সাহেবকুঠি

সাহেবকুঠি

বাড়িটাকে বলা হয় সাহেবকুঠি। একসময় নীলকর সাহেবরা থাকতেন এই কুঠিবাড়িতে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঘর আর দোতলার সমান উঁচু। প্রত্যেক ঘরে ফায়ারপ্লেস বা আগুন চুল্লি। কনকনে ঠান্ডায় গনগনে আগুনে সাহেবরা আরাম করতেন ওই চুল্লির সামনে। তবে দীর্ঘকাল ওগুলো পরিত্যক্ত, অব্যবহৃত অবস্থায় আছে।

এখানে একটা থার্মাল প্ল্যান্ট তৈরি হবে। সরকার থেকে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, মাটি কাটাও শুরু হয়েছে। লোহালক্কড়, ইট, বালি, সিমেন্ট এসব আসছে তো আসছেই। একটা টিনের ছাউনির গুদামই তৈরি করা হয়েছে এসবের জন্য— মস্ত বড়ো। দিনের বেলা কুলিকামিনদের কলরোলে সরগরম হয়ে ওঠে জায়গাটা কিন্তু সন্ধের পর থেকে নিঝুম। কুলিকামিনরা আশপাশের গাঁ থেকে সকালে আসে আবার সন্ধের মুখে ঘরে ফিরে যায়।

জনাকয়েক পাহারাদার আছে, তারা টিনের চালার অস্থায়ী ঘর বানিয়ে নিয়েছে। সন্ধের পর তারা রসুই পাকায় আর দেহাতি গান ধরে। কুঠিটা আরেকটু দূরে, তাই এমন নিঝুম।

রজত কেন্দ্রীয় সরকারের এক তাপবিদ্যুৎ সংস্থার তরুণ ইঞ্জিনিয়ার। ওই সংস্থার ওপরেই ভার পড়েছে এই থার্মাল প্ল্যান্ট বানাবার। আসল কাজ শুরু হতে দেরি আছে তাই প্রাথমিক তদারকির জন্য ওকে পাঠানো হয়েছে। ধু-ধু প্রান্তরের মধ্যে এই কুঠিটাই একমাত্র দালানবাড়ি, এখানেই আপিস হবে, বড়ো সায়েবরা এসে থাকবেন। এসব ব্যবস্থা করার জন্যই এসেছে রজত, সেইসঙ্গে ওকে সাইটেও থাকতে হচ্ছে সারাদিন, সেখানকার কাজকর্মও দেখতে হচ্ছে। এত বড়ো বাড়িতে একা ওর গা ছমছম করে। রজত কলকাতার ছেলে, অত দালানকোঠা, বিজলি বাতি, বাস-ট্রাম আর জনারণ্যে ভূতের চিন্তা কখনো মাথায় আসেনি, কিন্তু এখানে এই নিঝুম পুরীতে সেটাই যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়।

পাশের গাঁ থেকে একজনকে ও নিজের কাছে এনে রেখেছে। দু-বেলা রান্না করে দেয়, রাত্রে থাকে। তাই রক্ষে। লোকটির নাম হাসান আলি, বয়স বেশি নয়। তবে লোকটা কিন্তু রাঁধে ভালো, বিশেষ করে কষা মাংস দারুণ রাঁধে— পরোটা আর মাংস শীতের রাতে দারুণ জমে।

হাসানের মুখেই রজত শুনেছে, অনেক আগে এখানেই ওদের জমি-বাড়ি ছিল। নীলকর সাহেবরা নীল চাষের জন্য এখানকার জমি অন্যায়ভাবে দখল করেছিল। আরও অনেকের সঙ্গে পৈতৃক জমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল ওর নানাকে। এই জমি দখল নিয়ে নীলকর সাহেব আর তাদের লাঠিয়ালদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের কম লড়াই হয়নি। অনেক নিরীহ লোক মারা গিয়েছিল লেঠেলদের হাতে। তা নিয়ে কলকাতার একটা কাগজে নাকি খুব লেখালেখি হয়েছিল। হাসান ওর বাবার মুখে শুনেছে একজন সাহেব পাদরি নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখানে এসে কথা বলেছিলেন। রজতের পড়াশোনার ঝোঁক ছোটোবেলা থেকেই। ও বুঝেছিল হাসান হরিশ মুখুজ্যের হিন্দু পেট্রিয়ট আর পাদরি লং সাহেবের কথা বলছে।

মাসখানেক কেটে গেল। কয়েকদিন পরেই শুরু হবে রমজান। হাসানকেও রোজা করতে হবে। ও অবিশ্যি রজতকে আশ্বস্ত করে বলল ওর খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থা ও-ই করে দেবে, কোনো চিন্তা নেই।

আরও চার পাঁচদিন কেটে গেল। সেদিন রাত্তিরে রজত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক বইটা পড়ছিল। বইটা ও আগেও পড়েছে কিন্তু কখনো পুরোনো হয় না। রাত প্রায় দশটা, হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে আসা একটা কাতর ধ্বনি শুনে চমকে উঠল ও।

‘সাহেব… সাহেব!’

আর্তকণ্ঠে কেউ যেন ডাকছে।

কুঠিবাড়িটা যেমন বড়ো তেমন অনেকটা জমি নিয়ে। চারপাশে ইটের পাঁচিল। নীলকর সাহেবরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কুঠির চারপাশে উঁচু পাঁচিল আর মজবুত লোহার গেট বসিয়েছিল। সেই পাঁচিল এখন ভেঙে পড়েছে, লোহার গেট মরচে পড়ে ক্ষয়ে একটা কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কাতর শব্দটা আসছে গেটের বাইরে থেকে।

রজত প্রথমে ভাবল মনের ভুল। বইটা ও আবার খুলবে তখুনি ভেসে এল সেই কাতর ধ্বনি, ‘সাহেব… সাহেব।’

শীতের রাতে হৃৎপিণ্ড ভেদ করা অমন কাতর ধ্বনি, গায়ের রক্ত যেন হিম হয়ে যায়। প্রথম ধাক্কাটা সামলে রজত আশ্চর্য হয়ে ভাবল এত রাতে কে ডাকছে! কাকেই-বা ডাকছে! এখানে সাহেব কোথায়!

হাসান কাজকর্ম সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। গতকাল রাতের আকাশে রমজানের চাঁদ দেখা গেছে, আজ থেকে শুরু হয়েছে রোজা। সেই অন্ধকার থাকতে উঠে পান্তাভাত খেয়েছিল তারপর সারা দিন নির্জলা উপবাস। সূর্যাস্তে আজান শেষ হবার পর নিজের জন্য রান্না চাপিয়েছিল। একমাস চলবে এই কৃচ্ছ্রসাধন, তাই ওকে আর জাগাল না রজত। তিন ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে আলো ফেলে কাউকেও কিন্তু চোখে পড়ল না। শব্দটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা কী! রজত গেটের দিকে এগিয়ে গেল। না, গেটের বাইরে কেউ নেই। চারদিকে ও আলো ছড়াল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। চিন্তিত মুখে ও ঘরে ফিরে এল।

ঘরে এসে ঢুকেছে এমন সময় আবার সেই কাতর আর্তনাদ, ‘সাহেব… সাহেব।’

নাভিমূল থেকে যেন বেরিয়ে আসছে সেই কাতর ধ্বনি, বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল রজতের। এ কী মানুষের গলা!

‘সাহেব… সাহেব,’ পরের কথাগুলি এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল, ‘আমার জমি ফিইরে দাও… সাহেব আমার জমি ফিইরে দাও।’

গায়ের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে উঠল রজতের। এ কী অশরীরী কাণ্ড! কে জমি ফিরে চাইছে! কার জমি! কার কাছে চাইছে!

‘সাহেব… সাহেব,’ সেই কাতর ধ্বনিটা এখন আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে। সব কিছু হারিয়ে কেউ যেন হাহাকার করছে। রজত আর পারল না, দু-কানে হাত চাপা দিয়ে নিষ্পন্দের মতো বসে রইল। তারপর একসময় থেমে গেল সেই আর্তনাদ। রজত ঘড়ি দেখল, রাত বারোটা।

পরদিন সকালে হাসানকে ব্যাপারটা বলল ও। হাসান সব শুনে অবাক, ও অঘোরে ঘুমিয়েছে কিছু শোনেনি।

কাজের মধ্যে কেটে গেল দিন। রাত্রে খাওয়া সেরে আজও আরণ্যক বইটা নিয়ে বসেছে রজত। গতকালের মতো আজও ঘুমিয়ে পড়েছে হাসান। সারাদিন উপবাসের পর ও ক্লান্ত থাকে তার ওপর খাটাখাটুনি আছে। রাত্রে খাবার পর আর জেগে থাকতে পারে না, শোবার সঙ্গেসঙ্গেই ঘুম।

হঠাৎ চমকে উঠল রজত।

‘সাহেব… সাহেব,’ আবার সেই কাতর ধ্বনি যেন খান খান করে দিল রাতের নিস্তব্ধতা।

‘সাহেব… সাহেব… ফিইরে দাও… ফিইরে দাও আমার জমি…’

কথাগুলো আজ খুব স্পষ্ট। যেন এক বয়স্ক মানুষ কেঁদে কেঁদে কাতর প্রার্থনা করছে, ফিরে চাইছে তার জমি।

আজও রজত টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, কিন্তু গেটের বাইরে কাউকে দেখতে পেল না। ও যতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েছিল ততক্ষণ সেই বিলাপধ্বনি আর শোনা গেল না। রজত ঘরে ফিরে এল, আর সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল সেই কাতর আবেদন। এ বিলাপ যে মানুষের নয়, সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই ওর মনে। অতৃপ্ত এক অশরীরী আত্মার বিলাপ। ও এখানে এসেছে মাসখানেক, এতদিন এই বিলাপ শোনেনি, মাত্র গতকাল থেকে শুনতে পাচ্ছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ইতিহাস আছে। গতকাল থেকে রমজান শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে কী এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে!

পরদিন হাসানকে রজত ওর অভিজ্ঞতার কথা বলল। হাসান বলল, সেদিন রাতে ও রজতের সঙ্গে জাগবে।

অন্যান্য দিন রাত সাড়ে আটটার মধ্যে খাওয়ার পাট চুকে যায়, আজ একটু দেরি করেই খাওয়া সারল দু-জনে। হাসান এসে রজতের ঘরে একটা মাদুর বিছিয়ে বসল। ওর ঘন ঘন হাই উঠছিল অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছিল নিদ্রাদেবীকে।

ঠিক দশটার সময় শোনা গেল সেই কাতর বিলাপ। ‘সাহেব… সাহেব… আমার জমি ফিইরে দাও… আমার জমি ফিইরে দাও সাহেব।’

হাসানের দু-চোখ বিস্ফারিত, থর থর করে কাঁপছে শরীর। কাঁপা কাঁপা গলায় ও বলল, ‘বাবু এ মানুষ নয় শয়তান।’

রাত বারোটার পর আর শোনা গেল না সেই কণ্ঠস্বর।

পরদিন হাসান সকালে ছুটি নিয়ে ওর গ্রামে গেল, সন্ধের আগেই অবিশ্যি ফিরে এল।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ও রজতকে বলল, ‘বাবু, আমি বাড়ি গিয়েছিলাম কেন জানেন? আমার নানার বয়স নব্বুই, এখনও হেঁটে চলে বেড়ায়। আমি আপনাকে বলেছিলাম একসময় এখানে আমাদের জমিজমা ছিল, সাহেবরা নীল চাষের জন্য তা কেড়ে নিয়েছিল। নানা সেই সময় আরও অনেকের সঙ্গে সাহেবদের লেঠেলদের সঙ্গে লড়াই করেছিল। ওস্তাদ লেঠেল ছিল আমার নানা। শুনেছি এত জোরে লাঠি ঘোরাত যে একটা ঢিলও তার গায়ে লাগানো যেত না। বেশ কয়েকজন পাইক বরকন্দাজ ঘায়েল হয়েছিল নানার হাতে। সাহেবরা তাকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলাবার অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু নানা এমন জায়গায় লুকিয়েছিল কেউ তার হদিশ পায়নি।

‘নানাকে আমি এখানকার ঘটনা বললাম। আমার মনে হয়েছিল নানাই আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে, পুরোনো দিনের মানুষ তো। তা হ্যাঁ, আমি জবাব পেয়ে গেছি, বলি শুনুন।’

হাসান যা বলল তা হল, নীলকরদের অত্যাচারের আগে ওখানে একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। সবার পেশাই ছিল চাষবাস, কম বেশি সবারই জমি ছিল আর ছিল শান্তি। মুসলমানপ্রধান গ্রাম, সুখে দুঃখে একে অপরের পাশে দাঁড়াত।

রহমত আলি ছিল ওই গাঁয়েরই একজন। নিরীহ, ধর্মপ্রাণ মানুষ, কয়েক বিঘা জমির মালিক। বিবি আর কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ওর ছিল সুখের সংসার। ওর জমিতে যেন সোনা ফলত, লোকে বলত ওর হালে জাদু আছে। নীলকর সাহেবরা এসে ভালো ভালো জমিতে জোর করে দাদন ধরিয়ে দিল, বলল নীল ছাড়া অন্য কিছুর চাষ চলবে না ওসব জমিতে। রহমতের জমিও তার মধ্যে পড়েছিল। গাঁয়ের মানুষ এ অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে নালিশ জানাল কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না। তারা বলল, ‘জান দেব তবু নীল চাষ করব না।’ সাহেবরা অত্যাচার শুরু করল, জমিজমা মিথ্যে অজুহাতে কেড়ে নিতে শুরু করল। তাদের অত্যাচারে গাঁয়ের লোক পালিয়ে গেল, নীলকরদের বিরুদ্ধে শুরু হয়ে গেল লড়াই। সাহেবরা বলল, বিদ্রোহ।

রহমত ছিল শান্ত প্রকৃতির মানুষ। সে গ্রাম ছেড়েও পালাল না, বিদ্রোহেও যোগ দিল না। সে সাহেবদের কাছে ধরনা দিয়ে পড়ল, বলল তাঁদের হয়ে সব কাজ সে করে দেবে, এমনকী তার জন্য সে মজুরিও নেবে না, শুধু তার জমিটা যেন তাঁরা ফিরিয়ে দেন। খুব কাকুতিমিনতি করেছিল রহমত। নীলকর সাহেব ছিলেন দু-জন— বড়োসাহেব আর ছোটোসাহেব। বড়োসাহেব ওর কাকুতিমিনতিতে একটু নরম হয়েছিলেন কিন্তু ছোটো সাহেব ছিলেন মাতাল আর নিষ্ঠুর। তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। মত্ত অবস্থায় একদিন তিনি রহমতকে এমন লাথি মারলেন যে পড়ে গিয়ে তার কপাল কেটে রক্ত বেরিয়েছিল। ছোটোসাহেব সেই অবস্থায় পাইকদের দিয়ে তাকে কুঠি থেকে বার করে দিয়েছিলেন। আর্জি জানাবার জন্য ওখানেই গিয়েছিল রহমত।

তারপর থেকে প্রত্যেক রাত্রে রহমত আসত, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে ওর জমি ফেরত চাইত। এদিকে না খেতে পেয়ে ওর দুটো বাচ্চা মারা গেছে, বিবিও বিছানা নিয়েছে। রহমতের কিন্তু কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, নাছোড়বান্দার মতো সে রোজ রাত্রে এসে জমি ফেরত চাইত। সাহেবদের ঘুমের ব্যাঘাত হতে লাগল। ছোটোসাহেব একদিন রাত্রে বেরিয়ে ওকে খুব চাবুক পেটা করলেন। আধমরা হয়ে পড়ে রইল রহমত। পরদিন সকালে দেখা গেল সামনের একটা গাছের ডাল থেকে ওর লাশটা ঝুলছে। এই ঘটনা ঘটেছিল রমজানের চাঁদ যেদিন দেখা গিয়েছিল তার পরদিন রাত্রে। মনে হয় রাত দশটা নাগাদ ছোটোসাহেব ওকে চাবুক মেরেছিলেন আর রাত বারোটায় ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েছিল।

এরপর বেশ কিছুদিন সব শান্ত ছিল। আবার এল রমজান, আকাশে চাঁদ দেখা দিল, আর তার পরদিন রাত দশটায় কুঠিবাড়ির বাইরে শোনা গেল রহমতের আকুল কাকুতি, ‘সাহেব আমার জমি ফিইরে দাও।’ রমজানের গোটা মাস ঘটল এই ঘটনা। কুঠির পাইক বরকন্দাজদের অনেকেই ভয়ে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেল। ছোটোসাহেব নাকি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। রহমতের বিলাপ শুরু হলেই তিনি চাবুক নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আর শূন্যে আছড়াতেন, মুখ দিয়ে ছোটাতেন গালিগালাজের ফোয়ারা। তাঁকে বিলেতে এক পাগলাগারদে পাঠাতে হয়েছিল।

ওই ঘটনা কেমন করে যেন জানাজানি হয়ে গিয়েছিল, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ কাগজে ওই সাহেবদের বিরুদ্ধে খুব লেখালেখি হয়েছিল। পাদরি লং সাহেবও এ নিয়ে ছোটোলাট উইলিয়াম গ্রে-র কাছে দরবার করেছিলেন। বড়োসাহেব শেষ পর্যন্ত রহমতের বউকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে অনেক টাকা দিয়ে তবে পার পেয়েছিলেন। তবে তিনিও বেশিদিন এখানে টিকতে পারেননি। প্রত্যেক রমজানের সময় একটা মাস রহমতের আত্মার বিলাপে তিনি অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আরেকজন নীলকর সাহেবের কাছে জলের দামে সব বেচে এই দেশ ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু মজা হল, পরের সাহেবকেও সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। রহমত আলির প্রেতাত্মা যেন নাছোড়বান্দার মতো প্রতি রমজানের মাসে রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত ওই একই প্রার্থনা জানিয়ে যেত। সাহেবকুঠি হাতবদল হতে লাগল, তারপর একসময় কেউ আর ওখানে থাকতে রাজি হল না। এদিকে দেশ থেকে নীলচাষ উঠে গেল, সাহেবকুঠিটাও পরিত্যক্ত ভূতুড়ে কুঠি হয়েই পড়ে রইল। এতদিন পরে আবার এখানে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, কুঠিতে মানুষ এসেছে তাই রহমত আলির আত্মাও জেগে উঠেছে। তার দাবি জানাতে এসেছে সাহেব কুঠির নতুন মানুষের কাছে।

পরদিনই রজত অন্য জায়গায় থাকবার ব্যবস্থা করল। দরকার নেই ওর অমন ভূতুড়ে দালানবাড়িতে রাত কাটানো, তার চাইতে মাথা গোঁজবার মতো টিনের চালাও অনেক ভালো। সুখ না হোক স্বস্তি তো পাওয়া যাবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *