প্রতিহিংসা

প্রতিহিংসা

কলকাতার দক্ষিণ উপকণ্ঠে, বেশ ক-বছর আগেও যেখানে হোগলা বন ছিল, এখন সেখানে মাটি ভরাট করে এক বসতি গড়ে উঠেছে। সুন্দর ছিমছাম বাড়িঘর, পিচের রাস্তা। বিশেষ করে উঁচু মহলের সরকারি কর্মচারীরাই অবসর নেবার মুখে কিংবা অবসর নেবার পর এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। সরকার থেকেই সমস্ত জায়গাটা কিনে আধুনিক ছকে উন্নয়ন ও বিলিব্যবস্থা করা হয়েছে। জায়গাটার নামকরণ হয়েছে ‘নন্দন কানন’। প্রত্যেক বাড়ির সামনে বাগান, রংবেরঙের ফুল ফুটে আছে, বাড়িগুলিও হাল ফ্যাশনের; একটা ছোটো পার্কও আছে। এ ছাড়া আছে একটা ক্লাব, সন্ধ্যাবেলা প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের উপস্থিতিতে সেটা সরগরম হয়ে ওঠে। তাস-পাশার আসর তো বসেই, তা ছাড়া বসে জমাটি আড্ডা। সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি নিয়ে যেমন আলোচনা হয়, তেমনি এককালের জবরদস্ত সব অফিসাররা মাঝে মাঝে তাঁদের বৈচিত্র্যময় জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কাহিনিও বর্ণনা করেন।

পৌষের শেষ, ঠান্ডা বেশ চেপে বসেছে, কনকনে হাওয়ায় হাড় যেন কাঁপিয়ে দেয়। ক্লাবঘরে আজ তেমন লোকজন নেই, বৃদ্ধরা অনেকেই বোধ হয় শীতে কাবু হয়ে পড়েছেন। যে ক-জন ছিলেন, তাঁরাও উঠি উঠি করছেন। এমন সময় কর্নেল চ্যাটার্জি বললেন, ‘আচ্ছা সুপারন্যাচারাল কথাটার কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? বুদ্ধি দিয়ে যা আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না, কিন্তু অবচেতন মনে যাকে আমরা মেনে নিয়েছি একটু ভয়ের সঙ্গেই, তাকেই তো অতিপ্রাকৃত বলা হয়। আমার তো মনে হয়, সুপারন্যাচারাল কথাটাই হচ্ছে অস্পষ্ট, ভেগ।’

মি বোস একজন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। তিনি প্রায় নিভে যাওয়া চুরুটে দু-বার টান মেরে বললেন, ‘সুপারন্যাচারাল বলে কিছু আছে কী না সে-তর্কের মধ্যে না গিয়ে আমি আমার নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতা বলতে পারি। যার ব্যাখ্যা আজও আমার কাছে অজ্ঞাত।’

একটা রহস্যঘন কাহিনির আশায় সবাই মি বোসকে ঘিরে বসেন। মি বোস চুরুটে কয়েকবার ঘন ঘন টান মেরে বলতে শুরু করেন, ‘তখন আমি বাংলা-বিহারের সীমান্ত অঞ্চলে পোস্টেড। শহরটি ছোটো হলেও সুন্দর, চমৎকার জলবায়ু, হৃত স্বাস্থ্য উদ্ধারের পক্ষে আদর্শ জায়গা। সবচেয়ে আমার যা ভালো লেগেছিল, তা হল শালবন। মাইলের পর মাইল জুড়ে আছে সরকারের সংরক্ষিত এই শালবন। শহরের সীমানা পেরিয়ে মাইল দুয়েক গেলে সাঁওতাল পল্লি। এই অঞ্চলটায় সাঁওতালদের বাদ দিলে সাধারণ বসতি নেই বললেই চলে। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন সাঁওতাল পল্লির ধারেকাছে মাত্র দুই ঘর ভদ্র পরিবার বাস করতেন। সাঁওতাল পল্লি থেকে মাইল দুয়েক দূরে ছিল লোধা পল্লি। এরাও আদিবাসী, তবে সাঁওতালদের মতো এরা চাষবাসের শান্ত জীবনে অভ্যস্ত নয়। সাঁওতালদের সঙ্গে এদের ছিল দারুণ রেষারেষি, ফলে মাঝে মাঝে খুন-জখম ঘটত, আর তা নিয়ে আমাকে কম ছুটোছুটি করতে হত না।

এই সাঁওতাল পল্লির অনতিদূরে হঠাৎ এক আগন্তুকের আবির্ভাব আমাকে ভাবিয়ে তুলল। ভদ্রলোক লম্বায় প্রায় ছ-ফুট, বলিষ্ঠ পেশিবহুল চেহারা আর তার গায়ের রং তামাটে, ফর্সা লোক রোদে পুড়লে যেমন হয় অনেকটা তাই। ভদ্রলোক একটা পুরোনো বাড়ি কিনে সেটাকে সম্পূর্ণ সংস্কার করে নিয়েছিলেন। একটা সাঁওতাল ছেলে তিনি সবসময়ের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। সে তার সব কাজকর্ম মায় রান্নাবান্নাও করত। ভদ্রলোক বড়ো একটা বাড়ি থেকে বেরোতেন না, কিন্তু প্রতিদিন ভোরবেলা একটা বন্দুক নিয়ে মাঠের মধ্যে নেমে পড়তেন আর হাতের নিশানা ঠিক করতেন।

ভোরের আকাশে উড়ে যাওয়া পাখি শিকারে তাঁর লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ। সাঁওতালরা তাঁর অনাহূত উপস্থিতি পছন্দ করল না, বিশেষ করে তার বন্দুক থেকে গুলি ছোড়াটা তারা মোটেই সুনজরে দেখল না। ফলে আমার কাছে এসে তারা আগন্তুকের নামে নানান কথা বলতে লাগল। তাদের ধারণা লোকটা ডাকু। সভ্যজগতের বাইরে, মনুষ্যবিরল এ এলাকায় এই অপরিচিত আগন্তুকের আবির্ভাব ও স্থায়ীভাবে বসবাস আমার কাছেও কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হল। তাই আমি ঠিক করলাম, ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে তাঁর পরিচয় এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে। ইতিমধ্যে একটা চুরির ব্যাপারে আমাকে সাঁওতাল পল্লিতে তদন্ত করতে যেতে হল। ফেরার পথে আমি ভদ্রলোকের বাড়ি গেলাম। তিনি তখন তার বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে টুয়েলভ বোরের বন্দুকের নলটা পরিষ্কার করছিলেন। আমার পরিচয় দিতেই তিনি আমাকে সাদরে অর্ভ্যথনা জানালেন। কথায় কথায় জানলাম ভদ্রলোকের নাম নাসিরুদ্দিন বেগ, আদিনিবাস উত্তরপ্রদেশে। বহুদিন দেশছাড়া। সমুদ্রে ভেলা ভাসতে ভাসতে যেমন একসময় তীরে এসে ঠেকে যায়, তেমনি তাঁর জীবনতরিও সংসার-দরিয়ায় ভাসতে ভাসতে এখানে এসে ঠেকেছে। এই বন্য পরিবেশ তাঁর খুব ভালো লেগেছে, তাই বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেবেন স্থির করেছেন। ভদ্রলোক খুব ভালো শিকারি। বন্দুক ছাড়াও একটা রিভলভার আছে। আমি কর্তব্যের খাতিরে তাঁর আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেখতে চাইলাম। তিনি একটুও দ্বিধা না করে উঠে গিয়ে ঘর থেকে লাইসেন্স এনে দেখালেন। আমারও শিকারের নেশা ছিল, তাই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালো লাগল। কথায় কথায় ভদ্রলোক বললেন যে, তিনি জীবনে বহুবার হিংস্র জন্তুর মুখোমুখি হয়েছেন। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বন্যপশুর শিকার করার মধ্যেই তিনি আনন্দ পান, গাছে মাচা বেঁধে একটা শিশুও তো শিকার করতে পারে। তাঁর কথায় আমি চমৎকৃত হলাম। বাঘ, চিতা, নেকড়ে ছাড়াও একবার আসামের গভীর জঙ্গলে একটা প্রকাণ্ড বুনো হাতি তিনি মাটির ওপর দাঁড়িয়েই শিকার করেছিলেন। যেসব জন্তু তিনি শিকার করেছেন, তাদের ছাল ছাড়িয়ে শুকিয়ে একটা দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছেন। আমাকে তিনি সেই ঘরে নিয়ে গেলেন।

আমি ঘরে ঢুকে থ বনে গেলাম। দেওয়াল ভরতি সব বাঘ ভালুকের চামড়া ঝুলছে, যেকোনো শিকারির পক্ষে শ্লাঘার বস্তু। ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। দেওয়ালে একটা আংটার সঙ্গে একটা লোহার শেকল ঝুলছে, শেকলটার প্রান্ত একটা শক্ত হাতকড়ার সঙ্গে আটকানো, আর সেই হাতকড়া এঁটে বসেছে একটা হাতের মণিবন্ধের ওপর। মানুষের হাত, মনে হয় যেন একটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীর থেকে কনুইটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। হাতটা বেশ পুষ্ট, শক্তিশালী মানুষের হাত; নখগুলি হলদে হয়ে গেছে। আমি আঙুল দিয়ে হাতটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী?

মি বেগ হাতটার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে বললেন, এটা আমার পরম শত্রু।

তারপর তিনি আমাকে এক চমকপ্রদ কাহিনি শোনালেন। মি বেগ তখন মধ্যপ্রদেশের গভীর অরণ্যের কিছু অংশ ইজারা নিয়ে কাঠের ব্যাবসা করতেন, ভারতবর্ষের নানান জায়গায় তাঁর কাঠ চালান যেত। ওই বনের ধারে এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস ছিল। তারা একসময় ছিল যোদ্ধার জাত। এমনিতে তারা ছিল শান্ত, অতিথিবৎসল, কিন্তু কোনো কারণে উত্তেজিত হলে তারা হিংস্র হয়ে উঠত। আর তাদের প্রধান দোষ ছিল আদিম জিঘাংসা বৃত্তি। এই প্রতিহিংসা লিপ্সা এক পুরুষের মধ্যেই আবদ্ধ থাকত না, পুরুষানুক্রমে চলে আসত। কোনো পরিবারের কেউ যদি অন্য কারো দ্বারা অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত, তবে সেই পুরুষে তার প্রতিশোধ সম্ভব না হলে, তাদের দ্বিতীয়… এমনকী তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত তার জের চলত। ব্যাপারটা বুঝে দেখুন, হয়তো এক পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষের এক ব্যক্তি নিরীহ, শান্ত, কারো ক্ষতি সে কোনোদিন করেনি, কিন্তু তার পূর্বপুরুষের কৃত অপরাধের জন্যে তাকে জিঘাংসার বলি হতে হত। মি বেগ বনের গাছ কাটার কাজে সেই আদিবাসীদের অনেককে নিযুক্ত করেছিলেন। এই কাজের ব্যাপারে এবং টাকাপয়সার হিসেব নিয়ে ওদের একজন সর্দার গোছের লোকের সঙ্গে তার প্রচণ্ড মতবিরোধ ঘটে। ওই সর্দারের প্ররোচনায় অনেকেই তাঁর সঙ্গে অসহযোগিতা করতে শুরু করে ফলে তাঁকে বাইরে থেকে কিছু লোক আনতে হয়। এর ফলে ওরা আরও খেপে যায় এবং সেই সর্দার প্রকাশ্যেই তাঁকে একদিন আক্রমণ করে। লোকটা ছিল দুর্দান্ত প্রকৃতির আর শক্তিও ছিল তার প্রচণ্ড, কিন্তু মি বেগও ছিলেন বলিষ্ঠ পুরুষ। তা ছাড়া তিনি ছিলেন ভালো কুস্তিগীর। দু-জনের মধ্যে দারুণ লড়াই হয় এবং শেষ পর্যন্ত মি বেগ সেই সর্দারকে পরাস্ত করেন।

এই ঘটনার পর সে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। প্রতিহিংসার মানসে সে একদিন গভীর রাত্রে মি বেগের তাঁবুতে একটা ছোরা হাতে ঢোকে, মি বেগকে হত্যা করাই ছিল উদ্দেশ্য। অনেক সময় মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে আশু-বিপদের সংকেত দেয়। মি বেগেরও সেই রাত্রে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল, একটা অজানা বিপদের আশঙ্কা তিনি যেন মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করছিলেন।

চোখে ঘুম আসছিল না, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে হঠাৎ একটা মৃদু শব্দে সচকিত হয়ে উঠলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো কোনো বন্যপশু তাঁবুর মধ্যে ঢুকছে। পরক্ষণেই তাঁবুর পর্দাটা আস্তে আস্তে সরে গেল আর একফালি চাঁদের আলোয় তিনি দেখলেন মূর্তিমান বিভীষিকার মতো সেই সর্দারকে, চোখে-মুখে তার হিংস্রভাব, হাতে শানিত ছোরা। তিনি উঠে বসতেই সে বাঘের মতো তার ওপর লাফিয়ে পড়ল। বিদ্যুৎগতিতে তিনি পাশ কাটাবার চেষ্টা করলেন, ছুরিটার তীক্ষ্ন ফলা তাঁর কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। একটা অসহ্য যন্ত্রণা তিনি অনুভব করলেন, পিঠ বেয়ে রক্তের ধারা নামতে লাগল। সর্দার শিকার হাতছাড়া হয় দেখে একটা চাপা হুংকার দিয়ে আবার তেড়ে এল। মি বেগ তাঁর পিস্তলটা বালিশের তলা থেকে বের করবার সময় পেলেন না। মাটিতে গাছ কাটার একটা ভারী কুঠার পড়ে ছিল। মুহূর্তে সেটা তুলে নিয়ে দু-হাতে সজোরে তিনি ছোরা সমেত হাতটা লক্ষ করে কুঠার চালালেন। পরক্ষণেই কনুই থেকে অবশিষ্ট হাতের অংশটুকু শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁবুর গায়ে ঠিকরে মাটিতে আছড়ে পড়ল আর বিকট এক আর্তনাদ করে সেই সর্দার তাঁবু থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। সেই সর্দারকে আর কোনোদিন ওই অঞ্চলে দেখা যায়নি, সুতরাং সে জীবিত না মৃত তাও মি বেগ জানতে পারেননি। পরদিন অবশ্য তিনি শহরে গিয়ে পুলিশের কাছে সমস্ত ঘটনা জানিয়েছিলেন, কিন্তু সেই সর্দারের আর সন্ধান না পাওয়া যাওয়ায় ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে। মি বেগ সেই কাটা হাতটা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এবং পরে রোদে শুকিয়ে অক্ষত অবস্থায় রেখে দিয়েছেন।

হাতটাকে হাতকড়া লাগিয়ে শেকলের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন কেন, জিজ্ঞেস করায় মি বেগ বললেন যে, হাতটা নাকি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, তাই ওই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আমি ওই উত্তর শুনে ভদ্রলোকের মাথা খারাপ আছে ভাবলাম। তিনি বোধ হয় আমার মনের ভাব অনুমান করলেন, তাই মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি হয়তো আমাকে পাগল ভাবছেন, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আপনি যেন কখনো আমার অবস্থায় না পড়েন। এই হাতটা আমাকে যে কী যন্ত্রণা দিচ্ছে, তা যদি জানতেন!’

এর পর প্রায় একমাস আর ওমুখো হইনি। হঠাৎ একদিন সকালে কয়েকজন সাঁওতালের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে আসতেই তারা বলল যে, গতরাত্রে ডাকু সাহেব খুন হয়েছে। আমি কালবিলম্ব না করে ঘটনাস্থল অভিমুখে রওনা হলাম। মি বেগের বাড়ি পৌঁছে দেখলাম, সেখানে সাঁওতালদের ভিড় জমে গেছে। শোবার ঘরে মেঝের ওপর মি বেগের মৃতদেহটা চিত হয়ে পড়ে ছিল। তাঁর পোশাক ছিন্নভিন্ন। চারদিকের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে মনে হল, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ভদ্রলোক আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণে লড়ে গেছেন।

গলা টিপে শ্বাস রোধ করে মি বেগকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর মুখটা কালচে হয়ে ফুলে গেছে। দাঁত দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে তিনি যেন কিছু একটা কামড়ে ধরে আছেন। তাঁর রক্তাক্ত গলায় ও ঘাড়ে পাঁচটা গর্ত, যেন কেউ পাঁচটা লোহার তীক্ষ্ন শলাকা দিয়ে সজোরে তাঁর গলা টিপে ধরেছিল। ইতিমধ্যে সরকারি ডাক্তার এসে পড়লেন। মৃতদেহ পরীক্ষা করে তিনি যেন অনেকটা আপনমনেই বললেন, ‘ভূতুড়ে কাণ্ড দেখছি, মনে হয় যেন কঙ্কালের মাংসহীন পাঁচটা আঙুলের হাড় গলা টিপে ধরেছিল।’ কথাটা স্বগতোক্তি হলেও আমার কানে গেল আর আমার মেরুদণ্ড দিয়ে যেন একটা শিহরন বয়ে গেল। আমি চট করে প্রদর্শনী ঘরটায় ঢুকে যেখানে কাটা হাতটা ঝুলছিল সেদিকে তাকালাম। আশ্চর্য! হাতটা নেই, শেকলটা ছেঁড়া আর হাতকড়াটা দু-টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আমি শোবার ঘরে ফিরে এসে মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে পড়ে দাঁতের মধ্যে আটকানো জিনিসটা কী বুঝতে চেষ্টা করলাম। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, সেটা ওই হাতেরই একটা আঙুলের অংশ। মি বেগের শক্ত দাঁতের প্রচণ্ড দংশনে ওই অংশটুকু আঙুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অনুসন্ধান করে আমি চুরি-ডাকাতির কোনো প্রমাণ পেলাম না। ঘরের কোনো দরজা-জানলাই জোর করে খোলা কিংবা ভাঙার চিহ্ন নেই। টাকাপয়সাও কিছু খোয়া যায়নি। যে ছেলেটি মি বেগের কাছে থাকত তার জবানবন্দিতে জানা গেল যে, কিছুদিন ধরে তার মনিব কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন, সবসময় একটা ভয় ভয় ভাব, আর কোনো শব্দ শুনলেই চমকে উঠতেন। রিভলভারটা সবসময় হাতের কাছে থাকত। মাঝে মাঝে খেপে যেতেন আর শঙ্কর মাছের চাবুকটা দিয়ে দেয়ালে ঝোলানো হাতটার ওপর পাগলের মতো মেরেই চলতেন।

ছেলেটির মুখে আরও শোনা গেল যে, সাহেব অনেক রাত্রে শুতে যেতেন, আর শোবার ঘরের দরজা-জানলা সব ভালো করে বন্ধ করে দিতেন। শোবার সময় বন্দুক, পিস্তল কাছে নিয়ে শুতেন। অনেকদিন রাত্রে সে সাহেবকে জোরে জোরে কথা বলতে শুনেছে, যেন কারো সঙ্গে ঝগড়া করছেন। গতরাত্রে কিন্তু সে সাহেবের কোনো সাড়া-শব্দ পায়নি। আজ ভোরবেলা সাহেব দরজা খুলছে না দেখে তার কী রকম সন্দেহ হয়। অন্ধকার থাকতেই সাহেবের ওঠা অভ্যেস, তাই হয়তো সাহেবের অসুখবিসুখ করেছে ভেবে সে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে, কিন্তু তাতেও কোনো ফল না হওয়ায় বিপদের আশঙ্কা করে দরজা ভেঙে ফেলে।

অনেক অনুসন্ধান করেও সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। খুনের মাস কয়েক পর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমার মনে হল যেন সেই বীভৎস হাতটা আমার ঘরের চার দেয়াল বেয়ে বিছের মতো তরতর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই রাত্রে তিন তিনবার আমি একই স্বপ্ন দেখলাম, আর তিনবারই আমার ঘুম ভেঙে গেল। পরের দিন সত্যিই সেই হাতটা আমি দেখতে পেলাম। মি বেগকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই মাটির ওপরেই একজন রাখাল হাতটা কুড়িয়ে পায়। হাতটার একটা আঙুলের ডগায় কিছু অংশ নেই, যেন কেউ কেটে নিয়েছে। এই হচ্ছে আমার কাহিনি, এটাকে আপনারা সুপারন্যাচারাল বলবেন কি না আমি জানি না।’— মি বোস থামলেন। তারপর তাঁর নিভে যাওয়া চুরুটটায় আবার অগ্নিসংযোগ করতে লাগলেন।

কর্নেল চ্যাটার্জি বললেন, ‘আপনার নিজস্ব অভিমত মিস্টার বোস? বিশেষ করে একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে নিশ্চয় আপনার একটা বাস্তব মত আছে।’

মি বোস চুরুটে কয়েকবার জোরে জোরে টান দিয়ে উৎসুক শ্রোতাদের মুখের ওপর তাঁর দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, আমার ধারণা ওই সর্দার মরেনি, যেমন করেই হোক সে পালিয়েছিল আর বেঁচেও ছিল। আপনাদের আগেই বলেছি, ওদের সম্প্রদায় ছিল ভীষণ প্রতিহিংসাপরায়ণ, এমনকী বংশপরম্পরায় শত্রুতার জের চলত। খোঁজ করে করে হয়তো সেই সর্দার মি বেগের সন্ধান পেয়েছিল এবং একটা হাত দিয়েই তাকে কাবু করে গলা টিপে হত্যা করেছিল। অবশ্য কী করে সেটা সম্ভব, তা আমি বলতে পারব না।’

‘আর মিস্টার বেগের দাঁতের ফাঁকে সেই কাটা হাতের আঙুলের অংশের কী ব্যাখ্যা করেছিলেন?’ অবসরপ্রাপ্ত মি ভাদুড়ি প্রশ্ন করলেন।

মি বোস গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, ‘তার ব্যাখ্যা আজও আমি করতে পারিনি।’

বিদেশি কাহিনির ছায়ায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *