মাণ্ডূক্য উপনিষদ

মাণ্ডূক্য উপনিষদ

(কারিকাসহ)

মঙ্গলাচরণ

ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা
ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভি-
র্ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

অন্বয়: দেবাঃ (হে দেবগণ); কর্ণেভিঃ (কান দিয়ে); ভদ্রম্ (ভালো যা কিছু); শৃণুয়াম (যেন তাই শুনতে পাই); যজত্রাঃ (হে পূজ্য দেবগণ); অক্ষভিঃ (চোখ দিয়ে); ভদ্রম্ (যা কিছু ভালো); পশ্যেম (যেন তাই দেখতে পাই); স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তনূভিঃ (স্থির শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা); তুষ্টুবাংসঃ (যেন তোমাদের স্তুতি করতে পারি); দেবহিতং যৎ আয়ুঃ (দেবগণ যে আয়ু বিহিত করে দিয়েছেন); ব্যশেম (তা যেন লাভ করতে পারি); শান্তিঃ (আধ্যাত্মিক বিঘ্নের শাস্তি হোক [অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শান্তি]); শান্তিঃ (আধিদৈবিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ পরিবেশ বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শান্তি]); শান্তিঃ (আধিভৌতিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ কীটপতঙ্গ, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতি-কৃত বিঘ্নের শান্তি])।

সরলার্থ: দেবতাদের কাছে আমাদের এই প্রার্থনা যে আমরা যেন যা কিছু ভালো শুধু তাই-ই কান দিয়ে শুনি। দেবতাদের আমরা পূজা করি, আর তাঁদের কাছে এই প্রার্থনা করি যে, চোখ দিয়ে আমরা যেন শুধু ভালো জিনিসই দেখি। আরও প্রার্থনা, কায়মনোবাক্যে যেন তাঁদেরই জয়গান করি। তাঁদের যেমন ইচ্ছা ততদিনই যেন বেঁচে থাকি—বেশি নয়, কমও নয়। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।

ব্যাখ্যা: আমরা যেন ভালো কথা শুনি। ‘ভালো’ বলতে কি বুঝায়? যা কল্যাণপ্রদ, যা অনুকূল। দর্শন একটা শক্ত বিষয়। এ বুঝতে গেলে গভীর মনোযোগ চাই। বাজে কথায় সময় নষ্ট করা উচিত নয়। যা আমার পক্ষে কল্যাণকর, তাই শুধু আমরা দেখব। এতে আমাদের জ্ঞানার্জনের সুবিধা হবে এবং আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

এই প্রার্থনার মধ্যে আমাদের অঙ্গাদি স্থির থাকুক, এ কথাও বলা আছে। অঙ্গ বলতে শুধু বাইরের স্থূল অঙ্গ নয়, মনও ঐ সঙ্গে আছে বুঝতে হবে। শরীর ভালো থাকবে, মনও ভালো থাকবে, তবেই কাজে মন দিতে পারব। হয়তো শরীরের কোথাও একটা ব্যথা আছে, এতে মন বিক্ষিপ্ত থাকবে। মন যেন সর্বদা সজাগ থাকে; শরীরে বা মনে অবসাদ, জড়তা এসব কিছু যেন না থাকে। শরীর ও মন দুই-ই যেন স্থির থাকে, আর আমাদের আয়ত্তে থাকে।

আমরা এইভাবে চলব, তবে আমাদের আয়ু বিধাতার যেমন বিধান তেমনি হোক।

আমরা মাণ্ডূক্য উপনিষদ পড়তে চলেছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, আমাদের শরীর-মন যেন সুস্থ থাকে। তারা যেন আমাদের কাজে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি না করে। আমরা যেন আমাদের অধ্যয়নে ডুবে থাকতে পারি। বিধাতার যেমন ইচ্ছা ততদিন যেন এইভাবে বেঁচে থাকতে পারি।

মাণ্ডূক্য উপনিষদ (গৌড়পাদ-কারিকাসহ)

মাণ্ডূক্য উপনিষদ অথর্ববেদের অন্তর্গত। ছোট উপনিষদগুলির মধ্যে মাণ্ডূক্য অন্যতম। এতে মাত্র বারোটি শ্লোক আছে। রচয়িতা ঋষির নামানুসারেই হয়তো এই উপনিষদের এরূপ নামকরণ হয়েছে।

শঙ্করাচার্যের গুরু ছিলেন আচার্য গোবিন্দপাদ। আর তাঁর গুরু ছিলেন গৌড়পাদ। গৌড়পাদ এই উপনিষদ পাঠের সহায়ক হিসাবে একটি কারিকা লেখেন। কারিকাটি সংক্ষিপ্ত অথচ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং এতে অদ্বৈতবাদের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে। কারিকামতে, আত্মা, ছাড়া আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই, যে আত্মা এক ও অভিন্ন। এখানে দ্বিতত্ত্বের কোনও স্থান নেই। গৌড়পাদের মতে সৃষ্টি বলে কিছুই নেই। ফলে এরা কার্য-কারণ সম্পর্কও অস্বীকার করেন। কারিকা অনুসারে বলা যায়, জগৎ বলে কিছুই নেই। তবে দৃষ্টিবিভ্রমের জন্যই আমরা এই দৃশ্যমান জগৎকে দেখে থাকি। এই সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত এবং শাস্ত্র অনুমোদিত—কারিকা একথাই বলে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে এই কারিকার যে দর্শন আর বৌদ্ধদের বিজ্ঞানবাদ বা আত্মগত ভাববাদের মধ্যে অনেক মিল আছে বলে মনে হয়। কিন্তু বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠা করা এ কারিকার উদ্দেশ্য নয়। এ প্রসঙ্গে আচার্য গৌড়পাদ বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, তিনি নিজে একজন গোঁড়া অদ্বৈতবাদী। অবশ্য কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, কারিকাটি গৌড়পাদের রচনা হলেও এটা মাণ্ডূক্য উপনিষদের অন্তর্গত নয়। অর্থাৎ কারিকাটি স্বতন্ত্র। এই বিতর্কের মীমাংসা অবশ্য আজও হয়নি।

অধিকাংশ উপনিষদই এক বা একাধিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে মূল বক্তব্যকে তুলে ধরে। মাণ্ডূক্য উপনিষদ অবশ্য এর ব্যতিক্রম। এই উপনিষদ প্রতীকের মাধ্যমে তার মূল বক্তব্যকে তুলে ধরেছে। আর সেই প্রতীক হল ‘অউম্’, যা ‘ওম্‌’ নামে পরিচিত। ব্রহ্মকে আলাপ আলোচনার দ্বারা জানা যায় না। তাই এখানে প্রতীকের অবতারণা করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় গোলাকৃতি কালো পাথরের নুড়িকে আমরা নারায়ণ শিলা বলে থাকি। এটি তো নেহাতই একটি ছোট পাথরের টুকরো মাত্র। কিন্তু অনেকেই এই ক্ষুদ্র শিলাখণ্ডটিকে ঈশ্বররূপে উপাসনা করে থাকেন। এইসব উপাসকের কাছে এটি কেবলমাত্র পাথরের নুড়ি নয়, স্বয়ং ঈশ্বর। তাঁরা কোন পাথরের নুড়ির পূজা করেন না, এই নুড়ির আড়ালে তাঁদের আরাধ্য দেবতারই পূজা করে থাকেন। এই পাথরের নুড়িটি তাঁদের আরাধ্য দেবতার প্রতীক। যেহেতু ঈশ্বর সর্বত্র রয়েছেন এবং তিনিই সবকিছু হয়েছেন সেহেতু যে কোন কিছুই ঈশ্বরের প্রতীক হতে পারে।

‘অউম্‌’কে ব্রহ্মের উপযুক্ত প্রতীক বলে মনে করা হয়। সবকিছু যেমন ব্রহ্মের অন্তর্গত ঠিক তেমনি সমগ্র ধ্বনিজগৎ ‘অউম্’-এর অন্তর্গত। মুখবিবরের যেখান থেকে কোন শব্দ নির্গত হয় সেইসব অঞ্চলকে স্পর্শ করেই ‘অউম্’ উচ্চারিত হয়ে থাকে। সেজন্যই ‘ওম্‌’কে শব্দব্রহ্ম বলা হয়, যা ব্রহ্মের প্রতীক। হিন্দুমতে, এই ‘ওম্‌’ শব্দটি খুবই পবিত্র। প্রতীকের দিক থেকে এই ‘ওম’ বেদের সমান। উপনিষদ বলছেন ‘ওম্ এবং ব্রহ্ম’ এক ও অভিন্ন। সমগ্র ধ্বনিজগতের আশ্রয় হল ‘ওম্‌’ তেমনি এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের আশ্রয় হল ব্রহ্ম। জ্ঞানের দ্বারা যখন আমরা এই দৃশ্যমান জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করি তখন থাকে কেবলমাত্র ‘অউম্‌’ বা ‘ব্রহ্ম’। এ যেন ভুল ভাঙলে আমরা যেমন আবিষ্কার করি সেখানে সাপ বলে কিছু নেই, আছে কেবলমাত্র দড়ি।

এখন প্রশ্ন হল ‘অউম্‌’কে ধ্যান করব কেমন করে? প্রথমে আমাদের ‘বিরাটের’ ধ্যানে মগ্ন থাকতে হবে। জাগ্রত অবস্থায় আমাদের নিরন্তর এই চিন্তা করতে হবে—আমি ও বিরাট এক ও অভিন্ন। ব্রহ্মের সমষ্টি-শরীর হল এই বিরাট। ‘অউম্‌’-এর ‘অ’ বর্ণটি হচ্ছে বিরাটের প্রতীক। তারপর স্বপ্নাবস্থায় আমাদের ব্রহ্মের সমষ্টি-মন অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভের ধ্যানে মগ্ন থাকতে হবে। ‘অউম্‌’-এর ‘উ’ বর্ণটি হিরণ্যগর্ভের প্রতীক। সুষুপ্তি অবস্থায় আমাদের মায়াযুক্ত ব্রহ্ম অর্থাৎ ঈশ্বরের চিন্তায় ডুবে থাকতে হবে। ‘ম্‌’ বর্ণটি হল ঈশ্বরের প্রতীক। এই অবস্থাতেও আমাদের অজ্ঞানতা পুরোপুরি থাকে। আমরা যদি এই তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে যেতে পারি তখন আমরা শুদ্ধ চৈতন্য অর্থাৎ তুরীয় অবস্থার সাথে একাকার হয়ে যাই। আমরা তখন ‘অমাত্র’ অর্থাৎ সব দুই বোধের পারে চলে যাই। আমরা তখন ব্রহ্মই হয়ে যাই।

‘অউম্‌’ এইভাবেই আমাদেরকে জীবনের চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা তো সবসময়ই ব্রহ্ম। কিন্তু যে-কোন কারণেই হোক আমরা এ সম্পর্কে সচেতন নই। কিভাবে এই অজ্ঞানতাকে দূর করা যায়? তার একটি উপায় হল—‘আমি ব্রহ্ম’ একথা সবসময় চিন্তা করা। জাগ্রত অবস্থায় যদি আমরা এই চিন্তায় বিভোর থাকতে পারি তবে সেই ছাপ আমাদের স্বপ্ন ও সুষুপ্তিতেও পড়ে। এবং ক্রমে সেটাই আমাদের তুরীয় অবস্থায় পৌঁছে দেয়।

আগম প্রকরণ

ওমিত্যেতদক্ষরমিদং সর্বং তস্যোপব্যাখ্যানং ভূতং ভবদ্ভবিষ্যদিতি

সর্বমোঙ্কার এব। যচ্চান্যৎ ত্রিকালাতীতং তদপ্যোঙ্কার এব॥১

অন্বয়: ওম্ ইতি এতৎ অক্ষরম্‌ (ওম্ এই বিশেষ অক্ষরটি); ইদং সর্বম্‌ (এই সমস্ত); তস্য উপব্যাখ্যানম্‌ (এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা হল); ভূতম্ (অতীতকাল); ভবৎ (বর্তমানকাল); ভবিষ্যৎ (ভবিষ্যৎকাল); ইতি সর্বম্‌ ওঙ্কারঃ এব (এই সমস্ত ওঁকার ছাড়া আর কিছু নয়); যৎ চ অন্যৎ ত্রিকালাতীতম্ (যদি এই ত্রিকালের ঊর্ধ্বে কিছু থাকে); তৎ অপি ওঙ্কারঃ এব (সেও ওঁকার)।

সরলার্থ: ‘ওম্‌’ ব্রহ্মের প্রতীক, কার্য ও কারণ উভয়ই ব্রহ্ম। এই দৃশ্যমান জগৎও হচ্ছে ওম্‌। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, যা কিছু অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই সবই ওঁকার। এই ত্রিকালের অতীতও যদি আর কিছু থাকে তবে তাও ওঁকার।

ব্যাখ্যা: উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘এই সবই ওম্‌’। আমরা অনেকেই ‘ওম্‌’ প্রতীকটির সঙ্গে পরিচিত। এটি ব্রহ্মের প্রতীক তাই এই প্রতীককে অতি পবিত্র বলে মনে করা হয়। কখনো কখনো ওম্‌কে বলা হয় নাদব্রহ্ম অর্থাৎ শব্দব্রহ্ম। কারণ সমগ্র ধ্বনিজগৎ এই শব্দটির অন্তর্গত। ওম্‌ শব্দটি তিনটি বর্ণের সমষ্টি, অ-উ-ম৷ ‘অ’ বর্ণটি প্রধানস্বর। এই ধ্বনিটি গলদেশের পশ্চাদ্ভাগ থেকে নির্গত হয়। ‘ম’ হল অন্তস্বর। এটি ওষ্ঠ্যবর্ণ এবং ঠোঁট বন্ধ অবস্থায় উচ্চারিত হয়। ‘উ’ হল অন্তর্বর্তী স্বর। শব্দ দিয়ে আমরা কোন বস্তুকেই বুঝি। এবং ওম্ হচ্ছে সকল ধ্বনির প্রতীক। সুতরাং এই ও-ই ব্রহ্ম। সবকিছুর অর্থাৎ সমগ্র জগতের প্রতীকই হচ্ছে ওম্‌।

‘ইদম্‌’ শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইদম্‌ কথাটির অর্থ ‘এই’ অর্থাৎ যা কিনা আমাদের সামনেই রয়েছে। ‘এই’ বলতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জড়জগৎকে বোঝায়। এই জগৎকেই আমরা অনুভব ও স্পর্শ করতে পারি। ওঁকারই হচ্ছে ‘ইদম্‌’ তথা দৃশ্যমান জগতের প্রতীক।

ব্ৰহ্মই অক্ষর, কারণ এতে কোন ক্ষর বা ক্ষয় নেই। ব্রহ্ম অবিনাশী, যার সৃষ্টি আছে তার নাশও আছে, যার জন্য আছে তার মৃত্যুও আছে। কিন্তু যার সৃষ্টি হয়নি তা অবিনাশী। একমাত্র ব্রহ্মই সৃষ্ট নন। ইনি নিরপেক্ষ এবং ইনি সবসময়ই রয়েছেন। এঁর ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই। ইনি অবিনাশী। ব্রহ্ম বিভিন্ন রূপের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন, রূপটা বদলায় কিন্তু ব্রহ্ম ব্রহ্মই থাকেন।

এই ‘ওম্‌’-এর মধ্যেই অতীত (ভূতম্‌), বর্তমান (ভবৎ), এবং ভবিষ্যৎ। ওম্‌-ই অতীত, ওম্‌-ই বর্তমান আবার ওম্-ই ভবিষ্যৎ। শুধু তাই নয় ত্রিকালাতীত বলেও যদি কিছু থাকে তাও এই ওম্‌-এর অন্তর্গত। ‘ত্রিকালাতীতং’ বলতে বোঝায় যা তিন কালের ঊর্ধ্বে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এ সবই আপেক্ষিক শব্দমাত্র। ‘ত্রিকালাতীতং’ মানে যা নিত্যসত্য। আমরা দেশ-কালদ্বারা সীমাবদ্ধ। যখন আমরা কোন ব্যক্তির কথা বলি তখন কোন নির্দিষ্ট দেশ-কালের সাপেক্ষে তার উল্লেখ করি। ব্রহ্ম কিন্তু দেশ-কালের ঊর্ধ্বে। ব্ৰহ্ম দেশাতীত ও কালাতীত। আর তিনিই ওম্‌ (তৎ অপি ওঙ্কারঃ এব)।

ঈশ্বর সর্বত্র এবং তিনি সকলের মধ্যে বিরাজিত। যদিও তিনি সর্বব্যাপী তবুও একটি ক্ষুদ্র শিলাখণ্ডও তাঁর প্রতীক হতে পারে। শিলাখণ্ডের মধ্য দিয়েও মানুষ স্বয়ং ঈশ্বরকেই উপাসনা করে। একইভাবে, ওম্ ব্রহ্মের প্রতীক। ওম্‌-কে ব্রহ্মের প্রতীকরূপে ধ্যান করলে তা ব্রহ্মকেই ধ্যান করা হল।

সর্বং হ্যেতদ্‌ ব্ৰহ্মায়মাত্মা ব্রহ্ম সোঽয়মাত্মা চতুষ্পাৎ॥২

অন্বয়: সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম (এই সকলই ব্রহ্ম); অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম (এই আত্মাও ব্রহ্ম); সঃ অয়ম্ আত্মা চতুষ্পাৎ (এই আত্মার চারটি অবস্থা)।

সরলার্থ: সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম। এই জীবাত্মাও ব্রহ্ম। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মার চারটি অবস্থা।

ব্যাখ্যা: ‘সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম’—যা কিছুর অস্তিত্ব আছে অর্থাৎ এই সবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই আমরা এই জড় জগৎকে উপলব্ধি করতে পারি। আবার এমন অনেক জিনিস আছে যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। তবুও তাদের অস্তিত্ব আছে। আবার এমনও জিনিস আছে যা সূক্ষ্মভাবে মনে বিদ্যমান। সেটাও একরকমের অস্তিত্ব। উপনিষদে বলা হয়েছে সকল অস্তিত্ব অর্থাৎ সকল বস্তুই ব্রহ্মের অন্তর্গত। এইজন্যই ব্রহ্মকে বলা হয় ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’। ‘সৎ’ কথার অর্থ হল ‘যা আছে’। ব্রহ্ম স্বয়ং এই অস্তিত্ব।

উপনিষদে বলা হয়েছে জীব ও জগৎ এক। ‘অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম’—জীবাত্মাই ব্রহ্ম। ব্যষ্টি ও সমষ্টি এক এবং অভিন্ন। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (2।৮।৫) বলা হয়েছে ‘সঃ যঃ চ অয়ং পুরুষে যঃ চ অসৌ আদিত্যে’—যিনি এই দেহের ভেতরে রয়েছেন তিনিই সূর্যে বর্তমান। এই সেই একই আত্মা, একই ব্রহ্ম সকলের মধ্যে রয়েছেন। এ এক চমৎকার ধারণা, কিন্তু আয়ত্ত করা কঠিন। তবুও একই কথাই উপনিষদ বারবার বলছেন। তুমিই ব্রহ্ম কিন্তু তুমি জান না যে তুমি ব্রহ্ম। তুমি তোমার দেহটাকেই ‘তুমি’ মনে করেছ। ধর, যে জামাটা তুমি পড়ে আছ সেটা কি তুমি? অবশ্যই তা নয়। তুমি তোমার জামাটাকে পালটাতে পার কিন্তু তাতে তোমার কোন পরিবর্তন হয় না। ঠিক একইভাবে দেহের পরিবর্তন হয় মাত্র, কিন্তু আত্মা সবসময়ই অপরিবর্তনীয় ও নিত্যসত্য।

এই আত্মা চতুষ্পাদ্‌ও বটে। আক্ষরিকভাবে ‘চতুষ্পাদ্‌’ কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘চারটি পা যুক্ত’, যেমন গরু। কিন্তু এখানে কথাটির অর্থ ‘চারটি অবস্থা’। একই ব্রহ্মকে চারটি অবস্থায় দেখা যায়। প্রথম অবস্থা হচ্ছে ‘বিশ্ব’—স্থূল জাগতিক অবস্থা। যখন আমরা জেগে থাকি তখন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা এই জগৎকে প্রত্যক্ষ করে থাকি। কিন্তু যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখনও আমাদের কাছে এই জগতের অস্তিত্ব থাকে। তখন মনের দ্বারা এই জগৎকে উপলব্ধি করা যায়। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় ‘তৈজস’। এই অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি যে আমরা কোন কিছু খাচ্ছি বা কোথাও গেছি বা কোন কাজ করছি। এর পরবর্তী অবস্থা হল ‘সুষুপ্তি’ তথা গভীর নিদ্রার অবস্থা। এই অখণ্ড চৈতন্যের অবস্থাকে বলা হয় ‘প্রাজ্ঞ’। ঘন অন্ধকারে যেন তখন মনের সব বৈচিত্র লোপ পায়। তবুও সুষুপ্তি ভাঙার পর আমরা খুব সতেজ বোধ করি। এর পরেও আছে আর এক অবস্থা—‘তুরীয় অবস্থা’। এটিই ব্রহ্মের চতুর্থ অবস্থা। এই অবস্থায় আমরা চৈতন্যের সাথে এক হয়ে যাই। তখন আমরা ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করি।

এখন উপনিষদে ব্রহ্মের এই চারটি অবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবেরও কি পরিবর্তন হয়? না। সেই একই জীব কখনো জেগে আছে, কখনো বা স্বপ্ন দেখছে, কখনো আছে সুষুপ্তিতে, আবার কখনো বা সমাধি অবস্থায় ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে আছে। এই জগৎ বৈচিত্রপূর্ণ। এ জগতে আমরা নানারকম পরিবর্তন দেখতে পাই, কিন্তু ব্রহ্মই একমাত্র নিত্যসত্য। ব্রহ্ম সবসময়ই এক ও অভিন্ন, অপরিবর্তিত ও অপরিবর্তনীয়। জীবের যেমন চারটি অবস্থা তেমনি ব্রহ্মেরও এই চারটি অবস্থা। কিন্তু উভয়ই ব্রহ্ম, ব্যষ্টি ও সমষ্টি এক ও অভিন্ন। এ সকল অবস্থাই ব্রহ্মের অন্তর্গত। ব্রহ্মের মধ্যেই এই সমগ্র জগৎ। এর জন্যই উপনিষদ বলছেন, ‘অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম’—এই আত্মাই ব্রহ্ম।

জাগরিতস্থানো বহিষ্প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ

স্থূলভুগ্বৈশ্বানরঃ প্রথমঃ পাদঃ॥৩

অন্বয়: জাগরিতস্থানঃ বহিঃ প্রজ্ঞঃ (যখন জাগ্রত ও বাহ্যজগৎ সম্পর্কে সচেতন); সপ্তাঙ্গঃ (সাতটি অঙ্গবিশিষ্ট); একোনবিংশতিমুখঃ (উনিশটি মুখযুক্ত); স্থূলভুক্‌ ([শব্দাদি] স্থূলবিষয়ের ভোক্তা [উপভোগকারী]); বৈশ্বানরঃ (বিশ্বরূপ-পুরুষ); প্রথমঃ পাদঃ ([এটি তাঁর] প্রথম প্রকাশ)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে সচেতন এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা এই জগৎকে উপলব্ধি করি। যাঁর সাতটি অঙ্গ এবং উনিশটি উপলব্ধির দ্বারা জীব হিসাবে তিনিই এই স্থূলদেহ ভোগ করেন। এটিই আত্মার প্রথম প্রকাশ।

ব্যাখ্যা: আমাদের প্রথম অবস্থা হচ্ছে জাগ্রত। এই অবস্থায় আমরা বাহ্যজগৎ (বহিষ্প্রজ্ঞ) সম্পর্কে সচেতন এবং এই স্থূলজগৎকে (স্থূলভুক্‌) উপভোগ করি। বৈশ্বানর কথাটির অর্থ হল বিশ্ব এবং নর, অর্থাৎ সমগ্র জীবজগৎ। সকল জীবেরই জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতা আছে। জাগ্রত অবস্থায় আমরা এই জগৎকে অনুভব করি এবং উপভোগ করি। কিভাবে? আমাদের দেহ ও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা। উপনিষদে বর্ণিত সপ্তাঙ্গগুলি হল—মস্তক, চক্ষুদ্বয়, নাসিকা, দেহ, মূত্রাশয় ও পদযুগল। এরপর আছে উনিশটি অঙ্গ—একোনবিংশতি। ‘এক’ কথার অর্থ এক, ‘ঊন’ শব্দটির অর্থ কম, ‘বিংশতি’ অর্থ কুড়ি। কুড়ি থেকে এক কম অর্থাৎ উনিশ। প্রথম হচ্ছে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক), তারপর পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় (বাক্‌, পাণি, পাদ, উপস্থ, পায়ু), এরপর হচ্ছে পঞ্চ প্রাণ—অর্থাৎ পাঁচটি প্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান) এবং সবশেষে আসছে অন্তঃকরণের চারটি অবস্থা (মনঃ, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার)। এই বিষয়গুলি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। উপনিষদ শুধু এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন যে এই জগৎকে আমরা দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই ভোগ করে থাকি। জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূলভুক্‌ অর্থাৎ স্থূলজগৎকে ভোগ করি। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লক্ষণীয়।

জীব হিসাবে আমরা ‘বিশ্ব’, কিন্তু সমষ্টি জীবকে বলা হয় ‘বিরাট’। জীবাত্মা হল ব্যষ্টি আর পরমাত্মা হল সমষ্টি। বিরাট হল সমষ্টিগত স্থূলশরীর, অর্থাৎ স্থূলদেহের সমষ্টি। এই ব্যষ্টি আর সমষ্টি হচ্ছে এক এবং অভিন্ন—এটাই হল বেদান্তের মূল কথা। সমগ্র জগতে একটিমাত্র সত্তাই বিরাজিত। এই জগতে আমরা যে পার্থক্য দেখি তা আপেক্ষিক মাত্র। আমরা সমগ্র জগতের সাথে এক, এ তত্ত্ব আমাদের পক্ষে ধারণা করা কঠিন। জীবাত্মা হিসাবে আমি সচেতন। আমি জানি যে আমার একটি মাথা, দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি পা ইত্যাদি আছে। কিন্তু উপনিষদ বলছেন যে, তুমি জীবাত্মা নও, পরমাত্মা। এটিই উপলব্ধি করার চেষ্টা কর। ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে আচার্য শঙ্কর এক উদ্ধৃতি দিয়ে পরমাত্মার সম্বন্ধে বলছেন : দ্যুলোক তাঁর মস্তক, সূর্য তার চোখ, বায়ু তাঁর প্রাণ, সমগ্র আকাশ তাঁর দেহ, জগতের জলরাশি তাঁর মূত্রাশয়, পৃথিবী তাঁর পদযুগল, অগ্নি তাঁর মুখ। অগ্নিকে মুখ বলা হয়েছে তার কারণ আগুন সবকিছুকে নাশ করে। মূল কথাটি হল—এই জগৎও সেই এক অখণ্ড সত্তা ছাড়া আর কিছু নয়। একথা কখনই ভাববে না যে এ জগৎ থেকে তুমি আলাদা। যখন তুমি জেগে আছ তখন এই জগৎকে দেখতে পাচ্ছ এবং তুমি তোমাকেও দেখতে পাচ্ছ। প্রকৃতপক্ষে তুমি স্থূলরূপে ব্রহ্মকেই দেখছ। উপনিষদে বলা হয়েছে এটিই ‘প্রথমঃ পাদঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ।

আচার্য শঙ্কর বলছেন, আমরা এই বাইরের জগৎকে দেখতে পাই এবং এই জগৎ থেকে নিজেদের পৃথক বলে মনে করি। কেন? শঙ্করের মতে এটি অবিদ্যাকৃত অর্থাৎ এ অবিদ্যার ফলস্বরূপ। তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, আমরা যে জগৎকে দেখি তার কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই। যদি বলা হয় এই টেবিলটির পৃথক অস্তিত্ব আছে তবে ভুল করা হবে। ব্রহ্ম আছেন বলেই টেবিলটি আছে। সমস্ত বেদান্ত শাস্ত্রের এটাই হল সারকথা। যে কোন কারণেই হোক এই একত্ববোধ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। শঙ্কর বলছেন সমগ্র বিশ্বজুড়ে এক আত্মা বিরাজমান। পুরুষ, নারী, শিশু, পশু, উদ্ভিদ এ সবই সেই এক আত্মা। এই জগৎ-প্রপঞ্চ হচ্ছে বিভিন্ন পরিমাণে পঞ্চভূতের (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী) সমাবেশমাত্র। যখন এই পঞ্চভূত অর্থাৎ উপাদানগুলিকে তাদের মূল অবস্থায় (উপশম) ফিরিয়ে দেওয়া যায় তখনি একাত্মতা (অদ্বৈতসিদ্ধি) অনুভূত হয়। বর্তমান উপনিষদ আমাদেরকে ধীরে ধীরে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন। সমস্ত উপনিষদগুলির বিচার-বিশ্লেষণ করার লক্ষ্যই হচ্ছে এই একত্ব অনুভূতি।

বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি হল, এই জগৎ ব্রহ্মে আরোপিত। আমরা বিভিন্ন নাম-রূপের এই জগৎকে দেখি। কিন্তু এই নাম-রূপ সরিয়ে নিলে আর কি অবশিষ্ট থাকে? একমাত্র ব্রহ্ম। অজ্ঞানতার ফলে আমাদের কাছে এই নাম-রূপ সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে এগুলি সত্য নয়। বেদান্তমতে নির্গুণ ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, গুণবর্জিত ব্রহ্ম। এই ব্রহ্ম নিরপেক্ষ এবং উপাধিবর্জিত (নিরুপাধিক)। উপাধিমাত্রই গুণ। যেমন অনেকেই বলেন ঈশ্বর দয়ালু কিন্তু একথা বলে তাঁকে যেন সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। কোন্ অর্থে? ঈশ্বর দয়ালু বললে বোঝানো হয় তিনি নির্দয় নন। ব্রহ্ম নির্বিশেষ, অখণ্ড। দৈর্ঘ্য, বয়স ইত্যাদির সাহায্যে আমরা এক ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তি থেকে আলাদা করতে পারি। কিন্তু ব্রহ্ম হচ্ছেন সবকিছুর আধার। ব্রহ্ম আছেন বলেই সবকিছু আছে। তাই ব্রহ্মকে কোন কিছুর থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়।

নির্গুণ ব্রহ্মে মায়া প্রকাশিত হলে তখন তা হল ঈশ্বর। কোথা থেকে আসে মায়া? মায়া ব্রহ্মের ভেতরেই আছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন যে ব্রহ্ম আর মায়া যেন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি। আমরা কি অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তিকে আলাদা করতে পারি? না। সেইরকম ব্রহ্ম আর মায়াকেও পৃথক করা যায় না। ব্রহ্মে মায়া প্রকাশিত হলে ব্রহ্মই হন ঈশ্বর। শ্রীরামকৃষ্ণদেব কথিত সাপের উপমা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। একটি সাপ মাটিতে ঘুমিয়ে আছে, তখন সাপটি নিষ্ক্রিয়। ঘুম ভাঙার পর যখন সাপটি ফণা তুলল তখন সাপটি সক্রিয়। কিন্তু দুটি অবস্থাতেই একই সাপ বিদ্যমান। একইভাবে ঈশ্বরই মায়া। সক্রিয় ব্রহ্মই হচ্ছেন ঈশ্বর। এখানে ঈশ্বর শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঐশ্বর্য শব্দটি ঈশ্বর থেকেই এসেছে। ঐশ্বর্য কথার অর্থ হল সম্পদ, শক্তি। যাঁর ঐশ্বর্য আছে তিনিই ঈশ্বর। ব্রহ্ম এবং ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্যটি লক্ষণীয়। ব্রহ্মকে কেউই বর্ণনা করতে পারে না। ব্রহ্ম সম্পর্কে আমরা কোন কিছুই বলতে পারি না যে ‘ব্রহ্ম এই বা ব্রহ্ম সেই’। কিন্তু মায়াযুক্ত ব্রহ্ম অর্থাৎ সক্রিয় ব্রহ্মই হলেন ঈশ্বর। সৃষ্টির আদিতে ছিল হিরণ্যগর্ভ। এই জগৎ হিরণ্যগর্ভে সূক্ষ্ম অবস্থায় ছিল। তখন আমরাও সূক্ষ্ম অবস্থায় ছিলাম। এই হিরণ্যগর্ভেরই প্রথম স্থূল প্রকাশ হচ্ছে বিরাট।

এখানে উপনিষদও একই বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ক্রমবিন্যাসটি বিপরীত, স্থূল থেকে সূক্ষ্মের দিকে। জীবাত্মা উত্তরোত্তর ব্রহ্মের নিকটবর্তী হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মে লীন হয়ে যায়। ব্রহ্মের প্রথম অবস্থাই হচ্ছে ‘বিরাট’ অর্থাৎ এই জড়জগৎ, ব্যষ্টির কাছে যা বিশ্ব। অর্থাৎ যে অবস্থায় আমরা জেগে আছি। বিরাটকে আমাদের জাগ্রত অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কেন? জেগে না থাকলে আমরা এই জগৎকে দেখতে পাই না। আমাদের কাছে এ জগতের অস্তিত্ব যখন আমরা জেগে থাকি। পরবর্তী অবস্থা হল হিরণ্যগর্ভ, ব্যষ্টির নিকট যা ‘তৈজস’। এই অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি। যখন আমরা স্বপ্ন দেখি তখন এই জগৎ অতি সূক্ষ্মরূপে আমাদের মনে অবস্থান করে। এরপর হচ্ছে গভীর নিদ্রার অবস্থা (সুষুপ্তি)। তখন মানুষের দেহ-মন কোন কাজ করে না, এমনকি মানুষ তখন স্বপ্নও দেখে না। এই অবস্থায় মানুষ শান্তি লাভ করে এবং সুষুপ্তি ভাঙার পর খুব সতেজ বোধ করে। ব্যষ্টির ক্ষেত্রে এটাই ‘প্রাজ্ঞ’ এবং সমষ্টির ক্ষেত্রে এটাই ‘ঈশ্বর’। সমাধি অবস্থায় জীব ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে যায়, তখন জীবই ব্রহ্ম। ‘যঃ ব্রহ্ম বেদ সঃ ব্রহ্মৈব ভবতি’—যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন তিনি ব্রহ্মই হয়ে গেছেন। এই অবস্থায় জীব পরম শান্তি ও আনন্দ লাভ করে। তাই উপনিষদ বলছেন যে ব্যষ্টি ও সমষ্টি এক ও অভিন্ন। ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’—জীবাত্মা ব্রহ্ম থেকে আলাদা নয়। জীব যদি প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম না হয় তবে সে কোন দিন ব্রহ্ম হতে পারবে না। আমাদের প্রকৃত স্বরূপই হচ্ছে ব্রহ্ম। এই কথাটিই উপনিষদ আমাদের বোঝাতে চাচ্ছেন। উপনিষদ এখানে ব্রহ্মের এই চারটি অবস্থার সাথে জীবের এই চারটি অবস্থা যুক্তির দ্বারা তুলনা করে বোঝাতে চাচ্ছেন।

স্বপ্নস্থানোঽন্তঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমূখঃ

প্রবিবিক্তভুক্তৈজসো দ্বিতীয়ঃ পাদঃ॥৪

অন্বয়: স্বপ্নস্থানঃ অন্তঃ প্রজ্ঞঃ (যখন তুমি ঘুমিয়ে আছ [স্বপ্ন দেখছ] তখন যা কিছু তুমি দেখছ বা করছ, তা তোমার মনের ব্যাপার); সপ্তাঙ্গঃ (সাতটি অঙ্গ); একোনবিংশতিমুখঃ (উনিশটি মুখ [যখন তুমি জাগ্রত অবস্থায় ছিলে]); প্রবিবিক্তভুক্‌ ([কিন্তু] যদি তুমি কিছু ভোগ কর, তুমি তা কর মনের দ্বারা [স্থূলবস্তু নেই সেখানে]); তৈজসঃ দ্বিতীয়ঃ পাদঃ (এই মানসিক অভিজ্ঞতার অধিপতিই হচ্ছে [ব্রহ্মের] দ্বিতীয় অবস্থা)।

সরলার্থ: আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন আমরা যা কিছু করি সেসবের অস্তিত্ব আমাদের মনে। স্বপ্ন বাহ্যবিষয়-বিহীন। এটা পুরোপুরি মনের ব্যাপার। স্বপ্ন হচ্ছে জাগ্রত অবস্থায় আমাদের বাসনা ও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ। জাগ্রত অবস্থার মতো স্বপ্নবস্থাতেও আমাদের সাতটি অঙ্গ ও উনিশটি ইন্দ্রিয় অটুট থাকে, কিন্তু তখন আমরা যা কিছু কাজ করি মনের দ্বারা। এ অবস্থায় বাইরের জগতের সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না। এই মানস অভিজ্ঞতার অধিপতি হল (ব্রহ্মের) দ্বিতীয় অবস্থা।

ব্যাখ্যা: দ্বিতীয় অবস্থা হল ‘স্বপ্নস্থানঃ’। সংস্কৃতে ‘স্বপ্ন’ কথাটির অর্থ নিদ্রা। এই অবস্থায় আমাদের জ্ঞান অন্তর্মুখী, অর্থাৎ মনোগত (অন্তঃপ্রজ্ঞ), মনের সৃষ্টি। স্বপ্নে আমরা অনেক কিছু দেখি, অনুভব করি এমনকি শুনতেও পাই, কিন্তু এ সবই মনের কল্পনা। জাগ্রত অবস্থায় আমরা যেসব অভিজ্ঞতা লাভ করি স্বপ্নে আমরা তাই দেখতে পাই। আচার্য শঙ্কর বলেন যে মনের এই সক্রিয়তা কোন বাহ্যবস্তুর দ্বারা প্রভাবিত নয়। তিনি বলছেন মন যেন একটি কাপড়ের টুকরো যাতে ছবি আঁকা হয়েছে। এই একই কথা আমরা পাই ‘গীতা’ এবং স্বামীজীর ‘কর্মযোগে’ও। শারীরিকভাবেই হোক অথবা মানসিকভাবেই হোক আমরা যখন কোন কাজ করি তখন মনের ওপর তার একটা ছাপ পড়ে, যেন মনের ওপর একটা ছবি আঁকা হয়েছে। ধরা যাক আমি কারও ওপর রাগ করেছি এবং তাকে আমি আঘাতও করতে চাই। কিন্তু ব্যক্তিটি আমার চেয়ে শক্তিশালী তাই তাকে আমি আঘাত করতেও সাহস পাচ্ছি না, তখন আমি তাকে মনে-মনেই আঘাত করি। হিন্দুমতে এইরকম মনে-মনে আঘাত করাও সমভাবে নিন্দনীয়। উপনিষদ বলছেন যে, তুমি তোমার দেহ ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই কোন কাজ কর অথবা মনের দ্বারাই কোন কাজ কর, তার ফলে তুমি কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করবে এবং তোমার মনের ওপর তার একটা ছাপও পড়বে। সৎ চিন্তা বা অসৎ চিন্তা যে চিন্তাই কর না কেন মনের ওপর তার একটা ছাপ পড়ে। এই ছাপগুলিই পরে স্বপ্নে প্রকাশিত হয়।

এই উপনিষদের পূর্ববর্তী শ্লোকে বলা হয়েছে, জাগ্রত অবস্থায় আমরা ‘স্থূলভুক্‌’ অর্থাৎ এই জড়জগতের ভোক্তা। এই শ্লোকে বলা হচ্ছে স্বপ্নাবস্থায় আমরা ‘প্রবিবিক্তভুক্‌’—সূক্ষ্মবিষয় ভোগ করি অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা কিছু করি সে সমস্ত বাসনা ও স্মৃতি আমাদের মনের ওপরে একটা ছাপ ফেলে, সেগুলিই স্বপ্নে ধরা পড়ে। ‘প্রবিবিক্ত’ বলতে আসলে বোঝায় অনাসক্তি বা স্বতন্ত্রতা। এই অবস্থায় কোন স্থূলদেহের প্রয়োজন হয় না। কখনো কখনো স্বপ্নে আমাদের মনের অপূর্ণ কামনা-বাসনার পূর্তি হয়। ‘প্রবিবিক্তভুক্‌’ কথাটির অর্থ ‘বাসনামাত্রা প্রজ্ঞা ভোজ্য’—আমরা কামনা করি এবং এই কামনার দ্বারাই আমাদের উপভোগ হয়। এই ভোগ মনোগত, শারীরিক নয়। এই মনোগত অভিজ্ঞতার অনুরূপ কোন কিছু বাহ্য জগতে নেই। এই অবস্থায় মনের দ্বারাই ভোগ করা হয়। আমাদের কামনা-বাসনা ও অতীত অভিজ্ঞতার ছাপই হল স্বপ্ন।

‘তৈজস্’ কথাটির অর্থ হল আলো বা চৈতন্য। চৈতন্যকে প্রায়ই আলোর সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। ‘তৈজস্‌’ বলতে মনোগত চৈতন্যকে বোঝায়। তৈজস্‌ হল দ্বিতীয় অবস্থা অর্থাৎ দ্বিতীয়ঃ পাদঃ।

যত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি

তৎ সুষুপ্তম্‌। সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন এবানন্দময়ো

হ্যানন্দভুক্ চেতোমুখঃ প্রাজ্ঞতৃতীয়ঃ পাদঃ॥৫

অন্বয়: যত্র সুপ্তঃ (যখন তুমি স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রায় মগ্ন); ন কঞ্চন কামং কাময়তে (তোমার মনে কোন কামনা-বাসনা থাকে না); ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি (তখন তুমি স্বপ্নও দেখ না, এই অবস্থায় মনের ক্রিয়াও থাকে না); তৎ সুষুপ্তম্‌ (একেই বলা হয় সুষুপ্তি); সুষুপ্তস্থানঃ (যখন তুমি সুষুপ্তিতে থাক); একীভূতঃ (একাত্ম বোধ, অর্থাৎ মন আত্মার সাথে মিলিত; প্রজ্ঞানঘনঃ এব (এক ঘনীভূত চৈতন্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না); আনন্দময়ঃ (আনন্দে পূর্ণ); হি আনন্দভুক্‌ (আনন্দ উপভোগ কর); চেতোমুখঃ (তুমি তুরীয়ের [জ্ঞানের] নিকটবর্তী); প্রাজ্ঞঃ তৃতীয়ঃ পাদঃ (এই প্রাজ্ঞ, আত্মার তৃতীয় অবস্থা)।

সরলার্থ: যখন তুমি গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাক তখন তোমার মনে কোন কামনা-বাসনা থাকে না এবং তখন তুমি স্বপ্নও দেখ না; মন নিষ্ক্রিয় থাকে। একেই বলে সুষুপ্তি। জাগ্রত অবস্থায় বা স্বপ্নাবস্থায় তুমি বস্তু সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় কোন বিষয় বা কোন দ্বৈত দৃষ্টি থাকে না। তখন শুধুই এক দেখা যায়। কিন্তু এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা যায় না। এ যেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া, যেখান থেকে আবার স্বপ্ন বা জাগ্রত অবস্থায় তোমাকে ফিরে আসতেই হবে। এটাই প্রাজ্ঞ—আত্মার তৃতীয় অবস্থা।

ব্যাখ্যা: পরবর্তী অবস্থা সুষুপ্তি অর্থাৎ গভীর নিদ্রার অবস্থা। মনও তখন কোন কাজ করে না, সম্পূর্ণভাবে স্থির থাকে। তখন মনে কোন কামনা-বাসনা, কোন স্বপ্ন বা কোন চিন্তা থাকে না। সুষুপ্তি অবস্থায় কি হয়? ‘একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন’—তখন থাকে শুধুমাত্র চৈতন্য, যা অখণ্ড, নির্বিশেষ। আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন আমাদের মধ্যে যে চৈতন্য থাকে তাকে আলাদা করা যায়। স্বপ্নে আমরা মানুষ, জীব, ইত্যাদি বহু জিনিস দেখি। কিন্তু এসবের অস্তিত্ব আমাদের মনে। জাগ্রত অবস্থায় আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে স্থূলজগৎকে অনুভব করি। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় থাকে শুধুই নিরবচ্ছিন্ন চৈতন্য। আমাদের মধ্যে এই চৈতন্য সবসময় বিরাজিত। কখনো এই চৈতন্য নিজেকে প্রকাশ করে জাগ্রত অবস্থায়, কখনো স্বপ্নে, কখনো বা সুষুপ্তিতে। এই চৈতন্য একটি দীপের মতো, যা সবসময় জ্বলছে, তা কারও কাজে লাগুক বা না লাগুক। চৈতন্য সদা বিরাজমান এবং অপরিবর্তিত।

সুষুপ্তি অবস্থাটি ঠিক কেমন তা বোঝাবার জন্য আচার্য শঙ্কর সুষুপ্তিকে অন্ধকার রাত্রির সাথে তুলনা করেছেন। সেখানে চাঁদের আলো নেই, সবকিছু অন্ধকারে ঢাকা। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর এই অন্ধকারে এক বস্তু থেকে আর এক বস্তুকে পৃথক করাও সম্ভব নয়। শুধু বোঝা যায় সেখানে কিছু একটা রয়েছে। কিন্তু এই সুষুপ্তি ভাঙার পর আমরা খুব সতেজ বোধ করি।

এখন এই সুষুপ্তি অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি না এবং আমাদের মন এবং বহিরিন্দ্রিয় তখন কোন কাজ করে না। তবে চৈতন্য যে তখনও থাকে তা আমরা জানতে পারি কিভাবে? কারণ নিদ্রাভঙ্গে আমরা বলে থাকি ‘আঃ কী গভীর ঘুমিয়েছি?’ অর্থাৎ এই অবস্থায় আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমি সচেতন। সুষুপ্তিতে এই চৈতন্য কোথায় ছিল? এই চৈতন্য আমারই মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ছিল। বাইরে তার স্পষ্ট অস্তিত্ব ছিল না। মূল কথাটি হল, এই সাম্য অবস্থা থেকে স্থূলজগতে ফিরে আসতে হলে সাম্য অবস্থায় বিক্ষেপ সৃষ্টি করতে হবে। কে এই কার্যটি করে? এই কাজের কর্তা হল মায়া বা অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞানতা। এই সুষুপ্তি অবস্থায় আমাদের জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থা চৈতন্যে লীন হয়ে থাকে। তখন আমরা চৈতন্যের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন আবার আমরা এই জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসি? কে আমাদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে? তা হল অবিদ্যা, অর্থাৎ অজ্ঞানতা।

সুষুপ্তিকে বলা হয় ‘চেতোমুখঃ’, যা আত্মা এবং জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থার মধ্যবর্তী দ্বার। আচার্য শঙ্কর বলেছেন যে, এই ‘চেতোমুখঃ’ যেন দণ্ডায়মান প্রহরী। আমাদের সকলের মধ্যে চৈতন্য রয়েছে। যখন এই মধ্যবর্তী দ্বার খুলে যায় তখন এই চৈতন্য জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে—যেন জাগরণ ও স্বপ্নাবস্থার মধ্য দিয়ে এই চৈতন্য বয়ে চলেছে। সুষুপ্তিতে কোনও দ্বৈতভাব নেই, আছে কেবলমাত্র ‘এক’ অনুভূতি।

উপনিষদ বলছেন সুষুপ্তি অবস্থায় আমরা ‘আনন্দভুক্‌’ অর্থাৎ আনন্দ ভোগ করি। এই অবস্থায় আমরা পরম শান্তি ও আনন্দ লাভ করে থাকি। কেন? কারণ মন তখন নিষ্ক্রিয়। এই অবস্থায় মন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে রাখে এবং পূর্ণ বিশ্রামে থাকে। কখনো কখনো ঘুমন্ত অবস্থাতেও আমাদের মন বিক্ষিপ্ত ও চঞ্চল হয়ে ওঠে। যদিও আমরা মনে করি যে আমরা ঘুমিয়ে আছি কিন্তু জেগে উঠে আমরা বিশ্রামের স্নিগ্ধতা অনুভব করি না। নিদ্রাকালে মন ইতস্ততভাবে ঘুরে বেড়ায়—সংকল্প-বিকল্প। মনের স্বভাবই হচ্ছে এই। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় আমরা আনন্দে পরিপূর্ণ থাকি কারণ সেখানে মনের কোনও প্রভাব থাকে না (অনায়াস-রূপ)।

এখানে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আচার্য শঙ্কর আরও দু-একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, সুষুপ্তিকালে আমরা যে আনন্দ ও শান্তি লাভ করি তা আত্যন্তিক আনন্দ নয়। অর্থাৎ তা চিরস্থায়ী আনন্দ নয়। এই আপেক্ষিক আনন্দের অস্তিত্ব সাময়িক। এই অবস্থাতেও মানুষ অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত নয়। ঘুম ভাঙার পর আবার আমরা এই দৃশ্যমান জগতের নানা সংগ্রামের মুখোমুখি হই। তাই আমরা কখনো সুখী আবার কখনো দুঃখী। কিন্তু আত্যন্তিক আনন্দ চিরস্থায়ী যা সদা অপ্রতিহত। যিনি ব্রহ্মজ্ঞানী তিনিই কেবলমাত্র এই আত্যন্তিক আনন্দ লাভ করে থাকেন।

এষ সর্বেশ্বর এষ সর্বজ্ঞ এষোঽন্তৰ্যাম্যেষ যোনিঃ

সর্বস্য প্রভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাম্‌॥৬

অন্বয়: এষঃ (এই [প্রজ্ঞা]); সর্বেশ্বরঃ (সকলের অধিপতি); এষঃ সর্বজ্ঞঃ (তিনি সর্বজ্ঞও); এষঃ (এই [প্রজ্ঞা]); অন্তর্যামী (সকলের অন্তরস্থ আত্মা); হি (সুতরাং); [এষঃ (এই) প্রজ্ঞা]; ভূতানাম্ ([বর্ধনশীল ও বিনাশী] সকল জীবের); প্রভব-অপ্যয়ৌ (জন্ম এবং মৃত্যু); এষঃ (এই [প্রিজ্ঞা]); সর্বস্য যোনিঃ (সবকিছুর কারণ)।

সরলার্থ: এই প্রজ্ঞা সকল বস্তুর অধীশ্বর। ইনি সর্বজ্ঞ, ইনিই অন্তর্যামী। সকল বস্তু এঁর থেকে উৎপন্ন হয়ে এঁতেই লীন হয়। ইনিই সবকিছুর কারণ।

ব্যাখ্যা: এই প্রজ্ঞা অর্থাৎ আত্মাকে সর্বেশ্বর বলা হয়, যিনি সকলের অধীশ্বর এবং নিয়ন্তা। জাগ্রত, স্বপ্ন বা সুষুপ্তি সব অবস্থাতে ‘আমিই’ সবকিছুর অধীশ্বর। আত্মা সকল জ্ঞানের উৎস তাই তিনি সর্বজ্ঞ। তিনিই সকল বস্তুর অন্তর্নিহিত আত্মা বা অন্তর্যামী, সবকিছুর সারস্বরূপ। এই আত্মা আমার তোমার সকলের হৃদয়ে বিরাজিত। ইনি সর্বত্র বিরাজিত এবং সকল বস্তুতে বিদ্যমান। এই আত্মাই ‘সর্বস্য যোনিঃ’ অর্থাৎ সবকিছুর কারণ ও উৎস। পাশ্চাত্য দার্শনিকরা এই আত্মা অর্থাৎ ব্রহ্মকে ‘মহান প্রথম কারণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। ব্রহ্ম ছাড়া কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই।

‘প্ৰভব-অপ্যয়ৌ’—এই আত্মাই সকল বস্তুর উৎপত্তি (প্রভব) এবং বিনাশের (অপ্যয়) জন্য দায়ী। জন্ম ও মৃত্যুর জন্যও ইনিই দায়ী। মৃত্যুর পর আমরা যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানেই ফিরে যাই অর্থাৎ আত্মাতেই প্রত্যাবর্তন করি। এ অনেকটা জলবুদ্বুদের মতো। একটি বুদ্বুদ, সেটিকে যদি আমরা আঘাত করি তাহলে বুদ্বুদটি কোথায় যায়? বুদ্বুদটি জলেই মিশে যায়। একইভাবে সকল প্রাণী (ভূতানাম্‌), সকল বস্তু একই উৎস থেকে আসে, আবার সেই উৎসেই ফিরে যায়।

উপনিষদ বলছেন যে, পরম সত্য এক। নাম-রূপের পার্থক্যের দরুন সেই এককেই আমরা বহু দেখি, কিন্তু এই বৈচিত্র ক্ষণস্থায়ী। প্রশ্ন হল, কেমন করে বুঝব যে আমিই সেই পরম সত্য? বেদান্ত বলেন, তুমি কি তোমার নিজের অস্তিত্বে বিশ্বাসী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা প্রত্যেকেই বলব, হ্যাঁ। বেদান্ত বলছেন, যদি তোমার নিজের অস্তিত্ব থাকে এবং পরম সত্য বলতে সেই এক ও অভিন্ন সত্তাকেই বোঝায় তাহলে সেই পরম সত্য থেকে তুমি কখনো নিজেকে তালাদা করতে পার না। তুমি তোমার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি সেই পরম অস্তিত্বের সাথে একাকার হয়ে যাও, তোমার এই অস্তিত্বের বোধ আসে কোথা থেকে? এই মুহূর্তে অবশ্য পরম অস্তিত্ব আছে এবং ‘আমি’ নামক সত্তাটিও আছে। কিন্তু এই পরম সত্য থেকে আমি নিজেকে পৃথক বলে মনে করি। বেদান্তমতে এ থেকেই অজ্ঞানতার শুরু। পরম সত্তা কখনো দুটি হতে পারে না। আমাদের সকলের মধ্যেই সেই একই সত্তা বিরাজমান। আমাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ এই ভেদদৃষ্টি। জীবাত্মা ও পরমাত্মা যে এক, একথাই উপনিষদ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন।

গৌড়পাদ-কারিকা

অত্রৈতস্মিন্ যথোক্তেঽর্থ এতে শ্লোকা ভবন্তি॥

পূর্বে যা বলা হয়েছে তারই ব্যাখ্যা হিসাবে এখানে কতকগুলি শ্লোক পাওয়া যাচ্ছে।

(এখানেই গৌড়পাদের কারিকার সূচনা।)

বহিষ্প্রজ্ঞো বিভুর্বিশ্বো হ্যন্তঃপ্রজ্ঞস্তু তৈজসঃ।

ঘনপ্রজ্ঞস্তথা প্রাজ্ঞ এক এব ত্রিধা স্মৃতঃ॥১

অন্বয়: বহিঃ প্রজ্ঞঃ (জাগ্রত অবস্থায় যখন মানুষ বাহ্যজগৎ সম্পর্কে সচেতন [প্রথম অবস্থা]); বিভুঃ (সর্বব্যাপী); বিশ্বঃ (বিশ্ব বলে পরিচিত); হি (নিশ্চিতরূপে); অন্তঃ প্রজ্ঞঃ (যখন মানুষ নিদ্রিত এবং সবকিছুর অস্তিত্ব মনে [দ্বিতীয় অবস্থা]); তৈজসঃ (তৈজস বলে পরিচিত); তথা (অনুরূপভাবে); ঘনপ্রজ্ঞঃ (ঘনীভূত চৈতন্য এবং চৈতন্য ছাড়া আর কিছু নয়); প্রাজ্ঞঃ (এই সেই তৃতীয় স্তর যা প্রাজ্ঞ বলে পরিচিত); একঃ এব (সেই একই [আত্মা]); ত্রিধা স্মৃতঃ (তিনটি অবস্থায়)।

সরলার্থ: যখন তুমি জাগ্রত এবং চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সচেতন তখন তুমি ‘বিশ্ব’ বলে পরিচিত। তখন তুমি তোমার চারপাশের সকল বস্তু দর্শন করতে সক্ষম। তুমি সর্বব্যাপী। এটিই তোমার প্রথম অবস্থা। যখন তুমি স্বপ্ন দেখ তখন তুমি তোমার মনের সম্পর্কে সচেতন। তখন তুমি ‘তৈজস’, এটি তোমার দ্বিতীয় অবস্থা। যখন শুদ্ধ চৈতন্যমাত্র আছে, এমনকি তুমি কোন বিশেষ বস্তু সম্পর্কেও অবহিত নও, সেটাই তোমার তৃতীয় অবস্থা অর্থাৎ প্রাজ্ঞ। একই আত্মা তিনটি বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন।

ব্যাখ্যা: মানুষ জাগ্রত অবস্থায় এই বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন। তখন তাকে বলা হয় ‘বিশ্ব’। গৌড়পাদ তাকে বিভু তথা সর্বব্যাপী বলে বর্ণনা করেছেন। এই অবস্থায় মানুষ নিজের চারপাশের নানা জিনিস দেখে এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তা অনুভব করে থাকে। সুতরাং এই অবস্থায় মানুষের চেতনা বহির্মুখী (বহিঃ প্রজ্ঞঃ)। স্বপ্নাবস্থায় মানুষের চেতনা অন্তর্মুখী (অন্তঃ প্রজ্ঞঃ)। তখন তাকে বলা হয় ‘তৈজস’। এই অবস্থায় জীবের শারীরিক ক্রিয়া বন্ধ থাকে। কেবলমাত্র মন সক্রিয় থাকে। তখন মানুষ যা-কিছু দেখে তা দেখে মনে অর্থাৎ স্বপ্নে। আবার মানুষ যখন সুষুপ্তিতে থাকে তখন সে ‘প্রাজ্ঞ’। এ অবস্থায় থাকে শুধু ঘনীভূত চৈতন্য, শুদ্ধ চৈতন্য (ঘনপ্রজ্ঞঃ)। এই অবস্থায় দেহ-মন নিস্ক্রিয়; শুধু চৈতন্য থাকে।

গৌড়পাদ বলছেন যে তুমি সেই একই আত্মা (একঃ এব)। সংস্কৃতে ‘এব’ শব্দটি কোন কিছুকে জোর দিয়ে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। তিনটি বিভিন্ন অবস্থাতেও তোমার মধ্যে এক আত্মা বিরাজিত। জাগ্রত অবস্থায় অথবা নিদ্রায় কিংবা সুষুপ্তিতে তুমি সেই একই জীব। এই বিভিন্ন অবস্থাসকল তোমার ওপর আরোপিত মাত্র। জামা পরিবর্তন করলে যেমন ব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হয় না, তেমনি বিভিন্ন অবস্থার পরিবর্তনে মানুষটির কোনও পরিবর্তন হয় না। আচার্য শঙ্কর ব্যাখ্যা করেছেন যে, আত্মা ‘স্থানত্রয় ব্যতিরিক্তম্‌’ অর্থাৎ আত্মা কোনও অবস্থার অধীন নয়। তুমি হয়তো এখন একটি ঘরে রয়েছ, কিছু সময় পরেই আবার অন্য ঘরে চলে যাবে। এর অর্থ হল তুমি ঐসব ঘরের ওপর নির্ভরশীল নও। অনুরূপভাবে জাগ্রত, স্বপ্ন বা সুষুপ্তি এই তিন অবস্থাতেই তুমি সেই অভিন্ন আত্মা। তুমি শুদ্ধ এবং অনাসক্ত। শঙ্করের মতে, এইসব বিভিন্ন অবস্থার মধ্যেও ‘অহংবোধ’ বর্তমান। এই অহংবোধই যোগসূত্র। শঙ্করাচার্য এক বৃহৎ মৎস্যের উদাহরণ দিয়েছেন। নদীতে সন্তরণশীল বড় মাছটি নদীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ঘুরেফিরে বেড়াতে পারে। তার এই সন্তরণ হচ্ছে ‘যদৃচ্ছা’—অর্থাৎ মাছটি স্বাধীনভাবে একবার এপারে, আর একবার ওপারে, একবার নদীর তলদেশে, একবার উপরিভাগে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ছোট মাছকে খুব সাবধানে চলতে হয়। সে অন্যান্য বড় মাছের ভয়ে ভীত। তার গতি অবাধ নয়। কিন্তু বড় মাছটি স্বয়ংপ্রভু এবং স্বাধীন, অকুতোভয়। একইভাবে আত্মা সবকিছুর পূর্ণ পরিণতি। আত্মা কোন কিছুর অধীন নন। এটাই তাঁর প্রকৃত স্বরূপ।

দক্ষিণাক্ষিমুখে বিশ্বো মনস্যন্তস্তু তৈজসঃ।

আকাশে চ হৃদি প্রাজ্ঞস্ত্রিধা দেহে ব্যবস্থিতঃ॥২

অন্বয়: বিশ্বঃ (জাগ্রত অবস্থার আত্মা যা স্থূলবস্তু প্রত্যক্ষে সক্ষম); দক্ষিণাক্ষিমুখে (এই দেখার জন্য নিজ ডান চোখ ব্যবহার করেন); তৈজসঃ (স্বপ্নবস্থায়ও সেই অভিন্ন আত্মা); মনস্যম্ভঃ (স্বপ্নের মধ্য দিয়ে যখন এই স্থূলজগৎকে পুনরায় উপলব্ধি করে); প্রাজ্ঞঃ হৃদি চ আকাশে (সেই একই আত্মা হৃদয়মধ্যস্থিত শুদ্ধ চৈতন্যরূপে); ত্রিধা দেহে ব্যবস্থিতঃ (তিনটি অবস্থার মধ্য দিয়ে একই দেহে এটি বিস্তৃত)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় আত্মা হল বিশ্ব, সেই আত্মা তাঁর ডান চোখ দিয়ে স্থূল-জগৎকে প্রত্যক্ষ-সক্ষম। আত্মা যখন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেন তখন আত্মাকে বলে ‘তৈজস’, আবার হৃদয়ে যখন শুদ্ধ চৈতন্যরূপে বিরাজিত, আত্মার সেই অবস্থাকে বলে প্রাজ্ঞ। আত্মা এক এবং অভিন্ন। একই দেহের তিনটি বিভিন্ন অবস্থার মধ্যেও সেই এক আত্মা বিরাজিত।

ব্যাখ্যা: প্রাচীনেরা বিশ্বাস করতেন, যখন আমরা এই জগৎকে দেখি তখন আমরা বাম চোখের থেকে ডান চোখ বেশি ব্যবহার করে থাকি। এ ধারণা সত্য হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আমাদের জাগ্রত অবস্থার কথা বলতে গিয়ে গৌড়পাদ এই প্রাচীন ধারণাটির উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন যে জাগ্রত অবস্থায় আমরা যখন আমাদের ডান চোখের সাহায্যে এই জগৎকে দেখি, তখন আমাদের বলা হয় ‘বিশ্ব’, যখন আমরা মনের দ্বারা এই জগৎকে উপলব্ধি করি তখন আমাদের বলা হয় ‘তৈজস’। সবই তখন অন্তর্মুখী। মানুষের হৃদয়স্থিত ক্ষুদ্র আকাশে এই আত্মা রয়েছেন। ‘প্রাজ্ঞ’ অবস্থায় চৈতন্য বাইরের জগৎকে পরিহার করে কেবলমাত্র হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন। মূল কথাটি হল আত্মা অবিকৃত, স্ব-অবস্থায় অবস্থিত। আমরা জাগ্রত অথবা গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত থাকতে পারি কিন্তু আত্মার তাতে কিছু যায় আসে না। এই সেই একই আত্মা যিনি মুক্ত এবং কোন কিছুর অধীন নন।

বিশ্বো হি স্থূলভুঙ্‌নিত্যং তৈজসঃ প্রবিবিক্তভুক্।

আনন্দভুক্তথা প্রাজ্ঞস্ত্রিধা ভোগং নিবোধত॥৩

অন্বয়: বিশ্বঃ (বিশ্ব [আত্মার প্রথম অবস্থা]); হি (সুনিশ্চিত); নিত্যম্ (সর্বদা); স্থূলভুক্‌ (স্থূলবিষয় ভোগ করে [জাগ্রত অবস্থায়]); তৈজসঃ (তৈজস আত্মার দ্বিতীয় অবস্থা); প্রবিবিক্তভুক্‌ (সূক্ষ্মভাবে সব বস্তুকে মনের দ্বারা উপভোগ করে [বস্তুর উপর নির্ভরশীল নয়]); তথা (সেইভাবে); প্রাজ্ঞঃ (প্রাজ্ঞ তৃতীয় অবস্থার আত্মা); আনন্দভুক্‌ (আনন্দ ভোগ করে [এইভাবে]); ভোগম্‌ (উপভোগ); ত্রিধা (তিনরূপে); নিবোধত (লক্ষ্য কর)।

সরলার্থ: ‘বিশ্ব’ অবস্থায় আত্মা এই স্থূলজগৎকে ভোগ করেন। ‘তৈজস’রূপে নিজকামনা অনুযায়ী আত্মা সূক্ষ্মভাবে এ জগৎকে উপভোগ করেন। প্রাজ্ঞ অবস্থায় আত্মা শুধুমাত্র আনন্দ ভোগ করেন। এই তিন রকমের ভোগের কথা বলা হয়েছে।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ পূর্ববর্তী এক শ্লোকে বলেছেন যে, ‘স্থূলভুক্‌’ হল স্থূলভাবে এই জগৎকে ভোগ করা। এ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি সক্রিয় থাকে। ধরা যাক আমি সন্দেশ খাচ্ছি। ‘প্রবিবিক্তভুক্‌’ হল স্মৃতি এবং ধারণার মাধ্যমে মনে-মনে ভোগ করা। যেমন আমি স্বপ্ন দেখছি যে আমি সন্দেশ খাচ্ছি। এরপর ‘আনন্দভুক্‌’—যখন মন স্থির। এ অবস্থায় আমরা স্বপ্ন পর্যন্ত দেখি না। এখানে ‘আনন্দ’ শব্দটি আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এ পরমানন্দ নয়। এই শ্লোকের মর্মার্থ হল তিন রকমের ভোগ (ত্রিধা ভোগম্‌) আছে। কিন্তু সেই এক ও অভিন্ন আত্মাই এই তিন অবস্থাতে বিদ্যমান। এই আত্মাকে বিশ্ব, তৈজস, প্রাজ্ঞ বা অন্য যে-কোন নামে অভিহিত করা যাক না কেন, এ সবই আত্মার উপর আরোপিত গুণ বা উপাধিমাত্র।

আমরা আমাদেরকে দেহ বলে মনে করে থাকি। আমাদের শরীরে কোথাও কোন যন্ত্রণা থাকলে আমরা বলি ‘আমি যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছি’। কিন্তু বেদান্তমতে—তুমি দেহ নও, তুমি দেহ নিরপেক্ষ। দেহের পরিবর্তন আছে। কখনো তুমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, আবার কখনো তুমি হয়তো অসুস্থ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘তুমি’ এসবের ঊর্ধ্বে। আমরা যে দেহ থেকে আলাদা এ কথাটি ধারণা করা খুবই কঠিন। বেদান্ত বলেন : ‘হ্যাঁ, এখন কঠিন ঠিকই কারণ এখন তুমি অজ্ঞ। তুমি নিজেকে দেহ বলে মনে কর। কিন্তু যখন তুমি তোমার প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারবে তখন তুমি পরমানন্দ লাভ করবে।’

এখানে একটি গল্প বলা হয়েছে। একদা বিষ্ণু বরাহরূপে জন্ম নেন। এই বরাহশরীরে তিনি বহু শাবকের জন্ম দেন। শাবকগুলিকে লালনপালন করে ও অপরিষ্কার স্থানে জীবনযাপনে বরাহের সুখের অন্ত ছিল না। একদিন নারদ তাঁর কাছে এসে বললেন : ‘প্রভু! এ আপনি কি করছেন? আপনি এই জীবন ভোগ করছেন?’ কিন্তু বরাহমাতা উত্তর দিলেন : ‘আঃ! কে তোমার প্রভু? আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। আমি এখানে অত্যন্ত সুখী।’ তখন শিব এসে ত্রিশূল দিয়ে বরাহমাতাকে বধ করলেন। তৎক্ষণাৎ বিষ্ণু তাঁর বরাহ-শরীরের মধ্য থেকে সহাস্যে বেরিয়ে এলেন। ঠিক তেমনিভাবে আমারও দেহের পরিবর্তন হতে পারে। আমি বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারি। কিন্তু তার দ্বারা আমি প্রভাবিত হতে যাব কেন? মূল কথাটি এই—আত্মার কোনও পরিবর্তন হয় না, পরিবর্তন দেহের হতে পারে।

স্থূলং তৰ্পয়তে বিশ্বং প্রবিবিক্তং তু তৈজসম্।

আনন্দশ্চ তথা প্রাজ্ঞং ত্রিধা তৃপ্তিং নিবোধত॥৪

অন্বয়: স্থূলম্‌ (স্থূলবস্তু); বিশ্বং তৰ্পয়তে (বিশ্বকে তুষ্ট করে); প্রবিবিক্তম্‌ (সূক্ষ্মবস্তু); তৈজসম্ ([তুষ্ট করে] তৈজসকে); আনন্দঃ চ তথা প্রাজ্ঞম্‌ (একইভাবে আনন্দ তুষ্ট করে প্রাজ্ঞকে); ত্রিধা তৃপ্তিং নিবোধত (লক্ষ্য কর যে উপভোগ করার এই তিন রকমের পথ আছে)।

সরলার্থ: ‘বিশ্ব’ হিসাবে স্থূলবস্তুই আমার উপভোগের বিষয়। কিন্তু যখন আমি ‘তৈজস’, তখন সূক্ষ্মবস্তু পর্যন্ত আমার কাছে তৃপ্তিদায়ক হয়ে থাকে। আর যখন আমি প্রাজ্ঞ তখন আনন্দপ্রদ বস্তু আমাকে তৃপ্তি দেয়। (যদিও এক্ষেত্রে আমি কি উপভোগ করছি সে সম্পর্কে আমি সচেতন নই।) এই তিন রকম ভোগের কথা বলা হয়েছে।

ব্যাখ্যা: পূর্ববর্তী শ্লোকের কথা এই শ্লোকেও পুনরাবৃত্ত। তৃপ্তি’ কথাটির অর্থ সন্তোষ, তিনটি ভিন্ন অবস্থাতে মানুষ তিন রকমের তৃপ্তি বা আনন্দ লাভ করে থাকে। জাগতিক স্তরে মানুষ স্থূলবস্তুকেই সবথেকে বেশি উপভোগ করে। মানসস্তরে সূক্ষ্মবস্তুই উপভোগের পক্ষে উপযুক্ত। এছাড়া আরও একটি স্তর আছে যেখানে সকল ইন্দ্রিয় ও মন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। কিন্তু এই অবস্থাতেও মানুষ ভোগ করে কিন্তু তারজন্য কোনও ইন্দ্রিয় বা বাহ্যবস্তুর প্রয়োজন হয় না। এই আনন্দ কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়।

ত্ৰিষু ধামসু যদ্ভোজ্যং ভোক্তা যশ্চ প্রকীর্তিতঃ।

বেদৈতদুভয়ং যস্তু স ভুঞ্জানো ন লিপ্যতে॥৫

অন্বয়: ত্রিষু ধামসু (তিনটি অবস্থায় [জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ]); যৎ ভোজ্যম্‌ (যা-কিছু তুমি ভোগ কর [স্থূল, সূক্ষ্ম বা আনন্দময়]); যঃ চ ভোক্তা (যে কেউ ভোক্তা হন না কেন [অর্থাৎ বিশ্ব, তৈজস বা প্রাজ্ঞ]); প্রকীর্তিতঃ (তাদের বলা হয়); যঃ তু (যে কেউ); এতৎ উভয়ম্ (এই দুই-ই [ভোগ্যবস্তু ও ভোক্তা]); বেদ (জানেন); সঃ (সেই ব্যক্তি); ভুঞ্জানঃ (তিনি যদি ভোক্তা হন); ন লিপ্যতে (লিপ্ত হন না [কারণ তিনি জানেন ভোক্তা ও ভোগ্যবস্তু এক ও অভিন্ন])।

সরলার্থ: জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থায় মানুষ যথাক্রমে স্থূলজগৎ, সূক্ষ্মজগৎ ও আনন্দ উপভোগ করে। যিনি এই ভোগ্য বিষয় ও ভোক্তাকে জানেন, তিনি যদি নিজে এসব ভোগও করেন তাতেও এর দ্বারা তিনি লিপ্ত হন না।

ব্যাখ্যা: বিশ্ব (জাগ্রত অবস্থায়), তৈজস (নিদ্রিত এবং স্বপ্নদর্শী) অথবা প্রাজ্ঞরূপে (সুষুপ্তি অবস্থায়) আমার মধ্যে সেই একই আত্মা রয়েছেন। আবার স্থূল, প্রবিবিক্ত তথা সূক্ষ্ম বা আনন্দময় যে-কোনও খাবারই আমি খেতে পারি। কি অবস্থায় আমি খাদ্য গ্রহণ করছি অথবা কি ধরনের খাবারই বা আমি খাচ্ছি তাতে কিছুই যায় আসে না। তিন অবস্থাতেই আত্মা আত্মাই থাকেন এবং খাদ্যবস্তু খাদ্যবস্তুই থাকে। কি ধরনের খাদ্য গ্রহণ করা হচ্ছে তা দ্বারা আত্মা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হন না। একে আগুন আর তার প্রজ্বলনের জন্য যে জ্বালানি লাগে তার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। জ্বালানির দ্বারা আগুনের কোন রকম ক্ষতি সাধিত হয় না। একইভাবে কোন খাদ্যই আমার কোনও ক্ষতি করতে পারে না। কেন পারে না? কারণ আমি সাক্ষীমাত্র। আমি এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারি কিন্তু ‘আমি’ এক ও অভিন্ন। তুরীয় অবস্থাতেই (শুদ্ধ চৈতন্য) আমার প্রকৃত স্বরূপ বোধ হয়। ‘চেতোমুখ’ তথা সুষুপ্তি ও তুরীয়ের মধ্যে যে ব্যবধান তা অতিক্রম করতে পারলেই আমরা তুরীয় অবস্থা লাভ করি। যখন আমরা শুদ্ধ চৈতন্যমাত্র, কেবল তখনি আমরা সাক্ষীস্বরূপ। এই-ই আমাদের প্রকৃত পরিচয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোনও পরিবর্তন হয় না। আমরা সর্বদাই অপরিবর্তিত। বিশ্ব, তৈজস বা অন্য যে কোন অবস্থাই হচ্ছে রজ্জুতে সর্পভ্রমতুল্য। আমরা সঠিক চিনতে পারি বা না পারি দড়ি দড়িই থাকে। ঠিক তেমনি আত্মা আত্মাই থাকেন। খাদ্যের দ্বারা আত্মা প্রভাবিত হন না কারণ আত্মা সকল দোষ থেকে মুক্ত।

প্রভবঃ সর্বভাবানাং সভামিতি বিনিশ্চয়।

সর্বং জনয়তি প্রাণশ্চেতোংশূন্ পুরুষঃ পৃথকৃ॥৬

অন্বয়: প্রভবঃ [ইব] সতাম্ (সৎ বস্তু থেকেই সৎ বস্তুর উৎপত্তি [সৎ অর্থাৎ ‘যা আছে’]); সর্বভাবানাম্‌ (অস্তিত্ব আছে এমন সকল বস্তু [যথা বিশ্ব, তৈজস, প্রাজ্ঞ]); ইতি বিনিশ্চয়ঃ (একথা সুনিশ্চিত); প্রাণঃ (মায়াযুক্ত ব্রহ্ম); সর্বম্‌ (বিশ্বের সকল অচেতন বস্তু); জনয়তি (উৎপন্ন করে); পুরুষঃ চেতোংশূন্ (সূর্য থেকেই যেমন তার কিরণের উৎপত্তি তেমনি পরমাত্মা [পুরুষ]); পৃথক্‌ (পৃথকভাবে চেতন বস্তুর সৃষ্টি করে)।

সরলার্থ: একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় কোন বস্তু থেকে আর এক বস্তুর সৃষ্টি হয় (যেমন, বিশ্ব [স্থূল], তৈজস [সূক্ষ্ম], প্রাজ্ঞ [কারণ])। প্রাণ থেকেই অচেতন বস্তুর সৃষ্টি। সূর্য থেকেই যেমন তার কিরণের উৎপত্তি ঠিক তেমনি পরমাত্মা (পুরুষ) থেকে চেতন বস্তুর সৃষ্টি।

ব্যাখ্যা: গৌড়পাদ এখানে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইছেন যে, ব্রহ্ম সর্বত্র রয়েছেন। অন্যথায় এই পরিবর্তনশীল জগতের কোন অস্তিত্বই থাকত না। আনুমানিকভাবে ব্রহ্ম সম্পর্কে এটি হল পরোক্ষ প্রমাণ। আমরা এরকম কথা শুনে থাকি, ‘পর্বতঃ বহ্নিমান্‌ ধূমাৎ’—পর্বত থেকে যদি ধোঁয়া নির্গত হয় তবে সেখানে কোথাও নিশ্চয়ই আগুন আছে। একেই বলা হয় অনুমান। সেইজন্য এই শ্লোকে গৌড়পাদের যুক্তি হচ্ছে, কোন বস্তুকে দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এইসব বস্তুর উৎপত্তির নিশ্চয়ই কোন উৎস আছে। শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হয় না, এটা অসম্ভব। যা-কিছুর অস্তিত্ব আছে সেই অস্তিত্বের কোথাও না কোথাও উৎসও আছে। কারণ ছাড়া কোন কার্য হতে পারে না, ‘ইতি বিনিশ্চয়ঃ’—একথা সুনিশ্চিত।

দৃষ্টান্ত হিসাবে উপনিষদ আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে বলা হয়েছে, তুমি হয়তো এখন জেগে আছ, একটু পরেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে। তারপরে হয়তো গভীর নিদ্রা তথা সুষুপ্তিতে আচ্ছন্ন হবে, অর্থাৎ অবস্থার এইসব পরিবর্তন ঘটে থাকে। কিন্তু এইসব পরিবর্তনের জন্য কোন আশ্রয়ের প্রয়োজন, যার উপর নির্ভর করে এইসব পরিবর্তনগুলি ঘটতে পারে। তাহলে এই আশ্রয়টি কি? আশ্রয়টি ‘তুমি’ অর্থাৎ জীব। জীবকে থাকতেই হবে। একইভাবে সমগ্র সৃষ্টি প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল, কখনই স্থির নয়। কিন্তু যদি এর পেছনে কোন অপরিবর্তিত আশ্রয় না থাকে, তবে এই জগতের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। উপনিষদ বলছেন যে—ইতিবাচক কোন সত্তা বা অবলম্বন অথবা আশ্রয় বলে এমন কিছু আছে যার উপর এই দৃশ্যমান জগৎ স্থিত। এই সত্তা নিত্য এবং অপরিবর্তনীয় অর্থাৎ ইনিই ব্রহ্ম। ব্রহ্মের অস্তিত্ব না থাকলে এই দৃশ্যমান জগতের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। এমনকি দৃষ্টিবিভ্রমের জন্যও কোন অবলম্বনের প্রয়োজন। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, আমি একটা সাপ দেখলাম বলে মনে হল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল ওটা সাপ নয়, আসলে দড়ি। কিন্তু দড়িটি সেখানে না থাকলে আমার এই ভুল হত না। আরও একটি দৃষ্টান্ত হল : আমি মরুভূমিতে রয়েছি। আর তার একটু দূরে একটি জলাশয় দেখতে পাচ্ছি বলে আমার মনে হচ্ছে। কিন্তু আসলে সেটি জলাশয় নয়, নেহাতই মরীচিকা। মরীচিকা একমাত্র মরুভূমিতেই দেখা যায়। অর্থাৎ মরুভূমি ছাড়া মরীচিকা দেখা সম্ভব নয়। আচার্য শঙ্কর বলছেন—‘তুমি কখনো কি কোন বন্ধ্যা নারীর সন্তানকে দেখেছ? অথবা দেখেছ কি শশশৃঙ্গ? বা আকাশকুসুম?’ এসব অসম্ভব যেহেতু এদের কোন অস্তিত্বই নেই। এমনকি ভুল করেও আমরা এসব দেখতে পাই না। আসল জিনিস না থাকলে তার কোন নকল থাকতে পারে না।

সেজন্য গৌড়পাদ বলছেন, আমাদের একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এই দৃশ্যমান জগতের কোন অবলম্বন বা আশ্রয় আছে। আর সেই আশ্রয় হলেন ব্রহ্ম কারণ ব্রহ্ম নিত্য এবং অপরিবর্তিত। এই দৃশ্যমান জগতের পরিবর্তনসমূহ ব্রহ্মের উপরে কোনরূপ প্রভাব বিস্তার করে না। ব্রহ্ম ব্রহ্মই থাকেন অর্থাৎ ব্রহ্ম নিত্য, সনাতন, নির্বিশেষ এবং নির্গুণ।

এরপর গৌড়পাদ বলছেন যে, এই জগতে দুই রকমের বস্তু আছে—জড় বস্তু ও চেতন বস্তু। এই দুই বস্তুই ব্রহ্মের কাছ থেকে এসেছে, যদিও ব্রহ্ম কোন কিছুরই স্রষ্টা নন। ব্রহ্ম ব্রহ্মই অর্থাৎ ব্রহ্মের কোনও পরিবর্তন হয় না। ব্রহ্ম মায়ার সাথে যুক্ত হয়ে এই জগৎরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব যেমন বলতেন বিশুদ্ধ সোনা দিয়ে কোন গয়না প্রস্তুত করা যায় না। গয়না বানাতে হলে সোনার সাথে কিছু খাদ মেশাতে হয়। একইভাবে শুদ্ধ চৈতন্যই হচ্ছেন শুদ্ধ ব্রহ্ম। আর এই ব্রহ্মই মায়াযুক্ত হয়ে জড়-অজড়, চেতন-অচেতন অর্থাৎ এই জগৎরূপে প্রকাশিত হন। মায়া ব্রহ্মের মধ্যেই রয়েছেন—কখনো সক্রিয় আবার কখনো নিষ্ক্রিয়। মায়াকে একটা সাপের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে যা কখনো গতিশীল আবার কখনো বা স্থির। মায়া যখন নিষ্ক্রিয় তখন তা হল নির্গুণ ব্রহ্ম অর্থাৎ যা উপাধিবর্জিত বিশুদ্ধ চৈতন্যমাত্র। আর মায়া যখন সক্রিয় তখনি এই জগতের প্রকাশ ঘটে।

কারিকা বলছেন যে, অপ্রাণ বস্তু প্রকাশিত হয় প্রাণ তথা হিরণ্যগর্ভ থেকে। এই হিরণ্যগর্ভই অপরব্রহ্ম। মাকড়সা যেমন তার নিজদেহের ভেতর থেকেই জাল বার করে এ যেন ঠিক তাই। মাকড়সা চেতন, কিন্তু তার জালটি অচেতন, পুরুষ থেকেই চেতন বস্তু বা প্রাণিকুল প্রকাশিত হয়—এই পুরুষই পরব্রহ্ম। ‘অংশু’ কথাটির অর্থ কিরণ। প্রাণিকুল তথা আমরা সচেতন, কারণ আমরা ‘পুরুষ’ থেকেই উৎসারিত। এবং এইজন্যই আমরা সূর্যকিরণের সঙ্গে তুলনীয়। কারণ সূর্যের যা ধর্ম সূর্যকিরণেরও ঠিক একই ধর্ম। আবার মাকড়সা যেমন তার জালকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি প্রাণিকুলও জড়জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে। একইভাবে, আত্মাও দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু প্রাণ অপ্রাণ নির্বিশেষে সকল বস্তুই আসে ব্রহ্ম থেকে।

বিভূতিং প্রসবং ত্বন্যে মন্যন্তে সৃষ্টিচিন্তকাঃ।

স্বপ্নমায়াস্বরূপেতি সৃষ্টিরন্যৈর্বিকল্পিতা॥৭

অন্বয়: অন্যে সৃষ্টিচিন্তকাঃ (যাঁরা এ জগৎ সৃষ্টি হয়েছে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী); বিভূতিং প্রসবং মন্যন্তে (এ ঈশ্বরের মহিমা—এমন কথা তাঁরা মনে করেন); অন্যৈঃ (অন্যেরা [যাঁরা আত্মজ্ঞানলাভের প্রয়াসী]); সৃষ্টিঃ স্বপ্ন মায়া-স্বরূপ ইতি বিকল্পিতা ([সে যেমনই হোক] তাঁরা এই সৃষ্টিকে [এই জগৎ] স্বপ্ন তথা দৃষ্টিবিভ্রম ব্যতীত আর কিছুই মনে করেন না)।

সরলার্থ: যাঁরা জগৎ সৃষ্টি হয়েছে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁরা এই বিশ্বকে ঈশ্বরের মহিমা বলে মনে করেন। কিন্তু যাঁরা আত্মজ্ঞানলাভের প্রয়াসী তাঁদের নিকট এ জগৎ স্বপ্ন অর্থাৎ দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে গৌড়পাদ দুই শ্রেণীর মানুষের কথা বলেছেন। তিনি প্রথম শ্রেণীর নাম দিয়েছেন ‘সৃষ্টিচিন্তকাঃ’—সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী। এইসব মানুষরা বলেন এই সৃষ্টি ঈশ্বরের অলৌকিক কর্মবিশেষ—‘বিভূতিম্‌’। ‘বিভূতিম্‌’ কথাটির আর একটি অর্থ হচ্ছে মহিমা বা শক্তি। এরা দ্বিতত্ত্ববাদী, এঁদের মতে সৃষ্টি এবং স্রষ্টা হচ্ছে দুটি পৃথক সত্তা। এই ধারণা কিছু হিন্দুশাস্ত্রে এবং বাইবেলেও দেখতে পাওয়া যায়। এঁদের মতে ঈশ্বর বলে একজন আছেন এবং তিনি তাঁর নিজ শক্তির দ্বারা এই জগৎকে সৃষ্টি করেছেন। এটাই তাঁর অলৌকিকত্বের পরিচায়ক।

কিন্তু অন্য আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, তাঁদের নিকট—এ জগৎ স্বপ্নবৎ (স্বপ্ন-মায়া)। ‘স্বপ্ন’ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ জগৎ স্বপ্নের মতোই মিথ্যা। স্বপ্ন যে সত্য নয় একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু যখন আমি স্বপ্ন দেখছি তখন কি আমি বুঝতে পারি যে আমি স্বপ্ন দেখছি? তখন কি আমি জানি যে স্বপ্ন সত্য নয়? হয়তো স্বপ্নে আমি দেখছি আমি কাশী যাচ্ছি। স্বপ্নে দেখলাম আমি টিকিট কাটছি, আমার জিনিসপত্র গোছাচ্ছি এবং ট্রেনেও উঠেছি। কিন্তু এ সবই মনের কল্পনামাত্র। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি আমার ঘরে নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছি। তাই গৌড়পাদ বলছেন—যে অর্থে স্বপ্ন সত্য শুধুমাত্র সেই অর্থেই এ জগৎও সত্য। একটা বিশেষ মুহূর্তে এটা সত্য। কিন্তু পরমুহূর্তেই তা অন্তর্হিত। যদি তুমি মনে কর যে এ জগতের অস্তিত্ব চিরকাল থাকবে তাহলে তুমি ভুল করবে। এই জগৎকে অনিত্য বলা হচ্ছে এই অর্থে যে এ জগৎ সতত পরিবর্তনশীল।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটা সুন্দর উপমার সাহায্যে প্রকৃত জ্ঞানীর অবস্থা বর্ণনা করছেন, যাঁর কাছে এ জগৎ স্বপ্নবৎ। উপমাটি হল: এক চাষীর বেশি বয়সে একটি পুত্র সন্তান জন্মায়। শিশুটি যত বড় হতে থাকে তার প্রতি তার পিতামাতার স্নেহ-ভালোবাসাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিন চাষীটি যখন ক্ষেতে কাজ করছে এমন সময়ে এক প্রতিবেশী এসে তাকে খবর দিল যে তার ছেলেটি ভীষণ অসুস্থ, তার মৃত্যু আসন্ন-প্রায়। চাষী বাড়ি ফিরে যাওয়ার মধ্যেই ছেলেটি মারা যায়। তার স্ত্রী অঝোরে কাঁদতে থাকে কিন্তু চাষীর চোখ একেবারেই শুষ্ক। তখন শোকাতুরা স্ত্রী তার প্রতিবেশীকে বলছে—‘এমন ছেলে চলে গেল আর তার চোখ থেকে এক বিন্দু জলও পড়ল না।’ কিছুক্ষণ বাদে কৃষকটি তার স্ত্রীকে বলছে—‘বলতে পার কেন আমি কাঁদছি না?’ গত রাতে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম যে আমি রাজা হয়েছি এবং আমি সাত-সাতটি রাজপুত্রের পিতা। সেইসব রাজপুত্রেরা যেমন সুদর্শন তেমনি সৎগুণের অধিকারী। বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তারা জ্ঞান অর্জন করে বহু বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠল। এমন সময়ে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাই আমি এখন অবাক হয়ে ভাবছি আমি কার জন্য কাঁদব ঐ সাত পুত্রের জন্য না এই একটি পুত্রের জন্য?’ জ্ঞানীর কাছে জাগ্রত অবস্থাও স্বপ্নের মতো মিথ্যা।

এই জগৎ যে দৃষ্টিবিভ্রমমাত্র তার পক্ষে আচার্য শঙ্কর একটি চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এটি ভারতীয় দড়ির খেলার দৃষ্টান্ত : এক যাদুকর সপরিবারে যাদুর খেলা দেখাতে এসেছে। যাদুকর একটি দড়ি নিয়ে উঁচুতে হাওয়ায় ছুড়ে দিল, কেমন করে যেন দড়িটি গাছের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন যাদুকরটি বলল—এর উপরে নিশ্চয়ই কোন দুষ্ট প্রেত ভর করেছে। আমি তাকে শায়েস্তা করতে যাচ্ছি। এই বলে কিছু অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে সে দড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। তার স্ত্রী তাকে এই বলে বাধা দিতে চেষ্টা করল: না যেও না। এ কাজ বিপজ্জনক। কিন্তু যাদুকর এই নিষেধ শুনল না। সে দড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল এবং শেষে শূন্যে মিলিয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই একটি কাটা হাত মাটিতে পড়ল, তারপর যথাক্রমে আর একটি হাত, দুটি পা, মাথা এবং সবশেষে তার দেহটি সশব্দে মাটিতে পড়ল। দর্শকদের বিস্ময়বিমূঢ় অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এবার তার শোকাহত স্ত্রী-পুত্ররা ভূলুণ্ঠিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল : আমাদের অন্নদাতা চলে গেল। এখন কে আমাদের ভরণপোষণ করবে? তারপর স্ত্রী দর্শকদের কাছে ভিক্ষা চাইতে লাগল। আর দর্শকরা প্রত্যেকেই তাদের সাধ্যমত পয়সা দিয়ে ওদের সাহায্য করলেন। এরপর স্ত্রী তার মৃত স্বামীর দেহাংশগুলিকে একত্রিত করে একটি কাপড় দিয়ে ঢাকা দিল এবং বলল ‘এবার আমি একটা মন্ত্র পড়ে চেষ্টা করে দেখি।’ সে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল এবং হঠাৎ সকলে দেখল যাদুকর জীবিত অবস্থায় তাদের সামনে দাঁড়িয়ে।

সম্ভবত শ্রীরামকৃষ্ণদেব কারিকার এই শ্লোকটি শুনেছিলেন। আর হয়তো এ-কথা মনে করেই বলতেন: যাদুকর আর তার যাদুর মধ্যে কোন্‌টি সত্য? যাদু সত্য নয়। যাদুর খেলা মানুষকে মোহগ্রস্ত করে। এই খেলা অনেকক্ষণ ধরে চলে এবং সেখানে অনেক ঘটনাও ঘটে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমস্ত ব্যাপারটি দৃষ্টিবিভ্রমের ফল। যাদুকরই একমাত্র সত্য। আচার্য শঙ্করও ঠিক এই কথাই বলেছেন। এ জগৎ যাদুকরের যাদুমাত্র। যখন আমরা এ জগৎকে দেখি তখন তা আমাদের কাছে সত্য বলেই মনে হয়, কিন্তু আসলে তা নয়। অনন্ত সত্তাই এই জগৎকে প্রকাশ করে। অনুরূপভাবে জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি এই তিন অবস্থাই ভ্রান্ত, যা থেকে আমাদের সব দুঃখ-কষ্টের শুরু। এই পরিবর্তন সত্য নয়। প্রথমে আমি ছিলাম সদ্যোজাত এক শিশু, ক্রমে কিশোর, পরে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং এখন হয়তো আমি বৃদ্ধ। আবার বলছেন, এক সময়ে হয়তো আমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, আবার পরবর্তীকালেই রোগগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারি। এইসব পরিবর্তন দেহগত। এইসব পরিবর্তন সত্ত্বেও আমি সেই একই ব্যক্তি। উপনিষদ আমাদের বোঝাতে চাইছেন—জাগ্রত ও ঘুমন্ত, পীড়িত ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, শৈশব ও বার্ধক্য এইসব পরিবর্তনশীল অবস্থার কোনটিই সত্য নয়। তাহলে সত্য কি? এইসব পরিবর্তনের পেছনে যে আত্মা রয়েছেন তাই একমাত্র সত্য।

অনুরূপভাবে এই জগৎ এবং সংগ্রাম, আসক্তি, ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ এই যে জীবন এ সবই ভ্রান্ত। এই সবের স্থায়িত্ব স্বল্প এবং এগুলি বিনাশশীল, আমরা এই জীবনকে বড় বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমাদের প্রতিক্রিয়াসমূহ কোন বিশেষ অবস্থার, কোন বিশেষ মুহূর্তের অধীন। যেমন—কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটলে আমরা উচ্ছ্বসিত হই, আবার অর্থ নাশ হলে আমরা বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। তাই উপনিষদ বলছেন: আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে সৎ কি আর অসৎই বা কি? যতক্ষণ আমি এই দৃশ্যমান জগতের অন্তর্গত ততক্ষণ পর্যন্ত আমার আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ এবং জীবন-মৃত্যু—এই দ্বৈত দৃষ্টি থাকবে। জীবনের ধর্মই এই, কেউ বলতে পারে না, ‘আমি শুধুই আনন্দে থাকব’। কিন্তু উপনিষদ বলছেন—এই সুখ-দুঃখের পারে যাওয়ার চেষ্টা কর।’ উভয়ই বন্ধনের কারণ। যখন তুমি এ জগৎকে মিথ্যা বলে জানবে তখনি তুমি একথা বলতে পার: ‘হে জগৎ, আমি তোমাকে এখন জেনেছি। তুমি আর আমাকে ঠকাতে পারবে না।’ এ যেন দড়ি খেলার গোপন কৌশলটি আয়ত্ত করা। এবার যাদুকরের খেলা দেখে আমি আর বিস্মিত হই না। দেহের বিভিন্ন খণ্ডিত অংশগুলি মাটিতে পড়ে রয়েছে দেখেও আমি বিচলিত হই না। এখন আমি জানি এ সবই ভ্রান্তিমাত্র। ঠিক তেমনিভাবেই, এ জগৎকে সঠিকভাবে জানলে আর প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। যে কোনও ঘটনার জন্যই আমি তখন প্রস্তুত। অর্থ প্রাপ্তি বা নাশ তখন আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তখন সুখ-দুঃখ দুই-ই সমান বলে বোধ হয়।

এখানে গৌড়পাদ আমাদের বোঝাতে চাচ্ছেন, সৃষ্টি আর সৃষ্টির পেছনে যে সত্য রয়েছে—এ দুয়ের মধ্যে কোন্‌টি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েই মশগুল। অপরদিকে এমন কিছু ব্যক্তিও আছেন—যাঁরা বুদ্ধিমান। অন্তর্নিহিত মূল সত্যকে জানতেই তাঁরা অধিকতর আগ্রহী। শ্রীরামকৃষ্ণদেব এক শ্রেণীর মানুষের কথা বলতেন, যারা মন্দির দর্শন করতে গিয়ে তাদের সবটুকু সময় ব্যয় করে মন্দিরের বাইরে যে ভিখারি আছে তাদের সাহায্য করার জন্য। বলতেন: তারা যে মূল উদ্দেশ্যটা নিয়ে এসেছিল তা তারা ভুলে যায়। প্রথমেই মন্দিরে ঢুকে দেবীকে দর্শন কর। তারপর তোমার সাধ্যমত তুমি গরীবদের সাহায্য কর। সুতরাং প্রথমে ঈশ্বর উপলব্ধি, তারপর তাঁর সৃষ্টির কথা ভাবা।

একটি গানে সাধক রামপ্রসাদ অভিযোগ করেছেন: মা তুমি তোমার এই সুন্দর জগতের সাহায্যে আমাদের বোকা বানাচ্ছ। এই সৃষ্টির পিছনে তুমি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছ। তাই আমরা তোমাকে দেখতে না পেয়ে তোমাকে একেবারে ভুলে আছি। তুমি আমাদের সঙ্গে ছলনা করে চলেছ। তুমি কেমন মা? নিজেকে আড়ালে রেখে সন্তানদের এই অসার জগৎকে দিয়ে ভুলিয়ে রেখে, তুমি তোমার সন্তানদের ঠকাচ্ছ। একইভাবে গৌড়পাদ এই জগতের উৎসটা কোথায় সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। এটাই এই শ্লোকের মূল বক্তব্য।

ইচ্ছামাত্রং প্রভোঃ সৃষ্টিরিতি সৃষ্টৌ বিনিশ্চিতাঃ।

কালাৎপ্রসূতিং ভূতানাং মন্যন্তে কালচিন্তকাঃ॥৮

অন্বয়: প্রভোঃ ইচ্ছামাত্রম্ (প্রভুর ইচ্ছামাত্রেই); সৃষ্টিঃ (এই জগৎ [অস্তিত্ব লাভ করল]); ইতি সৃষ্টৌ (সৃষ্টি বিষয়ে); বিনিশ্চিতাঃ (এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত); কালচিন্তকাঃ (জ্যোতির্বিদগণ); ভূতানাং কালাৎ প্রসূতিং মন্যন্তে (বস্তু সৃষ্টির জন্য কালকে দায়ী করেন)।

সরলার্থ: যাঁরা সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেন যে, ঈশ্বরের ইচ্ছামাত্রেই এই জগতের সৃষ্টি। কিন্তু জ্যোতির্বিদগণ মনে করেন কাল থেকেই সর্বভূতের উৎপত্তি হয়েছে।

ব্যাখ্যা: কিন্তু এই জগতের উৎপত্তি হল কেমন করে? গৌড়পাদ বলেন যাঁরা সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁদের মতে এই জগতের সৃষ্টি হল ঈশ্বরের ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে, ‘ইচ্ছামাত্রং’—শুধুমাত্র তাঁর ইচ্ছার দ্বারা। বাইবেলে যেমন আছে, ঈশ্বর বললেন ‘আলো হউক’ এবং আলোর সৃষ্টি হল।

অন্য আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন (কালচিন্তকাঃ) যাঁরা মনে করেন কালই বিশ্বচরাচরের উৎস। তাঁরা কালকেই সবকিছুর স্রষ্টা বলে মনে করেন। এই হল বিবর্তনবাদী অর্থাৎ বিজ্ঞানীদের অভিমত। এই বিজ্ঞানীরা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা মনে করেন, কালের নিয়মেই এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে এবং তার পরে প্রাণ এসেছে। শুরুতে প্রাণ বলে কিছু ছিল না, প্রাণের প্রকাশ পরবর্তী স্তরে। কিন্তু একথা হিন্দুদর্শন স্বীকার করেন না। হিন্দুমতে প্রাণের অস্তিত্ব শুরু থেকেই ছিল, তবে তা ছিল অব্যক্ত। পরবর্তীকালে তা ব্যক্ত বা প্রকাশিত হয়।

ভোগাৰ্থং সৃষ্টিরিত্যন্যে ক্রীড়ার্থমিতি চাপরে।

দেবস্যৈষ স্বভাবোঽয়মাপ্তকামস্য কা স্পৃহা॥৯

অন্বয়: সৃষ্টিঃ ভোগার্থম্‌ ইতি (এ জগৎ শুধুমাত্র ভোগের জন্য); অন্যে (কিছু ব্যক্তি [মনে করেন]); ক্রীড়ার্থম্‌ ইতি চ অপরে (কারোর মতে এই জগৎ ক্রীড়ার জন্য); দেবস্য অয়ম্ এষঃ স্বভাবঃ (এই ঈশ্বরের প্রকৃতি); আপ্তকামস্য স্পৃহা কা (তাঁর কোনও ইচ্ছাই অপূর্ণ নেই, [সুতরাং জগৎ সৃষ্টিতে] তাঁর কি প্রয়োজন)?

সরলার্থ: কিছু ব্যক্তির মতে ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ভোগের জন্য। অপর কিছু ব্যক্তি বলেন, তিনি এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন তাঁর লীলার জন্য। অন্য কিছু ব্যক্তির মতে এই জগৎ সৃষ্টি তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ঈশ্বর আপ্তকাম অর্থাৎ তাঁর সব ইচ্ছাই পরিপূর্ণ। তবে কোন্‌ প্রয়োজনে তিনি এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন?

ব্যাখ্যা: ঈশ্বর যদি জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন তবে কেন তিনি এ সৃষ্টি করেছেন? কেউ কেউ বলেন ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন নিজের ভোগের জন্যে। কিন্তু যদি তাই হয় তবে ঈশ্বর বড় নিষ্ঠুর এবং খেয়ালী। কারণ তিনি তাঁর ভোগের জন্য আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন এই সৃষ্টি তাঁর খেলামাত্র (ক্রীড়ার্থং)। যেমন শিশুরা খেলার সময় মাটির বাড়ি তৈরি করে। কিন্তু মা যখন তাদের খেতে ডাকে তখন সব ভেঙে ফেলে তারা বাড়িতে ছুটে যায়। ঈশ্বরের খেলাও (সৃষ্টি) কতকটা এইরকম। এটা তাঁর কেবলই মজা।

রামপ্রসাদ একটা গানে বলছেন: মা কালী যেন একটা ঘুড়ি উড়াচ্ছেন। ঘুড়ির সুতোটা তিনি ধরে আছেন এবং ঘুড়ি অনেক উঁচুতে উড়ছে। ঘুড়িটা আকাশের একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুড়ি নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করছে কিন্তু আসলে তা নয়। কারণ ঘুড়ির সুতো যে মায়ের হাতে। একইভাবে আমরাও নিজেদের স্বাধীন মনে করি এবং ভাবি আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো যে-কোন কাজ করতে পারি। কিন্তু কোন এক সময় সুতো ছিঁড়ে ঘুড়ি কেটে যায়। তা দেখে মা খুশি হয়ে আনন্দে হাততালি দেয়া এবং হাসতে থাকেন। সুতরাং মা এ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন কেবলমাত্র কৌতুকের জন্য।

আবার কেউ কেউ বলেন এই সৃষ্টি ঈশ্বরের স্বভাব (দেবস্য অয়ম্ এষঃ সূভাবঃ)। একথা সহজেই বুঝতে পারতাম যদি ঈশ্বর আমাদেরই মতো একজন সাধারণ মানুষ হতেন। আমরা বাসনার দ্বারা তাড়িত। কিন্তু ঈশ্বর ‘আপ্তকাম’ অর্থাৎ তাঁর কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ নয়, বস্তুত তাঁর কামনা-বাসনা বলে আদৌ কিছু নেই। কোন কিছু করবার তাগিদ আমি তখনি বোধ করি যখন আমার মধ্যে কোন অভাববোধ থাকে। আর এই অভাব দূর করার জন্যই আমি কাজ করি। কুম্ভকার এই ভেবে ঘট নির্মাণ করেন যে সেটিকে বিক্রি করে তিনি অর্থ উপার্জন করবেন। এই পূর্বোক্ত ব্যাখ্যায় ঈশ্বরকে কুম্ভকারের স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে বলে মনে হয়। আর এইসব অপব্যাখ্যার মূল কারণ হল ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্টিকে পৃথক বলে মনে করা। কিন্তু বেদান্তেব মতে এদের পৃথক বলে মনে করা হচ্ছে বটে কিন্তু আসলে এরা পৃথক নয়। জলবুদ্বুদগুলিকে আমরা যেমন সমুদ্র থেকে পৃথক বলে মনে করি এও যেন ঠিক তাই। এরা এক ও অভিন্ন। ব্রহ্ম স্বয়ং এই জগৎরূপে প্রতিভাত। তাই গৌড়পাদ বলছেন ব্রহ্ম সৃষ্টি করবেনই বা কেন? যিনি আপ্তকাম (আপ্তকামস্য স্পৃহা কা) তাঁর আবার কিসের স্পৃহা? সুতরাং উল্লিখিত ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত নয়।

কে এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন আর কেনই বা করেছেন—ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তর্ক করে আমরা অহেতুক সময়ের অপচয় করি। আমি ভুল করে একটি দড়িকে সাপ বলে মনে করলাম। কেন আমি এই ভুল করলাম, এ নিয়ে তর্ক করা বৃথা। ভ্রম ভ্রমই এবং তাকে শোধরাতে হবে। আমাদের সকল সমস্যার মূলে হচ্ছে এই অজ্ঞানতা। বেদান্তের দৃষ্টিভঙ্গি হল—এই অজ্ঞানতাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূর করতে হবে।

বুদ্ধদেব একসময়ে বলেছিলেন, ধরা যাক, তুমি তীরবিদ্ধ হয়েছ এবং তোমাকে সাহায্য করতে মানুষ এগিয়ে এসেছে। তখন কি তুমি বলবে ‘দাঁড়াও, প্রথমেই আমাকে বল, যে ব্যক্তি আমাকে তীরবিদ্ধ করেছেন তিনি জাতিতে কি এবং তিনি কোথা থেকে এসেছেন’,—তা তুমি অবশ্যই বলবে না। এইসব প্রশ্ন অবান্তর। তোমার যা আশু প্রয়োজন তা হল তীরটিকে ক্ষতস্থান থেকে বার করে তোমার যন্ত্রণার উপশম ঘটানো। একইভাবে বলা যায় আমাদের সকল দুঃখের কারণ হল অজ্ঞানতা। সুতরাং এই অজ্ঞানতাকে দূর করতে হবে। কেন আমাদের এই অজ্ঞানতা কিংবা কিভাবে এই অজ্ঞানতা এল—এ জাতীয় প্রশ্ন একান্তই অবান্তর।

উপনিষদ

নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং নোভয়তঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন

প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্‌। অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণমচিন্ত্যম-

ব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং

শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়ঃ॥৭

অন্বয়: ন অন্তঃ প্রজ্ঞম্‌ ([তুরীয়] অন্ত্যস্থ বস্তু [তৈজস] সম্পর্কে সচেতন নয়); ন বহিষ্প্রজ্ঞম্‌ (বাইরের বস্তু [বিশ্ব] সম্পর্কেও সচেতন নয়); ন উভয়তঃ প্রজ্ঞম্‌ (উভয়ের কোনটির সম্পর্কেই সচেতন নয়); ন প্রজ্ঞান ঘনম্ (কেবলমাত্র ঘনীভূত চৈতন্যও নয়); ন প্রজ্ঞম্‌ (একযোগে নকল বস্তু সম্পর্কে সচেতন নয়); অপ্রজ্ঞং [চ] ন (অসচেতনও নয়); অদৃষ্টম্‌ দৃষ্টির অগোচর); অব্যবহার্যম্ (কোনরূপ ব্যবহারযোগ্যও নয়); অগ্রাহ্যম্‌ (কোন কর্মেন্দ্রিয়ের অধীন নয়); অলক্ষণম্‌ (সকল জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত); অচিন্ত্যম্ (চিন্তার অতীত); অব্যপদেশ্যম্ (কোন ধ্বনির দ্বারা নির্দেশিত নয়); একাত্মপ্রত্যয়সারম্‌ (কেবলমাত্র আত্মা সম্পর্কে সচেতন); প্রপঞ্চোপশম্‌ (এই ভৌতিক জগতের পূর্ণ অবসান হয়); শান্তম্‌ (শান্তির প্রতীক); শিবম্ (সর্বমঙ্গলময়); অদ্বৈতম্ (দ্বিতীয়রহিত অর্থাৎ এক); চতুর্থম্‌ (চতুর্থ অবস্থা—তুরীয়); মন্যন্তে সঃ আত্মা ([প্রাজ্ঞ ব্যক্তি] এই তুরীয়কে আত্মা বলে জানেন); স বিজ্ঞেয়ঃ (এই আত্মাকেই উপলব্ধি করতে হবে [এটাই জীবনের উদ্দেশ্য])।

সরলার্থ: অন্তরস্থ ঘটনা সম্পর্কে তুরীয় সচেতন নন (এর থেকে বোঝা যায় তুরীয় তৈজস নন), বাইরের ঘটনা সম্পর্কেও ইনি সচেতন নন (অর্থাৎ তুরীয় বিশ্ব নন)। ইনি জাগ্রত ও স্বপ্নবস্থার মধ্যবর্তী কোন কিছু সম্পর্কেও সচেতন নন। (সুষুপ্তি অবস্থার প্রাজ্ঞও নন। ইনি সর্বজ্ঞও নন, অচৈতন্য নন। ইনি অদৃশ্য—লৌকিক ব্যবহারের অতীত, কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়—এই দুয়েরই ঊর্ধ্বে, মনের অগোচর, এবং কোন শব্দ দ্বারা ইনি নির্দেশিত নন। এই অবস্থায় থাকে শুধু আত্মার চৈতন্য এবং এখানে জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই। এখানে শান্তি ও কল্যাণের মূর্ত প্রকাশ, এই চৈতন্য এক ও অদ্বিতীয়। এই চতুর্থ অবস্থাই তুরীয়। প্রাজ্ঞগণ একেই আত্মা বলেন। এই আত্মাকে উপলব্ধি করতে হবে।

ব্যাখ্যা: উপনিষদে পূর্বেই বলা হয়েছে যে, জাগ্রত অবস্থায় আমরা চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকি (বহিপ্রজ্ঞং)। নিদ্রিত অবস্থায় আমরা অন্তর্জগৎ (অন্তঃপ্রজ্ঞং) সম্পর্কে সচেতন। তখন এই জগৎকে আমরা স্বপ্নে অনুভব করি। আত্মা ‘বহিষ্প্রজ্ঞং’ নন আবার ‘অন্তঃপ্রজ্ঞং’ও নন। আত্মা বহির্জগৎ বা স্বপ্ন-জগৎ কোনটি সম্পর্কেই সচেতন নন। ইনি জাগ্রত ও স্বপ্নের মধ্যবর্তী জ্ঞান-সম্পন্নও নন (উভয়তঃ প্রজ্ঞং)।

আবার সুষুপ্তি অবস্থায় মানুষ প্রগাঢ় চৈতন্য অর্থাৎ ঘনীভূত চৈতন্যকে (প্রজ্ঞানঘনং) অনুভব করে। তখন তুমি কোন কিছুর সম্পর্কে সচেতন নও এমনকি নিজের সম্বন্ধেও না, আত্মা এরূপ অবস্থারও ঊর্ধ্বে। আত্মা চেতনও নন অচেতনও নন (ন প্রজ্ঞং ন অপ্রজ্ঞং)। এই দুই-এর কোনও অবস্থাই আত্মা তথা ব্রহ্মের সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। আত্মা সকল অবস্থা নিরপেক্ষ অবস্থাসমূহ আত্মায় আরোপিত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আত্মা ঐসকল বিশেষণ থেকে মুক্ত।

আত্মাকে বর্ণনা করা যায় কিভাবে? উপনিষদের মতে আত্মার সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না। আত্মাকে কোনও বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না। বলা যায় না যে, আত্মা এই প্রকার বা আত্মা ঐ প্রকার। যখন আমরা আত্মার সম্বন্ধে কিছু বলি তখনি আমরা তাঁকে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। আত্মায় আরোপিত গুণসমূহ আত্মার বৈশিষ্ট্য নয়। যেমন, কেউ হয়তো বলল পদ্মফুল নীল। নীল একটি গুণমাত্র, পদ্মের কোনও অংশ নয় কারণ পদ্ম সাদা কিংবা লালও হতে পারে। সেভাবেই কেউই বলতে পারে না আত্মা ছোট কিংবা বড় বা আর কিছু। আত্মাকে বর্ণনা করা যায় না, আত্মা যে সঠিক কি তা বলে বোঝানোও যায় না। সেইজন্যই বেদান্ত বলেন, ‘নেতি, নেতি’ অর্থাৎ ‘ন ইতি, ন ইতি’ যার অর্থ আত্মা এটি নয়, এটি নয়।

তাই উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘অদৃষ্টং’—আত্মা দৃষ্টির অগোচর। অর্থাৎ কোনও ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আত্মাকে অনুভব করা যায় না। ‘অব্যবহার্যং’—কোনও ইন্দ্রিয় দ্বারা আত্মা ব্যবহারযোগ্য নন। যেমন আমি এই ‘পেপার ওয়েট’কে অনুভব করতে পারি, এটাকে হাত দিয়ে ধরতে পারি। এটাকে আমি নানা কাজে ব্যবহারও করতে পারি। কিন্তু আত্মাকে এভাবে ব্যবহার করা যায় না। কারণ আত্মার কোনও রূপ নেই। ‘অগ্রাহ্যং’—আত্মাকে বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না। ‘অলক্ষণং’—আত্মা ইন্দ্রিয়াতীত। ‘অচিন্ত্যং’—আত্মা চিন্তার অতীত। এমনকি তাঁকে চিন্তা করাও যায় না। যেমন, সূর্য যে কত বৃহৎ তা বিজ্ঞানীরা আমাদের বলে দেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা কি তা ধারণা করতে পারি? কোন কিছুর সঙ্গেই আমরা আত্মাকে তুলনা করতে পারি না। আত্মা ‘অব্যগদেশ্যং’– তাঁকে বর্ণনা করা যায় না।

তবে আত্মা কি? ‘একাত্মপ্রত্যয়সারং’—এ কেবল ‘অহংবোধ’ অর্থাৎ আমাদের আত্মচৈতন্য। এটাই এর একমাত্র বৈশিষ্ট্য। আমাদের সকলেরই এই ‘অহংবোধ’ আছে। এমনকি ক্ষুদ্রতম কীটেরও এই বোধ আছে। কিন্তু আমাদের সকলের মধ্যে এক ‘সাধারণ অহংবোধ’ আছে। এবং সেটাই ব্রহ্ম। কেমন করে বুঝব যে এই ‘অহংবোধ’ই ব্রহ্ম? আমি মনে করি যে, আমি শ্ৰীযুক্ত অমুক এবং অমুক বংশে আমার জন্ম। তুমি মনে কর, তুমি আর একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। কিন্তু আমাদের এই ‘অহংবোধ’ আমাদের অহংকার ও দেহ-মনের সঙ্গে অভিন্ন। এই অহংকারের ফলেই আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে আলাদা মনে করি। প্রশ্ন ওঠে, তবে ‘আমি’ কে? এই দেহ ও মন চলে গেলে আর কি অবশিষ্ট থাকে? থাকে এক আত্মা, এটিই সাধারণ আশ্রয়, সাধারণ অধিষ্ঠান। ইনিই পরমাত্মা। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, উপনিষদ দক্ষতার সাথে আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করলেন—‘আমরাই ব্রহ্ম’। প্রথমে ‘নেতি নেতি’ করে আমরা সবকিছুকে অস্বীকার করি। শেষে থাকে কেবলমাত্র একটি সত্তা, ‘আত্মপ্রত্যয়’—অহংবোধ, সমগ্র জগৎ চরাচরের এই হল আশ্রয়, আমাদের সকলেরই সত্তাস্বরূপ।

কখন আমরা এই সত্য উপলব্ধি করি? ‘প্রপঞ্চ-উপশমং’, প্রপঞ্চ কথার অর্থ হল দৃশ্যমান জগৎ এবং উপশমং এর অর্থ অস্বীকার করা। এই দৃশ্যমান পঞ্চভূতে গড়া জগৎকে অস্বীকার করতে পারলেই আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারি। এই জগৎ নাম-রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই নাম-রূপ বর্জিত হলে আর কি অবশিষ্ট থাকে? ‘শান্তং শিবম্ অদ্বৈতম্’ অর্থাৎ শান্তি, আনন্দ ও একত্ববোধ। সাধারণভাবে, আমরা সবসময়েই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু যেখানে কোন দুই নেই, কেবলমাত্র এক রয়েছে সেখানেই শান্তি এবং আনন্দ। এটাই চতুর্থ অবস্থা—‘চতুর্থং’, একেই তুরীয় অবস্থা বলে। এই অবস্থা অর্থাৎ ব্রহ্মই আমাদের প্রকৃত অবস্থা। ‘সঃ বিজ্ঞেয়ঃ’—এই আত্মাকে জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। কেউ কেউ আপত্তি তুলতে পারেন আত্মাকে বিজ্ঞেয় বলা হচ্ছে কেন? কে এই আত্মাকে জানতে পারে? তাহলে কোন জ্ঞাতা থাকা চাই। আমি আমার থেকে পৃথক কোন বস্তুকে জানতে পারি অর্থাৎ সেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এই দুই বোধ আছে। ব্রহ্ম যদি জ্ঞেয় বস্তু হন তবে জ্ঞাতা কে? এর উত্তরে আচার্য শঙ্কর বলেছেন ‘জ্ঞেয়’ শব্দটি এই অর্থে উপনিষদে ব্যবহৃত হয়নি। উপনিষদ বলছেন যে এখানে আমরা নিজেদের আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞ। আমাদের এই অজ্ঞানতা দূর করতে হবে। এভাবেই আত্মাকে জানা যাবে।

গৌড়পাদ-কারিকা

নিবৃত্তেঃ সর্বদুঃখানামীশানঃ প্রভুরব্যয়ঃ।

অদ্বৈতঃ সর্বভাবানাং দেবস্তুৰ্যো বিভুঃ স্মৃতঃ॥১০

অন্বয়: অব্যয়ঃ (অপরিবর্তনীয়); ঈশানঃ (তুরীয় [প্রভু]); সর্বদুঃখানাং নিবৃত্তেঃ প্রভুঃ (সর্বদুঃখনাশক [অর্থাৎ প্রাজ্ঞ, তৈজস এবং বিশ্ব এই তিন অবস্থার নাশ]); সর্বভাবানাম্‌ ([কারণ] সব বস্তু [অসত্য] হওয়ায়); অদ্বৈতঃ (অদ্বিতীয়); দেবঃ (প্রকাশিত, জ্যোতির্ময়); তুৰ্য্যঃ (তুরীয়); বিভুঃ (সর্বব্যাপী ঈশ্বর); স্মৃতঃ ([স্মৃতির দ্বারা] এভাবে বর্ণিত)।

সরলার্থ: প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা তুরীয়কে এভাবে বর্ণনা করেছেন: এক ও অভিন্ন, সর্বব্যাপী (ঢেউয়ে যেমন জল থাকে), সম্পূর্ণভাবে এই দৃশ্যমান জগৎকে বর্জন, স্বয়ংপ্রকাশ, শুদ্ধ চৈতন্য, পরব্রহ্ম, একমাত্র তিনিই সকল দুঃখমোচনে সক্ষম। (পরব্রহ্মের সঙ্গে নিজ অভিন্নতা উপলব্ধি করতে পারলে সকল দুঃখের অবসান হয়।)

ব্যাখ্যা: বিশ্ব, তৈজস অথবা প্রাজ্ঞ—সব অবস্থাতেই আমরা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করি। অবিদ্যা এই তিন অবস্থাতেই প্রভাব বিস্তার করে। আমরা যদি প্রাজ্ঞকে অতিক্রম করে তুরীয়তে লীন হতে পারি তবে আর কোনও দুঃখ-কষ্টের অবকাশ থাকে না। তুরীয় বলতে এখানে ঈশ্বরকে বোঝানো হয়েছে—একমাত্র তিনিই আমাদের দুঃখমোচন করতে পারেন। বস্তুত তুরীয়ই আমাদের আত্মা। জীবনের লক্ষ্যই হল এই আত্মাকে জানা। যখন আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারব তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারব আত্মা ছাড়া আর দ্বিতীয় কিছু নেই। দ্বিতত্ত্বের ধারণা তখন পুরোপুরি দূরীভূত হয়। আত্মা জ্যোতির্ময়। যেন আত্মার বিচ্ছুরিত আলোকেই আমরা সকল বস্তুর মধ্যে ঐক্য দর্শনে সক্ষম হই।

কার্যকারণবদ্ধৌ তাবিষ্যেতে বিশ্বতৈজসৌ।

প্রাজ্ঞঃ কারণবদ্ধস্তু দ্বৌ তৌ তুর্যে ন সিধ্যতঃ॥১১

অন্বয়: তৌ (ঐ দুটি); বিশ্বতৈজসৌ (বিশ্ব এবং তৈজস); কার্যকারণবদ্ধৌ (কার্য-কারণ নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত); ইষ্যেতে ([প্রাজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারা] একথা স্বীকৃত); প্রাজ্ঞঃ তু কারণবদ্ধঃ (প্রাজ্ঞ কিন্তু কারণজাত বলেই বদ্ধ); তৌ দ্ধৌ (এ দুটি [কার্য এবং কারণ]); তুর্যে (তুরীয় অবস্থায়); ন সিধ্যতঃ (প্রযোজ্য নয়)।

সরলার্থ: বিশ্ব এবং তৈজস, উভয়ই কার্য-কারণ নিয়মে নিয়ন্ত্রিত—জ্ঞানী ব্যক্তিমাত্রই একথা স্বীকার করেন। প্রাজ্ঞ কিন্তু শুধুমাত্র জন্মসূত্রেই কারণবদ্ধ। কিন্তু কার্য-কারণের কোনটিই তুরীয় অবস্থায় প্রযোজ্য নয়।

ব্যাখ্যা: তুরীয় যে এক বিশেষ অবস্থা, সেকথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব, তৈজস এবং প্রাজ্ঞ—এই অবস্থাগুলি নিরপেক্ষ নয়, কিন্তু তুরীয় নিরপেক্ষ। প্রথম তিনটি অবস্থা অবিদ্যাপ্রসূত। কিন্তু তুরীয় স্বয়ং চৈতন্যস্বরূপ। এই অবস্থায় অজ্ঞানতা ও তার যাবতীয় আনুষঙ্গিক ঘটনা দূরীভূত হয়। অজ্ঞানতার প্রভাব প্রাজ্ঞ স্তর পর্যন্ত। সূর্যের আলোতে যেমন সকল অন্ধকারের অবসান ঘটে ঠিক তেমনি কোন মানুষ তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হলে তাঁর সমস্ত অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়।

নাত্মানং ন পরাংশ্চৈব ন সত্যং নাপি চানৃতম্।

প্রাজ্ঞঃ কিঞ্চন সংবেত্তি তুর্যং তৎ সর্বদৃক্‌ সদা॥১২

অন্বয়: প্রাজ্ঞঃ (প্রাজ্ঞ); আত্মানং ন ([যেমন পূর্বে বলা হয়েছে] নিজেকে জানে না); পরং চ ন (অন্য কিছুও জানে না); সত্যং ন অনৃতম্ (সৎ অসৎ জানে না); কিঞ্চন ন এব সংবেত্তি (কোন কিছুই উত্তমরূপে জানে না); তুরীয়ম্ (চতুর্থটি); সদা (সবসময়); তৎ সর্বদৃক্‌ (সর্ব বস্তু দর্শনে সক্ষম)।

সরলার্থ: প্রাজ্ঞ অবস্থায় ব্যক্তি নিজেকে জানে না, অন্য কিছুও জানে না। এ অবস্থায় সৎ-অসৎও জানা যায় না। অর্থাৎ এ অবস্থায় কোন কিছুই জানা যায় না। তুরীয় অবস্থায় ব্যক্তি কিন্তু সর্বদাই সবকিছু জানেন।

ব্যাখ্যা: প্রাজ্ঞ এবং তুরীয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্য কি? প্রাজ্ঞ অবস্থায় তুমি সম্পূর্ণ অচেতন। তুমি তখন সুষুপ্তিতে থাক। তখন তুমি তোমার আত্মা বা অন্য কোন কিছুই জান না। কোন্‌টি করা ঠিক কোন্‌টি ভুল এ বোধও তখন থাকে না। অজ্ঞানতার বীজ সবসময়েই তোমার মধ্যে রয়েছে। এই অজ্ঞানতা দেখা যায় না কিন্তু এ থাকে ঠিকই। সেইজন্য ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তুমি আবার সেই স্থানে ফিরে যাও যেখানে নিদ্রার পূর্বে ছিলে। তুমি আবার সেই একই ব্যক্তি যে কর্মের ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ। তুমি তখন আষ্টেপৃষ্ঠে বদ্ধ।

কিন্তু তুরীয় অবস্থায় তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত। তুমি তখন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সূর্যের মতো। এই অবস্থায় তুমি কোন কিছুতেই লিপ্ত নও। তুমিই তোমার আত্মা—যা অদ্বিতীয় ও স্বতন্ত্র। তুমি অপরিবর্তনীয়। কিছুই তখন তোমাকে প্রভাবিত করতে পারে না। এই অবস্থায় তুমি সর্বদৃষ্টিসম্পন্ন, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী এবং সতত বিদ্যমান।

দ্বৈতস্যাগ্রহণং তুল্যমুভয়োঃ প্রাজ্ঞতুর্যোয়োঃ।

বীজনিদ্রাযুতঃ প্রাজ্ঞঃ সা চ তুর্যে ন বিদ্যতে॥১৩

অন্বয়: প্রাজ্ঞঃ তুর্যয়োঃ উভয়োঃ (তুরীয় এবং প্রাজ্ঞ উভয়ই); দ্বৈতস্য অগ্রহণং তুল্যম্‌ (তাঁরা তুল্য এই অর্থে যে উভয়ের কেউই দ্বিতত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত নন [অর্থাৎ উভয়ের কারোর মধ্যেই দৃশ্যমান জগতের কোন বোধ নেই, কিন্তু একটি পার্থক্য আছে]); প্রাজ্ঞঃ বীজনিদ্রাযুতঃ (প্রাজ্ঞ নিদ্রাভিভূত কারণ সে অজ্ঞান); সা চ [নিদ্রা] তুর্যে ন বিদ্যতে (তুরীয় অবস্থা অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত)।

সরলার্থ: প্রাজ্ঞ এবং তুরীয়ের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, উভয়ই এই দৃশ্যজগৎ সম্পর্কে অবহিত নয়। আবার উভয়ের মধ্যে একটি পার্থক্যও আছে। প্রাজ্ঞ নিদ্রাভিভূত কারণ সে অজ্ঞান, কিন্তু তুরীয় অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত।

ব্যাখ্যা: প্রাজ্ঞ এবং তুরীয় অবস্থার মধ্যে বহু সাদৃশ্য দেখা যায়। উভয় অবস্থাতেই আমার কাছে এই দৃশ্যমান জগতের কোন অস্তিত্বই থাকে না। এই অবস্থায় দ্বিতত্ত্বের কোন প্রভাবও নেই, কিন্তু এই দুই অবস্থার মধ্যে এক মূল পার্থক্য আছে। আমরা দুই দেখি কেন? কারণ আমরা আত্মার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। সেই অভিন্ন আত্মা সর্বত্র ও সর্ববস্তুতে বিরাজমান। আমিই সেই আত্মা। তুমি আর আমি এক ও অভিন্ন। যদি আমি তোমাকে আঘাত করি তবে তো আমি নিজেকেই আঘাত করছি। কিন্তু আমি তোমাকে আঘাত করি কেন? কারণ আমি তোমাকে আমার থেকে পৃথক মনে করি এবং এই দ্বৈতবোধের জন্যই আমি তোমাকে আঘাত করি। যতক্ষণ এই দ্বিতত্ত্বের বোধ থাকবে ততক্ষণ আমি আমার কাছে এবং অপর সকলের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে থাকব, এই দ্বিতত্ত্ববোধ ত্যাগ করাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য।

একথা সত্য যে প্রাজ্ঞ বা তুরীয় অবস্থায় আমরা দুই দেখি না। প্রাজ্ঞ অবস্থাকে স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রার (সুষুপ্তির) অবস্থা বলে। তখন মানুষ গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন এবং কোন কিছুর সম্পর্কেই অবহিত নয়। আবার নিদ্রাভঙ্গের ঠিক অব্যবহিত পরেই কোথায় আছি বা এটা কোন্‌ সময় তা বোঝা যায় না। অচিরেই অবশ্য এই ঘোর কেটে যায় এবং নিদ্রার পূর্বে যেখানে ছিলাম আবার সেখানেই ফিরে যাই। এর কারণ কি? কারণ আত্মা সম্পর্কে আমি অজ্ঞ। আমি এখনও অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত নই এবং তার ফলে দ্বৈতবোধের সাময়িক বিলুপ্তি সত্ত্বেও আমার জীবনে সেই অজ্ঞানতা। পুরোমাত্রায় বর্তমান।

কিন্তু তুরীয় অবস্থায় আমার মধ্যে অজ্ঞানতার লেশমাত্র থাকে না। তখন আমি জানি আমি কে? আমি জানি যে আমি সেই অভিন্ন আত্মা যা সকলের মধ্যে বিরাজিত।

স্বপ্ননিদ্রাযুতাবাদ্যৌ প্রাজ্ঞস্ত্বস্বপ্ননিদ্রয়া।

ন নিদ্রাং নৈব চ স্বপ্নং তুর্যে পশ্যন্তি নিশ্চিতাঃ॥১৪

অন্বয়: আদৌ (প্রথম দুটি [অর্থাৎ বিশ্ব—জাগ্রত অবস্থা ও তৈজস—স্বপ্নাবস্থা]); স্বপ্ন-নিদ্রা-যুতৌ (দৃষ্টিবিভ্রম এবং স্বপ্নযুক্ত নিদ্রার দ্বারা বিশেষিত); প্রাজ্ঞঃ তু অস্বপ্ন নিদ্রয়া (স্বপ্নহীন নিদ্রার দ্বারা বিশেষিত); নিশ্চিতাঃ (যাঁরা ব্রহ্মকে নিশ্চিতভাবে জানেন); তুর্যে (তুরীয় অবস্থায়); নিদ্রাং ন স্বপ্নং চ ন পশ্যন্তি (এই তিন অবস্থা—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির মধ্যে কোনটিকেই দেখেন না)।

সরলার্থ: প্রথম দুই অবস্থা—বিশ্ব এবং তৈজস, দৃষ্টিবিভ্রম ও স্বপ্নের দ্বারা বিশেষিত। প্রাজ্ঞ হল স্বপ্নহীন গাঢ় নিদ্রার অবস্থা। যাঁরা ব্রহ্মকে যথার্থভাবে জানেন তাঁরা নিদ্রা ও স্বপ্নবস্থাকে কখনো তুরীয়ের সঙ্গে যুক্ত করেন না।

ব্যাখ্যা: এখানে স্বপ্ন কথাটির অর্থ এক বস্তুকে অন্য আর এক বস্তুর রূপে দেখা। যেমন—রজ্জুসৰ্প অর্থাৎ রজ্জুর স্থানে সর্পকে দেখা। বিশ্ব তথা জাগ্রত অবস্থাতেও আমাদের এই ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম হয়ে থাকে। দুটি অবস্থায়ই কার্য-কারণের অধীন। প্রাজ্ঞ কিন্তু দৃষ্টিবিভ্রম থেকে মুক্ত, কিন্তু এটিরও পিছনে কারণ আছে। আর সে কারণ হল অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা।

যেখানে সূর্যালোক আছে সেখানে অন্ধকার থাকতে পারে না। আলো এবং অন্ধকার পরস্পরবিরোধী। একইভাবে তুরীয়ে অজ্ঞানতার স্থান নেই আবার তুরীয় কার্য-কারণের অধীন নয়। একথাই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষরা দৃঢ়তার সাথে বলে থাকেন।

অন্যথা গৃহ্নতঃ স্বপ্নে নিদ্রা তত্ত্বমজানতঃ।

বিপর্যাসে তয়োঃ ক্ষীণে তুরীয়ং পদমশ্নুতে॥১৫

অন্বয়: অন্যথা গৃহ্নতঃ স্বপ্নঃ (স্বপ্নে [দৃষ্টিবিভ্রম] এক বস্তুর স্থানে অন্য বস্তু দেখা যায়); তত্ত্বং অজানতঃ নিদ্রা (নিদ্রিত অবস্থায় [অজ্ঞানতা] কোনও বস্তুকে যথার্থভাবে জানা যায় না); তয়োঃ বিপর্যাসে ক্ষীণে (এ দুটি ভ্রান্তির উপশম হলে); তুরীয়ং পদম্ অশ্নুতে (তুমি ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মর্যাদা অর্জন কর)।

সরলার্থ: স্বপ্ন এক দৃষ্টিবিভ্রম যেখানে এক বস্তুকে অন্য আর এক বস্তুরূপে দেখা যায়। নিদ্রা (সুষুপ্তি) হল অবিদ্যা যখন আমরা কিছুই জানতে পারি না। আমাদের নিকট এই দুই-ই বন্ধন। আমরা এ দুটিকে অতিক্রম করতে পারব তখনি যখন আমরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারব।

ব্যাখ্যা: আমাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে এই তুরীয় অবস্থা লাভ করা। কিন্তু কিভাবে এই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছনো যায়? আর এ পথের অন্তরায়ই বা কি?

এ পথের প্রতিবন্ধক হল মায়া। মায়ার প্রভাবে আমরা সত্যের প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারি না। অর্থাৎ আমরা অজ্ঞান। যেমন আকাশে সূর্য রয়েছে কিন্তু তা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। তা দেখে আমাদের মনে হতে পারে যে সেখানে সূর্য আদৌ নেই। এটাই অজ্ঞানতা। এই অজ্ঞানতা তথা অবিদ্যার জন্যই আমরা আমাদের যে প্রকৃত পরিচয় তুরীয় বা আত্মা তাঁকে জানতে পারি না।

মায়ার প্রভাবের আর এক লক্ষণ হল, আমরা এক বস্তুর স্থলে অন্য বস্তুকে দেখি। এ ক্ষেত্রে একটি অতি পরিচিত দৃষ্টান্ত হল : রজ্জুতে সর্পভ্রম। এই ভ্রান্তির ফলে আমরা আত্মার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি না। বিনাশশীল অস্থিমাংসের দেহকেই আমরা আত্মা বলে মনে করি। কিন্তু আত্মা অবিনাশী। সাপ যেমন দড়ির উপর আরোপিত, ঠিক তেমনি দেহও আত্মায় ন্যস্ত।

যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এই আত্মজ্ঞান লাভ করতে না পারে ততক্ষণ সে এই তিন অবস্থা—বিশ্ব, তৈজস এবং প্রাজ্ঞের অধীন। এখানে অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা নিদ্রারূপে বর্ণিত। এই অজ্ঞানতাই আমার ভাগ্যের নিয়ামক। বিশ্ব এবং তৈজস—এই প্রথম দুই অবস্থা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে। কিন্তু প্রাজ্ঞ অবস্থায় এই বিভ্রান্তি আর থাকে না কিন্তু অজ্ঞানতা থাকে। এই অবস্থায় আমাদের মন নিষ্ক্রিয় এবং আমরা কোন বস্তু সম্পর্কে সচেতন নই। এই অবস্থার ঊর্ধ্বে হল তুরীয় অবস্থা, এই তুরীয়ই আমাদের প্রকৃত আত্মা। অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা যা আত্মজ্ঞান লাভের অন্তরায় এবং নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে তাকে অতিক্রম করতে হবে। তবেই আমরা এই তুরীয় অবস্থা লাভ করতে পারব। অজ্ঞানতা আমাদের বিভ্রান্ত করে এবং সত্যকে জানার পথে বাধার সৃষ্টি করে। সত্যকে জানতে হলে এই অজ্ঞানতাকে দূর করতে হবে।

অনাদিমায়য়া সুপ্তো যদা জীবঃ প্রবুধ্যতে।

অজমনিদ্রমস্বপ্নমদ্বৈতং বুধ্যতে তদা॥১৬

অন্বয়: অনাদি মায়য়া (অনাদি মায়ার প্রভাবে); সুপ্তঃ জীবঃ যদা প্রবুধ্যতে (যখন জীবাত্মা আত্মজ্ঞান লাভ করে); অজম্‌ (জন্ম [মৃত্যু]-রহিত); অনিদ্রম্‌ (অজ্ঞানতাবর্জিত); অস্বপ্নম্ (দৃষ্টিবিভ্রমরহিত); অদ্বৈতং বুধ্যতে তদা (তখন সে সব বস্তুর একত্ব বুঝতে সক্ষম)।

সরলার্থ: অনন্ত কাল ধরে মায়া সক্রিয় এবং তারই প্রভাবে জীবাত্মা নিদ্রিত, যেন সম্মোহিত। জাগ্রত হলে জীবাত্মা নিজের স্বরূপকে উপলব্ধি করে। সে তখন অনুভব করে যে সে অজম্‌ (জন্মরহিত), অনিদ্র (অর্থাৎ অজ্ঞানতারহিত), এবং স্বপ্নবর্জিত (অর্থাৎ ভ্রমমুক্ত)। জীবাত্মাই পরমাত্মা আর পরমাত্মাই একমাত্র সত্য।

ব্যাখ্যা: এখানে গৌড়পাদ বলছেন, আমরা সকলেই বিভ্রম তথা মায়ার অধীন। আমরা যেন সম্মোহিত হয়ে আছি। আমরা নিজেদেরকে পরস্পরের থেকে এবং এই জগৎ থেকে পৃথক বলে মনে করি। নিজেদের অধিকার, নিজেদের সুযোগসুবিধা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আমরা অকারণ ব্যতিব্যস্ত হই। অধিকারের দাবিতে আমরা পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হই। ভুলে যাই যে অন্যেরও অধিকার আছে। যদি আমরা বিষয়টিকে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখি তাহলে সমগ্র ব্যাপারটিকেই এক বিরাট কৌতুক বলে মনে হয়। এই দ্বিতত্ত্ব অর্থাৎ ‘আমি’ এবং ‘তুমি’র এই যে দুইবোধ এর সবটাই একটা বিরাট কৌতুকের বিষয়। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে এই জগৎকে কৌতুক বলে মনে হয় না। বরং এই জগৎকে অতীব সত্য এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। গৌড়পাদ বলছেন এই মায়া অনাদি, অর্থাৎ এর কোন শুরু নেই।

আচার্য শঙ্কর মায়ার দুটি দিক তথা দুই প্রকার বিভ্রমের কথা বলছেন। এই দুটি, দিক হল ‘অন্যথা গ্রহণম্‌’ আর ‘অগ্রহণম্‌’। ‘অন্যথা গ্রহণম্‌’ এর অর্থ ভুল দেখা। সত্য এখানে বিকৃতরূপে প্রতিভাত। যে ধরনের বিকৃতি স্বপ্নে ধরা পড়ে। যেমন, আমি হয়তো স্বপ্ন দেখছি আমি হাওয়ায় উড়ে চলেছি। ‘অগ্রহণম্‌’ হল, না দেখা। যেমন, আমি ঘুমিয়ে আছি, সে সময়ে কেউ আমার ঘরে প্রবেশ করলেও তাকে আমি দেখতে পাই না। এমনকি সে যে এসেছিল তাও আমি জানতে পারি না। সব অবস্থাতেই আমরা এই অজ্ঞানতার দ্বারা তাড়িত। কিভাবে? প্রথমত এই অজ্ঞানতার ফলেই আত্মার প্রকৃত স্বরূপটি আমাদের কাছে ধরা পড়ে না। আমরা যে কে তা আমরা জানতেও পারি না। এই হল ‘অগ্রহণম্‌’ বা না দেখা। আর এই না দেখার জন্যই আমরা নিজেদেরকে পরস্পরের থেকে আলাদা বলে মনে করি। একেই বলে ‘অন্যথা গ্রহণম্‌’ বা ভুল দেখা। আমরা এই দেহকেই ‘আমি’ বলে মনে করি। আমার শরীর এক ধরনের, তোমার হয়তো আর এক ধরনের। এই দেহগত বিভিন্নতার জন্য আমরা নিজেদেরকে একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি। শুধু তাই নয়, শরীর নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনারও অন্ত নেই। শরীর অসুস্থ হলেই আমরা নিজেদের অসুস্থ বলে মনে করি। আমরা এই কথাটি কিছুতেই মনে রাখি না যে, এই দেহ ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু দেহের মধ্যে যে দেহী আছেন তিনিই চিরন্তন অর্থাৎ চিরস্থায়ী। আবার আমরা দেখতে পাই না যে একই আত্মা আমাদের সকলের মধ্যে রয়েছেন। আর তিনিই হলেন পরমাত্মা। এই দুই প্রকার ভুলই আমাদের অবিদ্যার মূল কারণ।

প্রশ্ন হল, এর শেষ কোথায়? গৌড়পাদ বলছেন: ‘যদা জীবঃ প্রবুধ্যতে’—যখন জীবাত্মা জাগে। তিনি বলছেন, আমরা যেন এখন এই মায়ানিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি। আবার সুষুপ্তি অবস্থায় আমাদের কাছে এই জগৎ বা অন্য কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু যখন আমরা জেগে উঠি তখন আবার আমরা সবকিছু সম্পর্কে সচেতন হই। ঠিক একইভাবে মায়ানিদ্রা ভঙ্গ হলে আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করি এবং উপলব্ধি করি যে আমাদের সকলের মধ্যে এক সত্তা বিদ্যমান। তখন আমরা ভাবি : ‘কি নির্বোধই না আমি ছিলাম! আমি ভাবতাম, এই জগৎ থেকে আমি আলাদা। কিন্তু আসলে আমি তা নই।’ যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁর প্রকৃত স্বরূপ হল : তিনি ‘অজম্‌’—জন্মরহিত, অনিদ্রম্‌—অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত, অস্বপ্নম্‌—ভুলত্রুটিবিহীন, এবং অদ্বৈতম্‌—দ্বিতত্ত্ববর্জিত।

অজম্‌—জন্মরহিত। তোমার জন্মও হয়নি, তোমার মৃত্যুও হবে না। তোমার কখনো জন্ম হতে পারে না কারণ তুমি সকলের আত্মা। দেহের জন্ম-মৃত্যু ঘটে। কিন্তু তা তোমার প্রকৃত স্বরূপকে প্রভাবিত করতে পারে না। ‘তুমি’ সবসময়ই এক। হিন্দুদর্শনে ‘অজম্‌’-এর ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুমতে এই হল সারকথা—দেই এবং আত্মা আলাদা। দেহ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আত্মা শাশ্বত ও নিত্য। এটাই আমাদের প্রকৃত পরিচয়। কিন্তু আমরা তা জানি না। এটা এমন নয় যে আত্মোপলব্ধির পূর্বে তুমি একরকমের ছিলে এবং আত্মজ্ঞান লাভ করার ফলে তোমার পরিবর্তন হয়েছে, এবং তুমি ‘অজম্‌’ অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছ। না, তুমি সবসময়ই জন্মরহিত। ব্রহ্মাস্বরূপ তুমি। মায়ানিদ্রা দূর হলে একথা জানা যায়।

আচার্য শঙ্কর বলেছেন আত্মা ‘অজম্‌’। কারণ আত্মা অবিকৃত, অপরিবর্তনীয়, স্বাধীন। হিন্দুদর্শনের সকল শাখা এইকথা স্বীকার করেন যে সৃষ্টি থাকলে তার বিনাশও থাকবে। যৌগিক বস্তু বলে যদি কিছু থাকে যা বহু বস্তুর সমষ্টি, তবে তার পরিবর্তন হবেই। সেইজন্যই উপনিষদ আত্মার সম্বন্ধে ‘নিষ্কলম্‌’ এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। ‘নিষ্কলম্‌’ কথাটির অর্থ অবিভাজ্য। যদি কোন বস্তু বিভিন্ন অংশের সমষ্টি হয় তবে কোন-না-কোন দিন এই অংশগুলি বিচ্ছিন্ন হবেই। যেমন আমাদের এই দেহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমষ্টি। আমার একটি পা, হাত বা চোখ বা যে কোনও একটি অঙ্গের হানি হতে পারে। কিন্তু তবুও আমি বেঁচে থাকি। তার কারণ ‘আমি’ পা বা হাত বা চোখ কোনটিই নই। কিন্তু দেহের সকল অংশ যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে দেহটি আর জীবিত থাকতে পারে না। কিন্তু আত্মা অবিভাজ্য, অখণ্ড এক সত্তা। বৌদ্ধধর্মেও একথা আলোচনা করা হয়েছে। বৌদ্ধরা বলেন: ‘তোমরা রথের কথা বল। কিন্তু রথটি কোথায়? আমায় রথটিকে একবার দেখাও দেখি।’ যদি তুমি রথের কোন একটি অংশ স্পর্শ করে দেখাও, তখন তাঁরা বলবেন : ও! এটি তো রথের চাকা। যদি তুমি রথের অন্য অংশ স্পর্শ করে দেখাও তখন তাঁরা বলবেন : এটি তো রথের পাটাতন। যদি বলা হয় রথ এ সব অংশেরই সমষ্টি তখন তাঁরা বলবেন, কিন্তু রথটি কোথায়? যদি এটি বিভিন্ন অংশের সমষ্টি হয় তবে এর মধ্যে রথ বলে তো আর কিছু নেই।

আচার্য শঙ্করের মতে এ জগতে সকল বস্তুই ষড়্‌বিকার বা ছয় প্রকারের পরিবর্তনের অধীন। জন্ম, কিছুকাল স্থিতি, বৃদ্ধি, পরিণতি বা সুপক্ক অবস্থা, ক্ষয় বা হ্রাস ও বিনাশ—এই ছয় অবস্থাভেদ বা বিকার। যেহেতু বস্তুমাত্রই কার্য-কারণের অধীন, তাই সকল বস্তুই এই ষড়্‌বিকারের শিকার। বৌদ্ধদর্শনে এই কার্য-কারণ সম্পর্ককে বলা হয়েছে ‘প্রতীত্য সমুৎপাদ’। একটি বস্তু অন্য আর একটি বস্তুর উপর নির্ভরশীল। এই জগৎ বিভিন্ন বস্তুর সমষ্টিমাত্র। এইসব বস্তুসকল একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। এ এক কার্য-কারণের শৃঙ্খলের মতো এবং জগৎ এই শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কিন্তু আত্মা কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নন। আত্মা স্বাধীন, স্বয়ম্ভূ। আত্মা অবিকৃত। তিনি কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। তাই আত্মা ‘অজম্‌’ অর্থৎ জন্মরহিত, নিত্য এবং শাশ্বত।

‘অনিদ্রম্‌’ অর্থ হল নিদ্রাহীন। নিদ্রাবস্থায় কি ঘটে? চতুর্দিক তখন অন্ধকার। অজ্ঞানতাকে ‘তমস্’ বা অন্ধকার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্ধকার ঘরে আমি কাউকে দেখতে পাই না। এমনকি কেউ যদি আমার সামনে দাঁড়িয়েও থাকেন তাহলে ও তাঁকে দেখতে পাই না। ঠিক তেমনিভাবে অজ্ঞানতাজনিত অন্ধকারের প্রভাবে আমি আত্মাকে দেখতে পাই না। কিন্তু আত্মা সবসময়ই রয়েছেন। তাই গৌড়পাদ জ্ঞানকে নিদ্রাহীন অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। যখন আমি আমার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারব তখন জানব আমিই সেই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। মানুষ সমাধি বা অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির দ্বারা তুরীয় অবস্থা বা আত্মার ‘চতুর্থ’ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। সুষুপ্তি অবস্থাতেও আমরা আনন্দ লাভ করে থাকি। কিন্তু তখন আমাদের কোনও দেহবোধ থাকে না। এমনকি এ জগতের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরে আমরা আবার সেই পূর্বাবস্থায় ফিরে আসি। সুষুপ্তির অভিজ্ঞতা অজ্ঞানতাকে নাশ করতে পারে না। সমাধির মাধ্যমে তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হলে তখনি অজ্ঞানতার সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটে। আমরা তখন ‘অনিদ্রম্‌’ অর্থাৎ অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত। আবার ‘অস্বপ্নম্‌’ও বটে অর্থাৎ ভ্রান্তিবিহীন। এখানে স্বপ্ন বলতে ভুল দেখা বোঝাচ্ছে, যেমন দড়িকে সাপ দেখা। তুরীয় অবস্থায় কোন দুই বোধ থাকে না। থাকেন কেবলমাত্র এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। তুরীয় অবস্থার পর মন স্বাভাবিক ভূমিতে ফিরে এলেও দ্বিতত্ত্বের দ্বারা আর বিভ্রান্ত হয় না। তখন সব বৈচিত্রের মাঝে আমরা কেবল ঐক্যই দেখে থাকি।

প্রপঞ্চো যদি বিদ্যেত নিবর্তেত ন সংশয়ঃ।

মায়ামাত্ৰমিদং দ্বৈতমদ্বৈতং পরমার্থতঃ॥১৭

অন্বয়: প্রপঞ্চঃ যদি বিদ্যেত (যদি এই দৃশ্যমান জগতের সত্যিই অস্তিত্ব থাকত); নিবর্তেত ন সংশয়ঃ (নিঃসন্দেহে তার পরিসমাপ্তিও ঘটত); ইদং দ্বৈতম্ (থাকা ও না থাকা এই দ্বিতত্ত্বই এর প্রমাণ); মায়ামাত্রম্ ([এ জগৎ) ভ্রান্তিমাত্র); অদ্বৈতং পরমার্থতঃ (অদ্বয় [ব্রহ্ম] একমাত্র সত্য)।

সরলার্থ: যদি এই দৃশ্যমান জগতের সত্যিই অস্তিত্ব থাকত তবে কোন এক সময়ে সেটি লুপ্তও হত। কিন্তু এ জগতের অস্তিত্ব নেই। এর অস্তিত্ব একটি ভ্রান্তিমাত্র। আসল কথাটি হল ব্রহ্মই একমাত্র সত্য।

ব্যাখ্যা: এখানে একটি আপত্তি ওঠে : জগৎ থাকতে ঐক্যের বোধ হয় কি করে? এর উত্তরে গৌড়পাদ বলছেন : এ জগৎ তো শুধু এক দৃষ্টিবিভ্রম। সুতরাং যা নেই তার আবার লোপ হয় কি করে? এর অস্তিত্ব কখনই ছিল না, থাকবেও না। ভুল সবসময়ই ভুল। আমার স্বরূপবোধ হলে আমি অনুভব করি, এ জগৎ বলে কখনো কিছু ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল জগতের অস্তিত্ব আছে। তাই এর (যা কখনো ছিল না) লোপ পাবার প্রশ্নই ওঠে না। এ কতকটা স্বপ্ন থেকে জাগ্রত হওয়ার মতো। এতক্ষণ আমি যা দেখছিলাম তা যে স্বপ্নমাত্র একথা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কারণ জাগ্রত হওয়ামাত্রই আমি অনুভব করি এ সত্য ঘটনা নয়। স্বপ্নে যেসব ঘটেছে বলে মনে হয় সেসব কখনো ঘটেইনি। ঠিক একইভাবে মায়ানিদ্রা দূর হয়ে যখন আমরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করি, তখন আমরা সর্বভূতে ব্রহ্মকেই দেখি। ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই দেখি না।

যাদুকর নানারকম খেলা দেখায়। আর সেগুলিকে আমরা সত্য বলে মনে করি। অবশ্য শীঘ্রই আমরা বুঝতে পারি খেলাগুলি সব ফাঁকি। যাদুকরই সত্য, তার দেখানো ভেলকিবাজি সত্য নয়। একই কথা এই জগৎ সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এ জগৎ কখনই ছিল না। তবে যে আমরা এ জগৎকে দেখছি, এ দেখা আসলে দৃষ্টিবিভ্রম-মাত্র। সত্য এক এবং তা স্বয়ং ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ছাড়া আমরা যদি আর কিছু দেখে থাকি, তা ভুল।

বিকল্পো বিনিবৰ্তেত কল্পিতো যদি কেনচিৎ।

উপদেশাদয়ং বাদো জ্ঞাতে দ্বৈতং ন বিদ্যতে॥১৮

অন্বয়: বিকল্পঃ (বহু [যেমন আচার্য, শিষ্য, শিক্ষকতা ইত্যাদি]); বিনিবর্তেত (ধ্বংস হতে বাধ্য); যদি (যদি); কেনচিৎ (কোনও কারণে); কল্পিতঃ (কল্পিত [শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে]); উপদেশাৎ (উপদেশের শেষে); অয়ং বাদঃ (এই বহুর প্রশ্নটি [লোপ পায়]); জ্ঞাতে (যখন আত্মজ্ঞান লাভ হয়েছে); দ্বৈতং ন বিদ্যতে (‘দুই’ বলতে আর কিছু থাকে না)।

সরলার্থ: কেবলমাত্র কোন কারণে যদি বহুর প্রয়োজন হয় যেমন—আচার্য, শিষ্য এবং শিক্ষকতা ইত্যাদির কল্পনা করতে হয়, তবে উদ্দেশ্য সিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই কল্পনারও সমাপ্তি ঘটে। শিক্ষাদানের ফলে যখন আত্মজ্ঞান লাভ হয়, তখন বহুর অস্তিত্বের অবসান ঘটে।

ব্যাখ্যা: এখানে আরও একটি আপত্তি ওঠে : যদি দুই-এর কোনও অস্তিত্ব না থাকে তবে গুরু-শিষ্যই বা এলেন কোথা থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে গৌড়পাদ বলছেন : ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। অজ্ঞানতা দূর করবার জন্য, সত্য কি তা মানুষকে শেখাবার জন্য সাময়িকভাবে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ককে মেনে নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে গুরুও কেউ নেই, শিষ্যও কেউ নেই। আমরা একথা যখন উপলব্ধি করতে পারব তখনি বুঝতে পারব।’ যখন যীশুখ্রীষ্টের কাছে লোকজন এসে বলল তাঁর মা তাঁকে দেখতে চাচ্ছেন, তখন যীশুখ্রীষ্ট বলছেন : ‘(আমার মা) কে?’ অর্থাৎ মা ছেলের এই সম্পর্কটি কি? এও তো মায়া। মায়ার লক্ষণই হল ‘অহংতা’ (আমি) আর ‘মমতা’ (আমার)। অর্থাৎ আমার মা, আমার বাবা, আমার সন্তান ইত্যাদি। এ সবকিছুই ‘অহং’কে কেন্দ্র করে।

কিন্তু এই ‘আমি-আমার বোধ’ থাকলে দোষেরই বা কি? দোষ হল এই যে এর দ্বারা আমরা নিজেদের বড় সীমাবদ্ধ করে ফেলি। তখন আমাদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে আমরা একে অপরের থেকে আলাদা। এই দেহ, পরিবার, দেশ, ধর্ম এসবের দ্বারা আমরা নিজেদের আবদ্ধ করে রাখি। এসবই বন্ধন। এইসব ধারণার অবসান ঘটলে আমরা মুক্তিলাভ করে থাকি। যিনি নিজের মধ্যে সকলকে আর সকলের মধ্যে নিজেকে দেখেন তিনিই পরম সত্যকে জেনেছেন। তাঁর কাছে দুই বলে কিছু নেই। তিনি সর্বভূতে এবং সর্বত্র এক আত্মাকেই দেখেন। এরই নাম জ্ঞান, এরই নাম মুক্তি।

উপনিষদ

সোঽমাত্মাঽধ্যক্ষরমোঙ্কারোঽধিমাত্রং পাদা মাত্রা মাত্রাশ্চ

পাদা অকার উকারো মকার ইতি॥৮

অম্বয়: সঃ (সে [পূর্বোক্ত ব্যক্তি]); অয়ম্ আত্মা (এই আত্মা); অধ্যক্ষরম্‌ (বর্ণমালার আকারে); ওঙ্কার (এটি ওম্); অধিমাত্রম্ (মাত্রা [বর্ণমালা] রূপে); পাদাঃ মাত্রাঃ (পাদ সকলই মাত্রা বা বর্ণ [সেইরূপ]); অকারঃ (অ এই বর্ণটি); উকারঃ (উ এই বর্ণটি); মকারঃ (ম এই বর্ণটি); মাত্রা চ [এইসব] মাত্রাও); পাদঃ (পাদসকল [অর্থাৎ এ সবই অভিন্ন])।

সরলার্থ: ওঁকারের বর্ণমালারূপে (অর্থাৎ অ, উ, ম) এখানেও সেই একই পরমাত্মা। আত্মার পাদসমূহই ওঁকারের মাত্রা। আবার ওঁকারের মাত্রাসমূহই আত্মার পাদ। অকার, উকার, মকার এই তিনটি ওঁকারের মাত্রা।

ব্যাখ্যা: পূর্বেই বলা হয়েছে আত্মা চতুষ্পদ্‌—বিশ্ব (জাগ্রত অবস্থা), তৈজস্ (স্বপ্ন অবস্থা), প্রাজ্ঞ (সুষুপ্তি অবস্থা) এবং তুরীয় (শুদ্ধ চৈতন্য)। তুরীয়ই আত্মার প্রকৃত অবস্থা।

এই অ, উ, ম তিনটি বর্ণের দ্বারা আত্মার প্রথম তিনটি অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। এইজন্যই বর্তমান শ্লোকে পাদ এবং মাত্রাকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

তুরীয়কে অমাত্র (মাত্রার ঊর্ধ্বে) বলা হয়। কারণ তুরীয় অবস্থা বর্ণনার অতীত।

জাগরিতস্থানো বৈশ্বানরোঽকারঃ প্রথমা মাত্রাঽঽপ্তেরাদিম-

ত্বাদ্বাঽঽপ্নোতি হ বৈ সর্বান্ কামানাদিশ্চ ভবতি

য এবং বেদ॥৯

অন্বয়: জাগরিতস্থানঃ বৈশ্বানরঃ (জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর [হিসেবে চিহ্নিত]); অকারঃ প্রথমা মাত্রা (প্রথম বর্ণ অ [কেন? কারণ]); আপ্তেঃ (ব্যাপী); আদিমত্বাৎ (এটিই প্রথম); বা (ও [বৈশ্বানর যেমন সকল জগৎ জুড়ে আছেন তেমনি প্রথম বর্ণ অকারও সবকিছু প্রকাশে সক্ষম, দুই-এর মধ্যে এটিই মিল]); যঃ (সাধক [যিনি]); এবং (এই [বৈশ্বানর]); বেদ (জানেন); হ বৈ (নিশ্চিতভাবে); সর্বান্ কামান আপ্নোতি (তিনি সমস্ত কাম্য-বস্তু পেয়েছেন); আদিঃ চ ভবতি (তিনি সর্বোত্তমও বটে)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানররূপী পরমাত্মা ‘অ’ এই বর্ণের দ্বারা চিহ্নিত। বৈশ্বানর এবং ‘অ’ উভয়ই সর্বব্যাপী। যিনি একথা নিশ্চিতভাবে জানেন তাঁর সকল কামনা-বাসনা পূর্ণ হয়ে গেছে। তিনি সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

ব্যাখ্যা: ‘অ’ বর্ণটি বৈশ্বানর—জাগ্রত অবস্থার জীবাত্মা। এটি আবার বিরাট তথা দৃশ্যমান জগৎও বটে। কেন? কারণ ‘অ’ হল প্রথমা অর্থাৎ শুরু। বর্ণমালার প্রথম অক্ষর হিসাবে ‘অ’কার সকল অক্ষরকে ব্যাপ্ত করে আছে। তেমনি বৈশ্বানরও সকল জগৎকে ব্যাপ্ত করে আছে। সুতরাং অতি সঙ্গতভাবেই ‘অ’কে বৈশ্বানরের প্রতীক বলা হয়েছে।

প্রতীক এবং যার প্রতীক, তারা এক ও অভিন্ন। অ এবং বৈশ্বানর যে এক ও অভিন্ন, এই জ্ঞান যিনি লাভ করেছেন তাঁর সকল কামনা-বাসনা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি আপ্তকাম। এরূপ ব্যক্তি সকলের মধ্যে অগ্রগণ্য হয়ে ওঠেন।

স্বপ্নস্থানস্তৈজস উকারো দ্বিতীয়া মাত্রোৎকৰ্ষাদুভয়ত্বাদ্বোৎকৰ্ষতি

হ বৈ জ্ঞানসন্ততিং সমানশ্চ ভবতি নাস্যাব্রহ্মবিৎ কুলে

ভবতি য এবং বেদ॥১০

অন্বয়: স্বপ্নস্থানঃ তৈজসঃ (স্বপ্নাবস্থায় আত্মা); উকারঃ দ্বিতীয়া মাত্রা (‘অউম’-এর দ্বিতীয় অক্ষর উ-এর তুল্য); উৎকৰ্ষাৎ উভয়ত্বাৎ (উভয়ই সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দুজনেই মধ্যবর্তীস্থান অধিকার করে আছেন [বিশ্ব এবং প্রাজ্ঞের মধ্যবর্তী অবস্থা হল তৈজস এবং উকার হল অ এবং ম-এর মধ্যবর্তী]); যঃ (মুমুক্ষু ব্যক্তি); এবম্‌ (উপরোক্ত মিল); বেদ (জানেন); জ্ঞানসন্ততিম্‌ উৎকৰ্ষতি (বোঝবার ক্ষমতার উন্নতি); [সতাম্‌] সমানঃ ভবতি (এক সাধু-পুরুষে পরিণত হন); অস্য কুলে (এমন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির পরিবারে); অব্রহ্মবিৎ ন ভবতি (এমন কেউই জন্মগ্রহণ করেন না যিনি ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনে অক্ষম)।

সরলার্থ: স্বপ্নাবস্থায় আত্মার তথা তৈজসের অবস্থান ‘অউম’-এর উ-এর তুল্য। কারণ উভয়ই মধ্যবর্তীস্থান অধিকার করে আছেন এবং উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যিনি এই দুই-এর অভিন্নতা জানেন তাঁর বোঝবার ক্ষমতা সকলের চেয়ে বেশি। এবং তিনি সাধু ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাঁর পরিবারের সকলেই ব্রহ্মজ্ঞানী।

ব্যাখ্যা: উ অক্ষরটি হল তৈজস, যা স্বপ্নবস্থার আত্মার সঙ্গে তুলনীয়। স্বপ্নাবস্থাতেও অবশ্য আমাদের মধ্যে চৈতন্য থাকে। কি জাগ্রত, কি নিদ্রিত উভয় অবস্থাতেই একই ব্রহ্ম বিরাজিত। যিনি এ তত্ত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম, তাঁর বংশে কোনও ‘অব্রহ্মবিৎ’-এর জন্ম হয় না। সে বংশের সকলেই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ হবেন। ব্রহ্মজ্ঞানের প্রশংসার্থেই উপনিষদ একথা বলছেন।

সুষুপ্তস্থানঃ প্ৰাজ্ঞো মকারস্তৃতীয়া মাত্রা মিতেরপীতের্বা

মিনোতি হ বা ইদং সর্বমপীতিশ্চ ভবতি য এবং বেদ॥১১

অন্বয়: সুষুপ্তস্থানঃ প্রাজ্ঞঃ (প্রাজ্ঞ হল সেই অবস্থা যেখানে আত্মা গভীর স্বপ্নহীন নিদ্রা উপভোগ করেন); মকারঃ তৃতীয় মাত্রা (এটি তৃতীয় অবস্থা [‘অউম’-এর ম-এর তুল্য]); মিতেঃ (পরবর্তী [বিশ্ব ও তৈজসের]); অপীতেঃ (একত্বে লীন হবার এটি তোরণদ্বার); যঃ এবং বেদ (যিনি এই একাত্মতা অনুভব করেন); ইদং সর্বং [জগৎ] মিনোতি (এই জগৎকে [জানেন]); চ অপীতিঃ ভবতি (এবং এর বিশ্রামস্থল হয়ে ওঠেন)।

সরলার্থ: সুষুপ্তি অবস্থার আত্মা তথা প্রাজ্ঞকে ‘অউম’-এর তৃতীয় অক্ষর ‘ম’-এর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে অ এবং উ-এর সাথে যথাক্রমে বিশ্ব এবং তৈজসের সমাপ্তি ঘটে সেখানেই প্রাজ্ঞ এবং ম উভয়েরই অবস্থান। প্রাজ্ঞ এবং ম হল একত্বে বিলীন হয়ে যাওয়ার সিংহদ্বার। যিনি একথা জানেন তিনি এ জগৎকে জানেন, এবং জগতের বিশ্রামস্থল হয়ে ওঠেন।

ব্যাখ্যা: প্রাজ্ঞ অবস্থা হল সুষুপ্তি অবস্থার আত্মা। ‘অউম’—এর ম-কারের সাহায্যে এই অবস্থাকে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব এবং তৈজস প্রাজ্ঞে লীন হয়। ঠিক একইভাবে অ এবং উ উভয়েই ম-কারে লীন হয়। প্রাজ্ঞ এবং ম-কারেই দ্বৈতদৃষ্টির সমাপ্তি ঘটে। দ্বৈত এবং অদ্বৈতের মাঝে এদের অবস্থান। এসবের ঊর্ধ্বে হল তুরীয় অবস্থা যা শুদ্ধ চৈতন্য, পরমাত্মা। যখন মানুষ এই অবস্থা প্রাপ্ত হন তখন সমগ্র বিশ্বের সাথে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন। তখন সমগ্র বিশ্বে শুধুমাত্র একটি সত্তাই বিরাজ করেন। আর তা হল আত্মা।

গৌড়পাদ-কারিকা

বিশ্বস্যাত্ববিবক্ষায়ামাদিসামান্যমুৎকটম্‌।

মাত্ৰাসংপ্রতিপত্তৌ স্যাদাপ্তিসামান্যমেব চ॥১৯

অন্বয়: বিশ্বস্য (বিশ্বরূপে পরিচিত ব্রহ্ম); অত্ব বিবক্ষায়াম্ (বিশ্ব ‘অ’-এর অনুরূপ তা বোঝাবার জন্য); আদিসামান্যম্‌ উৎকটম্‌ (এ কথাটি স্পষ্ট যে তারা উভয়েই প্রথম); [বিশ্বস্য] মাত্রা-সংপ্রতিপত্তৌ (এটি দেখানো যে তারা [বিশ্ব ও মাত্রা] সদৃশ); চ আপ্তি সামান্য (ব্যাপকতা এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য); স্যাৎ (সেটিও ওখানে আছে)।

সরলার্থ: বিশ্ব হল প্রথম অবস্থা, বর্ণের মধ্যে অ-কারও প্রথম। যেহেতু উভয়েই প্রথম সেহেতু তারা এক এবং অভিন্ন। বিশ্বকে যদি অ (মাত্রা)-রূপে মনে করা হয় তবে এদের মধ্যে ব্যাপকতার সাদৃশ্যটি লক্ষ্য করা যায়।

ব্যাখ্যা: আত্মার প্রথম অবস্থা হল জাগ্রত অবস্থা, যা বিশ্ব বলে পরিচিত। এই অবস্থায় আত্মা সমগ্র জগৎ জুড়ে অবস্থান করেন। আবার বর্ণমালার প্রথম বর্ণটি ‘অ’। আর প্রতিটি বর্ণের মধ্যে এই ‘অ’-কার রয়েছে। তাই এটি সর্বব্যাপী।

এইভাবে বিশ্ব এবং অ-কার উভয়ই প্রথম ও সর্বব্যাপী। সুতরাং এরা এক ও অভিন্ন।

তৈজসস্যোত্ববিজ্ঞান উৎকর্ষো দৃশ্যতে স্ফূটম্‌।

মাত্ৰাসংপ্রতিপত্তৌ স্যাদুভয়ত্বং তথাবিধম্‌॥২০

অন্বয়: তৈজসস্য উত্ব বিজ্ঞানে (যদি তুমি জান যে ‘তৈজস’ [আত্মার স্বপ্নাবস্থা] হল উকার); উৎকর্ষঃ ([এর] শ্রেষ্ঠত্ব); স্ফুটং দৃশ্যতে (তখন তোমার কাছে তা স্পষ্ট); মাত্রা সংপ্রতিপত্তৌ (যদি এর অবস্থান বিবেচনা কর); স্যাৎ উভয়ত্বম্‌ (মধ্যবর্তীরূপে আছে); তথাবিধম্‌ (এটি স্পষ্ট)।

সরলার্থ: যদি তৈজসকে ‘উ’ হিসেবে আমরা দেখি, তাহলে এর শ্রেষ্ঠত্ব স্পষ্টই বুঝতে পারব। (উ-কারের মতোই) তৈজসও দুই অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এর দ্বারা তৈজসের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

ব্যাখ্যা: উ-কার যেমন অ এবং ম এর মধ্যবর্তী, ঠিক তেমনি তৈজসও বিশ্ব ও প্রাজ্ঞের মধ্যবর্তী অবস্থা। এই কারণেই তৈজস ও উ-কার এক ও অভিন্ন।

অ, উ এবং ম যথাক্রমে বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞের প্রতীক। অর্থাৎ (অ, উ, ম) এরা আত্মার বিভিন্ন অবস্থার প্রতীক।

মকারভাবে প্রাজ্ঞস্য মানসামান্যমুৎকটম্‌।

মাত্ৰাসংপ্রতিপত্তৌ তু লয়সামান্যমেব চ॥২১

অন্বয়: প্রাজ্ঞস্য (আত্মার তৃতীয় অবস্থা); মকারভাবে (ম-কারে); মান-সামান্যম্‌ (একই অবস্থার অধিকারী); উৎকটম্‌ (আপাত); মাত্রা সংপ্রতিপত্তৌ (বৰ্ণরূপে); লয়-সামান্যম্ (উভয়েরই শেষ); এব (হওয়া); চ (ও)।

সরলার্থ: আত্মার তৃতীয় অবস্থা হল প্রাজ্ঞ। অবস্থার দিক থেকে প্রাজ্ঞ (অউম-এর) ম-এর তুল্য। উভয়ের মধ্যে এটিই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যেমন ‘অউম’-এর শেষ বর্ণ ম-কার, ঠিক তেমনি প্রাজ্ঞ হল আত্মার চূড়ান্ত অবস্থা। এইখানে উভয়ই সদৃশ।

ব্যাখ্যা: ‘ম’কারকে সুষুপ্তি তথা স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুষুপ্তি অবস্থায় জীবকে বলা হয় প্রাজ্ঞ। মানুষ তৈজস অবস্থায় অর্থাৎ যখন স্বপ্ন দেখে তখন সে মনের দ্বারাই নানা অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে। কিন্তু প্রাজ্ঞ অবস্থায় অভিজ্ঞতা বলতে আর কিছুই থাকে না। তখন দেহ-মন দুই-ই নিষ্ক্রিয়। মানুষ তখন কিছুই জানতে পারে না। সাময়িকভাবে এ যেন মৃত্যুর সমান। সেজন্যই এখানে ‘লয়’ বা ‘মৃত্যু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই ‘লয়’—প্রাজ্ঞ এবং ম উভয়েরই বৈশিষ্ট্য। যখন মানুষ প্রাজ্ঞ অবস্থায় অর্থাৎ সুষুপ্তিতে থাকে তখন তার দেহ-মন সব নিষ্ক্রিয়। সেইরকম ‘অউম’ যখন ম-কারে লীন হয় তখন সেখানে আর কোনও শব্দ থাকে না।

ত্রিষু ধামসু যস্তুল্যং সামান্যং বেত্তি নিশ্চিতঃ।

স পূজ্যঃ সর্বভূতানাং বন্দ্যশ্চৈব মহামুনিঃ॥২২

অম্বয়: যঃ (তিনি [বিবেকীপুরুষ যিনি]); নিশ্চিতঃ (স্থির মনে); ত্ৰিষু ধামসু (তিন অবস্থায় [বিশ্ব, তৈজস এবং প্রাজ্ঞ]); সামান্যং তুল্যং বেত্তি (জানেন যে, এক এবং অভিন্ন আত্মাই আছেন); সঃ (তিনি [এইভাবে আত্মদর্শনে যিনি সক্ষম]); মহামুনিঃ (এক মহাঋষি); সর্বভূতানাং পূজ্যঃ (সর্বজন শ্রদ্ধেয়); বন্দ্যঃ (সর্বজনপূজ্য); চ এব (অবশ্যই)।

সরলার্থ: অচঞ্চল বিবেকী ব্যক্তি এক ও অভিন্ন আত্মাকে তিনটি বিভিন্ন অবস্থায় দেখেন। এইরূপ ব্যক্তি প্রকৃতই মহর্ষি। তিনি সর্বজন-শ্রদ্ধেয় এবং সকলের ভালোবাসার পাত্র।

ব্যাখ্যা: ত্রিষু ধামসু—তিনটি অবস্থায়। এই তিন অবস্থা হল স্থূল, সূক্ষ্ম এবং কারণ। ব্যষ্টির ক্ষেত্রে এই তিন অবস্থা হল জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। আর সমষ্টির ক্ষেত্রে এই তিন অবস্থা হল—বিরাট (সমষ্টি স্থূল দেহ), হিরণ্যগর্ভ (সমষ্টি মন), এবং ঈশ্বর (সমষ্টি কারণ শরীর)। সামান্যং-এর অর্থ হল সাধারণ বা অভিন্ন। আমরা দেখি যে, এই তিন অবস্থার মধ্যে একই ব্রহ্ম অর্থাৎ একই সত্তা রয়েছেন।

বেত্তি নিশ্চিতঃ—তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন। নিশ্চিত কথাটির অর্থ কোন বস্তু নিয়ে কোনও সংশয় না থাকা। কোন বিষয়ে মনে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ‘ওঃ, ইনিই ব্রহ্ম—এ বিষয়ে আমি আর এখন বিভ্রান্ত নই।’ স্থূল বা সূক্ষ্ম যেরূপেই হোক না কেন, সকলই ব্রহ্ম। রূপের বা আকারের পার্থক্যে কিছু যায় আসে না। আমরা তখন শুধুমাত্র ব্রহ্মকেই দেখি। তখন ভালো-মন্দ, বড়-ছোট, সবই ব্রহ্ম। এ শুধু বুদ্ধি দিয়ে বোঝা নয়। আমরা বুদ্ধি দিয়ে অনেক কিছু জানতে পারি। কিন্তু ঐ জাতীয় জ্ঞান আমাদের জীবনকে পালটাতে পারে না। কিন্তু আত্মজ্ঞান আসে ইন্দ্রিয়াতীত অভিজ্ঞতা থেকে এবং এই জ্ঞানকে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করা যায়। তখন আমরা ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করি। মুণ্ডক উপনিষদ বলছেন : ‘ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি’। অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। তখন তিনি মহাঋষিতে পরিণত হন। এ এক অনির্বচনীয় অবস্থা। যেহেতু জাগতিক সবকিছুকে তিনি ত্যাগ করেছেন, সেহেতু এ জগতের পেছনে যে সত্য আছে তা উপলব্ধি করতে তিনি তখন সক্ষম। তাঁর কাছে এ জগৎ ব্রহ্ম বৈ আর কিছু নয়। সুতরাং তিনি এ জগতের সর্বত্র ব্রহ্মকেই দেখেন।

যিনি এই জ্ঞানের অধিকারী তিনি সর্বজন-শ্রদ্ধেয় ও সর্বজনপূজ্য। কেন? কারণ, মানুষের কাম্য যে সর্বোচ্চ অবস্থা, তা তিনি লাভ করেছেন। দ্বৈতবোধই আমাদের সকল দুঃখ-কষ্টের মূল। যখন আমরা ভালো-মন্দ সবকিছুর মধ্যে সেই এক ব্রহ্মকেই দেখতে পারব তখনি আমরা সকল দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে রেহাই পাব।

অকারো নয়তে বিশ্বমুকারশ্চাপি তৈজসম্।

মকারশ্চ পুনঃ প্রাজ্ঞং নামাত্রে বিদ্যতে গতিঃ॥২৩

অন্বয়: অকারঃ বিশ্বং নয়তে (যদি আমরা ‘অ’কারের উপর গভীরভাবে ধ্যান করি, তখন অনুভব করি আমরাই বিশ্ব [যে আত্মা বিশ্বচরাচরকে আচ্ছন্ন করে আছেন—বিরাট]); উকারঃ অপি চ তৈজসম্‌ (‘উ’ অক্ষরটিকে ধ্যান করলে আমরা দ্রুত তৈজস অবস্থা প্রাপ্ত হই [যে আত্মা সকল মনের সমষ্টি—হিরণ্যগর্ভ]); মকারঃ চ প্রাজ্ঞম্‌ (‘ম’ অক্ষরটির উপর গভীরভাবে ধ্যান করলে, আমরা হয়ে উঠি প্রাজ্ঞ [মায়াযুক্ত চৈতন্য—ঈশ্বর]); অমাত্রে (তুরীয় অর্থাৎ শুদ্ধ চৈতন্যের ধ্যান করলে); পুনঃ গতিঃ ন বিদ্যতে (তারপর আর কোনও গন্তব্যস্থান থাকে না)।

সরলার্থ: যখন আমরা ‘অ’কারের (প্রথম অবস্থা) ধ্যান করি, তখন নিজেদেরকে ‘বিশ্ব’ বলে মনে হয়। যখন ‘উ’কারের (দ্বিতীয় অবস্থা) ধ্যান করি তখন আমরা ‘তৈজস’ হয়ে যাই। সেইভাবে, যখন ‘ম’-কারের (তৃতীয় অবস্থা) ধ্যান করি, তখন আমরা হই ‘প্রাজ্ঞ’। কিন্তু যখন আমরা তুরীয়ের (চতুর্থ অবস্থা) ধ্যানে মগ্ন হই, তখন আমরা অসীম হয়ে যাই।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম অনন্ত ও বুদ্ধির অগম্য। তাই উপনিষদ আমাদের ‘ওম্‌’ এই প্রতীকের সাহায্য নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। উপনিষদ অনেক যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছেন কেন ‘ওম্‌’ ব্রহ্মের সব থেকে উপযুক্ত প্রতীক। উপনিষদ বলছেন যে, ‘ওম্‌’ বহু ধ্বনির সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। একথা স্পষ্ট যে ‘ওম্‌’ তিনটি ভিন্ন ধ্বনি অর্থাৎ অ, উ, ম-এর সমষ্টি। সব শব্দ এই তিনটি ধ্বনির অন্তর্গত। তাই ‘ওম্‌’কে বলা হয় নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম।

‘অ’ হচ্ছে এই স্থূল জগৎ অর্থাৎ বিরাটের প্রতীক। ‘অ’-কে ধ্যান করলে এই স্থূল জগৎকেই ধ্যান করা হয়। এর দ্বারা ব্যষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বে এবং সমষ্টির ক্ষেত্রে বিরাটে পৌঁছনো যায়। আবার ‘উ’কারকে ধ্যান করলে সূক্ষ্ম জগৎকেই ধ্যান করা হয়। এই উ-কার ব্যষ্টিকে তৈজস এবং সমষ্টিকে হিরণ্যগর্ভে নিয়ে যায়। একইভাবে ‘ম’কারকে ধ্যান করলে আমরা কারণ-অবস্থা প্রাপ্ত হই, ব্যষ্টির ক্ষেত্রে যা প্রাজ্ঞ এবং সমষ্টির ক্ষেত্রে যা ঈশ্বর।

কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, একই ব্রহ্ম একদিকে বিরাট, হিরণ্যগর্ভ ও ঈশ্বর এবং অন্যদিকে বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞ—এই তিন অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। উপনিষদ যে কথাটি আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে দিতে চাচ্ছেন তা হল, ব্রহ্ম কোনও অবস্থার অধীন নন। এইসব অবস্থার অনবরত পরিবর্তন ঘটে থাকে। বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে ব্রহ্ম নিজেকে নানাভাবে প্রকাশ করেন। কিন্তু ব্রহ্ম সবসময়ই অপরিবর্তনীয়। এই অবস্থাগুলিকে আমাদের সত্য বলে মনে করা উচিত নয়। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থাতে মানুষটির যেমন কোনও পরিবর্তন হয় না, ঠিক তেমনি স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ অবস্থার পেছনেও সেই একই ব্রহ্ম রয়েছেন। ‘ওম্‌’-কে ধ্যান করলে এই তিন অবস্থায় স্থিত সেই ব্রহ্মকেই ধ্যান করা হয়। ‘ওম্‌’ থেকেই তুরীয় অবস্থায় পৌঁছনো যায়। এই তুরীয় অবস্থা উপরোক্ত তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে।

তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হলে, ‘পুনঃ গতিঃ ন বিদ্যতে’—তখন আর যাওয়া-আসা কিছু থাকে না। তখন গন্তব্য বলে আর কিছু থাকে না। অনেক জায়গায় জীবনকে ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। আমরা সবসময়ই বৃত্তাকারে ঘুরে চলেছি। এই গতি বলতে কি বোঝায়? স্থান পরিবর্তন, পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং অবস্থার পরিবর্তন। বস্তুর অনিত্যতা বোঝাতে গিয়ে বুদ্ধদেব প্রায়ই বলতেন : ‘তুমি কখনই সেই এক ব্যক্তি নও। প্রতি মূহুর্তে তোমার পরিবর্তন হয়ে চলেছে। এই পরিবর্তন হয় শারীরিক না হয় মানসিক অথবা দুই-ই।’ এ জগৎ সর্বদা পরিবর্তনশীল। আমরা যখন আমাদের জীবনের চরম লক্ষ্য অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারব তখন আমাদের আর কোনও আসা-যাওয়া থাকবে না। আমরা তখন আমাদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারব। এই স্থূলদেহের পরিবর্তন হতে পারে। জড় বস্তুর ধর্মই এই, কারণ জড় বস্তু কখনো অপরিবর্তনীয় হতে পারে না। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি জানেন যে তিনি জড় অর্থাৎ এই দেহ নন। দেহের পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু তার প্রভাব দেহেই সীমাবদ্ধ। তার দ্বারা ‘তিনি’ প্রভাবিত হন না। ‘তিনি’ সবসময়ই এক, কারণ তিনি জানেন তিনি ব্রহ্ম। যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন কোন পরিবর্তনই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।

অনেক শাস্ত্রেই জ্ঞানকে আগুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে—জ্ঞানাগ্নি। এই জ্ঞানাগ্নিতে আমাদের কর্মবীজ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে অজ্ঞানতা থাকে ততক্ষণ আমাদের কামনা-বাসনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদিও থাকে। এর ফলে আমরা সুখ-দুঃখ ইত্যাদি সকলপ্রকার কর্মের ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ হই। কিন্তু ‘আমরাই স্বয়ং ব্রহ্ম’—এই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে তখন কর্ম বলে আমাদের আর কিছু থাকে না। এই আগুনে কর্মবীজ পুড়ে যায়। বীজই যদি পুড়ে যায় তাহলে তার থেকে আর নতুন চারাগাছ জন্মাতে পারে না। কর্মের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে। কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম থাকতে পারে অর্থাৎ যে কর্ম এখনি ফল দিতে শুরু করেছে। জীবন্মুক্ত পুরুষেরও এই প্রারব্ধ কর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত কর্ম চলতে থাকে। কিন্তু এই কর্ম জীবন্মুক্ত পুরুষকে বাঁধতে পারে না। তিনি এই কর্মের দ্বারা প্রভাবিত হন না। কারণ তিনি তখন নিজেকে দেহ থেকে পৃথক বলে মনে করেন। কুমোরের চাক ঘোরানো বন্ধ করার পরও চাকটি যেমন আপন গতিতেই খানিকক্ষণ ঘোরে, ঠিক তেমনি প্রারব্ধ কর্মের জন্য জীবন্মুক্ত পুরুষের দেহও কিছুদিন থাকে। কিছুসময় পরে চাকটি যেমন আপনিই থেমে যায় তেমনি প্রারব্ধ কর্ম ক্ষয় হলে জীবন্মুক্ত পুরুষেরও আর জন্মমৃত্যু হয় না।

উপনিষদ

অমাত্ৰশ্চতুর্থোঽব্যবহার্য প্রপঞ্চোপশমঃ শিবোঽদ্বৈত

এবমোঙ্কার আত্মৈব সংবিশত্যাত্মনাঽঽত্মানং য এবং বেদ॥১২

অন্বয়: অমাত্রঃ (অসীম); অব্যবহার্যঃ (ব্যবহারযোগ্য নয় [কারণ ইনি বাক্যমনাতীত]); প্রপঞ্চোপশমঃ (জগৎ তার অস্তিত্ব হারায় [কারণ সেখানে দুই বলে কিছু নেই]); শিবঃ (সদয়); চতুর্থঃ (তুরীয় [চতুর্থ অবস্থা]); এবম্ (যেরূপ বলা হয়েছে [জ্ঞানী ব্যক্তির দ্বারা]); ওঙ্কারঃ অদ্বৈতঃ (ওম্‌ই অদ্বৈত); আত্মা এব (আত্মা ছাড়া আর কিছু নয়); যঃ (সাধক); এবম্ (এইভাবে); বেদ (জানেন [তিনি]); আত্মনা (তিনি স্বয়ং); আত্মানম্ (পরমাত্মা); সংবিশতি (লীন হয়ে যান [আর কখনো ফিরে আসেন না])।

সরলার্থ: (যেমন আগে বলা হয়েছে), ‘ওম্‌’-এর চতুর্থ অবস্থা হচ্ছে পরমাত্মা। এই আত্মা অনন্ত, বাক্যমনাতীত, অদ্বয় এবং শিবস্বরূপ। দৃশ্যমান জগৎ এঁরই মধ্যে রয়েছে। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বলেন, জীবাত্মাই হলেন পরমাত্মা। যিনি এই তথ্য জানেন তিনি ব্রহ্মে লীন হয়ে যান। (তিনি নিজেকে আর কখনো জীবাত্মা বলে মনে করেন না।)

ব্যাখ্যা: অমাত্রঃ—আর কোনও অবস্থা নেই। যখন আমরা অ, উ, ম এই তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে যেতে পারি, তখনি আমরা তুরীয় অর্থাৎ চতুর্থ অবস্থা প্রাপ্ত হই। এই অবস্থা হল শুদ্ধ চৈতন্য; ঈশ্বরাতীত। এই অবস্থায় স্থূল জগতের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। স্বপ্নের জগৎও তখন থাকে না। সমগ্র জগৎ, এই দুই বোধ (দ্বিতত্ত্ব) তখন লোপ পায়। তুরীয় অবস্থায় আত্মাই একমাত্র থাকেন। সাধক ব্যক্তি তখন মুক্ত হয়ে যান। তাঁর আর পুনর্জন্ম হয় না।

প্রপঞ্চ—কথাটির অর্থ হল পঞ্চভূত বা পাঁচটি উপাদান। এখানে এই দৃশ্যমান জগৎ অর্থাৎ বৈচিত্রের কথা বলা হয়েছে। তুরীয় অবস্থায় সাধক মনে করেন এ জগৎ মিথ্যা। তখন তাঁর কাছে এ জগতের কোনও অস্তিত্বই নেই। তিনি তখন সবকিছুর মধ্যে কেবল ব্রহ্মকেই দেখেন। এই অবস্থায় থাকে শুধু শিব, আনন্দ এবং মঙ্গল। তখন এক বৈ দুই বলে কিছু থাকে না। সাধক তখন সর্বত্র ও সকলের মধ্যে এক ও অভিন্ন আত্মাকেই দেখেন। তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে এই ওম্‌, আত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। (এবম্ ওঙ্কার আত্মৈব।)

যঃ এবং বেদ—যিনি এই প্রকার জানেন, অর্থাৎ যিনি সত্যকে জানেন। এই হল প্রকৃত জ্ঞান যা ইন্দ্রিয়াতীত। তখন সাধক জানেন : ‘শুধু তিনিই আছেন।’ এই অবস্থায় সকল দ্বিতত্ত্বের অবসান হয়। সমগ্র জগৎ তখন সাধকের মধ্যে লয় হয়ে যায়। এই অবস্থাই হল চূড়ান্ত অবস্থা। সাধক বাইরে আর কিছুই দেখেন না। তখন সবকিছু তাঁর নিজের মধ্যে।

সংবিশতি—তিনি পুরোপুরি লীন হয়ে যান। সাধক নিজ আত্মাতেই তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। যেহেতু তাঁর কাছে এ জগতের পৃথক কোনও অস্তিত্ব নেই সেহেতু তিনি নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেন। অর্থাৎ তিনি আত্মতৃপ্ত। ‘আত্মনা আত্মানম্‌’—আত্মা আত্মাতেই স্থিত। জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যান। অর্থাৎ জীবাত্মাই পরমাত্মা হয়ে যান।

ইতি মাণ্ডূক্যোপনিষৎ সমাপ্তা।

এখানেই মাণ্ডূক্য উপনিষদ সমাপ্ত।

গৌড়পাদ-কারিকা

ওঙ্কারং পাদশা বিদ্যাৎপাদা মাত্রা ন সংশয়ঃ।

ওঙ্কারং পাদশো জ্ঞাত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ॥২৪

অন্বয়: ওঙ্কারং পাদশঃ বিদ্যাৎ (সাধককে ওঁকারের প্রতিটি অবস্থা জানতে হবে); পাদাঃ মাত্রাঃ সংশয়ঃ ন (পাদসমূহ [অবস্থা] যে মাত্রা [অক্ষর] এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই); ওঙ্কারং পাদশঃ জ্ঞাত্বা (বিভিন্ন পাদ [অবস্থা]-এর মধ্য দিয়ে ওঁকারকে জেনে); কিঞ্চিৎ অপি ন চিন্তয়েৎ (আর কিছু নিয়ে সাধকের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। [সাধক তখন নিজেকে ধন্য মনে করেন ])।

সরলার্থ: প্রতিটি অবস্থার মধ্য দিয়ে ওম্‌-কে জানার চেষ্টা করতে হবে। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পাদসমূহ (অবস্থাসকল) এবং মাত্ৰাসকল (অক্ষরগুলি) এক ও অভিন্ন। ওম্‌-কে যদি তার বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে জানা যায় তবে সাধকের আর কোনও চিন্তা থাকে না। সাধক তখন নিজেকে ধন্য মনে করেন।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্মের বিভিন্ন অবস্থার মতো অ, উ, ম বিভিন্ন অংশ, বিভিন্ন অবস্থা-মাত্র। ব্রহ্মই স্থূল জগৎ, ব্রহ্মই সূক্ষ্ম জগৎ, ব্রহ্মই কারণ জগৎ এবং ব্রহ্মই তুরীয়। একই ব্রহ্ম বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। একইভাবে, অ, উ, ম বিভিন্ন শব্দ হলেও এরা কিন্তু সেই একই ওম্‌ অর্থাৎ একই ব্রহ্ম। এই ওম্‌-কে তাঁর বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের জানতে হবে। কিন্তু একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এ সবই সেই এক ব্রহ্ম, যিনি নিজেকে নানারূপে প্রকাশ করেছেন।

যুঞ্জীত প্রণবে চেতঃ প্রণবো ব্রহ্ম নির্ভয়ম্‌।

প্রণবে নিত্যযুক্তস্য ন ভয়ং বিদ্যতে ক্বচিৎ॥২৫

অন্বয়: প্রণবে চেতঃ যুঞ্জীত (প্রণবে [ওম্‌] মন একাগ্র করতে হবে); প্রণবঃ নির্ভয়ং ব্রহ্ম (প্রণবই ব্রহ্ম এবং তিনি অভয় দান করেন); প্রণবে নিত্য যুক্তস্য (যদি প্রণবের সাথে সবসময় যোগ থাকে); ন ভয়ং বিদ্যতে ক্বচিৎ (সাধকের তখন আর কোনও ভয় থাকে না)।

সরলার্থ: মনকে প্রণবে একাগ্র করতে হবে। প্রণবই ব্রহ্ম এবং তিনি সব ভয়ের ঊর্ধ্বে। প্রণবে মন স্থির হলে সাধকের আর কোনও ভয় থাকে না।

ব্যাখ্যা: ‘যুঞ্জীত প্রণবে চেতঃ’—মনকে প্রণবের সাথে যুক্ত রাখতে হবে, স্থির রাখতে হবে। ব্রহ্মরূপে, আমাদের আত্মারূপে এই ওম্‌-কে ধ্যান করতে হবে। ব্রহ্ম অসীম, অরূপ (কোনও রূপ নেই), নির্গুণ (কোনও গুণ বা উপাধি নেই)। এমন ব্রহ্মকে কিভাবে ধ্যান করব? কাজটি প্রচণ্ড কঠিন হলেও সম্ভব। আমরা হৃদয়ে উজ্জ্বল, জ্যোতির্ময় ওম্‌-এর কল্পনা করব। আমাদের একথা মনে রাখতে হবে, ওম্‌ ব্রহ্ম বা আত্মা ছাড়া আর কিছুই নন। এবং আমরাই সেই আত্মা। সেই আত্মাই সকলের আত্মা। ‘প্রণবে নিত্য যুক্তস্য’—‘আমরাই ওম্‌, আমরাই ব্রহ্ম’, এ সম্পর্কে সবসময় আমাদের সচেতন থাকা উচিত। একথা আমাদের মনে রাখতে হবে।

যদি আমরা এইভাবে ধ্যান করতে পারি তবে আর আমাদের কোনও ভয় থাকবে না। আমরা ভয় পাই কখন? যতক্ষণ আমাদের মধ্যে দ্বিতত্ত্বের বোধ অর্থাৎ দুই বোধ থাকে ততক্ষণ আমরা ভয় থেকে মুক্ত নই। যেমন, আমি তোমাকে দেখি এবং মনে করি তুমি আমার থেকে আলাদা। হয়তো তুমি আমার থেকে শ্রেষ্ঠ তাই তোমার কাছে আমি পরাজিতও হতে পারি। এই দুই বোধ থেকেই আসে দ্বন্দ্ব, ভয় এবং প্রতিযোগিতা। কিন্তু আমার যদি দুই বোধই না থাকে, অর্থাৎ আমি যদি সর্বত্রই এই এক আত্মাকেই দেখি, তবে আর আমি কাকে ভয় করব? আমি তো আর আমাকে ভয় পাই না। ‘আমি’ সর্বত্র রয়েছি, তোমার মধ্যে, আমার মধ্যে, সকলের মধ্যেই ‘আমি’ বিদ্যমান।

প্রণবো হ্যপরং ব্রহ্ম প্রণবশ্চ পরঃ স্মৃতঃ।

অপূর্বোঽন্তরোঽবাহ্যোঽনপরঃ প্রণবোঽব্যয়ঃ॥২৬

অন্বয়: প্রণবঃ হি অপরং ব্রহ্ম (প্রণবই [ওম্‌] ব্রহ্ম, এমনকি তা যদি কার্যও হয় তবুও); প্রণবঃ পরঃ (প্রণবই ব্রহ্ম, যদি নির্গুণও হয় তবুও); চ স্মৃতঃ (এইরূপ বলা হয়); প্রণবঃ অপূর্বঃ (প্রণবের আগে এমন কিছু নেই যাকে প্রণবের কারণ হিসেবে চেনা যায়); অনন্তরঃ (কিছুই এঁর থেকে আলাদা নয়); অবাহ্যঃ (এঁর [প্রণবের] বাইরে কিছু নেই); অনপরঃ (ইনি একাকী); অব্যয়ঃ (এঁর ক্ষয় নেই)।

সরলার্থ: প্রণবই (ওম্‌) একই সাথে পরব্রহ্ম এবং অপরব্রহ্ম। প্রণবের কোন কারণও নেই, কার্যও নেই। প্রণবের বাইরে আর কিছুই নেই। সবই প্রণবের অন্তর্গত। প্রণবের কোন ক্ষয় নেই। (প্রণব সবসময়ই এক।)

ব্যাখ্যা: এই প্রণবই পরব্রহ্ম আবার ইনিই অপরব্রহ্ম। পরব্রহ্ম হলেন পরমব্রহ্ম। পরব্রহ্ম নির্গুণ এবং শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। অপরব্রহ্ম হলেন জগৎরূপে প্রকাশিত ব্রহ্ম। ব্রহ্ম কখনো কখনো এই জগৎরূপে ব্যক্ত আবার কখনো কখনো অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত। অব্যক্ত অবস্থায় জগৎ ব্রহ্মে লীন হয়ে যায়। কিন্তু জগৎ প্রকাশিত হোক বা না হোক, এর দ্বারা ব্রহ্ম প্রভাবিত হন না। ব্রহ্ম সবসময়ই ব্রহ্ম। তিনি নিত্য। পরব্রহ্ম এবং অপরব্রহ্ম হচ্ছে সেই এক ও অভিন্ন ব্রহ্ম। ব্রহ্ম কখনো কারণ আবার কখনো বা কার্য, কিন্তু সবসময় সেই একই ব্রহ্ম। ‘পূর্ণস্য পূর্ণম্‌ আদায় পূর্ণম্‌ এব অবশিষ্যতে’—যদি ‘এই পূর্ণকে’ (অর্থাৎ নাম-রূপসহ ব্রহ্মকে বা কার্যব্রহ্মকে) ‘ঐ পূর্ণ’ থেকে (অর্থাৎ অদৃশ্য ব্রহ্ম বা কারণব্রহ্ম থেকে আলাদা করা হয়, তবু ‘সেটি’ আগের মতোই পূর্ণ থাকে। ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে রয়েছেন। ব্রহ্ম সকলের মধ্যে রয়েছেন অর্থাৎ তিনি সর্বগত।

ব্রহ্মকে বলা হয় ‘অপূর্ব’—অর্থাৎ এঁর আগে আর কিছু নেই। ব্রহ্মের কোনও কারণ নেই। যেমন, এই টেবিলটা হচ্ছে কার্য। কারণ কেউ এই টেবিলটাকে তৈরি করেছে। কিন্তু ব্রহ্ম স্বয়ম্ভূ। অর্থাৎ কেউ ব্রহ্মকে সৃষ্টি করেননি।

‘অনন্তর’—এখানে কোনও দুই নেই। ব্রহ্মের থেকে পৃথক বা স্বতন্ত্র আর কিছু নেই। ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। এমন কথা আমরা বলতে পারি না যে, এই স্থানে এক ব্রহ্ম রয়েছেন আর অন্য স্থানে অপর এক ব্রহ্ম রয়েছেন। সবসময়ই সেই একই ব্রহ্ম রয়েছেন। সেইভাবেই, ব্রহ্মকে ‘অবাহ্য’ বলা হয়। ‘অবাহ্য’ অর্থাৎ এঁর বাইরে আর কিছু নেই। আবার ইনি ‘অনপর’ অর্থাৎ ব্রহ্ম কার্য নন। আবার ব্রহ্ম নিজে যেমন কারণরহিত তেমনি ইনি অন্য কোন কিছুরও কারণ নন। একমাত্র ব্রহ্মই রয়েছেন। ইনি অব্যয়, অপরিবর্তনীয়। এঁর কোনও ক্ষয় বা বিনাশ নেই। ব্রহ্মই চিরন্তন সত্য।

আচার্য শঙ্কর তাঁর ভাষ্যে বলেছেন যে, একই ব্রহ্ম অন্তরেও আছেন এবং বাইরেও আছেন। তিনি ব্রহ্মকে একটি লবণখণ্ডের সাথে তুলনা করেছেন। লবণখণ্ডটি বাইরে এবং ভেতরে অর্থাৎ সর্বত্রই একইরকম নোনা স্বাদ-যুক্ত। অর্থাৎ পুরো লবণখণ্ডটিই লবণাক্ত। ঠিক একইভাবে, আমাদের বাইরে এবং ভেতরে একই ব্রহ্ম রয়েছেন। অর্থাৎ ব্রহ্মই একমাত্র রয়েছেন।

সর্বস্য প্রণবো হ্যাদির্মধ্যমন্তস্তথৈব চ।

এবং হি প্রণবং জ্ঞাত্বা ব্যশ্নুতে তদনন্তরম্॥২৭

অন্বয়: প্রণবঃ হি সর্বস্য আদিঃ (প্রণবেই এই জগতের শুরু); মধ্যম্‌ (এ জগতের মধ্য); তথা এব অন্তঃ চ (একইভাবে এই জগতের শেষও বটে); এবং প্রণবং জ্ঞাত্বা (যদি প্রণবকে এইভাবে জানতে পার [অর্থাৎ নিজ আত্মারূপে]); তদনন্তরম্‌ (তক্ষণি); ব্যশ্নুতে (ব্রহ্মকে সম্পূর্ণভাবে জানতে পারবে)।

সরলার্থ: প্রণবই (ওম্‌) সবকিছুর শুরু, মধ্য ও শেষ। এইভাবে যদি প্রণবকে জানতে পারি, তবে তক্ষণি আমরা ব্রহ্মকেও সম্পূর্ণভাবে জানতে পারব।

ব্যাখ্যা: প্রণবই আরম্ভ (আদি), প্রণবই মধ্য এবং প্রণবই শেষ (অন্ত)। আবার প্রণবই অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। সব অবস্থাতে এবং সকল পরিস্থিতিতে প্রণব সেই একই ব্রহ্ম। প্রণব দেশ এবং কালের ঊর্ধ্বে। প্রণবকে যদি এইভাবে জানতে পারা যায় তবে সাধক তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যান।

‘ব্যশ্নুতে’ শব্দটি অশ্‌ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ খাওয়া। এটি একটি চমৎকার তুলনা। জ্ঞান লাভ করা যেন খাবার গ্রহণের মতো। কেউ হয়তো তৃপ্তি সহকারে প্রচুর পরিমাণে খাবার খেয়েছেন, অর্থাৎ আকণ্ঠ খেয়েছেন। এ একরকমের অভিজ্ঞতা, বুদ্ধির মারপ্যাঁচ নয়। খাবার জিনিস সামনে রেখে কেবলমাত্র দেখলেই কি খিদে মিটে যায়? না, খিদে মেটে না। খাবার খেলেই খিদে মেটে। ব্রহ্মের বেলাতেও ঠিক একই কথা খাটে। একই ব্রহ্ম মানুষের ভেতরে এবং বাইরে আছেন—এই ভাবটিকে বুদ্ধি দিয়ে বুঝে আংশিক আনন্দ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ আত্মজ্ঞান লাভ না হচ্ছে ততক্ষণ এর দ্বারা কোনও উদ্দেশ্যই সাধিত হয় না। সেইজন্যই গৌড়পাদ ‘ব্যশ্নুতে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ এই ভাবটিকে আমাদের খাওয়া উচিত। এ এক বিশেষ ধরনের অভিজ্ঞতা, অপরোক্ষ অনুভূতি। এই অনুভূতি হলে সাধক মুক্ত হয়ে যান, ‘তদনন্তরম্‌’—তক্ষণি মুক্ত হয়ে যান। এই হল প্রকৃত জ্ঞান।

প্রণবং হীশ্বরং বিদ্যাৎ সর্বস্য হৃদি সংস্থিতম্‌।

সর্বব্যাপিনমোঙ্কারং মত্ব ধীরো ন শোচতি॥২৮

অন্বয়: প্রণবং হি সর্বস্য হৃদি সংস্থিতম্‌ ঈশ্বরং বিদ্যাৎ (সকলের হৃদয়ে ঈশ্বররূপে প্রণব রয়েছেন—তা জান); ধীরাঃ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তি); সর্ব-ব্যাপিনম্ ওঙ্কারং মত্বা (এই সর্বব্যাপী প্রণবকে জেনে); ন শোচতি (সকল দুঃখ-কষ্টের পারে চলে যান)।

সরলার্থ: প্রণবকে সেই ঈশ্বর বলে জানতে হবে যিনি সকলের হৃদয়ে রয়েছেন এবং সকলকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা প্রণবকে সর্বব্যাপী বলে জানেন। এমন মানুষ কখনো দুঃখে কাতর হন না। অর্থাৎ তিনি সুখ-দুঃখের পারে চলে যান।

ব্যাখ্যা: প্রণবকে ঈশ্বর বলে জানতে হবে। ‘ব্রহ্ম’ শব্দের পরিবর্তে গৌড়পাদ এখানে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অন্তর্যামী ঈশ্বর সকলের হৃদয়ে রয়েছেন। তিনি সকলের অন্তরাত্মা। এই প্রণব অর্থাৎ ওম্‌ সর্বব্যাপী। ওম্‌-ই সেই সর্বব্যাপী ব্রহ্ম। তিনি এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন—একথা জেনে জ্ঞানী ব্যক্তিরা কখনো শোক করেন না। যখন আমরা এই জ্ঞান লাভ করি তখনি আমরা জ্ঞানী ব্যক্তিতে পরিণত হই। তখন আমরা সুখ-দুঃখ অর্থাৎ দুই বোধের ঊর্ধ্বে চলে যাই। আমাদের সকল দুঃখ-কষ্টের মূলে হচ্ছে এই অজ্ঞানতা। যখন আমরা সকলের মধ্যে—‘এক’ অর্থাৎ ব্রহ্মকে দেখতে পারব, তখন আমরা সব দুঃখ-কষ্টের পারে চলে যাব।

অমাত্রোঽনন্তমাত্রশ্চ দ্বৈতস্যোপশমঃ শিবঃ।

ওঙ্কারো বিদিতো যেন স মুনির্নেতরো জনঃ॥২৯

অন্বয়: যেন সঃ (যিনি); অমাত্রঃ (অখণ্ড); অনন্তমাত্রঃ (অসীম); চ দ্বৈতস্য উপশমঃ (এবং সকল দ্বিতত্ত্বের [দুই বোধ] লোপ); শিবঃ (মঙ্গলময়); ওঙ্কারঃ বিদিতঃ (ওঁকারকে জানেন); জনঃ (এমন ব্যক্তি); মুনিঃ (মুনি); ইতরঃ ন (অন্য কেউ নয়)।

সরলার্থ: অখণ্ড, অসীম, অদ্বৈত এবং মঙ্গলময়রূপে যিনি ওঁকারকে জানেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি, অন্য কেউ নয়।

ব্যাখ্যা: এই ওম্ ‘অমাত্র’ অর্থাৎ অখণ্ড। আবার এই ওম্ ‘অনন্তমাত্র’—অপরিমেয়, অর্থাৎ এই ওম্‌-কে পরিমাপ করা যায় না। তিনিই নিরাকার, তিনিই সাকার। আবার কখনো তিনি অব্যক্ত, কখনো অসংখ্যরূপে ব্যক্ত। ‘দ্বৈতস্য উপশমঃ’—এখানে কোনও দুই বোধ নেই। সকল দ্বিতত্ত্ব তখন ‘ওম্‌’-এ লীন হয়ে যায়। তখন সেখানে থাকে কেবল শিব, শান্তি এবং আনন্দ। কেন? কারণ, যেখানে দুই বোধই নেই সেখানে দ্বন্দ্ব বা সংগ্রামও নেই। সকল উপনিষদই এই একটি কথা বোঝাতে চাইছেন যে, সমগ্র বিশ্বে একটিমাত্র সত্তা রয়েছেন। আর তিনিই হলেন ব্রহ্ম। যিনি এই সত্যকে জেনেছেন তিনি তো মুক্ত। যেসব বৈচিত্র আমরা দেখি, তা আমাদের মনের ভুল। একই ব্রহ্ম বিভিন্নরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। দ্বৈতকে ভেদ করে আমাদেরকে অদ্বৈতে পৌঁছতে হবে। অজ্ঞানতা নাশ হলে আর দুই বোধ থাকে না।

মুনি কে? যাঁর মন স্বচ্ছ ও সজাগ। বিচারবুদ্ধি-সম্পন্ন পুরুষই হলেন মুনি। আমরা বেশিরভাগ মানুষই মনের সদ্ব্যবহার করি না। কিন্তু যিনি মুনি তিনি তাঁর মনের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেন। তিনি গভীরভাবে মনন বা চিন্তা করেন। যিনি সকলের মধ্যে এক আত্মাকে দেখেন তিনিই প্রকৃত মুনি। সাকার নিরাকার সবের মধ্যে তিনি সেই এক আত্মাকে দেখেন। ‘ইতরঃ ন’—এ অন্য কেউ পারে না।

বৈতথ্য প্রকরণ

বৈতথ্যং সর্বভাবানাং স্বপ্ন আহুর্মনীষিণঃ।

অন্তঃস্থানাত্তু ভাবানাং সংবৃতত্বেন হেতুনা॥১

অন্বয়: মনীষিণঃ (প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি); স্বপ্নে ভাবানাম্‌ (স্বপ্নে দৃষ্ট বস্তুসকল); অন্তঃ (অভ্যন্তরে); স্থানাৎ সংবৃতত্বেন (স্থানের সংকীর্ণতা); হেতুনা (এই কারণে); সর্বভাবানাম্‌ ([স্বপ্নে দৃষ্ট] বস্তুসকল); বৈতথ্যম্ (মিথ্যা); আন্থঃ (ঘোষণা করেন)।

সরলার্থ: প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বলেন, স্বপ্নে দেখা সকল বস্তুই মিথ্যা। তুমি স্বপ্নে নানারকম বস্তু দেখে থাক কিন্তু সেসব বস্তু তোমার মধ্যে থাকতে পারে না। কারণ তোমার দেহ সেইসব বস্তুর তুলনায় ক্ষুদ্র। (দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, তুমি স্বপ্নে পর্বত দেখতে পার। কিন্তু পর্বত কি সত্যিই তোমার দেহের মধ্যে থাকতে পারে? না, তাই স্বপ্নে দেখা পর্বত মিথ্যা।)

ব্যাখ্যা: ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু যে সত্যের বিকৃতি এই সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করতে বর্তমান অধ্যায় সচেষ্ট। ‘তথ্য’ কথাটির অর্থ সত্য। আর ‘বৈতথ্যে’র অর্থ হল ঠিক এর বিপরীত অর্থাৎ মিথ্যা। আমরা যা সত্য বলে মনে করি আসলে তা সত্য নয়, এখানে এই কথাই গৌড়পাদ বলতে চাচ্ছেন। আমরা বলে থাকি এ জগৎ সত্য এবং শুধু তাই নয় আমরা একথা বিশ্বাসও করি। কেন? কারণ এই জগৎকে আমরা দেখতে পাই, স্পর্শ করতে পারি এবং বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে এ জগৎকে আমরা অনুভব করি। আমাদের কাছে এই হল সত্যের মাপকাঠি। গৌড়পাদ দেখাচ্ছেন—এ আমাদের কত বড় ভুল। যেমন স্বপ্নে আমি একটি রথ বা একটি হাতী কিংবা একটি পর্বতও দেখতে পারি, কিন্তু এগুলির অস্তিত্ব কোথায়? ওগুলি আমি স্বপ্নে দেখি বটে কিন্তু এই দেখা কি সত্য? স্বপ্নে দেখা পর্বতটি কোথায়? সেটি কি তবে আমার দেহের মধ্যে? কিন্তু পর্বতের মতো বিশাল এক বস্তু আমার এই দেহের মধ্যে কিভাবে থাকতে পারে? আর ঐ পর্বতটি যদি বাইরে থাকে তবে জেগে উঠে বা সেটিকে দেখতে পাই না কেন? জেগে উঠে যখন চারিদিকে তাকাই তখন কিন্তু ঘরের মধ্যে কোথাও কোন পর্বত দেখি না। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত আগেই তো আমি সেটিকে দেখেছি। এইভাবে বোঝা গেল যে স্বপ্ন সত্য নয়। চাক্ষুষ দেখাই সত্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়।

গৌড়পাদের মতে স্বপ্নে নানা বস্তুকে দেখা যেমন মিথ্যা, জাগ্রত অবস্থাতেও আমরা যা দেখি তাও ঠিক ততটাই মিথ্যা। স্বপ্ন-অভিজ্ঞতা ও জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। কেন? কারণ উভয় ক্ষেত্রেই তো অভিজ্ঞতা ক্ষণস্থায়ী। স্বপ্নের অভিজ্ঞতার মতো জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতারও শুরু ও শেষ আছে। আমি ঘুমের মধ্যে কত শত অদ্ভুত বস্তুই না দেখি! ঘুমোবার সময় সেগুলি বিছানাতে ছিল না আবার জেগে ওঠার পরও সেগুলিকে বিছানাতে দেখা যায় না। গৌড়পাদ বলছেন, ঠিক তেমনভাবেই জাগ্রত অবস্থায় আমি এই বিশ্বকে সত্য বলেই মনে করি, কিন্তু যখন আমার বোধে বোধ হয় অর্থাৎ আত্মজ্ঞান তথা পরম সত্যকে উপলব্ধি করি তখন আমি ভাবি : ‘আমি কি ঝামেলার মধ্যেই না পড়েছিলাম! কারণ আমি ভেবেছিলাম এ জগৎ সত্য।’

আমাদেরকে একথা মনে রাখতে হবে যে বেদান্তমতে সত্যের মাপকাঠি হল, যা নিত্য অর্থাৎ অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু কি জাগ্রত অবস্থায় কি স্বপ্নে, আমাদের সকল অভিজ্ঞতাই ক্ষণস্থায়ী। একটি বিশেষ মুহূর্তে হয়তো অভিজ্ঞতাটি আছে আবার পরমুহূর্তেই সেটি নেই। এই কারণেই গৌড়পাদ বৈতথ্য শব্দটি ব্যবহার করেছেন। জাগ্রত অথবা স্বপ্নে আমাদের সকল অভিজ্ঞতাই এই সত্য অর্থাৎ ব্রহ্মকে বিকৃত করে দেখা।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ, যার সঙ্গে আমরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, তার অনিত্যতা প্রতিষ্ঠায় গৌড়পাদ উদ্যোগী। এর দ্বারা গৌড়পাদ এই জগৎ থেকে আমাদের মনকে সরিয়ে নিয়ে, মনটিকে চালনা করতে চাইছেন নিত্য-সত্যের দিকে। সেই নিত্য-সত্যটি কি? তা হল আমাদের আত্মা। গৌড়পাদ বলছেন এই বাহ্য জগতের কোন কিছুই সত্য নয়। আমাদের সকলের মধ্যেই এই সত্য নিহিত রয়েছে। অন্তরস্থ আত্মাই একমাত্র সত্য, এই আত্মাই সবকিছুর অধিষ্ঠান। আত্মা আছেন বলেই আমরা দেখি, শুনি, চিন্তা করি, কল্পনা করি অর্থাৎ এ জগৎকে অনুভব করতে পারি। এই আত্মা আছেন বলেই জাগ্রত বা স্বপ্নাবস্থাতে আমাদের নানারকম অভিজ্ঞতা হয়। সুতরাং আত্মাই একমাত্র সত্য। এই সিদ্ধান্তের দিকেই গৌড়পাদ আমাদেরকে ধীরে ধীরে নিয়ে চলেছেন।

অদীর্ঘত্বাচ্চ কালস্য গত্বা দেহান্ন পশ্যতি।

প্রতিবুদ্ধশ্চ বৈ সর্বস্তস্মিন্দেশে ন বিদ্যতে॥২

অন্বয়: কালস্য অদীর্ঘত্বাৎ চ (এই কারণেও যে কাল সংক্ষিপ্ত); দেহাৎ গত্বা (দেহের বাইরে গিয়ে); [স্বপ্নন্‌] ন পশ্যতি (স্বপ্নে দৃষ্ট বস্তুগুলি দেখে না); সর্বঃ প্রতিবুদ্ধঃ চ (যখন মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়); তস্মিন্ দেশে ন বৈ বিদ্যতে (স্বপ্নস্থানে নিজেকে দেখতে পায় না)।

সরলার্থ: মানুষ স্বপ্নের সময় দেহ থেকে বেরিয়ে স্বপ্নদৃষ্ট স্থানে যায়—একথা ঠিক নয়। এটা অসম্ভব। যদি সে দেহ থেকে বেরিয়ে যায় তবে ঘুম ভাঙার আগে ঐ অল্পসময়ের মধ্যে সে ফিরে আসতে পারত না। আবার জেগে ওঠার পর সে আর নিজেকে স্বপ্নদৃষ্ট স্থানে দেখে না।

ব্যাখ্যা: স্বপ্ন যে মিথ্যা একথা বোঝাবার জন্য গৌড়পাদ আরও একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। ধরা যাক, আমি স্বপ্ন দেখছি আমি কাশীতে গেছি। কিন্তু জেগে উঠে দেখলাম আমি নিজের ঘরেই আছি। এখন এই কাশী যাওয়া ও ফিরে আসার জন্য যে দীর্ঘ সময়ের দরকার সেই সময় পাওয়া গেল কিভাবে? অল্প সময়ের মধ্যে (কালস্য অদীর্ঘত্বাৎ) এ যাত্রা অসম্ভব। আগের শ্লোকে দেখেছি যে স্বপ্নে দেখা বস্তুগুলি (যেমন পর্বত ইত্যাদি) আমাদের এই ক্ষুদ্র দেহের মধ্যে থাকতে পারে না, তাই সেগুলি সত্য নয়। আর একটি যুক্তি হল, যদিও স্বপ্নে দেখছিলাম যে আমি কাশীতে রয়েছি কিন্তু জেগে উঠেই দেখি আমি কাশীতে নেই আমার ঘরেই আছি। সুতরাং সত্যি সত্যিই কাশী যাওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। এ সবই মনের ভুল।

আচার্য শঙ্কর এখানে আরও একটি যুক্তি দিয়েছেন। যেমন আমি স্বপ্নে দেখছি আমি কাশী গেছি। সেখানে বিভিন্ন স্থান ও আত্মীয়-বন্ধুদের দেখছি এবং আমি মনে করছি যে আমি সত্যিই কাশীতে আছি। কিন্তু পরে সেইসব আত্মীয়-বন্ধুরা আমাকে কখনো বলেনি : ‘ওঃ তোমার সঙ্গে কাশীতে দেখা হওয়ায় কি ভালোই না লেগেছিল। সেখানে আমাদের কতই না আনন্দ হয়েছিল!’ এরকম আমাদের কখনো ঘটে না। এই কারণেই আচার্য শঙ্কর বলছেন যে এই ধরনের ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা কখনো সত্যের মাপকাঠি হতে পারে না।

অভাবশ্চ রথাদীনাং শ্ৰূয়তে ন্যায়পূর্বকম্‌।

বৈতথ্যং তেন বৈ প্রাপ্তং স্বপ্ন আহুঃ প্রকাশিতম্‌॥৩

অন্বয়: স্বপ্নে রথাদীনাম্‌ (স্বপ্নে দেখা রথ); অভাবঃ (সব মিথ্যা); চ ন্যায়পূর্বকম্‌ (এটি যুক্তিগ্রাহ্য); শ্ৰয়তে (শাস্ত্রও এইকথা বলেন); তেন (স্থানের সংকীর্ণতার ফলে); প্রাপ্তম্ (প্রমাণিত); বৈতথ্যম্ (অসত্যতা); প্রকাশিতম্‌ ([শাস্ত্র শুধুই] বারবার বলেন); আহুঃ ([প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা] বলেছেন)।

সরলার্থ: স্বপ্নে দেখা রথ মিথ্যা। এটি যুক্তিযুক্ত এবং শাস্ত্রেও সেকথা বলা হয়েছে। দেহ-মধ্যবর্তী স্থান খুবই সংকীর্ণ (রথ রাখার পক্ষে); এর দ্বারাই রথের অনিত্যতা প্রমাণিত হয়। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বলেন একথা যুক্তিযুক্ত এবং শাস্ত্রও এইকথা বারবার বলে থাকেন।

ব্যাখ্যা: এখানে গৌড়পাদ বলতে চাচ্ছেন স্বপ্নের এই অনিত্যতা শাস্ত্র-সমর্থিত। যেমন, আমি স্বপ্ন দেখছি যে আমি রথে চড়ে চলেছি। শাস্ত্রমতে, আমার এ অভিজ্ঞতা সত্য নয়। এটি বৈতথ্য বা বিকৃতি। কিন্তু যদি এই সিদ্ধান্ত যুক্তিগ্রাহ্য না হয় তবে আমরা শাস্ত্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি। এমনকি অগ্রাহ্যও করতে পারি। কিন্তু গৌড়পাদ বলছেন যে, পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তটি যুক্তিগ্রাহ্য। আমার নিজের বিচারবুদ্ধিও এই যুক্তিকে মেনে নেয় যে, এই স্বপ্ন-অভিজ্ঞতা মিথ্যা। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরাও এই একই কথা (স্বপ্নের মিথ্যাত্ব) বলেন।

স্বপ্নের অভিজ্ঞতাই হল জ্যোতির্ময় আত্মার প্রমাণ। বস্তু থাক বা না থাক আত্মা জ্যোতিস্বরূপ।

অন্তঃস্থানাত্তু ভেদানাং তস্মাজ্জাগরিতে স্মৃতম্।

যথা তত্র তথা স্বপ্নে সংবৃতত্বেন ভিদ্যতে॥৪

অন্বয়: [স্বপ্নে] ভেদানাম্ (পার্থক্য); অন্তঃস্থানাৎ (দেহাভ্যন্তরে [স্বল্পস্থান, অতএব মিথ্যা]); তস্মাৎ এব (তার [প্রত্যক্ষের] দ্বারা); জাগরিতে [অপি] স্মৃতম্ (একই কথা [অনিত্যতা] জাগ্রত অবস্থাতেও প্রযোজ্য); তত্র (সেখানে [জাগ্রত অবস্থায়]); যথা (যেমন); স্বপ্নে (স্বপ্নাবস্থায়); তথা (একই [অনুভূতি]); সংবৃতত্বেন ভিদ্যতে ([কেবলমাত্র] স্থানগত বৈষম্য)।

সরলার্থ: যখন আমরা স্বপ্নে নানা বস্তু দেখি তখন আমরা জানি যে ঐসব বস্তু মিথ্যা। কারণ দেহের অভ্যন্তরে ঐসব বস্তু থাকার মতো জায়গা নেই। কিন্তু জাগ্রত অবস্থাতেও আমরা যা-কিছু দেখি তাও সমভাবে মিথ্যা। দুই-এর মধ্যে পার্থক্য শুধু এইখানে যে জাগ্রত অবস্থাতে বস্তুগুলি থাকার জন্য জায়গার অভাব হয় না। স্বপ্ন বা জাগ্রত উভয় অবস্থাতে বস্তুগুলি কিন্তু এক। স্বপ্নে দেখা বস্তুগুলি যদি মিথ্যা হয় তবে সেগুলি জাগ্রত অবস্থাতেও মিথ্যা।

ব্যাখ্যা: এখানে কথাটা এই স্বপ্ন বা জাগ্রত উভয় অবস্থার অভিজ্ঞতাই মিথ্যা। উভয়ের মধ্যে পার্থক্যটা শুধু এইখানে যে, স্বপ্নের সময় বস্তুগুলিকে আমি আমার মধ্যে দেখি এবং এইসব বস্তু আমার অভ্যন্তরে থাকার মতো যথেষ্ট জায়গা যে আমার নেই তাও আমি জানি। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় এইসব বস্তুগুলিকে আমি বাইরে দেখি এবং সেখানে সেগুলি থাকার মতো যথেষ্ট জায়গাও আছে। গৌড়পাদ বলছেন দুটি অভিজ্ঞতাই এক। বস্তু ও বস্তুর প্রকৃতি দুই-ই প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা।

জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্পর্ক জাগ্রত ও স্বপ্ন এই দুই অবস্থাতেই থাকে। এখানে দ্রষ্টা এবং দৃশ্য উভয়েই বর্তমান। এই অবস্থাতে দুই বোধ থাকে। গৌড়পাদের মতে এই দুই ধরনের অভিজ্ঞতা শর্তসাপেক্ষ। বৌদ্ধদর্শনে একেই বলা হয় ‘প্রতীত্য সমুৎপাদ’। যেমন, তুমি হয়তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ। কিন্তু আমি হয়তো তোমাকে দেখতে পাইনি। তাহলে কি আমার সামনে তুমি নেই? এখানে তোমার অস্তিত্ব আমার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যক্ষের ভূমিকা এখানে থেকেই যাচ্ছে। বস্তুটিকে থাকতে হবে আবার একই সঙ্গে দ্রষ্টাকেও থাকতে হবে। যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা ত্রুটিপূর্ণ, সেহেতু বস্তুর স্বভাবের সঠিক পরিচয় আমরা পাই না। যখন কোন বস্তুকে আমরা দেখি তখন তার কিছু বৈশিষ্ট্য হয়তো আমরা লক্ষ্য করে থাকি কিন্তু বস্তুর এমন অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। যেরূপে বস্তুটি প্রকাশিত সেইরূপেই আমরা বস্তুটিকে দেখি কিন্তু তার প্রকৃত স্বরূপকে আমরা দেখি না। বস্তুটি আমাদের অনুভূতির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমাদের এই অনুভূতি ত্রুটিহীন না হওয়ায় বস্তুর যথার্থ স্বরূপও আমরা কখনো জানতে পারি না। সুতরাং আমরা যা দেখি তা সত্য নয়। পরম সত্য সর্বদা এক ও অভিন্ন। এর কোন পরিবর্তন হয় না। এ তত্ত্ব কারও দ্বারা প্রভাবিতও নয়, এমনকি কোন কিছুর উপর নির্ভরশীলও নয়। পরম সত্য স্বতন্ত্র। সেইজন্যই গৌড়পাদ বলছেন এ বিশ্বকে সত্য বলে গ্রহণ করলে তাকে ব্যাখ্যা করব কি করে? কেউ কেউ বলেন যে এই বিশ্ব সত্য—এই কথাটির সঠিক অর্থ কি? কোন্ অর্থে এই জগৎ সত্য? গৌড়পাদ বলছেন—না, এ জগৎ সত্য নয়। এ এক দৃষ্টিবিভ্রম। দৃষ্টিবিভ্রম এই অর্থে যে আমরা বিশ্বকে যা মনে করি বিশ্ব কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা সবসময়ই নিজেদেরকে বঞ্চিত করি।

স্বপ্নজাগরিতস্থানে হ্যেকমাহুর্মনীষিণঃ।

ভেদানাং হি সমত্বেন প্রসিদ্ধেনৈব হেতুনা॥৫

অন্বয়: মনীষিণঃ (প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি); স্বপ্ন-জাগরিত-স্থানে (স্বপ্ন ও জাগ্রত উভয় অবস্থায়); প্রসিদ্ধেন হেতুনা (কারণ জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কটি সুপরিচিত); ভেদানাম্ (আলোচ্য বস্তুসকল); হি (নিশ্চিতভাবে); সমত্বেন (একই থাকে); হি (নিঃসন্দেহে); একম্ (একই [অর্থাৎ মিথ্যা]); আহুঃ (বলেন)।

সরলার্থ: একথা সকলেই জানেন, উভয় অবস্থাতেই জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কটি একই থাকে। এই দুই অবস্থায় যেসব বস্তুর অভিজ্ঞতা হয় সেই বস্তুগুলি অভিন্ন। এই কারণেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থার বস্তুকেই মিথ্যা বলে মনে করেন।

ব্যাখ্যা: প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বলে থাকেন যে জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থাই এক। কেন? কারণ উভয় অবস্থাতেই দ্বৈতবোধ থাকে। দ্রষ্টা এবং দৃশ্যবস্তু, জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়বস্তু, এই দুই বোধ উভয় ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। কিন্তু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বলেন এ জগতে এক বৈ দুই কিছু নেই। আমরা যে দুই দেখি সেটা ভুল। স্বপ্নদৃষ্ট বস্তু যদি মিথ্যা হয় তবে জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা-কিছু দেখি তাও মিথ্যা।

আদাবন্তে চ যন্নাস্তি বর্তমানেঽপি তত্তথা।

বিতথৈঃ সদৃশাঃ সন্তোঽবিতথা ইব লক্ষিতাঃ॥৬

অন্বয়: যৎ (বস্তুটি); আদৌ (প্রথম দেখার আগে); অন্তে ন অস্তি (শেষে তা দেখা যাবে না); তৎ (সেই বস্তুটি); বর্তমানে অপি (বর্তমানেও); তথা (সেটি মিথ্যা); বিতথৈঃ সদৃশাঃ (মরীচিকার ন্যায় ভ্রান্ত); সন্তঃ অবিতথা ইব লক্ষিতাঃ (সত্য বলে দৃষ্ট হয়)।

সরলার্থ: এমন কোনও বস্তু যদি থাকে যা শুরুর আগেও ছিল না আবার শেষ হবার পরেও থাকবে না তাকে মিথ্যা বলে মনে করতে হবে। বস্তুটি মরীচিকার মতোই মিথ্যা। বস্তুটিকে সত্য বলে মনে হলেও বস্তুটি আসলে সত্য নয়। যা চিরন্তন সত্য তা নিত্য অর্থাৎ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এই তিন কালেই তা সত্য।

ব্যাখ্যা: ধরা যাক, আমি স্বপ্ন দেখছি আমি ক্রিকেট খেলা দেখতে গেছি। অগণিত দর্শকদের মধ্যে বসে আমি খেলা দেখছি। জেগে ওঠার পরই আমি বুঝতে পারলাম স্বপ্নটি সত্য নয়। পুরো সময়টা আমি বিছানাতেই ছিলাম, এক মুহূর্তের জন্যও আমি বাইরে যাইনি। কিন্তু স্বপ্ন দেখাকালীন অভিজ্ঞতাটি আমার কাছে এত সত্য বলে মনে হয়েছিল যে কেউ ‘ক্যাচ্’ ধরলে আমি ভারী খুশি হয়ে উঠেছি, আবার যখন কেউ ‘ক্যাচ্’ ফেলে দিয়েছে তখন খুবই দুঃখ পেয়েছি। যতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম ততক্ষণ এইসব নানা প্রতিক্রিয়া আমার হচ্ছিল। এখানে গৌড়পাদের বক্তব্য স্বপ্নে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা যদি মিথ্যা হয় তবে জাগ্রত অবস্থায় ক্রিকেট ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতাও সমভাবে মিথ্যা। সত্যের যে বোধ আমার রয়েছে তা ভ্রান্তিমাত্র। এর স্বপক্ষে তাঁর যুক্তি : যখন আমি স্বপ্ন দেখি তখন কি আমি বুঝতে পারি যে আমি স্বপ্ন দেখছি? না, তা পারি না। যখন স্বপ্ন দেখি তখন স্বপ্নের সকল বস্তুই আমার কাছে অতি সত্য বলে মনে হয়। তখন এর সত্যতা নিয়ে আমার কোন সংশয়ও থাকে না। ধরা যাক, স্বপ্নে একটা বাঘ দেখলাম এবং দেখামাত্রই ভয়ে দৌড়ে পালাতে শুরু করলাম। যদি আমি জানতাম যে এটি নেহাতই স্বপ্ন, এখানে প্রকৃতপক্ষে কোনও বাঘ নেই তবে আমি ভয় পেয়েছিলাম কেন? কিন্তু জেগে উঠে আমাকে মানতেই হল যে সত্যিই কোনও বাঘ ছিল না। প্রকৃত জ্ঞানীর দৃষ্টিতে জাগ্রত অবস্থার সব প্রতিক্রিয়া ও আবেগসমূহ স্বপ্নাবস্থার মতোই সমভাবে মিথ্যা। আপাতদৃষ্টিতে সেগুলিকে সত্য বলে মনে হলেও আসলে সেগুলি স্বপ্নের অভিজ্ঞতার মতোই সাময়িক অভিজ্ঞতা মাত্র। অথবা জাগ্রত অবস্থায় রজ্জুতে সর্পভ্ৰমতুল্য। যখন দড়িকে সাপ মনে করি তখন নানারকম প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু পরে বুঝতে পারি দড়িটি কখনই সাপ ছিল না। দড়িই ছিল।

তাই এখানে গৌড়পাদ বলছেন : ‘সান্তঃ অবিতথা ইব লক্ষিতাঃ’—আমাদের অভিজ্ঞতাসমূহকে সত্য বলে মনে হতে পারে কিন্তু আসলে তা সত্য নয়। কারণ এইসব অভিজ্ঞতার শুরু ও শেষ আছে। কিন্তু যা সত্য তা নিত্য। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এই তিন কালেই তা সত্য। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ক্ষণস্থায়ী, কিছুক্ষণ পরেই তা শেষ হয়ে যায়। যা অতীতেও ছিল না ভবিষ্যতেও থাকবে না তা বর্তমানেই বা আছে কি করে? সত্যই একমাত্র নিত্য। অর্থাৎ তা সবসময়ই বিদ্যমান।

সপ্রয়োজনতা তেষাং স্বপ্নে বিপ্ৰতিপদ্যতে।

তস্মাদাদ্যন্তবত্ত্বেন মিথ্যৈব খলু তে স্মৃতাঃ॥৭

অন্বয়: তেষাম্ (জাগ্রত অবস্থায় দৃষ্ট বস্তুসকল); সপ্রয়োজনতা (সেই অবস্থায় কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে); স্বপ্নে বিপ্ৰতিপদ্যতে (স্বপ্নাবস্থায় ঐ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে নাও পারে); তস্মাৎ (সুতরাং); তে (জাগ্রত অবস্থার দৃষ্ট বস্তুসকল); আদ্যন্তবত্ত্বেন (যার শুরু এবং শেষ আছে); মিথ্যৈব খলু [তে] স্মৃতাঃ (এইসব বস্তু অবশ্যই মিথ্যা)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় আমাদের অনেক বস্তুই কাজে লাগে। স্বপ্নাবস্থায় সেগুলি কাজে নাও আসতে পারে। এর অর্থ হল ঐসকল বস্তুসমূহের আদি ও অন্ত আছে। এইরকম বস্তু অবশ্যই মিথ্যা।

ব্যাখ্যা: উপযোগিতার দিক থেকে একটি আপত্তি ওঠে : তুমি বলছ যে জাগ্রত অবস্থায় আমি যে খাবার খাচ্ছি তা সত্য নয় এবং খাবার গ্রহণের প্রক্রিয়াটিও সত্য নয়। আবার খাবার খাওয়ার ফলে আমি যে তৃপ্তি পাচ্ছি তাও সত্য নয়। কিন্তু এখানে খাদ্যবস্তু এবং খাবার খাওয়ার উপযোগিতা রয়েছে। কারণ জাগ্রত অবস্থায় ক্ষুধার্ত ব্যক্তি মনে করেন যদি তিনি কিছু খাবার খান তবেই তাঁর ক্ষুধা নিবৃত্তি হবে। কিন্তু কেউ যদি স্বপ্নে খাবার খায় তবে নিদ্রাভঙ্গে তার ক্ষুধা নিবৃত্তি হয় না। এই দুই অবস্থাই এক। কিন্তু স্বপ্নে তিনি যে খাবার খাচ্ছিলেন তা দিয়ে জাগ্রত অবস্থার ক্ষুধার উপশম হয় না।

এর উত্তরে গৌড়পাদ বলছেন : ধরা যাক, জাগ্রত অবস্থায় তুমি ভূরিভোজন করেছ। তারপর স্বপ্ন দেখছ যে তুমি ভারী ক্ষুধার্ত। আবার তুমি স্বপ্ন দেখছ যে তুমি পর্যাপ্ত পরিমাণে খেয়েছ কিন্তু ঘুম ভাঙার পর তুমি বুঝতে পার যে তুমি ক্ষুধার্ত। জাগ্রত অবস্থায় তুমি তোমার স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার কর, আবার স্বপ্নাবস্থায় জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার কর। নিদ্রাভঙ্গে স্বপ্নের যাবতীয় অভিজ্ঞতাকে তুমি মিথ্যা বলে বাতিল করে দাও। একইভাবে স্বপ্নাবস্থায় তুমি জাগ্রত অবস্থার সকল অভিজ্ঞতাকেই মিথ্যা বলে বাতিল করে দাও। কিন্তু তুমি সেই একই ব্যক্তিসত্তা, এক অবস্থায় তুমি এক ধরনের অভিজ্ঞতাকে বাতিল করছ আর এক অবস্থায় তুমি আর এক ধরনের অভিজ্ঞতাকে খণ্ডন করছ।

গৌড়পাদ বলছেন যে, যতক্ষণ তুমি স্বপ্ন দেখছ ততক্ষণ স্বপ্নের সবকিছু তোমার নিকট সত্য। স্বপ্ন চলাকালীন খাবার গ্রহণের অভিজ্ঞতাটি যে আদতে সত্য নয় তা কি তোমার কখনো মনে হয়েছে? না, তা হয়নি। কারণ স্বপ্নের সময় যে খাবার আমরা খাই তা আমাদের স্বপ্নের ক্ষুধাকে চরিতার্থ করে। ঠিক তেমনিই, জাগ্রত অবস্থায় যে খাবার আমরা খাই তাতে জাগ্রত অবস্থার ক্ষুধার উপশম হয়। কিন্তু সেই অবস্থার পরিবর্তন হলে প্রাসঙ্গিক সবকিছুর লোপ পায়। আমাদের অভিজ্ঞতা ক্ষণস্থায়ী। জাগ্রত এবং স্বপ্ন উভয় অভিজ্ঞতারই আদি এবং অন্ত আছে। আর যার শুরু এবং শেষ আছে তাই সীমিত। আমাদের অভিজ্ঞতা দেশ-কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ, সুতরাং তা সত্য হতে পারে না। আদি-অন্ত আছে কিনা তাই হল বিচারের মাপকাঠি। যা সত্য তার আরম্ভও নেই, শেষও নেই অর্থাৎ তা শাশ্বত ও সনাতন।

তবে সত্য কি? গৌড়পাদ বলেন যে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। এইসব অভিজ্ঞতা পর্দায় ফেলা চলমান ছবির মতো যায় আসে। পর্দার উপর কতশত ঘটনাই ঘটে চলে, কিন্তু পর্দাটির কোনও পরিবর্তন হয় না। পর্দার উপর চলচ্চিত্রটি আরোপিত হয়েছে মাত্র। একইভাবে সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা ইত্যাদি গুণাবলী আত্মার উপর আরোপিত। একমাত্র আত্মাই সত্য।

অপূর্বং স্থানিধর্মো হি যথা স্বর্গনিবাসিনাম্।

তানয়ং প্রেক্ষতে গত্বা যথৈবেহ সুশিক্ষিতঃ॥৮

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); স্বর্গনিবাসিনাম্ (যাঁরা স্বর্গবাসী [যেমন ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতা যাঁরা সহস্রচক্ষু এবং নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী]); অপূর্বম্ (ঠিক তেমন, স্বপ্নাবস্থায় এইরকম নানা অদ্ভুত বস্তুর দর্শন হয়); হি (নিশ্চিতভাবে); স্থানিধর্মঃ (এইসকল বস্তু যিনি স্বপ্ন দেখছেন তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ); যথা (এ ও তেমন); ইহ (জাগ্রত অবস্থার ব্যক্তি); সুশিক্ষিতঃ (পথঘাট যাঁর সুপরিচিত); গত্বা (ঐসব পথের গন্তব্যসীমায় চলাফেরা করার ফলে এবং সেইসব স্থানের দ্রষ্টব্য বস্তু উপভোগ করার ফলে); অয়ম্ (একইভাবে, সেই ব্যক্তি তাঁর স্বপ্নে); তান্ (ঐসব স্বপ্ন জগতের মনোহর বস্তুসকল); প্রেক্ষতে (দেখে আনন্দ করেন)।

সরলার্থ: কথিত আছে, স্বর্গের ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাগণ সহস্র চক্ষু ও বহু অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী। এবং স্বপ্নে আমরা এইসব অলৌকিক বস্তুর দর্শন পেতে পারি। স্বপ্নের প্রকৃতিই এমন। কোন স্থানের রাস্তাঘাট চেনা থাকলে আমরা সেখানে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারি এবং সেখানকার দর্শনীয় জিনিস দেখে চিনতে পারি। একইভাবে স্বপ্নেও আমরা নানা অলৌকিক বস্তু দেখি, যেন এই-সকল বস্তুকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানি। মরীচিকা অথবা রজ্জুতে সর্পভ্রমের মতো এসকল বস্তুও মিথ্যা।

ব্যাখ্যা: আমরা শুনেছি যে, স্বর্গস্থ ইন্দ্রাদি দেবতা সহস্র চক্ষু ও নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এবং আমরা স্বপ্নে এইসকল দেবদেবীকে দর্শন করতে পারি। কিন্তু এইসকল অভিজ্ঞতার স্থায়িত্ব শুধুমাত্র স্বপ্নে। জাগ্রত অবস্থায় এইসব অভিজ্ঞতার কোন স্থান নেই। যেমন—স্বপ্নাবস্থায় নিজেকে চতুর্ভুজা বলেও দেখা যেতে পারে। কিন্তু একি সত্য? এর উত্তরে আমরা হয়তো বলব হ্যাঁ। এগুলি সত্য না হলে মানুষ এসবের স্বপ্নই বা দেখে কি করে? এর স্বপক্ষে আরও যুক্তি হল : ‘স্বপ্নের অভিজ্ঞতা যেহেতু মিথ্যা সেহেতু জাগ্রত অভিজ্ঞতাও মিথ্যা।’ এই হেতুবাক্যটি ভুল। যেমন—স্বপ্নে আমি যে আমার চারটি হাত দেখি সেটি মিথ্যা নয়। কিন্তু এই স্বপ্নটি যদি সত্য হয় তবে দুটি অতিরিক্ত হাত এল কোথা থেকে? ঘুমোতে যাবার আগে তো এ দুটি হাত ছিল না। আবার ঘুম ভাঙার পরেও এ দুটি হাত থাকে না। এর অর্থ—অতিরিক্ত হাত দুটি হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছিল এবং নিদ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে তা অন্তর্হিতও হল। এসব কি আপনিই ঘটতে পারে? হাত দুটি কি কখনো নিজ ইচ্ছায় গজিয়ে ওঠে? হাত দুটির কি তবে নিজ ইচ্ছা বলে কিছু আছে? সুতরাং সমস্ত ভাবনাটাই উদ্ভট।

তবে এ ঘটনার ব্যাখ্যা কি? এর ব্যাখ্যা হল—স্বপ্নের প্রকৃতিই এইরকম। স্বপ্নে অসম্ভবও সম্ভব হয় এবং তা ঘটে ব্যক্তির প্রয়াস ছাড়াই। স্বপ্ন যেন ব্যক্তির সুপরিচিত পথ, আর সেই পথ ধরে ব্যক্তি কোন স্থানে চলে যায়, এবং সেখানে নানা মনোহর বস্তু দেখে। স্বপ্ন এইরকমই।

ভালোই হোক আর মন্দই হোক স্বপ্ন স্বপ্নই। স্বপ্ন মিথ্যা। একইভাবে জাগ্রত অবস্থাও স্বপ্নের মতোই মিথ্যা।

স্বপ্নবৃত্তাবপি ত্বন্তশ্চেতসা কল্পিতং ত্বসৎ।

বহিশ্চেতোগৃহীতং সদ্‌দৃষ্টং বৈতথ্যমেতয়োঃ॥৯

অন্বয়: স্বপ্নবৃত্তৌ অপি তু (স্বপ্নাবস্থাতেও); অন্তঃ (ভেতরে); চেতসা (মনের দ্বারা); কল্পিতম্ (কল্পিত); তু (অবশ্যই); অসৎ (মিথ্যা); বহিঃ (বাইরে [স্বপ্নাবস্থায়]); চেতোগৃহীতম্ (মনে অনুভূত); সৎ (সত্য); এতয়োঃ (এই দুই-ই); বৈতথ্যম্ (মিথ্যারূপে); দৃষ্টম্ (দৃষ্ট হয়)।

সরলার্থ: স্বপ্নাবস্থায় আমরা যেসব জিনিস দেখি তা মনের সৃষ্টি। সে সবই মিথ্যা। আমরা মনে করি জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা দেখি তা সত্য। আমরা এই দুই অবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্যে যে ভেদ কল্পনা করি তাও ভুল। স্বপ্ন ব্যাপারটিই মিথ্যা হওয়ার দরুন এর মাধ্যমে আমাদের যা কিছু অভিজ্ঞতা হয়, সেগুলিকে সত্য বা মিথ্যা যা বলেই মনে করি না কেন আসলে তা সবই মিথ্যা।

ব্যাখ্যা: জাগ্রত অবস্থায় বহির্জগতে আমরা বহু বস্তু দেখি এবং সেগুলিকে আমরা সত্য বলে মনে করি। আবার আমরা মনে মনে নানা চিন্তা নানা কল্পনা করে থাকি কিন্তু সেগুলিকে আমরা সত্য বলে মনে করি না। গৌড়পাদ এখানে বলছেন আমাদের স্বপ্নের অভিজ্ঞতা আমাদের জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতার মতোই। যখন আমরা স্বপ্ন দেখি তখন আমরা বাইরের জগতেরও অনেক বস্তুকে দেখে থাকি। যেমন আমরা স্বপ্নে দেখি যে আমরা কারও সাথে কথা বলছি অথবা স্বপ্নে পর্বত, নদী, হাতি ইত্যাদি নানা জিনিস দেখে থাকি। আবার আমরা এমন স্বপ্নও দেখি যে আমরা কিছু চিন্তা করছি এবং একথাও জানি এসব স্বপ্ন সত্য নয়। যখন জেগে উঠি তখন বুঝি স্বপ্নের সমস্তটাই মিথ্যা। গৌড়পাদ বলছেন যে, আমরা বস্তুকে বাইরে বা ভেতরে যেভাবেই দেখি না কেন দুই শ্রেণীর অভিজ্ঞতাই মিথ্যা। স্বপ্ন মিথ্যা হলে সেই স্বপ্নে যা কিছু দেখি, অনুভব করি বা কল্পনা করি—সে সবই মিথ্যা।

জাগ্রদ্‌বৃত্তাবপি ত্বন্তশ্চেতসা কল্পিতং ত্বসৎ।

বহিশ্চেতোগৃহীতং সদ্যুক্তং বৈতথ্যমেতয়োঃ॥১০

অন্বয়: জাগ্রদ্‌বৃত্তৌ অপি তু (জাগ্রত অবস্থাতেও); অন্তঃ (দেহের অভ্যন্তরে); চেতসা কল্পিতম্ (মনের সৃষ্ট বস্তুসমূহ); তু অসৎ (অবশ্যই মিথ্যা); বহিঃ (দেহের বাইরে); চেতোগৃহীতম্ (চোখ এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভূত); সৎ (সত্যরূপে); এতয়োঃ ([যে] এই উভয়ই); বৈতথ্যং যুক্তম্ (মিথ্যা—একথা যুক্তিযুক্ত)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থাতেও আমরা নানারকম কল্পনা করে থাকি। আমরা জানি এ সবই মিথ্যা। কিন্তু বাহ্যজগতে বস্তুকে দেখতে পাই বলে আমরা সেগুলিকে সত্য বলে মনে করি। কিন্তু এই দুই অভিজ্ঞতাই মিথ্যা। যুক্তি দ্বারা এ সিদ্ধান্তটি সমর্থনযোগ্য।

ব্যাখ্যা: পূর্ববর্তী শ্লোকের মতো এখানেও গৌড়পাদ বলছেন যে, জাগ্রত অবস্থাতেও মানুষ নানা কল্পনা করে। যেমন, আমি হয়তো ভাবছি আমি ইংল্যাণ্ড যাচ্ছি। এটা কি সত্য? না, আমি জানি এ আমার শুধুই কল্পনা, হঠাৎ মনে ওঠা চিন্তামাত্র। আবার আমার অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতাও আছে। যেমন আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি। গৌড়পাদ এখানে বলছেন যে, একথা যুক্তির দ্বারা প্রমাণিত আমার জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতা স্বপ্ন অবস্থার অভিজ্ঞতার মতোই মিথ্যা। এখন আপত্তি উঠতে পারে : ‘আমি কল্পনা করছি আমি ইংল্যাণ্ড যাচ্ছি, কিন্তু আমি জানি যে একথা সত্য নয়। আসলে আমি কোথাও যাচ্ছি না। কিন্তু আমি হয়তো কারও সাথে কথা বলছি তবে তাকে মিথ্যা বলব কেমন করে?’ গৌড়পাদ বলছেন যে, আমাদের উভয় অভিজ্ঞতারই আরম্ভ ও শেষ আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় আমার কাছে এই বাহ্য জগতের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। আবার জাগ্রত অবস্থায় আমি হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে আছি তখন আমার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি হয়তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না। অনেক সময়ে একথা বলা হয় এ জগৎ মনেরই সৃষ্টি। আমার মনই তোমাকে সৃষ্টি করেছে। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি কিন্তু তোমাকে তোমার স্বরূপে দেখি না। তোমার উপস্থিতি আমার কল্পনাকে নাড়া দিয়ে যায় মাত্র। তখন আমার মন সেই কল্পনা অনুযায়ী তোমাকে সৃষ্টি করে। তোমার উপস্থিতি এখানে উদ্দীপকের কাজ করে। অর্থাৎ এটি আমাকে কল্পনা করতে সাহায্য করে—এইমাত্র।

উভয়োরপি বৈতথ্যং ভেদানাং স্থানয়োর্যদি।

ক এতান্ বুধ্যতে ভেদান্ কো বৈ তেষাং বিকল্পকঃ॥১১

অন্বয়: যদি উভয়োরপি স্থানয়োঃ (যদি জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থাতে); ভেদানাম্ (বিভিন্ন বস্তু); বৈতথ্যম্ (মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়); কঃ (কে); এতান্ ভেদান্ (এইসব বস্তুকে); বুধ্যতে (প্রত্যক্ষ করে); কঃ বৈ (কে আবার); তেষাং বিকল্পকঃ (সেগুলি চিন্তা করে)।

সরলার্থ: যদি জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থাই মিথ্যা হয় তবে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্পর্ক বলে কিছু থাকতে পারে না। আবার এই দুই অবস্থায় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাসমূহ যদি মিথ্যা হয় তবে সে অভিজ্ঞতার স্রষ্টাই বা কে?

ব্যাখ্যা: এখানে ‘ভেদ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে এর অর্থ হল বস্তু। কিন্তু এর আক্ষরিক অর্থ ‘পৃথকীকরণ’। এখন আমরা ভেদ অর্থাৎ দুই দেখছি বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধীরে ধীরে আমরা অভেদ অর্থাৎ একের দিকেই এগোচ্ছি। এখন প্রশ্ন হল কে এই ব্যক্তি যিনি এইসব বস্তুকে দেখে এবং সেগুলিকে অসত্য বলে মনে করে। যদি বলা যায় এই জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থাই মিথ্যা তবে স্বপ্নটি দেখছে কে? কার নিদ্রাভঙ্গ হচ্ছে? এইসব বস্তু কার অভিজ্ঞতার অঙ্গ? বৌদ্ধদর্শন এবং বেদান্ত এই প্রশ্নের সমাধান করেছেন ভিন্নভাবে। বৌদ্ধদর্শন বলেন যে—আত্মা বলে কিছুই নেই। এঁদের মতে কেউ স্বপ্নও দেখে না আবার কেউ ঘুম থেকে জেগেও ওঠে না। কেবলমাত্র এই অসত্য অভিজ্ঞতাগুলিই আছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত অবশিষ্ট আর কিছুই থাকে না, থাকে শুধুমাত্র শূন্য। কিন্তু বেদান্ত বলেন যদি তুমি বল এ জগৎ মিথ্যা তবে কোন একজনকে থাকতে হবে যিনি এই জগৎকে অস্বীকার করবেন। এই জ্ঞাতাটি (যিনি অস্বীকার করছেন) কে? কর্তা ছাড়া কোনও কর্ম হতে পারে কি? অভিজ্ঞতাপ্রাপক ছাড়া কি অভিজ্ঞতা থাকতে পারে? বেদান্ত বলেন আত্মা রয়েছেন আর এই আত্মাই হলেন ব্রহ্ম। সেই চিরন্তন সত্তা অর্থাৎ ব্রহ্ম হলেন সবকিছুর অধিষ্ঠান বা আশ্রয়।

কল্পয়ত্যাত্মনাঽঽত্মানমাত্মা দেবঃ স্বমায়য়া।

স এব বুধ্যতে ভেদানিতি বেদান্তনিশ্চয়ঃ॥১২

অন্বয়: দেবঃ (স্বয়ং প্রকাশিত); আত্মা (আত্মা [যা শুদ্ধ চৈতন্য]); স্বমায়য়া (নিজ শক্তির দ্বারা [যাকে মায়া বলে]); আত্মনা (নিজের থেকেই); আত্মানম্ (নিজেকে); কল্পয়তি (প্রকাশিত করে [স্রষ্টা এবং সৃষ্টিরূপে]); সঃ এব (সেই অভিন্ন আত্মা); ভেদান্ (বিভিন্ন বস্তু); বুধ্যতে (প্রত্যক্ষ করে); ইতি (এই); বেদান্তনিশ্চয়ঃ (বেদান্তের সিদ্ধান্ত)।

সরলার্থ: আত্মা স্বয়ং প্রকাশিত। এই আত্মা নিজেই তাঁর মায়াশক্তির দ্বারা স্রষ্টা, সৃষ্টি এবং জগৎরূপে নিজেকে প্রকাশিত করেন। আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য ও অদ্বিতীয়, তা সত্ত্বেও মায়ার সাহায্যে বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হন। এটাই হল বেদান্তের সিদ্ধান্ত।

ব্যাখ্যা: সমগ্র জগৎই একটি কল্পনামাত্র। কিন্তু কার কল্পনা? তিনি কে যিনি এই কল্পনা করেন? ইনিই স্বয়ং প্রকাশিত আত্মা। ‘দেবঃ’ শব্দটির অর্থ স্বয়ং জ্যোতি। এই আত্মা জ্যোতিস্বরূপ। নিজ শক্তির সাহায্যে (স্বমায়য়া) আত্মা এই জগৎরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। তিনি সবসময়েই আছেন কিন্তু তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন এইমাত্র। এখন আমরা বহু—যেমন নারী, পুরুষ, পশুপাখি, গাছপালা, গ্রহ-নক্ষত্র অর্থাৎ ভেদ দেখি। কিন্তু আত্মা অভেদ অর্থাৎ আত্মা এক ও অভিন্ন। একথা ঠিক নয় যে এ জগতের অন্য কোন কর্তা আছেন। এ জগতের কর্তা একজনই আর তিনিই হলেন আত্মা বা ব্রহ্ম। ব্রহ্মই নিমিত্ত কারণ, তিনিই স্রষ্টা। আবার ব্রহ্ম হলেন উপাদান কারণ, তিনিই সৃষ্টি। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি অভেদ। ব্রহ্ম নিজ শক্তির দ্বারা এই বৈচিত্রপূর্ণ জগৎ প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু কে এই জগৎকে প্রত্যক্ষ করে? আর এর অভিজ্ঞতা প্রাপকই বা কে? ‘সঃ এব বুধ্যতে’—আত্মা স্বয়ং। এই বৈচিত্রের প্রকাশকও তিনি। তিনি নিজেই বহু হয়েছেন। এটাই হল ‘বেদান্ত-নিশ্চয়ঃ’ অর্থাৎ বেদান্তের সিদ্ধান্ত। এখানে এই সিদ্ধান্তটিতে যেন একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কি যুক্তির সাহায্যে এই সিদ্ধান্তটিকে খণ্ডন করতে সক্ষম? গৌড়পাদ এখানে বলছেন : এই আমার সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তকে খণ্ডন করা যায় না।

মায়াবাদ বেদান্তের এক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এই সৃষ্টিই মায়া। একথাটি কোন্ অর্থে বলা হয়? এই অর্থে বলা হয় যে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ যেন এক জাদুমাত্র। এ-সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন : এ-ব্যাপারে একটি কথাই বলা চলে—এ মায়া। আমি কেমন করে ভাবতে শুরু করলাম আমি এই জগৎ থেকে আলাদা, আমি যেন এই দেহ-মন, রাগ-বিদ্বেষ, সুখ-দুঃখ দ্বারা সীমাবদ্ধ এক ব্যক্তিসত্তা। এইসব ঘটনা কেমন করে যে ঘটল তা আমি নিজেও জানি না। এসবের ব্যাখ্যায় আমি ব্যর্থ। আমরা যে অনুভব করি আমরা বদ্ধ, আমরা পীড়িত, আমরা একে অপরের থেকে আলাদা—স্বামীজীর মতে এ এক অনস্বীকার্য ঘটনা। হতে পারে এটা ভুল কিন্তু যেভাবেই হোক এই উপরোক্ত বোধ আমার মধ্যেই থাকে। বেদান্তের মতে আমরা যেন সম্মোহিত হয়ে আছি। জ্ঞাতা-জ্ঞেয়র ধারণা, তুমি-আমির ধারণা এ সবই সম্মোহনের ফল। একেই বলা হয় মায়া।

বিকরোত্যপরান্‌ভাবানন্তশ্চিত্তে ব্যবস্থিতান্।

নিয়তাংশ্চ বহিশ্চিত্ত এবং কল্পয়তে প্রভুঃ॥১৩

অন্বয়: প্রভুঃ (অন্তরস্থ ঈশ্বর); অন্তঃ (দেহের অভ্যন্তরে); চিত্তে (মনে); ব্যবস্থিতান্ (বিদ্যমান কামনাসমূহ); অপরান্ (অন্য); ভাবান্ (বস্তুসকল); বিকরোতি (নানারূপে প্রকাশিত); এবং (আবার); বহিশ্চিত্তঃ (বাইরে দৃষ্টিপাত করে [বাইরে নিজেকে প্রকাশ করে]); নিয়তান্ (আপেক্ষিকভাবে স্থায়ী বস্তু [যেমন জগৎ]); চ (এবং বস্তুসমূহ যা অস্থায়ী [যেমন—প্রত্যক্ষ অনুভূতি]); কল্পয়তে (প্রকাশ করেন)।

সরলার্থ: আত্মা মনোমধ্যে স্থিত এবং চিন্তা ও কামনা-বাসনার মধ্য দিয়ে ইনি নিজেকে প্রকাশিত করেন। ক্ষণস্থায়ী (যেমন বিদ্যুৎ), এবং আপেক্ষিক স্থায়ী (যেমন এই জগৎ)—এই উভয় অবস্থার বস্তুসকলের মধ্য দিয়ে আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন।

ব্যাখ্যা: আত্মা নিজেই বহু হয়েছেন। নিজেকে তিনি নানাভাবে প্রকাশ করেন। ‘বি’ অর্থ বহু বা বিচিত্র। এই জগতে দৃশ্যবস্তু দুই প্রকারের—বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ, ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তু। ‘নিয়তান্’ হল প্রকাশিত বস্তু আর ‘অনিয়তান্’ হল অপ্রকাশিত বস্তু যা অব্যক্ত। আমাদের অন্তর্জগৎই নানা চিন্তা নানা কল্পনার উৎস। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সমগ্র জগৎ অব্যক্তরূপে আছে। সবকিছুকে আমরা প্রকাশ করতে পারি না। হিমবাহের যেমন শুধুমাত্র উপরিভাগ দেখা যায় ঠিক তেমনি যখন কোন মানুষকে দেখি তখন তার স্বরূপকে আমরা দেখতে পাই না কারণ তার প্রকৃত স্বরূপ তার নিজের মধ্যে লুক্কায়িত। শুধুমাত্র তার দেহ ও সংশ্লিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেই দেখতে পাই।

কিন্তু ব্যক্ত এবং অব্যক্ত এই উভয়ই ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। এ জগৎ দৃষ্টিবিভ্রমমাত্র। একেই বলে মায়া। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দুই অর্থাৎ বৈচিত্রপূর্ণ জগৎকে দেখি ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অজ্ঞানতার শিকার। কিন্তু জ্ঞানীব্যক্তিরা এ জগৎকে ব্রহ্মরূপে দেখেন। এটাই হল প্রকৃত জ্ঞান।

আমাদের যা-কিছু অভিজ্ঞতা তা জ্ঞাতা বা জ্ঞেয় যা সম্পর্কিতই হোক না কেন এ সবেরই উৎস ব্রহ্ম। আমাদের সমস্ত ধারণা ও কল্পনারও উৎস এই ব্রহ্ম। এইভাবেই সবকিছুর মধ্য দিয়ে ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেন। আমি হয়তো কোন শব্দ শুনলাম বা এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে প্রত্যক্ষ করলাম। এখানেও আমার মাধ্যমে আত্মাই অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হন। আমাদের সবকিছুর পেছনে এই ব্রহ্ম রয়েছেন। আমাদের চারপাশের বস্তুর রদবদল তিনিই ঘটাচ্ছেন। এই দৃশ্যমান জগতের পরিকল্পনাও তাঁর। আর সেভাবেই তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন। কুম্ভকার প্রথমে মনে মনে ঘটটিকে তৈরি করেন তারপরে তাকে বাস্তবে রূপ দান করেন। এইভাবে আত্মা মনের ভেতরে এবং বাইরে নিজেকে প্রকাশ করেন।

চিত্তকালা হি যেঽন্তস্তু দ্বয়কালাশ্চ যে বহিঃ।

কল্পিতা এব তে সর্বে বিশেষো নান্যহেতুকঃ॥১৪

অন্বয়: অন্তঃ তু (মনের মধ্যে); যে হি চিত্তকালাঃ (মনগড়া ব্যাপার, এর অস্তিত্ব ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ আমি তার অস্তিত্ব আছে বলে কল্পনা করি); যে চ (আর ঐসব বস্তু); বহিঃ (বাইরে); দ্বয়কালাঃ (যতক্ষণ তাদের অস্তিত্ব থাকে এবং আমি তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকি); তে সর্বে এব কল্পিতাঃ (আন্তর এবং বাহ্য উভয় প্রকার বস্তুই কল্পনাপ্রসূত); অন্যহেতুকঃ বিশেষঃ ন ([জাগ্রত ও স্বপ্নের অভিজ্ঞতার মধ্যে] পার্থক্যের কোনও যুক্তি নেই)।

সরলার্থ: মনের মধ্যে কোন বস্তুর অস্তিত্ব ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ বস্তুটি আছে বলে আমরা কল্পনা করি। বহির্জগতেও কোন বস্তুর অস্তিত্ব ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ আমরা বস্তুটি সম্পর্কে সচেতন থাকি। এই সবকিছুই মিথ্যা। এ দুই অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনরকম পার্থক্য আছে ভাবাই অযৌক্তিক।

ব্যাখ্যা: একথা সহজেই বোঝা যায় যে মনের মধ্যে আমরা যা দেখি তা ক্ষণস্থায়ী। ওগুলি মনেরই সৃষ্টি। ঐসব বস্তুর স্থায়িত্ব ততক্ষণই যতক্ষণ আমরা বস্তুটি আছে বলে কল্পনা করি। সুতরাং সেগুলি মিথ্যা—একথা মেনে নিতে পারি। কিন্তু গৌড়পাদ দাবি করছেন যে—আমাদের জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাও মিথ্যা। কিন্তু আবার এমন সব অভিজ্ঞতাও আছে যা ক্ষণিকের নয়; সেই অতীতকাল থেকে এখনও পর্যন্ত যাদের অস্তিত্ব আছে সেগুলিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেব কেমন করে?

গৌড়পাদ বলছেন যে, এইসব অভিজ্ঞতা দীর্ঘকাল ধরে থাকতে পারে কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে এইসব অভিজ্ঞতা সত্য। এগুলি সত্য নয় কারণ এগুলি অন্যের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ একটি ঘটনা অন্য আর একটি ঘটনার উপর নির্ভরশীল। এই ধরনের পর-নির্ভরশীল অভিজ্ঞতা কখনো সত্য হতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যাক, দেবদত্ত গরুর দুধ দুইছে। দেবদত্তের অস্তিত্ব ততক্ষণই আছে যতক্ষণ সে দুধ দুইছে। দোহনকার্য ততক্ষণই চলে যতক্ষণ দেবদত্ত সেখানে উপস্থিত। এইভাবে দেখা গেল যে, দেবদত্ত ও দোহনকার্য একে অপরের উপর নির্ভরশীল। একটি ব্যর্থ হলে অন্যটিও ব্যর্থ। এরা একে অপরের দ্বারা সীমাবদ্ধ। সুতরাং এগুলি কখনো সত্য হতে পারে না। কালের একটি বিশেষ মুহূর্তে এগুলি সত্য বটে কিন্তু মুহূর্তটির আগে ও পরে এগুলি সত্য নয়। যেহেতু এগুলি সবসময়ের জন্য সত্য নয় সেহেতু এগুলি মিথ্যা।

অব্যক্তা এব যেঽন্তস্তু স্ফুটা এব চ যে বহিঃ।

কল্পিতা এব তে সর্বে বিশেষস্ত্বিন্দ্রিয়ান্তরে।১৫

অন্বয়: অন্তঃ (মনে); যে অব্যক্তা এব (মনগড়া বস্তুর ছদ্মবেশে কামনা-বাসনা); বহিঃ (মনের বাইরে); যে চ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসকল); স্ফুটাঃ (স্পষ্টতই দৃষ্ট); তে সর্বে এব (ওগুলি সব); কল্পিতাঃ (মনের কল্পনাপ্রসূত); ইন্দ্রিয়ান্তরে তু বিশেষঃ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিসকল পরিবর্তনশীল)।

সরলার্থ: আমাদের মনে বহু বাসনা থাকে যদিও সেগুলি অস্পষ্ট কল্পনামাত্র। বহির্জগতের বস্তুগুলি খুবই স্পষ্ট হতে পারে। কিন্তু এ সবই কল্পনাপ্রসূত। আমরা যে এই বস্তুগুলিকে বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করি তারজন্য ইন্দ্রিয়গুলিই দায়ী।

ব্যাখ্যা: কোন একটি অবস্থায় ব্যক্তি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। এই সময়ে সে দেখে, শোনে বা আহার করে। বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তার এইসব অভিজ্ঞতা হয়। আবার মনের দ্বারাও সে বস্তুর অভিজ্ঞতা লাভ করে। সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে কিংবা জাগ্রত অবস্থাতেই মনে মনে কোন চিন্তা বা কল্পনা করছে। সাধারণত এই মানস কল্পনাগুলি খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু কোন কোন সময়ে আমাদের কল্পনা এতই স্পষ্ট ও জোরালো হয় যে সেগুলিকে প্রায় সত্য বলেই মনে হয়। যেমন আমরা কল্পনা করতে পারি আমরা কাশীতে মন্দির দর্শন করতে গেছি এবং সেখানে একাকী গঙ্গার ঘাটে বেড়াচ্ছি। আমরা মনে মনে এইসব বস্তুকে কত স্পষ্টভাবে দেখছি, তবুও সেগুলি কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই অভিন্ন আত্মাই এইসব অবস্থার মধ্য দিয়ে নানা অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হন। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হল এইসব অভিজ্ঞতা হয় কখনো বহিরিন্দ্রিয়ের দ্বারা কখনো বা মনের দ্বারা। যখন স্বপ্ন দেখি তখনও আমি কিন্তু সেই একই ব্যক্তি যে একটু আগেই জেগে ছিল। গৌড়পাদ বলছেন যে বাহ্য বা অভ্যন্তরীণ উভয় অভিজ্ঞতাই কল্পনাপ্রসূত, মিথ্যা এবং অনিত্য।

জীবং কল্পয়তে পূর্বং ততো ভাবান্ পৃথগ্‌বিধান্।

বাহ্যানাধ্যাত্মিকাংশ্চৈব যথাবিদ্যস্তথাস্মৃতিঃ॥১৬

অন্বয়: পূর্বম্ (প্রথম); জীবম্ (আমি কর্তা এই বোধ); কল্পয়তে (এইভাবে আত্মা অনুভব করেন); ততঃ (তারপরে); বাহ্যান্ (বাহ্যবস্তু); আধ্যাত্মিকান্ চ (অন্তরে সুখ-দুঃখের বোধ); পৃথগ্‌বিধান্ (বিভিন্ন প্রকার); ভাবান্ (বস্তুসমূহ); যথা বিদ্যাঃ (তার প্রত্যক্ষ অনুভূতি অনুযায়ী); তথা স্মৃতিঃ (সে মনে করে)।

সরলার্থ: প্রথমে জীবাত্মা কল্পনা করে। সে অনুভব করে এবং বলে ‘আমিই কর্তা’ (আমি সুখী, আমি দুঃখী ইত্যাদি)। এরপর সে কল্পনা করে শব্দের মতো বাহ্যবস্তুগুলিকে ও প্রাণের মতো অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বস্তুকে। জীবাত্মা তার নিজ কল্পনা অনুযায়ী বস্তুকে উপলব্ধি করে থাকে।

ব্যাখ্যা: প্রথমে পরমাত্মা নিজেকে জীবাত্মা বলে কল্পনা করেন। এ যেন রজ্জুতে সর্পভ্রম। এ ভুল থেকেই ক্রমে এইরকম চিন্তা আসে : ‘আমি এটি করেছি, আমি সুখী ইত্যাদি।’ বস্তুত এইসব গুণাবলী কাল্পনিকভাবে নিজের উপরে আরোপ করে। আত্মা স্বরূপত নির্গুণ।

একটি ভুল থেকেই অন্য ভুলের উৎপত্তি। পরমাত্মা নিজেকে জীবাত্মা বলে মনে করলে তখন তাঁর বহির্জগতে ও অন্তর্জগতে কল্পনার অন্ত থাকে না। এইসব বস্তুসকলের মধ্যে কোনটা কারণ আর কোনটা কার্য। কার্য কারণের অনুগামী, আবার কারণ কার্যের অনুগামী। এর কার্যপ্রণালী এইরকম : ধরা যাক, তুমি কিছু মিষ্টি খাচ্ছ এবং সেগুলি তোমার কাছে অতি উপাদেয় বলে মনে হচ্ছে। এখানে মিষ্টি হল কারণ আর সেগুলিকে যে উপাদেয় বলে মনে হচ্ছে তা হল কার্য। আবার যেহেতু মিষ্টি তোমার কাছে উপাদেয়, সেহেতু তুমি মিষ্টি খেতেও চাও এবং মিষ্টি খাও। এখানে কার্য কারণে এবং কারণ কার্যে পরিণত।

কিন্তু এটা হল বাহ্য জগতের ব্যাপার। ঠিক একই ব্যাপার আমরা মানসিকভাবেও উপলব্ধি করতে পারি। আমার মিষ্টি খাওয়ার স্মৃতি রয়েছে এবং এই স্মৃতির জন্যই আমি মিষ্টি খেতে চাই এবং মিষ্টি খাই।

এইভাবে বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ বস্তুর পরস্পরের প্রভাবের ফলে জীবাত্মা নিজ মনোসৃষ্ট বিষয়সমূহের দাস হয়ে পড়ে।

অনিশ্চিতা যথা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা।

সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদ্বদাত্মা বিকল্পিতঃ॥১৭

অন্বয়: অন্ধকারে অনিশ্চিতা (অন্ধকারে অনিশ্চিত); রজ্জুঃ (দড়ি); সর্পধারাদিভির্ভাবৈঃ (সাপ, জলধারা বা এই ধরনের অন্যান্য বস্তুর মতো); বিকল্পিতা (ভুল ধারণা করা হয় [পৃথক বস্তু হিসাবে]); তদ্বৎ (একইভাবে); আত্মা (পরমাত্মা); বিকল্পিতঃ ([জীবাত্মারূপে যিনি সুখ-দুঃখ ইত্যাদি নানা অভিজ্ঞতা লাভ করেন] কল্পনা করা হয়)। সরলার্থ: অন্ধকার জায়গায় কোন দড়ি দেখে আমরা অনেক সময়ই সাপ বা জলধারা বা এই ধরনের কোন বস্তু বলে ভুল করে থাকি। এ সবই আমাদের মনের ভুল। ঠিক একইভাবে, আমরা পরমাত্মাকে (যিনি শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ) কর্তা হিসাবে অথবা আমাদেরই মতো সুখী বা দুঃখী ব্যক্তি বলে মনে করে থাকি। কিন্তু এও আমাদের মনের ভুল।

ব্যাখ্যা: আমরা এরকম ভুল করি কেন? আমরা ব্রহ্মকে দেখতে পাই না কেন? আমরা পুরুষ, স্ত্রী, পশুপাখি, গাছপালা ইত্যাদি নানারকমের জিনিস দেখতে পাই। কিন্তু আমরা আত্মাকে দেখতে পাই না কেন? এখানে গৌড়পাদ বলছেন, ধরা যাক, অন্ধকার রাস্তায় একটি দড়ি পড়ে আছে। আমি ওটাকে দড়ি বলে চিনতে পারছি না। মনে করছি ওটা সাপ বা ঐ জাতীয় কোন কিছু। ঠিক একইভাবে, অজ্ঞানতার অন্ধকারের জন্য আমরা আমাদের নিজ আত্মাকে দেখতে পাই না।

নিশ্চিতায়াং যথা রজ্জ্বাং বিকল্পো বিনিবর্ততে।

রজ্জুরেবেতি চাদ্বৈতং তদ্বদাত্মবিনিশ্চয়ঃ॥১৮

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); রজ্জুঃ এব (এটি দড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়); নিশ্চিতায়াম্ (যখন স্থির হল); রজ্জ্বাম্ (দড়ির উপরে); বিকল্পঃ (এটা সাপ বা ঐ জাতীয় অন্য কিছু বলে মনে করা); বিনিবর্ততে (পুরোপুরি অস্বীকার করা); অদ্বৈতম্ ([তারপর যা বাকী থাকে] একটিমাত্র বস্তু [অর্থাৎ দড়িটি]); তদ্বৎ (একইভাবে [অর্থাৎ শাস্ত্রপাঠের দ্বারা যখন অজ্ঞানতা দূর হয়]); আত্মা বিনিশ্চয়ঃ (তখন তুমি তোমার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত [অর্থাৎ তুমিই পরমাত্মা])।

সরলার্থ: সেখানে দড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই, কিন্তু অন্ধকারের জন্য আমরা দড়িকে সাপ বলে মনে করছি। আলো এলেই আমরা বুঝতে পারি ওটা সাপ নয় আসলে দড়ি। ঠিক একইভাবে শাস্ত্রপাঠের দ্বারা নিজ স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের যে অজ্ঞানতা তা দূর হয়। তখন আমরা উপলব্ধি করি আমরাই পরমাত্মা (যা নিত্যমুক্ত, এবং জন্মমৃত্যুরহিত)।

ব্যাখ্যা: আমরা কখনো কখনো অন্ধকার জায়গায় পড়ে থাকা দড়িকে সাপ বলে ভুল করে থাকি। কিন্তু আলো নিয়ে এলে আমরা দেখি সেখানে আদৌ কোন সাপ ছিল না। আসলে ওটা একটা দড়ি।

একইভাবে, আমরা সংসারজালে বদ্ধ, একথা মনে করাও ভুল। আমরা আমাদের এই দেহটাকে ‘আমি’ বলে মনে করি এবং ভাবি আমরা পরিবেশের দাস। আমরা তাই সবসময় মৃত্যুভয়ে তাড়িত।

এই মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হল শাস্ত্রপাঠ এবং অনিত্য বস্তুকে ত্যাগ করা। এই অভ্যাসের ফলে ক্রমে আমার মধ্যে এই জ্ঞানের উদয় হয় যে, আমি জীবাত্মা নই, পরমাত্মা। তখন নিখিল জগতের সাথে আমি একাত্মতা অনুভব করে থাকি। তখন আমিই সকলের অন্তরাত্মা। আমার কখনো জন্ম হয়নি, আবার আমার মৃত্যুও হবে না। ‘আমি’ নিত্য, মুক্ত, সর্বব্যাপী ও সর্বজ্ঞ।

সূর্য উদয় হলে আর কোন অন্ধকার থাকে না। ঠিক সেইরকম, যখন আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করি তখন আমাদের সকল ভুলভ্রান্তির নাশ হয়। আমরা তখন উপলব্ধি করি আমরা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছু নই।

প্রাণাদিভিরনন্তৈশ্চ ভাবৈরেতৈর্বিকল্পিতঃ।

মায়ৈষা তস্য দেবস্য যযায়ং মোহিতঃ স্বয়ম্॥১৯

অন্বয়: এতৈঃ (এইসব); প্রাণাদিভিঃ (প্রাণ [প্রাণবায়ু] ইত্যাদি); অনন্তৈঃ ভাবৈঃ (অসংখ্য বস্তু); বিকল্পিতঃ (কল্পনা করা হয়েছে); তস্য দেবস্য (সেই স্বয়ং প্রকাশিত আত্মার); এষা মায়া (মায়ার এই মোহিনীশক্তি); যযা অয়ং স্বয়ং মোহিতঃ (যার দ্বারা আত্মা নিজেকেই মুগ্ধ করে)।

সরলার্থ: এই আত্মা অদ্বিতীয়। এই আত্মাকে প্রাণ ইত্যাদি বহু রূপে কিভাবে দেখা যায়? এটি সম্ভব হয় আত্মার নিজ শক্তি অর্থাৎ মায়ার প্রভাবে। বহু বস্তুকে দেখা ঠিক দেখা নয়। এ আমাদের মনের ভুল। এক আত্মাই নিজ শক্তি অর্থাৎ মায়ার প্রভাবে বহু হয়েছেন। বহু এই একের উপরই অর্থাৎ ‘আত্মার’ উপরই আরোপিত। আত্মা যেন নিজ মায়াতে নিজেই মুগ্ধ।

ব্যাখ্যা: যদি একথা সত্য হয় যে, আত্মা এক ও অদ্বিতীয়, তবে এই আত্মা নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করেন কিভাবে? কেমন করেই বা একমাত্র আত্মাকে আমরা আমাদের চারপাশের নানা বস্তুরূপে দেখতে পাব? উত্তরে বলা যায় এ মায়ার দ্বারাই সম্ভব হয়। মায়া স্বয়ংপ্রকাশিত চৈতন্যস্বরূপ আত্মারই শক্তি। যাদুকর নানা কৌশলে যাদু দেখায়। যেমন সে হয়তো শূন্যে বাগানও তৈরি করতে পারে। এ আমাদের মনের ভুল। কিন্তু যখন আমরা খেলাটা দেখি তখন এটাকে ভুল বলে মনে হয় না। সেইভাবে আত্মা আমাদের চারপাশের নানা বস্তুরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। আর এই কাজটি তিনি তাঁর নিজ মায়াশক্তির সাহায্যেই করেন। আত্মা যেন নিজ মায়াতে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আছেন। ভগবদ্‌গীতা বলছেন (৭।১৪) : ‘আমার মায়াশক্তিকে অতিক্রম করা কঠিন।’

প্রাণ ইতি প্রাণবিদো ভূতানীতি চ তদ্বিদঃ।

গুণা ইতি গুণবিদস্তত্ত্বানীতি চ তদ্বিদঃ॥২০

অন্বয়: প্রাণবিদঃ (সমষ্টি মন—হিরণ্যগর্ভের যাঁরা উপাসক [অর্থাৎ যাঁরা বৈশেষিক মতবাদী]); প্রাণ ইতি (পরমাত্মাকেই প্রাণ অথবা হিরণ্যগর্ভ [ঈশ্বরও] বলে মনে করেন); ভূতানি ইতি চ তদ্বিদঃ (জড়বাদীরা অর্থাৎ যাঁরা লোকায়ত উপাদানসমূহকে [যথা ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম] একমাত্র সত্য বলে মনে করেন); গুণবিদঃ (সাংখ্যরা); গুণাঃ ইতি (বিশ্বাস করেন তিনটি গুণ [সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ] দিয়ে আত্মার সৃষ্টি); তত্ত্বানি ইতি চ তদ্বিদঃ (শৈবরা এই জগতের কারণ হিসাবে আত্মা, অবিদ্যা [অজ্ঞানতা বা মায়া] ও শিবকে উপাসনা করে থাকেন)।

সরলার্থ: যাঁরা হিরণ্যগর্ভকে উপাসনা করেন তাঁরা মনে করেন আত্মাই হিরণ্যগর্ভ। বৈশেষিক দার্শনিকরা মনে করেন, ঈশ্বরই আত্মা এবং তিনি এই বিশ্বের স্রষ্টা। জড়বাদী অর্থাৎ লোকায়ত দার্শনিকদের মতে ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও বায়ু এই চারটি দ্বারাই এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। আবার সাংখ্যের মতে, সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিনটি গুণই হল আত্মার উপাদান। আর শৈবরা বিশ্বাস করেন শিব, অবিদ্যা এবং আত্মাই হল জগতের মূল।

পাদা ইতি পাদবিদো বিষয়া ইতি তদ্বিদঃ।

লোকা ইতি লোকবিদো দেবা ইতি চ তদ্বিদঃ॥২১

অন্বয়: পাদাঃ ইতি পাদবিদঃ (যাঁরা পাদে বিশ্বাসী [পাদ অর্থাৎ পরমাত্মার তিন অবস্থা—বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞ] তাঁরা পাদকেই সত্য বলে মনে করেন); বিষয়াঃ ইতি তদ্বিদঃ (বাৎসায়ন ও তাঁর অনুগামীরা বিশ্বাস করেন জড়বস্তুই সত্য); লোকাঃ (তিন লোকই [ভূ, ভুবঃ এবং স্বঃ] সত্য); ইতি লোকবিদঃ (পুরাণ-বিশ্বাসীদের মতে); দেবাঃ ইতি চ তদ্বিদঃ (যাঁরা দেবদেবীতে বিশ্বাসী, তাঁদের মতে দেবদেবীই সত্য)।

সরলার্থ: যাঁরা পাদ অর্থাৎ অবস্থায় বিশ্বাসী, তাঁরা পাদকেই সত্য বলে মনে করেন। তাঁরা বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞ এই তিন রূপে আত্মাকে গ্রহণ করেন। আবার আর একদল মানুষ জড়বস্তুকেই সত্য বলে মনে করেন। তাঁরা বাৎসায়ন প্রতিষ্ঠিত দর্শনে বিশ্বাসী। আর এক শ্রেণীর চিন্তাবিদরা বলেন পুরাণই সত্য। তাঁদের মতে ভূ, ভুবঃ এবং স্বঃ এই তিন লোকই সত্য। আরও এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যাঁরা দেবদেবীর পূজা করেন এবং দেবদেবীকেই সত্য বলে মনে করেন।

বেদা ইতি বেদবিদো যজ্ঞা ইতি চ তদ্বিদঃ।

ভোক্তেতি চ ভোক্তৃবিদো ভোজ্যমিতি চ তদ্বিদঃ॥২২

অন্বয়: বেদবিদঃ বেদাঃ ইতি যাঁরা বেদ বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেন বেদই সর্বশ্রেষ্ঠ); যজ্ঞাঃ ইতি তদ্বিদঃ (যাঁরা যাগযজ্ঞ [কর্মযজ্ঞ] করেন তাঁরা যাগযজ্ঞকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন); ভোক্তেতি চ ভোক্তৃবিদঃ (সাংখ্যদের মতে আত্মা কোন কিছুই করেন না অর্থাৎ কোন কিছুই ভোগ করেন না); ভোজ্যম্ ইতি তদ্বিদঃ (পাচক বিশ্বাস করেন খাদ্যবস্তু খাওয়ারই জন্য)।

সরলার্থ: যাঁরা বেদপাঠে অনুরাগী ও অভ্যস্ত তাঁরা বেদকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। যাঁরা যাগযজ্ঞ (অর্থাৎ কর্মযজ্ঞ) করেন তাঁরা যাগযজ্ঞকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। আবার সাংখ্যরা বলেন, আত্মা কোন কিছু করেন না। অর্থাৎ আত্মা কর্তা, ভোক্তা নন। (তাঁদের ভাষায় আত্মা পুরুষ এবং পুরুষ সাক্ষীমাত্র।) পাচকরা বলেন খাদ্যবস্তু তো খাওয়ারই জন্য। (পাচকের মতো, অনেক মানুষই মনে করেন জীবন শুধুমাত্র ভোগের জন্য।)

সূক্ষ্ম ইতি সূক্ষ্মবিদঃ স্থূল ইতি চ তদ্বিদঃ।

মূর্ত ইতি মূর্তবিদোঽমূর্ত ইতি চ তদ্বিদঃ॥২৩

অন্বয়: সূক্ষ্মবিদঃ সূক্ষ্মঃ ইতি (কিছু মানুষ মনে করেন আত্মা অণুর মতোই ছোট); স্থূলঃ ইতি তদ্বিদঃ (অন্যেরা মনে করেন আত্মা আমাদের শরীরের মতোই বড় [এঁরা জড়বাদী]); মূর্তঃ ইতি মূর্তবিদঃ (অন্য আর এক গোষ্ঠী মনে করেন সাকার উপাসনাই পরম সত্য [যেমন, শৈবদের মতে পরম সত্য যেন শিব, যিনি ত্রিশূলধারী ও ষাঁড়ের উপর বসে আছেন]); অমূর্তঃ ইতি তদ্বিদঃ (আবার আর একদল মানুষ মনে করেন পরম সত্য হল শূন্য [এঁরা শূন্যবাদী])।

সরলার্থ: কিছু মানুষ মনে করেন, আত্মা খুবই সূক্ষ্ম, যেন একটি অণু। আবার অনেকের মতে আত্মা স্থূলস্বভাবের। তাঁদের মতে আমাদের এই শরীরই আত্মা এবং শরীরই পরম সত্য। এঁরা লোকায়ত দার্শনিক বা জড়বাদী। অপর আর এক গোষ্ঠী মনে করেন পরম সত্য হল তাঁদের উপাস্য দেবদেবী, যেমন শিব—যাঁর হাতে ত্রিশূল ও যিনি ষাঁড়ের উপর বসে আছেন। আবার এমন ব্যক্তিও আছেন যাঁরা পরম সত্যকে নিরাকার (দেহহীন), নির্গুণ (গুণ বা উপাধিবিহীন) বলে মনে করেন। তাঁদের কাছে পরম সত্য কিছুই নয়, শূন্যমাত্র।

কাল ইতি কালবিদো দিশ ইতি চ তদ্বিদঃ।

বাদা ইতি বাদবিদো ভুবনানীতি তদ্বিদঃ॥২৪

অন্বয়: কালঃ ইতি কালবিদঃ (জ্যোতির্বিদদের মতে কালই পরম সত্য); দিশঃ ইতি তৎ বিদঃ (মানুষের শ্বাসক্রিয়া দেখে যাঁরা তাঁদের ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন, তাঁরা মনে করেন এই জ্যোতির্বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান); বাদাঃ ইতি বাদবিদঃ (যাঁরা শব্দের শক্তিতে বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেন শব্দই শ্রেষ্ঠ); ভুবনানি ইতি তৎ বিদঃ (যাঁরা [চতুর্দশ] লোক নিয়ে অধ্যয়ন করেন তাঁরা তাঁদের বিষয়কেই শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেন)।

সরলার্থ: জ্যোতির্বিদরা মনে করেন কালই পরম সত্য। আবার এমন সব মানুষও আছেন যাঁরা মানুষের শ্বাসক্রিয়ার ধরন দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। তাঁদের মতে জ্যোতিষই হল শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান। আবার এমন মানুষও আছেন যাঁরা শব্দের শক্তিতে বিশ্বাসী। তাঁরা শব্দকেই বিজ্ঞান হিসাবে পড়াশুনো করেন। এবং তাঁদের মতে এই শব্দ বিজ্ঞানই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আবার কিছু মানুষ এই চতুর্দশ লোক নিয়ে পড়াশুনো করেন। তাঁরা বলেন, অন্য সব বিদ্যার মধ্যে তাঁদের বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ।

মন ইতি মনোবিদো বুদ্ধিরিতি চ তদ্বিদঃ।

চিত্তমিতি চিত্তবিদো ধর্মাধর্মৌ চ তদ্বিদঃ॥২৫

অন্বয়: মনোবিদঃ মনঃ ইতি (কোন কোন ব্যক্তি বলেন মনই আত্মা); বুদ্ধিঃ ইতি তৎ বিদঃ (অন্যেরা বলেন বুদ্ধিই আত্মা); চিত্তম্ ইতি চিত্তবিদঃ (কারও [বৌদ্ধদের একাংশের] মতে সবকিছু মনেই রয়েছে, বাইরে নয়); ধর্মাধর্মৌ তৎ বিদঃ (কারও মতে, আমাদের কি করা উচিত আর কি উচিত নয় এ ব্যাপারে বৈদিক বিধিনিষেধই শেষ কথা)।

সরলার্থ: কিছু মানুষের মতে মনই আত্মা। আবার কারও মতে বুদ্ধিই আত্মা। বৌদ্ধদের মধ্যে এক গোষ্ঠী মনে করেন যে আমাদের মনেই সবকিছু আছে, বাইরে নয়। আর এক গোষ্ঠীর চিন্তাবিদরা মনে করেন যে বেদের শিক্ষাই একমাত্র সত্য। আমাদের কোন্ কাজ করা উচিত আর কোন্‌টা করা উচিত নয়, এ ব্যাপারে বেদের নির্দেশ মেনে চলাই আমাদের কর্তব্য।

পঞ্চবিংশক ইত্যেকে ষড়্‌বিংশ ইতি চাপরে।

একত্রিংশক ইত্যাহুরনন্ত ইতি চাপরে॥২৬

অন্বয়: একে (কিছু ব্যক্তি [সাংখ্য দার্শনিকরা]); পঞ্চবিংশকঃ ইতি (এই দৃশ্যমান জগতের পঁচিশটি অংশ : প্রকৃতি, মহৎ [সমষ্টি মন], অহংকার [অহংবোধ], পাঁচটি তন্মাত্র [সূক্ষ্ম উপাদান], পাঁচটি স্থূল উপাদান, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় [মন এবং পুরুষ, পুরুষ যিনি সাক্ষীমাত্র]); অপরে (অন্যেরা [যেমন, পাতঞ্জলি গোষ্ঠী]); ষড়্‌বিংশ [২৬] ইতি (এই জগতের ছাব্বিশটি অংশ [সাংখ্যের পঁচিশটি ও ঈশ্বর]); আহুঃ ইতি (অন্য গোষ্ঠী বলেন); একত্রিংশকঃ (সংখ্যাটি একত্রিশ); অনন্তঃ ইতি চ অপরে (আরও অন্য এক দল বলেন সংখ্যাটি গণনার অতীত)।

সরলার্থ: সাংখ্যমতে, এই দৃশ্যমান জগৎ সত্য এবং এই জগতের পঁচিশটি অংশ। পাতঞ্জলি গোষ্ঠীর মতে এই সংখ্যা ছাব্বিশ। কারও কারও মতে এই সংখ্যা একত্রিশ। আবার কারও মতে এই সংখ্যা গণনার অতীত।

লোকাঁল্লোকবিদঃ প্ৰাহুরাশ্রমা ইতি তদ্বিদঃ।

স্ত্রীপুংনপুংসকং লৈঙ্গাঃ পরাপরমথাপরে॥২৭

অন্বয়: লোকবিদঃ লোকান্ প্ৰাহুঃ (কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা অপরকে সন্তুষ্ট করতেই ব্যস্ত, তাঁরা মনে করেন অপরকে আনন্দ দেওয়াই একমাত্র ধর্ম); তৎ বিদঃ আশ্রমাঃ (আবার দক্ষের মতো কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বর্ণাশ্রমের নিয়মাবলীর উপরই বেশি গুরুত্ব দেন এবং এগুলিকেই তাঁদের জীবনের সব বলে মনে করেন); লৈঙ্গাঃ (যিনি ব্যাকরণ জানেন); স্ত্রীপুংনপুংসকম্ (স্ত্রী, পুরুষ এবং নপুংসক—এই প্রকার লিঙ্গভেদকে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং একমাত্র সত্য বলে মনে করেন); অথ অপরে পর অপরম্ (আবার এমন মানুষও আছেন যাঁরা পরব্রহ্ম ও অপরব্রহ্মকেই সত্য বলে মনে করেন)।

সরলার্থ: কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন্যকে আনন্দ দিতেই ব্যস্ত। তাঁদের কাছে এটাই ধর্ম। আবার অন্য কিছু মানুষ বর্ণাশ্রমপ্রথা কঠোরভাবে মেনে চলেন। একেই তাঁরা ধর্ম বলে মনে করেন। আবার যাঁরা ব্যাকরণবিদ তাঁরা লিঙ্গের উপরই বেশি গুরুত্ব দেন। যে সমস্ত শব্দগুলি লিঙ্গের প্রতীক সেগুলি তাঁদের কাছে পবিত্র। আবার এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা পরব্রহ্ম ও অপরব্রহ্মকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করেন।

সৃষ্টিরিতি সৃষ্টিবিদো লয় ইতি চ তদ্বিদঃ।

স্থিতিরিতি স্থিতিবিদঃ সর্বে চেহ তু সর্বদা॥২৮

অন্বয়: সৃষ্টিবিদঃ সৃষ্টিঃ ইতি লয় ইতি তৎ বিদঃ, স্থিতিঃ ইতি স্থিতিবিদঃ (পুরাণ মতে সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় এ সবই সত্য); সর্বে চ সর্বদা ইহ তু (এইসব এবং এছাড়াও অন্যান্য যা-কিছু মানুষ কল্পনা করে সবই আত্মার উপর আরোপিত)।

সরলার্থ: পুরাণ মতে সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় এ সবই সত্য। এইসব এবং এছাড়াও অন্যান্য যা-কিছু মানুষ কল্পনা করে, তা সবই আত্মার উপর আরোপিত।

ব্যাখ্যা: আচার্য শঙ্কর ২০ থেকে ২৮ এই শ্লোকগুলি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে করেননি। এদের কোন গুরুত্ব নেই। লোকের বিশ্বাস, জনশ্রুতি এবং কুসংস্কারের উপর ভিত্তি করেই এই শ্লোকগুলি বলা হয়েছে। স্পষ্টতই এগুলিকে উপেক্ষা করা যায় এবং শঙ্কর তাই করেছেন।

এইসব ধারণা যেন দড়ির উপর সাপ, জলধারা বা ঐ জাতীয় কোন বস্তুকে ব্রহ্মের কারণ-অবস্থার উপর আরোপ করা হয়েছে।

যং ভাবং দর্শয়েদস্য তং ভাবং স তু পশ্যতি।

তং চাবতি স ভূত্বাহসৌ তদ্‌গ্রহঃ সমুপৈতি তম্॥২৯

অন্বয়: যস্য যং ভাবং দর্শয়েৎ (যেভাবে সে বস্তুকে দেখতে শিখেছে); সঃ তং ভাবং তু পশ্যতি (সেভাবেই সে বস্তুটিকে গ্রহণ করে); অসৌ সঃ ভূত্বা (সে ঐ বস্তুতে পরিণত হয়); তং চ অবতি (বস্তুটি তাকে রক্ষা করে); তৎ গ্রহঃ (ঐ বস্তুতে তার মগ্নতা); তং সমুপৈতি (তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে)।

সরলার্থ: আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি, এই সম্পর্কে আচার্য আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন। উদ্দেশ্যটি কোন বস্তু বা ভাব হতে পারে। সেই বস্তুকে বা ভাবটিকে আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করেছি। এর ফলে আমার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয় এবং আমি ক্রমে ঐ ব্যক্তিতে (যা আমার লক্ষ্য) পরিণত হই। এই পরিবর্তনসমূহ আমাকে রক্ষা করে রাখে। আমার লক্ষ্যে আমি তখন এতই মগ্ন যে অন্য আর কিছু আমার মনকে আকর্ষণ করতে পারে না।

ব্যাখ্যা: এই মায়া থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? আমরা এক্ষেত্রে আচার্যের সাহায্য নিতে পারি। এই আচার্য কোন ব্যক্তি হতে পারেন, আবার শাস্ত্র; যেমন উপনিষদও হতে পারেন। কিন্তু আসল কথা হল যেমন করেই হোক অজ্ঞানতাকে দূর করতে হবে। অন্ধকারে রাস্তায় একটুকরো দড়ি পড়ে আছে। তা দেখে আমি সেটাকে সাপ বলে মনে করেছি। ভয় পেয়ে আমি তখন সাপ সাপ বলে চিৎকারও করলাম। কিন্তু একজন আলো এনে আমাকে দেখালো ওটি সাপ নয়, একটুকরো দড়ি। একইভাবে অন্ধকারের আবরণ সত্যকে ঢেকে রয়েছে। মায়ার উৎপত্তি এরই থেকে। আচার্য যখন জ্ঞানের আলো নিয়ে আসেন তখনি আমরা আসল বস্তুটিকে অর্থাৎ সত্যকে দেখতে পাই।

এই জগতে আমাদেরকে কে রক্ষা করে? শুধুমাত্র জ্ঞান। এই কারণেই জ্ঞানকে অন্য সবকিছুর থেকে বেশি শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। হিন্দুদর্শনে জ্ঞানকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেই আমরা মুক্ত হয়ে যাই। যখন আমরা চরম সত্যকে জানি তখনি আমরা মুক্ত। আচার্য আমাদেরকে এই জ্ঞানই দেন এবং এই জ্ঞানই আমাদেরকে সবকিছু থেকে রক্ষা করে।

আত্মজ্ঞান লাভ করলে আমরা বদলে যাই। অর্থাৎ অন্য এক মানুষে পরিণত হই। এখন আমরা নিজেদের আত্মার থেকে আলাদা বলে মনে করি। নিজ আত্মার কাছে আমরা নিজেরাই যেন অপরিচিত। আমরা আমাদের প্রকৃত পরিচয় জানি না। আত্মজ্ঞান লাভ করলে আমরা আমাদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারি। আমরা তখন নিজ আত্মাতে লীন হয়ে যাই। কোন কিছুই আমাদের মনকে তখন চঞ্চল করতে পারে না।

এতৈরেষোঽপৃথগ্‌ভাবৈঃ পৃথগেবেতি লক্ষিতঃ।

এবং যো বেদ তত্ত্বেন কল্পয়েৎ সোঽবিশঙ্কিতঃ॥৩০

অন্বয়: এষঃ (এই আত্মা); এতৈঃ (পূর্বে যেমন বলা হয়েছে); অপৃথগ্‌ভাবৈঃ (প্রাণ ও অন্যান্য বস্তু থেকে যদিও আলাদা নন); পৃথগেব (পৃথকরূপে); ইতি লক্ষিতঃ (অজ্ঞান ব্যক্তি এভাবেই দেখেন); যঃ (বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ); তত্ত্বেন (প্রকৃত স্বরূপ); এবং বেদ (এইভাবে জানেন); সঃ (সেই ব্যক্তি); অবিশঙ্কিতঃ (তাঁর মন সবরকমের ভয় থেকে মুক্ত); কল্পয়েৎ (বেদের বাণী নিয়ে চিন্তা করেন)।

সরলার্থ: আত্মা হলেন সেই আশ্রয় যাঁর উপর সকল অনিত্য বস্তু অধিষ্ঠিত। আমাদের চারপাশে আমরা প্রাণেরই প্রকাশ দেখতে পাই। অজ্ঞান ব্যক্তি এই প্রাণ ও তার প্রকাশকে পৃথক বলে মনে করেন। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন, প্রাণ আত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে, যা কিছু আছে তা সব আত্মারই বিকার। সবকিছুর মধ্যে এই এক আত্মাই বিরাজ করেন—একথা যিনি জানেন তিনি আত্মায় দৃঢ় বিশ্বাসী এবং ভয়শূন্য। যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তিনি বেদের বাণীসমূহকে উপলব্ধি করেছেন—একথা তিনি দাবি করতে পারেন।

ব্যাখ্যা: দড়ি ছাড়া রজ্জুসর্পে যেমন সাপের কোনও অস্তিত্ব নেই, ঠিক তেমনি আত্মা ছাড়াও এ জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই। আত্মার উপরেই এই জগৎ আরোপিত, দাঁড়িয়ে আছে। আত্মাই সেই অধিষ্ঠান যাঁর উপর এ জগৎ প্রতিষ্ঠিত। আত্মা ও জগৎ আলাদা এমন কথা ভাবাও ভুল। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন, এই জগৎ আত্মার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমরা চারিদিকে যে বৈচিত্র দেখে থাকি, সেই বৈচিত্রের মধ্যেও এক আত্মাই বিরাজ করছেন, এই আত্মারই বৈচিত্র। যিনি এই সত্যকে জেনেছেন তিনিই বেদের সারমর্ম বুঝতে সক্ষম। আত্মা এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু নাম-রূপের দরুন এই এক আত্মাই বহু হয়েছেন।

স্বপ্নমায়ে যথা দৃষ্টে গন্ধর্বনগরং যথা।

তথা বিশ্বমিদং দৃষ্টং বেদান্তেষু বিচক্ষণৈঃ॥৩১

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); স্বপ্নমায়ে (স্বপ্ন এবং দৃষ্টিবিভ্রম); দৃষ্টে (আপাতদৃষ্টিতে দুটোকেই সত্য বলে দেখ); যথা (ঠিক যেমন); গন্ধর্বনগরম্ (আকাশে নির্মিত প্রাসাদ [গন্ধর্ব নামক অতিমানবিক কারও দ্বারা তৈরি অর্থাৎ আকাশকুসুম কল্পনা]); তথা (সেই প্রকার); বেদান্তেষু (বেদান্তে); বিচক্ষণৈঃ (পণ্ডিতদের দ্বারা); ইদম্ (এই); বিশ্বম্ (বিশ্ব); দৃষ্টম্ (দেখা যায়)।

সরলার্থ: যখন আমরা স্বপ্নে কোন বস্তুকে দেখি বা এক বস্তুর স্থলে অন্য কোন বস্তুকে দেখি, ভুলবশত সেগুলিকেই আমরা সত্য বলে মনে করি। (কিন্তু পরে বুঝতে পারি যে, এগুলি আদতে সত্য নয়।) গন্ধর্বনগরের মতো এ যেন আকাশকুসুম কল্পনা। বেদান্তবাদীরা এ সত্য জানেন এবং এই জগৎকে মিথ্যা বলে মনে করেন।

ব্যাখ্যা: আমরা বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে বলতে পারি এ জগৎ মিথ্যা। বেদান্তও এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। শাস্ত্র বলেন, আমাদের স্বপ্নের অভিজ্ঞতা বা আমরা যে ভুল দেখি, এই দুই মিথ্যা। শাস্ত্রের স্পষ্ট নির্দেশ হলঃ প্রকৃতপক্ষে এ জগতের সবকিছুই আত্মা [বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ২।৪।৬], এবং আত্মা এক ও অদ্বিতীয় [ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬।২।১]।

আত্মজ্ঞান লাভ হলে তখন আর দুই বলে কিছু থাকে না। জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় এক হয়ে যায়। যিনি প্রকৃত জ্ঞানী তিনি সর্বত্রই এই ‘এক’ অর্থাৎ আত্মাকে দেখেন। তিনি দ্বৈতবুদ্ধির দ্বারা কখনো বিভ্রান্ত হন না। তিনি জানেন যে দড়িই সত্য, সাপ নয়। তাই তাঁর কাছে আত্মাই একমাত্র সত্য, এ জগৎ নয়।

ন নিরোধো ন চোৎপত্তির্ন বদ্ধো ন চ সাধকঃ।

ন মুমুক্ষুর্ন বৈ মুক্ত ইত্যেষা পরমার্থতা॥৩২

অন্বয়: ন নিরোধঃ (প্রকৃতপক্ষে শেষ বলে কিছু নেই); ন চ উৎপত্তিঃ (এবং শুরু বলেও কিছু নেই); ন বদ্ধঃ (কেউই বদ্ধ নয়); ন চ সাধকঃ (সাধক বলে কেউ নেই অর্থাৎ কারও মুক্ত হবার চেষ্টাও নেই); ন মুমুক্ষুঃ (কারও মুক্তির ইচ্ছা নেই); ন বৈ মুক্তঃ (কেউই মুক্ত নয়); ইতি এষা পরমার্থতা (এই পরম সত্য)।

সরলার্থ: জন্ম বা মৃত্যু বলে কিছু নেই। কেউই সংসারে বদ্ধ নয়। কারও মুক্ত হবার চেষ্টা বা ইচ্ছার অবকাশ নেই, কারণ তুমি তো মুক্ত হয়েই আছ। এই পরম সত্য।

ব্যাখ্যা: গৌড়পাদের সিদ্ধান্ত হলঃ ‘ন নিরোধঃ’—আমার মৃত্যু নেই; আবার ‘ন চ উৎপত্তিঃ’—আমার জন্ম বলেও কিছু নেই। কারণ আমিই সেই আত্মা। ‘ন বদ্ধঃ’—আমি কখনো বদ্ধ ছিলাম না। ‘ন সাধকঃ’—আর আমার যদি কোন বন্ধনই না থাকে তবে সাধনা করব কিসের জন্য? আমরা নিজেদের বদ্ধ বলে মনে করি বলেই তো মুক্তি লাভ করার জন্য সাধনা করি। আমার কোন কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা নেই। ‘ন মুমুক্ষুঃ’—মোক্ষলাভের ইচ্ছাও আমার নেই। যদি আমি মুক্তই হই তবে কেনই বা আমি মুক্তির চেষ্টা করব? ‘ন বৈ মুক্তঃ’—আমি মোক্ষলাভ করেছি এমনও নয়। কারণ আমি তো নিত্যমুক্ত, সবসময়ই মুক্ত।

মূল কথাটি এই, এর আগে আমি যদি আত্মা না হয়ে থাকি তবে আমি কখনই আত্মা হতে পারব না। যদি ইতিপূর্বেই আমি মুক্ত না হয়ে থাকি তবে আমি কোন দিনই মুক্ত হতে পারব না। আমি হয়তো নিজেকে বদ্ধ, দুর্বল, অসহায়, দুঃখী বলে মনে করি, কিন্তু এসবই অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞানতা। ‘তৎ ত্বম্ অসি’—‘তুমিই সেই’। অর্থাৎ তুমি তো ব্রহ্মই হয়ে আছ, তুমি ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নও। এই হল চরম সত্য (ইতি এষা পরমার্থতা)।

ভাবৈরসদ্ভিরেবায়মদ্বয়েন চ কল্পিতঃ।

ভাবা অপ্যদ্বয়েনৈব তস্মাদদ্বয়তা শিবা॥৩৩

অন্বয়: অয়ম্ (এই আত্মা); এব (অবশ্যই); অসদ্‌ভিঃ ভাবৈঃ (অনিত্য বস্তুর মতো); অদ্বয়েন চ (অদ্বয়রূপে); কল্পিতঃ (অজ্ঞান ব্যক্তি মনে করেন); ভাবাঃ অপি (অনিত্য বস্তুও); অদ্বয়েন (অদ্বয়রূপে); তস্মাৎ (এইজন্য); অদ্বয়তা (অদ্বৈততত্ত্ব); শিবা (কল্যাণকর)।

সরলার্থ: আত্মা চৈতন্যস্বরূপ। আত্মাই পরম সত্য। কিন্তু অজ্ঞান ব্যক্তি তাঁর প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারেন না। তিনি মনে করেন যে, এ জগতের অন্যান্য বস্তুর মতো আত্মাও একটি বস্তুমাত্র। সমগ্র জগৎ আত্মার উপর আরোপিত। এইভাবেই জগৎ আত্মার চরিত্র অর্থাৎ বৈশিষ্ট্যগুলি লাভ করে। এই কারণের জন্যই আত্মাকে তিনি বস্তু বলে ভুল করেন। আত্মা সত্য, তাই জগৎকেও সত্য বলে মনে হয়। আমরা একথা ভেবে খুবই আনন্দ পাই যে আত্মা ও জগৎ এক ও অভিন্ন। আমরা যে এমনটি ভাবি তার কারণ অদ্বৈততত্ত্ব এক আনন্দদায়ক চিন্তা।

ব্যাখ্যা: এই অদ্বৈততত্ত্বকে ভালো লাগে কেন? কোন স্থানে যদি দুজন ব্যক্তি থাকেন তবে তাঁদের মধ্যে কখনো ভালো কখনো খারাপ সম্পর্ক হতে পারে। অনিশ্চয়তার বোধ তাঁদের সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। তাঁদের মানসিক শান্তি বলে কিছু থাকে না।পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যদি দুই ব্যক্তির পরিবর্তে এক ব্যক্তি ও একটি বাঘ একসাথে থাকে। এই দুই-এর মধ্যে যে-কোন একজন জীবিত থাকবে—হয় মানুষটি, নাহয় বাঘটি। এইজন্যই অদ্বৈততত্ত্ব সবসময়েই সুখপ্রদ।

এই জগৎ সত্য নয়, কারণ এটি সতত পরিবর্তনশীল। চারিত্রিক দিক থেকে দেখতে গেলে এ জগৎ বৈচিত্রময়। তাই এখানে অদ্বৈতের কোন প্রশ্নই উঠে না। এ জগতের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। যদি এর কোনও অস্তিত্ব থেকে থাকে তা হল রজ্জুতে সাপের যেমন অস্তিত্ব, ঠিক সেইরকম। অর্থাৎ এ জগৎ আত্মার উপর আরোপিত মাত্র। একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভ হলেই জানা যায়, এ জগৎ আগেও কখনো ছিল না, পরেও কখনো থাকবে না।

এ জগতে আমরা কত রকমের বৈচিত্র দেখে থাকি। কিন্তু যেহেতু জগৎই মিথ্যা সেহেতু এর বৈচিত্রগুলিও সব মিথ্যা। এক ও অভিন্ন আত্মাই একমাত্র সত্য। সেই আত্মাই হল অদ্বৈততত্ত্ব। আত্মা আনন্দস্বরূপ তাই অদ্বৈততত্ত্ব আনন্দময়। যতদিন আমাদের মধ্যে অজ্ঞানতা থাকবে ততদিন ভাবতে ভালো লাগে এই জগৎ ও আত্মা এক ও অভিন্ন।

নাত্মভাবেন নানেদং ন স্বেনাপি কথঞ্চন।

ন পৃথঙ্ নাপৃথক্‌ কিঞ্চিদিতি তত্ত্ববিদো বিদুঃ॥৩৪

অন্বয়: নানা (বিভিন্ন নাম-রূপসহ); ইদম্ (এই জগৎ); আত্মভাবেন ন (আত্মার মতো নয়); স্বেন অপি (স্বাধীনভাবে); কথঞ্চন ন (কোনও বস্তু নয়); কিঞ্চিৎ পৃথক্ ন (এতটুকু আলাদা নয় [আত্মার থেকে]); ন অপৃথক্‌ (আত্মার মতোও নয়); তত্ত্ববিদঃ ইতি বিদুঃ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁকে এইভাবে জানেন)।

সরলার্থ: এই জগৎ বিভিন্ন নাম-রূপের সমষ্টি। আত্মার মতো এ জগৎ স্বয়ংপ্রকাশিত এবং স্বতন্ত্র কোন সত্তা নয়। বস্তুত আত্মা ছাড়া কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আবার আত্মার সদৃশ কিছু নেই। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা এভাবেই আত্মাকে দেখে থাকেন।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈততত্ত্বকে স্বাগত জানানো হচ্ছে কেন? দুটি ভিন্ন বস্তু একসাথে থাকলে সেখানে বিরোধের সম্ভাবনা থাকে। যেমন ধরা যাক, মানুষ ও একটি সাপ একসাথে আছে। এরা সবসময়ই একে অপরকে সন্দেহ করে। তাই তারা কখনো শান্তি পায় না।

কিন্তু ধরা যাক, কোন বস্তু আর একটি বস্তুর উপর আরোপিত, দড়ির উপর সাপ যেমন আরোপিত। অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে করে আমি ভয় পাই। কারণ অন্ধকারে, আমি সেখানে দড়িকে দড়ি বলে দেখতে পাই না সাপ হিসাবে দেখি। কিন্তু আলো এলে বুঝতে পারি আরে, এটা তো সাপ নয়, এ যে দড়ি!

একইভাবে এই জগৎও আত্মার উপর আরোপিত। প্রকৃতপক্ষে জগৎ সত্য নয়, আত্মার উপর আরোপিত বলে জগৎকে সত্য বলে মনে হয়। আত্মজ্ঞান লাভ হলে বোঝা যায় যে, জগতের কোনও পৃথক অস্তিত্ব নেই। তখন আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পারি। তখন এই জগৎ আর এর বৈচিত্র আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। এমনকি মানুষ ও সাপের মধ্যে যে ভেদ তাও ঘুচে যায়। সবকিছু তখন একে লীন হয়ে যায়।

দুই বোধই হল আমাদের সব দুঃখ-কষ্টের মূল। তাই অদ্বৈততত্ত্বই কাম্য।

বীতরাগভয়ক্রোধৈর্মুনিভির্বেদপারগৈঃ।

নির্বিকল্পো হ্যয়ং দৃষ্টঃ প্রপঞ্চোপশমোঽদ্বয়ঃ॥৩৫

অন্বয়: বীতরাগভয়ক্রোধৈঃ (আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত); বেদপারগৈঃ (বেদে পারদর্শী); মুনিভিঃ (চিন্তাশীল ঋষিদের দ্বারা); অয়ম্ (এই আত্মা); হি (নিশ্চিতভাবে); নির্বিকল্পঃ (কোনও পরিবর্তন নেই); প্রপঞ্চোপশমঃ (দ্বৈতভাবের লেশমাত্র নেই); অদ্বয়ঃ (অদ্বৈত); দৃষ্টঃ (প্রত্যক্ষ হয়)।

সরলার্থ: বেদে পারদর্শী ঋষিরা হলেন (ইন্দ্রিয়-ভোগসুখের প্রতি) নিরাসক্ত এবং ভয় ও রাগ থেকে মুক্ত। তাঁরা বলেন আত্মা অপরিবর্তনীয়। দ্বিতত্ত্বের বোধ তাঁদের নেই। এবং তাঁরা নিজেদেরকে এক ও অভিন্ন সত্তারূপে মনে করেন।

ব্যাখ্যা: এখানে বেদান্তদর্শনের প্রশংসা করা হয়েছে। কে এই দর্শনকে বুঝতে পারেন? এমন মানুষ যিনি নিজেকে পুরোপুরি বশে আনতে পেরেছেন। তাঁর কোন কিছুর প্রতি আসক্তি নেই, অনাসক্তিও নেই। তিনি সমস্ত রিপু—যেমন ক্রোধ, ঘৃণা, ভয় এর থেকে মুক্ত। তিনি চিন্তাশীল এবং শাস্ত্রজ্ঞ। তাঁর কাছে এই দৃশ্যমান জগৎ অনিত্য। তাঁর আগ্রহ একটিমাত্র বস্তুকে কেন্দ্র করে, তা হল আত্মজ্ঞান লাভ করা। উচ্চকোটির মানুষ অর্থাৎ যাঁরা প্রকৃত সন্ন্যাসী কেবলমাত্র তাঁরাই এই আত্মজ্ঞান লাভে সক্ষম।

তস্মাদেবং বিদিত্বৈনমদ্বৈতে যোজয়েৎ স্মৃতিম্।

অদ্বৈতং সমনুপ্রাপ্য জড়বল্লোকমাচরেৎ॥৩৬

অন্বয়: তস্মাৎ (সুতরাং); এবম্ (যেমন উল্লেখ করা হয়েছে); এনম্ (এই আত্মাকে); বিদিত্বা (উপলব্ধি করে); অদ্বৈতে (অদ্বৈতে); স্মৃতিম্ (মন); যোজয়েৎ (স্থির করতে হবে); অদ্বৈতম্ (অদ্বৈততত্ত্ব); সমনুপ্রাপ্য (প্রথমে শাস্ত্র পাঠ করে এবং পরে তা উপলব্ধি করে); জড়বৎ (জড়বুদ্ধির মতো); লোকম্ (লোকদের মাঝে); আচরেৎ (আচরণ কর)।

সরলার্থ: অদ্বৈতজ্ঞান ভালোভাবে আয়ত্ত করা বড়ই কঠিন। আমাদের যা করণীয় তা আগেই বলা হয়েছে। তা হল: এই তত্ত্বের একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। তারপর মনকে সেই ধারণায় সবসময় যুক্ত রাখতে হবে। শাস্ত্রে অদ্বৈততত্ত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাধককে এই তত্ত্বের সারকথা উপলব্ধি করতে হবে। সাধক সবসময় অদ্বৈততত্ত্বের মনন ও ধ্যানে যুক্ত থেকে পরিণামে আত্মাকে উপলব্ধি করবেন। সাধক কাউকে বুঝতে দেবেন না যে, তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন। বরং তিনি জড়বুদ্ধির মতো আচরণ করবেন।

ব্যাখ্যা: শাস্ত্র বলেন, যখন কারও একত্বের বোধ হয় অর্থাৎ সবকিছুর মধ্যে সেই এক আত্মাকে দেখেন তখন এ জগতের সবকিছুকেই তিনি ভালো বলে মনে করেন। তাঁর কাছে জীবনটা বড় আনন্দের হয়ে ওঠে। কিন্তু সবথেকে বড় কথা হল তিনি অভয়পদ লাভ করেন। সাধক তখন মনে করেন তিনিই পরমব্রহ্ম, এ জগতের সবকিছুর উৎসও তিনি। কোন কিছুর দ্বারাই তিনি আর প্রভাবিত হন না। সর্বত্র এবং সবকিছুর মধ্যে তখন ‘তিনি’ই বিরাজ করেন। এই নিখিল জগতের সাথে তিনি তখন এক হয়ে যান।

কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ তাঁর জ্ঞানের প্রচার করেন না। তাঁর আচরণ দেখে মনে হয় তিনি কিছুই জানেন না। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ যেন বিনয়ের প্রতিমূর্তি।

নিস্তুতির্নির্নমস্কারো নিঃস্বধাকার এব চ।

চলাচলনিকেতশ্চ যতির্যাদৃচ্ছিকো ভবেৎ॥৩৭

অন্বয়: যতিঃ (ঋষি); নিস্তুতিঃ (কাউকে তোষামোদ করেন না); নির্নমস্কারঃ (কারও কাছে নত হন না); নিঃস্বধাকারঃ (পিতৃপুরুষদের সম্মানে তর্পণ প্রভৃতি প্রচলিত অনুষ্ঠান করেন না); চলাচলনিকেতশ্চ (বিনাশী দেহ এবং অবিনাশী আত্মাকে বয়ে নিয়ে যান); যাদৃচ্ছিকঃ ভবেৎ (যা পান তাতেই তিনি খুশি)।

সরলার্থ: যখন কোন ব্যক্তি জানেন তিনি আত্মা ছাড়া আর কিছু নন, তখন তিনি কাউকে তোষামোদ করেন না। এমনকি সাধারণ শিষ্টাচার দেখাবারও প্রয়োজন মনে করেন না। পিতৃপুরুষের সম্মানে তর্পণাদি অনুষ্ঠানও তিনি করেন না। তিনি জানেন যে, এ দেহের নাশ হবেই কিন্তু আত্মা অবিনাশী। এই জ্ঞানে অবিচল থেকে সন্তোষের সাথেই তিনি জীবন কাটান।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ (যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন) কিরকম আচরণ করেন? প্রথমত এবং প্রধানত এমন মানুষ অবশ্যই সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসী, যিনি এ জগৎকে ত্যাগ করেছেন। তাঁর জীবন পরিপূর্ণ বৈরাগ্যের জীবন। তিনি সংসারে আছেন বটে কিন্তু তিনি সংসারী নন। তখন তাঁর বোধে বোধ হয়——তিনিই স্বয়ং পরমাত্মা। আর এই বোধ তাঁর সকল চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। তাঁকে দেখলে মনে হয়, তিনি হয় উন্মাদ, নাহয় শিশু। তাঁর দেহ আছে, কিন্তু দেহবোধ নেই। আকস্মিকভাবে যা পান, তাই তিনি খান। কারও প্রতি তাঁর কোনও কর্তব্য নেই। আবার নিজে কোনও নির্দিষ্ট সমাজের অন্তর্ভুক্ত, এমন কথাও তিনি মনে করেন না। সাধারণ নিয়ম তাঁর বেলাতে খাটে না। তিনি নিজের নিয়মে নিজে চলেন। তিনি স্বাধীন। কারও কাছ থেকে তিনি কিছু পাবার আশা করেন না। আবার অন্যকে তোষামোদও তিনি করেন না।

তত্ত্বমাধ্যাত্মিকং দৃষ্ট্বা তত্ত্বং দৃষ্ট্বা তু বাহ্যতঃ।

তত্ত্বীভূতস্তদারামস্তত্ত্বাদপ্রচ্যুতো ভবেৎ॥৩৮

অন্বয়: আধ্যাত্মিকম্ (দেহ সংক্রান্ত [জীবাত্মা]); তত্ত্বম্ (আত্মা [ব্রহ্ম]); দৃষ্ট্বা (উপলব্ধি করে); তু (এবং); বাহ্যতঃ (দেহের বাইরে); তত্ত্বম্ (আত্মা [ব্রহ্ম]); দৃষ্ট্বা (দেখে); তত্ত্বীভূতঃ (ব্রহ্মে পরিণত হন); তদারামঃ (ব্রহ্মে [আত্মায়] নিষ্ঠ); তত্ত্বাৎ (নিজের স্বরূপজ্ঞান থেকে); অপ্রচ্যুতঃ ভবেৎ (কখনো বিচ্যুত হন না)।

সরলার্থ: আত্মা (ব্রহ্ম) দেহ এবং সেই সংক্রান্ত সবকিছুর আশ্রয়—একথা বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা উপলব্ধি করেন। তাঁরা আরও উপলব্ধি করেন এই জগৎ আত্মায় প্রতিষ্ঠিত। একথা জেনে তাঁরা আত্মার প্রতি আকৃষ্ট হন। আত্মাকে ধ্যান করতে শুরু করেন এবং কালে তাঁর সাথে এক হয়ে যান। এইভাবে আত্মায় পরিণত হয়ে তিনি আর এই অবস্থা থেকে বিচ্যুত হন না।

ব্যাখ্যা: এই জগৎ এবং মানুষের দেহ দুই-ই মিথ্যা। সাপ যেমন রজ্জুর উপর আরোপিত ঠিক তেমনি এ জগৎও আত্মার উপর ন্যস্ত। আত্মাই একমাত্র সত্য।

এই আত্মা কিরকম? আত্মা আকাশের মতো। আত্মা সর্বত্র রয়েছেন। এবং তিনিই সবকিছু হয়েছেন। আত্মার আদি নেই, অন্তও নেই। আত্মা নির্গুণ ও নিরাকার। কোনও বিশেষণে তাঁকে বিশেষিত করা যায় না। তিনি সর্বব্যাপী। এ জগতে আত্মাই একমাত্র সত্য। এবং সাধকই সেই সত্য। তাঁর আত্মাই সকলের অন্তরস্থ আত্মা।

আত্মজ্ঞান লাভ করলে সাধক সবসময় আত্মচিন্তাতেই ডুবে থাকেন। অন্য কোনও চিন্তা তাঁর ভালো লাগে না। তিনি যেন আত্মাতে নোঙর ফেলেছেন। তাই তিনি অচল, অটল।

অদ্বৈত প্রকরণ

উপাসনাশ্রিতো ধর্মো জাতে ব্রহ্মণি বৰ্ততে।

প্রাগুৎপত্তেরজং সর্বং তেনাসৌ কৃপণঃ স্মৃতঃ॥১

অন্বয়: উপাসনাশ্রিতঃ (প্রার্থনায় যাঁর নিষ্ঠা); ধর্মঃ (জীবাত্মা); জাতে (জীব ও জগৎ রূপে প্রতিভাত); ব্রহ্মণি বৰ্ততে (ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত); উৎপত্তেঃ প্রাক্ (সৃষ্টির পূর্বে); সর্বং অজম্ (অনাদি এবং অনন্ত ব্রহ্ম); তেন (এরূপ চিন্তার দ্বারা); অসৌ (যে ব্যক্তি এভাবে প্রার্থনা করেন); কৃপণঃ (নির্বোধ); স্মৃতঃ (মনে করা হয়)।

সরলার্থ: ধরা যাক, কোন এক ব্যক্তি তাঁর অধিকাংশ সময় প্রার্থনা করে কাটান। তিনি মনে করেন তিনি ও এই দৃশ্যমান জগৎ পূর্বে ব্রহ্মা ছিলেন। কোন কারণে সেই অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়ে তিনি বর্তমান অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন; পূর্ব অবস্থা ফিরে পেতে হলে তাঁকে ব্রহ্মের (সগুণ ব্রহ্মের) উপাসনা করতে হবে। এহেন ব্যক্তি শুধুমাত্র অজ্ঞানই নন, নির্বোধও বটে। ‘আমি স্বরূপত ব্রহ্ম’—এই উপলব্ধি যাঁর একবার হয়েছে তাঁর আর কখনো ভুল হয় না। নিজের স্বরূপ সম্বন্ধে তিনি সবসময় সচেতন থাকেন। তিনি জানেন একমাত্র তিনিই আছেন, তিনি ছাড়া এই জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই।

ব্যাখ্যা: আগম প্রকরণে ‘ওম্’-এর তাৎপর্য আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে আত্মা এই দৃশ্যমান জগৎ থেকে আলাদা। আত্মা এক ও অদ্বিতীয় এবং তিনি মঙ্গলময় (শিব)। যিনি আত্মাকে উপলব্ধি করেছেন তাঁর কাছে আর দুই বলে কিছু নেই, সব এক।

কিন্তু এ একটা কথামাত্র। এটাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বৈতথ্য প্রকরণে জগৎকে স্বপ্ন বা মরীচিকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এ জগৎ যেন আকাশকুসুম কল্পনা। এর উৎপত্তি এবং বিনাশ আছে। এ জগৎ কার্য-কারণের অধীন এবং বৈচিত্রপূর্ণ।

এখন প্রশ্ন হল: অদ্বৈততত্ত্ব কি কেবলমাত্র শাস্ত্র -প্রমাণের উপর নির্ভরশীল? যুক্তির দ্বারা কি এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করা যায় না? বর্তমান প্রকরণে যুক্তির সাহায্যে অদ্বৈততত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী প্রকরণে দেখানো হয়েছে একমাত্র আত্মাই সত্য। উপাস্য-উপাসকের ধারণাটাই ভুল। দুই বলে কিছু নেই, সব এক। বর্তমান প্রকরণে উপাসকের বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। স্পষ্টতই উপাসক মনে করেন যে একসময় তিনি ব্রহ্ম ছিলেন এবং তাঁকে আবার ব্রহ্ম হতে হবে। আর দেবতাদের উপাসনা করে তিনি আবার ব্রহ্ম হতে পারেন। কিন্তু এই ধারণা ভুল। উপাসনার দ্বারা ব্রহ্ম হওয়া যায় একথা যিনি বিশ্বাস করেন, জ্ঞানীরা তাকে নির্বোধ ও অজ্ঞান বলে মনে করেন। কেনোপনিষদে আছে: ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নন—তাঁকে ‘এই’ ভাবে উপাসনা করা যায় না।

অতো বক্ষ্যাম্যকার্পণ্যমজাতি সমতাং গতম্।

যথা ন জায়তে কিঞ্চিজ্জায়মানং সমন্ততঃ॥২

অন্বয়: অতঃ (সুতরাং); অকার্পণ্যম্ (ব্রহ্মের স্বরূপ); অজাতি (যার জন্ম নেই); সমতাং গতম্ (সর্বত্র সমানভাবে বিদ্যমান); যথা (স্বরূপত); বক্ষ্যামি (ব্যাখ্যা করব); সমন্ততঃ (সব দিক থেকে); জায়মানম্ (জন্মগ্রহণ করছে); কিঞ্চিৎ (যে কোনও বস্তু); ন জায়তে (জন্মায় না)।

সরলার্থ: যেহেতু উপাসক নির্বোধ, তাই আমি ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা করব। এই ব্রহ্ম সর্বত্র সমানভাবে বিদ্যমান। এঁর জন্ম নেই। যখন দেখবে কোন কিছুর জন্ম হচ্ছে নিশ্চিত জেনো ভুল দেখছ—যেমন আমরা দড়িকে সাপ বলে ভুল করি এও তেমনি।

ব্যাখ্যা: উপাসক অজ্ঞান তাই নিজেকে তিনি হীন বলে ভাবেন। উপাসক জানেন না যে তিনি আত্মা। তিনি সর্বত্র বিরাজমান, নির্গুণ এবং সর্বব্যাপী। তিনি মনে করেন তাঁর জন্ম হয়েছে এবং এখন তিনি এই জগতের অন্তর্গত। এই জগৎ এক বৈ দুই নয়। কিন্তু নাম-রূপের জন্য বহুরূপে প্রতিভাত হয়। এই বহু দেখাটা ভুল—কেবল, আত্মাতে নাম-রূপ আরোপ করা হয়েছে মাত্র। এই নাম-রূপ মুছে ফেললে সব ‘এক’ দেখা যায়। এই ‘এক’-ই আত্মা, এই ‘এক’-ই ব্রহ্ম। ইনিই একমাত্র সত্য—ইনি নিত্য, শুদ্ধ, মুক্ত এবং নাম-রূপহীন। ইনি সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ। ইনি বিশুদ্ধ চৈতন্য—কোন কিছুর দ্বারা ইনি প্রভাবিত হন না। এঁর জন্ম হয়নি, কোনদিন মৃত্যুও হবে না। এই আত্মাই সর্বভূতের অন্তরাত্মা। এই আত্মাতেই আমরা স্বরূপত এক।

উপাসক নিজেকে আত্মা থেকে পৃথক বলে মনে করেন। তাই তিনি ক্ষুদ্র। তিনি অজ্ঞান কারণ তিনি জানেন না যে তিনি নিজেরই উপাসনা করছেন। তাঁর স্বরূপজ্ঞান যতদিন না হবে, ততদিন তিনি অসুখী থাকবেন।

আত্মা হ্যাকাশবজ্জীবৈৰ্ঘটাকাশৈরিবোদিতঃ।

ঘটাদিবচ্চ সংঘাতৈর্জাতাবেতন্নিদর্শনম্॥৩

অন্বয়: আকাশবৎ (আকাশের মতো); আত্মা (পরমাত্মা); হি ঘটাকাশৈঃ ইব (ঘটের মধ্যে সীমাবদ্ধ আকাশের মতো); জীবৈঃ (হৃদয়স্থ জীবাত্মার দ্বারা); উদিতঃ (প্রকাশিত [জীবরূপে]); ঘটাদিবৎ (ঘটের মতো); সংঘাতৈঃ (দেহের মতো); জাতৌ (জাত হয়েছে); এতৎ নিদর্শনম্ (এটি একটি উদাহরণ)।

সরলার্থ: পরমাত্মা (অনন্ত) আকাশের মতো। জীবাত্মা যেন ঘটের মধ্যে সীমাবদ্ধ আকাশ। জীবের দেহ ও জীবাত্মাকে নানাভাবে এই ঘটাকাশের সঙ্গে তুলনা করা চলে। জীবাত্মা কিভাবে এল তা বোঝাবার জন্য এই উদাহরণটি দেওয়া হয়।

ব্যাখ্যা: পরমাত্মা আকাশের মতো সর্বব্যাপী, সূক্ষ্ম এবং তার কোন রূপ নেই। জীবাত্মা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। পরমাত্মা যখন জীবের ক্ষুদ্র দেহের দ্বারা সীমাবদ্ধ তখন তাকে বলি জীবাত্মা। অনন্ত আকাশকে ঘটের মধ্যে যেমন দেখায়, এও ঠিক তেমনি। ঘটের ভিতরেও যে-ই আকাশ, বাইরেও সেই একই আকাশ। তেমনি জীবাত্মা আর পরমাত্মা একই। দেহ ধারণ করলেও তাতে পরমাত্মার কোনও পরিবর্তন হয় না—রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে যেমন দড়ির উপর সাপকে আরোপ করা হয়, তেমনিভাবে দেহ পরমাত্মার উপর আরোপিত হয় মাত্র।

যদি মনে করি পরমাত্মা থেকে জীবাত্মার উৎপত্তি তাহলে ভুল করব। দেহ পরমাত্মার উপর আরোপিত হওয়াতেই আমাদের এই ভুল হয়।

ঘটাদিষু প্রলীনেষু ঘটাকাশাদয়ো যথা।

আকাশে সংপ্ৰলীয়ন্তে তদ্বজ্জীবা ইহাত্মনি॥৪

অন্বয়: ঘটাদিষু প্রলীনেষু (যখন এই আরোপিত গুণ অর্থাৎ দেহের নাশ হয়); যথা ঘটাকাশাদয়ঃ (ঠিক যেমন ঘটের অভ্যন্তরস্থ আকাশ); আকাশে (অনন্ত আকাশে [মিশে যায়]); তদ্বৎ (একইভাবে); জীবাঃ (জীবাত্মাসকল); সম্প্রলীয়ন্তে (লীন হয়ে যায়); ইহ আত্মনি (পরমাত্মার মধ্যে)।

সরলার্থ: ঘট যখন ভেঙে যায় তখন ঘটের ভিতরের আকাশ বাইরের আকাশে মিশে যায়। সেইভাবে যে দেহের সঙ্গে জীবাত্মা যুক্ত সেই দেহের যখন নাশ হয় তখন জীবাত্মা (চৈতন্য) পরমাত্মাতে (চৈতন্যে) লয় হয়।

ব্যাখ্যা: জীবাত্মার দেহ পরমাত্মার উপর আরোপিত। ঘটের ভিতরের আকাশকে বাইরের আকাশ থেকে যেমন পৃথক বলে মনে হয়, তেমনি জীবের দেহ যেন জীবাত্মাকে পরমাত্মার থেকে আলাদা করে রেখেছে। ঘটটা ভেঙে গেলেই ভিতরের আকাশ ও বাইরের আকাশ একাকার হয়ে যায়। জীবাত্মা যখন জানতে পারে এই দেহ একটা উপাধিমাত্র, সে আসলে পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে এক হয়ে যায়।

যথৈকস্মিন্ ঘটাকাশে রজোধূমাদিভির্যুতে।

ন সর্বে সংপ্রযুজ্যন্তে তদ্বজ্জীবাঃ সুখাদিভিঃ॥৫

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); একস্মিন্ ঘটাকাশে (কোন একটি ঘটের অভ্যন্তরস্থ আকাশে); রজোধূমাদিভিঃ যুতে (ধোঁয়া, ধুলো ইত্যাদি দ্বারা কলুষিত হতে পারে); সর্বে ন সংপ্রযুজ্যন্তে (কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে অন্যান্য ঘটস্থ আকাশও ঐভাবে মলিন হয়ে গেছে); তদ্বৎ জীবাঃ সুখাদিভিঃ (সেইভাবে [যদি একটি জীবাত্মা দুঃখ ভোগ করে] অন্যান্য জীবাত্মাও কোনভাবেই প্রভাবিত হয় না [অর্থাৎ একের সুখ-দুঃখ অন্যদের স্পর্শ করে না])।

সরলার্থ: একটি ঘটের অভ্যন্তরস্থ আকাশ ধোঁয়া বা ধুলোর দ্বারা মলিন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার দ্বারা অন্যান্য ঘটের মধ্যে যে আকাশ তা কলুষিত হয় না। একইভাবে একটি জীবাত্মা যখন সুখ-দুঃখ ভোগ করে তখন তা অন্যান্য জীবাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকটি দ্বৈতবাদীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। দ্বৈতবাদীরা এই যুক্তি দেখাতে পারেন—‘যেহেতু আত্মা এক এবং অভিন্ন সেহেতু একটি দেহের যন্ত্রণা অন্যান্য দেহেও অনুভূত হওয়ার কথা।’ এরই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে এই শ্লোকটিতে—এর দ্বারা বৈশেষিক ও সাংখ্যের যুক্তিকে খণ্ডন করা হয়েছে।

বেদান্তমতে আত্মা দেহহীন, সুতরাং তিনি সুখ-দুঃখের পার। আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য। আত্মা আছে বলেই সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়। কিন্তু তার দ্বারা আত্মা প্রভাবিত হন না। সূর্য ভালো বা মন্দ উভয়কেই সমানভাবে আলো দান করে কিন্তু এই ভালো বা মন্দের দ্বারা সূর্য নিজে কখনো প্রভাবিত হয় না।

রূপকার্যসমাখ্যাশ্চ ভিদ্যন্তে তত্র তত্র বৈ।

আকাশস্য ন ভেদোঽস্তি তদ্বজ্জীবেষু নির্ণয়ঃ॥৬

অন্বয়: তত্র তত্র (যখনি [আকাশে বিভিন্ন গুণ আরোপিত হয়]); রূপ-কার্য সমাখ্যাঃ চ (রূপ, কার্যকারিতা এবং নাম); ভিদ্যন্তে বৈ (নিঃসন্দেহে ভিন্ন ভিন্ন বোধ হয়); আকাশস্য ভেদঃ ন অস্তি (আকাশ কিন্তু খণ্ডিত হয় না); তদ্বৎ জীবেষু নির্ণয়ঃ (জীবাত্মার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য)।

সরলার্থ: যখন আকাশ কোন পাত্র বা স্থানের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন সেই স্থান বা পাত্রের আকার অনুযায়ী আকাশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। দেখে মনে হয় নাম, রূপ, কার্য বা অন্যান্য গুণের দ্বারা আকাশকে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু বস্তুত আকাশকে কখনো খণ্ডিত করা যায় না। এইকথা জীবাত্মার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

ব্যাখ্যা: আত্মা এক এবং অভিন্ন। সুতরাং এই এক আত্মা কিভাবে ‘আমি’ ‘তুমি’ ‘তারা’ ইত্যাদির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে? ব্যবহারিক জীবনে আমরা সবসময়ই এই ভেদ দেখতে পাই। তার অর্থ কি এই যে আত্মাকে ভাগ করা যায়? নিঃসন্দেহে এর উত্তর হবে—না। পটাকাশ ও ঘটাকাশের উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে এই ভেদ কল্পিত। কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োজনে এই কল্পিত বিভাগকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়। আকাশ সর্বব্যাপী, এক এবং অভিন্ন। কিন্তু ঘটের মধ্যে থাকলে তাকে আমরা বলি ‘ঘটাকাশ’, ঘরের মধ্যে থাকলে বলি ‘ঘরের মধ্যস্থিত আকাশ’। এইভাবে স্থান, ব্যবহার ও অন্যান্য গুণ অনুযায়ী আমরা আকাশকে কৃত্রিমভাবে খণ্ডিত করি। তার অর্থ এই নয় যে আকাশকে সত্যিই ভাগ করা যায়। না, তা কখনই নয়। উপাধিযুক্ত হলে মনে হয় যেন আকাশকে ভাগ করা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘ধর একটি পুকুরের মাঝ বরাবর তুমি একটি দড়ি ফেলে দিয়েছ। দেখে মনে হবে জলটাকে যেন দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু জলটা কি সত্যিই ভাগ হয়েছে? না। দড়িটা সরিয়ে দিলেই সেই এক জল।

এক আত্মা যে বহু রূপে প্রতিভাত হতে পারে উপরোক্ত দৃষ্টান্তে সেটি দেখানো হয়েছে। আত্মা এক, কিন্তু নাম-রূপের জন্য তাকে বহু দেখায়।

এই বিষয়টিকে পরিষ্কার করে বোঝানোর জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ আর একটি উদাহরণ দিতেন : ধর একটি বালকের অনেকগুলি মুখোশ আছে। খেলার সাথীদের সঙ্গে মজা করার জন্য সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুখোশ ব্যবহার করে—কখনো বাঘের মুখোশ, কখনো বাঁদরের আবার কখনো বা কুকুরের। সেই একই বালক—কিন্তু নানারকমের মুখোশ পরে তাকে এক এক সময়ে এক এক রকম দেখায়। মুখোশগুলি সত্য নয়, আরোপিত।

নাকাশস্য ঘটাকাশো বিকারাবয়বৌ যথা।

নৈবাত্মনঃ সদা জীবো বিকারাবয়বৌ তথা॥৭

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); ঘটাকাশঃ (ঘটের অভ্যন্তরস্থ আকাশ); আকাশস্য বিকারাবয়বৌ ন (আকাশের বিকার বা অংশ নয় [ঘটাকাশও অখণ্ড আকাশ মাত্র]); তথা (একইভাবে); জীবঃ (দেহযুক্ত আত্মা [দেহ আত্মাতে আরোপিত]); সদা (সবসময়); আত্মনঃ (স্বয়ং পরমাত্মার); বিকারাবয়বৌ ন এব (বিকার বা অংশ নয়)।

সরলার্থ: ঘটাকাশ অনন্ত আকাশের অংশ বা বিকার নয়। বস্তুত ঘটাকাশ অখণ্ড আকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। একইভাবে, জীবাত্মা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ নয়, আবার বিকারও নয়।

ব্যাখ্যা: জল যখন বুদ্বুদের আকার ধারণ করে তখনি জলে বুদ্বুদের সৃষ্টি হয়—যেমন সোনাকে খোদাই করে অলংকার তৈরি করা হয়। কিন্তু ঘটাকাশকে কোনভাবেই বুদ্বুদের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। অনন্ত আকাশ ঘটের আকার প্রাপ্ত হয়েছে একথা বলা যাবে না। আবার শাখা-প্রশাখা যেরকম গাছের অংশ, সেইভাবে ঘটাকাশকে আকাশের অংশও বলা যায় না।

জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্কও সেইরকম। (জলবুদ্বুদ বা স্বর্ণালঙ্কারের মতো) জীবাত্মা পরমাত্মার বিকার নয়। আবার (গাছের শাখা যেমন গাছের অংশ) জীবাত্মা (সেইভাবে) পরমাত্মার অংশও নয়।

যথা ভবতি বালানাং গগনং মলিনং মলৈঃ।

তথা ভবত্যবুদ্ধানামাত্মাঽপি মলিনো মলৈঃ॥৮

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); বালানাম্ (শিশুদের কাছে); গগনম্ (আকাশ); মলৈঃ (ধোঁয়া, ধুলো ইত্যাদির দ্বারা); মলিনম্ (মলিন); ভবতি (হয়); তথা (সেইভাবে); অবুদ্ধানাম্ (অজ্ঞান ব্যক্তির কাছে); আত্মা অপি (আত্মাও); মলৈঃ (লোভ, ক্রোধ ইত্যাদি মলিনতার দ্বারা); মলিনঃ (কলুষিত); ভবতি (হয়)।

সরলার্থ: শিশুরা মনে করে আকাশ ধোঁয়া ধুলো ইত্যাদি দ্বারা আবৃত। সেইরকম অজ্ঞান ব্যক্তিদের কাছেও আত্মা (লোভ, ক্রোধ ইত্যাদির দ্বারা) কলুষিত বলে প্রতিভাত হন। (প্রকৃতপক্ষে আকাশ এবং আত্মা দুই-ই শুদ্ধ ও নির্মল।)

ব্যাখ্যা: আকাশের নিজস্ব কোন রং নেই। কিন্তু আমরা কখনো কখনো আকাশকে কালো, বাদামী বা ধূসর বর্ণের দেখি। আকাশে ধোঁয়া ধুলো বাষ্প বা অন্যান্য পদার্থ জমেই এরকম দেখায়। শিশুরা না বুঝে মনে করে আকাশই বুঝি কালো, বাদামী বা ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে।

সেইরকম আত্মা স্বরূপত শুদ্ধ, অমলিন ও নির্গুণ। কিন্তু মানুষ মনে করে ক্রোধ, লোভ, হিংসা এগুলি আত্মাতেই রয়েছে। অজ্ঞান ব্যক্তিরা এগুলিকে আত্মার গুণ বলেই মনে করে। কিন্তু তা সত্য নয়। এগুলি উপাধিমাত্র। এগুলি যেন আবরণ যা মানুষের প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে রাখে।

মরণে সম্ভবে চৈব গত্যাগমনয়োরপি।

স্থিতৌ সর্বশরীরেষু আকাশেনাবিলক্ষণঃ॥৯

অন্বয়: মরণে (মৃত্যুকালে); সম্ভবে চ (যখন তোমার জন্ম হয় তখনও); গত্যাগমনয়োঃ (ইহলোক ও পরলোকের মধ্যে যাতায়াত); অপি সর্বশরীরেষু স্থিতৌ (যে কোন দেহেই থাক না কেন); আকাশেন (আত্মা ও আকাশের [ঘটাকাশ] মধ্যে); অবিলক্ষণঃ (কোনও পার্থক্য নেই)।

সরলার্থ: মৃত্যু, জন্ম, লোক থেকে লোকান্তরে যাতায়াত এবং বিভিন্ন দেহধারণ—এই সব বিষয়ে আত্মা ও ঘটাকাশের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই (তাদের পার্থক্য শুধু উপাধিগত)।

ব্যাখ্যা: হিন্দুরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। তাঁরা বিশ্বাস করে কর্মফলের দ্বারা মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। যতদিন পর্যন্ত তার কর্মফল নিঃশেষিত না হয় এবং সে নিজের চেষ্টায় এবং গুরুকৃপায় নিজের স্বরূপ উপলব্ধি না করে, ততদিন তাকে বারবার জন্ম নিতে হয়। ততদিন সে যে পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন, তার অবস্থা ওই ঘটাকাশের মতো। ঘটের ভিতরে ও বাইরে একই আকাশ। ঘট দুয়ের মাঝে একটা কৃত্রিম ভেদ সৃষ্টি করে মাত্র। একইভাবে, আমাদের এই দেহ জীবাত্মা ও পরমাত্মার মাঝে একটা কল্পিত ভেদ সৃষ্টি করে।

সংঘাতাঃ স্বপ্নবৎসর্বে আত্মমায়াবিসর্জিতাঃ।

আধিক্যে সর্বসাম্যে বা নোপপত্তির্হি বিদ্যতে॥১০

অন্বয়: সর্বে সংঘাতাঃ (দেহ এবং তার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশ); স্বপ্নবৎ (যেন স্বপ্নে দেখা অবাস্তব এক জিনিস); আত্ম-মায়া-বিসর্জিতাঃ (আত্মার অবিদ্যার দ্বারা উৎপন্ন); হি (অতএব); আধিক্যে (পশুদের তুলনায় উৎকৃষ্ট); সর্বসাম্যে বা (অথবা সকলের সমান অবস্থা); ন উপপত্তিঃ বিদ্যতে (ঠিক মানায় না)।

সরলার্থ: দেহমাত্রই অবিদ্যার ফসল। দেহগুলি কাল্পনিক, সত্য নয়। এইসব দেহ উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট যাই হোক না কেন, এগুলি সবই গৌণ।

ব্যাখ্যা: সব দেহই স্বপ্নবৎ কাল্পনিক, সত্য নয়। এর মধ্যে কিছু দেহ হতে পারে উচ্চতর লোকের—যেমন দেবদেবীর শরীর; আবার কিছু হয়তো ইতর প্রাণীর—যেমন পশুপাখীর দেহ; আবার কিছু শরীর এ দুয়ের মাঝে—যেমন মানুষের শরীর। কিন্তু এই সব দেহই অবিদ্যার ফল। এগুলি গৌণ। এই দেহের দ্বারা কোন উদ্দেশ্য সাধন হয়, একথা মনে করার কোন কারণ নেই।

রসাদয়ো হি যে কোশা ব্যাখ্যাতাস্তৈত্তিরীয়কে।

তেষামাত্মা পরো জীবঃ খং যথা সংপ্রকাশিতঃ॥১১

অন্বয়: তৈত্তিরীয়কে (তৈত্তিরীয় উপনিষদে); রসাদয়ঃ (খাদ্য ও অন্যান্য বস্তুর সার); যে হি কোশাঃ (কোষগুলি); ব্যাখ্যাতাঃ (স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে); খং যথা (আকাশের মতো); পরঃ (পরমাত্মা); তেষাম্ (ঐ কোষের); আত্মা (আত্মা); জীবঃ (জীবাত্মা); সংপ্রকাশিতঃ (বর্ণনা করা হয়েছে)।

সরলার্থ: তৈত্তিরীয় উপনিষদে দেহের বিভিন্ন সার পদার্থগুলিকে কোষরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পরমাত্মা, যিনি আকাশের মতো, এইসব কোষগুলি দ্বারা বেষ্টিত থাকেন। তখন তাঁকে আমরা বলি জীবাত্মা।

ব্যাখ্যা: এখানে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়েছে। পরমাত্মা সর্বব্যাপী আকাশের মতো, আর জীবাত্মা যেন ঘটাকাশ। ঘটের ভিতরে ও বাইরে যেমন একই আকাশ আছে, আত্মাও তেমনি এক।

পরমাত্মা দেহ ধারণ করলে তাঁকে বলি জীবাত্মা বা জীব। দেহটা সত্য নয়, উপাধিমাত্র। দেহের মধ্যে পাঁচটি কোষ আছে—প্রতিটি কোষই খাদ্যরসের দ্বারা পুষ্ট। স্থূল থেকে সূক্ষ্ম যথাক্রমে এই পাঁচটি কোষ হল—অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ ও আনন্দময় কোষ। তৈত্তিরীয় উপনিষদে এই কোষগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

সব কোষেই পরমাত্মা বিদ্যমান। ঘটের দ্বারা যেমন আকাশ খণ্ডিত হয় না তেমনি পরমাত্মাও এই কোষগুলির দ্বারা বিভক্ত হয়ে যান না।

দ্বয়োর্দ্বয়োর্মধুজ্ঞানে পরং ব্রহ্ম প্রকাশিতম্।

পৃথিব্যামুদরে চৈব যথাঽঽকাশঃ প্রকাশিতঃ॥১২

অন্বয়: যথা (যেমন); পৃথিব্যাম্ (পৃথিবীতে, এই বাহ্যজগতে); উদরে চ ([মানুষের] উদরের ভিতরেও); আকাশঃ (আকাশ); প্রকাশিতঃ (প্রকাশিত); মধুজ্ঞানে ([বৃহদারণ্যক উপনিষদের অন্তর্গত] মধু ব্রাহ্মণে); দ্বয়োঃ দ্বয়োঃ পরং ব্রহ্ম প্রকাশিতম্ (সব যুগল বস্তুতে [যেমন ভিতরে ও বাইরে] ব্ৰহ্ম প্রকাশিত)।

সরলার্থ: একই আকাশ মানুষের দেহের অভ্যন্তরেও আছে, আবার পৃথিবীর অভ্যন্তরেও আছে। সেইরকম ব্রহ্মও সর্বত্র এবং সকল যুগল বস্তুর ভিতরে ও বাইরে আছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদের মধু ব্রাহ্মণে জীবাত্মা ও পরমাত্মার একত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

ব্যাখ্যা: আকাশের মতো পরমাত্মাও সবকিছুর ভিতরে ও বাইরে সর্বত্র বিদ্যমান—মানুষের দেহের অভ্যন্তরেও যেমন আবার বাইরের জগতেও তেমনি। দুই বোধ মুছে গেলে তখন সর্বত্র এক দেখা যায়। তখন ছোট-বড়, ভিতর-বাহির, ব্যষ্টি-সমষ্টি—সব যুগল বস্তুতে সেই একই আত্মা।

এই প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদের মধু ব্রাহ্মণ অধ্যায়ের উল্লেখ করা হয়েছে। ‘মধু’ শব্দটির অর্থ—‘আনন্দ’। জীবাত্মা ও পরমাত্মার একত্ব এই অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় বলে অধ্যায়ের নামকরণ হয়েছে ‘মধু’। কারণ এই একত্বের উপলব্ধি হলে মানুষ পরমানন্দ অনুভব করে।

জীবাত্মনোরনন্যত্বমভেদেন প্ৰশস্যতে।

নানাত্বং নিন্দ্যতে যচ্চ তদেবং হি সমঞ্জসম্॥১৩

অন্বয়: [যৎ (যেহেতু)]; জীবাত্মনঃ (জীবাত্মা ও পরমাত্মা); অনন্যত্বম্ (একত্ব); অভেদেন (অভিন্নভাবে); প্রশস্যতে (প্রশংসিত হয়); যৎ চ নানাত্বং নিন্দ্যতে (যেহেতু দ্বৈতবাদ শাস্ত্রে নিন্দিত); তৎ এবম্ (সেহেতু এই [একত্ব]); সমঞ্জসম্ (যুক্তিযুক্ত)।

সরলার্থ: যেহেতু শাস্ত্রে জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতার প্রশংসা এবং দ্বৈতবাদের নিন্দা করা হয়েছে সেহেতু এই একত্ব যুক্তিযুক্ত।

ব্যাখ্যা: শাস্ত্রে আছে, ব্রহ্মকে যিনি জানেন তিনি স্বয়ং ব্রহ্মই হয়ে যান। এর অর্থ এই যে মানুষ চিরকালই ব্রহ্ম, কিন্তু একথা সে জানে না। চোখের উপর থেকে অজ্ঞানতার আবরণ সরে গেলেই মানুষ তার প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে।

শাস্ত্র আরও বলে আত্মাই জগৎরূপে প্রকাশিত—দুই নেই, সব এক। দুই দেখাটা ভুল। দুই দেখলে মানুষ কখনো নিরাপদ বোধ করতে পারে না। ভয় তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। তার বারবার পুনর্জন্ম হতে পারে। অজ্ঞানতার জন্যই মানুষকে এই মূল্য দিতে হয়।

যাঁরা দ্বৈতবাদী তাঁরা অহেতুক বিষয়টাকে জটিল করে তোলেন। একত্বের ধারণা যুক্তিসিদ্ধ। এ শুধু মানুষকে শান্তি ও আনন্দই দান করে না, এই ধারণা শাস্ত্র-অনুমোদিতও বটে।

জীবাত্মনোঃ পৃথক্‌ত্বং যৎপ্রাগুৎপত্তেঃ প্রকীর্তিতম্।

ভবিষ্যদ্‌বৃত্ত্যা গৌণং তন্মুখ্যত্বং হি ন যুজ্যতে॥১৪

অন্বয়: উৎপত্তেঃ প্রাক্ ([উপনিষদ থেকে] আত্মজ্ঞান লাভের পূর্বে); জীবাত্মনোঃ পৃথক্‌ত্বম্ (জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য); যৎ (যা); প্রকীর্তিতম্ ([বেদের কর্মকাণ্ডে] বলা হয়েছে); তৎ (সেই পার্থক্য); ভবিষ্যদ্‌বৃত্ত্যা (ভবিষ্যতে যে অবস্থা হবে সেই অনুসারে); গৌণম্ (সেহেতু মুখ্য নয়); হি (কারণ); মুখ্যত্বম্ (যা কিছু সত্য); ন যুজ্যতে ([তা] এখানে প্রযোজ্য নয়)।

সরলার্থ: উপনিষদ থেকে আত্মজ্ঞান লাভের আগে—বেদের কর্মকাণ্ডে জীবাত্মা ও পরমাত্মার পার্থক্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ দ্বৈত মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই দ্বৈত ক্ষণিক অর্থাৎ যতক্ষণ অজ্ঞানতা আছে। এক ও অদ্বৈতেই এর পরিণতি। এই ভবিষ্যৎকালীন একত্বকে বোঝাবার জন্যেই ক্ষণিক পার্থক্য দেখানো হয়েছে। বস্তুত এই পার্থক্য যথার্থ নয়, কাল্পনিক।

ব্যাখ্যা: বেদে অনেক জায়গায় ‘বহু’র উল্লেখ আছে। বেদের এই বিশেষ অংশটিকে বলে কর্মকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে ফল কামনা করে যাগযজ্ঞ করার কথা বলা আছে। যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই ব্যক্তি এইটিই কামনা করেছে।’ আবার এমনও আছে ‘ঈশ্বর পৃথিবী ও স্বর্গ উভয়কেই ধারণ করে আছেন।’ অর্থাৎ স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি পৃথক। এই দ্বৈতবোধই কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য।

বেদের অপর অংশ জ্ঞানকাণ্ড—যার আলোচ্য বিষয় আত্মজ্ঞান। কর্মকাণ্ডের চেয়ে জ্ঞানকাণ্ড যে বেশি যুক্তিনির্ভর, একথা সর্বজনস্বীকৃত। কেন?

উত্তর হল, কর্মকাণ্ডে যে দ্বৈতবাদের কথা বলা হয় তা আদপে দ্বৈতবাদ নয়। পটাকাশ ও ঘটাকাশের দৃষ্টান্তে যেমন আকাশকে দুই বলে মনে হয়, কর্মকাণ্ডে দুই জ্ঞানও ঠিক সেইরকম। আসলে একই আকাশ। ঘট আরোপ করাতেই দুই বলে মনে হয়।

একইভাবে কর্মকাণ্ডে যে বাক্যগুলিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে পৃথক বলে দেখানো হয়েছে, সেগুলি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এই (ভেদবোধক) বাক্যগুলির দ্বারা সবসময় (জীবাত্মা ও পরমাত্মার) একত্বকেই বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে যা ঘটবে তাই বোঝানো হয়েছে। যেমন আমরা বলি, ‘আমি ভাত রান্না করছি।’ আসলে আমি ভাত রান্না করছি না, চাল সিদ্ধ করছি। চাল সিদ্ধ হয়ে তবেই ভাত হবে। সুতরাং ভাত এখনও ভবিষ্যতের ঘটনা—একথা বলা যায়। আবার এমনও নয় যে আমি নতুন কিছু তৈরি করছি। ভাত চালেরই রূপান্তর মাত্র। সেইভাবে জীবাত্মা সবসময়ই পরমাত্মা—দেহরূপ উপাধির জন্য এই জীবাত্মাকে পরমাত্মার থেকে পৃথক বলে মনে হয়। এই উপাধি অবিদ্যাপ্রসূত। চাল আর ভাতে যেমন মৌলিক কোন পার্থক্য নেই, তেমনি জীবাত্মা আর পরমাত্মাতেও কোন ভেদ নেই।

জ্ঞানকাণ্ডে এজাতীয় উল্লেখ পাওয়া যায়—‘তুমিই সেই’ (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬।৮।৭) এবং ‘যিনি বলেন “আমি এক আর সে আর এক” তিনি কিছুই জানেন না’ (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১।৪।১০)। এইসব বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদী উক্তির পাশে দ্বৈতবাদী মন্তব্যগুলি অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। যদি এগুলির কোন সার্থকতা থাকেও তা হল অদ্বৈততত্ত্ব ধারণা করার জন্য মনকে প্রস্তুত করা।

মৃল্লোহবিস্ফুলিঙ্গাদ্যৈঃ সৃষ্টির্যা চোদিতাঽন্যথা।

উপায়ঃ সোঽবতারায় নাস্তি ভেদঃ কথঞ্চন॥১৫

অন্বয়: মৃল্লোহবিস্ফুলিঙ্গাদ্যৈঃ (মাটি, লোহা, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও অন্যান্য এই জাতীয় দৃষ্টান্ত দ্বারা); অন্যথা (নানা উপায়ে); যা সৃষ্টিঃ চোদিতা (সৃষ্টিকার্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে); সঃ (সেই [সৃষ্টি]); অবতারায় উপায়ঃ (মনকে প্রস্তুত করার জন্য [অদ্বৈতজ্ঞান লাভের উপযুক্ত করার জন্য]); কথঞ্চন ভেদঃ ন অস্তি (কিছুমাত্র ভেদ নেই)।

সরলার্থ: যদিও শাস্ত্রে মাটি, লোহা, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ইত্যাদি দৃষ্টান্ত দিয়ে নানাভাবে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা শুধু অদ্বৈততত্ত্বের জন্য মনকে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে। বস্তুত এর মধ্যে কিছুমাত্র ভেদ নেই, দুই নেই।

ব্যাখ্যা: সৃষ্টি এবং দ্বিতত্ত্বের অস্তিত্ব অদ্বৈতবাদীরা স্বীকার করেন না। দুই-ই অলীক। ঘটাকাশ ও পটাকাশ যেমন দুই নয়, এক ও অভিন্ন, সেইভাবে সৃষ্টি ও স্রষ্টা আলাদা নয়, এক।

তবু শাস্ত্রে সৃষ্টি ও দ্বিতত্ত্বের যে উল্লেখ আছে, তা শুধু এই দুটি তত্ত্বের অসারতা বোঝাবার জন্য—অদ্বৈতবাদীরা এরকমই বলে থাকেন। তাঁরা আরও বলেন যে দ্বৈতবাদ নানা বিতর্কের সৃষ্টি করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ তাঁরা দেবাসুরের যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। দেবতাদের মন শুদ্ধ ও নিঃস্বার্থপর, তাই তাঁদের জয় হয়েছিল। অদ্বৈততত্ত্ব ধারণা করার জন্য মনের কিরকম প্রস্তুতি দরকার তা বোঝাতেই এই ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।

অবশ্য শাস্ত্রে সৃষ্টির কাহিনীও বর্ণনা করা আছে। মনকে অদ্বৈতজ্ঞানের উপযুক্ত করার জন্যেই এইসব কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে সৃষ্টি এবং ভেদদর্শনকে মনের ভুল বলে নিন্দাও করা হয়েছে—ঠিক যেমনভাবে বলা হয় ঘটাকাশের কখনো উৎপত্তি হয়নি এবং এর কোন বাস্তব অস্তিত্বও নেই।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল একই শাস্ত্রে আবার বহু অদ্বৈতবোধক উক্তিও রয়েছে। যেমন ‘তিনি এক এবং অদ্বিতীয়’ (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬।২।২)। ‘সে-ই সত্য, সে-ই আত্মা, এবং তুমিই সে।’ (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬।৮।৭)।

আশ্রমাস্ত্রিবিধা হীনমধ্যমোৎকৃষ্টদৃষ্টয়ঃ।

উপাসনোপদিষ্টেয়ং তদর্থমনুকম্পয়া॥১৬

অন্বয়: আশ্রমাঃ হীন-মধ্যম-উৎকৃষ্ট-দৃষ্টয়ঃ ত্রিবিধাঃ (ধারণা করার ক্ষমতা অনুযায়ী, স্ত্রী ও পুরুষদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায় : হীন, মধ্যম ও উৎকৃষ্ট); অনুকম্পয়া ([শাস্ত্রাদি] করুণাবশত); তদর্থম্ (তাদের জন্য); ইয়ম্ (এই); উপাসনা (উপাসনা পদ্ধতি); উপদিষ্ট (নির্দেশ করেছেন)।

সরলার্থ: অধিকারী ভেদে মানুষকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—হীন, মধ্যম ও উৎকৃষ্ট। শাস্ত্র করুণাবশত হীন ও মধ্যম অধিকারীদের জন্য নানা উপাসনা-পদ্ধতির নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু উত্তম অধিকারীর জন্য আলাদা কোন উপাসনার বিধান শাস্ত্রে নেই।

ব্যাখ্যা: শাস্ত্রে প্রায়ই পরস্পরবিরোধী উক্তি দেখা যায়। কোথাও আছে ‘অগ্নিহোত্র জাতীয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান কর’, ‘তাঁকে নিজ আত্মা জ্ঞানে উপাসনা কর’ ইত্যাদি। এইসব উক্তি স্পষ্টতই দ্বৈতবাদী এবং এর দ্বারা আচার-অনুষ্ঠানকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আবার অন্যত্র শাস্ত্রে আছে যে আত্মা এক এবং অদ্বিতীয় এবং মানুষের জীবনের লক্ষ্য সেই আত্মাকে উপলব্ধি করা। কিভাবে এই বিরোধের সমন্বয় সাধন করা যায়?

এর উত্তর খুব সহজ : আমরা সবাই এক ধাতুতে গড়া নই। বহু দিক থেকেই আমরা পরস্পর স্বতন্ত্র এবং শাস্ত্র এই পার্থক্যের কথা স্বীকার করে। একই জিনিস সকলকেই গলাধঃকরণ করতে হবে—এ কখনই শাস্ত্রের অভিপ্রায় নয়। শাস্ত্রের নীতি হল: যার পেটে যা সয়।

অনেক মানুষ আছেন যাঁরা জীবনকে উপভোগ করতে চান। শাস্ত্র বলে ‘তাঁরা উপভোগ করুন। কিন্তু একথা যেন তাঁরা মনে রাখেন ভোগের ভিতর দিয়ে কখনো সুখী হওয়া যায় না। একমাত্র ত্যাগের মধ্য দিয়েই তাঁরা আনন্দ পেতে পারেন।’ শাস্ত্রে একই গাছে দুটি পাখীর উপমা আছে। একটা পাখী একের পর এক ফল খেয়ে চলেছে—ফলটা মিষ্টি হলেই সে খুশি, আবার টক হলেই দুঃখী। সুতরাং পাখীটি কখনো সুখী, কখনো দুঃখী। অন্য পাখীটি কিন্তু অচল, অটল, স্থির। কিছু করছে না। সে সদাপ্রসন্ন।

এই পাখী দুটি পরস্পর পৃথক নয়, এক এবং অভিন্ন। প্রথম পাখীটি জীবাত্মার উপমা দ্বিতীয়টি পরমাত্মার। যখন আমরা উপলব্ধি করি আমরাই পরমাত্মা—তখন আমরা সুখী। কিন্তু সকলের জন্য তো আর ত্যাগের পথ নয়। শাস্ত্র তাদের জন্য ভোগের পথ অনুমোদন করে। কিন্তু তাঁরা যেন সব কাজ ‘ঈশ্বরের পূজা’ -জ্ঞানে করে—এই শাস্ত্রের নির্দেশ। তাদের জন্য ‘কর্মই উপাসনা’।

শাস্ত্র সবকিছু ব্যবহারিক দৃষ্টিতে দেখে। শাস্ত্র জানে বিভিন্ন মানুষের রুচি ও ক্ষমতাও বিভিন্ন। তাই শাস্ত্র চায় না সকলে একই পথে চলুক। বিভিন্ন মানুষের জন্য শাস্ত্র বিভিন্ন পথের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কিছু মানুষ আছে যাঁরা অদ্বৈততত্ত্ব ধারণা করতে সক্ষম। শাস্ত্র তাদের কাছে অদ্বৈতবাদই প্রচার করে এবং তাদের সম্পূর্ণ ত্যাগ-বৈরাগ্যের পথ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়। অন্যদের জন্য শাস্ত্রের নির্দেশ দ্বৈতবাদ এবং ‘কর্মই উপাসনা’ এই নীতি। এই দুই চরমপন্থীর মাঝে আরও নানা পথ রয়েছে। যার পক্ষে যা সর্বোত্তম—তাকে শাস্ত্র সেই পথই অবলম্বন করতে বলে। কিন্তু সে যেন না মনে করে তার পথই শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পথ—শাস্ত্র এ-ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়।

স্বসিদ্ধান্তব্যবস্থাসু দ্বৈতিনো নিশ্চিতা দৃঢ়ম্।

পরস্পরং বিরুধ্যন্তে তৈরয়ং ন বিরুধ্যতে॥১৭

অন্বয়: দ্বৈতিনঃ (দ্বৈতবাদীরা); স্বসিদ্ধান্তব্যবস্থাসু দৃঢ়ং নিশ্চিতাঃ (নিজ প্রত্যয়ে দৃঢ়বুদ্ধি); পরস্পরং বিরুধ্যন্তে (নিজেদের মধ্যে তর্কযুদ্ধ করে); তৈঃ (তাদের সঙ্গে); অয়ম্ (ইনি, অদ্বৈতবাদী); ন বিরুধ্যতে (কখনো দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন না)।

সরলার্থ: দ্বৈতবাদীরা আপন প্রত্যয়ে দৃঢ়বুদ্ধি, কিন্তু তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। কিন্তু অদ্বৈতবাদীরা কখনো তাঁদের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হন না।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈতবাদী অভ্রান্ত, কারণ তাঁর সিদ্ধান্ত যুক্তি এবং শাস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। কপিল কণাদ বুদ্ধ এবং জৈন প্রভৃতি দ্বৈতবাদীরা আপন আপন প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং মনে করেন যে তাঁদের সিদ্ধান্ত নির্ভুল। কিন্তু পরিহাসের ব্যাপার হল তাঁরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। অদ্বৈতবাদী কিন্তু কারও সঙ্গে বিবাদে প্রবৃত্ত হন না। অদ্বৈততত্ত্ব সর্বগ্রাহী এবং সব মতবাদের সর্বোচ্চ পরিণতি। তিনি সকলকেই গ্রহণ করেন, কাউকে বর্জন করেন না। তাঁর মতে বিভিন্ন মতবাদ একই লক্ষ্যে পৌঁছবার বিভিন্ন ধাপ মাত্র। কিন্তু দ্বৈতবাদীরা আত্মতুষ্ট এবং অহঙ্কারে অন্ধ।

অদ্বৈতং পরমার্থো হি দ্বৈতং তদ্ভেদ উচ্যতে।

তেষামুভয়থা দ্বৈতং তেনায়ং ন বিরুধ্যতে॥১৮

অন্বয়: হি (যেহেতু); অদ্বৈতম্ (অদ্বৈত); পরমার্থঃ (পরম সত্য); দ্বৈতম্ (দ্বৈত); তদ্ভেদঃ (কার্যমাত্র [অদ্বৈতের উদ্দেশে এক পদক্ষেপ মাত্র]); উচ্যতে (একটি নাম মাত্র); তেষাম্ (দ্বৈতবাদীদের পক্ষে); উভয়থা (নিত্য এবং আপেক্ষিক উভয়ই); দ্বৈতম্ (দ্বিতত্ত্বই একমাত্র সত্য); তেন (অতএব); অয়ং ন বিরুধ্যতে (এটি অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধতা করে না)।

সরলার্থ: যেহেতু অদ্বৈতই চূড়ান্ত তত্ত্ব, দ্বৈতের বহু দেখা কেবল অদ্বৈতেরই ভেদ, সুতরাং তার কার্যমাত্র। দ্বিতত্ত্বের অস্তিত্ব শুধুমাত্র নামে। কিন্তু দ্বৈতবাদীরা মনে করেন যে দ্বিতত্ত্ব একযোগে নিত্যও বটে আবার আপেক্ষিকও বটে। দ্বিতত্ত্ব যেহেতু অদ্বৈততত্ত্বের উপর নির্ভরশীল, তাই দ্বিতত্ত্ব কখনো অদ্বৈততত্ত্বকে খণ্ডন করতে পারে না।

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদের মধ্যে যে কোনও মৌলিক বিরোধ নেই—এই শ্লোকে তা পরিষ্কার করে দেখানো হয়েছে। দ্বিতত্ত্বের কোন স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। এটি অদ্বৈতেরই আর এক নাম। দ্বিতত্ত্ব হল কার্য, অদ্বৈততত্ত্ব কারণ। কারণ ছাড়া কি কার্য হতে পারে? কারণই কার্যে পরিণত হয়ে থাকে। একই বহু হয়ে আছেন—এই বহুত্ব শুধু নামে আর রূপে। শাস্ত্রে একেই বলে মায়া—এক পরমাত্মার উপর বহু আরোপিত মাত্র।

‘বহু’ বলে যে কিছু নেই তা প্রমাণিত হয় সুষুপ্তিতে ও মানুষ অজ্ঞান হয়ে গেলে। সেই অবস্থায় মানুষের কোন দুই বোধ থাকে না। দ্বৈত মনের রচনা এবং সুষুপ্তি অবস্থায় মন যেহেতু সক্রিয় থাকে না, তাই সুষুপ্তিকালে মানুষের দুই বোধও থাকে না।

দ্বৈতবাদীর সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় প্রবৃত্ত হওয়াকে অদ্বৈতবাদী আবশ্যক জ্ঞান করেন না। অদ্বৈতবাদী যেন হাতি চড়ে চলেছেন। নীচে মাটিতে দাঁড়িয়ে কোন ব্যক্তি যদি তাঁকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করে বলেন তিনিও হাতি চড়ে চলেছেন তাহলে প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় জনের এই আহ্বানে কর্ণপাত করবেন কি? করবেন না। তিনি হেসে শান্তভাবে নিজের পথে চলে যাবেন।

মায়য়া ভিদ্যতে হ্যেতন্নান্যথাঽজং কথঞ্চন।

তত্ত্বতো ভিদ্যমানে হি মর্ত্যতামমৃতং ব্রজেৎ॥১৯

অন্বয়: এতৎ (এই); অজম্ (যার জন্ম নেই [এবং মৃত্যুও নেই অর্থাৎ ব্রহ্ম]); হি (নিশ্চিতভাবে); মায়য়া (মায়ার দ্বারা); ভিদ্যতে (বহু বলে প্রতিভাত); অন্যথা ন (অন্য কোন উপায়ে নয়); কথঞ্চন (কোন না কোন ভাবে); হি (কারণ); তত্ত্বতঃ (স্বরূপত); ভিদ্যমানে (যদি এটি পরিবর্তিত হয়); অমৃতম্ (অবিনাশী [ব্রহ্ম]); মর্ত্যতাম্ (মরণশীল); ব্রজেৎ (হয়ে যাবে)।

সরলার্থ: ব্রহ্মের জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। নিজ মায়াশক্তির দ্বারা ইনি বহু রূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মের কোন পরিবর্তন হয় না। সত্যিই যদি ব্রহ্ম পরিবর্তিত হতেন তাহলে অবিনাশী হতেন না, মরণশীল হতেন।

ব্যাখ্যা: আগে বলা হয়েছে অদ্বৈত হল কারণ, দ্বৈত তার কার্য। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে অদ্বয় ব্রহ্ম এই দৃশ্যমান দ্বৈতজগতে পরিবর্তিত হয়েছেন? না, ব্রহ্ম সদা অবিকৃত। ব্রহ্ম নিত্য। পরিবর্তন হলে ব্রহ্ম অবিনাশী হতেন না। তাহলে এই দ্বৈতজগৎ কোথা থেকে এল? এই জগৎ প্রতিভাস মাত্র—চোখের অসুখে অনেক সময় আমরা যেমন দুটো দুটো দেখি, এও ঠিক তেমনি। আমরা দুই দেখছি, আসলে আছেন কেবল এক ও অদ্বয় ব্রহ্ম। দুই দেখা রজ্জুতে সর্পভ্ৰমতুল্য। ব্রহ্মই অধিষ্ঠান, নাম-রূপের এই দৃশ্যজগৎ ব্রহ্মের উপর আরোপিত মাত্র।

ব্রহ্ম নিত্য, অখণ্ড, অমৃত, নিরাকার, অপরিবর্তিত ও অপরিবর্তনীয়। ব্রহ্ম শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। ইনি আকাশের মতো—সর্বত্র এবং সর্বভূতে বিরাজমান। যেহেতু রূপ নেই, অতএব তাঁর রূপান্তরের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আগুন কি তার উত্তাপ হারিয়ে শীতল হয়ে যেতে পারে? পরমাত্মা স্বরূপত নিরাকার এবং চিরকাল নিরাকারই থাকবেন। ব্রহ্ম নরম মাটির তাল নন যে তাঁকে নানা রূপ দেওয়া যাবে।

অজাতস্যৈব ভাবস্য জাতিমিচ্ছন্তি বাদিনঃ।

অজাতো হ্যমৃতো ভাবো মর্ত্যতাং কথমেষ্যতি॥২০

অন্বয়: বাদিনঃ (দ্বৈতবাদীরা); অজাতস্য ভাবস্য (যা জন্মরহিত তার); এব জাতিম্ ইচ্ছন্তি (জন্মের স্বপক্ষে তর্কবিচার করেন); অজাতঃ হি অমৃতঃ ভাবঃ (যার জন্ম নেই তার [অবশ্যই] মৃত্যুও নেই); কথং মর্ত্যতাম্ এষ্যতি (কিভাবে মরণশীল হতে পারে)?

সরলার্থ: যা জন্মরহিত তারও জন্ম হতে পারে—এজাতীয় তর্ক দ্বৈতবাদীরা করে থাকেন। কিন্তু যে বস্তুর জন্ম নেই, তার মৃত্যুও নেই। সুতরাং এমন বস্তুর (যার জন্ম নেই) মৃত্যু কেমন করে হতে পারে?

ব্যাখ্যা: আত্মা অবিনাশী অর্থাৎ জন্মমৃত্যুরহিত। তথাপি কিছু দ্বৈতবাদী যুক্তিতর্কের দ্বারা আত্মার জন্ম হতে পারে একথা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তাঁরা ভুলে যান যে জন্ম থাকলে মৃত্যুও থাকতে হবে। জন্ম-মৃত্যুর একটি থাকলে অন্যটিও থাকতে বাধ্য। যেহেতু আত্মার মৃত্যু নেই, অতএব তাঁর জন্মও হতে পারে না। ‘মৃত্যুহীনের জন্ম হয়’—এ প্রস্তাব উদ্ভট।

ন ভবত্যমৃতং মর্ত্যং ন মর্ত্যমমৃতং তথা।

প্রকৃতেরন্যথাভাবো ন কথঞ্চিদ্ভবিষ্যতি॥২১

অন্বয়: অমৃতম্ (যা অবিনশ্বর); মর্ত্যং ন ভবতি (মরণশীল হতে পারে না); তথা (সেইরকমভাবে); মর্ত্যম্ (যা মরণশীল); অমৃতং ন [ভবতি] (তা মৃত্যুহীন হতে পারে না); কথঞ্চিৎ (যে কোনও বস্তু); প্রকৃতেঃ অন্যথাভাবঃ ন ভবিষ্যতি (যেভাবে প্রকৃতি তাকে সৃষ্টি করেছে তার চেয়ে অন্যরকম হতে পারে না)।

সরলার্থ: যা স্বভাবতই মৃত্যুহীন, তার কখনো মৃত্যু হতে পারে না। একইভাবে যা স্বভাবতই মরণশীল, তা অমর হতে পারে না। প্রকৃতি যে বস্তুকে যেভাবে তৈরি করেছে, তার থেকে সে অন্যরকম হতে পারে না।

ব্যাখ্যা: যা স্বভাবতই অমৃত—তা সবসময় এবং সব অবস্থাতেই অমর। আবার যা স্বভাবতই মরণশীল, তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য—যেহেতু এটি মরণশীল, অতএব সব অবস্থাতেই তাকে মরণশীল হতে হবে। কখনই এ অমর হতে পারে না। প্রকৃতি যে বস্তুকে যেমনভাবে সৃষ্টি করেছেন তার অন্যথা হওয়া সম্ভব নয়। আগুন কি কখনো উত্তাপহীন হতে পারে?

স্বভাবেনামৃতো যস্য ভাবো গচ্ছতি মর্ত্যতাম্।

কৃতকেনামৃতস্তস্য কথং স্থাস্যতি নিশ্চলঃ॥২২

অন্বয়: যস্য (যিনি মনে করেন); স্বভাবেন অমৃতঃ ভাবঃ (যে বস্তু স্বভাবতই মৃত্যুহীন [তাও তার স্বভাবের পরিবর্তন করতে পারে (এবং)]); মর্ত্যতাং গচ্ছতি (মরণশীল হতে পারে [তাঁর কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা]); তস্য কৃতকেন (তাঁর নিজের চেষ্টায় অর্জিত); অমৃতঃ (মোক্ষ); কথং স্থাস্যতি নিশ্চলঃ (কিভাবে চিরস্থায়ী হবে)?

সরলার্থ: যদি কেউ বলেন কোন বস্তু স্বভাবত অবিনাশী হয়েও নিজ স্বভাব পরিবর্তন করতে পারে অর্থাৎ বিনাশশীল হতে পারে (তবে আমরা তাঁকে প্রশ্ন করব)—তাহলে কঠোর সাধনায় তুমি যে মোক্ষলাভ করেছ তাও বদলাতে পারে? অর্থাৎ তোমার মোক্ষ চিরস্থায়ী নয়?

ব্যাখ্যা: কিছু মানুষ বিতর্ক শুরু করতে পারেন যে তথাকথিত ‘মরণরহিত’ বস্তুরও জন্ম হয় অর্থাৎ আত্মার জন্ম হয়। সেইক্ষেত্রে ‘মরণরহিত’ এই বিশেষণটির ব্যবহার তাঁদের পক্ষে কতটা যুক্তিযুক্ত? তাঁরা হয়তো উত্তরে বলবেন: ‘জন্মাবার আগে আত্মাতে এই বিশেষণটি প্রযোজ্য। যখন আত্মার জন্ম হয়নি তখন তিনি মরণরহিত ছিলেন।’ কিন্তু আদপেই যদি আত্মার জন্ম হয় তাহলে তিনি কিভাবে মৃত্যুহীন হবেন? জন্ম হলে তাঁর পরিবর্তনও হবে অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর অধীন হবেন। তাহলে আবার মরণরহিত হন কি করে? ‘অজ’ (যার জন্ম হয়নি) শব্দটি আত্মার প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। যদি বলা হয় আত্মার জন্ম হয়েছে—তবে ‘অজ’ শব্দটি সকল তাৎপর্য হারায়। সবকিছুই তখন বিনাশশীল হয়ে ওঠে, কারণ যা জন্মায়, তার মৃত্যুও অবধারিত।

আত্মার যদি জন্ম-মৃত্যু থাকে, তবে মোক্ষ বলে আর কিছু থাকতে পারে না। মোক্ষ এমন একটি অবস্থা যখন মানুষ নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলে বোধ করে। এই বোধ তখনি আসে যখন সাধক আত্মার সঙ্গে এক হয়ে যান। কিন্তু আত্মা যদি নিজেই মুক্ত না হন, নিজেই যদি জন্ম-মৃত্যুর অধীন হন, তবে সাধক কিভাবে নিজেকে জন্ম-মৃত্যুরহিত মনে করতে পারেন?

ভূততোঽভূততো বাঽপি সৃজ্যমানে সমা শ্রুতিঃ।

নিশ্চিতং যুক্তিযুক্তং চ যত্তদ্ভবতি নেতরৎ॥২৩

অন্বয়: ভূততঃ (সত্য); বা অভূততঃ (অথবা অসত্য); সৃজ্যমানে অপি সমা শ্রুতিঃ (সৃষ্টির বিষয়ে শাস্ত্রের সমর্থন সমপরিমাণে আছে); যৎ নিশ্চিতম্ (যা শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত); যুক্তিযুক্তং চ (যুক্তি-বিচারের দ্বারাও সমর্থিত); তৎ ভবতি (সেটিকে স্বীকার করে নিতে হবে); ন ইতরৎ (অন্য কিছু নয়)।

সরলার্থ: সত্য বা অসত্য—দুই প্রকার সৃষ্টির প্রসঙ্গেই শাস্ত্র সমানভাবে বলে গেছেন। এই অবস্থায় শুধুমাত্র যে সিদ্ধান্ত শাস্ত্রে আছে এবং বিচার-বুদ্ধি দ্বারাও যা সমর্থিত তাকেই গ্রহণ করতে হবে, অন্য কিছু নয়।

ব্যাখ্যা: শাস্ত্র কেন সৃষ্টির কথা বলেছেন—অদ্বৈতবাদীরা আবার তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। দ্বৈতবাদ খণ্ডন ও অদ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যই শাস্ত্র সৃষ্টি-প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। অদ্বৈততত্ত্ব গ্রহণে মনকে প্রস্তুত করে তোলার এটি একটি উপায়মাত্র।

আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে—‘তিনি সৃষ্টি করলেন’ অথবা ‘তিনি স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয়ই হলেন’—এজাতীয় শাস্ত্রীয় উক্তি অদ্বৈতবাদের বিরোধী নয়। আসলে আত্মার ‘সৃষ্টি’ও নেই, ‘হয়ে ওঠা’ও নেই কারণ আত্মা সতত অবিকৃত। কর্ম বা পরিবর্তনের ধারণা আত্মার ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য। তাহলে এজাতীয় শাস্ত্রীয় উক্তির ব্যাখ্যা কি করে হয়? উত্তর হল—বস্তুত আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না এবং আত্মায় কর্মেরও কোন স্থান নেই। আত্মার মায়াশক্তির প্রভাবে আমাদের ধারণা হয় যেন তিনি পরিবর্তিত হচ্ছেন, যেন কর্ম করছেন। জাগ্রত বা স্বপ্নাবস্থায় মনে হতে পারে যে সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি সত্য নয়। আত্মাই একমাত্র সত্য—আর সব মিথ্যা। শাস্ত্র বলে ‘আত্মা অন্তরে ও বাইরে সর্বত্র বিরাজমান, এক ও অদ্বিতীয়। আত্মাই সত্য, জ্ঞান। আত্মাই ব্রহ্ম—তাঁর জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই।’ শাস্ত্র এবং যুক্তি উভয়ই এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে।

নেহ নানেতি চাম্নায়াদিন্দ্রো মায়াভিরিত্যপি।

অজায়মানো বহুধা মায়য়া জায়তে তু সঃ॥২৪

অন্বয়: ইহ (ব্রহ্মে); নানা ন ইতি চ (বহু নেই এবং); ইন্দ্রঃ মায়াভিঃ (ঈশ্বর তাঁর মায়ার দ্বারা); ইতি অপি (এই মর্মে); অম্লায়াৎ (শাস্ত্র বলছেন); অজায়মানঃ ([যদিও] জন্ম নেই); সঃ (ঈশ্বর); মায়য়া (মায়ার দ্বারা); তু (কিন্তু); বহুধা জায়তে (বহু হলেন)।

সরলার্থ: ‘ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়, এবং ঈশ্বর মায়ার সাহায্যে বহু হলেন’—শাস্ত্রে এইসব কথা আছে। তাই আমরা জানি যদিও ঈশ্বর জন্মরহিত, তবু নিজ মায়ার দ্বারা বহুরূপে প্রকাশিত হলেন।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈততত্ত্বকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়? বৈচিত্রে পূর্ণ এই জগৎ সত্য নয়। সত্য যে নয় তার কারণ শাস্ত্র অকুণ্ঠভাবে ঘোষণা করছে: ‘বহু নেই, কেবল এক আছে।’ দ্বৈতবাদকে খণ্ডন করে এজাতীয় ঘোষণা শাস্ত্রে আরও অনেক আছে। প্রাণের (ইন্দ্রিয়ের) বিষয়ে একটি উপাখ্যান আছে যেখানে দেখানো হয়েছে একমাত্র মনের স্থানই সর্বোচ্চ। আবার আত্মাই একমাত্র সত্য, অন্য সবকিছু মিথ্যা—তা দেখাবার জন্য সৃষ্টির কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। নিজ মায়াশক্তির দ্বারা আত্মা আপনাকে বহুরূপে প্রকাশ করেন।

কিন্তু মায়া কি? মায়া হল জগৎকে আমরা যেভাবে দেখি। এই দেখাটা ভুল, কারণ তা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা লভ্য। আত্মা জন্মরহিত হয়েও বহুরূপে প্রতিভাত হন। এই ভুল দেখার জন্য দায়ী মায়া। যাঁর জন্ম নেই সেই আত্মা কি বহু হতে পারেন? আগুন কি একই সঙ্গে গরম ও ঠাণ্ডা দুই-ই হতে পারে? এ তো স্ববিরোধী কথা।

শাস্ত্র বলে যে ব্যক্তি জানেন একমাত্র আত্মাই আছেন তাঁর আর কোন আসক্তি থাকে না, কোন দুঃখও থাকে না। শাস্ত্র আরও বলে: ‘তুমি যদি বহু দেখ তবে মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে তোমাকে বারবার যাওয়া-আসা করতে হবে।’ এ-জাতীয় অসংখ্য শাস্ত্রীয় বিবৃতি পাওয়া যায়। এইসব উক্তির লক্ষ্য একটিই—তা হল অদ্বৈতজ্ঞান।

নংভূতেরপবাদাচ্চ সংভবঃ প্রতিষিধ্যতে।

কো ন্বেনং জনয়েদিতি কারণং প্রতিষিধ্যতে॥২৫

অন্বয়: সংভূতেঃ অপবাদাৎ (সংভূতিকে [হিরণ্যগর্ভ, প্রথম সত্তা] খণ্ডন করায়) সংভবঃ প্রতিষিধ্যতে (যে কোনও বস্তুর জন্মের প্রশ্নটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে); কঃ নু এনং জনয়েৎ (জীবাত্মাকে কে সৃষ্টি করবে?); ইতি ক্যরণং প্রতিষিধ্যতে (কারও পক্ষে এর কারণ হওয়া অসম্ভব)।

সরলার্থ: সর্বভূতের আদি কারণ হিসেবে হিরণ্যগর্ভের উপাসনা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। তাহলে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে এই ধারণা বাতিল হয়ে গেল। সেইক্ষেত্রে একে (জীবাত্মাকে) কে আবার সৃষ্টি করবে? এর দ্বারা জীবাত্মার উৎপত্তির কারণও বাতিল করা হয়েছে।

ব্যাখ্যা: যখন বীজ বৃক্ষে পরিণত হয়, তখন সেই বৃক্ষটি বীজের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। বীজ কারণ, বৃক্ষ কার্য। কার্য স্থায়ী নয়, কারণই স্থায়ী।

সেই একইভাবে ব্রহ্ম প্রথমে নিজেকে হিরণ্যগর্ভ (সম্ভৃতি)-রূপে প্রকাশ করলেন। হিরণ্যগর্ভের ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য, শক্তি ইত্যাদি অনন্ত। যদি কেউ হিরণ্যগর্ভের উপাসনা করে, তবে হিরণ্যগর্ভের মহৎ গুণাবলীর কিছু লাভ করার জন্যই তা সে করে থাকে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য কি? এইসব গুণ কি আত্মজ্ঞান লাভের পথ প্রশস্ত করে?—না। এগুলি অর্জন করলে অন্যের দৃষ্টিতে নিজেকে কেউকেটা বলে বোধ হয়—এইমাত্র। কিন্তু এর দ্বারা লক্ষ্যের কাছাকাছিও আসা যায় না। বরং উদ্দেশ্য (আত্মজ্ঞান) থেকে মানুষ ক্রমশ দূরে সরে যায়। এবং আরও বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। ‘সংভূতি’র উপাসনা করে উপাসক সংভূতি হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু কখনো নিজের আত্মার সঙ্গে এক হতে পারেন না। এইজন্য শাস্ত্রে সংভূতির উপাসনার নিন্দা করা হয়েছে।

কর্ম দুই প্রকার—সকাম কর্ম অর্থাৎ কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য যে কর্ম করা হয়। সকাম কর্ম করে মানুষ আরও দুঃখ-বিপদকে ডেকে আনে। আর এই কর্মের দ্বারা কখনো জন্ম-মৃত্যুর চক্রের বাইরে যাওয়া যায় না। আর একরকম কর্ম আছে যেখানে কর্মই সাধনা। যেমন, কেউ যখন পুজো করছেন তখন সেই পুজোর আনুষঙ্গিক বহু কাজ তাঁকে করতে হয়। এর প্রতিদানে তিনি কিছুই চান না। এই প্রকার কর্মের ফল হল চিত্তশুদ্ধি। চিত্তশুদ্ধি হলে—অর্থাৎ ঐহিক বা পারমার্থিক উভয় প্রকার কামনাশূন্য হলে, তবেই মানুষের অজ্ঞানতা দূর হয় এবং সে তার স্বরূপ জানতে পারে। সে তখন জানতে পারে সে-ই পরমাত্মা স্বয়ং।

এখন প্রশ্ন হল একবার স্বরূপজ্ঞান হলে মানুষ কি তা আবার ভুলে যেতে পারে? সে কি আবার ভাবতে পারে যে সে জীবাত্মা মাত্র এবং তার বহু অপূর্ণতা রয়েছে? না, তা আর সম্ভব নয়। একবার যখন ভুল ভেঙে যায় যে ওটা ‘সাপ’ নয়, ‘দড়ি’ তখন আর তার ভুল হয় না। তখন আর কোন উৎস নেই যার থেকে জীবাত্মার উৎপত্তি হতে পারে। আত্মজ্ঞান যে লাভ করেছে তার কাছে আর সম্ভূতির কোন অস্তিত্বই নেই।

স এষ নেতি নেতীতি ব্যাখ্যাতং নিহ্ণুতে যতঃ।

সর্বমগ্রাহ্যভাবেন হেতুনাঽজং প্রকাশতে॥২৬

অন্বয়: যতঃ (যেহেতু); সঃ এষঃ নেতি নেতি (ঐ [আত্মা] এই নয়, এই নয়); ইতি অগ্রাহ্যভাবেন (এইটি [শাস্ত্রবাক্যটি] বোঝা কঠিন); হেতুনা ব্যাখ্যাতং সর্বম্ (যা কিছু কারণ হিসেবে আগে বলা হয়েছে [তা হল দ্বিতত্ত্ব এবং সেইজন্য]); নিহ্ণুতে (বাতিল করা হল); অজং প্রকাশতে (এইভাবে যা থাকল তা জন্মরহিত আত্মা)।

সরলার্থ: ‘আত্মা এই নয় এই নয়’—এই শাস্ত্রবাক্যটি বোঝা কঠিন। সেইজন্য এতক্ষণ যা কিছু কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে—তা আসলে দ্বিতত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন এই দ্বৈতবাদ সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয়েছে। যা থাকল—তা জন্মরহিত আত্মা।

ব্যাখ্যা: আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাকে পাছে আমরা আত্মা বলে মনে করি তাই শাস্ত্র আমাদের বারবার এই বলে সতর্ক করছেন—‘এটি নয়, এটি নয়।’ অর্থাৎ আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নয়।

তবুও আত্মাকে জানার জন্য আমরা নানা পথ ও উপায় অবলম্বন করে থাকি। আত্মাতে আমরা নানা উপাধিও আরোপ করি। এ সবই নিরর্থক। শাস্ত্র বারবার বলে-‘এটি নয়, এটি নয়।’ কারণ যখন আমরা সব উপাধি, সব মতবাদ, এককথায় আর সবকিছু প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম হব—কেবল তখনি আত্মা নিজেকে আমাদের কাছে প্রকাশ করবেন। মনে রাখতে হবে আত্মা অনন্য। একমাত্র আত্মাই সত্য এবং স্বয়ংপ্রকাশ। আত্মাতেই আর সবকিছু রয়েছে। সেইজন্য সব মত ও সব পথ শেষ পর্যন্ত আত্মাতেই লয় হয়ে যাবে। এগুলির কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই—একমাত্র আত্মাই আছেন।

সতো হি মায়য়া জন্ম যুজ্যতে ন তু তত্ত্বতঃ।

তত্ত্বতো জায়তে যস্য জাতং তস্য হি জায়তে॥২৭

অন্বয়: হি (যেহেতু); সতঃ (যা ইতিপূর্বেই আছে [তার]); জন্ম মায়য়া যুজ্যতে (জন্ম মায়াজাত—সম্ভবত একথা বলা যায়); ন তু তত্ত্বতঃ (কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নয়); যস্য (প্রতিপক্ষের [অর্থাৎ দ্বৈতবাদীর] মতে); তত্ত্বতঃ জায়তে (সত্য সত্যই জাত হয়); তস্য হি (তাদের মতে নিশ্চিতভাবে); জাতম্ (যার জন্ম হয়েছে); জায়তে (জন্মায়)। সরলার্থ: যা ইতিপূর্বেই আছে, মায়ার সাহায্যে তার আবার জন্ম হয়েছে—সম্ভবত এমন কথা বলা যায়, কিন্তু তা যথার্থ নয়। যাঁরা জন্মকে সত্য বলে মনে করেন—তাঁদের কথার তাৎপর্য—জাত আবার জাত হয়।

ব্যাখ্যা: শাস্ত্র বারবার বলছেন—একমাত্র সত্য হল আত্মা, আর এই জগৎ আত্মার উপর নাম-রূপের আরোপ ছাড়া আর কিছু নয়—যেমন আমরা ভুল করে দড়ির উপর সাপ আবোপ করি।

কিন্তু এই আত্মা কোথায় আছেন? এর যে অস্তিত্ব আছে তাই বা কি করে বুঝব? কার্য থাকলে বোঝা যায় কারণও আছে। জাদুর খেলা দেখে তার পিছনে যে জাদুকর আছে তা বুঝতে পারি। শূন্য থেকে কিছুর উৎপত্তি হওয়া অসম্ভব। শূন্য থেকে এই জগতের সৃষ্টি হতে পারে না। জগৎ অবশ্যই কোন কিছুর থেকে হয়েছে—আর তা হল আত্মা। আত্মা এই জগতের নিমিত্ত কারণ। আত্মা নিজ মায়াশক্তির সাহায্যে এই জগৎ উৎপন্ন করেছে। কিন্তু এ জগৎ সত্য নয়—এ যেন জাদুকরের জাদুখেলা।

আত্মা এ জগতের উপাদান কারণও বটে। দড়িই সত্য। দড়ির জায়গায় যে সাপ দেখি তা সত্য নয়। তবু মায়ার প্রভাবে সত্য বলে মনে হয়। সেইভাবে ইন্দ্রিয়-মনের অতীত আত্মা নিজ মায়াশক্তির সাহায্যে এই জগৎরূপে প্রতিভাত হন। রজ্জুতে সর্পভ্রমের মতো এও নেহাতই দেখার ভুল।

দ্বৈতবাদীরা বলেন আত্মা জগৎরূপে জন্ম নিয়েছেন। যা জন্মমৃত্যুরহিত তারও জন্ম হয়—একথাই তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করতে চান। কিন্তু এ তো নেহাতই হাস্যকর। জন্মরহিত যে, তার জন্ম কি করে হয়? এ যে স্ববিরোধী কথা। এরকম প্রস্তাবে দ্বৈতবাদীদের স্বীকার করে নিতেই হয় যে—যে বস্তু ইতিপূর্বেই জন্মগ্রহণ করেছে, তার আবারও জন্ম হতে পারে। কিন্তু যদি তাঁরা যুক্তি দেখান যে একটি বস্তু থেকে আর একটি বস্তুর জন্ম হতে পারে, তবে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে প্রথম বস্তুটির জন্য আবার আরেকটি বস্তু থেকে হয়েছে। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়া অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে। মোক্ষলাভের আর কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।

সুতরাং সিদ্ধান্ত এই যে—আত্মাই একমাত্র সত্য, আত্মা জন্মমৃত্যুরহিত।

অসতো মায়য়া জন্ম তত্ত্বতো নৈব যুজ্যতে।

বন্ধ্যাপুত্রো ন তত্ত্বেন মায়য়া বাঽপি জায়তে॥২৮

অন্বয়: অসতঃ (যা মিথ্যা); জন্ম (জন্ম); মায়য়া (মায়ার সাহায্যে); তত্ত্বতঃ (প্রকৃতপক্ষে); নৈব যুজ্যতে (যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না); বন্ধ্যাপুত্রঃ মায়য়া বা অপি তত্ত্বেন ন জায়তে (মায়ার দ্বারা বা বাস্তবে বন্ধ্যানারী কখনো পুত্রের জন্ম দিতে পারে না)।

সরলার্থ: যা মিথ্যা তার কখনো জন্ম হয় না—মায়ার প্রভাবেও না, বাস্তবেও না। মায়াতে বা বাস্তবে কোনভাবেই বন্ধ্যানারী সন্তানের জন্ম দিতে পারে না।

ব্যাখ্যা: যার অস্তিত্বই নেই তার থেকে কি কোন বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে? কেউ কেউ মনে করেন তা সম্ভব। শাস্ত্র এই মত খণ্ডন করে। বাস্তবে তো নয়ই, মায়ার প্রভাবেও এ সম্ভব নয়। যেমন বন্ধ্যানারী কখনো সন্তানের জন্ম দিতে পারে না— মায়ার সাহায্যেও নয়, বাস্তবেও নয়।

যথা স্বপ্নে দ্বয়াভাসং স্পন্দতে মায়য়া মনঃ।

তথা জাগ্রদ্‌দ্বয়াভাসং স্পন্দতে মায়য়া মনঃ॥২৯

অন্বয়: যথা স্বপ্নে (যেমন স্বপ্নে); মনঃ মায়য়া দ্বয়াভাসং স্পন্দতে (অবিদ্যার প্রভাবে মন দুই দেখে ও তদনুরূপ কর্ম করে [যদিও দুই নেই, এক]); তথা জাগ্রৎ (সেইরকম জাগ্রত অবস্থাতেও); মনঃ মায়য়া (অবিদ্যার প্রভাবে মন); দ্বয়াভাসং স্পন্দতে (দুই দেখে এবং তদনুরূপ কর্ম করে)।

সরলার্থ: স্বপ্নে আমি ছাড়া আর কেউ নেই, তবু অজ্ঞানতাবশত মন দুই দেখে ও সেইমতো কর্ম করে। সেইরকম জাগ্রত অবস্থাতেও মন অবিদ্যার প্রভাবে ভেদদর্শন করে ও তদনুরূপ ব্যবহার করে (বস্তুত দুই নেই, এক। অবিদ্যার কারণে এই ভুল হয়)।

ব্যাখ্যা: মায়া কিভাবে বস্তু উৎপন্ন করে? উত্তর হল দড়িকে ভুল করে যেমন সাপ বলে মনে হয় এও ঠিক তেমনি। মায়ার প্রভাবে মন এই ছলনা করে।

ধরা যাক, স্বপ্নে একটি হাতি দেখলাম। এই দেখাটা আত্মাকে আশ্রয় করে হচ্ছে। আত্মা আছে বলেই এই দেখা সত্য বলে মনে হয়। মন নিজেকে হাতির আকারে আত্মার উপর আরোপ করে। তখন মানসচক্ষুতে হাতি দেখা যায়। মনের তাই এখানে দ্বৈত ভূমিকা: মনই দ্রষ্টা, মনই দৃষ্ট। মায়া মনকে এই দ্বৈত ভূমিকা পালনে অনুপ্রাণিত করে।

জাগ্রত অবস্থাতেও আমাদের দেখাটা এইরকমই।

অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং মনঃ স্বপ্নে ন সংশয়ঃ।

অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং তথা জাগ্ৰন্ন সংশয়ঃ॥৩০

অন্বয়: স্বপ্নে চ অদ্বয়ং মনঃ (যখন স্বপ্ন দেখি তখন শুধু মনই আছে); দ্বয়াভাসং ন সংশয়ঃ ([তথাপি] বহুদর্শন হয় এবং সে সম্পর্কে মনে কোন সংশয়ও থাকে না); তথা (একইভাবে); অদ্বয়ং চ জাগ্রৎ (যখন আমরা জাগ্রত, তখনও মন একাই আছে); দ্বয়াভাসং সংশয়ঃ ন (তবুও বহুদর্শন যে হয় সে-বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ থাকে না)।

সরলার্থ: যখন স্বপ্ন দেখি, তখন মন একাই থাকে। তথাপি আমাদের দুয়ের (জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়র) অভিজ্ঞতা হয়। এবং এ-বিষয়ে আমাদের মনে কোন সংশয়ও থাকে না। সেইরকম জাগ্রত অবস্থাতেও মন দ্বৈত ভূমিকা পালন করে ও জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়র সৃষ্টি করে। এর ফলে বহুদর্শন হয়। আর এই বহুর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহ থাকে না। কিন্তু স্বপ্ন ও জাগ্রত—উভয় অবস্থাতেই যা অভিজ্ঞতা হয় তা ভ্ৰমমাত্র।

ব্যাখ্যা: রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয় তখন তা সম্ভব হয় কারণ দড়ি ও সাপ একাকার হয়ে যায়। একইভাবে যখন স্বপ্ন দেখি তখন মন আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় এবং দ্বৈত ভূমিকা অর্থাৎ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়র ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়।

ধরা যাক স্বপ্নে হাতি দেখলাম। এখন কোথা থেকে এই হাতিটা এল? কেই বা এই হাতিটাকে দেখছে? উত্তর হল মন। আত্মা এখন মনের মধ্য দিয়ে কাজ করছে। মন একা। কিন্তু সে নিজেকে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়—এই দুই ভাগে ভাগ করেছে।

জাগ্রত অবস্থাতেও এই একই ঘটনা ঘটে। তখন আমরা বহু দেখি, কিন্তু সেগুলি সবই মনের আরোপ মাত্র। আত্মা এর দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হন না। মনই সুখ-দুঃখ অনুভব করে, আত্মা সাক্ষীমাত্র।

মনোদৃশ্যমিদং দ্বৈতং যৎকিঞ্চিৎসচরাচরম্।

মনসো হ্যমনীভাবে দ্বৈতং নৈবোপলভ্যতে॥৩১

অন্বয়: ইদং সচরাচরম্ (এই গতিশীল অথবা স্থাবর); যৎ কিঞ্চিৎ (যা কিছু); দ্বৈতং মনোদৃশ্যম্ (দুই বোধ মনের সৃষ্টি); মনসঃ অমনীভাবে (যখন মন নিষ্ক্রিয় হয়); দ্বৈতং ন হি উপলভ্যতে (আর ভেদদর্শন হয় না)।

সরলার্থ: এই দ্বৈতজগতে আমরা স্থাবর এবং জঙ্গম দুরকমের বস্তুই দেখি। এ সব বস্তুই মনের সৃষ্টি। মন নিষ্ক্রিয় হলে দুই বোধ আর থাকে না।

ব্যাখ্যা: আমরা যে জগতে বহু দেখি তারজন্য মনই দায়ী। যার মন সম্পূর্ণ স্থির হয়েছে তার আর ভেদদর্শন হয় না। যেমন, সুষুপ্তি অথবা সমাধি অবস্থায় মন নিষ্ক্রিয় থাকে—তখন আর দুইবোধ থাকে না। এর তাৎপর্য যথার্থ দ্বিতত্ত্ব বলে কিছু নেই। দুই দেখা মনের সৃষ্টি।

আত্মসত্যানুবোধেন ন সঙ্কল্পয়তে যদা।

অমনস্তাং তদা যাতি গ্রাহ্যাভাবে তদগ্ৰহম্॥৩২

অন্বয়: তৎ (মন); আত্মসত্যানুবোধেন (আত্মার সত্যস্বরূপ উপলব্ধি করে); যদা (যখন); ন সঙ্কল্পয়তে (কামনা করে না); তদা গ্রাহ্যাভাবেন (কোন বস্তুর আকাঙ্ক্ষা না থাকায়); অগ্রহম্ অমনস্তাম্ (নিষ্কাম ও মনাতীত অবস্থা); যাতি (লাভ করেন)।

সরলার্থ: যখন মন আত্মার সত্যস্বরূপ উপলব্ধি করে তখন সে নিস্ক্রিয় হয়; কারণ তখন আর মনের প্রত্যক্ষের বস্তু কিছু থাকে না; এমনকি প্রত্যক্ষ করার আকাঙ্ক্ষাও মনে উদিত হয় না। তখন মানুষ নিষ্কাম ও মনাতীত অবস্থা লাভ করে।

ব্যাখ্যা: এই মনের অতীত অবস্থা কিভাবে লাভ করা যায়? শাস্ত্র বলে ‘মাটিই সত্য। মাটিকে যে নানা আকার দেওয়া হয় সেগুলি সত্য নয়।’ একইভাবে আত্মাই সত্য। আত্মা সর্বব্যাপী। নিজের চেষ্টায়, শাস্ত্র পড়ে এবং আচার্যের নির্দেশ অনুসরণ করে এই আত্মার উপলব্ধি হয়। উপলব্ধি হলে তখন দেখি যা কিছু আছে সবই আত্মা এবং আমিই সেই আত্মা। তখন সর্বত্র নিজেকেই দেখি। অর্থাৎ তখন আমি ছাড়া দ্বিতীয় বস্তু না থাকায় কে কাকে দেখবে? এই অবস্থা ইন্ধনহীন আগুনের মতো। ইন্ধন না থাকলে আগুন আপনিই নিভে যায়। তেমনি মনকে সক্রিয় করার মতো কোন বস্তু না থাকায় মনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বস্তুত মন আর মন থাকে না। আত্মায় লীন হয়ে যায়।

অকল্পকমজং জ্ঞানং জ্ঞেয়াভিন্নং প্রচক্ষতে।

ব্রহ্মজ্ঞেয়মজং নিত্যমজেনাজং বিবুধ্যতে॥৩৩

অন্বয়: নিত্যম্ (সর্বদা অভিন্ন); অজং ব্রহ্ম (যাঁর কখনো জন্ম হয়নি সেই ব্ৰহ্ম [যার জ্ঞান]); জ্ঞেয়ম্ (জানতে হবে [তাহলে যদি]); অকল্পকম্ (যাকে কল্পনা করা যায় না); অজম্ (চিরন্তন); জ্ঞানম্ (জ্ঞানস্বরূপ); জ্ঞেয়াভিন্নম্ (যাকে জানতে হবে সেই ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়); প্রচক্ষতে ([বিবেকী ব্যক্তিরা] বলেন); অজম্ (জন্মরহিত [ব্রহ্ম স্বয়ং]); অজেন (জ্ঞানের দ্বারা); বিবুধ্যতে (উপলব্ধি করা যায়)।

সরলার্থ: ব্রহ্মের কখনো জন্ম হয়নি। ইনি নিত্য এবং অভিন্ন। ইনি নির্গুণ, অতএব কল্পনার অতীত। জ্ঞান এবং জ্ঞেয় উভয়ই ব্রহ্ম। এই অজাত এবং অমৃত ব্রহ্ম নিজেকে শাশ্বত জ্ঞানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

ব্যাখ্যা: ধরা যাক মনের সকল কর্মই মিথ্যা। তাই যদি হয় তাহলে আমরা আত্মাকে কি করে জানব? শাস্ত্র বলেন, মনের দ্বারাই আত্মাকে জানতে হবে। কিন্তু মন যদি না থাকে? তাহলে আত্মাকে জানব কেমন করে?

আত্মাকে অদ্বিতীয় বলা হয়। কারও সঙ্গে আত্মার তুলনা করা যায় না। আত্মা বাক্য-মনের অতীত। এমনকি কল্পনারও অতীত। কোন গুণের দ্বারাই আত্মাকে বিশেষিত করা যায় না। তবু শাস্ত্র বলে আত্মাকে ‘জানতে’ হবে। আবার শাস্ত্রে আত্মাকে জ্ঞানস্বরূপ বলা হয়েছে। এই উক্তি দুটি পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়। জ্ঞানকে কি জানা যায়? জ্ঞান জ্যোতিস্বরূপ, স্বয়ংপ্রকাশ। একটি প্রদীপ দেখতে গেলে আর একটি প্রদীপের আলোর দরকার হয় না। জ্ঞানকে ‘জানা’র অর্থ জ্ঞানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। এর ফলে মানুষটা আমূল পালটে যায়। সে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে ওঠে।

নিগৃহীতস্য মনসো নির্বিকল্পস্য ধীমতঃ।

প্রচারঃ স তু বিজ্ঞেয়ঃ সুষুপ্তেঽন্যো ন তৎসমঃ॥৩৪

অন্বয়: নিগৃহীতস্য (মন আত্মাতে স্থির); নির্বিকল্পস্য (একমুখী); ধীমতঃ (বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের); মনসঃ (মনের); প্রচারঃ (আচরণ); সঃ (সেই [আচরণ]); তু (নিশ্চিতভাবে); বিজ্ঞেয়ঃ (যত্নসহকারে পাঠ করা উচিত [যোগী ও সাধকদের দ্বারা]); সুষুপ্তে (গভীর নিদ্রামগ্ন [মানুষরা]); অন্যঃ (এক নয় [কারণ তাদের মন অবিদ্যা ও তার নানা কার্যের দ্বারা আবৃত]); ন তৎ সমঃ (ব্রহ্মে অটল যাঁদের মন, তাঁদের মতো নয়)।

সরলার্থ: যাঁর মন ব্রহ্মে স্থির, একমুখী এবং সবসময় নিত্য-অনিত্য বিচার করছে তাঁর আচরণ যোগীদের লক্ষ্য করা উচিত। গভীর নিদ্রামগ্ন ব্যক্তির আচরণ এরকম নয়। তার আচরণ আলাদা কারণ তার মধ্যে এখনও অজ্ঞানতা রয়েছে। সে এই জগতের প্রতি আসক্ত। তার ব্যবহার ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তির মতো হতে পারে না।

ব্যাখ্যা: যখন মানুষ আত্মাকে উপলব্ধি করে তখন তার মন সম্পূর্ণভাবে স্থির হয়ে যায়। আগুন যেমন ইন্ধন ফুরিয়ে গেলে নিভে যায় এও ঠিক তেমনি। এমন ব্যক্তি দুই দেখার ক্ষমতা হারিয়েছেন। তাঁর মন আত্মায় স্থির এবং তাঁর কাছে আত্মা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাঁর মনের অবস্থা যোগীদের পর্যবেক্ষণের বিষয়।

এহেন ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তির সঙ্গে গভীর নিদ্রামগ্ন মানুষের পার্থক্য কোথায়? উভয় ক্ষেত্রেই মনটা স্থির হয়ে আছে। কিন্তু কোন তফাত আছে কি? হ্যাঁ আছে— আকাশ-পাতাল তফাত। প্রথমজন আত্মাকে উপলব্ধি করেছেন। তিনি সর্বত্র এবং সর্বভূতে নিজেকে দেখেন। তিনি নিজেকে সকলের অন্তরাত্মারূপে জানেন। তাঁর কাছে দুই নেই, এক। তিনি সব কামনা-বাসনা মুক্ত—ইন্ধনহীন আগুনের মতো। তিনি আত্মতৃপ্ত।

অন্যদিকে গভীর নিদ্রামগ্ন ব্যক্তির মনের স্থিরতা সাময়িক। সকল দুঃখের মূল যে অবিদ্যা তা এই ব্যক্তির মধ্যে তখনও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে অবিদ্যার খেলা শুরু হয়ে যায় এবং নিজেকে সে ইন্দ্রিয়ের অধীন বলে দেখতে পারে।

লীয়তে হি সুষুপ্তে তন্নিগৃহীতং ন লীয়তে।

তদেব নির্ভয়ং ব্রহ্ম জ্ঞানালোকং সমন্ততঃ॥৩৫

অন্বয়: হি (যেহেতু); সুষুপ্তে তৎ লীয়তে (গভীর নিদ্রায় মন কারণ-অজ্ঞানে ফিরে যায়); নিগৃহীতম্ (সংযত); ন লীয়তে (কারণ-অজ্ঞানে ফিরে যায় না); তৎ (মন); এব নির্ভয়ম্ (ভয়মুক্ত); সমন্ততঃ (সম্পূর্ণভাবে [লয় হয়]); জ্ঞানালোকম্ (জ্ঞানের আলো [যা]); ব্রহ্ম (ব্রহ্ম)।

সরলার্থ: গভীর ঘুমের সময় মন কারণ-অজ্ঞানে লয় হয়। কিন্তু সংযত মনের ক্ষেত্রে এরকম হয় না। সংযত মন ভয়মুক্ত এবং জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মে লীন হতে সক্ষম।

ব্যাখ্যা: গভীর নিদ্রামগ্ন ব্যক্তির মনের অবস্থা কিরকম? যতদিন তিনি মনকে সংযত করে আত্মায় স্থির রাখতে সক্ষম না হন, ততদিন সুষুপ্তিকালে তাঁর মন অবিদ্যার কারণ অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু যাঁর মন সম্পূর্ণরূপে নিজের রূপে রয়েছে এবং নিরন্তর আত্মচিন্তায় মগ্ন তিনি আত্মাতে লীন হয়ে থাকেন।

এই দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? প্রথমজনের অশান্তি থেকে মুক্তি সাময়িক। জেগে উঠলেই যা ছিল তাই। সকল দুঃখের মূল অবিদ্যা। এই অবিদ্যা তার মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। অবিদ্যার বন্ধন থেকে তার তখনও মুক্তি হয়নি।

আর দ্বিতীয়জন? তিনি স্বরূপজ্ঞান লাভ করেছেন। আত্মার সঙ্গে একত্ব উপলব্ধি করে তিনি এখন জীবন্মুক্ত পুরুষ।

অজমনিদ্রমস্বপ্নমনামকমরূপকম্।

সকৃদ্বিভাতং সর্বজ্ঞং নোপচারঃ কথঞ্চন॥৩৬

অন্বয়: [ব্রহ্ম হলেন] অজম্ (জন্মরহিত); অনিদ্রম্ (নিদ্রাহীন); অস্বপ্নম্ (স্বপ্নহীন); অনামকম্ (তাঁকে কোনও নামের দ্বারা বিশেষিত করা যায় না); অরূপকম্ (কোনও রূপের দ্বারা তাঁকে পৃথক করা যায় না); সকৃৎ বিভাতম্ (এক সময় প্রকাশিত [অর্থাৎ উজ্জ্বল]); সর্বজ্ঞম্ (যিনি সব জানেন); কথঞ্চন উপচারঃ ন (কারও প্রতি দায়বদ্ধ নন)।

সরলার্থ: স্বভাবত ব্রহ্মের জন্ম নেই; তিনি বিনিদ্র স্বপ্নরহিত, নাম-রূপহীন এবং এককালে প্রকাশিত (অর্থাৎ সদা উজ্জ্বল)। ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ এবং সর্বব্যাপী চৈতন্য। অতএব তিনি সকল দায়ভারমুক্ত।

ব্যাখ্যা: অজ্ঞ ব্যক্তি জন্ম-মৃত্যুর অধীন। কিন্তু ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ, সেহেতু জন্ম-মৃত্যুহীন। তিনি বিনিদ্র এবং স্বপ্নরহিত। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে বা স্বপ্ন দেখে তখন তার স্বাভাবিক সজাগ ভাবটি থাকে না। অজ্ঞানতার ফলেও অনুরূপ বা আরও মন্দ অবস্থায় সে থাকে। এখানে নিদ্রাবস্থা এবং স্বপ্নাবস্থা বলতে বোঝাচ্ছে, যে অবস্থায় মানুষের উচিত-অনুচিত বা ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা থাকে না। এই পরিস্থিতির মূল কারণ অজ্ঞানতা।

পরম সত্য হল শুদ্ধ চৈতন্য। তাঁকে আমরা ব্রহ্ম বলি। ব্রহ্ম কিন্তু কোন নাম নয়। এর দ্বারা পরম সত্য যে সর্বব্যাপী সেকথা বোঝানো হয়েছে। ব্রহ্ম নিত্য প্রকাশিত। দিন বা রাত্রি সবসময়ই ইনি অপরিবর্তিত। দেশ বা কালের দ্বারা এই সত্য সীমাবদ্ধ নন। কোন গুণের দ্বারা তাঁকে বিশেষিতও করা যায় না। তিনি মুক্ত, শুদ্ধ, নিষ্কলঙ্ক। তিনিই সব। তিনি নিরপেক্ষ, কারও প্রতি দায়বদ্ধ নন। কিন্তু ব্রহ্ম ছাড়া কোন বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

সর্বাভিলাপবিগতঃ সর্বচিন্তাসমুত্থিতঃ।

সুপ্রশান্তঃ সকৃজ্জ্যোতিঃ সমাধিরলোঽভয়ঃ॥৩৭

অন্বয়: সর্বাভিলাপবিগতঃ (সকল ইন্দ্রিয়ের অতীত); সর্বচিন্তাসমুত্থিতঃ (মন তাঁর নাগাল পায় না); সুপ্রশান্তঃ (শান্ত); সকৃজ্জ্যোতিঃ (সতত উজ্জ্বল); সমাধিঃ (সর্বদা আনন্দে মগ্ন); অচলঃ (সদা স্থির); অভয়ঃ (ভয়মুক্ত)।

সরলার্থ: আত্মা অনির্বচনীয় অর্থাৎ ভাষায় তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। বস্তুত আত্মা সকল ইন্দ্রিয়ের অতীত। মনও এঁর নাগাল পায় না। ইনি প্রশান্ত এবং সদা জ্যোতির্ময়। একমাত্র সমাধিতে এঁকে উপলব্ধি করা যায়। ইনি সতত স্থির, অচল এবং নির্ভয়।

ব্যাখ্যা: ‘অভিলাপ’ কথাটির অর্থ বাগেন্দ্রিয়। এখানে অবশ্য এর দ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্মেন্দ্রিয় উভয় প্রকার ইন্দ্রিয়কেই বোঝাচ্ছে। ব্রহ্মের কোন ইন্দ্রিয় নেই এবং তিনি সব ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে।

ব্রহ্মের মনও নেই। শাস্ত্র বলেন, ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়-মনের অতীত এবং নিত্য শুদ্ধ। ব্রহ্ম প্রশান্ত কারণ ইনি কিছুতে লিপ্ত নন। ইনি সদা জ্যোতির্ময়। এই জ্যোতি ব্রহ্মের নিজস্ব। ব্রহ্মই সমাধি—কারণ ইনিই সমাধির কারণ। যেহেতু তাঁর কোন পরিবর্তন নেই তিনি সদা স্থির ও অচল এবং তিনি সর্বদা ভয়মুক্ত।

গ্রহো ন তত্র নোৎসর্গশ্চিন্তা যত্র ন বিদ্যতে।

আত্মসংস্থং তদা জ্ঞানমজাতি সমতাং গতম্॥৩৮

অন্বয়: যত্র (ব্রহ্মে); চিন্তা ন বিদ্যতে (কোনও চিন্তা নেই); তত্র (ব্রহ্মে); গ্রহঃ ন (সেখানে গ্রহণ বলে কিছু নেই); উৎসর্গঃ ন (দান বলে কিছু নেই); তদা (তখন [যখন আত্মজ্ঞান লাভ হয়]); আত্মসংস্থম্ (আত্মায় প্রতিষ্ঠিত); অজাতি (জন্ম নেই); জ্ঞানং সমতাং গতং (একত্বের জ্ঞান আসে)।

সরলার্থ: ব্রহ্ম চিন্তা করেন না। ইনি কিছু গ্রহণও করেন না, দানও করেন না। যিনি আত্মাকে উপলব্ধি করেছেন তিনি আত্মাতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। এই অবস্থায় তিনি জন্মরহিত এবং সর্বত্র তাঁর সমদর্শন হয়।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম প্রশান্ত এবং নির্ভয়। এইজন্য গ্রহণ বা দান কোন কর্মই তিনি করেন না। ব্রহ্মের মন বলে কিছু নেই। তাই তিনি সকল চিন্তার ঊর্ধ্বে। আত্মাকে জানলে মানুষ আত্মায় লীন হয়ে যায়—যেমনভাবে উত্তাপ আগুনে রূপান্তরিত হয়। এরূপ ব্যওি জন্মরহিত এবং সর্বত্র সমদর্শী। অর্থাৎ তিনি সর্বত্র আত্মাকেই দর্শন করেন।

অস্পর্শযোগো বৈ নাম দুর্দর্শঃ সর্বযোগিভিঃ।

যোগিনো বিভ্যতি হ্যস্মাদভয়ে ভয়দর্শিনঃ॥৩৯

অন্বয়: অস্পর্শযোগঃ (যে যোগে বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সংযোগ থাকে না); নাম (তথাকথিত [যোগ]); সর্ব যোগিভিঃ দুর্দর্শঃ (যোগীরা বহু কষ্টে উপলব্ধি করেন); বৈ (নিশ্চিতভাবে); ভয়দর্শিনঃ যোগিনঃ হি (স্বল্পবুদ্ধি যোগীরা যাঁরা [অহংবুদ্ধি নাশ করতে] ভীত); অস্মাৎ (এর থেকে [অর্থাৎ যে যোগে বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সংযোগ থাকে না তার থেকে]); অভয়ে (যেখানে ভয়ের কোন স্থান নেই); বিভ্যতি (ভয়ে সরে আসেন)।

সরলার্থ: একরকমের যোগ আছে যার নাম ‘অস্পর্শযোগ’। এই যোগে যোগীকে বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সবরকম সংস্পর্শ ত্যাগ করতে হয়। এই যোগ অভ্যাস করা কঠিন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যদিও এই যোগের দ্বারা সাধক অভয়পদ লাভ করেন তথাপি এই যোগ অনুশীলন করতে তাঁরা ভয় পান (কারণ তাঁরা তাঁদের ‘আমি’কে হারাতে ভয় পান)।

ব্যাখ্যা: শাস্ত্রে অস্পর্শযোগের কথা বলা হয়েছে। বাহ্যজগৎকে স্পর্শ করাও এই যোগে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ সাধক এই জগৎকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেন। কারণ তিনি জানেন এ জগৎ মিথ্যা এবং মানুষকে বদ্ধ করে। তাই তিনি নিজেকে নিজের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নেন। এই অবস্থা আত্মহত্যার সামিল।

অনেকের কাছেই এই যোগ ভীতিপ্রদ। যোগী জানেন জগৎ থেকে এই ধরনের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার তিনি যদি অনুশীলন করেন তবে কালে তিনি অভয়পদ লাভ করবেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তা জানা সত্ত্বেও এই যোগ অনুশীলন করতে তিনি ভয় পান। যেহেতু এই যোগে যোগীর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে হয়, সেহেতু খুব কম সাধকই এই পথে অগ্রসর হন।

মনসো নিগ্রহায়ত্তমভয়ং সর্বযোগিনাম্।

দুঃখক্ষয়ঃ প্রবোধশ্চাপ্যক্ষয়া শান্তিরেব চ॥৪০

অন্বয়: সর্বযোগিনাম্ (সেই যোগিগণ [যাঁরা তাঁদের লক্ষ্য থেকে এখনও অনেক দূরে]); অভয়ম্ (ভয়ের নিবৃত্তি); দুঃখক্ষয়ঃ (দুঃখের অবসান); প্রবোধঃ (আত্মজ্ঞান); অক্ষয়া (চিরন্তন); শান্তিঃ (মোক্ষ); এব চ (ও); মনসঃ (মনের); নিগ্রহায়ত্তম্‌ (সংযম আনতে হয়)।

সরলার্থ: যাঁদের (অর্থাৎ যে যোগীদের) এখনও আত্মোপলব্ধি হয়নি তাঁরা শুধুমাত্র মনকে নিয়ন্ত্রণ করে ভয় ও দুঃখকে সম্পূর্ণভাবে জয় করতে সক্ষম হন এবং মা আত্মজ্ঞান ও চিরশান্তি (অর্থাৎ মোক্ষ) লাভ করেন।

ব্যাখ্যা: কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিশ্চিতভাবে জানেন একমাত্র আত্মাই সত্য, অন্য কিছু সত্য নয়। মন এবং ইন্দ্রিয় সবই মিথ্যা। এরূপ ব্যক্তিরা অচিরেই শান্তি লাভ করেন। কালে তাঁদের মোক্ষও লাভ হয়। আর এই শান্তি বা মোক্ষ লাভ করার জন্য তাঁদের কোন কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না। তাঁদের কোন আচার-অনুষ্ঠানেরও প্রয়োজন নেই; সকল কর্তব্য থেকে তাঁরা মুক্ত।

কিন্তু নিম্নকোটির কিছু মানুষ আছেন যাঁদের এখনও আত্মোপলব্ধি হয়নি। তাঁরা মনে করেন মন আত্মার উপর নির্ভরশীল নয় বরং আত্মার মতোই স্বতন্ত্র এক সত্তা। তাঁদের পক্ষে ভয় ও দুঃখকে জয় করার একমাত্র উপায় মনকে সংযত করা। অসংযত মনই সকল দুঃখের মূল। বিবেক-বুদ্ধি না থাকলে মন অশান্ত হবেই। সুতরাং মনকে বশে আনতে হবে। মন সম্পূর্ণ সংযত হলে আত্মজ্ঞান লাভ হয়, মানুষ শাশ্বত শান্তির অধিকারী হয়।

উৎসেক উদধের্যদ্বৎকুশাগ্রেণৈকবিন্দুনা।

মনসো নিগ্রহস্তদ্বদ্ভবেদপরিখেদতঃ॥৪১

অন্বয়: কুশাগ্ৰেণ (কুশের অগ্রভাগের দ্বারা); একবিন্দুনা (এক এক বিন্দু করে); উদধেঃ (মহাসমুদ্রের); উৎসেকঃ (শুষ্ক করা); যৎ বৎ (ঠিক যেমন); অপরিখেদতঃ (অবিশ্রান্তভাবে); মনসঃ নিগ্রহঃ (মনের সংযম); তৎ বৎ ভবেৎ (এটি ওর অনুরূপ)।

সরলার্থ: ঘাসের ডগা দিয়ে বিন্দু বিন্দু করে জল তুলে যদি মহাসাগরকে শুষ্ক করতে হয়, তাহলে অবিরাম অক্লান্তভাবে এ কাজ করে যেতে হবে। মনকে নিজের বশে আনতে গেলেও ঠিক ঐরকমই পরিশ্রম করতে হয় (অর্থাৎ সমপরিমাণ পরিশ্রম ও ধৈর্যের প্রয়োজন)।

উপায়েন নিগৃহ্নীয়াদ্বিক্ষিপ্তং কামভোগয়োঃ।

সুপ্রসন্নং লয়ে চৈব যথা কামো লয়স্তথা॥৪২

অন্বয়: কামভোগয়োঃ (বাসনা এবং বাসনার তৃপ্তি); বিক্ষিপ্তম্ (অস্থির); [মনঃ (মন)]; উপায়েন (যেভাবে বলা হয়েছে); নিগৃহ্লীয়াৎ ([সুষুপ্তিতে] নিয়ন্ত্রণ করা উচিত); [বলা হয়] লয়ে (বিনাশ [কারণ এই অবস্থায় সবকিছুর লয় হয়]); সুপ্রসন্নম্ (উদ্বেগশূন্য [মন যখন সুনিয়ন্ত্রিত তখন এই অবস্থা লাভ হয়]); এব (নিশ্চিতভাবে); [যেহেতু] কামঃ (সুখভোগের বাসনা); যথা (ক্ষতিকর); লয়ঃ তথা (গভীর নিদ্রাও একইভাবে ক্ষতিকর)।

সরলার্থ: যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেভাবে মনকে বাসনা ও ইন্দ্রিয়সুখভোগ থেকে বিরত রাখতে হবে। গভীর নিদ্রায় যখন মন সম্পূর্ণ উদ্বেগশূন্য, তখনও এই অভ্যাস করে যেতে হবে (কারণ বাসনা ও গভীর নিদ্রা একইভাবে মানুষের ক্ষতিসাধন করে)।

ব্যাখ্যা: যাঁরা মনকে সংযত করার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তাঁদের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। মনকে বশে আনার উপায় কি? দুভাবে তা করা যায়। মনকে জগৎ থেকে প্রত্যাহার করার নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। করাটা কঠিন, কিন্তু ঠিক তাই করতে হবে। এটা হল নেতিবাচক দিক। কিন্তু একইসঙ্গে আত্মচিন্তাতেও মগ্ন থাকতে হবে অর্থাৎ মনকে আত্মায় একাগ্র করতে হবে। আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা—এই স্বরূপচিন্তায় আনন্দ আছে। এটা হল মনকে বশে আনার ইতিবাচক উপায়। যখন গভীর নিদ্রায় মন সম্পূর্ণ উদ্বেগশূন্য, তখনও এই অভ্যাস করতে হবে। জাগ্রত অথবা সুষুপ্তি সব অবস্থাতেই মন আমাদের সকল দুঃখ-কষ্টের মূল। সুতরাং মনকে নিজের বশে আনতেই হবে। জগৎ থেকে মনকে প্রত্যাহার করে সর্বদা আত্মায় যুক্ত রাখতে হবে।

দুঃখং সর্বমনুস্মৃত্য কামভোগান্নিবর্তয়েৎ।

অজং সর্বমনুস্মৃত্য জাতং নৈব তু পশ্যতি॥৪৩

অন্বয়: সর্বম্ (সকল প্রকার দ্বৈতবুদ্ধি); দুঃখম্ (দুঃখময়); অনুস্মৃত্য (সবসময় বিচার করতে হবে); কামভোগাৎ (ইন্দ্রিয়সুখের চিন্তা থেকে); নিবর্তয়েৎ ([মনকে] নিরস্ত করতে হবে); সর্বম্ (সকল রকমের দ্বৈতবুদ্ধি); অজম্ (ব্রহ্ম); অনুস্মৃত্য (সবসময় মনে রেখে); তু (আবার); জাতম্ (জন্মেছে [অর্থাৎ দুই দেখা]); ন এব পশ্যতি (দেখে না)।

সরলার্থ: সবরকমের দুই বোধ দুঃখযুক্ত—একথা সবসময় বিচার করে মনকে ইন্দ্রিয়সুখের চিন্তা থেকে বিরত রাখতে হবে। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে আমরা যে বহু দেখি তা বস্তুত বহু নয়, এক অর্থাৎ ব্রহ্ম। নিরন্তর এই চিন্তা করলে আর দুই দেখা যায় না।

ব্যাখ্যা: আমাদের এই ‘বহু’ দেখা কিভাবে দূর হবে? প্রথমত আমাদের মনে বাখতে হবে ‘বহু’ দেখা অজ্ঞানতাপ্রসূত। ব্রহ্মই যে একমাত্র সত্য আর এই জগৎ ব্রহ্মের উপর আরোপিত উপাধি ছাড়া আর কিছুই নয়—একথা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা ইন্দ্রিয়সুখের পিছনে ছুটছি, কারণ এই সুখকে আমরা সত্য এবং চিরস্থায়ী বলে মনে করছি। কালে আমরা সত্য কি তা বুঝতে পারি, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এইজন্যই উপনিষদ আমাদের বারবার ইন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তুর অসারতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। একইসঙ্গে মনে রাখতে বলছেন ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; ব্রহ্ম ছাড়া দ্বিতীয় কিছু দেখা ভ্রান্তি মাত্র। যা কিছু দেখি সবই ব্রহ্ম—একথা আমাদের সবসময় চিন্তা করতে হবে। পরিণামে আমরা শুধু ব্রহ্মকেই দেখব, ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পাব না। তখন আর বহু নেই, এক। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন: দুই দেখা ভুল। এই দুই দেখাই সব দুঃখ-কষ্টের মূল। আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে এই দুই বোধ না আসে।

লয়ে সংবোধয়েচ্চিত্তং বিক্ষিপ্তং শময়েৎপুনঃ।

সকষায়ং বিজানীয়াৎসমপ্রাপ্তং ন চালয়েৎ॥৪৪

অন্বয়: চিত্তং লয়ে (যখন মন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন); সম্বোধয়েৎ (জেগে ওঠ ও মনকে আত্মায় যুক্ত কর); বিক্ষিপ্তম্ (যদি মন ইন্দ্রিয়সুখের পিছনে ছোটে); পুনঃ শময়েৎ (বারবার চেষ্টা করে মনকে বশে আন); সকষায়ম্ (মন যদি ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত হয়); বিজানীয়াৎ (নিজের বিপদ ডেকে আনছ, একথা স্মরণ রেখে মনকে আত্মায় নিবদ্ধ কর); সমপ্রাপ্তম্ (একবার মনকে বশে আনতে পারলে); ন চালয়েৎ (ইন্দ্রিয়সুখের পিছনে মনকে আর ছুটতে দিও না)।

সরলার্থ: তুমি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন (যত তাড়াতাড়ি সম্ভব) জেগে ওঠ এবং মনকে আত্মার সঙ্গে যুক্ত কর। মন যদি ইন্দ্রিয়সুখের পিছনে ছোটে, বারবার তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর যতক্ষণ না মন সংযত হয়। যদি মন ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত হতে চায়, মনকে বোঝাও এর থেকে কি অনর্থ ঘটতে পারে। তারপর মনকে আত্মায় স্থির রাখার চেষ্টা করে যাও। আর একবার যদি সফল হও তাহলে মনকে আর ইন্দ্রিয়সুখের পিছনে ছুটতে দিও না।

ব্যাখ্যা: গাঢ় ঘুম সুখকর হতে পারে কিন্তু এও অবিদ্যার অবস্থা। তখনও আত্মা সম্বন্ধে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। নিরন্তর আত্মচিন্তা ও ত্যাগ-বৈরাগ্যের অনুশীলন করে নিজেকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করতে হবে। আত্মা (অর্থাৎ যা সত্য) এবং অনাত্মা (অর্থাৎ যা মিথ্যা)—এ দুয়ের পার্থক্য সুনিশ্চিতভাবে জানতে হবে। মনকে সর্বদা সংযত রাখতে হবে। যদি কোন বিচ্যুতি ঘটে তা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। অবিরাম চেষ্টা করে যেতে হবে। আর দুটো অবস্থাকে সর্বতোভাবে পরিহার করতে হবে: জড় অবস্থা (অর্থাৎ গভীর ঘুম) এবং ইন্দ্রিয়সুখে আসক্তি।

ধরা যাক, এই দুটি অবস্থা বর্জন করতে তুমি সক্ষম হয়েছ। তা সত্ত্বেও মন যদি সংযত না হয়, ইন্দ্রিয়সুখের সামান্যতম আকাঙক্ষাও যদি থাকে তখন মনকে আত্মায় সমাহিত করার দৃঢ় প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না আত্মাতে লীন হয়ে যাচ্ছ। মনকে সম্পূর্ণ আয়ত্তে না আনা পর্যন্ত থামা যাবে না। একবার মন তোমার নিয়ন্ত্রণে এলে আবার যাতে সে ইন্দ্রিয়সুখে প্রলুব্ধ না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

নাস্বাদয়েৎসুখং তত্র নিঃসঙ্গঃ প্রজ্ঞয়া ভবেৎ।

নিশ্চলং নিশ্চরচ্চিত্তমেকীকুর্যাৎপ্রযত্নতঃ॥৪৫

অন্বয়: তত্র (যখন তুমি ভোগ্যবস্তুর সংস্পর্শে আস); সুখং ন আস্বাদয়েৎ (কিছু সুখ অবশ্যই আছে কিন্তু তার প্রতি আসক্ত হয়ো না); প্রজ্ঞয়া (বিবেক-বৈরাগ্যের সাহায্যে); নিঃসঙ্গঃ ভবেৎ (নির্লিপ্ত থাক); নিশ্চলং নিশ্চরৎ চিত্তম্ (সংযত মনও যদি বহির্মুখী হতে চায়); প্রযত্নতঃ ([তখন] অক্লান্ত চেষ্টায়); একীকুর্যাৎ ([সংবরণ কর এবং] আত্মায় বিলীন করে দাও।

সরলার্থ: ভোগ্যবস্তু থেকে যখন তুমি কিছু সুখও পাও তখনও এর প্রতি আসক্ত হয়ো না; বরং বিবেক-বৈরাগ্যের সাহায্যে এর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখ। এমনকি মন যখন নিজের বশে রয়েছে তখনও সে বহির্মুখী হতে চাইতে পারে। কিন্তু যত কঠিনই হোক না কেন মনের রাশ টেনে ধরে মনকে আত্মায় সমাহিত কর।

ব্যাখ্যা: যদি আত্মাকে জানতে তুমি সত্যই আগ্রহী হও তাহলে কোনভাবেই ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত হয়ো না। এই সুখ অবিদ্যাপ্রসূত এবং আত্মজ্ঞানলাভের অন্তরায়। মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য আত্মাকে জানা। আত্মজ্ঞান ছাড়া আর যা কিছু তা সবই প্রতিবন্ধক; অতএব সেগুলি ত্যাগ করতে হবে। মন আপোষ করতে চাইতে পারে। তখন মনের লাগাম টেনে ধরে অনলস প্রচেষ্টায় মনকে আত্মায় বিলীন করে দিতে হবে।

যদা ন লীয়তে চিত্তং ন চ বিক্ষিপ্যতে পুনঃ।

অনিঙ্গনমনাভাসং নিষ্পন্নং ব্রহ্ম তত্তদা॥৪৬

অন্বয়: যদা পুনঃ চিত্তম্ (যখন মন [গভীর নিদ্রায় অভিভূত]); ন লীয়তে (লয় হয় না); ন চ বিক্ষিপ্যতে (বিক্ষিপ্তও হয় না); অনিঙ্গনম্ (স্থির অচঞ্চল থাকে); অনাভাসম্ (কোন কিছু সম্পর্কে সচেতন নয়); তদা (তখন); তৎ (সেই [মন]); ব্রহ্ম নিষ্পন্নম্ (ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায়)।

সরলার্থ: যখন সুষুপ্তিতে মনের লয় হয় না, আবার বিক্ষেপও হয় না বরং স্থির, অচঞ্চল থাকে এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে (যোগীর) কোন জ্ঞান থাকে না তখন সেই মন ব্রহ্মে লীন হয়ে আছে।

ব্যাখ্যা: যখন মন সম্পূর্ণভাবে তোমার বশে থাকে তখন কি হয় সেকথাই এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে। এই অবস্থায় সুষুপ্তিতেও মনের সম্পূর্ণ লয় হয় না, আবার কোনভাবেই মনের বিক্ষেপও হয় না। এইরকম মন সদা স্থির ও অচঞ্চল এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন অর্থাৎ উদাসীন। মনের এই অবস্থাই প্রমাণ করে যে মন ব্রহ্মে লীন হয়ে আছে।

স্বস্থং শান্তং সনির্বাণমথ্যং সুখমুত্তমম্।

অজমজেন জ্ঞেয়েন সর্বজ্ঞং পরিচক্ষতে॥৪৭

অন্বয়: উত্তমম্ (অনন্ত); সুখম্‌ (আনন্দ [আত্মজ্ঞান লাভের আনন্দ]); স্বস্থম্ (যখন তুমিই স্বয়ং আত্মা [অর্থাৎ আত্মায় স্থিত]); শান্তম্ (সব দুঃখ দূর হয়েছে); সনির্বাণম্ (মোক্ষলাভ হয়েছে); অকথ্যম্ (বর্ণনার অতীত); অজম্ (যার জন্ম নেই [শাশ্বত]); অজেন (যার জন্ম নেই তার দ্বারা); জ্ঞেয়েন (ব্রহ্মরূপে); সর্বজ্ঞম্ (যিনি সব জানেন); পরিচক্ষতে ([যাঁরা ব্রহ্মকে জেনেছেন] ব্রহ্ম সম্পর্কে [এইভাবে] বলেন)।

সরলার্থ: যাঁরা ব্রহ্মকে জানেন তাঁরা বলেন আত্মজ্ঞান লাভের যে আনন্দ তা আমাদের আত্মাতেই নিহিত রয়েছে। এই আনন্দেই সকল দুঃখের নিবৃত্তি। যখন মানুষ বাইরের কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয় তখনি এই আনন্দের উপলব্ধি হয়। একে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই আনন্দ অনাদি এবং সর্বজ্ঞ। সনাতন ব্রহ্ম ও এই আনন্দ এক ও অভেদ—ব্রহ্মই আনন্দস্বরূপ।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের মতে, একমাত্র আত্মজ্ঞান থেকে যে পরমানন্দ লাভ হয় সেই আনন্দ আমাদের আত্মাতেই নিহিত আছে। সেখানেই সকল দুঃখের অবসান। এরই নাম নির্বাণ তথা মোক্ষলাভ। আমাদের সকল বন্ধনের মুক্তি এই আনন্দে। ভাষায় একে বর্ণনা করা যায় না—শুধু যে তাকে জেনেছে, সে-ই পেয়েছে। এই আনন্দ অসীম; ক্ষণস্থায়ী ইন্দ্রিয়সুখের মতো নয়। এই আনন্দ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র, অতএব অনাদি। ব্রহ্ম থেকে এই আনন্দ পৃথক নয়। আনন্দই স্বয়ং ব্রহ্ম।

ন কশ্চিজ্জায়তে জীবঃ সম্ভবোঽস্য ন বিদ্যতে।

এতত্তদুত্তমং সত্যং যত্র কিঞ্চিন্ন জায়তে॥৪৮

অন্বয়: কশ্চিৎ জীবঃ ন জায়তে (কোন জীবেরই জন্ম হয় না); সম্ভবঃ অস্য ন বিদ্যতে (কোন সত্তার জন্ম হবার কোন সম্ভাবনাও নেই); যত্র কিঞ্চিৎ ন জায়তে (কোন কিছুরই জন্ম হয় না); তৎ এতৎ উত্তমং সত্যম্ (এই হল পরম সত্য)।

সরলার্থ: কেউ জন্মায় না, কারও জন্মাবার সম্ভাবনা পর্যন্ত নেই। বস্তুত কোন কিছুই জন্মায় না—এই হল পরম সত্য।

ব্যাখ্যা: সৃষ্টি, যোগ ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়েছে। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য—এই চূড়ান্ত তত্ত্বের জন্য মনকে প্রস্তুত করতেই এইসব প্রসঙ্গের অবতারণা। যদি কোন বস্তুকে জন্মাতে দেখি তবে তা আমাদের দৃষ্টিভ্রম মাত্র। ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোন বস্তুর অস্তিত্বই নেই।

অলাতশান্তি প্রকরণ

জ্ঞানেনাকাশকল্পেন ধর্মান্যো গগনোপমান্।

জ্ঞেয়াভিন্নেন সংবুদ্ধস্তং বন্দে দ্বিপদাং বরম্॥১

অন্বয়: যঃ (যিনি); আকাশকল্পেন (আকাশের মতো ব্যাপক); জ্ঞেয়াভিন্নেন (আত্মার সঙ্গে অভেদ); জ্ঞানেন ([আত্ম] জ্ঞানের দ্বারা); ধর্মান্ গগনোপমান (আকাশের যেমন কোন গুণ নেই তেমনি আত্মারও); সংবুদ্ধঃ (যিনি আত্মাকে জানেন); তং দ্বিপদাং বরম্ (সেই ব্যক্তি যিনি সর্বোত্তম [অর্থাৎ নারায়ণ]); বন্দে (আমি প্রণাম করি)।

সরলার্থ: যিনি মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম, আকাশের মতো ব্যাপক এবং আত্মার সঙ্গে অভেদ তাঁকে প্রণাম করি। তিনি আত্মাকে জানেন। আবার এই আত্মজ্ঞানের দ্বারা একথাও জানেন যে আত্মার (জীবাত্মার) উপাধিসকল আকাশের উপর আরোপিত উপাধির মতোই মিথ্যা।

ব্যাখ্যা: পূর্ববর্তী তিনটি অধ্যায়ের সঙ্গে বর্তমান অধ্যায়ের যোগসূত্রটি কি? আগের তিনটি অধ্যায়েই অদ্বৈততত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়, আগম প্রকরণে তা করা হয়েছে ‘ওম্’-এর তাৎপর্য আলোচনার মাধ্যমে। দ্বিতীয় অধ্যায়, বৈতথ্য প্রকরণে বাহ্যজগতের অসারতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়েই অদ্বৈততত্ত্বের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়, অদ্বৈত প্রকরণ। এই অধ্যায়ে শাস্ত্র ও যুক্তির সাহায্যে অদ্বৈতবাদ প্রমাণিত হয়েছে এবং সবশেষে তাদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা—‘অদ্বৈতই পরম সত্য।’

বৌদ্ধরা শাস্ত্রের সিদ্ধান্তকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেন না। তাঁরা শূন্যবাদী। এই শূন্যবাদী বৌদ্ধরা এবং দ্বৈতবাদীরা অদ্বৈততত্ত্বকে বারবার আক্রমণ করেছেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এই যে দ্বৈতবাদীরা পরস্পর বাগ্‌বিতণ্ডায় লিপ্ত, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করতে অভ্যস্ত। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় তাঁদের মতবাদ কোন দৃঢ় সিদ্ধান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

এই পটভূমিকায় চতুর্থ অধ্যায়, অলাতশান্তি প্রকরণের আলোচনা শুরু। এই প্রকরণে প্রথমে দ্বৈতবাদী, শূন্যবাদী ও অন্যান্য কয়েকটি মতবাদের প্রতি ব্যঙ্গ্যোক্তি করা হয়েছে। পরে যুক্তি ও পূর্বোক্ত প্রমাণের সাহায্যে নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে অদ্বৈতের কোন বিকল্প নেই। স্বাভাবিকভাবেই অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠাতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই অধ্যায়ের সূচনা। শুভ আরম্ভের সমাপ্তিও শুভই হয়।

কথিত আছে বদরিকাশ্রমে আচার্য গৌড়পাদ গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তখন স্বয়ং নারায়ণ কৃপাপরবশ হয়ে তাঁকে অদ্বৈতের বাণী দান করেন। এই অর্থে নারায়ণকেই অদ্বৈততত্ত্বের আদিগুরু বলা যায়। গৌড়পাদ এই জ্ঞান গোবিন্দপাদকে এবং গোবিন্দপাদ আচার্য শঙ্করকে দিয়ে যান। নারায়ণ নররূপে ভগবান স্বয়ং।

অলাত শব্দটির অর্থ ‘জ্বলন্ত মশাল’। ‘অলাত শান্তি’ মানে এই ‘জ্বলন্ত মশালটি নির্বাপিত করা’। কিন্তু জ্বলন্ত মশালটির তাৎপর্য কি? রূপক অর্থে এর দ্বারা জগৎকে বোঝানো হয়েছে। জগৎ যেন অগ্নিগর্ভ, এখানে কেউ সুখী নয়। এর কারণ কি? অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা। এই অবিদ্যার প্রভাবেই আমরা বহু দেখি। আমরা মনে করি আমরা পরস্পরের থেকে আলাদা। সেহেতু সবসময় একে অপরের বিরোধিতা করি। এই প্রকরণ অদ্বৈতজ্ঞানের সাহায্যে এই দুঃখের আগুন নিভিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়—ব্যষ্টি স্তরেও বটে, সমষ্টি স্তরেও বটে।

অদ্বৈতকে আকাশবৎ বলা হয়। একথা সত্য যে আত্মা আকাশের মতোই ব্যাপক, কিন্তু দুয়ের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে : বাইরের আকাশ জড় এবং তার পেছনে একটি কারণ বস্তু আছে। কিন্তু আত্মা স্বয়ংপ্রকাশ, শুদ্ধ চৈতন্য। আত্মা স্বতন্ত্র—কারণও নয়, কার্যও নয়।

আত্মা এক; কিন্তু নাম-রূপের জন্য বহু বলে প্রতিভাত। এইসব জীবাত্মাও আকাশের মতো। আকাশকে যেমন ভাগ করা যায় না, তেমনি আত্মাকেও কখনো খণ্ডিত করা যায় না। আগুন এবং তার উত্তাপ, সূর্য এবং তার কিরণ, আত্মা এবং জ্ঞান—এরা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। সেইভাবে পরমাত্মা ও জীবাত্মা পৃথক নয়, এক ও অভেদ। এখানে জ্ঞান, জ্ঞাতা, জ্ঞেয়—এই তিনকে এক দেখানো হয়েছে; ঠিক যেমন আকাশ বস্তুত এক ও অভিন্ন।

নরোত্তম প্রভু নারায়ণ এই জ্ঞান দান করেছেন। তাঁকে আমরা প্রণাম করি।

অস্পর্শযোগো বৈ নাম সর্বসত্ত্বসুখো হিতঃ।

অবিবাদোঽবিরুদ্ধশ্চ দেশিতস্তং নমাম্যহম্॥২

অন্বয়: অস্পর্শযোগঃ (সেই যোগ যাতে বাহ্যবস্তুর সঙ্গে কোন সংযোগ থাকে না); বৈ (যথার্থত); নাম (পরিচিত); সর্বসত্ত্বসুখঃ (সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য); হিতঃ (কল্যাণকর); অবিবাদঃ (বিবাদের অবকাশ নেই); অবিরুদ্ধঃ (বিরোধিতার স্থান নেই); দেশিতঃ (শাস্ত্রে নির্দেশিত); অহং তং নমামি (তাকে [সেই যোগকে] প্রণাম করি)।

সরলার্থ: যে যোগে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সঙ্গে কোন সংযোগ থাকে না তাকে বলে অস্পর্শযোগ। এই যোগ সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য ও কল্যাণকর। বিবাদ বা বৈরিতার কোন অবকাশ এই যোগে নেই। শাস্ত্র এই যোগশিক্ষা দেন। এই যোগকে আমি প্রণাম করি।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে অদ্বৈততত্ত্বের প্রশস্তি করা হয়েছে। অদ্বৈতবাদকে এখানে যোগ বলা হচ্ছে, আর সেই যোগের নাম অস্পর্শযোগ। কথাটির আক্ষরিক অর্থ, যে যোগে বহির্জগতের সঙ্গে কোন সংস্পর্শ থাকে না। যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞ তাঁরা এই যোগের তাৎপর্য বিশদভাবে জানেন।

এই যোগ সকলের জীবনে শান্তি আনে। এই জগতে বহু আপাতসুখকর বস্তু আছে, কিন্তু তা কল্যাণপ্রদ নয়। এই যোগ কিন্তু সুখকর হলেও ক্ষতিকর নয়। সর্বাবস্থায় সকলের পক্ষে এই যোগ মঙ্গলদায়ক।

অদ্বৈতমতে, একই সত্য। সুতরাং কোন সংঘাত ও বৈরিতার কোন স্থান এতে নেই। এখানে শুধু শান্তি ও সমন্বয়।

নিঃসন্দেহে এই যোগ আমাদের শ্রদ্ধা ও সমর্থন আদায় করে নেয়।

ভূতস্য জাতিমিচ্ছন্তি বাদিনঃ কেচিদেব হি।

অভূতস্যাপরে ধীরা বিবদন্তঃ পরস্পরম্॥৩

অন্বয়: পরস্পরং বিবদন্তঃ (নিজেদের মধ্যে বিবাদে রত); কেচিৎ এব (কিছু মানুষ); বাদিনঃ (যাঁরা সাংখ্য দর্শনের সমর্থক); ভূতস্য (ইতিপূর্বেই যা রয়েছে); জাতিম্ ইচ্ছন্তি (মনে করেন জন্মগ্রহণ করেছে); অপরে ধীরাঃ (অন্যান্য পণ্ডিতবর্গ [অর্থাৎ ন্যায়-বৈশেষিক গোষ্ঠী]); অভূতস্য ([দাবি করে] যার অস্তিত্ব নেই তা [জন্মায়])।

সরলার্থ: পরস্পর বিবাদরত পণ্ডিতদের মধ্যে কিছু পণ্ডিত (সাংখ্য) মনে করেন যেসব বস্তু ইতিপূর্বেই রয়েছে তাদের জন্ম হওয়া সম্ভব। অন্য পণ্ডিতেরা (ন্যায়-বৈশেষিক) দাবি করেন যে কেবলমাত্র যে বস্তুর অস্তিত্ব নেই কেবল সে বস্তুই জন্মগ্রহণ করতে সক্ষম।

ব্যাখ্যা: এখানে দেখানো হচ্ছে দ্বৈতবাদীরা পরস্পর বাগ্‌বিতণ্ডায় লিপ্ত। দ্বৈতবাদী সাংখ্যরা বলেন, যেসব বস্তু ইতিপূর্বেই রয়েছে তাদেরই জন্ম হওয়া সম্ভব। অন্যদিকে দ্বৈতবাদী ন্যায়-বৈশেষিক গোষ্ঠী নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান মনে করেন। তাঁদের দাবি, কেবলমাত্র যার অস্তিত্ব নেই সেইরকম বস্তুই জন্মগ্রহণে সক্ষম।

ভূতং ন জায়তে কিঞ্চিদভূতং নৈব জায়তে।

বিবদন্তোঽদ্বয়া হ্যেবমজাতিং খ্যাপয়ন্তি তে॥৪

অন্বয়: ভূতম্ (যা কিছু [ইতিপূর্বেই রয়েছে]); কিঞ্চিৎ (যাই হোক না কেন); ন জায়তে (জন্মগ্রহণ করে না); অভূতং ন এব জায়তে (যে বস্তুর অস্তিত্ব নেই তার পক্ষে জন্মগ্রহণ সম্ভব নয়); [ইতি] বিবদন্তঃ (পরস্পর বিবাদরত [সাংখ্য, ন্যায় ও অন্যান্য পণ্ডিতবর্গ]); এবম্ অদ্বয়াঃ ([এর ফলে] যেন তাঁরা অদ্বৈতবাদী); অজাতিম্ (যুক্তির দিক থেকে জন্ম মিথ্যা); হি (স্বয়ং); তে (ওরা); খ্যাপয়ন্তি (সমর্থন করছে)।

সরলার্থ: সাংখ্য, ন্যায় ও অন্যান্য দ্বৈতবাদীরা পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদে রত। তাঁদের মধ্যে কেউ বলেন, যা ইতিপূর্বেই আছে তার জন্মগ্রহণের প্রয়োজন নেই। অপর দল বলেন, যে বস্তুর অস্তিত্বই নেই তার পক্ষে জন্মগ্রহণ সম্ভব নয়। দ্বৈতবাদীরা এভাবে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে অদ্বৈতবাদীর বক্তব্যকেই সমর্থন করেন। অদ্বৈতমতে, কোন কিছুর জন্ম হওয়া যুক্তির দিক থেকে মিথ্যা।

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদীরা নিজেদের মধ্যে বাগ্‌যুদ্ধে পরস্পরকে খণ্ডন করতে চান। কিন্তু তা করতে গিয়ে তাঁরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে অদ্বৈত সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করেন।

সাংখ্য বলেন শুধুমাত্র অস্তিত্ববান বস্তুরই জন্ম হয়। নৈয়ায়িক বলেন—‘উদ্ভট প্রস্তাব। যার ইতিপূর্বেই অস্তিত্ব আছে তা আবার জন্মাবে কেন? তবে কি তোমরা বলতে চাও যে আত্মা, যা নিত্য আছে তাঁকে আবার জন্মাতে হবে?’ নৈয়ায়িক সিদ্ধান্ত এই যে কেবলমাত্র যার অস্তিত্ব নেই সেই বস্তুরই জন্ম হয়ে থাকে।

সাংখ্যের যুক্তি: যার অস্তিত্ব নেই তা যদি জন্মায় তাহলে তো একদিন খরগোশেরও শিং গজাবে, বন্ধ্যানারীও সন্তানের জন্ম দেবে। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়, অসম্ভব।

এইভাবে দ্বৈতবাদীরা পরস্পরকে খণ্ডন করেন। অদ্বৈতবাদীরা দাবি করেন, জন্ম-মৃত্যু সমস্যার একমাত্র সমাধান হল অদ্বৈততত্ত্ব। অর্থাৎ জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই, সৃষ্টি নেই, বিনাশও নেই। আছে কেবল রূপান্তর। বাইরের রূপটা বদলায়, বস্তু স্বরূপত একই থাকে। সেই অপরিবর্তিত ‘বস্তু’ই আত্মা।

খ্যাপ্যমানামজাতিং তৈরনুমোদামহে বয়ম্।

বিবদামো ন তৈঃ সার্ধমবিবাদং নিবোধত॥৫

অন্বয়: তৈঃ খ্যাপ্যমানাম্ (যাঁরা স্বপক্ষে বলেন); অজাতিম্ (সৃষ্টি না হওয়া); বয়ম্ অনুমোদামহে (আমরা তাঁদের সমর্থন করি); তৈঃ সার্ধং ন বিবদামঃ (আমরা তাঁদের [সাংখ্য] সঙ্গে বিবাদ করতে চাই না); [হে সাধকগণ] অবিবাদম্ (বিবাদের অবকাশ নেই [আত্মার প্রসঙ্গে]); নিবোধত (অনুধাবন কর)।

সরলার্থ: যাঁরা বলেন সৃষ্টি বলে কিছু নেই আমরা তাঁদের সঙ্গে একমত। কিন্তু অন্যদের সঙ্গেও আমাদের বিবাদ নেই। হে সাধকগণ, মন দিয়ে শোন, যেখানে আত্মার প্রসঙ্গ সেখানে বিবাদের অবকাশ নেই।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈতবাদীর মতে সৃষ্টি বলে কিছু নেই। কিন্তু সৃষ্টি নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডায় তাঁরা কোন পক্ষই অবলম্বন করতে চান না; সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকেন। তাঁদের একটিমাত্র বক্তব্য : আত্মাকে জানার চেষ্টা কর।

অজাতস্যৈব ধর্মস্য জাতিমিচ্ছন্তি বাদিনঃ।

অজাতো হ্যমৃতো ধর্মো মর্ত্যতাং কথমেষ্যতি॥৬

অন্বয়: বাদিনঃ (দ্বৈতবাদীরা); অজাতস্য ধর্মস্য (যা জন্মরহিত তার); এব জাতিম্ ইচ্ছন্তি (এমন বস্তুরও জন্মের স্বপক্ষে তর্কবিচার করেন); অজাতঃ হি অমৃতঃ ধর্মঃ (যার জন্ম নেই তার [অবশ্যই] মৃত্যুও নেই); কথং মর্ত্যতাম্ এষ্যতি (কিভাবে মরণশীল হতে পারে?)।

সরলার্থ: যা জন্মরহিত তারও জন্ম হতে পারে—এ জাতীয় তর্ক দ্বৈতবাদীরা করে থাকেন। কিন্তু যার জন্ম নেই তার মৃত্যুও থাকতে পারে না। সুতরাং এমন বস্তুর (যা জন্মরহিত) মৃত্যু কেমন করে হতে পারে?

[কারিকাভাষ্য ৩।২০ এবং ৪।৩ দ্রষ্টব্য]

ন ভবত্যমৃতং মর্ত্যং ন মর্ত্যমমৃতং তথা।

প্রকৃতেরন্যথাভাবো ন কথঞ্চিদ্ভবিষ্যতি॥৭

অন্বয়: অমৃতম্ (যা অবিনাশী); মর্ত্যং ন ভবতি (বিনাশশীল হতে পারে না); তথা (সেইভাবে); মর্ত্যম্ (যা মরণশীল); অমৃতং ন [ভবতি] (অবিনাশী হতে পারে না); কথঞ্চিৎ (যে-কোনও বস্তু); প্রকৃতেঃ অন্যথাভাবঃ ন ভবিষ্যতি (প্রকৃতিদত্ত স্বভাবকে অতিক্রম করতে পারে না)।

সরলার্থ: যা স্বভাবত অবিনাশী তার বিনাশ হতে পারে না। একইভাবে যা মরণশীল তা অবিনাশী হতে পারে না। প্রকৃতি যে বস্তুকে যেমনভাবে সৃষ্টি করেছেন তার থেকে সে অন্যরকম হতে পারে না।

[কারিকাভাষ্য ৩।২১ দ্রষ্টব্য]

স্বভাবেনামৃতো যস্য ধর্মো গচ্ছতি মর্ত্যতাম্।

কৃতকেনামৃতস্তস্য কথং স্থাস্যতি নিশ্চলঃ॥৮

অন্বয়: যস্য (যিনি মনে করেন); স্বভাবেন অমৃতঃ ধর্মঃ (যে বস্তু স্বভাবতই মৃত্যুহীন [তাও তার স্বভাবের পরিবর্তন করতে পারে এবং]); মর্ত্যতাং গচ্ছতি (মরণশীল হতে পারে [তাঁর কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা]); তস্য কৃতকেন (তাঁর নিজের চেষ্টায় অর্জিত); অমৃতঃ (মোক্ষ); কথং স্থাস্যতি নিশ্চলঃ (কিভাবে চিরস্থায়ী হবে?)।

সরলার্থ: যদি কেউ বলেন কোন বস্তু স্বভাবত অবিনাশী হয়েও নিজ স্বভাব পরিবর্তন করতে পারে অর্থাৎ বিনাশশীল হতে পারে তবে (আমরা তাঁকে প্রশ্ন করব) কঠোর সাধনায় তুমি যে মোক্ষলাভ করেছ তাও বদলাতে পারে? অর্থাৎ তোমার মোক্ষ কি চিরস্থায়ী নয়?

[কারিকাভাষ্য ৩।২২ দ্রষ্টব্য]

সাংসিদ্ধিকী স্বাভাবিকী সহজা অকৃতা চ যা।

প্রকৃতিঃ সেতি বিজ্ঞেয়া স্বভাবং ন জহাতি যা॥৯

অন্বয়: যা সাংসিদ্ধিকী (যা যোগ সাধনার দ্বারা অর্জন করা যায়); স্বাভাবিকী (যা স্বাভাবিক [যেমন আগুনের উত্তাপ]); সহজা (যা জন্মগত [যেমন পাখীর ডানা]); চ অকৃতা (যা কেউ সৃষ্টি করেনি); যা স্বভাবং ন জহাতি (যা নিজের স্বভাব পরিবর্তন করে না); সা ইতি বিজ্ঞেয়া প্রকৃতিঃ (তাই প্রকৃতি বলে পরিচিত)।

সরলার্থ: যা যোগ সাধনার বলে লাভ করা যায়, যা স্বাভাবিক, যা জন্মগত, যা কারও সৃষ্টি নয় বা যা কখনো নিজের স্বভাব পরিবর্তন করে না—তাই প্রকৃতি বলে পরিচিত।

ব্যাখ্যা: আত্মা স্বভাবত অবিনাশী। এর অন্যথা হয় না। আত্মা কখনো বিনাশশীল হতে পারে না।

কিন্তু প্রকৃতি শব্দটির অর্থ কি? একটি বস্তুর প্রকৃতি বলতে তার মূল স্বভাবকে বোঝায়। এই প্রকৃতিই বস্তুটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। কখনো কখনো আমরা এমন যোগীপুরুষের সন্ধান পাই, যাঁরা অলৌকিক শক্তির অধিকারী। সেই শক্তি তাঁদের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। যোগীপুরুষ সেইসব শক্তি সাধারণত হারান না। আরও সঠিক দৃষ্টান্ত আগুন ও তার উত্তাপ। আগুন স্বভাবতই উত্তপ্ত। উত্তাপহীন আগুন কল্পনাও করা যায় না, কারণ আগুন ও তার উত্তাপ অবিচ্ছেদ্য।

সেইভাবে পাখি এবং তার ডানা—একই সঙ্গে এদের জন্ম এবং এরা অচ্ছেদ্য। আবার পাখির উড়ার ক্ষমতাও তার সহজাত। আরেকটি দৃষ্টান্ত—জলের গতি স্বভাবত নিম্নমুখী। কোন অবস্থাতেই এইসব ক্ষণস্থায়ী বস্তু তাদের স্বভাব পরিবর্তন করে না। অতএব অবিনাশী আত্মা স্বভাব পরিবর্তন করে বিনাশশীল হবে সে প্রশ্নই ওঠে না।

জরামরণনির্মুক্তাঃ সর্বে ধর্মাঃ স্বভাবতঃ।

জরামরণমিচ্ছন্তশ্চ্যবন্তে তন্মনীষয়া॥১০

অন্বয়: স্বভাবতঃ (নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী); জরামরণনির্মুক্তাঃ (জরা, মৃত্যু ও অন্যান্য পরিবর্তন মুক্ত); সর্বে ধর্মাঃ (সকল জীবাত্মা); জরামরণম্ ইচ্ছন্তঃ (জরা এবং মৃত্যু ইচ্ছা করে); তন্মনীষয়া (তাদের কথা চিন্তা করে); চ্যবন্তে (নিজ প্রকৃত স্বভাব থেকে বিচ্যুত হয়)।

সরলার্থ: জীবাত্মা স্বভাবতই জরা-মৃত্যু থেকে মুক্ত। কিন্তু সবসময় এইসব পরিবর্তনের কথা চিন্তা করতে করতে জীবাত্মা তার মুক্তস্বভাব হারিয়ে ফেলে (অর্থাৎ জীবাত্মা নিজের উপর এইসব পরিবর্তন আরোপ করে)।

ব্যাখ্যা: জীবাত্মা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। পরমাত্মার মতো জীবাত্মারও জরা-মৃত্যু ইত্যাদি পরিবর্তন নেই। কিন্তু জীবাত্মা যদি নিজেকে পরমাত্মা থেকে পৃথক এবং জরা-মৃত্যুর অধীন বলে মনে করতে থাকে, তাহলে ঐ রকম ভাবতে ভাবতে সে ঐরকমই হয়ে যায়। আসলে কিন্তু কোন পরিবর্তন হয় না। সে ধরে নেয় যে, সে ঐরকমই হয়ে গেছে। অন্ধকার রাত্রে আমরা অনেক সময় দড়িকে সাপ বলে ভুল করি, এও ঠিক তাই। জীবাত্মা নিজের উপর অসুখ আরোপ করে নিজের অসুখ ডেকে আনে। আদতে হয়তো এসব অসুখ তার হয়নি, কিন্তু হয়েছে ভাবতে ভাবতে সে দুর্বল হয়ে পড়ে।

কারণং যস্য বৈ কাৰ্য্যং কারণং তস্য জায়তে।

জায়মানং কথমজং ভিন্নং নিত্যং কথং চ তৎ॥১১

অন্বয়: যস্য (যার মতে); কারণং বৈ কাৰ্য্যম্ (কারণ কাৰ্যে পরিণত হয়); তস্য (তার মতে); কারণং জায়তে (কারণ জন্ম নেয়); জায়মানম্ (যদি তা জন্মায়); কথম্ অজম্ (কি করে অজাত হতে পারে); কথম্ (কেমন করে); তৎ (সেই কারণ); ভিন্নম্ (খণ্ডিত হয় [অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হয়]); নিত্যম্ (অপরিবর্তিত থাকতে সক্ষম?)।

সরলার্থ: কারও (সাংখ্য) মতে কারণই কাৰ্য। তাঁরা আরও বলেন কারণের জন্ম হয়। তাই যদি হয় তাহলে কি করে কারণকে জন্মরহিত বলা যাবে? আর কারণ যদি কার্যে পরিণত হয় তবে তাঁকে কিভাবে অপরিবর্তনীয়ই বা বলা যায়?

ব্যাখ্যা: সাংখ্য মতে কারণ কার্যে পরিণত হয়। মাটির ঘটের কথাই ধরা যাক। ঘটের উপাদান-কারণ মাটি। মাটিই যেন ঘট হয়েছে।

সাংখ্য দর্শনের মতে জগতের প্রথম উপাদান-কারণ প্রধান [বা প্রকৃতি]। প্রধান মহতে এবং মহৎ অহং-কারে (অহং বোধ) পরিণত হয়। প্রতি ক্ষেত্রেই কারণ কার্যে পরিণত হয়। এইভাবেই সমগ্র জগতের আবির্ভাব। সাংখ্যেরা দাবি করেন প্রধান জন্মরহিত (অজ) এবং অপরিবর্তনীয় (নিত্য)।

অদ্বৈতবাদীরা সাংখ্যের এই দাবি মানেন না। তাঁরা প্রশ্ন করেন ‘যদি বল প্রধান মহতে পরিণত হয় তবে তো জন্ম প্রক্রিয়াই বোঝাচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রধানের জন্ম নেই কিভাবে বলবে? নিশ্চয়ই যার জন্ম নেই সে আর একটি বস্তুতে পরিণত হতে পারে না। এ তো স্ববিরোধী কথা।’

সাংখ্য আরও বলছেন প্রধানের কোন পরিবর্তনও নেই, প্রধান নিত্য। তাই যদি হয় তাহলে প্রধান মহতে পরিণত হয় কি করে? এখানেও সাংখ্য নিজের যুক্তির কাছেই নিজে পরাজিত হচ্ছে।

কারণাদ্যদ্যনন্যত্বমতঃ কাৰ্য্যমজং যদি।

জায়মানাদ্ধি বৈ কার্যাৎকারণং তে কথং ধ্রুবম্॥১২

অন্বয়: যদি (যদি [কার্য]); কারণাৎ অনন্যত্বম্ (কারণ থেকে পৃথক না হয়); অতঃ (অতএব); কাৰ্য্যম্ (কার্য); অজম্ [স্যাৎ] (জন্ম হয়নি); জায়মানাৎ কাৰ্য্যাৎ (যে কার্য উৎপন্ন হয়েছে তার থেকে [আলাদা নয়]); হি কারণং তে (তোমার মতে কারণ [কেমন করে]); কথং ধ্রুবম্ (স্যাৎ] (অপরিবর্তনীয় হতে পারে)।

সরলার্থ: কার্য যদি জন্মহীন কারণ থেকে পৃথক না হয় তাহলে কার্যেরও জন্ম নেই। উপরন্তু (কার্য-কারণ পৃথক না হলে) কারণ কিভাবে অপরিবর্তিত থাকে?

ব্যাখ্যা: সাংখ্যমতে, প্রধান (বা প্রকৃতি) মহৎ এবং অন্যান্য বস্তুর কারণ, জন্মরহিত এবং অপরিবর্তিত। আবার কারণই কার্যে পরিণত হয়, এও সাংখ্যের দাবি।

অদ্বৈতবাদীরা সাংখ্যের সঙ্গে একমত নন। তাঁরা বলেন—‘যদি কারণ কার্যে পরিণত হয় তার অর্থ হল কার্যের উৎপত্তি আছে। আবার যদি কার্য ও কারণ অভিন্ন হয় তাহলে বলতে হবে কারণেরও উৎপত্তি আছে। উপরন্তু কারণ কার্যে পরিণত হলে কারণকে কোনমতেই অপরিবর্তিত বলা যায় না। যেমন একটি মুরগীর শরীরের এক অংশ যখন রান্না করা হচ্ছে, অপর অংশ কি ডিম দিতে পারে?

অজাদ্বৈ জায়তে যস্য দৃষ্টান্তস্তস্য নাস্তি বৈ।

জাতাচ্চ জায়মানস্য ন ব্যবস্থা প্রসজ্যতে॥১৩

অন্বয়: যস্য (সাংখ্যমতে); অজাৎ (জন্মরহিত কারণ থেকে); জায়তে (কার্য উৎপন্ন হয়); তস্য (এইজন্য [এর সমর্থনে]); দৃষ্টান্তঃ ন অস্তি বৈ (নিশ্চয়ই কোন দৃষ্টান্ত নেই); জাতাৎ (যার জন্ম হয়েছে [সুতরাং ক্ষণস্থায়ী] তার থেকে); [এইরকম কারণ থেকে] জায়মানস্য (যার উৎপত্তি হল); চ (আরও); ব্যবস্থা ন প্রসজ্যতে (এই প্রক্রিয়া অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে)।

সরলার্থ: যে কারণের এখনও জন্মই হয়নি তার থেকেও কার্য হতে পারে—এর স্বপক্ষে সাংখ্য কোনও দৃষ্টান্ত দিতে পারেননি। আবার যদি বলা হয় কারণের উৎপত্তি আছে এবং সেই কারণ থেকে আবার কোন কার্য উৎপন্ন হয়েছে তাহলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয় তাকে ন্যায়শাস্ত্রে বলে ‘অনবস্থা’ দোষ।

ব্যাখ্যা: সাংখ্যমতে, কারণ না থাকলেও কার্য থাকতে পারে। কিন্তু এর স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ আছে কি? না, নেই। অদ্বৈতবাদী বলেন ‘শূন্য থেকে কিছুর উৎপত্তি’ এ একটি উদ্ভট প্রস্তাব।

যদি তর্ক ওঠে কোন কার্যের কারণ অপর আর একটি কারণের থেকে উৎপন্ন, তাহলে এই দ্বিতীয় কারণেরও আবার একটি কারণ থাকতে হবে। আর এইভাবেই চলতে থাকবে অনন্তকাল। এই অবস্থা যুক্তির দিক দিয়ে মিথ্যা, ন্যায়শাস্ত্রে এই অবস্থার নাম অনবস্থা দোষ (Regressus ad infinitum)।

হেতোরাদিঃ ফলং যেষামাদির্হেতঃ ফলস্য চ।

হেতোঃ ফলস্য চানাদিঃ কথং তৈরুপবর্ণ্যতে॥১৪

অন্বয়: যেষাম্ (যাঁরা মনে করেন); ফলম্ (কার্য [যেমন দেহ এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ]); হেতোঃ আদিঃ ([পূর্বকৃত] কর্মই তার কারণ); হেতুঃ চ (এই কারণও [অর্থাৎ এই কর্মও]); ফলস্য ([কারণের] কার্য); আদিঃ (কারণ [দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ]); তৈঃ (সেই দ্বৈতবাদীরা); হেতোঃ (কারণের); ফলস্য চ (কার্যের ও); অনাদিঃ (অনবস্থা দোষ); কথম্ উপবর্ণ্যতে (কেমন করে ব্যাখ্যা করবেন?)।

সরলার্থ: দ্বৈতবাদীরা মনে করেন দেহ কর্মের ফল। তাঁরা আরও মনে করেন কর্মও দেহের ফল (অর্থাৎ কারণ কার্যে পরিণত হয়, আবার কার্য কারণে পরিণত হয়)। এই অবস্থায় তাঁরা কি করে দাবি করবেন যে এই প্রক্রিয়া অনাদি?

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদীদের মতে মানুষের দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পূর্বকৃত ভালো বা মন্দ কর্মের ফল। একইভাবে কৃতকর্ম আবার দেহের ফল। এইভাবে কার্য-কারণ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। কারণ (হেতু) কার্যে (ফলে) পরিণত হয়, আবার কার্য কারণে পরিণত হয়। স্পষ্টভাবেই এখানে আরম্ভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাহলে দ্বৈতবাদীরা কি করে হেতু ও ফলের অনাদিত্ব ব্যাখ্যা করবেন? (অর্থাৎ এ তো স্ববিরোধী কথা কারণ নিত্যকূটস্থ আত্মায় হেতু-ফল ভাব সম্ভব নয়।)

হেতোরাদিঃ ফলং যেষামাদির্হেতুঃ ফলস্য চ।

তথা জন্ম ভবেত্তেষাং পুত্ৰাজ্জন্ম পিতুর্যথা॥১৫

অন্বয়: যেষাম্‌ (যাঁদের মতে); ফলং হেতোঃ আদিঃ (ফল [আবার] কারণেরও কারণ); হেতুঃ চ (কারণও); ফলস্য আদিঃ (ফলের কারণ); তেষাম্ (তাঁরা বলতে চান); পুত্ৰাৎ পিতুঃ জন্ম যথা তথা জন্ম ভবেৎ (পুত্রের থেকে পিতার জন্মের মতোই তাঁদের সৃষ্টির ব্যাখ্যা [যা নিতান্তই উদ্ভট])।

সরলার্থ: দ্বৈতবাদীদের মতে ফলই (অর্থাৎ কার্যই) হেতুর (অর্থাৎ কারণের) কারণ, এবং হেতুও (কারণও) আবার ফলের (অর্থাৎ কার্যের) কারণ। তাঁদের মতে উৎপত্তি অনেকটা পুত্রের থেকে পিতার জন্মের মতো—যা নেহাতই উদ্ভট।

সম্ভবে হেতুফলয়োরেষিতব্যঃ ক্রমস্ত্বয়া।

যুগপৎসম্ভবে যম্মাদসম্বন্ধো বিষাণবৎ॥১৬

অন্বয়: হেতু-ফলয়োঃ সম্ভবে (কার্য-কারণের উৎপত্তি বিষয়ে); ত্বয়া ক্রমঃ এষিতব্যঃ (তুমি অবশ্যই স্বীকার করবে যে পরম্পরা আছে); যস্মাৎ (কারণ); যুগপৎ সম্ভবে (যদি উভয়েরই উৎপত্তি একসঙ্গে হয়); বিষাণবৎ অসম্বন্ধঃ (পরস্পরের সঙ্গে সংযোগহীন দুটো শিং যেমন একই সঙ্গে বেরোয় সেইরকম)।

সরলার্থ: তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে কার্য-কারণের মধ্যে একটা পরম্পরা আছে (কারণ আগে আসে কার্য পরে)। কারণ যদি উভয়ের উৎপত্তি একইসঙ্গে হয় তা হবে পরস্পর সংযোগহীন দুটো শিংয়ের একসঙ্গে বেরোনোর মতো। অর্থাৎ কার্য-কারণ সম্পর্ক সেখানে সিদ্ধ হয় না।

ব্যাখ্যা: খরগোশের শিং নেই একথা সবাই জানে। যদি বলা হয় খরগোশের শিং থেকে কোন কিছুর উৎপত্তি হয়েছে তবে তা হবে অবিশ্বাস্য। কারণ না থাকলে কার্যও থাকতে পারে না। প্রথমে কারণ থাকতেই হবে, কার্য তাকে অনুসরণ করবে। আবার কার্য না থাকলে সেই কার্যের কারণে পরিণত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যদি খরগোশের শিংই না থাকে, তবে সেই শিং নিশ্চয়ই কোন কার্যের কারণ হতে পারে না।

কার্য-কারণ তত্ত্ব দুরূহ যেহেতু কার্য হতে গেলে কারণ থাকতেই হবে। কারণের অস্তিত্বে সংশয় থাকলে কার্যের অস্তিত্ব স্বতই বাতিল হয়ে যায়।

ফলাদুৎপদ্যমানঃ সন্ন তে হেতুঃ প্রসিধ্যতি।

অপ্রসিদ্ধঃ কথং হেতুঃ ফলমুৎপাদয়িষ্যতি॥১৭

অন্বয়: তে (তোমার মতে); হেতুঃ (কারণ); ফলাৎ (কার্য থেকে); উৎপদ্যমানঃ সন্ (জন্মায়); ন প্রসিধ্যতি (প্রমাণ করে না যে এটা কারণ); অপ্রসিদ্ধঃ হেতুঃ (কারণ যদি কারণ হিসেবে প্রমাণিত না হয়); কথং ফলম্ উৎপাদয়িষ্যতি (তবে তা কেমন করে কার্য উৎপন্ন করবে?)।

সরলার্থ: দ্বৈতবাদীরা বলেন যে কারণ কার্যে পরিণত হয় এবং কার্যও পরে কারণে পরিণত হয়। একথা যদি সত্য হয়, তবে কারণ আর কারণ থাকে না, যেহেতু কারণ এখানে কার্যের উপর নির্ভরশীল। এইভাবে কারণ যদি কারণরূপে প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে তা কার্য উৎপাদন কিভাবে করতে পারে?

যদি হেতোঃ ফলাৎসিদ্ধিঃ ফলসিদ্ধিশ্চ হেতুতঃ।

কতরৎ পূর্বনিষ্পন্নং যস্য সিদ্ধিরপেক্ষয়া॥১৮

অন্বয়: ফলাৎ যদি হেতোঃ সিদ্ধিঃ (যদি কার্য থেকে কারণ হয়); হেতুতঃ চ অপি ফলসিদ্ধিঃ (এবং কারণ থেকে কার্য হয়); কতরৎ পূর্বনিষ্পন্নম্ (দুয়ের মধ্যে কোন্‌টি আগে এসেছে); যস্য অপেক্ষয়া (যার সাহায্যে); [উত্তরস্য ফলস্য] সিদ্ধিঃ (পরের কার্যটি ঘটে থাকে)।

সরলার্থ: কারণ যদি কার্য থেকে আসে এবং কার্যও আসে কারণ থেকে তবে কোন্‌টি আগে এসে অপরটিকে পরে ঘটতে সাহায্য করেছে?

অশক্তিরপরিজ্ঞানং ক্রমকোপোঽথবা পুনঃ।

এবং হি সর্বথা বুদ্ধৈরজাতিঃ পরিদীপিতা॥১৯

অন্বয়: অশক্তিঃ ([যদি] এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পার [তার অর্থ হবে]); অপরিজ্ঞানম্ (তোমার অজ্ঞতা); অথবা (বা [যদি তুমি স্বীকার কর]); ক্রমকোপঃ (একটি অপরটিকে অনুসরণ করবে এমন নয় [কারণ উভয়েই যুগপৎ উপস্থিত]); পুনঃ (তবুও); এবং হি (এইভাবে); সর্বথা (প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে); বুদ্ধৈঃ (প্রজ্ঞাবানের দ্বারা); অজাতিঃ (জন্ম না হওয়া); পরিদীপিতা (স্পষ্টতই প্রমাণিত)।

সরলার্থ: যদি তোমরা (দ্বৈতবাদীরা) এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পার, তবে তা তোমাদের অজ্ঞতাই প্রমাণ করবে। যদি বল একযোগে কারণ ও কার্যের উৎপত্তি হয়, তার অর্থ হল কার্য-কারণ-পরম্পরা সম্পর্কে তোমাদের মত তোমরা নিজেরাই খণ্ডন করছ। এইভাবে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা সব দিক থেকে বিচার করে উৎপত্তির ধারণাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছেন।

বীজাঙ্কুরাখ্যো দৃষ্টান্তঃ সদা সাধ্যসমো হি সঃ।

ন হি সাধ্যসমো হেতুঃ সিদ্ধৌ সাধ্যস্য যুজ্যতে॥২০

অন্বয়: বীজাঙ্কুরাখ্যঃ দৃষ্টান্তঃ (বীজ ও চারাগাছের দৃষ্টান্ত); সঃ হি (সেই [দৃষ্টান্ত]); সাধ্যসমঃ (একটি তত্ত্ব বা মতবাদ ছাড়া আর কিছু নয় [অর্থাৎ প্রমাণ-সাপেক্ষ]); সাধ্যসমঃ হেতুঃ (কারণ সেই তথাকথিত উপমাটি এখনও একটি মতবাদ মাত্র); সাধ্যস্য সিদ্ধৌ ন হি যুজ্যতে (প্রমাণ হিসেবে প্রযোজ্য হতে পারে না [অর্থাৎ কার্য-কারণ সম্পর্ক অনাদি—এই মতের প্রমাণ হতে পারে না])।

সরলার্থ: বীজ ও চারাগাছের দৃষ্টান্তটি এখনও মতবাদের স্তরে (অর্থাৎ প্রক্রিয়াটির অনাদিত্ব এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি)। যেহেতু দৃষ্টান্তটি এখনও প্রমাণসাপেক্ষ, সেহেতু সেটিকে অন্য মতবাদের সমর্থনে ব্যবহার করা যায় না।

ব্যাখ্যা: কার্য-কারণ প্রক্রিয়াটি অনাদি কিনা—এইটিই প্রশ্ন। কারও কারও মতে অনাদি। তাঁদের মতে কারণ কার্যে এবং কার্য কারণে পরিণত হয়। আর এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এর কোনও শুরু নেই।

কার্য কারণে পরিণত হতে পারে—এই ধারণাকে বেদান্তবাদীরা বিদ্রূপ করে প্রশ্ন করেন : এর অর্থ কি এই যে পিতা নিজ পুত্রের পুত্র হতে পারেন? অথবা খরগোশের দুটি শিংয়ের মতো কার্য ও কারণ অসংলগ্নভাবে একই সময়ে উৎপন্ন হয়?

দ্বৈতবাদীরা উত্তরে বলেন: ‘কারণ যে কার্যে পরিণত হয় তাতো দেখাই যায়! এই প্রক্রিয়া অনাদি।’ বেদান্তবাদীরা এই প্রসঙ্গে একমত নন। তাঁরা বলেন : যখন বীজ থেকে চারাগাছ জন্মাচ্ছে, তখনি সেই নতুন চারাগাছের সূচনা হল বলতে হবে। অনুরূপভাবে যখন বীজের উৎপত্তি হয় তখন সেটিই বীজের সূচনা। অর্থাৎ প্রতিবারই যখন একটি বীজ উৎপন্ন হয় তখন সেটি একটি নতুন বীজ। চারাগাছ সম্পর্কেও একই কথা প্রয়োজন। সুতরাং কার্য ও কারণ উভয়েরই আদি আছে।

দ্বৈতবাদীরা বলতে পারেন: ভালো কথা। ধরা যাক, কার্য ও কারণ উভয়েরই আদি আছে। কিন্তু কারণের কার্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটি যে অনাদি তা কিভাবে অস্বীকার করা যায়? এই প্রক্রিয়া অবশ্যই চিরন্তন।

বেদান্তবাদীদের উত্তর—একথা বলে তুমি আবার একটা নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি করছ—কারণ থেকে কার্য। বস্তুত তুমি বিষয়টি আরও জটিল করে তুলছ। একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তুমি অন্য আর একটি মতবাদের অবতারণা করছ— যে মতবাদের নিজেরই কোন দৃঢ় ভিত্তি নেই।

পূর্বাপরাপরিজ্ঞানমজাতেঃ পরিদীপকম্।

জায়মানাদ্ধি বৈ ধর্মাৎ কথং পূর্বং ন গৃহ্যতে॥২১

অন্বয়: পূর্বাপরাপরিজ্ঞানম্ (কোন্‌টা কারণ [পূর্ব] কোন্‌টা কার্য [অপর] সে-বিষয়ে অজ্ঞতা); অজাতেঃ (যার জন্ম নেই তার); পরিদীপকম্ (সাক্ষ্যপ্রমাণ); হি (যদি); জায়মানাৎ ধর্মাৎ (যা জন্মগ্রহণ করল তার থেকে); পূর্বম (এর কারণ [যা পূর্ববর্তী]); কথম্ (কেন); ন গৃহ্যতে (জানা যাবে না [সুতরাং কিছুরই জন্ম হয় না])।

সরলার্থ: যদি কারণ ও কার্য না জানা যায়, তবে তাই প্রমাণ করে যে কিছুই জন্মায় না। যদি সত্যিই কিছুর জন্ম হয়, তবে তার কারণ (উৎস) অজ্ঞাত হওয়ার পেছনে কোন যুক্তিই নেই।

ব্যাখ্যা: বেদান্তবাদীরা বলতে চান আত্মাই একমাত্র আছেন। চতুর্দিকে যে বৈচিত্র আমরা দেখি তা আত্মার উপরে নাম-রূপের আরোপমাত্র—যেমন অন্ধকার রাত্রে দড়িকে আমরা সাপ বলে ভুল করি।

স্বতো বা পরতো বাঽপি ন কিঞ্চিদ্বস্তু জায়তে।

সদসৎ সদসদ্বাঽপি ন কিঞ্চিদ্বস্তু জায়তে॥২২

অন্বয়: স্বতঃ (স্বতন্ত্রভাবে); বা পরতঃ (অথবা কারও মাধ্যমে); কিঞ্চিৎ বস্তু ন জায়তে (কোন বস্তুই জন্মগ্রহণ করে না); সৎ (যার অস্তিত্ব আছে [যেমন—এই জগৎ]); অসৎ (যার অস্তিত্ব নেই [যেমন আকাশকুসুম]); সৎ-অসৎ (একাধারে সত্যও বটে আবার অসত্যও বটে); কিঞ্চিৎ বস্তু ন জায়তে (কোন রূপের কোন বস্তুরই জন্ম হয় না)।

সরলার্থ: স্বতন্ত্রভাবেই হোক বা কারও মাধ্যমেই হোক, কোন কিছুরই জন্ম হয় না। কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকুক বা নাই থাকুক, অথবা যার অস্তিত্ব আছেও বটে আবার নেইও বটে—যাই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই কোন বস্তুর জন্ম হয় না।

ব্যাখ্যা: বেদান্ত জন্মের ধারণাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়। যেমন, কোন কিছুই আপনা-আপনি জন্মায় না। ঘট কখনো নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারে না। অনুরূপভাবে ঘট একটি বস্ত্রখণ্ড বা অন্য কিছু থেকেও উৎপন্ন হতে পারে না। আবার একটি বস্ত্রখণ্ড ও ঘট একযোগেও আর একটি ঘট বা আর একটি বস্ত্রখণ্ড উৎপন্ন করতে পারে না।

পরবর্তী প্রশ্নটি হল: যা আছে তার কি আবার জন্ম হতে পারে? প্রশ্নটি হাস্যকর। কারণ একটি বস্তু যদি ইতিপূর্বেই থেকে থাকে তবে তা আবার জন্মাতে যাবে কেন? আবার যার আদৌ অস্তিত্বই নেই তা কি জন্মাতে পারে? এ তো খরগোশের শিং হতে পারে কিনা সেইরকম প্রশ্ন। স্পষ্টতই উত্তর হল—না, পারে না।

আর একটি প্রশ্ন হল কোন বস্তু, যার একাধারে অস্তিত্ব আছে এবং নেই সে কি জন্মাতে পারে? প্রশ্নটিই উদ্ভট কারণ এরকম বস্তু কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

আমরা বলি মাটি দিয়ে ঘট তৈরি হয় এবং পিতা পুত্রের জন্ম দেয়। কিন্তু ‘ঘট’ এবং ‘পুত্র’ শব্দে কোন আকার বা রূপকে বোঝায়, সত্যবস্তুকে নয়। সোনা দিয়ে গলার হার, বালা, কানের দুল প্রভৃতি গড়তে পারি। একই সোনা রূপ পালটাচ্ছে। আবার হার থেকে বালা, বালা থেকে কানের দুল তৈরি হতে পারে, কিন্তু সোনা সোনাই থাকে। বিবেকী ব্যক্তি আসল বস্তু ও তার বিভিন্ন আকারের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন। রূপ বদলায়, কিন্তু বস্তুটি একই থাকে।

বেদান্তমতে এই ‘বস্তু’টিই হল আত্মা—যা অপরিবর্তনীয় এবং অদ্বিতীয়। আমরা যত রূপ দেখি সে সবই আত্মার উপর আরোপিত উপাধিমাত্র—যেমনভাবে সাপ রজ্জুর উপর আরোপিত। এই আরোপ সত্ত্বেও আত্মা আত্মাই থাকেন। বিভিন্ন নাম-রূপের প্রভাবে এক আত্মাই বহু রূপে প্রতিভাত হন।

হেতুৰ্ন জায়তেঽনাদেঃ ফলং চাপি স্বভাবতঃ।

আদির্ন বিদ্যতে যস্য তস্য হ্যাদির্ন বিদ্যতে॥২৩

অন্বয়: অনাদেঃ (যদি অনাদি বলে কিছু থাকে); হেতুঃ ন জায়তে (তার কোন কারণ থাকে না); ফলং চ (কার্যও); স্বভাবতঃ অপি (অনুরূপভাবে কারণ না থাকলে [কার্য হয় না]); যস্য আদিঃ ন বিদ্যতে (যদি কারণ ছাড়া কিছু থাকে); তস্য হি আদিঃ ন এব বিদ্যতে ([তবে সিদ্ধান্ত এই যে] এরকম বস্তুর জন্ম নেই)।

সরলার্থ: কোন কিছুর যদি আরম্ভ না থাকে, তাহলে তার কারণও থাকে না। একইভাবে কারণ ছাড়া কার্যও উৎপন্ন হয় না। আবার যদি কারণ ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে তবে সেই বস্তুর জন্মই হয়নি।

ব্যাখ্যা: যদি কার্য ও কারণ উভয়ই অনাদি হয় তবে কার্যও থাকে না, কারণও থাকে না। অনাদি কার্য আর একটি বস্তুর কারণ হতে পারে না। একইভাবে অনাদি কারণ কার্য উৎপন্ন করতে পারে না। সুতরাং কার্য ও কারণ উভয়ই যদি অনাদি হয় তবে কোন কিছুরই জন্ম হয় না।

প্রজ্ঞপ্তেঃ সনিমিত্তত্বমন্যথা দ্বয়নাশতঃ।

সংক্লেশস্যোপলব্ধেশ্চ পরতন্ত্রাস্তিতা মতা॥২৪

অন্বয়: প্রজ্ঞপ্তেঃ (যখনি আমরা কিছু অনুভব করি [যেমন একটি শব্দ শুনলাম]); সনিমিত্তত্বম্ (সেই অনুভবের পেছনে অবশ্যই কোন কারণ থাকবে [এটি অবশ্যস্বীকার্য]); অন্যথা (অন্যথায় [যদি এটি কারণ বস্তু ছাড়াই ঘটে থাকে]); দ্বয়নাশতঃ (এর অর্থ দৃশ্যজগতে দুই বলে কিছু নেই); সংক্লেশস্য উপলব্ধেঃ চ (যন্ত্রণার অনুভূতি [কোন কিছু দ্বারা উৎপন্ন হয়—যেমন আগুন এবং এই যন্ত্রণার অনুভূতি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়]); পরতন্ত্রাস্তিতা মতা (এই বাহ্যবস্তুর উপস্থিতি দ্বৈতবাদীদের শাস্ত্রীয় বক্তব্যকে সমর্থন করে)।

সরলার্থ: যখনি আমাদের কোন ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা হয় তখন অবশ্যই তার পেছনে কোন কারণ আছে। একথা স্বীকার না করার অর্থ হল, এ দৃশ্যজগতে যে দুই আছে তা অস্বীকার করছি। কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি তো সবার হয়। সেক্ষেত্রে বাইরের কোন বস্তু আমাদের আঘাত করলে তবেই সেই অনুভূতি হয়ে থাকে। এই দুয়ের উপস্থিতিই দ্বৈতবাদী শাস্ত্রের বক্তব্য বিষয়।

প্রজ্ঞপ্তেঃ সনিমিত্তত্বমিষ্যতে যুক্তিদর্শনাৎ।

নিমিত্তস্যানিমিত্তত্বমিষ্যতে ভূতদর্শনাৎ॥২৫

অন্বয়: যুক্তিদর্শনাৎ (যেহেতু যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা আছে [সেহেতু দ্বৈতবাদী]); প্রজ্ঞপ্তেঃ সনিমিত্তত্বম্ (সকল উপলব্ধির পেছনে একটি বস্তুর উপস্থিতি); ইষ্যতে (দাবি করে [আমরা অদ্বৈতবাদীরা]); ভূতদর্শনাৎ (একই আত্মাকে সর্বত্র বিরাজিত দেখি); নিমিত্তস্য অনিমিত্তত্বম্ (বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতার জন্য বাহ্যবস্তুর প্রয়োজন নেই); ইষ্যতে (আমরা দেখি)।

সরলার্থ: (অদ্বৈতবাদী দ্বৈতবাদীকে বলছেন) তুমি বলতে চাইছ যেহেতু যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা আছে সেহেতু সেই যন্ত্রণার কারণও থাকবে। আমাদের বক্তব্য এই—যেহেতু আত্মা সর্বত্র আছেন, সবকিছুর ভিতরেও আছেন বাইরেও আছেন সেহেতু কোন অভিজ্ঞতার জন্য বাইরের বস্তুর প্রয়োজন নেই।

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদীরা বলেন: যদি তুমি যন্ত্রণা বোধ কর তবে সেই যন্ত্রণার নিশ্চয়ই কোন কারণ থাকবে। ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতার জন্য বাহ্যবস্তুর একান্ত প্রয়োজন—যেমন আগুন বা অন্য কোন আঘাতে আমাদের যন্ত্রণার অনুভূতি হয়। আমরা বহু বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাসী।

অদ্বৈতবাদীরা বলেন: জগতে একটিই মাত্র অস্তিত্ব আছে। তা হল আত্মা। এই আত্মাকেই নানা নামে নানা রূপে দেখা যায়। এই নাম-রূপ উপাধিমাত্র। সুতরাং এগুলি সত্য নয়। যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়—যদি দড়ি বলে বুঝতে পারি তাহলে সাপের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। যেমন নানারকমের মাটির পাত্র রয়েছে—থালা, পেয়ালা ইত্যাদি। যদি জানি সেগুলি মাটির তৈরি তাহলে আমার কাছে ওগুলি মাটি ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ আমার কাছে মানুষ আর মোষের মধ্যে যতটা তফাত, মাটির থালা আর পেয়ালার মধ্যে ততটা নয়। একইভাবে তুলোর তৈরি কিছু জিনিস নাম-রূপে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু আমার কাছে সেগুলি সবই তুলো।

দ্বৈতবাদীরা তর্ক করতে পারেন: পৃথক বস্তুর অনুভূতিও পৃথক হয়। যেমন কোন বস্তু আমার পক্ষে বেদনাদায়ক, কোনটা বা সুখপ্রদ। সুতরাং মানতেই হবে বাইরে নানা বস্তু রয়েছে এবং সেগুলিকে আমরা নানাভাবে অনুভব করি।

উত্তরে অদ্বৈতবাদী বলেন: এর দ্বারা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। বাইরে যাই দেখ বা অনুভব কর না কেন আত্মাই একমাত্র আছেন। যেমন স্বপ্নে অনেকরকম বস্তু দেখা যায়—তার কিছু ভালো আর কিছু মন্দ। কিন্তু সেগুলি কি সত্য? সেগুলির কি কোন অস্তিত্ব আছে? না, আত্মা ছাড়া আর কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমরা সেই আত্মাকেই উপলব্ধি করি।

চিত্তং ন সংস্পৃশত্যর্থং নার্থাভাসং তথৈব চ।

অভূতো হি যতশ্চার্থো নার্থাভাসস্ততঃ পৃথক্॥২৬

অন্বয়: [অতএব] চিত্তম্ (মন); অর্থম্ (বাহ্যবস্তু); ন সংস্পৃশতি (কোন সংযোগ নেই); ন অর্থাভাসং চ তথা এব (একইভাবে যে বস্তুগুলি সে দেখছে বলে কল্পনা করছে সেগুলি যে তার নিজেরই মনগড়া এ-ব্যাপারে সে সচেতন নয়); যতঃ (সেইজন্য); অর্থঃ (বাহ্যবস্তু); অভূতঃ হি (যথার্থই কোন অস্তিত্ব নেই); অর্থাভাসঃ চ (যেসব বস্তু দেখছে বলে মন কল্পনা করে); ততঃ পৃথক্ ন (সেগুলি মন থেকে পৃথক নয়)।

সরলার্থ: সুতরাং বাইরের কোন বস্তুর সঙ্গে মনের কোন যোগ ঘটে না। যদি মন ভাবে যোগ ঘটছে, তবে তা তার কল্পনা—যদিও একথা মন জানে না। তাই বাইরে যা দেখছি তার অস্তিত্ব নেই, তা কল্পনা, মনের বাইরের কোন বস্তু নয়।

ব্যাখ্যা: বাইরে কিছু নেই। আমাদের যদি মনে হয় বাইরে কি একটা আছে, আসলে কিছুই নেই। স্বপ্নে যেমন, বাইরেও তেমনি নানা জিনিস দেখা যায়। এ দেখা দেখা নয়। বাইরেই দেখি বা মনের মধ্যেই দেখি—সবই মনের সৃষ্টি মাত্র।

নিমিত্তং ন সদা চিত্তং সংস্পৃশত্যধ্বসু ত্রিষু।

অনিমিত্তো বিপর্যাসঃ কথং তস্য ভবিষ্যতি॥২৭

অন্বয়: চিত্তম্ (মন); ত্ৰিষু অধ্বসু (তিনকালে [অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ]); সদা নিমিত্তং ন সংস্পৃশতি (বাহ্যবস্তুর সঙ্গে কখনো সংযোগ হয়নি); [যদি তাই হয়] তস্য কথম্ অনিমিত্তঃ বিপর্যাসঃ ভবিষ্যতি (যার অস্তিত্ব নেই সেই বাহ্যবস্তুর অনুভব মন কিভাবে করতে পারে?)।

সরলার্থ: অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—কোন কালেই মনের সঙ্গে বাহ্যবস্তুর কোন সংযোগ নেই। যেহেতু মনের বাইরে কোনও বস্তু নেই সেহেতু অস্তিত্বহীন বস্তুর মিথ্যা অনুভবই বা কিভাবে হতে পারে?

ব্যাখ্যা: জ্ঞান বস্তু নিরপেক্ষ; শাশ্বত ও চিরন্তন। জ্ঞানই নিত্য।

এই শ্লোকে বলা হয়েছে যে মন কখনো বাহ্যবস্তুর সংস্পর্শে আসে না কারণ এসব বাহ্যবস্তুর কোন অস্তিত্বই নেই। তাহলে প্রশ্ন হল যদি ইতিপূর্বেই মনের সঙ্গে বস্তুর প্রত্যক্ষ যোগ না হয়ে থাকে, তবে একটা ঘট বা সাপকে দেখে মন তাদের কি করে চিনতে পারে?

এইখানেই মনের বিশেষত্ব। যদিও বাইরে কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই, মন নিজের ভিতরে বস্তু সৃষ্টি করে বাইরে আরোপ করে। সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ অবিদ্যায় আচ্ছন্ন। এই অবিদ্যাই একের উপর বহু আরোপ করে। জ্ঞান হলে এই দ্বৈতদৃষ্টি মুছে যায়।

তস্মান্ন জায়তে চিত্তং চিত্তদৃশ্যং ন জায়তে।

তস্য পশ্যন্তি যে জাতিং খে বৈ পশ্যন্তি তে পদম্॥২৮

অন্বয়: তস্মাৎ (সুতরাং); চিত্তং ন জায়তে (মনের জন্ম নেই); চিত্তদৃশ্যম্ (বাহ্যবস্তু); ন জায়তে (জন্মায় না); যে (যাঁরা); তস্য জাতিং পশ্যন্তি (বিশ্বাস করেন যে তাঁরা জন্মান); তে (এমন লোকেরা); বৈ (নিশ্চিতভাবে); খে পদং পশ্যন্তি (আকাশে [পাখীদের] পায়ের ছাপ দেখতে পান [অর্থাৎ যা অসম্ভব])।

সরলার্থ: (পূর্বোক্ত কারণে) মনের জন্ম নেই এবং বাহ্যবস্তুরও জন্ম নেই। যাঁরা বিশ্বাস করেন মনের জন্ম আছে, তাঁরা আকাশে পাখীদের পায়ের ছাপও দেখতে পান (অর্থাৎ যা অসম্ভব)।

ব্যাখ্যা: এক শ্রেণীর বৌদ্ধ (যথা বিজ্ঞানবাদী) বলেন যে মনের বাইরে কিছুই নেই। যা কিছু দেখতে পাওয়া যায় তা হল মনের সৃষ্টি। এই পর্যন্ত একমত হতে গৌড়পাদের কোনও অসুবিধে নেই।

কিন্তু এইসব ভাববাদীরা আরও বলেন যে, সবকিছুই শূন্য, দুঃখময় এবং মন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এসব অভিজ্ঞতার কথা বলছেন কে? যিনি বলছেন তিনি কি করে বলতে পারেন যে জগৎ ‘শূন্য’? দুঃখ আছে একথা নিঃসন্দেহে সত্য, কিন্তু দুঃখ তো নিত্য নয়। আবার যদি বলা হয় মন ক্ষণস্থায়ী তাহলে অবশ্যই একটা নিত্যবস্তু কিছু আছে যার তুলনায় মনকে ক্ষণিকের বলা যায়। সেই নিত্যবস্তুটি কি?

এইসব ব্যক্তিরা এমনভাবে কথা বলেন যে মনে হয় তাঁরা আকাশে পাখির পায়ের ছাপ (অবাস্তব এবং অসম্ভব) দেখতে পান, আকাশটাকে যেন তাঁরা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে রেখেছেন।

অজাতং জায়তে যস্মাদজাতিঃ প্রকৃতিস্ততঃ।

প্ৰকৃতেরন্যথাভাবো ন কথংচিদ্ভবিষ্যতি॥২৯

অন্বয়: অজাতম্ (যার জন্ম নেই); যস্মাৎ জায়তে (যার থেকে উৎপত্তি); প্রকৃতিঃ অজাতিঃ (যা স্বভাবতই জন্মরহিত); ততঃ (অতএব); প্রকৃতেঃ অন্যথাভাবঃ (সেই স্বভাব থেকে বিচ্যুতি); কথঞ্চিৎ ন ভবিষ্যতি (কোনও ভাবেই সম্ভব নয়)।

সরলার্থ: ব্রহ্ম, যিনি স্বভাবত জন্মরহিত তাঁর থেকে মনের উৎপত্তি। এর ব্যতিক্রমের প্রশ্নই ওঠে না।

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদীরা বলেন—মনের জন্ম হয়। কিন্তু কিসের থেকে মনের এই জন্ম? ব্রহ্ম থেকে? কিন্তু ব্রহ্ম তো স্বরূপত জন্মহীন। যদি ব্রহ্মের জন্ম না থাকে তবে মনেরও জন্ম থাকতে পারে না। ব্রহ্মের যা স্বভাব মনেরও তাই হতে বাধ্য।

অনাদেরন্তবত্ত্বং চ সংসারস্য ন সেৎস্যতি।

অনন্ততা চাদিমতো মোক্ষস্য ন ভবিষ্যতি॥৩০

অন্বয়: অনাদেঃ সংসারস্য (যদি জগৎ অনাদি হয়); অন্তবত্ত্বং চ ন সেৎস্যতি (তবে এর অন্তও থাকতে পারে না); আদিমতঃ (যার শুরু আছে [যেমন আত্মজ্ঞান]); মোক্ষস্য অনন্ততা ন ভবিষ্যতি (মোক্ষ অন্তহীন হতে পারে না)।

সরলার্থ: যাঁরা বলেন জগৎ অনাদি তাঁদের এও স্বীকার করে নিতে হবে জগৎ অন্তহীনও বটে। অনুরূপভাবে যেহেতু মোক্ষ আত্মজ্ঞানের ফল (আর সেই কারণে তার আদি আছে), সুতরাং মোক্ষ চিরস্থায়ী হতে পারে না।

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদীদের মতে, বন্ধন এবং মুক্তি উভয়ই সত্য। অদ্বৈতবাদীরা এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তাঁরা বলেন: ‘যদি কোন বস্তুর আরম্ভ না থাকে তার শেষও থাকবে না। জগতে এর অন্যথা হতে পারে না।’

দ্বৈতবাদীদের উত্তর : কিন্তু বন্ধনের কোন শুরু নেই কিন্তু শেষ আছে। আত্মজ্ঞান হলে মোক্ষলাভ হয়; তখন বন্ধনের অবসান হয়। কিন্তু অদ্বৈতবাদীরা বলেন : মোক্ষের আদি থাকলে অন্ত অবশ্যই থাকবে। সেক্ষেত্রে একে আদৌ মোক্ষ বলা যাবে না।

উত্তরে দ্বৈতবাদীরা বলেন : মোক্ষের কোন অস্তিত্ব নেই, এ ভাঙা ঘটের মতো। অদ্বৈতবাদীরা তখন প্রশ্ন করেন : মোক্ষের যদি অস্তিত্ব না থাকে, তবে কি তা খরগোশের শিংয়ের মতো? কিন্তু যার অস্তিত্বই নেই, অ-বস্তু, তার আবার আরম্ভ অর্থাৎ আদিই বা কি করে থাকতে পারে?

দ্বৈতবাদীরা তবু বলেন: বন্ধনের আদি না থাকলেও অন্ত আছে। এই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা বীজ-গাছ-বীজের দৃষ্টান্ত দেন। বীজ থেকেই গাছ হয়, আবার গাছ থেকে বীজ। এইভাবেই চলতে থাকে। কেউ জানে না কবে এর শুরু হয়েছিল। কোন বীজ না রেখে গাছটি মরে গেলে তবেই এই ধারায় ছেদ পড়ে। কিন্তু অদ্বৈতবাদীরা উত্তরে বলবেন যে এই দৃষ্টান্ত এখানে যথাযথ নয়। কারণ প্রতিবারই যখন গাছ হয় তখন সেটি একটি নতুন গাছ এবং প্রতিবারই যখন বীজ উৎপন্ন হয় তখন সেটি একটি নতুন বীজ। সুতরাং এই ধারাকে কখনই অনাদি বলা চলে না।

সমস্যাটির একমাত্র সমাধান এই যে, বন্ধন কখনো ছিল না, কাজেই তার থেকে মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না। একইসঙ্গে বলতে হয় মোক্ষের কোন শুরু নেই। মোক্ষ সবসময় হয়েই আছে।

আদাবন্তে চ যন্নাস্তি বর্তমানেঽপি তৎ তথা।

বিতথৈঃ সদৃশাঃ সন্তোঽবিতথা ইব লক্ষিতাঃ॥৩১

অন্বয়: যৎ (বস্তুটি); অদৌ (আবির্ভাবের আগে); অন্তে ন অস্তি (শেষ হয়ে গেলে দেখা যায় না); তৎ (বস্তুটি); বর্তমানে অপি (বর্তমানেও); তথা (এটি মিথ্যা); বিতথৈঃ সদৃশাঃ (মরীচিকার মতো দৃষ্টিভ্রম); সন্তঃ অবিতথাঃ ইব লক্ষিতাঃ (সত্য বলে মনে হয়)।

সরলার্থ: যদি এমন কোন বস্তু বর্তমানে থেকে থাকে, যা শুরুর আগেও ছিল না, আবার শেষ হয়ে গেলেও থাকবে না, তবে তাকে মিথ্যা বলেই ধরে নিতে হবে। মরীচিকার মতোই এও এক দৃষ্টিভ্রম—মনে হয় সত্য, কিন্তু আসলে সত্য নয়। যা সত্য তা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—এই তিনকালেই সত্য।

[কারিকাভাষ্য ২।৬ দ্রষ্টব্য]

সপ্রয়োজনতা তেষাং স্বপ্নে বিপ্ৰতিপদ্যতে।

তস্মাদাদ্যন্তবত্ত্বেন মিথ্যৈব খলু তে স্মৃতাঃ॥৩২

অন্বয়: তেষাম্ (জাগ্রত অবস্থায় যেসব বস্তু দেখা যায়); সপ্রয়োজনতা (সেই অবস্থায় কিছু উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে); স্বপ্নে বিপ্ৰতিপদ্যতে (স্বপ্নাবস্থায় সেই কাজে নাও লাগতে পারে); তস্মাৎ (সুতরাং); তে (জাগ্রত অবস্থায় দেখা বস্তুগুলি); আদ্যন্তবত্ত্বেন (শুরু ও শেষ আছে); মিথ্যৈব খলু [তে] স্মৃতাঃ (এইসব বস্তু অবশ্যই মিথ্যা)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় আমরা অনেক বস্তু দেখি যা আমাদের কাজে লাগে। কিন্তু স্বপ্নাবস্থায় সেসব বস্তু হয়তো কোন কাজেই লাগে না। অর্থাৎ ঐসব বস্তুর শুরু ও শেষ দুই-ই আছে। এইসব বস্তু অবশ্যই মিথ্যা।

[কারিকাভাষ্য ২।৭ দ্রষ্টব্য]

সর্বে ধর্মা মৃষা স্বপ্নে কায়স্যান্তর্নিদর্শনাৎ।

সংবৃতেঽস্মিন্ প্রদেশে বৈ ভূতানাং দর্শনং কুতঃ॥৩৩

অন্বয়: স্বপ্নে (স্বপ্নে); কায়স্য অন্তঃ (দেহের অভ্যন্তরে); নিদর্শনাৎ (যাকে তুমি সত্য বলে মনে কর); সর্বে ধর্মাঃ (সকল বাহ্যবস্তু); মৃষা (মিথ্যা হয়ে যায় [তাহলে]); অস্মিন্ সংবৃতে প্রদেশে (এই ব্রহ্মে, যিনি সর্বত্র অভিন্নভাবে রয়েছেন [চৈতন্য]); ভূতানাং দর্শনং বৈ (বস্তুসকলের উপলব্ধি); কুতঃ (কেন নয় [অর্থাৎ ভ্রম নয় কেন?])।

সরলার্থ: যখন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি তখন দেহের অভ্যন্তরে নানা বস্তু দেখতে পাই। পরবর্তীকালে জাগ্রত অবস্থায় সেগুলি মিথ্যা হয়ে যায়, আর দেখা যায় না। এ যদি সম্ভব হয় তাহলে এক ও অভিন্ন ব্রহ্মে (যা শুদ্ধ চৈতন্য) আশ্রিত বস্তুসকলও কেন মিথ্যা হবে না?

ন যুক্তং দর্শনং গত্বা কালস্যানিয়মাদৃগতৌ।

প্রতিবুদ্ধশ্চ বৈ সর্বস্তস্মিন্ দেশে ন বিদ্যতে॥৩৪

অন্বয়: গতৌ (নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো); কালস্য অনিয়মাৎ (কাল বলে কিছু নেই); গত্বা দর্শনং ন যুক্তম্ (এইসব স্থানে গিয়ে যে নানারকমের বস্তু দেখছ); বৈ (এই কারণে); সর্বঃ প্রতিবুদ্ধঃ (যারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে); তস্মিন্ দেশে ন বিদ্যতে (স্বপ্নে যেসব জায়গায় তারা ছিল, সেইসব জায়গায় আর নিজেদের দেখে না)।

সরলার্থ: আমরা স্বপ্নে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই এবং সেইসব জায়গায় নানা জিনিস দেখতে পাই। কিন্তু সেই সময়ে আমাদের সেখানে থাকা এবং নানা বস্তু দেখা শুধু সময়ের বিচারেই অসম্ভব বলে বোঝা যায়। এইজন্যই যখন স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি তখন সেইসব জায়গায় আর নিজেদের দেখা যায় না।

মিত্রাদ্যৈঃ সহ সংমন্ত্র্য সংবুদ্ধো ন প্রপদ্যতে।

গৃহীতং চাপি যৎ কিঞ্চিৎ প্রতিবুদ্ধো ন পশ্যতি॥৩৫

অন্বয়: [স্বপ্নে] মিত্রাদ্যৈঃ সহ সংমন্ত্র্য (মানুষ নিজেকে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে দেখতে পায়); সংবুদ্ধঃ (কিন্তু যখন তার ঘুম ভেঙে যায়); ন প্রপদ্যতে (সে আর তা খুঁজে পায় না); যৎ কিঞ্চিৎ গৃহীতং চ (সে স্বপ্নে যা কিছু পায়); প্রতিবুদ্ধঃ (যখন জেগে ওঠে); অপি ন পশ্যতি (আর দেখতে পায় না)।

সরলার্থ: স্বপ্নে আমরা বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছি দেখতে পাই। কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলে তা হারিয়ে যায়। আবার স্বপ্নে যা কিছু পাই জাগ্রত অবস্থায় সেগুলি আর দেখতে পাওয়া যায় না (যেমন স্বপ্নে হয়তো অনেক সোনা পেলাম, কিন্তু জেগে উঠে তা আর দেখা যায় না)।

স্বপ্নে চাবস্তুকঃ কায়ঃ পৃথগন্যস্য দর্শনাৎ।

যথা কায়স্তথা সর্বং চিত্তদৃশ্যমবস্তুকম্॥৩৬

অন্বয়: স্বপ্নে চ পৃথক্ অন্যস্য দর্শনাৎ (স্বপ্নে আমাদের মনে হয় যেন আর একটি দেহ আছে); কায়ঃ (সেই দেহ); অবস্তুকঃ (অবস্তু, অলীক); কায়ঃ যথা (ঠিক যেমন সেই দেহটি অলীক); তথা চিত্তদৃশ্যং সর্বম্ (যা কিছু আমরা স্বপ্নে দেখি); অবস্তুকম্ (অবস্তু, অলীক)।

সরলার্থ: স্বপ্নে আমরা অনুভব করি যেন আমাদের আর একটি শরীর আছে। সেই শরীর কিন্তু অবস্তু, অলীক। একইভাবে স্বপ্নে দেখা সব বস্তুও অবস্তু অর্থাৎ অলীক।

ব্যাখ্যা: আচার্য শঙ্কর এই বিতর্ককে আর একটু এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন স্বপ্নে দেখা সব অভিজ্ঞতাই যেমন মিথ্যা, তেমনি জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাও মিথ্যা।

গ্রহণাজ্জাগরিতবত্তদ্ধেতুঃ স্বপ্ন ইষ্যতে।

তদ্ধেতুত্বাত্তু তস্যৈব সজ্জাগরিতমিষ্যতে॥৩৭

অন্বয়: জাগরিতবৎ (জাগ্রত অবস্থার মতো); গ্ৰহণাৎ (কার্য-কারণের অভিজ্ঞতা তোমার হয়); স্বপ্নঃ (স্বপ্নাবস্থা); তদ্ধেতুঃ (জাগ্রত অবস্থায় যেসব অভিজ্ঞতা হয় তার কার্য); ইষ্যতে (এই মনে করা হয়); তদ্ধেতুত্বাৎ তু (যেহেতু এটি জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতার ফল); তস্য এব (যে স্বপ্ন দেখেছে কেবল তার কাছে); জাগরিতং সৎ [ইতি] ইষ্যতে (সত্য বলে গ্রহণযোগ্য)।

সরলার্থ: আমাদের স্বপ্নের অভিজ্ঞতা জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতার মতোই। এইজন্যই বলা হয় আমাদের জাগ্রত অবস্থার নানা অভিজ্ঞতাই স্বপ্নে দেখা অভিজ্ঞতার কারণ। আমরা স্বপ্নে যা দেখি তা একান্তভাবে আমাদেরই। অন্যে এতে অংশ নিতে পারে না। আবার যেহেতু স্বপ্নের নানা অভিজ্ঞতা জাগ্রত অবস্থারই প্রতিফলন সেহেতু জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাও একান্তভাবে আমাদেরই। সেখানেও অপর কেউ অংশ নিতে পারে না। জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতা যদি সত্য হয়, তবে তা কেবলমাত্র আমার কাছেই সত্য, অন্যের কাছে নয়।

ব্যাখ্যা: জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাও যে মিথ্যা এইখানে সেকথাই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেন একথা বলা হচ্ছে? কারণ আমাদের স্বপ্ন জাগ্রতকালের অভিজ্ঞতার প্রতিবিম্ব মাত্র। তাই আমাদের জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতা স্বপ্নের নানা অভিজ্ঞতার কারণ। আমাদের স্বপ্নের অভিজ্ঞতা একান্তভাবে আমাদেরই। আর কারও সেই অভিজ্ঞতা হয় না। আর যেহেতু স্বপ্ন জাগ্রতকালের অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি, সেহেতু স্বপ্নের মতোই জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাও একান্তভাবে আমাদের। তাতে অপর কারও অংশ নেই। জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতা যদি সত্যও হয় তা কেবল নিজের কাছেই সত্য। যেহেতু তা সকলের কাছে সত্য নয়, অতএব তা আদপেই সত্য নয়।

উৎপাদয়াপ্রসিদ্ধত্বাদজং সর্বমুদাহৃতম্।

ন চ ভূতাদভূতস্য সংভবোঽস্তি কথঞ্চন॥৩৮

অন্বয়: উৎপাদস্য অপ্রসিদ্ধত্বাৎ (বস্তুর উৎপত্তির কোন প্রমাণ না থাকায়); সর্বম্ অজম্ উদাহৃতম্ (সমগ্র জগৎকে অনাদি বলে বর্ণনা করা হয়); ভূতাৎ (শাশ্বত সত্য [ব্রহ্ম] থেকে); অভূতস্য কথঞ্চন সম্ভবঃ চ ন অস্তি (যা মিথ্যা তার উৎপত্তি হতে পারে না)।

সরলার্থ: বস্তুর উৎপত্তি না থাকায় সমগ্র জগৎকে অনাদি বলা হয়। বস্তুত নিত্য-সত্য (ব্রহ্ম) থেকে মিথ্যা অর্থাৎ যার অস্তিত্ব নেই তার উৎপত্তি হতে পারে না।

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদীরা বলেন: একথা সত্য যে জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাই স্বপ্নের কারণ, কিন্তু সেই কারণে জাগ্রতকালের অভিজ্ঞতাকেও অসত্য বলা চলে না। স্বপ্নের অভিজ্ঞতা দ্রুত বদলায়। সেইজন্য তা অসত্য হতে পারে। কিন্তু জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতা স্থায়ী। অতএব জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতা স্বপ্নের মতোই মিথ্যা একথা ভাবা ঠিক নয়।

এর উত্তরে অদ্বৈতবাদীরা বলেন: যদি তুমি বিবেকবান না হও, তবেই তুমি তোমার জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতাকে সত্য বলে মনে করবে। কিন্তু যিনি যথার্থ বিবেকী (অর্থাৎ যিনি নিত্য ও অনিত্য বস্তুর তফাত জানেন), তিনি জানেন এ জগতে কিছুরই উৎপত্তি হয় না এবং সেইহেতু কিছুই সত্য নয়। একমাত্র আত্মাই সত্য। শাস্ত্র বলছেন: সমগ্র জগৎ আত্মার দ্বারা আচ্ছাদিত। আত্মা থেকে অনাত্ম বস্তুর যেমন খরখোশের শিংয়ের উৎপত্তি হয় না।

অসজ্জাগরিতে দৃষ্ট্বা স্বপ্নে পশ্যতি তন্ময়ঃ।

অসৎস্বপ্নেঽপি দৃষ্ট্বা চ প্রতিবুদ্ধো ন পশ্যতি॥৩৯

অন্বয়: (মানুষ) জাগরিতে (জাগ্রত অবস্থায়); অসৎ দৃষ্ট্বা তন্ময়ঃ (অসৎ অর্থাৎ কাল্পনিক বস্তু দেখে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়); স্বপ্নে পশ্যতি (সে পরে সেইসব বস্তুকে স্বপ্নে দেখে); স্বপ্নে অপি অসৎ দৃষ্ট্বা (যদিও সে স্বপ্নে ঐ সব অসৎ বস্তু দেখে); প্রতিবুদ্ধঃ ন পশ্যতি (কিন্তু জেগে উঠে সে ঐ সব বস্তু আর দেখে না)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় মানুষ নানা অসৎ বস্তু দেখতে পারে এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে সেগুলিকে আবার স্বপ্নেও দেখতে পায়। কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলে সেগুলি আর দেখে না।

ব্যাখ্যা: যদি জাগ্রত অবস্থায় আমাদের কোন অভিজ্ঞতা হয়, সেই অভিজ্ঞতা আবার স্বপ্নেও আমরা পেতে পারি। কিন্তু তার দ্বারা ঐ অভিজ্ঞতা চিরন্তন সত্য হয়ে ওঠে না। যেমন জাগ্রত অবস্থায় দড়িকে সাপ বলে ভুল করলে সেই সাপ আবার হয়তো স্বপ্নেও দেখতে পারি। কিন্তু তাতে সাপটি সত্য হয়ে উঠবে না।

নাস্ত্যসদ্ধেতুকমসৎসদসদ্ধেতুকং তথা।

সচ্চ সদ্ধেতুকং নাস্তি সদ্ধেতুকমসৎকুতঃ॥৪০

অন্বয়: অসদ্ধেতুকম্ অসৎ ন অস্তি (অসৎ বস্তু [অর্থাৎ যে বস্তুর অস্তিত্ব নেই] থেকে আর একটি অসৎ বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে না); তথা (অনুরূপভাবে); অসদ্ধেতুকং সৎ (অসৎ বস্তু থেকে কোন সৎ বস্তুর [অর্থাৎ যার অস্তিত্ব আছে] উৎপত্তি হতে পারে না); সদ্ধেতুকং সৎ (যার অস্তিত্ব আছে [অর্থাৎ আপেক্ষিক অস্তিত্ব যেমন দড়িতে সাপের অস্তিত্ব] তার থেকে আর একটি অস্তিত্ববান [অর্থাৎ আরেকটি সাপ] বস্তু উৎপন্ন হতে পারে না); সদ্ধেতুকম্ অসৎ কুতঃ (সুতরাং কোন সত্য বস্তু অর্থাৎ অস্তিত্ববান বস্তু থেকে কি করে অস্তিত্বহীন বা মিথ্যা বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে?)।

সরলার্থ: যার অস্তিত্ব নেই সেই বস্তু অপর এক অস্তিত্বহীন বা মিথ্যা বস্তু উৎপন্ন করতে পারে না। ঠিক তেমনি অস্তিত্বহীন বস্তু থেকে সৎ বস্তু অর্থাৎ যার অস্তিত্ব আছে তার উৎপত্তি হতে পারে না। অনুরূপভাবে, যার অস্তিত্ব আছে (অর্থাৎ আপেক্ষিক অস্তিত্ব যেমন দড়িতে সাপের অস্তিত্ব) সেইরকম বস্তু থেকে আর একটি অস্তিত্বসম্পন্ন বস্তু (অর্থাৎ আরেকটি সাপ) উৎপন্ন হতে পারে না। সুতরাং কোন সত্য (অর্থাৎ অস্তিত্ববান) বস্তু থেকে কোন মিথ্যা (অর্থাৎ অস্তিত্বহীন) বস্তু কিভাবে হতে পারে?

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে কার্য-কারণ সম্পর্ক সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। এখানে দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো হচ্ছে কার্য-কারণ সম্পর্ক যুক্তি ও অভিজ্ঞতা দুয়েরই বিরুদ্ধতা করে। শুরুতে বলা হয়েছে, অস্তিত্বহীন কোন বস্তু থেকে আর একটি অস্তিত্বহীন বস্তু উৎপন্ন হতে পারে না। ‘আকাশকুসুম’ বা ‘খরগোশের শিং’য়ের কোন অস্তিত্বই নেই। তাদের একটির থেকে অন্যটির কি উৎপত্তি হতে পারে? ঠিক তেমনি অস্তিত্বসম্পন্ন কোন বস্তু থেকে অপর কোন অস্তিত্ববান বস্তুরও উৎপত্তি সম্ভব নয়। এখানে অস্তিত্বসম্পন্ন বলতে বোঝাচ্ছে আপেক্ষিক অস্তিত্ব, যেমন দড়ির উপর সাপের অস্তিত্ব। এই সাপের থেকে কি আর একটি সাপের উৎপত্তি হওয়া সম্ভব?

সুতরাং সত্য বস্তু অর্থাৎ অস্তিত্ববান কোন বস্তু থেকে মিথ্যা অর্থাৎ অস্তিত্বহীন কোন বস্তুর উৎপত্তি কোনভাবেই হতে পারে না।

বিপৰ্যাসাদ্যথা জাগ্রদচিন্ত্যান্ ভূতবৎ স্পৃশেৎ।

তথা স্বপ্নে বিপর্যাসাদ্ধর্মাংস্তত্রৈব পশ্যতি॥৪১

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); বিপৰ্যাসাৎ (অজ্ঞানতার হেতু ভ্রান্তির কারণে); জাগ্রৎ-অচিন্ত্যান্ (জাগ্রত অবস্থায় যেসব অপরিচিত বস্তুসকল দেখে); ভূতবৎ স্পৃশেৎ (সত্য বলে মনে করে); তথা (সেইভাবে); স্বপ্নে (স্বপ্নে); বিপৰ্যাসাৎ (অবিদ্যাপ্রসূত ভুলের জন্য); তত্র এব (স্বপ্নেও); ধর্মান্ (বস্তুসকল); পশ্যতি (দেখে)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় মানুষ নানা অপরিচিত বস্তু দেখে এবং অজ্ঞানতার হেতু সেগুলিকে সত্য বলে মনে করে। একই কারণে স্বপ্নেও সে বিভিন্ন বস্তু দেখে ও সত্য মনে করে। আসলে কিন্তু দুটির কোনটিই সত্য নয়।

ব্যাখ্যা: জাগ্রত অবস্থাতেও কখনো কখনো অদ্ভুত সব বস্তু দেখা যায়। লোকে যেমন অন্ধকারে দড়ির জায়গায় সাপ দেখে এবং তাকে সত্য বলে মনে করে। স্বপ্নেও একই রকম ঘটতে পারে। হয়তো স্বপ্নে ঘরের মধ্যে একটা হাতি দেখে তাকে সত্য বলে মনে হল। কিন্তু জেগে উঠে নিশ্চিতভাবেই বোঝা যায় ঘরে হাতি থাকা অসম্ভব।

জাগ্রত অবস্থায় রজ্জুতে সর্পদর্শন এবং স্বপ্নে ঘরের ভিতর হাতি দেখা—এ দুটি অভিজ্ঞতাই মিথ্যা। অভিজ্ঞতা দুটির পরস্পরের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। নিশ্চয়ই স্বপ্নের এই অভিজ্ঞতা জাগ্রত অবস্থার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নয়।

উপলম্ভাৎ সমাচারাদস্তিবস্তুত্ববাদিনাম্।

জাতিস্তু দেশিতা বুদ্ধৈরজাতেস্ত্রসতাং সদা॥৪২

অন্বয়: বুদ্ধৈঃ (প্রাজ্ঞ অদ্বৈতবাদীরা); তু (ও); উপলম্ভাৎ (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে); সমাচারাৎ (বর্ণাশ্রম অনুযায়ী আচরণ থেকে); অস্তি-বস্তুত্ববাদিনাম্ (যারা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন); সদা অজাতেঃ এসতাম্ (জন্ম নেই একথা চিন্তা করতে ভয় পান); জাতিঃ (জন্মবাদ); দেশিতা (শেখানো হয়)।

সরলার্থ: কিছু মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে ও প্রচলিত বর্ণাশ্রম অনুযায়ী কর্ম করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে। জন্ম বলে কিছু নেই—একথা চিন্তা করতেও তাঁরা ভয় পান। এঁদের কাছে প্রাজ্ঞ অদ্বৈতবাদীরা জন্মের ব্যাপারে আপোষ করতে রাজি আছেন। কিন্তু বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে তাঁরা সম্পূর্ণ আপোষহীন।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈতবাদীরা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। জন্ম বলে কিছু আছে এমন কথাও তাঁরা মানেন না। একথা শুনে দ্বৈতবাদীরা ভয় পেয়ে যান। তাঁদের কথা মনে রেখে অদ্বৈতবাদীরা কোন কোন ক্ষেত্রে জন্ম বা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বের সম্ভাবনা অনুমোদন করেছেন। যেমন, শাস্ত্রে এমন বাক্যও পাওয়া যায় ‘ব্রহ্ম সবকিছুর উৎস’। স্থূলবুদ্ধি মানুষের জন্য এ একটি আপোষমাত্র কারণ অদ্বৈততত্ত্ব ধারণা করা তাদের পক্ষে দুরূহ।

কিন্তু বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য অদ্বৈতবাদীর আপোষহীন সিদ্ধান্ত— ‘ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই।’ জন্ম ও মৃত্যু দুই-ই মনের সৃষ্টি।

অজাতেস্ত্রসতাং তেষামুপলম্ভাদ্বিয়ন্তি যে।

জাতিদোষা ন সেৎস্যন্তি দোষোঽপ্যল্পো ভবিষ্যতি॥৪৩

অন্বয়: অজাতেঃ এসতাম্ (জন্ম নেই এই সত্যের মুখোমুখি হতে যাঁরা ভয় পান); তেষাম্ (তাঁদের [দ্বৈতবাদীদের] মধ্যে); যে (যাঁরা); উপলম্ভাৎ (বাহ্যবস্তুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে); বিয়ন্তি ([অদ্বৈতবাদের] বিরোধিতা করেন); জাতিদোষাঃ ন সেৎস্যন্তি (উৎপত্তি আছে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী [অর্থাৎ দ্বৈতবাদ ও দ্বৈত উপাসনায় বিশ্বাসী] হওয়ায় তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না); দোষঃ অপি অল্পঃ ভবিষ্যতি (এটি ভুল হতে পারে, কিন্তু সাঙ্ঘাতিক নয়)।

সরলার্থ: কোন কিছুই জন্মায় না—এই সত্যের মুখোমুখি হতে যাঁরা (দ্বৈতবাদীরা) ভয় পান তাঁদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা অদ্বৈতবাদের বিরোধিতা করেন কারণ তাঁরা সর্বত্র দুই দেখেন। এঁরা দ্বৈত উপাসনাও করে থাকেন। এটি ভুল হতে পারে কিন্তু সাঙ্ঘাতিক ভুল নয় (কারণ তাঁরা সৎ ও অকপট এবং কালে তাঁরা অদ্বৈততত্ত্ব ধারণা করতে সক্ষম হবেন)।

ব্যাখ্যা: দ্বৈতবাদীদের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা দ্বৈতবাদকে নির্বিচারে গ্রহণ করেন। তাঁদের মনোভাবের কখনো পরিবর্তন হয় না। আবার কিছু দ্বৈতবাদী আছেন যাঁদের কাছে অদ্বৈততত্ত্ব যুক্তিগ্রাহ্য নয় কারণ তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিপরীত কথাই বলে। এঁরা সত্যকে প্রকৃতই জানতে চান। তাঁরা অকপট ও আন্তরিক এবং সাধুজীবন যাপন করেন। কালে তাঁরা অদ্বৈতবাদ মেনে নেবেন। এই মুহূর্তে যে তাঁরা অদ্বৈততত্ত্ব গ্রহণ করতে পারছেন না এটি তাঁদের ত্রুটি ঠিকই, কিন্তু মারাত্মক কিছু নয়।

উপলম্ভাৎসমাচারান্মায়াহস্তী যথোচ্যতে।

উপলম্ভাৎসমাচারাদস্তি বস্তু তথোচ্যতে॥৪৪

অন্বয়: উপলম্ভাৎ সমাচারাৎ (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সেই অনুরূপ ঘটনাবলী থেকে [সবই দ্বৈতের কার্য]); মায়াহস্তী (যাদুকরের দেখানো মায়া হাতি); যথা উচ্যতে (নির্বোধ ব্যক্তিরা সত্য বলে মনে করেন); তথা (ঠিক তেমনি); উপলম্ভাৎ সমাচারাৎ (প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও যেসব ঘটনাবলী সেই অভিজ্ঞতাকে সমর্থন করে তার থেকে); বস্তু অস্তি উচ্যতে ([লোকে] বলেন বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে)।

সরলার্থ ও ব্যাখ্যা: অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিরা যাদুকরের দেখানো মায়া-হাতিকে সত্য বলে মনে করেন, কারণ এর সঙ্গে তাঁদের দ্বৈতচিন্তা বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোন বিরোধ নেই। একইভাবে তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং সেই অনুরূপ ঘটনাবলী থেকে তাঁদের মনে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোন সন্দেহ থাকে না।

এই প্রত্যক্ষ দেখা ও নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই দ্বৈতবাদীরা দাবি করেন যে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে। তাঁরা নানারকমের বস্তু দেখেন এবং সেইসব বস্তুর নানা ব্যবহার লক্ষ্য করে সেগুলিকে সত্য বলে স্থির করেন।

কিন্তু অদ্বৈতবাদীরা বলেন: তোমাদের যে ভুল হচ্ছে না একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ধর, জাদুখেলা দেখছ। জাদুকর সেখানে মায়া-হাতির খেলা দেখাচ্ছে। হাতিটির আচরণ জীবন্ত হাতিরই মতো। সেটা দেখতে দেখতে আমরা বিশ্বাস করি সেটা সত্য। কিন্তু আসলে তা সত্য নয়, জাদুকরের সৃষ্টি।

জাত্যাভাসং চলাভাসং বস্ত্বাভাসং তথৈব চ।

অজাচলমবস্তুত্বং বিজ্ঞানং শান্তমদ্বয়ম্॥৪৫

অন্বয়: জাত্যাভাসম্ (জন্ম হয়নি কিন্তু হয়েছে বলে মনে হয়); চলাভাসম্ (আপাতদৃষ্টিতে সক্রিয়); তথা এব বস্ত্বাভাসম্ (অনুরূপভাবে সত্য বলে মনে হয়); চ (ও); বিজ্ঞানম্ (চৈতন্য); অজাচলম্ (জন্ম নেই এবং নিষ্ক্রিয়); অবস্তুত্বম্ (বস্তু নয় [সুতরাং]); শান্তম্ (অখণ্ড); অদ্বয়ম্ (অদ্বৈত, দুই নেই)।

সরলার্থ: শুদ্ধ চৈতন্য হয়েও মনে হয় যেন তাঁর জন্ম হয়েছে। তিনি সক্রিয় এবং জড়বস্তুরূপে প্রতিভাত হন। প্রকৃতপক্ষে চৈতন্য অনাদি, নিষ্ক্রিয় এবং আদৌ জড়বস্তুর মতো নন। তিনি অখণ্ড এবং অদ্বয়।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈতবাদীর মতে এই জগতে কিছুই সত্য নয়। সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ মিথ্যা। তাহলে সত্য কি? সত্য হল শুদ্ধ চৈতন্য। এই চৈতন্যকে বর্ণনা করা যায় না। তিনি অনন্য, এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে বলতে হয় ‘তিনি যা তিনি তাই’। এই চৈতন্যই আমাদের আত্মা।

এই চৈতন্যের জন্ম হয় না, তবু মনে হয় যেন জন্ম হয়েছে। যেমন, একটি বালকের জন্ম হল, তার নাম দেওয়া হল দেবদত্ত। কিন্তু আসলে দেবদত্তের জন্ম হয়নি। শুদ্ধ চৈতন্য এখানে দেবদত্তরূপে জন্ম নিয়েছে। অর্থাৎ লোকে মনে করে তার জন্ম হয়েছে। আসলে এর জন্ম জাদুকরের মায়া-হাতির জন্মের মতো। কিছুদিন পরেই দেখছি দেবদত্ত চলেফিরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কে চলছে? দেবদত্তরূপে শুদ্ধ চৈতন্যই চলেফিরে বেড়াচ্ছে। এরপর দেবদত্ত বড় হয়েছে। সে একজন দীর্ঘদেহী যুবক। কে এভাবে বড় হয়ে উঠল? এও সেই একই শুদ্ধ চৈতন্য। আসলে কিন্তু এই চৈতন্যের কোন পরিবর্তনই হয়নি, যা ছিল তাই আছে। কেবলমাত্র দেবদত্তের পরিবর্তনগুলি এই শুদ্ধ চৈতন্যের উপর আরোপিত হয়েছে। এই হল মায়ার কার্য।

এবং ন জায়তে চিত্তমেবং ধর্মা অজাঃ স্মৃতাঃ।

এবমেব বিজানন্তো ন পতন্তি বিপর্যয়ে॥৪৬

অন্বয়: এবম্ (উল্লিখিত কারণে); চিত্তম্ (মন [অর্থাৎ মনরূপে চৈতন্য]); ন জায়তে (কখনো জন্মায় না); এবম্ (একই কারণে); ধর্মাঃ (জীবাত্মাসকল [বিভিন্ন নাম এবং রূপে প্রতিভাত চৈতন্য]); অজাঃ স্মৃতাঃ ([আত্মজ্ঞ] জানেন কারোরই জন্ম হয়নি); এবম্ এব বিজানন্তঃ (যাঁরা একথা নিশ্চিতরূপে জানেন); বিপর্যয়ে ন পতন্তি (আর ভুল করেন না)।

সরলার্থ: এতক্ষণ যা বলা হল তার থেকে বোঝা যাচ্ছে মন (অর্থাৎ মনরূপে অনুভূত শুদ্ধ চৈতন্য) কখনো জন্মগ্রহণ করে না। একইভাবে জীবাত্মারও (বিভিন্ন নাম-রূপে প্রতিভাত শুদ্ধ চৈতন্যের) জন্ম হয় না (আত্মজ্ঞের দৃষ্টিতে)। যাঁরা এই সত্য জেনেছেন তাঁদের আর কখনো ভুল হয় না (অর্থাৎ তাঁরা আর অবিদ্যায় মুগ্ধ হন না)।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈতবাদীর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল শুদ্ধ চৈতন্যই একমাত্র সত্য এবং সেই সত্য অনাদি এবং অনন্ত। কিন্তু আমরা যে চারপাশে নানারকম বস্তু দেখি তাকে কি করে ব্যাখ্যা করব? এও সেই একই সত্য, কেবল বিভিন্ন নাম-রূপে প্রতিভাত হচ্ছে মাত্র। এই নাম-রূপের কারণেই সেগুলিকে পৃথক বলে মনে হয়। আসলে এক সত্য।

এই এক দেখাই জীবনের লক্ষ্য। যাঁরা এই একত্ব উপলব্ধি করেছেন তাঁরা আর অবিদ্যায় মুগ্ধ হন না।

ঋজুবক্রাদিকাভাসমলাতস্পন্দিতং যথা।

গ্রহণগ্রাহকাভাসং বিজ্ঞানস্পন্দিতং তথা॥৪৭

অন্বয়: অলাতস্পন্দিতং যথা ঋজুবক্রাদিকাভাসম্ (একটি জ্বলন্ত মশালকে যদি ঘোরানো যায়, তার আলোর রেখা কখনো সোজা, কখনো বাঁকা, কখনো বা অন্য কিছু বলে মনে হয়); তথা বিজ্ঞানং স্পন্দিতম্ (সেইভাবে [অজ্ঞানীর দৃষ্টিতে] চৈতন্যও [তাঁর নাম ও রূপ] বদলায়); গ্রহণগ্রাহকাভাসম্ (এই চৈতন্য কখনো জ্ঞাতা কখনো জ্ঞেয় [এবং কখনো কারণ, কখনো কার্য])।

সরলার্থ: একটি জ্বলন্ত মশালকে ঘোরালে তার আলোর রেখা কখনো সোজা, কখনো বাঁকা আবার কখনো বা অন্য কিছু বলে মনে হয় (যদিও প্রকৃতপক্ষে আলোকরশ্মি সবসময় সোজা)। ঠিক একইভাবে চৈতন্যের পরিবর্তনও প্রতিভাত হয়—একই চৈতন্য কখনো জ্ঞাতা, কখনো জ্ঞেয়, কখনো কারণ, কখনো কার্য (যদিও চৈতন্য সতত অপরিবর্তিত)।

ব্যাখ্যা: আলোর রেখা সবসময়ই সোজা। কিন্তু আলোর উৎসকে দ্রুত ঘোরালে আলোর রেখা অন্যরকম দেখায়। তার মানে এই নয় এর আকারের পরিবর্তন হচ্ছে। একইভাবে চৈতন্যেরও কখনো পরিবর্তন হয় না, অপরিবর্তিতই থাকে। কিন্তু যেহেতু এই চৈতন্য সব বস্তুর মধ্যে নিহিত রয়েছে সুতরাং বিভিন্ন বস্তুরূপেই চৈতন্য প্রতিভাত হয়। শুধু তাই নয় বস্তুর পরিবর্তন হলে অজ্ঞ ব্যক্তি মনে করে বুঝি চৈতন্যের পরিবর্তন হচ্ছে। এইভাবে জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি চৈতন্যের উপর আরোপ করা হয়েছে। আসলে শুদ্ধ চৈতন্য এক ও অভিন্ন।

অস্পন্দমানমলাতমনাভাসমজং যথা।

অস্পন্দমানং বিজ্ঞানমনাভাসমজং তথা॥৪৮

অন্বয়: যথা (যেমন); অস্পন্দমানম্ অলাতম্ (মশালটি যদি ঘোরানো না হয়); অনাভাসম্ (দৃষ্টি আকর্ষণ করে না); অজম্ (যেন এটি সেখানে নেই); তথা (সেইভাবে); অস্পন্দমানং বিজ্ঞানম্ (যদি চৈতন্য অপ্রকাশিত হয়); অনাভাসম্ অজম্ (তখন তা ইন্দ্রিয়ের গোচর নয়, যেন এর আদৌ জন্মই হয়নি)।

সরলার্থ: যদি জ্বলন্ত মশালটি স্থির থাকে এটি কারও নজরে নাও পড়তে পারে (কারণ তখন এ একটি আলোকবিন্দু মাত্র)—মনে হয় যেন এর কোন অস্তিত্বই নেই। সেইভাবে চৈতন্যও যদি কোন না কোন রূপে প্রকাশিত না হন তাহলে তিনি ইন্দ্রিয়ের গোচর হন না। তখন তাঁর অস্তিত্ব নেই বলেই মনে হয়।

ব্যাখ্যা: বাতি যদি অচঞ্চল থাকে তবে তা দৃষ্টিগোচর নাও হতে পারে। যেন বাতিটির আদৌ অস্তিত্ব নেই। সেইভাবে চৈতন্যও কখনো কখনো অপ্রকাশিত থাকতে পারে। তখন আর দুই থাকে না অর্থাৎ কোন নাম-রূপ থাকে না। যা থাকে তা শুধুই ব্রহ্ম, চৈতন্য বা আত্মা। তখন আর জ্ঞাতা বা জ্ঞেয় নেই, সেই এক ব্রহ্মই আছেন। তখনি সব অবিদ্যার অবসান হয়।

অলাতে স্পন্দমানে বৈ নাভাসা অন্যতোভুবঃ।

ন ততোঽন্যত্র নিস্পন্দান্নালাতং প্রবিশন্তি তে॥৪৯

অন্বয়: অলাতে স্পন্দমানে (যখন বাতিটি ঘোরানো হচ্ছে); অভাসাঃ ন বৈ অন্যতোভুবঃ (আকৃতিগুলি [ঋজু, বক্র ইত্যাদি যেরকম দেখা যায়] অন্য কোন উৎস থেকে আসে না); ততঃ নিস্পন্দাৎ (যখন বাতিটি থেকে যায় তার থেকে); অন্যত্র ন ([আকৃতিগুলি] অন্য কোথাও যায় না); তে অলাতং ন প্রবিশন্তি (সেগুলি বাতিতে ফিরেও আসে না)।

সরলার্থ: বাতিটি যখন ঘুরছে তখন যে আকৃতিগুলি দেখা যায় (সোজা অথবা বাঁকা) সেগুলি অবশ্যই বাতি ছাড়া অন্য কোনও উৎস থেকে আসেনি। অনুরূপভাবে, যখন বাতিটির ঘোরা থেমে যায়, আকৃতিগুলি অন্যত্র চলে যায় না বা বাতিতেও ফিরে আসে না।

ব্যাখ্যা: যখন বাতিটি ঘোরানো হয় তখন নানা আকৃতি দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু সেগুলিতে কোন বস্তু নেই, কাল্পনিক। ঠিক তেমনি যখন আত্মা নিজেকে প্রকাশ করে তখন নানা নাম ও রূপ দেখা যায়, কিন্তু সেগুলি সবই কাল্পনিক। যখন আত্মার কোন প্রকাশ থাকে না অর্থাৎ দুই থাকে না তখনি আত্মাকে স্বরূপে জানা যায়—অর্থাৎ তখনি আত্মজ্ঞান লাভ হয়।

ন নির্গতা অলাতাত্তে দ্রব্যত্বাভাবযোগতঃ।

বিজ্ঞানেঽপি তথৈব স্যুরাভাসস্যাবিশেষতঃ॥৫০

অন্বয়: তে (ঐসব আকৃতি); দ্রব্যত্বাভাবযোগতঃ (যেহেতু সেগুলি কাল্পনিক, বস্তু নয়); অলাতাৎ ন নির্গতাঃ (বাতি থেকে আসতে পারে না [অর্থাৎ যা বস্তু নয়, কাল্পনিক তা নড়াচড়া করতে পারে না]); আভাসস্য অবিশেষতঃ বিজ্ঞানে অপি (এইসব [আলোর] কল্পিত আকৃতির সঙ্গে মনের সৃষ্টির (যেমন জন্ম) কোন পার্থক্য নেই); তথা এব স্যুঃ (দুয়ের স্বরূপ একই [অর্থাৎ কারও মধ্যেই বস্তু নেই, দুই-ই কাল্পনিক])।

সরলার্থ: আলোর আকৃতিগুলি অলীক এবং তার মধ্যে কোন বস্তু নেই। সেগুলি বাতি থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। মন-কল্পিত (যেমন জন্ম) বস্তু সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। এই দুয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমরা মনে করি তাদের অস্তিত্ব আছে, তাই সেগুলি আছে। তাঁরা সত্য নয়, মনের রচনা।

ব্যাখ্যা: একটি বাতি ঘোরানো হলে নানারকমের আকৃতির সৃষ্টি হয়। এইসব আকৃতি সত্য নয়, কল্পনামাত্র।

জন্মের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এরকম বহু জিনিস আছে যা সত্য নয়, অলীক। বস্তুত সমগ্র দৃশ্যমান জগতের প্রকৃতিই এইরকম। মনে হয় ঘটনাগুলি ঘটছে কিন্তু সেগুলি আরোপিত, কল্পিত—যেমন অন্ধকারে দড়ির জায়গায় সাপকে কল্পনা করা হয়। দড়ির জায়গায় সাপ কখনো ছিলও না, থাকবেও না।

বিজ্ঞানে স্পন্দমানে বৈ নাভাসা অন্যতোভুবঃ।

ন ততোঽন্যত্র নিস্পন্দান্ন বিজ্ঞানং বিশন্তি তে॥৫১

অন্বয়: বিজ্ঞানে স্পন্দমানে বৈ আভাসাঃ (যখন চৈতন্য প্রকাশিত হয়, কেবলমাত্র তখনি এই দৃশ্য-জগৎ ও তার কার্য [জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি] দেখা যায়); অন্যতোভুবঃ ন (সেগুলির অন্য কোনও উৎস নেই); নিস্পন্দাৎ (যদি চৈতন্যের প্রকাশ না ঘটে); ততঃ অন্যত্র ন (তাদের অন্য কোনও আশ্রয় নেই); তে (এই জগৎ ও তার কার্য); বিজ্ঞানং ন বিশন্তি (চৈতন্যে বিলীন হয় না [কারণ সেগুলি কাল্পনিক])।

সরলার্থ: চৈতন্য যখন প্রকাশ পায় তখন এই জগৎ ও তার কার্যও প্রকাশ পায়। এইগুলির আর কোন উৎস নেই। কিন্তু চৈতন্যের প্রকাশ না হলে এই জগতেরও প্রকাশ থাকে না। কিন্তু এগুলি চৈতন্যে বিলীনও হয় না। কারণ এগুলি অবস্তু, অর্থাৎ অলীক এবং মিথ্যা।

ন নির্গতান্তে বিজ্ঞানাদ্ দ্রব্যত্বাভাবযোগতঃ।

কাৰ্য্যকারণতাঽভাবাদ্যতোঽচিন্ত্যাঃ সদৈব তে॥৫২

অন্বয়: তে (জন্মাদি আপাতদৃশ্য অভিজ্ঞতাসকল); দ্রব্যাত্বাভাবযোগতঃ (যেহেতু তারা অবস্তু অর্থাৎ অলীক); বিজ্ঞানাৎ ন নির্গতাঃ (চৈতন্য থেকে উৎপন্ন হতে পারে না); যতঃ (কারণ); তে (তারা [আপাতদৃশ্য অভিজ্ঞতাগুলি]); কার্য্য-কারণতা-অভাবাৎ (চৈতন্যের সঙ্গে কার্য-কারণ সম্পর্ক নেই); সদা এব অচিন্ত্যাঃ (সেগুলি অচিন্তনীয় [অর্থাৎ মিথ্যা])।

সরলার্থ: জন্মমৃত্যু ইত্যাদি আপাতদৃশ্য অভিজ্ঞতাগুলির কোন পারমার্থিক সত্তা নেই। সুতরাং সেগুলি অবস্তু। এদের উৎপত্তি চৈতন্য থেকে হতে পারে না কারণ দুয়ের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে আমরা যা কিছু দেখি তার কোন বাস্তব সত্তা নেই।

ব্যাখ্যা: জ্বলন্ত মশাল ও চৈতন্যের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে: চৈতন্য স্বভাবতই অপ্রকাশিত, কিন্তু জ্বলন্ত মশাল তা নয়।

চৈতন্য যদি স্বভাবতই অব্যক্ত হয় তবে জন্মমৃত্যুর মতো ঘটনাগুলো দেখা যায় কেন? এসবের জন্য চৈতন্য দায়ী নয়। এগুলি সবই মিথ্যা, চৈতন্যের উপর আরোপিত উপাধিমাত্র।

দ্রব্য দ্রব্যস্য হেতুঃ স্যাদন্যদন্যস্য চৈব হি।

দ্রব্যত্বমন্যভাবো বা ধর্মাণাং নোপপদ্যতে॥৫৩

অন্বয়: দ্রব্যং দ্রব্যস্য হেতুঃ স্যাৎ (একটি পদার্থ আর একটি পদার্থের কারণ হতে পারে); অন্যৎ (যাতে পদার্থ নেই [অর্থাৎ অবস্তু]); চ অন্যস্য এব [হেতুঃ] হি [স্যাৎ] (অন্য কোন অবস্তুর কারণও হতে পারে); ধর্মাণাং দ্রব্যত্বম্ অন্যভাবঃ বা (জীবাত্মারা বস্তু না অবস্তু এই বিষয়ে); ন উপপদ্যতে (প্রশ্নই ওঠে না)।

সরলার্থ: একমাত্র একটি বস্তুই অন্য আর একটি বস্তুর উৎপত্তির কারণ হতে পারে। অনুরূপভাবে কোন অবস্তু (অর্থাৎ অলীক) আর একটি অবস্তুরও কারণ হতে পারে। জীবাত্মা প্রসঙ্গে বলা যায় যে জীবাত্মা বস্তু না অবস্তু তার প্রশ্নই ওঠে না।

ব্যাখ্যা: আত্মা যে এক এবং জন্মরহিত একথা পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত। তবু এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা দ্বিতত্ত্বের উপর জোর দিয়ে থাকেন। তাঁদের মতে, এক বস্তু থেকেই আর একটি বস্তুর উৎপত্তি হয়। তাহলে আত্মার সম্বন্ধে কি বলা যায়? আত্মার স্রষ্টা কে? আত্মা নিশ্চয়ই নিজেকে নিজে সৃষ্টি করেননি।

যেহেতু আত্মা বস্তুও নন অবস্তুও নন, অতএব আত্মা কারণও হতে পারেন না কার্যও হতে পারেন না। আত্মা স্বতন্ত্র, অদ্বিতীয় এবং অনন্য।

এবং ন চিত্তজা ধর্মাশ্চিতং বাঽপি ন ধর্মজম্।

এবং হেতুফলাজাতিং প্রবিশন্তি মনীষিণঃ॥৫৪

অন্বয়: এবম্ (এইভাবে); ধর্মাঃ (বাহ্যবস্তুসমূহ); চিত্তজাঃ ন (চৈতন্য থেকে উৎপন্ন নয়); চিত্তং বা অপি ধর্মজং ন ([একইভাবে] বাহ্যবস্তু থেকেও চৈতন্য উৎপন্ন হয়নি); মনীষিণঃ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা); এবম্ (এই কারণে); হেতুফল-অজাতিং প্রবিশন্তি (কার্য-কারণ সম্পর্কের সূচনাই বাতিল করে দেন)।

সরলার্থ: এইভাবে আমরা জানি যে বাহ্যবস্তু চৈতন্য থেকে উৎপন্ন নয় এবং বাহ্যবস্তু থেকেও চৈতন্যের উৎপত্তি হয়নি। সুতরাং প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা কার্য-কারণ সম্পর্কের সূচনাই বাতিল করে দেন।

ব্যাখ্যা: মন চৈতন্য ছাড়া আর কিছু নয়। বাইরের বস্তুসকল মন থেকে উৎপন্ন নয়, আবার বাইরের বস্তু থেকেও মনের সৃষ্টি হয়নি। এই সমগ্র জগৎ ও তার কার্যকলাপ সেই পরম সত্য বা আত্মার বাহ্য প্রকাশমাত্র। এই পরম সত্যই ব্রহ্ম তথা চৈতন্য। এখানে কার্য-কারণ সম্পর্কের কোন স্থান নেই। আত্মা এক ও অভেদ। বিভিন্ন নাম-রূপ আত্মার উপর আরোপিত উপাধিমাত্র।

যাবদ্ধেতুফলাবেশস্তাবদ্ধেতুফলোদ্ভবঃ।

ক্ষীণে হেতুফলাবেশে নাস্তি হেতুফলোদ্ভবঃ॥৫৫

অন্বয়: যাবৎ হেতুফলাবেশঃ (কার্য-কারণ সম্পর্কে যতক্ষণ বিশ্বাস করা যায়); তাবৎ হেতুফলোদ্ভবঃ (ততক্ষণ পর্যন্ত কার্য-কারণ সম্পর্ক সত্য বলে প্রতিভাত হয়); হেতুফলাবেশে ক্ষীণে (কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাস যদি ক্ষীণ হয়ে আসে); হেতুফলোদ্ভবঃ ন অস্তি (তখন কার্য-কারণ সম্পর্কের ক্রিয়াকলাপ আর দেখা যাবে না)।

সরলার্থ: যতক্ষণ পর্যন্ত কার্য-কারণ সম্পর্ককে আমরা গুরুত্ব দিই, ততক্ষণ পর্যন্ত এ সম্পর্ক সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু যখন আমরা এই সম্পর্কের প্রতি উদাসীন থাকি, তখন দেখা যায় সম্পর্কটি মিথ্যা।

ব্যাখ্যা: মানুষ কেন কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী? কারণ সে ভালো ফল লাভের আশায় কর্ম করে। সেই ফল তারা হাতে হাতে নাও পেতে পারে কিন্তু তারা আশা রাখে এ জীবনে না হলেও জন্মান্তরে ফললাভ হবেই।

এ হল ঘোর অজ্ঞতা। মানুষ যেন সম্মোহিত হয়ে আছে। কিন্তু কিভাবে তারা এই অজ্ঞতাকে অতিক্রম করবে? কার্য-কারণ সম্পর্কের অর্থ দ্বৈতবাদ। কাজেই তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে—দুই নেই, সব এক। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। এই ব্রহ্মই চৈতন্য তথা আত্মা। এই আত্মার উপরেই নানা উপাধি যেমন কার্য-কারণ সম্পর্ক আরোপিত হয়ে থাকে।

যাবদ্ধেতুফলাবেশঃ সংসারস্তাবদায়তঃ।

ক্ষীণে হেতুফলাবেশে সংসারং ন প্রপদ্যতে॥৫৬

অন্বয়: যাবৎ হেতুফলাবেশঃ (যতক্ষণ কার্য-কারণ সম্পর্কে অনুরাগ থাকে); তাবৎ (ততক্ষণ পর্যন্ত); সংসারঃ ([জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে] এই জগৎ); আয়তঃ (ব্যাপ্ত [অর্থাৎ বেড়ে যায়]); হেতুফলাবেশে ক্ষীণে (যখন কার্য-কারণ সম্পর্কে অনুরাগ কমে যায়); সংসারং ন প্রপদ্যতে (তখন আর সংসারে প্রত্যাবর্তন করতে হয় না)।

সরলার্থ: যতক্ষণ মানুষ কার্য-কারণ সম্পর্কে আসক্ত থাকে ততক্ষণ তাকে এই (দুঃখের) সংসারে বদ্ধ থেকে নানা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। কিন্তু এই আসক্তি জয় করতে পারলে মানুষকে আর এই জগতে ফিরে আসতে হয় না (অর্থাৎ সে তখন মুক্ত হয়ে যায়)।

ব্যাখ্যা: কার্য-কারণ সম্পর্কে মানুষ গুরুত্ব দেয় কেন? কারণ তারা অজ্ঞ। তারা আত্মসর্বস্ব, মনে করে এ জীবন ভোগের জন্য। তাই তারা ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছোটে, কিন্তু কখনো সুখী হয় না। নিজের স্বার্থ ছাড়া তারা কখনো কিছু করে না, সবসময় প্রতিদান আশা করে। তাই কারণ থাকলে কার্য থাকবেই এই ধারণা তাদের পছন্দসই।

কিন্তু একটা সময় আসে যখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে। তারা উপলব্ধি করে এই সংসার ক্ষণস্থায়ী এবং জীবনের উদ্দেশ্য আত্মজ্ঞান লাভ। তখন মনকে তাঁরা ইন্দ্রিয়সুখের পথ থেকে ফিরিয়ে আত্মার দিকে চালনা করে। কালে তাদের মোক্ষলাভ হয়।

সংবৃত্যা জায়তে সর্বং শাশ্বতং নাস্তি তেন বৈ।

সদ্ভাবেন হ্যজং সর্বমুচ্ছেদস্তেন নাস্তি বৈ॥৫৭

অন্বয়: সংবৃত্যা (সমষ্টি অজ্ঞানতার [অর্থাৎ অবিদ্যার] প্রভাবে); সর্বম্ (সকল বস্তু); জায়তে (জন্মায়); তেন (এই কারণে); শাশ্বতং ন অস্তি বৈ (চিরন্তন বলে কিছু নেই [কিন্তু একই সঙ্গে]); সর্বম্ (জগতের সবকিছু); হি (নিশ্চিতভাবে); সদ্ভাবেন (ব্রহ্মরূপে); অজম্ (জন্মরহিত); তেন (একই কারণে); উচ্ছেদঃ (বিনাশ); বৈ (ও); ন অস্তি (নেই)।

সরলার্থ: অবিদ্যার প্রভাবে সকল বস্তুর জন্ম হয়ে থাকে। সেহেতু চিরন্তন বলে কিছু নেই। কিন্তু একইসঙ্গে ব্রহ্মরূপে এই জগতে কোন কিছুরই জন্ম হয়নি। অর্থাৎ জগতে বিনাশ বলেও কিছু নেই।

ব্যাখ্যা: ব্যবহারিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, অবিদ্যার প্রভাবে সবকিছুরই জন্ম এবং বিনাশ আছে। কিছুই চিরন্তন নয়। তবু, পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম বৈ আর কিছুই নেই। অর্থাৎ যাকে আমরা ব্যবহারিক জগৎ বলি তাও ব্রহ্ম। সেই অর্থে দেখলে জগতে মৃত্যু বা বিনাশ বলে কিছু নেই।

ধর্মা য ইতি জায়ন্তে জায়ন্তে তে ন তত্ত্বতঃ।

জন্ম মায়োপমং তেষাং সা চ মায়া ন বিদ্যতে॥৫৮

অন্বয়: যে ধর্মাঃ (সেইসব বস্তু [অর্থাৎ জীবাত্মা ও অন্যান্য সকল বস্তু]); জায়ন্তে (জন্মায় বলা হয়); তে তত্ত্বতঃ ন জায়ন্তে ([কিন্তু] বস্তুত তারা জন্মায় না); তেষাং জন্ম মায়োপমম্ (তাদের জন্ম যেন জাদুখেলা); সা চ মায়া ন বিদ্যতে (এবং সেই জাদুখেলা সত্য নয়)।

সরলার্থ: মানুষ মনে করে জীবাত্মা (এবং অন্যান্য বস্তু) জন্ম নেয়। কিন্তু আসলে তাদের কখনই জন্ম হয় না। তাদের জন্ম যেন ভোজবাজির খেলা এবং তা সত্য নয়।

ব্যাখ্যা: অবিদ্যার কার্যকলাপের কথা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে। অবিদ্যা এমন সব অঘটন ঘটায় যার ব্যাখ্যা চলে না। এইসব ঘটনা ব্যবহারিকভাবে সত্য হলেও আসলে তা সত্য নয়। এইসব যেন ভোজবাজির খেলা।

জীবাত্মার জন্মও এইরকম; জাদুখেলার মতো। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে সত্য। আসলে সত্য নয়। যেমন জাদুখেলা সত্য নয়, সত্যের ভান মাত্র।

যথা মায়াময়াদ্ বীজাজ্জায়তে তন্ময়োঽঙ্কুরঃ।

নাসৌ নিত্যো ন চোচ্ছেদী তদ্বদ্ধর্মেষু যোজনা॥৫৯

অন্বয়: যথা মায়াময়াৎ বীজাৎ জায়তে (জাদুখেলায় যেমন জাদুবীজ থেকে); তন্ময়ঃ অঙ্কুরঃ (জাদুগাছ জন্মায়); অসৌ (সেই গাছ); ন নিত্যঃ (চিরন্তন নয়); ন চ উচ্ছেদী (বিনাশশীল নয়); তদ্বৎ (সেইরকম); ধর্মেষু যোজনা (আত্মায় প্রযোজ্য)।

সরলার্থ: (জাদুকর) মায়াবীজ থেকে মায়াগাছ উৎপন্ন করে। সেই গাছ নিত্য নয়। আবার তাকে বিনাশও করা যায় না। একই কথা আত্মা সম্পর্কেও প্রযোজ্য।

ব্যাখ্যা: জাদুর খেলায় দেখা যায় আমের আঁটি থেকে আমগাছ বেরিয়ে এল। কিন্তু সমস্তটাই ভোজবাজি। আঁটিটাও সত্য নয়, গাছটাও সত্য নয়। সুতরাং গাছটা বিনাশশীল না অবিনাশী সে প্রশ্নই ওঠে না।

জীবাত্মা সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য কারণ জীবাত্মাও সত্য নয়।

নাজেষু সর্বধর্মেষু শাশ্বতাশাশ্বতাভিধা।

যত্র বর্ণা ন বর্তন্তে বিবেকস্তত্র নোচ্যতে॥৬০

অন্বয়: অজেষু সর্বধর্মেষু (জন্মবিহীন জীবাত্মা সম্পর্কে); শাশ্বত-অশাশ্বত-অভিধা ন (অমর বা মরণশীল শব্দগুলি প্রযোজ্য নয়); যত্র (যেখানে); বর্ণাঃ ন বর্তন্তে (বর্ণনার ভাষা নেই); তত্র (সেখানে); বিবেকঃ (নিত্য-অনিত্যের পার্থক্য); ন উচ্যতে (প্রযোজ্য নয়)।

সরলার্থ: জীবাত্মার জন্ম হয় না। সুতরাং সেক্ষেত্রে অমর বা মরণশীল এই শব্দগুলি প্রযোজ্য নয়। যা বর্ণনা করা যায় না তাকে শাশ্বত বা অশাশ্বত কিভাবে বলব?

ব্যাখ্যা: আত্মার কখনো জন্ম হয় না; আত্মা চিরন্তন এবং জ্ঞানস্বরূপ। আত্মাকে বর্ণনা করা যায় না। শাস্ত্র বলছেন ‘যতো বাচঃ নিবর্তন্তে’—যেখান থেকে শব্দ ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। তাই ‘মরণশীল’ ‘অমর’ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে তাঁকে বর্ণনা করার প্রয়াস বৃথা।

যথা স্বপ্নে দ্বয়াভাসং চিত্তং চলতি মায়য়া।

তথা জাগ্রদ্‌দ্বয়াভাসং চিত্তং চলতি মায়য়া॥৬১

অন্বয়: যথা স্বপ্নে (যেমন স্বপ্নে); চিত্তং মায়য়া দ্বয়াভাসং চলতি (মন অজ্ঞানতাবশত দুই দেখে ও সেই অনুরূপ কাজ করে [যদিও আসলে দুই নেই]); তথা জাগ্রৎ (সেইরকমই জাগ্রত অবস্থায়); চিত্তং মায়য়া (অবিদ্যার প্রভাবে মন); দ্বয়াভাসং চলতি (দ্বৈতচিন্তা ও সেইমতো কাজ করে)।

সরলার্থ: স্বপ্নে আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তবু মন দুই দেখে ও সেই অনুরূপ কাজ করে। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও মন অবিদ্যার প্রভাবে দুই দেখে ও সেই অনুযায়ী চিন্তা ও কাজ করে। (বস্তুত দুই নেই, এক। অজ্ঞানতার ফলেই এই ভুল হয়।)

[ব্যাখ্যার জন্য কারিকাভাষ্য ৩।২৯ দ্রষ্টব্য]

অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং চিত্তং স্বপ্নে ন সংশয়ঃ।

অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং তথা জাগ্ৰন্ন সংশয়ঃ॥৬২

অন্বয়: স্বপ্নে চ অদ্বয়ং চিত্তম্ (যখন স্বপ্ন দেখি তখন কেবল আমার মনই আছে); দ্বয়াভাসং ন সংশয়ঃ ([তবুও] দুই দেখি এবং এই বিষয়ে আমার মনে সন্দেহমাত্র থাকে না); তথা (সেইভাবে); অদ্বয়ং চ জাগ্রৎ (জাগ্রত অবস্থাতেও আমার মন একাই আছে); দ্বয়াভাসং সংশয়ঃ ন (তবু আমি যে বহু দেখছি এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই)।

সরলার্থ: স্বপ্নকালে মন নিঃসঙ্গ থাকে, তবু দুয়ের (জ্ঞাতা-জ্ঞেয়) অভিজ্ঞতা হয়। সেইভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও মনের দ্বৈতভূমিকা থাকে, এবং জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ধারণা সৃষ্টি করে। এর ফলে বহু দেখা যায়। আর এই বহুর অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্রষ্টার মনে সংশয়মাত্র থাকে না। কিন্তু স্বপ্ন ও জাগ্রত—এই দুই অবস্থার অভিজ্ঞতাই দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়।

[ব্যাখ্যার জন্য কারিকাভাষ্য ৩।৩০ দ্রষ্টব্য]

স্বপ্নদৃক্ প্রচরন্ স্বপ্নে দিক্ষু বৈ দশসু স্থিতান্।

অণ্ডজান্ স্বেদজান্ বাঽপি জীবান্ পশ্যতি যা সদা॥৬৩

অন্বয়: স্বপ্নদৃক্ (যে ব্যক্তি স্বপ্ন দেখছে); স্বপ্নে প্রচরন্ বৈ দশসু দিক্ষু (স্বপ্নে নানা দিকে বিচরণ করে); স্থিতান্ যান্ অণ্ডজান্ স্বেদজান্ বা অপি জীবান্ পশ্যতি সদা (এবং [ভ্রমণকালে] সে নানারকমের প্রাণী দেখে—কেউ অণ্ডজাত, কেউ স্বেদজাত ইত্যাদি)।

সরলার্থ: স্বপ্নকালে মানুষ চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায় এবং নানা ধরনের প্রাণী দেখতে পায়—কোনটি অণ্ডজাত (যেমন পাখী) কোনটি বা স্বেদজাত (যেমন মশা) প্রভৃতি।

ব্যাখ্যা: স্বপ্নে নানা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। কিন্তু সে সবই মিথ্যা। যা দেখা যায় তাই যে শুধু মিথ্যা তা নয়, যা শোনা যায় তাও মিথ্যা।

স্বপ্নদৃক্‌‌চিত্ত দৃশ্যাস্তে ন বিদ্যন্তে ততঃ পৃথক্।

তথা তদ্‌দৃশ্যমেবেদং স্বপ্নদৃক্‌‌চিত্তমিষ্যতে॥৬৪

অন্বয়: স্বপ্নদৃক্-চিত্তদৃশ্যাঃ (স্বপ্নে ব্যক্তি যেসব বস্তু দর্শন করে); তে (তারা); ততঃ (সেই ব্যক্তির মন থেকে); পৃথক্ ন বিদ্যন্তে (পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই); তথা ইদং স্বপ্নদৃক্ চিত্তম্ (সেইরূপ স্বপ্ন দেখছে এমন মানুষের মন); তদ্দৃশ্যম্ এব ইষ্যতে (কেবল তার দ্বারাই অনুভূতি হয় [অর্থাৎ এই মন তার থেকে পৃথক নয়])।

সরলার্থ: মানুষ স্বপ্নে যেসব বস্তু দেখে সেগুলি তার মনের সৃষ্টি। বস্তুত তার মনও ঐসব বস্তু থেকে স্বতন্ত্র নয়।

ব্যাখ্যা: স্বপ্নে যা কিছু দেখা যায় তা মনেরই সৃষ্টি। মন এবং মন-কল্পিত বস্তু অভিন্ন। একইভাবে বলা যায় আমি ও আমার মন অভিন্ন।

চরঞ্জাগরিতে জাগ্রদিক্ষু বৈ দশসু স্থিতান্।

অণ্ডজান্ স্বেদজান্ বাঽপি জীবান্‌পশ্যতি যান্‌সদা॥৬৫

জাগ্রচ্চিত্তেক্ষণীয়াস্তে ন বিদ্যন্তে ততঃ পৃথক্।

তথা তদ্‌দৃশ্যমেবেদং জাগ্রতশ্চিত্তমিষ্যতে॥৬৬

অন্বয়: জাগ্রৎ জাগরিতে চরন (যেমন জাগ্রত অবস্থায় মানুষ ঘুরে বেড়ায়); দশসু দিক্ষু (সব দিকে); স্থিতান্ যান্ অণ্ডজান্ স্বেদজান্ বা অপি জীবান্ সদা পশ্যতি (অণ্ডজ প্রাণী, স্বেদজ কীট ও অন্যান্য জীব দেখে)।

তে জাগ্রচ্চিত্তেক্ষণীয়াঃ (জাগ্রত অবস্থায় মানুষের মনে তারা [এইসব প্রাণীরা] ধরা পড়ে); ততঃ পৃথক্ ন বিদ্যন্তে (মন থেকে পৃথক কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই); তথা (একইভাবে); জাগ্রতঃ ইদং চিত্তং তদ্দৃশ্যম্ এব ইষ্যতে (যেহেতু জাগ্রত অবস্থায় মানুষের মন শুধু তার নিজের কাছেই ধরা পড়ে, অতএব সে ও তার মন অভিন্ন)।

সরলার্থ: জাগ্রত অবস্থায় একজন ব্যক্তি চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায় এবং অণ্ডজ প্রাণী, স্বেদজ কীট ও অন্যান্য প্রাণী দেখে থাকে। এইসব প্রাণী কেবলমাত্র জাগ্রত ব্যক্তিরই মনের গোচর। এইসব প্রাণী বা বস্তু তার মন থেকে পৃথক হতে পারে না। অনুরূপভাবে, মানুষের নিজের মনও নিজের কাছেই ধরা পড়ে। আর সেইহেতু মনও ব্যক্তির থেকে স্বতন্ত্র নয়।

ব্যাখ্যা: জাগ্রত অবস্থায় যে নানা বস্তু দেখা যায় সেই অভিজ্ঞতা একান্তভাবেই মনের ব্যাপার। এর কারণ সেই অভিজ্ঞতা ওই মনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ স্বপ্নের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয়। মূলকথা হল ব্যক্তিমানুষ ও তার মন এক এবং অভিন্ন।

উভে হ্যন্যোন্যদৃশ্যে তে কিং তদস্তীতি নোচ্যতে।

লক্ষণাশূন্যমুভয়ং তন্মতেনৈব গৃহ্যতে॥৬৭

অন্বয়: তে উভে (মন এবং বস্তু উভয়ই); হি (নিশ্চিতভাবে); অন্যোন্যদৃশ্যে (পরস্পরের উপর নির্ভরশীল [অতএব বিজ্ঞজনেরা কিভাবে]); তৎ অস্তি ইতি কিং ন উচ্যতে (বলতে পারেন এদের মধ্যে একটির অস্তিত্ব আছে? [তাঁরা বলেন] কোনটিরই অস্তিত্ব নেই); লক্ষণাশূন্যম্ (তাদের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই); উভয়ম্ (মন এবং বস্তু); তন্মতেন এব গৃহ্যতে (একসঙ্গে হলে তবেই প্রত্যক্ষ হয়)।

সরলার্থ: মন এবং বস্তু উভয়ই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। (যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন) ‘কোনটির অস্তিত্ব আছে?’ (প্রাজ্ঞজনেরা বলেন) ‘কোনটিরই নেই।’ তাদের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই। উভয়ে একত্র হলে তবেই তাদের উপস্থিতি বোঝা যায়।

ব্যাখ্যা: বস্তু যদি না থাকে তবে মনও থাকে না। উভয়ে একত্র হলে তবেই তাদের অস্তিত্ব। অর্থাৎ তারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। অন্তত তাদের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই। প্রাজ্ঞজনেরা তাই বলে থাকেন ওগুলি সত্য নয়।

বস্তুত প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন যে ‘কিছু আছে’ এই উক্তি ভ্রান্ত। যার স্বতন্ত্র সত্তা নেই তার প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বই নেই। ‘জ্ঞাতা’ ও ‘জ্ঞেয়’ পৃথকভাবে থাকে না। সেহেতু অদ্বৈতমতে জ্ঞান, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা পৃথক সত্তা নয়—এক ও অভিন্ন।

যথা স্বপ্নময়ো জীবো জায়তে ম্রিয়তেঽপি চ।

তথা জীবা অমী সর্বে ভবন্তি ন ভবন্তি চ॥৬৮

অন্বয়: যথা স্বপ্নময়ঃ (ঠিক যেমন স্বপ্নে); জীবঃ জায়তে চ ম্রিয়তে অপি (কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়); তথা অমী সর্বে জীবাঃ (সেইরকম [জাগ্রত অবস্থায়] এইসব প্রাণী); ভবন্তি ন ভবন্তি চ (জন্মাচ্ছে বা মারা যাচ্ছে দেখা যায়)।

সরলার্থ: স্বপ্নে কোন ব্যক্তিকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। একইভাবে, জাগ্রত অবস্থাতেও সকল প্রাণীর জন্ম বা মৃত্যু দেখা যায়।

যথা মায়াময়ো জীবো জায়তে ম্রিয়তেঽপি চ।

তথা জীবা অমী সর্বে ভবন্তি ন ভবন্তি চ॥৬৯

অন্বয়: যথা মায়াময়ঃ (ঠিক যেমন জাদুখেলায়); জীবঃ জায়তে চ ম্রিয়তে অপি (কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়); তথা (অনুরূপভাবে); অমী সর্বে জীবাঃ ([জাগ্রত অবস্থায়] এইসব প্রাণী); ভবন্তি ন ভবন্তি চ (জন্মাচ্ছে বা মারা যাচ্ছে দেখা যায়)।

সরলার্থ: জাদুখেলায় অনেক সময় কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও এইসব প্রাণীকে জন্মগ্রহণ বা মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়।

যথা নির্মিতকো জীবো জায়তে ম্রিয়তেঽপি বা।

তথা জীবা অমী সর্বে ভবন্তি ন ভবন্তি চ॥৭০

অন্বয়: যথা (ঠিক যেমন); নির্মিতকঃ জীবঃ (কৃত্রিমভাবে তৈরি বস্তু); জায়তে ম্রিয়তে অপি বা (জাত বা মৃত হতে দেখা যায়); তথা (অনুরূপভাবে); অমী সর্বে জীবাঃ (এইসব প্রাণী [জাগ্রত অবস্থায়]); ভবন্তি ন ভবন্তি চ (জন্ম বা মৃত্যু হতে পারে)।

সরলার্থ: ঠিক যেমন, কৃত্রিমভাবে উৎপন্ন বস্তুকে জন্মাতে বা বিনাশপ্রাপ্ত হতে দেখা যায় তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও এইসব প্রাণীর জন্ম বা মৃত্যু হতে দেখা যায়।

ব্যাখ্যা: স্বপ্নে, জাদুখেলায় অথবা কৃত্রিমভাবে উৎপন্ন বস্তুর ক্ষেত্রে জন্ম বা মৃত্যু উভয়ই দেখা যেতে পারে। উভয়ই মিথ্যা। অনুরূপভাবে, জাগ্রত অবস্থায় বিভিন্ন প্রাণীদের মধ্যে জন্ম এবং মৃত্যু দুই-ই দেখা যেতে পারে, কিন্তু দুই-ই সমভাবে মিথ্যা।

ন কশ্চিজ্জায়তে জীবঃ সংভবোঽস্য ন বিদ্যতে।

এতত্তদুত্তমং সত্যং যত্র কিঞ্চিন্ন জায়তে॥৭১

অন্বয়: কশ্চিৎ জীবঃ ন জায়তে (কোনও কিছু জন্মায় না); সম্ভবঃ অস্য ন বিদ্যতে (কোনও কিছুর জন্মাবার সম্ভাবনাও নেই); যত্র কিঞ্চিৎ ন জায়তে (বস্তুত কিছুরই জন্ম হয় না); তৎ এতৎ উত্তমং সত্যম্ (এই হল পরম সত্য)।

সরলার্থ: কেউ জন্মায় না, কারও জন্মাবার সম্ভাবনাও নেই; বস্তুত কোন কিছুরই জন্ম হয় না। এই হল পরম সত্য।

[ব্যাখ্যার জন্য কারিকা ৩।৪৮ দ্রষ্টব্য]

চিত্তস্পন্দিতমেবেদং গ্রাহ্যগ্রাহকবদ্‌দ্বয়ম্।

চিত্তং নির্বিষয়ং নিত্যমসঙ্গং তেন কীর্তিতম্॥৭২

অন্বয়: ইদং গ্রাহ্যগ্রাহকবৎ (জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের বিষয়); দ্বয়ম্ ([এই] দ্বৈতবুদ্ধি); চিত্তস্পন্দিতম্ এব (নিঃসন্দেহে মনের সৃষ্টি); চিত্তং নির্বিষয়ম্ (মন গুণের দ্বারা বিশেষিত নয়); তেন (অতএব); নিত্যম্ অসঙ্গম্ (সর্বদা অপরিবর্তনীয়, স্বনির্ভর); কীর্তিতম্ (বলা হয়ে থাকে)।

সরলার্থ: এই দ্বৈতজগৎ, যেখানে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় উভয়কেই দেখা যায় তা মনের সৃষ্টি। মন কিন্তু স্বভাবতই অপরিবর্তনীয়, স্বনির্ভর। এইজন্যই মনকে অদ্বয় বলা হয়।

যোঽস্তি কল্পিতসংবৃত্যা পরমার্থেন নাস্ত্যসৌ।

পরতন্ত্রাভিসংবৃত্যা স্যান্নাস্তি পরমার্থতঃ॥৭৩

অন্বয়: যঃ কল্পিতসংবৃত্যা অস্তি (যার অস্তিত্ব মনে কিন্তু [তা হলেও] ব্যবহারিক জীবনে কার্যকরী); অসৌ পরমার্থেন ন অস্তি (বাস্তব সত্তা নেই); পর-তন্ত্রাভি-সংবৃত্যা স্যাৎ (যদি অন্য কোন দার্শনিক গোষ্ঠী কোন কিছুকে সত্য বলে বর্ণনা করেন); পরমার্থতঃ ন অস্তি (পারমার্থিক দৃষ্টিতে তার অস্তিত্ব নেই)।

সরলার্থ: ব্যবহারিক জীবনে যেসব বস্তু কাজে লাগে সেগুলিকে সত্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেগুলি যদি মনের সৃষ্টি হয় তবে তাদের কোন বাস্তব সত্তা নেই। একইভাবে, অন্য মতে কোন জিনিসকে সত্য বলা হতে পারে। কিন্তু তার দ্বারাই সেই জিনিসের অস্তিত্ব প্রমাণ হয় না।

ব্যাখ্যা: মনকে (অর্থাৎ আত্মাকে) নিঃসঙ্গ বলা হয়। বাইরের জগৎ নেই বলেই কি একথা বলা হয়ে থাকে? যদি বাহ্যজগৎকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা যায় তাহলে শাস্ত্র, আচার্য এঁরা কোথা থেকে এলেন? আত্মার কথাই বা কিভাবে তাঁরা শেখাবেন? অদ্বৈতবাদীদের উত্তর হল: এইসব ব্যবহারিকভাবে সত্য। আত্মজ্ঞান হলে জানা যায় এসবের কোন বাস্তব সত্তা নেই।

অজঃ কল্পিতসংবৃত্যা পরমার্থেন নাপ্যজঃ।

পরতন্ত্রাভিনিষ্পত্ত্যা সংবৃত্যা জায়তে তু সঃ॥৭৪

অন্বয়: [আত্মাকেও] কল্পিত সংবৃত্যা (কল্পিত ব্যবহারিক দৃষ্টিতে [বলা হয়]); অজঃ (জন্মহীন); পরমার্থেন অজঃ অপি ন (পারমার্থিক দৃষ্টিতে জন্মহীনও নয়); সঃ (ইহা [জন্মহীন]); তু (কিন্তু); পরতন্ত্রাভিঃ নিষ্পত্ত্যা (অন্যান্য মতের শাস্ত্র অনুসারে); সংবৃত্যা (অবিদ্যায়); জায়তে (জন্ম হয়েছে বলা হয়)।

সরলার্থ: যদি বলা হয় আত্মার জন্ম নেই, তা শুধুমাত্র ব্যবহারিক দৃষ্টিতেই বলা হয়ে থাকে। পারমার্থিক দৃষ্টিতে আত্মাকে জন্মহীনও বলা যায় না। কিন্তু অন্যান্য দার্শনিক গোষ্ঠী অজ্ঞানতাবশত আত্মার জন্ম হয়েছে বলে বর্ণনা করেন।

ব্যাখ্যা: সঠিকভাবে বলতে গেলে আত্মাকে ‘জন্মরহিত’ও বলা যায় না। এই ধরনের উক্তি অজ্ঞানতার পরিচয় দেয়। একথা জেনেও যে অদ্বৈতবাদীরা আত্মাকে জন্মরহিত বলেন তা কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে (যাঁরা আত্মার জন্মে বিশ্বাসী) তাঁদের মতকে খণ্ডন করার জন্য। বস্তুত আত্মা সম্পর্কে কোন কথা বলাই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। যদি একান্তই কিছু বলতে হয় তা কেবলমাত্র মিথ্যাকে খণ্ডন করার জন্য।

অভূতাভিনিবেশোঽস্তি দ্বয়ং তত্র ন বিদ্যতে।

দ্বয়াভাবং স বুদ্‌ধ্বৈব নির্নিমিত্তো ন জায়তে॥৭৫

অন্বয়: অভূতাভিনিবেশঃ অস্তি (যা নেই তার প্রতি কেউ আকৃষ্ট হতে পারে); তত্র দ্বয়ং ন বিদ্যতে (শুধুমাত্র সেই কারণেই বস্তুটির অস্তিত্ব আছে বলা যায় না); দ্বয়াভাবং বুদ্‌ধ্বা এব (যেই সে বুঝতে পারে দুই বোধ মিথ্যা); নির্নিমিত্তঃ (তখন তাকে আর কিছুই আকৃষ্ট করতে পারে না); সঃ ন জায়তে (তার আর জন্ম হয় না)।

সরলার্থ: কেউ কোন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে কিন্তু তার দ্বারা দ্বিতত্ত্ব (অর্থাৎ বাইরে কিছু আছে) প্ৰমাণিত হয় না। যেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে দুইবোধ মিথ্যা, তখন আর কোন কিছুই তাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। এমন ব্যক্তির আর পুনর্জন্ম হয় না।

ব্যাখ্যা: একজন ব্যক্তি কোন এক বস্তুর প্রতি আসক্ত হতে পারে। কিন্তু তার দ্বারা বস্তুটির সত্যতা প্রমাণিত হয় না। বস্তুটি সত্য হোক বা না হোক, এই আসক্তি মানুষের বন্ধনের কারণ হতে পারে। আর সেইজন্য তাকে হয়তো বারবার জন্ম নিতে হবে। কিন্তু যদি সে বুঝতে পারে যে তার অনুরাগের বস্তুটির কোন বাস্তব সত্তা নেই তখন বস্তুটির প্রতি তার আর কোন আসক্তি থাকবে না। তখনি সে দ্বৈতচিন্তার মোহ থাকে মুক্ত হবে এবং আত্মাকে জানতে পারবে। এমন ব্যক্তির আর পুনর্জন্ম হবে না।

যদা ন লভতে হেতূনুত্তমাধমমধ্যমান্।

তদা ন জায়তে চিত্তং হেত্বভাবে ফলং কুতঃ॥৭৬

অন্বয়: [চিত্তম্] যদা (যখন মন); উত্তম-অধম-মধ্যমান্ হেতূন্ ন লভতে (ভালো, মন্দ বা মাঝারি কোন কারণকে স্বীকার করে না); তদা চিত্তং ন জায়তে (তখন আর মনের জন্ম হয় না); হেত্বভাবে (যদি কারণ না থাকে); ফলং কুতঃ (ফল কোথা থেকে আসবে?)।

সরলার্থ: মন যখন ভালো, মন্দ বা মাঝারি কোন কারণকেই আর স্বীকার করে না, তখন তার আর পুনর্জন্ম হয় না। কারণ যদি না থাকে, তবে কার্য থাকে কি করে? (মন বাসনামুক্ত হলে সে আর কারণ দেখে না। সুতরাং তার আর জন্মও হয় না।)

ব্যাখ্যা: সকল প্রাণীকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—উত্তম, মধ্যম এবং অধম। যাঁরা উত্তম তাঁরা ঈশ্বরতুল্য। তাঁরা তাঁদের কাজে শাস্ত্রীয় নির্দেশ পালন করেন। মধ্যম যাঁরা তাঁরা সাধুজীবন যাপনে চেষ্টা করেন। আর অধম শ্রেণীর অন্তর্গত হল পশু এবং কীটপতঙ্গ। এরা অধম এই অর্থে যে ভালো-মন্দ বিচারে তারা অক্ষম।

এই শ্রেণীবিভাগ অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ কিছু মানুষ আছেন যাঁরা আত্মা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আত্মা সবরকম শ্রেণীবিভাগের ঊর্ধ্বে, শুদ্ধ এবং স্বতন্ত্র। আত্মা আত্মাই (কেবল)। আত্মা সকল কামনামুক্ত, আপনাতে আপনি তৃপ্ত।

যে ব্যক্তি সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে, তার আর পুনর্জন্ম হয় না।

অনিমিত্তস্য চিত্তস্য যাঽনুৎপত্তিঃ সমাঽদ্বয়া।

অজাতস্যৈব সর্বস্য চিত্তদৃশ্যং হি তদ্যতঃ॥৭৭

অন্বয়: অনিমিত্তস্য (যার জন্মাবার কোন কারণ নেই [সেহেতু]); অজাতস্য (যার জন্ম হয়নি); সর্বস্য চিত্তস্য যা অনুৎপত্তিঃ (মনের মুক্তি); [সা] অদ্বয়া (যা সর্বদা অদ্বিতীয়); সমা (সর্বদা অভিন্ন); যতঃ (সুতরাং); তৎ চিত্তদৃশ্যম্ (মনের জন্ম এবং মন যেসব বস্তু অনুভব করে দুই-ই মিথ্যা)।

সরলার্থ: মনের জন্ম হওয়ার কোন হেতু নেই। কাজেই তার জন্ম হয় না। আর যেহেতু মনের জন্ম হয় না তাই মন মুক্ত, স্বাধীন। মন অদ্বিতীয় ও অপরিবর্তনীয়। মনের যেমন জন্ম নেই, মন দিয়ে যেসব বস্তু অনুভব করা হয় তাদেরও জন্ম নেই।

ব্যাখ্যা: যার মনে বাসনা থাকে তার জন্ম হয়। যার বাসনা নেই তার জন্মাবার কোন হেতুই নেই। কখন মন কামনা-বাসনা শূন্য হয়? যখন আত্মজ্ঞান লাভ হয়। সে তখন উপলব্ধি করে যে সে স্বয়ং আত্মা—অনন্য ও অদ্বিতীয়। সে তখন নিজেকে সর্বত্র এবং সবকিছুতে দেখে। কিছুই আর তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। সে-ই পরম ব্রহ্ম এবং সতত অপরিবর্তনীয়। এই জ্ঞান লাভ হলে মানুষের আর কি চাওয়ার থাকতে পারে? যা কিছু কাম্য সব সে পেয়ে গেছে। তখন মানুষ সর্বকামনাশূন্য হয়।

যেহেতু কোন আকাঙ্ক্ষা থাকে না, সুতরাং মন বলেও কিছু থাকে না। এমন নয় যে কখনো আবার কিছুর আকাঙ্ক্ষা হল এবং তখন আবার মনও হল। তিনি স্বয়ং আত্ম—অপরিবর্তিত ও অপরিবর্তনীয়। মন এবং কামনা-বাসনা—দুই-ই মিথ্যা।

বুদ্‌ধ্বাঽনিমিত্ততাং সত্যাং হেতুং পৃথগনাপ্নুবন্।

বীতশোকং তথাঽকামমভয়ং পদমশ্নুতে॥৭৮

অন্বয়: অনিমিত্ততাম্ (কারণের অনুপস্থিতিতে); সত্যাম্ (যা সত্য); বুদ্‌ধ্বা (উপলব্ধি করে); পৃথক্ হেতুম্ অনাপ্নুবন্ (আর কোনও কারণ না দেখে); বীতশোকম্ (দুঃখের ঊর্ধ্বে); তথা অকামম্ (কামনাশূন্য); অভয়ম্ (ভয়মুক্ত); পদম্ (পদ [ব্ৰহ্মপদ]); অশ্নুতে (লাভ করে)।

সরলার্থ: একমাত্র সত্যকে জানলে আর জন্ম হয় না, এছাড়া অন্য কোন পথ নেই—একথা উপলব্ধি করে মানুষ দুঃখের পারে চলে যায়। তখন সে কামনাশূন্য হয়, নির্ভয় হয় এবং ব্রহ্মপদ লাভ করে।

ব্যাখ্যা: যতদিন মানুষ দুই দেখে ততদিন তাকে বারবার জন্মাতে হয়। দুই দেখার অর্থ এই দৃশ্যমান জগৎকে সত্য মনে করা, যা প্রিয় তার পিছনে ছোটা এবং যা অপ্রিয় তা পরিত্যাগ করা। এও এক ধরনের দাসত্ব। মানুষের জীবনের লক্ষ্য এই দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া। তারজন্য প্রয়োজন নিজের স্বরূপকে জানা। মানুষ তখন বুঝতে পারে সে-ই আত্মা—মহত্তম, শুদ্ধ, মুক্ত, অনন্য এবং অপরিবর্তনীয়। এই উপলব্ধি হলে তার আর চাওয়ার কিছু থাকে না, সে সব পেয়ে গেছে। নির্বাসনা হলে মানুষের জন্মাবার কোন হেতুও থাকে না, ইচ্ছেও থাকে না। তখন সে অভয় ব্রহ্মপদ লাভ করে।

অভূতাভিনিবেশাদ্ধি সদৃশে তৎপ্রবর্ততে।

বস্ত্বভাবং স বুদ্‌ধ্বৈব নিঃসঙ্গং বিনিবর্ততে॥৭৯

অন্বয়: অভূতাভিনিবেশাৎ (যা মিথ্যা তার প্রতি যদি আকর্ষণ থাকে); হি সদৃশে তৎ প্রবর্ততে (সেইসব বস্তু মনকে অধিকার করে থাকে); সঃ বস্তু-অভাবং বুদ্‌ধ্বা ([কিন্তু] যদি সে বুঝতে পারে এগুলি [অর্থাৎ তার প্রিয় বস্তুগুলি] সত্য নয়); এব নিঃসঙ্গং বিনিবর্ততে (সে [তৎক্ষণাৎ সেইসব বস্তু থেকে] নিজেকে সরিয়ে আনে)।

সরলার্থ: অসত্য বস্তুর প্রতি আসক্তি থাকলে মন সেসব বস্তুর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। যে বুঝতে পারে এইসব বস্তুর পারমার্থিক সত্তা নেই সে তৎক্ষণাৎ সেগুলি ত্যাগ করে।

ব্যাখ্যা: দ্বৈত মিথ্যা। তবু মানুষ একথা ভুলে থাকে। তাঁরা হয়তো একটা কিছু দেখে মুহূর্তে তাতে মুগ্ধ হয়। মিথ্যা হলেও এই প্রিয় বস্তুর চিন্তা তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কিন্তু আগেই হোক বা পরে মানুষ একদিন তার ভুল বুঝতে পারে। প্রিয় বস্তুটির অসারতা আবিষ্কার করে সে তৎক্ষণাৎ তা ত্যাগ করে। দুইবোধ তার চিরতরে মুছে যায়।

নিবৃত্তস্যাবৃত্তস্য নিশ্চলা হি তদা স্থিতিঃ।

বিষয়ঃ স হি বুদ্ধানাং তৎসাম্যমজমদ্বয়ম্॥৮০

অন্বয়: তদা (তখন); হি (নিশ্চিতভাবে); নিবৃত্তস্য ([যদি তুমি ঐসব অসত্য বস্তু থেকে] দূরে থাক); অপ্রবৃত্তস্য (আর কখনো সেগুলিকে ভোগ না করে); নিশ্চলা (মন শান্ত হয়); স্থিতিঃ ([একমাত্র ব্রহ্মে] স্থির); হি (এইভাবে); বুদ্ধানাম্ (যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন); সঃ (পরমাত্মা); বিষয়ঃ ([তাঁদের সব কর্মের] কেন্দ্রবিন্দু); তৎ (ঐ); অজম্ (জন্মরহিত); অদ্বয়ম্ (অদ্বিতীয়); সাম্যম্ (সতত অভিন্ন)।

সরলার্থ: ইন্দ্রিয়ের বিষয়বস্তু থেকে দূরে থেকে আর কখনো সেগুলি ভোগ না করলে মন শান্ত হয়, ব্রহ্মে একাগ্র হয়। যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁদের সব চিন্তার কেন্দ্রে একমাত্র ব্রহ্ম—যিনি জন্মরহিত, অদ্বিতীয় ও সদা অভিন্ন।

ব্যাখ্যা: আমাদের আরম্ভ করতে হবে ইন্দ্রিয়ের বিষয়বস্তু ত্যাগের মধ্য দিয়ে। তারপর ব্রহ্মে মন একাগ্র করার চেষ্টা করতে হবে। যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁরা আত্মাতেই মগ্ন হয়ে আছেন। অতএব তাঁদের কাছে একমাত্র আত্মাই সত্য। এই আত্মার জন্ম নেই। আত্মা অপরিবর্তনীয়, এক ও অদ্বিতীয়।

অজমনিদ্রমস্বপ্নং প্রভাতং ভবতি স্বয়ম্।

সকৃদ্বিভাতো হ্যেবৈষ ধর্মো ধাতুস্বভাবতঃ॥৮১

অন্বয়: অজম্ (যার জন্ম নেই); অনিদ্রম্ (অবিদ্যাপ্রসূত ঘুম যার নেই); অস্বপ্নম্ (অবিদ্যাপ্রসূত স্বপ্ন যিনি দেখেন না); স্বয়ং প্রভাতং ভবতি (স্বয়ংপ্রকাশ); হি (যেহেতু); এষঃ ধর্মঃ (এই আত্মা); ধাতু স্বভাবতঃ (স্বধর্ম অনুযায়ী); সকৃৎ বিভাতঃ (সবসময় প্রকাশিত)।

সরলার্থ: আত্মা জন্মরহিত, অনিদ্র এবং স্বপ্নহীন। ইনি স্বয়ংপ্রকাশ এবং সদা প্রকাশিত।

ব্যাখ্যা: আত্মজ্ঞানীর কাছে আত্মা কিভাবে প্রতিভাত হন? তাঁর কাছে আত্মা স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি স্বয়ং জ্যোতি। এই জ্যোতি সূর্য বা অন্য কোনও উৎস থেকে ধার করা নয়। আত্মা আপন জ্যোতিতেই সদা জ্যোতির্ময়।

সুখমাব্রিয়তে নিত্যং দুঃখং বিব্রিয়তে সদা।

যস্য কস্য চ ধর্মস্য গ্রহেণ ভগবানসৌ॥৮২

অন্বয়: যস্য কস্য চ ধর্মস্য গ্রহেণ (কোন কিছুতে তোমার অনুরাগ হলে); অসৌ ভগবান্ সদা সুখম্ আব্রিয়তে নিত্যম্ (আত্মাকে তোমার থেকে সুদীর্ঘকাল আড়াল করে রাখতে পারে); দুঃখং বিব্রিয়তে ([কিন্তু] আত্মাকে যদি তুমি দর্শন করতে চাও, তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে)।

সরলার্থ: কোন বস্তুতে আমাদের অনুরাগ হলে সেই বস্তু সহজেই আত্মাকে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে। কিন্তু আত্মার সাক্ষাৎকার লাভ করতে হলে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

ব্যাখ্যা: প্রশ্ন হল: ‘আত্মা যদি সদা জ্যোতির্ময় হন তবে তাঁকে আমরা দেখতে পাই না কেন?’ দোষ আমাদেরই। আত্মাই একমাত্র সত্য, অন্য কোন কিছু সত্য নয়। তবু অজ্ঞানতাবশত আমরা যা মিথ্যা তার প্রতি আকৃষ্ট হই। এই মিথ্যাকে আমরা এতই ভালোবাসি যে আত্মাকে ভুলে থাকি। আমাদের প্রিয় বস্তুটি সত্য নয়, তবু তা আমাদের মুগ্ধ করে—এটাই পরিতাপের বিষয়। এর ফলে আত্মা আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যান।

আমাদের স্বভাবদোষেই আত্মাকে জানা এত কঠিন হয়ে পড়ে। এইসব দোষ দূর করতে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এ ব্যাপারে সদ্‌গুরুর কাছে শিক্ষাগ্রহণও আমাদের পক্ষে অপরিহার্য।

আত্মা সহজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখেন, তাঁকে লাভ করা দুরূহ।

অস্তি নাস্ত্যস্তি নাস্তীতি নাস্তি নাস্তীতি বা পুনঃ।

চলস্থিরোভয়াভাবৈরাবৃণোত্যেব বালিশঃ॥৮৩

অন্বয়: বালিশঃ (নির্বোধ); অস্তি নাস্তি অস্তি নাস্তি নাস্তি নাস্তি ইতি বা (আত্মা আছেন, আত্মা নেই, আত্মা আছেনও আবার নেইও, আত্মা নেই, অবশ্যই নেই ইত্যাদি); পুনঃ চল-স্থির-উভয়-অভাবৈঃ আবৃণোতি (কখনো চলমান, কখনো স্থির, কখনো উভয়ই, কখনো নেই—এইভাবে আত্মাকে আবৃত করে রাখে)।

সরলার্থ: নির্বোধ ব্যক্তি কখনো মনে করে আত্মা আছেন কখনো মনে করে নেই, আবার কখনো মনে করে আত্মা আছেনও বটে নেইও বটে। এইভাবে আত্মাকে কখনো স্থির, কখনো চঞ্চল, কখনো দুই-ই ইত্যাদি ভেবে নির্বোধ ব্যক্তি আত্মাকে আবৃত করে রাখে।

ব্যাখ্যা: এমন বহু দার্শনিক গোষ্ঠী আছেন যাঁরা ‘আত্ম অদ্বয়’ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। তাঁরা যে যাঁর মতে এতটাই মুগ্ধ যে আসল সত্যটি তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। আত্মা সম্পর্কে তাঁরা আক্ষরিক অর্থে অন্ধ। আত্মাকে যেন তাঁরা অবগুণ্ঠনের আড়ালে সরিয়ে রেখেছেন।

অদ্বৈতবিরোধী চারটি প্রধান দার্শনিক মত আছে। এঁদের মধ্যে বৈশেষিকরা বলেন: আত্মার অস্তিত্ব আছে কিন্তু আত্মার পরিবর্তন হয়। আত্মা কখনো সুখী কখনো দুঃখী। অবশ্য তাঁদের মতে আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র।

আর এক বিরোধী দার্শনিক মত হল বৌদ্ধদর্শন। তাঁরা বিশ্বাস করেন বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী। এঁরা বিজ্ঞানবাদী বা আত্মগত ভাববাদী বলে পরিচিত। এই মত অনুসারে মনই আত্মা এবং বস্তুর সঙ্গে যোগ হলে এর ক্রমাগত পরিবর্তন হয়।

দিগম্বর জৈনরা বলেন : আত্মা আছেও বটে, নেইও বটে। যতক্ষণ দেহের অস্তিত্ব আছে ততক্ষণই আত্মার অস্তিত্ব। দেহের মৃত্যুর সঙ্গেই আত্মারও মৃত্যু হয়। আবার দেহ বড় বা ছোট হলে আত্মাও বড় বা ছোট হয়।

বৌদ্ধদের আর এক শাখা আছে যাঁরা শুন্যবাদী বলে পরিচিত। এঁদের মতে আত্মা বলে কিছু নেই। পরম সত্য হল শূন্য। এঁদের বলা হয় নাস্তিবাদী (Nihilist)।

কোট্যশ্চতস্র এতাস্তু গ্রহৈর্যাসাং সদাঽঽবৃতঃ।

ভগবানাভিরস্পৃষ্টো যেন দৃষ্টঃ স সর্বদৃক্॥৮৪

অন্বয়: এতাঃ চতস্রঃ কোট্যঃ (এই চারটি গোষ্ঠী); যাসাম্ (যাঁদের); গ্রহৈঃ (মোহমুগ্ধতা [নিজ মতবাদের প্রতি]); সদা (সর্বদা); আবৃতঃ (অবগুণ্ঠিত); ভগবান্ (আত্মা); যেন (প্রাজ্ঞ ব্যক্তি); আভিঃ (এমন সব মানুষ [যাঁরা আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক করেন]); অস্পৃষ্টঃ (ঊর্ধ্বে [ওই চার মতবাদের]); দৃষ্টঃ ([সেইভাবে] দেখা যায়); সঃ সর্বদৃক্ (তিনি সর্বজ্ঞ)।

সরলার্থ: এই চারটি দার্শনিক মতবাদীদের কাছে আত্মা সর্বদাই নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। এর কারণ নিজ নিজ মতের প্রতি এঁরা মোহমুগ্ধ। কিন্তু এই চার মতবাদের ঊর্ধ্বে গিয়ে যে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি জ্যোতির্ময় আত্মার দর্শন লাভ করেন তিনি প্রকৃতই সর্বজ্ঞ।

ব্যাখ্যা: আত্মা সম্বন্ধে যে কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হল আত্মাকে বর্ণনা করা যায় না। এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অবিরাম বিতর্ক চলে, কিন্তু এইসব তর্কবিচার নিরর্থক। এঁরা নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলে মনে করেন। কিন্তু এত বাগ্‌বিতণ্ডায় তাঁদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। এঁদের আত্মজ্ঞান লাভের আশা সুদূরপরাহত।

যিনি বুঝেছেন আত্মা বিতর্কের বিষয় নয় তিনি আত্মাকে জানেন। তিনি যথার্থই প্রাজ্ঞ।

প্রাপ্য সর্বজ্ঞতাং কৃৎস্নাং ব্রাহ্মণ্যং পদমদ্বয়ম্।

অনাপন্নাদিমধ্যান্তং কিমতঃ পরমীহতে॥৮৫

অন্বয়: কৃৎস্নাম্ (পরিপূর্ণভাবে); সর্বজ্ঞতাম্ (সর্বজ্ঞতা); অনাপন্নাদিমধ্যান্তম্ (আদি, মধ্য এবং অন্ত নেই যার); অদ্বয়ম্ (অদ্বিতীয়); ব্রাহ্মণ্যং পদম্ (ব্রহ্মপদ); প্রাপ্য (লাভ করে); অতঃ (লাভ করার পর); পরম্ (সর্বোচ্চ); কিম্ (কি বস্তু); ঈহতে (পেতে ইচ্ছা করে)।

সরলার্থ: কোন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণভাবে সর্বজ্ঞ হন, তবে তিনি জন্ম, মৃত্যু এবং তাদের মধ্যবর্তী অবস্থাকেও জয় করে থাকেন। তারপর তাঁর আর আকাঙ্ক্ষার কি বা থাকতে পারে?

ব্যাখ্যা: প্রকৃত ‘ব্রাহ্মণ’ তিনিই যিনি ব্রহ্মকে জানেন। এমন ব্যক্তি সর্বজ্ঞ। আবার তাঁর মনে হয় তিনি যা চেয়েছেন, সব পেয়েও গেছেন। ব্রহ্মপদ লাভ করার পর তাঁর আর কি বা আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে?

বিপ্রাণাং বিনয়ো হ্যেষ শমঃ প্রাকৃত উচ্যতে।

দমঃ প্রকৃতিদান্তত্বাদেবং বিদ্বাঞ্‌শমং ব্রজেৎ॥৮৬

অন্বয়: এষঃ বিনয়ঃ (এই বিনয়); হি প্রাকৃতঃ শমঃ উচ্যতে (আত্মসংযম বলে পরিচিত); বিপ্রাণাম্ (ব্রাহ্মণদের পক্ষে); প্রকৃতি-দান্তত্বাৎ দমঃ (কারণ স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা আত্মসংযমে সমর্থ, তাঁরা যা করেন তাই আত্মসংযমের আদর্শ); এবং বিদ্বান্ (যখন এই আত্মসংযমকে ব্রহ্মরূপে জান); শমং ব্রজেৎ (তুমি আত্মসংযম অর্জন কর)।

সরলার্থ: এই বিনয় ব্রাহ্মণের স্বাভাবিক আত্মসংযম বলে পরিচিত। ব্রাহ্মণ স্বভাবতই আত্মসংযমে সক্ষম। তাঁরা যা কিছু করেন তাতেই সংযমের পরিচয় পাওয়া যায়। এ সংযম তাঁরা পরিশ্রম করে অথবা শাস্ত্রবিধি অনুশীলন করে লাভ করেননি। যিনি এই আত্মসংযমকে ব্রহ্মেরই মূল স্বরূপ বলে জেনেছেন তিনি নিজে এই সংযম লাভ করেছেন।

ব্যাখ্যা: বিনয়ই ব্রাহ্মণের স্বভাব। এ কোন অর্জিত গুণ নয়, এ তাঁর সহজাত ধর্ম। সকলেই স্বরূপত ব্রহ্ম; এই বোধই তাঁদের বিনয়ের উৎস। এই বিনয় ব্রাহ্মণদের আত্মসংযমেরই অঙ্গ। আত্মসংযমই ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মই আত্মসংযম।

সবস্তু সোপলম্ভং চ দ্বয়ং লৌকিকমিষ্যতে।

অবস্তু সোপলম্ভং চ শুদ্ধং লৌকিকমিষ্যতে॥৮৭

অন্বয়: সবস্তু (বস্তু সহ); সোপলম্ভং চ দ্বয়ম্ (এবং তাদের [অর্থাৎ বস্তুর] উপলব্ধি, এই দুই একযোগে); লৌকিকম্ ইষ্যতে (জাগ্রত অবস্থা বলা হয়); অবস্তু (যদি কোন বস্তু না থাকে); সোপলম্ভম্ (কিন্তু [তথাপি বস্তু] দেখা যাচ্ছে); চ শুদ্ধং লৌকিকম্ ইষ্যতে (সাধারণ স্বাভাবিক অবস্থা বা স্বপ্নাবস্থা যেখানে জাগ্রতের তুলনায় সীমিত বস্তুর উপলব্ধি হয় [সুতরাং বিশুদ্ধতর])।

সরলার্থ: বস্তুর উপস্থিতি ও তার উপলব্ধি—এ দুটি ব্যবহারিক সত্যকে একযোগে বলা হয় জাগ্রত অবস্থা। কিন্তু যদি বস্তু না থাকে, তবুও বস্তু দেখা যাচ্ছে তা হল স্বপ্নাবস্থা (এও সাধারণ স্বাভাবিক অবস্থা। তবে জাগ্রতের তুলনায় সীমিত বস্তুর উপলব্ধি হয়)।

ব্যাখ্যা: প্রশ্ন উঠতে পারে : কেন অদ্বৈতবাদীদের নির্ভুল আর অন্যান্য মতবাদীদের ভ্ৰান্ত বলা হচ্ছে? অদ্বৈতবাদীরা শান্তি ও সমন্বয়ে বিশ্বাসী। শান্তি ও সমন্বয়ের একমাত্র উপায় একত্বের অনুভূতি একথাই অদ্বৈতবাদীরা প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাঁদের প্রতিপক্ষরা সবসময় বাগ্‌বিতণ্ডায় লিপ্ত। তাঁরা কেবল তিক্ততা সৃষ্টি করেন।

অদ্বৈতবাদীদের মূল বক্তব্য: বস্তু ও তার উপলব্ধি ব্যবহারিক দৃষ্টিতে সত্য। এই দুয়ের একযোগে উপস্থিতি আমাদের জাগ্রত অবস্থায়। বেদান্তবাদী এই অবস্থাকে স্বীকার করেন এবং এই অবস্থার জন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করে থাকেন। কারণ শাস্ত্র অধ্যয়ন ও আত্মজ্ঞান লাভের জন্য সাধনা জাগ্রত অবস্থাতেই সম্ভব। এই আত্মজ্ঞানলাভই জীবনের পরম লক্ষ্য।

জাগ্রত অবস্থার বিপরীত হল স্বপ্নবস্থা। এই অবস্থায় বস্তু না থাকলেও বস্তুর অনুভূতি হয়। এই অবস্থা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

অদ্বৈতবাদীরা যে শুধুমাত্র স্বপ্নাবস্থাকেই মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেন তা নয়, তাঁদের কাছে জাগ্রত অবস্থাও একইভাবে মিথ্যা। তবে তাঁরা স্বীকার করেন যে জাগ্রত অবস্থার ব্যবহারিক সত্যতা আছে।

অবস্ত্বনুপলম্ভং চ লোকোত্তরমিতি স্মৃতম্।

জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চ বিজ্ঞেয়ং সদা বুদ্ধৈঃ প্রকীর্তিতম্॥৮৮

অন্বয়: অবস্তু (কোন জড়বস্তু নয়); অনুপলম্ভং চ (এবং প্রত্যক্ষ নয়); লোকোত্তরম্ (ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে [সুষুপ্তি]); ইতি স্মৃতম্ (পণ্ডিতদের দ্বারা এই আখ্যা দেওয়া হয়েছে); বুদ্ধৈঃ (যাঁরা জানেন তাদের দ্বারা); সদা জ্ঞানম্ (নিরবচ্ছিন্ন [বস্তু] উপলব্ধি); জ্ঞেয়ম্ ([উপলব্ধির] বস্তু); বিজ্ঞেয়ং চ (বিশেষ জ্ঞানের বস্তুও [অর্থাৎ তুরীয়, পরম সত্য]); প্রকীর্তিতম্ (এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে)।

সরলার্থ: যেখানে কোন জড়বস্তু নেই, বস্তু যে আছে এর বোধও নেই এবং যখন মানুষ সব ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে—সেই অবস্থাকে পণ্ডিতেরা ‘গভীর নিদ্রা’(সুষুপ্তি) আখ্যা দিয়েছেন। যাঁরা আত্মাকে জানেন তাঁরা শুধু তিনটি উপাদান স্বীকার করেন— জ্ঞান, জ্ঞেয় (জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থা) এবং আত্মা (তুরীয়)।

ব্যাখ্যা: ‘অবস্তু’র অর্থ—জড় বস্তুর অভাব, আর ‘অনুপলম্ভ’ কথাটির অর্থ—প্রত্যক্ষ নয়। এই দুটিই গভীর নিদ্রা তথা সুষুপ্তির লক্ষণ। জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি (গাঢ় নিদ্রা)—এই তিন অবস্থা হল জ্ঞেয় অর্থাৎ জ্ঞানের বিষয়। এই নামকরণের কারণ কি? কারণ, যত রকমের উপলব্ধি সম্ভব তা এই জ্ঞেয়র অন্তর্গত।

আরও এক ধরনের জ্ঞান আছে যা ‘বিজ্ঞেয়’ বলে খ্যাত। বিজ্ঞেয় কথাটির অর্থ বিশেষ ধরনের জ্ঞান। এই জ্ঞান বিশেষ তার কারণ এই জ্ঞানই পরম জ্ঞান অর্থাৎ আত্মজ্ঞান।

জ্ঞানে চ ত্রিবিধে জ্ঞেয়ে ক্রমেণ বিদিতে স্বয়ম্।

সর্বজ্ঞতা হি সর্বত্র ভবতীহ মহাধিয়ঃ॥৮৯

অন্বয়: জ্ঞানে (বস্তুর ব্যবহারিক জ্ঞান লাভের পর); ত্রিবিধে জ্ঞেয়ে চ ([জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির] ত্রিবিধ জ্ঞান লাভের পর); ক্রমেণ বিদিতে (ক্রমশ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে); মহাধিয়ঃ (অসাধারণ মেধাবী ব্যক্তি); সর্বত্র (সব ব্যাপারে); হি (আপনিই); ইহ (এই জীবনেই); স্বয়ম্ এব সর্বজ্ঞতা ভবতি (পরম জ্ঞান তাঁর কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন)।

সরলার্থ: ব্যবহারিক জ্ঞান ও (জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির) ত্রিবিধ জ্ঞান অর্জন করলে মানুষ ক্রমে অসাধারণ মেধার অধিকারী হয়। এবং এই জীবনেই পরাজ্ঞান লাভ করে।

ব্যাখ্যা: সাধারণভাবে, আমরা তিনটি অবস্থার মধ্যে বাস করি—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। জাগ্রত অবস্থায় আমরা জড়বস্তুর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসি। স্বপ্নাবস্থায় যদিও কোন জড়বস্তু থাকে না, তবু জড়বস্তু নিয়ে কাজ করার অনুভূতি আমাদের হয়ে থাকে। গাঢ় নিদ্রাবস্থাতেও (সুষুপ্তি) কোন বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের চেতনা থাকে না। এই তিন অবস্থাই আত্মার এলাকা। আমাদেরকে এই ত্রিবিধ অবস্থার পারে যেতে হবে।

এই তিন অবস্থার পারে পরম ব্রহ্ম। এই জ্ঞান লাভ হলে আমাদের ব্যক্তিত্বের রূপান্তর ঘটে। আমরা তখন সর্বজ্ঞ। এই রূপান্তর আপনিই ঘটে। আমরা তখন আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠি।

হেয়জ্ঞেয়াপ্যপাক্যানি বিজ্ঞেয়ান্যগ্রয়াণতঃ।

তেষামন্যত্র বিজ্ঞেয়াদুপলম্ভস্ত্ৰিষু স্মৃতঃ॥৯০

অন্বয়: অগ্রয়াণতঃ (প্রথমে); হেয় (ত্যাগ করতে হয় [তিন অবস্থা—জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি]); জ্ঞেয় (জ্ঞাতব্য বিষয় [পরম সত্য—ব্রহ্ম]); আপ্য (অর্জন করতে হয় [শাস্ত্রজ্ঞান, শিশুসুলভ স্বভাব, এবং নীরবতার অভ্যাস]); পাক্যানি (সংযত করতে হয় [রাগ, ঘৃণা ইত্যাদি]; বিজ্ঞেয়ানি (যত্নসহকারে লক্ষ্য করতে হবে); বিজ্ঞেয়াৎ অন্যত্র (আত্মা ব্যতীত); ত্ৰিষু (তিনের মধ্যে [অর্থাৎ ত্যাগ করতে হবে, অর্জন করতে হবে এবং সংযত করতে হবে]); [সারবস্তু বলে কিছু নেই] তেষাম্ উপলম্ভঃ (যদিও ওদের অস্তিত্ব তুমি অনুভব করতে পার)।

সরলার্থ: (মুমুক্ষু ব্যক্তি হিসেবে) সাধককে তিনটি অবস্থা প্রথমেই এড়িয়ে চলতে হবে (জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থা যে তোমার আছে, সেই ধারণাকে মুছে ফেলতে হবে)। আর আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে (অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভের জন্য একাগ্র হতে হবে), শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করতে হবে, বালকসুলভ স্বভাব এবং নীরব থাকার অভ্যাস করতে হবে, আর রাগ-দ্বেষ প্রভৃতি স্বাভাবিক দুর্বলতাগুলিকে নিজের বশে আনতে হবে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আত্মজ্ঞান ছাড়া এই তিনের (অর্থাৎ বর্জন করতে হবে, অর্জন করতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে) কোনও মূল্য নেই। সাধক এগুলির অস্তিত্বকে কেবল অনুভব করতে পারে।

ব্যাখ্যা: জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থা আত্মায় আরোপিত হয়ে থাকে, এগুলি সত্য নয়। রজ্জুতে সর্পভ্রমের মতোই এগুলি ভ্রান্তিমাত্র। আত্মজ্ঞান লাভ করতে হলে ইন্দ্রিয়সুখকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে হবে। যেমন, সম্পদ, সন্তান বা স্বর্গ, সাধক তখন এসবের কিছুই কামনা করেন না। সাধককে শাস্ত্রপাঠ, শিশুসুলভ সারল্য ও নীরবতার অভ্যাস করতে হবে। সবসময় একথাটি মনে রাখতে হবে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য আর সব মিথ্যা।

প্রকৃত্যাঽঽকাশবজ্‌জ্ঞেয়াঃ সর্বে ধর্মা অনাদয়ঃ।

বিদ্যতে ন হি নানাত্বং তেষাং ক্বচন কিঞ্চন।৯১

অন্বয়: সর্বে ধর্মাঃ (সকল জীবাত্মা); প্রকৃত্যা আকাশবৎ অনাদয়ঃ জ্ঞেয়াঃ (স্বভাবত আকাশের মতো [কারণ আত্মা নিষ্কলঙ্ক] এবং শাশ্বত বলে পরিচিত); তেষাং ক্বচন কিঞ্চন (এই আত্মার মধ্যে কোথাও এতটুকু); নানাত্বং ন হি বিদ্যতে (দ্বৈত বলে কিছু নেই)।

সরলার্থ: সকল জীবাত্মা স্বভাবত আকাশের মতো (কারণ জীবাত্মা নিষ্কলঙ্ক) এবং শাশ্বত বলে পরিচিত। এইসব জীবাত্মার মধ্যে দ্বৈতের কোনও স্থান নেই।

ব্যাখ্যা: মুমুক্ষু ব্যক্তি সকল জীবাত্মাকে (অনেক সময়েই ধর্ম বলে উল্লিখিত) আকাশের মতো সূক্ষ্ম, নিষ্কলঙ্ক, অনাদি এবং সর্বব্যাপী বলে গ্রহণ করবেন। ‘ধর্ম’ শব্দটি এখানে বহুবচনে (ধর্মাঃ) ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সেইজন্য আমরা যেন ভুল না করি আত্মা অনেক। কোন অর্থেই আত্মা অনেক নয়—এক ও অভিন্ন।

আদিবুদ্ধাঃ প্রকৃত্যৈব সর্বে ধর্মাঃ সুনিশ্চিতাঃ।

যস্যৈবং ভবতি ক্ষান্তি সোঽমৃতত্বায় কল্পতে॥৯২

অন্বয়: সর্বে ধর্মাঃ (সকল আত্মা); প্রকৃত্যা এব (নিজ প্রকৃতি অনুসারে); আদি-বুদ্ধাঃ (সতত জ্যোতির্ময়); সুনিশ্চিতাঃ (সতত অভিন্ন); যস্য এবং ক্ষান্তিঃ ভবতি (সাধক যখন এই তত্ত্ব নিশ্চিতভাবে জানেন এবং তৃপ্ত হন [অর্থাৎ আত্মা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার আর প্রয়োজন মনে করেন না])। সঃ অমৃতত্বায় কল্পতে (তিনি মোক্ষলাভ করেন)।

সরলার্থ: আত্মা স্বরূপত জ্যোতির্ময় এবং সতত অভিন্ন। সাধক এ তত্ত্ব আয়ত্ত করলে মোক্ষলাভ করেন।

ব্যাখ্যা: সূর্য যেমন সবসময়ই উজ্জ্বল আত্মাও তেমন সতত জ্যোতির্ময়। আমরা জানি বা না জানি আত্মা আত্মাই—স্বয়ং জ্যোতি এবং সর্বদা অভিন্ন। আমরা আত্মাকে জানার কথা বলি, কিন্তু এই জানা কোন বস্তুকে জানার মতো নয়। জ্ঞান সবসময়ই আমাদের ভেতরে রয়েছে। শুধু আমাদের যা করণীয় তা হল এই জ্ঞান এবং আমাদের মধ্যেকার আড়ালটুকু সরিয়ে দেওয়া। এ অনেকটা আয়নার উপর থেকে ধুলোর আবরণ মুছে দেওয়ার মতো, তাহলেই আয়নায় আমরা নিজেদেরকে আরও পরিষ্কার দেখতে পাব। মন যখন সব মোহ থেকে মুক্ত হয় তখন জ্ঞান আপনা-আপনিই প্রকাশ পায়। তখন আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের আর কোনও সংশয় থাকে না। আত্মাকে জানার সব চেষ্টা এইখানেই শেষ হয়।

আদিশান্তা হ্যনুৎপন্নাঃ প্রকৃত্যৈব সুনিৰ্বৃতাঃ।

সর্বে ধর্মাঃ সমাভিয়াঃ অজং সাম্যং বিশারদম্॥৯৩

অন্বয়: সর্বে হি ধর্মাঃ (সকল, আত্মা); প্রকৃত্যা (স্বভাবত); এব আদিশান্তাঃ (সর্বদা প্রশান্ত); অনুৎপন্নাঃ (যার জন্ম নেই); সুনিৰ্বৃৰ্তাঃ (মুক্ত); সমাভিন্নাঃ (সতত অভিন্ন); [অতএব] অজম্ (অনাদি); সাম্যং বিশারদম্ (নিঃসন্দেহে সদাপ্রসন্ন)।

সরলার্থ: আত্মা স্বভাবতই সদা প্রশান্ত, জন্মরহিত, নিত্যমুক্ত, এবং সতত অভিন্ন। আত্মা যে অনাদি এবং সদাপ্রসন্ন এ-বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই।

ব্যাখ্যা: আত্মাকে প্রশান্ত বলা নিষ্প্রয়োজন। আত্মা স্বভাবতই শান্ত, চেষ্টা করে তাঁকে শান্ত করতে হয় না। আত্মার জন্ম নেই। আত্মা সদা বিদ্যমান, অপরিবর্তনীয় ও সর্বদা অভিন্ন। আত্মা নিত্যমুক্ত। যখন বলা হয় আত্মা অপরিবর্তনীয় তার অর্থ হল আত্মা যা আত্মা তাই। তাঁর পক্ষে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

আত্মা শব্দটি এখানে বহুবচনে ব্যবহৃত, কিন্তু বস্তুত আত্মা এক ও অভিন্ন। অজ্ঞ ব্যক্তিদের কথা মনে রেখেই বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ পরবর্তী শ্লোকে স্পষ্ট হবে।

বৈশারদ্যং তু বৈ নাস্তি ভেদে বিচরতাং সদা।

ভেদনিম্নাঃ পৃথগ্বাদাস্তস্মাত্তে কৃপণাঃ স্মৃতাঃ॥৯৪

অন্বয়: সদা (সর্বদা); ভেদে বিচরতাম্ ([যারা] দ্বৈত জীবনচর্যায় মগ্ন); তু (আবার); বৈশারদ্যম্ (স্বচ্ছ [অর্থাৎ যুক্তিপূর্ণ চিন্তা]); ন বৈ অস্তি (তাদের আয়ত্ত নয়); তস্মাৎ (সুতরাং [যুক্তিপূর্ণ চিন্তা করার অক্ষমতার হেতু]); ভেদনিম্নাঃ পৃথগ্বাদাঃ (তারা [দ্বৈত] জগৎকে বেছে নেয় এবং বহু দেখে); তে [দ্বৈতিনাঃ] কৃপণাঃ স্মৃতাঃ (এই দ্বৈতবাদীরা সংকীর্ণচিত্ত ও হতভাগ্য)।

সরলার্থ: যাদের মন সবসময় দ্বৈতভূমিতে বিচরণ করে তারা কখনো শুদ্ধ আত্মাকে জানতে পারে না। যেহেতু তাঁরা সর্বত্র দুই দেখে এবং এই জগতের প্রতি আসক্ত হয়। এই দ্বৈতবাদীরা সংকীর্ণমনা এবং ভাগ্যহীন (যে হবেন) তাতে আর আশ্চর্য কি।

ব্যাখ্যা: যে আত্মাকে জানে না সে সংকীর্ণমনা এবং ভাগ্যহীন। এইরকম মানুষ জগতের প্রতি আসক্ত। সে এই জগৎকে ভোগ করতে চায়। ফলে তাকে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়। তার দৃষ্টি স্বচ্ছ নয়। আত্মার শুদ্ধস্বরূপ তথা সর্বভূতে একত্ব দর্শন করতে সে অক্ষম। সে সবকিছুতে ভেদ দর্শন করে। তার দৃষ্টিতে কিছু জিনিস প্রিয় আবার কিছু অপ্রিয়। সেই অনুযায়ী সে প্রিয় বস্তুর পেছনে ছোটে আর অপ্রিয়কে ত্যাগ করে।

অজে সাম্যে তু যে কেচিদ্ভবিষ্যন্তি সুনিশ্চিতাঃ।

তে হি লোকে মহাজ্ঞাস্তচ্চ লোকো ন গাহতে॥৯৫

অন্বয়: যে তু কেচিৎ (সেই সব লোক যাঁরা); অজে সাম্যে সুনিশ্চিতাঃ ভবিষ্যক্তি (সদা অভিন্ন ও জন্মরহিত আত্মাকে সংশয়াতীতভাবে জানেন); লোকে (এই পৃথিবীতে); তে হি মহাজ্ঞানাঃ (তাঁরা যথার্থই মহাজ্ঞানী); লোকাঃ (এই বিষয়ী লোকেরা); তৎ চ ন গাহতে (এই প্রজ্ঞাকে স্বীকার করেন না)।

সরলার্থ: এই জগতে যাঁরা জন্মরহিত এবং সতত অভিন্ন আত্মাকে নিশ্চিতরূপে জেনেছেন, তাঁরাই প্রকৃত অর্থে মহাজ্ঞানী। বিষয়ী লোকেরা কিন্তু তাঁদের এই প্রজ্ঞাকে স্বীকার করেন না।

ব্যাখ্যা: যাঁরা উদারমনা নন, শাস্ত্র পড়েননি, সুশিক্ষিত নন, বেদেও যাঁদের বিশ্বাস নেই আত্মজ্ঞান তাঁদের জন্য নয়। আত্মজ্ঞানের অধিকারী যিনি তাঁর পেশা বা সামাজিক মর্যাদা যাই হোক না কেন, তিনি স্ত্রী বা পুরুষ যাই হোন না কেন তাঁকে উচ্চকোটির সাধক বলেই স্বীকার করতে হবে। এমন মানুষ দেবদেবীরও ঈর্ষার পাত্র। আকাশের অনেক উঁচুতে পাখিরা যেমন স্বচ্ছন্দে উড়ে বেড়ায়, এমন মানুষের মোক্ষলাভও তেমনি সহজ ও স্বচ্ছন্দ হয়।

অজেষ্বজমসংক্রান্তং ধর্মেষু জ্ঞানমিষ্যতে।

যতো ন ক্ৰমতে জ্ঞানমসঙ্গং তেন কীর্তিতম্॥৯৬

অন্বয়: অজেষু ধর্মেষু জ্ঞানম্ অজম্ অসংক্রান্তম্ ইষ্যতে (আত্মায় নিহিত জ্ঞানও ঠিক আত্মার মতোই জন্মরহিত ও স্বতন্ত্র); যতঃ (যেহেতু); জ্ঞানং ন ক্ৰমতে (জ্ঞান [অন্য কোনও উৎস থেকে] আসে না); তেন (সেই কারণে); [ব্রহ্ম] অসঙ্গম্ (একা [স্বতন্ত্র]); কীর্তিতম্ (উল্লিখিত)।

সরলার্থ: আত্মায় নিহিত জ্ঞানও আত্মার মতোই শাশ্বত ও স্বাধীন। যেহেতু অন্য কোনও উৎস থেকে আত্মাকে এই জ্ঞান অর্জন করতে হয় না সেহেতু আত্মাকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বলা হয়েছে।

ব্যাখ্যা: আত্মা জ্ঞানস্বরূপ। আত্মা এবং জ্ঞান অবিচ্ছেদ্য যেমন সূর্য এবং তার উত্তাপ। তিনি আকাশের মতো স্বতন্ত্র। কোন অবস্থাতেই আকাশের যেমন কোন পরিবর্তন হয় না, ঠিক তেমনি আত্মা অপরিবর্তনীয়। আবার আত্মার মতো জ্ঞানও স্বতন্ত্র, কারণ এই জ্ঞান কোন উৎস থেকে আসে না। জ্ঞান স্বয়ং প্রকাশিত। আত্মার মতো জ্ঞানও জন্মরহিত এবং শাশ্বত। অর্থাৎ এই জ্ঞান ও আত্মা অভেদ।

অণুমাত্রেঽপি বৈধর্ম্যে জায়মানেঽবিপশ্চিতঃ।

অসঙ্গতা সদা নাস্তি কিমুতাবরণচ্যুতিঃ॥৯৭

অন্বয়: অবিপশ্চিতঃ (অবিবেকী ব্যক্তি [তার মতে]); অণুমাত্রে অপি বৈধর্ম্যে জায়মানে (সামান্যতম পরিবর্তনও যদি আত্মায় সম্ভব হয়); সদা অসঙ্গতা ন অস্তি (তবে আত্মা যে সকল আসক্তি থেকে মুক্ত এ দাবি টিকবে না); কিম্ উত আবরণ চ্যুতিঃ (অজ্ঞানতার আবরণ দূর করার প্রশ্নটি তবে ওঠে কি করে?)

সরলার্থ: অবিবেকী ব্যক্তির মতে, আত্মাতে যদি সামান্যতম পরিবর্তনও সম্ভব হয় তবে আত্মা যে আসক্তিশূন্য এ দাবি টিকতে পারে না। (অর্থাৎ আত্মাও আসক্ত হতে পারে যার তাৎপর্য হল যে অজ্ঞানতার আবরণ আত্মাকে আড়াল করে রাখে।) তবে অজ্ঞানতার আবরণ দূর হবার প্রশ্ন ওঠে কিভাবে?

ব্যাখ্যা: যুক্তিহীন মানুষ তর্ক করে যে, জ্ঞান বলতে সবসময়ই কোন বস্তুর জ্ঞানকে বোঝায়। আত্মার স্বরূপই যদি জ্ঞান হয়, তবে তা স্বতন্ত্র হতে পারে না। বাইরের কোনও বস্তুর উপর আত্মা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ সিদ্ধান্ত মেনে নিলে একথা স্বীকার করতেই হয় যে, আত্মার পরিবর্তন অনিবার্য, সে পরিবর্তন সামান্যই হোক বা বিরাটই হোক।

অলব্ধারণাঃ সর্বে ধর্মাঃ প্রকৃতিনির্মলাঃ।

আদৌ বুদ্ধাস্তথা মুক্তা বুধ্যন্ত ইতি নায়কাঃ॥৯৮

অন্বয়: সর্বে ধর্মাঃ (সব আত্মা); অলব্ধ আবরণাঃ (অজ্ঞানতার আবরণ যার নেই); প্রকৃতি নির্মলাঃ (শুদ্ধ স্বভাব); আদৌ (পূর্বেও); বুদ্ধাঃ তথা মুক্তাঃ (প্রজ্ঞাবান বা অজ্ঞানতার বন্ধনমুক্ত); বুধ্যন্তে (তাঁরা আত্মাকে জানেন); ইতি (এইভাবে); নায়কাঃ (বেদান্তের আচার্যরা [ঘোষণা করেন])।

সরলার্থ: আত্মা কখনই অজ্ঞানতার আবরণে আবৃত ছিলেন না। যিনি আত্মাকে জেনেছেন তিনি সতত শুদ্ধ, জ্ঞানস্বরূপ ও মুক্ত। বেদান্তের আচার্যরা আত্মাকে এইভাবেই প্রচার করেন।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈতবাদীরা এখানে তাঁদের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করছেন। তাঁদের মতে আত্মা নিত্যমুক্ত। আত্মা কোন দিনই অজ্ঞানতার আবরণে ঢাকা নন। কখনই তাঁর কোনও বন্ধন ছিল না।

তবে কেন বলা হয় ‘আত্মা জানেন’? আত্মা যদি জ্ঞানস্বরূপ হন তবে সেই জ্ঞান কিভাবে জ্ঞাতা হতে পারে? উক্তিটির উদ্দেশ্য একটিই, জ্ঞান যে আত্মার স্বরূপ সেই কথাটির উপর জোর দেওয়া। আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। বলা হয় সূর্য কিরণ দিচ্ছে। উজ্জ্বলতা (কিরণ) সূর্যের স্বভাব, তবু সাধারণভাবে সূর্যের উজ্জ্বলতার উপর জোর দেওয়াই এই উক্তিটির উদ্দেশ্য। এছাড়া অন্য কোনও বিশেষ তাৎপর্য নেই। আরও একটি দৃষ্টান্ত : ‘ওখানে পাহাড়গুলি আছে।’ সুদূর অতীত থেকেই ঐসব পাহাড় ওখানে ছিল এবং ভবিষ্যতেও বহুদিন থাকবে। উক্তিটি তথ্যপূর্ণ এর বিশেষ কোনও অর্থ নেই। ‘আত্মা জানেন’—এই উক্তিটিও উপরোক্ত বিবৃতিগুলির মতো, বিশেষ কোনও তাৎপর্য নেই।

ক্ৰমতে ন হি বুদ্ধস্য জ্ঞানং ধর্মেষু তায়িনঃ॥

সর্বে ধর্মাস্তথা জ্ঞানং নৈতদ্‌বুদ্ধেন ভাষিতম্॥৯৯

অন্বয়: বুদ্ধস্য জ্ঞানং ধর্মেষু ন হি ক্ৰমতে (জ্ঞানী কখনো [ব্রহ্ম ব্যতীত] অন্য বস্তুর চিন্তা করেন না); তায়িনঃ (অবিভক্ত); সর্বে ধর্মাঃ তথা জ্ঞানম্ [ন ক্ৰমতে] (সেই-প্রকার, বরণীয় জীবাত্মাসকল ও তাঁদের জ্ঞান [অর্থাৎ তাঁদের মন আর অন্য কোন দিকে ঘোরে না। তাঁরা সর্বদা আত্মচিন্তায় মগ্ন, অন্য কিছুর সত্তা তাঁরা স্বীকার করেন না]); এতৎ বুদ্ধেন ন ভাষিতম্ (বুদ্ধদেব এ বিবৃতি কখনো দেননি [অথবা এ বুদ্ধদেবের মত নয়])।

সরলার্থ: যিনি আত্মাকে জেনেছেন তিনি (ব্রহ্ম চিন্তা ছাড়া) অন্য কোনও চিন্তা করেন না। তাঁর মন সতত অভিন্ন। (কারণ তাঁর মনে আর দুই এর স্থান নেই।) এ জগতের সবকিছুকে (জীবাত্মা ও অন্যান্য সমস্ত বস্তু) তিনি শ্রদ্ধা করেন। কারণ তিনি সর্বভূতে সেই এক আত্মাকে দেখেন। সুতরাং কোন কিছুই তাঁর মনকে ব্রহ্মের চিন্তা থেকে সরিয়ে আনতে পারে না। বুদ্ধদেব এমন কথা কখনো বলেননি।

ব্যাখ্যা: যে ব্যক্তি আত্মাকে জেনেছেন তিনি আত্মচিন্তা ব্যতীত অন্য চিন্তা করতে পারেন না। তাঁর মন আত্মাতে স্থির। আত্মা আকাশের মতো সর্বব্যাপী। জ্ঞানও আকাশের তুল্য এবং সর্বত্র বিরাজমান। আকাশ যেমন কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয় না তেমনি কোনও কিছুই জ্ঞানের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

জীবাত্মাসকল আকাশের মতো রূপহীন, শাশ্বত, এক ও অদ্বিতীয়। জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে পৃথক নয়। জীবাত্মাই পরমাত্মা। শাস্ত্র বলেন আত্মা কখনই জ্ঞানবর্জিত নয়।

আত্মাই একমাত্র সত্য আর বাইরের সব বস্তু মিথ্যা—এই সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বৌদ্ধমতের কাছাকাছি হলেও এটি যথার্থ বৌদ্ধদর্শন নয়। বৌদ্ধদর্শন ও অদ্বৈতবাদের মধ্যে একটা মৌল পার্থক্য আছে, তা হল : জ্ঞান, জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় অভিন্ন, অদ্বৈতবাদীর এই সিদ্ধান্ত বৌদ্ধদর্শন স্বীকার করে না।

দুর্দর্শমতিগম্ভীরমজং সাম্যং বিশারদম্।

বুদ্‌ধ্বা পদমনানাত্বং নমস্কুৰ্মো যথাবলম্॥১০০

অন্বয়: দুর্দর্শম্ (বোঝা দুরূহ); অতি গম্ভীরম্ (প্রগাঢ়, সুগভীর); অজম্ (অনাদি); সাম্যম্ (সতত অপরিবর্তনীয়); বিশারদম্ (শুদ্ধ); অনানাত্বম্ (দুই নেই [অর্থাৎ আর বহু দেখে না]); পদম্ (এই মহান সত্য); বুদ্‌ধ্বা (বুঝে); যথাবলম্ (আমার যথাসাধ্য); নমস্কুৰ্মঃ (আমি নমস্কার করি)।

সরলার্থ: অদ্বৈততত্ত্ব ধারণা করা কঠিন। এই তত্ত্ব সুগভীর, অনাদি, সদা অপরিবর্তনীয়, শুদ্ধ এবং অদ্বৈত। আমি এই তত্ত্বকে বোঝার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছি। আমি তাঁকে নমস্কার করি।

ব্যাখ্যা: অদ্বৈততত্ত্ব অতি দুরূহ। কারণ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হল আত্মা, যাঁকে নিয়ে বহু বিতর্কের অবকাশ আছে। কেউ বলেন আত্মা আছেন আবার কেউ বলেন নেই। এ প্রসঙ্গে বহু পরস্পর বিরোধী মতবাদ আছে। সাধারণ মানুষের কাছে এ তত্ত্ব সমুদ্রের মতোই গভীর।

গৌড়পাদ বলছেন, তিনি উপলব্ধি করেছেন এই আত্মা অনন্য, অনাদি, শুদ্ধ এবং অপরিবর্তিত। এই ধরনের বিষয় সম্পর্কে কিছু বলা প্রায় দুঃসাধ্য, কিন্তু তিনি এই কাজে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এই পরম সত্যকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আচার্য এই প্রকরণের উপসংহার টেনেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *