আঁধারে কে কাঁদে

আঁধারে কে কাঁদে

মিলিটারি থেকে অবসর নেবার পর আমি কলকাতার কয়েক মাইল দূরে একটা বাড়ি কিনে সপরিবারে বসবাস শুরু করেছিলাম। বাড়িটা পুরোনো হলেও বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে, তাই আমার ও মিলির খুব পছন্দ হয়েছিল। বলা বাহুল্য, কম দামেই আমরা বাড়িটা পেয়েছিলাম। ওটাকে ঢালাও সংস্কার করতে আমার যা উপরি খরচ হয়েছিল, তাতে বিশেষ গায়ে লাগেনি।

নির্জন খোলামেলা এই পরিবেশে বাড়ি কেনার আমাদের আরও একটা বিশেষ কারণ ছিল। আমাদের সন্তান দুটি। মেয়ে ডালিয়া বড়ো, ক্লাস টেন-এ পড়ে আর ছেলে গৌতম, পড়ে ক্লাস এইট। আমাদের প্রথম সন্তান এক বছর বয়সেই মারা যায়, সেও ছিল ছেলে। অবশ্য আমি একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেছিলাম। ছোটোবেলা থেকেই গৌতমের হীন স্বাস্থ্য আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায়ই অসুখে ভুগে ভুগে ও এত ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল যে মনে হত ওর শরীরে রক্ত নেই। বাইরে বাইরে থাকা সত্ত্বেও ওর স্বাস্থ্যের উন্নতি না হওয়ায় আমরা ঠিক করেছিলাম, আমার অবসরের পর কলকাতায় থাকব না। আলোবাতাসহীন ঘিঞ্জি পরিবেশ গৌতমের স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক বলেই আমরা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

ওখানকার মুক্ত পরিবেশ আর প্রচুর আলো-বাতাস আমাদের মনে ধরেছিল; জলও চমৎকার। মাসখানেকের মধ্যেই আমরা গৌতমের একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। ওর পাণ্ডুর দু-গালে ক্ষীণ রক্তের আভাস দেখা দিল। আমরা স্বামী-স্ত্রী এতদিনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, জায়গাটা যে গৌতমের স্বাস্থ্যের পক্ষে মনোমতো হয়েছে, তার জন্য ভগবানকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম।

আমার বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরেই ঘন বসতি। সেখানেই দুটো স্কুলে ছেলেমেয়েকে ভরতি করে দিয়েছিলাম। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, গৌতমের হাঁটা-চলা করা দরকার। ওরা দু-ভাইবোন বড়ো বড়ো গাছের ছায়া ঢাকা পথ দিয়ে একসঙ্গে স্কুলে যেত, আবার ফিরতও একসঙ্গে। স্কুল থেকে ফিরে জলখাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে গৌতম বেড়াতে বেরুত, সন্ধের মুখে ফিরে আসত। জায়গাটার নির্জনতা, গাছগাছড়া, রংবেরঙের পাখি ওকে মুগ্ধ করেছিল। ওর মুখে একটা তৃপ্তির ভাব লক্ষ করেই আমরা তা অনুমান করেছিলাম।

আমাদের বাড়িটা লোকালয়ের বেশ বাইরেই ছিল। আগের যিনি মালিক, তিনিও বোধ হয় নির্জনতাই পছন্দ করতেন। তবে শুনেছিলাম, বেশ কয়েক বছর তিনি এখানকার বাস উঠিয়ে শহরের দিকে চলে গিয়েছেন। কারণটা অবশ্য আমি জিজ্ঞেস করা দরকার মনে করিনি। এক বুড়ো মালি আর তার বউ বাড়ির জমির মধ্যেই একটা খড়ের ঘরে থাকত, বাড়িটার দেখাশোনার ভার তাদের ওপরই ছিল।

এখানে দর্শনীয় কিছুই ছিল না, তবে একটা জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আমাদের বাড়ির পেছনে একটা সরু মেঠো পথ চলে গেছে। সেটা গিয়ে শেষ হয়েছে একটা ভগ্নস্তূপের কাছে। মনে হয়, আগে ওখানে একটা বাড়ি ছিল। কালের স্রোতে ইট-কাঠ-পাথর ধসে এখন একটা ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো কারণেই হোক বাড়িটা পরিত্যক্ত হওয়ায় ওই অবস্থা হয়েছে। মালি ও মালির বউকে আমরাও রেখে দিয়েছিলাম, তারাও খুশি হয়েছিল। কিন্তু মালিকে ওই ভগ্নস্তূপ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পাইনি।

আমার বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরে ছিল এক ক্রিশ্চান মিশনারি স্কুল। অনেকটা আশ্রমের মতো। প্রায় মাইলখানেক জায়গা জুড়ে ওই স্কুল ও আবাসিক আশ্রম। অনাথ শিশুদের মানুষ করাই ওই আশ্রমের উদ্দেশ্য। আমি একদিন সপরিবারে ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানকার অধ্যক্ষ একজন রোমান ক্যাথলিক, বয়স সত্তর পেরিয়েছে, কিন্তু সুন্দর স্বাস্থ্য। হাসিখুশি মানুষ, চেহারার মধ্যে একটা সৌম্য ভাব চোখে পড়ে। তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। নিজে আমাদের সঙ্গে ঘুরে সব দেখালেন। লেখাপড়া ছাড়া ছেলেরা ফসলের বাগান করেছে। একটা কামারশালা ও আরেকটা ছুতোরশালাও আছে। ছেলেরা হাতে-কলমে কাজ শেখে। তা ছাড়া আছে তাঁতশালা। অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ আশ্রম। অধ্যক্ষের নাম ফাদার ভিনসেন্ট। তিনি ছাড়া আরও দু-জন বিদেশি মিশনারি আছেন। বাকি সব এদেশি ক্রিশ্চান।

আমরা গৃহপ্রবেশ করেছিলাম আশ্বিন মাসে। দেখতে দেখতে পৌষ মাস এসে গেল। এই সময় কয়েকটা দরকারি কাজে আমার কলকাতা যাওয়া দরকার হয়ে পড়ল। কাজটা শেষ হতে পুরো দু-দিন লেগে যাবে, তাই আমি ঠিক করলাম কলকাতায় আমার বোনের বাড়ি উঠব। আমি সোমবার সকালে রওনা হয়ে গেলাম, ফিরব বুধবার রাত্রে কিংবা বৃহস্পতিবার সকালের দিকে।

কলকাতার কাজ সারতে সারতে বুধবার হয়ে গেল। বোন আর ভগ্নীপতি মিলে আমাকে সে রাতটা থেকে পরদিন খাওয়া-দাওয়া করে যাবার কথা বলল। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক ছ-টার সময় আমার নামে দুটো টেলিগ্রাম এল। একটা অজানা আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে উঠল। টেলিগ্রাম দুটো খুলে আমি পড়লাম। প্রথমটা করেছে মিলি, ‘শিগগির এসো, গৌতম খুব অসুস্থ।’ দ্বিতীয়টা করেছে মেয়ে, ‘বাবা আসছ না কেন? ভাই-এর অবস্থা খারাপ।’ আমি টেলিগ্রাম দুটোর তারিখ দেখলাম। প্রথমটা করা হয়েছে মঙ্গলবার, দ্বিতীয়টা আজই। দুটো একইসঙ্গে এসেছে।

আমার তখনকার মনের অবস্থা খুলে বলার দরকার নেই। এই কমাসেই গৌতমের চেহারা ভালোর দিকে মোড় নিয়েছিল, হঠাৎ আবার কী হল! যাই হোক, আমি সেই মুহূর্তে বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যক্রমে স্টেশনে পৌঁছুবার মিনিট পনেরোর মধ্যে একটা ট্রেন পেয়ে গেলাম। আমি যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তখন বাজে সাড়ে সাতটা। শীতের সন্ধে, তাই অনেকক্ষণ আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি একটা সাইকেল রিকশায় চেপে চালককে খুব তাড়াতাড়ি চালাতে বললাম।

আগেই বলেছি আমার বাড়িটা বেশ কিছুটা জমি নিয়ে। বাড়ির কাছাকাছি আসার পর একটা চাপা কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে এল। আমার বুক ধড়াস করে উঠল। আর একটু কান পাততেই বুঝতে পারলাম যে, কান্নাটা আমার বাড়ি থেকে আসছে না, পেছন দিকে জমাট অন্ধকার ভেদ করে আসছে। আমি মনে মনে বিরক্ত হলাম। সন্ধেবেলা কে অলক্ষুণে কান্না কাঁদছে।

গেটের কাছে পৌঁছে আমি রিকশাওয়ালার হাতে টাকা গুঁজে প্রায় ছুট মারলাম। আমার নেপালি চাকর বাহাদুর দরজা খুলে দিল। বিয়ের পর থেকেই ও আমার সঙ্গে আছে। যেমন বিশ্বাসী তেমনি সাহসী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, খোকাবাবু কেমন আছে? জবাবে ও বলল, একইরকম।

আমার সাড়া পেয়ে ডালিয়া ছুটে এসেছিল। আমাকে দেখে ও যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বলল, এত দেরি করলে কেন বাবা? আমি ওর হাত ধরে গৌতমের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ঘর পর্যন্ত যেতে হল না। মিলি বেরিয়ে এসে বলল, সারাক্ষণ ছটফট করে ও এখন ঘুমুচ্ছে, তুমি বরং একটু বিশ্রাম করে তারপর যেয়ো।

আমি লক্ষ করলাম, মিলির মুখে কালি পড়েছে। এই দু-দিন অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ওর কীভাবে যে কেটেছে তা বুঝতে কষ্ট হল না। আমি অসুখ সম্বন্ধে জানতে চাইলাম।

মিলির মুখে শুনলাম, সোমবার সকালে আমি যাবার পর গৌতম যথারীতি স্কুলে গিয়েছিল। বিকেলে যখন ফিরল, তখনও ভালো ছিল। তারপর বেড়াতে যায়। সাধারণত ও সন্ধের মুখেই বাড়ি ফেরে। কিন্তু সেদিন ফিরতে দেরি হয়েছিল। যখন ফিরল, তখন ওর চোখ-মুখ লাল, শরীর কাঁপছে, গা-ও বেশ গরম। মিলি তাড়াতাড়ি ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল কিন্তু জ্বর হু-হু করে বাড়ছে দেখে বাহাদুরকে ডাক্তারবাবুর কাছে পাঠায়। ডাক্তারবাবু এসে ওষুধ দেন আর কপালে জলপট্টি দিতে বলেন।

মাঝরাতে গৌতম ভুল বকতে থাকে। ও একটা কথাই বলছিল, মাগো দরজা খোলো, ও মা ভেতরে ঢুকতে দাও।

তোমাকে কী বলব, মিলি আমাকে বলল, কেঁদে কেঁদে ও যখন ওই কথা বলছিল, তখন আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। মিলির দু-গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। এ আবার কী! মিলি নিজেকে সামলে বলল, আমি ওকে আঁকড়ে ধরে যতই বলি, তুমি ঘরেই আছ, এই দেখো আমি মা, তোমার কাছে বসে আছি, ও কিন্তু কেঁদে কেঁদে একটানা সেই একই কথা বলছিল।

মঙ্গলবার সকালে নাকি ও একটু ভালো ছিল। দুপুরের দিকে খানিকক্ষণ ঘুমিয়েছিল। কিন্তু বিকেল থেকেই আবার ছটফট করতে থাকে, সন্ধের পর সেটা বেড়ে যায়। জ্বরও বাড়তে থাকে। ডাক্তারবাবু ওষুধ বদলে দেন। জ্বর আরো বাড়লে মাথা ধুইয়ে দিতে বলেন। মাঝরাত্রে আবার সেই ভুল বকা শুরু হয়। আজ সকাল থেকেই ও আমার কথা বলছে। কেউ ঘরে ঢুকলেই প্রত্যাশিত ভাবে তাকাচ্ছিল, কিন্তু পরেই হতাশভাবে বলছিল, বাবা এখনো এল না?

সমস্ত ঘটনা শুনে আমার দু-চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। বেচারি অসুস্থ ছেলেটা এত ব্যাকুল হয়ে আমাকে খুঁজছিল! আমি কাছে থাকলে একটা নিশ্চিন্ততায় হয়তো ওর অসুখের প্রকোপ একটু লাঘব হত।

ঠিক এইসময় ডাক্তার মজুমদার এলেন। তাঁর ডিসপেন্সারি গৌতমদের স্কুলের কাছেই। এখানে আসার পর গৌতমকে নিয়ে একবার আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তখন ওর কোনো অসুখ ছিল না। শুধু একটা সাধারণ পরীক্ষা অর্থাৎ জেনারেল চেকআপই আমার উদ্দেশ্য ছিল। ডা মজুমদারের বয়স চল্লিশ কি চল্লিশের কাছাকাছি হবে। ওই অঞ্চলে তাঁর বেশ সুনাম আছে। আমার কাছে গৌতমের ইতিহাস তিনি আগ্রহ নিয়েই শুনেছিলেন, আগে যেসব চিকিৎসা হয়েছিল তাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ওর খাওয়া-দাওয়ার একটা চার্ট আর একটা টনিক উনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমি বেড়াতে বেড়াতে কিংবা কাজে ওদিকে গেলে প্রায়ই ওঁর ডিসপেন্সারিতে একবার ঢুঁ মেরে আসতাম।

গৌতম ঘুমুচ্ছে শুনে তিনি খুশি হলেন। বললেন, ওর এখন ভালো ঘুম দরকার। আমি অসুখটা কী জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, মনে হচ্ছে ব্রেন ফিভার। আমার বিস্মিত দৃষ্টি লক্ষ করে বললেন, বোধ হয় আচমকা একটা ভয় অ্যাফেক্ট করেছে, জ্বরও হয়েছে ওই একই কারণে।

ডা মজুমদার দরজা থেকেই গৌতমকে দেখলেন। ওকে পরীক্ষা করতে গিয়ে জাগাতে চাইলেন না। ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে তিনি চলে গেলেন।

আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলাম। গৌতমের দিকে তাকিয়ে আমার বুক মুচড়ে উঠল। ওর শরীরে যেটুকু সজীবতা এসেছিল, তা আবার মিলিয়ে পাণ্ডুর হয়ে গেছে। আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওর বিছানার পাশে একটা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলাম। চিন্তা ও উদবেগে আমার শরীর যেন এলিয়ে পড়েছিল, প্রায় সঙ্গেসঙ্গে আমার দু-চোখ বুজে এল।

হঠাৎ একটা অনুভূতিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে আমি গৌতমের দিকে তাকালাম। উপুড় হয়ে দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। এক মুহূর্ত আমি বোধ হয় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপরই লাফ দিয়ে উঠে ওর পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। গৌতমের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।

আমি ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিলাম।

বাবা, ঘরে কেউ নেই তো? ও ব্যগ্রকণ্ঠে বলল।

আমি ওর কথার ধরনে বেশ অবাকই হলাম। ও যে আমাকে কিছু বলতে চায় এবং সেটা কারো সামনে নয়, তা বেশ বুঝতে পারলাম।

আমি ঘাড় নাড়তেই গৌতম বলল, তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও।

আমি ওর কথামতো কাজ করলাম, তারপর বিছানায় উঠে বসলাম।

জান বাবা, এ ক-দিন আমার খুব কষ্ট হয়েছে, তবু আমি মুখ বুজে ছিলাম। মাকে আর দিদিকে বলিনি, যদি ভয় পায় তাই।

আমি ওর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে সবিস্ময় তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ও বলল, আমার অসুখ ঠিক নয় বাবা। শুধু তুমি আর আমি জানব আর কেউ নয়।

আমি ওর চুলের ভেতর আঙুল বুলোতে বুলোতে বললাম, বেশ তোমার গোপন কথা আমি শুনব, কিন্তু তুমি একটু শান্ত হয়ে নাও।

ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করল। অসুস্থ পাণ্ডুর মুখের সেই ক্লান্ত ক্ষীণ হাসি আমাকে অভিভূত করল।

আমি জানতাম, তুমি এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

ওর কথায় আনন্দ বেদনার একটু অপূর্ব অনুভূতিতে আমার মন ভরে গেল।

শান্ত হয়ে বলো, আমি শুনি, আমি ওকে উৎসাহিত করার জন্য বললাম। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, ওর এখন বেশি কথা বলা উচিত না হলেও আমার কাছে মনের কথা খুলে বললে ওর মন তৃপ্ত হবে। হয়তো তার ফল ভালোই হবে।

বাবা, আমাদের বাড়ির পেছনদিকে কোনো ছেলের বোধ হয় খুব কষ্ট, কেউ তাকে কষ্ট দিচ্ছে।

আমি অবাক হয়েই বললাম, কে সে? কে তাকে কষ্ট দিচ্ছে?

সেখানেই তো মুশকিল, আমি নিজেও জানি না সে কে! শুধু তার কান্না শুনেছি। ও! তুমি যদি শুনতে বাবা! ঘুমের মধ্যেও সেই কান্না আমি ভুলতে পারছি না।

একটু একটু করে ওর মুখে আমি সব শুনলাম। বেশ দিনকয়েক ধরে ও নাকি সন্ধের পর আমাদের বাড়ির পেছন থেকে একটা চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পেত। দিদিকেও নাকি সে কথাটা বলেছিল, কিন্তু সে তেমন কান দেয়নি।

আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, গৌতম বলল, বোধ হয় কোনো জন্তুর ডাক, কিন্তু সকালে জায়গাটায় গিয়ে আমি কিছু দেখতে পাইনি! তুমি যেদিন চলে গেলে, সেদিন সন্ধেবেলা আমি একটা লাঠি নিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম। এখানে বলে রাখা ভালো, হীন স্বাস্থ্য হলেও গৌতমের সাহসের অভাব ছিল না।

তখনই প্রথম কেঁদে কেঁদে ও যা বলছিল, তা আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। গৌতম উঠে বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মা দরজা খোলো, আমাকে ভেতরে আসতে দাও। মাগো আমাকে ভেতরে আসতে দাও। কথাগুলো বলার সময় ওর মুখে নিদারুণ একটা ব্যথার চিহ্ন ফুটে চোখে ফেটে জল বেরিয়ে এল।

আমি ওকে আবার শুইয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলাম, সমস্ত ব্যাপারটাই কী ভ্রম! অলীক কল্পনায় ও ভুগছে! দুর্বল শরীরের জন্যই কি ওর মনে একটা অবাস্তব ধারণার সৃষ্টি হয়েছে!

তুমি যদি শুনতে বাবা? সে কী কান্না! আমি কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি। তখনই ঠিক করেছিলাম, তোমাকে বলব, তুমি ও বেচারির জন্য কিছু একটা করতে পারবে। আর কাউকে আমি বলিনি। আজ রাত্রেই তুমি কিছু করো বাবা। ওর কণ্ঠে অনুনয়ের সুর আমার হৃদয় স্পর্শ করল।

নিশ্চয়ই কোনো হারিয়ে যাওয়া ছেলে, আমি বললাম।

গৌতম চট করে আমার মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, তারপর বলে উঠল, যদি তা না হয়, যদি ও জীবন্ত কিছু না হয়?

তবে তুমি কান্না শুনবে কেমন করে? আমি অবাক হয়ে বললাম।

একটু অধৈর্য কণ্ঠে জবাব এল, তুমি বুঝতে পারছ না?

হঠাৎ আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

তুমি কি ভূতের কথা বলছ? আমার বিস্ময়ের অন্ত থাকে না।

গম্ভীর মুখে ও জবাব দিল, কোনো নাম আমি বলছি না বাবা। যে-ই হোক না কেন, তার খুব কষ্ট, ভীষণ কষ্ট বাবা। ওকে তুমি কষ্ট থেকে মুক্তি দাও।

কিন্তু তোমার কথাই যদি ঠিক হয়, তবে আমি কী করতে পারি? আমার বুদ্ধি যেন হারিয়ে ফেলছি।

তুমি পারবে বাবা, আমি জানি তুমি পারবে। আমার ওপর এই অগাধ বিশ্বাসে আমি বিচলিত হলাম।

সেই রাত্রের পর থেকে রোজই আমি ওই কান্না শুনতে পাই। দিনের পর দিন সেই কষ্টের কান্না কেমন করে আমি সইব। ওর জন্য কিছু করতে না পেরে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। একা একা অন্ধকার রাত্রে ওই ভাঙা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ও কাঁদছে, কেউ সাহায্য করার নেই। আমি এ সইতে পারছি না বাবা। গৌতম কেঁদে ফেলল।

আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে অনেক কষ্টে চুপ করালাম। আমার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। গৌতমের মনে একটা বিশ্বাস শেকড় গেঁথে বসেছে যে, ও একটা কিছু দেখেছে, নয় কিছু শুনেছে, অশরীরীর কান্না! ওর ইচ্ছে আমি সেই অশরীরীকে সাহায্য করি। অদ্ভুত অনুরোধ। এমন গুরুতর সমস্যায় আমি জীবনে পড়িনি। গৌতম ভূত দেখেছে বা ভূতের কান্না শুনেছে কথাটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম। নিজের সন্তানের এমন অবস্থা কোন বাবার পক্ষে সুখদায়ক? আমার পক্ষেও সেই বিদেহী আত্মাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেবার দায়িত্ব নেওয়া একটা অসম্ভব কিংবা অবাস্তব ব্যাপার নয় কি?

আমি গৌতমকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওর সেই এক কথা, তুমি যদি সেই কান্না শুনতে বাবা! তোমাকে একটা কিছু করতেই হবে। সারারাত ধরে ও কাঁদবে আর আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনব? ধরো ও যদি আমি হতাম!

কিন্তু আমি কী করতে পারি বল?

আমি জানি তুমি পারবে। যাও বাবা।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা আত্মার মুক্তি, তাই আমার কাছে গৌতম আশা করছে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস, বাবা নিশ্চয়ই একটা কিছু করতে পারবে। সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে বিচিত্র ঠেকল। এমন অলীক কল্পনা ওর মাথায় এল কী করে!

আমি শোবার ঘরে ঢুকে দেখলাম মিলি ঘুমোচ্ছে। দুশ্চিন্তায় ও রাত জাগার ক্লান্তিতে ও যে অবসন্ন হয়ে পড়েছে, তা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। ডালিয়া কিন্তু আমার অপেক্ষাই করছিল। ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ভাই কেমন আছে?

আমি ওকে আশ্বস্ত করে ভাইয়ের ঘরে থাকতে বললাম, তারপর বেরিয়ে পড়লাম।

চিন্তিত মুখে আমি হাঁটছিলাম, অনেকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে। হঠাৎ একটা কথা আমার মনে জাগলো। মালি অনেকদিন ধরে এখানে আছে, ওকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়! আমি মালির ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

মালি ওই অসময়ে আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল। আমি দু-চারটে মামুলি কথাবার্তার পর এই কান্না সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। মালি আর মালির বউ দু-জনেরই মুখ যেন শুকিয়ে গেল। প্রথমে ওরা কেউ মুখ খুলতে চাইল না। আমার চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত যেন খুব অনিচ্ছার সঙ্গে যা বলল, তা হচ্ছে এই—

এ জায়গায় নাকি সত্যিই ভূতের উপদ্রব আছে। কবে থেকে কান্না শোনা যাচ্ছে, তা ঠিক কেউ জানে না। ওই ভগ্নস্তূপকে কেন্দ্র করেই নাকি ভূতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনা গড়ে উঠেছে। মালি শুনেছে, আগে ওখানে এক সাহেবের বাংলো ছিল। বছরের সবসময় কিন্তু কান্না শোনা যায় না, শুধু পৌষ মাঘ মাসে। এই দুই মাসে অন্ধকার রাত্রে এমন দিন যায় না, যখন ওই কান্না শোনা যায় না। সন্ধের পর থেকেই শুরু হয় এবং থেকে থেকে ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত শোনা যায়। বেশির ভাগ সময় ওটা একটা দুর্বোধ্য চাপা কান্না ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। মাঝে মাঝে যখন কথা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তখন মনে হয় কেউ যেন কেঁদে বলছে, ‘মা, দরজা খোলো, ভেতরে ঢুকতে দাও।’

এই ভৌতিক রহস্য কেউ নাকি তেমন অনুসন্ধানের চেষ্টা করেনি। তা ছাড়া আমাদের বাড়ি লোকালয়ের বাইরে নির্জন জায়গায় হওয়ায় ব্যাপারটা তেমন চাউর হয়নি। বাড়ির আগে যিনি মালিক ছিলেন, তিনি এই কারণেই এখানে বেশিদিন বাস করতে পারেননি। তবে নিজের স্বার্থেই তিনি সমস্ত ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়েছিলেন। কারণ লোক জানাজানি হলে এ বাড়ি সম্বন্ধে কেউ আগ্রহী হবে না। মালির ওপরেও কড়া হুকুম ছিল, যেন এ নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা না করে। আমি যে ভদ্রলোকের কাছ থেকে বাড়ি কিনেছিলাম, তিনি আবার আর এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে ওটা কিনেছিলেন। তিনিও নিজের স্বার্থে ওই একই নীরবতা অবলম্বন করেছিলেন। ফলে ভৌতিক ব্যাপারটা শুধু ওই দুই পরিবার এবং মালি দম্পতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাইরের লোকের সন্ধের পর ওই ভগ্নস্তূপের আশপাশ দিয়ে যাবার তেমন কোনো দরকার হয় না। ঘটনা চাউর না হবার এটাও একটা কারণ। ওই ভগ্নস্তূপের আশেপাশে ঘন ঝোপঝাড়, তারপরই একটা পচা ডোবা, লোকজনের যাতায়াতের উপযোগী নয়।

মালি আরও বলল, ওই দু-মাস ওরা একটা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায়, সন্ধের পর একেবারেই বেরোয় না। এই বাড়িতে কেউ এসে স্থায়ী বসবাস করুক, এটা ওরা মনেপ্রাণে চায়। তাই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিল, যেন আমরা ভূতুড়ে কান্না শুনতে না পাই।

মালিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওই শব্দের আসল কারণ বার করার জন্য আমি যদি চেষ্টা করি, তবে ও আমার সঙ্গী হতে রাজি আছে কি না। মালি আতঙ্কে পিছিয়ে গেল, বলল, বাবু এমন কাজ করবেন না, যা আছে থাকতে দিন। মানুষ হলে অন্য কথা ছিল।

বুঝলাম, কুসংস্কার ওর মনে শেকড় গেড়ে বসেছে, তা উৎখাত করা আমার কর্ম নয়। আমি নিজে কিন্তু ভূতপ্রেত বিশ্বাস করি না। রাত্রের অন্ধকারে বিভ্রান্তিকর নানা শব্দ ভেসে আসে। নিশাচর পাখির ডাক, ঝোপজঙ্গলে শেয়াল বা বনবেড়ালের ডাক, শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রাণীর খস খস শব্দ, বাতাসে ডালপালা নড়ার শব্দ, এ সবই নানারকম উদ্ভট কল্পনার সৃষ্টি করে। মালির কাহিনি এবং গৌতম যা শুনেছে, সবই হয়তো অমন কিছু একটা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।

আমি ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি সেই ভগ্নস্তূপের দিকেই চললাম। শীতের রাত যে কী জমাট অন্ধকার, তা বোধ হয় বলে দেওয়ার দরকার নেই। আমি আর্মিতে ছিলাম, অন্ধকার আমার গা-সওয়া, ভয়ডরও ছিল না। কয়েকবারই ঝোপঝাড়ে ধাক্কা খেয়ে আমি একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। সামনেই সেই স্তূপ। জমাট অন্ধকারে ওটাকে প্রেতপুরী মনে হচ্ছে।

আমি স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। চারদিকে গভীর নিস্তব্ধতা। তবু আমার মনে হতে লাগল আমি একা নই। একটা অনুভূতি ছাড়া অবশ্য আর কিছু নয়। কোনো লোকের দিকে অন্য কেউ যদি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তবে ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিতে প্রথমজন যেমন ফিরে তাকায়, ঠিক সেই অনুভূতি। হয়তো মালির কাছে ঘটনা শোনার পর সব কিছুই আমার কল্পনা। রহস্যভরা ঘন অন্ধকার মানুষের মনে যে অলীক কল্পনার উদ্রেক করে, হয়তো তাই।

অনুভূতিটা কিন্তু আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। আমি একটু চেঁচিয়েই বললাম, কে? কেউ সাড়া দিল না। আমি অবশ্য, কেউ সাড়া দেবে, তা আশাও করিনি। নিজের অজান্তেই আমি একটু এগিয়ে গেলাম আর সঙ্গেসঙ্গে ভগ্নস্তূপের একটা অংশের সঙ্গে আমি ধাক্কা খেলাম। কাঁটাঝোপের খোঁচা খেয়ে আমি যেন অনেকটা আত্মস্থ হলাম।

ঠিক পরমুহূর্তে আমার শরীরের রক্ত যেন জল হয়ে গেল। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিম শিহরন বয়ে গেল। ঠিক আমার সামনেই, দু-হাত দূরে, নীচু থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস আমার কানে ভেসে এল। গোঙানির শব্দ নয়, বিলাপের শব্দও নয়, তেমন কিছুই নয়, শুধু একটা মৃদু দীর্ঘনিশ্বাস।

আমি এক লাফে পেছিয়ে এলাম, আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মনের ভুল? না, ভুল আমার হয়নি। আমি স্পষ্ট শুনেছি। একটা মৃদু ক্লান্ত দীর্ঘনিশ্বাস।

যেন কেউ বুকভরা নিশ্বাস টেনে অন্তরের অন্তঃস্থলের ঘনীভূত দুঃখ ওই নিশ্বাসের সঙ্গে বার করে দিল। ওই নির্জন অন্ধকার রাত্রে একা একা দাঁড়িয়ে আমার মনের তখন যে অবস্থা হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একটা ঠান্ডা হিমপ্রবাহ আমার শরীর বেয়ে যেন চুল স্পর্শ করল, তারপর আবার সর সর করে নীচে পায়ের নখ পর্যন্ত নেমে এল।

আমার পা দুটো যেন মাটিতে আটকে গেল। আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, কে ওখানে? আগেরবারের মতো এবারও কেউ সাড়া দিল না।

আমি যে কেমন করে ফিরে এলাম, তা আমিও জানি না। বাড়ি ফিরে আমি সমস্ত ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে লাগলাম। আমাকে একটা কিছু করতেই হবে, কেননা এই রহস্য সমাধানের ওপরই নির্ভর করছে আমার প্রিয় সন্তানের জীবন-মরণ।

বাহাদুরের কথা আমার প্রথমেই মনে পড়ল। সে শুধু বিশ্বাসী নয়, সাহসীও বটে। আমি তাকে ডেকে সব কথা খুলে বললাম। রাতে আমার সঙ্গী হতে রাজি আছে কি না তাও জিজ্ঞেস করলাম। বাহাদুর এককথায় রাজি হয়ে গেল। খোকাবাবু অর্থাৎ গৌতমকে সে খুবই ভালোবাসত। ব্যাপারটা কিন্তু মিলির কাছেও আমি ফাঁস করলাম না।

গৌতম নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছিল। বাবা একটা কিছু করবে তা ওর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল।

রাত প্রায় বারোটার সময় আমরা নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লাম। আমি একটা হ্যারিকেন লন্ঠন হাতে নিয়েছিলাম। অন্ধকার তখন আরও গাঢ় হয়েছে। লন্ঠনের আলোয় সামান্যই দেখা যায়।

নানারকম বিচিত্র শব্দ আমাদের কানে আসছিল। উত্তুরে বাতাস ধসে পড়া সেই ভগ্নস্তূপের ইট, পাথরে প্রতিহত হয়ে অদ্ভুত একটা শব্দের তরঙ্গ তুলছিল। শুকনো পাতায় হঠাৎ খস খস শব্দে আমরা চমকে উঠলাম। ক্রমশ শব্দগুলো আমাদের সয়ে গেল।

যেখানে আমি দীর্ঘনিশ্বাস শুনেছিলাম, সেখানে এসে দাঁড়ালাম। কাছেই একটা গাছে পেঁচা ডেকে উঠল। গভীর রাত্রে পেঁচার কর্কশ স্বর মোটেই শ্রুতিমধুর নয়। কিন্তু আমি কেমন যেন স্বস্তি বোধ করলাম। ওটাইতো স্বাভাবিক, বিশেষ করে জীবন্ত পাখির উপস্থিতিতে আমার মন খানিকটা হালকা হল।

প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই আমাদের খুব কাছে কেউ যেন কেঁদে উঠল। এত আকস্মিক ঘটনাটা ঘটল যে, আমি ভয় পেয়ে এক লাফ মারলাম। আর ভাঙা ইটের স্তূপের এক জায়গায় মাথাটা ঠুকে গেল। আশ্চর্য! প্রথমবার যেখানে গুঁতো খেয়েছিলাম, এবারও ঠিক ওই একই জায়গায়।

কান্নার শব্দটা মাটি থেকে ওপরদিকে উঠছিল। মৃদু, করুণ বিলাপ, যেন দুঃখ ও যন্ত্রণায় কেউ গুমরে মরছে। পেঁচার ডাকের সঙ্গে এটার তফাত খুবই স্পষ্ট। একটা নিশাচর পাখির স্বাভাবিক ডাক, আর এটা রক্ত জমাট করে দেয়।

মনে সাহস এনে আমি লন্ঠনটা বাড়িয়ে ধরলাম। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেটা বোধ হয় একসময় ওই বাড়ির সদর দরজার অংশ ছিল। দরজার কিছুই নেই, তবে কাঠামো দেখে মনে হয়, ওটাই প্রবেশদ্বার ছিল। আমরা সেই দরজার ভেতরে ঢুকেছি, বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। লন্ঠনের আলোয় একটা ভাঙা দেয়ালের অংশ আমাদের চোখে পড়ল, ঘন শ্যাওলায় সবুজ হয়ে গেছে। পাশেই একটা সবুজ ঝোপ বাতাসে দুলছে অর সেই ঝোপের লাগোয়া, ভাঙা দেয়ালের ঠিক নীচে সেই খোলা দরজাটা, যে দরজা দিয়ে কোথাও যাওয়া যায় না। এই দরজার ঠিক বাইরে থেকে কান্নার শব্দটা ভেসে এসেছিল। আমি আলো ফেলতেই শব্দটা থেমে গেল।

কয়েক মুহূর্ত একটা উৎকট নিস্তব্ধতা, তারপরই আবার ওটা শুনতে পেলাম। কান্নাটা এত কাছ থেকে, অন্ধকার চিরে, এত করুণভাবে ভেসে এল যে লন্ঠনটা আমার হাত থেকে পড়ে গেল। আমি সেটা মাটি থেকে তুলবার জন্য নীচু হতেই বাহাদুর আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর সর্বাঙ্গ ঠক ঠক করে কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে উঠল, ও কেয়া সাব!

আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। লন্ঠনটা ওর হাতে দিয়ে বললাম, তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি দেখছি কী ব্যাপার।

আমি দেয়াল ঘেঁষে হেঁটে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো খোলা দরজা দিয়ে বাইরে পড়ছিল। একটা কালো ছায়া আমার চোখে পড়ল। আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার চোখেরই ভুল। দেয়ালের এপাশে একটা ঝোপ ঘন হয়ে আছে। আমাকে এগিয়ে যেতে দেখে বাহাদুর বোধ হয় একা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস করল না। সে আমায় অনুসরণ করল আর ঠিক সেই সময় আমাদের দু-জনের মাঝখানে, মাটি থেকে কে যেন ককিয়ে উঠল। বাহাদুর দেয়ালের গায়ে কাঁটাঝোপের পাশেই লুটিয়ে পড়ল, লন্ঠনটাও তার হাত থেকে ছিটকে গেল। আমি লন্ঠনটা তাড়াতাড়ি তুলে চারদিকে ঘুরে ঘুরে আলো ফেললাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

কান্নার শব্দটা এখন যেন ঠিক আমার কানের পাশেই হচ্ছে। যেন কেউ প্রাণের দায়ে করুণ কণ্ঠে কাঁদছে। হয় গৌতম যা বলেছিল, তাই আমি শুনলাম, নয় উত্তেজনায় ওর কল্পনা আমাকেও পেয়ে বসল। কান্নার শব্দটা ক্রমশ যেন স্পষ্ট হয়ে কথায় রূপ নিতে লাগল। কিন্তু এক জায়গায় স্থির হয়ে নয়। ওটা নড়াচড়া করছে, যেন যে কাঁদছে, সে একবার এগুচ্ছে আর পরক্ষণেই পেছুচ্ছে।

মা, মাগো, তারপরই একটানা কান্নার সুর। আস্তে আস্তে আমার সাহস ফিরে এল। যে-ই কাঁদুক না কেন, আমার স্পষ্ট মনে হল, যেন এক হতভাগ্য প্রাণী কোনো বন্ধ দরজার সামনে বার বার এগিয়ে ফিরে আসছে। যেন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইছে, কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় গুমরে মরছে। একবার আমার মনে হল, দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনলাম, তারপরই মা, মাগো।

যে খোলা জায়গায় আমি লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানেই একবার আমার সামনে, একবার আমার পেছনে, অসুখী এক প্রাণী ছটফট করছে, যেন ঘরে ঢুকতে চাইছে। কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় ঢুকতে না পেরে আকুল হয়ে কাঁদছে। ওই খোলা দরজাটার সামনেই সব ঘটছে, যেটা এখন আর দরজা নেই, না যায় খোলা, না যায় বন্ধ করা।

বাহাদুর তখনও মাটিতে পড়ে আছে, দু-চোখ বিস্ফারিত। আমি ওকে লক্ষ করে বললাম, তুমি শুনতে পাচ্ছ বাহাদুর, কী বলছে?

বাহাদুর কথা বলার জন্য ঠোঁট নাড়ল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরিয়ে এল না। তারপরই ও হাতটা তুলে এমন ভঙ্গি করল, যেন আমাকে কথা বলতে নিষেধ করছে। কতক্ষণ যে আমরা ওইভাবে ছিলাম তা বলতে পারব না।

সেই শব্দটা ছটফট করে এগুচ্ছে, পেছুচ্ছে, আবার কখনো যেন ক্ষীণ হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ছে।

মা, মাগো, দরজা খোলো, ও মা, ভেতরে ঢুকতে দাও। কথাগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কী করুণ কণ্ঠস্বর! গৌতম যে বিচলিত হয়েছে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আমার ওপর গৌতমের অগাধ বিশ্বাসের কথা আমার মনে পড়ল। আমাকে একটা বিহিত করতেই হবে। উত্তেজনায় আমার মন ভরে উঠল, ভয় আস্তে আস্তে কেটে এল। ক্রমে কথাগুলি স্তব্ধ হল, শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।

ভগবানের দোহাই, কে তুমি? আমি বলে উঠলাম। ভগবানের নাম আপনা থেকেই যেন আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

যদি কোনো উত্তর পাই? সেকথা ভেবে আবার একটা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করতে চাইল। কার কাছ থেকে আমি জবাব চাইছি? অশরীরী এক আত্মার কাছ থেকে! আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। কিন্তু কোনো জবাব এল না, শুধু চাপা কান্নার শব্দ। তারপর ঠিক যেন ছোটো ছেলের আকুল কণ্ঠে পরিষ্কার শুনতে পেলাম, মা, মাগো দরজা খোলো! ও মা, মাগো, আমায় ঢুকতে দাও। অসহ্য এক কাকুতি ওই কাতরোক্তির মধ্য দিয়ে ঝরে পড়ছে।

বাহাদুর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে ওর জ্ঞান ফিরিয়ে আমরা যখন ফিরে চললাম, তখন চারদিক নিস্তব্ধ, কান্নার শব্দটা থেমে গেছে।

ডা মজুমদার আমাকে বললেন, আপনাদের বাহাদুর কী সব কান্নার শব্দ বলছে? আপনিও নাকি শুনেছেন? লোকটা পাগলের মতো যা তা বকছে, ব্যাপারটা কী?

আমি তাঁকে সব খুলে বললাম। তিনি বললেন, আপনার ছেলেও তো বিকারের ঘোরে একই কথা বলছিল। এ সবই আপনাদের মনের ভুল। বাতাসে কতরকম শব্দ সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে রাত্রে।

বেশ, আপনি আজ রাত্রে আমার সঙ্গী হন, তারপর আপনার মতামত দেবেন।

ডা মজুমদার রাজি হলেন। রাত এগারোটার সময় আমার বাড়ির সামনে গেটের কাছে তিনি অপেক্ষা করবেন। যতটা সম্ভব চুপি চুপিই আমরা যাব।

গৌতমের সামান্য উন্নতি হয়েছিল। আমাকে একা পেয়ে ও ব্যগ্রভাবে বলল, বাবা?

হ্যাঁ গৌতম, আমি জবাব দিলাম, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, আমি যা করবার করছি।

গৌতম পরম নিশ্চিন্ততায় একটু হাসল।

রাত এগারোটায় ডা মজুমদার এলেন। আগের রাত্রের মতো লন্ঠন হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

আমরা সেই ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি পৌঁছুতেই একটা চাপাকান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ যেন ডুকরে কেঁদে উঠে তারপরই কান্নায় ভেঙে পড়ল।

ওটার কথাই বোধ হয় আপনি বলছিলেন? ডাক্তার মজুমদার বললেন, আমিও অমন কিছুই ভেবেছিলাম। কোনো বনবেড়াল বোধ হয় ঝোপে আটকে গিয়ে চেঁচাচ্ছে।

আমি কোনো জবাব দিলাম না। আজ আর আমার ভয় করছিল না। এর পরেই যা ঘটবে তা আমি জানি। গত রাতে আমি আর বাহাদুর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে উপস্থিত হলাম। চারদিক নিস্তব্ধ, শীতের রাতে যে গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করে তাই, আমরা দু-জন নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু আজ আর কোনো শব্দই হচ্ছে না। ডা মজুমদার একসময় হেসে বললেন, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন?

অস্বীকার করব না, আমি হতাশই হলাম। নিজেকে যেন বোকা মনে হতে লাগল। ডা মজুমদারের কাছে আমাকে চিরকালের মতো হাস্যাস্পদ হয়ে থাকতে হবে!

আজ যেন ঠিক, আমি কথা শেষ করতে পারলাম না।

অবিশ্বাসী লোকের উপস্থিতিতে আত্মা আসে না, তাই না? ডা মজুমদার উপহাস ভরে হেসে উঠলেন।

তাঁর হাসির রেশটুকু মিলিয়ে যেতে-না-যেতেই খানিক আগে যে চাপাকান্নার শব্দ শুনেছিলাম, সেটা আবার জেগে উঠল। বেশ একটু দূর থেকেই ওটা আরম্ভ হয়ে যেন কাঁদতে কাঁদতে এদিকেই আসছে। ওটা যে কোনো বনবেড়াল বা জন্তুর আর্তনাদ নয়, সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই নেই। বেশ আস্তে আস্তেই শব্দটা এগিয়ে আসছিল। যেন ওটা একটু থেমে, একটু ইতস্তত করে, তারপর এগিয়ে আসছে। ঘাসের ওপর দিয়ে ওটা সোজা সেই দরজার দিকে আসছে।

ডা মজুমদার এবার কান্না শুরু হতেই একটু চমকে উঠেছিল। তিনি বলেই ফেললেন, বাচ্চাটা এত রাতে এখানে কেন? কিন্তু তিনিও আমার মতোই অনুভব করলেন যে, ওটা জীবন্ত বাচ্চার গলা নয়। ওঠা যেই এগিয়ে আসতে লাগল, তিনি চুপ হয়ে গেলেন। শব্দটা দরজার কাছে থামতেই তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি ওই জায়গায় লন্ঠনের আলো ফেললাম। প্রথম যখন ওটা শুরু হয়েছিল, আমি শরীরের ভেতর বরফ গলার মতো একটা হিম শিহরন অনুভব করেছিলাম, কিন্তু ওটা যতই এগিয়ে আসছিল, আমি একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম, কিন্তু ভয় নয়। ডা মজুমদার আর আমাকে ব্যঙ্গ করতে পারবেন না। লন্ঠনের আলো তাঁর মুখেও পড়েছিল। সেই আলোয় আমি লক্ষ করলাম, তিনি যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন, ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

পরক্ষণেই গতরাত্রের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল। প্রত্যেকটি ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ, কান্নার শব্দ যেন আমার চেনা। আমি ডাক্তারের দিকে তাকিয়েছিলাম। স্বীকার করছি, তাঁর মুখে কোনো ভয়ের চিহ্ন আমি দেখতে পেলাম না।

শব্দটার নড়াচড়া সবই ওই খোলা দরজার সামনেই হচ্ছিল। কালকের মতো আজও মনে হতে লাগল, যেন ওটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চায়, কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়ে হতাশায় ভেঙে পড়ছে। লন্ঠনের আলো বাইরে পড়েছিল। ডাক্তার মজুমদারের হাতের জোরালো টর্চের আলো শব্দ লক্ষ করে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছোটো কোনো প্রাণীও যদি ছুটে যেত, আমাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারত না। কিন্তু আমাদের চোখে কিছুই পড়ল না।

খানিক বাদে ডা মজুমদার সন্তর্পণে দরজা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে শব্দটা খাদে নেমে এল, তারপর যেন দরজায় আছড়ে পড়ল।

ডা মজুমদার ভীষণ চমকে দু-পা পেছিয়ে এলেন, তারপর মাটির ওপর টর্চের আলো ফেললেন।

কাউকে দেখতে পাচ্ছেন? আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় যে ভয়কে আমি জয় করেছিলাম তা আবার ফিরে এল। একটা ঝোপ, তিনি ইতস্তত করে বললেন।

সঙ্গেসঙ্গে আমি তাঁর ভুল বুঝতে পারলাম। ঝোপটা দরজার অন্যপাশে। তিনি বাইরে ঘুরে ঘুরে চারদিকে আলো ফেলতে লাগলেন, তারপর আমি ভেতরে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে ফিরে এলেন। তাঁর গলা থেকে উপহাসের সুর আর বেরিয়ে আসছিল না, মুখও পাংশু বর্ণ হয়ে গেছে।

কতক্ষণ এটা হয়? তিনি ফিসফিস করে প্রশ্ন করলেন, যেন ওটাকে বাধা দিতে চান না।

আমি কোনো জবাব দেবার আগেই ওটা আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে গেল, কান্নাটা কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।

আমরা নিঃশব্দে বাড়ির পথ ধরলাম। গেটের কাছে এসে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী বুঝলেন?

ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, এত সহজে হাল ছাড়ছি না। কোনো দুষ্টু লোক আমাদের ভয় দেখাবার জন্য সমস্ত ব্যাপারটা সাজিয়েছে কি না তা দেখতে হবে। ডা মজুমদার ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না।

আমার আসল সমস্যা সমাধানের কিছুই কিন্তু হল না। এই অশরীরীকে সাহায্য করতে হবে, তাকে করুণ বিলাপ থেকে মুক্তি দেব বলে আমি গৌতমের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। ওকে সাহায্য করতে না পারলে আমার ছেলেকে আমি বাঁচাতে পারব না। ওটা ছেলের কান্না, অথবা মেয়ের কান্না তাও আমি জানি না। কিন্তু একটা আত্মা যে অসহ্য ব্যথায় গোঙাচ্ছে, সে-বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। ওকে মুক্তি দিতে হবে। আর কোনো বাবাকে তার একমাত্র পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য এমন সাংঘাতিক অবস্থায় পড়তে হয়েছিল কি না, আমার জানা নেই।

সকালে চা খেয়ে ডা মজুমদার বেরিয়ে গেলেন, ফিরলেন ঘণ্টাখানেক বাদে। তাঁর চোখে-মুখে ক্লান্তির সঙ্গে একটা স্তম্ভিত ভাব আমাকে বিস্মিত করল।

গৌতম আর বাহাদুরকে পরীক্ষা করে তিনি বিদায় নিলেন। আমি কিছুটা পথ তাকে এগিয়ে দিলাম। গৌতমকে কেমন দেখলেন জিজ্ঞেস করায় তিনি জবাব দিলেন, অনেকটা ভালো। ওর সামনে গতরাত্রের ঘটনা আমি যেন আলোচনা না করি, সে-বিষয়ে আমাকে তিনি সাবধান করে দিলেন। বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হল, গৌতম আমার কাছে কী আশা করে আর আমিই-বা তাকে কী কথা দিয়েছি।

ডা মজুমদার যেন চমকিত হলেন। বললেন, আপনাকে এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হতাম।

তারপরই তিনি বললেন, আচ্ছা কাল রাত্রে দরজার ডান দিকে সেই ঝোপটা লক্ষ করেছিলেন? সবুজ পাতাভরা ঝোপ?

ডান দিকে নয়, বাঁ-দিকে। কাল রাত্রেও আপনি ওই একই ভুল করেছিলেন।

ভুল! ডা মজুমদার অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন। আমি সকালে আবার ওখানে গিয়েছিলাম। দরজার বাঁ-পাশে কি ডান পাশে কোথাও ঝোপ নেই, দিনের আলোয় গিয়ে দেখে আসুন।

আমি সত্যিই অবাক হলাম।

আজ রাতেও আমি আসব, কথাটা বলে তিনি চলে গেলেন।

খোলা হাওয়ায়, ঠান্ডা মাথায় আমার কী করণীয় তাই আমি ভাবছিলাম। হঠাৎ আমার মনে পড়ল ফাদার ভিনসেন্টের কথা। ওই ভেঙে পড়া বাড়িটা, যা শোনা যায় একসময় এক সাহেবের সম্পত্তি ছিল। ফাদার ভিনসেন্ট এখানকার অনেকদিনের বাসিন্দা। তিনি নিশ্চয়ই ওই সাহেব সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলতে পারবেন, হয়তো ওই বাড়িতে তাঁর যাতায়াতও ছিল।

আমি মুহূর্ত দ্বিধা না করে হাঁটা দিলাম।

ফাদার ভিনসেন্ট আমাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। আমার ছেলের অসুখের কথা শুনে তিনি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি অকপটে তাঁর কাছে সব খুলে বললাম। তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, তারপর বললেন, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম কর্নেল সেন। তুমি সেই হতভাগ্য আত্মাকে সান্ত্বনা দাও এটাই তোমার ছেলে চায়। ভগবান তোমার ছেলের মঙ্গল করুন। চমৎকার ছেলে। বাবার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস, কী পবিত্র, সুন্দর।

তিনি কিন্তু আমাকে কী করণীয় তা কিছু বললেন না, শুধু বললেন, আমিও আজ রাত্রে আপনার সঙ্গী হব।

আমি আবার বাড়ির পথ ধরলাম। শীতের সকালে মিঠে রোদ, বড়ো বড়ো গাছ, খোলা হাওয়া সব কিছু মিলিয়ে রাত্রের সেই ভয়াবহতাকে যেন ব্যঙ্গ করছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই ভগ্নস্তূপের কাছে এসে দাঁড়ালাম। সূর্যের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে ওটার ওপর পড়ছে। রোদ সেই দরজা দিয়ে বাইরে পড়েছে, যেমন আমাদের লন্ঠনের বেলায় হয়েছিল। খোলা দরজাটা আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওই দরজা দিয়ে যেখানে খুশি যাওয়া যায়। কোনো প্রাণী, সে যদি অশরীরীও হয়, ওটার ভেতরে ঢুকতে না পেরে কেঁদে কেঁদে হন্যে হয়ে যাচ্ছে কেন?

হঠাৎ ডা মজুমদারের কথা আমার মনে পড়ল, সেইসঙ্গে ঝোপের কথা। সত্যিই তো দরজাটার ডাইনে কিংবা বাঁয়ে কোনো ঝোপ নেই। আমার লন্ঠনের আলো সেই ঘন ঝোপের ওপর পড়ে সবুজ পাতাগুলো চিক চিক করে উঠেছিল, সেটা কোথায় গেল? আশেপাশে অবশ্য কাঁটাঝোপের অভাব নেই, কিন্তু চিরসবুজ যে ঝোপটা রাত্রে দেখেছিলাম তা যেন জাদুমন্ত্রে অদৃশ্য হয়েছে।

দরজার সামনে অনেক পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। ছাপগুলি এলোমেলো, কিছু দরজার দিকে এগিয়ে গেছে আবার কিছু ফিরে এসেছে। ওগুলো হয়তো আমাদেরই পায়ের ছাপ। চারদিকে একটা শান্ত সমাহিত ভাব। রাত্রে ওই জায়গাটাই যে জেগে ওঠে, অন্য রূপ নিয়ে শরীরের রক্ত জল করে দেয়, তা দিনের প্রসন্ন আলোয় কল্পনাও করা যায় না।

আমার আচরণে, আমার চেহারায়, মিলি শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। আমি তার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। ও বেচারি অবশ্য তখন গৌতমকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সারারাত ওর ঘরেই থাকে। তাই আমাকে জেরা করার মতো মনের অবস্থাও ওর ছিল না।

আমি বাড়িতে ঢুকতেই ডালিয়া বলল, বাবা, গৌতম তোমাকে ডাকছে।

গৌতম আজ বেশ ভালো আছে, রাত্রেও নাকি ভালো ঘুম হয়েছিল।

আমি গৌতমের কাছে গেলাম। ও আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাল।

বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না? গৌতম জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমাকে বলতে হল।

আমি কী করতে পারি? কিন্তু যদি কিছু করা সম্ভব না হয় তবে গৌতমের ওপর তার প্রতিক্রিয়া হবে নিদারুণ, সে-বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

সেদিন রাত দশটার সময় ডা মজুমদার এলেন। আমি তাকে ফাদার ভিনসেন্টের আসার কথা বললাম। আমরা দু-জনে পথ ধরে একটু এগিয়ে গেলাম। তিনি নির্দিষ্ট সময়েই এসে পড়লেন। এই বৃদ্ধ বয়সেও শীতের রাতে সুতির আলখাল্লার মতো ধর্মীয় পোশাক ছাড়া আর কিছুই তিনি গায়ে দেননি। তিনিও একটা জোরালো টর্চ এনেছিলেন। আমার লন্ঠন আর দুটো টর্চ, আজ আলোর অভাব হবে না। তা ছাড়া আমরা তিনজন সাহসী পুরুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই ঘটনাস্থলেই চলেছি, একটা কিছু উপায় কি আমাদের মাথায় আসবে না?

ভেঙে-পড়া বাড়িটার সামনে এসে আমরা কে কোথায় দাঁড়াব ঠিক করলাম। ফাদার ভিনসেন্ট দাঁড়ালেন ভেতরে, অবশ্য ওটাকে যদি ভেতর বলা যায়। ডা মজুমদার আর আমি দরজার দু-পাশে, একটু তফাতে পাহারা দিতে লাগলাম। মাঝে মাঝে টর্চ ও লন্ঠনের আলোয় জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠছিল।

তারপরই সেই চাপাকান্না শুরু হল। প্রথম ফুঁপিয়ে, তারপর গঙিয়ে, যখন চরমে উঠল, তখন আবার শুনলাম, সেই পাষাণ গলে যাওয়ার মতো কাতরোক্তি, মা, মাগো, দরজা খোলো! ওমা ভেতরে ঢুকতে দাও।

আমার মনে হল, শব্দটা যখন দরজার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল তখন কেউ যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তিনজনের হাতের আলোয় বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একমাত্র শব্দের মালিককে ছাড়া। আমার মন করুণা ও দুর্ভাবনায় ভরে উঠল। করুণা সেই হতভাগ্যের জন্য, যে অপরিসীম দুঃখে, বেদনায় কেঁদে মরছে আর দুর্ভাবনা আমার ছেলের জন্য। আমি যদি ওই নিপীড়িত আত্মাকে সাহায্য করতে না পারি, তবে তার নিদারুণ পরিণাম আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। গৌতমের মনে যে বিশ্বাস শেকড় গেঁথে বসেছে তা আমরা যদি এখানকার বাস উঠিয়ে চলেও যাই, তবু যাবে না। ফলে দুর্বল শরীর মানসিক অসুস্থতা ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে নিয়ে যাবে। ওকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় এই দুঃখী আত্মার মুক্তি বা চিরশান্তি।

কান্নার প্রথম দমক পর্যন্ত আমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফাদার ভিনসেন্টের অবশ্য এটা প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনিও ভেতরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার কিন্তু আজ এতটুকু ভয় করছিল না, এই তিন রাতে কান্নার শব্দটা আমার সয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু সেই মুহূর্তে কান্নাটা দরজার গোড়ায় মাটিতে আছড়ে পড়ল (যেন যে কাঁদছে সে মাটিতে আছড়ে পড়ে দরজার কপাটে মাথা ঠুকছে), ঠিক তখুনি এমন একটা কাণ্ড ঘটল, যার ফলে আমার হৃৎপিণ্ড সজোরে লাফিয়ে উঠল। ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, গম্ভীর অথচ বিষাদে ভরা কণ্ঠস্বর।

যোসেফ, যোসেফ, তুমি এসেছ?

একটু থেমে থেমে কথাগুলি উচ্চারিত হল।

পরমুহূর্তে আমি বুঝলাম, কণ্ঠস্বর ফাদার ভিনসেন্টের।

ফাদারের কথা শেষ হবার সঙ্গেসঙ্গেই কান্নাটা হঠাৎ থেমে গিয়েছিল। প্রথমেই যে চিন্তা আমার মনে এল, তা হল বুড়ো মানুষটাকে এই বিপদের মধ্যে এনে ঘোরতর অবিবেচকের কাজ করেছি। ভয় পেয়ে উনি হয়তো পাগল হয়ে গেছেন। আমি অনেকটা ছুটেই দেয়ালের অপর পাশে, যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালাম। লন্ঠনটা তাঁর মুখে তুলে ধরলাম। ফাদারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, দু-চোখ জলে ভরে উঠেছে, ঠোঁট নড়ছে। তিনি কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। যেন আমাদের দেখতেই পান নি। হঠাৎ তিনি দু-হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তারপর আবার বললেন, যোসেফ, যদি তুমিই এসে থাক, তবে শোনো, কেন তুমি এদের ভয় দেখাচ্ছ? এরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি! তুমি আমার কাছে এলে না কেন?

তিনি থামলেন, যেন জবাবের অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হলেও তাঁর মুখ, শরীরের প্রতিটি অংশ যেন সবাক হয়ে উঠল। ডা মজুমদারও আমার মতো উৎকণ্ঠা নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে নিঃশব্দে সেই খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

ফাদার ভিনসেন্ট কিন্তু লক্ষ করলেন না। তাঁর কণ্ঠস্বরে এবার যেন তিরস্কার ঝরে পড়ল, তোমার কী এমনভাবে এখানে আসা উচিত? তোমার মা তোমার নাম করতে করতেই চলে গেছে। তুমি কী ভেবেছ নিজের ছেলেকে ঢুকতে না দেবার জন্য সে দরজা বন্ধ করে রেখেছিল? তা কী কোনো মা পারে? আমি তোমাকে নিষেধ করছি যোসেফ, আমি তোমাকে নিষেধ করছি।

ফোঁপানো কান্নাটা হঠাৎ জোরে কেঁদে উঠল।

ফাদার দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর অনেকটা আদেশের সুরে বলে উঠলেন, না, না, আমি তোমায় নিষেধ করছি। এই পৃথিবীতে এমন করে কেঁদে নিজের আত্মাকে কষ্ট দিয়ো না যোসেফ। তোমার যেখানে এখন থাকা উচিত, সেখানে চলে যাও। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? আমিই তোমার নামকরণ করেছিলাম, তোমাকে কত কোলে করেছি, আদর করেছি, আমি ফাদার ভিনসেন্ট।

ফাদারের কণ্ঠস্বর নরম হয়ে আসে!

তারপর আবার তিনি আবেদনের কণ্ঠে বললেন, তোমার মা, হতভাগিনী মা, তোমার অপেক্ষা করে বসে আছে আর তুমি এখানে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ! তোমার মা এখানে নেই যোসেফ। ভগবানের কাছে তাকে তুমি পাবে। সেখানে গিয়ে তার খোঁজ করো, এখানে নয়। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? যাও, সেখানে চলে যাও। বড্ড দেরি করে ফেলেছ, তবু সে তোমাকে স্বর্গের দরজা খুলে দেবে। যদি কাঁদতেই হয়, তবে স্বর্গের সেই দরজায় গিয়ে কাঁদো, এখানে এই ভাঙা দোরগোড়ায় নয়। যাও, যাও, আর দেরি কোরো না, চলে যাও।

ফাদার ভিনসেন্ট একনাগাড়ে অতগুলি কথা বলার পর দম নেবার জন্য থামলেন। সেই কান্নার শব্দটাও থামল, আগের দু-রাতের মতো কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবার মতো নয়, যেন সেই অশরীরী অদম্য প্রচেষ্টায় উদগত কান্নার দমককে চাপবার চেষ্টা করছে।

ফাদার ভিনসেন্ট আবার বললেন, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ যোসেফ? যাও, ঈশ্বরের সন্তান ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাও। পরম পিতা নিশ্চয়ই তোমাকে গ্রহণ করবেন। তোমার মা তাঁর আশ্রয়েই ঠাঁই পেয়েছে।

তারপরই তিনি প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। তাঁর মুখ ওপরে আকাশের দিকে, দু-হাত তুলে ধরেছেন।

হে ঈশ্বর, ফাদার প্রার্থনার সুরে বলতে লাগলেন, হে পরম পিতা, ওকে তুমি তোমার চির শান্তির রাজ্যে আশ্রয় দাও। যে মায়ের জন্য ও কাঁদছে, সে তোমার আশ্রয়েই আছে। তোমার স্বর্গের দরজা তুমি ছাড়া আর কেউ খুলে দিতে পারবে না প্রভু, দুঃখিনী মা তার দুঃখী সন্তানকে কোলে টেনে নিক।

আমার স্পষ্ট মনে হল যেন কিছু একটা দরজা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আর কিছু বোঝবার আগেই মানুষের সহজাত অনুভূতিতে আমি ওটার পতন রোধ করার জন্য দু-হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল, কারণ শূন্যেই আমার হাত দুটো দুলে উঠল আর আমি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম।

ডা মজুমদার আমাকে তুলে ধরলেন। তারপর অদ্ভুত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ওটা চলে গেছে, ওটা চলে গেছে।

আমি সে-দৃশ্য কোনোদিন ভুলব না। চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে ফাদার ভিনসেন্টের শুভ্র, সৌম্য প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে থাকার অপূর্ব মূর্তি, যেন শুভ্রতার প্রতীক। তিনি বার বার ঈশ্বরের নাম করতে লাগলেন, আমরা যে সেখানে আছি, তা যেন তাঁর খেয়ালই নেই।

তারপর এক সময় তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ডান হাত দিয়ে বুকে ক্রিশ্চানদের প্রথায় ক্রস চিহ্ন এঁকে তিনি বললেন, আমেন।

আমরা যখন ফিরে চললাম, তখন রাতের শেষ প্রহর। ফাদার ভিনসেন্ট আমার একটা হাত আঁকড়ে ধরে আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন। ক্লান্তিতে তিনি যেন ভেঙে পড়েছেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা যেন মৃত্যুশয্যা থেকে উঠে এসেছি। চারদিকে একটা শান্ত, সমাহিত ভাব, বাতাসে যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস। মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রামের পর বিজয়ীর মতো স্বস্তির নিশ্বাস।

ফাদার ভিনসেন্টই প্রথম নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন, আমি আর আপনার বাড়ি বিশ্রাম করব না কর্নেল সেন, ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে যেতে চাই।

বেশ, আমি বললাম, কিন্তু একা আপনাকে ছেড়ে দেব না, আমিও আপনার সঙ্গে যাব।

ধন্যবাদ, আমি খুশি হব, তিনি বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, বড়ো ক্লান্ত বোধ করছি, আপনার সাহায্য পেলে হাঁটতে সুবিধে হবে।

ডা মজুমদার ফাদার ভিনসেন্টের অপরপাশে হাঁটছিলেন। তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, আপনাদের ধর্মে কি প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা আছে ফাদার?

ফাদার ভিনসেন্ট সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিলে না। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, সেটা বিতর্কের বিষয় আর আমার এই দীর্ঘ জীবনে এমন অনেক কিছু আমি দেখেছি বা শুনেছি যা তর্কের বাইরে। তবে ভগবানের অসীম করুণায় আমি বিশ্বাস করি।

তাঁর আশ্রমে পৌঁছুবার পর তিনি আমাদের তাঁর ঘরে আহ্বান জানালেন। সেখানেই তাঁর মুখে আসল ব্যাপারটা জানতে পারলাম।

ফাদার ভিনসেন্ট যখন এখানে প্রথম আসেন, তখন ওই ভগ্নস্তূপটা ছিল টমসন নামে এক সাহেবের বাংলো। তিনি এক বিলিতি সওদাগরি অফিসের ম্যানেজার ছিলেন। সাহেব তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ওই বাংলোয় বাস করতেন। তাঁদের কোনো ছেলেপুলে ছিল না। বাড়ির কাজকর্মের জন্য তাঁরা এদেশীয় এক ক্রিশ্চান দম্পতিকে রেখেছিলেন। ওদের একটি ছেলে হয়, তার নাম ছিল যোসেফ। ছেলের বয়স যখন তিন বছর, তখন ওর বাবা মারা যায়। যোসেফের নামকরণ ফাদার ভিনসেন্টই করেছিলেন।

যোসেফ যতই বড়ো হতে থাকে তার মধ্যে একটা পাগলামি দেখা দেয়। কাউকে কিছু না বলে সে মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেত, ফিরত বেশ কিছুদিন পর। ওর বয়স তেরো কি চোদ্দো, তখন টমসন দম্পতি কয়েক মাসের ছুটিতে বিলাতে যান। যোশেফের মাকে তাঁরা বাড়ি দেখাশোনার জন্য রেখে গিয়েছিলেন। ওঁরা চলে যাবার কয়েক দিন পরেই যোসেফ উধাও হয়। এদিকে হঠাৎ সামান্য ক-দিনের অসুখে যোসেফের মা মারা যায়। যোসেফ দিন কয়েক পর ফিরল। সেটা ছিল পৌষ মাসের গোড়ার দিক। বাড়ি ফিরে তার মাকে দরজা খুলে দেবার জন্য বার বার ডাকাডাকি করেও যখন দরজা খোলা পেল না, তখন ও ক্লান্ত হয়ে দরজার গোড়ায় কেঁদে লুটিয়ে পড়ে। ও ভেবেছিল ওর মা রাগ করে দরজা খুলছে না। অভিমানী ছেলে সারারাত ওই কনকনে ঠান্ডায় পড়ে রইল, কেউ জানতেও পারল না। ফলে যা ঘটবার তাই ঘটল। সকাল যখন হল, তখন ও জ্বরে বেহুঁশ, দুটো লাংসই আক্রান্ত। অনেক চেষ্টা করেও ওকে বাঁচানো যায়নি। মা, দরজা খোলো ভেতরে ঢুকতে দাও, এই প্রলাপ বকতে বকতে ও শেষনিশ্বাস ছেড়েছিল।

এদিকে টমসন দম্পতিও বিলাতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। তারপর থেকেই বাড়িটা পরিত্যক্ত। কেন জানি না কেউ ও বাড়িতে আর থাকেনি কিংবা থাকতে চায়নি। ফলে বাড়িটা ধসে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।

দু-একবার কানাঘুসোয় ফাদার ভিনসেন্ট ওখানে অশরীরীর কান্নার কথা শুনেছিলেন, কিন্তু তেমন গা করেননি, আসলে বিশ্বাস করেননি।

বাড়ির আগের মালিকরা ঘটনা চেপে রাখায় এবং জায়গাটা লোকালয়ের বাইরে হওয়ায় ওটা তেমন চাউর হয়নি তা আগেই বলা হয়েছে।

আমি যখন ওখান থেকে বাড়ি ফিরলাম, তখন সূর্য উঠে গেছে। মিলি বলল, গৌতমের অবস্থা অনেকটা ভালো। কাল মাঝরাত্রে ও নাকি হঠাৎ জেগে উঠে একটু ছটফট করেছিল। তারপর ওর মুখে একটা যেন নিশ্চিন্ততার ভাব ফুটে ওঠে। আমি ওর ঘরে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই ওর দু-গালে আবার লাল ছোপ পড়েছে।

ও হঠাৎ চোখ খুলল। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, অর্থপূর্ণ হাসি। যেন ও বুঝতে পেরেছে সব ঠিক হয়ে গেছে, আমার কিছু বলার দরকার নেই।

এই ঘটনার পর ওই কান্নার শব্দ আর কেউ কোনোদিন শোনেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *