৪. জাহিনের ঘুম ভেঙে যায়

জাহিনের ঘুম ভেঙে যায় কান্নার শব্দে।

কে যেন বাইরে করুণ সুরে কাঁদে। নারী নাকি পুরুষ! নাকি শিশু? এটা কি চপলের মোবাইল ফোনের রিংটোন? চপলের রিংটোনে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় বটে, তবে এই কান্না আর ওই কান্নার শব্দ এক নয়। চপল কই?

চপল আর জাহিন এক রুমে পাশাপাশি সিঙ্গেল বেডে ঘুমায়। জাহিন ভয় পায় বলে ঘরটা পুরো অন্ধকার নয়। এক কোণে একটা বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় জাহিন পাশের বিছানার দিকে তাকায়। চপল কই?

এই চপল। এই…তুই কই? বাথরুমে?

না তো। বাথরুমের দরজা খোলা। ভেতরটা অন্ধকার।

ঘরে কেউ নেই। সে দরজার দিকে তাকায়। দরজা খোলা। চপল কই গেছে? এই ছেলেটাকে নিয়ে এত মুশকিল। খালি দুষ্টুমি বুদ্ধি আঁটে। মানুষকে চমকে দিতে চায়। ভড়কে দিতে চায়। এই সব করেই সে আনন্দ পায়।

হঠাৎই বাইরে পায়ের শব্দ। একটা ধপাস আওয়াজ। কেউ কাউকে আঘাত করল। একটা আর্তনাদ। কারও পড়ে যাওয়ার শব্দ। কারও দৌড়ানোর। তারপর নীরবতা।

জাহিন ভয় পাচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে, ডাক্তার নাজনিন বলে গেছেন, ভয় পাবেন না। আপনার বন্ধুরা আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য অনেক কিছু আয়োজন করেছেন। অনেক কিছু ঢাকা থেকে এনেছেন।

তার মানে আবারও চপল তাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। না, সে ভয় পাবে না।

কিন্তু ভয় তো লাগছেই। দরজাটা খোলা। এই খোলা দুয়ার দিয়ে যে কেউ তার ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। চোর-ডাকাত। ভূত-প্রেত। বাঘ-ভালুক।

সে ওঠে। সুইচ টিপে দুটো বাতি জ্বালায়।

ঘরটা আলোয় আলোয় ভরে ওঠে।

সে আস্তে আস্তে বারান্দায় যায়। পাশের ঘরটা স্বাধীনের। স্বাধীন কি ঘরে আছে? নাকি সেও বেরিয়ে গেছে চপলের সঙ্গে? নাকি তারা দুজনেই এই ঘরে বসে কোনো ষড়যন্ত্র করছে?

সে স্বাধীনের দরজায় নক করে। স্বাধীন স্বাধীন।

স্বাধীন ঘুম থেকে জাগে। কে? সে ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলে।

আমি জাহিন। দোস্ত, দরজাটা একটু খোল।

স্বাধীন দরজা খোলে, কী হয়েছে?

চপল কই?

তোর ঘরে।

না ঘরে নাই।

তাহলে।

জানি না। বাইরে কিসের যেন শব্দ হলো। মনে হলো, কেউ কাউকে আঘাত করল। আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি, চপল নাই।

স্বাধীন বলল, এই চপলটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। চল তো দেখি। সে চপ্পলে পা গলিয়ে টর্চলাইট তুলে নিয়ে বেরোল ঘর থেকে। জাহিনদের ঘরে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারল। বাথরুম চেক করল।

তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল, চপল চপল।

কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই।

তারা দুজন বাইরের বারান্দায় এল। এখান থেকে গেস্টহাউসটার আঙিনা দেখা যায়।

দেখল, আঙিনায় কে যেন পড়ে আছে।

তারা দুজনে দৌড়ে গেল মানবশরীরটার কাছে।

স্বাধীন টর্চের আলো ফেলল তার মুখে। এ তো চপলই।

তারা দুজনে মিলে চপলের শরীরটা ধরে টেনে নিয়ে এল ঘরে।

স্বাধীন গ্লাসে করে পানি এনে ছিটা দিতে লাগল চপলের মুখে।

খানিক পরে চপল চোখ মেলে তাকাল।

স্বাধীন বলল, এখন একটু ভালো লাগছে?

চপল বলল, আমি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম?

স্বাধীন বলল, হ্যাঁ। বাইরের লনে পড়ে ছিলি। ভাগ্যিস জাহিন সাহস করে আমাকে ডেকে তুলেছিল।

বাইরে গিয়েছিলি কেন?

চপল উঠে বসল। বলল, ঘাড়ে মেরেছে। ব্যাটা মনে হচ্ছে প্রশিক্ষিত। এক মারেই আমাকে কুপোকাত করে ফেলল।

জাহিন বলল, ব্যাটাটা কে?

চপল বলল, জানি না। বাগানবাড়িটা তো সত্যি রহস্যজনক হয়ে উঠল।

স্বাধীন বলল, কথা বলিস না। শুয়ে থাক। রেস্ট নে। খুব ব্যথা করছে ঘাড়ে? ডাক্তার নাজনিনকে ডাকতে যাব?

চপল বলল, তোর খুব ইচ্ছা করছে ডাক্তার নাজনিনের কাছে যেতে, তা বুঝতে পারছি। কিন্তু দরকার হবে না। আমি ঠিক আছি। কিন্তু আমাকে কে অ্যাটাক করল? এটা তো জানা দরকার।

স্বাধীন বলল, এখন ঘুমাই। কালকে রহস্যের কিনারা করা যাবে। কী বলিস?

জাহিন বলল, সেই ভালো। স্বাধীন, তুইও আমাদের ঘরে চলে আয়। আমরা ডাবলিং করি। তিনজনে একসঙ্গে থাকলে ভয় কম লাগবে।

স্বাধীন বলল, আচ্ছা আমি বালিশ নিয়ে আসছি।

*

রাতে চপলের ভালো করে ঘুম হলো না। ঘাড়ে ব্যথা করছে। সেটাও খুব বড় কথা নয়? তাকে আঘাতটা কে করল? এর আগে পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, সবটাই ঘটেছে তার জানাশোনার ভেতরে। তার পরিকল্পনামাফিক। শুধু ওই ইংরেজি-বলা ভিক্ষুকটিকে সে চেনে না। নয়তো, সবটাই তো সাজানো। এই যে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল, ঢিল পড়ল, শিশুকণ্ঠে কান্নার আওয়াজ, বড় বড় ভূতের ছায়া—এসবই সে আর কাদের মিলে আয়োজন করেছে। স্বাধীনও সহযোগিতা করেছে।

কিন্তু কাল দুপুরে জানালার কাছে এসেছিল কে?

আর আজ রাতে কান্নার আওয়াজটাই বা এল কোত্থেকে? আর তাকে আঘাত করে বসল কে?

ভাবতে ভাবতে চপল একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল নারীকণ্ঠের গানের আওয়াজে।

আনন্দধারা বহিছে ভুবনে…

আধো ঘুমে, আধো জাগরণে চপল ভাবতে লাগল, কে গান গায়?

শিশির?

একটু পরে সে বুঝতে পারল, পাশের ঘরে কেউ গান বাজাচ্ছে।

গানটা খালি গলায় হচ্ছে। কোনোরকমের মিউজিক ছাড়া।

চপল উঠে পড়ল বিছানা থেকে। পাশের বেডে জাহিন আর স্বাধীন বিভোর হয়ে ঘুমুচ্ছে। সে বলল, এই তোরা ওঠ।

জাহিন আর স্বাধীনেরও ঘুম ভেঙে গেল।

চপল বলল, কী সুন্দর গান বাজছে। মন দিয়ে শোন গানের কথাগুলো। এই গানটা শুনলে আমার ভেতরটা যেন কেমন করে ওঠে।

তারা কান পেতে গানের কথা শুনতে লাগল:

‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে\
পান করে রবি শশী অঞ্জলি ভরিয়া—
সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি—
নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে\
বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,
স্বার্থনিমগন কী কারণে?
চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারী,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে\’

গান শেষ হলে চপল বলল, গানের কথা সুন্দর না। চারদিকে কত আলো, কত আনন্দ, কত সৌন্দর্য, এর মধ্যে আপনমনে নিজের ক্ষুদ্র দুঃখ নিয়ে বসে থাকলে চলবে? ওঠ ওঠ।

জাহিন বলল, শিশির কি পাশের ঘরে এই গান গাইছে নাকি?

চপল বলল, আমার মনে হয়, গানটা সিডি প্লেয়ারে বা মোবাইল ফোনে বাজছে।

স্বাধীন বলল, এই গান শুনে আমার মনটাও যেন কেমন কেমন করছে।

চপল বলল, কেমন কেমনটা কেমন?

স্বাধীন বলল, ওই যে গানের মধ্যে আছে না লাইনটা, ‘প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে’, ওই লাইনটা শুনে নিজের জীবনটাকে মনে হচ্ছে একটা বিশাল শূন্য।

চপল হাসতে লাগল হো হো করে।

কাল রাতে সে যে মার খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল বাইরে খোলা আকাশের নিচে, তাকে দেখে কে বলবে?

জাহিন হাতমুখ ধুয়ে গেল শিশিরের ঘরের দিকে। ভেতর থেকে একটার পর একটা রবীন্দ্রসংগীতের ধ্বনি ভেসে আসছে।

বাইরে থেকে দরজা বন্ধ, কিছুই করার নেই। সে আবার ফিরে এল বন্ধুদের কাছে।

তারপর সবাই মিলে বসল নাশতার টেবিলে।

কেয়ারটেকার আর তার সহকারী নাশতার টেবিল সাজাচ্ছে।

ব্রেড, বাটার, জ্যাম-জেলি। ডিম পোচ। চা।

দাদিকে সঙ্গে নিয়ে শিশিরও এল। তবে একটু দেরিতে। জাহিন উসখুস করছিল। শিশিরকে দেখে তার মুখটা একটা প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠল।

সে বলল, সকালবেলা খুব সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছিল আপনাদের রুম থেকে। আমি তো ভেবেছিলাম শিশির নিজেই গাইছেন।

শিশির বলল, হ্যাঁ গাইছিলাম তো!

জাহিন মুগ্ধ ও বিস্মিত। আপনি গাইছিলেন? দ্যাখ চপল, গানগুলো শিশিরই গাইছিলেন। চপল ভেবেছিল, সিডি প্লেয়ারে বাজছে।

শিশির বলল, সিডি প্লেয়ারেই বাজছিল।

জাহিন বলল, আপনি না বললেন আপনি গাইছিলেন?

শিশির বলল, আমি গাইছিলাম। আর সিডি প্লেয়ারেই সেসব বাজছিল।

জাহিন চোখে-মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে বলল, কথাটার মানে বুঝলাম না। রসিকতা করছেন বোধ হয়। সেটাও ধরতে পারছি না।

শিশির বলল, না না। রসিকতা না। আমি কতগুলো রবীন্দ্রসংগীত খালি গলায় রেকর্ড করে রেখেছিলাম। সকালবেলা তা-ই বাজাচ্ছিলাম।

জাহিন এবার অভিভূত। বলল, বাহ্! বাহ্! কী সুন্দর গলা! আর কী সুন্দর গায়কি। আমরা সবাই আপনার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছি। আজ রাতে আপনার রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসাব, আপনি যদি রাজি থাকেন।

স্বাধীন বলল, শ্রোতা হিসেবে আমাদের ডাক্তার আপাকেও ডাকা যেতে পারে। তিনি যদি রাজি থাকেন।

চপল বলল, দাদি, আমরা তিন বন্ধু। এর মধ্যে জাহিন দেখা যাচ্ছে আপনার নাতনির রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। তার ওপর সে বোটানির ছাত্র। গাছপালা চেনে। আপনার নাতনিও দেখা যাচ্ছে বৃক্ষপ্রেমিক। ভালোই মিলেছে। এই দিকে এক ডাক্তার আপাকে পাওয়া গেছে। আমার আরেক বন্ধু স্বাধীন তাকে আনা-নেওয়া করার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। শুধু আমারই এই সব বিষয়ে কোনো আগ্রহ নাই।

শিশির বলল, আপনার তো ভূত-পেতনির ব্যাপারে আগ্রহ। কী করে মানুষকে ভয় দেখানো যায়, এই নিয়ে আপনি গবেষণা করছেন। চিন্তা করবেন না। আপনার কপালে একটা পেতনি ঠিকই জুটে যাবে।

দাদি বললেন, এখানে আমরা আছিই পাঁচজন। শিশির আর জাহিন বোটানি নিয়ে কথা বলুক। স্বাধীনের আগ্রহ থাকুক ডাক্তারি নিয়ে। আমি তো আসলে একটা জিন্দা লাশ। আমি তোমার সঙ্গে আছি, চপল। চলো, আমরা দুজন আজকে জঙ্গল দেখতে বের হই। ভেতরে নাকি একটা ঝরনা আছে, সেই ঝরনার ধারে দুজনে বেড়িয়ে আসি।

দাদি এমন গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলল যে, তার কথা শেষ হলে সবাই হেসে উঠল খিলখিল করে।

স্বাধীন চা খেতে খেতে একটা আইডিয়া বের করে ফেলে। চপল তো সবাইকে বোকা বানায়, এবার সে চপলকেই খানিকটা বোকা বানাবে। সে ডাকে জাহিনকে।

জাহিন, জাহিন, শোন, এদিকে আয়। আয়, চপলকে বোকা বানাই।

জাহিন বারান্দার চেয়ারে বসে উঠোনের একটা কাঠবিড়ালির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, কী রকম?

স্বাধীন বলে, আমি ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অভিনয় করব। তুই কেবল জানবি যে আমি অজ্ঞান হয়ে যাইনি। এই যে ডাক্তার নাজনিনের মোবাইল ফোনের নম্বর। তুই ডাক্তার নাজনিনকে ডেকে আনবি।

তারপর?

ডাক্তার নাজনিন আমার হাতে-পায়ে গরম তেল মেখে দেবেন।

বাহ্। তাতে চপল বোকা বনবে কেন?

আরে চপল ভাববে, আমি সত্যিকারের অজ্ঞান হয়েছি। আমার পায়ে যতই তেল মাখুক, আমি তো আর জাগব না।

তখন চপল খুব ভয় পেয়ে যাবে। তখনই আমি হাসতে হাসতে উঠে বসব।

নট আ ব্যাড আইডিয়া, জাহিন বলে।

স্বাধীন আর জাহিন বসেছিল বারান্দায়। চপল গোসল সেরে বাইরে বেরিয়েছে। একা একা গান গাইছে। হঠাৎই স্বাধীন চিৎকার করে উঠল, ওরে বাবারে ওটা কী রে!

তারপর ধপাস করে পড়ে গেল বাইরের বেতের চেয়ারের ওপারে। সেখান থেকে শব্দ করে পড়ে গেল কাঠের মেঝেতে। শব্দটা একটু বেশিই জোরে হলো।

জাহিন নিজেই ভড়কে গেছে। এটা যে অভিনয়, সেটা সে ভুলেই গেছে। সে আর্তনাদ করে উঠল। তার বুক ধড়াস ধড়াস করে কাঁপছে।

তার চিৎকার শুনে দৌড়ে এল চপল। এই, কী হয়েছে?

জাহিন কথা বলতে পারছে না। ভয়ে তার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে আছে। শুধু ডান হাতের তর্জনী দিয়ে সে দেখিয়ে দিল স্বাধীনকে। স্বাধীন মেঝেতে পড়ে আছে চিত হয়ে। মুখটা একদিকে কাত করা। মুখের কোনায় ফেনা।

চপল বলল, এ তো যন্ত্রণা হলো। তুই দুবার জ্ঞান হারালি। আমি একবার। স্বাধীনটা বাকি ছিল। সেও হারাল। তাও এই দিনের বেলা। ধর। ওকে বড় সোফাটায় আগে শোয়াই।

জাহিন আর চপল মিলে ধরে স্বাধীনকে একটা লম্বা সোফায় শুইয়ে দিল।

কেয়ারটেকার দৌড়ে এসেছেন। চপল বলল, কামাল ভাই, একটু তেল গরম করে আনেন তো! ডাক্তার নাজনিনের চিকিৎসাপদ্ধতি অ্যাপ্লাই করি।

কেয়ারটেকার দৌড় ধরল রান্নাঘরের দিকে। চুলায় তেল গরম করতে।

চপল বলল, জাহিন, যা পানি নিয়ে আয় এক গ্লাস। ওর চোখে-মুখে পানি ছিটাই।

স্বাধীন চোখ বন্ধ করে আছে। অজ্ঞানের অভিনয় করা বড়ই কঠিন। পায়ের কাছটা চুলকাচ্ছে। কিন্তু সে সেখানে চুলকাতে পারছে না।

চপল তার চোখে-মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে। পানির ছিটা সহ্য করাও কঠিন। তার নাক ভ্রু কুঁচকে আসছে পানির ছিটায়। কিন্তু তার মুখও স্বাভাবিক রাখতে হচ্ছে।

সে মনে মনে রেগে যাচ্ছে জাহিনের ওপরে। জাহিনের কর্তব্য ডাক্তার নাজনিনকে ফোন করে ডেকে আনা। বদমাশটা সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে। আরে তুই যখন জ্ঞান হারালি, তখন তোর জন্য কি আমি ডাক্তার ডাকতে ছুটে যাইনি? অকৃতজ্ঞ পামর কোথাকার! তোর চিকিৎসা করল ডাক্তার নাজনিন, আর আমার চিকিৎসা করছে চপল। এই কি কথা ছিল?

গরম তেল এসে গেছে। কেয়ারটেকার নিয়ে এসেছেন।

চপল বলল, কামাল ভাই, আপনি একটু ওর পায়ে তেলটা মেখে দিন না!

স্বাধীন প্রমাদ গুনল। এই ছিল তার কপালে। একেই বলে অদৃষ্ট। জাহিন যখন অজ্ঞান হলো, তখন তার হাতে-পায়ে তেল মেখে দিল একজন তরুণী। আর সে যখন অজ্ঞান হওয়ার ভান করছে, তখন কিনা কেয়ারটেকারের রান্না করা পোড়া খসখসে হাতের ওপরে পড়ল সেই ভার। সে কি এখনই উঠে জাহিনকে একটা গদ্দা মারবে ঘাড়ে?

কেয়ারটেকার পায়ে গরম সরষের তেল মেখেই চলেছেন। এমন জোরে জোরে ঘষা দিচ্ছেন যেন স্বাধীনের পা ক্ষয়ে যাবে। হাত তো নয়, যেন সিরিঞ্জ কাগজ।

যতই মাখো না কেন বাবা, আমি উঠছি না। ডাক্তার নাজনিনের প্রশিক্ষিত হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বাধীন জাগবেই না।

চপল বলল, দুশ্চিন্তার মধ্যেই তো পড়া গেল। এর জ্ঞান তো ফিরছে না!

তখন হুঁশ হলো জাহিনের। আরে তাই তো। তার তো ডাক্তার নাজনিনকে ডেকে আনার কথা!

সে মোবাইল ফোন তুলে কল করল নাজনিনের নম্বরে।

হ্যালো, ডাক্তার নাজনিন বলছেন, আমরা ওই গেস্টহাউস থেকে। আমাদের বন্ধু স্বাধীন সেন্সলেস হয়ে গেছে। আপনি একটু আসবেন। প্লিজ প্লিজ…

আচ্ছা আসছি, নাজনিনের কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হলো জাহিন।

ডাক্তার নাজনিন এলেন।

চপল বলল, বড়ই টেনশন হচ্ছে। চোখে-মুখে পানি দিয়েছি। হাতে-পায়ে সরষের তেল মাখা হয়েছে। তবু তো ওর জ্ঞান ফিরছে না।

নাজনিন বললেন, আচ্ছা। আরেকটা উপায় আছে। কারও নোংরা মোজা আছে? দুর্গন্ধওয়ালা!

চপল বলল, আমার কালকের মোজা তো ধোয়া হয়নি। ওতে চলবে।

নাজনিন বললেন, চলতে পারে। বা জুতার সুকতলি। সেটা শুকানো যেতে পারে।

চপল মহা-উৎসাহে ছুটল নিজের জুতার মোজা আনতে।

কাদের মৃধাকেও দেখা গেল তার স্যান্ডেল হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে। কাদের বলল, আমার স্যান্ডেলের মতো বদ গন্ধ আর কারও স্যান্ডেলেই হইত না। এইটা নাকে ধরলে মিরগি রুগী খাড়া হইবই।

চপল এল তার আধোয়া মোজা নিয়ে। কাদের এল তার স্যান্ডেল নিয়ে।

এই সব এখন ধরা হবে স্বাধীনের নাকে। এই গন্ধ শুঁকলে নাকি মৃগী রোগী জাগবেই।

স্বাধীন প্রমাদ গুনল। এই ছিল তার কপালে? বড় আশা করে সে জ্ঞান হারানোর অভিনয়ে নেমেছিল। নাজনিন তার হাতে-পায়ে তেল ডলে দেবে! মানুষ আশা করে এক আর হয় আরেক।

কাদেরের স্যান্ডেল তার মুখের সামনে।

সে ওয়াক করে উঠল।

তারপর আর অভিনয় করার মানে হয় না।

চপল তার নাকের সামনে মোজা ধরতেই সে তার গালে কষে মারল এক চড়।

হারামজাদা, জাহিন অজ্ঞান হলে ডাক্তার আপাকে দিয়ে সেবা করো আর আমি অজ্ঞান হলে নাকের কাছে গন্ধওয়ালা মোজা ধরো না?

চপল এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে এর সবই ছিল অভিনয়। সে হা হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, ডাক্তার নাজনিন, আপনার পেশেন্ট আপনার শুশ্রূষা চায়। হা হা হা…

নাজনিন ব্যাপারটা খানিকটা বুঝলেন বলেই মনে হলো। তাদের শিক্ষকেরা ক্লাসে নানা ধরনের রোগীর নানা ধরনের আবদার-যন্ত্রণা-মানসিকতা নিয়ে অনেক গল্প করেছেন। এর মধ্যে একটা কথা হলো, ডাক্তার নারী হলে পুরুষ রোগী অনেক সময় বানিয়ে বানিয়ে রোগের গল্প শোনায়। বারবার আসে।

নাজনিন বললেন, স্বাধীন সাহেবের তো মনে হচ্ছে জটিল অসুখ। তাঁকে একটা ইনজেকশন দিতে হবে। নিডলটা একটু মোটা। এখানে আবার চিকন সুচ পাওয়া যায় না। গরু-ছাগলকে ইনজেকশন দেবার একটা সিরিঞ্জ পাওয়া গেছে। স্বাধীন সাহেব, আপনাকে ওই ইনজেকশনটাই এখন দেওয়া হবে।

স্বাধীন বলে, আরে আমার কিছু হয় নাই। চপলকে একটু ঘাবড়ে দিলাম আরকি! ও সবাইকে ভয় দেখায়। এবার আমরা ওকে একটু বোকা বানালাম। আপনি এসেছেন। আপনাকে দেখেই আমার সব রোগ সেরে গেছে। আপনি বসেন। আপনাকে এক কাপ কফি বানিয়ে খাওয়াই। আমি একেবারে কাপাচিনো বানিয়ে খাওয়াব আপনাকে। এখানকার খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে। আমি ঢাকা থেকে সব উপকরণ নিয়ে এসেছি।

আচ্ছা খাওয়ান দেখি আপনার কাপাচিনো।

এর মধ্যে দাদি আর শিশিরও এসে গেছে বারান্দায়। স্বাধীন কফি বানাচ্ছে। দুধ দিয়ে ভালো করে ঘুঁটা দিয়ে তার ওপরে চকলেটের গুঁড়া ছিটিয়ে সে বানাল কাপাচিনো।

মোট ছয় কাপ।

সেই কাপে চুমুক দিয়ে নাজনিন সত্যি বিমোহিত—উম্ম্, দারুণ!

চপল বলল, স্বাধীন। তুই তো দারুণ কফি বানানো শিখে গেছিস। তবে তোর এই প্রতিভা এত দিন চাপা দেওয়াই ছিল। আজকে জুতার আর মোজার গন্ধে সেটা জেগে উঠেছে। এর পর থেকে তোকে দুবেলা জুতা শোঁকানো হবে।

স্বাধীন ওয়াক করে উঠল।

কিন্তু ঘটনা নিরীহ হাসিঠাট্টার মধ্যে সীমিত রইল না।

সন্ধ্যার সময়ে রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসেছে।

উঠোনের এক কোণে বারবিকিউ হচ্ছে। আগুন জ্বলছে। বেশ আরামদায়ক ঠান্ডা।

আরেক পাশে গার্ডেন চেয়ার নিয়ে বসে আছে সবাই।

গোল হয়ে।

শিশির রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করল।

‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে…’

জাহিনের মনে হতে লাগল, এই গান যেন শিশির তার উদ্দেশেই গাইছে।

‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে

ও বন্ধু আমার!

না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে\’

গানের শেষে দাদি বললেন, রবীন্দ্রনাথের গানের সব সময় একাধিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। সব বড় কবি সাহিত্যিকদের বেলাতেই এটা সত্য। তাঁরা যা লেখেন, তাকে একেকজন একেকভাবে দেখতে পারে। বুঝতে পারে। যেমন এই গানটা শুনলে মনে হয় এটা প্রেমের গান। কিন্তু এইটাকে আবার পূজার গানও ধরা যায়। এটা হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের উদ্দেশে গেয়েছেন।

জাহিন মনে মনে বলল, চাবি ভেঙে ঘর থেকে বের করে নেবার কথা রবীন্দ্রনাথ কেন ঈশ্বরকে বলতে যাবেন। এটা নিশ্চয়ই শিশির আমার উদ্দেশেই বলছে।

শিশির গান গেয়েই যাচ্ছে একের পর এক। গান শুনে জাহিনের চোখ দিয়ে জলও এল।

শিশির গাইছে:

‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?’

এই কথা শুনলে চোখে জল না এসে পারে? তাই তো। কেন মাঝে মাঝে সে তার দেখা পাবে। কেন চিরদিন পাবে না?

দাদি একটু উঠছিল। বারবিকিউয়ের আগুনটা উসকে দিতে।

তারপর সে আগুনেরও ওই পাড়ে যে দোলনাটা আছে, সেটায় বসেছিল।

ও পাশটা একটু অন্ধকারও।

হঠাৎই একটা ভালুকের মতো কালো রোমশ অন্ধকার কিছু একটা, একটা প্রাণী বা মানুষ বা অতিপ্রাকৃত কোনো কিছু, তার পেছনের জঙ্গল থেকে চলে এল তার পেছনে।

এপাশ থেকে বসে গান শুনতে শুনতে চপল চিৎকার করে উঠল, দাদি, সরে যান।

সে দৌড় ধরল সেই প্রাণীটার দিকে।

সবাই সেদিকে তাকাল।

ওই ভালুকের মতো প্রাণীটা জাপটে ধরল দাদিকে।

তারপর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে লাগল জঙ্গলের দিকে।

চপল ছুটছে। পেছনে পেছনে ছুটছে স্বাধীন।

শিশিরও ছুটছে ওই জঙ্গলের দিকে।

শিশিরকে ছুটতে দেখে জাহিনের পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হলো না। সেও ছুটতে লাগল শিশিরের পেছনে পেছনে।

কেয়ারটেকার কামাল একটা আস্ত জ্বলন্ত কাঠের টুকরা হাতে ছুটছে পেছনে পেছনে।

ওই প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেছে জঙ্গলে।

তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

দেখা যাচ্ছে না দাদিকেও।

টর্চলাইট আনা হলো।

একটা চার্জার লাইট ছিল। সেটাও।

একটু পরে হাজির হলো কাদেরও।

কী হইছে?

চপল বলল, কাদের ভাই, দাদিকে কে যেন ধরে নিয়ে গেছে।

কাদেরও খুঁজতে লাগল জঙ্গলের ভেতরে।

কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।

তারা দুজন দুজন করে তিন দিকে খুঁজতে লাগল।

কাদের আর জাহিন একদিকে।

কেয়ারটেকার আর স্বাধীন একদিকে।

চপল আর শিশির আরেক দিকে।

শিশির কাঁদছে। দাদি দাদি বলে।

চপল বলল, শিশির, কাঁদবেন না। আমি বেঁচে থাকতে আপনার দাদির কোনো ক্ষতি করতে দেব না।

একটা ক্লু খুঁজে পেল চপল। দাদির গায়ের চাদর লটকে আছে একটা কাঁটাগাছের ডালে। ছোট্ট একটা কাঁটার ঝোপ।

তার পাশ দিয়ে চলে গেছে একটু সরু পায়ে চলা পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তাটা তিন দিকে বেঁকে গেল। এখন কোন দিকে যাবে চপল?

ওরা একটা রাস্তা ধরল।

রাস্তা ফিরে এল তাদের গেস্টহাউসেই।

সবাই ফিরে এল একে একে।

না। দাদিকে পাওয়া গেল না।

কাঁদতে কাঁদতে শিশিরের অবস্থা খারাপ। সে বলল, আমার তো ঢাকায় জানাতে হবে। আমি কী বলব?

সবাই বারান্দায় গোল হয়ে বসে আছে।

কিছু একটা তো করতেই হবে।

ওই বনের মধ্যে হঠাৎই আগুন জ্বলে উঠল।

আকাশ উঁচু আগুন। আবার নিভেও গেল সেই আগুন।

তারপর বিদ্যুৎ গেল চলে। পুরো গেস্টহাউস অন্ধকার।

আর ঢিল পড়তে লাগল টিনের চালে। ধপধপ করে।

বাইরে কিসের যেন শব্দ। কুকুর ডাকছে। শিয়াল ডাকছে। চারদিকে গাছে গাছে বাদুড় পাখা ঝাপটাচ্ছে। পাখিরা উড়ে উঠছে।

ভয়ে জাহিন অজ্ঞানপ্রায়।

সে বলল, আমি আর এইখানে এক মুহূর্ত থাকব না। আজ রাতেই চলে যাব এখান থেকে। কাদের ভাই। গাড়ি বের করেন।

শিশির বলল, আমি তো দাদিকে ছাড়া যেতে পারব না।

জাহিন বলল, শিশির না গেলে অবশ্য আমারও যাওয়াটা উচিত হবে না।

স্বাধীন বলল, ডাক্তার নাজনিনকে খবর দেওয়া দরকার।

চপল বলল, নাজনিন কী করবে এখানে?

উনি এখানে থাকেন। তাঁর পরামর্শ কাজে লাগতে পারে।

স্বাধীন বলল, পুলিশকে জানানো দরকার। আমি ঢাকায় ফোন করছি। আমার সংবাদপত্র অফিসে। এখানে নিশ্চয়ই কোনো সংবাদদাতা আছে আমাদের কাগজের। তাকে দিয়ে থানাকে জানাই। থানা থেকে পুলিশ আসুক। আজ রাতেই পুরো এলাকাটা ঘিরে ফেললে নিশ্চয়ই দাদিকে পাওয়া যাবে।

শিশির বলল, তাই করুন। আমি ঢাকায় খবর দেব কি না, বুঝছি না। সবাই তো খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।

স্বাধীন বারান্দায় পায়চারি করছে। তার কানে ফোন।

সে ফোন করছে ঢাকার দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকায়। এই পত্রিকায় সে পার্টটাইম অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করে।

ক্রাইম রিপোর্টার কামরুল হাসানের ফোনে ঢুকল সে। কামরুল ভাই, বড় বিপদে পড়েছি। আমরা এসেছি…

এই সময় কোত্থেকে একটা কলাগাছের ইয়া বড় টুকরা এসে পড়ল তার পিঠে।

স্বাধীন ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।

ওই ওখানে?

চপল জঙ্গলের দিকে টর্চ মারল। জঙ্গলটা নড়ে উঠছে।

সবাই দৌড় ধরল জঙ্গলের ওই দিকটা লক্ষ করে।

শিশির এগিয়ে গেল স্বাধীনের দিকে।

মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে স্বাধীন।

তারপর সে তাকে ধরে চিত করল।

ঠোঁটের কাছ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে…

নাহ্। আবারও পাওয়া গেল না আগন্তুককে।

সে দ্রুতই কেটে পড়েছে।

এখানে থাকা আর নিরাপদ হবে না।

চপল ঘোষণা করল।

তার আগে স্বাধীনকে সুস্থ করে তুলতে হবে।

শিশির বলল, আমি দাদিকে না নিয়ে ফিরছি না। আমি ঢাকাতে মুখ দেখাব কী করে?

হঠাৎ চপল বলে ফেলল, আমার মনে হয় আমি জানি, দাদি কোথায় আছে। আমি জানি।

সবাই আসো আমার সাথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *