কেন উপনিষদ

কেন উপনিষদ

মঙ্গলাচরণ

ওঁ আপ্যায়ন্তু মমাঙ্গানি বাক্‌ প্রাণশ্চক্ষু: শ্রোত্রমথো
বলমিন্দ্রিয়াণি চ সর্বাণি। সর্বং ব্রহ্মৌপনিষদম্। মাঽহং
ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোৎ;
অনিরাকরণমস্তু, অনিরাকরণং মেঽস্তু। তদাত্মনি নিরতে
য উপনিষৎসু ধর্মান্তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

অন্বয়: মম অঙ্গানি (আমার অঙ্গসমূহ); বাক্‌ প্রাণঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রম্ অথো বলম্ (বাক্‌শক্তি, প্রাণবায়ু, দৃষ্টি, শ্রবণ এবং বল); সর্বাণি ইন্দ্রিয়াণি চ (এবং সকল ইন্দ্রিয়); আপ্যায়ন্তু (পুষ্টিলাভ করুক); সর্বম্ ঔপনিষদং ব্রহ্ম (সকলই ব্রহ্ম, এই কথাই সমস্ত উপনিষদ বলে); অহং ব্রহ্ম মা নিরাকুর্যাম্ (আমি যেন ব্রহ্মের কথা শুনতে উদাসীন না হই) ব্রহ্ম মা মা নিরাকরোৎ (ব্রহ্ম যেন কখনও আমাকে সরিয়ে না দেন); অনিরাকরণম্ অস্তু (আমিও যেন তাঁর কাছ থেকে সরে না আসি); মে অনিরাকরণম্ অস্তু (তিনিও যেন আমায় তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে না দেন); উপনিষৎসু (উপনিষদসমূহে); যে ধর্মাঃ ( যে সকল ধর্ম আছে); তে (তারা); তৎ আত্মনি নিরতে ময়ি (আত্মনিষ্ঠ অর্থাৎ স্বরূপ জ্ঞান লাভের সাধনায় রত আমার); সন্তু (হোক); তে ময়ি সন্তু (সেগুলি যেন আমার আয়ত্তে আসে); শান্তিঃ (আধ্যাত্মিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শান্তি]); শান্তিঃ (আধিদৈবিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ পরিবেশ বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শান্তি]); শান্তিঃ (আধিভৌতিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ কীটপতঙ্গ, হিংস্রপ্রাণী প্রভৃতি-কৃত বিঘ্নের শান্তি])।

সরলার্থ: আমার সমস্ত অঙ্গ যেন পুষ্ট হয়। তার সঙ্গে আমার প্রাণবায়ু, বাক্‌শক্তি, দৃষ্টি, শ্রবণ এবং অন্যান্য সব ইন্দ্রিয়গুলিও যেন শক্তিশালী হয়। ব্রহ্মের কথাই সব উপনিষদ বলে। আমি যেন কখনও ব্রহ্মের কথা শুনতে উদাসীন না হই। ব্রহ্মও যেন কখনও আমাকে সরিয়ে না দেন। আমি তাঁর কাছ থেকে সরে আসব না, তিনিও যেন আমাকে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে না দেন। আমি বিশেষ করে এই চাই যে, আমি যেন সরে না আসি। আমি আমার স্বরূপ সম্বন্ধে পড়াশুনা করছি। কি কি গুণ থাকলে স্বরূপ-জ্ঞান হয়, তা উপনিষদ বলে দিয়েছেন। আমি যেন সেই গুণগুলি আয়ত্ত করতে পারি।

ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।

ব্যাখ্যা: এই মঙ্গলাচরণ যেন একটা প্রার্থনা—শক্তির জন্যে। কিন্তু কেন? উপনিষদ বুঝতে গেলে শক্তি চাই। ব্রহ্মতত্ত্ব তথা সত্য কি বুঝতে গেলে শক্তি চাই। উপনিষদ সত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি সেই সত্যই জানতে চাই। উপনিষদ যে তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন, তা আমি জানতে চাই। মুণ্ডক উপনিষদ বলেছেন, ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যো’—যারা দুর্বল তারা কখনও আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে না (মু. উ. ৩১|২|৪)। অর্থাৎ যারা দেহে, মনে এবং চরিত্রের শক্তিতে শক্তিমান, তারাই পারে। উপনিষদ বেশ দুর্বোধ্য, আবার সূক্ষ্মও বটে। দুর্বলের পক্ষে ব্রহ্মকে বোঝা সম্ভব নয়। তাই এই প্রার্থনা এবং এই প্রার্থনার তাৎপর্য বিশেষ অর্থবহ।

কেন উপনিষদ

এই উপনিষদের নাম ‘কেন উপনিষদ’; তার কারণ এই, এটি শুরু হয়েছে একটি বিশেষ শব্দ দিয়ে। শব্দটি হচ্ছে ‘কেন’, অর্থাৎ ‘কার দ্বারা’। উপনিষদ প্রশ্ন করছেন, ‘কার দ্বারা এই জগৎ নিয়ন্ত্রিত?’ এর উত্তর—ব্রহ্ম। এই তত্ত্বটি বোঝানোর জন্য এখানে একটি গল্প বলা হয়েছে যার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ব্রহ্ম ছাড়া দেবতারা একান্ত অসহায়; দেবতাদের যদি কোন শক্তি থেকে থাকে তার উৎসও ব্রহ্ম। জীবনের লক্ষ্য সেই এককে অর্থাৎ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা। কেন উপনিষদ বলছেন, একমাত্র এই একত্বের জ্ঞানই আমাদের মুক্তি দিতে পারে। বস্তুত সব উপনিষদেরই এই এক সুর, ‘একের’ আলোচনা। সকলেই বলছেন ব্রহ্মজ্ঞান ছাড়া মুক্তির আর কোন পথ নেই। ব্রহ্মজ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। তাই তাকে পরা বিদ্যা বলা হয়েছে। এই জ্ঞান পরম সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। অন্যান্য জাগতিক জ্ঞান হল অপরা বিদ্যা, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের তুলনায় নিকৃষ্ট বিদ্যা। ব্রহ্মজ্ঞান সর্বোত্তম, কারণ এই জ্ঞান হলে আপনি ব্রহ্মের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা অনুভব করেন। এই জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, কারণ তা মানুষকে অপার শান্তি ও আনন্দে ভরপুর করে দেয়।

প্রথম খণ্ড

ওঁ কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ
কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ।
কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি
চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো যুনক্তি॥১

অন্বয়: কেন ইষিতম্‌ [কেনেষিতম্ (কার ইচ্ছায়); প্রেষিতম্ (কার নির্দেশে); মনঃ পততি (মন পড়ে [স্ববিষয়ে অর্থাৎ স্ববিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়]); কেন (কার দ্বারা); প্রাণঃ (প্রাণবায়ু); প্রথমঃ (প্রথম); প্রৈতি (যায়, ধাবিত হয়); যুক্তঃ (কার দ্বারা নিয়োজিত হয়ে); ইমাং বাচম্ (এই কথা [শব্দ]); বদন্তি ([মানুষ] বলে); চক্ষুঃ (চোখ); শ্রোত্রম্ (কান); কঃ (কোন্); দেবঃ (দেবতা [দেবতা অর্থাৎ যিনি আলোকপ্রদ]); যুনক্তি (চালনা করেন)।

সরলার্থ: (শিষ্য)—কার ইচ্ছায় মন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়? প্রাণের প্রথম লক্ষণ, শ্বাসবায়ু, কার নির্দেশে কাজ করে? কার নির্দেশে মানুষ কথা বলে? চোখ, কান [এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে] কোন্ দেবতা চালনা করেন?

ব্যাখ্যা: একটি মূল প্রশ্ন দিয়ে এই উপনিষদ শুরু হয়েছে: ‘কে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেন?’ এই প্রশ্নের আর একটি তাৎপর্য: ‘কে এই জগৎকে চালান?’ স্পষ্টই বোঝা যায় ইন্দ্রিয়গুলি স্বাধীন বা স্বতন্ত্র নয়। তা যদি হত, তাহলে শেষপর্যন্ত যা ক্ষতিকর এমন কোন কাজ তারা করতে পারত না। অতএব দৃশ্যমান এই জগতের কার্যকলাপ অবশ্যই কারও দ্বারা পরিচালিত বলে মনে হয়। কে সেই পরিচালক?

শ্রোত্রস্য শ্ৰোত্ৰং মনসো মনো যদ্
বাচো হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ।
চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ
প্ৰেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি॥২

অন্বয়: শ্রোত্রস্য শ্রোত্রম্ (কানেরও কান [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি শ্রবণেন্দ্রিয়কে চালনা করে]); মনসঃ মনঃ (মনেরও মন [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তির দ্বারা মন কাজ করে]); যদ্ বাচো হ বাচম্ (যা বাগিন্দ্রিয়ের বাক্ [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি বাগিন্দ্রিয়কে পরিচালনা করে]); সঃ উ প্রাণস্য প্রাণঃ (তিনি প্রাণবায়ুরও প্রাণ [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি প্রাণবায়ুকে চালনা করে]); চক্ষুষঃ চক্ষুঃ (চোখেরও চোখ [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি চোখকে চালনা করে]); ধীরাঃ (প্রজ্ঞাবান বা বিচারশীল ব্যক্তিরা); অতিমুচ্য (ত্যাগ করে [অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়সমূহে আত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে]); প্ৰেত্য (নিবৃত্ত হয়ে); অস্মাৎ লোকাৎ (এই জগৎ থেকে); অমৃতাঃ ভবন্তি (অমরত্ব লাভ করেন)।

সরলার্থ: (আচার্য)—এই (ব্রহ্মই) কানের প্রকৃত কান, মনের যথার্থ মন, কথার প্রকৃত শক্তি, শ্বাসের প্রকৃত শ্বাস, চোখের প্রকৃত চোখ। তাই জ্ঞানীরা দেহে আত্মবুদ্ধি না করে এই জগৎকে ত্যাগ করেন এবং অমর হয়ে যান।

ব্যাখ্যা: আত্মার শক্তিতেই ইন্দ্রিয়গুলি শক্তিমান। মৃত্যুর সময় আত্মা তাঁর সেই শক্তি প্রত্যাহার করে নেন, তাই অক্ষত থাকলেও ইন্দ্রিয়গুলি অকেজো হয়ে পড়ে। ‘প্রেত্য’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘মৃত্যুর পর’। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে কথাটির অর্থ ‘নিবৃত্ত হয়ে’ বা ‘ত্যাগ করে’। কি ত্যাগ করতে হবে? দৃশ্যমান এই জড়জগৎ, নামরূপের এই প্রাতিভাসিক জগৎ। কেন? কারণ কেবলমাত্র প্রাতিভাসিক জগৎকে ত্যাগ করেই সেই পরম তত্ত্ব বা ব্রহ্মকে লাভ করা যায়। ঈশ উপনিষদও আমাদের সেই নির্দেশ দিচ্ছেন—‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’ অর্থাৎ ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে পুষ্ট করো (ঈশ. উ. ১)। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে অন্তর্নিহিত যে ব্রহ্মসত্তা তাঁকে কেবলমাত্র ত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা উপলব্ধি করতে পারি এবং অমর হতে পারি। ‘প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি’—এই বাক্যের দ্বারা কেন উপনিষদ আমাদের সেই কথাই বলতে চাইছেন। চারপাশে যা ঘটছে তা দেখে আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ আমাদের কাছে অত্যন্ত সত্য বলে মনে হয় এবং এই জগৎও নিঃসন্দেহে খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু আমরা যেন বিচারবুদ্ধি না হারাই; সত্যের প্রতি যেন আমাদের দৃষ্টি থাকে।

‘কেনেষিতম্’, কার নির্দেশে এই জগৎ সত্য বলে প্রতিভাত হয়? জগতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন যে ব্রহ্ম, তাঁরই নির্দেশে। ব্রহ্ম জগতের অধিষ্ঠান হয়ে আছেন বলেই এই জগৎকে সত্য মনে হয়। মাটিতে দড়ি পড়ে আছে বলেই সেটিকে সাপ বলে মনে হয়। সাপটা একটা চাপানো জিনিস। দড়িটি থাকাতেই সাপের অধ্যাস সম্ভব। দড়িটি সরিয়ে নিলে আর সাপ দেখা যাবে না। ঠিক সেইরকম, ব্রহ্মকে বাদ দিলে জগতের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না।

ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্‌গচ্ছতি নো মনঃ।
ন বিদ্মো ন বিজানীমো যথৈতদনুশিষ্যাৎ॥৩

অন্বয়: তত্র (সেখানে [অর্থাৎ যেখানে ব্রহ্ম আছেন]); চক্ষুঃ ন গচ্ছতি (চোখ যেতে পারে না); ন বাক্ গচ্ছতি নো মনঃ (যা বাক্য এবং মনের অতীত); ন বিদ্মঃ (আমরা জানি না [এই ব্রহ্মের স্বরূপ কি); যথা (কি ভাবে); এতৎ (এই [ব্রহ্ম]); অনুশিষ্যাৎ (গুরু শিষ্যের কাছে ব্যাখ্যা করেন); ন বিজানীমঃ ([তাও] আমাদের কাছে দুর্বোধ্য [অর্থাৎ আমরা জানি না])।

সরলার্থ: ব্রহ্ম যেখানে, সেখানে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছতে পারে না। তা আমাদের বাক্য এবং মনেরও অতীত। আচার্য এ দুরূহ তত্ত্ব কিভাবে শিষ্যের কাছে ব্যাখ্যা করেন তা আমরা জানি না।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন। তাঁর সম্পর্কে তাই আমরা কিছুই বলতে পারি না। তিনি অসীম—এতই বিশাল যে, আমাদের মন তাঁর ধারণা করতে পারে না। তাই আচার্য বলছেন, ‘ন বিদ্মঃ ন বিজানীমঃ’—আমরা জানি না, আমরা জানি না। কেন আমরা জানি না? কারণ, ব্রহ্ম জ্ঞানের বিষয় নন। আমাদের থেকে আলাদা একটা বস্তুকে আমরা জানতে পারি, কিন্তু ব্রহ্মকে পারি না। কারণ আমরাই ব্রহ্ম। আমাদের থেকে যা পৃথক তাকেই আমরা জানতে পারি, কিন্তু নিজের আত্মাকে আমরা কখনই দেখতে পাই না। ব্ৰহ্ম সর্বদাই জ্ঞাতা, বিষয়ী। তিনি কখনও জ্ঞেয় বা জ্ঞানের বিষয় হতে পারেন না। বস্তুত যা কিছু আছে, সব ব্রহ্ম। জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর পার্থক্য অথবা বিষয়ী এবং বিষয়ের মধ্যে যে পার্থক্য, অ আমাদের কল্পনা।

অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি।
ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নস্তদ্‌ব্যাচচক্ষিরে॥৪

অম্বয়: অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো [অন্যৎ এব, তৎ বিদিতাৎ অথো] (সব পরিচিত অথবা জানা জিনিস থেকে আলাদা); অবিদিতাদধি [অবিদিতাৎ অধি] ([এমনকি) অজানা বস্তুসমূহেরও অতীত); ইতি শুশ্রুম (এই আমরা শুনেছি); পূর্বেষাম্ (প্রাচীন আচার্যদের কাছ থেকে); যে (যাঁরা); নঃ (আমাদের কাছে); তৎ (সেই [ব্রহ্ম]); ব্যাচচক্ষিরে (ব্যাখ্যা করেছিলেন)।

সরলার্থ: সব পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ‘তৎ’ অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র; ব্রহ্ম অজ্ঞাত বস্তু থেকেও স্বতন্ত্র। প্রাচীন (আচার্য) যাঁরা এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা—আমরা তাঁদের কাছ থেকে একথা শুনেছি।

ব্যাখ্যা: এ জগতে এমন কিছু বস্তু আছে যাদের সম্বন্ধে আমরা কিছু কিছু জানি, আবার এমন সব বস্তুও আছে যাদের সম্বন্ধে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের কোন তুলনা হয় না। তিনি জ্ঞান-অজ্ঞানের পার। জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত দুই শ্রেণীর বস্তুরই ঊর্ধ্বে তিনি। ব্রহ্মজ্ঞান মানে আত্মজ্ঞান, নিজের স্বরূপকে জানা। অনেক বই পড়ে এই জ্ঞান লাভ করা যায় না; এ অঙ্ক শেখা নয় যে, শিক্ষক বুঝিয়ে দিলেন আর ছাত্র অমনি বুঝে গেল। ব্রহ্মজ্ঞান এমনই জ্ঞান যা পরম্পরাগতভাবে গুরু থেকে শিষ্যে আসে। বলা হয়, এ যেন একটি প্রদীপ থেকে আরেকটি প্রদীপ জ্বালানো। এই জ্ঞান সাধকের অন্তরে হঠাৎই একদিন দপ করে জ্বলে ওঠে। কেমন করে যে এটা সম্ভব হয় তা বুঝিয়ে বলা যায় না। এই জ্ঞান তাই অনির্বচনীয়। আপনি হয়তো খুবই বুদ্ধিমান, অগাধ পাণ্ডিত্য আপনার। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে আপনি ব্রহ্মকে বুঝে ফেলবেন তা নয়। তাই উপনিষদ বলছেন, আগে নিজেকে তৈরী করো। জমি তৈরী হলে যথাসময়ে গুরু তোমাকে এই জ্ঞান দেবেন। তিনিই তোমাকে তোমার প্রকৃত পরিচয় বলে দেবেন। এসব সত্ত্বেও এই উপনিষদ বলছেন যে, ব্রহ্ম অজ্ঞেয়। তাঁকে আমরা জানতে পারি না, কারণ তিনিই আমাদের আত্মা। প্রথমে জমি তৈরী করে ঐ জ্ঞান ধারণের উপযুক্ত হতে হবে। তারপর হঠাৎ একদিন ঐ জ্ঞান আপনিই এসে উপস্থিত হবে এবং তখন তুমি তোমার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারবে।

যদ্‌বাচাঽনভ্যুদিতং যেন বাগভ্যুদ্যতে।
তদেব ব্ৰহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥৫

অন্বয়: যৎ (যিনি); বাচা (বাক্যের দ্বারা); অনভ্যুদিতম্ (অপ্রকাশিত); যেন (যাঁর দ্বারা); বাক্ (বাক্য); অভ্যুদ্যতে (স্ফূর্ত হয়, প্রকাশের মাধ্যম হয়); তৎ এব ব্রহ্ম (তিনিই নিশ্চিত ব্রহ্ম); ত্বং বিদ্ধি (তুমি জানো); ন ইদম্ (এঁকে নয়); যৎ ইদম্ উপাসতে (যাঁকে লোক পূজা করে)।

সরলার্থ: একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যাঁকে বাক্য দিয়ে বর্ণনা করা যায় না, বরং যাঁর দ্বারা বাক্যই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম বা আত্মাকে কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। কেন যায় না? কারণ আত্মাই বাক্যকে প্রকাশ করে। আত্মা না থাকলে বাক্যের অস্তিত্বই অসম্ভব। তাই কেন উপনিষদের শুরু হয়েছে এই প্রশ্নটি দিয়ে—‘এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, দৃশ্যমান জগতের পেছনে কে আছেন?’ এই বাহ্যজগৎ আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছে। মন ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপেও আমরা চমৎকৃত। তাই আমরা প্রশ্ন করি—‘এসবের নেপথ্যে কে বা কোন্ শক্তি কাজ করছে?’ বিজ্ঞানীরা কখনও কখনও বলেন, যদি স্রষ্টা বলে কেউ একজন থাকেন তবে তিনি অবশ্যই একজন মস্ত গণিতজ্ঞ, কারণ জগতের সমস্ত কিছুই অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, অঙ্কের মতো নিখুঁত। আবার অন্য কেউ কেউ বলেন, জগৎ-স্রষ্টা একজন অসাধারণ এঞ্জিনীয়ার। বাস্তবিক এই জগতের সবকিছুই এমন নিখুঁত ছন্দে চলছে যে সময়ে সময়ে আমরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, কার জন্যে এটা সম্ভব হচ্ছে? তার উত্তর এই—ব্রহ্মের জন্যেই এইসব সম্ভব হচ্ছে। এই উপনিষদ সেই ব্রহ্মকে জানার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে বলছেন।

এই দৃশ্যমান স্থূলজগৎ আমাদের কাছে অত্যন্ত সত্য বলে মনে হয়। তাই আমরা জাগতিক ভোগসুখের পেছনে মোহগ্রস্তের মতো ছুটে চলি। জগতে যত ভোগের বস্তু, বস্তুত আমরা যেন তারই পুজো করি। কিন্তু আমাদের জানা উচিত যে, এই জগৎ অসার, অনিত্য; এর কোন পারমার্থিক সত্তা নেই। পার্থিব বস্তুর পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা অনিত্য বস্তুর পেছনে ছুটে বেড়াই। আর তার জন্যই আমাদের যত কষ্ট, যত জ্বালা-যন্ত্রণা। এই দৃশ্যমান জগতের নেপথ্যে রয়েছেন সেই পরম সত্য, ব্রহ্ম, যাঁর সঙ্গে আমরা অভিন্ন। অজ্ঞানতার মোহজাল ছিঁড়ে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, এবং ব্রহ্মোপলব্ধির জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

যন্মনসা ন মনুতে যেনাহুর্মনো মতম্।
তদেব ব্ৰহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥৬

অন্বয়: যৎ (যাঁকে [অর্থাৎ ব্রহ্মকে]); মনসা (মনের দ্বারা); ন মনুতে (বোঝা যায় না); যেন (যাঁর দ্বারা); আহুঃ (তাঁরা [অর্থাৎ ঋষিরা] বলেন); মনঃ (মন); মতম্ ([অনুপ্রাণিত হয়, কাজ করে] মন হিসাবে)।

সরলার্থ: একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো, মন যাঁকে বুঝতে পারে না কিন্তু ঋষিদের মতে যিনি মনকে কর্মক্ষম করেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।

ব্যাখ্যা: নিজেদের মনকে আমরা কতই না শক্তিমান মনে করি। কিন্তু এই মনের ক্ষমতাও সীমিত, কারণ এই মন দিয়ে আমরা ব্রহ্মের ধারণা করতে পারি না। কেন? কারণ ব্রহ্ম আছেন বলেই মন কাজ করে। ব্রহ্ম ছাড়া মন শক্তিহীন। তাই যে ব্রহ্ম আমাদের আত্মার সঙ্গে অভিন্ন তাঁকে উপলব্ধি করাই আমাদের ধ্যানজ্ঞান হওয়া উচিত। সবকিছু ত্যাগ করে আমাদের মন ব্রহ্মে নিবিষ্ট হোক।

যচ্চক্ষুষা ন পশ্যতি যেন চক্ষুংষি পশ্যতি।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিমুপাসতে॥৭

অন্বয়: যৎ (যাঁকে [অর্থাৎ ব্রহ্ম]); চক্ষুষা (চোখ দিয়ে); ন পশ্যতি (দেখা যায় না); যেন (যাঁর সাহায্যে); চক্ষুংষি (চোখদুটি); পশ্যতি (দেখে)।

সরলার্থ: তিনিই ব্রহ্ম যাঁকে চোখ দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু যাঁর শক্তিতে চোখ দেখতে পায়। এই ব্রহ্ম কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সকলের উপাস্য জগৎ থেকে স্বতন্ত্র।

ব্যাখ্যা: কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার চোখ, কান এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলিও অক্ষত থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলি আর কাজ করতে পারে না। তার চোখ আর দেখে না, কান আর শোনে না। কেন? কারণ ইন্দ্রিয়গুলির নিজস্ব কোন শক্তি নেই। কাজ করার জন্য তাদের শক্তির প্রয়োজন। সেই শক্তিটি কি? সেটি সকল শক্তির উৎস। সেই শক্তিকেই ব্রহ্ম বা আত্মা বলা হয়েছে।

যচ্ছ্রোত্রেণ ন শূণোতি যেন শ্রোত্রমিদং শ্রুতম্।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥৮

অন্বয়: যৎ (যাঁকে [অর্থাৎ ব্রহ্মকে]); শ্রোত্রেণ (কান দিয়ে); ন শৃণোতি (শোনা যায় না); যেন (যাঁর সাহায্যে); ইদং শ্রোত্রম্ (এই শ্রবণেন্দ্রিয়); শ্রুতম্ (শুনতে পায়, কাজ করে)।

সরলার্থ: একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যাঁকে কান দিয়ে শোনা যায় না, কিন্তু যাঁর শক্তিতে কান শুনতে পায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।

ব্যাখ্যা: অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মতো ব্রহ্ম কানেরও গোচর নন, কারণ তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নন। বরং ব্রহ্মের শক্তিতেই কান শুনতে পায়। এই জগৎকে সত্য ভেবে মানুষ তার পেছনে ছুটে বেড়ায়। কিন্তু এর মতো ভুল আর নেই। কারণ ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং ব্রহ্মের জন্যেই এই জগৎ সত্য বলে মনে হয়। ব্রহ্মই নামরূপাত্মক এই জগতের অধিষ্ঠান। ব্রহ্ম যেন একটা পর্দা, যার ওপর চলচ্চিত্রের নানান ছবি জীবন্ত হয়ে ওঠে।

যৎ প্রাণেন ন প্রাণিতি যেন প্রাণঃ প্ৰণীয়তে।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥৯

অন্বয়: যৎ (যাঁকে অর্থাৎ ব্রহ্মকে); প্রাণেন (শ্বাসের দ্বারা, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে); ন প্রাণিতি (কেউ আঘ্রাণ করতে পারে না); যেন (যাঁর দ্বারা); প্রাণঃ (শ্বাসবায়ু, ঘ্রাণেন্দ্রিয়); প্রণীয়তে (শ্বাস নেয়, আঘ্রাণ করে [অর্থাৎ কাজ করে])।

সরলার্থ: একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের গোচর নন, অথচ যাঁর শক্তিতে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঘ্রাণ নেয়, কাজ করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।

ব্যাখ্যা: যে শ্লোকগুলি এতক্ষণ পড়া হল তার মর্মার্থ এই যে ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন বস্তু নন। ব্রহ্মের সাহায্য ছাড়া ইন্দ্রিয়গুলি তাদের নিজের নিজের কাজ করতে পারে না। ব্রহ্মই সব শক্তির উৎস। ব্রহ্মই পরম সত্তা বা তত্ত্ব যাঁর উপর সবকিছু অধ্যস্ত, অর্থাৎ নির্ভরশীল। এখন আমাদের এটাই অনুভব করতে হবে যে, এই ব্রহ্মই আমাদের সকলের আত্মা।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই স্থূলজগৎ নিয়ে আমরা এমনই মত্ত যে, এটা যে সত্য নয় একথা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। জগৎ সত্য নয়, একথার অর্থ হল এই যে, জগৎ পরিবর্তনশীল। বেদান্তমতে, যা কিছু পরিবর্তনশীল তা-ই মিথ্যা, অর্থাৎ ‘অনিত্য’। একমাত্র ব্রহ্মই সত্য বা ‘নিত্য’ কারণ ব্রহ্ম অপরিবর্তনীয়। এই জগৎ যে সত্য বলে মনে হয় তার একমাত্র কারণ এই জগৎ ব্রহ্মে আশ্রিত। ব্রহ্মকে বাদ দিলে এই জগতের কোন অস্তিত্ব থাকে না।

কেন উপনিষদের প্রথম খণ্ড এইখানে সমাপ্ত।

দ্বিতীয় খণ্ড

যেভাবে জগতের আর পাঁচটা বস্তুকে জানা যায়, ব্রহ্মকে সেইভাবে জানা যায় না। এর কারণ ব্ৰহ্ম কোন জ্ঞেয় বস্তু নন। সাধারণভাবে কোন বস্তুকে জানতে গেলে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন : ‘জ্ঞেয়’ অর্থাৎ যে বস্তুটিকে জানতে চাই; ‘জ্ঞাতা’ অর্থাৎ যিনি জানবেন এবং ‘জ্ঞান’ অর্থাৎ যা জানা হল। কিন্তু যেহেতু তিনটি নিয়েই ব্রহ্ম, সেইহেতু ব্রহ্মকে জানার প্রশ্নই ওঠে না। আগুন অন্য বস্তুকে পোড়াতে পারে, কিন্তু নিজেকে কি পোড়াতে পারে? ব্রহ্মও ঐরকম।

যদি মন্যসে সুবেদেতি দভ্রমেবাপি
নূনং ত্বং বেত্থ ব্ৰহ্মণো রূপম্।
যদস্য ত্বং যদস্য দেবেষ্বথ নু
মীমাংস্যমেব তে মন্যে বিদিতম্॥১

অন্বয়: যদি (যদি); মন্যসে (তুমি মনে করো); সুবেদেতি [সুবেদ ইতি] (আমি ভালভাবে জানি [অর্থাৎ, আমি ব্ৰহ্মকে সম্যক্ রূপে জানি]); দভ্রম্ (অল্প [পাঠান্তরে ‘দহরম্’। ‘দভ্রম্’ ও ‘দহরম্’-এর একই অর্থ]); এব অপি নূনম্ (নিশ্চিতভাবে); ত্বং বেত্থ (তুমি জানো); ব্রহ্মণঃ রূপম্ (ব্রহ্মের স্বরূপ); যদস্য [যৎ অস্য] (ব্রহ্মের); ত্বং (তুমি [জানো]); যদস্য [যৎ অস্য] (ব্রহ্মের); দেবেষু (দেবতাদের মধ্যে বর্তমান); অথ নু (অতএব); তে (তোমার কাছে); মীমাংস্যম্ এব (গভীরভাবে বিচার্য); মন্যে (আমার মনে হয় [অর্থাৎ শিষ্য মনে করেন]); বিদিতম্ (এঁকে [ব্রহ্মকে] জেনেছি)।

সরলার্থ: যদি কেউ মনে করেন যে, আমি ব্রহ্মকে ভালমতো জেনে ফেলেছি, তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি জীবাত্মা, দেবতাদের ও দৃশ্যমান জগতে ব্রহ্মের প্রকাশকেই কেবল জেনেছেন। সুতরাং ব্রহ্ম সম্বন্ধে আরও গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। (শিষ্য): আমার মনে হয়, আমি (ব্রহ্মকে) জানি।

ব্যাখ্যা: আচার্য শিষ্যকে এক সম্ভাব্য ভ্রান্তি সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। নিজের মধ্যে (জীবাত্মায়), দেবতাদের ও দৃশ্য জগতের মধ্যে ব্রহ্মের প্রকাশ দেখে শিষ্য হয়তো মনে করতে পারেন যে, ব্রহ্ম সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার ধারণা আছে। কিন্তু নিজের মধ্যে ও অন্যত্র যা প্রকাশিত, ব্রহ্ম তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। সব বস্তুর সারাৎসার, সকলের অন্তরাত্মা রূপে ব্রহ্ম অনন্ত, অসীম। তাই তাঁকে বোঝার সব চেষ্টাই শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। শিষ্যের প্রতি আচার্যের এই সাবধান-বাণীর প্রয়োজনীয়তা আছে, কারণ শিষ্য মনে করতে পারেন—ব্রহ্মকে আর পাঁচটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সাধাবণ জিনিসের মতো দেখা যায়, ছোঁয়া যায়। এইজন্যেই গুরু শিষ্যকে ব্রহ্ম সম্পর্কে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে বলেছেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও শিষ্য বলছেন যে, তিনি জানেন। শুধু ‘জানি’ বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন যে, নিজেকে পরীক্ষা করে তিনি নিঃসংশয় হয়েছেন স্বরূপত তিনি ব্রহ্মই। শিষ্যের এই গভীর আত্মপ্রত্যয় বলে দিচ্ছে তিনি ব্রহ্মকে জানেন। উপলব্ধিজাত এই প্রত্যয় এতই জোরালো যে কোন তর্কবিতর্ক শিষ্যকে টলাতে পারবে না।

নাহং মন্যে সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।
যো নস্তদ্বেদ তদ্বেব নো ন বেদেতি বেদ চ॥২

অন্বয়: নাহং মন্যে (আমি মনে করি না); সুবেদেতি [সুবেদ ইতি] (আমি সম্যক্ রূপে একে জানি); নো ন বেদেতি [বেদ ইতি] ( এও নয় যে আমি জানি না); বেদ চ (এবং আমি জানি); নঃ (আমাদের মধ্যে [শিষ্যদের মধ্যে]); যঃ (যে কেউ); তৎ (সেই উক্তি [অর্থাৎ সেই উক্তির অর্থ]); নো ন বেদেতি [বেদ ইতি] বেদ চ (জানি না তাও নয়, জানি তাও বলতে পারি না); বেদ (তিনি জানেন); তদ্ (সেই [অর্থাৎ ব্রহ্মকে]); বেদ (জানেন)।

সরলার্থ: (ব্রহ্মকে) সম্যক্ জেনেছি এমন কথা আমি মনে করি না। জানি না তাও নয়, আবার জানি—তাও বলতে পারি না। শিষ্যদের মধ্যে উপরি-উক্ত বাক্যের অর্থ যিনি জানেন, তিনিই (ব্রহ্মকে) সঠিক জানেন।

ব্যাখ্যা: ‘নো ন বেদ ইতি, বেদ চ’—এই বাক্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যদি কেউ একথা বলেন, তবে বুঝতে হবে তাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে। আমরা দেখেছি এই বাক্যের আক্ষরিক অর্থ হল, ‘এমন নয় যে আমি ব্ৰহ্মকে জানি না, আবার জানি এ কথাও বলতে পারি না’। এখন প্রশ্ন হল, যদি তিনি সত্যই ব্রহ্মকে জেনে থাকেন, তবে একথা কেন বলছেন, ‘আমি ব্রহ্মকে জানি, এ কথাও বলতে পারি না’? আসলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বোঝাতে চাইছেন যে, ব্রহ্ম বই বা আসবাবপত্রের মতো কোন জ্ঞেয় বস্তু নন। স্থূল কোন বস্তুকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জানা যায়, কিন্তু ব্রহ্মকে ঠিক সেইভাবে জানা যায় না, কারণ ব্রহ্মই মানুষের অন্তরাত্মা, অম্ভরতম সত্তা। ব্রহ্মকে জানার অর্থ হল, ব্রহ্মই যে আমাদের আত্মা সেটি জানা। যখন কেউ দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, ‘নো ন বেদ ইতি, বেদ চ’ তখন বুঝতে হবে—তিনি জানেন যে তিনিই স্বয়ং ব্রহ্ম।

যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ।
অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্॥৩

অন্বয়: যস্য অমতম্ (যিনি বলেন যে তিনি জানেন না); তস্য মতম্ (তিনিই জানেন); যস্য মতম্ (যিনি বলেন তিনি জানেন); সঃ ন বেদ (তিনি জানেন না); অবিজ্ঞাতম্ (অজ্ঞাত); বিজানতাম্ (তাঁদের কাছে যাঁরা বলেন তাঁরা জানেন); বিজ্ঞাতম্ (জ্ঞাত); অবিজানতাম্ (তাঁদের কাছে যাঁরা বলেন তাঁরা জানেন না)।

সরলার্থ: যিনি বলেন যে, তিনি (ব্রহ্মকে) জানেন না, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন; যিনি বলেন যে, তিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না। যাঁরা বলেন যে, তাঁরা জানেন না, এ তত্ত্ব তাঁদেরই জানা; যাঁরা বলেন যে, তাঁরা জানেন, এ তত্ত্ব তাঁদের অজানা।

ব্যাখ্যা: যখন কোন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন যে, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না, তখন বুঝতে হবে, তিনি ব্রহ্মকে জানেন, অর্থাৎ তিনি জানেন যে, ব্রহ্মকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানা যায় না। উভয় ক্ষেত্রেই ‘জানা’, এই ক্রিয়াপদটির সাহায্যে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে। যখন অজ্ঞ কেউ বলেন, ‘আমি জানি’ তখন তিনি শুধু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অর্জিত অভিজ্ঞতাকেই বোঝান। যাকে তিনি ব্রহ্ম বলে মনে করছেন, আসলে তা ব্রহ্ম নয়। ব্রহ্মের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই নেই। কিন্তু যখন কোন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলেন, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না, তখন সে কথার অর্থ হল—ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হিসাবে তিনি ব্রহ্মকে জানেন না। তিনি জানেন যে, ব্রহ্মকে এভাবে জানা যায় না; কেবলমাত্র অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মধ্য দিয়েই তাঁকে জানা যায়। তাঁর কথা থেকেই বোঝা যায় তিনি যথার্থই ব্রহ্মকে জেনেছেন।

প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।
আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতেঽমৃতম্॥৪

অন্বয়: প্রতিবোধ-বিদিতম্ (ব্যক্তিচেতনার সর্বস্তরে জ্ঞাত); [প্রতিবোধ (প্রতিটি চেতনা, প্রতিটি মানসিক অভিজ্ঞতা)]; মতম্ ([সম্যক্ রূপে] জ্ঞাত); হি (কেননা); বিন্দতে (লাভ করেন); অমৃতত্বম্ (অমরত্ব, যা জন্মমৃত্যুর অতীত); আত্মনা (আত্মার সাহায্যে [অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের দ্বারা]); বিন্দতে (লাভ করেন); বীর্যম্ (শক্তি); বিদ্যয়া (জ্ঞানের দ্বারা [অর্থাৎ, আত্মজ্ঞানের দ্বারা, স্বরূপজ্ঞানের দ্বারা]); বিন্দতে (লাভ করেন); অমৃতম্ (অমরত্ব)।

সরলার্থ: যখন কেউ ব্রহ্মকে চেতনার সর্বস্তরে, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করেন তখন তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন এবং জন্মমৃত্যুর পারে চলে যান। আত্মজ্ঞানের দ্বারা মানুষ শক্তি অর্জন করে; প্রকৃত জ্ঞান লাভ করলে মানুষ অমর হয়ে যায়।

ব্যাখ্যা: মণিমালার প্রতিটি রত্ন যেমন একই সুতোয় গাঁথা, ঠিক তেমনি চৈতন্য (বুদ্ধি) রূপে ব্রহ্মও আমাদের সকল মানসিক অভিজ্ঞতার সর্বস্তরে বিরাজ করছেন। যেমন ধরা যাক, ঘরে একটি প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের ভিতরে হয়তো অনেক জিনিসপত্র আছে। কিন্তু সবকিছুই ঐ এক প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত। ঠিক তেমনি মন, তা সে যে কাজই করুক না কেন, সর্বসময় ব্রহ্ম বা চৈতন্যের আলোয় আলোকিত। ব্রহ্ম না থাকলে আমরা কোনকিছুই অনুভব করতে পারতাম না, কারণ আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। কিন্তু ব্রহ্ম ব্রহ্মই আছেন; সর্বদাই এক এবং অপরিবর্তনীয়। আমাদের সব মানসিক অভিজ্ঞতার নেপথ্যে তিনি আছেন, অথচ তিনি নির্লিপ্ত—আমাদের কোন অভিজ্ঞতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। যখন আমরা এই ব্রহ্মকে উপলব্ধি করি, তখন আমরা অমর হয়ে যাই।

ভাবটা হচ্ছে, আমাদের অভিজ্ঞতায় বৈচিত্র থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের আত্মা অপরিবর্তনীয়। সিনেমার পর্দার উপমাটি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। পর্দাটি সব অবস্থায় স্থির, অপরিবর্তিত। তার ওপর প্রতি মুহূর্তে কত রকমের ছবি ফেলা হচ্ছে, কিন্তু পর্দা পর্দাই আছে, তার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। ঠিক তেমনিভাবে পরমাত্মা আমাদের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঘূর্ণায়মান স্রোতের পিছনে নির্লিপ্ত দ্রষ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন; তাঁর কোন বিকার নেই। তিনি অপরিবর্তনীয়, সবকিছুর সাক্ষী-মাত্র।

এই উপনিষদ আরও বলছেন, যখন কেউ তার প্রকৃত স্বরূপ, তার আত্মাকে জানে, তখন সে ‘বীর্য’ তথা শক্তির অধিকারী হয়। সাধারণত আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার দাস। ভাল অভিজ্ঞতা হলে আমরা সুখী, আর মন্দ অভিজ্ঞতা হলে দুঃখী—এই আমাদের অবস্থা। এরকম হওয়ার কারণ ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমরা নিজেদের একাত্মতা অনুভব করি। কিন্তু বস্তুত এই জাতীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের স্বরূপের কোন সম্পর্কই নেই; স্বরূপত আমরা যা তাই আছি। যখন আমরা এই সত্য জানতে পারি, যখন আমাদের স্বরূপ-জ্ঞান হয় তখন আমরা ঠিক ঠিক শক্তিমান হয়ে উঠি। যখন আমরা উপলব্ধি করি ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের পরমাত্মার কোন সম্পর্কই নেই, আমরা সাক্ষী-মাত্র, চারপাশের ঘটনাবলী দেখে যাচ্ছি—তখনই আমরা নিজেদের প্রকৃত শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। জীবাত্মা ও পরমাত্মা যে এক এবং অভিন্ন, এটি জানার নামই আত্মজ্ঞান। পরমাত্মার জন্ম নেই এবং সেই কারণে তাঁর মৃত্যুও নেই। তিনি অমর। তাই যখন আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করি, তখন আমরাও অমর হয়ে যাই (অমৃতম্)।

ইহ চেদবেদীদথ সত্যমস্তি
ন চেদিহাবেদীন্মহতী বিনষ্টিঃ।
ভূতেষু ভূতেষু বিচিত্য ধীরাঃ
প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি॥৫

অন্বয়: ইহ (এখানে [অর্থাৎ এই জীবনে]); চেৎ (যদি); অবেদীৎ (কেউ জানেন [অর্থাৎ আত্মাকে ব্রহ্মরূপে জানেন]); অথ (তাহলে); সত্যম্ (সত্য, পরম সত্য); ন চেৎ ইহ অবেদীৎ (যদি কেউ এই পরম সত্য না জানেন); অস্তি (বর্তমান, আছে); মহতী বিনষ্টিঃ (অশেষ যন্ত্রণা); ভূতেষু ভূতেষু (সর্ববস্তুতে এবং সর্বজীবে [অর্থাৎ সর্বত্র]); বিচিত্য (জেনে [ব্রহ্ম সর্বত্র আছেন জেনে]); ধীরাঃ (জ্ঞানীরা, বিচারশীল ব্যক্তিরা); প্ৰেত্য (প্রত্যাহার করে, ত্যাগ করে); অস্মাৎ লোকাৎ (এই জগৎ থেকে); অমৃতাঃ ভবন্তি (অমর হন)।

সরলার্থ: কেউ যদি এ জীবনেই আত্মাকে ব্রহ্মরূপে জানতে পারেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হন। এই জ্ঞান ছাড়া অশেষ দুঃখভোগ অনিবার্য। কিন্তু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, যিনি এই সত্য জানেন যে, ব্রহ্ম সকল বস্তু ও সকল জীবের মধ্যে অনুস্যূত হয়ে আছেন, তিনি নিজেকে এই জগৎ থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং মুক্ত হয়ে যান।

ব্যাখ্যা: এখানে সার কথাটা হল—এই জীবনেই আত্মজ্ঞান সম্ভব, কিন্তু একমাত্র মনুষ্য শরীরেই তা সম্ভব। কারণ মানুষ চিন্তা করতে পারে, বিচার করতে পারে, জীবনের একটা লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে নিয়ে সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য সংগ্রাম করতে পারে। পশুর পক্ষে তা সম্ভব নয়। কাজেই মনুষ্যজন্ম লাভ করেও যদি আমরা আত্মজ্ঞান অর্জনের জন্য চেষ্টা না করি, তবে তার মতো ক্ষতি আর হয় না। এই উপনিষদ তাই সাবধান করে দিয়ে বলছেন, আত্মজ্ঞান লাভের উদ্যোগ না করলে আমাদের অশেষ দুঃখদুর্দশা ভোগ করতে হবে। কখনও ভাল, কখনও মন্দ অবস্থার শিকার হয়ে জন্মমৃত্যুর আবর্তে বারবার ঘুরপাক খেতে হবে।

মজার কথা হল আমরা অমর হয়েই আছি। এই নয় যে, আমাদের অমর হতে হবে, বা একটা উচ্চতর অবস্থায় আমরা উঠছি। না, তা নয়। আমরা প্রথম থেকেই ব্রহ্ম, তাই আমাদের মৃত্যু নেই। আমরা অমর। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক এ সত্য আমরা জানি না। একটা অবগুণ্ঠন আমাদের স্বরূপ বা প্রকৃত পরিচয়টি ঢেকে রেখেছে। আমাদের কাজ হল এই আবরণটিকে সরানো।

যিনি জ্ঞানী, তিনি ‘ভূতেষু ভূতেষু’ অর্থাৎ, পুরুষ, স্ত্রী, জীবজন্তু, এককথায় সর্বভূতে নিজের আত্মাকে দেখেন। যখন কেউ নিজের মধ্যে সবাইকে ও সবকিছুকে এবং সকলের মধ্যে নিজেকে দেখেন (অর্থাৎ, এক সত্তা বা একত্ব অনুভব করেন), তখন তিনি সকলকে না ভালবেসে পারেন না। তখন কেউই তাঁর পর নন। শোনা যায় বিখ্যাত বেদান্তবাদী রামতীর্থ কোন বক্তৃতা দিতে গেলে শ্রোতাদের এই বলে সম্বোধন করতেন—‘আমি, যে আমি সমবেত ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহোদয়া সকলের মধ্যে বিরাজমান’। ভাবটা হল এই যে, আমার আত্মাই সকলের আত্মা যিনি সর্বত্র বিরাজ করছেন। যিনি বলছেন আর যাঁরা শুনছেন, সবাই সেই এক এবং অভিন্ন আত্মা। যেন আত্মায় আত্মায় কথা হচ্ছে। তফাৎ শুধু নাম আর রূপের। অস্তিত্বের এই একত্ব, এই ঐক্যই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আমরা সকলে এক। পার্থক্য কেবলমাত্র প্রকাশের তারতম্যে।

কেন উপনিষদের দ্বিতীয় খণ্ড এইখানে সমাপ্ত।

তৃতীয় খণ্ড

আমরা যাতে ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ কিছুটা বুঝতে পারি সেইজন্য উপনিষদ এখানে একটি কাহিনীর অবতারণা করেছেন। আমরা শক্তির প্রকাশ দেখি, কিন্তু এই শক্তির উৎস কি? ব্রহ্ম। জগতে যতকিছু শক্তি আছে ব্রহ্মই সেই সবের উৎস। আলোচ্য কাহিনীর মধ্য দিয়ে সেই তত্ত্বটিকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

একবার দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে দেবতারা জয়ী হন এবং নিজেদের শক্তিতেই এই বিজয় সম্ভব হয়েছে মনে করে খুব গর্ববোধ করতে থাকেন। বস্তুত ব্রহ্মের জন্যই এই জয় সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দেবতারা সেকথা জানতেন না। ব্রহ্ম তাই দেবতাদের দর্প চূর্ণ করতে চাইলেন।

বিজয়োল্লাসে মত্ত দেবতারা যখন পরস্পরকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন ঠিক তখনই তাঁদের সামনে এক অদ্ভুত মূর্তির আবির্ভাব। তিনি যে কে তা দেবতারা বুঝতে পারলেন না। তাই প্রথমে তাঁরা অগ্নিকে ঐ মূর্তির কাছে গিয়ে তাঁর পরিচয় জেনে আসতে বললেন। অগ্নি তো গেলেন। কিন্তু মূর্তির কাছাকাছি আসতেই তিনি অগ্নিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’ অগ্নি বললেন, ‘আমি অগ্নি।’ মূর্তিটি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি করতে পারেন?’ অগ্নি বললেন, ‘আমি সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারি।’ অগ্নির এই কথা শোনামাত্র সেই মূর্তি একটি তৃণখণ্ড অগ্নির সামনে রেখে বললেন, ‘এটিকে পোড়ান দেখি।’ অগ্নি বারবার চেষ্টা করেও সেটিকে পোড়াতে পারলেন না। লজ্জিত হয়ে দেবতাদের কাছে ফিরে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি ওঁর পরিচয় জানতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই জানতে পারলাম না।

এরপর দেবতারা পবনদেব অর্থাৎ বায়ুকে পাঠালেন। তিনি কাছে যেতেই মূর্তিটি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কে?’ বায়ু উত্তর দিলেন, ‘আমি বায়ু।’ মূর্তিটি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি করতে পারেন?’ বায়ু বললেন, ‘আমি সব কিছু উড়িয়ে দিতে পারি।’ মূর্তিটি তখন সেই একই তৃণখণ্ড বায়ুর সামনে রেখে বললেন, ‘বেশ তো, এই তৃণখণ্ডটিকে উড়িয়ে দিন দেখি।’ বারবার চেষ্টা করেও বায়ু তৃণখণ্ডটিকে একচুল নড়াতে পারলেন না। তখন লজ্জিত হয়ে বায়ুও ফিরে গেলেন। অবশেষে মূর্তিটির পরিচয় জানতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু তিনি মূর্তিটির কাছে পৌঁছবার আগেই সেই মূর্তি অদৃশ্য হলেন এবং তাঁর জায়গায় আবির্ভূতা হলেন পরমা সুন্দরী, সালঙ্কারা এক দেবী। তিনি উমা হৈমবতী। ইন্দ্র তাঁকে অদ্ভুত মূর্তিটির পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় উমা জানালেন, উনি ব্রহ্ম। উমা আরও বললেন, ব্রহ্মের জন্যই দেবতারা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন। তখন ইন্দ্র বুঝতে পারলেন যে, দেবতাদের নিজেদের কোন শক্তি নেই, ব্রহ্মের শক্তিতেই তাঁরা শক্তিমান। দেবদেবী এবং যেখানে যত কিছু শক্তি আছে সকলের একটাই উৎস। তিনি ব্রহ্ম।’

ব্রহ্ম হ দেবেভ্যো বিজিগ্যে তস্য হ
ব্ৰহ্মণো বিজয়ে দেবা অমহীয়ন্ত।
ত ঐক্ষন্তাস্মাকমেবায়ং বিজয়োঽস্মাকমেবায়ং
মহিমেতি॥১

অন্বয়: ব্রহ্ম হ (প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মই, একমাত্র); দেবেভ্যঃ (দেবতাদের পক্ষে); বিজিগ্যে (জয়লাভ করেছিলেন); তস্য হ (সেটা নিশ্চিতভাবে তাঁরই [অর্থাৎ সে জয় অবশ্যই ছিল তাঁর]); ব্ৰহ্মণঃ বিজয়ে (ব্রহ্মের বিজয়ে); দেবাঃ অমহীয়ন্ত (দেবতারা গর্ব বোধ করেছিলেন); তে ঐক্ষন্ত (তাঁরা ভেবেছিলেন); অস্মাকম্ এব (বস্তুত আমাদেরই); অয়ং বিজয়ঃ (এই জয়); অস্মাকম্ এব অয়ং মহিমা ইতি (এই কৃতিত্ব কেবল আমাদেরই)।

সরলার্থ: দেবতাদের পক্ষে স্বয়ং ব্রহ্মই এই যুদ্ধ জয় করেছিলেন। এই জয় ব্রহ্মেরই, কিন্তু এই জয় নিজেদের মনে করে দেবতারা অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা ভাবলেন, ‘এ জয় আমাদেরই—এর সব কৃতিত্ব আমাদের প্রাপ্য।’

ব্যাখ্যা: ব্রহ্মের কাছ থেকে পাওয়া শক্তিতেই দেবতারা যুদ্ধে জয়ী হন; কিন্তু তাঁরা মনে করেছিলেন যে, নিজেদের শক্তিতেই তাঁরা যুদ্ধে জিতেছেন। তাই এই জয় তাঁদের অহঙ্কারী করেছিল, এবং তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন এর কৃতিত্ব সম্পূর্ণ তাঁদেরই।

তদ্ধৈষাং বিজজ্ঞৌ তেভ্যো হ প্রাদুর্বভূব
তন্ন ব্যজানত কিমিদং যক্ষমিতি॥২

অন্বয়: তদ্ধৈষাম্‌ [তৎ হ এষাম্‌] (তিনি অবশ্যই এই সব [অর্থাৎ দেবতাদের মিথ্যা দর্প]); বিজজ্ঞেী (জানতে পেরেছিলেন); তেভ্যো হ (শুধু তাঁদের জন্যই); প্রাদুর্বভূব (আবির্ভূত হয়েছিলেন); তৎ (তাঁকে [অর্থাৎ তাঁকে দেখে]); কিম্ (কি); ইদং যক্ষম্ (এই দিব্যমূর্তি), ইতি ন ব্যজানত (তা [তাঁরা] বুঝতে পারলেন না)।

সরলার্থ: ব্রহ্ম অবশ্যই দেবতাদের মিথ্যা অভিমানের কথা জেনে তাঁদেরই কল্যাণার্থে তাঁদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই দিব্যমূর্তিকে দেবতারা চিনতে পারলেন না।

ব্যাখ্যা: চরম জ্ঞানলাভের পথে অহঙ্কার যে কত বড় বাধা এই কাহিনীর মধ্যে দিয়ে সে কথাই বোঝানো হয়েছে। দেবতারাও অহঙ্কার মুক্ত নন। আর এই কারণেই অজ্ঞান জীবের মতো তাঁদের মধ্যেও নানান ত্রুটিবিচ্যুতি, নানান অসম্পূর্ণতা থাকে। পূর্বজন্মের শুভকর্মের পুরস্কারস্বরূপ তাঁরা কিছুকালের জন্য দেবতার পদ লাভ করেছেন। কিন্তু শুভকর্মের ফলভোগ শেষ হলেই তাঁরা তাঁদের পদ থেকে সরে যাবেন। দেবতা হিসেবে তাঁদের কিছু বিশেষ গুণ এবং ক্ষমতা থাকে বটে, কিন্তু অন্যান্য ব্যাপারে তাঁরা সাধারণ আর পাঁচজন মর্ত জীবেরই মতো। ব্রহ্মোপলব্ধি না হওয়া পর্যন্ত সাধারণ প্রাণীর মতো তাঁরাও বদ্ধ।

তেঽগ্নিমব্রুবন্ জাতবেদ এতদ্বিজানীহি
কিমেতদ্ যক্ষমিতি তথেতি॥৩

অন্বয়: তে অগ্নিম্ অব্রুবন্ (তাঁরা অগ্নিকে বললেন); জাতবেদ (হে জাতবেদ [অর্থাৎ যিনি সব সৃষ্ট পদার্থকে জানেন। এটা অগ্নির আর এক নাম]); এতৎ বিজানীহি (এটা জেনে আসুন); কিম্ এতৎ যক্ষম্ ইতি (এই দিব্যমূর্তি কে); তথা ইতি (তাই হবে)।

সরলার্থ: তাঁরা অগ্নিকে বললেন, ‘হে সর্বজ্ঞ জাতবেদ, এই দিব্য সত্তার পরিচয় জেনে আসুন।’ (উত্তরে অগ্নি বললেন 🙂 ‘তাই হবে।’

ব্যাখ্যা: সামনে অদ্ভুত মূর্তিটিকে দেখে দেবতারা হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তিনি যে স্বয়ং ব্রহ্ম দেবতারা সে কথা বুঝতে পারলেন না। ব্ৰহ্ম স্বরূপত নিরাকার, তাঁর কোন রূপ নেই। কিন্তু গল্পের খাতিরে এখানে ব্রহ্মের একটা রূপ কল্পনা করা হয়েছে।

তদভ্যদ্রবত্তমভ্যবদৎ কোঽসীতি অগ্নির্বা
অহমস্মীত্যব্রীজ্জাতবেদা বা অহমস্মীতি॥৪

অন্বয়: তৎ (তাঁর কাছে [অর্থাৎ দিব্যমূর্তির কাছে]); অভ্যদ্রবৎ (গেলেন [অর্থাৎ অগ্নি গেলেন]); তম্ অভ্যবদৎ (তাঁকে বললেন [অর্থাৎ সেই দিব্যমূর্তি অগ্নিকে বললেন]); কঃ অসি ইতি (আপনি কে); অব্রবীৎ অগ্নিঃ বৈ অহম্ অস্মি ইতি ([অগ্নি] বললেন, আমিই অগ্নি); জাতবেদাঃ বৈ অহম্ অস্মি ইতি (আমিই জাতবেদ [সর্বজীবের জ্ঞাতা])।

সরলার্থ: অগ্নি দিব্যমূর্তির কাছে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’ উত্তরে অগ্নি বললেন, ‘আমি অগ্নি, আমি সামান্য নই। আমিই জাতবেদ (অর্থাৎ, সব প্রাণীকেই আমি জানি)।’

ব্যাখ্যা: অগ্নির কথার ভঙ্গিতে অহঙ্কারের ছাপ স্পষ্ট।

তস্মিংস্ত্বয়ি কিং বীর্যমিতি অপীদং
সর্বং দহেয়ং যদিদং পৃথিব্যামিতি॥৫

অন্বয়: তস্মিন্ (তাতে [অর্থাৎ যেহেতু আপনি এত অসাধারণ]); ত্বয়ি (আপনার ভিতর); কিং বীর্যম্ ইতি (কি ধরনের শক্তি); ইদং সর্বম্ অপি দহেয়ম্ (আমি এই সমস্তই পুড়িয়ে ফেলতে পারি); পৃথিব্যাম্ ইদং যৎ ইতি (এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে)।

সরলার্থ: দিব্যসত্তা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো দেখছি অসাধারণ। কিন্তু আপনার মধ্যে কোন্ বিশেষ শক্তি আছে?’ (অগ্নি বললেন 🙂 ‘এই পৃথিবীর সবকিছু আমি পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারি।’

ব্যাখ্যা: ক্ষমতার গর্বে মত্ত হয়ে অগ্নি ভুলে গিয়েছিলেন যে, তাঁর শক্তি ব্রহ্মের কাছ থেকেই পাওয়া।

তস্মৈ তৃণং নিদধাবেতদ্দহেতি; তদুপপ্রেয়ায়
সর্বজবেন, তন্ন শশাক দগ্ধুম্, স তত এব
নিববৃতে—নৈতদশকং বিজ্ঞাতুং যদেতদ্ যক্ষমিতি॥৬

অন্বয়: তস্মৈ (তাঁর সামনে); তৃণং নিদধৌ (একটি তৃণ রাখলেন); এতৎ দহ ইতি (এটিকে পোড়ান); তৎ উপপ্রেয়ায় (তার দিকে ধেয়ে গেলেন); সর্বজবেন (দ্রুত বেগে [অর্থাৎ, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে]); তৎ ন শশাক দগ্ধুম্ (সেটিকে পোড়াতে পারলেন না); সঃ ততঃ এব নিববৃতে (তাঁর কাছ থেকে [অর্থাৎ, দিব্যমূর্তির কাছ থেকে] তিনি [অগ্নি] ফিরে এলেন); ন এতৎ অশকং বিজ্ঞাতুম্ (আমি জানতে পারলাম না); যৎ এতৎ যক্ষম্ ইতি (এই দিব্যমূর্তি কে)।

সরলার্থ: (দিব্যমূর্তিটি) অগ্নির সামনে একটি তৃণখণ্ড রেখে বললেন, ‘এটিকে পোড়ান তো।’ (অগ্নি) সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও সেটি পোড়াতে পারলেন না। দিব্যমূর্তির কাছ থেকে ফিরে গিয়ে তিনি (দেবতাদের বললেন: ‘ওই দিব্যমূর্তির পরিচয় জানতে আমি ব্যর্থ হয়েছি।’

অথ বায়ুমব্রুবন্বায়বেতদ্বিজানীহি
কিমেতদ্ যক্ষমিতি তথেতি॥৭

অন্বয়: অথ (তখন); বায়ুম্, অব্রুবন্ ([দেবতারা] বায়ুকে বললেন); বায়ো এতৎ বিজানীহি (হে বায়ু, সঠিক জানুন); এতৎ যক্ষং কিম্ ইতি (এই দিব্যমূর্তি কে); তথা ইতি (তাই হবে)।

সরলার্থ: তখন দেবতারা বায়ুকে বললেন, ‘হে বায়ু, এই দিব্যমূর্তির পরিচয় ভালভাবে জেনে আসুন।’ (বায়ু বললেন:) ‘তাই হবে।’

তদভ্যদ্রবৎ তমভ্যবদৎকোঽসীতি বায়ুর্বা
অহমস্মীত্যব্রবীন্মাতরিশ্বা বা অহমস্মীতি॥৮

অন্বয়: তৎ অভ্যদ্রবৎ (তাঁর কাছে গেলেন); তম্ অভ্যবদৎ (তাঁকে প্রশ্ন করলেন); কঃ অসি ইতি (আপনি কে); অব্রবীৎ বায়ুঃ বৈ অহম্ অস্মি ইতি (আমিই বায়ু); মাতরিশ্বা বৈ অহম্ অস্মি ইতি (আমিই সেই মাতরিশ্বা [যিনি আকাশে বিচরণ করেন])।

সরলার্থ: বায়ু সেই দিব্যমূর্তির কাছে গেলে মূর্তি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কে?’ বায়ু বললেন, ‘আমি বায়ু, আমি সামান্য নই; আমিই মাতরিশ্বা (যিনি শূন্যে বিচরণ করেন)।’

তস্মিংস্ত্বয়ি কিং বীর্যমিতি অপীদং
সর্বমাদদীয় যদিদং পৃথিব্যামিতি॥৯

অন্বয়: তস্মিন্ (তাতে [অর্থাৎ যেহেতু আপনি এত অসাধারণ]); ত্বয়ি (আপনার ভিতর); কিং বীর্যম্ ইতি (কি ধরনের শক্তি); ইদং সর্বম্ অপি আদদীয় (আমি নিতে পারি [অর্থাৎ উড়িয়ে দিতে পারি] সমস্ত কিছু); পৃথিব্যাম্ ইদং যৎ ইতি (এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে)।

সরলার্থ: (দিব্যমূর্তি প্রশ্ন করলেন:) ‘আপনি সত্যিই অসামান্য। কিন্তু আপনি কোন্ শক্তির অধিকারী?’ বায়ু বললেন, এই বিশ্বে যা কিছু আছে, সব আমি উড়িয়ে দিতে পারি।

তস্মৈ তৃণং নিদধাবেতদাদৎস্বেতি; তদুপপ্রেয়ায়
সর্বজবেন, তন্ন শশাকাদাতুম্; স তত এব নিববৃতে
নৈতদশকং বিজ্ঞাতুং যদেতদ্ যক্ষমিতি॥১০

অন্বয়: তস্মৈ (তাঁর সামনে); তৃণং নিদধৌ (একটি তৃণ রাখলেন); এতৎ আদৎস্ব ইতি (এটি গ্রহণ করুন [অর্থাৎ উড়িয়ে নিয়ে যান]); তৎ উপপ্রেয়ায় (তার প্রতি ধাবিত হলেন); সর্বজবেন (সবেগে [অর্থাৎ তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে]); তৎ ন শশাক আদাতুম্ (সেটিকে ওড়াতে ব্যর্থ হলেন); সঃ ততঃ এব নিববৃতে (তাঁর কাছ থেকে [অর্থাৎ সেই দিব্যমূর্তির কাছ থেকে] তিনি [অর্থাৎ বায়ু] ফিরে এলেন); ন এতৎ অশকং বিজ্ঞাতুম্ (আমি জানতে পারলাম না); যৎ এতৎ যক্ষম্ ইতি (এই দিব্যমূর্তি কে)।

সরলার্থ: (দিব্যমূর্তি) বায়ুর সামনে একটি তৃণখণ্ড রেখে বললেন, ‘এটিকে উড়িয়ে নিয়ে যান তো।’ (বায়ু) সবেগে ধেয়ে গেলেন এবং তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন, কিন্তু তবুও তৃণটিকে নড়াতে পারলেন না। তাই ফিরে এসে তিনি (দেবতাদের বললেন 🙂 ‘এই দিব্যমূর্তি যে কে তা আমি বুঝতে পারলাম না।’

অথেন্দ্রমব্রুবন্মঘবন্নেতদ্ বিজানীহি কিমেতদ্
যক্ষমিতি তথেতি তদভ্যদ্রবৎ তস্মাৎ
তিরোদধে॥১১

অন্বয়: অথ (তখন); ইন্দ্রম্ অব্রুবন্ ([দেবতারা] ইন্দ্রকে বললেন); মঘবন্ এতৎ বিজানীহি (হে মঘবা, সঠিক জেনে আসুন); এতৎ যক্ষং কিম্ ইতি (কে এই দিব্যমূর্তি); তথা ইতি (তাই হবে); তৎ অভ্যদ্রবৎ ([ইন্দ্র তাঁর কাছে গেলেন); তস্মাৎ (তাঁর সামনে থেকে [অর্থাৎ ইন্দ্রর সামনে থেকে]); তিরোদধে ([দিব্যমূর্তি] অদৃশ্য হলেন)।

সরলার্থ: তখন দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, ‘হে মঘবা, এই দিব্যমূর্তির সঠিক পরিচয় জেনে আসুন।’ (ইন্দ্র বললেন:) ‘তাই হবে।’ কিন্তু ইন্দ্র কাছে যেতেই সেই দিব্যমূর্তি অদৃশ্য হলেন।

স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং
হৈমবতীং তাং হোবাচ—কিমেতদ্ যক্ষমিতি॥১২

অন্বয়: সঃ (তিনি); তস্মিন্ এব আকাশে (সেই আকাশে); আজগাম (এলেন, আবির্ভূত হলেন); স্ত্রিয়ং হৈমবতীং বহুশোভমানাম্ উমাম্ (সালঙ্কারা এক নারীমূর্তি, উমা হৈমবতী); তাং হ উবাচ (এবং তাঁকে বললেন); কিম্ এতৎ যক্ষম্ ইতি (ঐ দিব্যমূর্তি কে?)।

সরলার্থ: ঐ আকাশে (যেখানে দিব্যমূর্তিকে দেখা গিয়েছিল) সালঙ্কারা এক নারীমূর্তি দেখা গেল। তিনি উমা হৈমবতী। ইন্দ্র তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই দিব্যমূর্তির স্বরূপ কি?’

ব্যাখ্যা: পুরাণমতে, উমা হৈমবতী হিমালয়-কন্যা। তিনি আত্মজ্ঞানের মূর্ত প্রতীক।

কেন উপনিষদের তৃতীয় খণ্ড এইখানে সমাপ্ত।

চতুর্থ খণ্ড

সা ব্রহ্মেতি হোবাচ, ব্রহ্মণো বা এতদ্বিজয়ে
মহীয়ধ্বমিতি ততো হৈব বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি॥১

অন্বয়: সা ব্রহ্ম ইতি হ উবাচ (‘উনি ব্রহ্ম’, তিনি বললেন); ব্ৰহ্মণঃ বৈ এতৎ বিজয়ে (এই জয় প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মেরই); মহীয়ধ্বম্ ইতি (তোমরা উল্লসিত হচ্ছ); ততঃ হ এব (বস্তুত তা থেকেই [অর্থাৎ উমার কথা থেকেই]); বিদাঞ্চকার ([ইন্দ্র] জানতে পারলেন); ব্রহ্ম ইতি (উনি ব্রহ্ম)।

সরলার্থ: তিনি (উমা হৈমবতী) বললেন, ‘উনি ব্রহ্ম। যে বিজয়ের জন্য তোমরা এত উল্লসিত হয়েছিলে, তা আসলে ব্রহ্মের জয়।’ তখন ইন্দ্র জানতে পারলেন যে, ওই দিব্যমূর্তি আসলে ব্রহ্ম।

তস্মাদ্ বা এতে দেবা অতিতরামিবান্যান্ দেবান্‌—
যদগ্নির্বায়ুরিন্দ্রস্তে হ্যেনন্নেদিষ্ঠং পস্পর্শুস্তে হ্যেনৎ
প্রথমো বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি॥২

অন্বয়: যৎ অগ্নিঃ বায়ুঃ ইন্দ্রঃ (যেহেতু অগ্নি, বায়ু এবং ইন্দ্র); তে হি এনৎ নেদিষ্ঠং পস্পর্শুঃ [পাঠান্তরে পস্পৃশুঃ] (তাঁর [ব্রহ্মের] ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে স্পর্শ করেছিলেন); তে হি প্রথমঃ এনৎ ব্রহ্ম ইতি বিদাঞ্চকার (তাঁরাই তাঁকে সর্বপ্রথম ব্রহ্ম বলে জেনেছিলেন); তস্মাৎ (সেইজন্য); এতে বৈ দেবাঃ (এই দেবতারা); অন্যান্ দেবান্ অতিতরাম্ ইব (অন্যান্য দেবতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ)।

সরলার্থ: যেহেতু অগ্নি, বায়ু এবং ইন্দ্র ব্রহ্মের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং তাঁরাই প্রথম ব্রহ্মকে জেনেছিলেন, সেইজন্য দেবতাদের মধ্যে এই তিন জনের স্থান সর্বোচ্চ।

ব্যাখ্যা: এখানে স্পর্শ বলতে দৈহিক সান্নিধ্য বোঝানো হচ্ছে না, দেবতাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের কথাই বলা হচ্ছে। ঐসব গুণের জন্যেই অগ্নি, বায়ু ও ইন্দ্র ব্রহ্মের মুখোমুখি হতে পেরেছিলেন। বলা হচ্ছে, তাঁরা যেন ব্রহ্মকে স্পর্শ করেছিলেন। ইন্দ্র দেবরাজ। পদমর্যাদা অনুসারে অগ্নি এবং বায়ুর স্থানও উচ্চে। বলা বাহুল্য, আধ্যাত্মিক গুণের জন্যেই তাঁদের এই পদমর্যাদা। তার ওপর উমা হৈমবতীর কাছ থেকে ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা হওয়ায় তাঁদের মহিমা আরো বেড়ে গেল। কাজে কাজেই তাঁরা যে দেবতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য বিবেচিত হবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

তস্মাদ্বা ইন্দ্রোঽতিতরামিবান্যান্ দেবান্ স
হ্যেনন্নেদিষ্ঠং পস্পর্শ স হ্যেনৎ প্রথমো বিদাঞ্চকার
ব্রহ্মেতি॥৩

অন্বয়: তস্মাৎ বৈ ইন্দ্ৰঃ অতিতরাম্ ইব অন্যান্ দেবান্ (সেইজন্যই ইন্দ্র অন্য দেবতাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ); সঃ হি এনৎ নেদিষ্ঠং পস্পর্শ (তিনি ব্রহ্মকে নিকটতম এবং প্রিয়তমরূপে স্পর্শ করেছিলেন); সঃ হি এনৎ প্রথমঃ বিদাঞ্চকার ব্রহ্ম ইতি (তিনিই অন্য সকলের আগে তাঁকে ব্রহ্ম বলে চিনতে পেরেছিলেন)।

সরলার্থ: যেহেতু ইন্দ্র ব্রহ্মের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং তিনিই প্রথম তাঁর (দিব্যমূর্তির) পরিচয় জেনেছিলেন, সেহেতু দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রের স্থান সর্বোচ্চ।

ব্যাখ্যা: ইন্দ্রের কাছেই উমা হৈমবতী দিব্যমূর্তির স্বরূপ প্রকাশ করেন। যেহেতু ইন্দ্রই প্রথম ব্রহ্মের পরিচয় এবং ব্রহ্মই যে সব শক্তির উৎস একথা জেনেছিলেন, সেহেতু তিনি দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়।

তস্যৈষ আদেশো—যদেতদ্বিদ্যুতো ব্যদ্যুতদা
ইতীন্ন্যমীমিষদা—ইত্যধিদৈবতম্॥৪

অন্বয়: তস্য এষঃ আদেশঃ (এখানে ব্রহ্ম সম্পর্কে একটি নির্দেশ); যৎ এতৎ বিদ্যুতঃ ব্যদ্যুতৎ (তিনি যেন এক ঝলক বিদ্যুতের মতো); আ (তার মতে); ইৎ (এবং, সদৃশ); ন্যমীমিষৎ (পলকপাত); আ (তার মতে); ইতি অধিদৈবতম্ (দৃশ্যমান জগৎ থেকে এই উপমা দুটি দেওয়া হয়েছে)।

সরলার্থ: ব্রহ্ম সম্পর্কে এখানে একটা নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে। ব্রহ্ম যেন এক ঝলক বিদ্যুতের মতো অথবা পলকপাতের মতো; দৃশ্যমান জগৎ থেকে এই দুটি উপমা দেওয়া হয়েছে।

ব্যাখ্যা: বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গেই যেমন অন্ধকার দূর হয়ে যায়, তেমনি হঠাৎ আত্মজ্ঞানের উদয় হবার সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞানতার সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ব্রহ্মের চোখের পলকে সৃষ্টি, চোখের পলকেই প্রলয়। এর থেকে ব্রহ্মের অপরিমেয় শক্তির কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। এই শ্লোকে ব্যবহৃত দুটি উপমাই প্রকৃতি থেকে নেওয়া হয়েছে।

অথাধ্যাত্মং—যদেতদ্‌গচ্ছতীব চ মনোঽনেন
চৈতদুপস্মরত্যভীক্ষ্নং সঙ্কল্পঃ॥৫

অন্বয়: অথ (এখন); অধ্যাত্মম্ (যা জীবাত্মার মনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত); মনঃ এতৎ যং গচ্ছতি ইব চ (মন যেন তাঁতে [ব্রহ্মে] গমন করে [প্রবেশ করে]); চ অনেন (এবং এর দ্বারা); এতৎ অভীক্ষ্নম্ উপস্মরতি ([সাধক] নিরন্তর তাঁর [ব্রহ্মের] ধ্যান করেন); সঙ্কল্পঃ ([এইভাবেই তাঁর উচিত] মনকে চালনা করা)।

সরলার্থ: এখানে ব্রহ্ম সম্পর্কে যে নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে তা জীবাত্মার মনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত; মনই যেন ব্রহ্মে পৌঁছায় এবং মন দিয়েই সাধক নিরন্তর ব্রহ্মের মনন করেন। এই ভাবেই মনকে চালানো উচিত।

ব্যাখ্যা: জীবাত্মার ক্ষেত্রে তার মনই ব্রহ্মশক্তির শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। মনের অসীম শক্তি। কেন মনকে শক্তিমান বলা হচ্ছে? কারণ এই মন ব্রহ্মের দিকে ধেয়ে যায়, ব্রহ্মকে ধরার চেষ্টা করে। দুরূহ হলেও এই মন দিয়েই সাধক ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। মনই ব্রহ্মকে আত্মারূপে ধ্যান করতে পারে। কিন্তু মনের এই ক্ষমতাও ব্রহ্ম থেকেই আসে। বিদ্যুতের মতো, মনের শক্তির উৎসও ব্রহ্ম। আমরা ব্রহ্মের চিন্তা করতে পারি না তার কারণ আমাদের মন অশুদ্ধ এবং তাতে বড্ড বেশী আমিত্ব। কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁদের মন শুদ্ধ এবং ইচ্ছাশক্তি প্রবল (‘সঙ্কল্প’)। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর শুদ্ধ মনে আমিত্বের লেশ মাত্র ছিল না। এমন মনের শক্তি অসীম। এ মন ব্রহ্মের খুব কাছাকাছি। তাই এই উপনিষদ জীবাত্মার (অধ্যাত্ম) অভিজ্ঞতা থেকে এই দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন।

তদ্ধ তদ্ধনং নাম তদ্বনমিত্যুপাসিতব্যম্। স য
এতদেবং বেদাভি হৈনং সর্বাণি ভূতানি সংবাঞ্ছন্তি॥৬

অন্বয়: তৎ হ (তিনি অবশ্যই [অর্থাৎ, সেই ব্রহ্ম অবশ্যই]); তদ্ধনম্ [তৎ+বনম্] (এই বরণীয়); নাম (নাম); ইতি উপাসিতব্যম্ (এইভাবে উপাসনা করা উচিত); সঃ যঃ এতৎ এবং বেদ (যিনি তাঁকে [ব্রহ্মকে] এইভাবে জানেন); সর্বাণি ভূতানি এনম্ অভিসংবাঞ্ছন্তি হ (সকল জীব অবশ্যই তাঁর কাছে প্রার্থনা করে [অর্থাৎ পূজা করে] [‘অভি’ শব্দটি এখানে ‘সংবাঞ্ছন্তি’র সঙ্গে যুক্ত হবে])।

সরলার্থ: সেই (ব্রহ্ম) নিঃসন্দেহে বরণীয়। (সুতরাং) বরণীয় (তদ্বনম্) বলেই তাঁর আরাধনা করা উচিত। যিনি ব্রহ্মকে এইভাবে জানেন, তিনি সকলেরই পূজ্য।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম সম্বন্ধে এইটুকুই শুধু বলা যায় যে, তিনি বরণীয়। তিনি বরণীয় কারণ সবকিছুর উৎসই তিনি। তিনি বরণীয় বলেই তাঁকে বরণ করা উচিত। এছাড়া আর কোন কারণ দেখানো সম্ভব নয়। যদি কেউ ব্রহ্মকে নিজের সঙ্গে অভিন্ন, একান্ত আপনার বলে জানেন, তাহলে তিনিও সকলের আদরণীয়, সকলের পূজ্য। আমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের স্বরূপ জেনে থাকেন, নিজেকে ব্রহ্ম বলে জানেন, তবে আমরা সকলেই তাঁকে ভালবাসি, তাঁর পূজা করি। তিনি আমাদের আদর্শ। আমরা তাঁকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করি।

উপনিষদং ভো ব্রূহীতি উক্তা ত উপনিষদ্ ব্রাহ্মীং
বাব ত উপনিষদমব্রূমেতি॥৭

অন্বয়: ভোঃ উপনিষদং ব্রূহি (হে [আচার্য], অনুগ্রহ করে আমাকে উপনিষদ [-এর উপদেশগুলি] বলুন); ত ([অর্থাৎ তে] তোমাকে); উপনিষদ্ উক্তা (উপনিষদ [-এর সারমর্ম] বলা হয়েছে); ব্রাহ্মীং বাব উপনিষদম্ ত [অর্থাৎ তে] অব্রূম ইতি (আমি তোমাকে উপনিষদ সম্বন্ধে [সবকিছুই] বলেছি যা অবশ্যই ব্রহ্মবিষয়ক)।

সরলার্থ: (শিষ্য)—‘হে আচার্য, অনুগ্রহ করে আমাকে উপনিষদের বাণীর (এবং শিক্ষার) কথা বলুন।’ (আচার্য)—‘উপনিষদের বাণী তোমাকে এর মধ্যেই বলা হয়েছে। উপনিষদে ব্রহ্মসংক্রান্ত যে-তত্ত্ব আছে তার সবই তোমাকে বলেছি।’

ব্যাখ্যা: শিষ্য এখন বলছেন, উপনিষদের বাণী কি অনুগ্রহ করে তা আমাকে বলুন। শিষ্য যা বলতে চাইছেন, এখনও পর্যন্ত আচার্য কেবলমাত্র ব্রহ্ম এবং আত্মা সম্পর্কেই বলেছেন। এখন তিনি জানতে চান উপনিষদের আর কিছু বক্তব্য আছে কিনা? উত্তরে আচার্য বলছেন, আমি তোমাকে এর মধ্যেই উপনিষদের সারকথা, অর্থাৎ ব্রহ্ম ও তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে বলেছি। উপনিষদ কেবলমাত্র ব্রহ্মের কথাই বলেন। ব্রহ্মই উপনিষদের একমাত্র বিষয়।

শিষ্যের মনে হয়তো অনুশীলন সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন জেগেছিল। একথা সত্য, আচার্য তাঁকে ব্রহ্ম সম্পর্কে বলেছেন, কিন্তু সেটাই কি সব? কর্ম বা সাধন সম্পর্কে কি উপনিষদের বলার কিছু নেই?

তস্যৈ তপো দমঃ কর্মেতি প্রতিষ্ঠা বেদাঃ সর্বাঙ্গানি
সত্যমায়তনম্॥৮

অন্বয়: তস্যৈ [অর্থাৎ, তস্যঃ] (এই বিষয়ে [অর্থাৎ, ব্রহ্ম অথবা আত্মজ্ঞান]); তপঃ (কৃচ্ছ্রসাধন); দমঃ (আত্মনিগ্রহ); কর্ম (কাজ, আধ্যাত্মিক অনুশীলন); প্রতিষ্ঠা (ভিত্তি); বেদাঃ (বেদসমূহ); সর্বাঙ্গানি (সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ); সত্যম্ (সত্য); আয়তনম্ (আবাস)।

সরলার্থ: কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন, এই তিনটি হল আত্মজ্ঞানের ভিত্তি। বেদসমূহ এই জ্ঞানের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং সত্য এই জ্ঞানের আবাস।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলছেন, ব্রহ্মকে জানতে গেলে আমাদের কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মসংযম এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশাসনের অনুশীলন করতে হবে। কারণ এগুলিই আত্মজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা বা মূলভিত্তি। বেদ এই জ্ঞানের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কারণ, বেদ পড়লে আমাদেব সংশয় দূর হয়ে যায়। আত্মসংযম, নিষ্কাম কর্ম, শাস্ত্রচর্চা—এগুলি সবই হচ্ছে উপায়, যার দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়, মনের পবিত্রতা আসে। যখন অহংবোধ চলে যায় এবং মন শুদ্ধ হয়, তখনই সাধক আত্মজ্ঞান লাভ করে।

সবথেকে প্রয়োজনীয় জিনিস হল সত্য। উপনিষদ বলছেন, আত্মজ্ঞানের নিবাস হল সত্য। সত্যের স্থান তাই সবার ওপরে। কেউ হয়তো সংযমী ও পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু সত্য ছাড়া আত্মজ্ঞান লাভ তাঁর পক্ষেও সম্ভব হবে না। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার বলেছিলেন, ‘জগৎ-জননীকে সবকিছু দিয়েছিলাম, শুধু সত্য দিতে পারিনি।’

এখন প্রশ্ন, সত্য কি? সত্য বলতে ঠিক কি বোঝায়? ‘অমায়িতা’, এবং ‘বাঙ্‌মনঃকায়ানাম্ অকুটিল্যম্’—এই হচ্ছে সত্যের উপাদান। সহজ করে বললে বলতে হয়, সত্য হচ্ছে চিন্তা, কথা ও কাজে সরলতা, সততা ও আন্তরিকতা। মন, মুখ এক করতে হবে; কথা ও কাজে সঙ্গতি আনতে হবে। শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, সত্য কথাই কলির তপস্যা, শ্রেষ্ঠ সাধন। তিনি বলতেন, আমাদের চিন্তা, কথা এবং কাজে যেন মিল থাকে। বস্তুত সত্যিকারের সৎ মানুষ কখনও সত্য থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না। তিনি যা বলেন তাই সত্য হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবনে এ কথার সত্যতা প্রমাণ করে গেছেন। যদি তিনি একবার বলতেন যে, এই কাজটা করব, তাহলে যত বাধাবিঘ্নই আসুক না কেন তিনি তা করতেন। অন্যদেরও তিনি সেই শিক্ষাই দিতেন এবং যাতে তাঁরা কঠোরভাবে সত্য পালন করেন সেদিকেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। ‘করব’ বলে কেউ যদি সেই কাজটা না করতেন, কিংবা ঠাট্টার ছলেও কেউ অসত্য কথা বলতেন, তাহলে তাতে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হতেন। সাধারণ মানুষ বলে, সততাই শ্রেষ্ঠ পথ। গান্ধীজী আরও একধাপ এগিয়ে বলতেন, সততাই একমাত্র পথ।

যো বা এতামেবং বেদ অপহত্য পাপ্‌মানমনন্তে
স্বর্গেলোকে জ্যেয়ে প্রতিতিষ্ঠতি প্রতিতিষ্ঠতি॥৯

অন্বয়: যঃ বৈ এতাম্ এবং বেদ (যিনি তাঁকে [অর্থাৎ ব্রহ্মকে] এইভাবে জানেন); পাপ্‌মানম্ অপহত্য (সব পাপ অতিক্রম করে [অর্থাৎ অজ্ঞানতা জয় করে]); অনন্তে জ্যেয়ে স্বর্গে লোকে (শ্রেষ্ঠ অনন্ত দিব্যধামে [অর্থাৎ অনন্ত আনন্দে); প্রতিতিষ্ঠতি (দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হন)।

সরলার্থ: যিনি ব্রহ্মকে এইভারে জানেন, তিনি সব অজ্ঞানতা অতিক্রম করে অসীম আনন্দে নিত্য প্রতিষ্ঠিত হন।

ব্যাখ্যা: এইভাবে যিনি ব্রহ্মকে জানেন অর্থাৎ, এই উপনিষদ যেভাবে ব্রহ্মকে ব্যাখ্যা করলেন সেইভাবে যিনি ব্রহ্মকে জানেন—তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেন। সব অজ্ঞানতার ঊর্ধ্বে উঠে তখন তিনি জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে যান। এখন আমরা সকলেই এই জন্মমৃত্যুর চক্রে বাঁধা। আমরা জন্মাই, সময় হলে মারা যাই, আবার জন্মাই। জন্ম এবং মৃত্যু অনিবার্যভাবে একটার পর আরেকটা আসে আর যায়। কিন্তু যখন আমাদের স্বরূপজ্ঞান হয়, যখন আমরা আমাদের আত্মাকে জানতে পারি, যখন বুঝি আমরা কে—তখনই আমরা মোক্ষ বা মুক্তি লাভ করি। অজ্ঞানতাবশত এখন আমরা ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেদের অভিন্ন বলে মনে করি, আর সেইজন্যেই অশেষ দুঃখভোগ করি। কিন্তু যখন জানবো যে আমরা দেহ নই, ইন্দ্রিয়াদি নই, যখন জানবো যে আমরা ইন্দ্রিয়াদি তথা সবকিছুর পারে, তখন আর আমাদের এ জগতে ফিরে আসতে হবে না। জন্মমৃত্যু চক্র চূর্ণ করে তখন আমরা মুক্ত হয়ে যাই। ‘স্বর্গ’ বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি এই শ্লোকে ‘স্বর্গ’ বলতে তা বোঝাচ্ছে না। আমরা যাকে স্বর্গ বলি তা অনিত্য। কিন্তু এখানে স্বর্গ বলতে অবিমিশ্র, নিত্য আনন্দ এবং সুখের একটা অবস্থা বোঝানো হয়েছে, যে অবস্থা ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বোধ করলেই লাভ করা সম্ভব। এই সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ করাই মনুষ্যজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

কেন উপনিষদের চতুর্থ খণ্ড এইখানে সমাপ্ত।
ওঁ আপ্যায়ন্তু মমাঙ্গানি বাক্‌ প্রাণশ্চক্ষুঃ শ্ৰোত্ৰমথো
বলমিন্দ্রিয়াণি চ সর্বাণি। সর্বং ব্রহ্মৌপনিষদম্।
মাঽহং ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোৎ;
অনিরাকরণমস্তু, অনিরাকরণং মেঽস্তু। তদাত্মনি
নিরতে য উপনিষৎসু ধর্মাস্তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *