বিজন ঘরে

বিজন ঘরে

অফিসে সেমিনার হচ্ছে। দীপের এই ধরনের সেমিনারে ভীষণ ঘুম পায়। অতি কষ্টে হাই চেপে বসে থাকতে হয়।

দিল্লি থেকে একজন বস মিস্টার মেহতা এসেছেন। আগামী পাঁচ বছর কীভাবে তাদের কোম্পানি মাটি থেকে আকাশে পৌঁছে যাবে সে বিষয়ক গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দিচ্ছেন।

দীপ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে বুঝল আর খানিকক্ষণ বসলে সে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়বে।

সে উঠে ওয়াশরুমের উদ্দেশে রওনা দিল।

অনেকক্ষণ মোবাইল চেক করা হয়নি, ওয়াশরুমে পৌঁছে সে মোবাইল বের করল। ফোন সাইলেন্টে ছিল। একটা আননোন নাম্বার থেকে দুবার মিসড কল এসেছে। দীপ চাপ নিল না। নির্ঘাত কেউ গাড়ি বা ক্রেডিট কার্ড গছাতে ফোন করেছিল। সে হিসেব করে দেখেছে এই টাইপের লোকগুলো বেছে বেছে দুপুরের সময়েই ফোন করবে।

খানিকক্ষণ মোবাইলে সেনসেক্সের হালচাল দেখে-টেখে আবার সেমিনার হলে ঢুকতে যাবে, এই সময় চোখে পড়ল মোবাইলে রিং হচ্ছে। সেই একই আননোন নাম্বার। ধরবে না ধরবে না করেও সে ফোনটা রিসিভ করল, “হ্যালো।”

“দীপ গাঙ্গুলি বলছেন?”

ওপাশের নারী কণ্ঠস্বর চিনতে পারল না দীপ। বলল, “হ্যাঁ বলছি।”

“কেমন আছেন আপনি?” ওপাশের মেয়েটার গলায় কৌতুকের ছোঁয়া।

দীপ অবাক হল, তবে কি চেনা কেউ? সে বলল, “কে বলছেন বলুন তো?”

“আপনি আমাকে চিনতে পারছেন নাকি বলুন তো?”

দীপ অনেক ভেবেও গলাটা চিনতে পারল না। ঈষৎ রেগে বলল, “ফাজলামি না করে নামটা বলুন। আমি মাছ ধরতে আসিনি। ইম্পর্ট্যান্ট অফিস মিটিংয়ে আছি।”

“ওকে ওকে। তাহলে মিটিংয়ের পরেই ফোন করছি।”

“না না, বলুন কে বলছেন।”

ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেল। দীপ অবাক হল। সে ওই নাম্বারে কলব্যাক করল।

ও প্রান্ত থেকে কেউ ফোন রিসিভ করল না।

দীপ নাম্বারটা সেভ করে চেষ্টা করল নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপে আছে নাকি দেখতে।

কিছুই দেখতে পেল না। নাম্বারটায় আরও দু-তিনবার ফোন করল। সুইচড অফ বলছে।

এক সিনিয়র সমীর রায় সেমিনার হল থেকে বেরোচ্ছিলেন। তাকে দেখে বললেন, “আরে গাঙ্গুলি, বাইরে কী করছ?”

দীপ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “টয়লেটে গেছিলাম স্যার। বেরিয়ে এসে দেখলাম বাড়ি থেকে ইম্পর্ট্যান্ট একটা কল এসেছে।”

সমীর বললেন, “ওকে, ওকে। এখন চলে যাও।”

দীপ বলল, “শিওর স্যার।”

হলে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে দীপ বুঝল, সে এতটা সময় বাইরে ছিল, কিন্তু বক্তৃতা ওই একই জায়গায় ঘুরঘুর করছে। তার পাশে কলিগ রাম শুক্লা বসে ছিল। তার হাতে একটা চিমটি কাটল রাম। দীপ রামের দিকে তাকালে রাম ঘুম পাওয়ার ইঙ্গিত করল।

দীপ আড়চোখে দেখে নিল কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে নাকি। দেখল সমীর তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। সে তাড়াতাড়ি ভালো মানুষের মতো মুখ করে মিস্টার মেহতার দিকে তাকাল।

সেমিনার শেষ হল সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়। রাম অফিস থেকে বেরিয়ে তাকে বলল, “পুরা মাথা চেটে রেখে দিল ইয়ার। চ একটু ফুঁকে নি।”

দীপ বলল, “তুই ফোঁক। আমি বাড়ি যাই।”

রাম বলল, “আবে বাড়ি গিয়ে কী করিস তুই? বিয়ে-থাও তো করিসনি যে বউয়ের পিছন পিছন ছুটবি?”

দীপ বলল, “ল্যাদ খাব ভাই। ল্যাদ খাব। ল্যাদ বুঝিস ব্যাটা অবাঙালি?”

রাম বলল, “তোর থেকে আমি বেশি বাঙালি শালা। চ ভাই আজ ফ্রাইডে আছে, একটু ওপিয়াম ঘুরে যাই।”

দীপ বলল, “টাকা নেই। তুই একা একা খা গিয়ে।”

রাম বলল, “আবে তুই স্যালারির সব কি এসআইপি ফান্ডে ভরে দিস নাকি? মাল-টাল খাবার জন্য কিছু তো রাখতে পারিস?”

দীপ গম্ভীর গলায় বলল, “কাল চাকরি চলে গেলে কী করবি?”

রাম বলল, “তুই কী করবি? তুই তো এখনই কোটিপতি! কত টাকা সেভিংসে রেখেছিস কে জানে।”

দীপ রামের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞামিশ্রিত একটা হাসি হেসে বলল, “সেভিংসে রেখেছি বলেই তোদের মান্থ এন্ডগুলো আমি বাঁচাই। সেটা ভুলে গেলে হবে মামা?”

রাম দীপের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “চল না ভাই একটু ওপিয়ামে। বেশি না, দু পেগ করে বিপি মেরে বাড়ি যাব। মাইরি বলছি।”

দীপ ব্যাজার মুখে বলল, “চল। এগুলো কিন্তু খুব বাজে খরচ ভাই।”

রাম বলল, “তাহলে একটা নিব কিনে নি? তোর গাড়িতে বসে মেরে দেব?”

দীপ বলল, “না, আমার মা কাল সকালে আমার সঙ্গে মাসির বাড়ি যাবে। গাড়িতে গন্ধ পেলে আমার গুষ্টির মা মাটি মানুষ করে দেবে। চ। ওপিয়ামেই চ।”

দুজনে ওপিয়ামে গিয়ে বসল। উইকেন্ডের বার এক্কেবারে গিজগিজ করছে। অতি কষ্টে দুজনে বসার জায়গা পেল।

দীপের ফোনের কথা খেয়াল হল। ফোনটা পকেট থেকে বের করতেই দেখতে পেল ফোনটা বাজছে।

বারে মিউজিকের শব্দ খুব বেশি জোরে হচ্ছে না। দীপ ফোনটা ধরল। ও প্রান্ত থেকে সেই অজানা নারী স্বর, “এবার ফ্রি তো?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ। এবার কে বলছেন বলে আমায় কৃতার্থ করুন।”

“আপনার মেমোরি খুব খারাপ কিন্তু।”

দীপ অবাক হল, “কেন বলুন তো?”

“তিনদিন আগের বিয়েবাড়ির কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?”

দীপ হাঁ করে কয়েক সেকেন্ড ভাবল। তারপর বলল, “ওহ… বুঝেছি বুঝেছি… দেবুদার জুতো আটকে রেখেছিলেন… কী যেন নামটা?”

“ভুলে মেরে দিলেন এর মধ্যে?”

ও প্রান্তে ছদ্ম হতাশা।

দীপ বলল, “খুব কেমন কেমন নাম যেন একটা… কী যেন?”

“এমন কিছুই আনকমন নাম না, মনে করে দেখুন।”

বারটেন্ডার এসে দাঁড়িয়েছে। রাম তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কে বে?”

দীপ ফোনের স্পিকারটা চেপে বলল, “আর্জেন্ট ফোন, তুই বিপি বলে দে। এক প্লেট ফিশ ফিঙ্গার বলে দে।”

দীপ স্পিকারটা থেকে আঙুল সরিয়ে বলল, “আপনার নাম তো আমি দেবসেনা রেখেছিলাম। ওই নামটাই ভালো।”

ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল, “হ্যাঁ, ওটাই ভালো। তবে আপনি কিন্তু একেবারেই বাহুবলী নন। ভল্লালদেবও নন। তবে টাকমাথা হলে কাটাপ্পার ধারে কাছে দেখতে হতে পারেন।”

দীপ বলল, “আপনি কি আমার ঠ্যাং টানাটানির জন্য ফোন করেছেন?”

ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এল, “আমি তো ভাবলাম আপনি যেভাবে আয়োজন করে, ছলছল চোখ করে আমার নাম্বার নিলেন, তাতে বিয়েবাড়ি থেকে গিয়েই আমাকে ফোন করবেন। বাস্তবে দেখা গেল আপনি সব ভুলেই মেরে দিয়েছেন। লজ্জার মাথা খেয়ে তাই আমিই ফোন করলাম। দুপুরেও আপনি আমাকে একটু ঝাঁঝি মেরে দিলেন, তারপরেও আমিই আপনাকে ফোন করলাম। এত কিছুর পরে অবশ্য আপনার আমাকে নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে মনেই হতে পারে, তাতে অবশ্য আমার কোনও যায় আসে না। আমি এরকমই।”

দীপ বলল, “আচ্ছা, নামটা বলুন না। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।”

“চিত্রলেখা। নামটা কঠিনই বটে। প্রাচীনও।”

বিপি চলে এসেছিল। রাম সোডা মিশিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “ফোনটা রাখো বাল।”

দীপ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রামকে ইশারা করে ফোনে বলল, “ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের যুগের নাম। ঠিক ঠিক, মনে পড়েছে। তবে আপনি দেবসেনা হলেও মন্দ হত না। যেভাবে জুতো নিয়ে ফাইট দিলেন।”

“আপনি কি বাড়ি গেছেন?”

“না। জাস্ট অফিস থেকে বেরোলাম। বাড়ি যেতে যেতে আটটা-নটা হবে। কেন বলুন তো?”

“কাল কী করছেন?”

দীপ একটু সময় নিয়ে ভেবে বলল, “কাল অনেক কাজ। মাকে নিয়ে মাসির বাড়ি যাব, তারপর অফিসের কিছু কাজ আছে, সেগুলো নিয়ে বসব।”

“আপনি উইকেন্ডেও অফিসের কাজ করেন?”

“সব সময় করি না, কাজ থাকলে করতে হয়।”

“ওহ। তাহলে ঠিক আছে।”

“কেন, আপনি দেখা করতেন?”

“নাহ। আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”

“ও। দেখা করলে বলতে পারেন। লজ্জা পাবেন না।”

“লজ্জা পেলে তো ফোনই করতাম না। তা ছাড়া আমি শনিবার কারও সঙ্গে দেখা করি না।”

“ওরে বাবা, আপনি এসব বার-টার মেনে চলেন?” গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল দীপ।

চিত্রলেখা বলল, “আমি না মানলেও মানতে হয় মার জ্বালাতনে। নিরামিষ খাইয়ে রেখে দেবে গোটা দিনটায়।”

“মার জ্বালায়? নিজের ইচ্ছাতে না বলছেন?”

“একেবারেই না।”

“তাহলে তো কালই মিট করতে হচ্ছে আপনার সঙ্গে। এবং অবশ্যই ননভেজ রেস্তোরাঁয়। করবেন?”

“ও বাবা। আপনি বিদ্রোহী প্রকৃতির পাবলিক দেখে তো মনে হয় না।”

“কী মনে হয় তবে? পেটরোগা বাঙালি?”

“হ্যাঁ, অনেকটা সেরকমই।”

রাম রাগ রাগ চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। দীপ বুঝল এবার ফোনটা না রাখলে খিস্তি খাবার সমূহ চান্স আছে। সে বলল, “তাহলে কী করবেন? কাল দেখা করবেন এবং আমিষ খাবেন? প্রথম দেখাটাই কমফোর্ট জোনের বাইরে করে দেখুন না।”

চিত্রলেখা একটু ভেবে বলল, “তাই হোক। কোথায় কখন মিট করবেন এসএমএস করে জানান। আমি হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক কোনোটাই ইউজ করি না।”

দীপ চোখ কপালে তুলে বলল, “ওরে বাবা, আপনিই তো সেই আদর্শ নারী যাকে কট্টরবাদী মেল শভিনিস্টরা পুজো করে।”

চিত্রলেখা বলল, “সেসব না, অ্যাকচুয়ালি আমার লাস্ট ব্রেকআপের পরে আমি এসব থেকে বিদায় নিয়েছি।”

দীপ একটু নিভে গিয়ে বলল, “ও। আপনার প্রেমও ছিল?”

চিত্রলেখা বলল, “ছিল। কেন আপনার ছিল না?”

দীপ বলল, “সব কথা আজকেই বলবেন?”

চিত্রলেখা বলল, “ভ্যালিড পয়েন্ট। ওকে, আপনি আমাকে এসএমএস করুন। গুড নাইট।”

দীপ গুড নাইট বলে ফোন রাখল।

রাম বলল, “কার শ্রাদ্ধ করছিলি ভাই?”

দীপ বলল, “তোর গুষ্টির। শোন, আমি আজ মানিব্যাগ আনিনি। বিল তুই দিচ্ছিস।”

রাম কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “জীবনে প্রথম একটা পাবলিক দেখলাম যে মানিব্যাগ ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোয়। তোরই হবে ভাই।”

দীপ রামের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

সন্ধে ছটার সময় ডেস্ক থেকে যখন ব্যাগ নিয়ে বেরোনোর জন্য মানালি উঠল, ঠিক তখনই ইন্টারকমের ফোনটা বেজে উঠল। মানালি বিড়বিড় করে বলল, “আই নিউ ইট।”

ফোনটা ধরতে এডিটর বিশ্বরূপদার গলা ভেসে এল “আর্জেন্ট, শিগগিরি আয়।”

মানালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগটা ডেস্কে রেখে বিশ্বরূপদার চেম্বারে ঢুকল। বিশ্বরূপদা বসে বসে সামনে রাখা ডায়েরিতে কিছু একটা লিখছিল। তাকে দেখে বলল, “একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক এত তাড়াতাড়ি বাড়ি গেলে হবে?”

মানালি বুঝল তার বেরোনোটা বিশ্বরূপদা দেখে নিয়েছে। বলল, “আজ কাজ ছিল। যাক গে, বলো তোমার কী দাবি।”

বিশ্বরূপদা পেনটা ডায়েরির ওপর রেখে ডায়েরিটা বন্ধ করে বলল, “তোর তো সামনে প্রচুর কাজ।”

মানালি চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, “সে তো বুঝতেই পারছি, ভালো সাইজের একটা বাঁশ তৈরি করেছ আমার জন্য। বলে ফ্যালো।”

বিশ্বরূপদা বলল, “ছজন বুদ্ধিজীবীর প্রতিক্রিয়া নিতে হবে।”

মানালি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “ওকে। কী বিষয়ে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “নিশ্চিন্তিপুরের শিশুমৃত্যু।”

মানালি বলল, “কবের মধ্যে লাগবে?”

বিশ্বরূপদা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ক্যালেন্ডার নয়, ঘড়ি ব্যবহার করতে হবে। সাড়ে সাতটার মধ্যে আই নিড অল রিঅ্যাকশানস।”

মানালি হাঁ করে বিশ্বরূপদার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কি দয়া মায়া নাই গো?”

বিশ্বরূপদা বলল, “আর্জেন্ট মা। দেরি করিস না। যত তাড়াতাড়ি দিবি, তত তাড়াতাড়ি ছুটি।”

মানালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল, “ঠিক আছে। তারপরে যেন আবার কোনও কাজ গছিয়ে দিয়ো না।”

বিশ্বরূপদা হেসে বলল, “একদম না, ডিল ইজ ডিল।”

মানালি বলল, “কোনও প্রেফারেন্স আছে বুদ্ধিজীবীদের?”

বিশ্বরূপদা বলল, “না। তবে অন্তত দুজন গ্রেড এ ক্যাটাগরির লাগবে।”

মানালি বলল, “ওকে, ট্রায়িং।”

বিশ্বরূপদার ঘর থেকে বেরিয়ে ডেস্কে এসে বসল মানালি। পাশের ডেস্কে ঋভু আর বিতস্তা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে কপি লিখে যাচ্ছে। ওদের দিকে কিছুক্ষণ দেখে মানালি ডায়েরি খুলল।

বিশ্বরূপদা বুদ্ধিজীবীদের একটা গ্রেড বানিয়ে দিয়েছে। টিভি চ্যানেলে অ্যাপিয়ারেন্স ফি এবং তাদের প্রতিবাদের রেটের ওপর নির্ভর করে তিনটে গ্রেড বানানো।

চার্টটা দেখে প্রথমে কবি অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করল মানালি। অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রেড এ বুদ্ধিজীবী কবি। ফেসবুক করেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে অরুণাচল সমস্ত ব্যাপারেই কবিতা লিখে থাকেন।

অনুপবাবু সাধারণ মানুষের ফোন ধরেন না। আননোন নাম্বার থেকে ফোনও ধরেন না। তবে তাদের অফিসের ফোন নাম্বার অনুপবাবুর ফোনে সেভ করা আছে। তিনটে রিং হতেই পরিশীলিত কণ্ঠে ফোন ধরে বললেন, “বলুন।”

মানালি বলল, “হ্যাঁ দাদা, আমি মানালি বলছি সময়ের কণ্ঠস্বর থেকে।”

“হ্যাঁ বলো।”

“বলছি দাদা, একটা ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানার ছিল।”

অনুপ একটু কেশে বললেন, “কী বিষয়ে?”

মানালি বলল, “নিশ্চিন্তিপুরের শিশুমৃত্যু দাদা।”

অনুপ খুব জোরে কাশতে লাগলেন। বেশ কয়েক মিনিট পরে বললেন, “আমার একটু কাশি হয়েছে বুঝলে, তা ছাড়া নিশ্চিন্তিপুরে আমি কোনও দিন যাইনি…”

মানালি হতাশ স্বরে বলল, “কিছু একটা বলুন দাদা।”

অনুপ সতর্ক গলায় বললেন, “না গো, যেখানে যাইনি, তা নিয়ে কিছু বলাটা ঠিক হবে না।”

মানালি একটু রেগে বলল, “আপনি তো দণ্ডকারণ্যেও কোনও দিন যাননি দাদা। ওটা নিয়ে একটা গোটা কবিতার বই আছে আপনার।”

অনুপ ফোনটা কেটে দিলেন।

মানালি ফোনটা রেখে একটা গালাগাল দিল।

সে লিস্টটায় চোখ রাখল আবার। বিদ্রোহী গায়ক টিংকু বড়াল আছেন লিস্টে।

মানালি ফোন করল, ফোনটা ধরলেন টিংকুবাবুর সেক্রেটারি। মানালি বলল, “টিংকুবাবুকে ফোনটা দেওয়া যাবে?”

সেক্রেটারি জানালেন টিংকুবাবু বলেছেন অ্যাপিয়ারেন্স ফি না দিলে ইদানীং উনি সব ব্যাপারে বিদ্রোহ জানানো বন্ধ রেখেছেন।

মানালি শ্বাস ছেড়ে নিজের হাতের তাস খেলল। দুজন প্রবীণ অভিনেত্রী। ইদানীং তাঁরা বসে আছেন। ফোন করলে ফোন ছাড়তে চান না। দুজনেই গ্রেড বি লিস্টে আছেন। কুড়ি মিনিট নিজেরা যখন মা ছিলেন তখন কীভাবে অভিনয় সামলে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন ইত্যাদি বকলেন।

একটু ভেবে মানালি একজন চিত্রকর এবং একজন ভাস্করকে ফোন করল। দুজন ভদ্রলোক ভালোভাবেই প্রতিক্রিয়া দিলেন।

মানালি দেখল ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। ফোন ধরে সে বিড়বিড় করে বলল, “স্টিল টু রিমেইনিং। মিস মানালি রয়, আজ তো তু গয়া।”

বিশ্বরূপদা চেম্বার থেকে বেরিয়ে তার ডেস্কে এসে বলল, “কি রে, আর কটা?”

মানালি হতাশ গলায় বলল, “গ্রেড এ দুটোই বাকি এখনও।”

বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “গ্রেড এ-দের পাবি কী করে? সবাই এখন কমিটি হেড।”

মানালি বলল, “তাহলে কী করব?”

বিশ্বরূপদা একটু ভেবে বলল, “কল ধ্রুব বাগচী।”

মানালি চোখ মুখ শক্ত করে বলল, “না। আটটা বাজে। লোকটা শিওর মাল খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।”

বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “ওইজন্যই তো তোকে ফোন করতে বলছি। সুস্থ অবস্থায় থাকলে প্রতিক্রিয়া দিত নাকি?”

মানালি বলল, “উনি খুব উলটোপালটা কথা বলেন।”

বিশ্বরূপদা বলল, “তাতে কী? তোর গায়ে ফোসকা পড়বে?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ পড়ে। তুমি করো।”

বিশ্বরূপদা বলল, “সব সময় আমি থাকব না মা। আজ থেকে একমাস পরেই হয়তো পারব না। তখন কী করবি?”

মানালি অবাক গলায় বলল, “এক মাস পরে কোথায় থাকবে তুমি?”

পাশের ডেস্ক থেকে বিতস্তা বলল, “শুনিসনি? রিউমার তো হাওয়ায় ঘুরছে।”

মানালি হাঁ হয়ে বিশ্বরূপদার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী রিউমার?”

বিশ্বরূপদা বলল, “দ্যাটস নট ইম্পর্ট্যান্ট মা। কল ধ্রুব। তারপর কাকে করবি বলে দিচ্ছি।”

বিতস্তা ফুট কাটল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বিশ্বরূপদা তো কাটাতেই চাইবে।”

বিশ্বরূপদা বিতস্তার দিকে কড়া চোখে তাকাল। বিতস্তা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

অগত্যা মানালি ধ্রুব বাগচীর নাম্বার ডায়াল করল, দুটো রিং হতেই ধরলেন ধ্রুব, “কে?”

“স্যার, আমি সময়ের কণ্ঠস্বর থেকে বলছি।”

“ওহ, দ্যাট শিট পেপার? ওটা তো আমি টয়লেট পেপার হিসেবে ইউজ করি। সুন্দর পেছন মোছা যায়।” জড়ানো গলায় কাটা কাটা কথাগুলো তিরের মতো ভেসে এল।

মানালির মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে বিশ্বরূপদার দিকে তাকাল। বিশ্বরূপদা হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে।

মানালি অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা করে বলল, “স্যার, আমি নিশ্চিন্তিপুরের শিশুমৃত্যু নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া পাবার জন্য ফোন করেছি।”

“আমি কটা কমিটির মাথায় এই মুহূর্তে আছি জানো মামণি?”

“না স্যার।”

“তবে? তুমি কি চাও আমার আমার মাসোহারাগুলো বন্ধ হয়ে যাক? হলে খুশি হবে?”

“না স্যার। জাস্ট কিছু একটা প্রতিক্রিয়া দিলেই হবে স্যার।”

“কিছু একটা?” ধ্রুব বাগচী চেঁচিয়ে উঠলেন ওদিক থেকে, “শিশুমৃত্যু তোমাদের কাছে ইয়ার্কির জিনিস বলে মনে হয়? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া ওইটুকু বাচ্চাগুলো যারা জন্মানোর পর কেন মারা যাচ্ছে? তোমাদের লজ্জা লাগে না? একটা ফিল্মস্টারের বাচ্চা হবে বলে তোমরা ধেই ধেই করে চিয়ারলিডারদের মতো নাঙ্গা নাচ নেচে বেড়াচ্ছ, আর গরিব মানুষগুলোর সন্তান মারা যায়, তোমাদের একটা বালও ছেঁড়া যায় না? তোমরা সকালে উঠে আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে চমকে ওঠো না?”

এতগুলো কথা হঠাৎ করে শুনে মানালি কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “স্যার আপনি এই নিয়ে গভর্নমেন্টকে কিছু বলেছেন?”

“আমি?” ধ্রুব বাগচী হো হো করে হাসতে শুরু করলেন, “আমি কেন বলতে যাব? আমার বুদ্ধি আছে বলেই তো আমি বুদ্ধিজীবী। ইউ নো হোয়াট, সব বুদ্ধিজীবীদেরই বুদ্ধি আছে। তারা সিলেক্টিভ বিষয় ছাড়া, নিজেদের সব দিক থেকে নিরাপদ না দেখে মুখ খুলবে না। আমিও খুলব না।”

“স্যার আপনি তো অনেকটাই বললেন।”

“আমি কিছু বলিনি। একটা মাতাল যেরকম বলে আমি সেরকম বলেছি। রাখো এবার। এরপরে আবার কবে কোন শিল্পপতি বা চিটফান্ডপতি যখন ঠিক করে দেবেন কোন প্রতিবাদ তাঁরা ফান্ডিং করবেন, তখন আমি পথে নামব। মনে রাখবে আমি চাকরি করি না, আমার ফিক্সড ইনকাম নেই। নাও গো টু হেল।”

ফোনটা কেটে গেল।

মানালি বড়ো করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “বাবা! পুরো আগুন।”

বিশ্বরূপদা বলল, “যাহ্, তোর ছুটি। আর-একজন আমি করে নেব।”

মানালি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “হঠাৎ এত উদারতা?”

বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “আমি তো ধ্রুব বাগচীর রিঅ্যাকশানটাই চাইছিলাম। আমি ফোন করলে আরও খিস্তি খেতাম। আগের উইকেই ওঁর একটা সিনেমাকে আমরা ওয়ান স্টার দিয়েছিলাম, ভুলে গেলি?”

মানালি বিশ্বরূপদার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “খুন করে ফেলব তোমায় বিশ্বাস করো।”

বিতস্তা পাশ থেকে বলল, “আমিও।”

দীপের ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে সাতটায়।

উঠেই শুনতে পেল বাইরের ঘরে বাবা কাগজের লোকটাকে তুমুল ঝাড়ছে। ঘরে বসেই শোনা যাচ্ছে বাবা বলছে, “কাগজগুলো একটু সকালে দেওয়া যায় না? এতক্ষণ ধরে কী করা হয় শুনি? আমাদের আশেপাশে ডাইনে বাঁয়ে সব বাড়ি কাগজ পেয়ে যায় সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে, আর তুমি এতক্ষণ ধরে কোথায় গাব জাল দাও হে? আমি তো ওদের থেকেই কাগজ নিতে পারি, তোমার থেকে কেন নেব শুনি?”

লোকটা মিনমিন করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বাবা শুনল না।

বেশ রাগি গলায় চ্যাঁচামেচি চলতে লাগল।

দীপ উঠে ড্রয়িং রুমে এল।

মা তৈরি হয়ে গেছিল। তাকে দেখে ব্যস্ত গলায় বলল, “তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, আমরা এখনই বেরোব।”

দীপ হাই তুলতে তুলতে বলল, “আমাকে ডাকোনি কেন?”

মা বলল, “তোর আর কতক্ষণ লাগে? যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। ভালো পাঞ্জাবিটা পরবি।”

দীপ অবাক গলায় বলল, “ভালো পাঞ্জাবি পরার কী আছে? একটা পরলেই হল।”

মা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “না, না, ওখানে তোর মেসোর গুরুভাইরা অনেকে আসবে। ছেঁড়া জামা-টামা পরবি না একদম। আগে থেকে বলে রাখলাম।”

দীপ বিরক্ত মুখে কমোডে গিয়ে বসল। বাইরে বাবার চ্যাঁচ্যামেচি এবার কমেছে। মা বাবাকে ঝাড়তে শুরু করেছে জায়গার জিনিস কেন জায়গায় নেই তা নিয়ে।

মিনিট পনেরো পর সে মাকে নিয়ে বেরোল। মা গাড়িতে উঠে বলল, “মিনুর ওখানে একটু থাকবি। আমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে আসবি না।”

দীপ গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, “কেন, কী ব্যাপার আবার?”

মা বলল, “আমার একটা মান সম্মান নেই নাকি? নামিয়ে দিয়ে চলে আসবি, সবাই কী ভাববে?”

শনিবার হলেও সকালে কলকাতার রাস্তায় যথেষ্ট জ্যাম আছে। দীপ সাবধানে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “কী আর ভাববে, সবাই কি আর পর নাকি? নিজের মাসি নিজের মেসো, চিন্তার কী আছে?”

মা বলল, “সেসব বুঝতে গেলে তোকে বড়ো হতে হবে। এখনও তো ছোটোই থেকে গেলি।”

দীপ কিছু না বলে এফএমটা চালিয়ে দিল। কথায় কথা বাড়বে। ঠিক করল খানিকক্ষণ বসে কেটে পড়বে। মেসো এখন এক নতুন গুরুর দীক্ষা নিয়েছে। মেসোর কাছে বসলেই বিভিন্ন নীতিকথা শুনতে হয়। সেসময় দীপের কান মাথায় আগুন জ্বলতে শুরু করে। ওখান থেকে পালানোও যায় না, আবার বকবকগুলো শুনেও যেতে হয়।

নটা পনেরো নাগাদ মাসির বাড়ি পৌঁছোল তারা।

মা বলল, “আমি কিন্তু আবার বলছি, আগে আগে কোথাও যাবি না।”

দীপ বলল, “ঠিক আছে।”

মেসো দরজা খুলল। তাকে দেখে খুশি হয়ে বলল, “আরে, দীপ যে, আয় আয়, ভালো সময়েই এসেছিস। মানালিও এখনই এল জাস্ট।”

দীপ অবাক হয়ে মার দিকে তাকাল। মা বলল, “ভিতরে চ।”

দীপ বলল, “এই সকালে মেয়ে দেখাতে নিয়ে এলে নাকি?”

মা বলল, “বললাম তো ভিতরে চ, বলছি।”

দীপের রাগ হচ্ছিল। এরকম জানলে সে কিছুতেই আসত না। ইদানীং তাদের বাড়ি থেকে তার বিয়ে নিয়ে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু এই প্ল্যানে যে মাসিকেও মা ইনক্লুড করে নিয়েছে সেটা খেয়াল ছিল না।

মাসিদের ড্রয়িংরুমে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। দীপ চিনল না।

মেসো পরিচয় করিয়ে দিল, “মিসেস রায়।”

মিসেস রায় উঠে হাত জোড় করলেন। মা বসতে বসতে বলল, “আমাদের ফোনে কথা হয়েছে।” মিসেস রায় হেসে বললেন, “হ্যাঁ।” মা তার সঙ্গে মিসেস রায়ের পরিচয় করিয়ে দিল। দীপ দাঁত বের করে বন্ধ করল।

মা মেসোর দিকে তাকাল, “মিনু কোথায়?”

মেসো বলল, “মানালিকে নিয়ে ছাদে বাগান দেখাতে গেছে। দাঁড়ান ডেকে দিচ্ছি।”

মেসো বেরিয়ে যেতে মিসেস রায় বললেন, “মানালি জানতে পারলে একটু রাগারাগি করতে পারে।”

মা বলল, “করলে করুক। সব বাড়িতে বাড়িতে এখন এই সমস্যা বুঝলেন? বিয়ের কথা বললেই ঠিক কিছু না কিছু ছুতো করে ঠিক পালিয়ে যাবে।”

মিসেস রায় অবাক হয়ে দীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও জানে তো?”

মা হাসতে হাসতে বলল, “না।”

দীপের রাগ হচ্ছিল। সে কিছু বলল না।

মিসেস রায় বললেন, “ওর বাবা নাগপুরে গেছে অফিসের কাজে। আপনাদের প্ল্যানটা শুনে বেশ এক্সাইটেড। এমনিতে তো মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তা করতে হয় আজকাল। খবরের কাগজের কাজ, বুঝতেই পারেন।”

মা বলল, “আমার ছেলের কি কম? সেই যে সকালে বেরোয়, অফিস থেকে কখন ফিরবে তার কোনও ঠিক নেই।”

মিসেস রায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় মাসি মানালিকে নিয়ে ঢুকল। তাকে দেখে বলল, “এই তো, দীপু এসে গেছে। মানালি, এই দেখ দীপু।”

মানালি কিছু না বুঝে তার দিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল।

দীপ কী বলবে বুঝতে না পেরে ক্যাবলার মতো হাসল।

মানালি তার মার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি এখানে আমাকে সম্বন্ধ দেখাতে নিয়ে এসেছ?”

মিসেস রায় হেসে বললেন, “না, না, ওসব কিছু না। বস না।”

মানালি গম্ভীর হয়ে বসে বলল, “দেখুন, প্রথমেই বলে দি আমার কিন্তু বয়ফ্রেন্ড আছে।”

দীপের হাসি পেল। সে বলল, “হ্যাঁ, আমারও গার্লফ্রেন্ড আছে।”

মা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বলল, “তোর গার্লফ্রেন্ড আছে? এই যে তোকে রোজ রোজ এত করে জিজ্ঞেস করি, কোনও দিনও তো বললি না?”

দীপ বলল, “এতদিন ছিল না। এখন আছে।”

মা মুখ কালো করে বসে থাকল। মিসেস রায় রেগেমেগে বললেন, “মানালির বয়ফ্রেন্ড নেই। থাকতেই পারে না। বয়ফ্রেন্ড থাকলে আমি ঠিক জানতে পারতাম।”

মানালি বলল, “কী আশ্চর্য, বাড়িতে জানিয়ে কেউ প্রেম করে নাকি?”

মেসো এসে গেছিল। একটা বই নিয়ে এসে গম্ভীর মুখে পড়তে লাগল, “শোনো তোমরা, আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী একশো আট চাঁদবদন মহারাজ বলেছেন, এখন ঘোর কলি উপস্থিত। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা এখন বাবা-মাকে লুকিয়ে প্রেম করা শিখেছে। ইহা পাপের পথ। পুণ্যের পথ হল প্রেম না করা। বাবা-মার দেখানো পথে বিবাহ করা।”

এতটা পড়ে মেসো গোঁফে তা দিয়ে বলল, “কী বুঝলে?”

মানালি হেসে ফেলল। দীপও।

মা রাগি গলায় বলল, “গোটা প্ল্যানটাই মাঠে মারা গেল।”

মিসেস রায় হতাশ গলায় বললেন, “সত্যিই ঘোর কলি।”

মাসি ব্যাজার গলায় বলল, “আমি কড়াইশুঁটির কচুরি বানিয়েছিলাম। দীপুর মতো ক্যাবলারও যে গার্লফ্রেন্ড থাকবে তা কী করে জানব?”

মা বলল, “আমি আর এসবে নেই। যা করবে নিজে নিজে করুক।”

দীপ বলল, “মাসি, কচুরিটা দাও। খেয়ে আমি যাই। মা থাকুক।”

মা গম্ভীর হয়ে বসে রইল। মেসো ধর্মের বাণী পড়ে যেতে লাগল। দীপ মোবাইল ঘাঁটতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে ব্রেকফাস্ট হয়ে গেলে দীপ বলল, “আমি যাই।”

মানালি সবাইকে চমকে দিয়ে তাকে বলল, “আপনি কি রুবি হয়ে যাবেন?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

মানালি বলল, “আমাকে একটু ড্রপ করে দেবেন?”

দীপ বলল, “শিওর। চলুন।”

সবার হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে দুজনে বেরিয়ে গেল।

গাড়ি স্টার্ট হলে মানালি বলল, “আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল আজ কিছু একটা এরকম ঝামেলা হবে। নইলে মিনু আন্টি এরকম সকাল সকাল ডাকে না কোনও দিন।”

দীপ বলল, “আমি বুঝিনি। ভেবেছিলাম মা দীক্ষা-টিক্ষা নেবে। ইদানীং ধর্মে মতি হয়েছে।”

মানালি বলল, “উফ। আমার মাও। এইসব জায়গা থেকেই এঁদের মাথায় এসব বুদ্ধি আসে বোঝা যায়।”

বাইপাসে হালকা জ্যাম আছে। দীপ বলল, “আপনি রিপোর্টার?”

মানালি হাসল, “হ্যাঁ, এই তো সবে ছ-মাস হল জয়েন করেছি।”

দীপ বলল, “কোন মিডিয়া?”

মানালি বলল, “সময়ের কণ্ঠস্বর।”

দীপ বলল, “আপনার বয়ফ্রেন্ডও সাংবাদিক?”

মানালি হাসতে হাসতে বলল, “আমার বয়ফ্রেন্ড নেই।”

দীপও হেসে ফেলল, “আপনার মা তাহলে ঠিকই ধরেছিলেন। উনি যদি প্রমাণ চান তাহলে কী করবেন?”

মানালি বলল, “চাইবে না। চাইলে দেখা যাবে।”

দীপ বলল, “সকাল থেকে এত ভয়ংকরভাবে দিনটা শুরু হল। বাকি দিনটা কেমন যাবে কে জানে।”

মানালি বলল, “সিরিয়াসলি। এমনিতেই অফিস যাওয়া আর ল্যান্ডমাইনের ওপর হাঁটা এখন এক হয়ে গেছে। তার ওপর এসব। কোন শ্বশুরবাড়ি মানবে বলুন তো বউমা রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরবে? সবাই বলবে চাকরি ছাড়তে। আর আমি একেবারেই তার জন্য প্রস্তুত নই।”

দীপ বলল, “চাকরি ছাড়তে যাবেন কেন? যারা ছাড়তে বলবেন, তাদের ছেড়ে দেবেন বরং।”

মানালি বলল, “একজ্যাক্টলি। আমারও তাই মত। বাই দ্য ওয়ে, আপনার গার্লফ্রেন্ড কী করেন সেটা জানা হল না। নাকি তিনিও আমার জনের মতোই অস্তিত্বহীন?”

দীপ বলল, “না না, অস্তিত্ব আছে। ইনফ্যাক্ট আজকে আমরা প্রথম মিট করব। তবে কী করে-টরে অত কিছুই জানি না। সেসব জানতেই মিট করব আজকে।”

মানালি বলল, “বাহ। অভিনব ব্যাপার তো! তার মানে আপনি এখন ভিত গড়ছেন।”

দীপ হেসে বলল, “একেবারেই।”

মানালি বলল, “বেস্ট অফ লাক।”

দীপ বলল, “থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।”

রুবি এসে গেছিল। দীপ বলল, “এখানে নামাব?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ। বাঁদিকের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিন। আপনাকে অনেকগুলো থ্যাংকস।”

দীপ হাসল। মানালিকে নামিয়ে খানিকটা এগিয়ে গাড়িটা রাস্তার বাঁদিকে দাঁড় করাল।

চিত্রলেখাকে ফোন করতে হবে।

ধ্রুব বাগচী বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মানালির অস্বস্তি হচ্ছিল। দুপুর আড়াইটে বাজে। লোকটা কি এখনও ঘুমাচ্ছিল? চোখ মুখ দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে অনেকটা। একটা মাঝারি মাপের টু বিএইচকে ফ্ল্যাট। চারদিকে অগোছালো। দেওয়ালে বড়ো বড়ো কয়েকটা সিনেমার পোস্টার। জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের একটা বড়ো পোর্ট্রেট। অভিমানের অমিতাভ-জয়ার পোস্টার। ধ্রুব বাগচীর সিনেমার কয়েকটা পোস্টার।

মানালি অফিস থেকে ফোন করেই এসেছিল। তবু কলিং বেল বাজানোর পরে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল। ধ্রুব দরজা খুলে ঘুম জড়ানো চোখে প্রথমেই বলেছেন, “কাজ-টাজ নেই এখন মা, পরে এসো।” মানালি পরিচয় দিতে দরজা খুলেছেন। ফটোগ্রাফার ঋপণ এসেছে তার সঙ্গে।

বসার ঘরে বসিয়ে দশ মিনিট পরে একটা পাঞ্জাবি পরে সোফায় ঘুম ঘুম চোখে বসেছেন। মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় ঘুমিয়ে পড়বেন। মধ্য চল্লিশ বয়স ভদ্রলোকের। শ্যামবর্ণ। ক্লিনশেভড। মাথায় কাঁচাপাকা চুল।

মানালি একটু গলা খাঁকরিয়ে বলল, “স্যার, আধঘণ্টায় হয়ে যাবে।”

ধ্রুব বললেন, “কী হবে আধঘণ্টায়? এ কি ইন্টারকোর্স পেয়েছেন নাকি? সেটার জন্য অবশ্য আধঘণ্টা আবার বেশি টাইম।”

মানালির কান মাথা লাল হয়ে গেল। ঋপণের দিকে তাকাল সে। ঋপণ অনেক কষ্টে হাসি চাপছে।

সে বলল, “শুরু করি স্যার?”

ধ্রুব অন্যমনস্কভাবে বললেন, “করুন।”

মানালি মোবাইল রেকর্ডার অন করল, “স্যার, ‘ডার্ক লাভ’ সিনেমাটা তো একেবারেই ফ্লপ করে গেল। এখন কি নতুন কোনও প্রোজেক্টে কাজ করছেন?”

ধ্রুব বললেন, “ফ্লপ করল? কে বলেছে আপনাকে?”

মানালি আমতা আমতা করে বলল, “মানে স্যার বক্স অফিস তো তাই বলছে। ইনফ্যাক্ট আমিও নন্দনে একদিন দেখতে গেছিলাম। সেরকম লোক ছিল না।”

ধ্রুব জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “আমার কাছে ফ্লপ না। আমার কাছে ডার্ক লাভ ইজ আ বিগ হিট।”

ধ্রুব একটা সিগারেট ধরালেন।

মানালি বলল, “বক্স অফিসকে আপনি অস্বীকার করছেন তার মানে? কিংবা প্রোডিউসার যে আপনার প্রোজেক্টে ইনভেস্ট করছেন, তিনি রিটার্ন পাবেন না, এইসব ব্যাপার আপনাকে বদার করে না বলতে চাইছেন?”

ধ্রুব জোরে জোরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, “কতগুলো পাবলিক সিনেমা বুঝবে না, তার দায় আমি নিই না।”

মানালি বলল, “কিন্তু স্যার, আপনার ফার্স্ট মুভি রেনেসাঁ তো দারুণ হিট ছিল। সেকেন্ডটাও…”

ধ্রুব হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, “ওসব ফ্লুক। ফ্লুক এক্কেবারে। তখন তো সবে সিনেমা বানানো শিখছিলাম। এখন যতবার দেখতে বসি রোজ নতুন নতুন ভুল পাই। তার তুলনায় ডার্ক লাভ অনেক পরিণত। আপনি তো দেখেছেন, আপনিই বলুন কেমন হয়েছে?”

মানালি ইতস্তত করে বলল, “ভালোই লেগেছে স্যার।”

ধ্রুব অবাক গলায় বললেন, “ভালোই লেগেছে? মানে নিতান্ত অনিচ্ছায় বলছেন আর কি! তা বলুন শুনি কোন জায়গাটা ভালোই লেগেছে।”

মানালি প্রমাদ গুনল, সিনেমাটা এত বোরিং ছিল যে সে ইন্টারভ্যালের আগেই বেরিয়ে গেছিল। সে ঠিক করল সত্যিটাই বলবে। মরিয়া হয়ে বলল, “স্যার, সত্যি কথা বলতে কী আমি কিছু বুঝিইনি সিনেমাটা।”

ধ্রুব খুশি হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, “গুড। আপনার ভালো লাগলে নিজের সিনেমা বানানোর প্রতিভাটাকেই সন্দেহ করতে শুরু করতাম আমি।”

মানালি বলল, “মানে?”

ধ্রুব বললেন, “মানে বুঝে কাজ নেই। নেক্সট কোয়েশ্চেন।”

মানালির অপমানিত লাগছিল। সে নোটপ্যাড দেখে পরের প্রশ্নটা করল, “অ্যাকট্রেসরা বলেন আপনি দুর্মুখ।”

ধ্রুব বললেন, “শুই না বলে। দামি দামি নেকলেস কিনে দিই না বলে।”

মানালি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “এটা অন রেকর্ড বললেন?”

ধ্রুব বললেন, “অফকোর্স, নেক্সট।” ধ্রুব ধোঁয়ার রিং করতে শুরু করলেন।

ঋপণ বলল, “স্যার, কয়েকটা ফটো তুলব আপনার?”

ধ্রুব বললেন, “তোলো। তোমাদেরও তো চাকরি করতে হবে।”

মানালি বলল, “আপনি কাজ না পেলে যদি প্রোডিউসার বলেন রিমেক বানাতে, আপনি বানাবেন?”

ধ্রুব বললেন, “তার থেকে ব্যান্ডেল লোকালে কন্ডোম বেচব।”

ঋপণ ভয়ে ভয়ে বলল, “স্যার, লোকাল ট্রেনে কেউ কন্ডোম বেচে না।”

ধ্রুব বললেন, “সেইজন্যই তো দেশটায় এইচআইভি বেড়ে যাচ্ছে। বয়ঃসন্ধির সময় ছেলেকে সেক্স এডুকেশন দেবে না, ছেলে পর্ন দেখে মাস্টারবেট করবে, তারপরে খারাপ পাড়ায় গিয়ে জীবনটা বরবাদ করবে। এ দেশের ওপর আমি আর কোনও আশা করি না।”

মানালি বলল, “স্যার আপনার বয়ঃসন্ধি কীভাবে কেটেছে?”

ধ্রুব বললেন, “নর্থ বেঙ্গলে। বাবা মারা গেছিলেন ছোটোবেলাতেই। ওই সময়টা আর পাঁচটা বাঙালি ছেলেদের মতো কেটেছে। তবে কপাল ভালো সেই সময় মোবাইল ছিল না।”

মানালি বলল, “আপনি কি মোবাইলের বিরোধী?”

ধ্রুব বললেন, “মোবাইলের ওপর রাগার সংগত কারণ আছে। টরেন্টের ওপরেও। একটা ইউনিটের এত এত পরিশ্রম, এত ইনভেস্টমেন্ট একটা ইল্লিগাল টরেন্ট মুহূর্তে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। পাঁচ ইঞ্চি স্ক্রিনে সিনেমা ঢুকে যাচ্ছে। সেই নাইন্টিজেও ক্যাসেটের রমরমা ছিল। তারপরে ঢুকে গেল এমপি থ্রি। লোকের অ্যালবাম বেরোচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে তা সিডিতে পাইরেসি হয়ে যাচ্ছে। আগে একটা লোকের দুটো গান থাকত একটা অ্যালবামে। তার পরিবর্তে একটা সিডিতে ছশোটা গান ধরে গেল। এবং সবটাই পাইরেটেড। বাজারটা, এত লোকের এত এফোর্ট, এত প্রতিভা চোখের সামনে ওই একটা চাকতি নষ্ট করে ফেলল। টেকনোলজি ইজ আ বিচ।”

মানালি বলল, “স্যার, টেকনোলজি ছিল বলেই তো আপনারা এত ভালো ভালো ক্যামেরা পাচ্ছেন।”

ধ্রুব বললেন, “তখন সিনেমা ভালো হত, না এখন? আপনার কী মনে হয়?”

মানালি উত্তর দিতে পারল না।

ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে মানালি বলল, “স্যার, আপনাকে কাল আমি ফোন করেছিলাম। নিশ্চিন্তিপুরের শিশুমৃত্যু…”

ধ্রুব বললেন, “পড়েছি রিপোর্টটা।”

মানালি বলল, “স্যার, আপনার ব্যাপারটা সেলফ কনফ্লিকটিং লাগে না? একদিকে আপনিই সরকারি কমিটিতে আছেন, অন্যদিকে আপনিই এত কিছু বলে দিচ্ছেন।”

ধ্রুবর সিগারেট শেষ হয়ে গেছিল। তিনি আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে মানালির দিকে তাকিয়ে বললেন, “নো কমেন্টস।”

মানালি হাসল, “রাত আটটার পরে ফোন করলে এই ব্যাপারে কমেন্ট পাওয়া যাবে?”

ধ্রুব কয়েক সেকেন্ড মানালির দিকে তাকিয়ে বললেন, “নো কমেন্টস।”

মানালি বলল, “আপনার হাতে এই মুহূর্তে কোনও কাজ নেই। একজন পরিচালক হিসেবে আপনার ব্যর্থতার দিন শুরু হয়েছে। মানুষ আপনার নামে ফেসবুকে ট্রল বানাচ্ছে, আপনাকে নিয়ে যা নয় তাই লিখছে, আপনাকে ট্যুইট করে এত কিছু বলছে, আপনার কি শেষের দিন এসে গেল মিস্টার বাগচী?”

ধ্রুব নতুন ধরানো সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। বললেন, “এই ফ্ল্যাটটা নিজের টাকায় কেনা। নিচে গ্যারেজে রাখা গাড়িটাও। কোনও বিখ্যাত বাপের ছেলে নই। বিখ্যাত বাপের রয়্যালটি পেয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে হয় না…”

মানালি বাধা দিয়ে বলল, “সে তো স্যার ম্যাক্সিমাম পরিচালকই তাই, আপনি একজনকে উদ্দেশ্য করেই বলে যাচ্ছেন কেন?”

ধ্রুব বললেন, “বলছি কারণ আমার মা, বাবা, মাসি, পিসি, কোনও দিন কেউ ছিল না। নিজের জোরে আমি এই জায়গায় এসেছি। ভিটেমাটি ছেড়ে ও দেশ থেকে ঠাকুরদা এসেছিল। বাবা লড়েছে, আমিও লড়ব। আমাকে হারানো এত সহজ না।”

মানালি বলল, “এখন আপনি কী করছেন?”

ধ্রুব বললেন, “লিখছি। লিখছি, কাটছি, আবার লিখছি।”

মানালি বলল, “আপনার গল্প যদি প্রোডিউসার পছন্দ না করেন? যদি তাঁরা মনে করেন আপনাকে নিয়ে ভবিষ্যতে আর কিছু হবে না? সেক্ষেত্রে আপনি কী করবেন?”

ধ্রুব উত্তর দিলেন না। সামনে রাখা টেবিলে রিমোটটা নিয়ে টিভিটা চালিয়ে একটা সিরিয়ালের চ্যানেল চালিয়ে বললেন, “আপনি সিরিয়াল দেখেন?”

মানালি বলল, “না। আমার মা দ্যাখে।”

ধ্রুব ঋপণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি দেখেন?”

ঋপণ মাথা নাড়ল, “না স্যার, বাড়িতে বাবা মা দুজনেই দ্যাখে।”

ধ্রুব হাসলেন, “প্রতি পরিবার পিছু কেউ না কেউ সিরিয়াল দ্যাখে। গড্ডল প্রবাহে গা ভাসাব!”

মানালি বলল, “সেটা সম্ভব হবে? বড়ো পর্দার সফল পরিচালক শেষমেশ সিরিয়াল বানাবেন?”

ধ্রুব বললেন, “সাবিত্রীদি, মাধবীদিরা অভিনয় করলে আপনারা সেটা নিয়ে নাক সিঁটকেছেন? আমার ঘরে হাঁড়ি না চড়লে আমি কী করব সেটা তো আমাকেই ঠিক করতে হবে, তাই না?”

মানালি বলল, “আপনার সিনেমা চলে না, আপনাকে সরকারি পদে রাখা হয়েছে বলে একটা গ্রেড এ ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে ট্রিটমেন্ট পান, আপনার নিজেকে ওভাররেটেড বলে মনে হয় না?”

ধ্রুব বললেন, “আপনার স্যালারি কত?”

মানালি বলল, “সেটা স্যার কী করে বলি?”

ধ্রুব ঋপণের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি ফ্রিল্যান্সার? না মাইনে করা?”

ঋপণ বলল, “স্যালারি পাই।”

ধ্রুব টেবিলে পা তুলে বললেন, “আপনারা মাইনে পান। আপনাদের কোম্পানি আপনাদের মাইনে দেয়। আপনাদের সময়ের দাম আছে। দুটোকে নিশ্চয়ই আমার কাছে ইয়ার্কি মারতে পাঠানো হয়নি। তাহলে আমি ওভাররেটেড কী করে হই?”

মানালি মরিয়া হল, “সেটা তো আপনি গরম গরম স্কুপ দেন, সেগুলোর জন্য।”

ধ্রুব হাসতে হাসতে বললেন, “সেটাও তো কোয়ালিটি। সেটার ভ্যালু নিশ্চয়ই আছে বলেই আপনাদের এখানে পাঠানো হয়েছে। রাস্তার নসু ঘোষ কী বলল, আর ধ্রুব বাগচী কী বলল, দুটোর মধ্যে নিশ্চয়ই ডিফারেন্স আছে।”

মানালি রেকর্ডার অফ করে বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”

ধ্রুব বাগচী বললেন, “শিক্ষানবিশ। তবে লেগে থাকুন। আপনার উন্নতি ঠেকায় কে?”

মানালি বলল, “কেন? আমার মধ্যে কী এমন দেখলেন?”

ধ্রুব বাগচী টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে বললেন, “আপনি মেয়ে। সুন্দরী। একটা কারণই উন্নতি ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।”

মানালির রাগ হচ্ছিল। সে সোফা থেকে উঠে বলল, “বাই স্যার।”

ধ্রুব বাগচী বললেন, “অফিসে বলে দেবেন আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিতে। আমার সময়ের দাম আছে।”

মানালি বলল, “ওকে স্যার।” ঋপণকে বলল, “চল।”

ধ্রুব বাগচী সিগারেট ধরিয়ে রিমোটটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “মধ্যমেধাই সর্বনাশ করল দেশটার।”

মানালি বলল, “আমায় কিছু বললেন, স্যার?”

ধ্রুব বাগচী বললেন, “না না। যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে যাবেন।”

***

ধ্রুব বাগচীর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে মানালি ঋপণকে বলল, “আমাকে যদি আবার এই জঘন্য লোকটার ইন্টারভিউ নিতে পাঠানো হয়, তবে আমি বিশ্বরূপদাকে জাস্ট খুন করে ফেলব।”

ঋপণ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, “তুই এত রিঅ্যাক্ট করে ফেলিস কেন? লোকটাকে খেলিয়ে আরও অনেক কিছু বের করতে পারা যেত। বিশ্বরূপদা ইচ্ছা করেই তোকে পাঠিয়েছে। আমার মনে হয় তোর ধৈর্য টেস্ট করছে।”

মানালি গজগজ করতে করতে যাচ্ছিল। মোবাইলটা রিং হচ্ছিল তার। জিন্সের পকেট থেকে বের করে দেখল মা ফোন করছে। সে ফোনটা ঋপণকে দিয়ে বলল, “মাকে বলে দে তো আমি হারিয়ে গেছি। টিভিতে অ্যাড দিয়ে দিক! সবাই মিলে আমাকে পাগল করে দেবে। যত্তসব!”

দীপ পৌঁছে দেখল চিত্রলেখা রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে একটু অপ্রস্তুত হেসে বলল, “এক্সট্রিমলি সরি। লেট করে ফেললাম।”

চিত্রলেখা বলল, “ঠিক আছে। আমিও মিনিট তিনেক আগেই এলাম।”

দীপ বলল, “চলুন।”

চিত্রলেখা বলল, “আপনি কি খুব ব্যস্ত ছিলেন আজকে? ঘেমে আছেন দেখছি।”

দীপ বলল, “জ্যাম ছিল খানিকটা চিংড়িহাটার দিকে। আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর?”

চিত্রলেখা বলল, “দুটো স্টপেজ।”

দুপুর দেড়টা বাজে। ভিড় হতে শুরু করেছে। টেবিল খালি হতে একটু দাঁড়াতে হল দুজনকে। মিনিট পাঁচেক পরে বসল তারা।

দীপ বলল, “আপনার ননভেজ ভোজন বাড়িতে জানলে অশান্তি হবে না?”

চিত্রলেখা হেসে বলল, “বাড়িতে সব কথা বললে চলে মিস্টার গাঙ্গুলি? আপনি বলেন?”

দীপ বলল, “না। ভারতবর্ষ সেন্সর বোর্ডের দেশ। সিনেমা থেকে নিজের কথা, সবখানে সেন্সর না থাকলেই বরং সমস্যায় পড়তে হয়।”

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে বলল, “এই তো। বুদ্ধিমান।”

দীপ বলল, “কী খাবেন?”

চিত্রলেখা বলল, “আপনি বলুন কী খাবেন। আপনাকে দেখে বেশ খানেওয়ালা বলেই মনে হয়। বিয়েবাড়িতেও তেরো পিস খাসির নিচে নামলেন না।”

দীপ অবাক হয়ে বলল, “আপনি পিস গুনেছেন?”

চিত্রলেখা বলল, “কথার কথা। গুনলে হয়তো আরও বেশিই হত। কী বলেন?”

দীপ বলল, “মাংস দেখলে আমার মাথার ঠিক থাকে না।”

চিত্রলেখা বলল, “রসগোল্লাও তো মন্দ টানলেন না।”

দীপ বলল, “সে তো চারটে খেয়েছি মাত্র। ওটা কোনও সংখ্যা হল? আপনাকে দেখে অবশ্য ডায়েট পার্টি বোঝা যায়। তবে প্লিজ ঘাস পাতা অর্ডার করবেন না।”

চিত্রলেখা আবার হেসে বলল, “ঘাস পাতা কেন অর্ডার করব! মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর প্রনের কোনও প্রিপারেশন খাওয়া যেতে পারে।”

ওয়েটার এসে গেছিল। দীপ অর্ডার দিয়ে দিল।

তারপর চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার হাসিটা ভারী সুন্দর। বিয়েবাড়িতে এটা দেখেই ক্লিন বোল্ড হয়ে গিয়েছিলাম বুঝতে পারলাম।”

চিত্রলেখা বলল, “থামুন। এমন বোল্ড হয়ে গেছিলেন, অফিস করতে গিয়ে আমাকে ভুলেই মেরে দিলেন।”

দীপ বলল, “সে তো সেনসেক্সটা হঠাৎ পাগলামি করতে শুরু করেছিল বলে। সেনসেক্স একটু এদিক ওদিক হলেই আমার মাথার প্রসেসর গুবলেট হয়ে যায়।”

চিত্রলেখা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “আপনি শেয়ার বাজার পাবলিক?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ, কেন?”

চিত্রলেখা মাথায় হাত দিয়ে বলল, “হয়ে গেল।”

দীপ অবাক হল, “কী হয়ে গেল?”

চিত্রলেখা হতাশ স্বরে বলল, “আমার ছোটো মামা। সারাক্ষণ এই করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক বিয়েও করলেন না এই চক্করে। আপনারও সেরকম প্ল্যান আছে নাকি?”

দীপ বলল, “বিয়ে করাই যায়। অতটাও কিছু না। তবে শেয়ার বাজারকে অবজ্ঞা করবেন না। চমৎকার জিনিস। একটু বোঝাই?”

দীপ একটা ন্যাপকিন নিয়ে পকেট থেকে পেন বের করল।

চিত্রলেখা হাত জোড় করে বলল, “রক্ষে করো। আপনি কি চান আমি এই মুহূর্তে এখান থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাই?”

দীপ পেনটা দিয়ে ন্যাপকিনে বাড়ি ঘর আঁকতে আঁকতে বলল, “ওকে। তাহলে থাক। এই দেখুন আমি কী সুন্দর ছবি আঁকি।”

চিত্রলেখা বলল, “বাহ, আপনি এক্কেবারে শেয়ার থেকে ছবি আঁকায় চলে এলেন দেখছি।”

দীপ বলল, “আপনার ইন্টারেস্ট নেই দেখে শিফট করে গেলাম। ছবি আঁকায় আমি অসাধারণ ট্যালেন্ট বুঝলেন? এই বাড়ি, নারকেল গাছ আর পাহাড়ের আড়াল দিয়ে সূর্য ছাড়া কিছু আঁকতে পারি না।”

চিত্রলেখা বলল, “ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আঁকতে পারেন তো?”

দীপ সভয়ে বলল, “ওরে বাবা, সে তো আমার কাছে ভয়ানক ব্যাপার। বায়োলজি শুনলেই আমি পালাতাম।”

চিত্রলেখা বলল, “তাহলে আপনার আর আমার কোনও মিল নেই। আমার বায়োলজিতেই অনার্স। আচ্ছা, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে সেসব আঁকা শিখিয়ে দেব।”

দীপ চিত্রলেখার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “যেখানে বাঘের ভয় ইত্যাদি ইত্যাদি।”

চিত্রলেখা বলল, “আপনার জীবনে প্রেম নেই বলছেন?”

দীপ বলল, “আছে তো। ইকোনমিক টাইমস, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, সিএনবিসি, আর সেনসেক্স। এইসব নিয়েই আছি।”

চিত্রলেখা বলল, “কী ভয়ানক! আমার এক্স-এর ব্যাপারে জানতে চান?”

দীপ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সে জেনে কী হবে? হিংসে করা ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই। আমি কি আর টাইম মেশিনে গিয়ে আপনার পাস্ট বদলে দিতে পারব?”

চিত্রলেখা বলল, “না না, শুনে নিন। আপনার এক্স নেই বলে, থাকলে বুঝতেন, এক্সকে খিস্তি মারলে শরীর ঠান্ডা হয়, মাথা ঠান্ডা হয়, এক অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি হয় সারা শরীরে। সে অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।”

দীপ ম্লান মুখে বলল, “আচ্ছা বলুন।”

চিত্রলেখা বলল, “আমার সঙ্গে ছেলেটির আলাপ আমার এইচএসের পরে। এইচএসের পরেই আমি ফেসবুক করা শুরু করি। তো, সেই সময় ছেলেটির সঙ্গে সারাদিন ধরে চ্যাট করে যেতাম। একসময় ফোন নাম্বার এক্সচেঞ্জ হল। মানে আজকালকার প্রেম-ট্রেম যে রুটে হয় সেরকমই আর কি।”

দীপ বলল, “সত্যি লোকের কত সময়।”

চিত্রলেখা বলল, “আপনার জ্বলছে? গুড।”

দীপ বলল, “বলুন বলুন। আমি শুনছি।”

চিত্রলেখা বলল, “ছেলেটি প্রথম প্রথম পজেসিভনেস দেখাত। আমি ভাবতাম ঠিক আছে। খুশিও হতাম। ভাবতাম ভালোবাসে বলেই পজেসিভ। কিন্তু একটা সময়ের পরে ছেলেটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করে দিল। ধরুন কোনও স্যারের কাছে পড়বে না, ম্যাডামের কাছে পড়তে হবে। এই টাইপ দাবি শুরু হল।”

দীপ বলল, “সুতরাং আপনি কাটিয়ে দিলেন।”

চিত্রলেখা বলল, “না। কাটাইনি। আমি ধৈর্য ধরে শুনতাম। ও যা বলত, তাই মেনে চলতাম। এক স্যার, বেশ ভালো পড়াতেন, তাঁর কাছে না পড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভালো পড়ান এমন একজন ম্যাডামের কাছে পড়া শুরু করলাম। ম্যাডাম যেভাবে পড়াতেন, আমার মাথায় না ঢুকলেও আমি সেটাও কম্প্রোমাইজ করতে শুরু করলাম।”

দীপ বলল, “তাহলে কাটালেন কখন?”

চিত্রলেখা বলল, “ব্রেকআপ করব ভাবা যতটা সোজা, করা ততটাই কঠিন। এত কিছু সত্ত্বেও আমার প্রেমটা ছ মাস সাত মাস টিকেছিল। তারপর এল সেই ভয়ংকর দিন। ও কীভাবে যেন আমার বাড়ির ল্যান্ডলাইন নাম্বারটা আমার থেকে নিয়েছিল। একদিন তুমুল ঝগড়া হয়েছে। আমি ফোন-টোন অফ করে রেখে দিয়েছিলাম। তিনি করলেন কী, আমার ল্যান্ডলাইনে ফোন করলেন। এবং আমার বাবাকে যা নয় তাই বলে দিলেন।”

দীপ অবাক হয়ে বলল, “সর্বনাশ।”

চিত্রলেখা বলল, “সর্বনাশ বলে সর্বনাশ। বাবাকে কৈফিয়ত, মাকে কৈফিয়ত, সে এক ভয়াবহ সময়। বাবা তো এত রেগে গেল যে আমার বিয়েই দিয়ে দেয়। অনেক কষ্টে, হাতে পায়ে ধরে সেসব ঠেকানো গেল। আমি ঠিক করলাম কিছুতেই আর এই সম্পর্কে আমি নেই। ছেলেটা বহু অনুনয় করল। কিন্তু আমি আর সে পথে যাইনি।”

দীপ বলল, “সে ভালো করেছেন। এই তো খাবার এসে গেল।”

ওয়েটার খাবার সার্ভ করে দিল। দীপ বলল, “আমারও আজ একটা সম্বন্ধ এসেছিল।”

চিত্রলেখা বলল, “তাই? মেয়ে দেখা শুরু হয়েছে? কেমন দেখতে? কী করে?”

দীপ বলল, “জার্নালিস্ট।”

চিত্রলেখা বলল, “বেশ তো। আপনার সঙ্গে জার্নালিস্ট খারাপ মানাবে না।”

দীপ চামচ দিয়ে ফ্রায়েড রাইস কায়দা করতে করতে বলল, “জেলাসিতে আপনিও কম যান না কিন্তু।”

চিত্রলেখা বলল, “আমার এক্স নিয়ে আপনার কোনও আপত্তি নেই তবে?”

দীপ চামচটা প্লেটে রেখে একটু ভেবে বলল, “দেখুন, প্রথমত ওই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে বকবক করাটা আমার দ্বারা জাস্ট হবে না। আমার রিলেশনশিপে যেতে ভয় পাওয়ার অন্যতম কারণ হল এই ফোন। কানের কাছে ফোন নিয়ে ফিসফিস করে, বিড়বিড় করে আমার সোনু খেয়েছে, আমার মনু হেগেছে করতে পারব না জাস্ট। তার জন্য প্রেম থাকুক না থাকুক আমার কিচ্ছু যায় আসে না। দ্বিতীয়ত, আপনার এক্স আপনার পাস্ট। আমি বায়োলজিতে খারাপ ছিলাম। একইসঙ্গে ইতিহাসেও। তাই আপনার ইতিহাস নিয়ে আমার বিশেষ চিন্তা নেই।”

চিত্রলেখা বলল, “তাও ভালো। আমার সঙ্গে এক ছেলে ছকাতে এসেছিল। আমার এক্সের কথা শুনে ইনিয়েবিনিয়ে কেটে পড়েছে। মেয়েমানুষ আর মোবাইলের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ তফাত দ্যাখে না। সেকেন্ডহ্যান্ড হলেই অচ্ছুৎ।”

দীপ খেতে খেতে বলল, “ওয়েভলেন্থ ম্যাচ করলেই হল। আপনি আমাকে স্বাধীনভাবে ইকোনমিক টাইমস পড়তে দেবেন, আমি আপনাকে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আঁকতে দেব। তাহলেই হবে।”

চিত্রলেখা হেসে ফেলল। বলল, “বিল কিন্তু সমান ভাগে ভাগ করবেন।”

দীপ বলল, “আজ আমি খাওয়াব। এমনিতে আমি হাড় কেপ্পন, তবু আমি খাওয়াব।”

চিত্রলেখা অবাক হয়ে বলল, “এমনিতে আপনি হাড় কেপ্পন, তবু খাওয়াবেন কেন?”

দীপ বলল, “জীবনে প্রথম কোনও মেয়েকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় এসেছি। সেলিব্রেশন তো বনতা হ্যায় বস।”

চিত্রলেখা নাক সিঁটকিয়ে বলল, “উফ, কী জঘন্য আপনার সেন্স অফ হিউমার।”

দীপ বলল, “আচ্ছা, আপনি কি আজ থেকে আমার অফিশিয়াল গার্লফ্রেন্ড? ফেসবুকে ট্যাগ করতে পারি?”

চিত্রলেখা বলল, “ফেসবুকে আগে বন্ধু হোন। তারপর তো সেসব করবেন।”

দীপ বলল, “কী জ্বালা। আচ্ছা। সেসব করা যাবে। আগে খেয়ে নি।”

চিত্রলেখা বলল, “আইসক্রিম স্কুপ আর গুলাবজামুনটা আমি খাওয়াব। আশা করব তাতে আপনার আপত্তি নেই?”

দীপ বলল, “ওকে ম্যাম। বেশি আপত্তি করলে যদি ধুতরো ফুল আঁকতে দিয়ে দেন তাহলেই চিত্তির।”

চিত্রলেখা বলল, “থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।”

ডেস্কে বসে মানালি পেন্টে ছবি আঁকছিল। বিতস্তা তাকে একটা চুইংগাম দিয়ে বলল, “কি রে, ধ্রুব বাগচীকে কেমন লাগল?”

মানালি বিতস্তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, “কেমন লাগতে পারে? তোর কেমন এক্সপেক্টেশন ছিল শুনি?”

বিতস্তা একটা শয়তানি হাসি হেসে বলল, “চেটে দিয়েছে?”

মানালি উত্তর না দিয়ে মন দিয়ে মাউস দিয়ে ভেড়া আঁকতে লাগল।

বিতস্তা বলল, “বিশ্বরূপদা কিন্তু যে-কোনো সময় উঁকি মারতে পারে।”

মানালি মুখ ব্যাজার করে বলল, “তাতে আমার ছেঁড়া গেল। পৃথিবীর যত জঘন্য অ্যাসাইনমেন্টগুলো আমার জন্য দেবে, তার ওপর আবার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ? আসুক আজকে, আমি বুঝে নেব।”

বিতস্তা বলল, “তোর মুড এত অফ কেন মা? কাজে এক-আধ দিন খারাপ যেতেই পারে। জার্নালিজমের পাবলিকদের এত মুডি হলে চলে?”

মানালি বলল, “শুধু কাজে? তুই জানিস আজ কী ভয়াবহ কাণ্ড হয়ে গেছে?”

বিতস্তা অবাক হয়ে বলল, “কী কাণ্ড?”

মানালি বলল, “সকালে মা বলল, মার এক গুরুভাইয়ের বাড়ি যাবে। কী সব নাকি ঠাকুর দেবতার নাম-টাম করবে, আমাকেও যেতে হবে, একদিন গেলেই হবে। আমি ভাবলাম ঘরে বসে একা একা কী করব, চলেই যাই। গিয়ে দেখি কোত্থেকে একটা ছেলে জোগাড় করে ফেলেছে। সম্বন্ধ!!! ভাবতে পারছিস?”

বিতস্তা চোখ কপালে তুলে বলল, “ও মাই গড!!! তারপর? ইনিয়েবিনিয়ে কথা বললি? বললি না, আপনি কোন কালারের আন্ডারওয়্যার ভালোবাসেন?”

মানালি পেপারওয়েটটা তুলে বিতস্তার দিকে ছোড়ার অভিনয় করে বলল, “সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না। আমি ক্লিয়ারলি বলে দিয়েছি আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।”

বিতস্তা চোখ নাচাল, “কে তোর বয়ফ্রেন্ড? বিশ্বরূপদা?”

মানালি কয়েক সেকেন্ড বিতস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “সকালে ক্লিয়ার হয়নি তোর? বিশ্বরূপদার সঙ্গে আমার এজ ডিফারেন্সটা জানিস?”

বিতস্তা বলল, “মেয়েরা তো একটু বেশি বয়সের পুরুষই পছন্দ করে। সেদিন তুই-ই তো বলছিলি!”

মানালি বলল, “তা বলে বিশ্বরূপদা?”

বিতস্তা বলল, “তাহলে কে? চাওয়ালা ন্যাপলা?”

মানালি বলল, “আমাকে খেপিয়ে লাভ নেই। এমনিতেই প্রচুর খেপে আছি আজ। স্যাচুরেশন লেভেলে চলে গেছি। একদিকে ধ্রুব বাগচী, একদিকে সম্বন্ধ… উফ।”

বিতস্তা বলল, “ছেলেটা কেমন ছিল?”

মানালি বলল, “লাভ নেই। ছেলেটার গার্লফ্রেন্ড আছে।”

বিতস্তা বলল, “তাতে কী? তোর যদি ছেলেটাকে পছন্দ থাকে তাহলে তোর মায়াজাল ইন্দ্রজাল আরও কী সব আছে সেসব ছড়িয়ে ছেলেটাকে জিতে নিবি। সিম্পল।”

মানালি চোখ ছোটো ছোটো করে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “তোর অবস্থা খুব খারাপ। বোঝাই যাচ্ছে আজকাল কেউ দিচ্ছে না তোকে।”

বিতস্তা চোখ মারল, “না না, সৌরভ ভালোই দিচ্ছে।”

মানালি বলল, “প্রেগন্যান্ট হয়ে যাস না দেখিস। হাজার ঝামেলা কিন্তু।”

বিতস্তা বলল, “হয়ে গেলে হয়ে যাব। সৌরভ ডিনাই করলে একা একা বাচ্চা মানুষ করব। কী চাপ?”

মানালি অবাক হল, “তুই সিরিয়াস?”

বিতস্তা বলল, “হ্যাঁ। হান্ড্রেড পারসেন্ট!”

মানালি বলল, “এরকম কিছু ঘটিয়ে ফেলেছিস নাকি অলরেডি?”

বিতস্তা হেসে ফেলল, “ধ্যাত। জাস্ট কথার কথা বলছি।”

মানালি বলল, “দেখিস বাপু। যা করবি ভেবেচিন্তে করবি।”

বিতস্তা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। অত চিন্তা করিস না। যুদ্ধে নামিবার পূর্বে সকলরকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়াই যুদ্ধে নামা হয়। তুই একটা প্রেম কর না জমিয়ে। এই অ্যাডভেঞ্চারগুলো খারাপ লাগবে না। লাস্ট মান্থেই তো সৌরভের ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল টিপেছি, আর ঠিক সেই সময় ওর পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক দরজা খুলে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি ওঁকে দেখেই বললাম চন্দনের গন্ধওয়ালা ধূপকাঠি নেবেন দাদা? একটা কিনলে একটা ফ্রি। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিলেন।”

মানালি হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, “সিরিয়াসলি? মানে এটা তুই করতে পারলি? তোর মাথায় এল? যদি সত্যিই ধূপকাঠি চাইত তাহলে কী করতি?”

বিতস্তা বলল, “ধূপকাঠি ছিল তো। কিছুক্ষণ আগেই কিনেছিলাম বাস থেকে নেমে। সেইজন্যই তো মাথায় এসে গেছিল। বেচে দিতাম।”

মানালি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “তুই শিওর কেস খাবি।”

বিতস্তা বলল, “কেস খাবার কিছু নেই। দুজন অ্যাডাল্ট পাবলিক কী করবে না করবে, সেটা পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন ঠিক করে দেবে নাকি?”

মানালি বলল, “সৌরভ কী বলে?”

বিতস্তা বলে, “ও তো আরও কুল। বলে, অত কিছু করার কী দরকার ছিল? পাত্তাই দিতে না। কী এমন হত?”

মানালি বলল, “বিয়ের কথা ভাবছিস না তোরা?”

বিতস্তা বলল, “নাহ। এখন কী?”

মানালি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় বিশ্বরূপদা চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “মানালি, শুনে যা তো একবার।”

বিতস্তা বলল, “নাও। হয়ে গেল।”

মানালি বলল, “হ্যাঁ রে, কাল বলছিলি বিশ্বরূপদার নামে কী সব রিউমার ছড়িয়েছে?”

বিতস্তা বলল, “হুঁ, রেজিগনেশন দেবে শুনছি শিগগিরি। অলমোস্ট দেড়গুণ বেশি সিটিসি পাবে সিথ্রি মিডিয়ায়।”

মানালি বলল, “যাহ্! তাহলে আমাদের কী হবে?”

বিতস্তা বলল, “আসবে আর-একটা ঝাঁটু কেউ।”

মানালি বলল, “ঠিক আছে। শুনে আসি কী বলছে। আজ বেশি কিছু বললে জাস্ট খুন করে ফেলব। আমি বাড়ি যাব তাড়াতাড়ি।”

বিতস্তা বলল, “আবার সম্বন্ধ দেখতে আসবে নাকি তোর?”

মানালি মাথা চাপড়ে বলল, “উফ! ঠিকই বলেছিস। আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়েও শান্তি নেই। মার ইমোশনাল অত্যাচারের পাল্লায় পড়তে হবে।”

বিতস্তা হাসল, “যা যা, দেখ বিশ্বরূপদা কী বলছে।”

বিশ্বরূপদা ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। মানালিকে দেখে বলল, “অফিসে এত গ্যাজালে চাকরি থাকবে না কিন্তু।”

মানালি বলল, “কী করব? দুজনে একটু হালকা ছিলাম।”

বিশ্বরূপদা বলল, “ধ্রুব বাগচীর ইন্টারভিউটা লেখা হয়ে গেছে?”

মানালি ঠোঁট কামড়াল, “না।”

বিশ্বরূপদা বলল, “তাহলে হালকা ছিলি কী করে?”

মানালি বলল, “আমি কাল লিখব। আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব।”

বিশ্বরূপদা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাকরিটাকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড ভাবাটা বন্ধ কর।”

মানালি বুঝল বিশ্বরূপদা রেগে গেছে। সে কিছু বলল না। মাথা নিচু করে নিজের জুতো দেখতে লাগল।

বিশ্বরূপদা বলল, “অডিও ক্লিপটা শুনলাম। তোর প্রবলেমটা কী, সেটা তুই ধরতে পারিস?”

মানালি বলল, “কী?”

বিশ্বরূপদা বলল, “তুই যে প্রশ্নগুলো করবি বলে প্রিপেয়ার হয়ে গেছিস, তার বাইরে আর বেরোতে পারিস না। তুই ভাবছিস কতগুলো প্রশ্ন তৈরি করে গেছিস, সেগুলো বলে ফেললেই হয়ে যাবে। তোকে আমি আগেও বলেছি, যে ওপেনিংগুলো পাবি, তাতে ঢুকে যা। ধ্রুব বাগচী তোকে বেশ কয়েকটা ভালো সিটার দিয়েছিল, তুই মিস করে গেলি।”

মানালি বলল, “ওকে। পরের বার ট্রাই করব। কিন্তু এই লোকটা ভীষণ অসভ্য। শুরুতেই ইন্টারকোর্স ইত্যাদি বলে আমার ফোকাসটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল।”

বিশ্বরূপদা বলল, “সেটাই তো করবে। ধ্রুব বাগচী তো শুধু মুখে বলে, কেউ কেউ আছে যারা চোখে বলে। তাদের ক্ষেত্রে তুই কী করবি?”

মানালি বলল, “চড় মেরে দেব।”

বিশ্বরূপদা হেসে বলল, “না। চোখে বলার মতো জায়গায় যেন না যায়, সেই পারসোনালিটিটাও তোকে তৈরি করতে হবে। ক্যাজুয়ালি একটা ট্রেনি মেয়ের মতো গেলে এসব লোক এভাবেই তোকে চেটে রেখে দেবে। ধ্রুব বাগচীর একটা ভালো ব্যাপার আছে যদিও।”

মানালি বলল, “কী ভালো ব্যাপার আছে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “লোকটার মুখ খারাপ। কিন্তু রেকর্ড ভালো। মেয়েদের সঙ্গে পাঁচ পেগ গিলেও পার্টিতে কোনও রকম অসভ্যতা করবে না। এটা সবার থেকে পাওয়া যায় না।”

মানালি ঠোঁট বাঁকাল, “আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই, ধ্রুব বাগচী মদ খাবে আর আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকব।”

বিশ্বরূপদা বলল, “যে-কোনো সময় যে-কোনো সিচুয়েশন আসতে পারে। তোকে তার জন্য প্রিপেয়ার্ড থাকতে হবে। এখন কটা বাজে?”

মানালি ঘড়ি দেখে বলল, “পাঁচটা।”

বিশ্বরূপদা বলল, “ওকে। তুই যেতে পারিস। কিন্তু কাল এসে দু ঘণ্টার মধ্যে গোটা রিপোর্টটা তৈরি করে দিবি আমায়। ডান?”

মানালি বলল, “ডান।”

বিশ্বরূপদা বলল, “ধ্রুব বাগচী আমায় ফোন করেছিল।”

মানালি অবাক হল, “কেন?”

বিশ্বরূপদা বলল, “তোর প্রশংসা করল। বলল, ডিপার্টমেন্টে ভালো ভালো জার্নালিস্ট এসেছে। ভালো করে গ্রুম করো।”

মানালি বলল, “ধ্যাত। হতেই পারে না। ইয়ার্কি মেরো না তো।”

বিশ্বরূপদা বলল, “ইয়ার্কি মারতে যাব কেন? সিরিয়াসলিই বলেছে।”

মানালির মনে পড়ল, “ওহ, লোকটা টাকা চাইছিল ইন্টারভিউর জন্য।”

বিশ্বরূপদা হাসল, “ওটা তোকে চমকানোর জন্য বলেছিল। ভদ্রলোক নিজের ইমেজ ইচ্ছা করেই খারাপ করে রাখেন। যতটা খারাপ দেখান ততটা নন। বিশেষ করে এখনকার ইন্টেলেকচুয়ালদের মতো তো একেবারেই নন। বাই দ্য ওয়ে, আমি ইচ্ছা করেই আজ তোকে ধ্রুব বাগচীর কাছে পাঠিয়েছিলাম। তুই কতটা ঘাবড়াস দেখার জন্য। ধরে নে এটা পার্ট অফ ইওর ট্রেনিং। নইলে কাল অবধি ইন্দ্রর যাওয়াই ঠিক ছিল। ডিসিশনটা আজই সকালের।”

মানালি অবাক হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। বিশ্বরূপদা বলল, “কী হল?”

মানালি বলল, “তোমার খুরে খুরে প্রণাম।”

 রবিবারের সকাল। দীপের ঘুম ভাঙল নটায়। উঠতে ইচ্ছা করছিল না তার। ফোনটা টেবিলের ওপর রাখা ছিল।

উঠে সেটা নিয়ে আবার কম্বলের তলায় সেঁধিয়ে গেল সে।

হোয়াটসঅ্যাপে চিত্রলেখা মেসেজ করেছে, “ঘুম ভাঙল?”

দীপ দেখল সকাল আটটায় মেসেজটা এসেছে।

সে লিখল, “না। এখনও ঘুমাচ্ছি।”

চিত্রলেখা অনলাইনই ছিল। লিখল, “ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কীভাবে টাইপ করছেন?”

দীপ লিখল, “সুপার পাওয়ার।”

চিত্রলেখা হাসির স্মাইলি দিল।

দীপ লিখল, “এবার কী বলবেন? আমার বাবু খেয়েছে?”

চিত্রলেখা আবার একগাদা হাসির স্মাইলি দিয়ে লিখল, “না না। আচ্ছা, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন বোধহয়। ওকে। পরে কথা বলছি।”

দীপ বলল, “ওকে।”

চিত্রলেখা মেসেজটা সিন করল। কিছু লিখল না।

দীপের মনে হল সে কি খানিকটা রূঢ় হল? একটু ভাবল। তবে সেও কিছু লিখল না আর। সকাল সকাল এত টাইপ করতে ইচ্ছা করছিল না।

বাইরের ঘর থেকে জোরে জোরে ঘণ্টার আওয়াজ আসছে। দীপ বুঝতে পারল মা পুজো শুরু করেছে। ফোনটা রেখে বেশ খানিকক্ষণ চোখ বুজে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকল সে। রবিবার শেয়ার বাজার বন্ধ থাকে। বেশ কিছু পড়াশোনা করতে হয় তাকে। সোমবার বাজার খুলতেই কোন কোন শেয়ারের ওপর কড়া নজর থাকবে, কোন কোন শেয়ারে একটু হলেও ফাটকা খেলতে হবে, এ সব কিছুর হোমওয়ার্ক রবিবার করে রাখতে হয়। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো এত সময় দেয় না।

দীপ বেশ খানিকক্ষণ কম্বলে শুয়ে উঠল। বাথরুমে মিনিট পনেরো কাটিয়ে বসার ঘরে গিয়ে দেখল বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে। সে বলল, “কী হল? রেগে আছ কেন?”

বাবা গলায় একরাশ বিরক্তি এনে বলল, “তোর মা বলছে এখন থেকে বাড়িতে আমিষ ঢুকবে না।”

দীপ অবাক গলায় বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এ আবার কী হল? এ তো ভয়ংকর ব্যাপার।”

বাবা বলল, “তোর কী মত এই ব্যাপারে?”

দীপ বলল, “বাইরে খেয়ে নেব।”

বাবা বলল, “ইডিয়ট তৈরি হচ্ছিস যত দিন যাচ্ছে। রোজ রোজ বাইরে খেলে পেট ঠিক থাকবে? তা ছাড়া তোর মার হাতের চিংড়ির মালাইকারি, চিতল মাছের মুইঠ্যা, কুচো চিংড়ি দিয়ে মোচার তরকারি মার্কেটে পাবি?”

দীপ বলল, “তাহলে কী চাইছ? বিদ্রোহ করি?”

বাবা সোফায় একটা চাপড় মেরে বলল, “অফকোর্স। এটা নিয়ে তোর মনে কোনও সংশয় আছে নাকি? তোর মা ওই কী সব গুরুদেবের পাল্লায় পড়ল ঠিক আছে, আমি ভেবেছিলাম একটা অ্যাসোসিয়েশন দরকার, মেনেও নিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে হেঁশেল এবং পেটের অন্দরমহলে সার্জিকাল স্ট্রাইক হলে আমি মেনে নেব না। এটা তোকে আগে থেকেই বলে দিলাম দীপু।”

দীপ বলল, “তাই করো। তুমি বিদ্রোহ করো।”

বাবা কিছুক্ষণ নিজের মনে গজগজ করতে করতে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে বলল, “এই মরেছে, তোকে কী একটা কথা বলার ছিল।”

দীপ বলল, “কী?”

বাবা খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, “কিছুতেই মনে পড়ছে না। আচ্ছা দাঁড়া, তোর মাকে জিজ্ঞেস করে আসি।”

বাবা তড়িঘড়ি ঠাকুরঘরের দিকে ছুটল।

দীপ কাগজটা খুলল। প্রথম পাতাতেই খবরের পরিবর্তে পাতা ভর্তি বিজ্ঞাপন। দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার।

বাবা ইকোনমিক টাইমস পড়ে না। ফলে কাগজটা ঝকঝকেই থাকে। সে ইকোনমিক টাইমসটা নিয়ে নিজের ঘরে যাবার জন্য সোফা থেকে উঠল, এমন সময় বাবা এসে বলল, “বস বস। তোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

দীপ বলল, “মার সঙ্গে কথা হল তবে?”

বাবা বলল, “হ্যাঁ।”

দীপ বলল, “বলো। কালকের কথা বলবে নিশ্চয়ই?”

বাবা চশমাটা কপালের উপর তুলে বলল, “হ্যাঁ। তুই কী করে জানলি?”

দীপ বলল, “গুরুত্বপূর্ণ কথা বললে যখন তখন ওটাই দাঁড়ায়। আমি তো ভাবলাম কালকেই বলবে।”

বাবা বলল, “কালকে জানলে তো বলব? কাল তো তোর মার মেজাজ একদম তুঙ্গে ছিল। যাই জিজ্ঞেস করি, রেগে যাচ্ছিল। আজ সকালে শেষমেশ বলল, কী হয়েছিল। যাক গে, আসল কথায় আসি, তুই নাকি প্রেম করছিস?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

বাবা বলল, “বিয়ে করবি কবে?”

দীপ বলল, “সবে তো প্রেম শুরু হল। এখনই বিয়ে নিয়ে টানাটানি শুরু করছ কেন?”

বাবা বেশ খানিকক্ষণ তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোর মতো বিচক্ষণ যদি আমি হতে পারতাম! সবে শুরু হল বলছিস?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

বাবা বলল, “কী করে? কোথায় থাকে?”

দীপ বলল, “ভয়াবহ ব্যাপার বাবা। মেয়ে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র পুরো আঁকতে পারে। তোমার মনে আছে, একবার ওটা তোমাকে আঁকতে বলেছিলাম? আর তুমি সারাদিন ধস্তাধস্তি করে রাতে বলেছিলে এসব মানুষের কম্মো নয়?”

বাবা বলল, “বলিস কী! এ তো সাংঘাতিক কাণ্ড! তাহলে তো দারুণ মেয়ে বলতে হয়! একদিন বাড়িতে নিয়ে আয়।”

দীপ বলল, “সেটা দেখা যাবে।”

বাবা বলল, “ম্যাপ পয়েন্টিং সব পারে কি না জিজ্ঞেস করেছিস? ছোটোনাগপুর মালভূমি, বিন্ধ্য পর্বত, লৌহ আকরিক উৎপাদক অঞ্চল, কচ্ছের রন কোথায় আছে ঠিকঠাক পারবে?”

দীপ মাথা চুলকে বলল, “সেটা জিজ্ঞেস করিনি।”

বাবা গম্ভীর হয়ে বলল, “জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আর শোন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর শাসনকাল, অশোকের ধর্মনীতি, শেরশাহের শাসনকাল, আকবর আর জাহাঙ্গীরের শাসনকালের তুলনামূলক আলোচনা নিয়েও জিজ্ঞেস করে নিবি। এক্কেবারে ঠিকঠাক যাচাই করে নেওয়াটাও দরকার।”

দীপ বলল, “ঠিক আছে।”

বাবা বলল, “দেখা করেছিস মেয়েটার সঙ্গে?”

দীপ মাথা নাড়ল, “কালকেই। মিক্সড ফ্রায়েড রাইস খেলাম। সঙ্গে চিংড়ি।”

বাবা রেগে গেল, “আসার সময় আমার জন্য একটু প্যাক করে নিয়ে আসতে কী হয়েছিল হারামজাদা?”

দীপ বলল, “মা এমনিতেই রেগে ছিল। আনলে আরও রেগে যেত।”

বাবা বলল, “তোর মা তো কী একটা সাইন্টিস্ট মেয়ে পছন্দ করেছিল নাকি! কী সাংঘাতিক। দেখা গেল বাড়িতে এসে বাড়ির জি(g)-এর মান কমিয়ে দিল। আমরা হাওয়ায় ভাসতে শুরু করলাম। তুই একদম ভালো করেছিস মেয়েটাকে বিয়ে করবি না বলে।”

দীপ হাসতে হাসতে বলল, “সাইন্টিস্ট না বাবা। জার্নালিস্ট।”

বাবা বলল, “জার্নালিস্ট?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ। খবরের কাগজের।”

বাবা বলল, “মেয়েটি কী বলেছে? সেও প্রেম করে?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় মা ঘরে এসে ঘরে ঠাকুরের ফটোতে ধুপকাঠি দিতে দিতে তাদের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। এখন প্রণামের সময় তাই বেশি কথা বলা যাবে না বলে মা কিছু বলতেও পারছিল না। মা অন্য ঘরে গেল।

বাবা ফিসফিস করে বলল, “তোর মার রাগ এখনও পড়েনি। আমাকে বলেছিল তোকে ঝাড়তে, এখন তোর সঙ্গে আলোচনা করছি দেখে ভদ্রমহিলা আরও রেগে গেলেন।”

দীপ বলল, “তুমি একটু চিৎকার করো। আমাকে ঝাড়ো।”

বাবা একটু গলা খাঁকরিয়ে উঁচু গলায় চ্যাঁচ্যাতে শুরু করল, “আমি এইসব প্রেম একদম বরদাস্ত করব না দীপু। ম্যাপ পয়েন্টিং করতে পারে নাকি না দেখে কোনও মেয়ে পছন্দ করা আমি একদম বরদাস্ত করব না। আগে আমি নিজের হাতে পরীক্ষা নেব, তারপর ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেব। তা ছাড়া অশ্বখুরাকৃতি হ্রদের টীকা ছবি সহ ঠিকমতো লিখতে পারছে নাকি সেটাও দেখতে হবে। শুধু ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র গাঙ্গুলিবাড়ির বউমা হয়ে আসার জন্য ইজ নট সাফিশিয়েন্ট।”

দীপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় সে শুনতে পেল তার ঘর থেকে ফোনটা সশব্দে বাজছে। সে তড়িঘড়ি নিজের ঘরের দিকে ধাবমান হয়ে ফোনটা ধরল, চিত্রলেখা ফোন করছে।

দীপ বলল, “হ্যালো।”

ওপাশে বেশ কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। দীপ জোরে জোরে বলল, “হ্যালো হ্যালো।”

তার ঘরে মা ঢুকে পড়েছে। ক্যালেন্ডারে ক্যালেন্ডারে ধূপকাঠি ধরে প্রণাম করছে।

দীপ বলল, “কেটে গেল মনে হচ্ছে।”

ওপাশ থেকে চাপা গলায় চিত্রলেখা বলে উঠল, “আপনার বোধহয় কাল আমায় পছন্দ হয়নি, তাই না?”

দীপ আকাশ থেকে পড়ল, “কেন বলুন তো? হঠাৎ কী হল?”

দীপ বুঝতে পারল এক-একটা ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়ানোর অ্যাভারেজ টাইমিং মা বাড়িয়ে দিয়েছে। কে ফোন করেছে এটা জানার জন্যই হয়তো।

চিত্রলেখা বলল, “আপনাকে আমি সকালে বিরক্ত করলাম। তার জন্য সরি।”

ফোনটা কেটে গেল।

দীপ বেশ কয়েক সেকেন্ড ফোনটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে মনে মনে বলল, “এ আবার কী রে বাবা!”

মা তড়িঘড়ি ধূপকাঠি রেখে ঠাকুর প্রণাম সেরে তাকে বলল, “কে ফোন করেছে?”

দীপ বলল, “শেয়ার মার্কেট থেকে।”

মা গজগজ করতে করতে তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দীপ কলব্যাক করল। দুটো রিং হতেই চিত্রলেখা ধরল, “বলুন।”

দীপ বলল, “কী হল আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না।”

চিত্রলেখা বলল, “আপনার বোধহয় আমাকে পছন্দ নয়, না?”

দীপ বলল, “কে বলল, পছন্দ না? একশো বার পছন্দ।”

চিত্রলেখা বলল, “কী দেখে পছন্দ হল? কী আছে আমার যা আর পাঁচটা মেয়ের মধ্যে নেই!”

দীপ বলল, “এ আবার কেমন প্রশ্ন?”

চিত্রলেখা বলল, “নাকি আমার এক্স আছে বলে আপনার পছন্দ না?”

দীপ বলল, “কই সেরকম কিছু না তো!”

চিত্রলেখা বলল, “তাহলে তখন হোয়াটসঅ্যাপের রিপ্লাই দিলেন না কেন?”

দীপ কী কেন বুঝে উঠতে উঠতেই ফোন কেটে গেল।

ফোনটা কান থেকে নামাতে নামাতে সে হতাশ গলায় বলল, “এখন আবার ফোন করে জানু মনু করে ঢপবাজি করতে হবে? হয়ে গেল আজ শেয়ার বাজারের একশো আট।”

ঘরের দরজায় কেউ নক করছে। দীপ দেখল বাবা। সে বলল, “কিছু বলবে?”

বাবা বলল, “সময় করে একবার ইতিহাস বইটা নামাস তো। বাবরের বাবার নামটা ভুলে গেছি মনে হচ্ছে।”

“এই শহরটা দেখছিস না, এখানে চার রকমের মানুষ থাকে।”

ড্রাইভ করতে করতে কথাগুলো বলল বিশ্বরূপদা। গাড়িটা ফ্লাইওভারে ওঠার আগের সিগন্যালে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটা বাচ্চা গোলাপফুল বিক্রি করছে। মানালি একটা গোলাপ কিনল। গাড়ি দাঁড়ানোর কাউন্টডাউন একশো কুড়ি থেকে শুরু হয়েছে।

বিশ্বরূপদা বলল, “কার জন্য কিনলি?”

মানালি ফুলটা খোঁপায় গুঁজে বলল, “নিজের জন্য। নিজেকে গিফট দেবার মজাটাই আলাদা। যাক গে, বলো কোন চার রকমের মানুষ থাকে এই শহরে?”

বিশ্বরূপদা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, “এক, যারা ঘেমে নেয়ে ভিড়ে মারপিট করতে করতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যায়। এদের মধ্যে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, পরিবেশ সচেতন এবং কিছু টিপিক্যাল কিপটে শ্রেণির পাবলিক থাকে। এদের কারও কারও ট্যাক্সিতে ওঠার সামর্থটুকুও নেই। রুটের বাসের গড্ডল প্রবাহে গা ভাসিয়ে বাসে উঠে পড়েছে। লোকের ঘেমো জামা, টিশার্ট থেকে শুরু করে মোজা, সব কিছুর গন্ধ সত্ত্বেও এরা নির্বিকার। এদের মধ্যে অবশ্য ছাত্রছাত্রীরাও পড়ে।”

মানালি বলল, “পরিবেশ সচেতন লোক যারা বাসে চড়ে, এরকম ধরনের লোক কলকাতায় আছে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “অফকোর্স। আমার নিজের চেনাই দুজন আছেন। তাঁরা যথেষ্ট সচ্ছল। কিন্তু খুব তাড়া না থাকলে তাঁরা কিছুতেই গাড়িতে চড়বেন না। এটা নিয়ে একটা স্টোরি করাই যায়।”

মানালি বলল, “তা তুমি পরিবেশ সচেতন নও কেন?”

বিশ্বরূপদা বলল, “দু নম্বর।”

সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বরূপদা গাড়ি স্টার্ট করে বলল, “আমার মতো পাবলিক, যারা সুখী মানুষ। ইএমআই-ও দিয়ে দেবে দরকার হলে, কিন্তু গাড়ি ছাড়া চড়বে না। ইএমআই দাতা থেকে আম্বানি, এই গোত্রে পড়ে।”

মানালি বলল, “তিন নম্বর?”

গাড়িটা ফ্লাইওভারে উঠল। বিশ্বরূপদা বলল, “ক্যাব পাবলিক। এরাও ল্যাদ। যেমন তুই।”

মানালি বলল, “মোটেও না। আমি সব সময় ক্যাবে চড়ি না। বললে হবে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “তাহলে লিফট নেওয়া পাবলিক।”

মানালি রেগে গেল, “আমি নেমে যাব চাইছ গাড়ি থেকে?”

বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “এখানে নামলে আর দেখতে হবে না। জার্নালিস্ট নিজেই খবর হয়ে যাবে।”

মানালি বলল, “হুঁ। চার নম্বর?”

বিশ্বরূপদা বলল, “ডব্লু টি পাবলিক। টিকেট কাটবে না। এদের মধ্যেও কেপ্পন শ্রেণি আছে অবশ্য। চান্স ফ্যাক্টর খেলবে। যদি ধরা না পড়ে। এই কেপ্পন তথা নিকিরি শ্রেণির লোকগুলো খুব ডেঞ্জার হয়।”

মানালি বলল, “তুমি কিন্তু একটু নিকিরি টাইপ আছ।”

বিশ্বরূপদা বলল, “কেন?”

মানালি বলল, “এই যে, দাতা কর্ণ হয়ে লিফটও দাও, আবার কথা শোনাতেও ছাড়ো না।”

বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “এটা খারাপ বলিসনি।”

মানালি বলল, “আচ্ছা, ধ্রুব বাগচী বিয়ে করেনি? ওঁকে নিয়ে তো তেমন গসিপ ছড়ায় না। বরং সবাই ওঁর বদমেজাজ নিয়েই যাচ্ছেতাই বলে দেখেছি।”

বিশ্বরূপদা বলল, “হুঁ। ধ্রুব বাগচী বিয়ে করেছিল তো।”

মানালি চমকে উঠে বলল, “এটা তো জানতাম না।”

বিশ্বরূপদা বলল, “জানার কথাও না। অনেকেই জানে না।”

মানালি বলল, “কী করেন ওঁর এক্স?”

বিশ্বরূপদা মানালির কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “ভালো সাংবাদিক মানেই ব্যোমকেশ বক্সী, জানিস তো?”

মানালি অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “মানে সত্যান্বেষী। একটা ক্লু দিলাম তো। এবার বাকিটা খুঁজে নে।”

মানালি বিরক্ত হল, “এ আবার কী! এ কী এমন বিরাট ব্যাপার যে খুঁজে দেখতে হবে?”

মানালির পাড়ার গলি চলে এসেছিল। বিশ্বরূপদা গাড়িটা বাঁদিকে রাখতে রাখতে বলল, “এসব ফিল্ডে তোকে কেউ চামচ দিয়ে খাইয়ে দেবে না মা। হতে পারে স্টোরিটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। হতে পারে নেহাতই ম্যাড়ম্যাড়ে। কিন্তু তোকে নিজেকেই স্টোরিটা খুঁজতে হবে। আমি আর কিচ্ছু বলব না।”

মানালি দরজা খুলে নামতে নামতে বলল, “অ্যাজ এক্সপেক্টেড।”

বিশ্বরূপদা গাড়ি স্টার্ট দিল, “নেক্সট অ্যাসাইনমেন্ট এটাই। আর হ্যাঁ, এবারে প্রশ্নগুলো যন্ত্রের মতো করে উত্তর নিয়ে এলে চলবে না। গভীরে যেতে হবে। মাইন্ড ইট।”

মানালিকে আর দ্বিতীয় কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। মানালি হাঁ করে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বাড়ির রাস্তা ধরল।

পাড়ার মোড়ে চপ ভাজা হচ্ছে। মানালি ঠোঁট কামড়ে একটু দাঁড়াল। ডায়েটিং চলছে আজকাল। তেল বারণ। বেগুনির গন্ধ অগ্রাহ্য করে খানিকটা হেঁটে আবার ফেরত এল। মনে মনে বলল, “আজই শেষ। প্রমিস প্রমিস প্রমিস। আর একটাও না কাল থেকে।”

কাগজের তিনকোনা ঠোঙায় বেগুনি দিয়ে তার ওপর দিয়ে একটু বিটনুন ছড়িয়ে দিয়েছে। মুখে দিতে জিভ পুড়ে যাবার জোগাড় এত গরম। মানালি কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে বেগুনির গন্ধ নিল। চোখ খুলে দেখল রকের তিন-চারটে ছেলে আড্ডা থামিয়ে তাকে দেখছে।

মানালি হাসি হাসি মুখে ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। ছেলেগুলো ঘাবড়ে গিয়ে ভারতের জিডিপি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করে দিল। বেগুনিতে কামড় দিতে দিতে মানালি বাড়ি ঢুকল।

মা গম্ভীর মুখে দরজা খুলে তাকে দেখে গজগজ করতে করতে বলল, “আরও খা। খেয়ে মোটা হ। আর বিয়ে-টিয়ে দিতে হবে না আমায়। অবশ্য কোনটাকে কোন মুল্লুকে জুটিয়েছিস কে জানে! আমি আর কিছু বলব না।”

মানালি বলল, “না বলাই ভালো। সংকীর্তন করো, যেমন করছিলে, তাতেই ভালো।”

মা বলল, “হ্যাঁ রে, ছেলেটার সঙ্গে গাড়িতে কী কথা বললি?”

মানালি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “ছেলে আর মেয়ের নাম ঠিক করছিলাম।”

মা রেগে গেল, “সব সময় ইয়ার্কি।”

মানালি বলল, “তা তুমি কী দাবি করো মা? ছেলেটা আমাকে লিফট দেবে আর আমি ছেলেটার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে যাব?”

মা বলল, “যা পারিস কর। আমি আর কিছু বলব না। এক ছাতার চাকরি জুটেছে, আমার হাড় মাস জ্বালিয়ে খেল!”

মানালি বলল, “আমিও তো তাই চাই মা, তুমি আর কিছু বলবে না।”

মা গজগজ করতে করতে ঠাকুরঘরে চলে গেল।

মানালি ফ্রেশ হয়ে ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ অন করল।

ওয়ার্ড খুলে বড়ো বড়ো করে লিখল, “ধ্রুব বাগচীর এক্স।”

কয়েক সেকেন্ড অন্যমনস্কভাবে বসে লেখাটার ফন্ট সাইজ বাড়াতে লাগল। ল্যাপটপের ঘড়ি জানান দিচ্ছে সাতটা পঞ্চান্ন।

বেশ কয়েকটা ইমেল এসেছে। মানালি বসে বসে চেক করল। মন বসছে না কাজে। ধ্রুব বাগচী লোকটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। উন্নাসিক, উদ্ধত। ইউটিউবে ধ্রুবর প্রথম সিনেমাটা দেখতে শুরু করল সে। বেশ সাবলীল গল্প বলা। ঝকঝকে সিনেমা। মানালি ফরোয়ার্ড করতে করতে গোটাটা দেখল। নিঃসন্দেহে বিগত কয়েক বছরের অন্যতম সেরা কাজ। লোকটা ট্যালেন্টেড সন্দেহ নেই।

ডার্ক লাভ ইউটিউবে এসে গেছে। মানালি হেডফোন কানে গুঁজে সিনেমাটা দেখতে বসল আবার। অবাক হয়ে সে নিজেই লক্ষ করল সিনেমাটা এবার দেখতে ভালো লাগছে। একটা বেশ অন্যরকমের কনসেপ্টে সিনেমাটা তৈরি করা। গতি একটু ধীর, কিন্তু গল্প বলার কায়দাটা অদ্ভুত সুন্দর। একটু মনখারাপ হল তার। হলে তিন-চারটে লোক পেছন থেকে “চলবে না চলবে না” শুরু থেকেই বলে যাচ্ছিল। শুধু ওইটুকু কথায় তখন প্রভাবিত হয়ে গেছিল।

একটানা দেখছিল সিনেমাটা। হেডফোনটা কান থেকে নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে রইল সে। এগারোটা বাজে। ডাইনিং টেবিল থেকে বেশ জোরে জোরে থালা বাসন ব্যবহার করার শব্দ আসছে। মানালি বুঝল মা ভীষণ রেগে আছে। সে চুপচাপ গিয়ে টেবিলে বসে পড়ল।

মা বলল, “বাহ, আমার কী সৌভাগ্য! এবার খেয়ে আমায় উদ্ধার করো।”

মানালি বলল, “বাবা কবে ফিরছে?”

মা বলল, “নিজে ফোন করে খবর নাও। আমি তোমার রিপোর্টার নই। বুঝেছ?”

মানালি বুঝল মা তুমুল রেগে গেছে। তুইটা থেকে তুমিতে কনভার্ট হলেই মানালি বুঝে যায় ঈশান কোণে মেঘ জমতে শুরু করেছে।

সে চুপচাপ দুটো রুটি খেয়ে বেসিনে প্লেট রেখে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।

মার সঙ্গে এখন বেশি কথা বলতে গেলেই ঝাড় অনিবার্য।

খাটে কয়েক মিনিট চুপ করে শুয়ে থাকল সে। সাড়ে এগারোটা বাজছে।

মানালি হঠাৎ ফোনটা বের করে ধ্রুব বাগচীকে ফোন করল।

দুটো রিং হতেই ফোন তুলে জড়ানো গলায় ভদ্রলোক বললেন, “ইয়েস।”

মানালি বলল, “স্যার, সময়ের কণ্ঠস্বর থেকে বলছি।”

ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল। বেশ কিছুক্ষণ হেসে ধ্রুব বাগচী বললেন, “বলুন, আবার কী দাবি আপনার?”

মানালি বলল, “স্যার, একটা ইনফরমেশন জানার ছিল। আপনার ওয়াইফ, মানে যাঁকে ডিভোর্স দিয়েছেন…”

এই অবধিই বলতে পারল মানালি। ওপাশ থেকে অকথ্য ভাষায় কয়েকটা গালাগালি ভেসে এল।

মানালি চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড ফোনটা দূরে রেখে দিল। খানিক পরে ফোনটা কানে দিল। ধ্রুব বাগচী প্রবল উৎসাহে তিন অক্ষর থেকে চারের ঘরে ঢুকে পড়েছেন সসম্মানে।

একটু ধরার পরে মানালি ফোনটা কেটে দিল।

ধ্রুব বাগচীর পেছনে সময় নষ্ট করার থেকে ল্যাপটপে তাস খেলা ভালো।

লাঞ্চ ব্রেকে দীপ অফিস ক্যান্টিনে খাবার অর্ডার করে মোবাইলে বাজারের হাল দেখছিল।

রাম তার কাঁধে একটা টোকা দিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসে বলল, “কী বে, তোর হল কী?”

দীপ অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

রাম বলল, “তুই আজ আমার পরে অফিস এসেছিস। ইনফ্যাক্ট সবার পরে। এবং এটা তোর অফিস লাইফে ফার্স্ট হল।”

দীপ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল, “হতে পারে। এতে অবাক হবার কিছু নেই। লেট তো হইনি।”

রাম বলল, “সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তুই তো প্রতিদিনই বিফোর টাইমে ঢুকে যাস।”

দীপ হাসল, “এভ্রিথিং চেঞ্জেস মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। আমি তো তুচ্ছ।”

রাম বলল, “সে তো দেখতেই পাচ্ছি। বিয়ে করার প্ল্যান করছিস নাকি?”

দীপ বলল, “তোর আর কোনও কাজ নেই? র্যাপিড ফায়ার শুরু করেছিস কেন? ওপিয়ামের বিলটা হিসেব করেছিস?”

রাম বলল, “ওটা আমি দিয়ে দেব। আজ তুই খাইয়ে দিস।”

দীপ বলল, “আজ খাব না। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।”

রাম বলল, “কোথায় যাবি?”

দীপ বলল, “কাজ আছে। রাধিকার মানভঞ্জন বোঝো মামা?”

রাম চোখ কপালে তুলে বলল, “রাধিকা? মানে তুই সিরিয়াসলি প্রেম করছিস?”

দীপ বলল, “ক্যাজুয়ালি তো আমি কোনও কাজই করি না। প্রেমটা কীভাবে করব তবে?”

রাম কপালে হাত দিয়ে বলল, “হয়ে গেল। আর-একজন শহিদ হল।”

দীপ বলল, “তোকে আর-একটা ফ্যাক্ট বলি। কাল রাত দেড়টা অবধি আমি ফোনে কথা বলেছি।”

রাম কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে দীপের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “খাটিয়া অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। আর কোনও আশা নেই। তেরা রাম নাম সত্য হো গয়া ভাই।”

দীপের খাবার এসে গেছিল। দীপ কাঁটা চামচ দিয়ে চাউ ম্যানেজ করতে করতে বলল, “সেটা ঠিকই বলেছিস। রাত দেড়টা অবধি আমি স্কুল কলেজ লাইফেও জেগে থাকতাম না। ফোন রাখার পর দেখলাম ঘুমও আসছে না। শেষতক ঘুম আসতে আসতে তিনতে বেজে গেল।”

রাম মৃদু স্বরে বলল, “তিনটে না, তোর বারোটা বেজে গেছে। মেয়ে কী করে?”

দীপ বলল, “আগে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ করত না, এখন করে।”

রাম বলল, “আহ, সেটা বলছি না। কী করে মানে, জব করে?”

দীপ বলল, “না, স্টিল স্টাডিয়িং।”

রাম বলল, “ভালোই তো। প্রবলেম কোথায়?”

দীপ বলল, “কোনও প্রবলেম নেই। শুধু রাত দুটো অবধি রোজ কথা বলতে হলে কী হবে সেটা নিয়ে আমি একটু চিন্তিত।”

রাম বলল, “অতক্ষণ কী কথা বললি?”

দীপ চাউ চিবোতে চিবোতে বলল, “তাকে আমি কী দেখে পছন্দ করলাম।”

রাম বলল, “এ কি আমাদের কোম্পানির এইচ আর নাকি বে? এই কোম্পানিতে কেন জয়েন করতে চাও জিজ্ঞেস করে! তুই কী বললি?”

দীপ বলল, “ভাট বকে গেলাম। আর কী বলার আছে? অ্যাকচুয়ালি একটা জিনিস বুঝলাম। সব রিলেশনশিপেই পাবলিক খুব ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। সেজন্যই ফোনে সব সময় অন্যজনকে ধরে রাখতে চায়। ভাবে এই বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল।”

রাম বলল, “এর মধ্যে ইনসিকিউরিটিও চলে এল? তোর সঙ্গে তো ফ্রাইডে মাল খেলাম। এই দুদিনে স্টোরি এতটা এগিয়ে গেল বলছিস?”

দীপ হাসল, “আমিও তো তাই দেখছি। বেসিক্যালি আই অ্যাম স্টিল কনফিউজড। প্রেমটা অ্যাসেট না লায়াবিলিটি! শুরুতে সব কিছু খুব ইন্টেলেকচুয়াল মেটিরিয়াল মনে হয়, ব্যাপারটা একটু এগোলেই বোঝা যায়, ছোটো ছোটো ন্যাকামিগুলো জুড়তে জুড়তে ব্যাপারটা আসলে একটা বড়োসড়ো ক্যাচাল ছাড়া আর কিছুই না।”

রাম মুখ বাঁকাল, “তোর কাছে লায়াবিলিটিই হবে। এখন থেকেই যা বিরক্তি দেখাচ্ছিস, বোঝাই যাচ্ছে এ জিনিসের বেশিদিন ভ্যালিডিটি নেই।”

দীপ বলল, “আই অ্যাম কনফিউজড। রিয়েলি। এসব আসলে বোঝা। তুই চিন্তা না করতে চাইলেও এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে, লটস অফ ইমোশনস আর ইনভলভড। সব মিলিয়ে…”

রাম বলল, “সব মিলিয়ে?”

দীপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এই সময় সমীর স্যার ক্যান্টিনে ঢুকে দীপকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম। কাল ভুবনেশ্বর যেতে হবে গাঙ্গুলি। এস টি ইনফোটেকে। একটা আর্জেন্ট কল আছে। কোনও প্রবলেম আছে নাকি? যেতে পারবে তো?”

দীপ বলল, “ওকে স্যার। চলে যাব।”

সমীর বললেন, “কাল ভোরের ফ্লাইটের টিকিট কাটতে বলে দিচ্ছি তবে। সন্ধেয় যাতে ফিরে আসতে পারো দেখছি। নইলে পরশু চলে আসবে।”

দীপ বলল, “ওকে স্যার।”

সমীর যেতে রাম বলল, “শালা! এর মধ্যে ট্যুর দিয়ে দিল!”

দীপ বলল, “ভালোই তো। সব সময় কলকাতা পোষায় তোর?”

রাম বলল, “দেখ কী করবি! তোর লায়াবিলিটিকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিস তো যাবি নাকি।”

দীপ কাঁধ ঝাঁকাল “অফিসের ব্যাপারে কেন জিজ্ঞেস করতে যাব।”

রাম বলল, “ওরম মনে হয়। দুদিন পরে সব ব্যাপারেই এক্সপ্ল্যানেশন চাইবে। তখন বুঝবি।”

দীপ বলল, “বাল। অত কে বলতে যাবে।”

দীপের ফোন বাজছিল।

রাম বলল, “সে?”

দীপ দেখল চিত্রলেখা ফোন করছে। তার চাউটা পোষাচ্ছিল না। খানিকটা বাকি ছিল তখনও। উঠে বেসিনে মুখ ধুয়ে এসে চিত্রলেখাকে কল ব্যাক করল। রিংও হতে পারল না, তার আগেই চিত্রলেখা ধরে বলল, “লাঞ্চ হল?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

রাম হতাশ মুখ করে উঠে খাবার অর্ডার করতে গেল।

চিত্রলেখা বলল, “কী খেলে?”

দীপ বলল, “টেস্টলেস চাউ।”

চিত্রলেখা বলল, “তুমি বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যাও না?”

দীপ বলল, “নাহ। দুপুরে অফিসের ভরসাতেই চলে যায়।”

চিত্রলেখা বলল, “আমি ডিস্টার্ব করছি না তো?”

দীপ বলল, “না না ঠিক আছে।”

চিত্রলেখা বলল, “বলছিলাম আজ সন্ধের মিটটা কাল করা যেতে পারে? আজ একটা প্রবলেম হচ্ছে।”

দীপ বলল, “কাল আমি কলকাতায় থাকছি না।”

চিত্রলেখা অবাক গলায় বলল, “কোথায় যাচ্ছ?”

দীপ বলল, “ভুবনেশ্বর। অফিসের কাজে।”

চিত্রলেখা বলল, “ওহ। তাহলে ঠিক আছে। এসে দেখা হবে তবে।”

ফোনটা কেটে গেল।

দীপ অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকল।

রাম এসে বসেছে তার সামনে। বলল, “কী রে? কী হল?”

দীপ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ফুল মারা গেল।”

রাম বলল, “কার?”

দীপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার। আর কার?”

১০

মানালি অফিসে ঢুকে ডেস্কে বসেই পেপারওয়েট চাপা চিরকুটটা দেখতে পেল।

“চেম্বারে আয় আগে।”

বিশ্বরূপদার হাতের লেখা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বিশ্বরূপদার চেম্বারে নক করল।

“আসব?”

“আয়।” বিশ্বরূপদা গম্ভীর হয়ে কিছু একটা লেখালেখি করছিল।

মানালি বলল, “কী ব্যাপার? জরুরি তলব?”

বিশ্বরূপদা চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকাল, “তুই কি গান্ডু?”

মানালি আকাশ থেকে পড়ল, “কেন? কী হল? সকাল সকাল গালাগাল করছ কেন?”

বিশ্বরূপদা বলল, “পুজো করব?”

মানালি বলল, “কী হয়েছে সেটা তো বলো!”

বিশ্বরূপদা বলল, “তোকে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং করতে বললাম আর তুই ধ্রুব বাগচীকেই ডাইরেক্ট জিজ্ঞেস করে বসলি ওঁর বউয়ের ব্যাপারে?”

মানালির মনে পড়ল। সে বলল, “আমি ভুলেই গেছিলাম। কাল রাতে ধ্রুব বাগচীকে ফোন করে ফেলেছিলাম ওঁর সিনেমা দুটো দেখে। মনে হল জিজ্ঞেস করে ফেলি, কিছু বলে নাকি! তোমায় কখন বলল?”

বিশ্বরূপদা বলল, “কাল রাতেই।”

মানালি বলল, “ওহ।”

বিশ্বরূপদা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ভেবেছিলাম তোর হেড অফিসে কিছু গ্রে ম্যাটারস আছে। দেখছি ব্যাপারটা ফুল ব্ল্যাক হোল।”

মানালি বলল, “এই শোনো, তোমার এভাবে রিঅ্যাক্ট করার কিচ্ছু হয়নি। তুমি আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছ। আমার মনে হয়েছিল ধ্রুব বাগচীকেই জিজ্ঞেস করে যদি কোনও শর্টকাট ওয়ে পাওয়া যায়, সিম্পল!”

বিশ্বরূপদা বলল, “ঝাড় তো খেয়ে গেলি, এবারে কী করবি?”

মানালি ঠোঁট কামড়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, “আবার অ্যাপ্রোচ করা যায়।”

বিশ্বরূপদা বলল, “বোঝা যাচ্ছে চাকরিটা তোর না করলেও হয়, তাই না?”

মানালি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আমার কথা শুনে কি তোমার তাই মনে হচ্ছে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “তোকে আর কত শেখাতে হবে বল তো মানালি? তোকে আমি একটা ক্লু দিলাম। তুই সেই ক্লুটা নিয়ে একটু ভাবলি না, তোর একবারও মনে হল না ধ্রুবর যেসব বন্ধু বা কাছের মানুষ আছে, তাদের মধ্যে সেফ কাউকে টার্গেট করে কিছু জানার চেষ্টা করার কথা, তুই শুরুতেই ওকে ফোন করে দিলি, মানে হচ্ছেটা কী? এভাবে করবি তুই তোর ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং?”

মানালি বুঝল বিশ্বরূপদা ভীষণ রেগে আছে। বলল, “ঠিক আছে আমি দেখছি কী করতে পারি। দয়া করে এত রেগো না। এমনিতেই বাড়িতে একটা থমথমে আবহাওয়ার মধ্যে থাকতে হয়, এরপরে যদি অফিসে তুমিও এত রেগে রেগে থাকো, তাহলে আমায় সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে হিমালয়ে চলে যেতে হবে।”

বিশ্বরূপদা কয়েক সেকেন্ড গজগজ করে বলল, “ধ্রুবকে ফোন করে সরি বলে দে।”

মানালি অবাক হল, “কেন?”

বিশ্বরূপদা বলল, “কেন বোঝো না? ছাত্রবন্ধু দিতে হবে? নাকি ডিকশনারি! মানে বুঝতে কোনটা চাই তোর?”

মানালি বলল, “ওকে ওকে। আবার রেগে যাচ্ছ। ঠিক আছে, আমি ডেস্কে গিয়ে এখনই ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”

বিশ্বরূপদা বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “নাও লিভ।”

মানালি বিশ্বরূপদাকে আর ঘাঁটাল না। চুপচাপ নিজের ডেস্কে এসে বসে হাঁফ ছাড়ল।

বিতস্তা এসেছে। তাকে দেখে বলল, “কী হল, সকাল সকাল অ্যাসাইনমেন্ট পেলি নাকি?”

মানালি বিতস্তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “একটা ফোন করে নি দাঁড়া।”

ডেস্কের ফোন থেকে সে ধ্রুব বাগচীর মোবাইলে ফোন করল। দুবার পুরো রিং হয়ে গেল। কেউ ফোন তুলল না।

বিতস্তা বলল, “কাকে ফোন করছিস?”

মানালি বলল, “আর কে! এক শনি জুটেছে মাথায়। লাইফ হেল হয়ে গেল।”

বিতস্তা অবাক গলায় বলল, “ধ্রুব বাগচী! আবার? কেন!”

মানালি বলল, “আর কেন! দাঁড়া লাস্ট ট্রাই করে নি।”

তৃতীয়বার রিং হবার পর ঘুমচোখে ধ্রুব ফোন ধরলেন, “হ্যালো, কে বে ভোরবেলা ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে?”

মানালি বলল, “স্যার আমি। সময়ের কণ্ঠস্বর থেকে বলছি। আপনাকে সরি বলার জন্য ফোন করেছি।”

 ধ্রুব একটু চুপ করে গেলেন। সম্ভবত মনে করার চেষ্টা করলেন কী হয়েছে। কয়েক সেকেন্ড পর বললেন, “এই এক নতুন চুতিয়াপা শুরু হয়েছে। সরি বলে দিলেই যেন সাতখুন মাফ।”

মানালি বলল, “স্যার আমি সত্যি সরি।”

ধ্রুব বলল, “আপনি কেন সরি? এক্সপ্লেইন।”

মানালি দেখল বিতস্তা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে একটু ভেবে বলল, “স্যার আপনাকে মাঝরাতে ফোন করে বিরক্ত করার জন্য।”

ধ্রুব বলল, “না। আপনাদের এটাই সমস্যা বুঝেছেন? ঠিক কোন জায়গাটায় অপরাধ করেছেন সেটাই বুঝতে পারেন না। আপনাদের মতো পাবলিকের জন্যই রিমেকের এত রমরমা বাজার। আসল ট্যালেন্টগুলো ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

মানালি অবাক হয়ে বলল, “এর মধ্যে রিমেক এল কোত্থেকে স্যার? তা ছাড়া আমি বাংলা সিনেমা দেখিও না খুব বেশি।”

ধ্রুব ফুঁসে উঠলেন, “খুব গর্ব হয় বলুন? আমি বাংলা সিনেমা দেখি না বলতে?”

মানালি একটু আক্রমণাত্মক হল, “গর্বের কী আছে স্যার? একটা সিনেমায় দেখলাম তামিলনাড়ুতে যেরকম বাড়ি সে সিনেমার সেটটাও সেরকম হয়েছে। এরকম বাড়ি বাংলায় কোথায় আছে?”

ধ্রুব বললেন, “তবু তো লোকে টিকিট কেটে দেখতে যাচ্ছে? কেন?”

মানালি বলল, “কারণ মানুষকে সেটাই খাওয়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। একটা শ্রেণির লোক সেটাই খেতে চাইছে তাই।”

ধ্রুব বললেন, “কারণ এই ইন্ডাস্ট্রি দেউলিয়া ঘোষণা করে দিয়েছে নিজেদেরকে। যেভাবে কোনও কোম্পানি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে, সেভাবেই ঘোষণা করে দিয়েছে। বাংলায় কথা বললে এখন ব্যাকডেটেড, বাংলা সিনেমা দেখা আউটডেটেড, বাংলা সিনেমার গল্প বলে তামিলের লোক, নাচ শেখায় অন্ধ্রের লোক, ক্যারাটে শেখায় মহারাষ্ট্রের লোক, বাঙালির নিজস্বতা বলেই কিছু নেই আর। যাক গে, ঘুম থেকে উঠে দাঁত না মেজে এসব ভাট বকতে ভালো লাগছে না। আসল কথায় আসি, শুনুন, প্রাইভেসি শব্দটা মিডিয়া ডিকশনারিতে কোনও কালেই ছিল না। পারলে তারা ইন্ডিয়া টিমের ক্যাপ্টেন কোন ব্র্যান্ডের কন্ডোম ইউজ করে সেটাও ব্রেকিং নিউজ করিয়ে দেয়, কিন্তু বস, একটা কথা বুঝে নিন। আমার প্রাইভেট লাইফ সম্পর্কে আমাকে ঝাঁকিয়ে লাভ নেই। আমি এ সম্পর্কে একটা শব্দও বলব না।”

মানালি বলল, “ওকে স্যার, আমি আপনাকে আর ডিস্টার্ব করব না।”

ধ্রুব বাগচী ফোনটা কেটে দিলেন।

মানালি সশব্দে ফোনটা রেখে বিড়বিড় করে বলল, “অসভ্য আনকালচারড লোক একটা।”

বিতস্তা বলল, “ঠিক আছে সব?”

মানালি বলল, “হুঁ।”

ইন্টারকমের ফোনে বিশ্বরূপদাকে ফোন করল সে, বিশ্বরূপদা ধরতে বলল, “বলে দিয়েছি সরি।”

বিশ্বরূপদা কেজো গলায় বলল, “ওকে।”

মানালি বলল, “তবে কি এই অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে আপাতত আর না এগোলেও হবে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “কোন অ্যাসাইনমেন্ট?”

মানালি বলল, “ধ্রুব বাগচীর বউ খোঁজার অ্যাসাইনমেন্ট! আর কী?”

“সাত দিনের মধ্যে স্টোরি করে ফেল। বেশি সময় নেই।”

বলেই ফোনটা কেটে দিল বিশ্বরূপদা।

বিতস্তা বলল, “মিটল?”

মানালি বলল, “এত সহজে মেটে? চাকরি করা যাবে না মনে হচ্ছে আর! ফাউ লোকের চাট খাবার কোনও ইচ্ছা নেই আমার। নিজেকে বিরাট কিছু ভেবে ফেলেছে। ওই তো সিনেমা, গোটা হলে দশটা লোক। তার মধ্যে হল স্টাফ থাকে পাঁচটা।”

বিতস্তা বলল, “অ্যাই! আমি কি একটু ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোটা জানতে পারি? সব কিছু কেমন হেঁয়ালি হেঁয়ালি মনে হচ্ছে।”

মানালি সংক্ষেপে সবটা বলে বলল, “শ্রীপর্ণা ঘোষালের সঙ্গে ধ্রুব বাগচীর রিলেশন কেমন জানিস?”

বিতস্তা বলল, “আমি কী করে জানব বল তো?”

মানালি বলল, “আমি কী জানি তুই কী করে জানবি? আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সাতদিনে কীভাবে সব কিছু আমি সামলাব বুঝতে পারছি না।”

মানালির গলাটা না চাইতেও কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।

বিতস্তা বলল, “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ধ্রুব বাগচীর এক্স কী এমন হাতি ঘোড়া যে বিশ্বরূপদা এমন ডেসপারেট হয়ে গেল স্টোরিটার জন্য?”

মানালি হাঁ করে বিতস্তার দিকে তাকিয়ে রইল।

এই কথাটা সেভাবে তার মাথায় আগে আসেনি কেন?

১১

সন্ধে সাতটা নাগাদ ভুবনেশ্বরের হোটেলের ঘরে ফিরল দীপ। ইচ্ছা করলে রাতের ফ্লাইটে কলকাতা ফেরা যেত, কিন্তু সে নিজেই থেকে গেল। অনেক রাত হয়ে যেত বাড়ি ফিরতে ফিরতে।

হোটেলের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে টিভিটা চালিয়েছে, এমন সময় দেখল ফোনটা বাজছে। সে দেখল চিত্রলেখা ফোন করছে। ধরল, “হ্যাঁ বলো।”

“তোমার কি সারাদিনে একবারও আমার কথা মনে পড়ল না?” ওপাশের গলা থমথমে।

দীপ বলল, “প্রচুর বিজি ছিলাম তো। ক্লায়েন্ট মিট ছিল, দুপুরে ভালো করে খেতেও পারিনি।”

“ওহ। আচ্ছা। এখন খেয়েছ?”

“হ্যাঁ, বিকেলে খেলাম।”

“ওঃ, তার মানে বিকেলে ফ্রি হয়েছিলে?”

“হ্যাঁ। ওই একটু ফাঁক পেলাম, ওই সময়টাতেই খেয়ে নিলাম আর কি।”

“আচ্ছা।”

“তোমার কী খবর?”

“আমার? আমার ঠিকঠাক। ভাবছিলাম ফেসবুক আবার ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেব।”

“সে কী কেন? কী হয়েছে?”

“তেমন কিছুই না। ভালো লাগছে না। আচ্ছা তুমি আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে খুশি তো?”

দীপ কপালে হাত দিল। সেই একই প্রশ্ন। সে বলল, “অবশ্যই খুশি। কেন খুশি হব না বলতে পারো?”

চিত্রলেখা বলল, “না, আসলে একটা মেয়ে একটা ছেলের থেকে নিরাপত্তা চায়। আমার আজকাল মনে হয় তুমি বোধহয় একটু পজেসিভ হলে, আমাকে একটু সন্দেহ করলে আমি বেশি খুশি হতাম। আমার মনে হয় সব সময় তুমি আমাকে ছেড়ে ছেড়ে রাখছ, উপেক্ষা করছ।”

দীপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একটা পরিণত সম্পর্কে ছেড়ে রাখাটাই স্বাভাবিক নয় কি? তোমার তো নিজেরও একটা স্পেস দরকার আছে, তাই না? দ্যাখো, আমরা কেউ তো আর ছোটোবেলার মতো প্রেম করি না, আমাদের একটা লাইফ আছে, দুজনে নিজের নিজের লাইফটা ঠিকভাবে কাটাতে পারলেই বোধহয় বেশি খুশি হতাম। আমাদের শুরুটাও তো এরকম ভেবেই হয়েছিল। তুমি বিরক্ত ছিলে তোমার এক্সের ওপর, যে অত্যধিক পজেসিভ ছিল, তো এখন হঠাৎ কী হল তোমার?”

চিত্রলেখা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমি আজকাল খুব ইনসিকিউরিটিতে ভুগছি।”

দীপ একটু রাগল, “কীভাবে তোমাকে সিকিউরিটি দিতে পারি? ফিজিক্যাল রিলেশন চাও?”

চিত্রলেখা বলল, “ধ্যাত। ওভাবে সিকিউরিটি আসে নাকি?”

দীপ বলল, “কীভাবে আসে? সারাক্ষণ কানে ফোন গুঁজে রাখলে আসে?”

চিত্রলেখা বলল, “জানি না। আমার মনে হয় আমাদের ফ্রিকোয়েন্টলি মিট করা দরকার। এভাবে দূরে দূরে থাকলেই আমার নিরাপত্তাহীনতাটা তৈরি হয়।”

দীপ বলল, “বেশ তো, আমি কলকাতা গিয়েই তোমাকে মিট করব, তাহলে খুশি তো?”

চিত্রলেখা বলল, “কোথায় মিট করব?”

দীপ বলল, “তুমিই বলো।”

চিত্রলেখা বলল, “সেই তো রেস্তোরাঁতেই করতে হবে। আর কোথায় মিট করবে?”

দীপ বলল, “তবে কোথায় করতে চাও, তুমিই বলো?”

চিত্রলেখা বলল, “জানি না। তুমি বোলো কোথায় কীভাবে দেখা করতে হবে, আমি চলে যাব।”

দীপ বলল, “ভেবে বলি?”

চিত্রলেখা বলল, “আচ্ছা।”

দীপ ফোন রেখে অন্যমনস্ক ভাবে খানিকক্ষণ টিভি দেখল। হোটেলটা বেশ ভালো। সংলগ্ন বারও আছে। সে রুম সার্ভিসে ফোন করে একটা হুইস্কি আনিয়ে নিল। একা একা বসে থাকলে ইদানীং তার মদ খেতে ইচ্ছা করে। সোডা মিশিয়ে এক চুমুক সবে দিয়েছে, এই সময়ে আবার সশব্দে ফোনটা বেজে উঠল। দীপ দেখল চিত্রলেখা আবার ফোন করছে, কয়েক সেকেন্ড ফোনের দিকে তাকিয়ে ফোনটা ধরল, “বলো।”

“তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। যতক্ষণ না বলছি, আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।” চিত্রলেখা যেন খানিকটা হাঁফাচ্ছিল।

দীপ অবাক গলায় বলল, “কী কথা? খুব জরুরি কিছু?”

চিত্রলেখা বলল, “আমার মনের মধ্যে বারবার এই কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু বলব বলব করেও বলা হয়ে উঠছে না।”

দীপ বলল, “বলো।”

চিত্রলেখা একটু থেমে বলল, “আমার যে এক্স ছিল, একটা সময় খুব খেপে উঠেছিল।”

দীপ বলল, “কী নিয়ে?”

চিত্রলেখা বলল, “ফিজিক্যাল রিলেশন নিয়ে।”

দীপ বাধা দিল, “এই ব্যাপারটা নিয়ে বোধহয় ডিসকাস না করলেই ভালো হয়। ইনফ্যাক্ট এসব আমাকে না বললেও চলবে।”

“না, প্লিজ শোনো। বলতে দাও। আসলে আমাদের মধ্যে একটা সময় এমন হয়ে গেছিল, কথা হলেই শুধু আমাকে কৈফিয়ত দিয়ে যেতে হত। এখানে গেছি কেন, এর সঙ্গে কথা বলেছি কেন, কেন বাজারে একা একা গেছি… মানে আমি পাগল হয়ে যেতাম।”

দীপ বলল, “হ্যাঁ, এই কথাটা তো তুমি আমাকে বলেছ।”

চিত্রলেখা বলল, “বলেছি। আরও কিছু বলিনি।”

দীপ বলল, “সেগুলো এখনই ফোনে বলতে হবে?”

চিত্রলেখা বলল, “হ্যাঁ, ফোনেই বলতে হবে। শুনে যাও শুধু। ওকে এই কৈফিয়ত দিয়ে যাচ্ছি, রোজ রোজ কিছু না কিছু নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়ে যায়, ঠিক এমন পরিস্থিতিতে একদিন আমাকে বলে বসল ওর কোন বন্ধুর ফ্ল্যাট ফাঁকা, আমাকে নিয়ে যেতে চায়।”

দীপ উত্তর দিল না। চিত্রলেখা বলল, “হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ, বলো।”

চিত্রলেখা বলল, “ওর ধারণা হয়েছিল ফিজিক্যাল রিলেশন একবার হয়ে গেলে আমি ওকে আর ছাড়তে পারব না। আমি কিছুতেই রাজি হইনি ওর প্রস্তাবে, যার ফলে ও আমার উপর ভীষণ রেগে গেল। যত রকম অসভ্যতা সম্ভব হয়, সব করতে লাগল।”

দীপ বলল, “এটুকুই বলতে?”

চিত্রলেখা বলল, “হ্যাঁ। তোমার মনে হতেই পারে আদৌ আমি ভার্জিন কি না, সেটা আমি তোমায় ক্লিয়ার করে দিলাম।”

দীপ বলল, “দ্যাখো, আমি তোমাকে বারবার বলেছি তোমার পাস্ট নিয়ে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই, তবু তুমি অনেক কিছু আমায় বলে যাচ্ছ। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা ভয় পাচ্ছ, ঠিক কী ব্যাপারে সেটা পাচ্ছ আমাকে কি একটু খোলসা করে বলা যায়?”

চিত্রলেখা একটু ইতস্তত করে বলল, “ছেলেটা একটু একরোখা। ভাংচি দেওয়া স্বভাব আছে। কিছুদিন আগে আমার একটা সম্বন্ধ এসেছিল, কোত্থেকে জেনেশুনে ওদের বাড়িতে ফোন করে আমার নামে যা নয় তাই বলেছে। স্বাভাবিকভাবেই বিয়েটা ভেঙে যায়। আমার ভয় হচ্ছে তোমায় যদি আবার ফোন করে…”

দীপ বলল, “বেশ তো, তুমি আমাকে ছেলেটার ফোন নাম্বার দাও, আমি এখন থেকেই ছেলেটার নাম্বার ব্লক করে রেখে দিচ্ছি।”

চিত্রলেখা বলল, “ব্লক করে দেবে?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ, ও আমাকে ফোনে পাবেই না। ফোন একবার জাস্ট রিং হয়ে অটোমেটিক ডিসকানেক্ট হয়ে বিজি টোন শুনিয়ে দেবে। দাও নাম্বারটা।”

চিত্রলেখা বলল, “সেটা দিচ্ছি, কিন্তু যদি অন্য নাম্বার থেকে ফোন করে?”

দীপ বলল, “ফোন কেটে দেব। এত চিন্তা করার তো কিছু নেই।”

চিত্রলেখা বলল, “আমি ওর দুটো নাম্বারই হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাচ্ছি। তাহলে তাই করো।”

দীপ ফোনটা রাখল। একা একা বসে মদ খেতে লাগল।

চিত্রলেখা নাম্বার দুটো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে। দীপ কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে কোনও কিছু না ভেবেই একটা নাম্বারে ফোন করে দিল। কয়েকটা রিং হতেই ওপাশ থেকে একজন বলে উঠল, “হ্যালো।”

দীপ বলল, “কে বলছেন?”

“আপনিই তো ফোন করলেন? জানেন না কে বলছি?”

দীপ বলল, “আপনি চিত্রলেখার এক্স?”

ওপাশে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধতা। তারপর খানিকটা সতর্ক গলা, “আপনি কে?”

দীপ বলল, “আমি ওর বন্ধু।”

“বন্ধু? ওর ছেলে বন্ধু কোনও কালেই ছিল না। ইদানীং উন্নতি হয়েছে দেখছি।”

দীপ বলল, “তা হয়েছে। কয়েক দিন পরে তো চিত্রলেখার বিয়ে। জানেন তো?”

“বিয়ে? ওহ, ওর আবার বিয়ে হয়েছে? তা যা হবার হোক, আমার যা করার আমি তো করে নিয়েছি।”

“কী করেছেন?” দীপের মাথায় একটু একটু করে আগুন জ্বলছিল।

“যা করে। একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে একসঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে থাকলে যা করে। আপনি তো ওর বন্ধু, আপনাকে বলেনি কিছু ওকে কতটা আনন্দ দিয়েছি?”

দীপ আর নিতে পারল না। ফোনটা কেটে দিল।

১২

টালিগঞ্জ মেট্রোতে নেমে মানালির খেয়াল হল লাঞ্চ করা হয়নি। রাস্তা পেরিয়ে রেস্তোরাঁয় বসে রুটি পনির খাচ্ছিল। ঋপণ মাটন দিয়ে পরোটা খেতে খেতে বলল, “কী করে পারিস তুই জানিস।”

মানালি বলল, “কী পারি?”

ঋপণ বলল, “এই যে মাটন চিকেন ছেড়ে পনির খাচ্ছিস। এককালে মুনি ঋষিরা যে লেভেলের কন্ট্রোল করতেন, তোর মধ্যে তার ছায়া দেখতে পাচ্ছি।”

মানালি খেতে খেতে বলল, “দয়া করে মনে করিয়ে দিস না। বহু কষ্টে কন্ট্রোল করছি।”

ঋপণ বলল, “শ্রীপর্ণা ঘোষালের ইন্টারভিউ আগে করেছিস?”

মানালি মাথা নাড়ল, “না। খুব মুডি ভদ্রমহিলা শুনেছি। হুটহাট বসের কাছে কমপ্লেইন করে দেন জার্নালিস্টদের নামে।”

ঋপণ বলল, “যৌবনোত্তীর্ণা নায়িকাদের সবার একই অবস্থা। এককালে লোকজন পাগলের মতো পিছনে দৌড়োত, এখন পাত্তাও দেয় না। কিছুদিন আগে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় দেখা। কেউ চেনে না। নিজেই অকারণ চ্যাঁচামেচি করে লোক ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন। তাতেও কেউ দ্যাখে না। মুড অফ করে বেরিয়ে গেলেন। বুঝতেই পারছিস তুই ওঁর কাছে ধ্রুব বাগচীকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাচ্ছিস, ব্যাপারটা বুঝতে পারলে তোর খবর আছে।”

মানালি স্যালাডের প্লেট থেকে শসা নিয়ে মুখে দিয়ে বলল, “বুঝতে পারছি। এও বুঝতে পারছি এই চাকরিটা খুব শিগগিরি ভোগে যাবে। কিন্তু কী আর করা, চেষ্টাটা করে যাই।”

ঋপণ বলল, “চাকরি গেলে কী করবি?”

মানালি বলল, “এন আর আই ধরব। আমেরিকায় গিয়ে গুলাবজামুন বানিয়ে তোকে ফেসবুকে ট্যাগ করে দেব। হবে না?”

ঋপণ হাসতে হাসতে বলল, “তুই পারবি না। আমি শিওর তুই পারবি না।”

মানালি বলল, “আমিও শিওর আমি পারব না। কিন্তু ভালো ইংরেজি বলতে পারি, স্মার্ট, আমার মার ওপর আমার পূর্ণ ভরসা আছে। নিশ্চয়ই একটা এন আর আই ধরতে পারবে।”

ঋপণ বলল, “এন আর আই নিয়ে পড়লি কেন হঠাৎ?”

মানালি বলল, “শুধু এন আর আই কেন? বিয়েতেই আমার আপত্তি আছে। আমি কি কোনও বোঝা নাকি বল তো? কোনও ভাবে পার করে দিতে পারলেই হল? কেন, আমি যদি নিজের পায়ে দাঁড়াই সিঙ্গল থেকে, সমস্যাটা কোথায়?”

ঋপণ চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “ওরে বাবা, আবার সেই সব কঠিন কঠিন ব্যাপার। আমি ভাই গরিব ফটোগ্রাফার, আমার এসব বুঝে কাজ নেই।”

মানালির খাওয়া হয়ে গেছিল। উঠে মুখ ধুয়ে ঋপণকে বলল, “খেয়ে চলে আয়। আমি বাইরে ওয়েট করছি।”

ঋপণ বলল, “আমারও হয়ে এসেছে। আসছি আসছি। যাবি কীসে স্টুডিও?”

মানালি হাসল, “হাঁটব। অনেকদিন হাঁটা হয় না।”

ঋপণ বলল, “অনেকটা কিন্তু। পরে পালটি খেলে চলবে না।”

মানালি বলল, “অনেকটা আমি জানি তো। নো চাপ।”

দুজনে যখন স্টুডিও পৌঁছোল, তখন তিনটে বাজে। মানালির আগে থেকে ফোন করা ছিল। মেকআপ রুম থেকে বেরিয়ে শ্রীপর্ণা খানিকটা আলাদা হয়ে তাদের নিয়ে বসলেন বাইরেই।

মানালি ভালো করে শ্রীপর্ণাকে দেখছিল। ধ্রুবর বয়সিই হবেন। তবে বয়সের ছাপ যেন আরও বেশি পড়ে গেছে ভদ্রমহিলার ওপরে। ইদানীং সিরিয়ালে মা মাসি পিসির রোল করেন।

শ্রীপর্ণা বললেন, “আমাকে ফোন করতে পারতে সকালে। বাড়িতেই দিব্যি হয়ে যেত।”

মানালি ভেবেই এসেছিল কী বলবে। সে অসহায়ের মতো মুখ করে বলল, “একটু আর্জেন্ট ব্যাপার ছিল ম্যাম। আমাদের শনিবারের সিনেমার পেজটার অ্যাসাইনমেন্টটা জাস্ট সকালেই ঠিক হয়েছে। কয়েকটা ব্যাপার একটু ক্ল্যাশ করে গেল।”

শ্রীপর্ণা বললেন, “ওহ, ঠিক আছে। শুরু করতে পারো। তুমি কি ফটো তুলবে?”

ঋপণের দিকে তাকালেন শ্রীপর্ণা।

মানালি বলল, “হ্যাঁ ম্যাডাম, ইন্টারভিউয়ের পরে। মানে আপনি যদি পারমিশন দেন।”

শ্রীপর্ণা খুশি হয়ে বললেন, “নো প্রবলেম। আচ্ছা, ইউ মে স্টার্ট ইওর ইন্টারভিউ।”

মানালি নোটপ্যাড খুলল। সে শুরুটা সাধারণ প্রশ্ন দিয়েই করল, “ম্যাম, আপনি শুনলাম ছোটো পর্দাকেই ঘর বানিয়ে ফেলছেন। বড়ো পর্দার ওপর কি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলছেন?” মানালি খুব ভালো করেই জানত ব্যাপারটা আসলে উলটো।

শ্রীপর্ণা প্রশ্নটা লুফে নিয়ে বললেন, “একেবারেই তাই। এখন ছোটো পর্দা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।”

মানালি মনে মনে বলল, কোথায় চ্যালেঞ্জিং! এখানে মা মাসির রোল করছিলেন, সিনেমাতেও তো তাই করতেন! সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আপনার লাস্ট বড়ো পর্দায় অভিনয় ধ্রুব বাগচীর ডার্ক লাভ। ক্রিটিক থেকে দর্শক, সিনেমাটা খুব একটা কেউই ঠিকঠাক নিতে পারেননি। আপনার কি মনে হয় সিনেমাটা করা আপনার একটা ভুল ছিল?”

শ্রীপর্ণা একজন স্পটবয়কে ডেকে জলের বোতল আনালেন। এক ঢোক জল খেয়ে বললেন, “দ্যাখো, ধ্রুবর সিনেমাটা কিন্তু বেশ কয়েকটা ফেস্টিভ্যালে বেশ ভালো রেসপন্স পেয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে বলা ভুল যে সিনেমাটা করা ভুল ছিল। ধ্রুবর সঙ্গে সিনেমা করলে বেশ কিছু নতুন নতুন জিনিস শেখা যায়।”

মানালি সন্তর্পণে বাতাসে ভাসিয়ে দিল পরবর্তী প্রশ্ন, “ম্যাম, একটা গুজব প্রায়ই ভাসে, আপনার সঙ্গে ধ্রুব…”

শ্রীপর্ণা রাগলেন না, বললেন, “আমি প্রিপেয়ারড ছিলাম এই বাউন্সারটার জন্য। কিন্তু আমি এটাকে ডাক করাটাই প্রেফার করব। নো পার্সোনাল কোয়েশ্চেন প্লিজ।”

মানালি বুঝতে পারছিল সে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল, “শিওর ম্যাম। বুঝতেই পারেন কৌতূহল আটকে রাখা খুব কঠিন ব্যাপার।”

শ্রীপর্ণা বললেন, “তোমাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে ইয়ং ছেলেমেয়েদের মিল হল, তোমরা একটা ছেলে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বললে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারো না আদতে তারা বন্ধু হলেও হতে পারো। একেবারে গুজবটাকে বেডরুম পর্যন্ত না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তোমরা শান্তি পাও না। শোনো মেয়ে, ধ্রুব আর আমাদের ফ্যামিলি অনেক দিন ধরে ক্লোজ ফ্রেন্ড। আমরা একে অপরের ফেলিওরে পরস্পরকে সান্ত্বনা দি। সাকসেস সেলিব্রেট করি। আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়ির কমপ্লেক্সে ধ্রুবও একটা ফ্ল্যাট কিনবে ঠিক করেছিল। পরে পিছিয়ে আসে। ধ্রুবর ধারণা ছিল ডার্ক লাভ হিট করে যাবে। সিনেমাটা যে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়বে, সেটা ধ্রুব কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ওই সময়টা ও ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। দিন রাত ড্রিংক করে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। আমি ওকে সাপোর্ট দিয়েছি। এতে তোমরা যদি কিছু খুঁজে পাও তো ভালোই, আমার আর কিছু বলার নেই।”

মানালি এবার তার আসল প্রশ্নটা করে ফেলল, “ধ্রুববাবুর স্ত্রী সে সময়টা ওঁর পাশে ছিলেন না?”

শ্রীপর্ণা কয়েক সেকেন্ড মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “ধ্রুবর স্ত্রীর ব্যাপারে তুমি কী করে জানলে?”

মানালি সত্যিটা বলে দিল, “আমার মনে হয় অনেকেই জানেন ম্যাম, ইনফ্যাক্ট ওঁর ব্যাপারে আমার বসই বলেছেন।”

শ্রীপর্ণা মাথা নাড়লেন, “আমার মনে হয় না আমার ইন্টারভিউর সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক আছে। তোমার আর কিছু প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।”

মানালি মরিয়া হল, “সম্পর্ক আছে ম্যাম, মার্কেটে অনেক গসিপ রটেছিল আপনাদের ব্যাপারে। আপনি বলতেই পারেন ব্যাপারটার সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু আপনার ফ্যামিলিতেও কি কোনও দিন ধ্রুবকে নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি?”

শ্রীপর্ণা তীক্ষ্ণ চোখে মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা ইন্টারভিউ এত পার্সোনাল জায়গায় যাচ্ছে কেন? সময়ের কণ্ঠস্বরের কি এত খারাপ অবস্থা যে শেষতক লোকের কেচ্ছা খুঁড়ে বের করতে হচ্ছে?”

মানালি দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম। স্বাভাবিক কৌতূহল এগুলো বুঝতেই পারছেন।”

শ্রীপর্ণা বললেন, “শোনো মেয়ে, খুব ভালোভাবে শুনে নাও। আমার ফ্যামিলি আছে, আমার হাজব্যান্ড আছেন, আমার একটা ক্লাস থ্রিতে পড়া মেয়ে আছে। আমি এঁদের ছাড়ার কথা কোনও দিনই ভাবতে পারব না। সুতরাং ধ্রুব বাগচী আর আমাকে নিয়ে যা যা গুজব শুনেছ তার গোটাটাই কল্পনার বালির বাঁধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা।”

মানালি অন্ধকারে ঢিল ছুড়ল, “অনেকের ধারণা যে ধ্রুব বাগচীর ডিভোর্সের জন্য আপনি অনেকাংশে দায়ী।”

শ্রীপর্ণা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “কার ধারণা? এক-এক করে নাম বলো।”

মানালি ঠোঁট কামড়ে বলল, “সেটা তো সিক্রেট ম্যাম। আমি সোর্স ডিসক্লোজ করতে পারব না।”

শ্রীপর্ণা রাগি গলায় বললেন, “আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার কাজ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করতে এসেছেন। আপনার প্রশ্নগুলো খুব মিসলিডিং সেটা বুঝতে পারছেন তো? আশা করি আপনার নামে আপনার অফিসে আমি কোনও রকম কমপ্লেইন করি সেটা আপনি চাইবেন না।”

মানালি রেকর্ডার অফ করল, “একটা শেষ প্রশ্ন ম্যাম।”

শ্রীপর্ণা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, “বলো।”

মানালি বলল, “ধ্রুব বাগচীর বউয়ের বর্তমান ফোন নম্বরটা দেওয়া যাবে?”

শ্রীপর্ণা উঠলেন, “এলাম। শট রেডি হয়ে গেছে।”

মানালি মাথা নিচু করে বসে থাকল। সে স্পষ্টতই বুঝতে পারল সন্ধেয় আবার ঝাড় খেতে চলেছে সে।

শ্রীপর্ণা অনেকটা চলে গেছিলেন।

হেঁটে ফিরে এসে আবার মানালির সামনের চেয়ারে বসে বললেন, “ধ্রুব বাগচী লোকটাকে রিড করা অত সহজ নয়। যত পাঁকই ঘেঁটে ফ্যালো, কিছুই বের করতে পারবে না।”

মানালি বলল, “ওঁর স্ত্রীর খোঁজ করা কি পাঁক ঘাটার সমান বলতে চাইছেন ম্যাম?”

শ্রীপর্ণা কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ফোন নাম্বারটা নাও।”

১৩

টেক অফের সময় দীপ অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করে। প্রথমে কিছু হয় না। এয়ারহোস্টেসরা যখন বোঝায় আপতকালীন সময়ে কী করতে হবে, সেই সময়ে ধীরে ধীরে তার ভয় হতে শুরু করে।

দীপ জানলার ধারে বসেছে। মাঝে বছর পঞ্চাশের এক বাঙালি ভদ্রলোক বসেছেন। ভদ্রলোকের ভুঁড়িটা নজর কাড়ার মতো। অপর কোনায় ভদ্রলোকের স্ত্রী। দুজনের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে ওঁরা পুরী গেছিলেন পুজো দিতে। প্লেন রানওয়ে দিয়ে দৌড় শুরু করতে না করতেই দুজনে ফিসফিস করে “জয় জগন্নাথ” বলতে শুরু করলেন। প্লেনটা যখন আকাশ অভিমুখে যাত্রা শুরু করল, দীপ কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করল। তার হঠাৎ মনে হল, আজ মরে গেলে কি খুব কষ্ট হবে কারও? পরমুহূর্তে বাবা-মার মুখটা মনে পড়ে গেল। খানিকটা দুর্বল হল সে। মরে যাবার জন্য বয়সটা খুব অল্প এখনও। আরও কয়েকটা বছর বাঁচলে খারাপ হত না। টেক অফ ঠিকঠাক হবার পরে প্লেনে এয়ারহোস্টেসরা ফেরিওয়ালাগিরি শুরু করে দিল। পাশের ভদ্রলোক বললেন, “সকালে ভালো করে কিছু খাওয়া হল না, একখান স্যান্ডউইচ খাই? কী বলো?”

ভদ্রমহিলা চাপা গলায় বললেন, “পনেরোটা কচুরি খেয়েছ। ওটা যদি খাওয়া না হয় তবে কোনটা খাওয়া?”

ভদ্রলোক নিচু স্বরে প্রতিবাদ করলেন, “প্লেন মাঝ আকাশে থাকলে সব হজম হয়ে যায়, জানো না?”

ভদ্রমহিলা কটমট করে ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ধাইকিড়িকিড়ি, আরও কতক্ষণ বসতে হবে কে জানে!”

ভদ্রমহিলা বললেন, “তোমাকে না বলেছি অকারণে ধাইকিড়িকিড়ি বলবে না! আজব লোক একটা, যে জায়গায় যাবে, সেখানকার কিছু না কিছু একটা মুদ্রাদোষে পরিণত না করলে শান্তি নেই।”

ভদ্রলোক সুবিধে করতে না পেরে তার দিকে তাকালেন, “আপনি বাঙালি?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

ভদ্রলোক বললেন, “কলকাতায় বাড়ি?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

ভদ্রলোক বললেন, “গুড। বিয়ে করেছেন?”

দীপ বলল, “না।”

ভদ্রলোক বললেন, “ভেরি গুড। এক্কেবারে করবেন না। ভয়ংকর ব্যাপার। আপনি কি পুরী গেছিলেন?”

দীপ বলল, “না, ভুবনেশ্বর, অফিসের কাজে।”

ভদ্রলোক বললেন, “ওহ। তা ঠিক। একা একা পুরী গিয়ে করবেনই বা কী?”

দীপ কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “সেই।”

ভদ্রলোক বললেন, “পুরীতে খুব খিদে পায়। আমার সমুদ্রের হাওয়া লাগলেই খিদে পায়।”

দীপ বলল, “ও।”

ভদ্রলোক বললেন, “তবে বাড়ির খাবার ব্যাপারই আলাদা। এই যে নেমে বাড়ি গিয়ে…”

দীপ পরিষ্কার দেখতে পেল ভদ্রলোকের পায়ে ভদ্রমহিলা একটা চিমটি কাটলেন। ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার বাড়ি কোথায়?”

দীপ বলল। ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, “ওহ, সাউথ! আমরাও তো ওদিকেই থাকি।”

ভদ্রমহিলা বললেন, “ওঁর কথায় কিছু মনে করবেন না ভাই, ও খুব খেতে পছন্দ করে।”

দীপ বলল, “তা আমিও।”

ভদ্রলোক খুশি হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “সবাই তো আর তোমার মতো পেটরুগি না। হুহ। খাবার কথা বললেই ওনার যত কথা!”

ভদ্রমহিলা বললেন, “তা তো বলবই। মাঝরাতে উঠে যখন বলো, ওগো আমার শরীর খারাপ লাগছে, তখন তো আমাকেই সামাল দিতে হয়।”

দুজনের প্রেমালাপের শব্দ একটু বেড়ে গেছিল। দীপ দেখল আশেপাশের সিট থেকে সবাই কৌতুকচিত্তে তাদের সিটের দিকেই তাকিয়ে আছে।

ভদ্রলোক দমবার পাত্র নন, বললেন, “গ্যাস জিনিসটাই এমন। রিলিজ হয়ে গেলেই তো সব ঠিক হয়ে যায়। তুমি একটু বেশিই চিন্তা করো।”

ভদ্রমহিলা গজগজ করতে করতে চুপ করলেন। এয়ারহোস্টেসদের চলন্ত টেবিল তাদের সিটের কাছে চলে এসেছিল। ভদ্রমহিলা বললেন, “নাও, যা পারো খাও।”

ভদ্রলোক প্রবল উৎসাহে তিনটে স্যান্ডউইচ অর্ডার করলেন। দীপকে একটা এগিয়ে দিলেন। দীপ আঁতকে উঠে বলল, “না না, আমি খাব না।”

ভদ্রলোক খেতে শুরু করে দিয়েছিলেন। চিবোতে চিবোতে বললেন, “ওরম বলে না। খেয়ে নিন ভাই, না খেলে জগন্নাথ পাপ দেবে।”

অগত্যা দীপ স্যান্ডউইচে কামড় দিল। তার মজা লাগছিল। এ ধরনের পাবলিক ট্রেনে প্রচুর দেখা যায়। প্লেনে উঠলে লোকে অনেক ধরনের কায়দা করার চেষ্টা করে। ভদ্রলোকের সেসব বালাই নেই।

ভদ্রলোক খেতে খেতে বললেন, “ফেলু মোদকের মোহিনী খেয়েছ ভাই? আমি তুমি বলছি। বেশিক্ষণ আপনি বললে আমার অ্যাসিডিটি হয়। তা ছাড়া তুমি আমার থেকে অনেক ছোটোও বটে।”

দীপ মাথা নাড়ল, “একেবারেই কোনও সমস্যা নেই। মোহিনীটা কী বস্তু?”

ভদ্রলোক বললেন, “দেবভোগ্য জিনিস। স্বয়ং স্বর্গের দেবদেবীরা খান। এখন খানিকটা আমাদের জন্য প্রসাদ পাঠাচ্ছেন। কুড়ি টাকা দাম। এই ছোট্ট মিষ্টি। ঠিক হাফটুকু নিয়ে মুখে পুরবে। দেখবে গোটা মুখে নতুন গুড় ফুল ফোটাচ্ছে। বুঝছ কী বলছি?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ। মিষ্টি তার মানে?”

ভদ্রলোক বললেন, “শুধু মিষ্টি না। এ অন্য লেভেলের জিনিস। বাড়ি গিয়েই বেরোতে হবে।”

ভদ্রমহিলা বললেন, “কোথাও বেরোবে না, আগে ব্লাড সুগার টেস্ট করাবে কাল, কতটা নেমেছে দেখব, তারপরে দেখা যাবে।”

ভদ্রলোক মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, “ওই শুরু হল খাদ্যপুলিশের উৎপাত। এদের জ্বালায় যদি কিছু শান্তিমতো করা যায়। এটা কোরো না, ওটা কোরো না, এটা খেয়ো না, ওটা খেয়ো না, মহা জ্বালা হয়েছে।”

দীপ ঘড়ির দিকে তাকাল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতা পৌঁছে যাবে। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে একটা ক্যাব নিয়ে অফিস রওনা দিতে হবে। ভদ্রলোককে মন্দ লাগছিল না। বেশ মজাদার কথাবার্তা।

ভদ্রলোক বললেন, “তুমি কোন অফিসে চাকরি করো ভাই?”

দীপ তাদের কোম্পানির নাম বলল। ভদ্রলোক বললেন, “আইটি। ওরে বাবা। ভয়ানক ব্যাপার। ছেলেপিলে খাবে কখন, ঘুমাবে কখন? সারাক্ষণ কাজ কাজ আর কাজ।”

দীপ হাসল, “সবটা তাই না। আমরা খাওয়াদাওয়ার সময়টা পাই ঠিকই, তবে বাকিদের তুলনায় কম এই আর কি!”

ভদ্রলোক বললেন, “জানি জানি, আমার মেয়েও তো একই কেস। ছুটি পর্যন্ত পেল না জানো, একটু ঠাকুরের দর্শনটা হয়ে যেত। এই তো তোমাদের ওদিকেই ওর অফিস। এন কে জি টেকে আছে।”

দীপ বলল, “ওহ। হ্যাঁ, ছুটিছাটা হঠাৎ করে নেবার ক্ষেত্রে একটু চাপ তো থেকেই যায়।”

ভদ্রলোক বকবক করতে লাগলেন। দীপ চোখ বন্ধ করে বসল। গোটা রাস্তায় প্লেন খুব একটা এয়ারপকেটে পড়ে অসভ্যতা করেনি। ঠিকঠাকই ছিল জার্নিটা।

কিছুক্ষণ পরেই কলকাতা শহরটার আকাশে প্রবেশ করল তারা। ধীরে ধীরে ল্যান্ড করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। ভদ্রলোক কপালে হাত দিয়ে জয় জগন্নাথ বলে যাচ্ছিলেন। প্লেনের চাকা এয়ারপোর্টের মাটি স্পর্শ করার পর ভদ্রলোক কপালে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে বললেন, “আরও কিছুদিন ধরাধামে থাকব তাহলে। যাক!”

দীপ অনেকক্ষণ পরে হাসল। তারও ভালো লাগছিল। প্লেনের দরজা খুলতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সে ধীরে সুস্থে নামল। ফোন অফ ছিল, সেটাকে অন করল।

চিত্রলেখার একগাদা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এসে জড়ো হয়েছে। সেসব দেখে তার হঠাৎই বিরক্তি শুরু হল।

সে লাগেজ নিতে লাগেজ বেল্টের কাছে পৌঁছে দেখল ভদ্রলোক হাঁফাতে হাঁফাতে সেখানে পৌঁছেছেন। তাকে দেখে বললেন, “আমাদের সঙ্গে চলো ভাই। ওদিকেই তো যাবে। গাড়ি আছে তো?”

দীপ মাথা নাড়ল, “আমাকে আসলে অফিসে যেতে হবে এখন। পরে নাহয় একদিন দেখা হবে।”

ভদ্রলোক বললেন, “বেশ তো, যাবে সল্টলেক। আমার মেয়ে নিতে এসেছে আমাদের। ওকেও তো সল্টলেকেই ড্রপ করে দেব।”

দীপ আর কিছু বলল না। কিছু টাকা ক্যাব ফেয়ার বেচে গেলে মন্দ না। তার ব্যাগটা ফ্লোরে রাখল। ভদ্রমহিলাকে সাহায্য করল ওঁদের ব্যাগগুলো ট্রলিতে রাখার জন্য। একজিট গেটে পৌঁছে দীপ শহরটা দেখে একটা জোরে শ্বাস নিল। এখনও ফিরতে ভালো লাগে তাহলে।

পরক্ষণেই যে মেয়েটা ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার দিকে দৌড়ে এল তাকে দেখে একটা হার্টবিট মিস করল সে। এই গোডাউনের এত হাইফাই প্রোডাক্ট আশাই করেনি যে!

১৪

বাসস্ট্যান্ডে নেমে টোটোয় উঠে কোয়ার্টারটা খুঁজতে খুব একটা সমস্যা হল না মানালির। ভোরবেলায় ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে আসানসোলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল তারা। আসানসোলে নেমে বাসে করে রূপনারায়ণপুর পৌঁছোল যখন, তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। রোদ থাকলেও মাঝে মাঝে এমন হাওয়া দিচ্ছে যে শরীর একেবারে শিরশির করে উঠছে। এক অদ্ভুত শুষ্ক শীতল হাওয়া বইছে।

রাস্তাঘাটের হাল খুব একটা ভালো না। মরে যাওয়া কারখানার আবাসনের একটা কোয়ার্টারে তারা পৌঁছোল বেলা বারোটা নাগাদ।

দরজা খুলে ঈপ্সিতা বললেন, “ভিতরে আসুন।”

ঋপণ জুতো পরেই ভিতরে চলে যাচ্ছিল, মানালি ঋপণের হাতে একটা চিমটি কাটল। ঋপণ জিভ কেটে জুতো খুলল।

নিতান্তই মধ্যবিত্ত ঘর। দেওয়ালে একটা সৌরভ আর দ্রাবিড়ের পোস্টার বেখাপ্পাভাবে আটকানো। দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন আগের। তারপরে দেওয়ালটার দিকে কারও বিশেষ নজর পড়েনি।

ঈপ্সিতা বললেন, “বসুন, আমাদের স্কুল নিয়ে স্টোরিটা করতে চেয়েছেন শুনে খুবই খুশি হয়েছি। দুঃখের বিষয় এখন ক্রিসমাসের ছুটি চলছে। নইলে আপনাকে স্কুল ঘুরে দেখাতে পারতাম।”

মানালি একটু ঢোক গিলল। শ্রীপর্ণার থেকেই শুনেছিল ঈপ্সিতা রূপনারায়ণপুরে এক স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। প্রথমে ভেবেছিল একবারে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেবে। পরক্ষণে তার মনে পড়ে গেছিল বিশ্বরূপদার কথা। সত্যি কথা বলার পরে ভদ্রমহিলা যদি দেখা করতেই না চান তাহলে মহা সমস্যা হয়ে যাবে। আচমকাই তার মাথায় আসে তাদের কাগজের “স্কুল ক্যাম্পাস সরগরম” বিভাগের কথা। প্রথম দিকে সে এই বিভাগে কয়েকটা আর্টিকেলও লিখেছিল। আর বেশি ভাবেনি সে। ফোন করে প্রস্তাবটা দিতে ভদ্রমহিলা বেশ খুশিই হলেন। জানালেন তাদের স্কুল নিয়ে তাঁরা কয়েকজন শিক্ষিকা বেশ ভালোভাবেই লড়ে যাচ্ছেন। স্টোরিটা হলে বরং তাঁরা বেশ খুশিই হবেন।

মানালি বলল, “আপনাদের স্ট্রাগলের কথা বলুন ম্যাম, একটু শুনি।”

ঈপ্সিতা বললেন, “দেখুন, এই এলাকা মূলত গড়ে উঠেছিল কারখানার উপর ভিত্তি করে। একটা সময় এসে কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হল এলাকাভিত্তিক স্ট্রাগল, যে স্ট্রাগল ভয়াবহ। যাঁরা এই স্ট্রাগল করেননি, তাঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না, এককালীন লাভজনক একটা কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে, মাইনে অনিশ্চিত হয়ে গেলে সে এলাকার লোকজনের ওপর কী ভয়ংকর চাপ পড়ে যায়। আমাদের এই শিল্পাঞ্চলেই বহু কারখানা এভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে…”

ঈপ্সিতা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মানালি হঠাৎ অধৈর্য হয়ে বাধা দিল, “ম্যাম, আপনি কি এই অঞ্চলের?”

ঈপ্সিতা বোধহয় একটু বিরক্ত হলেন, কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বললেন, “হ্যাঁ। আমার বাবা এখানে কাজ করতেন। হিসেবমতো আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু যাব যাব করেও থেকে গেলাম স্কুলটার জন্য।”

মানালি বলল, “আপনি বিয়ে করেছেন?”

ঈপ্সিতা অবাক হয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হয়েছিল। পরে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।”

মানালি একটু অপ্রস্তুত হবার ভান করে বলল, “খুব দুঃখিত ম্যাডাম, কৌতূহলবশত সীমাটা পেরিয়ে ফেললাম, প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

ঈপ্সিতা বললেন, “আচ্ছা। ঠিক আছে।”

এক বয়স্ক ভদ্রলোক ঘরে এলেন, ঈপ্সিতা বললেন, “পরিচয় করিয়ে দি, আমার বাবা।”

মানালি হাত জোড় করল। ঈপ্সিতা বললেন, “বাবা তুমি একটু বিশ্রাম নাও। আমি ওঁদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসছি।”

ঈপ্সিতার বাবা কয়েক সেকেন্ড তাদের দেখে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন।

ঈপ্সিতা বললেন, “আমাদের স্কুলের ব্যাপারে আপনারা এতটা জানলেন কী করে জানতে পারি?”

মানালি হাসার চেষ্টা করল, “ম্যাম, আমাদের কাজ তো সেটাই। কোথাও ভালো কোনও কাজ হলে সেটা মিডিয়া জানবে না তা তো হয় না। আমাদের চিফ এডিটর বিশ্বরূপদা খুব জোর দেন এই ব্যাপারগুলোয়। বলেন শুধু কলকাতায় বসে থাকলে হবে না, জেলায় জেলায়… ”

ঈপ্সিতা ভ্রূ কুঁচকে মানালির দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিশ্বরূপ… আপনাদের কাগজে…”

মানালি বুঝল ঈপ্সিতা বিশ্বরূপকে চেনেন। সে খানিকটা মরিয়া হল, “আপনি চেনেন বিশ্বরূপদাকে?”

ঈপ্সিতার মুখে একটা হাসি এসেই মিলিয়ে গেল, “না, সেরকম কিছু না। আচ্ছা আপনি কন্টিনিউ করুন।”

মানালি বলল, “বিশ্বরূপদা খুব ভালো মানুষ। শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী। এই তো কদিন আগেই আমাদের সবাইকে ধ্রুব বাগচীর ডার্ক লাভ দেখাতে নিয়ে গেছিলেন নন্দনে। কোন কাগজের এডিটর এরকম স্টাফেদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যান বলুন ম্যাম?”

ঋপণ হাঁ করে মানালির দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে বলবে করে ভেবেও চুপ করে গেল।

ঈপ্সিতা মানালির কথা শুনে কয়েক সেকেন্ড মানালির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওহ, আপনারা ডার্ক লাভ দেখেছেন? সিনেমাটা কেমন লেগেছে আপনাদের?”

মানালি বুঝল তার উইকেট লক্ষ্য করে একটা হাফভলি আসছে। ঠিকঠাক খেলতে পারলে বল বাউন্ডারির বাইরেও যেতে পারে, অল্পক্ষণের জন্য মনঃসংযোগ সরে গেলে উইকেট খুইয়ে ফেলার সুযোগও আছে। সে ধ্রুব বাগচীর প্রশংসা করাই মনস্থ করল, “আমার তো খুব ভালো লেগেছে। সব অডিয়েন্সের জন্য না অবশ্য।”

ঈপ্সিতা জানলার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, “মাস আর ক্লাস নিয়ে এ দেশটা খুব মোটা দাগে দুভাগে ভাগ হয়ে আছে। সিনেমা চলা না-চলার ওপরে ভিত্তি করে যে দেশে কোন সিনেমা ভালো কোন সিনেমা খারাপ নির্ধারিত হয়, সে দেশে সিনেমার আদতে কোনও ভবিষ্যৎ নেই।”

মানালি চমৎকৃত হল। কথাগুলো যেন ধ্রুবই বললেন!

মানালি আর পারল না। বলে বসল, “আপনাদের ডিভোর্সটা কেন হল?” বলেই বুঝল কপালে আবার ঝাড় নাচছে তার।

ঈপ্সিতা চমকে মানালির দিকে তাকালেন। তারপর ঋপণের দিকে। বললেন, “আমার… আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল যখন আপনি বিশ্বরূপের কথা বললেন…”

মানালি বুঝল আবার কেলো করে ফেলেছে সে। কোনওভাবে সামাল দেবার চেষ্টা করল, “প্লিজ ম্যাম, অনেক দূর থেকে এসেছি, একবারে তাড়িয়ে দেবেন না প্লিজ।”

ঈপ্সিতা কয়েক সেকেন্ড কপালে হাত রেখে বসে বললেন, “কাউকে তাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা থাকলে হয়তো অনেক ভালোভাবে জীবনটা কাটাতে পারতাম আমি। তবে অনুগ্রহ করে আমাকে আর কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন না। আমারই ভুল। আমি ভেবেছিলাম আমাদের মতো দূরের স্কুলগুলোকে আপনারা স্বীকৃতি দিতে চাইছেন। আমার বোঝা উচিত ছিল, আদতে সেই কেচ্ছা খোঁজাই আপনাদের কাজ।”

মানালি বলল, “ম্যাম, প্লিজ। আমি স্কুলের নিউজটা করব বিশ্বাস করুন। আপনি এভাবে বলবেন না।”

ঈপ্সিতা ঠোঁটের কোণে খানিকটা হাসি এনে বললেন, “সান্ত্বনা দিচ্ছেন?”

মানালি বলল, “না ম্যাম, বিশ্বাস করুন সান্ত্বনা দিচ্ছি না। এই অ্যাসাইনমেন্টটা খানিকটা কৌতূহলবশতই নেওয়া। ধ্রুব বাবু এমন একজন পারসোনালিটি, ওঁর সম্পর্কে আরও কিছু জানতে ইচ্ছা করাটা কি কোনও দোষ বলুন?”

ঈপ্সিতা বললেন, “আপনার তো যা চাওয়ার তা পেয়ে গেছেন। চিন্তা কী? আমাকে যতটা প্রশ্ন করেছেন তার থেকেই কেচ্ছা নেমে যাবে নিশ্চয়ই কিংবা শনিবারের ট্যাবলয়েডের খাদ্য হয়ে যাবে। কী বলেন? সমস্যা আছে?”

মানালি বলল, “ম্যাম, আমি ভেবেই এসেছি আপনাকে সবটা বলেই ইন্টারভিউ শুরু করব। আপনি প্লিজ আমাকে ভুল ভাববেন না। আপনি না চাইলে আপনাকে নিয়ে একটা শব্দও খরচ হবে না আমাদের কাগজে।”

ঈপ্সিতা বললেন, “অনেক দূর থেকে এসেছেন। লাঞ্চ করে বেরিয়ে যান। শীতের দিনে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা ঠিক হবে না।”

মানালি বুঝল বারবার ব্যাখ্যা দেওয়ার থেকে একবারে চুপ করে যাওয়া ভালো। সে আর কিছু বলল না।

ঈপ্সিতা উঠে ডাইনিং টেবিলে প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন, “দুজনে বেসিনে হাত ধুয়ে নিন।”

মানালি উঠল। ঋপণকে বলল, “চ।”

দুজনেরই খিদে পেয়েছিল। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ, মাছভাজা, মাছের ঝোল।

মানালির টেনশনও হচ্ছিল, আবার চুপচাপ খেয়েও নিচ্ছিল। এত কষ্ট করে আবার কলকাতা ফিরে যেতে হবে বিফলমনোরথ হয়ে, ভাবতেই বড়ো কষ্ট হচ্ছিল তার।

ঈপ্সিতা বেশ যত্ন করে খাওয়ালেন তাদের। একটা কথাও বললেন না ধ্রুব সম্পর্কিত।

খেয়ে উঠে মানালি বলল, “বিশ্বরূপদা খুব বকবেন, স্টোরিটা ফেল হয়ে গেল।”

ঈপ্সিতা বললেন, “আপনাদের বসকে বলতে পারেন, নিজে যা যা দেখেছে, শুনেছে, সেগুলো দিয়ে ভালো স্টোরি হয়। অকারণ একটা বাচ্চা মেয়েকে এতদূর না পাঠালেও পারত।”

মানালি কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

১৫

“সব কিছুর একটা ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি থাকে বুঝলে?”

পিছনের সিট থেকে বলে উঠলেন ভদ্রলোক। গাড়ি কৈখালি পেরোচ্ছে। দীপ সামনের সিটে বসেছিল। পিছনের সিটে মেয়েটা মায়ের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটার নাম ঋতি। জিন্স আর লাল টপে কিছু লাগছে মেয়েটাকে! দীপ অনেক কষ্ট করে হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ স্বাভাবিক করল। নিজের ওপর একটু অবাকও হল সে। গার্লফ্রেন্ড তো আছে! তাহলে কাউকে দেখলে হঠাৎ এরকম হওয়া তো মোটেও কাজের কথা নয়! আর অনেক কষ্ট করেও সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। লুকিং গ্লাসে মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই হার্টফেল হবার চান্স তৈরি হচ্ছিল। সে একটু আশা করেছিল মেয়েটা তার সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু মেয়েটা মায়ের সঙ্গেই ব্যস্ত।

দীপ ভদ্রলোকের কথার উত্তরে বলল, “বুঝলাম না।”

ভদ্রলোক বললেন, “এই যে দ্যাখো না, সিনেমায় দেখায় হিরো সবজিওয়ালার ভ্যান উলটে দিচ্ছে। গাড়ি এসে কোনও দোকানে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটার ওপাশটা কেউ আর দেখায় না। হয়তো দেখা গেল সবজিওয়ালার বাড়িতে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে আছে। তারা বাপের কাছে মাংস ভাত খেতে চেয়েছিল। বাপ হয়তো সবজি বেচেই তাদের জন্য মাংস কিনে নিয়ে যেত। কিন্তু হিরোর লাথি তার ভ্যানে পড়ায় ব্যবসা চৌপাট হয়ে গেল। কিন্তু সেই গল্পটা তো আর আমরা দেখছি না।”

দীপ বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু হঠাৎ এই কথা কেন?”

ভদ্রলোক বললেন, “ওই যে, প্রসঙ্গটা হল ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি। আমাদের দেখা হয়ে যাওয়াটাও যেমন। আমরা ভুবনেশ্বর গেছিলাম আমার মেয়ের জন্য পুজো দিতে। ফ্রন্ট স্টোরিটা হল তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা।”

মেয়ে পাশ থেকে বিরক্ত গলায় বলল, “আহ বাবা। থাক না।”

ভদ্রলোক বললেন, “কেন বলব না? কত ভালো খবর! তুই বিদেশ যাচ্ছিস, এটা আমাদের জন্য কত গর্বের ব্যাপার বল তো?”

মেয়ে আর কিছু বলল না। দীপ বুঝল ভদ্রলোক কন্যাগর্বে গর্বিত। সে বলল, “কনগ্র্যাটস।”

মেয়েটা নিয়মরক্ষার জন্য বলল, “ইউ আর ওয়েলকাম।”

ভদ্রলোক বললেন, “এই আইটি আসার পরে ভারী ভালো ব্যাপার হয়েছে ভাইটি। আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা বিদেশ-টিদেশ ঘুরছে। আগে তো একসময় আম্রিকা মানেই ছিল কঠিন ব্যাপার। এখন ব্যাপারটা জল ভাত হয়েছে। আমরাও সন্তানদের কল্যাণে দেশ বিদেশ ঘুরতে পাব। হ্যাঁ রে মা, ওই দেশে ইলিশ পাওয়া যায় তো?”

ভদ্রমহিলা রাগি গলায় বললেন, “তোমার শুধু খাওয়ার কথা। এখন কত কাজ সামনে আর তুমি সেই ইলিশ ভেটকি নিয়ে পড়ে আছ।”

কথার মাঝখানে দীপের মোবাইলটা বেজে উঠল। দীপ দেখল চিত্রলেখা ফোন করছে। রিংটা সাইলেন্ট করে দিল।

ভদ্রলোক বললেন, “বাড়ি থেকে বুঝি?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ। ওই আর কি!”

ভদ্রলোক বললেন, “স্বাভাবিক। কত দূরে দূরে চলে যাচ্ছে সব ছেলেমেয়েরা। বাড়ির লোক চিন্তা করবে না?”

গাড়ি রাজারহাটের রাস্তায় ঢুকে গেছিল। ভদ্রলোক বললেন, “তুমি কলেজ মোড়ে নামবে?”

দীপ লুকিং গ্লাসে ঋতির চোখের দিকে তাকাল, “হ্যাঁ।”

ভদ্রলোক তাকে বললেন, “তুমি লাঞ্চ করবে তো?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ। লাঞ্চ করেই অফিসে যাব।”

ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, “তাহলে তো আমরা লাঞ্চ করেই যেতে পারি।”

ভদ্রমহিলা রেগে গেলেন, “একদম না। ওসব লাঞ্চ-টাঞ্চ একদম না। অনেক খেয়েছ। বাড়ি গিয়ে খাবে।”

ভদ্রলোক মুষড়ে পড়লেন, “উফ। তোমার জ্বালায়… আচ্ছা, ছেলেটা লাঞ্চ করবে না?”

ঋতি হঠাৎ বলল, “আমি আজাদ হিন্দে নেমে যাব। উনি চাইলে নামতে পারেন। ওখানে লাঞ্চটা হয়ে যাবে।”

ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, “তাই কর। তোরা দুজন নেমে যা। তোর বাবাকে একদম নামতে বলবি না। জানিস না কী লেভেলে খাওয়াদাওয়া করেছে পুরীতে।”

দীপ একটু অবাক হল। মেয়েটা এতক্ষণ অ্যাটি নিচ্ছিল। হঠাৎ ইনডাইরেক্টলি লাঞ্চের প্রপোজাল দিচ্ছে। ব্যাপারটা মন্দ না।

বাকি রাস্তাটা ভদ্রলোক বিভিন্ন খাবারের গল্প করে গেলেন। দীপ কিছু বলছিল না। গাড়িটা তাদের নামিয়ে দেবার পরে ভদ্রলোক বললেন, “অবশ্যই এসো ভাই আমাদের বাড়িতে। আমার মেয়ের কাছ থেকে অ্যাড্রেসটা নিয়ে নিয়ো। খুব ভালো লাগল তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে।”

দীপ প্রত্যুত্তরে বলল, “নিশ্চয়ই। আমারও খুব ভালো লাগল।”

গাড়িটা চলে গেলে ঋতি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার বলুন তো?”

দীপ বলল, “কী?”

ঋতি বলল, “বাবা কাউকে এয়ারপোর্ট থেকে লিফট দেয় না। হঠাৎ কী এমন করলেন যে একবারে লিফট দিয়ে দিল?”

দীপ হাসল, “এমন কিছুই তো করলাম না। জানি না, ওঁর কেন এত ভালো লেগে গেল!”

ঋতি তার দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ীর মতো হাসল, “ইম্প্রেসিভ। আপনার মধ্যে একটা ইনোসেন্ট ব্যাপার আছে। আপনি সেটা বুঝতে পারেন?”

দীপ এবার অবাক হল। মেয়েটা এতক্ষণ এত ঘ্যাম নিচ্ছিল। এখন হঠাৎ করে মাঝরাস্তায় এত ভালো ভালো কথা বলছে কেন? সে বলল, “লাঞ্চ করবেন না?”

ঋতি বলল, “নাহ। আমি যাই। আপনার বোধহয় আমাকে ভালো লাগছে না বলুন?”

দীপ বুঝতে পারল না কী বলবে। সে বলল, “না না, কী যে বলেন, আপনার মতো, কী যেন বলে, একজন সুন্দরীকে ভালো না লাগাটাই তো অদ্ভুত ব্যাপার। লাঞ্চ কিন্তু করতেই হবে, আমার খিদে পাচ্ছে।”

ঋতি হাসল “থ্যাংকস ফর ইওর কমপ্লিমেন্ট। চলুন।”

লাঞ্চ ব্রেক অফিসগুলোতে শুরু হয়নি বলে রেস্তোরাঁ ফাঁকাই ছিল। তারা দুজন একটা টেবিলে বসল।

দীপ বলল, “আপনি কবে যাচ্ছেন?”

ঋতি বলল, “এই তো। আর এক মাস।”

দীপ বলল, “পার্মানেন্ট?”

ঋতি বলল, “প্রথমবারে ছ-মাসের জন্য। তারপর ফিরে আবার যাওয়া। সেটা ক-বছর জানি না।”

দীপ বলল, “গ্রেট। বয়ফ্রেন্ড আছে?”

ঋতি মাথা নাড়ল, “না। আপনার?”

দীপ বলল, “না, আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই। আমি স্ট্রেট।”

ঋতি হাসিতে ফেটে পড়ল, “ওরে বাবা, আপনাকে দেখে যতটা ইনোসেন্ট মনে হয় আপনি তো তা নন। যাক গে, গার্লফ্রেন্ড আছে?”

দীপের মোবাইলটা বাজতে শুরু করেছিল। চিত্রলেখা আবার। দীপ সেটার রিংটোনটাকে আবার মিউট করে দিয়ে বলল, “নাহ।”

ঋতি বলল, “বাহ। এনি এক্স?”

দীপ বলল, “নাহ, আপনার?”

ঋতি বলল, “সেরকম কেউ নেই।”

দীপ ঋতির দিকে তাকিয়ে বলল, “সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য!”

ঋতিও তার চোখের দিকে তাকাল, “কেন নয়?”

দীপ বলল, “আপনি এত সুন্দরী!” মনে মনে বলল, আর সেক্সি তো বটেই।

ঋতি বলল, “বারবার না বললেও চলবে। তবে কী জানেন, সবারই ধারণা আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। অফিসেরও অনেকে তাই মনে করে। আমি কারও ভুল ভাঙাই না আজকাল। কেরিয়রটাই আসল যখন, তখন অতটা না ভাবলেও চলবে।”

দীপ বলল, “তা ঠিক। আমি কিন্তু পাতি ভাত আর চিকেনের কোনও প্রিপারেশন খাব। কেন জানি না খুব ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।”

ঋতি বলল, “ওকে। একটা করেই নিন। শেয়ার করে নেওয়া যাবে। আমি খুব একটা ফুডি না।”

দীপ সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল, “আমিও না।”

ঋতি বলল, “গুড, শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং। বাই দ্য ওয়ে, আমাকে খুব গায়ে পড়া মেয়ে মনে হচ্ছে, না?”

দীপ বলল, “কেন বলুন তো?”

ঋতি বলল, “এই যে নিজে থেকেই লাঞ্চ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। আগে থেকেই বলে নি, আমি আমার বাবাকে চিনি। বাড়ি ফিরে আমাকে শুনতে হত ফ্লাইটে একটা দারুণ ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, মিট কর, সেই ফেজটাকে কাটাবার জন্য আগে থেকেই দেখা করে নিলাম।”

দীপ অবাক হয়ে বললাম, “বাবা! আপনি তো আলোর থেকেও দ্রুতবেগে ভাবতে পারেন দেখছি।”

ঋতি বলল, “তা বটে। আচ্ছা, আর ইউ ভার্জিন?”

দীপ হাঁ করে ঋতির দিকে তাকাল। বলল, “কেন বলুন তো?”

ঋতি বলল, “আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনি ভার্জিন নন। আপনি অত্যন্ত হ্যান্ডু। এত হ্যান্ডু ছেলে ভার্জিন হয়ে ঘুরে বেড়ালে আমার পৃথিবীর উপর বিশ্বাস উঠে যাবে।”

দীপ হেসে ফেলল, “আনফরচুনেটলি।”

ঋতি হাসতে লাগল। আশেপাশে যে কটা কাপল ছিল, দীপ পরিষ্কার বুঝতে পারছিল ছেলেগুলো ঈর্ষান্বিত হয়ে ঋতিকেই দেখছে। দীপ বলল, “আপনি ভার্জিন তো?”

ঋতি হাসতে হাসতেই বলল, “ইয়েস, আনফরচুনেটলি।”

পরের কথাটা দীপ অনেক কষ্টে আটকাল। সে বলতে যাচ্ছিল এতই যখন আনফরচুনেট ব্যাপারটা তখন ফরচুনেট হয়ে গেলেই হয়। বলতে পারল না।

ঋতি বলল, “আমি জানি না আপনার সঙ্গে এত কথা কেন বলছি, তবে একটা ব্যাপার হল আমার বাবার যাকে ভালো লাগে বলে আমার মনে হয়, আমারও কেন জানি না তাকে ভালো লেগে যায়।”

দীপ বলল, “আপনার বাবার আর কাকে ভালো লাগে?”

ঋতি বলল, “আমাদের পেপারওয়ালা।” বলেই আবার জোরে হেসে ফেলল।

দীপও হাসতে যাচ্ছিল, এই সময় আবার তার পকেট বেজে উঠল।

ঋতি বলল, “ফোনটা ধরুন না। কতবার করে ফোন হচ্ছে!”

দীপ আবার রিংটোন মিউট করে বলল, “আর বলবেন না, জোর করে পলিসি গছাবে। আমার এখন কোনও ইচ্ছা নেই!”

১৬

মানালির বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। মা দরজা খুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “শীতের রাতে রাস্তায় কুকুর বেড়াল পর্যন্ত বেরোচ্ছে না, এমন চাকরি করা কেন যেখানে এত রাতে ফিরতে হয়?”

মানালি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। হিমশীতল জলেই হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে বলল, “খেতে দাও তাড়াতাড়ি। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।”

মা বলল, “দাঁড়া, খাবারগুলো গরম করে নি।”

মানালি বলল, “কী আছে?”

মা বলল, “মাছের ঝোল। আলু ফুলকপির তরকারি।”

মানালি বলল, “শুধু মাছ গরম করো। একটু ভাত দিয়ে খাব শুধু।”

মা গজগজ করতে করতে মাছের পাত্র মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢোকাল। মানালি বলল, “ফিসফিস করে কী বলছ মা? জোরে জোরে বলো!”

মা বলল, “বলছিলাম শ্বশুরবাড়ি গিয়ে এরকম নবাবি চলবে না। সেটা বুঝিস?”

মানালি বলল, “সেজন্যই তো শ্বশুরবাড়ি যাব না।”

মা রেগে গেল, “কেন? যার সঙ্গে প্রেম করিস, তাকে বিয়ে করবি না?”

মানালি জিভ কাটল। মাকে আরও রাগানোর জন্য বলল, “শ্বশুরবাড়ি থোড়িই থাকব! কে বলেছে শ্বশুরবাড়ি থাকব? লিভ টুগেদার করব তো!”

মা তার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে বলল, “মানে!”

মানালি অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, “এরকম চমকে ওঠার কিছু নেই মা। দিন পালটাচ্ছে। কনসেপ্ট চেঞ্জ হচ্ছে। তোমাদের সময় ওইসব প্রি-ওয়েডিং ফটোশুট নামের কিছু ছিল? ধাড়ি উড বি-কে কোলে তুলে ফটো তুলছে বর, জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে তবু ফটো তোলা বড়ো বালাই। ছিল? দেখেছ?”

মা অবাক হয়ে বলল, “প্রি-ওয়েডিং… কী সেটা?”

মানালি বলল, “প্রি-ওয়েডিং ফটোশ্যুট। বিয়ের আগে স্বামী স্ত্রী ফটো তোলে। আমার এক বন্ধু প্রি-ওয়েডিং ফটোশ্যুটে কায়দা করে হবু বরের সঙ্গে ফটো-টটো তুলে বিয়ের দিন ড্রাইভারের সাথে পালিয়েছে। নে কত আদিখ্যেতা করবি কর!”

মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “এসব কী অলুক্ষুনে কথা বলছিস বল তো? পালিয়েছে মানে কী।”

মানালি বলল, “ওই আর কি! ওইজন্যই তো বলছি বিয়ের থেকে লিভ টুগেদার ভালো এখন। একসঙ্গে থাকো, পোষালে পোষাল, নইলে যে যার রাস্তায় ফিরে যাও। দেখবে দু-তিন বছর পরে কলকাতায় এটাই চলবে।”

মা মাইক্রোওভেন থেকে খাবার বের করে সার্ভ করতে করতে বলল, “যা ইচ্ছা কর, আমি আর কিছু বলব না। তবে বাচ্চা হবার সময় ছেলেটা যখন তোকে ছেড়ে চলে যাবে তখন বুঝবি এইসব আধুনিকতা আসলে কিছু লোক নিজেদের সুবিধার জন্যই বানিয়ে রাখে। কথাই আছে যস্মিন দেশে যদাচার। সেটার অন্যথা হলে সমস্যা বাড়ে।”

মানালি মাছ দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলল, “লিভ টুগেদার তারাই করে মা, যাদের নিজেদের সম্পর্কের ওপর সবথেকে বেশি বিশ্বাস থাকে। সম্পর্কটা তো কাউকে জোর করে হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাখার মতো নয়। সম্পর্কে আইনকানুন তখনই আসে, সালিশি সভা তখনই বসে, যখন সম্পর্কটার বাঁধনটা আলগা হয়ে যায়। আর বাচ্চা হবার সময় কেউ চলে গেলে চলে যাবে। একটা মেয়ে জানে কী করে একটা বাচ্চাকে বড়ো করে তুলতে হয়। তোমার কী মনে হয়, জানে না?”

মা বেশ কিছুক্ষণ মানালির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বলল, “তুই কি সত্যি সত্যি এসব জিনিস করতে যাচ্ছিস? আমায় ছুঁয়ে বল তো!”

মানালি হাসতে হাসতে বলল, “শেষ মিসাইলটা ছুড়েই ফেললে বলো? দেখা যাক কী করি। অত চিন্তা করতে হবে না।”

মা বলল, “চিন্তা করব না? তোরা বাপ মেয়ে মিলে এক-একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসে থাকবি, আর মাঝখান দিয়ে আমাকে দৌড়ে মরতে হবে। আমি অতশত জানি না, তুই আমাকে ছুঁয়ে বল এইসব অলুক্ষুনে কাণ্ড তুই কিছুতেই করবি না।”

মা হাতটা তার দিকে এগিয়ে দিল। মানালির রাগ হচ্ছিল। এই সময় তাকে বাঁচাতেই হয়তো ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। মা বলল, “এই নাও, কৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠেছে।”

মানালি দেখল বিশ্বরূপদা ফোন করছে, সে বলল, “মা প্লিজ, চুপ করো, বসো।”

মা রেগেমেগে অন্য ঘরে চলে গেল।

মানালি ফোন ধরল, “বলো।”

“কী রিপোর্ট? ঈপ্সিতা কী বলল?” ওপাশ থেকে গলাটা নির্লিপ্ত শোনাল।

মানালি বলল, “কী আশা করছ?”

বিশ্বরূপদা বলল, “একটা ভালো স্টোরি।”

মানালি বলল, “হবে না।”

বিশ্বরূপদা বলল, “সেন্টু খেয়ে গেলি, তাই তো?”

মানালি বলল, “এথিক্সে আটকাচ্ছে।”

বিশ্বরূপদা বলল, “তাহলে তো আর কিছু বলা যাবে না, মামণির এথিক্সে আটকাচ্ছে যখন! তা এথিক্স বাবাজি কী বলছে শুনতে পারি?”

মানালি মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বলল, “এক ভদ্রমহিলা নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখে একটা ভালো সোশ্যাল সার্ভিস করছেন, মানুষের জন্য কাজ করছেন, তাঁকে এইসব পেজ থ্রিতে আনতে আমি কোনও ভাবেই পারলাম না।”

বিশ্বরূপদা বলল, “ওকে, ফাইন। পেজ থ্রিতে আনতে হবে না।”

মানালি অবাক হল, “মানে? স্টোরিটা না করলেও চলবে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “আমার কথার মানে কি তাই দাঁড়াল?”

মানালি বলল, “তাহলে কী দাঁড়াল?”

বিশ্বরূপদা বলল, “বললাম পেজ থ্রি নিউজ করব না। পেজ ফাইভ বা সিক্সে করলাম। ফ্রন্ট পেজেও করা যায়। হেডলাইন হবে নিভৃত সমাজকর্মী। কলকাতা থেকে দূরে এক অর্থনৈতিক ভাবে কোমর ভেঙে যাওয়া অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার জন্য কাজ করছেন এক মহীয়সী নারী। লেটস মেক হার আ সেলিব্রিটি। সেটা করলে তো ব্যাপারটা আনএথিকাল হবে না? কী বলিস?”

মানালি বলল, “তুমি বলবে না ভদ্রমহিলা ধ্রুব বাগচীর স্ত্রী?”

বিশ্বরূপদা বলল, “না। বলব না। তাহলে হবে? এথিক্সে খোঁচা-টোচা লাগবে না তো?”

মানালি একটু থমকে বলল, “লাগবে না হয়তো। তবু ভদ্রমহিলা সেক্ষেত্রেও রেগে যেতে পারেন। তেমন কোনও সলিড গ্রাউন্ড কি আছে? অনেক হেডমাস্টার হেডমিস্ট্রেসই রাজ্যে আছেন যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে কাজ করেন। তাহলে তো তাঁদের নিয়েও স্টোরি করতে হয়।”

বিশ্বরূপদা বলল, “সলিড গ্রাউন্ড এটসেট্রা রাবিশ ব্যাপার। নিউজপেপার কাকে কখন তুলবে, কাকে ছুড়ে ফেলবে, সেসব তোর বোঝার কথা না। স্পটলাইটটা ফেলার কায়দা জানতে হবে। তুই স্টোরিটা বানা। যতটা পারিস মশলাবর্জিত, আবেগসর্বস্ব স্টোরি বানা। আমি তারপর দেখছি কী করা যায়।”

মানালি বলল, “ওকে। গুড নাইট।”

বিশ্বরূপদা বলল, “গুড নাইট। আর শোন, কাল ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে চাইলে করতে পারিস। আজকের জার্নিটা খুব হেকটিক ছিল শুনলাম।”

মানালি বলল, “না না, কাল যাব। বাড়িতে থাকলে খবর হয়ে যাব আমি।” মানালি আড়চোখে দেখল মা টিভি চালিয়েছে।

বিশ্বরূপদা হাসল, “পালিয়ে পালিয়ে কিন্তু কোনও কিছু হয় না। তার মানে তুই এখনও তোর কাজের গুরুত্বটা মাকে বোঝাতে পারিসনি। দেখ, ওয়ার্কিং লেডিদের একটা এক্সট্রা লোড সব সময়েই নিতে হয়, তাদের হোম ফ্রন্ট সামলাতে হয়, অফিসে আমাদের মতো ঝাঁটু বস সামলাতে হয়, দুদিক ঠিকঠাক ব্যালান্স করে তবেই চলতে হয়। তুই যদি একটা দিক এখন থেকেই ইগনোর করতে শুরু করিস, সেক্ষেত্রে তোকে ফিউচারে আরও প্রবলেমে পড়তে হবে। কেউ অবুঝ না কিন্তু। কনভিন্স ইওর মাদার। আই থিংক তোর বাড়ির লোকের সঙ্গেও সময়টা ইকোয়াল ইম্পর্ট্যান্স দিয়ে কাটানো দরকার। এভরিওয়ান ইজ নট অ্যাজ মাচ লাকি অ্যাজ ইউ আর। আমার বাপ মা কেউ বেঁচে নেই। আমার তো মনে হয় আমারও যদি তোর মায়ের মতন একজন এক্সট্রা কেয়ারিং মা থাকতেন তবে খারাপ হত না।”

মানালি বলল, “বুঝতে আমার জায়গায় থাকলে। ওরম মনে হয়।”

বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “ওকে। গুড নাইট। যা যা বললাম সেগুলোতে কনসেন্ট্রেট কর।”

মানালি ফোন রেখে প্লেট সিংকে রেখে ঘরে গিয়ে কম্বল গায়ে দিল।

ল্যাপটপটা বিছানাতেই রাখা আছে। খুলতে ইচ্ছা করছিল না।

ফোনটা আবার বাজতে শুরু করেছে।

মানালি দেখল ধ্রুব বাগচী ফোন করছেন।

১৭

অফিসে রিপোর্ট ইত্যাদি সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দীপের সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাবা বাইরের ঘরে বসে ছিল। তাকে দেখে বলল, “কী খবর?”

দীপ বলল, “খবর ভালো। অফিসের কাজ হল, ঘোরাও হল।”

বাবা বলল, “ব্যস?”

দীপ বলল, “আবার কী?”

বাবা বলল, “ফ্রেশ হয়ে নে। শিঙাড়া আছে। জাস্ট আনলাম নিরুর দোকান থেকে। নতুন খুলেছে দোকানটা। মশলাটা হিং দিয়ে যা বানায় না, জাস্ট ফাটাফাটি!”

দীপ বলল, “আসছি।”

ব্যাগ ঘরে রেখে দীপ বাথরুমে ঢুকল। চেঞ্জ করে বাইরে এসে দেখল চিত্রলেখা ফোন করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সারাদিনে তিরিশবারের বেশি ফোন করেছে মেয়েটা। সে যে ইগনোর করতে চাইছে, বুঝতে চাইছে না, নাকি বুঝতে পারছে না?

সে টাওয়ালে হাত মুছে ফোন ধরে হ্যালো বলল।

ওপাশে বেশ কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর চিত্রলেখা ধরা গলায় বলল, “আমি কি জানতে পারি, কী হয়েছে ঠিক?”

দীপ বলল, “কিছু হয়নি তো! কেন বলো তো? আমি বিজি ছিলাম সারাদিন।”

চিত্রলেখা বলল, “বিজি ছিলে? একবার ফোন ধরে সেটা বলা যেত না?”

দীপ বলল, “আমি এখনও বিজি। পরে ফোন করছি।”

চিত্রলেখা বলল, “দাঁড়াও। এক মিনিট। আগে বলো আমার দোষটা কী! কী এমন ভুল করেছি আমি যে তুমি এভাবে দূরে দূরে থাকছ?”

দীপ বলল, “তুমি কিছু করোনি। অ্যাকচুয়ালি আমার মনে হচ্ছে তুমি আর আমি ঠিক কম্প্যাটিবল কাপল না। সে কারণেই ডিসাইডেড টু…”

চিত্রলেখা বলল, “কী ডিসাইডেড টু? বলো বলো!”

দীপ বলল, “ছাড়ো। এত কথার কিছু নেই।”

চিত্রলেখা বলল, “তুমি তো কাল রাতেও আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বললে। এর মধ্যে কী এমন হল বলো! প্লিজ বলো, আমি জানতে চাই।”

দীপ কয়েক সেকেন্ড থমকে বলল, “তুমি ভার্জিন?”

চিত্রলেখা বলল, “এ কেমন প্রশ্ন?”

দীপ বলল, “তুমি তোমার এক্স-এর সঙ্গে কোনও রকম ফিজিক্যাল রিলেশনশিপে ছিলে কি না?”

চিত্রলেখা কেঁদে ফেলল, “এ কেমন প্রশ্ন করছ তুমি?”

দীপ বলল, “আমি জাস্ট জানতে চাইছি, কিউরিওসিটি।”

বাবা দরজা খুলে বলল, “শিঙাড়াটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

দীপ বলল, “আসছি বাবা, পাঁচ মিনিট।”

বাবা দরজাটা বন্ধ করে চলে গেল।

চিত্রলেখা বলল, “তোমাকে তো কালকেই বলেছি। ও আমাকে ফোর্স করত। আমি বহু কষ্টে আটকাতাম।”

দীপ বলল, “সে তো অন্য কথা বলছে। ওর ফাঁকা ফ্ল্যাটে নাকি ও তোমাকে নিয়ে যেত?”

চিত্রলেখা ফোনটা কেটে দিল। দীপ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল।

ফোনটা খাটের ওপর রেখে ডাইনিং রুমে গেল। ঠোঙার ভেতর থেকে একটা শিঙাড়া নিয়ে আবার ঘরে এল। বাবা দুটো শিঙাড়া নিয়ে টিভি দেখতে বসেছে। মা বাড়ি নেই। থাকলে বাবাকে কিছুতেই শিঙাড়া খেতে দিত না।

দীপ ঘরে এসে দেখল হোয়াটসঅ্যাপে ঋতি মেসেজ করেছে, “হাই। কী করছ?”

দীপ লিখল, “জাস্ট ফিরলাম। তুমি ফিরেছ?”

ঋতি— ক্যাবে।

দীপ— ওকে।

ঋতি— তুমি জানো, একটা কথা মনে হচ্ছে।

দীপ— কী?

ঋতি— এতদিন মনে হচ্ছিল কবে নতুন দেশ দেখব, এতদিন খুব এক্সাইটেড ছিলাম। আজ হঠাৎ করে কেন জানি না খুব মনখারাপ করছে।

দীপ— ??

ঋতি— যদি বলি একজনের সঙ্গে মিট করার পর থেকে?

দীপ— কার সঙ্গে?

ঋতি— আছে একজন। ম্যাজিক জানে। আমার বাবাকে কবজা করে ফেলেছে। বাবা আমাকে ফোন করে তার নামে একগাদা সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে।

দীপ— কী রকম?

ঋতি— অনেক রকম। ১) এই জেনারেশনের ছেলে হলেও অত্যন্ত ভদ্র, সভ্য, ২) এই জেনারেশনের ছেলে হয়েও গুরুজনদের রেসপেক্ট করতে জানে… আরও কী কী সব…

দীপ— বাহ। ছেলেটা দারুণ লাকি তো! এত সুন্দরী একজনের বাবা এত ভালো ভালো কথা বলেছে। হি মাস্ট সেলিব্রেট টুডে।

ঋতি— অ্যাবসোলিউটলি। উইকেন্ডে ছেলেটার দাওয়াতের ফোন আসতে চলেছে আজ রাতের মধ্যেই। ছেলেটা কি উইকেন্ডে ফ্রি থাকবে?

দীপ ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসল। লিখল, “থাকবে। তবে মনে হয় ছেলেটা মেয়েটার সঙ্গে একা দেখা করতে বেশি আগ্রহী থাকবে। জাস্ট গেস।”

ঋতি— তাই নাকি?

দীপ— হ্যাঁ।

ঋতি— কিন্তু বাবা যে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে চায়, তার কী হবে?

দীপ— নিশ্চয়ই করবে। অবশ্য ছেলেটা আর মেয়েটা তো কালকেও দেখা করতে পারে। অফিস থেকে বেরিয়ে।

ঋতি— তা পারে। বাই দ্য ওয়ে, আমার আবার একটা কথা মনে হচ্ছে।

দীপ— কী?

ঋতি— এত তপস্যার পর ছেলেটা ভার্জিন হইয়া রহিল, এখন কি তবে তপস্যাভঙ্গের জন্য ছেলেটি ব্যাকুল হইয়া গেল?

দীপ কয়েক সেকেন্ড স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু হেসে সে লিখল— তপস্যাভঙ্গ হইবার তো কোনও রকম লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। কন্যা সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হইয়া গেলে ছেলেটি আর কী করিবে?

ঋতি বেশ কয়েকটা হাসির স্মাইলি দিয়ে লিখল— দু পক্ষেরই কষ্ট। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস এবং বিচ্ছেদ।

দীপ— বাই দ্য ওয়ে, ছেলেটির ভার্জিনিটি নিয়ে মেয়েটি এত চিন্তিত কেন জানতে পারি?

ঋতি— নাহ। থাক। দীর্ঘশ্বাস এবং বিচ্ছেদ অবধিই ঠিক আছে হয়তো।

দীপ— ট্রাজেডি শেক্সপিয়ারের লেখায় আর আশিকি টু-এর গল্পেই হয়। মেয়েটা সম্ভবত সেটা জানে না।

ঋতি— রিয়েলি? সত্যিই জানে না। তা কী রকম কমেডির প্যাকেজ ছেলেটা অফার করে শুনি?

দীপ— এই মাঝেসাঝে দেখা, সুখ দুঃখের গল্প করা, দু-চারটে ভাসমান চুম্বন, দু-চারটে ভালবাসার কথা।

ঋতি— চুম্বন? বাহ, বাহ। ছেলেটি দেখছি সাহসীও বটে!

দীপ— দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বেড়ালও সাহসী হয়ে যায়, ছেলেটা তো তবু মানুষ!

ঋতি— তাই নাকি? তা কেমন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল ছেলেটির? জানতে পারি?

দীপ— এত যুগ পরে একজন মনের মানুষ মেলার পর মেয়েটি যদি বলে দীর্ঘশ্বাস এবং বিচ্ছেদ, তবে কি ছেলেটির দেওয়ালে পিঠ না ঠেকা ছাড়া কোনও উপায় আছে?

ঋতি— হুউউউ… ছেলেটি তবে ভাসমান চুম্বনেই সন্তুষ্ট?

দীপ উত্তর না দিয়ে কয়েকটা হাসির স্মাইলি দিল।

ঋতি— ছেলেটা খুব ভদ্র। মেয়েটির বাবা ঠিকই ধরেছিল তবে।

দীপ— সেটা হওয়া ছাড়া আর তো অপশন নেই কোনও।

ঋতি— ফরচুন ফেভারস দ্য ব্রেভ। ছেলেটা জানে না বোধহয়।

দীপ উত্তর দিতে যাচ্ছিল এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল, চিত্রলেখা। দীপ ধরল, “হ্যালো।”

ওপাশ থেকে চিত্রলেখার থমথমে গলা শোনা গেল, “অন্যের কথা শুনে আমার বিচার করে নিলে?”

দীপ বলল, “আমার টায়ার্ড লাগছে, আমি পরে কথা বলি?”

চিত্রলেখা বলল, “লাগুক টায়ার্ড। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।”

দীপ বলল, “কী করে বলি বলো তো? আমার তো আর টাইম মেশিন নেই যে তোমার পাস্টে গিয়ে দেখে আসব তুমি সত্যি বলছ না ছেলেটা সত্যি বলছে, তাই না?”

চিত্রলেখা বলল, “দেখতে হবে না। ইটস ওকে। তবে একটা কথা বলতে পারি, আমি হয়তো একটু ন্যাগিং, একটু ইনসিকিওর, কিন্তু আমি মিথ্যেবাদী নই। পরের মুখে ঝাল খেলে তুমি। বেশ। তবে এখানেই সব কিছু শেষ হোক। ভালো থেকো।”

দীপ কোনও উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল। স্বস্তি লাগছিল খানিকটা। ঋতির সঙ্গে ফ্লার্ট করার সময় একরকম গিল্টি ফিলিংস হচ্ছিল। সেটা এবারের পর থেকে আর হবে না হয়তো।

ফোনটা রাখতেই তার ফোনটা আবার বেজে উঠল। দীপ চমকে দেখল ঋতি ফোন করছে। সে ধরতেই ওপাশ থেকে ঋতি বলল, “কী ব্যাপার, ছেলেটা বিজি হয়ে গেল হঠাৎ করে?”

দীপ হাসার চেষ্টা করল, “আর বোলো না। অফিস থেকে ফোন এসেছিল।”

—হুঁ… আই নো। আমারও সেম কেস। অফিসের জ্বালায় বাড়ির কাজ করাও মাথায় ওঠে।

—একজ্যাক্টলি, বাড়ি ফিরলে?

—এই তো বাড়ির সামনের রাস্তায়। আর পাঁচ মিনিট। আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

—কী?

—আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরনোর সময়েও ভাবিনি, এমন কারও সঙ্গে দেখা হবে যার সঙ্গে কথা হলে মনে হবে কেউ যেন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ভায়োলিন বাজাচ্ছে, বাতাসে মোহাব্বতে ব্র্যান্ড পাতা ঘুরে বেড়াবে, মিস্টার দীপ সুপুরুষ মহাশয়, আপনি কি ম্যাজিক জানেন?

১৮

“কিছু মানুষ আছে, যারা কেচ্ছা ঘাঁটতে ভালোবাসে। তাদের কী বলে জানেন?”

ধ্রুব বাগচী তার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন। মানালি বিশ্বরূপদার দিকে তাকাল।

ধ্রুব বললেন, “উঁহুঁ, বসের দিকে তাকালে হবে না। আপনাকে প্রশ্নটা করেছি। জবাবটা আপনি দেবেন।”

মানালি একটু ইতস্তত করে বলল, “কী বলে?”

ধ্রুব বাগচী তাঁর সামনে রাখা বড়ো কফি মাগে চুমুক দিয়ে বললেন, “তাদের পেজ থ্রি রিপোর্টার বলে। কে হেগে জল দেয় না, কোন নায়কের হাইড্রোসিল হয়েছে, কার যৌন মিলনের সময় দশ সেকেন্ডে কোর্স কমপ্লিট হয়ে যায়, এসব রিপোর্ট করা হল পেজ থ্রি রিপোর্টারের কাজ। দেশের কার কী প্রবলেম, কোথায় লোক খেতে পাচ্ছে না তাতে এঁদের কিচ্ছু এসে যায় না, টাইগার শ্রফের লেজের কালার নিয়ে এঁরা সবথেকে বেশি চিন্তিত। বুঝেছেন তো?”

ধ্রুব বাগচী একটুও উত্তেজিত না হয়ে কথাগুলো বললেন।

মানালির কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল।

আগের দিন রাত্রে ধ্রুব ফোন করে পরের দিন সকালে দেখা করতে বলেছিলেন। মানালি গলা শুনেই বুঝেছিল, রাত্রে মদ খেলেও ধ্রুব ভীষণ রেগে ছিলেন। একটাও বাড়তি কথা বলেননি। সকালে বিশ্বরূপদাকে ফোন করলে বিশ্বরূপদা ঠিক করে সেও যাবে মানালির সঙ্গে।

“ওকে ঝেড়ে লাভ নেই। অ্যাসাইনমেন্টটা ওকে আমিই দিয়েছিলাম।” বিশ্বরূপদা বলল।

ধ্রুব বললেন, “কেন দিয়েছিলেন?”

বিশ্বরূপদা বলল, “সেটা তো বলা যাবে না কেন দিয়েছিলাম।”

ধ্রুব মন দিয়ে কফিটা শেষ করে মাগটা টেবিলে রেখে বললেন, “ওকে। দিয়েছিলেন। বেশ করেছিলেন। এবার তবে ধ্রুব বাগচীর কেচ্ছা নামিয়ে ফেলুন। ওঁকেই বলছেন কেন, সেই লোকের পেছনের গন্ধ শুঁকে যাওয়া মালটাকেই বলুন না আমার কেচ্ছা নামাতে। নিজেকে বেশ রবীন্দ্রনাথ সুলভ মনে হবে। বইয়ের নাম দেবেন নাহয় ধ্রুব বাগচীর আদরের দাগ! বুলশিট যত রাজ্যের!”

মানালি পরিষ্কার বুঝতে পারছিল ধ্রুব বাগচী একটু একটু করে রাগছেন, কিন্তু উত্তেজনাটা কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছেন না।

বিশ্বরূপদা বলল, “দেখুন ধ্রুব, একটা জিনিস আপনাকে বুঝতে হবে।”

ধ্রুব বাধা দিয়ে বললেন, “কী বুঝতে হবে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “আমরা মুখে বাকস্বাধীনতার কথা বলি। অথচ নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগলেই সবথেকে বেশি সেটার বিরোধিতা করি। এই আপনিই তো সেদিন বাকস্বাধীনতার পক্ষে কত কথা বললেন। আপনার মনে হয় না ব্যাপারটা সেলফ কন্ট্রাডিক্টরি হয়ে যাচ্ছে?”

ধ্রুব বললেন, “আপনার কী হিসেবে মনে হয় লোকের ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে কেচ্ছা ঘাঁটাটা বাকস্বাধীনতার আওতায় পড়ে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “নিউজটা কি বেরিয়েছে ধ্রুব? তাহলে এত উত্তেজনা কেন? ইনফ্যাক্ট কালকে রাতেই মানালির সঙ্গে আমার এই বিষয়ে কথা হয়েছে। ঈপ্সিতার কাজটা নিয়ে আমরা একটা স্টোরি করব, ব্যস। আপনাকে কোনও ভাবেই টানা হবে না।”

ধ্রুব কয়েক সেকেন্ড বিশ্বরূপের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি এরকম কোনও কিছু চাইছি না। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”

মানালি দেখল ধ্রুব বাগচীর চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে।

ঠিক এই সময়েই তার খেয়াল হল দেওয়ালে একটা নতুন পোস্টার লেগেছে। মগনলাল মেঘরাজের। তার হঠাৎ করে খুব হাসি পেয়ে গেল। বিশ্বরূপদা কেমন জটায়ুর মতো পরিস্থিতিতে আছে বলে মনে হচ্ছে এখন। অনেক কষ্টে জিভ কামড়ে হাসি চাপল সে। তার এটা একটা সমস্যা। সিরিয়াস জায়গাগুলোতে হাসি পেয়ে যায় বিচ্ছিরিভাবে।

বিশ্বরূপদা বলল, “সরকারি কিছু বিজ্ঞাপন বন্ধ হবে। এই তো?”

ধ্রুব বাগচী ফুঁ দেবার ভঙ্গি করে বললেন, “সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করার মতো ভাটের কথা বলার লোক ধ্রুব বাগচী নয় সেটা আশা করি আপনি জানেন। আমি আপনাকে এথিক্সের দিকটা বোঝাতে চাইছি। সেটুকু বোঝার মতো বোধ বুদ্ধি আশা করি আপনার আছে।”

মানালি দেখল ধ্রুব বাগচী বেশ আক্রমণাত্মকভাবে গোটা ব্যাপারটার দখল নিতে এগোচ্ছেন।

বিশ্বরূপদা বলল, “ঈপ্সিতার ইনিশিয়েটিভের একটা নিউজ বেরোবে। যেখানে কোথাও ধ্রুব বাগচীর নাম মেনশন থাকবে না। এখানে আপনার আপত্তিটা কোথায় সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

ধ্রুব বাগচী বললেন, “আপনি এতটাও মাথামোটা নন বিশ্বরূপ।”

বিশ্বরূপদা বলল, “আমি আপনাকে কথা দিতে পারছি না ধ্রুব। আমি অফিসে ফিরি। একটু ভাবনা চিন্তা করে নাহয় আপনাকে জানাই?”

ধ্রুব মানালির দিকে তাকালেন, “আপনি প্রেম করেন? উত্তর দিতে না চাইলে দিতে পারেন, জাস্ট আস্কিং।”

মানালি দুদিকে মাথা নাড়াল।

ধ্রুব বললেন, “কেন করেন না?”

মানালি বলল, “সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই।”

ধ্রুব বললেন, “ঈপ্সিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? সংক্ষেপে বলুন।”

মানালি বলল, “খুব পারসোনালিটি আছে। চোখগুলো অসম্ভব সৎ। আপনার মতোই সিনেমা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে। বারে বারে মনে হয়েছে আপনারা মেড ফর ইচ আদার কাপল।”

ধ্রুব সোফায় পা তুলে বসলেন, “কতক্ষণ ছিলেন?”

মানালি বলল, “দুপুরটা।”

ধ্রুব বললেন, “দু ঘণ্টা খুব বেশি হলে?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ।”

ধ্রুব বললেন, “এইটুকু সময়ের মধ্যে আপনারা দশ পাতা প্রতিবেদন রেডি করে বসে আছেন। তাই তো?”

মানালি মাথা নাড়ল, “না, এখনও লেখা শুরু হয়নি।”

ধ্রুব বললেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিটা লোকের কাজ কী বলুন তো? ইমেজ বিল্ডিং করা। প্রতিটা সেকেন্ডে, প্রতিটা মুহূর্তে লোকটা চারদিকের লোকজনকে জানান দিয়ে চলেছে যে সে কত ভালো। কত সৎ। সে আসলে একজন সুপারম্যান, ছদ্মবেশে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে বেঁচে আছে। বাস্তব জীবনে গিয়ে বোঝা যায় আসল পার্থক্যটা। ঈপ্সিতা ফেসবুক করে না। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে নেই। কিন্তু শি ইজ অনেস্ট। ইমেজ বিল্ডিং করার দায় ওর নেই। রূপনারায়নপুরে ওর সঙ্গে অনেকেই আছে যারা এই কাজটার সঙ্গে যুক্ত। আপনার মনে হয় না, সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু ওকে নিয়ে লিখলে ব্যাপারটা মারাত্মক বায়াসড হয়ে যাবে? আপনার কি মনে হয় ঈপ্সিতা সেটা দেখলে খুশি হবে?”

মানালি চুপ করে বসে থাকল। ধ্রুব বললেন, “বলুন। আপনার বক্তব্যটাও মূল্যবান আমার কাছে। আপনি নিজে গিয়ে ওর ইন্টারভিউ করে এসেছেন যখন!”

মানালি বলল, “আমি তো ওঁর সঙ্গে স্কুলটা নিয়ে নিউজ করব বলেই ফোন করেছিলাম। আমি যদি সেটা নিয়ে নিউজ করি তাহলে আশা করি ওঁর বা আপনার কারও কোনও আপত্তি থাকবে না।”

ধ্রুব কাঁধ ঝাঁকালেন, “ওকে। কুল। গো অ্যাহেড।”

মানালি অবিশ্বাসী চোখে ধ্রুবর দিকে তাকাল, “তার মানে স্কুলটা নিয়ে স্টোরিটা করলে আপনার কোনও আপত্তি নেই?”

ধ্রুব বললেন, “আপাতত। তবে আশা করি স্টোরির ভিতর খোঁচা-টোচাগুলো থাকবে না। সেক্ষেত্রে আপত্তি থাকবে। এবং নিউজটা বেরোনোর পর আপত্তির জায়গাটা আশা করি আপনাদের পক্ষে সুখকর হবে না।”

মানালি ভাবছিল সব মিটে গেল, এবার উঠে পড়লেই হয়, এই সময় হঠাৎ তাকে অবাক করে বিশ্বরূপদা বলল, “এভাবে আপনি ঈপ্সিতার থেকে দূরে থাকতে পারবেন বলে আপনার মনে হয়?”

ধ্রুব বিশ্বরূপদার দিকে তাকালেন।

ঘরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল।

বিশ্বরূপদা পরের তিরটা ছুড়ল, “এভাবে সব সময় মেয়েটাকে পিষে রেখে যাবার চেষ্টা করে গেলেন। কী পাবেন এসব করে?”

ধ্রুব স্থির চোখে বিশ্বরূপদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা আসতে পারেন।”

বিশ্বরূপদা উঠল, “স্টোরিটা হবে মিস্টার বাগচী। আপনার হিসেবে নয়, আমার হিসেবেই হবে। আপনি যা করার করতে পারেন।”

ধ্রুব বিশ্বরূপদার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না।

মানালি উঠল। যতক্ষণ না তারা বেরোল, মানালি দেখল ধ্রুব বাগচী চুপচাপ বসে তাদের দেখে গেলেন।

ব্যাকগ্রাউন্ডে মগনলাল মেঘরাজ।

তবে এই সময় বিশ্বরূপদাকে আর জটায়ুর মতো লাগছিল না।

হাবেভাবে জটায়ুর গল্পের প্রথমজনের মতোই লাগছিল।

১৯

দরজা ধাক্কানোর শব্দে সকালে ঘুম ভাঙল দীপের। উঠে ঘুমচোখে ঘড়ি দেখে চমকে উঠল। সাড়ে আটটা বাজে। উঠে তাড়াহুড়ো করল না। একটু চেঁচিয়ে বলল, “উঠেছি।”

সে আগে বসকে ফোন করল। সমীরবাবু ফোন ধরে বললেন, “বলো।”

“স্যার আজ একটু ডাউন লাগছে, কাল ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে খারাপ লাগছিল বটে, আজ দেখছি একেবারেই উঠতে পারছি না।”

“ওকে ওকে। টেক রেস্ট। একটা দিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। আর ভাইরাল হলে তো হয়ে গেল। মেডিসিন নিয়ে নাও। টেক কেয়ার।”

ফোনটা রেখে দীপ বাইরের ঘরে গেল। মা উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, “কি রে, এত দেরি করে উঠলি? অফিস যাবি না?”

দীপ ব্যস্ততা দেখাল, “হ্যাঁ, যাব তো, দেরি হয়ে গেল।”

মা বলল, “যা যা, ভাত হয়ে গেছে, স্নান সেরে বেরোলেই দিচ্ছি।”

দীপ অফিস যাবার সময় যেমন ব্যস্ততা দেখায় তেমন ব্যস্ততা দেখিয়েই তৈরি হয়ে বেরোল। ঋতিও আজ কিছু একটা অজুহাত দেখিয়ে অফিস থেকে ছুটি নেবে। আগের রাতে এই প্ল্যানই হয়েছে।

অফিস টাইমের জ্যাম কাটিয়ে ঋতি যখন দীপের গাড়িতে উঠল তখন সকাল দশটা বাজে। দীপের একটা অদ্ভুত উত্তেজনা হচ্ছিল। ঋতি গাড়িতে ওঠার পর সে বুঝতে পারল তার হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সে বলল, “তৈমুর ড্রাইভ?”

ঋতি অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

দীপ হাসল, “লং ড্রাইভ?”

ঋতি বলল, “আমিও সেটাই ভাবছিলাম, কলকাতায় থাকলে অফিসের কেউ দেখলে দুজনেই কেস খাব। তুমি কি শরীর খারাপ বললে?”

দীপ বলল, “ইয়েস।”

ঋতি হাসতে হাসতে বলল, “সেম হিয়ার।”

দীপ গাড়ি স্টার্ট দিল। কেজো অফিসের বাইরে গিয়ে একদিন আচমকা ছুটি নেওয়া, সঙ্গে ঋতির সান্নিধ্য, তার নেশার মতো লাগছিল। সে বলল, “পারফিউমটা দারুণ কিন্তু, ব্র্যান্ডটা?”

ঋতি বলল, “দারুণ মানে তো অনেক রকম দারুণ হয়। তুমি কোনটা মিন করতে চাইছ?”

দীপ বলল, “সিডাকটিভ। তুমি ড্রাইভ করতে জানো তো? সিডাকশন বেশি হয়ে গেলে আমার ঘুম পেয়ে যায়।”

ঋতি হাসল, “তাহলে তো বিপদ। ঘুমিয়ে পড়লে বউ পালাবে যে।”

দীপ ছদ্ম টেনশন আনল গলায়, “সত্যিই। তাহলে তো ভারী বিপদ। আচ্ছা বউয়েরও তো একটা দায়িত্ব থাকা উচিত তাই না? আমাকে জাগিয়ে রাখার?”

ঋতি হাসল, “হুউ, শখ কত! উনি পড়ে পড়ে ঘুমোবেন আর ওনার বউ ওনাকে জাগিয়ে রাখবে!”

দীপ বলল, “হ্যাঁ শুনেছি লিপস্টিকের গন্ধ নাকি খুব ভালো জাগিয়ে রাখতে পারে।”

ঋতি বলল, “ওহ!!! এটা তো জানতাম না! তা অফিসে ঘুমিয়ে পড়লে বুঝি কোনও মেয়ে এরকম লিপস্টিকের গন্ধেই ঘুম ভাঙায়?”

দীপ কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “নাহ, অত সৌভাগ্য এখনও হয়নি। আপাতত খোঁজ চলছে।”

ঋতি বলল, “খোঁজ চলছে বুঝি? এখনও পাওয়া হয়নি? আমিও খুঁজতে শুরু করি তবে?”

দীপ বলল, “শিওর, সবাই মিলে খুঁজলে তবেই তো অরূপরতন পাওয়া যাবে।”

ঋতি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এই সময়ে বুকপকেট থেকে দীপের ফোনটা বেজে উঠল।

ঋতি বলল, “অফিস থেকে নাকি?”

দীপ বলল, “যেখান থেকেই হোক। ড্রাইভ করার সময় আমি ফোন রিসিভ করি না।”

ঋতি বলল, “ইউ আর এ বিজি পার্সন। যখনই দেখা হয়, তোমার ফোন রিং হয়ে যায়।”

দীপের সিক্সথ সেন্স বলছিল ফোনটা চিত্রলেখাই করছে। সে মিথ্যা করে বলল, “অফিসের প্রোজেক্টটা নিয়ে একটু বিজি আছি এখন। ওই ব্যাপারেই হয়তো।”

ঋতি জিভ কাটল, “ইশ, তাহলে কি আমি দেখা করার আবদারটা করে ভুল করলাম?”

দীপ বলল, “ধুস, আমার নিজেরই কি রোজ রোজ অফিস করতে ভালো লাগে নাকি? এসব নিয়ে ভেবো না। আমি ফোনটা সাইলেন্ট করে দিচ্ছি।”

তারা দ্বিতীয় হুগলি সেতুর টোল প্লাজায় চলে এসেছিল। টোল ট্যাক্স দিয়ে দীপ বলল, “বলুন মেমসাহেব, একদিকে যাইতেছে দিল্লি রোড, অপরদিকে মুম্বই। আপনি কোন দিকে যাইতে আগ্রহী?”

ঋতি বলল, “মুম্বই কদিনে পৌঁছোব, আর দিল্লি? বেশ একটা পথ যদি না শেষ হয় টাইপ ফিলিং আসছে কিন্তু।”

দীপ বলল, “ডিসিশন প্লিজ।”

ঋতি তার ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দীপের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “একটা আঙুল ধর।”

দীপ ঋতির তর্জনীটা ছুঁয়ে দিল। সামান্য স্পর্শেই একটা ম্যাজিক হল তার ভেতরে।

ঋতি বলল, “দিল্লি জিতল। দিল্লি চলো।”

দীপ বলল, “ওকে। তাই হোক।”

ঋতি বলল, “একটা কোথাও ফাঁকা দেখে একটু দাঁড় করানো গেলে দাঁড়িয়ো। একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলব।”

দীপ বলল, “ওকে।”

সাঁতরাগাছি পেরিয়ে, আরও কয়েকটা লোকালয় ছাড়িয়ে দীপ রাস্তার বাঁদিকে গাড়িটা দাঁড় করাল।

বলল, “ইয়েস। প্রসিড প্লিজ।”

ঋতি তাকে চমকে দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে তার ঠোঁটে একটা চুমু খেল।

দীপ প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি। সেও ঋতিকে জড়িয়ে ধরল।

কয়েক মিনিট ধরে পরস্পরকে তারা পাগলের মতো চুমু খেল।

হাইওয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো প্রচণ্ড গতিতে চলে যাচ্ছে।

ঋতি একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বলল, “আই অ্যাম সরি। অনেক কষ্টেও নিজেকে আটকাতে পারলাম না, বিলিভ মি।”

দীপ কয়েক সেকেন্ড পর বলল, “সরির কিছু নেই। আমারও খুব ভালো লাগছে।”

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। দুজনে নিজেদের সামলে নিচ্ছিল।

ঋতি বলল, “তো?”

দীপ বলল, “লং ড্রাইভ?”

ঋতি বলল, “অ্যাজ ইউ উইশ। রাস্তাঘাটে তো…”

দীপ ঋতিকে কথাটা শেষ করতে দিল না। আবার ঋতির ঠোঁটে চুমু খেল।

ঋতি আটকাল, “এখানে আর দাঁড়িয়ো না। লোকে দেখলে বাজে ব্যাপার হয়ে যাবে। চলো।”

দীপ বলল, “আমি তোমাকে পুরোটা পেতে চাই ঋতি। এভাবে রাস্তাঘাটে না।”

ঋতি দীপের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কোথায়?”

দীপ বলল, “যেখানে সম্ভব।”

ঋতি বলল, “নিয়ে চলো। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে, আমি চোখ বন্ধ করে সেখানেই যাব।”

কয়েক মিনিট চুপ করে বসে দীপ গাড়ি ঘোরাল।

ঋতি বলল, “কোথায় যাচ্ছ?”

দীপ বলল, “তোমার কোনও আই কার্ড আছে তোমার সঙ্গে? আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড?”

ঋতি বলল, “দুটোই আছে।”

দীপ বলল, “দেন বুক আ রুম। আনম্যারেড কাপলদের জন্য অ্যাপস আছে। ডাউনলোড করো।”

ঋতি বলল, “হোটেল?”

দীপ বলল, “হুঁ। সেফ। আমার অনেক কলিগই যায়।”

ঋতি বলল, “আর কোনও অপশন নেই?”

দীপ বলল, “মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করবে পুরোনো বাংলা সিনেমার মতো?”

ঋতি হেসে ফেলল।

ঘণ্টাখানেক বাদে তারা পার্ক স্ট্রিটের একটা হোটেলে চেক ইন করল।

২০

সকালে সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় টিফিন নিয়ে আসা হয়নি।

মানালি ভেবেছিল বাইরে গিয়ে লাঞ্চ করবে। বিতস্তাই বারণ করল।

বিতস্তা লাঞ্চে চাউ এনেছিল। পরিমাণে অনেকটাই ছিল। আশেপাশের ডেস্কগুলো ফাঁকা। বেশিরভাগই অফিসের নিচের খাবারের স্টল থেকে খেতে গেছে।

বিতস্তা খেতে খেতে বলল, “তোর মনে হচ্ছে না এই ধ্রুব বাগচীর ব্যাপারটা নিয়ে বিশ্বরূপদা একটু বেশিই তেতেপুড়ে রয়েছে?”

মানালি বলল, “সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার ওপর দিয়ে জাস্ট ঝড় চলছে। আমি আর পারছি না বিশ্বাস কর।”

বিতস্তা কাঁধ ঝাঁকাল, “তো সেটা নিয়ে খোলাখুলি ডিসকাস তো কর। বলে দে বিশ্বরূপদাকে।”

মানালি মাথা নাড়ল, “নাহ। বলব না। আমিও শেষ দেখতে চাই। দেখ আমি একটা জিনিস ক্লিয়ারলি বুঝতে পারছি। বিশ্বরূপদা চাকরি ছাড়বে বা যাই করবে, যাওয়ার আগে ধ্রুব বাগচীর সঙ্গে একটা বড়োসড়ো পাঙ্গা নিয়ে যেতে চাইছে।”

বিতস্তা বলল, “সেটাই তো বলছি। কানাঘুষো শুনছিলাম বাইরের কোন ইউনিভার্সিটিতে নাকি আরও কী সব পড়ার জন্য যেতে পারে। যদি সেটাই হয় তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যাওয়ার আগে কোনও স্কোর সেটল করতে চায়।”

মানালি বলল, “যা পারে করুক। বাদ দে তো। এখন লাঞ্চ টাইমে এসব বালের কথা বাদ দে। তোর কথা বল। তোর স্কোর কেমন চলছে?”

মানালি চোখ মারল।

বিতস্তা বলল, “অ্যাপটা সুপার ভাই। কখনও ট্রাই করে দেখিস।”

মানালি অবাক হল, “কোন অ্যাপটা?”

বিতস্তা বলল, “রুম ফর আনম্যারেড কাপল। জাস্ট সার্চ কর, হোটেলে আই কার্ড দিয়ে চেক ইন করে যা।”

মানালি চোখ বড়ো বড়ো করল, “হোটেলে?”

বিতস্তা বলল, “ইয়েস। হোটেলে। আমি আর সৌরভ তো একদিন হোটেলেই মিট করলাম। রেটটা যদিও একটু হায়ার সাইডে থাকে, কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই ভেরি স্মুদ।”

মানালি বলল, “সৌরভের ফ্ল্যাটে যেতিস যে, সেসব?”

বিতস্তা মুখ ব্যাঁকাল, “আরে সে আর বলিস না, অতিথি তুম কব যাওগে কেস। ওর এক মামার ছেলে এসেছে। সে ব্যাটা তিন দিন থাকব বলে সাত দিন থেকে গেল। কী করব বল? আমাদেরও তো কিছু একটা জুগাড় করতেই হবে, তাই না?”

মানালি বলল, “দেখিস বাবা, পুলিশের ঝামেলায় পড়িস না।”

বিতস্তা বলল, “দেশের তো কোনও আইনে বলে না হোটেলে আনম্যারেড কাপল থাকতে পারে না। তবে কীসের ঝামেলা?”

মানালি বলল, “তাহলে হোটেলগুলোতে রেইড হয় কেন?”

বিতস্তা বলল, “আই কার্ড ছাড়া থাকলে রেইড তো হতেই পার। সিকিউরিটি ইস্যুসও তো আছে। তবে সমস্যা হল, যে কারণে হেলমেট থাকলেও তোকে রাস্তাঘাটে পুলিশ ধরতে পারে, হোটেলগুলো ঠিক সে কারণেই রেইড হতে পারে। একটু স্ট্যান্ডার্ড হোটেলে অবশ্য এই ঝামেলা হয় না। আর-একটা ব্যাপার কী জানিস, শহরে গুচ্ছ গুচ্ছ হোটেল আছে, পুলিশ কি আর সব রুমে গিয়ে নক করে করে দেখবে যে ভিতরে কী চলছে?”

মানালি বলল, “দেখিস, আর যাই হোক হেডলাইন হোস না, তবেই হবে।”

বিতস্তা আক্রমণাত্মক হল, “আসুক না, বুঝে নেব। আমার রিলেশন, কীভাবে হ্যান্ডেল করব আমি বুঝে নেব। পাড়ার জেঠিমা কাকিমার মতো বিহেভ করবে আর আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলব?”

মানালি হেসে ফেলল, “এত ডেসপারেট হয়ে গেছিস কেন? সেরকম হলে বিয়ে বা লিভ টুগেদার কিছু একটা করে নিলেই তো পারিস! সপ্তাহে একদিন দুদিন খেপ খেলতে হয় না।”

বিতস্তা বলল, “করব। সৌরভ আর আমি আর-একটু সেটল হলেই করব। দ্যাখো বস, ভিতরে খিদে থাকবে, আর থার্টিজের নির্বাক সিনেমার নায়ক নায়িকার মতো চোখ দিয়ে চু কিত কিত খেলতে পারলাম না জাস্ট।”

মানালি বলল, “বাড়িতে বলেছিস সৌরভের ব্যাপারে?”

বিতস্তা বলল, “বলেছি। বাবা গাঁইগুঁই করছে।”

মানালি অবাক হল, “কেন?”

বিতস্তা বলল, “সৌরভ ব্রাহ্মণ না। বাবার জাত্যাভিমানে লাগছে।”

মানলি চোখ কপালে তুলল, “সে কী রে! তাহলে কী করবি?”

বিতস্তার চাউ শেষ হয়ে গেছিল। সে আঙুল চাটতে চাটতে বলল, “বাবাকে বলে দিয়েছি, মানুষ মঙ্গলগ্রহে ক্রিকেট খেলবে দুদিন পরে। তুমি এখন ব্রাহ্মণ মুচি মেথর দেখে বেরিয়ো না। বাবা শুনে হালকা খচেছে, তবে ক্যাজ করে নেব। চাপ নেই।”

মানালি বলল, “আর আন্টি?”

বিতস্তা বলল, “মা? মা হল জাতির, থুড়ি, আমার বিবেক। শুধু বলে বিয়ে কর বিয়ে কর।”

মানালি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ঘর ঘর কি কাহানি ভাই। কী আর করবি।”

ইন্টারকমের ফোনটা বাজছে, বিতস্তা বলল, “নে, তোরই হবে। বিশ্বরূপদা নিশ্চয়ই।”

মানালি ধরল, “হ্যালো।”

“চলে আয়।”

ফোনটা কেটে গেল।

বিতস্তা বলল, “ঠিক গেস করেছিলাম তো?”

মানালি বলল, “আর কী! কপাল!”

বিতস্তা বলল, “মুখটা ধুয়ে যা। বাচ্চাদের মতো খাস এখনও। ঠোঁটের কোনায় চাউ লেগে আছে। তোর একটা বয়ফ্রেন্ড দরকার ছিল। এই সময় ঠোঁট দিয়ে চাউটা টুক করে খেয়ে নিত।”

মানালি বাঁ হাত দিয়ে বিতস্তাকে ঘুসি মারল, “সব সময় এক জিনিস ভেবে যাচ্ছিস। ভাক।”

বিতস্তা চোখ মারল, “জওয়ানি কা জোশ বেটা, তুম নেহি সমঝোগে রমেশ বাবু।”

মানালি রেগে গেল, “কেন বে? আমার কি জওয়ানি নেই? সব শিলা কি জওয়ানি তোরই আছে?”

বিতস্তা হাসতে হাসতে হাত নাড়ল, “ব্যাপারটা তো তাই দাঁড়াচ্ছে, তোকে দেখে তো মনে হয় এসব নিয়ে তোর কোনও ইন্টারেস্টই নেই। হাউ ক্যান ইউ বি সো কাম মা? হাউ?”

মানালি বলল, “থাম। তোর সঙ্গে এত ভাট বকতে থাকলে বিশ্বরূপদা খচে যাবে। আমি যাই।”

বিতস্তা বলল, “যা যা। দেরি না, যা।”

মানালি ওয়াশরুমে মুখ ধুয়ে মুখ-টুখ মুছে বিশ্বরূপদার চেম্বারে ঢুকল।

বিশ্বরূপদা ল্যাপটপে কাজ করছিল। তাকে দেখে বলল, “পেজ ফোর না, ওটা পেজ থ্রি-ই বানা।”

মানালি বুঝল না, “মানে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “পেজ থ্রি নিউজ বানা অ্যাবাউট ধ্রুব বাগচী অ্যান্ড ঈপ্সিতা বাগচী। স্টোরিটা এভাবে বানা যে ফেমাস ডাইরেক্টর ধ্রুবর ঘর ভাঙল কেন? শ্রীপর্ণা ঘোষাল, নাকি অন্য কেউ? ঈপ্সিতা বাগচী কেন এত দূরে গিয়ে জনসেবা করে যাচ্ছেন? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে?”

মানালি হাঁ করে বিশ্বরূপদার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “না। সব ঠিক আছে।”

মানালি বলল, “তাহলে এরকম একটা ডিসিশন নিলে কেন হঠাৎ করে?”

বিশ্বরূপদা কাঁধ ঝাঁকাল, “আমার ইচ্ছে। একটা লোক ফালতু অ্যাটিটিউড নিয়ে যাবে, আর আমরা তাকে খোলা বাজারে ফ্রি স্পেস দিয়ে দেব, তা আর হবে না। অনেক হয়েছে লুকোচুরি। ধ্রুব বাগচীকে এক্সপোজ করার টাইম এসে গেছে। নিউজ হিসেবেও পাবলিক খাবে। আমাদের এক্সক্লুসিভ নিউজ থাকবে। একটা গোটা পাতা জুড়ে।”

মানালির নার্ভাস লাগছিল। বলল, “সব আমার নামে যাবে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “হোয়াই নট? তোর আবার কী প্রবলেম হল?”

মানালি বলল, “তুমি বুঝতে পারছ এই নিউজের ফলে ঠিক কী কী ঘটতে পারে? তা ছাড়া… আমি ঈপ্সিতা ম্যামকে কথা দিয়েছিলাম, ওঁর রিলেশন সম্পর্কিত কোনও কিছু এক্সপোজ করব না।”

বিশ্বরূপদা মানালির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “ওকে, নিউজটা এমনভাবে বানা তুই ঈপ্সিতাকে মিট করিসনি। তাহলে হবে তো?”

মানালি উশখুশ করে বলল, “তোমার আবার কী হল? ধ্রুব বাগচীর সঙ্গে কি তোমার কোনও ইগো ক্ল্যাশ হল?”

বিশ্বরূপদা পেপারওয়েটটা হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলল, “হতেই পারে। একটা লোক ঘরে বসে বিশ্বসুদ্ধ লোককে তুচ্ছ প্রমাণ করে যাবে, আর তার সিরিয়াস প্রবলেমগুলো দেখাতে গেলে সে ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ফেলবে, আমি তো তা হতে দিতে পারি না। লিখে ফেল।”

মানালি মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বলল, “আমার এথিক্সে আটকাবে। তুমি লেখো বরং। আমাকে তো এই হাউসে চাকরি করতে হবে বিশ্বরূপদা। তুমি বাইরে চলে যাবে বা অন্য চাকরি পেয়ে যাবে তোমার যা এক্সপেরিয়েন্স আছে। আমার কী হবে?”

বিশ্বরূপদা বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোকে হাতে ধরে কাজ শেখাচ্ছি আমি। বাকিদের মধ্যে তুই-ই একটু কমজোরি, সেটা তুইও জানিস। সব কিছুর মধ্যে ইনভলভড হয়ে যাস, রিঅ্যাক্ট করে ফেলিস বলে এখনও তোকে যতটা পারি আমিই গার্ড দি। এবারও দেব। আর কিছু?”

মানালি উঠল, “ওকে। লিখছি। দেখে দিয়ো। তবে নিজের ইচ্ছায় আমি কাজটা করব না। তোমার কথাতেই করব। এটা মনে রেখো।”

আর একটা কথাও না বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিশ্বরূপদা কী বলে শোনার জন্য দাঁড়াল না।

২১

“তোমার অপরাধবোধ হচ্ছে না তো?” প্রশ্ন করল দীপ।

দীপ সোফায় বসে ছিল। ঋতি খাটে শুয়ে। অনাবৃত। গায়ে কেবল একটা চাদর।

ঋতি দীপের দিকে তাকিয়ে হাসল, “একটু ব্যথা আর ছাড়া কোনও বোধ হচ্ছে না।”

দীপ বলল, “ব্যথা? কোথায়? মনে?”

ঋতি বলল, “তোমার কী মনে হয়?”

দীপ বলল, “হুঁ। ইট হার্টস।”

“তুমি ওই গানটা জানো? তুমি নরম ঠোঁটে স্বেচ্ছা ব্যথার নীল?”

দীপ ঋতির দিকে তাকাল, “চন্দ্রবিন্দু?”

ঋতি হাসল, “ইয়েস।”

দীপ বলল, “ইয়েস।”

ঋতি বলল, “করো তাহলে।”

দীপ বলল, “আমি গান জানি না।”

ঋতি বলল, “আমি জানি না। করতেই হবে।”

দীপ বলল, “বেসুরো? শুনলে পালাবে না তো?”

ঋতি বলল, “না করলে পালাব। প্লিজ।”

দীপ একটু গুনগুন করে বলল, “ধুস। হচ্ছে না।”

ঋতি হেসে বলল, “জীবন কত অদ্ভুত না? দিন দু-এক আগেও আমরা দুজন দুজনকে চিনতাম না। সেক্টর ফাইভেই হয়তো পাশাপাশি গেছি, কিন্তু কোনও দিন মুখোমুখি হইনি।”

দীপ সোফা থেকে উঠল। ঋতির পাশে বসে ঋতির চুলে আদর করতে করতে বলল, “আর একমাস পরে সবটাই লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ হয়ে যাবে।”

ঋতি বলল, “প্লিজ মনে করিয়ে দিয়ো না। তবে তুমি যদি চাও…”

দীপ বলল, “তুমি যদি চাও সূর্যকে নিয়ে যাব তোমাদের বাড়ি?”

ঋতি বলল, “জানি। এটা নচিকেতার গান। আমি সিরিয়াস দীপ। তুমি যদি চাও আমি যাওয়াটা ক্যান্সেল করে দেব।”

দীপ বলল, “চাকরি চলে যায় যদি?”

ঋতি বলল, “যাক না। ক্ষতি কী?”

দীপ বলল, “তোমার অনুশোচনা হবে না কোনও দিন?”

ঋতি অধৈর্য হল, “আজ থেকে এক বছর পরে কোনও এক অচেনা শহরে একা একা থাকার চেয়ে আমি আমার প্রিয়জনের কাছে থাকাটা বেশি প্রেফার করব দীপ।”

দীপ বলল, “জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত ঋতি, দিন কয়েক আগে আমিও স্টক মার্কেট ছাড়া আর কিছু বুঝতাম না। আজ আমি একবারও দেখিনি সেনসেক্সের কী হাল। আমার ফান্ডগুলো কোন পজিশনে আছে। ইউ চেঞ্জড মি। ইউ চেঞ্জড মি আ লট।”

ঋতি দীপের হাতটা নিয়ে চুমু খেল, “আমাকে একজন বলেছিল প্রেম এমন একটা জিনিস যেখানে কারও সঙ্গে দেখা হবার পরে অদ্ভুত ভাবে সব কিছু তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। আমি জানি না দীপ, তোমার মধ্যে কী আছে। কিন্তু কাল থেকে কী যে হয়েছে, তুমি যাবার পর থেকে আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবতেই পারছি না। আমি জানি, আর পাঁচটা লোক আমাকে খারাপ মেয়ে ভাববে… কিন্তু…”

দীপ ঋতির কথা শেষ করতে না দিয়ে ঋতিকে কাছে টেনে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল।

বলল, “আর পাঁচটা লোক আমরা কী করব সেটা ঠিক করবে না ঋতি। আমরা কী করব সেটা আমি আর তুমি ঠিক করব।”

ঋতি বলল, “সো দীপবাবু? অফিশিয়ালি আজ থেকে তুমি আর আমি আজ ভার্জিনিটি হারালাম, বলো?”

দীপ হাসল “ইয়েস। অফিশিয়ালি। অ্যান্ড ইট ফিলস লাইক হেভেন।”

ঋতি বলল, “আমরা এবার বেরোতে পারি না? আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে। যদি পুলিশ রেইড হয়?”

দীপ বলল, “আমার মনে হয় না এত ভালো হোটেলে পুলিশ আসবে। ওসব সস্তার হোটেলে হয়। তা ছাড়া অ্যাপটা যথেষ্ট রিলায়েবল।”

ঋতি বলল, “আইডিগুলো নিয়ে রেখে দিয়েছে। ওগুলো দিয়ে কী করবে?”

দীপ বলল, “সেটা তো সিকিউরিটি পারপাস। রিসেপশনে বলল, শুনলে না? বেরোনোর সময় ফেরত দিয়ে দেবে।”

ঋতি বলল, “হোটেল যতই সেফ হোক, আমরা এর পর অন্য কিছু খুঁজি বরং।”

দীপ বলল, “তাই হোক। চলো লেটস ম্যারি।”

ঋতি ব্যাজার মুখে বলল, “ধুস! তুমি একেবারেই রোম্যান্টিক নও! এটা কোন ধরনের প্রোপোজ হল?”

দীপ বলল, “তুমি কোন ধরনের প্রোপোজ চাও?”

ঋতি বলল, “অ্যাটলিস্ট জ্যোৎস্না রাত হবে, ক্যান্ডেল লাইট ডিনার হবে। এই দুটো ক্রাইটেরিয়া তো থাকতেই হবে। আর হ্যাঁ, ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন না, বাজবে ‘তুমি যে আমার’।”

দীপ বলল, “তথাস্তু। লেকিন, পূর্ণিমা কব হ্যায়? আরে ও সাম্বা, পূর্ণিমা কব হ্যায়?”

ঋতি হেসে ফেলল, “এক কাজ করো, রুম সার্ভিসে ফোন করে একটা ক্যালেন্ডার আনাও।”

দীপ বলল, “ভালো মনে করালে, রুম সার্ভিসের কথায় মনে পড়ল। লাঞ্চ অর্ডার করে দি?”

ঋতি বলল, “এখানে খাবে?”

দীপ বলল, “তাহলে কোথায় খাবে?”

ঋতি বলল, “হাইওয়ের কোনও ধাবায়?”

দীপ খাটে শুয়ে পড়ল, “পারলাম না। জাস্ট আর ড্রাইভ করতে পারলাম না বস। আমি ল্যাদ খেয়ে গেছি। আজ থেকে আমি সংসারী মানুষ। ভুঁড়ি বাগিয়ে সংসার করব, ব্যস।”

ঋতি বলল, “তাহলে আমিও ছেড়ে চলে যাব। ভুঁড়ি আমার দু চোখের বিষ। ইয়াক। আমি কল্পনাও করতে পারছি না তোমার ভুঁড়ি!”

দীপ বলল, “আর-একটু দূর কি শোচো। আমার একটা বড়ো টাক হয়েছে। বারান্দার মতো। ইয়াব্বড়ো একটা ভুঁড়ি। তুমি অফিস যাওয়ার আগে আমাকে একটা ইয়াব্বড়ো টিফিনকৌটো ধরিয়ে দিলে। আমি অফিস গিয়ে সে টিফিন খুললাম। টিপিক্যাল বাঙালি টিফিন। ভাত। ট্যালট্যালে ডাল। মাছের ঝোল।”

ঋতি বলল, “ঈশ!!! ছিঃ! আমি দূর কেন, কোনও ভাবেই এত কিছু ভাবতে পারছি না। আমাকে দিয়ে দয়া করে এসব ভাবিয়ো না। তোমার পায়ে পড়ি।”

দীপ বলল, “জিম পাঠানোর ট্রাই নেবে নাকি?”

ঋতি বলল, “সে যা ইচ্ছা করো, কিন্তু ভুঁড়ি যেন না হয়। ওর থেকে বড়ো টার্ন অফ আর কিছু হয় না আমার কাছে।”

দীপ বলল, “ওকে ম্যাম। তাই হোক।”

কলিং বেল বাজল।

ঋতি বলল, “দ্যাখো কে এল। পুলিশ না তো?”

দীপ বলল, “ধুস! পুলিশ কেন হবে? এত ভয় পাও কেন? দাঁড়াও দেখি।”

দীপ উঠল। জামাটা পরে কি-হোলে চোখ রেখে বলল, “হোটেলের বয়।”

ঋতি শ্বাস ছাড়ল, “উফ! ভয় পেয়ে গেছিলাম সত্যি।”

দীপ দরজা খুলল, “কী চাই?”

ছেলেটা বলল, “স্যার রিসেপশনে লাঞ্চের জন্য বলেছিলেন। কিছু লাগবে?”

দীপ বলল, “আমি ফোন করছি। নক করার দরকার নেই, ওকে?”

ছেলেটা বলল, “ওকে স্যার।”

ছেলেটা যেতে ঋতি বলল, “এই চলো তো। আমার একদম টেনশন পোষায় না। কলকাতা এখনও যথেষ্ট সেফ না আনম্যারেড কাপলদের জন্য।”

দীপ কাঁধ ঝাঁকাল, “আমার আচ্ছা খাসা ল্যাদটা নষ্ট হল। ঠিক আছে। তাই হোক, আমি ওয়াশরুম যাই। তুমি যাবে আগে?”

ঋতি উঠল, “না, যাও রেডি হয়ে নাও। আমিও যাই। ফালতু দেরি করে লাভ নেই।”

দীপ ওয়াশরুমে ঢুকল। ঋতি তৈরি হচ্ছিল, এমন সময় দীপের ফোনটা ভাইব্রেট হতে শুরু করল। ফোনটা ঋতির চোখের সামনেই ছিল। ঋতি দেখল “চিত্রলেখা” নামটা ভেসে উঠছে। সে ফোনটা ধরল না।

দীপ বেরোলে বলল, “চিত্রলেখা কে?”

দীপ ঋতির দিকে তাকিয়ে একটু থতোমতো খেয়ে বলল, “কলিগ। কেন বলো তো?”

ঋতি বলল, “টোটাল কাব্যিক নাম তো! ফোন করেছিল।”

দীপ মুখে ছদ্ম বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, “উফ, এঁরা একদিন ছুটি নিতেও দেবে না। অফিস জুনিয়র, বুঝলে তো? একেবারে কিছুই কাজ জানে না। ক্ষণে ক্ষণে শুধু বিরক্ত করতে জানে।”

ঋতি হাসল, “বিরক্ত না, ওরম বলে না। এমন হ্যান্ডু সিনিয়র থাকলে একটু জ্বালানো তো হক বনতা হ্যায় বস। জানো তো, আমারও এরকম একজন সিনিয়র ছিল অফিসে। আমি খুব বোকা সেজে তাকে ফোন করতাম। একদিন সানডেতে তাকে ফোন করেছিলাম। তার বউ ধরে সে কী ঝাড়! কেন অফিস আওয়ারসের বাইরে ফোন করেছি এটসেট্রা এটসেট্রা। বোঝো! আমি তখন জাস্ট কয়েকদিন হল জয়েন করেছি। ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ হয়েছে আর নতুন প্রোজেক্ট দিয়েছে। আমি কী করে বুঝব ব্যাটার বউ অমন সন্দেহ করে। ইনফ্যাক্ট উনি যে ম্যারেড সেটাই জানতাম না। খুব কেঁদেছিলাম।”

দীপ বলল, “হুঁ। ক্রাশ ছিল তাহলে।”

ঋতি চোখ নাচাল, “জ্বলল?”

দীপ ঠোঁট ওলটাল, “সুন্দরী বউ হবে। আরও কত জ্বলা বাকি!”

ঋতি বলল, “সুন্দরী না ছাই। তুমিও তো কম হ্যান্ডু না বাপু। তোমাকেও আমি চোখে চোখে রাখব দেখে নিয়ো। একদম অন্য মেয়েদের দিকে তাকাবে না, চোখ গেলে দেব।”

বলেই ঋতি হাসতে শুরু করল।

দীপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আবার ফোনটা বেজে উঠল।

ঋতি বলল, “এই, ফোনটা রিসিভ করো। নইলে বারবার ফোন করবে।”

দীপ বিরক্ত গলায় বলল, “ছাড়ো তো। রিসিভ করলেও হ্যাজ দিতে শুরু করবে। অত হ্যাজ এখন নিতে পারব না। চেক আউট করি চলো।”

ঋতি বলল, “এক কাজ করি? আমি রিসিভ করি? ঝাড়ব না, বিলিভ মি। ভালো করে কথা বলি।”

দীপ আঁতকে উঠেও সামলে নিল, “না না, কোনও দরকার নেই। চলো চলো বেরোই।”

ঋতি অবাক হয়ে বলল, “তুমি এত রিঅ্যাক্ট করে ফেলছ কেন?”

দীপ নিজেকে সামলে নিল, “আরে সেটা না, অফিসে শরীর খারাপ বলেছি না, এখন যদি তুমি ধরো তখন অন্য ঝামেলা হতে পারে। ভেবে নেবে অ্যাপো মারছি। বুঝলে তো?”

ঋতি মাথা নাড়ল, “পয়েন্ট। ওকে। চলো বেরোই।”

দীপ বলল, “তোমার ইচ্ছাই থাকল। তবে হাইওয়েতে ধাবায় পৌঁছোতে পৌঁছোতে খিদে পাবে না তো?”

ঋতি হাসল, “পাবে না। এত চুমু খেয়েছ পেট ভরে গেছে।”

 ২২

মানালি ঘুমাচ্ছিল।

ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে।

মানালি কোনও মতে হাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করল, “হ্যালো।”

“কি রে, এটা কী নিউজ করেছিস?!” বিতস্তার উত্তেজিত গলা ভেসে এল ওপাশ থেকে।

মানালি ঘুমচোখে বলল, “রাখ এখন। পরে করছি।”

বিতস্তা বলল, “শোন শোন শোন। রাখিস না প্লিজ।”

মানালি বিরক্ত গলায় বলল, “বল। কাল সাড়ে এগারোটায় বাড়ি ফিরেছি সব কাজ সেরে। আজকে যাওয়ার কথা ছিল না তো নিউজটা। চলে গেছে?”

বিতস্তা বলল, “সেটাই তো বলছি। পেজ থ্রি নিউজ এত প্রম্পট বেরোয় এই প্রথম দেখলাম। আর তার ওপর এ তো পাতাজোড়া কেচ্ছা রে! কেচ্ছা নামানো তাও যুদ্ধকালীন তৎপরতায়! ইম্প্রেসিভ!”

মানালি বলল, “দেখিনি নিউজপেপার এখনও। রাখ দেখছি।”

বিতস্তা বলল, “ওকে, দেখা মাত্র কলব্যাক করিস। অফিস আসছিস কখন?”

মানালি বলল, “দেখি।”

ফোনটা কেটে দিল সে।

সকাল সাড়ে আটটা বাজে। মানালি উঠে বাইরের ঘরে গিয়ে বসল। মা তাকে দেখে বলল, “বাবা ফিরছে আজ। ছুটি পাবি?”

মানালি বলল, “দেখছি তাড়াতাড়ি চলে আসা যায় নাকি। কাগজ এসেছে?”

মা বলল, “হ্যাঁ, টিভির টেবিলে দেখ। কী এমন রাজকাজ আছে আজ যে ছুটি পাবি না?”

মানালি উত্তর না দিয়ে ড্রয়িং রুমে গেল। মা গজগজ করতে লাগল।

বহুদিন পরে তার এমন পাতাজোড়া একটা স্টোরি বেরিয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ নিজের নামটা দেখল মানালি। তারপর নিউজটা পড়তে শুরু করল। গত রাতে বিশ্বরূপদার সঙ্গে বসে যতটা লেখা হয়েছিল তেমনটাই বেরিয়েছে। ঈপ্সিতা বাগচীর একটা ছবিও বেরিয়েছে কাগজে।

শ্রীপর্ণা ঘোষালের সঙ্গে ধ্রুবর একটা ছবি বেরিয়েছে।

“কী কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ধ্রুবর? শ্রীপর্ণা, নাকি অন্য কেউ? পর্দার আড়ালে কে? খুঁজলেন মানালি।”

হেডলাইনটা এই। কাগজটা নিয়ে নিজের ঘরে গেল সে।

উত্তেজিত লাগছিল খানিকটা।

একটু ভেবে বিশ্বরূপদাকে ফোন করল সে। একটা রিং হতেই ধরল বিশ্বরূপদা, “এই তো, তোর ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, বল। ধ্রুব ফোন করেছে নাকি?”

মানালি কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “নিউজটা শনিবার যাবার কথা ছিল না?”

বিশ্বরূপদা বলল, “দেরি হয়ে যেত তো। অন্য কোনও মিডিয়া নিউজটা করে দিলে ফুল কেলো হয়ে যেত। রিস্কটা নেওয়া গেল না আর কি! এত বড়ো স্কুপ অন্য কোনও মিডিয়া পেলে ছাড়ত? তোর কী মনে হয়? তুই তো এখন টক অফ দ্য টাউন হয়ে যাবি। এত বড়ো এক্সক্লুসিভ নিউজ করলি। দেখ দেখ, কত ফোন আসবে আজ।”

মানালি বলল, “হুঁ। রাখছি। শোনো আজ যাচ্ছি না। কাজ আছে।”

বিশ্বরূপদা বলল, “রাগ হল নাকি?”

মানালি বলল, “নাহ। বাবা আসবে। বাড়িতে অনেক কাজ আছে। বাই।”

বিশ্বরূপদাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল সে। ফোনে একটা এস এম এস এসেছে। ঈপ্সিতা বাগচীর। সকালেই এসেছে। লেখা, “ফ্রি থাকলে ফোন করবেন একটু।”

মানালি বেশ খানিকক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। একটু ভেবে ফোনটা করল।

ঈপ্সিতা ধরলেন একবারেই, “গুড মর্নিং।”

মানালি খানিকটা কুণ্ঠিত ভাবে বলল, “গুড মর্নিং ম্যাম। নিউজটার ব্যাপারে ফোন করেছেন?”

ঈপ্সিতা বললেন, “হ্যাঁ। আমার একটাই কথা বলার। আমি ভেবেছিলাম এখনও হয়তো কেউ কেউ আছে যাকে ভরসা করা যায়। আপনাকে দেখে আমার তেমনটাই মনে হয়েছিল। ভুলটা আজ ভাঙল।”

মানালি বলল, “দেখুন ম্যাডাম, আমি এই ব্যাপারে একেবারেই কিছু বলতে পারব না। নিউজটায় শুধু নামটা আমার গেছে। গোটাটাই আমার বস বিশ্বরূপদার পরিকল্পনা অনুযায়ী লেখা।”

“রিপোর্টটা তো আপনার নামেই হয়েছে। আর দিনের শেষে সেটাই ম্যাটার করবে, তাই না?” ঈপ্সিতার গলাটা শান্ত।

মানালি একটু থেমে বলল, “দেখুন ম্যাম, আমার কেরিয়রটা জাস্ট শুরু হয়েছে। অনেক সিদ্ধান্তই আমি নিতে পারি না যেটা হয়তো নিতে চেয়েছিলাম। এই স্টোরিটার ব্যাপারও একেবারেই তাই। ধ্রুব বাবুর সঙ্গে বিশ্বরূপদার সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে যে এই নিউজটা তৈরি হবে, বিশ্বাস করুন ম্যাম, আমি কালকে এই সময়ে দাঁড়িয়েও ভাবতে পারিনি।”

ঈপ্সিতা বললেন, “বিশ্বাস করা না-করার ওপরে তো আর কিছু দাঁড়িয়ে নেই এখন। যা হবার তা তো হয়েই গেল। যাই হোক, ভালো থাকুন। আর হ্যাঁ, ওকে তো চেনেনই। একটু সামলে থাকবেন। নিজের মত অনুযায়ী কিছু না ঘটলে লোকটাকে আর চিনতে পারা যায় না।”

ফোনটা কেটে গেল।

মানালি ফোনটা অফ করে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল। মা ঘরে এসে বলল, “টিফিন রেডি আছে। স্নান করে নিয়ে যাস।”

মানালি বলল, “আজ ছুটি নিলাম।”

মা খানিকক্ষণ অবিশ্বাসী চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “সূর্যটা কোনদিকে উঠেছে আজ কে জানে।”

মা বেরোলে মানালি ফোনটা নিয়ে অন করল।

বাবাকে ফোন করল। বাবা বলল, “কি রে, এই ফ্লাইট থেকে নেমে ফোন অন করলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ফোন? বল কী বলবি।”

মানালি বলল, “আর কতক্ষণ বাবা?”

বাবা বলল, “আর বড়োজোর দেড় ঘণ্টা। কী আনব বল।”

মানালি বলল, “কিছু আনতে হবে না। শিগগির এসো তো।”

বাবা অবাক গলায় বলল, “শিগগির মানে? কী হল আবার? মা ঠিক আছে তো?”

মানালি বলল, “উফ, তুমিও না! ওসব কিছু না। তুমি এসো, তারপর কথা হবে।”

বাবা ফোন রাখতে মানালি ফোনটা আবার অফ করতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেখল ধ্রুব বাগচী টেক্সট করেছেন, “কনগ্র্যাচুলেশনস।” শুধু এই শব্দটা লেখা। আর কিচ্ছু না।

মানালি প্রথমে ভাবল রিপ্লাই দেবে। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত বদলাল। তার ফোন বাজতে শুরু করল আবার। মানালি দেখল এবার শ্রীপর্ণা ফোন করছেন, ধরল সে, “হ্যালো।”

“এসব কী হল আজ?”

শ্রীপর্ণা ওপাশ থেকে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

মানালি বলল, “আই ক্যান এক্সপ্লেইন ম্যাম।”

শ্রীপর্ণা বললেন, “কী এক্সপ্লেইন করবে? আর কী বাকি আছে এক্সপ্লেইন করার? সেই ধ্রুবকে জড়িয়েই নিউজটা করতে হল?”

মানালি বলল, “গোটাটাই এডিটরের নির্দেশে ম্যাম।”

শ্রীপর্ণা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “আজ আমার জন্মদিন। তোমরা কী অসাধারণ গিফটটাই না দিলে আজ! স্পিচলেস!”

মানালি বলল, “প্লিজ ম্যাম। রাগ করবেন না। আমার ওপর যেমন যেমন ইন্সট্রাকশন ছিল তেমনটাই লিখেছি।”

শ্রীপর্ণা বললেন, “একজন মেয়ে হয়ে এই লাইনটা লিখতে লজ্জা হল না তোমার? এটা… এটা কী লাইন? শ্রীপর্ণার ফাঁকা ফ্ল্যাটে বারবার কীসের আকর্ষণে যেতেন ধ্রুব? ছিঃ! একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ককে তোমরা এভাবে খোলাবাজারে খেলো করে দিলে! আমি ভাবতেই পারছি না।”

মানালির দম আটকে আসছিল। সে কোনওমতে “ম্যাম এই নিউজ রিলেটেড সব রকম কথা বিশ্বরূপদার সঙ্গে করলে ভালো হয়” বলে ফোনটা কেটে দিল।

সে কয়েক সেকেন্ড বসে ধ্রুব বাগচীকেই ফোন করল। টেনশন এতটাই হচ্ছিল তার যে আর নিজেকে সে সামলে রাখতে পারল না।

ফোনটা ধরে ধ্রুব শান্ত গলায় বললেন, “নিশ্চয়ই আপনি কিছুই জানেন না নিউজটার ব্যাপারে?”

মানালি থমথমে গলায় বলল, “আমার ওপর যা ইন্সট্রাকশন ছিল তাই লেখা হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলার নেই আমার।”

ধ্রুব বললেন, “দারুণ কাজ করেছেন। আমি খুশি হয়েছি। এস এম এসটা পড়েননি? আমি তো আপনাকে কনগ্র্যাচুলেট করলাম আবার।”

মানালি বুঝতে পারল না ধ্রুব এত ঠান্ডা মাথায় কেন কথা বলে যাচ্ছেন। ঝড়ের খানিকটা আভাস সে পাচ্ছিল।

ধ্রুব বললেন, “ইয়েলো জার্নালিজম অনেক দেখেছি। তবে আপনাদের মতো নির্লজ্জ এবং নির্বোধ জার্নালিস্ট এই প্রথম দেখলাম। চাকরি চলে গেলে কী করবেন ভেবেছেন? ওহ, আপনারা তো মেয়ে। মেয়েদের তো সাত খুন মাফ। কিছু বলা যাবে না। বললেই সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কেস করে দেবে।”

মানালি বুঝল ধ্রুবর রাগ ওয়ার্ম আপ শুরু করে দিয়েছে। সে ফোনটা কেটে অফ করে রেখে দিল।

২৩

ঋতিকে নামিয়ে দীপের ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল।

বাড়ি থেকে বারবার ফোন আসছিল রাস্তাতেই। দীপ ধরেনি। দরজা খুলে তাকে দেখে মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ফোন ধরছিলি না কেন?”

দীপ বলল, “বারবার বলেছি যখন ফোন ধরব না তখন বুঝে নেবে ড্রাইভ করছি, রাস্তায় যা জ্যাম ছিল।”

বাবা বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিল। বলল, “একবার ফোন করে দিলেই পারতিস। তোর মা তো সন্ধে সাতটার পর থেকেই রোজ ঘর বার করা শুরু করে দেয়। ইতিহাসে কাঁচা ছিল তো।”

দীপ অবাক হয়ে বলল, “মানে? এর সঙ্গে ইতিহাসে কাঁচা হবার সম্পর্ক কোথায়?”

বাবা বলল, “ওই যে, তোর যে রোজ ফিরতে দেরি হয় সেটা ভুলে যায়।”

মা বাবাকে ধমক দিল, “তুমি থামো তো! আমার কেমন চিন্তা হয় তা যদি বুঝতে।”

বাবা বলল, “আমার ভাগের চিন্তাটাও তুমি নিয়ে রেখেছ আগেকার দিনের সুলতানদের মতো। আমি আর কী করব।”

মা বলল, “তুই হাত পা ধুয়ে আয়, আমি খেতে দিচ্ছি।”

দীপ বলল, “না না, আমি খেয়ে এসেছি, অফিসেই। আজ আর খাব না।”

বাবা অবাক গলায় বলল, “বাবা, অফিসগুলো দেখছি আজকাল খাবারও দিচ্ছে। কালে কালে কত দেখব। আমাদের অফিসে তো ক্যান্টিনের খাবার একদিন খেলে দশদিন পেট খারাপে শুয়ে থাকতে হত। সবই আইটির দয়া।”

মা গজগজ করছিল। দীপ তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে হাত পা ধুয়ে ঘরে ঢুকে গেল।

ঋতি মেসেজ করেছে বাড়ি ফিরে গেছে। দীপ দেখল হোয়াটসঅ্যাপে চিত্রলেখার একগাদা মেসেজ এসেছে।

শেষে একটা ভয়েস মেসেজ এসেছে। রাত আটটা নাগাদ। দীপ প্লে বাটন টিপল, ওপাশ থেকে চিত্রলেখার গলা ভেসে এল, “দীপ, তোমাকে সারাদিন ধরে বারবার চেষ্টা করে গেলাম। পেলাম না। আমি বুঝতে পারছি তুমি একটা সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে একটা ডিসিশন নিয়েছ। আমি জানি, বুঝতে পারি তুমি যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছ সেটা তোমার দিক থেকে খুবই ভ্যালিড, কিন্তু বিশ্বাস করো, ছেলেটা ইচ্ছা করে তোমাকে কথাগুলো বলেছে। আমাদের মধ্যে এমন কোনও কিছুই হয়নি। ছেলেটা একটা সাইকো দীপ। ও চায় আমার জীবনটা দুমড়ে মুচড়ে যাক। আজ ও সফল। আমি হেরে গেলাম দীপ। ভালো থেকো। এইটুকুই বলব। আর কখনও তোমাকে বিরক্ত করব না। সবশেষে একটা রিকোয়েস্ট করব। আমরা একবার শেষ বারের জন্য মিট করতে পারি? অনেক হ্যাংলার মতো কথাগুলো বললাম। তবু জানিয়ো।”

থেমে থেমে কথাগুলো একটু একটু করে বলেছে চিত্রলেখা। দীপ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকল। হঠাৎ করে একটা অপরাধবোধ তার মাথায় একটু একটু করে চেপে বসছিল।

সে ফোনটা রেখে ড্রেস চেঞ্জ করে খাটে এসে বসল। ঋতি ফোন করছে। ধরল দীপ, “সব ঠিকঠাক তো?”

ঋতি বলল, “ইয়েস অ্যান্ড থ্যাংক ইউ।”

দীপ বলল, “ফর হোয়াট?”

ঋতি বলল, “আর কীসের জন্য হতে পারে? সব কিছুর জন্য। বিশেষ করে আজকের দিনটার জন্য।”

দীপ বলল, “তাহলে তো সেম টু ইউ বলতে হয় ঋতি রানি।”

ঋতি বলল, “বাড়িতে সব ঠিকঠাক তো? এত রাতে ফিরলে, বাবা মা কিছু বললেন না?”

দীপ বলল, “আমার তো হয়েই থাকে রাত। প্রায়ই। অতটা চাপ হয় না। তোমার বাবা কিছু বললেন বুঝি?”

ঋতি হাসল “আমারও হয়, তবে আজ একটু বেশিই হল। তবে সবথেকে খারাপ পার্ট হল আমাকে ভাত খেতে হল।”

দীপ আঁতকে উঠল, “সে কী! বলোনি তুমি যে খেয়ে এসেছ?”

ঋতি বলল, “না। বললেই মা একগাদা প্রশ্ন শুরু করে দিত। ওই গ্র্যান্ড ভাইভা অ্যাটেন্ড করার থেকে ভালো খেয়ে নেওয়া। বমি করলাম অবশ্য।”

দীপ বলল, “বোঝো। বমি করলে যখন মা কিছু বুঝল না?”

ঋতি বলল, “আমার দোতলায় ঘর তো। ওরা নিচে থাকে। বুঝবে না। এসেই মিউজিক সিস্টেমে হাই ভলিউমে গান চালিয়ে দিয়েছিলাম।”

দীপ হাসতে হাসতে বলল, “যাহ্, তাহলে তো কোনও চিন্তাই নেই।”

ঋতি বলল, “নেই আবার। হুহ। আমার মার প্রশ্নের সামনে তো কোনও দিন পড়নি, তাই বলছ এই কথা। যেদিন পাবে, দেখবে একে ফরটি সেভেনের মতো থেকে একের পর এক প্রশ্ন বেরিয়ে আসছে।”

দীপ বলল, “ওরে বাবা। সেটা আবার কবে হবে? ফ্লাইটে তো সেরকম কিছু মনে হল না।”

ঋতি বলল, “কী করে মনে হবে? তুমি তখন অপরিচিত একজন মানুষ ছিলে। এর পরে তো আর থাকবে না দীপবাবু। তখন বুঝবে।”

দীপ বলল, “আচ্ছা? বেশ তাই হোক।”

ঋতি বলল, “তো? কাল থেকে আবার সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়?”

দীপ বলল, “আর একমাস পরে তো তোমার সেটা থাকছে না। তখন?”

ঋতি বলল, “তোমাকে বলেছি না এটা মনে করাবে না?”

দীপ বলল, “তবে কী মনে করাব বলো? মনে করতে না চাইলেও তো সেটাই মনে পড়ে যাচ্ছে। কী করব?”

ঋতি বলল, “মনে করবে না ব্যস। তুমি আমাকে এমন করে ভালোবেসো যেন কোথাও যেতে না হয়। পারবে?”

দীপ বলল, “পারব। অবশ্যই পারব।”

ঋতি বলল, “ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেব ট্যাগ করে?”

দীপ বলল, “ইয়েস। গো অ্যাহেড।”

ঋতি বলল, “রাখছি। স্ট্যাটাসটা দিয়েই ঘুমোতে যাব। সকালে রিঅ্যাকশনগুলো দেখব।”

দীপ হাসল, “বেশ। গুড নাইট।”

ফোনটা রেখে দীপ সবার আগে ফেসবুক খুলে ব্লক করার জন্য চিত্রলেখার ফেসবুক প্রোফাইল খুঁজল। পেল না। বুঝল চিত্রলেখা প্রোফাইল আবার ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছে।

কয়েক মিনিট পরেই দেখল ঋতি তাকে ট্যাগ করেছে। ট্যাগটা অ্যাক্সেপ্ট করল সে। মিনিট দশেকের মধ্যেই ফেসবুকে কনগ্র্যাচুলেশন আসতে শুরু করল। নোটিফিকেশনের ঠেলায় দীপ নেট অফ করে দিল।

খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পরে তার ঘুম এসে গেল।

ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছিল সে, ফোন রিং হবার শব্দে ঘুম ভাঙল তার। ভেবেছিল চিত্রলেখা ফোন করছে, ফোনে চোখ পড়তে ভুলটা ভাঙল। ঋতি। সে ধরল, “বলো।”

“তুমি এটা কী করলে দীপ?”

ওপাশ থেকে ঋতির গলা গম্ভীর।

দীপ অবাক হল, “কী করলাম?”

ঋতি বলল, “তুমি এত বড়ো মিথ্যাবাদী আমি আগে বুঝলাম না কেন?”

দীপের একটা হার্টবিট মিস হল, “কেন?”

ঋতি বলল, “এইমাত্র চিত্রলেখার সঙ্গে আমার কথা হল। তুমি ওর সঙ্গে রিলেশনে ছিলে? আর আমাকে সারাদিন ধরে এতগুলো মিথ্যে কথা বলে গেলে?”

দীপের মুখ থেকে নিজে থেকেই বেরিয়ে এল, “হোয়াট দ্য ফাক।”

ঋতি কেঁদে ফেলল, “আমি ভাবতেই পারছি না তুমি আমার সঙ্গে এত বড়ো একটা… জাস্ট…”

দীপ কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আক্রমণাত্মক হল, “দ্যাখো ঋতি, আমি তোমাকে সব বলতেই যাচ্ছিলাম। চিত্রলেখা যা বলছে তার সবটা মিথ্যা। বিলিভ মি।”

ঋতি বলল, “পরে কথা বলছি। কিংবা আদৌ আর কোনও দিন তোমার সঙ্গে কথা বলব নাকি ভাবব। আমাকে আর ফোন কোরো না। বাই।”

ফোনটা কেটে গেল। দীপ সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করতে গিয়ে দেখল ঋতি ফোনটা অফ করে দিয়েছে। সে বেশ খানিকক্ষণ উঠে চুপচাপ বসে থাকল। মাথায় আগুন জ্বলছিল তার। চিত্রলেখাকে ফোন করল সে। ফোন বাজছিল। চিত্রলেখা ফোন ধরছিল না।

সাত-আটবার টানা রিং করে যাবার পরে অবশেষে চিত্রলেখা ফোন ধরল, বলল, “বলো।”

দীপ বলল, “তুমি যখন বুঝলে আমি তোমায় ফোন করছি না, আশা করি তখনই বুঝে গেছিলে তোমায় আমি চাইছি না।”

চিত্রলেখা হাসল অনেকক্ষণ ধরে। হাসতে হাসতে কেঁদে দিল শেষমেশ।

দীপ চাপা গলায় গর্জন করল, “ন্যাকামি করবে না চিত্রলেখা। একদম ন্যাকামি করবে না।”

চিত্রলেখা বলল, “তা তো করবই না। সম্পর্কে থাকতে থাকতে আর-একজনকে পেয়েই আমাকে ভুলে গেলে একটু ন্যাকামি করব না তা কি হয়? কী ভাগ্যে ফেসবুকটা ডিঅ্যাক্টিভেট করা ছিল। আর কী ভাগ্যেই না অসাবধানতাবশত লগ ইন করলাম। নইলে এত বড়ো যাত্রাপালাটা দেখার সৌভাগ্যই হত না।”

দীপের মাথায় আগুন জ্বলছিল। সে ফোনটা কেটে দিল।

ফেসবুক খুলে দেখল ঋতি তাকে ব্লক করে দিয়েছে।

২৪

“কি রে তোদের খবর কী?”

ঘরে ঢুকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল বাবা।

মানালি বলল, “সব ঠিকঠাক। নাগপুর কেমন ছিল?”

বাবা বলল, “ভালো। খাওয়াদাওয়া কদিন বাইরে হল এই যা।”

মা বলল, “হ্যাঁ, তোমার তো ভালোই। ঘরের খাবার তো তোমার আবার মুখে রোচে না।”

বাবা বলল, “সে বললে হবে? বাইরে থাকলে বোঝা যায় ঘরের খাবারের আসল দাম। যাক গে, মানির বিয়ে ফাইনাল করে ফেলেছ নিশ্চয়ই? আমি বেরোনোর আগে তো অনেক আশার কথা শোনালে।”

মা কড়া চোখে বাবার দিকে তাকাল, “সবই তো জানো। জেনেশুনে কেন অ্যাক্টিং করছ?”

মানালি অবাক হয়ে মার দিকে তাকাল, “মানে? তোমার সবটাই প্রি-প্ল্যানড ছিল?”

মা ব্যাজার মুখে বলল, “সে যাই থাক, তুই তো আর সেসব দিনের আলো দেখতে দিলি না। কোন না কোন একটা ছেলে ধরে নিয়ে আসবি কে জানে!”

বাবা মানালির দিকে তাকাল, “কই রে, দেখালি না তো! আমাকে তো অ্যাটলিস্ট দেখাতে পারতিস ছেলেটাকে।”

মানালি বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমরা একটু থামবে প্লিজ? আমার একদম এসব কথা ভালো লাগছে না। অফিস নিয়ে এমনিতেই ভীষণ টেনশনে আছি।”

বাবা অবাক হল, “কেন? কী হল আবার অফিসে?”

মা গজগজ করতে করতে বলল, “ও অফিস করার কী মানে বুঝি না বাপু! ফেরার ঠিক নেই, যাওয়ার ঠিক নেই, আজ এখানে যাচ্ছে, কাল ওখানে যাচ্ছে। কী দরকার আছে তোর চাকরিটা করার?”

মানালি বাবার দিকে তাকাল, “আমি বেরোই বাবা। পরে কথা বলব।”

মা রেগে গেল, “দেখলে? যেই আসল কথাটা বললাম মেয়ের ঝাল লেগে গেল। তুই তো বলেছিলি আজ ছুটি নিবি।”

মানালি উঠে পড়ল, “ঘরে আর কুড়ি মিনিট থাকলে দেখতে পাব বিকেলের মধ্যে তুমি আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছ। আমার এমনিতেই অনেক প্রেশার আছে। বেরোলাম। রাতে কথা হবে।”

ঘরে গিয়ে স্নান করে চেঞ্জ করে চার্জার আর ফোন নিয়ে মানালি বেরোল।

মা রান্না বসিয়েছিল। বাবা তাকে দেখে ফিসফিস করে বলল, “তাড়াতাড়ি ফিরিস। সন্ধেয় আমরা চাইনিজ খেতে যাব।”

মানালি রেগে ছিল, বলল, “তুমি মাকে বলো সর্বক্ষণ একই ক্যাসেট রিওয়াইন্ড না করে যেতে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি জাস্ট।”

বাবা বলল, “বলব বলব। সাবধানে যা। তাড়াতাড়ি ফিরিস।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানালি ঠোঁট কামড়াল।

যখনই মনে পড়ছিল অফিস গেলেই আবার গোটা কন্ট্রোভার্সিটা সামলাতে হবে তাকে, তখনই গায়ে জ্বর চলে আসছিল। রাস্তায় খানিকটা পথ উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে একটা বাসে চড়ে বসল। ঠিক করল কোনও একটা শপিং মলে গিয়ে সারাদিন সিনেমা দেখবে, নিজের সাথে সময় কাটাবে একা একা। চাকরি করার আগে এভাবে সময় কাটাত সে। সব সময় সঙ্গী দরকার পড়ে না। একা ঘোরারও একটা আলাদা মজা আছে।

বাসটায় খুব বেশি ভিড় ছিল না। মানালি বসার জায়গা পেল। শুনতে পেল তার সামনের সিটেই কমবয়সি দুজন ছেলে বেশ উত্তেজিত ভাবে চাপা গলায় ধ্রুব বাগচীর ব্যাপারে আলোচনা করছে।

একজন বলছে, “ভাই, আমি ভাবতাম আর যাই হোক, এই লোকটা অন্তত সাদা কাপড়ের লোক। এ তো দেখছি আরও এক কাঠি সরেস। কেচ্ছাটা জানতামই না ভাই?”

পাশের জন বলছে, “যাই বল, শ্রীপর্ণা ঘোষালের মধ্যে একটা অ্যাপিল আছে। এই বয়সেও ভদ্রমহিলা নিজেকে যা তা লেভেল মেন্টেন করেছে। ধ্রুব বাগচীর আর দোষ কী! ফাঁকা ফ্ল্যাট পেত। চলে যেত।”

দুজনেই উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসল। প্রথমজন বলল, “আমাদের কপাল দেখ, পরকীয়া করব কী, নিজেরটা করার মতো পাবলিক জোটাতেই প্যান্ট হলুদ হয়ে যাচ্ছে।”

পাশের জন বলল, “থাম, ওই লেভেলটায় গেলে সবার হয়। কোথায় ঝাঁসির রানি আর কোথায় বিছনায় মুতুনি।”

প্রথমজন রেগে গেল, “কেন বে? দাঁড়া না, চাকরিটা পেতে দে, দেখবি সামনে পিছনে দুটো করে মামণি নিয়ে ঘুরব। তুই দেখবি আর জ্বলবি, সি এফ এলের মতো ফুলবি।”

মানালির হাসি পাচ্ছিল। সে দেখতে পেল তার পাশে বসা গম্ভীর ভদ্রলোকও ছেলেদুটোর কথায় মুচকি মুচকি হাসছেন। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠার আলাদা মজা আছে। মাঝে মাঝে এমন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া যায়, যা মনের ভারকে অনেকটাই লাঘব করে দেয়।

ফোনটা একবার অন করল মানালি। একগাদা এস এম এস এসেছে। বেশি কিছু ভাবতে পারল না সে। ফোনটা অফ করে দিল।

হাইল্যান্ড পার্কে বাস থেকে নেমে গেল সে। সবে মলের দোকানগুলো খুলছে। খুব বেশি লোক আসেনি। বিগ বাজারে একা একা ঘুরল। এসকেলেটরে করে উপর নিচ করল। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক করে হঠাৎই তার চোখ পড়ল দীপের ওপরে। একা একা দাঁড়িয়ে কাচের ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মানালি এগিয়ে গেল, “কী ব্যাপার? অ্যাপো আছে নাকি?”

দীপ খানিকটা চমকে তাকে দেখে বলল, “ওহ আপনি! না না, ওসব কিছু নেই। অফিসের জন্যই বেরিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় এসে এখানে চলে এলাম কিছু না ভেবেই।”

মানালি অবাক চোখে দীপের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেম হিয়ার। আমিও অফিস বাঙ্ক করেছি। মনে হচ্ছে না আর কোনও দিন অফিসে যেতে পারব বলে। আচ্ছা, আপনার চোখ মুখ এরকম বসা বসা লাগছে কেন?”

দীপ খানিকটা সচেতন হয়ে বলল, “ওহ, একটু স্ট্রেস যাচ্ছে আর কি!”

মানালি বলল, “আমারও তো। আজ সময়ের কণ্ঠস্বর পড়েছেন? দ্যাট বিগ ব্রেকিং নিউজ?”

দীপ অপ্রস্তুত হল, “না, মানে আজ আর কাগজ পড়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। কী ব্রেকিং নিউজ বলুন তো!”

মানালি বলল, “ধ্রুব বাগচীকে চেনেন?”

দীপ বলল, “না! কে সে? নামটা একটু শোনা শোনা লাগছে।”

মানালি বলল, “আপনি বাংলা সিনেমা দেখেন না?”

দীপ বলল, “সেরকম দেখা হয় না। সময় কোথায়? শেষ মনে হয় হলে গিয়ে দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে। এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে। ইন্টারভ্যালের বেশি টিকতে পারিনি। গান শুনি অবশ্য।”

মানালি হাসল, “ওহ, তাহলে আপনি ধ্রুব বাগচীকে চিনতে পারবেন না। উনি এই সময়ের একজন বিখ্যাত পরিচালক। ওঁর একটা কেচ্ছা ফাঁস করেছি আমি আজকে।”

দীপ বলল, “তাহলে তো আপনার ভালো খবর! এর জন্য এত স্ট্রেস নিচ্ছেন কেন?”

মানালি মাথা নাড়ল, “মোটেও ভালো খবর নয়। খুব ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক। আমার কপালে দুঃখ আছে। আর এই নিউজটা আমার এডিটর খানিকটা জোর করেই করালেন। তবে সেসব না, কোথাও গিয়ে একটা এথিক্সে লাগছে আমার।”

দীপ অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। মানালির কথা শুনছিল না। ওভাবেই বলল, “ও।”

মানালি বলল, “ধ্রুব বাগচীর ওয়াইফ ঈপ্সিতা খুব ভালো মানুষ। আমি হয়তো ওঁর জীবনটাকে আর-একটু কঠিন করে দিলাম।”

দীপ বলল, “আচ্ছা।”

মানালি বলল, “বাদ দিন। ভাবতে চাইছি না এসব নিয়ে। আপনি বলুন, আপনার লাভ লাইফ কেমন চলছে?”

দীপ বলল, “ভয়াবহ।”

মানালি অবাক হল, “মানে?”

দীপ বলল, “আমার কোনও লাভ লাইফ নেই। যেটুকু ছিল কাল রাতেই সব ভেসে গেছে।”

মানালি জিভ কেটে বলল, “এ বাবা, তাই জন্য আপনিও আমার মতো এভাবে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ। জীবনের ট্রাজেডি কী জানেন?”

মানালি বলল, “কী?”

দীপ বলল, “যখন জীবনে মেয়ে আসে না, তখন কেউ আসে না, যখন আসে, তখন ঠিক আর-একজনকে সাথে নিয়ে আসে। অন্তত আমার জীবনে এসেছিল।”

মানালি বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

দীপ বলল, “না বোঝারই কথা, বিশেষ করে আমার সম্পর্কে যখন আপনি কিছুই জানেন না।”

মানালি বলল, “বলতে পারেন। আমারও বিশেষ কাজ নেই আজকে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া।”

দীপ বলল, “কী বলব বলুন! নিজেকে ভিলেন দেখিয়ে পৃথিবীতে কটা লোক গল্প বলেছে আজ অবধি?”

মানালি বলল, “আপনি বলুন। সে হিসেবে দেখতে গেলে আমিও তো ভিলেনই আজ। এথিক্স ভেঙেছি, বস যা বলেছে তাই করেছি, নিজের মেরুদণ্ড সোজা পর্যন্ত রাখতে পারিনি। আপনি বলতে পারেন। আমার তেমন পিএনপিসি করার মতো কেউ নেই। আপনার তথ্য সুরক্ষিত থাকবে।”

দীপ শূন্য দৃষ্টিতে কাচের জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, “সম্প্রতি এক বিয়েবাড়িতে এক মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমারও তাকে পছন্দ ছিল। তারও আমাকে। ফোন করা হল। যেভাবে সব কিছু চমৎকার ভাবে শুরু হয়, আমারও তেমনভাবেই শুরু হয়েছিল। সম্পর্কটা একটু এগোতেই আমি ব্যাপারটাতে নিজেকে তেমনভাবে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঠিক এই সময় আর-একজনের সঙ্গে আলাপ। একদিনের আলাপেই…”

দীপ চুপ করে গেল।

মানালি বলল, “একদিনের আলাপে প্রোপোজ করে ফেললেন?”

দীপ মাথা নাড়ল, “একদিনের আলাপে আমাদের ফিজিক্যাল রিলেশন হয়ে গেল। কাল। রাত্তিরে ব্রেক আপ।”

মানালি চোখ বড়ো বড়ো করে দীপের দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে? একদিনে শুরু একদিনে শেষ? আপনি তো বুলেট ট্রেনকেও হার মানিয়ে দেবেন দেখছি।”

দীপ অপ্রস্তুত মুখে বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে সব কিছু সাম আপ করার পরে আমারও সেটাই মনে হচ্ছিল।”

মানালি বলল, “শেষ মানে ঠিক কীভাবে শেষ জানতে পারি?”

দীপ গত রাত্রের ঘটনাটা বলল।

মানালি সবটা শুনে মাথায় হাত দিল। বলল, “এবার কী করবেন?”

দীপ ম্লান হাসল, “অনেকদিন স্টক মার্কেটের খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম না। আপাতত সেগুলোই শুরু করি। এই কদিনে যা বুঝলাম, এসব আমার জন্য না। যেমন ছিলাম তেমনই ভালো ছিলাম।”

মানালি বলল, “আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হল। সকাল থেকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব কেস আমি একা খেয়ে বসে আছি। আপাতত মনে হচ্ছে আমার থেকেও খারাপ অবস্থার কেউ আছে।”

দীপ বলল, “সে আর বলতে। আচ্ছা আমি এখন কি ঋতির কাছে ক্ষমা চাইব? আপনার কী অ্যাডভাইস?”

মানালি মাথা নাড়ল, “লাভগুরু হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা শূন্য। তবে সিক্সথ সেন্স বলছে এখনই ক্ষমা চাইতে গেলে জুতো খেতে পারেন। অপেক্ষা করলেই ভালো।”

দীপ বলল, “কদিন অপেক্ষা?”

মানালি বলল, “অন্তত এক মাস।”

দীপ মাথা নাড়ল, “অত দিন নেই। ও বাইরে চলে যাবে।”

মানালি বলল, “তাহলে শেয়ার মার্কেটই ঠিক আছে। খারাপ হবে না।”

দীপ অস্ফুটে বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছে। ধুস, আমি অফিসই যাই বরং। জিজ্ঞেস করলে বলা যাবে ডাক্তার দেখাতে গেছিলাম।”

কোনও দিকে না তাকিয়ে দীপ হনহন করে চলে গেল।

মানালি বলল, “বোঝো!”

সে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফোন অন করল।

ধ্রুব বাগচী এস এম এস করেছেন, “গেট রেডি ফর লিগাল প্রসিডিংস।”

২৫

“তোর হল কী ভাই?”

রাম কখন তার ডেস্কে চলে এসেছে দেখতে পায়নি দীপ। বলল, “ওই শরীর খারাপ বললাম তো।”

রাম তার পিঠ চাপড়ে বলল, “না ভাই, শরীর খারাপ বসকে বলেছিস ঠিক আছে। তোকে তো আমি চিনি। এ শরীর খারাপ না। অন্য কিছু হয়েছে।”

দীপ বিরক্ত হয়ে বলল, “বললাম তো শরীর খারাপ।”

রাম বলল, “ঠিক আছে। শরীর খারাপ। আচ্ছা আজকের সেনসেক্স কত বল তো?”

দীপ বলল, “জানি না।”

রাম অবাক হয়ে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “জানিস না? তেরা তো হো গয়া ভাই!”

দীপ বলল, “হো গয়া তো! অব খুশ? ফুটে যা এবার।”

রাম বলল, “ঠিক আছে ভাই, টেক ইওর টাইম। পরে কথা বলছি।”

রাম চলে গেলে দীপের একটু খারাপ লাগছিল। সে বুঝতে পারছিল দুর্ব্যবহারটা একটু বেশিই হয়ে গেল।

অফিসে ঢুকতে ঢুকতে দেড়টা বেজে গেছে। সমীর স্যারকে বলে দিয়েছে ডাক্তার দেখিয়ে ঢুকেছে। বেশি প্রশ্ন করেননি ভদ্রলোক। পরের সপ্তাহে আর-একবার ভুবনেশ্বর যেতে হবে সেটা অবশ্য শুনিয়ে দিয়েছেন।

দীপ কিছু বলেনি আর। কয়েক দিন কলকাতা থেকে দূরে গিয়ে থাকতে পারলে আরও ভালো হত। মোবাইলে কোনও ফোন আসেনি সকাল থেকে। হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক দুটোই আনইনস্টল করে দিয়েছে সে।

অফিসে সন্ধে সাড়ে ছটা অবধি কাটিয়ে বেরিয়ে দেখল রাম বেরোচ্ছে। সে নিজেই এগিয়ে গেল, “চল ভাই মদ খাওয়াব।”

রাম বলল, “তুই খাওয়াবি?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ, আমি খাওয়াব। চল।”

রাম তার দিকে তাকিয়ে হাসল, “খুব বড়ো কিছু পাকিয়েছিস, তাই তো?”

দীপও হাসল, “হ্যাঁ ভাই।”

রাম বলল, “চল। গিয়ে শুনি। তবে মদ না আজ, কফি হোক।”

দীপ বলল, “তাই হোক।”

দুজনে মিলে একটা কফি শপে ঢুকল। ওপিয়ামের মতো ভিড় নেই। ফাঁকাই ছিল।

দীপ বলল সবটাই। রাম শুনে-টুনে বলল, “এটাই হয় ভাই। বহুদিন ভুখা থাকার পর মানুষ যখন খেতে পায়, তখন সে তোর মতোই পাগলাচোদা হয়ে যায়। তোর আর দোষ কোথায়। কিন্তু যতক্ষণ না তুই, ওই কী যেন নাম বললি চিতরলেখা না কী নাম, ওই মেয়েটাকে ব্লক করলি, ততক্ষণ রিলেশনশিপ অ্যাক্সেপ্ট করা উচিত হয়নি।”

দীপ বলল, “আমি কী করে জানব সে মেয়ে রাতে লগ ইন করে ফেলবে!”

রাম বলল, “খুব ফ্রাস্ট্রু মাল। বোঝাই যাচ্ছে।”

দীপ বলল, “আমি কী করব সেটা বল। ক্যারেক্টার অ্যানালিসিস করতে দিইনি তোকে।”

রাম বলল, “তুই আর কী করবি ভাই। কোনও একটা গুরু পাকড়ে ফেল। গায়ে নামাবলি জড়িয়ে একটা খোল কর্তাল জোগাড় করে ভিক্ষে করতে বেরিয়ে পড়। তোর দ্বারা তো এর বেশি কিছু হবে না।”

দীপ বলল, “এইজন্য তোকে বলতে চাই না। সব কিছুর খিল্লি উড়িয়ে দিস।”

রাম বলল, “খিল্লি উড়াব না? এটা নিয়ে খিল্লি উড়াব না তো কী নিয়ে খিল্লি উড়াব বল তো? তোকে সিরিয়াসলি বলছি এসব থেকে দূরে থাক। কোনও মেয়ের সঙ্গেই কোনও কিছু করিস না এখন।”

দীপ বলল, “সে চাইলেও করতে পারব না, কিন্তু তুই দূরে থাকতে বলছিস কেন?”

রাম বলল, “যে হোটেলে উঠেছিলি সেখানে আই কার্ড জমা রেখেছিলি?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ।”

রাম বলল, “ওই মেয়েটার কত সেকেন্ড লাগবে এটা প্রমাণ করতে যে তুই ওকে নিয়ে ওই হোটেলে গেছিলি?”

দীপ অবাক হল, “ও কেন এসব প্রমাণ করতে যাবে?”

রাম বলল, “আজকালকার দিনের মেয়েদের চেনো মামা? বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস টার্মটা শুনেছ কখনও?”

দীপ জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “না না, ঋতি একেবারেই সে মেয়ে নয়।”

রাম দীপকে ভেঙিয়ে একইভাবে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাল মদু বেত্যা নয়। সবাই এরকমই ভাবে। তুই তো কোন ছাড়।”

দীপ বিরক্ত হয়ে বলল, “ভাট বকছিস তুই এবার। দয়া করে থাম। পোষাচ্ছে না এসব। ঋতি ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। তা ছাড়া হোটেলের ঘরে সব সময় সহবাস করার জন্যই যাওয়া হয় এরকম তো কোনও রুল নেই।”

রাম বলল, “তাহলে হোটেলের ঘরে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কী করতে যায় ভাই? সাপলুডো খেলে?”

দীপ বলল, “আড্ডা মারতেও যায়। আমি বলে দেব আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম। কী হয়েছে তাতে?”

রাম বলল, “তোকে যা বলছি তাই কর। পারলে মোবাইল নাম্বার চেঞ্জ করে ফেল। এই দুটো মেয়ের কারও সঙ্গেই কোনও রকম কন্ট্যাক্টস রাখিস না এখন।”

দীপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। চিত্রলেখা ফোন করছে।

রাম বলল, “ধরিস না।”

দীপ বলল, “দাঁড়া না, কী বলে দেখি।”

রাম বলল, “যা পারিস কর।”

দীপ ধরল, “হ্যালো।”

ওপাশ থেকে চিত্রলেখা বলল, “কী করছ?”

দীপ রামের দিকে তাকাল। বিরক্ত মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সে বলল, “কিছু না।”

চিত্রলেখা বলল, “তোমাকে একটা খবর দেওয়ার আছে।”

দীপ বলল, “বলো।”

চিত্রলেখা বলল, “ঋতি আর আমি এখন খুব ভালো বন্ধু।”

দীপ বলল, “তোমার এক্সটাকেও জুটিয়ে নাও। একটা সাইকো জুটে গেলে ভালো থ্রিসাম হবে।”

চিত্রলেখা ফোনটা কেটে দিল।

রাম চারদিকে তাকিয়ে বলল, “আস্তে ভাই। কী সব বলছিস!”

দীপ বলল, “মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না ভাই। হট করে মাথায় রক্ত উঠে গেল।”

রাম বলল, “শোন। তোকে যা বলছি কর। সিমটা ইমিডিয়েটলি চেঞ্জ কর।”

দীপ রেগে গেল, “কী হবে চেঞ্জ করে? আমার ব্যাংক ট্রানজাকশন থেকে শুরু করে সব অ্যালার্ট এই নাম্বারে আসে। চেঞ্জ করে কোথায় যাব?”

রাম বলল, “ওসব অল্টারনেটিভ নাম্বারে শিফট করতে ম্যাক্স এক দিন লাগবে। তুই ইনবক্স চেক কর, কোন কোন কোম্পানি তোকে মেসেজ পাঠায়, কোন কোন নোটিফিকেশন পাস, সবাইকে একসঙ্গে মোবাইল নাম্বার চেঞ্জের অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দে। বেশিক্ষণ লাগবে না। ট্রাস্ট মি। শোন ভাই, তুই মেয়েদের চিনিস না, আমি চিনি, দুটো মেয়ে যদি মনে করে তোর গাঁড় মেরে তোকে সাদ্দাম হুসেন বানিয়ে দেবে, ওদের বেশি সময় লাগবে না। সো বিওয়্যার।”

দীপ বলল, “আমার দোষটা কোথায় আমাকে একটু বোঝাতে পারবি? আমার যদি মনে হয় চিত্রলেখা ন্যাগিং, চিত্রলেখা ডিজঅনেস্ট, তার জন্য যদি আমি রিলেশনটা কাটিয়ে দিতে চাই, ওকে ইগনোর করি, ঋতির সঙ্গে নতুন করে স্টার্ট করতে চাই, সেক্ষেত্রে আমি দোষটা কী করলাম? চিত্রলেখা নিশ্চয়ই গোটা ব্যাপারটা এমন করে ঋতিকে বুঝিয়েছে, যেন আমি কতবার চিত্রলেখার সঙ্গে একইভাবে হোটেলে শুয়ে এসেছি, কিন্তু ব্যাপারটা কি তাই? তা তো নয়! ঋতি কেন আমার ফোন ধরবে না, আমার জন্য ফোন অফ করে রেখে দেবে?”

রাম চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, “তুই হঠাৎ করে ঋতিকে নিয়ে হোটেলে গেলি কেন?”

দীপ বলল, “না যাওয়ারই বা কী আছে? শোন ভাই, এসব ব্যাপারে আমি যথেষ্ট আধুনিক। প্রেমিকাকে নিয়ে হলে কিংবা ভিক্টোরিয়ার ঝোপে বসে দোতলার কাজ সেরে প্যান্ট ভিজিয়ে বাড়ি ফেরার পাবলিক আমি নই। আমার মনে হয়েছিল রিলেশনশিপে থাকলে ফিজিক্যাল হলে প্রবলেমের কিছু নেই। সো আই ডিড ইট।”

রাম বলল, “ওয়েল, তোর কথায় যুক্তি আছে, তবে এখানে অনেক কিন্তুও আছে। ঋতি সম্পূর্ণ স্ট্রেঞ্জার একটা মেয়ে। তুই ওর সম্পর্কে কিছু না জেনেই শুয়ে পড়লি? যদি কোনও রোগ হত? বা বড়ো কোনও ট্র্যাপ হত? কী করতিস?”

দীপ বলল, “আমি ওর বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেছি। যথেষ্ট ডিগনিফায়েড ফ্যামিলি ওরা।”

রাম বলল, “বাড়ি গেছিস? ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যানালিসিস করেছিস? যদি ফ্রড হত? যদি জাল কারবারি হত? কী করতি তখন? ওকে লিভ ইট, সব ছেড়ে দিলাম, ওয়ান ফাইন মর্নিং তোকে যদি ফোন করে বলে তোমার বাচ্চার মা হতে চলেছি, তখন কী করবি তুই?”

দীপ কিছু বলতে পারল না। চুপ করে থাকল।

রাম বলল, “শোন ভালো কথা বলছি। একটা ভালো ভদ্র মামণি দেখে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ কর। সব শনি থেকে দূরে থাকবি।”

দীপের মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল, “আবার ম্যারেজ!”

রাম বলল, “এখনই না, দশ বছর পরে। আপাতত বনবাসে চলে যা ভাই।”

২৬

দরজা খুলে তাকে দেখে ধ্রুব অবাক হলেন না।

মৃদু হেসে বললেন, “একটা ওয়াইল্ড গেস করেছিলাম বটে। আসুন।”

মানালির নিজেরই অবাক লাগছিল। এস এম এসটা পাবার পর থেকে এমন উত্তেজনা হচ্ছিল যে সে আর কিছু চিন্তা করেনি। হাইল্যান্ড পার্ক থেকে ট্যাক্সি ধরে সোজা ধ্রুবর বাড়ি চলে এসেছে।

সে ঢুকল না। সসংকোচে বলল, “আমি আপনাকে এটুকুই বলতে এসেছিলাম…”

ধ্রুব তার কথা শেষ হবার আগেই বললেন, “আপনি একা নিউজটা করেননি, তাই তো?”

মানালি থতোমতো খেয়ে বলল, “হ্যাঁ।”

ধ্রুব বললেন, “সে তো জানা কথা। কেসটা পেপারের এগেনস্টেই করব। আপনার ভয় পাবার কিছু নেই।”

মানালি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে বলল, “আমি আসি তাহলে।”

ধ্রুব বললেন, “ভিতরে আসুন। আপনি টেন্সড হয়ে আছেন। কফি খেয়ে যান।”

মানালি ইতস্তত করে ড্রয়িংরুমে ঢুকল।

ধ্রুব দরজা বন্ধ করে কিচেনে ঢুকলেন।

মানালি খানিকটা ঘোরের মধ্যে ছিল। সে চুপ করে বসে থাকল খানিকক্ষণ।

ধ্রুব কফি মাগ মানালির দিকে এগিয়ে সোফায় বসে বললেন, “আপনাদের জেনারেশনের সমস্যাটা কী জানেন? আপনারা কোনও কিছু করার আগে সামনে পিছনে চিন্তা করেন না। তারপরে হঠাৎ করে হুড়কো খেয়ে গেলে খোলা বাজারে দৌড়ে বেড়ান। সত্যিটার মুখোমুখি হতেই বা এত ভয় কীসের? ফোনটা অফ করে রেখেছেন কেন?”

মানালি কিছু বলতে পারল না। ফ্যাকাশে হাসল।

ধ্রুব কফি মাগে চুমুক দিয়ে বললেন, “আমরা মানুষের প্রাইভেসিকে সম্মান করতে জানি না। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে একজন লেখক, একজন শিল্পীর থেকে অনেক বেশি দাম পায় একজন তৃতীয় শ্রেণির সিরিয়াল অভিনেতা, যে কতগুলো শেখানো বুলি কপচে অভিনয় করে চলে আসে। কেন জানেন? আমরা মেধার সম্মান দিতে জানি না। শুধু তাই নয়, এ দেশে একজন স্টার মানে আমরা যতক্ষণ না তাদের ঘরের ভিতর উঁকি না মেরে দেখতে পারছি, ততক্ষণ আমাদের কোনও শান্তি হয় না।”

মানালি বলল, “আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন।”

ধ্রুব একটা সিগারেট ধরালেন, বললেন, “শুধু আপনি কেন, যে-কোনো সেন্সিবল মানুষই বুঝতে পারবে, কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হবে? আপনি আমাকে জাস্ট একটা কথার উত্তর দিন, আজকের নিউজটা বেরোনোর পরে কার কী এমন লাভ হবে? ক্ষতিটা তো একটা মেয়ের হবে, যে দাঁতে দাঁত চেপে একটা পিছিয়ে পড়া জায়গার কতগুলো অনাত্মীয় ছেলেমেয়ের জন্য লড়ে যাচ্ছিল। সম্পর্ক বলতে কি একসঙ্গে থাকাটাকেই বোঝেন আপনারা?”

মানালি মাথা নিচু করে বলল, “সম্পূর্ণ সিদ্ধান্তটাই বিশ্বরূপদার… আমি আর-একবার বলছি। তা ছাড়া নিউজটা এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার কথাও ছিল না। আমি যদি জানতাম স্টোরিটা কবে বেরোবে, তার আগে নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়ে দিতাম।”

ধ্রুব মাথা নাড়লেন, “একটা যুদ্ধ হবে। একটা বড়ো যুদ্ধ শুরু হবে। আপনাকে না চাইলেও হয়তো একটা পক্ষে থাকতে হবে। আপনি জানেন আজ সকাল থেকে কটা পেপার আমাকে ফোন করেছে?”

মানালি উত্তর দেবার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। ধ্রুব দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “এই যে, এসে গেছে কোনও চ্যানেল। কেচ্ছার খোঁজে খোঁজে। কেচ্ছায় কেচ্ছা বাড়ে। দেখবেন কাল অন্য কোনও পেপারে আমার সম্পর্কে আরও নতুন নতুন কেচ্ছা জানতে পারবেন। এঁরা মাইনেই পান লোকের গায়ে কালি ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য। যে কথা কেউ কোনও দিন বলেনি, সে কথাও কারও মুখে বসিয়ে দিতে এঁরা দুবারও ভাবেন না।”

ধ্রুব উঠলেন, দরজা খুললেন।

মানালি দেখল দুজন ধ্রুবর পিছন পিছন ড্রয়িং রুমে ঢুকল। দুজনের কাউকেই সে চিনতে পারল না।

ধ্রুব বললেন, “বসুন, আপনারাও বসুন। আমরা কি আরও কয়েকটা চ্যানেল আসার জন্য অপেক্ষা করব?”

দুজনের মধ্যে একটা ছেলে মাথা নাড়ল, “না স্যার, প্লিজ, আমরা আগে এলাম, আমাদের একটু অ্যাটেন্ড করুন।”

ধ্রুব বললেন, “এক্সক্লুসিভ নিউজ? সে তো আজকে বেরিয়েই গেছে সময়ের কণ্ঠস্বরে।”

সেই প্রথমজনই বলল, “স্যার, একটা জিনিসই জাস্ট জানার, ওই নিউজে যা যা লেখা হয়েছে সবই কি সত্যি?”

ধ্রুব বললেন, “আংশিক। পৃথিবীতে কোনও কিছু একশো শতাংশ খাঁটি হতে পারে না।”

দ্বিতীয়জন বলল, “স্যার শ্রীপর্ণা ম্যাডামকে আমরা ফোন করেছিলাম, উনি সব অ্যাবসার্ড বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।”

ধ্রুব বললেন, “সেটা তো বলাই স্বাভাবিক। বন্ধুত্বর সম্পর্ক আপনারা বোঝেন না।” ধ্রুব একবার মানালির দিকে তাকিয়ে আবার ছেলেদুটোর দিকে মনোযোগী হলেন, “আপনারা এবার আসুন। এই ব্যাপারে আমার একটাই বক্তব্য। নো কমেন্টস।”

ছেলেদুটো পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

ধ্রুব বললেন, “খাজনার থেকে বাজনা বেশি হয়ে গেছে ইন্ডাস্ট্রিতে। কে কেমন সিনেমা বানাচ্ছে তা নিয়ে কিন্তু বিন্দুমাত্র কারও উৎসাহ নেই। শুধু কে কার সঙ্গে শোবে, কে কবে কী গোপন কথা কাকে বলেছিল, সেসব নিয়ে কন্টিনিউয়াস হ্যাজ হয়ে যাচ্ছে। ওরা যা ইচ্ছা লিখুক।”

প্রথম ছেলেটা বলল, “স্যার আপনার মনে হয় না এই কন্ট্রোভার্সিটা সামনে আসার ফলে আসলে আপনার লাভই হল? আপনার বাজারটা পড়ে যাচ্ছিল, অনেকটা বুস্ট আপ হল সম্প্রতি।”

ধ্রুব আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “যে বাজার লোকের ঘরকে পৃথিবীর সবার সামনে তুলে ধরতে বিন্দুমাত্র ভাবে না, যে বাজার মানুষের প্রাইভেসিকে বিন্দুমাত্র সম্মান দেয় না, সে বাজারের মুখে আমি মুতি। বুঝলেন?”

ছেলেদুটো এবার একরাশ অস্বস্তি নিয়ে মানালিকে দেখে বলল, “তবে আমরা আসি স্যার।”

মানালিও উঠল। বলল, “আসছি স্যার।”

ধ্রুব হাত নাড়লেন। মানালির খানিকটা অপমানিত লাগছিল। সঙ্গে নিজের প্রতি রাগও হচ্ছিল। কোনও দরকার ছিল না এরকম ঝোঁকের মাথায় ধ্রুব বাগচীর বাড়ি চলে আসার। ব্যাপারটা সবাই জানলে আরও বেশি খিল্লি হতে পারে। বিশ্বরূপদা রেগেও যাবে ভীষণ।

ধ্রুবর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই দুজন ছেলের একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনিও প্রেস?”

মানালি অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “সময়ের কণ্ঠস্বর।”

দুটো ছেলেই মানালির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে প্রায় একসঙ্গে বলল, “আপনিই রিপোর্টটা করেছেন?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ।”

দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আবার।

মানালি দাঁড়াল না। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল একটা। উঠে অফিসের অ্যাড্রেস বলে দিল।

বিশ্বরূপদা চেম্বারেই ছিল। ল্যাপটপে কাজ করছিল। মানালিকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “কী হল? ছুটি নিবি ভেবেই নিলি না?”

মানালি বলল, “ধ্রুব বাগচীর বাড়ি থেকে আসছি। উনি লিগাল প্রসিডিংসে যাবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। আর ভীষণ ঠান্ডা মাথায় কথা বলছিলেন। আগের মতো রেগে রেগে না।”

বিশ্বরূপদা ল্যাপটপে মন দিল, “গেলে যাবেন। আমাদের ল সেল আছে, ওরা বুঝবে। তারপর তারিখ পে তারিখ তারিখ পে তারিখ হয়ে কেসটা ধামাচাপা পড়ে যাবে। মাঝখান থেকে তুই নার্ভ ফেল করলি, এটাই যা কষ্ট থেকে যাবে আমার।”

মানালি চুপ করে গেল। বিশ্বরূপদা বলল, “ফোনটা অন কর দয়া করে।”

মানালি বলল, “স্টোরিটার কোথাও তোমার নাম নেই। সর্বত্র আমার নাম। তুমি কেস খাবে কেন? কেস খেলে আমিই খাব।”

বিশ্বরূপদা বলল, “ওই আনন্দেই থাক। এডিটরের এগেনস্টে কেসটা হবে। হলে হবে। কী আর করার আছে!”

বিশ্বরূপদা কাঁধ ঝাঁকাল।

মানালি বলল, “খাল কেটে কুমির আনলে।”

বিশ্বরূপদা তার দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল।

২৭

দীপ দুঃস্বপ্ন দেখছিল। একটা ওভারব্রিজে উঠেছে সে। নিচ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় ওভারব্রিজটা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। কপালটা ঘামে ভিজে গেছে। মোবাইলটা বের করে সময় দেখল। আড়াইটা বাজে। বিছানার পাশেই বোতল থাকে। অনেকটা জল খেল সে।

অস্বস্তি হচ্ছিল তার। শীতের রাত। কম্বলটা সরিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল খানিকক্ষণ। শীত লাগছিল। তবু কম্বল গায়ে জড়াল না সে।

ফেসবুক গত রাত থেকে ডিঅ্যাক্টিভেট করা ছিল। সে লগ ইন করল নিজের অ্যাকাউন্টে। ঋতি কিংবা চিত্রলেখা কারও অ্যাকাউন্টই দেখা যাচ্ছে না।

সে বুঝল তাকে ব্লক করা হয়েছে।

দীপ বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে একটা নতুন আইডি খুলল। সেটা থেকে দুজনের প্রোফাইলে উঁকি মারল।

চিত্রলেখা বেশ লম্বা একখানা স্ট্যাটাস দিয়েছে। পুরুষ মাত্রেই ভয়ংকর, এটাই তার বক্তব্য। দীপ দেখল ঋতি সেখানে কমেন্ট করেছে। পুরুষ শুধু একটা জিনিসই চায়, সব পুরুষ সমান ইত্যাদি।

দীপ বেশ কিছুক্ষণ কমেন্টগুলো দেখল। ঋতির প্রোফাইল খুলল। প্রবল অস্বস্তির সঙ্গে সে লক্ষ করল হোটেলের রুমের কথাগুলো বারবার মাথায় চলে আসছে তার। ঋতিই কি তাহলে ঠিক? আদতে ঋতির শরীরটাই চেয়েছিল সে? ঠিকই তো, ঋতিকে সেভাবে মিসও করছে না সে। একটা গোটা দিন চলে গেল, চিত্রলেখা কিংবা ঋতি, কাউকেই সে মিস করেনি। বরং অনেকটা বিতৃষ্ণা এসেছে সম্পর্কের প্রতি। টানটা যেটা আসছে ঋতির প্রতি, তা সম্পূর্ণই জৈবিক কারণে।

দরজা খুলে বাথরুমে গিয়ে হিমশীতল জল দিয়ে মুখ ধুল দীপ। ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে এসে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করল। বেশ খানিকক্ষণ ভেবে ঋতিকে মেসেজ করল, “মিসড ইউ। টেরিবলি। এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে?” মেসেজটা না চাইতেই যেন করে ফেলল সে। শরীর যে কতরকম ভাবে মানুষকে মিথ্যা বলাতে বাধ্য করে!

ঋতি ফোন করছে। দীপ ধরল।

ওপাশ থেকে ঋতির গলা ভেসে এল, “কী চাই? এত রাতে ডিস্টার্ব করছ কেন?”

দীপ বলল, “আমি তোমায় জাস্ট একটা কথাই বলতে চাই। চিত্রলেখাকে আমি ইগনোর করা শুরু করেছিলাম। আমি কখনোই ওর সঙ্গে সেভাবে সম্পর্কে ছিলাম না।”

ঋতি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বলল, “ব্যস?”

দীপ মরিয়া হল, “দ্যাখো ঋতি, আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে চাইনি। কিন্তু তুমিই ভেবে দ্যাখো, আমি যদি তোমাকে বলে দিতাম আমি কারও সঙ্গে সম্পর্কে আছি, তুমি কি এগোতে? আমি চাইছিলাম আমাদের কেমিস্ট্রিটা ওয়ার্ক আউট করুক। জাস্ট একটাই কারণে, বিশ্বাস করো আমি চিত্রলেখার থেকে বেরোতে চাইছিলাম। ও ভীষণ ন্যাগিং, কনফিউজড, আমি জানি, ও আজকে আমায় বলেছে ও তোমার সঙ্গে নাকি দারুণ বন্ধুত্ব করেছে, তুমি দুটো দিন ওর সঙ্গে কাটাও, নিজেই বুঝে যাবে আদতে ও কেমন মেয়ে।”

ঋতি বলল, “তুমি সত্যি আমাকে মিস করছিলে?”

দীপ বলল, “তোমার ঠোঁটের পাশের তিলটার দিব্যি, তোমার পারফিউমের দিব্যি, তোমার শ্যাম্পুর দিব্যি, বিলিভ মি।”

ঋতি ফোনটা কেটে দিল।

দীপ চুপচাপ বসে রইল।

নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল তার। খানিকটা ভয়ও হচ্ছিল। ঋতি যদি কল রেকর্ডিং করে? কেন এমন হচ্ছে বারবার? কেন নিজের ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সে? যতবার ভাবছে সব কিছুর থেকে দূরে চলে যাওয়া দরকার, ততবারই হোটেলের ঘরটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রাত বাড়তে মনে পড়ে যাচ্ছে দরজা বন্ধ করেই কীভাবে পরস্পরের শরীরটা দখল করতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অন্য কোথায় কী হচ্ছে, কিছুই মাথায় আসছিল না সেই সময়টা।

ফোনটা বাজছিল দীপের।

দীপ দেখল ঋতি ফোন করছে। ধরতেই ওপাশ থেকে ঋতির গলা ভেসে এল, “তুমি সত্যি আমাকে মিস করছিলে?”

দীপ গলায় খানিকটা নাটকীয়তা আনল, “তোমার কী মনে হয়? আমি তোমাকে মিথ্যা কথা বলছি?”

ঋতি বলল, “না, আমার মনে হয় না। কালকে মিট করা যায়?”

দীপ কয়েক সেকেন্ড ফোনটা ধরে বলল, “থ্যাংক ইউ।”

***

সকালে তৈরি হয়ে দীপ নটার মধ্যেই বেরোল।

ঋতিকে যখন তুলল তখন পৌনে দশটা বাজে।

হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল তার।

এক অদ্ভুত নেশা মাথায় ভর করতে শুরু করেছিল।

২৮

দরজা খুললেন রত্না ব্যানার্জি নিজেই। মানালি খানিকটা চাপে পড়ে গেল। সে ভেবেছিল অন্য কেউ দরজা খুলবে। অফিসে ধ্রুব বাগচীর ব্যাপারটা নিয়ে একটু বেশি টেন্সড হয়ে ছিল সে, বিশ্বরূপদা জোর করে রত্না ব্যানার্জির ইন্টারভিউ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে ঋপণ এসেছে।

তাকে দেখে রত্না বললেন, “সময়ের কণ্ঠস্বর?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ ম্যাডাম।”

রত্না বললেন, “ভিতরে এসো।”

মানালি ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরময় বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের ছবি।

সে সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি একা থাকেন?”

রত্না মাথা নাড়লেন “না, আমার ভাইয়ের মেয়ে থাকে আমার সঙ্গে। এখন কলেজে গেছে। ও লেকচারার।”

মানালি রত্নার দিকে ভালো করে তাকাল। এককালে যে প্রবল সুন্দরী ছিলেন তার রেশ এখনও আছে। তবে বয়স অনেকটাই থাবা বসিয়েছে সত্তরোর্ধ্ব অভিনেত্রীর চেহারায়। চুল সব সাদা। মানালি অনেককেই দেখেছে বয়স হলেও চেহারায় তার ছাপ ফেলতে দেন না। রত্না ব্যানার্জির মধ্যে সেই চেষ্টাটা নেই।

সে বলল, “শুরু করব ম্যাডাম ইন্টারভিউটা?”

রত্না বললেন, “তোমরা কিছু খাবে না?”

মানালি মাথা নাড়ল, “না না ম্যাডাম, ওইসব একদম না। আপনি ব্যস্ত হবেন না।”

রত্না বললেন, “আচ্ছা। তবে শুরু করো। অনেক দিন কেউ ইন্টারভিউ নেয় না। ভুলেই গেছে সবাই।”

মানালি বুঝল রত্নার গলায় অভিমানের ছাপ স্পষ্ট। সে বলল, “শুরু থেকেই বলি? আপনার অভিনয় শুরু কার হাত দিয়ে?”

রত্না বললেন, “তুমি সিনেমার কথা বলছ না মঞ্চের? মঞ্চে আমি বারো বছর বয়েস থেকেই অভিনয় করি। ওখান থেকেই আমায় সিনেমায় নেওয়া হয়েছিল। সে এক সময় ছিল। আমার বাবার তো কিছুতেই মত ছিল না। আমার জ্যাঠামশাই বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি হয়েছিলেন। প্রথম সিনেমা করি ষোলো বছর বয়েসে। “রামের বনবাস”। তারপরেই তো পরপর ডাক পেতে শুরু করলাম।”

ঋপণ উশখুশ করছিল। মানালি বলল, “আপনার ছবি নেবে ম্যাডাম?”

রত্না বললেন, “নাও। আর বারবার ম্যাডাম বোলো না। কেমন কেমন লাগে শুনতে। তুমি আমায় দিদি বলতে পারো। যদিও তুমি আমার নাতনির বয়সি।”

মানালি হাসল, “দিদিটা ঠিক আছে।”

ঋপণ কয়েকটা ছবি তুলল। রত্না বললেন, “কী আর হবে ছবি তুলে। শেষ দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি এখন শুধু।”

মানালি বলল, “দিদি, অভিনয়ের প্রশ্ন থেকেই শুরু করি। আপনার স্বামী ফিল্মের বাইরের জগতের একজন মানুষ ছিলেন। ওঁর কোনও দিন আপনার সিনেমা করা নিয়ে আপত্তি ছিল না?”

রত্না বললেন, “সেভাবে ছিল না। বরং উলটোটা বলাই সমীচীন। ও আমাকে বরাবর উৎসাহ দিত। চার বছর আগে এক সকালে হঠাৎ সেরিব্রাল হল। সময় দিল না লোকটা।”

রত্নার চোখে শূন্যতা এল।

মানালি অপ্রস্তুত হল, “দুঃখিত দিদি। আপনাকে আঘাত দিতে চাইনি।”

রত্না হাসলেন, “নাহ, ঠিক আছে। কী আর করবে। সবাইকেই একদিন না একদিন যেতে হবেই। আজকাল আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো? আমরা সবাই এক অদ্ভুত সাজানো পৃথিবীতে বেঁচে আছি। কয়েক সেকেন্ড পরে আমার কী হবে আমরা কেউ বলতে পারি না। এইসব ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখি। একসময় যেভাবে মানুষের চোখে নিজের প্রতি সম্মান দেখেছি, ধীরে ধীরে যখন দেখেছি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবটাই অবজ্ঞায় পর্যবসিত হয়, তখন প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। পরে এসব ভেবেই সামলে উঠেছি।”

মানালি বলল, “অনেকেই তো টিভি সিরিয়ালে কাজ করছেন আপনার সমসাময়িকরা, আপনি করছেন না কেন?”

রত্না বললেন, “পারব না গো। বড়ো পরিশ্রম। অত পরিশ্রম এখন আর হয়ে উঠবে না। আমাকে এক প্রোডাকশন হাউস থেকে বলেছিল। আমি না করে দিয়েছি। তবে ধ্রুব, চেনো তো নিশ্চয়ই, ধ্রুব বাগচী, ওর একটা সিনেমায় আমাকে অফার করেছে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। আমাকে ও বলেছে কোনও সমস্যা নেই নাকি, বাড়ি নিয়ে যাওয়া, বাড়ি দিয়ে আসা, সব কিছু নাকি ও নিজে দেখবে। আমি না করা সত্ত্বেও জোর করে এই সিনেমাটা আমাকে দিয়ে করাতে চায়। আমি ওকে এও বলেছি, সিনেমার মাঝপথে যদি আমার কিছু হয়ে যায় তখন কী হবে? শুনে ছেলে তো একবারে রে রে করে উঠল। এখন এই নিয়েই ভাবছি। করব কি না। করলে প্রায় পনেরো বছর পরে স্ক্রিনে ফেরা। সঙ্গে কত ঝক্কি!”

মানালি মনে মনে কপালে হাত দিল। এখানেও ধ্রুব বাগচী! তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে বিশ্বরূপদা সব জেনে বুঝেই এই খবরটা করতে তাকে পাঠিয়েছে।

মানালি বলল, “আপনি সাম্প্রতিক কালের সিনেমা দেখেন?”

রত্না বললেন, “কয়েকটা দেখেছি। সাউথের রিমেকগুলো ইচ্ছা করেই আর দেখতে যাই না। ওরকম সিনেমা আমাদের ভালো লাগবারও কথা নয়। বড়ো পীড়াদায়ক জানো তো! এককালে এই বাংলা থেকে কত বড়ো বড়ো সাহিত্যিকের লেখা নিয়ে সিনেমা হত। তারাশঙ্কর, আশুতোষ কিংবা রবীন্দ্রনাথের দেশে যে দক্ষিণ থেকে গল্প টুকে নিয়ে এসে সিনেমা বানাতে হচ্ছে এই ভাবনাটাই বড়ো কষ্ট দেয় আমায়। এর বাইরে যে সিনেমাগুলো হচ্ছে তার বেশ কয়েকটা দেখেছি। কয়েকটা মনে হয়েছে বড়ো তাড়াহুড়ো করে বানানো। কয়েকটা দেখে মনে হয়েছে একটু বেশি স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে গল্পটা আর সামলে উঠতে পারেনি। তবে এখন তো সবটাই বাজারনির্ভর। বাজার যেভাবে ঠিক করে দেয়, মানুষের স্বাদ সেভাবেই তৈরি হয়। আমাদের পছন্দ অপছন্দে কার কী যায় আসে বলো?”

মানালি বলল, “রাস্তাঘাটে বেরোলে মানুষজনের সাড়া কেমন পান?”

রত্না ম্লান হাসলেন, “বেশিরভাগই চেনে না। যারা চিনতে পারে সেলফি নিতে চলে আসে। এই এক নতুন কায়দা হয়েছে তোমাদের প্রজন্মের। মানুষ যেখানে যাচ্ছে সেলফি তুলছে। অথচ জানো, আমার মনে পড়ে, আমরা যখন প্রথম ক্যামেরা কিনেছিলাম তখন কী অবস্থা ছিল? আমার উনি, দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। আগফা। এই কবছরে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেল।”

মানালি বলল, “আপনাদের সময়ে সেই সময়ের সবথেকে বড়ো ত্রিকোণ প্রেমের ঘটনা ঘটেছিল। সে ঘটনা আপনাকে কীভাবে নাড়া দিয়েছিল?”

রত্না বললেন, “মহানায়ক?”

মানালি হাসল।

রত্না বললেন, “সত্যি কথা বলতে কী, ওঁর ত্রিকোণ প্রেম ছিল না। আমরা সবাই ওঁর প্রেমিকা ছিলাম।”

বলেই হেসে ফেললেন রত্না। মানালিও হাসল। বলল, “তা বটে।”

রত্না বললেন, “এই প্রসঙ্গ থাক ভাই। ওঁদের তিনজনই আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। অনেক তো হল। আর কত?”

মানালি বলল, “আচ্ছা দিদি। আমি প্রসঙ্গ বদল করছি। অন্য কথা বলি, ধ্রুব বাগচীর সিনেমা যদি আপনি করেনও, সেক্ষেত্রে আপনার অসুবিধে হবে না এতদিন পরে আবার নতুন করে শুরু করতে?”

রত্না বললেন, “হবে না মানে? হবে তো বটেই। কিন্তু কী বলো তো, সাঁতার আর অভিনয় ভোলা যায় না। আমার স্বপ্নে এখনও সে দিনগুলো আসে। কীসব দিন ছিল! একদিকে রাজনৈতিক উথালপাতাল সময়, অন্যদিকে এমন সিনেমা বলো, গান বলো, একের পর এক কিংবদন্তি! এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়!”

মানালি একটু ইতস্তত করে বলল, “ধ্রুব বাগচীকে নিয়ে আজ একটা খবর বেরিয়েছে সময়ের কণ্ঠস্বরে, সেটা পড়েছেন?”

রত্না বললেন, “হ্যাঁ, আমি কাগজ খুঁটিয়েই পড়ি। পড়েছি। আমার কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তেমন আগ্রহ কোনও কালেই ছিল না। এখন তো আরও চলে গেছে। তবে ধ্রুবর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে জানো তো। কারও কারও মধ্যে এই ব্যাপারটা থাকে।”

মানালি অবাক হল, “কী ব্যাপার দিদি?”

রত্না হাসলেন, “কিছু কিছু মানুষকে দেখলে মনে হয় সে লোকটা কিছুতেই ভুল কিছু করতে পারে না। ধ্রুব এক্কেবারে সেই ধরনের মানুষ। আমার কেন জানি না ওকে ভীষণ সৎ মানুষ বলে মনে হয়।”

মানালি বলল, “আপনি ধ্রুবর স্ত্রী ঈপ্সিতার ব্যাপারটা জানতেন?”

রত্না বললেন, “না। জানার চেষ্টা করিনি কোনও দিন। হয়তো ওকে জিজ্ঞেস করলে বলত।”

মানলি বলল, “জানতে চাইবেন এর পরে?”

রত্না মাথা নাড়লেন, “নাহ। কাউকে বিব্রত করতে কোনও কালেই খুব একটা ভালো লাগে না। ধ্রুবর মতো একজন গুণী মানুষকে তো নয়ই। সংবাদপত্র তো লিখবেই। আমরা এই ছায়াছবির জগতের মানুষেরা যদি তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়ি তা দুর্ভাগ্যজনক হবে।”

মানালি মুগ্ধ হচ্ছিল। ভদ্রমহিলা বেশি জোরে জোরে কথা বলেন না, বয়সের ভারে অনেকটাই ক্লান্ত, কিন্তু ওঁর মধ্যে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা আছে, অনেকদিন পরে তার মনে হল কাউকে দেখে মাথা নত করাই যায়।

সে বলল, “আপনার কি মনে হয় না রুপোলি জগৎটা খুব দুর্ভাগ্যজনক একটা জগৎ। সম্পর্কের ভাঙা গড়ার জন্য এই জগতের গ্ল্যামার অনেকাংশে দায়ী?”

রত্না হাসলেন, “না। মনে হয় না। সবাই রক্তমাংসের মানুষ। আর পাঁচটা মানুষ যা করে, আমরাও তাই করি। সম্পর্কের ভাঙাগড়া আর পাঁচটা সম্পর্কেও থাকে। আজকাল তো তোমাদের কী সব ফেসবুক না কী এসেছে, আমার ভাইঝি মাঝে মাঝে আমাকে দেখায়, ওখানেই তারা সম্পর্কে জুড়ছে, ওখানেই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে তো বলতে হয় আধুনিক পৃথিবীটাই দুর্ভাগ্যের জগৎ।”

মানালি পরের প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এই সময় কলিংবেল বেজে উঠল। রত্না উঠলেন, “দাঁড়াও, ভাইঝি এল বোধহয়।”

রত্না দরজা খুলতে দরজা থেকে যিনি ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন তাঁকে দেখে মানালি আর-একটু হলেই চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল।

ধ্রুব বাগচী!

২৯

“একটা রাত, একটা দিন, আমার দুঃস্বপ্নের মতো কাটল।”

গাড়ি চলছিল। ঋতি কথাগুলো বলে থামল।

পেছন থেকে একটা গাড়ি অনেকক্ষণ থেকে অনাবশ্যক হর্ন বাজিয়ে চলছিল, দীপ সেটাকে সাইড দিল।

শহর থেকে শীত ছেড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। চিরপরিচিত উষ্ণতা গ্রাস করতে শুরু করে দিয়েছে প্রতিটা কোনা।

দীপের হৃৎস্পন্দন বাড়ছিল। পাশে বসে থাকা ঋতির প্রতিটা ছোঁয়া তাকে উত্তেজিত করে তুলছিল।

সে বলল, “আমারও। তোমার কাছে অনেকটা ক্ষমা চাওয়া বাকি আমার।”

ঋতি বলল, “একটা মেয়ে কখনও কাছের মানুষকে কারও সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না দীপ। আমি যখনই চিত্রলেখার কাছ থেকে তোমার কথা শুনেছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল…” ঋতি কথা শেষ করতে পারল না।

দীপ বলল, “এসব কথা থাক। হোটেল সার্চ করো প্লিজ। অ্যাপটা ওপেন করো।”

ঋতি মোবাইল বের করে হোটেল সার্চ শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পর হোটেলের লোকেশন বলে দিল।

জ্যাম বাড়ছে শহরে। দীপের অস্থির লাগছিল। কাজের সময়েই যত বড়ো বড়ো জ্যামগুলো শুরু হয়।

আধ ঘণ্টা লাগল হোটেলে পৌঁছোতে। গাড়ি পার্ক করে তারা রিসেপশনে গেল। দুজনের আই কার্ড নিয়ে বয় রুম দেখিয়ে দিল।

দীপ দেরি সহ্য করতে পারছিল না। রুমের দরজা বন্ধ হতেই ঋতিকে জড়িয়ে ধরল।

ঋতি তাকে ছাড়িয়ে নিল, “একটু ওয়াশরুম হয়ে আসি।”

দীপ বলল, “ওকে ওকে।”

ঋতি ওয়াশরুমে ঢুকল।

দীপের হোটেলের রুমের দিকে চোখ গেল। আট ঘণ্টার স্লটে হোটেল ভাড়া নিচ্ছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সে তুলনায় ঘরগুলো বিরাট কিছু না। একটা বড়ো এলইডি টিভি আছে। দীপ অন্যমনস্কভাবে রিমোট নিয়ে টিভিটা চালাল।

ঋতি বেরোল মিনিট পাঁচেক পরে। দীপ টিভিটা বন্ধ করল।

ঋতি বলল, “টিভিটা বন্ধ করলে কেন? চলুক না!”

দীপ ঋতিকে জড়িয়ে ধরল। পাগলের মতো ঋতির ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল।

ঋতি দীপকে দূরে ঠেলে দিল, “প্লিজ, এখন ভালো লাগছে না।”

দীপ অবাক হল, “মানে?”

ঋতি বলল, “একটু বসি প্লিজ। একটু গল্প করি। আজ ঠিক ভালো লাগছে না।”

দীপের রাগ হচ্ছিল। সে বলল, “তাহলে হোটেলে এলাম কেন?”

ঋতি বলল, “কথাটাও তো বলা দরকার আমাদের, তাই না?”

দীপ অবাক হচ্ছিল।

এই ঋতিকে সে চিনতে পারছিল না।

ঋতি খাটের সামনের সোফায় বসল। বলল, “আমাদের কিছু কথা বলা দরকার দীপ। শুরু করি?”

দীপ বলল, “করো।”

ঋতি বলল, “চিত্রলেখাকে তোমার ঠিক কোন কারণে অপছন্দ? তুমি সন্দেহ করো ও ভার্জিন নয়? ও মিথ্যাবাদী?”

দীপ খানিকটা হকচকিয়ে গেল। বলল, “এসব কথা কখন হল তোমার সঙ্গে?”

ঋতি বলল, “উত্তরটা দাও প্লিজ।”

দীপ বলল, “হ্যাঁ। অবশ্যই তাই। যখন থেকে বুঝতে পেরেছি ও মিথ্যে কথা বলছে, আমি সরে এসেছি।”

ঋতি বলল, “আমিও তোমায় মিথ্যে কথা বলেছি দীপ। তোমার সঙ্গে দেখা হবার আগে আমার দুটো অ্যাফেয়ার ছিল। দুবারেই আমার ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছিল।”

দীপ অবাক হয়ে ঋতির দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড পর খানিকটা নিজেকে সামলে বলল, “তবে আমাকে দেখে এতটা মুগ্ধতা? প্রথমবার হোটেলের রুমে… বললে… যেগুলো…”

ঋতি দীপের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “সব ফেক ছিল। আমার মনে হয়েছিল তুমি একটা ন্যালাভোলা ছেলে যাকে বাবা-মারও পছন্দ হয়। মেয়ে হিসেবে আমি যথেষ্ট অ্যাডভেঞ্চার লাভার দীপ। তুমি আর আমি তো অনেক ভদ্রভাবে হোটেলে এসে সব কিছু করছি, আমার লাস্ট যে এক্স ছিল তার সঙ্গে আমি যেখানে সেখানে যা ইচ্ছে করে বেড়াতাম। প্রায় সব উইকেন্ডেই, কখনও শান্তিনিকেতন, কখনও দিঘা, মন্দারমণি, বাবাকে বলতাম অফিস ট্যুরে বেরোচ্ছি, আদতে সব এসব করতে যেতাম। সমুদ্রের বালিতে রাত দেড়টার সময় সেক্স করার থ্রিল ইজ হেভেনলি…”

দীপের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সে হাঁ করে ঋতির দিকে তাকিয়ে বলল, “এত সব কথা এখন আমায় বলছ কেন? না বললেও তো পারতে?”

ঋতি বলল, “তোমার সব কথা আমি জেনে গেছি। আমার কেন জানি না মনে হয় আমার সব কথাও তোমাকে বলে দি। আমি ভেবেছিলাম তুমি একেবারেই ভোলাভালা টাইপ ইনসান। ভেবেছিলাম সেটল হয়েই যাব সব কিছু ছেড়ে। চিত্রলেখার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম তুমি একেবারেই সেরকম নও। তুমি ট্রুথ হাইড করতে পারো, তুমি সব কিছু লুকিয়ে ফেলতে পারো। আমার মনে হল আমি বরং তোমার সামনে কিছু অপ্রিয় সত্যি নিয়ে আসি। দেখি তুমি সহ্য করতে পারো কি না।”

দীপ ঋতির দিকে তাকাল। খানিকক্ষণ আগে তার নিজের ভেতরে যে উত্তেজনাটা তৈরি হচ্ছিল, ঋতির কথাগুলো সে সব কিছুর মুখে নুন ছুড়ে মেরেছে।

দীপ খানিকটা আক্রমণাত্মক হতে চেষ্টা করল, “আমি তো তোমাকে কাল রাতেই খুলে বলেছি সবটা। বলিনি?”

ঋতি বলল, “চিত্রলেখা যদি আমাকে না বলত তাহলে কি আদৌ কোনও দিন বলতে?”

দীপ বলল, “ভাগ্যিস বলেছিল। নইলে তো জানতেই পারতাম না তুমিও সব কোর্স কমপ্লিট করেই আমার কাছে সতী সাবিত্রী সেজে এসেছিলে। আমার অবশ্য প্রথমেই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, যখন তুমি আমাকে চুমু খেতে চলে এসেছিলে।”

ঋতি হাসতে লাগল। বেশ খানিকটা অপ্রকৃতিস্থের মতো হেসে বলল, “আমি এরকমই খানিকটা এক্সপেক্ট করেছিলাম তোমার কাছে দীপ। একটু অন্য সুরে কথা বলতেই তোমার ভিতরের অন্য মানুষটা কীভাবে বেরিয়ে এল। বিশ্বাসও করে নিলে দ্যাখো কী সুন্দর, যা বললাম সবটাই। তোমরা কখনোই মেনে নিতে পারবে না মেয়েটা প্রথম চুমু খেতে আসবে। এলে সে-ই খারাপ, তাই না?”

দীপ বলল, “মানে? যা বললে এগুলো সত্যি না?”

ঋতি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হতেও পারে, নাও হতে পারে।”

দীপের রাগ হচ্ছিল। প্রত্যাশাভঙ্গের রাগ। সে বলল, “এই নাটকটা তুমি না করলেই পারতে ঋতি। ফোনে বলে দিতে, ব্রেকআপ হত, সেটাই ভালো হত। এখানে ডেকে আনার কোনও দরকার ছিল না।”

ঋতি বলল, “শোনো দীপ, ওইসব শরীর নিয়ে ন্যাকামো আমারও কোনও কালেই ভালো লাগে না। ভালোবাসায় শরীর আসবেই। যারা বলে আসবে না, তাদেরও পেটে খিদে থাকবে। ফোনে তো বললে হতই, আমি তোমার মুখোমুখি হতে চেয়েছিলাম।”

দীপ বলল, “তো? তুমি কী চাও?”

ঋতি উঠে তার পাশে এসে বসল। ঠোঁটটা দীপের কানের কাছে নিয়ে এসে বলল, “প্রেমটা মিথ্যে। প্রেম ছাড়া শরীরটাও। চলো বেরিয়ে যাই।”

ঋতি কাছে এলেও দীপের মধ্যে কোনও রকম যৌনাকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছিল না। বরং গোটা ব্যাপারটাই তিতকুটে লাগছিল তার কাছে। সে উঠল, “চলো।”

ঋতি উঠল না, বলল, “নিজেকে ডিফেন্ড করবে না দীপ?”

দীপ নিস্পৃহ গলায় বলল, “চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। আগে বললে অফিসটা ডুব মারতাম না।”

ঋতি বলল, “আমার আর চিত্রলেখার একসঙ্গে মুখোমুখি হবার সৎসাহস আছে তোমার?”

দীপ চোখ বড়ো করে বলল, “মানে? রিয়ালিটি শো পেয়েছ নাকি?”

ঋতি বলল, “যদি বলি তাই?”

দীপ বিরক্ত হল, “আমি বেরোলাম। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি থেকে যাও। এখানে থেকে ফালতু সময় নষ্ট করতে পারছি না জাস্ট।”

ঋতি হাসল, “এখন সবই ফালতু লাগবে। এটাই স্বাভাবিক।”

দীপ বলল, “দ্যাখো ঋতি, মরাল অফ দ্য স্টোরি ইজ, আমি তোমাদের কারও সঙ্গেই কোনও রিলেশনে যাব না। সুতরাং এসব অর্থহীন জিনিস করে কোনও লাভ নেই।”

ঋতি বলল, “আমাকে একটা কথা বলো তো। তুমি তো চিত্রলেখাকে অ্যাভয়েড করছিলে জাস্ট। মেয়েটাকে সরাসরি বলে দিলে না কেন যে তোমার ওকে পছন্দ নয়?”

দীপ বলল, “তুমি কি এভাবে ইমোশনাল অত্যাচার করার জন্য হোটেলে রুম নিতে বললে?”

ঋতি ঠান্ডা গলায় বলল, “মানুষজন যদি জানে একটা মেয়েকে ভুলভাল বুঝিয়ে হোটেলের রুমে এনে এক্সপ্লয়েট করার চেষ্টা করেছ, তোমার কী হবে ভেবে দেখেছ?”

দীপের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা শীতল স্রোত চলে গেল। সে ফ্যালফ্যাল করে ঋতির দিকে তাকিয়ে থাকল। ঋতিকে কোনও ভাবেই আর চিনতে পারছিল না সে।

৩০

ধ্রুব ড্রয়িং রুমে ঢুকে মানালিকে দেখে বললেন, “বাহ, আপনি এখানেও?”

মানালি একেবারেই শকড অবস্থায় ছিল। কিছু বলতে পারল না।

রত্না অবাক হয়ে বললেন, “ওঁর এখানে না থাকারই বা কী হল?”

ধ্রুব সোফায় বসতে বসতে বললেন, “সে আর আপনার শুনে কাজ নেই দিদি।”

রত্না বললেন, “বেশ। তুমি যখন বলছ তখন নেই।”

ধ্রুব মানালির দিকে তাকালেন, “আপনার কতক্ষণ লাগবে?”

মানালি ঋপণকে উঠতে ইশারা করে নিজে উঠে দাঁড়াল, “আপনারা কথা বলবেন। আমি আসি বরং।”

রত্না হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “একদম না। সবে তো এলে। বসো। সর্বক্ষণ তো একা একাই কাটাচ্ছি। একটু থাকো। ভালো লাগবে।”

রত্নার কণ্ঠস্বরে কিছু একটা ছিল যেটা মানালি অবজ্ঞা করতে পারল না। চুপচাপ বসে পড়ল।

ধ্রুবর প্রশ্নটায় সে হঠাৎই খানিকটা অপমানিত বোধ করছিল, রত্নার কথায় খানিকটা প্রলেপ লাগল তাতে।

রত্না বললেন, “ওঁর সামনেই বলো ধ্রুব। অসুবিধা নেই।”

ধ্রুব চোখ ছোটো করে তাকে আর ঋপণকে খানিকটা দেখে বললেন, “বলব? ওরা কারা জানেন তো?”

রত্না বললেন, “জানব না কেন। প্রেস তো। যদি তোমার সিনেমার প্রচার হয় তাহলে সমস্যা কোথায়?”

ধ্রুব বললেন, “সিনেমা শুরু হল কোথায়? আপনিই বা রাজি হলেন কখন? আমি তো সেই ব্যাপারে জানতেই এলাম।”

রত্না বললেন, “ভাবছি ধ্রুব। ভেবে যাচ্ছি।”

ধ্রুব বললেন, “বেশ। ভাবুন। কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি ভাবুন। আপনার ওপরই নির্ভর করে আছে এই সিনেমার ভবিষ্যৎ।”

রত্না অবাক হলেন, “এরকম ব্যাপার?”

ধ্রুব বললেন, “অবশ্যই। আমি যে চরিত্রে আপনাকে ভেবেছি, সেটা আপনি না করলে সিনেমাটাই আমি বানাব না।”

রত্না একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, “এই কিছুদিন আগেও একা একা এই ঘরে বসে থেকে যখন টিভি দেখতাম ধ্রুব, আমার প্রতিদিন মনে হয়েছে আমাকে বোধহয় আর কেউ মনে রাখেনি। সবাই সব কিছু ভুলে গেছে। মানুষ স্বর্ণযুগ স্বর্ণযুগ বলে এত মাতামাতি করে অথচ নায়করা যে সম্মানটা পেয়ে বাঁচেন তার সিকিভাগও নায়িকারা পান না। কেমন নিঃশব্দে সবাই চলে যান। অথবা হয়তো যেতে না চাইলেও যেতে বাধ্য হন। তোমার এই কথাগুলো আমাকে অনেকটা বল দিল ধ্রুব। আমি তোমার সিনেমা করব। তবে আমি বয়স্কা একজন মানুষ। আশা করব…”

ধ্রুব হাত তুললেন, “আর কিছু বলতে হবে না। ওসব চিন্তা আমার।”

পরক্ষণেই ধ্রুব মানালির দিকে তাকালেন, “নিউজটা করছেন তো?”

মানালি অপ্রস্তুত হল, “আমি শুধু এটুকু জানলাম আপনি একটা সিনেমা বানাচ্ছেন, তাতে দিদি অভিনয় করবেন। এর বেশি আমি এমন কিছুই জানি না যা নিয়ে কোনও স্টোরি করা যায়।”

ধ্রুব বললেন, “টার্মটা একদম পারফেক্ট বলেছেন। স্টোরিই বটে। আপনারা নিউজ করেন না। স্টোরি করেন।”

রত্না বললেন, “এসব কথা এখানে না বললে খুশি হতাম ধ্রুব। ও কিন্তু আমার বাড়িতে এসেছে আজকে।”

রত্না যে রুষ্ট হচ্ছেন, বুঝল সবাই। মানালি ভেতরে ভেতরে একটু স্বস্তি বোধ করল।

ধ্রুব বললেন, “সরি সরি দিদি। আর হবে না। তবে কী জানেন তো, বাড়ি বয়ে এসে কেউ যদি কেচ্ছা খুঁড়ে বের করে নিউজ করে তখন খানিকটা রাগ হওয়া জায়েজ। সব সুস্থ মানুষই হয়তো রাগ করত, যেমন আমি করেছিলাম। সকাল থেকে ফোন আর টিভির ব্রেকিং নিউজের জ্বালায়… যাই হোক।”

রত্না বললেন, “বেশ তো। আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে নাহয় ঝগড়াটা কোরো। আপাতত বন্ধ রাখো।”

ধ্রুব কাঁধ ঝাঁকালেন, “আচ্ছা। আপাতত তাই হোক। অবশ্য আমার খুশি হবার কথা এখন। আমার এতদিনের পরিশ্রম আজ সফল হল। এবার প্রি-প্রোডাকশনের কাজ আমরা শুরু করে দিতে পারব।”

রত্না বললেন, “আর কে কে থাকবে?”

ধ্রুব একবার মানালির দিকে তাকালেন, তারপর রত্নার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শিগগিরি জানাচ্ছি দিদি।”

মানালি বুঝল তার সামনে বলতে চাইছেন না ধ্রুব।

রত্না বললেন, “যে-ই থাকুক আমার কোনও অসুবিধা নেই অবশ্য। আমার শুধু আমার শরীরটা নিয়েই যা ভয় লাগে। কখনও খুব খারাপ হয়ে পড়লে তোমাদের বড়ো সমস্যা হয়ে যাবে।”

ধ্রুব মাথা নাড়লেন, “সেসব ব্যাপার আমি বুঝব দিদি।”

রত্না খুশি হলেন, “বেশ। তাই হোক। দেখি কতটা কী করতে পারি।”

মানালি উঠল, “আমি আসি দিদি। আমাকে আবার বাড়িতে ফিরতে হবে।”

রত্না বললেন, “অনেকটা দূরে বাড়ি তোমার?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ দিদি। আমি আসি।”

রত্না বললেন, “বেশ। সাবধানে যেয়ো। খবরটা বেরোলে আমায় জানিয়ো একটু ফোন করে।”

মানালি হাসল, “নিশ্চয়ই দিদি। গুড নাইট।”

রত্না বললেন, “সাবধানে যেয়ো।”

মানালি আর ধ্রুবর দিকে তাকাল না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

রত্না ব্যানার্জি দরজা অবধি এলেন তাদের পৌঁছে দিতে।

রাস্তায় নেমে মানালি একটা শ্বাস ছাড়ল, “উফ, দেখলি? যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।”

ঋপণ বলল, “হয়েছিল তোর আজকে। মালটা তক্কে তক্কে আছে।”

মানালি ম্লান হল খানিকটা, “আমার বোধহয় আর বেশিদিন চাকরি করা হয়ে উঠবে না।”

ঋপণ ক্যামেরার ব্যাগ ঠিক করতে করতে বলল, “ধুস, ছাড় তো! অফিসে এসব চলতেই থাকে। তবে তোকে অনেক বেশি স্টেডি হতে হবে। তোর মধ্যে এখনও কলেজ স্টুডেন্ট ভাবটা রয়ে গেছে। এইজন্যই হয়তো বিশ্বরূপদাও বেশি বেশি করে তোকে এসব সিচুয়েশনে ফেলে টেস্ট করে যাচ্ছে।”

মানালি বলল, “হুঁ, আমি তো গিনিপিগ। এক আমাকেই পেয়েছে এইসব সিচুয়েশনে ফেলার জন্য। কই বাকিদের তো ফ্যালে না!”

ঋপণ বলল, “জানিস না তবে তুই। প্রান্তিকের ঘটনাটা জানিস তো?”

মানালি মাথা নাড়ল, “কী ঘটনা?”

ঋপণ বলল, “সেই যে সেই মন্ত্রীটার কোরাপশনের নিউজটা জোর করে করাল প্রান্তিককে দিয়ে। প্রান্তিক প্রায়ই থ্রেট খায়। বিশ্বরূপদার কাছে গেছিল। বিশ্বরূপদা ভাগিয়ে দিয়েছে এই বলে যে জার্নোদের ক্ষেত্রে এসব কমন ব্যাপার। অত ভয় খেলে বাড়িতে বসে সাপলুডো খেলো গে যাও।”

মানালি বলল, “প্রবলেমটা তো অন্য জায়গায়। অতই যখন তোমার সাহস তখন নিজের নামে নিউজটা করো না বাপু। আমাদের ফাঁসাচ্ছ কী করতে!”

ঋপণ বলল, “ওখানেই তো কবি কেঁদে দিয়েছে। দেখবি কদিন পরে কোনও প্রাইজ গিভিং সেরিমনিতে ধ্রুব বাগচী আর বিশ্বরূপদা পাশাপাশি বসে চিয়ার্স করছে আর তুই দৌড়ে বেড়াচ্ছিস কেসের ভয়ে। এসবই তো হয় এই লাইনে। কেউ নিজের ঘাড়ে কোনও কিছু নিতে চায় না।”

মানালি বলল, “যে যা পারে করুক, আমার না পোষালে আমি সিম্পলি চাকরি ছেড়ে দেব।”

ঋপণ বলল, “সেই ভালো। সংসার করবি মন দিয়ে।”

মানালি কড়া চোখে ঋপণের দিকে তাকাল। তার ফোনটা বেজে উঠল। মানালি দেখল আননোন নাম্বার। সে ধরল, “হ্যালো।”

“হ্যালো, আমি ট্রিভিয়া মিডিয়া হাউজ থেকে বলছি। মানালি বলছেন?”

মানালি অবাক হল। বলল, “হ্যাঁ, বলছি।”

“একটু হোল্ডে থাকুন ম্যাম, আমাদের স্যার একটু আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।”

ফোনের ওপাশ থেকে ইন্টারকমের মিউজিক শুরু হল।

মানালি বলল, “যাহ্বাবা।”

ঋপণ বলল, “কী কেস?”

মানালি ঠোঁট ওলটাল, “কে জানে। কিছুই বুঝছি না।”

ফোনের ওপাশ থেকে এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “মানালি বলছেন?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ, কে বলছেন?”

“আমি বিপ্রতীপ রায় বলছি।”

মানালি অবাক হল। বিপ্রতীপ রায়? যার একার নামেই ট্রিভিয়ার নিউজ চ্যানেলটা এত বিখ্যাত? সে বলল, “হ্যাঁ বলুন স্যার।”

“কনগ্র্যাচুলেশনস আজকের নিউজটার জন্য। আজ এই শহরে এই একটাই খবর। আপনি এক্কেবারে বুলস আই হিট করেছেন মানালি।”

মানালি বুঝল না তার এত তারিফ করছেন কেন ভদ্রলোক। শুধু বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”

“মানালি আপনার স্যালারির তিন গুণ আমরা আপনাকে অফার করছি। আপনি ট্রিভিয়া মিডিয়ায় জয়েন করতে আগ্রহী?”

রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ এই প্রস্তাবে মানালির হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাচ্ছিল। সকাল থেকে এত টেনশন, তার ওপর হঠাৎ করে এমন প্রস্তাব, সে কোনও মতে নিজেকে সামলাল।

৩১

ন্যাশনাল হাইওয়েতে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছিল দীপ। ঘণ্টাখানেক আগে হোটেল থেকে বেরিয়েছে দুজনে।

ঋতি আর গাড়িতে ওঠেনি তার। গাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেছিল সে।

স্টার্ট যখন দিল তখন আর মাথা কাজ করছিল না।

বেশ কিছুক্ষণ শহরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে গাড়ি চালিয়ে যখন দেখল বারবার গাড়ি দাঁড় করাতে হচ্ছে জ্যামের জন্য, গাড়ি নিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরে দিল্লি রোড ধরে ফেলল। ডানকুনির টোল প্লাজা পেরিয়ে আধ ঘণ্টাটাক চালিয়ে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করাল।

গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়াল। নিজের ওপর একটা অদ্ভুত রাগ হচ্ছিল তার। বারে বারে মনে হচ্ছিল আদতে সে হেরে গেছে। নিজের কাছে, নিজের ইন্দ্রিয়র কাছে।

ঝড়ের গতিতে এক-একটা গাড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। দীপ গাড়িতে গিয়ে বসল।

দেখল রাম মিসড কল মেরেছে। কলব্যাক করল সে।

রাম ধরতে বলল, “আজ ডুব মারলি। আবার কোনও চক্করে পড়লি, তাই তো?”

দীপ বলল, “ছিল। আর থাকবে না।”

রাম রেগে গেল, “সে তো সবাই তাই বলে। কাজের সময় দেখা যায় আবার গন্ধ পেলেই পেছন পেছন দৌড়োতে শুরু করবি। কী হয়েছে, খুলে বল।”

দীপ কাটাল, “কাল বলব। ফোনে বলা যাবে না।”

রাম বলল, “কাল কেন? আজ কিঁউ নেহি? কোথায় তুই এখন?”

দীপ বলল, “দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে।”

রাম আঁতকে উঠল, “লড়কি সাথ মে? ক্যা কর রহা হ্যায় বে?”

দীপ বলল, “না না, লড়কি নেই। একাই আছি।”

রাম বলল, “একা একা কী করছিস?”

দীপ বিরক্ত হল, “বললাম তো পরে বলব। রাখ এখন।”

ফোনটা কেটে দিল সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে গাড়ি ঘোরাল। বিকেলের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেল।

তাকে ঢুকতে দেখে মা বলল, “সে কী রে, আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছিল! এত তাড়াতাড়ি চলে এলি!”

দীপ বলল, “ছুটি হয়ে গেল। আমি এখন ঘুমাব। পরে কথা বলছি।”

মা বলল, “এই বিকেলে ঘুমোবি? পাগল নাকি?”

দীপ উত্তর না দিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। জামাকাপড় পরেই খাটের ওপর শুয়ে পড়ল। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা গ্রাস করছিল তাকে। বেশ খানিকক্ষণ পর শুয়ে থেকে যখন বাইরের ঘরে এল, দেখল বাবা মা বসে টিভি সিরিয়াল দেখছে।

বাবা তাকে দেখে বিরক্ত গলায় বলল, “দেখ, বাংলা সিরিয়াল। ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান কিছুই মানে না। এদের ধরে ধরে ম্যাপ পয়েন্টিং করানো উচিত।”

দীপ গম্ভীর গলায় বলল, “টিভিটা বন্ধ করো একটু। কথা আছে।”

মা বিরক্ত গলায় বলল, “বল না। বলতে কী অসুবিধা।”

দীপ বলল, “ঠিক আছে, এটা দেখে নাও, তারপরে বলছি।”

মা বলল, “পরে কী করে বলবি? এর পরে সন্ন্যাসী রাজা আছে, কুসুমদোলা আছে, গোপাল ভাঁড় আছে, রাত এগারোটার আগে আমি উঠতেই পারব না টিভির সামনে থেকে আজকে। যা বলার টিভি চলতে চলতেই বল।”

দীপ বলল, “আমার জন্য মেয়ে দ্যাখো। আমি বিয়ে করব।”

দীপের মুখ থেকে কথাটা বেরোতে বাবা মা তার দিকে হাঁ করে তাকাল। মার হাত থেকে রিমোটটা খসে গিয়ে মেঝেতে পড়ে সেটার ব্যাটারি বেরিয়ে গেল। বাবা বলল, “তোর নাকি নিজে নিজেই মেয়ে দেখা ছিল?”

দীপ বলল, “সব ক্যানসেল। তোমরা মেয়ে দ্যাখো। আমি বিয়ে করব।”

মা রিমোটটা তুলে ব্যাটারি লাগিয়ে টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে বাবাকে বলল, “ওর কথায় কান দিয়ো না। তুমি মেয়ে দেখে আনবে তারপর ও ঠিক ভেগে যাবে।”

বাবা বলল, “বুঝেছি। চতুর্থ পানিপথ।”

মা বলল, “মানে?”

বাবা বলল, “চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ হয়েছে আর কি! ঝগড়া করেছে।”

দীপ বলল, “দ্যাখো মা, আমি সেদিন ইচ্ছা করেই বলেছিলাম, আমার গার্লফ্রেন্ড আছে, তোমাদের কাটানোর জন্য। কোনও কালেই ছিল না। তোমরা মেয়ে দ্যাখো।”

মা বাবার দিকে তাকাল। বাবা মায়ের দিকে।

কয়েক সেকেন্ড পরে মা বলল, “কালকে তোকে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাব। কথা বলিস সামনাসামনি। উনি যা চাইবেন তাই করা যাবে।”

দীপ রেগে গেল, “গুরুদেব কী করবে? তা ছাড়া এসব ভণ্ড পাবলিক আমি কাকে বিয়ে করব সেটা ঠিক করে দেবে নাকি? বাবা, তুমি মাকে বোঝাও! এসব ধর্মগুরু সবকটা জালি হয়। যে জিনিসটার অস্তিত্বই নেই, তার দালালি করে মানুষকে টুপি পরিয়ে যাবে, তারা আবার ঠিক করে দেবে কে কাকে বিয়ে করবে, এসব অ্যাবসার্ড না?”

মা রেগে গেল, “এসব কথা বলবি না আমার সামনে। আমি কিন্তু সব কিছু মানি।”

বাবা বলল, “পিকে আমিও দেখেছি দীপ, ব্যাপারটা সেটা না। ব্যাপারটা হল কী এমন হল যে হঠাৎ করে তুই বিয়ে করার জন্য এরকম খেপে উঠলি?”

দীপ বলল, “ইচ্ছা হল।”

বাবা বলল, “ইচ্ছা হওয়া ভালো। কিন্তু কোনও প্রবলেমে আছিস, সেটা থেকে বাঁচার জন্য যদি বিয়ে করতে চাস তাহলে তুই বড়ো ভুল করবি। মানে তপ্ত কড়াই থেকে ফুটন্ত তাওয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে খুব একটা লাভ হয় কি?” বাবা গলা খাঁকড়াল, “বিয়ে করে লাইফটা নরক করার কোনও অর্থ নেই।”

মা বলল, “তুমি থামো। আমি কাল সকালে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি গুরুদেবের চেম্বারে। তুই আমার সঙ্গে একবারে রেডি হয়ে বেরোবি। ওখান থেকে অফিসে চলে যাবি।”

দীপ গোঁজ হয়ে রইল।

***

গুরুদেব শ্রী শ্রী একশো আট চাঁদবদন মহারাজ আলাউদ্দিন খলজির মতো একটা পদ্মফুল নাকে গুঁজে বসেছিলেন। সামনের ফরাসে খান তিরিশেক লুচি সাজানো। দীপ আর মা গুরুদেবের চেম্বারে ঢুকতে গুরুদেব ইশারায় দীপের মাকে বেরিয়ে যেতে বললেন।

মা বেরিয়ে গেল। ঘরে আর কেউ নেই। শুধু দীপ আর গুরুদেব।

নাক থেকে পদ্মফুলটা নামিয়ে গুরুদেব একটা লুচি মুখে পুরে বললেন, “তোমার মা বলছেন তুমি নাকি বিয়ে করতে চাও? কেন?”

দীপ বলল, “ইচ্ছা।”

গুরুদেব বললেন, “কেন? এমন ইচ্ছা হবার কারণ?”

দীপ গুরুদেবের দিকে তাকাল। মাথার বেশিরভাগ চুল পেকে গেছে। খুব করে চন্দন সাবান দিয়ে স্নান করেছেন সম্ভবত। ঘরময় চন্দনের গন্ধ। ঘরের ধুপকাঠিতেও চন্দনের গন্ধ।

দীপ একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আপনার কী দাবি? সারাজীবন একা একা কাটিয়ে দেব?”

গুরুদেব কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার কম বয়েস। এই বয়স ঠাকুর দেবতা মানার বয়স নয়। তুমি সেটা মানোও না সেটা তোমাকে দেখলে বোঝা যায়। নিতান্ত সমস্যায় পড়েই তুমি এখানে এসেছ। আমরা বন্ধুর মতো কথা বলতে পারি। তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে তোমার সমস্যা বলতে পারো। ভয় নেই। আমি তোমার কোনও কথাই পাঁচকান করব না।”

দীপ গুরুদেবের কথায় একটু অবাক হল। এতটা যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন উনি, সেটা সে ভাবতে পারেনি। চারদিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সেক্স করেছি দু-তিন দিন হল। তারপর থেকে আমি অন্য কিছুতে মন বসাতে পারছি না।”

গুরুদেব বললেন, “তার মানে তোমার কথা অনুযায়ী শারীরিক চাহিদার জন্যই তুমি বিয়ে করতে চাইছ, তাই তো?”

দীপ বলল, “অনেকটা তাই।”

গুরুদেব গম্ভীর হলেন। বললেন, “বলতে পারবে কেন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানটা এত জনপ্রিয়?”

দীপ বলল, “এর মধ্যে এই গানটা এল কোথা থেকে?”

গুরুদেব দীপের কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “এই কারণেই জনপ্রিয় যে মানুষ সবথেকে বেশি নিজেকেই ভালোবাসে। গানটা শুনতে শুনতে যখন মানুষ ভাবতে শুরু করে সত্যিই তো, যেদিন আমি থাকব না, তখনও তো সব থাকবে। শুধু আমি থাকব না। যাই হোক, বেশি বলে ফেলছি তবু বলি, তুমি যে কথাটা বললে সেটা আসলে নিজেকে ভালোবাসা। তুমি এই মুহূর্তে কাউকে ভালোবাসার অবস্থায় নেই। তোমার ভালোবাসায় ভালোবাসা কম, শরীর বেশি। এভাবে সম্পর্ক টেকে না যদিও।”

দীপ বলল, “সেইজন্যই তো ঠিক করেছি বিয়ে করব। এক কাজ করুন, আপনিও আমার জন্য একটা মেয়ে দেখুন। ঘটকালিও হবে, গুরুদেবগিরিও হবে। কী বলেন?”

গুরুদেব কটমট করে দীপের দিকে তাকালেন।

৩২

মানালির বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত নটা বাজল। বাবা টিভি দেখছিল। তাকে দেখে বলল, “চাইনিজ খাওয়াটা আর হল না আজ। যাক গে, আসন্ন ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ব্যবসায়ী সমিতির উন্নতিকল্পে কত টাকা দান করছিস?”

মানালি হাসল। বাবার কথাবার্তা এমনই। তার ক্লান্ত লাগছিল। ব্যাগটা সামনের টেবিলের রেখে সোফায় বসে বলল, “মা কোথায়?”

বাবা বলল, “ঘুমোচ্ছে। সান্ধ্যকালীন নিদ্রা।”

মানালি বলল, “যাক বাঁচা গেল, তবে দশটার মধ্যেই উঠে পড়ে সাধারণত।”

বাবা বলল, “অদ্ভুত অভ্যাস যাই বলিস, এর পর রাত বারোটা অবধি বাসন মাজবে। সেই কবে থেকে দেখছি।”

মানালি বলল, “তার আগে খেয়ে নিতে পারলে ভালো হয়। নইলে আবার শুরু করবে।”

বাবা বলল, “শুরু যাতে না করে সেই ব্যবস্থা করলেই তো পারিস।”

মানালি বলল, “প্লিজ বাবা। তুমিও শুরু কোরো না।”

বাবা বলল, “শুরু করছি না। জাস্ট আস্কিং। ছেলেটা কে? কী করে?”

মানালি অবাক হয়ে বলল, “ছেলে পেলে কোত্থেকে?”

বাবা বলল, “তুই যে বলেছিস তোর বয়ফ্রেন্ড আছে, ভুলে গেলি?”

মানালির মনে পড়ল। সে বলল, “ও আছে একজন।”

বাবা বলল, “অফিসের?”

মানালি মাথা নাড়ল, “না, অফিসের না।”

বাবা বলল, “তবে?”

মানালি বলল, “এম এন সিতে কাজ করে।”

বাবা খুশি হল, “বাহ, খুব ভালো তো। বিয়ে করে ফেল। তোর মা বাঁচে, তুই আর আমি দুজনেই বাঁচি।”

মানালি মাথায় হাত দিল। বলল, “বাবা, আমি অফিসে একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণভাবে ফেঁসে আছি, প্লাস একটা হাউস থেকে এই কিছুক্ষণ আগে বেশি মাইনের চাকরির অফার এসেছে। সব কিছু নিয়ে আমি খুব কনফিউজড। এর মধ্যে মিক্সার মেশিনে আবার আমার বিয়েটা ঢুকিয়ো না প্লিজ। আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাব বিশ্বাস করো।”

বাবা বলল, “কী ব্যাপারে ফেঁসেছিস? আজকের নিউজটা যেটা করেছিস সেটা নিয়ে?”

মানালি বলল, “ওই হল। ওই ব্যাপারগুলো নিয়েই আর কি।”

বাবা বলল, “এগুলো তো সব অকুপেশনাল হ্যাজার্ডস। সবার থাকে। তোরও আছে। থাকবে। তার জন্য কি নাওয়া খাওয়া ভুলে সব সময় চিন্তা করে যাবি? এক কাজ কর, একদিন ছেলেটাকে বাড়িতে ডাক, আমি কথা বলি। চিন্তা করিস না, আমার ছোঁড়াকে পছন্দ না হলেও সেই ছোঁড়ার সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব। এসব ব্যাপারে আমি একেবারেই পিউরিটান নই।”

মানালি বাবার দিকে রাগি চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “তোমাকে কি মা ব্রেইন ওয়াশ করেছে সারাদিন ধরে?”

বাবা হাসল, “কেন বল তো?”

মানালি বলল, “এই যে একই কথা অন্য ভার্সনে বলে যাচ্ছ! আচ্ছা বাবা, বিয়ে দিয়ে কী এমন লাভ হয় বাবা-মায়ের? তোমরা কেন এখনও এই সময়ে এসেও একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে একই ভাবতে পারো না? মেয়ে পার করতে পারলেই স্বস্তি তাই না?”

বাবা বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, তুই রেগে যাস না। তুই যদি রেগে যাস তাহলে আর তো কোনও কথাই বলা যাবে না। তোকে আমি আলাদা কোনও দিনও ভাবিনি, কিন্তু মা, আমাদেরও তো ইচ্ছা করে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে। এগুলো তো স্বাভাবিক ব্যাপার তাই না? আজ না হয় কাল তোরা বিয়ে করবি, এতদিন তোকে বড়ো করলাম, আমাদেরও তো খানিকটা অধিকারবোধ জন্মায় তোর ওপরে?”

বাবার গলা খানিকটা অভিমানী শোনাল।

মানালি টিভির দিকে তাকাল। ধ্রুব বাগচীর খবরটা দেখাচ্ছে। রূপনারায়ণপুরে চলে গিয়েছিল সাংবাদিকরা। ঈপ্সিতা কাউকেই ঢুকতে দেননি। ফোনে শ্রীপর্ণা ঘোষাল জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর এবং ধ্রুব বাগচী সম্পর্কে যা যা রটছে তা সম্পূর্ণ গুজব। তাঁরা খুব ভালো বন্ধু। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে এভাবে মিসইন্টারপ্রেট করায় যে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত তাও দেখাচ্ছে।

বাবা বলল, “কিছু বল।”

মানালি বলল, “দেখবে দেখবে। চিন্তা করছ কেন?”

বাবা বলল, “ফটো আছে?”

মানালি নিঃশ্বাস ছাড়ল, “না বাবা।”

বাবা বলল, “এইসব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর যুগে ফটো পাওয়া এমন কোনও চিন্তার ব্যাপার না। সেসব নিয়ে আমি ভাবছি না। যাক গে, বয়সের ডিফারেন্স স্বাভাবিক তো! আজকাল যা হচ্ছে! হয় মেয়েটা ছেলেটার থেকে দশ বছর বড়ো, নইলে কোনও বুড়োর সঙ্গে অষ্টাদশবর্ষীয়া কন্যার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তোর আবার কুড়ি তিরিশ বছর বড়ো কোনও কাকু জেঠু পছন্দ হয়ে যায়নি তো? হয়তো দেখা গেল তার স্ত্রীও আছে। দেখিস, কারও সংসার ভাঙিস না যেন।”

মানালি হাত জোড় করল, “প্রণাম বাবা। তোমার কল্পনাশক্তি পৃথিবীর সেরা লেখকের থেকেও এক কাঠি ওপরে। তুমি বরং লেখালেখি করো।”

বাবা বলল, “কী করব বল! তোদের জেনারেশনটাকে একেবারেই বুঝতে পারি না। আবার ভালোও লাগে। তোর যে নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছেটা হয়েছে সেটাকেও অ্যাপ্রিশিয়েট না করে পারি না।”

মানালি বলল, “থ্যাংকস বাবা। এতক্ষণ পরে একটা ভালো কথা বললে।”

বাবা বলল, “কথা আমি সব ভালোই বলি। তুই শুধু বুঝতে পারিস না এটাই প্রবলেম। যাই হোক, মাকে ডাক, খেয়ে নে। বা মা আসার আগেই খেয়ে নে। তাহলে আর একগাদা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না তোকে।”

মানালি বলল, “আর খেয়েই বা কী হবে? যা গেল সারাটা দিন, আমার আর কিছু পেটে ঢুকবে না।”

বাবা বলল, “কী গেল? সমস্যাটা কী?”

মানালি বলল, “সে অনেক সমস্যা। সব বলে লাভ নেই। বুঝবেও না।”

সে উঠল, “আমি ঘরে যাই। ঘুমিয়ে পড়ি।”

বাবা বলল, “কিছু তো খা।”

মানালি বলল, “দেখছি।”

সে ফ্রিজ খুলল। একটা চকোলেট ছিল। সেটা হাতে নিয়ে বলল, “এই তো, ডিনার পেয়ে গেলাম। আর চিন্তা নেই।”

বাবা বলল, “তোর মা ঝাড়লে আমি জানি না কিন্তু।”

মানালি বলল, “আমি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। তুমি সামলে নিয়ো।”

বাবা ব্যাজার মুখ করল, “দেখি, কী করে সামলাই।”

মানালি ঘরে ঢুকল। সকালে সব কিছু নিয়ে সে যতটা টেন্সড ছিল, অতটা আর হচ্ছিল না এখন। দরজা বন্ধ করে চেঞ্জ করে খাটে শুয়ে ল্যাপটপ খুলল। ফেসবুকে অনেকগুলো মেসেজ এসেছে। সে বেশিরভাগই ইগনোর করে গেল। কিছু পাবলিক আছে, মেয়ের প্রোফাইল পেলেই ওভারস্মার্ট সেজে ফ্যালে। বেশ কিছু এরকম মেসেজ জমেছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার ধরনগুলো দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ল সে। নিজের ওয়ালে এল। কয়েকটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। একটাও অ্যাক্সেপ্ট করল না। বিতস্তা পিং করল, “কি রে, কী হল শেষমেশ?”

মানালি লিখল, “কী আবার হবে?”

“আর কেউ ঝাঁট জ্বালিয়েছে আজ? ধ্রুব বাগচী ফোন করেছিল?”

“আমি তো জ্বলার ওপরেই থাকি। ও আর কী!”

“আচ্ছা, লিভ ইট, গেস কর তো আমি কোথায় আছি?”

“আর কোথায় থাকবি? সৌরভের ফ্ল্যাটে?”

“না বে। হোটেলে। জাস্ট চেক ইন করলাম। সেই অ্যাপ রে।”

“গান্ডু। হোটেলে চেক ইন করে এখন ফেসবুক করছিস?”

“ডেবিউ হয়ে গেছে। সৌরভের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। আনতে বেরিয়েছে।”

“হি হি। ওকে, এনজয়।”

“হ্যাঁ রে বাই।”

বিতস্তার সাথে কথা বলে ল্যাপটপটা শাট ডাউন করল মানালি।

সারাদিন বড়ো টেনশন গেছে। মাথাটা হঠাৎ খুব শান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছিল তার। চোখ বুজল সে।

ঘুম ভাঙল মোবাইলের শব্দে। মানালি দেখল রাত বারোটা বেজে গেছে। কোনও মতে ফোনটা ধরল সে, “কে?”

“আমি বলছি রে মানালি।” ওপাশ থেকে বিতস্তার গলা। কেমন টেন্সড।

মানালি বলল, “কী হল?”

“আর বলিস না, সেই যে সৌরভ বেরিয়েছিল এখনও ফেরেনি। আমি অনেকক্ষণ দেখলাম। তারপর সৌরভকে বারবার ফোন করছি। ফোন নট রিচেবল বলছে।” বিতস্তার গলার ভয়টা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল মানালি।

সে বলল, “শোন, শোন, নিশ্চয়ই কোনও প্রবলেম হয়েছে, তুই টেনশন করিস না, রাতটা হোটেলেই কাটিয়ে দে। সকালে নাহয় চেক আউট করে যাস। টাকা আছে তো?”

বিতস্তা বলল, “টাকা আছে, কিন্তু আমার তো ভয় লাগছে রে! যদি অন্য কেউ চলে আসে? বুঝতেই তো পারছিস!”

মানালি বলল, “বিশ্বরূপদাকে বলব তোকে নিয়ে আসতে? বা ঋপণকে?”

বিতস্তা বলল, “তুই খেপেছিস? গোটা পৃথিবীর লোক জেনে যাবে তাহলে। আমার তো মাথাই কাজ করছে না রে। ভয় লাগছে ওর কিছু হল নাকি!”

মানালি বলল, “তুই চিন্তা করিস না, ফোনটা অন রাখ, কোনও রকম প্রবলেম হলে ফোন কর আমাকে।”

বিতস্তা বলল, “প্রবলেম হবে ভাবতে গেলেই তো কেমন কেমন লাগছে রে। আনম্যারিড কাপল হোটেলে থাকছে এসব কেউ মেনে নেবে না! কিছু হলে সবাই তো আমাকেই দেখাবে।”

মানালি একটা ধমক দিল, “কিচ্ছু হবে না। অত ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। মাথা ঠান্ডা রাখ জাস্ট। ঘুমিয়ে পড় বরং। সকালে উঠে সৌরভকে খোঁজা যাবে।”

বিতস্তা বলল, “শোন না, আমরা তো এখন পার্ক স্ট্রিট এরিয়ায় আছি। পুলিশ স্টেশনে ফোন করে একটু খোঁজ নিতে পারবি, সৌরভ দাস বলে কারও কোনও খবর আছে নাকি?”

মানালি বলল, “আচ্ছা দেখছি। তুই টেন্সড হোস না। ফোনটা রাখ, আমি দেখছি।”

ফোনটা কাটল সে। মাথাটা এক্কেবারে ফাঁকা লাগছে তার। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।

৩৩

“ভাই সুস্থ আছিস তো?”

লাঞ্চ করতে একাই বেরিয়েছিল দীপ। রাম পেছন থেকে দৌড়োতে দৌড়োতে এল।

দীপ বলল, “হ্যাঁ। অসুস্থ কেন হব?”

রাম বলল, “তোর হালচাল তো ভালো ঠেকছে না। পাবলিক ইউরিনালওয়ালা কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়িসনি তো ভাই?”

দীপ অবাক হল, “মানে?”

রাম বলল, “কিছু কিছু আছে তো। টেগোরের একটা কবিতা শুনছিলাম, হেথায় আর্য হেথা অনার্য এক দেহে হল লীন। মানে ইউনিভারসাল গিভার। এরকম কারও পাল্লায় পড়িসনি তো ভাই? লাইফ হেল হয়ে যাবে কিন্তু আগে থেকে বলে দিলাম।”

দীপ বলল, “তুই টেগোর পড়লি কীভাবে? বাংলায় পড়েছিস?”

রাম চোখ নাচাল, “পড়েছি, কে পড়িয়েছে সেটা তোর না জানলেও হবে। আসল কথায় আয় ভাই। এরকম কারও পাল্লায় পড়লি না তো? যা ডেস্ক্রিপশন দিচ্ছিস, একদিনেই কোর্স কমপ্লিট করে ফেললি, তাতে তো সেরকমই লাগছে।”

দীপ উত্তর না দিয়ে একটা খাবারের স্টলে রুটি মাংস নিয়ে খেতে শুরু করল।

রাম বলল, “কী বে? চুপ হয়ে গেলি কেন?”

দীপ বলল, “পোষাচ্ছে না। ব্রেক লাগবে।”

রাম বলল, “হ্যাঁ তুই এই কর। একদিন পর পর ছুটি নে। তারপর বস তোকে একেবারেই লং ব্রেকে পাঠিয়ে দেবে।”

দীপ বলল, “বসের সঙ্গেই কথা বলব। মাইন্ডটা পুরো ছেতরে আছে। বিয়ে করলেও হয়।”

রাম অবাক হয়ে দীপের দিকে বড়ো বড়ো চোখে করে তাকিয়ে বলল, “এই হল তোদের বাঙালি ছেলেদের সমস্যা। বাঁড়া সারাজীবন কোনও মেয়ে দেখবি না, টেনে পড়াশুনা করবি, তারপর যখনই ফুটার পাল্লায় পড়বি, ঝাঁপিয়ে পড়ে যাচ্ছেতাই করে ফেলবি। তুই জাস্ট ভাব এ কদিনে তুই কী কী করলি! এর মধ্যে আবার তোর মাথায় বিয়েও নিয়ে এলি ভাই?”

দীপ মুরগির ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে বলল, “আমি সিরিয়াস। আমার মনে হয় বিয়ে করলেই আমি এক্কেবারে ঠিক হয়ে যাব।”

রাম বলল, “ঠিক হয়ে যাবি? ওকে! এক্সপ্লেইন।”

দীপ বলল, “আমি যেটা বুঝতে পারছি, সেটা হল আমার একটা ক্রাইসিস পিরিয়ড চলছে। সব কিছু নিয়ে বিচ্ছিরিভাবে ছড়িয়ে গেছি। এমন কোনও পার্টনার চাই, যার সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করা যাবে। আমাকে বুঝবে। মানে…”

রাম বাধা দিয়ে বলল, “মেয়েরা ছেলেদের বুঝবে। এই আশাতেই কত কবি কেঁদে দিল। উনি এলেন বুঝবে। আসল কথাটা বলো না মামা, তুমি এখন কামের ফাঁদে পড়েছ!”

দীপ চুপচাপ খেয়ে গেল। বলল, “তুই যদি উইকেন্ডে কোথাও যাবি তো বল। আমি তোর এই ভ্যাক ভ্যাক আর শুনতে পারছি না।”

রাম বলল, “চল। আমার তো কোনও কাজ নেই। ভুবনেশ্বর কবে যাবি?”

দীপ বলল, “পরের সোমবার। তার আগে শান্তিতে কোথাও বসে মদ খেয়ে আসি।”

রাম ফিসফিস করে বলল, “কাল কী করলি?”

দীপ বলল, “ছিঁড়লাম। ঝাঁট জ্বালাস না।”

রাম ব্যাজার মুখে বলল, “আমার কী! তোর এস টি ডি না হলেই হল। আমার এক বন্ধু তো সেই এসবের পাল্লায় পড়েছিল, শেষে দ্যাখে যন্ত্রটা ফুলে তাকিয়া হয়ে গেল। ডেঞ্জার চিজ ভাই ওই ব্ল্যাকহোল। প্রোটেকশন ইউজ না করে কত লোক কেস খেয়ে গেল।”

দীপ বিরক্ত হল, “ফোট তো! যত ভুলভাল কথা বলে যাচ্ছিস!”

দীপের ফোন বাজছিল। দীপ দেখল মা ফোন করছে, ধরল, “হ্যাঁ বলো।”

“শোন না, অফিস থেকে বেরোবি কখন আজ?”

দীপ বলল, “ছটা সাড়ে ছটা হবে। কেন?”

মা বলল, “বেরিয়ে আমাকে ফোন করিস। আমি আর তোর বাবা তখন বাড়ি থেকে বেরোব।”

দীপ অবাক হল, “কোথায় যাবে?”

মা বলল, “আহ। তুই-ই তো সকালে বললি আমরা যেখানে দেখব সেখানে যাবি। এত কথা কীসের?”

দীপ বলল, “তা বলে আজই?”

মা বলল, “হ্যাঁ। আজই। এর পরে কিন্তু তুই না এলে আমি আর কাউকে দেখতে পারব না আগে থেকে বলে দিলাম।”

দীপ বলল, “আচ্ছা। যাব। রাখো এখন।”

ফোনটা কাটল সে। রাম বলল, “কী বে, কী হল আবার?”

দীপ কথা ঘোরাল, “কিছু না। এমনি মা ফোন করে খেলাম-টেলাম নাকি জিজ্ঞেস করল।”

***

কাছের বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছিল বাবা মা। দীপ যখন পৌঁছোল দেখল দুজনেই পৌঁছে গেছে। মা গাড়িতে উঠে বলল, “তাও দেরি করে দিলি।”

দীপ বলল, “বাড়ি চেনো তো?”

মা বলল, “ডান দিক নে।”

দীপ বলল, “মেয়ে কী করে?”

মা বলল, “গিয়ে দেখবি। এখন কিছু বলব না।”

বাবা পিছনে বসেছিল, বলল, “তোর মা যে এতটা করিতকর্মা আগে বুঝিনি রে। আমার মনে হয় তোর মা প্রধানমন্ত্রী হবার ক্ষমতা রাখে। কত তাড়াতাড়ি নেটওয়ার্ক খাটিয়ে ফেলল ভাবছি শুধু।”

মা রেগে গিয়ে বাবাকে ধমক দিল, “তুমি থামো তো, শুধু বাজে কথা। দেখছ একটা শুভ কাজে যাচ্ছি। ছেলের এত দিনে একটু মতি ফিরল আর তুমি বাজে বকে যাচ্ছ।”

বাবা চুপ করে গেল। কয়েক মিনিট পরেই তারা বাড়িটার সামনে চলে এল। গাড়ি পার্ক করে তারা ভেতরে ঢুকল।

দীপের চেনা চেনা লাগছিল বাড়ির সবাইকে। বসার ঘরে বাড়ির গ্রুপ ফটো দেখেই বুঝতে পারল তারা চিত্রলেখার বাড়িতে এসেছে। তার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিল।

এক বয়স্ক মতো ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা দুপুরে যখন ফোন করলেন, তখন তো ভাবতেই পারিনি এত তাড়াতাড়ি মেয়ে দেখতে চাইবেন।”

মা বলল, “সে কী কথা, মেয়ে তো এই কয়েকদিন আগেই বিয়েবাড়িতে দেখলাম। পছন্দ তো তখনই হয়েছিল। আমার মাথার মধ্যে ছিল ব্যাপারটা, কিন্তু আমার ছেলের ভয়ে কিছুই বলতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি করলাম কারণ আমার ছেলে আবার অফিস ট্যুরে যখন তখন বেরিয়ে যেতে পারে…” মা যে শেষটা বানিয়ে বলল, সেটা বুঝল দীপ। কোন মা আর বলবে আমার ছেলে বিয়েপাগলা হয়ে গেছে, মেয়ে দেখতে বলল বলে আমি আজকেই দেখতে চেয়েছি!

বাবা বলল, “মেয়েকে দেখান। সামাজিকতা পরে হবে নাহয়।”

সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিত্রলেখাকে নিয়ে এল সবাই। দীপ চিত্রলেখার দিকে তাকাল না। গম্ভীর হয়ে রইল। মা মুগ্ধ গলায় বলল, “বাহ, আপনাদের মেয়ে এক্কেবারে যথার্থ সুন্দরী। কি রে দীপ, কিছু বল।”

দীপ দেখল চিত্রলেখা হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হাসার চেষ্টা করল।

বেশ কয়েক মিনিট চিত্রলেখার সঙ্গে মা-বাবার প্রশ্নোত্তর পর্ব চলল। খানিকক্ষণ পরে মা বলল, “যা বাবা, ওর ঘরটা দেখে আয়। আমরা একটু গল্প করি।”

দীপ উঠল। তার বিরক্ত লাগছিল। চিত্রলেখার ঘরে পৌঁছে সে বলল, “শোনো, প্রথমেই ক্লিয়ার করে নি। আমি কিছুই জানতাম না। এখানে আসবে জানলে আমি কখনোই আসতাম না।”

চিত্রলেখা একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, “জানি। তুমি বসো।”

দীপ বসল। তার মাথা কাজ করছিল না।

চিত্রলেখা বলল, “তুমি এখানে কিছুক্ষণ বসো। তারপর চলে যাও।”

দীপ শুকনো গলায় বলল, “থ্যাংকস।”

দীপ মোবাইল বের করল। চিত্রলেখা বলল, “কালকের হোটেল কেমন গেল?”

দীপ উত্তর দিল না।

সে বুঝতে পারছিল চিত্রলেখার সঙ্গে ঋতির সব কথাই হয়েছে।

চিত্রলেখা বলল, “আমার সমস্যা হল আমার রাগ হয় না।”

দীপ বলল, “আমার সমস্যা হল আমার সহ্য করার ক্ষমতা বেশ ভালো।”

চিত্রলেখা বলল, “আমাকে তোমার সহ্য হয় না, তাই না?”

দীপ উত্তর দিল না।

চিত্রলেখা বলল, “আমার সবথেকে খারাপ লাগল কী জানো তো? আমার ইনসিকিউরিটিটাকে তুমি আমার ন্যাগিং নেচার ভেবে নিলে।”

দীপ বলল, “তুমিই তো বললে বসতে পারি। তুমি যদি এখন এত কথা বলো তাহলে আমি বরং চলে যাই। এত কৈফিয়ত দিতে পারব না।”

চিত্রলেখা বলল, “থাক। আমি আর কিছু বলব না। তুমি বসে থাকো। সেটাই ভালো। অন্তত কিছুক্ষণ তো থাকবে। সেটাই অনেক।”

দীপ কিছু বলল না। গম্ভীর মুখে বসে রইল।

৩৪

সকাল সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙল মানালির। রাতটা দুঃস্বপ্নের মতো গেছে।

সৌরভ সারারাত ফেরেনি। বিতস্তার সঙ্গে ফোনে কথোপকথন চালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। সামান্য শব্দেই বিতস্তা ভেঙে পড়ছিল। ভোর নাগাদ চেক আউট করেছে বিতস্তা। হোটেলে সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছে। আই কার্ড দেখিয়েছে। সৌরভের আই কার্ড হোটেলেই আছে। সৌরভকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানালি সকাল সাড়ে ছটার পরে আর জাগতে পারেনি। যখন জানতে পেরেছিল বিতস্তা ট্যাক্সিতে উঠে গেছে, তারপরেই ফোন অফ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভাঙলেও গা হাত পা ব্যথা করছিল। রাত জাগলে এই সমস্যাগুলো হয়। উঠে ফোন অন করে বসার ঘরে গিয়ে বসল। বাবা টিভি দেখছিল। তাকে দেখে বলল, “কোনও প্রবলেম?”

মানালি দেখল মা একটু দূরত্বে আছে, গলা নামিয়ে বলল, “মাইনর। বড়ো কিছু না।”

বাবা বলল, “তোর?”

মানালি মাথা নাড়ল ঘুম গলায়, “না না, আমার না। এক কলিগের। মিটেছে পার্শিয়ালি। দেখছি কী করা যায়।”

বাবা বলল, “এখন বেরোবি?”

মানালি বলল, “ফোন করতে হবে। ইচ্ছা করছে না বেরোতে।”

বাবা বলল, “তাহলে ডুব মেরে দে।”

মানালি মাথা নাড়ল, “খেপেছ? অফিস যেতেই হবে।”

ফোনটা সবে অন হয়েছিল। বাজতে শুরু করে দিল। মানালি দেখল বিতস্তা ফোন করছে, ধরল তাড়াতাড়ি, “বল। সৌরভের খোঁজ পেলি?”

বিতস্তা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “না রে, থানা পুলিশে যেতেও কেমন কেমন লাগছে।”

মানালি বলল, “অফিসে আয়। কথা বলে দেখি কী করা যায়।”

বিতস্তা বলল, “বিশ্বরূপদাকে বলবি না তো?”

মানালি আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে উঠে নিজের ঘরে এল, “দ্যাখ, ব্যাপারটা যথেষ্ট সিরিয়াস মনে হচ্ছে। বিশ্বরূপদাকে না বললে মনে হয় না কিছু হবে। শোন না, একটা কথা বলবি?”

বিতস্তা বলল, “বল।”

মানালি বলল, “কাল রাতে কি তোদের মধ্যে কোনও ব্যাপারে ঝগড়া হয়েছিল? সিরিয়াসলি বলবি।”

বিতস্তা একটু চুপ করে থেকে বলল, “একটা ব্যাপার নিয়ে চলছিল। তবে এর আগেও এসব হয়েছে। একেবারে হাওয়া হয়ে যাবার ছেলে তো নয়!”

মানালি বলল, “কোনওভাবে ওর বাড়ির লোকেদের খবর দেওয়া যায় না?”

বিতস্তা আঁতকে উঠল, “তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওর বাড়ির লোকেরা জানলে কী হবে ভাবতেও গায়ে জ্বর চলে আসছে আমার। বললে তো সবই বলতে হয়। তা ছাড়া আজ দুপুর বারোটার পরে যদি সৌরভ ওর আই কার্ড না নেয় হোটেল থেকে, তাহলে তো পুলিশ কেস হতে পারে। নির্ঘাত আমি ফাঁসব। তখন থেকে আমার মাথায় এইসবই ঘুরছে শুধু।”

মানালির গলা থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এল, “শিট!” বলল, “বিশ্বরূপদা ছাড়া গতি নেই।”

বিতস্তা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “হুঁ। বল।”

মানালি বলল, “তুই বলবি না আমি বলব?”

বিতস্তা বলল, “তুই-ই বল। আমি ছড়িয়ে ফেলব। এমনিতেই বিশ্বরূপদা আমায় বেশি দেখতে পারে না।”

মানালি বলল, “জানতাম তুই এটাই বলবি। ঠিক আছে। রাখ এখন। আমি বিশ্বরূপদাকে ফোন করি।”

ফোনটা কেটে মানালি বিশ্বরূপদাকে ফোন করল। বিশ্বরূপদা ধরল, “অফিসে এসে গেছি কোন সকালে। তুই কি আজও ডুব মারার প্ল্যান করছিস?”

মানালি বলল, “একটা ব্লান্ডার হয়ে গেছে। তোমার একটু হেল্প চাই।”

বিশ্বরূপদা বলল, “সে তো তুই মানেই ব্লান্ডার। মানালি আর ব্লান্ডার ওয়ার্ড দুটো সিনোনিম। বল শিগগিরি কী হয়েছে।”

মানালি সবটা বলল। বিশ্বরূপদা পুরোটা শুনে বলল, “বিতস্তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মিনিমাম বোধ বুদ্ধি কিছুই নেই? কী রে!”

মানালি বলল, “কী করে ঝামেলাটা থেকে বেরোবে সেটা আগে বলো তো!”

বিশ্বরূপদা বলল, “সেই! মরণকালে হরির নাম। ওকে, আমাকে ছেলের নাম, চেহারার ডেস্ক্রিপশন আর হোটেলের নামটা হোয়াটসঅ্যাপ কর। দেখছি কী করা যায়।”

ফোনটা কেটে গেল। বিতস্তা বিশ্বরূপদাকে সব কিছু পাঠিয়ে স্নানে ঢুকল। বেশ খানিকক্ষণ ঠান্ডা জলে স্নান করে অফিসের জন্য তৈরি হতে শুরু করল। মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল শুধু। সৌরভকে না পাওয়া গেলে কী কী হতে পারে। ফোনটা বেজে উঠল আবার। মানালি দেখল ধ্রুব বাগচী ফোন করছেন। ধরবে না ধরবে না করেও ধরল, “বলুন স্যার।”

“মানালি, আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন করলাম।”

ওপাশের গলাটা শান্ত।

মানালি বলল, “হ্যাঁ, বলুন স্যার।”

ধ্রুব বললেন, “আমি এটা বলার জন্যই ফোন করেছিলাম, আজকের কোনও কাগজেই ধ্রুব বাগচী নেই। এর মানেটা বুঝলেন?”

মানালি কিছুই বুঝল না, “না স্যার, আমি তো ঠিক…!”

ধ্রুব বললেন, “বুঝবেন না। অত বুদ্ধি থাকলে সাংবাদিক হতেন না। এর মানে হল আপনার কালকের নিউজটা আজকে বাসি হয়ে গেছে। টয়লেট পেপার হয়ে গেছে। নতুন কাগজ এসে গেছে। পড়ে নিন।”

ফোনটা কেটে গেল। মানালি উঠে বাবার সামনে গিয়ে বসল। তিন চার রকম কাগজ রাখে তারা। অবাক হয়ে দেখল কোনও কাগজেই ধ্রুব সংক্রান্ত কোনও খবর নেই।

মানালি অবাক হল। ধ্রুব কি তার মানে তাঁর ক্ষমতা দেখালেন? খবরের কাগজগুলোকে ক্ষমতা বা অর্থবলে কিনে নিলেন? কয়েক সেকেন্ড ভেবেই তার বিতস্তার কথা মনে পড়ল।

মানালি বিশ্বরূপদাকে ফোন করল। বিশ্বরূপদা বলল, “কী হল আবার?”

মানালি বলল, “সৌরভের কোনও খবর পেলে?”

বিশ্বরূপদা কথা ঘোরাতে চাইল, “থাক জেনে কাজ নেই।”

মানালি অবাক হয়ে বলল, “মানে? মেয়েটা ওই অবস্থায় আছে, জানাতে হবে তো!”

বিশ্বরূপদা একটু থেমে বলল, “মন শক্ত কর।”

মানালি বলল, “আমার মন শক্তই আছে। তুমি যা বলতে চাও বলো তাড়াতাড়ি।”

বিশ্বরূপদা বলল, “একটা ছেলে কাল রাতেই স্পট হয়েছে। একটা গাড়ি মেরেছিল। বুঝতেও পারেনি। যা ডেস্ক্রিপশন পাঠালি, মনে হচ্ছে এ-ই সম্ভবত সৌরভ।”

মানালির হঠাৎ করে বিতস্তার মুখটা মনে পড়ে গেল। সে বলল, “এখনও কেউ জানেনি তো! এটা কী করে হল?”

বিশ্বরূপদা বলল, “হসপিটালে নিয়ে যেতে পারেনি। তার আগেই যা হবার হয়েছে। পকেটে মানিব্যাগ ইত্যাদি কিছুই ছিল না তো। সব চুরি হয়ে গেছে। পথের এক কোণে পড়ে ছিল। কেউ দেখেওনি। শেষমেশ এক সার্জেন্ট দেখতে পেয়ে সব ব্যবস্থা করে। চোরটা এমন চোর, চুরি করবি কর, বাড়ির লোককে খবরটা তো দিবি রে বাবা! তা না সরাসরি মানিব্যাগটাই নিয়ে হাওয়া। পুলিশ আমি বলার পরেই জানতে পারল ছেলেটা সম্পর্কে। যাক গে, বডি ডিটেক্ট করতে হবে, বিতস্তাকে জানা। এ ছাড়া এখন আর উপায় নেই।”

মানালি মাথায় হাত দিল। বলল, “দেখছি বলে।”

৩৫

গাড়িতে উঠেই মা জিজ্ঞেস করল “কি রে, কেমন দেখলি?”

দীপ বলল, “বাড়ি গিয়ে বলছি। গাড়ি চালাবার সময় বেশি কথা বোলো না। সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফের অ্যাড দেখছ না?”

বাবা বলল, “ঠিক ঠিক। তুমি বরং সিটবেল্ট বেঁধে বসো।”

মা গজগজ করতে লাগল, “কলকাতার বুকে বড়ো বাড়ি, মেয়ে উচ্চশিক্ষিত, সুন্দরী, পড়াশুনা করছে। তোদের জীবনে আর কী চাহিদা আছে কে জানে।”

দীপ চোয়াল শক্ত করে গাড়ি চালাচ্ছিল। রাস্তায় যথেষ্ট জ্যাম আছে। গাড়ি দেখে চালাতে হচ্ছিল। বাবা বলল, “ইস, একটা ভুল হয়ে গেল। মিষ্টিগুলো কোন দোকান থেকে কিনেছিল জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।”

মা বলল, “তুমি থামো। ওভাবে গেলে কেউ? লজ্জা লাগে তো সাধারণ মানুষের। তোমার তো দেখলাম সেসব বুদ্ধিশুদ্ধিও নেই।”

বাবা গম্ভীর মুখে বলল, “কী করব, খেতে ভালো দেখে একটা খেলাম। তারপর দেখলাম আর-একটা খেলেও তুমি কিছু বলছ না। একটু সিগন্যাল দিলে তো খেতাম না।”

মা রেগে গেল, “এখানেও আমার দোষ? নিজের তো কিছু বিবেচনা থাকবে না কি?”

দীপের বিরক্ত লাগছিল। এমনিতেই চিত্রলেখার ঘরে আধঘণ্টা চুপ করে বসে থাকতে হয়েছে। তার ওপর গাড়িতে এত কথা ভালো লাগছিল না তার।

সে বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলল, “অন্য কাউকে দ্যাখো মা। এখানে বিয়ে হওয়া সম্ভব না।”

বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। চুপ করে গেল।

মা বলল, “কী? আর-একবার বল?”

দীপ বলল, “বললাম তো। অন্য কোথাও দ্যাখো। না হলে ছাড়ো, আর দেখতে হবে না।”

মা বলল, “সমস্যা কোথায় সেটা তো বল! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই মেয়েকে পছন্দ না হলে তোর কেমন মেয়ে পছন্দ? কুমারটুলিতে অর্ডার দেব নাকি?”

দীপ কিছুটা গিয়ে গাড়িটা রাস্তার বাঁদিকে দাঁড় করাল। বলল, “সমস্যা আছে মা। অত বলা যাবে না।”

মা বলল, “মেয়ে বেশি সুন্দর? তোর কি কম সুন্দর পছন্দ? নাকি কম শিক্ষিত? নাকি আরও শিক্ষিত? চোখ ঠিক নেই, না নাক? নাকি হাইটে সমস্যা?”

দীপ বলল, “মা, পৃথিবীতে মেয়ে দেখা ছাড়াও অনেক সমস্যা আছে। আমরা বরং সেগুলোতে কনসেনট্রেট করি। বাদ দাও এসব।”

মা বলল, “বাদ দেব? মেয়ে কি এবার আমার ইচ্ছায় দেখতে গেছিলাম? তুই প্রথমে বললি যেতে, মেয়ে দেখার পর বলছিস দেখো না। তোর সমস্যাটা কোথায়? মানছি আমি একটা সময় তোকে খুব বলেছি, কিন্তু আমিও তো শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। এই কিছুদিন আগে বললি তুই নিজে থেকেই মেয়ে দেখেছিস, এখন বললি মেয়ে দ্যাখো, আবার বলছিস দেখো না, তোর হঠাৎ করে হলটা কী?”

দীপ একটু চুপ করে থেকে বলল, “এই সেই মেয়ে মা, যাকে বিয়েবাড়িতে পছন্দ হয়েছিল। কথাও হয়েছিল।”

মা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল। বাবা বলল, “ওহ, তার মানে হিস্ট্রিতে গলদ রয়েছে?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ, হিস্ট্রি জিওগ্রাফি সবেতে গলদ রয়েছে। এ বিয়ে হলে মহা বিপদ। এই মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে করা সম্ভব না।”

মা মাথায় হাত দিল, “ভগবান! কী সমস্যা সেটা তো বল?”

দীপ গাড়ি স্টার্ট করল, “অত শুনে লাভ নেই। অন্য কাউকে দ্যাখো।”

মা বলল, “আমি আর দেখব না। যেটাই দেখব কিছু না কিছু সমস্যা বের করবি। আমারও তো একটা মান সম্মান আছে।”

বাবা বলল, “এক কাজ করলেই হয়। পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়ে দি। আজকাল তো ছবিও দেয়। দীপের একটা ভালো ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দি। অনেক সম্বন্ধ আসবে। সেখান থেকে বেছেবুছে নেবে নাহয়।”

দীপ বলল, “না না, ছবি-টবি একদম না। ওসব হাস্যকর। থাক তোমাদের আর মেয়ে দেখতে হবে না।”

মা বলল, “সে তুই যা বল, আমি আর দেখছি না। এসব ভীষণ অসম্মানজনক।”

দীপ চুপ করে গেল। সারা রাস্তা বাবা মা বকবক করে গেল। বাড়ি ফিরে দীপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিল।

হোয়াটসঅ্যাপ চেক করল। চিত্রলেখা লিখেছে, “বাড়ি পৌঁছেছ?”

দীপের বিরক্তি আসছিল। সে ফোনটা ছুড়তে যাবে, এমন সময় দেখল একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসছে। ধরল সে, “হ্যালো। কে বলছেন?”

“কি রে ভাই, তোকে তো সব ডিটেলসে বললাম। তা সত্ত্বেও তুই মেয়েটাকে দেখতে চলে গেলি?”

গলাটা চিনতে পারল দীপ। চিত্রলেখার এক্স।

সে বলল, “হ্যাঁ। গেলাম। তো?”

ওপাশটা খানিক চুপচাপ থেকে বলল, “ভালো ভালো। খাওয়া মাল বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়েছে তোর। কর গিয়ে বিয়ে। পরে বলতে পারবি না আমি তোকে অ্যালার্ট করিনি।”

দীপ বলল, “তুই কে ভাই? আমার বাপ না মা? আর কে খেয়েছে, না খেয়েছে, তাতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।”

ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল, “এই তো ছেলে বার খেয়ে গেছে। যা ভাই। বেস্ট অফ লাক।”

দীপ ফোনটা কেটে দিল। মাথায় হাত দিয়ে বসল। সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সে নিজেই বুঝতে পারছিল। মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল। সে খানিকক্ষণ ভেবে দরজা খুলে ঘরের বাইরে বেরোল। বাবা মা ড্রয়িং রুমে গম্ভীর মুখে বসে আছে।

দীপ বলল, “মা, ওই বাড়িতে ফোন করে বলে দাও, আমরা বিয়ের জন্য রাজি।”

মা বাবা দুজনেই তার দিকে তাকাল।

বাবা বলল, “তুই তো দেখছি মহম্মদ বিন তুঘলককেও লজ্জায় ফেলে দিবি।”

মা বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে গো। আমার মনে হয় দীপের ভিতরে কোনও দুষ্টু প্রেতাত্মা ঢুকেছে। ভূত তাড়াতে হবে।”

বাবা বলল, “ধুস। ভূত-টুত কিছু নেই। এ যুগে আবার ভূত বলে কিছু আছে নাকি? ওর বায়ু চড়েছে। কদিন ধরে শুধু পেপে আর কাঁচকলা রান্না করো। অফিসেও টিফিন দিয়ে দাও। বাইরের খাবার যেন না খায়।”

দীপ বাবা-মার সামনে গিয়ে বসল, “দ্যাখো, আমার প্রথমে মনে হয়েছিল চিত্রলেখা ঠিক মেয়ে না। এখন মনে হচ্ছে ও-ই ঠিক মেয়ে। তোমরা ফোন করো।”

মা তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, “ধর আমি ফোন করলাম। তার ঠিক ঘণ্টাখানেক পরে তোর যদি মনে হয় বিয়েটা করা ঠিক হবে না, তখন কী হবে?”

দীপ কয়েক সেকেন্ড বাবা-মার দিকে তাকিয়ে ফোন নিয়ে চিত্রলেখার নাম্বার ডায়াল করল।

রিং হতেই ধরল চিত্রলেখা। বলল, “মেসেজ করেছিলাম। পৌঁছেছ?”

দীপ বলল, “আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?”

চিত্রলেখা বলল, “বলো।”

দীপ বলল, “আমি জানি আমি তোমার সঙ্গে খুব খারাপ করেছি। তবু এত সব কিছুর পরে আমি যদি তোমায় বিয়ে করতে চাই তুমি কি রাজি হবে?”

চিত্রলেখা চুপ করে গেল। বাবা মা হাঁ করে দীপের দিকে তাকিয়ে আছে।

দীপ অধৈর্য হল, “তোমার আবার কী হল?”

চিত্রলেখা বলল, “আমি খুব বোকা মেয়ে দীপ। মাঝে মাঝে অনেক কিছু বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু বুঝতে পারি আসলে একটা মিথ্যার মধ্যেই আছি। তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ?”

দীপ ফোন নিয়ে বাবা-মার সামনে থেকে উঠে নিজের ঘরে গেল, “দ্যাখো চিত্রলেখা। আমি এই মিনিট তিনেক আগেও ঠিক করেছিলাম তোমার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখব না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কোনও একটা জায়গায় তুমি বা আমি কোথাও একটা মিলে যাচ্ছি। তুমি সময় নাও। প্রয়োজনে ঋতির সঙ্গেও কনসাল্ট করতে পারো। আমার কোনও আপত্তি নেই। এটুকু কথা তোমাকে আমি দিতে পারি, ভবিষ্যতে আর কোনও রকম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগব না।”

চিত্রলেখা বলল, “তুমি ঝোঁকের মাথায় আবার এসব করছ দীপ, আমি বুঝতে পারছি। তুমি বরং একটা রাত সময় নাও। ভাবো। আমি অনেক কষ্টে এত সব কিছু থেকে নিজেকে সামলেছি দীপ। আবার সেই একই লুপে পড়তে চাই না। আমিও সময় নি। ভেবে নাহয় একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে? ঠিক আছে?”

দীপ বলল, “ঠিক আছে। সকালে জানিয়ো তুমি।”

ফোনটা কেটে দিল সে।

বিশ্রীভাবে মাথা ধরছে। দীপ ফোনটা রেখে একটু ভেবে ঋতিকে ফোন করল।

ঋতি ধরল না প্রথমটা। দীপ আবার ফোন করল।

এবার ধরল, ঠান্ডা গলায় বলল, “বলো।”

দীপ বলল, “আমি ঠিক করেছি চিত্রলেখাকে বিয়ে করব।”

ঋতি শুনে তেতো হাসল, “ফাইন। আমাকে বলছ কেন?”

দীপ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “জানি না।”

ঋতি বলল, “শোনো দীপ। তোমাকে বন্ধুর মতো একটা অ্যাডভাইস দি। কলকাতা শহরে এসকর্ট সার্ভিস হয় জানো তো? তুমি বরং সেসব কনসাল্ট করো। এখনই রিলেশনশিপের মধ্যে যেয়ো না। আই স্ট্রংলি বিলিভ, ইউ হ্যাভ সিরিয়াস ইস্যুস। চিত্রলেখা তোমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তুমি ওকে ভালোবাস না। জাস্ট কনফিউশন ক্রিয়েট হয়েছে তোমার মধ্যে, আর সব কিছুর মধ্যে ঘেঁটে থেকে তুমি এই ডিসিশনটা নিয়েছ।”

দীপ বলল, “আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তুমি আমাকে ডিচ করে দিলে।”

ঋতি বলল, “শোনো দীপ গাঙ্গুলি, আমার মাথা খেয়ো না। তোমার কী মনে হয়, হঠাৎ করে এই সব কিছুর থেকে বেরোনোটা আমার পক্ষে খুব সহজ ছিল? কিন্তু এটাও জেনে রেখো, আমি যথেষ্ট স্ট্রং। মোহ কাটতে আমার বেশিক্ষণ লাগেনি, যখনই জেনেছি তোমাকে একেবারেই বিশ্বাস করা যায় না। আমি চিত্রলেখাকে কিছুই বোঝাতে যাব না। ও নিজেই বুঝুক। তুমি এসকর্ট সার্ভিস কনসাল্ট করো। কাজ দেবে।”

দীপ ফোন কেটে দিল।

৩৬

বিতস্তা ঘুমোচ্ছিল। তিন-চারবার ফোন করার পরে ধরল।

মানালি কী বলবে বুঝতে পারছিল না প্রথমে। বেশ খানিকটা ভেবে নিয়ে বলল, “অফিস চলে আয়। সৌরভের একটা খোঁজ পাওয়া গেছে।”

বিতস্তা ঘুমঘোরেই বলল, “বল না প্লিজ আমাকে একটা ফোন করতে।”

মানালি বলল, “অফিস আয়। ওখানেই দেখছি।”

কথা বাড়াল না মানালি। ফোনটা কেটে দিল।

খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। রাস্তায় বেরিয়ে ক্যাব নিল একটা। মাথা কাজ করছিল না তার। বিতস্তার কাছে সৌরভই সব ছিল। এত বড়ো একটা ব্যাপার ঘটার পরে মেয়েটাকে কীভাবে সামলাবে তা নিয়ে ক্রমাগত ভেবে চলেছিল সে।

আর-একটা ব্যাপারও কাঁটার মতো বিঁধছিল। হোটেল কর্তৃপক্ষ বিতস্তাকে বলেছিল বারোটার মধ্যে সৌরভ তার আই কার্ড নিতে না এলে লোকাল পুলিশে তারা জানিয়ে দেবে। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যাবে।

এই ব্যাপারটা বিশ্বরূপদাকে বলা হয়নি। একটু ভেবে সে ঠিক করল সবটা জানাবে।

একবার রিং হতেই ফোন তুলল বিশ্বরূপদা, “কী হল আবার?”

মানালি বলল ব্যাপারটা।

বিশ্বরূপদা একটু থমকে বলল, “এটা কোনও ইস্যু না। তুই একটা কাজ কর, আগে হোটেলটায় যা। ম্যানেজারকে মিট কর। জানা। বাকিটা আমি দেখছি।”

মানালি আকাশ থেকে পড়ল, “আমি বলব?”

বিশ্বরূপদা বলল, “কেন? তুই বললে সমস্যাটা কী? ভাবছিস তুই একটা মেয়ে, তোর কথা শুনলে ওরা কী রিঅ্যাক্ট করবে? শোন, তুই যে জিনিসটা বারবার ভুলে যাস, তোর কাছে একটা মহা শক্তিশালী অস্ত্র আছে। সেটা হল তোর প্রেস কার্ড। দ্বিতীয়ত, একটা হোটেলে নিজেদের মতো করে একটা আনম্যারেড কাপল থাকতেই পারে। এ দেশের কোনও আইনে এটা বলা হয়নি যে এটা বেআইনি। নীতিপুলিশগিরি অনেকেই মাড়ায়। কিন্তু এই সংক্রান্ত কোনও আইন নেই। স্বেচ্ছায় কে কী করবে তা বলার জন্য সমাজ কেউ না। কোথাও কোথাও পুলিশের পকেট ভরার জন্য হোটেলে রেইড ইত্যাদি হয়। তুই নিশ্চিন্ত থাক। বিতস্তার এই ক্ষেত্রে কোনও ভয়ই নেই। তুই যেটা করবি, হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারকে নিজের পরিচয় দিয়ে ঘটনাটা এক্সপ্লেইন করবি। ওরা ঠিক বুঝে যাবে। পুলিশ ইত্যাদি আমি সামলাচ্ছি, ব্যাক আপ তো আমি থাকলাম। অফিসটাও তো সামলাতে হবে মা, আফটার অল সব কিছুর পরেও দ্য শো মাস্ট গো অন। আশা করি যেটা বোঝাতে চাইছি তুই বুঝলি।”

মানালি বলল, “ওকে। দেখছি।”

ফোনটা কেটে ক্যাব চালককে হোটেলের লোকেশন জানাল মানালি। জানলার বাইরে চোখ গেল তার। সব কিছু কেমন স্বাভাবিক গতিতে চলছে।

শহর ব্যাপারটাই এমন। সব কিছুই চলবে, আর প্রতিটা সময়ে কারও না কারও কত বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে, শহরের গায়ে কোনও আঁচই লাগবে না।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছোল মানালি।

বেশ ঝাঁ চকচকে হোটেল। মানালি ট্যাক্সিতে বসেই যতটা সম্ভব মানসিক শক্তি অর্জন করছিল।

রিসেপশনিস্টকে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জানাল ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চায়। রিসেপশনিস্ট তাকে লবিতে বসতে বলল। বসতে গিয়েই মানালির চোখ পড়ল দীপের দিকে। গম্ভীর মুখে বসে খবরের কাগজ পড়ছে।

মানালি প্রথমে ভাবল কিছু বলবে না, কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একগাদা কথা বললে হয়তো খানিকটা টেনশন কমবে। দীপকে দেখে কেন জানে না সে বেশ আশ্বস্ত হল। বলল, “এখানে কী ব্যাপার?”

দীপ চমকে তার দিকে তাকাল। বলল, “ওহ আপনি? এখানে কী ব্যাপার?”

মানালি বলল, “সেটা তো আপনি বলবেন। আমি আগে প্রশ্নটা করলাম।”

দীপ কয়েক সেকেন্ড মানালির দিকে তাকিয়ে নিজের সিট থেকে উঠে তার পাশে এসে বসল, “অ্যাকচুয়ালি আমি একটা বিরাট সমস্যায় পড়েছি। আপনার নামটা কী যেন?”

– “মানালি।”

দীপ বলল, “ওহ, সরি। আমার ভোলাটা উচিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ভীষণ কনফিউজড।”

মানালি বলল, “কী ব্যাপারে?”

দীপ কয়েক সেকেন্ড মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “কলকাতার এসকর্ট সার্ভিস সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?”

মানালি হাঁ করে দীপের দিকে তাকিয়ে থাকল। বিতস্তা আর সৌরভের ব্যাপারটা কিছুক্ষণের জন্য পুরোপুরিই ভুলে গেল সে। বলল, “মানে?”

দীপ বলল, “আপনি কী জানেন? এগুলো কি সেফ? মানে পুলিশ ধরে? বা এইচ আই ভি-র চান্স আছে?”

মানালি বলল, “আপনি কী বলে চলেছেন? এসকর্ট সার্ভিস নিয়ে আমি কী করে জানব?”

দীপ বলল, “অ্যাকচুয়ালি আমি আজকেও অফিস ছুটি নিয়েছি। একটা নাম্বারে সকালে ফোন করেছিলাম। ওরা এখানে বসতে বলল। আধ ঘণ্টার মধ্যে ওরা আমাকে কন্ট্যাক্ট করছে জানাল।”

মানালি বলল, “কিন্তু অফিস-টফিস না গিয়ে হঠাৎ করে এসকর্ট সার্ভিস নিয়ে পড়লেন কেন আপনি?”

দীপ বলল, “ঋতি সাজেস্টেড। আপনি ঋতিকে চেনেন?”

মানালি দুদিকে মাথা নাড়ল।

দীপ বলল, “ঋতির ধারণা হয়েছে আমি সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড একটা লোক, আমার নাকি এসকর্ট সার্ভিস দরকার। আমি সেটা দেখতেই এসেছি। ব্যাপারটা কি সত্যি!”

মানালি বলল, “আমি কিছুই বুঝছি না।”

দীপ বলল, “আমি বোঝাচ্ছি। আপনাকে তো আমার স্টোরিটা বলেছিলাম।”

মানালি বলল, “হ্যাঁ। বলেছিলেন।”

দীপ বলল, “তারপরে অনেক জল গড়িয়েছে। আমি কাল বিয়ের ডিসিশনও নিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু সব গোলমাল ঘটল ঋতিকে ফোন করার পরে।”

মানালি বলল, “আপনি সত্যিই কনফিউজড। আপনি বরং বাড়ি যান। কলকাতার এসকর্ট সার্ভিস কেমন সে ব্যাপারে আমার কোনও ধারণা নেই, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি ওসব আপনার জন্য না। আপনি এখান থেকে বেরোন।”

দীপ বিহ্বল চোখে মানালির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করল।

মানালির দীপকে দেখে হঠাৎ করেই খুব খারাপ লাগছিল।

প্রথম যেদিন আলাপ হয়েছিল সেদিনের সঙ্গে আজকের দীপকে সে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না।

ম্যানেজার এসে গেছিলেন। তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “গুড মর্নিং ম্যাম। হাউ মে আই হেল্প ইউ?”

মানালি উঠে নিজের আই কার্ড বের করল, “আমি সময়ের কণ্ঠস্বর থেকে আসছি। একটু আলাদা কথা বলা যাবে?”

ম্যানেজার বললেন, “আমার চেম্বারে চলুন তাহলে।”

মানালি দীপের দিকে তাকাল, “আপনি কি বসবেন?”

দীপ বলল, “হ্যাঁ আমি বসছি। আপনি কাজ সেরে আসুন। আমরা বরং একসঙ্গে বেরোই।”

মানালি বলল, “ঠিক আছে।”

ম্যানেজারের চেম্বারে গেল সে। ম্যানেজার সবটা শুনে বললেন, “ব্যাপারটা যদিও একটু কমপ্লিকেটেড হয়ে আছে তবু আশা করা যাচ্ছে পুলিশও খুব একটা সমস্যা করবে না। তবু এটা আমাদের ডিউটি ওঁদের জানানো। আশা করছি আপনাকে বোঝাতে পারছি।”

মানালির মাথা কাজ করছিল না। সে বলল, “আই কার্ডটা যদি আমি নিয়ে যাই?”

ম্যানেজার মাথা নাড়লেন, “না ম্যাম, ওটা থানাতেই জমা দিতে হবে আমাদের।”

মানালি ফোনটা বের করে বিশ্বরূপদাকে ফোন করল। সবটা শুনে বিশ্বরূপদা বলল, “ম্যানেজারকে দে।”

মানালি বলল, “আমাদের এডিটর স্যার একটু আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।”

ম্যানেজার হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলেন।

মিনিট তিনেক কথা বলার পর ফোনটা রেখে বললেন, “ওকে। আপনি আই কার্ডটা আপাতত নিয়ে যান। তবে হোটেলের রেজিস্টারে আপনাকে সই করে নিয়ে যেতে হবে।”

মানালি বলল, “তাই হোক।”

মিনিট পনেরো লাগল সব মিটতে। সৌরভের আই কার্ড নিয়ে মানালি যখন লবিতে ফিরল, দেখল দীপ তখনও ওখানেই বসে আছে।

 ৩৭

“আপনার অফিসটা কোন এরিয়ায় বলুন, আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।”

গাড়ি স্টার্ট করে বলল দীপ। মানালি অন্যমনস্ক ছিল খানিকটা। বারবার বিতস্তার মুখটা মনে পড়ছিল। এতক্ষণে বোধহয় বিতস্তা অফিসে এসেও গেছে। মানালি গুটিয়ে গেল খানিকটা। বলল, “অফিস যেতে ইচ্ছা করছে না ঠিক। আপনি কোথাও একটা নামিয়ে দিন আমায়।”

দীপ বলল, “সে তো আমারও ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা, এজেন্টটা আবার আমায় ফলো করবে না তো?”

মানালি ভুলে গেছিল দীপের কথা। সে বলল, “কোন এজেন্ট?”

দীপ বলল, “আপনাকে বললাম না, এসকর্ট সার্ভিসের এজেন্ট!”

মানালির মনে পড়ল, “ওহ। হ্যাঁ। ঠিক। কেন, আপনাকে ফলো করবে কেন?”

দীপ বলল, “লোকটা আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিল।”

মানালি বলল, “আপনি কোনও রকম টাকা দিয়েছেন কি?”

দীপ বলল, “না, এখনও অবধি দিইনি।”

মানালি বলল, “তাহলে ফোন করতে পারে। আপনি অ্যাভয়েড করুন।”

দীপ বলল, “আচ্ছা কোথাও একটা বসে কফি খেলে আপনার সমস্যা আছে? আমার মনে হয় আপনি খুব নিরপেক্ষ একটা জায়গায় আছেন। আমার এমন কাউকে দরকার যার সঙ্গে আমি আমার এই বিতিকিচ্ছিরি অবস্থাটা আলোচনা করতে পারি। যাকে আমাকে একগাদা এক্সপ্ল্যানেশন দিতে হবে না।”

মানালি একটু ভেবে বলল, “ওকে। আমারও তাই মনে হয়। মাথাটা পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়ে আছে। আপনি বলতে পারেন। আমি জাজমেন্টাল হব না। যদিও আগে একবার আপনি অনেক কিছুই বলেছিলেন, কিন্তু আমার সব ঘেঁটে গেছে। একেবারে শুরু থেকে বললেই ভালো হয়।”

দীপ বেশ খানিকক্ষণ গাড়ি চালিয়ে একটা কফিশপের সামনে গাড়ি পার্ক করল।

মানালি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “আপনি কি আজকাল রেগুলার অফিস বাঙ্ক করেন?”

দীপ অসহায় ভঙ্গিতে হাসল, “তাই হয়ে যাচ্ছে। একদিন যাচ্ছি, পরের দিন যাচ্ছি না। চাকরিটা থাকবে না সম্ভবত।”

মানালি অবাক হল, “এরকম হল কেন হঠাৎ করে?”

দীপ শপের দরজা খুলতে খুলতে বলল, “আমি তো সেই ব্যাপারটা নিয়েই ভেবে যাচ্ছি। বসুন আপনি, আমি একটু চোখে মুখে জল দিয়ে আসি।”

মানালি বসল একটা টেবিলে। কফিশপটা ছোটো হলেও বেশ সুন্দর। মানালির মনে পড়ল তার একসময় ইচ্ছা ছিল একটা কফিশপ খুলবে। অবশ্য এরকম অনেক ছোটো ছোটো ইচ্ছেই তার হত এককালে। একবার ঠিক করেছিল বইয়ের দোকান দেবে। মানালির মনে হল যত দিন যাচ্ছে, এইসব ইচ্ছাগুলো কেমন কমে যাচ্ছে। অলস লাগে বেশিরভাগ সময়েই। কাজের ভয়, কাজে ছোটোখাটো ভুল ভ্রান্তি হলে কাজ চলে যাবার ভয়, কাজ করতে গিয়ে বারবার বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে করার চাপ, সব মিলিয়ে পৃথিবীটা আজকাল কেমন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠছে যত দিন যাচ্ছে।

ফোনটা বাজছিল। মানালি দেখল বিশ্বরূপদা ফোন করছে। সে ধরল, “বলো।”

“কি রে হোটেল প্রবলেম মিটে গেছে?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ। মিটেছে।”

“তো চলে আয়। দেরি করছিস কেন?”

মানালি কাতর কণ্ঠে বলল, “বিতস্তার সামনে আমি যেতে পারব না বিশ্বরূপদা। প্লিজ ওকে সামলাও।”

বিশ্বরূপদা খুব রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। বলল না। একটু থেমে বলল, “ওকে। টেক কেয়ার।”

ফোনটা কেটে গেল।

দীপ চলে এসেছিল। কফির অর্ডার দেওয়া হল।

মানালি ফোনটা ব্যাগের ভেতর রেখে দীপের দিকে তাকাল, “বলুন।”

দীপ খানিকটা বিহ্বলভাবে মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি তো জার্নালিস্ট?”

মানালি অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”

দীপ বলল, “আপনার কাছে একটা কাগজ আর একটা পেন হবে? আমার একটা ডায়াগ্রাম এঁকে বোঝালে সুবিধা হত।”

মানালি ব্যাগ থেকে তার নোটবুক আর পেনটা বের করে দীপকে দিল।

দীপ টেবিলের ওপর নোটবুকটা রেখে বেশ খানিকক্ষণ পেন নিয়ে বসে থাকল। তারপর কাগজের ওপর বড়ো বড়ো করে লিখল, “চিত্রলেখা, ঋতি।”

মানালি বলল, “বাহ। দুটো নামই সুন্দর।”

দীপ মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “নামের সঙ্গে মানুষের কোনও মিল থাকে না বিশ্বাস করুন, নাম দেখে যারা মানুষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের মাথায় তিন চার কিলো গোবর আছে।”

মানালি হাসল, “ওকে। বলে যান।”

দীপ বলল, “দেখুন আমি এককালে ভীষণ ভালো ছেলে ছিলাম। বয়েজ স্কুলে পড়েছি, পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং কো-এড ছিল যদিও, কিন্তু কোনও দিন এইসব প্রেম-ট্রেম নিয়ে খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি করিনি। চাকরি পাবার পর শেয়ার মার্কেট, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি নিয়ে ভালোই ছিলাম। গোল বাধল একটা বিয়েবাড়িতে গিয়ে।”

মানালি বলল, “বিয়েবাড়ি একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা বটে। বেশিরভাগ বাঙালির প্রেম শুরু হয় কোনও না কোনও বিয়েবাড়ি থেকে।”

দীপ বলল, “আপনার হয়েছিল?”

মানালি বলল, “ছোটোখাটো। কিন্তু সে ছেলে এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। আপনি বলে যান।”

দীপ বলল, “ওকে। যা বলছিলাম। এই বিয়েবাড়িতে গিয়েই চিত্রলেখার সঙ্গে আমার আলাপ। বেশ পছন্দ হয়েছিল ওকে। সুন্দরী। কিন্তু ওই যে, আমার ঠাকুরদা বলত, কারও সঙ্গে এক ছাদের তলায় না থাকলে বোঝা যায় না সে মানুষটা আসলে কেমন। কারও সঙ্গে দু ঘণ্টা দেখা হওয়া, আর চব্বিশ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। যদিও চিত্রলেখার সঙ্গে আমি একসঙ্গে থাকিনি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, খানিকক্ষণ কথাবার্তা চলার পরে আমি বুঝতে পারলাম যতই ওকে আমি আলাদা আলাদা ভাবি না কেন, ভেতরে ভেতরে মেয়েটা অদ্ভুত ন্যাগিং নেচারের একটা মেয়ে। একটু অল্পতেই আমি হাঁফিয়ে উঠলাম।”

মানালি বলল, “সো ইউ ডিসাইডেড টু ব্রেক আপ?”

দীপ বলল, “না। একেবারেই না। মাথায় যে একেবারে আসেনি তা নয়, কিন্তু তখনও অতটা দূরে ভাবতে পারিনি।”

মানালি বলল, “তবে? সমস্যাটা কখন শুরু হল?”

দীপ একটু ইতস্তত করে বলল, “সমস্যাটা আসলে চিত্রলেখা শুরু করেনি। সমস্যাটা শুরু করেছিল আমার সন্দিগ্ধ মন। কথায় কথায় ওর এক্সের নম্বর আমি পেয়ে গেছিলাম। ওই নাম্বারে ফোন করে আমি জানতে পারলাম ওই ছেলেটার সঙ্গে চিত্রলেখার ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছে। এদিকে চিত্রলেখা আমাকে বলেছিল ওর তেমন কিছুই হয়নি। ছেলেটার গলায় একটা অদ্ভুত কনফিডেন্স লক্ষ করেছিলাম। চিত্রলেখা ভার্জিন কি না সেটা আমার মাথায় ঘুরছিল না, আমার শুধু মনে হচ্ছিল যে সম্পর্কের ভিত্তিই মিথ্যে দিয়ে তৈরি, সে সম্পর্কের আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ থাকে কি? আমি কনফিউজড হয়ে পড়লাম। আর এমন আয়রনিক ব্যাপারটা, আমি চিত্রলেখার সত্যি মিথ্যা নিয়ে ভাবছিলাম, আর এর পরেই সবথেকে বড়ো মিথ্যাবাদীর মতো কাজগুলো আমি করতে শুরু করলাম। ঋতির সঙ্গে আলাপ হল, আর… বাকিটা ইতিহাস।”

দীপ পেন দিয়ে দুটো নামই অনেকক্ষণ ধরে কাটল।

মানালি সেদিকে তাকিয়ে বলল, “এই মুহূর্তে ঠিক কী অবস্থা?”

দীপ বলল, “এমন কপাল, ঠিক করলাম এসবের থেকে আমি বেরিয়ে আসব। বাড়িতে বললাম মেয়ে দেখতে। এত কিছুর পরে মা সেই চিত্রলেখার বাড়িতেই নিয়ে গেল আমাকে। প্রথমে খুব রাগ হল। পরে কেন জানি না চিত্রলেখার কথা ভেবে একটা অপরাধবোধ এল। ঠিক করলাম চিত্রলেখাকে বিয়ে করব।”

মানালি বড়ো বড়ো চোখ করে দীপের দিকে তাকাল, “কিন্তু আপনি ওর নামটা কেটে দিলেন যে?”

দীপ বলল, “সে তো আমি ঋতির নামও কাটলাম। কিন্তু আসলে তো আমি ওকেই ভালোবাসি।”

মানালি কয়েক সেকেন্ড দীপের দিকে তাকিয়ে বলল, “অসাধারণ তো!”

দীপ দাঁত দিয়ে ডান হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, “চিত্রলেখা আর ঋতি খুব ভালো বন্ধুও বটে।”

মানালি বলল, “বাহ। তাহলে তো সোনায় সোহাগা।”

দীপ বলল, “তবে সুখের খবর হল ঋতি পরের মাসে বাইরে চলে যাচ্ছে।”

কফি এসে গেছিল। মানালি কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল, “আপনার সঙ্গে কথা বলার একটা ভালো ব্যাপার হল, এই সময়টাতে আমি ভুলে গেছিলাম পৃথিবীর বাকি মানুষেরা, কিংবা আমি, ঠিক কতটা সমস্যায় আছি। আমার এক বন্ধুর বয়ফ্রেন্ড মারা গেছে, এক সেলিব্রিটি আমার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পেপারের ওপর ডিফেমেশন চার্জ এনেছেন, একটা নতুন চাকরির অফার এসেছে, সেটায় যাব না যাব না কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছি না, বিশ্বাস করুন আমি সব ভুলে যাচ্ছিলাম।”

দীপ অধৈর্য হয়ে বলল, “আমাকে একটা সলিউশন বলুন প্লিজ।”

মানালি বলল, “কেমন সলিউশন?”

দীপ বলল, “আমি এসবের থেকে বেরোতে চাই। এরকম আর কটা দিন চললে আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাব।”

মানালি বলল, “আপনি টস করতে পারেন। যার নাম আসবে…”

দীপ বলল, “মজা করছেন?”

মানালি বলল, “একেবারেই না।”

দীপ বলল, “কিন্তু যদি চিত্রলেখা জেতে? ও ভীষণ অ্যানোয়িং।”

মানালি বলল, “তাহলে ঋতি।”

দীপ বলল, “ঋতি আমাকে দেখলেই কেমন রেগে যায়। আমাকে ঠিক সহ্য করতে পারে না। নিশ্চয়ই চিত্রলেখাকেও আমার নামে অনেক কিছু বলেছে। দেখুন আমি চাই ঋতি আর চিত্রলেখার বন্ধুত্বটা কেটে যাক। ওইজন্যই তো আমি চিত্রলেখাকে বিয়ে করার কথা বলেছি।”

মানালি একটু হেসে নিয়ে বলল, “আমার এক বন্ধু ক্লাস টুয়েলভ ফেল করেছিল, বাবার মারের ভয়ে পাড়ার একটা বখাটে ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছিল। এখনও আপশোশ করে। ঝোঁকের মাথায় কোনও রকম সিদ্ধান্তই বোধহয় নেওয়া উচিত না।”

দীপ মাথা চুলকে বলল, “তাহলে আমার গেম প্ল্যান কী হওয়া উচিত?”

মানালি বলল, “অফিস করুন। আর কোনও দিকে তাকাবেন না। সময়মতো বিয়ে থা করে তারপরে সংসার করুন। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি এটাই বলব।”

মানালির ফোন বাজছিল। ফোন বের করে মানালি দেখল ধ্রুব বাগচী ফোন করছেন।

ধরল, “বলুন স্যার।”

ধ্রুব বাগচী বললেন, “খানিকক্ষণ আগে ঈপ্সিতা এসেছে। আপনি ইচ্ছা করলে আসতে পারেন। ও আপনার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে চায়।”

ফোনটা কেটে গেল।

মানালি মাথায় হাত দিয়ে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বলল, “চলুন।”

দীপ অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”

মানালি বলল, “আপনার জীবনে এক্সাইটমেন্ট কমে যাচ্ছে। চলুন, আমার তুমুল ঝাড় খাওয়া দেখবেন। আপনি এত কিছু বললেন, আমারও মনে হল আপনি একটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আছেন যেখানে মানুষের প্রেমটাই সব। আর কোনও সমস্যাই নেই। দেখবেন নাহয় সেটাই।”

দীপ হতভম্ব হয়ে মানালির দিকে তাকিয়ে রইল।

৩৮

কলিং বেলের সুইচ টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঈপ্সিতা দরজা খুললেন। মানালি সারা রাস্তা ধরে শুধু এটাই ভেবে এসেছে ঈপ্সিতার মুখোমুখি হলে সে কী করবে। খানিকটা ঝোঁকের মাথাতেই চলে এসেছে সে। বিশ্বরূপদাকেও জানায়নি সে ধ্রুবর এখানে আসবে।

দীপ একবারই জিজ্ঞেস করেছিল এখানে সে এলে কোনও সমস্যা হবে নাকি। মানালি বলেছে, চলুন চুপচাপ থাকবেন, কী আর হবে।

ঈপ্সিতাকে দেখে মানালি কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “ভালো আছেন?”

ঈপ্সিতা দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন, “আসুন।”

তারা ভিতরে ঢুকল।

অন্যান্য দিন ফ্ল্যাটের সব জানলা বন্ধ থাকে, এখন জানলাগুলো সব খোলা। রোদ এসে পড়ছে জানলা দিয়ে। ধ্রুব বসেই ছিলেন ড্রয়িং রুমে। তাদের দেখে বললেন, “বসুন। আজকের ফটোগ্রাফারটি নতুন মনে হচ্ছে?”

মানালি বলল, “উনি ফটোগ্রাফার নন, বন্ধু বলতে পারেন।”

ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বললেন, “বিশেষ বন্ধু?”

মানালি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “না না। বরং একটু কম বন্ধু বলতে পারেন। এখনও বন্ধু হয়ে উঠতে পারেননি।”

ধ্রুব বললেন, “ওহ। নো প্রবলেম। সরি ফর আস্কিং পিসি মাসি টাইপস অফ কোশ্চেন। একটা ছেলে আর মেয়ে একসঙ্গে দেখলেই তারা একগাদা অ্যাসাম্পশনস করে ফ্যালে। আপনার নাম কী?” ধ্রুব দীপের দিকে তাকাল।

দীপ অন্যমনস্কভাবে ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্র দেখতে দেখতে বলল, “দীপ গাঙ্গুলি।”

ধ্রুব বললেন, “আপনি বুঝতে পারছেন আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

দীপ কয়েক সেকেন্ড ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বুঝতে পারছি। ওর ধারণা আপনারা ওকে খুব ঝাড়বেন, তাই আমাকে নিয়ে এসেছেন যাতে ঝাড়টা কম খেতে হয়।”

ধ্রুব আর ঈপ্সিতা দুজনেই হেসে ফেললেন। মানালিও হাসল।

দীপ বলল, “আমি কি ভুল কিছু বললাম?”

ধ্রুব বললেন, “একেবারেই না। তবে মানালি কিংবা আপনি যা ভাবছেন তা ভুল। ঈপ্সিতা আর আমি আসলে মানালিকে একটা গল্প শোনাতে ডেকেছি। কেন জানি না মনে হল, গল্পটা মানালির জানা দরকার। তার আগে একটু স্যান্ডউইচ খাওয়া যাক?”

মানালি মাথা নাড়ল, “না না, আমার খিদে নেই। আপনি বলুন।”

দীপ বলল, “চিকেন না ভেজ? ভেজ হলে খাব না।”

ধ্রুব বললেন, “চিকেন। চিন্তা নেই।”

ধ্রুব উঠতে যাচ্ছিলেন। ঈপ্সিতা বললেন, “আমি এনে দিচ্ছি। তুমি বোসো।”

দীপ মানালির দিকে তাকাল, “কিছু মনে করবেন না, আমার মাথা ঠিক কাজ করছে না কদিন ধরে। ব্যাপারটা কি হ্যাংলামি হয়ে গেল?”

মানালি বলল, “না না, তা কেন মনে হবে?”

ধ্রুব বললেন, “হ্যাংলা হওয়া ভালো। পেটে খিদে মুখে লাজ হওয়াটা কোনও কাজের কথা না। অথচ দেখবেন আমাদের এটাই শেখানো হয়। ভদ্রতা করো। এই এক ভদ্রতা শব্দটাই আমাদের সব কিছু নষ্ট করে রেখে দিয়েছে।”

দীপ বলল, “ঠিক বলেছেন। এই যে কথাটা আপনি বললেন, পেটে খিদে মুখে লাজ। এর থেকে বাজে জিনিস আর কিছু হয় না। আমি একটা উদাহরণ দি…” দীপ উদভ্রান্তের মতো মানালির দিকে তাকাল, “আমি কি বেশি কথা বলছি?”

ধ্রুব সিগারেট ধরালেন, “একেবারেই না। বেশি কথা বলছেন না। পেটে খিদে রাখবেন না, যা বলার বলে ফেলুন।”

দীপ উৎসাহ পেল, “আমি মনে করি বেশিরভাগ প্রেমিক প্রেমিকাই চায় পরস্পরের কাছে আসতে। কিন্তু চারদিকের পিউরিটান সমাজ তাদের পেছন থেকে টেনে রাখে। জাস্ট ভাবুন, এরা প্রেম করে অথচ শারীরিক সম্পর্কটাকে নিয়ে কত রকম কিছু ভেবে ফ্যালে। এগুলো হিপোক্রেসি নয়?”

ঈপ্সিতা স্যান্ডউইচের প্লেটটা দীপের দিকে এগিয়ে দিলেন। ধ্রুব বললেন, “অবশ্যই। আমরা যখন প্রেম করেছি, সেই সময়টাতেও এসব নিয়ে আমাদের কোনও রকম শুচিবাই ছিল না।”

দীপ স্যান্ডউইচে কামড় দিল।

মানালি ধ্রুবর দিকে তাকাল, “অ্যাকচুয়ালি দীপ ওর সব কিছু নিয়ে ভীষণভাবে ডিস্টার্বড। আপনি বরং আপনাদের গল্পটা…”

ধ্রুব বলল, “হুঁ। দ্যাট ড্যাম স্টোরি। কিংবা গল্প হলেও সত্যি। একটা ধূসর নস্টালজিক সময় কল্পনা করুন মানালি। অত্যন্ত মেধাবী এক ছাত্রী। এক ভবঘুরে ইন্টেলেকচুয়াল সাজতে চাওয়া চালচুলোহীন যুবক। প্রেমে পড়ে গেল। প্রেম মানে যে সে প্রেম নয়। প্রেম মানে সে ভয়াবহ প্রেম। একে অপরকে আঁচড়ে কামড়ে দেওয়া প্রেম। আমরা শুরুতে কখনোই ঘর বাঁধার কথা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু হঠাৎই একটা অ্যাড এজেন্সিতে আমার চাকরি পেয়ে যাওয়া, কিছু হঠাৎ জেগে ওঠা আবেগ আমাদের বিয়ে করিয়ে দিল। এ বাড়ি ও বাড়ি কোনও বাড়িই মানেনি সে বিয়ে যদিও।”

মানালি ঈপ্সিতার দিকে তাকাল। ঈপ্সিতা জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন।

দীপ বিড়বিড় করে বলল, “তাও ভালো আপনার কোনও চিত্রলেখা ছিল না।”

ধ্রুব অবাক চোখে দীপের দিকে তাকালেন, “মানে?”

মানালি বলল, “উনি বলতে চাইছেন সেই সময়ে কোনও তৃতীয় কেউ ছিল না আপনাদের দুজনের মধ্যে।”

ধ্রুবর সিগারেট শেষ হয়ে গেছিল। আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “আমার ছিল। আমার দু-তিন জন ছিল। আঁতলামি প্রেম যাকে বলে। বরাবরই আমি দুশ্চরিত্র। ঈপ্সিতা থাকলে আরও বেশি। ওর অনুপস্থিতিতেই বরং আমি সচ্চরিত্র হয়ে যাই।”

দীপ অবাক গলায় ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার হিংসা হত না?”

ধ্রুব বললেন, “হত না আবার? কিন্তু মেয়েরা কখনও সরাসরি মুখে বলবে না হিংসার কথা। আকারে ইঙ্গিতে কথায় পরোক্ষে বোঝাবে। ঈপ্সিতাও তাই। আমি ইচ্ছা করে ওকে রাগানোর জন্য আরও বেশি করে ওদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতাম। যাই হোক, সেগুলো তো সব রিলেশনেই হয়, নাথিং স্পেশাল, স্পেশাল যেটা হল, আমার তখন ফার্স্ট সিনেমার শ্যুট শুরু হচ্ছে। ঠিক তখন ঈপ্সিতা কলেজ সার্ভিস কমিশন পাশ করল এবং ওর প্লেসমেন্ট হল উত্তরবঙ্গে। ঈপ্সিতা আমার সঙ্গে কোনও রকম কনসাল্ট না করে চাকরিটা ছেড়ে দিল। ওর কলেজেই বিশ্বরূপ পড়তেন, বিশ্বরূপ সহ ওর অনেক বন্ধুরই ধারণা হল আমিই ওকে চাকরিটা করতে দিইনি। অথচ বিষয়টা একেবারেই তা নয়।”

বিশ্বরূপদার নাম শুনে মানালি খানিকটা চমকাল।

ধ্রুব বলে চললেন, “অভাবের সংসার, খুব বেশি টাকা আসছে না। এদিকে সহধর্মিণী চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন জানতেও পারিনি। তখন এই ফ্ল্যাটটা ছিল না। থাকতাম ছোটো একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে। এর মধ্যেই একদিন তুমুল ঝামেলা। সাবান বা শ্যাম্পু কিছু একটা নিয়ে মে বি। আমি ভয়াবহ কিছু কথা বলে ফেলেছিলাম ওকে, বরাবরই আমি দুর্মুখ, কারও সঙ্গে ঝগড়ায় সেসব আরও বেশি করে বোঝা যায়, ঈপ্সিতা কোনও দিকে তাকাল না, বাড়ি চলে গেল।”

“এবং এই গল্পে কোথাও শ্রীপর্ণা ঘোষাল নেই।” ঈপ্সিতা কথাটা বলে চুপ করে গেলেন।

মানালির অপরাধবোধ জন্মাচ্ছিল। সে বলল, “বুঝতে পারছি। উনি অনেক পরে এসেছেন।”

ধ্রুব বললেন, “কোনও কালেই আসেননি। বন্ধুরা বন্ধুই থাকেন।”

দীপ আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল “আপনি কখনও ওঁর রাগ ভাঙাতে যাননি?”

ধ্রুব সিগারেট ধরালেন, “আশ্চর্যজনক হলেও কথাটা সত্যি, ঝগড়াটা হয়েছিল তুচ্ছ কারণে, ঈপ্সিতা রূপনারায়ণপুরে চলে গেছিল, এদিকে ‘রেনেসাঁ’-র শুটিং তখন তুঙ্গে, কিছুতেই ও ফোন ধরছে না, একদিন শুটিং ছিল না, ঠিক করেছিলাম পরের দিন যাব, রাস্তায় টালিগঞ্জ মেট্রোর কাছে ওর এক বন্ধু আমাকে যা নয় তাই বলে গেল। আমার জন্য মেয়েটা নাকি কেরিয়র শেষ করেছে, কলেজে চাকরি পেয়েও গেল না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ধারণা হল ও-ই বন্ধুদের কাছে কাঁদুনি গেয়েছে, তুমুলভাবে রেগে গেলাম, সব কিছু শেষ করে দিলাম। আর গেলামই না। প্রবল জেদ ধরে ছিলাম। এর মধ্যেই সরকারি কোটায় এই ফ্ল্যাটটা কিনতে পারলাম।”

দীপ বলল, “আপনি গেলেন না, কোনও দিন যোগাযোগও হয়নি দুজনের? তবে? আজ হঠাৎ উনি এখানে?”

ধ্রুব মানালির দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, “সৌজন্যে এই ভদ্রমহিলা।”

দীপ একবার ধ্রুব, একবার ঈপ্সিতা, আর-একবার মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু স্যান্ডউইচেই কর্তব্য সেরে ফেললেন? উনি তো মিরাকল করেছেন!”

ঈপ্সিতা দীপের দিকে তাকালেন, “তা ঠিক। তবে কী জানেন তো, এতদিন পরে এসে আমরা দুজনেই বুঝতে পারি, সম্পর্কে দূরত্বেরও একটা দরকার আছে। আমরা দুজনে যথেষ্ট লাকি যে সাবান শ্যাম্পুর মতো ছোটোখাটো ব্যাপারেই সব কিছু শেষ হয়ে গেছিল। সে কারণেই হয়তো এত দিন পরেও আমরা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি।”

মানালি বলল, “আপনাদের ডিভোর্স হয়নি কোনও দিন, তাই না?”

ধ্রুব হাসলেন, “বিয়েই হয়নি কোনও দিন। আমরা লিভ টুগেদার করতাম। সবাই জানত বিয়ে। আপনাদের স্টোরি কোনও দিক থেকেই দাঁড়ায় না।”

মানালি হাঁ করে ধ্রুবর দিকে তাকাল।

ধ্রুব বললেন, “কেসটা রাগের মাথায় করব ঠিক করেছিলাম। সেসব আর করব না।”

মানালির মনে হল মাথা থেকে একটা বড়ো পাথর নেমে গেল। অকারণেই তার চোখের কোণ ভিজে উঠল।

দীপ বলল, “আপনারা তার মানে আজ থেকে একসঙ্গে থাকছেন?”

ধ্রুব ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, “দেখা যাক, পাগল তো দুজনেই। এখন থেকে দু ঘণ্টা পরে কোথায় যাব তাও জানি না। তবে অনেক দিন পরে ওর হাতে আলু পোস্ত খাব। আমার মতো মাতাল লোক, যার খাওয়ার ঠিক নেই, তার জন্য এটা তো একটা সুখবরই বটে।”

মানালির ফোন বাজছিল। দেখল বিশ্বরূপদা।

মানালি ধরল, “বলো।”

“শোন, চিন্তা করিস না, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কন্ট্রোলে। বিতস্তা ভীষণ কাঁদছে, তবে সামলে নেব। তোর আজকে অফিসে না এলেও হবে। কিন্তু কাল থেকে বিতস্তা যেন অফিসে আসে, স্বাভাবিক থাকে, এই দায়িত্বটা তোকে নিতে হবে। পারবি তো?”

মানালি বলল, “পারব।”

“কোথায় আছিস এখন?”

মানালি ধ্রুব আর ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “বন্ধুর বাড়ি।”

“ওকে। চোখ কান খোলা রাখ। নতুন যা নিউজ পাবি, নোট করতে থাক। একজন ভালো সাংবাদিকের কখনও বিশ্রাম নেই, মনে রাখিস।”

ফোনটা রেখে দিল বিশ্বরূপদা।

মানালি ধ্রুবর দিকে তাকাল, “বিশ্বরূপদাকে বলবেন না কোনও দিন?”

ধ্রুব হাসলেন, “আপনি বলে দেবেন। কিংবা আমিই কোনও দিন বলব। রাগের মাথায় অনেক কিছু বলেছি বটে, কিন্তু বেসিক্যালি আমাদের ভালোই চেয়েছিলেন উনি।”

মানালি বলল, “পরের সিনেমাটা কি তবে প্রেমের হবে?”

ধ্রুব হো হো করে হেসে উঠলেন।

৩৯

গাড়ি স্টার্ট করে দীপ বলল, “আমার লাইফে সত্যি সমস্যা আছে বুঝলেন?”

মানালি বলল, “কী রকম?”

দীপ বলল, “এত কিছু শুনেও আমি এখনও বুঝতে পারছি না এই জাগ্রত প্রেমের আবেগ নিয়ে আমি কার কাছে যাব, ঋতি, না চিত্রলেখা?”

মানালি হেসে ফেলল, “আপনি বরং গুরুদেবের কাছেই যান।”

দীপ বলল, “আচ্ছা আমরা কি বন্ধু? আপনি তো আবার কী যেন বললেন, কম বন্ধু না কী!”

মানালি বলল, “হ্যাঁ ওই হল আর কি!”

দীপ বলল, “তাহলে আমরা আপনি আপনি করছি কেন? তুইটা ঠিক আছে না?”

মানালি বলল, “ওকে, নো প্রবলেম। তবে একটাই শর্ত আছে বন্ধুত্বের।”

দীপ সিরিয়াস হয়ে রাস্তার বাঁদিকে গাড়ি দাঁড় করাল, “কী?”

মানালি বলল, “হঠাৎ করে ওয়ান ফাইন মর্নিং প্রোপোজ করে দেবেন না। আমার প্রায় সব ছেলে বন্ধুদের এটার জন্য কাটিয়েছি।”

দীপ বলল, “এই মরেছে।”

মানালি বলল, “কী হল?”

দীপ বলল, “আমি তো জাস্ট ভাবছিলাম তুই, মানে আপনিই আমার জন্য এক্কেবারে পারফেক্ট ম্যাচ। ন্যাগিং নন, হুটহাট রিঅ্যাক্ট করে ফেলেন না, জাজমেন্টাল বা মেন্টাল কোনোটাই নন, সব দিক থেকেই, মানে সেই ছক থেকেই আপনাকে আমি বন্ধু বানাবার ট্রাই নিচ্ছিলাম আর কি! ওল্ড স্কুল মেথড বা ওই সবই আর কি!”

মানালি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “প্লিজ না, আপনি ভীষণ বিপজ্জনক মানুষ।”

দীপ বলল, “তবে তোকে ফোন করতে পারি তো? মানে অ্যাটলিস্ট বায়ু চড়েছে তো, ফোন করলে হয়তো ত্রিকোণ প্রেম থেকে এবারের মতো সসম্মানে পালিয়ে বাঁচতে পারব।”

মানালি বলল, “ওকে, তাই হোক।”

দীপ বেশ কয়েক সেকেন্ড মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “তবে ঋতি মেয়েটা খারাপ ছিল না যাই বলুন।”

মানালি মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আপনি গাড়ি চালান প্লিজ।”

দীপ বলল, “তবে ঋতি তো আর ঈপ্সিতা নয় যে চাকরি ছেড়ে আমার জন্য থেকে যাবে! চিত্রলেখাও খারাপ না অবশ্য।”

মানালি গাড়ির এফ এমটা চালিয়ে দিল…

৪০

“তাহলে তুমি চাকরি করতে যাচ্ছ না? পড়তে যাচ্ছ? তাও এই বুড়ো বয়সে?”

বিশ্বরূপদাকে প্রশ্নটা করেই হেসে ফেলল মানালি। খানিকক্ষণ আগে বিশ্বরূপদার ফেয়ারওয়েল পার্টি হয়ে গেল। এখন বিশ্বরূপদাই তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছে তার গাড়িতে করে।

তার প্রশ্নের উত্তরে বিশ্বরূপদাও হাসল। বলল, “চাকরি করার থেকে ওটাই সেফ। দেখিস না কখন কার সেন্টিমেন্টে লেগে যায় আর পারলে তখনই ফাঁসিতে চড়িয়ে দেয়। বাদ দে, তোর খবর বল। বিপ্রতীপ রায়ের অফারটা নিয়ে কী ভাবলি?”

মানালি বলল, “জানি না। ভদ্রলোক আজকেও ফোন করেছিলেন। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আমার কথা ওঁকে তুমিই রেকমেন্ড করেছিলে, তাই না?”

বিশ্বরূপদা একটা খয়েরি রঙের আই-টুয়েন্টিকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল, “উঁহুঁ, এই বাজারে কেউ কাউকে রেকমেন্ড করে না। তুই একদিনে যা খেল দেখিয়ে দিয়েছিলি, এটা তারই সাইড এফেক্ট ছিল।”

মানালি বলল, “তোমার কী মনে হয়? আমার কী করা উচিত?”

বিশ্বরূপদা বলল, “কী আবার? সিম্পল। ট্রিভিয়া নিউজে জয়েন করবি। ওখানে তোকে কত বেশি স্যালারি দিচ্ছে সেটা দেখ!”

মানালি একটু ইতস্তত করে বলল, “বিতস্তাকে এভাবে একা ছেড়ে…”

বিশ্বরূপদা বলল, “শোন মানালি, এটা প্রফেশনাল ফিল্ড। এখানে এইসব সেন্টিমেন্ট নিয়ে ভাবলে জীবনে কিচ্ছু করতে পারবি না। তুই তো ঠিকই করে নিয়েছিস মোটামুটি সিঙ্গল থেকে জাতির উদ্দেশে নিজের সাংবাদিক কেরিয়রটাকে উৎসর্গ করবি। সেক্ষেত্রে এর থেকে বেটার অপশন আপাতত তোকে কে দেবে? আর বিতস্তা তো হারিয়ে যাচ্ছে না। দেখা করবি, মিট করবি মাঝে মাঝেই, সেরকম জায়গা করে নিতে পারলে ট্রিভিয়া নিউজে বিতস্তাকেও রেকমেন্ড করে নিতে পারবি।”

মানালি রাগল একটু, “তোমাকে কে বলেছে আমি সিঙ্গল থেকে জাতির উদ্দেশে এইসব বুলশিট?”

বিশ্বরূপদা হাসল, “সেরকমই তো ট্রেন্ড দেখছি। পাগলের মতো অফিস আসিস আর বাড়ি যাস। আর কোনও কিছু নিয়ে তো ভাবতেও দেখি না তোকে।”

মানালি বলল, “প্লিজ তুমি আর বাবা-মার মতো শুরু কোরো না।”

বিশ্বরূপদা বলল, “কোথায় ধ্রুব ঈপ্সিতার মতো জ্বলন্ত প্রেম করবি, গোটা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিবি, তা না…”

মানালি বলল, “ছোটো মুখে একটা বড়ো কথা বলব বিশ্বরূপদা?”

বিশ্বরূপদা বলল, “বাওয়া। বাংলা সিরিয়াল টাইপ ডায়লগ ঝাড়ছিস কবে থেকে? বল বল কী বলতে চাস।”

মানালি একটা ঢোক গিলে বলল, “ঈপ্সিতা বাগচীর ওপর কোনও এককালে তোমার চাপ ছিল, না?”

বিশ্বরূপদা গাড়ি চালাতে চালাতে হাসতে লাগল। মানালি বলল, “কী হল, বলো না, ছিল?”

বিশ্বরূপদা বলল, “এই এত্তবড়ো ওয়াইল্ড গেসটা করলি কী হিসেবে?”

মানালি বলল, “সব মেয়েই তো মা দুর্গার অংশ, জানো তো, ত্রিনয়ন দিয়ে সব দেখতে পায়। আমিও তেমন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ধ্রুব বাগচী আর ঈপ্সিতা প্রেম করছেন, তুমি ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলে, একটা সময় ধ্রুব আর ঈপ্সিতার তুমুল ঝামেলা, তুমি বুঝলে আর যাই হোক, ঈপ্সিতা ধ্রুবকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না, শেষমেশ চারটে কথা শুনিয়ে দিলে ধ্রুবকে। পরে বুঝলে সেটা আরও বাজে কেলো করে ফেলেছ, এত বছর পরে এসে ব্যাপারটা খুঁচিয়ে দেখতে চাইলে সত্যি কোনও লাভ হয় নাকি, এবং শেষ পর্যন্ত সফল হলে। দূর থেকে কাল হো না হো-র শাহরুখ খানের মতো গোটা ব্যাপারটা দেখে শহরটাই ছেড়ে চলে গেলে।”

বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “তাও ভালো, বলিসনি পৃথিবীটা ছেড়েই চলে গেলে।”

মানালি বলল, “বলো না, ঠিক বললাম কি না?”

বিশ্বরূপদা মাথা নাড়ল, “তুই ভাবলি কী করে ট্রিভিয়া নিউজের স্কুপ খুঁজে বেড়ানো সাংবাদিককে আমি এত বড়ো কনফেশনটা করে ফেলব?”

মানালি হেসে ফেলল, “তার মানে আমার গেস সত্যি?”

বিশ্বরূপদা চোখ পাকাল, “একদম না। এইসব নিয়ে আমি আর একটা কথাও বলব না।”

মানালি হাসছিল। বলল, “আচ্ছা। বলতে হবে না।”

মানালির ফোন বাজছিল। মানালি দেখল দীপ ফোন করছে। কেটে দিল।

বিশ্বরূপদা বলল, “কী ব্যাপার? কে ফোন করছে?”

মানালি বলল, “আরে এক পাগলের পাল্লায় পড়েছি। টোটাল কনফিউজড মেটিরিয়াল।”

বিশ্বরূপদা বলল, “বেশ তো পড়েছিস, পড়েছিস, তাতে ব্লাশ করছিস কেন?”

মানালি রেগে গেল, “কোথায় ব্লাশ করলাম?”

বিশ্বরূপদা বলল, “এই তো করছিস।”

মানালি বলল, “তুমি সামনের দিকে দেখে গাড়ি চালাও তো। কী সব ভুলভাল বকে যাচ্ছ।”

বিশ্বরূপদা বলল, “কেসটা কী?”

মানালি বলল, “সেরকম কিছু না। একটা কমপ্লিটলি এইমলেস ছেলে। এককালে বেশ গোছানো ছিল। এখন দুটো মেয়ের পাল্লায় পড়ে মাথা-টাথা বিগড়ে পেগলে গেছে।”

বিশ্বরূপদা বলল, “বেশ তো, তুই দিশা দেখা তবে।”

মানালি বলল, “খেপেছ? দুদিন পরে আরও কোনও একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে আমাকেও কনফিউজ করে দেবে। এইসব পাবলিকদের থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো।”

বিশ্বরূপদা বলল, “তাহলে ছেলেটা তোকে ফোন করছে কেন? তুই-ই বা ব্লাশ করছিস কেন?”

মানালি থতোমতো খেয়ে বলল, “কোথায় ব্লাশ করতে দেখছ তুমি?”

বিশ্বরূপদা বলল, “হয়, হয়, যানতি পারো না। ফোনটা করল ছেলেটা, সেটাও কেটে দিল, এটা বোঝাচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে তুই ওভারপ্রোটেক্টিভও বটে। গুড গুড, মেয়েরা একটু কনফিউজড ন্যালাক্যাবলা পছন্দ করে, তুইও সেরকমই তাহলে।”

মানালি রেগে গেল, “কী সব ফালতু বকে যাচ্ছ বলো তো? তুমি ছেলেটাকে দেখেছ? দেখলে এ কথা বলতে না।”

বিশ্বরূপদা বলল, “কথাগুলো আমাকে বলছিস না নিজেকে?”

মানালি গুম হয়ে বসে রইল।

বিশ্বরূপদা বলল, “প্রাচীন বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, জন্ম মৃত্যু বিয়ে…”

মানালি বলল, “ইশ, সেই ক্লিশে, মানে বলতে চাইছ ছেলেটা এত কনফিউজড কারণ শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গেই জুটবে বলে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “একজ্যাক্টলি। এই তো, ভালো মেয়ে। বুঝে গেছিস। এবার ফোন করে ফেল।”

মানালি বলল, “চুপ করো তো। যত ভুলভাল।”

তাদের বাড়ির গলি এসে গিয়েছিল। বিশ্বরূপদা হাসতে হাসতে বলল, “ঠিক আছে। করিস না। কিন্তু কিছু হলে ফেসবুকে আপডেট দিস। দূর থেকে আশীর্বাদ করে দেব।”

মানালি বলল, “কাল ফ্লাইট তো?”

বিশ্বরূপদা বলল, “ইয়েস।”

মানালি বলল, “কে এবার আমার পাগলামিগুলো প্রশ্রয় দেবে?”

বিশ্বরূপদা বলল, “দেখ মানালি, সাইকেল যারা শেখে, কখনও দেখেছিস?”

মানালি বলল, “না, আমি সাইকেল জানি না।”

বিশ্বরূপদা বলল, “যারা সাইকেল শেখায়, তারা প্রথমে ধরে থাকে, যে শিখছে সে নিশ্চিন্ত যে কেউ ধরে আছে, একটা সময় কিন্তু সাপোর্টটা ছেড়ে দেওয়া হয়। যে শিখছিল সে জানতেও পারে না সাপোর্টটা নেই। যখন জানতে পারে প্রথম প্রথম পড়ে যায়। একটা সময় ঠিকই শিখে যায়। তুই নিশ্চিন্ত থাক, এখন কদিন একটু আধটু পড়বি ঠিকই, কিন্তু তুই সাইকেল চালানোটা ঠিকই শিখে যাবি।”

মানালি কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থেকে বলল, “ভালো থেকো বিশ্বরূপদা।”

বিশ্বরূপদা বলল, “তুইও। যাহ্। অনেক রাত হল।”

মানালি গাড়ি থেকে নামল। বিশ্বরূপদা বেরিয়ে গেলে কয়েক সেকেন্ড রাস্তাতেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির পথে রওনা দিল। মনখারাপ লাগছিল। বিশ্বরূপদা একটা ছাতার মতো ছিল। মনে হচ্ছিল ছাতাটা সরে গেল আজ থেকে।

ফোনটা আবার বাজছিল।

মানালি ধরল, “বলুন।”

“আমি ঠিক করেছি সন্ন্যাস নিয়ে নেব। গেরুয়া পরে অফিস করব। ব্যাপারটা কেমন হবে?”

মানালি গম্ভীর হয়ে বলল, “ভালো হবে।”

“হাতের কাছে তো একজন গুরুদেব আছেই। চাঁদবদন মহারাজ। বাবার পাদপদ্মে আশ্রয় নিয়ে জনসেবা করা যাবে।”

মানালি বলল, “আচ্ছা, আর কী কী প্ল্যান আছে?”

দীপ বলল, “একটা জিনিস জানার আছে। সন্ন্যাসীদের মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট থাকলে পাপ লাগে না তো?”

মানালি বলল, “সেটা জানি না, চাঁদবদন মহারাজকে জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে।”

দীপ বলল, “আমায় কাল আবার ভুবনেশ্বর যেতে হবে।”

মানালির বলল, “বেশ তো, যাবেন।”

দীপ বলল, “কবে ফিরব ঠিক নেই। ফোনও করতে পারব না।”

মানালি বলল, “ভালো তো।”

দীপ বলল, “আপনি রাগ করলেন?”

মানালি বলল, “রাগ করতে যাব কেন বলুন তো?”

দীপ বলল, “তাও তো ঠিক। রাগ করতে যাবেন কেন খামোখা। তা ছাড়া আমি তো সন্ন্যাসী হয়ে যাব।”

মানালি বলল, “হুঁ। এবার রাখি?”

দীপ বলল, “আচ্ছা রাখুন।”

মানালি গলি দিয়ে হাঁটছিল। বাড়ির সামনে এসে দেখল দীপ দাঁড়িয়ে আছে। সে হাঁ করে বলল, “আপনি এখানে?”

দীপ বলল, “এই একটু চমকে দিলাম আপনাকে।”

মানালি বাড়ির চারপাশে দেখল। আশেপাশের কাকিমা পিসিমাদের অ্যান্টেনাগুলো বেশিই সক্রিয়। সে বিরক্ত হয়ে বলল, “বাড়ির ভেতরে গিয়ে বসতে পারতেন তো।”

দীপ বলল, “ও বাবা, আপনার বাবা মা আছেন না? তাঁরা কী ভেবে নেবেন।”

মানালি বলল, “কী ভাববে?”

দীপ বলল, “অনেক কিছু ভাবতে পারে।”

মানালি বলল, “আচ্ছা। চলুন ভিতরে চলুন।”

দীপ বলল, “না আমি যাব না। আমি বাড়ি যাই।”

মানালি বলল, “আচ্ছা। যান তাহলে।”

দীপ বলল, “অ্যাকচুয়ালি লং ড্রাইভে যেতে চাইছিলাম। কাউকে পাচ্ছি না।”

মানালি বলল, “ওহ। ঠিক আছে।”

দীপ কয়েক সেকেন্ড পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি যাবেন?”

মানালি আঁতকে উঠল, “এত রাতে?”

দীপ নিভে গেল একটু, “তাও ঠিক। অনেক রাত হয়েছে। আসলে আমি এখনও এত কনফিউজড, বুঝতে পারছি না কী করব। জাস্ট কয়েকটা দিনে কী থেকে কী হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারছি আমার এখানে আসা একেবারেই উচিত হয়নি। কদিন ধরে আপনাকেও বড্ড জ্বালাতন করছি বলুন? আমি বরং.. আমি বরং যাই, হ্যাঁ?”

মানালিকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দীপ হনহন করে হাঁটা লাগাল।

মানালি সেদিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বাড়ির দরজায় বেল বাজাল। মা দরজা খুলল। মানালি বলল, “মা ব্যাগটা রাখো তো, একটা জরুরি অ্যাসাইনমেন্ট এসেছে, একটু বেরোতে হবে।”

মা তার দিকে হাঁ করে তাকাল, “এত রাতে?”

মানালি বলল, “হ্যাঁ, এই তো জাস্ট এল। পরে ফোন করে নিচ্ছি। যাই এখন।”

মানালি ব্যাগটা মার হাতে দিয়েই পিছন ফিরে দৌড় লাগাল।

ছেলেটা কদ্দূর চলে গেল কে জানে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *