ঈশ উপনিষদ

ঈশ উপনিষদ

মঙ্গলাচরণ

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

অন্বয়: অদঃ (সেই [অর্থাৎ কারণ-ব্রহ্ম—ব্রহ্মকে ‘সেই’ বলা হচ্ছে যেহেতু ব্রহ্ম বাক্য-মনের অতীত]); পূর্ণম্ (সর্বব্যাপী, অনন্ত); ইদম্ (এই [অর্থাৎ কার্যরূপে ব্রহ্ম—এখানে ব্রহ্ম এই দৃশ্যমান জগৎরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। তাই ব্রহ্মকে ‘এই’ বলা হচ্ছে]); পূর্ণম্ (স্বরূপত, সর্বব্যাপী, অনন্ত); পূর্ণাৎ (কারণ-ব্রহ্ম থেকে); পূর্ণম্ (কার্য-ব্রহ্ম অর্থাৎ এই দৃশ্যমান আপেক্ষিক জগৎরূপে ব্রহ্ম); উদচ্যতে (প্রকাশিত হয়েছেন); পূর্ণস্য ([যদি] কারণ-ব্রহ্ম থেকে); পূর্ণম্ (এই জগৎরূপে প্রকাশিত ব্রহ্ম); আদায় (সরিয়ে দেওয়া হয় [অর্থাৎ জগৎ আরোপিত উপাধি মাত্র, অতএব মিথ্যা এই জেনে জগৎকে ত্যাগ করলে]); পূর্ণমেব (পূর্ণই অর্থাৎ অনন্ত ও সর্বব্যাপী ব্রহ্মই); অবশিষ্যতে (অবশিষ্ট থাকে)।

ওঁ শান্তিঃ (আধ্যাত্মিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শান্তি]); শান্তিঃ (আর্ধিদৈবিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শান্তি]); শান্তিঃ (আধিভৌতিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ কীটপতঙ্গ, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতি থেকে শান্তি])।

সরলার্থ: ব্রহ্ম অনন্ত। এই জগৎও অনন্ত। কিন্তু ‘এই’ জগৎ ‘সেই’ ব্রহ্মের উপর আরোপিত সত্তা মাত্র। ‘এই’ জগৎকে যদি সরিয়ে দেওয়া যায় (তথাপি) ‘সেই’ ব্রহ্ম অনন্তই থাকেন। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।

ব্যাখ্যা: এই দৃশ্যমান জগতের কোন স্বাধীন সত্তা নেই। ব্রহ্ম একে ধারণ করে আছেন বলে এ দাঁড়িয়ে আছে। বস্তুত ব্রহ্মের ওপর এ ন্যস্ত। সন্ধ্যায় রাস্তায় চলতে চলতে দড়ি দেখে আমরা সাপ বলে ভুল করতে পারি। বস্তুত এটা একটা দৃষ্টিভ্রম—দড়ি দেখে সাপ মনে করা। এই ভুল যখন ভাঙ্গে তখন দেখি সাপ নেই। সাপ যেন দড়িতে মিশে গেছে।

ব্রহ্ম যেন দড়ি, এই দৃশ্যমান জগৎ যেন সাপ। যখন জ্ঞান হয় তখন এই জগৎ ব্রহ্মে অর্থাৎ আত্মার মধ্যে লীন হয়ে যায়।

ঈশ উপনিষদ

‘উপনিষদ’ শব্দটি বলতে কোন গ্রন্থ বোঝায় না, বোঝায় জ্ঞান। এই জ্ঞান সাধারণ জ্ঞান নয়, অতি উচ্চকোটির জ্ঞান, যে জ্ঞান শান্তি ও আনন্দ এনে দেয়, মানুষ কৃতার্থ বোধ করে। এই জ্ঞান লাভ করতে হলে আচার্যের কাছে যেতে হবে—যে আচার্য স্বয়ং জ্ঞানের অধিকারী। যে নিজে অন্ধ সে পথ চেনবার জন্য নিশ্চয়ই আর এক অন্ধের কাছে যাবে না। সেই ভাবেই যে আচার্য নিজে এই আত্মজ্ঞান অর্জন করেননি তাঁর কাছে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। শিক্ষার্থী অতি বিনীতভাবে এই জ্ঞানী আচার্যের কাছে উপস্থিত হবেন। আচার্য শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অর্থ প্রত্যাশা করেন না কিন্তু শিষ্য বিনয়ী এবং ধৈর্যশীল শ্রোতা হবেন, এই প্রত্যাশা তাঁর থাকে। তিনি আরও আশা করেন যে শিষ্য বিষয়টি সম্পর্কে অনুরাগী এবং শ্রদ্ধাশীল হবেন। সত্যের জন্য শিষ্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকবে এবং যথাসাধ্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের পরই তিনি আচার্যের কাছে যাবেন।

‘ঈশ’ এই শব্দটি দিয়ে এই উপনিষদ শুরু হয়েছে, তাই এই উপনিষদের নাম ঈশ উপনিষদ। ঈশ কথাটির অর্থ ঈশ্বর, যিনি সর্ববস্তুর অন্তরস্থ আত্মা। অন্যান্য উপনিষদ থেকে ঈশ উপনিষদের পার্থক্য এই যে—এটি সম্পূর্ণ শ্লোকে লেখা, এবং অনেকের মতে উপনিষদ-সমূহের মধ্যে এটি প্রাচীনতম এবং সর্বোৎকৃষ্ট। এই উপনিষদ শুক্লযজুর্বেদে পাওয়া যায়। বেদের সংহিতা অংশ প্রধানত কর্মকাণ্ড বিষয়ক, ঈশ উপনিষদ সংহিতার অঙ্গ হলেও কেবলমাত্র অদ্বৈততত্ত্বের আলোচনাই এখানে আছে। যাগযজ্ঞকর্মাদির সঙ্গে এই উপনিষদের কোন সম্পর্ক নেই।

সাধারণভাবে জ্ঞান-অজ্ঞান, সত্য-অসত্য, এক-বহু ইত্যাদি বিতর্ক দিয়ে উপনিষদ-সমূহ ভরা। কিন্তু ঈশ উপনিষদে অতি স্পষ্টভাবে এই বিতর্কের মীমাংসা করা হয়েছে। আপেক্ষিক সত্য পরম সত্যে বিলীন হয়—এই উপনিষদে তাই দেখানো হয়েছে। এই পরমসত্য নামরূপহীন। সাধারণ ভাষায় ব্রহ্ম (বৃহত্তম) বা পরমাত্মা (বিশ্বাত্মা) বলে ইনি অভিহিত। ইনিই আমাদের সকল সত্তার সারস্বরূপ এবং সকল বস্তুর আশ্রয়। নাম এবং রূপেই যত বৈচিত্র, মূলত সকলের মধ্যে সেই একই সত্তা। এই একের স্বরূপ ও তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই এই উপনিষদের অনুসন্ধানের বিষয়।

ওঁ ঈশাবাস্যমিদং সর্বং
যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা
মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্॥১

অন্বয়: জগত্যাম্ (জগতে); যৎ কিঞ্চ (যা কিছু); জগৎ (পরিবর্তনশীল, বিনাশশীল); ইদং সর্বম্ (এই সবকিছু); ঈশা বাস্যম্ (ঈশ্বর কর্তৃক আচ্ছাদিত); তেন (সেই হেতু); ত্যক্তেন (ত্যাগের দ্বারা); ভুঞ্জীথা (পালন কর [অর্থাৎ ঈশ্বর সর্বত্র এবং সর্বভূতে আছেন এই চেতনাকে বলিষ্ঠ কর]); কস্য স্বিৎ (কারও); ধনম্ (ধনে); মা গৃধঃ (লোভ করো না)।

সরলার্থ: পরিবর্তনশীল এই জগতে সবকিছুরই ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। তথাপি সব কিছু পরমেশ্বরের দ্বারা আবৃত। ত্যাগ অনুশীলন কর এবং সর্বভূতের চৈতন্যস্বরূপ আত্মায় দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হও। অপরের ধনে লোভ করো না।

ব্যাখ্যা: এই জগৎ এবং জগতের সব কিছু সর্বদা পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। কিন্তু যিনি এই জগৎকে ধরে রেখেছেন তিনি অপরিবর্তিত। তিনি সদা অবিচল। তিনিই পরমেশ্বর। তিনি সকল বস্তুর আশ্রয়। এ জগৎ যেন পর্দার ওপর ফেলা চলমান ছায়াছবি। চিত্র পরিবর্তিত হচ্ছে কিন্তু পর্দার কোন পরিবর্তন নেই। একই ভাবে এই দৃশ্যজগৎ পরমেশ্বরের উপর আরোপিত মাত্র, যেমন অন্ধকার রাত্রে দড়িকে আমরা সাপ বলে ভুল করি। সাপের পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই। দড়ির কারণেই সাপের অস্তিত্ব এবং আলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই সাপের অস্তিত্ব লোপ পায়। তখন তা দড়িতে লীন হয়ে যায়। সেইভাবেই যখন ব্রহ্মকে জানা যায় তখন এই দৃশ্যজগৎও ব্রহ্মে লীন হয়। তখন আমরা উপলব্ধি করি যে, আমি এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন। এই জ্ঞানলাভই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। এই জ্ঞানলাভের পর জগতের কোন মলিনতা আর আমাদের স্পর্শ করতে পারে না। চন্দনকাঠ বহুদিন জলে থাকলে তাতে এক ধরনের দুর্গন্ধ হয়। সাময়িকভাবে তার সুগন্ধ চাপা পড়ে। কিন্তু অল্প ঘষলেই সেই গন্ধ চলে যায় এবং চন্দনকাঠের স্বাভাবিক সুগন্ধ ফিরে আসে। সেরকমভাবেই আমাদের জগতের প্রতি যে আসক্তি সেটাও সাময়িক। তা স্থায়ী হতে পারে না। ব্রহ্মরূপে, বিশুদ্ধ চৈতন্যরূপে নিজেকে চিন্তা করতে হবে। গভীরভাবে নিরন্তর এই চিন্তা করলে সব আসক্তি দূর হবে।

কিন্তু কিভাবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব? ত্যাগের অনুশীলন দ্বারা। সর্বদা মনে রাখতে হবে এই জগৎ এবং তার নানা প্রলোভন সত্য নয়; সত্য নয় এই অর্থে যে তা অনিত্য। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, কারণ ব্ৰহ্ম অবিনশ্বর। অনিত্য বস্তুর আকাঙ্ক্ষা চিরতরে ত্যাগ করে ব্রহ্মে মনকে একাগ্র করতে হবে। আমরা সোনা দেখে মুগ্ধ হই, কিন্তু তা নশ্বর। যা ক্ষণস্থায়ী তার পেছনে ছোটা, অপরের ধনে লোভ করা বা নিজের ধনেও আসক্ত হওয়া উচিত নয়। যিনি জানেন এই জগৎ ক্ষণস্থায়ী, তাঁর কাছে ধনসম্পদ ও ইন্দ্রিয়সুখ নিতান্তই তুচ্ছ। ব্রহ্মকেই একমাত্র আকাঙ্ক্ষার বস্তু বলে জানতে হবে এবং ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতে হবে। ‘ব্রহ্মই একমাত্র সত্য এবং আমিই সেই ব্রহ্ম’, এই জ্ঞান নিরন্তর অন্তরে জাগ্রত রেখে অন্য সবকিছুর প্রতি উদাসীন থাকতে হবে।

কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি
জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ।
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি
ন কর্ম লিপ্যতে নরে॥২

অন্বয়: কর্মাণি (শাস্ত্রীয় কর্মসমূহ); কুর্বন্ এব (করেই); ইহ (এখানে, এই জগতে); শতং সমাঃ (শত বৎসর); জিজীবিষেৎ (যদি বাঁচার ইচ্ছা হয়); এবম্ (এইভাবে); ত্বয়ি নরে (ওহে মানুষ তোমাতে); কর্ম ন লিপ্যতে (কর্মের ফল লিপ্ত হবে না); অন্যথা ন অস্তি (আর কোন পথ নেই)।

সরলার্থ: শাস্ত্রবিহিত কর্ম করার ফলে কোন ব্যক্তি শত বৎসর বাঁচতে ইচ্ছুক হতে পারেন। এভাবে যিনি কাজ করেন তিনি তাঁর কর্মফলে লিপ্ত হন না। এছাড়া আর অন্য কোন পথ নেই।

ব্যাখ্যা: আগের মন্ত্রটিতে ত্যাগের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। বলা হয়েছে জাগতিক সুখের পিছনে ছোটা অর্থহীন। কেননা এই সুখ ক্ষণস্থায়ী। তবু যদি আমরা এই সুখ লাভের জন্যই লালায়িত হই, তাহলে নিজেরাই নিজেদের দুঃখ ডেকে আনব। কেননা এই জাগতিক সুখের স্থায়িত্ব স্বল্পকাল। কিন্তু সকলের পক্ষে তো ত্যাগের পথ বেছে নেওয়াও সম্ভব নয়। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষই জীবনকে উপভোগ করতে চান এবং এই মন্ত্র তাঁদের উদ্দেশেই বলা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে, যদি তাঁরা দীর্ঘ জীবন কামনা করেন তাতে কোন ক্ষতি নেই। এমনকি সেই দীর্ঘ জীবন একশ বছরও হতে পারে। তাঁরা দীর্ঘায়ু হতে পারেন কিন্তু তাঁদের জীবনের বাসনাসমূহ চরিতার্থ করার জন্য শাস্ত্রের নির্দেশ কঠোরভাবে পালন করতে হবে। এর ফলে ক্রমে তাঁদের চিত্তশুদ্ধি হবে, ইন্দ্রিয়সুখের বাসনা ধীরে ধীরে লোপ পাবে, বিবেকজ্ঞান বৃদ্ধি পাবে এবং আত্মজ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষাও জাগ্রত হবে। যখন এই অবস্থায় পৌঁছনো যায় তখন সারাজীবন ধরে যে কাজ তাঁরা করেছেন সেই কর্মের ফলের দ্বারা তাঁরা আর আবদ্ধ হবেন না। তখন তাঁরা সব কিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত।

যাঁরা মুহূর্তমধ্যে সব কিছু ত্যাগ করতে সক্ষম নন, তাঁদের জন্য এই একমাত্র পথ। তাঁরা যেন হতাশ না হন। তাঁদেরও সময় আছে। কিন্তু শীঘ্রই হোক বা বিলম্বেই হোক তাঁদেরকেও এই ত্যাগের পথই গ্রহণ করতে হবে। এখানে যে পথের কথা বলা হয়েছে সেই পথই অনুসরণ করতে হবে।

অসুর্যা নাম তে লোকা
অন্ধেন তমসাবৃতাঃ।
তাংন্তে প্ৰেত্যাভিগচ্ছন্তি
যে কে চাত্মহনো জনাঃ॥৩

অন্বয়: অসুর্যাঃ (সূর্যহীন, অসুরোচিত); নাম (নামে পরিচিত); তে লোকাঃ (সেই সব লোক); অন্ধেন (আত্মজ্ঞানহীন বা অজ্ঞানরূপ); তমসা (অন্ধকারের দ্বারা); আবৃতাঃ (আচ্ছাদিত); যে কে চ আত্মহনঃ (আত্মঘাতী, যাঁদের আত্মজ্ঞান হয়নি); জনাঃ (মানুষেরা); তে প্ৰেত্য (দেহত্যাগের পর); তান্ (সেই সকল লোকে); অভিগচ্ছন্তি (যান বা প্রবেশ করেন)।

সরলার্থ: এমন সব জগৎ আছে যা (সূর্যহীন) দানবদের যোগ্য আবাস। এই সব জগৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন, যেমন কোন অন্ধ ব্যক্তি (অর্থাৎ যাঁরা আত্মজ্ঞান-রহিত) যেভাবে জগৎকে অনুভব করেন ঠিক সেই রকম। আত্মজ্ঞান অর্জনে উদাসীন হওয়া আত্মহত্যার সামিল। এই সব ব্যক্তি মৃত্যুর পর সূর্যহীন লোক অথবা অসুরলোক প্রাপ্ত হন।

ব্যাখ্যা: যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভে সচেষ্ট নন এই শ্লোকে তাঁদের নিন্দা করা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে তাঁরা আত্মঘাতী। জীবনের আসল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে ইন্দ্রিয়সুখের দাস হওয়ার চাইতে নিকৃষ্ট আর কী হতে পারে? জীবনের উদ্দেশ্য হল আত্মসংযম। এর দ্বারা ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করতে হবে; নিশ্চিতভাবে জানতে হবে—আমিই সেই পরমাত্মা, যা শুদ্ধ চৈতন্য, নিত্যমুক্ত, নামরূপহীন এবং কোন নিয়মের অধীন নন। আত্মা অপরিবর্তনীয় এবং এই আত্মা অনাদি, অনন্ত ও বাক্যমনাতীত। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে—আমিই সেই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। এই উপলব্ধিতেই মুক্তি। তখন আর জন্ম-মৃত্যুর দোলায় দুলতে হয় না। নিজেকে জানার চেষ্টা না করা আত্মহত্যার সমান। এর ফলে ইহলোক ও পরলোক দুই-ই নষ্ট হয়।

অনেজদেকং মনসো জবীয়ো
নৈনদ্দেবা আপ্লুবন্ পূর্বমর্ষৎ।
তদ্ধাবতোঽন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ
তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি॥৪

অন্বয়: অনেজৎ (নিষ্কম্প); একম্ (এক); মনসঃ (মনের চেয়ে); জবীয়ঃ (বেশী বেগবান); দেবাঃ (ইন্দ্রিয়সমূহ); পূর্বম্ অর্ষৎ (সকলের আগে); এনৎ ন আপ্লুবন্ (এঁর নাগাল পায় না); তৎ (তিনি); তিষ্ঠৎ (স্থির থেকে); ধাবতঃ (চলমান); অন্যান্ (অন্য সকলকে); অতি এতি (অতিক্রম করে যান); তস্মিন্ (তিনি আছেন বলে); মাতরিশ্বা (বায়ু অর্থাৎ জগৎ বিধায়ক সূত্ৰাত্মা বা হিরণ্যগর্ভ); অপঃ (জল অর্থাৎ কর্মসমূহ); দধাতি (বিশেষরূপে পালন করেন)।

সরলার্থ: ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। ব্রহ্ম একাধারে স্থির, আবার অপর দিকে চঞ্চল, মন অপেক্ষাও দ্রুতগামী। তিনি সব সময়ই সবার আগে রয়েছেন। ইন্দ্রিয়সমূহও এঁর নাগাল পায় না। তিনি নিজে স্থির থেকেও অন্য সকলকে অতিক্রম করে যান। শূন্যের দেবতা হিরণ্যগর্ভরূপে তিনি এই স্থূল ও দৃশ্যমান জগতের সবকিছুকে ধরে রেখেছেন।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। ব্ৰহ্ম স্বয়ংসম্পূর্ণ। ব্রহ্ম অচঞ্চল, সতত স্থির এবং অপরিবর্তিত। আবার মন অপেক্ষাও তিনি দ্রুতগামী। তিনি আছেন বলেই জগতের সব কিছু আছে, এবং তিনিই জগতের সব কিছুকে চালনা করেন। তিনি ব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা মাতরিশ্বাকে শক্তি দান করেন। এই মাতরিশ্বার (যাঁর বাস অন্তরীক্ষে) দ্বারাই জগতে কার্য-কারণ ইত্যাদি সক্রিয় থাকে।

ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায় না। তিনি বাক্য ও মনের অতীত। তিনি সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে বিরাজিত। তিনি নিরাকার, আবার তিনিই সাকার। তাঁর কোন নাম নেই আবার সব নামই তাঁর নাম। বস্তুত তিনি অনন্য। এই ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেবার জন্যই উপনিষদ পরস্পরবিরোধী উক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। একবার বলা হচ্ছে ব্রহ্ম স্থির, ঠিক পরের মুহূর্তেই বলা হচ্ছে মন অপেক্ষাও ইনি দ্রুতগামী। এ কথার অর্থ কি?

এর উত্তর হল: ব্রহ্মের দুটি দিক আছে। একদিকে তিনি নির্গুণ। তিনি পরম। তিনি শুদ্ধ চৈতন্য। তিনি সচ্চিদানন্দ। তিনিই পরমাত্মা।

অপরদিকে ব্রহ্ম সগুণ। এটি ব্রহ্মের আপেক্ষিক দিক। এই দিক থেকে বলা যায়, তিনি সাকার, তিনি সগুণ; ভালমন্দ ছোটবড় সবই তিনি। এইসব গুণের পার্থক্যে তাঁর কোন শেষ নেই। মনে রাখা প্রয়োজন যে, এগুলি আত্মার ওপর আরোপিত গুণ বা উপাধি (অধ্যাস) মাত্র। এই গুণসকল ব্রহ্মকে স্পর্শ করতে পারে না। শিশুরা যে মুখোশ পরে এই গুণগুলিও অনেকটা সেই মুখোশের মতো।

মন নিজে নিষ্ক্রিয়। মন তখনই সক্রিয় হয় যখন আত্মা (ব্রহ্মেরই অপর নাম) তাতে প্রাণসঞ্চার করে। মন আত্মা অপেক্ষা দ্রুতগামী নয়। কারণ আত্মাই তাকে সচল করে তোলে এবং সেই আত্মা সর্বত্র বিরাজমান। শুধু মনেই নয় শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের (এগুলিকে দেব বলা হয়, কারণ এগুলি ব্যক্ত) বেলাতে এবং প্রকৃতির সব উপাদান সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। এই শক্তিই সকল কার্য ও কারণের পেছনে কাজ করে থাকে।

এক্ষেত্রে বায়ুর দৃষ্টান্ত খুবই প্রাসঙ্গিক। বায়ু যখন আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন বায়ুই জীবনীশক্তি, কিন্তু আলাদাভাবে বায়ু জীবনকে রক্ষা করতে পারে না। বায়ুকে মাতরিশ্বা বলা হয়। কারণ তা অন্তরীক্ষে অর্থাৎ শূন্যে (মাতরি) চলমান (শ্বা)। কিন্তু পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন তিনি হিরণ্যগর্ভ (ব্যষ্টি হিসাবে ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ) অথবা সূত্ৰাত্মা (মালায় যেমন নানা ফুল এক সুতোতে গাঁথা থাকে, ‘সূত্রে মণিগণা ইব’)। এই ভাবে ব্রহ্ম এই দৃশ্য জগতের সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন—‘এঁর ভয়ে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়, সূর্য আলো দান করে, ইন্দ্র, বায়ু, মৃত্যু বা পঞ্চম ক্রিয়াশীল হয়।’

ব্রহ্ম ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না। কিন্তু কোন কিছুর দ্বারা ব্রহ্ম প্রভাবিত নন। এই দৃশ্যজগৎ ব্রহ্ম থেকেই এসেছে, ব্রহ্মেই স্থিত, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়।

তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ॥৫

অন্বয়: তৎ (তিনি); এজতি (চলেন); তৎ (তিনি); ন এজতি (চলেন না); তৎ (তিনি); দূরে (দূরে); তৎ (তিনি); উ অন্তিকে (কাছেও); তৎ (তিনি); অন্তঃ (ভিতরে); অস্য সর্বস্য (এর অর্থাৎ জগতের); তৎ (তিনি); উ (আবার); অস্য (এর); সর্বস্য (সকলের); বাহ্যতঃ (বাইরে)।

সরলার্থ: তিনি (ব্রহ্ম) সচল হয়েও স্থির। তিনি দূরেও আছেন আবার কাছেও আছেন। তিনি (ব্রহ্ম) সব কিছুর ভেতরেও আছেন আবার সব কিছুর বাইরেও আছেন।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্মকে বর্ণনা করার চেষ্টা যে কত বৃথা, এই মন্ত্রে তাই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ব্রহ্ম নামরূপহীন। কোন বিশেষণ দ্বারা ব্রহ্মকে বিশেষিত করা যায় না। তিনি কিছু না হয়েও সব হয়েছেন। তিনি কিছু নন, কারণ তিনি বাক্যমনাতীত। তিনি সবকিছু কেননা সবকিছু তাঁরই ওপর ন্যস্ত। তিনি আছেন বলেই সব কিছু আছে। সব অস্তিত্বের সারাৎসারও তিনি। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, কিন্তু নাম রূপের পার্থক্যের জন্য তিনিই আবার বহু হয়েছেন। এই নাম এবং রূপ ব্রহ্মের ওপর আরোপিত মাত্র। তিনি অপরিবর্তিত এবং অপরিবর্তনীয়। তিনি কোন কিছুর অধীন নন অর্থাৎ স্বাধীন। তিনি একইসঙ্গে সকলের অন্তরে আছেন, আবার বাইরেও আছেন।

স্বরূপত ব্রহ্ম নিশ্চল এবং পরিবর্তনরহিত। তিনি সতত বিদ্যমান। কখনও কখনও মেঘের আড়ালে চাঁদকে গতিশীল বলে আমাদের মনে হয়। আসলে এ গতি চাঁদের নয়, মেঘের। সেইভাবে ব্রহ্ম বা পরমাত্মা সর্বদা এক এবং অপরিবর্তিত। তাঁর জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। কিন্তু আত্মা যেহেতু দেহের সাথে যুক্ত তাই মনে হয় দেহের মতো আত্মারও জন্ম মৃত্যু ঘটে। আমরা নূতন কাপড় পরে থাকি, কিন্তু সে কাপড় যখন ছিঁড়ে যায় তখন আমরা তাকে ত্যাগ করি। কাপড়ের সঙ্গে দেহের যেরকম সম্পর্ক আত্মার সঙ্গেও দেহের সম্পর্ক সেইরূপ।

যস্তু সর্বাণি ভূতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্‌সতে॥৬

অন্বয়: যঃ তু (কিন্তু যিনি অর্থাৎ যে ব্যক্তি); আত্মনি এব (তাঁর মধ্যে); সর্বাণি (সকল); ভূতানি (ভূত সমূহ); অনুপশ্যতি (দেখেন); চ (এবং); সর্বভূতেষু (সর্বভূতে); আত্মানম্ (আত্মাকে); [অনুপশ্যতি (দেখেন)]; ততঃ (সেহেতু); ন বিজুগুপ্‌সতে (ঘৃণা করেন না)।

সরলার্থ: যিনি নিজের মধ্যে সকলকে দেখেন এবং সকলের মধ্যে নিজেকে দেখেন, তিনি কোন কিছু ঘৃণা করেন না।

ব্যাখ্যা: একেই সমদর্শিতা বা সমদৃষ্টি বলা হয়ে থাকে। সকলের মধ্যে এক আত্মা বিরাজ করছেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা সকলে এক, পার্থক্য শুধু নাম এবং রূপে। নাম এবং রূপ আত্মার ওপর আরোপিত মাত্র। নামরূপ সত্য নয়, অতএব এরা আত্মার অংশ নয়। নাম এবং রূপ যেন একটি স্বচ্ছ পর্দা যার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রকৃত সত্তাকে দেখি। ছোট ছেলেরা নানা রকমের মুখোশ পরে তাদের বন্ধুদের ভোলায়। প্রথমে হয়তো সে বাঘের মুখোশ পরে বাঘের মতো ব্যবহার করে, ফলে তার বন্ধুরা ভয় পায়। পরমুহূর্তেই সে বাঁদরের মুখোশ পরে, বাঁদরের মতো লাফ দেয়। এতে আবার বন্ধুরা মজা পায়। এভাবে কিছুক্ষণ খেলা চলে। শেষপর্যন্ত সে যখন সব মুখোশ সরিয়ে দেয়, তখন তার আসল চেহারা প্রকাশ পায়। ছেলেরা তখন বোঝে মুখোশ পরা ছেলেটি তাদেরই বন্ধু। আসলে তো সে বরাবরই এক, মুখোশের জন্য তাকে নানারকম মনে হচ্ছিল। ঠিক সেইরকম আমরাও সকলে এক ও অভিন্ন। শুধুমাত্র নামরূপের বিভিন্নতার জন্য আমাদের পৃথক দেখায়।

এই শ্লোকে আমরা যে স্বরূপত এক, একথাই বিশেষভাবে বলা হয়েছে। ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সর্বত্র সেই একই সত্তা বিরাজিত। কিছু খণ্ডিত অংশকে একত্রিত করে এই ঐক্যের সৃষ্টি হয়নি। কারণ আত্মা সকলের মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান। আমি যদি কাউকে আঘাত করি, তা হলে এমন হবে, তার দ্বারা যেন আমি আমাকেই আঘাত করেছি। সকলে সুখী হলেই আমরা সুখী। মানুষ, পশু, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ আমরা সবাই এক। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে এই একত্বকে উপলব্ধি করা। এই একের উপলব্ধি হলে মনে আর কোন বিদ্বেষ বা গোপনতার স্থান থাকে না। তখন থাকে শুধু সকলের প্রতি প্রেম।

যস্মিন্সৰ্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ॥৭

অন্বয়: যস্মিন্ (যখন); আত্মা এব (একমাত্র আত্মা); সর্বাণি (সকল); ভূতানি (ভূত সমূহ); অভূৎ (হয়েছে); তত্র (তখন); বিজানতঃ (যিনি এটা জানেন); একত্বম্ (একরূপে); অনুপশ্যতঃ (দেখেন যিনি); কঃ (কোথায়); মোহঃ (মোহ); কঃ (কোথায়); শোকঃ (শোক)।

সরলার্থ: যখন কোন ব্যক্তি সব কিছুর মধ্যে এক আত্মাকেই দেখেন এবং জানেন যে তিনি নিজেই সব কিছু হয়েছেন, তখন তিনি কোন কিছুকে ঘৃণাও করেন না বা কোন কিছুর প্রতি আসক্তও হন না।

ব্যাখ্যা: সবকিছুর সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করার মধ্য দিয়েই আত্মজ্ঞানের যথার্থ পরীক্ষা হয়। আমি সর্বত্র এবং সর্বভূতে রয়েছি। সেখানে ‘এক’ ভিন্ন ‘দুই’ নেই। সেই ‘এক’ই হল স্বয়ং ‘আমি’। এই একত্বকে উপলব্ধি করাই হল জীবনের পরম লক্ষ্য। ব্যবহারিক জীবনে যে বৈচিত্র আছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই এই বৈচিত্র। আর এই নামরূপ আমাদের মনেরই কল্পনা মাত্র। এতে আমার কোন পরিবর্তন হয় না। আমি সেই অপরিবর্তিত এক সত্তামাত্র।

যখন আমরা এই একত্বকে উপলব্ধি করতে পারব, তখন আমাদের আসক্তি, ঘৃণা, বা দুঃখ বলে কিছু থাকবে না। দ্বৈত বোধ আসে অজ্ঞানতা থেকে। আত্মজ্ঞান লাভে অর্থাৎ অদ্বৈতের উপলব্ধিতে এই অজ্ঞানতা সমূলে বিনষ্ট হয়।

স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ-
মস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।
কবিৰ্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভু-
র্যাথাতথ্যতোঽর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ॥৮

অন্বয়: সঃ পর্যগাৎ (তিনি [অর্থাৎ পরমাত্মা] সর্বব্যাপী); শুক্রম্ (শুভ্র, উজ্জ্বল); অকায়ম্ (রূপহীন); অব্রণম্, (সম্পূর্ণ, অর্থাৎ অক্ষত); অস্নাবিরম্ (শিরাহীন) [অর্থাৎ দেহহীন]; শুদ্ধম্ (পবিত্র); অপাপবিদ্ধম্ (দোষরহিত [অর্থাৎ অজ্ঞানতার লেশমাত্র নেই]); কবিঃ (প্রাজ্ঞ); মনীষী (সর্বজ্ঞ, মনের নিয়ন্তা); পরিভূঃ (উত্তম বা শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ সকলের উপরে তাঁর স্থান); স্বয়ম্ভূঃ (স্বত বিদ্যমান; তিনি সৃষ্ট নন, নিজের ইচ্ছাতেই নিজেকে প্রকাশ করেন); শাশ্বতীভ্যঃ (চিরন্তন); সমাভ্যঃ (কাল ব্যাপী); অর্থান্ (কর্মের ফলসমূহকে); যাথাতথ্যতঃ (যথাযথরূপে); ব্যদধাৎ (বিধান করেন)।

সরলার্থ: তিনি (আত্মা) সর্বব্যাপী, জ্যোতির্ময়, নিরবয়ব, অক্ষত, অচ্যুত, নির্মল, সর্বজ্ঞ, নিজ মনের নিয়ন্তা, সর্বোত্তম, স্বয়ম্ভূ এবং চিরন্তন। তিনি প্রত্যেকের জন্য যথাকর্তব্য বিধান করেন।

ব্যাখ্যা: আমরা কিভাবে শান্তিলাভ করব সেকথাই এখানে আলোচনা করা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে দুই বোধ থাকে, ততক্ষণ আমার শত্রু ও মিত্র দুই-ই থাকতে পারে। আমি যেন সেই মনের অধিকারী হতে পারি, যে মন আকাশের মতো উদার এবং সমগ্র পৃথিবীকে নিজের বলে গ্রহণ করে। সেই মন শুদ্ধ, উজ্জ্বল, উদার, মুক্ত এবং সর্বগ্রাহী। এ অবস্থা আমরা তখনই লাভ করতে পারব যখন আমরা উপলব্ধি করব যে, আমিই সকলের মধ্যে রয়েছি।

অদ্বৈতবাদীদের বিশ্বাস, এটিই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ। যদি আত্মাকে অন্যরকম বলে মনে হয় তবে তা আরোপিত গুণের জন্য। সেটা কিন্তু আত্মার স্বরূপ নয়। আত্মা সাক্ষী মাত্র। এই দৃশ্যমান জগতের কোন কিছুর সঙ্গেই আত্মা যুক্ত নন। অথচ তাঁরই প্রভাবে এই জগতের সব কিছু ঘটে চলেছে। এ যেন প্রদীপের মতো। প্রদীপ আলো দেয়। আলো ছাড়া ভাল বা খারাপ কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু সেই আলোতে ভাল বা মন্দ যে কাজই করি না কেন, তাতে প্রদীপটির কিছু যায় আসে না। আত্মার সঙ্গে দৃশ্যজগতের সম্পর্কও ঠিক সেরকম।

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে অবিদ্যামুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ॥৯

অন্বয়: অন্ধম্ (দৃষ্টিহীন অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের অভাবে দৃষ্টিহীন); তমঃ (অজ্ঞানতার অন্ধকার অর্থাৎ অহংতা [আমি], মমতা [আমার], অহঙ্কার ইত্যাদি); প্রবিশন্তি (প্রবেশ করেন); যে (যাঁরা); অবিদ্যাম্ উপাসতে (অবিদ্যাকে উপাসনা করেন অর্থাৎ যন্ত্রের মতো যাগযজ্ঞ করেন); ততঃ ভূয়ঃ ইব (তা থেকে আরও বেশী); তমঃ (অন্ধকারে); [প্রবিশন্তি (প্রবেশ করেন)]; য উ (কিন্তু যিনি); বিদ্যায়াং রতাঃ (দেবদেবীর পূজা করেন)।

সরলার্থ: যাঁরা যান্ত্রিকভাবে যজ্ঞাদি কর্ম (অবিদ্যা) করেন তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কিন্তু যাঁরা শুধু দেবদেবীর উপাসনা করেন (বিদ্যা) তাঁরা আরো গভীরতর অন্ধকারে প্রবেশ করেন।

ব্যাখ্যা: ‘দৃষ্টিহীন অন্ধকার’ বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে অজ্ঞানতা। যাঁরা দেবদেবীর পূজা করেন তাঁরা আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কারণ তাঁরা তাদের উপাসনাদি কর্মের প্রতিদানে পুরস্কার কামনা করেন। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে এই ‘আমি’ এবং ‘আমার’ বোধ থাকে ততক্ষণ আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। যখন ‘আমি’, ‘আমার’ বলি তখন আমরা নিজেদের দেহ-মনের সঙ্গে এক করে ফেলি। এর দ্বারা নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ অর্থাৎ যা বিশুদ্ধচৈতন্য, যা সকলের আত্মা, সে বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ পায়। ‘আমি’, ‘আমার’ এ দুটি অজ্ঞানের লক্ষণ। অজ্ঞান ব্যক্তি ‘আমি অমুক’, ‘আমার সম্পত্তি’ এরকম কথা বলে থাকেন।

যে অজ্ঞান, তার মনে নানা বাসনা থাকে এবং এই বাসনা পূরণের জন্য তাকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। তাকে দেহধারণ করতেই হয়, নয়তো বাসনা পূরণ সম্ভব হয় না। কিন্তু যত সে বাসনা পূর্ণ করার চেষ্টা করে ততই বাসনাসমূহ তাকে পেয়ে বসে। অনন্তকাল ধরে এই ধারা চলতে থাকে। কিন্তু মানুষের মধ্যেই চিন্তা, যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি আছে। তাই সে শীঘ্রই উপলব্ধি করে যে, ভোগের পথে শান্তি নেই। সে তখন বুঝতে পারে যে, তাকে অন্য পথ অর্থাৎ ত্যাগের পথ অনুসরণ করতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত সে ত্যাগের সাধনা করে, ততক্ষণ অন্ধব্যক্তির মতো সে অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় ও দুঃখভোগ করে।

পৃথিবীতে দু-ধরনের মানুষ দেখা যায় যারা অন্ধকারে ঘুরে মরে। এক ধরনের মানুষ অবিদ্যার (অজ্ঞান) উপাসনা করে। অর্থাৎ তারা যান্ত্রিকভাবে নির্দিষ্ট যজ্ঞাদি কর্ম করে। কিন্তু কেন যে তারা এই কর্মানুষ্ঠান করে তা তারা নিজেরাও জানে না। সুতরাং তারা যে অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়ায় তাতে আর বিস্ময়ের কি? এই সত্য যদি তারা না বোঝে এবং বুঝেও সেভাবে না চলে তবে তাদের বিনাশ অনিবার্য। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তাদের আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে।

আর এক ধরনের মানুষ আছে যারা বিদ্যার উপাসনা করে; তাদের অবস্থা আরও খারাপ। ‘বিদ্যা’ শব্দের অর্থ সাধারণত জ্ঞান, কিন্তু এখানে দেবদেবীকে বোঝানো হয়েছে। কিছু মানুষ এই আশায় দেবদেবীর উপাসনা করে যে একদিন তারা দেবত্ব লাভ করবে এবং তাদের সব কামনা বাসনা পরিপূর্ণ হবে। কিন্তু এর দ্বারা তাদের মুক্তিলাভে আরও দেরী হয়। এই কারণেই উপনিষদ বলেন যে, তারা আরও গভীরতর অন্ধকারে নিমগ্ন হবে।

অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া অন্যদাহুরবিদ্যয়া।
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নন্তদ্বিচচক্ষিরে॥১০

অন্বয়: অন্যৎ (ভিন্ন [ফেল]); এব (-ই); আহুঃ (বলেন); বিদ্যয়া (দেবতা উপাসনার দ্বারা); অন্যৎ(ভিন্ন [ফল]); আহুঃ (বলেন); অবিদ্যয়া (যজ্ঞকর্মের দ্বারা); যে নঃ (যাঁরা আমাদেরকে); তৎ (তা); বিচচক্ষিরে (ব্যাখ্যা করেছেন); ইতি (এইরূপ); শুশ্রুম (আমরা শুনেছি); ধীরাণাম্ (জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিকট থেকে)।

সরলার্থ: পণ্ডিতেরা বলেন—অবিদ্যার পথ (অগ্নিহোত্র এবং অন্যান্য যজ্ঞকর্ম) এবং বিদ্যার পথ (দেবদেবীর উপাসনা) ভিন্ন ভিন্ন ফল উৎপন্ন করে। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এই কথা সমর্থন করেন।

ব্যাখ্যা: বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়ই আত্মজ্ঞান লাভের অন্তরায়, কিন্তু বিদ্যা অবিদ্যা অপেক্ষা নিকৃষ্ট। ‘বিদ্যা’ শব্দটি এখানে বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; এখানে এর অর্থ হল দেবদেবীর উপাসনা করা। দেবদেবীর উপাসনার দ্বারা মৃত্যুর পরে আমরা দেবলোকে যেতে পারি। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের কি লাভ হবে? বরং দেবলোকে অবস্থানের ফলে আমাদের সময় নষ্ট হবে। কারণ যদি দেবলোকে অবস্থান না করতাম তবে সেই সময়টুকুও আমরা আমাদের জীবনের যা লক্ষ্য—আত্মজ্ঞান লাভ, তা অর্জনের চেষ্টায় ব্যয় করতে পারতাম। দেবলোকে কিন্তু তা সম্ভব নয়। সেখানে আত্মজ্ঞান লাভের চেষ্টা আর থাকে না। ফলে এই বিদ্যার পথ মানুষকে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।

অবিদ্যা হচ্ছে কর্মকাণ্ড, সুতরাং আত্মজ্ঞান লাভের পথে এও একটা বাধা। কর্ম হল—অগ্নিহোত্র বা অন্যান্য যাগ করা। এই পথ আমাদের সোজাসুজি চিত্তশুদ্ধির দিকে নিয়ে যায় না। এ যেন অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়ানো। তবে বিদ্যার পথের মতো এই পথে সময় এবং শক্তি অপচয়ের তত বেশি মাশুল দিতে হয় না।

এক্ষেত্রে শঙ্করাচার্যের চূড়ান্ত নির্দেশ হল : কর্ম এবং উপাসনার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এই দুটি পথ একত্রিত হলে আমরা আত্মজ্ঞানের দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারব। কারণ এই সমন্বয় আমাদের চিত্তশুদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। এর ফলে ক্রমে আমাদের ভোগের প্রতি আসক্তি হ্রাস পাবে এবং ‘আমি’ ‘আমার’ বোধ মুছে যাবে। আচার্য শঙ্কর একেই ‘ক্রমমুক্তি’র পথ বলেছেন।

বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াঽমৃতমশ্নুতে॥১১

অন্বয়: যঃ (যিনি); বিদ্যাম্ (বিদ্যা); চ (এবং); অবিদ্যাম্ (অবিদ্যা); তৎ উভয়ং সহ (উভয়কে একত্রে); বেদ (জানেন); অবিদ্যয়া (অবিদ্যার দ্বারা); মৃত্যুম্ (মৃত্যুকে); তীর্ত্বা (অতিক্রম করে); বিদ্যয়া (বিদ্যার দ্বারা); অমৃতম্ (অমৃত); অশ্নুতে (লাভ করেন)।

সরলার্থ: যিনি দেবদেবীর উপাসনা করেন (বিদ্যা), আবার যাগযজ্ঞাদি কর্মও করেন (অবিদ্যা), তিনি যজ্ঞকর্মের দ্বারা (অবিদ্যা) অমরত্ব লাভ করেন এবং দেবদেবীর উপাসনার (বিদ্যা) দ্বারা আনন্দ লাভ করেন।

ব্যাখ্যা: উপাসনা এবং যজ্ঞকর্ম উভয়ক্ষেত্রেই শর্ত হল, মানুষকে এই কাজ করতে হবে নিষ্কাম ভাবে। তিনি কর্মের কোন ফল কামনা করবেন না। এমনকি স্বর্গলাভ হবে, এ কামনাও তিনি করবেন না।

আগেই বলা হয়েছে এখানে ‘বিদ্যা’ শব্দটিকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ দেবদেবীর উপাসনা করা। সেরকম অবিদ্যারও বিশেষ অর্থ আছে। তা হল কর্ম—অগ্নিহোত্র প্রভৃতি যজ্ঞকর্ম। এই কর্ম অবশ্যকরণীয়। কিন্তু যদি ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে এই কর্ম করা যায় তবে তার দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়। কর্ম এবং উপাসনার সমন্বয়ের দ্বারাই মানুষ ক্রমমুক্তি লাভ করে। যারা ত্যাগের জন্য নিজেদেরকে এখনও প্রস্তুত করতে পারেনি তাদের জন্য শঙ্করাচার্য এই পথের কথা বলেছেন।

কিন্তু ধরা যাক, দুটি পথ পৃথকভাবে গ্রহণ করা হল। অবিদ্যার পথে অগ্রসর হলে মানুষ মৃত্যুর পর পিতৃলোকে যাবে (যে লোকে তার পিতৃপুরুষরা গেছেন)। এই পিতৃলোক অন্ধকারের রাজ্য কারণ আত্মজ্ঞান থেকে এই জগৎ বহুদূরে। আত্মজ্ঞান লাভের জন্য তাকে এখনও অনেক অপেক্ষা করতে হবে। আর বিদ্যার (দেবদেবী) উপাসনা করলে মানুষ গভীরতর অন্ধকারের জগতে পৌঁছবে এবং আত্মজ্ঞান লাভে আরো দেরী হবে। কিন্তু এর কারণ কি?

মৃত্যুর পর মানুষ দেবলোক (স্বর্গলোক, সেখানে দেবদেবীদের বাস) গেলে সেখানকার সুখভোগে মত্ত হয়ে থাকে। পুণ্যকর্মের ফল নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সে থাকতে পারে। তারপর আবার তার মানুষরূপে জন্ম হয় এবং আগের বার যেখানে সংগ্রাম শেষ হয়েছিল ঠিক সেখান থেকেই নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হয়। এ জন্যই বিদ্যাকে নিকৃষ্টতর বলা হয়।

কিন্তু যদি এই দুই পথকে একই সঙ্গে গ্রহণ করা যায় অর্থাৎ কামনাশূন্য হয়ে যাগযজ্ঞাদি অবশ্য কর্ম এবং স্বর্গলাভের আশা ত্যাগ করে দেবতার উপাসনা করা যায়, তা হলে মোক্ষ এবং পরমানন্দ দুই-ই লাভ করা যায়। যাদের মন ত্যাগের জন্য এখনও প্রস্তুত নয় তাদের জন্য এই পথের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেঽসম্ভূতিমুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ॥১২

অন্বয়: যে অসম্ভূতিম্ (যাঁরা অব্যক্তকে); উপাসতে (উপাসনা করেন); অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি (অন্ধকার লোকে প্রবেশ করেন, যেখানে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে অন্ধ); যে সম্ভূত্যাং রতাঃ (যাঁরা ব্যক্তকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন); ততঃ ভূয়ঃ ইব তে তমঃ (তার ফলে তাঁরা যেন আরও বেশী অন্ধকারে); প্রবিশন্তি (প্রবেশ করেন)।

সরলার্থ: যাঁরা অব্যক্তকে (জগতের কারণ অবস্থা) উপাসনা করেন তাঁরা অন্ধের মতো অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কিন্তু যাঁরা ব্যক্তকে (অর্থাৎ চতুর্দিকের দৃশ্যজগৎ) উপাসনা করেন তাঁরা আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেন।

ব্যাখ্যা: অসম্ভূতি—অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত। সম্ভূতি—ব্যক্ত বা প্রকাশিত। ভারতীয় দর্শন সৃষ্টি তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। অর্থাৎ শূন্য থেকে ‘কিছু’ সৃষ্টি হয় একথা ভারতীয় দর্শন স্বীকার করে না। কার্য থাকলে অবশ্যই তার পূর্বে কারণ থাকবে। কারণ দেখা না গেলেও তার অস্তিত্ব কোন না কোন সময়ে থাকবেই। যেমন একটি বিশাল বটগাছ। কোথা থেকে এই গাছটির জন্ম হল? মাটির নীচে নিহিত কোন বীজ থেকে। বীজটিকে আমরা দেখতে পাই না কিন্তু নিশ্চয়ই বীজটি কোথাও না কোথাও ছিল। বীজ ছিল না, একথা বলা যায় না। পূর্বে গাছটি বীজরূপে অব্যক্তভাবে ছিল। এখন গাছ রূপে প্রকাশিত হল। আমাদের চারপাশে যা দেখি—গাছ, আকাশ, পর্বত, সমতল, নদী, অরণ্য, মানুষ, পশু—সব এককালে অব্যক্ত অবস্থায় অর্থাৎ অসম্ভূতির অংশ রূপে ছিল। ‘অসম্ভূতি’ এবং প্রকৃতি একই। এ এমন অবস্থা যখন সব শক্তিগুলি একে অপরের সঙ্গে সাম্য অবস্থায় থাকে। ভারতীয় দর্শন প্রধানত সত্ত্ব, রজ, তম—এই তিনটি শক্তির উল্লেখ করেছেন। যখন এই তিনটি শক্তি সাম্য অবস্থায় থাকে অর্থাৎ তিনটিই সমানভাবে থাকে, তখন কোন প্রকাশ থাকে না। তখনকার অবস্থা বর্ণনা করা কঠিন। এ এক অনির্দিষ্ট সত্তা—যেন তরঙ্গবিহীন সমুদ্র যা অনন্ত, এক ও অভেদ।

কিন্তু কোন ভাবে কোন একসময় এই সাম্য অবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। কেন ঘটে কেউ জানে না। সম্ভবত বস্তুর প্রকৃতিগত কারণেই এই বিক্ষেপের সৃষ্টি হয়। এখানেই ‘সম্ভূতি’ বা প্রকাশের সূত্রপাত। এক বহুতে পরিণত হয়। বহু একে নিহিত ছিল। এবারে তা প্রকাশ পেল। প্রথম প্রকাশকে বলা হয় হিরণ্যগর্ভ অথবা ‘প্রথমজাত’।

‘অসম্ভূতি’ বা ‘সম্ভূতি’—যারই উপাসনা করা যাক না কেন ফল কিন্তু একই। এ যেন অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়ানো। ‘অসম্ভূতি’ সম্পর্কে কিছু না জেনেও তাকে উপাসনা করা যায়। হয়তো ভয় থেকে অথবা কিছু পাওয়ার আশা করে এই উপাসনা করা হয়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই মানুষ অন্ধ, অসহায় এবং অজানা আশঙ্কায় ভীত।

‘সম্ভূতি’ বা ব্যক্ত জগতের উপাসনা আরও নিকৃষ্ট কারণ সেখানে এমন কিছু জিনিস আছে যা ভীতিপ্রদ, আবার এমনও আছে যা লোভনীয়। কিন্তু এর কোনটিই পরিণামে সুখের নয়। মানুষ এখানে অসহায় ক্রীতদাস মাত্র। এই অবস্থাকে বোঝাবার জন্যই বলা হয়েছে সম্ভূতির উপাসনা আমাদেরকে গভীরতর অন্ধকারে নিয়ে যায়।

কিন্তু বেদান্ত বলেন, বাইরে কিছু নয় সবই তোমার ভেতরে আছে। তোমার আত্মাই সর্বোচ্চ। বাইরের কোন বস্তুর দাসত্ব স্বীকার করলে কখনও সুখী হওয়া যায় না। নিজেকেই নিজের প্রভু হতে হবে, এই বেদান্তের বক্তব্য।

অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ।
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে॥১৩

অন্বয়: সম্ভবাৎ (ব্যক্তপ্রকৃতি থেকে, হিরণ্যগর্ভ থেকে); অন্যৎ এব (ভিন্ন [ফল]); আহুঃ (পণ্ডিতেরা বলেন); অসম্ভবাৎ (অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে); অন্যৎ (অন্য, অন্য প্রকার ফল); আহুঃ (পণ্ডিতেরা বলেন); ইতি (এই); শুশ্রুম.(আমরা শুনেছি); ধীরাণাম্ (জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে); যে (যাঁরা); নঃ (আমাদেরকে); তৎ (প্রকৃতি বা হিরণ্যগর্ভকে উপাসনার ফল); বিচচক্ষিরে (ব্যাখ্যা করেছেন)।

সরলার্থ: পণ্ডিতেরা বলেন সম্ভূতির (হিরণ্যগর্ভ) এবং অসম্ভূতির (প্রকৃতি) উপাসনা পৃথক পৃথক ফল দান করে। জ্ঞানীরা তা সমর্থন করেন।

ব্যাখ্যা: ব্যক্ত এবং অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনা করা যে নিরর্থক আচার্য শঙ্কর তা পূর্বেই বলেছেন। ব্যক্ত প্রকৃতিকে (হিরণ্যগর্ভ) উপাসনা করে আমরা বড় জোর কিছু অসামান্য শক্তি লাভ করতে পারি। প্রকৃতির কার্যকলাপ অতি বিস্ময়কর। প্রকৃতিকে উপাসনা করে প্রকৃতির অত্যাশ্চর্য বিভূতির কিছুটা হয়তো আমাদের মধ্যে আসতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনা করে আমরাও অব্যক্ত হয়ে যাই। অব্যক্ত প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যাই। হিন্দুদের বিশ্বাস, আমরা যার উপাসনা করি তাই হয়ে যাই।

সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বাঽসম্ভূত্যাঽমৃতমশ্নুতে॥১৪

অন্বয়: সম্ভূতিং চ বিনাশং চ (অব্যক্ত প্রকৃতি এবং ব্যক্ত প্রকৃতি [হিরণ্যগর্ভ]); যঃ তৎ উভয়ং সহ বেদ (যিনি উভয়কে জানেন); বিনাশেন (ব্যক্তের, হিরণ্যগর্ভের উপাসনার দ্বারা); মৃত্যুম্ (মৃত্যুকে); তীর্ত্বা (অতিক্রম করে); অসম্ভূত্যা (অব্যক্তের উপাসনার দ্বারা); অমৃতম্ (অমরত্ব); অশ্নুতে (লাভ করেন)।

সরলার্থ: যিনি অব্যক্তকে (অসম্ভূতি) এবং ব্যক্তকে (সম্ভূতি) একই সঙ্গে উপাসনা করেন তিনি অব্যক্তের উপাসনা দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করেন এবং ব্যক্তের উপাসনা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করেন।

ব্যাখ্যা: প্রথম ‘সম্ভূতি’কে ‘অসম্ভূতি’ বলে পাঠ করতে হবে—অর্থাৎ অব্যক্ত। ‘অ’ এখানে ছন্দের কারণে অনুক্ত। বিনাশ বা মৃত্যু হল হিরণ্যগর্ভ, যা সম্ভূতির প্রথম প্রকাশ। হিরণ্যগর্ভের নাম বিনাশ কারণ একসময় পুরোপুরি তার লয় হবে। যা ব্যক্ত তাই পুনরায় অব্যক্তে পরিণত হতে পারে।

পরমসত্য, ব্যক্ত এবং অব্যক্ত দুই-ই হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে সত্য এক এবং অদ্বিতীয়, তা ব্যক্ত বা অব্যক্ত যাই হোক না কেন। যদি আমরা আমাদের উপাসনা ব্যক্ত বা সম্ভূতি বা হিরণ্যগর্ভ দিয়ে শুরু করি, তবে আমরা কিছু অলৌকিক শক্তির অধিকারী হতে পারি। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে মানুষ কি না করতে পারে। মানুষ জীবনের অনেক সীমাবদ্ধতাকেই অতিক্রম করতে পারে, এমনকি মৃত্যুভয়কেও জয় করতে পারে। যদি আমরা হিরণ্যগর্ভের উপাসনা করি তাহলে আমরা তাঁর মতোই হয়ে যাব। হিরণ্যগর্ভ মৃত্যুর অধীন। কারণ যার উৎপত্তি আছে তার লয়ও আছে। এর থেকে আমরা শিক্ষা পাই মৃত্যুই শেষ নয়, এ একটা অবস্থান্তর মাত্র। যখন আমরা তা.হৃদয়ঙ্গম করি তখন আমাদের অমরত্ব সম্বন্ধে ধারণা হয় এবং আমরা মৃত্যুকে জয় করি।

অব্যক্তের উপাসনাতেও আমাদের অনুরাগী হতে হবে। যখন আমরা অব্যক্তকে ভালবাসতে শিখি তখন আমরা অব্যক্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। অব্যক্তই প্রকৃতি এবং প্রকৃতিই চিরন্তন। এভাবে আমরাও চিরন্তন হয়ে উঠি। সম্ভূতি, অসম্ভূতি উভয়ই আমাদের অমরত্বের বোধ এনে দিতে পারে, কিন্তু সেই অমরত্ব আপেক্ষিক। কেবলমাত্র আত্মজ্ঞান লাভ হলে মৃত্যুকে সম্পূর্ণ জয় করা সম্ভব হয়।

বিদ্যা, অবিদ্যা, সম্ভূতি, অসম্ভূতি—এ সবই অজ্ঞানতার এলাকার মধ্যে পড়ে।

এ সব আমাদের কিছুকালের জন্য মুক্তির স্বাদ দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু তা স্থায়ী মুক্তি নয়। আমরা তখনও কর্মপাশে আবদ্ধ।

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে॥১৫

অন্বয়: পূষন্ (হে সূর্য, জগতের ধারক); হিরণ্ময়েন পাত্রেণ (জ্যোতির্ময় পাত্রের দ্বারা); সত্যস্য মুখম্ (সত্যের মুখ); অপিহিতম্ (আবৃত); ত্বং তৎ (তুমি তা); অপাবৃণু (দয়া করে সরিয়ে দাও); সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে (যাতে সত্যের অনুসন্ধানী আমি তা দেখতে পাই)।

সরলার্থ: সত্যের মুখ উজ্জ্বল সোনার পাত্রের দ্বারা আবৃত। জীবন ও জগতের ধারক হে সূর্য, তুমি সেই আবরণটি দয়া করে সরিয়ে দাও যাতে সত্যজিজ্ঞাসু আমি, সত্যকে দর্শন করতে পারি।

ব্যাখ্যা: সূর্যকে এখানে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। সূর্য সবকিছুর ধারক। তিনি জীবন এবং যাবতীয় বস্তুর উৎস। সূর্য নিজে উজ্জ্বল এবং সূর্যের কিরণেই অন্য সব বস্তু আলোকিত হয়। তাঁর উজ্জ্বলতা আমাদের চোখে ধাঁধা লাগায়। উপনিষদ বলেছেন, সূর্যের অন্তরালে সত্য আছে এবং সেই সত্যই ব্রহ্ম। আমরা সবাই সেই সত্যকে, ব্রহ্মকে খুঁজে চলেছি। কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই না। কারণ সূর্যের আলো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সূর্য যেন একটি উজ্জ্বল সোনার পাত্র, সত্যকে আড়াল করে আছে। আমরা তাই সূর্যের কাছে প্রার্থনা করি তিনি সেই আড়ালটি সরিয়ে দিন, আমরা যাতে ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার লাভ করতে পারি অর্থাৎ সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সব বস্তু এভাবেই যেন এক সোনার পাত্রের দ্বারা ঢাকা। আর সেই জন্যই আমরা সেদিকে আকৃষ্ট হই। কিন্তু এই বস্তুসমূহ সত্য নয়, যদিও সত্য বলে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। যেমন অন্ধকার স্থানে দড়িকে সাপ বলে ভুল করি। যখন আলো আসে তখন দড়িকে দড়ি বলে চিনতে পারি। সেইরকম সত্যকে দেখার জন্যও আলোর প্রয়োজন। সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য দরকার বিবেকজ্ঞান অর্থাৎ বিচারবুদ্ধির। দৃশ্যমান জগৎ সত্য নয়; সত্য নয় এই অর্থে যে, তা সদা পরিবর্তনশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু সত্যের কখনও পরিবর্তন হয় না। সত্য ধ্রুব এবং অক্ষয়। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। ব্রহ্মই আত্মা, এই আত্মাই সর্বভূতের অন্তরাত্মা। অজ্ঞানতার জন্য আমরা ক্ষণস্থায়ী বস্তুকে চিরস্থায়ী মনে করে তাতে আসক্ত হই। অচিরেই যখন তার বিনাশ হয় তখন আমরা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আমরা এই যে ভুল করি তার কারণ এইসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু আমাদের কাছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বলে মনে হয়। মনে হয় বস্তুগুলি যেন সোনা দিয়ে মোড়া; কিন্তু আসলে তা সোনা নয়। তাই উপনিষদের ঐকান্তিক প্রার্থনা—যথার্থ সত্য আমাদের কাছে প্রকাশিত হোক, আমরা যেন অসার এবং ক্ষণস্থায়ী বস্তুর মোহে বিভ্রান্ত হয়ে বিপথে না চলি। সূর্যই আলো; আলোই জ্ঞান; জ্ঞানই সত্য; সত্যই জ্ঞান।

পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য
ব্যূহ রশ্মীন্ সমূহ তেজঃ।
যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি।
যোঽসাবসৌ পুরুষঃ সোঽহমস্মি॥১৬

অন্বয়: পূষন্ (হে পূষন্, হে সূর্য, হে জগতের পালক); একর্ষে (একাকী বিচরণকারী); যম (হে যম, হে সর্বনিয়ন্তা); সূর্য (হে সূর্য); প্রাজাপত্য (হে প্রজাপতির পুত্র); রশ্মিন্ ব্যূহ (কিরণ সংবরণ কর); সমূহ তেজঃ (তোমার তেজ সংবরণ কর); যৎ তে (যাতে তোমার); কল্যাণতমং রূপম্ (কল্যাণতম রূপ); তৎ পশ্যামি (তা আমি দেখতে পাই); যঃ (যিনি); অসৌ (আদিত্য মণ্ডলে); অসৌ পুরুষ (ঐ পুরুষ); সঃ অহম্ অস্মি (তিনিই আমি)।

সরলার্থ: হে পষন্, হে নিঃসঙ্গ পথচারী, হে সর্বনিয়ন্তা, হে প্রজাপতি-নন্দন সূর্য, অনুগ্রহ করে তুমি তোমার কিরণরাশি সংহত কর। তোমার তেজ সংবরণ কর। আমি তোমার কল্যাণতম রূপটি দেখতে চাই। তোমার মধ্যে সেই পুরুষ রয়েছেন; আমিই সেই পুরুষ।

ব্যাখ্যা: সূর্য জগতের পালক এবং নিঃসঙ্গ পথচারী অর্থাৎ স্বনির্ভর। তিনি যম নামেও পরিচিত, কারণ তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রজাপতি সব প্রাণীর প্রভু এবং সূর্য প্রজাপতির পুত্র। সূর্য জগতের সর্বত্র আলো দেন। এখানে সূর্যকে তাঁর কিরণ কিছুটা সংবরণ করার জন্য প্রার্থনা জানানো হচ্ছে : তুমি আমার দৃষ্টির পক্ষে অতি উজ্জ্বল। অনুগ্রহ করে তোমার উজ্জ্বল জ্যোতি আমার প্রয়োজনে কিঞ্চিৎ ম্লান করো। আমি তোমাকে কল্যাণতম রূপে দেখতে চাই। আমি ভিক্ষা প্রার্থনা করছি না। তার প্রয়োজন নেই। কারণ আমি অনুভব করি যিনি তোমার রাজ্যের অধিপতি তিনিই আবার আমি।

সূর্য ব্রহ্মেরই প্রতীক। প্রথমে সূর্যকে দেবতারূপে উপাসনা করা হয়। তার ফলে তাঁর শক্তি এবং সৌন্দর্যে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। তার থেকেই আকাঙ্ক্ষা জাগে—সেই শক্তি এবং সৌন্দর্যের কিঞ্চিৎ যেন আমরা অর্জন করতে পারি। পরে আস্তে আস্তে উপলব্ধি করি যে, তিনি এবং আমি এক। এই উপলব্ধি বহু বৎসরের সংযম, ত্যাগ এবং ধ্যানের ফলেই সম্ভব হয়।

বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।
ওঁ ক্ৰতো স্মর কৃতং স্মর ক্রতো স্মর কৃতং স্মর॥১৭

অন্বয়: [আমার মৃত্যু আসন্ন] অথ (সেই হেতু); বায়ুঃ ([আমার] প্ৰাণবায়ু); অমৃতম্ অনিলম্ (মহাবায়ুতে মিলিত হোক); ইদং শরীরম্ (আমার এই স্থূল শরীর); ভস্মান্তম্ (ভস্মীভূত হোক); ওম্ (ব্রহ্মকে স্মরণ করা হচ্ছে); ক্রতো (হে আমার মন); স্মর ([স্মরণীয়কে] স্মরণ কর); কৃতং স্মর (জীবনে যা কিছু করেছ তা স্মরণ কর); ক্ৰতো স্মর কৃতং স্মর (পুনঃ পুনঃ স্মরণার্থে)।

সরলার্থ: এখন সেই মৃত্যু আসন্নপ্রায়। আমার প্রার্থনা যেন আমার প্রাণবায়ু বিশ্বপ্রাণে বিলীন হয়। যেন আমার দেহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। হে মন, সারা জীবনে তুমি যা কিছু করেছ তা চিন্তা কর। নিজের কৃতকর্ম স্মরণ কর।

ব্যাখ্যা: মৃত্যু আসন্ন হলে অনেক চিন্তা আমাদের মনে এসে ভিড় করে। আমরা সারা জীবন যেভাবে কাটিয়েছি সেই অনুরূপ চিন্তাই আমাদের মনে জাগে। আমাদের সেই সময় বিশেষ ভাবে চেষ্টা করা উচিত যাতে কেবল শুভ চিন্তাই আমরা করতে পারি। আমরা যা চিন্তা করি তাই হয়ে যাই। আমাদের চিন্তাই আমাদের সৃষ্টি করে। এই কারণেই বারবার চেষ্টা করতে হয় যাতে মন শুধু ভাল চিন্তাই করে। আর এইজন্যই আত্মীয়-পরিজনও মৃত্যুর সময়ে বিশেষ প্রার্থনা করে থাকেন।

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্
বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্।
যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো
ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম॥১৮

অন্বয়: অগ্নে (হে অগ্নি); রায়ে (শুভ কর্মফল লাভের উদ্দেশ্যে); অস্মান্ সুপথা (আমাদেরকে সুপথে); নয় (নিয়ে যাও); বিশ্বানি বয়ুনানি (সকল কর্ম এবং চিত্তবৃত্তি); বিদ্বান্ ([আপনি] জানেন); অস্মৎ (আমাদের কাছ থেকে); জুহুরাণম্ এনঃ (সকল অশুভ কর্মের ফল); যুযোধি (দূর করুন); তে (আপনাকে); ভূয়িষ্ঠাম্ (বার বার); নমঃ নমস্কার); উক্তিম্ (বচন); বিধেম (উচ্চারণ করি)।

সরলার্থ: হে অগ্নি, যা র্হিতকর তা লাভের জন্য অনুগ্রহ করে আমাদের সুপথে চালিত কর। হে দেব, আমাদের সব কৃতকর্ম এবং চিন্তা তুমি জান। আমাদের মধ্যে যা কিছু অশুভ, অনুগ্রহ করে তা দূর কর। আমরা তোমাকে বারবার প্রণাম করি।

ব্যাখ্যা: অগ্নির কাছে আমাদের এই প্রার্থনা, যাতে তিনি আমাদের ব্রহ্মের দিকে চালিত করেন। মৃত্যুকালে স্থূল শরীর আগুনে পুড়ে যায়, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর থাকে। সূক্ষ্ম শরীর সতেরটি অংশের সমষ্টি পাঁচটি প্রাণবায়ু, পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধি। এইসবই জড় কিন্তু অতি সূক্ষ্মরূপে থাকে। আমাদের সব কর্ম এবং চিন্তার ছাপ মনে থেকে যায়।

মৃত্যুকালে জীবাত্মা স্থূলদেহ ত্যাগ করে, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীরে থাকে। যার যেমন কর্মফল সেই অনুযায়ী আত্মা পিতৃলোকে বা দেবলোকে যায়। সেখানে সে কতকাল থাকবে তাও আমাদের কর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তারপরে আত্মা পুনরায় এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে, কেননা তখনও তার বাসনার নিবৃত্তি হয়নি।

এইভাবে জন্মমৃত্যুর মধ্যে আত্মার আসা যাওয়া চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে এই যাতায়াতের অসারতা বুঝতে পারে। তখন মানুষ ত্যাগের পথ অনুসরণ করে। একমাত্র ত্যাগের পথেই মানুষের মুক্তি। তখন জীবাত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যান।

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *