৫. প্রবাসে দৈবের বশে

প্রবাসে দৈবের বশে

‘বিশ্বাস করো, প্রিয় বন্ধু, বাংলা একটি অসাধারণ সুন্দর ভাষা; এর পরিমার্জনের জন্যে দরকার কেবল প্রতিভাবান কয়েকজন লোকের। আমরা নিজেরা যেমনটা শিক্ষা পেয়েছি, সেই শিক্ষার মতো ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে এ ভাষার কথা সামান্যই জানা আছে, অথবা লোকেরা এ ভাষাকে কেবল ঘৃণা করতে শিখেছে, সেটা নিতান্ত ভ্রান্তি; এর আছে অসাধারণ মূল্যবান ভাষিক উপাদান। আহা, আমি যদি এই ভাষা চর্চায় আত্মনিযোগ করতে পারতাম! কিন্তু তুমি তো জানো জীবিকা উপার্জনের কোনো কাজ না-করে কেবল সাহিত্যিক জীবন যাপন করার মতো আর্থিক সঙ্গতি আমার নেই। আমি বড্ডো গবিব, বা বলতে পারো, চিরকাল গরিব অবস্থা মেনে নেবার মতো মনোভাব আমার নেই –আমি তার চেয়ে অনেকটা গর্বিত। তোমার যদি টাকা থাকে, তুমি তা হলে ‘বড় মানুষ’, তা না-হলে কে তোমাকে পোছে? আমরা এখনো একটা মর্যাদাহীন জাতি। আমাদের দেশের বড় মানুষ’ কারা? চোরবাগান আর বড়োবাজারের নামহীন লোকেরা। … আমার যদি সাহিত্যিক প্রতিতা থাকা সত্ত্বেও সাহিত্যের জন্যে তেমন কিছুনা-করে থাকি, তা হলে আমি যা করেছি, তা নিয়েই আমাদের জাতির সন্তুষ্ট থাকতে হবে, কারণ, সেই আমার সাহিত্যিক প্রতিভা পুরোপুরি লালন করার মতো সঙ্গতি আমার নেই।’বিলেত যাবার আসল কারণ গৌরদাসকে লেখা এই চিঠিতে কবি অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছেন।

বন্ধুদের কাউকে নিজের খ্যাতি রক্ষার, কাউকে টাকাপয়সা আদায়ের এবংকাউকে পরিবারের দিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব দিয়ে — আপাতদৃষ্টিতে সবরকমের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে — ৯জুন (১৮৬২) সোমবার সকাল বেলায় কলকাতা থেকে তিনি বিলেতের উদ্দেশ্যে পাল তোলেন। বয়ঃসন্ধি কাল থেকে আরম্ভ করে তিনি বিলেত যাবার ধ্যান করেছিলেন। অবশেষে ক্যান্ডিয়া জাহাজে চড়ে সেই স্বপ্নরাজ্যের উদ্দেশ্যে তাঁর যাত্রা।

তাঁর জাহাজ মাদ্রাসে গিয়ে পৌছে তিন দিন পরে — ১২ জুন তারিখে। স্মৃতি-ভরা মাদ্রাসকে দেখে তাঁর সমগ্র অন্তর বেদনায় মথিত হয়েছিলো, বলা বাহুল্য। প্রায় চার বছর ধরে হেনরিয়েটার সঙ্গে ঘর করলেও, রেবেকাকে তিনি ভুলতে পারেননি। তা ছাড়া, রেবেকার প্রতি মনোভাব যেমনই হোক না কেন, ছোটো ছোটো যে-সন্তানদের তিনি ফেলে গিয়েছিলেন — ব্যর্থা, ফিবি, জর্জ আর মাইকেল — তাঁদের জন্যে তাঁর মন কেমন উতলা হয়েছিলো, তা-ও শুধু অনুমান করা যেতে পারে। কবি মাদ্রাস ছাড়ার তিন মাসের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র মাইকেল মারা গেলেও ব্যর্থা ততোদিনে তেরো বছরের কিশোরী হতে চলেছে। ফিবি এগারো বছরের বালিকা। জর্জের বয়স দশ হতে বাকি এক মাস। কেমন হযেছে ওরা দেখতে! কী পড়ছে? কোন স্কুলে পড়ে? লেখাপড়ায় কেমন হয়েছে? কেমন করে চলছে ওদের সংসার? নানা প্রশ্নই তাঁর মনকে ব্যাকুল করে থাকবে। পাবলে একবার গিয়ে দেখে আসতেন হয়তো। মাদ্রাসে এই জাহাজ দুদিন ছিলো। তখন দূর থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন কিনা, কে জানে? তিনি কি এই দু দিনের মধ্যে একবারও মাদ্রাস শহরে গিযে স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো দেখে আসেননি? অথবা পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেননি? রিচার্ড নেইলর তখন উভটন কলেজের শিক্ষক। তাঁর সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ হয়নি? প্রমাণের অভাবে আজ আর নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সুখের বিলেতযাত্রার পথে তাঁর মন যে বারবার ব্যাকুল এবং ব্যথায় বিদীর্ণ হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কলকাতায় যাঁদের তিনি ফেলে এসেছিলেন, তাঁদের জন্যেও তাঁর ব্যাকুলতা কিছু কম ছিলো না।

মাদ্রাস ছেড়ে ক্যান্ডিয়া যতো এগিয়ে যেতে থাকে আরব সাগরের দিকে, তাঁর মন ততোই ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে উচ্ছসিত হয়ে থাকবে। গন্তব্য স্থানে পৌছতে এই জাহাজের প্রায় চার সপ্তাহ লেগেছিলো। জাহাজ গিয়ে প্রথমে নোঙ্গর করেছিলো এডেনে। তারপর লোহিত সাগর ধবে আরও এগিয়ে গিয়ে ছোট্টো সুয়েজ বন্দরে। সেখানে জাহাজ বদল করার পালা। (এর তিন বছর আগে সুয়েজ খাল তৈরির কাজ শুরু হয়েছিলো। কিন্তু সে কাজ শেষ হয় আরও সাত বছর পরে। সুয়েজ খালের উদ্বোধন করা হয় ১৮৬৯ সালে।) সায়েদ বন্দরে যাত্রীদের উঠতে হয় অন্য একটি জাহাজে — সিলোনে। ৬ জুলাই রোববার এই জাহাজ গিয়ে ভিড়েছিলো আলেকজান্দ্রিয়ায। যাত্রীরা তখন ঘুরে এসেছিলেন দু হাজার বছরের চেয়েও পুরোনো এই শহর। চার দিন পরে ৯ জুলাই রাতের বেলায় তাঁরা পৌঁছে যান মন্টায়। তার উত্তর দিকে মাত্র কয়েক শো মাইল দূরে গীস। এ দেশের সভ্যতার বিস্তারিত ইতিহাস এবং সাহিত্যের সঙ্গে কবির যে নিবিড় পরিচয় ছিলো, তেমন পরিচয় সহযাত্রীদের মধ্যে সম্ভবত কারো ছিলো না। মনে মনে যে-হোমারের জগতে নিরন্তর ঘুরে বেড়াতেন তিনি, সেখান থেকে তা বেশি দূরে ছিলো না। তাঁর প্রথম যৌবনেব নায়ক লর্ড বায়রন যেখানে মারা যান, তা-ও ছিলো বেশ কাছেই। অনুমান করি, তিনি সেই জগতের কথা ভেবে কখনো অতীতমুখো হয়েছেন, কখনো বা দিন দশেক পরে তিনি লন্ডনের রাজপথে ঘুরে বেড়াবেন — সেই কথা ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। বর্তমান এবং অদূর অতীত থেকে তাঁর মন বার বার সরে গেছে অনেক দূরে। তাঁর এই সময়কার মনের অবস্থা কেমন ছিলো তাঁর সামান্য আভাস পাওয়া যায় গৌরদাসকে লেখা একটি চিঠি থেকে। কলকাতা থেকে রওয়ানা হবার ঠিক এক মাস দুদিন পরে আফ্রিকার উপকূলের ধার দিয়ে যখন জাহাজ চলছিলো — তখন লিখেছিলেন এ চিঠি।

সিলোন জাহাজ থেকে তোমাকে কয়েকটা লাইন লেখার জন্যে বসেছি। কি বলবো ভাই, এ জাহাজটাকে মনে হচ্ছে পরীর দেশের একটি ছোটোখাটো ভাসমান প্রাসাদের মতো। এই জাহাজের প্রতিটি জিনিশ যে কী জাঁকজমকপূর্ণ সেটা তুমি কল্পনাও রতে পারবে না। এই জাহাজে যে-স্যালুনগুলো আছে তা প্রাসাদের মততা, আব ক্যাবিনগুলো রীতিমতো রাজসিক। তবে এসব বিবরণ আমি তোমাকে বিস্তারিতভাবে জানাতে পারবো ইংল্যান্ডে গিয়ে তোমাকে লেখার সময় পেলে। এই মুহূর্তে আমি যাচ্ছি বিখ্যাত ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে। আমাদের জাহাজ থেকে দেখা যাচ্ছে উত্তর আফ্রিকার পাহাড়ী উপকূল। … মাত্র ৩২ দিন আগে আমি লকাতায় ছিলাম। কী দ্রুত ভ্রমণ করছি, তাই না? … আমি দিদ্বি দিয়ে বলতে পারি, আমার বিশ্বাস হয় না যে, আমি প্রতি মুহূর্তে সেই দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যার কথা আমি অতো ভেবেছি আমার ছেলেবেলা থেকে। কিন্তু সত্য কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত!

এ চিঠির মধ্যে কবির মনের দুটো অসাধারণ দিক ধরা পড়ে। তিনি এরই মধ্যে নিজের স্বরূপ নিয়ে সংকটে পড়েছিলেন। স্বদেশের ভিড়ে চিরদিন নিজেকে তিনি অন্য এক জগতের, সমাজের অন্য এক। স্তরের মানুষ বলে বিবেচনা করে এসেছেন। কিন্তু এখন শ্বেতাঙ্গদের ভিড়ে তিনি স্বদেশ এবং স্বদেশের মানুষদের সম্পর্কে একটু যেন বেশি মাত্রায় সচেতন হয়ে উঠলেন। জাহাজ-ভর্তি ভিনদেশীদের সঙ্গে নিজেকে ঠিক মেলাতে পারলেন না। সাড়ে ছ বছর আগে মাদ্রাস থেকে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে যান, তখন জাহাজের ভাবতবর্ষমুখী বিদেশী যাত্রীরা এবং/অথবা জাহাজ-কর্তৃপক্ষ ইংরেজ-বনে-যাওয়া মাইকেলকে নাম দিয়েছিলেন মিস্টার হোল্ট, সেটাকে তিনি নিতান্ত ঠাট্টা হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এবারে ভারতবর্ষ থেকে স্বদেশ-অভিমুখী বিদেশীদের ভিন্ন চেহারা দেখতে পেলেন তিনি।

আহা, এই জাহাজে যদি আমাদের দেশের অর্ধ-ডজন লোকও থাকতো! তা হলে তাঁদের নিয়ে আমাদের নিজেদের একটা দল তৈরি করতাম।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তিনি স্বভাবের দিক দিয়ে সরল হলেও, সাধারণ মানুষের মতো অতি-সরল অথবা একমাত্রিক চিন্তায় অভ্যস্ত ছিলেন না। মস্তো বড়ো সৃজনশীল একজন শিল্পীর জন্যে যা স্বাভাবিক — তিনি এমন একটি জটিল মনের অধিকারী ছিলেন, যা তাঁকে অসুখী করতে বাধ্য। প্রাচ্যে জন্মেও তাঁর মনন এবং মানসিকতা গড়ে উঠেছিলো পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং মূল্যবোধে। আবার তিনি যখন পাশ্চাত্যকে সমস্ত অন্তর দিয়ে আলিঙ্গন করতে গেছেন, তখন প্রাচ্যের প্রতি তাঁর সহজাত দরদ তাঁকে কিছুতেই পাশ্চাত্যের সঙ্গে পুরোপুরি একাত্ম হতে দেয়নি। এই দুয়ের সমন্বয় তিনি কোনো দিন করতে পারেননি, যেমন পারেননি লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর মধ্যে কোনো একজনকে পুরোপুরি বর্জন করে অন্য একজনকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে। তিনি অসুখী হবার মতো মানসিকতা নিয়েই প্রথম যৌবন থেকে বড়ো হয়েছিলেন। কলকাতায় থাকতে যে-হরির খোঁজ নেননি, সেই হরিকে স্মরণ করে এখন তাঁর অন্তব ব্যাকুল হয়ে উঠলো।

আমাদের হরি কোথায় জানো? জানলে তার কাছে আমার কথা মনে করিয়ে পিয়ো।… আজ সাগরটা যে কী শান্ত, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, একেবারে আমাদের নিজেদেব হুগলি নদীর মতো। এখনকার আবহাওয়া হলো অনেকটা আমাদের দেশে অঘ্রান মাসের শুরুতে যেমনটা থাকে, খুব ঠাণ্ডা নয়, আবার খুব গরমও নয়।

বোঝা যায়, ইতিমধ্যে তিনি নিজেকে প্রবাসী বলে বিবেচনা করছেন। স্বদেশকে মনে পড়ছে বারবার। সবকিছুকে আজ তুলনা করে দেখতে চাইছেন দেশের পাঁচটা জিনিশের সঙ্গে।

নিজের লক্ষ্যের কথাও তাঁর বিশেষ করে মনে পড়ে — যে-কাজে এসেছেন, সফলভাবে শেষ করা চাই। তিনি তো আর কবি হতে চান না! ভালো করে আইন শিখে দেশে ফিরে গিয়ে অনেক উপার্জন করবেন। বড়োলোক না-হলে সমাজে তাঁর কোনো মর্যাদা থাকে না। এবারে কেবল কপর্দকহীন কবিখ্যাতি অর্জন করে তিনি সুখী হতে চান না, তিনি চান অর্থ-প্রতিপত্তি দিয়ে সমাজের ওপরতলায় আসন নিতে। জীবনটাকে উপভোগ করতে চান নানাভাবে, নানা উপকরণ দিয়ে। পরবর্তী দু বছরে লেখা একাধিক চিঠিতে বাঙালিদের মধ্যে একজন ব্যারিস্টারও নেই — তিনি এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ কথা ভেবে উদ্দীপ্ত বোধ করেছেন যে, ব্যারিস্টার হতে পারলে তিনি প্রচুর সম্মান পাবেন আর সেই সঙ্গে করতে পারবেন একচেটিয়া ব্যবসা। নতুন প্রতিষ্ঠিত হাইকোর্টও ব্যবসার বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছে। কলকাতা ত্যাগ করার আগে তিনি জেনে এসেছিলেন সদর দেওয়ানি আদালত আর সুপ্রিম কোর্ট থাকছে না, তার বদলে জুলাই মাস থেকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হবে হাই কোর্ট। সেই হাই কোর্টের উদ্‌বোধন হয় পয়লা জুলাই। সেদিন যখন আরব সাগরের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কি মনে মনে ভাবেননি সেই হাইকোর্টের কথা? সেই জন্যে, লক্ষ্যের কথা সদাজাগরূক তাঁর হৃদয়ে:

আমার আশঙ্কা হয় ইংল্যান্ডে যাবার পর বন্ধুদের দেবার জন্যে আমার তেমন সময় হবে না, কারণ আমি আমার পেশা ভালো করে শিখতে চাই, আর চাই সম্মান অর্জন করতে।

বিদেশ থেকে লেখা তখনকার অনেক চিঠিতেই তাঁর এ ধরনের স্বাদেশিকতা এবং নিজের সংকল্প সম্পর্কিত মনোভাব দেখা যাবে।

১৪ জুলাই সিলোন জাহাজ গিয়ে পৌঁছে জিবরন্টারে। তারপর সেদিনই আবার যাত্রা শুরু করে। ১৯ জুলাই শনিবার সূর্য ওঠার আগে এই জাহাজ গন্তব্যে পৌছে সাউথ্যাম্পটন বন্দরে। ধারণা করি, দুপুরের দিকে তিনি গিয়ে পৌঁছে যান তাঁর স্বপ্নে-দেখা লন্ডন নগরীতে। এখানে তিনি মনোমোহন ঘোষ এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে উঠেছিলেন বলে মনে হয়। লন্ডন দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন এ প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। যদিও অনেক বড়ো বড়ো বাড়িঘরের স্থাপত্য দেখে তাঁর মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এ তিনি কলকাতায়ই দেখেছেন। পরবর্তী চার সপ্তাহ তিনি মনোমোহন এবং সত্যেন্দ্র- নাথের সঙ্গে ভালো করে লন্ডন ঘুরে দেখেছেন এবং পাকাপাকি ব্যবস্থা করেছেন ভর্তি হবার।

তিনি যে-লক্ষ্য নিয়ে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন তাকে কতোখানি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন, সেটা বোঝা যায়, কতো দ্রুত তিনি আইন পড়ার জন্যে ভর্তি হলেন, তা থেকে। পরবর্তী টার্ম শুরু হবার কথা নভেম্বর মাসে। বস্তুত, তিনি আরও তিন মাস পরে লন্ডনে এলে কোনো অসুবিধে হতো না। কিন্তু কোনো বিলম্ব তাঁর সহ্য হচ্ছিলো না। উনিশে অগস্ট তিনি ভর্তি হন গ্রেজ ইনে।১০ এর আগে ইনার টেম্পলে যান বলে মনে হয়। ইনার টেম্পলে লেখাপড়া শিখবেন বলেই তিনি ঠিক করে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এখানে ভর্তি হননি।

ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে লন্ডনে চারটি প্রতিষ্ঠান ছিলো – লিঙ্কনস ইন, ইনার টেম্পল, গ্রেজ ইন আর মিডল টেম্পল। এই চারটি প্রতিষ্ঠানকে একত্রে বলা হয় ইনস অব কোর্ট। সবগুলোই তিন শো বছরেরও বেশি পুরোনো এবং বনেদী। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিলো লিঙ্কনস ইন। সেখানে ছিলেন ৬২জন বেঞ্চার বা শিক্ষক। ইনার টেম্পলে বেঞ্চার ছিলেন ৪৬ জন। মিডল টেম্পলে ৩৯জন। সে তুলনায় সবচেয়ে ছোটো ছিলো গ্রেজ ইন – বেঞ্চারের সংখ্যা মাত্র ১৯। এঁদের মধ্যে প্রধান বেঞ্চার ছিলেন জর্জ লঙ। অন্য বেঞ্চারদের নাম হলো: রবার্ট গ্রীন ব্রেডলি, জন টীড, টমাস গ্রীনউড, স্যামুয়েল টার্নার, টমাস গ্রীন, স্যর জে. রমিলি, টমাস চ্যান্ডেলস, টমাস মার্শাল, উইলিয়াম ওয়াইল্ড, জেমস ব্যা, উইলিয়াম হেনরি ডডকিন, জন হাড়লস্টন, রবার্ট লাশ, হেনরি ম্যানিষ্টি, আর্চিবল্ড স্টীফেনস, উইলিয়াম হিল্ডমার্চ, টমস সাউথগেট আর জন লী। লন্ডনে তাঁর ভর্তি অনুমোদন করেন আর্চিবল্ড স্টীফেনস। ভর্তির সময়ে তাঁর জামিন থাকেন টেম্পলের অধিবাসী চার্লস জন প্লামট্রী আর ১১ নম্বর গ্রেজ ইন স্কোরের বাসিন্দা ফিলিপ জে, উইংফীল্ড। এঁরা দুজনেই ছিলেন ব্যারিস্টার।১১

তাঁর স্বরূপের সঙ্কটের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। গ্রেজ ইনের রেজিস্টারে তিনি যেভাবে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন, তা থেকেও এই সঙ্কটের খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। এখানকার ভর্তির রেজিস্টারে তিনি নিজের নাম লিখেছিলেন – Michael Madhusudana Datta৷ পিতৃ-পরিচয় দিয়ে লিখেছেন only son of Rajnaraina Datta. (সত্যিকার বয়স ৩৮ হলেও অজ্ঞাত কোনো কারণে লিখিয়েছিলেন ৩১।) যে-মাইকেল নিজের নাম অনেক আগেই পুরোপুরি ইংরেজি ধরনে লিখতে আরম্ভ করেন, তিনি হঠাৎ কোন প্রেরণায় একেবারে সংস্কৃত-ঘেঁষা বানানে নিজের নাম লিখলেন দেশ থেকে ছ হাজার মাইল দূরে এসে, তা অনুমান করা শক্ত নয়। চিরকাল তিনি মনে মনে ইংল্যান্ডে বিচরণ করেছেন, স্বদেশের অনেক কিছুকে সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করেছেন। কিন্তু আজ স্বদেশ থেকে এতো দূরে এসে স্বদেশকে ভোলার সুযোগ পেয়েও ভুলতে পারলেন না,রং তাঁকেই চাইলেন আঁকড়ে ধরতে নিজের পরিচয়ের খুঁটো হিশেবে। এর সঙ্গে প্রতিতুলনা করা যেতে পারে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের নামের বানান। মাইকেলের ঠিক দু বছর এগারো মাস আগে ১৮৫৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর – জ্ঞানেন্দ্রমোহন যখন লিংকনস ইনে ভর্তি হন, তখন তিনি তাঁর নামের বানান লিখেছিলেন যতোটা ইংরেজি ধরনে লেখা যায়, তেমন করে – Ganneundro Mohun Tagore। তা ছাড়া, পিতার নামও তিনি লিখেছিলেন ইংরেজি রীতিতে – Prosonno Kumar Tagore।১২

ইনার টেম্পলে ভর্তি না-হয়ে মাইকেল কেন যে গ্রেজ ইনে ভর্তি হলেন, তা জানার উপায় নেই। হঠাৎ তাঁর মন পরিবর্তনের কারণও অজ্ঞাত। তিনি যখন লন্ডনে পৌছেন, ততোদিনে কি ইনার টেম্পলে সব আসন পূরণ হয়ে গিয়েছিলো? (অসম্ভব না-হলেও এটাকে খুব বিশ্বাসযোগ্য কারণ বলে মনে হয়

গ্রেজ ইনে ভর্তির আবেদনপত্র। নামের বানানে পরিবর্তন লক্ষণীয়।

না। কারণ পরের টার্ম শুরু হতে তখনো সাড়ে তিন মাস বাকি।) দূর থেকে ভালো করে না-জেনে তিনি মনে মনে ইনার টেম্পলকে নির্বাচন করেছিলেন। লন্ডনে পৌছার পর মনোমোহন অথবা অন্যেরা কি তাঁকে ভিন্ন রকমের পরামর্শ দিয়েছিলেন? অসম্ভব নয়। আর-একটা সম্ভাব্য কারণ – গ্রেজ ইন সবচেয়ে ছোটো প্রতিষ্ঠান বলে সেখানে কোনো বাড়তি সুবিধে আশা করেছিলেন। অথবা এমনও হতে পারে, সেখান থেকে ব্যারিস্টার হওয়াও তুলনামূলকভাবে সহজ ছিলো। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়ে যখন ব্যারিস্টার হিশেবে কাজ করেন, তখন কলকাতা হাইকোর্টে৪০ জনের বেশি ব্যারিস্টার ছিলেন। কিন্তু গ্রেজ ইন থেকে পাস করা একজন ব্যারিস্টারও ছিলেন না। তাঁর আগে যে-দুজন বাঙালি ব্যারিস্টার হয়েছিলেন — জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরআর মনোমোহন ঘোষ–তাঁরা দুজনেই ব্যারিস্টার হয়েছিলেন লিঙ্কনস ইন থেকে।১৩

কয়েক সপ্তাহ তিনি মনোমোহন এবং সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে বাস করেছিলেন বলে তাঁর চিঠি থেকে আভাস পাওয়া যায়। খুব সম্ভব গ্রেজ ইনে ভর্তি হবার পর তিনি অন্যত্র বাসা ভাড়া করেন। আর সত্যেন্দ্রনাথ এবং মনোমোহনও তখন অন্য জায়গায় চলে যান। কবির ভর্তির আবেদনপত্রে তাঁর ঠিকানা দেওয়া আছে ৫৪ ব্যর্নার্ড স্ট্রীট। এই রাস্তা হলো রাসেল স্কোয়ারের গায়ে লাগানো এবং গ্রেজ ইনের অদূরে। এই ঠিকানায় মনোমোহন এবং সত্যেন্দ্রনাথ থাকতেন, না তিনি তাঁদের কাছ থেকে এসে এখানে বাস করেন, তার হদিস করতে পারিনি। ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে কবি মনোমোহনকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে মনে হয়, কদিন আগেই তিনি এঁদের সঙ্গে একত্রে বাস করছিলেন।

(ওখান থেকে চলে আসার পর আমার খুবই বিষণ্ণ এবং মন-মরা মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার এ অবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে। বিশেষ করে তোমরা যখন শিগগিরই শহরের বাইরে যাচ্ছো। বলা বাহুল্য, তোমাদের দুজনের জন্যে আমার মন খুব খারাপ। সারাক্ষণ তোমাদের কথা মনে পড়ছে। … আমার সত্যি সত্যি খুব একঘেযে এবং বিষন্ন লাগছে। তোমাদের কাছাকাছি কোনো শস্তা এবং ছোটো বাসা পাওযা যায় কিনা, আমাকে দয়া কবে জানিয়ো। তোমরা এখন যেখানে গেছে, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছো জেনে আমার ভালো লাগছে।১৪

মাইকেল রাজকীয় ব্যাপারে, জাঁকজমকপূর্ণ বিষয়ে খুব উৎসাহ বোধ করতেন। সাহিত্য এবং ইতিহাসে রাজাদের যে-কাহিনী এবং লন্ডন মহানগরীর যে-বর্ণনা পড়েছিলেন, তা তিনি যাচাই করে নিতে চেয়েছিলেন নিজের চোখ দিয়ে। সে জন্যে, বিষণ্ণ মন নিয়ে ঘরে বসে থাকতে চাননি, বরং লন্ডন এবং তার ধারে-কাছে যে-জায়গাগুলো ছিলো, তা তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে চেয়ে-ছিলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর, যেমন, তিনি যে-বাড়িতে থাকতেন তার অন্য এক ভাড়াটের সঙ্গে ট্রেনে করে বের হলেন দক্ষিণ লন্ডন ভালো করে ঘুরে দেখার জন্যে। প্রথমে তাঁরা যান বিখ্যাত কিউ [বট্যানিক্যাল] গার্ডেনে। ভারতবর্ষ থেকে আনা গাছপালাও তিনি সেখানে নিশ্চয় দেখে থাকবেন। তারপর রিচমন্ডে। কিন্তু যা তাঁকে তাক লাগিয়ে দেয় তা হলো হ্যাম্পটন কোর্ট-সাড়ে তিন শো বছর ধরে যা ছিলো ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদ।

আমি যে কী আশ্চর্যজনক জিনিশ দেখেছি, তা তোমাদেব বর্ণনা করতে পারবো না। কিন্তু কী দুঃখের বিষয় যে,

তোমরা লন্ডনের বাইরে যাও না অথবা এসব আশ্চর্যজনক জায়গাগুলো দেখে না। আমরা আমাদের তরুণ বয়সে যেসব শুকনো ঐতিহাসিক তথ্যাদি পড়েছি, এসব জায়গা সেই তথ্যাদির সঙ্গে একটা র‍্যোমান্টিক বাস্তবতা জুড়ে দেয়। আমি তো এরই মধ্যে হ্যাম্পটন কোর্টের বেশ প্রেমে পড়ে গেছি। এ দেশের কঠোর আবহাওয়ায় যতোটা প্রাচ্য হতে পারে, হ্যাম্পটন কোর্টকে আমার তাই মনে হলো। এই প্রাসাদের অনেকগুলো ভাগ আছে, যাকে বলা যায়: মহল; আর প্রত্যেক ভাগেরই আছে নিজস্ব উঠোন। প্রাসাদের ভেতরে যে-চিত্রগুলো আছে আর এর কারুকার্য-করা সিলিংগুলো চমৎকার।১৫

কিন্তু যতো সুন্দর হোক লন্ডনের চারদিক, যতো দেখার মতো জায়গা থাক, তাঁর মূল লক্ষ্যের কথা তিনি ভুলতে পারেন না। মনোমোহন এবং সত্যেন্দ্রনাথকেও তিনি সে কথা মনে করিয়ে দিতে চান। ১৪ নভেম্বর তিনি আবার মনোমোহনকে লেখেন:

কাজ চালিয়ে যাও ভাইয়ের। যতো পারো সম্মান অর্জন করো। আমরা এটা করার জন্যেই এসেছি। মনে রেখো সমস্ত দেশ T… সম্পর্কে নীরব, কিন্তু আমি বলতে পারি যে, আমাদের তিন জনের কথা নিয়ে আমাদের দেশের লোকেরা অনেক সমযে আলোচনা করেন।১৬

প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই T জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর। কবি যেদিন কলকাতা ত্যাগ করেন, তার দু দিন পরে — এগারোই জুন তারিখে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ব্যারিস্টার হন। তবে তিনি দেশের সঙ্গে তাঁর শিকড়ের বন্ধন কেটে ফেলেছিলেন। তা ছাড়া, বিলেতে তিনি ব্যারিস্টার হবার জন্যেও আসেননি। তিনি আগে থেকে লন্ডনে বাস করছিলেন। এক সময়ে তিনি ব্যারিস্টার হবার জন্যে ভর্তি হন লিঙ্কনসইনে। মাইকেল জ্ঞানেন্দ্রমোহনের মতো খৃস্টান হয়েছিলেন। কিন্তু দুজনের মধ্যে পার্থক্য ছিলো অনেক। জ্ঞানেন্দ্র-মোহন তাঁর শিকড় উপড়ে ফেলে একেবারে ইংরেজ বনে গিয়েছিলেন। আর মাইকেল সাহেব হয়েও, বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালি সমাজের সঙ্গে এক ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সে জন্যে, তিনি যখন ব্যারিস্টার হবার লক্ষ্য নিয়ে বিলেত যাত্রা করেন, তখন কলকাতার শিক্ষিত সমাজ তাঁর সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে অনেক প্রত্যাশা করেছে। তেমনি আইসিএস হবার বড়ো লক্ষ্য নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ এবং মনোমোহন যখন বাঙালিদের মধ্যে সবার আগে বিলেত আসেন, তখনো তাঁদের দিকে দেশবাসী প্রত্যাশার সঙ্গে তাকিয়েছেন। কবি সেই প্রত্যাশার কথা তাঁর তরুণ বন্ধুদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা তখন বাস করছিলেন লন্ডনের বাইরে – উইন্ডসরে। ৮ জানুআরি তিনি মনোমোহনকে লেখেন:

গত দু দিন লন্ডন ভয়ানক কুয়াশায় ঢাকা ছিলো। এ যে কী বর্বরোচিত দেশ! … তুমি এবং আমাদের খুদে ইন্দ্র (সত্যেন্দ্রনাথ) ভালো করছে জেনে আমি খুশি হয়েছি। মনে রেখো, ভাইয়েরা, আমাদের গোটা জাতির নজর রয়েছে তোমাদের ওপর।১৭

নিজের কথাও ভোলেননি। এবং মনে হয়, এ সময়ে তিনি রীতিমতো কঠোর পরিশ্রম করছিলেন তাঁর লেখাপড়া নিয়ে।

তোমার শ্রদ্ধাভাজন পিতার কাছে আমার ভক্তি জানিয়ো। তাঁকে বোলো যে, আমি যদি দেশে ফিরে যাবার সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তা হলে তিনি যাকে এক কালে স্নেহ করতেন এবং নিভের ছোটো ভাই-এর মতো গণ্য করতেন, আমার সেই বাবার সম্মান যাতে নষ্ট না-হয়, তার জন্যে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

আপতত বিদায়! তুমি যদি আমাকে অনুমতি দাও, তা হলে আমি তোমাদের শেকসপীয়র পাঠে সাহায্য করবো — তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটকগুলো সম্পর্কে তোমাদের মাঝেমধ্যে প্রশ্ন পাঠিযে। তোমরা কোন কোন নাটক পড়ছো আমাকে জানিয়ো।১৮

প্রথম যৌবনে তিনি যখন বিলেত যাবার জন্যে প্রায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, তখন সামনে ব্যারিষ্টার হবার কোনো স্বপ্ন ছিলো না। কিন্তু ১৮৬২ সালে শেষ পর্যন্ত তিনি যখন বিলেত যান, তখন তিনি যে আদৌ সাহিত্যের দিকে নজর দিয়েছেন, সমসাময়িক তৃতীয় প্রজন্মের রোম্যান্টিক কবিদের রচনা পড়ে তার প্রশংসা করেছেন — তাঁর কোনো চিঠিপত্র থেকে তার আভাস পাওয়া যায় না। অথবা তিনি পরে সামান্য হলেও যে-টুকু কাব্য চর্চা করেছেন, তা থেকেও তার কোনো পরোক্ষ প্রমাণ মেলে না। বরং আমরা দেখতে পাবো, সে সময়কার ইংরেজি অথবা ফরাসি কাব্যসাহিত্যের যে-ধারা আধুনিক বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিলো, তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হননি। প্রথম বারে যতোদিন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে লন্ডনে ছিলেন, ততোদিন তিনি সাহিত্যচর্চা নয়, কেবল আইন অধ্যয়নের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন।

অপরিচিত এবং বন্ধুহীন পরিবেশে স্বদেশ এবং স্বজন তাঁর হৃদয়কে বিশেষ করে অধিকার করে রাখে। স্বদেশে যখন ছিলেন, তখন ভিড় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার প্রযত্ন করতেন। তিনি যে চারদিকের লোকজনের তুলনায় আলাদা এবং অনেক বড়ো, সে ব্যাপারে সব সময়ে সচেতন থাকতেন। কিন্তু অনেক দূরে এসে এখন সেই স্বদেশ এবং স্বসমাজকে ভালো করে দেখতে পেলেন। এই স্বদেশ এবং সমাজকে তিনি কতো ভালোবেসেন, তাও অনুভব করেন। এই পরিস্থিতিতে কোন জগতের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম মনে করবেন, তা নিয়ে সত্যি সত্যি সংকটে পড়লেন তিনি। চেষ্টা করেও এখন ভিন দেশ এবং ভিন সমাজের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারলেন না। তাঁর স্বপ্নের ইংল্যান্ড এবং যে- ইংল্যান্ডকে তিনি সত্যি সত্যি দেখতে পেলেন, তার মধ্যে হয়তো বা তেমন সাদৃশ্যও খুঁজে পাননি। (না-দেখা ইয়ারো, সব সময়েই দেখা-ইয়ারোর থেকে আলাদা!) সাহিত্যের মধ্য দিয়ে যে-বড়ো ইংরেজকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, লন্ডনের ভিড়ে তাকেও কি দেখতে পেয়েছেন? মাদ্রাস এবং কলকাতায় তিনি ইংরেজদের বর্ণবাদ দেখেননি, তা নয়। যদিও সেখানে লাখ লাখ লোকের মধ্যে মুষ্টিমেয় ইংরেজদের বর্ণবাদ তাঁকে হয়তো অতো পীড়া দেয়নি। কিন্তু কলকাতা থেকে জাহাজে ওঠার পরেই তিনি অন্য রকমের পরিবেশ লক্ষ্য করে ব্যথিত হয়েছিলেন। সে জন্যে, দ্রুত এবং কৃতিত্বের সঙ্গে নিজের কাজ শেষ করে দেশে ফিরে যাবার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন। নিজের পরিবার ফেলে এসেছিলেন — সে-ও অবশ্য একটা পিছুটান হিশেবে কাজ করেছে। এ কারণে, তিনি বারবার নিজের লক্ষ্যের কথা স্মরণ করেছেন এবং মনোমোহন আর সত্যেন্দ্রনাথকেও তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।

এভাবে সব কিছু চলতে পারতো। কিন্তু হঠাৎ বাধা এলো একেবারে অপ্রত্যাশিত পথে। যাঁর কাছে নিজের তালুক পত্তনি দিয়ে এসেছিলেন, সেই মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ১৮৬২-৬৩ সালের জন্যে যে-টাকা পাবেন বলে আশা করেছিলেন, বছরের শেষ দিকে (১৮৬২) অথবা পরের বছরের প্রথম দিকে তা পেলেন না। এই টাকার প্রথম কিস্তি পাওনা হয়েছিলো ডিসেম্বর মাসে। মহাদেবের কাছে ১৮৬১ সাল বাবদেও প্রায় ৫০০ টাকা পেতেন বলে দাবি করেছেন। কোনো রকমের হুঁশিয়ারি ছাড়া সেই মহাদেব তাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করলেন। প্রথম চুক্তি অনুযায়ী মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন আর চৈত্র (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল) মাসে মোট প্রায় তিন হাজার টাকার (দ্বিতীয় চুক্তি অনুযায়ী দু হাজার টাকার) কিছু লন্ডনে মাইকেলকে এবং কিছু কলকাতায় হেনরিয়েটাকে দেবার কথা। কিন্তু মহাদেব চট্টোপাধ্যায় এই টাকার মধ্যে ২৩ নভেম্বর তারিখে হেনরিয়েটাকে দিয়েছিলেন মাত্র এক শো টাকা।১৯ কবিকে কোনো টাকা পাঠাননি।

লন্ডনের ছোটো একটি ঘরে বসে লেখাপড়া করার যে-প্রাত্যহিক নিয়ম তিনি করে নিয়েছিলেন, হেনরিয়েটার চিঠি পেয়ে তাতে ছেদ পড়লো। সম্পূর্ণ বন্ধুহীন পরিবেশে হেনরিয়েটা এবং তাঁদের দুটি ছোটো সন্তান হয়রানির শিকার হচ্ছেন, একথা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন হন। কলকাতা ছাড়ার আগে ব্যবস্থা হয়েছিলো মহাদেব হেনরিয়েটাকে মাসে মাসে ১৫০ টাকা দেবেন। এই টাকার একটা অংশ তিনি অগ্রিমও দিয়েছিলেন মে-জুন মাসে (১৮৬২)। যাবার আগে কবি সেই টাকা অরিয়েন্টাল ব্যাংকে রেখে গিয়েছিলেন।২০ কিন্তু তিনি কলকাতা ছাড়ার পর মহাদেব, যেমনটা এই মাত্র লক্ষ্য করেছি, নভেম্বর মাসে হেনরিয়েটাকে কেবল ১০০ টাকা দিয়েছিলেন। কবি হেনরিযেটাকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁর জ্ঞাতি ভাই-এরা যতো দিন না তাঁর মায়ের অলংকার ফিরিয়ে দেন, ততো দিন তিনি যেন

মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পাদিত দলিলের প্রতিলিপি

ডৌল বন্দবস্ত রূপোয়া জেলা জসহারের অন্তপাতি সুন্দরবনের ২২০ নম্বর লাটের মধ্যেগত চকমুনকিয়া ও গদারডাঙ্গা তালুকদার ও গাঁতিদার শ্রীমাইকেল মধুশুদন দত্ত মফস্বল তালুকদার ও দরগাঁতিদার শ্রীমক্ষ্যদা দেবী জওজে শ্রীমহাদেব চট্টোপাধ্যায় সাকিন পাইকপাড়া — পরগণে হোগলা থানা নওয়াবাদ হালসাকিন বাহিরশীমলা — সহর কলিকাতা — ইতি –

আসামীজুমনা

ইং সন ১২৬৮ সাল বাং সন ১২৭৪ সাল শালীয়ানা মুদ্দত ৭ বৎসর কোম্পানি ২৯৯৭॥

ইং সন ১২৭৫ সাল সৰ্ব্বকার জন্য কোম্পানি ৩৫০১

আমার বিষয় উদ্ধার ও দেনা পরিশোধ জন্য আপনার স্বামি অনেক সাহায্য ও যত্ন এবং পরিশ্রম করিয়াছেন এবং অদ্য পর্যন্ত আমার মকদ্দমার খরচ ও দেনা পরিশোধ জন্য ৫০০০ পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় করিয়াছেন তাহাতে উক্ত দুই চক তাঁহাকে কামি বন্দবস্ত করিয়া দিবার অঙ্গীকার ছিল তদনুজাই তাঁহার প্রার্থনা মতে উপরের লিখিত ৫০০০ পাঁচ হাজার টাকা পণে উক্ত চকমুনকিয়া ও গদারডাঙ্গা ১২৬৮ সনের প্রথমাবধি আপনাকে মফস্বলে তালুক ও তাঁতিদার করিয়া দেওয়া গেল এবং তাহার শালিয়ানা জমা ইং ১২৬৮ নং ১২৭৪ সাল মুর্দ্দত ৭বৎসৱ মং ২৯৯৭। উনত্রিশ শত সাড়ে সাতানব্বই টাকা ও ইং ১২৭৫ সাল সৰ্ব্বদার জন্য মঃ ৩৫০১ পৌত্রিশ শত এক টাকায় অবধারিত হইল আপনি উক্ত উভয় চকের হাসিল পতিত রাইয়তি খামারদীগর আবাদীয়াতে ও জলকর ও বনকর ও ফলকর ইত্যাদি দরোবস্তি হকুকে দখলিকার হইয়া মালগুজারির টাকা নিম্নলিখিত কিস্তিবতী-বন্দী মোতাবেক সন বসন মাহ মাহ কিস্তী বকিস্তী সরবরাহ পূৰ্ব্বক পুত্রপৌত্রাদি ক্রমে দান বিক্রয় অধিকারিণী হইয়া ভোগ দখল করিবেন কিন্তী খেলাপ করিলে শতকরা মাসীক ১ এক টাকা হিসাবে শুদ দিতে হইবেক … যে পর্যন্ত আমি অন্য কোন নিয়ম না করিব সে পর্যন্ত আমার প্রাপ্য টাকার মধ্যে আপনি ও আপনার ওয়ারিশান সন সন মঃ৩০০ তিন শত টাকা শ্ৰীযুক্ত বৈদ্যনাথ মিত্র ওশ্রীযুক্ত দ্বারকানাথ মিত্র মহাশয় ও তাঁহাদের ওয়ারিশানকে দীবার তাহাদের নিকট রশীদ লইবেন ঐ রশীদ ও কালেকট্ররির দাখিলা আমার নিকট দাখিল করিলে ঐ টাকার দাখিলা পাইবেন …ইতি সন ১২৬৮ আটসট্টি সাল — তারিখ ৯ই আশ্বিন –

কাত কিন্তী বন্দী

ইং ১২৬৮ সাল না ৭৪ সাল

মুদ্দত ৭ সাল বৎসর

মাহ পৌষ ॥ ৩৭৪ টাকা ১১ আনা৪৩৭ টাকা ১১ আনা
মাহ মাঘ ॥ ৭৪৯ টাকা ৬ আনা৮৭৫ টাকা ৮ আনা
মাহ ফাল্গুন ১১২৪ টাকা ১ আনা১৩১২ টাকা ৫ আনা
মাহ চৈত্র॥ ৭৪৯ টাকা ৬ আনা৮৭৫ টাকা ৮ আনা
২৯৯৭ টাকা ৮ আনা৩৫০১ টাকা

তাঁদের কোনো রকম আমলে না-আনেন।২১কিন্তু কবি কলকাতা ত্যাগ করার পর জ্ঞাতি ভাই-এরা অলংকার তো ফিরিয়ে দেনইনি, তদুপরি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগে ২৬/২৭ বছরের একটি নির্বান্ধব মহিলাকে নানাভাবে বিব্রত করার প্রয়াস পান। পরে কবি এটাকে অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে মহাদেব চট্টোপাধ্যায় এবং তার নিজের জ্ঞাতি ভাইদের ষড়যন্ত্র বলে বর্ণনা করেছেন।২২ তাঁরা কি আশা করেছিলেন, মাইকেল দেশছাড়া, এই অবস্থায় তাঁর পরিবারকেও যদি দেশছাড়া করা যায়, তা হলে তাঁরা তাঁর সম্পত্তিতে আবার হাত দিতে পারবেন?

এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়, তা নিয়ে মাইকেল এবং হেনরিয়েটা উভয় নিঃসন্দেহে চিন্তা-ভাবনা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হেনরিয়েটা লন্ডনে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কবির সম্মতি নিযে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন — এমনটা অনুমান করাই সঙ্গত। এ সময়ে বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকে তিনি পরামর্শ এবং টাকা আদায়ে সাহায্য পেয়েছিলেন বলে মনে হয়। কবির চিঠি থেকে জানা যায় যে, বিলেত যাত্রার আগে হেনরিয়েটাকে মহাদেব ১০ জানুআরি (১৮৬৩) তারিখে ৫০ টাকা, ফেব্রুআরি মাসে ৯৫ টাকা, এবং ২২ মার্চ তারিখে ১৩০০ টাকা শোধ দেন।২৩

এ হিশেব থেকে পরিষ্কার দেখা যায় যে, মহাদেব ১৮৬২-৬৩ সালের মোট পাওনা দু হাজার টাকার মধ্যে ১৫৪৫ টাকা শোধ দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে পাওনা ছিলো ৪৫৫ টাকা। নিঃসন্দেহে তিনি চুক্তি ভঙ্গ করেছিলেন। তবে তা সত্ত্বেও, বিদ্যাসাগরের কাছে মহাদেব এবং তাঁর জামিনদারদের কবি যতোটা দায়ী করেন, তাঁরা আসলে ততোটা দায়ী ছিলেন না। কবির পরবর্তী চিঠিপত্র থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, এ ব্যাপারে মহাদেব চট্টোপাধ্যায়েরও একটা বক্তব্য ছিলো। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কয়েকটি চিঠি আদান-প্রদানের পর মহাদেবের প্রতি কবির ভাষা এবং মেজাজ তাই অনেকটা নরম হয়েছিলো।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিলেত যাবার আগে টাকা আদায় করতে পারা সত্ত্বেও, হেনরিয়েটা চলে গেলেন কেন? ভবিষ্যতে যাতে আবার ঝামেলায় পড়তে না-হয়, সেটা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু আর-একটা কারণের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গৌরদাস এবং বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠিতে কবি বারবার কলকাতায় তাঁর নামে মিথ্যে অপবাদ রটনা করার জন্যে ‘শত্রুদের’ দায়ী করেছেন এবং এতে কান না-দেবার জন্যে অনুবোধ জানিয়েছেন। কিন্তু অপবাদটা কিসের, তা উল্লেখ করেননি। কারো কাবো লেখা থেকে মনে হয়, এ অপবাদ ছিলো করি ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে — সোজা কথায় — নারীঘটিত অপবাদ।২৪ এর বছর খানেক পরে এমন অপবাদও রটেছিলো যে, তিনি ফ্রান্সের কারাগারে বন্দী আছেন।২৫ নারীঘটিত অপবাদ যদি হেনরিয়েটার কানেউঠে থাকে, তাহলে তাঁর পক্ষে বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক। স্ত্রী এবং তিন-চারটি সন্তান থাকা সত্ত্বেও মাইকেল কিভাবে তাঁর সঙ্গে প্রণয় সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, আর যেই ভুলুক, হেনরিয়েটার তা ভোলার কথা নয়। তা ছাড়া, কবির চিঠি থেকে জানা যায়, তাঁর আত্মীয়রা হেনরিয়েটাকে যথেষ্ট বিব্রত করেছিলেন। কিন্তু কারণ যাই হোক, তিনি লন্ডনে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

ওদিকে, লন্ডনেও চিরদিনের বেহিশেবী কবি অর্থ সংকটে পড়েন। এই সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মাঝেমধ্যে তিনি মনোমোহনের কাছ থেকে ধাবও করেন। যেখানে তিনি থাকতেন, সেই বাড়িওয়ালার কাছে ধার হওয়াও স্বাভাবিক। আসলে লন্ডনে বসে নিজে আড়াই শো টাকা আর কলকাতায় হেনরিয়েটা দেড় শশা টাকা করে পাওয়ার যে-ব্যবস্থা তিনি করে গিয়েছিলেন, তা মোটেই সন্তোষজনক ছিলোনা। কারণ ব্যয়ের চেয়ে তাঁর আয় ছিলো কম। মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তাঁর বছরে (শেষ চুক্তি অনুযায়ী) দু হাজার টাকা পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কলকাতা এবং লন্ডন মিলে মাসে চার শো টাকা করে ব্যয় হলে বছরে আরও প্রায় তিন হাজার টাকার ঘাটতি পড়ার কথা। ধার করে বিলেত যাবার খরচ জোগাড় করলেও, এই ঘাটতি পূরণের স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা তিনি করে যেতে পারেননি। প্রবাসে তাঁর দারুণ ভোগান্তির বীজ তিনি নিজেই বপন করে গিয়েছিলেন।

মহাদেব টাকা পাঠানো বন্ধ করায় কবি যে-দুজনকে জামিন রেখে এসেছিলেন — দিগম্বর মিত্র আর বৈদ্যনাথ মিত্র — তাঁদের তিনি জরুরী চিঠি লেখেন। কিন্তু কারো কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট জবাব পাননি। দিগম্বর মিত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিলো তার প্রমাণ মেলে মেঘনাদবধ কাব্য তাঁকে উৎসর্গ করার ঘটনা থেকে। ওদিকে, বৈদ্যনাথ তাঁর নিজের জ্ঞাতি এবং আবাল্য তাঁর পিতার প্রতিপালিত। এঁকে এবং এঁর সহোদর দ্বারকানাথকে (ডায়মন্ড হারবারের উকিল) তিনি বিলেত যাত্রার মাত্র দু দিন আগে — ৭ জুন তারিখে — চক মুনকিয়াব সাড়ে চার আনা, সাগবাড়ীর পৈতৃক বাড়ির অংশ ও অন্য কিছু সম্পত্তি দান করেছিলেন।২৬ এই সম্পত্তির দাম ছিলো মোট পাঁচ হাজার টাকা।২৭ এখন তাঁরা কিভাবে মাইকেলের দুঃসময়ে এমন নীরব ভূমিকা পালন করেন, সেটা নিতান্ত বিস্ময়ের ব্যাপার।

কবি কলকাতা ত্যাগ করার সাড়েন মাস পরে — ১৮৬৩ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে হেনরিয়েটা কলকাতা ত্যাগ করে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন। তিনি কলকাতা ত্যাগ কবেন সম্ভবত ২৩ মার্চ — বেঙ্গল জাহাজে করে। কলকাতা ত্যাগ করার আগের কয়েক মাস কবির জ্ঞাতিদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হওয়া ছাড়াও তিনি আর্থিক সংকটে ছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু বিদেশ যাত্রা করার আগে যেখানে যতো টাকা পাওনা ছিলো তা আদায় করার ব্যাপারে সব রকমের চেষ্টা করেন।২৮ (আগেই দেখেছি, তিনি মহাদেবের কাছ থেকে জানুয়ারি মাস থেকে তিন কিস্তিতে ১৪৪৫ টাকা আদায় করতে সমর্থ হন।) তারপর নিরুপায় এই নারী দুটি সন্তানকে নিয়ে কলকাতা থেকে লন্ডনে গিয়ে পৌছেন দোসরা মে (১৮৬৩) তারিখে।২৯

পরিবার লন্ডনে যাবার ফলে কবির বিপদ বেড়ে যায় অনেক গুণ। পরিবার এলে সবাইকে নিয়ে তিনি কোথায় থাকবেন, কি করবেন — এটা নিশ্চয় আগে থেকে ভেবে রেখেছিলেন। তবে তিনি কোথায় কিভাবে থাকেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। হেনরিয়েটার পিতা, জর্জ জাইলস হোয়াইট জন্মেছিলেন লন্ডনের উপকণ্ঠ ফুলহ্যামে। সেই সূত্রে কোনো আত্মীয়ের কাছে হেনরিয়েটা আশ্রয় পেয়েছিলেন, এটা মনে করা শক্ত। অনুমান করি, তিনি কলকাতা থেকে যে-টাকাপয়সা নিয়ে আসেন, তা দিয়ে খুব কম ব্যয়ের একটি বাড়ি ভাড়া করেন এবং কোনো মতে সংসার চালাতে থাকেন। তিনি সংসার গুছিয়ে বসার পর, জুন মাসে কবি বিশেষ তাড়া দিয়ে দিগম্বর মিত্রকে চিঠি লেখেন মহাদেবের কাছে তাঁর পাওনা টাকাপয়সার ব্যাপারে। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত এই টাকার পরিমাণ ছিলো এক হাজারেরও কম। কিন্তু কবির হিশেবে তিন হাজারেরও বেশি। তিনি আশা করতে থাকেন দিগম্বর মিত্র এবং বৈদ্যনাথ মিত্র পৌষ মাস আসার আগে টাকা আদায় করে পাঠাতে পারবেন। পত্তনির শর্ত অনুযায়ী মহাদেব চট্টোপাধ্যাযের পৌষ মাসে পর্তী বছরের (১৮৬৩-৬৪) প্রথম কিস্তি টাকা দেবার কথা। পৈতৃক বাড়ি যাঁর কাছে বিক্রি করেছিলেন, সেই হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও কবি তখনো পাঁচ শো টাকা পেতেন। আলিপুর কোর্টের বি এন মিত্রের কাছে পেতেন এক হাজার টাকা। তাঁদের কাছেও তাগাদা দিয়ে চিঠি লেখেন।

জুন মাসে (১৮৬৩) তিনি গ্রেজ ইনে চারটি টার্ম পড়া শেষ করেন। প্রতিটি টার্মে ছটি করে ডিনার খেতে হতো। এবং সাধারণ ক্ষেত্রে মোট ৭২টি ডিনার খাওয়ার পর অর্থাৎ ১২টি টার্ম লেখাপড়া করার পর ব্যারিস্টার হিশেবে ডাক পড়তো। এই হিশেবে তাঁর ব্যারিস্টার হতে তখনো দু বছর বাকি। দেশ ছাড়ার আগে তিনি হিশেব করে দেখেছিলেন যে, কলকাতায় হেনরিয়েটার জন্যে দেড় শশা এবং লন্ডনে তাঁর নিজের জন্যে আড়াই শো — এই মোট চার শশা টাকা করে মাসে পেলে তিনি বেশ স্বচ্ছন্দে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করতে পারবেন। পরিবার লন্ডনে আসার পর তিনি লক্ষ্য করেন যে, মাসে চার শো থেকে সাড়ে চার শো টাকার কম সংসার চালানো যায় না। এই হিশেবে পরবর্তী দু বছরের জন্যে তাঁর আরও অন্তত দশ হাজার টাকা ব্যয় হবার কথা। যাতে এ টাকা নিয়মিত পেতে পারেন, তার জন্যে তিনি তাঁর প্রতিনিধিদের ওপর জুন মাস থেকে যথেষ্ট চাপ দিতে থাকলেন। কিন্তু তাঁর প্রত্যাশা এবং কলকাতার সাড়া এক পথে যায়নি। হিশেবে আরও গরমিল দেখা দিলে হেনরিয়েটা কলকাতা ছেড়ে চলে আসায়। কলকাতায় থাকলে তিনি পরিচিতদের কমবেশি প্রভাবিত করতে পারতেন।

সন্তানদের নিয়ে জাহাজে আসার জন্যে হেনরিয়েটার অনেক টাকা — দু হাজার টাকার চেয়ে বেশি — খরচ হয়েছিলো। তার পরও তাঁর হাতে কিছু টাকা অবশিষ্ট ছিলো। কিন্তু এই টাকা দিয়ে বেশি দিন য়োরোপে থাকা যাবে না, বেহিশেবী কবির পক্ষেও এটা হিশেব করতে কষ্ট হয়নি। তিনি বিবেচনা করে দেখলেন যে, লন্ডনে থাকলে তুলনামূলকভাবে ব্যয় অনেক বেশি হবে। তার কারণ সেখানকার জীবনযাত্রা মহার্ঘ। তদুপরি, সেখানে যেহেতু পরিচিত কয়েকজন লোক আছেন, সে জন্যে তিনি তাঁর মানমর্যাদার অনুপযুক্ত অবস্থায় বাস করতে পারেন না। এই অবস্থায় তিনি ভাবতে শুরু করেন, অবশিষ্ট সামান্য টাকা নিয়ে তিনি লন্ডন ছেড়ে এমন একটা জায়গায় যাবেন যেখানে থাকতে ব্যয় কম হবে এবং

তাঁকে কেউ চিনবেও না। নিদেন পক্ষে নিজের পরিবারকে রাখবেন সেখানে। তারপর টাকাপয়সা এসে গেলে তখন আবার গ্রেজ ইনে ফিরে লেখাপড়া শেষ করবেন। এ রকমের জায়গা হিশেবে তিনি নির্বাচন কবলেন ফ্রান্সের ভার্সাইকে। অজানা জায়গায় গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করার সাহস অনেকেরই হয় না। বিশেষ করে বাঙালিদের এ ব্যাপারে কোনো খ্যাতি নেই। কিন্তু কবির মধ্যে এই অ্যাডভেঞ্চারের মনোভাব ছিলো — আগেই আমরা তা লক্ষ্য করেছি। আসলে এতাঁর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ইংল্যান্ডের কোনো গ্রাম বেছে না-নিয়ে তিনি ফ্রান্সে যাবার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা এ যাবৎ কেউ দেননি। কিন্তু তাঁর চিঠিপত্র বিশ্লেষণ করলে এ সম্পর্কে কোনো আভাস পাওয়া যায় না, তা নয়। বিদ্যাসাগব এবং গৌরদাসকে লেখা তাঁর বেশ কয়েকটি চিঠিতে তিনি ইংল্যান্ডের আবহাওয়াকে দোষারোপ করেছেন। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা তাঁকে এ ব্যাপারে দায়ী করবেন না।

কিন্তু আসল কারণ সম্ভবত তখনকার ইংরেজ সমাজের বর্ণবাদ। সাম্প্রতিক কালে মধ্য-ভিক্টোরিয়ান আমলের বর্ণবাদ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ভালো গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তা থেকে দেখা যায়, তখনকার ইংল্যান্ডে বেশ কয়েক হাজার কালো লোক বাস করতেন এবং তাঁদের দারিদ্রের সীমা ছিলো না। তার চেয়েও বড় কথা, সমাজের বিভিন্ন স্তরের অনেক লোক এদের প্রতি সহানুভূতিবর্জিত ব্যবহার করতেন। ১৮৬৫ সালের টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে যেমন লন্ডনের দু শো ভারতীয় ভিখিরির করুণাবস্থা এবংতাঁদের প্রতি সমাজের নিতান্ত নির্দয় আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন একজন ছাত্র। হেনরি মেহিউও তাঁর বইতে (১৮৬১) ভারতীয় ভিখিরিদের করুণ অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন।৩০ ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত The Asiatics in England নামে আর-একটি বইতে দেখতে পাই, লন্ডনের রাস্তায় ভারতীয় নাবিকরা কী শোচনীয় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন।৩১ মাইকেল ছিলেন অত্যন্ত স্পর্শকাতর ব্যক্তি। কলকাতা অথবা মাদ্রাসে তিনি ইংরেজদের বর্ণবাদী মনোভাব দেখে তাঁদের বন্ধু হতে পারেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছিলেন সবাই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, অথবা এমন ইংরেজ যাঁরা বর্ণবাদী ছিলেন না। ইংল্যান্ডে আসার পর তিনি বাধ্য হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে থেকেছেন, কিন্তু ঘরে- বাইরে ইংরেজদের প্রভুসুলভ মনোভাব দেখে তাকে মেনে নিতে পারেননি। ফ্রান্সে তিনি এই মনোভাব দেখতে পাননি। সে জন্যে গৌরদাসকে পরে লিখেছিলেন, ‘ফ্রান্সে তোমাকে কেউ ড্যাম্‌ড্‌ নিগার বলে গালি দেবে না। এখানে তুমি তোমার প্রভুদেবও প্রভু।৩২ শ্যামলা চামড়ার মাইকেল লন্ডনে আসার ষোলো বছর পরে আসেন প্রায় ইংরেজদের মতো ফর্শা চামড়ার এবং ইংল্যান্ডের সমাজে আগে থেকে পরিচিত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে দেখে রাস্তার ছেলেমেয়েরা কি রকম ব্ল্যাকি বলে বিশ্বয় এবং কৌতুহল প্রকাশ করেছিলো রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিতে তা লিখেছিলেন। এমনকি, তিনি যখন ডক্টর জন স্কটের বাড়িতে টাকা-দেও্যা অতিথি হিশেবে থাকতে চান, তখন সে বাড়ির দুই কন্যা ‘জঙ্গলি’ রবীন্দ্রনাথের প্রতি কেমন মনোভাব দেখিয়েছিলেন, তাঁর চিঠি থেকে তার সকৌতুক কিন্তু সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায়।৩৩ ডক্টর স্কট এবং তাঁর স্ত্রী মেরীর স্নেহবশত রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাড়ির আবহাওয়া অচিরে বদলে গেলেও মাইকেলের ভাগ্য ততো ভালো ছিলো না।

আমরা জানি, মাদ্রাসে যাবার ব্যাপারে এবং সেখানে চাকরি পেতে কবিকে সহায়তা করেছিলেন বিশপস কলেজের বন্ধু চার্লস এগবার্ট কেনেট। ভার্সাই যাবার বুদ্ধি এবং সেখানে গুছিয়ে বসার ব্যাপারেও কোনো পরিচিত লোকের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন – এমনটা অনুমান করা সঙ্গত। এই পরিচিত ব্যক্তি কে — আরও তথ্য উদ্‌ঘাটিত না-হলে বলা সম্ভব নয়। ১৮৬৩ সালের অনেকটা সময় রেভারেন্ড জেমস লঙ ফ্রান্সে কাটিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কবির পরিচয় এবং যোগাযোগ ছিলো। ভারতবর্ষীয়দের ইংল্যান্ড যাবার ব্যাপারে লঙের বিশেষ উৎসাহও ছিলো। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দিগম্বর মিত্রের পুত্র (এবং আবও কয়েকজন) বিলেতে যাচ্ছেন বলে তিনি তাঁর বিভিন্ন সময়ের চিঠিতে উৎসাহের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।৩৪ কিন্তু প্যারিস থেকে লেখা তাঁর কোনো চিঠিতে কবির নাম খুঁজে পাইনি। সে যাই হোক, মাদ্রাসে গিয়ে মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামে পড়িয়ে তিনি এক সময়ে জীবিকা উপার্জন করেছিলেন। অসম্ভব নয় যে, এবারে ভেবেছিলেন ফরাসিদের ইংরেজি পড়িয়ে তিনি জীবিকা উপার্জন করবেন। কাজ করার কোনো রকমের ভরসা না-পেয়ে অথবা মাত্র কয়েক সপ্তাহ সেখানে থাকতে হবে, এ কথা ভেবে তিনি ভার্সাইতে গিয়েছিলেন – এটা বিশ্বাস করা শক্ত। তিনি যথার্থই অনুমান করেছিলেন যে, কলকাতায় টাকাপয়সা নিয়ে যে-জট তৈরি হয়েছে, তা খুলতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। তবে যতোটা সময় লাগবে বলে তিনি ধারণা করেছিলেন, পরে দেখা যাবে, সময় এবং প্রয়াস লেগেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি।

ফ্রান্সে বাস করার জন্যে লন্ডনের তুলনায় মাসে প্রায় এক শো টাকা কম লাগবে — আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্য নিয়ে তিনি লন্ডন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু আয় করার ভরসা যদি করেও থাকেন, তা সফল হয়নি। আগের আলোচনা থেকে দেখেছি, তিনি ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করতেন না। বস্তুত, ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বেশ কয়েক বার তাঁর জীবনের গতি আমূল পাল্টে ফেলেছিলেন। তাঁর খৃস্টান হওয়া, মাদ্রাসে যাওয়া, হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম করা, রেবেকা এবং সন্তানদের ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসা, ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত আসা — সবই এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এসব ঝুকি থেকে তিনি যে সব সময়ে ভালো ফল পাননি, তা কি নিজে হাড়ে হাড়ে টের পাননি? নিরন্তর কল্পনার জগতে বিচরণ করলেও, মাঝেমধ্যে এটা তিনি অনুভব করে থাকবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেমন ১৮৪৭ সালের ডিসেম্বব মাসে তিনি একবারে অজানা মাদ্রাসের দিকে পাল তুলেছিলেন, তেমনি এবারে যাত্রা করলেন সম্পূর্ণ অজানা ভার্সাই শহরের দিকে। ১৮৬৩ সালের জুন মাসের ১৭ তারিখে গ্রেজ ইনে ট্রিনিটি টার্মের লেখাপড়া শেষ করার পবপরই তিনি লন্ডন ছেড়েছিলেন। গ্রেজ ইনে ভর্তির সময়ে তিনি যে-টাকা (এক শো পাউন্ড) জমা রেখেছিলেন, এ সময়ে তিনি তার মধ্য থেকে ২০ পাউন্ড ধার করেন।৩৫ এ থেকে অনুমান হয়, হেনবিয়েটা যে-টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন, তার পরিমাণ বেশি ছিলো না। তাঁর জীবনীকারদের কেউ কেউ বলেছেন যে, তিনি প্রথমে প্যারিসে এবং তারপরে ভার্সাইতে বাস করেন।৩৬ এই বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্য অথবা যুক্তি তাঁরা দেননি। আমার কাছে এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, তিনি ফ্রান্সে গিয়েছিলেন সেখানে কম ব্যয়ে বেঁচে থাকার জন্যে। প্যারিস তখনো বড়ো নগরী এবং সেখানকার জীবনযাত্রা ভার্সাই থেকে মহার্ঘ হবে — এটা জানা কথা। সমকালীন একটি ইংরেজি ভ্রমণ কাহিনী থেকে দেখেছি, তখন প্যারিসের একটা মোটামুটি ভালো রেস্তোরাঁয় এক বেলা খেতে ব্যয় হতো দেড় শিলিং — তখনকার প্রায় দুই ফ্র।৩৭ সেকালে এ অর্থ দিয়ে অনেকের এক সপ্তাহ চলে যেতো। আসলে যা হয়ে থাকবে, তা হলো: তিনি ভার্সাইতে যাবার পথে কদিন পারিসে থাকেন। এর আগে তিনি কখনো প্যারিসে গেছেন বলে মনে হয় না। কাজেই আর্থিক অনটন থাকা সত্ত্বেও প্যারিস ঘুরে দেখা তাঁর মতো কৌতূহলী ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিক।

প্যারিস থেকে প্রায় পনেরো মাইল দূরে অবস্থিত ভার্সাই নগরীতে ছিলো ফ্রান্সের এক কালের প্রতাপশালী রাজার প্রাসাদ। রাজা চতুর্দশ লুই সপ্তদশ শতাব্দীতে এই বিশাল এবং বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরি করেন। তাঁর কর্মচারী, প্রহরী এবং সৈন্যসামন্ত আর তাঁদের পরিবার মিলে এই ছোট্টো শহর গড়ে ওঠে ১৬৭১ সাল থেকে। রাজার প্রাসাদ এতো বড়ো ছিলো যে, প্রাসাদেই প্রায় হাজার খানেক কর্মকর্তা এবং তাঁদের প্রায় চার হাজার সহায়ক কর্মচারী বাস করতেন। এক শো বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে এই শহর ছিলো ফ্রান্সের রাজধানী। সে জন্যে ফরাসি বিপ্লবের প্রথম ঢেউও বয়ে গিয়েছিলো এই শহরের ওপর দিয়ে। মাইকেল যখন এই শহরে বাস করতে যান, তার ২৬ বছর আগে লুই ফিলিপ রাজপ্রাসাদকে একটা মিউজিয়মে পরিণত করেন। সমস্ত রোরোপের মধ্যে এখনো যেসব জায়গা দেখতে সবচেয়ে বেশি লোক ভিড় জমান, ভার্সাই প্রাসাদ তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৮৬০ এর দশকে এই শহরের জনসংখ্যা ছিলো মাত্র হাজার চল্লিশ। (সওয়া শো বছর পরে এখনো এর জনসংখ্যা এক লাখের কম। ১৯৮২ সালের জনসংখ্যা ৯১ হাজার।) কবি এই শহর ছেড়ে কলকাতা চলে আসার মাত্র কয়েক বছব পর জর্মান সৈন্যরা ১৮৭০ সালে প্যারিস দখল করে। এর পর আর একবার ভার্সাই শহর প্রশাসনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৭১ সালে জার্মান সম্রাটের অভিষেক অনুষ্ঠিত হয় এই শহরে। জার্মান চলে যাবার পর আট বছর ধরে ভার্সাই-এব রাজপ্রাসাদ ছিলো ফরাসি প্রজাতন্ত্রের পার্লামেন্ট-ভবন।

ভার্সাইতে তাঁর জীবনের পরবর্তী আড়াই বছরের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, তিনি সেখানে কোনো কাজ পাননি। সামান্য যে-টাকাপয়সা তখনো হাতে ছিলো, তা দিয়ে যাতে সবচেয়ে বেশি সময় টিকে থাকা যায়, তার জন্যে তিনি অথবা হেনরিয়েটা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। জানুআরি মাস নাগাদ, তাঁর যে-সঞ্চয় ছিলো, তা ফুরিয়ে যায়। তারপর থেকে জমতে থাকে দেনা। তিনি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন রু দ্য শাঁতিয়ে নামে একটি রাস্তায়। এই রাস্তার ১২ নম্বর বাড়িতে। তিন তলার এই বাড়িটি ছিলো নিতান্তই ছোটো এবং এই বাড়িতে থাকতো ১৮টি পরিবার। ভার্সাই-এর সবকারী আর্কাইভসে রক্ষিত নথি থেকে দেখা যায়, ১৮৬৪-৬৭ সালে এই বাড়ির মোট আঠারোটি পরিবাবের মধ্যে বারোটি পরিবার দাতব্য তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য নিয়েছিলো।৩৮ এ থেকে বোঝা যায়, তিনি কতো নিচু মানে এবং শস্তা একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন এবং পড়শি হিশেবে তিনি কোন ধরনের লোকদের পেয়েছিলেন।

অবশ্য এই পবিবেশকে মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁর কোনো উপায় ছিলো না। তদুপরি, নিজের বাড়ি যেমনই হোক না কেন, ভার্সাই ছিলো সুন্দর শহর। বিশেষ করে বিশাল রাজপ্রাসাদ এই ছোট্টো শহরটিকে এর ক্ষুদ্রতা থেকে অনেক ওপরে টেনে তুলেছিলো। আগেই দেখেছি, তিনি হ্যাম্পটন কোর্টের প্রেমে পড়েছিলেন। এখন তার চেয়ে অনেক বড়ো এবং আড়ম্বরপূর্ণ এই ভার্সাই প্রাসাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে তাঁর সময় লাগেনি। তাঁর ফ্ল্যাট থেকে এই প্রাসাদের দূরত্ব ছিলো আধ-মাইলের মতো। তিনি যে মাঝেমধ্যে এই প্রাসাদের কাছে গিয়ে এর বাগানে বসে থাকতেন, বাগানের পাশের খিড়কির পুকুরে মাছ আর হাঁসদের খেতে দিতেন, তা তাঁর নিজের জবানি থেকে জানা যায়।৩৯ তিনি যখন ভার্সাইতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন, তখন গরমের সময়। তিনি অথবা তাঁর পরিবার লন্ডনের শীত মোটেই পছন্দ করেননি। অপেক্ষাকৃত গরম আবহাওয়ায় এসে তাঁরা আবাম বোধ করেন। এ ছাড়া, ফুলে-ফুলে এ প্রাসাদের বাগানই নয়, সমস্ত ভার্সাই সুন্দরী হয়ে ওঠে — এখনকার ঘনবসতি আর ব্যাপক সবুজ নিধনের পরেও সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। এক দিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি, অন্য দিকে মোটামুটি গুছিয়ে বসার পর তুলনামূলকভাবে স্বস্তির সময়ে তাঁর মনে আবার কবিত্ব জেগে ওঠে। তিনি আর-একটি মহাকাব্য লেখার পরিকল্পনা করেন। এবারে বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন মহাভারত থেকে — দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর। এ কাব্য তিনি রচনা শুরু করেন ৯ সেপ্টেম্বর (১৮৬৩) তারিখে।

এটি যে একটি মহাকাব্য হবার কথা ছিলো, তা গোড়াতেই বন্দনা অংশে তিনি বলে নিয়েছেন। মেঘনাদবধের পুনরাবৃত্তি তিনি করতে চাননি — ‘নবীন ছন্দে সে মহাকাহিনী/কহিবে নবীন কবি বঙ্গবাসী জনে’ — তাঁর এই প্রতিশ্রুতি থেকে এটা বোঝা যায়। তিনি এ কাব্যের মাত্র তিরিশ পঙ্‌ক্তির মতো লিখেছিলেন। কিন্তু এটুকু লেখার পরেই পরিশীলনে বিশ্বাসী কবি নিজের রচনা নিয়ে অতৃপ্তি বোধ করেন। তা ছাড়া, তিনি অনুভব করেছিলেন যে, নবীন ছন্দে এ কাব্য রচনা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি মেঘনাদবধের মতো এ কাব্যও শুরু করেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ দিয়ে। সে জন্যে, তিনি এ অংশটি দ্বিতীয় বার লিখে ফেলেন। এবারে সত্যি সত্যি তিনি পৰীক্ষা করলেন নতুন ছন্দ নিয়ে। লিখলেন সেই ছন্দে — পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথেব দৌলতে যা সমিল প্রবহমান পয়ার বলে বিখ্যাত হয়েছে।

কেমনে রখীন্দ্র পার্থ পরাভবি রণে

লক্ষ রণসিংহ শূরে পাঞ্চাল নগরে

লভিলা দ্রুপদবালা কৃষ্ণামহাধনে,

দেবের অসাধ্য কৰ্ম সাধি দেবরে, —

গাইব সে মহাগীত। এ ভিক্ষা চরণে

বাগ্‌দেবি! গাইব মা গো নব মধুস্বরে,

কর দয়া, চিরদাস নমে পদাম্বুজে,

দয়ার আসরে উর দেবি শ্বেতভুজে

মাইকেল এই ছন্দে লিখেছিলেন মাত্র তিরিশ পঙ্‌ক্তি। তা না-হলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমিল প্রবাহমান পয়ার ছন্দ সৃষ্টি করার কৃতিত্বও তাঁরই প্রাপ্য হতো। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এ কাব্য তিনি শেষ করতে পারেননি। নিদারুণ আর্থিক সংকট এবং প্রতিকূল প্রতিবেশ নিশ্চয় একটা কারণ। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কারণ তিনি নিজেই বন্ধু গৌরদাসকে লিখেছেন: ‘সেই নেশাটা কেটে গেছে।’৪০ সে জন্যে কাহিনীটাকে এগিয়ে নিতে পারলেন না। অথচ নতুন ছন্দে নতুন কাহিনী শোনাবার যে-বাসনা তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছিলো, তাও তাঁকে অলস হয়ে বসে থাকতে দেয়নি। সুতরাং প্রায় অভিন্ন ভাষায় ‘নবীন ছন্দে সে মহাকাহিনী কহিবে নবীন কবি বঙ্গবাসি-জনে’ –এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি রচনা শুরু করলেন ‘সুভদ্রা-হরণ’। এবারে লিখলেন ৬১ পঙক্তি। কিন্তু এবারেও কাহিনীর ভেতরে ঢুকতে পারলেন না। তার আগেই উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। তার পর তিনি নির্বাচন করলেন পাণ্ডববিজয়ের কাহিনী। প্রারম্ভে সেই একই প্রতিশ্রুতি লক্ষ্য করি – ‘সে মহাকাহিনী নববঙ্গে বঙ্গজন’কে শোনাবেন। কিন্তু সতেরো পক্তির বেশি লিখতে পারেননি।

যে-কাব্য তিনি লিখতে পাবেননি, তা কেমন হতো, সে সম্পর্কে মন্তব্য করা অসঙ্গত। কিন্তু অনুমান করি, তিনি তাঁর প্রস্তাবিত মহাকাব্য লিখতে পারলে তার মধ্যে মেঘনাবধকাব্যের চেয়ে বেশি পরিণতি লক্ষ্য করা যেতো। মেঘনাদবধ লেখার পরে তিনি যে কেবল ছন্দের ক্ষেত্রে অনেক দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তাই নয়, যোরোপে এক বছর থাকার অভিজ্ঞতাও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে অনেক প্রশস্ত এবং পরিণত করেছিলো। প্রসঙ্গত, মেঘনাদবধে তাঁর প্রাসাদ বর্ণনার কথা মনে রাখা যেতে পারে। তিনি যখন এ কাব্য লিখেছিলেন তখনো তিনি কোনো রাজপ্রাসাদ দেখেননি। অংশত মূল কাহিনী, অংশত কল্পনার ওপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছিলেন। কিন্তু, ধরা যাক, হ্যাম্পটন কোর্ট এবং ভার্সাই-এর রাজপ্রাসাদ দেখার পরে তিনি যদি লিখতেন, তা হলে ঐশ্বর্যের বর্ণনা কেবল আরও বাস্তবসম্মত হতো তাই নয়, অনেক বেশি আড়ম্বরও দেখা দিতে বলে অনুমান করা যায়।

আসলে গদ্যময় পরিবেশ কাব্য রচনায় আন্তরিক অনুপ্রেরণা দিতে পারেনি। তাঁকে দৃষ্টি এবং মন দিতে হয়েছে প্রতিদিনের সমস্যার দিকে। টাকা ফুরিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে লন্ডনে ফিরে গিয়ে মিকেলমেস টার্ম ধবার সময়ও এগিয়ে আসছিলো। সুতরাং একটার পর একটা পত্রাঘাত করতে থাকলেন দিগম্বর মিত্র, বৈদ্যনাথ মিত্র, বি এন মিত্র এবং হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু তাঁর পৌনঃপুনিক পত্রাঘাত সত্ত্বেও, এঁদের কাছ থেকে এ সময়ে তিনি কোনো টাকাপয়সা পাননি। এমন কি, যাঁর ওপর অমন ভরসা করেছিলেন, সেই দিগম্বর মিত্রের কাছ থেকে কোনো চিঠিও না।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে (১৮৬৩) তিনি আবার লন্ডন যাত্রা করেন। পরিবার থাকলো ভার্সাইতে। নভেম্বর মাসের মিকেলমেস টার্মের দৈর্ঘ্য মাত্র ২৪ দিনের — দোসরা থেকে পঁচিশে। সেখানে আরও ছটি ডিনার খেয়ে তিনি দ্রুত আবার ফিরে যান ভার্সাইতে। মনোমোহন ঘোষের কাছ থেকে তিনি আড়াই শো টাকা ধার করার কথা লিখেছিলেন৪১, সেটা এ সময়ে কিনা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এ সময়ে তিনি গ্রেজ ইনে আবার অনুরোধ জানান তাঁর জমা-দেওয়া টাকা থেকে ২৫ পাউন্ড ধার দেবার জন্যে। তিনি যে পরিবার নিয়ে বিদেশে-বিভুয়ে অর্থসঙ্কটের মুখে দারুণ বিপদে আছেন, দরখাস্তে তা লিখতে ভুলে যাননি। তাঁর এই করুণ আবেদন গ্রেজ ইনেব পেনশন কমিটি বিবেচনা করে ২২ ডিসেম্বর (১৮৬৩)। এবং তাঁর আবেদন মোতাবেক তাঁকে ২৫ পাউন্ড ধাব দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।৪২ এই টানাটানির সময়ে হেনরিয়েটা তৃতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন। উদ্বিগ্ন কবি তাঁর জামিন এবং দেনাদারদের কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে চিঠিপত্র লিখতে থাকেন। তারপর জানুয়ারি মাস থেকে জমতে থাকে তাঁর দেনার বোঝা। দেনা বাড়িওয়ালার কাছে, দেনা পাড়ার দোকানদারদের কাছে। নিজেদের যে-সব মূল্যবান জিনিশপত্র ছিলো, একে একে সেসব চলে যায় বন্ধকী দোকানের ভাণ্ডারে। তবু কলকাতা থেকে তিনি কোনো টাকা পাননি — যদিও এপ্রিল মাস (১৮৬৪) নাগাদ কবির হিশেব অনুযায়ী মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর প্রায় চার হাজার টাকা অথবা ৪০০ পাউন্ড পাওনা হয়েছে।৪৩ তা দিয়ে সপরিবারে তাঁর পক্ষে ভার্সাই-এর মতো জায়গায় খেয়ে-পরে প্রায় ষোলো মাস বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো। চরম অর্থকষ্টের মধ্যে এ সময়ে তিনি শারীরিক পরিশ্রমের কাজসহ কোনো রকমের কাজ করেছেন কিনা জানার উপায় নেই। অবশ্য তেমন কাজ করার মতো মানসিকতা তাঁর ছিলো না।

তিনি আশা করে থাকেন যে, তাঁর জামিনদারদের তাগাদা দিয়ে তিনি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারবেন। ১৮৬৩ সালের জুন মাস থেকে আরম্ভ করে পরের বছর মার্চ মাসের আগেই কবি দিগম্বর মিত্রকে পাঁচখানা চিঠি লেখেন। কিন্তু দিগম্বর মিত্রের কাছ থেকে একখানা চিঠিরও উত্তর পাননি। হতাশ কবি তেসরা মার্চ (১৮৬৪) তারিখে দিগম্বর মিত্রকে ষষ্ঠ চিঠি লেখেন। দিগম্বর মিত্র যাতে চিঠি পাওয়ার কথা অস্বীকার করতে না-পারেন, তার জন্যে এ চিঠি তিনি পাঠান তাঁর পুরোনো সহকর্মী, পুলিশ অফিসের কর্মচারী প্রাণকৃষ্ণ ঘোষের৪৪ চিঠির মধ্যে। যথাসময়ে (প্রায় তিন মাস পরে) তিনি প্রাণকৃষ্ণ ঘোষের কাছ থেকে তাঁর চিঠির জবাব পান, কিন্তু দিগম্বর মিত্ৰ তখনো নীরব। তবে তিনি যে তাঁর কথা একেবারে ভুলে যাননি, ফেব্রুয়ারি মাসে বৈদ্যনাথ মিত্রের একখানা বিরল পত্রে তিনি সে কথা জানতে পেরেছিলেন। বৈদ্যনাথ লিখেছিলেন যে, মহাদেব চট্টোপাধ্যায় মাইকেলকে পাঠানোর জন্যে ৫০০ টাকা নিয়ে এসেছিলেন। (ততো দিনে ১৮-৬২-৬৩ সাল বাবদে তাঁর অবশ্য পাওনা হয়েছিলো এক হাজার টাকার চেয়েও বেশি।) এজন্য, দিগম্বর মিত্র তাঁকে এক হাজার টাকা নিয়ে আসার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। বৈদ্যনাথ প্রসা দিয়েছিলেন, সে টাকা সত্বর পাঠানো হবে। অতি তুরায় টাকা পাঠানোর কথা আলিপুর কোর্টের বি. এন. মিত্রও লিখেছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসে।৪৫

তদুপরি, দিগম্বর মিত্র তাঁর প্রথম অনেকগুলো চিঠির উত্তর না-দিলেও, জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে অথবা অগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাঁর কাছ থেকেও কবি (এক বছরের ব্যবধানে) একটি চিঠি পান। এর পূর্ববর্তী দশ মাসের মধ্যে তিনি দিগম্বর মিত্রকে মোট আটখানা চিঠি লিখেছিলেন। ইতিমধ্যে বেকার অবস্থায় রু দ্য শাঁতিয়ের দোকানদারদের কাছ থেকে ধার করে আর পরিচিতদের দয়ায় তিনি এবং তাঁর পরিবার কোনো মতে বেঁচে থাকেন। তিনি যে-বাড়িতে ছিলেন, তার বাসিন্দাদের মধ্যে বেশির ভাগ সরকারী দাতব্য তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য পেলেও, তিনি কোনো সাহায্য পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। কবির দারুণ অভাব সত্ত্বেও তাঁর নাম ভার্সাই-এর সরকারী আর্কাইভসে বক্ষিত নথিতে খুঁজে পাইনি। তা থেকে ধারণা হয়, তিনি ভিন দেশের নাগরিক হওয়ায় সরকারী দাতব্য তহবিল থেকে সাহায্য পাননি। তবে সেকালে সরকারী সাহায্যের চেয়ে চার্চও কম সাহায্য করতো না। তিনি যে চার্চের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁর চিঠি থেকে তা জানা যায়। একবার সাহায্য নেবার কথা তিনি নিজেও উল্লেখ করেছেন।৪৬ এ ছাড়া, কতো বার তিনি চার্চের সাহায্য নেন, তার বৃত্তান্ত আমাদের জানা নেই। ১২ নম্বর রু দ্য শাঁতিয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু ডানে গেলেই রাস্তার বাঁ দিকে একটি গলি। সেখানে একটি চার্চ। কবির বাড়ি থেকে মিনিট তিনেকের পথ। চরম অভাবের সময়ে তিনি এবং তাঁর পরিবার এই চার্চের দয়া পেয়েছিলেন, এ প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। তা ছাড়া, তিনি পেয়েছিলেন তাঁর ফ্ল্যাট-বাড়ির অন্য দরিদ্র বাসিন্দাদের কাছ থেকে সহানুভূতি এবং দয়া। তাঁদের কেউ কেউ তাঁর ঘরের সামনে খাবার রেখে যেতেন — নগেন্দ্রনাথ সোম এ কথা উল্লেখ করেছেন।৪৭ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না, তিনি এ রকমের দয়া গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু চরম অভাবের মধ্যে মানুষ আত্মসম্মানও বিসর্জন দিতে পারে। এ সময়ে মাঝেমধ্যে তাঁকে যে অনাহার এবং অর্ধাহারে থাকতে হতো — তাঁর চিঠি থেকে তার আভাস পাওয়া যায়।৪৮ তাঁর দারিদ্র্য কী শোচনীয় ছিলো, পরের আলোচনা থেকে আমরা তা দেখতে পাবো।

তিনি ভাবতে পারেননি, তাঁর প্রতিনিধি এবং অন্য বন্ধুরা এতো মাসের মধ্যেও তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবেন না। দেশ থেকে যে-কোনো মুহূর্তে টাকা আসবে- এই ভরসায় তিনি মে মাস (১৮৬৪) নাগাদ আপাদমস্তক ঋণজালে জড়িয়ে পড়েন। যাঁদের কাছ থেকে তিনি ধার করেছিলেন, তাঁর ওপর বিরক্ত হয়ে তাঁরা শেষ পর্যন্ত আদালতে নালিশ করেন, অথবা নালিশ করবেন বলে ভয় দেখান। তাঁর কোনো সম্পত্তি ছিলো না, যা বিক্রি করে তাঁর ঋণ শোধ করা সম্ভব হতো। সে কারণে তিনি আশঙ্কা করতে থাকেন যে, ঋণদাযে তাঁকে কারাগারে যেতে হবে এবং তাঁর পরিবারকে আশ্রয় নিতে হবে সরকারী দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। একদিকে জেল এবং অন্যদিকে অনাহারে মারা যাবার ভয়ানক আশঙ্কার মুখে, তদুপরি অসুস্থ শরীর নিয়ে, কলকাতা ত্যাগ করার দু বছর পরে — ১৮৬৪ সালের দোসরা জুন তারিখে তিনি চিঠি লেখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। চিঠিতে তিনি অবশ্য বিদ্যাসাগরকে তাঁর বিদ্যার কথা নয়, মনে করিয়ে দেন তাঁর দয়ার কথা।

দিগম্বব মিত্রের ওপর ভরসা করে আমি যে-নিদারুণ অবস্থায় পড়েছি আপনি একমাত্র বন্ধু যিনি তা থেকে আমাকে উদ্ধার করতে পারেন। এ অবস্থায় আপনার প্রতিভার নিত্যসঙ্গী যে-বিবাট শক্তি এবং আপনার পুরুষোচিত যে-হৃদয়, তা নিয়ে আপনার কাজ প্রতে হবে। একটি দিনও নষ্ট করা যাবে না। … দিগম্বর মিত্র নিষ্ঠুরভাবে আমাকে যে-সাগরে ডুবতে দিয়েছেন, আপনি যদি অক্টোবর মাসের মধ্যে আমাকে তা থেকে রক্ষা করেন, এবং আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি যে, আপনি তা অবশ্যই করবেন, তা হলে আমি প্রেজ ইনে ফিরে যাবো এবং সেখান থেকে যথাসময়ে ভারতে ফিরে যেতে পারবো। তা না-হলে আমার বিনাশ সুনিশ্চিত। আমি মনে করিনে, আপনি তা হতে দেবেন। … আপনাকে যে-ঝামেলা দিচ্ছি, তার জন্যে আমি কি আপনার কাছে ক্ষমা চাইবো? — আমি তা মনে কবিনে, কারণ আপনাকে আমি অন্তত এতোটা জানি যাতে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, আপনি একজন বন্ধু এবং আপনার এই দেশবাসীর মর্মান্তিক সর্বনাশ আপনি হতে দেবেন না। … দয়া করে আমাকে উপরের ঠিকানায় ফ্রান্সে লিখবেন, কারণ ঈশ্বর এবং তাঁর নিচে আপনি সাহায্য না-করলে আমার পক্ষে এ দেশ ত্যাগ করার পার্থিব কোনো সম্ভাবনা নেই। … আমার দুঃখের কথা শুনে আপনার কোমল হৃদয় ভেঙ্গে যাবে।

তখন ফ্রান্স থেকে ভারতবর্ষে চিঠি যেতে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ লেগে যেতো। সুতরাং এ চিঠি বিদ্যাসাগর জুলাই মাসের মাঝামাঝির আগে পাননি। কিন্তু চরম হতাশা এবং শোচনীয় দুর্দশার মধ্যে অপেক্ষা করার অথবা ধৈর্য ধরার মতো মনের অবস্থা কবির ছিলো না। পরবর্তী চার সপ্তাহে বিদ্যাসাগরকে তিনি চারটি চিঠি লেখেন। প্রতিটি চিঠিতেই নিজের শোচনীয় অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ৯ জুনের চিঠিতে যেমন লেখেন, দিগম্বর মিত্র, বৈদ্যনাথ মিত্র আর মহাদেব চট্টোপাধ্যায় একযোগে তাঁকে কেমন অকল্পনীয় বিপদে ফেলেছেন।

আমি সব সময়ে ভাবতাম দিগম্বর মিত্র একজন বদান্য, উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ। একমাত্র ঈশ্বর জানেন কিসে আমাদের প্রতি তার মনের পরিবর্তন হলো। আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, তাঁর ওপর অতো ভরসা করার জন্যে তিনি আমাদের যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছেন। অবশ্য আমার মতো একজন গরিব মানুষ তাঁর ওপর অখুশি হলে তাঁর কী আসে-যায়। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনে, তিনি তাঁর নিজের বিবেকের কাছে কী বলে জবাবদিহি করবেন। কয়েক হাজার টাকা মিহাদেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একটা মস্তা ব্যাপার। এর জন্যে সে যা কিছু করতে প্রলুব্ধ হতে পারে। কিন্তু দিগম্বর মিত্র কী করে এমন একটা ঘৃণ্য ব্যাপারে সম্মতি দেন? এর জবাব আমার জানা নেই। সত্যি নেই। মহাদেব চট্টোপাধ্যায় হলো একটা নিচ, কাপুরুষ এবং সংকীর্ণমনা লোক (যদিও এক সময়ে আমি তাঁর সম্পর্কে অন্য রকম ভাবতাম)। সে টাকা দিতে ঘৃণা করে — যেন সে টাকাটা তার নিজের। বৈদ্যনাথ মিত্র হলো আফিমখোর, আপনি বুঝতেই পারেন, তার কাছ থেকে কি আশা করা যায়।

আপনি জেনে খুশি হবেন যে, এক সুন্দবী দল এবং করুণাময়ী ফরাসি তরুণীর দয়ায় জেলে যাওয়ার অপমান থেকে আমি বেঁচে গেছি। এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় রেলগাড়িতে। সেই থেকে তিনি আমাদের ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখিয়েছেন। তা ছাড়া, আমাদের দুঃসময়ে তিনি আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং তাঁর টাকাপয়সা দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন। তিনি আমাদের বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, যা কেবল একজন ফরাসি মহিলার পক্ষেই বলা সম্ভব। বাড়িওয়ালা তার কথায় লন্ডনে আমার এক বন্ধুর জামিনে আমাদের এ মাসের শেষ পর্যন্ত থাকতে দিতে রাজি হন। … একমাত্র ঈশ্বর জানেন, তাঁরা [দিগম্বর ও অন্যান্য] যদি আমাকে মে মাসের ৯ অথবা ২৩ তারিখের ডাকে টাকা না-পাঠিয়ে থাকেন, তা হলে আমরা কি করে বেঁচে থাকবো। হায়, তাঁরা যে পাঠিয়েছেন, তা মনে করারই বা আমার কি কারণ আছে? আমি এর মধ্যে তিনটি টার্ম খুইয়েছি। আমি যেমনটা হিশেব করেছিলাম, তার চেয়ে য়োরোপে আমার এখন এক বছর বেশি থাকতে হবে – যদি আদৌ গ্রেজ ইন আমাকে গ্রহণ করে।

মাইকেল সহজে অন্যকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দিগম্বর মিত্রদের আচরণে তিনি ততোদিনে সন্দেহপ্রবণ হতে আরম্ভ করেছেন। সে জন্যে, তাঁর মনে হলো, কি জানি, দিগম্বর মিত্ররা চেষ্টা করতে পারেন, যাতে বিদ্যাসাগরও তাঁকে সাহায্য না-করেন। তাই লিখলেন:

লোকেরা আপনার পথে হয়তো বাধা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু আশা করি, আপনি সব বাধা দূর করতে সমর্থ হবেন। আপনি যদি আমাকে আগামী অক্টোবর শেষ হবার আগেই কলকাতার ঐ লোকগুলোর হাত থেকে মুক্ত না-করেন, তা হলে আমি চিরতরে ডুবে যাবো। আমি আপনার উত্তর আশাকরছি অগস্ট মাসের ২০/২১ তারিখের দিকে। আশা করি তার তার আগেই আমরা অনাহারে মারা যাবো না। … কলকাতার লোকেরা আপনার কাছে নিশ্চয় আমাদের বিষয়ে মিথ্যা কথা বলে। আপনি তাতে কান দেবেন না। আপনার কাছে অনুবোধ করছি, দয়া করে আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন।

এ সময়ে কলকাতা থেকে মাসে চারটি ডাক যেতো যোরোপের উদ্দেশে। বোম্বাই হয়ে যেতো ৫ আর ১৮ তারিখে; এবং সরাসরি কলকাতা থেকে যেতে ৯ আর ২৩ তারিখে। এর মধ্যে বোম্বাই- এর ডাক য়োরোপে যেতে দু-চারদিন কম সময় লাগাতো। সে জন্যে মাইকেল বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ জানান বোম্বাই-এর ডাকে চিঠি পাঠাতে। বিদ্যাসাগরকে লেখা তাঁর প্রথম চারটি চিঠিতে (২, ৯ ও ১৮ জুন এবং ৪ জুলাই) তিনি প্রধান যে-অনুরোধ জানান, তা হলো তাঁর সম্পত্তি বন্ধক রেখে টাকা পাঠাতে। তিনি লেখেন যে, তাঁর সম্পত্তির বার্ষিক খাজনা ১৫০০ টাকা। সুতরাং বিদ্যাসাগর যেন এই সম্পত্তি ক্যালকাটা ল্যান্ড মর্টগেজ কম্পেনির কাছে বন্ধক রেখে অবিলম্বে ১৫ হাজার টাকা তুলতে চেষ্টা করেন। এর মধ্য থেকে তিনি দু হাজার টাকা যেন ফ্রান্সে পাঠান। তারপর কলকাতায় তাঁর যে-চার হাজার টাকা ঋণরয়েছে সেটাশোধ করে বাকি ৯ হাজার টাকাও যদ্রসম্ভব তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেন। তাঁর অভাব যে কী তীব্র, তা বোঝা যায়, ১৮ জুন তারিখের চিঠি থেকে। এতে তিনি লিখেছেন:

কলকাতা থেকে ৯ মে যে-ডাক ছেড়েছে, তা এখানে পৌছে গেছে; কিন্তু আমি এবারেও হতাশ হয়েছি। অনাহার থেকে বাঁচার জন্যে আমি বাধ্য হয়েছি একজন ইংরেজ পাদ্রির কাছে আবেদন জানাতে। তিনি তাঁর দরিদ্র-তহবিল থেকে আমাকে ২৫টি ফ্র ধার দিয়েছেন। সেটা হলো ন টাকার মতো। একমাত্র ঈশ্বর জানেন, এ মাসের বাকি দুটো ডাকের কোনোটায টাকা না-এলে আমাদের কী হবে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তা হলে আমাদের একেবারে বিনাশ হবে। হে বিধাতঃ, [বৈদ্যনাথ মিত্রবা] কি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন যাতে আমরা য়োরোপে খতম হযে যাই?

কবি লোকের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলেন। এ কারণে তিনি এই চিঠিটি বিদ্যাসাগরকে পাঠান পূর্বোক্ত প্রাণকৃষ্ণ ঘোষের চিঠির সঙ্গে — একই খামে। অবশ্য সে কথা তিনি চিঠিতে উল্লেখও করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, একবার বিদ্যাসাগরের আশ্রয় চাইবার পর, তাঁর আর মেঘনাদবধের রামের

মতো ‘বৃথা, হে জলধি, আমি বাঁধিনু তোমারে’ বলে কাঁদতে হবে না। ‘আমি যদি ভারতবর্ষে ফিরে যাবার জন্যে বেঁচে থাকি তা হলে আমি আমার দেশবাসীকে বলবো যে, আপনি কেবল বিদ্যাসাগর নন, আপনি করুণাসাগরও।’ বিদ্যাসাগর তাঁর দয়ার জন্যে সেকালে দয়ার সাগর নামে সুবিদিত হয়েছিলেন। কারো দুঃখ দেখলে তাঁকে সাহায্য করা তাঁর অন্যতম ধর্ম ছিলো। সে জন্যে, কবির

এই প্রশংসা শোনার জন্যে তিনি অপেক্ষা করে থাকেননি। তাঁর এই চিঠি পৌছার আগেই তিনি তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

ওদিকে, এই চিঠি লেখার সপ্তাহ খানেক পরে — জুন মাসের শেষ সপ্তাহে — দিগম্বর মিত্রের কাছ থেকে কবি ৮০০ টাকা পান — যদিও ততোদিনে তাঁর পাওনা হয়েছিলো — কবির হিশেব অনুযায়ী — বকেয়াসহ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা, আর দ্বিতীয় চুক্তি অনুযায়ী তিন হাজার টাকা। ফেব্রুয়আরি মাসে বৈদ্যনাথ যে-হাজার টাকা পাঠানোর কথা লিখেছিলেন, এই আট শশা টাকা সেই টাকারই অংশ। ফেব্রুআরি মাসে পাঁচ শশার বদলে এক হাজার টাকা নিয়ে আসার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও মহাদেব মে মাসের মাঝামাঝি কেন মাত্র আট শো টাকা নিয়ে এলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। সে যাই হোক, এই টাকা দিয়ে যে-ধার ছিলো, কবি তারও সবটা শশাধ করতে পারেননি। কিন্তু তবু এই টাকা পেয়ে তিনি আবার নীর অন্ধকারের মধ্যে বাঁচার ক্ষীণ আলোক দেখতে পান। দিগম্বর মিত্রের প্রতিও তাঁর মনোভাব খানিকটা নরম হয়। এ সময়ে তিনিতাঁর প্রকাশক ঈশ্বরচন্দ্র বসুকেও চিঠি লিখেছিলেন। খুব সম্ভব, তাঁর কাছ থেকেও এ সমযেঅথবা এর অল্প দিন পরে তিনি কিছু টাকা পান। পরবর্তী বছরের প্রথম ছ মাসে বই-এর রয়্যালটি বাবদ তাঁর এক হাজার টাকা আয় হয়েছিলো, কবি নিজে তা বিদ্যাসাগরকে লিখেছিলেন। তবে ১৮৬৪ সালের জুন মাসে তিনি দিগম্বর মিত্রের কাছ থেকে যে- টাকা পেয়েছিলেন, প্রযোজনের তুলনায় তা ছিলো নিতান্ত অপ্রতুল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে তিনি তাই আবার চিঠি লেখেন বিদ্যাসাগরকে। তার পরের সপ্তাহে আরও একখানা। এতে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বিদ্যাসাগর ইতিমধ্যে নিশ্চয় তাঁর চিঠি পেয়ে তাঁর তরফ থেকে দরকারী সব ব্যবস্থা নিয়েছেন।

দোসরা অগস্ট অর্থাৎবিদ্যাসাগরকে প্রথম চিঠি লেখার ঠিক দু মাস পরে কবিতাঁকে ষষ্ঠ চিঠি লেখেন। তিনি জানতেন, বিদ্যাসাগর তাঁর চিঠি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাঠালেও, তা পৌছার সময় হয়নি। কিন্তু তখন তাঁর শিরে সংক্রান্তি। ঘরে দুঃসহ অভাব। তার ওপর দু-চারদিনের মধ্যে হেনবিয়েটার সন্তান প্রসব করার কথা।

আমি আপনার ওপর আরও একটা পত্রাঘাত করছি বলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার উদ্বেগের জন্যে আমি লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি ভাবতে পাববেন না আমি কী অসহ্য যন্ত্রণায় আছি। হায়, আমি যে-লোকেদের পেছনে রেখে এসেছি, তাঁরা হলেন — বাইবেলের ভাষায় — কতোগুলো বিষাক্ত সাপ। অবশ্য দিগম্বর মিত্রকে আমি এর অন্তর্ভুক্ত করছিনে। কারণ তিনি অন্য রকমের মানুষ। কিন্তু মহাদেব চট্টোপাধ্যায় এবং ঐ বি. এন. মিত্র! একমাত্র ঈশ্বর জানেন, তাঁরা আপনাকে কতোটা ঝামেলা দেবেন। কিন্তু, প্রিয় বিদ্যাসাগর, আমাকে আপনার অবশ্যই বক্ষা করতে হবে। … ২০ জুনের [আসলে ২০ মের] চিঠিতে দিগম্বব মিত্র আমাকে এক মাসের মধ্যে আরও এক হাজার টাকা পাঠানোর কথা লিখেছিলেন। জুলাই মাসের সব ডাক য়োরোপে পৌছে গেছে। তবু তাঁর কাছ থেকে কালির একটি অচড়ও আমি পাইনি। আমরা সবেমাত্র যে-নিদারুণ [অভাবের] তীর ছেড়ে এসেছি, আবার সেই দিকে ভেসে যাচ্ছি। …এখানে আমার প্রায় ১৭/১৮ শো টাকা দেনা হয়েছে। আর তিনি কিনা আমাকে ৮০০ টাকা পাঠিযেই তারপর সব দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঈশ্বরের নামে বলছি, এটা অসহ্য!… আমার স্ত্রীর যে-কোনো দিন সন্তান হবে। কিন্তু ঘরে ২০ টাকার বেশি নেই। দোহাই ঈশ্বরেব, গ্রিয় বন্ধু, দয়া করে আমাকে এসব থেকে বাচান এবং এই লোকগুলোর কবল থেকে আমাকে ভবিষ্যতেও রক্ষা করুন। … আপনার ওপর আমার গভীর বিশ্বাস আছে, আশা করি, আপনি আমাকে হতাশ করবেন না। যদি করেন, তা হলে আমি যেভাবে পারি ভারতে ফিরে যাবো, তারপব জেনেশুনে পূর্বপরিকল্পিতভাবে একটি কি দুটি খুন করে ফাঁসিতে ঝুলবো।

এ চিঠির ভাষা থেকেই বোঝা যায়, এ সময়ে দুর্বিষহ অভাবের মুখে কবি কী রকম মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে সেটা অস্বাভাবিকও ছিলো না। এই চিঠি লেখার পরের দিন ভোর বেলায় হেনরিয়েটার একটি মেয়ে হয়। কবি নিজে এ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরকে লিখেছেন, তাঁর স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন।৪৯ কিন্তু তিন মাস পরে গৌরদাসকে যে-চিঠি লেখেন, তাতে বলেন, মেয়েটি বেশিক্ষণ বাঁচেনি।৫০ এই কন্যাকে সমাধিস্থ করার দলিল থেকেও মনে হয়, এ সন্তানটি জন্মের পর মারা যায়।৫১

এই শোক এবং তার চেয়েও তীব্র অভাবের মধ্যে ১৮ অগস্ট তিনি আবার বিদ্যাসাগরকে চিঠি লেখেন। প্রথম চিঠিটি লেখার পর দু মাস ষোলো দিন কেটে গিয়েছিলো — তাঁর মনে ক্ষীণ আশা জেগেছিলো যে, ইতিমধ্যে তাঁর কাছ থেকে তিনি একটি চিঠি পাবেন। তা ছাড়া, তাঁকে তিনি হয়তো ক্রমাগত চাপের মুখেও রাখতে চেয়েছিলেন। তাই আরও একবার নিজের নিদারুণ দুরবস্থার কথা তাঁকে মনে করিয়ে দেন:

দিগম্বর মিত্র তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন যে, তিনি মাসখানেকের মধ্যেই এক হাজার টাকা পাঠাচ্ছেন। মস্তো একটা আহাম্মুকের মতো আমি সেই কথা বিশ্বাস করে কেবল মাসখানেক চলার মতো টাকা রেখেছিলাম। কিন্তু দিগম্বর আবার নীরব এবং আমাদের প্রতি উদাসীন হয়ে গেছেন এবং আমরা চরম দুরবস্থায় পড়েছি। কারণ আমার স্ত্রী এ মাসের তিন তারিখে একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন এবং আমার হাতে একটি কানাকড়িও নেই। এ চিঠি লেখার জন্যে যে-ডাকটিকিট লেগেছে, তা-ও কেনা হয়েছে বন্ধকী দোকান থেকে টাকা জোগাড় করে! কোনো লোকের সঙ্গে কেউ কি এমন লজ্জাজনকভাবে ব্যবহার করেছে? বন্ধুবর, আপনি জানেন বদমাশ মহাদেবের কাছে এখনো আমি তিন হাজারের চেয়ে বেশি টাকা পাই, আলিপুর আদালতে এক হাজার আর খিদিরপুরের হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ৫০০! … আমার স্ত্রী এবং আমি দুজনেই মনে করি যে, আপনি নিশ্চয় ইতিমধ্যে আমাদের কাছে লিখেছেন এবং টাকা পাঠিয়েছেন। এবং আগামী ডাকে আমরা তা পাবো। আমি আশা করছি আমাদের এই আশা সুখের সঙ্গে পূরণ হবে।

কবি এবং তাঁর জীবনসঙ্গিনী সত্যি সত্যি আশায় বুক বেঁধেছিলেন, কারণ তাঁরা জানতেন, তাঁরা যাঁর সাহায্য চেয়েছেন, তিনি কেবল করুণাসাগর নন, তিনি যথার্থই বিবেকবান এবং দায়িত্বশীল। তাঁরা একটি একটি করে দিন গুনতে থাকেন। ওদিকে, অভাবের চাপও বাড়তে থাকে। এর মধ্যে রোববার ২৮ অগস্ট তারিখে মেলা বসেছে বাইরে। ঠিক আঠারো দিন পরে শর্মিষ্ঠার বয়স হবে পাঁচ বছর। আর পুত্র ফ্রেডারিকের বয়স তিন বছর পুরো হয়েছে এক মাসপাঁচ দিন আগে। হেনরিয়েটা কবির কাছে এসে সজল চোখে বললেন, ‘ঘরে আছে ৩ ফ্র। শর্মিষ্ঠা মেলায় যেতে চাইছে তার ছোটো ভাইকে নিয়ে।’ কবি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন: “আমরা যাঁর কাছে আবেদন জানিয়েছি, তাঁর আছে প্রাচীন ঋষির মতো প্রতিভা এবং বিচক্ষণতা, ইংরেজের মতো শক্তি আর বাঙালি মায়ের মতো অন্তর। আজ ডাক আসার কথা। দেখো আজকের ডাকে নিশ্চয় টাকা আসবে।’ কবির অনুমান ভুল ছিলো না। এর ঘণ্টাখানেক পরেই তিনি পেলেন বিদ্যাসাগরের চিঠি আর সেই সঙ্গে দেড় হাজার টাকা। — যে-টাকা দিয়ে বেশির ভাগ ধার শোধ দিয়েও কিছু টাকা নিজেদের হাতে থাকলো।৫২ কবি এতে কেমন খুশি হয়েছিলেন এবং কতোটা স্বস্তি লাভ করেছিলেন, তা খানিকটা বোঝা যায় বিদ্যাসাগরকে লেখা পরবর্তী চিঠি থেকে। এতে তিনি বিদ্যাসাগরকে এই টাকা পাওয়ায় সংবাদ আর সেই সঙ্গে অশেষ কৃতজ্ঞতা লিখে জানান। (আমার মহান, আমার বিখ্যাত, আমার সত্যিকার বন্ধু, আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো!) কিন্তু তাঁর সমস্যার তখনো সত্যিকার কোনো সমাধান হয়নি। তাই বিদ্যাসাগরকে মনে করিয়ে দেন:

আমার অবশ্যই আপনাকে আবার বলা দরকার যে, আপনি যদি আমার সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় না-করেন, তা হলে আমার পক্ষে এখানে বেঁচে থাকা অথবা ব্যারিস্টার হয়ে ভারতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ আমি প্রায় এক বছরের মধ্যে কলকাতা থেকে একটি পয়সাও পাইনি। এবং এখানে আমার অনেক ধার হয়েছে। সেসব দেনা শোধ করার জন্যে আমার অবশ্যই যথেষ্ট টাকা পেতে হবে। সেই বদমাশ মহাদেব চট্টোপাধ্যায় যদি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না-করতো, দিগম্বর যদি আমাকে ভুলে না-যেতেন, তা হলে এসব হতো না, কারণ আমরা মোটেই বেহিশেবী নই, এবং আমার স্ত্রী চমৎকারভারে সংসার চালাতে পারেন। কিন্তু টাকা না-পেলে আমরা কী ববে। চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আমি এখনো তিন হাজার টাকার চেয়ে বেশি পাই, তবে তা যথেষ্ট হবে না। আমার আরও টাকা লাগবে।৫৩

এ সময়ে কবির মাসে আড়াই শো টাকা করে লাগতো। ন মাসে তাঁর সেই হিশেবে সওয়া দুহাজার টাকা ঋণ হয়েছিলো। এ ছাড়া, হেনরিযেটার সন্তান জন্মদান এবং অন্যান্য কারণে সব মিলে তাঁর ধার হয়েছিলো প্রায় ২৬ শো টাকা।৫৪ আর দিগম্বর মিত্র এবং বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে তিনি তখন পর্যন্ত মোট টাকা পেয়েছিলেন দু হাজার তিন শশা। এই দুই দফা টাকা দিয়ে তিনি মোট ১২ শো টাকার ধার শোধ করেন। এছাড়া,সংসার চালানোর জন্যে হাতে রাখেন ৮০০ টাকা। তিনি জানতেন, লন্ডনে ফিরে যেতে হলে সব ধার শোধ করে যেতে হবে এবং সেখানে থাকার জন্যেও যথেষ্ট টাকা লাগবে। এ সময়ে তিনি পরিকল্পনা করেন যে, তিনি একা ফিরে যাবেন লন্ডনে। আর পরিবার রেখে যাবেন ভার্সাইতে — যেমনটা তিনি আগের বছরের নভেম্বর মাসেও করেছিলেন। এর পক্ষে তিনি যুক্তি দেখান যে, ফ্রান্সে পরিবার রেখে তিনি একা লন্ডনে থাকলে ব্যয় হবে কম। তিনি হিশেব করেন যে, তা হলে তিনি নিজে লন্ডনে মোটামুটি এক শো টাকায় এবং তাঁর পরিবার ভার্সাইতে আড়াই শো টাকায় — এই মোট সাড়ে তিন শো টাকায় থাকতে পারবেন। (কলকাতা থেকে লন্ডনে আসার সময়ে তিনি নিজের জন্যে মাসে আড়াই শো টাকা লাগবে বলে হিশেব করেছিলেন। তিনি বেশ জোর দিয়ে লেখেন যে, পবের জুলাই মাস (১৮৬৫) পর্যন্ত তাঁকে পরিবার থেকে আলাদা বাস করতে হবে।৫৫ এ ধারণা তাঁর কেন হয়েছিলো বলা মুশকিল। কিন্তু বিদ্যাসাগর এই ধারণার বিরোধী ছিলেন। পরে দেখতে পাবো, তিনি বারবার পবিবার ফ্রান্সে রেখে যাবার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন আর বিদ্যাসাগর বারবার তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, তাঁরা একত্রে থাকলে ব্যয় কম হবে।

সেপ্টেম্বর মাসের গোড়া অবধি তিনি বিদ্যাসাগরকে যতোগুলো চিঠি লিখেছেন, তার প্রত্যেকটিতে সম্পত্তি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করার অনুরোধ জানিয়েছেন। সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হলে তাঁর দলিলপত্র লাগবে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি লাগবে — এ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তাই তিনি বিদ্যাসাগরকে জানান যে, তাঁর কাগজপত্র আছে তাঁর প্রতিনিধি — দিগম্বর মিত্র আর বৈদ্যনাথ মিত্রের কাছে। পৈতৃক সম্পত্তি জীবনের একটা পর্যায়ে যেহেতু পাওয়ার আশা কবেননি এবং এ সম্পত্তি যেহেতু তাঁর নিজের কষ্ট করে অর্জনও করতে হয়নি, সে কারণে এর প্রতি তাঁর দরদ ছিলো সীমিত। কিছু কাল পরে আর-একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: ‘ব্যারিস্টার হিশেবে কলকাতায় গিয়ে আমার যদি একেবারে নতুন করে ভাগ্য তৈরি করতে হয়, আমি তা হলে কিছু মনে করবো না।৫৬ অপর পক্ষে বিদ্যাসাগর কবির মতো বেহিশেবী ছিলেন না। বরং বিষয়বুদ্ধি তাঁর যথেষ্টই ছিলো। হিতাকাক্ষী হিশেবে তিনি সম্পত্তি বন্ধক দেবার প্রস্তাব সমর্থন করতে পারেননি। তাঁর প্রথম চিঠিতে বিদ্যাসাগর এ সম্পর্কে কবির কাছে লিখেছিলেন। কিন্তু কবি তখন এ প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি। তবে দু সপ্তাহ পরে তিনি যখন বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় চিঠির জবাব দেন, তখন বন্ধক না-দিয়ে অন্য কোনো উপায়ে টাকা ধার করার পরামর্শ তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। আসলে ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধু হাই কোর্টের উকিল (পরে বিচারপতি) অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে টাকা ধার পাওয়ার আশ্বাস লাভ করেছিলেন। এর কথা কবি পরবর্তী এক বছর তাঁর চিঠিপত্রে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোথাও তাঁর নাম উল্লেখ করেননি। সব জায়গায়ই বলেছেন ‘আপনার বন্ধু’। এর কারণ জানা নেই। এমন হতে পারে, বিদ্যাসাগর প্রথমে তাঁর নাম জানাননি। সে যাই হোক, কেবল ধার করা নয়, বি. এন. মিত্র এবং মহাদেব চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গেও বিদ্যাসাগর যোগাযোগ করেন এবং তাঁদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা উদ্ধার করতে চেষ্টা করেন। প্রথম কিস্তিতে বিদ্যাসাগর যে-এক হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন, কবি অনুমান করেছেন যে, সে টাকা তিনি আদায় করেছিলেন বি. এন. মিত্রের কাছ থেকে। বিদ্যাসাগরকার কাছ থেকে কতো টাকা আদায় করতে সমর্থ হন, তাঁর চিঠিপত্র রক্ষা না-পাওয়ায়, এখন আর তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে তিনি যে-ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, তা যথেষ্ট মনে করে কবি বিষয়টা তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করেন।

আমি এক সময়ে যেভাবে আমার সম্পত্তি বন্ধক রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তা বাতিল করতে এবং সব কিছু আপনার হাতে ছেড়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ আমি আপনাকে বিবেচনা করি একটা শক্তির মিনার হিশেবে। এবংআমি বেশ নিশ্চিত যে, সম্ভাব্য সকল রকমের পরিস্থিতির জন্যে আপনার ব্যবস্থা যথেষ্ট হবে।৫৭

ওদিকে, দিগম্বর মিত্র এবং মহাদেব চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে মাইকেল যে-রূঢ় ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, তার জন্যে বিদ্যাসাগর তাঁকে ভদ্র কিন্তু দৃঢ়ভাবে ভর্ৎসনা করেন। এ থেকেও ধারণা হয়, মহাদেব চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে কবি যে-অভিযোগ করেছিলেন, তার সবটা সঠিক নয়। আগেই লক্ষ্য করেছি যে, কবি এক হাজার টাকা গ্রহণের মাধ্যমে মহাদেবের সঙ্গে নতুন একটি অলিখিত চুক্তি করেছিলেন। কয়েক বছর পরে কবি যখন তাঁর সম্পত্তি মহাদেবের কাছে বিক্রি করেন, তখনকার। দলিল থেকেও এর সমর্থন মেলে। এ দলিল থেকে দেখা যায় যে, ১৮৬১ সালের পত্তনির দলিলে বছরে তিন হাজার টাকা করে দেবার কথা থাকলেও, কবি একটি রোকা দিযে এই টাকার পরিমাণ আড়াই হাজার করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের ভৎসনার জবাবে কবি নমনীয় মনোভাব দেখান। তা-ও দলিল- অতিরিক্ত কোনো সমঝোতার ইঙ্গিত দেয়। তবে কথা যেমনই থাক না কেন, কবি বিদ্যাসাগরকে জানিয়েছিলেন যে, মহাদেব লোকটি মোটেই সরল নন, বরং ঠকবাজ। বিশেষণ হিশেবে তাঁর নামের আগে ‘বদমাশ’ শব্দটি তিনি বেশ কয়েক বার ব্যবহার করেন। কলকাতা ছাড়ার আগে মহাদেব কিভাবে তাঁকে চক মুনকিয়ার আয় নিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন, তিনি সে ঘটনারও উল্লেখ করেন।৫৮ তাঁর সঙ্গে আদান-প্রদানের ব্যাপারে কবি যে-দ্ব্যর্থহীন অথবা দৃঢ় আচরণ করেননি, মহাদেব তার সুযোগ নিয়ে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে নানা রকমের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি যে খুব সৎ লোক ছিলেন, তা বলা যায় না। ওদিকে, বিদ্যাসাগর তাঁকে অতোটা অসৎবলে বিবেচনা করতেন না। সে জন্যে এর পরেও একাধিক চিঠিতে মহাদেব সম্পর্কে কবির ধারণা বদল করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সরল মাইকেল এতোই চটে গিয়েছিলেন যে, বিদ্যাসাগর সহজে তাঁর মনোভাব বদল করতে পারেননি। তেসরা অক্টোবরের চিঠিতে যেমন দেখতে পাই তখনো মহাদেব নির্দোষ — এ কথাটা কবি মেনে নিতে পারছেন না।

আমার অবশ্যই খোলা মনে আপনার কাছে স্বীকার করতে হবে যে, মহাদেবের সঙ্গে আমার হিশেবপত্তর সম্পর্কে আমি মনে মনে সত্যি সত্যি অস্বস্তি বোধকরি। তিনি কোন কোনকিস্তি টাকা দেননি, আমি আপনাকে তার একটা তালিকা দিযেছি। আমি দেশ ছাড়ার আগে তখন পর্যন্ত পাওনা সব টাকা তিনি শোধ দিয়েছিলেন, আমি এ কথা বিশ্বাস করিনে অথবা বিশ্বাস করতে পারিনে। আমি সে জন্যে আশা করি আপনি এ ব্যাপারে তত্ত্বতল্লাশ করে নিজে সন্তুষ্ট হয়ে নেবেন। আপনি যদি সন্তুষ্ট হন, তা হলে আমি তাঁর সম্পর্কে যে-ভাষা ব্যবহার করেছি, তা প্রত্যাহার করবো।

এই চিঠি থেকে বোঝা যায়, তিনি ততোদিনে বিদ্যাসাগরের ওপর ভরসা করে আবার নিশ্চিন্ত বোধ করতে আরম্ভ করেছেন। কেবল তা-ই নয়, যে-দিগম্বর মিত্রকে মাত্র অল্পদিন আগে অভিশাপ দিচ্ছিলেন, তাঁর সম্পর্কেও তাঁর মনোভাব ততোদিনে অনেকটা নরম হয়েছে।৫৯ অবশ্য ইতিমধ্যে দিগম্বর নিজেও কবিকে আর-একটি চিঠি লেখেন — যা তাঁর হাতে পৌছে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। উপরের চিঠিতে তিনি বিদ্যাসাগরকে লিখেছেন: “আমি আজ ব্যস্ত, দিগম্বর মিত্রকে লিখতে পারছিনে। আগামী ডাকে লিখতে চেষ্টা করবো। তাঁকে আমার সৌজন্য জানাবেন।’

এর পরবর্তী এক বছর বিদ্যাসাগরের কাছে তিনি যেসব চিঠি লিখেছেন, তা থেকে জানা যায়, সম্পত্তি বন্ধক না-দিয়ে প্রয়োজনীয় টাকা তোলার জন্যে বিদ্যাসাগরকে কতো প্রয়াস পেতে হয়েছে এবং কবি এক থোকে বেশি টাকা পাওয়ার জন্যে কি রকম উতলা হয়ে উঠেছেন। কারণটা তিনি নিজেই বিদ্যাসাগরের কাছে কয়েক বার ব্যাখ্যা করেছেন — একবারে টাকা না-পেলে সব দেনা শোধ করে এবং পরবর্তী কয়েক মাসের জন্যে টাকা হাতে না-নিয়ে লন্ডন যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া, তিনি বিদ্যাসাগরকে এও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এক-এক কিস্তিতে অল্প টাকা পাঠালে উপকার না-হয়ে, অপকারই হয়। যেহেত, পরের কিস্তি টাকা আসার আগেই আগের কিস্তি টাকা শেষ হয়ে যায়।৬০ হিতাকাঙক্ষী হিশেবে বিদ্যাসাগর সম্পত্তি বিক্রি না-করে ধার করে এবং পাওনা টাকা আদায় করে পাঠাতে চেয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, এই টাকা তিনি দ্রুত জোগাড় করতে পারবেন এবং কবিও দ্রুত লন্ডনে ফিরে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করতে পারবেন। কিন্তু, আমরা পরে দেখতে পাবো, ভার্সাই-এর ঋণ শোধ দিয়ে লন্ডনে যাবার জন্যে যে-টাকার দরকার ছিলো, তা জোগাড় করতে বিদ্যাসাগরের লেগেছিলো প্রথম চিঠি পাওয়ার পরে এক বছরও বেশি। ভার্সাইতে এই এক বছর বাস করার জন্যে কবির ব্যয় হয়েছিলো কম পক্ষে তিন হাজার টাকা। ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করার জন্যে তাঁর বাকি ছিলো আরও পাঁচটি টার্ম অধ্যয়ন করা। বিদ্যাসাগর প্রথমইে সম্পত্তি বন্ধক রেখে (এমন কি, বিক্রি করে। কবির চাহিদা মতো এগারো হাজার টাকা পাঠাতে পারতেন, তা হলে কবি ব্যারিস্টারি শেষ করতে পারতেন ১৮৬৫ সালের নভেম্বর মাসে। ফলে শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে যতো টাকা পাঠাতে হয়েছিলো, কবির ততো টাকা লাগতো না। তদুপরি, মহাদেব চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যান্যের কাছে তাঁর পাওনাও বহাল থেকে যেতো।

বস্তুবাদী ভোগের প্রতি কবির ছিলো সীমাহীন প্রলোভন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তিনি ছিলেন জন্ম-রোম্যান্টিক এবং বিষয়বুদ্ধিবর্জিত। টাকাপয়সা, আয়-ব্যয় এসব নিয়ে আলোচনা করা তিনি আদৌ পছন্দ করতেন না। আলোচ্য অর্থসংকটের কালে তিনি যে চিঠিপত্র লিখেছেন, তা লিখেছেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে এবং তা থেকে তাঁর চবিত্রের এ দিকটি বেশ ভালো বোঝা যায়। আসলে, অসহনীয় অভাবে তিনি যখন সপরিবারে প্রায় অর্ধাহারে ছিলেন, তখনো নিজের স্বভাব ভুলতে পারেননি। তখনো বারবার করে লেখাপড়া, ভাষা শিক্ষা, সাহিত্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর চিঠিতে। বিদ্যাসাগরকে লেখা তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে তিনি যেমন বলেছেন

যদিও আমি এখানে খুব উদ্বিগ্ন এবং দুরবস্থায় আছি, তবু এরই মধ্যে আমি ফরাসি ভাষা প্রায আয়ত্ত করে ফেলেছি। আমি এ ভাষা ভালোই বলতে পাবি। তবে লিখতে পারি আরও ভালো। আমি ইটালিয়ান ভাষাও শিখতে আরম্ভ করেছি।৬১ এ ছাড়া, যোবোপ ত্যাগ করার আগে স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজ ভাষা যদি না-ও পারি, অন্তত জর্মন ভাষা আমি শিখতে চাই। … ফরাসিরা বিদেশী ভাষা সাধারণত ভালোবাসে না। তা সত্ত্বেও, সংস্কৃত ভাষা এখানে অজ্ঞাত নয়। এই মফস্বল শহরেও অর্ধ-ডজন লোক পাবেন যাঁরা এ ভাষা সম্পর্কে কিছু জানতে চান। আমার নিজেব শোচনীয় দুর্গতি ছাড়া অন্য কিছু লেখার মতো মনের অবস্থা আমার নেই। নয়তো আমি এ সম্পর্কে অনেক কথা লিখতে পারতাম।

মাসখানেক পরে তিনি আবার যখন লিখেছেন, তখন জানিয়েছেন –

য়োরোপ ছাড়ার আগেই আমি একজন যোরোপীয় পণ্ডিতে পরিণত হতে চাই। ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষায় আমার বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। শিগগিরই জার্মান শেখা শুরু করতে হবে। তা ছাড়া, ল্যাটিন, ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষা শেখার পর, স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজ ভাষাও কঠিন হবে না। আপনি ভাবতেও পারবেন না, ল্যাটিনে কী চমৎকার কাব্যসাহিত্য রয়েছে। ভ্যাপসা হচ্ছেন যোরোপের কালিদাস। আমি সত্যেন্দ্রনাথকে সেদিন ইটালিয়ানে একটা লম্বা চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু সে তার জবাব দিয়েছে ইংরেজিতে। অবাক না-হয়ে পারিনি। সে তো গত বছর খানিকটা ইটালিয়ান পড়েছিলো!

দেশ এবং দেশবাসীদের নিয়ে গর্ব করার যে-মনোভাব তাঁর মধ্যে কলকাতা ত্যাগ করার পর থেকে লক্ষ্য করেছিলাম, অভাবের মধ্যে তা খানিকটা চাপা পড়লেও তিনি তা মুছে ফেলতে পারেননি। লন্ডনে মনোমোহন ঘোষ আর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কী করছেন সে সম্পর্কে সব সময়ে চোখ-কান খোলা রেখেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরপরই এগারোই জুলাই (১৮৬৪) সে কথা লিখে জানিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে। তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি এতে এভোই উদ্দীপ্ত বোধ করেন যে, সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে নিজের দারুণ দুরবস্থা এবং উদ্বেগের মধ্যেও একটি সনেট রচনা করেন। এই সনেট থেকে বোঝা যায়, সত্যেন্দ্রনাথের সাফল্যে তিনি কতো গর্বিত হয়েছিলেন।

সুরপুরে সশরীরে, শূর-কুলপতি

অর্জ্জুন, স্বকাজ যথা সাধি পুণ্যবলে

ফিরিলা কানন-বাসে; তুমি হে তেমতি,

যাও সুখে ফিরি এবে ভারতমণ্ডলে,…

দূর বঙ্গে বহিবে সত্বরে

এ তোমার কীৰ্ত্তিবার্তা।….

মনোমোহন যে পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি, তাতে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ‘এক সময়ে আমি মনে করতাম, দুজনের মধ্যে মনোমোনই বেশি চালাক। এখন অবশ্য বুঝতে পারছি, আমার ভুল হয়েছিলো।’ পরের মাসে তিনি জানান,

বেচারা মনু আবার ফেল করেছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে সে পাশ করতে পারবেনা। পরীক্ষা আগের তুলনায় কঠিন করা হয়েছে। তা ছাড়া, সে গ্রীক এবং ল্যাটিন জানে না। আসল ব্যাপার হলো, আমাদের যুবক নয় — পাঠানো দরকার ১২/১৪ বছরের ছেলেদের। একটা প্রাথমিক ইংরেজি শিক্ষা একেবারে অপরিহার্য। আমার মনে হচ্ছে, বেচাব মনুকে আইন শিখতে হবে। অবশ্য সেখানেও প্রশ্ন হলো তার কি আইনে সফল হবার মতো মেধা আছে? সে কি ইংরেজ জুরিদের সামনে ভেঙে না পড়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা ইংরেজ [ব্যারিস্টারের] বিরোধিতার মুখে মামলার আর্জি জারার মতো যথেষ্ট ইংরেজি জানে? আমার খুব সন্দেহ হয়, মিস্টার জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাও সেটা পারবেন কিনা – যদিও তিনি আরও উচ্চমানের শিক্ষা পেয়েছেন, অধিকতর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং বয়সেও বড়ো।

মনোমোহন লেখাপড়ায় যেমনই হন না কেন, তাঁর প্রতি মাইকেলের গভীর দরদ এবং আন্তরিক স্নেহ ছিলো। পারিবারিক সূত্রে তিনি আগে থেকেই তাঁকে চিনতেন। নিজের অভাব এবং উদ্বেগের মধ্যেও তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন ভার্সাইতে বেড়িয়ে যেতে। আশা করেন, তাতে মনোমোহন সান্ত্বনা পাবেন। তা ছাড়া, কবি ভাবলেন, তিনি তাঁকে ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষায় কিছু সাহায্যও করতে পারবেন। কেবল দেশবাসীদের কথা নয়, নিজের লেখাপড়ার কথাও তিনি এক মুহূর্তের জন্যে ভুলতে পারেননি। বিদ্যাসাগরকে অনেক বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, গ্রেজ ইনে তাঁর তিনটি টার্ম নষ্ট হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে যথেষ্ট টাকাপয়সা না-পাঠাতে পারলে অন্তত আরও একটি টার্ম নষ্ট হবে। তদুপরি, গ্রেজ ইন তাঁকে গ্রহণ করবে কিনা, সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অবশ্য এ পর্যায়ে তিনি যে-চিঠিগুলো লেখেন, তা থেকে মনে হয়, গ্রেজ ইন তাঁকে গ্রহণ করবে না, এটা তিনি কখনো আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু ব্যারিস্টার হতে এবং ভারতবর্ষে ফিরে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে এবং তার ফলে আরও বেশি টাকা ব্যয় হবে — এ চিন্তা তাঁকে খুব উদ্বিগ্ন করেছে।

সেপ্টেম্বর মাসে মনোমমাহন ঘোষ তাঁর নিমন্ত্রণে ভার্সাইতে আসেন। এর আগেই বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে কবি এক কিস্তি টাকা পেযেছিলেন। তা ছাড়া, মনোমোহন সেখানে থাকার সময়ে — সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে — আরও এক কিস্তি টাকা পান। এবারে পান প্রায় এক হাজার টাকা। বিদ্যাসাগর যে-কম্পেনির কাগজ পাঠিয়েছিলেন, কবি তা বিক্রি করেন মোট ৯৬ পাউন্ড ১৩ শিলিং ৪ পেনিতে।৬২ এই খবর তিনি বিদ্যাসাগরকে লেখেন চিঠির শেষে পুনশ্চ দিয়ে। তা থেকেও আভাস পাওয়া যায়, দুর্বিষহ অভাবের চাপ একটু কমার সঙ্গে সঙ্গে টাকাপয়সার অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ তিনি ভুলতে আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর মনোভাবও অনেকটা উদ্বেগবর্জিত। বরং তিনি ভাবতে আরম্ভ করেন নিজের অধ্যয়ন, স্বদেশ এবং এ ধরনের অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে।

মনে মনে হিশেব করেন, কখন সত্যেন্দ্রনাথ বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে কলকাতায় পৌছে যাবেন। তাঁকে সংবর্ধনা জানাবেন তাঁর সুখী এবং গর্বিত দেশবাসীরা। তেসরা অক্টোবরের চিঠিতে সত্যেন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি লেখেন: ‘এতো দিনে আপনি নিশ্চয় সত্যেন্দ্রনাথকে দেখেছেন।৬৩ আমাদের দেশের প্রথম কভেনেন্টেড সিভিলিয়ন। … সে একজন চমৎকার লোক।’ মনে মনে তিনি কি সত্যেন্দ্রনাথকে ঈর্ষা করেছেন? করা অসম্ভব নয়। প্রথম যৌবনে তিনি যা পিতার বিরোধিতার জন্যে করতে পারেননি, সত্যেন্দ্রনাথ তাই করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ঈর্ষায় কোনো সংকীর্ণতা ছিলো না। বরং তিনি আপসোস করেন, তাঁর ব্যারিস্টার হতে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বলে। ‘অন্তত এক বছর পিছিয়ে গেছে।’ নভেম্বরে তাঁর ইংল্যান্ডে যাওয়া হচ্ছে কিনা, সে সম্পর্কে লেখেন:

আমার ইংল্যান্ডে যাওয়া হচ্ছে কিনা অথবা সেখানে গিয়ে লেখাপড়া শুরু করতে পারবো কিনা, তা আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন। আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন বলছি এ জন্যে যে, টাকা চেয়েছি আমি, কিন্তু পাঠিয়েছেন আপনি। আমি যেতে পারিনে এবং এখনো পর্যন্ত আমার কোনো ধারণা নেই আপনি কী করতে পেরেছেন (অর্থাৎ কতো টাকা পাঠাতে পেরেছেন)। আগামী ডাকে আমি আমার অবস্থান বুঝতে পারবো।

বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে দ্বিতীয় কিস্তিতে তিনি যে-টাকা পেয়েছিলেন, তাঁর সব ঋণ শোধ দেবার জন্যে তা যথেষ্ট ছিলো না। কারণ তিনি পান হাজার খানেক টাকা আর তখন তাঁর ধার ছিলো ১৪০০ টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সেই পরিবেশে তাঁর পুরোনো ‘নবাবী’ চাল এবং মেজাজ ফিরে পান। তাঁর বাড়িওয়ালা এবং রু দ্য শাঁতিযের দোকানদারদের তিনি ততোদিনে বুঝিয়ে দিয়েছেন — তিনি বড়ো লোক কিন্তু সাময়িকভাবে বেকায়দায় পড়েছিলেন। ভাবটা এই: ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম। এখন বিশ্বাস হচ্ছে তো!’ গৌরদাস বসাকের কাছ থেকে তিনি এ সময়ে একটি চিঠি পান। সে চিঠির জবাবে তিনি যা লেখেন, তা থেকেও পুরোনো মধু — যিনি এক মোহর দিয়ে চুল ছাঁটিয়ে অন্যের কাছে গর্ব করতে ভালোবাসতেন — সেই মধুর গলা অভ্রান্তভাবে শোনা যায়।

আমি এখানে – ফ্রান্সে কেন, তুমি নিশ্চয় তা জানার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়েছে। আমি তোমাকে বলছি। এ দেশে বাস করাটা যেমন আবামের, লন্ডন তার অর্ধেকও নয়। লন্ডনের তীব্র আবহাওযা মিসেস ডাটের সহ্যও হয় না। আমি অবশ্য এই পৃথিবীর যে-কোনো দেশে বাস করার মতো শক্ত মানুষ। তা ছাড়া, সেখানকার তুলনায় এখানে ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষা আয়ত্ত করার সুযোগ অনেক বেশি। আমি এখন এ দুটি ভাষা অবলীলার সঙ্গে লিখতে এবং পড়তে পাবি। এ দুটি ভাষা ছাড়া, আমি জার্মান ভাষাও শিখতে চাই। বস্তুত, ইতিমধ্যে আমি শিখতে আরম্ভ করেছি। সুতরাং তুমি যদি কোনো দিন আমাকে আবার দেখতে পাও, তা হলে শেষ বার আমাদের যখন দেখা হয়েছিলো, তার চেয়ে আমাকে একটু বেশি শিক্ষিত দেখতে পাবে। আমি আইন অধ্যয়নেও অবহেলা করছিনে। তবে ঠিক গুরুত্বের সঙ্গে শুরু করিনি। আমি কয়েকটা টার্ম অবহেলা করেছি এবং য়োরোপে আমার একটু বেশি দিন থাকতে হবে — এই যা। কিন্তু তার জন্যে আমার কোনো আপসোস নেই। আহা, আমি যদি আমার সারাজীবন এখানে থাকতে পারতাম আর বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের জন্যে মাঝেমধ্যে ভারত যেতে পাবতাম! কিন্তু তেমন টাকাপয়সা আমার নেই — যদিও তার জন্যে যে খুব একটা ধনী হবার দরকার আছে, তা নয়।৬৪

আকৈশোর গৌরদাস কবির ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। কিন্তু চিঠির এ পর্যন্ত তিনি একবারও উল্লেখ করেননি, আগের এক বছর তিনি কী দুঃসহ দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটিয়েছেন। জেলে যেতে যেতে রক্ষা পেয়েছেন। অর্ধাহারে এবং উদ্বেগে ভাগ্যের কাছে মাথা কুটেছেন। আর শেষ পর্যন্ত কিভাবে বিদ্যাসাগরের দয়ায় আবার বেঁচে উঠেছেন। এখানে মাইকেল-চরিত্রে একটা দিক যেমনস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে, তেমনটা অন্য কোথাও দেখা যায় না। যদিওমনোমোহন ঘোষের কাছে লেখা চিঠিতেও এই নিরুদ্বিগ্ন কুছ পরোয়া না-করার ভাব খানিকটা লক্ষ্য করা যায়। গৌরদাসকে এ চিঠি লেখার চার দিন পরে নিজের সত্যিকার অবস্থা গোপন করে মনোমোহন ঘোষকে লিখেছিলেন:

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, এ বছর (১৮৬৪) আমি লন্ডনে ফিরে যেতে পারবো। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। এখানে অনেক কিছু আছে, যা আমার মনোযোগ দখল করতে পারে, এবং যা প্রায়ই আমার সেসব উদ্বেগ ভুলিয়ে দিতে পারে, সব মানুষই যেসব উদ্বেগের উত্তরাধিকারী। আমি আশা করি আমার জীবনধারা শান্তিপূর্ণভাবেই বয়ে যাবে। … তাঁকে [সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে] বোলো যে, আমি আমার প্রবাসকে বেশ কাজের বলে বিবেচনা করছি।৬৫

এই চিঠিতে তিনি মনোমোহনকে আরও জানিয়েছিলেন ক দিন আগে তিনি ফ্রান্সের সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীকে কুর্নিশ করেছেন এবং তাঁদের কাছ থেকে পাল্টা কুর্নিশ পেয়েছেন। সেই সঙ্গে আরও লিখেছেন তিনি রাজবাড়ির উদ্যানে গিয়ে বসে থাকেন এবং তাঁর দিকে যখন দস্যুদলের মতো মাছের ঝাঁক এবং রাজহাঁসের দল ছুটে আসে, তখন তিনি তাদের খেতে দেন। (মনোমোহন নিজেও তিন সপ্তাহ আগে মাইকেল-পরিবারে থাকার সময়ে রাজবাড়ি এবং রাজ-উদ্যান দেখে গিয়েছিলেন।) যেহেতু আমরা জানি, তাঁর জীবনে এ সময়ে কী উদ্বেগ এবং অনটন নেমে এসেছিলো, সে জন্যেই গৌরদাস এবং মনোমোহনকে লেখা তাঁর চিঠি দুটি থেকে অভ্রান্তভাবে তাঁর কল্পনাবিলাসী মনের স্বরূপ অনুভব করতে পারি। এ সময়ে তিনি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকেও একটি চিঠি লিখেছিলেন।৬৬ তাতেও নিজের সমস্যার কথা গোপন রাখেন। বস্তুত, গৌরদাস, মনোমোহন (এবং যতীন্দ্রমোহনের) কাছে লেখা তাঁর চিঠি থেকে আমরা তাঁর নিজেকে জাহির করার মানসিকতা এবং বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করতে পারি। তাঁর কল্পনাবিলাসী মনের স্বরূপ আরও উন্মোচিত হয় ওপরে উল্লিখিত গৌরদাসের কাছে লেখা চিঠির পরের অংশে।

মাত্র কয়েক ফ্রঁ দিয়ে আমি বর্ধমানে মহারাজা স্বপ্নেও যা কল্পনা করতে পারেন না, তার চেয়ে ভালো খাবার খাই। মাত্র কয়েক ফ্রঁ দিয়ে আমি যে-আনন্দ উপভোগ কবি, তা জোগাড় করতে তীব অগাধ অর্থের অর্ধেকের বেশি চলে যাবে — না, না, তা দিযেও তা পাওয়া যাবে না। এমন সঙ্গীত, এমন নৃত্য, এমন সৌন্দর্য! আমাদের পুরোনো শাস্ত্রে যাকে বলা হযেছে ‘অমরাবতী’ এহলো তাই। … আমি যখন খাই, তখন যে-লোকটি আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়, ভারতবর্ষের সবচেয়ে নামজাদা রাজকুমারের দিকেও সে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাবে। একটা ভেজা দিনে যে-মেয়েটি আমার পা থেকে কর্দমাক্ত বুট খুলে নেয়, ভারতবর্ষের সবচেয়ে ধনী রাজাকে সে ছুঁয়ে দেখতেও ঘৃণা বোধ করবে।

রু দ্য শাঁতিয়ে-র ১২ নম্বর বাড়িটি এবং তার বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিলো — আগেই তার আভাস দিয়েছি। তা ছাড়া, ওপরের চিঠিটি লেখার কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত দত্ত-পরিবার কেমন চরম দুর্গতির মধ্যে এবং অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছিলো, তাও লক্ষ্য করেছি। তাঁর এই বড়াইকে সে জন্যেই একেবারে ফাঁকা আওয়াজ বলে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। সেই সঙ্গে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না তাঁর চরিত্রের সেই সুপরিচিত দিকটিকে — অতিরঞ্জিত করে নিজেকে প্রকটন করার দিকটি। প্রশ্ন হলো:তা হলে কবি কি মিথ্যাবাদী ছিলেন? বাস্তব এবং তাঁর বক্তব্যের এতো বড়ো অসঙ্গতি সত্ত্বেও আমি সে কথা বলতে অনিচ্ছুক। যে-জীবন তিনি তাঁর সমস্ত অন্তর দিয়ে যাপন করার স্বপ্ন দেখতেন সারাক্ষণ, যে-জীবন সে দেশের অভিজাতরা যাপন করতেন, কিন্তু নিজে যা পারেননি, সেই স্বপ্নের কথাই তিনি উচ্ছসিতভাবে তাঁর কৈশোরের বন্ধুকে বর্ণনা করেছেন। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই অসঙ্গতি নিশ্চয় মিথ্যে, কিন্তু কল্পনাবিলাসী কবির জন্যে এটা অনৃত ভাষণ নয়। এ হলো কবির অতিশয়োক্তি। এ মিথ্যে থেকে তাঁর অহং তৃপ্তি পায়, কিন্তু অন্য কারো ক্ষতি হয় না।

তদুপরি, তিনি আর্থিক সংকটের মধ্যেও ভার্সাই-এর কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের সমাজে মিশতে পেরেছিলেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সে ভক্ত মহিলাদের নিয়ে কবি- সাহিত্যিক-শিল্পীদের এক-একটা চক্র গড়ে উঠতো। এই চক্রের মধ্যে যাঁদের বলা যায়, সামাজিক মহিলা, তাঁরাও থাকতেন। তা ছাড়া, উনিশ শতকের বাংলার মতো বারাঙ্গনা-গমনও সাহিত্যিক-শিল্পীদের জন্যে মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিলো না। এ ব্যাপারে ইংল্যান্ডের ভিক্টোরীয সমাজের সঙ্গে ফ্রান্সের মস্তো একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কবির পক্ষে এ রকমের একটা চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া অসম্ভব নয়। তিনি যে রু দ্য শাতিযের বাড়ির দরজা বন্ধ করে সেখানে বসে সারা দিন ফরাসি আর ইটালিয়ান শেখেননি, তা তাঁর চিঠি থেকে জানা যায়। আগেই দেখছি, তিনি বিদ্যাসাগরকে একটি চিঠিতে বলেছেন যে, ভার্সাই-এর মতো একটি মফস্বল শহরেও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে আগ্রহী অর্ধ-ডজন লোক আছেন। এই লোকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিলো এবং তিনি সংস্কৃতসহ তাঁর ধ্রুপদী ভাষাজ্ঞান দিয়ে তাঁদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে চেষ্টা করেছেন, এটা অনুমান করা কঠিন নয়। তিনি যে বড়ো কবি, নাট্যকার, ব্যারিস্টার এবং জমিদার — সে কথা তিনি তাঁর পরিচিতদের ফলাও করে বলেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ভার্সাইতে থাকা কালে তাঁর যে-কন্যার জন্ম হয়, তার মৃত্যুর সার্টিফিকেটে তাঁর পবিচয় লেখা আছে ব্যারিস্টার হিশেবে — যদিও তখনো তিনি ব্যারিস্টার হননি। তিনি যে ভার্সাই-এর বন্ধুদের তাঁর লেখা সনেট পড়ে শুনিয়েছেন এং তাঁরা তার প্রশংসা করেছেন, গৌরদাসকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে তা জানা যায়।৬৭ তিনি যে সমাজের ওপরতলার একজন মানুষ — কোনো ভাগ্যান্বেষী নন, সে সম্পর্কে ইংরেজিতে লিখে জানানোর জন্যে তিনি বিদ্যাসাগরকেও অনুরোধ জানিয়েছিলেন। (বিদ্যাসাগর তাঁকে সাধারণত চিঠি লিখতেন বাংলায়। ভাসাইতে বেকায়দার মধ্যে থাকলেও তিনি তাঁর উচু সামাজিক অবস্থানের দোহাই দিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের চক্রে মিশে এমন ভোজসভায় হয়তো অংশ নিযেছেন যেখানে একটি পরিচারক অথবা পরিচারিকা তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িযেছে। এবং ঐ চক্রের কোনো নারীর সঙ্গে তাঁর এমন ঘনিষ্ঠতা হওয়া সম্ভব, যে তাঁর কর্দমাক্ত জুতো তাঁর পা থেকে একবার খুলে নিয়েছে। আমরা পরের আলোচনা থেকে দেখতে পাবো,তাঁর চারটি সনেট থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, ফ্রান্সের কোনো এক নারীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো। সুতরাং গৌরদাসকে তিনি যা লিখেছিলেন, তা একেবারে অমূলক না-ও হতে পারে।

সর্বোপরি, ফ্রান্সে তিনি এমন কতোগুলো মূল্যবোধ লক্ষ্য করেছিলেন, যা ছিলো ইংল্যান্ড এবং ইংরেজ-শাসিত ভারতবর্ষের তুলনায় অনেক উন্নত এবং এটা দেখে তিনি তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ না-করে পারেননি।

এখানে ছোটোবড়ো সবাই তোমাকে ড্যাম্‌ড্‌ নিগার হিশেবে নয় — একজন মানুষ হিশেবে বিবেচনা করবে। এখানে চলে এসো, তুমি তা হলে অচিরেই ভুলে যাবে যে, তুমি নিচ এবং পরাধীন একটি জাতির লোক। এখানে তুমি তোমার প্রভুদেবও প্রভু। … আমি ফ্রান্সের সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীকে কুর্নিশ করাব এবং তাঁদের কাছ থেকে পাল্টা কুর্নিশ পাওযার সম্মান অর্জন করেছি। এটা য়োরোপ, ভাই, ভারতবর্ষ নয়।

ভারতবর্ষে ইংরেজরা দেশীয়দের কেমন নিচ দৃষ্টিতে দেখে ‘ড্যামড নিগার’ হিশেবে তিনি সেটাকেই বোঝাতে চেয়েছেন। যোরোপীয় আদর্শ তাঁকে আগে থেকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। বিশেষ করে ইংরেজদের মধ্যে যে-বর্ণবিদ্বেষ লক্ষ্য করেছিলেন, ফ্রান্সে এসে তিনি তা তেমন করে দেখতে পাননি। সে জন্যে য়োরোপীয় আদর্শের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আরও জোরদার হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর সেই দুঃসমযের মধ্যেও ছেলেমেয়েকে পুরোপুরি য়োরোপীয় করে তোলার সংকল্প নিয়েছিলেন।

শর্মিষ্ঠা এরই মধ্যে বেশ ফরাসি হয়ে উঠেছে। সে যেভাবে গরগর করে কথা বলে তুমি তা শুনলে বিশ্বাস করতে পারবে না যে, সে হুগলি নদীর তীরে জন্মেছিলো। আমার ছেলে মিন্টনও বেশ এগিয়ে যাচ্ছে।… সন্তানদের শিক্ষার জন্যে আমি আমার পরিবার য়োরোপে রেখে যাবো।

অভাবের চাপ অপেক্ষাকৃত কম থাকায় সেই পরিবেশে নিজের কাব্যচর্চা করছেন কিনা, সে প্রসঙ্গেও কিছু না-বলে পারেননি। বিশেষত যাঁকে বলছেন, তিনি যখন তাঁর ‘ভাবী জীবনী-লেখক’ হবেন বলে তিনি প্রত্যাশা করছিলেন!

সম্প্রতি কাব্যচর্চা কিন্তু তেমন এগুচ্ছে না। তবে ফরাসি এবং ইটালিয়ান কাব্যে অনুকরণে ছিটেফোঁটা কিছু লেখার চেষ্টা করেছি। আগের সেই নেশাটা কেটে গেছে। আর কোনোদিন আসবে কিনা, তাও জানিনে। তুমি তো জানো আমি লিখি মাঝেমধ্যে, এক-একটা ঝোঁকের মাথায়।

নেশা যে কেটে গেছে, তা আগেই লক্ষ্য করেছি। এই চিঠিতে তিনি যে-ফরাসি কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন, তা হলো জঁ দে লা ফঁতেনের (১৬২১-৯৫) অনুকরণে তিনটি শিশুপাঠ্য নীতিকবিতা — ময়ূর ও গৌরী, কাক ও শৃগালী এবং রসাল ও স্বর্ণলতিকা। লা ফঁতেন ১৬৬৮ থেকে ১৬৯৪ সালের মধ্যে ১২টি সর্গে ফাব্‌ল শোয়াজি নামে নীতিগল্প প্রকাশ করেছিলেন। মাইকেল সেখান থেকে তাঁর এই কবিতা তিনটির ধারণা পান। বলা মুশকিল; এতো বিষয় থাকতে তিনি কেন নীতিমূলক কবিতা পছন্দ করলেন। তাঁর উল্লিখিত ইটালিয়ান কবিতা হলো পেত্রার্কার (১৩০৪-৭৪) অনুকরণে রচিত সনেট। এই চিঠি লেখার তিন মাস পরে কবি চারটি সনেট পাঠিয়েছিলেন গৌরদাসের কাছে।৬৮ যদিও ততোদিনে লিখে ফেলেছিলেন অনেকগুলো। গৌরদাসকে উল্লেখ করেছেন — শিগগিরিই তাঁব এক খণ্ড কবিতা প্রকাশিত হতে পারে।

সনেট যে মাইকেল ভার্সাইতে প্রথম রচনা করলেন, তা নয়। তরুণ বয়সে তিনি ইংরেজিতে বেশ কয়েকটি সনেট লিখেছিলেন। শেকসপীয়রের আদর্শেরচিত তাঁর এই সনেটগুলো লেখার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন প্রধানত তাঁর প্রিয় শিক্ষক রিচার্ডসনের কাছ থেকে। বিদেশী ভাষায় এই সনেটগুলো রচনা করেছিলেন একটি সতেরো/আঠারো বছরের তরুণ, এটা বিবেচনা করলে তাঁর এই সনেটগুলো যথেষ্ট উঁচু মানের বলতে হবে। তার বহু বছর পরে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘কবি-মাতৃভাষা’ সনেটটি লেখেন কলকাতায় থাকার সময়ে — আমরা আগেই তা লক্ষ্য করেছি। তবে এটা ছিলো তাঁর রচনার মধ্যে একটা ব্যতিক্রম। কিন্তু এবারে ইটালিয়ান শিখতে গিয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখালেন সনেটে — বিশেষ করে পেত্রার্কার সনেটে।

তিনি বিশেষ করে পেত্রার্কাকে কেন বেছে নিয়েছিলেন, সে প্রশ্ন অবান্তর নয়। তবে এর কারণ খুঁজে পাওয়া আদৌ কঠিন নয়। পেত্রার্কা ছিলেন পণ্ডিত-কবি। প্রিয়াকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতায় রোম্যান্টিকতার ছড়াছড়ি আছে; কিন্তু তিনি নিরন্তর বিচরণ করতেন ধ্রুপদী সাহিত্যের জগতে। মাইকেলও ছিলেন হুবহু সে রকমের। মনে-প্রাণে রোম্যান্টিক হওয়া সত্ত্বেও, তিনিও সারাক্ষণ চর্চা করতেন ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্য। আইনজীবীর সন্তান ছিলেন পেত্রার্কা। তাঁর পিতা তাঁকে বাধ্য করেছিলেন আইন পড়তে। কিন্তু পিতা মারা যাবার পরে তিনি আর কোনোদিন আইনের দিকে তাকিয়ে দেখেননি। অতঃপর তিনি ডুব দেন ধ্রুপদী সাহিত্য এবং প্রাচীন বিদ্যার বিশাল সরোবরে। অবশ্য প্রাচীন ভাষা এবং সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি প্রাচীন জগতে ফিরে যেতে চাননি। বরং অন্য রেনেসান্সের পণ্ডিতদের মতো প্রাচীন ভাষা এবং সাহিত্য দিয়ে তিনি সমকালীন ভাষা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন। পৌবাণিক কাহিনীর মধ্যেও তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন মানবিক আদর্শের জয়গান। মাইকেল এই আদর্শেদীক্ষা নিয়েছিলেনভার্সাইতে যাবার অনেক আগে থেকে। রেনেসান্সের মানবিকতার প্রতিফলন ঘটেছিলো তিলোত্তমাসম্ভব থেকে বীরাঙ্গনা পর্যন্ত কবির প্রতিটি রচনায়। এখন নিবিড়ভাবে পেত্রার্কার সাহিত্য পড়তে গিয়ে তিনি পেত্রার্কার সঙ্গে তাঁর মনন এবং মানসের আশ্চর্য মিল দেখতে পেলেন। পেত্রার্কার ছিলো সাহিত্য পাঠের অতৃপ্ত তৃষ্ণা। এখানেও মাইকেল পেত্রার্কার সঙ্গে নিজের অসামান্য মিল খুঁজে পান। সে জন্যে ইটালির কবি অমন করে বাঙালি কবির হৃদয় হরণ করেছিলেন। বেশ কম বয়সেই পেত্রার্কা এতো কবি-খ্যাতি লাভ করেন যে, তিনি রাজকবি হবার আহ্বান পান একই সঙ্গে প্যারিস এবং রোম থেকে। ১৩৪১ সালে তিনি অবশ্য রোমের আহ্বানই মেনে নিয়েছিলেন। রাজকবিদের প্রতি মাইকেলেরও একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিলো।

কবি যখন ভার্সাইতে বসে সনেটমক্স করছিলেন, তার পাঁচ শো বছর আগে প্রিয়তমা লরার উদ্দেশ্যে বচিত Canzoniere কাব্যের শ তিনেক সনেটের মধ্য দিয়ে পেত্রার্কা সনেটকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন। তিনি সনেট এবং খণ্ড কবিতার এমন আদর্শ স্থাপন করেন, যা পরবর্তী চার/পাঁচ শতাব্দী ধরে য়োরোপীয় সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ফ্রান্স, জার্মেনি, ইংল্যান্ড, স্পেন ইত্যাদি দেশে তাঁর যে- অনুকরণ এবং অনুসরণ চলতে থাকে, তাকে এক কথায় বলা হতো পেত্রার্কিজ্‌ম্‌ বা পেত্রার্কাবাদ। মাইকেলের সমসাময়িক ফ্রান্সের অত্যাধুনিক কবি বোদলেয়ারেও পেত্রার্কার প্রভাব অব্যাহত ছিলো — যদিও সীমিত পরিমাণে। পেত্রার্কা তাঁর কাব্যকে এমন পরিশীলিত এবং নাগরিক রূপ দিয়েছিলেন, রেনেসান্সের সময়কার এবং তার পরবর্তী কবিরা যাকে আধুনিকতার প্রথম সোপান হিশেবে গণ্য করেন।

পেত্রার্কা লরার (ইটালীয় উচ্চারণ লাউবা) প্রেমে পড়েছিলেন তেইশ বছর বয়সে। দূর থেকেই তাঁকে ভালোবেসেছিলেন। মিলন হয়নি কোনো দিন। তা ছাড়া, লরা মারাও যান অকালে। তারপর পেত্রার্কা বেঁচে থাকেন অনেক কাল। কিন্তু লরাকে উদ্দেশ্য করে চলতে থাকে তাঁর সনেট এবং অন্য কবিতা রচনার সাধনা। লরার প্রেম এবং বন্ধুত্ব; লরার অনুপস্থিতি, বিরহ এবং অসুস্থতা; প্রেম এবং অনুশোচনা; প্রেম এবং মৃত্যু; প্রেম এবং ধর্ম; লরার চোখ এবং চুল; লরার জন্যে শোক; প্রেম, খ্যাতি এবং হতাশা, অন্য এক নারীকে দেখে লরাকে মনে পড়া ইত্যাদি ছিলো তাঁর এসব সনেটের বিষয়বস্তু। এই সনেটগুলোর বিষয়বস্তু মাইকেল কোথাও অনুসরণ করেননি। যেমন পেত্রার্কার সনেট তাঁর আদর্শ হলেও, আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর সনেটে প্রেম কার্যত অনুপস্থিত। বস্তুত, তিনি অনুসরণ করেন পেত্রার্কার সনেটের কাঠামো। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও, অন্ত্যমিলে অনেক জায়গায় পেত্রার্কার আদর্শ তিনি মান্য করেননি। পেত্রার্কার সনেটের অষ্টকে অন্ত্যমিল ছিলো প্রায় সর্বত্র কখখককখখক। আর ষট্‌কে গ এবং ঘ এর নানা রকমের বিন্যাস — গঘগঘগঘ, গঘঘগগঘ ইত্যাদি। মাইকেল অষ্টকে পেত্রার্কার আদর্শ অনেক জায়গায় অনুসরণ করেছেন, কিন্তু ষট্‌কে নয়। তদুপরি, তাঁর অনেক সনেট তাঁর তরুণ বয়সের সনেটের মতো শেকসপীয়রের আদর্শে রচিত।

ডিসেম্বর মাসের (১৮৬৪) দ্বিতীয় সপ্তাহে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে তিনি তৃতীয় কিস্তি টাকা পেয়েছিলেন। তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্যেব এই সময়ে তাঁর মন থেকে কয়েক মাসের আগেকার তিক্ত স্মৃতির কালো মেঘ অনেকটা কেটে গিয়েছিলো এবং তার পরিবর্তে দেখা দিযেছিলো নরম আলোর মতো বাল্য এবং কৈশোরের সুখস্মৃতি। মনে মনে নিজেকে যতোই য়োরোপীয় ভাবুন না কেন, ছ হাজার মাইল দূরে ফেলে-আসা মাতৃভূমির জন্যে তাঁর সমস্ত অন্তর এ সময়ে উতলা হয়ে উঠেছিলো। এই অনুকূল পরিবেশে তাঁর সনেট লেখার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলে।

তাঁর সনেটের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে মোদ্দাভাবে বিষয়বস্তু অনুযায়ী সেগুলোকে নিচের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:

১. স্বদেশের নস্টালজিক স্মৃতি (৩১টি); ২. ব্যক্তি/কাব্য নিয়ে সনেট (২৮টি);৩, অর্থ এবং কবি-খ্যাতি নিয়ে আপন অন্তরের দ্বন্দ্ব (১২টি); ৪. করুণ, বীর, রৌদ্র, শৃঙ্গার ইত্যাদি রস বিষয়ক সনেট (৬টি); আর ৫ সৃষ্টিরহস্য এবং বিচিত্র রসের (২৭টি) সনেট।

নস্টালজিক স্মৃতি নিয়ে সনেটই তিনি নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি লিখেছিলেন। স্বদেশের মাটি ও মানুষ নিয়ে লেখা সনেটগুলোর মধ্যে ‘কপোতাক্ষ’ (তাঁর নিজের বানানে কবাতক্ষ) বিশেষ নাম-করা। ২৬ অক্টোবর তিনি গৌরদাসকে যে-চিঠি লেখেন, তাতে কপোতাক্ষের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু ‘কপোতাক্ষ নদ’ সনেটটির কথা উল্লেখ করেননি। বোঝা যায়, বাল্যবন্ধু গৌরদাসের চিঠি পড়ে কবির মনে বাল্যস্মৃতির যে-ঢেউ জেগে উঠেছিলো, তা-ই অতঃপর একটির পর একটি নস্টালজিক সনেট লিখতে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। ‘কপোতাক্ষ’-এর মতো স্বতঃস্ফূর্ত প্ৰেবণায় অনেকগুলো কবিতা রচনা করে ফেলার পর এক খণ্ড কাব্য প্রকাশের উদ্দেশ্য মনে রেখে তিনি বাকি সনেটগুলো রচনা করেন বলে মনে হয়। এসব সনেটের মধ্যে এমন কতোগুলো সনেট ছিলো যাতে তাঁর আবেগ ঘনীভূত হয়ে প্রকাশ পায়নি। তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাবলিতে মোট সনেট ছিলো এক শোটি। মনে হয় সংখ্যা পূরণের তাগিদেই যেন তিনি শেষ দিকের সনেটগুলো রচনা করেন। বিভিন্ন রস নিয়ে লেখা সনেটগুলো যদি তিনি শেষ পর্যায়ে লিখে থাকেন, তা হলে অবাক হবো না। ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের এ আদর্শ তাঁকে এসব সনেট লেখার পথ দেখিয়েছিলো। আরও একটা কথা এখানে মনে করা যেতে পারে। সে হলো: মুখে যতোই সাহিত্যদর্পণের মতো ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রকে অস্বীকার করুন না কেন, কাব্য এবং নাটক রচনা করার সময়ে তিনি সেসব একেবারে অস্বীকার অথবা অগ্রাহ্য করতে পারেননি। কলকাতায় তিনি যখন সৃষ্টিযজ্ঞে মশগুল তখনকার চিঠিপত্রের সঙ্গে তাঁর নাটক এবংকাব্য মিলিয়ে দেখলে এই মন্তব্যের যাথার্থ বোঝ যাবে। বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে কবি যে-সনেটগুলো রচনা করেন, বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তাদের কোনো কোনোটা তিনি লিখেছেন নিতান্ত লেখার খাতিরে অথবা আনুষ্ঠানিকতা পালনকরার তাগিদে — স্বতঃস্ফুর্ত আবেগের তাড়নায় নয়। পরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করবো।

মাইকেলের কাব্যরুচি সম্পর্কেও এখানে কিছু বলা যেতে পারে। যোরোপেব সভ্যতা এবং সাহিত্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা সত্ত্বেও সমকালীন যোরোপীয় সাহিত্যের হালচাল তিনি ঠিক ধরতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। তখন ইংরেজি সাহিত্যে চলছিলো তৃতীয় প্রজন্মের রোম্যান্টিক কবিতার ধারা। সেই সঙ্গে সূত্রপাত হয়েছিলো মধ্য-ভিক্টোরিযান ধারার। আর ফ্রান্সে বোম্যান্টিক-উত্তর নব্য-রোম্যান্টিক/প্রতীকী কাব্যের গোড়াপত্তন করেছিলেন শার্ল পিযের বোদলেয়ার। মাইকেল ভার্সাইতে যাবার ঠিক ছ বছর আগে বোদলেয়ার তাঁর বিখ্যাত কাব্য লে ফ্ল্যর দ্যু ম্যল প্রকাশ করেন। এই কাব্যের অশ্লীলতা এবং ধর্মদ্রোহিতার দায়ে আদালতে তাঁর জরিমানা হয়েছিলো তিন শো ফ্রঁ। (পরের জানুআরি মাসে তিনি যখন রানীর কাছে এই অর্থ দেবার ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা জানিয়ে জরিমানা মৌকুফ করার আবেদন জানান, তখন এই জরিমানা কমিয়ে ৫০ ফ্রঁতে নামানো হয়। বোদলেয়ারকে খরচ সমেত দিতে হয়েছিলো মোট ৫৩.৭০ ফ্রঁ। তবে একই সময়ে সরকার তাঁকে এক শো ফ্রঁর একটি অনুদান দেয়।) জরিমানা ছাড়াও, এ কাব্যের ছটি কবিতা তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। (এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় প্রায় এক শো বছর পরে — ১৯৪৯ সালে।)৬৯ প্রকৃত পক্ষে, এ কাব্য কেবল সাহিত্যের আসরে ঝড় তোলেনি, নৈতিকতার প্রশ্নে শিক্ষিত সমাজে তীব্র বিতর্কেরও সূচনা করেছিলো। এ কাব্যের কথা শোনেননি, ফ্রান্সে তেমন শিক্ষিত এবং বিদগ্ধ লোক তখন কমই ছিলেন। প্রায় এক শো চল্লিশ বছর পরে এখনো সাধারণ লোকের চোখে বোদলেয়ার পাপ এবং বিকারের প্রতীক বলে পরিচিত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লিখলেও তিনি আসলে লিখেছিলেন বিংশ শতকের আধুনিক সভ্যতার এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে-ক্ষতবিক্ষত আধুনিক মানুষের কবিতা। পরবর্তী প্রতীকবাদী কাব্যধারারও তিনি পথিকৃৎ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আস্থা না-থাকলেও, তিনি তাঁর কাব্যে ধর্মোত্তীর্ণ এক ঈশ্বরের অন্বেষণ করেছেন। অরূপ এবং জীবনের তাৎপর্য খুঁজেছেন রুপের মধ্যে। ক্লেদের মধ্যেও কুসুমের সৌন্দর্য এবং পবিত্রতা দেখতে পেয়েছেন তিনি।

নিষেধের গণ্ডি ভঙ্গ করে এবং প্রচলিত মূল্যবোধে অকল্পনীয় আঘাত করে তিনি যে-নান্দনিক জগৎ সৃষ্টি করেন, সমকালীন সমাজের অনেকে তা অনুধাবন করতে সমর্থ হননি। মাইকেলও সমর্থ হয়েছিলেন কিনা, বলা সম্ভব নয়। এমন কি, তিনি যে সমসাময়িক ফরাসি ভাষার সবচেয়ে বিতর্কিত এবং বৈপ্লবিক এই কবির নাম শুনেছিলেন – সে কথাও কোথাও উল্লেখ করেননি। যদিও পরের আলোচনায় লক্ষ্য করবো, তাঁর একটি কবিতার নামকরণে ফ্ল্যর দ্যু ম্যল নামটি প্রভাব বিস্তার করে থাকবে। তা ছাড়া, আরও দুটি কবিতার বিষয়বস্তুতেও বোদলেয়ারের ছাপ পড়া একবারে অসম্ভব নয়। তবে এ মিল কাকতলীয়ও হতে পারে। বোদলেয়ারের কাব্য পড়ে থাকলেও, তাঁর কবিতার অদ্ভুত গতিময়তা এবং নান্দনিক তাৎপর্য তিনি ঠিক অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, বোদলেয়ার যে-অর্থে আধুনিক, মাইকেল সে অর্থে আধুনিকও ছিলেন না। বোদলেয়ারে কল্পনার যে-অভিনবত্ব এবং ভাবের যে-গভীরতা লক্ষ্য করা যায়, মাইকেলে তা অনুপস্থিত।

তবে একটা কথা এখানে বলা যেতে পারে যে, সাহিত্যে এই দুই কবির সাদৃশ্য না-থাকলেও, এই দুই বোহীমিয়ান কবির ব্যক্তিগত জীবন এবং মনোভাবে — অসংযম, অমিতব্যয় এবং আত্মহননের প্রবণতায় — অনেক আশ্চর্য মিল দেখতে পাওয়া যায়। মাইকেলের মতো বোদলেয়ার ছিলেন ধনী পিতার একমাত্র সন্তান। কেবল কাব্যচর্চাকে তরুণ বয়স থেকে তিনি প্রধান কাজ হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৬২ সালের ৯ জুন মাইকেল কলকাতা থেকে যোরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার ঠিক একুশ বছর আগে, ১৮৪১ সালের ৯ জুন বোদলেয়ার যাত্রা করেছিলেন কলকাতার উদ্দেশে। কিন্তু জাহাজে তিনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। তা ছাড়া, মরিশাসে জাহাজ ভেড়ার পর তিনি ঠিক করেন, তিনি আর পুব দিকে যাবেন না। একারণে শেষ পর্যন্ত তাঁর কলকাতা অথবা ভারতবর্ষে যাওয়া হয়নি। তার বদলে পরের ফেব্রুআরি মাসে ফ্রান্সে ফিরে যান তিনি। কিন্তু তাঁর সেই স্বল্পকালীন যাত্রা বিফল হয়নি। সত্যি বলতে কি, সেই যাত্রা তাঁর মনোজগৎ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়ে এসেছিলো ব্যাপক পরিবর্তন। তাঁর পিতা মারা যান শার্লের বয়স যখন পুরো ছ বছরও হয়নি। তিনি যে-সম্পত্তি রেখে যান শার্লের জন্যে, একুশ বছর বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই সম্পত্তিতে পেয়েছিলেন প্রায় পূর্ণ অধিকার। অমনি দু হাতে তিনি টাকা ওড়াতে আরম্ভ করেন। দুবছর পুরো হবার আগেই তিনি অর্ধেক টাকা খরচ করে ফেলেন। অতঃপর তাঁর মা বাকি সম্পত্তি ট্রাস্থিদের হাতে সমর্পণ করেন। ট্রাস্টিরা ঠিক করে দিলেন যে, শার্ল পাবেন কেবল সেই সম্পত্তি থেকে সারা বছরে যে-লাভ হবে, সেই টাকা। মূলে তিনি হাত দিতে পারবেন না। অমিতব্যয়ী শার্ল এতে খুব বেকায়দায় পড়েন। তিনি হাতে যে-টাকা পেতেন তার পরিমাণ ছিলো বছরে মাত্র ৭৫ পাউন্ডের মতো। বেহিশেবী শার্লের এ দিয়ে আদৌ চলতো না। লিখে আয় করার তাঁর সংকল্প আর্থিক দিক দিয়ে কেবল অংশত সফল হয়েছিলো। ধীরে ধীরে তিনি জড়িয়ে পড়েন ব্যাপক ঋণজালে। তিনি যখন প্রায় নিঃস্ব তেমন অবস্থায়, ১৮৬২ সালে তাঁকে দেউলে ঘোষণা করা হয়। এর পর তাঁর সীমিত আয়ের প্রায় সবটাই আসতো তাঁর বই আর পত্রিকার লেখা থেকে। দুবছর পরে বক্তৃতা দিয়ে বাড়তি টাকা উপার্জনের জন্যে তিনি বেলজিয়াম যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা মোটেই সার্থক হয়নি। উল্টো, সেখানে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।

ওদিকে অল্প বয়সেই তিনি নানা নারীরসংসর্গ লাভ করেন। পরপর বেশ কয়েকটি নারীকে তিনি ভালোও বেসেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রথম প্রেম — কৃষ্ণাঙ্গ এক মহিলা — মাদাম জ্যান দুভাল সমাজের ওপরতলার বারবণিতা ছাড়া অন্য কিছু ছিলেন না। কবি অন্য একাধিক নারীর প্রতি আকৃষ্ট হলেও এবং তাঁর প্রতি জ্যান দুভালের আনুগত্য প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও প্রথম প্রেমিকার প্রভাব তিনি মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেননি। উপদংশ এবং অপরিমিত মদ্যপানে মাত্র বছর তিরিশেক বয়সেই তিনি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে যান। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৭ সালে ৪৬ বছর বয়সে তিনি পক্ষাঘাতে মারা যান। তাঁর একটি চিঠি থেকে বোঝা যায়, তাঁর এবং মাইকেলের সমস্যার মধ্যে বেশ মিল ছিলো। ১৮৫২ সালের ২৭ মার্চ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে বোদলেয়ার তাঁর পুরোনো এবং দুরারোগ্য সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তাঁর মাকে জানান: ‘এই অবস্থায় আমি নিজে যে-লক্ষ্যবস্তুগুলো অর্জন করবো বলে ঠিক করেছি, তা কোনো কালে অর্জন করতে পারবো না। এই লক্ষ্যগুলো হলো — আমার ধার শোধ দেওয়া, আর্থিক নিরাপত্তা লাভ, খ্যাতি অর্জন করা এবং তোমাকে যে-দুঃখ দিয়েছি, তা দূর করা।’৭০ শেষটি ছাড়া, বাকি লক্ষ্যগুলো মাইকেলেরও ছিলো। বোদলেয়ারের মতো অনাচারী না-হলেও, মাইকেল অন্য নারীর সংসর্গ করেছিলেন কিনা, নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ফ্রান্সে থাকার সময়ে অন্তত একটি ক্ষেত্রে করেছিলেন বলে অনুমান করি। কিন্তু অপরিমিত মদ্যপানের দ্বারা নিশ্চিতভাবে তিনি বোদলেয়ারের মতো অকালে আত্মহননে সমর্থ হয়েছিলেন।

সমকালীন ফরাসি কবি ভিক্তর উগো এবং ইংরেজ কবি অ্যালফ্রেড টেনিসনকে উদ্দেশ্য করে মাইকেল দুটি সনেট লিখেছিলেন।৭১ তা থেকে কারো কারো মনে হতে পারে যে, তিনি ‘বোধ হয় এ দুজন কবির ভক্ত ছিলেন অথবা তাঁদের কাব্য দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেটা আদপে ঠিক নয়। উগো আর টেনিসন ছিলেন সে সময়কার যথাক্রমে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত কবি। ১৮৬৫ সালে এঁদের বয়স ছিলো যথাক্রমে ৬৩ আর ৫৬। ফ্রান্সের রোম্যান্টিক কাব্য-আন্দোলনের প্রধান নায়ক হিশেবে উগোর নাম অবিস্মরণীয়। ঔপন্যাসিক এবং প্রতিষ্ঠান-বিরোধী রাজনীতিক হিশেবেও তাঁর নাম কম ছিলো না। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার দরুন তাঁকে দু দশকের জন্যে স্বেচ্ছানির্বাসন নিতে হয়েছিলো। এই নির্বাসনে যাবার ছবছর আগে ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপের কাছ থেকে তিনি সম্মান এবং খেতাব লাভ করেন। প্রজাতন্ত্র হবার পরেও তিনি শাসকদের কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান এবং খাতির পেয়েছিলেন। তবে উগো যে-ধরনের মানবতাবাদী রোম্যান্টিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং সত্যিকার অর্থে জনগণের কবি ছিলেন, মাইকেলের মানসিকতার সঙ্গে তার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। মাইকেল পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করে রেনেসান্সের হিউম্যানিস্ট আদর্শ তুলে ধরেছিলেন। বিশেষ করে মেঘনাদবধকাব্যে তিনি দৈবশক্তির বিরুদ্ধে মানুষের সগ্রামী স্পিরিটের জয়গান করেছেন। কিন্তু উগোর মতো গণসচেতন কবি তিনি ছিলেন না। ওদিকে, টেনিসন ছিলেন তৃতীয় প্রজন্মের রোম্যান্টিক কবি। মাইকেল তাঁকে নিয়ে সনেট রচনা করার পনেরো বছর আগে রাজকবি হিশেবে তিনি শিরোপা লাভ করেছিলেন। রাজকবিদের মাইকেল দেখতেন বিশেষ ঈর্ষা এবং শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে। নিজেও রাজকবি হবার স্বপ্ন দেখেছেন — বোধ হয় সারা জীবন। টেনিসন এবং উগোর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুটি সনেট রচনা করে তিনি যেন রাজকবিদের প্রতি তাঁর আন্তরিক দুর্বলতাই প্রকাশ করেন।

মাইকেলের সর্বশেষ কবিতাগুচ্ছ — চতুর্দশপদী কবিতাবলি — আঙ্গিক এবং আস্বাদের দিক দিয়ে তাঁর আগেকার কবিতা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে আলাদা। কিন্তু এ কবিতার মধ্যেও ব্যক্তি মাইকেলকে সমানভাবে — এমন কি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি করে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কাব্য এবং নাটকের আলোচনার সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি, তিনি আপাতদৃষ্টিতে পৌরাণিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করলেও, আসলে তাঁর অনেক রচনাই আত্মজৈবনিক। এবং আত্মজৈবনিক প্রেরণা যতো প্রবল, তাঁর সে রচনা ততো আন্তরিক এবং প্যাশন-পরিপূর্ণ। সনেটের মধ্য দিয়েও তিনি এই কথাটা আর-এক দফা প্রমাণ করেন। যেসব সনেটে তিনি তাঁর বাল্যের লীলাক্ষেত্র ফেলে-আসা সাগরদাঁড়ির স্বপ্ন দেখেছেন অথবা স্মরণ করেছেন স্বদেশের কথা, সেসব সনেটেই তাঁর ভাবাবেগ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘কপোতাক্ষ নদ’ এই প্রসঙ্গে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এ নদকে তিনি বিরলে বসে সতত স্মরণ করেছেন। তাঁর চেতনা এবং অবচেতনায় এই নদ, বস্তুত, একাকার হয়ে গিয়েছিলো। এই আন্তরিকতা এবং গভীরতা পাঠককে নাড়া না-দিয়ে পারে না।

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে! —

বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?

দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি-শুনে!…

এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে

লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে!

লক্ষ্য করা যেতে পারে, কৃশাঙ্গ কপোতাক্ষের ঘোলাটে জল এখানে কবির দৃষ্টিতে জননীর স্তন্যের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছে এবং ভাষাও প্রাত্যহিক জীবনের তুচ্ছ ভাষা থাকেনি, তা রূপ নিয়েছে সঙ্গীতের। তাঁর অন্য সনেটগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, নদীতীরের বটবৃক্ষ, ভাঙ্গা শিবমন্দির, বউ কথা কও পাখি, অন্নপূর্ণার ঝাঁপি, রামায়ণ, সীতা, মহাভারত, সরস্বতী, ঈশ্বরী পাটনী, শ্যামা-পক্ষী,শ্রীমন্তের টোপর — সবই তাঁর মনকে উদ্বুদ্ধ করেছে। হিন্দু ধর্মের বন্ধন তিনি কাটিয়ে এসেছিলেন বহু কাল আগে। মনে-প্রাণে একটা ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গেও নিজেকে চিহ্নিত করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা, বিজয়া দশমী, শ্রীপঞ্চমী, সরস্বতী পূজা ইত্যাদি অনুষঙ্গ তাঁর মনকে নস্টালজিক বোধে উতলা করেছে।

কবিকে চেনার জন্যে অবশ্য এ সনেটগুলোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্য কয়েকটি সনেট, যাতে তিনি একান্তভাবে বলেছেন নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। তিনি কবিযশ লাভ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আবার বড়োলোক হয়ে জীবনকে উপভোগ করার স্বপ্নও দেখেছিলেন। জীবনের কোনো পর্বে তিনি এর একটিকে পুরো বর্জন এবং অন্যটিকে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। কখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি, লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মধ্যে কে তাঁর বেশি আরাধ্য। কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করার আগে রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন: আর কবি-মধু নয়, অতঃপর মাইকেল এম এস ডাট ব্যারিস্টার অ্যাট ল। এ থেকে মনে হতে পারে যে, অতঃপর তিনি কবি-খ্যাতিব চেয়ে বড়োলোক হবার বাসনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সনেটগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, লক্ষ্মীর প্রতি সীমাহীন দুর্বলতা সত্ত্বেও, তিনি স্বীকার করেছেন, যে-অমরত্বের কাঙাল, সরস্বতীই তাঁকে তা দান করতে পারেন। একটি সনেটে বলেছেন

ভেবো না জনম তার এ ভবে কুক্ষণে,

কমলিনী-রূপে যার ভাগ্য-সরোবরে

লোতেন মা কমলা সুবর্ণ কিরণে, —

কিন্তু যে কল্পনারূপ খনির ভিতরে

কুড়াযে রতন-ব্রজ, সাজায় ভূষণ

স্বভাষা, অঙ্গের শোভা বাড়াযে আদরে!

এ কবিতায় তিনি যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়েছেন। অবশ্য তিনি যা পাননি — পার্থিব সম্পদ — তাঁর ভাষায় যা বড়বাজার আর চোরবাজারে অনেকের আছে — তাঁর জন্যে দীর্ঘনিশ্বাস এখানেও গোপন থাকেনি। কিন্তু যা পেয়েছেন — কবিখ্যাতি — তা যে অমূল্য, এ বিবেচনাও স্পষ্ট। কয়েক বছর আগে যখন তিনি বাংলা সাহিত্যাকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে রাতারাতি — তাঁর নিজের ভাষায় — ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ সাহিত্যিক বলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন, তখন ভেবেছিলেন, সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু স্বদেশ থেকে ছ হাজার মাইল দূরে এবং কয়েক বছরের ব্যবধানে তাঁর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছিলো। যা সৃষ্টি করেছেন, তা টিকে থাকবে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ উঁকি দিয়েছে মনের মধ্যে।

লিখিনু কি নাম মোর বিফল যতনে

বালিতে, রে কাল, তোর সাগর তীরে? …

অথবা খোদিমু তারে যশোগিরি-শিরে,

গুণ-রূপ যন্ত্রে কাটি অক্ষর সুক্ষণে, —

নারিবে উঠাতে যাহে, ধুয়ে নিজ নীরে,

বিস্মৃতি, বা মলিনিতে মলের মিলনে?

কিন্তু সন্দেহ যাই থাক এবং সে পথ যত দুর্গম হোক, তিনি সমস্ত অন্তর দিয়ে কামনা করেছেন, তিনি যেন সেই দুর্লভ যশের ভাগীদার হতে পারেন। তিনি ভালো করেই জানতেন, যশের তুঙ্গে আরোহণ করা দুঃসাধ্য সাধনা।

তবুও উঠিতে তথা — সে দুর্গম স্থলে —

করিছে কঠোর চেষ্টা কষ্ট সহি মনে

বহু প্রাণী। বহু প্রাণী কাদিছে বিকলে,…

কিন্তু তা সত্ত্বেও, তিনি ভরসা করেছেন, কালের বিশাল চত্বরের একটি ধারে তাঁর জন্যে ছোটোখাটো একটি আসন থাকবে।

শিয়রে দাঁড়ায়ে পরে কহিলা ভারতী,

মৃদু হাসি; ‘ওরে বাছা না দিলে শকতি

আমি, ও দেউলে কার সাধ্য উঠিবারে?

যশের মন্দিবে ওই; ওথা যার গতি,

অশক্ত আপনি যম ছুইতে রে তারে!’

পেত্রার্কার সনেট তাঁকে অনুপ্রেরণা দিলেও, আগেই বলেছি, পেত্রার্কার সনেটের মতো প্রেম তাঁর সনেটের বিষয়বস্তু হতে পারেনি। পেত্রার্কা গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর প্রতি, যাঁর সঙ্গে কোনো কালে তাঁর মিলন হতে পারেনি। কিন্তু তবু নিরন্তর তিনি সেই নারীর উদ্দেশ্যে সনেটের মালা গেঁথেছেন। মাইকেল যখন তাঁর সনেটগুচ্ছ রচনা করেন, তখন কোনো নারী তাঁকে এমন গভীর প্যাশনের সঙ্গে টানেননি। বস্তুত, এক শো সনেটের মধ্যে সব মিলে মাত্র পাঁচটি সনেট আছে নারীদের লক্ষ্য করে লেখা — ১৩, ১৪, ২৬, ৫৮ এবং ১০০ সংখ্যক সনেট। এর মধ্যে ‘পরিচয়’ শীর্ষক সনেট দুটি (১৩ ও ১৪), ২৬ সংখ্যক ‘কুসুমে কীট’ এবং শিরোনামহীন ৫৮ সংখ্যক সনেটটি একই নারীর উদ্দেশ্যে লিখিত বলে অনুমান করি। ১৩ সংখ্যক সনেটে আছে এক নারীর কাছে তাঁর নিজের পরিচয় দান। তারপর ১৪, ২৬ এবং ৫৮ সংখ্যক সনেটে এই নারীর প্রতি তাঁর প্রেম এবং তার সঙ্গে মিলনের কথা বলা হয়েছে।

যে-ফরাসি সুন্দরী কবিকে কারাগারের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং শেষোক্ত সনেট তিনটিতে যে-নারীর বর্ণনা পাই – তাঁরা এক নন। কবি যিনি উপকার করেছিলেন, তিনি বড়োঘরের মহিলা। অবস্থাপন্ন।৭২ কিন্তু পূর্বোক্ত ১৪ এং ২৬ সংখ্যক সনেটে যে-নারীকে দেখতে পাই, সুন্দরী হলেও তিনি যে-পবিবেশে বাস করেন, আপাতদৃষ্টিতে, তা উন্নত নয়। কবির ভাষায়, “সরঃ ত্যজি সরোজিনী ফুটিছে এ স্থলে।’ এ বর্ণনা থেকে এই নারীর অবস্থা পুরোপুরি পরিষ্কার না-হলেও ‘কুসুমে কীট’ অর্থাৎ ২৬ সংখ্যক সনেটের বর্ণনা সংশযহীন। সেখানে বলেছেন – ‘কানন-চন্দ্রিমা তুমি কেন রাহু-গ্রাসে?’ এই সনেট থেকে বোঝা যায়, এই ‘বন-সুন্দরী’ কোনো অত্যাচারী পুরুষের নির্যাতনে সংকটাপন্ন ছিলেন। এই নারীর সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা হওয়া সম্ভব। তবে কবির ভালোবাসা আন্তরিক কিনা, সে বিষয়ে এই নারী সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। ১৪ সংখ্যক সনেটটিতে কবি তাঁকে নিজের ভালোবাসা সম্পর্কে আশ্বাস দিয়েছেন: ভাল যে বাসিব আমি, এ বিষয়ে তবে। এ বৃথা সংশয় কেন?’। আর ২৬ সংখ্যক সনেটটিতে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন এই সুন্দরী নারীর প্রতি। কবির অন্যতম জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ সোম বলেছেন যে, ১৩ এবং ১৪ সংখ্যক সনেট কবি প্রথমে লিখেছিলেন ফরাসি ভাষায়। তার পর এই সনেটের ভাব অবলম্বন করে বাংলা সনেট দুটি রচনা করেন।৭৩ কোন তথ্যের ভিত্তিতে জীবনীকার এই মন্তব্য করেছেন, তা জানা যায় না। কিন্তু সত্য হলে এ থেকে পরোক্ষ প্রমাণ মেলে যে, কবি রক্তমাংসের কোনো নারীকে নিয়ে এই সনেট রচনা করে হয়তো তাঁকেই এই সনেট উপহার দেন। এই নারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কী ধরনের ছিলো, তার আভাস মেলে ৫৮ সংখ্যক সনেট থেকে। এই সনেটে তিনি এই নারীকে চারুনেত্রা বলে সম্বোধন করেছেন। তার পর বলেছেন: আমিতো বীর লক্ষ্মণ নই, তা হলে তোমার সঙ্গে প্রেমের মল্লযুদ্ধে কেন পরাজিত হবো না! মদনের বরে প্রেমের ব্যাপারে তুমি মেঘনাদের মতো শিক্ষা পেয়েছে। তুমি বড়ো ভয়ঙ্করী। গিরির আড়াল থেকে তুমি তোমার শত্রুকে নাগপাশে বাঁধে।

দশ গোটা শরে

কাট গণ্ডদেশ তার, দগুলো অধরে;

মুহুর্মুহঃ ভূকম্পনে অধীর লো করি! —

এ বড় অদ্ভুত রণ। তব শঙ্খ-ধ্বনি

শুনিলে টুটে লো বল! শ্বাস-বায়ু-বাণে

ধৈরয-কবচ তুমি উড়ায়ে, রমণি,

কটাক্ষের তীক্ষ্ণ অস্ত্রে বিধ লো পরাণে! —

একে দিগম্বরী-কপ যদি, সুবদনি,

ত্রস্ত হয়ে ব্যস্ত কে লো পরাস্ত না মানে?

এখানে কবি দৈহিক মিলনের যে-বর্ণনা দিয়েছেন, সমগ্র বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতেও তাকে অসাধারণ বলা যেতে পারে। এই বর্ণনার মধ্যে যে-রকমের আন্তরিকতা লক্ষ্য করা যায়, তাতে একে নৈর্ব্যক্তিক মনে করা শক্ত। বস্তুত এই সনেট কটি তাঁর বিবাহ-বহির্ভুত প্রেমের এবং নারী-সংসর্গের প্রমাণ বলে মনে করলে বোধহয় অন্যায় হবে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, এই সনেট কটি পড়লে মনে হয় না যে, এই নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেও দু কূল প্লাবিত-করা প্রেমের বন্যায় তিনি ভেসে গিয়েছিলেন।

চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলির নামপত্র

‘কুসুমে কীট’ নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ। চকিতে বোদলেয়ারের ফ্ল্যর দু ম্যলকে মনে করিয়ে দেয়। বোদলের যেমন ক্লেদজ কুসুমের মধ্যে সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছিলেন, মাইকেলও তেমনি মুগ্ধ হয়েছিলেন সম্ভবত সমাজের নিচের তলার কোনো ‘রাহুগ্রস্ত’ সুন্দরী মহিলাকে দেখে। তিনি ভার্সাই-এর যে-সাহিত্যিক-শিল্পীর চক্রের সঙ্গে মেশামেশি করেছিলেন তার মাধ্যমে এই নারীর সাহচর্য লাভ করে থাকবেন। এর পক্ষে কোনো রূপজীবী অথবা রু দ্য শাঁতিয়ের যে-বাড়িতে বাস করতেন, সেখানকার কোনো নিম্নশ্রেণীর মহিলা হওয়াও সম্ভব। তবে এ মহিলার পরিচয় যেমনই হোক না কেন, মাইকেল একজন ‘অসতী’ এবং সমাজের চোখে কলঙ্কিনীকে নিয়ে কবিতা রচনা করে বাংলা কাব্যের দিগন্তকে প্রসারিত করেছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যে কামের যথেষ্ট ছড়াছড়ি রয়েছে। বিদ্যাসুন্দরেও তার বিশদ প্রকাশ ঘটেছে। তবে তফাৎ হলো সংস্কৃত সাহিত্য এবং ভারতচন্দ্রে কামের বর্ণনা নৈর্ব্যক্তিক, মাইকেলে আত্মকথনমূলক — ভারতীয় সাহিত্যে যা অভিনব। যৌনতা সম্পর্কে বাঙালি সমাজে দ্বৈত মান চালু থাকায় এবং ইংরেজি শিক্ষিত সমাজভিক্টোরীয় আদর্শ দিয়ে প্রভাবিত হওয়ায়, বারবনিতা অথবা সন্দেহভাজন চরিত্রের মহিলাদের নিয়ে কবিতা রচনা করা উনিশ শতকের কোনো বাঙালি কবির জন্যে প্রত্যাশিত ছিলো না। এই সনেট দুটি রচনা করে কবি সত্যি সত্যি এক নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু বোদলেয়ারে অনুরূপ বিষয়-নির্ভর কবিতার সঙ্গে এই জাতীয় সনেট দুটির মিল নিতান্তই বহিরঙ্গের। বোদলেয়ারের কাব্যাদর্শ এবংপ্রতীকী ব্যঞ্জনা মাইকেলে নেই। বস্তুত,তাঁর এ সনেটগুলো থেকে বোদলেয়ারের পরোক্ষ প্রভাব প্রমাণিত হয় না, কিন্তু তাঁর কাব্যধারার বিবর্তনে ফরাসি সমাজে তাঁর বসবাসের প্রভাব প্রমাণিত হয়।

এই সনেটগুচ্ছের মধ্যে সত্যিকার প্রেমের কবিতা হলো: ১০০ সংখ্যক শিরোনামহীন সনেটটি। মাইকেলের কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন যে, এই সনেটটি হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে লেখা।৭৪ কিন্তু সনেটটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি লেখা রেবেকাকে লক্ষ্য করে। তার কারণ, যাঁর সঙ্গে কবি তখন বাস করছিলেন, তাঁকে লক্ষ্য করে তিনি কেন বলবেন

প্রেমের সুবর্ণ বঙে, সুনেত্রা যুবতি,

চিত্রেছ যে ছবি তুমি এ হৃদয়-স্থলে,

মোছে তাবে হেন কার আছে লো শকতি

যত দিন ভ্রমি আমি এ ভব-মণ্ডলে?

এই নারী তাঁর হৃদয়ে যে-ছবি এঁকেছেন, তা মোছার আশঙ্কা আছে, কিন্তু তিনি তা হতে দেবেন না — এটাই এই পঙ্‌ক্তিগুলো থেকে মনে হয়। যার সঙ্গে তিনি ঘর করছিলেন, তাঁর সম্পর্কে এ কথা খাটে না। তদুপরি, আড়াই পঙ্‌ক্তি পরেই তিনি বলেছেন।

দূরে কি নিকটে,

যেখানে যখন থাকি, ভজিব তোমারে,

হেনরিয়েটা — অর্থাৎ যাঁর সঙ্গে তিনি স্বামী-স্ত্রীর মতো বাস করছেন, তাঁকে ‘দূরে কি নিকটে’ বলার দরকার করে না। তিনি নিকটেই আছেন। ‘দূরে’রপ্রশ্ন উঠছে রেবেকার সঙ্গে বাস করছেন না বলেই। সবশেষে একটি পঙ্‌ক্তিতে যে-ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা আরও স্পষ্ট —

অধিষ্ঠান নিত্য তব স্মৃতি-সৃষ্ট মঠে

হেনরিয়েটা তখনো স্মৃতিতে পরিণত হননি, তিনি তখনো রক্তমাংসের মানুষ হিশেবে কবির সঙ্গে বসবাস করছিলেন। কিন্তু এর পরের পঙক্তিতে কবি যা বলেছেন, তাঁর সমালোচকরা সেটাকেই আগের পঙ্‌ক্তিগুলোর বক্তব্য বিচার না-করে বেদবাক্যের মতো এবং আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন — সতত সঙ্গিনী মোর সংসার-মাঝারে। আগের পঙুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে মনে হয় কবি বলেছেন — নিত্য তোমার অধিষ্ঠান স্মৃতির মঠে। তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে সংসারের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তোমার স্মৃতি সতত আমার সঙ্গিনী।

সনেটের আলোচনা প্রসঙ্গে দেখতে পাই যে, তিনি কয়েকটি সনেটে কেবল স্বদেশের প্রতি নয়, নিজের ভাষার প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই ভাবধারার উল্লেখ না-করলে, তাঁর মনোজগৎকে পুরোপুরি দেখা যাবে না। কলকাতায় লেখা ‘কবি-মাতৃভাষা’ সনেটটির দুটি পাঠান্তর ছাড়াও, চতুর্দশপদীর সবশেষের কবিতায় বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং প্রথম জীবনে এই ভাষার প্রতি অযত্ন করায় আন্তরিক অনুতাপ প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি তিনি অনেক জায়গাতেই তাঁর মনোভাব প্রকাশ করেছেন — কখনো চিঠিতে, কখনো কবিতার ছন্দে। এসব বিশ্লেষণ করলে এবং তাঁর জীবনের নানা ঘটনার সঙ্গে এগুলো মিলিয়ে দেখলে মনে হয়, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর মনোভাব ছিলো একই সঙ্গে আন্তরিক আকর্ষণ এবং অকৃত্রিম অবহেলার — অন্য কথায় — ভালোবাসা এবং ঘৃণার।

নারিনু, মা, চিনিতে তোমারে

শৈশবে, অবোধ আমি! ডাকিলা যৌবনে;

(যদিও অধম পুত্র, মা কি ভুলে তারে?)

এবে – ইন্দ্ৰপ্রন্থ ছাড়ি যাই দূরে বনে!

এ অবস্থায় তিনি আর-কিছু করতে পারবেন না, তিনি তা জানেন; কিন্তু বঙ্গভূমি যাতে জ্যোতির্ময়ী হয়ে ওঠেন তিনি কেবল এই কামনা করেন। এই কামনা দেশ এবং ভাষার প্রতি তাঁর নিষ্কাম প্রেমের প্রমাণ। সেই সঙ্গে আরও একবার লক্ষ্য করা যায়, স্বদেশ থেকে দূরে এসে, তাঁর মধ্যে যে-স্বরূপের সংকট দেখা দিয়েছিলো, তা তখনো কেটে যায়নি। বরং তা কেলাসিত রূপে এই সনেটগুলোতে প্রকাশিত। ভারতবর্ষ যে পরাধীন — একথাও তিনি একাধিক সনেটে কাতবতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এককালের গৌরবোজ্জ্বল ভারতের সন্তান হয়েও সেকালের ভারতবাসীদের অক্ষমতার জন্যে তিনি অনুতাপ বোধ করেছেন — ‘আমরা, — দুর্বল, ক্ষীণ, কুখ্যাত জগতে … বামন দানবকুলে, সিংহের ঔরসে। শৃগাল।’

তাঁর সনেটের প্রসঙ্গে একটি কবিতার কথা বিশেষ করে উল্লেখ করা হয় – যেটি তিনি রচনা করেন। দান্তের পঞ্চ শতবার্ষিকী উপলক্ষে। এটি তিনি ইটালির রাজাকে পাঠান। হিন্দু কলেজে পড়ার সময় থেকে তিনি দান্তের কাব্যের সঙ্গে পরিচিত। তা ছাড়া, নিজে যখন মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করেন, তখন সজ্ঞানে দান্তের রচনা থেকে ধার করেছেন। এখন সেই প্রখ্যাত কবিব বিশেষ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক।৭৫ তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে অনেকগুলো সনেটই রচনা করেছিলেন। তবে তিনি যে এই সনেটটি ইটালির রাজার কাছে পাঠান, তার পেছনে কাজ করেছে সেই মানসিকতা যার প্রেরণায় তিনি ফ্রান্সের নখ- দন্তহীন রাজা এবং রানীকে কুর্নিশ করে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছেন। রাজকীয় সব কিছুই তাঁকে দারুণ উদ্বুদ্ধ করতো। ভেবে অবাক হই, লন্ডনে তিনি ভিক্টোরিয়াকে কেন কুর্নিশ জানানোর চেষ্টা করলেন না, অথবা তাঁর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখলেন না। হয়তো, ভারতবর্ষের একজন সাধারণ প্রজার কুর্নিশ এবং কবিতা যথেষ্ট সমাদৃত হবেনা,একথা ভেবে তিনি সময় এবং উদ্যম ব্যয় করেননি।

১৮৬৪ সালের একেবারে শেষ দিকে কিছু সময়ের জন্যে সনেট রচনায় সাময়িকভাবে নিমগ্ন হলেও, কবি বেশি কাল তাতে ডুবে থাকতে পারেননি। টাকাপয়সার সমস্যা আবার দেখা দেয় ডিসেম্বর মাসে (১৮৬৪)। তিনি জানতেন বারবার বিদ্যাসাগরকে তাড়া দিলে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে। তা সত্ত্বেও ২৬ নভেম্বর বিদ্যাসাগরকে তাগাদা দিয়ে একটি চিঠি লেখেন। কেবল তাই নয়, এর দশ দিন পরে তিনি আবার বিদ্যাসাগরকে লিখতে বসেন। অভাবের মুখে তিনি কতোটা অসহায় বোধ করছিলেন, এ চিঠি থেকে তার আভাস পাওয়া যায়।

গত রাতে লন্ডনের ইনগুলো বড়োদিন উপলক্ষে বন্ধ হয়েছে। আবার খুলবে আগামী ১১ জানুআরি। … আমি যদি পরিস্থিতির চাপে পড়ে ইংল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য না-হতাম, তা হলে এটা দিয়ে আমার ন’টা টার্ম শেষ হতো। আগামী বছর এ সময়ে আমি কলকাতায় ফিরে যেতে পারতাম।

আমি বারবার একই কথা বলে আপনার বিরক্তি উৎপাদন করতে চাইনে। আমার গত দুটি চিঠিতেই আমি এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছি। তাই না? এখন আমার অবস্থা, আমাদের দেশের কবিদের ভাষায়, ঠিক চাতকের মতো, মেঘের জন্যে অপেক্ষা করে আছি, যে-মেঘ আমার তৃষ্ণা মেটাবে। … আপনাকে মনে করিয়ে দিই — এ মাসের শেষে আমার হাতে একটি পয়সাও থাকবে না। এবং আপনি যদি ইতিমধ্যে ব্যবস্থা না-নিয়ে থাকেন, তা হলে আমার আবার খুব দুরবস্থায় পড়তে হবে।

আপনাকে বিরক্ত করতে আমার একদম ইচ্ছে হচ্ছেন। কিন্তু আমি এমন মরিয়া হয়ে উঠেছি বলেই আপনাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করুন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমার প্রতি কারো কোনো সহানুভূতি নেই। আপনিও যদি আমাকে ত্যাগ করেন, তা হলে আমি ডুবে মরবো।

…আজ ডাক আসার কথা। সুতরাং এ চিঠি আমি বেলা বারোটা পর্যন্ত বন্ধ করবো না। আমি ভেবে পাচ্ছিনে, আজ আমরা কোনো চিঠি পাবো কিনা। বিদায়!

এখন বারোটার বেশি বাজে এবং আপনার চিঠির কোনো পাত্তা নেই। সুতরাং এখানেই আমার চিঠি শেষ করতে হচ্ছে, তা না-হলে এ চিঠি আজকের ভাকে পাঠানো যাবে না।৭৬

ছ দিন পরে — দোসরা ডিসেম্বর তিনি বিদ্যাসাগরকে আবার লেখেন যে, তাঁর সব টাকা ফুরিয়ে গেছে। সেই টানাটানির মুখে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে ২,৪৯০ ফ্রঁ (এক হাজার টাকা) পান। এ টাকা পাওয়া সত্ত্বেও তিনি খুব বিচলিত হন। টাকা পাওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর তারিখে লেখা চিঠিতে তিনি বিদ্যাসাগরকে জানান যে, এ সময়ে তাঁর ধারের পরিমাণ ছিলো ১৪০০ টাকা। বিদ্যাসাগরের পাঠানো টাকা দিয়ে তিনি ৪০০ টাকার ধার শোধ করেন। এক শো টাকার গরম কাপড়চোপড় কেনেন (কৈফিয়ত দিয়ে বলেছেন, ‘এবছর এখানে বেজায় ঠাণ্ডা পড়েছে।’)। আর তাঁর হাতে থাকে ৫০০ টাকা। তিনি বলেছেন যে, এই টাকা দিয়ে জানুআরি মাসের শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিতে পারবেন। তবে তখনকার মতো বেঁচে থাকা সম্ভব হলেও এ টাকা দিয়ে সব ধার-দেনা শোধ দিয়ে লেখাপড়া করতে গ্রেজ ইনেফিরে যাওয়া সম্ভব নয় — তা-ওতিনি জানিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের চিঠিতে চাহিদা মতো টাকা পাঠানোর কোনো আশ্বাস ছিলো না। কবি এতে সত্যি সত্যি দমে যান। তা হলে কি করুণাসাগরও বিমুখ হলেন? অতঃপর তিনি কোন দিকে মুখ ফেরাবেন? হতাশ মাইকেল বুঝতে পারেন, গ্রেজ ইনে ১৮৬৫ সালের প্রথম টার্ম তো বটেই, এমন কি, হয়তো দ্বিতীয় টার্মও তিনি হারাবেন। তার অর্থ হবে ভারতবর্ষে আরও দেরি করে ফেরা, আরও অর্থ ব্যয়, আরও ভোগান্তি। এই একান্ত নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, তাঁকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে।৭৭

এই চিঠিতে ‘করুণাসাগর’ বলে তিনি বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করেছিলেন। সেই সঙ্গে নিজের অসহায়তা এবং বিদ্যাসাগরের ওপর তাঁর নির্ভরতার পরিমাণ বোঝানোর জন্যে তিনি পূর্বোক্ত চিঠিতে ইংরেজির সঙ্গে একটি বাংলা অনুচ্ছেদ জুড়ে দেন। নিজের মনের অবস্থা বোঝাতে গিযে ভূমিকা করে বলেছেন — যেমনটা কেউ মাতৃভাষায় বলবে:

আমি বিলক্ষণ বুঝিতে পারিতেছি যে, এ হতভাগাৰ বিষয়ে হস্তনিক্ষেপ করিয়া আপনি এক বিষম বিপদজালে পড়িয়াছেন। কিন্তু কি করি? আমার এমন আর একটি]৭৩ বন্ধু নাই যে তাহার শরণ লইয়া আপনাকে মুক্ত করি। আপনি এখন অভিমন্যুর মতন মহাব্যুহ ভেদ করিয়া কৌরবদলে প্রবেশ করিয়াছেন; আমার এমন শক্তি নাই যে আপনাকে সাহায্য প্রদান করি; অতএব আপনাকে স্ববলে শত্রুদল সংহার করিয়া বহির্গত হইতে হইবেক; এবং বাহিরে আসিয়া এ শরণাগত জনকে রক্ষা করিতে হইবেক। এ কথাটী যেন সর্বদা স্মরণ-পথে থাকে।

বাংলা ভাষায় লিখে তিনি যে কেবল নিজের মনের কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করেন, তাই নয়, সেই সঙ্গে তিনি আশা করেন, বাংলায় লিখলে তা বিদ্যাসাগরের অন্তরকে বেশি করে স্পর্শ করবে। বিদ্যাসাগর তাঁর চিঠিতে কী লিখেছিলেন, তা জানার উপায় নেই। তবে বোঝা যায়, যে-পরিমাণ টাকা কবি চেয়েছিলেন, মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে টাকা আদায় করে এবং নিজের বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে অতো টাকা তিনি জোগাড় করতে পারেননি। বরং তিনি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়দের কাছ থেকে যথেষ্ট বিরোধিতার মুখোমুখি হন। বৈদ্যনাথবা কাগজপত্র দিতেও গড়িমসি করে থাকবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কবি লেখেন, তাঁকে একাই শক্রদলের ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে হবে।৭৮ মনে হয়, তিনি অন্য যাঁদের কাছে টাকা পেতেন, তাঁদের সবার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে বিদ্যাসাগর ব্যর্থ হন।

বিদ্যাসাগর মাইকেলকে আরও লিখেছিলেন যে, তাঁকে সম্পত্তি হস্তান্তর সম্পর্কে ঢালাও ক্ষমতা না-দিলে তাঁর পক্ষে আর টাকা ধার করে পাঠানো সম্ভব হবে না। এ ধরনের ঢালাও ক্ষমতা দেবার ব্যাপারে কবির কিছু দ্বিধা ছিলো। তা ছাড়া, অক্টোবর মাস থেকে তাঁর স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিলো না। মনোমোহন ঘোষকে কৌতুক করে তিনি নিজের স্বাস্থ্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:

তুমি চলে যাবার পর পেটের পীড়ায় আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি। আমার ধারণা হলো মিলনান্তক নাটক শেষ হয়ে আসছে এবং এর পরেই যবনিকা পতন। কিন্তু এই দেখো, আমি এখনো ঠিক টিকে আছি। আমার ভূমিকা এখনো শেষ হয়নি। ইনীয়াস যেমন ফীড্রাকে বলেছিলো: ‘মশাল এখনো জ্বলছে!’৭৯

হালকা চালে লেখা হলেও তিনি যে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়েছিলেন, তা বোঝা যায়। এর আগে, জুন মাসে, তিনি নিজে লিখতে পারছিলেন না এবং লেখাচ্ছিলেন হেনরিয়েটাকে দিয়ে। তদুপরি অক্টোবরের শেষ দিক থেকে তাঁর চোখের অসুখ হয়। তিনি কারণ দেখিয়ে বলেছেন, হয়তো খুব বেশি লেখাপড়া করার জন্যে। কিন্তু কারণ যা-ই হোক, তাঁর আশঙ্কা হয়েছিলো যে, তিনি এর ফলে অন্ধও হয়ে যেতে পারেন। এমতাবস্থায় তাঁর পক্ষে প্যারিসে গিয়ে একটা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করা সহজ ছিলো না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে বুঝতে পারলেন যে, ঢালাও ক্ষমতা দিয়ে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি না-পাঠালে তাঁকে আবার নিদারুণ অর্থ সংকটে পড়তে হবে। সে জন্যে তাঁর শারীরিক অসুবিধে যাই থাক না কেন, প্যারিসে গিয়ে একজন আইনজীবীকে ধরে তিনি একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করান। সেই পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাঠিয়ে দিয়ে তিনি বিদ্যাসাগরকে লিখলেন:

আপনি দেখতে পাবেন যে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ব্যাপারে আমি আপনার উপদেশ মতো কাজ করেছি। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি যে, আমার ভাগ্য, আমার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, আমার আপনজনদের স্বার্থ, না, না, আমার নিজের জীবন আপনার হাতে তুলে দেবার জন্যে আমি কতটা প্রস্তুত। এবং আমি আপনাকে আবার বলছি, আমি আমার লক্ষ্য অর্জন করতে না-পারলে আর কখনো ভারতবর্ষে গিয়ে আমার মুখ দেখাবো না। … এই সঙ্গে যে-দলিল [পাওয়ার অব অ্যাটর্নি] পাঠালাম, আশা করি তা দিয়ে আমার পক্ষ থেকে সবই করতে সমর্থ হবেন। … আপনি আমার চিঠি থেকে হয়তো জানতে পেরেছেন যে, আমি মিকেলমেস টার্মটি এবারেও ধরতে পারিনি। এবং বোধহয় আরও দুটি টার্ম হারাবো। তার অর্থ আমি গ্রেজ ইনে ফিরে যেতে পারবো যখন আসলে আমার সেখান থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ভারতবর্ষে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো — যদি মহাদেব চট্টোপাধ্যায় আর দিগম্বর মিত্র আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না-করতেন।৮০

কবি যখন এ চিঠি লেখেন, তখন তাঁর ধারের পরিমাণ প্রায় এক হাজার টাকা। কিন্তু তাঁর হাতে নগদ ছিলো মাত্র পাঁচ শো টাকা — যা দিয়ে জানুআরিব শেষ পর্যন্ত চলে যাবে বলে তিনি আশা করেছেন। তিনি আরও একবার বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ জানিয়েছেন যে, তিনি যেন এক থোকে এতোটা টাকা পাঠান যাতে ধার শোধ করে তাঁর হাতে ভার্সাই অথবা লন্ডনে তিন মাস চলার মতো টাকা থাকে। বিদ্যাসাগরের উপদেশ মতো এ সময়ে তিনি তাঁর পরিবার লন্ডনে নিয়ে যেতে রাজি হন। তবে, তিনি বিদ্যাসাগরকে মনে করিয়ে দেন যে, তার জন্যে মোট ২৯ শো টাকা দরকার — ১২৫০ টাকা মার্চ পর্যন্ত থাকার খরচ, ১০০ টাকা যাবার খরচ, ৮০০ টাকা শস্তা একটা বাড়ি সাজিয়ে নেবার খরচ, আর সেখানে গিয়ে তিন মাস থাকার জন্যে ২৫০ টাকা হিশেবে ৭৫০ টাকা।

আশা করি আমাদের বন্ধু এই টাকা আপনার হাতে এক্ষুণি এবং এক থোকে দিয়ে দেবেন, তা না-হলে, প্রিয় বন্ধু, আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। দুঃখের বিষয় এক-এক বার অল্প পরিমাণ টাকা পাঠালে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়। ‘একথাটীও যেন স্মরণ-পথে থাকে।’ আমার মনে হয় না আমাদের ৯/১০ হাজার টাকার চেয়ে বেশি নিতে হবে। আমি ফিরে গিয়ে যদুব সম্ভব তাড়াতাড়ি আপনার বন্ধুর টাকা ফেরত দেবো। কোনো লোকসান হলে সম্পত্তি থেকে আপনার বন্ধু সেটা পুষিয়ে নিতে পারবেন। আমি তাঁকে চিরদিন একজন বন্ধু এবং উপকারী বলে বিবেচনা করবো। তিনি যদি আমার একটি জীবনবীমা চান, তা হলে লন্ডন গিয়ে আমি তা করে নিতে পারবো।৮১

ইংরেজি-বাংলা মেশানো এ রকমের একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখার পরেও মাইকেল নিশ্চিন্ত থাকতে পারেননি। আট দিন পরে — ২৬ ডিসেম্বর তারিখে আর একটি চিঠিতেও প্রায় একই অনুরোধ জানান। এবারেও বাংলায় তাঁকে মনে করিয়ে দেন: ‘এই কথাটী যেন সৰ্ব্বদা স্মরণ-পথে থাকে!’ অবশ্য এতো দ্রুত আরও একটি পত্রাঘাত করার অন্যতম কারণ, তিনি ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে আর- এক দফা টাকা পেয়েছিলেন। এবারে ৪০০ টাকা।

আপনি আমার যে-অসাধারণ উপকার করছেন, তার জন্যে আপনার প্রতি আমার সকৃতজ্ঞ অনুভূতি প্রকাশ করার সময় এটা নয়। আমার পক্ষ থেকে আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ – না, না, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ না-পেলে আমার বিনাশ ছিলো সুনিশ্চিত। আমার গত চিঠির সঙ্গে আপনাকে আমার একমাত্র প্রতিনিধি করে পাওয়ার [অব অ্যাটর্নি] পাঠিয়েছি। যেভাবে এই পাওয়ার দেওয়া হয়েছে, তাতে সবচেয়ে খুঁতখুঁতে উকিলও সন্তুষ্ট হবেন। আশা করি এ ব্যাপারে আমার আর কোনো ব্যয় হবে না। গত বারে যে-পাওয়ার পাঠিয়েছি, সে বাবদে আমার প্রায় ৩০ টাকা খরচ হয়েছে। আপনি এতে দেখতে পাবেন যে, আমার পক্ষ থেকে কোনো কাজে হাত দিলে আপনি দরকার বোধে আপনার পছন্দমতো যে-কাউকে আপনার সঙ্গে নিতে পারার ক্ষমতাওআপনাকে দেওয়া হয়েছে। আপনি যে-ভদ্রলোকদের নামোল্লেখ করেছেন, তাঁরা যেহেতু নিজেরা বিরাট বড়ো লোক নন, সে জন্যে তাঁরা আমার মতো একজন সাধারণ লোকের জন্যে দরদ বোধ করবেন! যে-ভদ্রলোক আমাকে উদ্ধার করতে রাজি হয়েছেন, তাঁর জানা উচিত যে, আপনার অথবা আমার মতো লোক সকল নীচ কৌশলের উর্ধ্বে এবং (বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারি) আপনি অথবা আমি কেউই এখনো এতো বুড়ো হইনি যে, শিগগির এই বদখত পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো।

কবি বারবার এক থোকে বেশি টাকা চাওয়া সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর কয়েক বারই অল্প পরিমাণে টাকা পাঠাতে থাকেন। কারণ কবি তাঁকে যে-পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন, তা দিয়ে তিনি আইনজ্ঞ অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বড়ো অঙ্কের টাকা ধার পাননি। কিন্তু ডিসেম্বর-জানুআরি মাসে দুবার টাকা পেয়ে এবং জানুআরি মাসে, মাইকেলের ভাষায়, তাঁদের জীবন পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের হাতে তুলে দেবার মতো পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাঠিয়ে দেবার পর তিনি অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে মাস তিনেক অপেক্ষা করার জন্যে তৈরি হয়ে থাকেন।৮২

জানুআরি মাসে অভাবের তাড়না যখন একটু কম, তেমন সময়ে গৌরদাসের একটি চিঠি পেয়ে কবি তার উত্তর দেন। এ চিঠি থেকে আবার দেখা যায় চিরদিনের সেই রোম্যান্টিক কবিকে — যিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন, টাকাপয়সার কথা নয়, ভালোবাসেন লেখাপড়া, সাহিত্য এবং নিজের আশা- আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে। বিদ্যাসাগরকে তিনি যে-সব বিষয় নিয়ে এর আগের ক মাস যতোগুলো চিঠি লিখেছিলেন, এ চিঠির বিষয়বস্তু তাদের থেকে একেবারে আলাদা, এর মেজাজও সম্পূর্ণ ভিন্ন। একই সময়ে তিনি একজনের কাছে চরম অভাবের এবং অন্য একজনের কাছে পরম পরিতৃপ্তির কথা কী করে লিখেছেন, ভাবলে অবাক না-হয়ে পারা যায় না। তবে এটা তাঁর চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য। আগের অক্টোবর মাসেও (১৮৬৪) তাঁকে এমনি যুগপৎ দু রকমের চিঠি লিখতে দেখেছি — এক দিকে বিদ্যাসাগরকে, অন্য দিকে গৌরদাস এবং মনোমোহন ঘোষকে। এই সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দুটি চিঠির ধাবা বিশ্লেষণ করলে মাইকেল-মানস সহজেই চোখে পড়ে। গৌরদাসকে লেখা আলোচ্য চিঠির গোড়াতেই তিনি বলেছেন, ‘দোহাই তোমার, তোমার বন্ধু সম্পর্কে কোনো বদমাশ যখন এমন কিছু বলে যা তোমার বন্ধুর উপযুক্ত নয়, তখন তাকে নীরব এবং ঘৃণা-মেশানো হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়ো। কারণ আমি বোকা নই অথবা পাগলও নই।’৮৩ এর পর তিনি যে-রকম সরলভাবে নিজের বিষয়ে কয়েকটি মন্তব্য করেছেন, তা থেকে স্ফটিকের মতো তাঁর অন্তরের তলদেশ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়।

তুমি ভাবতে পারবে না, আমার অভ্যাস, আমার রুচি, জগৎ সম্পর্কে আমার ধারণা, এমন কি, আমার চেহারাকে য়োরোপ কিভাবে পাল্টে দিয়েছে। আশা করি সেদিন বেশি দূরে নয়, ভাই, যখন তুমি নিজেই এটা যাচাই করে দেখতে পাবে। আমি আব সেই বেপরোয়া, ঝোকের-মাথায়-কাজ-করা চিন্তাভাবনা-বর্জিত লোকটি নেই। আমি এখন হলাম একজন দাড়িওয়ালা পণ্ডিত যে দুটি গোলোপীয় ভাষায় এবং কয়েকটি এশীয় ভাষায় তার বন্ধুদের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করতে পারে। তুমি ভাবতেও পারবে না আমি কি রকমের বড়ো বড়ো দাড়িগোঁফ গজিয়েছি। আশা করছি, তোমাকে আমার একটা ছবি পাঠাতে পারবো। অবশ্য আমি এখনো রোম্যান্টিকই আছি, কারণ, তুমিতো জানোই,এটা হলো আমার প্রকৃতি; তাছাড়া, আমি তো খানিকটা কবিও! এর ওপর ব্যাপক পরিমাণে কল্পনাশক্তি আমাকে বাস্তব জগতের জন্যে বেশ অনুপযুক্ত করে তৈরি করেছে। আমার নিজের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা আর অস্পষ্ট অভিলাষ আছে, তবে আমি আস্তে আস্তে বিজ্ঞ হচ্ছি বৈকি! আমার এই অহঙ্কারের জন্যে আমাকে ক্ষমা করো — তবে কারো না কারো কাছে তো আমার হৃদয় খুলতে হবে। এবং সেটা যদি আমি আমার পুবোনো বন্ধু এবং ভাই-এর কাছে না-করি তো কার কাছে করবো?

এখানে কবি নিজের হৃদয় অনাবৃত করার কথা নিজেই বলেছেন। এভাবে নিজের কথা তিনি কমই| বলেছেন। তারপর নিজের সম্পর্কে জনশ্রুতির উল্লেখ করে আবার বলেছেন:

যখন লোকে আমার সম্পর্কে বাজে কথা বলে, আমার সম্পর্কে অলস এবং জঘন্য মিথ্যে কথা রটায় আমি তখন বিরক্ত বোধ করি। সত্যের দ্রকুটি মিথ্যাকে মিলিয়ে দিক। এ রকমেব ভীরু পরশ্রীকাতরতাকে যেমন করে সামাল দিতে হয়, তেমন করে সামাল দিয়ে, ভাই!

বোঝা যায়, বন্ধু সম্পর্কে কোনো বদনাম শুনে গৌরদাস তাঁকে সে সম্পর্কে লিখেছিলেন। সেই কথার সূত্র ধরে তিনি চিঠি শুরু করেন। কলকাতায় তাঁর বদনাম হচ্ছে – এ কথা কবি তাঁর চিঠিতে বারবার উল্লেখ করেছেন, কখনো বিদ্যাসাগরের কাছে, কখনো গৌরদাসের কাছে। গৌরদাসকে লেখা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের একটি চিঠিতেও বদনামের কথা আছে। কিন্তু কী ধরনের বদনাম, কবি অথবা তাঁর বন্ধুরা কেউ তার ব্যাখ্যা দেননি।

খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু একজন জীবনীকার অন্য রকম মন্তব্য করায় প্রসঙ্গত এখানে একটি ছোটো তথ্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা যায় — কবি কখন দাড়ি-গোঁফ গজান। চিঠির ওপরের অংশ থেকে পষ্ট বোঝা যায়, তিনি তখন ভার্সাইতে ছিলেন।৮৪ অবশ্য তাঁর দাড়ি দেশীয় স্টাইলের দাড়ি ছিলো না। তিনি দাড়ি বেখেছিলেন য়োরোপীয় স্টাইলে — গালপাট্টা বড়ো করে।

সে যাই হোক, এ চিঠিটি বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য অন্য একটি কারণে। এ চিঠি থেকে মাইকেল-মানসের দু-একটি দিক স্পষ্ট করে চোখে পড়ে। তিনি যে বাস্তবতার রূঢ় আলোতে নিজেকে স্থাপন না-করে কল্পনার আলো-আঁধারে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন, এখানে আর-একবার তার নির্ভুল স্বাক্ষর দেখা যায়। এখানে তাঁর দুরবস্থা এবং দারিদ্র্যের কথা বন্ধুর কাছে একেবারে লুকিয়ে রেখেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গৌরদাসের সঙ্গে আজীবন গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, তিনি কখনো নিজের আর্থিক সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে মন খুলে কথা বলেননি। তা ছাড়া, আগের অধ্যায়ে লক্ষ্য করেছি — মাদ্রাস থেকে ফেরার আগে তাঁর পারিবারিক জীবনে যে-প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে গিয়েছিলো, তিনি তাও তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর কাছে প্রকাশ করেননি। কলকাতায় ফেরার পর গৌরদাস তাঁকে পঞ্চাশ টাকা ধার দিয়েছিলেন, জানা যায়। কিন্তু ঐ একবারই। তারপর মাইকেল বহু বার দারুণ আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন। তা সত্ত্বেও গৌরদাসের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে তাঁর কোনো আদান-প্রদান হয়েছে বলে জানা যায় না। তবে মৃত্যুর আগে গৌরদাস যখন কবিকে উত্তরপাড়া থেকে নিয়ে আসেন, তখন অর্থসাহায্য দেওয়া সম্ভব। আসলে ছেলেবেলা থেকে স্বাচ্ছন্দ্যের ভেতরে মানুষ হওয়ায়, তাঁর মধ্যে একটা গর্ব জন্ম নিয়েছিলো। এবং তাঁর ছেলেবেলার বন্ধুদের কাছে সে গর্ব খুব প্রচ্ছন্নও ছিলো না। সে জন্যে, চরম অর্থসঙ্কটের সমযেও তিনি তা নিয়ে গৌরদাসের কাছে মন খুলতে পারেননি। বিদ্যাসাগরকে তিনি যে নিজের সমস্যা বিশদভাবে জানিয়েছিলেন, সেটা নিতান্ত বাধ্য হয়ে — নিজের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবন বাঁচানোর দায়ে। তা ছাড়া, বিদ্যাসাগর একই চত্বরে লেখাপড়া করলেও তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেননা। মনোমোহনের কাছ থেকেও একাধিকবার ধার নিয়েছিলেন, কিন্তু বাধ্য হয়ে। আলোচ্য চিঠিতে দেখতে পাই, গৌরদাস সমস্যার কথা উল্লেখ করায়, সে সম্পর্কে সামান্য আভাস দিয়েই কবি সোজা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন।

আমার বিশিষ্ট বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাকে হাত ধরে এ বিপদ থেকে পার করেছেন। তুমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবে আমার সঙ্গে কি রকমের দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। এ বিষয়টা খুব গুরুতর এবং এ নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাইনে। মাসের পর মাস আমি একটা আটকে-পড়া জাহাজের মতো ফ্রান্সে বন্দী হয়েছিলাম।

চরম অভাব এবং বিপদের কথা গোপন রাখলেও, ফলাও করে যা প্রচার করেছেন, তা হলো তিনি কতোগুলো ভাষা শিখেছেন এবং এসব ভাষা দিয়ে তিনি স্বদেশের কী উপকার করতে চান।

আমার চরম দুরবস্থাকে যদ্র সম্ভব ভালো কাজে লাগিয়ে যোরোপের তিনটি প্রধান ভাষা-ইটালিয়ান, জার্মান এবং ফ্রেঞ্চ শেখার মতো মনের জোর এবং সংকল্প আমার ছিলো। এসব ভাষার যে-সাহিত্য আছে, তারই দরুন এসব ভাষা শেখা মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রিয় গৌর, তুমি জানো, য়োরোপের একটা নাম-করা ভাষা শেখা হলো একটা বড়ো এবং চমৎকার আবাদী জমিদারি লাভ করার মতো — অবশ্য মননশীলতার জমিদারি। আমি যদি দেশে ফেরার জন্যে বেঁচে থাকি, তা হলে, আমার মাতৃভাষার মাধ্যমে আমার শিক্ষিত বন্ধুদের এসব ভাষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। … আমাদের মধ্যে যদি কেউ থাকে যে পশুর মতো হারিয়ে না-গিয়ে পেছনে তাঁর নাম রেখে যেতে চায়, তা হলে সে মাতৃভাষার চর্চা করুক। … যারা মনে করে যে, তাদের মধ্যে নতুন চিন্তাধারা আছে, তারা মাতৃভাষার দিকে ধাবমান হোক। তুমি এবং আমাদের দেশের যে-দ্রলোকেরা নিজেদের সোয়াধী, মেকলি, কার্লাইল এবং থ্যাকারে বলে বিবেচনা করেন, তাঁদের জন্যে এখানে ছোটোখাটো একটা লেকচার দিলাম। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, তাঁরা সে রকমের কিছুই নন। যে-তাঁর নিজের মাতৃভাষা ভালো করে আয়ত্ত করেননি, তেমন কেউ যদি নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি করে, তা হলে তাঁর ভানকে আমার ঘৃণা হয়।

য়োরোপ যাত্রা করার পর কবি যে স্বদেশে এবং স্বজন সম্পর্কে বিশেষ করে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন, আগেই তা বলা হয়েছে। কিন্তু যে-মাইকেল একদিন বাংলা ভাষা ভুলে যাবার ভান করেছেন এবং তা নিয়ে গর্ব করেছেন, সেই মাইকেল এখানে নিজের মাতৃভাষা এবংস্বরূপ সম্পর্কে যে-উক্তি করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। মানুষের সত্যিকার পরিচয় যে টাকাপয়সা দিয়ে নয় এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি যে টাকাপয়সার চেয়ে অনেক বড়ো, তিনি চিঠির শেষ দিকে তা জোর দিয়ে বলেছেন। অথচ দেশের লোকেরা টাকাপয়সাকে বেশি দাম দেয় — ঘৃণার সঙ্গে তিনি বন্ধুকে এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তারপর আবার ঠাট্টা করে বলেছেন: ‘টাকা করো, ভাই, টাকা করো।’ এর আগের চিঠিতে বিদ্যাসাগরের কাছেও ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছিলেন: ‘কিন্তু লেখাপড়া তো টাকাপয়সা নয়! এবং আমাদের মতো নিচু জাতির জন্যে টাকাপয়সাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’৮৫ তাঁর এ সময়কার চিঠিপত্র থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, প্রবাসে দৈবের বশে তিনি কিভাবে নিজের ভাষা এবং দেশের প্রতি অনুরাগ অনুভব করেছিলেন। আত্মপরিচয়ের যে-সঙ্কট তাঁর মধ্যে ছিলো, এ সময়ে তার অন্তত একদিকের নিষ্পত্তি হয়েছিলো। অতঃপর তিনি নিজেকে নিবন্ত ‘কালো ইংরেজ’ বলে শনাক্ত করেননি। বরং নিজেকে অনেক সময়ে বাঙালি বলেই চিহ্নিত করেছেন। তদুপরি, ময়ুরপুচ্ছ পরা যে-দেশীয়রা নিজেদের কালো সাহেব বলে গণ্য করতেন, অকাতরে তাঁদের নিন্দা করেছেন — যদিও নিজে চিঠি লিখেছেন ইংরেজিতে, এবং এই কালো সাহেবদের গালও দিয়েছেন ইংরেজিতে। এ তাঁর বহুমুখী, এমন কি, পবিবোধী সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় এবং প্রবণতারও প্রতিফলন।

ডিসেম্বর মাসের (১৮৬৪) শেষে এবং জানুআরি মাসের (১৮৬৫) গোড়ায় বিদ্যাসাগরকে যখন লিখেছিলেন, তখন তিনি আশা করেছিলেন যে, এপ্রিল মাস নাগাদ লন্ডনে ফিরে যাবেন। গৌরদাসকে লেখা ওপরের চিঠিতেও সে কথা উল্লেখ করেছেন। মে মাসের ২৭ তারিখ থেকে গ্রেজ ইনে ট্রিনিটি টার্ম শুরু হবার কথা। তিনি ধারণা করেছিলেন, এই টার্ম ধরতে পাববেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্য অতো প্রসন্ন ছিলো না। বিদ্যাসাগরের লেখা ২২ মার্চের চিঠি তাঁর হাতে পৌছেছিলো সম্ভবত ২৫ এপ্রিল। এ চিঠি থেকে তিনি জানতে পান যে, তাঁর পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ঋণদাতাদের মনঃপূত হয়নি।৮৬ প্রথম ঋণদাতা অনুকুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজেই উকিল বলে কবির পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মধ্যে ফাঁক দেখতে পাচ্ছিলেন। আর দ্বিতীয় ঋণদাতা শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নও তাঁকে ঋণ দিতে তেমন ভরসা পাননি। তাঁর সম্পত্তি পুরোপুরি নিঝাট ছিলো না। তাঁর সাগরদাঁড়ির সম্পত্তির তিনি যেমন কোনোদিন দখল পাননি। (এই দখলনা-পাওয়া সম্পত্তিই তিনি দান করেছিলেন পিসতুত ভাই বৈদ্যনাথ এবং দ্বারকানাথ মিত্রকে। তদুপরি তিনি খৃস্টান। ১৮৪৯ সালের আইন পাশ হওয়া সত্ত্বেও উত্তরাধিকারের ব্যাপারে ধর্মান্তরিত সন্তানদের অধিকার পাকাপাকিভাবে স্থাপিত হয়েছিলো বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। সর্বোপরি, তিনি নিজে ছিলেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। প্রবাসে তাঁর মৃত্যু হলে, তাঁর জ্ঞাতিদের বিরোধিতার মুখে চক মুনকিয়া এবং গদার ডাঙ্গার সম্পত্তিতে দখল পাওয়া যাবে কিনা, ঋণদাতারা তা বিবেচনা করে থাকবেন। জীবনবীমা নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে সে কারণে। এমতাবস্থায় ঋণদাতারা এমন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি চাইছিলেন যা থেকে তাঁরা তাঁদের টাকাকড়ির নিরাপত্তা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারবেন। তাই তাঁরা বিদ্যাসাগরের মতো সুপরিচিত ব্যক্তিদেরও এই আদান-প্রদানের সঙ্গে জড়িত করতে চাইছিলেন। বিদ্যাসাগর ছাড়া তাঁরা অন্তত আরও দুজনের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। কবির চিঠি থেকে এই দু জনের নাম জানা যায়। একজন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যজন কৃষ্ণদাস পাল।৮৭ এঁরা দুজনেই ছিলেন কলকাতার সুপরিচিত ব্যক্তি। তদুপরি, কৃষ্ণদাস পাল ছিলেন জমিদার সমিতি – ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা।

বিদ্যাসাগরের চিঠি পেয়ে কবি মর্মাহত হয়েছিলেন। তাঁকে তিনি লিখেছেন: তিনি অথবা বিদ্যাসাগর সব রকমের নোংরা কাজের উর্ধ্বে — এটা ঋণদাতাদের বোঝা উচিত।৮৮ বিষয়ী ঋণদাতারা অবশ্য এই সহজ কথাটা অতো সহজে বুঝতে চাননি। এমতাবস্থায় কবি নতুন করে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাঠালেন এপ্রিলের শেষে। এই চিঠির সঙ্গে তিনি একটা হিশেবও পাঠান। তাতে জানান যে, ভার্সাই-এর ধার শোধ করার জন্যে এবং বছরের শেষ পর্যন্ত থাকার খরচ বাবদ তাঁর মোট ব্যয় হবে পাঁচ হাজার টাকা — জুন মাস পর্যন্ত থাকার খরচ আর ধার বাবদে তিন হাজার, জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আড়াই শো টাকা করে দেড় হাজার, আর চিকিৎসা, কাপড়চোপড় ইত্যাদির জন্যে আরও পাঁচ শো — মোট পাঁচ হাজার।৮৯ কিছু দিন আগেই বলেছিলেন তিন হাজার। বস্তুত, এই একবারই নয়, পরবর্তী এক বছর তিনি বারবার তাঁর টাকার অঙ্ক বাড়িয়েছেন। বিদ্যাসাগরের চিঠি পেয়ে তাঁর বিশেষ করে হতাশ হবার কারণ কেবল এ নয় যে,এর ফলে লন্ডনে ফিরে যাওয়া পিছিয়ে গেলো; তাঁর হতাশ হবার অব্যবহিত কারণ ছিলো সেই মুহূর্তে তাঁর অসহনীয় অনটন। চিঠিতে বিদ্যাসাগরকে সে কথা জানাতে তিনি ভুলে যাননি। ‘এই মুহূর্তে আমার হাতে একটি পয়সাও নেই। আমাদের জীবন রক্ষার জন্যে সরকারী বন্ধকী দোকান থেকে আমার কিছু টাকা অবশ্যই জোগাড় করতে হবে।৯০ মুশকিল হলো বন্ধক রাখার মতো বেশি জিনিশ তাঁর হাতে ছিলো না। যা ছিলো, তা বন্ধক দিয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকা যায় না। সে জন্যে পরের মাসে তাঁকে দেখতে পাই প্যারিসে গিয়ে একটি ব্রিটিশ দাতব্য তহবিল থেকে টাকা জোগাড় করতে চেষ্টা করছেন। টাকার পরিমাণ মাত্র দু শো — ও রকমেব অঙ্কের টাকা তিনি জীবনে অনেক বার পেয়েছেন এবং অকাতরে উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন অবস্থার ফেরে পড়ে সেই সামান্য টাকা পাওয়ার জন্যে তাঁর যে-অপমানজনক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাতে তিনি মনে মনে খুব আহত হন। তবে তাঁর অন্য কোনো পথ খোলা ছিলো না।

আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। একটি ব্রিটিশ দাতব্য তহবিলের কাছে আমার দুশো টাকা ধার চেয়ে আবেদন করতে হয়েছে। আপনি ভাবতে পারবেন না, কমিটির সামনে যখন হাজির হতে হয়, আমার নিজেকে তখন কী রকমের অপমানিত মনে হয়েছিলো। সেখানে এমন কতোগুলো ইতর এবং দুর্গন্ধওয়ালা বদমাশ ছিলো। ‘বিপদে পড়লে অদ্ভুত লোকের সঙ্গেও সহবাস করতে হয়।’ এই দাতব্য তহবিলের সভ্যরা, আমার অবশ্যই বলতে হবে, আমাকে খুব ভালো করে খতিয়ে দেখেছিলো, বিশেষ করে স্যর জোসেফ ক্লিফ (কলকাতার সাবেক রোমান ক্যাথলিক বিশপের ভাই)৯১ এবং লৰ্ড ডিগ্রেসি।৯২ আমাকে লেখা আপনার শেষ চিঠিটি তারা অনুবাদ করানোর জন্যে রেখে দিয়েছে। অবশ্য প্যারিসে বাংলা পড়তে জানে এমন কাকে তারা পাবে, আমার জানা নেই। কলকাতার দু জন লোক সেখানে আছেন বটে — মিস্টার ডি সৌজা আর মিস্টার মেন্দিস — তবে তাঁরা হলেন মেটে ফিরিঙ্গি, যাঁরা বলেন ‘বাবু তুমি ভাল আছি?’ আমি তাদের সিদ্ধান্ত জানতে পারবো আগামী সোমবার।৯৩

বোঝা যায়, এ চিঠি দিয়ে কবি নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগরের ওপর টাকা পাঠানোর চাপ বহাল রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও বোঝা যায়, তিনি কী রকমের টানাটানির মধ্যে সময় কাটাচ্ছিলেন।

বিদ্যাসাগর যদি নতুন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাওয়ার দু সপ্তাহের মধ্যেও টাকা জোগাড় করতে পেরে থাকেন, তা হলেও জুলাই মাসের একেবারে শেষ দিকে কবি টাকা পেয়েছিলেন – তার আগে নয়। ১৮ জুলাই বিদ্যাসাগরকে নিজেদের করুণ অবস্থার বিবরণ দিয়ে অধীর কবি লিখে জানান:

এটা বোঝাই যাচ্ছে আপনি জুনের প্রথম ডাকে (৭ অথবা ৯) আমাকে লিখতে পারেননি। কারণ সে ডাক এখানে পৌছে গেছে। আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না আমি কী শোচনীয় এবং উদ্বিগ্ন অবস্থায় আছি। হে ঈশ্বর। আমাদের কী হবে? যে-পাওয়ার [অব অ্যাটর্নি] পাঠিয়েছি তা কি যথেষ্ট হযেছে? সে যাই হোক, আমি ২৩ জুনের ডাকের দিকে জ্বলন্ত উদ্বেগের সঙ্গে তাকিয়ে থাকবো। সপ্তাহখানেকের মধ্যে তা এখানে পৌছে যাবে। আমার কাছে একটি পয়সাও নেই। আমি জানিনে, কি করে মনটাকে চাঙ্গা করতে পারি। এই অবস্থায় আমার একমাত্র সান্ত্বনা হলো এই যে, আমার বিষয়টা এখন আপনার হাতে আছে এবং আপনি আমাদের বিদেশে-বিভুঁইয়ে কুকুরের মতো মরতে দেবেন না। … আশা করি আপনি চট্টোপাধ্যাযকে শাস্তি দিতে চেষ্টা করছেন।

২৩ জুনের ডাক ভার্সাইতে পৌছে ২৫ জুলাই-এর দিকে। তখনই কবি টাকা পেয়েছিলেন কিনা, ঠিক বলা যাচ্ছে না। যা বলা যাচ্ছে, তা হলো: যতো টাকা চেয়েছিলেন, এবারেও বিদ্যাসাগর ততো টাকা পাঠাতে পারেননি। তবে কবির সৌভাগ্য, তখন যে-টাকা পেয়েছিলেন, তা দিয়ে অন্তত ভার্সাই-এর সব দেনা শোধ করে লন্ডন গিয়ে গুছিয়ে বসতে পেরেছিলেন। তিনি যে এ সময়ে মোটামুটি অর্থকষ্টের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন, তার একটা পরোক্ষ প্রমাণ হলো: এ সময়ে বিদ্যাসাগরকে লেখা তাঁর কোনো চিঠি পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো দু-একটা লিখেছেন — যা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। কিন্তু টাকার তাগাদা জানিয়ে পরের বছর জানুআরি মাসে (১৭.১.১৮৬৬) তিনি বিদ্যাসাগরকে যে-চিঠি লেখেন তা থেকে জানা যায় যে, এ সময়ে তিনি বিদ্যাসাগরের চিঠির জবাবও সময়মতো দিচ্ছিলেন না। এই চিঠিতে তিনি এক সঙ্গে বিদ্যাসাগরের তিনটি চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে, পকেটে টাকা থাকায় এ সময়ে তাঁকে ঘন-ঘন বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখতে হয়নি।

জানুআরি মাসের (১৮৬৬) এই চিঠি থেকে দেখা যায়, তখন পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মাইকেলের জন্যে সাত হাজার টাকা ধার করেছিলেন। এর মধ্য থেকে তিনি তাঁকে পাঠান ছ হাজার টাকা। কারণ তিনি কবির কাছে এক হাজার টাকা পেতেন — যা তিনি লন্ডন যাবার আগেই তাঁকে ধার দিয়েছিলেন। অনেক দিনের পুরোনো ধার এবং কবি এক সময়ে বিদ্যাসাগরকে লিখেছিলেন, ধার-করা টাকা থেকে তাঁর এবং অন্যদের পাওনা চার হাজার টাকা কেটে রাখার জন্যে। বিদ্যাসাগর সম্ভবত সে কারণে কবির এতো টানাটানির মধ্যেও এক হাজার টাকা কেটে রাখেন। তিনি এই সাত হাজার টাকা ধার করা ছাড়াও, মহাদেব চট্টোপাধ্যায়, হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বি এন মিত্রের কাছ থেকেও টাকা আদায় করে পাঠিয়েছিলেন। নগেন্দ্রনাথ সোম মাইকেলের এই চিঠির বরাত দিয়ে বলেছেন যে, তখন পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার ন শো একত্রিশ টাকা, ন আনা আট পাই আদায় করেছিলেন আর তাঁর কাছেতখনো পাওনা ছিলো দশ হাজার এক শো টাকা।৯৪ কিন্তু এ হিশেবে সঠিক নয়। কবি চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৮৬৪ এবং ১৮৬৫ সালে তিনি মহাদেব চট্টোপাধ্যায় বাবদ পেয়েছিলেন মোট তিন হাজার টাকা। এ তিন হাজারের মধ্যে দিগম্বর মিত্র পাঠিয়েছিলেন ৮০০ টাকা। বাকিটা আদায় করে পাঠান বিদ্যাসাগর। আর ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত মহাদেবের কাছে শেষ চুক্তি অনুযায়ী পাওনা হয়েছিলো ছহাজার টাকা, পুরোনো চুক্তি অনুযায়ী ন হাজার টাকা। সুতরাং এ পর্যায়ে মহাদেব খুব বেশি ঋণী ছিলেন বলে মনে হয় না।

এর পর এক বছর লন্ডন এবং ভার্সাইতে থাকার খরচ, গ্রেজ ইনের বেতন এবং অন্যান্য খরচ, দেশে ফেরার খরচ এবং ভার্সাইতে পরিবারের জন্যে ব্যাংকে টাকা রেখে আসার জন্যেও বিদ্যাসাগরকে আরও বারো হাজার টাকা পাঠাতে হয় কবির তালুক বন্ধক রেখে। তিনি যে অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের কাছে তালুক বন্ধক রেখেছিলেন, তা জানা যায় বিদ্যাসাগরকে লেখা অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে।৯৫ চিঠিটি তিনি লেখেন কবি দেশে ফিরে আসার মাস দুয়েক পরে। তা ছাড়া, ১৮৬৭ সালে লেখা বিদ্যাসাগরের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকেও কম্পেনির কাগজ নিয়ে বিদ্যাসাগর কবির কাছে পাঠিয়েছিলেন। কবি এ টাকা ধার করেন কলকাতায় ফেরার পর। তবে ১৮৬৪ সালের অক্টোবররেও কম্পেনির কাগজ পেয়েছিলেন।৯৬ বিদ্যারত্নের কাছে সব মিলে কতো টাকা ধার হয়েছিলো, তা জানা যায় না।

অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে টাকা ধার করার কথা জীবনীকারগণ। উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ২৫ ফেব্রুআরি ১৮৬৬ তারিখে লেখা কবির একটি চিঠি থেকে জানা যায়, রাণী স্বর্ণময়ীর কাছ থেকেও বিদ্যাসাগর টাকা ধার করেছিলেন।

আপনি যেরকম সন্তোষজনকভাবে রাণী স্বর্ণময়ী সরকারের সঙ্গে ব্যবস্থা করেছেন, তাতে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। এর ফলে আমাকে বিপদে ফেলাব এবং আমার সর্বনাশ করার জন্যে মহাদেব চট্টোপাধ্যায় এবং তার চক্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে, আপনার বন্ধু যাতে সরে দাঁড়ান সে জন্যে সেই …. গোপনে আপনার বন্ধুর কানে ব্যাপারটা পৌছে দিয়েছে। বিশ্বাস করুন সেই লোকটা যে-কোনো রকমের বদমায়েশি করার উপযুক্ত।৯৭

এ সময় পর্যন্ত বিদ্যাসাগর কার-কার কাছ থেকে ঠিক কতো টাকা ধার করেছিলেন অথবা টাকা আদায় করে কবিকে মোট কতো টাকা পাঠান, সবগুলো চিঠি রক্ষা না-পাওয়ায় এখন আর তা নির্দিষ্ট করে বলার জো নেই। বিদ্যাসাগরের পাঠানো টাকা ছাড়াও, কবি নিজে তাড়া দিয়ে তাঁর প্রকাশক ঈশ্বরচন্দ্র বসুর কাছ থেকে একাধিক কিস্তিতে টাকা আদায় করেছিলেন।৯৮ ব্যারিস্টার হবার জন্যে তাঁর সব মিলে যে-অর্থ ব্যয় (কুড়ি হাজার টাকারও বেশি) হয়, তা তখন অন্য যাঁরা ব্যারিস্টারি পড়েছিলেন, তাঁদের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি নিজে ১৮-৬৫ সালে লিখেছিলেন, গৌরদাস যদি ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে যেতে চান, তা হলে তার জন্যে আট দশ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হবে না।

কবি যখন জুলাই-এর শেষে অথবা অগস্টের (১৮৬৫) প্রথম দিকে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে টাকা পান, ততোদিনে ট্রিনিটি টার্ম শেষ। পরবর্তী মিকেলমেস টার্ম শুরু হবার কথা নভেম্বরের প্রথম দিকে। সে জন্য অবিলম্বে লন্ডনে যাবার তাঁর কোনো তাড়া ছিলো না। খুব সম্ভব সেপ্টেম্বর মাসে সপরিবারে তিনি লন্ডন যাত্রা করেন। অন্তত তিনি যে অক্টোবরের আগেই লন্ডনে গিয়ে পৌছেছিলেন তার একটা পরোক্ষ প্রমাণ এই যে, তিনি সেখানে এক বছরের চুক্তিতে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন এবং পরের অগস্ট মাস (১৮৬৬) থেকে সেই বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্যে বিশেষ ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। বিদ্যাসাগরকে বারবার মনে করিয়ে দেন যে, তিনি যদি সেপ্টেম্বর মাস শেষ হবার আগে সব পাওনা মিটিয়ে দিয়ে অন্য বাড়িতে চলে যেতে না-পাবেন, তা হলে বিলেতের বাড়ি ভাড়ার কঠোর আইন অনুযায়ী তাঁকে পরবর্তী এক বছরের জন্যে অতিরিক্ত ভাড়ায় বাড়িটা রাখতে বাধ্য করা হতে পারে।৯৯

লন্ডনে তিনি যে-বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, তা থেকে তাঁর তখনকার মনোভাব খানিকটা আঁচ করা যায়। যখন মাদ্রাসে ছিলেন, সে সময়ের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, তাঁব আয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি বারবার বাড়ি বদল করতেন। মাদ্রাস থেকে ফেরার পর কলকাতায় আগাগোড়া আয় (শেষের এক বছর ছাড়া) একই রকম ছিলো। বাড়ি বদলের তাই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। (৬ নম্বর লোয়ার চিৎপুরের বাড়ি মেরামত হচ্ছিলো বলে ১৮৬১ সালের মাঝামাঝি তাঁকে অবশ্য অল্প দিনের উঠে যেতে হয়েছিলো খিদিরপুবের ৬ নম্বর জেমস লেনে। প্রথম দিকে সে বাড়ি অল্প দিনের মধ্যে ছেড়ে দেবার পরিকল্পনা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত আর ছাড়া হয়নি। বা পরিকল্পনা থাকলেও সাধ্যে কুলোয়নি।) আর ১৮৬৩ সালে হেনরিয়েটা হঠাৎ সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে চলে আসায়, তখন বিপন্ন কবি কোনো মতে মাথা গোঁজার মতো একটা বাড়ি ভাড়া করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। দারুণ অভাবের মধ্যে ভার্সাইতেও কোনো ভালো বাড়িতে থাকতে পারেননি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের দয়ায় আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে এসে কবি একটা ভালো বাড়ি নিতে পারতেন। তবে জীবনে ঐ একবার তিনি সুবিবেচনার পরিচয় দিয়ে বাড়ি ভাড়া করেছিলেন নিজের পকেটের কথা মনে রেখে।

সত্যি বলতে কি, লন্ডনে না-বলে, বরং বলা উচিত তিনি বাড়ি ভাড়া করেছিলেন লন্ডনের অনেকটা বাইরে — শেফার্ডস বুশে। (তাঁর সেই বাড়ির পাশেই এখন গড়ে উঠেছে বিবিসি টেলিভিশনের বিশাল ভবন এবং তাঁর সেই বাড়ির ওপর তৈরি হয়েছে লন্ডন ট্রান্সপোর্টের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র/কার পার্ক।) কেবল নামে নয়, কাজেও শেফার্ডস বুশ তখন ছিলো জঙ্গলে ভবা নগরীর উপকণ্ঠে ছোট্টো একটি পাড়া। রাস্তার এক পাশে কয়েকটি বাড়ি, অন্য পাশে একটি বিশাল নার্সারি। কয়েকটি বড়ো খামারও ছিলো এ রাস্তার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। উড লেন বৃহত্তর লন্ডনের পোস্টাল ডায়রেক্টরিতে তখনো আলাদা রাস্তার মর্যাদা লাভ করেনি — শেফার্ডস বুশ বলেই পরিচিত ছিলো। কবি যে-বাড়িতে ছিলেন, সেখান থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে তিন-চার মিনিট হাঁটলে পাওয়া যেতো বড়ো রাস্তা — আক্সব্রিজ রোড। সেই রাস্তা ধরে সোজা পুব দিকে আধ মাইল হাঁটলে একটা বড়ো বাজার-এলাকা — নটিং হিল। কিন্তু খোদ লন্ডন শহর ছিলো অন্তত আড়াই মাইল দূরে। আর সাড়ে পাঁচ মাইল দূরে গ্রেজ ইন। কয়েক মাস পরে একটি চিঠিতে কবি নিজেও লন্ডনকে আলাদা একটা শহর বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বাড়ির পেছনে ছিলো ব্রিস্টল-ব্যর্মিংহ্যাম অ্যান্ড টেমস জাঙ্কশন রেল লাইনের ওপর শেফার্ডস বুশ নামে ছোটো একটি রেল স্টেশন। এ ছাড়া, ১৮৬৩ সালে মেট্রোপলিটান লাইনের একটি স্টেশনও তৈরি হয় এখানে। অনুমান করি, অতো দূরের গ্রেজ ইনে তিনি এই রেল স্টেশন দিয়েই যাতায়াত করতেন। বাড়িগুলোর নাম থেকে এই পাড়ার বন চেহারার পরিষ্কার আভাস পাওয়া যায়। এই রাস্তার কয়েকটি বাড়িরনাম যেমন উড হাউস, উড কটেজ, উইলো ভেইল, লাইম গ্রোভ ইত্যাদি। যে-বাড়িতে তিনি থাকতেন, তার নাম ছিলো লোর্ন কটেজ বা লোর্ন হাউস। তবে পোস্টাল ডায়রেক্টরিতে এ বাড়ির নাম নয়, উল্লিখিত হয়েছে এ বাড়ির নম্বর।

শহরের বাইরে অনভিজাত পাড়ায় বাড়ি ভাড়া করেই কবি টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করেননি; সেই সঙ্গে তিনি আর-একটা হিশেবী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন বাৎসরিক হারে ভাড়ার চুক্তি করে। আসলে ভার্সাইতে তিনি যে-নিদারুণ দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন সেই স্মৃতি তিনি অথবা তাঁর স্ত্রী তখনো ভুলতে পারেননি। তদুপরি যেভাবে তিনি তাঁর ‘খাজাঞ্চি’ বিদ্যাসাগরের কথা মতো চলতে বাধ্য হচ্ছিলেন, তাতেও তাঁকে অগত্যা অল্প ভাড়ার বাড়ি পছন্দ করতে হয়েছিলো।

কবি এবং তাঁর সঙ্গিনী তৃতীয় একটা হিশেবী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁদের বাড়িতে টাকাপয়সার বিনিময়ে একজন অতিথি রেখে। তবে অতিথি নির্বাচনের ব্যাপারে হিশেবী বুদ্ধির পরিচয় দিযেছিলেন কিনা, কলা মুশকিল। তাঁদের এই অতিথি ছিলেন একজন বাঙালি — ক্ষেত্রমোহন দত্ত। তিনি ১৮৬৫ সালে লন্ডনে আসেন উচ্চশিক্ষা নেবার উদ্দেশ্যে, যদিও কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবেন, সে সম্পর্কে মনঃস্থির করতে পারেননি। অনেক দিন এটা-ওটা চেষ্টা করার পর, শেষ পর্যন্ত তিনি ডাক্তারি পড়েন। প্রথম দিকে এই ভদ্রলোককে কবি খুব পছন্দ করতেন। হেনরিয়েটাও। আর ক্ষেত্রমোহনও আপাতদৃষ্টিতে কবির পরিবারকে খুব পছন্দ করতেন। হেনরিয়েটা তাঁর এতো যত্ন নিতেন যে, তিনি হেনরিয়েটাকে, সম্ভবত ঠাট্টা করে, মা বলতেন।১০০ ‘ঠাট্টা করে’ এ জন্যে বলছি যে, এ সময়ে হেনরিয়েটার বয়স ছিলো ৩০ বছরের চেয়ে কয়েক মাস কম। আর ক্ষেত্রমোহনের বয়স ছিলো ২৬ বছর।১০১ যে-জন্যে তাঁকে কবি অতিথি রাখেন, তা অবশ্য তেমন সার্থক হয়নি। বিদ্যাসাগরকে এক চিঠিতে লিখেছেন যে, ক্ষেত্রমোহনের জন্যে যে-ব্যয় হয়েছে, হেনরিযেটা তার চেয়ে এক পয়সাও বেশি নিতে পারেননি।১০২

প্রথম দিকে একাধিক চিঠিতে কবি ক্ষেত্রমোহনের ব্যাপারে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সংস্কৃত পণ্ডিত ডক্টর গোল্ডকার কবিকে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে অবৈতনিক বাংলার অধ্যাপকের পদ নেবার আহ্বান জানালে তিনি নিজে তা গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ বেতন ছাড়া তাঁর সংসার চলবে না – তিনি গোল্ডস্টুকারকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন।১০৩ সংস্কৃত এবং আরবি ভাষার পণ্ডিত হিশেবে থিয়োডর গোল্ডস্টুকার (১৮২১-১৮৭২) তখন খুব সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর জন্ম জার্মেনির কনিংসবার্গে। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি ডাক্তারি পাশ করেন বন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অবশ্য চিকিৎসাবিদ্যার দিকে তিনি যাননি। তাঁর সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক মতামতের দরুন তাঁকে ব্যর্লিন ছেড়ে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপর ১৮৪২ থেকে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে বসবাস করেন। মাঝখানে ১৮৪৪ সালে প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ এইচ এইচ উইলসনের নিমন্ত্রণে লন্ডনে আসেন। পরে উইলসনের সঙ্গে লন্ডনেই কাজ করেন। ১৮৫২ সালে তিনি নিযুক্ত হন ইউনিভার্সিটি কলেজে লন্ডনের সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক। তিনি প্রবোধচন্দ্রিকা সম্পাদনা করেন। তা ছাড়া, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা করেন। উইলসনের অভিধানের জন্যেও কাজ করেন তিনি। কবি লন্ডনে থাকার সময়ে — ১৮৬৬ সালে — তিনি স্থাপন করেন স্যাক্রিট টেকস্ট সোসাইটি। রাজনৈতিক মতামতের জন্যে তিনি পরিচিত ছিলেন দারুণ বিতর্কিত মানুষ হিশেবে। কিন্তু প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ হিশেবে তাঁর ব্যাপক স্বীকৃতি ছিলো। কবি তাঁর কথা প্রথম জানতে পান মনোমোহন ঘোষের কাছ থেকে। ভার্সাইতে থাকার সময়ে তিনি মনোমোহনকে লেখেন যে, গোল্ডকারের সঙ্গে দেখা করার জন্যে তিনি উৎসুক হয়ে আছেন। তিনি লন্ডনে ফিরে আসার পর গোল্ডকারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁকে উদ্দেশ্য করে কবি যে-সনেটটি রচনা করেন সেটি ১৮৬৫ সালের শেষ অথবা ১৮৬৬ সালের প্রথম দিকের রচনা বলে মনে হয়। কবির সঙ্গে পরিচয় হলে গোল্ডকার দেখতে পান যে, তিনি রীতিমতো একজন ভাষাবিদ এবং পণ্ডিত। সেই সূত্রেই তিনি কবিকে ইউনিভার্সিটি কলেজে বাংলার অধ্যাপক হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

নিজে অবৈতনিক অধ্যাপকের পদটি কবি গ্রহণ করতে না-পারলেও তিনি ক্ষেত্রমোহন দত্তকে ডক্টর গোল্ডস্টুকারের কাছে নিয়ে গিয়ে এ পদটি তাঁকে দেবার জন্যে অনুরোধ জানান। গোল্ডস্টুকারও রাজি হন ক্ষেত্রমোহনের আবেদনপত্র সমর্থন করতে। তবে শেষ পর্যন্ত ক্ষেত্রমোহন এ পদটি পাননি। তিনি যে কোনো পণ্ডিত ছিলেন না, গোল্ডকার নিজে হয়তো তা টের পেয়েছিলেন। ক্ষেত্রমোহনের প্রতি কবি যথেষ্ট উষ্ণতা দেখালেও তাঁদের বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বস্তুত ফেব্রুআরি মাসের (১৮৬৬) মধ্যে ক্ষেত্রমোহন দত্তের সঙ্গে কবির পরিবারের সম্পর্ক টক হয়ে যায়। ২৫ ফেব্রুআরি কবি তাঁর চিঠিতে ক্ষেত্রমোহন সম্পর্কে লেখেন: ‘ক্ষেত্রমোহন দত্ত আমাদের ছেড়ে চলে গেছে শহরে থাকার জন্যে, কারণ সে মেডিকল লেকচার ইত্যাদিতে যোগ দিতে চায়। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে নিজের মন নিজে ভালো করে জানে না। সে অবশ্য নিজের ইচ্ছায় চলে গেছে। তার সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে দেখা হয়।’১০৪ শহরে থাকার কথা বলে গেলেও, ক্ষেত্রমোহন ঠিক শহরে ছিলেন না। তিনি যে-বাড়িতে টাকা দিয়ে অতিথি থাকেন, সেটি ছিলো শহরের বাইরে — চক ফার্মের কাছে। তবে শেফার্ডস বুশ শহর থেকে যতোটা দূরে ছিলো, এই জায়গাটা তততা দূরে ছিলো না।

পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে ক্ষেত্রমোহনের সঙ্গে কবির সম্পর্ক রীতিমতো শত্রুতার চেহারা নেয়। তিনি একাধিক চিঠিতে এঁর সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের কাছে কটুক্তি করেন (তাঁর ভাষায় — ‘ভাগ্যিস সব বাঙালি ক্ষেত্রমোহনের মতো নয়!’১০৫)। ক্ষেত্রমোহন বিয়ের বাজারে ঘোরাঘুরি করছেন এবং নিজের ফাঁপানো পরিচয় দিয়ে একটি ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে করতে চেষ্টা করছেন, ১০ই জুনের (১৮৬৬) চিঠিতে এও তিনি বিদ্যাসাগরকে লিখেছিলেন। তিনি এ খবর পেয়েছিলেন, ক্ষেত্রমোহন যে-মহিলাকে বিয়ে করেন, তাঁর বাবার এক বন্ধুর কাছ থেকে। এই ভদ্রলোক ছিলেন ভারতীয় সেনা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মাইকেল যা লেখেননি, তা হলো, তাঁর বাড়ি থেকে বিদায় নেবার চার-পাঁচ মাসের মধ্যে ক্ষেত্রমোহন যে-বাড়িতে টাকা দিয়ে অতিথি ছিলেন, সেই বাড়িরই মেয়ে অ্যালেন অ্যান জয়কে বিয়ে করেন। টমাস জয়ের কন্যা অ্যালেনের বয়স ছিলো কুড়ি বছর। এ বিয়ে হয় উত্তর লন্ডনেব হ্যাভারস্টক হিলের চার্চে – ২৯ জুন (১৮৬৬) তারিখে। বিয়ের দলিলে বর এবং কন্যা উভয়ের ঠিকানাই দেওয়া আছে ১৫ নম্বর মল্ডেন ক্রিসেন্ট। আর ক্ষেত্রমোহনের পরিচয় দেওয়া আছে — জেন্টেলম্যান।১০৬ এ থেকে বোঝা যায়, কবি যে লিখেছিলেন ক্ষেত্রমোহন ফাঁপানো পরিচয় দিয়ে বিয়ে করতে চেষ্টা করছেন১০৭, সে কথা সত্য। ইংরেজ সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে জেন্টেলম্যান শব্দের বিশেষ অভিধা ছিলো, সেটা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা যেতে পারে। কলকাতায়, এবং সম্ভবত লন্ডনে, তাঁর নামে যে-সব বদনাম হয়েছিলো, তার অনেকটার প্রণেতাই ক্ষেত্রমোহন, ক্ষুব্ধ কবি একাধিক চিঠিতে এ অভিযোগ করেছেন।১০৮ এমন কি, পরে দেখতে পাবো, ক্ষেত্রমোহন তাঁর আরও বড়ো রকমের ক্ষতি করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

১৮৬৫ সালের শেষ দিকে অপেক্ষাকৃত আর্থিক সচ্ছলতার সময়ে বিদ্যাসাগরকে কবি আগের মতো ঘন-ঘন চিঠিপত্র না-লিখলেও জানুআরি মাসের (১৮৬৬) দিকে হাতের টাকা ফুরিয়ে আসায় তিনি আবার ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ সময়ে বিদ্যাসাগরকে তিনি একাধিক চিঠিতে মনে করিয়ে দেন যে, তাঁর অনেক টাকা লাগবে — পরবর্তী এক বছর যোরোপে থাকার জন্যে, দেশে ফিরে যেতে এবং ফিরে গিয়ে ব্যবসা সাজিয়ে বসতে।১০৯ সেই সঙ্গে বিদ্যাসাগরকে অন্তত আরও চারবার মনে করিয়ে দেন যে, লন্ডনে সে বছর অন্য বছরের তুলনায় জিনিশপত্রের দাম ছিলো অনেক বেশি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে লিখেছেন যে, কোনো বৃদ্ধও তাঁর জীবনে এর আগে কখনো জিনিশপত্রের এতো দাম দেখেননি। এর একটা কারণও তিনি দেখিয়েছেন — রেন্ডারপেস্ট নামে গবাদি পশুর একটা রোগের দরুন মাংসের দাম বড্ডো চড়া।১১০ একটা পরিবারের সারা মাসে যে-পরিমাণ মাংস লাগতে পারে, তাতে ঐ একটা জিনিশ মহার্ঘ হলে মাসিক ব্যয় খুব বাড়ার কথা নয়। আসলে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে নিয়মিত টাকাপয়সা পাওয়ায় কবির খরুচে স্বভাবই এ সময়ে আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

ভার্সাই থেকে তিনি বিদ্যাসাগরকে লিখেছিলেন, লন্ডনে মাসে ব্যয় হবে আড়াই শো টাকা। কিন্তু লন্ডনের জীবনযাত্রা মহার্ঘ হওয়ায় একাধিক বার লিখে জানান যে, ৩৬০ টাকা বা ৩৬ পাউন্ডের চেয়ে

কমে সেখানে ব্যয় নির্বাহ করা খুব শক্ত। কয়েক মাসের মধ্যে ৩৬০ টাকাকে আরও বাড়িয়ে বলেছেন, ৪৫০ টাকার কমে এখানে থাকা যায়না। বিদ্যাসাগর তাঁর বায়না বারবার বেশ ধৈর্যের সঙ্গেই শোনেন। ছ হাজার টাকা পাওয়ার পরেও বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে তিনি ফেব্রুআরি মাসে এক হাজার টাকা (১০১ পাউন্ড) এবং এপ্রিল মাসে দেড় হাজার টাকা (১৫১ পাউন্ড) পান। কিন্তু চিরদিনের বেহিশেবী কবির নবাবী মেজাজ এ সময়েতাঁকে আবার পেয়ে বসে। তিনি আরও সাড়ে চার শো পাউন্ড চেয়ে পাঠান।১১১ জুন মাস নাগাদ (১৮.৬.৬৬) এই অঙ্ক আরও বাড়িয়ে বলেন, বারো শো পাউন্ড –ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকার এবং বারে ডাক পড়ার খরচ ৫০০ পাউন্ড, হেনরিয়েটার জন্যে রেখে যাবেন ২০০ পাউন্ড, দেশে যাবার খরচ ২০০ পাউন্ড আর দেশে গিয়ে ব্যবসা গুছিয়ে বসার জন্যে আরও তিন/চার শো পাউন্ড। এই দরাজ হিশেব থেকে বোঝা যায়, তিনি এ সময়ে খরচের ব্যাপারে কী রকমের সংযম হারিয়ে ফেলেছিলেন। হেনরিয়েটাও তীর খরচের লাগাম ধরে রাখতে পারেননি। তদুপরি, এই জুন মাসেই কবি এবং হেনরিয়েটা বেশ ভেবে-চিন্তে আরও একটি সিদ্ধান্ত নেন, যা পধ্ববর্তী কালে তাঁদের সর্বনাশের অন্যতম কারণ হয়েছিলো। এই সিদ্ধান্তের কথা তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে জানান এভাবে:

আপনি কল্পনা করতে পারবেন না, আমার বেচারী স্ত্রী এবং আমি সম্প্রতি আমাদের অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে করতে কিভাবে বাতের পর রাত অনিদ্রায় কাটিয়েছি। আমরা এখন এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আমি যদি আপাতত একাই দেশে চলে যাই, তা হলেই ভালো হবে। ওরা আসবে কয়েক মাস পরে  — যতো দিনে আমি আমার প্র্যাক্টিস খানিকটা গুছিয়ে বসতে পারি।১১২

কবি এখানে তাঁর মনের সত্যিকার ইচ্ছে বিদ্যাসাগরের কাছে প্রকাশ করেননি। পরে দেখতে পাবো, তিনি অন্তত এই একটি ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অ-সরল ব্যবহার করেছিলেন।

তিনি যতো টাকা চেয়েছিলেন, ততো টাকা জোগাড় করা বিদ্যাসাগরের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কারণ এই অর্থের পরিমাণ ছিলো তাঁর সম্পত্তির দামের চেয়েও বেশি। কবি নিজেও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। সে জন্যে পূর্বোক্ত চিঠির শেষে বলেছেন, ‘হায়রে, আমাকে এতো টাকা দেবে কে? আপনি যদি ধনী হতেন, তা হলে আমার অবস্থা এতো করুণ হতো না, আমি তো আপনার উদার হৃদয়ের কথা জানি! আপনার কি মনে হয়, আমি যতীন্দ্র ঠাকুরের কাছে একটা চিঠি লিখলে কোনো কাজ হবে?… চেষ্টা করে দেখতে ভয় পাবো কেন?’ বিদ্যাসাগরের করুণ হৃদয়ে বাড়তি করুণা জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই চিঠির শেষে লিখেছেন: “আমি আমার স্ত্রীকে বলি, আমি যখন কলকাতায় ফিরে যাবো, তখন আপনি আপনার বাড়ির একটি ছোটো ঘর আমাকে ছেড়ে দেবেন, আর দেবেন আমার বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ডাল-ভাত।১১৩

এভাবে মন ভেজাতে চাইলেও, তিনি যতো টাকার জন্যে বায়না ধরেছেন, সেটা জোগাড় করা যে বিদ্যাসাগরের সাধ্যের বাইরে, তা জানতেন বলে জানুআরি মাস থেকে তিনি বিদ্যাসাগরকে টাকা ধার করার একটা বিকল্প পথের কথা বলে আসছিলেন। এ সময়ে তিনি খবর পান যে, বোম্বাই-এর একজন ধনী পারসি ভদ্রলোক তিনজন ছাত্রকে বিলেতে পাঠিয়েছেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে। সুতরাং তিনি ভাবলেন, যখন ব্যারিস্টারি পড়ছেন, তখন দেশীয় লোক হিশেবে তিনিও সাহায্য পেতে পারেন। নিদেন পক্ষে এই ভদ্রলোক টাকা ধার দিতে রাজি হতে পারেন। বিদ্যাসাগরকে লেখা তাঁর যে-চিঠিগুলো রক্ষা পেয়েছে, তার মধ্যে চারটিতে এই প্রসঙ্গ আছে। মনে হয় প্রথম দিকে বিদ্যাসাগর এতে কোনো উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু কবির টাকার চাহিদা বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত তিনি এ ব্যাপারে সম্মতি জানিয়ে যে-চিঠি লেখেন, কবি তা পান ১০ জুন তারিখে। এ চিঠি পেয়েই তিনি দেখা করতে যান বোম্বাই-এর নামকরা পারসি নেতা দাদাভাই নওরোজির (১৮২৫-১৯১৭) সঙ্গে।১১৪ তিনি কবির সাত বছর আগে লন্ডনে আসেন কামা নামে একটি ভারতীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিশেবে। অল্পকালের মধ্যে তিনি প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যেতো বটেই, এমন কি স্থানীয় লোকদের মধ্যেও প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে বিবেচিত হন। ১৮৬৬ সালে লন্ডনে তিনি ভারতীয়দের নিয়ে ঈস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সমিতি তৈরি করেন। কবি তাঁর কাছে আরজি পেশ করায় বাস্তববাদী মানুষ দাদাভাই নওরোজি সঙ্গে সঙ্গে তা খারিজ করে দেন। কবির ভাষায় — ‘মিষ্টার নওরোজি আমার পরিকল্পনার ওপর ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিলেন। টাকাপয়সার জগতে এখন যা চলছে, তিনি সে বিষয়ে বললেন। আর বললেন, এ রকম অবস্থায় আমার অনুরোধ গ্রাহ্য হবে না।’১১৫

হতাশ হয়ে আট দিন পরে তিনি আর-একটি চিঠি লেখেন বিদ্যাসাগরকে। তিনি ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে এতো টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগরের বুদ্ধিতে তিনি দু বছর আগে সম্পত্তি বিক্রি করার অভিপ্রায় ত্যাগ করেছিলেন। এখন অগত্যা আবার বিক্রির কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু সম্পত্তি বিক্রি করলে লোকে যে হাসাহাসি করবে, এ তিনি জানতেন। তা ছাড়া, বিদ্যাসাগরও তাঁকে লিখেছিলেন যে, তিনি ব্যারিস্টারি পড়তে এসে যে-পরিমাণ ব্যয় করেছেন, তাতে লোকে হাসাহাসি করছে। তারা আরও বলছে যে, কবিকে এভাবে ডুবতে সাহায্য করছেন বিদ্যাসাগর। কবি তাঁর জবাবে বিদ্যাসাগরকে সান্ত্বনা দিয়ে লেখেন:

আমি জানি, আপনি যদি সম্পত্তি পুরোপুরি বিক্রি করতে বাধ্য হন, তা হলে কোনো কোনো লোক আমাদের ঠাট্টা করবে। তারা অট্টহাস্য দিয়ে বলবে, তারা আগেই এটা বলেছিলো। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এতে বিচলিত হবার মতো লোক আপনি নন – আপনি এব চেয়ে শক্ত মনের মানুষ। তা ছাড়া, বিবেচনাবর্জিত আজে-বাজে লোক কী বলছে, তাতে কী আসে-যায়? আপনি এবং আমার অন্য বন্ধু যদি এ কাজটা করতে আমাকে সাহায্য কবেন, তা হলে আমি ব্যারিস্টাব হবার পর চমৎকার একটা পেশা নিয়ে আমার জীবন শুরু করতে পারবো এবং তখন পর্বতের মতো ভারী বিশাল বোঝায় আমার দুর্বল পিঠ ভেঙ্গে পড়ার মতো কোনো ঋণও আমাব থাকবে না।

নিজেকেও তিনি সান্ত্বনা দেন এই বলে:

আমার নিজের সম্পত্তি যা খুশি তাই করার অধিকার আমার আছে। বুদ্ধিমান কোনো লোক বলবে না যে, আপনি আমার ক্ষতি করতে আমাকে সাহায্য করেছেন। আমি যেমনভাবে নতুন করে আমার জীবন শুরু করার কথা ভাবছি, সেভাবে কেউ কাউকে জীবন শুরু করতে সাহায্য করলে, তাকে নিশ্চয় ক্ষতি করা বলে না। অন্য লাখ লাখ মানুষের মতো আমারও ঝুকি নিতে হবে বৈকি! তারপর আমার নিজের হৃদয় এবং মনের সামর্থ্য অনুযায়ী হয় আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো, নয়তো ডুবে যাবো। … তবে আপনি যদি আমার লক্ষ্য হাসিল কবার মতো বিরাট অঙ্কের টাকা জোগাড় করতে পাবেন, তা হলে তাড়াহুড়ো করে কিছু করা ঠিক হবে না। তেমন অবস্থায় আমি দেশে গিয়ে দেখবো মহাদেব চট্টোপাধ্যাযের কী করা যায়। যদি কোনো উপকারী বন্ধু এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করেন, খুব ভালো কথা, তা না-হলে, আপনি অবশ্যই সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করবেন। আপনি অক্টোবরে অথবা তার আগেই এ সম্পর্কে আমার নির্দেশ জানতে পারবেন।১১৬

এর পরের প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যে কবির লেখা কোনো চিঠি আমাদের হাতে আসেনি। অপর পক্ষে, তিনি এ সময়ে শেফার্ডস বুশের বাড়ির সব ভাড়া ঢুকিয়ে দিয়ে লন্ডনের কেন্দ্রে নতুন বাড়িতে উঠে আসেন। তিনি এ সমযে গ্রেজ ইনের অনেক টাকার বকেয়া বেতনও চুকিয়ে দেন। তারপর কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেন নির্ধারিত ৭২টি ডিনার খাবার আগেই তাঁকে ব্যারিস্টারির সনদ দেবার জন্যে ‘বারে’ আহ্বান জানানোর। তিনি ডিনার খেয়েছিলেন মোট ৬০টি — অর্থাৎ গ্রেজ ইনে দুটি টার্ম কম ছিলেন। তাঁর আবেদন অনুযায়ী যথাসময়ে বারে তাঁর ডাকও পড়ে। এই ডাক পড়ে মিকেলমেস টার্মের মাঝামাঝি সময়ে — ১৭ নভেম্বর (১৮৬৬)।১১৭ এসব থেকে বোঝা যায়, জুন মাসের চিঠি পেয়ে বিদ্যাসাগর কবির চাহিদা মতো না-হলেও, যথেষ্ট পরিমাণে টাকা পাঠিয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের কাছে চক মুনকিয়া এবং গদার ডাঙ্গা তালুক বন্ধক দেবার কাজ সম্পন্ন করেন। এবারেও বিদ্যাসাগর হিশেবী বুদ্ধি এবং হিতাকাঙ্ক্ষার পরিচয় দিয়ে সম্পত্তি বিক্রি না-করে বন্ধক দেবার ব্যবস্থা করেন।

বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে কবি ঠিক কতো টাকা পেয়েছিলেন, আগেই বলেছি, সুনির্দিষ্টভাবে তা বলা যায় না। কিন্তু তিনি যে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট টাকা পেয়েছিলেন তার একটা পরোক্ষ প্রমাণ আছে। আমরা আগের আলোচনায় একাধিক বার লক্ষ্য করেছি, যখনই অর্থ-স্বাচ্ছন্দ্যে থেকেছেন, তখনই তিনি ভালো বাড়ি ভাড়া করতেন। লন্ডন বাসের শেষ দু মাসের জন্যে তিনি কেন্দ্রীয় লন্ডনে যে-বাড়ি ভাড়া করেন, শেফার্ডস বুশের বাড়ির সঙ্গে তার কোনো তুলনাই চলে না। শেফার্ডস বুশ কেমন গ্রাম্য এলাকা ছিলো, ইতিমধ্যে আমরা তা লক্ষ্য করেছি। সেই এলাকার যাঁরা বাস করতেন, তাঁরা কেউ ইঁট তৈরি করতেন, কেউ মদ তৈরি করতেন, কেউ ঘর সাজানোর ছোটোখাটো কাজ করতেন। কবির পাশের বাড়িতে — ১৩ নম্বরে — থাকতেন হেনরি উডস, ছোট্টো শেফার্ডস বুশ স্টেশনের স্টেশন-মাস্টার। ১৫ নম্বরে থাকতেন জন স্টিফেনশন। তাঁর পেশা জানা যাচ্ছে না। কিন্তু মাইকেল যে-বাড়িতে থাকতেন, ১৮৬১ সালের সেন্সাস থেকে দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিরাট পরিবার নিয়ে যে-ভদ্রলোক বাস করতেন — উইলিয়াম ডে, তাঁর পেশা ছিলো রুটি-বিস্কুট-মিষ্টি তৈরি করা।১১৮ অপরপক্ষে, মিসেস জুপের কাছ থেকে কবি রাসেল স্কোয়ারের গায়ে-লাগানো ৭নম্বর বেডফোর্ড প্লেসে যে-বাড়ি ভাড়া নেন, সে রীতিমতো উচ্চ মধ্যবিত্তের এলাকা। এই রাস্তার ৯ এবং ১০ নম্বর বাড়িতে থাকতেন দু জন সার্জন। ১১ এবং ২২ নম্বর বাড়িতে থাকতেন দুজন ধর্মযাজক। ৪ এবং ১৮ নম্বর বাড়িতে থাকতেন দুজন সলিসিটর। ২৩ নম্বর বাড়িতে থাকতেন একজন হীরা এবং মুক্তা ব্যবসায়ী। ২৫ নম্বর বাড়িতে বাস করতেন একজন ডাক্তার।১১৯ কবির এই বাড়ি থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়মের সদর দরজার দূরত্ব দু শো গজও নয়। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখযোগ্য, তিনি এই বাড়ি ভাড়া নেবার ১২ বছর পরে তরুণ রবীন্দ্রনাথ ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়ার সময়ে যে-বাড়িতে থাকতেন, ৭নম্বর বেডফোর্ড প্লেস থেকে সে বাড়ি চার-পাঁচ মিনিটের পথ।১২০ রাসেল স্কোয়ারের এই বাড়ির সঙ্গে আগের বাড়ির আর-একটা মস্তো পার্থক্য এই যে, শেফার্ডস বুশের বাড়ি ছিলো কলেজ থেকে সাড়ে পাঁচ মাইল দূরে, আর এ বাড়ি কলেজেব একেবারে কাছে — মাত্র কয়েকটা রাস্তা দূরে। মোট কথা, সাড়ে তিন বছর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করার পর তিনি লন্ডনবাসের একেবারে শেষ দিকে পছন্দসই এলাকায় থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে এটা সম্ভব হয়েছিলো বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যের ফলে, সে কথা বলা বাহুল্য।

বিদ্যাসাগর তাঁর জন্যে যা করেছিলেন, তার প্রতি কবিব সচেতনতা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় এ সময়ের প্রতিটি চিঠিতে। ১৭ নভেম্বর শুক্রবার রাতের বেলায় তাঁর ডাক পড়েছিলো গ্রেজ ইন সোসাইটির বারে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সে সময়ে ব্যারিস্টার হিশেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই সুখের খবর তিনি অন্য কোনো বন্ধুকে নয়, সবার আগে জানিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। পরের দিন তিনি বিদ্যাসাগরকে যে-চিঠি লিখেছিলেন, তাতে বলেছেন:

প্রিয় বন্ধু,

আমি নিশ্চিত আপনি জেনে দারুণ খুশি হবেন যে, গত রাতে গ্রেজ ইন সোসাইটি আমাকে বারে ডেকে পাঠিয়েছিলো এবং আমি অবশেষে ব্যারিস্টার হয়েছি। এব সব কিছুর জন্যে আমি ঋণী প্রথমে ঈশ্বর এবং তাঁর নিচে আপনার কাছে। এবং আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি চিরদিন আপনাকে আমার সবচেয়ে বড়ো উপকারী এবং সবচেয়ে খাঁটি বন্ধু বলে বিবেচনা করবো। আপনি না-হলে আমার যে কী হতো! … প্রিয় বিদ্যাসাগর, আমি জানি আপনি ছাড়া আমার কোনো বান্ধব নেই।

কবির যেমন অনেক ভালো বন্ধু ছিলেন, তেমনি লোককে শত্রুতে পরিণত করারও তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিলো। যে-ক্ষেত্রমোহন দত্তকে এক সময়ে তিনি তাঁর বাড়িতে অতিথি রেখেছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে অতো প্রশংসা করেছিলেন, সেই ক্ষেত্রমোহন গ্রেজ ইন সোসাইটির কাছে কবির চরিত্র এবং অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ করে অভিযোগ করতে চেয়েছিলেন।১২১ তিনি যে তাঁর নিন্দা রটাচ্ছিলেন এবং শত্রুতা করছিলেন, কবি সে সম্পর্কে জানতেন। সে জন্যে বিদ্যাসাগরকে এই ঘটনার কিছুকাল আগে লেখা একটি চিঠিতে তিনি ক্ষেত্রমোহনের বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন। সেই সূত্র ধরে এবারের চিঠিতে লেখেন: ‘সেই পাজিটা (আমার সম্পর্কে) গ্রেজ ইন সোসাইটিতে লিখবে বলে একেবারে সংকল্পবদ্ধ ছিলো। তবে আমাদের সবার সৌভাগ্যক্রমে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে ভয় দেখিয়ে তার কুমতলব থেকে সরিয়ে রাখে। আমি এই নোংরা বদমাশটার মতো এতো সংকীর্ণমনা, এতো নিচ, এতো নীতিহীন, এতো ‘পরশ্রীকাতর কোনো বাঙালিকে জানিনে।১২২ তাঁর এই তিক্ততার কারণ বোঝা কঠিন নয়। তাঁর পরে অনেক বাঙালি ব্যারিস্টার হয়েছেন। কিন্তু কাউকে তাঁর মতো বিপরীত স্রোতে সেই পথে যেতে হয়েছে বলে মনে হয় না। পরের আলোচনা থেকে দেখা যাবে, ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতার হাই কোর্টে তিনি অ্যাটর্নি হিশেবে প্র্যাক্টিস করার অনুমতিও সহজে লাভ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি নিজে ব্যারিস্টার হবার ঘটনাকে গণ্য করেছিলেন প্রতিকূল ভাগ্যের বিরুদ্ধে একটা বড়ো রকমের বিজয় বলে। তিনি জানতেন ইংল্যান্ডে তিনি ব্যারিস্টার হিশেবে প্র্যাক্টিস করবেন না। তা সত্ত্বেও, অনেকটা নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যারিস্টার হবার তিন দিন পরে তিনি লন্ডনে ইংলিশ ব্যারিস্টারদের তালিকায় নিজের নাম লেখান।১২৩ কতো আশা, কতো আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি এ সময়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিলেন, সেটা অনুমান করা অসম্ভব নয়। কেবল সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ নয়, তিনি নিশ্চয় আশা করেছেন, অতঃপর তিনি সেই ভোগবিলাসের অধিকারী হতে পারবেন, চিরকাল যা কেবল স্বপ্নে দেখেছেন, কিন্তু বাস্তবে যা কখনো উপভোগ করার সুযোগ পাননি।

ব্যারিস্টার হবার পর কবি দেশে ফেরার জন্যে ব্যস্ত হন। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনা মতো, হেনরিয়েটা এবং সন্তানদের মোরোপে রেখে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। ব্যারিস্টার হয়ে — আপাত-দৃষ্টিতে ভাগ্য খুলে যাবার ব্যবস্থা করে — কলকাতায় ফেরার পর তাঁর জীবনে সমৃদ্ধির পরিবর্তে যে-করুণ ট্র্যাজেডি নেমে এসেছিলো, যথাসময়ে দেখতে পাবো, তার একটা কারণ ছিলো পরিবার য়োরোপে রেখে যাবার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পরিবার যোরোপের রেখে যাবার ব্যাপারে বিদ্যাসাগর তাঁকে ঠিক কী ভাষায় লিখতেন, তা জানা যাচ্ছেনা। কিন্তু এই প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বিদ্যাসাগরকে অস্পষ্ট উত্তর দিতেন। অপর পক্ষে, ১৮৬৫ সালের গোড়ার দিকে একটি চিঠিতে তিনি গৌরদাস বসাককে স্পষ্ট লিখেছিলেন যে, তিনি পরিবার য়োরোপে বেখে যাবেন। কিন্তু একই সময়ে এবং পরবর্তী কালেও তিনি বিদ্যাসাগরকে এমনভাবে লিখেছেন যেন তিনি পরিবার রেখে যেতে চান না। পরিবার রেখে যাবার পক্ষে তিনি গৌরদাসের কাছে যে-যুক্তি দিয়েছেন, তা হলো: এর ফলে সন্তানরা যোরোপীয় হয়ে উঠবে। তাঁর সন্তানরা যে দ্রুত ফরাসি ভাষা শিখছে, তাতে তিনি উচ্ছসিত এবং গর্বিত হয়েছেন।১২৪ ব্যারিস্টার হিশেবে পাকাপোক্ত হবার আগে পর্যন্ত কয়েক মাসের জন্যে পরিবার য়োরোপে রেখে যেতে চান বলে তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে যে-চিঠি লিখেছিলেন, তার মধ্যে আসলে পুরো সত্য প্রকাশ পায়নি।১২৫ তা ছাড়া, তিনি এবং হেনরিযেটা এ সিদ্ধান্ত তখনই নিয়েছেন বলে যে-মন্তব্য করেছিলেন, তা-ও সঠিক নয়। স্বদেশে অভিমুখে যাত্রা করার আগে পরিবার রেখে যাবার যে-সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তিনি কি বিবেচনা করে দেখেছিলেন যে, এর ফলে স্ত্রী এবং সন্তানদের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের বিরহ হবে? অথবা এর জন্যে অর্থ ব্যয়ও হবে প্রচুর? তদুপৰি যখনকার কথা বলছি (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৮৬৬) তখন আবার হেনরিয়েটা চার-পাঁচ মাসের গর্ভবতী। সম্পূর্ণ অনাত্মীয় এবং সহায়হীন পরিবেশে গর্ভবতী স্ত্রী এবং যথাক্রমে সাত ও পাঁচ বছরের দুটি শিশুকে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে কাণ্ডজ্ঞানহীন না-বলে পারা যায় না। এতে মূল্য দিয়ে তিনি কী অর্জন করতে চেয়েছিলেন, সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কিন্তু তিনি ঝোঁকের মাথায় এ সিদ্ধান্ত নেননি। স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে অনেক চিন্তাভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

ব্যারিস্টারি পাশ করার পর কবি লন্ডনে আট-দশ দিনের বেশি ছিলেন বলে মনে হয় না। এ থেকেও ইংল্যান্ডের সমাজের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা চোখে পড়ে। যে-লন্ডনে এতো কষ্ট করে ছিলেন, এখন নির্ভাবনায় সেখানে কিছুদিন বাস করে সময়টা উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তা না-করে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবার যাত্রা করলেন ভার্সাইয়ের দিকে, আপাতদৃষ্টিতে যে-ভার্সাই তাঁকে কোনো বিশেষ সুখ অথবা সম্মান দিতে পারেনি। কিন্তু তিনি যে তাঁর পরিবার সেখানেই রেখে গেলেন, তা থেকে মনে হয় দারিদ্র জর্জরিত এবং পাওনাদারদের হাতে নিগৃহীত হলেও ভার্সাই তাঁর মনকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিলো। সেখানে আগের বার বাড়ি ভাড়া করেছিলেন নিতান্ত গরিবদের পাড়ায়, গরিবদের সঙ্গে। কিন্তু মনে মনে তিনি সারাক্ষণই বাদশাহী খোয়াব দেখতেন। অনেক সময় তিনি পড়ে থাকতেন রাজপ্রাসাদের উদ্যানে। এবারে তিনি ব্যারিস্টার। কলকাতায় গেলে তিনি হাজার হাজার টাকা আয় করবেন। এখন আর পঁচিশ ঠুর জন্যে কোনো পাদ্রির কাছে হাত পাততে হবে না। তিনি সেখানকার যে-কারো সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সমর্থ। তা ছাড়া, একদিন যারা তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেনি, চরম অভাবের দিনে উপহাস করেছে, তাদেরও দেখিয়ে দিতে চান, তিনি সমাজের কোন তলার মানুষ। সুতরাং এবারে তিনি বাড়ি ভাড়া নিলেন রাজপ্রাসাদের পেছনে যে-পুকুর আছে তারই পাশে,প্রাসাদের খিড়কির দরজার ঠিক পরে — ৫ নম্বর মোরপা সড়কে। রাজবাড়ি সম্পর্কে তাঁর মনে একটা মোহ এবং আবেশ ছিলো। এতো জায়গা থাকতে তিনি যে দ্বিতীয় বার ভার্সাইতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন, তা থেকেও এই মোহ প্রকাশ পায়।

ব্যারিস্টার হবার অব্যবহিত পরে তিনি বিদ্যাসাগরকে জানিয়েছিলেন যে, মার্সেই বন্দর থেকে রওয়ানা কববেন ১৯ জানুআরি (১৮৬৭)১২৬। কিন্তু তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি যখন আবার চিঠি লেখেন, তখন যাবার সময়টা দু সপ্তাহ এগিয়ে আনেন। এবারে জানান, তিনি যাত্রা করতে চান ৫ জানুআরি — যদি কিনা তার আগে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে টাকা পান। যাবার খরচ এবং হেনরিয়েটাকে দিয়ে যাবার জন্যে টাকার দরকার ছিলো। তিনি বিদ্যাসাগরকে জানিয়েছিলেন, যেতে লাগবে প্রায় দু শো পাউন্ড আর হেনবিয়েটার জন্যে ব্যাংকে রেখে যেতে চান দু শো পাউন্ড।১২৭

ব্যারিস্টার হয়ে তিনি তাঁর পিতার সম্মান রক্ষা করবেন — চার বছর আগে লন্ডনে পৌঁছে তিনি তেমন সংকল্পের কথা মন খুলেই বলেছিলেন। তা ছাড়া, পরিচিত এবং বন্ধুদের দেখাবেন, দু হাতে আয় করবেন — ইত্যাদি অনেক অভিপ্রায় তাঁর মনে ছিলো। কিন্তু ভার্সাইতে যাবার অব্যবহিত পরেই কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারলেন না। তিনি চাইলেন আসন্ন বড়ো দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিনটি পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে যেতে। ৯ ডিসেম্বরের (১৮৬৬) চিঠিতে পবিবাব পেছেনে রেখে যাবার কারণ ব্যাখ্যা করেন এভাবে:

আমার মনে হয়, আমি যতো দিন না কলকাতায় ভালো করে গুছিয়ে বসতে পারি, ততোদিন আমার পরিবার এখানেই রেখে যাওয়া উচিত হবে। ফ্রান্সে জীবন ধারণ করা শস্তা এবং আমার আশঙ্কা হচ্ছে, একজন ব্যারিস্টারের মানানসই জীবনযাত্রা আমি শুরু করতে পারবো না যদি না আপনি আমার জন্যে যতো টাকা জোগাড় কবতে পাববেন তার চেয়ে বেশি টাকা পাই। একা আমি যেখানে খুশি এবং যেমন খুশি থাকতে পারি; কিন্তু স্ত্রী এবং সন্তান থাকলে ব্যাপারটা বদলে যাবে। আশা করি আপনি মনে করবেন না যে, আমি আপনার উপদেশ হাল্কাভাবে নিতে পারি। কিন্তু য়োরোপে বাস করা বেশি খরচের ব্যাপার বলে আপনি যে- ধারণা করেছেন, তা ভুল। আমার এই দাবি আপনার কাছে যেমন অবিশ্বাস্যই মনে হোক না কেন, আমি বলতে পারি, অনেক ব্যাপারে সাবা পৃথিবীর মধ্যে য়োরোপে জীবন ধারণ সবচেয়ে শস্তা।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, এখানে তিনি একবারও উল্লেখ করেননি যে, য়োরোপীয় করে তুলতে চান বলে সন্তানদের য়োরোপে রেখে যাচ্ছেন। এ কথা শুনলে বিদ্যাসাগর কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন, তিনি তা ভালো করে জানতেন। মনের কথা তার কাছে খুলে বলার সাহস হয়নি। তা ছাড়া, খরচের ব্যাপারেও তিনি যা বলেছেন, তা ঠিক নয়। এই চিঠির একেবারে শেষ দিকে তিনি নিজে স্বীকার করেছেন, ‘আমি যেমনটা হিশেব করেছিলাম, দেখতে পাচ্ছি আমার তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে।’১২৮ তাঁর এ উক্তি স্ববিরোধী। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে এ কথা না-বলে উপায় ছিলো না — কারণ, তিনিই টাকা পাঠাচ্ছিলেন কলকাতা থেকে।

ব্যারিস্টার হলে তাঁকে অন্যদের তুলনায় একেবারে ভিন্ন ধরনের জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হবে — এ ধারণা তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, বলা মুশকিল। তবে আইনজীবী পিতার পরিবারে অর্থস্বাচ্ছন্দ্য এবং কলকাতার ব্যারিস্টারদের আয়ের পরিমাণ দেখে তাঁর এ ধারণা হওয়া সম্ভব। তদুপরি, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর কলকাতা থেকে লন্ডনে বন্ধুদের জানিয়েছিলেন যে, তিনি রোজ কুড়ি পাউন্ড বা দু শো টাকা কামাই করছেন। মাসে ছ হাজার টাকা আয় হলে জীবনযাত্রা কেমন হতে পারে — কবি তা হিশেব করে দেখেছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর উচ্চ ধারণা ছিলো না। তিনি নিজেকে তাঁর চেয়ে বড়ো মনে করতেন। ওদিকে, মনোমোহন ঘোষকে তিনি আন্তরিকভাবে স্নেহ করলেও তাঁর মেধা সম্পর্কে তাঁর মনে কোনো মোহ ছিলো না। ব্যারিস্টার হিশেবে তিনি যে এঁদের ছাড়িয়ে যাবেন — এটা চিন্তা করা তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। এবং বড়ো ব্যারিস্টার হিশেবে তাঁর আয়ও হবে বেশি — এও তিনি ভেবে থাকবেন।

বস্তুত, কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় যতো ঘনিয়ে এসেছে এবং শারীরিকভাবে তিনি কলকাতার যতো কাছে এগিয়ে গেছেন, ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ততোই গোলাপি হতে থাকে। আমরা আগেই তাঁর একটি চিঠিতে লক্ষ্য করেছি যে, তিনি এক সময়ে মনে করেছিলেন, কলকাতায় ফিরে যাবার পর বিদ্যাসাগর তাঁকে তাঁর একটি কক্ষ ছেড়ে দেবেন আর দেবেন পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাল-ভাত। তার জন্যেই তিনি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর প্রত্যাশা বৃদ্ধি পায়। ভার্সাই থেকে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতে দেখা যায়, তাঁর প্রত্যাশাকে তিনি কতোটা প্রশস্ত করেছিলেন:

আমি যখন কলকাতায় যাবো, তখন একটা বাড়ির উপরতলা ভাড়া করতে চাই। নিচের তলায় থাকবে অ্যাটর্নির অথবা ঐ জাতীয় কোনো অফিস। কয়েকটি কক্ষ সুন্দর করে সাজাতে চাই। যত দিন না মামলা আসতে শুরু করে, ততো দিন সেখানে বাস করবো একজন বাবুর্চি আর খিদমতগারকে নিয়ে।১২৯

কার্যকালে দেখতে পাবো, কলকাতায় পৌঁছে তিনি ওপরতলার ঘর নিয়েও সুখী থাকতে পারেননি। নিজের সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ততো দিনে আবও ফেঁপে উঠেছিলো।

কবির চিঠিগুলো পড়লে অনেক জায়গায় দেখা যায়, তিনি জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে উল্লেখ

করেছেন– অতো দিন যদি বাঁচি ইত্যাদি। এভাবে বলা তাঁর একটা ভঙ্গি ছিলো, নাকি তিনি সত্যি সত্যি জীবনের অনিত্যতা নিয়ে অতো ভাবিত ছিলেন, বলা শক্ত; ভার্সাই থেকে দেশের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে বিদ্যাসাগরকে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতে তিনি তাঁর অবর্তমানে তাঁর সম্পত্তি কে কতোটা পাবে, সে বিষয়ে নির্দেশ দিযেছেন। বলতে গেলে এ চিঠিটি ছিলো তাঁর অনানুষ্ঠানিক উইল। তখন জাহাজে চলাচল করা এখনকার মতো নিরাপদ ছিলো না ঠিকই, কিন্তু তিনি যেভাবে বিদ্যাসাগবকে বিস্তারিত নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে মনে হয় তাঁর ভেতবে এই নিরাপত্তাহীনতা একটু বেশি মাত্রায় ছিলো।

এবারে আমি অনেক গুরুতর একটি বিষয়ের দিকে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। আমার বলার বোধ হয় কোনো প্রয়োজন নেই যে, আপনি আমার একমাত্র বন্ধু। আমি অচিরে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা করতে যাচ্ছি। জীবন অনিশ্চিত। ‘জীবিত অবস্থায়ও আমবা মৃত্যুৰ মধ্যে আছি।’ আমার যদি কিছু হয়, তা হলে আমার স্ত্রী এবং সন্তানরা আপনি ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারবে না। আমি মারা গেলে আপনি আমার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে আমার সত্যিকার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বাকি টাকা এখানে আমার স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেবেন এবং তাঁরা কী করবে — সে বিষয়ে নির্দেশ দেবেন। আমি নিশ্চিত যে, আপনি আপনার নিজের ছোটো ভাই-এর বিধবা স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি যে দৃষ্টি রাখতেন, আমার স্ত্রীর দিকেও সমান সহানুভূতি রাখবেন। যাদের রেখে গেলাম, আপনাকে অবশ্যই তাদের বন্ধু এবং অভিভাবক হতে হবে।

আমার মনে হয় না আপনি জানেন যে, বই থেকে আমার বেশ আয় হয়। এই আয় বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব। আমি সেই আয় ফ্রান্সের ভার্সাইনিবাসী মাদমোজেল হেনরিয়েটা এলাইজা শর্মিষ্ঠা দত্ত এবং তার উত্তরাধিকারীদের দিয়ে যেতে চাই। আর আপনি এবং আপনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি আমার বিষযসম্পত্তি তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব নেবেন। আপনি এবং আপনার সঙ্গে যুক্ত অন্য ব্যক্তিরা হবেন এই দানব ট্রাষ্টি। এই সন্তানের মৃত্যু হলে এই দানের ভাগী হবে মাষ্টার ফ্রেডাবিক মাইকেল মিন দত্ত এবং তার উত্তরাধিকারীরা। এই শেষোক্ত সন্তানের মৃত্যু হলে এই দানের উত্তরাধিকারী হবে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমেলিয়া হেনরিয়েটা সফাইয়া দত্ত এবং তার পব আমার অন্য উত্তরাধিকারীরা। আমি কলকাতা পৌঁছার আগে আমার মৃত্যু হলে আমার দানপত্র অবশ্যই এই চিঠির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করতে হবে। আপনি এবং অন্য ট্রাস্টিরা এই অর্থ হে. অ্যা. শ. দত্ত অথবা ফ্রে. মা. মি. দত্তের শিল্ডাব খরচ অথবা আমার স্ত্রীর ব্যয়েব জন্যে য়োরোপে পাঠিয়ে দেবেন। আমি একা হলে ভাবতাম না। কারণ আমি ভীরু নই। কিন্তু অসহায় স্ত্রী এবং সন্তান রেখে যাওয়া অনেক গুরুতর ব্যাপার।১৩০

এই চিঠি থেকে কবির তখনকার মনের অবস্থা বেশ বোঝা যায়। এক দিকে তাঁর মনে তখন ব্যারিস্টার হিশেবে নতুন করে জীবন শুরু করার রঙিন স্বপ্ন জাল বুনেছিলো, অন্য দিকে পরিবারের জন্যে পিছু টান এবং অনিশ্চয়তা বোধ মনকে কাতর করেছিলো। ব্যারিস্টার হয়ে তিনি অনেক টাকা আয় করবেন, বড়ো লোক বলে সমাজে মর্যাদা লাভ করবেন, এবং, তার চেয়েও বড়ো কথা, জীবনকে উপভোগ করবেন — এবিষয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করতেন বলে মনে হয় না। তবে চায়ের কাপ এবং ঠোঁটের মধ্যেও ব্যবধান অনেক — এ তিনি ভালো করে জানতেন। আগের কয়েক বছরের, এমন কি, তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নভঙ্গের অনেক অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি এ সত্য অনুভব করেছিলেন। সে জন্যে, বিদ্যাসাগরের কাছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তার কথা প্রকাশ করেছেন নিজের কাছ থেকে আমি এ কথাটা গোপন করতে পারিনে যে, এই পেশায় প্রবেশ করার জন্যে আমি নিজেকে প্রায় ভিখিরি করে ফেলেছি। অতঃপর দেখা যাক ‘এ বৃক্ষে কি ফল ফলিবে।’১৩১

উল্লেখপঞ্জী ও টীকাটিপ্পনী – প্রবাসে দৈবের বশে

পৃ ২২৯

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১১২।

Madras Almanac, 1863. Candia (Capt. N. Stewart) left Madras for Galle, Aden & Suez on 14th June 1862 at night.

পৃ ২৩০

ঐ।

Lloyd’s List (London), 17 July 1862.

পৃ ২৩১

সম্ভবত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছেলেবেলা থেকে হরিচরণের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলো। তা ছাড়া, কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁর কাছে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করেছিলেন। সপ্তাহ আগে তাঁর কাছে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করেছিলেন।

সরকারী কাগজপত্র অনুযায়ী হাইকোর্ট শুরু হয় ১৮৬২ সালের পয়লা জুলাই। কিন্তু বিচারপতিরা শপথ গ্রহণ করেন ৯ই জুলাই।

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৯০, HRP।

পৃ ২৩২

Lloyd’s List (London), 19 July 1862.

সত্যেন্দ্রনাথ এবং মনোমোহন বসু কোন ঠিকানায় থাকতেন, তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু পরে মাইকেল মনোমোহন বসুকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, তাঁরা একই জায়গায় ছিলেন। পত্রসংখ্যা ৯১, HRP।

১০ Register of Admission to Gray’s Inn, 1522-1889, J. Forster, ed. (London: The Hansard Publishing Union, 1889), p. 479.

১১ Staff List, Gray’s Inn, 1862, Gray’s Inn Library.

পৃ ২৩৩

১২ Register of Admission to Lincoln’s Inn, J. Forster (ed.) (London: Hansard Publishing Union, 1889). জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ভর্তি হন ১৮৫১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর।

১৩ জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ব্যারিস্টার হন ১৮৬২ সালের ১১ই জুন। আর মনোমোহন ঘোষ ৬৬ সালের ৬ই জুন।

পৃ ২৩৪

১৪ MMD to Manomohan Ghosh, পত্রসংখ্যা ৯১, HRP।

পৃ ২৩৫

১৫ ঐ।

১৬ MMD to Manormohan Ghosh, পত্রসংখ্যা ৯২, HRP।

১৭ পত্রসংখ্যা ৯৩, HRP।

পৃ ২৩৬

১৮ ঐ।

পৃ ২৩৭

১৯ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০২, HRP।

২০ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ৯৪, HRP।

পৃ ২৩৮

২১ MMD to vidyasagar, পত্রসংখ্যা ৯৬, HRP।

২২ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০২, HRP।

পৃ ২৩৯

২৩ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৮, HRP।

২৪ সুরেশচন্দ্র মৈত্র, পৃ. ১৮০।

২৫ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১০৪, HRP।

পৃ ২৪০

২৬ দলিলের তারিখ ৭ই জুন, ১৮৬২। গিরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, ‘মাইকেল ও বিদ্যাসাগর’, পৃ. ৯৬৯।

২৭ এ দলিলের পুরো পাঠের জন্যে দ্রষ্টব্য: ঐ, পৃ. ৯৭৩-৭৪।

২৮ হেনরিয়েটা বিলেত যাত্রা করার আগের দিন মহাদেব তাঁকে ১২০০ টাকা দেন। MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০২, HRP।

২৯ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৯৪, HRP।

পৃ ২৪২

৩০ H. Mayhew, London Labour and the London Poor (L. Griffin, Bohn & Co., 1981).

৩১ J. Salter, The Asiatics in England (London: Seely, Jackson & Halliday, 1873).

৩২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১০৪, HRP।

৩৩ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যুবোপ-প্রবাসীর পত্র, ৩ ও ১৩ সংখ্যক পত্র দ্রষ্টব্য।

৩৪ J. Long to Parent Committee, Church Missionary Society Papers, Birminghain University, CI, 1/0/185/1-154, 28.2.1862. অন্য এক পত্রে লিখেছেন দিগম্বর মিত্রের পুত্রের কথা।

পৃ ২৪৩

৩৫ Gray’s Inn Records, Extract form the Pension Minutes, 22. 12. 1863, quoted in a letter to W. Radice by the Librarian of the Gray’s Inn Library and printed in সুরেশচন্দ্র মৈত্র, পৃ. ১৯৫।

৩৬ মধু-স্মৃতি, পৃ. ১৬৪।

৩৭ এই ভ্রমণ-কাহিনীটি পড়ি ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে। এটি ১৮৫০ অথবা ১৮৬০-এর দশকে প্রকাশিত হয়।

পৃ ২৪৪

৩৮ (Versailles) Aux Archives Departmentales des Yvelines, Document on Charity, 1863-64. যারা দাতব্য তহবিল থেকে সাহায্য নিয়েছিলো, তাদের কয়েকজনের নাম এবং বয়সও এই দলিলে দেওয়া আছে। – Denis Fleury (48), Emily Fleury (18), Lion Fleury (14), Cloudine Mathius (39), L. Masson (12), J. Martin (13) and Augustus Martin (47).

৩৯ MMD to M, Ghosh, পত্রসংখ্যা ১০৫, HRP।

পৃ ২৪৫

৪০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১০৪, HRP।

পৃ ২৪৬

৪১ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ৯৪, HRP।

পৃ ২৪৭

৪২ Gray’s Inn Records, Extract form the Pension Minutes, 22. 12. 1863, quoted in a letter to W. Radice by the Librarian of the Gray’s Inn Library and printed in সুরেশচন্দ্র মৈত্র, পৃ. ১৯৫।

৪৩ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ৯৪, HRP।

৪৪ পুলিশ অফিসে কবির সহকর্মী। পরে ইনি আইন বিষয়ে একটি বই লিখেছিলেন।

৪৫ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ৯৯, HRP।

পৃ ২৪৮

৪৬ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ৯৬, HRP।

৪৭ মধু-স্মৃতি, পৃ. ১৬৫।

৪৮ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৪, HRP।

পৃ ২৫২

৪৯ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৪, HRP।

৫০ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ১০৪, HRP।

৫১ Versailles Municipal Archives, Ecclesiastical Document, no. 671, dated 3. 8. 1864. এতে বলা হয়: Amelia Henrietta White, aged 27 years, wife of Michel [sic] Madhusudan Dutt, barrister, with whom she lives at 12 rue de Shantiers, gave birth to a female child to day at 6 o’clock in the morning and she was presented dead at the Alderman/Deputy Mayor… [my translation]

পৃ ২৫৩

৫২ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০১, HRP।

৫৩ Ibid.

৫৪ Ibid.

৫৫ Ibid.

পৃ ২৫৪

৫৬ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৬, HRP।

৫৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০২, HRP।

পৃ ২৫৫

৫৮ Ibid.

৫৯ Ibid.

৬০ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০২, HRP।

পৃ ২৫৬

৬১ কলকাতায় থাকার সময়ে তিনি মূল ইটালীয় ভাষায় ত্যাসো পড়ছেন বলে রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন। MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭২, HRP।

পৃ ২৫৭

৬২ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০৩, HRP।

৬৩ Ibid. কবি যখনএ চিঠি লেখেন (৩ অক্টোবর ১৮৬৪) সত্যেন্দ্রনাথ তখনো ফিরে আসেননি। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যখন বিদ্যাসাগর তাঁর চিঠি পাবেন, ততোদিনে সত্যেন্দ্রনাথ পৌঁছে যাবেন। সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতায় কবে ফিরে আসেন, সে তারিখ নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। কিন্তু তিনি অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ফিরে আসেন বলে মনে করা হয়। — অমিতা ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর: জীবন ও সৃষ্টি (কলকাতা: টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউ, ১৯৮৬), পৃ. ১৮-১৯।

পৃ ২৫৮

৬৪ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ১০৪, HRP।

৬৫ MMD to M. Ghosh, পত্রসংখ্যা ১০৫, HRP।

পৃ ২৫৯

৬৬ গৌরদাস বসাককে লেখা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ২১শে মার্চ ১৮৬৫ তারিখের একটি পত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি কবির কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন। নগেন্দ্রনাথ সোমের মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৮১।

পৃ ২৬০

৬৭ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ১১২, HRP।

পৃ ২৬১

৬৮ Ibid.

পৃ ২৬৪

৬৯ C. Pichois, Baudlaire (London: Hamish Hamilton, 1989), pp. 232-35.

পৃ ২৬৬

৭০ Baudlaire’’s letter to Mme Aupick, 27 March 1852, quoted in Ibid., p. 199.

৭১ একজন জীবনীকারের মতে, তিনি টেনিসন এবং ভিক্তর উগোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। – মধু-স্মৃতি, পৃ. ১৯৩। এটা একেবারেই ভিত্তিহীন।

পৃ ২৬৯

৭২ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ১১২, HRP।

৭৩ মধু-স্মৃতি, পৃ. ১৮৪, HRP।

পৃ ২৭০

৭৪ সুরেশচন্দ্র মৈত্র, পৃ. ১৮০।

পৃ ২৭২

৭৫ মূল সনেটটি ইটালি থেকে উদ্ধার করেন ডক্টর রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত।

পৃ ২৭৩

৭৬ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০৭, HRP।

৭৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০৯, HRP।

পৃ ২৭৪

৭৮ Ibid.

৭৯ MMD to M. Ghosh, পত্রসংখ্যা ১০৫, HRP।

পৃ ২৭৫

৮০ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০৯, HRP।

৮১ Ibid.

৮২ Ibid.

পৃ ২৭৬

৮৩ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ১১২, HRP।

৮৪ Ibid.

পৃ ২৭৮

৮৫ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১১, HRP।

৮৬ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৩, HRP।

৮৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৪, HRP।

৮৮ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১০, HRP।

পৃ ২৭৯

৮৯ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৩, HRP।

৯০ Ibid.

৯১ যে-রোম্যান ক্যাথলিক বিশপের কথা মাইকেল উল্লেখ করেছেন, তার নাম ড. টমাস অলিফ।

৯২ মাইকেল কমিটির সদস্যদের দুর্গন্ধওয়ালা বদমাশ বলে বর্ণনা করলেও, লর্ড ডি গ্রে ছিলেন জর্জ ফ্রেডারিক স্যামুয়েল রবিনসন, ফ্যর্স্ট মার্কুইস এবং সেকেন্ড অ্যর্ল অব রিপন। কবি মারা যাওয়ার সাত বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি ভারতবর্ষে আসেন ভাইসরয় হিশেবে। যখনকার কথা মাইকেল লেখেন, তথন রিপন ছিলেন পার্লামেন্টের সদস্য এবং ভাইকাউন্ট গোডেরিচ উপাধিতে ভূষিত। ১৮৫৯ সালে তিনি ইংল্যান্ডের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পিতার উপাধি অ্যার্ল অব রিপন পদবী উত্তরাধিকার হিশেবে লাভ করেন।

৯৩ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৬, HRP।

পৃ ২৮০

৯৪ মধু-স্মৃতি, পৃ. ১৯৬।

এ হিশেব মাইকেল নিজেই ১৮৬৬ সালের ১৭ই জানুয়ারির চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর হিশেবেই ভুল ছিলো।

৯৫ বিদ্যাসাগরকে লেখা অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের চিঠি (৮, ৪. ১৮৬৭), গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে উদ্ধৃত, পৃ. ৯৬৯।

৯৬ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১০৩, HRP।

পৃ ২৮১

৯৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৯, HRP। রানী স্বর্ণময়ীর এই সরকারের নাম রাজীবলোচন রায়। কয়েক বছর পরে কবি আবার এঁর সহাযতা লাভের জন্যে বিদ্যাসাগরের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

৯৮ কবি একাধিক চিঠিতে ঈশ্বরচন্দ্র বসুর কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে ৯ ডিসেম্বর ১৮৬৬ তারিখে লেখা। চিঠিতে লিখেছেন যে, বই-এর রয়্যাল্টি বাবাদ ১৮৬৬ সালের প্রথমার্ধে পাওয়া গিয়েছিলো এক হাজার টাকা।

পৃ ২৮২

৯৯ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৩, ১২৫, ১২৬, HRP।

পৃ ২৮৪

১০০ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৮, HRP।

১০১ General Register Office (Catherine House, London), Document No. 339, dated 29, 6. 1866, Pancras, Middlesex, এটি ক্ষেত্রমোহন দত্তের বিয়ের দলিল।

১০২ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৮, HRP।

১০৩ Ibid.

পৃ ২৮৫

১০৪ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৯, HRP।

১০৫ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৮, HRP। ১২৪ এবং ১২৮ সংখ্যক চিঠিতেও ক্ষেত্রমোহন সম্পর্কে প্রতিকূল মন্তব্য আছে।

১০৬ General Register Office (Catherine House), Document No. 339, dated 29. 6. 1866, Pancras, Middlesex.

১০৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৪, HRP।

১০৮ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৭, HRP। অন্তত তিনটি চিঠির বয়ান থেকে বোঝা যায় যে, ক্ষেত্রমোহন সম্পর্কে কবির মনে অনেক অভিযোগ ছিলো। গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠিতে (১১২ সংখ্যক) ক্ষেত্রমোহনের নাম নেই, কিন্তু যে-ব্যক্তির উল্লেখ আছে, তাঁর পক্ষে ক্ষেত্রমোহন হওয়া অসম্ভব নয়।

১০৯ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৮, ১২১, ১২৩, ১২৪, ১২৫, ১২৬ এবং ১২৮, HRP।

১১০ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১১৮, HRP।

পৃ ২৮৬

১১১ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২১, HRP।

১১২ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৫, HRP।

পৃ ২৮৭

১১৩ Ibid.

১১৪ Ibid.

১১৫ Ibid.

পৃ ২৮৮

১১৬ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৬, HRP।

১১৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৭, HRP।

১১৮ Census Report, 1861.

পৃ ২৮৯

১১৯ London Postal Directory, 1861.

১২০ London Postal Directory, 1879 & Census Report, 1881. রবীন্দ্রনাথ থাকতেন ডক্টর জন স্কুটের বাড়িতে, ১০ নম্বর ট্যাভিষ্টক স্কোয়ারে। এ নিয়ে আমার প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ ও তিন নারী’তে বিস্তারিত তথ্য আছে। দেশ, ১৮ নভেম্বর, ২০০২।

পৃ ২৯০

১২১ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৭, HRP।

১২২ Ibid.

১২৩ Ibid.

পৃ ২৯১

১২৪ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ১০৪, HRP।

১২৫ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৫, HRP।

১২৬ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৭, HRP।

১২৭ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৫, HRP।

পৃ ২৯২

১২৮ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৫, HRP।

১২৯ MMD to Vidyasagar, পত্রসংখ্যা ১২৮, HRP।

পৃ ২৯৪

১৩০ Ibid.

১৩১ Ibid.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *