হিমগিরিতে সাবধান!

ভলিউম ৯০ – হিমগিরিতে সাবধান! – তিন গোয়েন্দা – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ২০০৪

এক

রাশেদ চাচার সঙ্গে স্নোশু মাউন্টেন স্কি লজে এসেছে তিন গোয়েন্দা। তিন দিনের ছুটি কাটাতে। স্নোশু লজ স্কি স্কুলে স্কিইং শিখবে ওরা। স্কুলটিতে সবাই ক্লাস করতে পারে, শিক্ষানবীশ থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় প্রত্যেকে।

আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমরা সত্যি সত্যি এখানে রয়েছি, বলল কিশোর। আইসক্রিমের উপর বাদাম কুচি ছড়িয়ে দিল। কাঠের প্যানেল ঘেরা বিশাল ডাইনিং রূমটার চারধারে দৃষ্টি বুলাল ও।

আশপাশে সবাই যার যার আইসক্রিম নিয়ে ব্যস্ত। জানালার বাইরে হালকা তুষারপাত হচ্ছে। স্নোশু পাহাড়ের উঁচু চূড়ার পিছনে ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে সূর্য।

স্কি করতে দারুণ লাগে আমার, বলল কিশোর।

আমারও, সায় জানাল রবিন।

আরেকটু শেখা হয়ে গেলে দেখবে আরও ভাল লাগছে, বলল মুসা। তিনজনের মধ্যে ওর অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বেশি।

ছেলেরা জনাকীর্ণ কামরাটার ওপাশে, রাশেদ চাচার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। চাচা কফি পান করছেন।

এখানকার সবাই কি স্কি স্কুলে এসেছে নাকি? বন্ধুদের নিয়ে বসবার ফাঁকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না এলেই বাঁচি, বলল মুসা। আমি এনজয় করতে চাই, লোক বেশি হয়ে গেলে সব মাটি হবে।

চিন্তার কিছু নেই, মুসা, মৃদু হেসে বললেন চাচা। আমি শিয়োর, তুমি সাধ মিটিয়ে স্কি করতে পারবে।

হ্যাঁ, যোগ করল রবিন। তোমার লাকি লকেটটা আছে না?

মুসা তার হট ফাজ আইসক্রিমের খানিকটা চামচে তুলে নিয়ে মাথা ঝাঁকাল।

মুসার ওই লকেটটার কথা বলছ? আঙুল দেখিয়ে প্রশ্ন করল কিশোর।

আইসক্রিমটুকু গিলে নিল মুসা। তারপর খুদে রুপোলী স্কি দুটো স্পর্শ করল। ভেলভেটের রিবন দিয়ে গলার সঙ্গে ঝুলছে।

এটা আমার লাকি লকেট। জিনিসটা দারুণ দেখতে, তারিফ করল কিশোর।

ঘরের এক মাথায় ছোট্ট এক মঞ্চ। সেদিকে ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন রাশেদ চাচা।

ওরা কী যেন ঘোষণা দিতে যাচ্ছে, বললেন।

ছেলেরা ঘুরে বসল। খাটো মত, কোঁকড়াচুলো এক ভদ্রলোককে মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখল। উপস্থিত সবার মনোযোগ কামনা করলেন তিনি।

তিন গোয়েন্দা কথা বন্ধ করল। কিন্তু পাশের টেবিলের ছেলে দুটো লোকটার কথায় কর্ণপাত করল না। হো-হো করে হাসাহাসি করছে। এক চামচ আইসক্রিম চামচে তুলে নিয়ে একজন ছুঁড়ে মারল আরেকজনের উদ্দেশে।

দ্বিতীয় ছেলেটি ঝট করে সরে গেল। আইসক্রিম উড়ে আসছে সোজা রবিনকে লক্ষ্য করে।

রবিন দেখতে পেয়ে মাথা নামাল। ফলে, ওর পিছনে মেঝেতে গিয়ে পড়ল। আইসক্রিমটুকু।

অ্যাই, কী করছ তোমরা? চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আরেকটু হলেই তো আমার সোয়েটারটা নষ্ট হত।

ছেলে দুটি একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে। অবিকল একই রকম দেখতে। যমজ। বয়সে তিন গোয়েন্দার চাইতে খানিকটা ছোট।

প্রথমজন আরেক চামচ আইসক্রিম তুলে নিয়ে রবিনের দিকে লক্ষ্যস্থির করল।

অ্যাই, সাবধান, গর্জন ছাড়ল মুসা।

রাশেদ চাচা এবার এদিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হলেন। ছেলে দুটির দিকে চেয়ে মাথা নাড়লেন তিনি।

তার নিষেধ অমান্য করবার সাহস পেল না ওরা। ভাল মানুষের মত ঘুরে। বসে মঞ্চের দিকে মন দিল।

স্নোশু মাউন্টেনে সবাইকে স্বাগতম, মঞ্চে দাঁড়ানো ভদ্রলোক বললেন। আমি টনি গ্রেগ, স্কি স্কুলের ডিরেক্টর। এখানে যারা উপস্থিত তাঁদের মধ্যে কতজন আমাদের স্কি স্কুলে এসেছেন, বলবেন কি?

অনেক লোক হাত তুলল। তাদের মধ্যে কিশোর আর রবিনও রয়েছে। মুসা মুখে দুআঙুল পুরে শিস দিয়ে উঠল।

মৃদু হাসলেন টনি গ্রেগ।

কথা দিতে পারি, সময়টা আপনারা উপভোগ করবেন এবং অনেক কিছু শিখতেও পারবেন। আমি এখন আপনাদের সঙ্গে আমাদের ইন্ট্রাকটরদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।

ইন্ট্রাকটরদের পরনে কালো স্কি প্যান্ট ও উজ্জ্বল লাল জ্যাকেট।

লোকগুলোকে এই ড্রেসে হেভী মানিয়েছে তো, অস্ফুটে প্রশংসা করল। রবিন।

আপনাদের খাওয়া হয়ে গেলে লজের যেখানে খুশি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারেন-কোন বাধা নেই। হলের ওপাশে গেম রূম রয়েছে, আর লাউঞ্জে আছে ফায়ারপ্লেস, ছুটিটা সবার আনন্দে কাটুক এই কামনা করে বিদায় নিচ্ছি!

চলো, গেম রূমটা দেখে আসি, বন্ধুদের উদ্দেশে বলল কিশোর। রাশেদ চাচা একটু পরে যোগ দেবেন ওদের সঙ্গে।

তিন গোয়েন্দা ঝটপট আইসক্রিম খেয়ে শেষ করল। তারপর যার যার জ্যাকেট তুলে নিয়ে হাঁটা দিল গেম রূমের উদ্দেশে। রবিন ওর গোলাপী স্কি হ্যাটটা পুরেছে জ্যাকেটের পকেটে।

ওখানে মনে হয় স্কিইং ভিডিও দেখাচ্ছে, জানালার পাশে প্রকাণ্ড টেলিভিশনটা ইশারায় দেখাল মুসা।

এদের কাছে হয়তো স্টার কোয়েস্টও আছে, দেয়ালে ভিডিওর সারি লক্ষ করে বলল কিশোর। ওর প্রিয় এক ছায়াছবির উপর ভিত্তি করে তৈরি ওই গেমটা। চলো তো দেখি।

ছেলেরা গেমগুলোর দিকে এগোচ্ছে, পিছনে ছুটন্ত পদশব্দ শোনা গেল। পরমুহূর্তে কে যেন খুব জোরে ধাক্কা দিল রবিনকে।

হুমড়ি খেয়ে আরেকটু হলেই একটা টেবিলের উপর পড়ে যাচ্ছিল রবিন। কিশোর শেষ মুহূর্তে ওর বাহু চেপে ধরাতে বেঁচে গেল।

রবিন, লাগেনি তো? জিজ্ঞেস করল ও।

না। কিন্তু আমার নতুন স্কি হ্যাটটা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে যমজ বিচ্ছু দুটো, চেঁচিয়ে উঠল নথি।  

দুই

হ্যাট, হ্যাট, কে নিল হ্যাট? গেয়ে উঠল যমজরা।

তিন গোয়েন্দার পিছনে দাঁড়িয়ে ওরা। যার হাতে হ্যাটটা ছিল সে শূন্যে ছুঁড়ে দিল।

অ্যাই, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! বলে হ্যাটটা ধরবার জন্য হাত বাড়াল রবিন।

অপর যমজটা ওর আগেই লুফে নিল হ্যাটটা। এবার সে ওটা ছুঁড়ে দিলে দ্বিতীয়জন হাত বাড়িয়ে দিল।

মুসা এক লাফে এগিয়ে এসে হ্যাটটা থাবা মেরে ছিনিয়ে নিল। ও ঘুরে দাঁড়িয়ে কটমট করে চাইতে ছেলে দুটো ভয়ে দিল দৌড়।

মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে হ্যাটটা আবার জ্যাকেটের পকেটে ঢোকাল রবিন।

কিম-জিমের দুষ্টুমি আর গেল না, এক কিশোর কণ্ঠ বলে উঠল।

কিশোর ঘুরে দাঁড়াল। গেম রূমের দরজার কাছে ওদের সমবয়সী এক কিশোর দাঁড়িয়ে। কালো চুল ছোট করে ছাঁটা ওর, চোখজোড়া সবুজ।

ওদেরকে চেনো নাকি? কিশোর প্রশ্ন করল।

গত বছর ওরা আমার সাথে বিগিনার্স ক্লাসে ছিল, তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এল ছেলেটি। সব সময় সমস্যা পাকায় দুই ভাই।

জোড়া সমস্যা, আওড়াল মুসা।

ছেলেটি মুসার দিকে চাইল।

বাহ, তোমার লকেটটা তো চমৎকার!

মুসা রুপোলী স্কি দুটো স্পর্শ করল।

ধন্যবাদ। এটা আমার নতুন লাকি লকেট। এটা ছাড়া স্কি করব না আমি।

তুমি বুঝি ভাল স্কি জানো?

শ্রাগ করল মুসা।

তেমন কিছু না। অল্প কয়েকবার স্কি করেছি আরকি। তবে স্কি ভালবাসি আমি। অপেক্ষা করে আছি কখন ক্লাস শুরু হবে।

আমিও স্কি স্কুলে এসেছি, জানাল ছেলেটি। আমার নাম উডি বোর্ডার। এসময় আরেক কিশোর এসে উডির পাশে দাঁড়াল। এ আমার ছোট ভাই মারি বোর্ডার, বলল উডি।

হাই, হাসিমুখে বলল মারি।

পাল্টা হাসল কিশোর। বন্ধুদের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল।

চলো, স্কি ভিডিও দেখি, বলল উড়ি। ওদেরকে পিছনে নিয়ে টিভির সামনে রাখা প্রমাণ সাইযের কাউচটার কাছে এসে দাঁড়াল।

ছেলেরা বসে পড়লে, স্ক্রীনের স্কিয়ারের দিকে চোখ রাখল কিশোর। কমলা রঙের কয়েকটা পতাকার আশপাশ দিয়ে স্কি করছে সে।

আমি ওর মত পারব না, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান।

হেসে উঠল মারি।

আমিও না। সবে শুরু করেছি। উডির সাথে গতবছর আসতে পারিনি, ফ্লু হয়েছিল।

রবিন আর আমিও বিগিনার, জানাল কিশোর। আমাদেরকে হয়তো একই ক্লাসে দেবে।

তুমি কোন লেভেলে, মুসা? উডি জিজ্ঞেস করল।

ইন্টারমিডিয়েট, বলল মুসা। চোখ ওর পর্দায় সাঁটা। পাথর আর গাছ পালা এড়িয়ে, একেবেকে স্বচ্ছন্দ গতিতে নেমে আসছে স্কিয়ার।

আমিও, জানাল উডি। প্রত্যেক বছর এখানে একটা কনটেস্ট হয়। প্রতি ক্লাস থেকে একজন করে সেরা স্কিয়ার বেছে নেয়া হয়। এ বছর আমার গ্রুপ থেকে আমি জিতব।

এই কনটেস্টে জিতলেই কী আর না জিতলেই কী! চড়া গলায় বলে উঠল একটি কণ্ঠ।

ঘুরে দাঁড়াল ওরা। দেখতে পেল এক কিশোর এগিয়ে আসছে। কদমছাট চুল ছেলেটির মাথায়।

স্কিইঙে কোন মজা নেই, বলল ও।

কে বলেছে? চ্যালেঞ্জ জানাল মুসা।

ছেলেটি ভ্রূ কুঁচকে তাকাল।

আমি বলছি, দৃঢ় কণ্ঠে বলল।

মজা নেই তো তুমি এখানে কী করছ? রবিনের প্রশ্ন।

বাবা-মার চাপে পড়ে আসতে হয়েছে।

বিল, দরজার কাছ থেকে হাঁক ছাড়লেন এক মহিলা।

আসি, মা, চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটি। তারপর বিদায় না নিয়েই ঘুরে দাঁড়িয়ে গটগট করে হাঁটা দিল।

আজব সব চরিত্র এখানে এসেছে দেখতে পাচ্ছি, বলল রবিন।

স্কি করতে ভয় পায় হয়তো, বলে লকেটে আঙুল ছোঁয়াল মুসা। আমার মত ওরও একটা গুড লাক চার্ম দরকার।

ওটা কি সত্যি সত্যি, পয়মন্ত? জানতে চাইল উডি। আমি একবার পরতে পারি? এ মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল মুসা। কিশোর জানে, লকেটটা খুলবার ইচ্ছে নেই ওর। কিন্তু অবশেষে ভেলভেটের রিবনটা খুলে উডির হাতে তুলে দিল মুসা।

ধন্যবাদ। উডি নিজের গলায় বাঁধল রিবনটা। এটা মিনিট খানেক পরে থাকলে আমারও ভাগ্য ফিরতে পারে।

রাশেদ চাচাকে এসময় ঘরে ঢুকতে দেখল কিশোর।

চল, যাওয়া যাক, ডাকলেন তিনি ওদেরকে।

তিন গোয়েন্দা জ্যাকেট পরে নিল। তারপর উডি আর মারির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাশেদ চাচাকে অনুসরণ করল।

আরে! লকেটটার কথা তো বেমালুম ভুলেই গেছি, বলল মুসা। ফিরে এল ও।

উডি লকেটটা গলা থেকে খুলল।

পরিয়ে দেব? প্রশ্ন করল।

মুসা সায় জানালে লকেটটা ওকে পরিয়ে দিল উডি। পয়মন্ত স্কি দুটো স্পর্শ করতে হাসি ফুটে উঠল মুসার মুখে।

রাশেদ চাচার পিছু পিছু লজ থেকে বাইরের তারাজ্বলা, ঠাণ্ডা রাতে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। উডি আর মারিও লজ ত্যাগ করেছে।

বাই! মারি দরজার কাছ থেকে ওদের উদ্দেশে বলল।

কিশোর ঘরে তাকিয়ে নতন বন্ধদের উদ্দেশে হাত নাড়ল। মারি পাল্টা হাত নাড়লেও উডির এদিকে খেয়াল নেই। ওর মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। চকচকে তুষার।

কালকেও এরকম ঠাণ্ডা পড়বে নাকি! বলল রবিন। গোলাপী হ্যাটটা চেপে বসাল।

যত ঠাণ্ডাই পড়ক, বলল কিশোর, বুট ঝাড়া দিল। আমরা ঠিকই এনজয় করব!

কমিনিটের মধ্যেই ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গেল ওরা। লিভিংরুমের জানালা দিয়ে রঙবেরঙের গন্ডোলা কার দেখা যাচ্ছে। স্কি করতে আসা অতিথিদেরকে প্রতিদিনই পাহাড় চূড়ার রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দেয় এসব গন্ডোলা।

অ্যাপার্টমেন্টের ভিতর বেজায় ঠাণ্ডা। কিশোর ঝটপট ওর ফ্লানেলের গরম স্লীপিং সুটটা পরে নিয়ে দাঁত ব্রাশ করে ফেলল।

দুসারি বাঙ্ক বেড রয়েছে এই বেডরূমটিতে। তিন গোয়েন্দা এটাতে উঠেছে। একটা বেডের নীচের বাঙ্কে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল কিশোর। গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল গরম কম্বলের তলায়।

রবিন বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে আরেকটা বাঙ্কে আশ্রয় নিল।

উহ, ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে এসো, মুসা। ঘুমানোর আগে স্কিইং সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিতে চাই।

এখুনি আসছি, বলে এক দৌড়ে বাথরূমে চলে গেল মুসা।

একেবারে হাড় কাঁপানো শীত, বলল কিশোর।

যা বলেছ, বলল রবিন।

এসময় হঠাৎ মুখ ভর্তি টুথপেস্টের ফেনা নিয়ে দৌড়ে এল মুসা। টুথব্রাশ আঁকাচ্ছে।

কী হয়েছে, মুসা? কিশোর জিজ্ঞেস করল। আমার লকেটটা খোয়া গেছে!

তিন

কিশোর ঠাণ্ডার কথা ভুলে, এক লাফে নেমে পড়ল বিছানা থেকে।

দাঁত ব্রাশ করার সময় পড়ে যায়নি তো?

খুঁজে দেখেছি, জানাল মুসা। কোথাও নেই।

আরেকবার খুঁজি চলো, বলল গোয়েন্দাপ্রধান।

বাথরূমে গিয়ে খুঁজে দেখল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না লকেটটা।

শেষ কখন পরে ছিলে মনে আছে?

শ্রাগ করল মুসা, তারপর সিঙ্কের নীচে আরেকবার পরীক্ষা করল।

উডি লজের ভিতর বেঁধে দিয়েছিল। তারপর জানি না।

দুপদাপ পা ফেলে বাঙ্কের কাছে চলে এল ও। মই বেয়ে কিশোরের উপরের বেড়ে উঠে গেল।

ছুটির দিনগুলো আমাকে এখানেই হয়তো পড়ে থাকতে হবে, বিছানায়। শুয়ে বলল। লাকি লকেটটা ছাড়া স্কি করতে পারব না আমি।

কেন পারবে না, বলল রবিন। ওসব কুসংস্কার মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও তো, মুসা।

কুসংস্কার নয়, জোর গলায় বলল মুসা। এক হুজুর দোয়া পড়ে ওতে ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন ওটা গলায় থাকলে কোন বিপদ-আপদ আমাকে

স্পর্শ করতে পারবে না। বরঞ্চ নানা কাজে সাফল্য আসবে।

 কিশোর তোমার লকেট খুঁজে দেবে, চিন্তা কোরো না, আশ্বাস দিল রবিন।

ওটা গেছে, আর পাওয়া যাবে না, মুসা নিরাশ কণ্ঠে বলল।

রবিন কিশোরের দিকে এক ঝলক চাইল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ও নিজের বাঙ্কে উঠে পড়লে বাতি নিভিয়ে দিল কিশোর।

বিছানায় শুয়ে চোখ বুজল কিশোর। ঘুম আসতে দেরি আছে। মুসার লকেটটা গেল কোথায়?

তোরা এখনও ঘুমোচ্ছিস? রাশেদ চাচা ওদের ঘরে উঁকি দিয়ে বলে উঠলেন। উঠে পড়।

ছেলেরা পোশাক পরে কিচেনে চলে এল।

দারুণ গন্ধটা কীসের? রবিন প্রশ্ন করল।

নাক টানল কিশোর।

এখুনি রহস্যের সমাধান করে দিচ্ছি, বলল। প্যানকেক!

কেস খতম, বললেন চাচা, এটা আমার স্পেশাল আইটেম। নে, শুরু কর।

কিশোর লক্ষ করল, আশ্চর্য হলেও সত্যি মুসার খাওয়ায় মন নেই। লকেট হারিয়ে ভেঙে পড়েছে বেচারা।

নাস্তা সেরে স্কি ভাড়া নেওয়ার জন্য লজের উদ্দেশে হাঁটা দিল ওরা। কিশোর হাঁটছে ধীর গতিতে, মাটিতে চোখ রেখে। কাল রাতে বাসায় ফিরবার সময় হয়তো কোথাও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে লকেটটা, ভাবছে ও।

লকেটটা খুঁজে পেল না কিশোর। ফলে অন্য আরেকটা চিন্তা উদয় হলো ওর মাথায়। রাশেদ চাচাকে এগোতে বলে বন্ধুদের নিয়ে গেম রূমের দিকে পা বাড়াল গোয়েন্দাপ্রধান।

আমি স্কি শপে আছি, বলে গেলেন চাচা। ওখান থেকে তোদেরকে বুট আর স্কি নিতে হবে।

গেম রূমে পৌঁছে বন্ধুদেরকে আইডিয়াটা খুলে বলল কিশোর।

এখানে পাওয়া যাবে মনে করো? মুসা জিজ্ঞেস করল।

জানবার একটাই উপায়, বলল কিশোর।

তিন গোয়েন্দা গোটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল। লকেটটা নেই।

সরি, মুসা, বলল কিশোর। তখন যে বললে লকেটটা ছাড়া স্কি করবে না, ওটা নিশ্চয়ই কথার কথা?

ত্যাগ করল মুসা।

হ্যাঁ, তাই তো, বলে হাসবার চেষ্টা করল ও।

স্কি শপে তিন গোয়েন্দা ও রাশেদ চাচা স্কি বুট পরে, পোল আর স্কি তুলে নিল।

তিন গোয়েন্দার প্রত্যেকের স্কিতে ওদের নাম লেখা টেপ সেঁটে দিল কেরানী।

কোটা কার কি এখন আর গুলিয়ে ফেলার ভয় থাকল না, বলল লোকটা।

ছেলেরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, চাচার পিছু পিছু শপ ত্যাগ করল। ভারী স্কি বুট পায়ে থপথপিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। এত কিছু হাতে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। হাত ফস্কে যতবারই পোল পড়ে যাচ্ছে, হেসে ফেলছে রবিন।

ওই যে, অন্যান্য স্টুডেন্টরা, বাইরে বেরিয়ে এসে বলল কিশোর। ইস্ট্রাক্টরদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোটদের বড়সড় এক দল।

আমি রেগুলার ট্রেইলে স্কি করব, বললেন চাচা। লাঞ্চের সময় লজে দেখা হবে। হ্যাভ ফান! চলে গেলেন তিনি।

ছেলেরা তড়িঘড়ি এগোল দলটার সঙ্গে যোগ দিতে। টনি গ্রেগ লিস্টে ওদের নাম দেখে নিলেন।  কিশোর আর রবিন যাচ্ছে জুলিয়ার বানি ক্লাসে, বললেন। দীর্ঘাঙ্গী এক সোনালী মাথা মহিলার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকালেন। বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী ইতোমধ্যে জড় হয়েছে তার পাশে।

আর আমি? পরম আগ্রহে প্রশ্ন করল মুসা।

কিশোর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। যাক, মুসা ওর তথাকথিত পয়মন্ত লকেটটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছে না।

তুমি পড়েছ জ্যাকর্যাবিট ক্লাসে। ভিক্টর তোমাদের টিচার, বললেন টনি গ্রেগ। কোকড়া বাদামী চুলের এক লোককে দেখিয়ে দিলেন। চোখে বড় ফ্রেমের সানগ্লাস তার।

মুসা বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, পোল আর স্কি হাতে দ্রুত পায়ে সেদিকে এগোল।

জুলিয়া টিচারের উদ্দেশে এগোবার সময় হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন।

এহ হে, দেখো না আমাদের সাথে কে জুটেছে, বলল ফিসফিসিয়ে। কালকের সেই অভদ্র ছেলেটা।

বিল নামের কিশোরটি গতরাতে বিদায় না নিয়েই চলে গিয়েছিল ওদের কাছ থেকে।

জুলিয়া টিচারের পাশেই দাঁড়িয়ে বিল।

উহ, ভীষণ শীত, অভিযোগ করল ছেলেটি।

ওকে পাত্তা না দিলেই হলো, রবিনকে বলল কিশোর।

মারি চলে এলেই আমাদের লেসন শুরু হবে, বানি গ্রুপের উদ্দেশে বললেন জুলিয়া।

কিশোর আশপাশে তাকিয়ে মারিকে খুঁজল। টনি গ্রেগের সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখল। কোমরে দুহাত রেখে মাথা নাড়ছে। অবশেষে ঘুরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এল এদিকে।

কিছু হয়েছে নাকি? কিশোর কৌতূহলী হলো।

আমি চেয়েছিলাম আমার ভাইয়ের ক্লাসে থাকতে, জানাল মারি। কাঁধের উপর দিয়ে জ্যাকর্যাবিটদের দিকে চাইল।

কিন্তু তুমি না আমাদের বলেছ ভাল স্কি করতে জানো না, বলল রবিন।

উডি তো বলে তেমন কঠিন কিছু না, বলল মারি। তোমরা না পারলেও আমি ঠিকই পারব।

মারির কথা-বার্তা আজকে কেমন অন্যরকম লাগল ছেলেদের কাছে।

অ্যাই, তোমরা শোনো, জুলিয়া তাঁর বানি ক্লাসের উদ্দেশে বললেন। ওদের বুট শক্ত করে বেঁধে দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে স্কি পরতে হয়।

আমরা এখন হাঁটা প্র্যাকটিস করব, জানালেন।

আমি জানি কীভাবে হাঁটতে হয়, কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল মারি। স্কি পায়ে কয়েক পা এগোল, দুপা সোজা করল।

ধুর, বিরক্তিকর, ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করল বিল।

ছুটিটা মাটি করে ছাড়বে নাকি মারি আর বিল মিলে? মনে মনে বলল রবিন।

মুচকি হাসলেন জুলিয়া।

চিন্তা কোরো না, বিল, বেশিক্ষণ বিরক্তি লাগবে না।

বানি ক্লাস হাঁটা দিয়ে শুরু করল। তারপর ঘোরা প্র্যাকটিস চলল।

বিল ঘুরতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়ে গেল। দুটো স্কি আড়াআড়ি হয়ে আটকা পড়ল ও।

ওর চিৎকার শুনে জুলিয়া গিয়ে মুক্ত করলেন ওকে।

এবার এই ছোট পাহাড়টার পাশ দিয়ে হেঁটে উপরে উঠব আমরা, সবার ঘোরা শেখা হয়ে গেলে জানালেন জুলিয়া।

তেমন কঠিন না, হাসি মুখে মন্তব্য করল রবিন, উপরে উঠবার সময়।

কিন্তু থেমে দাঁড়িয়ে নীচে যখন তাকাল, আবিষ্কার করল পাহাড়টা যথেষ্ট উঁচু আর খাড়া। পাহাড়তলী থেকে এতটা বোঝা যায়নি।

এবার? রবিন ভয়ে-ভয়ে জানতে চাইল।

এবার সড়সড় করে নীচে নামা, বললেন জুলিয়া।

পা ভেঙে যাবে তো, প্রতিবাদ করল বিল।

হাঁটু ভাঁজ করে বুটের আগায় শরীরের ভার চাপিয়ে দাও, ব্যাখ্যা করলেন জুলিয়া। এরকম।

স্বচ্ছন্দ গতিতে নীচে নেমে গেলেন তিনি। ওখান থেকে গলা ছাড়লেন। কিশোর, নেমে এসো।

কোন অসুবিধে হলো না কিশোরের। এরপর একে একে অন্যরাও নেমে এল। এবার থেমে দাঁড়ানো শিখবার পালা।

মারি একটু পরে ঝুলন্ত কেবল চেয়ারের দিকে আঙুল তাক করল। আমাদেরকে চূড়ায় নেবেন কখন? এগুলো তো বাচ্চাদের শেখায়।

কিশোর মুখ তুলে চাইল।

স্কি লিফট চেয়ারে বসে মুসা আর উডি। ঢালের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদেরকে।

ভিক্টরের ক্লাস ট্রেইলের খানিকদূর পর্যন্ত স্কি করে তারপর এই পাহাড়ের মাথায় মিলবে আমাদের সাথে, বললেন জুলিয়া।

বেশ খানিকক্ষণ বাদে, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তিনি আবার ছোট পাহাড়টার চূড়ায় তুলে আনলেন।

ভিক্টর ও তার জ্যাকব্যাবিটরা অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য।

অ্যাই, মুসা, বলল কিশোর। কেমন লাগছে?

দারুণ, সোল্লাসে বলল মুসা।

কোন সমস্যা হচ্ছে না তো? রবিনের প্রশ্ন।

সমস্যা বলতে ওই যমজ ভাই দুটো। ওরা আমার ক্লাসে পড়েছে।

কিম আর জিমকে জ্যাকর্যাবিটদের সঙ্গে দেখা গেল। কিশোরকে তাকাতে দেখে একটা ভাই চোখ টিপল।

ভাগ্যিস ওরা আমাদের দলে নেই, নিচু গলায় বলল রবিন। বিল আর মারির জ্বালাতেই তো জুলিয়া টিচার অস্থির।

সবাই লাইন আপ করো, দুই দলের উদ্দেশেই হাঁক ছাড়লেন ভিক্টর। আমরা একসাথে ঢাল বেয়ে নামব।

কিশোর ওর দলের মধ্যে সবার আগে।

গুড লাক, বলল রবিন। সে কিশোরের পিছনে।

কিশোর পোলে ধাক্কা দিয়ে তরতর করে নেমে চলল ঢাল বেয়ে। নীচে পৌঁছে নিখুঁতভাবে থেমে দাঁড়াতে পারল। হাসি ফুটল ওর মুখে।

হঠাৎ এ সময় কার যেন চিৎকার কানে এল ওর।

যথাসম্ভব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। সতর্ক ছিল যাতে স্কি ক্রস হয়ে আটকা না পড়ে।

মুসা রবিনের পিছু পিছু পাহাড় বেয়ে হড়হড় করে নেমে আসছে।

সাবধান, রবিন! চেঁচিয়ে উঠেছে ও। খাইছে! আমি থামতে পারছি না!

চার

কাঁধের উপর দিয়ে চাইল রবিন। ফলে স্কি দুটো আড়াআড়ি হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

মুসা ঘুরবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। ওর একটা স্কি ঢুকে গেল রবিনের স্কির নীচে। মুসা হোঁচট খেয়ে সোজা বন্ধুর গায়ের উপরে পড়ল!

কিশোর ঢাল বেয়ে যতটা সম্ভব উঠে আসতে লাগল বন্ধুদের সাহায্যে।

বানি ও জ্যাকর্যাবিটরা তাদের টিচাররা কী করেন দেখবার জন্য অপেক্ষা করছিল। ভিক্টর ও জুলিয়াকে দুই গোয়েন্দার উদ্দেশে নামতে দেখে উডি, মারি, বিল আর জনাকয় ছাত্র তাদের পিছু নিল।

ভিক্টর ও জুলিয়া তুষারের ঝড় তুলে রবিন ও মুসার কাছে এসে থামলেন।

ছেলেদেরকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন ভিক্টর।

কিশোর ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে ওখানে।

তোমাদের লাগেনি তো? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

ওদের হয়ে জবাব দিলেন ভিক্টর।

আরে না, কিছু হয়নি। একটু ঘাবড়ে গেছে শুধু।

এবার সবাই নীচে নেমে এল।

কে করল কাজটা? নীচে পৌঁছে বলল মুসা। তুষারে মাখামাখি ওর জামা কাপড়।

আমি তো দেখলাম তুমি, বলল রবিন। তুষার মেখে সাদা হয়ে গেছে। সে-ও।

তর্ক বাড়াবার সুযোগ দিলেন না জুলিয়া।

স্কি করতে গেলে এরকম হয়েই থাকে, বুঝেছ? বললেন ওদের উদ্দেশে। আমাদের এখন বাকিদের নামাতে হবে।

তোমরা এখানেই থেকো, দলের উদ্দেশে বললেন ভিক্টর।

ইন্সট্রাক্টর দুজন স্কি করে রওনা হয়ে গেলেন।

কিশোর বড়দের চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।

কী ব্যাপার বলো তো?

চোখ সরু করল মুসা।

আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে।

পড়ে গেলে সবাই একথা বলে, বলে উঠল মারি। ঠিক না, উডি?

শ্রাগ করল উডি।

তাই তো মনে হয়।

রবিন ওর স্কি পোল দুটো তুষারে গেঁথে দিয়ে সটান সোজা হয়ে দাঁড়াল।

দেখো, আমার বন্ধু যদি বলে থাকে ওকে ধাক্কা দেয়া হয়েছে, তার মানে সত্যিই ধাক্কা দেয়া হয়েছে, জোরাল গলায় বলল।

আমি তো আগেই বলেছিলাম স্কিইঙে কোন মজা নেই, মুসার উদ্দেশে বলল বিল।

মুসা ওর কথা কানে নিল না। ওকে তখনও ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে।

আমার লাকি লকেটটা থাকলে এসব ঘটত না।

হারিয়ে গেছে নাকি? মারি প্রশ্ন করল।

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

 অদ্ভুত তো, বলল উডি। তুমি বলেছিলে ওটা ছাড়া স্কি করতে পারবে না। আর সত্যি সত্যি পড়ে গেলে।

আমাকে ধাক্কা দেয়া হয়েছে, দৃঢ় তোমার পেছনে কে ছিল?

জিজ্ঞেস করল কিশোর।

খেয়াল করিনি, জানাল মুসা। অন্যরাও লক্ষ করেনি অপকর্মটা কার।

 ইতোমধ্যে বাদবাকিরা পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেছে।

লাঞ্চ টাইম, ঘোষণা করলেন ভিক্টর।

লাঞ্চের পর মুসার সঙ্গে ক্লাস পাল্টাপাল্টি করে দিয়েন আমার, জুলিয়াকে বলল মারি। আমি তো একবারও পড়িনি।

উঁহু, সোজা নিষেধ করে দিলেন টিচার।

কিশোর আর রবিন ওদের স্কি খুলে ফেলেছে।

ওরা লজের বাইরে স্কি র‍্যাকের উদ্দেশে এগোলে, মুসা ওদের আগে আগে চলল।

রবিন ঝুঁকে এল কিশোরের কানের কাছে।

বেচারী মুসা। প্রথমে সিলভার স্কি হারাল, তারপর ঠেলা খেল। কে করল কাজটা? কেনই বা?

ভ্রূ কুঁচকে গেল কিশোরের। নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল.।

ইচ্ছা করে হয়তো ঠেলেনি, বলল। কিন্তু তা হলে ক্ষমাই বা চাইল না। কেন?

ভয় পেয়েছে হয়তো। কিংবা যমজ দুটোর মত বিচ্ছু। কাল রাতে আমার সোয়েটারে আরেকটু হলেই আইসক্রিম লেগে যাচ্ছিল, অথচ সরি বলেনি।

লজের দরজার ঠিক বাইরে, স্কি র‍্যাকের এক কোণে স্কি দুটো হেলান দিয়ে রাখল মুসা।

জলদি এসো, বন্ধুদেরকে তাড়া দিল। খাইছে রে আল্লা, খিদেয় নাড়ি ভূঁড়ি তো সব জ্বলে যাচ্ছে।

কিশোর আর রবিনও র‍্যাকে স্কি রাখল। ফিতেওয়ালা পোল দুটোও ঝুলিয়ে দিল স্কির ডগা থেকে।

তারপর স্কি বুট পায়ে, সবাই মিলে থপথপিয়ে প্রবেশ করল লজের ভিতরে। স্কি বুট পুরে হাঁটতে কিশোরের ভাল লাগছে। জিনিসটা শক্ত, কিন্তু পায়ে থাকলে নিজেকে সত্যিকারের স্কিয়ার মনে হয়।

উডি আর মারি ডাইনিং রূমের বাইরে হলঘরে দাঁড়িয়ে ছিল। তোমরা ঠিক আছ তো? উডি প্রশ্ন করল মুসা আর রবিনকে।

হ্যাঁ, জানাল মুসা। মাথা ঝাঁকাল রবিন।

হঠাৎ করে পড়ে-উড়ে গেলে অনেকে ভয় পেয়ে যায়, বলে চলল উডি। আবারও স্কি করবার কথা ভাবতে ভয় লাগে।

আমি আগেও এরকম পড়েছি, বলল মুসা। নতুন কিছু না।

উডি, তুমি আমাকে প্র্যাকটিসে সাহায্য করবে বলেছিলে, মারি বলল। তাড়াতাড়ি চলো। বাচ্চাদের ক্লাসে পড়ে থাকতে চাই না আমি।

দুই ভাই হনহন করে চলে গেল।

তিন গোয়েন্দা ক্যাফেটেরিয়ার ভিতর রাশেদ চাচাকে দেখতে পেল। ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

কেমন কাটল সময়টা? জিজ্ঞেস করলেন চাচা।

দারুণ, জানাল কিশোর।

শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া, মুসা বলল। কে যেন ধাক্কা দিয়েছিল আমাকে।

আমি জানি কে, বলল রবিন। ও হচ্ছে—

হঠাই তীক্ষ্ণ চিৎকার ছাড়ল রবিন।

কিম আর জিম! তবে রে, বিচ্ছ কোথাকার–

পাঁচ

যমজদের একজন রবিনের গোলাপী স্কি হ্যাটটা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। অপরজন নিজের লাল স্টকিং ক্যাপটা চাপিয়ে দিয়েছে ওর মাথায়। কান অবধি ঢাকা পড়ে উদ্ভট দেখাচ্ছে বেচারী নথিকে।

মাথা থেকে টেনেটুনে স্টকিং ক্যাপটা খুলে ফেলল ও।

ওরা আবার আমার হ্যাট চুরি করেছে!

যমজরা হল পেরিয়ে গেম রূমের উদ্দেশে ছুট দিল। ওদেরকে ধাওয়া করল তিন গোয়েন্দা।

দিয়ে দাও ওটা! গর্জন ছাড়ল নথি।

এটা যখন যার তখন তার-জাদুর হ্যাট কিনা, প্রথমজন কথাগুলো বলে। রবিনের হ্যাটটা পরে ফেলল।

রবিন ওটা কেড়ে নিতে হাত বাড়াল। ছেলেটা ঝট করে মাথা নামাল।

পারলে ধরো দেখি!

এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। দোরগোড়ায় ধাক্কা খেল মি, গ্রেগের সঙ্গে।

উফ, বলে উঠে মি. গ্রেগের দিকে চাইল যমজ।

এসময় এক মহিলা উদয় হলেন মি. গ্রেগের পাশে।

কিম, জিম, তোমরা ভুলে গেছ? বললেন। মাউন্টেনটপ ক্যাফেতে আজ আমাদের লাঞ্চ করার কথা। গন্ডোলায় চড়বে না?

চড়ব না মানে? দ্বৈত সঙ্গীত গাইল যমজরা।

প্রথম জন রবিনের হ্যাটটা খুলে ছুঁড়ে দিল ওর উদ্দেশে। অপরজুন রবিনের হাত থেকে কেড়ে নিল লাল স্টকিং ক্যাপটা।

মুসা দাঁত কিড়মিড় করে এগোতে যাচ্ছিল, কিশোর ইশারায় ওকে থামতে নির্দেশ দিল। ছেলে দুটো মহা বিচ্ছু হতে পারে, কিন্তু বয়সে তো ছোট। ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই ওর।

দাঁড়াও,যমজদের উদ্দেশে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। তোমরা কি একটা স্কি আকৃতির রুপোলী লকেট দেখেছ?

হ্যাঁ, বলে উঠল দ্বিতীয় ভাই। ওসব তো মেয়েরা পরে।

মুসা চোখ পাকিয়ে তাকাল, কিন্তু তার আগেই ঘুরে দাঁড়িয়ে মার সঙ্গে বেরিয়ে গেল দুভাই।

ওদের গন্ডোলা আটকে যাক, আর না নামুক, থমথমে গলায় বলল মুসা।

ইতোমধ্যে রাশেদ পাশা এসে যোগ দিয়েছেন ওদের সঙ্গে। হেসে উঠলেন তিনি।

লাঞ্চ করবি না? আয়।

সবাই ওরা ফিরে গেল ক্যাফেটেরিয়ায়। সামনে ধূমায়িত খাবারের প্লেট নিয়ে বসল।

তোদের নতুন রহস্যের কথা বল, রাশেদ চাচা কিশোরকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

তুমি রহস্যের কথা জানলে কী করে, চাচা? জিজ্ঞেস করল কিশোর। পানির গ্লাসে চুমুক দিল।

মুচকি হাসলেন চাচা।

একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি তো আমিও জানি, না কি? গেম রূমে যমজ ভাইদেরকে প্রশ্ন করলি শুনলাম। আর সকালে কী যেন খুঁজছিলি মনে পড়ে গেল। ব্যস, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেললাম।

আমার লকেটটা, বলল মুসা। কাল রাত থেকে পাচ্ছি না।

পাহাড়ে আজকে কে যেন পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে মুসাকে, বলল। রবিন। লকেটটা যে চুরি করেছে সে হতে পারে!

তোমারও কি তাই মনে হয়, চাচা? কিশোর প্রশ্ন করল।

জানিসই তো, বললেন চাচা। কোন সিদ্ধান্তে আসতে হলে তথ্য প্রয়োজন। চেয়ারে হেলান দিলেন। মুসাকে কি কেউ ইচ্ছে করে ঠেলা দিয়েছে? নাকি ওটা নিছকই একটা অ্যাক্সিডেন্ট?

নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল গোয়েন্দাপ্রধান।

দুটো ঘটনা আমাদের মনে রাখতে হবে, বলল।

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে।

এক হচ্ছে, মুসার লাকি লকেটটা হারিয়ে গেছে। এবং দুই, পাহাড়ের ঢালে মুসাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ব্যাপারটা চাচা যেমন বললেন ইচ্ছাকৃত কিংবা অ্যাক্সিডেন্ট, দুরকমই হতে পারে।

এবার আসি সন্দেহভাজনদের তালিকায়।

কারা তোর সাসপেক্ট? রাশেদ চাচা জানতে চাইলেন।

নীচের ঠোঁটে আবারও চিমটি কাটল কিশোর।

যমজ দুটো, কিম আর জিম, বলল ও। কোটা কে বলতে পারব না, কাজেই দুটোকেই রাখছি আমার সন্দেহের তালিকায়। ওদের যে কোন একজনের পক্ষে মুসাকে ধাক্কা দেয়া সম্ভব।

ওরা কেন করতে যাবে কাজটা? রাশেদ চাচা প্রশ্ন করলেন।

স্রেফ দুষ্টামি, বলল রবিন। ছেলেমানুষী।

মৃদু হাসলেন চাচা।

ব্যস, এরা দুজনই তোদের সাসপেক্ট, আর কেউ না?

ঘ্যানঘেনে বিল? রবিন জিজ্ঞেস করল।

ও ছিল ঘটনাস্থলে, বলল কিশোর। স্কিইং পছন্দ করে না ও। ক্লাসটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দেয়ার জন্যে মুসাকে ধাক্কা দিয়ে থাকতে পারে।

আর কেউ? মুসা বলল।

উডি আর মারি কাছাকাছি ছিল।

ওরা মুসাকে ধাক্কা দিতে যাবে কেন? রাশেদ চাচা জিজ্ঞেস করলেন।

দুমুহূর্ত ভেবে নিল কিশোর।

মারি বানি ক্লাসে থাকতে চায় না, জ্যাকর্যাবিটে যেতে চায়, বলল।

ও ভেবেছিল আমি পড়ে গেলে ইন্ট্রাক্টর আমার সাথে ওকে পাল্টাপাল্টি করে দেবেন, বলল মুসা। কথাটা বলেও ফেলেছে।

কিন্তু উডি? চিন্তিত কণ্ঠে বলল কিশোর। মারিকে জ্যাকর্যাবিট ক্লাসে আনার জন্যে ও কি মুসাকে ফেলে দিতে পারে?

কাজটা তোদের। গোয়েন্দাগিরি করে জবাবটা তোদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে, বললেন চাচা।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল কিশোর। বিল, উডি আর মারির নাম গেঁথে নিল মনের মধ্যে।

আমাদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, বন্ধুদের উদ্দেশে বলল। আজকে বিকেলের ক্লাসে নতুন কোন ক্ল পেয়ে যেতে পারি।

সে আর বলতে, বলল মুসা। আমরা সতর্ক থাকব।

লাঞ্চের পর চাচার কাছ থেকে বিদায় নিল ছেলেরা। তারপর থপথপ করে দরজার উদ্দেশে পা বাড়াল।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মুসা।

আরে, আমার স্কি জোড়া এখানে কেন?

দরজার এপাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা, ও দুটো।

তুমি শিয়োর এগুলো তোমার? কিশোর প্রশ্ন করল।

টেপ দিয়ে নাম লেখা রয়েছে, আঙুল তাক করে দেখাল মুসা।

ওই দেখো। আর কোন সন্দেহ আছে?

কেউ হয়তো ভুল করে নিয়ে ফেলেছিল, পরে বুঝতে পেরে এখানে রেখে গেছে, বলল গোয়েন্দাপ্রধান।

কিংবা ওই যমজ বিচ্ছু দুটো হয়তো ইয়ার্কি মেরেছে, বলল রবিন। চারপাশে দৃষ্টি বুলাচ্ছে।

আশপাশে যমজদের দেখা গেল না।

যাক, পাওয়া তো গেছে স্কি দুটো, স্বস্তির সঙ্গে বলল মুসা। স্কি আর পোল তুলে নিয়ে বন্ধুদের অনুসরণ করল ও।

কিশোর আর রবিন যথাস্থানে ওদের স্কি খুঁজে পেল। তিন বন্ধু স্কি পরে নিল।

জুলিয়া টিচার আর বিল ঢালের নীচে দাঁড়িয়ে। ভিক্টরকে উডি, মারি আর কয়েকজন জ্যাকর্যাবিটের সঙ্গে দেখা গেল।

কিশোর আর রবিনকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল বিল।

জলদি এসো। ঠাণ্ডায় জমে গেলাম!

পরে দেখা হবে, বলে পোলে চাপ দিল মুসা।

কিন্তু এক চুল নড়তে পারল না ও।

আরও জোর খাঁটিয়ে আবারও চাপ দিল।

অবস্থা যে কে সেই।

আমার স্কিতে কী যেন হয়েছে, চেঁচিয়ে উঠল মুসা। নড়ছে না!

ছয়

স্কি খুলে ফেলল মুসা। উল্টে দিল। চাকা চাকা বরফে ভরে আছে তলা দুটো!

জুলিয়া স্কি করে চলে এলেন ছেলেদের কাছে।

কী হয়েছে?

মুসা ওর স্কি জোড়া ইন্ট্রাক্টরকে দেখাল।

লাঞ্চের সময় লজের ভিতর রেখেছিলে নাকি? প্রশ্ন করলেন জুলিয়া।

মাথা নাড়ল মুসা।

না, বাইরেই রেখেছি। কিন্তু কে যেন ভিতরে নিয়ে গেছে।

এবার বোঝা গেল, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন জুলিয়া। তোমার স্কিজোড়া ভিতরে থাকার ফলে গরম হয়ে যায়। বাইরে যখন পা রেখেছ তুষার গেছে। গলে। কিন্তু বাইরে এতটাই ঠাণ্ডা, পানি আবার জমে গেছে। আর তাই তোমার। স্কির নীচে বরফ দেখতে পাচ্ছ।

এগুলো পরে স্কি করা যাবে না, হতাশ কণ্ঠে বলল মুসা। আমার কপালটাই খারাপ!

ভিক্টর, উডি আর মারি স্কি করে চলে এল।

কী হয়েছে? ভিক্টর প্রশ্ন করলেন।

জুলিয়া ঘটনাটা জানালেন।

মুসার স্কি বরফ হয়ে আছে।

আমরা যখন লাঞ্চ করছিলাম, সেই ফাঁকে কেউ একজন ওগুলো ভেতরে রেখে দেয়, বলল রবিন।

খুব খারাপ কথা, বলল মারি। তা হলে তো মুসার আর ক্লাস করা হচ্ছে না। ওর জায়গাটা আমি নিতে পারি।

তার দরকার পড়বে না, জোরাল গলায় বললেন জুলিয়া।

হ্যাঁ, সায় দিলেন ভিক্টর, আমি মুসাকে নিয়ে যাচ্ছি। ও আরেক জোড়া স্কি ভাড়া করে নেবে।

স্কি খুলে মুসার সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি।

গোটা ক্লাসটায় কিশোর মুসার জমে-যাওয়া স্কিজোড়ার কথাই শুধু ভাবল। কেউ একজন ওকে সরাতে চাইছে। কে সে?

বিকেল নাগাদ বানি ক্লাসের রোপ টো ব্যবহার করা শেখা হয়ে গেল। এরপর পাহাড়ের অনেকখানি উঁচু থেকে নেমে এল ওরা। দারুণ মজা পেল কিশোর। কিন্তু ওর মাথায় কেবলই ঘুরপাক খেল রহস্যটার চিন্তা।

তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে স্নোম্যান বানানোর পার্টিতে, ক্লাস শেষে বললেন জুলিয়া। সবার জন্যে প্রচুর হট চকোলেটের ব্যবস্থা থাকবে।

হট চকোলেট আমার ভাল্লাগে না, সাফ জানিয়ে দিল বিল। জিভ পুড়ে যায়।

স্নোম্যান তো বাচ্চারা বানায়, আওড়াল মারি।

পার্টি জমাতে এদের দুজনের জুড়ি মেলা ভার, ব্যঙ্গের সুরে কিশোরকে বলল রবিন।

দুই বন্ধু চলল মুসার সঙ্গে দেখা করতে।

লকার রূম নানা ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের ভিড়ে গিজগিজ করছে।

উহ, টায়ার্ড হয়ে গেছি, বলে নিজের জুতোজোড়া পরে নিল রবিন।

আমি হইনি, বলল মারি। আমি সারা দিন-রাত স্কি করতে পারব।

উডি ওর জুতোজোড়া তুলে নিল। ফিতে দিয়ে বাঁধা ও দুটো। একটা ফিতে ধরে টান দিতেই আলাদা হয়ে গেল দুপাটি।

কীভাবে করলে? রবিন উৎসুক কণ্ঠে জানতে চাইল।

একে বলে স্লিপ নট, বলল মারি। উডি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে বাঁধতে হয়।

আঙুল ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এটা খুব কাজে আসে, ব্যাখ্যা করল উডি।

অবশ্য সাবধান থাকতে হয়, মারি বলল। নইলে যখন তখন খুলে যেতে পারে।

রাশেদ চাচা লকার রূমের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন ওদের জন্য।

কীরে, কেমন কাটল তোদের বিকেলটা?

ভাল, জানাল মুসা। তবে আমার লাকি লকেটটা থাকলে আরও ভালভাবে স্কি করতে পারতাম।

ভাগ্যটাও হয়তো ভাল থাকত, বলল রবিন।

কিশোর চাচাকে মুসার জমাট বাঁধা স্কির কথা জানাল।

কপাল খারাপ, মন্তব্য করলেন চাচা।

আরেকটা সূত্র, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। গেঁথে নিল মনে।

ওরা সবাই মিলে এরপর লজের পিছনের তুষারাবৃত মাঠটার উদ্দেশে এগোল। গিয়ে যখন পৌঁছল, জায়গাটা তখন লোকে লোকারণ্য।

তোরা মজা কর, বললেন চাচা। আমি সব মালপত্র জড় করে ঘরে নিয়ে যাই। একটু পরে দেখা হবে।

আচ্ছা, বলল কিশোর।

একটা তুষার কুকুর বানানো যাক, চাচা চলে গেলে প্রস্তাব করল রবিন।

রাফিয়ানের মত, সোৎসাহে সায় জানাল মুসা।

ভাল হচ্ছে না কিন্তু! মারির গলা ভেসে এল। পরমুহূর্তে তুষারের একটা বল ছুঁড়ে দিল ও ভাইকে লক্ষ্য করে।

কিম আর জিম তুষারমানব বানাচ্ছিল। ওটার আড়ালে ঝট করে বসে পড়ল উডি।

ফলে, মারির ছোঁড়া বলটা যমজদের তুষারমানবের মাথার খানিকটা অংশ ভেঙে দিল।

সরি,বলল মারি।

নো প্রবলেম, বলল যমজদের একজন।

জিম আর আমি একটা তুষারানো বানাচ্ছি। একটা মাত্র চোখ থাকবে ওটার।

আর লম্বা একটা নাক, জিম বলল। দানোটার নাকের জায়গায় একটা কাঠি গুঁজে দিল ও।

উডি আরেকটা তুষারের বল ছুঁড়ে মারল মারির উদ্দেশে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।

উফ! বলে উঠল এইমাত্র পার্টিতে যোগ দেওয়া বিল। কোট থেকে ঝেড়ে ফেলল তুষার। আমি এসব ফালতু খেলার মধ্যে নেই! চলে গেল গট গট করে।

বিল বেচারার সময়টা একেবারেই ভাল কাটছে না, মনে মনে বলল কিশোর। তুষার কুকুরের দেহ তৈরির জন্য একটা বল পাকাল ও।

দানোটার নাক ফুল, কিশোরের কানে এল যমজদের একজনের কণ্ঠ। চোখ তুলে চাইল ও।

তুষারানোর নাকে কী একটা ঝুলিয়ে দিল এক ভাই।

চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল গোয়েন্দাপ্রধানের।

ওটা পেলে কোথায়? চেঁচিয়ে উঠল।

অ্যাই! মুসা চিৎকার ছেড়ে দৌড়ে গেল ওর লকেটটা কেড়ে নিতে।

কিন্তু তার আগেই কিম ওটা হাত করে ফেলেছে।

অ্যাই, জিম, ধর! ভাইয়ের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিল।

জিম লুফে নিল ওটা।

তবে রে! মুসা ওর দিকে তেড়ে যেতে কিমের দিকে ছুঁড়ে দিল।

কিন্তু কিমের আগেই এক লাফে এগিয়ে এসে ওটা লুফে নিল উডি।

গুড ক্যাচ, উডি, বলল মুসা।

এসো, বেঁধে দিই, বলল উডি।

শক্ত করে বেঁধো। আবার যাতে পড়ে না যায়। রুপোলী লকেটটা স্পর্শ করে বলল মুসা। ওর হাসি কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে।

উডি মুসাকে লকেটটা পরিয়ে দিচ্ছে, হেসে উঠল মারি।

উডি, স্লিপ নট দিয়ো না যেন।

যমজদের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর।

তোমরা বলেছিলে মুসার লকেট দেখোনি।

ওটা ওরাই নিয়েছিল, গর্জে উঠল রবিন।

বিশ্বাস করো আমরা নিইনি, কিম ফ্যাকাসে মুখে জানাল। খুঁজে পেয়েছি।

লজের পাশে মাটিতে আঙুল তাক করল জিম।

তুষারে পড়ে ছিল, বলল।

কিশোর জিমের নির্দেশিত জায়গাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। তুষারে অসংখ্য পদচিহ্ন। কে বলবে কার পায়ের ছাপ ওগুলো।

মুসার লকেট ওখানে গেল কীভাবে?

কেউ নিশ্চয়ই ফেলেছে। মুসার গলা থেকে খসে পড়েনি তো?

উডি আর মারি তুষারমানব বানাচ্ছে জায়গাটার কাছেই। যমজদের তুষারদানবটাও কাছাকাছি রয়েছে। আর একটু আগেই এ পথ মাড়িয়ে গেছে। বিল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল গোয়েন্দাপ্রধান। মুসার লকেট পাওয়া গেল। কিন্তু এর ফলে আরও জটিল হলো রহস্য।

সাত

সে রাতে, ডিনারের পর বাঙ্কে বসে সারা দিনের ঘটনাগুলো উল্টেপাল্টে ভেবে দেখল কিশোর।

কিশোরের বাঁ পাশে বসেছে রবিন।

আমার ধারণা, যমজ ভাইগুলো মুসার স্কি সরিয়েছে।

কিশোরের ডান দিকে মুসা বসা।

যমজরা কাজটা করেনি, বলল। ওরা মাউন্টেনটপ কাফেতে লাঞ্চ করতে গিয়েছিল।

হয়তো বেরিয়ে যাওয়ার সময় কাজটা করেছে, রবিন নাছোড়বান্দার মত বলল।

মাথা নাড়ল কিশোর।

ওরা মার সাথে ছিল।

ঠিক আছে, বলল রবিন। ধরে নিলাম স্কি সরায়নি। কিন্তু কোনভাবে লকেটটা হাতানো ওদের পক্ষে অসম্ভব কিছু না। মনে নেই বারবার আমার হ্যাট কেড়ে নিচ্ছিল?

হতে পারে, আস্তে করে বলল কিশোর। কিন্তু মোট তিনটে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে মুসা। আমি শিয়োর, কাজটা একজনের।

কাজেই যমজদের নাম বাদ দেয়া যায়, বলল ও। কিম আর জিম তো একজন হতে পারে না।

তোমার সন্দেহ তালিকায় তো উডি, মারি আর বিলের নাম আছে, বলল মুসা। আমাকে যখন ধাক্কা দেয়া হয় তিনজনই আশপাশে ছিল।

নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর।

উডি আর মারি পরের ক্লাস শুরুর আগেই প্র্যাকটিস করতে চলে গিয়েছিল, বলল ও।

ওরা মুসার স্কি সরিয়ে থাকতে পারে, বাকিটুকু যোগ করল রবিন।

আমরা যখন বাইরে বেরোই, বিল ক্লাস শুরুর জন্যে অপেক্ষা করছিল, স্মৃতি হাতড়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। ও-ও আগেই বেরিয়ে এসে কাজটা সারতে পারে।

সন্দেহ তালিকার নামগুলো একে একে মনে করল কিশোর।

মারি বানি ক্লাসে থাকতে চায়নি। ও কি মুসার স্কি সরিয়েছে? জ্যাকর্যাবিট ক্লাসে ঢুকবার জন্য ও-ই কি মুসাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল?

হতে পারে, ভাবল কিশোর। কাজটা উডিও করে থাকতে পারে। কেন? ভাইকে সাহায্য করবার জন্য।

কিন্তু বিল তোমার স্কি সরাতে যাবে কেন, মুসা? প্রশ্ন করল কিশোর।

কে জানে, বলল মুসা। হয়তো ওর স্কিইং পছন্দ নয় বলে চায় না অন্য কেউ এনজয় করুক।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। এখন আর ভাবনা-চিন্তা করতে ভাল লাগছে। না।

এখনও রহস্যটার সমাধান করতে পারলাম না, হতাশ কণ্ঠে বলল।

মুসা ওর লকেটটা স্পর্শ করল।

কিন্তু আমার লকেটটা তো খুঁজে পেয়েছ, বলল ও। অন্তত আমার দুর্ভাগ্যের অবসান হবে।

তাই যেন হয়, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। কিন্তু মনের গভীরে কু-ডাক ডাকছে ওর কপালে আরও দুর্ভোগ আছে ওদের।

.

স্কি লিফট চেয়ারের এক কোনা দিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে রবিন। চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ও।

বাপরে! অনেক নিচু!

বানি ক্লাস সারা সকাল প্র্যাকটিস করেছে। স্কি লিফটে এই প্রথম চড়বার সুযোগ পেয়েছে ওরা।

এটা অতটা খারাপ লাগছে না, বিল মারিকে বলছে, শুনতে পেল কিশোর। ওদের পিছনের চেয়ারে রয়েছে ওরা।

তেমন ভাল লাগারই বা কী আছে, দ্বিমত প্রকাশ করল মারি। স্রেফ একটা চেয়ার লিফট বই তো নয়।

মারি কোন কিছুতেই খুশি হওয়া যাবে না ভেবে নিয়ে গোঁ ধরে বসে আছে, মনে মনে বলল গোয়েন্দাপ্রধান।

চূড়ায় পৌঁছে, সেফটি বার তুলে দিল কিশোর ও রবিন। স্কি পায়ে সিধে উঠে দাঁড়িয়ে হড়কে নেমে এল লিফট থেকে। জুলিয়ার পাশে গিয়ে থেমে দাঁড়াল।

সবাই রেডি তোমরা? গোটা ক্লাস হাজির হলে বললেন জুলিয়া। গুড। এসো, স্কি করা যাক!

উম, আমি কি হেঁটে নামতে পারব? রবিন প্রশ্ন করল।

নিশ্চয়ই পারবে, বলল কিশোর।

স্কি ক্রস হয়ে না গেলেই হলো, বাতলে দিল বিল।

মারি ঠেলেঠুলে লাইনের সামনে চলে এল।

আমি আগে। আমি চাই না কেউ আমার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ুক আর আমাকেও পড়তে বাধ্য করুক।

শ্রাগ করলেন জুলিয়া।

বেশ তো, যাও।

হাসি ফুটল ওর মুখে। পোলে চাপ দিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে লাগল।

কিশোরের পালা এলে, বুক ভরে শ্বাস টানল ও। তারপর নামতে শুরু করল।

অসম্ভব দ্রুত গতিতে নেমে যাচ্ছে ও! মুহূর্তের জন্য ভড়কে গেল। কিন্তু এই ছুটিতে অনেক কিছু শিখেছে। গতি ধীর করে আনতে পেরে মনটা খুশি হয়ে উঠল ওর।

বিকেলের বাকি সময়টুকু ঢাল বেয়ে নামা অনুশীলন করল ওরা।

তোমরা সবাই খুব ভাল করেছ, ক্লাস শেষে প্রশংসা করলেন জুলিয়া। কাল সকালে স্কিইং প্রতিযোগিতা আছে। তারপর মাউন্টেনটপ কাফেতে পুরস্কার বিতরণী।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, টিচার, হাসি মুখে বলল কিশোর। সময়টা দারুণ এনজয় করেছি।

হ্যাঁ, সুর মেলাল বিল। যতটা খারাপ লাগবে ভেবেছিলাম স্কিইং ততটা খারাপ না।

হাসি ফুটল জুলিয়ার মুখে।

শুনে খুশি হলাম। পুকুরের ধারে আজ রাতে দেখা হবে, স্কেটিং পার্টিতে। আঙুল তুলে দূরে পুকুরটা নির্দেশ করলেন। গুড লাক টুমরো!

মারি তুষারে পোল দাবিয়ে রওনা হলো।

আমার ভাগ্যের প্রয়োজন নেই, কাঁধের উপর দিয়ে বলল। কারণ আমি জিততে চলেছি। তোমরা সব হারু পাট্টি।

.

সে রাতে ছেলেরা স্কেটিং পার্টিতে পৌঁছবার পর, মুসা ঝটপট স্কেট পরে নিয়ে আইস হকি খেলতে গেল।

কিন্তু স্কেটের ফিতে লাগাতে অনেক সময় নিয়ে নিল কিশোর আর রবিন।

কিশোর লক্ষ করল, একাকী এক খাবারের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মারি। ড্রিঙ্ক আর স্ন্যাকস দেখা যাচ্ছে টেবিলের উপর।

এক কাজ করা যাক, ফিসফিস করে বলল কিশোর। মারির জন্যে একটা। ফাঁদ পাতি।

কীভাবে? রবিন জানতে চাইল।

ও যদি মুসার স্কি সরিয়ে থাকে, তবে ও দুটো দেখতে কেমন ও জানে, ঠিক না?

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

সটান উঠে দাঁড়াল কিশোর।

এসো। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।

মারির উদ্দেশে স্কেট করে এগোল ও।

কী প্ল্যান? নিচু গলায় জবাব চাইল রবিন, বন্ধুর নাগাল পেতে চেষ্টা করছে। কী করব আমরা?

স্রেফ আমার সাথে তাল দিয়ে যেয়ো, ফিসফিসিয়ে জানাল কিশোর। টেবিলের পাশে এসে থেমে দাঁড়াল। হাই, মারি!

মারি সবে মাত্র এক কাপ হট কোকো শেষ করেছে।

ও, তোমরা? ভালই হলো। আমি একা-একা বোর হচ্ছিলাম। উডি আইস হকি খেলতে গেছে। এসো, আমরা স্কেট করি।

অ্যাই, মারি, বলল কিশোর, রবিন স্কি কিনতে চাইছে। ওরা তিনজন পুকুরটাকে ঘিরে ধীরে ধীরে চক্কর কাটছে।

আমি? সবিস্ময়ে বলে উঠল রবিন। পরক্ষণে কিশোরের কনুই খেয়ে বলল, হ্যাঁ, চাইছিই তো।

মুসা প্রথমে যেরকম ভাড়া করেছিল তেমনি স্কি ওর পছন্দ, বলে চলল কিশোর। ও দুটো ভাল ছিল। তোমার কী মনে হয়?

শ্রাগ করল মারি।

হতে পারে। আমি সেভাবে লক্ষ করিনি।

মারির মুখের চেহারার অভিব্যক্তি খুঁটিয়ে পরখ করল কিশোর। মিথ্যে বলছে বলে মনে হলো না।

বুদ্ধিটা কাজে দিল না। অন্য কিছু চেষ্টা করে দেখতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল গোয়েন্দাপ্রধান।

তোমার কি এখনও জ্যাকর্যাবিট ক্লাসে যাওয়ার ইচ্ছা? প্রশ্ন করল। হেসে উঠল মারি।

কী বোকামিটাই না করছিলাম, বলল। উডির ক্লাসে গেলে আমাকে ওর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। ও আমার চাইতে অনেক ভাল স্কি করে। এখন ওর ক্লাসে ও সেরা আর আমার ক্লাসে আমি। দুজনই জিতব।

অন্য কেউও তো জিততে পারে, বলল রবিন। তুমি অত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?

আবার হেসে উঠল মারি।

এখন তুমি বোকামি করছ, বলল।

মারি! উডির গলা শোনা গেল। চলে এসো। জিততে হলে আমাদের আরেকজন প্লেয়ার চাই।

আসছি, চেঁচিয়ে বলল মারি। পরে দেখা হবে, কিশোর আর রবিনের উদ্দেশে বলে চলে গেল।

রবিন জ্বলন্ত চোখে ওর গমনপথের দিকে চেয়ে রইল।

ও নিজেকে বিরাট কিছু একটা ভাবে, বলল।

হ্যাঁ, বলল কিশোর। ও এখনও আমাদের সন্দেহভাজন-যদিও ফাঁদটা কাজ করল না।

.

পরদিন সকালে নাস্তার পর, রাশেদ চাচার সঙ্গে তিন গোয়েন্দা স্কি লজের উদ্দেশে হাঁটা ধরল। প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে ছেলেরা।

সামনের ধাপগুলোর কাছে মাত্র এসে পৌঁছেছে, এমনিসময় ছুটতে ছুটতে আসতে দেখল মারিকে।

হাই, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। আগের জায়গায় না, আজকে আমাদেরকে পুকুর পাড়ে জড় হতে বলেছে। কথা কটা বলেই দৌড়ে চলে গেল।

তাড়াতাড়ি চলো, তাগাদা দিল মুসা। পুকুরটা কম দূর না।

ভাল দেখে একটা জায়গা বেছে ফেলি, সোৎসাহে বললেন রাশেদ চাচা। প্রতিযোগিতা দেখবার জন্য মুখিয়ে আছেন। গুড লাক, বয়েজ!

তিন গোয়েন্দা স্কি বুট পরে নিল। পুকুরের দিকে স্কি করে যথাসম্ভব দ্রুত রওনা দিল ওরা।

লোকজন সব গেল কোথায়, ওখানে পৌঁছে বলল মুসা।

এক মহিলা যন্ত্রপাতি রাখবার শেডের পাশে বসে। স্নোমোবাইল পালিশ করছে।

তোমরা কি পথ হারিয়েছ নাকি, বাছারা?

স্কেটিং প্রতিযোগিতা তো এখানেই হবে, তাই না? কিশোর জানতে চাইল।

মাথা নাড়ল মহিলা।

না, ওদিকে। বিগিনার্স স্লোপের নীচের দিকে আঙুল, নির্দেশ করল সে। এখুনি মনে হয় শুরু হয়ে যাবে।

ধক করে জ্বলে উঠল মুসার চোখজোড়া।

দাঁড়াও, আগে ওই মারি শয়তানটাকে বাগে পেয়ে নিই, দেখাব মজা!

দৌড় দাও, তুরিত বলে উঠল কিশোর। এখনও হয়তো সময় আছে।

স্কি বুট পরে দৌড়ব কীভাবে! আর্তস্বর ফুটল রবিনের কণ্ঠে। সময়মত কিছুতেই পৌঁছতে পারব না। কোন আশা নেই!

আট

মনে হচ্ছে কেউ তোমাদেরকে ভুল ইনফর্মেশন দিয়েছে, বলল মহিলা। এক কাজ করো, আমার স্নোমোবাইলে উঠে পড়ো। আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

তিন গোয়েন্দা ওদের স্কি রেখে দিল স্নোমোবাইলের পিছনে, স্লেডের ভিতর। তারপর উঠে বসল স্নোমোবাইলে। একটু পরেই ঢালের উদ্দেশে সা-সঁ করে ছুটে চলল।

থ্যাংকস, স্নোমোবাইল থেমে পড়লে মহিলাকে আন্তরিকভাবে বলল কিশোর।

এক লাফে নেমে পড়ে, ছোঁ মেরে খুলে নিল স্কিজোড়া। ছুটল জুলিয়া টিচারের কাছে। রবিন ওর পায়ে পায়ে ছুটছে।

মুসা ওদের পাশ কাটিয়ে লিফটের উদ্দেশে ধেয়ে গেল। জ্যাকর্যাবিট ক্লাসের বাদবাকিরা ইতোমধ্যে শূন্যে উঠে পড়েছে।

তোমরা দেরি করে ফেলেছ, কুঁচকে বললেন জুলিয়া।

আমাদের দোষ নেই, সাফাই দিল রবিন। একজন আমাদেরকে পুকুরের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তীব্র চোখে মারির দিকে চাইল ও। কিন্তু মারি চোখে চোখ ফেলল না।

টিচার, মৃদু কণ্ঠে বলল কিশোর। আপনার সাথে একটু কথা ছিল। আমার সাথে? বলো না।

জুলিয়া টিচারকে এক পাশে নিয়ে গেল কিশোর। মিনিট খানেক দুজনের মধ্যে কী কথা-বার্তা হলো কেউ জানতে পারল না।

কথা সেরে ফিরে এসে স্কি পরে নিল কিশোর। রবিন ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এবার স্কি লিফটে চড়ল ওরা।

ডায় যখন উঠে আসছে, মুসাকে দেখতে পেল তীব্র গতিতে নেমে যাচ্ছে স্কি পায়ে। কিশোরের মনে হলো, চমৎকার স্কি করছে ওর বন্ধু।

মুহূর্ত পরে নেমে এল উডি, সে-ও কম যায় না। ওর মান ভিডিওতে দেখা স্কিয়ারদের কাছাকাছি প্রায়।

অবশেষে চুড়োয় এসে পৌঁছল ওরা। এবার বানি ক্লাসের প্রতিযোগিতার পালা।

বিল ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে পড়ে গেল। বাকি পথটুকু পিছলে নেমে গেল। কিন্তু উঠে দাঁড়ালে দেখা গেল দাঁত বের করে হাসছে।

এবার মারি তুষারে স্কি পোল দুটো গেঁথে জোরে চাপ দিল–এতটাই জোরে যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল স্কির সামনে! উঠে দাঁড়িয়ে ঠেলা দিল আবার। এবার আর কোন সমস্যা হলো না।

ছেলেটার সাহস আছে, তারিফ করল কিশোর। পড়ে গেছে বলে ঘাবড়ায়নি।

ওর পেট ভর্তি হিংসে, হিসিয়ে উঠল রবিন। কী কাজটা করল আমাদের সাথে! আচ্ছা, কিশোর, জুলিয়া টিচারের সাথে তোমার কী কথা হলো?

মুচকি হাসল কিশোর।

সময় মত সবই জানতে পারবে।

এরপর কিশোর। বুক ভরে শ্বাস টেনে রওনা হলো ও দমকা বাতাস পাশ কাটাচ্ছে। এঁকেবেঁকে তুষারাবৃত ট্রেইল ধরে নেমে আসছে সে।

দারুণ দেখিয়েছ! নীচে পৌঁছবার পর সপ্রশংস কণ্ঠে বলল মুসা।

থ্যাংকস, বলল কিশোর। তুমিও খুব ভাল করেছ।

লোকজন হাততালি দিচ্ছে, সেদিকে চাইল কিশোর। রাশেদ চাচা হাসি মুখে হাত নাড়ছেন ওর উদ্দেশে।

রবিনও নেমে এল খানিক বাদে। গতি ধীর, তবে একবারও পড়েনি ও।

চিৎকার করে ওকে উৎসাহ জোগাল কিশোর আর মুসা।

.

আমি জানতাম কাজটা মারির! লাঞ্চ টেবিলে বলল রবিন। আরেকটু হলেই কনটেস্ট মিস করতাম আমরা। এতেই সব প্রমাণ হয়!

কিশোর ওর সন্দেহ তালিকা থেকে বিলের নাম মুছে দিল। ছেলেটি স্কিইং পছন্দ করতে শুরু করেছে, কাজেই সে এখন আর সন্দেহভাজন নয়।

বাকি রইল শুধু উডি আর মারি। মারি যেহেতু ওদেরকে মিথ্যে কথা। বলেছে, তার মনে সে-ই অপরাধী।

নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। কিছু একটা মাথায় আসি-আসি করেও আসছে না। বড় অস্থিরতা বোধ হচ্ছে ওর।

বিকেলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যখন যাচ্ছে তিন গোয়েন্দা, তখনও কিশোরের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রহস্যটার চিন্তা।

ও কেন করল এরকম? গন্ডোলা লিফটের দিকে পা বাড়িয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল গোয়েন্দাপ্রধান।

কার কথা বলছ? মুসা জিজ্ঞেস করল।

আমাদের ধারণা ছিল এসব কিছুই মারি করেছে, কারণ সে জ্যাকব্যাবিট ক্লাসে যেতে চেয়েছে, জানাল কিশোর। তারপর তো ঠিক করল যাবে না। তা হলে তোমার সাথে এসব করে ওর কী লাভ? কোন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য…

মুসা ওর লকেটের ভেলভেট রিবনটা নাড়াচাড়া করছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল রুপোলী স্কি দুটো। ব্যাপারটা দৃষ্টি কেড়ে নিল কিশোরের।

ঠিক এ সময় ওর মনে পড়ে গেল উডি কীভাবে স্লিপনট বাঁধতে হয়। জানে। এবং মুসাকে লকেট পরাবার সময় মারি ঠাট্টা করে ভাইকে বলেছিল, স্লিপনট যেন না বাঁধে।

মনে পড়েছে! বলে উঠল কিশোর। গন্ডোলা লাইনটা এক ঝলক দেখে নিল। তারপর বন্ধুদের হাত ধরে হন্তদন্ত হয়ে পা চালাল।

ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়াল উডি আর মারি ওদের বাবা-মার সঙ্গে যেখানে দাঁড়িয়ে।

পরের গন্ডোলা এলে উড়িদের পিছনে বন্ধুদের ঠেলে তুলে দিল ও। নিজেও উঠে পড়ল। ভরে গেছে গন্ডোলা।

আপনারা পরেরটায় আসুন, উডির বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলল গন্ডোলা অপারেটর।

পাহাড়ের গা ঘেঁষে ক্রমেই উঠে চলেছে গন্ডোলা। কিশোর উডি আর মারির মুখোমুখি হলো।

উডি, আমি জানি মুসার পেছনে যে লেগেছিল সে আর কেউ নয়, তুমি।

উডি শ্রাগ করে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।

তুমি কী বলছ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

মারির দিকে দৃষ্টি স্থির করল গোয়েন্দাপ্রধান।

উডি তোমাকে পাঠিয়েছিল, তাই না, আমাদেরকে পুকুরের পাড়ে যেতে বলার জন্য?

উডির দিকে এক নজর চাইল মারি।

না, বলল। আমি ভেবেছিলাম ওখানেই প্রতিযোগিতাটা হবে।

কিশোর অত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। মারির কাছ ঘেঁষে বসল ও।

উডিই তোমাকে বলেছে মিথ্যে খবরটা দিতে। আমাদের কাছে গোপন করে লাভ নেই, মারি। আমরা সবই জেনে গেছি। মুসার লাকি লকেটটা উডিই চুরি করেছে। আর পাহাড়ের ঢালে মুসাকে ও-ই ধাক্কা দিয়েছে।

কোন প্রমাণ আছে? বিস্ফোরিত হলো উড়ি। তোমার কেন মনে হলো। ওর পচা লকেটটা আমি নিয়েছি?

স্লিপনটার জন্য, ঠাণ্ডা গলায় বলল গোয়েন্দাপ্রধান। মুসার লকেটে স্লিপনট ব্যবহার করোনি তুমি?

মুহূর্তের জন্য মনে হলো উডি বুঝি অস্বীকার করবে। কিন্তু ভাইয়ের দিকে এক পলক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

হ্যাঁ, শান্ত কণ্ঠে বলল। খুব ঢিলে করে স্লিপনট বেঁধেছিলাম যাতে লকেটটা খুলে পড়ে যায়। মুসা লজের বাইরে যেতেই ওটা তুষারের উপর পড়ে যায়। ও টেরও পায়নি।

তারপর যমজরা ওটা খুঁজে পায়, বলল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল উডি।

অন্য অকাজগুলোও আমার। মারির কোন দোষ নেই।

কিন্তু কেন করতে গেলে এসব? মুসা কৈফিয়ত দাবি করল।

জবাবটা আমি দিচ্ছি, বলল কিশোর। তোমার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করবার জন্যে। গত বছরের প্রতিযোগিতায় স্কি করতে গিয়ে উডি পড়ে যায়, এমনকী ফিনিশও করতে পারেনি। সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এবার তাই ও মরিয়া হয়ে ওঠে জেতার জন্য। ওর ধারণা হয় লকেটটা পরা থাকলে মুসার সাথে ও পারবে না। ঠিক বলেছি?

মাথা নিচু করে বসে রইল উড়ি।

আমি চাইনি মুসা লাকি লকেটটার জন্যে বাড়তি কোন সুবিধা পাক, স্বীকার করল ও। কেউ খেলে জিতলে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু, কিশোর, তুমি গত বছরের এতসব কথা জানলে কীভাবে?

জুলিয়া টিচার, মুচকি হেসে বলল গোয়েন্দাপ্রধান।

গন্ডোলা এ সময় চূড়ায় পৌঁছে ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল। উডি লাফিয়ে নেমে ঝেড়ে দিল দৌড়।

মারিও নেমে পড়ল।

আমি দুঃখিত, বলে সে-ও ভাইয়ের পিছন পিছন ছুটল।

.

মাউন্টেনটপ ক্যাফেতে এখন উত্তেজিত গুঞ্জনধ্বনি। বানি ক্লাসের পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করলেন জুলিয়া।

রবিন জিতল সবচাইতে স্টাইলিশ স্কি প্রতিযোগীর পুরস্কার। বিল জিতে নিল মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সেরা পুরস্কার।

মারিকেও পুরস্কার দেওয়া হলো-বীরত্বের স্বীকৃতি। পড়ে যাওয়ার পরও ফিনিশ করেছে সে।

সব শেষে, যে পুরস্কারটার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছ, ঘোষণা করলেন জুলিয়া।

সব দিক বিবেচনার পর বানি গ্রুপের সেরা স্কিয়ার নির্বাচন করা হয়েছে, বলে একটু বিরতি নিলেন টিচার, সবাই উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে। কিশোর পাশাকে।

হাসি মুখে জুলিয়া টিচারের হাত ঝাঁকিয়ে দিল কিশোর।

ক্লাসের সবাই কোন না কোন পুরস্কার পেয়েছে। কেউ হারেনি।

এবার জ্যাকর্যাবিট ক্লাসের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো কিশোরের।

সবাই তোমরা কঠোর পরিশ্রম করেছ, বললেন ভিক্টর। তবে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিবান খেলোয়াড় হিসেবে বিচারকমণ্ডলী বেছে নিয়েছেন মুসা আমানকে।

খাইছে! কান অবধি হাসি পৌঁছল মুসার। পুরস্কার নিতে গেল হাসতে হাসতে।

কিম আর জিম পেল সবচেয়ে দ্রুতগামী যমজ স্কিয়ারের পুরস্কার। ছুটে গিয়ে পুরস্কার নিয়ে আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে এল ওরা।

এবং বিচারকদের বিবেচনায় সেরা স্কিয়ারের পুরস্কার পাচ্ছে, বললেন ভিক্টর। উডি বোর্ডার।

উডির নাম ঘোষণা করা হলে হাততালি দিল কিশোর। কিন্তু মুখ গোমড়া। করে বসে রইল রবিন।

তিন গোয়েন্দার টেবিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল উডি, লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা।

কগ্রাচুলেশন্স, উডি!

উডির মুখের চেহারায় বিস্ময়ের অভিব্যক্তি।

সত্যি বলছ, মুসা?

নিশ্চয়ই, খোলা মনে বলল মুসা। তুমি ন্যায্যভাবেই কনটেস্ট জিতেছ। তুমিই এবারের সেরা খেলোয়াড়।

উষ্ণ ঝাঁকুনি দিল উডি মুসার হাত ধরে। তারপর গলা খাদে নামিয়ে বলল, আমি সত্যিই দুঃখিত, মুসা। আমাকে মাফ করে দিয়ো।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, সহাস্যে বলল মুসা। আগামী বছর কিন্তু এমন কোরো না!

আর লজ্জা দিয়ো না, বলে পুরস্কার আনতে গেল উডি।

রবিনও এবার বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিল হাততালিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *