নগ্ন ঈশ্বর

নগ্ন ঈশ্বর – উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

এক

শেষ রাতে তুষারঝড়ে পড়ে জাহাজ বন্দর ধরছে।

প্রায় মাসখানেক পর জাহাজ এবং জাহাজিরা লেগুনের মুখে বন্দরের আলো দেখতে পেল।

আর তুষারঝড়ের জন্য জাহাজিরা রেনকোট গায়ে ডেকের উপর ছুটোছুটি করছে, ওরা দড়িদড়া ফেলে দিচ্ছে নিচে। জেটিবয় সেই সব দড়িদড়া অথবা হাসিলের সাহায্যে জাহাজ বন্দরে বাঁধছে। মেজ মালোমকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে না—তিনি দু’হাত তুলে বিচিত্র এক ভঙ্গিতে ডেক—জাহাজিদের দড়িদড়া হাপিজ অথবা হাড়িয়া করতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

তখন জাহাজের পাঁচ নম্বর সাব অবনীভূষণ পোর্টহোলে উঁকি দিল। শেষরাতে জাহাজ বন্দর ধরছে, জাহাজ সেই কবে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে নোঙর তুলে সমুদ্রে ভেসেছিল, কবে কোন এক দীর্ঘ অতীতে যেন। তারা বন্দর ফেলে শুধু সমুদ্র এবং সমুদ্রে ভাসমান দ্বীপ—বালির অথবা পাথরের জনমানবহীন দ্বীপ দেখেছে। তারা সেই দ্বীপের ঝাউগাছ এবং অপরিচিত গাছগাছালি দেখে চিৎকার করার সময় মনে করত—জাহাজ বুঝি আর কোনোদিনও বন্দর ধরবে না। শুধু সমুদ্র, এবং নীল জল, নীল আকাশ আর হয়তো ক্বচিৎ কোথাও সমুদ্রের চিড়িয়াপাখি—দূরে কখনও ডলফিনের ঝাঁক….। পাঁচ নম্বর সাবের মনে হত জাহাজ ওদের নিয়ে অন্তহীন এক সমুদ্রে যাত্রা করেছে। ওরা বন্দরে কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না, জাহাজ ওদের সঙ্গে তঞ্চকতা করছে।

সুতরাং এই তুষারঝড়ের ভিতরও জাহাজিদের প্রাণে উল্লাসের অন্ত ছিল না। মেজ মালোম প্রায় ছুটে ছুটে কাজ করতে জাহাজিদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। সামনে পাহাড়, আলো, মাটি এবং মানুষের বসতি। ওখানে কোথাও রমণীদের গৃহ আছে। মেজ মালোম উত্তেজনায় রা রা করে গান গাইতে থাকলেন। তুষারঝড়ের জন্য ওঁর কণ্ঠ ভয়ংকর কঠিন মনে হচ্ছিল আর তুষারঝড়ের জন্য সব পোর্টহোল বন্ধ। কাচের ভিতর থেকে এখন অন্যান্য জাহাজিরা বন্দর দেখছে। বন্দরটা ছোট অথচ খুব সুন্দর মনে হচ্ছিল। ক্রমশ আলো ফুটছে, ক্রমশ তুষারঝড় কমে আসছিল। আর এক এক করে সব আলো পথের এবং জেটির এক সময় নিবে যেতে থাকল। দূরের গির্জায় তখন ঘণ্টা বাজছে, জাহাজিরা সকলে ডেকের উপর উঠে এল এবং সকলে রেলিঙে ঝুঁকে পড়ছে। আবেগে উত্তেজনায় জাহাজিরা বন্দরের সকল ঘাস মাটি ফুলকে ভালোবাসার কথা জানাল।

বন্দরের প্রথম দিন এবং রবিবার। জাহাজিদের ছুটির দিন। ওরা হইহই করে আকাশ পরিষ্কার হলেই বন্দরে নেমে যাবে। শুধু তুষারঝড়ের জন্য ওরা বিরক্ত। জাহাজের পাঁচ নম্বর সাব অবনীভূষণ পোর্টহোলে বারংবার হাত রেখে ঝড়ের সঙ্গে তুষারকণা পরখ করছিল। মনে হচ্ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস ক্রমশ কমে যাবে, যেন ওর ইচ্ছা এই ঠান্ডা বাতাস থেমে গেলেই সে তার প্রিয় তামাকের পাইপটি মুখে পুরে যুবতীর সন্ধানে বন্দরে বের হয়ে পড়বে। এইটুকু ভেবে অবনীভূষণ আয়নায় মুখ দেখল। ভয়ংকর মুখ অবনীভূষণের, কালো নিগ্রো—সুলভ চেহারা। চুল কোঁকড়ানো, ঠোঁট পুরু—জাহাজে অবনীভূষণকে বাঙালি বলে চেনাই যায় না। অবনীভূষণ শক্ত ধাতের মানুষ। অবনীভূষণ লম্বা আর অবনীভূষণের জন্ম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দিকে। অবনীভূষণ মাকে দেখেছে, বাবাকে দেখেনি। ‘অবনীভূষণ জারজ’—আয়নায় মুখ দেখার সময় পাঁচ নম্বর সাব কথাটা উচ্চারণ করল। এত দীর্ঘ ঋজু চেহারা অবনীভূষণের, আর এতবড় চোখ এবং মুখ অবনীভূষণের আর এত লম্বা থাবা অবনীভূষণের যে যুবতীরা কোনো বন্দরেই অবনীভূষণকে পছন্দ করে না।

ডেকে সামান্য কাজ অবনীভূষণের। ফরোয়ার্ড ডেকে দু’নম্বর মাস্টের নিচে উইনচ মেসিনের লিভার প্লেট আলগা হয়ে গেছে—ওটা সারাতে হবে। রবিবার তবু ওকে এই সামান্য কাজটুকু করতে হবে। বয়লার স্যুট পরে অবনীভূষণ ডেকে বের হয়ে গেল। চারিদিকে পাহাড়। তুষারঝড় কমে গেছে বলে আকাশ পরিচ্ছন্ন, লেগুনের জল সামান্য সবুজ রঙের; আর দূরে দূরে সব পাহাড় ক্রমশ উপরে উঠে গেছে। পাহাড়ের কোলে সব পরিচ্ছন্ন লাল নীল কাঠের রঙবেরঙের বাড়ি, ইতস্তত বড় বড় প্রাসাদ এবং ঠিক সেতুর অন্য পাড়ে বড় বড় কিছু স্কাইস্ক্র্যাপার। লেগুনের দু’পারেই শহর। ঠিক লৌহ আকরিকের গুদামখানার বিপরীত দিকের সেতুর ব্যালকনিতে অবনীভূষণ মানুষের ভিড় দেখল। সূর্য আলো দিচ্ছে সামান্য—খুব নিষ্প্রভ এই আলো, কোনো উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। অবনীভূষণ লেদার জ্যাকেটের ভিতরেও হু হু করে শীতে কাঁপছিল—সামান্য উত্তাপের জন্য পাঁচ নম্বরকে খুব দুঃখিত মনে হচ্ছে।

অবনীভূষণ হাতের কাজ খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল। তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নের আহার শেষ করে নিজের বাংকে শুয়ে প্রতিদিনের অভ্যাসমতো কিছু নগ্ন ছবির উপর চোখ রাখতেই শুনতে পেল এলওয়েতে কে বা কারা যেন পায়চারি করছে। মেজ মালোমের গলার স্বর পাওয়া যাচ্ছে। তিনি খুব দ্রুত এবং জোরে হাসছেন। বোধহয় খুব সকাল সকাল তিনি যুবতী—সন্ধানের জন্য বের হয়ে পড়ছেন। অবনীভূষণেরও ইচ্ছা হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে, যখন পোর্টহোল দিয়ে অন্য তীরে তিমি শিকারের জাহাজ ভিড়তে দেখা যাচ্ছে, যখন দূরে কোথাও এক তৈলবাহী জাহাজ বাঁধা হচ্ছিল, যখন আর কিছু হাতের সামনে করণীয় নেই অথবা ‘ট্যানি টরেন্টো’ ‘ট্যানি টরেন্টো’ এক বিশ্রী শব্দ কানের কাছে ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে তখন মেজ মালোমের মতো টিউলিপ গাছের নিচে যুবতীর সন্ধানে বের হয়ে পড়াই ভালো। এত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অবনীভূষণ জাহাজ থেকে সকাল সকাল নেমে পড়তে পারল না। সে রাতের জন্য অপেক্ষা করল। কারণ দিনের বেলা এই চেহারা বড় ভয়ংকর। রাতের বেলায় অস্পষ্ট অন্ধকারে অথবা নিয়ন আলোর ভিতর, ফেল্ট ক্যাপের ভিতর আর বৃহৎ ওভারকোটের জন্য মানুষের মতো মনে হয় ওকে। সুতরাং হাত—পা শক্ত করে সে বাংকেই পড়ে থাকল। শরীরের ভিতর ভয়ংকর কষ্ট এবং উত্তেজনা। বন্দরে এলেই কষ্টটা বাড়ে। বন্দর ধরলেই এই সব জাহাজিরা অমানুষের মতো চোখ—মুখ করে ঘোরাফেরা করতে থাকে—কী যেন এক সোনার আপেল ওদের হারিয়ে গেছে—সেই আপেলের জন্য, সেই সোনার হরিণের জন্য ওরা সবসময় মাটি পেলেই দ্রুত ছুটতে চায়। অবনীভূষণ দ্রুত ছুটতে চাইল।

সন্ধ্যার সময় জাহাজের স্টারবোর্ড—সাইডের কেবিনগুলোর দিকে হেঁটে গেল সে। সেখানে প্রিয় বন্ধু ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস উইলিয়াম উড থাকেন। সে দরজায় কড়া নেড়ে ভিতরে ঢুকে বলল, এ কি, তুমি এখনও চুপচাপ বসে রয়েছ! বের হবে না?

উড বলল, ভয়ংকর ঠান্ডা।

অবনীভূষণ বলল, অন্তত সিম্যান মিশানে চল। সেখানে জুটে যেতে পারে।

সুতরাং ওরা উভয়ে সাজগোজ করে বের হয়ে পড়ল। সেই লম্বা ওভারকোট গায়ে অবনীভূষণ, লম্বা তামাকের পাইপ মুখে এবং ভয়ংকর বড় বেঢপ জুতো পায়ে অবনীভূষণ গ্যাঙওয়ে ধরে নেমে গেল। আর নেমে যাবার মুখেই দেখল মেজ মালোম বন্দর থেকে ফিরছে। মেজ মালোম বেশ সুন্দরী এক যুবতীকে (বয়সে চল্লিশের মুখোমুখি) নিয়ে এসেছেন। যুবতীর পাতলা গড়ন, ছিমছাম চেহারা আর কালো গাউন, সোনালি ব্লাউজের উপর ফারের লম্বা মতো কোট গায়ে…। ওর কোমরে মেজ মালোমের হাত। যেন চুরি করে তিনি এক যুবতীকে জাহাজে নিয়ে যাচ্ছেন। সমুদ্র থেকে তেমনি ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে। তীক্ষ্ন শীতের ভিতর এই সামান্য উত্তাপটুকু অবনীভূষণকে অস্থির করে তুলল। মেজ মালোমকে সে ‘গুড—ইভনিং সেকেন্ড’ বলতে পর্যন্ত ভুলে গেল। সে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে।

তুষারপাতে গাছের সব পাতা ঝরে গেছে, আর কিছু দিন গেলে এখানে হয়তো বরফের পাহাড় জমে যাবে। বাগানের আপেল গাছগুলোকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল, চেরিফলের গাছগুলো মৃতবৎ দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সব অপরিচিত গাছগাছালির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। গাছগুলোর পাতা ঝরে গেছে বলে কোনো গাছই চেনা যাচ্ছে না, ওরা বৃদ্ধ পপলার হতে পারে, পাইন হতে পারে, এমনকি বার্চ গাছও হতে পারে। এই শীতে পথের দু’পাশে কাঠের বাড়ি এবং লাল নীল রঙের শার্সির জানালা এবং বড় বড় কাচের জানালার ভিতর পরিবারের যুবক—যুবতীদের মুখ। অ্যাকর্ডিয়ানের সুর, গ্রাম্য কোনো লোকসংগীত অবনীভূষণকে ক্রমশ উত্তেজিত করছে। ইতস্তত দু’পাশে বার এবং বার পার হলেই সেই কার্নিভাল। সদর দরজার উপর একটা লোক হাঙরের মুখোশ পরে বসে নানাভাবে জাহাজিদের প্রলুব্ধ করতে চাইছে। ওরা কার্নিভালে ঢুকল না। ওরা ক্রমশ পাহাড়ের উতরাইয়ে নেমে যাচ্ছে। আর ওরা দেখল, হরেক রকমের রমণীরা মুখে ফুঁ দিতে দিতে চলে যাচ্ছে—স্থানীয় কোনো উৎসব হবে হয়তো—মেয়েরা মাথায় রুমাল বেঁধে শহরের বড় কবরখানার দিকে হাঁটছে। অবনীভূষণের এ—সময় ইচ্ছা হচ্ছিল ওর বড় থাবা দিয়ে ঠিক ছোট পাখি ধরার মতো কোনো যুবতীকে ওভারকোটের পকেটে লুকিয়ে ফেলতে।

তুষারঝড়ের চিহ্ন এখনও এই সব পাহাড়ে এবং ছবির মতো বাড়িগুলোর মাথায় লেগে আছে। কোথাও দেখল, কাচের ঘরে সুন্দরী যুবতী পিয়ানো বাজাচ্ছে, আর দু’পাশে হরেক রকমের দৃশ্য এবং অবনীভূষণ এখন উন্মাদ—সে হন্যে হয়ে যুবতীর সন্ধান করছে। এইসব জাহাজিদের আনন্দ দানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অশালীন পোশাকে নানা বয়সের যুবতীরা ঘোরাফেরা করছে। ওরা এক এক করে সকলে নাচের আসরে নেমে পড়ছে। স্টেজের উপর একদল লোক কালো পোশাক পরে ব্যান্ড বাজাচ্ছে। ঈগল পাখির মতো মুখওয়ালা বাঁশির শব্দ বীভৎস এবং উৎকট মনে হচ্ছিল। পাশের কাউন্টার কাচ দিয়ে মোড়া। সেখানে মেয়েরা মদ বিক্রি করছে। জাহাজিরা কিউ দিয়ে মদ গিলছিল। অবনীভূষণ এবং উড উভয়ে মদ খেল এক গেলাস করে। ওদের পার্টনার নেই, বিশেষ করে অবনীভূষণ এইসব নাচ এতদিনেও রপ্ত করতে পারেনি। সুতরাং অবনীভূষণ আর এক গেলাস মদ নিয়ে পাশের সোফাতে বসে মাংসের পুরের সঙ্গে মদটুকু খেয়ে ফেলল। বাকি মাংসের পুরটুকু সে চেখে চেখে চেটে চেটে খাচ্ছিল আর রমণীরা এই যে নেচে চলেছে, এই যে সুন্দর শরীর এবং উটের মতো মুখটি তুলে নেচে বেড়াচ্ছে, এই যে রমণীরা ঘোড়ার মতো পা ফেলে এক দুই করে সামনে পিছনে পিছনে সামনে—যাচ্ছে আসছে—তা দেখে অস্থির হয়ে পড়ছিল। ফলে অবনীভূষণ ল্যালা ফ্যালার মতো চারিদিকে তাকাচ্ছিল। তারপর সে সহসা আবিষ্কারের মতো দেখে ফেলল দুই সুন্দরী যুবতী যেখানে মদের কাউন্টার, ঠিক তার বিপরীত দিকের টেবলে বসে উল বুনছে। অবনীভূষণ মুখ নীচু করে চুপি চুপি উডের হাত ধরে ওদের দিকে গিয়ে বসল। তারপর চোখ—মুখ টান টান করে বলল, গুড ইভনিং ম্যাডাম এবং পাশে বসে পরিচিত হবার ভঙ্গিতে বলল, এম ভি সিটি অফ গ্লাসগো। সে তার জাহাজের নাম বলল ওদের।

মেয়ে দুজন ওকে স্বাগত জানালে সে কাউন্টারে আবার মদের অর্ডার দিয়ে বলল, ছবির মতো এই শহর। মেয়ে দুজনকে ভিন্ন অলীক স্বপ্নের কথা বলে অথবা সমুদ্রের গল্প বলে ভেজাতে চাইল।

অবনীভূষণ দামি সিগারেট বের করে ওদের একটি করে দিতেই ওরা এসে ওর ঘাড়ের উপর পড়ার মতো ভান করল—সো নাইস। কোনো অলৌকিক ঘটনার মতো অবনীভূষণের সিগার কেস, সিগারেট কেসটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল ওরা।

অবনীভূষণ চুল—সোনা মেয়েটিকে বলল, ইউ লাইক ইট? বলে সে ওর সম্মতির অপেক্ষা করল না; সে চুল—সোনা মেয়ের হাতে যৌতুকের মতো সিগারেট কেস তুলে ধরার সময়ই কাচের জানালায় মুখ বার করে পাহাড়ের উতরাইয়ের ভিন্ন ভিন্ন আলো দেখল। আকাশ পরিচ্ছন্ন বলে, পথঘাট শুকনো বলে পার্কের বেঞ্চে এখন সব যুবক—যুবতীরা বসে নিশ্চয়ই গল্প করছে। অবনীভূষণ এবার উডের দিকে তাকাল, উড তন্ময় হয়ে নাচ দেখছে। সে, অবনীভূষণ অথবা চুল—সোনা মেয়েকে লক্ষ্য করছে না। সুতরাং অবনীভূষণ উডকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, চল এবার উঠি। প্রায় ঠিক করে এনেছি।

এবার অবনীভূষণ যুবতী দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলুন অন্য কোথাও।

যুবতী দুজন পরস্পর মুখ দেখল। তখন ব্যান্ড বাজছে উঁচু পর্দায়, তখন সার্কাসের ঘোড়ার মতো পা ফেলে এই নাচের ভিতরই কেউ কেউ বেলেল্লাপনা করছিল। নাচতে নাচতে কোনো এক ফাঁকে দেয়ালের পাশে অথবা সামান্য অন্ধকারে পরস্পর পরস্পরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর সব ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গির ছবি। অবনীভূষণ কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারছে না। যুবতীরা সব উটের মতো মুখ তুলে কেবল চুমু খাচ্ছে, কেবল সার্কাসের ঘোড়ার মতো পা মুড়ে বসে পড়তে চাইছে। অবনীভূষণ আবার বলল, চলুন কোথাও। অবনীভূষণ চুল—সোনা মেয়ের হাতে নরম চাপ দিল।

ব্যান্ড বাজছে, হরদম বাজছে। সামনের কাউন্টারে ফের দু—একজন করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাবিক এসে ভিড় করছে। ওরা কেউ কেউ মাথার টুপি খুলে তিমি শিকারের গল্প আরম্ভ করল। উত্তর সাগরে ওরা গর্ভিণী তিমি শিকার করতে গিয়ে দুজন নাবিককে হারিয়েছে, এমন গল্প করল। ওরা গল্প করার সময় পাশের হিটার থেকে উত্তাপ নিচ্ছিল এবং গর্ভিণী তিমির প্রসব সম্পর্কে রসিকতা করছিল।

ভিড় কাচঘরে ক্রমশ বাড়ছে। মিশনের ডানদিকে মসৃণ ঘাসের চত্বর এবং মৃত বৃক্ষের মতো কিছু পাইন গাছ—তার নিচে বড় বড় টেবিল আর ফাঁকা মাঠে হেই উঁচু লম্বা এক হারপুনার হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছে। হারপুনার কাচঘর অতিক্রম করে কাউন্টারের সামনের লোকটির সঙ্গে ফিস ফিস করে কী বলছে। অবনীভূষণ সব লক্ষ্য করছিল। আগের দলটা এতক্ষণ হইচই করছিল মদ খেতে খেতে, কিন্তু হেই উঁচু লম্বা হারপুনারকে দেখে ওরা সব যিশু হয়ে গেল। আর তখন কে বা কারা যেন সেই যুবতী দুটিকে উদ্দেশ্য করে লম্বা গলায় বড় রাস্তায় হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছে—ট্যানি টরেন্টো… ট্যানি টরেন্টো… আমাদের বন্ধুবর হারপুনার এবার উত্তর সাগর থেকে গর্ভিণী তিমি শিকার করে ফিরেছে।

উঁচু লম্বা লোকটার টেবিলে সকলে এক এক করে গোল হয়ে বসে গেল। সেই যুবতীরাও ছুটে যেতে চাইল। অবনীভূষণ কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারছে না। সে এবার বিদ্রুপ করে বলতে চাইল হ্যাঁগো সতীর দল… তোমরা আমাদের ফেলে যাচ্ছ! সে বিরক্ত হয়ে এবার উডকে বলল, উড, তুমি তো বলতে পারো বুঝিয়ে। তোমাদের সুন্দর মুখ দেখে ….।

উডের কথা যুবতী দুজন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে শুনল। ওরা চুল ঘাড়ে ফেলে উলের কাঁটা ব্যাগের ভিতর ভরে সেই চৌকোমুখ এবং গামবুট—পরা ভদ্রলোক—যে গর্ভিণী তিমি শিকার করে এইমাত্র উত্তর সাগর থেকে ফিরেছে—তার টেবিলের দিকে হাঁটতে থাকল। অবনীভূষণ প্রচুর মদ গিলেছে। ওর শরীর নেশায় টলছিল। অবনীভূষণের ভিতরে ভিতরে এক অপরিসীমা তৃষ্ণা—সে পাগলের মতো চুল—সোনা মেয়ের হাত ধরে ফেলল। কারণ সে যেন সেই চৌকোমুখ হারপুনার, মাথায় যার হাঙরের হাড়ের টুপি, যে বিশ্রী এবং যে ওখানে বসে কটু গন্ধের তামাক টানছে, যার চেহারা দেখলে মনে হয় মেয়েমানুষ সামান্য বস্তু—তার দৃষ্টি একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না। সে রাগে—দুঃখে চুল—সোনা মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাইলে—হারপুনার ব্যক্তিটি ও তার দলবল লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজার সামনে পথ আগলে দিলে। অবনীভূষণ ক্ষিপ্ত এক জানোয়ারের মতো গর গর করে উঠল। হারপুনারের দলবল তখন অবনীভূষণকে এলোপাথাড়ি মুখে মাথায় ঘুষি চালাচ্ছে।

বাইরে সাদা আলোর ভিতর নাক মুছতে গিয়ে অবনীভূষণ দেখল সামান্য রক্ত নাকের ডগায় জমাট বেঁধে আছে। ভিতরে তখন সেই যুবতী হারপুনারের সঙ্গে রসিকতা করছিল এবং হাসছিল।—কাচের ভিতরে সব স্পষ্ট। সুতরাং অবনীভূষণ আর সহ্য করতে পারছে না। সে ফের দরজা অতিক্রম করে ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করলে উড হাত চেপে ধরে বলল, অবনী, তুমি বেশ জোরে হারপুনারকে মেরেছ। লোকটা পেটে লাথি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গল গল করে মদ বমি করছে।

অবনীভূষণের ঝুট—ঝামেলা করার আর ইচ্ছা থাকল না। এবং এখানে আর যুবতী অনুসন্ধান করা নিরর্থক ভেবে ওরা পাহাড়ের গায়ে গায়ে অথবা সেতুর দুই পাশে, লোহালক্কড়ের কারখানার দেওয়ালের ছায়ায় এবং যেখানে সব তিমি মাছের চর্বি সংরক্ষণ করার জন্য বড় বড় পিপের সারি সেইসব অঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় শহরের মাঝামাঝি অঞ্চলে এসে গেল।

অবনীভূষণ চড়াই—উতরাইয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় উডকে উদ্দেশ্য করে বলল, আজ এই শীতে সতীর দল গেল কোথায়?

তখন উড সহসা আবিষ্কারের ভঙ্গিতে বলল, ঐ দেখ অবনী, লাইটপোস্টের নিচে যেন দুজন মেয়ে শিস দিচ্ছে। বলে উড দূরের লাইটপোস্টের দিকে হাত তুলে নির্দেশ করল।

অবনীভূষণ বলল, চল তবে।

শীতের রাত। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবনীভূষণের মনে হল ওরা শীতে জমে যাবে ক্রমশ। মনে হল ওরা যুবতী দুজনে বেশিদূর আর অনুসরণ করতে পারবে না। অথবা মেয়ে দুজন এই শীতের রাতে ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। পথের ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে, দূরে দূরে সব পুলিশের বুটের শব্দ এবং ট্রলি বাসের আলো আর পথে পড়ছে না, শহর ক্রমশ যেন নির্জন নিঃসঙ্গ হয়ে আসছে। উড পর্যন্ত আর জোরে হাঁটতে পারছিল না।

একসময় ওরা এবং যুবতী দুজন শোকেসের সামনে মুখোমুখি পড়ে যেতেই উড ঝুঁকে বলল, আস্তানা কত দূর?

দুজন বলল, সরি। বোধহয় অবনীভূষণের লম্বা চেহারা এবং হাতের বড় বড় থাবা, ওদের আতঙ্কিত করেছে।

অবনীভূষণ বলল, সামান্য সময়।

যুবতী শক্ত হয়ে গেল। বলল, না। ওরা বরং উডকে সঙ্গে নিতে চাইল।

উড বলল, আমরা দুজন, একা যেতে পারি না।

অবনীভূষণ এবার মরীয়া হয়ে বলল, মেয়ে, এই লম্বা কোটের পকেটে করে নিয়ে যাব তবে—কেউ টেরটি পাবে না। তারপর অবনীভূষণ চারিদিকে তাকাল যেন যথার্থই সে এই দুই যুবতীকে পকেটে পুরে শহর ত্যাগ করে চলে যাবে।

এবার যথার্থই ভয় পেয়ে গেল ওরা। তাড়াতাড়ি বড় রাস্তায় পড়ার জন্য ছোট সরু গলি অতিক্রম করে নেমে যেতে চাইল। পথ আগলে অবনীভূষণ তার দুই হাতের বড় থাবা দেখাল। সে হাত দুটো অঞ্জলির মতো করে রাখল—তৃষ্ণার জল আর কে দেবে? সে যেন বলতে চাইল কথাটা। এবং সে এই নিঃসঙ্গ রাতের আঁধারে উচ্চস্বরে সেই ট্যানি টরেন্টো, ট্যানি টরেন্টো শব্দের মতো চিৎকার করে নগরীর দুর্ভেদ্য অন্ধকারকে বলতে চাইল, হায় অবনীভূষণ, এই তৃষ্ণার জল তোমাকে আর কে দেবে!

তারপর অবনীভূষণ সেই যুবতী দুজনকে উদ্দেশ্য করে যেন বলল, আমি তোমাদের সব দেব, তোমরা আমাকে স্পর্শ দাও। সামান্য উত্তাপ দাও।

ওরা উত্তর করল না। বড় রাস্তার উজ্জ্বল আলোর নীচ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আর অবনীভূষণ শুনতে পেল সেই আগের মতো দূরে কারা যেন হেঁকে যাচ্ছে—ট্যানি টরেন্টো… ট্যানি টরেন্টো ….. উত্তর সাগর থেকে এক হারপুনার এক গর্ভিণী তিমি শিকার করে ফিরেছে। অবনীভূষণ দুর্গের পাশে পাশে হেঁটে গেল। সর্বত্র যেন সেই একই ট্যানি টরেন্টো ট্যানি টরেন্টো শব্দ। সে দু’কান চেপে শীতের ঠান্ডায় ট্যাক্সির ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল এবং ট্যাক্সিওয়ালাকে নিজের জাহাজের নাম, ডকের নাম বলে শরীর এলিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল হাত পায়ে বড় ব্যথা, সে ঘাড় নাড়তে পারছে না—পরাজিত এক সৈনিকের মতো আত্মগ্লানিতে ডুবে গেল।

গ্যাঙওয়েতে কোয়ার্টার মাস্টার পাহারা দিচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন পাঁচ নম্বর সাব এবং ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস উড হামাগুড়ি দিতে দিতে সিঁড়ি ভাঙছে। ওরা ফেরার পথে প্রচুর মদ গিলেছে; ওরা সিঁড়ি ধরে সোজা হেঁটে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সুতরাং মাস্টার ওদের দুজনকে উঠে আসতে সাহায্য করলেন।

উড স্টারবোর্ড, সাইডের কেবিনগুলোর দিকে হেঁটে হেঁটে চলে গেল।

অবনীভূষণ বালকেডে ভর করে নিজের কেবিনের দিকে হাঁটতে থাকল। স্তিমিত আলো এলওয়েতে। সে বড় মিস্ত্রি এবং মেজ মিস্ত্রির কেবিন পিছনে ফেলে যেতেই মনে হল পায়ের সঙ্গে কী যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। সে যত পা আলগা করতে চাইছে ততই পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যাচ্ছিল। সে এবার নুয়ে পায়ের নিচে হাত দিয়ে দেখল একটা কালো রঙের গাউন। সে আলোর ভিতর নাকের কাছে সেটাকে নিয়ে কিছুক্ষণ আলগা করে ঘ্রাণ নেবার সময় দেখল সামনে মেজ মালোমের কেবিন, কেবিনের দরজা খোলা, মেজ মালাম বাংকে উপুড় হয়ে মৃতবৎ পড়ে আছেন। ঘরে সেই বিকেলে ধরে আনা যুবতী নেই। মেজ মালোম এক হাতে কোনোরকমে প্যান্টটা কোমর পর্যন্ত তুলে রেখে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছেন। অবনীভূষণ বলল, শালা মদ খেয়েছে। বলে, গাউনটা দরজা দিয়ে মেজ মালোমের মুখের ওপর ফেলে দিল। মেজ মালোমের এখন মুখ ঢাকা এবং শরীর প্রায় উলঙ্গ। সে দরজা টেনে বন্ধ করে দিল মালোমের কেবিন। তারপর এনজিন ঘরের সিঁড়ির মুখে নিজের কেবিনের দরজা খুলতে গিয়ে মনে হল ভিতর থেকে কে যেন বন্ধ করে রেখেছে। সে রাগে দুঃখে অপমানে দরজার উপর ভীষণ জোরে লাথি মারল। দরজা খুলছে না। সে তার অবসন্ন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে বলল, বাস্টার্ড, সে গাল দিল, সোয়াইন! সে তারপর বাংলা ভাষায় খিস্তি করে ভিতরে ঢুকে বিস্মিত—সে চোখ গোল গোল করে দেখল, সেই বিকেলের যুবতী ওর বাংকে আশ্রয় নিয়েছে। এবং অসহায় বালিকার মতো চোখ। যুবতীকে এখন বুনো কাকের মতো শীর্ণ মনে হচ্ছে অথবা গর্ভিণী শালিখের মতো রোঁয়া ওঠা। প্রথমে সে কী করবে, ভেবে পেল না। তারপর বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে সে বলল, কি গো, একেবারে বাঘের মুখে!

যুবতী কিছু বলল না। চোখে মুখে ভয়ের এতটুকু চিহ্ন নেই। যেন এক্ষেত্রে কিছু করণীয় নেই, সব হয়ে গেছে, হয়ে যাবে ভাব। ঝড় এবং জীবনের আর্তনাদ কোথাও থেমে থাকছে না। যুবতী তবু ধীরে ধীরে বাংক ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করল। বলল, সরি মিস্টার। সে তার শীর্ণ হাত বালিশের উপর রেখে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গেল।

অবনীভূষণ যুবতীটিকে পড়ে যেতে দেখেই বুঝল—সেই বিকেল থেকে বাঁদরের হাড় চুষে চুষে যুবতীর এক কঠিন অসুখ, এক কঠিন স্থবির অসুখ—যা এতক্ষণ অবনীভূষণকে এই শহরময়, নগরময় এবং দুর্ভেদ্য অন্ধকারে বারংবার ঘুরিয়ে মারছে।—অবনীভূষণ তাড়াতাড়ি যুবতীকে ধরে ফেলল। না হলে বাংক থেকে যেন পড়ে যেত মেয়েটি, হাত—পা কেটে মাথায় আঘাত লাগতে পারত। যুবতীর পড়ে যাবার মুখে কম্বলটা শরীর থেকে সরে গিয়েছিল। অবনীভূষণ দেখল আঁচড়ে কামড়ে যুবতীর শরীর মেজ মালোম ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। লজ্জা নিবারণের জন্য অবনীভূষণ তাড়াতাড়ি ফের কম্বলটা শরীরে তুলে দিল এবং শুয়ে পড়তে বলে ঘড়িতে সময় দেখল—একটা বেজে গেছে, এখন ওকে সামান্য শুশ্রূষা করলে সামান্য সময়ের জন্য এই বন্দর শুভ—বার্তা বহন করবে। এইটুকু ভেবে অবনীভূষণ দরজা ভেজিয়ে চিফ কুকের গ্যালি পর্যন্ত হেঁটে গেল। নেশার ঘোর কী করে যেন একেবারে কেটে গেছে এবং ভিতরের সব দুঃখ ক্রমশ নিরাময় হচ্ছিল। সমুদ্র থেকে তেমনি ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে। সে গরম জল করে যুবতীর শরীর ভালো করে ধুয়ে সামান্য শুশ্রূষার পর বলল, আমার জন্য সামান্য খাবার আছে। ইচ্ছা করলে আমরা দুজনে ভাগ করে খেতে পারি।

যুবতী কষ্ট করে হাসল,—আপনি আমাকে বরং একটু সাহায্য করুন।

অবনীভূষণ বলল, কী করতে হবে?

সেকেন্ড অফিসারের ঘর থেকে দয়া করে আমার পোশাকটা এনে দিন।

অবনীভূষণ মেজ মালোমের ঘর থেকে পোশাকটা এনে দিলে মেয়েটি বলল, আমাকে দয়া করে বন্দরে নামিয়ে দিন। একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলে আমি ঘরে চলে যেতে পারব।

বেশ চলুন। বলে তুলে ধরতেই মনে হল যুবতীর মাথা ঘুরে গেছে। সে বসে পড়ল।

আপনি বন্দরের রাস্তাটুকু হেঁটে পার হতে পারবেন না। বরং এখানেই রাতটা কাটিয়ে দিন।

আমার ভয় করছে মিস্টার, সে আবার আসতে পারে। অত্যন্ত কাতর চোখে অবনীভূষণের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

আপনি ঘুমোন, আমি বরং দরজায় পাহারা দিচ্ছি।

যুবতী আর কথা বলতে পারল না। চোখ জলে ভার হয়ে গেছে।

আর অবনীভূষণের মনে হল দীর্ঘদিন পর সে এক অসামান্য কাজ করে ফেলেছে। সে বলল, আমি বাইরে বসে থাকছি, আপনি নির্ভয়ে ঘুমোন—বলে অবনীভূষণ দরজা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিল এবং ঠিক দরজার সামনে ভয়ংকর ঠান্ডার ভিতর পা মুড়ে বসে থাকল এবং জেগে জেগে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখল—দ্বীপের স্বপ্ন, বড় এক বাতিঘর দ্বীপে—সব বড় বড় জাহাজ সমুদ্রগামী। অবনীভূষণ নিঃশব্দে হাঁটু মুড়ে মাথা গুঁজে বসে থাকল—তার এতটুকু নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না, যেন জীবনের সাত রাজার ধন এক মাণিক, খুবই হাতের কাছে রয়েছে। তাকে গলা টিপে মারতে নেই। সুতরাং সে উঠল না এবং এই নিদারুণ রাত্রি জীবনের প্রথম আলোর পথ বলে মনে হল অবনীভূষণের।

দুই

সমুদ্রে বৃষ্টি পড়ছে। প্রথমে ইলশে—গুঁড়ি, তারপরে জোরে। জোরে বৃষ্টি নামল। মাস্তুলের গা বেয়ে বৃষ্টি ডেক ভিজাল। এখন ফল্কা ভিজছে। গ্যালির ছাদ থেকে ব্রিজের ছাদ, চার্টরুমের ছাদ সব ভিজছে। কুয়াশা—ঘন ভাব বৃষ্টির। সেলিম ফোকসালে কাশছে। বৃষ্টি সমুদ্র এবং জাহাজ সেলিমের বুকের যন্ত্রণায় কাতর হল না। বৃষ্টি পড়ছে—পড়ছে। সমুদ্রে তরঙ্গ। জাহাজ নীল জলে নোনা রঙে সাঁতার কাটছে। সেলিম শরীরে কম্বল জড়াল তখন। ফোকসাল যখন খালি, বাংকে যখন কেউ নেই, জাহাজিরা যখন ডেকে দড়িদড়া টানছে তখন কম্বলের নিচে শুয়ে বিড়ি ধরানো যাক। সে বিড়ি ধরাল এবং কম্বলের নিচে বিড়ির ধোঁয়াকে ফুঁ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর কম্বলটা দিয়ে গোটা ধোঁয়াকে চেপে ধরে দরজার দিকে তাকাল। কেউ নেই। কেউ সিঁড়ি ধরে নামছে না। সে নিশ্চিন্ত হল। অথচ পোর্টহোলের কাচে সমুদ্র এবং আকাশের প্রতিবিম্ব। সেলিম সে কাচে নিজের প্রতিবিম্বও দেখল। চোখ দুটো ওর পালক ওঠা মুরগির মতো। চোখ দুটো পোর্টহোলের কাচে আকাশ এবং সমুদ্রের মতো নীল হতে পারেনি। সাদাটে অথবা বরফ—ঘরের চার—পাঁচ মাসের বাসি গোস্তের মতো। সেলিম কাশির সঙ্গে রক্তের দলাটা কোঁত করে গিলে ফেলল এবার।

দুপুর থেকে শুনে আসছে—উপকূল দেখা যাচ্ছে। সকলে ডেকে চিৎকার করছে—কিনারা দেখা যাচ্ছে। সকলে উপরে হল্লা করছে। সেলিম কোনোরকমে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠছিল, সেও মাটি দেখবে, মাটি দেখে উত্তেজিত হবে, কিন্তু সিঁড়ির মুখেই সারেঙের ধমক, কোথায় যাচ্ছ মিঞা। মরণের দাওয়াই কানে বাঁধতে চাও? সেলিম ভয়ে ফের ফোকসালে নেমে এসেছিল। সে বাংকে শুয়ে সব যেন ধরতে পারছে—যেন কিছু সমুদ্রপাখি ফল্কায় বসে ভিজছে। পাখিরা ফল্কায় একদা বসতের মতো আশ্রয় নিয়েছে। উপকূল দেখে অথবা দ্বীপ দেখে ওরা উড়ছে। এমন ভেবে সেলিম কাশল। সমুদ্রপাখিরা হয়তো এতক্ষণে উড়ে গেছে। ওর জানার ইচ্ছা হল ওরা আকাশে উড়ছে, না দ্বীপের পাশাপাশি কোথাও উড়ছে। আর কেন জানি এই সময় বারবার ওর বিবির কথা মনে হচ্ছে। বিবির মুখে সুখের ইচ্ছা, শখের ইচ্ছা। সেলিমের শরীরে যন্ত্রণা, বুকে যন্ত্রণা। সে যেন বলতে চাইল—এবার আমরা ফিরব, বিবি। ছোট ঘরে তুই তোর খসমের মুখ দেখবি। জাহাজ এবং সমুদ্র উভয়ই আমাদের বিনাশ করতে পারেনি। আমি ফিরব, ফিরব। আমরা ফিরব। খতে এমন একটা প্রত্যয়ের কথা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে সেলিমের।

দীর্ঘ সফর, নোনা পানীর অশ্লীল একঘেয়েমি এতদিন ওকে দেশে ফেরার জন্য মাতাল করতে পারেনি। সেলিম দুবার দুটো ওয়াচ করেছে, ফোকসালে এসে শুয়েছে, হাত—পা ছড়িয়ে, অশ্লীল চিন্তা করতে করতে সমুদ্রের বুকে ঘুম দিয়েছে; অথবা হিসাবের কড়ি গুণে—সফর শেষ হতে কত দেরি—এইসব ভেবে স্থান—কাল—পাত্রের কিংবা বন্দরের বেশ্যামেয়ের হিসাবের কড়ি গুণেছে। গুণতে গুণতে ওর একদিন কাশি উঠল। কাশি আর থামছে না। বিকেলে জ্বর এল। বন্দর থেকে বন্দর ঘুরে জ্বর বেড়েছে। শরীর ভেঙেছে। এক বন্দরে কাপ্তানের কাছে আর্জি পেশ করেছে—সাব, একবার হাসপাতালে যাব। কাশির দমকে আর বাঁচছি না। মনে হচ্ছে, মরে যাব।

এই নিয়ে অন্য ফোকসালে কথা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল, এ বন্দর নিয়ে পাঁচ বন্দর হবে অথচ সেলিম এখনও জাহাজেই আছে। সেই কবে ফ্রি—ম্যান্টেল বন্দরে ওকে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল, আর নয়, আর জাহাজে রাখা চলবে না। বন্দরে নামিয়ে দিতে হবে। হাসপাতালে পাঠাতে হবে। এ—অবস্থায় জাহাজে রাখা নিরাপদ নয়।

সেলিম এখনও জাহাজেই আছে। সে কাশছে। কাশির সঙ্গে রক্ত উঠলেই কোঁত করে ঢোক গিলছে। কিছুদিন থেকে এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সে সকলকে বলছে কাশির ব্যামোটা তেমন নয়। ওটা সেরে যাবে। কোম্পানি দামি দামি ওষুধ দিচ্ছে। দিচ্ছে বলেই এবং বাড়িয়ালা গা করছে না দেখে সেও বুঝেছে ওটা ধীরে ধীরে সেরে যাবে। কাশি যখন বেশি হয় তখন সেলিম অপরাধের কথা ভাবে। নিজের অপরাধের কথা। বিবিকে নিয়ে অথবা বন্দরে দেখা কোনো মেয়েকে নিয়ে বিছানায় পড়ে থেকে অশ্লীল ধারণায় অথবা অশ্লীল আবেগে মেখে শরীরে উত্তাপ সঞ্চয়ের বৃথা চেষ্টা না করলেই হত। অথচ রক্ত কম উঠলে ওষুধে কাজ করছে এমত ভেবে সে খুশি হয়। ওর ইচ্ছা ওর দুরারোগ্য রোগের কথা কেউ না জানুক, কেউ না ভাবুক সে দুরারোগ্য রোগে ভুগে মরে যাবে। অথচ প্রত্যয়ের ঘোরে এই ভেবে খুশি—সে ঘরে ফিরবেই। বিবি তার খসমের মুখ দেখে উজ্জ্বল হবেই। এ—শরীরে সে কিছুতেই সমুদ্রে অথবা বিদেশ বন্দরে রেখে যেতে চাইছে না। সে সকলকে শুধু জিজ্ঞেস করছে—জাহাজ কবে ফিরবে? কবে আমরা ঘরের বন্দর পাব?

জাহাজিরা কেউ বলেছে, সিডনি থেকে পুরানো লোহা নিয়ে জাহাজ যাবে জাপানে।

কেউ বলছে, গম নিয়ে তেলবাড়ি।

সেলিম এইসব খবরে বিষণ্ণ হয়েছে। খুব অসহায় ভঙ্গিতে পোর্টহোলে মুখ রেখে দিগন্তরেখায় নিজের দেশকে খুঁজেছে। কখনও অপলক সমুদ্র দেখেছে। জলের নীল বিস্তৃতি দেখেছে।

সেলিম স্থির করল কাপ্তানকে শেষবারের মতো বলবে, আমায় দেশে পাঠিয়ে দিন, মাস্টার। ঘরে ফিরে আমি বিবির কোলে মাথা রেখে মরব। জাহাজে আমি মরব না। বিদেশ—বন্দরে আমি মরব না। শুয়ে শুয়ে সেলিম এইসব ভেবে উত্তেজিত হতে থাকল।

তখন সিঁড়িতে শিস দিচ্ছে বিজন। সেলিম শুয়ে শুয়ে শুনছে। এ—কেবিন সে—কেবিন সে উঁকি মারল। এঞ্জিন—পরীদাররা ঘুমোচ্ছে। এনজিন—পরীদাররা (যারা চারটা—আটটার পরীদার) গল্প করছে। বিজন লক্ষ করল শিস দিতে দিতে, সতেরো মাস সফর ওদের ক্লান্ত করতে পারেনি। বিষণ্ণ করতে পারেনি। জাহাজটা আরও যদি সতেরো মাস সমুদ্রের নোনা জল ভাঙে, যদি আরও সতেরো মাস বন্দরে না ভিড়ায় তবু নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে জাহাজ চালিয়ে যাবে। বিজন দ্বিতীয় সিঁড়ির মুখেই শুনল—সেলিম কাশছে। কাশির জন্য দম নিতে পারছে না। বিজন আর শিস দিল না। প্রতিদিনের মতো সে ফের সেলিমের জন্য কষ্ট পেতে থাকল। সে ফোকসালে ঢুকে বলল, একবার কাপ্তান সাহেবকে বল হাসপাতালে দিতে। এভাবে আর কতদিন বাংকে পড়ে থাকবি। রাতে জাহাজ বন্দর ধরবে।

সেলিম মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরাল। চোখ দুটোতে নোনা পানি অথবা আকাশের রঙ নয়, কালো রঙ নয়, অথবা বেতফলের মতো রঙও ধরতে নয়—অথচ আশ্চর্য এক রঙ ধরেছে যা দেখলে সকলের ভয় হবে। অথচ মায়া হবে। সকলের মনে হবে, সেলিম রহমানে রহিম হওয়ার জন্য শরীর স্থির করতে চাইছে। এবং বাংকের সঙ্গে মিশে গিয়ে অদৃশ্য হতে চাইছে।

বিজন বলল, বলিস তো আমরা সকলে মাস্তার দি’। সারেংকে বলি মাস্তার দিতে। এভাবে আর কতদিন ভুগবি। জ্বর কাশি—দেখে—শুনে তো ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।

 সেলিম সহসা উঠে বসল। তারপর আশ্চর্য রকমের স্নিগ্ধ এবং করুণাঘন মুখ করে হাসল। তারপর ফের দুঃখময় প্রকাশে বলল, বিজন রে, তোর মতো যদি একটু ইংরেজি বুলি জানতাম, তবে আমার সব হত। সারেঙ আর কাপ্তান কী বুদ্ধিই ধরেছে খোদাই জানে। তুই সকলকে বলে কয়ে মাস্তার দে। আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে বল। দেশে ফিরে বাঁচি।

বিজন এই বাংকে বসে কী করে যেন বুঝল সেলিমের এই দুরারোগ্য রোগ নিয়ে জাহাজে ষড়যন্ত্র চলেছে। সে ভেবে অবাক হল কেন সে সারেংকে বলল না, ওকে এবার অন্য ঘরে না রেখে উপায় নেই, অথবা কেন যে মেজ মালোমকে ডেকে একবার চিকিৎসার সুব্যবস্থার কথা বলতে পারেনি এতদিন! সেও আজ পোর্টহোল দিয়ে সমুদ্র দেখল। তারপর উপকূল। উপকূলে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে। সেলিমের মুখ পাণ্ডুর। জাহাজটা চলছে এবং সেলিমের শরীর নড়ছে। সেলিমকে দেখলে আত্মহননের কথা মনে হয়। বিজন বাংক থেকে ওঠার সময় সেলিমকে ফের লক্ষ্য করল, ওর কম্বলের ভিতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে হাসল। সেলিমও হাসল। ওরা পরস্পর দুঃখটুকু ধরতে পেরে ফের দুজনই অন্যমনস্ক হতে চাইল। বিজন দরজা ধরে বের হচ্ছে। সারেং—এর ঘরে উঁকি মেরে সে দেখে, তিনি নেই। ফোকসালে নেই। নিশ্চয়ই মেজ মালোমের কেবিনে অথবা ফরোয়ার্ডপিকে আছেন। বিজন ডেকের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকল।

বন্দরে জাহাজ ভিড়বে বলে সারেং ডেক—কসপের নিকট দড়িদড়া সব বুঝে নিচ্ছে। বিজন ডেক অতিক্রম করে কসপের ঘরের দিকে যাচ্ছে। সে একবার দাঁড়াল। বড় মালোমের পোর্টহোলে উঁকি দিল। বড় মালোম কেবিনে নেই। বিজনের ইচ্ছা হল বড় মালোমকে বলতে—আপনার জাহাজে এমন একটা মারণ রোগ পুষে রাখছেন, সেলিমকে হাসপাতালে দেওয়া হবে না, দেশে পাঠানো হবে না, কোম্পানির টাকা বাঁচানো হবে, অন্যান্য জাহাজিরা পর্যন্ত নিরাপদ নয়—এমতাবস্থায়ও আপনারা চুরি করে মদ গিলতে পারছেন!—আশ্চর্য! সে ভেবে আশ্চর্য হল। সে হাঁটল।

সে সারেঙকে বলল, চাচা চোখ বুজে আর কতদিন থাকবেন?

সারেং ফিসফিস করে বলল, তোমার এত মাথাব্যথা কেন? বেশ তো আছ। সফর করছ। তোমার তো কোনো অসুবিধা করছে না কোম্পানি।

সেলিমের মুখ দিয়ে কফের সঙ্গে রক্ত উঠছে। আপনি জানেন এটা অন্যান্য জাহাজিদের পক্ষে কত ক্ষতিকর। তাছাড়া দেখছি সেলিম বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। এ নিয়ে পাঁচ বন্দর হল অথচ কোনো বন্দরেই ওকে হাসপাতালে দেবার ব্যবস্থা করছেন না।

সব জানি বাপু। সব বুঝি বাপু। অথচ জেনেশুনেও চুপ করে আছি। বাড়িওয়ালার ইচ্ছা নয় সেলিম হাসপাতালে থাকুক। কোম্পানির অযথা এত খরচ করাতে বাড়িয়ালা রাজি হচ্ছে না।

তবে ওকে দেশে পাঠিয়ে দিন। দেশে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন।

দু—একজন করে তখন অন্য জাহাজিরাও ওর চারপাশে জড়ো হচ্ছে। ওরা শুনছে ওরা সারেং—এর মুখ দেখছে। বিজনকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। সেই লঘু পরিহাসজনিত অথবা হালকা সুরের শিস দেওয়া মুখ কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সমুদ্রের উদার নীল বিস্তৃতিতে ওরা কয়েকজন কেমন অসহায়ের ভঙ্গিতে ডেকে পদচারণা করছে। এনজিনের শব্দ, সমুদ্রের তরল ঠান্ডা হাওয়া ওদের নিঃশব্দ এই ভাবটুকুকে নিদারুণ দুঃখময় করে তুলছে।

রাত্রিতে সব জাহাজিরা যখন একত্রিত হল, একমাত্র আটটা—বারোটার পরীদাররা যখন নিচে বয়লারে কয়লা মারছে, যখন ওরা সকলে শুনল, জাহাজ বন্দর ধরবে সকাল দশটায়—রাতে আর পাইলট—বোট আসছে না, ডেক—জাহাজিরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে, তখন ওরা বিজনের ঘরে জড়ো হয়ে বলল, আমরা সকলে একযোগে বিদ্রোহ করব। আমরা সকলে জাহাজ চালাব না। কাপ্তান আসুক, ডেক—সারেং আসুক, কেউ আমাদের নড়াতে পারবে না। আমাদের কথা শুনলে আমরা ওদের কথা শুনব। সেলিমকে হাসপাতালে পাঠালে অথবা দেশে পাঠালে আমরা কাজে যাব। জাহাজ চালাব।

একজন বলল, জাহাজি বলে আমরা গোরু—ভেড়া নই।

অন্যজন বলল, জাহাজি বলে আমরা বিনা নোটিশে মরব তেমন দাসখত দেওয়া নেই।

অথচ দেবনাথ বলল, বিজন, এটা নিয়ে তোমার ক’সফর জাহাজে?

বিজন বিস্মিত হল। দেবনাথ ভালো ভাবেই জানে এটা ওর ক’নম্বর সফর। ভালো ভাবেই জানে প্রথম সফরে সে কোন কোম্পানির কোন জাহাজে কাজ করেছে। তবু দেবনাথ যখন এমন একটা প্রশ্ন করল এবং দেবনাথ যখন খুব জরুরি ভাবে ওকে প্রশ্নটা করেছে তখন একটা যথোচিত উত্তর দেওয়াই যুক্তিসংগত। সে বলল, তুমি তো জানো দেবনাথ—এটা আমার দু’নম্বর সফর।

এখনও তুমি ঠিক জাহাজি হওনি। তারপর কী ভেবে বিজনকে দেবনাথ অন্য ফোকসালে নিয়ে গেল। এখানে কেউ নেই, কেউ থাকে না। জাহাজিরা এখানে কাজে যাওয়ার আগে জামাকাপড় ছাড়ে। ঘরটা একেবারেই খালি। দেবনাথ ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। এবং বলল, তুমি এর মধ্যে থেকো না। শেষে সকলে বেঁচে যাবে, কেবল তুমি মারা পড়বে। কাপ্তান তোমার নলি খারাপ করে দেবে। তখন তোমার পিছনে ওরা কেউ দাঁড়াবে না। আমি ওদের ভালো করে চিনি।

বিজন কথা বলল না। চুপ করে দেবনাথের পরামর্শ শুনল। শেষে জবাব দিল, কিন্তু সেলিম যে মরে যাবে?

মরে যাবে তো তুমি কী করবে? তোমার উপর ট্যান্ডল আছে, সারেং আছে—ওরা দেখছে না, তুমি দেখে কী উপকারটা সেলিমের করবে? এটা মাত্র তোমার দু’সফর। অনেক দেখবে কিন্তু জাহাজে বিদ্রোহ করলে চলবে না।

তার জন্য কোনো প্রতিকারের দাবি আমরা তুলব না!

দেবনাথ খুব অভিজ্ঞ লোকের মতো বলল, বম্বের নৌবিদ্রোহের আমি আসামি। তাই তোমাকে এতগুলো কথা বললাম। তোমাকে মাস্তার দিতে বারণ করলাম। তা ছাড়া আমি এইসব জাতভাইদের চিনি। ওরা শেষ পর্যন্ত তোমার কথা কেউ বলবে না। ওরা ওদের জাতভাইদের কথা বলবে, সারেঙের কথাই শুনবে। মাঝখান থেকে তুমি ব্ল্যাক—লিস্টেড হবে।

বিজন আর কোনো কথা না বলে দরজা ঠেলে বের হয়ে এল। সে দেখল, সকলে ওর ঘরে তখনও পরামর্শ করছে। সকলে উদগ্রীব হয়ে আছে। বিজনকে দেখে ওরা বলল, চল, মাস্তার দি বোট ডেক—এ।

বিজন দেবনাথের কথাগুলো আর একবারের জন্য ভেবে নিল। আর একবারের জন্য সকলের মুখ দেখল। সকলের মুখ ভয়ানক হয়ে উঠেছে। বিজন বুঝতে পারল—এই সমস্ত মুখের ছবি মিথ্যা হবার নয়। ওরা কখনোই ওকে অন্ধকার পৃথিবীতে ঠেলে দেবে না। বিজন দৃঢ় গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখন সারেঙ নিচে নেমে এসে ডাকল, ইসকান্দার, সামসুদ্দিন, রহমান, শোভান। ওরা ধীরে ধীরে ঘর থেকে একান্ত বশংবদের মতো বের হয়ে যাচ্ছে। সারেং বলল, কাপ্তান তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

এই ঘটনায় বিজন খুব ভেঙে পড়ল। এবং অসহ্য উত্তেজনায় ভুগতে থাকল। প্রচণ্ড শীতের ভিতর সে ওর নিচের ঘরে পায়চারি করছে। দেবনাথ উপরের বাংকে শুয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে। পোর্টহোল দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে বলে বিজন কাচটা বন্ধ করে দিল। সারেং—এর সেই রক্তচক্ষুর কথা মনে হল এবং ভাবল কত সহজে সব নাবিকদের নিয়ে সে উপরে উঠে গেল। সে এই ফোকসালে, এই ঠান্ডায় পায়চারি করতে করতে ধরতে পারছে। ধরতে পারছে—সারেং ওদের কী বলছে এবং কী বলে ওদের প্রত্যয়কে ভেঙে দিচ্ছে। সেলিম এখনও কাশছে তার ফোকসালে—ফোকসালের অন্য বাসিন্দা কোরাণ—শরীফ পাঠ করছে বাংকে। সে পায়চারি করতে করতে সব শুনল। জাহাজটা নোঙর ফেলে আছে বলে স্টিয়ারিং ইঞ্জিনে কোনো শব্দ নেই। সবাই কেমন নিঃসঙ্গ, সব কেমন নিঃশব্দ যেন। ডেক থেকে সারেং—এর কথা ভেসে আসছে। সকলকে সারেং জোর গলায় কথাগুলো বলল। বলে ওদের ভয়ংকর বিদ্রোহের প্রতিবিম্ব মুছে দিল। সারেং ওদের বলল, তোরা তো জানিস কলকাতা বন্দরে চল্লিশ হাজার নাবিক খোদা হাফেজ বলত, এখন কিছু কিছু লোক ঈশ্বর, ভগবান বলতে শুরু করেছে। তোরা যদি বাঙালিবাবুদের কথায় মাতিস, তোরা যদি জাহাজে বিদ্রোহ করিস তবে তোদের চল্লিশ হাজার চল্লিশে নামতে আর বেশি দেরি নেই।

একসময় কাপ্তান সারেঙকে ডেকে পাঠালেন।

ব্রিজ থেকে কাপ্তান বললেন, কী বলছে সব?

ভাঙা ভাঙা ইংরেজি এবং হিন্দিতে ডেক—সারেং বলতে থাকল, সব গুড, সাব। সব ঠিক হ্যায়। জাহাজি লোক ভেরি গুড, সাব। বাঙালি বাবুলোক নো গুড, সাব। বাঙালি বাবুলোক গিভস ট্রাবল। বাঙালি বিজন, ইয়েস বিজন তেইল রূপায়াকা খালাসি, ও তো সাব রিংলিডার আছে। দুটো—চারঠু ইংলিশ স্পিকিং আছে, সাব। প্যাসেন্টকে লিয়ে কুছ ফাইট দেনে মাংতা। লেকিং নাও অলরাইট, সাব। বিগ বিগ টক লেকিন নো জব। ভেরি লেজি বাগার। সারেঙ এই পর্যন্ত বলে পায়ের কাছে থুথু ফেলল। ফের মুখ তুলতেই দেখল বাড়িয়ালা নিজের কেবিনে ঢুকে গেছেন। কেবিনে পেয়ালা—পীরিচের শব্দ। নিচে অফিসার—গ্যালিতে চিফ কুক আগুন পোহাচ্ছে। সিঁড়ি ধরে নামবার সময় সে এখানেও থুথু ফেলল।

সমুদ্রে সূর্য উঠছে। একদল পাখি উড়ছে আকাশে। দূরে ইতস্তত জাহাজ নোঙর করা। অনেকগুলো বয়া অতিক্রম করে পাইলট—শিপ। অনেকগুলো জেলেডিঙি এই শীতের ভোরেও মাছ ধরতে বের হয়ে পড়েছে। আকাশ নীল, সমুদ্র নীল। জাহাজের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। ওরা সমুদ্র ধরে উপকূলে উঠে যাচ্ছে। উপকূলের স্কাই—স্ক্যাপারগুলো ম্যাচবাক্সের মতো মনে হচ্ছে। এইসব দেখার জন্য জাহাজিরা ডেকে দাঁড়াল। অথবা দড়িদড়া টানার জন্য ডেক থেকে টুইন—ডেকে নেমে যাচ্ছে। এখন ওরা দড়িদড়া টানছে। হাসিল নিচে নামিয়ে দিতে চাইছে। মেজ মালোম গলুইয়ে চলে এসেছেন। বড় মালোম ফরোয়ার্ড—পিকে চলে গেছেন। বিজন হাসিল কাঁধে বড় মালোমের পিছনে ছুটছে। তিনটে টাগবোট এসেছে, পাইলট এসেছেন। পাইলট ডেক থেকে বোট—ডেকে এবং ব্রিজে উঠে গেলেন।

বড় মালোম বললেন, গতকাল তুমি জাহাজিদের উত্তেজিত করেছিলে?

বিজন হাসিল পায়ের নিচে রেখে বলল, হ্যাঁ, স্যার। করেছিলাম।

আমি খুশি হয়েছি শুনে। বড় মালোম কসপকে স্টোর—রুমে যেতে বলে এ—কথাগুলো বিজনকে বললেন।

ওদের ভিতর আর কোনো কথা হল না। একজন জাহাজি ফরোয়ার্ড—পিকে উঠে গেছে। ওরা ওয়ারপিন ড্রাম ঘুরাচ্ছে, ওরা উইঞ্চ চালাচ্ছে। তারপর হাপিজ—হাড়িয়া এই ধরনের কিছু শব্দ। বিজন এবং অন্যান্য জাহাজিরা প্রায় আধঘণ্টা ধরে ফরোয়ার্ড পিকে কাজ করল, বিজন এবং অন্যান্য জাহাজিরা সেলিমের দুঃখ, বন্দরের জীবন এবং দেশে ফেরার অথবা জাহাজে প্রথম দিনের গল্প নিয়ে কিছু সময় মশকরা, কিছু কাঁচা খিস্তি করল। কাজ শেষ হলে নীল উর্দি ছেড়ে ওরা দাঁড়িয়ে থাকল ডেকে। কেউ নিচে নামল না। খাড়ি ধরে জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। ওরা দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দৃশ্য দেখল। সমুদ্রের খাড়ি ধরে জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। দু’পাশে পাথরের পাহাড়; অতিকায় তিমি মাছের মতো কালো কালো সব পাথর। পাথরের পাহাড়। কুৎসিত এইসব পাথরের পাশে ছোট ছোট অনেক রকমের ফার—জাতীয় গাছ। পাতাগুলো শীতের হাওয়ায় কাঁপছে। নিচে সব নৌকো—বাইচ হচ্ছে। দু’পাশের জনতা চিৎকার করছে। এইসব দৃশ্যে ওরা সকলে মাটির গন্ধ নিতে চাইল এবং এই জনতার মতো উন্মত্ত হতে চাইল। এইসব দৃশ্য দেখে বিজন জাহাজি যন্ত্রণার উপশম খুঁজছে।

অথচ বিজন দীর্ঘ দু’সফরে প্রকৃত জাহাজির মতো বাঁচতে গিয়ে মাঝে মাঝে খুব বিব্রত হয়ে পড়ছে। পরিবারের কিছু সংস্কার, বিশেষত ধর্মের—সে কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। এখনও বিফ গ্যালিতে এলে সে ভালোভাবে খেতে পারে না। দেবনাথের মতো গোমাংস—ভক্ষণে তৃপ্তি নেই। জাহাজিদের প্রচণ্ড রকমের ইতর জীবনকে সে গ্রহণ করতে পারছে না। অথচ এইসব ইচ্ছাগুলো তাকে মাঝে মাঝে টানে। তখন সে কাঁচা খিস্তি করে, শিস দেয়, অযথা ফোকসালে বসে রঙের টব বাজায় এবং কাপ্তান ও তাঁর পারিষদদের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে।

বিজন একদা কিছু লেখাপড়া করেছিল অর্থাৎ গ্রামের বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ সমাপ্ত করেছিল। অন্য দশটা অসামাজিক ছেলে—ছোকরার মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজের খালাসিতে নাম লেখায়নি। বেঁচে থাকার জন্য এবং এই জীবনকে আরও দীর্ঘ করার জন্য এই জাহাজের কাজ, জাহাজি হওয়া। ‘হালিসহর’ এবং ‘ভদ্রা’র ট্রেনিং শেষ করেছে একদা, জাহাজের প্রথম সফরে দুনিয়া ঘুরেছে এবং ইংরেজি বুলিতে রপ্ত হয়েছে। জাহাজি হয়ে উপরি পাওনা হিসাবে চটপট পরিবেশকে মানিয়ে চলার স্বভাব এবং দেহজ আবেগধর্মিতার জন্য মানুষের ভালো করার সুকোমল বৃত্তির কিছু অধিকার সহজে পেয়ে গেছে। সেজন্য সেলিমকে কেন্দ্র করে একটি অশেষ দুঃখ ওকে এখনও মাঝে মাঝে উত্তেজিত করছে। খাড়ির সংকীর্ণতা এবং মানুষের এই আনন্দ সেই অশেষ দুঃখকে যেন আরও বাড়িয়ে দিল। সে বড় মালোমকে বলল, কতদিন থাকব এখানে স্যার? যেন তার জাহাজ ভালো লাগছে না।

বড় মালোম বললেন, বলতে পারছি না। ইঞ্জিন রুমে ইন্সপেকশান আছে।

সারেং বলল, সরফাই হবে জাহাজে। জাহাজ বন্দরে বসবে। ঠিক তখনই বিজন দেখল দুজন জাহাজি সেলিমকে ধরে ধরে বোট—ডেকে তুলছে।

কাপ্তানের সামনে দাঁড়িয়ে সেলিম বলল, সাব, আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিন। সারেং ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথাটা অনুবাদ করে শোনাল।

কাপ্তান বললেন, আমিও তা চাইছি। হাসপাতালে দিলে ওরা সহজে ছাড়বে না। জাহাজ এখান থেকে তোমার দেশেই যাচ্ছে। এই বলতে গিয়েই দেখলেন কাশির সঙ্গে সেলিমের মুখে রক্ত। সকলের সামনে ধরা পড়ে যাবে ভয়ে সে এখানেও কফটা গিলে ফেলল। কাপ্তান উপলব্ধি করলেন। তাহলে অসুখটা অনেক দূর গড়িয়েছে। কোম্পানির ওষুধ এবং ইনজেকশন কোনো কাজে আসেনি। তিনি সারেংকে ডেকে বললেন, ওকে সকলের সঙ্গে রাখা চলবে না। ওকে ওপরে তুলে আনো এবং কোনো খালি কেবিনে ফেলে রাখ। ওর ভাতের থালা এবং মগ ভিন্ন করে দাও। তোমরা কেউ ওর জিনিসপত্র ব্যবহার করবে না। কাপ্তান সারেংকে অন্যত্র নিয়ে কথাগুলো বললেন। বললেন, সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে সেলিম খারাপ রোগে ভুগছে। যে ক’টা দিন বাঁচে এ—জাহাজেই বাঁচুক।

তারপর তিনি সেলিমের সামনে বললেন, জাহাজ বন্দরে ভিড়লেই তোমাকে কোম্পানির ভালো ডাক্তার দেখানো হবে। আশা করছি তুমি শীগগিরই ভালো হয়ে উঠবে। ‘ঈশ্বর তোমায় করুণা করুন’ এই বক্তব্যে তিনি স্বয়ং জেসাস—এর মতো চোখ বুজলেন।

বাড়িয়ালার এই পাদ্রিসুলভ চেহারাতে সারেং বিমুগ্ধ হল। পির—পয়গম্বরের মতো তিনি হয়তো কোনো ওক্তে সারেংকে দোয়া জানাবেন। সে এবারে বলল, সাব, ইউ ফাদার। ইউর শিপ, ইউর ম্যান, ইউ সি সাব এভরিথিং। সারেং এইসব বলে এই মুহূর্তে দোয়া ভিক্ষা করছে। অর্থাৎ সেলিমের প্রতি বিগলিত করুণার অংশীদার হতে চাইছে।

বিজন ডেকে কাজ করতে করতে সব দেখল। সে জাহাজ জেটিতে বাঁধতে দেখল। বন্দরের পথ ধরে সব শহরবাসীরা সামনের ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। কিছু টিনের শেড অতিক্রম করে মাঠ। সেখানে মেয়েপুরুষরা এই শীতেও ক্রিকেট খেলছে। সে দেখল সেলিমকে ডেকের উপর দিয়ে দুজন লোক সেই নিঃসঙ্গ কেবিনটায় নিয়ে যাচ্ছে। সেলিম সেখানে থাকবে, সেখানে খাবে, সেখানে শোবে। বিজন এও বুঝল যেন সেলিম আর বেশি দিন বাঁচবে না। জাহাজের ওই ঘরটাতেই অন্য দিন বিজন এবং অন্যান্য কয়েকজন জাহাজি মিলে কিছু পাথর, দুটো বড় গানি—ব্যাগ যত্ন করে এক কোণায় রেখে দিয়েছিল। জাহাজে মৃত্যু হলে সমুদ্রে এই সব পাথর এবং গানি—ব্যাগ দিয়ে সলিল—সমাধি দেওয়া হবে। দেহজ আবেগধর্মিতার জন্য ওর সুকোমল বৃত্তিরা ওকে ফের অশেষ যন্ত্রণাতে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। কাপ্তানের নিষেধ আছে বলে সে আর ঘরে ঢুকল না। পোর্টহোলের কাচ ফাঁক করে দেখল, সেলিম বাংকে শুয়ে সেই পাথর এবং গানি—ব্যাগগুলো দেখছে। শরীরটা ওর স্থির। সে এখন কফ চুরি করে গিলে খাচ্ছে না। এখন সে নিচের পাত্রে কফ ফেলছে। এবং সঙ্গে কিছু রক্ত পুঁজ ফেলছে। পোর্টহোল দিয়েই বিজন কথা বলল, বিকেলে ভাবছি কিনারায় যাব। তোর জন্য কিছু আনব কি?

কী আর আনবি। মুখে আমার বিস্বাদ শুধু।

কিছু কমলা, কিছু আপেল?

সে অনেক দাম। অত দামের ফল আনবি না। আমার টাকার বড় দরকার, বিজন। দেশে ফিরব। শরীরের চিকিৎসা আছে, বিবি আছে, বাচ্চা আছে। ওদের জন্য ঘর করতে হবে। জমি করতে হবে। ঘর জমি হলে জাহাজে আর সফর দেব না। জমি—জিরাত দেখে, বিবি বাচ্চা দেখে আল্লার ঘরে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেব।

বিজনের মুখে বিষণ্ণ হাসি। পোর্টহোলের কাচ বন্ধ করে দেবার সময় সে ইচ্ছে করেই সেলিমের শরীর থেকে জোর করে চোখ তুলে নিল। ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ির ভিতর যে মুখ, যে মুখে একদা বসন্ত হয়েছিল, যে শরীর বাচ্চার জন্ম দিয়েছে—সেই মুখ, শরীর এবং দাড়ি, ওর চোখের সামনে মৃত অক্টোপাসের মতো পচা দুর্গন্ধময় ফুলো ফুলো শব হয়ে যাচ্ছে। সে জোর করে পোর্টহোলের কাচ বন্ধ করে দিল এবং ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।

ভোর থেকেই সমুদ্র থেকে হাওয়া উঠে আসছে। ঠান্ডা হাওয়া। বিকেলে সে—হাওয়ার গতি আরও বাড়ল। প্রচণ্ড শীতে বিজন ওভারকোটের পকেটে হাত ঢোকাল এবং কোনোরকমে ম্যাচটা বের করে সিগারেট ধরাল। এখানে হয়তো আরও ঠান্ডা পড়বে, সে ভাবল। প্রচণ্ড শীত মাটির শেষ উত্তাপটুকু যেন শুষে নিচ্ছে। দূরে পাইন গাছগুলো থেকে পাতা ঝরছে। গাছগুলো ক্রমশ হালকা করছে শরীর। তারপর একদিন এই শীতের দৃশ্য প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রস্তরীভূত হবে যেন পাইন গাছগুলো। পাখিরা এদেশে থাকবে না। ওরা অন্য দেশে পালাবে। ওরা অন্য দেশে ঘর বাঁধবে। আর্শির মতো আকাশ। রোদের উত্তাপশূন্য হলদে রঙ জাহাজের উপর ছায়া ফেলে অনেক দূর চলে গেছে। পাইনের শাখা—প্রশাখায় পাখির বাসাগুলো ঝুলছে। রোদ সেখানেও যেন চুরি করে উত্তাপ দিচ্ছে। তারপর জেটি অতিক্রম করে পথ। সে পথের মানুষজন দেখতে নিচে নেমে গেল। একটি বাদাম গাছের নিচে দাঁড়াল। এখানে দুটো পথ। সে কোন পথে যাবে চিন্তা করল দাঁড়িয়ে।

দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর বন্দর ধরলে এক অনন্য সুখের সন্ধান সে পায় এই মাটির স্পর্শে। বাদাম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ মাটির স্পর্শ নিল। সামনে শুধু শহর। ইট কাঠ। মাটির কোনো গন্ধ নেই সেখানে। সেখানে শুধু যানবাহন, কিছু কৌরীপাইনের ছায়া, পথের দু’পাশে অথবা এভিন্যুর মোড়ে মোড়ে আলো জ্বলছে—কাচের ঘর, মাংসের দোকান, রেস্তোরাঁ, কাফে, পাব। কোথাও ডেইজি ফুলের প্রদর্শনী অথবা আরও পিছনে সমুদ্রের খাঁড়ির অভ্যন্তরে নৌকা—বাইচ। এইসব ভালো লাগলেও মাটির স্পর্শের মতো সুখপ্রদ নয় যেন এরা। তবু সে হাঁটছে। তবু এই মানুষের ভীড়ে, মাটির গন্ধের জন্যে হারিয়ে যেতে ভালো লাগছে। সে দেবনাথের সঙ্গে বের হয়নি। দেবনাথ জাহাজ থেকে নেমে প্রথমেই কোনো পাব অনুসন্ধান করবে, প্রথমে পেট ভরে অন্তত বিয়ার খাবে এবং কোনো পাব অথবা কুকুরের রেসে না গিয়ে এখন শুধু এইসব সুন্দরী রমণীদের ভিড়ে বিজনের হারিয়ে যাওয়া। সে এই ভিড়ে হারিয়ে যেতে চায়। কেমন এক অশ্লীল শরীরী চিন্তায় দু’দণ্ড সে ওদের সঙ্গে কথা বলে সুখ পায়। অথচ সে ওর দেহজ কামনাকে রূপ দেবার ভঙ্গিটুকু এখনও ইচ্ছে করে আবিষ্কার করেনি। মূলত সে ভালো ভাবের জাহাজি হয়ে বাঁচতে চায়।

সে একটা দোকানে ঢুকে কিছু ফল কিনল সেলিমের জন্যে। মেয়েটি ওর হাতে ফলের প্যাকেট দিয়ে মাথা নোয়াল এবং হাসল। বিজন একগুচ্ছ মিমোসা ফুল দেখেছিল মিসিসিপি নদীর তীরে, কোনো যুবতী ওকে ফুলের গুচ্ছটি দিয়েছিল, এ—মেয়ের হাসি সে—যুবতীকে, স্মৃতির কোঠায় এনে দিল।

 সে ফলের দাম দিয়ে প্যাকেট হাতে রাস্তায় নেমে এল। ফেল্ট—হ্যাটটা আর একটু টেনে দিল কপালের উপর। এবং ওভারকোট টেনে পথের ভিড়, বিশেষ করে পথের সব ফুলের মতো মেয়েদের দেখতে দেখতে ঝুলন্ত ব্রিজের রেলিংয়ে এসে দাঁড়াল। সমুদ্র থেকে এখন তেমন জোরে হাওয়া উঠে আসছে না। সে এখানে দাঁড়িয়ে তা টের পেল। দুটো খোলা গাড়িতে পুরুষ—রমণীরা হাসতে হাসতে বন্দর থেকে শহরে উঠে যাচ্ছে। দুজন যুবক—যুবতী পরস্পর কোমর ধরে হাঁটছে। সে দেখল—ওরা দুজন নেমে যাচ্ছে এবং নিচে নেমে ব্রিজের থামের আড়ালে দাঁড়াল। সে স্পষ্ট দেখল ওরা রাস্তার উপরই প্রকাশ্য আলোতে কোমর জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে। এইসব দেখে বিজন হাঁটতে পারছে না। সস্তায় কিছু মদ এবং সস্তায় যৌন সংযোগের তাড়নায় সে বিব্রত হয়ে পড়ল। নাইটিঙ্গেল ধরে রাত যাপনের ইচ্ছায় সে পীড়িত হতে থাকল। অথচ যেমন করে প্রতি বন্দরে এ—ইচ্ছার জন্ম হয়েছে এবং যেমন করে প্রতি বন্দরে এ—ইচ্ছার মৃত্যু—কামনা করেছে আজও তেমন ধারণার বশবর্তী হয়ে সে হাঁটতে থাকল। ভালো ভাবের জাহাজি হতে গিয়ে সে গোলাপি নেশা করে জাহাজে ফিরবে ভাবল।

সে জাহাজের সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে এল। সেলিমের ফোকসালের দরজা বন্ধ। দরজার সামনে সে দাঁড়াল। ডাকল—সেলিম, ঘুমিয়ে পড়েছিস?

 সেলিম উঠে দরজা খুলছে। সে বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে দরজা খুলতে সেলিমের খুব কষ্ট। তবু সেমিল দরজা খুলবে এবং ওকে একটু ওর পাশে বসতে বলবে। দু’দণ্ড গল্প করতে চাইবে। দেশের গল্প, জোত—জমির গল্প। বিবি—বাচ্চার গল্প। অথবা মাছ এবং বনমুরগি ধরার গল্প। অথবা বর্ষাকালে কোড়া পাখি ধরবার সময় ধানক্ষেতের আলে কেমন করে নৌকায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে হয় তার গল্প। তখন দেখলে মনে হবে সেলিম যেন এ—জাহাজেও কোড়া ধরছে। কোড়া পাখি শিকার করছে।

দরজা খুললে সে ফলগুলি সেলিমের হাতে দিয়ে বলল, তোর জন্যে এনেছি।

এতগুলো!

বিজন একটু হেসে বলল, ভয় নেই। এবারেও তোর কাছে টাকা চাইব না। আমি তোকে খেতে দিলাম।

বিজন বাইরে এসে দাঁড়ালে সেলিম বলল, কোনো খবর পেলি? জাহাজ কোথায় যাচ্ছে, কবে ছাড়ছে?

ঠিক কিছু বলা যাচ্ছে না। এজেন্ট—অফিস থেকে কোনো খবর আসেনি। বড়মালোম শুধু বললেন, জাহাজে সরফাই হবে। কাল সব সাহেব—সুবোরা আসবেন। এনজিন—রুমে মেরামতের কাজ আছে অনেক। জাহাজ এখানে কতদিন বসবে কাপ্তান নিজেও বলতে পারেন না।

এবার চুপি চুপি সেলিম বলল, জানিস, কাপ্তানকে আমি বললাম, সাব আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। দেশে গেলেই আমি ভালো হয়ে উঠব। কাপ্তান বললেন, সেজন্যেই তো তোমাকে হাসপাতালে দিচ্ছি না। একবার হাসপাতালে গেলে তোমাকে ওরা সহজে ছাড়তে চাইবে না। তার অনেক আগেই তুমি দেশে পৌঁছে যাবে।

বিজনের বলতে ইচ্ছা হল, তা ঠিকই যাবি। তার অনেক আগেই যাবি। সে বিরক্তিতে ফেটে পড়ল। সারেং এবং কাপ্তান মিলে সেলিমকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সে আর কোনো কথা বলতে পারল না সেলিমের সঙ্গে। সেলিমের বিষণ্ণ দৃষ্টি ওকে অত্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সে ডেকে এসে নামল। কী মানুষটা কী মানুষ হয়ে গেল, ভাবল, সে সিঁড়ি ধরে ফের উপরে উঠছে। সমস্ত জাহাজে অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা জাহাজের উপরে এখন যেন কেউ জেগে নেই। কিছু কিছু জাহাজি বন্দরে নাইটিঙ্গেল ধরতে বের হয়ে গেছে—তাদের ফিরতে দেরি হবে। যারা শুধু নেশা করে ফিরবে তারা একটু বাদেই ফিরবে। বিজন গলুই ধরে হাঁটল। সে এখানে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরাল। অন্য জেটিতে কাজ হচ্ছে বলে তার কিছু শব্দ। নীল আর্শির মতো আকাশ। আকাশে নক্ষত্র জ্বলছে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ, নক্ষত্র, সমুদ্রগামী জাহাজের আলো অথবা গ্যালির পাশে ইঁদুরের ঘর দেখল। কাল ভোরে এ—জাহাজের মাল নামতে শুরু করবে। অন্ধকার রাত থেকে সব লোক উঠে আসবে ডেকে। ওরা কাজ করবে, গ্যালির আগুনে ওরা হাত—শরীর গরম করবে। আর তখন বাংকে পড়ে পড়ে দেশের কথা ভাবতে ভাবতে কাশবে সেলিম।

ভোরবেলায় বিজন এনজিন ঘরে নেমে গেল। তখন সমস্ত ফল্কায় কাজ হচ্ছে। উইঞ্চ—ড্রাইভার সিগারেট ধরাবার ফুরসত পাচ্ছে না। ক্রেন—মেশিন চালকেরা টুপি মাথায় নিচের ফল্কায় উঁকি মারছে। ফল্কায় সব কুলিদের কোলাহল। এজেন্ট—অফিস থেকে ক্লার্ক এসেছেন। তিনি ঘুরেঘুরে দেখছেন। মেজ মালোম দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছেন এক ফল্কা থেকে অন্য ফল্কায়। পাঁচ ফল্কায় পাঁচজন লোকের মুখে হাড়িয়া—হাপিজ শব্দ। মাল জাহাজ থেকে উঠছে, ফের বন্দরে নেমে যাচ্ছে।

এইসব দৃশ্যগুলো এখন জাহাজের ডেকে ঝুলছে।

গ্যালিতে ভাণ্ডারী নেই। বাটলারের ঘরে সে ক্রু—দের রসদ আনতে গেছে। ব্রিজে কাপ্তান পায়চারি করছেন, মেজ মিস্ত্রি নিচে নেমে গেছেন। বড় মিস্ত্রি এইমাত্র হাই তুলতে তুলতে টর্চ হাতে নিচে নামছেন। বন্দর থেকে সব কিনারার লোক উঠে আসছে। ওরা ডেক অতিক্রম করে এনজিন—রুমে নেমে গেল। বড় মিস্ত্রি ওদের নিয়ে সব এনজিন—রুমটা ঘুরলেন। বয়লারের ঘর দেখালেন। ছ’টা বয়লারের ট্যাংক—টপ, চক, টানেল পথ, কনডেনসার, এমনকি স্মোক—বক্সগুলো পর্যন্ত। তারপর ওরা বাংকারে বাংকারে ঘুরল। বিজন অন্ধকারে কোণে দাঁড়িয়ে সব দেখল। ওরা উপরে উঠে যাচ্ছে। সে ওদের দেশীয় ইংরেজি কথাগুলো কিছু কিছু ধরতে পারছে। জাহাজ এখানে বসবে অনেক দিন—এমনই ওরা যেন বলল। যেন বলল, জাহাজে অনেক কাজ, জাহাজডুবি হয়নি—জাহাজিদের সৌভাগ্য।

বিজন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা পোর্টসাইডের বয়লারের নিচু অংশ। হাঁটু পর্যন্ত ছাই জমে আছে এখানে। নিচে কিছু পুরোনো বেলচে, শাবল, র‍্যাগ, স্লাইশ। কিছু ফায়ার—ব্রিজের প্লেট। ওপরের আলোটা নেই। এখানে অন্ধকার। সে এখান থেকে এনজিন—কসপের ঘরে উঠে গেল। ডেক—কসপের জন্য দুটো তামার প্লেট চাইল। তারপর সে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতেই বন্দরের একজন শ্রমিক বলল, গুড মর্নিং, মিস্টার।

ইয়েস, গুড মর্নিং।

বিজন বুঝল লোকটি কাজের ফাঁকে ওর সঙ্গে একটু গল্প করতে চায়। লোকটি হয়তো সস্তায় সিগারেট কিনতে চায়।

লোকটি ফের বলল, ইয়ু গ্যান্ডিম্যান?

বিজন বলল, ইয়েস।

দেবনাথ গ্যান্ডিম্যান?

বিজন বলল, ইয়েস।

দেবনাথের সঙ্গেও ওর আলাপ হয়েছে দেখে বিস্মিত হল।

লোকটি ফের বলল, অল ড্যাড়িওয়ালা পাকিস্তানি?

লোকটি তবে এইসব খবরও রাখে। সে বলল, ইয়েস।

বিজন হেঁটে যাচ্ছে ডেক ধরে। শ্রমিকটি ওর পিছু পিছু এল। এবং পকেট থেকে একটি ইউক্যালিপটাসের বোতল বের করে বলল, ইটস ফর ইউ।

বিজন এবারেও আশ্চর্য হল। দামি এই অয়েলটুকু পেয়ে বিজন খুব খুশি হল। বলল, কাম অন। কত দাম দিতে হবে?

কোনো দাম নেই। আমাকে এক শিশি সরষের তেল দেবে। দেবনাথও দেবে বলেছে। তেলটা আমি মাথায় দিচ্ছি। ইন্ডিয়া থেকে জাহাজ এলেই আমি এ—তেলের জন্য ডেকে কাজ নিয়ে উঠে আসি। তেল সংগ্রহ করি এবং তেলটা মাথায় দি। রাতে আমার ভালো ঘুম হয়।

ওরা সেলিমের কেবিন অতিক্রম করার সময় সেলিম পোর্টহোলের ভিতর থেকে কয়েদির মতো উঁকি দিল। সেলিম বাংকে বসে পোর্টহোল দিয়ে এইসব মানুষদের কাজ দেখছে। হাড়িয়া—হাপিজের শব্দ শুনছে। ড্যারিক উঠতে নামতে দেখছে। এইমাত্র এই পথ দিয়ে বড় মালোম গেলেন। দুটো মেয়ে গেল—বোধ হয় বড় মিস্ত্রির ঘরে অথবা ছোট মিস্ত্রির বাংকে। সে এখানে বসে দূরের পাইন গাছ দেখতে পেল। এবং পোর্টহোলের কাচ পেরিয়ে বিজনকেও চলে যেতে দেখল।

শ্রমিকটি বলল, ম্যান ইজ সিক?

সে বলল, ইয়েস, সিক। টিবিতে ভুগছে।

টিবিতে ভুগছে! হাসপাতালে দিচ্ছে না! বড় আশ্চর্য! যেন শ্রমিকটি ঝুপ করে আকাশ থেকে পড়ল।

বড় আশ্চর্য! বিজন হাঁটতে থাকল। লোকটি ওর পাশাপাশি হাঁটছে। সে বলল ফের, এ নিয়ে পাঁচ বন্দর ঘোরা হল। কাপ্তান এতদিন হাসপাতালে দেবেন দেবেন করছিলেন, এখন শুনতে পাচ্ছি দেওয়া হবে না। জাহাজ দেশে ফিরবে। সেও দেশে ফিরবে।

এসব দেখেও তোমরা চুপ করে আছ!

বিজন দেখল লোকটি যেন এই মুহূর্তে বিদ্রোহ করে সকলকে জানাতে চাইছে, জাহাজে একজন জাহাজি টিবিতে ভুগছে অথচ ওকে হাসপাতালে দেওয়া হচ্ছে না, কাপ্তান কোম্পানির টাকা বাঁচাচ্ছে। আপনারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র পেশ করুন।

শ্রমিকটিকে বেশ চিন্তিত দেখাল। পাশের অন্যান্য কুলিদের সে ঘটনাটা খুলে বলল। ওরা সকলে একত্র জমা হচ্ছে। ওরা এই নিয়ে জটলা পাকাতে চাইছে যেন। ওরা যেন বলতে চাইছে—তোমরা সেলর, তোমরা এইসব সমুদ্রগামী জাহাজগুলোকে বন্দর থেকে বন্দরে নিয়ে যাও, ঝড়ের দরিয়া পার করে জাহাজের কোম্পানির প্রতিপত্তি বাড়াও—আর তোমাদের চিকিৎসা হবে না, তোমাদের জন্যে হাসপাতালের বন্দোবস্ত থাকবে না, কোম্পানি বেইমানি করবে, তোমরা ভেড়ার মতো ঘাস খাবে—সে ঠিক কথা নয়। তোমরা বিদ্রোহ কর। সে বিদ্রোহে আমরা যোগদান করব। তোমাদের একতার অভাব, আমাদের একতা ইচ্ছা করলে ধার নিতে পারো। দেউলিয়া হবার ভয় নেই।

ভিতর থেকে লম্বা লোকটি বের হয়ে বিজনকে বলল, ইউ বেটার গো টু মিস্টার ট্রয়। তিনি সিম্যান ইউনিয়নের সেক্রেটারি। ঠিকানা—পাঁচ কলিন স্ট্রিট; স্টেশনের পাশ দিয়ে যে বড় এভিন্যুটা পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে সেখানে গিয়ে খোঁজ করবে। তাঁকে পেলে, ঘটনাটি খুলে বলবে। তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন।

বিজন ওদের ধন্যবাদ জানাল। এবং কেবিনে ঢুকে লোকটিকে এক বোতল সরষের তেল দিয়ে বলল, ইউ হ্যাভ ডান এনাফ। আমি আজই মিঃ ট্রয়ের কাছে যাব।

অথচ সে দেবনাথের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিল—এইসব আবেগধর্মিতার লক্ষণগুলো ভালো নয়। সেলিমের উপকার করে তোর কী আখের হবে এমন ভাব দেবনাথের মুখে। সুতরাং স্পষ্টতই দেবনাথ যেতে রাজি হল না।

বিকেল। শীতের বিকেল। চারটে না বাজতেই শীতের সমুদ্রে অলস সূর্য উত্তাপের জ্বালায় ডুব দিচ্ছে। গাছগুলো নেড়া নেড়া। ইউক্যালিপটাসের পাতা খসে পড়ছে। আকাশ থেকে যেন শীতের তুষার ঝরছে। ঠান্ডা ঠান্ডা, হাত—পা জমে যাবে ভাব। বিজন হাতের দস্তানা টেনে দিল। টুপিতে কপাল ঢেকে দিল। তারপর ধীরে ধীরে গ্যাংওয়ে ধরে নেমে গেল। সমুদ্র থেকে শীতের হাওয়া ফের উঠে আসছে।

ইচ্ছা হল বন্দরে নেমে ট্যাক্সি করার। ইচ্ছা হল দু’ শিলিং—এর আপেল কেনার। এবং ইচ্ছা হল এভিন্যুর টিন—কাঠের ঘরের ভিতর ঢুকে দু দণ্ড জুয়া খেলার। তবু সেলিমের জন্য আপাতত হাঁটতে থাকল সে। ধীরে ধীরে হেঁটে গেল, ঝুলন্ত ব্রিজ অতিক্রম করতে পনেরো মিনিট, সিম্যান—মিশান বাঁয়ে ফেলে রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করতে অনধিক পনেরো মিনিট—তারপরই চড়াই পথে উঠতে গিয়ে কলিন স্ট্রিট মিলবে। নাম্বার ফাইভ কলিন স্ট্রিট। মনে মনে নম্বর মুখস্থ করার মতো উচ্চারণ করল কথাটা এবং দুটো সুন্দরী মেয়েকে রমণীয় হতে দেখে শিস দিয়েও ফেলল। এবং যদি ওরা প্রশ্ন করে ওর শিস শুনে, তুমি সিম্যান?

সে বলবে, ইয়েস।

যদি বলে, ইন্ডিয়া থেকে এলে?

সে বলবে, ইয়েস?

যদি বলে, তুমি গান জানো?

সে বলবে, ইয়েস।

তুমি ক্রিকেট খেতে পারো?

সে বলবে ইয়েস।

সুতরাং ওর গান, খেলা এবং এই শঠতা সবই ইয়েসের কোঠায় পড়বে।

বিজন নিজের মনেই হেসে ফেলল। সুন্দরী রমণীরা এখন ঝুলন্ত ব্রিজের উপরে উঠে যাচ্ছে। ব্রিজের রেলিং ধরে কিছু মেয়েপুরুষ গুঞ্জনে মশগুল। অথচ সুন্দরী রমণীরা ওকে দেখেও প্রশ্ন করল না। ওর শিস দেওয়ার অর্থকে ব্যতিক্রম বলে ভাবল না। সুতরাং সে জোরে জোরে হেঁটে ওদের পিছনে ফেলে নিচে নেমে একটি চলন্ত ফলের দোকান থেকে দু’শিলিং—এর আপেল কিনল। তারপর বুলফাইটের বিজয়ী মাটাডরের মতো এইসব সুন্দরী রমণীদের এবং সুন্দর পুরুষদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে গেল। বের হয়ে যাচ্ছে। সে হাঁটছে। এখন যেন সহসা মনে হল সেলিম পীড়িত। সে বাংকে শুয়ে রক্ত তুলছে মুখে। দেশে একমাত্র পিসিমা বেঁচে আছেন, তাঁকে টাকা পাঠাতে হবে। আজও বয়স্কা সুন্দরী রমণীদের দেখলে সে তার মাকে স্মৃতির কোঠায় সংগ্রহ করতে পারে। সে সামনের বয়স্কা সুন্দরী রমণীকে প্রশ্ন করল উড ইউ হেলপ মি? আপনি কি আমাকে কলিন স্ট্রিটে যেতে সাহায্য করবেন?

বয়স্কা সুন্দরী রমণী বলল, তুমি কি স্ট্রেঞ্জার?

সে বলল, ইয়েস। আমি সেলর।

এ বন্দরে প্রথম এলে?

ইয়েস, এই প্রথম এসেছি।

ইওর কানট্রি?

বিজন দেশের নাম করল।

অল রাইট। তুমি এসো। তুমি গ্যান্ডিম্যান। তুমি ভালো লোক আছ এমন ভাব যেন বয়স্কা সুন্দরী রমণীর চোখে।

বিজন শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে গেল। সে দীর্ঘস্থায়ী আলাপে রাজি হল না। নতুবা এদের ভিন্ন ভিন্ন রকমের সংশয় আর দুঃসহ রকমের প্রশ্নের মুখে পড়ত—এখনও দুর্ভিক্ষ আছে? এখনও মহামারি হয়? এখনও সন্ন্যাসীরা গাঁজা খেতে খেতে ধর্মালোচনা করে? এখনও হিমালয়ের বুকে নাক জাগিয়ে সাধু মহান্তরা বরফের নিচে ঈশ্বর—উপাসনা করছেন?

প্রায়ই সে এইসব ক্ষেত্রে চটপট উত্তর দেবার ভঙ্গিতে সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এবং কিছু বলে পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা করে। সত্য—মিথ্যা—যে—কোনো প্রকার। এসব ক্ষেত্রে সে কখনও নিজেকে ছোট করবে না। নিজেকে, নিজের দেশকে ছোট করার ইচ্ছা তার কোনোদিন হয়নি।

একদা ভিক্টোরিয়া বন্দরে একজন ব্রেজিলিয়ান গার্ল বলেছিল, তোমার চোখ বড় গভীর, তোমার চোখ কবিতার মতো।

সে বলেছিল, আমি যে কবিতা লিখি।

একদা একটি চিলি—কন্যা বলেছিল, তোমার কোমর খুব সরু। তোমার এই দীর্ঘ কোমল চেহারা নাচিয়ের মতো।

সে বলেছিল, একদা আমি ব্যালেতে নাচতুম।

বিজন এইসব ভাবনার ভিতর এভিন্যু ধরে উপরে উঠে যাচ্ছে। রেল—স্টেশন অতিক্রম করে সে ডাইনে মোড় ঘুরল। এখানে সে কিছু ফুলের গাছ দেখল। মিমোসা—ফুলের গুচ্ছের মতো এইসব ফুলেরা গাছে ঝুলছে। যারা পথ ধরে যাচ্ছে, ফুলেরা তাদের শরীরের উপর ঝরে পড়েছে। বিজনের ব্লু—ব্ল্যাক কোটের রঙে জাফরি রঙ ধরাল। সে অনেকক্ষণ এইসব গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। চারিদিকে নিয়ন আলো, কাচের ঘরে আলো জ্বলছে। এই আলোর ভিড়ে এইসব শ্বেতাঙ্গ রমণীদের বিজনের বড় ভালো লাগল। ওর আর ইচ্ছে হচ্ছে না এক পা নড়তে। ওর ইচ্ছে নেই এখন কলিন স্ট্রিটের পাঁচ নম্বর বাড়িতে ঢুকে নীরস আলোচনায় ডুবে যেতে। তার চেয়ে বরং এই ভালো। বিদেশি এইসব ফুলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড সাগরের দুঃখকে ভুলে এই সুখ—দুঃখে ডুবে যাওয়া।

অথচ সে দাঁড়াতে পারল না। বন্দরে সেলিম, ওর কাশি, ওর নিরীহ মাছের মতো চোখ বিজনকে তাড়া দিচ্ছে। বিজন ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তা অতিক্রম করে বড় হলঘরটায় ঢুকে গেল। গায়ে পেতলের প্লেটে লেখা—পাঁচ, কলিন স্ট্রিট, পাথরের উপর খোদাই করা সাইনবোর্ড। লেখা আছে—জাহাজিরাও আপনার আমার মতো মানুষ।

এইসব বড় বড় হরফে বড় বড় কথা পড়তে পড়তে বিজন হলঘরে ঢুকে গেল। পাথরের দেয়ালে বড় বড় ছবি ঝুলছে। পায়ের নিচে মসৃণ পাথরের ওপর প্রতিবিম্ব ভাসছে। মসৃণ পাথরে ওর চেহারা আয়নার মতো ধরা পড়ছে। বিজন সন্তর্পণে হাঁটল। সন্তর্পণে পাথরের আর্শিতে নিজের মুখ দেখল, কারণ অন্য কোনো মুখ অথবা অন্য কোনো শব্দ এ—হলঘরে ভেসে উঠছে না। সে বিস্মিত হল। পাথরে দেয়ালে কিছু তৈলচিত্র। কিছু দামি আলো এবং এইমাত্র পালিশ—করা জুতোর রঙে এইসব দেয়াল, এইসব ছবি। সে একবার ভাবল বরং চলে যাওয়া যাক। বরং কাল দেবনাথকে বলেকয়ে একসঙ্গে আসা যাবে। এই নিঃসঙ্গ পুরীতে বিজন ভীত এবং বিহ্বল হয়ে পড়ল। অথচ সে এখন দেয়ালের কিছু কিছু তৈলচিত্র চিনতে পারছে—ওরা শেক্সপিয়ার, টলস্টয় এবং আরও সব মনীষীদের পাশে ট্যাগোর—জন্ম ১৮৬১… মৃত্যু ….. কী একটা সালের নাম। ট্যাগোর ………. তারপর জন্ম—মৃত্যুর কথা ভেবে ওর কিঞ্চিৎ সাহস জন্মাল। সে চারিদিকে চোখ তুলে একবার তাকাল। উত্তরের দিকে পাথরের দেয়ালের একটা দরজা স্বয়ং খুলে যাচ্ছে। এবং একজন প্রৌঢ় বের হয়ে আসছেন। তিনি যেন কোনো যক্ষপুরী থেকে উঠে আসছেন। সে তাকেই কোনোরকমে প্রশ্ন করল, মিঃ ট্রয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্রশ্ন করে ট্যাগোরের ছবির প্রতি ফের নজর ফেলে নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে গৌরব বোধ করল।

ভদ্রলোক বললেন, দরজা ঠেলে ভিতরে যান। ওর স্টেনো এলবি আছেন। তাঁকে প্রশ্ন করুন। শেষে ভদ্রলোক ওকে গুডবাই ভঙ্গিতে বিদায় জানালেন।

বিজন একান্ত বশংবদের মতো দরজা ঠেলতেই ভিতর থেকে জবাব এল, কাম ইন, কাম ইন!

বিজন এই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কোনো মুখ দেখতে পাচ্ছে না অথচ অপ্রত্যাশিত মেহমানের মতো ডাক ওকে বিচলিত করছে। যেন সে দেয়াল—ঘেরা কোনো যক্ষপুরীতে এসে ঢুকেছে। সেখানে দেয়ালের ভিতর থেকে নারী—কণ্ঠের জবাব, কান ইন, কাম ইন। এবং সে ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে গেছে বলেই দেখতে পেল মেয়েটি টেবিলের উপর ঝুঁকে কাজে ব্যস্ত। মেয়েটি একবার চোখ তুলে দেখছে না। দেখল না। কে এল কে গেল, সে দেখল না। সে হাত তুলে ইশারায় ওকে সামনের চেয়ারে বসতে বলছে। ছোট চিলতে করিডরের মতো এই একফালি ঘরে একটি টেবল সহ মেয়েটিকে খুব ভিন্নধর্মী বলে মনে হচ্ছে।

 সে চেয়ারে বসে ইতস্তত দেয়ালে নজর দিতেই দেখল মেয়েটির দেয়ালের কীলকেও রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং—যেন উপস্থিত। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং স্মিত হাসিতে এইসব অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করছেন। ছবিটি হাতে আঁকা বলেই বিজনের মনে হল। কোনো ছবির যেন নকল। এইটুকু দেখে এবং ভেবে বিজনের বিচলিত ভাবটুকু কেটে গেল। সে বলল, মিঃ ট্রয় থাকলে দেখা করতাম।

এলবি চোখ তুলে বিজনকে দেখল। একজন সুপুরুষ বিদেশি যুবাকে দেখল। যুবাকে দেখে চোখেমুখে কোনোও ভাবান্তর নেই। বিজনকে দেখে লেজারে হিসাব কষছে এমন ভাব চোখে। চোখের পাতা পড়ছে না—দৃষ্টি এমন দৃঢ়, আত্মপ্রত্যয়ে গভীর। এই নির্লজ্জ ভাবটুকু বিজনের ভালো লাগল না। বস্তুত বিজন খুব আড়ষ্ট বোধ করছে।

তিনি তো নেই। তোমার কী দরকার আমাকে বলে যাও। তিনি এলে বলব।

বিজন বলল, প্রয়োজন আমার অনেক। তোমাকে আমার প্রয়োজনের কথা অনেকক্ষণ ধরে শুনতে হবে।

শুনব।

সব ঘটনাই মিঃ ট্রয়কে কিন্তু বলতে হবে।

এলবি হাসল। এলবি বিদেশি যুবাকে ফের কৌতূহলের চোখ নিয়ে দেখছে। এবং সেই পুরুষের মতো দৃষ্টি—যা বিজন সহ্য করতে পারছে না। সে এলবিকে সাধারণ যুবতীর মতো দেখে, খুশি হতে চাইল।

এলবি বলল, তুমি বল, আমি নোট করছি।

নিজের ভুলটুকু বুঝতে পেরে বিজনও হাসল।—তোমাকে নোট নিতে হবে না। মুখে বললেও চলবে। ঘটনা হচ্ছে পার্থ বন্দরে ….

এলবি এ—সময়ে বাধা দিল বিজনকে, জাহাজটার নাম বল। তোমরা কোন দেশের ক্রু, কোন দেশ থেকে এসেছ সব বলতে হবে।

জাহাজের নাম ‘এস এস টিবিড ব্যাংক’। আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি।

তারপর?

বিজন জাহাজের সব ঘটনা, সেলিমের বর্তমান অবস্থা, এমনকি সারেং এবং কাপ্তানের গোটা চক্রান্তের কথাও খুলে বলল। বিশেষ করে মেয়েটির স্বাভাবিক আগ্রহে সব খুলে বলতে পারল। এখন সে আর কোনো আড়ষ্টতায় ভুগছে না। এখন সে রবীন্দ্রনাথকে দেখে রীতিমতো উত্তেজিত হতে পারছে। সে এবার একটু ঝুঁকে বলল, এর একটা বিহিত করতেই হবে দয়া করে। নতুবা বেচারা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। বেচারার ঘরে বিবি আছে। ছোট একটি মেয়ে আছে। ওরা সব ওরই পথ চেয়ে বসে আছে।

এখন বিজনকে দেখলে কে বলবে, এ জাহাজি বিজন। কে বলবে এ বিজন কথায় কথায় শিস দেয়। কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলে বিদেশি রমণীকুলে বাহবা নিতে চায়! বিজনের চোখ—মুখ মানুষের ভালো করার প্রবৃত্তিতে বস্তুতই সজল হয়ে উঠেছে এখন।

এলবি বলল, ও ঠিক আছে। মিঃ ট্রয় এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। জাহাজিদের ভালো করাই আমাদের কাজ।

বিজন ওঠবার সময় ফের রবীন্দ্রনাথকে দেখল এবং অদম্য কৌতূহল চাপতে না পেরে বলল, আমরা ট্যাগোরের দেশ থেকে এসেছি। তোমরা ট্যাগোরের ভক্ত দেখছি। দেখি তোমরা এখন আমাদের জন্য কতটা কী করতে পার।

তুমি ভারতবর্ষের লোক? কিন্তু ভারতবর্ষ তো বিরাট দেশ। এখানে পাঁচ বছর আছি। ভারতবর্ষ থেকে আসা কিছু কিছু জাহাজিদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। অথচ দুর্ভাগ্য ওরা কবির ছবি দেখেও কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেনি। বিশ্রী ধরনের পোশাক পরে এখানে এসেছে। চেয়ারে না বসে মেঝেতে বসে পড়েছে। শীতে দেখেছি ওরা ভয়ানকভাবে কাঁপত। শীতের গরম জামাকাপড় পর্যন্ত নেই।

বিজন বলল, ওরা এখনও আছে। জাহাজে গেলে তুমি ওদের এখনও দেখতে পাবে।

এলবি বলল, ভারতবর্ষের লোক ভাবতে তোমাকে কষ্ট হয়।

বিজন বলল, মাপ করবেন। যারা তখন ছিল এখনও আছে। তাদের জাহাজি জীবনের এক বিচিত্র অধ্যায় আছে। ওরা আসছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, সন্দীপ অঞ্চল থেকে। ওরা অজ্ঞ। চাষি পরিবার থেকে আসছে।

বিজন ভাবল—এইসব জাহাজিদের জাতীয় পোশাকের প্রতি এলবির তীব্র ঘৃণা। বস্তুত লুঙ্গি এবং কাঁধে গামছা ফেলে এইসব জাহাজিদের বড় বড় এভিন্যু ধরে হাঁটা এবং নিজেদের ভারতবাসী বলে পরিচয় দেওয়া এলবির কাছে বিশ্বকবিরই যেন অবমাননা। সেজন্য বিজনের দুর্লভ ইংরেজি বলার কায়দা এবং উজ্জ্বল বিদেশি পোশাক, উপরন্তু কবির প্রতি শ্রদ্ধাটুকু এলবিকে বিজন সম্বন্ধে অভিভূত করেছে। বস্তুত এলবি ভারতবর্ষের দারিদ্র্যকে সহ্য করতে পারে না। আজও পারছে না। ওর চোখেমুখে এইসব যেন ধরা পড়ছে।

বিজন বলল, ওরা অজ্ঞ নিরক্ষর বলেই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ওদের কোনো কৌতূহল নেই।

এলবি সহসা বলল, বাবা কবিকে ইউরোপে দেখেছেন। তুমিও কবির দেশের লোক। তুমি কবিকে দেখেছ?

সহসা এই প্রশ্নে বিজন কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে পড়ল। ওর জাহাজি মনটা ধীরে ধীরে ওর অস্তিত্বকে গ্রাস করছে। সে বলল, নিশ্চয়ই। নিমতলা থেকে বটতলা বেশি দূরে নয়। নিমতলার কাছেই জোড়াসাঁকো। আমার ছেলেবেলায় কত ও—পাড়ায় কত খেলতে গেছি। কতদিন আমরা কবিকে দেখে প্রণাম করেছি। তিনি তখন প্রায় অচল।

তুমি ওঁকে প্রণাম করেছ! তুমি ওঁকে স্পর্শ করতে পেরেছ!

বিজন বিনয়ের আধার হয়ে গেল। বিজন বলল, কবি আমাদের আশীর্বাদ করতেন। বলতেন ভালো ছেলে হবে, দেশের দুঃখ দূর করবে।

এলবি ফের আশ্চর্য এক শ্রদ্ধার ভঙ্গিতে বলল, তুমি ওকে স্পর্শ করতে পেরেছ, প্রণাম করতে পেরেছ!

বিজন দেখল এলবির চোখ দুটো শ্রদ্ধায় গভীর হয়ে উঠছে। এলবি একবার ঘাড় ফিরিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখল, একবার বিজনকে দেখল। কবির খুব নিকটের একজন যুবাকে স্পর্শ করার প্রকট ইচ্ছায় সে হাত বাড়িয়ে দিল। যেন বলতে চাইছে—তুমি বি—জন, তুমি কবিকে স্পর্শ করেছ, তুমি কবির দেশের, ঘরের লোক। এলবির মনে এই ভাবগুলো কাজ করছে।

এলবি বলল, বাবা তখন ইউরোপে ছিলেন। বাবা কবিকে ইউরোপে দেখেছেন। বাবা মাকে এবং আমাকে বলতেন, হি ইজ এ সেইন্ট, জাস্ট অ্যাজ পিটার অর পল। বিজন সেই ঋষিপুরুষদের আশীর্বাদ পেয়েছে। এলবি বিজনের আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাইল।

এলবি বলল, তোমরা আর কতদিন থাকবে এ—বন্দরে?

প্রায় মাস দুই। জাহাজ এখানে মাস দুই বসবে। ড্রাইডক হবে। মেরামত হবে।

সহসা এলবি বলে বসল, আমার একটা অনুরোধ তোমায় রক্ষা করতে হবে।

বিজন একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তবু সে বলল, বল; রাখব। যদি ক্ষমতায় কুলোয় নিশ্চয়ই রাখব।

তোমার কাছে আমি ট্যাগোরের কবিতা বাংলা—ভাষায় শুনতে চাই। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা। যখন থেকে ট্যাগোরের কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই তখন থেকে ইচ্ছা—তোমার দেশে যাব, ভারতবর্ষকে দেখব। কবির শান্তিনিকেতন দেখব। আমি এইজন্য প্রথম থেকেই টাকা জমিয়ে আসছি। কবির কবিতা বাংলা ভাষায় শুনব—কত দিনের ইচ্ছা আমার!

তার জন্য কী আছে—সেলিমের ঝামেলাটা চুকে যাক। তারপর একদিন তোমায় শোনানো যাবে।

এলবি চোখ বুজল। যেন রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর দেশকে, বিজনকে অনুভব করার জন্যই চোখ বুজল। বিজন এই আবেগধর্মিতায় বিমুগ্ধ হল না। বরং পীড়িত হল। সাহিত্যের অ—আ—ক—খ সম্বন্ধে যার কোনো স্পৃহা নেই, তাকেই এই নিদারুণ সত্যে টেনে আনার কী যে অর্থ, বিজন বুঝতে পারল না। তবু সে ভাবল, হাতে অনেক দিন, পরে ভেবে যা কিছু একটা বলা যাবে।

বিজন এবার উঠতে চাইল এবং বলল, তোমার নামটা জানা হল না।

এলবি বলল, আমাকে সকলে এখানে এলবি বলেই জানে। পুরো নাম সিসিল এলবার্টি। মিস এলবার্টি বলেও ডাকতে পারো।

এলবি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিল, আমি তোমায় কবিতা শোনাব। ট্যাগোরের কবিতা।

বিজন ভাবল, আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। সে উঠে পড়ল।

এ সময় এলবি ওর সামনে এসে দাঁড়াল এবং হ্যান্ডশেক করল। তারপর প্রশ্ন করল, জাহাজ তোমার কোন ডকে নোঙর ফেলেছে?

সাউথ—ওয়ার্ফে। বিজন এবার দৌড়ে পালাবার মতোই হলঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে গেল এবং দুঃসহ ভার থেকে যেন মুক্ত হল।

ডেকে তখন পুরোদমে কাজ চলছে। এনজিন রুমেও। এনজিন—রুমে বড় বড় প্লেট সব স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে। বড় বড় সব অক্সিজেনের সিলেন্ডার নামানো হচ্ছে। ফল্কায় ফল্কায় কাজ; জাহাজিরা রঙ করছে ফানেলে, বোট—ডেকে। একজন দুজন করে সকলে উঁকি মেরে যাচ্ছে সেলিমের কেবিনে। বিজন গতকালের ঘটনার কথা কাউকে বলেনি, সে এ ব্যাপারে যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করতে চায়। শুধু আজ সে কিনারার লোকেদের ডেকে সেলিমের অবস্থা দেখাচ্ছে। দেখাল—এইখানে সেই লোকটি থাকে, তাকে তোমরা দেখে যাও।

প্রচণ্ড শীত এবং হাওয়ার জন্য জাহাজিদের হাতে কাজ তেমন জমছে না। ওরা ফানেলের উপর ঝুলে অথবা বোটের উপর দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছিল। মাঝে মাঝে গ্যালিতে গিয়ে আগুনের উত্তাপ নিয়েছে। শক্ত হয়েছে ওরা এবং রাত্রির কোনো আকস্মিক যৌন ঘটনার কথা ফলাও করে বলে কোনো জাহাজি বাহবা নিতে চাইছে।

বিজন নিচে দাঁড়িয়ে ফানেলে যে রঙ করতে উঠে গেছে তার দড়িদড়া ঢিল দিয়ে অথবা শক্ত করে বেঁধে রেখে কাজে সাহায্য করছে। আকাশ তেমনি আর্শির মতো। বন্দরের পাইন গাছ থেকে তেমনি পাতা ঝরছে। এ শীতেও এনজিন—ট্যান্ডল পুরোনো কোট গায়ে লুঙ্গি পরে নিচে নেমে গেল। জেটি ধরে হাঁটতে থাকল। গতরাতেও এনজিন—ট্যান্ডল শীতে কাঁপতে কাঁপতে বন্দরে নেমে গেছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বন্দরের পথ ধরে শহরে উঠে গেছে। পুরোনো বাজারে গিয়ে দু—শিলিং দাম দিয়ে পুরোনো জামাকাপড় কিনেছে। জাহাজিরা আফ্রিকার বন্দরে অথবা ফিজি দ্বীপে ওগুলো বিক্রি করবে। গতরাতে ফেরার পথে ট্যান্ডল শীতে যখন আর হাঁটতে পারছিল না, যখন সস্তায় যৌন সংযোগের দায়িত্ব পালন করে আর হাঁটতে পারছিল না, তখন বুড়ি মেমসাব গাড়ি থেকে এই বুড়ো ট্যান্ডলকে একটা দামি ওভারকোট দয়াপরবশ হয়ে ছুড়ে দিয়েছিল। ভোরে সে দামি ওভারকোটটা সকল জাহাজিদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। বলেছে—শীতে রাস্তায় কাঁপছিলাম, বুড়ি মেমসাব দিয়ে দিল। গতকাল এই ভারতীয় নাবিকদের কথাই দুঃখ করে বলছিল এলবি। বিজন ফানেলের নিচে দাঁড়িয়ে এনজিন—ট্যান্ডলকে শহরে উঠে যেতে দেখছে আর বিরক্তিতে ফেটে পড়ছে।

বিজন ফানেলের পাশ থেকে অন্য জাহাজিকে উদ্দেশ করে বলল, মকবুল, দেখলি এনজিন—ট্যান্ডলের কাণ্ড! আজও এই ভোরে শীতের ভিতর লুঙ্গি পরে বন্দরে নেমে গেল। দেশের জাত—মান সব ডুবাচ্ছে। তোরা কিছু বলতে পারিস না ওকে?

বিজন দেখল মকবুলের মুখেও এমত ইচ্ছা—শীতের রাতে নীলরঙের পায়জামা পরে ছেঁড়া কোট গায়ে বের হয়ে যাওয়া, পথে দাঁড়িয়ে শীতে কষ্ট পাওয়া এবং কোনো পুরুষ অথবা মহিলার দাক্ষিণ্য গ্রহণ করা। বিজন ভাবল, শীতের রাত, রাস্তায় বরফ পড়ছে, তবু নীল মার্কিন কাপড়ের জামা পায়জামা শরীরে এঁটে এইসব জাহাজিদের ভিড় কিনারায়। এইসব জাহাজিরা ভারতবর্ষ থেকে আসে। বড় গরিব, বড় নিঃস্ব। এইসব জাহাজিদের ইংরেজ কোম্পানির মালিকেরা কলকাতা বন্দর থেকে ধরে নিয়ে আসে। তাদের খেতে দেওয়া হয় বাসি গোরুর মাংস, ডাল, ভাত। মাঝে মাঝে বাঁধাকপির তরকারি দিয়ে কোম্পানি বদান্যতা দেখায়। এইসব জাহাজিরা বন্দরে লুঙ্গি পরে, ছেঁড়া ওভারকোট গায়ে শীতের রাতে ঘন আঁধারে বুড়ি মেমসাবদের খুঁজে বেড়ায়। দাম যত কমে হয়, জিনিস যত নীরস হয় ক্ষতি নেই, তবু যৌন সংযোগটুকু রক্ষা করতেই হবে। তখন বিদেশে এলবির মতো রমণীরা ভাবে ওরা অসভ্য, ওরা বর্বর। একদা পৃথিবীর সব বন্দরগুলোতে কলকাতা বন্দরের এইসব নাবিকেরা ঘুরে বেড়িয়েছে। পৃথিবীর সব বন্দরে বন্দরে ভারতবর্ষকে ওরা নোংরা নিঃস্ব প্রতিপন্ন করেছে। আজও করছে। অথচ বিজন ভাবল এর বিরুদ্ধে নালিশ নেই। যতদিন এরা থাকবে—এনজিন—ট্যান্ডলের মতো এইসব লোকগুলোও থাকবে।

বিজন এইসব ভেবে এত বিরক্ত এবং অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল যে কখন মকবুল ফলঞ্চার দড়িতে ঢিল দিতে বলেছে, কখন ইটন এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ওর অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে হাসছে—বিজন তার কিছুই ধরতে পারেনি।

ইটন বলল, গুড মর্নিং।

বিজন বলল, ইয়েস, গুড মর্নিং।

তারপর ওরা সকলেই লক্ষ্য করল জাহাজে কেমন একটা চঞ্চলতা প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকগুলো মোটরগাড়ি এসে বন্দরে থেমেছে। সব লম্বা চৌক মুখওয়ালা লোকেরা জাহাজে উঠে আসছে। ডেকের উপর সব জাহাজিরা, কিনারায় লোকগুলো হাত তুলে আকাশ দেখছে। ইটনও আকাশ দেখল, বিজনও আকাশ দেখল। দেখে বিস্মিত হচ্ছে। ইটনের মুখ রহস্যময় হয়ে উঠেছে, ইটন বলছে—কেমন, কাজ হল তো।

ফানেলের চূড়ায় ঝুলে মকবুল প্রশ্ন করল, আকাশে এরোপ্লেনটা কী লিখছে রে?

বিজন দেখল একটা এরোপ্লেন আকাশটাকে স্লেটের মতো ব্যবহার করছে। গ্যাস দিয়ে বড় বড় হরফে ভোরের খবর দিচ্ছে। ‘দি ডেইলি হেরাল্ড’—এর খবর। হয়তো উড়োজাহাজটা ভাড়া করা—কিংবা ওদেরই। বিজন দুটো বড় খবরের পর পড়ল : দি শিপ এস এস টিবিড ব্যাংক উইল বি ব্ল্যাক ব্যানড, ইফ সেলিম……

মকবুল ফানেল থেকে বিরক্ত করছে। মকবুল বারবার প্রশ্ন করছে—আকাশে জাহাজটা কী লিখছে রে? বিজন এইসব পড়ে অধীর হয়ে উঠছে। সে মকবুলকে বলল, সেলিমকে এক্ষুনি হাসপাতালে না দিলে জাহাজের সমস্ত কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। সিম্যান—ইউনিয়নের সেক্রেটারি এই হুমকি দিয়েছেন।

ইটন বলল, কাল রাতে এখান থেকে যারা কাজ করে ঘরে ফিরেছে তারাই ইউনিয়নে খবরটা পৌঁছে দিয়ে গেছে।

বিজন ভাবল, সব যেন মন্ত্রের মতো কাজ করল। জাহাজে খুবই লোকের ভিড়। সকলে কাজ থামিয়ে দিয়ে লেখাগুলি দেখছে। কোম্পানির এজেন্ট পর্যন্ত জাহাজে উঠে এসেছেন। মিঃ ট্রয় এবং আরও অনেক সব লোক। ক্লার্করা এসেছেন। ওরা প্রথমে ব্রিজে উঠে গেল। কাপ্তানের ঘরে ঢুকে গেল অনেকে। কাপ্তানকে খুবই বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তিনি এই খবরে প্রথমে খুবই অধীর এবং উত্তেজিত হয়েছিলেন। দুই সারেংকে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন, কে এ—খবর ইউনিয়নে পৌঁছে দিয়েছে? কার এমন হিম্মত? সেলিমের দরজা কে খুলেছিল? ওর পোর্টহোল কেন বন্ধ ছিল না? এইসব প্রশ্নের শেষে তিনি দেখলেন স্বয়ং এজেন্ট এবং অন্যান্য সব দায়িত্বশীল কর্মচারীরা ওঁর কেবিনে ঢুকে যাচ্ছেন। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না—এত উত্তেজিত। তবু এইসব দায়িত্বশীল কর্মচারীদের দেখে কেমন বিব্রত হয়ে পড়লেন। মিঃ ট্রয় নানারকম প্রশ্ন করে ওঁকে আরও বিব্রত করে তুলেছেন। বিজন, ইটন এবং মকবুল, পরে দেবনাথ পর্যন্ত ফানেলের গুঁড়িতে এসে সন্তর্পণে কাপ্তানের কেবিনের সব কথাবার্তা শুনছিল। ওরা শুনে বলল, শালা ঠিক জব্দ হয়েছে এতদিনে।

বিজন মনে মনে এলবিকে ধন্যবাদ জানাল। এলবির লম্বা চোখ এবং ডিমের মতো মুখের গঠন ওর চোখে এখন প্রীতির জোয়ারে ভাসছে। ওর কালো চুলে মনোরম গন্ধ, বিজন গতকাল তা টের পেয়েছে। গতকালের অসহিষ্ণু ভাবটুকু আর ওর ভিতর নেই। এলবিকে সে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারলে খুশি হবে এমত ধারণায় বোট—ডেকে এবং নিচে ভিড়ের ভিতর এলবিকে খুঁজল। এবং খুঁজতে থাকল। অথচ এলবিকে যেই বোট—ডেকে আসতে দেখল, বিজন তাড়াতাড়ি মাস্তুলের আড়ালে আত্মগোপন করল।

এলবি, মিস এলবার্টি এবং সিসিল এলবার্টি—যে—কোনো নামেই ওকে ডাকা চলে। সে মাস্তুলের আড়াল থেকে যদি এই নামে ডাকে নিশ্চয়ই এলবির সাড়া পাবে। এলবি এখন দু’নম্বর বোটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেও যেন কাপ্তানের ঘরের দিকে উঠে যাচ্ছে। বিজন সব দেখেও এলবিকে গুড মর্নিং বলতে পারল না, কৃতজ্ঞতা জানাতে পারল না। এলবির সঙ্গে যে কোনো পরিচয়ই এ—মুহূর্তে এ—জাহাজে মারাত্মক। কাপ্তান তাঁর বিরক্তি ভাবটুকু কলকাতা বন্দর পর্যন্ত পুষে রাখবেন। সারেং সেই ভাবটুকু কলকাতা পর্যন্ত জিইয়ে রাখবেন। তারপর এক শুভদিনে বিজনের নলিতে লাল দুটো দাগ পড়বে। বিজন ব্ল্যাক—লিস্টেড হবে।

সুতরাং সে এলবিকে দেখে আত্মগোপন না করে পারল না। তাই সে এলবিকে দেখেই এই মাস্তুলের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। এলবি সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। সে যেন কোনো জাহাজিকে প্রশ্ন করছে, বি—জন, বি—জন কোথায় কাজ করছে?

বিজন আঁতকে উঠল। সে ধীরে ধীরে টুইন ডেকে নেমে গেল এবং দু’লাফে ফল্কা পার হয়ে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে নিজের ফোকসালে ঢুকে দরজা বন্ধ করার আগে অন্য জাহাজিদের বলে দিল, কেউ ওকে যদি খোঁজ করে তবে যেন বলা হয় সে জাহাজে নেই। বন্দরে নেমে গেছে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাংকে বসে হাঁপাতে থাকল।

কী সর্বনাশ—বিজন ভাবল। বিজন নিজের ভুলের জন্য নিজেই ক্ষেপে গেল। গতকাল যা ওর সবচেয়ে বেশি বলা দরকার ছিল, এলবিকে তাই বলা হয়নি। ওর উচিত ছিল, এ খবর তোমাদের আমি পৌঁছে দিলাম এ কথা যেন জাহাজের কেউ না জানে। তবে আর গরিবের চাকরিটা থাকবে না। সেলিমের সঙ্গে তবে আমিও মরব। অথচ সেই কথাটাই এলবিকে বলা হয়নি।

এলবি এদিকে এসে দেবনাথকেও প্রশ্ন করল, বিজন কোথায়?

দেবনাথ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, বিজন তো এখানেই ছিল। বলে ইতস্তত এদিক—ওদিক চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, চল কেবিনে। বোধহয় সে সেখানেই আছে।

নীচে নামবার আগে এলবিকে নিয়ে দেবনাথ একবার ভিড়ে বিজনকে খুঁজে দেখল। তাকে ওরা সেখানে পেল না। সেলিম ভিড়ের ভিতর স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। সেলিম কাঁদছে। সারেং বুঝ—প্রবোধ দিচ্ছে। বলছে, ভালো হয়ে গেলেই কোম্পানি তোকে দেশে পাঠিয়ে দেবে। কাঁদছিস কেন? ভালোর জন্যই তোকে হাসপাতালে দিচ্ছে।

বিজন এই বাংকে বসেও যেন টের পাচ্ছে—এইমাত্র সেলিমকে ধরাধরি করে নিচে জেটিতে নামানো হল। সেলিম কাঁদছে। সে বলছিল, বিবির কোলে মাথা রেখে মরব। সে বলেছিল, আমার দেশের মাটিতে আমার কবর হবে। সে এ—কথাগুলো বিজনকে বলেছিল। ওর খুব দুঃখ হচ্ছে এ সময়—সে কাছে থাকতে পারল না, বলতে পারল না—রোজ আমি যাব। বিকেলে যাব। তুই ভয় পাবি না। তুই ভালো হয়ে উঠবি—বলতে পারল না….তখন দরজাটা কে যেন ঠেলছে। সে এই বাংকে বসে দেবনাথের গলার শব্দ পেল। দেবনাথ বলছে—এই, দরজা খোল। দরজা বন্ধ করে ভিতরে কী করছিস?

বিজন দরজা খুলতেই এলবিকে দেখতে পেল। এলবি দেবনাথের একপাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।

বিজন বলল, গুড মর্নিং।

তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান।

কেন, এখানেই তো ছিলাম।

এখানেও খুঁজেছি।

বিজন বিব্রত হয়ে পড়ল।

এলবি ভিতরে ঢুকে বলল, ট্রয়কে কিন্তু সব কথাই খুলে বলতে পেরেছি।

বিজন ধন্যবাদ জানাল। তারপর বলল, বোসো।

ছোট ঘর, সোফা নেই। একটা ইজিচেয়ার আছে, কিন্তু পাতবার জায়গা নেই। ওরা তিনজন এমত কথায় হাসল।

এলবি বলল, আমি বেশিক্ষণ বসব না। হাতে অনেক কাজ। তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য দেরি হয়ে গেল। অ্যামবুলেন্স হয়তো এতক্ষণে চলে গেছে। সেলিমকে রয়েল হাসপাতালে রাখা হচ্ছে। আশা করছি বিকেলে ওকে দেখতে যাবে। যেতে অসুবিধা হলে, আমার ওখানে চলে যেও, সেখান থেকে আমি তোমায় নিয়ে যাব। বলে সে আর বসল না। তরতর করে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল।

ওরা দুজন ফোকসালে বসে এলবির পায়ের শেষ শব্দটুকু পর্যন্ত মিলিয়ে যেতে শুনল। দেবনাথ আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল বিজনের। বলল, কী করে এ—মেয়েকে ধরলি?

বিজন গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ব্যস্ত। সুতরাং সে এ—ব্যাপারে আদৌ সাড়া দিল না। আদৌ মুখর হল না। সে জবাবে শুধু বলল, পথে আলাপ।

তারপর ওরা দুজনে চুপচাপ। গ্যালিতে মাংস সিদ্ধ হচ্ছে। ওরা সেই গন্ধ নিচে বসে পেল। ওরা দুজনে কথা বলল না, তখন এক এক করে সকলে এসে নিচে নামছে। যে যার হাত—মুখ ধুলো। থালা—মগ ধুলো। এবং ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেল। ওরা ভোরের এই আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত হয়েছে, খেতে বসে সকলে এমত ভাব প্রকাশ করতে চাইল।

বিজন এই শীতের বিকেলে ডেকে এসে দাঁড়াল। ওর পোশাক এবং মুখের কমনীয়তায় শীতের রঙ অথবা সমুদ্রের রঙ। ওর শরীরের রঙে আশ্চর্য স্নিগ্ধতা। শীতের দেশে ঘুরে এবং সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় শরীরের রঙ কমনীয় হতে হতে কোনো এক ভোরে বিজন যেন বিদেশির মতো কথা বলতে শিখল।

সে রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে দেখল একটা সমুদ্রগামী জাহাজ বন্দরে এসে নোঙর ফেলেছে। সে ওদের ফানেলের রঙ দেখেই বুঝল ওটা আমেরিকান জাহাজ। সে বন্দর দেখে বুঝল ওরা এখানে ইস্পাত—জাতীয় দ্রব্য নামাবে। এবং হয়তো কোনো বিকেলে ভেড়ার মাংস অথবা ফলের রসদে বোঝাই হয়ে অন্য বন্দরে পাড়ি দেবে।

শেষে অন্যান্য অনেক জাহাজির মতো সেও সেলিমের রুগণ ফোকসাল অতিক্রম করে গ্যাংওয়ে ধরে বন্দরে নেমে গেল। সে হাঁটতে থাকল। একজন স্থায়ী বাসিন্দার মতো সে এই ঝরা পাইনের পথ ধরে শহরে উঠে যাচ্ছে। ঝুলন্ত সেতু অতিক্রম করে বন্দরের সিম্যান—মিশান বাঁয়ে ফেলে সে উঠে যাচ্ছে। সেই পাঁচ কলিন স্ট্রিট ও সেই মেয়ে এলবি। সে নির্দিষ্ট আস্তানায় উঠে যাওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সি ডাকল। মোটরে বসে এলবি এবং ওর ইউনিয়নের হলঘর, ওর চিলতে ঘরটুকু…এলবি সুন্দরী, সে সুখে আছে…এলবির চোখ গভীর, আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ়….এলবিকে মনে মনে সুন্দরী বিদেশি রমণী অথচ আপনার মতো করে দেখার এক সবিশেষ কৌতূহলে সে পীড়িত হতে লাগল। এবং সহসাই স্মরণ করতে পারল—এলবি যদি বাতিকগ্রস্ত রুগির মতো ফের বলতে থাকে—তুমি ট্যাগোরের কানট্রি থেকে এসেছ, তুমি কবির কাছের লোক, তুমি কবিকে দেখেছ, সুতরাং তুমি কবির কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও। তুমি আমাকে বাংলা ভাষা শেখাও। আমি মূল কবিতার রস পেতে চাই। তা হলে……তা হলে! সে শরীরের আড়ষ্টতায় এমত উচ্চারণ করে কেমন জড়বৎ বসে থাকল, সে ড্রাইভারকে বলতে পারল না তুমি বন্দরে চল, পাঁচ কলিন স্ট্রিট গিয়ে আমার দরকার নেই।

হলঘরের দরজায় বিজন এলবিকে দেখতে পেল। বিজন ট্যাক্সি থেকে নামল ফুটপাথে। এলবি সিঁড়ি ধরে নেমে আসছে। ওরা পরস্পর অভিবাদন জানাল, তারপর উভয়ে মোটরে চড়ে সেলিমকে দেখতে রয়েল হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। শীতের সন্ধ্যা। এলবির হাতের দস্তানা লাল রঙের। মোজা বেগুনি রঙের। বব—করা ব্লন্ডচুলে দুটো প্রজাপতি—ক্লিপ। গলায় সরু সোনার চেনে পাথর বসানো। হলদে স্কার্ট, লাল জ্যাকেট শরীরে। শীতের সন্ধ্যায় এলবিকে এই পোশাকে অতীব তীক্ষ্ন মনে হল। শহরের বড় রাস্তা ধরে ওরা চলেছে। আপাতত ওরা কোনো কথা বলছে না। এলবি স্টিয়ারিং ধরেছে। বিজন শহর দেখছে। বড় রাস্তা, সুতরাং বড় বড় সব কাচ—মোড়া আসবাবপত্রের কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যের, পোশাকের অথবা মোটরের দোকান। ভিন্ন ভিন্ন সব বিজ্ঞাপন ঝুলছে। এলবি দুটো—একটা কথা বলছে এখন। শহরের এইসব দোকানের এবং কোন মুল্লুক ধরে কীভাবে রয়েল হাসপাতালে যাচ্ছে এইসব খবর দিয়ে নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছে।

এলবি বলল, জাহাজ তবে অনেক দিন থাকল।

তা থাকল।

প্রায় দু’মাসের মতো হবে।

তা হবে।

পাশের পত্রিকাটা তুলে বিজনকে দেখাল। সামনে মোড় ঘুরতে হবে। নীল বাতি জ্বলছে না। সুতরাং এলবি দু’হাতেই পত্রিকাটা বিজনের হাতে তুলে দিল। —খবরটা পড়েছ?

আকাশে দেখেছি এবং পড়েছি। আচ্ছা এলবি,….বিজন একটা প্রশ্ন তুলে ধরার ইচ্ছায় ঘাড়টা বাঁকাল।—আচ্ছা এলবি….তোমাদের ভিতর থেকে কেউ তো বলেনি এ—ঘটনার সঙ্গে আমি যুক্ত? পত্রিকায় তেমন খবর নেই তো! বিজন পত্রিকাটা ধীরে ধীরে নিজের কোলের কাছে নিয়ে এল। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবটুকু পড়ল। এবং এলবির মুখ দেখে যেন বুঝতে পারছে তার আকস্মিক আড়ষ্টতায় এলবি পীড়িত হচ্ছে।

এলবির কঠিন মুখ সহসা নানা রঙে ক্রমশ নরম হচ্ছে।—বিজন, তুমি পাকা জাহাজি হওনি। তুমি দেখছি মিঃ ট্রয়কে খুব কাঁচা লোক ভেবেছ। পত্রিকা পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে এ—ব্যাপারে আমরা কিনারার কুলি লোকেদের উপর বেশি নির্ভর করেছি। কথা কী জানো, এখানকার মতো এত জোরালো ইউনিয়ন পৃথিবীর কম বন্দরেই আছে। পাঁচ কলিন স্ট্রিটে পাঁচ বছর থেকে আছি। এ—ব্যাপারে আমি অভিজ্ঞ। তোমাকে জড়ালে কাপ্তান অন্য বন্দরে তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে ভেবেছ?

ওদের মোটর হাসপাতালের দরজায় এসে থামল। মোটর পার্ক করে পার্কবোর্ডে নাম লিখে ওরা সদর দরজা অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।

বিজন দেখল, দুটো বিশাল বৃত্তের মতো বাগান দু’পাশে রেখে ওরা উঠে যাচ্ছে। এলবি ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে সিট—নম্বর এবং ব্লক—নম্বর দেখে নিল। তারপর নম্বর মিলিয়ে ওরা একসময় সেলিমের বিছানার পাশে পৌঁছে গেল।

এলবি বলল, গুড ইভনিং। তোমাকে এখন ভালো দেখাচ্ছে।

বিজন সেলিমের বিছানার পাশে বসে ওর চুলে হাত দিয়ে বলল, এত ভেঙে পড়েছিস কেন? আমি রোজ বিকেলে তোকে দেখতে আসব। জাহাজ এখানে অনেক দিন থাকবে। আশা করি ততদিনে তুই ভালো হয়ে উঠবি।

সেলিম পাশ ফিরে শুল। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকে কষ্ট, হাতে পায়ে যন্ত্রণা। সেলিম বড় বড় চোখে এলবিকে দেখছে। এলবি কিছু ফল এনেছিল সঙ্গে। সেলিমের টেবিলে ফলগুলো রাখল। সেলিম বড় বড় চোখে এলবিকে দেখছে। সেলিম কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়েছে এমন ভাব ওর চোখে মুখে। অথচ এইসব যন্ত্রণার ভিতরও সেলিম হাসল। একজন ডাক্তার, দুজন নার্স ওর পাশে এসে এখন দাঁড়িয়েছে। ওরা ওর শরীরে ওষুধ প্রয়োগ করল। ওরা সেলিমকে বাঁচবার জন্য উৎসাহিত করল।

এলবি একজন সিস্টারকে প্রশ্ন করল, কাল নিশ্চয়ই প্লেট নেওয়া হচ্ছে?

আজ রাতেই হবে। মিঃ ট্রয় সব ব্যবস্থা করে গেছেন।

এলবি সিস্টারের প্রতি মাথা নোয়াল। মেনি থ্যাংকস।

ওরা উঠে পড়ল। সব ভিজিটারের শেষে ওরা প্রশস্ত পথ ধরে বড় বড় সব চত্বর পার হয়ে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে, ফের সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে হাসপাতালের সদর দরজায় এসে হাজির হল। এলবি বলল, চল, একটু ঘুরে আসি। একটু ইউনিভার্সিটির সামনের পার্কটায় বসব। একটু গল্প করব। রাত ঘন হলে তোমাকে জাহাজে পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরে যাব।

মোটরের ভিতর বসে বিজন প্রশ্ন করল, সেলিম শীগগিরই ভালো হয়ে উঠবে—কী বল?

নিশ্চয়ই। খুব জোর দিয়েই যেন এলবি কথাটা বলল। সেলিম ভালো হয়ে উঠলে, তুমি আমি সেলিম জীলঙে যাব। সেখানে আমার বাবা মা থাকেন। বাবা তোমাকে পেলে কিছুতেই ছাড়তে চাইবেন না। তোমাকে পাশে বসিয়ে কেবল ট্যাগোরের কবিতা শুনতে চাইবেন। আমাদের পরিবারের সকলের ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতা মুখস্থ। বলে এলবি মোটরে স্টার্ট দিল এবং জোরে জোরে বিশুদ্ধ সংগীতের মতো কবিতা উচ্চারণ করল :

“When the warriors came out first from

their Master’s hall, where had they hid

their power? Where were their aromour

and their arms?

 They looked poor and helpless, and

the arrows were showered upon them

on the day they came out from their

master’s hall.

 When the warriors marched back

again to their master’s hall where did

they hide their power?

 They had dropped the sword and

dropped the bow and the arrow ; peace

was on the their foreheads, and they had

left the fruits of their life behind them

on the day they marched back again to

their master’s hall.”

কবিতা আবৃত্তি করার সময় আবার সেই ভাবটুকু এলবির মুখে—তুমি কবির দেশের ছেলে, তুমি কবিকে দেখেছ, প্রণাম করেছ, তোমার ঘনিষ্ঠ হয়ে কবিতা আবৃত্তিতে অশেষ আনন্দ। তখন মোটর চলছে। তখনও এলবি কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে মোটর চালাচ্ছে। শহরের সব ছোট—বড় দোকান, রোশনাই আলো, থিয়েটার হল অতিক্রম করে ওরা পশ্চিমের দিকে চলেছে। এলবি ফের বিশুদ্ধ জগতের বাসিন্দা হয়ে যেন প্রতিধ্বনি করল—পিস ওয়াজ অন দেয়ার ফোরহেডস। অথচ বিজনের কপালে এখন নিষ্ঠুরতার চিহ্ন। সে এলবির এই সাহিত্য—প্রীতিতে পীড়িত হচ্ছে। যেন বলার ইচ্ছা—আমি বাপু জাহাজি মানুষ, আমার ইতস্তত মিথ্যা বলার নিদারুণ অভ্যাস আছে। সাহিত্য—প্রীতি কোনো কালে ছিল না আমার, এখনও নেই।

এলবি বিজনের দিকে মুখ না তুলেই বলল, আমরা এসে গেছি। আমরা এখানে বেশিক্ষণ বসব না। জলপাই গাছের নিচে বসে তুমি কবির কবিতা বল। আমি শুনি।

বিজন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। সে বলতে চাইল—আমি কবির কবিতা আবৃত্তি করতে পারব না। জাহাজি মানুষের কবিতা কণ্ঠস্থ করে লাভ নেই। এই নীরস জীবনে সততার আশ্রয়ে বাঁচা নিরর্থক। তবু এলবি ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এলবিকে সে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরণ করছে। এলবি যেখানে বসল, সে সেখানেই বসে পড়ল। এলবির প্রতি বিদ্রুপের ইচ্ছায় অথবা মাতাল হওয়ার ইচ্ছায় নিরন্তর সে কঠিন। এলবি এখন কোনো কথা বলছে না। এলবি ঘন হয়ে বসল। এলবি বস্তুত বিজনকে কবির প্রতীকীতে অনন্য করে রাখতে চাইল।

বিজন মরিয়া হয়ে শিশু বয়সের পড়া কোনো কবিতার কথা মনে করতে পারল। (দশম শ্রেণীতে কবির কবিতা সে কিছু পড়েছে।—কিন্তু এখন বিধির বিধানে তাও মনে করতে পারছে না। তা ছাড়া ঘটনাটা এমন শীঘ্র ঘটবে সে তাও ভাবতে পারেনি।) সে আবৃত্তি করল। ওর কণ্ঠ মসৃণ বলে কবিতা আবৃত্তির বিশুদ্ধ ভঙ্গিটুকু এলবিকে আপ্লুত করল।

বিজন টেনে টেনে আবৃত্তি করছে—

”পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল

কাননে কুসুম-কলি সকলি ফুটিল।

রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে

শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।”

ওরা পরস্পর কথা বলতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে ওরা উভয়ে যেন গম্ভীর এবং ঘন। উভয়ে যেন রবীন্দ্রনাথের মতো বিশুদ্ধ ইচ্ছায় পরস্পর মহৎ ভাবটুকু রক্ষা করছে।

বিজন এলবির কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রতীকীতে বাঁচবার ইচ্ছায় এও বলল, মোটরে যে কবিতা আমাকে শোনালে এ—কবিতা তারই মূল ভাষা।

বিজন ভাবল—বন্দরে আমি এলবির চোখে রবীন্দ্রনাথ হয়ে বাঁচব।

তারপর এলবির মোটর থেকে একসময় বিজন জাহাজে উঠে ফোকসালে ঢুকে দেখল, দেবনাথ বাংকে ঘুমিয়ে আছে। অন্যান্য কেবিনেও বিশেষ সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ানক শীতে সব জাহাজিরা কম্বল মুড়ি দিয়ে জাহাজে ঘুমোচ্ছে। সে ফোকসালে দাঁড়িয়ে কিছু কাশির শব্দ শুনল। দু—একজন জাহাজির আলাপ শুনল। এই শীতে উপরে উঠে হাত—মুখ ধুতে ইচ্ছা হল না। কোনোরকমে লকার থেকে খাবারটা বের করে খেয়ে নিল। তারপর ঠান্ডা জলে কুলকুচা করে পোর্টহোলে মুখ ধুলো এবং বাংকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছায় হাত—পা সটান করে দিল। অথচ ঘুম এল না। ঘুম আসছে না। বিজন অন্য ফোকসালে ফের কিছু জাহাজির আলাপ শুনছে। এখন হয়তো এলবি ঘরে ফিরে অন্য কবিতা আবৃত্তি করছে। এই বাংকেও সে এলবির কাছে মিথ্যার মুখোশের জন্য ছটফট করছে। অথচ সে স্পষ্ট হলে এই সাময়িক মানসিক অস্থিরতার গ্লানিকে ধৈর্য ধরে লালন করতে হত না; এই করে সে এক মিথ্যার জন্য হাজার মিথ্যায় জড়িয়ে পড়ছে।

ওর ইচ্ছা হল একবার দেবনাথকে ঘটনাটা খুলে বলে। সাহিত্য—প্রীতি এবং স্পৃহা দেবনাথের যথেষ্ট আছে। বরং সে দেবনাথকেই সঙ্গে নেবে। অথবা দেবনাথকে প্রশ্ন করে জানবে—ওর কাছে কবির কোনো বই অথবা কোনো কবিতা কণ্ঠস্থ….যদি থাকে তবে…তবে…সে নিঃসংশয় হতে পারছে না তবু। দেবনাথ! দেবনাথ! সে যেন ডেকেই উঠল। মনে মনে ওর এই ডাক এবং এলবির সরল বিশ্বাস, দুটো চোখের ঘনিষ্ঠতা—সব মিলিয়ে ওর চোখে জ্বালা। ওর ঘুম আসছে না। এলবি ‘পাখীসব করে রব’ ইংরেজি হরফে লিখে নিতে চেয়েছিল। সে হয়তো এইসব মুখস্থ করে অন্য কোথাও আবৃত্তি….কিংবা বাহবা….কিন্তু বিজন বলেছে তখন শরীরটা ভালো নেই। আবার কাল হবে। আবার সে ছলনাকে কেন্দ্র করে বাঁচতে চাইল। এলবির ঘনিষ্ঠতা, সঙ্গ এবং দু’দণ্ডের আলাপ থেকে বিচ্ছেদের নিঃসঙ্গতায় সে বাঁচতে চাইল না। বিশেষত এই বিদেশিনীর কাছে স্পষ্ট হওয়ার দরুন কোনো পরাভবকে স্বীকার করার দরুন কোনো গ্লানিকে সহ্য করতে পারত না। অপমানবোধ বিজনের তীব্র। সেজন্য এই মিথ্যার মুখোশে আপাতত সে জাহাজি। সে খুশি।

ভোরবেলায় জাহাজে অনেক কাজ। সালফার নামানো হচ্ছে। হাড়িয়া—হাপিজ হচ্ছে ফল্কায় ফল্কায়। ভোরে আজ সূর্য উঠল না। আকাশ মুখ গোমড়া করে আছে। সমুদ্রের বাতাস পর্যন্ত। বন্দরের পাইন গাছে কোনো পাখি বসে নেই। শীতের জন্য ওরা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। শীতের জন্য এইসব জাহাজিরা হি হি করে কাঁপছে। ওরা সাবান—জল নিয়ে আজ ছুটে ছুটে কাজ করতে পারছে না, ওরা স্থাণুর মতো নীল উর্দির ভিতর গুটিয়ে আসছে। ওরা পুরানো জামা—কাপড় সব আফ্রিকার বন্দরে বিক্রি করে এখন পস্তাচ্ছে। শীতের কষ্ট ভয়ানক কষ্ট।

পাশের জাহাজে কীসের যেন শোরগোল। পাশের জাহাজের নাবিকরা পোর্ট—সাইডের ডেকে জড়ো হয়েছে। ওরা রেলিংয়ের উপর ঝুঁকছে। ওদের সকলের চোখ বন্দরের জলের উপর। এই জাহাজের নাবিকরা ঘটনাটা ধরতে না পেরে গলুই—এ জড়ো হয়েছে। মেজ মালোম অন্য জাহাজিদের ডেকে ঘটনার কথা জানতে চাইলেন। পাশ থেকে কে একজন যেন বলল, পাশের জাহাজের তিন নম্বর মিস্ত্রি জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটা তারপর আরও বিস্তৃত হল। বন্দরের সব লোক চারপাশে জড়ো হয়েছে। এ—শীতেও কিছু লোক জলে নেমে অনুসন্ধান করছে তিন নম্বর মিস্ত্রিকে অথচ মিস্ত্রিকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইংলন্ডে ওর স্ত্রী এডালট্রি কেসে জড়িয়ে পড়েছে—এই খবরটা এখন জাহাজিদের মুখে মুখে।

ভোরের এইসব সাত—পাঁচ ঘটনায় বিজন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। ওর মনে নেই এবং মনে পড়ছে না—গতকাল এক রমণীয় পরিবেশে কোনো এক সুন্দরী যুবতীর পাশে মরিয়া হয়ে নকল কবির অভিনয় করেছে। মনে পড়ছে না আজও এমন ঘটতে পারে। একজন জাহাজির আত্মহত্যা এবং সালফেটের গন্ধ এই প্রচণ্ড শীত ওকে ওর অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিলকুল বিপরীত ধারণার বশবর্তী করেছে। সে ভাবল মৃত্যুই শ্রেয়, মৃত্যুই শ্রেষ্ঠ। পিস ওয়াজ অন দেয়ার ফোরহেডস—সে এ—কথাও ভাবল। সেলিমের কপালে শান্তির রেখা ফুটে উঠেছে হয়তো। এলবির সেই মুখ—সেখানেও একদিন শান্তির রেখা নামবে—কেউ বাদ যাবে না। কবিতা আবৃত্তির সময় এলবির সেই গভীর দৃষ্টি, সেই দৃঢ় অথচ প্রীতিপূর্ণ চোখ সে রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে নিঃস্ব পাইনের আঁধারে সহসা যেন দেখল। এলবি তাকে ভালোবাসতে চায়। রবীন্দ্রনাথের মতো করে ভালোবাসতে চায়। বিজন যেন এখন কবির প্রতীকীতে বাঁচবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে ডাকল—দেবনাথ, দেবনাথ, নিচে এসো কথা আছে। বিকেলের কথা রাখার জন্য সে নিচে সিঁড়ি ধরে ফোকসালে ঢুকে গেল। —তুমি তো অনেক বই এনেছ সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের কোনো বই আছে তোমার কাছে? এইসব বলার ইচ্ছা হল।

সে দেবনাথের কাছেই একটি কবিতার সংকলন পেয়ে গেল। সে তিক্ত বিস্বাদে বইটির পাতা উলটাচ্ছে। সে বারবার করে একই কবিতা পড়ল। পড়ে মুখস্থ করল। সে পড়ল।

”জড়ায় আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই

 ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে”

বিকেলে মোটর নিয়ে এলবি বন্দরে হাজির। বন্দরে সে বিজনের জন্য অপেক্ষা করছে। কিনারার শ্রমিকরা এখন জাহাজের কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরছে। ওরা সকলে এলবিকে অভিবাদন জানাল। কোয়ার্টার মাস্টার তখন খবর দিয়ে পাঠিয়েছে বিজনকে। বিজন একবার গলুই—এ উঠে উঁকি দিয়ে এলবিকে দেখল। সে আবার আবৃত্তি করল সিঁড়ি ধরে নামার সময়। সে একবার সেলিমের হাসপাতালের দৃশ্যে, পরে এই কবিতার সুরে এবং আরও পরে পোশাকের ভিতর ঢুকে গিয়ে অম্লান থাকার ইচ্ছায় শিস দিতে থাকল।

নিচে নেমে ওরা উভয়ে পরস্পরকে অভিবাদন জানাল। বিজন মনে মনে কবিতা আবৃত্তি করল—সেই নির্দিষ্ট কবিতা, সেই সুরে, সেই নিঃস্ব অথচ ভরা কোটালের মতো আবেগধর্মিতায়। অথচ এলবিকে জানতে দিল না মনে মনে সে এখন কবিতা আওড়াচ্ছে। মনে মনে সে এখন কবিতার মতোই বিশুদ্ধ ভাব নিয়ে বেঁচে আছে। সে সেলিমের পাশে বিশুদ্ধ ভাব নিয়ে বসবে। সে সেলিমের মাথায় হাত দিয়ে বিশুদ্ধ শান্তি দেবে। বলবে, তুই ভালো হয়ে উঠবি। বলবে নার্সকে, প্লেট কী বলছে? আর কত দিন সেলিমকে এখানে থাকতে হবে?

গাড়িতে এলবি রাস্তার নাম, জায়গার নাম তারপর আরও কতরকমের কথা—রাজনীতি থেকে খেলাধুলো, এমনকি রয়েল হাসপাতালে দুজন ভারতীয় মেয়ে নার্স ট্রেনিং—এ আসছে এ খবরও দিল এলবি। ওর বাবা পার্থে যাচ্ছেন। মা এবং বাবা হয়তো যাওয়ার পথে একবার এখানে এসেও যেতে পারেন। কারণ এলবি বিজন সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখে দিয়েছে। সুতরাং বাবা আসছেন, মা আসছেন।

এলবি গাড়ি চালাবার সময় একবার হাতের ঘড়ি দেখল। যেন আজ হাতে কিছুটা সময় বেশি আছে। খুব বিশেষ তাড়া নেই কাজের। গাড়ির গতি সাধারণ। এলবি খুব খুশি খুশি হয়ে কথা বলছিল। বলছিল, আশা করি সেলিমের ভালো খবরই আমরা পাব।

ওরা হাসপাতালে কিন্তু শুনল অন্য কথা। মিঃ ট্রয় সেলিমের কাছে এলবির নামে একটা চিঠি রেখে গেছেন। এলবি চিঠিটা পড়ল। এলবিকে এখন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। বিষণ্ণতা বিজনেও সংক্রমিত হল।

এলবি বলল, সেলিমের মেজর অপারেশন হবে। বাঁদিকের ফুসফুসটা কাটা ছেঁড়া করবে। এলবি এইসব কথা হাসপাতালের সিঁড়ি ধরে নামার সময় বিজনকে শোনাল।

বিজন বিছানায় বসে সেলিমের সঙ্গে রঙ্গতামাসা করেছিল। দেশে ফিরলে সেলিম বিবিকে প্রথম কোন জাহাজি বন্ধুর গল্প শোনাবে, প্রশ্ন করে বিজন জানতে চেয়েছিল আরও অনেক সব কথা বিজন যেন মনে করতে পারছে না।

আরও দু—একজন জাহাজি ওর পাশে বসে ছিল। সারেং বলে পাঠিয়েছেন তিনি কাল এসে দেখে যাবেন। বিজন সেলিমের বিছানায় শেষ সময়টুকু পর্যন্ত কাটাতে পেরে খুশি। তারপর ভিজিটারদের শেষ ঘণ্টা পড়ল। সিঁড়ি ধরে নামবার সময় সেলিমের অস্ত্রোপচারের কথা শুনল। এবং এই শুনে বিজনের কেমন অন্যমনস্কতা বাড়ছে। এলবি গাড়িতে বসে লক্ষ্য করছে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় বিজন খুব ভেঙে পড়ছে। এলবির এখন বিজনকে আশ্বস্ত করা দরকার।

বিজন বলল, সেলিম আমার সঙ্গে দু’সফর ধরে কাজ করছে। দু’সফর ধরে ওর সঙ্গে মেলামেশা, কখন যে আমরা এত ঘনিষ্ঠ হয়েছি জানি না। এখন বুঝতে পারছি ওর অভাবটা জাহাজে আমার কত বড় হয়ে বাজছে।

তারপর ওরা এইসব স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আলোয় অথবা মনের আরও সব নীল ইচ্ছায় প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে তারপর সেই কবিতার জগতে ফিরে আসা, কবিতার জগতে ডুবে যাওয়া, ইতিহাসের মৃত নায়কের মুখের মতো ছবি হয়ে বসে থাকা এবং অবশেষে মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকা। এমন একদিন হয়নি, অনেক দিন হয়েছে। এরা পরস্পরকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছে। এলবি বিজনকে বাড়ি নিয়ে গেছে। ওর হাতের আঁকা ছবি দেখিয়েছে। তারপর কোনো রেস্টুরেন্টে অথবা নীল আকাশের নিচে বসে সেলিমের অস্ত্রোপচারের দিনের কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়েছে।

একদিন এলবি বলল, বাবা, মা কাল আসছেন।

জীলঙ এখান থেকে কত দূর? প্রশ্ন করেছিল বিজন।

খুব বেশি দূর নয়।

কীসে ওঁরা আসবেন?

ট্রেনে আসা যায়। বাবা মোটরে আসছেন। খুব প্লেজান্ট জার্নি। তারপর একটু থেমে এলবি আবার বলল, ওঁদের সঙ্গে আলাপে তুমি খুশি হবে।

আমার সঙ্গে আলাপে ওঁরা খুশি হবেন তো?

এলবি হাসল।

দু’দিন পর এলবি ওর বাবা—মার সঙ্গে বিজনকে পরিচয় করিয়ে দিল। ওঁরা বিজনকে বললেন, আমাদের পরম সৌভাগ্য তোমাকে আমাদের ভিতর পেয়েছি। পরম সৌভাগ্য, এলবি এ সময় খবর দিয়ে তোমার কথা জানিয়েছে। আমরা সকলেই কবির খুব ভক্ত। তুমি তাঁর দেশের লোক। তুমি ওঁর স্পর্শ লাভ করেছ—এবং আমরা তোমার সঙ্গলাভ করেছি ভেবে খুশি।

এলবির বাবার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে বিজন সত্যি খুশি। ভদ্রলোক অমায়িক। ভদ্রলোক প্রাণোচ্ছল অথচ কথাবার্তায় খুব সংযত। বিজনের মুখ থেকে কবির কবিতা শোনার একান্ত ইচ্ছা ওঁদের। বিজন পর পর কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করল।

ওঁরা খুশি হয়ে বললেন, তুমি আমাদের কথা দাও ডিনারে একদিন উপস্থিত থাকবে। আমরা খুব আনন্দিত হব তোমার উপস্থিতিতে।

দিন স্থির করুন, আসব।

কিন্তু একটা কথা, মিঃ চার্লটন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। একটা সিগারেট ধরালেন এবং পাশে এসে বললেন, আমরা তোমাকে চাইনিজ ডিশ দেব। খুব মনোরম খেতে। কিন্তু…।

এলবি এবার আর একটু খুলে বলল। বাবা চিনে অনেক দিন ছিলেন। এমব্যাসিতে কাজ করতেন। সুতরাং বাবা কোনো ভদ্রলোককে ডিনার—পার্টিতে নিমন্ত্রণ করলেই তাঁকে চাইনিজ ডিস দিতে ভালোবাসেন।

চার্লটন আবার আরম্ভ করলেন, কীন্তু কথা হচ্ছে ট্যাগোরের দেশের ছেলে তুমি বলতে গেলে ঘরের ছেলে। সুতরাং ট্যাগোর কী খেতেন এবং খেতে ভালোবাসতেন নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে। মেনুতে ট্যাগের ডিশও একটা থাকবে কী বল? তার প্রিপারেশনের ভার তোমার উপর। কী কী লাগবে বলে দাও, আমি সব সংগ্রহ করে রাখব। আগামী রবিবার ছুটির দিনে আমরা এখানে ফের আসব। এবার তিনি থামলেন। পাশে মিসেস চার্লটন উল বুনতে বুনতে লাফিয়ে উঠলেন, বড় চমৎকার হবে। এলবির পিসিকে বললে হয়। তারপর আরও দু—একজনের নাম তিনি বলে গেলেন।

বিজন বলল, রান্নাতে আমি অভ্যস্ত নই। দেবনাথ বলে একজন জাহাজি আছে, সেও বাঙালি, সে ভালো রাঁধতে জানে। ওকে নিয়ে আসব।

এলবি টেবিলের উপর খাতা রেখে বলল, কী কী সংগ্রহ করতে হবে বল।

কিছুই দরকার হবে না। কারণ মশলাপাতি তুমি এখানে কোথাও খুঁজে পাবে না। সরষের তেলও বোধহয় নেই। দেবনাথকেই বলব সব সংগ্রহ করতে, পারো তো কিছু ডিম, মাংস এবং ভেজিটেবল সংগ্রহ করে রেখ। তাতেই চলবে।

এলবি দীর্ঘদিন পর আজ সকলকে পিয়ানো শোনাল। বিজনের মনে হল, এলবি উলের পোশাক পরে আছে। এলবির সাদা স্কার্ট এবং সাদা জ্যাকেট থেকে সে রঙ যেন চুঁইয়ে পড়ছে। বাইরে শীতের ঠান্ডায় যেন তুষার ঝরছে। ওরা তিনজন আগুনের পাশে বসে উত্তাপ নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মিসেস চার্লটন উনুনে কাঠ গুঁজে দিচ্ছেন। মিঃ চার্লটন চীনদেশের গল্প করছেন এখন। সে—দেশের রীতিনীতির গল্প করছেন। এলবি এখন আর পিয়ানো বাজাচ্ছে না। চেয়ারে বসে সেও বিদেশের গল্প শুনছে। সহসা এইসব কথার ভিতর বিজন যেন দেখল ওরা সকলে একই পরিবারভুক্ত লোক হয়ে শীতের রাতে উনুনের পাশে আগুন পোহাচ্ছে। মনে হল বাংলাদেশেরই কোনো পরিবারের ভিতর বসে সে যেন ঠাকুমার গল্প শুনছে।

নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে দেবনাথ এবং বিজন সকাল সকাল জাহাজ থেকে নেমে গেল। ছুটির দিন। এই শীতের ভিতরও শহরের সব যুবক—যুবতী ছুটি ভোগ করতে দলে দলে বের হয়ে পড়েছে। ওরা সব রেস্তোরাঁয়, পাব—এ অথবা পার্কে কিংবা শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়ছে। দেবনাথ এবং বিজন হেঁটে যেতে যেতে সব টের পাচ্ছে। ওদের হাতে ছোট নীল ব্যাগ। ট্যাগোর ডিশের জন্য যাবতীয় দ্রব্য সংগ্রহ করা ওতে। ওরা গল্প করতে করতে অথবা অযথা উচ্ছল হতে হতে হাঁটছে।

ওরা বন্দর ফেলে, জনসন রোড ধরে ছোট পাহাড়টায় উঠে গেল। এখানে ছোট ছোট কাঠের ঘর—নীল অথবা হলুদ রঙের। দরজায় নীল রঙের পালিশ। বাড়ির সংলগ্ন ছোট ফুলের বাগান, সবজির বাগান। প্রচণ্ড শীতের জন্য বাগানে কোনো ফুল অথবা সবজির চিহ্ন নেই। গোলাপেরা শুধু কুঁড়ি মেলার চেষ্টা করছে। ওরা দ—এর মতো পথে, কখনও সিঁড়ি ভেঙে, কখনও ঘুরে ঘুরে এলবির ছোট নীল আস্তানায় গিয়ে হাজির হল। প্রথমেই ছোট কাঠের দরজা।

সংকীর্ণ ফুটপাতের বাঁ—পাশের থামটায় লেখা ‘শান্তির নীড়’ তামার প্লেটে খুব চকচক করছে। সদর দরজার উপর আইভিলতার গুচ্ছ। পাতা নেই। শুধু লতাগুলো দুলছে। ভিতরে বাঁ—পাশে মুরগির ঘর। ডানপাশে ফুলের বাগান। ‘এল’ অক্ষরে পথ। পথের দু’পাশে নানা রকমের সামুদ্রিক পাথর। অন্য পাশে কোমর সমান কাঠের রেলিংয়ে কিছু নীল প্রজাপতি বসে আছে; মিঃ চার্লটন এবং মিসেস চার্লটন বের হয়ে এসে ওদের অভিবাদন জানালেন। বললেন, গতকালই আমরা এসে গেছি।

এলবিও সেজেগুজে বের হল। যেন ফুলের মতো এই শীতের হালকা রোদে ফুটে উঠল। এলবি ওদের ভিতরে নিয়ে গেল। বিজন দেবনাথের সঙ্গে ওঁদের পরিচয় করিয়ে দিল। এলবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেবনাথকে সমস্ত বাড়িটা দেখাল। এই ওর বাড়ি এখানে সে থাকে, ওই ওর ঘর—এখানে সে রাঁধে, এই ওর ঈজেল—এখানে সে ছবি আঁকে। দেবনাথ সব ঘুরে ঘুরে দেখল। এলবির একটি বিশেষ রুচি আছে এ বোধ ওর এখন জন্মাচ্ছে। ঘরে সব বড় বড় ক্যানভাস। নানা রঙের ছবি।

ওরা এসে পাশের ঘরটায় বসল। মিঃ চার্লটন কতকগুলো ছোট ছোট কাঠি এনে পাশে রাখলেন। মসৃণ করার জন্য কিছু শিরিষ কাগজ। তিনি সকলকে কাঠিগুলো দেখালেন—এগুলো রাইস—স্টিক। তারপর দু—আঙুলের ফাঁকে কাঠি চেপে ধরার কায়দা—কানুন শেখাতে থাকলেন দেবনাথ এবং বিজনকে। দেখালেন, কী করে স্টিক ধরতে হয়, কী করে মুখে ভাত তুলতে হয়। একটা খালি চিনেমাটির বাসনও রাখলেন সকলের সামনে। ছোটখাটো একটা ডেমনস্ট্রেশন দিলেন।

দেবনাথ এইসব দেখে বিরক্ত হচ্ছিল। সে ঘড়ি দেখল। এখন দশটা বাজে। এখনও এলবি টেবিল সাজাচ্ছে। কখন রান্না হবে এবং কখন খাওয়া হবে এই ভেবে সে উষ্মা প্রকাশ করল।

একটি ঘরকেই এলবি কাঠের পার্টিশন দিয়ে দু’ভাগ করে নিয়েছে। এ—ঘর থেকে সে—ঘরে যাবার একটি মাত্র খোলা পথ। একটিমাত্র দরজা। দরজায় পাল্লা নেই। দরজায় চাইনিজ সিল্কের দামি পর্দা। পর্দা সরালেই ঘরটা স্পষ্ট। পর্দা সরালেই ধবধবে বিছানা স্পষ্ট। দেবনাথ পর্দা সরিয়ে সব দেখল। বারান্দার দক্ষিণ দিকে চিলতে রান্নার জায়গা। পরে বাথরুম, পাশে ছোট একটি লনের মতো জায়গা। সেখানে গরমের দিনে ইজিচেয়ার নিয়ে বসা যায়। সেখানে একটি ভাঙা ঈজেল এখনও রেলিং—এর সংলগ্ন হয়ে পড়ে আছে। ছুটির দিনে এলবি সেখানে ছবি আঁকে।

ওরা উঁচু জায়গায় বসে বন্দর দেখল। বন্দরের জাহাজ দেখল। এখানে বসে অসীম সমুদ্রের বিস্তৃতি চোখে পড়ছে। পাহাড়ের নিচে সারি সারি ছবির মতো ঘর, ছবির মতো মানুষেরা হাঁটছে। দেবনাথ চারপাশটা চোখ মেলে দেখল।

দেবনাথ ফের ঘড়ি দেখে বাংলাতে বিজনকে বলল, ওরা কি আমাদের নিমন্ত্রণ করে খালি—পেটে রাখার ব্যবস্থা করছে নাকি। এখন বাজে সাড়ে দশটা অথচ রান্নার কোনো আয়োজনই করছে না।

বিজন বলল এলবিকে, সব জোগাড় আছে তো? অর্থাৎ এই কথা বলে বিজন রান্নার প্রসঙ্গে আসতে চাইল।

এলবি ফুলদানিতে কিছু সংগ্রহ—করা ফুল ভরে দিল। তারপর বিবাহিত রমণী—সুলভ চোখে বিজনকে দেখল এবং বলল, সবই এনেছি। তোমাকে ভাবতে হবে না। রান্নাঘরে ঠিক আমরা এগারোটায় ঢুকব। এবং আশা করছি ঠিক বারোটায় রান্না শেষ করতে পারব। ট্যাগোর—ডিশের কী কী মেনু হবে? এলবি দেবনাথকে প্রশ্ন করল।

দেবনাথ বলল, মেনু বেশি করতে হলে অনেক সময়ের দরকার হবে। বস্তুত দেবনাথ ডিমের ঝোল অথবা মাংসের ঝোলই ভালো রান্না করতে পারে। মাংসের ঝোল করতে বেশি দেরি হবে বলে সে বলল, রাইস এবং এগ—কারি।

এলবি বলল, রাইস তো চাইনীজ ডিশেও থাকবে। সুতরাং একমাত্র এগকারি।

একসময় দেবনাথ এবং মিঃ চার্লটন রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। দেবনাথ সঙ্গে করে গুঁড়ো মশলা এনেছে। এলবি দেবনাথকে সিদ্ধ ডিমের কৌটা খুলে বড় বড় কিছু ডিম বের করে দিল। মিসেস চার্লটন এবং বিজন ওঁদের সকলকে কাজে সাহায্য করলেন। গ্যাসের উনুনে আতপ চালের ভাত হল। এই ভাত রান্নার কৌশলটুকু আয়ত্ত করে মিঃ চার্লটন এখন গৌরব বোধ করছেন। তিনি ভাত রান্নার সময় গল্প করছিলেন—কোথায়, কখন এবং কী কৌশলে তিনি এই দুর্লভ বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন। বারবারই সেই চাইনিজ মহিলাটিকে তিনি ধন্যবাদ জানালেন। জানালেন ভদ্রমহিলা খুবই আন্তরিক।

এলবি কৌটা খুলে কিছু কর্ন—বিফ বের করে দিল। মিসেস চার্লটন ময়দার ডেলা গোল করে সেই কর্ণ—বিফ ভিতরে ভরে দিচ্ছেন। সেগুলো জলে সিদ্ধ করে নেওয়া হয়েছে। এ—সময় ভয়ানক উৎকট গন্ধে বিজন ঘরে থাকতে না পেরে বাগানে চলে এল এবং অনেকক্ষণ ধরে একা একা পায়চারী করল।

এক ঘণ্টার ভিতরেই রান্না সব হয়ে গেল। রাতে ছোট একটি ভেড়ার বাচ্চা রোস্ট করে রাখা হয়েছিল। এখন শুধু ওটাকে ফের চর্বি মাখিয়ে গরম করে নেওয়া হল। গ্রিন পিজ সিদ্ধ করে নেওয়া হয়েছে। কিছু স্যালাড, স্যান্ডউইচ। ইতিমধ্যে মিঃ ট্রয় এসে গেছেন, টনি এসে গেছে, এলবির পিসিও এসে পড়লেন। এবং অন্যান্য আরও দু—একজন অপরিচিত ব্যক্তি, যাঁরা সকলেই মিঃ চার্লটন অথবা মিসেস চার্লটনের বন্ধু পর‍্যায়ে। ওঁরা ঘরে ঢুকে সকলকে অভিবাদন জানালেন এবং পরিচিত হলেন।

খাবার টেবিলে ওঁরা সকলে সকলকে সাহায্য করলেন। খেতে বসার আগে এলবি বলল, আমরা ভগবানের পৃথিবীতে নিত্য দুটো আহার্য গ্রহণের সময় সকলে প্রার্থনা করব। বেচারি সেলিম আরোগ্য লাভ করুক। সকলে দাঁড়ালেন এবং মিনিট দুই কাল সেলিমের নিরাময়ের জন্য অধোবদনে থাকলেন। তাঁরা সকলে প্রার্থনা করছেন। এলবিকে যথার্থই এখন বাঙালি আটপৌরে গৃহিণীর মতো মনে হচ্ছে।

খেতে বসেই খুব উৎসাহের সঙ্গে চার্লটন ভোজ্যদ্রব্যের ফিরিস্তি দিলেন প্রথম। কিছু রাইস—স্টিক পরস্পর পরস্পরকে দিলেন। প্রথমেই চীনেমাটির বাসনে কিছু ভাত এবং আধসিদ্ধ মাংসপুর, একটু গোলমরিচের গুঁড়ো চার্লটন সকলকে পরিবেশন করলেন। এবং কাঠির সাহায্যে সকলকে খেতে অনুরোধ করলেন।

এইসব আধসিদ্ধ মাংসপুর, ভাত কাঠির সাহায্যে মুখে তুলতে গিয়ে বিজন ওয়াক তুলতে তুলতে বলে ফেলল, যথার্থই চমৎকার আপনার এই চাইনিজ ভোজ্যদ্রব্য। সঙ্গে সঙ্গে মিঃ চার্লটন মেয়েকে লক্ষ্য করে বললেন, বলেছি না, ওরা তারিফ করবে। চীন ভারতবর্ষ পাশাপাশি দেশ। সংস্কৃতিতে সভ্যতায় ওরা প্রায় এক।

দেবনাথ কান্নি মেরে মিঃ চার্লটনকে দেখল। ইচ্ছে হল ডিশের সবগুলো ভোজ্যদ্রব্য চার্লটনের মুখে ছুড়ে দেয়। অথচ সেও বলল, ভেরি নাইস।

দেবনাথ এবার ট্যাগোর ডিশের এগকারি সকলকে পরিবেশন করল। সে জানত লঙ্কার গুঁড়োটা একটু বেশিই পড়েছে। সে জানত ঝাল খেয়ে ওদের জিভ টাটাবে। সে বিদ্রুপ করে বলল, ট্যাগোর ঝাল একটু বেশি খেতেন।

খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাল চার্লটনের মাথায় উঠে গেল। চার্লটনের মাথায় টাক। তিনি তালুতে ঠান্ডা হাত রাখলেন। ঝাল খেয়ে অন্য সকলের ঠোঁট কুঞ্চিত হচ্ছে প্রসারিত হচ্ছে। সকলে জল খেলেন প্রচুর। এবং গাদা গাদা চিনি খেলেন। চোখ সকলের ভারী হয়ে উঠেছে, লাল হয়ে উঠেছে। ওঁরা তবু কোনোরকমে উচ্চারণ করলেন, গ্র্যান্ড। ট্যাগোর ডিশ গ্র্যান্ড।

দেবনাথ এবং বিজন ভাতের সঙ্গে ডিমের ঝোল বেশ তৃপ্তি করেই খেল। ওরাও বলল, ট্যাগোর ডিশ গ্র্যান্ড। তারপর ওরা কাঠি দিয়ে ভাত খাওয়ার চেষ্টা করল। কিছু খেল, কিছু নষ্ট হল। তারপর স্যান্ডউইচ, গ্রিন পিজ এবং ল্যাম্ব—রোস্ট খেয়ে ওরা খুশি হতে পারছে। ওদের ওখন সেই ত্রাহি—ত্রাহি ভাবটুকু নেই। শেষে কফি খেয়ে ওরা সকলে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল। সকলের মুখ দেখে মনে হবে এখন এইমাত্র টেবিলে বড় রকমের একটা ঝড় বয়ে গেছে।

বিকেলে স্টেশন—ওয়াগনে মিঃ এবং মিসেস চার্লটন জীলঙের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। মিঃ ট্রয় ও অন্যান্য দু—একজন আগেই চলে গেছেন। এলবির পিসি গেলেন এইমাত্র। যাওয়ার আগে দেবনাথ এবং বিজনকে ওঁর ঘরে একদিন নিমন্ত্রণ করে গেলেন।

এরপর এলবি বিজন এবং দেবনাথকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ওরা তিনজন যখন গাড়িতে উঠতে যাবে তখন দেবনাথ বলল, এবার আমি যাই। জাহাজে আমার একটু দরকার আছে।

গাড়ির ভিতর এলবিকে আজ একটু উচ্ছল বলে মনে হল। এলবি বলল, দেখবে সেলিম ভালো হয়ে উঠবে। ওকে আজকে খুব ভালো দেখাচ্ছিল। সে নিজে এখন হাঁটাচলা করছে। এখন অপারেশন হলে বাঁচি।

বিজন বলল, আমিও আশা করছি আমরা একসঙ্গে দেশে ফিরতে পারব। একসঙ্গে ফিরতে পারলে খুবই আনন্দের ব্যাপার ঘটবে।

এলবি কথা বলল না। এলবি সন্তর্পণে ওর মুখ দেখল। বিজনের মুখে যেন এখন আর কোনো যন্ত্রণার ছবি নেই। যেন সে এমত ঘটনায় যথার্থই আনন্দিত হবে। এলবি স্টিয়ারিং—এ বসে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।

ওরা আবার জাফরি—কাটা আলো এবং পাতার ছায়ায় এসে বসল। বিকেল থেকে ঠান্ডা হাওয়া বইছে না। ওরা আজ পাশাপাশি বসল না। ওরা মুখোমুখি বসল। এলবি আজ ইচ্ছা করেই পর পর চার—পাঁচটি কবিতা শোনাল বিজনকে। আর বিজনকে বাংলা কবিতা আবৃত্তি করার জন্য কোনো অনুরোধ করল না, এমনকী বিজন কতটা আগ্রহ নিয়ে শুনছে তাও লক্ষ্য করল না। এবং এই কবিতা আবৃত্তির সময়েই এলবির একটু মদ খেতে ইচ্ছে হল। বলল, তুমি একটু মদ খাবে, বিজন?

সে রাতে উভয়ে মদ খেয়েছিল। অথচ পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়নি। পরস্পর গোলাপি নেশায় উন্মত্ত হয়নি। তবু কেন জানি বিজন ঘাস থেকে উঠতে পারছিল না। সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওর দস্তানা খুলে যাচ্ছে। পেটের ভিতর এক দুরন্ত যন্ত্রণায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে। সে বলল, এলবি, আমি আর পারছি না।

এলবি সমস্ত শক্তি দিয়ে বিজনকে তুলে ধরল এবং ধীরে ধীরে মোটরের ভিতর এনে শুইয়ে দিল। তারপর বাড়ি ফিরে বিজনকে নিজের খাটে শুইয়ে দিল এবং ফোন তুলে ডায়াল করল। বলল, ক্যারল আছেন? ডঃ ক্যারল। প্লিজ ফাইভ বাই এইট নটিংহিল। পেশেন্ট সিরিয়াস।

ডাক্তার বিজনকে দেখেছিলেন এবং বলেছিলেন, কনস্টিপেশনের জন্য এমন হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই। দু’দিনেই ভালো হয়ে উঠবে। দু’রকমের পিল থাকল। এখন একটা খাইয়ে দিলেই ব্যথাটা কমে আসবে। পেটে একটু গরম জলের সেঁক দিতে পারেন।

ডাক্তারবাবু চলে গেছেন। এলবি বিজনকে বলে দু’মিনিটের জন্য বাইরে গেছে। বিজন যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে দেয়ালের সব ছবি দেখল। বড় বড় সব ক্যানভাসে নানা রঙের ছবি। কবির ছবি দেয়ালে। হলুদ রঙের দেয়াল। এলবির হাতে আঁকা কবির এই ছবি যেন বিজনকে বিদ্রুপ করছে। যেন বলছে বাহবা, যা হোক তোমরা আমাকে নিয়ে তামাসা করলে। বিজন এই যন্ত্রণার ভিতরও প্রথম দিনের কথা ভেবে অনুতপ্ত। বস্তুত সে সঙ্গসুখে অধীর হয়ে ওর প্রথম দিনের ইচ্ছাকৃত তামাসার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল।

এলবি ঘরে ফিরেই বিজনের কপালে হাত রেখে উত্তাপ দেখল। তারপর জল এনে পিল খাইয়ে দিয়ে হট—ওয়াটার ব্যাগে পেটে সেঁক দিতে থাকল। অধীর আগ্রহে সারারাত জেগে ওর পাশে বসে থাকল। ভোর রাতের দিকে যন্ত্রণা থেকে বিজন যেন মুক্তি পেল। বিজন পাশ ফিরে এলবির সেই আন্তরিক এবং প্রীতিপূর্ণ চোখের দিকে চেয়ে বলল, এলবি, তোমাকে খুব কষ্ট দিলাম।

এলবি ওর কপালে হাত রাখল শুধু। কোনো কথা বলল না। বিজন ওর চোখ দেখেই বুঝল, বুঝতে পারছে এ মুহূর্তে ওকে নিরাময় করে তোলার কী আকুল ইচ্ছা এলবির চোখে।

ভোরের দিকে বিজন ঘুমিয়ে পড়েছে। সুতরাং ঘুম ভাঙতে ওর দেরি হল। জানালার রোদ ওর বিছানায় এসে নেমেছে। এলবি বাইরের ঘরে আছে। কাকে যেন ফোন করল এইমাত্র। বিজন বিছানায় শুয়ে সব ধরতে পারছে—এলবি জাহাজে ফোন করে কাপ্তানের সঙ্গে কথা বলছে, ওর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর দিচ্ছে এবং সঙ্গে চার—পাঁচদিনের ছুটি মঞ্জুর করার জন্য ফোনে আবেদন পেশ করছে। এলবি এ—ঘরে এসে দাঁড়ালে বিজন ভাবল, কী দরকার আর থেকে। শরীর আমার ভালো হয়ে গেছে। বেশ সুস্থ বোধ করছি। বরং আজ জাহাজে চলি। কিন্তু এলবির মুখের দিকে চেয়ে বলতে পারল না কথাগুলো। চোখে ওর সারারাত অনিদ্রার অবসাদ। শরীরে ক্লান্তি। এলবি ওর কপালে হাত রেখে বলল, খুব ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে যাহোক।

তাই নাকি!

তা নয়তো কী! একটু মদ খেলে তো, অমনি ঘাসে লুটিয়ে পড়লে।

তুমি তো জানো এলবি, ওটা মদের জন্য হয়নি। ওটা জাহাজে কাজ করার পর থেকেই হচ্ছে। মাঝে মাঝেই হত, কিন্তু এমন কঠিন হত না।

একটু থেমে বিজন বলল, বরং এখন জাহাজে চলি।

তুমি কি পাগল, বিজন। ক্যারল তোমাকে পুরা পাঁচদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন। কাপ্তানকে এইমাত্র খবর দিলাম। তিনি খুব ভালো মানুষের মতো বললেন, সেজন্য কী আছে। নিশ্চয়ই ও চার—পাঁচদিন ছুটি পাবে।

তুমি তো ছুটি নিলে। কিন্তু এখানে থাকার অর্থই হচ্ছে তোমাকে অসুবিধায় ফেলা।

আমার কোনো অসুবিধা হবে না। পাশের ঘরে আমি থাকব। যখন যা দরকার আমাকে বলবে।

বিজন পুরো পাঁচ রাতই ওই ঘরে থাকল।

পাঁচ রাত ওরা পাশাপাশি ভিন্ন ঘরে শুয়ে জানালায় রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখতে দেখতে অথবা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ত। অথবা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করত। এলবি বালিশের নিচে দুটো হাত সন্তর্পণে ঢুকিয়ে কী যেন বারবার খুঁজত। কী যেন বালিশের নিচে ওর হারিয়ে গেছে। কখনও এলবি রাতের প্রজাপতিদের বিছানার চারপাশে দেখত। ওর প্রতীক্ষার জগতে সেইসব প্রজাপতিরা উড়ে উড়ে একদা অবসন্ন হত এবং সকালের দিকে ওরা ঘুমিয়ে পড়ত। কোনো কোনো রাতে এলবি এই শীতেও জানালা খুলে রাতের প্রজাপতিদের শরীর থেকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। এই ঘন রাতে এবং শীতের রাতেও ওর শরীর মধুর এক উত্তেজনায় অধীর হয়েছে। বাঙালি এক নাবিকের শরীরে কবির যুবা শরীরী বৃত্তিকে স্পর্শ করার ইচ্ছায় এলবি সহসা কাতর হত। আর বিজন নিজেকে রবীন্দ্রনাথের অনুগামী ভেবে মেকি সাধুর অভিনয় করে গেল। পর্দার আড়ালটুকু ওদের দুজনকে সেজন্য পরস্পর মহৎ করে রাখল। জাহাজে ফিরে এসে বিজন প্রথম রাতে অনিদ্রায়, দ্বিতীয় রাতে অসহিষ্ণুতায় ভুগে সারাদিন কাজ করার অজুহাতে ডেক—এ পড়ে থাকল। দু’দিন এলবি ইউনিয়নের কাজে শহর ছেড়ে অন্যত্র থাকছে মিঃ ট্রয়ের সঙ্গে। দুদিন দেখাসাক্ষাতের কোনো সুযোগ নেই। বিকেল কাটছে হাসপাতালে। পরবর্তী সময়টুকু আর কিছুতেই কাটতে চাইছে না। খুব নিঃসঙ্গ ভাব জাহাজে। কেউ থাকছে না। বন্দরে নেমে সকলে গলির আঁধারে হারিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এইসব দেখে সে আর পারছে না; সংযম না আত্মরক্ষায় সে তাও বুঝতে পারছে না।

বস্তুত বিজন এক অহেতুক ঈর্ষায় পীড়িত হচ্ছে। মিঃ ট্রয়কে কেন্দ্র করে এই ঈর্ষার জন্ম। বিজন প্রতি মুহূর্তে নিঃসঙ্গ জাহাজি যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল। এলবির অনুপস্থিতি যন্ত্রণার গ্রাসকে কঠোর করে তুলল। নিদারুণ জাহাজি যন্ত্রণায় সে দেবনাথের সঙ্গে গোপনে সস্তায় একটু মদ এবং সস্তায় একটু যৌন সংযোগ—রক্ষার্থে বদ্ধপরিকর হল। কিন্তু মুখের ভাবটুকু সকল সময়ের জন্য সরল নিঃস্বার্থ এবং যৌন জীবনে নিষ্পাপ, যেন এই মহৎ পৃথিবীতে অশ্লীল হবার মতো কিছুই নেই। বিজন দেবনাথের সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে বলল, আর কত দূর তোমার রাতের আস্তানা?

অথচ বিজন রাতের আস্তানায় দর করতে গিয়ে দেখল যুবতী সব সময়ের জন্য চোখ দুটো কোটরাগত করে রেখেছে। প্রতিদিনের যৌন অত্যাচারে গালে অশ্লীল টোল। নগ্ন চেহারাতে জাদুকরের লাঠির মতো ভেল্কি। এবং সমস্ত শরীরে কীসের যেন দাগ! যেন অত্যাচারের অশ্লীল উল্কি পরে নিত্য জাহাজি যন্ত্রণার সাক্ষী থেকেছে। পাশাপাশি দুটো চোখ—এলবির চোখ, এলবির প্রীতিপূর্ণ চোখ……সে পারল না। সে নগ্ন হয়ে নাচতে পারল না রাতের আস্তানায়। মদের গোলাপি নেশা ছুটে গেলে সে যথাসম্ভব সত্বর ছুটে পালাল।

সে জাহাজে ফিরে দেখল ডেক খালি। কোনো জাহাজির সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ডেকের উপর ইতস্তত কিছু আলো জ্বলছে। একটা বেড়াল এ শীতে অফিসার—গ্যালিতে খাবার খুঁজছে। বিড়ালটা শীতে কষ্ট পাচ্ছে এবং ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদছে। সে আরও এগিয়ে গেল। সে শুনল ডেক—ভাণ্ডারী মদ খেয়ে নিচে হল্লা করছে। নিচে নেমে দেখল সকল জাহাজিদের দরজা বন্ধ। যে দু—একজন জাহাজি এখনও ফেরেনি তারা আর এ—রাতে ফিরবে না। সে ধীরে ধীরে নিজের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেবনাথ আগে ফিরে এসেছে। ফোকসালের ভিতরে লকারের শব্দ। বুঝি দেবনাথ লকার খুলছে। বুঝি দেবনাথ বাংকে বসে খাচ্ছে। বিজন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বলল, আমি পারিনি, দেবনাথ—আমি পারিনি। মেয়েটির শরীর দেখে আমার করুণা হল।

এই করুণার কথা ভেবে যখন সে ক্ষতবিক্ষত তখন দেবনাথ খেতে খেতে বলছে—এলবি এসে এই বাংকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে গেছে তোমার জন্য।

তুমি কী বললে?

বললুম রাতের আস্তানায় গেছে।

দেবনাথ! সে চিৎকার করে উঠল। ইচ্ছা হল দেবনাথের গলা টিপে ধরতে। বিজন লক্ষ্য করল, দেবনাথ দুজনের ভাত একাই গিলছে। ওর নেশা এখনও প্রকট। সেজন্য দেবনাথের হাত কাঁপছে। এবং গোল গোল চোখে সে বিজনকে দেখছে।

বললাম তুমি এলবিকে ঠকিয়েছ। তুমি রবীন্দ্রনাথের নামে ‘পাখী সব করে রব’ শুনিয়েছ। বললাম তুমি পূর্ববঙ্গের ছেলে, বললাম দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে এসেছ। কোনো এক কলোনিতে পিসিমার বাড়িতে থাক। তোমার বাড়ি বটতলায় নয়। সুতরাং বটতলা থেকে নিমতলা কাছেও নয়। আর কিছু বলল না দেবনাথ। ফের ভাত খাচ্ছে। অথবা বললে যেন এরকম শোনাত—বিজন, আমি ঈর্ষার তাড়নায় ভুগছি। তুমি এমন প্রীতিপূর্ণ চোখের স্নেহচ্ছায়ায় বন্দরের দিনগুলো কাটাবে, তুমি বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মতো বাঁচতে চাইবে, সে আমার সহ্য নয়। সে বলল, কবির প্রতীকী হয়ে তুমি এলবির কাছে বেঁচে আছ, আর আমি কোটরাগত চোখে জাহাজি হয়ে বেঁচে আছি, আমি ঈর্ষার তাড়নায় ভুগছি—আমি পারিনি, আমি পারিনি। ঈর্ষার তাড়নায় আমি একটু বেফাঁস হয়েছি।

বিজন বাংকে শুয়ে পড়ল। কোট—প্যান্ট পরেই শুয়ে আজ যথার্থ জাহাজি কায়দায় রাত যাপন করল।

সকালে জাহাজের কাজ বলতে তার, দেয়াল রঙ করা, দেয়াল সাবান—জলে পরিষ্কার করা—সে সব কাজগুলো আজ নিখুঁতভাবে করল। সে ইচ্ছা করেই এলবিকে ভাবল না। সে ইচ্ছা করেই কাঁচা খিস্তি করল আজ। ভোরবেলায় দেবনাথ ওর পাশে দাঁড়ালে, বলল, আমাকে ছোট করে কী লাভ হল, দেবনাথ?

দেবনাথ ওর দুটো হাত ধরে বলল, বিজন, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমার বড় ভুল হয়েছে। গত রাতে টাকার অভাবে মেয়েটাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারিনি। মাথা গরম। বাধ্য হয়ে সস্তায় গলা পর্যন্ত মদ গিলে জাহাজে ফিরেছিলাম।

মাতাল হয়ে জাহাজে ফিরেছি। তোমার বাংকে এলবিকে দেখেই ধৈর্য ধরতে পারিনি। আমি ওকে টেনে তুলেছিলুম। এলবি বিরক্ত হয়ে তাকাতেই তোমাকে দুশমন বলে ভেবেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর, বিজন। বলে দেবনাথ যথার্থই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ওর পাশে দাঁড়াল।

বিকেলে বিজন হাসপাতালে গেল। সেলিমের অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। সেলিম ভালো হয়ে উঠছে। সেলিম ফের জাহাজের জাহাজি হয়ে একই সঙ্গে হয়তো ঘরে ফিরতে পারবে। এইসব ভাবনায় দেবনাথ এবং বিজন পথ চলছিল। দেবনাথ বলল, এলবির কাছে তোর একবার যাওয়া উচিত।

কোন মুখে যাব, বল।

আমার বড় ভুল হয়ে গেল, বিজন।

ওরা পরস্পর তাকাল। ওরা পরস্পর হাত ধরে হাসপাতালে উঠে গেল।

সিঁড়ি ধরে উঠবার সময় ভাবল, এলবি যদি আসে, এই হাসপাতালে এলবি যদি ওর জন্য অপেক্ষা করে, যদি বলে—বিজন, তুমি কি যথার্থই রবীন্দ্রনাথের নামে ‘পাখী সব করে রব’ শুনিয়েছ, তুমি কি যথার্থই কবিকে নিয়ে তামাসা করেছ তখন, তখন সে কী উত্তর দেবে! এইসব ভেবে বিজন, হাসপাতালে ভয়ে ভয়ে, সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকল। এবং যখন দেখল সেলিমের বিছানার পাশে কেউ বসে নেই তখন সে এক অহেতুক আনন্দে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পেল।

সেলিমের শরীরে এখনও রক্ত দেওয়া হচ্ছে। সেলিম এত দুর্বল যে, কথা বলতে পারছে না। ওরা ওর পাশে বসল এবং বেঁচে থাকার জন্য উৎসাহিত করল।

বন্দরে বিজন এলবিকে এড়িয়ে বাঁচতে চাইল। সামনে পড়লেই ধরা পড়বে অথবা কলিন স্ট্রিট ধরে হাঁটলেই সাক্ষাতের সম্ভাবনা। সে সেজন্য জাহাজ থেকে কম নামল, বন্দর ধরে শহরে উঠল না এবং বড় বড় পথ ধরে পায়চারি করল না। সে শুধু বিকেলে হাসপাতালে গেল। এবং একদিন সেলিম বলল, সেলিম তখন ভালো হয়ে উঠছে, সেলিম তখন কথা বলতে পারছে—বলল, এলবি রোজ ভোরে আসেন।

জাহাজে সারাদিন কাজের পর যখন ক্লান্ত হয়ে বিজন রেলিংয়ে এসে ভর করে দাঁড়াত তখন ওর মনে পড়ত নটিংহিলের সেই ছোট্ট কাঠের ঘর, সেই ছোট অক্ষরে লেখা ‘শান্তির নীড়’, সেই ইজিচেয়ারটা এবং পাশের ভাঙা ঈজেলটার কথা। মনে পড়ত ওর কবিতা—আবৃত্তির কথা। এলবি ‘গীতাঞ্জলি’র সব কবিতা যেন ওকে বারবার শুনিয়েছে। সে যেন এখন এই রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে সব কবিতাই স্পষ্ট মনে করতে পারছে। ওর একান্ত ইচ্ছা—এলবি যদি আসত, যদি সে ওর সামনে দাঁড়িয়ে সব অভিযোগ করত, যদি বলত, তুমি কবিতার মতো না বেঁচে জাহাজির মতো বাঁচলে! অথচ সে এল না। একদিন গেল, দু’দিন গেল, দু’সপ্তাহ গেল, অথচ সে এল না। পাইন গাছগুলো তখন পাতা মেলতে শুরু করেছে। পাখিরা সব আবার ফিরে এসেছে, গাছে গাছে তারা কোলাহল করছে। বসন্তের আগমনে এই ধরণি যেন উচ্ছল যুবার মতো অথবা গর্ভবতী তরুণীর মতো বয়সি হতে চাইছে। অথচ এলবির আর দেখা নেই।

বন্দরে যতদিন যেতে থাকল তত বিজন এলবির কাছে নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করল। তত সে ভেঙে পড়ল। তত সে নিঃসঙ্গবোধে পীড়িত হতে থাকল। জাহাজ ছেড়ে দেবে ক’দিন পর। সেলিম ভালো হয়ে উঠছে। যে সেতুবন্ধটি গড়ে উঠেছিল সেলিমকে কেন্দ্র করে, সেলিম জাহাজে ফিরে এলে সেটুকুও শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু কোনো এক ভোরে জাহাজে খবর এল, কাপ্তান হাসপাতালের সঙ্গে সংযোগ—রক্ষা করছেন—ডেক—এ ফের উদ্বেগ উত্তেজনা, সারেং ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যান্য জাহাজিরাও ব্রিজের নিচে অপেক্ষা করছে—জাহাজের সবাই বোটডেকে মাস্তারে দাঁড়িয়ে আছে—তখন কাপ্তান বলছেন ব্রিজ থেকে, সেলিম ইজ ডেড—সেলিম মৃত।

বিকালে সব জাহাজিরা জাহাজ থেকে নেমে গেল। ওরা হাসপাতালের দরজায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মৃত নাবিকের শরীর নিয়ে যাত্রার ইচ্ছায় উন্মুখ হয়ে থাকল। ওদের অবয়বের ইচ্ছা যেন এই আমরা এই সন্ধ্যায় সকলে কবরভূমিতে নেমে যাচ্ছি। আমরা নেমে যাচ্ছি, আমরা নেমে যাব। আমরা মরে যাচ্ছি, আমরা মরে যাব।

শহরবাসীরা নাবিকের শবযাত্রার পথে ভিড় করল। একদল বিদেশি লোক জাহাজি পোশাকে কোনো নাবিকের মৃতদেহ নিয়ে সৈনিকের মতো পা ফেলে হাঁটছে। জানালায় যুবতী আর্শির আলোতে সেই শবযাত্রীদের দেখে মুখ ঘোরাল। কিছু স্বজাতীয় দেখল সেই শবানুগমন—এলবি কফিনের বাঁপাশে পথ দেখিয়ে চলছে। মিঃ ট্রয় এবং কিছু জাহাজি শ্রমিক কফিনের আগে আগে চলছে। ভারতীয় নাবিকেরা পিছনে। বিজন সকলের পিছনে। ওরা নিঃশব্দে পথ অতিক্রম করছে। ওরা সকলে শহর অতিক্রম করে ক্রমে পাহাড়ের উৎরাইয়ে নেমে গেল। ওরা সকলে আজ কোনো কথা বলল না। কত নিঃসঙ্গ, কত নিঃশব্দ এই যাত্রা! ওরা পরস্পর অপরিচিতের মতো ব্যবহার করল, যেন অথবা, এই শোকাবহ ঘটনায় ওরা পরস্পর সাময়িক বেদনায় আত্মনিষ্ঠ। এলবি পর্যন্ত কোনো কথা বলে বিজনকে কিংবা অন্যান্য জাহাজিদের সমবেদনা জানাল না। এলবি চোখ তুলে বিজনকে দেখল না। অথবা না—দেখার ইচ্ছায় সর্বদা কফিনের আগে আগে পথ দেখিয়ে চলেছে। অথবা এলবির প্রত্যয় এমনভাবে ভেঙে গেছে যে, সে বিজনকে ফের উৎসাহ দিয়ে বলতে পারল না, সেলিম দেখবে ভালো হয়ে উঠবে।

কবরভূমির সদর দরজা দিয়ে ওরা ভিতরে ঢুকে গেল। বিজন ছোট বড় সব বেদি দেখতে পেল। গির্জার মতো ছোট—বড় কবরের দেয়াল দেখতে পেল। অনেক সুখ—দুঃখর এপিটাফ চোখে পড়ল। সেলিম এখন কফিনে শুয়ে আছে। সেলিমের স্ত্রী এখন হয়তো দরজায় বসে মেয়েটাকে আদর করছে। অথবা মেয়েকে খসমের খবর দিয়ে সুখ পাচ্ছে। সেলিমের কবর এখানেই হল। সে বিবির কোলে মাথা রেখে মরতে পারল না। এইসব ভেবে বিজনের অশেষ দুঃখ। তবু একবার এলবিকে বলার ইচ্ছা—কিছু, বলার ইচ্ছা—শোকাবহ ঘটনার কথা বলে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করার ইচ্ছা—ওর সেই কবিতা—আবৃত্তির ইচ্ছা—পিস ওয়াজ অন হিজ ফোরহেড।

সেলিমের কবরের উপর প্রথম এলবিই মাটি দিল। সকলের শেষে বিজন মাটি দিতে গিয়ে অসহায় মানুষের মতো কেঁদে উঠল। এই মাটিটুকু দিয়ে সে আজ কত অসহায়, কত নিঃসঙ্গ এমতভাব প্রকাশ করল। এলবি পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিজন শেষ মাটিটুকু কবরের উপর চাপড়ে চাপড়ে দিচ্ছে এবং কাঁদছে। সে যেন এই মাটির স্পর্শ ছেড়ে উঠতে পারছে না। উপরে আলো জ্বলছে। শীতের কুয়াশা আলোর ডুমটাকে অস্পষ্ট করে রেখেছে। সকলে একে একে কবর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সকলেই যেন এই মৃত্যুতে দুঃসহ এক যাতনায় পরস্পর কথা বলতে পারছে না। পরস্পর সান্ত্বনা দিতে পারছে না। সকলেই মাথা নিচু করে পাহাড়ের ঢাল ধরে চড়াইয়ে উঠে যাচ্ছে।

এলবি ডাকল, বিজন, ওঠ। সেলিমকে বহু চেষ্টায়ও বাঁচানো গেল না। মৃত্যুরই জয় হল। প্রভুকে ওর কথা বল। ওর আত্মার শান্তি কামনা কর।

এলবি বিজনকে টেনে তুলল। ওরা পরস্পর তাকাল। তারপর হাত ধরে কবরভূমি ফেলে পাহাড়ের চড়াই ভেঙে সমুদ্রের ধারে এসে বসল। এলবিই বিজনকে এই অসীম সমুদ্রের আঁধারে বসতে অনুরোধ করল।

অন্য তীরে সব বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজ। ওরা এপারে নির্জন জায়গায় বসে শোকটুকু ভুলতে চাইল। এলবি বিজনকে এই মৃত্যুশোক ভুলে যেতে অনুরোধ করল। এলবি ভিন্ন ভিন্ন রকমের কথা বলে বিজনের শেষ দুঃখটুকু মুছে দিতে চাইল—মুছে দেবার ইচ্ছায় ওকে শেষ পর্যন্ত নটিংহিলের ছোট কাঠের ঘরে নিয়ে এসে বলল, এ ঘর তোমার। তুমি এখানে থেকে যাও। যেন আরও বলতে চাইল—তোমার জাহাজি নিঃসঙ্গতাটুকু আমি, আমি—সব দিয়ে ভরে তুলব।

বিজন মনে মনে ভাবল—মূলত আমি নষ্টচরিত্রের মানুষ। তুমি আমায় ঘরে রেখে শান্তি পাবে না। বিশেষত কবির প্রতীকী হয়ে দীর্ঘ দিন আমি বাঁচতে পারব না। আমার জাহাজি চরিত্র আমাকে সমুদ্রের মতো অশান্ত করে রেখেছে। বন্দরে বন্দরে চরিত্র নষ্ট করে বেড়াতে না পারলে আমার জাহাজি চরিত্রের শান্তি নেই।

বিজন বলল, আশা করেছিলাম তুমি একদিন অন্তত অভিযোগ করতেও জাহাজে আসবে।

এলবি বলল, ভোরে সেলিমকে দেখে, সারাদিন অফিসে কাজ করে বিকেল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পার্কে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।

বস্তুত উভয়ে এক দুর্বিনীত অভিমানে পরস্পরের নিকট ঘনিষ্ঠ হয়ে অভিযোগ করতে পারেনি। এলবি জলপাই গাছের নিচে বসে যত আশাহত হয়েছে তত এক ক্ষুব্ধ আক্রোশে ঘরে ফিরে মাতাল হওয়ার ইচ্ছায় জানালায় প্রজাপতি গুনেছে। যখন একান্ত উত্তেজনায় স্থির থাকতে পারেনি তখন রবীন্দ্রনাথের ছবির নিজে বসে একের পর এক কবিতা উচ্চারণ করে এক অশেষ আনন্দে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অথবা ঈশ্বরের মতো ইচ্ছায় বিজনকে কবিতার মতো সুস্থ করে তোলার প্রবৃত্তিতে এলবি প্রতিদিন ছটফট করত। রবীন্দ্রনাথের নামে ‘পাখী সব করে রব’ এবং জাহাজিদের রাতের আস্তানা উভয়ই নষ্ট চরিত্রের লক্ষণ জেনেও সে ঠিক থাকতে পারেনি। বিজনকে রমণীয় স্মৃতির অন্তরে বাঁচিয়ে রাখার প্রেরণায় সে গর্ভবতী হতে চাইল।

এলবি বলল, তিনমাস ধরে তোমাকে পেয়ে কোনো নাচঘরে যেতে ভুলে গেছি। তুমি এমত আমায় আপনার করে রেখেছ।

এলবি যেন মনে মনে বিজনকে অনুরোধ জানাল, বিজন, তুমি যদি নষ্ট চরিত্রের মানুষ হতে চাও তবে আমায়ও নষ্ট চরিত্রের করে রেখে যাও। আমি আর এমনভাবে বাঁচতে পারছি না। দেয়ালে কবির ছবি, আমরা নিচে বসে এমত ভাবছি আমরা পরস্পর প্রীতির সম্পর্কে বাঁচছি—তুমি আমার আরও ঘন হয়ে বসো, আমার এতদিনের যৌন আদর্শকে ভেঙে দাও ; তোমার হাতে আমি নষ্ট চরিত্রের হয়ে বাঁচি। তোমার স্পর্শে কবির স্পর্শ এমত ভাব নিয়ে বাঁচি। এলবি ফের বলল, তুমি থেকে যাও, বিজন। বাকিটুকু বলতে পারল না। বাকিটুকু এলবির চোখে ধরা পড়ল—এ পৃথিবীতে বিজন ব্যতীত এলবি নিঃসঙ্গ যন্ত্রণায় দীর্ঘদিন ভুগবে। এ পৃথিবীতে ভারতবর্ষের এক রূপকথার মতো যুবকের ঘন গভীর প্রীতির সম্পর্কে এলবিকে দীর্ঘকাল আচ্ছন্ন করে রাখবে।

বিজন ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকল। কোনো কথা বলল না। এলবি দাঁড়াল। ওর পাশে এসে দাঁড়াল। ঘন হয়ে দাঁড়াল এবং বিজনের শীর্ণ ঠোঁটে ধীরে ধীরে নুয়ে চুমু খেল। বিজন এই ঘটনায় এতটুকু উত্তেজিত হল না বরং সে কেমন ঠান্ডা হতে হতে একসময় ইজিচেয়ারের সঙ্গে যেন মিশে গেল। বস্তুত বিজন কবির প্রতীকীতে বাঁচতে গিয়ে মৃত্যুর মতো শিথিলতায় অথবা কবির প্রতি ঠান্ডা ঈর্ষায় এই ঘন চুম্বনে কোনো যৌন উত্তেজনা পেল না। বরং সে এলবির প্রতি করুণাঘন হল। এলবির মাথা—হাত বুলিয়ে ঈশ্বরের মতো বলল, আবার যদি এ বন্দরে আসি, তোমার ঘরে আসব। জাহাজি মানুষের মতো আসব। বস্তুত বিজন নিজের সহজ সত্তায় এলবির ঘরে বাঁচবার ইচ্ছায় উঠে দাঁড়াল।

বিজন বলল, কাল ভোরে আমাদের জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছে। তুমি ভোরে যেও।

এলবি উত্তর দিতে পারল না। সে খাটে পড়ে বালিকাসুলভ কান্নায় ভেঙে পড়ল।

বিজন বুঝল এ সময় কোনো কথা বলে এই আশাহত বিদেশিনীকে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। সে সেজন্য অনেকক্ষণ ওর পাশে বসে থাকল এবং ওকে কাঁদতে দিল।

অনেকক্ষণ পর যখন বিজন দেখছে এলবি আর কাঁদছে না, বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে, তখন ওর হাত ধরে টেনে তুলল এবং বলল, চল, জাহাজে তুমি আমায় পৌঁছে দেবে।

গাড়িতে বসে বিজন ভাবল সেলিম এবং তুমি উভয়ে আমার আত্মার আত্মীয়। দুজনকেই আমি এ বন্দরে ফেলে যাচ্ছি। হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো এক বন্দরে আমার জাহাজ ভিড়বে। সেখানে সেলিমের মতো কোনো পাইনের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ব। তুমি তোমার জানালায় সেদিন আত্মার গভীরে যে অজ্ঞাত দুঃখের স্পর্শটুকু পাবে—সে আমারই। তখন তুমি জানালায় বসে এই সমুদ্রকে দেখে কবির কবিতা আবৃত্তি কোরো। সে কবিতার ভিতর আমরা, এইসব মৃত নাবিকেরা ঈশ্বরকে খুঁজব।

বিজন বলল, এলবি, তুমি আমার সঙ্গে কথা বল। এভাবে চুপচাপ গাড়ি চালালে আমার খুব কষ্ট হয়।

এলবি কথা বলার পরিবর্তে ধীরে ধীরে কবিতা আবৃত্তির সময় দেখল এই শহরের পথের সব আলোগুলো এখনও জেগে আছে। ইতস্তত দুটো—একটা মোটর ওদের অতিক্রম করে বের হয়ে যাচ্ছে। পথের মোড়ে মোড়ে পুলিশের বুটের শব্দ। পুলিশ টহল দিচ্ছে। দোকানের শো—কেসে আলো জ্বলছে না। এলবি এই ঘন রাতে বিজনকে কোনো কথাই বলতে পারল না—সে ভেঙে পড়ছে। তাই ধীরে ধীরে শেষ প্রিয় কবিতাটি সে আবৃত্তি করে বিজনকে বিদায় জানাল—

‘‘Art thou aboard on this stromy night

on the journey of love, my friend? The

sky groans like one in despair.

I have no sleep to-night. Ever and

again I open my door and look out on

the darkness, my friend!

I can see nothing before me. I

Wonder where lies thy path!

By what dim shore of the ink-black

river, by what far edge of the frowning

forest, through what mazy depth of

gloom art thou threading thy course

to come to me, my friend?”

তিন

কাকাতিয়া দ্বীপ থেকে ফসফেট নিয়েছে জাহাজটা। জাহাজ আগামী দশদিন পাশাপাশি ওসানিক দ্বীপপুঞ্জ সকল অতিক্রম করে অনবরত জল ভাঙবে। দশদিন জাহাজিরা মাটি দেখতে পাবে না, তেরো মাস সফরে যেমন এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে গিয়েছে, সমুদ্রের নোনা জল ভেঙে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে, তেমনি এ—দশ দিনও শুধু জলই দেখবে অথবা অসংখ্য নক্ষত্র এবং রাতের আঁধারে অন্য জাহাজের আলো।

তখন বিকেলের ঘন রোদের রঙ জেটিতে, ফসফেট—কারখানার প্রার্থনা—হলের গম্বুজে এবং দূরে, দূরে নারকেল গাছের ছায়াঘন চত্বরে অথবা শ্রমিকদের ভাঙা কুটিরে, আকাশ অথবা নীলের গভীরতায় সমুদ্র মগ্ন। জলের নীল অথবা সবুজ ঘন রঙের ছায়া সাহেবদের বাংলোগুলো উজ্জ্বল করে রেখেছে। কিছু শ্রমিক বিকেলের আনন্দ হিসেবে ছোট ছোট স্কীপ নিয়ে বঁড়শি নিয়ে সমুদ্রে ভেসে গেল। এবং তারা এই জাহাজের পাশ দিয়ে গেল। গলুইতে জাহাজিরা ভিড় করে আছে। যেখানে দ্বীপের পাথর সমুদ্রে বাতিঘরের মতো, যেখানে ফার্ন জাতীয় গাছ সমুদ্রের হাওয়ায় নড়ছে, সেখানে দ্বীপের সব শিশুরা অযথা লাফাল, নাচল, গাইল। কখনও সমুদ্রের জলে স্নান করল অথবা সাঁতার কাটল। এইসব দৃশ্যের ভিতর জাহাজটা ছাড়বে। গলুইতে জাহাজিরা ভিড় করে থাকল। মাস্টে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর জাহাজ ছাড়ছে এমন ভাবের কালো বর্ডার দেওয়া নিশান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রিজে কাপ্তান, বড় মালোম। গ্যাঙওয়েতে কোয়ার্টার মাস্টার এখনও পাহারা দিচ্ছে। সিঁড়ি এখনও জেটি থেকে তোলা হয়নি, অথচ সকল কাজ শেষ। ডেক, ফল্কা সব জল মেরে সাফ করা হয়েছে। হ্যাচ, ত্রিপল এবং কাঠের সাহায্যে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবু মেজ মালোম সারেংকে ডেকে গলুইতে চলে এলেন না, কিংবা ওয়ারপিন ড্রাম ঘুরিয়ে বললেন না হাসিল—হাপিজ। বললেন না, তোমরা জাহাজিরা এসো, আমরা বন্দরের নোঙর তুলে সমুদ্রের পাল তুলি।

সমুদ্রের শান্ত নিবিড়তার ভিতর দ্বীপের পাহাড়, ঘর—বাড়ি, কারখানা এবং এইসব দ্বীপের পুরুষ—রমণীরা সকলে যেন রাজকন্যার মতো জেগে সারা রাত ধরে, মাস ধরে এমনকি বৎসর, যুগ যুগ ধরে কোনো এক রাজপুত্রের প্রতীক্ষাতে মগ্ন। সুপারি গাছ, নারকেল গাছ এবং উষ্ণদেশীয় সকল শ্রেণীর গাছ দ্বীপে দৃশ্যমান। সুমিত্র, জাহাজি সুমিত্র, সেজন্য বিকেলে পথে ঘুরতে ঘুরতে কখনও এ অরণ্য অঞ্চলে ঢুকে কাগজি লেবু সংগ্রহ করত। দু’পা এগিয়ে গেলে ওপাশে সমুদ্র, ধারে ধারে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। সুমিত্র প্রায়ই বালিয়াড়িতে চুপ হয়ে, বালুচরের সঙ্গে ঘন হয়ে এই দ্বীপের নিবিড়তায় মগ্ন থাকত। যেন সে দীর্ঘদিন পর নিজের দেশের মতো দৃশ্যমান বস্তু সকলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে।

প্রস্থে দৈর্ঘ্যে তিন গুণিত চার মাইল পরিমিত স্থানটুকু জুড়ে এই দ্বীপ। কিছু সমতল ভূমি, কিছু পাহাড়শ্রেণী। দ্বীপের দক্ষিণ অঞ্চলে সাহেবদের বাংলো—সকল, পার্ক, বিদ্যালয় এবং ক্লাব—ঘর। পশ্চিমটুকু জুড়ে শ্রমিকদের নিবাস। পাহাড়ের উপর যেখানে কৃত্রিম উইলো গাছের সংরক্ষিত অঞ্চল আছে, যেখানে মার্বেল পাথরের প্রাসাদ এবং দ্বীপসকলের প্রধান কর্তার অবস্থিতি—তার ঠিক নিচে সুপেয় জলের হ্রদ। পাথুরে সিঁড়ি নিচে বালিয়াড়িতে গিয়ে নেমেছে। ছোট নীল হ্রদ অতিক্রম করার স্পৃহাতে সুমিত্র কোনো সিঁড়ির নিচে বসে থাকত। সমুদ্রের বুকে মার্বেল পাথরের স্থাপত্যশিল্প সুমিত্রকে রূপকথার গল্প স্মরণ করিয়ে দিত। সেখানে একদা সুমিত্র এক যুবতীকে আবিষ্কার করল। যুবতী উইলো গাছের ছায়ায় হ্রদের তীরে বসে ভায়োলিন বাজাত।

সুমিত্র জাহাজ—রেলিংয়ে ভর করে গতকালের কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারছে। সে দীর্ঘ সময় সিঁড়িতে বসেছিল এই ভেবে—যুবতী হয়তো এই পথ ধরে অপরাহ্ণ বেলায় অন্য অনেকের মতো সমুদ্রে নেমে আসবে। যুবতীর প্রিয়মুখ দর্শনে সে প্রীত হবে। কিন্তু দীর্ঘ উঁচু পাহাড়শ্রেণীর ফাঁক দিয়ে যুবতীর মুখ স্পষ্ট ছিল না। সুতরাং অন্য দিনের মতো ভায়োলিনের সুরে মুগ্ধ হওয়া ব্যতিরেকে কোনো গত্যন্তর ছিল না। প্রতি দিনের প্রতীক্ষা তার কখনও সফল হল না। এবং সেইসব নিষিদ্ধ এলাকায় যেতে পারত না বলে সমুদ্রে যুবতীর প্রতিবিম্ব দেখে গল্পের ডালিমকুমার হয়ে বাঁচবার স্পৃহা জন্মাত। আহা, আমি ওর চোখে স্পষ্ট হলুম না গো! যখন জাহাজিরা শ্রমিকদের বস্তিতে পুরনো কাপড়ের বিনিময়ে যৌন—সংযোগটুকু রক্ষা করত, তখন সুমিত্র পাথরের আড়ালে বসে উদাস হবার ভঙ্গিতে আকাশ দেখত।

সূর্য এখন সমুদ্রে ডুবছে। নীল সমুদ্রের লাল রঙ এখন পাহাড় এবং পাহাড়শ্রেণীর উপত্যকা সকলকে স্নিগ্ধ করছে। ছোট ছোট স্কীপগুলো ঘরে ফিরছে। ক্লাব—ঘরে ব্যান্ড বাজছে। জেটিতে অনেক মানুষের ভিড়। সুন্দরী রমণীরা, আর পাহাড়ের সব বাসিন্দারা যুবতীকে জাহাজে তুলে দিল। সকল জাহাজিরা গলুইতে ভিড় করে থাকল। সেই যুবতী, চঞ্চল দুটো চোখে, গ্যাঙওয়ে ধরে উঠে আসছে। সন্ধ্যার গাঢ় লাল রঙ যুবতীকে রহস্যময়ী করে তুলছে।

এবার সব ডেক—জাহাজিরা দু’ভাগ হয়ে আগিলা—পিছিলা চলে গেল। উইঞ্চ হাড়িয়া—হাপিজ করল হাসিল। ড্যারিক নামানো হল। যুবতীর বাপকে দেখা গেল কাপ্তানের ঘরে। কিছু কিছু জেটির লোক ডেকে উঠে এসেছিল। ওরা সিঁড়ি তোলার আগে নেমে গেল। যুবতীর বাবা নেমে গেলেন। তারপর জাহাজ ধীরে ধীরে তীর থেকে সরতে থাকল। রুমাল উড়ল অনেক জেটিতে, যুবতী কেবিনে ফিরে যাওয়ার আগে সন্ধ্যার গাঢ় রঙের গভীরতায় ওই দ্বীপের ছবি দেখতে দেখতে কেমন তন্ময় হয়ে গেল। এই তার দেশ, এত সুন্দর এবং রমণীয়।

কেবিনে ঢুকে যুবতী টুপাতি চেরি দেখল কাপ্তান—বয় সবকিছু সযত্নে সাজিয়ে রেখেছে। চেরি আয়নায় মুখ দেখল, তারপর লকার খুলে রাতের পোশাক পরে বোট ডেকে উঠে যাবার জন্য দরজা অতিক্রম করতেই মনে হল জাহাজটা দুলছে এবং মাথাটা কেমন গুলিয়ে উঠছে। চেরি আর উপরে উঠল না। সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। নরম সাদা বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে পোর্টহোলের কাচ খুলে দিল। চেরি এখন সমুদ্র এবং আকাশ দেখছে।

দরজায় খুব ধীরে ধীরে কড়া—নাড়ার শব্দে চেরি প্রশ্ন করল, কে?

আমি কাপ্তান—বয়।

এসো।

আপনার খাবার, বলে সযত্নে টেবিল সাজাল।

চেরি বলল, এক পেয়ালা দুধ, দুটো আপেল।

আর কিছু?

না।

আপনার কষ্ট হচ্ছে মাদাম?

না।

উপরে উঠবেন না? বেশ জ্যোৎস্না রাত। বোট—ডেকে আপনার জন্য আসন ঠিক করা আছে।

না, উপরে উঠব না।

বয় চলে যাচ্ছিল, চেরি ডেকে বলল, শোন!

কাপ্তান—বয় কাছে এল। বলল, তুমি কাপ্তানকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।

জী, আচ্ছা। কাপ্তান—বয় দরজা টেনে চলে গেল।

তখন ফোকসালে জাহাজিরা চেরিকে কেন্দ্র করে মশগুল হচ্ছিল। সকলে ওর চোখমুখ দর্শনে সজীব। এবং চেরি যেন এই নিষ্ঠুর জাহাজে সকল জাহাজিদের নিঃসঙ্গ মনে সমুদ্রযাত্রাকে সুখী ঘরণির ঘরকন্নার মতো করে রাখছে। আর এমন সময় ডেক—সারেং এলেন, এনজিন—সারেং এলেন। তাঁরা দরজায় দরজায় উঁকি দিয়ে বললেন, তোমরা উপরে যাও, বোট—ডেকে মাস্তার দাও।

জাহাজিরা সিঁড়ি ধরে উপরে উঠল সকলে। ওরা বোট—ডেকে পশ্চিমমুখো হয়ে দাঁড়াল। ডেক—সারেং ওদের পাশ দিয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরা, বাপুরা, ওঁর সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করতে যাবে না। কাপ্তানের বারণ আছে। জেনানা মানুষ, কাঁচা বয়েস, তার উপর আবার শুনছি রাজার মেয়ে এবং তিনি নাকি আমাদের কোম্পানির একজন কর্তাব্যক্তি।

সুমিত্র হাসল। —কী যেন বলেন চাচা! উনি তো কাকাতিয়া দ্বীপের প্রেসিডেন্টের মেয়ে।

সারেং বললেন, ওই হল। যে রাজা, সেই—ই প্রেসিডেন্ট।

এখন রাতের প্রথম প্রহর। অল্প জ্যোৎস্না সমুদ্রে এবং জাহাজ—ডেকে। জাহাজিরা গরম বলে সকলে ফোকসালে গিয়ে বসল না। ওরা ফল্কার উপর বসে ভিন্ন রকমের সব কথাবার্তা বলল। দু—একজন জাহাজি অভদ্র রকমের ইঙ্গিত করতেও ছাড়ছে না। এ ধরনের কথাবার্তা শুনে অভ্যস্ত বলে সুমিত্র রাগ করল না। বরং হাসল। দীর্ঘদিনের সমুদ্রযাত্রা সুমিত্রকে বিরক্ত করছে।

সুমিত্র ভাবল, সেই মেয়ে, হ্রদের তীরে বসে বেহালা বাজাত, পাথরের আড়ালে বসে হ্রদে প্রতিবিম্ব দেখে যার রহস্য আবিষ্কারে সে মত্ত থাকত, যার প্রতিবিম্ব সমুদ্রের কোনো রাজপুত্রের ইচ্ছাকে সকরুণ করে রাখত, অথবা সেই প্রাসাদের ছায়া, ঘন বন, সমুদ্রের পাঁচিল এবং উঁচু পাথরের সব দৃশ্য সুমিত্রকে ঠাকুমার গল্প মনে পড়িয়ে দিত….যেন রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে….যাচ্ছে….শুধু পাতালপুরীতে ভোজ্যদ্রব্য, যেন প্রাসাদের পর প্রাসাদ, কোনো জন—মনিষ্যির গন্ধ নেই, ফুলেরা, গাছেরা, পাখিরা এবং পতঙ্গসকল পাথর হয়ে আছে। হ্রদের তীরে খুব নিচু উপত্যকা থেকে সুমিত্র যতদিন চেরিকে দেখেছে, ততদিন পাতালপুরীর দৃশ্যসকল কাকাতিয়া দ্বীপের সকল দৃশ্যমান বস্তুসকলের উপর এক ক্লান্ত ইচ্ছার ঘর তৈরি করে চলে গেছে।

এখন জাহাজিরা সকলে বাংকে শুয়ে পড়েছে। সুমিত্রও দরজা বন্ধ করে কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল। সুমিত্র এই বাংকে শুয়ে পর্যন্ত চেরির কথা ভাবছে—চেরি হয়তো শুয়ে পড়েছে। সিঁড়ি ধরে গ্যাংওয়েতে যখন উঠে আসছিল চেরি, সুমিত্র তাকে স্পষ্টভাবে দেখেছিল। বড় বড় চোখ মেয়েটির—বাদামি রঙ শরীরে, চোখের রঙ ঘন গভীর এবং সমস্ত শরীরে প্রজাপতির মতন হালকা গড়ন যেন ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছার ঘর সবটুকু যত্ন দিয়ে তৈরি করেছেন।

জাহাজ এখন সমুদ্রে। তীর দেখা যাচ্ছে না, কেবল দ্বীপ অথবা প্রবালবলয়। ভোরের সূর্য উঠেছে সমুদ্রে। সমুদ্রটাকে দু—ফাঁক করে সহসা যেন সূর্যটা আকাশে উঠে গেল। ডেক—জাহাজিরা এ সময় জাহাজে জল মারছে। এবং অন্য অনেক জাহাজি ইতস্তত রঙের টব নিয়ে মাস্টে, ড্যারিকে রঙ দেবার জন্য ফল্কায় ফল্কায় হাঁটছে। সুমিত্র ভোরে উঠে ওয়াচে যাবার আগে গ্যাংওয়েতে চোখ তুলে দিল। চেরি সেখানে নেই। বোট—ডেক খালি। ব্রিজে ছোট মালোম দূরবিন চোখে লাগিয়ে দূরের আকাশ দেখছে।

সুমিত্র এনজিন—রুমে নেমে যাবার আগে দুখানা ভাঙা চাঁদের মতো রুটি খেল, জল খেল। চা খেল। অন্যান্য জাহাজির মতো প্রশ্ন করে জানতে চাইল, গত রাতে চেরি কেবিনে শুয়ে সারারাত ঘুমিয়েছিল, না, গরমে কেবিনের দরজা খুলে রাতে ডেকে বসে সমুদ্র এবং আকাশের নিরাময় ভাবটুকু লক্ষ্য করে শরীর নিরাময় করেছিল!

সুমিত্র এনজিন—রুমে নেমে যাওয়ার সময় দেখল ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস চুরি করে টুপাতি চেরির পোর্টহোলে উঁকি দিচ্ছে। সুমিত্ররও এমন একটা ইচ্ছা যে না হচ্ছে, তা নয়। তারও না—দেখি না—দেখি করে পোর্টহোলের কাচ অতিক্রম করে চেরির অবয়ব দর্শনে খুশি হবার ইচ্ছা। কিন্তু পোর্টহোলের মুখোমুখি হতে কেমন যেন বিব্রত বোধ করল। সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ধরে এনজিন—রুমে নেমে কসপের ঘর থেকে তেল মেপে এনজিনের পিস্টনগুলোতে এবং অন্যান্য যুক্তস্থানে তেল ঢালতে লাগল। ওয়াচ শেষে উপরে উঠবে তখন নিশ্চয়ই চেরি কেবিনে পড়ে থাকবে না, সমুদ্র এবং আকাশ দেখার জন্য নিশ্চয়ই বোট—ডেকে উঠে পায়চারি করবে, সে এমত চিন্তাও করল।

ওয়াচ শেষে অন্য পীরদারদের ডেকে দিল সুমিত্র। এনজিন—রুম থেকে সোজা না উঠে, স্টোকহোলড দিয়ে ফানেলের গুঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল, প্রত্যাশা চেরি যদি ব্রিজের ছায়ায় বোট—ডেকে বসে থাকে। সে ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে এই ইচ্ছায় যথার্থই বোট—ডেকে উঠে গেল। যখন দেখল ব্রিজের ছায়ায় কেউ নেই, তখন সুমিত্র কেমন বিচিত্র এক অপমানবোধে পীড়িত হতে থাকল।

সুমিত্র স্নান করার সময় ভাণ্ডারীকে বলল, মানুষের কত রকমের যে শখ জাগে চাচা!

ভাতিজার হ্যান মনের দশা ক্যান?

এই কিছু না। সুমিত্র মনে করতে পারল, এনজিন—রুমে সে যতক্ষণ ছিল, সব সময়টা উপরে ওঠার জন্য মনটা ছটফট করেছে। সে চেরির সঙ্গে কী এক আত্মীয় সম্পর্কে যেন ঘনিষ্ঠ। সে মনে মনে এই বোধের জন্য না হেসে পারল না।

এ—ছাড়া সুমিত্র পর পর দু’দিনের জন্য একবারও চেরিকে বোট—ডেকে অথবা গ্যাঙওয়েতে এমনকি ডাইনিং—হলেও দেখল না। যুবতী এই জাহাজে উঠেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। দশদিনের সমুদ্রযাত্রা। এ—দু’দিন চেরি জাহাজ—ডেকে একবারও বের হল না। সুতরাং সুমিত্র যতবার এনজিন—রুমে নেমেছে, ততবার কেবিনের পাশে এসে একবার থেমেছে। সে পোর্টহোলের ঘন কাচের ভেতর দিয়ে চেরির কেবিন প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা করত। কিন্তু পোর্টহোলের ঘন কাচের ভিতর দিয়ে চেরির কেবিন সবসময় অস্পষ্ট থাকছে। কেবিনের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মেস—রুম মেট অথবা মেস—রুম বয় এদিকে আসছে না। বুড়ো কাপ্তান—বয় চেরিকে দেখাশোনা করছে। অফিসাররা পর্যন্ত জাহাজে চুপ মেরে গেছেন। যত জাহাজটা চলছে তত যেন নাবিকরা সব ঝিমিয়ে পড়ছে। চেরি দরজা খুলল না, ডেকে বের হল না, পায়চারি করল না। অফিসারসকল প্রতিদিন ডেক—চেয়ারে সাজগোজ করে বসে থাকলেন, অবসর সময় একটু আলাপ অথবা উদ্বিগ্ন হবার ভঙ্গিতে কৃত্রিম ইচ্ছা প্রকাশের জন্য। কখনও কখনও ছোট মালেম দরজা পর্যন্ত হেঁটে আসতেন। তারপর সমুদ্রের নির্জনতা ভোগ করে একসময় কেবিনে ঢুকে সস্তা সব ক্যালেন্ডারের ছবি দেখে ভয়ানক অশ্লীল আবেগে ভুগতেন।

সমুদ্রে নীল নোনা জল, আকাশে ইতস্তত নক্ষত্র জ্বলছে। খুব গরম পড়েছে—উষ্ণমণ্ডলের এই আবহাওয়া জাহাজিদের ফোকসালে বসতে দিচ্ছে না, ওরা শুতে পারছে না গরমে। ওরা উপরে উঠে ফল্কাতে মাদুর বিছিয়ে সেজন্য অধিক রাত পর্যন্ত তাস খেলছে। কেউ জাল বুনছে মাস্টের আলোতে। জাহাজটা চলছে, জ্যোৎস্না রাত। সমুদ্রে অকিঞ্চিৎকর তরঙ্গ এবং সহসা সমুদ্র থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে এসে জাহাজিদের সুখ দিচ্ছে। এবং প্রপেলারটা অনবরত ঝিঁ ঝিঁ পোকার করুণ আর্তনাদের মতো যেন কাঁদছে। বিশেষ নির্দিষ্ট গতিতে জাহাজটা চলছে, দৃশ্যমান বস্তু বলতে এই নক্ষত্রের আকাশ এবং সমুদ্র। গরমে কাপ্তান ব্রিজে পায়চারি করছেন। দুটো একটা আলো দেখা যাচ্ছে সমুদ্রে। দ্বীপপুঞ্জের জেলেরা এখন হয়তো গভীর সমুদ্রে মাছ ধরছে।

সুমিত্র জাহাজিদের বলল, আচ্ছা ব্যাপার তো! দু’দিনের ভেতর একবারও যুবতীকে ডেকে দেখা গেল না! এ যে দেখছি চাচারা তোমাদের বিবিদেরও হার মানাচ্ছে!

ডেকের বড় ট্যান্ডল বলল, তোমাদের ভয়েই বার হচ্ছে না।

আমরা খেয়ে ফেলব নাকি?

বড় বাকি রাখবে না।

সুমিত্র দেখল তখন বুড়ো কাপ্তান—বয় এদিকেই আসছে। সে এসে ওদের পাশেই তাস খেলা দেখতে বসে গেল।

সুমিত্র বলল, রাজকন্যার খবর কী চাচা?

আর বলবেন না দাদা। রাজকন্যাকে দেওয়ানিতে ধরছে। মাথা তুলতেই পারছে না। শুধু বিছানায় পড়ে থাকছে।

রাজকন্যা কিছু বলছে না তোমাকে?

আমি বুড়োমানুষ, আমাকে কী বলবে দাদা!

অন্য জাহাজি প্রশ্ন করল, মাথা একেবারেই তুলতে পারছে না?

কাপ্তান—বয় বলল, পারছে। বিকেলে দেখছি কেবিনেই পায়চারি করছে। মনে হয়, কালতক ডেকে ঘুরে বেড়াতে পারবে।

জাহাজটা তখন তেমন দুলছে না। ওরা ফল্কার উপর বসে গল্প করছে। জ্যোৎস্নার আলোতে ওদের মুখ বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। গ্যালিতে মাংস সিদ্ধ করছে ভাণ্ডারী। উইন্ডসহোল ধরে নিচ থেকে জাহাজিদের কথা ভেসে আসছে। এবং সেখানেও চেরি—সংক্রান্ত কথাবার্তাতে ওরা নিজেদের কঠিন মেহনতের দুঃখকে ভুলতে চাইছে।

সুমিত্রই সকল জাহাজিদের খবরটা দিল—কাল টুপাতি চেরি ডেকে বের হবে। পরদিন আটটা—বারোটার ওয়াচে সুমিত্র এনজিন—রুমে নেমে কসপের ঘর থেকে তেল মেপে নিল। ক্যানে ভর্তি তেল সে এনজিনের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে দিচ্ছে। একটু নুয়ে মেসিনের ভিতর ঝুঁকে পড়ল। তারপর ক্যানের তেল উঠাল, নামাল এবং সে ঘুরে ঘুরে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করছে….সে ক্যান উঠাল, নামাল। অন্য কোনো দিকে তাকাতে পারছে না। সে যেন বুঝতে পারছে উপর থেকে সিঁড়ি ধরে কারা নামছে। সে চিফ ইনজিনিয়ার এবং কাপ্তানের গলা শুনতে পাচ্ছে। সুতরাং এ সময়ে কোনো অন্যমনস্কতা রাখতে নেই। এ সময়ে সে তেলয়ালা সুমিত্র। তাকে ক্রমশ উপরে উঠতে হবে। তাকে ছোট ট্যান্ডল থেকে বড় ট্যান্ডল হতে হবে। বড় মিস্ত্রির চোখে যেন কোনো অন্যমনস্কতা ধরা না পড়ে এবং সে যেন জীবনের ঋণ অনাদায়ে পরিশ্রমী তেলয়ালা সুমিত্র। সুতরাং সে ভীষণভাবে রড ধরে মেশিনের ভিতর ঝুঁকে কাজ করতে থাকল। থামের মতো সব মোটা পিস্টন রডগুলো উঠছে নামছে, ক্রাঙ্কওয়েভগুলো ঘুরছে অনবরত এবং এইসব ভয়ংকর শব্দে উপরের কণ্ঠসকল ঢেকে যাচ্ছে। তবু সে এ—সময়ে কোনো রমণীর কণ্ঠ শুনতে পেল এবং চোখ না তুলেই বুঝল বড় মিস্ত্রি আর কাপ্তান চেরিকে নিয়ে এনজিন—রুমে নেমে আসছে। সিলিন্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে রেসিপ্রকেটিং এনজিনের কার্যকারিতা সম্বন্ধে বড় মিস্ত্রি তাকে বিস্তারিত বলছেন।

সুমিত্র যেখানে কাজ করছে, সেটা এনজিনের তৃতীয় স্তর। দ্বিতীয় স্তরে চেরি এবং কাপ্তান। চেরি এনজিনটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুমিত্র একবার চেরিকে গোপনে দেখে ফেলল। চেরি সিলিন্ডার পরিদর্শন করে সিঁড়ি ধরে ক্রমশ নিচে নামছে। ওরা সুমিত্রের পাশ দিয়ে যথাক্রমে নিচে নেমে যাচ্ছে। সুমিত্র নিজের পোশাকের দিকে তাকাল—নীল কোর্তা ওকে মোল্লা মৌলভি বানিয়ে রেখেছে। চেরি নিচে নেমে যাচ্ছে। মেশিনের হাওয়ায় ওর চুলগুলো উড়ছে। গায়ে সাদা সিল্কের ফ্রকোট। পরনে নেভি ব্লু স্কার্ট। সুমিত্র নিজেকে আড়াল দেবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, বড় মিস্ত্রি এবং কাপ্তান চেরিকে এনজিনের মতো দ্রষ্টব্য বস্তু হিসাবে সুমিত্রর দিকে হাত তুলে দেখাচ্ছে—এরা ইন্ডিয়ান। কোম্পানি ওদের কলকাতা অথবা বোম্বাই বন্দর থেকে তুলে নেয়। খুব কম পয়সায় ওরা বেশি কাজ দেয়।

বড় মিস্ত্রি অনেকটা পাদরিসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, বেচারা!

সুমিত্র লজ্জায় মেশিনের ভিতর আরও ঝুঁকে পড়ল। চেরি ওর মুখ না দেখে ফেলে এমত ইচ্ছা এখন সুমিত্রর।

সুমিত্রর এখন কত কাজ। সে ঘুরে ঘুরে এনজিনের সকল স্থানে তেল দিল। চেরি হেঁটে যাচ্ছে, চেরি ফিরেও তাকাচ্ছে না, চেরি পোর্ট—সাইডের বয়লার ককের সামনে দাঁড়াল। বড় মিস্ত্রি বলল, এটা কনডেনসার। সার্কুলেটিং পাম্পের সাহায্যে জল ফের বয়লারে চলে যায়। ফের চেরি এবং বড় মিস্ত্রি ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। ওরা গল্প করছে। সে তাকাল না। লজ্জায় সংকোচে সে টানেলের ভিতর ঢুকে গেল। কিন্তু চেরির চোখ দুটো বড় গভীর এবং ঘন। সুমিত্র টানেলের মুখে এসে প্রপেলার শ্যাফটের একপাশে দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে চেরিকে আড়াল থেকে দেখতে থাকল। চেরি ওকে দেখতে পাচ্ছে না, ওর শরীরের বাদামি রঙ, হালকা পোশাক—প্রজাপতির মতো যেন এনজিনে ও উড়ে বেড়াচ্ছে।

চেরি ইভাপোরেটারের পাশ দিয়ে যেতেই সেই গোপনীয় চোখ দুটোকে আবিষ্কার করে ফেলল। চেরি দেখল দুটো ডাগর চোখ (ঠিক যেন ঠাকুমার গল্পের রাজপুত্রের মতো) রাক্ষসের দেশে চেরিকে কেউ চুরি করে দেখছে। এইসব ভেবে একটু অন্যমনস্কতায় ভুগে যখন আবার চোখ তুলল চেরি, তখন দেখতে পেল চোখ দুটো সেখানে নেই, অন্যত্র কোথায় সরে গেছে।

ভয়ে সুমিত্র একপাশে সরে দাঁড়াল। সে তেল দিল ইতস্তত এবং কাপ্তানকে টুপাতি নালিশ দিলেও যেন বলতে পারে, না মাস্টার, আমি শুধু এনজিনেই তেল দিচ্ছি। টুপাতি এ সময়ে সামনে এসে দাঁড়াল। লজ্জায়, সংকোচে সুমিত্র চোখ তুলতে পারছে না। সে পেটের সঙ্গে অথবা এইসব যন্ত্রের সঙ্গে যেন মিশে যাচ্ছে। চেরি এখন সুমিত্রর কোঁকড়ানো চুল শরীরের বাদামি রঙ দেখছে। ঘাড়ের নরম মাংসগুলো দেখল। তারপর সিঁড়ি ধরে স্টিয়ারিং—এনজিনে তেল দিতে যাবার সময় সুমিত্র শুনল টুপাতি যেন ওর সম্বন্ধে কী বলছে।

সুমিত্র ফোকসালে এসে কাপড় ছাড়ল—কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলল না। উপরে উঠে স্নান করল, কোনো কথা বলল না। খেতে বসে চুপচাপ খেয়ে উঠল। অন্য তেলয়ালা বলল, কী হয়েছে রে? মুখটা খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।

অনেকে এমত প্রশ্ন করলেও সুমিত্র জবাব দিচ্ছে না। সে বাংকে বসে অযথা সিগারেট খেল, অযথা কতকগুলি ইংরেজি পত্রিকার সস্তা অশ্লীল ছবি দেখল এবং কোনো আতঙ্কে সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। এনজিনের ভিতর থেকে সেই চোখ দুটো যেন এখনও ওকে তাড়া করছে। বারবার মনে হচ্ছে চেরির প্রতি চোখের এই স্পর্শকাতরতা সুখকর নয়। পোর্টহোলে সুমিত্রকে উঁকি দিতে দেখেছে এবং সেজন্য নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছে চেরি। কাপ্তানকে নালিশ দিয়েছে হয়তো।

আর বিকাল বেলাতেই বুড়ো কাপ্তান—বয় এল পিছিলে। প্রায় ছুটতে ছুটতে এল। সুমিত্র বাংকে শুয়ে ছিল, ঘুম আসছে না। সেই চোখ কেবল ওকে অনুসরণ করছে। কাপ্তান—বয় সারেংয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে বলল, সারেংসাব, বাড়িয়ালার ঘরে সুমিত্রর ডাক পড়েছে।

সুমিত্র শুনল, কাপ্তান—বয় এইসব কথা বলে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে যাচ্ছে। সে শুনল, সারেং সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে আসছে এবং ওর ঘরের ভিতরও সেই শব্দ। সুমিত্র ভয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকল।

সারেং ডাকল, এই সুমিত্র ওঠ। বাড়িয়ালা তোকে ডাকছে।

সুমিত্র উঠে বসল, আমাকে যেতে হবে সারেংসাব?

কী করি বল? বাড়িয়ালা যে যেতেই বলল।

আমি কিছুই করিনি সারেংসাব। সুমিত্র অপরাধবোধে পীড়িত হতে থাকল। বার বার নামতে উঠতে পোর্টহোলে সহসা কখনও চোখ রেখেছে এবং এক তীব্র কৌতূহল ওকে বারবার এই বৃত্তিতে প্রলুব্ধ করেছে।

সুমিত্র লকার খুলে সাদা জিনের প্যান্ট পরল, জ্যাকেট গায়ে দিল, তারপর পায়ে জুতো গলিয়ে সারেংসাবকে বলল, চলুন। সে সিঁড়ি ধরে উঠবার সময় দৃঢ় হবার চেষ্টা করল। কেউ প্রশ্ন করলে না। কারণ, বাড়িয়ালা একমাত্র জাহাজিদের অপরাধের জন্য তাঁর ঘরে অথবা ডাইনিং—হলে ডেকে থাকেন। সুতরাং সকল জাহাজিরা সুমিত্রকে দেখল সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে। সুমিত্র যেন ওর অপরাধ সম্বন্ধে সচেতন, সে সেজন্য চোখ তুলল না। সে এখন অন্য কোনো জাহাজিকেই দেখছে না। জাহাজটা যে চলছে এ—বোধও এখন সুমিত্রর নেই। উষ্ণমণ্ডলের গরম কমে যাচ্ছে, বিকেল হতেই ঠান্ডা—ঠান্ডা ভাব ডেকে, সুমিত্র ডেক ধরে যাবার সময় তাও অনুভব করতে পারল না। সে সারেংয়ের সঙ্গে বোট—ডেক পার হয়ে ব্রিজে উঠে যাবার সিঁড়ি ধরে কাপ্তানের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

ওরা এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। সারেং ঘরে ঢুকতে ইতস্তত করছে এবং কোনোরকমে গলা সাফ করতেই কাপ্তান দরজা খুলে বের হলেন। তিনি ওদের দেখে বললেন, সারেং, তুমি কেন? তোমাকে তো ডাকিনি!

হুজুর, কাপ্তান—বয় যে বলল—

আরে না না, সুমিত্র হলেই চলবে। আমাদের সম্মানীয়া যে যাত্রীটি যাচ্ছেন, তিনি একবার ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

এতক্ষণ সুমিত্র শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু বাড়িয়ালার এইসব কথায় সে কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয় করতে পারছে। সে বলল, মাস্টার, আমি যাব?

তুমি একবার পাঁচ নম্বর কেবিনে যাবে। যখন ডেকে পাঠিয়েছেন, তখন যেতেই হবে।

সুমিত্র ইচ্ছা করলে বোট—ডেক অতিক্রম করে টুইন—ডেকে নেমে অফিসার গ্যালি ডাইনে ফেলে পাঁচ নম্বর কেবিনে হাজির হতে পারে, অথবা অ্যাকোমোডেশান ল্যাডারেরই একটা অংশ ডাইনিং হলে নেমে গেছে—সেই সিঁড়ি ধরে নামলেও চেরির দরজা। একটু ঘোরা পথ অথবা খুব কাছের পথ—কোনটা ধরে যাবে ভাবছিল, ভাবছিল চেরির সহসা এই ইচ্ছা কেন? পাথরের আড়াল থেকে চেরি ওকে নিশ্চয়ই দেখেনি, কারণ সেখানে সুমিত্রর অবয়ব স্পষ্ট ছিল না। সে অন্যমনস্কভাবেই হাঁটছিল। সে সিঁড়ি ধরে টুইন—ডেকে নেমে দেখল কমলা রঙের রোদ ডেকে, কিছু নীল তরঙ্গ জাহাজের চারপাশটায়। পিছিলে জাহাজিরা অনেকে নামাজ পড়ছে। সে নেমে আসার সময় তাদেরও দেখল।

ডেক—কসপ বলল, কিরে সুমিত্র, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কাপ্তান তোকে কিছু বলেছে?

সুমিত্র কোনো উত্তর না দিয়ে আলওয়েতে ঢুকে দেখল কেবিনের দরজা বন্ধ। সে ধীরে ধীরে কড়া নাড়তে থাকল।

ভিতর থেকে কাপ্তান—বয় বলল, কে?

আমি চাচা, সুমিত্র।

ভিতরে এসো। ভিতরে এসো।

সে পা টিপে টিপে কেবিনে ঢুকল। সে দেখল, কাপ্তান—বয় লকার, টিপয় এবং অন্য সব বাংকের বিছানা ঝেড়ে দিচ্ছে। চেরির বাদামি রঙের ঘাড় আঙুরফলের মতো রঙ ধরেছে। চেরি ঘাড় গোঁজ করে বাক্সের ভিতর কী যেন খুঁজছে।

কাপ্তান—বয় বলল, সুমিত্র এসেছে মাদাম।

সুমিত্র দেখল সেই আঙুলফলের মতো ঘাড় খুব সন্তর্পণে যেন নড়ছে। যেন বেশি চঞ্চল হতে নেই, উচ্ছল হতে নেই। সে দেখল সুমিত্রকে ঘাড় ঘুরিয়ে এবং যত ধীরে ঘাড় ঘুরিয়েছিল তার চেয়েও ধীরে ঘাড় ফেরাল।—ওকে বসতে বল।

সুমিত্র পাশের ছোট্ট ডেক—চেয়ারে বসল।

চেরি তখনও বাক্সের ভিতর কী যেন খুঁজছে। সে বলল, বয়, তুমি যেতে পারো।

সুমিত্র বাংলায় বলল চাচা, আপনি চলে যাচ্ছেন!

মেয়েমানুষকে এত ভয় দাদা, ফোকসালে তো খুব হইচই করতে।

সুমিত্র জবাব দিতে পারল না। সে চুপ করে বসে থাকল। কাপ্তান—বয় দরজা বন্ধ করে চলে গেল। সুমিত্র এ সময় উঠল এবং দরজা কিঞ্চিৎ খুলে দিল। সে নিচে এনজিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে অথবা সুমিত্রর মুখে উষ্ণবলয়ের শেষ উত্তাপ—চিহ্ন… সে চুপ করে বসে পড়ল ফের। পোর্টহোলের কাচ খোলা, উপরে পাখা ঘুরছে এবং দরজা দিয়েও কিছু হাওয়া প্রবেশ করতে পারছে, তবু সুমিত্র ঘেমে নেয়ে উঠল। যত সে দৃঢ় হবার চেষ্টা করছে, তত যেন ওর মুখে আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণতার ছোপ লাগছে। তত সে অসহায় বোধ করল নিজেকে।

এতক্ষণ পর চেরি মুখ ফেরাল। শরীরে হালকা গাউন, ব্রেসিয়ার স্পষ্ট। চেরি দু’হাঁটু ভাঁজ করে বাংকে বসল। সুমিত্রর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল, পোর্টহোলে রোজ উঁকি মারতে কেন?

আর উঁকি মারব না মাদাম।

কেন উঁকি দিতে তাই বল।

দীর্ঘদিন সফর করছি। দেশে জাহাজ ফিরছে না, কেবল জল আর জল।

একটু বৈচিত্র্য চাইছ?

আজ্ঞে।…. সুমিত্র আর কিছু প্রকাশ করতে পারল না। ভয়ে এবং বিষণ্ণতায় আড়ষ্ট বোধ করতে থাকল। ওর পায়ে সুন্দর জুতো, নেলপালিশ নখে, সুগোল হাঁটু পর্যন্ত পা… সে নিচু করে রেখেছে মুখ, তবু ওর সব যেন দেখতে পাচ্ছে সুমিত্র। গাউনের শেষ প্রান্তে লতার গুচ্ছ, পায়ের কোমল ত্বকে কেবিনের আলো… সে আর পারছে না, সে বলল, মাদাম, আর হবে না। আমাকে ক্ষমা করুন।

তুমি তো ভারতবর্ষের লোক সুমিত্র?

সুমিত্র মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, এবং চোখ তুলে এই প্রথম চেরির চোখ দুটো খুব কাছে থেকে দেখল, এত উজ্জ্বল, এত প্রাণবন্ত চোখ সে যেন ওই প্রথম দেখল। শালীনতার তীব্র তীক্ষ্ন ভাব চেরিকে, চেরির চোখ দুটোকে কঠিন করে তুলেছে। সুমিত্র চেরিকে সহ্য করতে পারছে না। সে বলল, আমি উঠি।

চেরি এবার না হেসে পারল না,—তুমি ভয়ানক ভীতু সুমিত্র। শুনেছি সম্রাট অশোক দিগবিজয়ে বের হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ছেলে এবং মেয়েকে এইসব দ্বীপে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই ভারতবর্ষের ছেলে তুমি!

সুমিত্র এবার একটু হালকা বোধ করল এবং ভালো করে কেবিনের চারপাশটা দেখে নিল। এতক্ষণ পরে সে ধরতে পারছে এই কেবিনে ফুলেল তেলের গন্দ, বিদেশি দামি সেন্টে অথবা কোথাও ধূপ দীপ অনবরত জ্বলে জ্বলে চেরিকে, ওর পোশাককে রূপময় করেছে। বাংকের উপর ভায়োলিন। দেয়ালে সুন্দর ক্যালেন্ডার। সমুদ্রে ঢেউ। বাইরে ঢেউ ভাঙার শব্দ। নিচে এনজিন—ঘরের আওয়াজ এবং চেরির চোখ দুটোতে দ্বীপপুঞ্জের কমলালেবুর গন্ধ। চোখ দুটো কমলালেবুর মতোই সজল।

চেরি কাপ্তান—বয়কে দিয়ে দু’কাপ কফি আনাল। চেরি ইচ্ছা করেই দূরত্ব ভেঙে দেবার চেষ্টাতে এক কাপ কফি খেতে অনুরোধ করল। সুমিত্র এরপর ভারতবর্ষের কোনো রাজপুত্রের মতোই দৃঢ় হল এবং বলল, আপনি আমায় কেন ডেকেছেন মাদাম?

সুমিত্রর দৃঢ়তাটুকু কেন জানি চেরির ভালো লাগল না। যে মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও এনজিনে ঘাড় গুঁজে কাজ করছিল, যার চোখ দুটো ভয়ে বিব্রত ছিল, সে সহসা এমত দৃঢ় ইচ্ছায় প্রকট হবে, অথচ চোখে কোনো করুণার চিহ্ন থাকবে না, অবাধ্য যুবকের মুখভঙ্গিতে বসে থাকবে চেরি এমত ভাব সহ্য করতে পারছে না। সে ফের প্রশ্ন করল, পোর্টহোলে উঁকি দিয়ে কী দেখার চেষ্টা করতে বল।

মাদাম, আমার সম্বন্ধে আপনি খুব বেশি ভাবছেন।

একবার নয়, দুবার নয়, অনেকবার পোর্টেহোলে উঁকি দিয়েছ তুমি। ভেবেছ, পোর্টহোলের কাচ মোটা বলে আমি কিছু দেখতে পাইনি? সি—সিকনেসে ভুগছিলাম, নতুবা কাপ্তানকে দিয়ে তক্ষুনি ডেকে পাঠাতাম।

সুমিত্র মাথা নিচু করে আগের মতো বসে থাকল।

পরে জেনেছি তুমি ইন্ডিয়ান সুমিত্র। টুপাতি একটা বালিশ টেনে কোলের উপর চেপে বলল, কফি ঠান্ডা হচ্ছে, খেয়ে নাও।

সুমিত্র ভয়ে ভয়ে কফিতে চুমুক দিল। খুব আদর—যত্নে এই মেয়েটি প্রতিপালিত—সে তাও ধরতে পারছে। সে একবার ভাবল, কাপ্তানকে বলে দেয়নি তো; সুমিত্র কেমন শুকনো মুখে কফি গিলতে থাকল। বলল, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি এই পথ ধরেই আর এনজিন—রুমে আসব না। আপনি দয়া করে কাপ্তানকে শুধু কিছু বলবেন না। আমি সব করব। আপনি যা বলবেন সব করব। সে কেমন আড়ষ্ট গলায় এইসব বলে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। কারও দিকে তাকাল না। সোজা ফোকসালে গিয়ে বাংকে শুয়ে ভয়ংকর অপমানবোধে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল।

চেরি বাংকেই চুপ করে বসে থাকল। সুমিত্রর পায়ের শব্দও একসময় মিলিয়ে গেছে। পোর্টহোলের কাচে এখন আর কোনো প্রতিবিম্ব ভাসছে না। এতক্ষণ এই কেবিনে সুমিত্রর চোখ মৃত এবং সাদা ছিল, এতক্ষণ চোখ দুটোতে যেন নিঃসঙ্গ ভূতের আতঙ্ক—এইসব ভেবে চেরি নিজের উপরই বিরূপ হতে থাকল। সে সুমিত্রকে কোনো কৌশলেই যেন আয়ত্তে আনতে পারছে না। অথচ দু’দিনের দেওয়ানি চেরিকে যখন এই কেবিনে মৃত্যুর মতো আতঙ্কিত করে রেখেছিল, তখন পোর্টহোলের কাচে কোনো এক যুবকের চঞ্চল চোখ, জীবনের প্রতীক যেন… যেন দর্পণ—তাকে নিয়ত রাজকন্যার মতো করে রেখেছে। ঠাকুরমার গল্পের স্মৃতি এই কেবিনে কোনো এক যুবকের শরীরে রূপ পাচ্ছিল—রাজপুত্র, কোটালপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, এক রাজ্য আক্রমণ করে অন্য রাজ্যে, কত গাছ, কত পাখ—পাখালি কত বন—বাদাড় অতিক্রম করে যাচ্ছে—আহা, ভারতবর্ষের রাজপুত্রেরা ঘোড়ায় চড়ে একদা রাজকন্যা খুঁজতে বের হত, গল্পে রাজপুত্রের চোখ যেমত এই বয়স পর্যন্ত অনুসরণ করেছে চেরিকে—এই কেবিনে সেই চোখ, সেই রাজপুত্র এতক্ষণ ক্লান্ত ঘোড়ার মতো পা ঠুকে ঠুকে নিঃশেষ হয়ে গেল। চেরি উচ্চারণ করল—বেচারি!

বস্তুত টুপাতি চেরি শৈশবের রূপকথার রাজপুত্রের চোখকেই যেন পোর্টহোলে প্রত্যক্ষ করেছিল। দেওয়ানিতে মাথা তুলতে পারছে না, শরীরে ভীষণ ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং সারাদিন বাংকে পড়ে থাকা, সে—সময় পোর্টহোলের ঘন কাচে সুমিত্রর চোখ দুটোই এক অসামান্য রূপকথার রাজত্ব, সুখ এবং আনন্দ এই কেবিনে পৌঁছে দিয়ে গেছে। ঠাকুরমার কোলে শুয়ে রাজপুত্রের গল্প শুনতে শুনতে চেরি ঘুমিয়ে পড়ত, যে রাজপুত্রের চোখ দুটো জীবনের এতদিন পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করে আসছে, পোর্টহোলে সহসা সেই চোখ দুটোকে যেন আবিষ্কার করেছে চেরি এবং প্রত্যক্ষ করেছে।

রাত্রিবেলায় সুমিত্র ওয়াচে নামার সময় অন্য পথ ধরে গেল।

ওয়াচ থেকে উঠে আসবার সময় কসপ বলল, কাজ রাজকন্যা তোমাকে কী বলল সুমিত্র?

সুমিত্র জবাব দিল, আমার দেশ কোথায়, কী নাম—এইসব নানারকমের কথা। সব মনে নেই।

সাহেবদের ফেলে তোমার দিকে এমন নজর!

কী করি! রাজকন্যার মর্জি বোঝা দায়।

বিকাল বেলায় সুমিত্র দেখল চেরি বোট ডেকে বসে আছে। কাঁটা দিয়ে উল বুনছে। পাশে ছোট মালোম বসে—নিশ্চয়ই গল্প করছেন। ডেক—অ্যাপ্রেন্টিসরাও সেখানে আছে। বেশ গুলজার বলতে হবে। সে পিছিলের ছাদের নিচ থেকে সব দেখল। রঙিন কাগজের মতো মখমলের পোশাক চেরির সমস্ত শরীরে জড়ানো। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত গাউনের শেষ প্রান্ত ঝুলছে। চুলের গুচ্ছ বুফা কায়দায় জড়ানো। ঘাড়ের মসৃণ ত্বক, কমলা রঙের রোদ, কালো মেঘবরণ চুল এই সমুদ্রের নীল নির্জনতাকে ভেঙে দিচ্ছে। সুমিত্র গ্যালিতে ঢুকে, গ্যালির জানালা দিয়ে আড়ালে চেরিকে দেখতে থাকল। অন্যান্য জাহাজিরাও সেখানে এসে ভিড় করছে। ওর এই ভিড় ভালো লাগছে না। ওর মনে হল ফের জাহাজি নিঃসঙ্গতা ওকে জড়িয়ে ধরছে। এই মনোরম বিকেল, কমলা রঙের রোদ এবং ছোট মালোমের উপস্থিতি কেন জানি তাকে কেবল পীড়া দিচ্ছে। সে গ্যালি থেকে বের হয়ে সিঁড়ি ধরে নেমে ফোকসালে ঢুকে বাংকে শুয়ে পড়ল। এক অহেতুক ঈর্ষার জন্ম হচ্ছে মনে। সে বাংকে শুয়ে চেরির অসামান্য রূপে দগ্ধ হতে থাকল।

কাপ্তান—বয় ছুটতে ছুটতে এসে বলল, সুমিত্র, আবার যে ডাক পড়েছে পাঁচ নম্বর কেবিনে।

সুমিত্র বলল, কেন, চেরি তো বোট—ডেকে বসে আছে দেখে এলাম।

এখন আর নেই। কেবিনে ঢুকেই বলছে, সুমিত্রকে আসতে বল।

কী ফ্যাসাদে পড়া গেল চাচা!

কোনো ফ্যাসাদ নেই। আল্লাতায়লায় ভরসা রাখ। খুশি হয়ে চলে যাও।

কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে সুমিত্র প্রথমে অনুমতি নিল, পরে ঘরে ঢুকে ডানদিকের বাংকে বসল। চেরি সুমিত্রর জন্য প্রতীক্ষা করছিল এমন ভাব চোখে—মুখে। সে—ও সুমিত্রর পাশে বসে পড়ল এবং বলল, জাহাজে কত দিন ধরে কাজ করছ?

এই নিয়ে দু’সফর।

যাত্রী—জাহাজে কোনোদিন চড়নি?

না মাদাম।

তাই তুমি জানতে না অন্যের কেবিনে কখনও উঁকি দিতে নেই।

পোর্টহোল দিয়ে কেবিন অস্পষ্ট বলে আমিও আপনার কাছে অস্পষ্ট—এই ভেবেছি। আপনি ঘরের অন্ধকারে পড়ে থাকতেন, আমি বাইরের আলোতে থাকতাম। সে কথাটা তখন আমার কিন্তু একবারও মনে হয়নি।

তবে বল আমাকে দেখার জন্য চুরি করে উঁকি দিতে?

সুমিত্র মাথা নিচু করে রাখল আগের মতো।

হুঁ এ তো ভালো কথা নয়, সুমিত্র।

সুমিত্র মাথা তুলছে না। সুমিত্রর চোখে—মুখে ফের অপরাধবোধ জেগে উঠছে।

এইসব জাহাজে তোমার কাজ করতে ভালো লাগে?

না মাদাম। কাজ করতে ভালো লাগে না।

তোমার দেশ ভারতবর্ষ, কত বিরাট আর কত অসামান্য দেশ!

আজ্ঞে, মাদাম।

ঠাকুমার কাছে তোমার দেশের রাজপুত্রদের গল্প শুনেছি। সমুদ্রের ধারে ঠাকুমা আমাদের তোমার দেশের রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। এইসব কথা বলে চেরি উত্তেজিত হল অথবা কেমন উত্তেজিত দেখাল চেরিকে। চেরি বলল, চিফ—এনজিনিয়ারের কথায় তোমার কিন্তু প্রতিবাদ করা উচিত ছিল।

কোন কথায় মাদাম?

তোমাদের সস্তায় নেওয়া হয়। যেন অনেকটা গোরু—ভেড়ার মতো ভাব।

ওঁরা তো ঠিকই বলেছেন মাদাম। আমরা তাঁদের কাছে—

এইসব লোকদের আমি ঘৃণা করি।

সুমিত্র এবার কথা বলল না। সবকিছুই রহস্যময় মনে হচ্ছে। চেরির সকল কথাই কেমন অসংলগ্ন। সুমিত্র বুঝল না চেরি যথার্থ কাকে ঘৃণা করছে। সুতরাং সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল এবং চেরির অসামান্য রূপে বিহ্বল হতে থাকল।

আমি কাপ্তানকে ধমক দিতে পারতাম। কিন্তু দিইনি। এতে তোমাদের আরও বেশি অপমান করা হবে। একটু থেমে চেরি ফের বলতে থাকল, কাপ্তান এবং চিফ—এনজিনিয়ার আমাকে এনজিন—রুমের সবকিছু দেখালেন। তোমাদের দেখালেন, যেন তোমাদের বাদ দিলে এনজিনের নাট বল্টু বাদ যেত।

মাদাম, আমরা নাবিক। এর চেয়ে বড় অস্তিত্বের কথা ভেবে আপনি অযথা কষ্ট পাবেন না।

তার চেয়ে বড় কথা তুমি ভারতবর্ষের ছেলে। গৌতম বুদ্ধ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ তোমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন।

আপনি দেখছি ভারতবর্ষের প্রতি খুব অনুরক্ত।

আমি একটি মহান জাতির প্রতি অনুরক্ত। এখন চেরিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই মুহূর্তে জাহাজে বিপ্লব শুরু করে দিতে পারে।

আমি উঠি মাদাম। ওয়াচের সময় হতে বেশি দেরি নেই।

যেন চেরি শুনতে পেল না, যেন খুব অন্যমনস্ক। চেরি আবেগের সঙ্গে বলতে থাকল, সুমিত্র, আমিও ভারতবাসী। আমার পূর্বপুরুষ ভারতবর্ষ থেকে বাণিজ্য করতে এসে এই সকল দ্বীপে থেকে গেল। আর ফিরল না। তোমাকে দেখে আমি তবে খুশি হব না, তোমার অপমানে আমি আমার অপমান ভাবব না?

সুমিত্র ফের স্মরণ করিয়ে দিল তার ওয়াচের সময় হয়ে গেছে। অথচ চেরি এতটুকু কর্ণপাত করছে না কথায়। এবং সেজন্য সুমিত্র চেরির সকল কথারû ভিতর নষ্ট—চরিত্রের লক্ষণ খুঁজে পাচ্ছে। এই বিষণ্ণ আলাপ সুমিত্রকে চেরি সম্বন্ধে আদৌ কোনো কৌতূহলী করছে না। সুমিত্র মৃত চোখ নিয়ে বসে থেকে সকল কিছুকে বিরক্তিকর ভেবে পোর্টহোলের কাচে ঠান্ডা হাওয়ার গন্ধ নিতে সহসা উঠে দাঁড়াল।

সুমিত্র চলে যাচ্ছে। দরজায় এক পা রেখে দেখল চেরি কথাবার্তায় এখন নরম এবং সহজ হয়ে উঠছে। চেরির মুখ প্রসন্নতায় ভরা। যেন প্রগাঢ় স্নেহ এই জাহাজি মানুষটির জন্য সে লালন করছে। সুমিত্র নির্ভয়ে দরজা টেনে দিতে শুনল, চেরি ভিতর থেকে বলছে, ঠাকুমা আমাদের সকলকে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। ভারতবর্ষের রাজপুত্রদের গল্প করতেন। ভয় অথবা বিষণ্ণতা এ—কদিন ধরে সুমিত্রকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, চেরির শেষ আলাপ, প্রগাঢ় স্নেহবোধ সুমিত্রকে নূতন জীবন দান করছে। সে ডেকের উপর দিয়ে প্রায় ছুটে এল। হালকা শিস দিল ফোকসালে নামার সময়।

চেরি বাংকে বসে থাকল। ভয়ানক একঘেয়ে এই সমুদ্রযাত্রা—চেরি ঠাকুমার স্মৃতি মনে করল। সেই সব রাজপুত্রদের ঘোড়াসকলকে মনে করল। অথবা রাক্ষসের প্রাণ রুপোর কৌটায় সোনার ভ্রমরে… যেন পা ছিঁড়ছে হাত ছিঁড়ছে—রাক্ষসটা গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে… চেরি এই কেবিনে উঠে দাঁড়াল। অথবা নির্জন দ্বীপে রাজকন্যা নিদ্রিত, রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে ছুটছে… চেরি ঠাকুমাকে স্মরণ করতে পেরে এইসব ভাবল। সেইসব মনোরম বিকেলের কথা তার মনে হল। যেন সুমিত্রকে দেখেই সে তার কৈশোর—জীবনের কথা মনে করতে পারছে। বিকালের সমুদ্র পাহাড়ের ধারে, ছোট ছোট মাছেরা খেলছে। সমুদ্রের ধারে ওরা ছুটোছুটি করছে। নারকেল গাছের ছায়ায় ঠাকুমা ভারতবর্ষের দিকে মুখ করে বসে আছেন, যেন যথার্থই তিনি ভারতবর্ষকে, তাঁর পিতৃপুরুষের দেশকে, দেখছেন। তখন অ্যান্টনি নারকেল গাছ থেকে ডাব কেটে দিচ্ছে সকলকে। ওরা বালিয়াড়িতে ছুটে ছুটে ক্লান্ত। ওরা ডাবের জল খেতে খেতে ঠাকুমার পাশে বালির উপর শুয়ে পড়ল। তখন সমুদ্রে সূর্য ডুবছে। নির্জন পাহাড়ি দ্বীপে কচ্ছপেরা ডিম পেড়ে গেল এবং ঠাকুমা তাঁর ঠাকুমার—মতো—রূপকথার গল্প আরম্ভ করে চেরির মুখ টিপে বলতেন, তোর জন্য ভারতবর্ষ থেকে এক টুকটুকে রাজপুত্র ধরে আনব। চেরির সেই কৈশোর মন ঠাকুমার কথা যথার্থই বিশ্বাস করে এক রঙিন স্বপ্নে ঠাকুমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ত।

চেরি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পোর্টহোলের কাচ খুলে দিল। পর্দা তুলে দিল, অথচ সেই চোখ দুটোকে আর খুঁজে পেল না। যতক্ষণ সুমিত্র এই বাংকে বসে ছিল, যতক্ষণ গল্প হল, পোর্টহোলের চঞ্চল চোখ দুটোর গোপনীয় ভাব সুমিত্রর চোখে—মুখে ফিরে এল না। কেমন নিষ্প্রভ, কেমন পাথরের মতো চোখ নিয়ে এতক্ষণ ওর কেবিনে বসে থাকল সুমিত্র। সুতরাং সকল দুঃখকে ভুলে থাকবার জন্য পোর্টহোলের পাশে দাঁড়িয়ে ভায়োলিনটা বাজাতে থাকল চেরি। উপরে নিচে, সামনে পিছনে শুধু নিরবচ্ছিন্ন আকাশ, শুধু নীল সমুদ্র এবং মনে হল সমুদ্রে রূপকথার রাজপুত্রেরা ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। এবং সেই সব দ্বীপপুঞ্জের অনেক সম্ভ্রান্তবংশীয় যুবকদের চেরি পোর্টহোলে দাঁড়িয়ে দেখল ঘোড়ায় চড়ে সমুদ্রে সুমিত্রর সমানে সমানে ছুটতে পারছে না। জীবনের প্রথম লগ্নে ভারতবর্ষের এক সুপুরুষ যুবাকে, যুবার কোমল চোখ দুটোকে পরম অপার্থিব বস্তু ভেবে চেরি কেমন প্রীত হতে থাকল। চেরি সেই দিঘির (ঠাকুমার বর্ণিত রূপকথা) সিঁড়িতে সুমিত্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। যেন রাজপুত্র কোটালপুত্র নামছে, নামছে। মানিকের আলোয় দিঘির সিঁড়ি ধরে রাজকন্যার দেশে নামছে। নিঝুম পুরী, কোনো শব্দ নেই। লোক নেই, প্রাণী নেই, পাখি নেই, নিঃশব্দ ভাব। সোনার গাছ। গাছে হীরা—পান্নার ফল। সোনার ঝরনা, সোনার পাখি। একই গাছের ডালে নাচ এবং গান। রাজপুত্র গান শুনতে শুনতে নাচ দেখতে দেখতে সদর দেউড়ি পার হয়ে সাত দরজা ডাইনে ফেলে অন্দরের চাবিকাঠিতে হাত বুলাল। এখানে ছোট নদী বইছে—সুবর্ণরেখা নদী। নদী ধরে পদ্ম ভাসছে—কখনও হীরা, কখনও মাণিক্যের। এবং রাজপুত্র চন্দনকাঠের পালঙ্কে রাজকন্যাকে দেখল। এইসব গল্প শুনে টুপাতি চেরি বলত, আমরা কোনোদিন ইন্ডিয়ায় যাব না ঠাকমা?

ঠাকুমা বলতেন, বড় হলে, যাবে। দেখবে তখন কত রাজপুত্র তোমাদের খুঁজতে বের হয়েছে।

চেরি যেন এই বয়স পর্যন্ত কোনো রাজপুত্রকে অনুসন্ধান করতে করতে সহসা পোর্টহোলের কাচে তাকে আবিষ্কার করেছে।

ছোট বড় ঢেউ উঠছে সমুদ্রে। দূরে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডলফিনরা, ফ্লাইং—ফিসের ঝাঁক বর্শার মতো ছুটে আসছে জাহাজের দিকে। দুটো—একটা দ্বীপ, দুটো একটা আগ্নেয়গিরি আকাশ লাল করছে। দ্বীপে ছোট ছোট পাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ছে। জলে, লাল নীল হলুদ রঙের মাছ। তখন সূর্য উঠছে।

আবার বিকাল। সূর্য পাটে বসেছে। পোর্টেহোলের ঘন কাচে কোনো চোখ ধরা দিচ্ছে না। টুপাতি দেখল, সুমিত্র আর অ্যালওয়ে ধরে এনজিনে নামছে না। অথবা এনজিন—রুম থেকে উঠে আসছে না। অভিমানে টুপাতির চোখে জল আসতে চাইল।

সেই বিকালে ছোট মালোম এসে বললেন, আসুন, আমরা একসঙ্গে চা খাই।

চেরি বলল, ক্ষমা করবেন মিস্টার। আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

পরদিন ডিনার—পার্টিতে নিমন্ত্রণ করলেন কাপ্তান। বললেন, আজ আপনি আমাদের গেস্ট। আমরা সকলে একসঙ্গে ডাইনিং—হলে খাব।

চেরি বলল, বেশ হবে।

বুড়ো কাপ্তান উঠলেন। চেরি ফের প্রশ্ন করল, আর ক’দিন বাদে বন্দর ধরবে ক্যাপ্টেন?

তিনি কী হিসাব করে একটি তারিখের উল্লেখ করলেন এবং কাপ্তান কী ভেবে ফের বললেন, সন্ধ্যায় ডাইনিং—হলে, একটু নাচ—গান হোক—এই আমার ইচ্ছা।

বেশ হবে।

আপনি অংশগ্রহণ করলে বাধিত থাকব।

অংশগ্রহণ করব।

ভারতীয় জাহাজিটি নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করছে? কাপ্তান কথাপ্রসঙ্গে যেন এই কথাগুলো বললেন।

কোথায় করছে! চেরি এই বলে বড়ো বড়ো হাই তুলল।

ছোঁড়া ভারী বেয়াদপ দেখছি!

ভয়ানক। আবার হাই তুলল চেরি।

দাঁড়ান, ঠিক ব্যবস্থা করছি।

তা করুন। সে কেবল হাই তুলতে থাকল।

এবার আমি আসি।

আচ্ছা।

তখন ঘড়িতে সাতটা বাজল। আটটা—বারোটা ওয়াচের জাহাজিরা বোট—ডেকে উঠে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ওরা ফানেলের পাশ দিয়ে স্টোকহোলডে নেমে যাবে এমন সময়ে কাপ্তান—বয় ছুটে এল। বলল, সুমিত্রকে বাড়িয়ালা তাঁর কেবিনে ডাকছে।

সুমিত্র এই ডাকে ভীত অথবা সন্ত্রস্ত নয়। চেরির চোখে যে স্নেহ দেখেছিল, নিশ্চয়ই তা বেইমানি করতে পারে না। অন্য কোনো কারণ অথবা সারেঙের কানভারী কথা—এমন সব ভেবে সে অ্যাকোমোডেশান ল্যাডার ধরে ব্রিজ অতিক্রম করে কাপ্তানের ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা ছিল বলে কাপ্তান তাকে দেখতে পাচ্ছে। কাপ্তান যে চার্ট—রুমে কোনো মানচিত্র দেখছে এমন চোখে সুমিত্রকে দেখে দেখে একসময় বলল, তুমি এই জাহাজে কোল—বয়ের চাকরি করতে?

ইয়েস মাস্টার।

আমি তোমাকে ফায়ারম্যান করেছি?

ইয়েস স্যার।

তারপর ইফাতুলা কার্ডিফে নেমে গেল বলে তুমি গ্রিজার হলে?

ইয়েস স্যার।

ইয়েস, স্যার, ইয়েস স্যার! বেয়াদপ পাজি, ন্যাস্টি হেল! কাপ্তান চিৎকার করতে থাকলেন।

সুমিত্র নিচের দিকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। সুমিত্র বুঝতে পারছে না। ওর বেয়াদপি কোথায় এবং কখন ঘটেছে। তবু স্বীকার করাই ভালো। নতুবা কাপ্তান এখনই লগ—বুক এনে খচ খচ করে হয়তো লিখবেন—সুমিত্র, অ্যান ইন্ডিয়ান সেলর ডাজ নট ক্যারি আউট হিজ জব। সে বলল, ইয়েস মাস্টার, আর কোনোদিন বেয়াদপি হবে না।

তাহলে কোনোদিন বেয়াদপি করবে না বলছ?

না মাস্টার, কোনোদিন করব না।

ফের কোল—বয় হবার যদি ইচ্ছা না থাকে, চেরিকে যথাযথ সম্মান দেখাবে।

সুমিত্র ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর কাপ্তানের কথামতো যখন ব্রিজ পার হয়ে সিঁড়ি ধরে বোট—ডেকে নেমে এল, যখন দেখল সকল জাহাজিরা নেমে যাচ্ছে স্টোকহোলডে, তখন উত্তেজনায় অধীর হতে হতে সে বাংলায় অশ্লীল সব কথাবার্তা বলল চেরিকে উদ্দেশ্য করে এবং এসময় তার একটু মদ খাবার শখ জাগল।

বিকেলবেলা চেরির ঘরে ডাক পড়তেই সুমিত্র তাড়াতাড়ি ছুটে গেল। এক মুহূর্ত দেরি করল না, অথবা সাজগোজের জন্য আয়নার সামনে দাঁড়াল না। সে অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল চেরি ভয়ানক ভাবে সাজগোজ করে বসে আছে। কোলের উপর ভায়োলিন। প্রসাধনের তীব্র তীক্ষ্ন ভাব সুমিত্রকে যেন সুচতুর যৌনবিলাসী হতে বলছে। চেরিকে সে দেখল। মখমলের পোশাক দেখল এবং নগ্ন ভঙ্গিতে বসে ঠোঁটে বিদ্যুৎ খেলতে দেখল। চিবুকে ভাঁজ পড়েছে—পায়ের ভাঁজে ভাঁজে কেমন আড়ষ্ট ভঙ্গি।

সুমিত্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, কোনো কথা বলল না।

এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।

সুমিত্র কোথায় বসবে ঠিক করতে পারল না।

ডেক—চেয়ারটাতে বোস সুমিত্র।

সুমিত্র খুব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসল।

অমন পুতুল—পুতুল ভাব কেন? কোনো সজীবতা নেই চলাফেরাতে। কেবিনে ঢোকবার আগে পোর্টহোলের চোখ দুটো কোথায় রেখে আসো?

আমাকে ক্ষমা করবেন মাদাম। সেই চোখ দুটো কিছুতেই আর সংগ্রহ করতে পারছি না।

কেন, কেন পারছ না?

আজ্ঞে, কাপ্তান অযথা ধমকালেন।

চেরি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অযথা হো হো করে হেসে উঠল, আচ্ছা কাপ্তানের পাল্লায় পড়েছ।

ইয়েস মাদাম। আপনি কিন্তু ও—কথা আবার কাপ্তানকে বলবেন না।

কাপ্তানকে তুমিও কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে পারলে না?

সুমিত্র জিভ কাটল।— তা হয় না মাদাম। আমাদের কাপ্তান খুব ভালো লোক। অন্য জাহাজের কাপ্তান ভারতীয় জাহাজিদের সঙ্গে সাধারণত কোনো কথাই বলেন না। সব সারেঙের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। অথচ আমাদের প্রিয় কাপ্তান সকল জাহাজিদের নাম জানেন। তাছাড়া নাম ধরে ডেকে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করেন। আমি কিছু ইংরেজি জানি বলে তিনি খুব খুশি আমার উপর। এই জাহাজে কোলবয় হয়ে উঠেছি, তাঁর দয়ায় এখন আমি গ্রিজার। জাহাজিদের এর চেয়ে বড় উন্নতি এত অল্প সময়ে হয় না।

তবে বলতে হয় কাপ্তান তোমাকে খুব ভালোবাসেন?

হ্যাঁ মাদাম।

আমি ভায়োলিন বাজাই, কই, কোনোদিন তো বললে না আপনার বাজনা শুনতে ইচ্ছা হয়, ভালো লাগে?

কথার আকস্মিক পরিবর্তনে সুমিত্র ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, সাহসে কুলায় না মাদাম।

সাহসে কুলায় না, না ইচ্ছা হয় না?

সুমিত্র এবার জিভ কাটল। চোখে পোর্টহোলের প্রতিবিম্ব ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠেই ফের মিলিয়ে গেল।—যদি অভয় দেন তো বলি।

সুমিত্র আবার ভাবল কোনো বেয়াদপি করে ফেলছে না তো? সে বলল, না থাক মাদাম।

কেন থাকবে? তুমি বলো। অভয় দিচ্ছি।

সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় আপনার বাজনা শুনেছি, দিঘির পারে উইলোগাছের ছায়ায় বসে রোজ বিকেলে ভায়োলিন বাজাতেন।

তুমি লুকিয়ে এতসব করতে?

কিছু মনে করবেন না মাদাম। আমরা সেলার। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর বন্দরে এলেই একটু বৈচিত্র্য খুঁজি। কেউ মদ খায়… কেউ…। চুপ করে গেল সহসা।—না থাক।

চেরি খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, ডাইনিং—হলে নাচগান হবে। তুমি এসো।

সুমিত্র জবাব দিল, সে হয় না, মাদাম। জাহাজিদের অতদূর যাবার সাধ্য নেই।

চেরি বলল, আমি যদি কাপ্তানকে অনুরোধ করি?

মাদাম, আপনি জাহাজে আর চার—পাঁচ দিন আছেন। আপনি নেমে গেলে সব জাহাজিরা, সব অফিসাররা আমাকে ঠাট্টা—বিদ্রুপ করবে।

চেরি চুপ করে থাকল। অন্যমনস্কভাবেই ছড় চালাল ভায়োলিনের তারে। এই সুর সুমিত্রর সেই পরম অপার্থিব চোখ দুটিকে যেন খুঁজছে।

ছোট মালোম এলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। সেই শব্দে সুমিত্র উঠে দাঁড়াল।—আমি তবে আসি মাদাম।

বোস। ছোট মালোমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি যাচ্ছি। একটু দেরি হবে। চেরি এবার সুমিত্রকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি রোজ এই পথ ধরে নামবে সুমিত্র, কথা দাও।

আপনি দুঃখ পাবেন মাদাম। আমার চোখ দুটো ফের বেইমানি করতে পারে।

না, কথা দাও।

এই পথ ধরেই নামব। কথা দিলাম।

চেরি বসে ছিল চুপচাপ। সুমিত্র চলে গেছে। ছোট মালোমও চলে গেছেন। সে ঘড়ি দেখল। ছ’টা বাজার দেরি নেই। সে বাংক থেকে নেমে জামাকাপড় বদলাল। সে তার দামি ইভনিং—পোশাক পরে আয়নায় প্রতিবিম্ব ফেলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এ—সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চেরি প্রশ্ন করল, কে?

আমি, ক্যাপ্টেন স্মিথ।

হয়ে গেছে আমার। আমি যাচ্ছি। বলে চেরি বেহালা হাতে বের হল। কাপ্তানের সঙ্গে চলতে থাকল। ওরা ডাইনিং—হলের দিকে যাচ্ছে। যে সকল অফিসারদের, এনজিনিয়ারদের ওয়াচ নেই তারা পূর্বেই নির্দিষ্ট স্থানে বসে আছে। চেরি ঢুকলে সকলে উঠে সম্মান দেখাল চেরিকে। মালবাহী জাহাজের ছোট ডাইনিং—হল, অল্প পরিসরে কয়েকজন মাত্র পুরুষ। ঘরে নীল আলো। বাটলার, কাপ্তানের আদেশমতো এই ছোট্ট ঘরটিকে বিচিত্র সব রঙিন কাগজে এবং বিভিন্ন রকমের চেয়ার—টেবিলের জেল্লায় জৌলুস বাড়াবার চেষ্টা করেছে। চেরি কেমন খুঁতখুঁত করতে থাকল।

কাপ্তান একটু ইতস্তত করে বলল, সমুদ্রের দিনগুলোতে কোনো আনন্দ নেই। মাদাম। সুতরাং স্বল্প আয়োজন থেকেই যতটা আনন্দ নিতে পারি।

আমি কিন্তু অন্য কথা ভাবছি কাপ্তান। সেটা আপনাকেও ভেবে দেখতে বলি।

বলুন।

এই ছোট্ট ঘরে না হয়ে খোলা ডেকে ভালো হয় না?

কাপ্তান এবারও একটু ইতস্তত করল।— আপনি সব জাহাজিদের এ আনন্দে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন?

মন্দ কী! আমার কিন্তু মনে হয় সেই ভালো হবে। ডেকে সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে। সমুদ্রে ঢেউ নেই। এমন সুন্দর দিন…।

তাই হবে।

সুতরাং চার নম্বর এনজিনিয়ার দৌড়ে গেল ডেকে। ডেকের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ড্যারিকে, মাস্টে সবুজ—লাল—নীল আলো জ্বেলে দিল। সতরঞ্চ পেতে সকল জাহাজিদের বসতে বলা হল। তারপর কাপ্তান নিজেই বলতে থাকলেন, আমাদের মাননীয়া অতিথি মিস টুপাতি চেরির সম্মানার্থে এই আনন্দের আয়োজন। আমাদের সমুদ্রের দিনগুলো ভয়ানক নিঃসঙ্গ। সুতরাং সকলেই আজ খোলা মনে আনন্দ করব। এবং এই সম্মানীয়া অতিথির প্রতি নিশ্চয়ই অশালীন হব না।

অফিসারদের জন্য কিছু চেয়ার, কাপ্তান একপাশে এবং তার ডাইনে রেলিংয়ের ধারে চেরি বসল। সমুদ্রে ঢেউ নেই বলে জাহাজ বিশেষ দুলছে না। একটু একটু শীত লাগছে। সকল জাহাজিরা চারপাশে বসে আছে। চেরি সহজ হয়ে দাঁড়াল, প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল, আমরা আজ সকলে পরস্পরের বন্ধু। আসুন, আমরা আজ সকলে একসঙ্গে ঈশ্বরের প্রার্থনা করি। এই কথায় সকলে উঠে দাঁড়াল। ওরা প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশ দেখতে থাকল।

তারপর ছোট মালোম চেরির অনুমতি নিয়ে গান গাইলেন, লেটস লাভ মাই গার্লফ্রেন্ড অ্যান্ড কিস হার…।

মেজ মিস্ত্রি তাঁর ছোট্ট ক্যানারি পাখিটা খাঁচাসহ টেবিলের উপর রাখলেন। শিস দিয়ে পাখিটাকে নানা রকমের অঙ্গভঙ্গিতে নাচালেন। সকলে হেসে গড়াগড়ি দিল।

কাপ্তান কীটসের একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন সকলকে।

একটু বাদে এলেন জাহাজের মার্কনি সাব। মুখোশ পরে চারিধারে বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো ঘুরে বেড়ালেন কিছুক্ষণ। হাতের লাঠিটা মাঝে মাঝে ঘোরাচ্ছেন, তিনি যেন কী খুঁজছেন, অথবা কী যেন তাঁর হারিয়ে গেছে। শেষে কাপ্তানের কাছে এসে বললেন, দিস ম্যান, মাই ফ্রেন্ড, দিস ম্যান ইজ দি রুট অফ অল ইভলস। সুতরাং আসুন, ওকে খতম করে জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাই। বলে তিনি তাঁর লাঠিটা কাপ্তানের মাথায় তুলে ফের নামিয়ে আনলেন, না, মারব না। নোবেল কমিটির শান্তি পুরস্কারটা আমার ভাগ্যে ফসকে যাক—সেটা আমি চাই না। এবং দুঃখে দুটো বড় হ্যাঁচ্চো দেওয়া যাক। তিনি বড় রকমের দুটো হ্যাঁচ্চো দিলেন। লাঠিটা আপনারা নিয়ে নিন, বলে ক্লাউনের কায়দায় লাঠিটা ছুড়ে মেরে ফের ধরে ফেললেন। এবারও সকলে না হেসে পারল না।

এনজিন—রুমে যাদের ওয়াচ ছিল, তারা উপরে উঠে মাঝে মাঝে উঁকি মেরে যাচ্ছে। সুমিত্র সকলের পিছনে বসে আছে। ব্রিজে ঘণ্টা বাজল। এখন সাতটা বাজে। সুতরাং আর আধঘণ্টা এখানে বসে থাকা যাবে। সুমিত্র উঠি—উঠি করছিল, এ সময় চেরি বলল, এবার সুমিত্র আমাদের একটু আনন্দ দিক।

কাপ্তান বললেন, সুমিত্র গান গাইবে।

স্যার, আমাদের গান আপনাদের ভালো লাগবে না।

না সুমিত্র, ঠিক কথা বলছ না। আমরা এখানে কেউ সংগীতজ্ঞ নই। শুধু একটু আনন্দ—সে যেমন করে হোক। একটু আনন্দ, আনন্দ কর।

সুমিত্র একটি সাধারণ রকমের বাংলা গান গেয়ে শোনাল।

এ সময় ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস এল পায়ে খড়খড়ি লাগিয়ে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে অথবা শুয়ে বসে নাচল। এবং শেষে চেরি ওর দীর্ঘদিনের অভ্যাসকে বেহালার তারে মূর্ত করে তুলে সকলকে আনন্দ দিল।

তারপর রাত নামছে, ডাইনিং—হলে কাঁটা—চামচের শব্দ। সেখানে বাটলার এবং অন্যান্য বয়সকল ছুটোছুটি করে পরিবেশন করল। সকলে মদ খেল অল্পবিস্তর। চেরি মদ খেয়ে মাতাল হল আজ।

রাত দশটা বেজে গেছে। চেরি নেশাগ্রস্ত শরীরে কেবিনের ভিতর ডেকচেয়ারে বসে আছে। সুমিত্র সকলের পিছনে চুপচাপ বসে ছিল। উইংস থেকে একটি আলোর তির্যক রেখা এসে ওর চোখে পড়েছে। চেরি ক্ষণে ক্ষণে সুমিত্রকে দেখছিল। দুটি পরস্পর গোপনীয় দৃষ্টি ঘনিষ্ঠ হতে হতে এক সময় লজ্জায় আনত হল। সে কেবিনে ঢুকে পোর্টহোলের পর্দা সরিয়ে দিল। ঘুম আসছে না। এ সময় সুমিত্রকে ডেকে পাঠালে হত।

বয়, বয়! দরজায় পায়ের শব্দে চেরি উঠে গেল এবং দরজা খুলে দিল! শরীর টলছে।— বয়, আজ সুন্দর রাত। বয়, তোমার বাড়িতে কে কে আছে? মাদাম, অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়ুন। গেলাসে জল রেখে গেছি।

বয়, তুমি জানো আমি ভারতীয়?

জী, না।

জেনে রাখো আমি ভারতীয়। বড় দুঃখ হয়, আমরা আর সে দেশে যেতে পারব না। বয়, একটা কথা বলব তোমাকে। কিন্তু সাবধান, কাউকে বলবে না।

মাদাম, আপনার শরীর ভালো নেই। শুয়ে পড়ুন।

বয়, সুমিত্র কিন্তু রাজপুত্র হতে পারত। ওর চোখ, মুখ, শরীর সব সুন্দর।

মাদাম, সুমিত্র যে রাজার ঘরের ছেলে। ভাগ্য দোষে—

চেরি এবার কিছু বলল না। সে ধীরে ধীরে উঠে পোর্টহোলে মুখ রাখল।—তুমি যাও, বয়।

মাদাম, দরজাটা বন্ধ করে দিন। কাপ্তান—বয় বের হয়ে যাবার সময় এই কথাগুলো বলল।

চেরি পোর্টহোল থেকে যখন দেখল কাপ্তান—বয় ঘরে নেই, ওর পায়ের শব্দ অ্যালওয়েতে মিশে গেছে এবং যখন মনের উপর শুধু সুমিত্রই একমাত্র দৃশ্যমান তখন দরজা বন্ধ না করে নিচে এনজিন রুমে নেমে সুমিত্রর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোই ভালো। চেরি দরজা খুলে বাইরে বের হল। এনজিন—রুমে নামার মুখেই দেখল সুমিত্র তেলের ক্যান নিয়ে উপরে উঠে আসছে।

এই যে, মাদাম!

সুমিত্র, তোমার ওয়াচ শেষ?

না মাদাম, পিছিলে যাচ্ছি, স্টিয়ারিং—এনজিনে তেল দিতে।

রাত এখন কত?

এগারোটা বেজে গেছে, মাদাম।

জাহাজে আর কারা এখন জেগে থাকে সুমিত্র?

অনেকে মাদাম। অনেকে। ব্রিজে ছোট মালোম, এনজিন—রুমে তিন নম্বর মিস্ত্রি, স্টোকহোলডে চারজন ফায়ারম্যান, তিনজন কোল—বয়, কম্পাস ঘরে কোয়ার্টার—মাস্টার, ফরোয়ার্ড পিকে কোনো ডেকজাহাজি।

তুমি এত কষ্ট করতে পারো সুমিত্র!

এখন তো কোনো কষ্টই নেই মাদাম। যখন কোল—বয় অথবা ফায়ারম্যান ছিলাম সে কী কষ্ট!

তুমি আমার ঘরে আসবে সুমিত্র?

আপনার শরীর ভালো নেই মাদাম। আমি আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিতে সাহায্য করছি। কারণ চেরির এই উচ্ছৃঙ্খল ভাবটুকু ভালো লাগছে না সুমিত্রর। সে চেরির অন্য কোনো অনুরোধ রাখল না। সে চেরিকে ধরে বলল, আসুন।

কোথায় সুমিত্র?

কেবিনে।

আমার ভালো লাগছে না।

ভালো না লাগলে তো চলবে না মাদাম।

তুমি কেবিনে বসবে, বলো?

বসব।

তোমার ফের ওয়াচ ক’টায়?

ভোর আটটায়।

চেরি কেবিনের দিকে না গিয়ে ডেকের দিকে পা বাড়ালে সুমিত্র বলল, এ তো আচ্ছা বিপদে পড়া গেল দেখছি। রাতদুপুরে জাহাজিরা দেখলে বলবে কী?

কী বলবে সুমিত্র?

কী আর বলবে! আসুন। ধমকের সুরে কথাগুলো বলল সুমিত্র। তারপর জোর করে চেরিকে কেবিনে ঠেলে দিতেই শুনতে পেল—চেরি বলছে—ভালো হচ্ছে না সুমিত্র। আমি মাতাল বলে কিছুই বুঝতে পারছি না ভাবছ। কাল ঠিক কাপ্তানকে নালিশ করে দেব দেখ। আমার উপর জোর খাটালে ঈশ্বর সহ্য করবেন না।

ফের সুমিত্র নিজের অবস্থা বুঝে খানিক বিব্রত বোধ করছে। এমত ঘটনার কথা কাপ্তানকে বললে—তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন না। অথবা মনে হল বৃদ্ধ কাপ্তানকে খবর দেওয়া যায়—চেরি ডেকের অলিগলিতে ঘুরতে চাইছে। চেরি মদ খেয়ে মাতাল এবং চেরির এই সময় যৌনেচ্ছার বড় ভয়ানক শখ। কিন্তু দেখল যে রাত গভীর। ফরোয়ার্ড পিক থেকে ওয়াচ করে ডেক—জাহাজি হামিদুল ফিরছে। ওয়াচের ঘণ্টা বাজছে ব্রিজে। সুতরাং বৃদ্ধ কাপ্তানকে এ সময় ডেকে তোলা নিশ্চয়ই সুখকর হবে না। বরং কাপ্তান—বয়ের খোঁজে গেলে হয়, যথার্থ উপকার এসময় তবে হতে পারে। সে আরও কিছু ভাবছিল তখন চেরি ওর হাতটা পিছন থেকে খপ করে ধরে ফেলল। বলল, দোহাই সুমিত্র, আমাকে একা ফেলে যেও না। খুব ভয় করছে।

সুমিত্র ছোট মালোমের কথা মনে করতে পারল। প্রতিদিন ওয়াচের শেষে অথবা রাতের নিঃসঙ্গতায় ভুগে ভুগে এই দরজার ফাঁকে চোখ রাখার জন্য উপস্থিত ছোট মালোম। এই দরজায় হাত রেখে বলত, বোট ডেকে বড় সুন্দর রাত।

চেরি বলত, আমার শরীরটা যে ভালো যাচ্ছে না থার্ড।

আমরা এখন একটা নির্জন দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, মাদাম।

সেটা আমার দ্বীপের চেয়ে নিশ্চয় বেশি সুন্দর হবে না থার্ড।

চেরি কতদিন এমন সব কথা বলে প্রাণ খুলে হাসত।—তোমাদের থার্ড আচ্ছা বেহায়া! চেরি ভয়ানক টলছিল। সে এখন এক হাত বাংকে রেখে অন্য হাতে সুমিত্রের কলার চেপে বলছে, মাই প্রিন্স।

মাদাম, আপনি কীসব বলছেন!

আমি ঠিক বলছি সুমিত্র। আমি ঠিক বলছি। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও সুমিত্র, নতুবা আমি জোরে জোরে চিৎকার করব। বলব, প্রিন্স প্রিন্স। একশোবার বলব। সকলকে শুনিয়ে বলব। তুমি কী করবে? কী করতে পারছ?

ভয়ে সুমিত্র কাঠ হয়ে থাকল। সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে বলল, চুপ করুন মাদাম চুপ করুন। আপনার ঈশ্বরের দোহাই।

সুমিত্র দেখল কেবিনের পোর্টহোল খোলা। ফরোয়ার্ড পিকে কোনো জাহাজি যদি এখন এই সময় ওয়াচে যায়, চোখ তুলে দেখলে ওদের দুজনকে স্পষ্ট দেখতে পাবে। সে তাড়াতাড়ি পোর্টহোলের কাচ বন্ধ করতে গিয়ে দেখল—ক্যালেন্ডারটা উড়ছে। সে সন্তর্পণে পোর্টহোল দিয়ে কিঞ্চিৎ মুখ বার করে যখন দেখল কেউ এ—পথে আসছে না, বারোটা—চারটের পরীদাররা সব এনজিন রুমে নেমে গেছে এবং শেষ ওয়াচের পরীদারদের চিৎকার স্টোকহোল্ড থেকে উঠে আসছে তখন দ্রুত পোর্টহোলে কাচ এবং লোহার প্লেট উভয়ই বন্ধ করে দিয়ে চেরির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল এবং বাংলায় বলল, বেশ্যা! তারপরের খিস্তি উচ্চারণ না করে মনে মনে হজম করে ফেলল। তবে অভ্যস্ত ইংরেজিতে উচ্চারণ করল, মাদাম, আমাকে বিপদে ফেলবেন না।

বোস সুমিত্র।

সুমিত্র পূর্বে এ—কেবিনে যে সংকোচ নিয়ে যে ভয় এবং মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বসত আজও তেমন দু’হাতের তালুতে মাথাটা রেখে কেমন অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকল। সে এ—মুহূর্তে কিছুই ভাবতে পারছে না। চার ঘণ্টা ওয়াচের পর ক্লান্ত শরীরটাকে যখন ফোকসালে নিয়ে যাবে ভাবছিল, যখন স্নান সেরে শরীরের সকল ক্লান্তি উত্তাপ দূর করবে ভাবছিল তখন চেরির এই মাতাল ইচ্ছা ব্যাধিগ্রস্ত শরীরের মতো ক্রমশ ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

চেরি বলল, তুমি ইচ্ছা করলে স্নান সেরে নিতে পারো সুমিত্র।

সুমিত্র যেহেতু একদা এইসব কেবিনের দেয়াল সাবান—জল দিয়ে পরিষ্কার করেছে, যেহেতু ওর সব জানা… সুমিত্র সুতরাং উত্তর করছে না।

চেরি বাংক থেকে উঠে ওর পাশে বসল। বলল, মাই প্রিন্স। বলে সুমিত্রর কপালে চুমু দেবার জন্য ঝুঁকে পড়ল।

সুমিত্র উঠে দাঁড়াল এবং বলল, মাদাম, আপনি পাগল।

চেরির পা দুটো টলছে এবং চোখ দুটো তেমনি মায়াময়।

সুমিত্রর এই অপমানসূচক কথায় চোখ দুটো কেমন সজল হয়ে উঠল। নিচে এনজিনের শব্দ। আরও নিচে সমুদ্র অতল থেকে যেন ফুঁসছে। চেরি বলল, আমি ভারতবর্ষে যাব সুমিত্র। তুমি নিয়ে চলো। তুমি আমাকে ঘোড়ার পিছনে নিয়ে কেবল ছুটবে, ছুটবে—কোথাও পালিয়ে যাবে।

চেরির সেই রাজপুত্রের কথা মনে হল। সেই রাজকন্যার কথা মনে হল। রাজকন্যা স্বয়ম্বর সভা অতিক্রম করে দূরে দূরে চলে যাচ্ছে। ঝাড়লণ্ঠন পরিত্যাগ করে আঁধারের আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। মুক্তোর ঝালর—দ্বারীরা হাঁকছে অথচ নিকটবর্তী কোনো জলাশয়ে প্রতিবিম্ব রাজপুত্রের। সকলের অলক্ষ্যে রাজপুত্র রাজকন্যার জন্য প্রতীক্ষা করছে। চেরির এইসব কথা মনে হলে বলল, তুমি পারো না সুমিত্র, তুমি আমাকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে পারো না!

সুমিত্রকে উদাস দেখে ফের বলল, পারো না তুমি? আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না ভারতবর্ষে?

মাতাল রমণীকে খুশি করার জন্য সুমিত্র বলল, নিয়ে যাব।

তোমার দেশের গ্রাম মাঠ দেখব সুমিত্র!

সুমিত্র সহজভাবে কথা বলতে চাইল।—ফুল দেখবে না? পাখি দেখবে না?

ফুল দেখব, পাখি দেখব।

আমার দেশের আকাশ দেখবে না? আকাশ?

সাপ বাঘ দেখবে না? সাপ বাঘ? বিধবা বউ, যুবতী নারী? এইসব বলতে বলতে সুমিত্র কেমন উত্তেজিত বোধ করছিল। সে মরিয়া হয়ে যেন বলে ফেলল, আমি সব দেখাতে পারি। কিন্তু দেখাব না। তুমি নেশায় টলছ। নিজের সম্বন্ধ তুমি সচেতন নও, সুতরাং সব দেখালে অন্যায় হবে।

প্রথমটায় চেরি ধরতে না পেরে বলল, কী বললে? চেরির চোখ দুটো তারপর সকল ঘটনার কথা বুঝতে না পেরে ছোট হয়ে এল।—কাপুরুষ! চেরি সুমিত্রর মুখের কাছে এসে কেমন একটা থু শব্দ করে দরজার পাট সহসা খুলে দিল। গেট আউট, ইউ গেট আউট! এমন চিৎকার শুরু করল চেরি যে সুমিত্র পালাতে পারলে বাঁচে। সুতরাং সুমিত্র ছুটতে থাকল। সে ডেক ধরে ছুটে এসে পিছিলে উঠে দেখল পরীদারেরা সকলে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে এইসব কথা গোপনে লালন করে দীর্ঘ সময় ধরে মেয়েটির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দুঃখ বোধ করল।

তখন চেরি পোর্টহোলের প্লেট খুলে দিল। কাচ খুলে দিল। সে শরীরটাকে বাংকে এলিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে—এমন সময় দরজায় শব্দ, কড়া নাড়ছে কে যেন। ধীরে ধীরে এবং সন্তর্পণে। অথবা চোরের মতো। সে বুঝতে পারছে—কারণ চট করে শরীরের মাতাল ভাবটা কেটে গেছে পোর্টহোলের ঠান্ডা হাওয়ায় এবং নিজের বেলেল্লাপনার রেশটুকু ধরতে পেরে লজ্জিত, কুণ্ঠিত। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার সামনে। বলল, কে?

আমি মাদাম।

আপনি কে?

আমি থার্ড।

আজ তো আকাশে নক্ষত্র নেই। আকাশে মেঘ দেখতে পাচ্ছি। এইসব কথার ভিতর চেরির মাতাল মন ধীরে ধীরে যেন সুস্থ হচ্ছে। এতক্ষণ প্রায় সে সকল বস্তুকে দুটো অস্তিত্বে দেখছিল— দুটো ক্যালেন্ডার, দুটো লকার, চারটে বাংক এবং এমনকি সুমিত্র পর্যন্ত দুটো অস্তিত্বে ওর পাশে বসে ছিল। পোর্টহোলের ঠান্ডা হাওয়ায় সবকিছুই মিলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে। যেন সবই এখন এক অখণ্ড বস্তু। তবু থার্ডকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, চলুন কাপ্তানের ঘরে। রাতদুপুরে কেমন জ্বালাতন করছেন টেরটি পাবেন।

এতক্ষণ মাদাম, দয়া করে আপনার কেবিনে কে ছিলেন?

চেরি বিদ্রূপ করে বলল, কেন, আপনি নিজে। তারপর দরজাটা মুখের উপর ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিয়ে বলল, লক্ষ্মীছেলের মতো ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন।

কিন্তু সুমিত্র নিজের বাংকে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারল না। সুমিত্রের মনে পড়ল মাতাল রমণী যদি দরজা খুলে শুয়ে থাকে, যদি থার্ড সেই ফাঁকে বেড়ালের মতো সন্তর্পণে ঢুকে পড়ে এবং চুরি করে চেটে চেটে মাংসের স্বাদ নিতে নিতে যদি… ভালো নয়, ভালো নয় সব—এমন ভেবে সে ডেকের উপর উঠে এলো। কাপ্তান—বয়ের দরজায় কড়া নেড়ে ডাকল, চাচা, অ চাচা, একটু উঠুন।

বৃদ্ধ কাপ্তান—বয়ের সারাদিন পরিশ্রমের পর এই বিশ্রামটুকু একান্ত নিজস্ব। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুতরাং দু—এক ডাকে সাড়া পেল না সুমিত্র। সুমিত্র বারবার ধীরে ধীরে ডাকল, চাচা, অ চাচা! সে জোরে ডাকতে পারছে না, কারণ পিছনে মেসরুম মেট এবং মেসরুম বয় থাকে। তারপর এনজিনের স্কাইলাইট পার হলে ফানেল। ফানেল অতিক্রম করে অ্যাকোমোডেশান ল্যাডার, যা ধরে কাপ্তানের ঘরে উঠে যাওয়া যায়। জোরে ডাকাডাকি করলে বৃদ্ধ কাপ্তানের ঘুম পর্যন্ত ভেঙে যেতে পারে। সুতরাং ধীরে ধীরে সে কড়া নাড়তে থাকল।

বৃদ্ধ কাপ্তান—বয় একসময় দরজা খুললে বলল, চেরির দরজা বন্ধ করে আসুন চাচা। মদ খেয়ে ভয়ানক মাতলামি করছে।

তাড়াতাড়ি কাপ্তান—বয় গায়ে উর্দি চাপিয়ে নিচে ছুটল। গিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। তবু সে ধীরে ধীরে ঠেলে দেখল—দরজা খোলা এবং খুলে যাচ্ছে। চেরি বাংকের উপর বসে ক্যালেন্ডারটা দেখছে নিবিষ্ট মনে। কাপ্তান—বয়ের কোনো আওয়াজই চেরি শুনতে পাচ্ছে না। তখন দরজাটা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। কিন্তু কী ভেবে ঘরের ভিতর ঢুকল কাপ্তান—বয়। টিপয়ে খাবার জল রাখল, তারপর পিতৃত্বের ভঙ্গিতে বলে উঠল, মাদাম, শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে। এখন প্রায় একটা বাজে।

চেরি বড় বড় হাই তুলছে। সে কম্বলটা নিচে ঠেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল। কাপ্তান—বয় দাঁড়িয়ে ছিল—চেরি কাত হয়ে শুয়ে ক্যালেন্ডারটা দেখছে। ওর পোশাকের গাঢ় রঙের ভাঁজ এখন আর নেই। চোখে অবসাদের চিহ্ন। কেমন এক তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব ওর সমস্ত অবয়বে। কাপ্তান—বয় কম্বলটা ওর শরীরের উপর বিছিয়ে দিয়ে বাইরে এল। দরজা টেনে সন্তর্পণে তালা মেরে দিল। ডেকে বের হয়ে দেখল ঠান্ডায় সুমিত্র তখনও পায়চারি করছে।

কাপ্তান—বয় কাছে এসে বলল, দরজা বন্ধ করে তালা মেরে দিলাম।

যাক, বাঁচা গেল। এইটুকু বলে সুমিত্র পিছিলের দিকে উঠে যেতে থাকল।

ভোরবেলায় জাহাজিরা সাবানজল নিয়ে কেবিনের দেয়াল ধুতে অথবা ফল্কা বেঁধে নিচে নেমে অদৃশ্য হতে চাইছে। তখন চেরি বিছানায় উঠে বসল। দরজা বন্ধ দেখল। সে গত রাতের কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারছে। সুমিত্র, জাহাজি সুমিত্রর প্রতি চেরির বলতে ইচ্ছা হল, গত রাতের ঘটনার জন্য আমাকে ক্ষমা কর সুমিত্র। এই জাহাজে, সমুদ্রের ভয়ানক নিঃসঙ্গতা এবং তোমার পাথরের মতো শরীরের স্থির অথবা অচঞ্চল উপস্থিতি আমাকে নিয়ত তীব্র তীক্ষ্ন করছে। আমাকে অস্থির, চঞ্চল করেছে। অথচ তুমি কখনও পুতুলের মতো শরীর নিয়ে, কখনও একান্ত বশংবদের চিহ্ন শরীরে এঁকে আমার কেবিনে সময়, কাল অতিক্রম করার হেতু আমি ক্রমশ এক অস্থির নিয়তির ইচ্ছায় কালক্ষয়ের বাসনায় মগ্ন। কৈশোরের স্বপ্ন তোমার অবয়বে কেবল রূপ পাচ্ছে। আমার প্রিয়তম দ্বীপে এমত ঘটনা ঘটলে কী হত জানি না, আমার বাবা বর্তমান—তিনি আমাকে কী বলতেন জানি না এবং তোমার উপস্থিতি সহসা আমাকে অন্ধকারে নিদারুণ চঞ্চলতার জন্মদানে আমার সম্মানিত জীবনকে বিব্রত করে কেন জানি না, তবু তুমি কখনও এই কেবিনে এসে দাঁড়ালে আমি অধোবদনে লজ্জিত থাকব। তারপর আয়নায় চেরি তার মুখ দেখে উচ্চারণ করল—গত রাতের ঘটনার জন্য তুমি আমায় ক্ষমা করো সুমিত্র।

রাতের বিড়ম্বনার জন্যই হোক অথবা অন্য কোনো কারণে, সুমিত্র ভোর রাতের দিকে শরীরে ভীষণ ব্যথা অনুভব করতে থাকল। পাশের বাংকে অনাদি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওর যেহেতু চারটে আটটা পরী, যেহেতু এক্ষুনি তেলয়ালা হাফিজদ্দি ওকে এসে ডেকে তুলবে সুতরাং জল তেষ্টাতে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে ওকে ডাকা ভালো।

সুমিত্র ডাকল, অনাদি, ও অনাদি। একটু উঠে জল দে ভাই।

এই রাতে জল চাওয়ায় অনাদি আশ্চর্য হল। সে বলল, উঠে খেতে পারিস না।

শরীরে ভয়ানক কষ্ট।

কেন, কী হল!

মনে হয় জ্বর এসেছে।

অনাদি তাড়াতাড়ি উঠে কপালে হাত রেখে দেখল জ্বরে সুমিত্রর শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সে জল দিল সুমিত্রকে এবং শরীরটা টিপে দেবার সময় বলল, রাত একটা পর্যন্ত তুই কোথায় ছিলি রে?

সুমিত্র উপরের দিকে হাত তুলে দেখাল।

কী করছিলি।

চেরিকে পাহারা দিচ্ছিলাম।

চেরি তোকে কিছু বলেছে?

না।

জাহাজের একঘেয়েমি তোর ভালোই লাগছে।

সুমিত্র জবাব দিল না। চুপ করে অন্য দিকে দেখতে দেখতে সুমিত্র কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

ভোরের দিকে সারেং ঘরে ঢুকে বলল, কী রে বা, অসুখ বাধাইছ!

না, তেমন কিছু নয় চাচা। মনে হয় ফ্লু গোছের কিছু। মেজ মালোমের কাছ থেকে একটু ওষুধ এনে দেন চাচা।

সারেংকে চিন্তিত দেখাল। ওর পরী কে দেবে এখন এমতই কোনো চিন্তা যেন সারেঙের মনে। সুতরাং সে একজন ফালতু আগওয়ালকে ডেকে সুমিত্রর পরী দিতে বলে যাবার সময় বলে গেল—পরীতে সুমিত্রর আজ যেতে হবে না এবং তখুনি কোনো কয়লায়ালাকে দিয়ে ওষুধ পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছে। সব কাজ হয়ে যাবার পর সারেং যেন খুশি। তবে সুমিত্র যেন ডেকে উঠে ফের ঠান্ডা না লাগায়, বেশি হাঁটাহাঁটি না হয় সেজন্য সারেং শাসনের ভঙ্গিতেও কিছু কথা বলে গেল। বিশেষত, ভাতের জন্য ভাণ্ডারীকে পীড়াপীড়ি করলে নির্ঘাত পরী দিতে হবে এইসব কথার দ্বারা সারেং সকলের উপরে, সে—ই জাহাজের সব খালাসিদের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা এমন এক ধারণার ভিত্তিতে সারেং মেজ মিস্ত্রির মতো ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে গেল—যেন এনজিনিয়ার হাঁটছে।

শুয়ে ছিল, সে পরীদারদের ওঠানামার সঙ্গে ধরতে পারছে, এখন ক’টা বাজে। পোর্টহোল খোলা ছিল, কিন্তু সে সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে না। উপরের ঘরে ট্যান্ডেলের তামাক কাটার শব্দ ভেসে আসছে। পাশের ফোকসালে কোনো জাহাজি এখন নামাজ পড়ছে। তা ছাড়া সমুদ্রে ঢেউ একটু বেশি আজ। জাহাজটা কিঞ্চিৎ বেশি দুলছে যেন।

মুখটা ওর বিস্বাদ লাগল। সে এক মগ চায়ের জন্য প্রতীক্ষা করছে এখন। ভাণ্ডারী এক মগ চা এনে দিলে ঢক ঢক করে সবটা খেয়ে সমস্ত শরীরে কম্বল ঢেকে পড়ে থাকবে—তারপর যদি ভীষণভাবে ঘাম হয় শরীরে তবে নিশ্চয়ই শরীরটা ঠান্ডা হবে এবং অসহনীয় যন্ত্রণাবোধ থেকে সে মুক্তি পাবে।

কেবিনে বসে চা—এর সঙ্গে স্যান্ডউইচ, কিছু ফল এবং মাখনের স্বাদ এতবার চেখেও যখন চেরি তৃপ্তি পেল না, যখন আটটা—বারোটার পরীদাররা সকলে নেমে গেছে ধীরে ধীরে অথচ সুমিত্র নামছে না—দূরে সমুদ্রের বুকে সূর্যের ম্লান আলো তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে এবং তরঙ্গসকলকে আলোকিত করছে; কিছু উড়ুক্কু মাছ তেমনি ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটছে, ছোট মালোম দূরবিনে আকাশ এবং সূর্যের অবস্থান প্রত্যক্ষ করছেন তখন চেরির মনে হল ডেকছাদের ছায়া ধরে একটু হেঁটে এই জাহাজের রেলিংয়ে ভর করে একটু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালে হয়। সমুদ্রের উপর জাহাজের প্রপেলার জল কেটে যাচ্ছে, জলে ফসফরাস জ্বলছিল—সূর্যের ম্লান আলোর জন্য সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকার থাকলে এখন যেন ভালো হত। ফসফরাস জ্বলছে, এইসব দেখে গত রাতের মতো ঘোর উত্তেজনায় ভুগতে পারত। রাতের নিঃসঙ্গতায় এখানে চেরি কতবার এসে ভর করে দাঁড়িয়েছে। রেলিংয়ে ঝুঁকে ফসফরাস জ্বলতে দেখেছে। কখনও সুমিত্র থাকত, কখনও থাকত না। একদিন সে সুমিত্রকে খুশি করার জন্য বলেছিল—দ্বীপে নেমে সোজা আমাদের প্রাসাদে গেলে না কেন? সুমিত্র তুমি…। সুমিত্র এই সময় কোথায়! ডেকসারেং এক নম্বর ফল্কার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। জাহাজিরা সাবানজল নিয়ে মাস্টের উপর উঠে হাসিঠাট্টায় মশগুল। চেরি তখন ডাকল, সারেং, সারেং!

ডেকসারেং দৌড়ে এলে চেরি বলল, সুমিত্র কোথায়? সে তো এখনও নিচে নামেনি। ওর তো আটটা—বারেটা ওয়াচ।

সারেং জবাব দিল, মাদাম, ওর অসুখ হয়েছে।

চেরি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, যাঃ!

জী মাদাম। আপনাকে আমি মিথ্যা বলতে পারি?

ওকে কে দেখাশুনা করছে?

কে করবে মাদাম? কেউ তো বসে নেই। সকলেই কাজ করছে। ও জ্বরে কাতরাচ্ছে।

তোমরা ওকে দেখতে পারো না! জ্বর হয়েছে… একলা ফেলে…

তা দেখি, মাদাম। সারেং নিজের দোষ কাটাবার জন্য বলে গেল, সব ব্যবস্থা করা হয়েছে মাদাম। এনজিন—সারেং মেজ মালোমের কাছ থেকে ওষুধ এনেছে।

তারপর চেরির মনে পড়ল এই মালবাহী জাহাজে সেবা—শুশ্রূষার কোনো ব্যবস্থা নেই। জাহাজিদের জন্য ভালো ওষুধ নেই। কোনো ডাক্তার নেই। সাধারণ রকমের অসুখে মেজ মালোমই ওষুধ দেন। সাধারণ রকমের অসুখে প্রয়োগ করার মতো কিছু ওষুধপত্র এই জাহাজের কোনো এক প্রকোষ্ঠে সঞ্চিত আছে। কাপ্তানের উপর কোম্পানির উপর চেরির রাগ ক্রমশ বাড়তে থাকল। অথচ চেরি ফোকসলের দিকে হেঁটে যেতে পারছে না। গত রাতের ঘটনাসকল চেরিকে সংকুচিত করছে। যেন এই মুখ সুমিত্রকে দেখানো চলে না। যেন সুমিত্রর ফোকসালে ঢুকলে সে অপমানিত হতে পারে। গত রাতের দুঃসহ অপমানের কথা নিশ্চয়ই সে ভুলে যায়নি। সুতরাং, কী ভেবে চেরি নিজের কেবিনে ঢুকে কিছু ফল তুলে নিল হাতে এবং কাপ্তান—বয়কে ডেকে বলল, যাও সুমিত্রর কেবিনে এই ফলগুলি রেখে এসো। কিছু বললে বলবে বাটলার দিয়েছে। আমার কথা বলবে না।

কাপ্তান—বয় দরজার চৌকাঠ পার হলে চেরি বলল, জ্বর কত এবং কেমন আছে দেখে আসবে।

কাপ্তান—বয় আলওয়েতে হাঁটছিল এবং শুনতে পাচ্ছে, ওকে বেশি নড়াচড়া করতে বারণ করবে। মনে থাকে যেন, আমার কথা বলবে না।

কাপ্তান—বয় খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে। কারণ তখনও চেরি নানারকমের নির্দেশ দিচ্ছে।—কম্বল গায়ে না থাকলে দিয়ে দেবে। কাপ্তান—বয় সব শুনে হাসল। বস্তুত চেরি আভিজাত্য বোধে ফোকসালের দিকে হেঁটে যেতে পারছে না। কাপ্তান—বয় বুঝল, চেরির ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। ডেকছাদের নিচে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল—দূরে কেবিনের দরজাতে ভর করে চেরি অপলক চোখে কাপ্তান—বয়ের কাছে কোনো খবরের প্রতীক্ষায় আছে। কাপ্তান—বয় এবার সত্বর ছুটে গেল। কারণ ওরও চেরির দুঃখবোধে মনের কোণে এক স্নেহসুলভ ইচ্ছার রঙ করুণ হয়ে উঠেছে।

সিঁড়ি ধরে নামছিল কাপ্তান—বয়। নিচের ফোকসালগুলি সবই প্রায় খালি। কিছু কিছু জাহাজি ডেকে হল্লা করছে। ওরা দেশের গল্পে, বিবিদের গল্পে মশগুল। প্রতিদিনের মতো ফলঞ্চা বেঁধে কেউ কেউ জাহাজে রঙ করছে। কাপ্তান—বয় প্রতিদিনের এইসব একঘেয়েমি দৃশ্য দেখতে দেখতে নিচে নেমে গেল। সুমিত্রর শিয়রে দাঁড়িয়ে কপালে হাত রাখল। ডাকল, সুমিত্র, ওঠ বাবা।

এই সময় কে কপালে হাত রাখল! ডাকল! সুমিত্রর মনে হল বড় প্রীতময় এই জাহাজিদের সংসার। দীর্ঘদিনের সফরে কাপ্তান—বয়কে আপনজনের মতো করে ভাবতে গিয়ে চোখে জল এল। সে ডাকল, চাচা!

কেমন আছ?

শরীরটা বড় ব্যথা করছে।

একটু নুনজল এনে দেব? গরম জল?

গরম জল ভাণ্ডারী দিয়েছে।

কী খেলে।

কিছু না। ভাবছি ভাত খাব না। শরীরটা খুব ঘামছে। মনে হয় ভালো করে ঘাম হলে শরীরটা খুব ঝরঝরে হবে।

যখন কাপ্তান—বয় দেখল শরীরে কোনো উত্তাপ নেই এবং যখন বুঝল ফ্লু—গোছের কিছু হয়েছে তখন আর বেশি দেরি করল না। পকেট থেকে আপেলগুলো বের করে দিয়ে বলল, নাও খাও। খাবে। কী খেতে ভালো লাগে বলবে। বিকেলে এনে দেব। তারপর সুমিত্রকে একটু বিস্মিত হতে দেখে বলল, বাটলার দিয়েছে। বড় বড় চোখে তাকাবার মতো কিছু হয়নি।

সুমিত্রর শরীরে কম্বল টেনে দিয়ে কাপ্তান—বয় বাইরে বের হয়ে গেল। সিঁড়ি ধরে উঠছে। সুমিত্র শুয়ে শুয়ে উপরে কাপ্তান—বয়ের জুতোর শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে শুনতে পেল। ওর পোর্টহোলটা খোলা নেই। খোলা থাকলেও সে আকাশ দেখতে পেত না। মালবোঝাই জাহাজ। সমুদ্রের জলে মাঝে মাঝে পোর্টহোলটাকে ঢেকে ফেলছে। সমুদ্রের এই জল দেখে গতরাতের কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারছে সুমিত্র। চেরির যৌন ইচ্ছা এবং প্রগলভতা ওর মনে এখনও কামনার জন্ম দিচ্ছে। অথচ সে পারছে না। বারবার এই আত্মঘাতী ইচ্ছা ওকে নিদারুণ যন্ত্রণায় দগ্ধ করছে, রাতে চেরির কেবিন থেকে ফিরে এসে এই ফোকসালে দীর্ঘ সময় পায়চারি করেছে এবং সকল দগ্ধ যৌন ইচ্ছার প্রতি উষ্মা প্রকাশের জন্য বার বার জাহাজিসুলভ খিস্তি করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে চেয়েছে।

বিকালে সুমিত্রর জ্বরটা থাকল না। বাংকে বসে সে—শরীর তার এখন হালকা, নিরন্তর এই বোধে খুশি। সে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে একটি বেঞ্চিতে বসল। সমুদ্রের হাওয়ায় ওর শরীর প্রাণ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। সে এবার ধীরে ধীরে চার নম্বর ফল্কা অতিক্রম করে ডেক—ছাদের নিচ দিয়ে এলওয়ে পথটাকে দেখল—সেখানে কোনো পরিচিত মুখ ভেসে উঠছে না। সেই মুখ, নরম ঘাড় আর তার কোমল মন সুমিত্রর নিঃসঙ্গ এবং পীড়িত শরীরের জন্য বড় প্রয়োজন। এবং গত রাতের ‘বেশ্যা’ এই শব্দটি গ্লানিকর সুতরাং উচ্চারণে কিঞ্চিৎ সংযত হওয়া প্রয়োজন। তারপর এই মুহূর্তে নিজেকে ছোটলোক ভেবে ক্ষোভ থেকে কিঞ্চিৎ প্রশমিত হওয়া গেলে মন্দ কী? চেরির মাতাল যৌনেচ্ছাতে সমুদ্রের নেশা ছিল। ওর ঘরে দ্বীপের আভিজাত্য অনেক দূরের স্মৃতির মতো এবং এইজন্যই বুঝি সমুদ্রের ঢেউ অথবা আকাশ দেখতে দেখতে একটু প্রেম করা চলে—ভালোবাসলে ক্ষতি নেই, তারপর রাত যদি ঘন ঘন শরীরের রমণীয়তায় তন্ময় করে রাখে, যুক্ত করে রাখে তবে বিঘ্নকারী জানোয়ারের মতো ইতর হবার প্রয়োজন কোথায়! সে ভাবল, সুতরাং আজ রাতে চেরির দরজার পাশ দিয়ে একবার হেঁটে যাবে। এবং গৃহপ্রবেশের দিনে গিন্নিমার মতো একবার যৌনসংযোগ ঘটাবে—এই নিরন্তর ইচ্ছার জন্য সে এবার ডাকল— ভাণ্ডারী—চাচা, আমাকে একমগ চা দিন।

ভাণ্ডারী উঁকি দিল গ্যালি থেকে। জাহাজিরা ঘরে ফেরার মতো একে একে সকলে পিছিলে জমছে। ওদের হাতে রঙের টব ছিল। ওরা হাতের রঙ কেরোসিন তেলে মুছে নিচ্ছে। ওরা এবার স্নান করবে। নামাজ পড়বে এবং আহার করবে। তারপর সমুদয় কাজ সেরে ওরা গিয়ে বেঞ্চিতে বসে ন্যক্কারজনক কথাবার্তায় ডুবে ডুবে জল খাবে। সুমিত্র ওদের সকলকে দেখল। ওরা সকলে ওকে এক প্রশ্ন করল, তোমার শরীরটা ক্যামন আছেরে বা? এইসব বলে ওরা ফোকসালে নেমে গেলে ভাণ্ডারী বলল, চা কড়া করে দেব?

তাই দাও।

সুমিত্রর এখন আর কিছু করণীয় নেই। সুতরাং পা ঝুলিয়ে বসে থাকল। শরীরে সমস্ত দিনের সঞ্চিত গ্লানি এই সমুদ্র এবং এক কাপ চা দূর করে দিল। সে এবার জাহাজের অলিগলি না খুঁজে সোজা দিগন্তে নিজের দৃষ্টিতে নিযুক্ত করে তার দেশ বাড়ির চিন্তা—সেখানে কী মাস, কী ফুল ফুটছে অথবা কোন ঋতু হতে পারে, দুর্গাপুজোর সময় হতে কত দেরি, শেফালি ফুল ছড়ানো উঠোন অথবা বৃষ্টি বৃষ্টি… এবং জাহাজে থেকে থেকে বাংলাদেশের মাস কালের হিসাব ভুলে গেল সুমিত্র। অথবা এইসব চিন্তার দ্বারা দেশের আকাশকে উপলব্ধি করার জন্য আঁকু—পাঁকু করতে থাকল সুমিত্র।

ডেক—সারেং বলল, তবিয়ত কেমন?

ভালো চাচা। জ্বরটা মনে হয় সেরে গেছে।

কী খেয়েছিলে?

চাপাটি খেলাম চাচা।

ভালো করেছ।

রাত্রে দেখি বাটলারকে বলে একটা পাঁউরুটি সংগ্রহ করতে পারি কি না।

অনাদি উঠে এল। সে বলল, এখানে বসে শরীরে ঠান্ডা লাগানো হচ্ছে? এক্ষুনি নেমে পড়! বলে, সুমিত্র অনাদিকে অনুসরণ করে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। সারেংয়ের ঘরটা অতিক্রম করে স্টোর রুমের পাশের নির্জন জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে সুমিত্র ডাকল, অনাদি!

কিছু বলবি!

তুই তো সারাদিন পাঁচ নম্বরের সঙ্গে ডেকে কাজ করছিলি?

হ্যাঁ, তা করছিলাম।

চেরিকে ডেকে বের হতে দেখলি না?

না। তবে এলওয়ে ধরে আসবার সময় দেখলাম চেরি বিছানায় শুয়ে আছে।

কিছু করছে না।

ঘরটা অন্ধকার। দরজা জানলা সব বন্ধ করে রেখেছে।

সুতরাং ভালোমতো দেখিসনি।

না।

সুমিত্রকে দেখে মনে হচ্ছে খুব আশাহত। অনাদি নিজের ফোকসালে চলে গেল এবং পিছনে এসে এ সময় কাপ্তান—বয় ডাকল, সুমিত্র, এই নাও তোমার বিকেল এবং রাতের খাবার। বাটলার দিয়েছে।

চাচা, বাটলার এত সদয় কেন আমার প্রতি?

তা আমাকে বললে কী হবে! বরং বাটলারকে জিজ্ঞেস কর। একটু থেমে বলল, তোমার শরীর এখন কেমন?

ভালো চাচা।

বেশি নড়বে না। এ—জ্বর কিন্তু খুব খারাপ। আবার হলে অনেক ভোগান্তি হবে। বলে চলে যাবার জন্য উদ্যোগ করতেই সুমিত্র কেমন যেন সংকোচের সঙ্গে ডাকল, চাচা।

কাপ্তান—বয় মুখ ফিরিয়ে বলল, কী!

আমার যে শরীরটা খারাপ করেছিল, চেরি জানে?

তা আমি কী করে জানব বাপু।

তোমাকে কীছু জিজ্ঞেস করেনি?

না। আমি কতক্ষণ থাকি ওর কাছে? কাপ্তান—বয় আর দাঁড়াল না। সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সুমিত্র ফোকসালে ঢুকে ফের বাংকে শুয়ে পড়ল। শরীরটা বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে। গত রাতের ঘটনাগুলো ওকে এখনও যেন যন্ত্রণা দিচ্ছে। অথচ একবার চেরির কেবিনে যেতে পারলে সব দুর্ঘটনার যেন অবসান হত। তবু সে নিজের শরীরে কম্বল টেনে পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। নির্জনতায় ভুগে কেমন বিস্বাদ বিস্বাদ সব। অনাদি পাশের বাংকে শুয়ে বকবক করছে ছোট ট্যান্ডলের সঙ্গে। এইসব কথা এবং যৌন আলাপ শুনতে ভালো লাগছে না। ফোকসালের সর্বত্র একই জৈব ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মুসলমান বৃদ্ধ পুরুষসকল অযথা বদনা নিয়ে বারবার এই ঠান্ডা দিনেও গোসলখানায় ঢুকে স্নান করছে এবং আল্লা আল্লা করছে।

ফোকসালে ফোকসালে এখন অন্ধকার। এবং সন্ধ্যা অতিক্রম করছে বলে সকলে আলো জ্বলে দিল। কিন্তু সুমিত্রর এই আলো ভালো লাগছে না। আলোটা ওর চোখে লাগছে। সে আলোটা নিভিয়ে দিতে বলল। এবং এই অন্ধকার এখন ওকে গ্রাস করছে। রাত বাড়ছে। ফোকসালে ফোকসালে জাহাজিরা ভিড় করে আছে। ওরা এবার উপরে উঠবে। ওরা রাতের আহার শেষ করে আবার নিচে নেমে আসবে।

সুতরাং সুমিত্র দীর্ঘ সময় এই বাংকে একা আর পড়ে থাকতে পারছে না। রাত যত বাড়ছিল, ঘন হচ্ছিল, তত শরীরের দুর্বলতা যৌনক্ষুধাকে আবেগমথিত করছে। এবং যখন দেখল ফোকসালে ফোকসালে ডেক—জাহাজিরা ঘুমিয়ে পড়েছে, এনজিন অথবা ডেকসারেং—এর ঘরে আলো জ্বলছে না তখন ধীরে ধীরে সে সিঁড়ি ধরে চোরের মতো পা টিপে টিপে উপরে উঠতে থাকল।

ডেকে উঠতেই শীত শীত অনুভব করল সুমিত্র। অস্ট্রেলীয় উপকূলের যত নিকটবর্তী হচ্ছে তত শীতটা যেন বাড়ছে। তত সমুদ্র যেন শান্ত হয়ে আসছে। আজও সে ডেকে এসে দেখল কেউ কোথাও নেই। মাস্টের আলোগুলি ভূতের মতো রাতের আঁধারে দুলে দুলে ভয় দেখাচ্ছে। ব্রিজে ছোট মালোমও পায়চারি করছেন; ওঁর এখন ওয়াচ নিশ্চয়ই। সুমিত্র আড়াল থেকে দেখল সব এবং খুশি হল। ছোট মালোম কেবিনে থাকেন। সুতরাং চেরির কেবিনে কোনো শব্দ হলে পোর্টহোল দিয়ে উঁকি মারতে পারেন। সে উত্তেজনায় দাঁড়াতে পারছিল না, চুলোয় যাক ছোট মালোম—সে ছুটে এলওয়ে পথে ঢুকে গেল। এবং চেরির দরজার উপর ভর করে সতর্ক গলায় ডাকতে থাকল, মাদাম, মাদাম! আমি এসেছি দরজা খুলুন, যেন বলার ইচ্ছা, আমি যথার্থই কাপুরুষ নই। আপনাকে বেশ্যা বলে নিরন্তর আমি দগ্ধ। আমরা সকলেই উনুনের তাপ চুরি করে শরীর গরম করছি। আপনি দরজা খুলুন মাদাম।

চোরের মতো সুমিত্র কড়া নাড়তে থাকল। রাত বলে এনজিনের আওয়াজ প্রকট। সুতরাং এখন কেউ সুমিত্রর কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাবে না। কেউ এদিকে এলে এনজিন রুমে নেমে যাবার মতো ভান করে দাঁড়িয়ে থাকবে। বড় মালোমের ঘর পর্যন্ত খোলা নেই। সে আবার কড়া নাড়তে থাকল এবং এ—সময়েই দেখল ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। চেরির পায়ের শব্দ ভিতরে। চেরি দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। ভিতর থেকে প্রশ্ন এল, কে! কে?

আমি সুমিত্র, মাদাম। সে আর কীছু প্রকাশ করতে পারছে না। সে উত্তেজনায় অধীর। সে শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। সমস্ত গা পুড়ে যাচ্ছে। গলা ভয়ে শুকনো, কাঠ। সে কোনোরকমে গলা ঝেড়ে আবার ডেকে উঠল, মাদাম, আমি সুমিত্র।

দরজা খুললে চেরি দেখতে পেল সুমিত্র দরজায় দাঁড়িয়ে ঘামছে। এই শীত—শীত রাতেও এমত ঘাম সুমিত্রর মুখে শরীরে সর্বত্র। কেবিনের আলোয় মুখের বিন্দুসকল ঝলমল করছে। সুমিত্রর চোখের নিচে কালি পড়েছে; বিশেষ করে গত রাতের সেই যুবকটিকে যেন আর চেনাই যাচ্ছে না। চেরি এবার সুমিত্রের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এল। পাখা খুলে দিয়ে বলল, বোস। ইজিচেয়ারে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল চেরি। তারপর ধীরে সুস্থে বাংকে বসে বলল, এত রাতে!

সুমিত্র চেরির কণ্ঠে গত রাতের কোনো ইশারাকেই খুঁজে পেল না। একেবারে স্বাভাবিক।

মাদাম!

কিছু বলবে?

চেরি দেখল সুমিত্রর চোখ দুটো জ্বলছে। সমস্ত শরীর থেকে কামনার আবেগ গলে গলে পড়ছে। স্থিরভারে তাকাতে পারছে না—যেন অবসন্ন সৈনিক কুয়াশার অন্ধকার থেকে পথ খুঁজে খুঁজে অবিরাম হেঁটে হেঁটে কোনো আশ্রমে উপস্থিত। পানীয় জলের মতো যুবতীর চোখ মুখ শরীর তার তৃষ্ণা দূর করার জন্য যেন অপেক্ষা করছে। সে শুধু বলল, আপনি ফুল ভালোবাসেন মাদাম?

ভালোবাসি সুমিত্র।

পাখি?

পাখি ভালোবাসি।

আমার ফুল, পাখি কিছুই ভালো লাগছে না মাদাম।

কেন, কেন?

কী জানি। এই জাহাজ কেবল উচ্ছৃঙ্খল হতে বলছে।

সুমিত্র! খুব দূর থেকে যেন চেরির গলা ভেসে আসছে। গলা আবেগে কাঁপতে থাকল।

আমাকে কিছু বলবেন মাদাম?

তুমি উচ্ছৃঙ্খল হলে আমার যে কিছু থাকল না। নিজের সতীত্ব প্রমাণে চেরি যেন মরিয়া হয়ে উঠল।

না না। আপনি ভুল বুঝবেন না মাদাম। আমি যত্নের সঙ্গে সব পরিহার করে চলেছি মাদাম। অথবা বলতে পারেন, চলার চেষ্টা করছি।

সুমিত্র, কখনও যদি সময় অথবা সুযোগ পাই আমি ভারতবর্ষে যাবই।

ভয়ানক গরিবের দেশ। রাজপুত্রেরা এখন ফুটপাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে মাদাম।

চেরি নিজেও তার ইচ্ছার কথা যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। এক কৃত্রিম আদর্শ উভয়কে সংকুচিত করে রাখছে। অথবা এও বলা যেতে পারে, চেরির ব্যবহার কেবলই মাতৃসুলভ হয়ে উঠছে। সে সুমিত্রর কপালে হাত রেখে বলল, সারাটা দিন আমার কী যে গেছে!

সুমিত্র আর পারছে না। সুতরাং মাথাটা ইজিচেয়ারের উপর আরাম করার জন্যে স্থাপন করল। যেন ঘুমোচ্ছে সুমিত্র এবং দেখলে মনে হবে মৃত। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসাড়। সে যেন আর দাঁড়াতে পারছে না। সে হেঁটে যেতে পারছে না ফোকসালে—দেখলে এমনই মনে হবে সুমিত্রকে। দীর্ঘ সময় ধরে চেরিও চুপ করে শুয়ে থাকল বাংকে। এখন ওরা উভয়ে পরস্পর আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করার জন্যে প্রথম শহীদ কে হবে, কে প্রথম যৌন বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্যে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবে এমতই কোনো এক প্রতিযোগিতায় মত্ত। চেরি শুয়ে শুয়ে সুমিত্রর অবয়বে সেই রাজপুত্রের প্রতিবিম্ব দর্শনে আর স্থির থাকতে পারল না। সে যিশুর নাম স্মরণ করে ডাকল, এসো সুমিত্র।

চেরি আবার ডাকল, সুমিত্র এসো। নীল আলো জ্বলছে, দেখ।

সুমিত্র জবাব দিচ্ছে না। এমনকি ওর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়ল না। যেমন শিথিল শরীর নিয়ে পড়ে ছিল তেমনি পড়ে থাকল।

সুমিত্র, সুমিত্র। চেরি বাংকে থেকে নেমে সুমিত্রর ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে দেখল, সুমিত্র যথার্থই ঘুমিয়ে পড়েছে। যে আবেগ এবং যৌনেচ্ছা এতক্ষণ ধরে বাজিকরের মতো আবির্ভূত করে রেখেছিল, সুমিত্রর অসহায় মুখ দেখে সেই রঙ জলের মতো নির্মল হল। চেরি সন্তর্পণে কাছে গিয়ে কম্বলে পা শরীর ঢেকে দিয়ে কেবিনের নীল আলোর ছায়ায় ভারতবর্ষের রাজপুত্রের মুখ দেখতে দেখতে রাত ভোর করে দিল। বাইরে আলো ফুটে উঠছে। পোর্টহোলের কাচ খুলে দিতেই বাইরের ঠান্ডা হাওয়া এই কেবিনের সকল ঘটনাকে প্রীতিময় করে তুলছে। চেরি বাংক থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকে পোশাক পালটাল। শেষে কাপ্তান—বয়ের খোঁজে ডেকে বের হয়ে গেল। ডেক—ছাদের নিচে এসে দাঁড়াতেই দেখল দুটো নির্জন দ্বীপের পাশ দিয়ে জাহাজ যাচ্ছে। সবুজ এক প্রান্তর, এই ভোরের মিষ্টি আলো, এবং দিগন্তের ফাঁকে সূর্য উঠছে, শুধু রক্তিম আকাশ, কেবিনে সুমিত্র ঘুমোচ্ছে, চেরির বুক ঠেলে কেমন এক কান্নার চিহ্ন ঠোঁটে মুখে ফুটে উঠল। দূরের দ্বীপ থেকে মাটির গন্ধ ভেসে আসছে, সবুজের গন্ধ এই জাহাজের ফাঁকফোকরে যত অন্ধকার আছে সব নির্মল করে দিচ্ছে। দ্বীপের পাখি সকল জাহাজটাকে দেখে চক্রাকারে উড়তে থাকল। নীল রঙের পাখিরা ডাকল আর আকাশের চারধারে সাদা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এবং তার ফাঁকে ফাঁকে দ্বীপের সকল পাখিরা কোনো এক নিরুদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে। চেরি ভাবল, এই দ্বীপের কোনো গুহায় তার এবং সুমিত্রর জন্য একটু আশ্রয় কি মিলতে পারে না! একটু আশ্রয়ের জন্য মাটির কাছে তার প্রার্থনা, ঈশ্বর আমার কী হবে!

কাপ্তান—বয় এসে ডাকল, মাদাম।

কফি। দু’কাপ।

ধীরে ধীরে জাহাজটা দ্বীপ দুটোকে পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। সূর্যের আলো দ্বীপের সব অপরিচিত গাছের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রে এসে পড়েছে। জনহীন এইসব ছোট ছোট দ্বীপ কতকাল থেকে এমন নিঃসঙ্গ কাটাচ্ছে কে জানে। দ্বীপের ঝোপ জঙ্গলের পাশে সুমিত্র এবং তার জন্য যদি কোনো তপোবন থাকত, যদি একফালি রোদ সেই কুটির—সংলগ্ন উঠোনে এসে পড়ত এবং সারাদিন পর সমুদ্র থেকে ঘরে ফিরে এসে সুমিত্র ওকে জড়িয়ে যদি জীবনের স্বাদ গ্রহণ করত, কত রঙিন স্বপ্ন দেখল চেরি, কত আকাঙ্ক্ষার কথা, বিচিত্র সব শখ সারাদিন ধরে ডেক পাটাতনে ভেবে ভেবে কখনও অন্যমনস্ক, কখনও বেদনায় বাংকে শুয়ে শুয়ে স্মৃতিকে ধরে রাখোর স্পৃহাতে এক নির্দিষ্ট যুবকের পায়ের শব্দ শুনতে চায়।

তখন সুমিত্র চোখ খুলে দেখল এই কেবিন। গভীর ঘুমের আচ্ছন্ন ভাবটুকুর জন্য বুঝতে পারল না কোথায় এবং কীভাবে, সে দেখল এই কেবিন ওর পরিচিত। তারপর একে একে বিগত রাতের ঘটনার কথা স্মরণ করে সে ফের আতঙ্কিত হল। দিনের আলো পোর্টহোল দিয়ে কেবিনে গলে গলে পড়ছে। চেরি ঘরে নেই। সুতরাং মনে নানা অগোছালো চিন্তা জট পাকাচ্ছে। অথবা রাত হলেই তার কী যে হয়। নিজের এই অপরিণামদর্শিতার জন্য সে দুঃখিত হল। তারপর চেয়ার থেকে সন্তর্পণে উঠে ডেকে এসে দেখল, চেরি দূরের দ্বীপসকল দেখছে। চেরি খুব ঝুঁকে আছে রেলিংয়ে। সে তাড়াতাড়ি নিজের কেবিনে ঢুকে বিছানায় হাত—পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল।

কাপ্তান—বয় এসে ডাকল, মাদাম।

এই যে!

আপনার কফি দেওয়া রয়েছে।

দু’কাপের মতো?

হ্যাঁ মাদাম।

চেরি তাড়াতাড়ি কেবিনে ঢুকবে ভাবল, সুমিত্রকে হাতমুখ ধুতে বলবে বাথরুমে। তারপর একসঙ্গে কফি খেতে খেতে দ্বীপের গল্প, ওর দেশ বাড়ি এবং অন্য অনেক সব খবর নিতে হবে—কিন্তু ভিতরে ঢুকেই দেখল, কেবিন ফাঁকা। সুমিত্র নেই। তারপর সে দেখল পোর্টহোলের কাচ খোলা। সে এবার কফির সবটুকু বেসিনে ঢেলে দিল। একটু এগিয়ে গিয়ে কাচ এবং লোহার প্লেট দিয়ে পোর্টহোল বন্ধ করে দিল। যেন সুমিত্রর কোনো প্রতিবিম্ব ভাসবে না এবং লজ্জায় আর অধোবদনও হতে হবে না। নিজের এই দুর্বলতাকে পরিহার করার জন্য সে আজ ভালোভাবে স্নান করল। সুমিত্রকে এড়িয়ে চলার জন্য নানা রকমের পত্রপত্রিকা খুলে বসল বাংকে। মনের বিক্ষিপ্ত ইচ্ছাগুলিকে সংযত করতে গিয়ে বারবার সে হোঁচট খাচ্ছে। কোথায় যেন এক বিশাল পাথরের বোঝা হয়ে ভারতীয় জাহাজিটা মনের উপর চেপে বসে আছে। চেরি আর পারছে না। চেরি নিজেকে রক্ষার জন্য দরজা খুলে তাড়াতাড়ি কাপ্তানের কেবিনে ছুটে গেল। বলল, আপনার এই বারান্দায় একটু বিশ্রাম নিতে চাইছি।

যতক্ষণ খুশি।

একটি ইজিচেয়ারে বসে সমুদ্র দেখতে থাকল চেরি। এখানে সুমিত্র নেই, শুধু সমুদ্র শুধু ঢেউ। কিছু পারপয়েজ মাছ। কিছু ঢেউ মেঘ হয়ে আছে আকাশে। সমুদ্রের ওপাশ দিয়ে একটা জাহাজের মাস্তুলে নিশান উড়তে দেখছে। কাপ্তান নিচে আছেন। তিনি দূরবিন চোখে রেখে জাহাজটাকে দেখলেন। চেরি উঠে দাঁড়ালে কাপ্তান ওর হাতে দূরবিন দিয়ে বললেন, দেখুন দূরে একটা তিমি মাছ দেখতে পাবেন। চেরি কিন্তু দূরবিন চোখে রেখে সুমিত্রর দিকে চেয়ে থাকল। পিছনের রেলিংয়ে সুমিত্র ঝুঁকে আছে—সে বোধহয় প্রপেলারের শব্দ কান পেতে শুনছে। চেরি দূরবিনটা কাপ্তানের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ইজিচেয়ারটা ইচ্ছা করে দূরে সরিয়ে নিল। সুমিত্রকে আর দেখা যাচ্ছে না এবং সে খুশি হওয়ার ভান করে কাপ্তেনকে পরবর্তী বন্দর সম্বন্ধে প্রশ্ন করল, আশা করছি দু’দিন বাদেই আমরা সিডনি পৌঁছাব।

আপনার সমুদ্রযাত্রা ভালো লাগছে না বোধহয়?

চেরি কথা বলল না।

ভালো লাগবে কী করে! যাত্রীজাহাজে যেতে পারলে আপনার এতটা অসুবিধা হত না।

চেরি বলল, কাল বিকেলটা বেশ লাগল।

তা বটে।

আপনাদের কথা আমার মনে থাকবে ক্যাপ্টেন।

আপনার কথাও আমাদের মনে থাকবে। কাল আপনার ভায়লিনের সুর অপূর্ব লাগছিল।

ক্যাপ্টেন, এবার কিন্তু কথাটা একটু খোশামোদের মতো মনে হল।

না মাদাম, আপনি বিশ্বাস করুন। সকলেই আপনার প্রশংসা করছে। সুমিত্র ভারতীয়, সে পর্যন্ত বলল, মাস্টার, এ সফরের কথা আমরা সকলেই মনে রাখতে বাধ্য হব। তারপর সে আপনার কথায় এল।

চেরির বলতে ইচ্ছা হল, আর কিছু বলেছে, আর কিছু? কিন্তু সম্মানিত জীবনের কথা ভেবে সে ওই প্রগাঢ় ইচ্ছাকে জোর করে থামিয়ে দিল।

কাপ্তান চেরির নিকট থেকে উৎসাহ না পেয়ে চার্ট—রুমে ঢুকে গেল এবং নিজের কাজ করতে থাকল।

চেরি ব্রিজে পায়চারি করছে। একবার উইংসের পাশে ঝুঁকে অথবা কখনও কম্পাসটার সামনে এসে (যেখানে কোয়ার্টার—মাস্টার স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে) নিজেকে বারবার আড়াল করার চেষ্টা করল। সুমিত্রকে আর দেখাই যাচ্ছে না। সুমিত্র পিছিলে কোথাও নেই। সে অ্যাকোমোডেশন ল্যাডার ধরে নেমে বোট—ডেক পার হয়ে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সুমিত্র এখন এনজিন—রুমে। সে হাতঘড়িতে সময় দেখে এমত ধারণা করল। এবং কেন জানি অপার বিষণ্ণতা চেরিকে গ্রাস করছে। এবার দু’হাত ছুড়ে চেরির যেন বলবার ইচ্ছা—কে আছ তোমরা এসো, সুমিত্র নামে এক ভারতীয় যুবক আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমাকে রক্ষা করো!

সুতরাং বিকেলে জোর করে নিজেকে কেবিনে আবদ্ধ করে রাখল। সুমিত্র যে ক’বার এনজিন—রুম থেকে উঠেছে নেমেছে, প্রত্যেকবার চেরির দরজা, পোর্টহোল বন্ধ দেখেছে। বিকেলবেলাতে সুমিত্র কাপ্তান—বয়কে প্রশ্ন করল, চাচা, রাজকন্যার দরজা—জানালা যে সব বন্ধ!

কী জানি, মেয়েমানুষের মর্জি বোঝা দায়। আমাকে বলল, ঘুমালে ডেকো না। বারোটার সময় দরজার কড়া নাড়লাম, খাবার দিতে হবে…. কোনো সাড়াশব্দ না। কাপ্তানকে বললাম—তিনি বললেন, বোধহয় ঘুমোচ্ছে, সুতরাং বাটলারকে বলে দাও যেন খাবারটা গরম রাখার ব্যবস্থা রাখে। ও আল্লা, নিচে নামতেই দেখি হৈ—হল্লা বাধিয়ে দিয়েছে।

সুমিত্র বলল, কাপ্তান আচ্ছা রাজকন্যার পাল্লায় পড়েছে!

তা হবে। কিন্তু কাল রাতে তোমার কথাই বারবার বলছিল।

কেন? কেন?

না, থাক। ওসব আমার বলা বারণ আছে, বলে কাপ্তান—বয় টুইন—ডেকে নেমে গেল।

এবং এ সময় সুমিত্র দেখল চেরি সান্ধ্য—পোশাকে টুইন—ডেক অতিক্রম করে এদিকেই আসছে।

সুমিত্র অন্যান্য সকল জাহাজিদের সঙ্গে কথা বলছে—চেরিকে দেখছে না এমত ভাব ওর চোখে—মুখে। চেরি আফট—পার্টে চলে আসছে। সুমিত্রর গলা শুকনো শুকনো ঠেকছে। চেরি আফট—পার্টে উঠে সুমিত্রকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সুমিত্রর দিকে তাকাল না, অথবা কথা বলল না। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে জাহাজ—ডেকে। সুতরাং সকলে সরে দাঁড়াল। চেরি স্টারবোর্ড সাইডের ডেক ধরে এক নম্বর, দু’ নম্বর ফল্কা পার হয়ে ফের অদৃশ্য হয়ে গেল।

সুমিত্র পাশের জাহাজিকে বলল, চেরিকে খুব শুকনো লাগছে, না চাচা?

জাহাজে চড়লে প্রথম সকলেরই একটু শরীর খারাপ হয়। সুখী ঘরের মেয়ে। তা, একটু শুকনো লাগবে।

সুমিত্র এইসব কথা শুনল না। সে পিছিল থেকে নড়ছে না। সে চেরিকে ফরোয়ার্ড—ডেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল। চেরির মুখ শুকনো, সেই হেতু একটা কষ্ট—কষ্ট ভাব সুমিত্রর মনে। চেরি চুপচাপ চলে যাচ্ছে—গেল। সুমিত্র স্থাণুবৎ। এই প্রথম একজন পরিচিত যুবতীর জন্য মনে মনে দুঃখ বোধ করছে এবং যতবার অস্বীকারের ইচ্ছায় দৃঢ় হয়েছে ততবার এক দুর্নিবার মোহ সুমিত্রকে উত্তেজিত করে একসময় নিদারুণ প্রেমে ঘনিষ্ঠ করতে চেয়েছে।

সুমিত্র অনেকক্ষণ স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থেকে সহসা দেখল ডেক এবং অন্যত্র সকল স্থান আলো আলোময় করে জাহাজ গতিশীল। সে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে ডেক ধরে নেমে গেল। সে হাঁটতে থাকল উদ্দেশ্যহীনভাবে। অথচ একসময় সে নিজেকে দেখল চেরির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চেরির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মনে হচ্ছে ভিতরে কোনো আলো জ্বলছে না। চেরি অন্ধকারে শুয়ে আছে চুপচাপ। সে ধীরে ধীরে কড়া নাড়ল।

ক্লান্ত গলায় ভিতর থেকে প্রশ্ন করল চেরি, কে?

আমি, সুমিত্র।

সুমিত্র ভিতরের শব্দে বুঝল চেরি খুব দ্রুত কাজসকল সম্পন্ন করছে। আলো জ্বালাচ্ছে, প্রসাধন করছে। সবকিছুতেই ত্রস্তভাব। সুমিত্র এ—সময় এতটুকু ভীত হল না।

চেরি দরজা খুলল। চোখে ভয়ানক ক্লান্তি, তবু সুমিত্রর হাত ধরে এনে ভিতরে বসাল।

আপনাকে আজ খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে। কাল রাতে বুঝি এতটুকু ঘুমোননি?

সুমিত্র, আমি তোমাকে মিথ্যা বলব না। কাল আমি ঘুমোতে পারিনি।

আমি দেখছি মেজ—মালোমের কাছে ওষুধ পাওয়া যায় কী না।

না সুমিত্র, তুমি বোস। ঘুমোতে পারছি না বলে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

কিন্তু আপনার চোখের কোল যে ফুলে উঠেছে!

সব সেরে যাবে। তুমি বোস। একটু কফি খাও। চেরি দরজায় গলা বের করে কাপ্তান—বয়কে ডাকল।

কফি খেতে খেতে চেরি প্রশ্ন করল, তোমার কে কে আছে সুমিত্র?

কেউ নেই।

কেউ নেই?

না।

মা?

না।

বাবা?

না।

আত্মীয়স্বজন?

সুমিত্র এবারেও ঠোঁট ওলটাল।

কী করে এমন হল?

সব দাঙ্গাতে মারা গেছে। আমার বাড়ি পূর্ববঙ্গে ছিল।

ঈশ্বর! চেরি আর কিছু প্রকাশ করতে পারল না। অনেকক্ষণ নির্জনে বসে থাকার মতো চুপচাপ বসে থাকল। দীর্ঘ সময় ওরা হতবাক হয়ে থাকল।

সুমিত্রই কথা বলল, আমি না ডাকতেই এসেছি বলে রাগ করেননি তো?

সুমিত্র, আমি খুব খুশি হয়েছি খুব।

আপনার শুকনো মুখ দেখে আমার আজ কেন জানি বারবারই মনে হল, এই জাহাজে আপনি আমার মতোই একা। আমার মতো আপনারও কেউ নেই। এবং সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত ধরনের কষ্টে পীড়িত হতে থাকলাম। শেষে বিশ্বাস করুন, কে যেন জোর করে আপনার দরজায় আমাকে এনে হাজির করল।

এইসব কথায় চেরি আবেগে প্রগাঢ় হল। সমস্ত শরীরে এক অদৃশ্য কম্পন। সে তার সকল দৃঢ়তা, সকল প্রত্যয়, সকল সম্মানিত জীবনের আলো গান পরিত্যাগ করে সুমিত্রর দু’হাত চেপে ধরল। কিন্তু আবেগের প্রগাঢ়তায় কিছুই প্রকাশ করতে পারল না। বলতে পারল না, মাই প্রিন্স! আমার আশৈশবের রাজপুত্র! সে মাথা নত করে সুমিত্রর মুখোমুখি বসে থাকল। মনে কোনো আলো জাগল না। নিমজ্জমান তরীর মতো জীবনের এক প্রবল মাধ্যাকর্ষণে ক্রমশ গভীর সমুদ্রে ওরা মিলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে। এবং একসময় সুমিত্র যখন চোখ তুলল চেরিকে দেখবার জন্যে, তখন চেরি অবাক হতে হতে দেখল, সেই চোখ, সেই বিষণ্ণ চঞ্চল চোখ কাচের জানালায় প্রতিবিম্ব হয়ে ভাসছে। কত ইচ্ছাই না চেরিকে এ সময় বিব্রত করেছে, কিন্তু কোনো ইচ্ছার সফলতাকেই অমৃতময় বলে মনে হল না, সুতরাং চেরি সুমিত্রর প্রিয়মুখ দর্শনে শুধু বিহ্বল হতে থাকল।

রাত্রির বিষণ্ণ আলোতে চেরিকে সুখী করার জন্যে সুমিত্র বলল, তোমাকে যদি রাজা—রানির গল্প বলি, তুমি খুশি হবে?

চেরি শুধু চেয়ে থাকল ফ্যাল ফ্যাল করে।

পরদিন ভোরে সুমিত্র টুপাতির কেবিনে ঢুকে বলল, তোমার সময় হবে?

চেরি বলল, আমার হবে, তোমার হবে কী না বল?

আমার আজ থেকে কোনো ওয়াচ থাকবে না।

কেন?

কাপ্তান সারেংকে বলে পাঠিয়েছে, আজ এবং কালকের জন্যে অন্য কাউকে দিয়ে ওয়াচ চালিয়ে দিতে। সুমিত্র আজ বেশ আরাম করে দুটো পা বাংকের উপর তুলে দিয়ে বসল, তারপর ঠাকুমার মুখে শোনা চম্পা এবং আর দুই সখীর গল্প করে চেরিকে আনন্দ দিল। গল্পটা বলতে বেশি সময় নিল না সুমিত্র। বারোটার পর সাহেবদের লাঞ্চ। চেরি খাবে তখন। সুমিত্র এগারোটা বাজতেই উঠে গেল।

বিকেলে বোট—ডেকে গল্প করতে এসে সুমিত্র দেখল চেরি বসে বসে সমুদ্র দেখছে। সে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর কী ভেবে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই ব্রিজে কাপ্তানের গলা পেল।

সুমিত্র, গুড আফটারনুন।

গুড আফটারনুন, মাস্টার।

কাল আমরা বন্দর পাব।

কখন স্যার?

সন্ধ্যায়।

চেরি এখনও চোখ তুলছে না, অথবা ওদের দেখছে না।

কাপ্তান বলল, বেশ সমুদ্রযাত্রা আমাদের। কোনো ঝড় নেই, সমুদ্র একেবারে শান্ত।

মাস্টার, আকাশ খুব পরিষ্কার।

সারা রাতই ডেকে জ্যোৎস্না। মাদাম কী বলেন? চেরিকে উদ্দেশ্য করে কাপ্তান ব্রিজ থেকে কথা বলতে চাইল।

চেরি মুখ না তুলে এক ধরনের সম্মতিসূচক শব্দ করল।

সুমিত্র চলে যাচ্ছিল, চেরি ডেকে বলল, সুমিত্র, কাল আমরা বন্দর পাব।

আশা করছি।

বন্দরে আমার এক আত্মীয়া এবং এক বন্ধু আসবেন রিসিভ করতে, তুমি তাদের সঙ্গে পরিচয় করবে না?

নিশ্চয় করব। কী রকম আত্মীয় হন তাঁরা?

একজন পিসিমা। অন্যজন পিসেমশায়ের দাদার ছেলে। একটা মোটর কোম্পানির পরিচালক।

এইসব কথার ভিতর কেবলই তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। বলো তো আর একটা গল্প শোনাই। খুব আনন্দ পাবে।

না, আর রূপকথা নয়। এবার জীবনের কথা বল। আমি জাহাজ থেকে নেমে গেলে তোমার কষ্ট হবে না?

হবে, খুব কষ্ট হবে।

তোমাকে অযথা মন্দ কথা বলেছি।

এ—কথা এখন আর ভালো শোনাচ্ছে না।

হয়তো আর দেখাই হবে না কোনোদিন। অথচ…

দেখা হবে না কেন? জাহাজে যখন কাজ করছি, তখন নিশ্চয়ই দেখা হবে।

সুমিত্র, তুমি তো জিজ্ঞাসা করলে না তোমার জন্য আমার কষ্ট হবে কি না?

তোমারও হবে। সুমিত্র পাশেই বসে পড়ল। বলল, বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।

এই কথা শুনে চেরি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিল। অথচ সুমিত্রকে দেখে মনে হল না, সে চেরির বিদায়বেলাতে কোনো দুঃখবোধে পীড়িত হবে। চেরি বলল, আমার কেবিনে এসো। বলে, সে হাঁটতে থাকল।

একটু বসো না, এই সমুদ্র তোমার ভালো লাগছে না?

এখনই সন্ধ্যা হবে। চল, কেবিনে নীল আলো জ্বেলে তোমার গল্প শুনব।

একটা অনুরোধ করলে রাখবে?

বলো। যা বলবে আমি সব করব।

আমাকে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাবে?

শোনাব। কেবিনে চলো।

কেবিনে নয় চেরি। এই বোট—ডেকে। খোলা আকাশের নিচে বসে।

তাই হবে।

এখন রাত নামছে সমুদ্রে। ফরোয়ার্ড পিকে পাহারা দিতে দুজন জাহাজি চলে গেল। ব্রিজে পায়চারি করছেন মেজ—মালোম। ওরা লাইফ—বোটের আড়ালে বসে আকাশ দেখল, নক্ষত্র দেখল। পরস্পর গল্প করতে করতে একসময় ঘনিষ্ঠ হল এবং পরস্পর হাতে হাত রেখে সমুদ্রের গর্জন শুনল যেন যথার্থই কোনো রাজপুত্র কোটালপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে… ছুটছে। চেরি এ সময় গর্ভিণী তিমির মতো উদগ্র আবেগে ছটফট করতে লাগল।

চেরি ভায়োলিন বাজাতে বাজাতে বলল, কেমন লাগছে সুমিত্র?

শীতের নদীতে কাশফুলের রেণু উড়ছে। প্রজাপতি উড়ছে যেন এবং শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে নতুন বউ। কলের গান বাজছে নৌকার পাটাতনে। দুটো ফুটফুটে ছেলেমেয়ে সাদা ফ্রক গায়ে তখন চরের কাশবনে প্রজাপতি খুঁজে বেড়াচ্ছে—টুপাতি চেরির বেহালার বাজনা সুমিত্রর মনে সে রাতে এমন একটা ভাব সৃষ্টি করেছিল।

তারপর অধিক রাতে যখন পরস্পর বিদায় জানিয়েছিল কেবিনে, চেরি সুমিত্রর চোখ দুটোতে চুমু খেল, যে চোখ দুটো দীর্ঘকাল ধরে চেরিকে অনুসরণ করে ফিরছে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জাহাজিরা কিনারা দেখার চেষ্টা করল। আকাশের কিনারায় কোনো দ্বীপ অথবা মাটির রেখা ভেসে উঠছে কি না দেখল। ওরা খবর পেয়েছে, জাহাজ বিকালে নোঙর ফেলবে। এবং রাতে পাইলট—জাহাজ এসে বন্দরে জাহাজ টেনে নেবে। সুতরাং জাহাজিরা মন দিয়ে কাজ করল, ডেকে ফল্কায়, অথবা ড্যারিকে। ফানেলে কেউ রঙ করল। চেরি একবার ডেকে বের হয়ে সকল কিছু দেখে কেবিনে ঢুকে গেছে। এবং সুমিত্র এই ভোরেও বাংকে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কাপ্তান—বয় এল এসময়। ফোকসালে ঢুকে ডাকতে থাকল সুমিত্রকে।

সুমিত্র একটা বড় রকমের হাই তুলে বলল, তারপর চাচা, নতুন কিছু খবর আছে?

কাপ্তান যে আবার ডেকে পাঠিয়েছেন।

সুমিত্র ব্রিজে গেলে কাপ্তান বললেন, বিকালে পাইলট ধরবে জাহাজ। সুতরাং তখন থেকে তুমি আর চেরির কেবিনে যাবে না। পাইলট—জাহাজে ওর আত্মীয়স্বজন আসার কথা আছে।

কিন্তু স্যার…।

আমি সব বুঝি সুমিত্র। মনে রেখো, তুমি জাহাজি। কত বন্দরে কত ঘটনা থাকবে। তোমাকে যে একটু দৃঢ় হতে হবে।

সুমিত্র ব্রিজের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল—আকাশ তেমনি পরিষ্কার। জাহাজিরা সকলেই বন্দরের জন্য উদগ্রীব। যত বন্দরের দিকে এগোচ্ছে জাহাজ, তত জাহাজিরা উৎফুল্ল হচ্ছে, সুমিত্রর মনে একটা দুঃসহ কালো মেঘের অন্ধকার নেমে আসতে থাকল। সে ধীরে ধীরে ব্রিজ থেকে নেমে এল। চেরির কেবিন অতিক্রম করার সময় ইচ্ছা করেই আজ আর পোর্টহোলে চোখ তুলে কাউকে খুঁজল না। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ক্লান্ত বোধ করল। ফোকসালে ঢুকে নিজের বাংকে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।

বুড়ো কাপ্তান—বয় এসে সুমিত্রর পাশে বসল।

কিছু খবর আছে চাচা?

না। আমি বুঝি কেবল তোমার দুঃসংবাদই বয়ে আনছি?

তেমন কথা কি আমি বলেছি?

কী জানি বাপু, কেবল খবর আর খবর!

চেরি কী করছে চাচা?

সারাদিন বাইবেল পড়ছে।

আমার কথা কিছু বলছিল?

না।

সুমিত্র পাশ ফিরে শুলো। কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছা নেই। কেবল পড়ে পড়ে ঘুমোতে ইচ্ছা হচ্ছে। বন্দরে জাহাজ নোঙর করলে কোনো পাব—এ ঢুকে মদ খাওয়ার শখ হচ্ছে।

বিকেলে সুমিত্র উপরে উঠে গেল। অ্যাফটার—পিকে ভর করে দাঁড়াল। দূর সমুদ্রে পাইলট—জাহাজটা যেন উড়ে চলে আসছে। এ—সময় চেরিকে দেখার প্রত্যাশা করল সুমিত্র। চেরি ওর আত্মীয়ের জন্য গাঙওয়েতে অপেক্ষা করবে। অথচ চেরি নেই। চেরি এখনও কেবিনে পড়ে আছে। সুমিত্র দেখল পাইলট—জাহাজ থেকে ওর আত্মীয়া—পিসি এবং সেই যুবক উঠে আসছে। হাতে বড় বড় দুটো গোলাপের কুঁড়ি। পাইলট সকলের শেষে উঠে এল। কাপ্তান ওদের সকলকে সঙ্গে করে অ্যালওয়েতে ঢুকে গেলেন। সুমিত্র এইসব দেখে কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।

সুমিত্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপ্তান—বয় এবং মেসরুম মেটের সব কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। পাশাপাশি অন্যান্য জাহাজিরাও এসে ভিড় করেছে। জাহাজিরা সুমিত্রকে কোনো প্রশ্ন করছে না। এইসব ঘটনা ওদের সকলকেই অল্পবিস্তর দুঃখ দিচ্ছে। তখন ওরা সকলেই দেখল চেরি এবং ওরা দুজন, কাপ্তান, বড় মিস্ত্রি, পাইলট—ডেক ধরে হাঁটছে। সুমিত্র তাড়াতাড়ি জাহাজিদের ভিতর নিজেকে আড়াল করে ফেলল। সে চেরিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, চেরি সমুদ্রযাত্রায় যেন ভয়ানক দুর্বল। এখন ওরা পরস্পর বিদায়—সম্ভাষণ জানাচ্ছে। ওরা নেমে গেল। সুমিত্র চেরিকে দেখতে পাচ্ছে না এখন। সে ফের নিচে নেমে বাংকে শুয়ে পড়ল।

চেরি চোখ তুলে এই জাহাজের ডেকে কিছু অন্বেষণ করতে গিয়ে গলায় এক দুঃসহ আবেগের কান্না অনুভব করল—কোথাও কোনো অমৃতের চিহ্ন নেই। চোখ দুটো সজল হতে হতে এক রুদ্ধ আবেগে চেরি ভেঙে পড়ল। এই ঘটনায় প্রিয়জনেরা উদ্বিগ্ন; ভাবল, শারীরিক কুশলে নেই চেরি; ভাবল, দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর প্রিয়জন দর্শনে কোনো পরিচিত আবেগের জন্ম হচ্ছে শরীরে। কাপ্তান নিজেও এই বিচ্ছেদটুকু লালন করতে পারলেন না। তিনি ইচ্ছা করে পাইলটের সঙ্গে জাহাজ—সংক্রান্ত কথাবার্তা আরম্ভ করলেন। কাপ্তান—বয় যখন বখশিশ নিয়ে উঠে আসছিল, চেরি সন্তর্পণে তাকে কাছে ডাকল। একটি চিরকুট দিল, গোলাপের কুঁড়ি দুটো দিল, অথচ কোনো নির্দেশ দিল না, তারপর চেরি পাইলট—জাহাজের পাটাতনে নেমে ইজিচেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে মুহ্যমান। কিছুই এখন সে দেখতে পাচ্ছে না যে, যেন এক রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ছুটে ছুটে সমুদ্র অতিক্রম করছে এবং হিমালয়ের পাদদেশে গিয়ে আর পথ খুঁজে পাচ্ছে না, তাই ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দিয়ে চেরির দিকে অনিমেষ নয়নে চেয়ে আছে।

কাপ্তান—বয় ফোকসালে ঢুকে বলল, এই নাও তোমার বকশিশ। বলে, গোলাপের কুঁড়ি দুটো এবং চিরকুটটি পাশে রাখল।

সুমিত্র বলল, পাইলট—জাহাজটা কত দূরে গেছে?

অনেক দূর।

সুমিত্র এবার চিরকুটটি পড়ল।

যখন আমি বুড়ো হব সুমিত্র, যখন নাতি—নাতনিদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে রূপকথার গল্প করব, তখন বলব ভারতবর্ষের এই রূপকথার রাজপুত্র সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে কাকাতিয়া দ্বীপের রাজকন্যাকে খুঁজতে বের হয়েছিল। বলব, ঘোড়ায় চড়ে নয়, রথে চড়ে নয়, জাহাজে চড়ে। বলব, কাকাতিয়া দ্বীপের রাজকন্যাকে খুঁজে বের করেছিল, ভালোবেসেছিল, সোনার কাঠি রুপোর কাঠি নিয়ে হাত বদলেছিল, কিন্তু রুপোর কাঠি ইচ্ছা করেই শিয়রে রাখার চেষ্টা করেনি।

শেষে তার কোনো এক প্রিয় কবির দুটো লাইন লিখেছে,

–Better by far you should forget and smile

Than that you should remember and be sad.

সুমিত্র উপরে উঠে রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়াল। দূরে পাইলট—শিপ অস্পষ্ট। ক্রমশ তীরের দিকে চলে যাচ্ছে। মনে মনে সেই লাইন দুটো আবৃত্তি করতে গিয়ে বুঝল, পৃথিবী অমৃতময়। চেরি অমৃতময়। দুঃখ এবং বেদনার কিছুই নেই। পিছনে এ সময় কার হাতের স্পর্শে সে ঘুরে দেখল কাপ্তান ওর পিঠে হাত রেখেছেন, বলছেন, আমার কেবিনে এসো সুমিত্র। আজ আমি তোমাকে খ্রিস্টের গল্প শোনাব।

চার

অবনীভূষণ বিজন এবং সুমিত্রর দীর্ঘদিন জাহাজে কেটে গেছে। অবনীভূষণ এখন প্রৌঢ়। বিজন সুমিত্র উত্তরত্রিশের যুবক। ওরা সফরে ক্রমশ এক প্রাচীন নাবিকের গন্ধ মেখে বন্দর থেকে বন্দরে, এক সমুদ্র থেকে অন্য সমুদ্রে এবং এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে ঘুরছে। তারপর একই জাহাজে ওরা তিনজন একদা দূর সমুদ্রযাত্রায় বের হয়েছিল। সে রাতও তুষারঝড়ের রাত ছিল। সে ঘটনার সাক্ষী অবনীভূষণ ছিল, বিজন ছিল এবং সুমিত্র ছিল। শুধু এ ঘটনা অথবা কাহিনী একা এক অবনীভূষণের থাকছে না, বিজনেরও থাকছে না, এমনকি সুমিত্রেরও নয়। এ ঘটনা অথবা কাহিনী ওদের সকলের এবং সকল মানুষের।

ফোকসালে সকলেই প্রায় ঘুমোচ্ছিল। কারণ দীর্ঘ সমুদ্রাযাত্রার পর এই বন্দরের আলো—ঘর—বাতি সবই কেমন মুহ্যমান এবং তুষারঝড় হচ্ছে। সুতরাং জাহাজিরা বন্দর দেখে খুশি হতে পারল না। ওরা ডেকে পায়চারি করতে করতে বন্দরের গল্প করল না। ওরা শীতে অবসন্ন, ওরা কম্বল মুড়ি দিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকল।

বিজন গ্যাঙওয়ের পথ ধরে ফিরছিল। গ্যাঙওয়েতে তুষারঝড়টা মুখোমুখি লাগছে। সুতরাং সে হাঁটতে হাঁটতে চিফ কুকের গ্যালিতে চলে এল। হাত পা সেঁকল এবং চা করে আবার সেই শীতের রাজ্যে ঢুকে জাহাজটা পাহারা দেবার সময় দেখল, দূরে কোথাও কোনো আলোর রেখা ফুটে উঠছে না। তুষার—ঝড়ের জন্যে সব কেমন অন্ধকারময়। বসে বসে সে ঝড়ের শব্দ শুনল, সমুদ্র দূরে গর্জন করছে। জাহাজটা নড়ছিল। যেন জাহাজটা হাসিল ছিঁড়ে এবার ছুটবে অথবা জাহাজের শরীরে এক রকমের শব্দ, যা বিজনকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। মাস্টের আলোগুলি দুলছিল—সে দেখতে পেল। বন্দরের আলোগুলি অস্পষ্ট, বরফের কুচি ওদের অস্পষ্ট করে রেখেছে। সে হাতের দস্তানাটা এবার আরও টেনে দিল।

নিচেও কোনো লোক চলাচল করছে না। ক্রেনগুলো দৈত্যের মতো এই জেটির সকলকে তুষারঝড়ের ভিতর পাহারা দিচ্ছে। উইংসের আলো জ্বলছে না। শুধু জাহাজটা নড়ছিল। এতদিনের এই সমুদ্রযাত্রা এবং প্রপেলারের শব্দ, এনজিন রুমের শব্দ তারপর সমুদ্রের ঢেউ—সবই কেমন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সবই কেমন রাতদুপুরে মাঠের নির্জনতায় ডুবে যাওয়ার মতো। সে এবার ধীরে ধীরে উঠল। বসে থাকলেই শীত বেশি করছে। সে পায়চারি করতে লাগল। এবং ডেক পার হলে গ্যালি, পরে সব জাহাজিদের ফোকসাল। বিজন এত দূর পর্যন্ত হেঁটে গেল না। সে পোর্টহোলের কাচের ভিতর দিয়ে বড় মিস্ত্রির কেবিন দেখল। ওর ঘরে নীল লাল মিশ্রিত এক ধরনের আলো। বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণ এত রাতেও একটা বই পড়ছেন। অশ্লীল সব বই এবং নগ্ন সব ছবি দেয়ালে দেয়ালে। বড় মিস্ত্রি জাহাজ নোঙর করলে ঘন ঘন রেলিংয়ে ভর করে দূরে কিছু যেন প্রত্যক্ষ করছিলেন। প্রত্যাশা যেন কিছুর। অন্ধকার জেটিতে কিছু আবিষ্কারের জন্য পাগল। বিজন বলেছিল, স্যার, বন্দরে কেউ নেই। খালি।

কেউ নেই! কথাটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

যথার্থই কেউ নেই স্যার।

অবনীভূষণ চোখের চশমা খুলে রুমালে মুছতে মুছতে কথাটা অবিশ্বাস করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ডেসির আসার কথা অথচ ডেসি এল না। তিনি বিড় বিড় করে তুষারঝড়কে ধিক্কার দিচ্ছিলেন। ডেসি এলে এই জাহাজ মনোরম… বড় কামুক গন্ধ এই জাহাজের অলিগলিতে, নোনা জলের ঘন রঙ অথবা সমস্ত বিষাদ সমুদ্রের—ডেসি একা সামলাত। ডেসি এলে ওর ঘরে রাত যাপনের প্রশ্ন উঠত। অন্যান্য সফরের মতো বন্দরের দিনগুলো উপভোগের সুখ পেত। বড়ই দুঃসময়, এমনকি বেশ্যামেয়েরা পর্যন্ত ঘর থেকে বের হচ্ছে না, কী অনাবশ্যক দিন—শুধু তুষারঝড়, বরফের কুচি উড়ছে আর রাত বলে, আলো কম বলে সমস্ত শহরটা অদ্ভুত রহস্যময় ঠেকছে। দূরে ইতস্তত কোনো কুকুরের চিৎকার, গির্জাতে ঘণ্টা বাজছে এবং অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি যাচ্ছে, জেটিতে একটা মাতাল পুরুষকে পর্যন্ত দেখা গেল না। কী অবিশ্বাস্যভাবে নসিব বদলা নিতে শুরু করেছে। ডেসির জন্য এই প্রচণ্ড শীতকে উপেক্ষা করে বড় মিস্ত্রি রেলিংয়ে ভর করে প্রতীক্ষা করছিলেন। উত্তেজনায় শরীর অধীর হচ্ছিল। কারণ উত্তর অঞ্চলের অন্য বন্দরে ডেসির চিঠি ছিল। চিঠিতে লেখা ছিল—চিফ, জাহাজ তোমার ভিড়বে রাতে। যত প্রতিকূল অবস্থাই হোক না, আমি উপস্থিত থাকব জেটিতে। তোমাকে নিয়ে ঘরে ফিরব। চিঠিতে সে ওর বেড়ালের জন্য বড় মিস্ত্রিকে কড মাছের চর্বি আনতে লিখেছিল।

বড় মিস্ত্রি অশ্লীল পুস্তকের ভিতর থেকে ডেসির তলপেটের গন্ধ নিচ্ছিলেন যেন। এবং এ সময়ে পোর্টহোলে প্রতিবিম্ব পড়তেই তিনি প্রশ্ন করলেন, কে?

আমি স্যার, সুখানী। বিজন বলল।

অবনীভূষণ শান্ত গলায় বললেন, সুখানী, আমাকে একটু চা খাওয়াবে ভাই। রাত অনেক হল। ঘুম আসছে না। আর এই রাতে বয়দের জ্বালাতন করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

বিজন ফের চিফ কুকের গ্যালিতে ঢুকে গেল। চা করল, তারপর চিফ এনজিনিয়ারের দরজাতে দাঁড়িয়ে ডাকল, আপনার চা এনেছি স্যার। দরজা খুলুন।

বড় মিস্ত্রি ভিতর থেকে বললেন, দরজা খোলাই আছে, ভিতরে এসো।

বিজন দরজার ভিতর ঢুকে দেখল, নীল কাচের গেলাসে এখনও লিকার পড়ে আছে। সে টিপয়তে চা রাখল। তারপর বের হতেই শুনল, তিনি ডাকছেন, সুখানী। সুখানী কাছে গেলে বললেন, কোথাও কেউ নেই?

না স্যার।

কোনো ঘরে কেউ আসেনি?

না স্যার।

যথার্থ কথা বলছ?

হ্যাঁ, স্যার। কোনো কেবিনে কেউ আসে নি।

কাপ্তানের ঘর?

ঘর ফাঁকা স্যার।

ঠিক আছে, যাও। বড় সাব অবনীভূষণ কেবিনের সোফায় বসে চা খেলেন। রাত এখন কত? কাচের ঘরে ঘড়ির কাঁটা নড়তে দেখলেন। রাত বারোটা বেজে গেছে। সমুদ্রে এবার একনাগাড়ে কত দিন? দশ মাসের উপর হবে। হোম থেকে কবে বের হয়েছেন—কত কাল আগের যেন সেইসব দিন, সেইসব বন্দর এবং স্ত্রীর কালো দুটো চোখ এখন পোর্টহোলের কাচে দৃশ্যমান। শরীরে তার যৌবন নিঃশেষ অথচ প্রেমটুকু আলোক—উজ্জ্বল দিনের মতো। সবই তিনি স্মরণ করতে পারছেন অথচ ডেসি এল না—ডেক ছাদে কার পায়ের শব্দ। তিনি এবার কম্বল টেনে শুয়ে পড়লেন। কারণ বাইরে তখনও তুষারঝড় হচ্ছে।

বিজন তুষারঝড়ের জন্য চিফ স্টুয়ার্ডের কেবিন এবং অ্যালওয়ের ফাঁকটাতে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকল। এই ফাঁকটুকু থেকে গ্যাঙওয়ে স্পষ্ট। ওর শরীরে এখন ঠান্ডা হাওয়া লাগছে না। জাহাজ কতদিন পর বন্দর পেল অথচ দুর্যোগের জন্য জাহাজিরা কিনারায় নামতে পারছে না। কাল সকালে এবং অপরাহ্ণ বেলায় যখন জাহাজিরা একে একে জাহাজ খালি করে বন্দরে মানুষজন গাছপালা মাটির টানে নেমে যাবে, তখন ওরা কিংস পার্কে অথবা সান্তাক্লজের চূড়ায় উঠে শহর দেখবে তখন… তখন বিজনের বড় ইচ্ছা এই ঠান্ডায় কোনো যুবতীর উত্তাপ, কাপ্তানের ইচ্ছা কিছু উত্তাপ…. তখন বিজন পাশের কেবিনে বড় পরিচিত শব্দ শুনল। শব্দটা মধুর। শব্দটা ভীষণ উত্তেজনাময়—সে স্থির থাকতে পারছে না। সে ধীরে ধীরে দরজায় কান পেতে শুনতে চাইল—কিছুই শোনা যাচ্ছে না, অস্পষ্ট। সে এ সময় অধীর যুবকের মতো দেয়ালে হাত রাখল।

বিজন এই ফাঁকটুকুতে দাঁড়িয়ে শান্তি পাচ্ছে না। পোর্টহোলের কাচে মুখ রাখা যাচ্ছে না। পোর্টহোলের কাচে কিছুই দেখা যাচ্ছে না—সে এই কেবিনের একটা রন্ধ্রপথ খোঁজার জন্য খুব সন্তর্পণে দেয়াল হাতড়ে বেড়াতে লাগল। দরজার পাল্লা ধীরে ধীরে একটু ফাঁক করতে গিয়ে বুঝল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ভিতরে এবং বাইরে আলো বলে বিজন বুঝতে পারছে না, বিজন এবার বাইরের আলো নিভিয়ে এক ঘন অন্ধকার সৃষ্টি করতেই দেখল পোর্টহোলের উপরে যেখানে স্টিম পাইপ আছে তার পাশে গোলাকার ছিদ্রপথ। সে তাড়াতাড়ি টুলটা গ্যাঙওয়ে থেকে নিয়ে মই বেয়ে ওঠার মতো উঠল। মুখটা কিঞ্চিৎ ঢুকিয়ে দেখল ওরা দুজনই পাশাপাশি শুয়ে আছে। ওরা উভয়ে রাতের প্রথম প্রহরে বোধহয় যৌনক্রিয়ায়û মুখর ছিল। এখন শান্ত। এখন ঘর এবং ঘরণীর মতো ওদের মুখচ্ছবি। কোনো অপরাধবোধের চিহ্ন নেই মুখে। যেন কত দীর্ঘ দিনের আলাপ, যেন কত দীর্ঘদিনের প্রেম এবং সহিষ্ণুতা উভয়কে গভীর শান্তিতে আচ্ছন্ন রেখেছে। বিজন, কম্বলের নিচে ওদের নগ্ন এমন এক ছবির কথা চিন্তা করে টুল থেকে নেমে পড়ল। ওর ওয়াচ শেষ হবে এখন। সুতরাং এই নগ্নতা দর্শনে তৃপ্তি নেই, এতে শুধু উত্তেজনা বাড়ে। মেয়েটির রুক্ষ চুলে সুমিত্রর মোটা শক্ত হাত। অন্য হাতটি কম্বলের নিচে নড়ছিল… কম্বলের নিচে মেয়েটির তলপেটের কাছাকাছি কোথাও ইঁদুরের মতো ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে অথবা যেন শরীরের সকল কুশল চিন্তার কথা ভুলে সারারাত যৌনসংযোগে মগ্ন থাকলে সকলই সুখের আকর…. বিজন আর ভাবতে পারল না, সে তাড়াতাড়ি টুলটা হাতে নিয়ে কেবিনের পাশ থেকে সরে গিয়ে কিঞ্চিৎ ছুট দিল। সে ছুটতে ছুটতে বড় মিস্ত্রির কেবিনের পাশে এসে দাঁড়াল এবং বলতে চাইল, স্যার আমি… আমি যথার্থ কথা বলিনি।

এখন বড় মিস্ত্রি দরজা খুললে বলতে হবে স্টুয়ার্ডের ঘরে চটুল রমণী স্টুয়ার্ডকে পতিব্রতা ভার্যার প্রেম এবং সুখ বিতরণ করছে। সুতরাং কাল ভোরে আপনার দরজার পাশ দিয়ে একজন চটুল রমণী উঁচু জুতো পরে এবং নিতম্বে রস সঞ্চার করতে করতে জেটিতে নেমে যাবে তারপর আমি অভিযোগের করুণ বিষোদগারে জর্জরিত হব, সে ঠিক নয় স্যার। সুতরাং সকল ঘটনার কথা খুলে বলাই ভালো।

সে ডাকল, সাব।

কে বাইরে? কম্বলের ভিতর থেকেই বড় মিস্ত্রি চোখ পিট পিট করে তাকাতে থাকলেন।

আমি স্যার, সুখানী।

ঘরে এসো। শরীরটা বড় খারাপ বোধ হচ্ছে।

বিজন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল এবং বলল স্যার, আমি যথার্থ কথা বলিনি।

যথার্থ কথা বলিনি! তবে আস্তে বলো। দরজাটা ভেজিয়ে দাও। বড় ঠান্ডা হাওয়া আসছে। বাইরের তুষারঝড়টা মনট্রিলের দিকে যাচ্ছে না তো, অথবা ভ্যানকুবার থেকে জাহাজ আসার কথা ছিল—ওরা কিছু মেয়ে আমদানি করতে পারে হয়তো।

না স্যার। সেসব কথা আমি বলছি না। আমাদের জাহাজে এই ঝড়ের মধ্যেও একজন মেয়ে উঠে গেছে। মেয়েটা চিফস্টুয়ার্ডের কেবিনে আছে।

এমত কথায় বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণের চোখ গোল হয়ে উঠল। ওঁর বাসি দাড়িগুলি লম্বা হয়ে গেল যেন। তিনি বললেন, এই ঝড়ের রাতে!

আজ্ঞে স্যার।

ভালো কথা নয়।

নয় স্যার।

তুমি দেখলে?

আজ্ঞে দেখলাম স্যার। টুলের উপরে উঠে উঁকি দিয়ে দেখতে হল ঘুলঘুলিতে।

ওরা কী করছে। অবনীভূষণ ঢোক গেলার মতো মুখ করে থাকলেন।

বিজনকে কিঞ্চিৎ লজ্জিত দেখাচ্ছে। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই স্যার।

তুমি তো খুব স্বার্থপর লোক হে। আমি একটু দেখতে যাব ভাবছি আর তুমি কিনা বলছ আমাকে একা ফেলে চলে যাবে!

আমার ওয়াচ শেষ হতে দেরি নেই স্যার।

আরে চলো। বলে তিনি কম্বল ছেড়ে উঠে পড়লেন। ওভারকোট গায়ে জড়িয়ে বললেন, দেখা যাক না ঘটনাটা কেমনভাবে ঘটেছে। বুঝলে সুখানী, ডেসি নামে একটি মেয়ে আমার কেবিনে আসার কথা ছিল। সেজন্য আমার ঘুম আসছে না। আর ডেসি মেয়ের মতো মেয়ে বটে। ডেসি বেশ্যামেয়েদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর। সে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে পারে। এক এক রাতে পাঁচটা সাতটা লোককে সে হজম করতে পারে।

তাই বুঝি স্যার! সুখানীকে এ সময় ভয়ানক বোকা বোকা লাগছিল।

একে, দেখে কেমন মনে হল?

স্যার, ওরা এখন শুয়ে আছে। তবে ঘুমোয়নি। ঘুমোলে, কম্বলের নিচে স্যার ইঁদুর নাচত না।

রাত গভীর এবং ঝড়ের গতি বাড়ছে। অ্যালওয়ের দরজা বন্ধ। ঝড়টা ভিতরে ঢুকতে পারছে না অথচ বাইরে ভয়ংকর শব্দে যেন আকাশ ফেটে পড়ছে। যেন জাহাজের মাস্তুল এবার ভেঙে পড়বে। ওরা দুজনে সন্তর্পণে এনজিন রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে চলল, উভয়ে হেঁটে যেতে থাকল। পাশের কেবিনগুলোর দরজা বন্ধ। অবনীভূষণ খুব মদ টেনেছিলেন বলে গতিতে শ্লথ ভাব। অথবা বয়সের ভারে ঠিকমতো যে হেঁটে যেতে পারছেন না। তিনি বালকেড ধরে ধরে হাঁটছিলেন। শরীরের ওজন ভয়ানক, হাত পা শক্ত এবং নিবিড় এক মদিরতা ওঁকে এই গতির ভিতর আচ্ছন্ন করে রাখতে চাইছে।

বড় মিস্ত্রি চলতে চলতে খুব আস্তে এবং জড়ানো গলায় বললেন, আমার শরীরটা কিঞ্চিৎ মোটা হয়ে গেছে। এতবার এনজিন রুমে নামা—ওঠা করি তবু ভুঁড়ির হেরফের হচ্ছে না। আপদ!

হ্যাঁ স্যার, আপদ!

পেট মোটা থাকলে যৌনতায় আনন্দ পাওয়া যায় না। তৃপ্তি নেই।

বিজন ভাবল, লোকটা মদ খেয়েছে বলে এত কথা বলছে। কারণ সুখানী জানত দিনের বেলাতে বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণ গোমড়ামুখো। কোনো কথা নেই—তিনি চুপচাপ এনজিনে নেমে যান অথবা বাংকে শুয়ে শুয়ে অশ্লীল সব বই পড়েন। অথবা ব্রিজের নিচে ছোট একটা ডেকচেয়ারে বসে পাইপ টানতে টানতে দূরের বন্দর, পাইন গাছ এবং সমুদ্র দেখেন। কোনো কথা বলেন না, কোনো হাসি—ঠাট্টা করেন না জাহাজিদের সঙ্গে। তখন তিনি যথার্থই বড় মিস্ত্রি জাহাজের।

বিজন একটু থেমে বলল, স্যার টুলটা নিয়ে আসি। টুলটা না নিলে ঘুল—ঘুলিতে মুখ রাখা যাবে না।

কেবিনের আলো এবং একটি ক্যালেন্ডারের পাতায় সুন্দর এক হ্রদের দৃশ্য অথবা অ্যালওয়ে পার হয়ে অন্য অফিসারদের কেবিন, স্টোর রুম এবং ডাইনিং হল অতিক্রম করে চিফ স্টুয়ার্ডের ঘর—বাংকে বেশ্যা রমণীর সুন্দর চোখ, আর পারা যাচ্ছে না—সে আগে আগে চলতে থাকল, কোনো কথা বলল না। অন্য কেবিনে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাল না।

বিজন ফিস ফিস করে বলল, এসে গেছি।

যে টুলটা বালকেডের পাশে সন্তর্পণে রাখল। বলল, এবারে উঠুন স্যার। সে আঙুল দিয়ে ঘুলঘুলি নির্দেশ করে দিল।

আমাকে উঠতে সাহায্য কর। বড় মিস্ত্রি মাতাল। তিনি কুকুরের মতো উত্তেজনাতে হাঁসফাঁস করছেন।

বিজন অ্যালওয়ের আলোটা নিভিয়ে দিল। বাইরে ঝড় এবং ঝড়ের গতি বাড়ছে। সুতরাং ওদের কথাবার্তার শব্দ ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বড় মিস্ত্রি ফস করে লাইটার জ্বালিয়ে একটা চুরুট ধরালেন। ওদের মুখ এখন বীভৎস রকম দেখাচ্ছে।

বিজন বলল, স্যার এক কাজ করেন?

এখন কোনো কাজের কথা নয়, সুখানী তুমি বড় বেশি কথা বল।

বিজন কোনো জবাব দিল না অথচ মনে মনে গাল দিল। বেঢপ মোটা বামন।

দেখ সুখানী, আমার ভাড়া করা স্ত্রী যদি কাল জাহাজে আসে, তুমি আবার এ সব ঘটনার কথা বলে দিও না। মেয়েটি খুব সুন্দর। বছর পাঁচেক আগে নাইট ক্লাবে ওর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বুঝলে সুখানী, তুমি তো মদ খাও না অথচ মেয়েমানুষের শরীর পেলে পেটুকের মতো কথাবার্তা বলো।

বিজন বলল, স্যার, আপনি আমার ওপরওয়ালার ওপরওয়ালা। আপনার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথাবার্তা বলতে ভয় হয়।

সুখানী, আবার তোমার সেই বেশি কথা।

সুতরাং ভয়ে ভয়ে বিজন টুলটা ধরে রাখল। অ্যালওয়ে অন্ধকার বলে ওরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে না।

আমাকে টুলে উঠতে সাহায্য করো। ফের ধমক দিলেন বড় মিস্ত্রি।

চিফ টুলের উপর উঠে সেই ঘুলঘুলিতে চোখ রাখতে গিয়ে বুঝতে পারলেন যে তিনি এই হালকা টুলে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারবেন না। শরীর টলছিল। তিনি একটি শক্ত টুল অন্বেষণ করলেন। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, শক্ত টুল নেই সুখানী?

আছে স্যার। কসপের ঘরে একটা শক্ত টুল আছে। কসপকে ডেকে তুলব?

না, দরকার নেই। বেশি হইচই করো না, সকলে, কুকুরের মতো এখানে এসে ভিড় করবে। এবং কাপ্তান জানলে রাগ করবেন।

বড় মিস্ত্রি এবার টুল থেকে নেমে পড়লেন। ফিস ফিস করে বললেন, বরং তুমি দেখ ওরা কী করছে। যা দেখবে, সব বলবে। কিছু লুকোলে আমি ধরতে পারব।

বিজন টুলের উপর উঠে ঘুলঘুলিতে চোখ রাখল। গরম হাওয়া ভিতর থেকে বের হয়ে আসছে। স্টুয়ার্ড এবং মেয়েটি সন্তর্পণে এখন কী যেন লক্ষ্য করছে। খরগোসের মতো ভীত চোখ নিয়ে কী যেন দেখছে। ওরা তাড়াতাড়ি উঠে বসল। বোঝা যাচ্ছে দুজনই উলঙ্গ। ওরা পরস্পর কী বলছে বুঝতে পারছে না বিজন।

বিজনকে কিছু বলতে না দেখে বড় মিস্ত্রি ক্ষেপে গেলেন।—সুখানী, তুমি নেমকহারাম, পাজি। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলছেন।—তুমি নিজে সব দেখছ অথচ আমাকে কিছু বলছ না।

স্যার, ওরা এখন উঠে বসল।

তারপর সুখানী?

ওরা বোধহয় টের পেয়েছে।

মেয়েটি দেখতে কেমন সুখানী?

রোগা স্যার। মেয়েটি এখন আবার কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল।

চিফস্টুয়ার্ড তখন ভিতরে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলছিল, মর্লিন, কারা যেন বাইরে কথা বলছে। যদি টের পায় তবে নিশ্চয় হামলা করবে।

মর্লিন উঠতে চাইল না। বলল, শরীর আর দিচ্ছে না। বাইরে ঝড়, নতুবা চলে যেতাম সুমিত্র।

সুমিত্র খুব দুঃখের সঙ্গে একটা হাত ওর স্তনের নিচে রাখল এবং কাছে টানল। বলল, অ্যালওয়েতে এখনও যেন কারা চলাফেরা করছে। কথা বলছে। অনেকক্ষণ থেকে এটা হচ্ছে। দরজা খুলে দেখব?

এই সুখানী, হারামজাদা! তুমি আমাকে বাগে পেয়ে খুব কলা দেখাচ্ছ হে।

স্যার, ওরা কিছু করছে না।

নিশ্চয় করছে। তুমি আমায় মিথ্যা কথা বলছ।

ভেতরে মেয়েটি বলল, না, আমার শরীর ভালো নেই সুমিত্র। ঠান্ডায় জমে গেছিলাম। এই ঘর আমাকে উত্তাপ দিচ্ছে। আমি আজ আর একটি লোককেও সামলাতে পারব না। সে অন্য পাশ ফিরে ঘুমোবার চেষ্টা করল। চিফ স্টুয়ার্ড সুমিত্র হাঁটু ভাঁজ করে রাখল মেয়েটির নিতম্বের নিচে এবং বুকে হাত রেখে ঘন হয়ে শুতে চাইল। অথচ শান্তি পাচ্ছিল না। সে ফের উঠে বসল। পোর্টহোল খুলে সমুদ্রের গর্জন শুনতে চাইল। ওর শরীর নগ্ন। ঠান্ডা হাওয়া ওকে কাঁপিয়ে তুলছে। স্টুয়ার্ড তাড়াতাড়ি রাতের পোশাক পরে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে শুনল, বাইরে চেঁচামেচি, সুতরাং সে একটা হাই তোলার চেষ্টা করল।

স্যার, আমি মিথ্যা বলছি না।

তুমি আলবাৎ বলছ। খুব আস্তে অথচ ক্ষুণ্ণ গলায় বললেন বড় মিস্ত্রি।

বিজন মরিয়া হয়ে বলল, বলেছি তো বেশ করেছি।

বেশ করেছ! তুমি বেশ করেছ! আচ্ছা… এইটুকু বলে বড় মিস্ত্রি কড়া নাড়লেন, স্টুয়ার্ড, দরজা খোল। আমি বড় মিস্ত্রি। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দ হল না বলে তিনি ফের বললেন—আমি। স্টুয়ার্ড আমি কোনো হামলা করব না। তুমি বললে আমি তিন সত্যি করতে পারি।

তুষারঝড় সকলকেই নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। দীর্ঘদিনের সমুদ্রযাত্রা অতিক্রম করার পর এই বন্দর, বন্দরে আলো অথবা কোনো রাস্তার নিচে বেশ্যা রমণীর আপ্যায়ন ওদের জন্য প্রতীক্ষা করল না। বড় সাহেবের ডেসি আসেনি, সুখানী বাইরে গিয়ে একটু মদ গিলতে পারেনি অথবা রমণীর মুখ দর্শন যেন কত কাল পর, কত দীর্ঘ সময় ধরে ওদের নোনা জলের চিহ্ন মুখে, রমণীর নরম নরম মুখ এবং চাপ চাপ আস্বাদন সবই কোন অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত।

এই দিকের কেবিনগুলি ফাঁকা। স্টুয়ার্ডের একমাত্র কেবিন, পরে ডাইনিং হল, সামনে ছোট ঘর অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য। ডেকের নিচে মাংসের ঘর তারপর সোজা সব ফাঁকা কেবিন, কারণ এই শীতের অঞ্চলে কোনো যাত্রী ওঠেনি। কেবিনে সুতরাং কোনো মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। স্টুয়ার্ড এসব জেনেই মেয়েটিকে অন্ধকার জেটির ওপর থেকে তুলে সিঁড়ি ধরে জাহাজে নিয়ে এসেছিল—কারণ সে জেটি থেকে তখন দেখেছে গ্যাঙওয়েতে কোয়ার্টার মাস্টার নেই, সুতরাং এটাই উপযুক্ত সময়। সে সময়ের সদ্ব্যবহার করেও কোনো ফল লাভ করতে পারল না, এত সতর্কতা তবু সব কেমন ফাঁস হয়ে গেল! চিৎকার এবং হামলা আরও বেশি হতে পারে ভেবে সে দরজা খুলে দিল। ভয়ানক শীত এই অ্যালওয়ের অন্ধকারে। কেবিনের আলোতে সে বড় মিস্ত্রির পাথরের মতো চোখ দুটো দেখল। এই সময় চিফস্টুয়ার্ডকে অদ্ভুত রকমের তোতলামিতে পেয়ে বসল।

বড় মিস্ত্রি কেবিনের ভিতর ঢুকে গেলেন। বললেন, আমি তিন সত্য করছি স্টুয়ার্ড, আমি কোনো হামলা করব না। আমাকে একটু সুখ দাও। আমি তবেই চলে যাব। কেমন বেহায়া এবং নির্লজ্জ ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন বড় মিস্ত্রি। তিনি ধমকের সুরে বিজনকে ডাকলেন, এসো। নচ্ছার সব জাহাজি। এটা তোমার বাড়ি নয় সুখানী! এখানে মা বাবা ঘুলঘুলি দিয়ে দেখতে আসবে না, এসো।

সুখানী ভালো ছেলের মতো বড় মিস্ত্রিকে অনুসরণ করল। সে কেবিনের ভিতর ঢুকল না। সে দরজার একটা পাল্লা ধরে উঁকি দিল মাত্র। স্টুয়ার্ডের সবকিছু দেখছে। ভয়ে ওর তোতলামি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। বড় মিস্ত্রির চোখ দুটো চক চক করছে এবং হননের ইচ্ছাতে একাগ্র। জানোয়ারের মতো উদগ্র লালসা মুখে, অবয়বে। সে দেখল, বড় মিস্ত্রি চেয়ার টেনে বসেছেন, দেয়ালে বিচিত্র সব নগ্ন ছবি এবং এই বাংকের অন্য পাশে মর্লিন—ওর কোমল ত্বকের গন্ধ অথবা মুরগির মতো নরম কলজের উত্তাপ বড় মিস্ত্রিকে এতটুকু অন্যমনস্ক করছে না। সে ঘরের ভিতর নিমন্ত্রিত অতিথির মতো বসে থাকল।

মর্লিন কম্বলের ভিতর থেকে উঁকি দিল। ওর সোনালি চুল বালিশের উপর, ওর নীল চোখ শান্ত। বড় মিস্ত্রির বিদঘুটে শরীর ক্রমশ পাশবিকতায় আচ্ছন্ন হচ্ছে। মর্লিন কম্বলের ভিতরে এসব দেখে ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। সে অন্য একটি মুখ দেখল দরজার পাশে। সে মনে মনে বড় মিস্ত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাইল, ম্যান, আমি জানি তোমাকে নিয়ে কোন কোন ভঙ্গিতে ক্রীড়াচাতুর্য প্রদর্শন করলে তুমি দু’বার, তিনবার অত্যধিক চারবার… কিন্তু শরীর ভালো নেই, বড় কষ্ট এই শরীরে, শীতে শরীর মুখ বিবর্ণ এবং ভিতরে ভয়ানক যন্ত্রণায় ভুগছি। তুমি আজকের মতো রেহাই দাও। এই দুর্যোগ যাক, বসন্ত আসুক—তখন তোমার কত টাকা আমার কত সুখ বিদ্যমান, দেখাব। অথচ মর্লিন কিছু বলতে পারছে না। ভয়ে ওর শরীর কেবল গুটিয়ে আসতে থাকল।

সুখানী দেখল, বড় মিস্ত্রি কেমন পাগলের মতো করছেন। পোশাক আলগা করার সময় তিনি দরজা খোলা কী বন্ধ পর্যন্ত দেখছেন না। সুতরাং সুখানী নিজেই দরজাটা টেনে দিল।

বড় মিস্ত্রি দুটো শক্ত হাত ওর সোনালি চুলের ভিতর ঠেসে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লেন। তিনি মর্লিনের চুলের ভিতর মুখ গুঁজে দিলেন। মর্লিন মৃতপ্রায় পড়েছিল। বড় মিস্ত্রি কম্বলটা শরীর থেকে বাঁ হাতে ঠেলে দিলেন। ঠোঁট দুটো নীল, বিবর্ণ। ঠোঁট দুটো কামড়ে দেবার সময় দেখলেন, কেমন সাপের মতো পিছলে যাচ্ছে। অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলছে, ম্যান আমাকে মেরে ফেলো না। আমি আর পারছি না।

মর্লিনের মুখ থেকে তখন থুথু উঠছিল। বাইরে বড় মাস্টের আলোগুলো দুলছে। মেসরুমে বাতি জ্বলছিল। মনসুর আসবে এ সময়। ওর এখন ওয়াচ। মনসুরকে ডাকতে হবে। যতক্ষণ না ডাকবে ততক্ষণ মনসুর শুয়ে থাকবে। সুতরাং সুখানী বিরক্ত হচ্ছে। বড় বেশি সময় নিচ্ছে বড় মিস্ত্রি। সুখানী দরজা ঠেলে উঁকি দিতেই দেখল বড় মিস্ত্রি বড় বেশি বেহুঁস। সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। মর্লিনের শরীর থেকে সুখানী বড় মিস্ত্রিকে শক্ত হাতে ঠেলে ফেলে দিল। তারপর টানতে টানতে দরজার বাইরে এনে বলল, আপনি দাঁড়ান। বেশি ইতরামি করলে ভালো হবে না। বলে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণ অসহায় পুরুষের মতো স্টুয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখলে কাণ্ডটা, কাল আমি ওকে দেখব।

স্টুয়ার্ড বলল, বড় দুর্বল স্যার। শীতে কষ্ট পাচ্ছিল। আমি জাহাজে তুলে এনেছি। টাকা তো মুফতে দেওয়া যায় না। তাই রয়ে সয়ে একটু সুখ নিচ্ছিলাম।

ওরা দুজনই চুপচাপ বালকেডে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল।

স্টুয়ার্ড অত্যন্ত বিচলিতভাবে কথা বলতে থাকল, স্যার, এটা অত্যাচার হচ্ছে ওর উপর। একটা রুগণ মেয়েকে দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়।

তার জন্য আমি কী করতে পারি। বলে, তিনি অ্যালওয়েতে পায়চারি করতে থাকলেন। অন্ধকার আলওয়েতে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সেই থেকে থেকে আগের মতো সমুদ্রগর্জন ভেসে আসছে। তুষারঝড়ের গতি কমছে কী বাড়ছে অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে বড় মিস্ত্রি টের করতে পারলেন না। তিনি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, সুখানী বড় দেরি করছে। স্টুয়ার্ডের দিকে এখন নজর বড় মিস্ত্রির। স্টুয়ার্ড এখনও কিছু বলছে না।

তোমার নিশ্চয়ই স্টুয়ার্ড যেতে ইচ্ছা করছে ভিতরে?

স্যার, আপনার কথার উপর আমার কথা বলা সাজে না।

বড় মিস্ত্রি ভাবলেন, এবার কড়া নাড়বেন দরজার। কিন্তু সেই মুহূর্তে দরজা খুলে গেল। বিজনকে খুব বিব্রত দেখাচ্ছে। চোখ মুখ উদ্বিগ্ন। বলল, স্যার ঘরে মদ আছে? মেয়েটা কেমন করছে স্যার! বড় নিস্তেজ, একটু মদ দিলে হত।

সুমিত্র বলল, স্যার, আমি আগেই বলেছি এত ধকল সে সহ্য করতে পারবে না।

বড় মিস্ত্রি চিৎকার করে বলতে চাইলেন, তুমি একটা অমানুষ, সুখানী। অথচ বলতে পারলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তুমি একটা পশু, তুমি পশু সুখানী।

স্যার বিশ্বাস করুন, আমি কিছু করিনি।

কিছু করনি!

না স্যার, শুধু আদর করছিলাম। কিন্তু কেবল দেখছি মুখ থেকে ওর থুথু উঠছে সাদা সাদা ফেনার মতো। আমি বারবার আলোতে মুখ দেখলাম। জল দিলাম খেতে। খেল। ফের ওরকম হতেই দরজা খুলে দিয়েছি। আপনারা আসুন।

স্টুয়ার্ড কথা বলতে পারছিল না। বড় মিস্ত্রি বিমূঢ়। নেশার রঙ মুছে যাচ্ছে। এবং তিনি এই সময় সারিবদ্ধ উট দেখলেন, ওরা মরুভূমির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সারিবদ্ধ উটের দলটা একটা নগ্ন মানুষকে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শুধু। মানুষটার হাত—পা বাঁধা। তিনি প্রায় চিৎকার করে ওঠবার ভঙ্গিতে বললেন, ওদিকের দরজা বন্ধ করে দাও। আলো নেভাও বাইরের। স্টোর থেকে মদ নিয়ে এসো।

ওরা ভিতরে ঢুকে বাংকের পাশে দাঁড়াল। সবুজ গাউনটা পাশ থেকে তুলে মর্লিনের কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া হল। সুখানী পায়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। মর্লিনের বড় বড় চোখ দুটো স্থির। বিবর্ণ হাত দুটো বুকের উপর। মুখের রঙ জলের সঙ্গে গলে গেছে। সাদা এবং অদ্ভুত এক অবয়বের মুখ যা দেখলে ভয় ভীতি ক্রমশ মানুষকে গ্রাস করে।

বড় মিস্ত্রি বললেন, মর্লিন মরে যাচ্ছে সুখানী।

স্টুয়ার্ড বলল, যথার্থই মরে যাচ্ছে মর্লিন?

বড় মিস্ত্রি পুনরাবৃত্তি করলেন, মর্লিন মরে যাচ্ছে সুখানী।

সুখানী বলল, কোনো ডাক্তার….?

ও বাঁচবে না। ডাক্তার ডাকলে সকলে ধরা পড়ে যাব।

স্টুয়ার্ড অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাল, স্যার, আমরা ওকে মেরে ফেললাম।

বড় মিস্ত্রি ধমক দিলেন, আস্তে কথা বল। এত বেশি বিহ্বল হবে না। পোর্টহোল খুলে দেখ ঝড়ের গতি কীরকম? এবং বড় মিস্ত্রি এই নিশ্চিত মৃত্যু জেনে যেন বলতে চাইলেন, এতটুকু পাশবিকতা যে সহ্য করতে পারে না তার মরাই উচিত।

সুখানী পোর্টহোলের কাচ সন্তর্পণে খুলে মুখ গলাবার চেষ্টা করল। বাইরে ঝড়। এবং জলের উপর অন্ধকার। দূরে সমুদ্রের উপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একটা জাহাজ দেখল সে বাইরে। জাহাজটা লকগেট দিয়ে বন্দরে ঢুকছে। সে সমুদ্রের বুকে পাহাড়টা দেখল, আলো, ঘর বাড়ি দেখল। জাহাজটা এখন এখানেই নোঙর ফেলবে। সে জাহাজিদের হাড়িয়া—হাপিজের শব্দ এবং যাত্রীদের কোলাহল এই পোর্টহোল থেকেই শুনতে পেল। সে বলল, ঝড় কমে যাচ্ছে স্যার। তারপর বলল, পাশে একটা জাহাজ নোঙর ফেলছে।

বড় মিস্ত্রি হাঁটু গেড়ে বসলেন মর্লিনের পাশে। ওর কপালে মুখ হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। বড় মিস্ত্রি ভিতরে খুব কষ্ট অনুভব করছিলেন। ভয়ানক কষ্টবোধে তিনি সুখানীর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছেন না। স্টুয়ার্ড স্টোর রুমে গেছে মদ আনতে; তিনি ভালো করে মর্লিনের শরীর ঢেকে বসে আছেন। একটু মদ খেলে যদি উত্তেজনা আসে। অথবা বাঁচবার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাঁর ইচ্ছা হল মেজ মালোমকে ডেকে এই ঘটনার কথা, ওষুধের কথা অথবা কোনো বুদ্ধির জন্য… তিনি আর ভাবতে পারছিলেন না। স্টুয়ার্ড এ সময় মদ এনে ওর মুখে ঢেলে দিলে, মদটুকু ঠোঁটের কস বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

স্টুয়ার্ড বলল, কী হবে স্যার!

বড় মিস্ত্রি বললেন, জানতে পারলে ফাঁসি হবে।

এই ধরনের কথায় চোখ গোল গোল হয়ে উঠল স্টুয়ার্ডের। সে দ্রুত বলে চলল, আসুন, তবে ওকে পোর্টহোল দিয়ে জলে ফেলে দিই স্যার। কেউ টের পাবে না।

ওকে ভালো করে মরতে দাও। তা ছাড়া বাইরে যাত্রীজাহাজ এসে থেমেছে।

এখন অনেক রাত স্যার। আসুন ওকে জেটিতে ফেলে আসি।

গ্যাঙওয়েতে সুখানী মনসুর আছে। এইসব ঘটনা কাক—পক্ষীতে টের পেলে পর্যন্ত কপালে দুঃখ থাকে।

কী হবে স্যার? আগে এমন ঘটবে জানলে মর্লিনকে তুলে আনতাম না স্যার। কী কুক্ষণে এই বন্দরে এসেছি। ঝড় ঝড় শুধু ঝড়।

ওদের ভিতর নানা ধরনের কথা হচ্ছিল। এবং এইসব বিচিত্র সংলাপ ওদের তিনজনকেই সাময়িকভাবে এই মৃত্যু সম্পর্কে নির্বিকার করে রাখছে। এ সময় ওরা তিনজনই ওর পাশে বসল। বড় মিস্ত্রি বললেন, এসো, আমরা তিনজনই ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকি। ওর মৃত্যু আমাদের জানুর উপর সংঘটিত হোক—এমত এক আবেগদীপ্ত কথায় অবনীভূষণ চোখ বুজলেন। তাঁর মনেই হল না শরীর থেকে যেসব জাহাজি যন্ত্রণা নেমে এই মেয়েটির দুর্বল শরীরে গরল ঢেলেছে তারা এখনও একই শরীরে বিদ্যমান। তিনি যেন কোনো এক উপাসনা গৃহে বসে আছেন এমতই এক গভীর প্রত্যয়ের চোখ। তিনি বললেন, এসো ওকে আমরা শান্তিতে মরতে দিই। কারণ আমরা জানি না ওর নিকট আত্মীয় কেউ আছেন কি না, আমরা কোনো পুরোহিতকেও ডাকতে পারছি না, সুতরাং ঈশ্বরের নাম আমরাই স্মরণ করাব। আর এই গৃহই আমাদের উপাসনাগৃহ।

কেবিনের নীল দেয়ালে একটা মাকড়সা অনবরত নিচ থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে। ওদের তিনজনের কোলের উপর মর্লিনের মুখ, শরীর। দেয়ালে পা ঠেকে আছে। মর্লিনের শরীর কম্বল আবৃত। র‍্যাকে ওর ওভারকোট। হাতের দস্তানা নীল রঙের। চোখ দুটো মর্লিনের ক্রমশ সাদা হয়ে আসছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওরা তিনজনই এই মৃত্যুর দ্বারা অভিভূত হচ্ছিল এবং মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে ভাবছিল। ওরা দেখল—চোখ দুটো সাদা হতে হতে একেবারে স্থির হয়ে গেল। একটা ঢেকুরের মতো শব্দ, তারপর মৃত্যু।

ওরা মর্লিনের মৃত শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বড় মিস্ত্রি পায়চারি করলেন কেবিনে। দেয়ালে শরীর রেখে মর্লিনের মুখ দেখছিল সুখানী। সে একটু হেঁটে গিয়ে কম্বল দিয়ে মর্লিনের মুখটা ঢেকে দিল। স্টুয়ার্ড দেয়ালে টাঙানো নগ্ন চিত্রের ক্যালেন্ডার থেকে—আজ কত তারিখ, কী মাস, কী বছর এবং বন্দরের নামটা পর্যন্ত তুলে আনল। স্টুয়ার্ড, বড় মিস্ত্রি এবং সুখানীর নির্বিকার ভঙ্গি দেখে দুঃখিত হল। সে বলল, স্যার, সারা রাত আমরা মড়া আগলে পড়ে থাকব।

বড় মিস্ত্রি কী ভেবে যেন দরজা খুললেন, এবং বাইরে যাবার উপক্রম করতেই সুখানী হাত চেপে ধরল, স্যার, আপনি আমাদের ফেলে চলে যাচ্ছেন?

তোমাদের ফেলে যাচ্ছি না সুখানী। মর্লিনের জন্য বাইরে একটু জায়গা খুঁজতে যাচ্ছি।

সুখানী বলল, দরজা বন্ধ করে দেব স্যার?

দাও। বড় মিস্ত্রি অ্যালওয়ে ধরে হাঁটতে থাকলেন। গ্যাঙওয়েতে মনসুর বসে আছে। তিনি গ্যাঙওয়েতে নেমে যেতেই মনসুর উঠে দাঁড়াল এবং আদাব দিল। তিনি লক্ষ্য করলেন না ওসব। তিনি জাহাজময় ঘুরে জেটিতে, জেটির জলে মর্লিনকে ফেলে রাখবার জন্য জায়গা খুঁজতে লাগলেন। তিনি কোথাও জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি দেখলেন সর্বত্র এক নিদারুণ নিরাপত্তার অভাব। তিনি দেখলেন, সর্বত্রই যেন কে জেগে আছে। ওঁদের এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। এ সময়ে ওঁর ফের মদ খেতে ইচ্ছা হল। কিন্তু এ সময় মদ খাওয়া অনুচিত কারণ মর্লিনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাই এখন একমাত্র কর্তব্য। তিনি তারপর দেখলেন ডেকের উপর থেকে একটা শুকনো পাতা উড়ে উড়ে সমুদ্রের দিকে চলে যেতে থাকল। তিনি ভাবলেন, মর্লিনের শরীরে কোনো কোনো আঘাতের চিহ্ন বিদ্যমান….. মর্লিন একবার ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছিল অথবা পাশবিকতার চিহ্ন এখনও ওর শরীরে বিদ্যমান কি না অথবা সুখানী এবং স্টুয়ার্ডের শরীরে মাংস ভক্ষণের মতো উদগার নিক্ষেপ করেছে কি না, যা ওদের তিনজনকেই গ্রাস করবে…. তিনি ছুটতে থাকলেন, তিনি তাড়াতাড়ি কেবিনের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললেন, স্টুয়ার্ড, দরজা খোল—স্টুয়ার্ড! স্টুয়ার্ড!

কেবিনের দরজা খুললে তিনি ঝড়ের মতো ঢুকে মর্লিনের শরীর থেকে কম্বল তুলে নিলেন। ওর শরীরের শেষ আবরণটুকু খুলে ঝুঁকে পড়লেন শরীরের উপরে। সুখানী এসো, স্টুয়ার্ড এসো। বড় মিস্ত্রি চিবুকের নিচে হাত রেখে বললেন, এই দাঁতের চিহ্ন কার?

সুখানী অত্যন্ত সংকুচিত চিত্তে বলল, স্যার আমার। মর্লিনের সামনে মিথ্যা বলে পাপ আর বাড়াতে চাই না।

বড় মিস্ত্রি তীক্ষ্ন চোখে মর্লিনকে দেখতে লাগলেন। সুখানীর কথার সঙ্গে নিজেও বিড় বিড় করে বললেন, শরীরের এসব চিহ্ন দেখে পুলিশ ধরে ফেলবে।

স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে!

আমাকেও নেবে। বড় মিস্ত্রি একবার সুখানীর দিকে তাকালেন।

সুখানী বলল, বড় অমানবিক!

স্টুয়ার্ড বলল, এই তুষারঝড় এ—জন্য দায়ী।

বড় মিস্ত্রি বললেন, পুলিশের ঘরে আমাদের বিচার হওয়াই উচিত। সুতরাং এসো, ওকে এখন আর কোথাও নিক্ষেপ না করে এখানেই ফেলে রাখি।

এইসব কথা বলার পর সকলে দাঁড়িয়ে থাকল। সকলে পরস্পরকে চোখ তুলে দেখল।

স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, যা হয় তাড়াতাড়ি করুন।

সুখানীর সঙ্গে তোমার এখানেই ফারাক। এসব কাজ তাড়াতাড়ি হয় না।

তাড়াতাড়ি হয় না?

না, হয় না।

স্যার আপনি ঠিক কথা বলেছেন!

আমাদের এখন ভাবতে হবে কোনো অপরাধই আমরা করিনি। এখন শুয়ে পড়লে ঘুমোতে পারব এমন মনের অবস্থা সৃষ্টি করতে পারলেই এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। যদিও আমরা জানি মনের এমন অবস্থা সৃষ্টি করা অসম্ভব। সুতরাং বোস।

বড় মিস্ত্রি ফের বললেন, একটু কফি হলে ভালো হত। সুখানী কী বলছ।

তা মন্দ নয় স্যার।

স্টুয়ার্ড কিন্তু বের হতে চাইল না। কারণ ওর ভয় কফি আনতে গেলেই ওরা এই কেবিন ছেড়ে চলে যাবে এবং ভোরবেলায় যখন সব জাহাজিরা,—তখনও অন্ধকার থাকবে ডেকে, তখনও সূর্য ভালো করে আকাশের গায়ে ঝুলবে না,—সকল জাহাজিরা ডেক—ছাদ অথবা এনজিনে নেমে যেতে শুনবে স্টুয়ার্ডের ঘরে একজন তরুণীর মৃতদেহ—কম্বলের নীচে স্টুয়ার্ড মৃতদেহটিকে আড়াল করে রেখেছিল।

স্টুয়ার্ড বলল, স্যার আমার মাথার ভিতরটা কেমন ফাঁকা ঠেকছে। তারপর ওদের উত্তর করতে না দেখে বলল, স্যার, আসুন মর্লিনকে পোর্টহোল দিয়ে জেটির জলে ফেলে দি।

যখন লাশ ফুলে ফেঁপে জলের উপর ভেসে উঠবে, যখন দাঁতের কামড় দেখে তোমার দাঁতের চিহ্ন নেবে, তখন…?

কোথাও কোনো উপায় নেই।

আপাতত দেখতে পাচ্ছি না।

সুখানী বলল, বড় দুঃখজনক পরিস্থিতি।

বড় মিস্ত্রি অন্যমনস্কভাবে মর্লিনের দস্তানা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।

স্টুয়ার্ড যেন ক্ষেপে গেল।—স্যার, আমার কেবিনে এসব হচ্ছে! আপনারা আমাকে জপাতে চাইছেন। আপনারা যদি আমাকে এ কাজে সাহায্য না করেন আমি একাই ওকে বয়ে নিয়ে যাব। স্টুয়ার্ড তাড়াতাড়ি কম্বলের ভিতর থেকে মর্লিনকে তুলে কাঁধে ফেলল তারপর দরজা দিয়ে বের হতেই মিস্ত্রি ওর হাত চেপে বলল, তুমি কি ক্ষেপে গেলে?

স্টুয়ার্ড এবার কেঁদে ফেলল, স্যার, আপনারা এ সাংঘাতিক ঘটনাকে আমলই দিচ্ছেন না! আমাকে আপনারা ফাঁসিয়ে দিতে চাইছেন। ঘরে আমার স্ত্রী আছে, সন্তান—সন্ততি আছে।

এইসব কথায় তিনি যথার্থই অভিভূত হলেন। তিনি ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে গেলেন। চোখ মুখ উদ্বিগ্ন। এবং অবিবাহিত জীবনের কিছু সুখদুঃখের কথা স্মরণ করতে পেরে যেন বলতে চাইলেন, স্টুয়ার্ড তুমি আমি সকলে এক সরল পাশবিকতার মোহে আচ্ছন্ন। কখনও ঘরে, কখনও উঠোনে এবং দূরের যব গম ক্ষেতের ভিতর নগ্ন শরীর আমাদের শুধু কামুক করে তোলে। অথবা এই জাহাজ আমাদের কত দীর্ঘ সময় সমুদ্র এবং আকাশের ভিতর আবদ্ধ করে রেখেছে—শুধু নোনা জল, কখনও প্রবাল দ্বীপ এবং নির্জনতা জাহাজের অস্থির এনজিনের শব্দ, দেয়ালের উলঙ্গ সব ছবি আমাদের নিরন্তর নিষ্ঠুর করে রাখছে। সুতরাং দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর বন্দর এবং রমণীর দেহ স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। মর্লিন মরে গেছে। এসো, ওর শরীর আমরা সযত্নে রক্ষা করি। বন্দরে ঝড়। এ অঞ্চলে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত। দেশটাতে এখন শীতের শেষ—কুয়াশা লেগেই থাকবে। ডেসি এমন দিনে আসবে না।

এতক্ষণ সকলকে চুপচাপ থাকতে দেখে সুখানী মর্লিনের চুল মুঠোর ভিতর তুলে বলল, স্যার দেখুন, এই সোনালি চুল কী অপূর্ব! সুখানী ভাবল, কীভাবে আর কথা আরম্ভ করা যায়। স্টুয়ার্ড ভয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছে। সুখানী দুঃখিতভাবে বলল, এই সোনালি চুলে মর্লিন স্যার সুগন্ধ তেল মাখত। গন্ধটা কিন্তু এখনও জীবিত মেয়েদের মতো, তারপর সে একটা ঢোক গিলে বলল, স্যার, আপনি পর্যন্ত ভয়ে টেসে গেলেন! কথা বলছেন না! চুপচাপ বসে মর্লিনের হাতের দস্তানা আপনার শক্ত হাতে গলাবার চেষ্টা করছেন। স্টুয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলল, এসো, তোমাকে লাশটা নামিয়ে রাখতে সাহায্য করছি।

বড় মিস্ত্রি বাংক থেকে নেমে পোর্টহোলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাচের ভিতর থেকে পাশের জাহাজ স্পষ্ট। কাচ খুলে দিলে জাহজিদের শব্দ পেলেন, যাত্রীজাহাজ বলেই সেখানে মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি পোর্টহোলে মুখ রেখে ভাবলেন, এই পোর্টহোল দিয়ে লাশটাকে হাড়িয়া করে দেওয়া যাক। স্টুয়ার্ডের ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কান্না আর ভালো লাগছে না। বস্তুত বড় মিস্ত্রি নিজেও এই মৃতদেহ নিয়ে কী করা যাবে ভেবে উঠতে পারছেন না। তাঁর মাথার ভিতরও শূন্যতা এসে আশ্রয় করেছে। তিনি পোর্টহোলে মুখ রেখেই বললেন, স্টুয়ার্ড, সুখানি মর্লিনকে কাঁধে নাও। তাড়াতাড়ি পোর্টহোল দিয়ে গলাবার চেষ্টা করো বলে, তিনি পাগলের মতো পোর্টহোলটাকে টেনে ফাঁক করবার চেষ্টা করতে থাকলেন।

সুখানী বলল, স্যার, আপনারও কি মাথা খারাপ হয়ে গেল।

বড় মিস্ত্রি গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তবে আমরা কী করতে পারি সুখানী? সমস্ত জাহাজ ঘুরে দেখলাম মর্লিনকে কোথাও রাখা যাচ্ছে না। যেখানেই রাখতে যাব— সেখানেই ধরা পড়ে যাচ্ছি। তারপর তিনি থেমে থেমে বললেন, আহা, ওকে যদি সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারতাম! সমুদ্রে ফেলে দিলে কোনো চিহ্নই পাওয়া যেত না।

সুখানী বলল, স্যার তবে আসুন, ওকে বরফ ঘরে রেখে দি। ভেড়া গোরুর সঙ্গে পড়ে থাকবে। কেউ টের করতে পারবে না। জাহাজ সমুদ্রে গেলে ওকে ফেলে দেওয়া যাবে।

বড় মিস্ত্রির কপাল কুঁচকে উঠল। তিনি আড়চোখে সুখানীর দিকে চাইলেন। যেন, সুখানী এখানে একমাত্র বুদ্ধিমান এবং স্থিরচিত্ত পুরুষ। সুতরাং তিনি ওর উপরই নির্ভর করতে পারেন এমত এক নিশ্চিন্ত মত পোষণ করছেন মনে মনে। তিনি বললেন, স্টুয়ার্ড কী বলে?

স্টুয়ার্ড কোনো কথা বলছে না। সুখানী ওদের দুজনকে অনুশাসনের ভঙ্গিতে বলল, তবে আর দেরি করে লাভ নেই। ওকে কাঁধে তুলে নেওয়া যাক।

মর্লিনের হাত পোর্টহোলে গলানো ছিল এবং মাথাটাও। পোর্টহোল থেকে ওর শরীর ঝুলে পড়ছিল। স্টুয়ার্ড ওর কোমর একটু উপরে তুলে রেখেছে। বড় মিস্ত্রি ডানদিকে দাঁড়িয়ে মর্লিনের তলপেটের নিচে হাত রেখে স্টুয়ার্ডকে ধরে রাখতে সাহায্য করছিলেন।

ওরা তিনজন মিলে মর্লিনকে বাংকে শুইয়ে দিল। ওরা প্রথমেই দরজা খুলে দিল না। সুখানী এখন মাঠে দাঁড়িয়ে কোনো সেনাবাহিনীকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে। সে বলল, স্যার, দরজা খোলার আগে আমাদের কান পেতে শুনতে হবে, বাইরে কোনো শব্দ হচ্ছে কিনা। তারপর দরজা খুলে একজনকে ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্য কেউ যদি আসে তবে শিস অথবা হাতের ইশারা। ইতিমধ্যে মর্লিনকে রসদঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর ফের দরজা বন্ধ করে ছাদের ঢাকনা খুলে মর্লিনের লাশ নিচে হাড়িয়া করে দিলেই ভয় থেকে নিষ্কৃতি। সে রাজ্যটা চিফস্টুয়ার্ডের একান্ত নিজস্ব। এবং আশা করব জাহাজ যতদিন না বন্দর ছেড়ে সমুদ্রে যায় ততদিন স্টুয়ার্ড মর্লিনকে আগলে রাখতে পারবে। তাই বলে সুখানী স্টুয়ার্ডের কাঁধে চাপ দিল।

এনজিন রুমে নেমে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ। অ্যাকোমোডেশান ল্যাডার ধরে ডেক—ছাদে উঠে যাওয়ার পথটাতে বড় মিস্ত্রি কড়া নজর রাখছেন। তাছাড়া ডাইনিং হলের পথটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। বড় মিস্ত্রি অ্যালওয়ের আলো নিভিয়ে পাহারাদারদের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এখন বাইরে ঝড় নেই বললেই হয়। এনজিন রুমে কোনো ফায়ারম্যান হয়তো ওয়াচ দিতে নেমে যাচ্ছে, বুটের ঠক ঠক শব্দ সিঁড়ি ধরে ক্রমশ নিচে নিচে—তিনি সন্তর্পণে অন্ধকার থেকেই বললেন, এবার তোমরা রসদঘরে ঢুকে যাও। কেউ নেই।

সুখানী মর্লিনের মাথার দিকটা ধরেছিল। স্টুয়ার্ড পায়ের দিকটা ধরে বাইরে নিয়ে এল। তারপর রসদঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করার আগে ডাকল, স্যার, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। অ্যালওয়ের আলো জ্বেলে দিন।

ওরা ধীরে ধীরে মর্লিনকে একটা টেবিলের উপর শুইয়ে দিল। টেবিল থেকে কাচের ডিস এবং অন্যান্য সব পানীয় পাত্র তুলে অন্য স্থানে রেখে দিল। এই ঘরে অন্যান্য দরজা খুললে জাহাজিদের রসদ, নিচে রসদ ঘর—ভিন্ন ভিন্ন রকমের সব সবজি এবং সবজির গন্ধ আসছে এই ঘরে। ওরা এ সময় মর্লিনের শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ল।

স্টুয়ার্ড বলল, কম্বল দিয়ে ঢেকে দি?

বরং ওর গাউনটা নিয়ে এসো।

মর্লিনের নগ্ন শরীর ভয়ানক কুৎসিত দেখাচ্ছে। বড় টেবিলের উপর ওর শরীর মৃত ব্যাঙের মতো—হাত পা দুটো শীর্ণ এবং চুলের সেই গন্ধটা তেমনি ফুর ফুর করে উড়ছে। চোখ দুটো এখনও শুধু স্থির। ওর বুকের পাঁজর স্পষ্ট। স্তনের সর্বত্র মাতৃত্বের চিহ্ন ধরা পড়ছে। স্টুয়ার্ড এবার কেমন শিউরে উঠল। এই শুকনো স্তনের আশে পাশে সহসা সে দেখে জঠরে নিমগ্ন কোনো যুবক যেন হাত বাড়াচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি কম্বল এনে ওর শরীর ঢেকে দিল।

ওরা এখন সকলেই কথা কম বলছে। বড় মিস্ত্রি ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, নিচে হাড়িয়া করে দেওয়া যাক তবে।

স্যার। স্টুয়ার্ড ডাকল।

বলো।

আপনি স্যার আমাদের ওপরওয়ালা। আপনি আমাদের সাহস দিন।

যেন এই পশুবৎ আচরণ অথবা নিষ্ঠুর ইচ্ছার দ্বারা প্রহৃত এই যুবতীর সকল অস্তিত্বের করুণা ক্রমশ জাহাজের ঘুলঘুলিতে মুখ রাখছে। দেয়ালে ওদের ছায়া পড়ছিল। সুখানী কেমন বিকৃতভাবে একটা ঢোক গিলে বলল, আমি নিচে নেমে যাচ্ছি। আপনারা উপর থেকে ওকে হাড়িয়া করুন। এই বিসদৃশ ঘটনা চোখে আর দেখা যাচ্ছে না।

বড় মিস্ত্রি নিচের ঢাকনা খুলে দিল। নিচের ঘরগুলো অন্ধকার। সুখানী সিঁড়ি ধরে নেমে যাবার আগে নিচের আলো জ্বেলে নিল। স্টুয়ার্ড হাঁটু গেড়ে বসল। নিচের ঘরগুলোতে ভয়ানক ঠান্ডা। আলু, পেঁয়াজ এবং শাক—সবজি এখান থেকে কিছু কিছু চোখে পড়ছে। বরফের ঠান্ডা স্রোত সুখানীকে ভয়ংকর কষ্ট দিচ্ছে। সবকিছু ক্লান্তিকর। সে এবার উপরের দিকে তাকাল। বড় মিস্ত্রি হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন।

ওরা তিনজন বড় টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ওরা তিনজন মাথায়, কোমরে এবং পায়ে হাত রাখছে। বড় বড় চিনেমাটির বাসন টেবিলের নিচে, কাবার্ডে টি—সেট সাজানো। মাদক দ্রব্য পানের নিমিত্ত সব পাতলা কাচের পাত্র ইতস্তত সজ্জিত। বড় মিস্ত্রি অন্যমনস্ক ছিলেন। পা সরিয়ে আনার সময় কিছু কাচের পাত্র ভেঙে নিচে গড়িয়ে পড়ল। কাচ ভাঙার শব্দ, টেবিলের উপর বড় দর্পণে তিনজনের প্রতিবিম্ব, মর্লিনের শক্ত শরীর—সবই ভীতিপ্রদ। মর্লিন ওদের দিকে যেন শক্ত চোখ নিয়ে চেয়ে আছে। সুতরাং নিরন্তর এক পাপবোধ ওদের তীব্র তীক্ষ্ন করছিল।

ওরা এবার মর্লিনকে কোলের কাছে নিয়ে শব—বাহকের মতো সিঁড়ি ধরে নেমে যাবার সময় সন্তর্পণে ছাদের ঢাকনা টেনে খুব ধীরে ধীরে—যেন এতটুকু আওয়াজ না হয় অথবা যেন মর্লিনের গায়ে আঁচড় না লাগে—ওরা মর্লিনকে এ সময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছিল। অথচ মর্লিনের শরীর মুরগির মৃত ঠ্যাং—এর মতো কদর্য এবং কঠিন। এই আলিঙ্গনের উষ্ণতা ওদের তিনজনকেই ভাবপ্রবণ করে তুলছিল।

মর্লিনের মুখ থেকে সব রঙ মুছে গেছে। চোখে টানা কাজলের চিহ্ন তখন চোখের নিচে এবং ভ্রুর আশেপাশে লেগে আছে। পুতুলনাচের নায়িকার মতো চোখ—মুখ। ওরা মর্লিনকে দরজার সামনে শুইয়ে দিল। বরফ ঘরের তালা খুলে দিল স্টুয়ার্ড—বড় বড় সব মাংস, গোরু, ভেড়া, শূকর এবং গোটা গোটা ধড় হুকের মধ্যে ঝুলছে। অথবা বড় বড় সব টার্কির মাংস—সোঁদা গন্ধ সর্বত্র, প্রচণ্ড ঠান্ডা এই বরফ ঘরে। ওরা তিনজনই ভিতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি মর্লিনকে একপাশে রেখে একটা ত্রিপলে ঢেকে বের হয়ে পড়ল। দরজা টেনে সিঁড়িতে ওঠার মুখে প্রথম কথা বলল স্টুয়ার্ড—স্যার, কাল ভোরে যখন চিফ কুক রসদ নিতে আসবে, কী বলব?

রসদ দেবে।

ওরা ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই রসদের ওজন দেখে। দরজাটা খোলা থাকলে দেখার ভয় আছে।

দরজা বন্ধ রাখবে।

দরজা সবসময় বন্ধ রাখলে সন্দেহ করতে পারে। কারণ মেস—রুম মেট গোস্ত কেটে এনে ওজন করে দেয়।

মেস—রুম মেটকে ভোরবেলায় অন্য কাজ দেব। রসদ ভালো দেবে, ওজন বেশি দেবে। সবাই খুশি থাকবে তবে। কেউ সন্দেহ করবে না।

স্টুয়ার্ড তবু সিঁড়ি ধরে উঠল না। সে বরফ ঘরের দিকে পিছন ফিরে তাকাল।

সে নড়ছিল না। সে বিড়বিড় করে কীসব বকছিল। সে দরজাটার সামনে হেঁটে গেল। দরজা খুলতেই দেখল পা’টা মর্লিনের খালি। সে ত্রিপল দিয়ে পা’টা ঢেকে দরজা বন্ধ করে তালাটা লাগাল। তালাটা টেনে দেখল ক’বার। যখন দেখল তালাটা ঠিকমতো লেগেছে—কোথাও কোনো গোপন বিশ্বাসভঙ্গ উঁকি দিয়ে নেই অথবা যখন সবই অতি সন্তর্পণে সংরক্ষিত হল…. আর কী হতে পারে, স্টুয়ার্ড এইসব ভেবে সন্দেহের ভঙ্গিতে বলল, স্যার এটা আমার ভালো লাগছে না। অর্থাৎ এখন মনে হচ্ছে যেন স্টুয়ার্ড নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়ছে।

এতক্ষণ পর মনে হল, বড় মিস্ত্রির গলাটা ভিজে যাচ্ছে। এতক্ষণ পর একটা চুরুটের কথা মনে হল। তিনি চুরুটে আগুন দিয়ে বললেন, কেন, কী হতে পারে?

সুখানী মুখ বিকৃত করে বলল, ওর কথা বাদ দিন স্যার।

সুখানী যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।

বেশ চুপ করে থাকলাম।

স্টুয়ার্ড বলল, আর একবার নামলে হয় স্যার।

কেন? আবার কেন?

দেখতাম কোথাও কিছু পড়ে থাকল কি না। স্টুয়ার্ডকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। যেন এই হত্যার জন্য ওকে সকলে দায়ী করে সরে পড়ছে। সে বলল, স্যার, ধরা পড়লে আমি সকলের নাম বলে দেব। কাউকে ছাড়ব না। আপনারা সকলেই ওকে কামড়েছেন।

বড় মিস্ত্রি ধমক দিলেন, স্টুয়ার্ড, তোমার মন অত্যন্ত ছোট।

স্যার, আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন না। আপনারা কাল থেকে যদি এমুখো না হন তবে কী করতে পারি! স্টুয়ার্ডের গলায় কান্না ভেসে উঠল।

সুখানী পায়ের নখে ডেকের কাঠে আঁচড় কাটবার চেষ্টা করছিল। বড় মিস্ত্রি স্টুয়ার্ডের মুখ দেখছেন। সে মুখ বিবর্ণ। তিনি এবার স্টুয়ার্ডের হাত ধরে বললেন, রাতে কোথাও যাব না স্টুয়ার্ড। ছাদের নিচে বরফ ঘরে মর্লিনের পাশে বসে থাকব। কোনো ভয় নেই তোমার।

ওরা তিনজনই এবার যার যার কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। স্টুয়ার্ড নিজের কেবিনের দরজা খুলে দিল। দরজার পাল্লাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। সে দরজা বন্ধ করতে যেন সাহস করছে না। ওর ভয় করছে। এতদিনের জাহাজি জীবন অথচ কখনও এমন নিষ্ঠুর ঘটনার দ্বারা সে আহত হয়নি।

বড় মিস্ত্রি কিছু বলতে পারছেন না। তিনি খুব ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।

সুখানী বলল, শুয়ে পড় স্টুয়ার্ড। রাত আর বেশি নেই।

সুখানীর ঘর ডেক পার হলে। সে ফোকসালে থাকে। জাহাজের শেষ দিকটাতে জাহাজিদের জন্য অনেকগুলো ঘর। সুখানী এবং ডেক—কসপ সেখানে থাকে—পাশাপাশি বাংকে।

সুতরাং সুখানী বাইরে এসে দেখল, রাত কমে যাচ্ছে। সুখানী হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। রাত শেষ হচ্ছে। বরফ পড়ছে না। ঝড় নেই। এক শান্ত নীল রঙ জাহাজের শরীরে যেন লেপ্টে আছে। কুয়াশা নেই। সুতরাং শহরের আলো স্পষ্ট। আকাশে ইতস্তত নক্ষত্র জ্বলছে। যেসব জাহাজ উষ্ণ স্রোতে সমুদ্রে মাছ ধরতে বের হয়েছিল ওরা একে একে ফিরে আসছে। সে এই শীতের ভিতর রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়াল। রাতের সব ঘটনা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। দেশ বাড়ির কথা মনে হল। স্ত্রীর কথা মনে হল—সন্তান—সন্ততি অর্থাৎ এক সুনিপুণ সাংসারিক জীবনের কথা ভেবে এই জাহাজি জীবনকে ধিক্কার দিতে থাকল। প্রেম, প্রীতি, স্নেহ, হৃদয়ের ঘরে সব মরে গেছে, কারণ এই মৃত্যুজনিত বেদনা সুখানীকে আড়ষ্ট করছে না, মর্লিন মরে গেছে—জাহাজের অন্যান্য জাহাজিরা ঘুমে মগ্ন শুধু ওয়াচের জাহাজিরা জেগে ওয়াচ দিচ্ছে। যদি পুলিশ খোঁজ করতে আসে, যদি এই হত্যাজনিত দায়ে একটা লম্বা দড়ি ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে… সুখানী ভয়ে নিজের গলাটা চেপে ধরল এবার। তারপর আরও সব ভয়ংকর দৃশ্যের কথা ভেবে সে চুপি চুপি স্টুয়ার্ডের কেবিনে ফিরে যাবার জন্য পা চালাল। এক দুরারোগ্য ভয় সুখানীকে নিঃসঙ্গ পেয়ে জড়িয়ে ধরছে।

সে স্টুয়ার্ডের কেবিনে এসে দেখল, দরজা খোলা! পাল্লা ধরে স্টুয়ার্ড আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে ডাকল, এই! এই! হচ্ছে কী! এবং মনে হচ্ছে বজ্রজনিত মৃত্যু। সুখানী ওকে নাড়া দিল বারবার। এবং স্টুয়ার্ডকে টেনে নিল বাংকের কাছে; তারপর ধমক। চুপচাপ শুয়ে থাক। এমন করবে তো খুন করব।

সুখানী ঘুরে গিয়ে বড় মিস্ত্রির কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল। কেবিনের দরজা খোলা। বড় মিস্ত্রি একটা টেবিলের উপর ঝুঁকে আছেন। শরীরে কোনো জীবনের লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না।

সুখানী ডাকল, স্যার, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন।

বড় মিস্ত্রি টেবিল থেকে নড়লেন না।—দরজাটা টেনে দাও সুখানী। বড় মিস্ত্রি টেবিল থেকে মাথা তুললেন না। মর্লিনের সাদা চোখ ওঁকে তখনও অনুসরণ করছে যেন। তিনি কেবিনে পায়চারি করতে থাকলেন। রাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পায়চারি করার ইচ্ছা। ভোরের বাতাসে পাখিরা যখন উড়বে, যখন কোথাও কোনো হত্যা অথবা রাতের দুর্ঘটনাজনিত দুঃখ মাস্তুলের গায়ে লেগে থাকবে না, তখন বড় মিস্ত্রি বাংকে শুয়ে ঘুম যাবার চেষ্টা করবেন।

কিন্তু অধিক সময় তিনি পায়চারি করতে পারলেন না। তিনি বাংকে শুয়ে পড়লেন।

সুখানী ডেক ধরে হেঁটে চলে গেল। সে নিজের ফোকসালে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকল। আলো জ্বালল না। দরজা বন্ধ করে পোর্টহোল খুলে সামনে মুখ রেখে বসে থাকল। রাতের সব পাখিদের দেখে ইতস্তত ছড়ানো নাবিকদের সব ছবি দেখে এবং দূরের জেটিতে একটি শিশুর কান্না শুনে ওরও মর্লিনের জন্য কষ্ট হতে থাকল!

ওরা তিনজন জাহাজের তিনটি ঘরে পোষা পাখিদের মতো ঘুমোচ্ছিল। বরফ ঘরে মর্লিন। ত্রিপলে শরীর ঢাকা পড়ে আছে। অন্যান্য কেবিনে দীর্ঘদিন পর রাতের এই প্রহরটুকুকে জাহাজিরা আস্বাদন করছে। ঠান্ডার জন্য সকলেই কেমন কুঁকড়ে ছিল। কোয়ার্টার মাস্টার গ্যাঙওয়ের ওয়াচ শেষ করে ফোকসালে ফিরে আসছে। ভোরের আলো ফুটে উঠলে সকলে রেলিংয়ে ভর করছে—জেটি অতিক্রম করে শহরের বাস ট্রাম এবং রমণীদের প্রিয়মুখ… তারপর মাটির স্পর্শের জন্য উদ্বিগ্ন এক জীবন…. আহা এই দেশ, মাটি, পাব, নাইট ক্লাব, সুখ শুধু সুখ, উলঙ্গ এক চিন্তা সব সময়ের জন্য—জাহাজিরা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর সুখ নামক উলঙ্গ এক নগরে হাঁটছে যেন।

ওরা তিনজন পোষা পাখির মতো স্বপ্ন দেখল।

বড় মিস্ত্রি স্বপ্নের কোলাহলে এক অপার্থিব দৃশ্য দেখে অনেক দূর চলে যেতে থাকলেন। তিনি দূরে সব চীনার গাছ দেখলেন, আকাশ দেখলেন অথবা দেখলেন পাইন আপেলের নীচে সুন্দরী রমণীগণ নগ্ন হয়ে বসে আছে। তিনি বড় বড় চীনার গাছ ফাঁক করে চলে যাচ্ছেন। ডেইজি ফুলের গন্ধ কোথাও এবং সামনে সেই উলঙ্গ নগর। তিনি পোশাক পরিত্যাগ করে সেই নগরে প্রবেশ করে কেবল হ্যাঁচ্চো দিতে থাকলেন।

বড় মিস্ত্রি স্বপ্নের ভিতর বিগত জীবনের কিছু মহত্তম ঘটনা দেখতে পেলেন।

সুখানী স্বপ্ন দেখল—একটা উট মরুভূমি থেকে নেমে আসছে। ওর সঙ্গে দড়ি দিয়ে এক উলঙ্গ নারীকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বরফঘরে ছাল তুলে নেওয়া গোরু অথবা শূকরের মতো দেখাচ্ছে রমণীকে। উট দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এক মরূদ্যানে প্রবেশ করল। সামনে নীল হ্রদ। হ্রদের জলে উট নেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যুবতী প্রাণ পাচ্ছিল। যখন খেজুর গাছের পাতাগুলি সবুজ গন্ধ ছড়াচ্ছিল তখন সুখানী দেখল যুবতী সেই উটের পিঠে বসে এবং হাজার হাজার পুরুষ সেই যুবতীর জন্য প্রাণ দিতে উদ্যত হচ্ছে। যুবতী বসে বসে প্রেমের আধার থেকে কণামাত্র বিতরণ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সুখানী ফের যখন উটটিকে দেখল তখন স্বপ্নের ভিতর উটটি চলাফেরা করছিল—উটের পায়ে দড়ি এবং দড়িতে রমণীর শরীর আবদ্ধ। সেই এক ঘটনা বারবার চোখের উপর পুনরাবৃত্তি হতে থাকল।

সুখানী স্বপ্নের ভিতর শেষ পর্যন্ত এলবিকে দেখল। এলবির সকরুণ চোখ এবং কান্না স্বপ্নের অলি গলি থেকে বের হয়ে আসছে।

আর স্টুয়ার্ড একটা মৃত কৃমি হয়ে বাংকে পড়েছিল। নড়ছিল না। সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুখ। অথচ ওর স্বপ্নে একটা তাজা গোলাপ ফুল ফুটে ছিল সবসময়। চেরি নামক এক যুবতীর মুখ সেই ফুলের ভিতর থেকে বারবার উঁকি দিচ্ছে। সে শুয়ে শুয়ে শুধু ঢোক গিলল। ওর স্বপ্নের শেষটুকুতে ছিল একটি পুরুষ—অশ্বের নিচে শুয়ে একটি নগ্ন যুবতী বারবার সহবাসের চেষ্টায় ব্যর্থ হচ্ছে।

তারপর জাহাজে ভোর হল। সকলেই উঠে পড়ল একে একে। এখনও জাহাজ—ডেকে অন্ধকার আছে। সারেং সকলকে বলল, টান্টু। ওরা উপরে উঠে এল। ওরা জল মারতে আরম্ভ করল ডেকে। এনজিনের জাহাজিরা এনজিন সারেংয়ের সঙ্গে নিচে নেমে গেল। বয়লারের স্মোকবক্স পরিষ্কার করার জন্য কয়েকজন কোলবয় তরতর করে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল। মেজ মিস্ত্রি একবার নীচে নেমে ব্যালেস্ট পাম্পের আশেপাশে টর্চ মেরে কী যেন অনুসন্ধান করে গেছেন—উপরে এখন ডেকজাহাজিরা ডেকে জল মারছে। রাতে যে তুষারঝড় হয়েছিল জল মেরে তার শেষটুকু যেন পরিষ্কার করে দিচ্ছে। একটু বাদে আলো ফুটবে। এবং রোদ উঠবে।

ডেক—জাহাজিরা গাম—বুট পরে জল মারছিল। হিমেল হাওয়া সমুদ্র থেকে উঠে আসছে। জেটি অতিক্রম করলে বালিয়াড়ি। এ দেশে এবার বসন্ত আসছে। বালির চরে নতুন ঘর উঠছে। কার্নিভেল বসবে। গাছের পাতাসকল কুঁড়ি মেলেছে। ডেক—জাহাজিরা এই শীতের ভিতর রোদের উষ্ণতার জন্য প্রতীক্ষা করছিল এবং তীরের দৃশ্যসকল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার গ্লানি মুছে দিচ্ছিল।

ঠিক এ সময়েই স্টুয়ার্ড দরজা খুলে দেখল ভোর হয়ে গেছে। ওর স্বপ্নের কথা মনে হল এবং মনে হল ভাণ্ডারী, চিফ কুক আসবে রসদ নিতে। তারপর গত রাতের মর্লিন, মৃত্যু এবং হত্যাজনিত দায়—সবকিছু ওকে ফের গ্রাস করতে থাকল। সে বাথরুমে গেল না, চোখমুখ ধুল না—রসদ ঘরের ঢাকনা খুলে তরতর করে নিচে নেমে গেল। বরফ ঘরের দরজা খোলার আগে ভাবল, বড় বড় ভালো গোস্ত বাইরে বের করে দরজা বন্ধ করে দেবে। সে মেনুর কথা ভাবল। কী মেনু হবে এমত একটা আন্দাজ করে দরজা খুলতেই সে ভয়ে এবং বিস্ময়ে হতবাক! দেখল, মর্লিনের মুখ খোলা। মর্লিনের মৃত সাদা চোখ ওকে দেখছে। সে সেই ছোট ত্রিপলে মুখ ঢাকতে গিয়ে দেখল পা বের হয়ে থাকছে। সে টানাটানি করল অনেকক্ষণ। কিন্তু পা মাথা একসঙ্গে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিতে পারল না।

স্টুয়ার্ড একা বলে হুক থেকে গোস্ত নামাতে দেরি হচ্ছিল। ওর কষ্ট হচ্ছিল খুব। কী করবে কী না করবে ভেবে উঠতে পারছে না। একটা অস্পষ্ট আশঙ্কা ওকে সব সময় বিব্রত করছে। ওর গলা শুকিয়ে উঠছে। ছাদে পায়ের শব্দ। ভাণ্ডারী, চিফ কুক নেমে আসছে। ওদের শব্দ পেয়ে সে হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে বসে পড়ল। মর্লিনকে টেনে টেনে বরফ ঘরের বালকেডের পাশে নিয়ে গেল। স্টুয়ার্ড দেখল, ওর অনাবৃত দেহের রঙ এবং এই বাসি গোস্তের রঙ হুবহু এক। সে ঝুলানো ষাঁড় গোরুর ভেতর থেকে দেখল ওরা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। সে কেমন মাথার ভিতর যন্ত্রণা বোধে অবসন্ন হয়ে পড়ছে। সে দুবার দুর্গা দুর্গা নাম জপতেই ভূতের মতো নতুন এক বুদ্ধির আশ্রয়ে চলে গেল—কপিকলটাকে এগিয়ে এনে মর্লিনকে পায়ে গেঁথে হুকে ঝুলিয়ে দিল। সে নিচে বসে সব দেখতে দেখতে ভাবল—এই অনাবৃত শরীরের রঙ নিয়ে মর্লিন এখন ছাল চামড়া ছাড়ানো গোরু ভেড়া হয়ে গেল। দরজা থেকে মর্লিনের অস্পষ্ট শরীরের রঙ এবং আকার আধপোড়া শূকরের মতো দেখাচ্ছিল। স্টুয়ার্ড বুঝল, এই ঘরের দেয়াল, ছাদ এবং হুকের সর্বত্র একই দুঃখময় নৈরাশ্যে নিমজ্জিত। সে দরজার ভিতর দিয়ে ঝোলানো গোস্তের সঙ্গে মর্লিনের এতটুকু প্রভেদ খুঁজে পাচ্ছে না। সে এবার কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারল। রসদ বের করে অন্যান্য দিনের মতো কমবেশি করার স্পৃহাতে মেসরুম—মেটকে ডেকে আলু কপির ঘরে হামগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে ঢুকে গেল।

অন্যান্য দিনের মতো চিফকুকের সঙ্গে স্টুয়ার্ডের বচসা হল না রসদ নিয়ে। চিফকুক উলটেপালটে গোস্ত দেখল। ওরা রসদ নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। ডেক ভাণ্ডারী এবং এনজিন ভাণ্ডারীও রসদ নিয়ে উপরে উঠে গেল। স্টুয়ার্ড সকলকে দুটো করে আলাদা ডিম দিয়েছে। চিফকুককে আলাদা অক্সটেল দিয়েছে। সকলেই মোটামুটি খুশি। ওরা সকলে রসদ নিয়ে উপরে উঠে গেলে স্টুয়ার্ড ফের বরফ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। অনেকগুলো ঝুলানো মাংসের লাশ অতিক্রম করে মর্লিনের পিঠ এবং মাথার ডান দিকের অংশটা অস্পষ্ট এক শূকরের মাংসের মতো। টার্কির পেটের দিকটার মতো নিতম্বের ভাঁজ। এই ঘরে মর্লিন শূকর ভেড়া অথবা গোরুর মতো শরীর নিয়ে এখন হুকে ঝুলছে। শুকনো স্তন এবং অন্য কিছু দেখার জন্যই সে এবার ভিতরে ঢুকে মুখোমুখি দাঁড়াল। মর্লিনের তলপেট সংলগ্ন মুখ, সোনালি চুলে এখনও তাজা গন্ধ, অথচ মর্লিনকে মরা মাংস ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। সে পেটের নিচে হাত বুলোতে থাকল অন্যমনস্কভাবে।

যে ভয়টা নিরন্তর কাজ করছিল স্টুয়ার্ডের মনে এ সময় সেই ভয়টা কেটে যাচ্ছে। সে বলল, মর্লিন আমরা তোমাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করব। সে প্রদক্ষিণ করার মতো মর্লিনের শরীরটা একবার ঘুরে ঘুরে দেখল। সে বলল, এই নিষ্ঠুরতার জন্য গতকালের তুষারঝড় দায়ী। অথচ মনে হল— নিরন্তর সে তার অপরাধবোধকে দূরে রাখার স্পৃহাতে এমন সব কথা বলছিল। সে নিজের মনেই হেসে বলল, শুধু মাংস ভক্ষণে তৃপ্তি থাকে না মর্লিন।

তারপর সে দরজা বন্ধ করে উপরে উঠে যাচ্ছে।

জাহাজে দৈনিক কাজ জাহাজিরা করে নিচ্ছে। সারাদিন কাজ। দিন ছোট বলে রাতের কিছু অংশও ওদের কাজের ভিতর ঢুকে গেল। সারাদিন কাজের পর এক সময়ের জন্য বড় মিস্ত্রি, স্টুয়ার্ড এবং সুখানী একত্রে বসেছিল। ওরা কোনো কথা বলেনি। কারণ রাতে একই দুঃস্বপ্ন এসে এদের জড়িয়ে ধরবে ওরা জানত।

ওরা প্রতি রাতে জাহাজের কেবিনে দুঃখী জাহাজির মতো বসে থাকত।

একদিন ওদের পোর্টহোলের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ায় সুখানী বলল, বড় সাব, বাইরে রোদ উঠেছে।

বড় মিস্ত্রি বললেন, সুখানী, চল, মর্লিনকে দেখে আসি।

স্যার, ও—ভাবে মর্লিনকে আমি দেখতে পারব না। স্যার, বরং আমাদের পুলিশের কাছে ধরা দেওয়া ভালো। এভাবে মৃতদেহের উপর কুৎসিত আচরণ করে জাহাজে আমি বাঁচতে পারব না। রাতে স্যার ঘুম হচ্ছে না। যেখানে যখন থাকছি মর্লিন মৃত পাথরের চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকছে।

স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, আমার সামনে শুধু ঈশ্বরের থাবা। যেখানে থাকছি সেখানেই গলা টিপে ধরতে চাইছে।

বড় মিস্ত্রি দেখছেন ধীরে ধীরে ওরা তিনজনই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বড় মিস্ত্রি বললেন, রাতে আজকাল একই স্বপ্ন দেখছি—আমার স্ত্রী সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছেন। মৃত। চোখ মুখ পচে গেছে।

সুখানীর চোখ মুখ লাল। ওর শরীর বাংকের উপর হিংস্র থাবা নিয়ে বসে আছে।

বড় মিস্ত্রি স্টুয়ার্ডকে বললেন, স্টুয়ার্ড, মর্লিনকে সন্ধ্যার পর হুক থেকে নামিয়ে বাইরে শুইয়ে রাখবে। আমি আর সুখানী শহর থেকে ফুল নিয়ে আসব। ওর পোশাক যেন পরানো থাকে। আমরা মর্লিনকে ভালোবাসার চেষ্টা করব।—সুখানী, তিনি সুখানীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমার মনে হয় যদি যথার্থই আমরা মর্লিনকে ভালোবাসতে পারি, যদি মনে হয় মর্লিনের শরীর প্রীতিময়—তখন আমাদের পাপবোধ নিশ্চয়ই কিছুটা লাঘব হবে। কারণ আমরা সকলেই একদিন এরকম ছিলাম না। আমরা ঘুমোতে পারব। সারারাত কঠিন দুঃস্বপ্ন আমাদের আগলে থাকবে না।

সুখানী বলল, বরং আমাদের জীবনেও কিছু কিছু মহত্তর ঘটনা আছে যা মর্লিনকে ফুল দেবার সময় বলতে পারি।

পাঁচটা না বাজতেই জাহাজ ডেকে রাত নেমে এল। বাইরে ঠান্ডা। শীত যাবার আগে যেন বন্দরটাকে প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ভোরের রোদটুকু এবং আকাশের পরিচ্ছন্নতা এই শীতকে তীব্র তীক্ষ্ন করেছে। ওরা তিনজন গ্যাঙওয়ে ধরে নেমে গেল। ওরা ওভারকোট পরেছিল, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ ছিল ওদের। বড় মিস্ত্রি হাতে একটা স্টিক রেখেছে।

সুখানী সহসা বলল, স্যার স্টুয়ার্ডের ফিরে যাওয়া উচিত। মর্লিনকে জাহাজে একা ফেলে রাখা উচিত হয়নি। অন্য কেউ যদি ওকে আবিষ্কার করে ফেলে?

বড় মিস্ত্রি বললেন, আরে না! তুমিও যেমন—স্টুয়ার্ড ফাঁক পেলেই ওখানে ঘুর ঘুর করবে এবং ধরা পড়ার সুযোগ করে দেবে।

এ সময় ওরা সমুদ্রের ধারে ধারে কিছু পুরুষ এবং রমণী দেখতে পেল। জেটির জাহাজগুলো অতিক্রম করে ছোট এক মাঠ, কিছু টিউলিপ ফুলের গাছ। বার্চ জাতীয় গাছের ছায়ায় ছায়ায় ওরা হেঁটে যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে সব লাল নীল রঙের বাড়ি। এবং সাদা আলো। সমুদ্রের জল বাতাসের সঙ্গে উঠে আসছে। ইতঃস্তত ভিন্ন ভিন্ন পাব এবং নাইট ক্লাবের লাল বিজ্ঞাপন। অন্য দিন হলে স্টুয়ার্ড এইসব নাইট ক্লাবে ঢুকে যেত, ওদের উলঙ্গ নাচ দেখে সারারাত কামুক হাওয়ায় ভেসে বেড়াত। সুখানী, পাবের ধারে অথবা রাস্তার মোড়ে পালকের টুপি পরে সং দেখানোর মতো যারা দাঁড়িয়ে থাকত তাদের একজনকে বগলে চেপে বালিয়াড়িতে নেমে যেত—কিন্তু আজ ওরা তিনজনই শুধু দেখছে, ওরা তাজা ফুল কেনার জন্য পথ ধরে হাঁটছে।

বড় মিস্ত্রি স্টুয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মর্লিনকে জেটির কোন জায়গা থেকে তুলে নিয়েছিল?

জেটির তিন নম্বর ক্রেনের নিচ থেকে।

সুখানী স্টুয়ার্ডকে পুলিশের মতো জেরা করে বলল, সে তখন কী করছিল?

একজন জাহাজিকে সুখ দিচ্ছিল।

কতক্ষণ ধরে?

খুব শীত। সময় আমি হিসাব করিনি।

তুমি ওকে কী বললে?

আমি একটু সুখ চাইলাম।

উত্তরে সে কী বলল?

ওরা উঁচুনিচু পথ ধরে হাঁটছিল। ওরা শহরের বাজার দেখার জন্য এবং ফুল কেনার জন্য উঠে যাচ্ছে। বড় মিস্ত্রি চলতে চলতে লাঠি ঘুরাচ্ছিলেন, যেন তিনি কুকুরের দৌড় দেখতে যাচ্ছেন। হত্যাজনিত কোনো ভয়ই ওদের এখন নেই, এমত চোখ—মুখ ওদের সকলের।

সে বলল, একটু গরম দাও আমাকে, নইলে শীতে মরে যাব।

বড় মিস্ত্রি ধমকের সুরে বললেন, সুখানী, আমরা এই বন্দর—পথ ধরে কোথায় যাচ্ছি?

স্যার, ফুল কিনতে।

কিন্তু গোটা পথটা ধরে তুমি একটা পেটি দারোগার মতো কথা বলছ!

বড় মিস্ত্রিকে খুশি করার জন্য সে বলল, আজ ভোরেও স্যার কাগজ দেখলাম। শহরের কর্তৃপক্ষ মর্লিন সম্পর্কে একেবারে উদাসীন। শহর থেকে একটি মেয়ে গায়েব হয়ে গেল অথচ…

স্টুয়ার্ড নাকের মধ্যে রুমাল ঢুকিয়ে ভিতরটা পরিষ্কার করল। এবং বলল, নিরুদ্দিষ্ট কলামটা দেখেছিলে?

হ্যাঁ, দেখেছিলাম বইকি। ওতে আছে, এক ভদ্রমহিলার একটি কুকুর নিখোঁজ হয়েছে। কুকুরের যে খোঁজ দিতে পারবে তাকে দশহাজার পাউন্ড পুরস্কৃত করা হবে। স্যার, চলুন, একটা কুকুর ধরে নিয়ে ভদ্রমহিলার কাছে যাই।

ওরা একটা পথের মোড় ঘুরল। এই পথটা একটু অন্ধকার। ওরা ক্রমশ সমুদ্র থেকে দূরে সরে আসছে। সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে না আর। বাতাসের সঙ্গে তেমন জলীয় কণাও নেই। আগন্তুক তিনজনকে শহরের পুরুষ ও রমণীগণ দেখছিল। নীল আলো, হিমেল হাওয়া এবং পথের বাস, ট্রামের শব্দ, নাইট ক্লাবের সংগীত, কাফে, বার মিলে একটা রহস্যের অন্ধকার যেন এই পথটার ভিতর ঢুকে স্তব্ধ হয়ে আছে। ওরা এখানে থামল। একটা বাড়ির ভিতর থেকে কিছু কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে। ওরা দেখল, উপরে লেখা আছে ‘কুকুর ভাড়া পাওয়া যায়’।

ওরা একসময় একটা সরু লেগুনের পাড় ধরে হাঁটতে থাকল। উঁচুনিচু পথ। সমুদ্র বড় সন্তর্পণে খুব সরু পথ করে শহরের ভিতর ঢুকে গেছে। কতবার ডেসি এবং বড় মিস্ত্রি এখানে নৌকা বাইচ দেখতে এসেছিলেন। ডেসিকে নিয়ে বড় মিস্ত্রি কোন কোন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন—নৌকা বাইচ দেখার পর লেগুন অতিক্রম করে এক নির্জন স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় একটি বার্চগাছের নিচে অথবা দূরের সব পাহাড়শ্রেণী পার হলে ছোট্ট কিশোরী মেয়ের গ্রাম্য এক পাবে সারাদিন মাতলামি এবং অন্য অনেক সব নগণ্য ঘটনার স্মৃতি ভিতর থেকে বয়ে বয়ে উঠে আসছিল।

বড় মিস্ত্রি, সুখানী এবং স্টুয়ার্ডের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললেন কারণ যে সেতুটা এই লেগুনকে সংযুক্ত করছে সেখানে হরেক রকম যুবক—যুবতী লেগুনের জলে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে এবং প্রেম নিবেদন করছে। দূরে পাহাড়শ্রেণী, মাথায় লাল নীল অজস্র আলো। লেগুনের নীল জলে সরু সরু স্কিপ বাঁধা। ছই আছে এবং অনেকটা ঘরের মতো—যেখানে ইচ্ছা করলেই কোনো বেশ্যা রমণীকে নিয়ে রাত কাটানো যায়। ডেসি এবং বড় মিস্ত্রি অনেকবার এইসব স্কিপে রাত কাটিয়েছেন—ওদের দুজনকে আজ তিনি এ কথা জানালেন। জাহাজে রোজ রোজ ডেসি যাচ্ছে আর রোজ রোজ তিনি তাড়িয়ে দিচ্ছেন—এ কথাও জানালেন। নির্মল এই আকাশ, মাথার উপর পাহাড়শ্রেণীর অজস্র আলো এবং দূরের কোনো গ্রাম্য পাবের কিশোরী এক বালিকার মুখচ্ছবি—বড় মিস্ত্রিকে প্রাণ খুলে কথা বলবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিল।

বড় মিস্ত্রি বললেন, কী ফুল কিনবে?

ওরা তখন সেতু অতিক্রম করে নিচে বাজারের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।

সুখানী বলল, রজনীগন্ধা দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এখানে তা পাওয়া যাবে না।

সুখানী একটা ফুলের নাম মনে আনার চেষ্টা করছিল। অথচ কিছুতেই সে নামটা স্মরণ করতে পারল না। ফুলগুলি এ অঞ্চলে পাওয়া যায়, ঠিক রজনীগন্ধারই মতো। ফুলগুলির গায়ে মোমের রঙ অথবা যেন কচি আঙুরের স্তবক এবং সুগন্ধময়। সে ভাবল সেই সব ফুলের স্টিক কিনে নেওয়া যাবে।

ওরা বাজারে ফুলের গলিতে ঢুকে গেল।

স্টুয়ার্ড বলল, স্যার আমরা ব্যবহারে যথার্থই মানুষের মতো হবার চেষ্টা করব। আমরা মদ খাব না এই ক’দিন।

এটা ভালো প্রস্তাব বটে। বড় মিস্ত্রি মাথা নাড়লেন।

ওরা ফুল নিয়ে জাহাজে উঠে গেল একসময় এবং ভালোবাসার অভিনয় করার জন্য নাটকের প্রথম অঙ্কের গর্ভে ঢুকে গেল।

কেবিনে ওরা আরও কিছুক্ষণ বসে থাকল। দেয়ালের সাদা রঙ কেবল এই কেবিনে শূন্যতা সৃষ্টি করছে। ওরা পরস্পর কিছুক্ষণের জন্য অপরিচিতের মতো মুখ করে বসে থাকল। ওয়াচের ঘণ্টা পড়ছে। সারাদিন জেটিতে যে চঞ্চলতা ছিল, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিভে আসছে। দূরে সমুদ্র গর্জন করছে। আকাশ তেমনি পরিষ্কার। এই জাহাজের বুকে নক্ষত্রের আলো এসে নামছে। তিনজন নাবিক বসে থাকল। রাতের নিঃসঙ্গতার জন্য বসে থাকল। ওরা মর্লিনের জন্য মর্লিনের পাশে দুঃখ লাঘবের জন্য বসে থাকল। ওরা আগের মতোই চুপচাপ। দূর থেকে আগত সমুদ্র গর্জন শোনার জন্যই হোক অথবা এই জাহাজের কোনো কক্ষে রমণীর মৃত শরীর হুকে ঝুলছে, রমণীর ঘর সংসার, ওদের দুঃস্বপ্ন সকল… মানুষ এক নির্লজ্জ ইচ্ছার তাড়নাতে ভুগছে এইসব চিন্তা, তারপর সমুদ্র অতিক্রম করে সেই প্রিয় সংসার এবং মাঝে মাঝে পুলিশ নামক এক জন্তুর ডাক… ওরা ভয়ে পরস্পর এখন তাকাতে পারছে না।

স্টুয়ার্ড বলল, আসুন, স্যার, একসঙ্গে নামি। একা একা নামতে ভয় করছে। স্টুয়ার্ড হাতের দস্তানা বের করল বালিশের ভেতর থেকে। ওভারকোট নিল এবং জুতো জোড়া বের করার সময় সুখানী চিৎকার করে উঠল, স্টুয়ার্ড একটা রাস্কেল। স্যার, সে মর্লিনকে হুক থেকে নামায়নি। আমি যাব না স্যার, আমার বীভৎস দৃশ্য সহ্য হবে না।

বড় মিস্ত্রি প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসলেন। বললেন, ওটা বীভৎস বললে চলবে কেন সুখানী?

স্টুয়ার্ড বলল, আপনিই বলুন স্যার।

বড় মিস্ত্রি ফের বললেন, আমরা এই মানুষেরা বীভৎস স্থানটুকুর জন্যই লড়াই করছি। সংগ্রাম বলতে পারো অথবা লোভ লালসা, চরম কুৎসিত বস্তুটির জন্য আমাদের কামুক করে রাখে। এবার বড় মিস্ত্রি সুখানীকে দু’হাতে ঠেলে রসদ ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে বললেন, তুমি যদি পা দুটো উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে দেখ, কী দেখবে সুখানী? একটা মুখের মতো অবয়ব দেখবে, নাক দেখবে, গহ্বর দেখবে। শুধু চোখ নেই। কবন্ধের মতো অথবা অন্ধ বলতে পারো। আর অন্ধ বলেই সকল অত্যাচার নীরবে সহ্য করছে। অন্ধ বলেই এত কুৎসিত, এত ভয়ংকর এবং আমাদের এত ভালোবাসা।

রসদ ঘরে আলু পেঁয়াজের গন্ধ। ডিমের শুকনো গন্ধ। বাসি বাঁধাকপির গন্ধ মলমূত্রের মতো। সুখানী ফুলগুলি এবার বুকে চেপে ধরল। স্টুয়ার্ড বরফ—ঘরের দরজা খুলে বড় মিস্ত্রিকে দেখাল—কিছু কি দেখতে পাচ্ছেন স্যার?

বড় মিস্ত্রি যথার্থই কিছু দেখতে পেলেন না। সারি সারি হুকে বড় বড় ষাঁড়ের শরীর ঝুলছে। ভেড়া এবং শূকর। টার্কির শরীর পর্যন্ত। সব এক রঙ। এক মাংস। এবং শুধু ভক্ষণের নিমিত্তই তৈরি। তিনি নিজেই এবার ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, মর্লিন কোথায় স্টুয়ার্ড!

ওরা একটি টেবিল সংগ্রহ করে মর্লিনকে সযত্নে তার উপরে রেখে দিল। পোশাক পরানো হল। পায়ে জুতো এবং ফুলগুলি ওর মাথার কাছে রেখে ওরা বসে থাকল নির্বোধের মতো। বড় মিস্ত্রি পায়ের দিকটায় বসে আছেন। দু’পাশে সুখানী এবং স্টুয়ার্ড। ওরা মর্লিনের মুখ দেখছিল। যত ওরা মৃত মুখ দেখছিল তত ওদের এক ধরনের আবেগ গলা বেয়ে উঠে আসছে। ওর প্রতি আচরণে এতটা নির্বোধ না হলেও চলত এমত এক চিন্তার দ্বারা প্রহৃত হচ্ছে। বড় মিস্ত্রিই বললেন, এই মৃত রমণীর কাছে আমাদের জীবনের এমন কী মহত্ত্ব ঘটনা আছে যা বলতে পারি—তিনি এইটুকু বলে উঠে দাঁড়ালেন—এমন কী ঘটনা আছে জাহাজি জীবনে যা বলে এই তীক্ষ্ন বিষণ্ণতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি?

সুখানী বলল, ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে। এইটুকু বলে চিবুকে হাত রাখে সুখানী। কিছুক্ষণ কী যেন দেখল সমস্ত ঘরটার ভিতর। পাশের একটা ষাঁড়ের শরীর ঝুলছে। এবং মাঝে মাঝে ওর শরীরে এসে ধাক্কা দিচ্ছে যেন। সে বলল, আমরা সকলেই জীবনের কোনো না কোনো মহত্তর ঘটনা বলব। চিরদিন আমরা এমন ছিলাম না।

স্টুয়ার্ড বলল, মহত্তর ঘটনা বলতে পারলে ফের আমরা ঘুমোতে পারব।

বড় মিস্ত্রি পায়ের কাছটায় বসলেন আবার।

স্টুয়ার্ড দেখল ওদের সকলের চোখ ধীরে ধীরে কোটরাগত হচ্ছে। চোখের নিচে এক ধরনের অপরাধবোধের চিহ্ন ধরা পড়েছে। সে সুখানীকে বলল… আচ্ছা সুখানী, আমার চোখের নিচে কালি পড়েছে!

আয়নায় দেখো। আমার তো মনে হয় তোমারই সবচেয়ে বেশি!

সুমিত্র, বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার, কাপ্তান আমাকে বলেছেন, তোমার কি কোনো অসুখ করেছে স্টুয়ার্ড? তোমাকে খুব পীড়িত দেখাচ্ছে!

অবনীভূষণ বললেন, তুমি আবার বলনি তো, রাতে স্যার ঘুম হচ্ছে না। কেমন এক অশরীরী পাপবোধ চারধারে ঘোরাফেরা করছে। বলনি তো?

আমি পাগল নাকি স্যার! আমি এমন কথা বলতে পারি?

সুখানী এবার কঠিন গলায় বলল, তুমি শালা পাগল। আলবত পাগল। পাগল না হলে একটা রুগণ বেশ্যা মেয়েকে কেবিনে কেউ তুলে আনতে পারে?

স্যার, আপনি শুনুন। নালিশের ভঙ্গিতে বলল সুমিত্র।

সুখানী, তুমি বেশ্যা বলবে না। মর্লিন বেশ্যা হলে তোমার মা—ও বেশ্যা।

বড় মিস্ত্রি তার মাকে বেশ্যা বলেছে—বিজন ভাবল। সে সুখানী জাহাজের আর অবনীভূষণ বড় মিস্ত্রি জাহাজের। সুতরাং বড় মিস্ত্রির বিজনের মাকে বেশ্যা বলার এক্তিয়ার আছে। সুতরাং বিজন চুপচাপ বসে থাকল। কোনো জবাব দিল না। নির্বোধের মতো তাকাতে থাকল ফের ঘরের চারিদিকে।

সুমিত্র আর দেরি করতে চাইল না। সে বলল, স্যার আমার জীবনে একটা মধুর ঘটনা আছে। অনুমতি দিলে বলতে পারি।

বলবে? অবনীভূষণ অদ্ভুতভাবে ঠোঁট চেপে কথাটা বললেন।

হ্যাঁ স্যার, আগেই বলে ফেলি। আগে আগে যদি একটু ঘুমোতে পারি।

বলো।

সুমিত্র গল্প আরম্ভ করার আগে মর্লিনের মুখের খুব কাছে ঝুঁকে পড়ল। বলল, এই মুখ দেখলে, স্যার আমার শুধু চেরির কথা মনে হয়। তখন জাহাজে স্যার তেলওয়ালার কাজ করতাম।

বিজন এবার উঠে দাঁড়াল। আমি সুখানী জাহাজের, তাছাড়া আমি স্যার এই তিনজনের ভিতর সকলের ছোট। আমাকে সকলের আগে বলতে দেওয়া হোক। বলে সেও মর্লিনের মুখের কাছে ঠিক স্টুয়ার্ডের মতো ঝুঁকে পড়ল। সে বলল, এই মুখ দেখলে শুধু এলবির কথা মনে হয়। তখন স্যার আমাদের জাহাজ অস্ট্রেলিয়াতে।

সুমিত্র চিৎকার করে উঠল, বেয়াদপ!

বড় মিস্ত্রি দেখলেন ওরা ঝগড়া করছে—তিনি বললেন, বরং গল্পটা আমিই বলি। বলে তিনি আরম্ভ করলেন—শেষ রাতের দিকে ভীষণ ঝড়ের ভিতর জাহাজ বন্দর ধরেছে। আমি তখন জাহাজের পাঁচ নম্বর মিস্ত্রি। আমাদের জাহাজ সেই কবে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে নোঙর তুলে সমুদ্রে ভেসেছিল, কবে কোন এক দীর্ঘ অতীতে যেন। আমরা বন্দর ফেলে শুধু সমুদ্র এবং সমুদ্রে ভাসমান দ্বীপ—বালির অথবা পাথরের জনমানবহীন দ্বীপ দেখছি। সুতরাং দীর্ঘদিন পর বন্দর পেয়ে তুষাররাতেও আমাদের প্রাণে উল্লাসের অন্ত ছিল না। আমাদের মেজ মালোম উত্তেজনায় রা রা করে গান গাইছিলেন…।

অবনীভূষণ কিছুক্ষণ থেমে সহসা বলে ফেললেন, এ কী স্টুয়ার্ড তুমি বাসি বাঁধাকপির মতো মুখ করে বসে আছ কেন? শুনছ তো গল্পটা।

কী যে বলেন স্যার!

বুঝলে তোমাদের অবনীভূষণও বিকেলের দিকে সাজগোজ করে তুষারঝড়ের ভিতরেই বের হয়ে পড়ল। সেই লম্বা ওভারকোট গায়ে অবনীভূষণ, লম্বা তামাকের পাইপ মুখে এবং ভয়ংকর বড় বেঢপ জুতো পরে অবনীভূষণ গ্যাঙওয়ে ধরে নেমে গেল। আর নেমে যাবার মুখেই দেখল মেজো মালোম বন্দর থেকে ফিরছে। মেজ মালোম বেশ সুন্দরী এক যুবতীকে নিয়ে এসেছেন। যুবতীর পাতলা গড়ন, ছিমছাম চেহারা আর কালো গাউন, সোনালি ব্লাউজের উপর ফারের মতো লম্বা কোট গায়ে।

তুষারঝড়, সুতরাং গাছের পাতা সব ঝরে গেছে। আর পাতা ঝরে গেছে বলে কোনো গাছই চেনা যাচ্ছে না। ওরা বৃদ্ধ পপলার হতে পারে, পাইন হতে পারে এমনকি বার্চ গাছও হতে পারে। আমার সঙ্গে আমার প্রিয় বন্ধু ডেক অ্যাপ্রেন্টিস উড ছিল। শীতে পথের দু’পাশে কাঠের বাড়ি এবং লাল নীল রঙের শার্সির জানালা এবং বড় বড় জানালার ভিতর পরিবারের যুবক—যুবতীদের মুখ, একর্ডিয়ানের সুর, গ্রাম্য লোকসংগীত তোমাদের অবনীভূষণকে ক্রমশ উত্তেজিত করছে।

বড় মিস্ত্রি এবার সুখানীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার সব হুবহু মনে পড়ছে। নাচঘরে অবনীভূষণ দুজন যুবতীকে একলা দেখতে পেল।

তখন ব্যান্ড বাজছে, হরদম বাজছে। মদের কাউন্টারে ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাবিক এসে ভিড় করছিল। ওরা কেউ কেউ মাথার টুপি খুলে তিমি শিকারের গল্প আরম্ভ করল। উত্তর সাগরে ওরা গর্ভিণী তিমি শিকার করতে গিয়ে দুজন নাবিককে হারিয়েছে এমন গল্পও করল। ভিড় সেই কাচঘরে ক্রমশ বাড়ছিল। মিশনের ডানদিকে মসৃণ ঘাসের চত্বর আর মৃত বৃক্ষের মতো কিছু পাইন গাছ—তার নিচে বড় বড় টেবিল আর ফাঁকা মাঠে হেই উঁচু এক হারপুনার হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছে। হারপুনার কাচঘর অতিক্রম করে কাউন্টারের সামনে লোকটির সঙ্গে ফিস ফিস করে কী বলছে। অবনীভূষণ সব লক্ষ্য করছিল। হারপুনার সেই যুবতী দুজনকে উদ্দেশ্য করে হাঁটছে। অথবা তোমাদের অবনীভূষণের মনে হচ্ছিল যেন কে বা কারা সেই যুবতী দুটিকে উদ্দেশ্য করে লম্বা গলায় বড় রাস্তায় হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছে…. ট্যানি টরেন্টো… ট্যানি টরেন্টো….

রাত ক্রমশ বাড়ছিল। গল্প ক্রমশ জমে উঠেছে। মর্লিনের সাদা মুখ এবং পায়ের নিচে বসে বড় মিস্ত্রি সব দেখতে পাচ্ছিল। এখন যেন আর সেই মুখ দেখে অবনীভূষণের এতটুকু ভয় করছে না। তিনি এবার প্রিয় মর্লিনকে উদ্দেশ্য করেই যেন গল্পটা শেষ করলেন—অবনীভূষণের মনে হল দীর্ঘদিন পর তিনি এক অসামান্য কাজ করে ফেলেছেন। বুঝলে মর্লিন, তোমার এই বড় মিস্ত্রি সেই জাহাজে আবদ্ধ যুবতীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, আপনি নির্ভয়ে ঘুমোন, আমি বাইরে তুষারঝড়ের ভিতর বসে আপনার পাহারায় থাকছি। বলে তোমার বড় মিস্ত্রি দরজা বাইরে থেকে টেনে বদ্ধ করে দিয়েছিল এবং ঠিক দরজার সামনে ভয়ংকর ঠান্ডার ভিতর পা মুড়ে বসেছিল এবং জেগে জেগে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন… দ্বীপের স্বপ্ন… বড় এক বাতিঘর দ্বীপে, সব বড় বড় জাহাজ সমুদ্রগামী—জাহাজের মাস্তুলে তোমাদের অবনীভূষণ ‘মানুষের ধর্ম’ বড় বড় হরফে এইসব শব্দ ঝুলতে দেখল। অবনীভূষণ নিঃশব্দে হাঁটু মুড়ে মাথা গুঁজে বসে থাকল—তার এতটুকু নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না, যেন জীবনের সাত রাজার ধন এক মাণিক খুবই হাতের কাছে রয়েছে। তাকে গলা টিপে মারতে নেই।

বড় মিস্ত্রি জীবনের সেই মহৎ গল্পটুকু বলে সকলকে দুঃখিত করে রাখলেন। মর্লিনের মৃত শরীরে এবার ওরা ফুল রাখল। এবং ওরা যথার্থই এখন এই রসদ ঘরে সেই যুবতীকে প্রত্যক্ষ করল।

সুখানী, বড় মিস্ত্রি ফুল রেখে উপরে উঠে যাচ্ছে। পিছনে স্টুয়ার্ড দরজা বন্ধ করে ফিরছে। ওরা সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল। খোলা ডেকে দাঁড়াল। এই উদার আকাশ এবং শহরের নীল লাল আলো এবং সাগর দ্বীপের পাখিরা কেবল ডাকছে। ওরা এখন সমুদ্রের সিঁড়ি ভেঙে আকাশের তারা গুণতে থাকল যেন এবং এ সময়েই ওরা ঘরে ফেরার জন্য সকলে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ওরা নির্জন ডেক ধরে যে যার আশ্রয়ে চলে গেল। পরস্পর কোনো কথা বলল না। বলতে পারল না।

এরা বন্দরে নেমে সোজা মার্কেটে চলে গেল। পথের কোনো দৃশ্যই ওদের আজ চোখে পড়ছে না। তাজা ফুলের জন্য ওরা সন্ধ্যা না হতেই দোকানে ভিড় করল। ওরা আজও তিনগুচ্ছ ফুল নিয়ে জাহাজে ফেরার সময় কোনো পাব—এ ঢুকে একটু মদ খাবার জন্য আকুল হল না। মর্লিন এক তীব্র পাপবোধের দ্বারা ওদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

স্টুয়ার্ড নিজের কেবিনে চোখ টেনে আর্শিতে দেখল। চোখের নিচটা টেনে টেনে দেখল। রুগণ পীড়িত ভাবটা কমেছে কী না দেখল। বড় মিস্ত্রির চোখ দেখল। বড় মিস্ত্রিকে কিঞ্চিৎ সতেজ মনে হচ্ছে।

সে বড় মিস্ত্রির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, স্যার, আমাকে আগের চাইতে সুস্থ মনে হচ্ছে না?

সুখানী বলল, মোটেই না।

বড় মিস্ত্রি বললেন, আমাদের তিনজনকেই গত রাতের চেয়ে বেশি সুস্থ মনে হচ্ছে।

ওরা সিঁড়ি ধরে নিচে নামবার সময় শুনল, দূরে কোথাও একদল পাখি উড়ে যাচ্ছে। ওদের মুখে খড়কুটো। ওরা আসন্ন ঝড়ের আগে ডিম পাড়ার জন্য পাহাড়ের খাঁজ অন্বেষণে রত। সুখানী সিঁড়ি ধরে নামবার সময় পাখিদের মুখে খড়কুটো দেখল। কেবল বড় মিস্ত্রি শুনলেন পাখিরা পাখায় রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে বিষণ্ণ সুরে কাঁদছে।

স্টুয়ার্ড একধারে ফুলগুলি রেখে মর্লিনের মুখটা ঠিক করে দিল। তারপর গাউনটা টেনে পায়ের নিচটা পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপর বাসি ফুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে দেবার সময় বলল, মনে হয় আমরা আমাদের প্রিয়জনের পরিচর‍্যা করছি। আমাদের এত যত্ন মর্লিন বেঁচে থাকতে পেত!

সুখানী বলল, আচ্ছা স্যার, এসব করার হেতু কী? কী দরকার এই ফুল সংগ্রহের। কী দরকার প্রতি রাতে এ—ভাবে… আমাদের আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাস যুক্তির যে ধর্ম থাকছে না।

বড় মিস্ত্রি বাধা দিয়ে বললেন, মৃতের প্রতি সম্মান দিতে হয় সুখানী। মর্লিনকে এখন যত সুন্দর মনে হচ্ছে, যত স্বচ্ছ মনে হচ্ছে, ওকে আমরা এখন যত ভালোভাবে দেখতে পারছি…

স্টুয়ার্ড মাঝপথেই বলে ফেলল, মর্লিন যে সত্যের জোরে বেঁচে ছিল এতদিন, মরে গিয়ে সেই সত্যকে সে আবিষ্কার করল, কী বলেন স্যার? আর সেজন্যই বোধহয় ওকে আমরা এত ভালোবেসে ফেলেছি।

সুখানী বলল, কীসব বলছ পাগলের মতো। বলে যে মর্লিনের শক্ত হাত পাগুলিকে ঠিক করে দিল। চুলগুলি যত্ন করে গুছিয়ে দিল। তারপর টেবিলটাকে প্রদক্ষিণ করার সময় ষাঁড় গোরু অথবা শূকরের মাংস ঝুলতে দেখে জীবন সম্পর্কে কেমন উদাসীন হয়ে পড়ল। সে চেয়ারে বসে মর্লিনের পায়ের কাছে মাথা রেখে ঘুম যাবার ভঙ্গিতে হাত পা টানা দিতে গিয়ে বুঝল এই শরীর এখন মলমূত্রের আধার। অথচ মর্লিনের চোখ পাথরের মতো। বড় মিস্ত্রি মর্লিনকে নিবিষ্ট মনে দেখছেন, স্টুয়ার্ড গল্প আরম্ভ করেছে।

সে বলল, তখন আমি জাহাজের তেলয়ালা সুমিত্র। সে বক্তৃতার কায়দায় বলল, স্যার আপনি আছেন, নচ্ছার সুখানী আছে আর এই সম্মানীয়া অতিথি—আমাদের এই মহত্তর ঘটনার স্মৃতিমন্থনই আশা করি আমাদের সুস্থ করে তুলবে।

সুখানী বলল, তাহলে বুঝতে হবে মাথাটা আর ঠিক নেই।

চুপ রও বেয়াদপ! তুমিই সব নষ্টের গোড়া। বলে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। সে কিছু বলতে পারছিল না; ওর কষ্ট হচ্ছে বলতে। সে আবেগে কাঁপছিল। সে ধীরে ধীরে বিগত জীবনে চেরি নামক এক রাজকন্যার গল্প শোনাল। তার আর চেরির গল্প। জাহাজি জীবনের অপূর্ব এক প্রেম ভালোবাসার গল্প।

স্টুয়ার্ড গল্প শেষ করে মর্লিনের মাথার কাছে দাঁড়াল এবং ওর চোখ দুটোতে চুমু খেল। বলল, আমাদের ছোট এবং স্বার্থপর ভেব না, মর্লিন।

সারা ঘরময় সুখানী এখন কোনো মাংসের শরীর দেখতে পাচ্ছে না। দূর থেকে আগত কোনো সংগীতের ধ্বনি যেন এই ঘরে বিলম্বিত লয়ে বেজে চলেছে। সে থেকে থেকে কবিতার লাইন বারবার আবৃত্তি করল। এবং এই আবৃত্তির ভিতরেই সে এলবিকে স্মরণ করতে পারে।

ওরা তিনজন আজও ফুল রাখল মর্লিনের শরীরে। ওরা উঠে যাবার সময় কোনো বচসা করল না। ওরা কোনো সমাধি ক্ষেত্র থেকে ফিরে আসছে যেন এমত এক চোখ—মুখ সকলের।

বন্দরে এটাই ওদের শেষ রাত ছিল। ভোরের দিকে জাহাজ নোঙর তুলবে। ওরা তিনজন প্রতিদিনের মতো বসল। প্রতিদিনের মতো বাসি ফুলগুলি মর্লিনের শরীর থেকে তুলে ভিন্ন জায়গায় রাখল।

বড় মিস্ত্রি দু’হাত প্রসারিত করে দিলেন টেবিলে। সুখানী দীর্ঘ সময় ধরে উপাসনার ভঙ্গিতে বসে থাকল। সে তখন চোখ বুজে একটি বিশেষ দৃশ্যের কথা স্মরণ করে গল্পটা আরম্ভ করতে চাইছে।

সুখানী বড় মিস্ত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলল, তখন স্যার আমার নাম ছিল বিজন। তখন আমি সুখানী হইনি। বলে, গল্পটার ভূমিকা করল।

তারপর আস্তে আস্তে বিজন এক অব্যক্ত বেদনার গল্প শোনাল। জাহাজের বাতাস পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে শুনল বিজনের গল্প। একসময় বিজন গল্প শেষ করে অবসন্ন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সে এখন মর্লিনের কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। সে যেন এই কপালের কোথাও কিছু অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে।

বড় মিস্ত্রি এত অভিভূত যে গল্প শেষ হবার পরও তিনি কিছু সময় ধরে বিজনের মুখ দেখলেন। তিনি বিজনকে মর্লিনের কপালে নুয়ে পড়তে দেখে বললেন, কী দেখছ সুখানী?

সুখানী বড় মিস্ত্রির কাছে এল এবং বলল, Peace is on her forehead. Peace-কে অন্বেষণ করছি স্যার। মর্লিন সারাজীবন ঝড়ে নৌকা বেয়ে এখন গভীর সমুদ্রে বৈতরণী পার হচ্ছে। এইটুকু বলে বিজন পুনরায় এলবির সেই কবিতাটি একটু অন্যভাবে আবৃত্তি করল—

‘‘She had dropped the sword and

dropped the bow and the arrow : peace

was on her forehead, and she had

left the fruits of her life behind herself

on the day she marched back again to

her master’s hall.’’

জাহাজ ছাড়বার সময় ওরা তিনজন নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। শীতের প্রকোপ কমে গেছে। সুখানী, স্টুয়ার্ড এবং অন্যান্য সকল জাহাজিরাই বন্দর থেকে চোখ তুলে নিল। বন্দর ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বন্দরের আলো ঘর বাতি সবই একে একে সমুদ্রের ও—পাশে হারিয়ে গেল। আবার ওরা, সকল জাহাজিরা দীর্ঘদিন এই সমুদ্রে রাত যাপন করবে। ওরা বন্দরের জন্য আকুল হবে ফের। এবং মাটির স্পর্শের জন্য হবে ভয়ংকর মরিয়া।

বড় মিস্ত্রি ডেক ধরে হেঁটে ডেক—কসপের ঘরে ঢুকলেন। বললেন, আমাকে কিছু তক্তা দাও কসপ। করাত, হাতুড়ি বাটালি দাও। কিছু পেরেক লাগবে। সব আমার ঘরে রেখে এসো।

বড় মিস্ত্রি এবং স্টুয়ার্ডের কোনো ওয়াচ ভাগ নেই বলে ওরা খুশিমতো নিচে নেমে যেত। ওরা সন্তর্পণে সকলের আড়ালে সেই কাঠ, পেরেক নিচে নিয়ে গেল।

বড় মিস্ত্রি কানে পেনসিল গুঁজে সেই প্রায়—অন্ধকার রসদঘরে কাজ করতেন। তক্তাগুলোকে পালিশ করে উজ্জ্বল করে তুলতেন মাঝে মাঝে। কিছু পাথর কফিনে সাজিয়ে চট বিছিয়ে মর্লিনের বিছানা, তারপর ওরা গান করত নিচে। দুঃখ এবং বেদনায় সেই গান সমুজ্জ্বল। মাঝে মাঝে ওরা নিজেদের ঘর অথবা স্ত্রী পুত্রদের কথা বলত। ওরা বলত, আমরা যথার্থই মানুষ, ঈশ্বর!

বড় মিস্ত্রি বলতেন, আমার বড় ছেলেটা জলে ডুবে মারা গেল! দুঃখ আমার অনেক স্টুয়ার্ড। স্টুয়ার্ড বলত, কী আশ্চর্য স্যার, আমরা মর্লিনকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি দেখুন। সুখানী এসব কথায় থাকত না; সে চুপচাপ একটু ফাঁক পেলেই রসদ ঘর অতিক্রম করে বরফ ঘরে ঢুকে যেত। মাঝে মাঝে বলত, দেখছেন স্যার, মর্লিন অবিকৃতই আছে। মনে হয় মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে।

বড় মিস্ত্রি বললেন, কফিনে কিছু কারুকার্য করলে ভালো হত।

স্টুয়ার্ড বলল, স্যার ধর্মযাজকের কাজটুকু কে করবে?

সুখানী বলল, কেন আমরাই করব। পৃথিবীতে আমরা তিনজন বাদে মর্লিনকে আর কে এত ভালোবেসেছে। এই জাহাজে কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই আমরা এখানে আশ্রয় নিয়েছি। মর্লিনকে জীবনের সুখদুঃখের ভাগ দিয়েছি। ধর্মযাজকের কাজ আমরাই করব। আমরা তিনজন ওর শববাহক হব। আমরা তিনজন ওর পরম আত্মীয় এবং আমরা তিনজনই ওর ধর্মযাজক। সুখানী কিছুটা দৃঢ়তার সঙ্গেই কথাগুলি উচ্চারণ করল। তারপর গজকাঠি দিয়ে কফিনের মাপ দেখে বলল, ইচ্ছে হচ্ছে এই কফিনের পাশে একটু জায়গা নিয়ে শুয়ে থাকি। আর উঠব না। সব সুখ দুঃখ প্রিয় মর্লিনের সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যাক।

রাতে বড় মিস্ত্রি বললেন, আমার কাজ শেষ। এসো, এখন আমরা ওকে কফিনের ভিতর পুরে দি।

সুখানী কাতর গলায় বলল, স্যার, আজ থাক। আসুন, আজও আমরা গোল হয়ে বসি। মর্লিনকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে আমরা বড় একা হয়ে যাব। জাহাজটা বড় অসহায় লাগবে। এইসব কথার সঙ্গে এক দ্রুত কান্নার আবেগ উথলে ওঠে সুখানীর গলাতে। ঘরে আমার স্যার কেউ নেই। এলবিকে পরিত্যাগ করে আর কোথাও নোঙর ফেলতে পারিনি। প্রিয় মর্লিন আমাকে একটু আশ্রয় দিয়েছিল যেন। স্যার, ওকে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেব!

বড় মিস্ত্রি বললেন, আমারও ভালো লাগছে না হে।

স্টুয়ার্ড বলল, আজকে থাক। কালই ওকে গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করব।

পরদিন ওরা তিনজন যখন রাত গভীর, জাহাজিরা কোথাও কেউ জেগে নেই, শুধু ওয়াচের জাহাজিরা এনজিন রুমে এবং ব্রিজে পাহারা দিচ্ছে, যখন সমুদ্র শান্ত, যখন আকাশে অজস্র তারা জ্বলছিল এবং দূরে কোথাও কোনো তিমি মাছের দল ভেসে যাচ্ছে অথবা ডলফিনের ঝাঁক এবং এক কাক—জ্যোৎস্না নীল জলের উপর, জাহাজটা রাজহাঁসের মতো সাঁতার কাটছে তখন শববাহী দলটি গ্যাঙওয়েতে কফিন রেখে সব বাসি ফুলগুলি প্রথমে সমুদ্রে ফেলে দিল। ফুলগুলি দূরে দূরে ভেসে যাচ্ছে, ওরা ফুলগুলি দেখতে পাচ্ছে না। ওরা মর্লিনের জুতো এবং গাউন নিক্ষেপ করল, তারপর হাতের দস্তানা। ওরা এসব ফেলে দেবার সময়ই কাঁদছিল। ওরা কাঁদছিল। তিনজন নাবিকের চোখ থেকে জল কফিনের উপর পড়ছিল। সমুদ্র এবং বন্দর যাদের ঘর এবং এইসব বেশ্যামেয়েরা যাদের ঘরণি সেইসব রমণীদের উদ্দেশ্যে তিনজন নাবিক যেন চোখের জল ফেলছিল। ওরা পরস্পর দুঃখে এতই কাতর, ওরা এতই ব্যথিত….. ওরা কান্নার আবেগ সামলানোর জন্য রুমাল ঠেসে দিচ্ছিল মুখে। ওরা প্রিয় মর্লিনের কফিন কাঁধে তুলে ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলে ফেলে, দেখল, আস্তে আস্তে প্রিয় মর্লিন জলের নিচে ডুবে যাচ্ছে। ওরা পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার আবেগে এলবির উচ্চারিত সেই কবিতাটি আবৃত্তি করল—

‘‘When the warriors came out first from
their Master’s hall, where had they hid
their power? Where were their armour
and their arms?
They looked poor and helpless, and
the arrows were showered upon them
on the day they came out from their
Master’s hall.
When the warriors marched back
again to their Master’s hall where did
they hide their power?
They had dropped the sword and
dropped the bow and the arrow; peace
was on their foreheads; and they had
left the fruits of their life behind them
on the day they marched back again to their Master’s hall.’’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *