১. জননীর ক্রোড়-নীড়ে

জননীর ক্রোড়-নীড়ে

‘বন্ধু রাজ, তোমাকে আমি হলপ করে বলতে পারি, আমি দেখা দেবো একটা বিশাল ধূমকেতুর মতো – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’ – নিজের সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসুকে মাইকেল যা লিখেছিলেন, তার মধ্যে সন্দেহের সত্যি কোনো কারণ ছিলো না। তবে তাঁর এই উক্তিতে একটি ভ্রান্তি লক্ষ্য করি — তিনি যখন (জুলাই ১৮৬১) বলেছেন, তিনি ধূমকেতুর মতন দেখা দেবেন, তখন আসলে তিনি কেবল দেখা দেননি, রীতিমতো তুঙ্গে পৌঁছে গেছেন। মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড এবং বীরাঙ্গনা ছাড়া তাঁর সবগুলো গ্রন্থ ততোদিনে প্রকাশিত হয়েছে। ততোদিনে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যের বিতর্কাতীত সর্বশ্রেষ্ঠ কবি এবং নাট্যকার হিশেবে। এ প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও তিনি অবশ্য নিজেকে নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত ছিলেন না। তখনো ভাবছেন, কাব্যকলা তাঁর ঠিক আয়ত্তে আসেনি। সেজন্যে বলেছেন, ‘দেখা দেবো।’ গত দেড় শশা বছরে বাংলা সাহিত্যের আকাশে ছোটো-বড়ো অনেক তারকা দেখা দিয়েছেন। নিজের নিজের বৈশিষ্ট্যে তাঁরা সমুজ্জ্বল। কিন্তু ধূমকেতুর মতো হঠাৎ দেখা দিয়ে নাটকে, কাব্যে যুগান্তর ঘটিয়ে সবাইকে একেবার উচ্চকিত করেছিলেন একজনমাত্র — মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি যে কেবল ধূমকেতুর মতো অল্প সময়ের জন্যে দেখা দিয়েছিলেন, তাই নয়; তাঁর গতি-প্রকৃতি অন্যদের থেকে আলাদা, কক্ষপথও আলাদা। যতোক্ষণ ছিলেন, ততোক্ষণ তিনি অসাধারণ দীপ্তিতে ভাস্বর ছিলেন। চোখ-ধাঁধানো জ্যোতি দিয়ে সবাইকে চমক লাগিয়ে অচিরে তিনি হারিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব অথবা তাঁর বিস্ময়কর আবির্ভাবের কথা এতো কাল পরেও বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা ভুলতে পারেননি।

স্বসমাজের তুলনায় তিনি ছিলেন সবার থেকে আলাদা। আচার-আচরণে তাঁর ঔদ্ধত্য, সনাতন মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা, জীবন এবং সাহিত্যের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি বিদ্রোহ — সবই তাঁকে চার দিকের জনতা থেকে একেবারে আসমান-জমিন ফারাক করেছে। ছাত্রজীবন থেকে নিষিদ্ধ খাবার খেয়েছেন তিনি। নিষিদ্ধ পানীয়তে আদৌ কোনো অরুচি ছিলো না। পোশাকে-আশাকে তিনি অনুকরণ করেছেন ফিরিঙ্গিদের। পরীর মতো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে — এ খবর শুনে বন্ধুদের মতো আহ্লাদে আটখানা হননি। বরং খৃস্টান হয়েছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে। সেই যুগে দু-দুটি শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে ঘর করেছেন। ডেপুটি হওয়া যে-কালে ছিলো জীবনের চরম আকাঙ্ক্ষা, সেকালে তাঁর ধ্রুব লক্ষ্য ছিলো কবি হওয়া। যেকালে বাঙালিরা অহঙ্কারে ফেটে পড়তেন সদর দেওয়ানি আদালতের উকিল হয়ে, সেই কালে কেবল ব্যারিস্টার হবার উদ্দেশ্য নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বিলেত গেছেন। এবং সে সময়ের তুলনায় বিত্তও উপার্জন করেছেন যথেষ্ট। কিন্তু তা দিয়ে আর পাঁচ জনের মতো জমি কেনেননি। দু হাতে তা উড়িয়ে দেবার তাক-লাগানো নজির রেখে গেছেন। তিনি এমন অসাধারণ ছিলেন যে, সে সময়ের লোকেরা কেউ তাঁকে ঘৃণা করেছেন, কেউ ভালোবেসেছেন, কেউ-বা করুণা করেছেন; কিন্তু কেউ তাঁকে অস্বীকার করতে পারেননি।

মধ্য বাংলার একটি সাধারণ গ্রামের প্রথাবদ্ধ কিন্তু নব্যধনী পরিবারে তাঁর জন্ম। ছেলেবেলা থেকে মানুষ হয়েছেন কলকাতায়। লেখাপড়া শিখেছেন হিন্দু কলেজে। তাঁর চরিত্রে এসব অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য তা হলে এলো কোত্থে কে? কতোটা তিনি পেয়েছেন পরিবার থেকে? কতোটা পরিবেশ থেকে? হিন্দু কলেজে প্রথম তিরিশ বছরে কয়েক হাজার ছেলেই পড়েছিলেন! কেউ তো এমন সৃষ্টি-ছাড়া হননি! তা হলে? পরে দেখতে পাবো, কোনো একটি সূত্রের কাছে তিনি এই আদর্শ পাননি; তিনি যা হয়েছিলেন, তাও একদিনে হননি।

তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল। জেঠা রাধামোহন যশোরের সেরেস্তাদার, মেজ জেঠা মদনমোহন কুমারখালির মুন্সেফ আর। সেজ জেঠা যশোরের উকিল। পরবর্তী সোপান হিশেবে মধুসূদনের পক্ষে ব্যারিস্টার হওয়াই স্বাভাবিক ছিলো। হয়েও ছিলেন একদিন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের আর-একটা দিক ছিলো — সেই দিকটা দীর্ঘদিন অবধি আদালতের ধারেও যায়নি। ঘুরে বেড়িয়েছে আইন এবং যুক্তির জগৎ থেকে অনেক দূরে — কবিতার জগতে। তাঁর একমাত্র বাসনা মাইকেলেরসমাধিস্তম্ভে হেনরিয়েটারভুলবংশনাম,সমাধিস্থ ছিলো তিনি উকিল নন, হাকিম নন, ডেপুটি নন – কবি হবেন। এই অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা কোথায় খুঁজে পেলেন তিনি?

ব্যক্তির চরিত্রগঠনে পরিবারের প্রভাব থাকে। পরিবেশের প্রভাবও অস্বীকার করার জো নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্তও এ ব্যাপারে কোনো ব্যতিক্রম ছিলেন না। সে জন্যে, তাঁর জীবনী পুনর্গঠনে তাঁর পরিবার কেমন ছিলো এবং সেই পরিবারের আওতায় তিনি কিভাবে মানুষ হয়েছিলেন, তা দেখা দরকার। কিন্তু দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, জীবনী-লেখকের জন্যে একাজটা মোটেই সহজ নয়। কারণ তিনি যে-পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবার এতোটা শিক্ষিত অথবা ঐতিহ্যবাহী ছিলো না যে, তার সব তথ্য লিখিত থাকবে। যেমনটা ছিলো, ধরা যাক, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। মধু যে জন্মেছিলেন বঙ্গদেশের একটি অজ গ্রামে, তার ফলে এ কাজটা আরও কঠিন হয়েছে। এ রকমের পরিবেশে জন্ম তারিখটা পর্যন্ত কেউ লিখে রাখেনা। মধুর জন্ম তারিখও লেখা নেই। বস্তুত, পাড়াগাঁয়ে জন্মের সময়টা আনুমানিক মনেরাখা হতো কোনো ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে — “ঐ যে সেই বন্যার বছর”! তারপর বয়স গোনা হতো কুড়ির হিশেবে। এমন কি, পৌনে দুশো বছর পরে এখনও জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এবং অন্যান্য পারিবারিক খবর লিখে রাখার রেওয়াজ, বিশেষ করে গ্রামে, চালু হয়নি। আর এসব তথ্যাদি রাখার সরকারী আইনও হয়নি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে গবেষক নিতান্ত অসহায়। মাইকেল-জীবনেব এ দিকটা নিখুঁত অথবা পূর্ণাঙ্গভাবে পুনর্গঠন করা, সে জন্যে, খুব শক্ত, প্রায় অসম্ভব।

মাইকেলের পারিবারিক পরিচয় উদ্ধার করার কাজটা বিশেষভাবে কঠিন হবার অন্য কারণও ছিলো। তাঁর কববের ওপর যে-স্মৃতিফলক আছে, তার দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। তাঁর পৌত্ররা এই স্মৃতি-প্রস্তরের ওপর পিতামহী হেনরিয়েটার যে-পরিচয় দিয়েছেন, তা থেকেই বোঝা যায় নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে তাঁরা কতোটা অজ্ঞ ছিলেন। তাঁরা হেনরিয়েটার পুরো নাম লিখেছেন: Amelia Henrietta Sophia। তারপর বন্ধনীর মধ্যে তাঁর কুমারী বংশ-নাম লিখেছেন Dique। কিন্তু হেনরিয়েটার বংশ-নাম আদৌ ডিক ছিলো না। জন্মপত্র থেকে দেখা যাবে, তাঁর বংশনাম ছিলো হোয়াইট। তা হলে তাঁর নিজের পৌত্রদের এ ভুল করার কারণ কী?

আসলে, মাইকেল এবং হেনরিয়েটা যখন মারা যান তখন তাঁদের কন্যা শর্মিষ্ঠার বয়স ১৪ বছরও পুরো হয়নি। তিনি আবার মারা যান মাত্র উনিশ বছর বয়সে। ওদিকে, কবির মৃত্যুকালে তাঁর দুই পুত্র ফ্রেডারিক এবং নেপোলিয়নের বয়স ছিলো যথাক্রমে এগারো বছর এগারো মাস এবং ছ বছর দু মাস। এদের মধ্যে ফ্রেডারিক মারা যায় এর দু বছর পরে। কেবল বেঁচেছিলেন নেপোলিয়ন। মাইকেলের নিজের তরফে ভাই-বোন থাকতে পারতেন, কিন্তু তাঁর অনেক জ্ঞাতি থাকলেও, কোনো সহদোর ছিলেন না। যে-জ্ঞাতিরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কার্যকারণে তাঁর কোনো যোগাযোগও ছিলো না। হেনরিয়েটার তরফেও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগসূত্র লোপ পাওয়ার কারণ ছিলো। তিনি কবির জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করে। মোট কথা, মাইকেল এবং হেনরিয়েটা মারা যাবার পরে তাঁদের সন্তানদের কাছে তাঁদের পরিচয় বিশদভাবে দেবার মতো কোনো লোক ছিলেন না। কবির বন্ধুরাও এ ব্যাপারে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেননি। কারণ বন্ধুদের সঙ্গে তিনি পারিবারিক পর্যায়ে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না। তাঁর ব্যক্তিগত সুখদুঃখ অথবা কোনো গোপন তথ্য কারো সঙ্গে তিনি ভাগ করে নিতেন না। এজন্যে, তাঁর বন্ধুরা যে-সামান্য তথ্য জানতেন, তাঁর পুত্র অথবা পৌত্ররা তার চেয়ে বড়ো একটা বেশি জানতেন না। নিজেকে জাহির করতে পছন্দ করলেও, তিনি নিজে তাঁর জীবন সংক্রান্ত তথ্যাদি কাউকে দেননি। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে তাঁর বন্ধু এবং পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আত্মজীবনী লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি এদিকে মনোযোগ দেননি। একটিমাত্র ব্যতিক্রম যা লক্ষ্য করি, তা হলো: তিনি কেদারনাথ দত্ত নামে একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের অনুরোধে তাঁর জীবনের কিছু তথ্য লিখে পাঠিয়েছিলেন। এভদ্রলোক সম্ভবত জানিয়েছিলেন যে, তিনি দত্ত বংশীয়দের একটি ইতিহাস লিখছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যা তৈরি করেছিলেন, তা হলো বঙ্গদেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী দত্ত বংশীয়দের তালিকা। এতে তিনি দেখিয়েছিলেন, বঙ্গদেশে আগমনের পর থেকে দত্তদের কতোটি প্রজন্ম হয়েছে এবং তাঁরা কোথায় কোথায় বাস করছেন। নিতান্ত চটি বই। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতোটুকু সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। অপর পক্ষে, কেদারনাথ যদি দত্ত বংশের দিকে নজর না-দিয়ে কেবল কবির দিকে নজর দিতেন, তা হলে হয়তো মাইকেল-জীবনী রচনার মূল্যবান কিছু উপকরণ পাওয়া যেতো।

প্রশ্ন উঠতে পারে, পিতামহীর পরিচয় দেবার জন্যে, কবির পৌত্ররা এতো নাম থাকতে ডিক নামটি বেছে নিলেন কেন? তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাবো, হেনরিয়েটার সত্যিকার পরিচয় কবির বন্ধু অথবা সন্তানরা কেউই জানতেন না। কিন্তু হেনরিয়েটা মাদ্রাস থেকে পালিয়ে এসেছিলেন — এমন একটা গল্প তাঁদের মধ্যে চালু ছিলো। এমন কি, রাজনারায়ণ বসু সন্দেহ করেছিলেন যে, তাঁদের বিয়ে হয়নি। তাঁরা অস্পষ্টভাবে আর-একটা খবর শুনেছিলেন, সে হলো: হেনরিয়েটা মাদ্রাস স্কুলে মাইকেলের এক সহকর্মীর কন্যা। হেনরিয়েটা সম্পর্কে তৃতীয় জনশ্রুতি – তিনি ফরাসি। (রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় হলপ করে এই ভুল তথ্য পরিবেশন করেছিলেন।) সুতরাং কবির পৌত্র এবং জীবনী-লেখকরা মাদ্রাস স্কুলের শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন ফরাসি নামধারী লোক খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বিবেচনায়, এ রকমের নাম ছিলো দুটো –ডিক আর পেপিন। ডিক নামে ছিলেন দুজন শিক্ষক আর পেপিন নামে একজন। এঁরা তিনজনই কবির সঙ্গে একত্রে মাদ্রাস স্কুলে কাজ করেছিলেন। কিন্তু হেনরিয়েটা তাঁদের কারো কন্যা ছিলেন না। টমাস বেডফোর্ড পেপিন বিয়ে করেন ১৮৪৩ সালে এবং তাঁর প্রথম কন্যা মার্গারেটের জন্ম হয় ১৮৪৮ সালে — যে-বছর মাইকেল রেবেকাকে বিয়ে করেন। অপর পক্ষে, এ. ডিক এবং এল.ডিক মাদ্রাস স্কুল থেকে পাশ করে সেখানেই টিউটরের চাকরি পান। বয়সে তাঁরা দুজনই ছিলেন মাইকেলের চেয়ে ছোটো। তদুপরি, পেপিন অথবা ডিক — কেউই ফরাসি ছিলেন না। এঁদের মধ্যে একজনের — ডিকের — পরিচয় স্কুলের রেজিস্টারেই দেওয়া আছে — ঈষ্ট ইন্ডিয়ান।১০ আর টমাস বেডফোর্ড নামই প্রমাণ করে তিনি আদৌ ফরাসি নন। মাইকেলের জীবনী লেখক এবং পৌত্ররা আরও একটা কথা বিবেচনা করতে পারতেন: মাদ্রাস স্কুল ছিলো সরকারী স্কুল। সেকালে ইংরেজ এবং ফরাসিদের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সে স্কুলে কোনো ফরাসির চাকরি পাওয়ার কথা নয়। সর্বোপরি, তাঁরা লক্ষ্য করতে পারতেন যে, হেনরিয়েটা ফরাসি হলে তাঁর দ্বিতীয় নামটি হেনরিয়েটা না-হয়ে আঁরিয়েৎ হতো। বানান হতো Henriette এবং তৃতীয় নামটি সোফিয়া (অথবা সফাইয়া) না-হয়ে সোফি — Sophie — হতো।

পৌত্ররাই যদি তাঁদের পিতামহ এবং পিতামহীর পরিচয় সম্পর্কে এতো কম জানেন, তা হলে তেমন একজন কবির জীবনী লেখা কতো শক্ত কাজ, তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব। বস্তুত, যোগীন্দ্রনাথ বসু থেকে আরম্ভ করে সুবেশচন্দ্র মৈত্র পর্যন্ত যাঁরা এর আগে কবির জীবনী লিখেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন এবং, এক কথায়, অসাধ্য সাধন করেছেন। যোগীন্দ্রনাথ বসু, নগেন্দ্রনাথ সোম, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং সুরেশচন্দ্র মৈত্র প্রায় এক শো বছরের ব্যবধানে মাইকেল-জীবনের বহু অজ্ঞাত তথ্য খুঁড়ে বের করেছেন। তাঁদের কারো কৃতিত্বই তাই কম নয়। এঁরা, বিশেষ করে, যোগীন্দ্রনাথ বসু এবং নগেন্দ্রনাথ সোম মাইকেল-জীবনীর বহু তথ্য লোপ পাওয়ার আগে সেসব উদ্ধার করে লিখে না-রেখে গেলে আজ কারো পক্ষেই তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা সম্ভব হতো না।

কবির আত্মীয়রা বেঁচে থাকতে থাকতেই যোগীন্দ্রনাথ বসু তাঁর পরিবারের কিছু খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। তবে আত্মীয়দের কাছ থেকে তিনি যেসব খবর পেয়েছিলেন — যেমন মানকুমারী বসুর কাছ থেকে — তার কতোটা সত্য, কতোটা জনশ্রুতি, নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। নিজের পরিবারের কথা বলার সময়ে অতিরঞ্জন করা এবং তার ওপর গৌরবারোপ করা একটা খুব সাধারণ ব্যাপার। আবার পরিবারের কলঙ্কজনক কোনো দিক থাকলে তা গোপন করাও স্বাভাবিক প্রবণতা। ভার্জিনিয়া উলফের জীবনী লিখতে গিয়ে কুইন্টিন বেল আট বছর বয়সে ভার্জিনিয়া অন্য এক নিকটাত্মীয়ের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন — এই তথ্যের উল্লেখ করেছেন। বেল দেখিয়েছেন, ভার্জিনিয়া বড়ো হয়েও সারা জীবনে কখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি যৌনসম্পর্কিত মনোভাবে।১১ এ রকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকলে, তার বিশ্লেষণ ছাড়া, যাঁর জীবনী লেখা হচ্ছে তাঁর অন্তর্জীবনের পরিচয় দেওয়া সহজ হয় না। অথচ পরিবার অথবা নিকটাত্মীয় ছাড়া এমন তথ্য দেবে কে? এ সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে এ রকমের তথ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব, কিন্তু গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বঙ্গদেশে অথবা ভারতবর্ষে বেল কি এমন তথ্য খুঁজে পেতেন? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার ঘটনা সে সময়কার একটা বড়ো রহস্য। আর ঠাকুর পরিবারও ছিলো কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বিদগ্ধ পরিবার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ঘটনার নেপথ্য কাহিনী জনগণের কাছে আজও প্রায় অজ্ঞাত।১২ মানকুমারী বসু অথবা অন্যান্য আত্মীয়ের কাছ থেকে যোগীন্দ্রনাথ যেসব তথ্য পেয়েছিলেন, নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে তিনি সেসব মিলিয়ে নেননি। সত্যি বলতে কি, তেমন কোনো সূত্র হয়তো ছিলোও না। বালক অথবা কিশোর মধুকে দেখেছিলেন, এমন কারো পক্ষে ১৮৯২-৯৩ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকা খুব স্বাভাবিকও নয়।

যোগীন্দ্রনাথের সিকি-শতাব্দী পরে নগেন্দ্রনাথ সোম যখন তথ্য জোগাড় করতে চেষ্টা করেন, ততোদিনে তথ্যের সঙ্গে কিংবদন্তী আরও বেশি পরিমাণে মিশে গেছে। তবু এই দুজনের সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই বর্তমানে মাইকেলের পারিবারিক ইতিহাস লিখতে হবে। সে জন্যে, এর গুরুত্ব সত্ত্বেও, এই ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ না হবারই সম্ভাবনা।

*

মধুসূদনের প্রপিতামহ রামকিশোর দত্ত বাসিন্দা ছিলেন সেকালের যশোর জেলার, একালের খুলনার। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর তিন ছেলে — রামনিধি, দয়ারাম এবং মানিকরাম এসে স্থায়ীভাবে বাস করতে আরম্ভ করেন মাতামহের গ্রাম — যশোরের সাগরদাঁড়িতে। তাঁরা সেখানে কেন ঘর বাঁধলেন, আমাদের জানা নেই। পিতৃহীন বালকদের দারিদ্র্যই সম্ভবত এর কারণ। তবে সাগরদাঁড়িতে এসেও রামনিধি তাঁর অবস্থা ভালো করতে পারেননি। তাঁর কুলগত বৃত্তি কী ছিলো, তাও অজ্ঞাত। কিন্তু কায়স্থদের ঐতিহ্য রক্ষা করে তিনি তাঁর সন্তানদের খানিকটা লেখাপড়া শেখাতে চেষ্টা করেন। বড়ো ছেলে — রাধামোহনকে তিনি সেকালের আইন-আদালতের ভাষা — ফারসি শিখিয়েছিলেন। শিক্ষা লাভ করে রাধামোহন অবশ্য গ্রামের বাড়িতেই, আপাতদৃষ্টিতে আলসেমি করে, কালক্ষেপ করছিলেন। তারপর একদিন পিতার ভর্তসনা রাগ করে জীবিকার অন্বেষণে চলে যান যশোরে। সেখানে অল্পকালের মধ্যেই তাঁর ভাগ্য খুলে যায়। ফারসি ভাষায় তাঁর জ্ঞানের জন্যে তিনি আদালতে চাকরি পান এবং ধীরে ধীরে সেরেস্তাদার পদে উন্নীত হন।

রাধামোহনকে দিয়েই বস্তৃত দত্ত পরিবার সৌভাগ্যের সূচনা। তাঁর ছোটো তিন ভাইকে তিনি যশোরে নিয়ে আসেন এবং সেখানে তাঁদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। এই তিন ভাইও তাঁর মতো ভালো করে ফারসি শেখেন এবং তার দৌলতেই টাকাপয়সার মুখ দেখেন। মেজভাই মদনমোহন প্রথমে যশোরের মীর-মুন্সী হন। পরে উন্নতি করে হযেছিলেন কুমারখালির মুন্সেফ। সেজভাই দেবীপ্রসাদ লেখাপড়ায় আরও এগিয়ে গিয়ে যশোবে উকিল হন। আর চার ভাই-এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটো — কবিব পিতা — রাজনারায়ণ লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। তিনি ফারসি খুব ভালো শিখেছিলেন। ফারসি ভাষায় তাঁর এই পারদর্শিতার জন্যে তাঁকে নাকি সবাই বলতো মুন্সী রাজনারায়ণ।১৩ তাঁর এই মুন্সী পদবী কতোটা সুপরিচিত অথবা এর গুরুত্ব কতোটা ছিলো, সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। কারণ, এ পদবী যদি কেবল তাঁর বন্ধু অথবা পরিচিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে থাকে, তা হলে এ দিয়ে ফারসি-জানা লোক ছাড়া তেমন কিছু বোঝায় না। তদুপরি, কলকাতায় তখন মুন্সী রাজনারায়ণ নামে আর-একজন লোক ছিলেন। তিনি ১৮৩০ সালের শেষ দিকে অবোধ বৈদ্যবোধোদয় নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং সমাচার চন্দ্রিকায় তার সমীক্ষা প্রকাশিত হয়।১৪ মাইকেলের জীবনী-লেখকরা পরে এই মুন্সী রাজনারায়ণের সঙ্গে রাজনারায়ণ দত্তকে এক করে ফেলেছিলেন কিনা, জানার উপায় নেই। শোনা যায়, নিজের বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে তাঁর নিজেরও বেশ অহংকার ছিলো। ছোটো ভাই হিশেবে সবার আদর পেয়ে তিনি খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল হয়েছিলেন বলেও জানা যায়। পরে দেখা যাবে, তাঁর পুত্র তাঁর কাছ থেকে এই দুটো গুণই উত্তরাধিকার সূত্রে যথেষ্ট পরিমাণে পেয়েছিলেন।

উকিল হয়ে দেবীপ্রসাদের তুলনায় রাজনারায়ণ আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে যান। যশোরে কাজ না-করে তিনি যান কলকাতায়। সেকালে নিজের গ্রাম অথবা এলাকা ছেড়ে কেউ সাধারণত দূরে কোথাও যেতেন না। অন্য কোথাও গিয়ে ভাগ্য ফেরানোর জন্যে যে-উদ্যোগ এবং সাহস দরকার, তা কম লোকেরই ছিলো। গ্রাম ছেড়ে জিলা সদরে এসে রাধামোহন নিজের এবং পরিবারের উন্নতির পথ অবারিত করেছিলেন। অপর পক্ষে, রাজনারায়ণ যেহেতু যশোবেই তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন, সে কারণে তিনি আর-একটু সাহস এবং উদ্যোগ নিয়ে কলকাতার পথে পা বাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন। কথিত আছে, তিনিও নাকি বড়ো ভাই-এর মতো পরিবারের ওপর রাগ করে অজানা এবং অনিশ্চিত কলকাতার দিকে যাত্রা করেছিলেন। তাঁর কলকাতায় আসার অব্যবহিত কারণ যাই হোক না কেন, তিনি উদ্যোগী, উদ্যমী এবং কৌতুহলী পুরুষ ছিলেন নিঃসন্দেহে। অপরিচিত জায়গায় গিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার মতো দুঃসাহসও তাঁর ছিলো। মাইকেলের চরিত্রেও এই বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ্য করবো।

দত্ত পরিবারের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এক কথায় বলতে পারি — এক পুরুষের মধ্যে এই পরিবার বিদ্যা এবং উদ্যোগকে মূলধন হিশেবে ব্যবহার করে সেকালের তুলনায় প্রচুর বিত্ত উপার্জন করেছিলো। এবং সেই বিত্ত দিয়ে জমিদারি কিনে দ্রুত আবার “বাবু”তে পরিণত হয়েছিলো। জমিদার না-হওয়া পর্যন্ত সে যুগে সমাজের চোখে সত্যিকার মর্যাদা লাভ করা সহজ হতো না। তা ছাড়া, জমানো টাকা জমিতে খাটানো তখন সবচেয়ে বিচক্ষণ এবং নিরাপদ কাজ বলে গণ্য হতো। রাতারাতি ধনী হয়ে এ পরিবার একদিকে জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িঘর, পূজা-মণ্ডপ ইত্যাদি তৈরি করেছিলো। অন্য দিকে চালু করেছিলো আড়ম্বরের সঙ্গে পূজা-পার্বণ উদ্‌যাপন করার রীতি। মোট কথা, সাধারণ মানুষের চোখে বড়োলোক বলে পরিচিত হবার মতো চিরকেলে ক্রিয়াকলাপ এঁরা বেশ ঘটা করেই পালন করতেন। এই পরিবারের জাঁকজমক এবং অমিতব্যয়ের দৃষ্টান্ত হিশেবে যোগীন্দ্রনাথ যে-ঘটনার উল্লেখ করেছেন, সত্য হলে, তাকে খুব জুতসই বলে বিবেচনা করতে হবে। রাধামোহন তাঁর পুত্রের কল্যাণের উদ্দেশ্যে একবার ১০৮টি কালী পুজো করেন এবং তাতে ১০৮টি মোষ, ১০৮টি ছাগল এবং ১০৮টি ভেড়া বলি দেওযা হয়। আর অঞ্জলি দেওয়া হয় ১০৮টি সোনার তৈরি জবা ফুল।১৫ এই পুজোয় অন্য আনুষঙ্গিক যেসব ব্যয় হয়েছিলো, তাও এই প্রসঙ্গে অনুমান করা যেতে পারে। রাজনারায়ণ দত্তের পিতা গরিব ছিলেন। নব্য ধনী এবং নব্য জমিদার হয়ে রাজনারায়ণ এবং তাঁর ভাই-এরা আর কী কী গুণের অধিকারী হয়েছিলেন, জানা নেই, কিন্তু রাজনারায়ণসহ সে পরিবারের সব সদস্যের চরিত্রে বেহিশেবি ব্যয়ের মধ্য দিয়ে অন্যদের চমক লাগানোর একটা মনোভাব অভ্রান্তভাবে তৈরি হয়েছিলো। মধুও তাঁর চরিত্রে এই বৈশিষ্ট্য পুরো মাত্রায় লাভ করেছিলেন। সে জন্যে এক মোহর দিয়ে চুল ছাঁটিয়ে তিনি নিজে যতো না খুশি হতেন, তার চেয়ে অন্যদের বিস্মিত করতেন বেশি।

প্রসঙ্গত, রাজনারায়ণের আয় কেমন ছিলো, সে বিষয়ে একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র মামলা করে যে-সম্পত্তি উদ্ধার করেন, তা থেকে তাঁর মোট বিষয়-আশয় এবং আয় সম্পর্কে একটা ধারণা করা সম্ভব। মাইকেল পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করেছিলেন সাত হাজার টাকায়। ১৮৩০-এর দশকের একেবারে গোড়ার দিকে রাজনারায়ণ এ বাড়ি নিশ্চয় এর চেয়ে বেশি দামে কেনেননি। এ ছাড়া, সুন্দরবন অঞ্চলের জমিদারি কবি বিক্রি করেছিলেন ২০ হাজার টাকায়। মায়ের অলংকার তিনি পুরো উদ্ধার করতে পারেননি। তবে এই বাবদে মোট ১৩০০ টাকা ডিকরি পেয়েছিলেন। তার অর্থ সব মিলে কমবেশি ৩০/৩৫ হাজার টাকার সম্পত্তি রেখে রাজনারায়ণ মারা গিয়েছিলেন। শেষ দিকে তাঁর আয় ছিলো না। মনে হয়, সবচেয়ে ভালো সময়ে তাঁর সম্পত্তির দাম ছিলো মোটামুটি ৪০ হাজার। সেকালের কলকাতায় এর চেয়ে শতগুণে ধনী ছিলেন অনেকে। রাজনারায়ণ তাঁর বাড়ি কেনার মাত্র কয়েক বছর আগে কলকাতার এক বাবু নিকি নামে একটি বাইজি কিনেছিলেন এক লাখ টাকা দিয়ে। তা ছাড়া, তাকে মাসে তিনি বেতন দিতেন এক হাজার টাকা।১৬রামদুলাল দে মায়ের শ্রাদ্ধে ব্যয় করেছিলেন এক লাখ টাকা।১৭ মোট কথা, কলকাতায় লাখপতির অভাব ছিলো না। রাজনারায়ণ দত্তের সমসাময়িক উকিল প্রসন্নকুমার ঠাকুরের আয় তাঁর চেয়ে কতো বেশি ছিলো এই প্রসঙ্গে তাও মনে করা যেতে পারে। তাঁর উইল থেকে দেখা যায় তাঁর বার্ষিক আয় ছিলো অন্তত আড়াই লাখ টাকা। এবং তিনি তাতে বলেছেন যে, তাঁর এই আয় আরও বৃদ্ধি পাচ্ছিল।১৮

রাজনারায়ণ কতো বড়ো উকিল ছিলেন, সে বিষয়ে যে-জনশ্রুতি চালু আছে, তাও বাস্তবের তুলনায় অনেকটা অতিরঞ্জিত। আসলে, তাঁর পুত্র যেহেতু অমন বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেজন্যে তাঁর পরিচয়কেও বাড়িয়ে দেওয়ার একটা মানসিকতা জীবনী-লেখক এবং কবির ভক্তদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কয়েকটি তথ্য থেকে আমাদের বক্তব্য বোঝা যাবে। উনিশ শতকের ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে, রাজনারায়ণ ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গলদের সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভায পঠিত ইংরেজিতে লেখা একটি প্রবন্ধও তিনি উদ্ধৃত করেছেন।১৯ কিন্তু রাজনারায়ণ আদৌ ইংরেজি জানতেন না। গৌতম চট্টোপাধ্যায় যে-রাজনারায়ণ দত্তের প্রবন্ধ উদ্ধার করেছেন, তা হিন্দু কলেজে পড়া অন্য-একজন রাজরানায়ণের। ১৮৩৪ সালের ৭ মার্চ তারিখে কলকাতার টাউন হলে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের পুরস্কার-বিতরণী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় যাঁরা আবৃত্তিতে অংশ নেন, তাঁদের মধ্যে এই রাজনারায়ণ দত্তও ছিলেন।২০ বলা বাহুল্য তিনি মধুসূদন দত্তের পিতা রাজনারায়ণ নন। গৌতম চট্টোপাধ্যায় আসলে হিন্দু কলেজে পড়া এই রাজনারায়ণের নাম উল্লেখ করেছেন। ইনি জ্ঞানোপার্জিকা সভার সদস্য ছিলেন। যে-সভায় তিনি আবৃত্তিতে অংশ নিয়েছিলেন, সেখানে আর-একজন আবৃত্তিকার হাজির ছিলেন, তাঁর নাম মধুসূদন দত্ত। তিনিও মাইকেল মধুসূদন নন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে মাইকেল বলে বিবেচনা করেছিলেন।২১ মাইকেলের কোনো কোনো জীবনীকার বলেছেন যে, রাজনারায়ণ উকিল হিশেবে প্রসন্নকুমার ঠাকুর অথবা রমাপ্রসাদ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।২২ কিন্তু কলকাতার শিক্ষিত সমাজে উকিল হিশেবে প্রসন্নকুমার অথবা রমাপ্রসাদের যে-প্রতিষ্ঠা ছিলো, রাজনারায়ণের তার এক অংশও ছিলো বলে সমসাময়িক পত্রপত্রিকা অথবা অন্য কোনো সূত্র থেকে জানা যায়না। বরংব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ প্রভাকর থেকে যে-তথ্য উদ্ধার করেছেন, তা উল্টোটাই প্রমাণ করে। ১৮৪৮ সালের ১২ই এপ্রিলের সংখ্যায় বলা হয়েছে:

পৌষ [১২৫৪]:- সদর আদালতের জজেরা খাস আপীলঘটিত মোকদ্দমায় উকিল বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুরকে সৰ্বশ্রেষ্ঠ, অপিচ গোলাম সরদার এবং রমাপ্রসাদ রায় বাবুকে শ্রেষ্ঠরূপে গণ্য করিয়াছেন। পরন্তু রাজনারায়ণ দত্ত প্রভৃতি কএকজনকে অযোগ্য বলিযা পদচ্যুত করিলেন।২৩

রাজনারায়ণ এই ঘটনার আগে আদালতের কোনো বিশেষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন কিনা, জানা যাচ্ছে না; তবে তাঁর সুনাম যে নষ্ট হয়েছিলো, এ খবর থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

ঠাকুর পরিবার কলকাতার বিখ্যাত পরিবার। সেই পরিবারের সদস্য হিশেবে সমাজে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের, অথবা রামমোহন রায়ের সন্তান হিশেবে রমাপ্রসাদের বাড়তি প্রতিষ্ঠা এবং সুনাম ছিলো — এটা জানা কথা। এরকম অভিজাত ব্যক্তি কলকাতার সমাজে কম ছিলেন না। অপর পক্ষে, রাজনারায়ণ এসেছিলেন যশোরের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থেকে এবং তিনি ছিলেন এক পুরুষের শিক্ষিত ও ধনী। তাঁর এই পটভূমি তাঁকে আরও বেকায়দায় ফেলেছিলো। তদুপরি, বৈদগ্ধ্য, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক প্রতিপত্তির দিক দিয়েও এঁদের সঙ্গে রাজনারায়ণের যোজন যোজন তফাত ছিলো। সেকালের বঙ্গদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা নিয়ে যখন আলোচনা হতো অথবা যখন সমাজ সংস্কারের আন্দোলন হতো, তাতে রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ রায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রমাপ্রসাদ রায়, সত্যচরণ ঘোষাল, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, তারাচরণ চক্রবর্তী এবং রামগোপাল ঘোষের মতো লোকের ডাক পড়তো, রাজনারায়ণ সে ক্ষেত্রে থাকতেন অনেক পিছিয়ে। কলকাতার সমাজে কারা পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন, সে সম্পর্কে আর-একটা ধারণা করা যায় কলকাতার জুরিদের তালিকা থেকে। গ্র্যান্ড এবং পেটি জুরিদের সংখ্যা ছিলো দু হাজাবেও বেশি। এই তালিকায় কলকাতার জানা-অজানা বহু লোকের নাম আছে। হিন্দু কলেজে মধুর যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, আদালতের উকিল (প্রসন্নকুমার ঠাকুর ইত্যাদি), জমিদার, গণ্যমান্য অন্যান্য লোক — অনেকের নামই সেখানে আছে, এমন কি, ১৮৪৭ সাল নাগাদ তাতে গৌরদাস বসাক-সহ মধুসূদনের কোনো কোনো সহপাঠীর নামও অন্তর্ভুক্ত হয়, তিনি রাজনারায়ণের নাম কখনো আসেনি।২৪ আমরা এ দিয়ে রাজনারায়ণকে ছোটো করতে চাইছিনে, বরং এটাই বোঝাতে চাই যে, মধুসূদন যা হয়েছিলেন, নিজের প্রতিভা বলেই হয়েছিলেন এবং একজন বিখ্যাত লোকের পিতাকেও বিখ্যাত হতে হবে — এমন কোনো কথা নেই।

রাজনারায়ণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি সৌন্দর্যের পূজারী ছিলেন এবং কারও মধ্যে সংগীত অথবা অন্য কোনো শিল্পগুণ দেখতে পেলে তার স্বীকৃতি দিতেন। সুনির্দিষ্ট করে এও বলা হয়েছে যে, আগমনী এবং বিজয়ার গান অথবা সখীসংবাদ শুনে তিনি মুগ্ধ হতেন এবং গায়কদের দান করতেন দরাজ হাতে। পিতার কাছ থেকে মধু এই গুণটি পুরোপুরি পেয়েছিলেন। মধুর মধ্যেও এই রকমের সৌন্দর্যপ্রিয়তা এবং বদান্যতা লক্ষ্য করি। রাজনারায়ণ ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং অসংযমী ছিলেন এমন কথাও জীবনী-লেখকরা উল্লেখ করেছেন।২৫ কিন্তু কী অর্থে তিনি ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং অসংযমী ছিলেন, সে কথা বলা হয়নি। তবে ইঙ্গিতটা সম্ভবত যৌনতা এবং নৈতিকতার প্রতি। তখনকার বঙ্গদেশে শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এই অসংযম কোনো অসাধারণ বিষয় নয়। বিশেষ করে কলকাতা, কৃষ্ণনগর, যশোর ইত্যাদি শহরের এ বিষয়ে নাম ছিলো।

সে সময়ের যশোহর নগরের বিষয়ে এরূপ শুনিয়াছি যে, আদালতের আমলা, মোক্তার প্রভৃতি পদস্থ ব্যক্তিগণ কোনও নবাগত ভদ্রলোকের নিকটে পরস্পরকে পরিচিত করিয়া দিবার সময়ে — “ইনি ইহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকা বাড়ী করিয়া দিয়াছেন,” বলিয়া পরিচিত করিতেন। রক্ষিতা স্ত্রীলোরে পাকা বাড়ী করিয়া দেওয়া একটা মানসম্ভ্রমের কারণ ছিল।২৬

এই যশোরেই ওকালতি আরম্ভ করেন রাজনারায়ণ। সুতরাং তাঁর পেশাদার বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি যদি রক্ষিতা রেখে থাকেন, তা হলে অবাক হবার কারণ নেই। কিন্তু এই সুস্বীকৃত প্রথা বাকা সত্ত্বেও তাঁকে কেন ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং অসংযমী বলে নিন্দা করা হয়, সেটাই বরংবিস্ময়ের কারণ বলে বিবেচিত হতে পারে। তা হলে এব্যাপারে তিনি কি অন্য পাঁচজনকে টেক্কা মেরে অনেকটা দূরে এগিয়ে গিয়েছিলেন? কোনো রোগের কারণেই কি ১৮২৭/২৮ সালের পর নিতান্ত যুবা বয়সে তাঁর ঔরসে আর কোনো সন্তান জন্মেনি? আজ তথ্যের অভাবে এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যে রীতিমতো ভোগী ছিলেন, তাঁর জীবনযাত্রার যে-সামান্য আভাস পাওয়া যায়, তা থেকে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই দিকটা বেশ লক্ষ্য করা যায় তাঁর পুত্রের চরিত্রেও। মধুসূদনের কবি হবার এবং যশ লাক্সে আকাঙ্ক্ষার কথা যেমন সবার জানা আছে, তেমনি জানা আছে তার বস্তুগত ভোগের বাসনার কথা।

রাজনারায়ণের কখন জন্ম হয় সে সম্পর্কে কোনো উল্লেখ দেখা যায় না। কিন্তু অনুমান করি, ১৮০০ সালের আগে নয়। সেকালের রীতি অনুযায়ী তীরবয়স বছর বিশেক হবার আগেই তাঁকে নিশ্চয় বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিলো। আর তাঁর প্রথম সন্তান মধুর জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। (এই তারিখ অবশ্য আনুমানিক, যদিও বিয়ের সময়ে অথবা বিশপস কলেজে ভর্তির সময়ে কবি যে-বয়স লিখিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এর হুবহু মিল না-থাকলেও, সঙ্গতি আছে।২৭) এই হিশেবে রাজনারায়ণের স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর জন্ম ১৮০৭/৮ সালের আগে হয়েছিলো বলে মনে হয় না। জাহ্নবী দেবীর পিতা ছিলেন যশোরের আর-একটি গ্রাম — কাটিপাড়ার জমিদার। মামা-বাড়ির সঙ্গে মধুর কোনো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো অথবা তাঁদের কোনো প্রভাব তাঁর চরিত্রে বিশেষভাবে পড়েছিলো — এমন কথা জীবনী-লেখকরা উল্লেখ করেননি। কিন্তু মধু তাঁর মায়ের চরিত্রের কোনো কোনো বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবেই পেয়েছিলেন।

বাঙালি সব মা-ই স্নেহপ্রবণ; তবে জাহ্নবী দেবী বোধ হয় একটু বেশি মাত্রায় এই গুণটার অধিকারী ছিলেন। শুধু নিজের সন্তানদের নয়, অন্যদেরও তিনি সহজে আপন করে নিতে পারতেন। কলকাতায় তিনি পড়শি হিশেবে পেয়েছিলেন বর্ধমানের একটি পরিবারকে। এই পরিবারের কর্তার নাম রামকমল মুখোপাধ্যায়। এঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিলো না। কিন্তু তিনটি ভাগ্নে তাঁর সেই অভাব ভালো মতো পূরণ করেছিলেন। এই তিন ভাগ্নের মধ্যে একজন ছিলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় — পরে যিনি কবি হিশেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বড়ো ভাই গণেশচন্দ্রও একাধিক কাব্য প্রকাশ করেছিলেন। এই তিন ভাগ্নেই মধুর মাকে মা বলে ডাকতেন। সেকালে ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থের মধ্যে পার্থক্য ছিলো প্রায় দুস্তর, এমন কি, ঘটি এবং বাঙালের মধ্যেও ব্যবধান কম ছিলো না। ভাষার পার্থক্যটা লক্ষ্য করা যেতো সবার আগে। তারপর পারিবারিক পর্যায়ে মিশতে গেলে আচার-আচরণ এবং রান্নবান্নাতেও স্বাতন্ত্র্য দেখা দিতো। তা সত্ত্বেও, সেই যুগে তিনটি কুলীন ব্রাহ্মণ সন্তান একজন কায়স্থ রমণীকে মা ডাকতেন – এটা সেই মহিলার অন্যকে আপন করার অসাধারণ ক্ষমতা প্রমাণ করে। মধুও মায়ের কাছ থেকে প্রচুর আন্তরিকতা লাভ করেছিলেন। তিনি সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন না। কিন্তু যাঁদের সঙ্গে মিশতেন, তাঁদের জন্যে যে-কোনো রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে তৈরি থাকতেন।

জাহ্নবী দেবীর ছিলো আর-একটি অসাধারণ গুণ। সে যুগে স্ত্রীশিক্ষাকে বৈধব্যের প্রতীক বলে মনে করা হতো। এমন কি, মহিলারা নিজেরাও তাকে মনে করতেন মহা-অনিষ্টের আকর হিশেবে।২৮ তা সত্ত্বেও, তিনি সেই শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মধুকে তিনি রামায়ণ, মহাভারত, কবিকঙ্কণ চণ্ডী এবং অন্নদামঙ্গল পড়ে শোনাতেন বলে কবির জীবনী-লেখকরা উল্লেখ করেছেন।২৯ এর মধ্যে অবশ্য অতিরঞ্জন থাকা সম্ভব। কিন্তু, তা সত্ত্বেও বোঝা যায়, তিনি লেখাপড়া জানতেন এবং পুত্রকে ছেলেবেলায় লেখাপড়ায় সাহায্য করেছেন; আর সেই সঙ্গে তাঁকে উৎসাহিত করেছেন রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পড়তে। তাঁর ভালো স্মরণশক্তি ছিলো এবং তিনি এসব কাব্য থেকে অনেকটা মুখস্থ বলতে পারতেন। মায়ের এই আবৃত্তি করার ক্ষমতা পুত্রের মনে কবিতার প্রথম স্বাদ দিয়েছিলো। মধু বালক বয়স থেকে কেবল কবিতা পড়তে ভালোবাসতেন না, তিনি কবিতা মুখস্থ করে ফেলতেন। পরিণত বয়সে তিনি যখন দাবি করতেন যে, তিনি বাংলা ভুলে গেছেন, তখনো স্বদেশ এবং বিদেশ থেকে চিঠি লেখার সময়ে পুরোনো বাংলা কবিতার পঙক্তি উদ্ধৃত করতেন। এ থেকে বোঝা যায়, ছোটোবেলায় শোনা কবিতা তাঁর মনের কতো গভীরে শিকড় গেড়েছিলো।

মধুর জন্মেব চার বছরের মধ্যে জাহ্নবী দেবীর আরও দুটি ছেলে হয়েছিলো — প্রসন্নকুমার এবং মহেন্দ্রনারায়ণ। প্রসন্নকুমার মারা যায় এক বছর বয়সে। আর মহেন্দ্রনারায়ণ পাঁচ বছরের সময়ে। এ ছাড়া, জাহ্নবী দেবীর আর কোনো সন্তান হয়নি। একমাত্র জীবিত সন্তান হিশেবে মধু মানুষ হন আলালের ঘরের দুলালের মতো। তা ছাড়া, চার ভাই-এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটো এবং সবচেয়ে শিক্ষিত ভাই-এর একমাত্র পুত্র হিশেবেও বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে তিনি একটু বেশি যত্ন এবং প্রশ্রয় পেয়েছিলেন। পরে কবিব চরিত্রে বেহিশেবী ব্যয়, জেদ, নিজের খুশি মতো চলা, অন্যদের তুলনায় নিজেকে বড় মনে করা ইত্যাদি যেসব মনোভাব দেখতে পাই, তার অনেকটা তিনি পরিবারের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত আদর এবং আশকারা লাভের ফলে আয়ত্ত করেছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে।

মধু যেমন তাঁর বাবা-মার অন্তহীন ভালোবাসা পেযেছিলেন, তেমনি তিনিও তাঁর বাবা-মাকে খুব ভালোবাসতেন বলে বোঝা যায়। ছেলেবেলায় বাবাকে নিয়ে মধুর গর্বের সীমা ছিলো না। তাঁর বিখ্যাত উক্তি — রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে টাকা গুণে খরচ করে না — কেবল তাঁর নিজের অহমিকা প্রকাশ করে না; এর মধ্য দিয়ে পিতাকে নিয়ে গর্ব করার মনোভাবও স্পষ্ট। অবশ্য বাবা-মা তাঁকে যে তাঁদের ডানার নিচে আটকে রাখতে চেয়েছিলেন, যৌবনে পৌছে মধু তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে রীতিমতো প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তাঁর রুচি এবং লক্ষ্যের সঙ্গে বাবা-মার প্রত্যাশার মিলন হয়নি। সে কারণেতাঁকে সেই অল্প বয়সেই স্বশাসনের জন্যে বিদ্রোহ করতে হয়েছে। আমার ধারণা, এ ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে নয়, বাবার সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ বেশি করে দেখা দেয়। পিতা এটা বুঝতে চাইছিলেন না যে, মধু বড়ো হচ্ছেন এবং তাঁর মধ্যে একটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে। আমরা পরে দেখতে পাবো,এরকম একটা পর্যায়ে মধু খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে পরিবারের বাঁধন স্থায়ীভাবে কেটে ফেলেছিলেন। একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ তিনি খৃস্টান হয়েছিলেন, ঠিকই; কিন্তু বাবা-মার বিরুদ্ধে তাঁর অসন্তোষ এবং তাঁদের শাসন থেকে বেরিয়ে আসার বাসনা তাঁর মধ্যে দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছিলো অনেক আগে থেকেই।

রাজনারায়ণ ঠিক কখন কলকাতায় এসে ওকালতি শুরু করেন, জীবনীকারদের রচনা থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। সবচেয়ে পুরোনো জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথের মতে রাজনারায়ণ কলকাতায় আসেন মধু যখন সাত বছরের — অর্থাৎ ১৮৩১ সালে।৩০ আর সবচেয়ে সাম্প্রতিক জীবনীকার সুরেশচন্দ্র মৈত্রের মতে মধুর বয়স যখন পাঁচ-ছ বছর — অর্থাৎ ১৮২৯-৩০ সালে৩১ (এ মতের সপক্ষে তিনি অবশ্য কোনো তথ্য দিতে পারেননি। কিন্তু কলকাতায় ওকালতি করলেও, সেকালের রীতি এবং লোকাচার অনুযায়ী৩২ রাজনারায়ণ তাঁর স্ত্রী এবং দুসন্তানকে রেখে আসেন গ্রামের বাড়ি — সাগরদাঁড়িতে। উকিল হিশেবে তিনি প্রথম থেকে বেশ পসার লাভ করেছিলেন। কিছুকাল ওকালতি করার পরে তিনি খিদিরপুরে একটি বাড়ি কেনেন। খিদিরপুর তখন ছিলো নিতান্তই শহরতলী। খবু সম্ভব পাকা রাস্তা হয়নি। সেখানে বাড়ির দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কমই হওয়ার কথা। তবু এ থেকে ওকালতিতে তাঁর মোটামুটি ভালো আয়ের আভাস পাওয়া যায়।

নিজে কলকাতায় আসার কতোদিন পরে তিনি তাঁর পরিবার কলকাতায় নিয়ে আসেন, তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে পরিবার কলকাতায় নিয়ে আসার ঘটনাটাকে জীবনী-লেখকরা যতোটা এগিয়ে এনেছেন, তা সঠিক না-ও হতে পারে। নিশ্চিতভাবে যা জানা যাচ্ছে তা হলো: মধু কলকাতায় আসেন তাঁর ছোটো ভাই মহেন্দ্রনারায়ণ মারা যাবার পরে। যোগীন্দ্রনাথের বর্ণনা অনুযায়ী মহেন্দ্রনারায়ণ মধুর চেয়ে চার বছরের ছোটো এবং তার মৃত্যু হয় তার বয়স যখন পাঁচ বছর।৩৩ এ হিশেব ঠিক হলে, জাহ্নবী দেবী তাঁর পুত্রকে নিয়ে ১৮৩৩-৩৪ সালের আগে কলকাতায় আসেননি। এই প্রসঙ্গে আরও মনে রাখা দাকার যে, কলকাতায় আসার আগেই মধু সাগরদাঁড়িতে ফারসি শিখেছিলেন। একান্নবর্তিতা কাটিয়ে সেকালে নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে যাওয়া কারো পক্ষে সহজ ছিলো না। হয়তো রাজনারায়ণও আরও অনেক দিন তাঁর পরিবার কলকাতায় আনতে সমর্থ হতেন না। কিন্তু পর পর তাঁর দুটি সন্তান অকালে মারা যায় এবং কলকাতায় তিনি বড়ো বাড়ি কেনেন — এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের গণ্ডী থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। মধু বড়ো হচ্ছেন এবং তাঁকে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া প্রযোজন, এ যুক্তিও সম্ভবত রাজনারায়ণকে এ ব্যাপারে ওকালতি করতে সহায়তা করে থাকবে।

কলকাতায় আসার আগে পর্যন্ত মধু লেখাপড়া শিখেছিলেন গ্রামের পাঠশালায়। তা ছাড়া, বাড়িতে মা এবং অন্যান্য আত্মীয়ের কাছ থেকেও তিনি সাহায্য এবং অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি সে সময়ে লেখাপড়ায় খুব উৎসাহী এবং মনোযোগী ছিলেন — যোগীন্দ্রনাথ এবং নগেন্দ্রনাথ উভয়ই তা বলেছেন।৩৪ তখন থেকে কবিতা পড়া এবং মুখস্থ করায় তাঁর আগ্রহ লক্ষ্য করা যেতো। আট-দশ বছর বয়স থেকে তিনি তাঁর মা এবং বাড়ির অন্য মহিলাদের এসব কাব্য থেকে পড়ে শোনাতেন। এভাবে বিশেষ করে রামায়ণ আর মহাভারতের দিকে এবং সাধারণভাবে কাব্যের দিকে তাঁর যে- আন্তরিক আকর্ষণ তৈরি হয়, সারাজীবনের শত ঝড়ঝাপটার মধ্যেও তা মান হয়নি। বঙ্গদেশ থেকে অনেক দূরে মাদ্রাসে অথবা আরও দূরে ভার্সাইতে তিনি যখন নির্বাসিত, তখনো তাঁর মানসপট থেকে রামায়ণ-মহাভারতের নস্টালজিক স্মৃতি মুছে যায়নি।

তাঁর পিতা এবং জেঠারা ফারসি ভাষা-জ্ঞানের ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে ভালো করেই সচেতন হয়েছিলেন। সে জন্যেই, তাঁদের গ্রামে ফারসি শেখার ব্যবস্থা না-থাকলেও মধুকে ফারসি শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় তাঁর আট-ন বছর বয়সে। এর জন্যে আদরের সন্তানকে কষ্ট করে মাইলখানেক হেঁটে অন্য গ্রামে যেতে হতো। ফারসি তিনি খুব বেশি শিখেছিলেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তাঁর ফারসির শিক্ষক তাঁকে ফারসি শ্লোক মুখস্থ করিয়েছিলেন। তাঁকে তিনি সেই বয়সে গজল গাইতেও শিখিয়েছিলেন। হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ে বন্ধুদের তিনি নাকি মাঝেমধ্যে গজল গেয়ে শোনাতেন।৩৫অবশ্য তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দিন গান শিখেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু গানের প্রতি তাঁর একটা স্বাভাবিক ভালোবাসা ছিলো। এই প্রীতি তিনি অনেকাংশে পেয়েছিলেন পরিবার এবং বাল্য পরিবেশ থেকে। ছেলেবেলায় ফারসি পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি যে-ফারসিপ্রীতি অর্জন করেন, সেই প্রীতি এবং সেই সঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা দীর্ঘ কাল বজায় ছিলো। পরে দেখতে পাবো, তাঁর রচনায় নগণ্য হলেও ফারসি অধ্যয়নের প্রভাব পড়েছিলো। তা ছাড়া, তিনি যে বারবার মুসলমানী বিষয় নিয়ে লেখার অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন, এ-ও আংশিকভাবে তাঁর সংক্ষিপ্ত ফারসি অধ্যয়নের ফল হতে পারে। এই প্রীতিবশত মাদ্রাস থেকে তিনি ফারসি কবি শেখ সাদীর বই চেয়ে পাঠিয়েছিলেন।

কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতে আরম্ভ করার পরেও, মধু নিশ্চয় অনেক বার সাগরদাঁড়িতে বেড়াতে গেছেন, বিশেষ করে পুজোর সময়ে। কিন্তু তবু সেই বয়স থেকেই সাগরদাঁড়ির সঙ্গে তাঁর বন্ধন আপাতদৃষ্টিতে আলগা হয়েছিলো। আর নিজের পরিবারের সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটেছিলো এক দশকের মধ্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মন থেকে তিনি তাঁর শিকড়ের টান সারা জীবন কাটাতে পারেননি। তাঁর সাহিত্য এবং তাঁর জীবনের নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে নিজের উৎসের প্রতি তাঁর এই দরদ কতো আন্তরিক এবং জোরালো ছিলো, নির্ভুলভাবে তা বোঝা যায়। পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাবো, সাগরদাঁড়ি থেকে চলে যাবার তিরিশ বছরেরও পরে এবং ছ হাজার মাইল দূরে বসেও তিনি তাঁর শৈশবের গ্রামের প্রতি নাড়ীর টান অনুভব করেছেন।

বাল্য এবং কৈশোরে তাঁর মনে বিশেষ করে যা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলো, তা হলো: গ্রাম বাংলার নিসর্গ। তাঁর এই নিসর্গপ্রীতি কতো অন্তরঙ্গ এবং দীর্ঘস্থায়ী সেটা বোঝা যায় তাঁর বিভিন্ন রচনা থেকে। মাদ্রাসে তিনি যখন The Captive Ladie-সহ তাঁর ইংরেজি রচনাগুলো প্রকাশ করেন, তখন জন্মস্থান এবং স্বজনদের কাছ থেকে তিনি ছিলেন অনেক দূরে। তা সত্ত্বেও, তাঁর শৈশবে দেখা নিসর্গ তাঁর রচনায় বার বার ছায়া ফেলেছে। ভার্সাইতে তিনি যখন তাঁর সনেটগুলো রচনা করেন, তখনও সেসব সনেটে তাঁর সাগরদাঁড়ির স্মৃতি একেবারে জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। কলকাতায় তিনি যখন বীররস পরিবেশনে ব্যস্ত এবং তাঁর কল্পনাকে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল পর্যন্ত বিস্তৃত করছিলেন, তখনো কোথাও কোথাও প্রায় ধান ভানতে শিবের গীতের মতো তাঁর রচনায় মধ্য-বাংলার সবুজ গাছপালা, নদীনালা, অবারিত প্রান্তর ফিরে ফিরে দেখা দিয়েছে। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে যেমন স্বর্গের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আসলে তাঁর শৈশবে দেখা নিসর্গের বর্ণনা দিয়েছেন:তৃ

শাল্মলী, শাল, তাল, অভ্রভেদী

চূড়াধর; নারিকেল যার স্তনচয়

মাতৃদুগ্ধ-সম রসে তোষে তৃষাতুরে !

গুবাক; চালিতা; জাম সুদ্ৰমরূপী

ফল যার; উর্দ্ধশির তেঁতুল; কাঁঠাল,

যার ফলে স্বর্ণকণা শোভে শত শত

ধনদের গৃহে যেন।

গুবাক, চালিতা, জাম, তেঁতুল, কাঁঠাল-ঘেরা নিসর্গ দেখে সহজেই চেনা যায় যে, এই স্বর্গ সাগরদাঁড়ি তথা মধ্য-বঙ্গ থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয়। বস্তুত, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর মন নিয়ত সাঁতার কেটেছে কপোতাক্ষের জলে। এই নদীর দুই তীরের সবুজ ছোটো গ্রামগুলো, তাদের কোথাও একটা ভাঙ্গা মন্দিব, কোথাও একটা বিচ্ছিন্ন বট তাঁর মনে চিরস্থায়ী ছাপ এঁকে দিয়েছিলো।

১৮৪৩ সালের পরে তিনি গ্রামের সঙ্গে তাঁর এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ একেবারে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তা ছাড়া, প্রথম বছর দশেক বাদ দিলে, তিনি গোটা জীবন বাসও করেছেন কোনো না কোনো নগরীতে — কলকাতা, মাদ্রাস, লন্ডন এবং ভার্সাইতে। অংশত সে কারণে, অংশত শৈশবে দেখা নিসর্গ তাঁর মনে স্থায়ীভাবে চিহ্ন এঁকে দেবার দরুন — তিনি যখন নিসর্গের কল্পনা করেছেন, তখন সাগরদাঁড়ি এসে তাঁর মনের পেছনে ভর করেছে, এমন কি, তাঁর অবচেতনায়। অবশ্য এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বড় হবার পর নিসর্গের আরও দুটি উপাদানের প্রতি তাঁর অনুরাগ তৈরি হয়েছিলো। এ দুটি হলো: সাগর আর পর্বত। সাগরের প্রতি তাঁর প্রথম আকর্ষণ জন্মে — এই সাগরের ওপর দিয়ে তাঁকে তাঁর স্বপ্নের দেশ ইংল্যান্ডে যেতে হবে — এই কথা চিন্তা করে। তারপর অবশ্য মাদ্রাসে থাকার সময়েও তিনি একেবারে কাছ থেকে সাগরকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছিলেন। স্পষ্ট বোঝা যায়, সাগর আর পর্বতকে তিনি ভালোবেসেছিলেন এদের বিশালত্বের জন্যে। সাগরতীরে বাস করলেও, তিনি অবশ্য কোনো বড়ো পর্বতের কাছে কখনো বাস করেননি। এমন কি, বড়ো কোনো পর্বত তিনি কোনো দিন দেখেছিলেন কিনা, সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।

কলকাতায়

মধুর যখন জন্ম হয় তার আগে থেকেই কলকাতার সমাজ এবং অর্থনৈতিক জীবনে দেখা দিয়েছিলো নানা ধরনের উথান-পতন। পশ্চিমের সংস্পর্শে এসে রোজ সেখানে চলছিলো পুরাতনের বিদায়ের পালা আর তার জায়গায় নতুনের সংবর্ধনা। অর্থকরী ইংরেজি শিক্ষা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন যুগের উপযোগী করে তোলার উদ্দেশ্যে উনিশ শতকের প্রথম পাদেই হিন্দু কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিলো।৩৬ বাংলা খবরের কাগজ আত্মপ্রকাশ করেছিলো ১৮১৮ সাল থেকে। স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮২২ সালের গোড়ার দিকে।৩৭ ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কেও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন কেউ কেউ। রামমোহন রায় ফারসি ভাষায় একেশ্বরবাদ সম্পর্কে বই লিখেছিলেন এবং পরে আত্মীয় সভা স্থাপন করেছিলেন এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে। সতীদাহ প্রথা নিয়ে তুমুল বিতর্ক আরম্ভ হয়েছিলো সমাজের দু দিক থেকে। দিনের বেলায় ফিরিঙ্গি দপ্তরে কাজ করে বাড়ি ফেরার সময়ে গঙ্গায় স্নান করে পবিত্র হবার রীতিকে অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন বিবেককে সাফ রাখার প্রামাণ্য ব্যবস্থা হিশেবে।৩৮ মোট কথা, পুরোনো আর নতুন মূল্যবোধের রীতিমতো বোঝাপড়া চলছিলো কলকাতার বাসিন্দাদের মধ্যে। কলকাতা কমলালয়ে ব্যবসা করে অনেকে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছিলেন। সেই টাকা দিয়ে জমিদারি কিনে তাঁরা আবার সম্ভ্রান্ত বলেও নাম কিনছিলেন। কিন্তু মধু জন্মেছিলেন শহর থেকে অনেক দূরে এক অজ পাড়াগাঁয়ে। সেখানকার জীবনযাত্রা ছিলো নগরের ব্যস্ততাবর্জিত — শান্ত এবং মন্থর। মূল্যবোধ মধ্যযুগীয়। সেখানে আধুনিকতার হাওয়া পুরোনো ব্যবস্থাকে বিচলিত করতে পারেনি। তখনো আগের যুগের ঘুমে সে বিভোর। সেই নিস্তরঙ্গ সাগরদাঁড়ির ছোটো ছেলে মধুর চারদিকে সবাই পরিচিত। বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে বাস তাঁর। গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবারের সন্তান হিশেবে পরিবারের বাইরেও বাড়তি খাতির সবার কাছে। তারপর সেই পরিচিত লোকজন এবং পরিবেশ থেকে তিনি একেবারে বালক বয়সে হঠাৎ ছিটকে পড়লেন সেকালের এবং সে বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক দূরের এক মহানগরীতে।

ক্ষুদ্র গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে বিশাল নগরীতে আসার দৃষ্টান্ত মধু অবশ্য পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর পিতা যে-কলকাতা আর সাগরদাঁড়ির মধ্যে বছরে কয়েক বার যাতায়াত করতেন, মহানগরী কলকাতার বার্তা বয়ে নিয়ে আসতেন একটি অজগ্রামে, তা থেকে অনেকেই হয়তো উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে বালক মধুই অনুপ্রাণিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। কলকাতায় যাবার স্বপ্ন তিনি শৈশব থেকেই দেখতে শুরু করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত যখন তিনি কলকাতায় গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে আরম্ভ করেন, তখন কলকাতাকে ঘিরে তাঁর যেসব কৌতূহল ছিলো, তা ঘুচে যেতে সময় লাগেনি। অতঃপর সাগরদাঁড়িই বালক মধুর মনকে মোচড় দিয়েছে। কপোতাক্ষ; বটবৃক্ষের নিবিড় ছায়া; ঠাকুরমা, পিসিমা এবং জেঠীমার রূপকথা; আর পাঠশালার বন্ধুদের স্মৃতি তখন মনকে দূর থেকে হাতছানি দিযে আহ্বান করেছে।

অতীতের স্মৃতিজনিত এই মর্মবেদনা ছাড়া, সংবেদনশীল এই বালকের কাছে বর্তমানও দেখা দেয় নানা সমস্যা নিয়ে। ঠিক কোন বছর, কোন মাসে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন, সে তথ্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, কলকাতায় আগমনের ফলে তাঁর জীবনে কী ধরনের সংকট দেখা দিয়েছিলো এবং তিনি সেই সংকট কী করে ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছিলেন। কলকাতায় লেখাপড়ার জন্যে নতুন স্কুলে যাওয়া, সেখানে অন্য ধরনের বইপত্র এবং পাঠের আয়োজন, শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, সহপাঠীদের কৌতূহল এবং শত্রুতার মোকাবেলা করে তাদের বন্ধুতে পরিণত করা, পড়শিদের মধ্য থেকে খেলার সাথী জোটানো – এসবও তাঁর মনকে নিশ্চয় উতলা করেছে। একান্ত আশ্রিত জীবন থেকে হঠাৎ তিনি যেন সহানুভূতি- এবং ভালোবাসাহীন একটা পরিবেশে এসে পড়েছিলেন। তিনি যেন ইটের পরে ইট দিয়ে ঘেরা একটা বিরাট কারাগারে বন্দী হয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে এটা ছিলো তাঁর জীবনের একটা সংকট এবং সংক্রান্তির সময়।

প্রসঙ্গত, একটা কথা এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, যাকে পোশকী ভাষায় বলে জীবনের “অধ্যায়”, মধুসূদনের জীবনে সত্যি সত্যি সে রকমের সুস্পষ্ট আলাদা আলাদা অধ্যায় ছিলো। সাগরদাঁড়ি থেকে কলকাতায় আসার ফলে তাঁর জীবনে তেমনই একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিলো। তাঁর সেই আগেকার জীবন এবং নতুন জীবনের মধ্যে যোগসূত্র ছিলেন তিনি নিজে আর তাঁর বাবা-মা, নয়তো অন্য সব কিছু বদলে গিয়েছিলো। তেমনি তিনি যখন ধর্মান্তরিত হন, তখন তাঁর একেবারে নতুন জীবন আরম্ভ হয়েছিলো। মাদ্রাসে গিয়ে তিনি আর-একবার শুরু করেছিলেন একেবারে ভিন্ন একটি জীবন — আগেকার জীবনের সঙ্গে যাঁর সামান্যই যোগ ছিলো। মাদ্রাস থেকে তিনি যখন কলকাতায় আসেন, তখন আগেকার জীবনের সঙ্গে, বলতে গেলে, সকল বন্ধন কাটিয়ে এসেছিলেন। জাহাজ থেকে কলকাতায় নেমে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর পঞ্চম জীবন। কলকাতা ছেড়ে তিনি যখন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে বিলেত যাত্রা করেন, তখন যে-জীবনের স্বাদ পেয়েছিলেন, সে জীবন ছিলো আগের জীবন থেকে অনেকটাই আলাদা। আর সবশেষে তিনি যখন তৃতীয় বারের জন্যে কলকাতায় জীবন শুরু করেন, তখনকার সেই কলকাতার জীবনের সঙ্গে আগেকার কলকাতার জীবনের সামান্যই মিল ছিলো। এমনি করে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেই তিনি একে-একে সাতটি জীবন যাপন করেছিলেন।

গ্রামের পাঠশালায় তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন এবং লেখাপড়ায় তাঁর আত্যন্তিক মনোযোগ ছিলো — আগেই তা উল্লেখ করেছি। ভাষা শেখার ব্যাপারেও তাঁর একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিলো। সুতরাং কলকাতায় স্কুলে যাবার পর ইংরেজি-জানা অন্য ছাত্রদের তিনি দ্রুত ধরে ফেলেছিলেন — এটা বোঝা যায়। বরং অন্যদের সঙ্গে নতুন করে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সময় লাগাই স্বাভাবিক। ধারণা করা সঙ্গত যে, সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে প্রথম দিকে তাঁর মতো একজন স্পর্শকাতর এবং সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন বালকের বেশ হাবু-ডুবু খেতে হয়েছে। তিনি যে গোড়াতে ইংরেজি ভাষা জানতেন না, এমন কি জানতেন না কলকাতার বাংলা, রং কথা বলতেন যন্তরে ভাষায় এবং আচার-আচরণে, পোশাকে-আশাকে অ-নাগরিক ছিলেন, এটা নিশ্চয় তাঁকে পীড়িত করেছে। সহজেই অনুমান করা যায়, তিনি কতো বার সহপাঠীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপের মুখোমুখি হয়েছেন তাঁর পূর্ববঙ্গীয় ভাষার জন্যে। (রামমাণিক্যের উক্তি স্মরণীয়: পুঙ্গির বাই বাঙ্গাল বাঙ্গাল কইরা মস্তক গুরাই দিচে — বাঙ্গাল কউস ক্যান? ৩৯।) এ সময়ে মধু যদি ইংরেজ কবি বালক শেলির মতো তাঁর পাঠশালায় গিয়ে সবার অজ্ঞাতে চোখ মুছে থাকেন, লেখার খাতায় ফেলে-আসাগ্রামের ছবি এঁকে থাকেন, তাহলে অবাক হবার কারণ নেই। আমার বিশ্বাস, এই পরিবেশে তিনি মাঝেমধ্যে তাঁর পিতা যে ধনী উকিল — এই উক্তি করে বন্ধুদের বিদ্রুপের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন। এবং গোড়াতে যা ছিলো তাঁর আত্মরক্ষার হাতিয়ার, শেষ পর্যন্ত তাই একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। এই হীনম্মন্যতাই কয়েক বছরের মধ্যে নিজেকে জাহির করার মানসিকতায় পরিণত হয়। তিনি যে পরবর্তী কালে সহপাঠীদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছেন, দামী উপহার দিয়েছেন, বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন, সেও অংশত তাঁর হীনম্মন্যতা/অহমিকার ক্ষতিপূরণ।

স্কুলের নামস্হাপনের
সময়
ঠিকানাকি পড়াশুনো
হতো/শিক্ষক
ক্যালকাটা হাই স্কুল১৮৩০১০২ জান বাজারইংরেজি, ল্যাটিন,গ্রীক, ফ্রেন্‌চ পড়ানো হতো। বিদেশী শিক্ষক
প্যারেন্টাল অ্যাকাডেমি১৮২৩১ ফ্রী স্কুল স্ট্রীটইংরেজ শিক্ষক
লোয়ার অরফ্যান স্কুল আলিপুর৩জন ইংরেজ শিক্ষক
সেন্ট জেমস স্কুল১৮২৩ ইংরেজ শিক্ষক
বেনোভলেন্ট ইনস্টিটিউশন১৮০৯৩৬ বৌ বাজার 
জেনারেল এসেমব্লি   
অরিএন্টাল সেমিনারি চিৎপুর রোডকয়েকজন ইংরেজ শিক্ষক
ইউনিয়ন স্কুল ভবানীপুর 
আপার অরফ্যান ফুল খিদিরপুর৪জন ইংরেজ শিক্ষক

১৮৩০-এর দশকে কলকাতার কয়েকটি স্কুল।
এর যে-কোনোটিতে মধুর পক্ষে পড়া সম্ভব ছিলো।

কলকাতায় তিনি কোন স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোনো তথ্য জানা যায়নি। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি খিদিরপুরে কোনো একটা ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়ার জন্যে ভর্তি হয়েছিলেন। সুরেশচন্দ্র মৈত্র এটা স্বীকার করেননি। সেকালে খিদিরপুরে কোনো ইংরেজি স্কুল ছিলো কিনা, ইংরেজি পঞ্জিকা এবং অন্যান্য সূত্র থেকে তিনি তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, মধু ভর্তি হয়েছিলেন খিদিরপুর থেকে অনেকটা দূরে লালবাজারের গ্রামার স্কুলে। পিতা তাঁকে সকালে আদালতে যাবার সময়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন এবং বিকেলে ফেরার সময়ে সঙ্গে করে বাড়িতে আনতেন।৪০ সুরেশচন্দ্রের এই অনুমান সত্য হওয়া সম্ভব। তবে এ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। বিশেষ করে, রাজনারায়ণ পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে আদালতে যেতেন এবং সঙ্গে করে বাড়ি ফিরতেন — এই যুক্তিকে তেমন জুৎসই বলে ভাবতে পারছিনে। তখন কলকাতায় পালকি ভাড়া ছিলো সারা দিনে চার আনা। মধুকে বাড়ি থেকে স্কুলে এবং স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্যে দু আনার বেশি লাগার কথা নয়। সুতরাং মধুকে একজন ব্যস্ত উকিলের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে; অথবা বালক মধুকে পিতার আদালত বন্ধ হবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে হবে বাড়ি ফেরার জন্যে, সুরেশচন্দ্রের এই যুক্তিকে খুব গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। তখন হিন্দু কলেজের জুনিয়র শাখায় ভর্তির জন্যে বয়সের সীমানা ছিলো আট থেকে বারো। মধুর বয়স তখন ছিলো এই সীমানার মধ্যে। তা হলে তিনি প্রথমেই হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেন না কেন, তারও সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

মধু কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, তথ্য হিশেবে সেটা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, আসলে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই স্কুলে তিনি কী ধরনের শিক্ষা পেয়েছিলেন। আমরা যখনকার কথা আলোচনা করছি, ভালো ইংরেজি শেখার জন্যে কলকাতায় তখন বেশি স্কুল ছিলো না। প্রাইভেট পড়ার সুযোগও ছিলো সীমিত। ভালো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্যে এ সময়ে, রামকমল সেনের মতে, মাসে চার থেকে ষোলো টাকা বেতন লাগতো।৪১ অনেকে ইংরেজি শেখাব নামে যা শিখতেন, তা হলো মুখে মুখে কতোগুলো জিনিশের নাম এবং কতোগুলো ক্রিয়াপদ। যাদের শিক্ষা আর-একটু এগুতো তাঁরা বর্ণমালাও শিখতেন সেই সঙ্গে। কিন্তু মধু শিখেছিলেন একেবারে চোস্ত ইংরেজি। তাঁর সহপাঠীদের তুলনায় ইংরেজিতে তাঁর দক্ষতা ছিলো অনেক বেশি। এর ভিত্তি সাগরদাঁড়িতে স্থাপিত হয়নি — কলকাতায়ই হয়েছিলো। সে কারণে মনে হয়, রাজনারায়ণ তাঁকে কোনো ভালো স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। সে স্কুলে ইংরেজ/ফিরিঙ্গি শিক্ষকও ছিলেন বলে ধারণা হয়।৪২ এ ব্যাপারে রাজনারায়ণের বাস্তব এবং হিশেবী বুদ্ধির কথা মনে রাখা যেতে পারে। তিনি নিজে তাঁর পেশার জন্যে ইংরেজি শেখেননি। এমন কি, তিনি যে আদৌ ইংরেজি জানতেন, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু স্বগঠিত এবং সফল একজন মানুষ হিশেবে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, ফারসির যুগ শেষ হতে যাচ্ছে এবং নতুন যুগে তাঁর মতো সফলতা লাভ করতে হলে ইংরেজি ভাঙ্গিযেই তা করতে হবে। মধু যখন কলকাতার স্কুলে ভর্তি হন, তার এক-আধ বছরের মধ্যে সরকারী কাজকর্মে ইংরেজি ভাষা চালু হয়েছিলো মেকলির সুপারিশে।৪৩ সুতরাং সন্তানকে রাজনারায়ণ নিশ্চয় কলকাতার সেরা স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। মধু তাঁর নতুন স্কুলে কেবল ইংরেজি নয়, খানিকটা ল্যাটিন, গ্রীক এবং হিব্রু শিখেছিলেন — এমন কথাও বলা হয়।৪৪ তা থেকেও কোনো ভালো স্কুলে লেখাপড়া শেখার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি আগে থেকে ভালো ছাত্র ছিলেন এবং লেখাপড়ায় তাঁর খুব আগ্রহ ছিলো। এখন এই স্কুলে এসে তিনি দ্রুত নতুন নতুন ভাষা শেখায় তাঁর দক্ষতা দেখাতে আরম্ভ করেন।

মধু হিন্দু কলেজে ভর্তি হন ১৮৩৭ সালে।৪৫ তখন হিন্দু কলেজে মোট ১৩টি শ্রেণী ছিলো। এর মধ্যে নিচের আটটি ছিলো জুনিয়র স্কুলের আওতায়, আর উপরের পাঁচটি শ্রেণী ছিলো সিনিয়র স্কুলের অধীনে। মধু ভর্তি হন নিচের দিক থেকে গুনলে পঞ্চম শ্রেণীতে, আর ওপরের দিক থেকে গুনলে নবম শ্রেণীতে। তখন ওপরের দিক থেকে গোনারই রীতি ছিলো। কলকাতার অন্য স্কুলে মধুর ভাষা শিক্ষার যে-ভিত্তি তৈরি হয়, মনে হয় তা মজবুত ছিলো। তবু হিন্দু কলেজেই তিনি সত্যিকার শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। পরে তিনি যে কবি হয়েছিলেন, বিশ্ব-সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর যে-নিবিড় পরিচয় হয়েছিলো, তার জন্যে হিন্দু কলেজের কাছে তাঁর ঋণ অপরিসীম।

মধু হিন্দু কলেজে পড়তে আসেন, ডিরোজিও মারা যাবার ছ বছর পরে। সত্যি বলতে কি, তিনি মারা যান বালক মধু কলকাতায় আসারও আগে। হিউম, রীড, কান্ট, স্কিউয়ার্ট এবং টম পেইন পড়ার যে-রীতি তিনি উৎসাহিত করেছিলেন, তার গতি ততোদিনে অনেকটা স্তিমিত হয়েছিলো; কিন্তু হিন্দু কলেজে পঠন-পাঠন এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে-অসাধারণ ঐতিহ্য তিনি স্থাপন করেছিলেন, সে ঐতিহ্য তখনো ম্লান হয়নি। তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও অনেকে তখন পর্যন্ত হিন্দু কলেজে ছিলেন। ডিরোজিও কেবল সাহিত্য পড়াতেন না; অথবা সাহিত্য পড়িয়েই তিনি হিন্দু কলেজে বিপ্লব আনেননি। তিনি ছাত্রদের মনে আললাড়ন সৃষ্টি করেছিলেন কলেজের পাঠ্য-তালিকাভুক্ত নৈতিক দর্শন পড়িয়ে। অবশ্যই বলতে হবে, তিনি কখনো পাঠক্রমের বাঁধা গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেননা। বাইরের প্রশস্ত পৃথিবীর জানালাটাও তিনি খুলে দিতেন। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি তাঁর ছাত্রদের স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখাতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের আসলে দুটো ভাগ ছিলো। একদিকে, তিনি রোম্যান্টিক কবি ছিলেন — কল্পনাই সেখানে তাঁর মূলধন। অন্যদিকে, তাঁর চরিত্রে বড় আর-একটা বৈশিষ্ট্য ছিলো — চুলচেরা যুক্তিবাদের। তাঁর শিষ্যরা সেই যুক্তিবাদের প্রভাবে প্রচলিত মূল্যবোধ অনেকাংশে বিসর্জন দিয়েছিলেন। হিন্দুকলেজ থেকে তিনি বিদায় নিতে বাধ্য হবারবারো বছর পরে যিনি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন এবং মধু যাঁকে দারুণ অপছন্দ করতেন, সেই জেমস ক্যর ডিরোজিওর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন:

ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে সবকিছু যুক্তিবাদের আলোকে বিচার করার প্রবণতা দেখা দিয়েছিলো। ঈশ্বর, ভবিষ্যৎ, পারিবারিক সম্পর্ক — যা আমরা যুক্তির বদলে দরদের সঙ্গে দেখি, তাঁর শিষ্যরা যুক্তিবাদে দীক্ষা নেওয়ায় সেসবকেও প্রশ্ন করেন।৪৬

শিষ্যদের এই আমূল সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কলেজের ছাত্রদের অভিভাবক এবং কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজে যে-উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিলো, তার ফলে ডিরোজিও অকালে কলেজ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁর প্রভাব দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁর শিষ্যদের ওপর বজায় ছিলো।

মধু যখন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন, তখনও ডিরোজিওর শিষ্যদের পরিচালিত একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছিল। এসব পত্রিকায় তাঁর শিষ্যরা অনেক সময়ে প্রচলিত মূল্যবোধ কাটিয়ে যুক্তিবাদের মাধ্যমে সত্যকে অঙ্গীকার করার আহ্বান জানাতেন। হিন্দু ধর্মকে তাঁরা আঘাত করতেন উঠতে-বসতে। তাঁরা যে-বিতর্ক সভা স্থাপন করেছিলেন, সেখানে স্বদেশ এবং স্বধর্মের পুরোনো রীতিনীতিকে অহরহ তাঁরা প্রশ্ন করতেন।৪৭ ডিরোজিওর মৃত্যুর পবে তাঁরা যে-সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা গঠন করেন, সেখানেও তাঁরা সমাজ সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করতেন। এসবের সঙ্গে মধু যোগ দেননি। ১৮৪০ সালে সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার যে-সভ্য তালিকা পাওয়া যায়, তাতে প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশোরীচাঁদ ঠাকুর, প্যারীচরণ সরকার, গোবিন্দ দত্ত, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ইত্যাদি তাঁর সহপাঠীদের নাম পাওয়া গেলেও, গৌরদাস বসাক অথবা মধুবনাম সেখানে অনুপস্থিত। একজন মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম আছে বটে, কিন্তু তিনি হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র।৪৮ তবে এসব সমাজ সংস্কারমূলক কাজকর্মে যোগ না-দিলেও মধু এসব না-শুনে পারেননি।

ডিরোজিওর সঙ্গে মধুর অন্য একটি যোগাযোগ ঘটেছিলো কবিতার মাধ্যমে। ডিরোজিওকে অনেকে বলতেন ইউরেশীয় বায়রন, যদিও অন্য প্রধান রোম্যান্টিক কবিদের — স্কট, মূর, বার্নস – দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তা ছাড়া, যে-দেশাত্মবোধের জন্যে তিনি এখনো সুপরিচিত এবং প্রশংসিত, সেই দেশাত্মবোধের আদর্শ অনেকটা তিনি পেয়েছিলেন আর-একজন রোম্যান্টিক কবি — টমাস ক্যাম্বেলের কাছ থেকে। তাঁর কবিতায় যে-উচ্ছাস এবং প্রাণ ছিলো, তরুণ মধু তা দিয়ে যতো সামান্যই হন না কেন, প্রথম দিকে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সর্বোপরি, দুজনই খাতক ছিলেন অভিন্ন মহাজনদের। সে দিক দিয়েও তাদের সাদৃশ্য অপ্রত্যাশিত নয়। খিদিরপুরের যে-বাড়িতে মধু বাস করতেন, তিনি সেখানে আসার আগে সে বাড়ির ওপরও ডিরোজিওর প্রভাব পড়েছিলো – সে বাড়িতে বাল্যকালে বাস তেন বাঙালিদের মধ্যে প্রথম যিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখেছিলেন — কাশীপ্রসাদ ঘোষ।৪৯ তিনিও মধুসূদনের আগে ডিরোজিওর কবিতা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন, বিশেষ করে তাঁর দেশাত্মবোধক ভাবনা দিয়ে। বস্তুত, ডিরোজিও মাত্র ২৩ বছর বয়সে মারা গেলেও, হিন্দু কলেজ এবং কলকাতার ইঙ্গ-ভারতীয় সাহিত্য ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রভাব রেখে গিয়েছিলেন।

সাহিত্য ছাড়া, তরুণ মধু ডিরোজিওর আর-একটি প্রভাব স্বীকরণ করেছিলেন, তবে কোন পথে, তা জানা নেই। ডিরোজিওর অনেক শিষ্য সত্যের জন্যে দরকার হলে পিতামাতা এবং সমাজকে অস্বীকার করার আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন অসাধারণ সাহসের সঙ্গে। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়,৫০ রসিককৃষ্ণ মল্লিক,৫১ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়,৫২ মহেশচন্দ্র ঘোষ,৫৩ রামগোপাল ঘোষ৫৪ প্রমুখ সেকালের অনেক নাম-করা ব্যক্তিত্ব তাঁদের নিজ নিজ বিশ্বাস এবং আদর্শের জন্যে তাঁদের জীবনে বহু বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা সাধারণ মানুষ নেয় না। ধর্মবিশ্বাস এবং সমাজসংস্কারে তাঁদের আগ্রহ ছিলো একান্ত আন্তরিক। মাইকেল এঁদের মতো কোনো সামাজিক বিষয়ে নিজের বিশ্বাসকে মর্যাদা দেবার জন্যে পরিবার এবং সমাজের বিরোধিতা করেননি। তাঁর সত্য ছিলো প্রধানত কবিতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র। তার জন্যে তিনি আপনজন এবং আপাত সুখের জীবন বিসর্জন দিতে ভয় পাননি। পরে দেখতে পাবো, তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যখন হুমকির সম্মুখীন হয়েছে এবং কবি হবার পথে তিনি নিজের পরিবারকে বাধা বলে বিবেচনা করেছেন, তখন কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা করেননি।

হিন্দু কলেজ থেকে ডিরোজিওর বিদায় নেবার কয়েক বছরের মধ্যে — ১৮৩৫-৩৬ সালে — কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হয়ে আসেন একজন প্রাক্তন সৈন্য — ক্যাপ্টেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন (১৮০১-৬৫)। ক্যাডেট হিশেবে তিনি বেঙ্গল আর্মিতে যোগদান করেছিলেন ১৮১৯ সালে। বেশ দ্রুত তিনি তাঁর যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, মেজর পর্যন্ত তাঁর পদোন্নতি হয়েছিলো। কিন্তু বন্দুক নয়, তাঁর আসল অস্ত্র ছিলো কলম। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে কবি। অচিরেই তিনি বেসামরিক দায়িত্ব পান। প্রথমে তিনি কাজ করেন গভর্নর-জেনরেল বেন্টিঙ্কের অধীনে। তারপর শিক্ষা বিভাগে। ১৮২৭ সালে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান এবং সেখানে London Weekly Review পত্রিকা প্রকাশ করেন। তবে বছর আড়াই পরে তিনি আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে তিনি প্রথমে Bengal Annual এবং তারপরে Calcutta Literary Gazette পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তা ছাড়া, তিনি বেশ কয়েকটি কাব্য এবং প্রবন্ধের বইও প্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম কাব্য – Miscellaneous Poems — প্রকাশিত হয় ১৮২২ সালে, কলকাতা থেকে। পরে লন্ডন থেকেও এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো। তা ছাড়া, ১৮২৫ সালে লন্ডন থেকে তীর আর-একটি কাব্য প্রকাশিত হয় — Sonnets and Other Poems। তাঁর Literary Leaves প্রকাশিত হয় ১৮৩৬ সালে। ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি আরও কয়েকটি কাব্য এবং কাব্য-সমালোচনা প্রকাশ করেন।৫৫ তবে বই-এর সংখ্যা দিয়ে নয়, তাঁর কবিতা এবং কাব্য-সমালোচনার উন্নত মানের জন্যেই তিনি সেকালের ইঙ্গ-ভারতীয় সকল সাহিত্যিকের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতে পারেন। মেকলি ছিলেন তাঁর বিশেষ গুণমুগ্ধ। সেই মেকলির সুপারিশে তিনি হিন্দু কলেজে ডক্টর টাইটলার অবসর নেওয়ার পর সাহিত্যের অধ্যাপক হিশেবে যোগ দিয়েছিলেন।

অল্পকালের মধ্যে তাঁর সাহিত্যিক গুণাবলীর সঙ্গে আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিলো শিক্ষকতার গুণাবলীর। ডিরোজিও এবং ডেভিড হেয়ার ছাত্রদের প্রতি ব্যক্তিগত মনোযোগ এবং সহানুভূতি দিয়ে লেখাপড়া শেখানোর যে-প্রশংসনীয় রীতি প্রবর্তন করেছিলেন, রিচার্ডসন তা কেবল বহাল রাখেননি, তাকে বরং এগিয়ে দিয়েছিলেন। ছাত্ররা সচরাচর তাঁব ব্যক্তিগত যত্ন এবং উদার সহানুভূতি লাভ করতো। রিচার্ডসন শিক্ষক হিশেবে খুব ভালো ছিলেন — একথা তাঁর ছাত্রদের অনেকে তাঁদের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে রাজনারায়ণ বসু তাঁর যে-রকম উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন, তা থেকে ছাত্রদের ওপর তাঁর প্রভাবের মাত্রা খানিকটা বোঝা যায়:

কাপ্তেন সাহেব ইংরাজী সাহিত্যশাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। শেকসপিয়র তিনি যেমন পাঠ করিতেন ও বুঝাইতেন এমন আর কাহাকেও দেখি নাই। … তাঁহাকে স্মরণ হইলে কি পর্যন্ত ভক্তি ও প্রেম উচ্ছসিত হয়, তাহা বলিতে পারি না — তাঁহার স্বভাব বিশুদ্ধ ছিল না — কিন্তু তথাপি হয়।৫৬

কেবল ছাত্ররা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন না, মেকলি পর্যন্ত তাঁর উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষের সবকিছু তিনি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু কলকাতায় রিচার্ডসন যেভাবে শেকসপীয়র আবৃত্তি করতেন, সেটা কখনো ভুলতে পারবেন না।৫৭ উইলিয়াম র‍্যাডিচি মাইকেল সম্পর্কিত তাঁর অভিসন্দর্ভে লিখেছেন যে, রিচার্ডসনের সাহিত্যবোধ ছিলো অত্যন্ত উঁচু মানের। তাঁর মতে, রিচার্ডসন যে ইংরেজি সাহিত্যের প্রধান ধারায় সুপরিচিত হননি, সে হয়তো তিনি ইংল্যান্ড থেকে অতো দূরে বসে সাহিত্যচর্চা কবছিলেন বলে।৫৮ নিজেও সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে মনে হয়। সে জন্যে, সুদূর কলকাতা থেকে ইংল্যান্ডের রোম্যান্টিক কবিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে চেষ্টা করতেন। এই কবিদের একজন – লেই হান্টের কাছে লেখা তাঁর কয়েকটি চিঠি রক্ষা পেয়েছে।৫৯

বস্তুত, ডিরোজিও যেমন হিন্দু কলেজের একজন অতি অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন, রিচার্ডসনও ছিলেন তেমন অসাধারণ। তবে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাধারার মধ্যে সামান্যই মিল ছিলো। তা ছাড়া, তাঁদের অগ্রাধিকারও ছিলো একেবারে ভিন্ন রকমের। ডিরোজিও পড়াতেন নৈতিক দর্শন এবং সাহিত্য। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি দর্শন এবং সামাজিক বিষয়ে সচেতন হবার আদর্শে তিনি ষোলো আনা বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু রিচার্ডসন কেবল যে নৈতিক দর্শন পড়াতেননা, তাই নয়, তিনি দর্শনের প্রতি কোনো গুরুত্বই দিতেন না। তাঁর আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিলো সাহিত্যের মধ্যে। ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ চমৎকারভাবে বলেছেন যে, ডিরোজিও জোর দিতেন লক, হিউম, পেইন ইত্যাদি দার্শনিকের রচনা পড়ার ওপর, কিন্তু ডিএলআরের আমলে এঁদের জায়গা দখল করলেন বায়রন, কীটস, শেলি ইত্যাদি রোম্যান্টিক কবিরা।৬০ সামাজিক বির্তক এবং রাজনীতিতে ডিএলআরেব রুচি ছিলো না। সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্যও ছিলো বিতর্কাতীত। ডিরোজিও সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পেতেন না। তাঁর East Indian পত্রিকায় তিনি ইংরেজ কর্মকর্তাদেরও সমালোচনা করতেন। কিন্তু ডিএলআর এ রকম মনোভাবকে রাজদ্রোহিতা মনে করতেন। প্রসঙ্গত, একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮৪৩ সালের ৮ ফেব্রুআরি সংস্কৃতি কলেজের হলে সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভার একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বঙ্গদেশের আদালত এবং পুলিশের অবস্থা নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু প্রবন্ধের বিষয়বস্তু পরিষ্কার হতেই তাকে রাজদ্রোহিতার সামিল মনে করে ডিএলআর এই প্রবন্ধ পাঠ বন্ধ করে দেন। কিন্তু পরের মাসের ২ ও ৩ তারিখের Bengal Hurkaru পত্রিকায় এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।৬১ এ থেকে ডিএলআর-এর মনোভাব বোঝা যায়। বস্তুত, সামাজিক বিষয়ে তিনি ছাত্রদের রক্ষণশীল শিক্ষাই দিতেন। এই ভিন্ন ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শের প্রভাব ছাত্রদের ওপর পড়েছিলো ভিন্নভাবে। ডিরোজির শিষ্যরা হয়েছিলেন প্রধানত সমাজ-সংস্কারক; আর রিচার্ডসনের শিষ্যরা সাহিত্যিক। রিচার্ডসনের মতো একজন অসামান্য সাহিত্যিকের কাছে মধু যে গোড়া থেকে সাহিত্যের পাঠ নিতে পেরেছিলেন, সেটাকে তাঁর সৌভাগ্য বলে বিবেচনা করতে হবে। সত্যি বলতে কি, সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ অতো আন্তরিক এবং তাঁর সাহিত্যবোধ অতো গভীর হবার পেছনে রিচার্ডসনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিলো। মাইকেলের চিঠিপত্রে বিক্ষিপ্তভাবে ইতিহাসের উল্লেখ থাকলেও, কোথাও তিনি কোনো দার্শনিকদের অথবা দর্শনের উল্লেখ করেননি। ১৮৩০-এর দশকের ছাত্রদের, এমনকি, রাজনারায়ণ বসু এবং ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতো তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে যে-সমাজসংস্কার সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়, তাঁর মধ্যে, বলতে গেলে, তা অনুপস্থিত। এ থেকেও তাঁর ওপর রিচার্ডসনের প্রভাব কতো গভীর ছিলো তার খানিকটা আভাস পাওয়া যায়।

১৮৪০ সালে রিচার্ডসন একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করেন। এটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন মেকলির অনুরোধে। Selections from the British Poets নামে এই বিশাল গ্রন্থ এক দিকে তাঁর ছাত্রদের সাহিত্যিক রুচি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলো; অন্যদিকে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো চসার থেকে আরম্ভ করে তরুণ টেনিসন (তখন তাঁর বয়স ৩১), ডিরোজিও থেকে আরম্ভ করে রিচার্ডসন, এমন কি, কাশীপ্রসাদ ঘোষ পর্যন্ত একেবারে সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে। এই সংকলনে পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিলো – ভূমিকা ১৯ পৃষ্ঠা, কবিদের জীবনী এবং রচনা সম্পর্কে টীকাটিপ্পনী ১২৮ পৃষ্ঠা এবং কবিতা ৯৭৪ পৃষ্ঠা — এই মোট ১১২১ পৃষ্ঠা। যে-অংশে কবিতা ছাপা হয়েছিলো, সে অংশের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় দুটি করে কলাম ছাপা হয়েছিলো, তার মানে সাধারণ হিশেবে সেখানে পৃষ্ঠা ছিলো ১৯৪৯ পৃষ্ঠা। এই সংকলনে ৩০৯ কলাম ব্যাপী শেকসপীয়রের পুরো নাটক ছিলো পাঁচটি, একটির অংশবিশেষ। মিন্টনের রচনারও একটা প্রধান অংশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। হয়তো এই সংকলনের মাধ্যমেই মিন্টনের সঙ্গে মধুর প্রথম ভালো করে পরিচয় হয়েছিলো। হোমার, ভ্যর্জিল, দান্তে, ত্যাসো, শিলার এবং গ্যেটেসহ বহু য়োরোপীয় কবির (গ্রীক, ল্যাটিন, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, জর্মান, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ এবং ডাচ ভাষা থেকে অনূদিত) রচনাও ছিলো এই বইতে। এই সংকলনের আর-একটি অত্যন্ত মূল্যবান অংশ হলো নির্বাচিত কবিদের পবিচয় এবং তাঁদের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এই অংশটা ছিলো অত্যন্ত সুলিখিত এবং তথ্যপূর্ণ। মধু এটি পড়ে বিশেষ মুগ্ধ হয়ে তাঁর বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন: “আমি যদি এই ভূমিকাটা লিখতে পারতাম!”৬২ এই ভূমিকা মধু এবং অন্য ছাত্রদের সাহিত্য বুঝতে নিঃসন্দেহে সাহায্য করেছিলো।

রিচার্ডসন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ হিশেবে কাজ আরম্ভ করেন ১৮৩৯ সালে — মধু এই কলেজে যোগদান করার দু বছর পবে। কিন্তু বালক কবি এবং ভালো ছাত্র হিশেবে তিনি অল্প দিনের মধ্যে রিচার্ডসনের নজরে পড়েছিলেন। আব মধু নিজেও অচিরেই প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিক্ষকের দ্বারা। ১৮৪১ সালে লেখা তাঁর সবচেয়ে পুরোনো যে-কবিতাগুলো রক্ষা পেয়েছে, তা পড়লে সন্দেহ থাকে না যে, তিনি এর অনেক আগে থেকে কবিতা লেখা মক্স করতে শুরু করেছিলেন। কবিতা লেখার অনুপ্রেরণাও তিনি সম্ভবত পেয়েছিলেন ডিএলআরের কাছ থেকে। পরে দেখতে পাবো, ১৮৪১ সালে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে মধু রিচার্ডসনের রীতিমতো নৈকট্য লাভ করেছিলেন। ডিএলআর মনে করতেন, সাহিত্য শেখার একটা খুব ভালো উপায় হলো নাটক দেখা। সে জন্যে তিনি তাঁর ছাত্রদের কলকাতার পেশাদার থিয়েটারে ইংরেজি নাটক দেখার উপদেশ দিতেন। আর মধু তাঁর এতো নৈকট্য লাভ করেছিলেন যে, নাটকের টিকিট লাগলেও তিনি ছুটতেন তাঁর শিক্ষকের কাছে।৬৩

এই বালক কবিকে রিচার্ডসন স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, সেটা পরিষ্কার। মধু নিজেও অনুভব করতেন যে, ডিএলআর তাঁকে বিশেষ স্নেহ করছেন। তাঁর জন্যে এই অনুভূতি ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই অনুভূতি তাঁকে ধ্রুবতারার মতো বিশেষ একটা দিকের নির্দেশ দিয়েছিলো। ডিএলআর ছুটিতে গেলে ঝোঁকের মাথায মধু ঠিক করলেন, তিনি কলেজে যাবেন না, যদিও শেষ পর্যন্ত না-গিয়ে পারেননি। এমন সিদ্ধান্ত নেবার কারণ, ডিএলআরের জায়গায় যিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন, সেই জেমস ক্যরকে তাঁর অপছন্দ। এর জন্যে ক্যর নিজে কতোটা দায়ী, বলা শক্ত। কারণ ডিএলআরের তুলনায় ক্যর যতোটা অনাকর্ষণীয় ছিলেন, মধুতাঁকে তার চেয়েও বেশি অনাকর্ষণীয় করে দেখেছেন। এ-ও রিচার্ডসনের প্রতি তাঁর ভালোবাসার মাত্রা প্রমাণ করে। মধু প্রথম দিকে খুব সনেট লিখতেন। একটি ভিন্ন ভাষাভাষী কিশোর কবির জন্যে সেটা নিঃসন্দেহে অসাধারণ। তবে তারও একটা কারণ হতে পারে সনেটের প্রতি রিচার্ডসনের পক্ষপাত।

তখন হিন্দু কলেজে কী পড়ানো হতো, প্রসঙ্গত সে সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। জুনিয়র এবং সিনিয়র উভয় স্কুলে সাহিত্য এবং নৈতিক দর্শন পাঠ্য ছিলো। ডিএলআরের সংকলন প্রকাশিত হওয়ার পরে স্কুলের উভয় শাখায় এই সংকলনটি পাঠ্য করা হয়। এ ছাড়া, সিনিয়র স্কুলে টেকস্ট বুক সোসাইটিব English Reader-ও পাঠ্য ছিলো। জুনিয়র স্কুলে গোল্ডস্মিথ এবং অ্যাডিসনের প্রবন্ধ পড়ানো হতো। নৈতিক দর্শনের মধ্যে জুনিয়র স্কুলে পাঠ্য ছিলো অ্যাবাক্ররম্বাই-এর Intellectual Powers, ওয়েটলির Easy Lessons in Reasoning, রাসেলের Modern Europe আর টাইটলারের Universal History। গণিত এবং বাংলাও পড়তে হতো। সিনিয়র স্কুলে পড়ানো হতো মারের বিখ্যাত ব্যাকরণ, ক্ৰম্বির Etymolgy and syntax এবং মার্শম্যানের History of Bengal। শেষ দুই শ্রেণীতে, যাকে বলা হতো কলেজ বিভাগ, সেখানে পড়ানো হতো মিল্টন, শেকসপীয়র, পোপ এবং গ্রে-র কবিতা আর বেইকনের প্রবন্ধ। ইতিহাসের মধ্যে পাঠ্য ছিলো হিউমের History of England, গিবনের The Decline and Fall of the Roman Empire, মিটফোর্ডের History of Greece, রাসেলের Modern Europe, মিলের Indian History, এলফিনস্টোনের Indian History, রবার্টসনের Charles IV ইত্যাদি।

বাংলা পড়ানোর জন্যে হিন্দু কলেজে ছিলেন একাধিক শিক্ষক — জুনিয়র বিভাগে রামতনু লাহিড়ী এবং সিনিয়র বিভাগে রামচন্দ্র মিত্র। কিন্তু বাংলা পড়ার দিকে ছাত্রদের বিশেষ নজর ছিলো না।১৮৪১ সালে কলেজের বাংলা পরীক্ষা নিয়েছিলেন রামকমল সেন। মধুও তখন ছাত্র ছিলেন। ছাত্রদের ফলাফল দেখে তিনি হতাশ হন। তিনি লিখিত মন্তব্য করেন:

সিনিয়র ক্লাসের ছাত্ররা কেবল ইংরেজি পড়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তারা বাংলা পড়া বন্ধ করেছে। …মোট কথা, নিজেদের ভাষার চেয়ে ইংরেজি তারা ভালো বোঝে বলে মনে হয়। ইংরেজির তুলনায় নিজেদের ভাষা শেখার দিকে তারা সামান্যই গুরুত্ব দেয়, অথবা আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয় না।৬৪

কুড়ি বছর পরে মাইকেল নিজেও বাংলার প্রতি গুরুত্ব না-দেবার সেকালের এই প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছেন। কবির রচনার প্রতিলিপি করার জন্যে দীননাথ ধর নামে এক তরুণকে (জন্ম ১৮৪০) নিয়োগ করা হয়েছিলো। কিন্তু এই তরুণের বানান দেখে সাহেব মাইকেলও আঁতকে ওঠেন। রাজনারায়ণকে তাই কপি পাঠানোর সময়ে বানান সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন: “বেশি দিন আগে নয়, তখন তুমি অথবা আমি যদি “শিব”-এর বদলে “ষীব” লেখা দেখতাম, অথবা দেখতাম বানানের এ ধরনের কোনো অস্থিরতা, তা হলে তাকে খুব অসাধারণ মনে করতাম না। সত্যি সত্যি আমাদের মাতৃভাষা কী দ্রুত অগ্রগতি এবং বিশুদ্ধতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বহু যুগের ঘুম ভেঙ্গে কিভাবে সে জেগে উঠছে!”৬৫

হিন্দু কলেজের পাঠক্রম বিশ্লেষণ করলে বুঝতে কষ্ট হয় না, এই কলেজে পড়ার সময়েই ইংরেজি সাহিত্য এবং ইংরেজির মাধ্যমে য়োরোপীয় ধ্রুপদী সাহিত্যের সঙ্গে মধু খুব ভালোভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে রিচার্ডসনের মতো সাহিত্যিক এবং সাহিত্যরসিককে শিক্ষক হিশেবে পাওয়ায় মধু সাহিত্যকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। ভাষার বুনিয়াদ হিন্দু কলেজে মজবুত কবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হতো। মধু তা দিয়েও খুব উপকৃত হয়েছিলেন। দর্শন এবং তর্কবিদ্যার দিকে তাঁর তেমন আকর্ষণ ছিলো না। কিন্তু ইতিহাস তিনি ভালো করে শিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যখন মাদ্রাসে পত্রিকা সম্পাদনা এবং শিক্ষকতার কাজ করেন তখন এই ইতিহাস শিক্ষা তাঁর কাজে লেগেছিলো। তাঁর তখনকার একাধিক লেখায় এই ইতিহাস-চেতনা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু তিনি যে হিন্দু কলেজে থাকার সময়ে বাংলা ভালো করে পড়েননি, রামকমল সেনের প্রতিবেদন থেকে তা অনুমান করা সম্ভব। হিন্দু কলেজের পাঠক্রমে একটা বিষয় লক্ষযোগ্যভাবে অনুপস্থিত ছিলো, সে হলো বিজ্ঞান। বিলেতে অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞান পড়ানো হতো। এমন কি, হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখারও ব্যবস্থা ছিলো। আলোচ্য সময়ের তিন দশক আগে শেলি বিজ্ঞান পাঠ করে কী দারুণ প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং রাসায়নিক পরীক্ষা করতে গিয়ে কতো বার আগুন লাগিয়েছেন, প্রসঙ্গত সেটা এখানে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু কলকাতায় বিজ্ঞান পড়ানোর প্রয়োজনীয়তা কেন ইংরেজরা অনুভব করেননি, বোঝা মুশকিল। হয়তো কেবল কেরানি আর ডেপুটি তৈরি করাই ছিলো তাঁদের উদ্দেশ্য। এদের জন্যে তাঁরা বিজ্ঞান পড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করেননি। কিন্তু, কারণ যা-ই হোক, মাইকেল কোনো দিন বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারেননি। ভূগোলেও তাঁর জ্ঞান তেমন গভীর ছিলো বলে মনে হয়না। নয়তো, তিনি ইংল্যান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে বড়ো বড়ো পর্বত আর উপত্যকার কথা লিখতেন না।৬৬ (পরে আমরা এ সম্পর্কে আরও দেখতে পাবো।) কিন্তু বিজ্ঞান যে উন্নতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, এটা তিনি জানতেন। সে জন্যে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা একদিন স্বদেশের মুখোজ্জ্বল করবে বলে তিনি যে কবিতাটি লিখেছিলেন, তাতে এ দিকটার দিকে জোর দিয়েছিলেন:৬৭

some, perchance, here are,

Who, with a Newton’s glance, shall nobly trace

The course mysterious of each wandering star,

And, like a God, unveil the hidden face

Of many a planet to man’s wandering eye,

And give their names to immortality.

হিন্দু কলেজে মধু লেখাপড়া ছাড়া, আর-একটা জিনিশ পেয়েছিলেন, তা হলো: বন্ধুত্ব। তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একজন বলেছেন যে, তিনি সবার সঙ্গে সহজে মিশতে বা আলাপ করতে পারতেন না এবং তাঁর বন্ধুরা ছিলেন সবাই সুনির্বাচিত।৬৮ পরে লক্ষ্য করবো, তাঁর যাঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাঁদের সঙ্গে তিনি ছিলেন হরিহর আত্মা। তাঁদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতে, তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে, তাঁদের নিয়ে বেড়াতে যেতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু নিজের গোপন কথা, বিশেষ করে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে তাঁদের কাছে তিনি মন খুলতে পারতেন না। তাঁকে সে জন্যে অন্তর্মুখী বলে মনে হয়। হিন্দু কলেজে পড়ার আগে তিনি যে-স্কুলে পড়েছিলেন, সেখানকার কোনো সহপাঠী তাঁর জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে তাঁর বন্ধু বলে পরিচিত হননি। কিন্তু হিন্দু কলেজে তিনি একে-একে বেশ কয়েকজন বন্ধু পেয়েছিলেন, যাদের সঙ্গে তাঁর স্থায়ী ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিলো। এই বন্ধুদের কেউ কেউ পরে বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলে সুপরিচিত হয়েছিলেন। তবে এই কলেজে ভর্তি হবার পর বছর দুয়েক আপাতদৃষ্টিতে তিনি কোনো বন্ধু লাভ করেননি।

তাঁর সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু বলে যাঁর হদিস করা যাচ্ছে তিনি ভূদেব মুখোপাধ্যায়। সংস্কৃত কলেজ এবং অন্য ছোটো ছোটো তিনটি স্কুলে কয়েক বছর পড়ার পর সংস্কৃত পণ্ডিতের ছেলে ভূদেব ১৮৩৯ সালে ইংরেজি পড়ার জন্যে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। তিনি এই স্কুলে যোগ দেবার পরেই যেচে গিয়ে মধু তাঁর সঙ্গে আলাপ করেন। দুজনই ভালো ছাত্র, দুজনই সুদর্শন, দুজনই তাঁদের পিতামাতার একমাত্র পুত্র। অল্পকালের মধ্যে দুজনের দীর্ঘস্থায়ী অন্তরঙ্গতা জন্মে। সামাজিক ভাবনার দিক দিয়ে ভূদেব খুব রক্ষণশীল ছিলেন, আর মধু ছিলেন কালাপাহাড়ী। তা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে কী করে বন্ধুত্ব হয়েছিলো, বোঝা যায় না। ভূদেবের সুন্দর চেহারা একটা কারণ ছিলো বলে মনে হয়। ১৮৪১ সালে টাকাপয়সার অভাবে ভূদেবের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছিলো। তখন হিন্দু কলেজে ছাত্র-বেতন ছিলো মাসে পাঁচ টাকা। সেকালের বিচারেরীতিমতো বড়ো অঙ্কের টাকা। (বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এব বছর পনেরো আগে মাসে দু টাকা বেতনের একটি চাকরি পাওয়ায়, তিনি এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনরা রীতিমতো খুশি হয়েছিলেন।৬৯) ভূদেবের পড়া বন্ধ হতে পারে, এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মধু তাঁর জলপানির টাকা থেকে এই খরচ দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।৭০ এ থেকে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা এবং মধুর বন্ধুপ্রীতির মাত্রা অনুমান করা সম্ভব। কিন্তু মধুর মাইকেল হয়ে যাওয়াটা ভূদেব কোনো দিন ক্ষমা করতে পারেননি। তাঁর মতে, মধু খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করার পরে তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতাও অনেকটা নষ্ট হয়েছিলো।৭১ এবং খৃস্টান হবার জন্যেই পরবর্তী কালে মধুর কাছ থেকে তিনি খানিকটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কবি তাঁর কৈশোরের এই বন্ধুকে কোনো কালে ভুলতে পারেননি। বিলেত থেকে পাক্কা সাহেব হয়ে ফিরে আসার পরেও তিনি ভূদেবের চুঁচুড়ার বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। কোট-প্যান্টালুন খুলে ধুতি পরে পিড়িতে বসে খেয়েছেন। তা ছাড়া, অক্ষম শরীর নিয়ে হেক্টরবধ রচনা করে তাঁর নামে তা উৎসর্গ করেছিলেন।৭২

ভূদেবের সঙ্গে প্রথমে পরিচয় হলেও মধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো গৌরদাস বসাকের সঙ্গে। তাঁদের পরিচয় হয় ১৮৪০ সালে। এর আগে গৌরদাস কোথায় পড়তেন, তা জানা যায় না। তাঁর সঙ্গে একবার বন্ধুত্ব হবার পরে মধু আর তাঁকে কোনো দিন ভুলে যেতে পারেননি। সুখে-দুঃখে এই সম্পর্ক টিকে ছিলো তাঁর জীবনের একেবারে গোধূলি পর্যন্ত। কখনো খিদিরপুর থেকে বড়োবাজারে, কখনো মাদ্রাস থেকে কলকাতায়, কখনো কলকাতা থেকে বালেশ্বরে কি খুলনায়, কখনো ভার্সাই থেকে বাগেরহাটে এরই নামে কবি যে-অসংখ্য চিঠি লিখেছিলেন, তার অনেকগুলো হারিয়ে গেলেও, প্রায় সত্তরখানা রক্ষা পেয়েছে। চিঠিতে যে-ভাষায় তিনি বার বার গৌরদাসের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন অথবা গৌরদাসের ভালোবাসা কামনা করেছেন, তা সাধারণত প্রেমিকার জন্যে প্রেমিক জমা করে রাখে। প্রথম দিকে তাঁর লেখা গোটা পঞ্চাশেক কবিতার মধ্যে আটটি গৌরদাসের প্রতি উৎসর্গ করা অথবা তাঁকে নিয়ে লেখা। এর মধ্যে একটিতে বন্ধুকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন:

Tho’ short, oh! too short is the Time we’ve, My Gour!

To meet on this side of the tomb, killing thought!

Yet Friendship and Love shall be e’er ours, My Gour!

Where’er may Fate land me, thou shan’t be forgot!৭৩

এই ভালোবাসাকে সাধারণ বন্ধুত্বের চেয়ে আরও গভীর বলে মনে হয়। বস্তুত, ভূদেবের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর গৌরদাসের প্রতি তাঁর ভালোবাসা – প্রকৃতি এবং মাত্রা উভয় দিক দিয়ে আলাদা। তাঁরা একে অন্যকে যেভাবে সাহায্য করেছেন, তা-ও দৃষ্টান্ত হবার যোগ্য। আমরা নানা জায়গাতে এঁদের পারস্পরিক যোগাযোগ দেখতে পাবো। ১৮৪০ সালে মধুর আরো দুজন বন্ধু জোটে — বন্ধুবিহারী দত্ত আর শ্যামাচরণ ল। ভূদেব, গৌরদাস, বন্ধুবিহারী, শ্যামাচরণ আর কবি নিজে — এই পাঁচজনই ছাত্র হিশেবে খুব ভালো ছিলেন। সে জন্যে ১৮৪১ সালে সিনিয়র স্কুলের পঞ্চম শ্রেণী থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে এরা সবাই বৃত্তি পান। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ: এঁরা সবাই এক লাফে পঞ্চম শ্রেণী থেকে চতুর্থ অথবা তৃতীয় শ্রেণীতে নয়, একেবারে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছিলেন। গৌরদাস ছাড়া বন্ধুবিহারী দত্তের সঙ্গে একটা পর্যায়ে মধুর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এই ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করে বন্ধুবিহারী বলেছেন যে, তিনি অনেক সময়ে মধুদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সেখানে দু-এক দিন কাটিয়ে আসতেন। মধুর মা এবং বাবাও তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। বিশেষ করে মধুর মা তাঁকে ভালো ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।৭৪মধুর মতো বন্ধুবিহারীও পত্রপত্রিকায় লিখতেন। সে সূত্রেও দুজনের মধ্যে ভাব হয়েছিলো।

ও দিকে, রাজনারায়ণ বসুও এ সময়ে হিন্দু কলেজে পড়তেন। তিনি হেয়ার সাহেবের স্কুল থেকে এই কলেজে আসেন ১৮৪০ সালে। এখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। মধু তখন তার দুই শ্রেণী নিচে — ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। কিন্তু তিনি নিচ থেকে লাফিয়ে উঠে ১৮৪২ সালে রাজনারায়ণের সহপাঠী হন। তবে তাঁর সঙ্গে তখন মধুর বন্ধুত্ব, এমনকি, বিশেষ আলাপও হয়নি। ক্লাসে নতুন ছাত্র এলে। পুরোনোরা অনেক সময়ে তাদের সহজে গ্রহণ করতে রাজি হয় না। রাজনারায়ণের ক্লাসে মধু এবং তাঁর অন্য চার বন্ধু নতুন ছিলেন। (কারণ তাঁরা ক্লাস ডিঙিয়ে রাজনারায়ণদের সহপাঠী হয়েছিলেন।) তাঁরা যে নিচের ক্লাস থেকে এক বারে এই ক্লাসে উঠেছিলেন, তার জন্যে এই ক্লাসের অন্য ছাত্ররা তাঁদের অন্তত কিছু কাল সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি, এটা অনুমান করা অসঙ্গত হবে না। তদুপরি, রাজনারায়ণ বৃত্তি-পাওয়া ভালো ছাত্র ছিলেন। সাহিত্যেও তাঁর দখল ছিলো। সে জন্যে তিনি যদি মধুকে বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিশেবে অথবা তাচ্ছিল্যর দৃষ্টিতে দেখে থাকেন, তা হলে অবাক হবো না। একদিন কলেজের জুনিয়র বিভাগের শিক্ষক রামতনু লাহিড়ীর পটলডাঙার বাড়িতে তাঁদের আলাপ হয়। সেখানে মিল্টন এবং শেকসপীয়র থেকে মধুর অনর্গল আবৃত্তি শুনে রাজনারায়ণ মুগ্ধ হন। ঈর্ষা বোধ করেন বটে, তবে একই সঙ্গে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও বোধ করেন।৭৫ অবশ্য আলাপ একটু এগুলেও, কলেজ জীবনে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা হয়নি।

মধু তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে আরও কয়েক জনের কথা এখানে-ওখানে উল্লেখ করেছেন — শ্রীরাম চট্টোপাধ্যায়, স্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, হরি আর বেণীমাধব বসু। বেণীমাধবের নামে তিনি একটি কবিতাও উৎসর্গ করেছিলেন।৭৬ বেণীমাধব নিজেও কবিতা লিখতেন। মধুর আর-একজন বিশিষ্ট সহপাঠী ছিলেন গোবিন্দচন্দ্র দত্ত — কলেজের পরিচালকমণ্ডলীর সেক্রেটারি এবং ছোটো আদালতের জজ রসময় দত্তের পুত্র। (রসময় দত্ত একই সঙ্গে সংস্কৃত কলেজেরও সেক্রেটারি ছিলেন।) তিনিও স্কলারশিপ-পাওয়া ভালো ছাত্র ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মধুর পরিচয় দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠার পরে। রাজনারায়ণ বসু এবং গোবিন্দ দত্ত ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এঁদের বন্ধুত্বের একটা কারণ: দুজনেই সাহিত্য, বিশেষ করে ইংরেজি কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতেন। রাজনারায়ণ এঁর কথা উল্লেখ করে তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন: “কলেজে থাকিতে ইংরাজী কবিতা পড়িতাম,না বলিয়া, তাহা গিলিতাম বলিলে হয়, তাহা এমনই আগ্রহের সহিত পাঠ করিতাম। ইনি এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একহৃদয় ছিলেন বলিলে হয়। প্রাচীন এবং আধুনিক ক্ষুদ্রতম ইংরাজী কবির গ্রন্থ পর্যন্ত আমরা পড়িতাম।”৭৭ কেবল সাহিত্য পড়াই নয়, গোবিন্দ দত্ত ইংরেজিতে কবিতাও লিখতেন। (তাঁর এই প্রতিভা) পরে তাঁর দুই কন্যা তরু এবং অরু দত্ত লাভ করেছিলেন।) ছাত্রজীবনে এঁর সঙ্গে মধুর কোনো ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো বলে জানা যায় না। পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং ঈর্ষা হয়তো এর কারণ। ভোলানাথ চন্দ্রের সঙ্গেও মধুর বেশ বন্ধুত্ব ছিলো। তাঁর কথা কবি তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। অন্য আরও দুজন সহপাঠীর সঙ্গে মধুর ওঠা-বসা ছিলো বলে জানা যায় — এঁরা হলেন: দিগম্বর মিত্রের ভাই মাধব মিত্র আর গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

মধু এবং তাঁর বন্ধুদের মধ্যে লেখাপড়ার ব্যাপারে বেশ স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা ছিলো বলে আভাস পাওয়া যায়। গৌরদাসকে লেখা মধুর চিঠিপত্র থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, গৌরদাসও স্কুলপাঠ্য বইপত্রের বাইরে অনেক বই এবং পত্রপত্রিকা পড়তেন। মোট কথা, এই কলেজের ভালো ছাত্ররা কলেজে থাকতেই যথেষ্ট লেখাপড়া শিখতেন। এঁদের মধ্যে, মধুর আবার বিশেষ করে নাম ছিলো — “গ্রন্থকীট”। তা থেকে বোঝা যায়, তিনি সেই তরুণ বয়সেই কতোটা অধ্যয়ন করতেন। তবে তাঁর কোনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে তাঁর লেখাপড়ার তফাত ছিলো। তাঁর অনেক বন্ধু পড়তেন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্যে। কিন্তু মধু পড়তেন জানার জন্যে। পরীক্ষা তাঁর কাছে খুব জরুরী ছিলো না। যদিও ভালো ছাত্র হিশেবে পরীক্ষায়ও তিনি ভালো করতেন। গণিতে তাঁর আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি যে গণিতেও ভালো করতে পারতেন, ক্লাসে তার পরিচয় দিয়েছিলেন। অন্যরা যে-অঙ্ক করতে পারেননি, সেই অন্ধ করে তিনি নাকি মন্তব্য করেছিলেন: “দেখলে তো, শেকসপীয়র ইচ্ছে করলে নিউটন হতে পারতেন, কিন্তু নিউটন ইচ্ছে করলে শেকসপীয়র হতে পারতেন না।”৭৮ মধু স্বভাব-কবি ছিলেন না। মিল্টনের মতো তিনি হয়েছিলেন পণ্ডিত-কবি। তাঁর সেই পাণ্ডিত্য এবং বৈদগ্ধ্যের প্রথম ধাপ নির্মিত হয়েছিলো হিন্দু কলেজে।৭৯

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধায়কেও মধু “আমার খিদিরপুরের ছেলেবেলার সাথী” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্য হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন না। তদুপরি তিনি বাস করতেন কলকাতার বাইরে। পাঁচ বছর বয়স থেকে তিনি প্রথমে বাকুলিয়ার পাঠশালা এবং পরে মিশনারিদের স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তার পরে তিনি ১৮৪৩ সাল অবধি লেখাপড়া শেখেন হুগলি কলেজে। আট বছরের সময়ে তাঁর বাবা মারা যান। আগাগোড়া তিনি তাঁর পুত্রহীন বড়ো মামা, মধুদেব প্রতিবেশী, রামকমল মুখোপাধ্যায়ের স্নেহ এবং তত্ত্বাবধানে মানুষ হয়েছিলেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তিনি কলকাতায় বাস করতে আরম্ভ করেন, তাঁর মা মারা যাবার পরে, ১৮৪৩ সাল থেকে।৮০ আবার তখন থেকে মধুও মাইকেলে পরিণত হন এবং খিদিরপুরে তাঁর বাসের পর্ব চুকে যায়। সুতরাং রঙ্গলাল কবির কতোটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, অথবা তাঁদের মধ্যে কতোটা যোগাযোগ ঘটেছিলো, সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। ১৮৬০ সালের আগে পর্যন্ত মধুর কোনো চিঠিতে রঙ্গলালের কোনো উল্লেখও দেখতে পাইনে। হতে পারে, রঙ্গলালরা তাঁদের বাল্যবয়সে মাঝেমধ্যে কলকাতায় বড়ো মামার বাড়িতে বেড়াতে আসতেন এবং প্রতিবেশী হিশেবে তখন মধুর সঙ্গে রঙ্গলালের পরিচয় হয়। রঙ্গলাল এবং তাঁর বড়ো ভাই গণেশচন্দ্র আর ছোটো ভাই হরিমোহন মধুর মাকে যে মা ডাকতেন, সেটাও ১৮৪৩ সালের পরের ঘটনা হওয়াই সম্ভব। তার অল্প আগে তাঁদের মা মারা যান। অন্য দিকে জাহ্নবী দেবীও ১৮৪৩ সালের ফেব্রুআরি থেকে বস্তুত তাঁর একমাত্র পুত্রকে হারান। সুতরাং উভয় পক্ষের জন্যেই এই মা-পাতানো পারস্পরিক সান্ত্বনার কারণ হয়েছিলো।

যে-রোম্যান্টিক কবিদের মধু মনে মনে পুজো করতেন, তাঁদের সঙ্গে তুলনা করলে তিনি কবি হয়েছিলেন বেশ পরিণত বয়সে। বায়রন অথবা শেলির কবিতা বয়ঃসন্ধি কালেই প্রকাশিত হয়েছিলো।৮১ মধু যে তাঁর জীবনের প্রথম ন-দশ বছর গ্রামে কাটিয়েছিলেন এবং তারপর সেই শিকড় কেটে নতুন করে কলকাতার শক্ত মাটিতে শিকড় গেড়েছিলেন, তার জন্যে তাঁর হয়তো কিছু বাড়তি সময় নষ্ট হয়েছে। নয়তো মধুর মন কম বয়সেই পরিণতি লাভ করেছিলো। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাঁর কবিজীবনের গোড়া পত্তন হয়েছিলো হিন্দু কলেজে এবং, আগেই লক্ষ্য করেছি, তাতে সবচেয়ে বড়ো অবদান রেখেছিলেন রিচার্ডসন। তা ছাড়া, হিন্দু কলেজে যা পড়ানো হতো এবং যাঁরা এসব বিষয় পড়াতেন তাঁদের ব্যক্তিগত রুচি এবং ঝোঁক — উভয়ই এর জন্যে অনেকাংশে দায়ী।

কেবল সাহিত্যরুচি নয়, মাইকেলের গোটা মানস-গঠনে হিন্দু কলেজ পর্ব ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জীবনের, বলতে গেলে, প্রতিটি ক্ষেত্রে চিরকেলে প্রথা এবং রীতির বিরোধিতা করেছেন। তাঁর কয়েক বছর আগেকার ছাত্রদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মহেশচন্দ্র ঘোষ খৃস্টান হয়ে হিন্দু সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন।৮২ রসিককৃষ্ণ মল্লিক শপথ নিতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি গঙ্গাজলের পবিত্রতা মানেন না।৮৩ মাধবচন্দ্র মল্লিক হরকরা পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলেন এই বলে যে, তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা যদি অন্তর থেকে কিছু ঘৃণা করেন, তা হলে সেটা হলো হিন্দু ধর্ম।৮৪ খৃস্টধর্ম গ্রহণ করার আগে পর্যন্ত মধু তেমন গুরুতর অথবা চাঞ্চল্যকর কিছু না-করলেও নিজস্ব ভঙ্গিতে তিনিও কম বিদ্রোহী ছিলেন না। বস্তুত, তাঁর নানা আচরণে প্রচলিত রীতির বিরোধিতা দেখতে পাই। পরিবারের কাছ থেকে তিনি যে-অতিরিক্ত আদর এবং প্রশ্রয় পেয়েছিলেন, তা এ বিষয়ে তাঁকে উৎসাহিত করেছিলো। কিন্তু তা-ই একমাত্র কারণ নয়।

একটি ঘটনার কথা শোনা যাক, গৌরদাসের স্মৃতিচারণ থেকে। গৌরদাসের সঙ্গে বেশ ভাব হবার পরে মধু অনেক সময়ে যেতেন বড়োবাজারে তাঁদের বাড়িতে (২ নম্বর বসাক লেন)।৮৫ এ পর্যায়ে তিনি একদিন গৌরকে তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। সেই প্রথম। তাঁর সঙ্গে ভোলানাথ চন্দ্র। সেজেগুজে গৌরদাস সেখানে হাজির হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা আঘাত পেয়ে মুহূর্তের জন্যে পিছিয়ে যান। তিনি এবং ভোলানাথ সেখানে গিয়ে দেখেন, রাজনারায়ণ দত্ত আলবোলা টানছেন। তাঁর টানা শেষ হবার পরে তিনি নলটা এগিয়ে দিলেন মধুর দিকে। তারপর মধুও তৃপ্তির সঙ্গে তামাকের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন।৮৬ ১৮৪০-এর দশকে গুরুজনের সামনে ধূমপানের প্রতি মূল্যবোধ কতোটা কঠোর ছিলো, সঠিকভাবে বলা শক্ত। তবে গত শতাব্দীর শেষ দিকে ধূমপান না-করা ভালো চরিত্রের লক্ষণ এবং গুরুজনদের সামনে ধূমপান না-করা ভব্যতার অঙ্গ বলে বিবেচিত হতে আরম্ভ করে। (ব্রাহ্মদের প্রভাব হওয়া অসম্ভব নয়।) হতবাক গৌরদাস পরে মধুকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে মধু বলেন যে, তাঁর পিতা অন্য অভিভাবকদের মতো এসব তুচ্ছ আচার-অনুষ্ঠানের ধার ধারেন না।৮৭

অনেকে বলেছেন, মধু সেই বয়স থেকে রাতে ঘুমানোর আগে এক পাত্র মদও খেতেন। তাঁর অন্যতম বন্ধু বন্ধুবিহারীও এ রকমের সাক্ষী দিয়েছেন।৮৮ কিন্তু এ কথা ঠিক নয় বলেই মনে হয়। অন্তত এ উক্তির মধ্যে অতিরঞ্জন আছে, এবিষয়ে সন্দেহ নেই। মধু পরে মদ্যপায়ী হিশেবে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন, ধারণা করি, সে জন্যে তাঁর বন্ধু এবং জীবনীকারেরা পরে তাঁর মদ্যপান সম্পর্কে অনেক কথাই কল্পনা করে নিয়েছেন বা বাড়িয়ে বলেছেন। ১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে গৌরদাস বসাককে নৌকোয় ভ্রমণ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে মধু একটি চিঠি লেখেন। তাতে তিনি লেখেন যে, গৌরদাস সঙ্গে করে উদার-মনা বন্ধুদের আনতে পারেন। [অন্যদের নয়।] কারণ তিনি এই প্রথমবারের মতো সুরা-দেবের পূজা করতে চান।৮৯ মোট কথা, মধুসূদন হিন্দু কলেজে থাকতেই মদ্যপান করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু রোজ রাতে ঘুমানোর আগে এক পাত্র মদ্যপান করতেন — এ কথা অভ্রান্ত বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, মদ্যপান করাকে এখন যতোটা অসাধারণ বলে বিবেচনা করা হয়, সে সময়ে তা তেমন মহাভারত-বিধ্বংসী বলে গণ্য হতো না। বরং, সেকালে শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে মদ খাওয়া ব্যাপকভাবে চালু ছিলো। একে অপরাধ মনে না-করে অনেকে একে বিবেচনা করতেন চলতি হাওয়ার পন্থা বলে। অনেকে আবার মনে করতেন যে, মদ খাওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা প্রাচীন সমাজের সঙ্গে তাঁদের বন্ধন, বিশেষ করে রক্ষণশীল মূল্যবোধের শিকল কাটিয়ে উঠতে পারবেন।৯০ বস্তুত, অনেকের কাছে মদ্যপান ছিলো পাশ্চাত্য চিন্তাধারার মতোই উদারনৈতিকতার প্রতীক। পরে মদ্যপান নিবারণী সভার পৃষ্ঠপোষক হলেও, রাজনারায়ণ বসু হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ে অত্যন্ত পানাসক্ত ছিলেন। এর দরুন তিনি পীড়ায় আক্রান্ত হন এবং কলেজের লেখাপড়া পুরোপুরি শেষ হবার আগেই বাধ্য হন কলেজ ছাড়তে। পরিমিত মদ্যপানের শিক্ষা দেবার জন্যে তাঁর পিতা তাঁকে নিয়ে রোজ সন্ধ্যে বেলায় মদ এবং মাংস খেতেন। কিন্তু পিতার সঙ্গে দু গ্লাস শেরি খেয়ে রাজনারায়ণের তৃপ্তি হতো না। সে জন্যে তিনি পিতাকে না-জানিয়ে অন্যত্রও মদ খেতেন। ১৮৪৬ সালে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেবার সময়ে পুরোনো মূল্যবোধ মুছে ফেলার প্রতীক হিশেবে তিনি বিস্কিট আর মদ খেয়েছিলেন।৯১ খৃস্টান এবং মুসলমানদের তৈরি বলে বিস্কিট খাওয়াও সেকালে মদের মতো গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হতো।

ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবর্তক স্বয়ং রামমোহন রায় রোজ পরিমিত পরিমাণে মদ খেতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪০-এর দশকে মহর্ষি বলে পরিচিত না-হলেও, তিনিই ধর্মীয় উৎসাহ এবং আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্রাহ্ম মূল্যবোধ প্রচার করতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনিও নিয়মিত মদ খেতেন। ১৮৫১ সালে অক্ষয়কুমার দত্তের প্রভাবে তিনি মদ না-খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।৯২ তখনকার বিখ্যাত লোকদের মধ্যে অনেকে মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে অকালে মারা যান। এঁদের মধ্যে হরিশ মুখার্জি, কিশোরীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ এবং ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।৯৩ ইংরেজি শিক্ষিত তরুণরা মদ্যপানকে কোন দৃষ্টি দিয়ে দেখতেন, মাইকেলের একেই কি বলে সভ্যতায় তার চমৎকার ছবি দেখতে পাওয়া যায়।৯৪ রাজনারায়ণ বসুও এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

তখন হিন্দু কলেজের ছাত্ররা মনে করিতেন যে, মদ্যপান করা সভ্যতার চিহ্ন, উহাতে দোষ নাই। তখনকার কলেজের ছোকরারা মদ্যপায়ী ছিলেন বটে, কিন্তু বেশ্যাসক্ত ছিলেন না। তাঁহাদিগের এক পুরুষ পূর্বে যুবকেরা মদ্যপান করিত না — কিন্তু অত্যন্ত বেশ্যাসক্ত ছিল; গাঁজা, চরস খাইত, বুলবুলের লড়াই দেখিত, বাজি রাখিয়া ঘুড়ি উড়াইত ও বাবরি রাখিয়া মস্ত পাড়ওয়ালা ঢাকাই ধুতি পরিত। কলেজের ছোকরারা এইসব রীতি একেবারে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।৯৫

আগেই বলেছি, রাজনারায়ণ বসু মধুর সহপাঠী হলেও কলেজ-জীবনে তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। উঠলে, যে-গোলদিঘিতে বসে রাজনারায়ণ মদ খেতেন, মধুকেও হয়তো সেখানে তিনি সঙ্গী হিশেবে পেতেন। কিন্তু মদ্যপানের প্রতি মধুর মনোভাব যেমনই হোক না কেন, রাজনারায়ণ বেশ্যাদের প্রতি কলেজের ছাত্রদের অনাসক্তির যে-মনোভাব প্রকাশ করেছেন,৯৬ তা মধুসূদন সম্পর্কে সমানভাবে প্রযোজ্য।

রাজনারায়ণ দত্তের পরিবার শাক্ত ছিলেন কিনা, জানিনে, কিন্তু মাংসে তাঁদের বেশ রুচি ছিলো। মধু বাল্যকাল থেকে মাংস খেতে শিখেছিলেন। গৌরদাসকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে দেখতে পাই, তিনি পরের দিন তাঁকে নিয়ে নৌকা ভ্রমণে যাবার সময়ে সঙ্গে করে বিস্কিট আর পাঁঠার মাংসের প্যাটিস নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছেন।৯৭ মনে হয়, বন্ধুকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে তিনি এই খাবারের নাম উল্লেখ করেছিলেন। গৌরদাস বসাক ছিলেন বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান। বন্ধুদের মধ্যে মাংস খাবার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তাঁকেও প্রভাবিত করেছিলো। মধুর বাড়িতে তিনি প্রথম পাঁঠার মাংস খান এবং, নিজেই লিখেছেন যে, তা তাঁর খুব ভালো লেগেছিলো।৯৮ ভোলানাথ চন্দ্র ও জাহ্নবী দেবীর রান্না-করা পাঁঠার মাংসকে মাংসের রাজা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।৯৯বন্ধুবিহারীও মধুদের বাড়িতে মাংস খেয়েছেন। তা ছাড়া, কলেজের কাছে এক রেস্তোরাঁয় মধুতীকে মোরগ আর পাঁঠার মাংস খাওয়াতেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।১০০ হিন্দু কলেজের অনেক ছাত্রই — রাজনারায়ণ বসুও — গোমাংস খেতে আদৌ অপছন্দ করতেন না। আত্মচরিতে রাজনারায়ণ বসু বর্ণনা দিয়েছেন যে, তর সইতো না বলে তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা কলেজের গেট দিয়ে না-বেরিয়ে কলেজের দেয়াল টপকে কাবাব কিনতে যেতেন।১০১ মধুও সে বয়সে নিষিদ্ধ মাংস খাওয়া আরম্ভ করেছিলেন কিনা, জীবনীকারেরা সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে মনে হয়, কেবল পানীয় এবং বিস্কিটের প্রতিই নয়, অন্য খাদ্যের প্রতিও তাঁর মনোভাব বেশ উদার ছিলো।

মধু যে পিতার সঙ্গে একত্রে হুঁকো খেতেন, তা থেকে গুরুজনদের প্রতি তাঁর মনোভাব খানিকটা বোঝা যায়। তিনি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ছিলেন, তা বলা না-গেলেও, তিনি যে গুরুজনদের সম্পর্কে প্রচলিত অনেক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে শেখেননি, তার বেশ আভাস পাওয়া যায়। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর বিয়ের আয়োজন করা হলে গুরুজনদের আদেশ এবং মাতার অশ্রু অগ্রাহ্য করে তিনি যে নিজের পথে পা বাড়িয়েছিলেন, সেই সম্ভাবনার বীজ আসলে তাঁর মধ্যে অনেক আগেই বপন করা হয়েছিলো। বস্তুত, আচার-আচরণে, পোশাকে-আশাকে তিনি বহু প্রথাই ভঙ্গ করেছিলেন। নতুন কায়দায় অথবা ফিরিঙ্গিদের মতো তাঁর চুল ছাঁটার কথা তাঁর বন্ধু ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণের দৌলতে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে।১০২ বিশেষ করে এক মোহর দিয়ে চুল ছাঁটানোর কথা। পোশাকেও তিনি ছিলেন অনৈতিহ্যিক। প্রথমে ধুতি পরলেও ক্রমে তিনি আচকান এবং পরে কোট- প্যান্টালুন পরতে আরম্ভ করেন। তাঁর বন্ধুদের স্মৃতিচারণ থেকে মনে হয়, হিন্দু কলেজের কোনো ছাত্র তাঁর আগে পাশ্চাত্য পোশাক পরেননি।১০৩

প্রসঙ্গত বিয়ে এবং নারী সম্পর্কে সেকালের প্রথা-বিরুদ্ধ তাঁর রোম্যান্টিক মনোভাবের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যে-সময়ে নারীদের গণ্য করা হতো নিতান্ত ভোগের সামগ্রী এবং প্রায় জড় পদার্থ হিশেবে, মধুসে সময়েই তাদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর এই মনোভাবের সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়, রচনা-প্রতিযোগিতা উপলক্ষে স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে তিনি যে-প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তা থেকে। ১৮৪২ সালে তিনি যখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র তখন রামগোপাল ঘোষ স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে একটি রচনার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করেন। এই প্রতিযোগিতায় তাঁর এই প্রবন্ধটি সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচিত হয় এবং তিনি এর জন্যে স্বর্ণপদক পান। তাঁর বন্ধু ভূদেব পেয়েছিলেন, রৌপ্যপদক। মা শিক্ষিত না-হলে সন্তানকে শিক্ষিত করা কঠিন হয় — এ যুক্তি সবারই জানা এবং মধুও তা লিখতে ভুলে যাননি। কিন্তু বিশেষভাবে তিনি যা লিখেছিলেন, তা হলো:

Extensive dissemination of knowledge amongst women is the surest way that leads a nation to civilization and refinement… The happiness of a man who has an enlightened partner is quite complete… In India … women are looked upon as created merely to contribute to the gratification of the animal appetites of men…. The people of this country do not know the pleasure of domestic life, and indeed they cannot know, until civilization shows them the way to attain it১০৪

মেয়েদের শিক্ষা দেওয়াকে তিনি গণ্য করতেন সভ্যতার প্রতীক এবং পারিবারিক জীবনকে আরও উপভোগ্য করে তোলার পূর্ব-শর্ত হিশেবে। তাঁর বিশ্বাস ছিলো, শিক্ষা লাভের মাধ্যমে মহিলারা পুরুষদের যথার্থ জীবন-সঙ্গিনী এবং আত্মার দোসর হয়ে উঠবেন। রমণীরত্ন যে বোখারা আর সমরখন্দের সমস্ত রত্ন এবং অলঙ্কারের চেয়েও বেশি মূল্যবান, ফারসি কবির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন।১০৫ তাঁর বন্ধুরা, এমন কি, তাঁর মা বলেছেন, তিনি নাকি মনে করতেন, বাঙালি মেয়েরা সৌন্দর্য অথবা গুণের দিক দিয়ে ইংবেজ মেয়েদের এক শো ভাগের এক ভাগও নয়। বাঙালি মহিলারা অশিক্ষিত বলে তাঁদের সঙ্গে স্বামীদের সম্পর্ক, তাঁর মতে, কখনোই পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনা। আমরা পরে দেখতে পাবো, এ কেবল তাঁর রচনার কথা নয়, এই বক্তব্য তিনি বিশ্বাস করতেন মনেপ্রাণে।

গৌরদাস বলেছেন যে, মধু প্রথম দৃষ্টিতে প্রেমে পড়ার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।১০৬ অন্যের পছন্দ করা কোনো মেয়েকে তিনি বিয়ে করবেন না এবং প্রেম করে বিয়ে করবেন — তাঁর এই আদর্শ অবশ্য স্বদেশের মাটিতে প্রোথিত ছিলো না। সেকালের লোকেরা অভিভাবকের পছন্দ করা বালিকাকে বিয়ে করেই সুখী হতেন। তা ছাড়া, কুলীনকন্যা অথবা অন্য কোনো সমস্যা-আক্রান্ত মেয়ে ছাড়া, সাধারণত সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে যেতো দশ-বারো বছর বয়স হবার মধ্যে। সে জন্যে কোর্টশিপের ধারণা ছিলো একেবারে অবাস্তব। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মধু সেই কোর্টশিপের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তিনি যে- সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের জীবনী পড়েছিলেন, সেখানেই খুঁজে পেয়েছিলেন এই আদর্শ। পরে এ সম্পর্কে আমরা আরও বিস্তারিত দেখতে পাবো।

আগেই লক্ষ্য করেছি, মধু ছিলেন রিচার্ডসনের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। তবে কেবল ভালো ছাত্র বলে কলেজের অধ্যক্ষ তাঁকে স্নেহ করতেন না। ভালো ছাত্র কলেজে আরো ছিলেন। কিন্তু মধুর মধ্যে তিনি যে-কবিত্ব এবং প্রতিভার স্বাক্ষর দেখতে পেয়েছিলেন, সেটা অন্য কারো মধ্যে প্রত্যক্ষ করেননি। পরে আমরা দেখতে পাবো, মধুর প্রকাশিত একটি দেয়াল-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে রিচার্ডসন এই বিশেষ স্নেহের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর প্রতি রিচার্ডসনের এই স্নেহের কথা তিনি ভালো করে জানতেন এবং সে কারণে শিক্ষকের প্রতি তাঁর যে-কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা ছিলো, তা সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকেও জোরদার করেছিলো। তাঁর বন্ধুরা সাহিত্য পড়তেন, কিন্তু মধু সাহিত্যকে তাঁর নিজের জীবনে স্বীকরণ করতে চেষ্টা করতেন। তখন হিন্দু কলেজে যে-সাহিত্য পড়ানো হতো, তা-ও ছিলো অত্যন্ত ব্যাপক এবং বিচিত্র। সে কারণে, তরুণ মধু নানা স্বাদের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলেন।

কিন্তু তখন সাহিত্যের যে-শাখা তাঁর হৃদয় হরণ করেছিলো, তা হলো রোম্যান্টিক কবিদের রচনা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে আরম্ভ করে ক্যাম্পবেল পর্যন্ত নাম-করা সব রোম্যান্টিক কবির রচনা তিনি পড়েছিলেন। আগেই যেমনটা বলেছি, এঁদের মধ্যে বায়রনই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। ধীরে ধীরে কীটস,মূর এবং স্পেনসরও তাঁকে আকৃষ্ট করেন। তাঁর সহপাঠীদের বেশির ভাগ রিচার্ডসনের সংকলন থেকে রোম্যান্টিক কবিদের কবিতা পড়ে সন্তুষ্ট হতেন; কিন্তু তিনি কেবল তাঁদের রচনা পাঠ করে খুশি হতেন না, জানতে চাইতেন তাঁদের জীবনের কথা। তা ছাড়া, নিজের জীবনে তাঁদের অনুকরণ করতেন সজ্ঞানে। যেমন রিচার্ডসনকে তিনি ভালোবাসতেন বলে তাঁর হাতের লেখাটিও তিনি অনুকরণ করতে চেষ্টা করতেন — যদিও রিচার্ডসনের হাতের লেখা আদৌ ভালো ছিলো না।১০৭ তখনো পর্যন্ত বায়রন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কবি। সে জন্যে, কেবল তাঁর কবিতা পড়ে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বায়রনের জীবনের সব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। টমাস মূরের লেখা বায়রন-জীবনী (Letters and Journals of Lord Byron, 1830. ১৮৪০ সালের আগেই এ বই-এর চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো, ধারণা করি, মধু কিনেছিলেন ১৮৩৮ সালের সংস্করণ — খুব ছোটো হরফে ছাপা ৭৩৫ পৃষ্ঠার বই।) কিনে তিনি কী আগ্রহের সঙ্গে তা পড়েছিলেন, গৌরদাসকে লেখা একাধিক চিঠি থেকে তা বোঝা যায়।১০৮ বায়রনের প্রতি তাঁর এই আকর্ষণ ধ্রুপদী সাহিত্যে তাঁর ভালোবাসা জন্মানোর পর অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিলো; তবু রোম্যান্টিক কবিদের মধ্যে বায়রনের প্রতিই তাঁর ভালোবাসা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো। হিন্দু কলেজে ভর্তি হবার আগে তিনি একাধিক ধ্রুপদী ভাষার সঙ্গে সামান্য পরিচিত হলেও, ১৮৪১-৪২ সাল পর্যন্ত ধ্রুপদী সাহিত্যে আগ্রহ দেখাননি। শেকসপীয়রের রচনাও পাঠ্য ছিলো, কিন্তু তা তখন পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত, হৃদয়ের সঙ্গে নয়।

মধু ভালো ছাত্র হিশেবে পরিচিত হয়েছিলেন এবং এ-ও একটা কারণ যার জন্যে তিনি বাবা-মার কাছে বাড়তি প্রশ্রয় লাভ করেছিলেন। ইতিপূর্বে দেখা গেছে, তিনি ১৮৪১ সালের শেষ দিকে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পরীক্ষা দিয়ে কেবল বৃত্তি লাভ করেননি, সেই সঙ্গে দুটি ধাপ ডিঙিয়ে একেবারে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছিলেন। তাঁকে ঘিরে রাজনারায়ণ দত্ত এবং জাহ্নবী দেবী উভয়ই নিশ্চয় অনেক স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন। তাঁকে নিয়ে তাঁর বাবার কতো গর্ব ছিলো, পরের অধ্যায়ে তাঁর সোনার পদক প্রাপ্তি উপলক্ষে আমরা তা লক্ষ্য করবো। সেকালে পরিবারের আয়তন বহু ক্ষেত্রে এখনকার তুলনায় অনেক বড়ো হতো। তাঁদের যে আরও কয়েকটি সন্তান ছিলো না, সে জন্যে রাজনারায়ণ এবং জাহ্নবী দেবীব হয়তো মনে মনে দুঃখ ছিলো। কিন্তু তাঁরা নিজেদের মনকে নিশ্চয়ই বলে সান্তনা দিয়ে থাকবেন যে, মধু তাঁদের সোনার টুকরো ছেলে। এমন ছেলে একাই তাঁদের বংশই কেবল টিকিয়ে রাখতে পারবে না; বরং সে তাঁদের মুখও উজ্জ্বল করতে সমর্থ হবে। তাঁরা হয়তো কল্পনা করেছেন, লেখাপড়া শেষ করে মধু সমাজে প্রতিপত্তি লাভ করবে। তার জন্যে একটি টুকটুকে লাল বৌ নিয়ে আসবেন তাঁরা। কিন্তু তাঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, তাঁদের একমাত্র সন্তান একদিন থেকেও থাকবে না — সরে যাবে তাঁদের কাছ থেকে অনেক দূরে।

*

মধু কখন থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন, ঠিক জানা যায় না। তবে তাঁর বয়স ১৭ হবার আগেই — এটা অনুমান করা সম্ভব। ১৮৪১ সালের তারিখ দেওয়া তাঁর সাতটি কবিতা পাওয়া গেছে। তাঁর যেসব কবিতায় কোনো তারিখ দেওয়া নেই, সেসবের মধ্যেও কতোগুলো এ বছরে লেখা। ১৮৪২ সালের তারিখ দেওয়া কবিতার সংখ্যাও সাত। এসব কবিতায় ভাষা, ছন্দ এবং আঙ্গিকের যে-পরিচয় পাওয়া যায়, তা থেকে অবশ্যই মনে হয় যে, এর বেশ কিছুকাল আগে থেকে তিনি কবিতা লেখা আরম্ভ করেছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৮৪১ সালে লেখা তাঁর বহু-উদ্ধৃত একটি কবিতার কথা এখানে বলা যায়:

I sigh for Albion’s distant shore,

Its valleys green, its mountains high;

Tho’ friends, relations, I have none

In that far clime, yet, oh! I sigh

To cross the vast Atlantic wave

For glory, or a nameless grave!

*

My father, mother, sister, all

Do love me and I love them too,

Yet oft the tear-drops rush and fall

From my sad eyes like winter’s dew,

And, oh! I sigh for Albion’s stand

As if she were my native land.

অ্যালবিয়নের যে-দেশের জন্যে তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছেন অথবা অশ্রু বিসর্জন করেছেন, সে দেশে উঁচু কোনো পর্বত নেই, ভারতবর্ষ থেকে সে দেশে যেতে তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ আটলান্টিক পাড়ি দেবারও কোনো দরকার নেই, এমন কি ঘরে তাঁর কোনো ভগ্নীও তাঁর জন্যে চোখের জল ফেলছিলেন না, কিন্তু এসব সত্ত্বেও এ কবিতায় কবিত্বের অথবা আবেগের কোনো অভাব নেই। বোঝা যায়, এই পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্যে কিশোর কবিকে অনেক সাধনা করতে হয়েছে। অনুমান করি, তিনি এর অন্তত দু বছর আগে থেকে কবিতা লিখে হাত মক্স করছিলেন।

তাঁর কৈশোরক কবিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উচ্ছাস এবং গীতলতার প্রাচুর্য। এ পর্যায়ে তিনি কোনো নীলনয়নাকে বাস্তবে ভালোবাসার সুযোগ পাননি — ভালোবাসা জানাতে পেরেছিলেন একমাত্র গৌরদাস বসাককে। তবু বার বার তাঁর ‘aching heart’ নিয়ে তিনি অজানা নীলনয়নার স্বপ্ন দেখেছেন এবং অবাস্তব সেই স্বপ্নকেই প্রেম নিবেদন করেছেন। শেলি ষোলো-সতেরো বছর বয়সে তাঁর সমবয়সী জ্ঞাতি বোন হ্যারিয়েটকে দেখে ভালোবেসেছিলেন। তবে তাঁর কাছ থেকে তেমন অনুকূল সাড়া না-পেয়ে তাঁর সেই ভালোবাসা তখন প্রণয়ে পরিণত হতে পারেনি। কিন্তু হ্যারিয়েট শেলিকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁকে লক্ষ্য করে কবিতা লিখলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। বেচারা মধু দূর থেকেও তেমন কাউকে পাননি, যাকে লক্ষ্য করে তাঁর কবিতাগুলো লিখতে পারেন। অনেক কবিতাই তিনি উৎসর্গ করতেন গৌরদাসের নামে। তাই তিনি যখন লেখেন:

My thoughts, my dreams, are all of thee,

Though absent still thou seemest near;

Thine image everywhere I see-

Thy voice in every gale I hear.

তখন তাকে নিতান্ত অসার ভাবোচ্ছাস বলে বিবেচনা করতে হয়। কেবল একটি জিনিশকে এর মধ্যে খাঁটি বলে মনে হয়, সে তাঁর উপচে-পড়া ভাবাবেগ। অন্য-একটি কবিতায় তিনি বলেছেন:

I loved a maid, a blue-eyed maid,

As fair a maid can e’er be, O

*

For her 1 sighed, and e’er shall sigh’

Tho’ she shall ne’er be mine, O

তাঁর একেবারে গোড়ার দিকের কবিতায় কখনো নীলনয়না, কখনো পেনিলোপি, কখনো কাব্যলক্ষ্মীর কথা ভেবে তিনি মুহুর্মুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। এই কবিতাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে তিনি অনির্দিষ্ট কোনো “কুমারী”র উদ্দেশ্যে প্রেম নিবেদন করেছেন। একটিতে তার সঙ্গে মিলনের কথাও বলেছেন:

When I gladly met her beneath yon almond tree …

There I kissed and embraced her; – and oh! who can tell

What passions tumultuous did in my bosom swell!

কিন্তু তাঁর কৈশোরক কবিতায় বাল্যপ্রেমের উচ্ছাস ছাড়া বাকি সব কিছুনীহারিকার মতো অবয়বহীন। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কবিতায় অবশ্য পরিণতি দেখা দিয়েছে। ১৮৪৩ সাল নাগাদ তিনি King Porus-এর মতো কবিতা রচনা করেছেন। ছটি অনুচ্ছেদ বিভক্ত১৪০ পঙক্তির এই কবিতাটি তখন পর্যন্ত তাঁর লেখা সবচেয়ে লম্বা কবিতা। প্রথম এবং শেষ অনুচ্ছেদ দুটি একই ধরনে সাজানো এবং মাঝখানের চারটি অনুচ্ছেদ ভিন্ন ধরনের। কবিতাটি তিনি কি তাঁর ধর্মান্তরের আগে লেখেন, না পরে, তা সঠিক করে জানা যায়না। একবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিলো ঐবছরের (১৮৪৩) Literary Gleaner পত্রিকায়।১০৯ গোড়াতে তিনি কবিতা লিখতে রুকরেছিলেন ছোটো ছোটো লিরিক দিয়ে। রিচার্ডসন বিশেষ করে লিরিক পছন্দ করতেন। ন্যারেটিভ বা আখ্যানমূলক কবিতায় তাঁর তেমন রুচি ছিলো না। রিচার্ডসনের প্রভাবে তিনি প্রথমে লিরিক কবিতা লিখতে শুরু করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর কবিতায় গল্পের বীজ দেখা দিতে আরম্ভ করে। এবং এ ধরনের কবিতায় কিশোর-কবি তুলনায় বেশি দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রথম দিকের কবিতায় বস্তুর অভাবে থাকতে প্রধানত দুঃখবিলাস, দীর্ঘনিশ্বাস, বিস্ময় এবং প্রেমের জন্যে বয়ঃসন্ধি কালের হা-হুতাশ। কাহিনীমূলক কবিতা লিখতে শুরু করার পরে, তাঁর কবিতায় দেখা দিলো যৎকিঞ্চিৎ বস্তু। রিচার্ডসনের প্রভাবও ততোদিনে তিনি খানিকটা কাটিয়ে উঠেছিলেন।

King Porus কবিতায় আমরা তাঁর আর-একটা বৈশিষ্ট্য নির্ভুলভাবে লক্ষ্য করি। সে হলো: তাঁর দেশপ্রেম। তিনি পাশ্চাত্যের দারুণ ভক্ত ছিলেন — ১৮৪১ সালে অ্যালবিয়নের দেশকে তাঁর স্বদেশ বলেই বিবেচনা করেছেন — As if she is my native land — কিন্তু দু বছরের মধ্যে King Porus- এ তাঁর বক্তব্য অনেকাংশে পাল্টে গেছে।

But where, oh! Where is Porus now?

Where the noble hearts that bled

For Freedom – with the heroic glow

In patriot-bosoms nourish’d ….

And where art thou – fair Freedom!-Thou-

Once goddess of Ind’s sunny clime!

মধুর স্বদেশ ভাবনা এবং দেশপ্রেম তাঁর রোম্যান্টিকতার মতো একেবারে অন্তরিক। তবে তিনি যে-কালে এ কবিতা লেখেন, তখনো ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আন্দোলন আরম্ভ হয়নি অথবা জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয় হবার মতো সময় হয়নি। সে জন্যে, তাঁর বলার ভঙ্গি আলাদা। তা সত্ত্বেও স্বদেশকে নিয়ে তাঁর গর্ব এবং স্বদেশের প্রতি তাঁর প্রেমকে চিনে নিতে অসুবিধে হবার কথা নয়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর এই স্বদেশ-এবং স্বাধীনতা-প্রীতি অক্ষুন্ন ছিলো। তা ছাড়া, তিনি যখন স্বদেশের অথবা স্বদেশ-প্রেমের কথা লিখেছেন, তখন তাঁর কবিতায় সাবলীল ভঙ্গিতে তেজ এবং বলিষ্ঠতা প্রকাশ পেয়েছে। King Porus-এ তিনি যে-স্বতঃস্ফূর্ততা এবং আন্তরিকতা প্রকাশ করেছিলেন, তা কয়েক বছরের মধ্যে আরও পরিণতি লাভ করেছিলো তাঁর প্রথম কাব্য — The Captive Ladie-তে।

১৮৪১ সালের শেষ দিকে তাঁর আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো: একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ। আত্মপ্রকাশের বাসনা কমবেশি সবারই থাকে। তাঁরও ছিলো। তাঁর পরবর্তী জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, বারবার তিনি স্বীকৃতি এবং প্রশংসার জন্যে কাঙালপনা ব্যক্ত করেছেন। বায়রন- জীবনীর মতো শেলির কোনো জীবনীও তিনি সেই বয়সে পড়েছিলেন কিনা, তা জানা নেই। কিন্তু পত্রপত্রিকায় অথবা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার আগেই শেলি তাঁর পিতামহের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিতরণের জন্যে নিজের এবং তাঁর বোনের কবিতা ছাপিয়েছিলেন।১১০ মধু যে-কালে তাঁর কবিতার কোনো প্রকাশক পাননি, সে সময় নিজেই একাধিক কবিতা ছাপিয়ে দেখতে কেমন লাগে, ত, পরীক্ষা করে দেখেছেন।১১১ ধারণা করি, বন্ধুদেরও দিয়েছেন দেখতে। হাতের লেখা পত্রিকা তাঁর সেই আত্মপ্রকাশের একটা বাহন হয়ে দাঁড়ায় এবং সেদি কদিয়ে তা তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই পত্রিকাটিকে ছিলো মাত্র তিন-চার মাস। তবু তার মধ্যে তিনি উপরের ক্লাসের ছাত্রদের ঈর্ষা এবং কলেজের অধ্যক্ষ ডিএলআর-এর প্রশংসা আকর্ষণ করেছিলেন। এই পত্রিকাটি নামে এজমালি পত্রিকা হলেও, এর মধ্যে বারো আনাই থাকতো তাঁর রচনা। রিচার্ডসন এ পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা পড়ে দেখতেন এবং তাতে পত্রিকার প্রধান লেখক এবং সম্পাদক — তরুণ মধু বিশেষ করে উৎসাহ বোধ করতেন। রিচার্ডসন অনেক সময়ে মধুর কবিতা সংশোধন করে দিতেন এবং তাঁর ভাষা, ছন্দ ও কবিতার ভাব কী করে উন্নত করতে হবে সে সম্পর্কে উপদেশ দিতেন।

ভবিষ্যতে মধু বড়ো কবি হতে পারেন — এ কথা বলে এ সময়ে রিচার্ডসন তাঁকে উৎসাহ দিয়ে থাকবেন। এ অনুমানের কারণ এই যে, এর পর থেকে তাঁর কবি হবার বাসনা আগের চেয়েও প্রবল হয়ে ওঠে। তিনি কবি হবেন, এ কথা তিনি এর আগে বন্ধুদের বলে থাকলেও, তার লিখিত কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু আলোচ্য সময়ে লেখা তাঁর চিঠিতে তিনি যে মহাকবি হবেন, সেই দৃঢ় বিশ্বাস গৌরদাসের কাছে প্রকাশ করেছেন।১১২ কেবল তাই নয়, তিনি তাঁর জীবনী লেখার দায়িত্বও দিয়েছেন গৌরদাসকে: “আমি যদি বড়োকবি হই, তাহলে তুমি আমার জীবনী লিখলে আমার কী ভালো লাগবে! আর আমি যদি ইংল্যান্ড যেতে পারি, তা হলে আমি যে বড়ো কবি হবো সে সম্পর্কে আমি প্রায় নিশ্চিত।”১১৩ মূরের লেখা বায়রন-জীবনী থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন, কিভাবে বায়রন তাঁর বন্ধুকে তাঁর স্মৃতিকথা, ডাইরি এবং চিঠিপত্র দিয়ে গিয়েছিলেন। গৌরদাসকেও তিনি তাঁর জীবনী লেখার উপাদান দিয়ে যাবার কথা ভেবে থাকবেন। রিচার্ডসনের প্রশংসা পেয়ে বড়ো কবি হবার ব্যাপারে তাঁর আত্মবিশ্বাস যে জোরদার হয়েছিলো, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেদিক দিয়ে তাঁর এই ক্ষণজীবী পত্রিকার অবদান খুব কম নয়।

১৮৪২ সালে প্রকাশিত তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতার খবর পাওয়া গেলেও যা নিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে না, তা হলো ১৮৪১ সালের আগে অন্য কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো কিনা। জীবনীকারেরা বলেছেন যে, তাঁর কবিতা Calcutta Literary Gazette, Literary Gleaner, Bengal Herald, Oriental Magazine Comet ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।১১৪ যেসব পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতো তাদের নাম তিনি নিজের একটি কবিতায়ও উল্লেখ করেছেন। কাব্যদেবী বিদায় নিয়েছেন, এ কথা বলার পর, তিনি তাঁকে আবার শিগগির ফিরে আসার আল্ডান জানিয়ে বলেছেন:

Farewell! But oh! remeber me,

Return before our “Monthlies” all,

The “Gleaner” – “Blossom” – “Comet” tempt

Me, to scribble for them all.

সুরেশচন্দ্র মৈত্রের অনুমান, মধুর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালের গোড়ার দিকে Literary Gleaner পত্রিকায়।১১৫ এই পত্রিকা ছাড়া, আর কোন কোন পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো অথবা তাঁর মোট কটি কবিতা ১৮৪২-৪৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। কারণ এসব পত্রিকার বেশির ভাগের পুরোনো নথি কোথাও রক্ষিত হয়নি।১১৬ কিন্তু ১৮৪২ সাল থেকে তাঁর কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে, এ বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। কলেজের দেয়াল টপকে তাঁর কবিতা যখন সদর রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো দেয়াল পত্রিকাটিকে তিনি আর তখন আবশ্যিক বলে গণ্য করতে পারেননি। সে জন্যে ১৮৪২ সালের গোড়ার দিকে হাতে লেখা পত্রিকাটি লোপ পায়।

কলকাতার পত্রিকাগুলোতে বেশ কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরে, কয়েক মাসের মধ্যে বড়ো কবি হওয়ার ব্যাপারে তিনি এতো আত্মবিশ্বাস লাভ করেন যে, অক্টোবর মাসের চার তারিখ — মঙ্গলবার, বিলেতের Blackwood Magazine-এ প্রকাশের জন্যে তিনি কয়েকটি কবিতা পাঠান। এর কয়েক বছর আগে এই পত্রিকায় মধুর মানসনায়ক রিচার্ডসনের কাব্যের প্রতিকূল সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিলো। কজেই বোঝা যায়, এ পত্রিকার মান সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি এই পত্রিকায় কবিতা পাঠানোর দুঃসাহস করেছিলেন। কবিতাগুলোরসঙ্গে পত্রিকার সম্পাদককে তিনি কী লিখেছিলেন, জানা যায় না। কিন্তু এর কদিন পরে তিনি যখন আরও কয়েকটি কবিতা পাঠান বিলেতের Bently’s Miscellary-তে, তখন যে-চিঠিটি লিখেছিলেন, সৌভাগ্যক্রমে সেটি রক্ষা পেয়েছে। এতে তিনি লিখেছিলেন:

সঙ্গের কবিতা কটি আপনার পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে পাঠাচ্ছি বেশ ভয়ে ভয়ে। কবিযশঃপ্রার্থীদের আপনি যে-রকম সব সময়ে মহানুভবতার সঙ্গে উৎসাহ দেন, তার জন্যেই আমি আপনার কাছে এ কবিতাগুলো পাঠাচ্ছি। মহাশয়, এই মুহূর্তে যশ আমার লক্ষ্য নয়, কারণ ভালো করে জানি আমি যশের উপযুক্ত নই। আমার যা প্রযোজন তা হলো অনুপ্রেরণা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ব্রিটিশ জনসাধারণ, যাঁরা দৃশ্যত বদান্যতাপূর্ণ এবং মহান, তাঁরা এক বিদেশী উৎসাহে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেবেন না। আমি একজন হিন্দু, বঙ্গদেশের লোক, কলকাতার হিন্দু কলেজে ইংরেজি পড়ছি। আমার বয়স এখন আঠারো, — আপনার দেশের একজন কবি, কাউলির ভাষায় — “বয়সে না-হলেও, জ্ঞানের দিক দিয়ে একটি বালক মাত্র”।১১৭

এই পত্রিকায় তিনি যে-কবিতাগুলো পাঠান, সেগুলো প্রথমে উৎসর্গ করেছিলেন গৌরদাসের নামে। কিন্তু গৌরদাসের নাম কে জানে? সে জন্যে মধুর মনে হলো, কবিতাগুলো একেবারে সুপ্রতিষ্ঠিত কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থেব নামে উৎসর্গ করলে এগুলোর প্রকাশযোগ্যতা বাড়বে। সুতরাং গৌরদাসের নাম বদল করে ওয়ার্ডসওয়ার্থের নাম লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু হায়রে দুরাশা! সে কবিতা তবু Bently নিলো না। মধু নিশ্চয় ভাবলেন, Bently যথার্থ প্রতিভা চিনতে পারলো না।

তিনি যে আশা করেছিলেন, তাঁর ঐ বালসুলভ কবিতা সেকালের এই বিখ্যাত দুই পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে গৃহীত হবে, এ থেকে বোঝা যায়, নিজের কবিতার মান সম্পর্কে তিনি একটু বেশি আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। অস্বীকার করা যাবে না, নিজের বিষয়ে তাঁর ধারণা সব সময়ে একটু ফাঁপানো ছিলো। বস্তুত, তাঁর চরিত্রের একটা বড় বৈশিষ্ট্য নিজেকে অন্যের তুলনায় বড়ো মনে করা। নিজের কবিতা সম্পর্কে এই উচ্চধারণা তাঁর অহংবাদী মনোভাবের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। তাঁর পরবর্তী জীবনের নানা ঘটনা থেকেও সেটা আমরা বার বার লক্ষ্য করতে পারবো। কিন্তু বিলেতের পত্রিকায় কবিতা পাঠানোর ব্যাপারটাকে কেবল তাঁর অহমিকার প্রকাশ বলে মনে করা ঠিক হবে না। সৃষ্টির আনন্দে তিনি তখন উচ্চকিত। তাঁর সেই আনন্দ এবং তৃপ্তি কোনো মহাকবির চেয়ে কম ছিলো না। নিজের রচনাকে তিনি স্বভাবত দেখেছেন খানিকটা পাঠকের চোখ দিয়ে, কিন্তু বেশির ভাগটাই দেখেছেন, নিজের মনের মধ্যে ভাবের যে-বান ডেকেছিলো, তাতে ভাসতে ভাসতে। তাঁর কবিতা এই দুই পত্রিকায়, বলা বাহুল্য, প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু আত্মপ্রকাশের এবং স্বীকৃতি লাভের স্বপ্ন তিনি যে প্রথম যৌবন থেকে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন, তা এ ঘটনা থেকে একেবারে স্পষ্ট করে দেখা যায়।

বড়ো কবি হবার জন্যে তাঁর ইংল্যান্ডে যাওয়া দরকার — মধু এই ধারণা কোথায় এবং কখন পেয়েছিলেন, তা বলা সহজ নয়। অ্যালবিয়ন-তীরের জন্যে তিনি হা-পিত্তেশ করে কবিতা লিখেছিলেন ১৮৪১ সালে। তা থেকে মনে হয়, তার আগে থেকেই তিনি বিলেত যাবার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেন। ১৮৪২ সালেও একটি কবিতায় তিনি ইংল্যান্ড যাবার বাসনা প্রকাশ করেছেন। এই কবিতায় তাঁর সে বাসনা এতো প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়েছে যে, তিনি তাঁর স্বদেশকেও কারাগারের মতো অসহ্য বোধ করেছেন:

Of like a sad imprisoned bird I sigh

To leave this land; though mine own land it be;

স্বদেশের সবুজ প্রান্তর, রংবেরঙের উজ্জ্বল ফুল, মেঘহীন আকাশ সুন্দর নিঃসন্দেহে; কিন্তু তাঁর কাছে তার আবেদন সামান্যই। কারণ;

For I have dreamed of climes more bright and free

Where virtue dwells and heaven-born liberty

Makes even the lowest happy; – where the eye

Doth sicken not to see man bend the knce

To sordid interest: – climes where science thrives,

And genius doth receive her guerdon meet…

There let me live and there let me die.

ইংল্যান্ডের রোম্যান্টিক কবিদের নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। নিজেদের রচনা সম্পর্কে তাঁরা আলাপ-আলোচনা করতেন এবং তার ফলে একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিতও হতেন। বায়রন, শেলি, কীটস, মূর, সাউদি এবং হান্টের যোগাযোগের কথা এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে মনে রাখা যেতে পারে। যে-কলকাতায় বসে মধু সাহিত্য রচনা করছিলেন, সেখানে এ রকমের পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সে যোগাযোগের ফলে লাভবান হবার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। তিনি কি সে কথা ভেবে বিলেত যাবার পরিকল্পনা করতে থাকেন? তিনি দেশে থাকলে কবি হিশেবে স্বীকৃতি পাবেন না — এই আশঙ্কা অন্তত এই কবিতায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রিচার্ডসন খুব উঁচু দরের কবিতা রচনা করেছিলেন, অথচ সে পরিমাণ স্বীকৃতি পাননি এবং স্বীকৃতি লাভের আশায় তিনি ইংল্যান্ডেব রোম্যান্টিক কবিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন — আগেই তা উল্লিখিত হয়েছে। তিনি যে যথেষ্ট স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হয়েছেন, সে জন্যে রিচার্ডসন নিজেও কি ছাত্রদের সামনে আপসোস করেননি? করাই স্বাভাবিক। হতে পারে, ডিএলআররের এই হতাশার কথা শুনে মধুর মনে হয়েছিলো যে, ভালো কবিতা তিনি ভারতবর্ষে বসেও লিখতে পারবেন, কিন্তু সত্যিকার কবিযশ পেতে হলে তাঁকে ইংল্যান্ডে যেতে হবে। মনে হয়, এটাই ছিলো তাঁর ইংল্যান্ড যাবার উদগ্র কামনার প্রধান কারণ।

শিবনাথ শাস্ত্রী রিচার্ডসনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, রিচার্ডসন ভাববিহ্বল হয়ে সাহিত্য পড়াতেন। তাঁর পড়ানো শুনে তাঁর ছাত্ররা এতো প্রভাবিত হতেন যে, তাঁরা মনে করতেন, শেকসপীয়রের মতো বড়ো কবি আর নেই, ইংরেজি সাহিত্যের মতো সাহিত্যও আর নেই। শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে, এভাবে তাঁর ছাত্রদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বদেশ থেকে অন্যত্র পরিচালিত হয়।১১৮ রিচার্ডসনের প্রভাবেও মধুর মনে এ ধারণা হওয়া সম্ভব যে, ভালো কবি হতে হলে তাঁকে অবশ্যই বিলেতে যেতে হবে। তবে কারণটা যা-ই হোক, কবিযশ লাভের স্বপ্নের মতোই তাঁর বিলেত যাবার আগ্রহ ছিলো তাঁর সম হৃদয়-জোড়া।

তখন অবধি বাঙালিদের জন্যে বিলেত যাবার দৃষ্টান্ত বলতে গেলে ছিলোই না। আঠারো শতকেই বঙ্গদেশ থেকে আসা এবং ভৃত্য হিশেবে কিছু কিছু লোক বিলেতে গেলেও, শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মধ্যে কেউই এই দুঃসাহস করেননি। (একমাত্র ব্যতিক্রম মুরশিদাবাদের একজন শিক্ষিত মুসলমান মীর্জা আবু তালিব খান। তিনি ১৭৯৯ সালে য়োরোপ ভ্রমণে যান। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স-সহ কয়েকটি দেশ তিনি সফর করেছিলেন এবং পরে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন।)১১৯ ১৮৩০-এর দশকে রামমোহন রায় আর ১৮৪০-এর দশকে দ্বারকানাথ ঠাকুর এই দুঃসাহসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এর মধ্যে রামমোহন স্বধর্ম এবং স্বসমাজত্যাগী বলে বদনাম কিনেছিলেন। আর দ্বারকানাথ ধনী এবং প্রভাশালী ব্যক্তি হিশেবে সমাজের সমালোচনা খানিকটা অবজ্ঞা করতে পারলেও, ঐতিহ্যিক হিন্দু হিশেবে সুনাম অর্জন কবতে পারেননি। এমন কি তাঁর অনৈতিহ্যিক আচরণের জন্যে স্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর দেয়ালের ব্যবধান গড়ে উঠেছিলো। মধু কি ভেবেছিলেন? বিলেত যাওয়া তখন খুব ব্যয়সাধ্য ছিলো। যাঁদের সে রকমের টাকাপয়সা ছিলো, তাঁরাও আবার লোকাচার অমান্য করে কালাপানি পাড়ি দেবার কথা ভাবতে পারতেন না। (এ সম্পর্কে রক্ষণশীল হিন্দুদের মনে প্রবল আপত্তি শতাব্দীর শেষ দিকেও পুরো মাত্রায় বহাল ছিলো। ১৮৯৪ সালেও কালাপানি পাড়ি দিয়ে যাঁরা বিলেত গিয়েছিলেন, তাঁদের জাত রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কলকাতায় একটি কমিটি গঠিত হয়েছিলো।)১২০ সূর্য (গুডিভ) চক্রবর্তী থেকে আরম্ভ করে যাঁরা তখন বিলেত গিয়েছিলেন, সমাজে তাঁদের পাতক এবং একঘরে হতে হযেছিলো।১২১ দেশে ফিরে অনেককেই প্রায়শ্চিত্ত করে স্বসমাজে ফিরে যেতে হয়েছিলো। এক কথায় বলা যেতে পারে, বিলেত যাবার ব্যাপারে মধুর সামনে কোনো দৃষ্টান্ত ছিলো না। তা সত্ত্বেও, এই ধারণা কোথায় পেলেন তিনি ? বস্তুত, আজীবন তিনি যে-ঔদ্ধত্য এবং দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁর ইংল্যান্ড যাবার ইচ্ছের মধ্যেও সেই মনোভাবের প্রতিফলন দেখতে পাই।

তবে কবি হবার জন্যে সে পর্যায়ে — বোধ হয় সারা জীবনই — তিনি যে-কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে তৈরি ছিলেন। তাঁকে তাঁর বন্ধুরা অনেক সময়ে পোপ বলে ডাকতেন। যে-কবির নাম অনুযায়ী বন্ধুরা তাঁকে এ নাম দিয়েছিলেন, সেই অ্যালেকজান্ডার পোপ এক জায়গাতে বলেছেন: কবিতার জন্যে দরকার হলে আপনজনদের, এমন কি বাবা-মাকেও ত্যাগ করতে হবে। মধু এই উক্তিকে গ্রহণ করেছিলেন আপ্তবাক্যের মতো ধ্রুব সত্য বলে। বাবা-মা কি তাঁকে বিলেত যেতে দেবেন? এ প্রশ্ন তিনি নিশ্চয় অনেক বারই জিজ্ঞেস করেছেন নিজেকে। এমন কি, মায়ের কাছেও হয়তো পেড়েছেন কখনো কখনো। অবশ্য তিনি ভালো করে জানতেন, বাবা-মা তাঁর সব আবদার মেনে নিলেও তাঁকে সুদূর ইংল্যান্ডে যেতে দেবেন না। সে জন্যে, ইংল্যান্ডে যাবার কথা গোপনে তিনি বন্ধু গৌরদাসের সঙ্গে আলাপ করেন। তাঁর বাবা-মা যে তাঁকে যেতে দেবেন না, গৌরদাস নিশ্চয় তাঁকে সে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তার উত্তরে তিনি ১৮৪২ সালের নভেম্বর মাসে পোপের উল্লেখ করে গৌরদাসকে লিখেছিলেন যে, কবিতার কারণে দরকার হলে তিনি বাবা-মাকেও ত্যাগ করতে প্রস্তুত।১২২ তখনো তিনি জানতেন না, বিয়ে নিয়ে তাঁর জীবনে মস্তো সংকট নেমে আসছিলো। সুতরাং বিলেত যেতে চাওয়ার একমাত্র কারণ তখনো ছিলো কবি হওয়া। বস্তুত, ১৮৪২ সালে তিনি ইংল্যান্ডে যাবার ব্যাপারে মন স্থির করে ফেলেছিলেন। তমলুকে গিয়ে তিনি চিঠিতে গৌরদাসকে লিখেছিলেন: “কোন কুক্ষণেই যে এখানে আসতে রাজি হয়েছিলাম!… কিন্তু, গৌর, আমার জন্যে একটা সান্ত্বনা আছে — আমি সাগরের আরও কাছাকাছি এসেছি — যে-সাগরের বুক চিরে, আশা করি শিগগিরই একদিন আমি ইংল্যান্ডের গৌরবোজ্জ্বল তীরের দিকে যাত্রা করবো।”১২৩

একটি প্রথাবদ্ধ পরিবারের আওতায় প্রায় সীমাহীন আদরের মধ্যে মানুষ হলেও, মূল্যবোধ এবং মনোভাবের দিক দিয়ে তিনি তাঁর পিতামাতার কাছ থেকে জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছিলন। তাঁর আশা-আকাঙ্খা ধ্যানধারণা এবং কল্পনার জগৎ সেকালের সাধারণ লোকদের মাপে তৈরি ছিলো না। তাঁর এই “সৃষ্টিছাড়া” চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে রাজনারায়ণ অথবা জাহ্নবী দেবী খুব একটা সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, পুত্র যুবক হচ্ছেন, তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটছে — এ সম্পর্কেও তাঁরা খুব একটা সজাগ ছিলেন না। কিন্তু ১৮৪২ সালের অগস্ট মাসে — মধুর বয়স যখন সাড়ে আঠারো বছর-তখন কোনো একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ পিতা-পুত্রের বিরোধ দতি মেলে দেখা দিলো। বিরক্ত পিতা পুত্রকে আদেশ দিলেন, অবিলম্বে গ্রামের বাড়ি সাগরদাঁড়িতে চলে যাবার জন্যে। এ আদেশ অংশত তাঁকে শাস্তি দেবার এবং ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে; অংশত এই প্রত্যাশায় যে, বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু দিন দূরে রাখলে এই “রোগ” সেরে যাবে। ৭ অগস্ট মধু গৌরদাসকে লেখেন সেদিন রাতের বেলায় তাঁকে যশোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে।

বন্ধুদের ছেড়ে যেতে, বিশেষ করে একজনকে (কল্পনা করে নাও সে জন কে) ছেড়ে যেতে আমার হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি কি কবির ভাষায় দুঃখ প্রকাশ করে বলতে গারি “ওহ! কী অসহ! ওহ! কী দুর্ভর বেদনা!” আমি যদি একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম! কিন্তু আমাকে তা নিষেধ করা হয়েছে। প্রিয়, প্রিয় গৌর — প্রিযতম বন্ধু! আমাকে ভুলে যেয়ো না! আমি জানিনে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে কখন আমি ফিরে আসবো। … “চির বিদায়”

ইতি

প্রিয়তম গৌর, আমি তোমার চিরদিনের অনুগত এবং অনুরক্ত, কিন্তু হতভাগা বন্ধু।

পুনঃ এই সঙ্গে তোমার জন্যে “ফরগেট মি নট”-এর একটা কপি পাঠালাম। বাঁধাই করার সময় পাইনি। দয়া করে আমার তরফ থেকে তুমি নিজেই বাঁধাই করে নিয়ো। এটা হলো তোমার প্রতি উপহারদাতার শ্রদ্ধা, প্রশংসা এবং ভালোবাসার প্রতীক।

যশোর যাবার সম্ভাবনা তাঁকে কতো কাতর করেছিলো, এ চিঠি থেকে সেটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। সেই সঙ্গে এ-ও দেখা যাচ্ছে যে, সে পর্যায়ে তিনি বাবার আদেশ অমান্য করার মতো মনোবল অর্জন করতে পারেননি। তাই দুঃখ যতোই মর্মভেদী হোক, বাবার আদেশকে মেনে নেওয়া ছাড়া তিনি আর-কোনো বিকল্পের কথা ভাবতে পারেননি।

এতো বড়ো ভাবী বিপদের হাত থেকে তিনি রক্ষা পেলেন। কী উপায়ে আমাদের জানা নেই। মায়ের আবেদন-নিবেদনে হোক অথবা পরীক্ষার কারণে হোক মধুর শেষ পর্যন্ত যশোরে যেতে হয়নি। ওদিকে, সেপ্টেম্বরের উনিশ থেকে কলেজে বার্ষিক পরীক্ষা আরম্ভ হবার কথা। প্রথম তিন দিন ছিলো সাহিত্যের পরীক্ষা, গণিত পরীক্ষা বাইশ থেকে চব্বিশ তারিখ পর্যন্ত। আর ছাব্বিশ থেকে আটাশ তারিখ ছিলো বাংলা এবং অনুবাদের পরীক্ষা। সে বার পরীক্ষা নিতে হুগলি কলেজ থেকে এসেছিলেন মিস্টার ক্লিন্ট। এছাড়া, মিস্টার হ্যালিডে এবং ডক্টর গ্র্যান্টও পরীক্ষক ছিলেন। এই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে যাঁরা স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন গোবিন্দ দত্ত, প্যারীচরণ সরকার আর ভূদেব মুখোপাধ্যায়।১২৪ তখনকার মতো যশোরে যেতে না-হলেও, তাঁর যাবার আশঙ্কা কয়েক সপ্তাহ তাঁকে এবং গৌরদাসকে ভাবিত করেছে। অক্টোবরের সাত তারিখ তিনি গৌরদাসকে চূড়ান্তভাবে জানান, সাগরদাঁড়িতে যেতে হচ্ছে না, তার বদলে তাঁকে যেতে হচ্ছে তমলুকে।

রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন তমলুকেররাজপরিবারের উকিল। মামলার সূত্র ধরে সে বার পুজোর সময়ে তাঁকে সেখানে যেতে হয়। এই উপলক্ষে তিনি সঙ্গে নিতে চাইলেন মধুকে। ব্যস্ত উকিল তিনি। কলকাতায় পুত্রকে অনেক সময়ে কাছে ডেকে তিনি আদর করতেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর লেখাপড়া এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। এমন কি, মাঝেমধ্যে পুত্রের হাতে আলবোলার নলও তুলে দিতেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুত্র যে তাঁর কাছ থেকে, পরিবারের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন, এটা তাঁর তেমন নজরে পড়েনি। এটা দেখার মতো চোখ অথবা মনস্তত্ত্বও রাজনারায়ণের ছিলো কিনা, কে জানে! কিন্তু পুত্রের ব্যক্তিত্ব নিয়ে একটা সমস্যা যে দেখা দিচ্ছে সেটা তিনি ভুলে যেতে পারলেন না। অল্প দিন আগে পুত্রের আচরণে দারুণ বিরক্ত হয়ে তাঁকে যশোরে পাঠাতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাঠানো হয়নি। সে জন্যে এবারে তাঁকে তিনি তমলুকে নিয়ে যেতে চাইলেন। আশা করলেন, এর ফলে পুত্রের কিছু দিন কলকাতার বাইরে থাকা হবে। আর তিনিও সুযোগ পাবেন তাঁকে কাছ থেকে দেখার। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার।

রাজনারায়ণ নিজের চেষ্টায় কলকাতায় বড়ো উকিল হিশেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। গরিব অবস্থা থেকে রীতিমতো ধনী হয়েছেন তিনি। জীবনকে তিনি উপভোগ করেছেন নানাভাবে। কলকাতার শিক্ষিত এবং ধনীদেরও তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর একটি মাত্র ছেলে। তাঁর জন্যে তিনি কলকাতায় পাওয়া যায় এমন সবচেয়ে ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে ছাত্র হিশেবে তাঁর ছেলেও সুনাম অর্জন করেছে। ইংরেজিতে তুখোড়। স্কলারশিপ পেয়েছে। বড় হয়ে এ ছেলে যে উকিল হিশেবে তাঁকেও ছাড়িয়ে যাবে, এ বিষয়ে আর সন্দেহ কী! ওকালতি ভালো না-লাগলে, ডেপুটি হতে পারে। একজন ডেপুটির আয় এবং সামাজিক প্রতিপত্তি অনেক। রাজনারায়ণ তাঁর চারদিকে প্রতিশ্রুতিশীল অনেক তরুণকে দেখেছেন অথবা তাদের কথা শুনেছেন। মধুকে তাদের মতো করেই তিনি কল্পনা করেছেন। কিন্তু তাঁর সেই আদরের দুলাল আর-পাঁচজনের থেকে একেবারে আলাদা “অসাধারণ” কোনো আচরণ করবে — এটা তিনি প্রত্যাশা করেননি। রাজনারায়ণ ছেলের সমস্যাটা বুঝে উঠতে পারেন না। ভিড় এবং ব্যস্ততা থেকে দূরে — তমলুকে গিয়ে তিনি কাছ থেকে মধুকে দেখবেন বলে আশা করলেন।

পুত্রকে নিয়ে রাজনারায়ণ নৌকোয় করে তমলুকের পথে যাত্রা করেন ১০ অক্টোবর সোমবার আর সেখানে গিয়ে পৌঁছেন ১২ তারিখ সকাল বেলায়।১২৫ পুজোর হৈচৈ, চারদিকে হট্টগোল। বিজয়ার শেষে পরিবেশটা একটু থিতিয়ে এলেও কদিনের মধ্যে — ১৯ অক্টোবর বুধবারে আবার লক্ষ্মী পুজো। এর পরেরাজনারায়ণ সত্যি সত্যি তাঁর প্রত্যাশিত সুযোগ পান পুত্রকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার। এবং দেখতে পান, নিজের ছেলে হলেও মধু অন্য এক জগতের মানুষ। পুত্রের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখদুঃখ, আগ্রহ এবং কৌতূহলের সঙ্গে তাঁর নিজের অনেক তফাত। বাজনারায়ণ যেন তাঁকে চিনতে পারেন না। পূজাপার্বণ, প্রচলিত ধর্ম, এবং অন্যান্য সাংসারিক ব্যাপারে পুত্রের উৎসাহের অভাব তিনি লক্ষ্য না- করে পারলেন না। তিনি এতে কেবল বিস্মিত হননি, রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তিনি ভাবতে আরম্ভ করেন — কি করা যায়। তারপর কলকাতায় ফিরে এসে পুত্রের জন্যে, তাঁর বিবেচনায়, এক ধন্বন্তরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

উল্লেখপঞ্জী ও টীকাটিপ্পনী – জননীর ক্রোড়-নীড়ে

পৃ. ১৩

রাজনারায়ণ বসুকে লেখা মাইকেলের চিঠি, জুন ১৮৬১, পত্রসংখ্যা ৮৩। মাইকেল মধুসূদনের অনেকগুলো চিঠির সংকলন এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ক্ষেত্র গুপ্তের সম্পাদিত এবং সাহিত্য সংসদ-প্রকাশিত সংকলনই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এ সংকলনেও বহু ভুল এবং গ্রহণ-বর্জন রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ক্রটিব দিক –এ চিঠিগুলো তারিখ অনুযায়ী সাজানো নয়। মাইকেল অনেক সময়ে চিঠিতে কোনো তারিখ দিতেন না। এসব চিঠি কালানুক্রমিকভাবে সাজানোর উপায় এদের আভ্যন্তরীণ প্রমাণ। কিন্তু আমার লেখা এই জীবনী প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত মাইকেল-জীবনী অনেক তথ্যই জানা ছিলো না। সে জন্যে আগের সংকলন-কারীরা চিঠিগুলো ঠিকমতো সাজাতে পারেননি। অধ্যাপক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের কাছেরক্ষিত মাইকেলের মূল চিঠির যে-সংকলন ছিলো এবং এখন যা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে আছে, তার ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি আমি এই চিঠিগুলোর একটি সংকলন করেছি। ২০০৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত এই সংকলনের নাম The Heart of a Rebel Poet: Letters of Michael Madhusudan Dutt (HRP)। এই সংকলনের বেশির ভাগ জুড়ে আছে প্রাসঙ্গিক তথ্য। পত্রসংখ্যা আমি সেই সংকলন থেকে দিচ্ছি।

বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ব্যারিস্টার হন জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর, ১৮৬২ সালে — মাইকেল বিলেত যাত্রা করার দুদিন পরে। তবে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বিলেত যাননি। তিনি লন্ডনেই বসবাস করছিলেন। তারপর এক সময়ে সিদ্ধান্ত নেন ব্যারিস্টারি পড়ার। তিনি লিঙ্কন্স ইনে ভর্তি হন ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৫৯ তারিখে। ব্যারিস্টার হবার পর প্রথমে তিনি কিছু কাল লন্ডনে প্র্যাক্টিস করেন। তারপর কলকাতা হাই কোর্টে ব্যারিস্টার হিশেবে প্র্যাস্টিস করার অনুমতি লাভ করেন ১৮৬৫ সালের ২৮ নভেম্বর।

পৃ.১৪

হিন্দু কলেজে ১৮৩০-এর দশকে ছাত্রসংখ্যা ছিলো গড়পড়তা প্রায় ৫০০। সে হিশেবে প্রথম তিরিশ বছরে বেশ কয়েক হাজার ছাত্র এ কলেজে অধ্যয়ন করেছিলেন।

পৃ.১৬

দত্ত বংশমালা নামে এই পুস্তিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে এর একটি কপি আছে।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রক্ষিত গৌরদাস বসাককে লেখা রাজনারায়ণ বসুর চিঠি (২৪.১১.১৮৮৯)। এতে তিনি লেখেন & The Madras secret, I believe, is that Modhu eloped with the lady with whom he lived as wife (sic) but this myself and my son knew before I corresponded with you about Modhu’s life. You did not tell me anything about it.” ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধুসূদন দত্ত (চতুর্থ সং; কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬২) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৯।

রাসবিহারী বসুর স্মৃতিচারণ (৯. ১, ১৮৮৮) – নগেন্দ্রনাথ সোমের মধু-স্মৃতি (প্রথম বিদ্যোদয় সং; কলকাতা বিদ্যোদয় লাইব্রেরি, ১৯৮৯। প্রথম সংস্করণ চৈত্র ১৩২৭) গ্রন্থে উদ্ধৃত পৃ. ৫২।

মাইকেলের শ্বশুর মাদ্রাস স্কুলে তাঁর সহকর্মী ছিলেন -এ রকমের জনশ্রুতি অনেক আগে থেকেই চালু ছিলো। নগেন্দ্রনাথ সোমও অনেক দিন আগে তাঁর মধু-স্মৃতি গ্রন্থে সঠিক অনুমান করেছিলেন যে, হেনরিয়েটার পিতা ছিলেন মাত্ৰাস স্কুলে মাইকেলের সহকর্মী। (-পৃ. ৫৩। কিন্তু এই সহকর্মী কে, তা তিনি অথবা অন্য কেউ আবিষ্কার করতে পারেননি। মাইকেলের কনিষ্ঠ পুত্র অ্যালবার্ট নেপোলিয়নের পরিচিত এক ভদ্রলোক — এইচ ডাবলিউ বি মোরেনো কবিব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানস্ত্রীদের বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন Bengal Past and Present (Vol. 26, 1923) পত্রিকায়। তাতে তিনি ডিককে মাইকেলের শ্বশুর হিশেবে অনুমান করেছেন। মাদ্রাস স্কুলে দুজন ডিক ছিলেন এ. ডিক আর এল. ডিক। এ. ডিক মাইকেলের কনিষ্ঠ সহকর্মী। আর এল, ডিক মাদ্রাস স্কুল থেকে পাশ করেন ১৮৫৩ সালে। ফরাসি সহকর্মী আবিষ্কার করার চেষ্টা থেকেই মোরেনো এবং পৌত্ররা ভুল করেছিলেন বলে মনে হয়। তাঁদের কাছে ডিক নামটাকে যথেষ্ট ফরাসি-গন্ধী মনে হয়।

India office Record, N/2/21/424 and N/2/27/28. ইন্ডিয়া অফিস এর পর কেবল IOR নামে উল্লিখিত হবে।

The Annual Report of the Madras University, 1850 (Madras: Pharoah & Co., 1850).

১০ The Annual Report of the Madras University, 1853 (Madras: Pharoah & Co., 1853).

পৃ১৭

১১ Q.Bell, Virginia Woolf (Triad/Paladin ed; London: Triad/Paladin, 1987), pp. II, 5-6.

১২ প্রশান্তকুমার পাল এসম্পর্কে সবচেয়ে বেশিতথ্য দিয়েছেন। – রবি-জীবনী, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা:ভূর্জপত্র, ১৯৮৪), পৃ. ২৬৮-৭৬। কিন্তু তা সত্ত্বেও রহস্য পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।

পৃ ১৮

১৩ যোগীন্দ্রনাথ বসুর মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত প্রথম দেজ সংস্করণ; কলকাতা: দেজ পাবলিশিং, ১৯৮৩), পৃ. ১২; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, পৃ. ১৩।

১৪ সমাচার চন্দ্রিকা, সমাচার দর্পণে উদ্ধৃত, ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৩০, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড (পঞ্চম মুদ্রণ;কলকাতা:বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৪০১),পৃ. ১৫০

পৃ ১৯

১৫ যোগীন্দ্রনাথ বসু, পৃ. ১১।

১৬ সমাচার দর্পণ, ১৬ অক্টোবর ১৮১৯, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সংবাদপত্রে সেকালের কথা,প্রথম খণ্ড (তৃতীয় সং; কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৯৪৯) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৩৬।

১৭ ঐ, পৃ. ২৯৭-৯৮। কয়েক বছর পরে রামদুলাল দের নিজের শ্রাদ্ধে ব্যয় হয়েছিলো তার চেয়েও বেশি। ১৮২০ সালে রামরত্ন মল্লিক ছেলের বিয়েতে সাত-আট লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন বলে শোনা যায়। – বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙারীসমাজ (তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ; কলকাতা: ওরিয়েন্ট লংম্যানস, ১৯৯৩), পৃ. ৩৯।

১৮ H. Cowell and L. A. Goodeve, eds., The Bengal Law Reports, Vol. IV, 1869 (Calcutta: Thacker, Spink and Co, 1870) 403 Ganendro Mohun Tagore and Upendro Mohun Tagore মামলা দ্রষ্টব্য, p. 108.

পৃ ২০

১৯ Awakening in Bengal in Early Nineteenth century, Vol. 1, ed. Goutam Chattopadhayy (Calcutta: Progressive Publishers, 1965), p.411. রাজনারায়ণ দত্তের প্রবন্ধটি উদ্ধৃত হয়েছে ৩৩ থেক ৫৪ পৃষ্ঠায়।। এই গ্রন্থে মাইকেলকে জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভার সদস্য হিশেবে দেখানো হয়েছে। ইনি আসলে হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, কিন্তু কবি মধুসূদন নন। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের আগে ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষও লিখেছিলেন যে, রাজনারায়ণ হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। — মাইকেল-জীবনীর আদিপর্ব (কলিকাতা: মডার্ন বুক এজেন্সি, ১৯৬২), পৃ. ৩১।

২০ সমাচার দর্পণ, ১২ মার্চ ১৮৩৪, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৯।

২১ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, পৃ. ৯।

২২ যোগীন্দ্রনাথ বসু, পৃ. ১২; নগেন্দ্রনাথ সোম, মধু-স্মৃতি, পৃ. ১-২।

২৩ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৬।

পৃ ২১

২৪ দৃষ্টান্তস্বরূপ দ্রষ্টব্য The Bengal and Agra Directory and Annual Annual Register for 1848 (Calcutta: Samuel Smith & Co., 1848). এই তালিকা আছে ৩০ পৃষ্ঠা জুড়ে।

২৫ যোগীন্দ্রনাথ বসু, পৃ. ১২।

২৬ শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (লকাতা: নিউ এজ, চতুর্থ সং, ১৯৮৩), পৃ.৪৩।

২৭ বিশপস কলেজের ছাত্রদের তালিকায় বয়স দেওয়া আছে, তবে মাসের কোনো উল্লেখ নেই। কলেজে অধ্যক্ষ জর্জ উডনি উইদার্স ১৮৪৬ সালের ২৬ জানুআরি তারিখের একটি চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, কদিন আগে ১৩ জানুয়ারি তারিখে মধুসূদন ডাটের বয়স ২২ বছর পুরো হয়েছে। See G. U. Withers to the Bishop of Madras, 26. 1. 1846, SPG Papers, Rhodes Library, Oxford University, C Ind, 1/13/18. মাইকেলের বিয়ের তারিখেও বছর সঠিকভাবে উল্লিখিত হয়েছে। মোট কথা মাইকেলের বয়স বছরের দিক দিয়ে সঠিক, কিন্তু তাঁর জন্মতারিখ ২৫ জানুয়ারি কিনা বলা শক্ত।

পৃ ২২

২৮ এ বিষয়ে আমি আমার Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernization (Rajshahi; Sahitya Samsad, 1983) এন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এতে সেকালের মহিলাদের রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। এই মহিলাদের মধ্যে ছিলেন রাসসুন্দরী দেবী, বামাসুন্দরী দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী প্রমুখ। এ বই-এর বাংলা অনুবাদ — নারীপ্রগতি: আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী (দ্বিতীয় সংস্করণ; কলকাতা: নয়া উদ্যোগ, ২০০০)।

২৯ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ১৮; মধু-স্মৃতি, পৃ.৫; সুরেশচন্দ্র মৈত্র, মধুসূদন দত্ত জীবন ও সাহিত্য (দ্বিতীয় সং; কলকাতা: পুথিপত্র, ১৯৮৫), পৃ. ১৯।

পৃ ২৩

৩০ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ২২।

৩১ সুরেশচন্দ্র মৈত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২০।

৩২ সেকালে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে কেউ দূরে চাকরি করলে ছুটির সমযে বাড়িতে আসতেন; কিন্তু স্ত্রী এবং সন্তানদের পৈতৃক বাড়িতে রাখার নিয়মই চালু ছিলো। সুপরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে এ নিয়ম প্রথম ভঙ্গ করেন উত্তরপাড়াব রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। তিনি উত্তব ভারতে চাকরি পেয়ে পরিবার সেখানে নিয়ে যান। দ্বিতীয় সবচেয়ে সুপরিচিত দৃষ্টান্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি আহমেদাবাদে চাকরি পেয়ে পিতার প্রায় বিনা-অনুমতিতে স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে নিয়ে যান। আরও দ্রষ্টব্য আমার Reluctant Debutante গ্রন্থ।

৩৩ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ১৩।

৩৪ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ১৬-১৮; মধু-স্মৃতি, পৃ. ৪।

পৃ ২৪

৩৫ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ২০।

পৃ ২৫

৩৬ ইংরেজি জানলে উনিশ শতকের প্রথম পাদে একটা ভালো চাকরি পাওয়া খুবই সহজ হতো। কিন্তু তখন ইংরেজি শেখার সুযোগ যেমন সীমিত ছিলো, তেমনি তা ছিলো দারুণ ব্যয়সাপেক্ষ। এই কথা চিন্তা কবেই সমাজের কেবল প্রগতিশীল ব্যক্তিরা নন, বাধাকান্ত দেবের মতো রক্ষণশীল লোকেরাও দেশীয় ছেলেদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। সাংগঠনিক কাজে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন বিচারপতি এডওয়ার্ড ঈস্ট এবং দেশীয়দের বন্ধু ডেভিড হেয়ার। কিন্তু ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পেনি এ ব্যাপারে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেনি। আর এ উদ্যোগ যেহেতু সমাজের উপবতলার উচ্চবর্ণের উচ্চবিত্তের হিন্দুরা নিয়েছিলেন, সে জন্যে এ কলেজে লেখাপড়ার অধিকার থাকে কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের। হিন্দু কলেজ স্থাপনের পটভূমি জানার জন্যে দ্রষ্টব্য: A.F.S.Ahmed, Social Ideas and Social Change in Bengal 1818-1835 (Leiden: E.J. Brill, 1965), Ch. 6.

৩৭ গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের স্ত্রী শিক্ষাবিধায়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮২২ সালের এপ্রিল মাসে। এ বই লেখা হয় প্রধানত রামমোহন রায়ের সতীদাহ সম্পর্কিত প্রথম গ্রন্থে মহিলাদের সম্পর্কে সাধারণভাবে যে- মন্তব্য করা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারকে এ গ্রন্থ লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন রাধাকান্ত দেব।

পৃ ২৬

৩৮ নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত (তৃতীয় সং, কলকাতা: সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, ১৯৮৭), পৃ. ৩২।

পৃ ২৭

৩৯ এই বিখ্যাত উক্তি দীনবন্ধু মিত্রের লেখা সধবার একাদশী নাটকের চরিত্র বামমাণিক্যের। সেও আর পাঁচজনের মতো রাজধানী কলকাতায় গিয়েছিলো ভাগ্যান্বেষণে।

পৃ ২৮

৪০ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২৫।

৪১ Ram Comul Sen, A Dictionary of the English and Bengali Language, Introduc-tion, বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (কলকাতা: পাঠভবন, ১৯৬৮) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৮৯।

৪২ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২৫।

৪৩ মেকলি তাঁর বিখ্যাত প্রস্তাব পেশ করেন ১৮৩৫ সালের দোসরা ফেব্রুআরি। পরের মাসে যথেষ্ট বিরুদ্ধ জনমত সত্ত্বেও সরকারী সিদ্ধান্ত হয় সরকারী কাজকর্মে ফারসির বদলে ইংরেজি ব্যবহারের। এ নিয়ে চমৎকার আলোচনা আছে পূর্বোক্ত A F S Ahmed-এর গ্রন্থে, ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

৪৪ Letter of A. W. Street to The Society for the Propagation of Gospels Papers, Rhodes House, Oxford University, Ind. অতঃপর কেবল SPG Papers বলে উল্লিখিত।

৪৫ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সমাচাবদর্পণে অন্য এক মধুসূদন দত্তের নাম দেখে হিন্দু কলেজে মাইকেলের ভর্তির সময় ১৮৩৩ সাল বলে অনুমান করলেও, আসলে ১৮৩৭ সালের আগে মধুসূদন সেখানে ভর্তি হননি। এ সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সুরেশচন্দ্র মৈত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ২৬-২৮।

পৃ ২৯

৪৬ J. Kerr, A Review of Public Instruction in the Bengal Presidency, from 1835 to 1851, Pt. II (London: Wm. H. Allen & Co., 1853) p.23.

পৃ ৩০

৪৭ Ibid; এ ছাড়া, সালাহউদ্দীন আহমেদ তাঁর গ্রন্থে সমকালীন সাক্ষ্যপ্রমাণসহ ইংরেজি শিক্ষিত তরুণদের ধর্মীয় আচার এবং রীতিনীতি-বিবোধী আচরণের অনেকগুলি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। -A. F.S. S. Ahmed, pp. 43-50.

৪৮ পাদটীকা ১৯ দ্রষ্টব্য।

৪৯ কাশীপ্রসাদ ঘোষ (১৮০৯-৭৩) হিন্দু কলেজে ডিরোজিও ছাত্র ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর কাছ থেকেই কবিতা লেখার প্রেরণা পান। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ — Shair and other Poems — প্রকাশিত হয় ১৮৩৪ সালে। ডি এল রিচার্ডসন যে-কাব্য সংকলন প্রকাশ করেন, তাতে কাশীপ্রসাদের একটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়। এর অন্য একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ Memoir of Native Indian Dynasties। তিনি এগারো বছর Hindu Intelligencer পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

পৃ ৩১

৫০ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫) সরাসরি ডিরোজিওর ছাত্র ছিলেন না; কিন্তু যাঁরা ডিরোজিওর দ্বারা সবচেয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ১৮৩২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি অ্যালেকজান্ডার ডাফের কাছে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা নেন। এর আগে থেকে তিনি একটি স্কুলে চাকরি করছিলেন, ধর্মান্তরের ফলে তাঁর চাকরি চলে যায়, কিন্তু তিনি তাতে পিছুপা হননি। ধর্মান্তরের ফলে তিনি স্ত্রীকেও হারাতে বসেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর চরিত্রে সামাজিক সুবিধে নেবার প্রবণতা কমবেশি দেখা গেলেও, ১৮৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে নীতির ব্যাপারে তিনি আপোশহীনতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি পণ্ডিত হিশেবেও সুপরিচিত ছিলেন। বেশ কয়েকটি গ্রন্থে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেন।

৫১ রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০-৫৮) ডিরোজিওর ছাত্র এবং ইয়ংবেঙ্গল হিশেবে যাঁরা সবচেয়ে নাম-করা ছিলেন, তাঁদের একজন। সমাজসংস্কার বিষয়ে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। সত্যবাদিতা এবং হিন্দু ধর্মের বিরোধিতার জন্যে সেকালে সুপরিচিত হয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করার ফলে তিনিও কৃষ্ণমোহনের মতো তাঁর স্কুলের চাকরি খোয়ান এবং পিতৃগৃহ থেকে নির্বাসিত হন।তাঁর থেকেও তাঁর খ্যাতি ছিলো স্পষ্টবাদিতার জন্যে। তিনি জ্ঞানান্বেষণ-সহ একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

৫২ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ও (১৮১৪-১৮৭৮) ডিরোজিওর শিষ্য হিশেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনিও নিজের আদর্শের খাতিরে নানা রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করেননি। সেকালেই তিনি বিধবাবিবাহ করেছিলেন এবং তার ফলস্বরূপ বঙ্গদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

৫৩ ডিরোজিওর আরও একজন শিষ্য মহেশচন্দ্র ঘোষ (১৮১৩-১৮৩৭) হিন্দু সমাজ এবং ধর্মের কট্টর সমালোচক ছিলেন। ১৮৩২ সালে তিনি খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং মিশনারি হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বিশপস কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু এই কলেজের কাগজপত্র থেকে মনে হয় ১৮৩৭ সালে তিনি সম্ভবত সাগরে ডুবে অকালে মারা যান।

৫৪ রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-৬৮। ডিরোজিও শিষ্য এবং ইয়ং বেঙ্গলদের একজন নেতা হিশেবে পরিচিত। তিনি ডিরোজিও অ্যাকাডিমিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গলদের প্রকাশিত সবগুলো পত্রিকার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সুবক্তা এবং সমাজসংস্কারক রূপে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সেকালেব সব রাজনৈতিক’ ক্রিয়াকলাপের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি অনেকগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন। সেকালের শিক্ষিতদের মধ্যে তাঁর চেয়ে সফল ব্যক্তি কমই ছিলেন।

পৃ ৩২

৫৫ রিচার্ডসন সম্পর্কে তথ্যবহুল আলোচনা আছে তাঁর মৃত্যুর পরে Calcutta Review পত্রিকায় প্রকাশিত একটি দীর্ঘ নিবন্ধে – Sanial, S.C. “Captain David Lester Richardson”, Calcutta Review, Vol. 123 (Jan. 1906), pp. 74-89.

৫৬ রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত (ষষ্ঠ সং; কলকাতা: ওবিযেন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৮৫), পৃ. ১৪-১৫।

৫৭ ঐ, পৃ. ১৪; রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রীও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। – পৃ. ১৫৭।

৫৮ W. Radice অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে ডিফিল ডিগ্রি করেন। “Tremendous Literary Rebel: the Life and Works of Michael Madhusudan Datta” (a thesis submitted for the degree of D. Phil. in the Faculty of Oriental Studies, University of Oxford, 1986) নামে তাঁর এই চমৎকার অভিসন্দর্ভে কবির নতুন মূল্যায়ন আছে। পৃ. ১৫১।

৫৯ (D.L. Richardon to L. Hunt, Index of Manuscripts in the British Museum Library, Vol. VIII (Cambridge: Chadwyck Healy, 1985), p. 337.

৬০ ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, মাইকেল জীবনের আদিপর্ব। অবশ্য এ কথা মৌলিক নয়, ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষের আগে জেমস ক্যরও অনুরূপ মন্তব্য করেন — (p. 23.)।

পৃ ৩৩

৬১ See Bengal Hurkaru, March2-3, 1843. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন যে, ডিএলআর ছিলেন বিলেতের রক্ষণশীল দলের সমর্থক এবং তিনি যুবকদলের স্বাধীন চিন্তায় উৎসাহ দিতে পারতনে না।- পৃ. ১৪৪। আলোচ্য সভা অনুষ্ঠিত হবার পর রিচার্ডসনকে নিয়ে বিতর্ক উঠেছিলো। সে সম্পর্কে উল্লেখ করে রিচার্ডসন দক্ষিণারঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে পত্রিকায় একটি কৈফিয়ত প্রকাশ করেন। Bengal Hurkaru, February 8, 1843.

পৃ ৩৪

৬২ MMD to Gourdas Bysack, পত্র সংখ্যা ,HRP.

৬৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্র সংখ্যা , HRP.

পৃ ৩৫

৬৪ Ramcomul Sen’s report quoted in J. Kerr’s A Review of Public Instruction in the Bengal Presidency, p. 33.

৬৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্র সংখ্যা ৬৮, HRP.

পৃ ৩৬

৬৬ মধুসূদন রচনাবলী, ইংরেজি কবিতা, সংখ্যা ৮।

৬৭ পত্রসংখ্যা, ৪১ — HRP.

পৃ ৩৭

৬৮ রাজনারায়ণ বসুর স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৭০।

৬৯ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগর-চরিত, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, ৩য় খণ্ড (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, ১৯৭২), পৃ.৩৯৩। তাঁর বেতন যখন ৮ টাকা হয়, তখন তাঁর বাড়িতে রীতিমতো উৎসব হয়।

৭০ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, ১৭ এপ্রিল ১৮৯৩, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৬৬।

৭১ ঐ, পৃ.৪৬৭।

৭২ ঐ, পৃ. ৪৬৯।

পৃ ৩৮

৭৩ মধুসূদন রচনাবলী, ইংরেজি কবিতা, সংখ্যা ১৮।

পৃ ৩৯

৭৪ বন্ধুবিহারী দত্তের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি, পৃ.৩০৪। অনুরূপ উক্তি ভোলানাথ চন্দ্র এবং গৌরদাস বসাকও করেছেন — মধু-স্মৃতি, পৃ. ২০।

৭৫ রাজনারায়ণ বসুর স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৭০।

৭৬ মধুসূদন রচনাবলী, ইংরেজি কবিতা, সংখ্যা ৬২।

৭৭ রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, পৃ. ১৮।

পৃ ৪০

৭৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৮।

৭৯ উইলিয়াম র‍্যাডিচি একটি প্রবন্ধে মিল্টন এবং মাইকেলের চমৎকার তুলনা করেছেন। — W. Radice, Milton and Madhusudan’ in Literature East and West, Essays Presented to R.K. Das Gupta, ed. G. R. Taneja and Vinod Sena (Delhi:Allied Publishers Ltd., 1995).

৮০ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (চতুর্থ সংকবণ; কলকাতা: সাহিত্য পরিষৎ, ১৯৫৬), পৃ. ৬।

৮১ শেলির প্রথম কবিতার বই বেনামিতে প্রকাশিত হয় যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। — R. Holmes, Shelley the Pursuit (London: Penguin Books, 1987), pp. 33.

পৃ ৪১

৮২ A. F. S. Ahmed, p. 44 f.n. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় India Review পত্রিকার বরাত দিয়ে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন, রামকমল সেন, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (দ্বিতীয় সং: কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৯৫৬), পৃ. ৩৬-৩৭।

৮৩ A. F. S. Ahmed, p. 49.

৮৪ তাঁর এ উক্তি প্রকাশিত হয় ৩ অক্টোবর ১৮৩১ তারিখের Bengal Hurkaru পত্রিকায়। উদ্ধৃত A. F. S. Ahmed, p. 49.

৮৫ গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৪৫। মাইকেল নিজেও তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি গৌরদাসের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাননি। — MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২৮, HRP। ২৪ সংখ্যক পত্রেও অনুরূপ ইঙ্গিত আছে।

৮৬ গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচবিত, পৃ. ৪৪৫।

৮৭ ঐ।

৮৮ বন্ধুবিহারী দত্তের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩০৩।

৮৯ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১, HRP।

পৃ ৪২

৯০ রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, পৃ. ২৬। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র বায়ও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। — ‘আত্ম জীবন চরিত’, সাহিত্য, ফারুন, ১৩০৩, পৃ. ৭০৪।

৯১ ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেবার সময়ে কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠার এবং জাতিভেদনা-মানার প্রতীকস্বরূপ রাজনারায়ণ অন্য দুজনের সঙ্গে এক গ্লাস শেরি এবং বিস্কিট খেয়েছিলেন। — রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, পৃ. ২৮।

৯২ রাজনারায়ণ বসুকে লেখা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্র, পত্রসংখ্যা ৩২, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেব পত্রাবলী, প্রিয়নাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত (কলকাতা, ১৯০৯), পৃ. ৪২।

৯৩ হরিশচন্দ্র মারা যান ৩৭ বছর বয়সে, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ তিরিশের কোঠায়, কালীপ্রসন্ন ৪০ বছরে, রসিককৃষ্ণ মল্লিক ৪৮ বছরে, কিশোরীচাঁদ মিত্র ৫১ বছরে এবং রামগোপাল ঘোষ ৫১ বছরে।

৯৪ একেই কি সভ্যতায় মাইকেল নব্যসমাজের পানাসক্তির এতো চমৎকার ক্যারিকেচার অঙ্কন করেছিলেন যে, পরবর্তী কালে এর অসংখ্য অনুকরণ প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু সবচেয়ে পরিহাসের বিষয় সধবার একাদশীতে দীনবন্ধু মিত্র নিমে দত্তের ভূমিকায় স্বয়ং মাইকলের সফল ক্যারিকেচার অঙ্কন করেছিলেন।

৯৫ আত্মচরিত, পৃ. ২৬।

৯৬ ঐ। শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ইংরেজি শিক্ষার বিকাশ এবং ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধের প্রভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে বেশ্যাদের প্রতি খুব বিরূপ মনোভাব দেখা দিয়েছিলো। বিশেষ করে ব্রাহ্ম এবং ব্রাহ্ম ভাবাপন্ন লোকেরা বেশ্যাদের সম্পর্কে খুবই স্পর্শকাতর হয়ে পড়েন। একটি দৃষ্টান্ত থেকে এই মনোভাবের তীব্রতা বোঝা যায়। বিদ্যাসাগর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী অভিনয় দেখতে পছন্দ করতেন। কিন্তু যখন থেকে সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনেত্রীরা অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করেন, তখন থেকে তাঁরা অভিনয় দেখা বন্ধ করেন। অথচ সেকালে বাঙালি সমাজে মহিলাদের প্রতি এঁদের থেকে বেশি সহানুভূতিশীল লোক কমই ছিলেন। — শিবনাথ শাস্ত্রী, আত্মচরিত (কলকাতা সিগনেট প্রেস, ১৯৫২), পৃ. ৯০; ইন্দ্র মিত্র, সাজঘর (কলকাতা: ১৩৬৭), পৃ. ৪০।

৯৭ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ২, HRP.

৯৮ গৌরদাস বসাকেব স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৪৬।

৯৯ ভোলানাথ চন্দ্রের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৭৭।

পৃ ৪৩

১০০ বন্ধুবিহারী দত্তের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩০৩।

১০১ রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, পৃ. ২৬।

১০২ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৬৭।

১০৩ বন্ধুবিহাবী দত্তের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩০৩।

১০৪ মধুসূদন রচনাবলী, পৃ. ৬২২-২৪। এই রচনা প্রথমে প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালের Annual Report of the Hindoo College-41 See Appendix, Ixii 47 General Report on Public Instruction in the Bengal Presidency, 1842-43 (Calcutta: Military Orphan Asylum Press, 1843), Appendix K, XCV-VI.

১০৫ মধুসূদন রচনাবলী, পৃ. ৬২৩।

পৃ ৪৪

১০৬ গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৬১।

১০৭ বন্ধুবিহারী দত্তের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৬১।

১০৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৬, ১৩ ও ১৫ HRP.

পৃ ৪৬

১০৯ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ.৪০।

পৃ ৪৭

১১০ R. Holmes, Shelley the Pursuit , pp. 23-24.

১১১ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৮, HRP.

পৃ ৪৮

১১২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৩, HRP.

১১৩ ঐ।

১১৪ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ.৮২; মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ.৩৫। একটি কবিতায় মাইকেল নিজেই কয়েকটি পত্রিকার নাম উল্লেখ করেছেন, মধুসূদন রচনাবলী, ইংরেজি কবিতা সংখ্যা ১০।

১১৫ মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৩৫।

১১৬ সবগুলো প্রকাশিত না-হলেও ১৮৪১ সালে লেখা এ রকমের ১৪টি কবিতার সন্ধান পাওয়া গেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ৩৫।

পৃ ৪৯

১১৭ পত্রসংখা ৭. HRP.। Blackwood’s Magazine-এ ৪ অক্টোবর (১৮৪২১ তারিখে কয়েকটি কবিতা পাঠানোর কদিন পরে Bentley’s Miscellary-তে পাঠিয়েছিলেন।

পৃ ৫০

১১৮ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, পৃ. ১৫৭।

১১৯ তাঁর এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮০৩ সালে তিনি য়োরোপ থেকে ফেরার পর। এ গ্রন্থের নাম মাসির-ই তালিফী বিলাদী ইফ্রাঞ্জি। চার্লস স্টুয়ার্ট এই গ্রন্থের যে-অনুবাদ করেন, তা প্রকাশিত হয় ১৮১২ সালে। তারপর এর ফরাসি এবং জর্মান অনুবাদও প্রকাশিত হয়। আবু তালিব (১৭৫২-১৮০৬) জন্মগ্রহণ করেন মুর্শিদাবাদে। আসফ উদদৌলা সিংহাসন আরোহণের পর তিনি ১৭৭৫ সালে অযোধ্যায় চলে যান। কিন্তু ১৭৯৯ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।

পৃ ৫১

১২০ See Bankim Chandra Chatterji’s letter in P. Sinha, Nineteenth Century Bengal (Calcutta: Firma K. L. Mukhopadhyaya, 1965), pp. 157-59; কালাপানি পার হওয়ার বিতর্ক যে ১৮৯০-এর দশকেরও চলছিলো এবং বিলেত-ফেবতদের সমাজে গ্রহণ করার জন্যে পত্রপত্রিকায় ওকালতি করা হয়েছে, এ সম্পর্কে আরও দ্রষ্টব্য আমার হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি (ঢাকা: অবসর, ২০০৬), পৃ. ৫০৭।

১২১ দেশ ফিরে আসার পর একটা লোক-দেখানো প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিলেত-ফেরতরা সমাজে গৃহীত হতেন। এবং অল্পকালের মধ্যেই বিত্ত এবং বিদ্যা দিয়ে সমাজের উপর তলায় স্থান করে নিতেন। সেকালের বিলেত-ফেরতরা কেউই চিরকাল পতিত থাকেননি।

১২২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১৪, HRP.

১২৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ১১, HRP.

পৃ ৫২

১২৪ General Report on Public Instruction in the Bengal Presidency, 1842-1843, p. 45.

পৃ ৫৩

১২৫ দশমীর দিন তিনি গৌরদাসকে ৯ সংখ্যক চিঠিটি লেখেন। তমলুকে পৌঁছেছিলেন তার আগের দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *