্ড দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারেও তাঁকে সাহায্য করেন। সবশেষে সাহায্য করেন কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়।

১৩৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬২।

১৩৯ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪২৮; মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬৯।

১৪০ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬৯, ২৭৩।

১৪১ প্রাণনাথ বিশ্বাসের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৭৪-৭৫।

১৪২ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪২৯।

১৪৩ হিন্দু কলেজের এক তরণ ছাত্র – মধুসূদন দত্ত খৃস্টান হয়েছেন – এ খবর Bengal Harkaru থেকে আরম্ভ করে অনেকগুলি পত্রিকায়। সরকারী কর্মকর্তা, মিশনারি, এমন কি, ফোর্ট ইউলিয়ামের কর্মকর্তারা পর্যন্ত সহযোগিতা করেছিলেন। তা থেকে ইংরেজ সমাজেব উৎসাহ বোঝা যায়। কিন্তু সেই ছাত্র যখন বাংলা ভাষার তখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি এবং নাট্যকার এবং একজন ব্যারিষ্টার হবার পর মারা যান, তখন ইংরেজ পরিচালিত পত্রপত্রিকায় সে খবর বলতে গেলে প্রকাশিত হয়নি।

পৃ ৩৩৯

১৪৪ Englishman, 30 June – 6 July 1873.

১৪৫ Friend of India, 3 July 1873: “His habits were irregular and he squandered his patrimony.” তবে এতে উল্লেখিত হয়েছিলো যে, তিনি দেশের বিখ্যাত লোক ছিলেন। বাঙালিদের পরিচালিত ইংরেজ মিরর পত্রিকায় তাঁকে দেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল বুদ্ধিজীবী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো।

১৪৬ Baudlaire, p. 366-68.

১৪৭ নগেন্দ্রনাথ সোম অবশ্য লিখেছেন মর্গে কবির মৃতদেহ ‘পুষ্পচ্ছন্ন’ অবস্থায় ২৪ ঘণ্টার চেয়েও বেশি সময় ছিলো। – মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৭৬।

১৪৮ প্রাণনাথ বিশ্বাসের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৭৫।

১৪৯ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৭৪।

১৫০ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৭৭।

১৫১ ঐ, পৃ. ২৭৬।

১৫২ জে বিশ্বাসের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৭৭।

পৃ ৩৪০

১৫৩ হেনরিয়েটা মারা যাবার পর কবি যখন মনোমোহন ঘোষকে জিজ্ঞেস করেন বিদ্যাসাগর, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এবং দিগম্বর মিত্র এসেছিলেন কিনা, তখন মনোমমাহন বসু বলেছিলেন যে, তাঁদের খবর দেওয়ার সময় হয়নি। এ থেকে মনে হয়, এঁরা তখন কলকাতায় ছিলেন। কেশবচন্দ্র গাঙ্গলি, ভূদেব মুখোপাধ্যায় এবং প্রতাপচন্দ্র বাহাদুরও তখন জীবিত ছিলেন।

১৫৪ কলকাতার Eccleciastical Papers-এ হেনরিযেটা অথবা কবির মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই। কিন্তু তাঁদের দুটি সন্তান এবং কবির দীক্ষা গ্রহণের তথ্য আছে।

১৫৫ বিস্তারিত বিবরণের জন্যে দ্রষ্টব্যঃ গোলাম মুরশিদ, কালান্তরে বাংলা গদ্য (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯২), পৃ. ১০১-০৬।

পৃ ৩৪১

১৫৬ Tapan Raychaudhuri-র Europe Reconsidered (Delhi: Oxford University Press, 1989) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৫৩।

১৫৭ এর সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত রক্ষণশীল হিন্দুদের নেতা রাধাকান্ত দেব। নিম্নবর্ণের হওয়া সত্ত্বেও, তিনি বিত্ত এবং বিদ্যা দিয়ে কলকাতার হিন্দু সমাজের সর্বোচ্চ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। বিত্ত ও বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা লাভের প্রক্রিয়া বাঙালি সমাজে বস্তুত ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। এ সম্পর্কে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দিয়েছি আমার হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি গ্রন্থে (ঢাকা: অবসর, ২০০৬), পৃ. ১৫১-৫৩।

পৃ ৩৪২

১৫৮ রামগতি ন্যায়রত্ন এ সম্পর্কে লিখেছেন: বাঙ্গালাবিনোদীদিগের এক্ষণে দুইটি বিশেষ দল হইয়াছে — একদল লোক মেঘনাদের অতি-প্রশংসাকারী, — ইংরেজীতে কৃতিবিদ্যগণ এই দলে অধিক। ইহাদের মধ্যে অনেকে এরূপ আছেন যে, তাঁহারা মাইকেলের লেখা ‘ম’ বলিলেই ঘুসী উচাইয়া আসেন, ‘ন্দ্‌’ পর্যন্ত বলিবার অপেক্ষা রাখেন না। আর একদল না বুঝিয়াও অনেক নিন্দা করেন। আমরা এই দুই দলের নাম ‘গোঁড়া’ ও ‘নিন্দক’ রাখিলাম — আমরা স্বয়ং কপাটি খেলার ঘোলষাঁড়ের ন্যায় উভয় দলেই থাকিব।’ ‘মেঘনাদবধ কাব্য সমালোচনা’, দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ সম্পাদিত মধুসূদন সাহিত্যপ্রতিভা ও শিল্পী-ব্যক্তিত্ব গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৯।
রাজনারায়ণ বসু এ সম্পর্কে বলেছেন: মাইকেল মধুসূদনের যেমন গোঁড়াও অনেক, তেমনি শত্রুও অনেক।’ ‘এই বক্তৃতা করিবার পর আমি অবগত হইলাম যে, উপরে আমি যাহা বলিয়াছি, তজ্জন্য মাইকেল মধুসূদনের পক্ষ এবং বিপক্ষ উভয় পক্ষীয় লোকেরা আমার উপরবিরক্ত হইয়াছেন। ইহাতে কেবল এই মাত্র প্রমাণিত হইতেছে যে; আমি যাহা বলিযাছি, তাহা ঠিক বলিয়াছি।’ — বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (কলিকাতা: নূতন বাঙ্গালা যন্ত্র, ১৮৭৮), পৃ. ৩৫, ৩৬-৩৭।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও Calcutta Review পত্রিকায় (৫২ খণ্ড, ১০৪ সংখ্যা, ১৮৭১) Bengali Literature প্রবন্ধে নিজেকে মধ্যপন্থী বিবেচনা করেছেন।

১৫৯ রামগতি ন্যায়রত্ন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯-২০।

পৃ ৩৪৩

১৬০ রাজনারায়ণ বসু, বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা, পৃ. ৩৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *