হে অতীত

হে অতীত

‘অতীতকে ভুলে যাওয়াই ভালো,’ টেবিল চাপড়ে বলল কমলেশ, ‘অতীতের রেশ বর্তমানে টেনে আনার কোনো মানে হয় না, মিনিংলেস…’

‘কিন্তু অতীত সব সময় আমরা ভুলতে পারি কি?’ একটু যেন কুণ্ঠার সঙ্গে বলল অমিতাভ, ‘কিংবা ভুলতে চাইলেও এড়ানো যায়?’

গড়িয়ার কাছে আমাদের ক্লাবরুমে বসে জটলা হচ্ছিল। অল্প অল্প শীত পড়তে শুরু করেছে, আরামদায়ক সন্ধ্যা।

‘এ তো আপনি তর্কের খাতিরে বলছেন,’ কমলেশের গলা অনেকটা খাদে নেমে এল, ‘অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্কের কোনো প্রমাণ দিতে পারেন?’

‘মানে…,’ অমিতাভ একটু কাশল, তারপর বলল, ‘আমার নিজের অভিজ্ঞতার একটা ঘটনা বলতে পারি। আমি আর কাউকে এ ঘটনা বলিনি, আমি জানি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, ভাববে মাথা খারাপ হয়েছে।’

অমিতাভ প্রবাসী বাঙালি। কয়েক পুরুষ ধরে ওদের বাস কানপুরে। ওখানেই ওর জন্ম, লেখাপড়া, সব কিছু। দিল্লিতে একটা কোম্পানিতে ও এগজিকিউটিভ ট্রেনি হিসাবে ঢুকেছিল। ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ হবার পর বছর তিনেক হল কলকাতায় শাখা অফিসে বদলি হয়ে এসেছে। শুধু কলকাতায় কেন, পশ্চিমবাংলায় ওর এই প্রথম পদার্পণ। প্রথম প্রথম ওর খুব বিচ্ছিরি লাগত। নোংরা শহর, ঘিঞ্জি, যানবাহনের দুরবস্থা, সারা বছর মিছিল আর আন্দোলন, ও যেন হাঁফিয়ে উঠেছিল। তারপরই আস্তে আস্তে এই নগরীর যে একটা মায়াময়ী সৌন্দর্য আছে, তার সন্ধান পেয়ে অভিভূত হয়েছিল অমিতাভ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এই বিতর্কিত নগরীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই সূত্রেই আমাদের ক্লাবের ও একজন সদস্য।

‘ছোটোবেলা থেকে আমার যে পশ্চিমবাংলার বাইরে কেটেছে, তা আমি আপনাদের আগেই বলেছি,’ সবার মুখের ওপর দৃষ্টির পরশ বুলিয়ে অমিতাভ শুরু করল। ‘কলকাতায় আসার পর যে ইচ্ছেটা প্রথমেই আমার মনে মনে উঁকিঝুঁকি মারছিল, তা হল, এই সুযোগে আমার পূর্বপুরুষের আদি ভিটে যেখানে ছিল, সে-জায়গাটা দেখে আসব। জায়গাটা উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ির কাছে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ভেতরে আরও কয়েক মাইল যেতে হয়। বাস সার্ভিস, ট্যাক্সি সব সুবিধেই আছে।

‘আমি কলকাতায় এসেছিলাম জুলাই মাসে, তিন মাস পরেই পুজো। প্রথমে ভেবেছিলাম পুজোর সঙ্গে আরও কয়েকদিন ছুটি যোগ করে কানপুরে ঘুরে আসব, কিন্তু নিয়তিই আমাকে টেনে নিয়ে গেল উত্তরবঙ্গে। শিলিগুড়ি থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে আমি আমার পূর্বপুরুষের আদি ভিটে যেখানে ছিল, সেই ছোট্ট শহরে পৌঁছুলাম। শহরটা ছোটো হলেও ছবির মতো সুন্দর। শহরের কোল ঘেঁষে একটা ছোটোখাটো পাহাড়, তার গা বেয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা নদী। ভালো কথা, ওই পাহাড়ের পাশ দিয়েই গাড়ি চলাচলের পাকা সড়ক। তিনশো বছর আগে আমার পূর্বপুরুষরা এই অঞ্চলেই বাস করতেন এটা ভাবতেই আমার সারা শরীরে কেমন যেন একটা শিহরন বয়ে যাচ্ছিল। সব মানুষেরই পূর্বপুরুষের ভিটের ওপর বোধ হয় একটা তীব্র আকর্ষণ থাকে।

‘ওখানে আমি একটা হোটেলে উঠেছিলাম, ওটাই ওখানকার সেরা হোটেল। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, সপ্তমী। ষষ্ঠীর দিন আপিস ছুটির পর আমি ট্রেনে চেপেছিলাম, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। চারদিকে উৎসবের সুর আর বাদ্যির আওয়াজ, বড়ো ভালো লাগছিল। পশ্চিমবাংলায় আর কখনো পুজো দেখিনি, তাই দু-চোখ ভরে সব কিছু দেখছিলাম।

‘বিকেলের দিকে ঘুরতে ঘুরতে আমি শহরের সীমানায় এসে পড়লাম। পাহাড়ের ঠিক নীচে দিয়ে নদী বয়ে গেছে। বর্ষার জল এখনও নামেনি, দুরন্ত যৌবনার মতোই নদীর দু-কূল কানায় কানায় ভরপুর।

‘পাহাড়ের কোলে একটু পরিষ্কার জায়গা বেছে আমি বসে পড়লাম। সন্ধে হতে আর বেশি দেরি নেই। চারদিকে বন্য সৌন্দর্য— বুনো গাছ, বুনো ফুল, বাতাসেও কেমন যেন একটা বুনো বুনো গন্ধ, কিন্তু খারাপ নয়। হয়তো এ নদী আর পাহাড় তিনশো বছর আগেও ছিল, হয়তো আমার কোনো পূর্বপুরুষ আমারই মতো এখানে এসে বসতেন, চারপাশের সৌন্দর্য তাঁকেও আকুল করে তুলত।

‘হঠাৎ ইন্দ্রিয়ের কী-একটা অনুভূতিতে আমি ওপরদিকে তাকালাম, আর সঙ্গেসঙ্গে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে সরে গেলাম। এক মুহূর্ত আগে যেখানে আমি বসে ছিলাম, ঠিক সেখানে একটা মস্ত পাথরের চাঁই পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল, তারপর গড়াতে গড়াতে খরস্রোতা নদীর জলে অদৃশ্য হল। আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে ততক্ষণে ঘামের বন্যা নেমেছে, কী সাংঘাতিক! এক চুল সময়ের এদিক-ওদিক হলে ওই পাথরের চাঁই আমাকে পিষে ফেলত, পূর্বপুরুষের জন্মভূমিতেই অন্তিম শয্যা নিতে হত আমাকে।

‘জামাকাপড় ঝেড়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, আর সঙ্গেসঙ্গে দ্বিতীয়বার চমকালাম। পাহাড়ের গা বেয়ে একটা সরু পায়ে-চলা-পথ এঁকেবেঁকে ওপরদিকে চলে গেছে। তার এক জায়গায় একজন বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শনের দড়ির মতো তার চুল পাকানো পাকানো, পরনে একটা কালো পাড় শাড়ি। আমার থেকে তার দূরত্ব তেমন বেশি নয়। কিন্তু যা আমাকে হতচকিত করল তা হচ্ছে, তার দৃষ্টি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, দু-চোখে রাজ্যের ঘৃণা নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও সম্মোহিতের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আরও একটা জিনিস আমাকে আশ্চর্য করল। তার সর্বাঙ্গ ভেজা, গা আর কাপড় থেকে জল ঝরছে, যেন এইমাত্র নদীর জলে ডুব দিয়ে উঠেছে। খোলা চুল কাঁধের দু-পাশ দিয়ে ছড়ানো, তা থেকেও টপ টপ জল ঝরছে। হঠাৎ কেন জানি না একটা বিপদের অনুভূতিতে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল।

‘কতক্ষণ এভাবে দু-জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তা ঠিক বলতে পারব না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকালের জন্য আমরা দু-জনে দু-জনকে দেখছি। তারপরেই সেই বৃদ্ধা পেছন ফিরে হনহন করে হাঁটা দিল, দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল একটা বাঁকের মুখে।

‘হঠাৎ যেন সম্বিৎ পেয়ে আমি ওই পথ ধরে ছুটলাম, ওই বৃদ্ধাই যে পাথর গড়িয়ে ফেলেছে সে-বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। তার চোখে-মুখে অপরিসীম ঘৃণার চিহ্নই বলে দিচ্ছিল সেকথা। কিন্তু সেই বাঁক পেরিয়ে আরও কিছুটা পথ যাবার পরেও সেই বৃদ্ধাকে আর দেখতে পেলাম না, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হতবুদ্ধির মতো আমি ফিরে এলাম যেখানে পাথরটা পড়েছিল সেখানে।

‘ঠিক তখনই একটা খালি ট্যাক্সি ও-পথ দিয়ে যাচ্ছিল, আমি হাত উঠিয়ে ওটাকে দাঁড় করালাম। জায়গাটা নির্জন। ট্যাক্সি-ড্রাইভার বোধ হয় বুঝল আমি ওখানে নতুন, বেড়াতে বেরিয়েছি। সে আমার সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করল। আমিও ঘটনার আকস্মিকতায় এত বিচলিত হয়েছিলাম যে, একজন সঙ্গী কিংবা কথা বলবার লোক অন্তর দিয়ে চাইছিলাম। ড্রাইভারকে পাথর গড়িয়ে পড়ার কথা বলেই ফেললাম।

‘লোকটা আমার কথা শুনে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে আমার মুখটা দেখে নিল, সে-দৃষ্টিতে অবিশ্বাসের চিহ্ন সুস্পষ্ট। তারপরই সে বলল, ‘পাথরের চাঁই গড়িয়ে পড়ার কথা এই প্রথম আমি শুনলাম। এ অঞ্চলে প্রায় দশ বছর আমি ট্যাক্সি চালাচ্ছি, এই পথে সারাদিনে কতবার যে যেতে আসতে হয় তার হিসেব করা সোজা নয়। এমন ঘটনা কেউ আগে কখনো বলেনি বা শোনেনি। ঘুমিয়ে পড়েননি তো? হয়তো এমন স্বপ্ন দেখেছেন যে, মনে হচ্ছে বুঝি সত্যি!’

‘ড্রাইভারের মনে হয়তো এ সন্দেহও হয়েছিল যে, আমি নেশা করেছি, নেশার ঘোরে ওই ঘটনা কল্পনা করেছি। ভদ্রতার খাতিরে সেটুকু আর বলল না। কিন্তু সত্যিই কী আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম! অতবড়ো পাথরটা কয়েক ইঞ্চির জন্য আমাকে ছাতু করে ফেলেনি। আর ওই বুড়িকেও আমি স্বপ্ন দেখলাম! তার খোলা চুল আর পোশাক থেকে জল ঝরে পড়ছিল, আমি স্পষ্ট দেখেছি। দু-চোখের সেই তীব্র দৃষ্টি এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমার চোখের সামনেই আবার যেন সে মিলিয়ে গেল। মানুষের জীবনে কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে, যুক্তি দিয়ে তার কোনো ব্যাখ্যা চলে না! মনকে আমি এই বলে প্রবোধ দিলাম।

‘স্বীকার করতে লজ্জা নেই, হোটেলের দরজায় পৌঁছে আমার গা দিয়ে যেন ঘাম ছাড়ল, একটা নিশ্চিন্ত ভাব অনুভব করলাম।’

‘আগেই বলেছি, ছোটো শহর হলেও ছবির মতো সুন্দর। বেড়াবার জায়গাও প্রচুর। সকাল বিকেল আমি খুব হাঁটতাম, বিশেষ করে নদীর ধারে চমৎকার বেড়াবার জায়গা। মঙ্গলবার সকালে আমি ওখানে পৌঁছেছিলাম, দেখতে দেখতে বুধ-বৃহস্পতি কেটে গেল। এ দু-দিন খেয়ে, ঘুমিয়ে মন বেশ তাজা হয়ে উঠেছিল, প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা একটা দুঃস্বপ্নের মতোই মুছে গিয়েছিল মন থেকে।

‘দশমীর দিন বিকেলে জলপ্রপাত দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। শহর থেকে ওটা কয়েক মাইল দূরে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে নদীতে গিয়ে পড়েছে। ওটা নাকি দেখবার মতো। সন্ধের মুখে আমি ওখানে পৌঁছুলাম। সূর্য অস্ত গেলেও চারিদিকে তখন কিন্তু বেশ আলো ছিল। জলপ্রপাতটা সত্যিই অপূর্ব। শুভ্র ফেনিল জলরাশি অনেক উঁচু থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে সহস্র ধারায় নামছে, সশব্দে আছড়ে পড়ছে নীচে। সেখানে মস্ত মস্ত পাথরে বাধা পেয়ে যেন ফুঁসে উঠছে, প্রকাণ্ড পাথরগুলোর ফাঁক দিয়ে জায়গা করে কল কল ধ্বনি তুলে ধেয়ে চলেছে নদীর পানে। সামনে যা পড়ছে সব ভাসিয়ে নিয়ে চলছে। অপূর্ব দৃশ্য।

‘জলপ্রপাতের পাশেই পাহাড়ের গা দিয়ে একটা সরু রাস্তা। দৃশ্যটা ভালো করে দেখব বলে আমি সেই রাস্তা ধরে ওপরে উঠছিলাম। এক জায়গায় একটা প্রকাণ্ড পাথর জলপ্রপাতের প্রায় গা ঘেঁষে অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। আমি সেই পাথরটায় দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে জলপ্রপাতের ভীষণ সৌন্দর্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলাম। জলপ্রপাতের গর্জন ছাপিয়ে মাথার ওপর আরেকটা ঘর্ঘর শব্দে আমি চোখ তুলে তাকালাম। একটু অন্যমনস্কভাবেই আমি তাকিয়েছিলাম, তারপরই ভীষণ চমকে উঠলাম। একটা আতঙ্কে আমার শরীর যেন হিম হয়ে গেল। ওপর থেকে একটা বড়ো পাথরের চাঁই ওই সরু রাস্তা বেয়ে নেমে আসছে। আমার এদিক-ওদিক কোথাও পালাবার পথ নেই। কী করে যে মুহূর্তেরও কম সময়ের মধ্যে আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিলাম তা আজও আমি জানি না। কিছু না ভেবেই যে প্রকাণ্ড শিলার ওপর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার পেছনে আমি ঝাঁপ দিলাম। পাথরের চাঁইটা ওই শিলায় প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ল, তারপর গড়িয়ে জলপ্রপাতের পাদদেশে স্থির হয়ে গেল। আরও অনেক পাথরের চাঁইয়ের সঙ্গে যুক্ত হল ওটা। আমি অমনভাবে লাফ না দিলে আমাকে গুঁড়িয়ে ওটা চলে যেত।

‘খুব সাবধানে শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে আমি দাঁড় করালাম। অনেক জায়গা ছড়ে গেছে, রক্ত পড়ছে, বাঁ-পায়ের গোড়ালি ফেলতে কষ্ট হচ্ছে, বোধ হয় মচকে গেছে। আমি কি নীচে নামতে পারব?

‘কেন জানি না আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠে আটকে গেল গলায়। সাদা শনের মতো চুল, ভেজা কাপড় থেকে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছে, এক বুড়ি তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, সারা মুখে ফুটে উঠেছে বিজাতীয় এক ঘৃণার ছাপ। ঠিক তিনদিন আগের ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি। একটা অজানা আশঙ্কা আর বিপদের সম্ভাবনায় আমার হঠাৎ নিজেকে খুব দুর্বল মনে হতে লাগল।

‘জলপ্রপাতের জলধারা নীচে একটা ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করেছে। শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পারলে ওখানে পড়ে যাবার সম্ভাবনা ষোলো আনাই। আমি দু-হাত দিয়ে প্রকাণ্ড পাথরটাকে চেপে ধরলাম, যাতে পা হড়কে না পড়ে যাই। আমার সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে। একটু একটু করে মনে সাহস ফিরে এল। শুধু মনের জোরেই আমি আবার সরু পথটায় উঠে এলাম। বুড়িকে কিন্তু আর দেখতে পেলাম না। আস্তে আস্তে আমি নামতে শুরু করলাম। খানিকটা হেঁটে খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে নামতে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছুলাম। ক্লান্তিতে আমার সর্বাঙ্গ ভরে গেছে, ওখানেই শুয়ে পড়লাম। দু-দু-বার দুর্ঘটনায় ওই বুড়িটাই যেন ভীষণ এক জিঘাংসায় আমাকে পরপারে পাঠাতে চেষ্টা করেছিল, অথচ কে ওই বুড়ি, কেন আমার ওপর তার এই ঘৃণা, কিছুই আমি জানি না। জ্ঞানত তার কোনো ক্ষতি আমি করিনি, তা ছাড়া এখানে আমার আসাই তো এই প্রথম।

‘সেদিন কীভাবে আমি হোটেলে ফিরেছিলাম তা আশা করি আপনারা খানিকটা অনুমান করতে পারবেন। প্রথমে মনে করেছিলাম ওই রাতেই ওখান থেকে পালাব। আপনারা আমাকে কাপুরুষ ভাবতে পারেন, তবে আমি যে সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম সেকথা একশোবার। কিন্তু রাত্তিরে ওই পথ দিয়ে যেতে হবে ভেবেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঠিক করলাম পরদিনই ওখান থেকে বিদায় নেব।

‘রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর হোটেলের মালিককে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। সাতদিন থাকব বলে ওখানে উঠেছিলাম, তাই আমার এই মত পরিবর্তনে মালিক ভাবলেন আমার বোধ হয় যত্ন-আত্তির ত্রুটি হচ্ছে। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম যে, কলকাতা থেকে জরুরি চিঠি পেয়েই আমার কর্মসূচির পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আমার পূর্বপুরুষের ভিটে খুঁজে বার করা আমার হল না। প্রথম দিনই কথায় কথায় হোটেলের মালিককে আমার ওখানে যাবার আসল কারণটা বলেছিলাম। ‘আপনি সাধু মহারাজের সঙ্গে দেখা করেছেন?’ মালিকের আচমকা এই প্রশ্নে আমি বিস্মিত হলাম।

‘না,’ আমি জবাব দিলাম, ‘কে তিনি? তাঁর সঙ্গে দেখাই-বা করব কেন?’

‘এখানকার পুরোনো ইতিহাস তাঁর মতো আর কেউ জানে না। এ নিয়ে খুব পড়াশোনা করেন।’ একটু থেমে তিনি বললেন, ‘সাধু মহারাজকে এখানে সবাই শ্রদ্ধা করে, খুব ধার্মিক আর সৎ মানুষ।’ হোটেলের মালিক একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, ওঁর একটা আলাদা শক্তি আছে… লোকে বলে দৈবশক্তি, তার প্রমাণও বেশ কয়েকবার পাওয়া গেছে, তবে তিনি কখনো নিজেকে জাহির করবার চেষ্টা করেন না। আমার মনে হয় তাঁর সঙ্গে দেখা না করে আপনার চলে যাওয়া ভুল হবে। আপনার পূর্বপুরুষের ইতিহাস একমাত্র তিনিই জানতে পারেন।’

‘এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করা যাবে?’ আমি বেশ আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তখন সাড়ে ন-টা।

‘হ্যাঁ, তাঁর দরজা সবার জন্য সবসময় খোলা। আচ্ছা, চলুন আমিই আপনাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাচ্ছি, এখান থেকে পাঁচ-সাত মিনিটের রাস্তা।’

‘কেন জানি না আমার মনে অদম্য কৌতূহলের সঞ্চার হল। হোটেলের মালিকের সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম।

‘খড়ের একচালার একটা ঘরের সামনে এসে হোটেলের মালিক থামলেন। সামনে খানিকটা বাঁশের বেড়া দেওয়া জমিতে শেফালি, জবা নানান ফুল ফুটে আছে। দরজায় মৃদু টোকা দিতেই যিনি দরজা খুলে দাঁড়ালেন, তাঁকে দেখলে সত্যিই শ্রদ্ধা হয়। সৌম্যকান্তি এক বৃদ্ধ, মাথার চুল তুষারশুভ্র, কিন্তু বলিষ্ঠ গড়ন। পরনে গেরুয়া বসন।

‘স্মিত মুখে তিনি আমাদের ভেতরে আহ্বান করলেন। ঘরে ঢুকেই এক কালীমূর্তি আমার চোখে পড়ল, সামনে পূজার উপাচার, বোধ হয় পুজোয় বসতে যাচ্ছিলেন। আমি একটু আশ্চর্যই হলাম, কারণ আমার ধারণা ছিল কালীর সাধক রক্তপট্টাম্বর বস্ত্র ধারণ করেন, গৈরিক বসন নয়।

‘বাইরের পোশাকটা বাহ্য আড়ম্বর, ভেতরের শুদ্ধিই হচ্ছে আসল,’ সাধু মহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন। আমি থতোমতো খেলাম।

‘মহারাজ, চৌধুরীবাবুকে আপনার কাছে নিয়ে এলাম,’ হোটেলের মালিক এবার বললেন, ‘কাল উনি এখান থেকে চলে যাচ্ছেন, এসেছিলেন পূর্বপুরুষের ভিটে খুঁজতে। তিনশো বছর আগে এখানে ওঁদের আদি বাস ছিল। তা আমি বললাম, কেউ যদি এ ব্যাপারে খোঁজ দিতে পারেন তবে আপনিই পারবেন।’

‘মহারাজ আমার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। হোটেলের মালিক আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ”চৌধুরী!” সাদা রেশমের মতো দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে মহারাজ বললেন, শুধু চৌধুরী বললে তো হবে না, এখানে চৌধুরীর ছড়াছড়ি, তাদের পরিবারের কেউ-না-কেউ গত দু-তিনশো বছরে নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। আর কিছু বলতে পারেন?’

‘আমাকে স্বীকার করতে হল যে, তিনশো বছর আগে আমার পূর্বপুরুষের এ অঞ্চলে কোথাও ভিটে ছিল। এ ছাড়া আর কিছুই আমার জানা নেই।

‘মহারাজ মাথা নাড়লেন, বললেন, ”না, ওভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। একসময় শুধু এ অঞ্চলটাই নয়, আশেপাশের অঞ্চলেও চৌধুরীদের খাস তালুক ছিল, সবাই চৌধুরী আর শরিক। তারাই জমি বিলি বন্দোবস্ত করে এখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। এখন যারা আছে তারা তাদেরই বংশধর, বাকি সব কলকাতা, দিল্লি, কানপুর, নাগপুর, এলাহাবাদ নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। তা ছাড়া শাখাপ্রশাখা যত ছড়িয়ে পড়েছে, একই নাম ঘুরেফিরে এসেছে। সুতরাং একই নামের একাধিক চৌধুরী এখান থেকে চলে গেছে। যাহোক, তুমি… আপনি…, তারপরই তিনি হেসে বললেন ”বুড়ো মানুষ,” ”তুমি” বলে ফেলললাম কিছু মনে কোরো না বাবা।

‘আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আমারই তাঁকে বলা উচিত ছিল আমাকে আপনি বলে যেন সম্বোধন না করেন।

‘যা, বলছিলাম,’ মহারাজ অর্ধসমাপ্ত কথাটা আবার শুরু করলেন, ‘পিতৃপুরুষের ভিটের সন্ধান না পেলেও এখানে যে কয়েকদিন তোমার আনন্দে কেটেছে সেটাই বড়ো কথা।’

‘তা ঠিক,’ আমি জবাব দিলাম, ‘শুধু এক ডাইনি বুড়ি যদি দু-দু-বার আমাকে পাথর চাপা দিয়ে মেরে ফেলবার চেষ্টা না করত, তবে এখানে থাকাটা আমি ষোলো আনা উপভোগ করতে পারতাম।’

‘কী বললে,’ মহারাজ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, তাঁর দু-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘সেই বুড়ির সারা গা থেকে জল ঝরে পড়ছিল, যেন নদীতে সদ্য ডুব দিয়ে উঠেছে?’

‘হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন?’ আমার বিস্ময়ের যেন আর অন্ত নেই, ‘বুড়ির সারা গা বেয়ে জল ঝরছিল, কাপড় চপচপে ভেজা, মাথার চুলও তাই। আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন দু-চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছিল। ওর চোখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম আমায় খুন করবার চেষ্টা করেছিল। কে ওই বুড়ি!’

‘ও কে তা আমি জানি,’ মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন সাধু মহারাজ, ‘আর এখন বুঝতে পারলাম তুমি কে! তোমার পূর্বপুরুষের কথা এবার তোমাকে আমি বলতে পারব। কাল সকালে তুমি এখান থেকে চলে যাবে, একদিক দিয়ে তোমার পক্ষে সেটা ভালো। তোমার কাহিনি আগে বলো।’

আমি তাঁকে সংক্ষেপে দুটো ঘটনার কথাই বললাম, দু-বারই আমার মনে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, তাও খুলে বললাম। ‘কিন্তু ওই বুড়িটা কেন আমাকে এত ঘৃণা করে? আমি তো ওকে চিনি না, কোনোদিন দেখিনি— আমাকে খুন করবার জন্য এত আগ্রহ কেন!’ আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলাম।

‘তুমি ওকে চেনো না, কিন্তু ও তোমাকে চিনেছে,’ সাধু গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন। তুমি ভুজঙ্গ চৌধুরীর সরাসরি বংশধর, তাই সেই বংশের ওপর অভিশাপ তোমাকেই স্পর্শ করেছে। শুধু তাই না, ওই অভিশাপের তাড়নায় তোমার পূর্বপুরুষ এখানকার বাড়িঘর, জমিজমা সব বিক্রি করে অনেক দূর গিয়ে নতুন করে ডেরা বেঁধেছিল, ভেবেছিল অত দূরে ওই অভিশাপের ভীষণতা থেকে তারা রেহাই পাবে, হয়তো পেয়েও ছিল, কিন্তু তুমি এখানে এসে ভীষণ বিপদে পড়েছ সেই অভিশাপের নাগপাশে।’

‘কিন্তু এমন ঘটনা অসম্ভব… অবিশ্বাস্য,’ আমি না বলে পারলাম না।

‘মোটেই নয়,’ সাধু মহারাজ জবাব দিলেন, ‘অশুভ আত্মার নানান কুকীর্তির ঘটনা সেই আদিম কাল থেকে সারা পৃথিবীতে ঘটেছে, ঘটছে।’

‘কিন্তু কী সেই অভিশাপ?’ আমি একটু অধৈর্যভাবেই প্রশ্ন করলাম।

‘পাথর চাপা পড়ে তোমাদের বংশের সবাই ধ্বংস হবে,’ সাধু মহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে করুণামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, তুমি এখান থেকে নিরাপদে চলে গেলে খুশিই হব।’

‘কিন্তু কেন এই অভিশাপ?’ আমি প্রশ্ন করলাম, আমার গলা বোধ হয় একটু কেঁপে গেল।

‘তবে তোমাকে খুলেই বলি,’ মহারাজ শুরু করলেন, ‘আজ থেকে তিনশো বছর আগে ভুজঙ্গ চৌধুরী ছিলেন এ অঞ্চলের একজন প্রতাপশালী পুরুষ, প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক। সেই সময় আইনশৃঙ্খলা ছিল সমাজের উঁচু মানুষদের হাতে, তাঁরাই ছিলেন বিচারের দণ্ডমুণ্ড কর্তা। পুরোনো পুঁথিপত্র ঘেঁটে আমি যে সময়ের নিশানা পাচ্ছি, তা হল ইংরেজি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকের। সেসময় ডাইনি এ অপবাদে অনেক হতভাগিনীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হত। আজ এই সভ্য যুগেও এমন ঘটনা কাগজে চোখে পড়ে।’

‘ভুজঙ্গ চৌধুরী অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন।’ মহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে একটু যেন সংকোচের সঙ্গে বললেন। ‘বিন্দুবাসিনী নামে এক বৃদ্ধা সেসময় এ অঞ্চলের এক প্রান্তে কুঁড়েঘরে বাস করত। সংসারে তার আর কেউ ছিল না, কীভাবে তার দিন চলত তা কেউ জানত না। কিন্তু দু-একটা ঘটনায় স্থানীয় লোক তাকে ডাইনি বলে সন্দেহ করতে শুরু করে। ভুজঙ্গ চৌধুরীর কানেও কথাটা ওঠে। তিনি বুড়িকে বেঁধে এক বিচারসভায় নিয়ে আসেন। বিচারে তার মৃত্যু দণ্ডাদেশ হয়, ভুজঙ্গ চৌধুরীই ওই আদেশ দিয়েছিলেন, বুড়ির কোনো কথাই তিনি কানে তোলেননি। হতভাগিনীর দু-হাত একটা লম্বা দড়ির একদিকে বাঁধা হয়, অন্যদিকটা জুড়ে দেওয়া হয় একটা নৌকার সঙ্গে। ভুজঙ্গ চৌধুরী নিজে তাঁর কয়েকজন ইয়ার বন্ধু নিয়ে ওই নৌকায় ওঠেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না হতভাগিনী ডুবে মরে, ভুজঙ্গ চৌধুরী আর তাঁর ইয়ার বন্ধুরা মত্ত অবস্থায় নৌকা বিহার করেছিলেন। নদীর দু-তীরে কাতারে কাতারে লোক জমেছিল। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল নৌকার মানুষদের উল্লাস আর ওই হতভাগিনীর করুণ মৃত্যু। পুরোনো পুথিতে এ কাহিনি লেখা আছে।

‘ডুবে যাবার ঠিক আগে বিন্দুবাসিনী, ভুজঙ্গ চৌধুরী আর তার বংশকে অভিশাপ দিয়েছিল। সেই অবস্থাতেও তার দু-চোখ থেকে নাকি ঘৃণা ঝরে পড়ছিল, খোলা শণের মতো চুল থেকে ঝরছিল নদীর জল। নদীর জলে আমাকে তুমি ডুবিয়ে মারছো, ভুজঙ্গ চৌধুরীকে লক্ষ করে তীক্ষ্ন কণ্ঠে সে বলে উঠেছিল, কিন্তু তুমি আর তোমার বংশের পুরুষরা ওপর থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরে মরবে… মরবে…।

‘সাধু মহারাজ একটু থামলেন, তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, বিন্দুবাসিনীর অভিশাপ মিথ্যে হয়নি। ভুজঙ্গ চৌধুরী অবশ্য ওই অভিশাপ শুনে তাচ্ছিল্যভরে হেসেছিলেন। কয়েক বছর নির্বিঘ্নে কেটে গেল, তারপর এক রাতে ঘটল দুর্ঘটনা। নিজের ঘরে বিলাসশয্যায় ঘুমিয়ে ছিলেন ভুজঙ্গ চৌধুরী, পাশেই ছিলেন তাঁর স্ত্রী। ভোররাতে উঠল ঝড়, আর ভুজঙ্গ চৌধুরীর পাথরের তৈরি বাড়ির ছাদ ভেঙে একটা পাথরের চাঁই ওপর থেকে ধসে পড়ল, একেবারে থেঁতলে দিল তাঁর মাথা। আশ্চর্যভাবে রক্ষা পেয়ে গেলেন তার স্ত্রী। ভুজঙ্গ চৌধুরীর বয়স তখন চল্লিশ পেরোয়নি।

‘তাঁর ছেলে গগনেন্দ্র ছিল বাপের সম্পূর্ণ বিপরীত। শান্ত, ভদ্র, পরোপকারী। জ্ঞানত কারো ক্ষতি সে কখনো করেনি। তার বয়স যখন তিরিশ, কী-একটা কাজ সেরে সে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা পথ ধরে ফিরছিল। তখন নিশ্চয়ই রাস্তা খারাপ ছিল। একটা হোঁচট খেয়ে সে ছিটকে পড়ে, ওপর থেকে একটা মস্ত পাথর গড়িয়ে এসে তাকে গুঁড়িয়ে দেয়। তার সঙ্গী প্রত্যক্ষদর্শী। গগনেন্দ্রর বড়ো ছেলের বয়স তখন আট।

‘তারপরই লোকে বলাবলি শুরু করল। শুধু তাই নয়, তারপর থেকেই ভুজঙ্গ চৌধুরীর বংশের পুরুষরা দুর্ঘটনায় ঘন ঘন মারা পড়তে লাগল। আশ্চর্য, সব ঘটনাতেই পাথর চাপা পড়া মৃত্যুর কারণ। কেউ কেউ মৃত্যুর আগে অদ্ভুত কথা বলেছে— এক বুড়ির কথা, আগুনের ভাঁটার মতো যার চোখ, ভেজা কাপড় আর চুল থেকে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছে। শেষ পর্যন্ত বিমলকান্ত চৌধুরী নিজের চোখে তাঁর বাবাকে অমন এক দুর্ঘটনায় মারা পড়তে দেখে জমিজমা, বাড়িঘর সব বিক্রি করে এখান থেকে চলে যান। তখন তিনি মাত্র যুবক, সবে বিয়ে করেছেন।

‘আর বাছা তুমি,’ মহারাজ আমার কাঁধে আলগাভাবে হাত রেখে বললেন, ‘সেই ভুজঙ্গ চৌধুরীর বংশের ছেলে, নিয়তিই যেন তোমাকে এখানে টেনে এনেছে। আগামীকাল হচ্ছে সেই তারিখ, যেদিন ভোরে বিন্দুবাসিনীকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। ওর আত্মা এতদিনে আবার জেগে উঠেছে, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে। তবে,’ একটু থেমে মহারাজ বললেন, ‘পুথিপত্র যা পড়েছি, বিন্দুবাসিনীর অভিশাপ আগে কখনো ব্যর্থ হয়নি, কিন্তু তোমার বেলায় দু-দু-বার ওটা ফলেও ফলেনি। আমার ধারণা তার অশুভ শক্তি ক্ষয়ে এসেছে। আমি তোমার জন্য প্রার্থনা করব। তুমি এখান থেকে সুস্থ শরীরে ফিরে যাও এই কামনাই করি।’

‘আমার কি কিছুই করণীয় নেই?’ ছোটো ছেলের মতো আমি বলে উঠলাম।

‘না, ভগবানে বিশ্বাস রাখা ছাড়া আর কিছু নয়।’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আর মনে রেখো, ঈশ্বরের শক্তি অমোঘ, অশুভ শক্তিকে শেষ পর্যন্ত তার কাছে মাথা নোয়াতে হবেই। আমার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে তিনি কী যেন মন্ত্র আওড়ালেন।

‘সত্যি কথা বলতে কী, একটা ভীষণ আতঙ্কে আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। সাধু মহারাজের মুখে শোনা তিনশো বছর আগের এক বর্বর ঘটনা, যার নায়ক আমারই পূর্বপুরুষ, আমাকে নিশ্চয়ই ভীষণ বিচলিত করেছিল, আমার চোখে-মুখেও বোধ হয় ফুটে উঠেছিল তার ছাপ। কারণ, মহারাজ আমাকে একা ছেড়ে দিলেন না, হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

‘হোটেলে ফিরে নিজের ঘরে যেতে আমার যেন ভয় করছিল। বিন্দুবাসিনীর অভিশাপ এবং ভুজঙ্গ চৌধুরীর বংশের একজনের পর একজনের পাথর চাপা পড়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু আমার সমস্ত মন ভরে রেখেছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমাকে একা পেলেই একটা পাথর গড়িয়ে আসবে আমার দিকে, লোকজনের মধ্যে থাকাই আমার পক্ষে নিরাপদ।

‘কিন্তু সবার তো আর আমার মতো অবস্থা নয়। একটু রাত হতেই একতলার যে ঘরে লোকজন প্রথমে এসে বসে, সে-ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল। হোটেলের মালিকও আমার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন লক্ষ করে আমি উঠে পড়লাম। দোতলায় আমার ঘরে এসে দরজা ভালোভাবে এঁটে তবে শুলাম। ঘরের ওপরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম, ইট সিমেন্ট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা আছে কি না। বিছনায় এপাশ ওপাশ করছিলাম কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বিন্দুবাসিনীর চেহারা আর সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। তারপর একসময় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

‘হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম পুব আকাশ গাঢ় লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এত ভোরে আমার ঘুম ভাঙল কেন? বাইরে জোরে বাতাস বইছে, ঠিক ঝড় নয়, কিন্তু ঠিক স্বাভাবিকও নয়। আমার ঘরের বাইরে ঢাকা বারান্দা থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এল আমার। সঙ্গেসঙ্গে আতঙ্কে আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম আমি। আবার সেই শব্দ। একটা ঘেষটানো শব্দ, যেন ভারী কিছু ঘষে ঘষে কিংবা গড়িয়ে আমার দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। ওই বিচিত্র শব্দের সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা শব্দ হচ্ছে— ধপ। ক্রমেই এগিয়ে আসছে ওটা।

‘আমি চিৎকার করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না। বিছানা থেকে আমি লাফিয়ে মাটিতে পড়লাম, আমার সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপছিল। কী করে আমি পালাব! আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, তিনশো বছর আগের এক অভিশাপ ফলতে চলেছে। একটা প্রকাণ্ড পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে আমাকে গুঁড়িয়ে দিতে আসছে। একটা পাথর! তারই শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। বিন্দুবাসিনীর প্রেত ওটাকে ঠেলে নিয়ে আসছে আমার দরজার দিকে। উঃ সে কী ভয়ানক অনুভূতি!’ অমিতাভর চোখে-মুখে ফুটে উঠল একটা আতঙ্কের ছাপ। ঘরের মধ্যে আমরা সবাই ভীষণ একটা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছি। ওর আতঙ্ক আমাদেরও স্পর্শ করেছে।

‘আমি উন্মত্তের মতো চারদিকে তাকালাম,’ অমিতাভ আবার শুরু করল, ‘কোথা দিয়ে পালাব? হঠাৎ মনে পড়ল আমার বাথরুমের পেছন দিয়েই জমাদারের লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা চলে গেছে। জয় ভগবান! আমি এক ছুটে বাথরুমের পেছনের দরজাটা খুলে ফেললাম, তারপর তরতর করে ওই সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। তাড়াহুড়োয় মাটিতে পা দেবার সঙ্গেসঙ্গে আমি টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়লাম আর সেটাই বাঁচিয়ে দিল আমাকে। এক পলক আগে আমি যেখানে মাটিতে পা দিয়েছিলাম, সেখানে প্রায় আমার পা ছুঁয়ে ধপ করে একটা পাথরের মস্ত চাঁই মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল। আমি যদি গড়িয়ে না পড়তাম তবে আর আমার রক্ষা ছিল না। পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মতো আমি পড়ে রইলাম, সমস্ত শরীর যেন অসাড় হয়ে গেছে।

‘আস্তে আস্তে আমি মাথা তুললাম। পাথরটা চোখে পড়তেই আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুতের শিহরন বয়ে গেল। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। একটা চিৎকার করে ছুটলাম, ওই অভিশপ্ত পাথরটা থেকে যতদূর সম্ভব আমি সরে যেতে চাই। কে যেন শক্ত করে আমাকে বুকে চেপে ধরল। আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল, বাচ্চা ছেলের মতো ভেউ ভেউ করে আমি কাঁদছিলাম। যিনি আমাকে বুকে চেপে ধরেছিলেন, তিনি সাধু মহারাজ।

‘আর ভয় নেই তোমার,’ আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে শান্ত গলায় তিনি বললেন, ‘বিপদ কেটে গেছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অশুভ শক্তি আর কোনোদিন তোমার ক্ষতি করবার চেষ্টা করবে না। তুমি আমার সঙ্গে এসো, গতকাল রাত্তিরেই আমার কাছে তোমাকে রাখা উচিত ছিল।’

‘হোটেলে ততক্ষণে একটা শোরগোল পড়ে গেছে। আমার ভয়ার্ত চিৎকারে অনেকেই জেগে উঠেছিল। সাধু মহারাজ কিন্তু কোনেদিকে না তাকিয়ে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে নিয়ে চললেন তাঁর কুটিরে। আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে তিনি নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন। সঙ্গেসঙ্গে নিশ্চিন্ত নিদ্রা আচ্ছন্ন করে ফেলল আমাকে।

‘পরদিন বেশ বেলায় আমার ঘুম ভাঙল। শরীর ঝরঝরে মনে হচ্ছে। আমি উঠে বাইরে এলাম। একটা গাছের তলায় হরিণের চামড়ার আসনে সাধু মহারাজ ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন। আমি তাঁকে বিরক্ত করলাম না। হাত-মুখ ধুয়ে ভেতরে গিয়ে বসলাম। তখুনি আমার নজরে পড়ল এক কোনায় আমার চামড়ার সুটকেসটা দাঁড় করানো রয়েছে।

‘খানিক বাদেই মহারাজ ঘরে ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হেসে বললেন, ”তোমার বিপদ কেটে গেছে, অভিশাপ থেকে তুমি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত, যেখানে খুশি এবার তুমি যেতে পার!”

‘তাঁর মুখেই শুনলাম, আমার সুটকেসটা, তিনিই আনিয়ে রেখেছেন, আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে হোটেলের পাওনাও মিটিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে প্রণাম করে সেইদিনই আমি ওখান থেকে রওনা দিলাম।

‘সুতরাং অতীতকে ইচ্ছে করলেই ভোলা যায় না,’ আমাদের দিকে তাকিয়ে অমিতাভ একটু হাসল, তারপরই বলল, ‘আমার কাহিনি কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। ওখান থেকে আমি শিলিগুড়ি এলাম। দুপুরে স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে বসে খাবার অর্ডার দিয়েছি, এমন সময় পেছন থেকে দু-জনের কথাবার্তা আমার কানে এল। ওরা বোধ হয় আমাকে লক্ষ করেনি।

‘কাল রাত্তিরে ওই ভদ্রলোকের কথাবার্তা আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল। যেন ভীষণ একটা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন, ঘর ছেড়ে যাবার ইচ্ছে ছিল না। আমার সঙ্গে চেনা নেই, কিন্তু কিছুতেই যেন ছাড়তে চাইছিলেন না আমাকে।’

‘আমার তো মনে হয়েছিল ভদ্রলোক নেশা করেছিলেন,’ দ্বিতীয়জন বলল।

‘তা হতে পারে, কিন্তু একটা আশ্চর্য ঘটনার মাথামুন্ডু কিছু আমি বুঝতে পারিনি। আমার ঘরটা ছিল ওঁর ঠিক পাশেই। ভদ্রলোকের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। কোথা থেকে শব্দটা আসছে বুঝতে না পেরে আমি জানালা দিয়ে উঁকি মেরেছিলাম, ভেবেছিলাম হয়তো বাইরে থেকেই আসছে।

‘বাইরের দিকে তাকিয়ে আমি তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। ভোরের ফুটফুটে আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম একজন গেরুয়াধারী সাধু বাবাজি পেছনদিকের বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর ডান হাতটা আকাশের দিকে, আর ডাইনির মতো একজন বুড়ি তাঁর সামনে জড়োসড়োভাবে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তারপরই ওই ভদ্রলোক লোহার সিঁড়ি বেয়ে পড়ি-মরি করে নামলেন, আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গে একটা মস্ত পাথর, বোধ হয় কার্নিশের একটা চাঁই তার পায়ের কাছে ভেঙে পড়ল। ভদ্রলোক পড়ে গিয়েছিলেন, উঠে কানফাটা চিৎকার করে তিনি দৌড়ে একেবারে সেই সাধুর বুকে গিয়ে পড়লেন। ওই বুড়িকে কিন্তু আর দেখতে পেলাম না, কখন যে সে চলে গেছে, তা জানতেও পারিনি। সাধুবাবা তাঁকে কী বলছিলেন তার একবর্ণও আমি শুনতে পাইনি…।’

‘অদ্ভুত ব্যাপার তো…’

‘আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, দরজা খুলে বেরুতে গিয়ে আরও একটা অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখে পড়ল। পুরো বারান্দাটাই ভেজা, যেন ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে ভিজে গেছে।’

অমিতাভ ওর কাহিনি শেষ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *