প্রশ্ন উপনিষদ

প্রশ্ন উপনিষদ

মঙ্গলাচরণ

ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভির্ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

অন্বয়: দেবাঃ (হে দেবগণ); কর্ণেভিঃ (কান দিয়ে); ভদ্রম্ (ভাল যা কিছু); শৃণুয়াম (যেন তাই শুনতে পাই); যজত্রাঃ (হে পূজ্য দেবগণ); অক্ষভিঃ (চোখ দিয়ে); ভদ্রম্ (যা কিছু ভাল); পশ্যেম (যেন তাই দেখতে পাই); স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তনূভিঃ (স্থির শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা); তুষ্টুবাংসঃ (যেন তোমাদের স্তুতি করতে পারি); দেবহিতং যৎ আয়ুঃ (দেবগণ যে আয়ু বিহিত করে দিয়েছেন); ব্যশেম (তা যেন লাভ করতে পারি); শান্তিঃ (আধ্যাত্মিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শান্তি]); শান্তিঃ (আধিদৈবিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ পরিবেশ বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শান্তি]); শান্তিঃ (আধিভৌতিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ কীটপতঙ্গ, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতি-কৃত বিঘ্নের শান্তি])।

সরলার্থ: দেবতাদের কাছে আমাদের এই প্রার্থনা যে, আমরা যেন যা কিছু ভাল শুধু তাই-ই কান দিয়ে শুনি। দেবতাদের আমরা পুজো করি, আর তাঁদের কাছে এই প্রার্থনা করি যে, চোখ দিয়ে আমরা যেন শুধু ভাল জিনিসই দেখি। আরো প্রার্থনা, কায়মনোবাক্যে যেন তাঁদেরই জয়গান করি। তাঁদের যেমন ইচ্ছা ততদিনই যেন বেঁচে থাকি—বেশি নয়, কমও নয়। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।

ব্যাখ্যা: আমরা যেন ভাল কথা শুনি। ‘ভাল’ বলতে কি বুঝায়? যা কল্যাণপ্রদ, যা অনুকূল। দর্শন একটা শক্ত বিষয়। এ বুঝতে গেলে গভীর মনোযোগ চাই। বাজে কথায় সময় নষ্ট করা উচিত নয়। যা আমার পক্ষে কল্যাণকর, তাই শুধু আমরা দেখব। এতে আমাদের জ্ঞানার্জনের সুবিধা হবে এবং আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

এই প্রার্থনার মধ্যে আমাদের অঙ্গাদি স্থির থাকুক, এ কথাও বলা আছে। অঙ্গ বলতে শুধু বাইরের স্থূল অঙ্গ নয়, মনও ঐ সঙ্গে আছে বুঝতে হবে। শরীর ভাল থাকবে, মনও ভাল থাকবে। তবেই কাজে মন দিতে পারব। হয়তো শরীরের কোথাও একটা ব্যথা আছে। এতে মন বিক্ষিপ্ত থাকবে। মন যেন সর্বদা সজাগ থাকে; শরীরে বা মনে অবসাদ, জড়তা এসব কিছু যেন না থাকে। শরীর ও মন দুই-ই যেন স্থির থাকে, আর আমাদের আয়ত্তে থাকে। আমরা এইভাবে চলব, তবে আমাদের আয়ু বিধাতার যেমন বিধান তেমনি হোক।

আমরা প্রশ্ন উপনিষদ পড়তে চলেছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, আমাদের শরীর-মন যেন সুস্থ থাকে। আমরা যেন আমাদের অধ্যয়নে ডুবে থাকতে পারি। বিধাতার যেমন ইচ্ছা ততদিন যেন এইভাবে বেঁচে থাকতে পারি।

প্রশ্ন উপনিষদ

প্রশ্ন উপনিষদ অথর্ববেদের অন্তর্গত। প্রশ্ন কথার অর্থ হল জিজ্ঞাসা। এই উপনিষদের বিষয় কিছু প্রশ্নের ভিত্তিতে আলোচনা করা হয়েছে। তাই এই নামকরণ। আমাদের মনে সব সময়ই নানা প্রশ্ন জাগে। বিশেষত নিজেদের স্বরূপ সম্বন্ধে। আমরা সবাই বলি ‘আমি’। কিন্তু এই ‘আমি’টি কে? ভারতের শিক্ষা হল সর্বপ্রথম নিজেকে জানা। তা হলেই দৈনন্দিন জীবনে সবরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করা আমাদের পক্ষে অনেক সহজ হবে।

এই উপনিষদের আরম্ভ কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীকে নিয়ে। এই সব তরুণ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। শুধু তাই নয়, সত্যকে জানার জন্য প্রয়োজনীয় সবরকম সংযম অভ্যাস করেছেন। কিন্তু এত প্রস্তুতি সত্ত্বেও তাঁরা শাস্ত্রের মর্মার্থ গ্রহণ করতে সক্ষম নন। তাঁরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তখন এই তরুণরা আচার্যের নির্দেশ লাভের জন্য ঋষি পিপ্পলাদের কাছে যাওয়া মনস্থ করলেন। পিপ্পলাদ ছিলেন সেই কালের একজন খ্যাতনামা আচার্য।

শাস্ত্র পরম সত্য বিষয়ে শিক্ষা দেয়। কিন্তু সেই সত্য ধারণা করার জন্য এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে থাকা প্রয়োজন যিনি সেই সত্যকে জেনেছেন। এরকম গুরুগৃহে বাস হিন্দুদের রীতি। কিন্তু গুরু নিজে সত্যকে উপলব্ধি করেছেন কি না তা জানা যাবে কি ভাবে? সত্যদ্রষ্টা আচার্য সূর্যের মতো। সূর্যকে যখন আমরা দেখি তখন কাউকে বলে দিতে হয় না যে এটা সূর্য। ঠিক সেরকম যখন সত্যদ্রষ্টা ব্যক্তির সাক্ষাৎ লাভ করি তখন তাঁর চরিত্রেই তাঁকে চেনা যায়। মুণ্ডক উপনিষদে আছে—যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান।

শিষ্যকে গুরুর কাছে যেতে হবে অত্যন্ত বিনীতভাবে। গুরু অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদান করেন না। সুতরাং গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও অনুরাগের প্রতীক হিসেবে শিক্ষার্থী সাধারণত কিছু উপহার নিয়ে যান। শিষ্য যদি প্রকৃত জিজ্ঞাসু হন তাহলে আচার্য প্রসন্ন হয়ে তাঁকে শিক্ষা দান করেন। কিন্তু নিষ্ঠা এবং আগ্রহের প্রমাণ-স্বরূপ শিষ্য অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে গুরুর নিকট উপস্থিত হবেন এবং প্রার্থনা জানাবেন : ‘ভগবান, অনুগ্রহ করে আমায় শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করুন। আমি কিছুই জানি না’।

গুরু পিপ্পলাদের কাছে যে-ছাত্ররা এসেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং প্রত্যেকেই খুব ভাল প্রশ্ন করছিলেন: কোথা থেকে আমরা এসেছি? জীবনের উৎস কি? কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জগৎ আমাদের কাছে নিজেকে প্রকাশ করে এবং প্রধান ইন্দ্রিয় কোন্‌টি? প্রাণের (প্রাণবায়ুর) উৎপত্তি কোথা থেকে? কি ভাবে প্রাণ শরীরে প্রবেশ করে এবং কি ভাবেই বা শরীর ত্যাগ করে? কে ঘুমোন আর কেই বা জেগে থাকেন? স্বপ্নকালে কি ঘটে? আনন্দের উৎস কি? ‘ওম্‌’কে ধ্যান করলে মানুষ কোথায় যায় এবং সে কি লাভ করে? এবং সবশেষে, পরম সত্তা কি? এবং তিনি কোথায়ই বা আছেন?

প্রশ্নগুলি সরাসরি ব্রহ্ম বিষয়ে নয়, তবে ব্রহ্মকে জানার জন্য প্রাসঙ্গিক। প্রশ্নগুলি বিশেষ ভাবে প্রাণকে নিয়ে। দৃশ্যমান জগতে সবকিছুর মূলে রয়েছে প্রাণ। সেই প্রাণ হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি এবং সূত্ৰাত্মা নামেও পরিচিত। প্রাণ একাধারে স্থূল এবং সূক্ষ্ম, ভোক্তা এবং ভোগ্য, কারণ এবং কার্য। প্রাণই সবকিছু। মুণ্ডক উপনিষদ এবং প্রশ্ন উপনিষদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে। মুণ্ডক উপনিষদ যেন আকরগ্রন্থ এবং প্রশ্ন উপনিষদ তার ভাষ্য। মুণ্ডক উপনিষদের অধিকাংশই শ্লোকের আকারে লেখা হয়েছে। শুধু কয়েকটি অংশ গদ্যে লেখা। প্রশ্ন উপনিষদ ঠিক তার বিপরীত।

প্রশ্ন উপনিষদে এই সব প্রশ্নের আলোচনা ধাপে ধাপে করা হয়েছে। প্রথমে দৃশ্যমান জগৎ—সেখানে কত বিচিত্র প্রাণীর সমাবেশ। কিন্তু যে ভাবেই হোক, সব বৈচিত্রের পিছনে একটি মূল কারণ আছে বলেই মনে হয়। কিন্তু কি সেই কারণ? প্রথমে আমরা এই কারণকে বাইরে খুঁজি, পরে ফিরে তাকাই নিজের দিকে। অবশেষে দেখা যায় যা বাইরে আছে, তা-ই অন্তরে। যখন বাইরে আছে তখন বিশ্ব অর্থাৎ সমষ্টি। সেই একই জিনিস যখন ভেতরে, তখন তা জীব অর্থাৎ ব্যষ্টি। এই জীব ও অনন্ত সত্তা এক এবং অভিন্ন। এই হল সিদ্ধান্ত। আর এই সিদ্ধান্তই হল অদ্বৈত তত্ত্ব।

প্রথম প্রশ্ন

ওঁ সুকেশা চ ভারদ্বাজঃ শৈব্যশ্চ সত্যকামঃ সৌর্যায়ণী চ গার্গ্যঃ

কৌসল্যশ্চাশ্বশায়নো ভার্গবো বৈদর্ভিঃ কবন্ধী কাত্যায়নস্তে হৈতে

ব্রহ্মপরা ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ পরং ব্রহ্মান্বেষমাণা এষ হ বৈ তৎ সর্বং বক্ষ্যতীতি

তে হ সমিৎপাণয়ো ভগবন্তং পিপ্পলাদমুপসন্নাঃ॥১

অন্বয়: ভারদ্বাজং সকেশা (ভরদ্বাজপুত্র সকেশা); শৈব্যঃ সত্যকামঃ চ (এবং শিবিপুত্র সত্যকাম); সৌর্যায়ণী গার্গ্যঃ চ (গর্গগোত্রীয় সূর্যপৌত্র); আশ্বলায়নঃ কৌসল্যঃ চ (এবং অশ্বলপুত্র কৌসল্য); বৈদর্ভিঃ ভার্গবঃ (বিদর্ভ দেশীয় ভৃগুতনয়); কাত্যায়নঃ কবন্ধী (কত্যতনয় কবন্ধী); তে হ এতে (এঁরা সকলে); ব্রহ্মপরাঃ (ব্রহ্মে সমর্পিত); ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ (ব্রহ্মে একাগ্র); পরং ব্রহ্ম অন্বেষমাণাঃ (পরব্রহ্মকে জানতে ইচ্ছুক হয়ে); এষঃ হ বৈ (ইনি সেই ব্যক্তি); তৎ সর্বং বক্ষ্যতি (যিনি আমাদের সেই সব শিক্ষা দেবেন); ইতি (এভাবে স্থির করে); তে (তাঁরা); সমিৎপাণয়ঃ (যজ্ঞের কাঠ হাতে নিয়ে); ভগবন্তং পিপ্পলাদম্‌ উপসন্নাঃ (পিপ্পলাদের নিকট উপস্থিত হলেন)।

সরলার্থ: ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা, শিবিপুত্র সত্যকাম, গর্গগোত্রীয় সৌর্যায়ণী অশ্বলপুত্র কৌসল্য, বিদর্ভদেশীয় ভৃগুপুত্র ভার্গব, কত্যতনয় কবন্ধী—এঁরা সকলেই ছিলেন ব্রহ্মে সমর্পিত প্রাণ। ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু তাঁরা জানতেন না। ব্রহ্মকে তাঁরা সম্যক্‌ ভাবে জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা সকলে যজ্ঞের কাঠ হাতে নিয়ে গুরু পিপ্পলাদের নিকট উপস্থিত হলেন। তাঁরা জানতেন গুরু পিপ্পলাদ তাঁদের ব্রহ্ম বিষয়ে জ্ঞান দিতে সক্ষম।

ব্যাখ্যা: এই উপনিষদের আরম্ভ ছয়জন যুবককে নিয়ে। এই ছয়জন যুবক হলেন: সুকেশা, সত্যকাম, সৌর্যায়ণী, কৌসল্য, ভার্গব এবং কবন্ধী। তাঁরা হয়তো কেউ ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন। ভারতীয় ধারণায় সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা আসল তা হল তাঁদের শিক্ষালব্ধ জ্ঞান।

উপনিষদ তাঁদের ‘ব্রহ্মপরাঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্মে নিবেদিত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের ‘ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ’ এবং ‘পরং ব্রহ্ম অন্বেষমাণাঃ’ বলা হয়েছে। ‘ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ’র অর্থ একান্ত ভাবে যাঁরা ব্রহ্মে অনুরাগী এবং ‘পরং ব্রহ্ম অন্বেষমাণাঃ’ হল পরব্রহ্মকে যাঁরা জানতে আগ্রহী। এঁরা সবাই ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভের জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। বেদান্তসারে বলা হয়েছে, যখন এরকম ব্যাকুলতা জাগে তখন মনে হয় সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলছে। গায়ে আগুন লাগলে যেমন একটিই মাত্র চিন্তা থাকে কেমন করে একটু জল পাওয়া যায়, এঁদের ব্যাকুলতাও ছিল তেমনি একমুখী। শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। একজন মানুষের মাথা যদি জোর করে জলের নীচে ডুবিয়ে দেওয়া যায় তবে নিঃশ্বাস নেবার জন্য তার প্রাণ আঁকুপাঁকু করবে। ব্রহ্মের জন্যও এইরকম তীব্র ব্যাকুলতার নামই ব্ৰহ্মনিষ্ঠা।

আমাদের মনোভাব কি রকম হওয়া উচিত কঠোপনিষদে নচিকেতার উপাখ্যান তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। একটি মাত্র বিষয়ে নচিকেতার আগ্রহ। তা হল আত্মাকে জানা। যম তাঁকে নানা ভাবে পরীক্ষা করছেন। তিনি বলছেন, ‘হে বালক, মৃত্যুর পরে মানুষের কি হয় তা জেনে তুমি কি করবে? তোমার বয়স অল্প, এখনও অনেক বছর বাঁচবে। জীবনটাকে তুমি উপভোগ কর। আমি তোমাকে সাহায্য করব। ধন-সম্পদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আমোদ-আহ্লাদ, যা তুমি চাইবে সব পাবে। কিন্তু তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করো না।’ কিন্তু নচিকেতা ব্রহ্মনিষ্ঠ, তাঁর মন ব্রহ্মে স্থির। নচিকেতা উত্তর দিলেন: ‘ধনরত্ন, দীর্ঘ আয়ু, আমোদ-আহ্লাদ এসব আমার দরকার নেই। ওসব আপনারই থাক। মৃত্যুর পরে মানুষের কি গতি হয় আমি শুধু সেকথাই জানতে চাই। আমি আত্মতত্ত্ব জানতে ইচ্ছুক।’

এই উপনিষদে যে ছয়জন শিক্ষার্থীর নাম করা হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই সগুণ ব্রহ্মের কথা জানতেন। এখন তাঁরা পরব্রহ্ম অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্মের কথা জানতে আগ্রহী। এইজন্য তাঁরা ঋষি পিপ্পলাদের নিকটে যাওয়া স্থির করলেন। কেননা তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, ব্রহ্ম বিষয়ে যা কিছু জানবার আছে পিপ্পলাদ তাঁদের শেখাতে পারবেন। গুরুকে ভগবান বলা হয়, কারণ তিনি নানা গুণের অধিকারী। শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী এই ছয়জন যুবক যজ্ঞের জন্য শুকনো কাঠ হাতে নিয়ে, ‘সমিৎপাণয়ঃ’, গুরুর নিকট উপস্থিত হলেন। সেই কালে যজ্ঞকর্মের জন্য গুরুর জ্বালানী কাঠের প্রয়োজন হত। গুরুর প্রতি এই অর্ঘ্যটুকু শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা, বিনয় এবং শিক্ষালাভের জন্য তীব্র আগ্রহের প্রতীক।

তান্‌ হ স ঋষিরুবাচ ভূয় এব তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া সংবৎসরং সংবৎস্যথ যথাকামং প্রশ্নান্ পৃচ্ছত যদি বিজ্ঞাস্যামঃ সর্বং হ বো বক্ষ্যাম ইতি॥২

অন্বয়: সঃ ঋষিঃ (সেই ঋষি); তান্‌ হ উবাচ (তাঁদের বললেন); ভূয়ঃ এব (পুনরায়); তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া (কৃচ্ছ্রসাধন ও সংযম অভ্যাস করে এবং শাস্ত্র ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে); সংবৎসরং সংবৎস্যথ (একবছর একত্রে বাস কর); যথাকামম্ [অতঃপর] (ইচ্ছানুযায়ী); প্রশ্নান্‌ পৃচ্ছত (প্রশ্নসমূহ জিজ্ঞাসা করো); যদি বিজ্ঞাস্যামঃ (যদি আমি জানি); সর্বং হ বঃ বক্ষ্যামঃ ইতি (আমি তোমাদের সবকিছু বলব)।

সরলার্থ: ঋষি তাঁদের বললেন: ‘আমার সঙ্গে একবছর থাক। শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে শ্রদ্ধাবান হয়ে কৃচ্ছ্রসাধন ও সংযম অভ্যাস কর। তারপরে তোমাদের যা প্রশ্ন আছে করো। আমি যথাসাধ্য উত্তর দেবার চেষ্টা করব’।

ব্যাখ্যা: পিপ্পলাদ ছিলেন সত্যদ্রষ্টা ঋষি। তিনি বুঝেছিলেন এই তরুণরা সকলেই ছাত্র হিসেবে উত্তম। কাজেই তিনি তাঁদের একবছর তাঁর সঙ্গে বাস করার নির্দেশ দিলেন। গুরুর সান্নিধ্যে থেকে শিষ্য সেই মহাপুরুষের পবিত্র জীবন কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়। তাই পিপ্পলাদ বললেন, ‘আমি জানি তোমরা ইতিপূর্বেই আত্মসংযম অভ্যাস করেছ। তবু আমার ইচ্ছা তোমরা আরও একবছর কৃচ্ছ্রসাধন কর। তারপর তোমাদের যেমন খুশী প্রশ্ন করো। আমি যথাসাধ্য উত্তর দেবার চেষ্টা করব।’

আত্মজ্ঞান দানই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোচ্চ দান। পিপ্পলাদ চেয়েছিলেন তাঁর শিষ্যরা সেই সর্বোচ্চ জ্ঞান লাভের যোগ্য অধিকারী হয়ে উঠুন। সেইজন্য তাঁদের সেখানে থেকে কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মসংযম অভ্যাস করতে বললেন; গুরু ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবান হওয়ারও নির্দেশ দিলেন। আধ্যাত্মিক জীবনে এই গুণগুলি অপরিহার্য।

অথ কবন্ধী কাত্যায়ন উপেত্য পপ্রচ্ছ। ভগবন্ কুতো হ বা ইমাঃ প্রজাঃ

প্রজায়ন্ত ইতি॥৩

অন্বয়: অথ (একবছর পরে); কাত্যায়নঃ কবন্ধী উপেত্য (কত্যপুত্র কবন্ধী [পিপ্পলাদের নিকটে] উপস্থিত হলেন); পপ্ৰচ্ছ [এবং] (জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্ (প্রভু অথবা ভগবান); ইমাঃ প্রজাঃ (এই সকল প্রাণী [যাদের আমরা চারদিকে দেখি]); কুতঃ (কোথা থেকে); বা প্রজায়ন্তে ([তারা] আসে)?

সরলার্থ: একবছর পর কত্যপুত্র কবন্ধী পিপ্পলাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘হে ভগবান, এইসব প্রাণীরা কোথা থেকে আসে?’

ব্যাখ্যা: কবন্ধী প্রথম প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলেন। পরব্রহ্মের (পরম সত্য) কথা জানার জন্যই তরুণরা পিপ্পলাদের কাছে এসেছিলেন। কবন্ধী তাহলে জীবের (অর্থাৎ প্রাণীদের) বিষয়ে প্রশ্ন করলেন কেন? এই জগৎকে যে আমাদের সত্য বলে মনে হয় তার কারণ জগতে যা কিছু আছে সবই সেই পরব্রহ্মের প্রকাশ। সেইজন্য কবন্ধীর প্রথম প্রশ্ন এই জীবজগৎকে নিয়ে।

শিষ্যরা সগুণ ব্রহ্মের বিষয়ে জানেন। কিন্তু নির্গুণ ব্রহ্মের (পরব্রহ্ম) কথা তাঁরা কিছুই জানতেন না। সেই কারণেই কবন্ধী জগৎ বিষয়ে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে শিষ্যরা বুঝতে পারবেন এই দৃশ্যমান জগৎ অনিত্য, পরব্রহ্মই একমাত্র সত্য।

তস্মৈ স হোবাচ প্রজাকামো বৈ প্রজাপতিঃ স তপোঽতপ্যত স তপস্তত্ত্বা

স মিথুনমুৎপাদয়তে। রয়িং চ প্রাণং চেত্যেতৌ মে বহুধা প্রজাঃ

করিষ্যত ইতি॥৪

অন্বয়: সঃ (তিনি) [পিপ্পলাদ]; তস্মৈ (তাঁকে) [কবন্ধীকে]; উবাচ (বললেন); সঃ প্রজাপতিঃ (সেই তিনি [যিনি] সমস্ত প্রাণীর প্রভু); প্রজাকামঃ (সন্তান কামনা করে); সঃ তপঃ অতপ্যত (তিনি তপস্যা করলেন [অর্থাৎ তিনি বিষয়টি চিন্তা করলেন]); তপঃ তপ্ত্বা (তপস্যা সম্পূর্ণ করে [অর্থাৎ বিষয়টি সবিশেষ চিন্তা করে]); এতৌ মে বহুধা প্রজাঃ করিষ্যতঃ (এই উভয়েই আমাকে বহু সন্তান সৃষ্টিতে সাহায্য করবে); ইতি [মত্বা] (এইরকম মনে করে); রয়িং চ প্রাণং চ (চন্দ্র [অন্নের প্রতীক] এবং সূর্য [অথবা অগ্নি, ভোক্তার প্রতীক]) মিথুনম্‌ উৎপাদয়তে (এই উভয়ে উৎপাদন করবে)।

সরলার্থ: পিপ্পলাদ তাঁকে বললেন—প্রজাপতির সন্তান সৃষ্টি করার ইচ্ছে হল। সেই উদ্দেশ্যে তিনি তপস্যা শুরু করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যদি অন্ন [চন্দ্র বা রয়ি] থাকেন এবং সেই অন্ন গ্রহণ করার একজন ভোক্তা [সূর্য] থাকেন, তবে তাঁরা সম্মিলিতভাবে বহু সন্তান সৃষ্টি করতে পারবেন।

ব্যাখ্যা: প্রজাপতি শব্দটির অর্থ ‘জগতে সব কিছুর প্রভু বা পিতা’। ‘পতি’ শব্দের অর্থ ‘প্রভু’ বা ‘পিতা’ এবং ‘প্রজা’ শব্দের অর্থ ‘যা সৃষ্টি হয়েছে’, ‘যা জন্মেছে’ অথবা ‘যার অস্তিত্ব আছে’। প্রজাপতি পরম সত্য নন। যে কেউ প্রজাপতি হতে পারেন। প্রজাপতি একটি পদ। যে-কোন ব্যক্তি নিজেকে উন্নত করে এই পদ লাভ করতে পারেন। ধরা যাক, কেউ এ-জীবনে কঠোর তপস্যা করে কিছু শক্তি অর্জন করেছেন, কিন্তু ব্রহ্মকে লাভ করতে পারেননি। পরজন্মে হয়তো তিনি প্রজাপতি হলেন। তখন তাঁর মধ্যেই সমস্ত সৃষ্টির বীজ নিহিত থাকবে। প্রজাপতিকে হিরণ্যগর্ভ এবং ব্রহ্মাও বলা হয়।

হিন্দুরা নতুন নতুন ‘যুগ’ বা ‘কল্পে’র ধারণায় বিশ্বাসী। প্রতি যুগে কত কিছু আসে যায়। কিন্তু কল্পান্তে সব কিছু আবার তার উৎসে মিলিয়ে যায় অর্থাৎ বীজাকারে ফিরে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ একজন বুড়ীর উপমা দিতেন। সেই বুড়ী সব জিনিসের বীজ কুড়িয়ে একটা ঝুড়িতে সংগ্রহ করে রাখেন। সময় হলে সেগুলি মাটিতে ছড়িয়ে দেন। সেই বীজ থেকে অঙ্কুর হয়ে গাছ জন্মায়। গাছ বড় হয়, ফল দেয়, তারপর একদিন মরে যায়। কিন্তু গাছগুলি মরে যাবার আগেই বুড়ী আবার সেই গাছের বীজ কুড়িয়ে ঝুড়িতে তুলে রাখেন এবং ঠিকসময়ে আবার তা মাটিতে ছড়িয়ে দেন। সেই বীজ থেকে আবার গাছ হয়।

জীবনও এইভাবে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে—জন্ম থেকে মৃত্যু, আবার মৃত্যু থেকে জন্ম; কারণ থেকে কার্য, আবার কার্য থেকে কারণ। প্রাণের বিনাশ বলে কিছু নেই। প্রাণ সবসময় আছে, যদিও তা কারণরূপে বা বীজাকারেও থাকতে পারে।

বেদান্তমতে, সবকিছু এমনকি প্রজাপতিও ব্রহ্ম থেকে এসেছেন। কিন্তু ব্রহ্ম কিছু সৃষ্টি করেন না। ব্ৰহ্ম নির্গুণ অর্থাৎ কোন গুণ দ্বারা তাঁকে বিশেষিত করা যায় না; এবং তিনি নিরাকার অর্থাৎ তাঁর কোন রূপ নেই। সৃষ্টির কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাও তাঁর নেই। তাঁর যদি কোন আকাঙ্ক্ষা থাকত তাহলে তিনি নির্গুণ হতেন না। কাজেই প্রজাপতির স্থান ব্রহ্মের এক ধাপ নীচে।

প্রজাপতি কিভাবে সৃষ্টি করেন? হিন্দুদের ধারণা এই জগৎ কারোর সৃষ্টি নয়, প্রকাশ বা অভিব্যক্তি। কুম্ভকার যেভাবে ঘট সৃষ্টি করে সেভাবে এ জগৎ সৃষ্টি হয়নি। প্রজাপতি থেকে এই জগৎ প্রকাশিত হয় আবার প্রজাপতিতেই ফিরে যায়। কিন্তু জগৎকে প্রকাশের জন্য প্রজাপতি কোন চেষ্টা করেন না। তিনি কেবল সঙ্কল্প করেন অর্থাৎ গভীরভাবে চিন্তা করেন। তাঁর সৃষ্টির সঙ্কল্প থেকেই সূর্য ও চন্দ্র (প্রাণ এবং রয়ি), এই যুগল বস্তু প্রকাশিত হয়। চন্দ্র অর্থাৎ রয়ি হল অন্ন বা খাদ্য। আবার চন্দ্রই আর্দ্রতা। এই আর্দ্রতা গাছ এবং অন্যান্য প্রাণীদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আবার যদি অন্ন থাকে, সেই অন্নের ভোক্তাও থাকবে। সূর্য (প্রাণ) হল সেই ভোক্তা। আবার সূর্যই প্রাণ।

বেদান্তমতে প্রাণের প্রকাশ ত্রিবিধ: সূর্য, অগ্নি যা আমরা জ্বালাই (ভূতাগ্নি) এবং আর এক প্রকার অগ্নি যা আমাদের শরীরের ভেতরে আছে (অর্থাৎ জঠরাগ্নি)। এই জঠরাগ্নি আমাদের খাদ্যবস্তু হজমে এবং দেহধারণে সাহায্য করে। রয়ি (অন্ন বা চন্দ্র) এবং প্রাণ (সূর্য) পরস্পরকে ধারণ করে আছে। কিন্তু প্রাণ এবং রয়ি দুটি পৃথক বস্তু নয়; তাদের পার্থক্য শুধু নাম আর রূপে।

আদিত্যো হ বৈ প্রাণো রয়িরেব চন্দ্রমা রয়ির্বা এতৎ সর্বং যন্মূর্তং চামূর্তং

চ তস্মান্মূর্তিরেব রয়িঃ॥৫

অন্বয়: আদিত্যঃ হ বৈ প্রাণঃ (আদিত্য-ই [সূর্য] প্রাণ); রয়িঃ এব চন্দ্রমা (খাদ্য হল চন্দ্র); যৎ মূর্তম্‌ অমূর্তং চ (যা কিছু স্থূল [অর্থাৎ কার্য] অথবা সূক্ষ্ম [অর্থাৎ কারণ]); এতৎ বৈ সর্বং রয়িঃ (এই সবই খাদ্য [অর্থাৎ কার্য]); তস্মাৎ মূর্তিঃ রয়িঃ এব (অতএব স্থূলই খাদ্য [কার্য])।

সরলার্থ: আদিত্যই (সূর্যই) প্রাণ; চন্দ্রই রয়ি অর্থাৎ অন্ন। স্থূল বা সূক্ষ্ম উভয়ই খাদ্য। খাদ্য (কার্য) ও খাদ্যের ভোক্তার (কারণ) মধ্যে যা পার্থক্য, স্থূল ও সূক্ষ্মের মধ্যে সেই একই পার্থক্য।

ব্যাখ্যা: এখানে উপনিষদের বক্তব্য হল—জগতে দুটি বস্তু আছে। আসলে বস্তু এক, কিন্তু কোন ভাবে এই এক ভাগ হয়ে দুই হয়েছে—একজন ভোক্তা বা প্রাণ এবং অপরটি খাদ্য বা জড়পদার্থ। সূর্যই প্রাণ। প্রাণ থাকলে সেই প্রাণকে ধারণ করার জন্য অন্নও থাকবে। রয়ি বা চন্দ্রই হল সেই অন্ন। আপাতদৃষ্টিতে প্রাণ আর রয়ি দুই হলেও বস্তুত তারা এক, আলাদা নয়।

কার্য ও কারণের মধ্যে যে সম্পর্ক জগতে সব যুগলবস্তুর মধ্যেই সেই সম্পর্ক বিদ্যমান। কারণ সূক্ষ্ম এবং কার্য স্থূল। বেদান্তমতে, কারণ অধিকাংশ সময়েই নিরাকার অর্থাৎ ‘অমূর্ত’। তাকে দেখা যায় না। কিন্তু কার্যকে দেখা যায় এবং তার রূপ আছে অর্থাৎ ‘মূর্ত’।

অবশ্য কার্য ও কারণ এবং অন্ন ও অন্নভোক্তা পরস্পর সম্পর্ক বিনিময় করতে পারে। এ যে সম্ভব হয় তার কারণ তারা এক এবং অভিন্ন।

অথাদিত্য উদয়ন্যৎপ্রাচীং দিশং প্রবিশতি তেন প্রাচ্যান্‌ প্রাণান্ রশ্মিষু

সন্নিধত্তে। যদ্দক্ষিণাং যৎ প্রতীচীং যদুদীচীং যদধো যদূর্ধ্বং যদন্তরা দিশো

যৎ সর্বং প্রকাশয়তি তেন সর্বান্ প্রাণান্ রশ্মিষু সন্নিধত্তে॥৬

অন্বয়: অথ (যেমন); আদিত্যঃ (সূর্য); উদয়ন্‌ (উদিত হয়ে); যৎ প্রাচীং দিশং প্রবিশতি (যেমন পূর্ব দিকে প্রবেশ করেন); তেন প্রাচ্যান্‌ প্রাণান্ রশ্মিষু সন্নিধত্তে (তিনি নিজ কিরণের দ্বারা পূর্ব দিকে অবস্থিত সমস্ত প্রাণীকে প্রাণ দান করেন); যৎ দক্ষিণাম্‌ (যেমন দক্ষিণে); যৎ প্রতীচীম্ (পশ্চিমে); যৎ উদীচীম্ (উত্তরে [ভ্রমণ করেন]); যৎ অধঃ (নীচে); যৎ ঊর্ধ্বম্ (ঊর্ধ্বে); যৎ অন্তরা দিশঃ (দিকসমূহের মধ্যভাগে); যৎ সর্বং প্ৰকাশয়তি (অন্য সকলকে আলো দেন); তেন সর্বান্‌ প্রাণান্‌ রশ্মিষু সন্নিধত্তে (নিজের আলোয় সকল প্রাণীকে আলিঙ্গন করেন)।

সরলার্থ: (ভোরবেলা) সূর্য উঠে পূর্বদিগন্তে প্রবেশ করে। তখন পূর্বদিকের সকল প্রকার প্রাণীকে সে আপন কিরণে আলিঙ্গন করে। একইভাবে দক্ষিণ, উত্তর, উপর, নীচ এবং অন্তর্বর্তী দিকসমূহ—সর্বত্র সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়ে। এইভাবে সকল প্রাণীকে সূর্যই প্রকাশ করে, সঞ্জীবিত করে।

ব্যাখ্যা: সূর্যকে প্রাণের তথা সমস্ত কিছুর উৎস বলা হয়। আর প্রাণকে ধারণ করে থাকে চন্দ্র। রাত্রে আমরা সবাই ঘুমিয়ে থাকি, কোন কাজ করি না—যেন সবাই অচৈতন্য হয়ে থাকি। কিন্তু যে মুহূর্তে সূর্য উঠে দিনের সূচনা করে, আবার সর্বত্র প্রাণের স্পন্দন দেখা যায়। সবাই জেগে ওঠে, চলেফিরে বেড়ায়, কাজকর্ম শুরু করে। সূর্যই যেন তার কিরণ ছড়িয়ে সবকিছুকে চেতন করে। সূর্য সকলকে, সব প্রাণীকে আলো দেয়—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, উপর, নীচ সর্বত্র। সূর্যালোক সর্বব্যাপী। যা কিছু আমরা দেখি সবার মধ্য দিয়েই সূর্য নিজেকে প্রকাশ করে।

স এষ বৈশ্বানরো বিশ্বরূপঃ প্রাণোঽগ্নিরুদয়তে। তদেতদৃচাঽভ্যুক্তম্‌॥৭

অন্বয়: সঃ এষঃ বৈশ্বানরঃ বিশ্বরূপঃ (তিনি সকল প্রাণীর অন্তরে নিহিত [সেই কারণে তাঁকে বলা হয় বৈশ্বানর], এবং এ জগতের সব রূপ তাঁরই রূপ [তাই তাঁকে বলা হয় বিশ্বরূপ]); প্রাণঃ অগ্নিঃ (তিনি প্রাণরূপী অগ্নি); উদয়তে (তিনি [দিগন্তে আদিত্য তথা সূর্যরূপে] উদিত হন), তৎ এতৎ ঋচা অভ্যুক্তম্‌ (একথাই ঋক্‌-মন্ত্রে বলা হয়েছে)।

সরলার্থ: সূর্য উদয় হচ্ছেন—সেই সূর্য যিনি সকল জীবের অন্তরাত্মা; সব রূপই তাঁর রূপ। সূর্য একই সঙ্গে প্রাণ এবং অগ্নি দুই-ই অর্থাৎ একই সঙ্গে তিনি সব কিছু গ্রহণ করেন এবং প্রকাশ করেন। একটি ঋক্‌-মন্ত্রে একথাই বলা হয়েছে।

ব্যাখ্যা: এখানে সূর্যকে ‘বৈশ্বানর’, ‘বিশ্বরূপ’, ‘প্রাণ’, এবং ‘অগ্নি’ বলা হয়েছে। ‘প্রাণঃ বৈশ্বানরঃ’—সূর্যকে (প্রাণকে) সকল জীবের সঙ্গে অভিন্ন ভাবে দেখানো হয়েছে। ‘নর’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ মানুষ। কিন্তু এখানে শব্দটিকে প্রাণী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাণীরূপে সূর্যকে বৈশ্বানর বলা হয়। সূর্যই যেন সব প্রাণী হয়েছেন। সূর্যকে আবার বিশ্বরূপও বলা হয় অর্থাৎ জগতে সব রূপই তাঁর রূপ।

উপনিষদ আরো বলেছেন—প্রাণই অগ্নি। সূর্যের তেজ ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। খাদ্য পরিপাক করে দেহকে সজীব রাখার জন্য আমাদের মধ্যেও এই অগ্নি থাকা প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি অজীর্ণরোগে আক্রান্ত হলে, আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বলা হয় তার অগ্নিমান্দ্য হয়েছে অর্থাৎ আগুনের তেজ দুর্বল হয়েছে। আমরা এও জানি মানুষের মৃত্যু হলে তার দেহ শীতল হয়ে যায়। অতএব দেহের উত্তাপ হল জীবনের লক্ষণ। আবার দেহরক্ষার জন্য আমরা যে খাদ্যদ্রব্য রান্না করি তার জন্যও প্রয়োজন অগ্নি। উপনিষদ বলেন—প্রাণই সূর্য, প্রাণই অগ্নি অর্থাৎ দেহের বাইরের ও ভিতরের আগুন দুই-ই প্রাণ। যখন প্রাণকে সূর্যরূপে দেখি তখন তা আধিদৈবিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক। যখন প্রাণ অগ্নিরূপে আছেন তখন আধিভৌতিক অর্থাৎ পদার্থগত। আবার যখন প্রাণই জীবন তখন আধ্যাত্মিক অর্থাৎ জীব-সম্পর্কিত। প্রাণই আয়ু আবার প্রাণই অগ্নি কারণ প্রাণ সবকিছুকে প্রকাশ করেন আবার গ্রহণও করেন।

বিশ্বরূপং হরিণং জাতবেদসং

পরায়ণং জ্যোতিরেকং তপন্তম্‌।

সহস্ররশ্মিঃ শতধা বর্তমানঃ

প্রাণঃ প্রজানামুদয়ত্যেষ সূর্যঃ॥৮

অন্বয়: বিশ্বরূপম্ (সমস্ত রূপ); হরিণম্ (উজ্জ্বল); জাতবেদসম্ (সর্বজ্ঞ); পরায়ণম্‌ (সকলের আশ্রয়); একং জ্যোতিঃ (একমাত্র আলো); তপন্তম্ (যিনি উত্তাপ দেন); সহস্ররশ্মিঃ (সহস্ৰকিরণে); শতধা বর্তমানঃ (শতরূপে বিদ্যমান); প্রজানাং প্রাণঃ (প্রাণিকুলের প্রাণ); এষঃ সূর্যঃ উদয়তি (এই সূর্য উঠছেন)।

সরলার্থ: সহস্র কিরণ নিয়ে সূর্য উদিত হচ্ছেন। নানারূপে তাঁর প্রকাশ। তিনিই প্রাণিকুলের প্রাণস্বরূপ। পণ্ডিতেরা বলেন, এই সূর্য সর্বত্র ও সকল রূপের মধ্যে রয়েছেন; তিনি সদা উজ্জ্বল, সর্বজ্ঞ, এবং সকলের আশ্রয়। তিনিই আলোর একমাত্র উৎস ও সকলকে তাপ দেন।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ এখানে ঋগ্‌-বেদ থেকে সূর্যের একটি প্রশস্তি মন্ত্র উল্লেখ করেছেন। ‘বিশ্বরূপম্‌’-সূর্য সব রূপের মধ্যে রয়েছেন। আমরা যত রূপ দেখি সব রূপই তাঁর রূপ। ‘হরিণম্‌’ শব্দের অর্থ এখানে ‘উজ্জ্বল’ ‘জ্যোতির্ময়’ ‘কিরণশালী’।

‘জাতবেদসম্’ অর্থ ‘সর্বজ্ঞ’, ‘যিনি সবকিছু জানেন’। জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে অনেক সময় আলো অথবা আগুনের উল্লেখ করা হয়। আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, তেমনি জ্ঞানও অজ্ঞানতা দূর করে। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’—আমাদের অন্ধকার থেকে আলোতে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানে নিয়ে চল। ‘তমঃ’ অর্থ অন্ধকার, অজ্ঞানতার অন্ধকার। অজ্ঞান হলে আমাদের পক্ষে কিছুই ধারণা করা সম্ভব হয় না; আমরা কিছুই জানি না। কাজেই আমাদের লক্ষ্য হল জ্ঞান।

গায়ত্রী মন্ত্রকে কোথাও কোথাও বেদের সার বলা হয়েছে, কারণ এই মন্ত্রে জ্ঞানের প্রতীক সূর্যের কাছে প্রার্থনা করা হয়। ‘ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যম্‌ ভর্গো দেবস্য ধীমহি’—যেই দেবতার প্রতীক সূর্য, যিনি সবকিছুর স্রষ্টা আমরা তাঁর উপাসনা করি। ‘ধীয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ’—অনুগ্রহ করে তিনি আমাদের বুদ্ধিকে চালিত করুন। আমরা যাতে বিপথে না চলি, আমাদের লক্ষ্য ভুলে না যাই—সেই জ্ঞানই আমরা প্রার্থনা করি। আমরা প্রত্যেকে জ্ঞান লাভ করতে চাই। জ্ঞান ছাড়া আমরা অন্ধ, অসহায়, যেন অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি। জ্ঞানই শক্তি, আর আত্মজ্ঞান হল মহত্তম শক্তি।

‘পরায়ণম্‌’—সূর্যকে সবকিছুর অধিষ্ঠান বা আশ্রয় বলা হয়ে থাকে। তিনি সবকিছুকে ধারণ করে আছেন। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। উপনিষদে প্রায়ই ‘একম্‌’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এখানে ‘একম্‌’ শব্দের অর্থ অনন্য। সূর্য আমাদের কাছে অনন্য, অতুলনীয়।

‘তপন্তম্‌’—যিনি তাপ দেন। ‘তপঃ’ শব্দটি কৃচ্ছ্রসাধন বা কঠোর শ্রম বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়। সেই পরম সত্যকে জানবার জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম এবং কৃচ্ছ্রসাধন। আর এই তপস্যার জন্য আমরা বল ও শক্তি দুই-ই লাভ করি সূর্যের থেকে।

‘সহস্ররশ্মিঃ’—অর্থাৎ সহস্ৰকিরণ। সূর্যকিরণ কখনও নিঃশেষিত হয় না; সূর্য সবসময় আলো দেন। জ্ঞানও এই সূর্যালোকের মতোই অনন্ত।

‘শতধা বর্তমানঃ’—নানাভাবে নানারূপে সূর্য সবসময় রয়েছেন, সবার মধ্যে রয়েছেন।

‘প্ৰজানাং প্রাণঃ’—সূর্য সকল জীবের প্রাণস্বরূপ। অর্থাৎ প্রাণীরা সূর্য থেকেই জীবন ও পুষ্টি লাভ করে।

যখন আমরা নিজেকে সূর্যরূপে জানতে পারি, যখন বুঝতে পারি প্রকৃত আলোর উৎস আমার নিজের মধ্যেই রয়েছে তখনই আমরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করি।

সংবৎসরো বৈ প্রজাপতিস্তস্যায়নে দক্ষিণং চোত্তরং চ। তদ্যে হ বৈ

তদিষ্ঠাপূর্তে কৃতমিত্যুপাসতে তে চান্দ্রমসমেব পোকমভিজয়ন্তে। ত

এব পুনরাবর্তন্তে তস্মাদেত ঋষয়ঃ প্ৰজাকামা দক্ষিণং প্রতিপদ্যন্তে।

এষ হ বৈ রয়িৰ্যঃ পিতৃযাণঃ॥৯

অন্বয়: সংবৎসরঃ বৈ প্রজাপতিঃ (প্রাণিকুলের প্রভুই সংবৎসর); তস্য দক্ষিণং চ উত্তরং চ অয়নে (তিনি দক্ষিণ এবং উত্তর, এই দুই পথে যাওয়া আসা করেন); তৎ (সেই কারণে); যে হ বৈ (যাঁরা); ইষ্টাপূর্তে ইতি (বিধিমতে বৈদিক যাগযজ্ঞ [ইষ্ট] এবং লোকহিতকর কর্ম [পূর্ত] যেমন কূপ খনন ইত্যাদি); কৃতং তৎ (‘এসব আমার করা হয়েছে’); উপাসতে (তিনি সবসময় এই প্রকার কর্মরত [এবং তিনি সর্বদা সচেতন যে তিনি এইসব কর্ম করছেন]); তে চান্দ্রমসম্‌ এব লোকম্‌ অভিজয়ন্তে (এরকম ব্যক্তি চন্দ্রলোক লাভ করেন); তে পুনঃ আবর্তন্তে এব (তাঁরা এই জগতে [মর্তে] আবার ফিরে আসেন); তস্মাৎ (সেই কারণে); এতে প্ৰজাকামাঃ ঋষয়ঃ (এই ঋষিগণ যাঁরা কোন ফললাভের আশায় [যেমন সন্তান কামনায়] বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান করেন); দক্ষিণং প্রতিপদ্যন্তে (দক্ষিণদিকে গমন করেন); যঃ পিতৃযানঃ (পিতৃলোকের পথ); এষঃ হ বৈ রয়িঃ (এই হল চন্দ্র [খাদ্য])।

সরলার্থ: প্রজাপতি স্বয়ং সংবৎসর; তিনিই সৃষ্টিকর্তা। দুই পথে তাঁর আসা-যাওয়া—দক্ষিণ এবং উত্তর। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান এবং লোকহিতকর কর্মে সবসময় ব্যস্ত। তাঁরা এ ধরনের কর্ম করতে গর্ব বোধ করেন। মৃত্যুর পর এই শ্রেণীর মানুষ চন্দ্রলোকে যান। কিন্তু তা কিছুদিনের জন্য। আবার তাঁদের এই মর্তজগতে ফিরে আসতে হয়। সেইজন্যই সন্তান কামনায় যাঁরা যাগযজ্ঞ করেন তাঁরা দক্ষিণপথে যান। এই পথ পিতৃলোকের পথ, এই পথই রয়ি।

ব্যাখ্যা: সাধারণভাবে মানুষকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণীর মানুষের কাছে জীবনের অর্থ গভীর। তাঁরা জ্ঞানলাভ করতে চান। জানতে চান সত্য কি, মানুষের স্বরূপ কি, এবং কোথা থেকে তাঁরা এসেছেন। এই শ্রেণীর মানুষ আত্মসংযম অভ্যাস করেন, ঈশ্বরচিন্তা করেন এবং নানা গুণাবলী আয়ত্ত করার চেষ্টা করেন। আবার অপর শ্রেণীর লোকদের ধারণা মানবজীবন শুধুই ভোগের জন্য। তাঁরা কেবলমাত্র ভোগেই মত্ত থাকতে চান। কিন্তু একসময় তাঁরা বুঝতে পারেন তাঁদেরও মৃত্যু অনিবার্য। যদি ভাল কাজ করে সাধুজীবন যাপন করতে পারেন, তাহলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হবে এবং সেখানেও সুখভোগ করতে পারবেন।

এই দুই শ্রেণীর মানুষ একই ধরনের কাজ করতে পারেন, কিন্তু দুয়ের মধ্যে পার্থক্যটা একেবারে গোড়ায়। যিনি জ্ঞানলাভ করতে চান, জাগতিক ভোগসুখকে তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করেন। কিন্তু যাঁরা বিষয়সুখে আসক্ত তাঁদের জ্ঞানলাভের ইচ্ছাই হয় না। বিষয়ী মানুষ সৎকর্ম করলেও তা করেন ইহকাল বা পরকালে কিছু পুরস্কার লাভের আশায় (সকাম কর্ম)।

যিনি প্রকৃতই আত্মজ্ঞান লাভ করতে চান, কোন অনিত্য বস্তু তাঁকে তৃপ্ত করতে পারে না। নিত্যকে লাভ করাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। নিজের জন্য কোনরকম ফলের আশা না করে তিনি সব কর্ম করেন। যা কিছু তিনি করেন তা ঈশ্বরার্থ অর্থাৎ ঈশ্বরের উদ্দেশে অথবা লোকহিতার্থ অর্থাৎ লোককল্যাণের জন্য। তাঁর কাছে কর্মই উপাসনা। সমাজ তাঁকে স্বীকৃতি দিল কিনা, সংবাদপত্রে তাঁর নাম বেরোল কিনা, ঈশ্বর তাঁকে পুরস্কার দেবেন কিনা এসব নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত নন। তিনি ভাল কাজ করেন কারণ তিনি ভাল কাজ করতে ভালবাসেন।

অতএব উপনিষদ বলেন—যেমন এই দুই শ্রেণীর মানুষ আছেন তেমনি পথও দুটি। একটি দক্ষিণায়ন, অপরটি উত্তরায়ণ। সূর্য যখন দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে তখন দক্ষিণায়ন। একে চন্দ্রের পথও বলা হয়। আর সূর্য যখন উত্তর গোলার্ধে তখন তাকে বলে উত্তরায়ণ। এই পথ সূর্যের পথ। এখন উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন, এই যে দুভাগ করা হয়েছে এসবই রূপক অর্থে। উপনিষদে বলা হয়েছে—সময়ের এই যে বিভাগ তাও প্রজাপতি।

যাঁরা জ্ঞানলাভে ইচ্ছুক তাঁদের সূর্যের পথ অর্থাৎ জ্ঞানের পথই গ্রহণ করতে হবে। আলো জ্ঞানের প্রতীক। কাজেই প্রথম শ্রেণীর মানুষ যাঁরা জ্ঞানের পথে চলেন তাঁরা মৃত্যুর পর সেই জ্যোতির্লোকে যান বলে বিশ্বাস। কিন্তু যাঁরা ভোগবিলাসী, তাঁরা উপনিষদের মতে, চন্দ্রের পথ অনুসরণ করেন। চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই। তাই তাকে অন্ধকারের প্রতীক বলে ধরা হয়।

অধিকাংশ মানুষই চন্দ্রের পথ বেছে নেন কারণ তাঁরা ভোগে আসক্ত। উপনিষদ বলেন—এঁরা দুরকমের কাজ করেন, ইষ্ট এবং পূর্ত। ইষ্ট অর্থ দৈনন্দিন অবশ্যকর্তব্য যেমন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ যা প্রাচীনকালে অনুষ্ঠিত হত এবং অতিথি সৎকার ও পশুপাখীর সেবা। সৎ হওয়ার চেষ্টাও এ জাতীয় কর্মের মধ্যেই পড়ে। আর ‘পূর্ত’ অর্থ লোককল্যাণের জন্য বিশেষ সেবাকর্মের অনুষ্ঠান যেমন কুয়ো বা পুকুর খনন, মন্দির নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ বা দরিদ্রকে বিনামূল্যে অন্নবিতরণের জন্য রন্ধনশালার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

এসব কর্ম অতি উত্তম সন্দেহ নেই। যাঁরা তা করেন তাঁদের উপনিষদ ঋষি আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে এ জাতীয় কর্ম করা অত্যন্ত কঠিন। প্রথমে মানুষের মধ্যে একটা গর্ববোধ আসে, ‘আমি এতসব কাজ করেছি’। অর্থাৎ মানুষ নামযশের আকাঙ্ক্ষা করে। এছাড়া সে নিজেকে কোন বিশেষ পুরস্কার যেমন সন্তান, বা ধনসম্পদ বা পরকালে স্বর্গলাভ ইত্যাদি পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করে।

তখন কি হয়? এই ব্যক্তি মৃত্যুর পরে চন্দ্রের পথ অনুসরণ করে। আগেই বলা হয়েছে চন্দ্রই অন্ন; চন্দ্র প্রাণকে ধারণ করে রাখে। চন্দ্র ভোগের প্রতীক। কাজেই মানুষ যখন চন্দ্রের পথ বা ‘দক্ষিণ’পথ অনুসরণ করে তখন সে পিতৃলোক বা চন্দ্রলোকে যায়। এই পথ অন্ধকারের পথ, অবিদ্যার পথ। সেখানে মানুষের কিছুদিন সুখভোগ হয় ঠিকই, কিন্তু তাকে আবার ফিরে আসতে হয়। পুণ্যকর্মের পুরস্কারও ক্ষণস্থায়ী। ভাল কাজের ফল যখন নিঃশেষ হয়ে আসে তখন এই পৃথিবীতে তাকে আবার ফিরে আসতে হয়।

অথোত্তরেণ তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া

বিদ্যায়াঽঽত্মানমম্বিষ্যাদিত্যমভিজয়ন্তে।

এতদ্বৈ প্রাণানামায়তনমেতদমৃতমভয়মেতৎ

পরায়ণমেতস্মান্ন পুনরাবর্তন্ত ইত্যেষ নিরোধস্তদেষ শ্লোকঃ॥১০

অন্বয়: অথ (কিন্তু [অনেকে আছেন যাঁরা]); তপসা ব্রহ্মচর্যেণ (কৃচ্ছ্রসাধন এবং আত্মসংযম অভ্যাসের দ্বারা); শ্রদ্ধয়া ([গুরু এবং শাস্ত্রের প্রতি] বিশ্বাসের দ্বারা); বিদ্যয়া (শাস্ত্র অধ্যয়ন করে); আত্মানম্ অন্বিষ্য (আত্মাকে জানতে চেয়ে); উত্তরেণ [মার্গেন] (উত্তরপথ অনুসরণ করে); আদিত্যম্ অভিজয়ন্তে (সম্পূর্ণভাবে আদিত্যের পদ লাভ করে); এতৎ বৈ প্রাণানাম্ আয়তনম্‌ (ইনি সকল প্রাণের আশ্রয়); এতৎ অমৃতম্ অভয়ম্ (ইনি, অমৃত, অভয়); এতৎ পরায়ণম্ (সর্বোত্তম অবস্থা লাভ করে); এতস্মাৎ ন পুনঃ আবর্তন্তে (মর্তে আর ফিরে আসতে হয় না); এষঃ নিরোধঃ (এই হল [যাত্রার] শেষ); তৎ এষঃ শ্লোকঃ ([সেই বিষয়ে] এই শ্লোক আছে)।

সরলার্থ: কিন্তু এমন অনেকে আছেন যাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মসংযম অভ্যাস করেন এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। শাস্ত্রে ও গুরুবাক্যে তাঁদের অগাধ বিশ্বাস। এইসকল গুণের অধিকারী হয়ে তাঁরা আত্মার অনুসন্ধান করেন। এই আত্মাই হলেন সূর্য। মৃত্যুর পরে এইসব মানুষ উত্তরমার্গ অনুসরণ করেন এবং কালে আদিত্যপদ লাভ করেন। আদিত্য সকল প্রাণীর আশ্রয়। আদিত্যপদ প্রাপ্ত হলে মানুষ অমর হয়, অভয়পদ লাভ করে। এই হল মানুষের সর্বোত্তম অবস্থা। একবার এই অবস্থা লাভ হলে কেউ আর এই মর্তজগতে ফিরে আসে না। এখানেই যাত্রা শেষ। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: ‘আত্মানম্ অন্বিষ্য’—‘আত্মাকে জানতে চেয়ে’। আমরা প্রত্যেকেই বলি ‘আমি’ ‘আমি’। কিন্তু এই ‘আমি’টি কে? এর দ্বারা কাকে বোঝান হয়? এই জগতের সব কিছু হয়তো আমরা জানি, কিন্তু নিজেকে জানি না। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা শুধু আত্মাকেই জানতে চান। তাঁরা সত্যের অনুসন্ধান করে চলেছেন। অবিনাশী বা চিরন্তন কিছু আছে কি না তা-ই তাদের জিজ্ঞাসা। ভোগের ইচ্ছা তাঁদের নেই, শুধু জ্ঞানলাভই উদ্দেশ্য।

প্রশ্ন হল, কি উপায়ে আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব? উপনিষদ বলেন, ‘তপস্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনার দ্বারা’। বুদ্ধের জীবন কৃচ্ছ্রসাধনা এবং দৃঢ়সঙ্কল্পের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। বহু বছর গভীর ধ্যান-চিন্তা অভ্যাস করার পর তিনি একটি গাছতলায় বসে শপথ নিলেন, ‘আমার দেহ শুকিয়ে যাক, চামড়া খসে পড়ুক, তথাপি যতদিন সেই দুঃসাধ্য বোধিলাভ না হয় এই আসন ত্যাগ করব না।’

উপনিষদ বলেন, যিনি আত্মাকে জানতে চান তাঁকে ব্রহ্মচর্য, মিতাচার এবং আত্মসংযম অবশ্য পালন করতে হবে। এর সঙ্গে অপরিহার্য হল গুরুবাক্য ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। সাধক যদি এগুলিকে অস্বীকার করেন তাহলে তাঁর পক্ষে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।

সূর্য যেহেতু জ্ঞানের প্রতীক, যাঁরা জ্ঞানের পূজারী তাঁরা মৃত্যুর পরে সূর্যের পথ অনুসরণ করেন। ‘এতৎ বৈ প্রাণানাম্ আয়তনম্‌’—সূর্যই প্রাণীদের আশ্রয়। তিনি অমৃত, অবিনাশী এবং নিত্য। চাঁদ কিন্তু সবসময় বদলাচ্ছে। একদিন পূর্ণচন্দ্র, তারপর দিনে দিনে ছোট হতে থাকে। কিন্তু সূর্যের কোন ক্ষয়-বৃদ্ধি নেই, সবসময় একরকম।

‘অভয়ম্‌’ অর্থাৎ ‘ভয়কে অতিক্রম করা’। আমরা যদি মৃত্যুর অধীন হই তবে মৃত্যুভয় সবসময় আমাদের তাড়া করে বেড়াবে। কিন্তু যদি জানি, ‘আমি দেহ নই, আত্মা যা শাশ্বত এবং অমর’—তখন বুঝতে পারি আমার মৃত্যু হতে পারে না। তখনই আমরা সম্পূর্ণ নির্ভয় হই।

তখন ‘পরায়ণম্‌’ অর্থাৎ পরাগতি বা ব্রহ্মলোক লাভ হয়। ‘এতস্মাৎ ন পুনঃ আবর্তন্তে’—সেখান থেকে আর কখনও ফিরে আসতে হয় না। একেই বলে মোক্ষলাভ।

সুতরাং উপনিষদ বলেন—আমরা কি চাই এবং আমাদের উদ্দেশ্য কি সে সম্পর্কে নিজেদের মনে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। আমরা কি করছি এবং কেন করছি সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই হবে আধ্যাত্মিক অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের পূজা করছি’ এই বুদ্ধিতে সব কাজ করতে হবে। এভাবেই আমরা আমাদের চরম লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারি। উপনিষদ আমাদের ধীরে ধীরে সেই লক্ষ্যের দিকে চালনা করছেন।

পঞ্চপাদং পিতরং দ্বাদশাকৃতিং

দিব আহুঃ পরে অর্ষে পুরীষিণম্।

অথেমে অন্য উ পরে বিচক্ষণং

সপ্তচক্রে ষড়র আহুরর্পিতমিতি॥১১

অন্বয়: [যাঁরা ত্রিকালকে জানেন তাঁরা আদিত্যের বর্ণনায় বলেছেন যে তাঁর] পঞ্চপাদম্ (পাঁচটি পা [ঋতু]); দ্বাদশাকৃতিম্ (বারটি আকৃতি [বার মাস]); দিবঃ পরে অর্ধে (স্বর্গ ও মর্তের মধ্যবর্তী স্থানের ঊর্ধ্বে [অবস্থিত]); পুরীষিণম্ (জল বর্ষণ করে); পিতরম্ আহুঃ ([তাঁরা] তাঁকে পিতা বলেন [কারণ তিনি জগতের স্রষ্টা]); অথ উ (অপরপক্ষে); অন্যে ইমে পরে (অন্যরা [পণ্ডিতেরা বলেন]); বিচক্ষণম্‌ (সর্বজ্ঞ [আদিত্য যিনি রথ চালনা করেন]); সপ্তচক্রে (সপ্তচক্রবিশিষ্ট রথ); ষড়রে ([প্রতি চক্রে] ছয়টি শলাকা সহ); অর্পিতম্‌ ইতি আহুঃ (এই জগৎ প্রতিষ্ঠিত বলা হয়)।

সরলার্থ: পণ্ডিতেরা বলেন, আদিত্যের পাঁচটি ঋতু এবং বারটি মাস আছে। তিনি সকলের পিতা, স্বর্গে থাকেন এবং তিনিই বৃষ্টির কারণ। আরেক দল পণ্ডিতের মতে, সেই আদিত্য সর্বজ্ঞ এবং তিনি একটি সপ্তচক্রবিশিষ্ট রথ চালনা করেন। সেই চক্রের প্রতিটি আবার ছয়টি শলাকার সঙ্গে সংযুক্ত। এই আদিত্যেই সমগ্র জগৎ প্রতিষ্ঠিত।

ব্যাখ্যা: সূর্যের উদ্দেশে উপনিষদ ঋগ্বেদ থেকে আর একটি প্রশস্তি মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। এই মন্ত্রে রূপকের সাহায্যে আদিত্যকে বর্ণনা করা হয়েছে। আদিত্য এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, জগৎকে ধারণ করে আছেন। ‘পঞ্চপাদম্‌’—এর আক্ষরিক অর্থ পাঁচটি পা। এখানে পাঁচ ঋতু বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষে সাধারণত ছয়টি ঋতুর কথা বলা হয়। কিন্তু এই শ্লোকে হেমন্ত, শিশির অর্থাৎ শরতের শেষভাগ যা স্বল্পকাল স্থায়ী এবং শীতকে একত্র করে একটি ঋতু ধরা হয়েছে। ‘দ্বাদশাকৃতিম্‌’ অর্থ বছরের বারটি মাস।

‘দিবঃ’ অর্থ স্বর্গ এবং মর্তের মধ্যবর্তী আকাশ, তারও উপরে ‘দিবঃ পরে অর্ধে’, অর্থাৎ যেখানে সূর্য জলকে আকর্ষণ করে নেয়। জল একবার উপরে স্বর্গলোক পর্যন্ত যায়, আবার বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। মনে হয় যেন সূর্য থেকেই বর্ষণ হচ্ছে।

‘সপ্তচক্র’ অর্থ সাতটি চাকা। কখনও কখনও সূর্যকে দেবতারূপে কল্পনা করা হয়; সপ্তচক্রবিশিষ্ট রথে তিনি বসে আছেন। সাতটি চাকার তাৎপর্য হল আলোর সাতটি রঙ। ‘ষড়র’ কথাটির অর্থ চাকার ছয়টি শলাকা যা ছয়টি ঋতুর প্রতীক। এখানে ছয়টি ঋতুকে স্বীকার করা হয়েছে। ‘অর্পিতম্‌’—এই সবকিছু সূর্যে প্রতিষ্ঠিত।

প্রশ্ন হল, আমরা যে সময়ের কথা বলি সেই ‘সময়’ বলতে আমরা কি বুঝি? একটি বছর, একটি মাস, একটি ঋতু, দিন ও রাত্রি সকলেরই সম্বন্ধ সূর্যের সঙ্গে। আমাদের সময়বোধ সূর্য থেকেই আসে। কিন্তু সময়ের এইসব বিভাগের উৎস একই—তিনি প্রজাপতি।

মাসো বৈ প্রজাপতিস্তস্য কৃষ্ণপক্ষ এব রয়িঃ শুক্লঃ প্রাণস্তস্মাদেত

ঋষয়ঃ শুক্ল ইষ্টং কুর্বন্তীতর ইতরস্মিন্‌॥১২

অন্বয়: মাসঃ বৈ প্রজাপতিঃ (মাসও প্রজাপতি); তস্য কৃষ্ণপক্ষঃ এব রয়িঃ (এর মধ্যে কৃষ্ণপক্ষ অন্ন); শুক্লঃ প্রাণঃ (শুক্লপক্ষ প্রাণ); তস্মাৎ (এই কারণে); এতে ঋষয়ঃ (ঋষিগণ); শুক্লে ইষ্টং কুর্বন্তি (শুক্লপক্ষে তাঁদের ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠান করেন); ইতরে (অন্যরা); ইতরস্মিন্ (অন্যপক্ষে [অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষে])।

সরলার্থ: বৎসরের মতো মাসও প্রজাপতির প্রতীক। কৃষ্ণপক্ষ তাঁর অন্ন (চন্দ্র), শুক্লপক্ষ তাঁর প্রাণ (আদিত্য যিনি সেই অন্ন গ্রহণ করেন)। এই কারণেই ঋষিরা, যাঁরা প্রাণ অনুসন্ধান করছেন তাঁরা শুক্লপক্ষে বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান করে থাকেন। অন্যরা সেইসব অনুষ্ঠান কৃষ্ণপক্ষেই করেন।

ব্যাখ্যা: সমগ্র পৃথিবী প্রজাপতিকে আশ্রয় করে আছে। এর আগে প্রজাপতিকে বৎসর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু যদি প্রজাপতিকে একটি মাস হিসেবে ধরা হয় তবু প্রজাপতি প্রজাপতিই থাকেন। প্রজাপতির দুটি ভাগ—প্রাণ (জীবন) এবং রয়ি (অন্ন)। তেমনি মাসেরও দুটি ভাগ—শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ।

যাঁরা যাগযজ্ঞ করেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মজ্ঞান লাভ করতে চান। তাঁরা এইসব আচার-অনুষ্ঠান শুক্লপক্ষে করা পছন্দ করেন। অন্যরা যাঁরা স্বর্গকামনা করেন অথবা যাঁদের অন্য কোন বাসনা আছে তাঁরা এইসব অনুষ্ঠান করার জন্য কৃষ্ণপক্ষকেই বেছে নেন।

বস্তুত যার যেমন ভাব, সে সেইভাবে যজ্ঞকর্মের উপযুক্ত সময় বেছে নেয়। ইন্দ্রিয়সুখই যাঁর উদ্দেশ্য তাঁর কাছে শুক্লপক্ষই কৃষ্ণপক্ষ হয়ে ওঠে। আবার আত্মজ্ঞান লক্ষ্য হলে সেই ব্যক্তির জন্য কৃষ্ণপক্ষও শুক্লপক্ষে পরিণত হয়।

অহোরাত্রো বৈ প্রজাপতিস্তস্যাহরেব প্রাণো রাত্রিরেব রয়িঃ

প্রাণং বা এতে প্রস্কন্দন্তি যে দিবা রত্যা সংযুজ্যন্তে ব্রহ্মচর্যমেব

তদ্যদ্রাত্রৌ রত্যা সংযুজ্যন্তে॥১৩

অন্বয়: অহোরাত্রঃ বৈ প্রজাপতিঃ (দিন এবং রাত্রি একত্রে প্রজাপতি); তস্য অহঃ এব প্রাণঃ (দিন তাঁর প্রাণ); রাত্রিঃ এব রয়িঃ (রাত্রি তাঁর খাদ্য); যে দিবা রত্যা সংযুজ্যন্তে (যাঁরা দিনের বেলায় [অর্থাৎ কাজের সময়] ইন্দ্রিয়সুখকে প্রশ্রয় দেন); এতে প্রাণং বৈ প্রস্কন্দন্তি (জীবনকে ধ্বংস করেন); যৎ রাত্রৌ রত্যা সংযুজ্যন্তে (যাঁরা তা রাত্রিভাগে [বিশ্রামের সময়] সম্পন্ন করেন); তৎ ব্রহ্মচর্যম্‌ এব (তা ব্রহ্মচর্য তুল্য [তাঁরা আত্মসংযমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন])।

সরলার্থ: দিন এবং রাত্রি প্রজাপতির দুটি অংশ। দিন তাঁর প্রাণ, রাত্রি খাদ্য। যাঁরা দিনের বেলায় (কঠোর পরিশ্রমের সময়) ইন্দ্রিয়সুখকে প্রশ্রয় দেন, তাঁরা নিজের জীবনকে ধ্বংস করেন। কিন্তু যাঁরা রাত্রিবেলায় তা সম্পন্ন করেন তাঁরা আত্মসংযমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

ব্যাখ্যা: ‘অহোরাত্র’, দিন এবং রাত্রি—এ সবই প্রজাপতির ব্যক্ত রূপ। দিন যেন প্রাণ, এবং রাত্রি রয়ি বা অন্ন। অর্থাৎ বলতে চাইছেন, দিনের বেলায় পৃথিবী কর্মচঞ্চল। এই কর্মচাঞ্চল্য জীবনের লক্ষণ। কাজেই তখন ইন্দ্রিয়সুখের জন্য সময় অপচয় করা কোনভাবেই উচিত নয়। তার জন্য রাত্রিবেলাই নির্দিষ্ট রাখা উচিত। একেই বলে আত্মসংযম।

অন্নং বৈ প্রজাপতিস্ততো হ বৈ তদ্রেতস্তস্মাদিমাঃ প্রজাঃ প্রজায়ন্ত ইতি॥১৪

অন্বয়: অন্নং বৈ প্রজাপতিঃ (অন্নই প্রজাপতি), ততঃ হ বৈ তৎ রেতঃ (সেই অন্ন থেকে আসে প্রাণের বীজ); তস্মাৎ (তার [বীজ] থেকে); ইমাঃ প্রজাঃ প্রজায়ন্তে (এইসব প্রাণীদের জন্ম)।

সরলার্থ: অন্নই প্রজাপতি। এই অন্ন থেকে আসে প্রাণের বীজ। এই বীজ থেকে সমস্ত প্রাণীর জন্ম। কবন্ধী পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করেছিলেন—এই হল পিপ্পলাদের উত্তর।

ব্যাখ্যা: ব্ৰহ্ম সব কিছুর কারণ। ব্রহ্মই নানারূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। যেহেতু ব্রহ্ম সবকিছুর উৎস সেইজন্য তাঁকে বলা হয় প্রজাপতি অর্থাৎ যা কিছুর জন্ম হয়েছে তিনি তার প্রভু।

সূর্য (প্রাণ) এবং চন্দ্র (খাদ্য) প্রজাপতির প্রথম ব্যক্ত রূপ। তারপর সংবৎসর, মাস, দিন-রাত্রি সবশেষে প্রাণবীজে তাঁর প্রকাশ। প্রাণের সেই বীজ থেকেই সমস্ত অস্তিত্বের জন্ম। এ ভাবেই সেই এক বহু হয়েছেন।

তদ্যে হ বৈ তৎ প্রজাপতিব্রতং চরন্তি তে মিথুনমুৎপাদয়ন্তে।

তেষামেবৈষ ব্ৰহ্মলোকো যেষাং তপো ব্রহ্মচর্যং যেষু সত্যং

প্রতিষ্ঠিতম্‌॥১৫

অন্বয়: তৎ (সেহেতু); যে হ বৈ (যাঁরা); তৎ প্রজাপতিব্রতং চরন্তি (প্রজাপতির নিয়ম পালন করেন); তে মিথুনম্‌ উৎপাদয়ন্তে (সন্তানের জন্ম দেন); তেষাম্ এব এষঃ ব্রহ্মলোকঃ (তাঁরাই শুধু ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন); যেষাং তপঃ ব্রহ্মচর্যম্ (যাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন করেন এবং সংযত জীবন যাপন করেন); যেমু সত্যং প্রতিষ্ঠিতম্‌ (যাঁরা সত্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত)।

সরলার্থ: এমন অনেক গৃহস্থ আছেন যাঁদের বিবাহিত জীবন প্রজাপতির জীবনাদর্শে গড়া। তাঁরা প্রজাপতির মতোই নির্দিষ্ট নীতি অনুযায়ী সন্তানের জন্ম দেন। তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ আবার কঠোর ও সংযত জীবন যাপন করে থাকেন। তাঁরা সত্যেও দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। মৃত্যুর পর এরকম ব্যক্তি চন্দ্রলোক অর্থাৎ পিতৃলোকে যান। তাঁদের পক্ষে এটিই ব্রহ্মলোক।

ব্যাখ্যা: তপস্যা ও আত্মসংযম (ব্রহ্মচর্য) অভ্যাস করে এবং কায়মনোবাক্যে (অর্থাৎ কর্মে, চিন্তায় ও কথায়) সত্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত (সত্যং প্রতিষ্ঠিতম্‌) থেকে গৃহস্থ ব্রহ্মলোক (বস্তুত চন্দ্রলোক) লাভ করতে পারেন। গৃহস্থই হোন বা সন্ন্যাসী, সকলকেই সত্যপালন করতে হবে। এখানে ‘ব্রহ্মচর্য’ কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ হল আত্মসংযম। এমনকি বিবাহিত জীবনেও আত্মসংযমের প্রচুর অবকাশ আছে। প্রজাপতির দৃষ্টান্তই গৃহস্থদের অনুসরণ করতে হবে।

আত্মাই ব্রহ্ম এবং সেই আত্মাকে উপলব্ধিই প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য। কেউ গৃহস্থ হতে পারেন, তাঁর পরিবার-পরিজনও থাকতে পারে কিন্তু তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই; শুধু সকলকে তাঁদের লক্ষ্য ঠিক রেখে চলতে হবে।

তেষামসৌ বিরজো ব্রহ্মলোকো ন যেষু জিহ্মমনৃতং ন মায়া চেতি॥১৬

অন্বয়: যেষু (যাঁদের মধ্যে); জিহ্মম্ (কুটিলতা); অনৃতম্‌ (মিথ্যাচার, সততার অভাব); [চ] ন (অনুপস্থিত); মায়া চ ন (কপটতাও নেই); তেষাম্‌ (শুধু তাঁদেরই); অসৌ বিরজঃ ব্রহ্মলোকঃ (এই শুদ্ধ ব্রহ্মলোক)।

সরলার্থ: যাঁদের মধ্যে মিথ্যাচার, কুটিলতা বা কপটতার লেশমাত্র নেই তাঁরাই শুধু ব্রহ্মলোকে স্থান পাওয়ার যোগ্য।

ব্যাখ্যা: আমরা বলতে পারি আমরা ব্রহ্মলোক লাভ করতে চাই। কিন্তু তখনই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি রকম জীবন যাপন করছি?

উপনিষদ বলেন, সেই পরমকে লাভ করতে হলে একান্ত প্রয়োজন পবিত্রতা। রজঃ শব্দের অর্থ মলিনতা, কালিমা। ‘বিরজ’ অর্থ শুদ্ধ বা নির্মল। তারপর প্রয়োজন ঋজুতা অর্থাৎ সরলতার। আমার মধ্যে কোন কুটিলতা থাকবে না (ন জিহ্মম্‌), থাকবে না কোন মিথ্যাচারও। ‘ঋতম্‌’ অর্থ ‘সত্য’। ‘অনৃতম্‌’ অর্থ ‘মিথ্যা’। হিন্দুশাস্ত্রমতে সত্যের চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই।

আমরা হয়তো লক্ষ্য করেছি যে, এখানে বিশেষ কোন আচার-অনুষ্ঠান পালন বা কোন বিশেষ দেবতার উপাসনার কথা বলা হয়নি। কোন প্রার্থনা বা মন্ত্রোচ্চারণের নির্দেশও দেওয়া হয়নি। কেবলমাত্র পবিত্র, সৎ এবং সরল হতে বলা হয়েছে। এইজন্যই স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন—ধর্ম হল ‘হওয়া এবং হয়ে ওঠা’। মানুষকে শুদ্ধ ও নির্মল হয়ে উঠতে হবে।

যে প্রশ্ন দিয়ে আমরা আরম্ভ করেছিলাম তা হল, ‘এই সকল প্রাণী কোথা থেকে আসে?’ উত্তর হল—প্রজাপতি থেকে। প্রজাপতিই বহু হয়েছেন। জগতে কত রকম বস্তু রয়েছে। সব মূলত এক। কিন্তু তাদের দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—কারণ এবং কার্য, প্রাণ এবং রয়ি, জীবন এবং জীবনধারণ, অন্ন এবং তার ভোক্তা।

জীবনের সূচনা প্রজাপতি (প্রাণ) থেকে এবং রয়ির (খাদ্য) দ্বারা তা পুষ্ট। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মসংযম এবং সত্যপালনের দ্বারা পিতৃলোক (চন্দ্রলোক) প্রাপ্ত না হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকে। কিন্তু পিতৃলোকও যাত্রার শেষ নয়। অর্থাৎ তখনও মুক্তিলাভ হয়নি। মুক্তিলাভের জন্য তাকে ভিক্ষু (সন্ন্যাসী) হতে হবে—কেননা একমাত্র সন্ন্যাসীরই মিথ্যা বা ছলনার আশ্রয় নেবার প্রয়োজন হয় না। তিনি নির্মল জীবন যাপন করেন। প্রাণের (প্রজাপতির) সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে যান।

এখানেই প্রশ্ন উপনিষদের প্রথম প্রশ্ন সমাপ্ত।

দ্বিতীয় প্রশ্ন

অথ হৈনং ভার্গবো বৈদর্ভিঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন্‌ কত্যেব দেবাঃ প্রজাং

বিধারয়ন্তে কতর এতৎ প্ৰকাশয়ন্তে কঃ পুনরেষাং বরিষ্ঠ ইতি॥১

অন্বয়: অথ হ (অতঃপর); এনম্‌ (তাঁকে [পিপ্পলাদকে]); ভার্গবঃ বৈদর্ভিঃ পপ্রচ্ছ (বিদর্ভদেশীয় ভার্গব [ভৃগুপুত্র] জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্‌ কতি এব দেবাঃ প্রজাং বিধারয়ন্তে (হে ভগবান, কয়টি বা কয়জন ইন্দ্রিয় প্রাণীর দেহকে ধারণ করে); কতরে (তাদের মধ্যে কারা); এতৎ প্ৰকাশয়ন্তে (দেহকে প্রকাশ করে); এষাং কঃ পুনঃ (আবার তাদের মধ্যে কোন্‌টি); বরিষ্ঠঃ ইতি (প্রধানতম)?

সরলার্থ: অতঃপর বিদর্ভদেশীয় ভার্গব তাঁকে (পিপ্পলাদকে) প্রশ্ন করলেন, ‘ভগবান, কয়টি ইন্দ্রিয় প্রাণীর দেহকে ধারণ করে থাকে? তার মধ্যে কোন্‌টি দেহকে প্রকাশ করে এবং কোন্‌টি প্রধানতম?’

ব্যাখ্যা: দ্বিতীয় প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলেন ভৃগুবংশীয় ভার্গব। ‘বৈদর্ভিঃ’ অর্থ বিদর্ভদেশের লোক। বিদর্ভ মধ্যপ্রদেশের একটি জনপদ। ভার্গবের প্রশ্ন ইন্দ্রিয় বিষয়ে। ‘দেব’ শব্দের অর্থ যা প্রকাশ করে, উজ্জ্বল করে অথবা ব্যক্ত করে। দিব্‌ ধাতু থেকে ‘দেব’ শব্দটি এসেছে। দিব্‌ ধাতুর অর্থ প্রকাশ করা, ব্যক্ত করা। এখানে ‘দেবাঃ’ শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়সমূহ। কয়টি ইন্দ্রিয় বাইরের বস্তুকে আমাদের কাছে প্রকাশ করে? কয়টি আমাদের দেহকে ধারণ করে আর কয়টিই বা এই দেহকে প্রকাশ করে? কোন্ ইন্দ্রিয় প্রধানতম?

তস্মৈ স হোবাচাকাশো হ বা এষ দেবো বায়ুরগ্নিরাপঃ পৃথিবী

বাঙ্‌মনশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ। তে প্রকাশ্যাভিবদন্তি বয়মেতদ্‌বাণমবষ্টভ্য

বিধারয়ামঃ॥২

অন্বয়: তস্মৈ (তাঁকে [ভার্গবকে]); সঃ হ উবাচ (তিনি [পিপ্পলাদ] বললেন); আকাশঃ এষঃ দেবঃ হ বৈ (আকাশই এই দেবতা); চ বায়ুঃ অগ্নিঃ আপঃ পৃথিবী (বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবীও); বাক্ (কথা এবং অন্যান্য কর্মেন্দ্রিয়); মনঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ (মন, চোখ, কান এবং [অন্যান্য ইন্দ্রিয়সমূহ]); প্রকাশ্য (তাদের নিজ শক্তি প্রকাশ করে); অভিবদন্তি (দর্পভরে বলা আরম্ভ করলেন); বয়ম্ এতৎ বাণম্‌ অবষ্টভ্য বিধারয়ামঃ (আমরাই দেহকে বলিষ্ঠ করি এবং ধারণও করি)।

সরলার্থ: পিপ্পলাদ ভৃগুপুত্রকে বললেন—আকাশই এই দেবতা। তেমনি বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাক্, মন, চোখ এবং কানও দেবতা। তাঁরা সকলেই দর্পভরে নিজ নিজ ক্ষমতার কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তাঁদের সকলের দাবি তাঁরাই দেহকে বলিষ্ঠ করেছেন এবং দেহকে ধারণও করে আছেন।

ব্যাখ্যা: এখানে দেহকে ‘বাণম্‌’ বলা হয়েছে কারণ দেহ চিরস্থায়ী নয়। কর্ম শেষ হলে দেহের বিনাশ হয়। আচার্য শঙ্করের মতে, এই দেহ কার্য-কারণের ফল। কারণ ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব নয়। অতএব এই দেহ কর্মেরই ফল। যখন আমাদের কর্ম নিঃশেষ হয়, তখন দেহেরও অবসান হয়।

হিন্দুমতে, এই দেহ পাঁচটি উপাদানে গঠিত : যথা আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং পৃথিবী। আমাদের কর্মেন্দ্রিয় এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়ও এই একই উপাদানে তৈরী। কর্মেন্দ্রিয় হল যথাক্রমে বাক্‌-বাগিন্দ্রিয়, পাণি—দুই হাত, পাদ—দুই পা, পায়ু—মলমূত্রদ্বার; উপস্থ—জননেন্দ্রিয়। আর জ্ঞানেন্দ্রিয় হল শ্রোত্র—কান, ত্বক—স্পর্শেন্দ্রিয়, চক্ষু—চোখ, জিহ্বা—জিভ, নাসিকা—নাক। এছাড়া আর একটি ইন্দ্রিয় আছে, তা হল মন। আর সবশেষে হল প্রাণ বা জীবনীশক্তি। প্রাণই প্রধানতম, সব কিছুর উৎস। মৃত্যু হলে আমাদের দেহ এবং ইন্দ্রিয় অবিকৃত থাকতে পারে, কিন্তু তথাপি আমরা মৃত কারণ জীবনীশক্তি বা প্রাণ এই দেহ ত্যাগ করে গেছে।

এই ইন্দ্রিয়গুলিকে অনেকসময় দেবম্‌ বা দেবতা বলা হয়। ‘দেব’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘যা প্রকাশ করে’। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের কাছে প্রকাশ করে। যেমন, জল ঠাণ্ডা না গরম তা আমরা স্পর্শ করে অর্থাৎ ত্বক দিয়ে বুঝতে পারি। আবার দেহের প্রতিটি উপাদানের এবং প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরও এক একটি দেবতা রয়েছেন।

পিপ্পলাদ এখানে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটি কাহিনী বলছেন। একদা দেবতাদের (ইন্দ্রিয়সমূহের) মধ্যে বিবাদ শুরু হল। নির্বোধের মতো তাঁরা ভাবলেন তাঁরা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র। এই নিয়ে তাঁরা দম্ভ প্রকাশ করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন: ‘এই দেহ আমরাই ধারণ করি। দেহ সহজেই নষ্ট হয়ে যায়; কাজেই মাঝখানে থেকে আমরা একে একত্র রাখি।’ ইন্দ্রিয়দের ধারণা প্রাসাদ যেমন বড় বড় স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনিভাবে তাঁরাও এই দেহকে ধারণ করে আছেন। তাঁরা বলতে চাইছেন : ‘আমরা যদি সরে যাই এই দেহের পতন ঘটবে।’

তান্ বরিষ্ঠঃ প্রাণ উবাচ। মা মোহমাপদ্যথ অহমেবৈতৎ পঞ্চধাঽঽত্মানং

প্রবিভজ্যৈতদ্‌বাণমবষ্টভ্য বিধারয়ামীতি তেঽশ্রদ্দধানা বভূবুঃ॥৩

অন্বয়: বরিষ্ঠঃ প্রাণঃ (প্রাণ, যিনি প্রধান); তান্‌ উবাচ (ইন্দ্রিয়সমূহকে বললেন); মোহং মা আপদ্যথ ([তোমরাই দেহকে ধারণ করে আছ এই চিন্তা করে] ভুল করো না); অহম্‌ এব এতৎ (আমিই একাজ করি [অর্থাৎ আমি দেহকে ধারণ করি, তোমরা নও]); আত্মানং পঞ্চধা (আমি আমার পাঁচটি শক্তি [প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান এবং সমান] প্ৰয়োগ করি); প্রবিভজ্য (যার যা কাজ তাকে তা ভাগ করে দিয়ে); এতৎ বাণম্‌ অবষ্টভ্য বিধারয়ামি (দেহের যত্ন নিয়ে আমি তাকে ধারণ করি); তে ([কিন্তু] তাঁরা [ইন্দ্রিয়সমূহ]); অশ্রদ্ধধানাঃ বভূবুঃ ([প্রধান ইন্দ্রিয় প্রাণকে] বিশ্বাস করতে পারলেন না)।

সরলার্থ: প্রাণ, যিনি প্রধান, ইন্দ্রিয়সমূহকে বললেন : ‘এভাবে অহঙ্কার করো না। আমি নিজেকে পাঁচটি বিভিন্ন শক্তিতে ভাগ করেছি এবং দেহকে সচল রাখতে তাদের নিয়োগ করেছি। দেহের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমি দায়ী।’ ইন্দ্রিয়সমূহ সেকথায় কর্ণপাত করলেন না।

ব্যাখ্যা: এবার প্রাণ প্রতিবাদ জানালেন : ‘মা মোহম্‌ আপদ্যথ’—‘সাবধান, মোহগ্রস্ত হয়ো না’। আমরা প্রত্যেকেই সময়ে সময়ে এ ধরনের ভুল করে থাকি। নিজেদের সম্বন্ধে যা নয় তাই ভেবে বসি। ফলত নিজেদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এই হল মোহ।

কাজেই প্রাণ তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই নিজেকে ঠকাচ্ছ, নির্বোধের মতো কথা বলছ। নিজেকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে কেবলমাত্র আমিই এই দেহ ধারণ করে আছি।’ এই পাঁচটি ভাগ কি কি? এরা হল—প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান ও সমান। প্রাণের কাজ শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করা এবং অপানের কাজ খাদ্যের অসার পদার্থ বর্জন করা। ব্যান দেহের সকল স্নায়ুতে ছড়িয়ে রয়েছে। আবার উদান দেহের তাপ রক্ষা করে এবং সমান খাদ্য হজম ও পরিপাকে সাহায্য করে। এই পাঁচটি শক্তির দ্বারা প্রাণ আমাদের শরীরকে সচল রাখে, কাজ করার শক্তি যোগায়।

প্রাণের এসব কথা ইন্দ্রিয়দের উপর কোন প্রভাব ফেলল না। অহঙ্কারবশত তাঁরা প্রাণের কথা মেনে নিতে পারলেন না।

সোঽভিমানাদূর্ধ্বমুৎক্রামত ইব তস্মিন্নুৎক্রামত্যথেতরে সর্ব এবোৎক্রামন্তে

তস্মিংশ্চ প্রতিষ্ঠমানে সর্ব এব প্রাতিষ্ঠন্তে। তদ্যথা মক্ষিকা

মধুকররাজানমুৎক্রামন্তং সর্বা এবোৎক্রামন্তে তস্মিংশ্চ প্রতিষ্ঠমানে সর্বা এব

প্রাতিষ্ঠন্ত এবং বাঙ্‌মনশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ তে প্রীতাঃ প্রাণং স্তুন্বন্তি॥৪

অন্বয়: সঃ অভিমানাৎ (তিনি [প্রাণ] অভিমানবশতঃ); ঊর্ধ্বম্‌ উৎক্ৰামতে ইব (শরীর ছেড়ে যাবার উপক্রম করলেন); তস্মিন্ উৎক্ৰামতি (যেমনি তিনি [প্রাণ] ছেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ করলেন); অথ (তৎক্ষণাৎ); ইতরে সর্বে এব উৎক্ৰামন্তে (অন্যান্য ইন্দ্রিয়সমূহও ছেড়ে যাবার উপক্রম করলেন)। তস্মিন্ চ প্রতিষ্ঠমানে (এবং যখন তিনি [প্রাণ] স্থির হলেন) সর্বে এব প্রাতিষ্ঠন্তে (তাঁরাও যে যাঁর জায়গায় ফিরে এলেন)। তৎ যথা (এ যেন); মধুকর-রাজানম্‌ (মৌমাছির রাণীকে); উৎক্ৰামন্তম্‌ (উড়ে যাচ্ছে [দেখে]); সর্বাঃ এব মক্ষিকাঃ উৎক্ৰামন্তে (সমস্ত মৌমাছিই উড়ে যায়); তস্মিন্ প্রতিষ্ঠমানে (যতক্ষণ রাণী মৌমাছি নিজের জায়গায় স্থির থাকে); সর্বাঃ এব প্রাতিষ্ঠন্তে (সব মৌমাছিই যে যার জায়গায় থাকে); বাক্‌ মনঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ (বাক্, মন, চোখ, কান এবং অন্য সকল ইন্দ্রিয়); এবম্ (একইভাবে [আচরণ করেন]); তে (ইন্দ্রিয়সমূহ); প্রীতাঃ (প্রীত হলেন [প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব দেখে]); প্রাণং স্তুম্বন্তি (এবং প্রাণের স্তব করতে লাগলেন)।

সরলার্থ: প্রধান ইন্দ্রিয় প্রাণ অভিমানবশত উঠে যাওয়ার অর্থাৎ শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ভান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ইন্দ্রিয়রাও তাঁকে অনুসরণ করলেন। আবার প্রাণ নিজের জায়গায় ফিরে এলে অন্যরাও যে যাঁর জায়গায় ফিরে এলেন। এ যেন রানী মৌমাছির মৌচাক ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো। রানী চাক ছেড়ে বেরিয়ে গেলে গোটা মৌমাছির দল তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে আবার রানী থাকলে অন্যরাও থাকে। বাক্‌, মন, চোখ, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলি মৌমাছির দলের মতো। প্রাণের উপর প্রসন্ন হয়ে তাঁরা প্রাণের স্তব করতে লাগলেন।

ব্যাখ্যা: অন্যান্য ইন্দ্রিয়দের অশ্রদ্ধা দেখে প্রাণ ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি চিন্তা করলেন, ‘ওরা ভাবছে আমার কোন গুরুত্বই নেই। ঠিক আছে, আমি ওদের বুঝিয়ে দেব।’ এই ভেবে প্রাণ শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ভান করলেন। যেই প্রাণ বেরোতে শুরু করেছেন সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ইন্দ্রিয়রা তাঁর পেছন পেছন বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করলেন। প্রাণ আবার স্থির হয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এলে তাঁরাও যে যাঁর জায়গায় ফিরে এলেন। উপনিষদ বলছেন, এ যেন রানী মৌমাছির চাক ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো। রানী মৌচাক ত্যাগ করলে গোটা মৌমাছির দল তাকে অনুসরণ করে। রানী মৌমাছিই তাদের নেত্রী। নেত্রী ছাড়া তারা কাজ করতে পারে না। তার ওপর গোটা দলটাই নির্ভর করে আছে। একইভাবে অন্যান্য ইন্দ্রিয়রা প্রাণের ওপর নির্ভরশীল। প্রাণ ছাড়া তাঁরা কাজ করতে পারেন না। এমন কি মনও স্বাধীন নয়।

‘তে প্রীতাঃ প্রাণং স্তন্বম্ভি’—অতএব ইন্দ্রিয়রা তুষ্ট হয়ে প্রাণের স্তব করতে লাগলেন।

এষোঽগ্নিস্তপত্যেষ সূর্য

এষ পর্জন্যো মঘবানেষ বায়ুঃ।

এষ পৃথিবী রয়ির্দেবঃ

সদসচ্চামৃতং চ যৎ॥৫

অন্বয়: এষঃ (এই [প্রাণ]); অগ্নিঃ (অগ্নি রূপে); তপতি (তাপ দেন); এষঃ (এই প্রাণ); সূর্যঃ (সূর্য [অর্থাৎ সূর্যরূপে আলো দেন]); এষঃ (এই প্রাণ); পর্জন্যঃ (মেঘ [অর্থাৎ মেঘরূপে বৃষ্টি দেন]); এষঃ মঘবান্ (এই প্রাণ ইন্দ্ররূপে সব কিছু পালন করেন [ইন্দ্র হলেন দেবরাজ]); এষঃ বায়ুঃ (এই প্রাণ বায়ু [অর্থাৎ বায়ু রূপে সর্বত্র বিদ্যমান]); এষঃ দেবঃ (ইনি প্রকাশ করেন); পৃথিবী (পৃথিবী); রয়িঃ (চন্দ্র); সৎ (স্থূলকাৰ্য); অসৎ (সূক্ষ্মকারণ); চ অমৃতম্ (এবং অমর); চ [অপি] যৎ (এই সবই প্রাণ)।

সরলার্থ: এই প্রাণই অগ্নি এবং অগ্নিরূপে ইনি তাপ দেন। সূর্য, মেঘ, ইন্দ্র, বায়ু, পৃথিবী এবং চন্দ্র [যাঁদের তিনি প্রকাশও করেন] সবই এই প্রাণ। সংক্ষেপে বলতে গেলে [কার্যরূপে] তিনিই স্থূল এবং [কারণরূপে] তিনিই সূক্ষ্ম। আবার তিনি অমরও বটে। এই সবই প্রাণ।

ব্যাখ্যা: বিস্ময়কর যা কিছু আমরা দেখি সবই প্রাণের প্রকাশ। প্রাণই বাইরের অগ্নি, আবার দেহের উত্তাপ অর্থাৎ ভেতরের অগ্নিও প্রাণ। মানুষ মারা গেলে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সুতরাং দেহের উত্তাপ জীবনের লক্ষণ। প্রাণই এই উত্তাপ।

সূর্যরূপে প্রাণ আমাদের তাপ ও আলো দেন; আর মেঘরূপে দেন বৃষ্টি। ইন্দ্র হয়ে তিনি দেবতাদের রাজা এবং বায়ুরূপে প্রাণ সর্বত্র রয়েছেন। যে পৃথিবী আমাদের আশ্রয়, আমাদের পালন করছেন তাও এই প্রাণ।

প্রাণই রয়ি অর্থাৎ চন্দ্র। চন্দ্র এখানে অন্নের প্রতীক। একদিক থেকে প্রাণই জীবন বা ভোক্তা অর্থাৎ যে খাদ্য গ্রহণ করে। আর এক দিক থেকে আমরা যে খাদ্য খাই তাও প্রাণ। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের খাদ্য প্রয়োজন। আবার মারা গেলে মানুষই অন্য জীবের খাদ্য হতে পারে। এই ধারা চক্রাকারে চলছে। আসলে সবই এক। একই বস্তু বিভিন্ন ভূমিকা পালন করছে।

‘সৎ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘যার অস্তিত্ব আছে’। কিন্তু এখানে যা স্থূল, যা দেখা যায় তা বোঝাতেই ‘সৎ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সৎ-ই কার্য। ‘অসৎ’ অর্থ যা দেখা যায় না। অসৎ-ই কারণ। সৎ-অসৎ, স্থূল-সূক্ষ্ম, কার্য-কারণ—উভয়ই প্রাণ। প্রাণকে অমৃত [অর্থাৎ অমরত্বের যে সুধা দেবদেবীদের ধারণ করে আছে] বলা হয়েছে। প্রাণ সকল মানুষ এবং সকল দেবদেবীর আশ্রয়।

অরা ইব রথনাভৌ প্রাণে সর্বং প্রতিষ্ঠিতম্‌।

ঋচো যজূংষি সামানি যজ্ঞঃ ক্ষত্রং ব্রহ্ম চ॥৬

অন্বয়: অরাঃ ইব রথনাভৌ (যেখানে রথচক্রে শলাকাগুলি চক্রের কেন্দ্রে নিবদ্ধ); প্রাণে ([সেইরকম] প্রাণে); সর্বম্ (এই [জগতে] সবকিছু); প্রতিষ্ঠিতম্‌ (দৃঢ়ভাবে স্থাপিত); ঋচঃ যজূংষি সামানি (তিন বেদ—ঋক্‌, যজুঃ এবং সাম); যজ্ঞঃ (বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠান); ক্ষত্রম্ (ক্ষত্রিয় [দ্বিতীয় বর্ণাশ্রম]); ব্রহ্ম চ (এবং ব্রাহ্মণ [প্রাণকে আশ্রয় করে আছেন])।

সরলার্থ: অন্যান্য বস্তু তো বটেই এমনকি ঋক্‌, যজুঃ এবং সাম বেদ, বৈদিক যাগযজ্ঞ, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ সকলেই প্রাণকে আশ্রয় করে আছেন। রথচক্রে শলাকাগুলি যেমন চক্রের কেন্দ্রকে আশ্রয় করে থাকে, এও ঠিক তেমনি।

ব্যাখ্যা: প্রাণকে এখানে রথচক্রের নাভি বা কেন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। চাকার কেন্দ্রবিন্দু এবং বাইরের বৃত্তের মাঝে থাকে অনেকগুলি শলাকা। এই নাভি বা কেন্দ্র ছাড়া কোন শলাকা বা চাকা থাকা সম্ভব নয়। ইন্দ্রিয়রা প্রাণকে বলছেন, ‘এই বিশ্ব, এই জগৎ এক বিশাল চাকার মতো এবং আমরা তার শলাকা। সেই চাকার কেন্দ্রকে আমরা সবাই আশ্রয় করে আছি। সেই কেন্দ্র তুমি। আর শুধু আমাদের কেন, সবকিছুকেই তুমি ধারণ করে আছ।’ সবকিছু প্রাণেই প্রতিষ্ঠিত (প্রাণে সর্বং প্রতিষ্ঠিত)।

‘ঋচঃ যজূংষি সামানি’—ঋগ্‌ বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ। বেদই জ্ঞান। কে এই জ্ঞানকে ধারণ করে আছেন? প্রাণ। এখানে ‘যজ্ঞ’ শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ধরা যেতে পারে। যজ্ঞ বলতে শুধুমাত্র বৈদিক যাগযজ্ঞ বোঝায় না। আমরা যা কিছু করি তা-ই একরকমের যজ্ঞ। আমাদের কোন কিছুই ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়। আমরা যা কিছু করি তা প্রাণ আছে বলেই সম্ভব হয়। ‘ক্ষত্রং ব্রহ্ম চ’—যে বর্ণাশ্রমেরই হই না কেন আমরা প্রত্যেকেই প্রাণের উপর নির্ভরশীল, কেউ স্বাধীন নই। ব্রাহ্মণ পরাবিদ্যা এবং বৈদিক ক্রিয়াকর্মের সংরক্ষণ করেন, কিন্তু তিনিও স্বাধীন নন। আবার ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য বর্ণের মানুষকে রক্ষা করেন। সমস্ত সমাজ ক্ষত্রিয়ের উপর নির্ভর করে অথচ ক্ষত্রিয় স্বয়ং প্রাণের উপর নির্ভরশীল। শঙ্করাচার্য বলেন—আমরা যা কিছু দেখি, যা কিছুর অস্তিত্ব আছে সব প্রাণের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রজাপতিশ্চরসি গর্ভে ত্বমেব প্রতিজায়সে।

তুভ্যং প্রাণ প্রজাস্ত্বিমা বলিং হরন্তি

যঃ প্রাণৈঃ প্রতিতিষ্ঠসি॥৭

অন্বয়: ত্বম্ এব প্রজাপতিঃ গর্ভে চরসি (তুমিই প্রজাপতি এবং এইরূপে তুমি [মাতৃ] গর্ভে নড়েচড়ে বেড়াও); প্ৰতিজায়সে (তোমার মা-বাবার প্রতিরূপ হয়ে [অর্থাৎ মা-বাবার মতো চেহারা নিয়ে] জন্মগ্রহণ কর); প্রাণ (হে প্রাণ); যঃ (যে তুমি); প্রাণৈঃ (চোখ এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে); প্রতিতিষ্ঠসি (প্রতি শরীরে বাস কর); তুভ্যং তু (তোমার জন্য); ইমাঃ প্রজাঃ (এই প্রাণিসমূহ); বলিং হরন্তি (ভোগ্যবস্তু আহরণ করে)।

সরলার্থ: তুমি প্রজাপতিরূপে মাতৃগর্ভে নড়েচড়ে বেড়াও। তুমি তোমার মা-বাবার মতো চেহারা নিয়ে জন্মগ্রহণ কর। হে প্রাণ, তুমি সব শরীরে ইন্দ্রিয়দের প্রধান হয়ে রয়েছ। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীরা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা (ভোগ্যবস্তু গ্রহণ করে) তোমাকে উপহার দেয় (তাদের পক্ষে এটাই সঠিক কাজ)।

ব্যাখ্যা: ‘প্রজাপতি’ শব্দের অর্থ সবকিছুর (প্রজাদের) প্রভু (পতি); ব্রহ্মার আর এক নাম প্রজাপতি। প্রাণের প্রশস্তি করে ইন্দ্রিয়রা বলছেন, ‘তুমি প্রজাপতি এবং তুমিই মাতৃগর্ভে নড়েচড়ে বেড়াও (প্রজাপতি চরসি গর্ভে)।’

‘ত্বম্‌ এব প্রতিজায়সে’—তোমার মা-বাবার অনুরূপ চেহারা নিয়ে তুমি জন্মগ্রহণ কর। শঙ্করাচার্য বলেন, ‘হে প্রাণ, যেহেতু তুমি প্রজাপতি, সব দেহে সব প্রজন্মে সেই এক তুমিই রয়েছ। তোমার চেহারা তোমার মা-বাবার অনুরূপ, আবার তোমার মা-বাবাও তোমার অনুরূপ। এ ঘটনা আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে কারণ সেই এক তুমিই বারবার আসা-যাওয়া করছ।’

‘তুভ্যং প্রাণ প্রজাঃ ইমাঃ বলিং হরন্তি’—ইন্দ্ৰিযরা তোমার জন্য উপহার নিয়ে আসে। ‘বলি’ শব্দের অর্থ উপহার। এই উপহার দেবতার প্রতি প্রীতি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন। আমরা যখন কিছু দেখি, আমাদের চোখ কিছু অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে। কিন্তু তা সে নিজের জন্য করে না, প্রাণকে জানিয়ে দেয়। একইভাবে, অন্যান্য ইন্দ্রিয়রাও তাদের অভিজ্ঞতা প্রাণকে উপহার দেয়। ‘যঃ প্রাণৈঃ প্রতিতিষ্ঠসি’ অর্থাৎ এই ইন্দ্রিয়গুলি প্রাণের উপর নির্ভরশীল। ‘তারা তোমাকেই আশ্রয় করে আছে। তাই তোমার প্রশস্তি গাইছে। এটাই তাদের পক্ষে উপযুক্ত কাজ।’

দেবানামসি বহ্নিতমঃ পিতৃণাং প্রথমা স্বধা।

ঋষীণাং চরিতং সত্যমথর্বাঙ্গিরসামসি॥৮॥

অন্বয়: দেবানাং বহ্নিতমঃ অসি ([তুমি] দেবতাদের উদ্দেশে প্রদত্ত যজ্ঞীয় আহুতির শ্রেষ্ঠ বাহক); পিতৃনাং প্রথমা স্বধা (পিতৃপুরুষের উদ্দেশে প্রথম নিবেদিত অন্ন); ঋষীণাং চরিতং সত্যম্ (তুমি সেই সত্য যা ঋষিরা পালন করেন); অঙ্গিরসাম্ অথর্বা অসি (অঙ্গিরস ঋষিদের [অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণের] মধ্যে তুমি অথর্বা [প্রাণ]) [অর্থাৎ তুমি ইন্দ্রিয়দের সঠিকভাবে চালনা কর]।

সরলার্থ: হে প্রাণ, দেবতাদের উদ্দেশে যজ্ঞে প্রদত্ত আহুতির তুমি শ্রেষ্ঠ বাহক। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে প্রথম নিবেদিত অন্ন তুমিই গ্রহণ কর। ঋষিরা যে সত্য অনুশীলন করেন তাও তুমি। আবার তুমিই ইন্দ্রিয়দের নিজের নিজের কাজে সঠিকভাবে চালনা কর।

ব্যাখ্যা: ‘বহ্নিতমঃ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘দ্রুততম বাহক’। এটি অগ্নিরই আর এক নাম। কেন অগ্নিকে বাহক বলা হয়? কারণ বৈদিক যাগযজ্ঞে দেবতাদের উদ্দেশে প্রদত্ত আহুতি অগ্নিই দেবতাদের কাছে বহন করে নিয়ে যান। ইন্দ্রিয়রা এখানে বলছে : প্রাণই দেবতা; আবার সেই দেবতার উদ্দেশে প্রদত্ত আহুতিও বহন করে আনে প্রাণ।

‘পিতৃণাং প্রথমা স্বধা’—অর্থাৎ পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে প্রথম নিবেদিত অর্ঘ্য। প্রথা অনুযায়ী শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য প্রথম আহুতি দেওয়া হয় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে। আমরা তাঁদের স্মরণ করলে তাঁরা তুষ্ট হন। এখন ইন্দ্রিয়রা প্রাণকে বলছে : ‘বস্তুত এই প্রথম আহুতি তোমাকেই নিবেদিত। এই অর্ঘ্য তোমারই উদ্দেশে।’

‘ঋষিণাম্‌’—ঋষি কে? যিনি দেখেছেন। কি দেখেছেন? সত্যকে! যিনি সত্যকে দেখেছেন, সত্যের জ্ঞান লাভ করেছেন তিনিই ঋষি। ঋষিরা আমাদেরও সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করেন। সেই কারণে আমরা তাঁদের কাছে ঋণী। তাঁরা আমাদের আচার্য।

এখানে ইন্দ্রিয়দের ঋষি বলা হয়েছে, কারণ আমরা ইন্দ্রিয়দের মাধ্যমেই দেখি। সত্য উপলব্ধি করতে হলে ইন্দ্রিয়ের সহায়তা প্রয়োজন। তারাই আমাদের কাছে সত্যকে প্রকাশ করে। ইন্দ্রিয়সহায়ে আমরা বুঝতে পারি জগতে যা কিছু আছে সবই ঈশ্বর। বাস্তবিক, এছাড়া জীবন আর কিসের জন্য? আমরা বেঁচে আছি কেন? এই জীবনের গুরুত্ব এই যে, সত্যকে, ঈশ্বরকে জানার জন্য জীবন অপরিহার্য। মানবজন্ম লাভ করে আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নানা অভিজ্ঞতা লাভ করি। আর তখনই বুঝতে পারি আমরা যা কিছু দেখছি সব ঈশ্বরেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সুতরাং ইন্দ্রিয়রা প্রাণকে বলছে: ‘তুমিই সেই প্রাণশক্তি যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কাজ করে। তুমি ইন্দ্রিয়দের সঠিকভাবে চালিত করছ যাতে সত্যকে জানা যায়। শাস্ত্রে আছে তুমিই সেই অথর্বা যাকে অঙ্গিরা প্রমুখ ঋষিরা উপাসনা করে থাকেন।’

ইন্দ্ৰস্ত্বং প্রাণ তেজসা রুদ্ৰোঽসি পরিরক্ষিতা।

ত্বমন্তরিক্ষে চরসি সূর্যস্ত্বং জ্যোতিষাং পতিঃ॥৯

অন্বয়: প্রাণ (হে প্রাণ); ত্বম্‌ ইন্দ্রঃ (তুমি ইন্দ্র [দেবরাজ]); তেজসা রুদ্রঃ অসি (সংহারকারী শক্তিতে তুমিই স্বয়ং রুদ্র); পরিরক্ষিতা ([একই সঙ্গে] তুমি সকলকে রক্ষা কর); ত্বম্ অন্তরিক্ষে চরসি (তুমি অন্তরীক্ষে বিচরণ করে বেড়াও); ত্বং জ্যোতিষাং পতিঃ সূর্যঃ (তুমিই সূর্য, সমস্ত জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রভু)।

সরলার্থ: হে প্রাণ, তুমিই ইন্দ্র, দেবগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দেবতা। তুমি রুদ্ররূপে সকলের সংহার কর। আবার তুমিই সকলের রক্ষক। সূর্যরূপে তুমি আকাশে বিচরণ কর এবং তুমি সমস্ত জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রভু।

ব্যাখ্যা: ‘হে প্রাণ, তুমি ইন্দ্র’। শঙ্করাচার্য বলেন, ইন্দ্র পরমেশ্বর, সকলের প্রভু। শিবের আর এক নাম রুদ্র। রুদ্র নিজের তেজে, ‘তেজসা’, সবকিছু সংহার করেন। শুধু তাই নয়, তিনি রক্ষাও করেন, ‘পরিরক্ষিতা’। ‘পরি’ অর্থ সবকিছু। তিনি সবকিছু সংহারও করেন, রক্ষাও করেন। ‘অন্তরিক্ষে চরসি’—‘তুমি স্বর্গলোকে বিচরণ কর’ অর্থাৎ তুমি সর্বত্র রয়েছ। ‘তুমি সূর্য’—অন্তরীক্ষে কত গ্রহ নক্ষত্র রয়েছে, কিন্তু তুমি উজ্জ্বলতম।

যদা ত্বমভিবর্ষস্যথেমাঃ প্রাণ তে প্রজাঃ।

আনন্দরূপাস্তিষ্ঠন্তি কামায়ান্নং ভবিষ্যতীতি॥১০

অন্বয়: প্রাণ (হে প্রাণ); ত্বং যদা অভিবর্ষসি (যখন [মেঘরূপে] তুমি বর্ষণ কর); অথ (বর্ষণের পরে); তে (তোমার); ইমাঃ প্রজাঃ (এই প্রাণীরা [মনে করে]); কামায় অন্নং ভবিষ্যতি (আমরা যত খাদ্য চাই তত পাব); ইতি (এই কারণে); আনন্দরূপাঃ তিষ্ঠন্তি (তারা উৎফুল্ল হয়)।

সরলার্থ: হে প্রাণ, যখন মেঘরূপে তুমি বর্ষণ কর তখন সমস্ত প্রাণীরা (যারা তোমার সন্তান) উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কারণ তারা তখন মনে করে, ‘এখন থেকে আমরা নিজেদের জন্য যত খাদ্য চাই তত পাব।’

ব্যাখ্যা: ইন্দ্রিয়রা এখন বলছে প্রাণই বৃষ্টির উৎস। বর্ষা হলে প্রাণীরা উৎফুল্ল হয়। এর কারণ কি? কারণ ভাল বৃষ্টি হলে ফসলও ভাল হবে। প্রচুর পরিমাণে খাদ্যও পাওয়া যাবে। শঙ্করাচার্য বলছেন, ‘তে ইমা প্রজাঃ’—এই সব প্রাণী তোমারই সন্তান। তারা তোমার থেকে পৃথক নয়।

ব্রাত্যস্ত্বং প্রাণৈকর্ষিরত্তা বিশ্বস্য সৎপতিঃ।

বয়মাদ্যস্য দাতারঃ পিতা ত্বং মাতরিশ্ব নঃ॥১১

অন্বয়: প্রাণ (হে প্রাণ); ত্বং ব্রাত্যঃ (তুমি পতিত [যেহেতু তুমিই প্রথম পুরুষ, তোমাকে পৈতে দেওয়ার কেউ ছিল না]); একৰ্ষিঃ (একর্ষি নামক অগ্নি); অত্তা (যজ্ঞের হবি বা ঘি যে গ্রহণ করে); বিশ্বস্য সৎপতিঃ ([এবং] জগতের পরম পতি); বয়ম্ (আমরা [ইন্দ্রিয়সমূহ]); আদ্যস্য (প্রথমে যার জন্ম হয়েছে অর্থাৎ তোমার); দাতারঃ ([তুমি যে হবি গ্রহণ কর] আমরা তার দাতা); মাতরিশ্ব ত্বং নঃ পিতা (হে মাতরিশ্বা, তুমি আমাদের পিতা [অথবা, ত্বং মাতরিশ্বনঃ পিতা, তুমি মাতরিশ্বা অর্থাৎ বায়ুরও পিতা])।

সরলার্থ: হে প্রাণ, তুমি ব্রাত্য, অশুদ্ধ (কারণ তোমার উপনয়ন হয়নি)। তথাপি তুমিই সেই একর্ষি নামক অগ্নি এবং (যজ্ঞে প্রদত্ত) হবির ভোক্তা। তুমি জগতের পরমপতি। তুমিই প্রথম জন্মগ্রহণ করেছ। আমরা ইন্দ্রিয়রা তোমার প্রয়োজনীয় খাদ্য তোমাকে দিই। হে মাতরিশ্বা, তুমি আমাদের পিতা (অথবা তুমি মাতরিশ্বা অর্থাৎ বায়ুর পিতা)।

ব্যাখ্যা: ধরা যাক ব্রাহ্মণ বংশে কোন বালকের জন্ম হয়েছে। নির্দিষ্ট বয়সে তার উপনয়ন হওয়ার কথা। কিন্তু কোন কারণে যদি তাকে উপনয়ন দ্বারা সংস্কার না করা হয় তাহলে সে হবে ব্রাত্য। ‘ব্রাত্য’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ পতিত। আবার কেউ যদি তাঁর নির্দিষ্ট কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হন তাহলে তাঁকেও ‘ব্রাত্য’ বলা হবে। কিন্তু এখানে তো ইন্দ্রিয়রা প্রাণের প্রশস্তি করছিল। তাহলে কেন ‘ব্রাত্য’ কথাটা ব্যবহার করা হল? কারণ প্রাণ যেহেতু প্রথম সত্তা তাঁর উপনয়ন অনুষ্ঠান করার মতো দ্বিতীয় কেউ ছিল না। সুতরাং তাঁর উপবীত নেই, তাই তিনি ‘ব্রাত্য’। কিন্তু স্বভাবত প্রাণ চিরপবিত্র, উপবীত থাকুক বা নাই থাকুক।

‘বিশ্বস্য সৎপতিঃ’—তুমি এই জগতের একমাত্র পতি। তুমিই প্রথম প্রকাশ। তোমার থেকে আমরা সবাই এসেছি। আমরা উপাসনা করলে তোমারই উপাসনা করি। যজ্ঞে আহুতি দিলে সে আহুতি বস্তুত তোমাকেই দিই। যা কিছু আমরা করি সব তোমারই উদ্দেশে নিবেদিত।

‘পিতা ত্বং মাতরিশ্ব নঃ’—হে মাতরিশ্বা, তুমি আমাদের পিতা। বায়ুকে মাতরিশ্বা বলা হয়। ইন্দ্রিয়রা প্রাণকে বায়ুর সঙ্গে তুলনা করছে কারণ বাতাস ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। তাই ইন্দ্রিয়রা বলছে, ‘আমরা সবাই তোমার সন্তান, তোমার উপরে নির্ভর করে আছি।’

যা তে তনূর্বাচি প্রতিষ্ঠিতা যা শ্রোত্রে যা চ চক্ষুষি।

যা চ মনসি সন্ততা শিবাং তাং কুরু মোৎক্রমীঃ॥১২

অন্বয়: তে যা তনূঃ (তোমার যে অংশ); বাচি প্রতিষ্ঠিতা (আমার কথায় প্রতিষ্ঠিত); যা শ্রোত্রে (আমার শ্রবণে); যা চ চক্ষুষি (আমার চোখে); যা চ মনসি (আমার মনে); সন্ততা (একযোগে); তাং শিবাং কুরু (তাদের কল্যাণ কর); মা উৎক্ৰমীঃ (তাদের পরিত্যাগ করো না)।

সরলার্থ: আমাদের কথা বলা, শোনা, দেখা, চিন্তা করা এবং মনের অন্যান্য কর্মে তোমার যেসব অংশ উপস্থিত—সেগুলিকে একযোগে তুমি কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত কর। দয়া করে তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না।

ব্যাখ্যা: প্রাণ অর্থাৎ প্রাণবায়ু আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে সক্রিয় করেন। প্রাণ ছাড়া ইন্দ্রিয়রা অকেজো। আমাদের এই প্রার্থনা যে প্রাণ সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকুন এবং ইন্দ্রিয়দের সুপরিচালিত করুন। ইন্দ্রিয়রা শুধু যে কাজ করবে তাই নয়, এমন ভাবে করবে যাতে অন্যের উপকার হয়।

এই প্রার্থনার মূল সুর হল—যদি আমরা বেঁচে থাকি তবে পরহিতার্থে বাঁচব।

প্রাণস্যেদং বশে সর্বং ত্রিদিবে যৎ প্রতিষ্ঠিতম্‌।

মাতেব পুত্ৰান্ রক্ষস্ব শ্রীশ্চ প্রজ্ঞাং চ বিধেহি ন ইতি॥১৩

অন্বয়: ইদং সর্বম্ (এই সব); প্রাণস্য বশে (প্রাণের অধীনে); ত্রিদিবে যৎ প্রতিষ্ঠিতম্‌ (স্বর্গে যা কিছু আছে); মাতা ইব পুত্রান্‌ রক্ষস্ব (মাতা যেমন সন্তানকে রক্ষা করেন সেইভাবে অনুগ্রহ করে আমাদের রক্ষা করুন); নঃ শ্রীঃ চ প্রজ্ঞাং চ বিধেহি (আমাদের সৌভাগ্য এবং জ্ঞান দান করুন)।

সরলার্থ: জগতে যা কিছু আছে সব প্রাণই নিয়ন্ত্রণ করেন। মা যেমন সন্তানকে রক্ষা করেন, প্রাণও তেমনি আমাদের রক্ষা করুন—এই প্রার্থনা। তিনি আমাদের সৌভাগ্য ও জ্ঞান দান করুন।

ব্যাখ্যা: প্রাণই প্রজাপতি, যিনি সকল কিছুর উৎস। প্রাণের কাছে আমাদের বিশেষ প্রার্থনা তিনি আমাদের সৌভাগ্য ও জ্ঞান দান করুন। এই দুটি জিনিস লাভ করলে আমরা সফল হবই।

এখানেই প্রশ্ন উপনিষদের দ্বিতীয় প্রশ্ন সমাপ্ত।

তৃতীয় প্রশ্ন

অথ হৈনং কৌসল্যশ্চাশ্বলায়নঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন্ কুত এষ প্রাণো

জায়তে কথমায়াত্যস্মিঞ্‌শরীর আত্মানং বা প্রবিভজ্য কথং

প্রাতিষ্ঠতে কেনোৎক্ৰমতে কথং বাহ্যমভিধত্তে কথমধ্যাত্মমিতি॥১

অন্বয়: অথ হ (তারপরে); কৌসল্যঃ আশ্বলায়নঃ (অশ্বলপুত্র কৌসল্য); এনং পপ্ৰচ্ছ (তাঁকে [পিপ্পলাদকে] জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্ কুতঃ এষঃ প্রাণঃ জায়তে (ভগবান কোথা থেকে এই প্রাণ এসেছেন); অস্মিন্ শরীরে কথম্ আয়তি (এই শরীরে তিনি কিভাবে আসেন); আত্মানং প্রবিভজ্য (নিজেকে বিভক্ত করে); কথং বা প্রাতিষ্ঠতে (কিভাবে তিনি থাকেন); কেন উৎক্ৰমতে (কিভাবে তিনি [শরীর] পরিত্যাগ করেন); কথং বাহ্যম্‌ অভিধত্তে (কিভাবে তিনি বাইরের বস্তু অর্থাৎ জীবজন্তু ও পদার্থসমূহকে ধারণ করেন); কথম্ অধ্যাত্মম্ ইতি (অথবা শরীরের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলি [কিভাবে ধারণ করেন])?

সরলার্থ: অতঃপর অশ্বলপুত্র কৌসল্য ঋষি পিপ্পলাদকে জিজ্ঞাসা করলেন : হে ভগবান, প্রাণ কোথা থেকে আসেন? শরীরে তিনি কিভাবে প্রবেশ করেন? কিভাবে তিনি নিজেকে সারা দেহে ছড়িয়ে দেন এবং কিভাবেই বা নিজের কর্ম সম্পাদন করেন? কি কৌশলে তিনি শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান? কিভাবে তিনি বাইরের বস্তু অর্থাৎ প্রাণী ও পদার্থসমূহকে ধারণ করেন? ইন্দ্রিয় ইত্যাদি শরীরের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলিই বা কিভাবে তাঁকে আশ্রয় করে থাকে?

ব্যাখ্যা: এতক্ষণ আমরা প্রাণের বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু এই প্রাণের উৎপত্তি কোথা থেকে হল? এঁর উৎস কি এবং আরম্ভই বা কোথায়? এই জগতের স্রষ্টা কে? প্রশ্নটি অতি সঙ্গত। বেদান্ত মতে সৃষ্টি বলে কিছু নেই। ‘শূন্য’ থেকে কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না। যদি দেখি কিছু আছে তাহলে ধরে নিতে হবে তার পূর্বেও কিছু ছিল। বেদান্তমতে ব্রহ্ম সদা বিদ্যমান এবং ব্রহ্মই এই জগতের আশ্রয়। বস্তুত ব্রহ্মই একমাত্র আছেন।

তাহলে প্রাণ কিভাবে শরীরে প্রবেশ করেন ও শরীর ত্যাগ করেন? পিপ্পলাদ আগেই বলেছেন, প্রাণ নিজেকে পাঁচটি অংশে ভাগ করেন। এই বিভাগ কেমন করে সম্পন্ন হয় এবং বিভিন্ন অংশের কাজই বা কি? প্রাণকে আমরা প্রাণী, কীটপতঙ্গ ও নানা পদার্থের মধ্যে দেখতে পাই। এই দৃশ্যমান জগতে প্রতিটি পদার্থ, প্রতিটি অংশ এবং প্রতিটি প্রাণীর নির্দিষ্ট কর্তব্য আছে। প্রাণ কিভাবে এই সবকিছুকে চালনা করেন? কিভাবেই বা প্রাণ দেহের ভিতরের ও বাইরের বিষয়সমূহকে ধারণ করে থাকেন?

তস্মৈ স হোবাচাতিপ্ৰশ্নান্‌ পৃচ্ছসি ব্রক্ষিষ্ঠোঽসীতি

তস্মাত্তেঽহং ব্রবীমি॥২

অন্বয়: তস্মৈ সঃ হ উবাচ (তিনি তাঁকে বললেন); অতিপ্রশ্নান্ পৃচ্ছসি (তুমি দুরূহ সব প্রশ্ন করছ); ব্রহ্মিষ্ঠঃ অসি ([কিন্তু] তুমি ব্রহ্মে সমর্পিত); তস্মাৎ তে অহং ব্রবীমি (সুতরাং আমি [তোমার প্রশ্নের] উত্তর দেব)।

সরলার্থ: ঋষি পিপ্পলাদ কৌসল্যকে বললেন, ‘অত্যন্ত কঠিন বিষয়ে তুমি প্রশ্ন করছ। কিন্তু যেহেতু তুমি ব্রহ্মনিষ্ঠ, আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।’

ব্যাখ্যা: ছাত্র সঠিক প্রশ্ন করলে গুরু প্রসন্ন হন। তাই পিপ্পলাদ কৌসল্যকে বললেন : তুমি আমাকে ‘অতিপ্রশ্নান্‌’ অর্থাৎ অত্যন্ত কঠিন সব প্রশ্ন করছ। প্রাণ বিষয়টি অতি দুরূহ এবং তোমার সব প্রশ্নই প্রাণকে নিয়ে। তুমি ‘ব্রহ্মিষ্ঠ’, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানলাভে তোমার একান্ত নিষ্ঠা। বিষয়টি তুমি গভীরভাবে চিন্তা করেছ। আর.সেইজন্যই তুমি এইসব প্রশ্ন করছ। পিপ্পলাদ বললেন, ‘আমি সানন্দে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।’

আধ্যাত্মিক বিষয়ে অধিকাংশ মানুষের কোন উৎসাহ বা আগ্রহ নেই। তাঁরা বলেন, ‘ঈশ্বর আছে কি নেই এ বিষয়ে আমার কোন কৌতূহল নেই। এ প্রশ্ন আমার কাছে নিরর্থক।’ বস্তুত উদাসীন হওয়ার থেকে নাস্তিক হওয়া ভাল। বিষয়টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে যদি কেউ সিদ্ধান্ত করেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, সেটা বরং বোঝা যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ঈশ্বর নিয়ে কোন ভাবনা-চিন্তাই করেন না, সেটাই পরিতাপের বিষয়। তাঁরা বিষয়টিকে সর্বতোভাবে এড়িয়ে চলেন। ফলে সত্য তাঁদের কাছে অধরাই থেকে যায়।

আত্মন এষ প্রাণো জায়তে যথৈষা পুরুষে ছায়ৈতস্মিন্নেতদাততং

মনোকৃতেনায়াত্যস্মিঞ্‌শরীরে॥৩

অন্বয়: এষঃ প্রাণঃ আত্মনঃ জায়তে (এই প্রাণ আত্মা থেকে আসেন); পুরুষে যথা ছায়া (যেমন দেহের একটি ছায়া আছে); [একই ভাবে] এতৎ (এই [প্রাণ]); এতস্মিন্ (আত্মাতে); আততম্ (অন্তর্নিহিত); মনোকৃতেন (ইচ্ছা হলে); অস্মিন্ শরীরে আয়াতি (এই স্থূল দেহে আসেন)।

সরলার্থ: প্রাণ আত্মা থেকে আসেন। দেহকে আশ্রয় করে যেমন ছায়া থাকে তেমনি আত্মায় প্রাণ নিহিত রয়েছেন। ইচ্ছা হলে এই প্রাণ স্থূল শরীর ধারণ করেন।

ব্যাখ্যা: আত্মা থেকে অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে প্রাণের উৎপত্তি। সবকিছু সেই এক আত্মা থেকে আসে আবার আত্মাতেই ফিরে যায়। সমুদ্রে তরঙ্গ ওঠে, কিছুক্ষণ থেকে আবার তা সমুদ্রেই মিশে যায়। এই তরঙ্গরাশিকে কি সমুদ্র থেকে আলাদা করা যায়? না, তা সম্ভব নয়।

উপনিষদ প্রাণকে ছায়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমাদের শরীর আছে এবং তার ছায়াও আছে। এই ছায়া কোথা থেকে আসে? শরীর থেকে। অনুরূপভাবে প্রাণ আত্মা থেকে আসেন। প্রাণকে আত্মা থেকে পৃথক করা যায় না—যেমন তরঙ্গকে সমুদ্র থেকে বা ছায়াকে দেহ থেকে পৃথক করা যায় না। আচার্য শঙ্কর বলেন, এই ছায়া ‘অনৃত’ অর্থাৎ অসত্য। ছায়ায় কোন বস্তু নেই, অতএব তা স্বতন্ত্র নয়। ঠিক সেইরকম প্রাণ সম্পূর্ণভাবে আত্মার উপর নির্ভরশীল এবং সেই অর্থে অসত্য বা মিথ্যা। প্রাণকে যে সত্য বলে মনে হয় তার কারণ প্রাণ সত্যকে অর্থাৎ আত্মাকে আশ্রয় করে আছেন। আবার একই অর্থে জগৎও সত্য যেহেতু সত্যই জগৎকে ধরে আছেন। সেই সত্যস্বরূপই জগতের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হন।

পরবর্তী প্রশ্ন ছিল—প্রাণ কিভাবে শরীরে প্রবেশ করেন? উপনিষদ বলেন, আমাদের মনের গতি (মনোকৃতেন) অর্থাৎ আমাদের প্রবণতা, আকাঙ্ক্ষা, সঙ্কল্প ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের দেহের গঠন হয়। মনই শরীরকে সৃষ্টি করে। কেউ হয়তো সবল, সুন্দর দেহের অধিকারী; আবার কারোর দেহ জীর্ণ, দুর্বল। তাছাড়া অন্যান্য প্রাণী ও কীটপতঙ্গ তো আছেই। আবার মানুষের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যাঁরা নরোত্তম।

সুন্দর মনই সুন্দর দেহ সৃষ্টি করে। যে মন সবসময় সৎ চিন্তা করে, ঘৃণা ক্রোধ ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেয় না সেই মনই সুন্দর। আর যাঁরা সুন্দর মনের অধিকারী তাঁরা বলেন, ‘এই শরীর ভোগের জন্যে নয়, বাসনা চরিতার্থ করার জন্যেও নয়। শরীর থাকলে আমরা শাস্ত্রপাঠ করতে পারি, সত্যকে জানার চেষ্টা করতে পারি। শরীর না থাকলে সত্যের অনুসন্ধান সম্ভব নয়।’ কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের মনকে সংযত করতে পারেন না। তাঁরা লোভ ক্রোধ ইত্যাদি রিপুর বশীভূত হয়ে ভিন্ন ধরনের শরীর লাভ করেন।

এই শরীরকে কখনও কখনও ‘ভোগায়তন’ অর্থাৎ ‘ভোগের স্থান’ বলে উল্লেখ করা হয়, কারণ দেহ ছাড়া আমরা বাসনা চরিতার্থ করতে পারি না। আমাদের মনে ভালমন্দ নানারকম আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। হয়তো কোন কারণে সেই বাসনা এই জীবনে অপূর্ণই থেকে গেল। কিন্তু যেহেতু সেই আকাঙ্ক্ষা মনে থেকেই যায়, পরজন্মে আবার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপযুক্ত শরীর লাভ হয়। উপনিষদ প্রকারান্তরে বলতে চাইছেন, ‘তুমিই তোমার ভাগ্যবিধাতা।’

পুনর্জন্মের এই ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেদান্তদর্শনে শরীরকে বলা হয়েছে ‘জলৌকাবৎ’ অর্থাৎ জোঁকের মতো। জোঁক যেমন গাছের এক পাতা থেকে আর এক পাতায় যায়, প্রাণও তেমনি এক দেহ থেকে অন্য দেহে যান। আমাদের কামনা-বাসনাই বারবার আমাদের এই জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

যথা সম্রাড়েবাধিকৃতান্ বিনিযুঙ্‌ক্তে।

এতান্ গ্রামানেতান্‌ গ্রামানধিতিষ্ঠস্বেত্যেবমেবৈষ প্রাণ ইতরান্‌

প্রাণান্ পৃথক্‌ পৃথগেব সন্নিধত্তে॥৪

অন্বয়: যথা সম্রাট এব অধিকৃতান্‌ বিনিযুঙ্‌ক্তে (সম্রাট যেমন তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন); এতান্ গ্রামান্ এতান্ গ্রামান্ অধিতিষ্ঠস্ব ইতি (‘অমুক অমুক গ্রামে যাও এবং তাদের দেখাশোনা কর’—এই বলে); এবম্ এব এষঃ প্রাণঃ (একই ভাবে এই প্রাণ); ইতরান্‌ প্রাণান্‌ পৃথক্‌ পৃথক্‌ এব সন্নিধত্তে (তাঁর অধীনস্থ কর্মীদের অর্থাৎ চোখ এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়সমূহকে তাদের যথানির্দিষ্ট কর্মে নিযুক্ত করেন)।

সরলার্থ: সম্রাট যেমন তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করে বলেন—‘অমুক অমুক গ্রামে যাও এবং তাদের দেখাশোনা কর’—ঠিক সেইভাবে প্রাণ তাঁর অধীনস্থ ইন্দ্রিয়সমূহকে যথানির্দিষ্ট কর্মে নিযুক্ত করেন।

ব্যাখ্যা: প্রাণের কাজ কি? প্রাণকে এখানে সম্রাট বলা হয়েছে। এই সম্রাট এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি। সম্রাট থাকলে সম্রাটের অধীনস্থ বহু শাসকও থাকেন। রাজ্যের এক একটি অংশের শাসনভার এক একজন শাসকের হাতে দিয়ে সম্রাট বলেন—‘যাও, শাসন কর।’ এইভাবে তাঁদের দিয়েই সম্রাট সাম্রাজ্য শাসন করেন। সেইরকম দেহে ইন্দ্রিয়সমূহও প্রাণের অধীন। প্রাণ প্রত্যেক ইন্দ্রিয়কে নিজ নিজ কর্তব্য ও এলাকা ভাগ করে দেন। তারা কিন্তু শাসন করে প্রাণেরই নির্দেশে। প্রাণের আদেশ তারা মেনে চলে। এই অধীনস্থ ইন্দ্রিয়গুলি হল চোখ, কান, নাক ইত্যাদি।

পায়ূপস্থেঽপানং চক্ষুঃশ্রোত্রে মুখনাসিকাভ্যাং প্রাণঃ স্বয়ং

প্রাতিষ্ঠতে মধ্যে তু সমানঃ এষ হ্যেতদ্ধুতমন্নং সমং নয়তি

তস্মাদেতাঃ সপ্তাৰ্চিষো ভবন্তি॥৫

অন্বয়: পায়ু উপস্থে অপানম্ (প্রাণ গুহ্য ও জননেন্দ্রিয়ের তত্ত্বাবধান করতে অপানকে নিযুক্ত করেন); মুখ-নাসিকাভ্যাং চক্ষুঃ-শ্রোত্রে স্বয়ং প্রাণঃ প্রাতিষ্ঠতে (মুখ, নাক, চোখ এবং কানে প্রাণ নিজে অবস্থান করেন); মধ্যে তু সমানঃ (পাকস্থলীর দেখাশোনা করে সমান); হি (সুতরাং); এষঃ (এই [সমান]); হুতম্ (ভুক্ত, যা খাওয়া হয়েছে); অন্নম্ (খাদ্য); সমং নয়তি (সমভাবে খাদ্যকে সারবস্তুতে [যেমন রক্তে] রূপান্তরিত করে); তস্মাৎ ([প্রাণের অগ্নি] থেকে); এতাঃ সপ্ত (এই সাত [ইন্দ্রিয় যথা দুই চোখ, দুই নাসারন্ধ্র, দুই কান এবং জিভ]); অর্চিষঃ ভবন্তি (অগ্নিশিখার মতো প্রকাশ পায়) [আমাদের সঠিক জ্ঞান দেয়]।

সরলার্থ: এই প্রাণ গুহ্য ও জননেন্দ্রিয়ের তত্ত্বাবধান করতে অপানকে নিযুক্ত করেন। চোখ, কান, মুখ ও নাসারন্ধ্রে প্রাণ নিজে অবস্থান করেন। শরীরের কেন্দ্রীয় অংশের তত্ত্বাবধান করে সমান। সমান খাদ্যকে পরিপাক করে সার পদার্থে পরিণত করে (যেমন রক্তে)। প্রাণের অগ্নি (যা পাকস্থলীর মধ্যে) থেকে সাতটি শিখা নির্গত হয় (যা হল সাতটি ইন্দ্রিয় : যথা দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র এবং জিভ)।

ব্যাখ্যা: উপনিষদে আগেই বলা হয়েছে প্রাণ নিজেকে পাঁচভাগে ভাগ করেন : যথা প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান এবং উদান। এই পাঁচ অংশের পাঁচরকম কাজ। প্রাণ মুখ্য বায়ুরূপে শরীরের প্রধান কাজগুলি যেমন শ্বাসক্রিয়া, শোনা, দেখা ইত্যাদি নিজের দায়িত্বে রাখেন। শরীরের আবর্জনা বের করার জন্য গুহ্য ইন্দ্রিয়ের ভার অপানের উপর ন্যস্ত। জননেন্দ্রিয়ের তত্ত্বাবধানও অপানই করে।

জঠর অর্থাৎ পাকস্থলীর ভিতর রয়েছে ‘সমান’। ‘সমান’ খাদ্য ও পানীয়কে সারা শরীরে সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়। জঠরে অগ্নি আছে। আমরা যা কিছু খাদ্য গ্রহণ করি তা জঠরাগ্নিতে পরিপাক হয়। হিন্দুমতে, আহার করা যেন একটি যজ্ঞ যেখানে জঠরাগ্নিতে খাদ্যরূপ আহুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই লোভের বশে খায় এবং বেশী খেয়ে ফেলে। যতটা খাদ্য আমরা হজম করতে পারি, ঠিক সেই পরিমাণই আমাদের খাওয়া উচিত।

এই অগ্নির সঙ্গে থাকে সাতটি শিখা (সপ্ত অর্চিষঃ)। এই সাত শিখা হল : দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র এবং জিভ। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয় জিভ তা কথা দিয়ে প্রকাশ করে। যেখানেই অগ্নি আছে সেখানে এই সাতটি শিখার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করে। অগ্নি না থাকলে অথবা সেই অগ্নিতে আহুতি না দিলে চোখ দেখতে পায় না, কান শুনতে পায় না, নাক কোন গন্ধ পায় না এবং জিভ কথা বলতে পারে না। এইভাবে ইন্দ্রিয়গুলি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে।

হৃদি হ্যেষ আত্মা। অত্রৈতদেকশতং নাড়ীনাং তাসাং শতং

শতমেকৈকস্যা দ্বাসপ্ততির্দ্বাসপ্ততিঃ প্ৰতিশাখানাড়ীসহস্রাণি

ভবন্ত্যাসু ব্যানশ্চরতি॥৬

অন্বয়: হৃদি হি এষঃ আত্মা (হৃদয়েই আত্মা বাস করেন); অত্র (এই হৃদয়ে); নাড়ীনাম্‌ এতৎ একশতম্ (একশ এক ধমনী বিদ্যমান); তাসাম্ একৈকস্যাঃ শতং শতম্‌ (প্রতি ধমনীর একশত শাখা); প্রতিশাখানাড়ী সহস্রাণি দ্বাসপ্ততির্দ্বাসপ্ততিঃ ভবন্তি (প্রতি শাখার বাহাত্তর হাজার উপশাখা আছে); আসু (এরমধ্যে [শাখা প্রশাখায়]); ব্যানঃ চরতি (ব্যান বিচরণ করে)।

সরলার্থ: হৃদয়ই আত্মার আসন। এই হৃদয়ে একশ একটি ধমনী রয়েছে। প্রতিটি ধমনীর একশ শাখা এবং প্রতিটি শাখার বাহাত্তর হাজার উপশাখা। ব্যান এই ধমনী ও তার শাখাপ্রশাখার মধ্য দিয়ে চলাচল করে।

ব্যাখ্যা: হৃদয় শরীরের প্রধানতম অঙ্গ। বেদান্তদর্শনে বলা হয় আত্মার স্থান হৃদয়ে। আচার্য শঙ্কর বলেন, হৃদয়মধ্যস্থ আকাশে (হৃদয়াকাশে) আত্মা রয়েছেন। হৃদয়ের মধ্যে আকাশ আছে। সেই আকাশ অধিকার করে আছেন আত্মা তথা প্রাণ। হৃদয়েই প্রাণের অধিষ্ঠান। প্রাণ বেরিয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। হৃদয়ের আকৃতি পদ্মকুঁড়ির মতো বলা হয়। সেইজন্য হৃদয় বোঝাতে ‘হৃদয়পদ্ম’ শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করা হয়।

শিরা, ধমনী ও স্নায়ু বোঝাতে এখানে একটি সাধারণ শব্দ ‘নাড়ী’ ব্যবহার করা হয়েছে। হৃৎপিণ্ড থেকে বহু ধমনী ও শিরা বেরোয়। সেগুলির মধ্যে দিয়ে হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত সমপরিমাণে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শঙ্করাচার্য এই শিরা ও ধমনীগুলিকে সূর্যকিরণের সাথে তুলনা করেছেন—সূর্য থেকে বেরিয়ে কিরণরাশি যেমন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, এ-ও ঠিক তেমনি। প্রাণের যে-অংশ শরীরের সর্বত্র সমানভাবে রক্ত ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করে তাকে বলা হয় ব্যান। উপনিষদ বলেন, হৃদয়ে একশ একটি নাড়ী আছে, প্রতিটি নাড়ীর একশটি শাখা। আবার প্রতি শাখার বাহাত্তর হাজার প্রশাখা। এই সংখ্যা অবশ্য আক্ষরিকভাবে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রতিটি শিরা, ধমনী, স্নায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে যদিও তা হয়তো আমাদের কাছে এখনও তত স্পষ্ট নয়।

অথৈকয়োর্ধ্ব উদানঃ পুণ্যেন পুণ্যং লোকং নয়তি পাপেন

পাপমুভাভ্যামেব মনুষ্যলোকম্‌॥৭

অন্বয়: অথ (এবং); একয়া (একটি ধমনী দ্বারা [অর্থাৎ সুষুম্না]); ঊর্ধ্বঃ (ঊর্ধ্বগামী হয়ে); উদানঃ (প্রাণের অধীনস্থ উদানবায়ু); পুণ্যেন (পুণ্যকর্মের দ্বারা); পুণ্যং লোকং নয়তি ([যে ব্যক্তি এরূপ পুণ্যকাজ করে তাকে] পুণ্যলোকে নিয়ে যায়); পাপেন পাপম্ (পাপকর্মের ফলে পাপলোকে); উভাভ্যাম্ এব (যখন পুণ্য এবং পাপকর্ম উভয়ই সমান); মনুষ্যলোকম্‌ (মানুষ সাধারণত যেই লোকে যায় তাকে সেই লোকে নিয়ে যায়)।

সরলার্থ: যদি কোন মানুষ পুণ্যকর্ম করে থাকে তবে মৃত্যুকালে উদান তাকে সুষুম্না নাড়ীর মধ্য দিয়ে পুণ্যলোকে নিয়ে যায়। আবার যদি মানুষ পাপকর্ম করে তাহলে উদান তাকে পাপলোকে নিয়ে যায়। কিন্তু যদি কেউ পাপ-পুণ্য উভয়বিধ কর্ম সমপরিমাণে করে থাকে তবে উদানের সাহায্যে সে মনুষ্যলোকে যায়।

ব্যাখ্যা: উদানের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যুকালে উদান জীবাত্মাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়। মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনটি ধমনী রয়েছে। কেন্দ্রের ধমনী অর্থাৎ সুষুম্নার মধ্য দিয়ে আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

মানুষের আত্মা যখন দেহত্যাগ করে, সেই সময় উদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি কেউ পুণ্যকর্ম করে, সৎ জীবন যাপন করে তবে উদান তাকে পুণ্যলোকে নিয়ে যায়। আবার যে মানুষ পাপকাজে জীবন অতিবাহিত করে তাকে উদান পাপলোকে নিয়ে যায়। তেমনি যে মানুষ ভাল-মন্দ দুই কাজই সমপরিমাণে করেছে উদান তাকে নিয়ে যায় সাধারণ মনুষ্যলোকে। সেখানে তার জন্য না থাকে পুরস্কার, না থাকে শাস্তি।

আদিত্যো হ বৈ বাহ্যঃ প্রাণ উদয়ত্যেষ হ্যেনং চাক্ষুষং

প্রাণমনুগৃহ্নানঃ। পৃথিব্যাং যা দেবতা সৈষা

পুরুষস্যাপানমবষ্টভ্যান্তরা যদাকাশঃ স সমানো বায়ুর্ব্যানঃ॥৮

অন্বয়: আদিত্যঃ হ বৈ বাহ্যঃ প্রাণঃ (সূর্য বাইরের প্রাণ); এষঃ হি (এই সূর্য); এনং চাক্ষুষং প্রাণম্ অনুগৃহ্নানঃ (চক্ষুমধ্যস্থ প্রাণকে অনুগ্রহ করে); উদয়তি (উদিত হয়); পৃথিব্যাং যা দেবতা (পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা); সা এষা (সেই দেবতা); পুরুষস্য অপানম্‌ অবষ্টভ্য (অপান বায়ুকে দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে) [অপান অর্থাৎ যে নিঃশ্বাস আমরা ত্যাগ করি এবং যা আমাদের ভূমিতে ধরে রাখে, উপরে উঠে যেতে দেয় না]; অন্তরা যৎ আকাশঃ (দ্যুলোক এবং ভূলোকের মধ্যস্থ আকাশে যে বায়ু); সঃ সমানঃ (তাকেই বলা হয় সমান); বায়ুঃ ব্যানঃ (সাধারণ বায়ুকে বলা হয় ব্যান)।

সরলার্থ: সূর্যই বাইরের প্রাণ। চোখকে অনুগ্রহ করতেই যেন সূর্যের উদয় হয়, যাতে চোখ সব কিছু দেখতে পায়। এই প্রাণই পৃথিবীর অধিপতি দেবতা এবং তিনি তাঁর অধীনস্থ অপানকে দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। সেই কারণেই কোন বস্তু উপরেও উঠে যায় না আবার মাটিতেও পড়ে না; অপান সব কিছুকে নিজের নিজের জায়গায় ধরে রাখে। দ্যুলোক এবং ভূলোকের অন্তর্বর্তী আকাশে বায়ু রয়েছে। সেই বায়ুই সমান এবং তা প্রাণের অধীন। প্রাণের অপর এক অধীনস্থ বায়ু হল ব্যান যা শরীরের ভিতরে বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

ব্যাখ্যা: সব কিছুর ভিতরে এবং বাইরে সেই একই প্রাণ রয়েছেন, যদিও তাঁর নাম ও রূপ ভিন্ন ভিন্ন। বাইরের জগতে সূর্যই প্রাণ, আবার আমাদের শরীরের মধ্যে চোখও প্রাণ। অপানরূপে প্রাণ পৃথিবীকে এবং প্রতিটি বস্তুকে নিজের নিজের জায়গায় ধরে রাখেন; উপরে উঠে যেতে দেন না আবার নীচে পৃথিবীতেও পড়তে দেন না। আবার ব্যানরূপে প্রাণ শরীরের ভিতরে ও বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছেন।

প্রাণ প্রজাপতিরূপে ছোট-বড়, ভিতর-বার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।

তেজো হ বা উদানস্তস্মাদুপশান্ততেজাঃ। পুনর্ভবমিন্দ্রিয়ৈর্মনসি

সম্পদ্যমানৈঃ॥৯

অন্বয়: তেজঃ হ বৈ উদানঃ (অগ্নিই উদান); তস্মাৎ (সুতরাং); উপশান্ততেজাঃ (যার দেহের আগুন নিভে গেছে [অর্থাৎ যখন তার মৃত্যু হয়েছে]); মনসি সম্পদ্যমানৈঃ ইন্দ্রিয়ৈঃ (সমস্ত ইন্দ্রিয় তার মনে সংহত হয়); পুনর্ভবম্‌ [প্রতিপদ্যতে] (পুনর্জন্ম হয়)।

সরলার্থ: অগ্নিই উদান। মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তার শরীর শীতল হয়ে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয় এবং সে জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয়।

ব্যাখ্যা: মৃত্যুর লক্ষণ কী? প্রথমে আমরা বাক্‌শক্তি হারাই। এই অবস্থায় দেখা বা শোনা হয়তো সম্ভব হয়, কিন্তু কথা বলা সম্ভব হয় না। তারপরে একে একে সব ইন্দ্রিয়ের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, যদিও শেষপর্যন্ত মন সচেতন থাকে। মনও যখন শরীর ত্যাগ করে তখন আমরা চেতনা হারাই। অবশ্য যতক্ষণ শরীরের উত্তাপ থাকে ততক্ষণ আমরা জীবিত। মৃত্যুর লক্ষণ হল শরীরে উত্তাপের অভাব।

মৃত্যুকালে আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে যায় তখন সে একা যায় না। মন এবং সূক্ষ্ম অবস্থায় সমস্ত ইন্দ্রিয় আত্মাকে অনুসরণ করে। সাধারণত নাসারন্ধ্র অথবা মুখগহ্বরের ভিতর দিয়ে আত্মা শরীর ত্যাগ করে। পুণ্যাত্মা ব্যক্তির ক্ষেত্রে অবশ্য ব্রহ্মরন্ধ্র অর্থাৎ মস্তকের শীর্ষদেশের ছিদ্র দিয়েও আত্মা বেরিয়ে যেতে পারে।

যচ্চিত্তস্তেনৈষ প্রাণমায়াতি। প্রাণস্তেজসা যুক্তঃ সহাত্মনা

যথাসঙ্কল্পিতং লোকং নয়তি॥১০

অন্বয়: এষঃ (এই ব্যক্তি); যৎ চিত্তঃ ([মৃত্যুকালে] যেমন সে চিন্তা করে); তেন প্রাণম্‌ আয়াতি ([সেই চিন্তা নিয়ে] সে প্রাণের সঙ্গে যুক্ত হয়); প্রাণঃ তেজসা সহ যুক্তঃ (প্রাণ তখন অগ্নির [উদান] সঙ্গে যুক্ত হয়); আত্মনা যথা সঙ্কল্পিতং লোকং নয়তি (জীবাত্মাকে তার অভীষ্ট লোকে নিয়ে যায় [এবং তারপরে আত্মা নূতন জন্ম গ্রহণ করে]।

সরলার্থ: মৃত্যুকালে জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের যত চিন্তা ও বাসনা সমূহ। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদানের সঙ্গে যুক্ত হয় (কেননা উদানই তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়)। আত্মা যে লোক কামনা করে প্রাণ তাকে সেই লোকেই নিয়ে যায়। তারপরে আত্মা নতুন জন্ম গ্রহণ করে।

ব্যাখ্যা: মানুষের যখন মৃত্যু হয়, তার সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি তখন দুর্বল হয়ে আসে। মৃত্যুকালেও মানুষের অনেক অপূর্ণ বাসনা থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলি চরিতার্থ হবার আর কোন উপায় থাকে না। অতএব, মন ও তার অপূর্ণ বাসনা এবং সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গুলিকে সঙ্গে নিয়ে জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। প্রাণ তখন তার অধীনস্থ উদানের (উত্তাপ) সাহায্যে আত্মাকে তার অভীষ্ট লোকে নিয়ে যায়। জীবাত্মা সেখানে কিছুকাল থেকে আবার নতুন জন্ম নেয়।

য এবং বিদ্বান্ প্রাণং বেদ ন হাস্য প্রজা হীয়তেঽমৃতো ভবতি

তদেষঃ শ্লোকঃ॥১১

অন্বয়: বিদ্বান্‌ (জ্ঞানী ব্যক্তি); যঃ প্রাণম্ এবম্‌ বেদ (এইভাবে যিনি প্রাণকে জানেন); অস্য প্রজাঃ ন হ হীয়তে (তিনি কখনও তাঁর সন্তানকে হারান না); অমৃতঃ ভবতি (তিনি অমরত্ব লাভ করেন); তৎ এষঃ শ্লোকঃ (এখানে এই তত্ত্বের প্রতিপাদক একটি শ্লোক আছে)।

সরলার্থ: যে জ্ঞানী ব্যক্তি প্রাণকে এইভাবে জেনেছেন (অর্থাৎ প্রজাপতি বা হিরণ্যগর্ভরূপে) তিনি কখনও সন্তানকে হারান না (কেননা তিনি জানেন প্রজাপতির সঙ্গে তিনি অভিন্ন) এবং তিনি অমরত্ব প্রাপ্ত হন। এই তত্ত্বকে সমর্থন করে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: প্রাণকে প্রাণাত্মা, প্রজাপতি এবং হিরণ্যগর্ভও বলা হয়। এ হল সমষ্টি মনে প্রকাশিত চৈতন্য। প্রাণকে জানলে মানুষ প্রাণের সঙ্গে অভিন্ন বোধ করে। তখন সে জানে প্রাণরূপে সে কারো পিতামাতা হতে পারে না, সুতরাং তার সন্তানও থাকতে পারে না। সন্তান থাকলে কালে তার মৃত্যু হবেই। এককথায় বলতে গেলে, সে তখন অনুভব করে সে অমর।

উৎপত্তিমায়তিং স্থানং বিভুত্বং চৈব পঞ্চধা। অধ্যাত্মং চৈব

প্রাণস্য বিজ্ঞায়ামৃতমশ্নুতে বিজ্ঞায়ামৃতমশ্নুত ইতি॥১২

অন্বয়: প্রাণস্য উৎপত্তিম্‌ (প্রাণের উৎপত্তি); আয়তিম্‌ (শরীরে আসে অর্থাৎ শরীর ধারণ করে); স্থানম্ (শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান); পঞ্চধা বিভুত্বং চ এব (পাঁচটি অংশের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে); অধ্যাত্মং চ এব (শরীরের ভিতরে [যেমন চোখে] এবং বাইরে [যেমন সূর্যরূপে]); বিজ্ঞায় অমৃতম্ অশ্নুতে (প্রাণকে এভাবে জেনে তুমি অমৃতত্ব লাভ কর) [শেষ কথাটি বার বার বলা হয়েছে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেবার জন্য এবং অধ্যায়ের সমাপ্তি বোঝাবার জন্য]।

সরলার্থ: প্রাণ পরমাত্মা থেকে আসে। তারপর বাসনা পূরণের জন্য উপযুক্ত শরীর গ্রহণ করে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে নিজেকে স্থাপন করে। প্রাণের প্রতিটি অংশের জন্য আবার পৃথক পৃথক কাজ ভাগ করা থাকে। বাইরের প্রাণই সূর্য; আবার শরীরের মধ্যে চোখই প্রাণ। প্রাণ ও তার কার্যকলাপ বুঝতে পারলে মানুষ অমর হয় (কারণ তখন সে জানে সে-ই স্বয়ং প্রাণ)।

ব্যাখ্যা: প্রাণের (সমষ্টি শক্তি) উৎপত্তি আত্মা থেকে। বস্তুত প্রাণ আত্মারই বিকার। মনে বাসনা থাকলে প্রাণ শরীর গ্রহণ করে। শরীরে সে নিজেকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান)। প্রতিটি ভাগকে শরীরের একটি বিশেষ অংশ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেমন অপান পায়ু (বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের অঙ্গ) এবং উপস্থের (জননেন্দ্রিয়) ভারপ্রাপ্ত। প্রাণ স্বয়ং চোখ ও কানকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমানের উপর থাকে শরীরের মধ্যভাগের দায়িত্ব। ব্যান ধমনীসমূহকে ও উদান সুষুম্না নাড়ীকে নিয়ন্ত্রণ করে। মৃত্যুকালে প্রাণ উদানের সাহায্যেই দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

শরীরের বাইরে প্রাণ সূর্যরূপে প্রকাশিত। আর দেহের ভিতরে চক্ষুরূপে। বস্তুত প্রাণ শরীরের ভিতরের ও বাইরের সমস্ত উপাদান যথা ক্ষিতি, তেজ, বায়ু ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাণকে জানলে মানুষ প্রাণের সঙ্গে অভিন্ন বোধ করে। সেই অবস্থায় সে জন্ম-মৃত্যুর পারে চলে যায়, অর্থাৎ অমর হয়।

এখানেই প্রশ্ন উপনিষদের তৃতীয় প্রশ্ন সমাপ্ত।

চতুর্থ প্রশ্ন

অথ হৈনং সৌর্যায়ণী গার্গ্যঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন্নেতস্মিন্ পুরুষে

কানি স্বপন্তি কান্যস্মিঞ্জাগ্রতি কতর এষ দেবঃ স্বপ্নান্‌ পশ্যতি

কস্যৈতৎ সুখং ভবতি কস্মিন্নু সর্বে সম্প্রতিষ্ঠিতা ভবন্তীতি॥১

অন্বয়: অথ হ (তারপরে); সৌর্যায়ণী গার্গ্যঃ (গর্গ বংশের সৌর্যায়ণী); এনং পপ্ৰচ্ছ (তাঁকে [পিপ্পলাদকে] জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্‌ (ভগবান); এতস্মিন্ পুরুষে (এই শরীরে); কানি স্বপন্তি (কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয় নিদ্রা যায়); অস্মিন্ কানি জাগ্ৰতি (একই শরীরের কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয় জেগে থাকে); কতরঃ এষঃ দেবঃ [এই দুই দেবতার মধ্যে কোন্‌টি] (একটি নিদ্রিত এবং অপরটি জাগ্রত); স্বপ্নান্‌ পশ্যতি (স্বপ্ন দেখে); কস্য এতৎ সুখং ভবতি (কে সেই [সুষুপ্তির] আনন্দ উপভোগ করে); কস্মিন্ নু (কার উপর); সর্বে সম্প্রতিষ্ঠিতাঃ ভবন্তি ইতি (এই সকলে আশ্রয় গ্রহণ করে)?

সরলার্থ: তারপরে গর্গ বংশের সৌর্যায়ণী পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করলেন, হে ভগবান, মানুষের শরীরে কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয় নিদ্রা যায় এবং বিশ্রাম গ্রহণ করে? কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয়ই বা জেগে থাকে এবং কাজ করে? এই দুই প্রকার ইন্দ্রিয়ের মধ্যে (একটি সক্রিয়,অপরটি নিষ্ক্রিয়).কোন্‌টি বা স্বপ্ন দেখে? সুষুপ্তির আনন্দই বা কে উপভোগ করে? সুষুপ্তির অবস্থায় সকল ইন্দ্রিয় কোথায়ই বা যায়?

ব্যাখ্যা: সমগ্র জীবকুলই এই নিদ্রা নামক অভিজ্ঞতার অধীন। শুধুমাত্র মানুষই নয়, পশু, পক্ষী, কীট-পতঙ্গ সকলেই ঘুমোয়। কিন্তু আমাদের দেহের কোন্‌ অংশটি ঘুমোয়? দেহ? ইন্দ্রিয়? কিংবা আর কিছু? এটা খুব সহজ প্রশ্ন। বস্তুত আমাদের সকলেরই এই তিন রকম অভিজ্ঞতা হয়—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। এখন প্রশ্ন হল, কে স্বপ্ন দেখে? এই দেহের মধ্যে কোন অংশটি জেগে থাকে? আমরা বলে থাকি, ‘আমি অমুক’। আমরা সকলেই এই ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এই ‘আমি’ই বা কে?

যখন আমরা জেগে থাকি তখন আমাদের শরীর এবং মন দুই-ই সক্রিয় থাকে। কিন্তু নিদ্রাবস্থায় আমাদের শরীর কোন কাজ করে না কিন্তু মন তখনও সক্রিয় থাকে। আমরা হয়তো বিছানায় শুয়ে আছি কিন্তু দেখছি আমি কাশী গেছি। আবার সুষুপ্তি অবস্থায় আমাদের দেহ, মন, দুই-ই তখন নিষ্ক্রিয়। উভয়ই তখন স্থির থাকে। তখন ইন্দ্রিয়সকল মনে লয় হয়, তাদের আর কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না।

বিভিন্ন নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়লে নদীর যেমন কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, এও যেন ঠিক তাই। এই গভীর নিদ্রা বা সুষুপ্তি অবশ্যই মুক্তি বা মোক্ষ নয়—কারণ অজ্ঞানতা তখনো বিদ্যমান। কাজেই সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমরা যখন জেগে উঠি তখন পূর্বে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই ফিরে আসি। এইমাত্র লাভ হয় যে, গভীর নিদ্রার পরে জাগ্রত হয়ে আমরা অত্যন্ত সতেজ বোধ করি।

আচার্য শঙ্কর বলেছেন, পূর্বের প্রশ্নগুলি অপরা বিদ্যা সংক্রান্ত। এটাই স্বাভাবিক, প্রথমে আমাদের আগ্রহ থাকে এই শরীর ও জগৎকে ঘিরে। আমরা হয়তো বিজ্ঞান, ইতিহাস, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারি। এইসব জানা ভাল। কিন্তু এই জ্ঞানই শেষ নয়। আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন অর্থাৎ পরা বিদ্যা লাভ করাই হল প্রকৃত জ্ঞান।

ধীরে ধীরে আমরা এই জাগতিক বিষয় থেকে দূরে সরে যাই, কারণ আমরা অনুভব করি এই দৃশ্যমান জগৎই সব নয়। এই জগতের বাইরেও আরও কিছু আছে যা ইন্দ্রিয়াতীত। এমন কিছু আছে যা এই জগৎকে ধরে রেখেছে। এই বিশ্ব সতত পরিবর্তনশীল। এই ক্রমাগত পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এই জগতের এমন কোন আশ্রয় আছে যা নিত্য এবং অপরিবর্তনীয়। এমন কোন সত্তা অবশ্যই আছেন যা আমাদেরও ধরে রেখেছেন। সেই সত্তাটি কি? সেই অপরিবর্তনীয় সত্তা হল—‘আত্মা’।

আত্মা আমাদের বাইরেও আছেন আবার ভেতরেও আছেন। বেদান্ত বলেন—যা বাইরে তাই অন্তরে। সমষ্টির ক্ষেত্রে যা সত্য ব্যষ্টির ক্ষেত্রেও তা সত্য। যে বিরাট ও বৈচিত্রময় জগৎ বাইরে আছে সেই জগৎই আবার ক্ষুদ্ররূপে আমাদের মনেও আছে। বস্তুত বাহির এবং অন্তর বলে আসলে কিছু নেই।

এই প্রসঙ্গে বেদান্ত একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। একটি পাত্রকে জলে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। ঐ পাত্রটির ভেতরে জল আছে, আবার বাইরেও আছে। আপাতদৃষ্টিতে পাত্রটি জলকে দুইভাগে ভাগ করেছে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে এক জলই পাত্রটির ভিতরে ও বাইরে আছে। ঠিক সেরকমভাবে একই আত্মা এই জগৎকে এবং আমাদের দেহকেও ধরে রেখেছেন।

আত্মা এবং এই দৃশ্যমান জগতের বস্তুসমূহের মধ্যেকার সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে মুণ্ডক উপনিষদ অগ্নি ও তার স্ফুলিঙ্গের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। সব বস্তুই আত্মা থেকে এসেছে আবার আত্মাতেই ফিরে যাবে। বস্তুসমূহের পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই।

তস্মৈ স হোবাচ। যথা গার্গ্য মরীচয়োঽর্কস্যান্তং গচ্ছতঃ সর্বা

এতস্মিংস্তেজোমণ্ডল একীভবন্তি। তাঃ পুনঃ পুনরুদয়তঃ প্ৰচরন্ত্যেবং হ

বৈ তৎ সর্বং পরে দেবে মনস্যেকীভবতি। তেন তর্হ্যেষ পুরুষো ন

শৃণোতি ন পশ্যতি ন জিঘ্রতি ন রসয়তে ন স্পৃশতে নাভিবদতে নাদত্তে

নানন্দয়তে ন বিসৃজতে নেয়ায়তে স্বপিতীত্যাচক্ষতে॥২

অন্বয়: তস্মৈ সঃ হ উবাচ (তিনি তাঁকে বললেন); গার্গ্য (হে গার্গ্য); যথা অস্তং গচ্ছতঃ অর্কস্য (সূর্য যখন অস্ত যায়); সর্বাঃ মরীচয়ঃ (সমস্ত রশ্মি); এতস্মিন্ তেজোমণ্ডলে একীভবন্তি (এই জ্যোতির্মণ্ডলে এক হয়ে যায়); পুনঃ উদয়তঃ (পুনরায় যখন সূর্য উদিত হয়); তাঃ (সেই কিরণরাশি); পুনঃ প্রচরন্তি (পুনরায় বিকীর্ণ হয়); এবং হ বৈ (একই ভাবে); তৎ সর্বম্ (সব ইন্দ্রিয়); পরে দেবে মনসি (শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে, মনে); একীভবতি (এক হয়ে যায়); তেন (সেই কারণে); তর্হি (সেই মুহূর্তে); এষঃ পুরুষঃ (এই পুরুষ); ন শৃণোতি (শোনে না); ন পশ্যতি (দেখে না); ন জিঘ্ৰতি (ঘ্রাণ নেয় না); ন রসয়তে (আস্বাদন করে না); ন স্পৃশতে (স্পর্শ করে না); ন অভিবদতে (অভিবাদন করে না); ন আদত্তে (গ্রহণ করে না); ন আনন্দয়তে (ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করে না); ন বিসৃজতে (মলমূত্র ত্যাগ করে না); ন ইয়ায়তে (কোথাও গমন করে না); স্বপিতি ([শুধু] নিদ্রা যায়); ইতি আচক্ষতে (তার সম্পর্কে লোকে এই কথা বলে)।

সরলার্থ: পিপ্পলাদ তখন তাঁকে বললেন: হে গার্গ্য, সূর্যাস্তের সময় সূর্যের রশ্মিসকল সূর্যেই ফিরে যায়। কিন্তু সূর্যোদয়ে সেই রশ্মিগুলি পুনরায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেইরূপ সুষুপ্তি অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল তাদের দেবতা মন, তাতে ফিরে যায় এবং মনের সঙ্গে এক হয়ে যায়। তখন ইন্দ্রিয়সকল কোন কাজ করে না। এর ফলে সুষুপ্তি অবস্থায় মানুষ (স্থূলদেহ) শোনে না, দেখে না, ঘ্রাণ নেয় না, স্বাদ গ্রহণ করে না, স্পর্শ করে না, কথা বলে না, কোন কিছু গ্রহণ করে না, ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করে না, মলমূত্র ত্যাগ করে না, চলাফেরাও করে না। অন্যেরা তখন তার সম্পর্কে বলে থাকে, ‘সে ঘুমিয়ে আছে’।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলেন, দিনের বেলা সূর্যের কিরণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সূর্য যখন অস্ত যায় তখন সেই কিরণরাশিই আবার সূর্যে ফিরে আসে। একইভাবে, আমরা যখন রাত্রিতে ঘুমাই তখন ইন্দ্রিয়সকল মনে ফিরে যায় (পরে দেবে মনসি একীভবতি)। ইন্দ্রিয়গুলি তখন মনে লীন হয়ে যায়। সেই অবস্থায় চোখ দেখে না, কান শোনে না, জিভ স্বাদ গ্রহণ করে না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সকল তখন কোন কাজ করে না, তারা তখন তাদের সমস্ত কার্যকলাপ মনের কাছে সমর্পণ করে।

এখানে মনকে ‘দেব’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ যা আলো দান করে, যা প্রকাশ করে। ‘পর’ অর্থ শ্রেষ্ঠ। মনই সকল ইন্দ্রিয়ের নেতা। অর্থাৎ মনই সব ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে।

প্রাণাগ্নয় এবৈতস্মিন্‌ পুরে জাগ্ৰতি। গার্হপত্যো হ বা এষোঽপানো

ব্যানোঽন্বাহার্যপচনো যদ্গার্হপত্যাৎ প্ৰণীয়তে প্রণয়নাদাহবনীয়ঃ প্রাণঃ॥৩

অন্বয়: এতস্মিন্‌ পুরে (এই শরীরে যা একটি নগরের সমান); প্রাণাগ্নয়ঃ এব জাগ্রতি (অগ্নিস্থানীয় এ প্রাণই সবসময় জেগে থাকে); এষঃ অপানঃ হ বৈ গার্হপত্যঃ (অপানই গার্হপত্য নামক অগ্নি); ব্যানঃ অন্বাহার্যপচনঃ (ব্যান বায়ুই দক্ষিণাগ্নি); যৎ (যেহেতু); গার্হপত্যাৎ (গার্হপত্য অগ্নি থেকে); প্ৰণীয়তে (পৃথকরূপে গৃহীত); প্রণয়নাৎ (এই পৃথক করার দ্বারা); প্রাণঃ আহবনীয়ঃ (প্রাণকেই আহবনীয় বলা হয়ে থাকে)।

সরলার্থ: এই দেহ একটি নগরের মতো। আমরা যখন ঘুমোই তখন অগ্নির সমান যে প্রাণ তা জেগে থাকে। অপান হল গার্হপত্য অগ্নি। আর ব্যান হল ‘অন্বাহার্যপচনঃ’ অর্থাৎ দক্ষিণাগ্নি। কারণ প্রাণকে গার্হপত্য অগ্নি থেকে নেওয়া হয়েছে।

ব্যাখ্যা: এই দেহকে কখনও কখনও পুর বা নগর বলা হয়ে থাকে। কারণ নগরের ভেতর ঢোকার জন্য অনেক দরজা থাকে। শরীরের দরজা বলতে দুটি চোখ, দুটি কান ও নাসারন্ধ্র ইত্যাদি বোঝায়। এই জগৎ সম্পর্কে যা কিছু অভিজ্ঞতা তা আমরা এই দরজার মাধ্যমেই লাভ করে থাকি।

প্রাচীনকালে গৃহস্থরা নির্দিষ্ট কিছু যাগযজ্ঞ করতেন। কোন কোন যন্ত্র প্রতিদিন করা হত আবার কোন কোন যজ্ঞ বিশেষ বিশেষ সময়ে করা হত। এই যজ্ঞসকল বিশাল, অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আজকাল আর এইসব যাগযজ্ঞ করা সম্ভব নয়।

কিন্তু উপনিষদ বলেন, এর বিকল্পও আছে। যেমন মানসপূজা অর্থাৎ মনে মনে পূজা করা। আমরা দেবতাকে মনে মনে ফল ফুল ইত্যাদি নানা অর্ঘ্য নিবেদন করে থাকি। ঠিক তেমনি শ্বাসকার্য এবং প্রাণের অন্যান্য কাজকর্মকে আমরা যাগযজ্ঞ বলে মনে করতে পারি। উপনিষদে ‘অগ্নিহোত্র’ যজ্ঞের কথা আছে। অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করতে হলে তিন রকমের অগ্নির প্রয়োজন, যথা—গার্হপত্য, আহবনীয় এবং দক্ষিণাগ্নি (অন্বাহার্যপচনঃ)। গার্হপত্য অগ্নির আগুন কখনও নেভে না। যজ্ঞের সময় গার্হপত্য অগ্নি থেকে আগুন নিয়ে আহবনীয় অগ্নিকে জ্বালানো হয়। অর্থাৎ অন্য অগ্নি থেকে এই আগুন নেওয়া হয় বলে এর নাম আহবনীয়। দক্ষিণাগ্নিও গার্হপত্য থেকে নেওয়া হয়। যজ্ঞবেদীর দক্ষিণ ভাগে থাকে বলে এর নাম দক্ষিণাগ্নি।

একইভাবে আমাদের দেহে প্রাণাগ্নি সবসময় জ্বলতে থাকে অর্থাৎ সবসময়ই তা সক্রিয়; যতক্ষণ আমরা জীবিত আছি ততক্ষণ আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস এবং ইন্দ্রিয়সকল প্রাণশক্তির মধ্য দিয়ে কাজ করে থাকে। অপান হল শ্বাসবায়ু ত্যাগ করা। অপানবায়ু যেহেতু সবসময়ই রয়েছে এবং এটা অপরিহার্য তাই একে গার্হপত্যের সাথে তুলনা করা হয়। যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখন প্রাণবায়ু অপানবায়ুর জায়গা দখল করে এবং মুখ ও নাসাপথে বেরিয়ে আসে। এই কারণেই প্রাণবায়ুকে আহবনীয় অগ্নির সাথে তুলনা করা হয়েছে। ব্যানকে দক্ষিণাগ্নিও বলা হয় কারণ ব্যান দক্ষিণ নাসারন্ধ্র দিয়ে নির্গত হয় (যা দক্ষিণদিকরূপে মনে করা হয়)।

যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি প্রাণের এই অগ্নিসকল তখনও কাজ করে চলে, মনে হয় আমরা যেন যজ্ঞ করছি। আমাদের শরীরের নানা ইন্দ্রিয় ও তাদের কার্যকলাপকে অন্তরস্থ আত্মার (আমাদের সকলের মধ্যে যে আত্মা আছেন) উপাসনা করছি বলে মনে করতে হবে।

এখানে একটা আশ্চর্য কথা বলা হয়েছে। যদি আমি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে থাকি তখন আমার আর কোন প্রার্থনা, যাগযজ্ঞ, মূর্তিপূজা ইত্যাদির প্রয়োজন থাকে না। এমনকি তীর্থভ্রমণ ও শাস্ত্রপাঠেরও তখন আর দরকার হয় না। সমগ্র জীবনই প্রার্থনায় পরিণত হয়। পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক এই দুই-এর মধ্যে তখন কোন ভেদ থাকে না। সবই তখন আধ্যাত্মিক। আমাদের শ্বাসক্রিয়াও তখন পূজায় পরিণত হয়।

যদুছ্বাসনিঃশ্বাসাবেতাবাহুতী সমং নয়তীতি স সমানঃ। মনো হ বাব

যজমানঃ। ইষ্টফলমেবোদানঃ। স এনং যজমানমহরহর্ব্রহ্ম গময়তি॥৪

অন্বয়: যৎ (যেহেতু); এতৌ উচ্ছ্বাস নিঃশ্বাসৌ (এই প্রশ্বাস নিঃশ্বাস); আহুতি (দুটি আহুতি); সমং নয়তি (সমানভাগে বণ্টন করে); ইতি (এই কারণে); সঃ সমানঃ (সেই সমানই [হোতা]); মনঃ হ বাব যজমানঃ (মনই সেই ব্যক্তি যার জন্য যজ্ঞ করা হয়); উদানঃ এব ইষ্টফলম্‌ (এই যজ্ঞের ফল হল উদান); [সেইজন্য] সঃ (সেই [এই উদান]); এনং যজমানম্‌ (এই মনরূপ যজমানকে); অহরহঃ (প্রতিদিন [শ্বাসহীন গভীর নিদ্রায়; সুষুপ্তিতে]); ব্রহ্ম গময়তি (ব্রহ্মের কাছে নিয়ে যায়)।

সরলার্থ: সমান হল হোতা বা পুরোহিত। অগ্নিহোত্র যজ্ঞে হোতা যেমন আহুতিকে দুটি সমান ভাগে দান করেন ঠিক সেরকম আমাদের শরীরের সামঞ্জস্য রক্ষার্থে সমানবায়ুও নিঃশ্বাস এবং প্রশ্বাসকে সমপরিমাণে ভাগ করে। মন সেই ব্যক্তি যার জন্য যজ্ঞ করা হয়। উদান অভীষ্ট ফল, কারণ সুষুপ্তি অবস্থায় উদানই মনকে ব্রহ্মের কাছে নিয়ে যায়।

ব্যাখ্যা: এখানে উপনিষদ বলছেন, সমানবায়ু যেন অগ্নিহোত্র যজ্ঞের হোতা বা পুরোহিত। সমান নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে দেখাশোনা করে। এই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকে অগ্নিহোত্র যজ্ঞে পুরোহিত যে দুটি আহুতি দান করেন তার সাথে তুলনা করা হয়। অগ্নিহোত্র যজ্ঞে পুরোহিত সমানভাবে আহুতি দুটি দান করেন। অনুরূপভাবে, শরীরের সামঞ্জস্য রক্ষা করার জন্য সমানবায়ু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে সমতা বজায় রাখে।

যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁর আর অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করার দরকার হয় না। তাঁর শরীরে আপনা আপনিই এই যজ্ঞ চলতে থাকে। এরকম ব্যক্তি কিন্তু অলস নন। এমনকি ঘুমের মধ্যেও তিনি কাজ করে চলেন। মনই তাঁর যজমান (অর্থাৎ যার জন্য যজ্ঞ করা হয়) এবং তা সবসময়ই সক্রিয়। মানুষ স্বর্গলাভের আশায় এই অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করে থাকেন। কিন্তু আবার এমন মানুষও আছেন যাঁরা স্বর্গলাভে ইচ্ছুক নন, আত্মজ্ঞান লাভ করাই তাঁদের জীবনের লক্ষ্য। ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহ তাঁদের মনের অধীন। মন এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলেই তাকে ‘যজমান’ বলা হয়।

এই যাগযজ্ঞ ঠিক ঠিকভাবে সম্পন্ন হলে উদানবায়ু কার্যকরী হয়ে ওঠে। উদানবায়ুকে যজ্ঞের যে ফল তার সঙ্গে তুলনা করা হয়। উদানবায়ুই মন ও ইন্দ্রিয়কে ব্রহ্মের কাছে নিয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় সুষুপ্তি। যজমানের পক্ষে এ স্বর্গলাভের সামিল।

অত্ৰৈষ দেবঃ স্বপ্নে মহিমানমনুভবতি। যদ্‌দৃষ্টং দৃষ্টমনুপশ্যতি শ্রুতং

শ্রুতমেবার্থমনুশৃণোতি দেশদিগন্তরৈশ্চ প্রত্যনুভূতং পুনঃ পুনঃ

প্রত্যনুভবতি দৃষ্টং চাদৃষ্টং চ শ্রুতং চাশ্রুতং চানুভূতং চাননুভূতং চ

সচ্চাসচ্চ সর্বং পশ্যতি সর্বঃ পশ্যতি॥৫

অন্বয়: এষঃ দেবঃ (এই দেবতা; মন); অত্র স্বপ্নে (স্বপ্নবস্থা); মহিমানম্‌ অনুভবতি (তিনি তাঁর শক্তি অনুভব করেন); যৎ দৃষ্টং দৃষ্টম্‌ অনুপশ্যতি (যা কিছু তিনি আগে দেখেছেন তা তিনি আবার দেখেন); শ্রুতং শ্রুতম্‌ এব অর্থম্‌ অনুশৃণোতি (আগে যা শুনেছেন তা তিনি পুনরায় শোনেন); দেশদিগন্তরৈঃ চ প্রত্যনুভূতং পুনঃ পুনঃ প্রত্যনুভবতি (বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দেশে যা তিনি অনুভব করেছেন তা তিনি পুনরায় অনুভব করেন); দৃষ্টম্‌ অদৃষ্টং চ (দৃষ্ট অথবা অদৃষ্ট); শ্রুতম্‌ অশ্রুতং চ (শ্রুত অথবা অশ্রুত); অনুভূতং চ অননুভূতং চ (অনুভূত অথবা অননুভূত); সৎ চ অসৎ চ (সত্য বা মিথ্যা); সর্বং পশ্যতি (সব দর্শন করেন); সর্বঃ পশ্যতি (তিনিই সব হয়েছেন এই ভাবেই তিনি সব দেখেন)।

সরলার্থ: স্বপ্নবস্থায় আমাদের মন তার নিজের মহৎ শক্তিকে অনুভব করে। জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা দেখে থাকি স্বপ্নে তা ধরা পড়ে। ঠিক সেরকম, জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা শুনে থাকি স্বপ্নে যেন তাই শুনতে পাই। আমরা হয়তো বহু জায়গায় বা বহু দেশে গিয়ে থাকতে পারি, কিন্তু স্বপ্নে যেন আমরা সেই সব স্থানেই আবার যাই। যা দেখেছি বা দেখিনি, যা শুনেছি বা শুনিনি, যা অনুভব করেছি বা করিনি, সত্য এবং অসত্য—এমন সব বস্তুই আমরা দেখে থাকি। সবকিছুর সঙ্গেই আমরা তখন একাত্মতা অনুভব করি।

ব্যাখ্যা: এখানে ‘দেব’ শব্দটি দ্বারা মনকে বোঝানো হয়েছে। আমরা সকলেই মনের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন। যেমন, মন খুব কম সময়ের মধ্যে অনেক দূরের পথ বেড়িয়ে আসতে পারে। এখন হয়তো আমরা কলকাতায় আছি কিন্তু আমাদের মন হয়তো কাশীতে রয়েছে। এমন সময় কেউ যদি আমাকে ডাকে সঙ্গে সঙ্গে আবার আমার মন কলকাতাতে ফিরে আসে। প্রকৃতপক্ষে স্বপ্নবস্থাতেই মন তার শক্তিকে অনুভব করে। জাগ্রত অবস্থায় যেসব জায়গায় আমরা গেছি স্বপ্নে যে কেবল সেসব জায়গা দেখি তা নয়। এমন সব স্থানেও মন আমাদের নিয়ে যায় যা আমরা আগে কখনও দেখিনি। মাঝে মাঝে আমাদের এমন সব অভিজ্ঞতাও হয় যা আগে কখনও হয়নি। স্বপ্নে আমরা সৎ অর্থাৎ যার অস্তিত্ব আছে এবং অসৎ অর্থাৎ যা কাল্পনিক এ দুই-ই দেখে থাকি (সৎ চ অসৎ চ)। মন সর্বশক্তিমান, সবকিছু করতে সক্ষম।

এসবের ব্যাখ্যা করা কঠিন। একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমরা হয়তো আগের জন্মে সেইসব স্থান, সেইসব বস্তুকে দেখেছি, অথবা এই স্বপ্নের অভিজ্ঞতা কল্পনামাত্র। কিংবা হয়তো আমাদের অপূর্ণ বাসনাসকলই স্বপ্নে ধরা পড়ে। মন যেন একটি হ্রদ। আমাদের মনে নানারকমের বাসনা আছে। আবার মনের গভীরে এমন বহু আকাঙ্ক্ষা থাকে যার সম্পর্কে আমরা আদৌ সচেতন নই। এইসব কামনা-বাসনাই স্বপ্নে ধরা দেয়।

স যদা তেজসাঽভিভূতো ভবতি। অত্রৈষ দেবঃ স্বপ্নান্ন পশ্যত্যথ

তদৈতস্মিঞ্‌শরীর এতৎ সুখং ভবতি॥৬

অন্বয়: সঃ (এই মন); যদা (যখন); তেজসা অভিভূতঃ ভবতি (আত্মার আলোয় অভিভূত); অত্র (স্বপ্নহীন এই নিদ্রিত অবস্থায় অর্থাৎ সুষুপ্তিতে); এষঃ দেবঃ (মন); স্বপ্নান্‌ ন পশ্যতি (স্বপ্ন দেখে না [কারণ যে দ্বারপথে বাসনাসমূহ আমাদের মনে প্রবেশ করে তখন সাময়িকভাবে সেই দরজা বন্ধ থাকে]); অথ তদা (সেই সময় [অর্থাৎ স্বপ্নহীন নিদ্রায় বা সুষুপ্তিতে]); এতস্মিন্ শরীরে (এই শরীরে); এতৎ সুখং ভবতি (সমস্ত শরীরে এবং মনে এক প্রশান্তি বিরাজ করে)।

সরলার্থ: আত্মার মহিমায় মন যখন অভিভূত অর্থাৎ মনের মধ্যে বাসনা প্রবেশের দরজা যখন বন্ধ, সেই সুষুপ্তি অবস্থায় মন কোন স্বপ্ন দেখে না। এই সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমাদের দেহ ও মন খুব সতেজ হয়।

ব্যাখ্যা: জাগ্রত অবস্থায় আমাদের শরীর, মন এবং সমস্ত ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকে। যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি বা স্বপ্ন দেখি তখন আমাদের শরীর নিষ্ক্রিয় থাকলেও মন কিন্তু তখনও কাজ করে চলে। এমন স্বপ্নও আমরা দেখি যে, আমরা অনেক কাজ করছি। কিন্তু আসলে আমি তো তখন বিছানায় শুয়ে আছি, কিন্তু মনে করছি কত কাজ করছি। এমনকি এটা যে অবাস্তব কল্পনা, একথা আমাদের একবারও মনে হয় না।

কখনও কখনও গভীর নিদ্রায় আমাদের মন এবং শরীর কোনটাই কাজ করে না। তখন কোন কিছু আছে বলেই আমাদের মনে হয় না। আবার ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝে উঠতে পারি না আমরা কোথায় আছি বা তখন দিন না রাত অর্থাৎ চারপাশের সবকিছুকে বুঝে উঠতে আমাদের সময় লাগে। যদিও তখন আমরা অত্যন্ত সতেজ এবং প্রসন্ন বোধ করি। তাহলে তখন কি ঘটেছিল? মৃত্যু? না। এরকম অবস্থাকে বলা হয় সুষুপ্তি।

বেদান্তে জীবাত্মা ও পরমাত্মার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্বরূপত আত্মা দুই নয়, এক ও অদ্বিতীয়। পরমাত্মা যখন দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত তখনই তা জীবাত্মা। নামরূপের বিভিন্নতার জন্য আমরা নিজেদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা বলে মনে করি। আমাদের মধ্যে কেউ হয়তো লম্বা আবার কেউ বেঁটে, কেউ ফরসা কেউ বা কালো, আবার কেউ ভারতীয় কেউ বা বিদেশী—এরকম থাকতেই পারে। আমাদের মধ্যে এই যে পার্থক্য এর ফলে আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের সকলের মধ্যে একই সত্তা রয়েছে। সেই অনন্ত সত্তাই হলেন পরমাত্মা। আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন নামরূপের দ্বারা এই এক পরমাত্মাই চিহ্নিত হয়েছেন। এবং তখন তাঁকে বলা হয় জীবাত্মা।

বেদান্ত বলেন, সুষুপ্তি অবস্থায় কোন বিষয়বোধ অর্থাৎ কোন দুই বোধ থাকে না। যে অজ্ঞানতার জন্য আমরা নিজেদের দেহ এবং মনের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করি, সেই অজ্ঞানতা তখন সাময়িকভাবে দূর হয়। এবং সবকিছু তখন চৈতন্যময় হয়ে ওঠে।

জাগ্রতাবস্থাতেও আমাদের মধ্যে চৈতন্য থাকে। হয়তো তা খুবই সামান্য, যার দ্বারা আমরা দেখি, শুনি, বা কথা বলি। এ যেন একটি বাতিকে জ্বালাবার জন্য অল্প পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মতো। কিন্তু উপনিষদ বলেন, সুষুপ্তি অবস্থায় আমরা চৈতন্যের আলোয় অভিভূত হই (তেজসা অভিভূতঃ)। সেই সময় জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়। জীবাত্মার আলাদা কোন অস্তিত্ব বোধ থাকে না। সুষুপ্তি অবস্থায় মানুষ পরিপূর্ণ আনন্দ ও সুখ অনুভব করে।

স যথা সোম্য বয়াংসি বাসোবৃক্ষং সংপ্রতিষ্ঠন্তে।

এবং হ বৈ তৎ সর্বং পর আত্মনি সংপ্রতিষ্ঠতে॥৭

অন্বয়: সোম্য (হে সৌম্য); সঃ (সে একটি দৃষ্টান্ত); যথা (ঠিক যেমন); বয়াংসি (পাখীরা); বাসোবৃক্ষম্‌ (যে গাছে তারা বাস করে); সংপ্রতিষ্ঠন্তে (ফিরে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে); এবং হ বৈ (একই প্রকারে); তৎ সর্বম্ (সব বস্তু); পরে আত্মনি সংপ্রতিষ্ঠতে (পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত হয়)।

সরলার্থ: হে সৌম্য, দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, পাখীরা যেমন গাছে তাদের বাসার দিকে উড়ে যায়, ঠিক তেমনি এ জগতের সবকিছুই পরমাত্মায় আশ্রয় গ্রহণ করে। অর্থাৎ পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়।

ব্যাখ্যা: সুষুপ্তিতে জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয় এবং আমরা তখন আনন্দ অনুভব করি। কিন্তু এটি শুদ্ধ চৈতন্যের অবস্থা নয় এবং এর মাধ্যমে আমরা মুক্তিলাভও করতে পারি না। সুষুপ্তি অবস্থা, সমাধি অর্থাৎ শুদ্ধ চৈতন্য অবস্থার মতো হলেও দুটি অবস্থা পুরোপুরি এক নয়। সুষুপ্তিতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে একটা ভেদ থাকে। এই ভেদই হল অজ্ঞানতা। এই অবস্থাতেও আমাদের মধ্যে অজ্ঞানতা থাকে কিন্তু তখন তা নিষ্ক্রিয়। সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমরা যখন জেগে উঠি তখন আমরা আবার সেই আগের অবস্থাতেই ফিরে যাই। অর্থাৎ নিদ্রার পূর্বে যেখানে ছিলাম। যেখানে সংগ্রাম শেষ হয়েছিল আবার সেখান থেকেই আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়। কারণ আত্মা সম্পর্কে আমরা তখনও অজ্ঞ। সুষুপ্তিতে দুই বোধ সাময়িকভাবে দূর হয় বটে কিন্তু অজ্ঞানতা তখনও পুরোমাত্রায় থাকে।

সুষুপ্তির অবস্থা বোঝাতে গিয়ে আচার্য শঙ্কর এখানে একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। অনেকক্ষণ যাবৎ পাখীরা হয়তো উড়ে বেড়াচ্ছে। উড়তে উড়তে ক্লান্ত হওয়ায় তারা বাসায় ফিরে যাবে স্থির করল। একই কথা আমাদের বেলাতেও সত্য। পাখীদের মতো আমরাও চারিদিকে ঘুরে বেড়াই। তারপর একসময়ে আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানেই ফিরে যেতে চাই। সুষুপ্তিতে আমরা পরমাত্মার সাথে মিলিত হই এবং আনন্দ অনুভব করে থাকি।

আচার্য শঙ্করের মতে, জাগ্রত অবস্থায় আমরা অবিদ্যা, কামনা-বাসনা এবং কর্মের অধীন। অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা আছে বলেই আমাদের কামনা-বাসনা আছে। এই বাসনা থেকেই কর্মের সৃষ্টি। অর্থাৎ অপূর্ণ বাসনা মেটাতেই আমরা কাজ করে থাকি। আমরা ভাল বা খারাপ দু-রকমেরই কাজ করতে পারি। ভাল কাজ করলে আমরা ভাল ফল লাত করি। আবার খারাপ কাজ করলে খারাপ ফল ভোগ করি। অর্থাৎ আমরা কর্মফলের অধীন। এভাবেই আমরা কার্য-কারণ শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ি।

সুষুপ্তি অবস্থায় কামনা-বাসনা অর্থাৎ দুই বোধ সাময়িকভাবে দূর হয় এবং আমাদের দেহ ও মন তখন কোন কাজ করে না। আমাদের উপাধিসমূহ যেমন ‘অহংতা’ (আমি) আর মমতা (আমার) ইত্যাদি আমাদের সীমাবদ্ধ করে। এইসব উপাধির জন্য আমরা নিজেদেরকে লম্বা-বেঁটে, সুখী-অসুখী বলে মনে করে থাকি। সুষুপ্তিতে এইসব বোধ থাকে না। শঙ্করাচার্যের মতে সুষুপ্তিতে আমরা ‘অদ্বয়ম্‌ একম্‌ শিবং শান্তম্‌’ অবস্থা প্রাপ্ত হই। এই অবস্থায় কোন দুই বোধ থাকে না (অদ্বয়ম্‌)। থাকে কেবল এক চৈতন্য। এবং এই চৈতন্য শান্তি (শান্তম্‌)। আমাদের অজ্ঞানতাপ্রসূত এই জগতের অস্তিত্ব তখন লোপ পায়।

পৃথিবী চ পৃথিবীমাত্রা চাপশ্চাপোমাত্ৰা চ তেজশ্চ তেজোমাত্রা চ

বায়ুশ্চ বায়ুমাত্রা চাকাশশ্চাকাশমাত্রা চ চক্ষুশ্চ দ্রষ্টব্যং চ শ্রোত্রং চ

শ্রোতব্যং চ ঘ্রাণং চ ঘ্রাতব্যং চ রসশ্চ রসয়িতব্যং চ ত্বক্‌ চ

স্পর্শয়িতব্যং চ বাক্‌ চ বক্তব্যং চ হস্তৌ চাদাতব্যং

চোপস্থশ্চানন্দয়িতব্যং চ পায়ুশ্চ বিসর্জয়িতব্যং চ পদৌ চ গন্তব্যং চ

মনশ্চ মন্তব্যং চ বুদ্ধিশ্চ বোদ্ধব্যং চাহংকারশ্চাহংকর্তব্যং চ চিত্তং চ

চেতয়িতব্যং চ তেজশ্চ বিদ্যোতয়িতব্যং চ প্রাণশ্চ বিধারয়িতব্যং চ॥৮

অন্বয়: পৃথিবী চ পৃথিবীমাত্রা চ (পৃথিবী এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); আপঃ চ আপোমাত্রা চ (জল এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); তেজঃ চ তেজোমাত্রা চ (অগ্নি এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); বায়ুঃ চ বায়ুমাত্রা চ (বায়ু এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); আকাশঃ চ আকাশমাত্রা চ (আকাশ এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); চক্ষুঃ চ দ্রষ্টব্যং চ (চোখ এবং চোখ যা দেখে); শ্রোত্রং চ শ্রোতব্যং চ (কান এবং কান যা শোনে); ঘ্রাণং চ ঘ্রাতব্যং চ (নাক এবং নাক যা গন্ধ গ্রহণ করে); রসঃ চ রসয়িতব্যং চ (জিভ এবং জিভ যা স্বাদ গ্রহণ করে); ত্বক্‌ চ স্পর্শয়িতব্যং চ (ত্বক এবং ত্বক যা স্পর্শ করে); বাক্‌ চ বক্তব্যং চ (বাগিন্দ্রিয় এবং বক্তব্য বিষয়); হস্তৌ চ আদাতব্যং চ (হাত এবং হাত যা গ্রহণ করে); উপস্থঃ চ আনন্দয়িতব্যং চ (উপস্থ এবং তার ভোগ্য বিষয়); পায়ুঃ চ বিসর্জয়িতব্যং চ (পায়ু এবং মলমূত্রাদি বর্জন); পাদৌ চ গন্তব্যং চ (পা এবং তার গন্তব্যস্থল); মনঃ চ মন্তব্যং চ (মন এবং তার মনন); বুদ্ধিঃ চ বোদ্ধব্যং চ (বুদ্ধি এবং বুদ্ধির বিষয়); অহঙ্কারঃ চ অহঙ্কৰ্তব্যং চ (অহঙ্কার এবং তার বিষয়); চিত্তং চ চেতয়িতব্যং চ (স্মৃতি এবং তার বিষয়); তেজঃ চ বিদ্যোতয়িতব্যং চ (জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয়); প্রাণঃ চ বিধারয়িতব্যং চ (প্রাণ এবং প্রাণ যা ধারণ করে) [এই সবকিছু পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে]।

সরলার্থ: পৃথিবী ও তার সূক্ষ্ম রূপ (গন্ধ), জল ও তার সূক্ষ্ম রূপ (স্বাদ বা রস), অগ্নি ও তার সূক্ষ্ম রূপ (রূপ), বায়ু ও তার সূক্ষ্ম রূপ (স্পর্শ), আকাশ ও তার সূক্ষ্ম রূপ (শব্দ), চোখ এবং চোখ যা দেখে, কান এবং কান যা শোনে, নাক এবং নাক যা গন্ধ নেয়, জিভ এবং জিভ যা স্বাদ গ্রহণ করে, ত্বক এবং ত্বক যা স্পর্শ করে, বাগিন্দ্রিয় ও বক্তব্য বিষয়, হাত এবং হাত যা গ্রহণ করে, জননেন্দ্রিয় ও তার ভোগ্য বিষয়, পায়ু এবং মলমূত্রাদি বর্জন, পা এবং তার গন্তব্যস্থল, মন এবং তার মনন, বুদ্ধি এবং বুদ্ধির বিষয়, অহঙ্কার ও তার বিষয়, স্মৃতি এবং তার বিষয়, জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয়, প্রাণ ও প্রাণ যা ধারণ করে—এই সবকিছুই পরমাত্মাতে বিলীন হয়।

ব্যাখ্যা: হিন্দুদর্শন অনুসারে, এই জগৎ পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। উপাদানগুলি হল: ক্ষিতি, অপ্‌, তেজঃ, মরুৎ, ব্যোম। এই উপাদানগুলির আবার দুটি দিক আছে, স্থূল এবং সূক্ষ্ম। উপাদানগুলি বিভিন্ন মাত্রায় একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে এই দৃশ্যমান জগৎ সৃষ্টি করে।

পৃথিবী স্থূলরূপে পাঁচটি গুণবিশিষ্ট—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। কিন্তু সূক্ষ্মরূপে পৃথিবী একটি গুণবিশিষ্ট এবং তা হল গন্ধ।

সূক্ষ্ম উপাদান থেকে স্থূল উপাদানে পরিণত হওয়ার উপায়টি হল: প্রত্যেকটি উপাদান দুই ভাগে বিভক্ত। ধরা যাক, পৃথিবী এই উপাদানটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তারপর এর (পৃথিবী উপাদান) এক ভাগ নিয়ে, তার সঙ্গে চারটি উপাদানের প্রত্যেকটির থেকে এক অষ্টমাংশ নিয়ে যোগ করা হল, তখন এই সূক্ষ্ম পৃথিবী স্থূল পৃথিবীতে পরিণত হয়। প্রত্যেকটি উপাদানই সূক্ষ্ম থেকে স্থূলে পরিণত হবে যদি উপাদানগুলি নির্দিষ্ট অনুপাতে অপর উপাদানগুলির সাথে মিলিত হয়।

সূক্ষ্ম অবস্থায় উপাদানগুলিকে বলা হয় ‘তন্মাত্র’ অর্থাৎ শুধু সেটিই থাকে। একে ‘অপঞ্চীকৃত’ও বলা হয়ে থাকে। ‘অপঞ্চীকৃত’ যা অন্য কোন উপাদানের সাথে মিলিত নয় অর্থাৎ যা অবিমিশ্র। এই অবস্থায় উপাদানগুলিকে শুধুমাত্র তার গুণের দ্বারা চেনা যায়; যেমন গন্ধের দ্বারা পৃথিবীকে, রস বা স্বাদের দ্বারা জলকে, রূপের দ্বারা অগ্নিকে, স্পর্শ দ্বারা বায়ুকে, এবং শব্দের দ্বারা আকাশকে। সমস্ত উপাদানগুলির যোগ বিয়োগই হচ্ছে এই দৃশ্যমান জগৎ।

আমাদের ইন্দ্রিয় আছে এবং প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের ভোগ্য বিষয়ও আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চোখ এবং চোখের বিষয়, অর্থাৎ চোখ দিয়ে আমরা যেসব বস্তু দেখে থাকি।

কিন্তু আমাদের অবশ্যই অন্তরিন্দ্রিয়ও আছে যা বাইরের ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অন্তরিন্দ্রিয় হল মন। মনের কাজ কি? মন প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় বিচার করে দেখে। মন প্রত্যেকটি বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করে। এক অবস্থায় মনকে বুদ্ধি বলা হয়ে থাকে। আমাদের কি করা উচিত বুদ্ধিরূপে মনই তা স্থির করে।

মনকে আবার হৃদয় বলেও উল্লেখ করা হয়। হৃদয়রূপে এই মনেই আমাদের অনুভূতি, আবেগ ও অভিজ্ঞতাসমূহ সঞ্চিত থাকে। মনের আর একটি দিক হল অহঙ্কার অর্থাৎ আমিত্ববোধ। এই ‘অহংতা’র ফলেই আমরা নিজেদেরকে ‘আমি ধনী, আমি বিদ্বান’ ইত্যাদি মনে করে থাকি।

তেজঃ কথার অর্থ হল যা আলোকিত করে। প্রাণঃ কথার অর্থ হল যা আমাদেরকে ধারণ করে রাখে। এখানে প্রাণ বলতে সূত্ৰাত্মা বা হিরণ্যগর্ভকে বোঝানো হয়েছে।

এষ হি দ্রষ্টা স্প্রষ্টা শ্রোতা ঘ্রাতা রসয়িতা মন্তা বোদ্ধা কর্তা বিজ্ঞানাত্মা

পুরুষঃ। স পরেঽক্ষর আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে॥৯

অন্বয়: এষঃ (এই জীবাত্মা); হি (নিশ্চিতভাবে); দ্রষ্টা (যিনি দেখেন); স্প্রষ্টা (যিনি স্পর্শ করেন); শ্রোতা (যিনি শোনেন); ঘ্রাতা (যিনি ঘ্রাণ গ্রহণ করেন); রসয়িতা (যিনি আস্বাদন করেন); মন্তা (যিনি চিন্তা করেন); বোদ্ধা (যিনি প্রত্যক্ষ করেন); কর্তা (কর্তা); বিজ্ঞানাত্মা পুরুষঃ (জীবাত্মা যিনি ইন্দ্রিয়সমূহকে পরিচালনা করেন); সঃ (তিনি, সেই জীবাত্মা); পরে (শ্রেষ্ঠ); অক্ষরে (অক্ষর, নিত্য); আত্মনি (পরমাত্মায়); সম্প্রতিষ্ঠতে (বাস করেন)।

সরলার্থ: যিনি দেখেন, স্পর্শ করেন, শোনেন, স্বাদ গ্রহণ করেন, চিন্তা করেন, অনুভব করেন এবং যিনি কর্তা ও ইন্দ্রিয়সমূহের নিয়ামক তিনিই জীবাত্মা বলে পরিচিত। এই জীবাত্মাই অক্ষর পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত।

ব্যাখ্যা: ‘এষঃ হি দ্রষ্টা স্প্রষ্টা শ্রোতা’— এই শ্লোকের দ্বারা আমাদের বর্তমান অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। ‘এষ’ কথার অর্থ হল এই অর্থাৎ জীবাত্মা, যখন আমি দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, ঘ্রাণ গ্রহণ করি, তখন আমার ইন্দ্রিয়সকল সক্রিয় থাকে। আমি চিন্তা করতে পারি, বুঝতে পারি এবং ‘আমি কর্তা’ এই বোধও আমার থাকে (মন্তা বোদ্ধা কর্তা)। এ সমস্ত মনেরই কাজ, ‘কর্তা’ বলতে বোঝায় ‘আমিই কাজ করছি’, ‘এই সমস্ত কিছুই আমার’ ‘আমিই প্রভু’। অর্থাৎ আমি (অহংতা) ও আমার (মমতা) বোধই হল কর্তা।

কিন্তু দেহ, ইন্দ্রিয় এবং মন সবেরই একদিন না একদিন বিনাশ ঘটবে। যেহেতু আমরা নিজেদেরকে শরীর এবং মনের সাথে অভিন্ন ভাবি সেহেতু মনে করি আমাদেরও বিনাশ হবে—আমরা নিজেদের নির্দিষ্ট দেহ ও মনের অধীন বলে মনে করি। এর ফলে আমরা প্রত্যেকেই আলাদা ব্যক্তিতে পরিণত হই। এই চিন্তাই আমাদের বন্ধনের কারণ। কিন্তু এই জীবাত্মা যখন পরব্রহ্মে পরমাত্মাতে মিলিত হয় তখন তিনি সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যান। ‘পর’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ, সার্বভৌম। যার ক্ষর অর্থাৎ ক্ষয় নেই তাই অক্ষর। এই পরমাত্মা অপরিবর্তিত, চিরন্তন এবং নিত্য। ‘পরে অক্ষরে আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে’— আত্মা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ‘পর অক্ষর’— এই হল আমাদের যথার্থ অবস্থা, আমাদের প্রকৃত সত্তা। এই অবস্থায় সমস্ত ভেদ ঘুচে যায়। আমরা তখন পরমাত্মাতে লীন হয়ে যাই এবং মুক্তি লাভ করি।

এ যেন সূর্য এবং তার রশ্মি। দিনের বেলায় সূর্যের রশ্মিগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই রশ্মিসকল সূর্যের কাছ থেকেই এসেছে, কিন্তু এগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীকে আলোকিত করে। আবার সন্ধ্যাবেলায় এই রশ্মিসকল যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যায়। অর্থাৎ সূর্যের সাথে এক হয়ে যায়। ঠিক তেমনি, আমাদের ইন্দ্রিয়সকল বহির্মুখী। কিন্তু যখন আমরা ইন্দ্রিয়গুলিকে বাইরের জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে ভেতরের দিকে চালনা করতে পারব, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সকল যখন অন্তর্মুখী হবে তখন সেখানে কেবলমাত্র পরমাত্মাই বিরাজ করবেন।

পরমেবাক্ষরং প্রতিপদ্যতে স যো হ বৈ তদচ্ছায়মশরীরমলোহিতং শুভ্ৰমক্ষরং

বেদয়তে যস্তু সোম্য। স সর্বজ্ঞঃ সর্বো ভবতি। তদেষ শ্লোকঃ॥১০

অন্বয়: সোম্য (হে সৌম্য); যঃ হ বৈ (তিনি-ই যিনি); তৎ (সেই); অচ্ছায়ম্‌ (উজ্জ্বল); অশরীরম্ (শরীরহীন); অলোহিতম্ (লাল নয় অর্থাৎ বর্ণহীন); শুভ্রম্‌ (বিশুদ্ধ); অক্ষরম্ (অক্ষয়); বেদয়তে (জানেন); সঃ পরম্‌ অক্ষরম্‌ এব প্রতিপদ্যতে (তিনি পরমাত্মার সাথে এক হয়ে যান); যঃ তু (তিনি—যিনি) [এই জানেন]; সঃ (তিনি); সর্বজ্ঞঃ (সবকিছু জানেন); সর্বঃ ভবতি (সকলের সাথে এক হয়ে যান); তৎ এষঃ শ্লোকঃ (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে)।

সরলার্থ: হে সৌম্য, আত্মা নিরঞ্জন, নামরূপহীন, বর্ণহীন,শুদ্ধ এবং নিত্য। যিনি এই আত্মাকে জানেন তিনি আত্মাতে মিলিত হয়ে যান। অর্থাৎ তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও অমর। এরকম ব্যক্তি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সকলের সঙ্গে এবং সবকিছুর সাথে একাত্মতা অনুভব করে থাকেন। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: ‘পরম’ অর্থাৎ সর্বোচ্চ অবস্থা। এই অবস্থায় মানুষ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে একাত্মতা অনুভব করে। বর্তমানে আমরা নিজেদেরকে রক্তমাংসের দেহ বলে মনে করে থাকি। কিন্তু এই দেহের ক্ষয় অনিবার্য এবং একদিন তা ধ্বংস হয়ে যাবেই। তবে আমরা এরকম ভাবি কেন? যে আত্মা কোন শর্তের অধীন নন এবং নিত্যমুক্ত তাঁকে আমরা দেহ বলেই বা ভুল করি কেন? অজ্ঞানতার জন্য আমরা এমন ভুল করে থাকি। আত্মা সার্বভৌম। আত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং প্রভু। কিন্তু এই প্রভুই নিজেকে দাস বলে মনে করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি সিংহশাবকের গল্প বলতেন। শাবকটি একটি মেষের দলের সঙ্গে থাকত। মেষদের সাথে থাকতে থাকতে সে নিজেকে মেষ বলেই মনে করত এবং মেষের মতো হাবভাব করত। একদিন সেখানে একটি সিংহ এসে উপস্থিত। সিংহটি তখন এ মেষ-সিংহটির ঘাড় ধরে একটি পুকুরের ধারে নিয়ে গেল। জলে মেষ-সিংহটির যে ছায়া পড়েছে তা দেখিয়ে, সিংহটি তাকে বলল: দ্যাখ, তুমি আর আমি এক; তুমিও সিংহ। গুরু এই কাজই করে থাকেন। তিনি আমাদের এই শিক্ষাই দেন। ‘তৎ ত্বম্ অসি’— অর্থাৎ তুমিই সেই। তুমিই ব্রহ্ম। আমরা সকলেই এই শুভমুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করে আছি, যখন আমরা আমাদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারব।

আমরা নিজেদের সম্পর্কে তখন কি আবিষ্কার করি? ‘অচ্ছায়ম্‌’— এর আক্ষরিক অর্থ হল ছায়াহীন। কিন্তু এখানে এই শব্দটির সাহায্যে বোঝানো হয়েছে আত্মা দেহের (অবস্থার) পরিবর্তন ও দৈহিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। আমাদের শরীর যখন সুস্থ থাকে তখন আমরা বলে থাকি, আমি ভাল আছি। আবার শরীর যখন অসুস্থ, হয়তো কোন রোগে ভুগছি তখন বলে থাকি, আমি ভাল নেই। এই সব অসম্পূর্ণতা আসে অজ্ঞানতা থেকে। এসবই মোহ। আমরা তখন মোহগ্রস্ত। কেউ যেন আমাদেরকে সম্মোহিত করেছে, যার জন্য আমরা আমাদের প্রকৃত পরিচয় ভুলে গেছি। সেসময়ে কেউ যদি এসে আমাকে বলেন যে, ‘তুমিই ব্রহ্ম—তুমি সব বন্ধন থেকে মুক্ত, তুমি কখনও বদ্ধ ছিলে না’; তখন আমি বলে উঠি : ‘এসব বাজে কথা, আমি সবসময়ই বদ্ধ, আমি কখনও মুক্ত নই। আমার এই দেহ আছে, এই মন আছে।’ এই সব অসম্পূর্ণতাকে আমরা সত্য বলে মনে করি এবং ভাবি এই দেহ-মনই হল আমাদের প্রকৃত সত্তা।

কিন্তু যখন আমি আত্মজ্ঞান লাভ করি তখন উপলব্ধি করি আমি ‘অশরীরম্‌’। অর্থাৎ আমার কোন দেহ নেই। এই দেহ যেন একটি জামা। যে জামাটি আমি পরে আছি সেই জামাটি তো কখনও ‘আমি’ নই; জামাটি আমার উপর আরোপিত মাত্র। আমি যেমন জামাটিকে বদলাতে পারি ঠিক তেমনি এই দেহকেও আমি ত্যাগ করতে পারি।

‘অলোহিতম্‌’ কথার আক্ষরিক অর্থ হল যা লাল নয়। আত্মা বর্ণহীন। অর্থাৎ আত্মা গুণ বা উপাধিবর্জিত, নির্গুণ। লাল-কালো, ভাল-খারাপ, ধনী-দরিদ্র, বিদ্বান-মূখ এসবই উপাধিমাত্র। দেশ, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি উপাধি দিয়ে আমরা নিজেদেরকে খুব সংকীর্ণ করে ফেলি। এই কারণেই উপনিষদ আত্মা সম্বন্ধে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করেন, যেমন অচ্ছায়ম্‌, অশরীরম্‌, অলোহিতম্‌ ইত্যাদি। উপনিষদ বলেন, আত্মা এটি নয়, আত্মা ওটি নয় অর্থাৎ নেতি, নেতি।

তারপরে উপনিষদ বলছেন, যখন আমরা আমাদের প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারব, আমাদের সত্য পরিচয় কি তা জানতে পারব তখন আমাদের অজানা আর কিছুই থাকবে না। সেটা কিভাবে সম্ভব? যখন আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করি তখন আমরা আবিষ্কার করে থাকি ঘরের কীটের মধ্যে যে আত্মা রয়েছেন আমাদের মধ্যেও সেই একই আত্মা রয়েছেন। এ কীটটির মধ্যেও আমি আবার জঙ্গলের হাতিটির মধ্যেও আমি। অর্থাৎ ‘আমি’ই সর্বত্র রয়েছি। এবং এই আমিই সবকিছু হয়েছি। ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’— ‘আমি’ই ব্রহ্ম। ‘আমি’ই সব, ‘আমি’ ছাড়া আর কিছুই নেই। এক আত্মাই বহুরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই আমরা বহু দেখে থাকি।

আমাদের প্রত্যেকেরই নাম এবং রূপ (অর্থাৎ শরীর) আছে। নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই আমরা নিজেদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা বলে মনে করি। কিন্তু এসবই উপাধিমাত্র যা আত্মার উপর আরোপিত। যদি এই উপাধিসকল সরিয়ে নেওয়া যায় তবে যা অবশিষ্ট থাকে তা হল শুদ্ধ আত্মা অর্থাৎ পরমাত্মা। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, মানুষ-পশু অর্থাৎ সকলের মধ্যে একই পরমাত্মা রয়েছেন।

বিজ্ঞানাত্মা সহ দেবৈশ্য সর্বৈঃ প্রাণা ভূতানি সম্প্রতিষ্ঠন্তি যত্র।

তদক্ষরং বেদয়তে যস্তু সোম্য স সর্বজ্ঞঃ সর্বমেবাবিবেশ ইতি॥১১

অন্বয়: সোম্য (হে সৌম্য); বিজ্ঞানাত্মা (জীবাত্মা [যিনি সবসময় সচেতন]); প্রাণাঃ (দেবতাগণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের নিয়ামক); ভূতানি চ (উপাদানসমূহ যেমন পৃথিবী); সর্বৈঃ দেবৈঃ সহ (সকল ইন্দ্রিয়সহ); যত্র (যার মধ্যে অবিনাশী আত্মা, অর্থাৎ পরমাত্মা); সম্প্রতিষ্ঠন্তি (বিশ্রাম গ্রহণ করে); তৎ অক্ষরম্‌ (সেই পরমাত্মা); যঃ তু বেদয়তে (যিনি জানেন); সঃ (তিনি); সর্বজ্ঞঃ (সর্বজ্ঞ); সর্বম্‌ এব আবিবেশ (সকল বস্তুতে প্রবেশ করেন)।

সরলার্থ: হে সৌম্য, সুষুপ্তিতে জীবাত্মা ও তার ইন্দ্রিয়সমূহ, ইন্দ্রিয়ের বিষয়সকল, এবং উপাদানসমূহ অক্ষর পরমাত্মায় বিশ্রাম গ্রহণ করে। জাগ্রত অবস্থায় কোন ব্যক্তি যদি পরমাত্মার সাথে নিজেকে অভিন্ন বলে উপলব্ধি করেন তখন তিনি নিখিল জগতের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন এবং সবকিছুর মধ্যে তিনিই বিরাজ করেন।

ব্যাখ্যা: আমাদের দেহ এবং মনের নানা কার্যকলাপের উৎস হলেন এই পরমাত্মা। বিজ্ঞানাত্ম হল চৈতন্য অর্থাৎ জীবাত্মা। এখানে ‘দেব’ শব্দটির দ্বারা ইন্দ্রিয়কে বোঝানো হয়েছে। ‘দেব’ কথার অর্থ হল যা প্রকাশ করে। আমার চোখ আছে বলেই আমি তোমাকে দেখতে পাই। চোখ দিয়েই আমরা সবকিছুকে দেখে থাকি। একইভাবে, কান আছে বলেই আমরা শুনতে পাই। এখানে ‘প্রাণা’ শব্দটির দ্বারা ইন্দ্রিয়ের অধিপতি দেবতাদের বোঝানো হয়েছে। ‘ভূতানি’ হল উপাদানসমূহ, যেমন— ক্ষিতি, অপ্‌, তেজঃ, মরুৎ, ব্যোম। আমাদের দেহ এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। উপনিষদ বলেন যে, জীবাত্মার এইসব উপাদানগুলি পরমাত্মায় স্থিত। পরমাত্মাই এদেরকে ধারণ করে আছেন। আবার পরমাত্মাই এ সবের বিশ্রাম স্থান।

এই এক ও অভিন্ন পরমাত্মাই আমাদের সকলের মধ্যে আছেন। দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের দ্বারা এই পরমাত্মা নিজেকে আবৃত করে রেখেছেন, কিন্তু তিনি সার্বভৌম। তিনি যেন রাজপ্রাসাদে সভাসদ্‌ পরিবেষ্টিত সম্রাট। দেহ, ইন্দ্রিয় এবং মন হল আত্মার সভাসদ্‌বর্গ।

যখন আমি পরমাত্মার সাথে অভিন্নতা উপলব্ধি করতে পারব তখন আমিই ‘সর্বম্’। অর্থাৎ তখন সবকিছুই আমি। কোন জলবিন্দু সমুদ্রে গিয়ে পড়লে জলবিন্দুর যেমন কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, সমুদ্রের সাথে মিলেমিশে তা একাকার হয়ে যায়, এও যেন ঠিক তাই। আত্মজ্ঞান লাভ হলে সসীম অসীম হয়ে যায়। জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়।

এখানেই প্রশ্ন উপনিষদের চতুর্থ প্রশ্ন সমাপ্ত।

পঞ্চম প্রশ্ন

অথ হৈনং শৈব্যঃ সত্যকামঃ পপ্রচ্ছ। স যো হ বৈ তদ্ভগবন্মনুষ্যেষু

প্ৰায়ণান্তমোঙ্কারমভিধ্যায়ীত। কতমং বাব স তেন লোকং

জয়তীতি। তস্মৈ স হোবাচ॥১

অন্বয়: অথ (অতঃপর); এনং হ (তাঁকে [অর্থাৎ পিপ্পলাদকে]); শৈব্যঃ (শিবিপুত্র); সত্যকামঃ (সত্যকাম); পপ্ৰচ্ছ (জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্ (ভগবান); মনুষ্যেষু (মানুষের মধ্যে); সঃ যঃ হ বৈ (তিনি যিনি); প্রায়ণান্তম্ (মৃত্যু পর্যন্ত); তৎ ওঙ্কারমভিধ্যায়ীত (ওম্‌কে ধ্যান করেন); কতমং বাব লোকং সঃ জয়তি (কোন বিশেষ লোক তিনি প্রাপ্ত হন); তেন (তার [ধ্যান] দ্বারা); তস্মৈ সঃ হ উবাচ (তিনি তাঁকে বললেন)।

সরলার্থ: অতঃপর শিবিপুত্র সত্যকাম ঋষি পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করলেন: ‘ভগবান, যদি কোন ব্যক্তি সমস্ত জীবন ওম্‌কে ধ্যান করেন তাহলে তিনি এই ধ্যানের দ্বারা কোন্‌ লোক প্রাপ্ত হবেন?’ পিপ্পলাদ তাঁকে বললেন :

ব্যাখ্যা: জগৎ সংক্রান্ত প্রশ্ন দিয়েই এই উপনিষদের শুরু। এই দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কে আমরা আগ্রহী হব—এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের চারপাশের এই দৃশ্যমান জগতের নানা বস্তুকে দেখে আমরা মুগ্ধ হই। এভাবেই আমাদের ইন্দ্রিয়সকল কাজ করে থাকে। এই ইন্দ্রিয়সকল বহির্মুখী। উপনিষদ ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে আমাদের বাইরের জগৎ থেকে মনের জগতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন এবং সর্বশেষে এই দুই জগতের ঊর্ধ্বে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।

পঞ্চম প্রশ্নটি করেছিলেন সত্যকাম। ‘সত্যকাম’ নামটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হল যিনি সত্যকে জানতে চান। আমরা সকলেই সত্যের কথা শুনে থাকি। কিন্তু এই ‘সত্য’ কি? আমরা সেই সত্যকে জানতে ইচ্ছুক। সত্যকামের প্রশ্নটি ছিল ‘ওম্‌’কে নিয়ে। তিনি জানতে চান : কোন কোন মানুষ সারা জীবন ধরে ‘ওম্‌’-এর ধ্যান করেন, মৃত্যুর পরে তাঁরা কোথায় যান? মৃত্যুর পর তাঁরা কোন্ লোক প্রাপ্ত হন?

এ বিষয়ে শঙ্করাচার্যের মন্তব্য হল : এমন অনেক আশ্চর্য ব্যক্তি আছেন যাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ‘ওম্‌’-এর ধ্যান করেন। কি ভাবে করেন? প্রথমে তাঁরা মনটাকে এই দৃশ্যমান জগৎ থেকে পুরোপুরি তুলে নেন, তারপর ব্রহ্মের প্রতীক ‘ওম্‌’কে চিন্তা করে তাতে মন স্থির করেন। তখন তাঁরা ওম্-এর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যান। তাঁদের মন ভক্তিতে পূর্ণ এবং একমুখী হয়ে ওঠে। এরকম ধ্যান যেন জ্ঞান ও অনুরাগের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ যা মনকে ধ্যেয় বস্তুর সাথে যুক্ত করে। আচার্য শঙ্কর এখানে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি এরকম ধ্যানকে নিবাত (বাতাসহীন) নিষ্কম্প প্রদীপ-শিখার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই শিখাটি সবসময়ই ঊর্ধ্বমুখী ও স্থির। ঠিক সেরকমভাবে, মনও সবসময় তার লক্ষ্যের অভিমুখী।

আমরা কেমনভাবে এই অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারি? আচার্য শঙ্কর বলেন, ‘যম’ এবং ‘নিয়ম’ অভ্যাসের দ্বারা; অর্থাৎ আত্মসংযম অনুশীলনের দ্বারা আমরা এই অবস্থা লাভ করতে পারি। ‘যম’ এবং ‘নিয়ম হল যথাক্রমে শারীরিক ও মানসিক সংযম। ‘যম’ বলতে বোঝায় অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ। এ কিন্তু কোন নেতিবাচক মানসিকতা নয় বরং তা ইতিবাচক। অহিংসা বলতে বোঝায় সকলের প্রতি ভালবাসা এবং সকলের জন্য কল্যাণ কামনা করা। তারপরেই সত্য অর্থাৎ কায়মনোবাক্যে (কথায়, কাজে এবং আচরণে) সত্যকে ধরে থাকা। ‘অস্তেয়’—চুরি না করা। ‘ব্রহ্মচর্য’ অর্থাৎ আত্মসংযম, কিন্তু কথাটির অন্য তাৎপর্য হল ব্রহ্মনিষ্ঠ মন। ‘অপরিগ্রহ’—অপরের দান গ্রহণ না করা।

‘নিয়ম’-এর অন্তর্গত অভ্যাসগুলি হল: ‘শৌচ’—পরিচ্ছন্নতা অর্থাৎ শরীরের ও মনের পবিত্রতা; ‘সন্তোষ’—তৃপ্তি; ‘তপস্‌’—কৃচ্ছ্রসাধন; স্বাধ্যায়—শাস্ত্রপাঠ এবং ‘ওম্‌’ বা ঈশ্বরের প্রতীক অন্য কোন মন্ত্র জপ করা; ‘ঈশ্বরপ্রণিধান’ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ, ভালবাসা।

সত্যকাম জিজ্ঞাসা করছেন: সারাটা জীবন ধরে কৃচ্ছ্রসাধন এবং শারীরিক ও মানসিক সংযম অভ্যাসের দ্বারা আমরা কি লাভ করে থাকি? সত্যকামের এ প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। এরকম ধ্যানের উপকারিতাই বা কি? ওম্‌কে ধ্যান করলে আমরা কোন্ বিশেষ লোকই বা প্রাপ্ত হই? অনেক লোকের মধ্যে কোন্‌টি আমরা ‘ওম্‌’-এর দ্বারা লাভ করতে পারি?

এতদ্বৈ সত্যকাম পরং চাপরং চ ব্রহ্ম যদোঙ্কারঃ।

তস্মাদ্বিদ্বানেতেনৈবায়তনেনৈকতরমন্বেতি॥২

অন্বয়: সত্যকাম (হে সত্যকাম); যৎ (যেহেতু); ওঙ্কারঃ (ওঙ্কার); এতৎ বৈ (প্রসিদ্ধ); পরং চ অপরং চ ব্রহ্ম (নির্গুণ এবং সগুণ ব্রহ্ম); তস্মাৎ (সেইজন্য); বিদ্বান্ (যিনি জানেন); এতেন এব আয়তনেন (এর [প্রতীক] সাহায্যে); একতরম্‌ (উভয়ের মধ্যে একটিকে) [পরব্রহ্ম অথবা অপরব্রহ্ম]; অন্বেতি (অনুসরণ করেন)।

সরলার্থ: হে সত্যকাম, ওম্‌ নির্গুণ ব্রহ্ম (পরব্রহ্ম) এবং সগুণ ব্রহ্ম (অপরব্রহ্ম) এই দুই-এরই প্রতীক। যিনি একথা জানেন তিনি ওম্‌কে ব্রহ্মের প্রতীক রূপে ধ্যান করেন। পরিণামে তিনি যে কোন অবস্থা প্রাপ্ত হন।

ব্যাখ্যা: বেদান্ত মতে ব্রহ্মের দুটি দিক আছে: পর অর্থাৎ পরম বা নির্গুণ ব্রহ্ম। আর অপর অর্থাৎ আপেক্ষিক বা সগুণ ব্রহ্ম। আমরা অনেক সময়েই ঈশ্বর দয়ালু, ঈশ্বর মঙ্গলময়—এ কথা বলে থাকি। এ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তাও তিনি। তখন তিনি অপরব্রহ্ম বা সগুণ ব্রহ্ম। অর্থাৎ ব্রহ্ম এখানে মায়ার দ্বারা বিশেষিত। নির্গুণ ব্রহ্ম যেন সগুণ ব্রহ্ম হয়েছেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ব্রহ্ম পরিবর্তিত হয়েছেন। ব্রহ্ম সব সময় ব্রহ্মই থাকেন।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি সাপের উদাহরণ দিতেন। সাপটি রাস্তায় শুয়ে আছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় সাপটি মৃত। কিন্তু সাপটির কাছে গেলে সে ফণা তুলে ভয় দেখায়। সাপটি যখন রাস্তায় নিষ্ক্রিয়ভাবে শুয়ে থাকে তখন সে নির্গুণ। কিন্তু যখন সক্রিয় অর্থাৎ ফণা তুলে ফোঁস করে তখন ঐ সাপটিই সগুণ। দুটো অবস্থাতেই সেখানে কিন্তু একটি সাপই রয়েছে। ঠিক একইরকম ভাবে, পর এবং অপর, সগুণ এবং নির্গুণ উভয় অবস্থাতেই ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন।

আরেকটি দৃষ্টান্ত হল সমুদ্র এবং তার তরঙ্গ। তরঙ্গহীন সমুদ্রকে আমরা এক বিশাল জলরাশি বলে মনে করতে পারি। ঠিক তেমনি পরব্রহ্মই হলেন অনন্ত ও অদ্বিতীয় সত্তা। সমুদ্রের তরঙ্গের মতো এই অনন্ত সত্তা কখনও কখনও রূপ ধারণ করে থাকেন।

ব্রহ্ম যখন নিজেকে জগৎরূপে প্রকাশ করেন তখন তিনিই হলেন অপরব্রহ্ম অর্থাৎ পরব্রহ্মের আপেক্ষিক দিক। বেদান্ত একথা কখনই বলেন না যে, ব্রহ্মই এ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন। এই জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশমাত্র—সমগ্র জগৎ তাঁরই প্রকাশ। কিন্তু তা বলে এ জগৎ তাঁকে নিঃশেষ করতে পারেনি। এ জগতের সর্বত্রই তিনি রয়েছেন। সূর্য, গ্রহ, গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ সকলের মধ্যেই তিনি বিদ্যমান। এ জগতের ভেতরে এবং বাইরে তিনিই রয়েছেন।

অধিকাংশ মানুষই ওম্‌কে ব্রহ্মের প্রতীক বলে মনে করেন। এখানে উপনিষদ বলছেন, ‘ওম্‌’ ব্রহ্মের আপেক্ষিক বা সগুণ এবং পরম বা নির্গুণ—এই দুটি অবস্থারই প্রতীক। ব্রহ্মের প্রতীক রূপে ওম্‌কে ধ্যান করলে যে-কোন একটি অবস্থা (পর বা অপর ব্রহ্ম) লাভ করা যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা প্রতীক ব্যবহার করি কেন? মনে করা যাক, একজন ‘জল’ এই শব্দটি বলল। সঙ্গে সঙ্গে জল বলতে যা বোঝায় তা যেন আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। আমরা যখন ব্রহ্ম এই শব্দটা বলি তখন এটা কি আমাদের নির্দিষ্ট কিছু মনে করিয়ে দেয়? আমরা কি মানসচক্ষে এমন কিছু দেখতে পাই যা ব্রহ্ম নামে পরিচিত? না। আচার্য শঙ্করের মতে ব্রহ্ম নির্গুণ এবং ইন্দ্রিয়াতীত। নির্দিষ্ট নাম ও রূপ আছে বলে আমি কোন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য বলে কিছু নেই।

প্রতীককে আমরা চাক্ষুষ দেখতে পাই এবং তাতে মনকে একাগ্র করতে পারি। আমরা যে মূর্তি বা ছবি পুজো করে থাকি এও যেন ঠিক তাই, আমরা কিন্তু মাটি বা কাগজকে পূজা করি না। এই মূর্তি বা ছবি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যা আমাদের মনকে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করে।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি দৃষ্টান্ত দিতেন। তিনি বলতেন : তোমার আঙ্গুলে একটি কাঁটা ফুটেছে। তুমি কেমন করে এই কাঁটাটিকে বার করবে? তুমি আর একটি কাঁটা নেবে এবং এর সাহায্যে প্রথম কাঁটাটিকে তুলে আনবে, তারপর দুটো কাঁটাকেই ছুড়ে ফেলে দেবে। ঠিক তেমনি, আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্রহ্মকে ধ্যান করার জন্য আমরা প্রতীকের সাহায্য নিয়ে থাকি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতীক প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোন সাহায্য করে কি? শাস্ত্রমতে, প্রতীক আমাদের অবশ্যই সাহায্য করে।

কিন্তু ব্রহ্মের প্রতীক হিসাবে ‘ওম্‌’কেই বেছে নেওয়া হয়েছে কেন? কারণ ব্রহ্মই ‘সব’ এবং তিনিই ‘সব’ কিছু হয়েছেন। ব্রহ্ম যে ‘সব’ একথা ধারণা করা কঠিন। আবার এই ‘সব’কে বর্ণনা করাও সহজ কাজ নয়। শব্দরূপে ‘ওম্‌’ই সকল শব্দের মধ্যে রয়েছেন। সব শব্দের প্রতীকই হলেন এই ‘ওম্‌’। যখন আমরা ‘ওম্‌’ উচ্চারণ করি তখন গলার পেছনদিক থেকে বদ্ধ ওষ্ঠ পর্যন্ত প্রতিটি অংশকেই আমরা স্পর্শ করে থাকি। অ, উ এবং ম—একযোগে সব শব্দের উৎস। এই কারণের জন্যই ‘ওম্‌’ ব্রহ্মের সব থেকে উপযুক্ত প্রতীক। এই কারণেই ‘ওম্‌’কে শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম বলা হয়ে থাকে। আমরা যদি ব্রহ্মকে কোন শব্দরূপে কল্পনা করে থাকি তবে ওম্‌ই হলেন সেই শব্দ। ওম্‌কে ধ্যান করলে ব্রহ্মকেই ধ্যান করা হয়। ‘ওম্‌’ আমাদের সবসময় মনে করিয়ে দেন আমরাই ব্রহ্ম।

শঙ্করাচার্য ওম্‌কে বিষ্ণুর সাথে তুলনা করেছেন; ভক্তরা অনুরাগের সাথে যাঁর (বিষ্ণুর) ধ্যান করেন। একইভাবে, কেউ যদি অনুরাগের সাথে ওম্-এর ধ্যান করেন তাহলে ব্ৰহ্ম তাঁর প্রতি প্রসন্ন হন। আচার্য শঙ্কর বলছেন, ‘ইতি অবগম্যতে শাস্ত্রপ্রামাণ্যাৎ’—একথা শাস্ত্রও বলে থাকেন।

স যদ্যৈকমাত্রমভিধ্যায়ীত স তেনৈব সংবেদিতস্তূৰ্ণমেব

জগত্যামভিসম্পদ্যতে। তমৃচো মনুষ্যলোকমুপনয়ন্তে স তত্র তপসা

ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া সম্পন্নো মহিমামনুভবতি॥৩

অন্বয়: সঃ যদি (তিনি যদি); একমাত্রম্‌ অভিধ্যায়ীত (সবসময় অউম-এর যে-কোন একটি অক্ষর ধ্যান করেন); সঃ (তিনি); তেন এব (তার দ্বারা); সংবেদিতঃ (জ্ঞানলাভ হবে); তৃর্ণম্‌ এব (শীঘ্রই); জগত্যাম্‌ (এই জগতে); অভিসম্পদ্যতে (জাত হবেন); তম্ ঋচঃ মনুষ্যলোকম্‌ উপনয়ন্তে (যদি তিনি ঋগ্বেদকে অর্থাৎ অউম্-এর অ-কে ধ্যান করেন তাহলে তিনি পুনরায় মানবজন্ম গ্রহণ করবেন); সঃ (তিনি); তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া সম্পন্নঃ (শ্রদ্ধা, ব্রহ্মচর্য, তপস্যার ফলের দ্বারা সম্পন্ন হয়ে); তত্র (সেখানে); মহিমানম্‌ অনুভবতি (মহিমা লাভ করেন)।

সরলার্থ: যিনি ‘অউম্‌’-এর যে কোন একটি অক্ষর (যেমন অ)-এর ধ্যান করেন, সেই ধ্যানই তাঁর জাগতিক জ্ঞানলাভের পক্ষে যথেষ্ট। শীঘ্রই তিনি আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ‘অউম্‌’-এর ‘অ’ ঋগ্বেদের প্রতীক। ‘অ’-এর ধ্যানের দ্বারা তিনি মনুষ্যজন্ম লাভ করেন। তখন তিনি তপস্যায় মগ্ন হন ও ব্রহ্মচর্য, আত্মসংযম অভ্যাস করেন। শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে তখন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়। এই সকল গুণের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলেন, ‘ওম্‌’ শব্দটি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক। কিভাবে? ‘ওম্‌’ হচ্ছে অ, উ এবং ম এই তিনটি বর্ণের সমষ্টি। উপনিষদের মতে, অ, উ এবং ম এই তিনটি বর্ণ যথাক্রমে ‘ভূঃ’, ‘ভুবঃ’ এবং ‘স্বঃ’—এই তিনটি লোকের প্রতীক। ‘ভূঃ’ হল পৃথিবী, ‘ভুবঃ’—পৃথিবী এবং স্বর্গের মধ্যবর্তী লোক এবং ‘স্বঃ’ হচ্ছে স্বর্গলোক।

কিন্তু আমরা ‘অউম্’ শব্দটিকে তিনটি অক্ষরে ভাগ করি কেন? আমাদের বোঝার সুবিধার জন্য যে, যখন আমরা এই পৃথিবী এবং তার চারপাশের বস্তুকে দেখি তখন আমরা আসলে ব্রহ্মকেই দেখি। বেদান্ত বলেন যে, এই দৃশ্যমান জগৎকে আমরা স্থূল, সূক্ষ্ম এবং কারণ—এই তিনটি অবস্থার মধ্য দিয়ে দেখে থাকি। কারণ অবস্থাটি একটি ধারণার মতো। সমষ্টির ক্ষেত্রে যা সত্য ব্যষ্টির ক্ষেত্রেও তা-ই সত্য। কেননা সবকিছু ব্রহ্মের অন্তর্গত। স্থূল অবস্থায় আমরা জেগে থাকি, সূক্ষ্ম অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি এবং কারণ অবস্থায় আমরা সুষুপ্তিতে থাকি।

এখানে স্থূল জগৎ অর্থাৎ এই পৃথিবীই আলোচ্য বিষয়। জাগ্রত অবস্থায় আমরা এই জগৎকে দেখতে পাই। ‘অউম্‌’-এর ‘অ’কারই হচ্ছে এই জগৎ। ‘অ’কে ধ্যান করলে ব্রহ্মের প্রকাশরূপে এই জগৎকেই ধ্যান করা হয়। কাজেই ‘অ’কার বলতে এই জাগ্রত অবস্থা ও তার প্রত্যক্ষ অনুভূতিসকল বোঝায়। জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীও এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অন্তর্গত।

কিন্তু উপনিষদ বনে, ‘অ’কে ব্রহ্মের প্রতীক মনে না করে আলাদাভাবে যদি ধ্যান করি তবে আমরা এই জাগ্রত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকি এবং জড়জগতের সাথে জড়িয়ে পড়ি। আমরা সৎ হতে পারি এমন কি সাধু জীবনযাপনও করতে পারি। কিন্তু এই অবস্থায় আমাদের উন্নতি ঐ পর্যন্তই। তাই মৃত্যুর পর আমরা শীঘ্রই এই পৃথিবীতে ফিরে আসি এবং জীবনের সংগ্রাম যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু করি। আমরা শুধুমাত্র দেহ এবং এ জড় জগতেরই একজন এরকম যেন মনে না করি।

অথ যদি দ্বিমাত্রেণ মনসি সম্পদ্যতে সোঽন্তরিক্ষং যজুৰ্ভিরুন্নীয়তে

সোমলোকম্‌। স সোমলোকে বিভূতিমনুভূয় পুনরাবর্ততে॥৪

অন্বয়: অথ যদি (কিন্তু যদি); সঃ (তিনি); দ্বিমাত্রেণ (অউম-এর দ্বিতীয় অক্ষরকে অর্থাৎ উ-কে [ধ্যান করেন]); মনসি সম্পদ্যতে (মনকে সমৃদ্ধ করেন); যজুৰ্ভিঃ (যজুর্বেদের দ্বারা); অন্তরিক্ষং সোমলোকম্‌ উন্নীয়তে (অন্তরিক্ষের মধ্য দিয়ে তিনি চন্দ্রলোকে যান); সঃ সোমলোকে বিভূতিম্‌ অনুভূয় (তিনি সেই লোকের সমস্ত উত্তম বস্তু উপভোগ করেন); পুনঃ আবর্ততে (তখন তিনি আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন)।

সরলার্থ: সাধক যদি ‘অউম্’-এর দ্বিতীয় অক্ষরের (‘উ’কার) ধ্যান করেন, তবে এর দ্বারা তিনি মনকে উন্নত করেন (অর্থাৎ সাধক এই অক্ষরটির সাথে একাত্মতা অনুভব করেন)। মৃত্যুর পর এই বর্ণই (‘উ’কার) সাধককে অন্তরীক্ষের মধ্য দিয়ে চন্দ্রলোকে নিয়ে যায়। অন্তরীক্ষ হল স্বর্গ এবং মর্তের মধ্যবর্তী আকাশ। ‘অউম্‌’-এর দ্বিতীয় বর্ণ ‘উ’ যজুর্বেদের প্রতীক। সাধক চন্দ্রলোকের সমস্ত ঐশ্বর্য ভোগ করে পুনরায় মানুষ রূপে এই মর্তলোকে ফিরে আসেন।

ব্যাখ্যা: ধরা যাক, সাধক ‘উ’কারের ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন। ‘উ’কার-এর দ্বারা ভুবঃ বা স্বর্গ এবং মর্তের মধ্যবর্তী স্থান এবং স্বপ্নের জগৎকে বোঝানো হয়েছে। উপনিষদ বলেন যে, ‘উ’কারের ধ্যান করার ফলে সাধক মৃত্যুর পর চন্দ্রলোকে যান। যে জগতে আমরা এখন বাস করি তার তুলনায় চন্দ্রলোক সূক্ষ্ম ও উন্নততর।

‘অউম্‌’-এর দ্বিতীয় বর্ণ উ, যজুর্বেদের প্রতীক। যখন আমরা ‘উ’কারের ধ্যান করি তখন আমরা যজুর্বেদের প্রভাব অনুভব করে থাকি। আমরা তখন আর এই পার্থিব ভোগসুখের প্রতি আসক্ত হই না। বরং আমরা তখন পরহিতকর কর্ম যেমন কূপখনন, বৃক্ষরোপণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি কাজে আনন্দ পাই। এইসব কাজ করার ফলেই আমরা চন্দ্রলোক প্রাপ্ত হই। যজুর্বেদের প্রতীক ‘উ’ বর্ণটি যেন আমাদেরকে অন্তরীক্ষের মধ্য দিয়ে (স্বর্গ ও মর্তের মধ্যবর্তী আকাশ) চন্দ্রলোকে নিয়ে যায়। এই লোকে আমরা নানা পার্থিবসুখ ভোগ করে থাকি এবং সুখে জীবনযাপন করি। আমরা দেবদেবীর সান্নিধ্য ও পূর্বপুরুষদের সঙ্গ লাভ করে থাকি। কিন্তু এই লোকে আমরা কতদিন থাকব, আমাদের কর্মই তা স্থির করে দেয়। সময় ফুরিয়ে গেলে এই পৃথিবীতে আমরা মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে পুনরায় ফিরে আসি।

যঃ পুনরেতং ত্রিমাত্রেণোমিত্যেতেনৈবাক্ষরেণ পরং পুরুষমভিধ্যায়ীত

স তেজসি সূর্যে সম্পন্নঃ। যথা পাদোদরস্ত্বচা বিনির্মুচ্যত এবং হ বৈ স

পাপ্‌মনা বিনির্মুক্তঃ স সামভিরুন্নীয়তে ব্রহ্মলোকং স এতস্মাজ্জীবঘনাৎ

পরাৎপরং পুরিশয়ং পুরুষমীক্ষতে। তদেতৌ শ্লোকৌ ভবতঃ॥৫

অন্বয়: যঃ পুনঃ (কিন্তু যে ব্যক্তি); ওম্ ইতি এতেন এব ত্রিমাত্রেণ অক্ষরেণ (তিন অক্ষরের শব্দ ‘অউম্‌’-এর মধ্য দিয়ে); এতং পরং পুরুষম্‌ (এই পরম পুরুষকে) [সূর্যের মধ্যে]; অভিধ্যায়ীত (ধ্যান করেন); সঃ (তিনি); তেজসি সূর্যে সম্পন্ন (জ্যোতির্ময় সূর্যের সঙ্গে এক হয়ে যান); যথা (যেমন); পাদোদরঃ (সাপ); ত্বচা বিনির্মুচ্যতে (ত্বক থেকে মুক্ত হয়); এবং হ বৈ (ঠিক সেইভাবে); সঃ পাপ্‌মনা বিনির্মুক্তঃ (তিনি নিজেকে সব ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে মুক্ত করেন); সামভিঃ (সামমন্ত্রের মধ্য দিয়ে); সঃ ব্রহ্মলোকম্‌ উন্নীয়তে (তিনি ব্রহ্মলোকে উন্নীত হন); সঃ এতস্মাৎ জীবঘনাৎ পরাৎ পরম্‌ (জীবের সমষ্টি অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভের চেয়েও তিনি শ্রেষ্ঠ); পুরিশয়ম্‌ (হৃদয়পদ্ম); পুরুষম্‌ (পরমাত্মা); ঈক্ষতে (ধ্যানের মাধ্যমে দেখেন); তৎ এতৌ শ্লোকৌ ভবতঃ (এ বিষয়ে দুইটি শ্লোক আছে)।

সরলার্থ: যিনি পরমাত্মার প্রতীকরূপে তিন অক্ষর বিশিষ্ট ‘অউম্‌’-এর ধ্যান করেন তিনি জ্যোতির্ময় সূর্যে লীন হয়ে যান। সাপ যেমন জীর্ণ খোলস ত্যাগ করে ঠিক তেমনি এরূপ ব্যক্তিও নিজেকে সব পাপ থেকে মুক্ত করেন। সামমন্ত্র তখন তাঁকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়, সেখানে তিনি ব্রহ্মের সাথে অভিন্নতা উপলব্ধি করেন। এমনকি সাধক তখন নিজেকে হিরণ্যগর্ভ থেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে থাকেন। তখন তিনি জানেন তিনিই এ জগতের সবকিছু হয়েছেন। এ বিষয়ে দুটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: সূর্যের মধ্যেও সেই পরমপুরুষ রয়েছেন। পরমপুরুষের প্রতীক রূপে যিনি ‘অউম্’-এর ধ্যান করেন তিনি সূর্যে লীন হয়ে যান। সূর্য জ্ঞান, জ্যোতি, আনন্দ ও পবিত্রতার প্রতীক। সূর্যের মতো সাধকও এইসব গুণের অধিকারী। চিত্তশুদ্ধির ফলে সাধক তখন আত্মজ্ঞান লাভ করেন। মৃত্যুর পর চন্দ্রলোক প্রাপ্ত ব্যক্তির মতো তিনি আর এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন না। সামমন্ত্রের দ্বারা সাধক ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন। ব্রহ্মলোক—হিরণ্যগর্ভের জগৎ; যে হিরণ্যগর্ভ সমস্ত প্রাণীর আত্মা। সাধক তখন সবকিছুর সাথে একাত্মতা অনুভব করেন। কিন্তু এটাই শেষ অবস্থা নয়, সাধক তখন আরো এগিয়ে যান। পরিশেষে তিনি পরব্রহ্মের সাথে এক হয়ে যান। অর্থাৎ তিনিই ব্রহ্ম হয়ে যান।

তিস্রো মাত্রা মৃত্যুমত্যঃ প্রযুক্তা অন্যোন্যসক্তা অনবিপ্রযুক্তাঃ।

ক্ৰিয়াসু বাহ্যাভ্যন্তরমধ্যমাসু সম্যক্ প্রযুক্তাসু ন কম্পতে জ্ঞঃ॥৬

অন্বয়: তিস্রঃ মাত্রাঃ (‘অউম্’-এর তিনটি অক্ষর); প্রযুক্তাঃ (পৃথকভাবে); মৃত্যুমত্যঃ (মৃত্যুর অধীন); অন্যোন্যসক্তাঃ (যদি তারা পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত হয়); অনবিপ্রযুক্তাঃ (সঠিক কাজ); বাহ্যাভ্যন্তরমধ্যমাসু ক্ৰিয়াসু (বাহ্য, অভ্যন্তর, এবং মধ্যম অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থার অধিষ্ঠাত্রী দেবতার ধ্যান করে); সম্যক্‌ প্রযুক্তাসু (সঠিকভাবে); জ্ঞঃ ন কম্পতে (যিনি পরমাত্মাকে জানেন তিনি কখনও বিচলিত হন না)।

সরলার্থ: যিনি ‘অউম্‌’-এর তিনটি অক্ষরকে আলাদাভাবে ধ্যান করেন তিনি মৃত্যুর অধীন। কিন্তু এই তিনটি অক্ষরকে একত্রে ধ্যান করতে পারলে সেই ধ্যানই যথার্থ। জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আলাদা নন, এক। যিনি সঠিকভাবে এই দেবতার ধ্যান করেন তিনিই ‘অউম্‌’-এর প্রকৃত অর্থ জানতে পারেন। যিনি এই ‘অউম্‌’কে ঠিক ঠিক ভাবে জানেন তিনি অভয়পদ লাভ করেন।

ব্যাখ্যা: আমরা সকলেই এই তিন অবস্থার অধীন—বাহ্য অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থা, অভ্যন্তর বা সুষুপ্তি অবস্থা এবং মধ্য বা স্বপ্নাবস্থা। উপনিষদ বলেন, যিনি ওম্‌কে এই তিন অবস্থার সাথে যুক্ত করে ধ্যান করেন তিনি নিখিল বিশ্বের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন। সাধক যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন সব অবস্থাতেই তিনি ব্রহ্মের সাথে অভিন্নতা বোধ করেন। এর ফলে তিনি নিজেকে কখনও অপরের থেকে আলাদা বলে মনে করেন না। এবং তিনি সবরকম ভয় থেকে মুক্ত। ভয় করার মতো কে-ই বা তাঁর আছে? তখন থাকে শুধুই প্রেম।

আচার্য শঙ্কর বলছেন, যিনি ‘ওম্‌’কে এইভাবে জেনেছেন তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন। ‘ন কম্পমান’—তাঁর আর বিপথে পা পড়ে না। ‘কুতো বা চলেৎ’—কোথায়ই বা যাবেন তিনি? তিনি কি নিজের থেকে দূরে যেতে পারেন? তিনিই সর্বত্র রয়েছেন।

ঋগ্‌ভিরেতং যজুৰ্ভিরন্তরিক্ষং সামভির্যৎ তৎ কবয়ো বেদয়ন্তে।

তমোঙ্কারেণৈবায়তনেনান্বেতি বিদ্বান্ যত্তচ্ছান্তমজরমমৃতমভয়ং

পরং চেতি॥৭

অন্বয়: ঋগ্‌ভিঃ (ঋক্‌-মন্ত্রের সাহায্যে); এতম্ (এইজগৎ [নরনারীর]); যজুর্ভিঃ (যজুঃ মন্ত্রের দ্বারা); অন্তরিক্ষম্ (চন্দ্রলোক); সামভিঃ (সামমন্ত্রের সহায়ে); তৎ (সেই [ব্রহ্মলোক]); যৎ কবয়ো বেদয়ন্তে (জ্ঞানী ব্যক্তিরা জানেন); তম্ (এই ত্রিবিধ লোক); ওঙ্কারেণ এব আয়তনেন (অউম প্রতীকের মধ্য দিয়ে); বিদ্বান্ অন্বেতি (জ্ঞানী ব্যক্তি প্রাপ্ত হন); তৎ যৎ (সেই যা); শান্তম্ (শান্ত); অজরম্ (জরাহীন); অমৃতম্ (অমৃত); অভয়ম্ (ভয়ের ঊর্ধ্বে); পরং চ (সর্বোচ্চ)।

সরলার্থ: সাধক যদি ব্রহ্মরূপে ‘অউম্‌’কে ধ্যান করেন, তবে তিনি ঋক্‌-মন্ত্রের সাহায্যে মনুষ্যলোক, যজুঃমন্ত্রের দ্বারা চন্দ্রলোক এবং সামমন্ত্রের সহায়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন। একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এই ব্রহ্মলোক লাভ করেন। ওম্‌কে ঠিক ঠিক ভাবে জানতে পারলে সাধক পরম শান্তি অনুভব করেন। সাধক তখন জরা, ব্যাধি এবং সকল প্রকার ভয় থেকে মুক্ত। তখন তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন এবং পরমাত্মার সাথে এক হয়ে যান।

ব্যাখ্যা: অ, উ, ম এই তিন অক্ষরের সমষ্টি হল ‘ওম্‌’। এর প্রতিটি অক্ষরকে বলা হয় মাত্রা। এই মাত্রা তিনটির ঊর্ধ্বে হল তুরীয় বা বিশুদ্ধ চৈতন্যের অবস্থা। ‘অ’ অক্ষরটি এই জগৎ, ঋগ্বেদ এবং জাগ্রত অবস্থার প্রতীক। ‘উ’ অক্ষরটি স্বর্গ ও মর্তের মধ্যবর্তী আকাশ, যজুর্বেদ এবং স্বপ্নাবস্থার প্রতীক। স্বর্গলোক, সামবেদ এবং সুষুপ্তি অবস্থার প্রতীক হল ‘ম’।

যদি আমরা এই তিনটি অক্ষরকে পৃথকভাবে ধ্যান করি তবে আমরা পৃথক লোক প্রাপ্ত হই। পরমাত্মারূপে ‘অ’কে ধ্যান করলে এই জগৎকে লাভ করা যায়। ‘উ’কে ধ্যান করলে চন্দ্রলোকে যাওয়া যায়। এ দুটি লোকই অজ্ঞানতার অধীন এবং তা নশ্বর। এই দুটি অক্ষরকে ধ্যান করার পর যদি আমরা ‘ম’-এর ধ্যান করি তবে আমরা ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হই। যাঁরা জ্ঞান অর্জন করেছেন তাঁরাই একমাত্র ব্রহ্মলোকে যেতে সক্ষম। সাধক ব্রহ্মলোকে অপরব্রহ্ম অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন। এই নিখিল বিশ্বের সাথে তিনি তখন এক হয়ে যান। সাধক যদি সেখানেও (ব্রহ্মলোকে) ‘অউম্’-এর ধ্যানে মগ্ন থাকেন তবে তিনি তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হন। সাধক তখন পরব্রহ্ম বা শুদ্ধ চৈতন্যের সাথে এক হয়ে যান। তুরীয় অবস্থায় সাধক সমস্ত লোক এবং সকলপ্রকার বন্ধনের ঊর্ধ্বে চলে যান।

কাজেই সিদ্ধান্তটি হল—‘শান্তম্‌’। সাধক তখন শান্ত, স্থির। এই অবস্থায় তিনি তখন প্রশান্তি লাভ করেন। তিনি কখনও বিচলিত হন না। ‘অজরম্‌’—কোন বার্ধক্য বা জরা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। কারণ তিনি অসীম ও স্বতন্ত্র। তিনি সবসময়ই এক অর্থাৎ পরিবর্তন রহিত। ‘অমৃতম্‌’—তাঁর মৃত্যু নেই। যাঁর জন্ম হয়নি তাঁর তো কখনও মৃত্যু হতে পারে না। ‘অভয়ম্‌’—তিনি সকলপ্রকার ভয় থেকে মুক্ত। মৃত্যু, দুর্ভাগ্য, ইত্যাদি নানারকমের ভয়ে আমরা সবসময়ই ভীত। আমরা ভয়ের দ্বারা তাড়িত। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভ করলে আর কোনও ভয় থাকে না। সাধক তখন স্থির, শান্ত ও সমাহিত। কোন কিছুই তখন তাঁকে প্রভাবিত করতে পারে না।

‘পরং চ ইতি’—এটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। পরম হল সর্বোচ্চ অবস্থা, যে অবস্থায় মানুষ পৌঁছাতে চায়। এ অবস্থায় কোন কিছুই সাধককে স্পর্শ করতে পারে না। কেউ প্রশংসা করলে আমরা খুশি হয়ে উঠি আবার কেউ নিন্দা করলে আমরা হতাশ হই। কিন্তু সাধক যখন এই অবস্থা (তুরীয় অবস্থা) প্রাপ্ত হন তখন তিনি নিন্দাস্তুতির ঊর্ধ্বে চলে যান। তিনি তখন নিরপেক্ষ। মন বশে থাকলে সাধকের কাছে এ জগৎ মজার কুটি। সেই অবস্থায় প্রশংসা বা নিন্দা দুটোই তাঁর কাছে কৌতুকের বিষয়। সাধক তখন মনে করেন, তিনি নিজেই নিজের প্রশংসা করছেন। আবার নিজেই নিজেকে দোষী বলে মনে করছেন। তিনিই ভিন্ন নাম এবং ভিন্ন রূপ নিয়ে সকলের মধ্যে রয়েছেন। সাধক যখন পরম অবস্থা লাভ করেন তখনই তাঁর মধ্যে এই একত্বের বোধ ফুটে ওঠে। অর্থাৎ সাধক তখন সকলের মধ্যে এক আত্মাকে দেখেন।

শিষ্য গুরু পিপ্পলাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা সারাজীবন ধরে এই ‘ওম্‌’-এর ধ্যান করেন। এর দ্বারা তাঁরা কি লাভ করেন? গুরু বললেন—তাঁরা এই পরম সত্যকে লাভ করেন।

এখানেই প্রশ্ন উপনিষদের পঞ্চম প্রশ্ন সমাপ্ত।

ষষ্ঠ প্রশ্ন

অথ হৈনং সুকেশা ভারদ্বাজঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন্ হিরণ্যনাভঃ কৌসল্যো

রাজপুত্রো মামুপেত্যৈতং প্রশ্নমপৃচ্ছত। ষোড়শকলং ভারদ্বাজ পুরুষং

বেত্থ। তমহং কুমারমব্রুবং নাহমিমং বেদ। যদ্যহমিমমবেদিষং কথং তে

নাবক্ষ্যমিতি। সমূলো বা এষ পরিশুষ্যতি যোঽনৃতমভিবদতি

তস্মন্নার্হাম্যনৃতং বক্তুম্‌। স তূষ্ণীং রথমারুহ্য প্রবব্রাজ। তং ত্বা পৃচ্ছামি

ক্বাসৌ পুরুষ ইতি॥১

অন্বয়: অথ হ (তারপর); এনম্ (তাঁকে [পিপ্পলাদকে]); ভারদ্বাজঃ সুকেশা (ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা); পপ্ৰচ্ছ (জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্‌, (ভগবান); কৌসল্যঃ রাজপুত্রঃ হিরণ্যনাভঃ (কোসলদেশীয় রাজপুত্র হিরণ্যনাভ); মাম্‌ উপেত্য এতং প্রশ্নম্‌ অপৃচ্ছত (আমার কাছে এসে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন); ভারদ্বাজ (হে ভরদ্বাজপুত্র); ষোড়শকলং পুরুষং বেত্থ (ষোড়শকলা বিশিষ্ট পুরুষকে আপনি জানেন কি?); অহং তং কুমারম্‌ অব্রুবম্ (আমি রাজকুমারকে বলেছিলাম); ন অহম্ ইমং বেদ (আমি এই পুরুষকে জানি না); যদি অহম্‌ ইমম্‌ অবেদিষম্‌ (যদি আমি তাঁকে জানি); কথং তে ন অবক্ষ্যম্ (তবে কেন আপনাকে তা বলব না); যঃ অনৃতম্‌ অভিবদতি (যিনি মিথ্যা বলেন); এষঃ সমূলঃ পরিশুষ্যতি (তিনি সমূলে শুষ্ক [অর্থাৎ বিনষ্ট] হন); তস্মাৎ (সেই কারণে); অনৃতং বক্তুং ন অর্হামি (আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না); সঃ (তিনি, রাজপুত্র); তূষ্ণীম্ (শান্তভাবে); রথম্ আরুহ্য প্রবব্রাজ (রথে চড়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন); তং ত্বা পৃচ্ছামি (এখন আমি আপনাকে সেই [পুরুষ] বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি); ক্ক অসৌ পুরুষঃ (কোথায় সেই পুরুষ)?

সরলার্থ: তারপর ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা পিপ্পলাদকে বললেন: ভগবান, কোসলদেশীয় রাজপুত্র হিরণ্যনাভ একসময়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হে ভরদ্বাজপুত্র, ষোলকলাবিশিষ্ট পুরুষকে আপনি জানেন কি?’ আমি সেই কুমারকে বললাম, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। যদি আমি জানতাম তবে আপনাকে বলব না কেন?’ যে লোক মিথ্যা কথা বলে সে সমূলে বিনষ্ট হয়। অতএব আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না।’ এই কথা শুনে তিনি নীরবে রথে চড়ে চলে গেলেন। এখন আমি আপনাকে সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছি, ‘সেই পুরুষ কোথায়?’

ব্যাখ্যা: ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা এই ষষ্ঠ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি পিপ্পলাদকে বললেন, একসময়ে কেমন করে কোসলদেশীয় এক রাজপুত্র তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ষোলকলাবিশিষ্ট পুরুষকে আপনি জানেন কি?’ অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সেই পুরুষকে তিনি জানেন কিনা। ষোল আনায় যেমন এক টাকা তেমনি তিনি ষোলকলাবিশিষ্ট এক পূর্ণসত্তা।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে সুকেশা বিদ্বান ব্যক্তি বলেই রাজপুত্র তাঁর কাছে এসেছিলেন। রাজপুত্র তো তাঁকে ডেকে পাঠাতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। রাজপুত্র অত্যন্ত বিনীতভাবে সুকেশার নিকট উপস্থিত হলেন। এভাবেই সত্যলাভে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী গুরুর কাছে যান। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে গুরুকে প্রশ্ন করেন।

সুকেশার মধ্যে কোন কপটতা ছিল না। তাই তিনি খোলাখুলি বললেন, এ প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন না। রাজপুত্র শিষ্য হবার পক্ষে অনুপযুক্ত তাই সুকেশা জেনেও না জানার ভান করছেন—পাছে রাজপুত্র এমন কথা মনে করেন তাই সুকেশা বলছেন, ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা থাকলে তোমায় বলব না কেন?’

শিষ্য অনেকসময়ই গুরুকে প্রশ্ন করে থাকেন। প্রশ্নের ধরন দেখে গুরু বুঝে নেন শিষ্য কি প্রশ্ন করার জন্যই প্রশ্ন করছেন, না তিনি প্রকৃতই জিজ্ঞাসু। শিশুরাও কখনও কখনও প্রশ্ন করে থাকে। প্রশ্ন শুনে বেশ বোঝা যায় তারা এ ব্যাপারে মনোযোগী নয় এবং এ বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। তাই সে প্রশ্নের উত্তর শুনলেও তারা কিছু বুঝে উঠতে পারে না।

কিন্তু শিষ্য যদি আন্তরিকতার সাথে গুরুকে প্রশ্ন করেন এবং গুরু যদি প্রশ্নের উত্তর দিতে না চান তাহলে তিনি খুব অন্যায় করবেন। উপনিষদ বলেন, এরকম অবস্থায় তাঁর সকল জ্ঞান সমূলে বিনষ্ট হয়। শুকিয়ে গেলে গাছের যেরকম অবস্থা হয়, এও যেন ঠিক তাই। এমনও অনেক গুরু আছেন যিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান শিষ্যকে দান করেন না অর্থাৎ জেনেও না জানার ভান করে মিথ্যা কথা বলেন। তখন তাঁর জীবনে অভিশাপ নেমে আসে। তাঁর সমস্ত জ্ঞান লোপ পায়।

সুকেশা দেখলেন রাজপুত্র নীরবে ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন। রাজকুমারের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার জন্য সুকেশার ভীষণ খারাপ লাগল। তখন থেকেই তিনি সেই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে সচেষ্ট হলেন। আচার্য শঙ্কর বলছেন, জ্ঞানলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তির মনে হয় তাঁর হৃদয়ে যেন তীর গেঁথে আছে। ব্যথায় তিনি ছটফট করছেন। বেদান্তসারে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির মাথায় আগুন জ্বললে তিনি যেমন জলের জন্য ছটফট করতে থাকেন শিষ্যের আত্মজ্ঞান লাভের ব্যাকুলতাও ঠিক সেইরকম, তাঁকে অবশ্যই এই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সেজন্য শিষ্য আদর্শ গুরুর খোঁজ করবেন যিনি পথ দেখাবেন।

এই ষষ্ঠ প্রশ্নটি আত্মার সম্বন্ধে করা হয়েছে, যে আত্মা নিজেকে জগৎরূপে প্রকাশ করেছেন। আত্মাকে এখানে ‘পুরুষ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ইনিই সকলের অন্তরস্থ আত্মা। এখানে এই আত্মাকে ষোলকলাবিশিষ্ট পুরুষ বলা হয়েছে। ষোলকলা বলতে সম্ভাব্য সকল বৈশিষ্ট্য বা উপাধিকে বোঝায়। এই সকল উপাধির নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নেই, এরা আত্মার ওপর আরোপিত মাত্র। এ সকল উপাধি অনিত্য।

শঙ্করাচার্য এই শ্লোকের সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন সমগ্র বিশ্ব (সমস্তং জগৎ) এই কার্যকারণের যোগবিয়োগ বা তার পরিণতি ছাড়া আর কিছুই না। সুষুপ্তিতে (স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রায়) আমরা কোথায় যাই? জাগ্রত অবস্থায় আমরা চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সচেতন। স্বপ্নাবস্থায় আমরা বিছানায় শুয়ে থাকলেও আমাদের মন কিন্তু পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় দেহ, মন কোনটিই কাজ করে না। মনে হয় আমরা যেন মৃত। সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমরা যখন জাগ্রত হই তখন পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে আমাদের একটু সময় লাগে। ‘এটি সকাল না সন্ধ্যা? আমি কোথায় আছি? আমার কি হয়েছিল?’—ইত্যাদি নানা প্রশ্ন তখন আমাদের মনে এসে ভীড় করে।

আচার্য শঙ্করের মতে, সবকিছুই তার উৎসে ফিরে যায়। সেই উৎসটি তাহলে কি? পরমাত্মা। পরমাত্মা চৈতন্য ও জ্ঞানস্বরূপ। আমরা যখন জেগে থাকি তখন পরমাত্মা মন ও ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। তখনই সেই আত্মা জগতের সংস্পর্শে আসেন। আমরা কোন কিছু দেখি কিভাবে? এই চোখ কিছুই না, এমনকি মনও কোন কাজ করে না। আত্মা আছেন বলেই আমরা দেখতে পাই। আত্মা মনের মধ্য দিয়ে কাজ করে থাকেন এবং মন কাজ করে চোখের মধ্য দিয়ে। পরমাত্মা তখনই সবকিছু দেখেন।

শঙ্করাচার্য আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পরমাত্মা সবকিছুর উৎসই শুধু নন, সবকিছুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করেন। পরমাত্মা নিজেকে হিরণ্যগর্ভ (সমষ্টি মন) এবং বিরাটরূপে (সমষ্টি দেহ) ব্যক্ত করেন। পরমাত্মা থেকেই সব কিছু এসেছে আবার পরমাত্মাতেই সবকিছু ফিরে যায়। কোন কিছুর আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই।

জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থায় আমরা অনেক কিছু দেখি ও অনুভব করে থাকি। এই সবকিছুর আশ্রয় হল পরমাত্মা। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় আমরা কিছু দেখি না বা অনুভব করতে পারি না। সবকিছু তখন কোথায় যায়? সাময়িকভাবে এসবই পরমাত্মায় লীন হয়। কার্য কারণে ফিরে যায়। জগতের যখন লয় হয় তখন তা আত্মায় ফিরে যায়।

তস্মৈ স হোবাচ। ইহৈবান্তঃশরীরে সোম্য স পুরুষো

যস্মিন্নেতাঃ ষোড়শকলাঃ প্ৰভবন্তীতি॥২

অন্বয়: সঃ তস্মৈ হ উবাচ (তিনি [পিপ্পলাদ] তাঁকে বললেন); সোম্য (হে সৌম্য); ইহ এব অন্তঃশরীরে (এখানে হৃৎপদ্মাকাশে); সঃ পুরুষঃ (সেই পরমাত্মা [আছেন]); যস্মিন্ (যাতে); এতাঃ ষোড়শকলাঃ (এই ষোড়শকলা যেমন প্রাণ); প্রভবন্তি (উৎপন্ন হয়)।

সরলার্থ: পিপ্পলাদ তাঁকে বললেন, হে সৌম্য, দেহের মধ্যে হৃৎপদ্মকাশে পরমাত্মা বিরাজিত। এই ষোলকলা (যেমন প্রাণ) পরমাত্মার কাছ থেকেই এসেছে।

ব্যাখ্যা: ‘পুরুষ’ কথার অর্থ হল ‘অন্তরতম সত্তা’, যা আমাদের সকলের মধ্যে রয়েছে। ‘পুর’ শব্দের অর্থ আবাস। আর ‘শী’ অর্থ হল যা শায়িত বা বিশ্রাম নিচ্ছে। হৃদয়কে অনেকসময় ‘হৃৎপদ্ম’ বলা হয় কারণ মনে করা হয় হৃদয়ের আকৃতি পদ্মের মতো। ‘পুরুষ’ এই হৃদয়াকাশেই বিরাজ করেন। ঘটাকাশ আর পটাকাশ, একই আকাশ ঘটের মধ্যেও রয়েছে আবার বাইরেও রয়েছে। ঠিক তেমনি পুরুষ বা ব্রহ্ম প্রত্যেকের ভেতরেও রয়েছেন আবার বাইরেও রয়েছেন। অর্থাৎ তিনিই সর্বত্র বিরাজ করছেন।

এই পুরুষই ষোলকলাবিশিষ্ট। ‘কলা’ শব্দটির অর্থ হল অঙ্গ বা অংশ। এ যেন বীজ যার থেকে অঙ্কুর বেরিয়েছে। পুরুষ হলেন সেই বীজ যা থেকে এই ষোলকলা-বিশিষ্ট জগতের সৃষ্টি হয়েছে। এরা (এই জগৎ) বীজ থেকে আলাদা নয়। ব্রহ্ম নিজেকে এই জগরূপে প্রকাশ করেছেন।

উপনিষদ এখানে ষোলকলাবিশিষ্ট পুরুষ বলতে সগুণ ব্রহ্মের কথা বলেছেন। বস্তুত এই সমগ্র জগৎ ব্রহ্মের উপাধিমাত্র। এ জগৎ ব্রহ্মের ওপর আরোপিত (অধ্যারোপ)। ব্রহ্মই এ জগতের আশ্রয়।

শঙ্করাচার্য একথাই আমাদেরকে বিশেষভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, কোনকিছুই ব্রহ্মকে প্রভাবিত করতে পারে না। ব্রহ্ম ব্রহ্মই থাকেন, যা নির্গুণ, নিরাকার। কোনও বিশেষণের দ্বারা ব্রহ্মকে বিশেষিত করা যায় না। যদিও এ জগৎরূপে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করে থাকেন। এ জগৎ ব্রহ্মের কাছ থেকেই আসে। আবার ব্রহ্মেই লয় হয়।

স ঈক্ষাংচক্রে। কস্মিন্নহমুৎক্রান্ত উৎক্রান্তো ভবিষ্যামি কস্মিন্বা

প্রতিষ্ঠিতে প্রতিষ্ঠাস্যামীতি॥৩

অন্বয়: সঃ (সেই [ষোলকলা বিশিষ্ট] পুরুষ); ঈক্ষাং চক্রে (চিন্তা করলেন); কস্মিন্‌ উৎক্রান্তে (কে শরীর ত্যাগ করেন); অহম্‌ উৎক্ৰান্তঃ ভবিষ্যামি (যার জন্য আমি ত্যাগ করি); কস্মিন্‌ বা প্রতিষ্ঠিতে কে থাকেন); প্রতিষ্ঠাস্যামি (যার জন্য আমি থাকব)।

সরলার্থ: সেই পুরুষ চিন্তা করলেন : যখন আমি এই শরীর ছেড়ে চলে যাই তখন আসলে কে শরীর ত্যাগ করেন? একইভাবে কার জন্যই বা আমি অনুভব করি যে, আমি এই দেহে আছি?

ব্যাখ্যা: এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘পুরুষ’ কে? ইনিই অন্তরতম সত্তা, যিনি আমাদের সকলের মধ্যে রয়েছেন। আমরা কি তাঁকে দেখতে পাই? না, কিন্তু যোগীরা ধ্যানে তাঁকে উপলব্ধি করেন। তাঁরা তাঁকে আপন হৃদয়ে জ্যোতিরূপে দেখেন। আমাদের মধ্যে এই পুরুষ আছেন বলেই আমাদের এই ‘আমি’বোধ আছে। এমনকি ছোট কীটের মধ্যেও এই ‘অহং’বোধ রয়েছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই ‘আমি’ কে? কখনও কখনও এই ‘আমি’ দেহ ধারণ করেন। তখন তিনি সগুণ ও চিন্তা করতে সক্ষম। এই সকল গুণকে বলা হয় কলা বা অংশ। এ শুদ্ধ ‘আমি’ নয়। এই ‘আমি’ দেহ, মন ও বুদ্ধির অধীন। কিন্তু শুদ্ধ ‘আমি’র কোন কলা বা অংশ থাকে না।

সুতরাং ‘কলা’ আর ‘পুরুষের’ মধ্যে সম্পর্ক কি? বেদান্তমতে এই কলাসমূহ পুরুষের কাছ থেকেই এসেছে আবার পুরুষেই ফিরে যাবে। এরা পুরুষের ওপর আরোপিত মাত্র। আমাদের সকলের মধ্যেই সেই এক ও অভিন্ন ‘আমি’ রয়েছে। কলাসমূহ এই ‘আমি’র ওপরেই আরোপিত। এর ফলেই আমরা নিজেদেরকে একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি, যেমন লম্বা-বেঁটে, সুখী-অসুখী ইত্যাদি। আমাদের দেহের ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ‘আমি’ অপরিবর্তনীয়, নিত্য এবং শাশ্বত।

কিন্তু এই পুরুষ অর্থাৎ পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন কি ভাবে? তিনি কেমন করে এই কলা, দেহ এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন? উপনিষদ বলেন, ‘স ঈক্ষাং চক্রে’—তিনি চিন্তা করেন। ঈক্ষ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল দেখা। কিন্তু এখানে এর অর্থ হল চিন্তা করা। শুধুমাত্র চিন্তার দ্বারা তিনি অর্থাৎ পরমাত্মা বা ব্রহ্ম নিজের মধ্য থেকেই সবকিছুকে প্রকাশ করেন। বাইবেলেও আছে : ‘ভগবান বললেন, আলো হোক এবং আলো প্রকাশিত হল।’

‘কস্মিন্ অহম্‌ উৎক্রান্তে উৎক্ৰান্তঃ ভবিষ্যামি’—কে শরীর থেকে চলে গেলে আমার মনে হয় আমি শরীর ত্যাগ করেছি? যখন কেউ মারা যান তখন আসলে শরীর ছেড়ে কে বেরিয়ে যান? যার জন্য আমরা বলে থাকি তিনি এই শরীর ত্যাগ করেছেন অর্থাৎ মৃত্যুর সময় কে আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে যান? আবার কার জন্যই বা আমরা জীবিত আছি?

স প্রাণমসৃজত প্ৰাণাচ্ছ্রদ্ধাং খং বায়ুর্জ্যোতিরাপঃ পৃথিবীন্দ্রিয়ং

মনঃ। অন্নমন্নাদ্বীর্যং তপো মন্ত্রাঃ কর্ম লোকা লোকেষু চ

নাম চ॥৪

অন্বয়: সঃ (তিনি অর্থাৎ ব্রহ্ম); প্রাণম্ (হিরণ্যগর্ভ); অসৃজত (সৃষ্টি করলেন); প্রাণাৎ শ্রদ্ধাম্ (প্রাণ থেকে শ্রদ্ধা [অর্থাৎ শাস্ত্রাদিতে শ্রদ্ধা]); খম্‌ ([শ্রদ্ধা থেকে] আকাশ); বায়ুঃ ([আকাশ থেকে] বাতাস); জ্যোতিঃ (অগ্নি); আপঃ (জল); পৃথিবী (পৃথিবী); ইন্দ্রিয়ম্‌ (ইন্দ্রিয়); মনঃ (মন); অন্নম্ (খাদ্য); অন্নাৎ (খাদ্য থেকে); বীর্যম্ (বীর্য); তপঃ (তপস্যা); মন্ত্রাঃ (বেদসমূহ); কর্ম (যজ্ঞকর্ম); লোকাঃ (কর্মের দ্বারা প্রাপ্ত লোকসমূহ); লোকেষু চ নাম চ (এবং সেই লোকসমূহে বিভিন্ন নামরূপ)।

সরলার্থ: সেই পুরুষ (সগুণ ব্রহ্ম) হিরণ্যগর্ভকে (প্রাণাত্মা) সৃষ্টি করলেন। হিরণ্যগর্ভ বা প্রাণ থেকে সৃষ্টি হল শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা থেকে আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী এবং ইন্দ্রিয় এল (সৃষ্টি হল)। তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন মন এবং অন্ন। অন্ন থেকে ক্রমে বীর্য, বেদসমূহ, কর্ম (যাগযজ্ঞ), স্বর্গ এবং অন্যান্য লোক, এবং লোকসমূহে বিভিন্ন নাম বা পদসমূহ এল (সৃষ্টি হল)।

ব্যাখ্যা: মৃত্যুর সময় আমাদের দেহ ছেড়ে কে বেরিয়ে যান? উত্তরটি হল প্রাণ অর্থাৎ প্রাণশক্তি। এই প্রাণকে হিরণ্যগর্ভও বলা হয়। হিরণ্যগর্ভই হল ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ। এঁর অপর নাম হল সূত্ৰাত্মা। সূত্র অর্থ সুতো। বিভিন্ন প্রাণীকে ইনি একই সুতোয় গেঁথে রাখেন। কোন মানুষ হয়তো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, তার ইন্দ্রিয়সকলও হয়তো অক্ষত। কিন্তু মৃত্যুর পর তার আর কোন ইন্দ্রিয়ই কাজ করতে পারে না। কারণ প্রাণ দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

উপনিষদ বলেন, শ্রদ্ধা আসে এই প্রাণ থেকেই। শ্রদ্ধা শব্দটির অর্থ হল বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস বা আত্মশ্রদ্ধা। কিন্তু এর অপর অর্থ হল আস্তিক বুদ্ধি, গুরুবাক্যে ও শাস্ত্রে বিশ্বাস। শ্রদ্ধা শব্দের দ্বারা সৎ ইচ্ছাকেও বোঝানো হয়। শ্রদ্ধা যেন একরকমের সংগ্রাম, ভাল থেকে ভালতর, ভালতম হওয়ার সংগ্রাম। এই শ্রদ্ধা শুধুমাত্র মানুষেরই থাকে।

তারপর শ্রদ্ধাসম্পন্ন প্রাণশক্তি থেকে একে একে পাঁচটি উপাদান প্রকাশ পায়। প্রথম হল ‘খম্‌’—যা আকাশ হিসেবে পরিচিত। প্রতিটি উপাদানেরই নির্দিষ্ট গুণ আছে যেমন আকাশের গুণ হল শব্দ। আকাশ থেকে আসে বাতাস। বায়ুর দুটি গুণ। এর প্রধান গুণ হল স্পর্শ। কিন্তু আকাশের গুণ শব্দও এর সাথে জড়িত। এর পরের উপাদান হল জ্যোতি যাকে অগ্নিও বলা হয়। এর নিজস্ব গুণ হল রূপ কিন্তু শব্দ ও স্পর্শ গুণও অগ্নির সাথে যুক্ত। বায়ুকে দেখা যায় না কিন্তু এর শব্দ শোনা যায় এবং একে অনুভব করা যায়। আবার আগুনকে দেখা যায়, শোনা যায় এবং স্পর্শ করা যায়।

জল আসে আগুনের কাছ থেকে। জলের নিজস্ব গুণ হল রস (স্বাদ)। তবে শব্দ, স্পর্শ ও রূপ এই তিন গুণই এর মধ্যে রয়েছে। তারপর জল থেকে আসে এই পৃথিবী বা ক্ষিতি। পৃথিবীর মধ্যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এ সকল গুণই রয়েছে। গন্ধ হল পৃথিবীর নিজস্ব গুণ। কাজেই এই প্রকাশ সূক্ষ্ম থেকে ধীরে ধীরে স্থূল হয়।

কর্ম ছাড়া জীব এ সংসারে থাকতে পারে না। তাই উপাদান থেকে ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি হয়—প্রথমে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পরে কর্মেন্দ্রিয়। পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় হল—কান (শ্রোত্র), চোখ (চক্ষু), নাসিকা (ঘ্রাণ), জিভ (জিহ্বা), ত্বক (স্পর্শেন্দ্রিয়)। এগুলো আবার উপাদানের বিভিন্ন গুণ যথা—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ-এর অনুরূপ। জ্ঞানেন্দ্রিয় সকল খুবই সূক্ষ্ম। তারপরে আসে আমাদের কর্মেন্দ্রিয় যা অপেক্ষাকৃত স্থূল। কর্মেন্দ্রিয়গুলি হল বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।

এখন প্রশ্ন হল, এই ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে কে? মনঃ অর্থাৎ মন। এই মনকে অন্তঃকরণও বলা হয়ে থাকে। মনের চারটি দিক আছে। মন শব্দটি প্রথম দিককে অর্থাৎ মনের বিষয়কে প্রকাশ করে। এই দিকটি যেন সবসময়ই দুলছে। যেমন—আমি এটা করব না ওটা করব? বুদ্ধিই সিদ্ধান্ত নেয়। এটাই হল বোধশক্তি। ‘আমি কি করব, আমার কি করা উচিত’—বুদ্ধি তা স্থির করে। ‘চিত্ত’ হল মনের আর একটি দিক যাতে অনুভূতি, আবেগ ও স্মৃতি জমা থাকে। তারপর হচ্ছে অহঙ্কার অর্থাৎ আমিত্ব বোধ। এই আমিত্ব বোধ থেকেই জীবের উৎপত্তি। ব্যক্তি মাত্রেই এই অহংবোধ থাকে।

পরবর্তী প্রকাশ হল অন্ন বা খাদ্য। ব্যক্তিমাত্রেরই জীবনধারণের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য থেকেই আসে বীর্য ও তেজ। বীর্য থেকেই আসে তপঃ অর্থাৎ কৃচ্ছ্রতা। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা ক্রমশ বুঝতে পারি এ জগতে কিছু লাভ করতে গেলে শক্তি, কৃচ্ছ্রসাধন এবং আত্মসংযমের প্রয়োজন। এর জন্য একজন পথপ্রদর্শক প্রয়োজন, যিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। আমরা এই সমাজের জন্য কিছু করতে চাই এবং আমাদের মধ্যে হয়তো সে ক্ষমতাও আছে। তা সত্ত্বেও একজন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন যিনি আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। তারপর আসে মন্ত্র। মন্ত্র বলতে এখানে বেদকে বোঝানো হয়েছে। শাস্ত্রের নির্দেশমতো আমাদের চলা উচিত।

মন্ত্র থেকেই কর্মের উৎপত্তি। বেদের বিধান অনুসারে আমরা যাগযজ্ঞ এবং অন্যান্য কার্যকলাপ করতে পারি। এর ফলস্বরূপ আমরা বিভিন্ন লোক প্রাপ্ত হই। লোক অর্থাৎ জগৎ। তপস্যা, আত্মসংযম, শাস্ত্রপাঠ এবং যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা আমরা নিজেদেরকে উন্নত করতে পারি। আমরা ভাল আছি কিন্তু আরো ভাল হতে পারি। আবার লোক শব্দের দ্বারা আমাদের অবস্থা বোঝানো হয়ে থাকে। যদি আমি সৎ, সাধু, দয়ালু ও নিঃস্বার্থপর হই এবং সৎসঙ্গে জীবন কাটাই তবে তা হবে স্বর্গবাসের সমান। ঠিক সেরকমভাবে আমি যদি বাজে কাজ করি, অসৎসঙ্গে দিন কাটাই তাহলে সবসময়ই আমাকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে এবং অসুখী হব। একেই নরকবাস বলা হয়ে থাকে। লোক বলতে এখানে চৈতন্যের স্তর, অস্তিত্বের স্তরকে বোঝানো হয়েছে। তারপর এই জগৎ থেকেই নামের সৃষ্টি হয়েছে। নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আমরা একে অপরের থেকে আলাদা অর্থাৎ স্বতন্ত্র।

কাজেই নির্গুণ, নিরাকার পুরুষ থেকেই এই ষোলকলা এসেছে। তারা পুরুষ থেকে পৃথক নয়। পুরুষ এইভাবেই নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন।

স যথেমা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্ৰায়ণাঃ সমুদ্রং প্রাপ্যান্তং গচ্ছন্তি

ভিদ্যেতে তাসাং নামরূপে সমুদ্র ইত্যেবং প্রোচ্যতে। এবমেবাস্য

পরিদ্ৰষ্টুরিমাঃ ষোড়শকলাঃ পুরুষায়ণাঃ পুরুষং প্রাপ্যাস্তং গচ্ছন্তি,

ভিদ্যেতে চাসাং নামরূপে পুরুষ ইত্যেবং পোচ্যতে স এমোঽকালো-

ঽমৃতো ভবতি তদেষ শ্লোকঃ॥৫

অন্বয়: সঃ (এর দৃষ্টান্ত রূপে); যথা (যেমন); ইমাঃ (এইগুলি); সমুদ্ৰায়ণাঃ (সমুদ্রের পথে); স্যন্দমানাঃ (বয়ে চলেছে); নদঃ (নদীসমূহ); সমুদ্রং প্রাপ্য (সমুদ্রে গিয়ে); অস্তং গচ্ছন্তি (অদৃশ্য হয়); তাসাং নামরূপে (তাদের নাম এবং রূপ); ভিদ্যেতে (লোপ পায়); [তদা (তখন থেকে)]; সমুদ্রঃ ইতি এবং প্রোচ্যতে (সমুদ্র রূপে পরিচিত); এবম্ এব (ঠিক এইরূপে); অস্য পরিদ্রষ্টুঃ (যিনি সবকিছু জানেন [সূর্য সবকিছু দেখেন]); পুরুষায়ণাঃ (পুরুষের দিকে যাচ্ছে); ইমাঃ ষোড়শকলাঃ (এই ষোল কলা); পুরুষং প্রাপ্য (লাভ করে); অস্তং গচ্ছন্তি (অদৃশ্য হন); চ আসাং নামরূপে ভিদ্যেতে (তাঁদের নাম এবং রূপ লোপ পায়); পুরুষঃ ইতি এবং পোচ্যতে (তখন তাঁদের পুরুষ বলা হয়); সঃ এষঃ (সেই জ্ঞানী ব্যক্তি); অকলঃ অমৃতঃ ভবতি (সকল গুণের ঊর্ধ্বে এবং অমর); তৎ এষঃ শ্লোকঃ (এখানে এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে)।

সরলার্থ: দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় সমুদ্রে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত নদীসমূহ বইতে থাকে। সমুদ্রে মিলিত হবার পর তাদের আর কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, অর্থাৎ তাদের নামরূপ লোপ পায়। তখন তারা সমুদ্রই হয়ে যায়। অনুরূপভাবে, কোন ব্যক্তি যখন নিজেকে জানেন তখন তিনি ‘পুরুষ’ হয়ে যান। এর ফলে তাঁর সমস্ত উপাধি লোপ পায়। তখন থেকে তিনি নিজেই পুরুষ যিনি নির্গুণ এবং অমর। এ বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: এই সকল কলা কি গতি লাভ করে থাকে? জীবনের উদ্দেশ্য কি? উপনিষদ এখানে সুন্দর একটি উপমা দিয়েছেন। আমরা যেন সকলেই এক একটি নদী, তুমি একটি নদী, আমি হয়তো আর একটি—এভাবে প্রত্যেকেই এক একটি নদীর মতো। এরকম অসংখ্য নদী দ্রুতবেগে সমুদ্রের দিকে বয়ে চলেছে। তারা যেন বলছে : ‘আমি বৃহৎ হতে চাই, আমি অসীম হতে চাই।’ ক্ষীণ জলধারা হয়ে গঙ্গানদী হিমালয় থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে তা নদীর রূপ নেয় এবং ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। তার যেন সবসময় একটা তাড়া থাকে যে, ‘আমাকে সমুদ্রে মিলিত হতে হবে।’ সে অল্পে সন্তুষ্ট নয়, সে সমুদ্র হতে চায়।

আমরা বৃহৎ হতে চাই কেন? কারণ আমরা যে স্বরূপত অসীম। যদিও আমরা নিজেদেরকে ক্ষুদ্র, দুর্বল বলে মনে করি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা তা নই। আমরা অনন্ত। আমরা অসীম।

নদী যখন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে তখন কি হয়? ‘অস্তং গচ্ছন্তি’—তাদের পৃথক অস্তিত্ব তখন লোপ পায়। সমুদ্রের সাথে তারা মিলিত হয়। অর্থাৎ তারা সমুদ্রই হয়ে যায়। অনুরূপভাবে, আত্মজ্ঞান লাভ হলে জীবাত্মা পরমাত্মাই হয়ে যান। ‘নাম-রূপে ভিদ্যেতে’—তাদের নামরূপ লোপ পায়। সেই গঙ্গা এখন কোথায়? কোথায় বা সেই যমুনা? সেই নামরূপে তারা আর এখন নেই। আমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা নাম এবং রূপ আছে। সেই নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই আমরা একে অপরের থেকে আলাদা। কিন্তু এই সবই উপাধিমাত্র। আমি তো কোন নাম নিয়ে জন্মাইনি। নামকরণ হয়েছিল জন্মের পরে। ছোট শরীর নিয়ে আমি জন্মেছিলাম। এবং ক্রমশ তা বড় হয়েছে। প্রথমে আমার যে গঠন ছিল এখন আর তা নেই। এই নামরূপ চিরস্থায়ী নয়।

‘পরিদ্রষ্টুঃ’ অর্থ হল প্রকৃত দর্শক, জ্ঞানী ব্যক্তি, চিন্তাশীল ব্যক্তি। ‘পরি’ অর্থাৎ নির্ভুলভাবে এবং ‘দ্রষ্টুঃ’ অর্থাৎ দর্শক বা পর্যবেক্ষক। জ্ঞানী ব্যক্তি যদি মনোযোগের সাথে নিজেকে লক্ষ্য করেন তবে তিনি শীঘ্রই উপলব্ধি করেন যে তিনি দেহ নন। তিনি দেহ অপেক্ষা অনেক বেশি কিছু। তখন তিনি অনুভব করেন এই সকল কলা আরোপিত মাত্র। তারা পুরুষের কাছ থেকেই এসেছে, পুরুষকে আশ্রয় করেই আছে এবং পুরুষেই লয় হয়ে যাবে। তাদের আর পৃথক অস্তিত্ব থাকে না।

সাধক যখন এই সত্যকে উপলব্ধি করেন তখন তিনি পুরুষে লীন হয়ে যান। ‘পুরুষ’ই ব্রহ্ম, এটাই হল আমাদের প্রকৃত পরিচয়। সাধক তখন উপলব্ধি করেন। তিনি কেবলমাত্র এই দেহতেই সীমাবদ্ধ নন। তিনি অসীম, তিনি পূর্ণ। ‘অকলঃ’— তিনি উপাধিরহিত, নির্গুণ। তিনি তখন অমর হয়ে যান—‘অমৃতঃ ভবতি’। এ দেহের মৃত্যু ঘটে কিন্তু তিনি তো আর দেহ নন। তিনি আত্মা। তিনি ব্রহ্ম।

অরা ইব রথনাভৌ কলা যস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতাঃ। তং বেদ্যং পুরুষং বেদ

যথা মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথা ইতি॥৬

অন্বয়: রথনাভৌ (রথচক্রের নাভিতে) [কেন্দ্রবিন্দু]; অরাঃ ইব (শলাকার মতো); যস্মিন্ (যে পুরুষে); কলাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ (গুণসকল [যেমন প্রাণ ইত্যাদি] আরোপিত); তং বেদ্যং পুরুষম্‌ (সেই পুরুষকে [সেই পরমাত্মাকে] জানতে হবে); বেদ (তাঁকে জান); যথা (যাতে); মৃত্যুঃ বঃ মা পরিব্যথাঃ ইতি (মৃত্যু তোমাদের ব্যথা দিতে না পারে)।

সরলার্থ: রথনাভিতে (রথচক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে) রথচক্রের শলাকাগুলি প্রতিষ্ঠিত। একইভাবে জীবাত্মার উপাধিসকলও পুরুষের (পরমাত্মার) ওপর আশ্রিত। সেই পুরুষকে জানতে চেষ্টা কর। তাঁকে জানতে পারলে মৃত্যু আর তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ এখানে আর একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। চক্রের মধ্যে শলাকা থাকে। সেই শলাকাগুলি একটি কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ রথচক্রের নাভি থেকেই এসেছে এবং নাভির ওপরেই আশ্রিত। এখানে কলা বা উপাধিসকলকে রথচক্রের শলাকার সাথে এবং ব্রহ্মকে রথচক্রের কেন্দ্রবিন্দুর (নাভি) সাথে তুলনা করা হয়েছে। এমন কোন একটা আশ্রয় বা অধিষ্ঠানের প্রয়োজন যার ওপর এই জগৎ স্থিত। আর সেই আশ্রয়ই হলেন ব্রহ্ম। রথচক্রের শলাকাগুলি যেমন তার নাভির ওপর আশ্রিত ঠিক তেমনি এ জগৎ ব্রহ্মে স্থিত।

‘তং বেদ্যং পুরুষং বেদ’—‘তুমিই সেই পুরুষ, তুমিই আত্মা’—একথা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। ‘আমি নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত আত্মা’—এই জ্ঞান অর্জন করতে পারলে মৃত্যুভয় আর আমাদের স্পর্শ করতে পারে না। আমরা তখন উপলব্ধি করি, ‘আমি পূর্ণ, আমিই পৃথিবীর সবকিছু হয়েছি’ এবং ‘আমি অমর’।

তান্‌ হোবাচৈতাবদেবাহমেতৎ পরং ব্রহ্ম বেদ। নাতঃ পরমস্তীতি॥৭

অন্বয়: তান্ উবাচ হ [পিপ্পলাদ] (তাদের [অর্থাৎ শিষ্যদের] বললেন); অহম্‌ (আমি); এতৎ পরং ব্রহ্ম (এই পরব্রহ্ম); এতাবৎ এব (এই পর্যন্ত); বেদ (জানি); অতঃ পরম্ (এর চেয়ে উচ্চতর); ন অস্তি (আর নাই)।

সরলার্থ: পিপ্পলাদ শিষ্যদের বললেন : ‘পরব্রহ্মকে আমি এই পর্যন্তই জানি। তাঁর সম্পর্কে জানবার আর কিছু নেই।’

ব্যাখ্যা: এই হল গুরুর শেষ কথা। আমাদের মনে পড়বে, একদল তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী ঋষি পিপ্পলাদের কাছে এসেছিলেন। এই সকল তরুণ শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও পরম সত্য সম্পর্কে তাঁদের কোন প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিল না। শাস্ত্রের শব্দার্থ তাঁরা বুঝেছিলেন কিন্তু মর্মার্থকে তাঁরা গ্রহণ করতে পারেননি। তাই এইসব শিক্ষার্থীরা পিপ্পলাদকে বলেছিলেন : ‘সবকিছু (শাস্ত্র) পড়েও আমাদের মনে হচ্ছে আমরা কিছুই জানি না। অনুগ্রহ করে আপনি আমাদের শিক্ষা দিন। আমরা ব্রহ্মকে জানতে চাই।’

তখন পিপ্পলাদ সবকিছু ব্যাখ্যা করলেন। সবশেষে তিনি বললেন : ‘এই হল পরমতত্ত্ব। এর অতিরিক্ত আমি আর কিছুই জানি না এবং আমি মনে করি এর বাইরে আর কিছুই নেই।’ মুণ্ডক উপনিষদে আছে, যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি সব কিছু জানেন। আমরা অনেক কিছু জানতে পারি, কিন্তু সে জ্ঞানই চূড়ান্ত নয়। যতক্ষণ ব্রহ্মকে জানতে না পারি ততক্ষণ আমরা কিছু জানি না। আমাদের মধ্যে তখন শূন্যতার বোধ জন্মায়। ঋষি পিপ্পলাদ বললেন: ‘পরব্রহ্ম ছাড়া আর জানবার কিছুই নেই। আমি তোমাদেরকে এই পরব্রহ্মের কথাই বলেছি। এছাড়া পরব্রহ্ম সম্পর্কে আর কিছু বলবার নেই।’

সুতরাং এই সিদ্ধান্ত। পরব্রহ্মকে জানাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। তুমি হয়তো একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এবং শাস্ত্রে তোমার অগাধ পাণ্ডিত্যও আছে। কিন্তু পাণ্ডিত্য এবং ব্রহ্মজ্ঞান এক নয়। শাস্ত্রনিহিত সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে না পারলে তা হবে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ মাত্র। আত্মজ্ঞান লাভ হলে মানুষের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে। তিনি এক অন্য মানুষে পরিণত হন। এটাই জ্ঞানের পরীক্ষা। আমরা শাস্ত্র নিয়ে নানা আলোচনা করতে পারি, এমনকি তা থেকে উদ্ধৃতিও দিতে পারি। কিন্তু আমরা যদি নীচ, স্বার্থপর ও অসৎ হই তবে এই সকল আলোচনা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনই আমাদের বলে দেয় তিনি পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছেন। তাঁর জীবন আমাদের মুগ্ধ করে। তাঁর চরিত্র আমাদের আকৃষ্ট করে। তাঁকে ভগবান বলে মনে হয়। তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন কিন্তু আগুনকে কি কখনও লুকিয়ে রাখা যায়? শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারেন না। আমরা তাঁকে দেখে আনন্দ পাই। কারণ তিনি যে আনন্দস্বরূপ। এই লক্ষণ দেখেই ঈশ্বরতুল্য ব্যক্তিকে চেনা যায়।

তে তমৰ্চয়ন্তস্ত্বং হি নঃ পিতা যোঽস্মাকমবিদ্যায়াঃ পরং পারং
তারয়সীতি। নমঃ পরমঋষিভ্যো নমঃ পরমঋষিভ্যঃ॥৮

অন্বয়: তে (ঐ শিষ্যেরা); তম্ অৰ্চয়ন্তঃ (তাঁকে অর্চনা করতে আরম্ভ করলেন); ত্বং হি নঃ পিতা ([তাঁরা বললেন] আপনিই আমাদের পিতা); যঃ ([কারণ আপনি) যিনি); অস্মাকম্ (আমাদের); অবিদ্যায়াঃ পরং পারম্ (অবিদ্যার পরপারে); তারয়সি (নিয়ে গেলেন); নমঃ পরম-ঋষিভ্যঃ (আমরা মহান ঋষিদের প্রণাম করি); নমঃ পুরম-ঋষিভ্যঃ ([পুনরায়] আমরা মহান ঋষিদের প্রণাম করি)।

সরলার্থ: শিষ্যরা গুরুর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন। তাঁরা বললেন : ‘আপনি আমাদের পিতা, কারণ আপনিই আমাদের অজ্ঞানতার পরপারে নিয়ে গেছেন। আমরা সেই মহান ঋষিদের বারবার প্রণাম করি।’

ব্যাখ্যা: শিষ্যরা এখন সবকিছু জেনেছেন। তাই তাঁরা গুরুর প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আত্মজ্ঞানই সর্বোচ্চ দান। অর্থদানও দান। কিন্তু অর্থ তো চিরস্থায়ী নয়। আবার শিক্ষাদানও যথেষ্ট নয়। কারণ শিক্ষার সাহায্যেও সব সমস্যার সমাধান হয় না। আধ্যাত্মিক জ্ঞানই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান। তাই অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে শিষ্যরা গুরুকে তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছেন।

‘ত্বং হি নঃ পিতা’—আপনিই আমাদের পিতা। পিতা যেমন ধনসম্পদ তাঁর সন্তানদের দিয়ে যান ঠিক তেমনি আপনি আমাদের এই সর্বোচ্চ জ্ঞান দান করেছেন।

আমরা গুরুকে পিতা বলি কেন? শঙ্করাচার্য বলেন : যিনি তোমাকে এই শরীর দিয়েছেন তিনিই তোমার পিতা। এই কারণে তিনি পূজনীয়। আমরা তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। আমরা তাঁকে ভালবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। কিন্তু যিনি আমাকে মুক্তির পথ দেখান, যিনি আমাকে অভয়ধামে পৌঁছে দেন তাঁকে আমরা কোন্‌ স্থান দেব? তিনি কি আমাদের পিতা নন?

‘অস্মাকম্‌ অবিদ্যায়াঃ পরং পারং তারয়সি’—তিনি আমাদের অজ্ঞান নদীর পরপারে নিয়ে যান। প্রায় সবধর্মেই এই নদীর ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। এই সেই নদী যার পরপারে আমাকে যেতে হবে। কিন্তু কিভাবে অপর পারে যাব আমি তা জানি না। এই নদীটি কি? এ অজ্ঞানতার নদী। কে আমাদের এই নদীর অপর পারে পৌঁছে দেবেন? গুরু, তিনিই তো আমাদের কর্ণধার।

‘নমঃ পরমঋষিভ্যঃ’—এবার আমরা সকল গুরুপরম্পরাকে প্রণাম করি, যাঁরা এই জ্ঞান—আত্মজ্ঞান বা পরমজ্ঞান আমাদের দান করেছেন। কিন্তু এখানে ‘নমঃ পরমঋষিভ্যঃ’ কথাটি দুবার বলা হয়েছে কেন? গুরুর প্রতি ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।

এখানেই প্রশ্ন উপনিষদের ষষ্ঠ প্রশ্ন সমাপ্ত।

ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভির্ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *