ডাকবাংলো

ডাকবাংলো

আমি যখন ডাকবাংলোয় পৌঁছুলাম তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। চারদিকে গাছ আর গাছ; সবুজের প্রলেপ, মাঝখানে ছবির মতো সুন্দর ডাকবাংলোটি, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ডাকবাংলোর চৌকিদার আমাকে একটা ঘর খুলে ঝেড়ে-ঝুড়ে দিল তারপর জিজ্ঞেস করল রাতের খাবার বানাতে হবে কিনা। আমি টিফিন ক্যারিয়ারে ডজন খানেক লুচি আর কষা মাংস ভরে এনেছিলাম। আমার সঙ্গে খাবার আছে জেনে চৌকিদার চলে গেল। খানিক বাদেই চোঙা মতো চিমনির একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে আমার ঘরে রেখে সে জানাল তাকে আমার আর দরকার না থাকলে, সে বাড়ি যেতে চায়, তার মেয়ের নাকি অসুখ, খুব ভোরেই আবার সে চলে আসবে। আমি তাকে বিদায় দিলাম। যাবার সময় সে যেন একটু ইতস্তত করে বলল, বাবু একটু সাবধানে থাকবেন, রাতবিরেতে হুট করে ঘর থেকে বেরুবেন না।

আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে গেল, আটটার সময় নামল বৃষ্টি অঝোর ধারায়। আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে দু-চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল তাই তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাম। বেশ ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় ঘন ঘন করাঘাত হতেই আমার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরের আলোটা জ্বলছিল, আমি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মোটে রাত দশটা। আবার দরজায় করাঘাতের শব্দ। আমি ঘুম জড়ানো চোখে উঠে দরজাটা খুলেই দু-পা পিছিয়ে এলাম। স্তিমিত আলোয় আমার চোখে পড়ল একটি অল্পবয়সি সুন্দরী বউ দাঁড়িয়ে আছে, তার দু-চোখে উদবেগ আর আশঙ্কার ছায়া। বৃষ্টিতে বউটি ভিজে একেবারে যেন নেয়ে গেছে। সবচেয়ে যা আমাকে বিমূঢ় করল তা হচ্ছে বউটির মুখ বেয়ে রক্তের ধারা নেমে আসছে।

বউটির কথায় আমার চমক ভাঙল। ব্যাকুল কণ্ঠে আমাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘শিগগির আসুন, আমার স্বামীর ভীষণ বিপদ, রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।’

আমি আর কিছু ভাববার সময় পেলাম না, টর্চটা হাতে নিয়ে বউটির পিছন পিছন ছুটলাম, বৃষ্টি তখন অনেকটা ধরে এসেছে।

ভাগ্য ভালো, রাস্তাটা পাকা তাই বিশেষ অসুবিধে হচ্ছিল না। বেশ কিছুটা যাবার পর পথের পাশে একটা প্রকাণ্ড গাছের সামনে এসে বউটি থমকে দাঁড়াল তারপর আমার দিকে আকুলভাবে ফিরে তাকাল। আমি বুঝলাম ওই গাছের কাছাকাছি কোথাও ওর স্বামী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমি টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে গেলাম কিন্তু চারদিকে আলো ফেলেও মাটিতে কাউকে পড়ে থাকতে দেখলাম না। মিনিট কয়েক ব্যর্থ খোঁজাখুঁজির পর আমি বউটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে ফিরে এলাম, কিন্তু তাকেও দেখতে পেলাম না। আমার সঙ্গে ছিল পাঁচ ব্যাটারির শক্তিশালী টর্চ, সেই আলো পথের ওপর ফেললাম, ‘আপনি কোথায়, আপনি কোথায়’, বলে তাকে উদ্দেশ্য করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, কিন্তু বউটির কোনো সাড়া শব্দই পেলাম না।

কী করব ভাবছি এমন সময় কাছেই মেয়েলি কণ্ঠে কে যেন কাতর বিলাপ করে উঠল। আমি সেই শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে আলো ফেললাম, কিন্তু কই, কেউ তো নেই। আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পরক্ষণেই সেই বিলাপ আবার ভেসে এল, কিন্তু এবার আরও একটু দূর থেকে; একটা প্রচণ্ড বেদনা যেন সেই বিলাপ ধ্বনির মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে, একটা বিদেহী আত্মা যেন গোঙিয়ে গোঙিয়ে কেঁদে আকাশে বাতাসে তার অব্যক্ত যাতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে

আমার সমস্ত শরীর যেন হিম হয়ে গেল, একটা ভীষণ ভয় আমাকে পেয়ে বসল, তারপরই আমি মরিয়া হয়ে ডাকবাংলো লক্ষ্য করে ছুটলাম আর সেই কান্নাটা চড়া সুর তুলে পরমুহূর্তে আছড়ে খানখান হয়ে আমাকে অনুসরণ করতে লাগল। কীভাবে যে আমি ডাকবাংলোয় পৌঁছে দরজা বন্ধ করে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছিলাম তা আমার মনে নেই।

পরদিন সব ঘটনা জানতে পারলাম। বছর কয়েক আগে এক বর্ষার রাত্রে ওই গাছটার সঙ্গে একটা গাড়ির ধাক্কা লাগে। গাড়িতে ছিলেন মণিমোহন বোস নামে এক যুবক ও তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী। বিয়ের পর তাঁরা বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। বোধ হয় জোর বৃষ্টির দরুণ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়ার ফলেই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ভদ্রলোকের স্ত্রীও গুরুতর আহত হন কিন্তু স্বামীর অবস্থা দেখে ওই অবস্থাতেই তিনি সাহায্যের আশায় ছোটেন। ডাকবাংলোটাই তাঁর চোখে পড়েছিল। সেই রাত্রে ভাগ্যক্রমে একজন বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক ডাকবাংলোয় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি সঙ্গেসঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যান, কিন্তু তাঁর কিছু করবার ছিল না। স্টিয়ারিং-এর হুইল মণিমোহনবাবুর বুকের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। বউটিও বাঁচেনি, হাসপাতালে নিয়ে যাবার দু-দিন পরে তারও মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর থেকে নাকি বৃষ্টি-বাদলের রাত্রে বউটিকে মাঝে মাঝে দেখা যায়, স্বামীর প্রাণ রক্ষার আশায় সে ডাকবাংলোয় ছুটে আসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *