৩. পরদেশে

পরদেশে

‘যখন কলকাতা ত্যাগ করি তখন আমি বিরক্তি এবং উদ্বেগে অর্ধ-উন্মাদ হয়েছিলাম। এক মুহূর্তের জন্যেও ভেবো না যে, বিদায়ের আগে কেবল তোমার সঙ্গে আলাপ করিনি। আসলে, আসার আগে আমি দু-তিন জনের চেয়ে বেশি কাউকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বলিনি। সত্যি সত্যি কলকাতা ত্যাগের সিদ্ধান্ত তিনি খুব গোপন রেখেছিলেন। খৃস্টান হবার সময়েও নিজের উদ্দেশ্য কারো কাছে প্রকাশ করেননি। তাঁর চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি নিজের অনেক কথাই কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতেন না। কী ভেবে তিনি কলকাতা ছাড়লেন, অথবা তিনি কেন বেছে নিলেন মাদ্রাসকে, তার কোনো বিবরণ নিজে কোথাও দেননি; অথবা বন্ধুদেরও বলেননি। এমনকি, গৌরদাসকেও নয়। কিন্তু মনে মনে তিনি নিশ্চয় যোগ-বিয়োগ করে দেখেছিলেন — এর ফলে জীবনের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে।

অসাধারণ অনেক গুণ ছিলো তাঁর, কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও তাঁকে হিশেবী বলে প্রশংসা করেননি। জীবনে বারবার বেহিশেবী ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। তার ফলে আঙুলও পুড়িয়েছেন অনেক বার; কিন্তু তারপরও অজানা অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপ দিতে দ্বিধা করেননি। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বিলেত যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন এই দুঃসাহস এবং হঠকারিতা থেকেই। আয়োজিত বিবাহ এড়ানোর জন্যে মরিয়া হয়ে খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তার পেছনেও ছিলো এ রকমের বিদ্রোহী মনোভাব। এর ফলে বিয়ে তিনি এড়াতে পেরেছিলেন, কিন্তু লাভের অন্য অঙ্কগুলো যে হিশেবে মিলছে না, কয়েক মাসের মধ্যে তা টের পেয়েছিলেন। বস্তুত, বারবার ঝুকি নিয়ে সাহিত্য ছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কাঙ্ক্ষিত ফল ক্বচিৎলাভ করেছেন। কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, তাঁর মাদ্রাস যাত্রাও এমনি এক অ্যাডভেঞ্চার। অজানা জায়গায় গিয়ে তাঁর ভাগ্য পরীক্ষা করার এই দুরুসাহস পরেও একাধিক বার লক্ষ্য করা যাবে।

এতো জায়গা থাকতে তিনি কেন মাদ্রাসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন, তার কারণ এতো কাল একেবারে অজ্ঞাত ছিলো। তাঁর একাধিক জীবনীকার অনুমান করেছেন যে, ১৮৪৭ সালে বিশপস কলেজে যে-চারজন (আসলে পাঁচজন) দক্ষিণ ভারত এবং শ্রীলঙ্কার ছাত্র লেখাপড়া করতেন, তাঁরা তাঁকে কোনো পরামর্শ দিয়ে থাকবেন। এই দক্ষিণী ছাত্রদের সঙ্গে তিনি এক জাহাজে করে মাদ্রাসে গিয়েছিলেন — এমন অনুমান করেছেন সুরেশচন্দ্র মৈত্র।

কিন্তু এ অনুমান আদৌ ঠিক নয়। সত্যিকার ঘটনা হলো এই দক্ষিণী ছাত্রদের কেউ মাইকেলকে মাদ্রাস যাবার পরামর্শ দেননি। তিনি সে পরামর্শ এবং আশ্বাস পেয়েছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বিশপস কলেজের সাবেক ছাত্র – মাদ্রাসের চার্লস এগব্যর্ট কেনেটের কাছ থেকে। আমরা আগেই দেখেছি, কবি এই কলেজে ভর্তি হবার ঠিক পাঁচ মাস পরে — ১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাসের ৫ — তারিখে তিনি মিডলটন বৃত্তি নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছিলেন। বয়সে দু বছরের ছোটো হলেও, কবির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো।

পিতা যখন টাকাপয়সা দেওয়া বন্ধ করেন এবং বাড়ির পরিবেশ একেবারে অসহ্য বোধ হয়, মাইকেল তখন কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চান। কিন্তু যেখানেই যান না কেন,জীবিকার জন্যে একটা কাজ করার প্রয়োজন ছিলো। কিভাবে তাঁর সমস্যার সমাধান করা যায়, তা নিয়ে তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু চার্লসের সঙ্গে আলোচনা করেন। চার্লস তাঁকে পরামর্শ দেন মাদ্রাসে গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতে। মাদ্রাসের বিশপের সঙ্গে মাইকেল আগের বছরই কথা বলেছিলেন এবং বিশপ তাঁর যোগ্যতা দেখে তাঁকে ধর্মান্তরে সহায়তা করার চাকরি দেবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তিনি সে কাজ তখন গ্রহণ করেননি। কিন্তু মাদ্রাস গেলে তিনি সে কাজ এখন হয়তো পেতে পারেন – এমনটা বিবেচনা করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব। অন্তত কলকাতা ছাড়ার আগে নিতান্ত অসহায় পরিবেশে অধ্যাপক স্ট্রীটের কাছে তিনি ধর্মযাজক হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন – এটা আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি।

সেকালের বিচারে মাদ্রাস পরদেশ বলে বিবেচিত হলেও, কবির কাছে মাদ্রাস অজ্ঞাত জায়গা ছিলো না। তিনি সেখানে গিয়ে বিশপের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তা ছাড়া, চার্লসের মাধ্যমে মাদ্রাস সম্পর্কে তিনি অনেক খবরও পেয়েছিলেন। সুতরাং সেখানে গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করার প্রস্তাব অযৌক্তিক বলে বিবেচনা করেননি। তা ছাড়া, চার্লস তাঁকে রসা দিয়ে থাকবেন যে, বিশপের কাছ থেকে কোনো সাহায্য না-পেলেও তাঁর পিতা তাঁকে প্রথম দিকে কিছু সাহায্য করতে পারবেন। তাঁর পিতা – চার্লস কেনেট ছিলেন মাদ্রাসের ট্রেজারি ম্যানেজার। তার চেয়েও তাঁর বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন সাতাশ বছর ধরে একটি সুপরিচিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি। বস্তুত, বন্ধুর আশ্বাসে ভরসা করেই কবি মাদ্রাসের দিকে যাত্রা করেছিলেন। মিশনারির কাজ না-দিলেও, তাঁর মাদ্রাস যাবার ব্যাপারে কলেজের অধ্যাপকরাও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বলে ধারণা করি।

কলকাতা থেকে হঠাৎ মাদ্রাসের অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা না-করলেও, যাবার আগে তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন ছিলো, গৌরদাস বসাককে লেখা উপরে উদ্ধৃত চিঠি থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। এ চিঠি তিনি লিখেছিলেন মাদ্রাস যাবার তেরো মাস পরে। যাবার আগে তিনি তাঁর অভিপ্রায়ের কথা না-বলায়, যোগাযোগ হবার পর গৌরদাস চিঠিতে অনুযোগ করেছিলেন। তার উত্তরে তিনি লিখেছিলেন তাঁর কলকাতা ত্যাগের খবর তিনি বলতে গেলে কাউকে জানাননি। নয়তো তাঁর প্রতি তাঁর বন্ধুত্বে কোনো ভাঁটা পড়েনি।

মনে হয়, তাঁর পরিকল্পনার ব্যাপারে গৌরদাসকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। পাঁচ বছর আগে — ১৮৪২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যখন বিলেত যাবার ব্যাপারে একেবারে দৃঢ়সংকল্প হয়েছিলেন, তখন তাঁর এই পরিকল্পনার কথা বন্ধুর কাছে প্রকাশ করায় গৌরদাস মা-বাবাকে বলে দেবেন বলে ভয় দেখিয়েছিলেন। গৌরদাস গোপনীয়তা রক্ষা করলেও, এ ব্যাপারে কবি তাঁকে আর পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। খৃষ্টান হওয়ার পরিকল্পনা যেমনতিনি তাঁকে জানাননি, তেমনি জানাননি মাদ্রাসে যাবার পরিকল্পনা।

সেকালে জাহাজে করে সরাসরি কলকাতা থেকে মাদ্রাস যেতে সময় লাগতো চার-পাঁচ দিন। ক্যাবিনে ভাড়া ছিলো কম পক্ষে এক শো টাকা। বেশির ভাগ কম্পেনির জাহাজে একশো ষাট টাকা। একটি কম্পেনি নিতে ২২০ টাকা। যে-মধু চিরকাল লালিত হয়েছেন স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে, অর্থকষ্ট কাকে বলে জানতেন না, হিশেব করে খরচ করতে পারতেন না — তিনি মাদ্রাস যাবার জন্যে এতোটা ব্যয় করতে সমর্থ হলেন না। ধারণা করি, যে-টুকু ব্যয় করতে পারলেন, তার জন্যেও তাঁকে অন্যের কাছে হাত পাততে হয়েছিলো। আর এই রূঢ় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রথম বারের মতো তিনি মিতব্যয়ী হবার চেষ্টা করেন। তবে পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখা যাবে, সে চেষ্টায় তিনি কোনো কালেই আশানুরূপ সাফল্য লাভ করতে পারেননি। মাদ্রাস যাবার আগে, যে-সামান্য টাকাপয়সা তিনি জোটাতে পেরেছিলেন (ধারণা করি, মা-র কাছ থেকে পাননি, কারণ মাদ্রাসে যাবার কথা মাকে বলতে পারেননি।) তা দিয়ে সরাসরি মাদ্রাসগামী জাহাজের টিকিট কেনা যায় না। সে জন্যে তিনি যান কম খরচের লেডি সেইল নামে ৩২৫ টনের ছোট্টো একটি উপকূলীয় জাহাজে করে। জাহাজের কাপ্টেন জে ক্যাস্টর। জাহাজটি গাঞ্জাম, কলিঙ্গপত্তম, বিশাখাপত্তম এবং করিঙ্গ হয়ে মাদ্রাসে যেতে সময় নিয়েছিলো মোট কুড়ি দিন। ২৯ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতা থেকে যাত্রা করে মাইকেল মাদ্রাসে পৌঁছেছিলেন ১৮৪৮ সালের ১৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার। পরের মঙ্গলবার তাঁর বয়স ২৪ বছর পুরো হবার কথা।

পাঁচ বছর আগে তিনি যখন তমলুকে গিয়েছিলেন, তখন সাগরের কাছাকাছি যেতে পারায় উচ্ছসিত হয়েছিলেন। কলকাতা ছেড়ে আসার দারুণ কষ্টের মধ্যে তখন তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা ছিলো — তিনি সাগরের আরো কাছে এসেছেন, যে-সাগরের বুক চিরে অল্পদিন পরে একদিন তিনি পৌছে যাবেন তাঁর স্বপ্নে দেখা ‘ইংল্যান্ডের গৌরবোজ্জ্বল উপকূলে’। কিন্তু তাঁর সেই সযত্নে লালিত স্বপ্ন বাস্তবতার রূঢ় আঘাতে খানখান হয়ে ভেঙ্গে পড়েছিলো কয়েক মাস পরে। অতঃপর খৃস্টান হয়ে আয়োজিত বিবাহের হাত থেকে রেহাই পেলেও বিলেত যাবার পথ তাতে প্রশস্ত হয়নি। ‘সাগর থেকে গেলো দূর অস্ত’। মাদ্রাসের পথে লেডি সেইলে করে কলকাতা ছেড়ে শীতের শান্ত বঙ্গোপসাগরে পড়ে সাগরের অপরূপ রূপ দু চোখ দিয়ে তিনি নিশ্চয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু সাগরের বুকে চড়েও এতোকাল যে-উপকূলে যাবার বাসনা অন্তরের অন্তস্তলে পোষণ করে আসছিলেন, সেখানে যেতে পারলেন না। মহানগরী কলকাতা ছেড়ে বরং যেতে হলো তুলনামূলকভাবে অনেক ছোটো এবং সেকালের ‘কলকাতাই’ ইংরেজদের ভাষায় ‘তমসাচ্ছন্ন’ একটি শহরে। হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক। তা ছাড়া, যেভাবে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে কলকাতা ত্যাগ করতে হয়েছিলো, তাতে সমুদ্রযাত্রার সমস্ত আনন্দের ওপর আন্তরিক দুঃখ এবং ক্ষোভের গাঢ় কালো ছায়া পড়ে থাকবে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তাও মনকে হয়তো দমিয়ে দিয়েছে। তবে আগের কয়েক সপ্তাহ কেটেছে দারুণ মানসিক অশান্তি, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে, এখন কোনো একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যাত্রা করে তিনি খানিকটা স্বস্তি লাভ করে থাকবেন।

জাহাজে মাইকেল নিজে এবং চারজন দেশীয় ভৃত্য আর কয়েকজন সেপাই ছাড়া, সহযাত্রীরা সবাই ছিলেন য়োরোপীয় অথবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন — ডভটন, মি এবং মিসেস প্রেসগ্রেভ, মিসেস ল্যাংলি আর ম্যাকফারলেন। হংসদের মধ্যে বকের মতো, শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের মধ্যে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ তিনি; কিন্তু তাঁর আত্মসম্মান বোধ ছিলো নিতান্ত টনটনে। জাহাজের কম ভাড়ার যাত্রী হয়েও তাঁর অহমিকা তিনি ছাড়তে পারেননি। জাহাজের যাত্রীদের তালিকায় যে-নামগুলো পাচ্ছি, তাঁদের বিশেষ কোনো পরিচয় দেওয়া নেই। নামের সঙ্গে আছে শুধু পদবী — মিষ্টার অথবা মিসেস। একটি নাম কেবল সবার থেকে আলাদা করে লেখা — মি এম এম ডাট অব বিশপস কলেজ। নেটিভ অথবা কোয়ার্টার-ডেকের যাত্রী হলেও তিনি যে ফেলনা নন, অব বিশপস কলেজ কথাটা জুড়ে দিয়ে সেটা জোর গলায় বলতে চেয়েছেন। পরবর্তী কালেও নিতান্ত প্রতিকূল পরিবেশে বারবার এটা তিনি প্রমাণ করতে তৎপর হয়েছেন। ‘গৌরবারোপিত’ অথবা ফাঁপানো পরিচয় দিয়ে বারবার তিনি তাঁর মাহাত্মের কথা বলতে চেয়েছেন — কখনো মাদ্রাস, কখনো লন্ডন, কখনো বা ভার্সাইতে।

ইংল্যান্ডের বদলে তিনি যখন মাত্রাসের ‘অনুজ্জ্বল’ উপকূলে নোঙ্গর প্রলেন, তখন কি তাঁর মনে অনেক উষ্টাশা ছিলো? মনে হয় না। কারণ, তখনো তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন না, সেখানে তিনি কোনো কাজ জোটাতে পারবেন কিনা অথবাকী কাজ জোটাতে পারবেন। কলকাতার পরিচিত পরিজন থেকে দূরে মাদ্রাসে গিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্যে গোড়াতে তাঁকে রীতিমতো সগ্রাম করতে হয়েছে। পরে গৌরদাসকে লেখা চিঠিতে তিনি এই অভিজ্ঞতার কথা ব্যাখ্যা করেছেন: ‘এখানে আসার পর একটা দাঁড়াবার মতো জায়গা পেতে আমার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তোমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, সে কাজটা সোজা ছিলো না — বিশেষ করে একজন বন্ধুহীন আগন্তুকের জন্যে। একটা অপরিচিত জায়গায় কোনো মতে মাথা গোঁজার জায়গা পাওয়াও সহজ নয়। তার ওপর তিনি সেখানে গিয়ে স্থির হয়ে বসতে না-বসতেই তাঁর বসন্ত হয়েছিলো। তখন যে অপরিচিত বিভুঁইয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় তিনি মারা যাননি, তা থেকেও পূর্ব-পরিচিতদের সাহায্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

সেকালের মাদ্রাস ছিলো কলকাতার চেয়ে অনেক ছোটো, প্রায় একটি মফস্বল শহর। এর মোট জনসংখ্যা ছিলো সাড়ে তিন লাখ এবং এঁদের মধ্যে য়োরোপীয় আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের সংখ্যা ছিলো — ১৮৬২ সালের লোকগণনা অনুযায়ী — ষোলো হাজার। তখনো মাদ্রাসে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটেনি — অন্তত কলকাতার সঙ্গে তার তুলনা চলতোনা। মাদ্রাস হাই স্কুলের পরিচালক-মণ্ডলীর সদস্য, শিক্ষক এবং পরবর্তী কালে মাদ্রাসের অ্যাডভোকেট জেনরেল জন ব্রুস নর্টন মাদ্রাসের উন্নতির জন্যে ওকালতি করে লন্ডনে বড়ো কর্তাদের কাছে চিঠির কাঠামোয় একটি বই ছেপে পাঠিয়েছিলেন ১৮৫৪ সালে।১০ তাতে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন যে, যেখানে বঙ্গদেশে চল্লিশটির বেশি ইংরেজি স্কুল- কলেজ রয়েছে, সেখানে মাদ্রাসে আছে মাত্র একটি স্কুল। সত্যি বলতে কি, কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপনের সাড়ে তিন দশক পরে মাত্রাসের প্রথম ইংরেজি শিক্ষার কলেজ স্থাপিত হয়। এই পরিবেশে চোস্ত ইংরেজি-জানা দেশীয় খৃষ্টান হিশেবে মাইকেলের পক্ষে মোটামুটি ভদ্রবেতনের ভালো চাকরি পাওয়া উচিত ছিলো। কোনো একটা স্কুলে অথবা কোনো সরকারী চাকরি। কিন্তু তিনি তা পাননি। পরেও চাকরির ব্যাপারে ভাগ্য তাঁকে সহায়তা করেনি।

তাঁর সম্পর্কে মাদ্রাসের বিশপের ধারণা খুব অনুকূল ছিলো না, তা তিনি জানতেন। তা সত্ত্বেও, মাদ্রাসে গিয়ে অসহায় অবস্থায় তাঁর সহায়তা চাওয়া সম্ভব। তাঁকে সাহায্য করার জন্যে মিডিয়ালট্রির পক্ষেও মাদ্রাসের বিশপকে লেখাও অসম্ভব নয়। আগেই লক্ষ্য করেছি, তাঁর মাদ্রাস যাবার কথা তিনি দু-তিনজনকে বলেছিলেন। এই দু-তিনজনের মধ্যে একজন প্রায় নিশ্চিতভাবে মিডিয়ালট্রি।১১ কিন্তু তা সত্ত্বেও মাদ্রাসের বিশপ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বলে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তিনি সাহায্য পেয়েছিলেন কেনেট পরিবার থেকে। তাঁকে কোনো চাকরি দেওয়া সম্ভব হবে কিনা, এ নিয়ে এগব্যর্ট এবং তাঁর পিতার মধ্যে আগেই আলাপ হয়েছিলো, এ প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়। এগব্যর্ট কেনেটের পিতা চার্লস কেনেট ছিলেন অরফ্যান অ্যাসাইলামের সেক্রেটারি। তাঁরই কল্যাণে মাইকেল এই অ্যাসাইলামেব বয়েজ স্কুলের আশার অর্থাৎ সহকারী শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলেন।

যে-য়োরোপীয়ান অথবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা যথেষ্ট সঞ্চয় না-রেখে অথবা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান রেখে মারা যেতেন, তাঁদের সন্তানদের জন্যে মাদ্রাসে দুটি অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্থাপিত হয় — একটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে আর একটি উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। এর মধ্যে একটা ছিলো সামরিক বিভাগে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের সন্তানদের জন্যে; অন্যটি বেসামরিক ব্যক্তিদের সন্তানদের জন্যে। এই দুটি অ্যাসাইলামের আবার দুটি করে শাখা ছিলো – একটি মেয়েদের জন্যে, একটি ছেলেদের জন্যে। স্বদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে স্বজনহীন দেশে অসহায় সন্তানদের রেখে পিতা মারা গেলে, সেকালে সেসব সন্তান অকূলে ভাসতো। বিশেষ করে মেয়েরা অনেকে শেষ পর্যন্ত দেহ বিক্রি করেই দেহকে বাঁচিয়ে রাখতো। সে জন্যে অ্যাসাইলাম তৈরির প্রস্তাব উঠেছিলো। তবে প্রথমে তৈরি হয়েছিলো মিলিটারি ফিমেইল অ্যাসাইলাম – ১৭৮৭ সালে। এই তৈরি হয় এগমোরে। তার পরে বছর প্রতিষ্ঠিত হয় মিলিটারি মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম। বেসামরিক অ্যাসাইলামও একই ধাবায় তৈরি হয় – আগে মেয়েদের, পরে ছেলেদের। বেসামরিক ফিমেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্থাপিত হয় ১৮১৬ সালে। আর মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম ১৮২৩ সালে। এ ছাড়া, ১৮০৭ সালে বেসামরিক অনাথদের জন্যে একটি ফ্রী লও স্থাপিত হয়েছিলো।১২ যা পরে বেসামরিক মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অ্যাসাইলাম স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন মাইকেল। নিতান্ত সাধারণ চাকরি এবং তার বেতন অথবা সম্মান কোনোটাই ঈর্ষা করার মতো ছিলো না।

তিনি যে-স্কুলে চাকরি পেযেছিলেন তার পুরো পোশাকী নাম হলো: মাদ্রাস মেইল অ্যান্ড ফিমেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম অ্যান্ডি বয়েজ ফ্রী ডে স্কুল। আর যে-চাকরি পেয়েছিলেন, তার বেতন ছিলো সম্ভবত ৪৬ টাকা।১৩ সহকারী শিক্ষক শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সে স্কুলে তখন অনেক শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি যোগ দিয়েছিলেন একজন সহকারী হিশেবে। কিন্তু পরের আলোচনা থেকে দেখা যাবে, সে স্কুলে ১৮৫০ সালের আগে পর্যন্ত বাইবেল, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি পড়ানোর জন্যে একজনের বেশি শিক্ষক ছিলেন না। তিনি কাজে যোগ দেবার সময়ে অথবা তার ঠিক পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই স্কুলের প্রধান এবং একমাত্র শিক্ষক ছিলেন জেসি বে নেইলর। তিনি চলে যাওয়ায় বা চলে যাবার কথা ঠিক হওয়ায় মাইকেল নিযুক্ত হন – তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা না-থাকায় পুরোপুরি শিক্ষক পদে নয়, সহকারী শিক্ষক পদে। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত অ্যাসাইলামের প্রতিটি ছাপানো বার্ষিক রিপোর্ট আমি দেখেছি। তাতে তাঁর নিয়োগের তারিখ অথবা বেতনের কথা কোথাও উল্লিখিত হয়নি। তবে ১৮৪৮-৪৯ সালে তিনি ছাড়া এই বিদ্যালয়ে আর কোনো শিক্ষক ছিলেন না, তা এই রিপোর্ট থেকে পবিষ্কার জানা যায়।

আর-একটি লক্ষ্য করার মতো তথ্য হলো: নামে বয়েজ স্কুল হলেও এই স্কুলে ‘ফিমেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের মেয়েরাও পড়তো। ১৮৪৯ সালে পরিচালকরা মেয়েদের জন্যে একটি আলাদা স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু ১৮৫১ সালের আগে মেয়েদের জন্যে পুরোপুরি আলাদা লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।১৪ মেয়েদের শিক্ষা দেবার জন্যে একজন শিক্ষিকা নিয়োগ করা হয়েছিলো ১৮৫০ সালে।১৫ পরের বছর আরও একজন। তা ছাড়া, ১৮৫১ সালে মাইকেলের সহকারী হিশেবে নিয়োগ করা হয় মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের দুজন পুরোনো ছাত্রকে।১৬ অ্যাসাইলামের এই সম্প্রসারণের কারণ ১৮৪৮ সালে মাদ্রাসে পিটার উলি নামে এক ভদ্রলোক মারা যান এবং তিনি অ্যাসাইলামের জন্যে ১৫,০০০ টাকার একটি স্থায়ী তহবিল রেখে যান!১৭

১৮৪৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত সব সময়ে এই স্কুলে ছাত্র এবং ছাত্রীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০। প্রথমে ছেলেদের চারটি শ্রেণী ছিলো, মেয়েদের তিনটি। স্কুলের সময় ছিলো সকাল আটটা থেকে একটা, আবার দুটো থেকে পাঁচটা। স্কুলের শিক্ষকের সংখ্যা একজন। সে জন্যে এক-একটা শ্রেণীকে এক-এক সময়ে পড়ানো হতো বলে মনে হয়। তবে লেখাপড়ার বাইরে ছেলেদের একটা ওয়ার্কশপে হাতে-কলমে কতোগুলো কাজ শেখানো হতো – টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে জুতো তৈরি পর্যন্ত। স্কুলের পড়ার চেয়ে বেশির ভাগ সময়ে তারা এসব কাজ করতো বলে মনে হয়। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত এসব হাতের তৈরি কাজের বাবদে অ্যাসাইলাম বছরে পাঁচ শশা অথবা তার চেয়ে বেশি করে টাকা পেতো – বার্ষিক রিপোর্টে তা দেখা যায়। মেয়েদের শেখানো হতো সেলাই-এর কাজ। এই দুটি ওয়ার্কশপে কাজ শেখানোর জন্যে কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। স্কুল এবং ওয়ার্কশপ বাবদে অ্যাসাইলামের বার্ষিক ব্যয় ছিলো প্রায় ন হাজার টাকা। অরফ্যান অ্যাসাইলামের গড়পড়তা বাসিন্দা ছিলো মেয়েদের অ্যাসাইলামে ৭৫ থেকে ৮০ জন আর ছেলেদের অ্যাসাইলামে ৭০ থেকে ৭৫ জন। বছরে বছরে কিছু অনাথ অন্যের আশ্রয় পেয়ে চলে যেতো, এদের হিশেবও বার্ষিক রিপোর্টে দেওয়া আছে। আর মেয়েদের অ্যাসাইলামের কোনো কোনো সদস্যের আরও একটা গতি হতো – তাদের বিয়ে হয়ে যেতো – তার খবরও এই রিপোর্টগুলোতে আছে। ১৮৪৭-৪৮ সালে যেমন ফিমেইল অ্যাসাইলামের একজন বর্ডার-সহ মোট ছজন মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ১৮৪৮-৪৯ সালে বিবাহিতার সংখ্যা ছিলো বর্ডার একজন আর অন্য দুজন সদস্য – এই মোট তিনজন। রেবেকা ছিলেন এই তিনজনের একজন।

রেবেকা থাকতেন ফিমেইল অ্যাসাইলামে এবং লেখাপড়া করতেন অরফ্যান অ্যাসাইলামের ছেলেদের স্কুলে। ১৮৪৭-৪৮ শিক্ষাবর্ষে এই স্কুলে মোট ছাত্র এবং ছাত্রীর সংখ্যা ছিলো ৫১ জন। ছেলে এবং মেযেদের হাতে-কলমের কাজে পার্থক্য থাকলেও, তাদের পাঠক্রমের তেমন কোনো পার্থক্য ছিলো না – সঙ্গের তালিকা থেকে তা দেখা যাবে। বাইবেল শিক্ষার প্রতি এই পাঠক্রমে বিশেষ ঝোঁক দেওয়া হতো। তা ছাড়া, প্রথম শ্রেণীতে ইংরেজি সাহিত্য এবংইংল্যান্ডের ইতিহাস; দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ইংরেজি ব্যাকরণ, এশিয়া এবং য়োরোপের ইতিহাস এবং ভূগোল পড়ানো হতো। মাইকেল এখানেই রেবেকাকে পান তাঁর ছাত্রী হিশেবে। জুতো সেলাই তাঁকে শেখাতে না-হলেও, চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সবগুলো বিষয় তাঁকে পড়াতে হতো। পরবর্তী কালে তিনি বারবার খৃস্টান ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং আগ্রহের-অভাবের কথা উল্লেখ করলেও, তিনি এই স্কুলে চার বছর বাইবেল এবং বাইবেলের ইতিহাস পড়িয়েছিলেন। এই কাজে তাঁকে অবশ্য বছরখানেক সাহায্য করেছিলেন ব্ল্যাক টাউনের চ্যাপলেইনমি রবার্ট পসনেট। তিনি চলে যাবার পর জন রিচার্ডস যখন চ্যাপলেইন হন, তখন তিনিও সাহায্য করেন বছরখানেক। বিশপস কলেজে পড়ার সময়ে এবং অরফ্যান অ্যাসাইলামে পড়ানোর সময়ে তিনি খুব ভালো করে বাইবেলের শিক্ষা পেয়েছিলেন। এবং এই শিক্ষা একেবারে বাহ্যিক ছিলো না।

তিনি চাকরি নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে – ফেব্রুআরি মাসে – বয়েজ স্কুলে সে বছরের বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সে পরীক্ষা নিতে আসেন তিনজন ধর্মযাজক – রেভারেন্ড টেইলর, ব্রাদারটন এবং রজার্স। এ ছাড়া আসেন মাদ্রাস স্কুলের শিক্ষক জর্জ জাইলস হোয়াইট।১৮ এ সময়ে জর্জ হোয়াইটের সঙ্গে তরুণ মাইকেলের পরিচয় হয়। এই পরিচয় পরে ধীরে ধীরে পারিবারিক পর্যায়ে ঘনিষ্ঠতা লাভ করেছিলো। এবং তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো। পরীক্ষকরা সবাই তাঁদের রিপোর্টে লিখেছিলেন যে, উপরের শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্রছাত্রী লেখাপড়ায় উঁচু মানের পরিচয় দিয়েছিলো। পরবর্তী বছরগুলোতে মাইকেলের শিক্ষকতায় তাঁর ছাত্রছাত্রীরা যে ভালো লেখাপড়া শিখেছিলো, তার প্রমাণও অ্যাসাইলামের বার্ষিক রিপোর্টে ছড়িয়ে রয়েছে। বিশেষ করে ১৮৫০ সালের পরীক্ষার রিপোর্টেছাত্রছাত্রীদের ভালো ফলাফলের জন্যে তাঁদের শিক্ষক মি ডাট যে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, সে কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর দুজন ছাত্রের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে।

… under the judicious superintendence and instruction of the Master and Mistress, the progress made by pupils in various parts of their education has been satisfactory and they (Directors) confidently trust that the objects contemplated in the nurture and education of these orphans have been realized.

এখানে শিক্ষক এবং শিক্ষিকার নাম উল্লেখ করা না-হলেও, সরকারী গ্যারিসনের চ্যাপলেইন রেভারেন্ড ডাবলিউ বি পাওয়েল স্কুলের শিক্ষক — মি ডাটের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি সবচেয়ে দুটি ভালো ছাত্রের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন:

… the first as right to be expected, evinced powers of thought, and habits of thinking, which reflected very great credit on their master Mr Dutt.১৯

কবি নিজে ভালো ছাত্র ছিলেন এবং লেখাপড়া শিখেছিলেন ভালো শিক্ষকদের কাছে। সে জন্যে, শিক্ষকতা শুরু করার প্রথম দিকে তিনি যদি বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগেও থাকেন, দ্রুত তিনি শিক্ষকতার কৌশল ভালো করে আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর শিক্ষকতা সম্পর্কে কোথাও ভালো-মন্দ কোনো মন্তব্য করেননি। তবু ওপরে পরীক্ষকদের যে-মন্তব্য উদ্ধৃত করেছি, তা থেকে বোঝা যায়, শিক্ষক হিশেবে তিনি অল্প দিনের মধ্যে সাফল্য এবং সুনাম অর্জন করেছিলেন।

৪৬ টাকার চাকরি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সব সমস্যার সমাধান হয়েছিলো অথবা অস্থির হৃদয় শান্ত হয়েছিলো, এমনটা মনে হয় না। একদিন ৮০ টাকা বেতনের ক্যাটেকিস্টের কাজ নেননি। এখন তার অর্ধেক বেতনের শিক্ষকতা নিয়ে তিনি কী করে তৃপ্তি পাবেন? তদুপরি, নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পরিজন থেকে ছিটকে পড়ায় তাঁর মন বারবার মুষড়ে পড়াই স্বাভাবিক। মায়ের করুণ মুখ মনে পড়েছে। বন্ধুদের স্মৃতিও মনকে মোচড় দিযেছে। তদুপরি, জীবন সংগ্রাম কাকে বলে, তা টের পেয়েছেন প্রথম বারের মতো। এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাঁর নিশ্চয় সময় লেগেছে। তবে ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে থাকার ঘর এবং তার কয়েক মাস পরে ঘরনীও জুটেছিলো। পরের বছর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গৌরদাসকে লিখেছেন: “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার পরীক্ষার দিন অনেকটা বিগত। এখন নিজেকে দেখতে শুরু করেছি ভয়ানক ঝড়ে বিধ্বস্ত একটা জাহাজের কাপ্তান হিশেবে – যে- জাহাজ মোটামুটি একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে সবে মাত্র নোঙ্গর ফেলেছে। — তোমার জন্যে একটা উপমা দিলাম!’২০ জন্ম-বোম্যান্টিক মাইকেল বিষযীর চোখে জগৎকে দেখেননি কোনোদিন। যখন ধনী হবার স্বপ্ন দেখেছেন, তখন যোগবিযোগ করে কড়ায়-ক্রান্তিতে মিলছে কিনা, তা খতিয়ে দেখেননি। গৌরদাসকে যখন এ চিঠি লেখেন, তখন তাঁর নিজের আর্থিক এবং সাংসারিক সমস্যা কিছু কম ছিলো না। তখন স্ত্রী তিন মাসের গর্ভবতী এবং আয় যতো, ব্যয় তার চেয়েও বেশি, কারণ তিনি তো কৃচ্ছ্রসাধনা শেখেননি! ও বস্তু ধাতেই ছিলো না তাঁর। এই পরিবেশে তিনি বাস্তব সমস্যা নিয়ে হাহাকার না-করেকল্পনার জগতে বিচরণ করেছেন সাধনা করেছেন কাব্যদেবীর। শিগগিরই সাহিত্যের অঙ্গনে তিনি স্থায়ী খ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হবেন – এই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।

মাদ্রাসে যাবার পর সেখানে চাকরি জোটানো এবং খানিকটা প্রতিষ্ঠা লাভ ছাড়া তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ভালোবেসে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করা। অরফ্যান অ্যাসাইলামের স্কুলে পড়াতে শুরু করার পরেই ভাবী স্ত্রী রেবেকার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিলো। প্রথম যৌবন থেকে তিনি কেবল নীলনয়নার স্বপ্ন আকাশে আকাশে বপন করেছিলেন। এবারে রক্তমাংসের অবয়বে সেই কল্পনার নায়িকাকে প্রত্যক্ষ করলেন। শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করার এই ব্যাপারটি ছিলো একেবারে অবাস্তব। অবাস্তব বলছি এ জন্যে যে, তখনো পর্যন্ত তাঁর শিক্ষক ডিএলআরের মতো কোনো কোনো ইংরেজ কর্মচারী অথবা ব্যবসায়ী দেশীয় নারী বিয়ে করলেও কিংবা তাঁদের রক্ষিতা রাখলেও, কোনো দেশীয় ব্যক্তি কোনো শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করেছিলো, এমন প্রমাণ নেই। (সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করেছিলেন আরও পরে – ১৮৫১ সালে।) এই বিবাহে সে জন্যে বাধা দেবার লোকের অভাব ছিলো না। গৌরদাসকে তিনি লিখেছেন: ‘তাঁকে পেতে আমার দারুণ ঝামেলা হয়েছিলো। তাঁর বন্ধুরা, বুঝতেই পারছো, এই বিয়ের খুব বিরোধী ছিলো। কিন্তু সব ভালো যার শেষ ভালো।’২১ অপরিচিত জায়গায় গিয়ে রোগ ভোগ করা, চাকরি জোটানো, একটি শ্বেতাঙ্গিনীর হৃদয়হরণ করা এবং সব বাধাকে অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিয়ে করতে পারা — এসবই ঘটেছিলো মাত্র ছ মাস তেরো দিনের মধ্যে। বিয়ে হয় ৩১ জুলাই তারিখে (১৮৪৮)।

এই বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন জেসি রে (তাঁর পোশাকী নাম জেসি রে হলেও, তিনি পরিচিত ছিলেন রিচার্ড নামে) নেইলর (১৮২৩-১৮৭২) নামে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক — আগেই যাঁর নাম উল্লেখ করেছি, তাঁর স্ত্রী সুসানাহ্ এইচ নেইলর এবং এডওয়ার্ড প্রাইস।২২ নেইলরের বয়স কবির চেয়ে এক বছর বেশি। ১৮৪৫ সালের ২৯ জুলাই তারিখে নেইলর যখন বিয়ে করেন তখন তিনি ছিলেন অরফ্যান আসাইলামের হেডমাস্টার।২৩ আশার হিশেবে মাইকেল এই স্কুলের কাজ আরম্ভ করার সময়ে নেইলর বিদায় নেন। বছরখানেক পরে তিনি ব্ল্যাক টাউনের লাগোয়া পশ্চিমের পাড়া ভেপারির একটি স্কুলের শিক্ষক হন। (তিনি থাকতেনও ভেপারিতে।) কবি যত দিন মাদ্রাসে ছিলেন ততোদিন এঁর সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব ছিলো। এই বন্ধুত্বের সূত্র ধরে কয়েক বছরের মধ্যে নেইলর মাদ্রাস স্কুলে তাঁর সহকর্মী হিশেবে যোগ দিয়েছিলেন।২৪তাঁর বিয়েতে পুরুত হিশেবে কাজ করেছিলেন ব্ল্যাক টাউনের চ্যাপলেইন রবার্ট পসনেট – অরফ্যান অ্যাসাইলামে বাইবেল পড়ানোর ব্যাপারে যিনি তাঁকে সাহায্য করতেন। তা ছাড়া, তিনি ছিলেন অরফ্যান অ্যাসাইলামের পরিচালকমণ্ডলীর অন্যতম। অ্যাসাইলামকে তিনি বার্ষিক পনেরো টাকা করে চাঁদা দিতেন।২৫ এ বিয়েটা ছিলো অরফ্যান অ্যাসাইলামের প্রায় পারিবারিক ব্যাপার, কেবল বর অথবা কন্যার পরিবার সেখানে উপস্থিত ছিলো না, এই যা!

রেবেকার সঙ্গে তাঁর প্রণয় কিভাবে হয়েছিলো, এখন সাধ্যসাধনা করেও তার খবর জোগাড় করা সম্ভব নয়। মাইকেল কৃষ্ণাঙ্গ। মাদ্রাসে অজ্ঞাতকুলশীল। কপর্দকহীন। তা সত্ত্বেও, রেবেকা যে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন, সে কৃতিত্ব কতোটা রেবেকার, কতোটা কবির, তা বলা সহজ নয়। এ ব্যাপারে প্রথম যৌবনে উপনীত অনাথ এবং আত্মীয় ও সহাযহীন রেবেকার কাঙাল ও নিঃসঙ্গ মন যতোটা দায়ী; প্রতিভাদীপ্ত, উচ্ছসিত, সপ্রতিভ, তরুণ মাইকেলের ব্যক্তিত্বও তার চেয়ে কম দায়ী ছিলো বলে মনে হয় না। বস্তুত, তাঁর বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব দেখেই রেবেকা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়। তাঁর কবিতা এবং রোম্যান্টিক মনের পরিচয়ও তিনি পেয়েছিলেন। মাদ্রাসের পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি যখন একজন উঠতি কবি হিশেবে নাম করেন, রেবেকা তাঁর প্রতি তখন আকৃষ্ট হননি — ততোদিনে তাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে। নিঃসঙ্গ রেবেকা মাইকেলের মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতা এবং আশ্রয়ের ভরসা পেয়েছিলেন, তাঁর কাছে যা অসামান্য বলে মনে হয়েছিলো। সে জন্যে, তিনি তাঁর গায়ের রং এবং আর্থিক দৈন্য দেখে ভয় পাননি। বিশেষ করে, কেনেট এবং মাইকেলের কাছে তিনি যখন জানতে পেরেছেন যে, আপাতত মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের দরিদ্র আশার হলেও তিনি ‘কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট রাজনারায়ণ দত্তের’ একমাত্র পুত্র।

বিয়ের সময়ে চার্চের রেজিস্টারে লেখার জন্যে কবি যখন তাঁর পিতৃপরিচয় দেন, তখন একটু জাহির করেই বলেছিলেন: সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট।২৬ তাঁর চরিত্রের সঙ্গে এটা আদৌ অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। রাজনারায়ণ দত্ত আদৌ অ্যাডভোকেট ছিলেন না। ১৮৪৮ সালে কলকাতায় অ্যাডভোকেটের সংখ্যা ছিলো মাত্র উনিশ। সবাই ইংরেজ। সবাই ব্যারিস্টার। এমন কি, ৫৩ জন অ্যাটর্নিরও সবাই ছিলেন ইংরেজ অথবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। দেশীয়রা ছিলেন প্লীডার – উকিল। কলকাতায় তখন প্লীডারের সংখ্যা ছিলো প্রায় চার শো। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ইংরেজ/অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানও ছিলেন। রাজনারায়ণ ছিলেন এই প্লীডারদেরই একজন। এবং তিনি যে প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রমাপ্রসাদ রায় অথবা গোলাম সবদারের মতো প্রথম সারির উকিল ছিলেন না, আগেই তা উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া, মাইকেল সদর দেওয়ানি আদালতকে সুপ্রিম কোর্ট বলে উল্লেখ করেছিলেন, তাকেও অনেকে অতিরঞ্জন বলতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে যা বলার আছে, তা হলো: তখন সদর দেওয়ানি আদালত এবং সদর নিজামত আদালতকে ইংরেজিতে সুপ্রিম কোর্ট বলা হতো। হাই কোর্টের অভাবে এই দুই আদালতই ছিলো সর্বোচ্চ আদালত। যে-মানসিকতা থেকে মাইকেল লেডি সেইলে করে মাদ্রাসে যাবার সময়ে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘এম এম ডাট অব বিশপস কলেজ’ বলে, সেই একই মানসিকতা থেকে পিতৃপরিচয়কেও তিনি খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, পিতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না-থাকা সত্ত্বেও।

পিতার পরিচয় দেবার ব্যাপারে রেবেকাও তাঁর স্বামীর পথ অনুসরণ করেছিলেন। সত্যি বলতে কি, তিনি পিতৃ-পরিচয় বিকৃত করেছিলেন আরও বেশি। তবে কারণটা ভিন্ন ধরনের। তিনি বিয়ের রেজিস্টারে তাঁর পিতার নাম লিখিয়েছিলেন ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশ, কিন্তু তাঁর পিতার নাম মোটেই ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশ নয়। চার্চের রেজিস্টারে বিয়ের সময়ে রেবেকা টমসন ম্যাকট্যাভিশের বয়স লেখা হয়েছিলো ১৭ বছর। ১৮৪৮ থেকে ১৭ বছর বাদ দিয়ে ১৮৩১ সালের চার্চের রেজিস্টার থেকে রেবেকার পিতামাতার সত্যিকার পরিচয় পাওয়া যায়। ঐ বছর ২১ ডিসেম্বর তারিখে তাঁর ব্যাপটিজমের সময়ে তাঁর পরিচয় লেখা হয় — পিতা রবার্ট টমসন, হর্স আর্টিলারি ব্রিগেডের গানার। আর মা ক্যাথরিন টমসন। মায়ের পরিচয় দিয়ে লেখা হয়েছে ইন্ডো-ব্রিটন। এ থেকে দেখা যাচ্ছে, মধুসূদন “of English parentage” বলে স্ত্রীকে নিয়ে গর্ব করলেও, আসলে তিনি পুরোপুরি য়োরোপীয়ান ছিলেন না। রেবেকার জন্ম নাগপুরে, ১৮৩১ সালে।২৭

স্ত্রীর পরিচয় দিতে গিয়ে মাইকেল গৌরদাসকে লিখেছিলেন, তাঁর শ্বশুর ছিলেন মাদ্রাসের একজন নীলকর। চার্চের রেজিস্টারে যে-পরিচয় আছে, তা সঙ্গে তাঁর এই উক্তির পুরো সঙ্গতি নেই। কারণ বিয়ের রেজিস্টারে ‘ছিলেন’ লেখা হয়নি, বরং রেবেকার পিতার নাম লেখা হয়েছে – ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশ, কড়াপ্লার ইন্ডিগো সুপারিন্টটেন্ডেন্ট – যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, এই ব্যক্তি জীবিত।২৮ তা ছাড়া, নীলকর নন, তিনি নীলব্যবসায়ী আর্ব্যথনট কম্পোনির কর্মচারী মাত্র। তবে রেবেকার তরফ থেকে পিতৃ-পরিচয় পুরো অস্বীকার করার প্রয়াস ছিলো না। বিয়ের রেজিস্টারে নিজের নাম কেবল রেবেকা ম্যাকট্যাভিশ লিখলে, বলা যেতো তিনি পিতার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন করেছেন। কিন্তু তাঁর বদলে তিনি আসল নাম – রেবেকা টমসনের – সঙ্গে ম্যাকট্যাভিশ বংশ-নামটি জুড়ে দিয়েছিলেন। তবে পিতার নাম রবার্ট টমসন না-লিখে, লিখেছিলেন ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশ। এই অসঙ্গতির কারণ কী?

রবার্ট টমসনের পরিচয় যতোটুকু জানতে পেরেছি, তাতে দেখা যাচ্ছে, তিনি ক্যাথরিন ডাইসনকে বিয়ে করেন বাঙ্গালোরে, ১৮২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখে। মাইকেল এবং রেবেকার মতো তাঁদেরও বিয়ে হয়েছিলো ব্যানস দিয়ে।২৯ রেবেকাসহ তাঁদের আরো একাধিক সন্তান জন্মেছিলো। তাদের মধ্যে সারাহ টমসনের জন্ম ১৮৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে।৩০ আর রবার্ট টমসন মারা যান ১৮৪৪ সালের ১২ এপ্রিল তারিখে।৩১ ক্যাথরিন টমসন এবং ছোটো মেয়ে সারাহ অতঃপর কোথায় যান আমি তার হদিস করতে পারিনি। তবে খুব সম্ভব, রবার্ট টমসনের মৃত্যুর পরে তাঁরা ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশের আশ্রয় পান এবং পালক-পিতা ম্যাকট্যাভিশের নামকেই রেবেকা নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেন। (মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিআম ক্লিন্টন এর একটা দৃষ্টান্ত। উইলিআম তাঁর পিতার বংশনাম না-লিখে, নিজের নামের শেষে ব্যবহার করেন তাঁর মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর বংশনাম। পার্থক্য এই যে, রেবেকা নিজের মূল বংশনামও বহাল রেখেছিলেন।) পরে নিজের পরিবারেও রেবেকা ঘনিষ্ঠ এবং উপকারী বন্ধুদের নাম ব্যবহার করার এই ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। তিনি চারটি সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তানের নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন অরফ্যান অ্যাসাইলামের সেক্রেটারি, মি চার্লস কেনেটের নাম, যাঁর কল্যাণে মাইকেল চাকরি এবং আশ্রয় পেয়েছিলেন। তা ছাড়া, কাজের জন্যে তিনি সরাসরি দায়ীও থাকতেন মি কেনেটের কাছে। মি কেনেটের পুত্র চার্লস এগব্যর্ট তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু – সে যোগাযোগও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অরফ্যানঅ্যাসাইলামের ছাত্রী হিশেবে স্বয়ং রেবেকাও সরাসরি মি কেনেটের অভিভাবকত্বে লালিত হয়েছিলেন। বোঝা যায়, তাঁদের বিয়েতে মি কেনেটের আশীর্বাদ ছিলো। দ্বিতীয় মেয়ের নামের সঙ্গে রেবেকা জুড়ে দিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের হিতাকাঙ্খী জে ডাবলিউ সালফেন্টের নাম। আর তৃতীয় সন্তান – বড়ো পুত্রের নামের সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন ম্যাকট্যাভিশ নাম।

মাইকেলের বিয়ের দলিল

ডুগাল্ড ম্যাকট্যাভিশের সঙ্গে রেবেকার মায়ের বিয়ে হয়নি — অন্তত চার্চের রেজিস্টারে এমন বিয়ের কোনো প্রমাণ নেই। যদ্দুর জানতে পেরেছি, ডুগাল্ড ম্যাকট্যাভিশের জন্ম স্কটল্যান্ডে, ১৭৮৩ সালে। তাঁর পিতার নামও ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশ।৩২ তাঁর ছোটো ভাই কলিন সৈন্য বিভাগের সহকারী সার্জন হিশেবে ভারতবর্ষে আসেন এবং বেশির ভাগ সময়ই বোম্বাই অঞ্চলে কাজ করেন। তাঁরা দু ভাই-ই বিয়ে করেন স্কটল্যান্ডে এবং অবসর নেবার পর মারা যান স্বদেশে। এই পরিচয় কলিন বেলায় যতোটা অভ্রান্ত বলে দাবি করতে পারি, ডুগাডের বেলাতে তেমন নয়। কারণ,ইউটার বংশ-পরিচয়ের তথ্যাবলী থেকে ১৭৮০-র দশকে জন্মেছিলেন এমন ২৯জন ডগান্ড ম্যাকটেভিশের নাম জানতে পারছি, যাঁদের পিতাদের নামও ডুগান্ড। অপর পক্ষে, এডিনবরার পাবলিক রেকর্ডস অফিসে কলিনের নামে তথ্য থাকলেও, ডুগান্ডের নামে নেই। তদুপরি, মাদ্রাস এবং বোম্বাই চার্চ-এলাকায় ম্যাকট্যাভিশ নাম দিয়ে সেকালে কোনো জন্ম, মৃত্যু অথবা বিয়ের তথ্য পাওয়া যায় না। এক মাত্র ব্যতিক্রম রেবেকা। এর কারণ তিনি পদবী হিশেবে ব্যবহার করেছিলেন ম্যাকট্যাভিশ নামটি। ধারণা কবি, রবার্ট টমসন মারা যাবার পর, রেবেকা কিছু কাল ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশের আশ্রয়েছিলেন। কিন্তু তারপর তাঁকে থাকতে হয় অরফ্যান অ্যাসাইলামে। ম্যাকট্যাভিশের মেয়ে হলে তাঁর অরফ্যান অ্যাসাইলামে থাকার প্রশ্ন উঠতো না, কারণ এই অ্যাসাইলামে থাকতো কেবল যারা অনাথ। রেবেকা যে অনাথ ছিলেন, তার আর-একটা প্রমাণ বিয়ের সময়ে রেবেকার পিতা অথবা অন্য কোনো আত্মীয় উপস্থিত ছিলেন না। কবির চিঠি থেকে এর আভাস পাওয়া যায়। তাঁদের বিয়েতে কেউ কেউ প্রবল বাধা দিয়েছিলো – এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন বন্ধু এবং অন্যদের কথা, কিন্তু আত্মীয়দের কথা বলেননি।৩৩ প্রবল বাধা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের যে বিয়ে হলো, তার কারণ রেবেকার বক্তব্য এ ব্যাপারে ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

রেবেকার সঙ্গে পরিচয়ের পর, তাঁর সঙ্গে প্রেমে পড়তে রোম্যান্টিক মাইকেলের দেরি হয়নি। প্রথম যৌবন থেকে তিনি ভালোবাসার ধ্যান করেছেন — নীলনয়নাকে ভালোবাসার। তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে একজন রক্তমাংসের শ্বেতাঙ্গিনীকে পেয়ে তরুণ কবির কবিত্ব এবং প্রেম উভয়ই দ্রুত উথলে উঠেছিলো। তা ছাড়া, তিনি তখন বসবাস করছিলেন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিত পরিবেশ থেকে অনেক দূরে প্রায় অসহায় অবস্থায়। এ ছিলো সহানুভূতিশীল এক জোড়া মুগ্ধ চোখের মায়ায় দেউলে হয়ে যাবার একেবারে আদর্শ পটভূমি। রেবেকাকে তিনি যে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন, তাঁর কবিতা থেকে তার বেশ আভাস পাওয়া যায়। রোম্যান্টিক কবি প্রথম প্রেম এবং সেই প্রেমের পাত্রী নতুন বৌকে নিয়ে নেশায় যখন মেতে আছেন, তেমন সময়ে – অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে Madras Circulator পত্রিকায় পরপর তাঁর চারটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলো প্রেমের। এই চারটি কবিতা তিনি প্রকাশ করেন একটি ছদ্মনামে — Timothy Penpoem।৩৪ এতো নাম থাকতে তিনি টিমথি নামটি কেন পছন্দ করে নিলেন, বোঝা যায় না। এই কবিতাগুলো প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি হিশেবে Madras Circulator-এর কাছে তিনি বেশ প্রতিষ্ঠিত হন। তা ছাড়া, তাঁর আত্মবিশ্বাসও পোক্ত হয়। সদ্যবিবাহিত এবং প্রেমের পরিপূর্ণতার আবেগে তিনি এ সময়ে বিহ্বল। বিয়ের মোটামুটি সাড়ে তিন মাস পরে রেবেকা গর্ভবতী হন। সে খবরও তাঁকে উচ্ছসিত করে থাকবে। এই পরিবেশে তিনি বাস্তব জীবনের সকল রূঢ়তা অগ্রাহ্য করে প্রাণের আনন্দে কাব্য রচনা করতে আরম্ভ করেছিলেন।

অবশ্য কবিতায় সাংসারিক অভাবকে গ্রাহ্য না-করা, আর গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করা এক নয়। বস্তুত, নিজেই লিখেছেন, সমস্যা কিছু কম ছিলো না। মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামে চাকরি করে বেতন পেতেন পঞ্চাশ টাকারও কম – তাই দিয়ে শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করা কি সহজ ব্যাপার? যদিও রেবেকার দাবি খুব বেশি ছিলো বলে মনে হয় না। তিনি নিজে ছিলেন গরিব একজন গোলন্দাজ সৈন্যের মেয়ে, কোনো দিন স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে মানুষ হয়েছেন, তার কোনো প্রমাণ নেই। তদুপরি বিয়ের চার বছর আগে, মাত্র সাড়ে বারো বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর, জায়গা হয়েছিলো অনাথ আশ্রমে। এ থেকেই তাঁর পটভূমি সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। এমতাবস্থায় রেবেকার প্রত্যাশা খুব উঁচু হবে কী করে? তা ছাড়া, মাইকেলের যে কোনো চাল-চুলো নেই, তা জেনেশুনেই তাঁকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। কবির দারিদ্র্যের সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন বলেই মনে হয়। তবু বিয়ের পর সংসারের চাপে কবির অর্থকষ্ট বেড়েছিলো। এ সময়ে ব্ল্যাক টাউন ছেড়ে তিনি বাস করেছিলেন ব্ল্যাক টাউনের লাগোয়া উত্তর দিকে সাগরের ধারে রায়পুরমের একটি বাড়িতে।৩৫ তার ভাড়াও বেশি। এ কারণে বাড়তি আয় করার জন্যে ১৮৪৮ সালের শেষ দিক থেকে তিনি পত্রপত্রিকায় লিখছিলেন অথবা অন্য কোনো কাজ করছিলেন বলে অনুমান করি।

এই পরিবেশে কাব্য চর্চা করা সহজ নয়। তবু এরই মধ্যে তিনি Captive Ladie নামে একটি কাব্য লিখে ফেলেন Madras Circulator পত্রিকার জন্যে। নভেম্বর মাসের গোড়ায় তিনি এটি লিখতে আরম্ভ করেন। আর শেষ করেন এ মাসেরই ২৫ তারিখ নাগাদ। এ কাব্যের পুরো নাম The Captive Ladie (An Indian Tale) in two Cantos। এ ছাড়া, এ কাব্যের শেষে তিনি জুড়ে দিয়েছেন Visions of the Past – A Fragment। The Captive Ladie-র ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, এটা লেখা হয়েছে জীবনের নগ্ন বাস্তবতার মধ্যে –অভাব আর অনটনের সঙ্গে লড়াই করে। মাদ্রাসে পা দেবার এক বছর এক মাস পরে ১৮৪৯ সালের ১৪ ফেব্রুআরি গৌরদাসকে লেখা তাঁর প্রথম চিঠিতেও এই প্রতিকূল অবস্থার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, শত অসুবিধে সত্ত্বেও ছাপানোর জন্যে একটি কাব্য রচনার কাজ শেষ করেছেন। গ্রন্থকার হবার জন্যে এ হলো তাঁর প্রথম রীতিমতো প্রয়াস। এ কাব্যের সূচনায় আছে রেবেকা-বন্দনা। আর এ কাব্য যখন Madras Circulator-এর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় তখন এর ললাটে ছিলো বন্ধু রিচার্ড নেইলরের নাম – অংশত যাঁর আনুকূল্যে রেবেকার গলায় তিনি মালা পরাতে পেরেছিলেন।

এই কাব্যের বন্দনা অংশে রেবেকার প্রতি তিনি যে-গভীর প্রেম এবং নির্ভরতা দেখিয়েছেন, তা থেকে তাঁর প্রতি কবির ভালোবাসার স্বরূপ এবং গভীরতা অনুভব করা যায়। The Captive Ladie-র সূচনায় তিনি লিখেছেন:

রবিকরোজ্জ্বল স্বপ্ন বুনবো আমি, তোমার নয়ন জোগাবে আমায় প্রেরণা;

কেবল তোমায় পাবো আমার মালা, প্রেমের মালা; সৌন্দর্যের সিংহাসনে আসীন আমার রানী।

মধুর এমন ওই নয়নে নয়ন রাখা, যে-নয়নে ভিড় করেছে নরম প্রেমের আলোকমালা।

কবির সমস্ত নিঃসঙ্গতাকে ভুলিয়ে দিয়ে প্রিয়া তাঁর জীবনপাত্রকে কানায় কানায় ভরে দিয়েছেন তাঁর সঙ্গ দিয়ে। আজ আর কোনো দুঃখ নেই।

The heart which once has sigh’d in solitude,

And yeam’d t’ unlock the fount where softly lie

Its gentlest feelings, – well may shun the mood

Of grief – so cold – when thou, dear one! art nigh,

To sun it with thy smile, Love’s lustrous radiancy?

কেবল সৌন্দর্য এবং প্রেম নয়, কবি তাঁর প্রেমিকার চোখে দেখতে পেয়েছেন অগাধ আশ্বাস আর পরিপূর্ণতার ইশারা।

…. like that star which, on the wildemess

Of vasty ocean, woos the anxious eye

Of lonely mariner, and woos to bless

For there be Hope writ on her brow on high,

He recks not darkling waves, – fears the lightless sky!

কবির চোখে তাঁর প্রিয়া মূর্তিমতী প্রেরণা। এমন আঁখিতে আঁখি রেখে সকল অভাব আর সন্তাপকে অস্বীকার করা কঠিন নয় মোটেই:

Tho’ ours the home of want, – I ne’er repine,

Art thou not there –

তারপর চূড়ান্ত ঘোষণায় বলেছেন: ‘তুমি আমার মধুর স্বপন, তুমি আ-মা-র! পরিপূর্ণ সুখের বাস্তবতায়! ঝরে যাওয়া আমার বসন্তের স্মৃতি এখনো তিক্ত, তবু দুঃখ নেই কোনো!’

এক কথায় এ কাব্যের পরিচয় দিয়ে কবি গৌরদাসকে লিখেছেন, ‘এতে আছে দুটি সর্গের একটি কাহিনী – আধা-ঐতিহাসিক কাহিনী। ভালো-মন্দতে মেশানো মোট প্রায় বারো শশা পঙুক্তি। এ ছাড়া আছে ছোটো একটা কি দুটো কবিতা। দিব্যি দিয়ে বলেছেন, ‘লিখতে সময় লেগেছে তিন সপ্তাহেরও কম।’ অসম্ভব নয়, কারো সঙ্গে বাজি রেখে – কোনো কথার প্যাঁচে পড়ে এ কাব্য তিনি রচনা করেছিলেন। অন্যের সঙ্গে বাজি ধরে অথবা জেদ করে ঝড়ের গতিতে লেখার তাঁর এই প্রবণতা পরেও দেখা যাবে। এ কাব্যের জন্যে তিনি যে-কাহিনী বেছে নিয়েছিলেন, তার কথা তিনি বন্ধুকে লেখেননি। কিন্তু লিখেছিলেন এ কাব্যের ভূমিকায়:

এ কহিনীটি রচিত হয়েছে এমন একটি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে, যা ভাবতবর্ষে বেশ জানা, এবং, আমার ভুল না-হয়ে থাকলে, কোনো কোনো যোরোপীয় লেখকও এটা লক্ষ্য করেছেন। … গজনির মাহমুদ ভারত আক্রমণ করার অল্প আগে কনৌজের রাজা রাজসূয় যজ্ঞ পালন করেন। আমি একে অনুবাদ করেছি ‘বিজয় উৎসব’ হিশেবে। সমকালীন প্রায় সব রাজাই কনৌজ-বাজের শক্তিকে অস্বীকার করতে না-পেরে এই যজ্ঞে যোগদান করেন। ব্যতিক্রম ছিলেন দিল্লির রাজা। তিনি নিজেকে বিবেচনা করতেন ব্যাসের মহাভারতে বর্ণিত পাণ্ডব রাজাদের বংশধর বলে। তিনি এই উৎসবে যোগদান করলে কনৌজের রাজাকেই সমগ্র দেশের সবচেয়ে বড়ো রাজা হিশেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। কিন্তু দিল্লিবাজ তাঁর বংশকে মনে করতেন রাজাধিরাজ হবার উপযুক্ত। সুতরাং তিনি কনৌজের রাজার রাজসূয় যজ্ঞে যাননি। কনৌজরাজ এতে দারুন ক্রুদ্ধ হয়ে দিল্লিরাজের একটি সোনার মূর্তি তৈরি করে সেটি যজ্ঞস্থানে রাখেন। এই উৎসবের শেষ দিন দিল্লিরাজ তাঁর কিছু নির্বাচিত অনুসারী নিয়ে ছদ্মবেশে কনৌজরাজের প্রাসাদে ঢুকে এই সোনার প্রতিমা এবং সেই সঙ্গে রজকুমারীকে হরণ করেন। এই রাজকুমারীকে তিনি আগেই বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু কনৌজরাজ নিজের বংশকে রাজাধিরাজ হবার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করায় দিল্লিরাজের কাছে তাঁর কন্যা সম্প্রদান করতে চাননি। পরে কনৌজরাজ অবশ্য তাঁর কন্যাকে উদ্ধার করে বন্দী করে রাখেন একটা নির্জন দুর্গে। ওদিকে, দিল্লিরাজ খবর পেয়ে রাজকুমারীকে এক ভাটের ছদ্মবেশে সেই দুর্গ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। কনৌজরাজ এই অপমানের কথা কখনো ভুলে যাননি। সে জন্যে গজনির মাহমুদ যখন দিল্লি আক্রমণ করেন, তখন কনৌজরাজ তাঁর জামাতাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেন। তবে মাহমুদ অল্পদিনের মধ্যে স্বয়ং কনৌজরাজকেও গুড়িয়ে ফেলেন। আমি অবশ্য রাজসূয় যজ্ঞে আগেই রাজকুমারীকে নির্জন দুর্গে বন্দী করে গল্পের খানিকটা পরিবর্তন করেছি।

যে-কাহিনী তিনি নির্বাচন করেছিলেন, তা পুরোপুরি ঐতিহাসিক ছিলো না। কনৌজের রাজকুমারীকে অপহরণ করে দিল্লির রাজা তাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তারপর কনৌজের রাজা আবার তাঁর কন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে বন্দী করে রেখেছিলেন নিজের প্রাসাদে। সেই নারীই The Captive Ladie-র, নায়িকা। কাহিনী লেখার সময়ে কবি তার ঐতিহাসিকতা প্রমাণের জন্যে মোটেই ব্যাকুল হননি; এর মধ্যে যুদ্ধের ভেরীও তিনি বাজাননি। তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এই কাহিনীর মানবিক প্রেমের দিকটিকে। এতো কাহিনী থাকতে তিনি বিশেষ করে এই কাহিনী নির্বাচন করলেন কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তবে কলকাতার ধনী এবং নাম-করা উকিল রাজনারায়ণ দত্তের নামকরা পুত্র বিয়ে করতে চাইছে অরফ্যান অ্যাসাইলামের একটি অনাথ তরুণীকে, কিন্তু তাঁকে প্রবলভাবে বাধা দিচ্ছে তাঁর অনভিজাত ফিরিঙ্গি বন্ধুরা – এমন একটা ধারণা এর পেছনে কাজ করেছিলো কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।

যে-পরিবেশে তিনি কাব্যটি লিখেছিলেন, ভূমিকা থেকে দেখা যায়, কাব্য রচনার জন্যে তা তেমন অনুকূল ছিলো না। তা ছাড়া, কাব্যটি তিনি রচনাও করেছিলেন খুব কম সময়ের মধ্যে। এই তাড়াহুড়োর ছাপ তাঁর লেখায় পড়েছিলো এবং তিনি নিজেও এ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কৈফিয়ত দিয়ে তাই লিখেছেন:

আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এ কাব্যে অনেক খুঁত দেখা দিয়েছে, এবং তার জন্যে পাঠকদের কাছে আমার মাফ চাইবার অনেক কারণ আছে। গোড়াতে এই কাব্য খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে রচিত হয় স্থানীয় একটি পত্রিকা – Madras Circulator and General Chronicle-এর জন্যে। জীবনের যে-নগ্ন বাস্তবতার মধ্যে এই কাব্য লেখা হয়েছে, তা থেকে মনকে সরিয়ে নিয়ে কাব্য সাধনা করার জন্যে অসাধারণ প্রয়াস দরকার। অভাব এবং অনটন তাদের সঙ্গে দূঃখদুর্দশার যে-বাহিনী নিয়ে আসে, তা তাদের শিকারকে সামান্যই প্রেরণা দিতে পারে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও, পত্রিকার সম্পাদক তাঁর রচনার মান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কবি নিজের উচ্ছাস চাপা রাখতে পারেননি।

এই পত্রিকার সম্পাদক গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা সম্পাদকদের অন্যতম। তিনি সারাক্ষণই আমার ঢাক পেটাচ্ছেন। চমৎকার লোক! এ কাব্যটা এখানে খুব মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। যাঁদের বিচারবুদ্ধি এবং যোগ্যতা খুব উন্নত মানের এমন অনেকে আমাকে এই কাব্যটিকে বই আকারে প্রকাশ করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছেন। সে জন্যে ছাপাখানার ভূত আমাকে ইতিমধ্যে পেয়ে বসেছে।

তাঁর লেখার ধরন থেকে অবশ্য মনে হয় না, এই ভূত তাঁর ওপর ভর করায় তিনি একটুও অখুশি। বরং মনে হয়, এ কাব্য প্রকাশ করছেন তিনি দারুণ উৎসাহ নিয়ে এবং এরই মধ্যে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে আশা করতে আরম্ভ করেছেন যে, এ কাব্য তাঁকে দেবে তাঁর আকৈশোর-কাতি কবিযশ। তাঁর মতে, এ পথে দুস্তর কোনো বাধা নেই, আছে কেবল একটা ছোটোখাটো পার্থিব বাধা – ছাপার খরচ। আর, পরে নিজেই জানিয়েছেন, মাদ্রাসে ছাপার খরচ বড়ো বেশি।৩৬ (১৮৪৮-৪৯ সালের অরফ্যান অ্যাসাইলামের ২৪ পৃষ্ঠার বার্ষিক রিপোর্ট ছাপাতে খরচ হয়েছিলো ৩৫ টাকা ৪ আনা। The Captive Ladie-র পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিলো মোট ১১ + ৮০। সুতরাং ছাপাতে দেড় শো / দুশো টাকা খরচ হওয়া অসম্ভব নয়। এর মধ্যে প্রথম সর্গ শেষ হয়েছে ২৮ পৃষ্ঠায়, দ্বিতীয় সর্গ ৫৪ পৃষ্ঠায়। তার পরে একটি সনেট এবং দীর্ঘ কবিতা (Visions of the Past)। আর-এক চিঠিতে লিখেছেন, তাঁর পক্ষে বড়ো কবি হওয়া শক্ত নয় মোটেই — কেবল কেউ যদি মাসে মাসে কয়েক শো করে টাকা ব্যয় করতে রাজি থাকতো!৩৭

গৌরদাসের কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন, এই কাব্যের জন্যে তিনি কিছু গ্রাহক জুটিয়ে দিতে পারবেন কিনা। আমি জানি, তুমি চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই পারবে। প্রতি কপির দাম মাত্র দু টাকা। এমন কি আমাদের স্কুলের পুরোনো বন্ধুদের মধ্য থেকে তুমি নিশ্চয় কমপক্ষে ৪০ জন গ্রাহক জুটিয়ে দিতে পারবে। আমি এখানে খুব কম লোককে জানি। সে জন্যে আমি এ কাব্য বিক্রি থেকে ছাপার খরচ চুকিয়ে দিতে পারবো বলে মনে হয়না। …তোমাকে আমি হলপ করে বলতে পারি, আমি কোনো আর্থিক লাভে আশায় এ বই ছাপাচ্ছিনে। কেবল লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেলেই হলো।’ তিনি আশা করেছেন, মার্চ মাসের গোড়াতে এ বই বেরিয়ে যাবে। এবং মার্চের মাঝামাঝি বিশপস কলেজের একজন ছাত্র (মাদ্রাস চার্চ এলাকার তিনজন ছাত্র পড়তেন বিশপস কলেজে) তাঁর পরিবারকে দেখে কলকাতায় ফিরে যাবেন। তাঁর হাত দিয়ে যতো খুশি কপি নিখরচায় পাঠানোর সুবর্ণ সুযোগও রয়েছে। সুতরাং গ্রাহক জুটিয়ে গৌরদাস কেবল যেন জানান, তাঁর কতো কপি দরকার। পুরোনো বন্ধুরা-বন্ধু,ভূদেব, হরি, শ্যাম এবং স্বরূপও কি কিছু গ্রাহক জোটাতে পারবেন না?৩৮ গ্রাহক সগ্রহের অনুরোধ জানিয়ে তিনি হিন্দু কলেজের সাহিত্যের সহকারী অধ্যাপকমি মন্টেগু এবং বিশপস কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবার্ট ওয়াকারকেও চিঠি লেখেন।

কবি যদি কেবল এই বই-এর গ্রাহক জোগাড় করার অনুরোধ করে গৌরদাসের সঙ্গে চিঠিপত্র লেখার সম্পর্ক ঝালাই করতেন, তা হলে তাঁকে স্বার্থপর বলা যেতো। কিন্তু তিনি সে ধরনের লোক ছিলেন না। আসলে, তিনি লেখার আগেই গৌরদাস তাঁর খবর এবং ঠিকানা জোগাড় করে বছরের গোড়ার দিকেই চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর বিয়ের কথাও জানতে পেরেছিলেন গৌরদাস। তিনি কোথায় তাঁর ঠিকানা এবং খবর পেয়েছিলেন, তার কথা জানা যায় না। রাজনারায়ণ দত্ত যতোই রাগ করুন না কেন, পুত্র কাউকে কিছু না-বলে উধাও হবার পরে এক সময়ে নিশ্চয় তাঁর খবর নিতে চেষ্টা করেছেন। বিশপস কলেজ থেকে তাঁর খবর জোগাড় করাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া, মাদ্রাসে যাবার কিছু কালের মধ্যে কবি নিজেই হয়তো তাঁর মাকে জানিয়ে থাকবেন যে, তিনি সেখানে আছেন। তবে তাঁর বিয়ে অথবা জীবন-সগ্রামের কথা অভিমানবশত জানিয়েছিলেন কিনা, কে জানে? কিন্তু গৌরদাস তাঁর বিয়ের খবর পাওয়ার পরে তাঁর বাবামাও সে খবর তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয় জেনেছিলেন।

সে যাই হোক, কবি যেমনটা আশা করেছিলেন, Captive Ladie তেমন সময়ে অর্থাৎ মার্চের গোড়ার দিকে বের হয়নি। তাঁর চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯ মার্চও বই ছাপাখানা থেকে মুক্তি পায়নি।৩৯ বোধ হয় এপ্রিলের প্রথম দিকে এ বই সূর্যের আলো দেখেছিলো। ইতিমধ্যে বিশপস কলেজের ছাত্রটি কলকাতায় , ফিরে গেছেন। সে জন্যে খরচ করে বই পাঠাতে হয়েছে লেডি সেইল। জাহাজে করে – এক বছর চার মাস আগে যে-জাহাজে করে কাব্যের রচয়িতা নিজে কলকাতা থেকে মাদ্ৰাসে এসেছিলেন। এই জাহাজ মাদ্রাস ছেড়ে কলকাতা যাত্রা করে ২২ এপ্রিল। এক-এক জনের কাছে আলাদা করে বই পাঠালে খরচ বেশি পড়বে, তাই সব বই-ই পাঠান বিশপস কলেজে রবার্ট ও্যকারের কাছে।৪০

ক্যাপটিভ লেডির নামপত্র, নিচে মাইকেলের হাতের লেখায় “অব বিশপস কলেজ, ক্যালকাটা”

কবির বন্ধুরা গ্রাহক সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁকে সত্যি সত্যি দ্রুত সাহায্য দিয়েছিলেন। গৌরদাস ফেব্রুআরি মাসের শেষ দিকে চিঠি পেয়ে সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে ১৮জন গ্রাহক জোটান। আর বিশপস কলেজের বন্ধুরা জোটান ২৫জন।৪১ ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বন্ধুবিহারী দত্ত এবং স্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ সময়ে তাঁর কাছে চিঠি লেখেন। অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, তাঁরাও দু-চারজন গ্রাহক জুটিয়ে দিয়েছিলেন। গৌরদাস লিখেছিলেন যে,গ্রাহক সংগ্রহের কাজে সহায়তা হতো মধু যদি এ কাব্য সম্পর্কে একটা ছাপানো প্রোসপেক্টাস পাঠাতেন।৪২ কিন্তু প্রোসপেক্টাস ছাড়াই তিনি ৫০ কপি বই নিয়েছিলেন। অবশ্য সব কপি বিক্রির জন্যে নয়। কবির নির্দেশে কয়েক কপি পাঠাতে হয়েছিলো পত্রিকায় সমালোচনার জন্যে এবং কয়েক কপি কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে উপহার দেবার জন্যে। উপহারপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষা পরিষদের সভাপতি জে ই ডি বেথুন, দিগম্বর মিত্র আর রামচন্দ্র মিত্র। পুরোনো শিক্ষক রামতনু লাহিড়ীকে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। হিন্দু কলেজের বদলে তিনি তখন কৃষ্ণনগরে শিক্ষকতা করছিলেন। তাঁকেও কৃষ্ণনগরের ঠিকানায় তিনি এক কপি বই পাঠাতে অনুরোধ জানান। তবে কপি ফুরিয়ে যাবার দরুন প্রথম কিস্তির মধ্য থেকে তাঁকে বই দেওয়া সম্ভব হয়নি। বেথুনকে কী লিখে বই পাঠাতে হবে, তার বয়ানের সঙ্গে লিখেছেন: রামতনুর আপাতত অপেক্ষাকরতে হবে।৪৩ কলকাতায় আর-একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তিনি কেন বই পাঠাতে বলেননি, বোঝা যায় না — তাঁর প্রিয় শিক্ষক ডিএলআর। তিনি এর মাস ছয়েক আগে — ১৮৪৮ সালের অক্টোবর মাসে হুগলি কলেজ থেকে জেমস ক্যরের জায়গায় এক বছরের জন্যে প্রিন্সিপাল হয়ে হিন্দু কলেজে আসেন। অবশ্য হিন্দু কলেজের মি মন্টের মাধ্যমে৪৪ রিচার্ডসনকে পাঠানো সম্ভব। রিচার্ডসন আখ্যানমূলক কবিতার ভক্ত ছিলেন না। তিনি কোনো অনুকূল মন্তব্য করে থাকলে — কবির চরিত্র যেটুকু আমরা বুঝতে পারি, তাতে মনে হয় — তিনি সেটা ফলাও করে বলতেন।

ক্যাপটিভ লেডির প্রথম পৃষ্ঠা

ওদিকে, The Captive Ladie প্রকাশিত হবার পরই সে বই-এর মুদ্রক তাঁর টাকার জন্যে ব্যস্ত হয়ে কবিকে তাড়া দিতে আরম্ভ করেন। কিছু টাকা তাঁকে দেওয়াও হয়, কিন্তু তাতে তাগাদা বন্ধ হয়নি। তিনি তাই গৌরদাসকে অন্তত দুবার (৫ জুন আর ৬ জুলাই) বই বিক্রির টাকা যদ্দুর সম্ভব তাড়াতাড়ি পাঠানোর অনুরোধ জানান। দু বারই তিনি মুদ্রকের অসহিষ্ণুতার কথা মনে করিয়ে দেন। অবশ্য রসিক মধুর ঠাট্টার স্বর তখনো চাপা পড়েনি। লিখেছেন: ‘শ্যাম(াচরণ ল)কে বোলো (কলকাতার) ব্যাগ্‌শ অ্যান্ড কম্পেনির তরফ থেকে একটা হুন্ডি এই শহরের বেইনব্রিজ অ্যান্ড কম্পেনির নামে পাঠাতে, যাতে বলা থাকবে সুউচ্চ এবং শক্তিমান মাইকেল ডাট স্কোয়ার অ্যান্ড কম্পেনি অথবা তাঁর বাহককে নজরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ঐ পরিমাণ টাকা দিয়ে দেওয়া হয়।’৪৫ বেইনব্রিজ কম্পেনির ছিলো বিরাট ব্যবসা, ব্ল্যাক টাউনে — একেবারে সাগরের ধারে। তাদের অফিস ছিলো ১৬ নম্বর বীচ ফ্যষ্ট লেইনে — কবির রায়পুরমের বাড়ির কাছে। টাকা পাঠানোর তাগিদ দিয়ে বিশপস কলেজ এবং হিন্দু কলেজেও কবি এ সময়ে অনুরূপ চিঠি লিখেছিলেন — সেটা অনুমান করা শক্ত নয়।

এ কাব্য তিনি ছাপিয়েছিলেন Madras Advertiser প্রেসে। তখন এই প্রেস ছিলো ১৪২ নম্বর মাউন্ট রোডে এবং পত্রিকার মালিক ছিলেন অ্যাবেল পেন সিমকিন্স।৪৬ The Captive Ladie ছাপানোর টাকা দেবার জন্যে তিনি কবিকে বেশ চাপ দিলেও, পরে দেখা যাবে কবিব সঙ্গে তাঁর বেশ ঘনিষ্ঠ এবং সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। (প্রসঙ্গত আরও একটা কথা বলে রাখি, স্বামী মারা যাবার পর অ্যাবেল সিমকিন্সের মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন পেন্ত্রক ত্রুপলিকে। এই ঘরের প্রথম সন্তানের নাম অ্যামেলিয়া সোফিয়া। এঁকেই আমি প্রথমে অ্যামেলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া বলে ধারণা করেছিলাম।৪৭ গোড়াতে এই প্রেসের মালিকও ছিলেন অ্যামেলিয়ার পিতা। সেই থেকেই আমার এ ভুল হয়েছিলো।)

The Captive Ladie প্রকাশের সময়ে প্রেসের পাওনা, গ্রাহক জোটানো ইত্যাদি বৈষযিক কথাবার্তা মাঝেমধ্যে বলতে হয়েছে বৈকি! কিন্তু ধনী হবার সাধ থাকলেও মাইকেল বিষয়ী ছিলেন না। তাঁর আসল লক্ষ্য ছিলো কবিযশ লাভ। এ ব্যাপারে মাদ্রাস নিয়ে তাঁর কোনো দুর্ভাবনা ছিলো না — পত্রিকায় বের হবার সময়ে তিনি এ রচনা সম্পর্কে সুধীমহেলের অনুকূল প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছিলেন। তদুপরি তিনি যাঁর নামে এ কাব্য উৎসর্গ করেছিলেন, সেই অ্যাডভোকেট-জেনরেল জর্জ নর্টন যখন কবিকে বললেন: এমন অসাধারণ ক্ষমতা এবং প্রতিশ্রুতি যে-কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে, তেমন একটি কাব্য তাঁর নামে উৎসর্গ হতে দেখে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন, তখন এ কাব্যের উঁচু মান সম্পর্কে তাঁর মনে আর কোনো সংশয় থাকলো না। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, মাদ্রাস তিনি অনায়াসে জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মতে, তিনি প্রথম যখন মাদ্রাসে এসেছিলেন তখন তাঁর পক্ষে সেখানে কলকে পাওয়া শক্ত ছিলো। কিন্তু এ কাব্য প্রকাশের পর, ‘এখন আমার জুতো পরে দাঁড়াতে পারলে বর্তে যাবে এখানকার অনেক বদমাশ।’৪৮ বারবার তিনি উল্লেখ করেছেন, The Captive Ladie মাদ্রাসে খুব অনুকূল সাড়া জাগিয়েছে। নিজের এবং এই কাব্য সম্পর্কে তাঁর এই মূল্যায়ন খানিকটা রঙিন ছিলো, কিন্তু একেবারে কবিকল্পনা ছিলো না। বস্তুত, তেমন বিক্রি না-হলেও এবং তাঁকে সামান্য ঋণজালে জড়িয়ে ফেললেও, এই কাব্য মাদ্রাসের সুধীমহলে তাঁর আসন মজবুত করেছিলো। Athenæum পত্রিকায় প্রকাশিত এক চিঠিতে Lælius ছদ্মনামে এক ভদ্রলোক এই কাব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।৪৯ তিনি বিশেষ করে এই কাব্যের সূচনা অংশের খুব প্রশংসা করেন। এ চিঠির শুরুতে নতুন প্রকাশিত এই কাব্যের দিকে পত্রিকা সম্পাদকের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে:

Addressing you as a friend to Literature, and yourself a cultivator and reaper of its fruits, I am desirous of bespeaking your attention to a work of no ordinary Poctic talent just published at Madras, by Mr M. S. Dutt, entitled the ‘Captive Ladie,’

এর পর পত্রলেখক তাঁর চিঠিতে হলপ করে বলেছেন যে, একটু বেশি প্রশংসা করলেও কবির সঙ্গে তাঁর আদৌ কোনো পরিচয় নেই।

In offering a few critical remarks, which some may think of too favourable a character, I must premise that they proceed from a total stranger to the author of this poem – the Preface and Introductory verses to which but too plainly proclaim an obscure and unbefriended man.

গোড়াতে তিনি উল্লেখ করেছেন কাব্যের সূচনা সম্পর্কে — যেখানে কবি তাঁর রচনাকে নিবেদন করেছেন তাঁর প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে:

There is a melancholy tenderness in that Introductory address, which at once charms from its poetic feeling, and elevates from its ardent manliness. In the whole range of recent Poetry we shall rarely meet a swceter strain of melody or more impassioned sentiment, addressed to beloved object than stream forth in the following lines –

পত্রলেখক কবির ক্রটিও দেখিয়েছেন। কবি যে অতিরিক্ত উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন, বক্তব্যের তুলনায় তিনি যে ভঙ্গিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, পত্ৰলেখক তার প্রশংসা করেননি। তবে এটাকে দোষ ধরলে বায়রন, কীটস এবং শেলিও যে বাদ যাবেন না, তাও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন:

The Poem, itself too much – and too fatally perhaps for its popularity – recalls the o’er burdened sentimentality of the Byron school; and may probably be the effusion of youthful or unpractised musing. It sins, therefore, in exuberance of epithet, and in wanderings of fancy. The reader pauses too often to comprehend the feeling, which in truer and more perfect poetry at once reaches the heart. More care and fondness is displayed in dressing up the thoughts than in expressing the thought themselves. But it would be to deny to Keats and Shelley, and even to Byron himself, one-half of their poetic merit, to refuse all admiration of beauties, which, however graceful in themselves, often encumber rather than adom the sentiments to which they are allied; and sometimes overwhelm the sentiments altogether.

অ্যাথেনিয়ামের পৃষ্ঠায় ক্যাপটিভ লেডির সমালোচনা

এরপর পত্রলেখক মনে করিয়ে দেন যে, এক সময়ে এ ধরনের ‘অপরাধ’ কাব্যকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলতো। কিন্তু এখন সে কাল বিগত এবং কাব্যের গুণাগুণ নির্ধারণের মানদণ্ড এখন অনেক সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর পর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রলেখক বলেন, তাঁর বিশ্বাস এমন রচনা ‘বায়রন অথবা স্কট তাঁদের নিজের বলে মেনে নিতে লজ্জিত হতেন না। আমাদের মহৎ দেশবাসীদের মধ্যে খুব কমই আছেন যাঁরা নিচের পঙ্‌ক্তিগুলো বিনা আবেগে পড়তে পারবেন:

Oh! who can look upon the plain,

Where sleep the glorious – mighty slain, –

Brave Hearts that for their country bled,

And read upon their eyes, tho’ seal’d,

The proud defiance there revealed,

Lit by each spirit ere it fled –

Or, mark the fierce disdain that lies,

Upon their lips and yet defies’-

Unquench’d by Death, like the last ray,

Of the set sun, still lingering there,

As if too loth to pass away,

But scorch and blast with lightning glare,-

Nor feel his blood within his vein,

Rage like the tempest-stirred main,

As if to burst – to gush – to flow –

And sweep away Fair Frecdom’s foc,

Nor madly long to wield the brand,

To save – defend – his Native Land.,,

লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই অংশে দেশাত্মবোধ কেবল স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়নি; সেই সঙ্গে এর মধ্যে এমন একটা আবেগ এবং তেজ প্রকাশ পেয়েছে, যা পাঠককে মুগ্ধ না-করে পারে না। পত্রলেখক কাব্যের সূচনা অংশেরও প্রশংসা করেছিলেন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন প্রেমের জোয়ার এবং আন্তরিকতা।

পত্ৰলেখক কবির যে-সমালোচনা করেছেন, তাকে মেকি বলে মনে হয় না। সমালোচকের মতে, কবির অনুভূতি সোজাসুজি পাঠকের চিত্তকে স্পর্শ কবে না, বরং তা অনুধাবন করার জন্যে পাঠককে বারবার থামতে হয়। এটা তাঁর কবিতার একটা সত্যিকার বৈশিষ্ট্য। তা ছাড়া, ভাবনাগুলো প্রকাশের দিকে কবি যতোটা যত্ন এবং অনুরাগ দেখান, তার চেয়ে ভাবনাগুলোকে অলঙ্কৃত করার দিকে তাঁর যত্ন এবং অনুরাগ বেশি। এই দুটি সমালোচনাই ন্যায্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ধারণা করি, এ চিঠি কবির কোনো বন্ধু অথবা তাঁর নিজেরই লেখা। রিচার্ড নেইলরের হওয়া সম্ভব। নয়তো বই প্রকাশের দু সপ্তাহের মধ্যে একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে এ বই কিনে, তা পড়ে সে সম্পর্কে একটি অনুকূল সমালোচনামূলক চিঠি লিখে পত্রিকায় প্রকাশ করতে পারার কথা নয়। আর এ চিঠি খাঁটি হলে: যে-বায়রনের কথা মধু তাঁর কৈশোর থেকে অমন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, তাঁর কবিতার সঙ্গে The Captive Ladie-র তুলনা দেখে তাঁর মনে ইংল্যান্ডে না-গিয়েই চূড়ান্ত কবিযশ পাবার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।

মাদ্রাসের অনুকূল সমালোচনা উপভোগ করলেও, কাব্য হিশেবে এর সত্যিকারের মূল্য কতোটা তা বোঝার জন্যে তিনি কলকাতার সমালোচকদের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকলেন। গৌরদাসকে কলকাতার প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে, বন্ধুরা কী বলেন এবং কোনো গ্রন্থসমালোচনা প্রকাশিত হয় কিনা, জানাতে একাধিক বার অনুরোধ করেছেন।৫০ কাব্য ছাপা হবার সময়ে এবং তা প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পরে তিনি এ কাব্য সম্পর্কে উষ্টাশা পোষণ করেছেন। যে-কাব্য মাদ্রাসে অমন উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা কুড়িয়েছে, কলকাতায় তার সমাদর হবে না, এটা কি হতে পারে! এবং, ভাবলেন, একবার কলকাতার নিক্তিতে টিকে গেলে, তখন লন্ডনের বাজার যাচাই করে দেখবেন। এ কথা ভেবেও তিনি উত্তেজিত এবং উদ্দীপ্ত বোধ করে থাকবেন।

যখন The Captive Ladie ছাপার কাজ চলছিলো, সেই সময়ে — মার্চ মাসে — সৃষ্টির আনন্দে উচ্চকিত কবি তড়িঘড়ি করে লিখতে আরম্ভ করলেন আর একটি কাব্য — যার নাম জানা যায়নি। মাসখানেকের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সর্গের মাঝামাঝি পৌঁছে যান। ‘রক্তের স্বাদ পেলে’ তিনি কিভাবে সাগরদাঁড়ির নয়, একেবারে সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো ছুটতে পারেন, দশ বছর পরে আরও একবার তিনি তা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সে প্রসঙ্গ যথাসময়ে আলোচনা করবো। উচ্ছ্বাসিত কবি এপ্রিল মাসে গৌরদাসকে আর মে মাসে ভূদেবকে লেখেন, The Captive Ladie-র তুলনায় এ কাব্য অনেক ভালো হবে — বস্তুত, তুলনাই হয় না। সুতরাং পরিকল্পনা করলেন, আর মাদ্রাসে নয়, কয়েক মাসের মধ্যে এ কাব্য ছাপাতে হবে খোদ লন্ডনে।৫১ লন্ডনের স্বীকৃতিই তো সত্যিকারের স্বীকৃতি! সেই সঙ্গে ভাবলেন, নতুন কাব্যটি যদি লন্ডনেই ছাপালেন, তা হলে The Captive Ladie-ও সেই সঙ্গে জুড়ে দিলে হয়! The Captive Ladie-র মধ্যে হিন্দুদের পুরাণ আর রীতিনীতির অনেক কথা আছে, সেসব কথা ভালো করে বোঝার জন্যে টীকাগুলো যদি একজন হিন্দু-শাস্ত্রবিশারদকে দিযে লিখিয়ে নেওয়া যায় আর সেই সঙ্গে সংস্কৃত উদ্ধৃতি এবং সূত্রসহ একটা বড়ো প্রবন্ধ — তা হলে ইংরেজ পাঠকদের পক্ষে এ কাব্যের প্রশংসা করা সহজ হবে। ভূদেবকে অনুরোধ করলেন, লিখে দেবার জন্যে। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিলেন, প্রকাশ্যে তার স্বীকৃতি থাকবে।৫২

The Captive Ladie সম্পর্কে গ্রন্থসমালোচনা দূরের কথা, প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পরেও বন্ধুদের কোনো মতামত জানতে পারলেন না কবি। উচ্ছ্বাসিত হযে মতামত জানিয়েছিলেন এক মাত্র চিরদিনের বন্ধু গৌরদাস। তিনি লিখেছিলেন: ‘এ কথা বলতে পেরে আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে যে, তোমার এ কাব্য পড়ে আমি যখন উঠলাম, তখন তোমার প্রতিভা সম্পর্কে আমার ধারণা আরও উন্নত হলো। ব্রিটিশ-ভারতীয় সাহিত্যের দরবারে তুমি যে খুব লক্ষণীয় একটি ভূমিকা পালন করবেই এ সম্পর্কে আমার ধারণা আরও জোরদার হলো।’৫৩ গৌরদাস সত্যিকারের সাহিত্যরসিক ছিলেন না। তাই তাঁর প্রশংসা পেয়ে কবি কতোটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন, বলা যায় না। অন্য বন্ধুদের মতামত জানানোর জন্যেও অনুরোধ জানালেন। বইটা কলকাতার সুধীমহলের যাতে চোখে পড়ে, তার জন্যে Hindu Intelligencer-এ দু-তিনটে বিজ্ঞাপন দেবার কথাও ভেবেছিলেন।৫৪ মোট কথা, কলকাতায় এ কাব্যের অনুকূল সমালোচনা হচ্ছে কিনা, তা জানার জন্যে The Captive Ladie প্রকাশিত হবার পরবর্তী দু মাস তিনি উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকলেন। মনকে আশ্বাস দিতে থাকলেন, সুখ্যাতি না-পাবার তো কোনো কারণ নেই! কিন্তু তারপরই Bengal Harkaru-র শক্তিশেল অকস্মাৎ গিয়ে তাঁর একেবারে মর্মে বিঁধে গেলো।

এ পত্রিকায় The Captive Ladie-র সমালোচনা প্রকাশিত হয় ১৯ মে (১৮৪৯) তারিখে। ৫ জুনের চিঠিতে গৌরদাসকে তিনি যা লিখেছিলেন, তা থেকে দেখতে পাচ্ছি, তিনি খুব ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। Bengal Hurkaru যে-সমালোচনা করেছিলো, তাকে সত্যিকার সাহিত্য সমালোচনা না-বলে ব্যক্তিগত আক্রমণ বলাই ভালো। গোড়া থেকে এ সমালোচনাকে নিতান্ত বিদ্বিষ্ট বলে চিনে নিতে ভুল হয় না। তা না-হলে কবির নাম নিয়ে অথবা দত্তদের নিয়ে বিদ্রুপ ব্রার দরকার ছিলো না। হীদেনডমের প্রতিও সমালোচকের বর্ণবাদী মনোভাব চাপা থাকেনি:

There is nothing poetical in the curt and dumpy name of Dutt. No more would there be in the equally brief and insignificant patronymic of Scott were it divested of its associations. But the Scotts and above all the Scott, have given to their name a classical euphony that makes it musical all over the world. Perhaps the Dutts may do as much for their own little pudgy appellation. Unpoetical as it sounds now, it designates a family whom the gods seem to have made poetical, or, at all events, endowed with the wish to be or the belief that they are so In Calcutta we have at least three of the name who write English verse of faultless rhyme and musical rhythm, as our columns often show and as even the most inveterate contemner of Young Bengal must allow. And now we find they have another, if not more, at Madras – yes! At benighted Madras of all places in heathendom!

কবি ভূমিকায় লিখেছিলেন যে, তিনি এ কাব্য রচনা করেছিলেন দারুণ তাড়াহুড়ো এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, অভাব আর জীবনের নগ্ন বাস্তবতার মধ্যে — সেটাকেও সমালোচক কশাঘাত করতে ছাড়েননি।

Possibly had our poet looked the ugly realities of life manfully in the face instead of trying to abstract his thoughts from them, he might not have been dependent on Want, Poverty, and Co. for his inspiration.

তারপর সমালোচক কবিকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন যে, যখন কাজ (লেখাপড়া) করার সময় ছিলো, তখন তিনি যদি ঠিকমতো কাজ করতেন, তা হলে তাঁর অভাবে থাকতে হতো না:

We are not of those that think a poct must nccessarily be poor and miserable; but we believe that a youth

Who pens a stanza when he should engross

has only himself to blame if his pen neither brings him fame nor food.

সমালোচক খোদ কাব্যের দোষত্রুটি দেখাতে গিয়ে বেশি কিছু বলেননি। তাঁর প্রথম বক্তব্য: এ কাব্য হলো রীতিমতো অপেশাদারী। আর তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্য এ কাব্য লেখা হয়েছে স্কট-মূর-বায়রনের ভঙ্গিতে। সমালোচক যে-দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমাদের বিবেচনায় মন্দ নয়।’ তৃতীয় বক্তব্য: Visions of the Past মূল কাব্যের মতো অতোটা ভালো হয়নি। এখানে ঈভ আর অ্যাডম হলেন বায়রনের রচনায় মেরী চ্যাওয়ার্থ আর বায়বন নিজে যেমন।

The style – which is Scott-Moore-Byronical – and quality of the poem may be judged from the following passage with which it commences and which we think is not bad:

The star of Eve is on the sky,

But pale it shines and tremblingly,

As if the solitude around

So vast – so wild – without a bound,

Hath in its softly throbbing breast

Awaken’d some maiden fear – unrest;

But soon – soon will its radiant peers

Peep forth from out their deep-blue spheres

And soon the ladie Moon will rise

To bathe in silver Earth and Skies

The soft – pale silver of her pensive eyes.

এর পর সমালোচক এই জায়গা থেকে আরও ২৬ পঙ্‌ক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আসলে যতো বিদ্বেষই মনের ভেতরে থাকুক না কেন, উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে সমালোচক থামতে পারেননি। সমালোচক আসলে এখানে নিজের সৌন্দর্যবোধের কাছে নিজেই পরাজিত হয়েছেন। এবং যেকোনো মাপকাঠিতে বিচার করা হোক না কেন, উদ্ধৃত অংশে যে খাঁটি কবিত্ব প্রকাশ পেয়েছে, তা তিনি কী করে অস্বীকার করবেন? কবি এখানে সন্ধ্যার আকাশের যে-বর্ণনা দিয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে খুব উচ্চ এবং সূক্ষ্ম কল্পনার পরিচয় দিয়েছেন। সেই কল্পনার সঙ্গে মিশেছে নরম আবেগের স্পর্শ।

সন্ধ্যা তারা ডুবে যায়নি, কিন্তু সে কাঁপতে কাঁপতে দিচ্ছে মান আলো, যেন তার চারদিকের বিশাল, বন্য এবং সীমাহীন নির্জনতা তার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে এক অভূতপূর্ব ভীতি এবং চঞ্চলতা; কিন্তু অচিরেই তার জ্বলজ্বলে আলো নীলাকাশ থেকে মিলিয়ে যাবে; অচিরেই চাঁদকন্যা দেখা দেবে; রূপালি আলোতে সে ধুইয়ে দেবে ধরণী আর আকাশকে, তার নিষ্প্রভ আর বিষণ্ণ রূপোলি আলো দিয়ে।

কাব্যের শেষ ২৫ পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করার সময়ে সমালোচক উপরে উদ্ধৃত পঙ্‌ক্তিগুলোর তুলনায় তাকে আরও জোরে নাড়া দেবার মতো বলে আখ্যায়িত করেছেন। Visions of the Past-কে তিনি তেমন ভালো বলতে পারেননি। তা সত্ত্বেও, সেখান থেকে তিনি ১৯ পঙ্‌ক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। নিজের সংকীর্ণতার যদ্দুর সম্ভব পরিচয় দিয়ে তিনি স্পর্শকাতর এবং যশ-প্রার্থী কবিকে নানাভাবে জর্জরিত করেছেন। তাঁর বানান এবং ব্যাকরণের ভুলও দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে মর্মাঘাতী মন্তব্য করে বলেছেন, তিনি যদি কবি হিশেবে খ্যাতি লাভের স্বপ্ন দেখে থাকেন, তা হলে সেটা তিনি ভুলে যেতে পারেন:

These verses of M.M.S. Dutt are very fair ameteur poetry; but if the power of making has deluded the author into a reliance on the exercise of his poetical abilities for fortune and reputation, or templed him to turn up his nose at the more common-place uses of the pen, the delusion is greatly to be regretted. We believe that none of our Calcutta Dutts has fallen into this ruinous error, but that steadily following their more homely and more profitable vocations, they prudently reserve their poctical powers to amuse their moments of leisure – it will be well if the recreations of Young Bengal were always so innocent.

বেঙ্গল হরকরার পৃষ্ঠায় ক্যাপটিভের সমালোচনা

সবশেষে অভদ্রতার সঙ্গে সমালোচক তাঁর সমীক্ষা শেষ করেছেন:

With this we take our leave of M. M. S. Dutt and his poetry.

কবির নিতান্ত শত্রু ছাড়া, যেকোনো পাঠক এরকম সমালোচনা পড়ে সমালোচকের রূঢ়তা এবং অন্যায় সমালোচনায় বিরক্ত না-হয়ে পারবেন না। আর যে-উচ্ছ্বাসিত যুবক ধার করে কাব্য ছাপিয়েছেন কবি বলে খ্যাতি লাভ করার আশায়, তিনি এ সমালোচনা দেখে কী ভাববেন তা বলাই বাহুল্য। এই ‘সমলোচনা’ প্রকাশিত হবার ৩১ বছর আগে আর-এক তরুণ কবির তিনটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিলো Blackwood’s Edinburgh Magazine, Quarterly Review আর British Critic পত্রিকায়। মাইকেলকে Harkartuর সমালোচক আক্রমণ করেছিলেন তাঁর বায়রন-প্রীতির জন্যে, আর Blackywood’s এই তরুণ কবিকে আক্রমণ করেছিলো তাঁর হান্ট-প্রীতির জন্যে। এই সমালোচনায় নবীন কবিকে আগাগোড়া এক অশিক্ষিত ডাক্তারের শিক্ষানবিশ বলে ব্যঙ্গ করা হয়। আর প্রবন্ধের শেষে এই কবি – জন কীটসকে এই বলে উপদেশ দেওয়া হয় যে, একজন অনাহারী কবি হবার চেয়ে একজন অনাহারী ডাক্তার হওয়া অনেক ভালো এবং বুদ্ধির কাজ। ‘সুতরাং, মিস্টার জন, দোকানে ফেরত যান।’ Hurkaruর সমালোচক Blackwood’s এর এই সমালোচনা পড়েছিলেন কিনা, জানা যায় না। তবে প্রবন্ধের শেষ দুই সমালোচকই একই উপদেশ দিয়েছেন।

এই সমালোচনার জবাবে কীটস তাঁর ভাই জর্জকে লিখেছিলেন যে, তিনি মৃত্যুর পর ইংরেজ কবিদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। মাইকেলও প্রকাশ্যে এই সমালোচনাকে চূড়ান্ত আঘাত বলে মেনে নিলেন না। গৌরদাসকে লিখলেন: ‘যাঁদের প্রশংসাকে সন্দেহ করা যায় না, তাঁদের কাছ থেকে এ যাবৎ এ কাব্যের যতো প্রশংসা শুনেছি, তাতে এটুকু সমালোচনা আমার সহ্য হবে।’৫৫ তিনি তখনকার মতো মনকে প্রবোধ দিলেন, এই বলে যে, এটা Hurkaru-র সমালোচকের সংকীর্ণতা। তা ছাড়া, Hurkaru-ই তো শেষ কথা নয়। সমালোচনার জন্যে কাব্যটি অন্য পত্রিকায়ও পাঠানো হয়েছে। দেখা যাক, তারা কী বলে! বন্ধুরা কী বলেন, তাও শোনার জন্যে উৎকণ্ঠ হয়ে থাকলেন। Harkaru-র সমালোচনায় প্রভাবিত হবেন — বন্ধুদের সম্পর্কে তিনি এমন কথা ভাবতে পারলেন না। বস্তুত, তাঁর কোনো কোনো বন্ধু যে এই সমালোচনা পড়ে অথবা এর কথা শুনে দুঃখিত হযেছিলেন, তার একটি প্রমাণ উদ্ধৃত করেছেন যোগীন্দ্রনাথ বসু। অজ্ঞাতনামা এক বন্ধু তাঁর চিঠিতে এই সমালোচনা সম্পর্কে লিখেছিলেন: ‘আমার কোনো পত্রিকা পড়ারই অভ্যেস নেই। সে জন্যে, এই পত্রিকা পড়ে কলকাতার এই হৃদয়হীন বদমাশ সম্পাদকদের হাতে এক বন্ধুর লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়নি।’৫৬

Hurkaru — য় সমালোচনা প্রকাশিত হবার ৯ দিন পরে Hindu Intelligencer পত্রিকায়ও একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়। এ সমালোচনাটি কবির বিশেষ প্রশংসা না-করলেও, একেবারে সহানুভূতি-বর্জিত ছিলো না। এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কাশীপ্রসাদ ঘোষ। আগেই বলেছি, খিদিরপুরে মধু যে-বাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন, সেই বাড়িতে এক কালে বাস করতেন। তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং তাঁর একটি কবিতা ডিএলআর তাঁর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বাঙালি কবি হয়েও তিনি একজন বাঙালি কবির বিশেষ প্রশংসা করতে পারেননি।

আমরা মাদ্রাসে-ছাপা ৮০ পৃষ্ঠার মতো একটি পুস্তিকা পেয়েছি। এতে দুটি কবিতা আছে। এর একটির নাম Captive Ladie, অন্যটির নাম Visions of the Past। রচয়িতা এম এম এস ডাট। আমরা ধারণা করি ইনি এই দেশের লোক। এবং সে কারণে তাঁর প্রথম প্রচেষ্টার জন্যে সব রকমের উৎসাহ লাভ করতে পারেন।

কাব্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি যে-মন্তব্য করেন, তাকে প্রশংসা না-বলে, পৃষ্ঠপোষণা বলা যায়।

দেখা যাচ্ছে, যে-গুণাবলী থাকলে সত্যিকার কবি বলা যায় আমাদের গ্রন্থকর্তা তা বর্জিত নন। প্রকৃতি তাঁকে যে-মানসিক শক্তি দিয়েছে, তিনি যদি তা কাজে লাগাতে থাকেন, তা হলে কাব্যজগতে আরও উঁচু আসন লাভ করতে পারবেন – এ সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই এবং তিনি যাতে তা পারেন — তার জন্যে আমাদের শুভেচ্ছা থাকলো।৫৭

এ সমালোচনা পড়ে কবি উচ্ছ্বাসিত হতে পারেননি — বলা বাহুল্য। বছরের শেষ দিকে Calcutta Review পত্রিকায় The Poetry of the Dutts নামে একটি রচনায় The Captive Ladie-র আলোচনা হয়েছিলো (Vol. 12, No. 24)। তাতে মাইকেলের কবিতাকে গোবিন্দ দত্তের কবিতার চেয়ে নিম্নমানের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মন্তব্য কবি দেখেছিলেন কিনা, জানা নেই। দেখে থাকলেও, গোবিন্দ দত্তের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করায় উল্লসিত হননি। তা ছাড়া, গ্রন্থ প্রকাশের অনেক দিন পবে প্রকাশিত হওয়ায় এক সময়ে সমালোচকদের মতামত জানার যে-গভীর আগ্রহ ছিলো, তা-ও ততোদিনে হারিয়ে ফেলার কথা। কিন্তু কলকাতার অন্যান্য নাম-করা পত্রিকা কোনো সমালোচনাই করলো না, সেটা তাঁর কাছে আরও দুঃখের বলে মনে হয়েছিলো। এরপরে কবি আর নিজের উৎসাহ ষোলো আনা বজায় রাখতে পারলেন না। কলকাতা পর্বেও দেখা যাবে, তিনি উৎসাহের সঙ্গে সাহিত্য সাধনা করেছেন; অধ্যবসায়কে তিনি ডরাননি। কিন্তু নিজেই বলেছেন, অধ্যবসায় বহাল রাখার জন্যে চাই স্বীকৃতি আর প্রশংসার কিঞ্চিৎ বারিসেচন।৫৮

আমার ধারণা, সেই বারিসেচনের অভাবে তাঁর অজ্ঞাতনামা নতুন কাব্যটি সাহিত্যক্ষেত্রে পল্লবিত হতে পারলো না। তা ছাড়া, ছাপাখানার ভূত নয়, স্বয়ং মুদ্রকের পেয়াদাও তাঁকে ধাওয়া করেছিলো। তাই নিরুৎসাহের মধ্যে তাঁর দ্বিতীয় কাব্য — যাকে তিনি প্রথম কাব্যের তুলনায় অনেকটা উঁচুদরের বলে অভিহিত করেছিলেন — সেটি আর প্রকাশিত হলো না, লন্ডনে কেন, মাদ্রাসেও নয়।

অনামা যে-কাব্যটি কবি লিখছিলেন, সেটি প্রকাশিত না-হলেও তিনি যে The Captive Ladieর মতো এটিও লিখছিলেন একটি কাহিনীকাব্য হিশেবে এবং পৌরাণিক বিষয়কে অবলম্বন করে, তা জানা যাচ্ছে। এবং তা থেকে তাঁর প্রতিভা যে বিশেষ করে কাহিনীকে কেন্দ্র করে স্ফূর্তি লাভ করে, তার একটা স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। এর পরেও তিনি তাঁর সব কাব্য রচনা করেছিলেন কোনো না কোনো কাহিনী অবলম্বন করে।

The Captive Ladie তাঁকে মাদ্রাসের বাইরে তেমন কোনো কবিখ্যাতি দিতে পারেনি। তবে কবি নিজে এ কাব্যকে তুচ্ছ বলে মনে করতে পারেননি। কোনো অনুকূল সমালোচনা না-দেখে হতাশ গৌরদাস যখন তাঁকে বোঝাতে চেয়েছেন, এ কাব্য প্রকাশ করে কোনো লাভ হয়নি, তখনোও তিনি সেটা মেনে নিতে পারেননি। মাদ্রাস, কলকাতা, লন্ডন – সর্বত্র তাঁর জয়জয়াকার পড়ে গেছে, এ কথা লিখতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু এ কাব্য মাদ্রাসে তাঁর প্রতিষ্ঠার জন্যে কতোটা অবদান রেখেছে, সেটা বন্ধুকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন।

মনে হচ্ছে তুমি ‘ক্যাপটিভ’কে ধরে নিয়েছো একটা ব্যর্থতা বলে, কিন্তু আমি তা মনে করিনে। কারণ, তাকিয়ে দেখো, আমার জন্যে অশেষ সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে এ কাব্য। এর মাধ্যমে যাঁদের বন্ধুত্ব লাভ করেছি — তাঁদের চিনতে পারাও সৌভাগ্যের বিষয়। তুমি শুনে নিশ্চয় খুশি এবং বিস্মিত হবে যে, অল্প আগে আমাকে অ্যাডভোকেট-জেনরেল জর্জ নর্টন ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এই বুড়ো ভদ্রলোক আমাকে যতোটা সম্ভব সৌজন্যের সঙ্গে স্বাগত জানান। … আমরা আলাপ-আলোচনা করি বন্ধুর মতো। তিনি আমাকে ধ্রুপদী সাহিত্যের কতোগুলো বই দিয়েছেন তাঁর শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ।৫৯

আগেই বলেছি, পত্রিকায় প্রকাশের সময়ে কাব্যটি মাইকেল উৎসর্গ করেছিলেন বন্ধু রিচার্ড নেইলরের নামে। কিন্তু কাব্যটি যখন এক সর্গেরও বেশি ছাপা হয়ে গেছে, তখন তাঁর মাথায় এলো এটি জর্জ নর্টনের নামে উৎসর্গ করলে হয়। নর্টন ছিলেন মাদ্রাসের বিশেষ নাম-করা ব্যক্তি। অ্যাডভোকেট-জেনরেল ছাড়াও তিনি ছিলেন অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক এবং উপদেষ্টা। মাদ্রাস স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৮৩৮ সালে যে-বোর্ড গঠন করা হয়, নর্টনকে তার সভাপতি নিয়োগ করা হয়েছিলো। তারপর ১৮৫২ সালের দোসরা জুলাই পর্যন্ত তিনি সেই পদে বহাল ছিলেন। কিন্তু সুপরিচিত লোক হওয়া সত্ত্বেও ১৮৪৯ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কবির আলাপ হয়নি। তবু সেই অপরিচিত নর্টনের নামে জীবনের প্রথম কাব্যটি উৎসর্গ করার এ খেয়াল হঠাৎ কেন তাঁর মনে এলো? আমার ধারণা, বিষয়ী না-হলেও, একটা ব্যাপারে কবি বারবার হিশেবী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন — পৃষ্ঠপোষকদের নামে তাঁর গ্রন্থগুলো উৎসর্গ করে। বন্ধুবৎসল কবি তাঁর গ্রন্থাবলী বন্ধুদের নামে, একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, উৎসর্গ করেননি। সে ব্যতিক্রম ভূদেব মুখোপাধ্যায়। নয়তো প্রিয়তম বন্ধু গৌরদাসকে — যাঁকে তিনি নিজের জীবনী রচনার ভার দিয়েছিলেন, অথবা রাজনারায়ণ বসু — যাঁকে নিজের কবিখ্যাতি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন — তাঁদের নামেও কোনো রচনা উৎসর্গ করেননি। একবার একজনকে একটি কাব্য উৎসর্গ করার পর সেই কাব্য আর-একজনের নামে উৎসর্গ করার এই ঘটনা কোনো সুরুচি অথবা ঔদার্যের পরিচয় বহন করে না। তা সত্ত্বেও, কবি তা করেছিলেন। এবং করে তাঁর কিঞ্চিৎ ইহলৌকিক লাভ হয়েছিলো বৈকি!

জর্জ নর্টন

কাব্যটি উৎসর্গ করার অনুমতি পাওয়ার জন্যে তিনি The Captive Ladie-রপ্রথম সর্গটি পুরো এবং দ্বিতীয় সর্গের খানিকটা জর্জ নর্টনের কাছে পড়ে দেখার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। নর্টন যখন দেখলেন, কাব্যটির মধ্যে ‘অনেক শক্তি আর প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রয়েছে’, তখন আপত্তি করলেন না। কাব্যটি জর্জ নৰ্টনের নামে উৎসর্গ করার জন্যে তিনি কি পরিমাণ আগ্রহী ছিলেন এবং জৰ্জ নৰ্টনকে তুষ্ট করার জন্যে তিনি কি পরিমাণ বিনয় প্রকাশ করেছিলেন, তা বোঝা যায়, এ কাব্যের উৎসর্গপত্র থেকে। এতে তিনি লিখেছিলেন:

To/George Norton, Esquare/The following tale/is/(by permission)/most respectfully dedicated, / by his most obedient/ and / most humble servant / The author.

এই উৎসর্গপত্রে আর-একটা জিনিশ লক্ষযোগ্য, তা হলো: by permission কথাটি। এমনটা অবশ্য কোনো উৎসর্গপত্রে দেখা যায় না, তা নয়। কিন্তু বিরল নিশ্চয়। বোঝা যায়, এ ব্যাপারে জর্জ নর্টন খুব কড়া এবং পোশাকী ছিলেন।

কাব্যটি প্রকাশিত হবার তিন মাস পরে জর্জ নর্টন কবিকে ডেকে পাঠান। গৌরদাসকে লেখা চিঠি থেকে লক্ষ্য করেছি, তাঁকে নর্টন খুব সমাদর করেন। তার চেয়েও বড়ো কথা, স্বয়ং কবি যা চেযেছিলেন, নর্টন সেই আশ্বাস দিলেন। বললেন, মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের শিক্ষকতার চেয়ে অনেক উচুঁ দরের একটি সরকারী চাকরি তিনি জুটিয়ে দেবেন। নর্টন বলেছিলেন ঢাকা, বেনারস অথবা হুগলিতে যেমন কলেজ আছে, তেমন একটি কলেজ মাদ্রাসে শিগগির খোলা হবে। সেই কলেজের প্রধান শিক্ষকের অথবা ইনস্পেক্টরের কাজ পাওয়া যাবে — এ আশ্বাসও তিনি দিয়েছিলেন। এ চাকরি পাওয়া যে কিছু কঠিন হবে না, নর্টনের কথা থেকে কবি সেটা অনুমান করেছিলেন। কারণ নর্টন বলেছিলেন যে, মাইকেল কলকাতায় থাকলে অনেক রাঘব বোয়াল চিরদিনের জন্যে না-হলেও সাময়িকভাবে তাঁর পথ আটকে রাখতে পারতো। কিন্তু মাদ্রাসে রাঘব বোয়াল কেন, সাধারণ রুই-কাৎলার তরফ থেকেও তেমন কোনো আশঙ্কার কারণ নেই।৬০

ঢাকা, বেনারস এবং হুগলির মতো মাদ্রাসে কবে কলেজ খোলা হবে, সেই আশায় বসে থাকলে কবির সংসার চলবে না। বিশেষ করে মাসখানেক পরেই যখন স্ত্রী সন্তান প্রসব করবেন। তাই দ্রুত একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। সুতরাং নর্টন তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন মাদ্রাস স্কুলের হেডমাস্টার এয়ার বার্টন পাওয়েলের কাছে, মাদ্রাস স্কুলে একটি চাকরি দেবার জন্যে। পাওয়েল ছিলেন কেম্ব্রিজের র‍্যাংলার। ১৮৪০ সালে তিনি পেমব্রক কলেজ থেকে গণিতে ট্রাইপস করেন। স্বয়ং গভর্নর লর্ড এলফিনস্টোনের সুপারিশে তাঁকে মাদ্রাস স্কুল চালু হবার সময় থেকে অর্থাৎ ১৮৪১ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে প্রধান শিক্ষক করা হয়েছিলো সাত শো টাকা বেতনে, সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়া আরও ৮০ টাকা দিয়ে। (১৮৫৫ সালে তাঁর বেতন বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার টাকায়।) কবির চেয়ে মাত্র ছ বছরের বড়ো হলেও, তিনি ছিলেন মাদ্রাসের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে তিনি মুগ্ধ হলেন। গৌরদাসকে লিখলেন: ‘ভাবতে পারবে না, কী ভালো মানুষ তিনি।’ স্কুলভবনটা দেখে তাঁর অবশ্য ভালো লাগেনি, তার অবস্থা কাহিল। (এই স্কুল বসানো হয়েছিলো এগমোরের পুরোনো পোস্ট অফিস ভবনে।) লাইব্রেরি বলতে গেলে নেই।৬১ কিন্তু তাতে কী আসে যায়? মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের তুলনায় তো অনেক ভালো! তা ছাড়া বেতন তিন গুণেরও বেশি। সুতরাং মাইকেল তক্ষুণি মাদ্রাস স্কুলে চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তবে মাদ্রাসে কলেজ খোলার প্রস্তাব তখন কার্যকর করা হয়নি। মাদ্রাস স্কুলেও সেই মুহূর্তে কোনো চাকরি খালি ছিলো না। ফলে The Captive Ladie অনেক বন্ধু দিলেও, পার্থিব কোনো সুফল সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারেনি।

বৈষয়িক উন্নতিতে তেমন কোনো সহায়তা না-হলেও, The Captive Ladie লিখে কবির কোনো লাভ হয়নি, তা নয়। এতোকাল তিনি কেবল খণ্ড কবিতা লিখেছিলেন — এর উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিলো King Porus আর Visions of the Past। কিন্তু পরে তিনি আখ্যানকাব্য লিখেই খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সেই আখ্যান কাব্য লেখার গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন এই কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে। কলকাতায় বসে তিনি যে-সব কবিতা লিখেছিলেন, তার তুলনায় এ কাব্য অনেক পরিণত — কাহিনীর বুননিতে এবং ভাষা, ছন্দ ও উপমা-অলংকারের ব্যবহারে। এর চেয়েও কবির বড়ো লাভ হয়েছিলো পরোক্ষভাবে। ইংরেজিতে কাব্য রচনা করে সাহিত্যের দরবারে স্থায়ী আসন পাবেন বলে তাঁর উচ্চাশা ছিলো, কিন্তু The Captive Ladie-কে কলকাতার পাঠক সমাজ যেভাবে গ্রহণ করেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে সেই উচ্চাশাকে তিনি একবার বাস্তবতার আলোকে খতিয়ে দেখার সুযোগ পান। বিশেষ করে ডিঙ্কওয়াটার বেথুন যে-রূঢ় সত্য লিখেছিলেন, তা তাঁর উচ্ছ্বাসের ওপর তখনকার মতো ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিলেও, তাঁকে ভাববার খোরাকও কম দেয়নি। বেথুনকে বই পাঠানোর সময়ে তিনি গৌরদাসকে তার ওপর লিখে দিতে বলেছিলেন:

আপনি এ দেশের জন্যে যে লোকহিতকর কাজগুলো করেছেন, তার প্রতি লেখকের বিনীত কৃতজ্ঞতার প্রতীকস্বরূপ এই কাব্যটি সম্মানের সঙ্গে পাঠালাম।৬২

এ বই পড়ে বেথুন গৌরদাসকে যা লিখেছিলেন, তার মধ্য দিয়ে The Captive Ladie-র প্রতি খুব উচ্চ ধারণা প্রকাশ পায়নি।

তাঁর কাব্য উপহার দেবার জন্যে আপনার বন্ধুকে আপনি দয়া করে আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ জানাবেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে, তাঁর উপহারের আমি একটা রূঢ় জবাব দিচ্ছি। এই সুযোগে আপনার মাধ্যমে তাঁকে আমি সেই উপদেশটাই দিতে চাই, যা আমি ইতিমধ্যে তাঁর কয়েকজন দেশবাসীকে দিয়েছি। এই উপদেশ হলো: তিনি ইংরেজিতে কবিতা না-লিখে তাঁর সময়টা বরং অন্য কোনো কাজে ব্যয় করলে বেশি লাভবান হবেন। তবে মাঝেমধ্যে অনুশীলন হিশেবে এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা প্রমাণের জন্যে এ ধরনের প্রয়াস অনুমোদন করা যেতে পারে। অবশ্য কবিতা লেখাই তাঁর লক্ষ্য হলে তিনি তাঁর দেশের অনেক বেশি সেবা করতে পারবেন এবং তাঁর নিজের জন্যেও স্থায়ী খ্যাতি লাভের অনেক বেশি সুযোগ পাবেন, যদি কিনা ইংরেজি চর্চার মাধ্যমে তিনি যে-রুচি এবং মেধা অর্জন করেছেন, তা তাঁর নিজের ভাষার মানোন্নয়ন এবং কাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যয় করেন।

আমি যদ্দুর জানি আপনাদের সাহিত্যের সবচেয়ে সেরা নমুনাগুলোও স্থুল এবং অশ্লীল। নিজেদের ভাষায় উষ্টতর এবং মহত্তর স্বাদের সাহিত্য গড়ে তোলার জন্যে একজন উষ্টাকাঙক্ষী তরুণ কবির পক্ষে দেশবাসী-দেব মধ্যে নেতৃত্ব দেবার চেয়ে উন্নত কোনো আশা থাকতে পারে না। তা ছাড়া, তিনি অনুবাদের মাধ্যমেও অনেক সেবা করতে পারেন। এভাবেই বেশির ভাগ য়োরোপীয় জাতির সাহিত্য গড়ে উঠেছে।৬৩

বেথুনের এই চিঠিতে সত্যের কোনো অভাব নেই। তবে তিনি মাইকেলের অন্য যে-দেশবাসীদের এই উপদেশ দিয়েছিলেন, তাঁদের তুলনায় মাইকেলের কবিপ্রতিভা এবং The Captive Ladie-র কাব্যগুণ নিঃসন্দেহে বেশি ছিলো। সে জন্যে, কেবল কবির কাছে নয়, তাঁর সহানুভূতিশীল পাঠকদের কাছেও এ চিঠিকে খুব রূঢ় বলে মনে হয়। বেথুন তাঁকে যে-উপদেশ দেন, প্রায় একই সময়ে এবং প্রায় একই ভাষায় তিনি সে কথা বলেন কৃষ্ণনগর কলেজে প্রদত্ত তাঁর এক ভাষণে।৬৪ আমার ধারণা, এ বক্তব্য ছিলো তাঁর একটি বহু-ব্যবহৃত উপদেশ। এবং সে জন্যে, তিনি যদি The Captive Ladie না-পড়েই অথবা তাতে সামান্য চোখ বুলিয়েই কবিকে এই উপদেশ দিয়ে থাকেন, তা হলে বিস্মিত হবো না।

বেথুন সাহিত্যের মস্তো বড়ো সমজদার অথবা সমালোচক ছিলেন, এমন কথা কেউ বলেননি। সুতরাং তাঁর মুখে The Captive Ladie এবং তার রচয়িতার মৃত্যুদণ্ড এই কাব্য অথবা তার কবি সম্পর্কে চূড়ান্ত সত্য মনে করার কারণ নেই। কিন্তু স্পর্শকাতর তরুণ কবির মনে এ আঘাতটা Bengal Harkaruর শক্তিশেলের চেয়েও রূঢ় মনে হয়েছিলো। কলকাতার রূঢ় সমালোচনার ফলে তাঁর আত্মবিশ্বাসে দারুণ চোট লেগেছিলো। এর পরোক্ষ একটা প্রমাণ পাই এ যাবৎ সম্পূর্ণ অজানা এবং একেবারে ভিন্ন একটা সূত্র থেকে। ব্রিটিশ মিউজিয়মে The Captive Ladie-র একটি কপি আছে। এই কপিটি কবি নিজে মাদ্রাস থেকে পাঠিয়েছিলেন। এক সময়ে তিনি ভাবতেন, The Captive Ladie নিজের কাব্যগুণেই তাঁকে খ্যাতি দেবে। এর জন্যে কারো কাছে দরবার করার দরকার নেই। কিন্তু তিনি যখন এই বই ব্রিটিশ মিউজিয়মে পাঠান, তখন নিজের ছাপানো নামের নিচে নিজেই লিখে দিয়েছেন ‘of Bishop’sCollege, Calcutta’।৬৫ কারণ, তাঁর তখন মনে হয়েছে, কাব্য হিশেবে এ বই ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে স্থান পাবে কিনা, সে সম্পর্কে মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষের মনে যদি কোনো সন্দেহ দেখা দেয়, তা হলে অন্তত ‘of Bishop’sCollege’ কথাটা দিয়ে তিনিগ্রন্থাগারিকদের দ্বিধা দূর করতে সমর্থ হবেন। (কবির এই পরিচিতি ছাড়া, The Captive Ladie-র দ্বিতীয় সর্গের চারটি জায়গায় কেটে ছাপার ভুল সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। তেরো বছর পরে তিনি যখন তাঁর দুটি অনূদিত নাটকসহ তাঁর সবগুলো বই মিউজিয়মকে দান করেন, তখন সেগুলোর ওপর কোনো পরিচিতি লেখেননি। তা থেকে বোঝা যায়, প্রথম কাব্য প্রকাশের পরে প্রতিকূল সমালোচনার দরুন তাঁর আত্মবিশ্বাস টোল খেলেও, পরবর্তীকালে মিন্টন এবং কালিদাসের সঙ্গে তাঁর তুলনা শুনে তাঁর আত্মবিশ্বাস এতোটা বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে, তখন আর নামের শেষে ‘অব বিশপস কলেজ, ক্যালকাটা’ কথাটা জুড়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তাঁর মনে হয়নি। এই বইগুলোর বেশির ভাগই তিনি নিজে ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বইগুলো এক সঙ্গে ৬৬ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখে লাইব্রেরির তালিকাভুক্ত করা হয়।

কবি তাঁর কলকাতার সমালোচকদের কাছ থেকে যে নির্দয় সমালোচনা শুনেছিলেন, তা তাঁর প্রাপ্য ছিলো বলে মনে হয় না। কিন্তু তাঁর এ আঘাতের দরকার ছিলো। ইংরেজিতে কাব্য লিখে মহাকবি হবার তাঁর বাসনা যে নিতান্ত আকাশকুসুম কল্পনা এবং নিজের মাতৃভাষা ভুলে যাবার মধ্যে যে কোনো বাহাদুরি নেই — এ দুই অনুভবই এ চিঠি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে দানা বেঁধেছিলো। বেথুনের মন্তব্য পাওয়ার কয়েক মাস আগেই গৌরদাসকে মাদ্রাস থেকে লেখা তাঁর প্রথম চিঠিতে তিনি প্রায় বড়াই করে লিখেছিলেন: ‘আমি বাংলা ভুলে যাচ্ছি, কতোটা দ্রুত, তোমাকে বোঝাতে পারবো না।’৬৬ অতঃপর বাংলায় তাঁর দক্ষতা নেই বলে বিনয় প্রকাশ করলেও, কোনো চিঠিতে তিনি বাংলা ভুলে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেননি।

জে ই ডি বেথুন

মাইকেলের জীবনী-লেখকরা যেভাবে তাঁর বাংলায় কাব্যচর্চা এবং বেথুনের চিঠির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ দেখিয়েছেন, তা সঠিক নয়। বেথুনের চিঠি পড়ে কবি অমনি ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা ছেড়ে দিলেন এবং বাংলায় কাব্য রচনা করার জন্যে বাংলা ভাষা চর্চার কাজে উঠে-পড়ে লাগলেন, ইতিহাস এমনটা সাক্ষ্য দেয় না। এই মাত্র তাঁর যে-চিঠির উল্লেখ করলাম, ১৪ ফেব্রুআরির (১৮৪৯) সেই চিঠিতে তিনি গৌরদাসকে কাশীদাসী মহাভারত এবং শ্রীরামপুর সংস্করণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাঠানোর অনুরোধ করেন। সেই সঙ্গে পাঠাতে বলেন, বিশপস কলেজে যে-বইগুলো ফেলে এসেছিলেন, সেগুলো। শৈশবে রামায়ণ এবং মহাভারতের সঙ্গে তাঁর যে-নাড়ির যোগ ঘটেছিলো, খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ, ভিনদেশী সংস্কৃতিকে স্বীকরণ অথবা খৃস্টান স্ত্রী বরণ করায় তা মোটেই ছিন্ন অথবা দুর্বল হয়নি। তা ছাড়া, কোনো শ্রেষ্ঠ রচনা লিখতে হলে তাঁকে যে ভারতীয় বিষয়ই নির্বাচন করতে হবে — এ কাণ্ডজ্ঞান তাঁর ছিলো। তাই, বেথুনের মন্তব্য পাওয়ার অনেক আগেই, শুধু The Captive Ladie নয়, তাঁর অনামা অসমাপ্ত কাব্য এবং Upsori-র বিষয়বস্তুও তিনি নিয়েছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তী এবং পুরাণ থেকে। বোঝা যায়, ইংরেজি ভাষায় লিখলেও, দেশীয় উপকরণ তাঁকে সারাক্ষণ উদ্দীপ্ত করছিলো। তা ছাড়া, বেথুনের উপদেশ পাওয়ার আগে থেকে তিনি মাতৃভাষায় লেখায় কথাও ভাবছিলেন বলে মনে হয়। সর্বোপরি, বেথুনের উপদেশ পাওয়ার পরও কবি ইংরেজিতে কাব্য রচনার চেষ্টা একেবারে ত্যাগ করেননি। তারপরেও ইংরেজিতে কবিতা লিখেছেন। তবে তাঁর উপদেশ বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চা করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করে থাকবে।

The Captive Ladie থেকে কাঙ্ক্ষিত খ্যাতি অথবা স্বীকৃতি না-পেয়ে তিনি হতাশ হলেন, কিন্তু হাল ছেড়ে দিলেন না। বরং নিজেকে আরো ভালো করে তৈরি করার সংকল্প নিলেন। অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করলেন অনেকগুলো ধ্রুপদী ভাষা। ফেব্রুআরি মাসে গৌরদাসকে যে বইগুলো পাঠাতে বলেছিলেন, সেগুলো নিরাপদে তাঁর হাতে এসে পৌঁছলো অগস্ট মাসের মাঝামাঝি। সেই সঙ্গে এসেছিলো বেথুনের প্রশংসাবর্জিত কঠোর উপদেশ। তার ওপর ঠিক সেই সময়ে — বিয়ের ঠিক এক বছর আঠারো দিন পরে — ১৮ অগস্টশনিবার শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়ার দিন জন্ম নিলো তাঁদের প্রথম সন্তান — ব্যর্থ।৬৭ আনন্দ করবেন, না মাথার চুল ছিঁড়বেন, ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। কারণ, তাঁর হাত একেবারে খালি। সাধারণ খুচরোও নেই পকেটে ঝুনঝুন করে যা বাজতে পারে। ‘এই মুহূর্তে আমার অভাব এমন প্রকট যে, কোনো দর্শন দিয়েও একে সহনীয় করে তোলা সম্ভব নয়। বেথুনের মন্তব্য সম্পর্কে আমার অনেক কিছুই বলার মতো আছে, কিন্তু সময়টা এখন বড্ডো খারাপ যাচ্ছে।’৬৮

উদ্‌বেগ আর দুশ্চিন্তার সেই অসহ্য পরিবেশে নিজের সৃষ্টিকে আরও মহৎ করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি কষে লেখাপড়া আরম্ভ করেছিলেন। ছাত্র ছিলেন না তিনি। কিন্তু অধ্যয়নকেই তপস্যা বলে গণ্য করেছিলেন। সকালে দু ঘণ্টা পড়েন হিব্রু, দুপুরের পর দু ঘণ্টা গ্রীক, বিকেলে তিন ঘণ্টা তেলেগু এবং সংস্কৃত, সন্ধ্যে বেলায় দু ঘণ্টা ল্যাটিন আর রাতের বেলায় তিন ঘণ্টা ইংরেজি — মোট বারো ঘণ্টা। (এ ছাড়া, পেট চালানোর জন্যে মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের ছেলেদের স্কুলে পড়ানো আছে চার ঘণ্টা। অ্যাসাইলামের বিপোর্টে ক্লাসের সময় দেখানো হয়েছে মোট সাত ঘণ্টা।) ‘কী বলো, পূর্বপুরুষদের ভাষাকে অলঙ্কৃত করার জন্যে তৈরি হচ্ছি না যথেষ্ট মাত্রায়?’৬৯ লেখাপড়া করার এই সময়সূচী তৈরি করেছিলেন বেথুনের মন্তব্য পাওয়ার আগেই। ভবিষ্যতে মহৎ কাব্য রচনার জন্যে আরো অধ্যয়নের উদ্‌যোগের কথা বন্ধুকে লিখলেন সরবে — এর মধ্যে গর্ব করার মনোভাব যেমন রয়েছে, তেমনি রযেছে বন্ধুকে সান্ত্বনা দেবার প্রয়াস। গৌরদাস বেথুনের উপদেশ পেয়ে তাকে ধ্রুব সত্য বলে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি নিজে এই সমালোচনায় দুঃখিত হয়েছিলেন। মধু কতোটা মর্মাহত হবেন, তাও তিনি অনুমান করতে পারছিলেন। শোকার্ত আপনজনকে মানুষ যেমন সান্ত্বনা দেয়, গৌরদাস তেমনি মধুসূদনকে প্রবোধ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে সান্ত্বনা দিয়ে লিখেছিলেন যে, মধু বাংলায় কাব্য লিখলে অসাধ্য সাধন করতে পারবেন।৭০ গৌরদাসের এই হতাশার সুর মধু নিশ্চয় শুনতে পেয়েছিলেন, তাঁকে চাঙ্গা করার জন্যে তাই অধ্যয়ন এবং পূর্বপুরুষের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন অমন দুঃসময়ে। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন — পূর্বপুরুষের ভাষাকে অলংকৃত করার জন্যে আমি কি তৈরি হচ্ছি না?’ — থেকে বোঝা যায়, বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করবেন বলে তিনি এর আগে থেকেই মনে মনে সংকল্প নিয়েছিলেন।

এই চিঠি লেখার পর গৌরদাসের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নাটকীয়ভাবে কমে যায়। যেমন হঠাৎ চিঠিপত্রের আদানপ্রদান শুরু হয়েছিলো, তেমনি হঠাৎ আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। তা না হলে আমরা জানতে পারতাম, ধ্রুপদী ভাষা চর্চা করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কতোটা সাহিত্য পাঠ করছিলেন। কী কী পাঠ করছিলেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ না-থাকলেও, অনুমান করা সম্ভব, পরে কলকাতায় ফিরে তিনি যে-সাহিত্য রচনা করেছিলেন, তা তিনি শূন্য থেকে পাননি; বরং তার ভিত্তি খানিকটা তিনি তৈরি করেছিলেন এ সময়ে। যদিও ১৮৪৯ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে ১৮৫২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা এবং একই সঙ্গে একাধিক পত্রিকা সম্পাদনার কাজ নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায়, কতোটা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। অবশ্য স্কুলে যোগ দেবার পরবর্তী বছর তিনেক তিনি সে সুযোগ পেয়েছিলেন।

The Captive Ladie বই আকারে প্রকাশের সময়ে রিচার্ড নেইলরের নাম বাদ দিয়ে তিনি সে বই নর্টনের নামে উৎসর্গ করলেও নেইলরের প্রতি তাঁর বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়েনি। প্রথম বিবাহ বার্ষিকী যখন ঘনিয়ে এলো, বার্ষিকীর তিন চার দিন আগে, তিনি আবার তাঁর নামে উৎসর্গ করলেন দুটি সনেট — কেবল নিজের বিয়েতে সহায়তা দেবার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নয়, বরং নেইলরের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষেও এ ছিলো তা একান্ত নিজস্ব উপহার। নেইলরের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী ছিলো ২৯ জুলাই। এই সনেট দুটির মধ্য দিয়ে কবিব নিজের মনের প্রগাঢ় বেদনা প্রকট হয়ে দেখা দিলো।

Richard! there is a grief which few can feel;

It cuts into the bosom’s deepest core,

And with unwearied fingers aye doth steal

Its summer gladness, and its faery store

Of hopes and aspirations.

এ এমন মর্মাঘাতী বেদনা যা সব ছারখার করে দেয়। পবিত্রতম দৈববাণীও তারপর কোনো সান্ত্বনার মলম লাগাতে পারে না। এই কবিতা দুটিতে পারিবারিক কোনা দুঃখের ইঙ্গিত নেই। সে পর্যায়ে বিবাহ নিয়ে কোনো সংকট দেখা দেয়নি, স্ত্রীর সঙ্গে প্রণয়েও ভাঁটা পড়েনি। যদিও সংসারে নিদারুণ অভাব আছে, সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে প্রথম সন্তান হতে যাচ্ছে। কিন্তু সে রকমের সমস্যা সম্পর্কেও এ কবিতায় কোনো আভাস নেই। এ হলো কবির মর্মস্থলে জমাট বাঁধা দুঃখের গাঢ় কুয়াসা — when morrow smiles it dies away. অলৌকিক আনন্দের উল্টো পিঠে যে-অপার বেদনা থাকে এ সেই ব্যাখ্যার অতীত অকারণ দুঃখ, অন্য কিছু নয়। জনারণ্যে থেকেও নিঃসঙ্গতার যে-দুর্বিষহ বিষাদ কবিকে বিপন্ন করতে পারে, এ সেই ব্যথা। পরেও দেখা যাবে, এ রকমের ব্যাখ্যাতীত ব্যথার কথা তিনি অনেক বার বলেছেন। আপাতসুখের মধ্যেও বুক ভাঙ্গা হাহাকার করেছেন।

মাইকেল এবং রেবেকা তাঁদের প্রথম আদরের সন্তানের নাম রাখেন বেশ জমকালো দেখে — ব্যর্থা ব্লানশ। এর সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন একটি বংশনাম — কেনেট। তাঁদের দুঃখের দিনে মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের সেক্রেটারি চার্লস কেনেট তাঁদের যে-সমর্থন এবং সহানুভূতি দিয়েছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যে মেয়ের নামের সঙ্গে তাঁর নাম জুড়ে দিয়েছিলেন। চার্লস কেনেটও তাতে খুশি হয়েছিলেন। তিন মাস পরে, ১৫ নভেম্বর যখন ব্যর্থার ব্যাপটিজম হয়, তখন অন্যদের মধ্যে চার্লস কেনেটও চার্চে হাজির হয়েছিলেন। আব এসেছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জে আর নেইলর৭১ — বিয়ের সময়ে যিনি কেবল সাক্ষীই ছিলেন না, বরং বিরোধিতার মুখে তাঁদের দিয়েছিলেন নৈতিক সমর্থন। তিনি ছিলেন কবির কাছে অনেকটা মাদ্রাসের গৌরদাসের মতো।

গৌরদাসকে লেখা চিঠি থেকে বোঝা যায়, সন্তানের জন্মে কবি উচ্ছসিত হয়েছেন।৭২ আগের মাসে গৌরদাসের চিঠি থেকে খবর পেয়েছিলেন যে, তাঁর কাছে মধুর খবর পেয়ে বাবামা ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন, বিশেষ করে মা। আদরের একমাত্র সন্তানের জন্যে কয়েকটা জিনিশ দিয়ে মা একটা পোটলা বেঁধে দিয়েছিলেন গৌরদাসের হাতে। অনুরোধ করেছিলেন সেটা মধুর কাছে পাঠিয়ে দিতে। (কী ছিলো সেই পোটলাতে? সেকালে একজন সাধারণ বাঙালি মা কী পাঠাতে পারতেন যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন, পর-হয়ে যাওয়া তাঁর খৃস্টান সন্তানকে?) গৌরদাস সম্ভবত লিখেছিলেন মায়ের অনুযোগের কথা। গৌরদাসের নিজের অভিযোগের কথা — মধু মায়ের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন। কবি তার উত্তরে বন্ধুকে লিখলেন, মায়ের আঁচলের তলায় মানুষ কি চিরদিন লুকিয়ে থাকতে পারে? বাস্তব পৃথিবীতে সবার নিজের নিজের পথ করে নিতে হয়।৭৩ সাত বছর আগে — ১৮৪২ সালের নভেম্বর মাসেও একবার বন্ধুকে অ্যালেকজান্ডার পোপের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, কবিতার জন্যে দরকার হলে বাবামাকেও ছাড়তে হয়। তবে কলকাতায় যেতে না-পারলেও, সন্তান জন্মের পর আনন্দে উদ্বেল কবির মনে হলো: বাবামাকে খবরটা এই মুহূর্তে জানানো দরকার। তাই বন্ধুকে লিখলেন: ‘চিঠিটা পেয়েই বাবাকে জানিয়ো আমার একটি মেয়ে হয়েছে। আমার এমন বাংলা জানা নেই যাতে করে খবরটা তাঁকে লিখতে পারি।’৭৪

প্রথম যৌবন থেকে মাইকেল ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিলেন, সেই সঙ্গে সজ্ঞানে বাংলা ভোলারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তবু তাঁর মাতৃভাষা এবং পাঠ্য বিষয় হিশেবে বাংলা তাঁকে পড়তে হযেছে দীর্ঘ দিন। যে-রামচন্দ্র মিত্রকে শ্রদ্ধার সঙ্গে The Captive Ladie-র একটি কপি পাঠিয়ে-ছিলেন, হিন্দু কলেজে কবি তাঁর কাছে নিশ্চয় বাংলা পড়েছিলেন, নয়তো হঠাৎ আকাশ থেকে তাঁর মনে এই শিক্ষক সম্পর্কে শ্রদ্ধা আসেনি। হিন্দু কলেজের জুনিয়র শাখায় রামতনু লাহিড়ীর কাছেও তিনি বাংলা পড়েছিলেন। (রামতনু লাহিড়ী হিন্দু কলেজে যোগদান করেন মধু সে কলেজে ভর্তি হবার চার বছর আগে — ১৮৩৩ সালের পয়লা জুলাই।) বিশপস কলেজেও বাঙালি ছাত্রদের বাংলা এবং সংস্কৃত শিখতে হতো। মাইকেল ব্যতিক্রম ছিলেন কিনা জানা যায় না। সে জন্যে বলতে হয়, বাংলা ব্যবহার না-করে, নিজের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া অসম্ভব নয়, তাই বলে বাবাকে সন্তান হবার খবর লিখে জানানোর মতো বাংলাও তিনি ১৮৪৯ সাল নাগাদ ভুলে গিয়েছিলেন, এমনটা মনে করা শক্ত। তাঁর বহু ভানের মধ্যে বাংলা ভুলে যাবার প্রসঙ্গও একটা। এর মধ্য দিয়ে তিনি দেখাতে চাইতেন, তিনি কতোটা খাঁটি ইংরেজ বনে গিয়েছেন।

সন্তান জন্মের পর আর্থিক অনটনে তিনি যখন অস্থির হয়ে পড়েন তখন তিনি আর অরফ্যান অ্যাসাইলামের আশার অর্থাৎ সহকারী শিক্ষক ছিলেন না। ইতিমধ্যে তাঁর পদোন্নতি ঘটেছিলো। অ্যাসাইলামের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে মনে হয়, তিনি ছিলেন এ সময়ে (১৮৪৯ সালে) স্কুলের প্রধান এবং একমাত্র শিক্ষক। পরের বছর এপ্রিল মাসে Eurasian পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি রচনা থেকেও বোঝা যায়, তিনি তখন অরফ্যান অ্যাসাইলামের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমাদের হাতে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু মনে হয় অরফ্যান অ্যাসাইলামেব চাকরি ছাড়াও, তিনি বাড়তি আয়ের জন্যে পত্রপত্রিকায় লিখতেন। এটা মনে করার কারণ এই যে, ১৮৪৯ সালে তাঁকে সম্পাদক নিয়োগ করে Madras Advertiser পত্রিকার মালিক অ্যাবেল পেন সিমকিন্স Eurasian নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রপত্রিকার সঙ্গে আগে থেকে কোনো রকমের যোগাযোগ না-থাকলে, একেবারে অভিজ্ঞতাহীন একজন লোককে সম্পাদক করে একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা সিমকিন্স ভাবতেন না। আমাদের অনুমানের দ্বিতীয় কারণ, তিনি এই পত্রিকা বেশ যোগ্যতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। এই যোগ্যতা তিনি কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া অর্জন করেছিলেন, এমনটা মনে করা সঙ্গত নয়।

অ্যাবেল পেন সিমকিন্সের প্রেস থেকে কবি তাঁর প্রথম কাব্য ছাপিয়েছিলেন, ইতিপূর্বে তা উল্লেখ করেছি। সিমকিন্স ছিলেন দক্ষ মুদ্রক এবং প্রকাশক। তিনি তাঁর ছাপাখানা থেকে একই সঙ্গে একাধিক পত্রিকা বের করেন এবং পত্রিকাগুলো বেশ কিছু দিন টিকে থাকে, তা থেকে তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। মাদ্রাসে সেকালে একটি বড়ো ইউরেশিয়ান সম্প্রদায় বাস করতো। (১৮৭৫ সালে এঁদেরসংখ্যা দাঁড়ায় বারো হাজারে।) তিনি অনুমান করেছিলেন যে, বিশেষ করে ইউরেশিয়ানদের স্বার্থের কথা মনে রেখে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে পারলে তা জনপ্রিয় হবে। ওদিকে মাইকেল দেশীয় হলেও, আধা-ইংরেজ ছিলেন। তা ছাড়া, তাঁর একটি পূর্ণকালীন চাকরিও ছিলো। পত্রপত্রিকায় লিখে ইতিমধ্যে ইংরেজি ভাষা এবং সাংবাদিকতায় তাঁর যোগ্যতারও পরিচয় দিয়েছিলেন। অ্যাবেলের মনে হলো: অল্প বেতনে এঁর চেয়ে ভালো সম্পাদক আর হয় না। এ জন্যে তাঁকে সম্পাদক করে ৩ নভেম্বর (১৮৪৯) থেকে তিনি এ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকা প্রকাশিত হতো প্রতি শনিবার।

Eurasian পত্রিকা নানাভাবে কবিকে সাহায্য করেছিলো। বিশেষ করে, সামান্য হলেও, নিয়মিত বাড়তি আয়ের রাস্তা খুলে দিয়েছিলো এ পত্রিকা — আসলে এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এর হাল ধরতে রাজি হয়েছিলেন। কন্যার জন্মের পরে দারুণ অভাবের মধ্যে এই বাড়তি আয় বিশেষ কাজে এসেছিলো। তা ছাড়া, এ পত্রিকা তাঁর রচনা প্রকাশের একটা প্রশস্ত মাধ্যম হয়ে দাঁড়ালো। প্রথম যৌবন থেকে তিনি লিখেছেন এবং নিজের লেখার মান সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণাও পোষণ করেছেন। তাঁর ‘সেই উচু মানের কবিতা’ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি কতো না সম্পাদকের তোয়াজ করেছেন। Bentley’s Miscellany-সহ কতো পত্রিকায় তিনি কবিতা পাঠিয়েছিলেন প্রকাশের জন্যে। খুব অনুনয় করে চিঠিও লিখেছেন কোনো কোনো সম্পাদকের কাছে। কলকাতার Literary Gleaner ইত্যাদি পত্রিকায় মাঝেমধ্যে কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বটে, কিন্তু প্রতিবারেই কবিতা পাঠিয়ে ছাপা হয় কিনা, তা দেখার জন্যে তীর্থের কাকের মতো তাঁকে তাকিয়ে থাকতে হতো। মাদ্রাসের দুটি প্রধান পত্রিকা Athenæum এবং Spectator-এও তাঁর মাদ্রাসে আগমনের পর প্রথম প্রায় দু বছর কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়নি। এক মাত্র অবলম্বন সেই Madras Circulator। কবি হয়তো অনেকবার ভেবেছেন, তাঁর যদি একটা পত্রিকা থাকতো! সে জন্যে Eurasian-এর দায়িত্ব পেয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন। হোক না অপ্রতিষ্ঠিত, অজ্ঞাতপরিচয়, সদ্যপ্রকাশিত পত্রিকা, তবু Eurasian-এর তিনি সম্পাদক। এখন থেকে তাঁর রচনা প্রকাশে আর কোনো বাধা থাকলো না। তা ছাড়া, তিনি বোধ হয় এ-ও ভেবেছিলেন যে, কী করে পত্রিকা চালাতে হয়, তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ সম্পাদকদের তা দেখিয়ে দেবেন। তিনি যা ধরতেন, কষেই ধরতেন। Eurasian-ও তিনি চালাতে আরম্ভ করলেন আন্তরিকতা আর উৎসাহের সঙ্গে।

Eurasian-এ বিজ্ঞাপন থাকতো, স্থানীয় এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকতো, চিঠিপত্রের কলাম থাকতো। আর থাকতো সেকালের পত্রিকার জন্যে অত্যাবশ্যক বিষয়, যেমন জাহাজ চলাচলের খবর, সেনাবাহিনীর খবর, আদালতের খবর ইত্যাদি। অন্যান্য পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতিও থাকতো সেকালের পত্রিকায় — বিশেষ করে লন্ডনের এবং কলকাতার পত্রপত্রিকা থেকে। Spectator পত্রিকা মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে শুক্রবারের সংখ্যায় একটি ক্রোড়পত্রিকা বের করতো সাহিত্য সম্পর্কে। তাতে লন্ডনের বাসি মালমশলাই থাকতো প্রধানত। কবি তাঁর পত্রিকা ভরে দিতে আরম্ভ করেন তাঁর নিজের রচনা দিয়ে। দ্বিতীয় সংখ্যা অর্থাৎ ১০ নভেম্বরের সংখ্যা থেকে তিনি Rizia: Empress of Inde কাব্যনাট্য প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন। তারপর ১২ জানুআরি পর্যন্ত এ নাটকের। মোট নটি দৃশ্য প্রকাশিত হয়।৭৫

Rizia-র বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক উভয় সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিনব। সেকালের বাঙালি সাহিত্যিকরা মুসলিম বিষয়বস্তু নিয়ে সাহিত্য রচনার কথা ভাবতে পারতেন না। এ রকম বিষয়বস্তুর প্রতি তাঁদের যেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না, তেমনি পাঠকরাও এতে উৎসাহী হবেন বলে তাঁরা মনে করতেন না। কিন্তু মাইকেল চিরাচরিত পথে হাঁটার পাত্র ছিলেন না। আদর্শের খাতিরে যিনি নিজের ধর্ম বিসর্জন দিয়েছিলেন, স্বজন এবং স্বসমাজকে ত্যাগ করতে ভয় পাননি, তাঁর মূল্যবোধ যে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী! তিনি সে জন্যে গতানুগতিক পথে না- চলে আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর রচনায় বারবার পরীক্ষানিরীক্ষা করতে দ্বিধা বোধ কবেননি। বরং সেটাই ছিলো তাঁর স্বভাবসিদ্ধ। Rizia-ও এর ব্যতিক্রম ছিলো না।

প্রথম অধ্যায়ে লক্ষ্য করেছি, বাল্যকালে মধু ফারসি পড়েছিলেন। ফারসি অবশ্য সেকালের অন্য লেখকরাও কমবেশি পড়েছিলেন। সুতরাং কেবল ফারসি পড়ার ঘটনাটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু তাঁর প্রসঙ্গে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ফারসি ভাষা তাঁর মনে কোনো দাগ না-কাটলেও, ফারসি সাহিত্য এবংমুসলমানি বিষয়বস্তু তাঁর মনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিলো। বিশেষ করে সাদির রচনার প্রত্যক্ষ প্রভাব তাঁর একাধিক রচনায় দেখা যায়। তা ছাড়া, তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলমানি বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন একটা তেজ এবং প্রবল আবেগ অথবা প্যাশন আছে, শক্তিশালী সাহিত্যিক যাকে খুব সুন্দরভাবে কাজে লাগাতে পারবেন।৭৬ পরেও দেখা যাবে, তিনি একাধিক বার এ রকম বিষয়বস্তু নিয়ে সাহিত্য রচনা করার সংকল্প প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রত্যেক বার তাঁর পৃষ্ঠপোষক অথবা বন্ধুরা তাঁকে সে পথ থেকে সরিয়ে রেখেছেন। সমকালের তুলনায় তাঁর মনে এই অসাধারণ চেতনা বিকাশের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি তাঁর বন্ধুদের তুলনায় শুধু নয়, তাবৎ বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় একটা জায়গাতে আলাদা — তিনি নিজের ধর্মের বন্ধন কেটে অন্য একটি ধর্মগ্রহণ করেছিলেন। তারপর কয়েক বছরের মধ্যে সে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার প্রতিও আনুগত্য হারিয়ে ফেলেন। মোট কথা, কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে তিনি একাত্ম বোধ করতে পারেননি — না তাঁর আদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে, না তিনি যে-সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে চেয়েছিলেন, সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে। বরং তিনি নিজের সম্প্রদায় থেকে দূরে সরে যাবার দরুন এবং য়োরোপীয় মুক্তবুদ্ধির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করার কারণে একটা অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক চেতনা স্বীকরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অন্তত বঙ্গদেশের নাগরিক সমাজে সেকালে যে-প্রবল হিন্দু-মুসলমান ভেদবুদ্ধি জনপ্রিয় ছিলো,তিনি তার ঊর্ধ্বে উঠতে সমর্থ হয়েছিলেন। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে এটাকে তাই একক না-বলে পারা যায় না।

Rizia নাটক রচনার মধ্য দিয়ে তিনি সম্রাজ্ঞী রিজিয়ার প্রশস্তি গাননি, মুসলমান সমাজেরও নয়। তিনি যে-কাহিনী বেছে নিয়েছেন, তা কতোটা ঐতিহাসিক সে সম্পর্কেও সন্দেহ আছে — যদিও তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এ নাটকের বিষয়বস্তু তিনি নিয়েছেন, অ্যালেকজান্ডার ডাও-এর অনূদিত মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতার ফারসি ভাষায় লেখা হিন্দুস্তানের ইতিহাস থেকে। কিন্তু রচনার ঐতিহাসিকতা প্রমাণের জন্যে তিনি বড়ো একটা ব্যস্ত ছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি ইতিহাসের মধ্য থেকে একটি মানবিক আগ্রহের কাহিনী বেছে নিতে চেয়েছিলেন। The Captive Ladie-তেও তাঁর একই মানসিকতা দেখতে পাই। তার মধ্যে রাজসূয় যজ্ঞ আছে, অস্ত্রের ঝনঝনানি আছে, কূটনীতি আছে, কিন্তু সেসব বহিরঙ্গের বিষয়। কবি আঁকতে চেয়েছেন একটি প্রণয়কাহিনী। Rizia নাটকেও তাঁর লক্ষ্য অভিন্ন। বরং এ নাটকে তিনি এঁকেছেন একটি অসামাজিক প্রেমের কাহিনী এবং, সে কারণে, সে কাহিনী আরো প্রবল আবেগ এবং আকর্ষণের। এই কাব্যনাট্যে একটা অসাধারণ জিনিশ লক্ষ্য করি সে হলো: এতে হিন্দু, মুসলিম এবং গ্রীক — এই তিন পুরাণ থেকে তিনি অবলীলায় মালমশলা ব্যবহার করেছেন। সেকালের ভারতবর্ষে এটা করতে পারতেন মুষ্টিমেয় যে-কজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁদের অন্যতম। অন্য যাঁরা শিক্ষিত ছিলেন, তাঁদের অনেকে হিন্দু এবংগ্রীক পুরাণ জানলেও, মুসলিম ‘পুরাণ’ জানতেন না; অথবা জানলেও তাকে নিজেদের রচনায় ব্যবহার করার মতো ঔদার্য অথবা অনুরাগ তাঁদের ছিলো না।

মাইকেলের এই নাট্যকণা অনুযায়ী রিজিয়ার সঙ্গে প্রণয় ছিলো তাঁরই এক ক্রীতদাস — জামালের। কিন্তু তাঁর এই প্রণয়কে, স্বাভাবিকভাবেই, হিংসার চোখে দেখতেন তাঁর সাবেক স্বামী সিন্ধুর সুলতান আলতুনিয়া। ষড়যন্ত্র করে আলতুনিয়া তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং জামালের ছিন্নমস্তক উপহার দেন। তা ছাড়া, রিজিয়ার বন্দী ভ্রাতা বাইরমকে মুক্তি দেন আলতুনিয়া। অতঃপর বাইরম হন ভারতের সম্রাট। আর রিজিয়া প্রথমে বন্দিনী এবং পরে নিহত হন। এই কাহিনীর মধ্যে যে-আবেগ, নাটকীয় উত্থান-পতন এবং সহিংসতা আছে তা মাইকেলের কল্পনাকে উস্কে দিয়েছিলো।

রিজিয়া যখন বিদ্রোহের একেবারে মুখোমুখি হন, তাঁকে বন্দী করার জন্যে এগিয়ে আসছে তাঁর শক্ররা, সেই নাটকীয় মুহূর্তটি মাইকেল অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন:

Riz. (Rising) Stand off-and dost thou dare–

Several We dare…

Kab. (From behind) That’s right…be bold and seize her, friends

Riz. Summon my guards!

1st T.C. All gone t’ imperial Delhi,

To ravel in the coronation feast

O’thy brother Byram…

Riz. Miscreant! thou lyest…call Jammal…

ঠিক সেই মুহুর্তে দ্বিতীয় তুর্কি আমীর জামালের ছিন্ন মস্তক এগিয়ে দিলো রিজিয়ার দিকে:

2nd T.C. Here he is

(Throwing down the head of Jammal)

Riz. O God!

বিস্ময় এবং আঘাত কাটিয়ে উঠে অতঃপর সম্রাজ্ঞীর মতোই রিজিয়া তেজ, বীরত্ব এবং দৃঢ়তা প্রকাশ করেন। বস্তুত, মাইকেল পরবর্তী সময়ে প্রমীলা এবং বীরাঙ্গনার যে-তেজোদ্দীপ্ত ও বীরনারীদের চরিত্র অঙ্কন করেছিলেন, তাদের আভাস এখানেই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো: Rizia-তে তিনি কেবল নায়িকার বীরত্ব দেখাতে চাননি। তাঁর কোমল নারী হৃদয়ের ছবি পাঠকের কাছে তুলে ধরাই ছিলো কবির আসল উদ্দেশ্য। রিজিয়া নির্বাসিত হবার আগের অবসর মুহুর্তে স্বগতোক্তি করছেন:

And is this all? It is a dream…

A hideous-hideous dream! Wake Rizia! Wake…

And let no idle dreams now daunt my heart,

Wake, empress of proud Inde!

(She rises)

Why shouldn’t thou fear?

Earth hath no glory brighter than thine own!-

They talked of Byram…of my brother Byram…

Poor Byram! I did love him…where is he?

The tenant of an iron-mused dungeon!

Fy! ‘twas a baseless dream!

(She turns round and sees the head of Jammal)

O God! O God!

And art thou there, mute witness of dead truth!

Then ‘twas no dream? Can’st thou not speak? An empress

Ev’n when a mighty empress questions thee?

O that this heart will break! But sleep in peace!

এই দৃশ্যে যে উত্তম কাব্য এবং নাটকীয়তা আছে, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি কলকাতায় এসে বছর আটেক পরে নাটক রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু করেছিলেন। যথাসময়ে দেখতে পাবো, প্রথম নাটকেই তিনি অসামান্য সাফল্য এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। নাটক রচনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এটা প্রায় অসম্ভব হতো। বস্তুত, Rizia রচনার মাধ্যমে তাঁর নাটক রচনাব হাতেখড়ি হয়েছিলো। এ নাটক নিয়ে তিনি কতো ভেবেছিলেন এবং কতো বার এক-একটা অংশের খসড়া করেছিলেন, কে জানে! কিন্তু নাটকটি তিনি শেষ করতে পারেননি। আমার ধারণা, শিক্ষকতা এবং পত্রিকা সম্পাদনার কাজের ওপর প্রতি সপ্তাহে আবার একটি করে দৃশ্য লেখার প্রতিযোগিতার সঙ্গে তিনি শেষ পর্যন্ত এঁটে উঠতে পারেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কাহিনীর প্রতি তাঁর প্রেম কোনো কালেও লোপ পায়নি। পরে কলকাতায় যখন তিনি একটির পর একটি সফল নাটক লিখেছেন, তখনো রিজিয়ার কাহিনী নিয়ে একবার একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনার সংকল্প প্রকাশ করেছেন। লিখেও ফেলেছেন অর্ধ শত পঙ্‌ক্তি। তারপর ইংল্যান্ড থেকে ফিরে সাহিত্যের আসর থেকে বিদায় নিয়ে তিনি যখন বিচারপতির দরবারে হাজির হয়েছেন, তখনোও আর-একবার এই কাহিনীর নাট্যরূপ দেবার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সাধ থাকলেও, সে নাটক লেখার শারীরিক অথবা মানসিক সাধ্য, এমন কি, অবকাশ তাঁর তখন আর ছিলো না।।

Rizia শেষ করতে না-পারলেও, এই নাট্যকণার প্রতি তাঁর কেবল দরদ নয়, গর্বও ছিলো। সে জন্যে Rizia প্রকাশিত হবার পরে তিনি মাদ্রাসে যেসব কবিতা প্রকাশ করেছিলেন, তার অনেকগুলোতে নিজের নাম না-লিখে লিখেছেন ‘Rizia-র রচয়িতা’। মনের মধ্যে এ নাটিকা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ না-করলে তিনি এভাবে তাঁর পরিচয় দিতেন না। বরং হয়তো লিখতেন ‘The Captive Ladie-র রচয়িতা।’ তাঁর Rizia নাট্যকণা সম্পর্কে তিনি কী ভাবতেন, তাঁর সে সময়কার কোনো চিঠিপত্র থাকলে জানা যেতো। The Captive ladie ছাপা হবার সময়ে যখন তিনি তার অনামা কাব্যটি লিখছিলেন, তখনই এই দুই কাব্য সম্পর্কে তাঁর ধারণার কথা তিনি অকপট উচ্ছাসের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে Rizia-র দু কিস্তি ছাপা হবার পরেই আগের নভেম্বর মাস (১৮৪৯) থেকে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গৌরদাসসহ বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্র লেখায় ছেদ পড়ে। দোষটা মাইকেলের নয়। তিনি গৌরদাসকে শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘তোমরা কি সবাই মরে গেছে? নাকি না-জেনে আমি কোনো অপরাধ করে ফেলেছি? ভূদেব অথবা তোমার কাছ থেকে তিন মাসেও একটি লাইন পেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। ভূদেব, স্বরূপ তোমরা সবাই এক-একটা হামবাগ।’ নিজের সম্পর্কে আর তাঁর কীর্তি সম্পর্কে অনেক কথা যে বলার আছে, তা জানতে পাই এই চিঠিরই একটি কথা থেকে। লিখেছেন: ‘নিজের কথা কিছু বলার লোভ সম্বরণ করছি। কারণ ইতিমধ্যে তুমি যদি পঞ্চত্ব পেয়ে থাকো, তা হলে আমি চাইনে আমার এ চিঠি অন্য কারো হাতে পড়ুক। দোহাই তোমার চিঠি লিখো। ইতি তোমার দারুণ ক্রুদ্ধ ইত্যাদি।’৭৭ এ চিঠি গৌরদাস পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও, তাঁর সঙ্গে কবির চিঠিপত্রের যোগাযোগ কেন ছিন্ন হলো বোঝা যায় না। কেবল গৌরদাস নন, এরপর ছ বছর এক মাসের মধ্যে অন্য বন্ধুদের কাছে লেখা কোনো চিঠিও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এলেও, গৌরদাসের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো, এমনটা মনে করার কারণ নেই। ১৮৫১ সালের জুলাই এবং ১৮৫২ সালের এপ্রিল মাসে লেখা গৌরদাসের অন্তত দুটি চিঠি পাওয়া গেছে এবং তা থেকে মনে হয় তাঁদের মধ্যে সামান্য যোগাযোগ তখনো রয়েছে। গৌরদাস তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে (১৮৫২ সালের) আরো উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি মাইকেলের পাঠানো Hindu Chronicle পত্রিকা পাচ্ছেন (নিশ্চয় সৌজন্য সংখ্যা)।৭৮ এ-ও যোগাযোগ বহাল থাকার ইঙ্গিত।

Eurasian প্রকাশিত হবার পর কবি ভেবেছিলেন, তিনি হাতে একটি পত্রিকা পেয়েছেন, অতঃপর প্রাণের আনন্দে একের পর এক রচনা প্রকাশ করতে থাকবেন। Rizia প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর এ সংকল্পের খানিকটা আভাসও পাই। কিন্তু ১৮৫০ সালের প্রথম দিকে থেকে হঠাৎ তাঁর রচনার ধারা যেন শুকিয়ে গেলো। এর কোনো কারণ আমাদের জানা নেই। তবে Rizia শেষ করতে না-পারার যে-কারণ উল্লেখ করেছি, সৃজনশীলতা রুদ্ধ হবার কারণও হয়তো তাই। অর্থাৎ পূর্ণকালীন শিক্ষকতা, শিশুকন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করা, অধ্যয়ন এবং একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনা — এর পর আর কাব্য অথবা নাটক রচনার অবসর তাঁর হাতে ছিলো না। আমার ধারণা, তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু, সংস্কৃত, ইংরেজি অধ্যযনের যে-সময় তালিকা পাঠিয়েছিলেন বন্ধুকে, সে তালিকা অনুযায়ী লেখাপড়া করার কর্মসূচীও বেশি দিন বজায় রাখতে পারেননি। উৎসাহের অভাব ছিলো না, সময়ের অভাব এবং পরিবেশের প্রতিকূলতাই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৫০ সালের ১২ জানুআরির পর কেবল Rizia-ই বন্ধ হলোনা, প্রকৃতপক্ষে,নতুন রচনা প্রকাশই প্রায় বন্ধ হলো। কিন্তু তিনি যে শুধু একজন পত্রিকা লেখক নন, তিনি যে একজন কবি,তার প্রমাণ তিনি দিতে থাকেন কলকাতায় প্রকাশিত পুরোনো কোনো কোনো কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। এসব রচনার মধ্যে একটি ছিলো King Porus। তা ছাড়া, তিনি ডিএলআর এবং শশিচন্দ্র দত্তের কবিতাও পুনঃপ্রকাশ করেছিলেন।৭৯

ওদিকে, সন্তান জন্ম দেবার পর, রেবেকার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিলো। অতঃপর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের আশায় এবং স্বজনদের সঙ্গে কিছুকাল বাস করার জন্যে রেবেকা বেড়াতে যান উত্তরে (জন্মস্থান নাগপুরে?), সম্ভবত ফেব্রুআরি মাসের শেষ দিকে। এক বছর সাত মাসের মধ্যে রেবেকার সঙ্গে এই প্রথম বিচ্ছেদ। আদরের শিশুকন্যার সঙ্গেও। কবির এই বিচ্ছেদের বেদনা প্রকাশিত হয়েছে On the Departure of My Wife and Child to the Upper Provinces নামে একটি কবিতায়। কবিতাটি বের হয় ১ মার্চের (১৮৫০) Eurasian-এ। সেই বেদনাই প্রতিফলিত হয়েছে এই একান্ত ব্যক্তিগত কবিতায়। কবি বলেছেন:

My home is lonely – for I seek in vain

For them who made its star-light: there’s a cry

Of anguish fiercely wrung by untold pain

E’en from heart of heart’s! Hear it on high!

কেবল যে স্ত্রী এবং সন্তানের জন্যে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তা-ই নয়, তিনি বিধাতার কাছেও প্রার্থনা জানিয়েছেন তাঁদের জন্যে। তিনি বলেছেন, ‘হে স্বর্গীয় পিতা, তোমার কাছেই আমরা ফিরে যাই, তবে আমাদের আনন্দের মুহূর্তে নয়, বরং আমাদের প্রগাঢ়তম দুঃখের দিনে। তুমি আমাদের দুঃখের কথা শোনো এবং আমাদের যন্ত্রণাকে মোচন করো।’

O Mercy throned thou, whose eyes of light

Aye beam with sleepless love – to thee I kneel

For them – the lov’d – the loving! yes to thee,

O Lord – our God of glorious majesty.

রেবেকার সঙ্গে কবির এই প্রথম বিচ্ছেদ দেখা দিলেও, এই বিচ্ছেদের সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটে যা পরে চিরবিচ্ছেদের সূচনা করেছিলো। কিন্তু সে সম্পর্কে রেবেকা অথবা মাইকেল কেউই তখন অবগত ছিলেন না। রেবেকা উত্তর দিকে যাত্রা করার কয়েক সপ্তাহ পরে — ১১ এপ্রিল তীর ভাবী প্রতিদ্বন্দ্বী কিশোরী হেনরিয়েটার মা মারা যান মাত্র ৪০ বছর ১১ মাস বয়সে।৮০ আমরা পরে দেখতে পাবো, এই মৃত্যুর ঘটনা দু-তিন বছর পরে হেনরিয়েটার সঙ্গে কবির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছিলো — যদিও এই মৃত্যুর সময়ে তারা পরস্পরকে চিনলেও ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন কিনা, তা বলা যাচ্ছে না। অন্তত তাঁদের মধ্যে প্রণয় সম্পর্ক গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা তখনো দেখা দেয়নি। সে যাই হোক, ঠিক কতো দিন পরে রেবেকা ফিরে আসেন, আমাদের জানা নেই — জুন মাসের আগেই। কারণ এই মাসে তিনি দ্বিতীয় বার গর্ভবতী হন।

পত্রিকা চালাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু কবির প্রধান আয়ের উৎস ছিলো অরফ্যান অ্যাসাইলামের শিক্ষকতা। ১৮৫০ সালের এপ্রিলে তিনি ছিলেন অ্যাসাইলাম স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তখন স্কুলের কোনো স্থায়ী প্রধান শিক্ষক ছিলেন না। স্কুলের পরিচালকরা এ কারণে বিলেত থেকে একজন শিক্ষক নিয়ে আসার কথা চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। Madras Circulator-এ এই রকম একটা সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিলো। মাইকেল এটাকে তাঁর পদোন্নতির এবং উচ্চতর বেতনের প্রতি একটা হুমকি বলে বিবেচনা করেন। তিনি একে নীরবে মেনে নিতে চাইলেন না। সে জন্যে, Eurasian-এর ২৯ এপ্রিলের সংখ্যায় এই প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করলেন। তিনি লিখলেন:

একজন ইরেশিয়ান শিক্ষকের জায়গায় একজন য়োরোপীয়ান শিক্ষক নিযোগের ঔচিত্য সম্পর্কে আমি শুধু প্রশ্নই করছিনে, আমি আপোশহীনভাবে এর বিরোধিতা করছি। এ স্কুলটি হলো বিশেষ করে একটি পূর্ব ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। তা হলে এই স্কুলের শিক্ষককে একজন যোরোপীয়ান হতে হবে কেন? যাঁরা চামড়ার রঙের পার্থক্যের কাছে নতি স্বীকারের শোচনীয় ক্রোধেব আগুন জ্বালানো অব্যাহত রাখেন, সেই অবলুণ্ঠিত মোশাহেবি এবং মানসিক দাসত্বের নিন্দা কবার মতো কঠোর ভাষা আমাদের জানা নেই।৮১

এই বক্তব্যে যে-তিক্ততা প্রকাশ পেয়েছে, তা থেকে মনে হয়, মাইকেল চোস্ত্ ইংরেজি-জানা লোক হলেও, তাঁর প্রতি বর্ণবাদী আচরণ কম লক্ষ্য করেননি। কলকাতা এবং মাদ্রাস, বস্তুত, উভয় জায়গায় কালো চামড়ার লোকেদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের ঘৃণা এবং অবিচারের বহু দৃষ্টান্ত তিনি দেখেছিলেন। কখনো কখনো নিজেও তার ভুক্তভোগী হয়েছিলেন। হিন্দু কলেজে বেশ কয়েকজন ইংরেজ শিক্ষক ছিলেন; কিন্তু, অনুমান করি, তাঁদের কারো মনের গভীরে বর্ণবিদ্বেষ থাকলেও প্রকাশ্যে তাঁরা তা দেখাতেন না। কিন্তু বিশপস কলেজে চামড়ার রঙ ভেদে পোশাক এবং পানীয়ের পার্থক্য করা হতো বলে তাঁর জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন। পোশাক নিয়ে মাইকেলের সঙ্গে যে-তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিলো, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার বর্ণনা দিয়েছেন।৮২ (এই গল্পের কোনো ভিত্তি আছে কিনা বলা মুশকিল। বিশপস কলেজের কাগজপত্রের মধ্যে এর কোনো উল্লেখ দেখতে পাইনি — যদিও এ ধরনের অন্য একটি বর্ণবাদী ঘটনার কথা উল্লিখিত হয়েছে। তা ঘটেছিলো তরুণ মাইকেল সে কলেজে ভর্তি হবার আগে।) এই কলেজের ছাত্রদের তালিকায় সব সময়ে সম্প্রদায়ের উল্লেখ থাকতো। ছাত্রদের বর্ণ অনুযায়ী তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হতো-ইংরেজ, ইউরেশিয়ান আর নেটিভ। কলেজের অধ্যক্ষ উইদার্স এবং অধ্যাপক রেভারেন্ড স্ট্রীট যতো জায়গায় কবির নাম উল্লেখ করেছেন, তার কোথাও মাইকেল বলেননি। ছাত্রদের তালিকায়ও কোথাও তাঁর নাম মাইকেল নয়। সর্বত্র তিনি মধুসূদন ডাট। এ থেকে সে কলেজে এক ধরনের সূক্ষ্ম বর্ণবিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং বর্ণবৈষম্যের অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে এই প্রথম নয়। তদুপরি, তাঁর নিজের জীবিকার প্রতি হুমকি লক্ষ্য করে তিনি একটু বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। নিজের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন:

এই বিদ্যালয়ের দায়িত্ব যাঁর ওপর অর্পিত রয়েছে মননশীলতা, প্রতিভা এবং কর্মশক্তির দিক দিয়ে তিনি কোনো য়োরোপীয়ানের তুলনায় ছোটো নন। তা ছাড়া ব্ল্যাকটাউনের মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামের তুলনায় যেসব স্কুলের লক্ষ্য অনেক উচু তিনি সেখানে কাজ করার উপযুক্ত।৮৩

অনুমান করি, এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে অ্যসাইলামের পরিচালকমণ্ডলীরও তিক্ততা হয়ে থাকবে। তবে অনেক উঁচু দরের স্কুলে কাজ করার উপযুক্ত হলেও, পরবর্তী দু বছর তিনি অ্যাসাইলাম স্কুলে পড়ে থাকতেই বাধ্য হন। তিনি যে-ধরনের স্কুলের কথা বলেছিলেন, মাদ্রাসে তেমন স্কুল একটাই ছিলো এবং জর্জ নৰ্টনের সুপারিশ এবং ভালো মানুষ হেডমাস্টার থাকা সত্ত্বেও সেখানে তখনকার মতো কোনো চাকরি তিনি পাননি।

অরফ্যান অ্যাসাইলামে দু-চারটি ভালো ছাত্র ছিলো; কিন্তু অযত্নে লালিত অনাথ সন্তানদের বেশির ভাগের লেখাপড়ার মান ছিলো নগণ্য। সে জন্যে, এ স্কুলে পড়িয়ে তিনি যে-দারুণ আত্মতৃপ্তি পেতেন, এমনটা মনে করার কারণ নেই। আমার ধারণা, জীবিকার খাতিরেই এ কাজ করছেন বলে তিনি মনে করতেন। Eurasian-এ লিখে তিনি কতোটা আনন্দ পেতেন, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে কবি। সাংবাদিকতার জন্যে আবশ্যিক পারিপার্শ্বিক জীবনের চলতি ঘটনাবলীর প্রতি তাঁর সত্যিকার আগ্রহ কতোটা ছিলো, আর কতোটা বাধ্য হয়ে সে সবের খোঁজখবর নিতেন, তা জানার উপায় নেই। তবু পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে যে-পরিচিতি এবং সম্মানের যোগ রয়েছে, তিনি তা থেকে যদি কোনো সান্ত্বনা এবং সন্তোষ পেয়ে থাকেন, তা হলে অবাক হবো না। পত্রিকা পরিচালনার কাজ তিনি খুব যোগ্যতার সঙ্গে করতেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর এই যোগ্যতার কারণে Eurasian পত্রিকা টিকে যায়। এ সময়ে — পত্রিকার মালিক ভাবলেন Eurasian পত্রিকাকে তিনি কেবল ইউরেশিয়ানদের জন্যে না-রেখে আর একটু বৃহত্তর ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবেন। তাতে পাঠক এবং ক্রেতাসমাজের পরিধি সম্প্রসারিত হবে। পত্রিকাটির নাম সে জন্যে তিনি পরিবর্তন করলেন। ১২ জুন (১৮৫০) থেকে এ পত্রিকার নাম হলো Eastern Guardian। এ ছাড়া, তিনি দেশীয়দের জন্যে চালু করলেন একটি নতুন পত্রিকা। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে Madras Hindu Chronicle নামে এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকারও সম্পাদক মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

মাদ্রাসে তখন দেশীয়দের উদ্যোগে একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো বটে, কিন্তু সেসব পত্রিকাকে কোনো প্রামাণ্য পত্রিকা বলে গণ্য করা যেতো না। অথচ নব্যশিক্ষিত দেশীয়দের মধ্যে ভালো একটি ইংরেজি পত্রিকার চাহিদা ছিলো। এটা বিবেচনা করে সিমকিন্স Madras Hindu Chronicle প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। মাইকেল একই সঙ্গে ইউরেশিয়ান এবং দেশীয়দের সমস্যা সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলে সিমকিন্স আরও ভরসা পান। তা ছাড়া, Madras Circulator এবং Spectator প্রকাশিত হতো প্রতি সোম, বুধ আর শুক্রবার। Athenæum প্রকাশিত হতে মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনিবার। অ্যাবেল সিমকিন্সের Madras Advertiser প্রকাশিত হতো সোম আর বৃহস্পতিবার। তবে এ পত্রিকা ছিলো প্রধানত বিজ্ঞাপনেরই পত্রিকা। Eurasian বের হতো প্রতি শনিবার। দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে একমাত্র বৃহস্পতিবারই একটি মাত্র পত্রিকা প্রকাশিত হতো। অনেকটা সেই অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্য এই দিনটিতে Madras Hindu Chronicle প্রকাশের ব্যবস্থা হয়।

দোসরা অক্টোবর (১৮৫০) এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যা থেকেই সম্পাদক উচু মানের পরিচয় দেন। পত্রিকা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে Athenæum পত্রিকা তার খুব প্রশংসা করে একটি খবর ছাপে। এতে বলা হয়:

এ সপ্তাহে A Madras Hindu Chronicle নামে একটি নতুন সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে যে মৌলিক নিবন্ধগুলো এবং উদ্ধৃতিসমূহ রয়েছে, তা থেকে এই নতুন পত্রিকার মতামত এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা অনুকূল ধারণা তৈরি হবে।৮৪

মাইকেল দেড় বছর এই পত্রিকা যোগ্যতার সঙ্গে চালিয়েছিলেন এবং সম্পাদক হিশেবে মাদ্রাসের সাংবাদিক মহলে যথেষ্ট সুনাম এবং স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন মাদ্রাস স্কুলে চাকরি নেবার কারণে এই পত্রিকার কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছিলো, তখন Athenæum যে-মন্তব্য করেছিলো, তা থেকে সম্পাদক হিশেবে তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। Athenæum-এ Daily News, Crescent এবং Examiner-এর সমালোচনা করে লেখা হয়েছিলো:

…there is but one paper, the Hindu Chronicle, which has any pretensions to merit; and the public will regret to Icam that it is likely to be discontinued.

Mr Dutt became a writer from the sheer force of ability; and has lapsed into a school master from the force of circumstances. His mental power partakes so much of the nerve and energy of the Saxon spint, that the distant contemporaries have expressed doubts as to the paternity of the articles in the Hindu Chronicle.৮৫

Madras Hindu Chronicle পত্রিকায় তিনি যেসব লেখা লিখতেন, তাদের মান এতো উঁচু ছিলো যে, সেগুলো তাঁর লেখা কিনা, তাই নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতো। — এই মন্তব্য থেকেই পত্রিকার মান সম্পর্কে অভ্রান্ত ধারণা জন্মে। বস্তুত, তিনি এই পত্রিকা যে দক্ষতার সঙ্গে চালাতে পেরেছিলেন, Athenæum পত্রিকার মন্তব্য থেকে বারবার তার প্রমাণ পাওয়া যায়। Athenæum যে সব সময়ে তাঁর সঙ্গে একমত হতো, তা নয়। যেমন, চার্লস নেপিয়ারের সমালোচনা প্রসঙ্গে এ পত্রিকার সঙ্গে তাঁর বচসা হয়।৮৬ এর কদিন পরে তিনি তাঁর অ্যাংলো-স্যাক্সন-প্রীতির নমুনা বেখে এক নিবন্ধে লেখেন যে, কোনো কোনো য়োরোপীয় ভারতবর্ষের অবিমিশ্র প্রশংসা করেন; কিন্তু তা আদৌ বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাঁরা তা করেন নিতান্ত আদর্শবাদী এবং মোহের দৃষ্টি দিয়ে।

Athenæum পত্রিকা সঙ্গে সঙ্গে এর সমুচিত সমালোচনা করে। প্রসঙ্গত এ পত্রিকা উল্লেখ করে ভারতবর্ষের মেয়েদের আনুগত্য এবং আন্তরিক ভালোবাসার কথা।৮৭ মাইকেল লিখেছিলেন, ইংরেজরা সিপাহিকে সিপয় বলে–এই বিকৃতি অর্থহীন। Athenæum এই সমালোচনা মেনে নিতে পারেনি।৮৮ মোট কথা, তাঁর সঙ্গে এ রকমের মতভেদের অনেক প্রমাণ Athenæum-এ পাওয়া যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, Athenæum যখন Hindu Chronicle পত্রিকার কথা উল্লেখ করেছে, তখনই বিশেষ সমীহ করে উল্লেখ করেছে। মাইকেল যে অন্য সম্পাদকদের তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী এবং যথেষ্ট সামর্থ্যের অধিকারী, এই পত্রিকার বহু মন্তব্য থেকে তার আভাস পাওয়া যায়।

তিনি ভালো সম্পাদক ছিলেন — তার আর-একটা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রিকা প্রকাশিত হবার পরের বছর। অ্যাবেল সিমকিন্স এ সময়ে মিলিটারি বোর্ডে ভালো চাকরি পেয়ে তাঁর ব্যবসা এবং পত্রিকা ছেড়ে দেন। তখন তাঁর কাছ থেকে Madras Hindu Chronicle কিনে নেন সি. এম. পেরেরা আর Madras Advertiser এবং Eastern Guardian কিনে নেয় লরেন্স অ্যান্ড কম্পেনি। Madras Hindu Chronicle-এর নতুন মালিকও কবির হাতে পত্রিকার দায়িত্ব বহাল রাখেন। তবে Eastern Guardian-র সঙ্গে এর পর তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিলো বলে মনে হয় না। কারণ Athenæum পত্রিকায় একই বিষয় নিয়েএকই সংখ্যায় Madras HinduCaronicle-এর সম্পাদকের প্রশংসা এবং Eastern Guardian-এর সম্পাদকের সমালোচনা লক্ষ্য করা যায়।

তিনি যোগ্যতার সঙ্গে পত্রিকা পরিচালনা করতে পেরেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু পত্রিকায় তিনি কী লিখতেন? Madras Hindu Chronicle থেকে তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লেখা উদ্ধার করেছেন সুরেশচন্দ্র মৈত্র এবং বীরেশ চট্টোপাধ্যায়। তা থেকে চলতি ঘটনা সম্পর্কে কবির সচেতনতা, সমালোচনা করার ব্যাপারে তাঁর সাহস এবং তাঁর স্পষ্টবাদিতার নির্ভুল পরিচয় পাওয়া যায়। ‘Native Education’ নামে একটি নিবন্ধে তিনি গভর্নরের দুজন উপদেষ্টার ধারালো এবং ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা করে লেখেন:

পরম শ্রদ্ধেয গভর্নরের মাননীয় সহকর্মীরা উভযই দেশীয়দের শিক্ষিত করে তোলার বিরোধিতা করেন — তবে আলাদা আলাদা কারণে। একজন, যাকে বলা হয় সরকারী শিক্ষা পদ্ধতি, সে সম্পর্কে আপত্তি করেন, কারণ তার মধ্যে বাইবেল শেখানোর কোনো সংস্থান নেই। অন্য জনের আপত্তির কারণ, তাঁর প্রভুদের সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার খাতিরে তাঁদের দাসদেব জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফল খাওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে।

এরপর তিনি শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার কতোটা ব্যবস্থা থাকা উচিত, বাইবেল শিক্ষার কোনো দরকার আছে কিনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন। সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে যিনি শিক্ষা দেবার ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন, তাঁর বক্তব্য তিনি এক কথায় উড়িয়ে দেন: all that we can say is that we wish him – a pleasant morning!। তিনি আরও বলেন: The people of this country must be educated.৮৯

বিধবাদেব অথবা স্বামী-পরিত্যক্তা স্ত্রীদের বিবাহ হিন্দু শাস্ত্রমতে হতে পারে কিনা, তা নিয়ে ১৮৫১ সালে তিনি যে-মতামত Madras Hindu Chronicle-এ প্রকাশ করেন, তার মধ্যে কোনো প্রগতিশীলতা নেই। বরং পুনরায় স্বামী গ্রহণ করার সপক্ষে যে-শ্লোক আছে, কলিযুগে তা অচল – এ কথাটাই তিনি বলতে চেয়েছেন।৯০ কিন্তু ১৮৫৫ সালে যখন বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নের জন্যে রক্ষণশীল আর প্রগতিবাদীদের মধ্যে তুমুল আন্দোলন চলছিলো, তখন তিনি আইন পাশ করার পক্ষ সমর্থন করেছেন। Spectator পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি রক্ষণশীলদের বিরোধিতার উল্লেখ করে বলেছেন যে, সরকার এ বাধা নিশ্চয় অগ্রাহ্য করবে। তিনি আশা করেছেন: যে-সরকার সতীদাহ নিষিদ্ধ করেছে, আইন পাশ করে ধর্মান্তরিতদের উত্তরাধিকার রক্ষা করেছে, মিশনারিদের স্কুলে অর্থ সাহায্য দিয়েছে এবং সর্বোপরি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে — সে সরকার রক্ষণশীলদের বিরোধিতায় বিচলিত হবে না। প্রসঙ্গত বঙ্গদেশ এবং মহারাষ্ট্রে এ আইন প্রণয়ন করার পক্ষে এবং বিপক্ষে আন্দোলন কতটা এগিয়েছে, তিনি সে কথাও লিখেছিলেন।৯১

১৮৫২ সালের জানুআরি মাসে ভারতবর্ষীয় মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি Hindu Chronicle একটি নিবন্ধে যা লিখেছিলেন, তার মধ্যে মুসলমান রাজত্বের সমালোচনা থাকলেও, সত্যের অথবা সাহসের অভাব ছিলো না। মুসলমান রাজত্বের সমালোচনা করে অন্য একটি পত্রিকায় একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো। এই লেখার সমালোচনা করে তিনি লেখেন, ইংল্যান্ডের ইতিহাস আলোচনা করলে যে-অষ্টম হেনরি অথবা তাঁর কন্যাকে দেখতে পাই, সেকি কোনো যুগের চেয়ে কম অগৌরবের? তারপর তিনি বলেন:

লীডেনহলের শাসনে ভারতের অবস্থা যেমনটা দাঁড়িয়েছে, তার চেযে মুসলমান আমলে ভারতের সমৃদ্ধি বেশি ছিলো। স্যার চার্লস এই সত্যকে লুকিয়ে রাখতে চাইতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস তাঁর বিপক্ষে।৯২

এই রচনায় সমকালীন ব্রিটিশ শাসনের তুলনায় মুসলিম আমলকে ভালো বলার মাধ্যমে তিনি ইংরেজ এবং শিক্ষিত হিন্দু উভয় মতকেই চটিয়ে দিয়েছিলেন। Athenæum পত্রিকা, যা সব সময়ে তাঁর উদারতা এবং প্রগতিশীলতার প্রশংসা করতো, সে পত্রিকাও এই নিবন্ধের সমালোচনা করেছিলো।৯২ কিন্তু এই রচনায় তাঁর অসাম্প্রদায়িকতা এবং সৎসাহস অনায়াসে চোখে পড়ে।

১৮৫১ সাল তাঁর জীবনে কম ঘটনাবহুল ছিলো না। এ বছরের প্রথম দিকে তাঁর মা মারা যান। তিনি মায়ের প্রথম সন্তান হলে, তাঁর বয়স ৪২/৪৩ বছরের বেশি হয়েছিলো বলে মনে হয় না। খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে মধু তাঁর বাবামার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন; কাব্যদেবীর সাধনা করতে হলে বাবামাকে ত্যাগ করতে হবে, এ বিশ্বাসও তাঁর প্রবল ছিলো; তার ওপর, তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সেকালের বিবেচনায় ‘সুদূর’ মাদ্রাসে ছিলেন; তদুপরি নিজের সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে নতুন জীবন পরিচালনা করছিলেন। তা সত্ত্বেও, মায়ের মৃত্যুর খবর তাঁকে কম বিচলিত করেনি। এ খবর গৌরদাস তাঁকে দেননি। দিয়েছিলেন তাঁর পিতা – দায়িত্ববোধের দরুন, না জাহ্নবী দেবীর শেষ অনুরোধ পালন করতে গিয়ে, এখন আর জানার উপায় নেই। খবর পেয়ে নিজের আর্থিক সচ্ছলতা না-থাকা সত্ত্বেও মধু একবার কলকাতায় না-গিয়ে পাবলেন না। মাদ্রাস থেকে ফিরতি টিকিটের দাম ক্যাবিনে ভ্রমণ করলে দু শো টাকার চেয়েও বেশি — তাঁর তখনকার প্রায় তিন মাসের বেতন। এমতাবস্থায় তিনি কী ভেবেছিলেন অথবা কিভাবে সমস্যার সমাধান করেছিলেন, জানার উপায় নেই। তবে চার বছর পরে পিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে বন্ধুকে যা লিখেছিলেন, তা আমাদের জানা আছে। তা থেকে মনে হয়, এই টাকা ব্যয় করা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও, অংশত মায়ের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে, অংশত নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্যে, তিনি শেষ পর্যন্ত কলকাতায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন। আসলে শৈশব থেকে মধু মায়ের যে-অসাধারণ স্নেহের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন, বাঁধন আলগা হলেও, সেটা তিনি ভুলতে পারেননি। তিনি ঠিক কখন কলকাতায় যান, জাহাজের যাত্রীদের নাম থেকে তা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ১৮৫১ সালের যাত্রীদের তালিকায় তাঁর নাম কোথাও খুঁজে পাইনি। আমার ধারণা, ক্যাবিনে যাবার মতো টাকা তাঁর হাতে ছিলো না। তাই তিনি হয়তো ডেকের যাত্রী হিশেবে কলকাতায় গিয়েছিলেন। ডেকের যাত্রীদের নাম তালিকায় লেখা হতো না। বরং লেখা হতো: ‘এতো জন নেটিভ’, ‘এতো জন সেপাই’। নতুন কোনো কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া না-গেলে, আজ আব জানার উপায় নেই, তিনি ঠিক কখন কলকাতায় গিয়েছিলেন। তবে ধারণা করি, মে-জুন মাসে।

অনুমান করা সম্ভব, কলকাতায় এসে তিনি অপরাধীর মতো তাঁর পিতার মুখোমুখী দাঁড়িয়েছিলেন। মাতার অকাল মৃত্যু এবং দুর্দশার জন্যে তিনি নিজেকে কতোটা দোষারোপ করতেন, বলা শক্ত। কিন্তু রাজনারায়ণ দত্ত তাঁদের জীবনে অনেক দুঃখের জন্যে মধুকেই দায়ী মনে করতেন। কলকাতার সেই অস্বস্তিকর পারিবারিক পরিবেশে তিনি সপ্তাহখানেকের বেশি থাকেননি। তাই যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিলেন, তেমনি ঝড়ের গতিতে মাদ্রাসে ফিরে যান। পিতার প্রতি কতোটা শ্রদ্ধা তাঁর অবশিষ্ট ছিলো, বলা শক্ত। এক সময়ে তিনি তাঁর লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সেই তিক্ততার কথা তো মনে ছিলোই; তদুপরি পরপর তিনটি বিয়ে করে পিতা যে মায়ের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন, সে অভিযোগ তাঁকে পিতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অক্ষুন্ন রাখতে সাহায্য করেনি। তবে ১৮৫১ সালে তিনি যখন কলকাতা থেকে বিদায় নেন, তখন তিনি জানতেন না, পিতার সঙ্গে এটাই হবে তাঁর শেষ দেখা — যদিও সদ্য স্ত্রী মারা যাবার পরে শ্মশান বৈরাগ্যবশত তাঁর পিতার পক্ষে সেটা ভাবা অসম্ভব নয়। পিতার ঘরে তখন অবশ্য একাধিক স্ত্রী ছিলো। তখনো তিনি স্বর্গ আর উত্তরাধিকারী লাভের আশা ত্যাগ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। পুত্র লাভের জন্যে তাঁর এই এয়াসে তিনি কতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, তা বোঝা যায় মাত্র তিন-চার বছরের মধ্যে একে-একে তিন-তিনটি বিয়ে করার ঘটনা থেকে। সন্তান না-হবার জন্যে রাজনারায়ণ তাঁর স্ত্রীদের দায়ী করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁরা দায়ী ছিলেন, মনে করা শক্ত। কারণ, জাহ্নবী দেবী যখন মারা যান, তখনো তাঁর গর্ভ ধারণের বয়স চলে যায়নি। রাজনারায়ণ অকারণেই অতোগুলো বিয়ে করেছিলেন। অনুমান করি, একবার দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তাঁর কোনো চক্ষুলজ্জা অথবা সঙ্কোচ ছিলো না।

এ যাত্রায় পরিচিতদের মধ্যে কবি কেবল রেভারেন্ড যদুনাথ ঘোষের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁরই কাছ থেকে গৌরদাস মাইকেলের এই সফরের খবর পান। তাঁদের বন্ধু স্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ কথা তাঁকে বলেছিলেন। এ খবর শুনে খুশি না-হয়ে তিনি আহত হয়েছিলেন। কারণ, তাঁর অমন অন্তরঙ্গ বন্ধু তাঁর সঙ্গে দেখা না-করে চলে যেতে পারেন, এটা তিনি ভাবতে পারেননি। সে জন্যে তাঁর অভিমান এবং অনুযোগ জানিয়ে তিনি ২৯ জুলাই তারিখে কবিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ‘তোমার কাজ সেরে তুমি তোমার প্রিয় শহরে চলে গেছে। এটা শুনে আমি খুব দুঃখিত হয়েছি। কারণ আমার অবশ্যই পুরোপুরি প্রত্যাশা ছিলো, তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেবে। …বোঝা যায়, আমার প্রতি তোমার আদৌ কোনো ভালোবাসা নেই।’৯৩ এ চিঠি পেয়ে কবি তাঁর সম্পাদিত Madras Hindu Chronicle পত্রিকা বন্ধুর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন; কিন্তু তাঁর চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন কিনা, জানা যায় না।

১৮৫১ সালে কবির পারিবারিক জীবনে আর-একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো: দ্বিতীয় কন্যা ফীবির জন্ম। এই কন্যার জন্ম ৯ মার্চ তারিখে। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মে তিনি খুশি হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু আর-একটি সন্তানের জন্মের ফলে সংসারের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিলো — সেটা যে তাঁর কাছে সুখবর ছিলো না, তা বলা বাহুল্য। এই সন্তানের নামকরণের সময়েও রেবেকা আর মাইকেল তাঁদের বন্ধু এবং হিতাকাঙ্ক্ষীদের কথা মনে রেখেছেন। অরফ্যান অ্যাসাইলামের সেক্রেটারি হিশেবে চার্লস কেনেট ছিলেন তাঁদের সবচেয়ে বড়ো মুরব্বি। প্রথম মেয়ের নামের সঙ্গে তাঁরা তাই কেনেট নাম জুড়ে দিয়েছিলেন। এবারে দ্বিতীয় মেয়ের নাম রাখতে গিয়ে ফীবি নামটা নিলেন চার্লস এগব্যর্ট কেনেটের সদ্য-বিবাহিত স্ত্রী ফীবির নাম থেকে। আর সালফেন্ট নামটি নিলেন পরিবারের আর-এক বন্ধু জে ডাবলিউ সালফেন্টের নাম থেকে। ফীবি কেনেট এবং জে ডাবলিউ সালফেন্ট দুজনই হাজির ছিলেন ফিবির ব্যাপটিজমের সময়ে।৯৪ তবে মায়ের মৃত্যু উপলক্ষে কলকাতায় যাওয়া-আসার অপ্রত্যাশিত খরচ ইত্যাদি কারণে ব্যাপটিজম করাতে অনেকটা সময় লেগে গেলো। জন্মের প্রায় পাঁচ মাস পরে – তেসরা অগস্ট ফিবির ব্যাপটিজম হয়েছিলো। ব্যাপটিজমের জন্যে তখন সামাজিকতা ছাড়াও, রেজিষ্ট্রি করাতে ১৭ টাকা এবং কেরানির মাশুল ৫ টাকা দিতে হতো।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তাঁর এই পারিবারিক উৎসবের ২০ দিন পরে — ২৩ অগস্ট শনিবার — চার্লস কেনেট মারা যান। তিন দিন পরের Athenæum পত্রিকায় দেখতে পাই, তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যতো লোক হয়েছিলো, মাদ্রাসে তা অতি বিরল ঘটনা। তিনি যে গরিবদের বিশেষ বন্ধু ছিলেন এবং অ্যাসাইলামের সেক্রেটারি হিশেবে ৩০ বছর জনহিতকর কাজে প্রভূত অবদান রেখেছিলেন, তা-ও এ পত্রিকায় বলা হয়েছে।৯৫ ২৯ অগস্ট সন্ধ্যেয় অ্যাসাইলামের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হবার তারিখ কেনেটই ঠিক করেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি মারা যাওয়ায় সেই সভায় তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর নামে একটি তহবিল গঠন করা হয় অনাথ শিক্ষানবিশদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে।৯৬

অক্টোবর মাসের শেষ দিকে রেবেকা তৃতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন। তৃতীয় একটি সন্তানের সম্ভাবনা মাইকেলের অভাববোধকে তীব্রতরকরে থাকবে। বস্তুত, অভাবের তাড়নায় তাঁর এ সময়টা ছিলো একেবারে নিষ্ফলা। ১৮৫০ সালেও তাঁকে মাঝেমধ্যে দু-একটা কবিতা লিখতে অথবা তা পত্রিকায় প্রকাশ করতে দেখি। কিন্তু ১৮৫১ সালে তিনি কিছু লিখেছিলেন, তার কোনো প্রমাণ নেই। সৃজনশীলতার বদলে এ সময়ে মাদ্রাস স্কুলে অথবা অন্য কোথাও একটা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্যে তিনি তাঁর প্রধান মুরুব্বি জর্জ নৰ্টনকে অনুরোধ করেছিলেন, এমনঅনুমান অসঙ্গত নয়। নর্টন এসময়ে তাঁকে একটা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি কেন জুটিয়ে দিলেন না, বলা শক্ত। তা ছাড়া, কলকাতায় ফিরে তিনি আদালতে যে-ধরনের চাকরি করেছিলেন তেমন চাকরি অথবা তার চেয়ে ভালো চাকরি জর্জ নর্টনের অধীনে পাওয়া কঠিন হতো বলে মনে হয় না।

অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্ন মাইকেলের কোনোদিন পূরণ হয়নি। অবশ্য তার জন্যে কেবল সীমিত সুযোগ এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম আয়ই দায়ী নয়, তাঁর অমিতব্যয়িতা এবং বেহিশেবি মনোভাবও কম দায়ী ছিলো না। তবে মাঝেমধ্যে অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের আশা ঝিলিক দিয়েছে বৈকি! ১৮৫২ সালের শুরুতে এমনি একটি সুসময়ের সম্ভাবনা দেখা দেয়। মাদ্রাস হাই স্কুল — যার তখনকার নাম ছিলো মাদ্রাস ইউনিভার্সিটি৯৭ — তার ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, দ্বিতীয় টিউটর, মি এইচ বাওযার্স মাত্র ৩৪ বছর বয়সে, অবসর গ্রহণ করেন ৩১শে জানুআরি। তার পর তিনি চলে যান য়োরোপে। আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি, স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং অ্যাডভোকেট-জেনরেল জর্জ নর্টন কবিকে স্কুলের হেডমাস্টার মি পাওয়েলের কাছে পাঠিয়েছিলেন আড়াই বছর আগে। এখন স্কুলের একটা শূন্য পদ দেখা দেওয়ায় তাঁকে সেখানে একটা চাকরি দেবার সুযোগ এলো। মার্চ মাসের ২৬ তারিখে পরিচালকমণ্ডলী গভর্নরকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে সেই শূন্য পদে একজন নেটিভ — মি ডাটকে মনোনীত করেছেন। তাঁর পরিচয় দিয়ে এঁরা বলেন, ইনি প্রথমে কলকাতার হিন্দু কলেজে এবং তারপর বিশপস কলেজে লেখাপড়া শেখেন। ধ্রুপদী এবং ইংরেজি সাহিত্যে ঐ পাণ্ডিত্য খুব উচু মানের, এবং বয়সে তরুণ হলেও শিক্ষকতায় তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।৯৮

আগেই দেখেছি, এয়ার বার্টন পাওয়েলকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক করে নিয়ে আসা হয়েছিলো ইংল্যান্ড থেকে। তাঁর সঙ্গে আরো তিনজন শিক্ষক প্রথম থেকেই কাজে যোগদান করেন — জর্জ জাইলস হোয়াইট, জে, ম্যাকলিশ আর অ্যাডাম এ. গর্ডন। ম্যাকলিশ ছিলেন ফিরিঙ্গি। কিন্তু গর্ডন আসেন ইংল্যান্ড থেকে — ১৮৪৬-৪৭ সালে। তিনি সেখানে এমএ পাশ করেন এবং সেই সঙ্গে শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন লন্ডনের অদূরে একটি কলেজে। মাইকেলের চেয়ে বছর চারেকের বড়ো। আর জর্জ হোয়াইটের জন্ম লন্ডনের ফুলহ্যামে হলেও তিনি কতোটা লেখাপড়া শিখেছিলেন তা জানা যায় না। তবে তিনি ১৮২০ সালে মাদ্রাসে এসে মিলিটারি অ্যাসাইলাম স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হয়েছিলেন।৯৯ ১৮২৫ সালে তিনি মাদ্ৰাসেই বিয়ে করেছিলেন।১০০ মাইকেল যখন মাদ্রাস স্কুলে কাজ করতে আসেন তখনো এই তিনজন শিক্ষক সেখানে কাজ করছিলেন। এঁদের মধ্যে অ্যাডাম গর্ডন ছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক, বেতন ৩৫০ টাকা, আর জর্জ জাইলস হোয়াইট এবং ম্যাকলিশ ছিলেন যথাক্রমে প্রথম এবং তৃতীয় টিউটর, বেতন ২০০ টাকা। দ্বিতীয় টিউটর বাওয়ার্স য়োরোপ চলে যাওয়ায় পরিচালকমণ্ডলী সেই শূন্যপদে জানুআরি মাসের শেষে মাইকেলকে দ্বিতীয় টিউটর হিশেবে নিয়োগ করার সুপারিশ করেন। অন্য শিক্ষকরা সবাই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। তাঁর বেতন কর্তৃপক্ষ শ্বেতাঙ্গ শিক্ষকদের মতো দরাজ হাতে নির্ধারণ করেনি। তাঁর বেতন ঠিক হয় মাত্র দেড় শো টাকা। ১৮৫৫ সালের এপ্রিল মাসে স্কুলে যে-শিক্ষকরা ছিলেন, তাঁদের নামের তালিকা এবং বেতন দেখলেই বোঝা যায়, তাঁদের মধ্যে কারা য়োরোপীয়ান, আর কারা ইউরেশিয়ান অথবা মাইকেলের মতো কৃষ্ণাঙ্গ নেটিভ।

ওদিকে, মাইকেল মাদ্রাস স্কুলে চলে যাচ্ছেন দেখে, অ্যাসাইলামের পরিচালকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত নিলেন যে, অরফ্যান অ্যাসাইলামের বয়েজ্ স্কুল ৮ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হোক। বার্ষিক রিপোর্টে অবশ্য তাঁরা মিস্টার ডাট চলে যাচ্ছেন, এ কারণ দেখাননি। তাঁরা বরং বলেছেন যে, ১৮৫২ সালের ৮ মার্চ তারিখে অ্যাসাইলামের ফ্রী বয়েজ স্কুলের পরিচালকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, বছরের গোড়ার দিকে বেকারিতে পাদ্রী টেইলার এবং তার আগের বছর অ্যাসাইলামের কাছে — পার্চারিতে একটি ফ্রী প্যারিস স্কুল খোলায় অ্যাসাইলামের বয়েজ স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অ্যাসাইলামে তখন যে জনা পঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রী পড়ছিলো, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় রেভারেন্ড টেইলরের ওপর।১০১

কবি মাদ্রাস স্কুলে ঠিক কোন তারিখে যোগ দিয়েছিলেন, তা জানা যায় না, তবে মার্চ মাসে। বয়েজ স্কুল বন্ধ হবার তারিখ (৮মার্চ) এবং Athenæum পত্রিকার ৯ মার্চের সম্পাদকীয় থেকে মনে হয়, তিনি মোটামুটি এর দু-চার দিনের মধ্যেই মাদ্রাস স্কুলে কাজ আরম্ভ করেন।

স্কুলে পড়িয়ে তিনি কতোটা আনন্দ পেতেন সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। তবে মাদ্রাস স্কুলে তিনি কী পড়াতেন তা আমরা সংক্ষেপে দেখে নিতে পারি। প্রথম শ্রেণীতে (ওপরে দিক থেকে গুনলে) তিনি পড়াতেন না। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াতেন ইতিহাস আর কবিতা। পাঠ্যবই-এর মধ্যে কলকাতার হিন্দু কলেজের ডিএলআর সম্পাদিত কাব্য সংকলন পড়ানো হতো। তৃতীয় আর পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি পড়াতেন কাব্য আর ভূগোল। একটা সময়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াতেন কাব্য আর ইতিহাস। তিনি কেবল যে প্রচুর সাহিত্য পড়েছিলেন, তাই নয়; একটি কাব্য এবং নাটক প্রকাশ করেছিলেন। সুতরাং তিনি নিজেকে হয়তো সাহিত্য পড়ানোর যোগ্য শিক্ষক বলে বিবেচনা করতেন। অপর পক্ষে, তাঁর ইংরেজ সহকর্মীদের পক্ষে তাঁর যোগ্যতাকে খানিকটা ছোটো করে দেখা অসম্ভব নয়। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে টানাপোড়েন হওয়াও স্বাভাবিক।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মাদ্রাস স্কুলে চাকরি পেয়ে তিনি নিশ্চয় খুশি হয়েছিলেন। তার চেয়েও বড়ো কথা, তিনি নিশ্চয় নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলেন। The Captive Ladie ছাপা হওয়ার সময় থেকে তিনি এ চাকরির দিকে নজর রেখেছিলেন। অ্যাসাইলামের চাকরির তুলনায় এ চাকরি ছিলো অনেক সম্মানের এবং সেই সঙ্গে অনেক বেশি বেতনের। তদুপরি, তিনি আশা করেছিলেন, Madras Hindu Chronicle-এরকাজ থেকেও তাঁর নিয়মিত বাড়তি আয় বজায় রাখতে পারবেন। কিন্তু মানুষের আশা এবং বাস্তব ঘটনাবলী সব সময়ে একই পথে যায় না। তিনিও একটা রূঢ় আঘাত পেলেন। যে-জর্জ নর্টনকে তিনি তাঁর প্রথম কাব্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং যে-এয়ার বাটন পাওয়েলকে তিনি খুব ভালো মানুষ বলে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন, এখন তাঁর বাড়তি আয়ের পথে তাঁরা বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। স্কুল কমিটি তাঁকে জানিয়ে দিলো, স্কুলের কাজে যোগ দিলে তাঁকে পত্রিকার কাজ ছেড়ে দিতে হবে। তাঁরা কারণ দেখালেন যে, এই কাজ তাঁর স্কুলের কাজে বাধা দেবে। তাঁদের যুক্তি আদৌ খোঁড়া ছিলো না। কিন্তু তাঁর কাছে এটা বাড়া ভাতে ছাই-এর মতো মনে হলো।

স্কুল কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত বদল করানোর ব্যাপারে তিনি যে তদবির করেছিলেন তার পরোক্ষ প্রমাণ রয়েছে। তাঁর বন্ধু কম ছিলো না। তাঁর হয়ে Athenæum পত্রিকা ৯ মার্চ তারিখে জোরালো সুপারিশ জানায় স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়। Athenæum যা লিখেছিলো তার খানিকটা আমরা আগেই উদ্ধৃত করেছি।

দেশীয় পত্রিকাগুলো মধ্যে Madras Hindu Chronicle-ই একমাত্র উঁচু মানের পত্রিকা। কিন্তু পত্রিকাটি এখন বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ পত্রিকার সুযোগ্য সম্পাদক মাইকেল ডাট পরিবেশের চাপে পড়ে মাদ্রাস স্কুলে চাকরি নিতে বাধ্য হচ্ছেন। স্কুল বোর্ড বলছে শিক্ষকতার সঙ্গে পত্রিকার কাজ করলে শিক্ষকতার কাজে ক্ষতি হবে। এটা ঠিক নয়। আসলে ক্ষতি হবে একটি দেশীয় পত্রিকার।

Athenæum-এ বাড়তি মন্তব্য করা হয় তাঁর মননশীলতা এবং যোগ্যতা সম্পর্কে। এতে বলা হয়: পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে দেশীয় একজন মানুষও কতো বড়ো এবং সুশিক্ষিত হতে পারেন, মি ডাট তার একটা দৃষ্টান্ত। Athenæum-এর এই সুপারিশ সত্ত্বেও কবি Madras Hindu Chronicle-এ কাজ করার অনুমতি পাননি স্কুলের কাছ থেকে। আমার ধারণা, পত্রিকার সম্পাদক হিশেবে জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তারের যে-হাতিয়ার তাঁর হাতে ছিলো, স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটাকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখেনি। ১৮৫০ সালে অ্যাসাইলামে য়োরোপীয় শিক্ষক নিয়োগের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে তিনি Eurasian পত্রিকাকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন, অসম্ভব নয় যে, কর্তৃপক্ষ সেটাও মনে রেখেছিলো। স্কুলের কাজ নেওয়া ছাড়া তাঁর অবশ্য কোনো বিকল্প ছিলো না। মাদ্রাস স্কুলে তাঁর বেতন আগের স্কুলের তুলনায় এতো বেশি ছিলো যে, তিনি এই চাকরি না-নিয়ে পারেননি। তা ছাড়া, চাকরির স্থায়িত্বের কথাও তিনি বিবেচনা করে থাকবেন। (১৮৫৩ সালের জানুআরি থেকে এই চাকরি সরকারী বলে বিবেচিত হয়।) সুতরাং অ্যাসাইলাম এবং Hindu Chronicle-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি মাদ্রাস স্কুলে যোগ দিলেন।

মাদ্রাস স্কুলে কাজ আরম্ভ করে কবি দারুণ অর্থকষ্ট থেকে খানিকটা স্বস্তি লাভ করেছিলেন বলে অনুমান করাই সঙ্গত। তবে আয় যতোই বাড়ুক না কেন, অর্থেব চাহিদা শেষ হবার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না। তা ছাড়া, পরিবারের আয়তন এবং সেই সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ছিলো। স্কুলে চাকরি শুরু করার চার মাস পরে এবং বিয়ের চতুর্থ বার্ষিকী আসার পাঁচ দিন আগে তৃতীয় সন্তান উপহার দেন রেবেকা। প্রথম পুত্রের জন্ম হলো ২৬ জুলাই তারিখে। পুত্রের জন্মে মাইকেল এবং রেবেকা খুশি হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। দু মাস পুরো হবার আগেই তাঁরা পুত্রের ব্যাপটিজমের আয়োজন করেন। এই ব্যাপটিজম হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। পুত্রের নাম দেওয়া হলো জর্জ জন ম্যাকট্যাভিশ ডাট।১০২ তৃতীয় নামটি — ম্যাকট্যাভিশ — ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশের নাম থেকে নেওয়া। রেবেকার সত্যিকার বংশ নাম যদি ম্যাকট্যাভিশ হতো তা হলে পুত্রের নামের সঙ্গে ম্যাকট্যাভিশ নাম দেওয়ার দরকার হতো না। আর যদি পিতা এবং মাতা — উভয়ের বংশনাম ব্যবহার করার উদ্দেশ্য থেকে পুত্রের নামের সঙ্গে ম্যাকট্যাভিশ নাম দিতেন, তা হলে অন্য পুত্র এবং কন্যাদের নামের সঙ্গেও ম্যাকট্যাভিশ নাম লাগানো থাকেতো। কিন্তু আগেই দেখেছি, দু মেয়ের নামের সঙ্গে তাঁর দিয়েছিলেন পারিবারিক বন্ধুদের বংশনাম। আর এর দু বছর পরে দ্বিতীয় পুত্র জন্ম নিলে তার নামের সঙ্গে ডাট ছাড়া অন্য কোনো বংশনামই দেওয়া হয়নি। কবি যে তাঁর নিজের পদ এবং সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সব সময়ে খুব সচেতন ছিলেন, জর্জের ব্যাপটিজমের দলিল থেকে তার খানিকটা প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি চার্চের রেজিস্টারে তাঁর পরিচয় লেখান: মাদ্রাস স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু আগের বছর যখন দ্বিতীয় কন্যার ব্যাপটিজম হয় তখন পেশা লিখিয়েছিলেন শুধু শিক্ষক। অ্যাসাইলামের কথা আব উল্লেখ করেননি। (অবশ্য সব ধর্মযাজক রেজিস্টারে এক রকম করে নাম-ধাম লিখতেন না। তাই এ থেকে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় না)।

স্কুলে যোগ দেওয়ার পর তুলনামূলকভাবে সচ্ছল অবস্থায় তিনি তাঁর রায়পুরমের বাড়ি ছেড়ে বাস করতে আরম্ভ করেন ভেপারি ক্যাসেলেটে। এই নিশ্চিন্ত এবং ব্যস্ততাবর্জিত পরিবেশে তিনি আবার কেন কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন না, সেটা বোঝা শক্ত। তিনি কি তখনো গোপনে পত্রপত্রিকার জন্যে বাড়তি লেখা তৈরি করতে ব্যস্ত, নাকি তিন-তিনটি সন্তান এবং সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তা এখন জানার উপায় নেই। এমনও হতে পারে যে, বেথুনের কঠোর মন্তব্য পাওয়ার পর থেকে তিনি ইংরেজিতে কবিতা লেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আবার বাংলায় কবিতা লেখার কথাও তখনো পর্যন্ত ভাবেননি। এ সময়ে মাদ্রাস স্কুলকে কেন্দ্র করে তাঁর নতুন বন্ধু পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিলো। সহকর্মীদের সঙ্গেও তাঁর ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। তিনি প্রভাব বিস্তার করে এ সময়ে বন্ধু রিচার্ড নেইলরকে ভেপারি স্কুল থেকে মাদ্রাস স্কুলে নিয়ে আসেন।

সহকর্মীদের মধ্যে জর্জ হোয়াইটের সঙ্গে কবির আগে থেকেই বন্ধুত্ব হয়েছিলো। মনে হয় পারিবারিক পর্যায়েও তাঁদের মধ্যে যাওয়া-আসা আরম্ভ হযেছিলো। একসমযে তাঁরা থাকতেনও একই পাড়ায় — রায়পুরমে।১০৩ এঁদের পরিচয় হয়েছিলো কবি মাদ্রাস যাবার পরের মাসে — অরফ্যান অ্যাসাইলামের পরীক্ষা উপলক্ষে — ইতিপূর্বে আমরা তা লক্ষ্য করেছি। জর্জ হোয়াইট অরফ্যান অ্যাসাইলামের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি প্রতিটি বার্ষিক সভায় যোগ দিতেন এবং তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। যেমন, ১৮৪৮ সালের ৩০ অগস্ট যখন অ্যাসাইলামের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়, তখন জর্জ হোয়াইট তাতে কেবল যোগ দেননি, তিনি সভায় একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং সে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিলো।১০৪ তা ছাড়া, মাসে মাসে তিনি অ্যাসাইলামে এক টাকা করে চাঁদা দিতেন। (জর্জ হোয়াইট আরও একটি অনাথ তহবিলের পরিচালকমণ্ডলীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই তহবিলের নাম ছিলো Madras Widows andOrphan’s Fund) কবি মাদ্রাস স্কুলে তাঁর সহকর্মী হবার পরে, তাঁদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়াই স্বাভাবিক। তদুপরি, এর দু বছর আগে জর্জ হোয়াইটের স্ত্রী অ্যালাইজা মারা যাবার পর নিঃসঙ্গ জর্জ হোয়াইটের সঙ্গে তাঁর সঙ্গ ঘনিষ্ঠতা বাড়া অসম্ভব নয়। Athenæum-এর মন্তব্য থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, পারিবারিক কারণে বাধ্য হয়ে কবি মাদ্রাস স্কুলে চাকরি নেন। এই কারণটা প্রধানত আর্থিক। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস, অংশত মাদ্রাস স্কুলের চাকরি নেবার পরে স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে তাঁর যে সুখের সংসার ছিলো, তা চিরদিনের জন্যে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

জর্জ জাইলস হোয়াইটের অন্তত তিনটি সন্তান ছিলো — বড়োটি মেয়ে — অ্যামেলিয়া হেনরিয়েটা সফাইয়া আর ছোটো দুটি ছেলে। ছেলেদের নাম উইলিয়াম জন টমাস হোয়াইট আর এডুইন আর্থার হোয়াইট। হেনরিয়েটার জন্ম ১৮৩৬ সালের ১৯ মার্চ,১০৫ উইলিয়ামের জন্ম ১৮৩৭ সালের ৩১ জুলাই১০৬ (বিয়ে ১৮৬৪ সাল) আর এডুইনের জন্ম ১৮৩৯ সালের ১০ এপ্রিল।১০৭ মাইকেলের সঙ্গে এই তিন কিশোর-কিশোরীর পরিচয় হয়। ঠিক কখন তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের মা মারা যাবার পরে কবি তাদের বাড়তি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন বলে মনে হয়। উইলিয়াম, এডুইন এবং অ্যামেলিয়া হেনরিয়েটার সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং তাঁদের প্রতি তাঁর এই সহানুভূতি আরো বৃদ্ধি পায় তিনি মাদ্রাস স্কুলে চাকরি নেবার পর। ওদিকে, স্ত্রী মারা যাবার পর তিন বছর পূর্ণ হবার আগেই ১৮৫৩ সালের ৭ ফেব্রুআরি জর্জ হোয়াইট দ্বিতীয় বার বিয়ে করে ফেললেন। স্ত্রী মরে গেলে আবার বিয়ে করা কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু যা প্রায় অসম্ভব ছিলো, তা হলো ৪৭ বছর বয়স্ক জর্জ হোয়াইট বিয়ে করলেন ১৬ বছর বয়স্ক এমিলি জেইন শর্ট নামে একটি কিশোরীকে। কন্যা হেনরিয়েটার ১৭ বছর বয়স হতে তখন বাকি ছিলো মাত্র ৪০ দিন। মধুসূদনের পিতাও মোটামুটি ঐ একই বয়সে পরপর তিনটি কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। পার্থক্যটা এই যে, বাঙালি সমাজে ওর থেকে বেশি বয়সী মেযেকে বিয়ে করা কুলীন ব্রাহ্মণ ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কিন্তু জর্জ হোয়াইট নিজের অবিবাহিত কন্যার চেয়েও কম বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন বেশি বয়সী মেয়ে অথবা মহিলা পাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। জর্জ হোয়াইট মনে মনে কতোটা অপরাধ বোধ করেছিলেন, আমার জানা নেই। তবে তিনি লাইসেন্স দিয়ে বিয়ে করার সময়ে নিজের বয়সের উল্লেখ না-করে বিয়ের দলিলে লিখেছিলেন ‘of full age’.১০৮

এই বিয়ের পর হেনরিয়েটা এবং তাঁর ছোটো ভাই উইলিয়াম ও এডুইন অসুখী হন। বিশেষ করে, সমবয়সী বিমাতার সঙ্গে হেনরিয়েটার সম্পর্ক অল্পদিনের মধ্যে তিক্ত হয়ে ওঠে। কবিও তাঁর পিতাকে এমনি দ্বিতীয় (এবং তারপর তৃতীয় এবং চতুর্থ বার) বিয়ে করতে দেখেছিলেন এবং/অথবা শুনেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে বিমাতা তাঁকে গঞ্জনা দিতে পারেননি; কিন্তু এসব অবস্থায় সংসারে যে-অশান্তি হয়, তার স্বরূপ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। এখন হেনরিয়েটা, উইলিয়াম ও এডুইনকে সেই দারুণ অশান্তির ভুক্তভোগী হতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনে দরদ উথলে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে তিনি যদি কান্নার জন্যে হেনরিয়েটাকে তাঁর কাঁধ এগিয়ে দিয়ে থাকেন, তা হলে অবাক হবার কিছু নেই। দুঃখকাতর হেনরিয়েটাও এই সহানুভূতি গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। বস্তুত, এই সহানুভূতি থেকে। ক্রমে দুজনের মধ্যে প্রণয়সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওদিকে, জর্জ হোয়াইটের বিয়েকে কেন্দ্রকরে মাদ্রাসের ছোট্টো য়োরোপীয় সমাজে যে-কেলেঙ্কারী দেখা দিয়েছিলো, তা তাঁর কর্মস্থানেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এই বছর তিনি মাদ্রাস স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পেনশন নিতে বাধ্য হন। মনে হয়, তিনি বেশি বয়সের জন্যে অবসর নেননি। কারণ, মাদ্রাস স্কুলে তাঁর চাকরি চলে যাবার পরে তিনি ঘরে বসে থাকেননি। ১৮৫৪ সালে তাঁকে প্রধান শিক্ষকের কাজ করতে দেখা যায় ভেপারি স্কুলে। আর মাদ্রাস স্কুলে তাঁর জায়গাতে প্রথম টিউটর হন জে এস জেনকিনস। এর পর কবির সঙ্গে জর্জ হোয়াইট এবং হেনরিয়েটার সম্পর্ক কী দাঁড়ায়, আমরা তা কেবল অনুমান করতে পারি।

ওদিকে, মাদ্রাস স্কুলের সম্প্রসারণের প্রশ্ন এবং অন্যান্য উপদলীয় কোন্দল উপলক্ষে জর্জ নর্টন এবং পরিচালকমণ্ডলীর অন্য পাঁচ জন সদস্য ১৮৫২ সালের ১২ জুলাই পরিচালকমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠানের পর ১৩ তারিখে পদত্যাগ করেন। এই স্কুলে যাতে সাধারণ পরিবারের ছেলেরা ভর্তি হতে না-পারে, তার জন্যে, যেমনটা আগেই লক্ষ্য করেছি, ছাত্রদের মাসিক বেতন ঠিক হয়েছিলো ৪ টাকা। কিন্তু জর্জ নর্টনের মত অগ্রাহ্য করে ১৮৫৩ সালের পয়লা জানুআরি থেকে কলেজ শাখাতে দু টাকা আর প্রাইমারি শাখাতে এক টাকা বেতন নির্ধারিত হয়। ছাত্র সংখ্যার ওপর সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাবও পড়েছিলো। হাই স্কুলের ছাত্র সংখ্যা সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২২১-এ, আর প্রাইমারির ছাত্র সংখ্যা হলো ২৭৮।১০৯ এই সংখ্যা আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। ১৮৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে, বস্তুত, স্কুলের কাঠামো রীতিমতো ঢেলে সাজানো হয়। এ সময়ে উচ্চতর শাখার জন্যে প্রিন্সিপাল করা হয় এয়ার বার্টন পাওয়েলকে। আর স্কুলের প্রাইমারি শাখার প্রধান নিযুক্ত হন জে ম্যাকলিশ। ইতিহাসের অধ্যাপক হন অ্যাডাম গর্ডন। তখন তাঁর বেতন ৩৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়। মাসখানেক পরে বাওয়ার্সও দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিশেবে যোগদান করেন।১১০ কবি এই পদটি পাবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু কার্যকালে তা পেলেন না। তাঁর বেতনও থেকে গেলো আগের মতো–দেড় শো টাকা। এর ফলে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। নতুন কাঠামোয় স্কুলের কাজ শুরু হয় ১৮৫৩ সালের ১৫ জানুআরি।

মাদ্রাস স্কুলের রুটিন

এ সময়ে কবির বন্ধু রিচার্ড নেইলরকে স্কুলের চতুর্থ টিউটর হিশেবে নিয়োগ করা হয়। ধারণা করা অসঙ্গত হবে না যে, এই নিযোগের পেছনে তাঁর সুপারিশ কাজ করেছিলো। এবং করে থাকলে, এ থেকে পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কযেক মাসের মধ্যে তিনি তাঁর যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে স্কুলে তাঁর আসন পাকা করে নিয়েছিলেন। তবে আসন যতোই পাকা হোক, তাঁর নিজের কোনো পদোন্নতি না-হওযায় অথবা বেতন না-বাড়ায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকবেন। পরে তাঁর অসন্তোষ ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়েছিলো। পাওয়েল বিএ এবং গর্ডন এমএ পাশ হলেও, জেনকিন্স অথবা বাওয়ার্সের কোনো ডিগ্রি ছিলো না। তবু তাঁরা কবির চেয়ে উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বেতনও পেতেন বেশি। তাঁর এই অসন্তোষ শেষ পর্যন্ত বছর দেড়েকের মধ্যে তাঁকে মাদ্রাস স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। অথবা এমনও হতে পারে, যে এই অসন্তোষ থেকে সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে এবং পরিণতিতে তিনি তাঁর চাকরি খোয়ান।

মাদ্রাস স্কুলে চাকরি শুরু করে জীবিকা অর্জনের লড়াইতে খানিকটা সুস্থির হয়ে কবি আবার কাব্যের জগতে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু যাননি। তবে এই স্কুলে চাকরি করার সময়ে — ১৮৫৪ সালের গোড়ার দিকে তিনি একটি বক্তৃতা করেছিলেন, যা পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো ঐ বছর এপ্রিল মাসে। তিনি এই বক্তৃতাটি রচনা করার আগে এক গুরুতর দুর্ঘটনায় প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। এর ফলে বেশ কিছুদিন তাঁকে বাড়ির মধ্যে আটকা থাকতে হয়েছিলো। বক্তৃতাটি তিনি লেখেন সেই সময়ে।১১১ এই পুস্তিকার নাম দেন The Anglo-Saxon and the Hindu, Lecture I৷ অসম্ভব নয় যে, তিনি এ বিষয়ে একাধিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ভাষণের বক্তব্য আমাদের হাতে এসে পৌছেছে। তাঁকে যাঁরা হিন্দু হিশেবে দেখতে পছন্দ করেন, তাঁরা এই লেখাটিকে তাঁর ব্যতিক্রমী রচনা বলে বিবেচনা করেন। কারণ এঁর মধ্যে তিনি হিন্দু পুরাণ নিয়ে গর্ব করার মতো কোনো কথা বলেননি। বরং এর মধ্য দিয়ে তাঁর খৃস্টানি মনোভাব এবং ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে তাঁর কবিতা এবংকাব্যের সঙ্গে এই মনোভাবের সাদৃশ্য নেই। সে জন্যে, শ্রীমধুসূদন এমন কথা বলতে পারেন দেখে তাঁর ভক্ত সমালোচকরা তাঁর এই রচনাটি অস্বীকার করতে পারলেই খুশি হন।

কিন্তু The Anglo-Saxon and the Hindu আদৌ অস্বীকার করার মতো রচনা নয়। কবিকে পুরো দেখতে চাইলে বরং এই রচনাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। তিনি যে একাধিক সংস্কৃতির মূল্যবোধ স্বীকরণ করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁর মধ্যে যে পরস্পর-বিরোধী মূল্যবোধ দেখা দিয়েছিলো, এপ্রবন্ধ থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এবং এটা এ বক্তৃতার উৎসর্গপত্রেও লক্ষ্য করা যায়। এই পুস্তিকাটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন জন হেনরি কেনরিক (১৮১৫-?)১১২ নামে এক ভদ্রলোককে। মাদ্রাস পলিটেকনিকের সেক্রেটারি হলেও, জর্জ নৰ্টনের মতো কেনরিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন না। কবিও কোনো লাভের আশায় তাঁকে এই পুস্তিকা উৎসর্গ করেনি। এঁর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। সম্বোধন (My dear Kenrick) থেকে শুরু করে উৎসর্গপত্রের সর্বত্র এই বন্ধুত্বের ভাবটি লক্ষযোগ্য। বিগত দিনগুলোতে তাঁর কাছ থেকে যে-সহৃদযতা এবং অনুপ্রেরণা পেযেছেন উৎসর্গপত্রের শেষ দিকে তিনি তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।

এই বক্তৃতাটি আপনার নামে উৎসর্গ করার অনুমতি দিন। আমার দুঃখ: এটা আপনার সম্মানের জন্যে যদি আবও মূল্যবান হতো! তবে আমি যখন চিন্তা করি যে, এটা লেখার সময়ে দারুণ শারীরিক কষ্টের মধ্যে দীর্ঘ সময়েব জন্যে আমি সান্ত্বনা পেয়েছি, তখন আমি এই লেখাটার প্রতি একটা সকৃতজ্ঞ পক্ষপাতের অনুভূতি লাভ না-করে পারিনে। আমি যখন একটা দুর্ঘটনায় প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিলাম এবং অনেক দিন গৃহবন্দী ছিলাম, তেমন একটা সমযে এটি পরিকল্পনা এবং রচনা কবি। এই রচনাটি নিখুত না-হলেও এটির নাম এমন একজনের নামে সঙ্গে যুক্ত করতে পেরে ভালো লাগছে, যিনি যে-সম্প্রদায়ের সদস্য সেই সম্প্রদায়ের অলঙ্কাবস্বরূপ, যে-দেশের অধিবাসী সে দেশের সম্মানস্বরূপ এবং যার বন্ধুত্বে আমি গর্ব বোধ করি।

মাদ্রাস স্কুলের শিক্ষকদের নাম এবং বেতন, জানুআরি ১৮৫৫

কেনরিক ছিলেন বিজ্ঞানে খুব উৎসাহী। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে মাদ্রাসে একাধিক বক্তৃতা করে-ছিলেন, যা নিয়ে দিনের পর দিন সেখানকার পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে। মাদ্রাসে টেলিগ্রাফ লাইন বসানো এবং বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। মাদ্রাস পলিটেকনিকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও তাঁর বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি-প্রীতির পরিচয় দেয়। কিন্তু কবি বিশেষভাবে প্রশংসা করতেন তাঁর দেশপ্রীতির। কেনরিক ফিরিঙ্গি হলেও, বোঝা যায়, বিলেতকে নয়, নিজের দেশ বলে গণ্য করতেন ভারতবর্ষকে (স্বভাবতই ডিরোজিওর কথা মনে করিয়ে দেয়।) এবং কবি তাঁর এই মনোভাবকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। উৎসর্গপত্রে সে দিকে পরিষ্কার ইঙ্গিত আছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, তিনি নিজে এ ধরনের লোকদের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট বোধ করতেন। হিন্দু কলেজ-উত্তর তাঁর সব ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ফিরিঙ্গি। চার্লস এগব্যর্ট কেনেট, রবার্ট ওয়কার এবং বিচার্ড নেইলর – তিন জনই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। জর্জ ম্যানও ছিলেন মরিশাসের ‘নেটিভ’। যে-বহুসাংস্কৃতিক শিক্ষা পেয়েছিলেন তাতে নিজেকে তিনি অনেক সময়ে ত্রিশঙ্কুর মতো বিবেচনা করতেন। তিনি না-পারতেন দেশীয়দের ভিড়ে মিশে যেতে, না-পারতেন যোরোপীয়দের সঙ্গে একাত্ম হতে। (এমন কি, যোরোপীয়রা তাঁকে দু হাত বাড়িয়ে নিতেনও না!) কেনরিকের মতো যে-স্বল্প সংখ্যক লোককে তিনি চিনতেন, তাঁদের সঙ্গে তিনি ভাবনার মিতালি লক্ষ্য করতেন।

আগেই দেখেছি, খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর তাঁর মানসিকতায় রীতিমতো পরিবর্তন দেখা দিতে আরম্ভ করেছিলো। এমন কি, তিনি মিশনারি হবার জন্যে চেষ্টা করেছিলেন। তবে বিশপস কলেজ ছাড়ার পর খৃস্টধর্মের আনুষ্ঠানিক দিকের প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস দুর্বল হতে আরম্ভ করে। কিন্তু হিন্দু সভ্যতার অবক্ষয় এবং ঐতিহ্যসর্বস্বতার তুলনায় খৃস্টধর্মের ঔদার্য এবং খৃষ্টীয়-য়োরোপের আধুনিকতা তাঁর মন এবং মননশীলতাকে উদবুদ্ধ করেছিলো। জীবনের বেশির ভাগ সময় খৃস্টান সমাজ এবং খৃষ্টান জীবনসঙ্গিনীদের সঙ্গে বাস করার ফলেও তিনি চিন্তার দিক দিয়ে জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে হিন্দু সমাজ থেকে সরে গিয়েছিলেন অনেকটা দূরে। এ সমাজের বহু মূল্যবোধকে তিনি পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছিলেন বললেও যথেষ্ট হয় না। বস্তুত, ভারতবর্ষীয় অনেক কিছুকেই ঘৃণা করতে শিখেছিলেন। তাঁর সেই মনের অভ্রান্ত পরিচয় পাওয়া যায় এই বক্তৃতায়।

এতে তিনি বলেছেন, পশ্চিম থেকে ভারতবর্ষে যে-বিজয়ীরা এসেছে, তারা ভারতবর্ষের অবক্ষয়ী সভ্যতাকে উদারতা দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করবে। গৌরব এবং ক্ষমতায় তাঁরা বিজয়ী মোগলদের তুলনায় অনেক শ্রেষ্ঠ। সত্যি বলতে কি, সামরিক শক্তি এবং জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তারা আগেকার যে কোনো সভ্যতার তুলনায় অনেক অগ্রসর। ইংরেজি সভ্যতার কথা বলতে গিয়ে তিনি উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। কিন্তু গৌরবোজ্জ্বল প্রাচীন ভারতের কথা ক্ষণিকের জন্যে মনে করলেও, তাঁর সমকালীন হিন্দু সভ্যতার প্রতি তাঁর আন্তরিক বিতৃষ্ণা এবং অনুকম্পা চাপা থাকেনি।

The Hindu! — Alas! Centuries of servitude and oppression; the predominance of a superstition, dismal and blasting; a fatal adherence to institutions whose cruel tendency ever it is to curb and to restrain the onward march of a man as a social, as an intellectual pilgrim, tracing round him a wizard ring, solemnly believed to be impassable — and violently repressing every inborn longing to be free; these alas! have rendered that name a name of reproach — an astonishment, a proverb and a byword among the nations!

তিনি হিন্দু এবং অ্যাংলো-স্যাক্সনের মধ্যে তুলনা করে বলেছেন, হিন্দু জাতি এখন প্রৌঢ়ত্বে উপনীত এবং তার দেবার কিছু নেই। এখন বিধাতা অ্যাংলো-স্যাক্সনকে পাঠিয়েছেন,এই অর্ধমৃত হিন্দুকে কবর থেকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে।

…it is the Solemn Mission of the Anglo-Saxon to renovate, to regenerate, to civilize, or in one word, to Christianize the Hindu!

অ্যাংলো-স্যাক্সনকে তিনি কেবল রেনেসান্স-উত্তর একটি আধুনিক শক্তিহিশেবে প্রশংসা করেন না,তার খৃস্টধর্মীয় পরিচয়কেও তিনি উর্ধ্বে তুলে ধরেন।

The Anglo-Saxon is the soldier of the Cross — the Crusader, who has come to the sunny East to carry on a bloodless, though a far more glorious war, than did the lion hearted Richard, than did the puissant Edward — the first of that name.

After quelling the obstinate antagonism, after crushing the stout resistance of European Paynimrie, the victorious gonfalon of the Cross is now unfurled before the mighty and vast citadel of Brahminism, and it is the hand of the Anglo-Saxon which must plant it on the embattled towers of that citadel.

বস্তুত, তাঁর এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে খৃস্টধর্মের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসা এবং সে ধর্মকে হিন্দু ধর্মের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর মনে করার নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া যায়। অ্যাংলো-স্যাক্সন (কয়েক দশক পরে রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘বড়ো ইংরেজ’) — তার প্রতি মাইকেলের এই মুগ্ধ দৃষ্টি পরবর্তীকালে অক্ষুন্ন ছিলো কিনা, বা তাতে ঘা লেগেছিলো কিনা, সে আমরা যথাসময়ে দেখতে পাবো। কিন্তু খৃস্টধর্মীয় উদারতা এবং কোনো কোনো মূল্যবোধের প্রতি তাঁর আস্থা ধীরে ধীরে আরো জোরদার হওয়া ছাড়া দুর্বল হয়নি।

হেনরিয়েটার ব্যাপটিজমে দলিল

মাদ্রাস স্কুলের শিক্ষকদের যে-তালিকা আগেই উদ্ধৃত হয়েছে, তা থেকে দেখা যায়, ১৮৫৫ সালের ৩০ এপ্রিলও তিনি সে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু কাগজপত্রের অভাবে বলা যাচ্ছে না ঠিক কবে তিনি স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন অথবা ছাড়তে বাধ্য হন। ১৮৫৫ সালের পরবর্তী শিক্ষা পরিষদের যে-কটি বার্ষিক প্রতিবেদন দেখেছি, তার কোথাও তাঁর নাম খুঁজে পাইনি। নেইলরের নামও নয়। তার অর্থ ঐ বছরের ৩০ এপ্রিলের পরে কোনো এক সময়ে তাঁদের চাকরি চলে যায়। ঠিক এই সময়ে অসুস্থতার কারণে মি পাওয়েলও লম্বা ছুটিতে যোরোপে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আপাতদৃষ্টিতে মাইকেলের পৃষ্ঠপোষক। তাঁর অনুপস্থিতে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন, অথবা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ওদিকে, ১৮৫৫ সালের ৬ মার্চ তারিখে Spectator পত্রিকা সপ্তাহে তিনবার প্রকাশের পরিবর্তে দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়। পত্রিকার নাম সামান্য বদলে রাখা হয় Madras Spectator। এই পত্রিকায় তিনি সহকারী সম্পাদকের কাজ পেয়েছিলেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন যে, নামে সহকারী সম্পাদক হলেও, আসলে সম্পাদকের কাজই করতেন তিনি। সেটা অসম্ভব নয়। কলকাতার তখনকার একটি পত্রিকায় তাঁকে Spectator-এর নেটিভ এডিটর বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। ১১৩ Spectator-এর চাকরি তাঁর খুব কাজে লেগেছিলো। মাদ্রাস স্কুলের চাকরি ছেড়ে এ কাজ না-পেলে তিনি নিঃসন্দেহে বিপদে পড়তেন। ওদিকে, Spectator-এর জন্যেও এটাকে একটা মওকা বলে বিবেচনা করা যায়। তাঁর মতো একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং যোগ্য সাংবাদিক মাদ্রাসে পাওয়া আদৌ সহজ ছিলো না, আবার দৈনিকে পরিণত হওয়ায় এমন একজন সাংবাদিক Spectator-এর জন্যে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিলো।

Spectator দৈনিক হিশেবে আত্মপ্রকাশের তিন দিন পরে কবি এবং রেবেকার চতুর্থ সন্তান — দ্বিতীয় পুত্র – মাইকেল জেমসের জন্ম হয়। বেচারা জুনিয়র মাইকেলের ব্যাপটিজম এক বছরের মধ্যেও হতে পারেনি।১১৪ এই পুত্রের জন্মের অল্প দিন পরে কবি বেকার হয়েছিলেন কিনা, ঠিক বলা যাচ্ছে না। এমনও হতে পারে যে, চাকরি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এবং ঝামেলার দরুন পুত্রের জন্মের দু-চারমাসের মধ্যে ব্যাপটিজমের আনুষ্ঠানিকতা পালনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। অথবা হতে পারে, সন্তানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আর নতুন সন্তানের আবির্ভাবকে তেমন করে স্বাগত জানানোর মতো উৎসাহ পিতামাতার ছিলো না। কিন্তু কারণ যাই হোক, জুনিয়র মাইকেলের ব্যাপটিজম দেখা তার পিতার ভাগ্যে আর কোনোদিন ঘটে ওঠেনি।

Spectator-এর চাকরি আর সেই সঙ্গে ‘চমৎকার স্ত্রী এবং চারটি সন্তানের’ সংসার সাজিয়ে তিনি যখন বেশ গুছিয়ে বসেছেন, তেমন সময়ে – ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখ বুধবার তিনি হঠাৎ গৌরদাসের চিঠি পেলেন – চিঠিটি লেখা তাঁর সহস্র স্মৃতিবিজড়িত খিদিরপুরের বাড়ি থেকে। গৌরদাস লিখেছেন

কয়েক বছর পর তোমাকে লিখছি। তোমার এবং আমার যোগাযোগবিহীন নীরবতার মধ্য দিয়ে যে-দীর্ঘ সময় চলে গেছে, সেটাকে তোমার এবং আমার উভয়ের জন্যে একটা গুরুত্তর এবং নিন্দনীয় কর্তব্যচ্যুতি বলে বিবেচনা করি। এক মাত্র ভগবান জানেন, আমি কতোবার তোমার কথা মনে করেছি। আমার চিন্তা যদি কোনো ভাষা না-পেয়ে থাকে, তা হলে তার একমাত্র কারণ আমি জানতাম না তুমি কোথায় আছো। তুমি কেমন আছো, সে সম্পর্কেও কোনো কথা শুনতে পাইনি। সর্বত্র খুঁজেও হদিস পাইনি তুমি কোথায় আছো। … আমি এখন তোমাকে লিখছি এমন একটা জায়গা থেকে যেখানে তুমি তোমার শৈশব এবং বাল্যকাল — না আমার বরং বলা উচিত — তোমার যৌবনের সবচেয়ে ভালো সময়টা কাটিয়েছো। আমি কেন এবং কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি, সেটা আমি এক্ষুণি তোমাকে বলছিনে, তোমার উত্তর না-পাওয়া পর্যন্তই বলছিনে। … আমি তোমার প্রতি একটা ভালোবাসা চিরদিন অনুভব করেছি, সে জন্যে তোমাকে ভুলে যেতে পারিনে। তোমার প্রতি ভালোবাসার প্রভা ম্লান হলেও, ভালোবাসা চলে যায়নি। আবার হাওয়া দিলে দ্বিগুণ বেগে জ্বলে উঠবে, যদিও দীর্ঘকাল চলে গেছে এবং তোমার বাড়ি, তোমার পরিবার, বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজন এবং আমার সঙ্গে তোমার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তোমাকে না-লেখার একটা কৈফিয়ত যতো ছোটোই হোক, আমার তরফ থেকে আছে; কিন্তু তুমি যেমন তোমার নিজেকে চেনো, তেমনি আমাকে চেনো, আমার বাবাকে চেনো, আমাদের বাড়ি চেনো; তুমি চাইলে যেকোনো সমযে আমাকে লিখতে পারতে। তা সত্ত্বেও, তুমি তেমন কিছু করা থেকে বিরত থেকেছো। এমন কি, তুমি একবার খোঁজও নাওনি, আমি বেঁচে আছি, নাকি মরে গেছি। … এদিকে আমার স্ত্রী এখন স্বর্গে।

অনুমান করি, এ পর্যন্ত পড়ে মাইকেল পুরোনো বন্ধুর অভিমান দেখে বিব্রত হয়েছেন। কিন্তু খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন, তাঁর সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হওয়ায় – যদিও বন্ধুর স্ত্রী মরে যাওয়ার খবরে দুঃখিত হয়েছেন। কিন্তু অমনটা এদেশে মোটেই বিবল নয়। তারপর চিঠিতে যা পড়লেন, তাতে অবশ্য তিনি চমকে উঠলেন:

আমি দুঃখিত, তোমার পরিবার সম্পর্কে, বরং বলি তোমার বাবার পরিবার সম্পর্কে, ভালো কোনো খবর দিতে পারছিনে। তুমি বোধহয় অনেক আগেই শুনেছো যে, তোমার বাবামা উভয়ই এখন মৃত। সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে তোমার জ্ঞাতি ভাইয়েরা কাড়াকাড়ি করছে। তোমার দুই বিধবা বিমাতা বেঁচে আছেন। কিন্তু তোমার লোভী এবং স্বার্থপর আত্মীয়দেব কাড়াকাড়িব জন্যে তাঁরা তাঁদের মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে প্রায় বঞ্চিত হয়েছেন। ১১৫

যোগাযোগ যতোই বিচ্ছিন্ন হোক, পিতা নেই – এ খবর শুনে কবি একটা আকস্মিক রূঢ় আঘাতে বিচলিত হলেন। সেই তমলুক থেকে ফেরার পর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিলো। তারপর খৃস্টধর্ম গ্রহণ, বাড়ি ছেড়ে হস্টেলে থাকা, বাবার পুনর্বিবাহ, লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দেওয়া — পরপর অনেক তিক্ত ঘটনাই মুহূর্তের মধ্যে তাঁর মনে পড়ে থাকবে। কিন্তু সব ছাপিয়ে হয়তো মনে পড়েছিলো, শৈশব, বাল্য আর কৈশোরের কথা। চলচ্চিত্রের মতো এক ঝাঁক সুখস্মৃতি দ্রুত মনের পর্দার ওপর একের পর এক ভেসে ওঠাই স্বাভাবিক — বাবা যে কী ভালোবাসতেন! আর বাবার কথা বলতে গিয়েও মধুর বুক ফুলে উঠতো গর্বে, অহংকারে! নিজের অজ্ঞাতে অনেক বিষয়ে তাঁকেই নায়ক হিশেবে গণ্য করতেন তরুণ মধু। সেই বাবা আর নেই! মধু ভাবেন, ‘সত্যি সত্যি আমি আজ অনাথ হলাম!’ একটু পরেই বন্ধুকে তিনি তাঁর সেই বিষণ্ণতার কথাই লিখেছেন।

আর্থিক অবস্থা ভালো হবার সঙ্গে সঙ্গে কবি একাধিক বার বাড়ি বদল করেছিলেন। সম্ভবত এ জন্যে গৌরদাস তাঁর ঠিকানা পাননি। পরেও দেখা যাবে, আয় বাড়লে তিনি ভালো বাড়িতে না-থেকে পারতেন না। আয় কমে গেলে পুনরায় মূষিক হতেও দেরি হতো না। সে যাই হোক, ঠিকানা জোটাতে না-পারার জন্যে গৌরদাস তাঁর চিঠিটি পাঠান রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে। কৃষ্ণমোহন তাঁর কন্যা দেবকীকে নিয়ে কলকাতা থেকে যাত্রা করেন ৭ ডিসেম্বর (১৮৫৫)। মাইকেল যে-ধরনের ছোট্টো উপকূলীয় জাহাজ লেডি সেইলে করে মাদ্রাস এসেছিলেন, কৃষ্ণমোহনও তেমন একটি ছোটো জাহাজ-নাইলে করে মাদ্রাস আসেন। নানা বন্দর হয়ে মাদ্রাসে আসতে এই জাহাজের সময় লেগেছিলো ১০ দিন।১১৬ ১৯ তারিখ তিনি গৌরদাসের চিঠি তাঁকে পৌঁছে দেন। চিঠি পড়ে তিনি সব জানতে পেলেন। তখনো তিনি নির্দিষ্ট তারিখ না-জানলেও, রাজনারায়ণ মারা যান এগারো মাস আগে — ১৬ জানুয়ারি।

গৌরদাস তাঁকে সম্পত্তির কথা বলেছিলেন — তাঁর প্রাপ্য সম্পত্তি নিয়ে অন্যরা কাড়াকাড়ি করছে। কিন্তু তিনি কী করবেন?

প্রিয়তম গৌর, তুমি তো জানো কলকাতায় যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। দারুশ খরচসাপেক্ষ, বিশেষ করে আমার মতো হতভাগার জন্যে! তবে তুমি যদি আশ্বাস দাও যে, বাবার সম্পত্তি থেকে আমার যাবার খরচ উশুল হবে, তা হলে কলকাতা, আমার পুরোনো কলকাতার উদ্দেশে পাল তুলতে রাজি আছি।

বাবা মারা যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর আত্মীয়রা যে তাঁকে কোনো খবর দেননি, সে কথা ভেবে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে থাকবেন।

তুমি খবর না-দিলে আমার বাবার মৃত্যুর খবর আমি হয়তো বছরের পর বছর জানতেই পারতাম না! গৌর, কখন এবং কেমন করে বাবা মারা গেলেন? আমার মনটা উদাস হয়ে যাচ্ছে। তুমি যা যা জানতে পারো, আমাকে জানিয়ো। এই চিঠি পাওয়া মাত্র ফিরতি ডাকে আমাকে লিখো। বাবার যশোরে জমিজমা আছে, সে আমি জানি। আর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি অর্থগৃধ্নুু শকুনগুলোর হাত থেকে সে জমি উদ্ধার করতে পারবো।

চিঠির বয়ান থেকে মনে হয়, যখন চিঠি লিখতে আরম্ভ করেন তখনো কলকাতায় যাবেন কিনা, সে সম্পর্কে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না; ভেবেছিলেন, সম্পত্তির পরিমাণ কততটা তা জানার পর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু চিঠি লিখতে লিখতে মন স্থির করে ফেলেছেন। — ‘পারলে ২৭ তারিখে আগামী জাহাজে করেই চলে যাবো।’ গৌরদাসের স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে নিজের পরিবারের কথা মনে পড়লো। লিখলেন: স্ত্রী এবং চারটি সন্তান নিয়ে তিনি সুখে আছেন।১১৭

কার্যকালে ২৭ তারিখে (ডিসেম্বর) তাঁর যাওয়া হলো না। হয়তো যাওয়ার আগে পরিবারে জন্যে যেসব ব্যবস্থা করে যাওয়া দরকার, তা করতে পারেননি। হয়তো যাওয়ার জন্যে ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ বাবদ যে-টাকাকড়ি দরকার, তা জোগাড় করতে পারেননি। হয়তো গৌরদাসের চিঠির জন্যেও অপেক্ষা করে থাকলেন। ওদিকে, কবির চিঠি পেয়ে গৌরদাস উচ্ছসিত হয়েছিলেন। তিনি এই চিঠির উত্তর দেন ৫ জানুআরি (১৮৫৬)।

তোমার উষ্ণতা এবং ভালোবাসায় ভরা চিঠি পেয়ে কী যে খুশি এবং আনন্দিত হয়েছি, তা বোঝানোর মতো ভাষা আমার নেই। চিঠির কালো বর্ডার দেখে আমি খানিকটা চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু চিঠির বক্তব্য আমাকে দিয়েছে নির্ভেজাল সন্তোষ। তার চেয়েও বড় কথা, তোমার খিদিরপুরের আত্মীয় এবং বন্ধুরা তুমি নেই বলে যে ভুয়ো খবর দিয়েছিলো এবং যা শুনে আমি মর্মান্তিক বেদনায় কাতর হয়েছিলাম, তা মুহূর্তের মধ্যে দূর হয়ে গেছে। …

তোমার বাবা মারা যাবার আগে মানসিক দিক দিয়ে ঠিক সুস্থ ছিলেন বলে মনে হয় না। … তিনি কতোটা সম্পত্তি রেখে গেছেন, তার সঠিক ধারণা আমি দিতে পারবো না। যশোরে যে-সম্পত্তি আছে, তার দাম কতো তুমিই তা ভালো বলতে পারবে। তাঁর অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির দাম খুব বেশি হবে না। তবে খিদিরপুরের বাড়িটির দাম চার হাজার বলে শোনা যাচ্ছে। কলকাতায় আসার এবং ফিরে যাবার জন্যে তোমার যে-ব্যয় হবে, তার জন্যে যথেষ্ট সম্পত্তি রয়েছে। আমি তোমাকে দেখার জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করছি। কারণ তুমি এলে এই সম্পত্তি নিয়ে যে মামলা-মকদ্দমা চলছে, তারই অবসান হবে না, এই অরক্ষিত সম্পত্তি দিয়ে যারা কেবল নিজেরা লাভবান হবার স্বপ্ন দেখছে সেই বেআইনী দাবিদারগণও ভয় পেয়ে যাবে। তোমার বিমাতারাও লাভবান হবেন – তাঁরা তা হলে একজন রক্ষক পাবেন এবং টাকাপয়সার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবেন।

আমি খিদিরপুরে চাকরি করতে আসার পর, আমার হাতে প্রথম যে-তদন্তটি এলো, তা হলো চার আইন (১৮৪৯) অনুযায়ী একটি বাড়ির মালিকানা বিষয়ে তদন্ত করা – যে-বাড়িতে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজনের সঙ্গে আমার সুখের দিন কেটেছে।১১৮

মধু যাতে কলকাতায় সপরিবারে ফিরে আসেন, তার জন্যে এ চিঠিতেও গৌরদাস অনুরোধ জানিয়েছেন। এমন কি, Spectator পত্রিকার সহ-সম্পাদকের কাজ থেকে তাঁর নিশ্চয় বেশি আয় হয় না, বরং কলকাতায় এলে বড়ো কোনো কাজ পাওয়া যাবে – এ রকম যুক্তি দিয়েও তাঁকে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছেন। তিনি লেখেন যে, নতুন শিক্ষা পদ্ধতি (উড্‌স ডেসপ্যাচের ওপর ভিত্তি করে) প্রবর্তিত হওয়ায় অধ্যাপক অথবা ইনস্পেক্টরের পদ পাওয়া শক্ত হবে না এবং পেলে তাঁর ভালো আয় হবে।

গৌরদাসের চিঠি থেকে সম্পত্তির পরিমাণ সম্পর্কে ভরসা পেয়ে কবি কলকাতা যাবার পরিকল্পনা পাকা করে ফেললেন। তবে কলকাতায় যাওয়া, বিশেষ করে পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করতে যাওয়া, দু-চার দিনের ব্যাপার নয়। পত্রিকা থেকে ছুটি নেওয়া এবং সংসারের সব ব্যবস্থা করার জন্যে সময় লাগলো যতোটা ভেবেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সবকিছু সামাল দিয়ে কলকাতার জাহাজে চড়ে বসলেন জানুয়ারির শেষে।

মোটামুটি এসময়ে চমৎকার স্ত্রী আর চার সন্তানের আপাতদৃষ্টিতে একেবারে পরম সুখের নীড়ে একটা ঝড় বয়ে গিযেছিলো। প্রমাণের অভাবে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় — কবি মাদ্রাস ত্যাগ করার আগে, নাকি তার অব্যবাহিত পরে। কিন্তু সে এমনই প্রচণ্ড ঝড় এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছাস যে, সমস্ত সংসার যে-ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছিলো, সে ভিত্তি পর্যন্ত ধুয়ে-মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। এর পর কবি আর সে সংসারে কোনো দিন ফিরে যেতে পারেননি। চমৎকার বৌ-এর মুখের দিকে তাকানো তো দূরের কথা, সাড়ে ছ বছরের বড়ো-মেয়ে ব্যর্থা, চার বছর দশ মাসের ছোটো-মেয়ে ফিবি, সাড়ে তিন বছরের বড়ো-ছেলে জর্জ আর দশ মাসের ছোটো-ছেলে মাইকেল – কারো সামনে জীবনে আর দাঁড়াতে পারেননি। এই সর্বনাশী বাত্যার কারণ কী? এর কারণ ব্যাখ্যা করার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী থেকে একটা সম্ভাব্য কারণ আমরা অনুমান করতে পারি।

কবির সহকর্মী জর্জ হোয়াইট তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর মেয়ের চেয়েও কম বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনেন এবং তার ফলে সে সংসারের শান্তি বিনষ্ট হয় – এ আমরা ইতিপূর্বে লক্ষ্য করেছি। তখন সহকর্মীর কন্যা হেনরিয়েটাকে কবি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। সেই সহানুভূতিই ধীরে ধীরে প্রেমে পরিণত হয়। কিন্তু, অনুমান করি, এই গোপন প্রেমের কোনো প্রভাব তাঁর সংসারে গভীর ছাপ ফেলতে পারেনি। হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম এবং রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্যজীবন সমান্তরালভাবেই চলছিলো – দ্বৈত জীবন যাকে বলে। সংসারে যদি অশান্তি হতো, রেবেকাকে ত্যাগ করার আদৌ কোনো পরিকল্পনা যদি তাঁর মনে থাকতো, তা হলে গৌরদাসকে লেখা চিঠিতে একেবারে অযাচিতভাবে লিখতে পারতেন না: I have a fine English wife and four children।১১৯ তিনি হয়তো ভেবেছিলেন: এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না! হেনরিয়েটার পিতা ছিলেন সাহিত্যের শিক্ষক। পরবর্তী জীবনের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, হেনরিয়েটা বাংলা শিখে কবির সাহিত্যসঙ্গিনী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। অপর পক্ষে, আমার ধারণা, অনাথ রেবেকার শিক্ষা সামান্যই হয়েছিলো। হেনরিয়েটা ছিলেন সে তুলনায় বেশি শিক্ষিত। কবি যে তাঁর সঙ্গ পছন্দ করতেন, তাঁকে ভালোবাসতেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সে প্রেমের জন্যে নিজের স্ত্রী অথবা সন্তানদের ত্যাগ করতে তিনি তৈরি ছিলেন না। রেবেকা তাঁকে বিয়ে করতে গিয়ে যে-সাহস দেখিয়েছিলেন এবং যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, কবি সেটাও ভুলতে পারেননি। তা ছাড়া, রেবেকাকে তিনি আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। সে জন্যে নির্ঝঞ্ঝাটে আপন গতিতে এগিয়ে চলছিলো এই প্রণয়ের ধারা।

কিন্তু মাইকেল দীর্ঘদিনের জন্যে কলকাতায় চলে যাচ্ছিলেন — এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতো দিনের লুকানো এই প্রণয়লীলা হঠাৎ প্রকাশ পেয়েছিলো। কিভাবে প্রকাশ পেলো, কতোটা প্রকাশ পেলো, সে আমাদের জানা নেই। কিন্তু ব্যাপারটা আর রেবেকার কাছে চাপা থাকেনি, এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়। যে-রেবেকা স্বজন এবং বন্ধুদের তীব্র বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে তখনকার সমাজের দৃষ্টিতে একেবারে অগ্রহণযোগ্য একটি কৃষ্ণাঙ্গকে বিয়ে করেছিলেন এবং সব অভাব স্বীকার করে ভালোবাসা আর সন্তান দিয়ে স্বামীর সংসারকে ভরে দিয়েছিলেন, তিনি এই বিশ্বাসঘাতকতাকে মেনে নিতে পারেননি। অতঃপর রেবেকা আর মাইকেলের সঙ্গে ঘর করতে রাজি হননি। কিভাবে সংসার চলবে, কৃষ্ণাঙ্গ শিশুগুলোর কী হবে — এসব গুরুতর সমস্যা ছিলো রেবেকার সামনে, তা সত্ত্বেও অভিমানিনী নারী ভেবে থাকবেন যে, তিনি ভিক্ষা করে খাবেন, তবু এর সঙ্গে আর নয়! মাইকেল যেন আর ফিরে না আসেন – মুখ রক্ষার জন্যে তিনি সম্ভবত তাঁকে তা বলে দিয়েছিলেন। অবশ্য আর-একটা সম্ভাবনার কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারিনে। সে হলো: এই প্রেমের খবর কবির মাদ্রাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। প্রকাশ পেয়েছিলো তিনি কলকাতা যাবার পরে। এই সম্ভাবনার কারণ, পরে ব্যাখ্যা করবো। কিন্তু মাইকেলের প্রণয় এবং বিশ্বাসঘাতকতার কথা যখনই প্রকাশ পেয়ে থাকুক না কেন, তিনি সত্যি সত্যি আর কোনো দিন মাদ্রাসে ফিরে যাননি।

তাঁর মাদ্রাস ত্যাগের সময়ে কনিষ্ঠ পুত্র মাইকেল জেমসের বয়স ছিলো দশ মাস। তখনো তার ব্যাপটিজম হয়নি। তার ব্যাপটিজম হয় কবি মাদ্রাস ছাড়ার কিঞ্চিদধিক দু মাস এবং ঈস্টারের কদিন পরে – দোসরা এপ্রিল। ১২০ এবং এই পুত্রের মৃত্যু হয় আরো উনিশ দিন পরে – ২১ এপ্রিল। ১২১ তা সত্ত্বেও কবি আর মাদ্রাসে যাননি। বস্তুত, স্নেহের বন্ধন অথবা পারিবারিক দায়িত্ব কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। তেরো বছর আগে তিনি যখন ধর্মান্তরের জন্যে বাড়ি ছাড়েন অথবা ন বছর আগে কলকাতা ছেড়ে তিনি যখন মাদ্রাসের পথে পা বাড়ান, তখনো কোনো স্নেহের টান তাঁর মনকে টলাতে পারেনি। এ তাঁর চরিত্রেরই একটা বৈশিষ্ট্য।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ব্যবহারে কোনটা বিবেচনা এবং কোনটা অবিবেচনা, বলা শক্ত। কারণ আন্তরিক প্রণয় থেকেও মানুষ মানুষকে নিষ্ঠুরতম আঘাত দিতে পারে। সুতরাং কেবল রেবেকাকে ত্যাগ করলে তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু চার-চারটি অপোগন্ড অসহায় সন্তানকে তিনি কোন বিবেচনায় চিরদিনের জন্যে ত্যাগ করেছিলেন, তা বোঝা মুশকিল। তিনি এঁদের জন্যে এক গাদা টাকাকড়িও রেখে আসেননি। কারণ ২০ ডিসেম্বরের (১৮৫৫) চিঠিতে তিনি নিজেকে একটা “poor devil” বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন যে, কলকাতায় যেতে পারবেন যদি পিতার সম্পত্তি থেকে সেই খরচটা উঠে আসে। সুতরাং বলা যায়, স্ত্রী এবং সন্তানদের মাদ্রাসে ফেলে এসে তিনি ‘বীররসের’ বড়ো কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেননি। মাকে ত্যাগ করে এসে পোপের দোহাই দিয়ে বলেছিলেন, কাব্যদেবীর সাধনা করার জন্যে দরকার হলে পিতামাতা সবাইকে ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু সন্তানদের তিনি কি জন্যে ত্যাগ করেন কোনো কালে তার ব্যাখ্যা দেননি। গৌরদাসের মতো অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও কোনোদিন কিছু খুলে বলেননি। তবে তিনি পাষণ্ড ছিলেন না, পরে দেখতে পাবো, এই অপরাধ বোধ তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে এবং সে জন্যে কবিতার ভাষায় আত্মগোপন করে তিনি গলা ফাটিয়ে আন্তরিক আর্তনাদ করেছেন।

রেবেকাও তাঁর স্বামীকে ভুলতে পারেননি। সেটা প্রেমের কারণে নাকি কৃষ্ণাঙ্গ তিনটি সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, তা বলা শক্ত। মাইকেল মাদ্রাস ত্যাগের সাড়ে ৩৬ বছর পরে, ১৮৯২ সালের ২২ জুলাই, তিনি যখন ক্ষয় রোগে মারা যান, তখনো চার্চের খাতায় তাঁর নাম লেখা হয়েছে রেবেকা টমসন ডাট। ১২২ বিবাহবন্ধন তিনি ত্যাগ করেননি। তার একটা কারণ হতে পারে: যে- হেনরিয়েটার জন্যে তিনি তাঁর সুখের সংসার ভাঙতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই হেনরিয়েটা যাতে মাইকেলকে কোনো দিন বিয়ে করতে না পারেন, তিনি সে জন্যে বিবাহবিচ্ছেদে রাজি হননি। প্রসঙ্গত, আরো একটা কথা উল্লেখ করতে হয়, যে-সন্তানদের রেবেকা পক্ষীমাতার মতো দুই পাখার নিরাপত্তা দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাঁর অতো ত্যাগ স্বীকার সত্ত্বেও তাঁদের জীবনের গতি স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি। পরে আমরা তা বিস্তাবিতভাবে লক্ষ্য করবো।

মাদ্রাস থেকে মাইকেল কেন ছদ্মনাম (মিস্টার হোন্ট) নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন – এ নিয়ে তাঁর জীবনী-লেখকরা গবেষণা না-করলেও, জল্পনা-কল্পনা কম করেননি। রেবেকা এবং তাঁর বান্ধবদের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি ছদ্মনামে কলকাতায় আসার টিকিট কিনেছিলেন; মি হোন্টের নামে যে-আসন সংরক্ষিত ছিলো, হঠাৎ করে আসতে হয় বলে সেই আসনে তিনি এসেছিলেন; দেশীয়রা ক্যাবিনে যেতে পারেন না, সে জন্যে ইংরেজি নাম নিতে হয় ইত্যাদি অনেক কিছুই ছিলো এই জল্পনা-কল্পনার মধ্যে।১২৩ কিন্তু আসল ঘটনা হলো: মাইকেল তাঁর নিজের নামেই টিকিট কিনেছিলেন। Athenæum পত্রিকায় দেখতে পাই দু হাজার টনের এবং ৫২০ অশ্বশক্তির সেকালের বিবাট জাহাজ বেন্টিঙ্ক মাদ্রাস ত্যাগ করে ২৮ জানুআরি সোমবার। এই জাহাজটি সাউথ্যাম্পটন থেকে কলকাতায় যাচ্ছিলো মাদ্রাস হয়ে। শূন্য আসনে মাদ্রাস থেকে ছ জন ‘ভদ্রলোক’ যাত্রী, একজন নেটিভ যাত্রী, দুজন দেশীয় ভৃত্য আর দুজন সহিস ওঠেন। ভদ্রলোক যাত্রীদের মধ্যে একজনের নাম মি. এম এম ডাট।১২৪ সুতরাং আর যাই হোক, তিনি মাদ্রাস থেকে ছদ্মনাম নিয়ে পালিয়ে যাননি।

তা হলে কবি যে মি হোন্ট নামের কথা লিখেছেন, সেটির উৎস কী? জাহাজটি ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় যাচ্ছিলো। যাত্রীরা সবাই ছিলেন য়োরোপীয়। জাহাজে তিনি ছিলেন মাত্র চারদিন। কিন্তু তারই মধ্যে বিদগ্ধ এবং চোস্ত ইংরেজি-জানা যাত্রী হিশেবে তিনি অন্য যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁরা তাঁকে এই পরিচয়/ঘনিষ্ঠতা থেকে হোন্ট নাম দিয়েছিলেন। তবে বিশেষ করে হোন্ট কেন – অন্য কোনো তথ্য না-পেলে তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। সরকারী কাগজপত্র অনুযায়ী জাহাজটি কলকাতায় পৌঁছে পয়লা ফেব্রুআরি, শুক্রবার রাতের বেলায়। কলকাতায় যে-যাত্রীরা পৌছেছিলেন, সেই যাত্রীদের তালিকায় মাদ্রাস থেকে আগত যাত্রীদের মধ্যে পাচ্ছি মি হোন্টসহ ছ জনের নাম,১২৫ আর মি এম এম ডাটের নাম সেখানে অনুপস্থিত। বোঝা যায়, কলকাতায় নামের তালিকা দেবার সময়ে জাহাজ-কর্তৃপক্ষ তাঁর সত্যিকার নাম না-লিখে, তাঁর ঠাট্টা করে-দেওয়া নামই লিখে দিয়েছিলো।

মাদ্রাস থেকে তিনি যাত্রা করেছিলেন এক নামে, কিন্তু চারদিন জাহাজে থাকার পর কলকাতায় নামার সময়ে তাঁর নাম হয়ে গেলো আর-এক। বাস্তবেও তিনি মাদ্রাসে তাঁর জীবনের এক অধ্যায় শেষ করে কলকাতায় শুরু করেন জীবনের সম্পূর্ণ নতুন আর-এক অধ্যায়।

উল্লেখপঞ্জী ও টীকাটিপ্পনী –  পরদেশে

পৃ ৯০

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৭২-৭৩। তাঁর আগে এ রকমের অনুমান করেন ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, পৃ. ১০৪। কিন্তু তাঁরা এমনও বলেছেন যে, মাইকেল এঁদের সঙ্গে এক জাহাজে করে যান। এ অনুমানও ঠিক নয়।

পৃ ৯১

SPG Papers, Rhodes Library, Oxford, C. Ind. I/13/107 and 126.

পৃ ৯২

The Madras Aintanac, 1855, Shipping অধ্যায় দৃষ্টব্য। ১৮৫৫ সালে কলকাতা থেকে মাদ্রাস যাবাব ভাড়া ছিলো ক্যাবিনে ১২০, কোয়ার্টার ডেকে ৯০ টাকা।

Ibid.

Shipping Intelligence, Athenaeunt, 18 January 1848. লেডি সেইল ২৯ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতা ত্যাগ করে ৩০শে গাঞ্জামে পৌঁছে। পয়লা জানুযারি পৌঁছে কলিঙ্গপত্তম, ৯ই বিশাখাপত্তম আর ১৬ই করিঙ্গা।

পৃ ৯৩

Madras Spectator পত্রিকায় এম এম ডাটের বদলে তাঁর নাম ছাপা হয়েছে এন এন ডাট হিশেবে। কিন্তু সেখানেও অব বিশপস কলেজ, ক্যালকাটা কথাটা আছে।

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩৩।

১০ A Letter to Robert Lowe, Joint Secretary of the Board of Control, From John Bruce Norton on the Condition and Requirements of the Presidency of Madras (Madras: Pharoah & Co., 18540).

পৃ ৯৪

১১ মিস্টার ডিয়ালট্রির সঙ্গে মাদ্রাসের যোগাযোগ ছিলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মাইকেল মাদ্রাসে যাওয়ার তিন মাস পরে ডিয়ালট্রি মাদ্রাস হয়ে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। পথে কদিন ছিলেন মাদ্রাসে। কেবল তাই নয় ডিসেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে থাকার সময়ে তাঁকে মাদ্রাসের লর্ড বিশপ পদে নিযুক্ত করা হয়। এর দু মাস পরে – ১৮৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে – তিনি মাদ্রাসে এসে এই পদে যোগদান করেন। একই মাসে তাঁর পুত্র টমাস কেমব্রিজ থেকে ডিগ্রি লাভ করে মাদ্রাসের ধর্মযাজক পদে নিযুক্ত হন। মাইকেল মাদ্রাসে যাবার ১৮দিন আগে রেভারেন্ড ডাফ এবং তাঁর স্ত্রী কলকাতা থেকে বিশাখাপত্তম হয়ে মাদ্রাসে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। ইনিও হয়তো মাইকেলকে সুপারিশ করেছিলেন। বস্তুত, নানা জনের সুপারিশই হয়তো তাঁকে মাদ্রাসে গুছিয়ে বসতে সাহায্য করেছিলো।

১২ তখনকার The Madras Almanac-এর প্রকাশক ছিলে মিলিটারি মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম। এতে প্রতিটি অ্যাসাইলামের বিস্তারিত ইতিহাস দেওয়া আছে।

১৩ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৮১।

পৃ ৯৫

১৪ Reports of the Madras Male and Female Orphan Asylum and Free Day School, 1848-7855 (Madras: C. M. Pereyra, Current Press, 1848-1855).

১৫ Ibid., 1850. এ বছবেব রিপোর্টে আলাদা করে একজন মাস্টার এবং একজন মিস্ট্রেসের কথা উল্লেখ করা হয়। p. 3.

১৬ Ibid., 1851, p. 3.

১৭ Ibid., 1849.

পৃ ৯৬

১৮ Ibid., 1858, p. 5. Also see “A Letter on the Annual General Meeting of Asylum”, Athenaeum, 2 September 1848.

পৃ ৯৭

১৯ Reports of the Madras Male and Female Orphan Asylum and Free Day School, 1848-1855 (Madras: C. M. Pereyra, Current Press, 1848-1855), 1850, p.3.

পৃ ৯৮

২০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

২১ ঐ।

পৃ ৯৯

২২ I.O.R./N/2/27/436.

২৩ I.O.R./N/2/ নেইলরের বিয়ের তারিখ ২৯ জুলাই ১৮৪৫ তারিখে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে বাইশ, তাঁর স্ত্রী সুস্যাসাহর বয়স সাড়ে সোলা।

২৪ পরের আলোচনা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১৪৬।

২৫ Reports of the Madras Male and Female Orphan Asylum and Free Day School, 1848, অন্য চাঁদাদাতাদের মধ্যে জর্জ নর্টন দিতেন বছরে ৩০ টাকা, এয়ার বার্টন পাওয়েল ১৫ টাকা, পাত্রী নক্স ২০ টাকা।

২৬ I.O.R./N/2/27/436.

পৃ ১০০

২৭ I.O.R./N/2/13/196.

২৮ বিয়ের দলিলে ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশের নামের আগে মৃত বলা হয়নি, বরং তার কাজেরও উল্লেখ করা হয়েছে — Superintendant, Indigo Plantation, Cuddapah.

২৯ বিয়ের রেজিস্টারেই এর উল্লেখ আছে। I.O.R./N/2/10/268..

৩০ I.O.R./N/2/16/159.

৩১ I.O.R./N/2/22/87.

পৃ ১০১

৩২ Ecclesiastical Records, Public Records Office, Edinburgh.

পৃ ১০২

৩৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

৩৪ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে এই কবিতাগুলো প্রথম প্রকাশ করেন নগেন্দ্রনাথ সোম।

৩৫ Captive Ladie-র ভূমিকায় এই ঠিকানা দেওয়া আছে। কিন্তু মাইকেলে বড়ো মেয়ে ব্যর্থার ব্যাপটিজমের দলিলে ঠিকানা ব্ল্যাক টাউনে দেওয়া আছে।

পৃ ১০৫

৩৬ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬ ও ৪১, HRP।

৩৭ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৭, HRP।

৩৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

পৃ ১০৬

৩৯ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৭, HRP।

৪০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৮, HRP। ওয়াকারের কাছ থেকে গৌরদাসকে নিতে লিখেছিলেন ৫০ কপি।

৪১ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৭, HRP।

৪২ Ibid.

পৃ ১০৭

৪৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪১, HRP।

৪৪ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

৪৫ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪১, HRP।

৪৬ অ্যাবেল সিমকিন্সের দুটি পত্রিকা ছাড়া তিনটি প্রেস ছিলো। একটি প্রেস ছিলো ১০৭ নম্বর আর্মেনিয়ান রোডে, একটি ১৪২ নম্বর মাউন্ট রোডে আর-একটি ১৬৩ নম্বর সেকেন্ড লেইন বীচে।

পৃ ১০৮

৪৭ আমি এই তথ্য পরিবশেন করি ১৯৮৬ সালে – আমার দুটি প্রবন্ধে। ‘মাইকেলের মাদ্রাস-জীবন”, সাহিত্য পত্রিকা, ৩০:৩; এবং ‘নতুন তথ্যের আলোকে মাইকেলেব মাদ্রাস-জীবন ও বিবাহ’, জিজ্ঞাসা, ৭:৪। এ ছাড়া প্রতিক্ষণ পত্রিকায়ও একটি ছোটো প্রবন্ধে এ রকমের মত প্রকাশ করি। পরে ভার্সাইতে গিয়ে হেনরিয়েটার সত্যিকার পরিচয় পাই। নিজের ভুল সংশোধন করে সত্যিকার তথ্য পরিবেশন করি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে।. ‘প্রবাসে দৈবের বশে’, দেশ, ২৫ ফেব্রুআরি ১৯৮৯।

৪৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

৪৯ Athenaeum, 17 April 1848.

পৃ ১১০

৫০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪০ ও ৪১, HRP।

৫১ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৮, HRP।

পৃ ১১১

৫২ MMD to Bhudeb Mukhopadhyay, পত্রসংখ্যা ৩৯, HRP।

৫৩ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৬১।

৫৪ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৮, HRP।

পৃ ১১৪

৫৫ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪০, HRP।

৫৬ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১১৩।

পৃ ১১৫

৫৭ স্বপন বসুর চিঠিতে মূল ইংরেজি সমালোচনা উদ্ধৃত, ‘আশার ছলনে ভুলি’, দেশ, ৮ এপ্রিল ১৯৯৫, পৃ. ১৭।

৫৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪১, HRP।

৫৯ ঐ।

পৃ ১১৭

৬০ ঐ।

৬১ ঐ।

৬২ ঐ।

পৃ ১১৮

৬৩ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১১৬-১৭।

৬৪ এই বক্তৃতার অংশ বিশেষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে (পৃ ১১৭)। পুরো বক্তৃতা পড়েছিলাম অ্যাথেনিয়াম পত্রিকায়। কিন্তু কোন তারিখের পত্রিকা সে তথ্য এখন হারিয়ে ফেলেছি।

৬৫ এ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় Captive Ladie-র মলাটের ছবি দ্রষ্টব্য।

পৃ ১১৯

৬৬ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৬, HRP।

পৃ ১২০

৬৭ I.O.R/N/2/28/557. MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪২, HRP।

৬৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪২, HRP।

৬৯ ঐ।

৭০ মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৭।

পৃ ১২১

৭১ I.O.R/N/2/28/557.

৭২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪২, HRP।

৭৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪১, HRP।

পৃ ১২২

৭৪ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪২, HRP।

পৃ ১২৩

৭৫ Eurasian পত্রিকার নথি আমি দেখিনি। এ তথ্য উদ্ধৃত করেছেন সুরেশচন্দ্র মৈত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৮৬।

পৃ ১২৪

৭৬ MMD to Keshab Gangooly, পত্রসংখ্যা ৭০, HRP।

পৃ ১২৬

৭৭ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪৩, HRP।

৭৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৪৮।

পৃ ১২৭

৭৯ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৮৭।

৮০ I.O.R/N/2/29/264.

পৃ ১২৮

৮১ Quoted in Athenaeum, 2 May 1850.

৮২ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৯৯; মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩১।

৮৩ Quoted in Athenaeum, 2 May 1850.

পৃ ১২৯

৮৪ Athenaeum, 9 March 1952.

পৃ ১৩০

৮৫ Athenaeum, 19 April 1851.

৮৬ Athenaeum, 3 May 1851.

৮৭ Athenaeum, 7 June 1851.

৮৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৪৩৭-৪০। এই রচনা প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালের মার্চ মাসে।

পৃ ১৩১

৮৯ ঐ, পৃ ৪৪০-৪১। প্রকাশ কাল মে ১৮৫১।

৯০ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২২৭-২৯।

৯১ Athenaeum, 15 January 1852.

৯২ Athenaeum, 17 January 1852:

পৃ ১৩২

৯৩ মধু-স্মৃতি, গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৭-৪৮।

পৃ ১৩৩

৯৪ I.O.R/N/2/30/330.

৯৫ Athenaeum, 26 August 1851.

৯৬ Reports of the Madras Male and Female Orphan Asylum and Free Day School, 1851.

৯৭ Eleventh Annual Report from the Governors of Madras University. 1852 (Madras: Pharoah & Co., 1852),

পৃ ১৩৪

৯৮ Ibid, p. 14.

৯৯ জর্জ জাইলস হোয়াইট জন্মেছিলেন লন্ডনের উপকণ্ঠে ফুলহ্যামে। তিনি ১৮২০ সালে লিয়ান্ডার জাহাজে করে মাদ্রাসে আসেন এবং এগমোরের মিলিটারি মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর আগে তাঁর পেশা কি ছিলো তা জানা যায় না। মাদ্রাস পুলিস অফিসের রিপোর্ট, ৩১ ডিসেম্বব ১৮২৭, IOR, European Inhabitants in Madras, 0/5/30, Vol. 4, Pt 3.

১০০ I.O.R./N/2/10/286, তাঁর স্ত্রীর কুমারী নাম ছিলো অ্যালাইজা গ্রে। বিয়ের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ১৮২৫। তিনি বিয়ে করেছিলেন লাইসেন্স দিয়ে।

১০১ Reports of the Madras Male and Female Orphan Asylum and Free Day School, 1852.

পৃ ১৩৬

১০২ I.O.R./N/2/31/260.

১০৩ ক্যাপটিভ লেডি লেখার সময় থেকেই কবি রায়পুরমে বাস করতেন। তিনি সেখানে প্রায় চার বছর বাস করেছিলেন। তাঁর ঠিকানা খুঁজে পাইনি। কিন্তু জর্জ হোয়াইট বাস করতেন রায়পুরমের ২৯ নম্বর জেইল রোডে।

১০৪ 3rd proposal moved by G. G. White and seconded by Mr Jones, Report of the Madras Male and Female Orphan Asylum and Free Day School for Boys, 1848 (Madras: C. M. Pereyra, Current Press, 1848).

পৃ ১৩৭

১০৫ I.O.R./N/16/169.

১০৬ I.O.R/N/2/16/385.

১০৭ I.O.R/N/2/20/4.

১০৮ I.O.R/N/2/ বিয়ের তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৩। এই বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন টমাস এবং এডওয়ার্ড গ্রীন।

পৃ ১৩৮

১০৯ Report of the Madras University, 1853.

১১০ ঐ।

পৃ ১৩৯

১১১ The Anglo-Saxon and the Hindu গ্রন্থের ভূমিকা। মাইকেল ১৮৫৪ সালের জুন মাসে পরপর চার সপ্তাহে এই বক্তৃতা করেন। অ্যাথেনিযাম পত্রিকায় এই বক্তৃতার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু যখন ছাপা হয়, তখন চারটি বক্তৃতাই ছাপা হয়েছিলো কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। অন্তত তার কোনো লিখিত প্রমাণ আমাদের হাতে আসেনি। লেকচার ওয়ান নামে প্রকাশিত বক্তৃতাটি এত লম্বা যে, এর মধ্যেই চারটি বক্তৃতা সংকতি হওয়া অসম্ভব নয়।

১১২ হেনরি কেনরিকের জন্ম তারিখ (১৮১৫) এবং বিয়ের তারিখ (১৮৪০) খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর তারিখ খুঁজে পাইনি। ১৮৫৬ সালের পরবর্তী পত্রপত্রিকায় তাঁর নামও লক্ষ্য করিনি। আবার মাদ্রসের বেরিয়াল রেজিস্টারেও তাঁর নাম নেই। কিন্তু ১৮৫৭ সালে তাঁর স্ত্রীকে পার্সেবাকুম এলাকায় বাস করতে দেখি। আমার ধারণা, ১৮৫৫ সালে তিনি অন্য কোথাও মারা যান অথবা চলে যান। কয়েক বছর পরে উটকামুণ্ডের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিশেবে জে এইচ কেনরিকের নাম দেখতে পাই। ইনি জন হেনরি কেনরিক হওয়া সম্ভব।

পৃ ১৪৩

১১৩ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ১০৮।

১১৪ I.O.R./N/2/36/217.

পৃ ১৪৪

১১৫ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৮৯-৫০।

১১৬ Shipping Intelligence, Athenaeum, 19 December 1855.

পৃ ১৪৫

১১৭ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪৪, HRP।

১১৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৫১-৫২।

পৃ ১৪৬

১১৯ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪৪, HRP।

পৃ ১৪৭

১২০ I.O.R/N/2/36/167.

১২১ I.O.R/N/2/36/217.

১২২ I.O.R/N/2/74/65.

পৃ ১৪৮

১২৩ কৌতূহলবশত এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি এবং সম্ভাব্য বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন অমলেন্দু দে। Michal Madhusudan Datta (Delhi: Sahitya Akademi,), pp. 90-91. ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ এই জল্পনা-কল্পনা শুরু করেন বলে মনে হয়। পৃ. ১৪৫-৪৬।

১২৪ Shipping Intelligence, Athenaeum, 29 January 1856.

১২৫ New Calcutta Directory for 1857 (Calcutta: P. M. Cravenburgh, 1857), Arrivals, Passenger List from Madras, Pt. XI.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *