২. সাধিতে মনের সাদ

সাধিতে মনের সাদ

সতেরো/আঠারো দিন তমলুকে থাকার পর রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতায় ফিরে আসেন, ৩০ অক্টোবর, রোববার — পরের দিন আদালত এবং হিন্দু কলেজ, দুই-ই খোলা। কলকাতায় ফিরে কাজ নিয়ে তিনি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ব্যস্ততার মধ্যেও পুত্রের যে-সমস্যা লক্ষ্য করেছিলেন, তার কথা ভুলতে পারলেন না। তাঁর দ্বিতীয় কোনো সন্তান ছিলো না। সুতরাং সব কাজের চেয়ে তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর ছেলে। কিভাবে ছেলের মতি-গতি পরিবর্তন করা যায়, তা নিয়ে তিনি এ সময়ে জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে নিশ্চয় পরামর্শ করেন। তিনি শুধু চান, মধু আর-পাঁচজনের মতো আচরণ করুক! শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলের স্বভাব বদলের জন্যে স্থায়ী এবং অব্যর্থ একটি ব্যবস্থা নেবেন তিনি। সেকালে বাঙালি সমাজে উঠতি বয়সের তরুণদের কোনো সমস্যা দেখা দিলে, বিশেষ করে মানসিক অথবা আচরণের সমস্যা, তা হলে বিযেকে একটা আচ্ছা দাওয়াই হিশেবেমনে করা হতো। সুতরাং ঘটক আসা-যাওয়া করতে আরম্ভ করলো। সমস্যাটাকে তিনি কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন, তা বোঝা যায় কী রকম তড়িঘড়ি করে তিনি পুত্রের বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, তা থেকে। তমলুক থেকে ফিরে আসার চার সপ্তাহের মাথায় — ২৭ নভেম্বর মধু জানতে পারলেন, ঠিক তিন মাস পরে ফাল্গুন মাসে তাঁর বিয়ে। ইচ্ছে থাকলেও, রাজনারায়ণ বিয়ের তারিখটা আরও এগিযে আনতে পারলেন না। কারণ পৌষ মাস বিয়ের জন্যে প্রশস্ত নয়। আর মাঘ মাস মধুর জন্ম মাস।

নাম-করা উকিল রাজনারায়ণ। বিত্তের অধিকারী। কলকাতায় বাড়ি আছে। তাঁর অন্য ভাইরাও সবাই শিক্ষিত এবং বিত্তশালী। আর পাত্র হিশেবে মধুও অসাধারণ। বাবা-মার একমাত্র সন্তান। শ্যামলা হলেও, সুদর্শন। মেধাবী ছাত্র হিশেবে এরই মধ্যে নাম কিনেছেন — হিন্দু কলেজের সোনার পদক- এবং বৃত্তি-পাওয়া ছাত্র। ভবিষ্যতে নিদেন পক্ষে ডেপুটি হতে পারবেন। এর চেয়ে যোগ্য পাত্র কমই আছে। তাদের সুন্দরী মেয়ের উপযুক্ত পাত্র। সুতরাং প্রস্তাব দেবার সঙ্গে সঙ্গে পাত্রী-পক্ষ রাজি হয়ে গেলো। মধু গৌরদাসকে লেখা তাঁর চিঠিতে বলেছেন, মেয়েটি একটি জমিদার- কন্যা। আর গৌরদাস বলেছেন, মেয়েটি ছিলো পরীর মতো সুন্দরী। কিন্তু মেয়েটি কে, তা জানা যায়নি।

মধু কি মনে করতেন, তাঁর বিয়ে করার মতো বয়স অথবা সময় হয়নি? অসম্ভব নয়। তবে এ কথাটা জোরে-সোরে বলার মতো সাহস তাঁর ছিলো না। কারণ ততোদিনে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কারো কারো বিয়ে হয়ে গেছে, যদিও তাঁরা বিবাহিত জীবন্বশুরু করতে পারেননি নিতান্ত বালিকার সঙ্গে বিয়ে হওয়ায়। সুতরাং বিয়ের আয়োজন করে রাজনারায়ণ দত্ত এমন কিছু অদ্ভুত আচরণ করেননি। বস্তুত, তিনি যা করেছিলেন, তা-ই ছিলো সে কালের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক এবং সমাজ-স্বীকৃত রেওয়াজ। পুত্রের মুখ চেয়ে তিনি তদুপরি একটি ‘পরীর মতো’ কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক করেছেন। আর কী চাই! অবশ্য পরীর মতো সুন্দরী হলেই মধু যে `না — এটা তাঁর অভিভাবকরা কল্পনা করেননি। বিয়ের ব্যাপারে সে যুগের বিচারে তাঁর ছিলো একেবারে ভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ।

বিয়ে এবং প্রেম সম্পর্কে মধু দারুণ বোম্যান্টিক ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গৌরদাসকে লেখা তাঁর গাদা গাদা চিঠিতে তিনি তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষা, কল্পনাবিলাস অনেক কিছুর কথাই লিখলেও কোথাও কোনো মেয়ের কথা অথবা মেয়েদের সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের কথা উল্লেখ করেননি। সে কথা তিনি বার বার লিখেছেন তাঁর কবিতায়। অবশ্য কবিতায়ও তাঁর স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার একটি মাত্র বৈশিষ্ট্য তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন — সে নীলনয়না। এবং এ থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, নারীদের সম্পর্কে তিনি যে-রোম্যান্টিক ধারণা পোষণ করতেন, তা তিনি স্বদেশের মাটিতে পাননি, পেয়েছিলেন পাশ্চাত্যের যে-সাহিত্য তিনি পাঠ করেছিলেন, সেখান থেকে। তাঁর প্রিয় যে-রোম্যান্টিক কবিদের কথা তিনি পড়েছেন, তাঁদের দৃষ্টান্তও তাঁকে উদ্‌বুদ্ধ করে থাকবে। এই কবিরা কেউ আয়োজিত বিবাহ করেননি। রীতিমতো প্রেম করে, বিয়ের আগে প্রেমিকা অথবা প্রেমিকাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে তাঁরা মনের মতো মেয়েকে বিয়ে করেছেন। বিশেষ করে টম মূরের লেখা জীবনী পড়ার সময়ে তাঁর ‘প্রিয়’ বায়রনের দৃষ্টান্ত তিনি ভালোভাবে লক্ষ্য করেছিলেন।

বিয়ের আগেই বায়রন একাধিক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়েছিলেন। মাত্র ন বছর বয়সে তাঁর প্রেম ভাব জাগিয়ে তুলেছিলেন তাঁর নার্স। তাঁর দুই জ্ঞাতি বোন মেরী ডাফ আর মার্গারেট পার্কারকেও তিনি ভালোবেসেছিলেন ছেলেবেলায়। ১৩ বছর বয়সে তিনি যখন ন্যারো স্কুলে ভর্তি হন, সেখানেও তিনি অন্য বালকদের সঙ্গে প্রেমে পড়েন। তাঁর সমকামিতা এই স্কুলে এবং পরবর্তী কালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে অথবা গ্রীসে থাকার সময়ে আদৌ গোপন ছিলো না। ১৫ বছর বয়সে বায়রন প্রেমে পড়েন মেরী চ্যাওয়ার্থের। ২০ বছর বয়সে লন্ডনে তিনি যৌনাচারে এতো বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, তার ফলে তাঁর স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। তাছাড়া,মনের মধ্যেও দেখা দিয়েছিলো একটা অপরাধবোধ। তা সত্ত্বেও, পরের বছর টেরোপ ভ্রমণের সময়ে তিনি প্রেমে পড়েন, এক বিবাহিত মহিলার। কেবল তাই নয়, সেই মহিলার জন্যে একটা ডুয়েল লড়েন তিনি। একই বছর তিনি অ্যাথেন্সে জড়িয়ে পড়েন অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে। ২৪ বছর বয়সের সময়ে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে লেডি ক্যারোলিন ল্যাম্ব, লেডি অক্সফোর্ড, লেডি অক্সফোর্ডের সৎ বোন অগাস্টা লেই এবং লেডি ফ্রান্সিস ওয়েবস্টারের সঙ্গে। ১৮১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (সাড়ে ছাব্বিশ বছর বয়সে) তিনি অ্যান ইসাবেলা মিলব্যাঙ্কের কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেন। কয়েক মাস প্রেম করার পরে, তাঁকেই তিনি বিয়ে করেন পরের জানুআরিতে। কিন্তু এর অল্পদিন পরে অগাস্টা লেই লন্ডনে আসায় তাঁর সঙ্গে বায়রনের পুরোনো সম্পর্ক আবার গড়ে উঠতে আরম্ভ করে। অংশত এরই জন্যে এক বছরের মধ্যে তাঁর বিয়ে ভেঙে যায়। অতঃপর বায়রন চলে যান য়োরোপে। সেখানে তাঁর কবি-বন্ধু শেলির শ্যালিকা ক্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর প্রণয় হয় এবং তাঁদের একটি অবৈধ সন্তান জন্মে (জানুয়ারি, ১৮১৭)। এখানেই শেষ নয়, ঐ বছর মারিয়ানা নামে আর-একজন বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে তিনি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু মারিয়ানার এক প্রতিযোগিনী দেখা দেন পরের বছর — মার্গারিতা নামে রোমে এক রুটিওয়ালার স্ত্রী তাঁর প্রেমে পড়ে তাঁর সঙ্গে ভেনিসে চলে যান। এর পরের বছর তিনি প্রেমে পড়েন কাউন্টেস তেরেসার সঙ্গে। এই ঘটনার পর তিনি অল্প কাল বেঁচেছিলেন। তবে তখন এক বালকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মোট কথা, কবিতা এবং কামই ছিলো তাঁর জীবনের প্রধান প্যাশন।

উদার যৌনাচারের জন্যে মধু বায়রনকে ভালোবাসেননি। তবে তাঁর প্রিয় কবির জীবনী পড়ে তিনি যে-আদর্শ দেখতে পেয়েছিলেন, নিজের জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে তা দিয়ে কমবেশি প্রভাবিত হয়ে থাকবেন। বায়রনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কতো গভীর ছিলো, টম মূরের লেখা বায়রন-জীবনীর পৌনঃপুনিক উল্লেখ থেকেও তার আভাস পাওয়া যায়। বায়রনের মৃত্যুর বর্ণনা পড়ে তিনি না-কেঁদে পারেননি। বায়রনকে তিনি কিভাবে অনুকরণ করতেন, তার একটি দৃষ্টান্ত দিলে তাঁর বায়রন-প্রীতি আরও পরিষ্কার হতে পারে। মিস্টার হার্নেসকে লেখা বরায়রনের একটি চিঠির সঙ্গে গৌরদাসকে লেখা মধুর একটি চিঠির তুলনা করে উইলিয়াম র‍্যাডিচি দেখিয়েছেন যে, মধু বায়রনের চিঠিরও অনুকরণ করতেন। বায়রনের চিঠির প্রথম অংশের পাঠ এই রকম:

I am going abroad, if possible, in the spring, and before I depart, I am collecting the pictures of my most intimate school-fellows; I have already a few, and shall want yours, or my cabinet will be incomplete. I have employed one of the first miniature painters of the day to take them, of course, at my own expense, as I never allow my acquaintance to incur the least expenditure to gratify a whim of mine,

মধু এই চিঠির অনুকরণে বন্ধু গৌরদাসকে লেখেন:

When I go to England, -which period, I hope, is not very far -(next cold season) – I intend to take a picture of yours — let it cost me whatever it will. I will sell my very clothes for it -a miniature picture of course. This is what I have been thinking of today: I must do it. If circumstances allow, I intend to take one, even before my departure for England. If you are acquainted with any artist, – native – English – let me know it.

কেবল কাব্য ন্য, চিঠি লেখাও যদি অনুকরণ করে থাকেন, তাহলে বোঝা যায়, বায়রনের প্রেম-জীবনও তরুণ মধু লক্ষ্য না-করে পারেননি। অন্তত পক্ষে, একজন বিখ্যাত কবির জীবন যে এ রকমের হতে পারে এবং তার ফলে সাহিত্যের প্রশস্ত কক্ষ থেকে তাঁর কাব্য যে ছিটকে পড়ে না অথবা তার ফলে তাঁর কবিযশ যে কিছু মাত্র হ্রাস পায় না — এটা তিনি অনুধাবন করেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে মধু অবশ্য বায়রনের প্রেমের আদর্শকে মেনে নিতে পারেননি। সত্যি বলতে কি, যৌন সম্পর্কিত কোনো রকমের যথেচ্ছাচার সেই বয়সে তিনি আদৌ অনুমোদন করেননি। সমকালে তিনি অনেক বদনামের ভাগী হয়েছিলেন, কিন্তু যৌনাচার নিয়ে কেউ তাঁকে দোষারোপ করেননি। বরং দেখতে পাই যৌনাচার সম্পর্কে তিনি বিশেষ শুদ্ধাচারী ছিলেন। রাতের বেলায় গৌরদাসের বাড়িতে গিয়ে যখন তাঁর দেখা পাননি, তখন অকারণে সন্দেহ করে তিনি গৌরদাসকে লিখেছেন: “আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবকরা যে-পাপের পথে ভেসে যায়, তুমিও সে পথে পা বাড়িয়েছে। আগের অধ্যায়ে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সেকালের কলকাতায় বারাঙ্গনার সঙ্গ নিতে যাওয়া অথবা রক্ষিতা রাখা তেমন দোষের বলে বিবেচিত হতো না। বরং শিক্ষিত সমাজেও এ রীতি বেশ স্বীকৃত ছিলো। মধুসূদন সেটাকে কেবল যে ঘৃণা করতেন, তাই নয়; তিনি প্রেমহীন যে-কোনো যৌনাচারকে অপরাধ বলে গণ্য করতেন। তিনি যখন পিতার সঙ্গে তমলুকে বেড়াতে যান, তখন সেখানে নাকি একটা তাৎক্ষণিক ‘প্রেমের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তমলুকে পৌছানোর ছ দিন পরে তিনি সেখান থেকে গৌরদাসকে যে-চিঠি লেখেন, তাতে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। নিশ্চয় তিনি আট/দশ বছরের কোনো কুমাবীর প্রেমে পড়েননি! খুব সম্ভব কোনো বিধবা অথবা বিবাহিতার সঙ্গে এই ক্ষণিকের প্রণয় হয়ে থাকবে। আঠারো বছরের এক তরুণের জন্যে এটা একটা রোমাঞ্চকর সুখের অভিজ্ঞতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এর ফলে তিনি অপরাধবোধে জর্জরিত হন। গৌরদাসকে লিখেছেন: এখানে আমার একটা ছোটোখাটো প্রেমের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছো, বিরাগী এবং সন্ন্যাসী থেকে রাতারাতি আমি একটা লম্পটে পরিণত হয়েছি। তাঁর এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য থেকে দুটো জিনিশ চোখে পড়ে। এক, নারীঘটিত ব্যাপারে তাঁকে সবাই বিরাগী এবং সন্ন্যাসী বলে ভাবতো। আর দুই, ক্ষণিকের জন্যে কোনো মহিলার সংস্পর্শে এসেও তিনি অপরাধবোধে কাতর হয়েছেন।

প্রেম তাঁর কাছে তখনো একটা আদর্শায়িত বস্তু। আয়োজিত বিয়ের কথা শুনে মধু তাই খুশি হতে পারলেন না, বরং খুব ঘাবড়ে গেলেন। কী করবেন প্রথমে বুঝতে পারলেন না। পাশ্চাত্য সাহিত্য এবং মূল্যবোধের প্রভাবে তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলেন। তা ছাড়া, একদিন প্রথম দৃষ্টিতে এক ‘নীলনয়না’র প্রেমে পড়বেন এবং পরিণতিতে তাকে বিয়ে করবেন বলে গোলাপি স্বপ্ন দেখেছিলেন। বস্তুত, ভালোবেসে বিয়ে করার আদর্শকে তিনি তাঁর মনের গভীরে একেবারে স্থায়ীভাবে জায়গা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সমূহ সমস্যার মুখোমুখি হলেন, পিতার পছন্দ করা একটি সাত/আট (কি বড়ো জোর দশ/বারো) বছরের বালিকাকে বিয়ে করার। এটাকে তিনি বিবেচনা করলেন গুরুতর একটা বিপদ হিশেবে। কী আশা করেছিলেন এবং কী হতে যাচ্ছে — এই দুই-এর মধ্যে তুলনা করে আঁৎকে উঠলেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখলেও, মধুর ব্যক্তিত্ব তখনো এতোটা বিকাশ লাভ করেনি, অথবা তিনি নিজস্ব এমন আয়ের অধিকারীও হননি, যাতে পিতার মুখের ওপর বলতে পারেন, তিনি বিয়ে করবেন না। এই অবস্থায়, নিজের সমস্যা কাউকে বলে তিনি মনের ভার খানিকটা লঘু করতে চেয়েছিলেন। তাই রাতের বেলায় বিচলিত মধু চিঠি লেখেন গৌরদাসকে:

এখন সময়টা হলো প্রেমপত্র লেখার। কিন্তু আমার সমস্ত মন ভরে গেছে বিষাদের অন্ধকারে। আমি এখন কী করে প্রেমপত্র অথবা খুশির চিঠি লিখি? আমি যে-বিপদে পড়েছি, তা কতোটা গুরুতর, তুমি জাননা না। এখন থেকে ঠিক তিন মাস পরে আমার বিয়ে করতে হবে — কী ভয়ানক ব্যাপার। এটা ভাবলেও আমার রক্ত শুকিয়ে যায় এবং আমার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা, সে হলো এক ধনী জমিদারের কন্যা। হতভাগিনী মেয়ে! অজ্ঞাত ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্যে কী দুঃখই যে জমা আছে! তুমি জানো আমার বিলেত যাবার ইচ্ছের শিকড়টা এত গভীরে প্রোথিত যে, সেটাকে কোনোক্রমে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। সূর্য উঠতে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আমি এই স্বপ্ন আমার হৃদয় থেকে কখনো মুছে ফেলতে পারবো না। আর এক-দুবছর অপেক্ষা করলে, নিশ্চয় দেখতে পাবে, আমি হয় বিলেতে থাকবো, নয়তো আমি আদৌ বেঁচেই থাকবো না — এর কোনো একটা হতেই হবে। গৌর, তুমি আমার বন্ধু, তোমাকে এই গোপন কথাগুলো জানালাম। এ কথাগুলো কোনোক্রমে প্রকাশ পাবে, আমি আদৌ এমনটা আশঙ্কা করছিনে। তুমি একজন ভদ্রলোক। এ যাবৎ আমি এসব গোপন কথা তোমাকেও বলিনি। কিন্তু আজ আর আমি এসব চেপে রাখতে পারছিনে। আমার সহানুভূতি দরকার — এবং আমি তা আর কার থেকে পেতে পারি?

এ চিঠির ভাষা থেকে বোঝা যায়, বিয়ের সংবাদে তিনি কতোটা উদ্বিগ্ন এবং বিচলিত হয়েছিলেন। এর আগের চিঠিতে গৌরদাসকে তিনি লিখেছিলেন যে, ২৬ নভেম্বর তাঁর পিতা এক বড়োলোক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। সেই বড়ো লোকের বাড়ি থেকে ফিরে এসে পরের দিন রাতের বেলায় তিনি মধুকে বিয়ের এই খবর শোনান। আর মধুতাকে বিবেচনা করেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।

পিতার মনোনীত বালিকাকে বিয়ে করার সংবাদ শুনে মধু যে-প্রতিক্রিয়া দেখান, সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে তা একান্তই অভিনব এবং একেবারে অভূতপূর্ব। এই ঘটনার ৪০ বছর পর কলকাতার আর-একটি অত্যন্ত বিদগ্ধ পরিবারের একজন বিলেত-ফেরত কবির বিয়ে ঠিক হয়েছিলো যশোরের একটি অশিক্ষিত এবং দেখতে সুশ্রী নয় – এমন একটি এগারো বছরের বালিকার সঙ্গে। তাতে মনে মনে কতোটা খুশি হয়েছিলেন, জানা না-গেলেও এই তরুণ কবি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বাধ্যগত পুত্রের মতোই বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসেছিলেন। গোটা উনিশ শতকেই অসংখ্য বার এমনটা হয়েছে। ১৮৪০-এর দশকে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মধুসূদন আর ৭০-এর দশকে এ ধরনের একটি ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গিয়েছিলো শিবনাথ শাস্ত্রীর ক্ষেত্রে। নিজের অমতে পিতার আদেশে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু দীর্ঘকাল সে স্ত্রীকে স্ত্রী হিশেবে গ্রহণ করতে পারেননি।

আমরা পরে দেখতে পাবো, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধুর জীবন আমূল বদলে গিয়েছিলো। এতোদিন ছিলেন ধনী বাবা-মার একমাত্র আদরের সন্তান — জীবন ছিলো লঘু। কোনো সমস্যা নিয়ে তাঁর ভাবতে হয়নি। যখন যে-আবদার করেছেন, প্রায় সবই পূরণ করেছেন বাবা-মা। তাঁদের নিরাপদ ডানার নিচে সুখের নীড়ে জীবন কাটিয়েছেন। সেখানে কেবল স্নেহ, আবদার এবং প্রশ্রয়। জীবনের রূঢ়তার সঙ্গে এতোদিন তাঁর পরিচয় হয়নি। রুটিনমাফিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে তিনি নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাচ্ছিলেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। কিন্তু প্রচণ্ড আঘাতে আকস্মিকভাবে তার ছিঁড়ে গেলো। তখন অঘ্রান মাস। কিন্তু বাইরের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেকে দেখতে পেলেন চৈত্র-দুপুরের খর রৌদ্রে। জীবনে এই প্রথম সত্যিকার একটা সমস্যার মুখোমুখি হলেন। এই সমস্যার একটা সমাধান তিনি করেছিলেন, কিন্তু তার ফলে তিনি জীবনের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষপথে ছিটকে পড়েন। অতঃপর তাঁর পরিচিত জগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ এক অর্থে চিরদিনের জন্যে ছিন্ন হয়েছিলো।

গৌরদাসের ওপর ভরসা করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, তাঁর কাছ থেকে সহানুভূতি পাবেন। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবংএকই কলেজের একই পাঠক্রম-পড়া ছাত্র হলেও, তাঁদের দুজনের চিন্তাধারা এ ব্যাপারে অভিন্ন ছিলো না। মূল্যবোধেও ছিলো আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে — এটাকে গৌরদাস মস্তো বড়ো সমস্যা হিশেবে দেখতে পেলেন না। এর আগেই তাঁর বিয়ে হয়েছিলো। কই, তিনি তো সেটাকে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো কোনো ঘটনা বলে গণ্য করেননি! মধুর বয়স উনিশ হতে আর বাকি আছে মাত্র দু মাস। এতো বিযেরই বয়স! বেশির ভাগ লোকের তো এর আগেই বিয়ে হয়। এ ঘটনার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে না-পাওয়ায় গৌরদাস বন্ধুকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত সহানুভূতি অথবা সান্ত্বনা দিতে পারেননি। গৌরদাস যে মধুর সমস্যা দেখতে পাননি, তাঁর কারণ কেবল তাদের মূল্যবোধের পার্থক্য নয়, তাঁর আনুগত্যও ছিলো বিভক্ত। তিনি বন্ধুর প্রতি যেমন অনুগত ছিলেন, তেমনি অনুগত ছিলেন বন্ধুর পরিবারের প্রতি। রাজনারায়ণ দত্ত এবং জাহ্নবী দেবী এ সময়ে গৌরদাসের মারফত পুত্রকে বোঝাতে চেয়েছেন। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে গৌরদাসকে লেখা মধুর যে-দুটি চিঠি পাওয়া যায়, তাতে বন্ধুত্ব এবং প্রণয়ের চিহ্ন অনুপস্থিত। এ থেকে অনুমান করি, গৌরদাসের ওপর মধু আর ভরসা করতে পারছিলেন না। কী করে বিয়ে এড়ানো যায়, এ পরামর্শের জন্যে ততোদিনে তিনি তাঁর অন্যত্র যাতায়াত আরম্ভ করেন।

বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং এ সিদ্ধান্ত আর বদল করা যাবে না — মধু এটা প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন। কিন্তু পিতাকে সরাসরি বলবেন, এবিয়ে তিনি করবেন না — এক হুঁকোয় তামাক খেলেও, সে রকমের সাহস তাঁর ছিলো না। মাকে নিশ্চয় বলেছেন। হয়তো যুক্তিও দেখিয়েছেন যে, লেখাপড়া শেষ করে তিনি বিয়ে করবেন। কিন্তু তাতে কোনো ফায়দা হয়নি। মধু তাঁর নয়নমণি হলেও, তিনি বুঝতে পারছিলেন না, অমন সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে তার আপত্তিটা কোথায়। বাপ-ঠাকুরদা চোদ্দো পুরুষ তো ওভাবেই বিয়ে করেছেন! প্রতিবেশী রামকমল বাবুর ভাগ্নে রঙ্গলাল — সে তো আগের বছরই বিয়ে করেছে! তখন তার বয়স ছিলো মাত্র চোদ্দো। মধুর উনিশ! বিয়ের ব্যবস্থা হলে সবাই তো খুশি হয়। তাঁর ছেলে তা হলে এমন আজব আচরণ করছে কেন! গর্ভে ধারণ করলেও, জাহ্নবী দেবী এখন তাঁর ছেলের মন বুঝতে সত্যি সত্যি ব্যর্থ হন।

পুত্রের কাছে সমস্যাটা যে অতো গুরুতর, তা বুঝতে পারলে পিতামাতা বিষয়টা আর-একবার ভেবে দেখতেন বলে মনে করাই সঙ্গত। তাঁরা মধুর ভালোই করতে চেয়েছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, তাঁরা তাঁকে হারাতে চাননি মোটেই। একমাত্র সন্তান হিশেবে মধু তাঁর মায়ের কতোটা প্রিয় ছিলেন, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। সর্বোপরি, মধুর প্রতি অগাধ স্নেহ ছাড়াও, পরকালে পিণ্ড লাভ আর ইহকালে উত্তরাধিকারীর প্রয়োজনীয়তা রাজনারায়ণ যে হাড়ে হাড়ে অনুভব করতেন, সে তাঁর পরবর্তী অর্ধ-উন্মাদ আচরণ থেকে বোঝা যায়। এই পর্যায়ে মধু কি মাকে পালিয়ে যাবার ভয় দেখিয়েছেন? আমার ধারণা, দেখাননি। দেখালে গৌরদাস পালিয়ে যাবার কথা ফাঁস করে দেবেন বলে তাঁকে হুমকি দিতেন না। আর মা-ও তা হলে আর-একটু গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা বিবেচনা করতেন।

তাঁর বাবামা অথবা অন্যদের কাছে কোনো সমস্যা বলে মনে না-হলেও, মধুর নিজের কাছে এটা ছিলো প্রায় জীবন-মরণ সমস্যা। বিশেষ করে জীবনের ঐ পর্বেই সমস্যাটা অতো কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছিলো। যদি আরও দু বছর আগে রাজনারায়ণ এই বিয়ের আয়োজন করতেন, মধু এতো প্রবলভাবে আপত্তি করতেন না। তাঁর ব্যক্তিত্ব তখনো অতোটা পরিণতি লাভ করেনি। বিলেত যাবার ইচ্ছেটাও তখন এত প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। রাজনারায়ণ যদি আরও দুবছর পরে বিয়ের আয়োজন করতেন, তা হলেও সমস্যাটা মধুর কাছে অমন বিশাল বলে মনে হতো না। ততোদিনে হিন্দু কলেজে তাঁর লেখাপড়ার পাঠ প্রায় চুকে যেতো এবং তিনি স্বাধীন আয় করার এবং/অথবা বাবার কর্তৃত্ব অস্বীকার করার কথা ভাবতে পারতেন। কিন্তু ১৮৪২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি না বালক ছিলেন, না পরিণত যুবক। এই অবস্থায় তিনি কী করার কথা ভেবেছিলেন? কী কী বিকল্প ছিলো তাঁর? পালানোর কথা তিনি নিশ্চয় ভেবে থাকবেন। কিন্তু কোথায়? পালিয়ে গিয়ে তিনি কী করবেন? – তাঁর তো কোনো আয় ছিলো না! কী খাবেন? কোথায় থাকবেন? চাকরি করার কথাও ভাবা সম্ভব — যদিও চাকরির বয়স তখনো তাঁর ঠিক হয়নি।

এই একেবারে নিরুপায় অবস্থায় তাঁর মাথায় একটা ভাবনা এলো। তাঁকে কেউ বুদ্ধি দিয়েছিলো, এমনও হতে পারে। তিনি ভাবলেন, মিশনারিদের কাছে গিয়ে তিনি যদি খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন, তা হলে এক ঢিলে দুই নয়, তার চেয়েও বেশি পাখি মারা সম্ভব হতে পারে। সমূহ যে-লাভের কথা ভাবলেন, তা হলো: খৃস্টান হলে সঙ্গে সঙ্গে এ বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।

দ্বিতীয় যে-লাভের কথা ভাবলেন, তা হলো: খৃস্টান হলে তিনি খৃস্টান সমাজ এবং ইংরেজ কর্মকর্তাদের সহায়তা পাবেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, কোনোপ্রতিষ্ঠিত এবং সুপরিচিত পরিবারের কোনো সন্তান খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করলে মিশনারিরা তাকে একটা দৃষ্টান্ত এবং সম্মানের বিষয় বলে গণ্য করেন। এর কয়েক মাস আগে খিদিরপুরে তাঁদের পাড়ার একটি তরুণ (সুরেশচন্দ্র মৈত্র এঁব নাম লিখেছেন নবীনকৃষ্ণ মিত্র।১০ চার্চের রেজিস্টারে এঁর নাম আমি খুঁজে পাইনি।) যখন খৃষ্টান হন, তখন একদিকে বাঙালি সমাজ এবং অন্যদিকে মিশনারি এবং ইংরেজ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে-হৈচৈ দেখা দিয়েছিলো, তা তিনি লক্ষ্য করে থাকবেন। তাঁর সামনে অন্য দৃষ্টান্তও ছিলো। ডিরোজিওর অনেক ছাত্র হিন্দু ধর্মকে অস্বীকার করে অথবা তার সমালোচনা করে সমাজকে চটিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছাত্রদের মধ্যে দুজন–কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধায় এবং মহেশচন্দ্র ঘোষ খৃস্টান হয়ে সমাজে দারুণ আলোড়ন তুলেছিলেন। (কৃষ্ণমোহন খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন ১৮৩২ সালের ১৭ অক্টোবর। মহেশচন্দ্র তার মাস দুয়েক আগে। তিনি মিশনারি হবেন বলে বিশপস কলেজে ভর্তি হন ২৯ অগস্ট।) এর কয়েক বছর পরে পড়তে এলেও মধু কলেজে সে কথা নিয়ে আলোচনা শুনেছেন। তা ছাড়া, তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে জ্ঞানেন্দ্রমোহনকে তিনি অনেক সময়েই খৃষ্ট ধর্মের গুণগান করতে শুনেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভূদেব রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তিনিও খৃস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বেশ বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতা দিনের পর দিন তাঁর সঙ্গে হিন্দু এবং খৃষ্টধর্মের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তাঁর বিচলিত বিশ্বাসকে আবার হিন্দু ধর্মের দিকে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হন।১১রাজনারায়ণ বসকে মধু শুনেছিলেন ইসলাম ধর্মের গুণগান করতে।১২ পারিবারিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও আনুষ্ঠানিক ধর্মেমধুর নিজের তেমন আগ্রহ ছিলো না। অপর পক্ষে, তিনি যখন য়োরোপীয় সভ্যতার কথা চিন্তা করতেন, চিন্তা করতেন হিন্দু সমাজের অসংখ্য কুসংস্কারের কথা — তখন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং সমাজ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দিতো — তাঁর পরবর্তী কার্যকলাপ থেকে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায! অপর পক্ষে, তিনি যখন চিন্তা করতেন যে, তাঁর শ্রদ্ধেয় কবিরা এবং ডিএলআরের মতো তাঁর প্রিয় শিক্ষকরা — সবাই খৃস্টান, তখন তিনি হয়তো হিন্দু ধর্মের তুলনায় খৃস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার না-করে পারতেন না। অন্তত সভ্য জাতি হিশেবে অ্যাংলো-স্যাক্সনরা যে ভারতীয়দের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে, সে ইতিহাস তিনি ভালো করেই পড়েছিলেন। বছর এগারো পরে তিনি নিজেও সেকথা লিখেছিলেন।১৩খৃস্ট য়োরোপের উদারতা এবং যুক্তিবাদ তাঁকে সত্যি সত্যি আকৃষ্ট করে।

ধর্মান্তর খুব গুরুতর ব্যাপার, ধর্মান্তরের কয়েকটি ঘটনা দেখে তিনি তা খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অথবা তার জন্যেই এখন এই সংকট কালে খৃস্টান হয়ে তিনি গোটা সমাজে একটা আলোড়ন তুলতে পারবেন, এমন লোভ তাঁর মনে দেখা দিয়েছিলো কিনা, কে জানে? বিশেষ করে একটা কথা চিন্তা করে তিনি উদ্দীপ্ত বোধ করে থাকবেন। তিনি ভেবেছিলেন, খৃস্টান হবার শর্ত হিশেবে মিশনারিদের কাছে দাবি করবেন, তাঁকে বিলেতে পাঠানো হোক। বিলেত চলে গেলে তিনি বিয়ে এড়াতে পারবেন, যে বাবা-মা তাঁকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁদের আচ্ছা জব্দ করতে পারবেন, আর সবচেয়ে বড়ো লাভ হবে তিনি এতোকাল বিলেতে গিয়ে কবি হবার যে-স্বপ্ন দেখেছেন, তাকে বাস্তবায়িত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ পাবেন। তিনি বিবেচনা করলেন, তাঁর সমস্যার এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হতে পারে না। কিন্তু তিনি জানতেন, এ কথা ঘুণাক্ষরে প্রকাশ পেলেও তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। সুতরাং তিনি খুব গোপনে এবং সুকৌশলে খৃস্টান মিশনারিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা আরম্ভ করলেন। তিনি যদি কেবল খৃস্টান হতে চাইতেন, তা হলে কাজটা অনেক সহজ হতো। একদিন গোপনে কোনো চার্চে গিয়ে দীক্ষা নিলেই চুকে যেতো। কিন্তু তিনি সেই সঙ্গে চাইলেন বিলেত যাবার নিশ্চিত আশ্বাস। সেটা অতো সহজ ব্যাপার ছিলো না।

পরবর্তী আড়াই মাস তিনি পরিবারের মধ্যে থেকেছেন, নিয়মিত কলেজে গেছেন, আর অত্যন্ত গোপনে তাঁর পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যে কথাবার্তা চালিয়েছেন। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি, তিনি গোপনে পা বাড়িয়েছিলেন এক অনিশ্চিত অন্ধকার পথে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভূদেব মুখোপাধ্যায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন — মধু তাঁকে খৃষ্টান হবার কোনো আভাস দেননি। আসলে,সমস্যায় পড়ে মধু তাঁর চারদিকের গোটা প্রথাবদ্ধ সমাজকে বিবেচনা করেছিলেন প্রতিকূল সাগরের মতো। কারণ কোথাও কারো মধ্যে তাঁর সমস্যার প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতির চিহ্ন তিনি দেখতে পাননি।

খৃস্টান হবার ফলে তার জীবনে যে-প্রভাব পড়তে পাবে, তিনি তা কি ভেবে দেখেছেন? ভাবাই স্বাভাবিক। তবে সেটা কতোটা গুরুতর হতে পারে, তা কল্পনা করতে পারেননি। খৃস্টান হলে তিনি যে আর কোনো দিন মায়ের কাছে, বাবার কাছে, খিদিরপুরের বাড়িতে থাকতে পারবেন না; স্বজনদের কাছ থেকে ছিটকে পড়বেন বহু দূরে; এমন কি, হিন্দু কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে লেখাপড়ার পাটও চুকে যাবে — এতোটা তলিয়ে দেখেননি। খৃস্টান হলে এবং বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরলে, তিনি যে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন — সে সমস্যা কি আদৌ তাঁর মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছিলো? আমার ধারণা, বাস্তব বুদ্ধির অভাবে অথবা বাবা-মার ওপর অভিমানবশত এসব কথা তিনি আদপে চিন্তা করেননি। করলে, তিনি কি বিয়ে এড়ানোর জন্যে এতো মূল্য দিতে রাজি হতেন? এ সম্পর্কে সঠিক করে কিছু বলা যায় না।

খৃস্টান হবার উপায় কী? কার সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন? সিদ্ধান্ত নিলেন, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। হিন্দু কলেজের ছাত্র হিশেবে তিনিও পরিবার এবং সমাজের তীব্র বিবোধিতার মুখে এবং বিবেকের তাড়নায় খৃস্টান হয়েছিলেন। মধু ভাবলেন, তাঁর সমস্যাটা তিনি সম্যকভাবে বুঝতে পারবেন। কৃষ্ণমোহন তখন ক্রাইস্ট চার্চের পাদ্রি হিশেবে কর্নওয়ালিস স্কোয়ারে বাস করতেন। মধু একদিন সেখানে গিয়ে হাজির হন। তাঁকে কৃষ্ণমোহন আগে থেকে চিনতেন বলে মনে হয় না। তাঁর কাছে মধু নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন একজন খৃস্ট-ধর্মানুসন্ধী হিশেবে। তবে, কৃষ্ণমোহন দাবি করেছেন যে, দুতিন দফা আলোচনার পর তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন যে, খৃষ্টান ধর্মের প্রতি মধু যতোটা আগ্রহী, বিলেত যাবার ব্যাপারে আগ্রহী তার চেয়েও বেশি।১৪ তিনি খৃস্টান হতে চাইছিলেন ঠিকই, তবে তার শর্ত হিশেবে দাবি করছিলেন তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠাতে হবে। কৃষ্ণমোহন জানতেন, সেটা সহজ ব্যাপার নয়। সে জন্যে তিনি মধুকে উপদেশ দিলেন যাতে এ দুটো বিষয় তিনি গুলিয়ে না-ফেলেন। সে কথা শুনে বেশ হতাশ হলেন মধু। এবং তারপর থেকে তিনি কৃষ্ণমোহনের বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, খৃষ্টান হয়ে এক ঢিলে একাধিক পাখি মারার যে-পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, তা অতো সহজ নয়।

কৃষ্ণমোহন অবশ্য মধুর ব্যাপারে আলোচনা করেন অ্যাংলিকান চার্চের একজন ওপরওয়ালার সঙ্গে। মধুর বিলেত যাবার বায়নার কথা শুনেও এই ওপরওয়ালা তাঁকে তাঁর কাছে পাঠানোর অনুরোধ জানান। এই উপরওয়ালা খুব সম্ভব আর্চডীকন টমাস ডিয়ালট্রি(১৭৯৬-১৮৬১)। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ১৮২৯ সালের গোড়ার দিকে তিনি ধর্মযাজকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তখনই তিনি কলকাতায় আসেন। তারপর ২২ জুন থেকে তিনি ওল্ড চার্চের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৮৪৩ সালে তিনি ছিলেন পদের দিক দিয়ে কলকাতায় অ্যাংলিকান চার্চের দ্বিতীয় উচ্চতম ব্যক্তি। তাঁর ওপরে ছিলেন একজন — লর্ডবিশপ (রেভারেন্ড ডেনিয়েল উইলসন)। তিনি যদি মধুর বিলেত যাবার বাসনার কথা শোনা সত্ত্বেও তাঁকে তাঁর কাছে পাঠানোর কথা কৃষ্ণমোহনকে বলে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে তিনি বিলেত পাঠানোর ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে থাকবেন। কৃষ্ণমোহনের দেওয়া পরিচয়পত্র নিয়ে মধু এঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং ইনি তাঁকে সব রকমের উৎসাহ দেন। এমন কি, তাঁকে তখনকার বঙ্গদেশের অস্থায়ী ছোটো লাট মিস্টার ব্যর্ডের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেন। এসব ব্যাপার থেকে মধুর নিশ্চিত ধারণা হয় যে, খৃষ্টান হলে তাঁর বিলেত যাওয়ার ব্যবস্থা হবে। তরুণ মধু সরল মনেই এটাকে বিশ্বাস করেছিলেন। তা না-হলে, তাঁর গুরুতর সমস্যা সত্ত্বেও, তিনি সেই পর্যায়ে দারুণ খৃস্ট-প্রেমে পাগল হয়েছিলেন বলে মনে হয় না।

স্বয়ং কৃষ্ণমোহন যাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন খৃস্টান হবার ব্যাপারে সেই অ্যালেকজান্ডার ডাফের সঙ্গেও তিনি কথাবার্তা বলেছিলেন বলে মনে করার কারণ আছে। ডাফ ছিলেন চার্চ অব স্কটল্যান্ডের মিশনারি। তিনি তাঁর মিশনারি কার্যকলাপের জন্যে তখনকার কলকাতায় তাবৎ ধর্মযাজকের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ছিলেন। তাঁর একাধিক স্কুল ছিলো ইংরেজি শেখানোর। সেখানে তিনি ইংরেজি শেখাতেন তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে। স্ত্রীশিক্ষার পক্ষেও তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৮৩০ সালে কলকাতায় আসার পরে তিনি নিজে ভালো বাংলা শিখেছিলেন। আর এ জন্য তিনি বাঙালিদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে সমর্থ হতেন। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের আকৃষ্ট করার জন্যে নানাভাবে তিনি তাঁদের প্রলুব্ধও করতেন। তাঁর এমন একটা মননশীল আবেদন ছিলো যে, হিন্দু কলেজের ছাত্ররাও তাকে পছন্দ করতো। মধু যা চাইছিলেন অর্থাৎ বিলেত যাওয়ার ব্যবস্থা, ডাফ তা দিতে পারবেন না বলে তাঁকে সরাসরি জানিয়েছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও চার্চ অব স্কটল্যান্ডের সঙ্গে পরেও মধুর একটা যোগাযোগ ছিলো বলে পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়।

নগেন্দ্রনাথ সোম তাঁর মধু-স্মৃতিতে খৃস্টান হবার পেছনে মধুর আর-একটি অনুপ্রেরণা ছিলো বলে অনুমান করেছেন। তিনি ধারণা করেছেন যে, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেজ মেয়ে দেবকীর সৌন্দর্যে মধু আকৃষ্ট হন এবং সেটাও একটা কারণ যার ফলে তিনি খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন।১৫ এই অনুমানের আদৌ কোনো ভিত্তি ছিলো না। দেবকী কেন, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জির বড়ো মেয়ের সঙ্গেও ১৮৪৩ সালে মধুর পক্ষে প্রেম করার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা ছিলো না। এই কন্যা, কমলের জন্ম হয় ১৮৩৭ সালের ১২ জানুআরি এবং তার ব্যাপটিজম হয় ৫ ফেব্রুআরি।১৬ মাইকেল যখন খৃস্টান হন তখন এঁর বয়স মাত্রছবছর। ১৫ বছর বয়সে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে এই কন্যার বিয়ে হয় ১৮৫২ সালের ১৫ এপ্রিল।১৭ আর দেবকী ব্যানার্জির সঙ্গে হেনরি সেলসের বিয়ে হয় ১৮৫৬ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখে।১৮ এই ভদ্রলোক প্রথমে ছিলেন বিশপস কলেজের কর্মচারী, পরে ধর্মযাজক। বিয়ের সময়ে দেবকী ব্যানার্জির বয়স ১৮ বছর। (দেবকীর জন্ম এবং ব্যাপটিজমের তারিখ চার্চের কাগজপত্রে খুঁজে পাইনি। কিন্তু বিয়ের সময়কার বয়স দিয়ে হিশেব করলে, তাঁর জন্ম কমলের এক বছর পরে। তার অর্থ মধু ধর্মান্তরিত হবার সময়ে এঁর বয়স ছিলো ৫ বছর।) একে সঙ্গে করে নিয়েই কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি মাদ্রাসে গিয়েছিলেন ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে।১৯ দেবকীর বিয়ের সময়ে কবি মাদ্রাস থেকে ফিরে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন।

বিয়ের তারিখ এগিয়ে আসছে, ওদিকে ধর্মযাজকদের কাছ থেকেও কিছু আশ্বাস পাচ্ছে, এভাবে দেখতে দেখতে জানুআরি মাস এসে গেলো। ৫ জানুআরি টাউন হলে কলেজের পুরস্কার বিতরণী সভা। সেখানে ভিড় করেন সরকারী বড়ো কর্মকর্তা, দ্বারকানাথ এবং প্রসন্নকুমার ঠাকুরসহ কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিক এবং অভিভাবকরা। বহু ছাত্র ছিলেন সেখানে। সভায় রসময় দত্ত কলেজের বার্ষিক রিপোর্ট পড়ে শোনালেন। শিক্ষা পরিষদের সভাপতি ভাষণ দিলেন। ভাষণ দিলেন মি ব্যর্ড এবং বাংলার ডেপুটি গর্ভনর। কৃতিবান ছাত্ররা একে একে পুরস্কার নিলেন সভাপতির কাছ থেকে। স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কিত রচনার জন্যে সভাপতি তার পরে বিতরণ করেন দুটি পদক। মিস্টার ক্যামেরন নিজে এই রচনার বিচারক ছিলেন।২০ প্রচুর হাততালির মধ্যে মধু পেলেন সোনার পদক, আর তাঁর বন্ধু ভূদেব রুপোর পদক। পুত্রের কৃতিত্বে রাজনারায়ণ দত্তের বুক ফুলে উঠলো। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বার্ষিক পরীক্ষার ভিত্তিতে যখন বৃত্তি পাওয়া ছাত্রদের নাম ঘোষণা করা হলো তখন মধুর নাম শোনা গেলো না। পরীক্ষার আগে তাঁর যে কিছু সমস্যা হয়েছিলো, আমরা আগেই তা লক্ষ্য করেছি। সাহিত্যে তিনি অবশ্য মোটামুটি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। ৫০ মার্কের মধ্যে তিনি ৩০ পেয়ে অষ্টম হয়েছিলেন। (গোবিন্দ দত্ত পেয়েছিলেন ৪৯, প্যারীচরণ সরকার ৪৭, ভূদেব ৩২।) কিন্তু সিনিয়র স্কলারশিপ তিনি পাননি। তাঁর সেই ৮ টাকার বৃত্তিই থেকে গেলো। ভূদেব কিন্তু আট টাকার জায়গায় পেলেন ৩০ টাকার বৃত্তি। রাজনারায়ণ বসুর ৩০ টাকার বৃত্তিও অপরিবর্তিত থাকলো।২১

মধু সিনিয়র স্কলারশিপ না-পেলেও, রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর ফলাফল নিয়ে কী গর্বিত হয়েছিলেন, তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের কদিন পবে কলেজের সিনিয়র শাখার হেড মাস্টার, জেমস ক্যর মধুর পদক পাঠিয়ে দেন তাঁদের বাড়িতে। বন্ধুরা এই পদক দেখতে চান। তার জবাবে মধু গৌরদাসকে লেখেন: ‘আমার মেডলটা রয়েছে বাবার কাছে’।২২ ছেলে কৃতিত্ব দেখিয়ে যে-পুরস্কার পেয়েছেন, পিতার কাছে সেটা অত্যন্ত মূল্যবান মনে হয় এবং তিনি সেটি সযত্নে গচ্ছিত রাখেন নিজের কাছে। হয়তো সেটা সগর্বে দেখিয়েছেন বন্ধুদের।

এ সময়ে মধু গৌরদাসকে যে-চিঠিপত্র লেখেন, তার মধ্যে দুখানা মাত্র পাওয়া গেছে। দুখানা চিঠিই খুব সংক্ষিপ্ত এবং তার মধ্যে দু-একটি টুকরো খবর ছাড়া কোনো আবেগের কথা নেই। তিনি যে খৃষ্টান হবার জন্যে মিশনারিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন, সামনে বিয়ের খাঁড়া ঝুলছে অথবা তিনি খুব কাতর হয়ে আছেন — এই দু খানা চিঠি থেকে তার কোনো আভাস পাওয়া যায় না। বরং দেখা যাচ্ছে, তিনি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁদের বাড়িতে খাবার জন্যে এবং একটি লম্বা কবিতা লিখছেন — সম্ভবত King Porus। এ থেকে মনে হয়, নভেম্বর মাসে বিয়ের খবর শুনে তিনি যতোটা উতলা এবং উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন জানুআরি মাসের প্রথম দিকে তা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছিলেন। তা ছাড়া, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিলেত যাবার ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না বলে তাঁকে জানিয়ে দেওয়ায়, খৃস্টান হয়ে বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং বিলেত যাবার দ্বৈত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে বলে মেনে নিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময়ে ডিয়ালট্রির সঙ্গে কৃষ্ণমোহন তাঁর যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। অতঃপর যে-স্বপ্নকে তিনি অবাস্তব বলে বিবেচনা করেছিলেন, তারই আবার সফল হবার সম্ভাবনা দেখতে আরম্ভ করেন।

এভাবেই দ্রুত জানুআরি মাস শেষ হয়ে গেলো। প্রিয় শিক্ষক ডিএলআর ছুটিতে, জেমস ক্যর, যাঁকে তিনি হাড়ে হাড়ে অপছন্দ করেন, তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্বে। কলেজে যেতে মোটে ভালো লাগছিলো না। কিন্তু না-গিয়ে উপায় নেই। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। তবে তাঁদের কাউকে তিনি নিজের পরিকল্পনার আভাস দিতে ভরসা পান না। বরং সযত্নে আপন পরিকল্পনা লুকিয়ে রাখেন। খৃস্টান হলে তিনি যে এঁদের সঙ্গে আর লেখাপড়া করতে পারবেন না, এমন কি, কারো কারো সঙ্গে বন্ধুত্বেও ভাটা পড়বে, এ তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। সে জন্যে তাঁর আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখাননি তিনি। ডিয়ালট্রি অনেক ভরসা দিয়েছেন এবং দীক্ষা নেবার তারিখ ঠিক হয়েছে ৯ই ফেব্রুআরি। পয়লা, কি দোসরা (ফেব্রুআরি) তিনি এক মোহব দিয়ে ফিরিঙ্গি ধরনে চুল ছাঁটিয়ে এলেন। কলেজে এসে প্রিয় বন্ধু ভূদেবকে বললেন: ‘বলো, কেমন লাগছে দেখতে?’ মধু যে নিজস্ব ভঙ্গির বদলে ফিরিঙ্গিদের অনুকরণে চুল ছাঁটালেন, ঐতিহ্যবাদী বন্ধুর সেটা ভালো লাগলো না।২৩ কিন্তু মধু কোনো যুক্তি দেখালেন না। ঝগড়া করলেন না। তিনি জানেন, তাঁর ধর্মান্তরের দিন ঘনিয়ে আসছে। আর জানেন, তাঁর বিলেত যেতেও দেরি নেই। কাউকে কিছু বললেন না তিনি। পরের দিন উধাও হলেন বাড়ি থেকে। পরিচিতদের মধ্যে শেষবার তাঁকে দেখেছিলেন দিগম্বর মিত্রের ছোটো ভাই — মধুর সহপাঠী — মাধব মিত্র। তাঁরা দুজন মিলে মিত্রদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন।২৪ তবে একই বাড়ি থেকে বের হলেও, দুজনের উদ্দেশ্য অভিন্ন ছিলো না।

তাঁর যখন হদিস মিললো তখন তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে। কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিলের সন্তান এবং হিন্দু কলেজের একজন নাম-করা ছাত্রকে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হবে — এটা মিশনারিদের একটা কৃতিত্বের দৃষ্টান্ত। তাঁরা কেবল গরিব আর নিম্নবর্ণের লোকদের ধর্মান্তর করাতে পারেন টাকাপয়সা আর খাবার-দাবারের লোভ দেখিয়ে — এ কথা বলে তাঁদের প্রয়াসকে ছোটো করে দেখানো হতো ভারতবর্ষে এবং ইংল্যান্ডে। সে জন্যে যখন তাঁরা কোনো ধনী এবং উচবর্ণের লোককে দীক্ষা দিতে সমর্থ হয়েছেন, তখন সেটাকে ফলাও করে প্রচার করেছেন।২৫ মধুসূদন তেমন একজন দীক্ষাপ্রার্থী। কিন্তু সমাজের ওপরতলার কাউকে দীক্ষা দেবার পেছনে ঝুঁকিও আছে বিস্তর। স্থানীয় লোকেরা তার বিরোধিতা করেন। তা ছাড়া, দীক্ষার পরে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে দীক্ষিতকে স্বধর্মে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টাও চলে। ১৮৪২ সালের নভেম্বর মাসে মিশনারিরা শ্যামাচরণ বসু নামে একটি উঁচুঘরের যুবককে দীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর আত্মীয়রা তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেন।২৬ মধুর বেলাতেও সেই চেষ্টা হতে পারে। তার চেয়েও সমূহ আশঙ্কার কথা মনে করিয়ে দেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নাকি বলেছিলেন, দীক্ষা দেওয়ার আগেই রাজনারায়ণ লাঠিয়াল এবং সড়কিওয়ালাদের নিয়ে মধুকে ছিনিয়ে নিতে পারেন মিশনারিদের কাছ থেকে। সে কারণে মধুকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো একেবারে দুর্গের ভেতরে।

খবর পেয়ে রাজনরায়ণ পুত্রকে উদ্ধার করার জন্যে যতো পথ ছিলো সবগুলোর কথাই ভেবেছিলেন। তিনি তো মধুর মতো কল্পনার জগতে বাস করছিলেন না! খৃস্টান হবার ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। সুতং মধুকে ছাড়িয়ে আনার সব রকমের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সরকারী মহলে ভূকৈলাসের জমিদার সত্যচরণ ঘোষালের যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। তিনি বাস করতেন খিদিরপুরে, মধুদের বাড়ির কাছেই।২৭ রাজনারায়ণ তাঁকে দিয়ে মধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন। মধুকে জানানো হযেছিলো, তাঁকে বিলেত যেতে দেওয়া হবে, বিয়ে করতে না-চাইলে বিয়ে করতে হবে না, মর্মাহত জাহ্নবী দেবী শোকে পাগলের মতো হয়েছেন ইত্যাদি। কিন্তু দুর্গের কর্তৃপক্ষ সত্যচরণকে মধুর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিলেন না। ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষের মতে, দুর্গের কর্তৃপক্ষ দেখা করতে অনুমতি দিয়েছিলেন মধুর জেঠতুতো ভাই প্যারীমোহন, হিন্দু কলেজের শিক্ষক রামচন্দ্র মিত্র আর বন্ধু গৌরদাসকে। তাঁরা পারিবারিক, সামাজিক নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটা মধুর কাছে তুলে ধরেছিলেন। মধুকে এ সময়ে বিলেতে যাবার জন্যে রাজনারায়ণ নাকি এক হাজার টাকার কম্পেনির কাগজও পাঠিয়েছিলেন।২৮ কিন্তু পিতা তাঁকে বিলেত পাঠাবেন এবং, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর বিয়ে বন্ধ করতে রাজি হয়েছেন — এ কথা শোনা সত্ত্বেও মধু কেন নিজের সংকল্প থেকে বিচলিত হলেন না, তার কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। তবে মিশনারিদের পক্ষ থেকে এ পর্যায়ে তাঁর ওপর অনেক চাপ ছিলো — এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাঁর ধর্মান্তর ততোক্ষণে কলকাতার খৃস্টান ধর্মযাজকদের কাছে একটা সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাড়িঁয়েছিলো।

*

৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেয় ওল্ড চার্চে মধুর দীক্ষার কাজ শেষ হলো। চার্চের সামনে মোতায়েন থাকলো সশস্ত্র প্রহরী। এই চার্চের প্রধান পুরোহিত এবং আর্চডীকন ডিয়ালট্রি জর্ডানের বারি দিয়ে মধুর সব অতীতের পাপ ধুইয়ে দিলেন। মধু মাইকেলে পরিণত হলেন। নিজের ধর্মান্তরের মুহুর্তে গাইবার জন্যে একটি হীম রচনা করেছিলেন তিনি। গাম্ভীর্যের সঙ্গে সেটি গাওয়া হলো।২৯ মধু লিখেছিলেন:

Long sunk in superstition’s night,

By sin and Satan driven,-

I saw not, – cared not for the light

That leads the blind to Heaven.

*

I sat in darkness, Reason’s eye

Was shut, – was closed in me; –

I hastened to Eternity

O’er Error’s dreadful sea

*

I’ve broken Affection’s trenderest ties

For my blest Saviour’s sake; –

All, all I love beneath the skies,

Lord! I for Thee forsake!

সবাই প্রার্থনা করলেন মধু যাতে পুণ্যধর্মের পথ চিরকাল আঁকড়ে থাকতে পারেন। এ গানে খৃস্টধর্মের প্রতি মাইকেল বিশেষ আকর্ষণ দেখিয়েছেন। সেই সঙ্গে হিন্দু ধর্মের তুলনায় এ ধর্মকে বিবেচনা করেছেন অনেক উন্নত বলে। দেশীয়দের দীক্ষা দেবার ইতিহাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি বিশিষ্ট নাম। অন্য পাঁচজনের মাপে তাঁকে ধর্মযাজকরা বিচার করেননি। বরং একটু বাড়তি সৌজন্য দেখিয়েছেন। আর্চডীকন ডিয়ালট্টি তাঁকে ব্যক্তিগত অতিথি হিশেবে নিয়ে যান তাঁর নিজের বাড়িতে।৩০তিনি যে মধুর দীক্ষার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। তবে মাইকেল নিজে তাঁকে দায়ী করেননি। দীক্ষা হয়ে যাবার অল্পদিন পরে গৌরদাস ডিয়ালট্রিকে দোষারোপ করে মধুর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তার জবাবে মধু লিখেছিলেন:

তুমি যে আমার প্রতি বন্ধুত্ব দেখিয়েছে, তার জন্যে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ না-হয়ে পারছিনে। কিন্তু সেই সঙ্গে তুমি যে-ভ্রান্তির জন্যে কষ্ট পাচ্ছে (আমি বলতে চাইছি দুর্ভাগ্যক্রমে কষ্ট পাচ্ছে) তার জন্যে তোমাকে অনুকম্পা না-করেও পারছিনে। মি ডিযালট্রির এখানে আসার সময়টাকে তুমি কেন কুক্ষণ বলে মনে করছো? তুমি কি ভেবেছো তিনি আমাকে খৃষ্টান হতে রাজি করিয়েছেন? তুমি দারুণ দুঃখজনক ভুল করছে।৩১

কেবল গৌরদাস নয়, মাইকেলের আত্মীয় এবং বন্ধুরা তাঁর ‘সর্বনাশের’ অর্থাৎ খৃস্টান হবার ব্যাপারে মি ডিয়ালট্রিকেই দোষারোপ করেছিলেন। এ চিঠির মাধ্যমে তিনি ডিয়ালট্রির দোষ ক্ষালন করেছিলেন এই বলে যে, খৃস্টান হবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনি নিজে নিয়েছিলেন। ডিয়ালট্ৰি তাঁকে লোভ দেখিয়েছিলেন কিনা, তিনি তা স্বীকার অথবা অস্বীকার করেননি। কিন্তু বিলেত যাবার বিষয়টা যে ডিয়ালট্রির সঙ্গে আলোচনা হয়েছিলো, এক্ষুণি আমরা তা দেখতে পাবো।

মধুর মাইকেল হবার অব্যবহিত কারণ ছিলো আয়োজিত বিয়ে থেকে রক্ষা পাওয়া এবং বিলেত যাওয়া — এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে কারণে তাঁর সব জীবনীকারই খৃস্টান হওয়াটা তাঁর জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে স্বীকার করেছেন; কিন্তু এর সঙ্গে তাঁর অন্তরের কোনো যোগাযোগ ছিলো, এটা স্বীকার করেননি। বরংখৃস্টধর্ম তাঁর অন্তৰ্জীবনে কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি জোর দিয়ে জীবনী-লেখক এবং সমালোচকরা এই কথাটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন। দীক্ষা উপলক্ষে মাইকেল তাঁর হীমে যা লিখেছিলেন, তাতে নিজের সমাজের কুসংস্কার এবং পাপের কথা আছে। বলেছেন, তিনি এ যাবৎ অন্ধকারে নিমগ্ন ছিলেন, এবাবে যুক্তির আলো দেখতে পেয়েছেন। এবং এই আলোতে আসার জন্যে আকাশের নিচে যা কিছু তাঁর প্রিয়, সব ত্যাগ করেছেন। তাঁর এই ধর্মীয় সংগীতের সবটাই লোক-দেখানো, সবটাই মেকি — এটা মনে করার কারণ নেই। ষষ্ঠ অধ্যায়ে দেখতে পাবো, এই ঘটনার তিরিশ বছর পরে তিনি ব্যাপটিজম উপলক্ষে আর-একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেখানেও খৃস্টধর্মে দীক্ষা নেবার ঘটনাকে ‘পবিত্রতর’ বলে উল্লেখ করেছেন।৩২ তবে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষা নেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধার্মিক হয়ে পড়েছিলেন — বলা ঠিক হবে না। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে এই ধর্মের সঙ্গে তিনি নিজেকে শনাক্ত করেছিলেন। তা ছাড়া, বহু খৃস্টীয় মূল্যবোধকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন এবং কোনো একটা সময়ে তিনি নিজে খৃষ্ট ধর্ম প্রচার করার জন্যে মিশনারিও হতে চেয়েছিলেন।

যে-মাইকেল আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি পরবর্তীকালে আনুগত্য অথবা অনুরাগ দেখাননি, সেই মাইকেলই আবার যেভাবে বারবার পাপবোধ এবং আত্মার সদ্গতির কথা বলেছেন, অথবা হিন্দু ধর্মের তুলনায় খৃষ্টীয় পাশ্চাত্যের জয়গান করেছেন, তাতে তাঁর ওপর এ ধর্মের সূক্ষ্ম প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। দীক্ষা নেবার দু বছর পরে তিনি Visions of the Past নামে যে-দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছিলেন, প্রসঙ্গত তার কথাও উল্লেখ করা যায়। এই কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন, আদি-মানব এবং আদি-মানবী কিভাবে শান্তি এবং আশীর্বাদের কুঞ্জ থেকে শয়তানের আবির্ভাবে অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন এবং তারপর আবার স্বর্গীয় জ্যোতির আশীর্বাদে অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরে গেলেন। তিনি আরও দেখিয়েছেন, এঁরা আলোতে ফিরে গেলেও, আগেকার স্বর্গে ফিরে যেতে পারলেন না। সেখানে যাবার জন্যে তাঁদের অনুশোচনা এবং প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।৩৩ এই যে স্বর্গের স্বপ্ন তিনি অঙ্কন করেছেন, এর সঙ্গে হিন্দু ধর্মীয় অনুষঙ্গের কোনো যোগ নেই। বলা বাহুল্য, এটা তিনি পেয়েছিলেন খৃষ্টীয় ঐতিহ্য থেকে। ১৮৫০ সালে তাঁর স্ত্রী রেবেকা যখন তাঁদের কন্যা ব্যর্থাকে নিয়ে উত্তরের দিকে বেড়াতে যান, তখন তিনি যে-সনেট রচনা করেন, তা থেকেও খৃষ্ট ধর্মের প্রতি তাঁর বিশ্বাস কতোটা গভীর ছিলো, তার প্রমাণ মেলে। এ কবিতায় তিনি বলেন যে, আমরা আনন্দের দিনে তাঁকে স্মরণ করিনে, স্মরণ করি দুঃখের তিমিরে। কবি নিজে তাঁর বিরহ এবং নিঃসঙ্গতার মুহূর্তে যেভাবে Heavenly Father-কে O Lord-our God of glorious majesty বলে স্মরণ করেছেন, যথাসময়ে আমরা তার পরিচয় পাবো।৩৪

পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং সংস্কৃতি সংস্পর্শে এসে হিন্দু সমাজের বহু কুসংস্কার সম্পর্কে তিনি সচেতন হয়েছিলেন। সেই সমাজে তখনো যুক্তির বাণী অনেকাংশে অর্থহীন, এ-ও তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। এ রকমের অনেক ঘটনা তিনি যে তাঁর উনিশ বছরের জীবনে দূর থেকে দেখেছিলেন, তাই নয়; মর্মে মর্মে সেটা অনুভব করেছিলেন যখন বাবা-মা তাঁর বিয়ের আয়োজন করেন। তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কথা তাঁরা এক বারও ভেবে দেখেননি! একজন বিবেকবান এবং স্পর্শকাতর লোককে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য করলে সেটা যে তাঁর মনের ওপর কী দারুণ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে, বাঙালি সমাজে তার ভূরি ভূরি নজির নেই সত্যি, কিন্তু একেবারে নেই, তা নয়। দু দশক পরে, আর-একজন যুক্তিবাদী মানুষ -শিবনাথ শাস্ত্রী বাবার আয়োজিত বিষের অত্যাচারে কিরকম জর্জরিত হয়েছিলেন, তাঁর আত্মজীবনী থেকে তার খানিক আভাস পাওয়া যায়। একদিকে তিনি একটি নিরপরাধ মহিলাকে ত্যাগ করতে পারছেন না, অন্যদিকে তাঁর সঙ্গে বিবাহিত সম্পর্কও পালন করতে পারছেন না– এই অসাধারণ মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যেও আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন।৩৫ মাইকেলকে অতো দূর অবধি যেতে হয়নি, তার আগেই তিনি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সমাজ যে যুক্তির ধার ধারে না, হাড়ে হাড়ে সেটা তিনি টের পেয়েছিলেন। তাই মনে হয়, তিনি হীমে যে-কথা লিখেছিলেন, তার সবটা কৃত্রিম ছিলো না।

মধু বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন, কিন্তু পালিয়ে বেঁচেছিলেন কিনা — এক কথায় সেটা বলা যায় না। তিনি অনেকের তুলনায় বেশি আদর-যত্নের মধ্যে মানুষ হচ্ছিলেন। অবশ্য অভিভাবকরা তাঁকে মানুষ করছিলেন – সমাজ যাকে উন্নতি বলে – সেই উন্নতির পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবার জন্যে। তিনি যে সবার থেকে আলাদা, সৃষ্টি-ছাড়া একটা মানুষ হবেন, এটা তাঁর অভিভাবকরা আশা করেননি। দিনরাত্রি কবি হবার স্বপ্ন দেখলেও, তিনি নিজেও সে পর্বে কল্পনা করেননি যে, কবিতা লেখাকে তিনি পেশা হিশেবে গ্রহণ করবেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থে উন্নতির যে-সরল পথ ধরে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন খৃষ্টান হবার ঘটনা তাঁকে সে পথ থেকে একেবারে দূরে ঠেলে দেয়। অতঃপর তাঁর কক্ষপথ অন্য পাঁচ জনের মতো সুগোল ছিলো না, সেটা হয়ে গিয়েছিলো ধূমকেতুর কক্ষপথের মতো — উৎকেন্দ্রিক। এর পরে তিনি নিয়মমাফিক কিছু করেননি, যা করেছেন আকস্মিক ঝোঁকের মাথায় এবং তাঁর সব ব্যবস্থা ছিলো সাময়িক। কিন্তু খৃস্টান হতে না-হলে, বাড়ি ত্যাগ করতে না-হলে, তিনি কী হতেন, এখন আর তা বলার জো নেই।

লেখাপড়ায় খুব ভালো এবং একমাত্র সন্তান হিশেবে মধুকে তাঁর বাবামা কতোটা ভালোবাসতেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই পুত্র যখন হঠাৎ খৃস্টান হলেন, তখন তাঁর পিতামাতা তাকে সাজানো বাগান শুকিয়ে যাবার মতো বিবেচনা করেছিলেন, সন্দেহ নেই। মুহূর্তের মধ্যে রাজনারায়ণ দত্তের মাথায় যেসব চিন্তা খেলে যাওয়া স্বাভাবিক, সেগুলো হলো: “আমি মরে গেলে আমাকে পিণ্ডি দেবে কে? আমার এতো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে কে? মধুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো কি করে? ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে গোটা সমাজ আমাকে একঘরে করবে!” যে-সন্তান তাঁদের নয়নমণি, জীবিত থাকতেও সে যে এখন মৃতের অধিক –এই মর্মান্তিক দুঃখে রাজনারায়ণ দত্ত এবং জাহ্নবী দেবী অর্ধ-মৃত হয়েছিলেন। কবির প্রতি সহানুভূতিবশত তাঁর জীবনী-লেখকরা তাঁর পিতামাতার এই দারুণ যন্ত্রণাকে খানিকটা লঘুকরে দেখিয়েছেন বলে সন্দেহ হয়। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, মর্মাহত হলেও, অচিরে খৃষ্টান পুত্রের কল্যাণের ব্যাপারে রাজনারায়ণ সচেতন হয়েছিলেন। এমন কি, কিছুকাল পরে অংশত সন্তানের মঙ্গল এবং অংশত হিন্দুত্বের টানে সেকালের বিবেচনায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পুত্রের লেখাপড়ার সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন – যদিও প্রথাবদ্ধ হিন্দু সমাজের কট্টর গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতার মধ্যে থেকে খৃষ্টান পুত্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে সহজ ছিলো না– বিশেষ করে একজন উকিলের পক্ষে – যাঁর ব্যবসা নির্ভরশীল সামাজিক শুভেচ্ছার ওপর।

পুত্র খৃস্টান হবার ঠিক পরে পিতামাতার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে-দারুণ সংকট দেখা দিয়েছিলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা থিতিয়ে এসেছিলো। তারপর মধুর সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্ক কী হবে, তার সংজ্ঞা মোটামুটি সুনির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মাইকেল গৌরদাসকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে দেখা যাচ্ছে, ততোদিনে বাবা-মার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিলো।৩৬এই পর্যায়ে তিনি বোধ হয় বাড়িতে গিয়ে বাবা-মার সঙ্গে অথবা বাড়ির কাছাকাছি কোথাও বাস করার কথা ভেবেছিলেন। বাড়ি থেকে তিনি দরাজভাবে টাকাপয়সা পাচ্ছিলেন, একটি চিঠিতে তারও উল্লেখ আছে। ‘ডিসেম্বরের আগে আমি ইংল্যান্ডে যাচ্ছিনে। শিগগিরই আমি গিয়ে বাবার সঙ্গে অথবা তাঁর কাছাকাছি কোথাও থাকবো। তবে মিডিয়ালট্রির সঙ্গে ইংল্যান্ডে যাওয়া হচ্ছে না; বাবা তা হতে দেবেন না।’৩৭ – তাঁর এই প্রশান্ত উক্তি থেকে বোঝা যায়, রাজনারায়ণ তাঁকে বিলেত পাঠানোর ব্যাপারে নিশ্চিত আশ্বাস দিয়েছিলেন। অল্প দিনের মধ্যে ডিয়ালট্রির ইংল্যান্ড যাবার কথা। মাইকেল তাঁর সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনারায়ণ মিশনারিদের সঙ্গে তাঁকে যেতে দিতে রাজি হলেন না। তিনি চেয়েছিলেন বিলেত যাবার লোভ দেখিয়ে অথবা সত্যি সত্যি সেখানে পাঠিয়ে পুত্রের আশা পূরণ করে মিশনারিদের কাছ থেকে তাঁকে সরিয়ে আনবেন। ডিয়ালট্রির সঙ্গে যেতে দিলে সেই উদ্দেশ্য কেবল যে ব্যর্থ হবে, তাই নয়, বরং মিশনারিদের সঙ্গে পুত্রের ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে যেতে পারে। সে জন্যে তিনি মধুকে বছরের শেষের দিকে — হয়তো ডিসেম্বরে — পাঠানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু কার্যকালে তিনি আর তাঁকে বিলেতে যাবার জন্যে সম্মতি অথবা টাকাপয়সা দেননি। কেন, তা জানা যাচ্ছে না। পিতা কি আশা করেছিলেন যে, পুত্রকে বিলেত যাবার আশা দিয়ে এবং কিছু দিন মিশনারিদের সংস্রব থেকে দূরে রাখতে পারলে, ঘরের ছেলে প্রায়শ্চিত্ত করে আবার ঘরে ফিরে আসবে! অসম্ভব নয়। বরং এই প্রত্যাশাকেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।

খৃস্টান হবার কারণ যদি হয়ে থাকে আয়োজিত বিবাহের ফাঁস থেকে রক্ষা পাওয়া আর বিলেত যাওয়া, তা হলে সেটা এ পর্যায়ে পরিবারের মধ্যে ফিরে গিয়েও মাইকেল অর্জন করতে পারতেন বলে মনে হয়। তবু তিনি পরিবারে ফিরে এলেন না কেন? বস্তুত, পরিবারে ফিরে আসার পেছনে তাঁর জন্যে যথেষ্ট প্রলোভনও ছিলো। অপর পক্ষে, খৃষ্টান সমাজ অথবা ধর্মকে আঁকড়ে থাকার মধ্যে তাঁর এমন কী আকর্ষণ ছিলো? খৃস্ট ধর্মে তাঁর বিশ্বাস কি এমন মজবুত ছিলো যে, তিনি আর সে ধর্ম ত্যাগ করে পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরে যেতে পারতেন না? খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে তখনকার মতো বিয়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া ছাড়া তিনি আর কোনো লাভ করেছিলেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, তা হলে খৃষ্ট ধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্য কী কারণে তিনি অতো প্রতিকূলতার মধ্যেও অতো দীর্ঘ দিন ধরে টিকিয়ে রাখলেন? এ প্রশ্নের জবাব এতো কাল জানা ছিলো না। কিন্তু বিশপস কলেজের তখনকার দুই অধ্যাপক — জর্জ উডনি উইদার্স এবং অ্যালফ্রেড স্ট্রীটের চিঠি এবং অন্য রচনা থেকে এর একটা মোটামুটি উত্তর পাওয়া যায়। তাঁদের মতে, খৃস্ট ধর্মে তিনি কেবল বিশ্বাস স্থাপন করেননি, বরং তিনি এ ধর্মের প্রতি রীতিমতো আকৃষ্ট হয়েছিলেন।৩৮ তাঁর এই আকর্ষণ বছর দেড়েকের মধ্যে কতো প্রবল হয়ে উঠেছিলো, তাঁর বিশপস কলেজে ভর্তির প্রসঙ্গে আমরা তা লক্ষ্য করবো। এখানে কেবল এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, সে পর্যায়ে, মধু ‘কুসংস্কারাচ্ছ’ হিন্দু ধর্মের তুলনায় খৃষ্ট ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করেছিলেন এবং নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে কোনো কিছুর বিনিময়ে বিসর্জন দিতে তৈরি ছিলেন না। খৃস্ট ধর্মের কোন কোন বৈশিষ্ট্য তখনকার মতো এই ধর্মের প্রতি তাঁর আকর্ষণকে আন্তরিক এবং তীব্র করে তুলেছিলো, তা আমাদের জানা নেই। তিনি নিশ্চয় আশা করেছিলেন যে, এই ধর্মের ছায়ায় তিনি তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্ররকে রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। এক দশক পরে তিনি এক বক্তৃতায় যেভাবে খৃষ্টধর্মকে হিন্দুধর্মের তুলনায় শ্রেষ্ঠ করে দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন, এ প্রসঙ্গে তা মনে রাখা যেতে পারে। তাঁর খৃস্ট ধর্ম-প্রীতির গোড়াপত্তন হিন্দু কলেজে থাকতেই হয়েছিলো বলে মনে হয়।

মধুকে বাড়িতে রাখার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করার পরেও, বোধহয় সমাজের কথা চিন্তা করে রাজনারায়ণ পুত্রকে আর বাড়িতে রাখতে পারেননি। মধু কিছুতেই একটা প্রতীকী প্রায়শ্চিত্ত করতেও রাজি ছিলেন না। এবং এ জন্যে সমাজের বিরুদ্ধতার কারণে নিজেদের বাড়িতে বাস করা দূরের কথা, বাবমা-র কাছাকাছি বাস করারও সুযোগ পাননি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই তিনি এ সময়ে বাড়িতে আসতেন তাঁদের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে। ওদিকে, কলেজে ফিরে যেতে গিয়ে দেখলেন, সে কলেজের দ্বার তাঁর জন্যে রুদ্ধ। হিন্দু কলেজে তখনো উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা ছিলো না। সে ব্যবস্থা হয়েছিলো আরও বছর দশেক পরে।৩৯ তিনি ভাবলেন, ধীরে ধীরে উত্তেজনা চলে গেলে, পুরোনো ছাত্র তিনি — সেই সুবাদে তাঁকে হয়তো কলেজ বিশেষ বিবেচনায় ফিরে যেতে দেবে। কিন্তু রাজনারায়ণ দত্তের তদবির সত্ত্বেও মাইকেল কলেজে ফিরে যাবার অনুমতি পেলেন না। মাইকেল নিজেও এ সময়ে (মার্চ-এপ্রিল), তাঁর ভাষায়, বার পঞ্চাশেক ডিএলআরের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁর কাছ থেকে ২৬ টাকা দিয়ে চারখানা বইও কিনেছিলেন।৪০ কলেজে ফিরে যাবার ব্যাপারে তিনি কি তাঁর কাছেও তদবির করেছিলেন? অসম্ভব নয়। কিন্তু ১৫ এপ্রিল তারিখে ডিএলআর হিন্দুস্তান জাহাজে করে চলে যাবার আগে পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টার ফয়সালা হলো না।

এর পরে ১৯ এপ্রিল থেকে কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হলেন জেমস ক্যর। ১৯ জুন থেকে স্থায়ী প্রিন্সিপাল।৪১ তিনি যে কেবল মাইকেলকে কলেজে যাবার অনুমতি দিলেন না, তাই নয়, তিনি অন্য ছাত্রদেরও হুকুম দিলেন, তাঁরা কেউ তাঁর অনুমতি ছাড়া মাইকেলের সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। গৌরদাসকে লেখা অন্তত দুটি চিঠিতে ক্যরের অনুমতি নেবার কথা কবি উল্লেখ করেছেন।৪২ হিন্দু কলেজের ছাত্ররা সদ্য-ধর্মান্তরিত একটি যুবকের সঙ্গে মেলামেশা করছে — এ কথা রটে গেলে কলেজের অন্য ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে কী প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা ক্যর উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। প্রায় অনুরূপ পরিস্থিতিতে বারো বছর আগে কলেজের পরিচালকদের চাপে ডিরোজিও হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।৪৩এবারে ক্যর আগে থেকে সতর্ক হলেন। ওদিকে, রাজনারায়ণ আশা ছাড়তে পারলেন না — ফেব্রুআরি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ছেলের কলেজের বেতন দিয়ে দিলেন।৪৪ কলেজ সেটা গ্রহণও করলো। কিন্তু তার পরেই কলেজের পরিচালকমণ্ডলী চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো — কোনো ধর্মান্তরিত ছাত্রকে কলেজে পড়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না, কারণ তা হলে সেটা অন্য ছাত্রদের ধর্মান্তরে উৎসাহ দেবে।৪৫ সুতরাং হিন্দু কলেজের দরজা চিরদিনের জন্যে বন্ধ হলো মধুর জন্যে।

ধর্মান্তরের ফল পেলেন তিনি হাতে-হাতে — বাড়িতে ঢুকতে পারলেও থাকতে পারলেন না; আর কলেজে ঢুকতেই পারলেন না। ওদিকে, ডিয়ালট্রি গোড়াতে সমাদর করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেও, সেখানে কয়েক দিনের বেশি থাকতে পারেননি। তাঁকে তখন থাকতে দেওয়া হলো মিশন রো-র ওল্ড চার্চে – যেখানে তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন। এখানে থাকার সময়ে তিনি অনুভব করলেন, এটা তাঁর জীবনের একটা সংকট কাল। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। তাঁদের সঙ্গ পছন্দ করতেন। কিন্তু খৃষ্টান হবার পরে হঠাৎ সবাই তাঁর কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেলেন। ভূদেব একবার এসেছিলেন তাঁর ধর্মান্তরের পরে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। অন্য বন্ধুদের টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পাওয়ার উপায় নেই। কেবল যোগাযোগ রাখছিলেন প্রিয়তম বন্ধু গৌরদাস। কবি তাঁকে ইংরেজি প্রবাদ মনে করিয়ে দেন — প্রয়োজনের সময়ের বন্ধুই সত্যিকার বন্ধু। মনে করিয়ে দেন, তাঁকে ভুলে না-যাবার কৈশোরক প্রেমের পবিত্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গৌরদাসও মাঝেমধ্যে অজুহাত দেখান। মাইকেল তাঁকে লেখেন: ‘দরকার হলে পালকি ভাড়া করে এসো – টাকার জন্যে ভেবো না, আমার অনেক টাকা আছে।’ তিনি যে এ সময়ে কী নিঃসঙ্গ ছিলেন, তা বোঝা যায় তাঁর একটি চিঠি থেকে:

কথা বলে ‘সে-ই সত্যিকার বন্ধু, যে তোমাকে প্রয়োজনের সময়ে সাহায্য করে।‘ এখন আমি সংকটের মধ্যে আছি এবং, তুমি যদি আমার সত্যিকার বন্ধু হও, তা হলে এখন সেটা দেখাও। তুমি কি ভাবছো, আমি তোমার কাছে টাকা ধার চাইবো? তুমি কি ভাবছো আমাকে কোনো জিনিশ জোগাড় করে দেবার জন্যে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে তোমার সম্পর্কের ওপর আমি আঘাত করবো? না, না, না! মোতই সে রকমেব কোনো বিষয় নয়। চমকে উঠো না। হায়! আমি একা! এবং আমার যা প্রযোজন, তা হলো সঙ্গ। হ্যাঁ গৌর! তুমি কি এসে আমার সঙ্গে আজকের দিনটা কাটাবে? আমি প্রায় নিশ্চিত যে, তুমি এটা করবে না, কিন্তু যেহেতু তুমি দাবি করো যে, তুমি আমার বন্ধু সে জন্যে আমি যে সংকটে আছি, এটা তোমাকে জানানো আমার — বলতে গেলে — একটা দায়িত্ব।’৪৬

এই একবারই নয়, তিনি বার বার গৌরদাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে, তার সঙ্গে গিয়ে সময় কাটানোর জন্যে। এবং তাঁর চিঠি থেকে জানা যায়, গৌরদাস নানা রকমের বাধা সত্ত্বেও, তাঁর সঙ্গে এই যোগাযোগ বহাল রেখেছিলেন। গৌরদাসকে তিনি তাঁর ভালোবাসার নিশ্চয়তা দিয়েছেন এভাবে: ‘কবি তাঁর প্রিয়াকে বলেছেন — Can I cease to love thee! No! – আমিও সে রকম করেই আমার প্রিয়, প্রিয় এবং সত্যিকার (যেটা খুব বিরল), সত্যিকার বন্ধুকে বলছি!’৪৭ এই ভালোবাসার টান গৌরদাসও অনুভব করতেন, তাই কবি যতোটা চাইতেন, ততোটা না-হলেও, মাঝেমধ্যে তিনি যেতেন তাঁর কাছে। তা ছাড়া, অনেক সময়েই চিঠিপত্র লিখতেন। কয়েক বার তিনি অন্য বন্ধুদেরও সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, এঁদের নিয়ে কবি বাইরে কোনো অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে গেছেন।৪৮ কিন্তু তাঁর নিঃসঙ্গ মনের তৃষ্ণা তাতে মিটতো না। তিনি কখনো ভূদেব, কখনো বেণী, কখনো বঙ্কু, কখনো ভোলানাথের কথা লিখতেন গৌরদাসের কাছে। বন্ধুদের কাছে তাঁর কথা মনে করিয়ে দিতে বলতেন।৪৯

ওল্ড চার্চে কয়েক মাস থাকলেও কবি দীর্ঘ দিন থাকতে পারেননি। আসলে থাকার জন্যে তিনি একটা জুৎসই জায়গাই পাচ্ছিলেন না। তখন কলকাতায় একজন দেশীয় খৃস্টানের পক্ষে দেশীয় পাড়ায় একটা বাড়ি ভাড়া পাওয়া সহজ ছিলো না। ওদিকে, খৃস্টান হলেও, ইংরেজদের মধ্যে থাকার অসুবিধে তিনি বেশ টের পাচ্ছিলেন। এ সময়েই একজন সজ্জন ধর্মযাজক তাঁকে আশ্রয় দিলেন — মি টমাস স্মিথ।৫০মধু হয়েছিলেন অ্যাংলিকান খৃস্টান। তখন কলকাতার বিভিন্ন শাখার খৃস্টানদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও ছিলো তীব্র। কোন চার্চ কতোজন ধর্মান্তর করাতে পারে, সেটা ছিলো তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত একটা প্রশ্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, স্কটিশ চার্চের ধর্মযাজক মি স্মিথ মাইকেলকে নিজের বাড়িতে রাখেন। ধারণা করি টাকার বিনিময়ে। তিনি তখন বাস করতেন বরানগরে। আমার অনুমান, এ ব্যাপারে কলকাতায় স্কটিশ চার্চের অন্যতম প্রধান ধর্মযাজক আলেকজান্ডার ডাফের হাত ছিলো। তিনি নিজে কৃষ্ণমোহনের মতো মধুকেও খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষা দিতে না-পারলেও আশ্রয় দানের ব্যাপারে সহায়তা করেছেন।

ইতিমধ্যে গৌরদাস ছাড়া অন্য বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কমে এসেছে। হয়তো অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু গৌরদাসের সঙ্গেও তাঁর এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো। মধু যে মাইকেলে পরিণত হয়েছিলেন, এটা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না। চিঠিতে তিনি একবার মধুকে নতুন নামে সম্বোধন করলেন। লিখলেন, ‘প্রিয় খৃস্টান বন্ধু মাইকেল মধুসূদন দত্ত’। বন্ধু তাতে দারুণ বিরক্ত হলেন। গৌরদাসকে নিজের অভিমানের কথা জানিয়ে দিলেন।৫১একটি চিঠিতে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁকে কি বলে সম্বোধন করতে হবে।৫২ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী মাইকেল নিশ্চয় মনে মনে প্রশ্ন করেছেন, এঁরা ধর্ম দিয়ে সব বিচার করে কেন? তিনি নিজে খৃষ্টান হযেও অন্যদের সঙ্গে মানবিক সম্পর্কগুলো ভুলতে পারেননি, অথবা সেগুলোর নতুন সংজ্ঞাও দিতে পারেননি। খৃষ্টান হয়েছেন, সেতীর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, সে তাঁর নিজের সমস্যা। তাতে বন্ধুত্ব বিনষ্ট হবে কেন? প্রথাবদ্ধ সমাজের এই অদ্ভুত মনোভাবকে মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিলো।

ওদিকে তাঁর লেখাপড়ায় কঠিন বাধার সৃষ্টি হয়েছিলো। যে-মধু লেখাপড়া করতে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন, যাঁকে বন্ধুরা এই অভ্যেসের জন্যে নাম দিয়েছিলেন ‘গ্রন্থকীট’, সেই মধুর লেখাপড়া প্রায় বন্ধ। কেবল যে কলেজের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া হচ্ছে না, তাই নয়, সমস্ত পরিবেশটাই এমন এলোমেলো এবং সমস্যায় ভরে গিয়েছিলো যে, তা লেখাপড়ার অনুকূল ছিলো না। নিজের পুরোনো বইগুলো জোগাড় করে লেখাপড়ায় মন দিতে তিনি চেষ্টা করেছিলেন। এই সময়ে তিনি তাঁর এক বন্ধু — শিবের কাছ থেকে ইংরেজি ব্যাকরণ এবং রোম্যানদের ইতিহাস ফেরত চেয়ে পাঠান।৫৩ কিন্তু তাঁর পড়ার আগ্রহ দেখে যিনি তাঁকে সত্যিকার সাহায্য করতে পারলেন, তিনি মি টমাস স্মিথ। ধর্মযাজক হলেও, সাহিত্যে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিলো। মাইকেল তাঁর বাড়িতে থাকার সময়েই — ১৮৪৪ সালের মে মাসে — Calcutta Review পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার চতুর্থ সম্পাদক হয়েছিলেন মি স্মিথ। (দ্বিতীয় সম্পাদক হয়েছিলেন মি ডাফ।) শেকসপীয়রের সাহিত্যে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিলো। তিনি মাইকেলকে নিয়মিতভাবে শেকসপীয়র পড়াতে শুরু করলেন। এই পড়া মাইকেলের খুব কাজে লেগেছিলো। আসলে এ সময় থেকেই তাঁর সাহিত্যরুচির বিবর্তন আরম্ভ হয়। হিন্দু কলেজেও শেকসপীয়র পাঠ্য ছিলো। রিচার্ডসন শেকসপীয়র পড়াতেনও চমৎকার। কিন্তু মাইকেল তখন পর্যন্ত ভক্ত ছিলেন রোম্যান্টিক কবিদের। শেকসপীয় এবং মিল্টন পড়লেও সে পর্যায়ে তিনি ভালোবাসতে পারেননি। হয়তো সে সাহিত্যের গভীরে ডুব দেবার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিলো না। মি স্মিথ তাঁকে নতুন একটা জগতের সন্ধান দিলেন এবং সেখানে বিচরণের পথ বাতলে দিলেন।

মনে হয়, স্মিথের বাড়িতে থাকার সময়ে ধর্মের প্রতিও তাঁর মনোভাব অনেকাংশে বদলে যায়। এক সময়ে ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন উদাসীন। কিন্তু দীক্ষা নেবার পর ধীরে ধীরে, বিশেষ করে স্মিথের সাহচর্যে এসে, তিনি খৃষ্ট ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকেন। ধর্মান্তরের পর তিনি আপন পরিচিত পরিবেশ থেকে ছিটকে পড়েছিলেন অনেক দূরে। কেবল আত্মীয়-স্বজন নন, তাঁর প্রিয় বন্ধুরাও একে একে তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। অপর পক্ষে, কবি তাঁর বন্ধুদের কথা কতোটা মনে করতেন এবং তাঁদের সঙ্গ চাইতেন গৌরদাসকে লেখা চিঠিগুলো থেকে পরিষ্কার তা বোঝা যায়। বোঝা যায়, তিনি কী তীব্রভাবে স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করেছিলেন। এই দুঃসহ নিঃসঙ্গতার মধ্যে তিনি একটা পরিচয়ের সঙ্কটে পড়েন এবং খৃস্ট ধর্মকে সান্ত্বনা হিশেবে আঁকড়ে ধরেন। অল্পকালের মধ্যে কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে নয়, খৃস্ট ধর্মের প্রতিই দারুণ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এমন কি, এই উৎসাহেব আতিশয্যবশত ১৮৪৪ সাল নাগাদ তিনি মিশনারি হবেন বলে ভাবতে আরম্ভ করেন।

লেখাপড়ার মতো আর-একটা জিনিশ এ সময়ে বাধা পেয়েছিলো – সে হলো তাঁর কবিতা রচনার ধারা। ১৮৪১-৪২ সালে তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন এবং সেগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিলো। ১৮৪২ সালের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে তিনি কয়েকটি কবিতা লন্ডনের দুটি নাম করা পত্রিকায় প্রকাশের জন্যেও পাঠিয়েছিলেন।৫৪ তারপরই বিয়ে নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। সেই ঝামেলা থেকে একে একে লেখাপড়ার সমস্যা, থাকার সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা – নানা রকমের সমস্যা দেখা দেয়। এই অস্থিরতার মধ্যে কবিতা লেখার মতো অনুকূল পরিবেশ অথবা অনুপ্রেরণা পাননি। তবে খৃস্টান হবার মাস তিনেকের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে যখন একটা আপোশ-রফা হয়, তখন কবিতা লেখার কথা ভেবেছিলেন বৈকি। গৌরদাসকে লিখেছিলেন: ‘দীক্ষা নেবার পর থেকে কবিতা তেমন লেখা হয়নি। তবে তার চেষ্টা করছি। আর এবারে কোথা থেকে কবিতা প্রকাশিত হবে, জানো? একেবারে খোদ লন্ডন থেকে।’৫৫ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও কল্পনাবিলাসটুকু ছাড়তে পারেননি। নিজেকে জাহির করার মনোভাবও নয়। এই একটি মাত্র চিঠি পড়লেও মাইকেল-চরিত্রে এই দিকটি চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয়। ১৮৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (সুরেশচন্দ্র মৈত্রের মতে মার্চ মাসে৫৬) Literary Gleaner পত্রিকায় তাঁর King Porusনামে যে-কবিতাটি প্রকাশিত হয়, সেটি জানুআরি মাসে লিখতে আরম্ভ করেছিলেন এবং শেষ করেন দীক্ষা নেবার পরে।

মি স্মিথের বাড়িতে তিনি প্রায় বছরখানেক ছিলেন। আগেই দেখেছি, তাঁব জীবনের এই পর্বটি তাঁর ভবিষ্যৎ সাহিত্যজীবন গড়ে তোলার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। কিন্তু তাঁর বাড়িতে থেকে মাইকেলের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার অথবা আবাসিক সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। বিলেত গিয়ে লেখাপড়া শিখবেন বলে তাঁর যে-আশা ছিলো, তা-ও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ১৮৪৪ সালের গোড়ার দিকে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাঁর বিলেতে যাওয়া হচ্ছে না। তা ছাড়া, তিনি যে হিন্দু ধর্মে ফিরে যাবেন না, অনেক ঝগড়াঝাটির পর সেটাও তাঁর পরিবারের কাছে ততোদিনে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বরং বলতে শুরু করেন যে, তিনি বিশপস কলেজে গিয়ে লেখাপড়া শিখে মিশনারি হবেন। এর পেছনে কেবল ধর্মপ্রীতি ছিলো বলে মনে হয় না। তিনি পেশা হিশেবেও মিশনারি হবার কথা ভেবে থাকবেন। তাঁর আগে কৃষ্ণমোহন মিশনারি হয়েছিলেন।৫৭ মহেশচন্দ্র ঘোষও মিশনারি হবার উদ্দেশে বিশপস কলেজে কিছু কাল লেখাপড়া শেখেন। কিন্তু অকালে মারা যাবার ফলে মিশনারি হতে পারেননি।৫৮ গোপালচন্দ্র মিত্র ডীকন হন ১৮৪৩ সালে।৫৯তখন মিশনারিদের সবচেয়ে নিচের পদ –ক্যাটেকিস্টের বেতন ছিলো ৮০ টাকা, ডীকনের ১৫০ টাকা আর প্রীস্টের ২০০ টাকা।৬০ চাকরি হিশেবে দেখলে শিক্ষিত বাঙালিদের জন্যে বেশ প্রলোভনের কাজ। তাই কবির কাছে এই লক্ষ্য হয়তো অদ্ভুত মনে হয়নি। তিনি গিয়ে বিশপস কলেজ-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিশনারি হবার ব্যাপারে আলোচনা করেন। এ কলেজে যাঁরা লেখাপড়া করতেন, তাঁরা সবাই ছাত্রবৃত্তি পেতেন। থাকার জন্যে অথবা লেখাপড়া শেখার জন্যে তাঁদের কোনো খরচ দিতে হতো না। মাইকেলও ছাত্রবৃত্তি নিয়ে সেখানে ভর্তি হতে চান। এতে তীব্র বাধা দেন রাজনারায়ণ। কারণ, খৃস্টান হয়েছেন বলে মধু একেবারে মিশনারি হবেন — এটা তিনি মোটেই মেনে নিতে পারলেন না। কলেজের অধ্যক্ষ জর্জ উডনি উইদার্সের চিঠি থেকে এ সম্পর্কে পরিষ্কার জানা যায়। মাইকেল এই কলেজে ভর্তি হবার ঠিক পরে অধ্যক্ষ এক চিঠিতে লেখেন:

চতুর্থ ছাত্রটি – মধুসূদন দত্ত – বেতন-দেওয়া ছাত্র। বেতন দেওয়া ছাত্র এই প্রথম আমরা ভর্তি করলাম। সে ভর্তি হতে চেয়েছিলো ধর্মতত্ত্বের ছাত্র হিশেবে। কিন্তু তার পিতা – যিনি এখনো একজন হীদেন – তিনি এ ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি খাওয়ার খরচ এবং কলেজের বেতন দিয়ে পড়ানোর বিকল্প বেছে নেন এবং অবস্থাপন্ন লোক হিশেবে সেটা তিনি অনায়াসে করতেও পারেন।৬১

বেতন দিয়ে পড়া আর বেতন না-দিয়ে ছাত্রবৃত্তি নিয়ে পড়ার মধ্যে পার্থক্য কি তা আরও পরিষ্কার হয় অধ্যাপক অ্যালফ্রেড স্ট্রীটের একটি চিঠি থেকে। তিনি লেখেন:

সে (ডাট)। এখানে আসে মিশনারি হবার প্রকাশ্যে ঘোষিত সংকল্প নিয়ে। তাঁর পিতা, যিনি একজন মোটামুটি ধনী নেটিব, তিনি অন্তত এটা ঠেকানোর উদ্দেশ্যে একজন বেতন-দেওয়া ছাত্র হিশেবে তাকে কলেজে রাখার প্রস্তাব দেন। এবং (তখন থেকে) তা-ই করেছেন।৬২

বেতন দিয়ে পড়লে মিশনারি হবার ব্যাপারে অগ্রিম কোনো প্রতিশ্রুতি দেবার আবশ্যক নেই এই কারণেই রাজনারায়ণ পুত্রকে বেতন দিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আশা করেছিলেন, কিছু কালের মধ্যে পুত্রের মন বদলে যেতে পারে। সে ফিরে আসতে পারে তাঁর পিতৃপুরুষের ধর্মে।৬৩ ঠিক এক বছর নমাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকার পর ৯নভেম্বর (১৮৪৪) মাইকেল ভর্তি হলেন বিশপস কলেজে। কয়েক সপ্তাহের জন্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় বিভাগের ছাত্র। তবে তার পরই তাঁকে দ্বিতীয় বিভাগে তুলে দেওয়া হয়। (কলেজের মোট তিনটি বিভাগ ছিলো। প্রথমে ছাত্ররা ভর্তি হতো সাধারণত তৃতীয় বিভাগে।)৬৪

বিশপস কলেজে ভর্তি হওয়ায় দুদিক থেকেই তাঁর সমস্যার সমাধান হয়েছিলো – সেখানে লেখাপড়া শেখার খুব ভালো ব্যবস্থা ছিলো; আর ব্যবস্থা ছিলো বাসস্থানের। মধু কলেজে একার জন্যে একটা ঘর পেয়েছিলেন। কলেজের বেতন এবং থাকার খরচ মাসে ৬৪ টাকা৬৫; আর মধুর হাত খরচ ৩৬ টাকা – এই মোট এক শো টাকা দিতে হতো রাজনারায়ণকে। মায়ের কাছ থেকেও মধু টাকাপয়সা নিতেন – এমন অনুমান অসঙ্গত হবে না।

হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ে মধুর জীবন যেমন নিঝঞাট ছিলো, বিশপস কলেজে তাঁর জীবন তেমন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ছিলো বলে মনে হয় না। কারণ, পিতার সঙ্গে কলহ ছাড়াও তিনি একাধিক বার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন — এক বার মদ্যপান নিয়ে, এক বার পোশাক নিয়ে৬৬এবং একবার তার চেয়েও গুরুতর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে – যার কথা আমরা একটু পরেই আলোচনা করবো। তবু বলা যায় যে, বিশপস কলেজে ভর্তি হবার পর প্রায় আড়াই বছর তাঁর জীবন ধরা-বাঁধা পথে এবং রুটিনমাফিক চলেছিলো।

বিশপস কলেজের আর হিন্দু কলেজের মধ্যে ছিলো আকাশ-পাতাল ব্যবধান। হিন্দু কলেজ নামে হিন্দু হলেও এখানকার পাঠ্য-তালিকায় নৈতিক শিক্ষা ছাড়া হিন্দু ধর্ম শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তদুপরি, যতো দিন ডিরোজিও বেঁচেছিলেন, ততোদিন বরং হিন্দু ধর্মবিরোধী একটা মনোভাব কলেজের অনেক ছাত্রের মধ্যে দানা বেঁধেছিলো। একটা ইহলৌকিকতার মনোভাবও কারো কারো মধ্যে দেখা দিচ্ছিলো। মাইকেল এই কলেজে ভিরোজিও-বিপ্লবের কয়েক বছর পরে পড়তে এলেও, হিন্দু ধর্ম এবং প্রচলিত রীতিনীতি-বিরোধী মনোভাবের ধারা তখনো কলেজ থেকে লোপ পায়নি। এই পরিবেশে মধু হিন্দুধর্ম-বিরোধী কোনো কার্যকলাপে লিপ্ত না-হলেও হিন্দু সমাজে প্রচলিত বহু রীতিনীতির প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন। অপর পক্ষে, বিশপস কলেজ ছিলো সত্যিকারভাবে একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কলেজ তৈরি হয়েছিলো ইংল্যান্ডের বাইরে খৃস্ট ধর্মীয় শিক্ষা ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে। ধর্মান্তরের পর স্বরূপের সংকট থেকে হোক, ধর্মযাজকদের সাহচর্যে হোক, তাঁর মনে যে-ধর্মীয় ভাব জেগে উঠেছিলো, বিশপস কলেজের ধর্মীয় পরিবেশে তা শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

কলকাতার অদূরে এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন কলকাতার তখনকার বিশপ — মি মিডলটন। এই কলেজ স্থাপনের জন্যে গভর্নর জেনরেল মার্কুইস অব হেস্টিংস বিশপ মিডলটনের অনুরোধে বট্যানিক্যাল গার্ডেনের পাশে মোট ৬২ বিঘা জমি দান করেন। পরে চার্লস মেটকাফ দান করেছিলেন আরও এক খণ্ড জমি।৬৭ মিডলটন নিজে দান করেন ৫০০ পাউন্ড আর লাইব্রেরির জন্যে ৫০০ বই। এ ছাড়া সাহায্য এসেছিলো নানা সূত্র থেকে। ব্রিটিশ অ্যান্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটি দান করেছিলো পাঁচ হাজার পাউন্ড।৬৮ চার্চ মিশনারি সোসাইটি দিয়েছিলো এক হাজার পাউন্ড। অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের প্রেসে ছাপা সব বই-এর এক খণ্ড করে দান করেছিলো। প্রথম থেকেই এই কলেজের লাইব্রেরি অত্যন্ত মূল্যবান বইপত্রে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এই কলেজের কাজ আরম্ভ হয় ১৮২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। বস্তুত, এই কলেজ গড়ে ওঠে খৃস্টান ধর্মযাজক প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিশেবে। খুব কম ছাত্র এখানে পড়তে আসতো। খরচও ছিলো সেকালের তুলনায় খুব বেশি। যে-ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতো, তারা আসতো ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সুদূর শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ভারত থেকেও এখানে ছাত্ররা পড়তে আসতো।৬৯ মাত্র জনা কুড়ি ছাত্রের জন্যে৭০ এ কলেজে তিন জন পুরো অধ্যাপক ছাড়াও, নানা ধরনের আরও চারজন দেশীয় শিক্ষক ছিলেন। এই কলেজে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে খুব গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হতো ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্য। তার চেয়েও বড় কথা, এই কলেজের পরিবেশে একটা ধর্মীয় ভাব এবং গাম্ভীর্য বজায় রাখা হতো।

ধর্মের ব্যাপারে এখানে কী কড়া নিয়ম পালন করা হতো, তার একটা প্রমাণ পেয়েছি এই কলেজের অধ্যাপক অ্যালফ্রেড স্ত্রীটের একটি চিঠি থেকে। চিঠির তারিখ পয়লা ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭।৭১ এতে দেখা যায়, মধুসূদন দত্ত তাঁর মাদ্রাসের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু চার্লস এগব্যর্ট কেনেটের সঙ্গে কলকাতার রোম্যান ক্যাথলিক চার্চের বিশপ ডক্টর ক্যারিউ-এর সঙ্গে দেখা করতে যান আগের বছরের শেষ দিকে। কেনেটের মা ছিলেন বোম্যান ক্যাথলিক। সেই সূত্রে কেনেটও ছেলেবেলায় রোম্যান ক্যাথলিক ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তাঁর পিতার ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং অ্যাংলিকান হন। কলকাতায় তাঁর পূর্ব পরিচিত রোমান ক্যাথলিক বন্ধু-বান্ধব ছিলেন। সেই সূত্রে মাইকেল এবং চার্লস কেনেট ডক্টর পি জে ক্যাবিউ-এর সঙ্গে দেখা করতে যান। বিশপের সঙ্গে পরিচিত হবার সময়ে মাইকেল তাঁর প্রতি সম্মানের নিদর্শন স্বরূপ তাঁর আংটিতে চুমু খান। এই নিয়ে তাঁদের দু জনের কৈফিয়ত চাওয়া হয়, কারণ এই চুমু দেওয়ার মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ পেতে পারে। দু জনই লিখিত কৈফিয়ত পেশ করেন। ব্যাপারটা আর্চডীকন ডিয়ালট্রিকেও জানানো হয়। (ডিয়ালট্রি এঁদের দিকে নজর রাখার পরামর্শ দেন।) পরে দুজনকে সতর্ক করে বলা হয় যে, নিতান্ত প্রয়োজ না-হলে তাঁরা যেন আর কখনো রোম্যান ক্যাথলিক বিশপের সঙ্গে দেখানা-করেন।৭২ কয়েক মাস ধরে ঝামেলা চলার পর ঘটনাটা চাপা পড়ে। অধ্যাপক স্ট্রীটের ভাষা থেকে বোঝা যায়, গোটা কলেজ, এমন কি, কলকাতার অ্যাংলিকান প্রতিষ্ঠান এই বিষয়টাকে কী রকমের গুরুতর বলে বিবেচনা করেছিলো।

মাইকেল হিন্দু কলেজে ভর্তি হবার আগে অন্য যে-স্কুলে পড়তেন, সেখানে ল্যাটিন, গ্রীক এবং হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন বলে তাঁর জীবনীকারেরা দাবি করেছেন। কিন্তু তিনি এসব ভাষা কতোটা জানতেন, তা এ যাবৎ নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি। বিশপস কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড জর্জ উডনি উইদার্সের চিঠি থেকে এখন সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়, মাইকেল এই কলেজে ভর্তি হবার সময়ে বিভিন্ন ভাষা কতোটা জনাতেন। এ চিঠি তিনি লিখেছিলেন আর্নেস্ট হকিন্সের কাছে — মাইকেল ভর্তি হবার ঠিক এগাবো দিন পরে।

চতুর্থ ছাত্রটি (মধুসূদন দত্ত) তুলনামূলকভাবে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে অনেক বেশি পরিচিত। তদুপরি তার ল্যাটিন ভাষার কৃতিত্ব পাওয়ার মতো জ্ঞান আছে, গ্রীক ভাষার অকখও সে জানে।৭৩

তিনি বিশপস কলেজে এসে দ্বিতীয় বার গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষা শেখার সুযোগ পান। উইদার্স নিজে হিব্রু ভাষার একটি ব্যাকরণ লিখেছিলেন। তবে এ কলেজে হিব্রু পড়ানো হতো কিনা, তার কোনো প্রমাণ পাইনি। মাইকেল এ কলেজে থাকার সময়ে ল্যাটিন এবং গ্রীক — দুই ভাষাতেই তাঁর দক্ষতার পরিচয় দেন। ২৩ জুলাই ১৮৪৭ তারিখে সোসাইটি ফর দ্য প্রোপ্যাগেশন অব দ্য গসপেল (এসপিজি)- এর সেক্রেটারি রেভারেন্ড জি এইচ ফ্যাগানকে লেখা এক চিঠিতে অধ্যাপক স্ফীট লিখেছিলেন গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষার মাইকেলের জ্ঞান কতোটা গভীর।৭৪

দীর্ঘ দিন লেখাপড়ার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর, কলেজে ফিরে যেতে পেরে মাইকেল খুঁশি হয়েছিলেন বলে পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। মাস দুয়েকের মধ্যে তিনি ডুবে গেলেন তাঁর লেখাপড়ায়। এ সময়ে তাঁর ব্যস্ততার মাত্রা বোঝা যায়, তাঁর একটি চিঠি থেকে (২৭. ১. ৪৫):

এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, আমি এর আগে তোমার দুখানা সহৃদয় পত্রের জবাব দিতে পারিনি। কিন্তু তুমি যদি জানতে এখানে আমার সময় কী করে কাটছে, তা হলে তুমি নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করতে। অবশ্য তুমি যদি আসো এবং তোমার সঙ্গে অন্য কোনো বন্ধুদের নিয়ে আসে, তা হলে আমি তোমার এবং সেই বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে খুশি হবো। .. এতো ছোটো চিঠির জন্যে আমাকে ক্ষমা করতে হবে; কিন্তু বিধাতার নামে বলছি, আমার পক্ষে আর একটা মিনিট সময়ও নষ্ট করা সম্ভব নয়।৭৫

হিন্দু কলেজে তিনি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, কিন্তু সাহিত্যকে তিনি সেখানে একটা ধর্মনিবপেক্ষ এবং মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শিখেছিলেন। তা ছাড়া, ধ্রুপদী সাহিত্যের পাশাপাশি সমকালীন সাহিত্যের পঠনপাঠনও হতো সেখানে। বিশেষ করে নিজে একজন রোম্যান্টিক কবি হিশেবে ডিএলআর সমকালীন কাব্য সাহিত্যের প্রতি ছাত্রদের কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। রোম্যান্টিক কবিদের প্রতি মাইকেলের মনে যে-গভীর ভালোবাসা লক্ষ্য করি, সেটা নিতান্ত হিন্দু কলেজের আমলে। এ সময়ে তিনি বায়বন, কীটস, স্কট, মূর, বার্নস, রিচার্ডসনের জগতে বিচরণ করতেন এবং এঁদের রচিত সাহিত্যকে বিবেচনা করতেন অনুকরণীয় একমাত্র সাহিত্য হিশেবে। পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখা যাবে যে, তিনি নিজে রোম্যান্টিক কবিতার অনুকরণ করলেও, কয়েক বছরের মধ্যে রোম্যান্টিক কবিদের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত ঔৎসুক্য হাবিয়ে ফেলেছিলেন। প্রসঙ্গত, ১৮৬০ সালে তিনি রঙ্গলাল সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছিলেন, তাও এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি তখন বলেছিলেন: ‘রঙ্গলালের দৌড় বড়ো জোর বায়রন, স্কট আর মূর পর্যন্ত। এই কবিরা ভালো কবি হলেও শ্রেষ্ঠ কাব্য এঁরা রচনা করেননি। বায়রনকে হয়তো ব্যতিক্রম বলে গণ্য করা যায়। আমি ওয়ার্ডসওয়ার্থকে তার চেয়ে বেশি পছন্দ করি।৭৬ এই উক্তি থেকে দেখা যায় তাঁর প্রথম যৌবনের সাহিত্য-চিন্তা ততোদিনে কতোটা পাল্টে গিয়েছিলো। তরুণ বয়সে তিনি রোম্যান্টিক কবিদের প্রতি, বিশেষ করে বায়রনের প্রতি, কথায় কথায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও পরিণত বয়সে কোনো দিন তিনি আর রোম্যান্টিক কবিদের সম্পর্কে কোনো বেহিশেবী অথবা উচ্ছসিত মন্তব্য করেননি। রোম্যান্টিক সাহিত্য থেকে তাঁর মন কতো দূরে সরে গিয়েছিলো, য়োরোপ-বাসের সময়কার আলোচনা থেকেও আমরা তার পরিচয় পাবো।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে দেখা দিয়েছিলো ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি অসামান্য প্রেম। এই রুচি গঠনে কোনো একটি সূত্র যদি সবচেয়ে প্রবলভাবে কাজ করে থাকে, তা হলে সেটা হলো বিশপস কলেজ। এই কলেজে উইদার্স, স্ট্রীট এবং, শেষ বছর, মি ওয়েল্ডারম্যানের কাছে তিনি আর-এক ধরনের সাহিত্যে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন, সাহিত্যকে দেখতে শিখেছিলেন আর-এক দৃষ্টিকোণ থেকে। এই কলেজের পাঠক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হতো। ইউরিপিদিসের মতো নাট্যকারের সঙ্গে এখানেই তাঁর পরিচয়। কিন্তু এখানে বিশেষ করে ঝোঁক ছিলো ধর্মীয় সাহিত্যের দিকে। গ্রীক ভাষায় বাইবেল এখানে খুব বিশদভাবে শেখানো হতো। সংস্কৃত এবং বাংলাও পড়ানো হতো। তবে মাইকেল পড়েছিলেন কিনা তা জানা যায় না। লন্ডনে এসপিজির কাছে পাঠানো বিশপস কলেজের প্রতিবেদনে ইংরেজি সাহিত্যের কোনো উল্লেখ দেখতে পাইনি। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা শক্ত, এখানে ইংরেজি পড়ানো হতো কিনা। এই কলেজে ধ্রুপদী সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের ফলে এতো দিনের ভালো-লাগা রোম্যান্টিক সাহিত্যকে তিনি হয়তো অগভীর এবং হালকা সাহিত্য হিশেবে বিবেচনা করে থাকবেন। এ জন্যেই বলতে হয় যে, পরিণত বয়সে তিনি যে-সাহিত্য রচনা করেন, তার ভিত্তি অনেকাংশে তৈরি হয়েছিলো বিশপস কলেজে। এই কলেজে না-পড়লে, তিনি পরে যে-পণ্ডিতকবি হয়েছিলেন, তা হতে পারতেন কিনা, সন্দেহ আছে। আর তিনি খৃষ্টান না-হলে হিন্দু পুরাণ থেকে কাহিনী নিয়ে তার গতানুগতিক ব্যাখ্যা না-দিয়ে যে- মানবকেন্দ্রিক সাহিত্য রচনা করেছিলেন, তা রচনা করতে পারতেন কিনা, সে সম্পর্কেও সন্দেহ আছে। Visions of the Past সহ তাঁর একাধিক বচনাও এই কলেজে তাঁর সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যয়নের প্রত্যক্ষ ফল।

বিশপস কলেজে ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্যের স্বাদ পাওয়ায় পরে তিনি আর অনুবাদের মাধ্যমে ধ্রুপদী সাহিত্য পড়ে তৃপ্ত হতে পারেননি; বরং মূল ভাষায় মূল গ্রন্থ পড়ার চেষ্টা করেছেন। মাদ্রাসে গিয়ে তিনি যে তামিল-তেলেগু শিখেছিলেন এবং মূল দক্ষিণী রামায়ণ পড়তে চেষ্টা করেন, তাও এই ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্যপ্রীতির প্রত্যক্ষ ফল। ১৮৬১ সালেও তিনি কলকাতায় বসে মূল ইতালীয় ভাষায় ত্যাসো পড়তে আরম্ভ করেন৭৭ – সেও বিশপস কলেজে অধ্যয়নের প্রভাব। এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে, তাঁর খৃস্টান হওয়া এবং বিশপস কলেজে পড়া – উভয়ই তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা বিকাশের জন্যে আর্শীবাদের কারণ হয়েছিলো। এই কলেজে তাঁর অধ্যয়নকাল শেষ হবার মুখে তাঁর অন্যতম অধ্যাপক রেভাবেন্ড স্ট্রীট তাঁর সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছিলেন, তা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে:

সে খুব চালাক-চতুর। গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষার ভালো ছাত্র। এখানে আসার আগেই ইংরেজি-কবিতা লিখে সে খ্যাতি লাভ করেছিলো – এ কথা উল্লেখ করলেই বুঝতে পারবেন, ইংরেজি সে পুরোপুরি আয়ত্ত করেছে। সে হলো বালকসুলত অহমিকা-পূর্ণ এবং সেই সঙ্গে আত্মশ্লাঘা-পূর্ণ একটি তরুণ। তবু সে বাধ্যগত, সম্মানযোগ্য, নীতিবাদী এবং, আমি বিশ্বাস করি, ধার্মিক। সে এখানে এসেছিলো উদারপন্থী ইয়ং বেঙ্গলের হাবভাব এবং বিশ্বাস নিয়ে – যদিও ইয়ং বেঙ্গলের খারাপ অভ্যাসগুলো তাঁর ছিলো না। কিন্তু মানুষেব যথেচ্ছ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ এবং বশ করার ব্যাপারে চার্চপদ্ধতি শিক্ষা অথবা, যাকে বলতে পারেন, ঈশ্বরভাতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ক্ষমতা [তার ওপর] লক্ষ্য করা গেছে।৭৮

স্ট্রীট মিশনারি ছিলেন। মনে করা সঙ্গত যে, তাঁদের ধর্মীয় শিক্ষা খুব যে কার্যকর হয়েছে — এটা তিনি দেখতে চাইতেন। তবু তাঁর এবং উইদার্সের মন্তব্য ছাড়া সে সময়কার মাইকেল চরিত্র নির্মাণের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে নেই। স্ট্রীটের মন্তব্যে অতিরঞ্জন থাকতে পারে – এ কথা মনে রেখেও এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, বিশপস কলেজে পড়ার সমযেতাঁর চরিত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছিলো।

হিন্দু কলেজে থাকলে মাইকেলের ছাত্রজীবন শেষ হতে ১৮৪৫-৪৬ সালে। তাঁর সহপাঠী এবং সমসাময়িক ছাত্রদের কেউ কেউ অবশ্য এর আগেই কলেজ ত্যাগ করেন। গোবিন্দ দত্ত, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর আর প্যারীচরণ সরকার খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, তবে তাঁরা সবাই ১৮৪২ সালের শেষে হিন্দু কলেজ ত্যাগ করেন। ১৮৪৩ সালে জ্ঞানেন্দ্রমোহন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন; প্যারীচরণ হুগলি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন; আর গোবিন্দ দত্ত কলেজ ছাড়ার পর চাকরি পান ট্রেজারিতে। কবির বেশির ভাগ সহপাঠীই কলেজ ছেড়ে যান ১৮৪৬ সালে। এ বছরের জুলাই মাসেও গৌরদাস পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, মাইকেলের চিঠি থেকে তা জানা যায়।৭৯ গৌরদাসসহ ক্লাসের অন্য কয়েকজন ডেপুটি হয়েছিলেন। জগদীশনাথ রায় তুখোড় ছাত্র ছিলেন। তিনি পুলিশ বিভাগে বড়ো চাকরি পেয়েছিলেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় আর রাজরানায়ণ বসু পেশা বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা।৮০

ধর্মান্তরের পর দেড় বছর মাইকেল আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি। ১৮৪৭ সালের শেষে তিনি যখন বিশপস কলেজ ত্যাগ করেন, তখন তিনি সিনিয়র বিভাগের ছাত্র, তবে সেখানকার চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনি তখনো উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তার অর্থ এ নয় যে, তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন না। ১৮৪৬ সালের জানুআরি মাসে কলেজের প্রিন্সিপাল রেভারেন্ড উইদার্সের লেখা একটি চিঠি থেকে দেখা যায়, তার ঠিক আগে ডিসেম্বরে যে-পরীক্ষা হয়েছিলো, তাতে মাইকেল ধর্মতত্ত্ব এবং ধ্রুপদী সাহিত্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।৮১ তা ছাড়া, স্ত্রীটের চিঠি থেকে আগেই আমরা দেখেছি, তিনি ভাষা শিক্ষায় বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।৮২ এ কলেজে থাকার সময়ে তিনি যে লেখাপড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতেন, তাও ভালো করে জানা যায়। ১৮৪৫ সাল থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত গৌরদাসকে লেখা তাঁর ছ খানা চিঠি পাওয়া গেছে। সবগুলো চিঠিই আকারে ছোটো এবং সবগুলো চিঠির মধ্যে একটি জিনিশ অভিন্ন দেখতে পাই – সে হলো তাঁর ব্যস্ততার উল্লেখ। বিশপস কলেজে লেখাপড়ার চাপ যে খুব বেশি ছিলো, সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন: ‘এখন টার্মের সময়, তোমার সঙ্গে দেখা করা অসম্ভব।’ ৮৩ কিন্তু কলেজ যখন খোলা থাকতো না, তখনো তিনি কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন – তাঁর চিঠি থেকে তারও আভাস পাওয়া যায়। ‘নানা কারণে গত ছুটিতে আমি তোমার সঙ্গে একদিনের জন্যেও দেখা করতে পারিনি, এ জন্যে আমি সত্যি দুঃখিত।’৮৪ তাঁর এ সময়কার চিঠিতে আর-একটা জিনিশ বেশ লক্ষ্য করা যায় – গৌরদাসের প্রতি আগে যে-কৈশোরক প্রেমের উচ্ছাস প্রকাশ পেতে, তার অনেকটা ততোদিনে শুকিয়ে এসেছিলো। তবে তিনি যে তাঁর একান্ত আন্তরিক বন্ধু, গৌরদাসের অব্যাহত বন্ধুতা এবং অবিচল আনুগত্য থেকে এ উপলব্ধি তাঁর পাকা হযেছিলো। ‘যাঁরা আমাকে সত্যি ভালোবাসে তাদের যে আমি আরও বেশি করে মনে করিনে, এ জন্যে নিশ্চিতভাবে আমি নিজেকে একটা বদমাশ বলে গণ্য করি।’৮৫ যাঁদের তিনি এ যাবৎ বন্ধু বলে বিবেচনা করতেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর যে একটা সত্যিকার দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো, এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া তিনি কোনোদিনই চলতে পারেননি। বিশপস কলেজে তা হলে তিনি কাদের বন্ধু হিশেবে পেয়েছিলেন? তাঁর অধ্যাপকদের চিঠি থেকে জানা যায়, এখানে তাঁর অন্তত তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখতে পাবো, তাঁর ভবিষ্যৎ জীবন কোন দিকে মোড় নেবে এঁদের একজন সেব্যাপারেও বড়ো রকমের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

এই কলেজে তিনি প্রথমে যাঁকে বন্ধু হিশেবে পেয়েছিলেন, তাঁর নাম জর্জ ম্যান। তাঁর বয়স ছিলো মাইকেলের চেয়ে তিন বছরের ছোটো। কবি এই কলেজে ভর্তি হওয়ার এক মাস দুদিন পরে জর্জ ভর্তি হন। তিনি মরিশাস থেকে এসেছিলেন ধর্মযাজক হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের জন্যে। তিনি আশা করেছিলেন যে, ধর্মযাজক হয়ে মরিশাসে ফিরে গিয়ে সেখানকার লোকেদের খৃস্ট ধর্মে দীক্ষা দিয়ে তাঁদের অন্তহীন অগ্নির হাত থেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার ঠিক ন মাস পরে – ১৮৪৫ সালের ১১ অগস্ট তারিখে তিনি হঠাৎ মাত্র চার দিনের জ্বরে মারা যান। মৃত্যুর মাত্র তিন ঘণ্টা আগে তিনি চার্চে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করান।৮৬ মরিশাসবাসীদের নরকের যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর তাঁর মহৎ আকাঙ্ক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু মাইকেলকে তিনি পেয়েছিলেন সত্যিকার বন্ধু হিশেবে। তাঁর মৃত্যুর পর তাই মাইকেল মরিশাসে গিয়ে বন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সংকল্প করেন। কিন্তু একটা বড়ো রকমের বাস্তব বাধা এসে তাঁর পথ আটকালো। তিনি মরিশাসে যাবেন, কিন্তু তাঁর বেতন কে দেবে? সেখানে থাকার খরচ জোগাবে কে? তিনি তাই বিষয়টা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে মাদ্রাসের বিশপের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।

বিশপস কলেজে মাইকেলের দ্বিতীয় বন্ধু চার্লস এগবার্ট কেনেট। মাদ্রাস থেকে এই কলেজে আসেন। মাদ্রাস চাৰ্চমণ্ডলী মিডলটন বৃত্তি নিয়ে, সেখানকার লর্ড বিশপের নির্দেশে।৮৭ তাঁর বয়স ছিলো মাইকেলের চেয়ে দুবছরের ছোটো। মাইকেলের ছ মাস পরে — ১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাসে — তিনি এই কলেজে এসে ভর্তি হন এবং তাঁর আগেই – ১৮৪৭ সালের অক্টোবর কি নভেম্বর মাসে – তিনি এই কলেজের পাঠ শেষ করে মাদ্রাসে ফিরে যান।৮৮ তিনি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েনগুডিতে ক্যাটেকিস্টের অর্থাৎ ধর্মযাজকদের মধ্যে সবচেয়ে নিচের পদে চাকরি পেয়েছিলেন। তবে অল্প কালের মধ্যেই — ১৮৫১ সালে তিনি ডীন পদে উন্নীত হন। কবির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিলো। সত্যি বলতে কি, মাইকেলের জীবনের গতি কোন দিকে যাবে, তারও খানিকটা তিনি প্রভাবিত করেছিলেন বলে মনে হয়। কেনেটের স্ত্রী ফীবির নাম অনুসারে মাইকেল তাঁর দ্বিতীয় কন্যার নামও দিয়েছিলেন ফীবি।৮৯ তা ছাড়া, কবি তাঁর একটি কন্যার নামের সঙ্গে কেনেট নামও জুড়ে দিয়েছিলেন,৯০ তবে, অনুমান করি, সেটা চার্লস এগবার্ট কেনেটেরপিতা চার্লস কেনেটের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যে, এবার্টের প্রতি নয়। ১৮৮৪ সালে তিনি মারা যান।

এই কলেজে মাইকেলের তৃতীয় বন্ধু রবার্ট চার্লস ওয়কার। মাইকেলের চেয়ে দু বছরের ছোটো। বিশপস কলেজে পড়তে আসেন কবির ছ মাস পরে – পয়লা এপ্রিল ১৮৪৫ তারিখে।৯১খুব ভালো ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৮৪৯ সালের শেষ দিকে তিনি কলেজের চুড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর কলেজ ত্যাগ করে চলে যাবার ঠিক আগে হঠাৎকদিনের জ্বরে তিনি মারা যান ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখে। তাঁর মৃত্যুতে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওয়েন্ডারম্যান লন্ডনে এসপিজির কাছে খুব দুঃখ প্রকাশ করে একটি চিঠি লিখেছিলেন।৯২ চার্লস এগবার্ট কেনেটের মতো ওয়কারও ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান।

বন্ধুত্ব ছাড়াও, পরিবারের কাছ থেকেও মধু অসামান্য আদর-যত্ন পেয়েছিলেন। প্রথমে সাগরদাঁড়িতে তিনি বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে মানুষ হয়েছেন। তারপরে কলকাতায় এসেও বাবা-মার ডানার নিচে পক্ষী-শাবকের মতো লালিত হয়েছেন। জীবনের রূঢ় দিকগুলো সম্পর্কে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ ধারণা ছিলো না। সেই নিরাপদ সুখের আশ্রয় ত্যাগ করে তিনি প্রথম রূঢ়তার স্বাদ পেয়েছিলেন খৃস্টান হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অবশ্য তখনো তাঁর মধ্যে স্বনির্ভরতা এবং স্বাধীন ব্যক্তিত্ব পুরোপুরি গড়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু প্রথমে ওল্ড চার্চে কয়েক মাস এবং টমাস স্মিথের বাড়িতে বছর খানেক বাস করার ফলে তাঁর মধ্যে একটা স্বনির্ভরতা দেখা দিতে আরম্ভ করে। তারপর মূল কলকাতার বাইরে – বিশপস কলেজে – বাস করার ফলেও তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটেছিলো বলে মনে হয়। তা না-হলে তিনি সম্পূর্ণ অজানা উপকূলের দিকে তরী ভাসাতে ভরসা পেতেন কিনা, সন্দেহ আছে।

বিশপস কলেজে শেষ বছর তাঁর কার্যকলাপ সম্পর্কে এ যাবৎ বলতে গেলে কিছুই জানা ছিলো না। যেটুকু জানা ছিলো, তার উৎস প্রধানত গৌরদাসকে লেখা কয়েকটি বিরল পত্র। ১৮৪৭ সালের মাঝামাঝি লেখা এ রকমের একটি পত্র থেকে জানা যায় যে, তাঁর সময়টা বিশেষ ভালো যাচ্ছিলো না। এ চিঠি তিনি লেখেন তাঁর পরীক্ষা শুরু হবার দু সপ্তাহ আগে।

তোমার শেষ চিঠি পাওয়ার সময় থেকে আমি নানা ঝামেলায় প্রায় অর্ধ-মৃত। তোমার সঙ্গে দেখা হলে আমি সুখী – খুব সুখী হবো। কাল এগারোটায় এসো। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই একটি দিনের ব্যাপারেই আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি (যখন তোমাকে সময় দেওয়া সম্ভব। তবে তোমার যদি জরুরী কাজ থাকে তা হলে অবশ্যই (যখন খুশি তখন) চলে এসো।৯৩

এই চিঠিতে তিনি ঝামেলায় অর্ধ-মৃত হবার যে-প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, সেটা কী ধরনের ঝামেলা এবং তার কারণ কী — তিনি অথবা অন্য কেউ তা উল্লেখ করেননি। অবশ্য পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে বোঝ যায়, এ ঝামেলা লেখাপড়া এবং পারিবারিক। এই বছরের শেষে তাঁর পিতা তাঁর খরচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তার ফলে তিনি বিশপস কলেজের লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ঠিক কবে রাজনারায়ণ মধুর পড়ার খরচ দেওয়া বন্ধ করেন, তা জানা যায় না। তবে স্ত্রীটের চিঠি থেকে জানা যায়, এ সিদ্ধান্ত রাজনারায়ণ নিয়েছিলেন নভেম্বর মাসের আগে। ২২ নভেম্বর তারিখে অধ্যাপক স্বীট এসপিজির কাছে যে-চিঠি লেখেন, তাতে বলেন:

[আমাদের] ছাত্র ডাট আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে, কারণ তার বাবা এখন আর তার খরচ দেন না। আর নিজের খরচ দেবার মতো সামর্থ্য তার নেই।৯৪

অধ্যাপক স্ট্রীট যেভাবে লিখেছেন, তাতে মনে হয়, নভেম্বরের আগেই রাজনারায়ণ পুত্রকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন। আর, এ নিয়ে পিতা এবং পুত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিলো, তারও অনেক আগে — এ অনুমানই সঙ্গত। স্ত্রীটের লেখা থেকে আরও দেখা যাচ্ছে যে, পিতা খরচ দেওয়া বন্ধ করার পরেও মাইকেল কয়েক সপ্তাহ কলেজে ছিলেন – যদিও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি যে-বার্ষিক পরীক্ষা হয়েছিলো, তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। অথচ এটাই ছিলো তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তিনি পাশ করলে পরে ধর্মযাজক হবার পথে কোনো বাধা থাকতো না। তিনি যে পরীক্ষা না দিয়েই কলকাতা ত্যাগ করেন — তা থেকে তাঁর মানসিক এবং আর্থিক সংকটের তীব্রতা বোঝা যায়।

বিশপস কলেজে পড়ার জন্যে রাজনারায়ণ প্রায় তিন বছর খরচ দিয়েছিলেন – এ থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এই পুরো সময়টা তাঁদের সম্পর্ক ভালো অথবা স্থিতিশীল ছিলো। কিন্তু আসল ঘটনা সে রকমের ছিলো না। মাঝেমধ্যে তাঁর ধর্মান্তরের প্রসঙ্গ নিয়ে পারিবারিক কলহ এবং ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। পড়ার খরচ এবং উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়েও তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত, একে কেন্দ্র করে মাইকেল একাধিক বার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে মিশনারি হবার জন্যে চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে এ পর্যন্ত জীবনী-লেখকরা জল্পনা-কল্পনা করলেও, কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা ছিলো না। কিন্তু বিশপস কলেজের নথি থেকে এখন এ বিষয়ে আসল খবরটা পাওয়া যায়।

মাইকেল লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে প্রথম বার মিশনারি হবার চেষ্টা করেন ১৮৪৫ সালের শেষ দিকে। ঘটনাটা বর্ণনা করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ উইদার্স। তিনি লিখেছেন যে, মধুসূদন ডাটের ‘অতি-ঘনিষ্ঠ’ বন্ধু জর্জ ম্যান মারা যাওয়ার পর মাইকেল লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে মিশনারির কাজ নিয়ে মরিশাসে যাবার জন্যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন। তাঁর হয়ে অধ্যক্ষ উইদার্স মাদ্রাসের বিশপ জর্জ জন ট্রেভর স্পেন্সরের কাছে চিঠি লেখেন ১৮৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।৯৫ বিশপ যখন জানান যে, মরিশাস তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না, তখন উইদার্স চিঠি লেখেন লন্ডনে এসপিজি অর্থাৎ গসপেল সোসাইটির কাছে। এতে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন একটি মিশন খোলাব জন্যে।৯৬ কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সংস্থাকে তিনি রাজি করাতে পারেননি। মাইকেল তাই মিশনারি হয়ে মরিশাসে যেতে পারলেন না।

১৮৪৬ সালের প্রথম দিকে তিনি আর-এক দফা মিশনারি হবার কথা চিন্তা করেন – এ তথ্য জানা যায় স্ত্রীটের একটি চিঠি থেকে। ১৮৪৭ সালের ২৩ জুলাই তারিখে তিনি যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, মিশনারি হবার আন্তরিক ইচ্ছ ১৮৪৬ সালের গোড়ার দিকে তাঁর মনে প্রবল হয়ে উঠেছিলো।

বছর দেড়েক আগে, ছেলেটির যখন মনে হলো যে, তার মিশনারি হবার সংকল্প আগের তুলনায় অনেক জোরালো হয়েছে, তখন সে ভাবলো, তা হলে পিতার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেওয়া ঠিক নয়, কারণ সে তার সংকল্প ত্যাগ কবেছে মনে করে পিতা তাকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।

কিন্তু এর পরে স্ট্রীট যা লেখেন, তা বিশ্লেষণ করলে মিশনারি হবার পেছনে ধর্মীয় আকর্ষণের চেয়েও অন্য আর-একটা কারণ চোখে পড়ে। মনে হয়, পিতার সঙ্গে তিক্ততা ছিলো এর অব্যবহিত কারণ।

সে … আমাকে জিজ্ঞেস করলো যে, তার পিতা তাকে ত্যাগ করার এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে-হুমকি দিচ্ছে, তা কার্যকর করলে তাকে একটা ছাত্রবৃত্তি দেওয়া হবে কিনা। এতে আমি তাকে বলি যে, সে যদি সোসাইটির (এসপিজি) কাজে আত্মনিয়োগ কবে, তা হলে এটা পাওয়ার ব্যাপারে আমি কোনো সন্দেহ দেখিনে। তবু সে আবও জানতে চায় যে, তাকে কী রকমের বৃত্তি দেওয়া হবে। আমি বললাম, যেমনটা অন্য নেটিব ছাত্রদের দেওয়া হয় — থাকা খাওয়ার খরচ আর যোগ্যতা লাভের পর চাকরি, যদিও আমি বলতে পারছিনে তাতে বেতন কতো হবে। এর পরে তার আত্মপ্রবঞ্চনার ছবিটা বেরিয়ে পড়লো। সে অন্য নেটিব ছাত্ররা যেমন পোশাক-আশাক পরে তেমনটা পরতে রাজি নয়, অথবা অন্যরা যেমন বেতন পেয়েছে, তার চেয়ে কম বেতন নির্ধারিত হলে তা নিতেও রাজি নয়। এখানে আমার প্রসঙ্গত বলে নেওয়া উচিত ছিলো যে, সে যখন হিন্দু কলেজ থেকে এখানে আসে তখন পুরোপুরি য়োরোপীয় অত্যাস নিয়ে এসেছিলো (অর্থাৎ পোশাক আশাক, খাওয়া-দাওয়া ও পানীয়ের ব্যাপারে)। আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা অর্থহীন, তবু আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, সে যে-সংকল্প পোষণ করছে সেটা স্বীকার করা এবং তা থেকে পিতা অথবা সংসার অথবা টাকাপয়সা অথবা জমিজমার চেয়ে সে বেশি পাবে – এই বিশ্বাস রাখা তার কর্তব্য।

মাইকেলের ধর্ম প্রচারের আগ্রহ যে তাঁর সমস্ত অন্তরকে অধিকার করতে পারেনি, অন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করে স্ত্রীট চিঠিতে তারও প্রমাণ দিয়েছেন। মরিশাসে একটি মিশন খোলার ব্যাপারে সাহায্য করতে না-পারলেও, ১৮৪৬ সালের গোড়ার দিকে মাদ্রাসের লর্ড বিশপ তাঁকে চাকরি দেবার প্রস্তাব দেন। তিনি জানান যে, মাইকেল যদি দক্ষিণ ভারতে গিয়ে দেশীয়দের ধর্মান্তর করানোর কাজ নিতে রাজি থাকেন, তা হলে তাঁকে চাকরি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তিনি এই প্রস্তাবে আগ্রহ দেখাননি। এর পরও

মাদ্রাসের লর্ডবিশপ তাকে ডেকে পাঠান এবং তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আমারই মতো এ সিদ্ধান্ত না-নিয়ে পারেননি যে, এটা হলো এমন একটা ব্যাপার যার একদিকের পাল্লায় আছে একটি কোট এবং ভাতা, আর অন্য দিকে আছে ধর্মপ্রচারের আহবান।৯৭

এ চিঠি থেকে আরও একটা বিষয়েব আভাস পাওয়া যায়, সে হলো: দূরে কোথাও গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করবেন – এ বাসনা তাঁর তখন থেকেই মনের মধ্যে দানা বাঁধছিলো। কখনো তিনি বিলেতে যেতে চেয়েছেন, কখনো মরিশাসে, কখনো মাদ্রাসে, কখনো ভার্সাই, এমন কি, জীবনের একেবারে শেষ পর্বে অজ্ঞাত পঞ্চকোটে।

স্ট্রীটের চিঠি থেকে আরও কযেকটি জিনিশ চোখে পড়ে। বিশেষ করে য, দেখা যায়, তা হলো: পিতাপুত্রের সম্পর্কে টানাপোড়েন আগাগোড়াই চলছিলো। শেষ পর্যন্ত মিশনারি হবার লক্ষ্যে অটল থাকলে পিতার কাছ থেকে টাকা নেওয়া ঠিক হবে কিনা – বিবেকের তেমন একটা দ্বন্দ্বও মধুব মধ্যে কাজ করেছে। কিছুদিন পর পর রাজনারায়ণ তাঁকে টাকাপয়সা বন্ধ করে দেবার এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিতেন। তা সত্ত্বেও মাইকেল খৃস্ট ধর্ম ত্যাগ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসতে রাজি হননি। উল্টো, খৃস্ট ধর্মের প্রতি তাঁর বিশ্বাস এতোটা দৃঢ় হয়েছিলো যে, তিনি মিশনারি হবার কথা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন এবং পিতার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি না-করে মিশনারির কাজ নিয়ে দূরে সরে যাবার কথাও চিন্তা করতেন। তবে পার্থিব সুখ এবং ভোগের দিকে তাঁর যে-আন্তরিক আকর্ষণ ছিলো, তা তিনি ত্যাগ করতে পারেননি। তাঁর খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করার প্রাক্কালে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিলেত যাওয়া এবং ধর্মান্তরের দ্বৈত বাসনার যে-তুলনা করেছিলেন — তিন বছর পরেও তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তা ছাড়া, তিনি যে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র এবং শ্রেষ্ঠ এ চিন্তাও তাঁর মধ্যে বদ্ধমূল ছিলো। তাঁর অতো যোগ্যতা সত্ত্বেও তিনি বেতন পাবেন দেশীয় মিশনারিদের সমান এবং বিদেশী মিশনারিদের চেয়ে কম — এর কোনোটাই তিনি মেনে নিতে পারেননি।

অনুকূল শর্তে মিশনারির কাজ পেলেন না, সরকারী কাজও নয়। তাই ১৮৪৬ সালে তাঁকে বিশপস কলেজেই থেকে যেতে হয়েছিলো। ওদিকে পিতার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জোড়াতালি দিয়ে একটা সাময়িক রফা হয়েছিলো – তার পেছনে কতোটা জাহ্নবী দেবীর অশ্রুবিসর্জন ছিলো তা অবশ্য জানা যায় না। এরপর কিছুকাল তিনি আবার মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেন। জুন মাসে পরীক্ষা। তিনি ভালো ছাত্র হিশেবে সেই পরীক্ষার আহ্বানও কম গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারলেন না। তবে লেখাপড়ায় তিনি অখণ্ড মনোযোগ দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ১৮৪৭ সালের মে মাসে তিনি গৌররদাসকে যে-চিঠি লেখেন, তাতে তিনি নিজেই ঝামেলার কথা বলেছেন। এ ঝামেলা পারিবারিক। কলেজের খরচ নিয়ে পিতার সঙ্গে নতুন করে তিক্ততা দেখা দিয়েছিলো। এই তিক্ততার কারণ তিনি নিজে অথবা তাঁর পিতা লিখে রেখে যাননি। তবে এর কারণটা অনুমান করা কঠিন নয়। আমার ধারণা, বিরোধ বাধে উভয় পক্ষের প্রত্যাশা সমান অথবা একমুখী না-হওয়ায়। আড়াই বছর অপেক্ষা করেও রাজনারায়ণ যখন দেখলেন, মধু প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু সমাজে ফিরে এলেন না, বরং মাঝেমধ্যে মিশনারি হবেন বলে ইচ্ছে প্রকাশ করেন, তখন তিনি আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর পর তিনি দুটি পদক্ষেপ নেন। প্রথম পদক্ষেপ ছিলো: পড়ালেখার খরচ দেওয়া বন্ধ করে খৃস্টান সমাজ থেকে পুত্রকে ফিরিয়ে আসতে বাধ্য করা আর দ্বিতীয় পদক্ষেপ পুত্র লাভের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ।

আমার বিশ্বাস, পুত্রের পড়ালেখার খরচ বন্ধ করার যে-সিদ্ধান্ত রাজনারায়ণ গ্রহণ করেন, তাঁর জন্যে পুরোপুরি মধুই দায়ী ছিলেন না। এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে আরও একটি বড়ো কারণ ছিলো। সদর দেওয়ানী আদালতের উকিল হিশেবে রাজনারায়ণের প্রতিষ্ঠা ছিলো এবং তিনি বেশ ভালো আয় করতেন, তা আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ১৮৪৭ সালের শেষ দিকে তিনি কোনো একটা পেশাদারি অযোগ্যতা এবং/অথবা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সে জন্যে, ডিসেম্বর মাসে আদালতের বিচারকরা তাঁকে আপীলঘটিত মামলা থেকে ‘পদচ্যুত’ করেন।৯৭ স্থায়ীভাবে, না সাময়িকভাবে তা জানা যায়নি। রাজনারায়ণ কি কোনো বিশেষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন? সাধারণ একজন উকিলের ‘পদচ্যুত’ হবার কথা নয় ! অবশ্য পেশাগত কোনো গুরুতর অনিয়মের দরুন উকিলদের ব্যবসা করার অধিকার আদালত কেড়ে নিতে পারে। রাজনারায়ণ তেমন কিছু করেছিলেন কিনা, আরও তথ্য আবিষ্কৃত না-হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে তা বলা সম্ভব নয়।৯৮ কিন্তু এ ঘটনার পরে রাজনারায়ণের আয় কমে যাবার কথা। তিনি মধুর পড়ার খরচ বন্ধ করে দিলেন মোটামুটি এ সময়ে। তিনি ধরে নিলেন, পুত্র আর কখনো স্বধর্মে ফিরে আসবেন না। জোর করে বিয়ে দেবার সম্ভাবনা এ পর্যায়ে ছিলো না। সুতরাং জেদ করে মাইকেলের খৃস্ট ধর্ম আঁকড়ে থাকার কারণ যে সে ধর্মের প্রতি তাঁর আকর্ষণ এবং হিন্দু ধর্মের তুলনায় সে ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তাঁর অটল বিশ্বাস – এটা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়। অতঃপর তিনি আমৃত্যু খৃস্ট ধর্মের মানবিক দিকগুলোকে, বিশেষ করে য়োরোপীয় মানবিক সভ্যতাকে, হিন্দু ধর্মের / ভারতীয় সভ্যতার তুলনায় শ্রেষ্ঠতর বলে বিবেচনা করেছেন।

মোটামুটি এই পরিবেশে রাজনারায়ণ তাঁর দ্বিতীয় পদক্ষেপ নেন – তিনি পারলৌকিক মঙ্গল এবং ইহলৌকিক উত্তরাধিকারী লাভের কথা চিন্তা করে, পুত্রার্থে আর-একটি ভার্যা আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি ঠিক কখন বিয়ে করেন, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। এই স্ত্রী, শিবসুন্দরী, অল্প দিন পরেই মারা যান। খিদিরপুরেব বাড়িতে ইনি আসেননি বলেই মনে হয়। প্রথম বার বিয়ে করে রাজনারায়ণ খানিকটা অপরাধবোধে কাতর হয়েছিলেন। কিন্তু এই স্ত্রী — রাজনারায়ণের ভাষায় — জাহ্নবী দেবীর ‘সেবিকা’৯৯ অকালে মারা যাবার পর দেরি না-করে রাজনারায়ণ একে-একে তৃতীয় এবং চতুর্থবার বিয়ে করেন। একজন জীবনীকার এমনভাবে এর বর্ণনা দিয়েছেন, যাতে মনে হয়, মাইকেল মাদ্রাস যাবার আগেই তাঁর পিতা তৃতীয় বার বিয়ে করেন। এই জীবনীকার বলেছেন, কবি খিদিরপুরে বেড়াতে গেলে জাহ্নবী দেবী তাঁকে আপ্যায়ন করার দায়িত্ব দিতেন বিমাতা প্রসন্নময়ীকে।১০০ মাইকেল ১৮৪৭ সালের মে মাসে গৌরদাসকে বিশপস কলেজ থেকে শেষ যে-চিঠিটি লিখেছিলেন, তাতে নানা ঝামেলার কথা লিখেছিলেন; কিন্তু তাঁর পিতার বিয়ে করার কোনো ইঙ্গিত নেই। এ থেকে জীবনীকারেরা ধরে নিয়েছেন যে, তখনো রাজনারায়ণ পুনর্বিবাহ করেননি। সে জন্যে সুরেশচন্দ্র মৈত্র এমনভাবে লিখেছেন, যা থেকে মনে হয় রাজনারায়ণ দ্বিতীয় বিয়ে করেন মোটামুটি এসময়ে।১০১ কিন্তু সুরেশচন্দ্রের এই অনুমান নগেন্দ্রনাথ সোমের বিবরণের সঙ্গে মেলে না। রাজনারায়ণ কখন দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বিবাহ করেন, তা সঠিক বলা যায় না।

সঠিক যা বলা যায়, তা হলে তিনি জাহ্নবী দেবীকে জানিয়ে অথবা তাঁর অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেননি। সাগরদাঁড়িতে গিয়ে শিবসুন্দরীকে বিয়ে করার পর খবর পাঠান জাহ্নবী দেবীর কাছে। সেই সঙ্গে সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে খুব অসাধারণ — এক রাশ অপরাধ বোধ নিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। দ্বিতীয় বার বিয়ে করা সেকালে আদৌ অসাধারণ ব্যাপার ছিলোনা। তদুপরি,এ ক্ষেত্রে এক মাত্র সন্তান খৃস্টান হয়ে যাওয়ায় প্রথাবদ্ধ সমাজের দৃষ্টিতে রাজনারায়ণের দ্বিতীয় বার বিয়ে করার বেশ যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিলো। তিনি যদি সেকালের বাবুদের মতো দত্তক নেওয়ার প্রস্তাব দিতেন, তা হলেও সেটা অযৌক্তিক বলে বিবেচিত হতো না। আগের আলোচনা থেকে দেখেছি, স্ত্রীর জ্ঞাতসারে উপপত্নী রাখাও তখন রীতিমতো সমাজস্বীকৃত বিষয় ছিলো। তা সত্ত্বেও, তিনি যেভাবে জাহ্নবী দেবীর কাছে ক্ষমা চেযেছেন, তা থেকে স্ত্রীর প্রতি রাজনারায়ণের এক ধরনের দায়বদ্ধতার আভাস পাওয়া যায়। সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, স্বামী অন্য নারীর সংস্পর্শ লাভ করেছেন বলে জাহ্নবী দেবী আঘাত পাননি, বরং অন্য একটি নারীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার জন্যেই তিনি অপমানিত বোধ করেছিলেন। তবে দারুণ দুঃখ পেলেও, এ ঘটনাকে তিনি নাকি শান্তভাবেই মেনে নিয়েছিলেন।

লেখাপড়ার খরচ বন্ধ হয়ে যেতে পারে — বিশপস কলেজে পড়ার সময়ে মাইকেল আগাগোড়াই এ আশঙ্কার মধ্যে সময় কাটিয়েছেন। সুতরাং পিতার চূড়ান্ত এবং রূঢ় সিদ্ধান্ত জানতে পেরে তিনি দুঃখিত হলেও বিস্মিত হয়েছেন বলে মনে হয় না। তবে এই বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি এর কোনো সহজ সমাধান দেখতে পাননি। বরং এতোকাল বিলাসের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন বলে তাঁর পক্ষে চোখে অন্ধকার দেখাই স্বাভাবিক। আগের বছরের (১৮৪৬) মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি সরকারী কাজও খুঁজছিলেন বলে স্ত্রীটের চিঠি থেকে জানা যায়।১০২ তখন গরজ অবশ্য এতো প্রবল হয়নি। কিন্তু এখন টাকা বন্ধ হওয়ায় তিনি মরিয়া হয়ে একটি চাকরিব চেষ্টা করলেন। এক সময়ে বঙ্গদেশের ডেপুটি গভর্নর, মি ব্যর্ড নাকি তাঁর ধর্মান্তরের সময়ে কেল্লায় রেখে তাঁকে মদত দিয়েছেন।১০৩ ১৮৪৭ সালে ছোটো লাট ছিলেন টি এইচ ম্যাডক। মাইকেল নাকি তাঁর সঙ্গে দেখা করে এ সময়ে একটা চাকরি দেবার অনুরোধ জানান।১০৪ তা ছাড়া, তিনি চীফ সেক্রেটারি এফ জে হ্যালিডের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।১০৫ কিন্তু কোনো সরকারী চাকরি তিনি পাননি। ওদিকে বিদেশী এবং দেশী মিশনারির বেতনের বৈষম্যের দরুন এক সময়ে তিনি মিশনারির কাজ নেবেন না বলে তাঁর অধ্যাপকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন নিরুপায় হয়ে মিশনারির কাজ নিতেও রাজি হন। অধ্যাপক স্ট্রীট চিঠিতে এ সম্পর্কে লেখেন:

কলেজের প্রিন্সিপাল যিনি আমার চিঠির অনুলিপি দেখেছেন … তিনি মনে করেন আমি একটা কথা উল্লেখ না-করে তার (মাইকেলের) প্রতি বলতে গেলে কোনো সুবিচার করিনি। সে নিজের থেকে মরিশাস অথবা অন্য যেকোনো জায়গায় যেকোনো বেতনে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলো। বেতনেব কথাটা (সুনির্দিষ্টভাবে) ওঠেনি। আমি স্বীকার করছি, কথাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।১০৬

তাঁর মিশনারি হবার উৎসাহ সম্পর্কে তাঁর অধ্যাপকরা যা লিখেছেন, তার মধ্যে কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জন থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু ঘটনার সত্যতা তাতে ঢাকা পড়ে না।

চিরকাল-সুখে-লালিত তরুণ কবি এ সময়ে তীব্র অর্থকষ্টের মধ্যে কী করেছেন, তা জানার উপায় নেই। শেলির মতো তিনি কি বাড়িতে গিয়ে পিতার সঙ্গে টাকাপয়সার জন্যে ঝগড়া করেছেন? তখন মাইকেলের বয়স প্রায় ২৪ বছর। আগের তুলনায় স্বাধীন ব্যক্তিত্বেরও বিকাশ ঘটেছে — তিনি আর হিন্দু কলেজে-পড়া কিশোর ননীর পুতুল ছিলেন না। সুতরাং এই ঝগড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু তার চেয়েও যা বেশি সম্ভব মনে হয়, তা হলো তিনি তীব্র অভিমানে বাবা-মা কারো সঙ্গে দেখাই করেননি। এই তাঁর পিতা রাজনারায়ণ দত্ত — যাঁকে তিনি ছোটোবেলা থেকে মনে মনে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আদর্শ পিতা বলে বিবেচনা করে এসেছেন! এই তিক্ততা ছাড়া পিতার পুনর্বিবাহেও তিনি নিশ্চয় দারুণ বিরক্ত হয়েছিলেন। এই পুনর্বিবাহের ফলে মায়ের ওপর যে-প্রতিক্রিয়া পড়েছিলো, তিনি তা-ও দেখেছিলেন। যে-স্নেহশীলা মাকে তিনি চিরদিন দেখেছেন প্রসন্ন, সুখের প্রতিমার মতো, তাঁর চোখে অশ্রু এবং মুখে রাশি রাশি না-বলা ব্যথার যন্ত্রণা দেখে বিচলিত বোধ করেন। পিতার প্রতি ক্রুদ্ধ হন।

অতঃপর কলকাতা অসহ্য। এই অবস্থায়ই, তিনি অন্য কোথাও চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বরং ভিক্ষা করে খাবেন, তবু আর বাড়ির দিকে পা বাড়াবেন না! এর আগে তাঁর শিকড় ধরে নাড়া দেবার মতো অভিজ্ঞতা তিনি একবারই লাভ করেছিলেন — বিয়ের আয়োজন এবং তারপর খৃস্টান হবার ঘটনা থেকে। কিন্তু তারপর চার বছর ন মাসে পরিস্থিতি এসেছিলো স্থিতিশীল হয়ে। এবারে ঝড় এলো একেবারে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। সে বাত্যাঘাতে তাঁর ঘর আবার ভাঙলো। পাঁচ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় বার অনিকেত হলেন।

উল্লেখপঞ্জী ও টীকাটিপ্পনী – সাধিতে মনের সাদ

পৃ ৫৪

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৬, HRP.

গৌরদাসের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৬১।

পৃ ৫৬

W. Radice, “Tremendous Literary Rebel: the Life and Works of Michael Madhusudan Datta” (a thesis submitted for the degree of D. Phil. in the Faculty of Oriental Studies, University of Oxford, 1986), পৃ. ১৫১।

T. Moore, Letters, and Journals of Lord Byron (London: John Murrray, 1838), p.79. এ চিঠির তারিখ ১৮ মার্চ ১৮০৯। টমাস মূরের লেখা এই জীবনীর ১৮৩৮ সালের সংস্করণই মাইকেল পড়ে থাকবেন। ছোটো হরফে ছাপা এই বই-এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৩৫ এবং এতে মোট ৫৭টি অধ্যায় আছে।

পৃ ৫৭

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৩; তারিখ ২৫ নভেম্বর ১৮৪২, HRP.

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২৮, HRP.

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৯, HRP.

পৃ ৫৮

MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৬, HRP.

শিবনাথ শাস্ত্রী, আত্মচরিত, পৃ. ১১১।

পৃ ৬০

১০ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৪৮।

১১ ভূদেব মুখোপাধ্যায় এক সময়ে অ্যালেকজান্ডার ডাফের সংস্পর্শে আসেন এবং বেশ প্রভাবিত হন। এই সূত্রে তিনি পুজো করার ব্যাপারেও পিতার কাছে আপত্তি করেন। তবে ডাফ তাঁকে দীক্ষা দিতে চেষ্টা করেননি। পিতা ভূদেবকে আশ্বস্ত করেন যে, হিন্দু ধর্ম পাশ্চাত্য চিন্তাধারার তুলনায় কম আধুনিক নয়। – T. Raychaudhuri, Europe Reconsidered (2nd Impression; Delhi: Oxford University Press, 1989), pp.28, 46.
ডাফ নানাভাবে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। তিনি বাংলা শিখেছিলেন। ইংরেজি শেখার জন্যে একাধিক স্কুল স্থাপন করেছিলেন। সর্বোপরি, তাঁর চমৎকার বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা ছিলো। তাঁর আগে পর্যন্ত মিশনারিরা প্রধানত নিম্ন শ্রেণীর লোকদেরই খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু ডাফ প্রথম উচ্চবর্ণের এবং উচ্চবিত্তের লোকদের দীক্ষা দিতে সমর্থ হন। তাঁর কাছে দীক্ষাপ্রাপ্তদের মধ্যে সবচেযে নাম-করা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

১২ রাজনারায়ণ নিজেই তাঁর এই ইসলামপ্রীতির কথা তাঁর আত্মচরিতে বর্ণনা করেছেন। আত্মচরিত (তৃতীয় সং; কলিকাতা: ওরিয়েন্ট বুক এজেন্সি, ১৯৫২), পৃ. ৪৪।

পৃ ৬১

১৩ The Anglo-Saxon and the Hindu (Lecture I) দ্রষ্টব্য। পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

পৃ ৬২

১৪ কৃষ্ণমোহনের পত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৯২।

পৃ ৬৩

১৫ মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৬।

১৬ India Office Record (I. O. R.), N/1/47/66.

১৭ I.O.R./N/1/81/347.

১৮ I.O.R./N/1/90/444.

১৯ যাত্রীদের তালিকায় দুজনের নাম ছিলো: Rev. Mr. & Miss Banerjee, কলকাতা থেকে জাহাজ ছাড়ার তাবিখ ৭ ডিসে’র। Shipping News, Atheneum, 18 December 1855.

পৃ ৬৪

২০ General Report on Public Instruction in Bengal Presidency for 1842-43 (Calcutta: Bengal Military Orphan Press, 1843) p. lxxiii.

২১ ঐ। অন্য বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের নাম: প্যারীচরণ সরকার – ৪০ টাকা; যোগেশচন্দ্র ঘোষ, মাধবচন্দ্র রুদ্র, আনন্দকৃষ্ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায় এবং গোবিন্দচন্দ্র দত্ত ৩০ টাকা; জুনিয়র স্কলারশিপ – জগদীশনাথ রায়, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, রাজেন্দ্রনাথ মিত্র ও শ্যামাচরণ ল। pp. vi-vii.

২২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৮, HRP।

পৃ ৬৫

২৩ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তেব জীবনচরিত, পৃ. ৪৬৭।

২৪ ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, মাইকেল-জীবনের আদিপর্ব (কলকাতা: মডার্ন বুক এজেন্সী, ১৯৬২), পৃ. ৮০।

২৫ এর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত মেলে জেমস লঙের রচনায়। তাঁর A Handbook of Bengal Missions (London: J. Farquhar, 1848) গ্রন্থে বিভিন্ন মিশনের সমবেত চেষ্টায় কলোজনকে ধর্মান্তরিত করা সম্ভব হয়েছে, তার বদলে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন উচ্চবর্ণের কোন কোন হিন্দুকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

২৬ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৫৭।

পৃ ৬৬

২৭ এক নম্বর ওল্ড গার্ডেন রীচ।

২৮ ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, পৃ. ৮৩।

২৯ Bengal Hurkaru, 13 February 1843, মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৫।

পৃ ৬৭

৩০ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ২৭।

৩১ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২৩, HRP।

পৃ ৬৮

৩২ পরে, পৃ. ৩২৫-২৬।

৩৩ Visions of the Past, মধুসূদন রচনাবলী, ইংরেজি কবিতা সংখ্যা ৫১।

পৃ ৬৯

৩৪ পরে, পৃ. ১২৭।

৩৫ শিবনাথ শাস্ত্রী, আত্মচরিত, পৃ. ১১১।

পৃ ৭০

৩৬ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২১, HRP।

৩৭ Ibid.

পৃ ৭১

৩৮ এই দুই অধ্যাপকই বলেছেন যে, ডাট মিশনারি হবার উদ্দেশ্য নিয়েই বিশপস কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তা ছাড়া, তিনি যে-ধর্মে গভীর আস্থা স্থাপন করেছিলেন – সে সাক্ষ্যও তাঁরা দিয়েছেন। পরে বিস্তারিত আলোচান করা হয়েছে। দ্রষ্টব্য Professor A. W. Street’s Letter to Rev. Fagan, and W. U. Wither’s letter to the Bishop of Madras, SPG Papers, Rhodes Library, Oxford, C. Ind. I/13/134 and 118.

৩৯ ১৮৫৪ সালে হিন্দু কলেজের নাম বদলে প্রেসিডেন্সি কলেজ করা হয় এবং তখন থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাড়া অন্য বর্ণের হিন্দুদেরও ভর্তির ব্যবস্থা রাখা হয়। এর আগে তথাকথিত জাতহীন একটি ছাত্রকে ভর্তি করার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে হিন্দু সমাজের বিতর্ক হয়। এ সময়ে হিন্দু কলেজ সরকারী অর্থে চলতো বলে হিন্দু সমাজ সরকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারেনি।

৪০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২১, HRP।

৪১ I.O.R., Resoluion of the Education Council, 1843.

৪২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২২ ও ২৩, HRP।

৪৩ সালাহউদ্দীন আহমেদ, তাঁর গ্রন্থে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা কবেছেন। pp. 53-55.

৪৪ Unpublished Records of the Hindu College, মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৬০।

৪৫ ডিরোজিওকে কলেজ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করার সময়ে ডেভিড হেয়ার-সহ কলেজের সমস্ত পরিচালক একই যুক্তি দিয়েছিলেন।

পৃ ৭২

৪৬ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২০, HRP।

৪৭ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২১, HRP।

৪৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩০, HRP।

৪৯ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২১, HRP।

৫০ মিস্টার স্মিথ বাস করতেন ডেকার্স লেনে। তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেবার আগে অল্পদিনের জন্যে মাইকেল ওল্ড চার্চের চ্যাপলেইন মি ডনের বাড়িতেও ছিলেন। মধু-স্মৃতি, পৃ. ২৭।

পৃ ৭৩

৫১ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২৫ ও ২৬, HRP।

৫২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২৯, HRP।

৫৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২২, HRP।

পৃ ৭৪

৫৪ পত্রসংখ্যা ৭ ও ৮, HRP।

৫৫ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২১, HRP।

৫৬ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৪০।

৫৭ পরে অধ্যাপক স্ট্রীট এবং অধ্যক্ষ উইদার্সের পত্র থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত লক্ষ্য করা যাবে। পৃ. ৮৫-৮৬।

৫৮ বিশপস কলেজের ভর্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র অনুযায়ী মহেশচন্দ্র ঘোষের জন্ম ১৮১৩ সালে। তিনি এই কলেজে ভর্তি হন ১৮৩২ সালের ২৭ অগস্ট তারিখে। মারা যান ১৮৩৭ সালে। তিনি অন্যন্য বিষয়ের মধ্যে গ্রীক টেস্টামেন্ট পাঠ করেন। SPG Papers, Rhodes Library, Oxford, C. Ind. I (6) 30.

৫৯ List of old students, SPG Papers, Rhodes Library, Oxford, C. Ind. I/6/30. তাঁর ডীকন হবার তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৪৩। তিনি বিশশপস কলেজ থেকে পাস করেন ১৮৪১ সালে।

৬০ Scales of Salaries, Street to G. H. Fagan, 10.3. 1845, SPG Papers, C. Ind. I/13/87.

পৃ ৭৫

৬১ Withers to E. Hawkins, 20 Nov. 1844, SPG Papers, C. Ind. I/12/111.

৬২ A. Street to Rev. Fagan, 23 July 1847, SPG Papers, C. Ind. I/13/134. Also Withers to the Bishop of Madras, 26 Jan. 1846, C. Ind. I/12/118.

৬৩ A. Street to Rev. Fagan, 23 July 1847, SPG Papers, C. Ind. I/13/134.

৬৪ ২০ নভেম্বর তারিখে অধ্যক্ষ উইদার্স যে-চিঠি লেখেন, তাতে তিনি তাঁকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে গ্রহণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। Withers to E. Hawkins, 20 Nov. 1844, SPG Papers, C. Ind. I/12/111.

পৃ ৭৬

৬৫ G. Weildermann’s letter, SPG Papers, Rhodes Library, Oxford, C. Ind. I/13/200.

৬৬ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাত দিয়ে এ কথা তাঁর জীবনীকারেরা বললেও, এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা বিশপস কলেজের কাগজপত্রে দেখিনি।

৬৭ Charles T. Metcaff’s gift to Bishop’s College, deed dated 6 Nov. 1820, SPG Papers.

৬৮ Bill of Exchange, 14 May 1823, SPG Papers. বিশপস কলেজ সম্পর্কিত বাকি সব খবরই SPG Papers থেকে সংগৃহীত।

৬৯ ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত যেসব ছাত্রদের তালিকা আছে, তাতে বিভিন্ন এলাকার ছাত্রদের নাম দেখা যায়। তবে প্রথম দিকে বাঙালি ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি ছিলো। ১৮৩৬ সালের ছাত্র তালিকা এ রকম:
তোরাব, চণ্ডীচরণ আঢ্যি (১৯), ব্রজনাথ ঘোষ (১৮), জয়গোপাল দত্ত (১৮), দ্বারকানাথ ব্যানার্জি (১৮), গোপালচন্দ্র মিত্র (১৭), মধুসূদন শীল, বেণীমাধব মজুমদার (২০)।
এই তালিকা থেকে আরও দেখা যায় যে, আলোচ্য সময়ে ছাত্রদের সংখ্যা কখনো ২৫ জনের বেশি ছিলো না, বেশির ভাগ সময়ে ২০ জনের কম। ১৮৪৩-৪৪ সালে ছাত্রের সংখ্যা ছিলো গড়পড়তা ১৫। ৯ নভেম্বর ১৮৪৪ মাইকেল এই কলেজে ভর্তি হবার দু মাস আগে ছাত্র ছিলেন মাত্র ১১ জন। মাইকেল এবং অন্য তিনজন ছাত্র এ সময়ে ভর্তি হওয়ায় অধ্যাপকরা বেশ খুশি হয়েছিলেন। অধ্যাপক উইদার্স সে কথা লিখে জানিয়েছেন লন্ডনে। জেমস লঙ তাঁর গ্রন্থে ১৮৪৭ সালে ছাত্রদের তালিকা দিয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে কলেজে তখন ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৬-এ দাঁড়ায়। এঁদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন শ্রীলঙ্কা এবং মাদ্রাস থেকে। মাইকেল ছাড়া, শ্রীনাথ বসু, কালী নন্দী এবং সায়মন প্যারি নামে তিনজন বাঙালি ছাত্র ছিলেন।

৭০ ১৮৪৩ সালে বছরের ন মাস গড়পড়তা ছাত্র ছিলো ১৭জন। বাকি তিন মাস ১৩ জন। ১৮৪৪ সালে ছ মাস ছাত্র ছিলো ১৩ জন, তিন মাস ছিলো ১১ জন, বাকি তিন মাস যথাক্রমে ১৪, ১৬ ও ১৭ জন। স্ট্রীট এবং উইদার্স ছাড়া মাঝেমধ্যে তৃতীয় একজন অধ্যাপক ছিলেন। তা ছাড়া, দেশীয় ভাষা শেখানোর জন্যে চার/পাঁচজন শিক্ষক ছিলেন। অন্যান্য খরচ সম্পর্কে ধারণা করার জন্যে দ্রষ্টব্য: Monthly expenditure, SPG Papers, I/8/(11) 9; I/13/87.

পৃ ৭৭

৭১ Street’s letter dated 1 Feb. 1847, SPG Papers, C Ind. I/13/126.

৭২ Ibid.

৭৩ Withers to Hawkins, 20 Nov. 1844, SPG Papers, 1/12/111.

৭৪ Street to Fagan, 23 Jul. 1847, SPG Papers, C Ind. I/13/134.

পৃ ৭৮

৭৫ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২৯, HRP।

৭৬ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭২, HRP।

পৃ ৭৯

৭৭ Ibid.

৭৮ Street’s letter dated 23 Jul. 1847, SPG Papers, C Ind. I/13/134.

৭৯ MMD to Gourdas Bysack, 20 Jul. 1846, পত্রসংখ্যা ৩৪, HRP।

৮০ প্যারীচরণ সরকার এবং প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীও শিক্ষকতায় যোগদান করেন। এঁদের মধ্যে সবার আগে কলেজ ত্যাগ করেন প্যারীচরণ সরকার। মাইকেলের আর-একজন সহপাঠী এবং ভালো ছাত্র – গোবিন্দ দত্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হয়েছিলেন ১৮৪৫ সালে।

পৃ ৮১

৮১ Withers to the Bishop of Madras, 26 Jan. 1846, SPG Papers, C Ind. I/12/118.

৮২ Street’s letter dated 23 Jul. 1847, SPG Papers, C Ind. I/13/134.

৮৩ MMD to Gourdas Bysack, 20 Jul, 1846, পত্রসংখ্যা ৩৪, HRP।

৮৪ Ibid.

৮৫ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৩, HRP।

৮৬ Street to Hawkins, 16. 8. 1845, SPG Papers, C. Ind. I/13/95.

৮৭ Street to Fagan, C. Ind. I/13/134 and 137.

৮৮ Street’s letter dated 22 Nov. 1847, SPG Papers, C Ind. I/13/137.

পৃ ৮৩

৮৯ এগব্যর্ট কেনেট বিয়ে করেন ১৮৫১ সালে। তাঁর স্ত্রীর নাম ফীবি রজার্স। (See IOR, N/2/30/412). মাইকেল তাঁর কন্যার নাম দেন ফীবি রেবেকা সালফেন্ট ডাট।

৯০ মাইকেল তাঁর প্রথম কন্যার নামের সঙ্গে (ব্যৰ্থা ব্লানশ কেনেট ডাট) জুড়ে দিয়েছিলেন চার্লস কেনেটের বংশ-নাম। IOR, N/2/28/557.

৯১ Street to Fagan, C. Ind. I/13/134.

৯২ G. Weilderman’s letter, C. Ind. I/13/200.

পৃ ৮৪

৯৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৩৫, HRP।

৯৪ Street’s letter dated 22 Nov. 1847, SPG Papers, C Ind. I/13/137.

পৃ ৮৫

৯৫ Withers to the Bishop of Madras, SPG Papers, C Ind. I/12/118.

৯৬ Withers to E. Hawkins, 11 Feb. 1846, SPG Papers, C Ind. I/12/119.

পৃ ৮৬

৯৭ Street to Fagan, C. Ind. I/13/134.

পৃ ৮৭

৯৭ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, পৃ. ৬।

৯৮ Bengal Hurkaru এবং Friend of India পত্রিকার নথি থেকে এ সম্পর্কে আর-কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা, তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তাতে রাজনারায়ণের পদচ্যুতি অথবা প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও অন্যান্যের কোনো খবর আবিষ্কার করতে পারিনি। এ রকমের সিদ্ধান্ত সদর দেওয়ানি আদালতের কার্যবিবরণীতে থাকার কথা, কিন্তু ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে আগের কয়েক দশকের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ধারাবাহিক নথি থাকলেও ১৮৪০-এর দশকের নথি রক্ষিত হয়নি।

৯৯ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৬৮।

১০০ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩। যোগীন্দ্রনাথ এমনভাবে লিখেছেন যা থেকে মনে হতে পারে যে, মাইকেল মাদ্রাসে চলে যাওয়ার পর রাজনারায়ণ জাহ্নবী দেবীর কাছে পুনর্বিবাহ করার কথা বলেন। পৃ. ১৪।

১০১ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৬৮।

পৃ ৮৮

১০২ Street to Fagan, 22 November 1847, C. Ind, I/13/137. ঐ বছর ১৯ মে তারিখে মাইকেল গৌরদাস বসাককে যে-চিঠি লেখেন, তাতে ঝামেলায় অর্ধ-মৃত হবার কথা বলেছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ এর জন্যে পিতার দ্বিতীয় বিবাহকে দায়ী মনে করেছেন। আসলে অধ্যাপক স্ট্রীট বেং অধ্যাপক উইদার্সের চিঠি থেকে বোঝা যায়, এ সময়ে পিতার টাকা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মাইকেল বিপদে পড়েছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, পৃ. ১০২।

১০৩ ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, পৃ. ১০২।

১০৪ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৬৮।

১০৫ চীফ সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করার কথা একাধিক জীবনীকার উল্লেখ করেছেন। – মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩২; ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, পৃ. ১০৪।

১০৬ Street to Fagan, 22 November 1847, C. Ind. I/13/137.

1 Comment
Collapse Comments

এত লম্বা করে লিখার কি দরকার ছিল, একটা বিষয় নিয়ে এত লিখা পড়তে পড়তে পরে পড়ার আগ্রহই চলে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *