সদানন্দ স্যার

সদানন্দ স্যার

সদানন্দ স্যার ক্লাশে ঢুকতেই মুহূর্তের মধ্যে সব গোলমাল যেন জাদুমন্ত্রে থেমে গেল। এমন অখণ্ড নিস্তব্ধতা নেমে এল যেন একটা ছুঁচ পড়লেও টের পাওয়া যায়। অথচ এক মিনিট আগেও ক্লাশে যেন ডাকাত পড়েছিল।

আর কোনো স্যারের ক্লাশে কিন্তু ছেলেরা এমন মনোযোগী হয় না, শান্ত হয়েও বসে থাকে না, সেই ওরাই আবার সদানন্দ স্যারের ক্লাশের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। এমন সুন্দর উনি পড়ান, গল্পের মতো মনে হয়, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে সবাই।

সদানন্দ স্যারের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। শ্যামবর্ণ পাতলা চেহারা, চোখে মুখে একটা দৃঢ়তার ছাপ। শক্ত সমর্থ চেহারা না হলেও তাঁর মন যে খুব শক্ত তার পরিচয় ছেলেরা অনেক বারই পেয়েছে, এমনকী হেড স্যার পর্যন্ত সমীহ করে চলেন এই রাশভারী মানুষটিকে।

সদানন্দ স্যার ক্লাশ নাইন আর টেন-এ বাংলা আর ইংরেজি পড়ান। একবার দু-জন নতুন ছেলে ক্লাশ নাইনে ভরতি হয়েছিল। একজন ডি এম-এর ছেলে অন্যজন এস পি-র। ওদের বাবারা এই শহরে একই সময়ে বদলি হয়ে এসেছিলেন। মফসসল শহর, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আর সুপারিনটেন্ডেন্ট অফ পুলিশকে সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখে, খাতির করে চলে। ছেলে দুটি সামনের বেঞ্চিতে বসে গল্প করছিল। সদানন্দ স্যার কী পড়াচ্ছেন সেদিকে হুঁশ ছিল না, একটু যেন তাচ্ছিল্য ভাব। অন্য ছেলেরা বিরক্ত ভাবে তাদের দিকে তাকাচ্ছিল, সেদিকে ওদের ভ্রূক্ষেপও ছিল না।

সদানন্দ স্যার হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন। ওরা তখনও গল্প করে যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, সারা ক্লাশে একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা। সেটাই বোধ হয় ছেলে দুটিকে সজাগ করেছিল। ওরা তাকিয়ে দেখেছিল সদানন্দ স্যারের স্থির দৃষ্টি ওদের মুখের ওপর।

‘তোমাদের গল্প শেষ হয়েছে?’ সদানন্দ স্যার শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন।

ওরা কোনো জবাব দেয়নি, বোধ হয় জবাব দেওয়া প্রয়োজন মনে করেনি।

‘প্লিজ গো আউট অ্যান্ড হ্যাভ ইওর টকস ওভার’, তেমন শান্ত কণ্ঠেই বলেছিলেন সদানন্দ স্যার।

ওরা দু-জন বসেই ছিল, যেন কথাটা কানে যায়নি।

‘আই টোল্ড ইউ টু গো আউট’, একটু গলা উঠেছিল সদানন্দ স্যারের।

ওদের মুখ লাল হয়েছিল। যার তার ছেলে নয় ওরা, এ ধারণাটা ছোটো বয়স থেকেই শেকড় গেঁথে বসেছে ওদের মনে।

সদানন্দ স্যারের মুখও লাল হয়ে উঠেছিল। জীবনে তিনি কখনো কোনো ছেলের গায়ে হাত তোলেননি। সেদিন প্রথম ডেস্কের ঢাকনা খুলে বেত বের করে বলেছিলেন, ‘ডোন্ট ফোর্স মাই হ্যান্ডস। গো আউট।’

তাঁর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠেছিল ক্লাশসুদ্ধ ছেলে, স্যারকে এমন রাগতে তারা কখনো দেখেনি। ছেলে দুটি সুড়সুড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল।

পরে হেড স্যার বলেছিলেন, ‘অতটা হার্ড না হলেই পারতেন সদানন্দবাবু। যতই হোক ডি এম আর এস পি-র ছেলে।’

‘ক্লাশে সব ছেলেই আমার কাছে সমান’, সদানন্দ স্যার শান্ত গলায় জবাব দিয়েছিলেন। ‘বংশতালিকা দেখে ছেলে পড়াবার মতো মানসিক ক্লীবতা আমার নেই।’

হেড স্যার চুপ করে গিয়েছিলেন।

সদানন্দ স্যার ক্লাশে ঢুকে সবার ওপর এক বার চোখ বুলিয়ে নিলেন, তাঁর মুখে ফুটে উঠল একটা প্রসন্ন ভাব।

‘দ্য বেস্ট টিচার্স অফ হিউম্যানিটি আর দ্য লাইভস অফ গ্রেট মেন’, তিনি পড়াতে শুরু করলেন। ‘মানুষের চরিত্র গঠনে মনীষীদের জীবনীর মতো আর কোনো শিক্ষা নেই। আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাঁদের চারিত্রিক ও মানসিক গুণ সাধারণের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছিল, তাঁরাই হলেন গ্রেট মেন— যেমন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, হাজি মহম্মদ মহসিন, ঋষি অরবিন্দ। মহাপুরুষ তাঁরা ছিলেন কিনা সে বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু তাঁরা যে অসাধারণ পুরুষ ছিলেন সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। মহাকবি শেক্সপিয়ার এই গ্রেটনেসকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন, যেমন ”সাম পিপল আর বর্ন গ্রেট, সাম অ্যাচিভ গ্রেটনেস, অ্যান্ড সাম হ্যাভ গ্রেটনেস থ্রাস্ট আপন দেম।” অর্থাৎ মহৎ গুণ নিয়েই কেউ কেউ জন্মগ্রহণ করেন, কেউ কেউ-বা নিজের চেষ্টায় অর্জন করেন, আবার কিছু মানুষের ওপর সেই মহত্ত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়— বলা যেতে পারে পারিপার্শ্বিক ঘটনায় তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরে যায় অ্যান্ড দে বিকাম গ্রেট।’

‘আজ আমরা ডেভিড হেয়ারের জীবনী আলোচনা করব।’ সদানন্দ স্যার একটু থামলেন তারপর আবার শুরু করলেন, ‘ডেভিড হেয়ার নিজে কিন্তু তেমন লেখাপড়া শেখেননি। ছোটোবেলা বাবার দোকানে ঘড়ি মেরামতির কাজ করতেন। বড়ো হয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে সুদূর বিলেত থেকে তিনি এদেশে এসেছিলেন। কলকাতা তখন ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি। ডেভিড হেয়ার এত ভালো ঘড়ির কাজ জানতেন যে, অল্পদিনেই তাঁর ব্যবসা ফেঁপে উঠেছিল। সব জায়গা থেকে কাজ আসছিল তাঁর কাছে। তিনি লক্ষপতি হয়েছিলেন। ফলে গণ্যমান্য মানুষদের সঙ্গে তাঁর একটা নিকট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এদিকে দরিদ্র ভারতবাসীর দুর্দশা আর পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অশিক্ষার অন্ধকারই এখানকার মানুষের প্রধান ব্যাধি। তাঁর নিজের জীবনেও তিনি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তাই জীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি মনে-প্রাণে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি নিজের চেষ্টায় এখানে স্কুল কলেজ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, অকাতরে অর্থব্যয় করেছিলেন, শেষপর্যন্ত নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন।’

‘শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান ভারতবাসী কখনো ভুলতে পারবে না। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন পরম দয়ালু। ধার কর্জ করেও সাহায্যপ্রার্থীর মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। কাউকে নিরাশ করেননি। গরিব মানুষকে সাহায্য করার জন্য তিনি নোংরা, দুর্গন্ধময় বস্তিতে পর্যন্ত অনায়াসে চলে যেতেন। একজন বিদেশি হয়েও এখানকার মানুষের জন্য তাঁর এই যে ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ সেবা, তা শুধু একজন মহাপ্রাণ মানুষের পক্ষেই সম্ভব। হি ওয়াজ এ গ্রেট ম্যান ইনডিড, বাট হি ওয়াজ নট বর্ন গ্রেট, দ্য মিজারি অ্যান্ড পভার্টি অফ দ্য পিপল অফ দিস ল্যান্ড মেড হিজ হার্ট ব্লিড, অ্যান্ড প্রমটেড হিম টু ডু নোবল থিংগস হুইচ মেড হিম গ্রেট।’

পিরিয়ড কোথা দিয়ে শেষ হয়ে গেল কেউ বুঝতেও পারল না, এমন তন্ময় হয়ে শুনছিল সবাই। সদানন্দ স্যার বেরিয়ে যাবার পরেও কয়েক মুহূর্ত কেউ কথা বলল না, তারপরই শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন থেকে হট্টগোল।

ছুটির পর ওরা দুই বন্ধু একসঙ্গে বেরোল— সুজিত আর অর্ণব। দু-জনেই এবার ক্লাস টেনে উঠেছে। সুজিতের গায়ের রং কালো, পেটা স্বাস্থ্য, খেলাধুলায় ইস্কুলের সেরা। ওর বাবা কালেক্টরিতে চাকরি করেন।

অর্ণবের ফর্সা গায়ের রং, একটু রোগা চেহারা। ও কিন্তু লেখাপড়ায় খুব ভালো, হেড স্যার থেকে শুরু করে সবাই আশা করেন ও ইস্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। অর্ণবের বাবা উকিল।

ওদের দু-জনের চরিত্রে একেবারেই মিল নেই অথচ ওদের এমন ভাব হল কেমন করে সেটাই আশ্চর্য! সুজিত যেন এক অশান্ত ঘূর্ণী, ডানপিটে; আর অর্ণব শান্ত প্রকৃতির, খেলা টেলা ওর তেমন আসে না। ওদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এক নাটকীয় ঘটনার ভেতর দিয়ে। অর্ণব ক্লাস সেভেনে এই ইস্কুলে ভরতি হয়েছিল। ও কারও সঙ্গে তেমন মিশত না। তাই একদিন সুজিত আর তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ ইস্কুল থেকে ফেরার পথে ওকে টিটকিরি দিয়েছিল। সুজিত বলেছিল, ‘এই যে আইনস্টাইন যাচ্ছেন। জ্ঞানী মানুষ তো তাই আমাদের সঙ্গে মেশেন না। গুমোরে পা যেন মাটিতে পড়ে না।’ ওর বন্ধুরা হেসে উঠেছিল।

অর্ণব চুপ করে থাকেনি, বলেছিল, ‘না ভাই, আইনস্টাইন হবার মতো অত বড়ো স্বপ্ন আমি দেখি না। তবে তোমাদের সঙ্গে কথা বলি না সেটা গুমোরের জন্য নয়, আমার স্বভাবটাই অমন। হয়তো সেটা আমার দোষ।’

‘অমন ছেঁদো কথায় আমরা ভুলি না’, একজন বলেছিল। ‘এসো, একহাত হয়ে যাক।’

অর্ণব শান্ত কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমি কখনো মারামারি করিনি, কিন্তু তুমি যখন আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ, আমি নিশ্চয় লড়ব। আমি জানি আমি মার খাব, কিন্তু তার জন্য ভয়ে পিছিয়ে যাব না।’

তারপরই বই-খাতা মাটিতে রেখে ও ছেলেটির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। সুজিতই তখন ওর পিঠ চাপড়ে বলেছিল, ‘না, তোমার রোগা শরীর হলেও সাহস আছে, আজ থেকে আমরা বন্ধু।’

তারপর থেকেই আস্তে আস্তে ওরা কীভাবে পরস্পরের খুব কাছে এসে পড়েছে তা ওরা নিজেরাই জানে না। পথে-ঘাটে বিপদের হাত থেকে অর্ণবকে সামলায় সুজিত, আর অর্ণব ওকে লেখাপড়ায় সাহায্য করে, নোট তৈরি করে দেয়।

‘সদানন্দ স্যারের পড়াবার মধ্যে মাঝে মাঝেই একটা আক্ষেপ ফুটে ওঠে, বুঝতে পারিস?’ হাঁটতে হাঁটতে অর্ণব জিজ্ঞেস করল।

‘কীসের আক্ষেপ?’ প্রশ্ন করল সুজিত।

‘আমাদের এই বাংলায় কত মনীষী একসময় জন্মেছিলেন, আর আজ সেই বাংলায় মানুষের মতো মানুষ নেই। সারা ভারতবর্ষকে একসময় যাঁরা পথ দেখিয়েছিলেন, আজ তাঁদের স্থান শূন্য। এই আক্ষেপটাই যেন ফুটে ওঠে।’

‘স্যারের জন্য আমার খুব মন খারাপ লাগে’, সুজিত রাস্তার পাশে একটা বুনো গাছের পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল। ‘অত ভালো পড়ান। সবাই বলে খাঁটি মানুষ, অন্যায়ের সঙ্গে কখনো আপোশ করেন না। অথচ তাঁর একমাত্র ছেলে প্রতিবন্ধী, দুটো পা-ই অসাড়, কোনোদিন হাঁটতে পারবে বলে মনে হয় না।’

‘সত্যি’, অর্ণব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল। ‘কিন্তু ওই ছেলের কী মেধা! সারাক্ষণ বই আর লেখাপড়া নিয়েই আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত যেন ওর জিভের ডগায় তেমন বিখ্যাত সব ইংরেজি বই এর মধ্যেই ও শেষ করে ফেলেছে। সুযোগ পেলে ছেলেটা কি না হতে পারত!’

‘এত দুঃখের মধ্যেও সদানন্দ স্যার তাঁর নিষ্ঠায় অচল, ভাবতেও অবাক লাগে’, সুজিত বলল।

‘হ্যাঁ, একজন সৎ আর নির্ভীক মানুষ’, অর্ণব বলল। ‘স্যার একদিন বলেছিলেন, ‘রেসপেক্ট কমান্ডস রেসপেক্ট।’ তুমি যদি অপরকে সম্মান কর তবেই অপরের কাছ থেকে সম্মান আশা করতে পার— কী সুন্দর কথা!’

একটা টিনের চালার বাড়ির পাশে এসে সুজিত দাঁড়িয়ে পড়ল। উঠোনে একটা কামরাঙা গাছ, রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে। গাছটা প্রায় দোতলা সমান উঁচু, সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে। সেই পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে অনেক কাঁচা, পাকা কামরাঙা— পাকাগুলোয় হলুদ রং ধরেছে।

‘অ ঠানদি’, সুজিত হাঁক মেরে বলল। ‘দুটো কামরাঙা নেব?’

আধ ময়লা কাপড় গায়ে জড়ানো, মাথায় কদম ছাঁট সাদা চুল, এক বুড়ি বেরিয়ে এসে ফোকলা দাঁতের হাসি হেসে বলল, ‘নাতিদের কি দুটোয় মন ভরবে গো… তা এক গন্ডাই নাও, বেশি নিওনি যেন।’

সুজিত পাকা দেখে চারটে কামরাঙা পাড়ল, অর্ণবকে দুটো দিল। টসটসে পাকা, রসে টইটম্বুর। খাসা খেতে গাছপাকা কামরাঙা, অম্লমধুর।

মফসসল শহর বলেই বোধ হয় সভ্যতার কৃত্রিমতা এখনও এখানকার আবহাওয়া কলুষ করেনি, পাড়াপ্রতিবেশীর মধ্যে একটা মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মাচার লাউটা, গাছের কলাটা আশপাশের মানুষকে না দিয়ে কেউ খায় না। তাই পাড়াপড়শিরা রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই আপনজন হয়ে উঠেছেন।

ওদের এবার ক্লাস টেন। ইস্কুলের শেষ ধাপ, এ ক্লাসে উঠলে ছেলেদের মধ্যে যেন একটু ভারিক্কি ভাব আসে। নিজেকে হঠাৎ বড়ো মনে হয়। এর মধ্যে একদিন স্কুল ইনস্পেকটর এলেন। আগে থেকে জানিয়ে আসেননি, তাই কোনো প্রস্তুতি ছিল না। অর্ণবদের ক্লাসে এসে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আমি গত দশ বছর এই শহরে বাস করছি, ইংরেজি কী হবে?’

যাকেই প্রশ্ন করেন সেই উঠে দাঁড়িয়ে ‘আই অ্যাম লিভিং’ দিয়ে শুরু করে।

শেষপর্যন্ত অর্ণব জবাব দিল, ‘আই হ্যাভ বিন লিভিং ইন দিস সিটি ফর দ্য লাস্ট টেন ইয়ারস।’

ইনস্পেকটর আগে মাথা দোলালেন। তারপর বললেন, ‘করেক্ট দ্য সেনটেন্স — হি রাইটস নট অনলি এ গুড হ্যান্ড বাট অলসো টকস ফ্লুয়েন্টলি।’

কেউ সঠিক জবাব দিতে পারল না। সব শেষে অর্ণবের দিকে তাকালেন ইনস্পেকটর। ও সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হি নট ওনলি রাইটস এ গুড হ্যান্ড বাট অলসো স্পিকস ফ্লুয়েন্টলি।’

‘গুড—ভেরি গুড’, ইনস্পেকটর বললেন। ‘এ ক্লাসে দেখছি তুমিই একমাত্র লেখাপড়া কর। ”দ্য সলট অফ দ্য আর্থ” কথাটার মানে জান?’

অর্ণব মাথা নাড়ল।

‘পৃথিবীর জ্ঞানী, গুণী, নমস্য মানুষদের তাই বলা হয়’, ও বলল।

‘তেমন কয়েক জন মানুষের নাম করতে পার?’ ইনস্পেকটর বলল।

‘সক্রেটিস, যিশু খ্রিস্ট, হজরত মহম্মদ, গুরু নানক, শ্রী চৈতন্য।’

‘বাঃ! ইউ আর এ ভেরি শার্প বয়, আমি খুব খুশি হলাম।’

ইনস্পেকটর যেদিন এসেছিলেন তার দু-দিন পরে এক ঘটনায় সারা শহর তোলপাড় হল। সুজিতদের ইস্কুলের হস্টেলের কয়েক জন ছাত্র সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। টিকিট কাটা নিয়ে কয়েক জনের সঙ্গে ওদের বচসা হয়। তারা ছিল টিকিটের কালোবাজারি, দলেও ছিল ভারী। ছেলেদের তারা বেদম মারল। ওরা হস্টেলে ফিরে এসে ব্যাপারটা জানাতেই ছাত্ররা খেপে গেল, হকি স্টিক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কালোবাজারিদের ওরা সেদিন উচিত শিক্ষাই দিত, কিন্তু পুলিশ এসে পড়ল। সামান্য প্ররোচনায় তারা এলোপাথাড়ি গুলি চালাল, দু-জন ছাত্র মারা গেল। কালোবাজারির দল কিন্তু পুলিশ আসার আগেই সরে পড়েছিল, কেউ বোধ হয় ওদের সাবধান করে দিয়েছিল।

ব্যাস, যেন আগুনে তেল পড়ল। দুই কিশোরের মৃত্যুতে শহরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। কাগজেও লিখল পুলিশের সঙ্গে কালোবাজারিদের আঁতাত আছে, তাদের রক্ষা করার জন্যেই পুলিশ এসেছিল এবং বিনা প্ররোচনায় তারা গুলি চালিয়েছে।

শহর উত্তাল। একদিন ডি এম আর এস পি-র বাড়ির সামনে জড়ো হল শয়ে শয়ে মানুষ, তাদের দাবি বিচার চাই। তাদের হটাতে পুলিশ লাঠি চার্জ করল। আহত হল বেশ কিছু, পুলিশ হাতের কাছে যাকে পেল তাকেই গ্রেপ্তার করল। আরও খেপে গেল মানুষ। ভাঙচুর শুরু হয়ে গেল। সারা শহর থমথমে। ডি এম কার্ফু ঘোষণা করলেন, সন্ধ্যা সাতটা থেকে পরদিন ভোর ছ-টা পর্যন্ত কার্ফু। কেউ বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবে না। তা ছাড়া দিনের বেলা ১৪৪ ধারা। কলকাতা থেকে মন্ত্রীরা এবং এম এল এ-রা ছুটে এলেন। রাজনৈতিক দলগুলি পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিল।

ইস্কুল কলেজ বন্ধ। শহরের জীবনযাত্রা প্রায় অচল। এমন অরাজক অবস্থা অর্ণব আর সুজিত আগে কখনো দেখেনি। রাজনৈতিক আন্দোলনে এই ওদের প্রথম অভিজ্ঞতা। তবে শহরের অবস্থা ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। সেদিন অর্ণবের বাড়ি গিয়ে সুজিত দেখল ওর মুখ গম্ভীর, যেন খুব চিন্তা করছে।

‘কী ব্যাপার?’ সুজিত জিজ্ঞেস করল। ‘কী ভাবছিস অত?’

‘আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থার কথা ভাবছি’, অর্ণব জবাব দিল। ‘দুর্নীতি আমাদের সমাজকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, নইলে যে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে তারা কালোবাজারিদের রক্ষার জন্য যারা অন্যায়ের প্রতিকার করতে গিয়েছিল, তাদের ওপরেই গুলি চালাল কেন?’

‘কিন্তু পুলিশ এসে না পড়লে একটা দাঙ্গা বেঁধে যেত’, সুজিত বলল।

‘আমি সে-কথা বলছি না’, অর্ণবের গলায় উত্তেজনার ছোঁয়া। ‘পুলিশ যদি এলোপাথাড়ি গুলি না চালিয়ে আসল অপরাধীদের ধরবার চেষ্টা করত তবে এসব কাণ্ড কিছুই হত না। ওই কালোবাজারিদের সঙ্গে পুলিশের একটা রফা আছে সবাই জানে, কেন এমন হবে? আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ঘুণ ধরেছে বলেই আজ এই অবস্থা।’

‘ওসব রাজনীতির ব্যাপার’, সুজিত বলল। ‘আমার বাবা বলেন রাজনীতির মতো নোংরা জিনিস আর নেই। ভালো কথা, এখানে আসার সময় সদানন্দ স্যারের সঙ্গে দেখা হল, তিনি বললেন সঞ্জয় তোকে আর আমাকে যেতে বলেছে।’

সঞ্জয় হল সদানন্দ স্যারের ছেলে। ছোটোবেলায় পোলিও হয়ে পা দুটো শুকিয়ে গেছে। ওদের দু-জনের সঙ্গে ওর খুব ভাব যদিও বয়সে ও ছোটো।

সদানন্দ স্যারের বাড়ি যেতেই তিনি বললেন, ‘তোমরা এসেছ। যাও ভেতরে চলে যাও।’

সঞ্জয় বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিল। মাথার নীচে দুটো বালিশ দিয়ে একটু উঁচু করা হয়েছে। অর্ণব বইটার নাম পড়ল, ”দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার”, লেখক মার্ক টোয়েন।

‘এসো’, ওদের দেখে বইটা মুড়ে পাশে রেখে হাসিমুখে বলল সঞ্জয়। ও যে খুশি হয়েছে তা ওর চোখ-মুখই বলে দিচ্ছে।

‘কেমন আছিস আজ?’ অর্ণব জিজ্ঞেস করল। ‘সর্দি জ্বর হয়েছিল শুনলাম।’

‘ও কিছু না’, সঞ্জয় জবাব দিল। ‘আমি তোমাদের বিশেষ একটা কারণে আসতে বলেছিলাম।’

‘কী ব্যাপার?’ সুজিত কৌতূহলী হয়ে উঠল।

‘এই যে পুলিশের গুলিতে দু-জন ছাত্র মারা গেল, কয়েক জন আহতও হয়েছে, তার বিরুদ্ধে তেমন জোরালো প্রতিবাদ হল কই? শুধু কিছু ভাঙচুর আর নেতারা এসে একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বক্তৃতা দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকার কিছু হয়নি।’ সঞ্জয়ের মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠল, ‘গুন্ডারা আগের মতোই বুক ফুলিয়ে টিকিটের কালোবাজারি করছে। যে দু-জন ছাত্র মারা গেল তাদের বাড়ির কথা কেউ ভাবল না। হয়তো তারাই ছিল সেই পরিবারের আশা-ভরসা। বারুদের মতো জ্বলে উঠেই নিভে গেল আন্দোলন, আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম।’

‘তুই কি এ নিয়ে আমাদের আবার আন্দোলনে নামতে বলছিস?’ অর্ণব জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, তবে শুধু ছাত্র আন্দোলন নয়, গণ আন্দোলন। সবাইকে সঙ্গী করতে হবে সেই আন্দোলনে। দোষী পুলিশদের সাজা চাই, সিনেমায় কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে, যারা মারা গেছে আর আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

‘থিতিয়ে পড়া আন্দোলনকে আবার জাগিয়ে তোলা খুব সহজ হবে না’, অর্ণব একটু ভেবে বলল।

‘আমি সে-কথা ভেবেছি’, সঞ্জয় বলল। ‘আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে, তা নিয়ে পরামর্শ করার জন্যই তোমাদের ডেকেছি।’

‘শুনি তোর প্ল্যান’, এবার বলল সুজিত।

‘তোমরা প্রথমে গণ স্বাক্ষর অভিযানে নেমে পড়। সব ঘটনা লিখে ঘরে ঘরে গিয়ে স্বাক্ষর জোগাড় কর, ইস্কুলের ছাত্ররাও তাতে সই করবে, তাদের বয়স লিখবে। সেই দরখাস্ত যাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। কাগজে কাগজে তার অণুলিপি পাঠাতে হবে, একটা পাঠাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ওই দিনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা, গুন্ডাদের সঙ্গে তাদের গোপন আঁতাত, কিছুই বাদ দেবে না। ছাত্রদের এক করে সেই আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে আমার বিশ্বাস তা ব্যর্থ হবে না।’

‘তুই ঠিক বলেছিস’, অর্ণব উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলল। ‘আমার মনও বলছিল এ ব্যাপারে কিছু একটা করা উচিত, কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’

‘আর পথ দেখাল যে আমাদের চাইতে বয়সে ছোটো’, সুজিত হেসে বলল।

‘বয়সটা এখানে কোনো ব্যাপার নয় সুজিতদা’, সঞ্জয় বলল। ‘ভগবান একদিক দিয়ে আমাকে মেরে রেখেছেন, তাই আমার চিন্তা করার সময়ের অভাব নেই। এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। এমন অন্যায়ের কোনো প্রতিকার হল না ভেবে ভেবে আমার ভেতরটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। আমি একটা দরখাস্তের খসড়া করে বাবাকে দিয়ে দেখিয়ে নিয়েছি।’

বালিশের তলা থেকে একটা কাগজ বের করে ও অর্ণবের হাতে দিল।

‘এতে যদি কিছু না হয় তবে আমরা আরও বড়ো আন্দোলন গড়ে তুলব, দরকার হলে শহরের জনজীবন স্তব্ধ করে দেব’, সঞ্জয় বলল। ‘আমিও সামিল হব সেই আন্দোলনে।’

ওখান থেকে বেরিয়ে ওরা বাড়ির পথ ধরল। বয়সে ছোটো হলে কী হবে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে সঞ্জয় ওদের চাইতে অনেক এগিয়ে। শারীরিক অক্ষমতা ওকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি বরং আত্মবিশ্বাস যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন তীক্ষ্ন মেধা, সুস্থ থাকলে ও যে একদিন খুব বড়ো হত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ইস্কুলে খেলাধুলা, শক্তিতে সুজিত ছিল এক নম্বর, ফলে ছাত্রদের পাণ্ডা হয়ে উঠতে ওর দেরি হয়নি। ওর ডাকে সাড়া দেবে না এমন ছেলে কমই ছিল। অন্যদিকে অর্ণব ধীর, স্থির, ক্লাসের ফার্স্ট বয়, ওকে একটু সম্ভ্রমের চোখেই দেখত ছেলেরা। ওদের দু-জনের মিলিত চেষ্টায় ছাত্রদের মধ্যে দারুণ সাড়া পড়ে গেল। দল বেঁধে ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাক্ষর অভিযানে বেরিয়ে পড়ল। প্রথম সই কিন্তু করল ইস্কুলের ছাত্ররা, তাও নীচু ক্লাস দিয়ে শুরু, বয়স আর শ্রেণি উল্লেখ করতেও ভুল হল না।

সুজিতদের ক্লাসেই পড়ত আনিমুল। ও একদিন ওদের দু-জনকে বলল, ‘কই তোমরা তো আমাদের এই আন্দোলনে যোগ দিতে বললে না?’

সুজিত একটু থতমত খেল, কিন্তু অর্ণব বলল, ‘আমরা সবাইকে ডেকেছি, তোমাদের আলাদা করে ডাকতে হবে কেন? তোমরা নিজেদের আলাদা ভাবছই বা কেন? আমাদের ইস্কুলের দু-জন ছেলে মারা গেছে, আমি কিংবা তুমিও মারা যেতে পারতাম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এ আমাদের সবার লড়াই।’

আনিমুল লজ্জা পেল। বন্ধুদের নিয়ে সেও যোগ দিল ওই স্বাক্ষর অভিযানে।

ব্যাপারটা কিন্তু গোপন রইল না। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আর এস পি-র দুই ছেলে ওই ইস্কুলে পড়ে, তারাই বোধহয় বাবাদের কানে কথাটা তুলে দিল। একদিন এস পি ইস্কুলে এলেন, হেডমাস্টারমশাইকে কড়া কথা শোনালেন। তাঁর ইস্কুলের ছেলেরা শহরে হাঙ্গামা বাঁধাবার চেষ্টা করেছে, তিনি চুপ করে বসে আছেন। ডি এম খুব রেগেছেন। বলেছেন, এমন চলতে থাকলে ইস্কুল বন্ধ করার হুকুম দেবেন।

হেডমাস্টারমশাই শান্ত মানুষ। এস পি-র ধমকানিতে একটু ভয়ই পেলেন। সুজিত আর অর্ণবকে ডেকে পাঠালেন তিনি। ওদের দেখে এস পি যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, খুব ধমক-ধামক দিয়ে বললেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ওদের জেলে পুরে দেবেন।

অর্ণব খুব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমরা কোনো হাঙ্গামার সৃষ্টি করছি না, অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গণ আবেদন করছি। এতে দোষের কিছু নেই। গণতান্ত্রিক দেশে এমন আবেদন করার অধিকার আমাদের কাছে। বেআইনি কোনো কাজ আমরা করিনি। তবু যদি আমাদের জেলে পোরেন, যাব জেলে। তবু শুধু আমরা দু-জন নই, ইস্কুলের সব ছেলেই তখন জেলে যাবার জন্য লাইন দেবে, জেলখানায় অত ছেলের জায়গা হবে তো? তা ছাড়া অন্য সব ইস্কুলের ছেলেরাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, তারাও পিছিয়ে থাকবে না।’

‘ঠিক আছে’, এস পি গর্জন করে বললেন। ‘তোমাদের বিষদাঁত কেমন করে ভাঙতে হয় তা আমি জানি।’

তিনি চলে যাবার পর হেডমাস্টারমশাই সমস্ত ব্যাপারটা জানতে চাইলেন। সব শুনে তিনি বললেন, ‘না, তোমরা অন্যায় কিছু করনি, তবে পুলিশ তোমাদের হেনস্থা করতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যদি সত্যি সত্যি ইস্কুল বন্ধ করে দেন তবে তো মুশকিল।’

‘আপনি কিছু ভাববেন না স্যার’, সুজিত বলল। ‘ওটা শুধু ভয় দেখানো। আমাদের পেছনে সব মানুষের সমর্থন আছে, ইস্কুল বন্ধ করা অত সহজ হবে না।’

ওদের অনুমানই ঠিক। এস পি অমন শাসিয়ে গেলেও সত্যিই যদি ছেলেরা জেলে যাবার জন্য মিছিল করে আসে, আর কাগজে ফলাও করে সেই খবর ছাপা হয়, তার পরিণাম ভেবে হঠকারী কোনো কাজ তিনি করলেন না।

সুজিতের বাবা কালেক্টরিতে চাকরি করেন, সেটা আবার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অধীনে। তিনি সুজিতের বাবাকে নিজের চেম্বারে ডেকে ছেলেকে শাসন করার হুকুম দিলেন, নইলে কোপটা তাঁর ওপর পড়তে পারে বলে শাসালেন।

সুজিতের বাবা অত সহজে ভয় পাবার মানুষ নন। তিনি বললেন, ‘আমার ছেলে অন্যায় কাজ করলে আমি নিশ্চয়ই তাকে শাসন করব, তার জন্য কারও বলার অপেক্ষায় আমি থাকব না। কিন্তু ওর জন্য আমাকে শাস্তি পেতে হবে কেন? আমার কাজে গাফিলতি হলে আপনি আমাকে শাস্তি দিতে পারেন, কিন্তু আমার ছেলের কাজের জন্যে আমাকে যদি শাস্তি পেতে হয় তা ন্যায় বিচার হবে না। আপনি এ জেলার দন্ডমুন্ডের কর্তা, আপনার কাছে এমন অবিচার আমি আশা করি না।’

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খোঁচাটা হজম করে গেলেন।

অর্ণবেরা আর দেরি করল না। গণ আবেদনটা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দিল, সেইসঙ্গে তার অণুলিপিও পাঠাল কলকাতার কয়েকটা নামি কাগজে এবং দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

কাগজগুলো ব্যাপারটা লুফে নিল। একটা কাগজ প্রথম পাতায় হুবহু ছাপল ওটা, গণস্বাক্ষর সমেত। কলকাতা থেকে রিপোর্টাররা ছুটে এলেন রসাল খবরের আশায়। এস পি আর ডি এম-এর শাসানি প্রকাশ হয়ে পড়ল, রিপোর্টাররা তাঁদের ছবি সমেত সেই খবর পাঠিয়ে দিল। কাগজে ছাপা হল। দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করলেন। জল অনেক দূর গড়াল।

এদিকে বিধানসভায় এ নিয়ে বিরোধী পক্ষ তুমুল হইচই করল। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইল তাঁর কাছে যে গণ আবেদন করেছে ওখানকার মানুষ, কিশোরমতি ইস্কুলের ছাত্ররা যাতে সামিল হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত ব্যাপারটা বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দিলে শান্ত হল বিধানসভা। এরপর মন্ত্রী পরিষদের জরুরি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হল। গণ আবেদনটা পড়া হল ওই বৈঠকে। সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা ও আবেদনে যেসব যুক্তি আর তথ্য দেখানো হয়েছিল, তা মুখ্যমন্ত্রী আর তার মন্ত্রী পরিষদ উপেক্ষা করতে পারলেন না। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে ডেকে পাঠানো হল। কাগজে বেরোল, তাঁকে নাকি খুব ধমকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এস পি ওখান থেকে বদলি হলেন, দোষী কনস্টেবলদের সাসপেন্ড করা হল। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে একজন মন্ত্রী ওখানে টাউন হলে সভা করলেন, সেখানে শহরের গণ্যমান্য মানুষ ছাড়াও সাধারণ মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হল। ভিড়ে উপচে পড়ল টাউন হল, বাইরেও কাতারে কাতারে মানুষ। মাইকের ব্যবস্থা ছিল। মন্ত্রী ওই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। যে দু-জন ছাত্র মারা গেছে তাদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে সরকার থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেন। যারা আহত হয়েছিল তারাও সাহায্য পাবে। গুন্ডাদের দমন করা হবে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আর এস পি-কে এ বিষয় কড়া ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ছাত্রদের তিনি খুব প্রশংসা করলেন। তারা যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরে নেতৃত্ব দিয়েছিল, হিংসার পথে পা বাড়ায়নি, তার জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ধন্যবাদ তাদের কাছে পৌঁছে দিলেন।

হাততালিতে ফেটে পড়ল টাউন হল। বাইরেও তুমুল হাততালি পড়ল। এ যেন জনগণের জয়।

সুজিত আর অর্ণব রাতারাতি সবার প্রিয় হয়ে উঠল। নতুন এস পি একদিন ওদের নিজের অফিসে ডেকে পাঠালেন। মিষ্টি খাওয়ালেন। তিনি বয়সে নবীন, আই পি এস পাশ করে সরাসরি পুলিশ অফিসার হয়েছেন। এই প্রথম তিনি এস পি হিসেবে একটা জেলার দায়িত্ব পেয়েছেন, ন্যায় অন্যায় বোধটা এখনও জলাঞ্জলি দিতে পারেননি। তিনি ওদের সৎ সাহসের খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, কোনো দরকার হলেই ওরা যেন সোজা তাঁর কাছে চলে আসে, তাঁর দরজা সবসময় খোলা থাকবে।

তিরস্কৃত হবার ঘটনাটা প্রকাশ হয়ে পড়ায় ডি এম ওখানে আর মুখ দেখাতে পারছিলেন না। চেষ্টা চরিত্র করে তিনিও ওখান থেকে বদলি হয়ে গেলেন।

এই ঘটনায় সবচেয়ে খুশি হল কিন্তু সঞ্জয়। ও নিজে স্বাক্ষর অভিযানে অংশ নিতে পারেনি, কিন্তু ওর মন সবসময় ছিল অর্ণবদের সঙ্গে।

সিনেমা টিকিটের কালোবাজার যারা করত তাদের একটা চক্র ছিল। সেই চক্রের সঙ্গে সিনেমা হলের কয়েক জন কর্মী আর স্থানীয় থানার কয়েক জন পুলিশও জড়িত ছিল। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা সবাই মনে মনে চটল।

ওই ঘটনায় সুজিত আর অর্ণব যে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটা আর অজানা ছিল না। ওদের দু-জনের ওপর আক্রোশের একটা কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল অথচ ওরা কেউ টেরও পায়নি। এস পি যাদের স্বয়ং আশ্বস্ত করেছেন, তাদের আবার ভয় কীসের!

সেদিন সন্ধের মুখে খেলার মাঠ থেকে ওরা দুই বন্ধু গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছিল। গল্পে ওরা এত মশগুল হয়ে গিয়েছিল যে একটা রাস্তার মোড়ে জনা কয়েক গুন্ডা প্রকৃতির মানুষ যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে তা ওদের খেয়ালই হয়নি।

খুব কাছাকাছি আসার পর হঠাৎই সুজিত ওদের প্রথম দেখল। ছোটোবেলা থেকেই ও ডানপিটে, মারামারি করতে ওস্তাদ। এক মুহূর্তে ও বুঝে নিল গতিক সুবিধের নয়। তা ছাড়া যারা ওখানে অপেক্ষা করছিল তাদের দু-এক জনের মুখ ওর চেনা, সিনেমা হাউসের সামনে টিকিট নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। এখানে সাহস দেখাতে যাওয়া বোকামি, ওরা দলে অনেক ভারী, সশস্ত্রও হতে পারে।

অর্ণবের হাত ধরে এক ঝটকায় ওকে পেছন ফিরিয়ে ও বলল, ‘দৌড়ো।’

অর্ণবের হাত ধরেই ও ছুটতে লাগল। ও বেচারা কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু কিছু একটা ঘটছে আশঙ্কা করে দৌড়ল। সঙ্গেসঙ্গে হইহই করে তেড়ে এল গুন্ডার দল। এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল অর্ণব আর সঙ্গেসঙ্গে গতি বাড়িয়ে দিল। দৌড়ে ওদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এমন ভরসা ছিল না, বিশেষ করে অর্ণবের পক্ষে। সুজিত একা হলে অবিশ্যি আলাদা কথা ছিল, ইস্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় ও বরাবর প্রথম হয়।

বন্ধুকে ফেলে পালাবার কোনো ইচ্ছেই ওর ছিল না। এই অবস্থায় ওর মাথায় খেলতে লাগল কেমন করে গুন্ডাদের চোখে ধুলো দেওয়া যায়। অর্ণবকে নিয়ে ও ডান দিকের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। এদিকের অলিগলি ওর সব মুখস্থ। পেছনে গুন্ডারা তেড়ে আসছে, ব্যবধান খুব বেশি নয়।

এ গলি ও গলি হয়ে ওরা ছুটছে। এদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে, গুন্ডাদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে ওরা। একবার ধরতে পারলে অন্ধকারে ওদের খুনই করে ফেলবে। একটা গলির মধ্যে ঢুকতেই একটি ছেলের মুখোমুখি পড়ে গেল ওরা।

‘কী অমন করে দৌড়চ্ছ কেন?’ চেনা গলায় প্রশ্ন শুনে ওরা তাকিয়ে দেখল অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে আমিনুল।

‘গুন্ডারা আমাদের তাড়া করেছে’, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সুজিত। ‘ধরতে পারলে খুন করে ফেলবে।’

‘ও বুঝেছি’, এক লহমায় ব্যাপারটা আঁচ করল আমিনুল। তারপর বলল, ‘আমার সঙ্গে এসো।’

পাশেই ওর বাড়ি। চটপট ওদের ঘরে ঢুকিয়ে ও দরজা বন্ধ করে দিল, দু-মিনিটও কাটেনি, ওখান দিয়ে ছুটে গেল গুন্ডার দল।

ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল ওরা দু-জন, ওদের বুকের ভেতর যেন হাপর পড়ছে।

‘পানি খাবে?’ ওদের অবস্থা দেখে আমিনুল জিজ্ঞেস করল। ওরা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল।

ওরা একটু ধাতস্থ হতেই আমিনুল ওর বাবাকে ডেকে আনল। সব শুনে তিনি বললেন, ‘আল্লার দোয়ায় তোমরা আজ জানে বেঁচেছ, আমি ওই গুন্ডাদের জানি, ওদের কারবার বন্ধ বলে খেপে আছে। তোমাদের ধরতে পারলে আর রক্ষে ছিল না।’

তিনি লোকজন নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিলেন।

পরদিন সকালেই এস পি-র সঙ্গে দেখা করল সুজিত আর অর্ণব, সব ঘটনা খুলে বলল। শুনতে শুনতে তাঁর মুখ আরক্ত হয়ে উঠল, শক্ত হল চোয়াল। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমাদের গায়ে যাতে আঁচড়টি না পড়ে তার ব্যবস্থা আমি করছি।’

তিনি তক্ষুনি ওই এলাকার থানায় গিয়ে হাজির হলেন। সিনেমা হাউসটা ওই অঞ্চলেই। এস পি বড়োবাবুকে হুকুম করলেন, ওই গুন্ডাদের যেমন করেই হোক ধরে আনতে হবে। এ কথাও বললেন যদি প্রমাণ পাওয়া যায় কোনো পুলিশ ওদের পেছনে আছে তবে সেও রেহাই পাবে না।

এস পি-র মূর্তি দেখে থানার বড়োবাবুর প্যান্ট খুলে যাবার মতো অবস্থা। তিনি তক্ষুনি গুন্ডাদের ধরে আনার হুকুম দিলেন। পুলিশ তৎপর হলে কি না পারে! আধ ঘণ্টার মধ্যে ধরে আনা হল টিকিটের কালোবাজারিদের কয়েক জন পাণ্ডাকে। তাদের ভালো করেই সমঝে দেওয়া হল যে, ছাত্রদের কারো গায়ে হাত দিলে ফল খুব খারাপ হবে। ওরা নাক কান মলে, মুখ কাঁচুমাচু করে চলে গেল।

আনিমুল সেদিন অমন করে ওদের আশ্রয় না দিলে গুন্ডারা হয়তো ওদের মেরেই ফেলত। সুজিত আর অর্ণবের বাবা একদিন আনিমুলের বাড়ি গিয়ে ওর বাবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, তিনিও সেদিন ওদের রক্ষার জন্য কম করেননি।

আনিমুলের বাবা জজ কোর্টের সেরেস্তাদার। বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করায় তিনি খুব লজ্জা পেলেন। আমিনুল একদিন সুজিত আর অর্ণবকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করল। ওর মা এমন মাংস রান্না করেছিলেন যে অনেকদিন ওদের জিভে লেগেছিল।

অর্ণবের মা আমিনুল আর ওর বাবাকে পালটা নেমন্তন্ন করলেন। অর্ণবের মায়ের হাতের তেতোর ডাল আর মাছ পাতুড়ি খেয়ে আমিনুলের বাবা তো মুগ্ধ, বললেন এমন রান্না জীবনে খাননি।

সদানন্দ স্যার পড়াচ্ছিলেন। ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে’— কত বড়ো কথা বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। যে অন্যায় করে সে দোষী এ কথা সবাই জানে। তার অপরাধের শাস্তিও তার প্রাপ্য। কিন্তু যে কাপুরুষের মতো অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করে না, মুখ বুজে সহ্য করে, তাকেও রবীন্দ্রনাথ ক্ষমা করেননি। এমন মেরুদণ্ডহীন মানুষের প্রতি কোনো সহানুভূতি তাঁর ছিল না। বাঁচতে হলে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে হবে। তাই তিনি বলেছেন, ‘চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, শান্ত শিষ্ট বাঙালি জাতি সম্বন্ধে বঙ্গ জননীর কাছে তাই তাঁর কাতর মিনতি, আঁচলের তলায় সন্তানদের আশ্রয় না দিয়ে বরং তিনি যেন তাদের বৃহৎ জগতে নিজেদের ভাগ্য গড়বার জন্য ঠেলে বের করে দেন। তার জন্য তাদের যদি গৃহহারা, লক্ষ্মীছাড়া করতে হয় সেও ভালো।

‘যারা অক্ষম, অপদার্থ তারাই নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে ভাগ্যের দোহাই পাড়ে। অদৃষ্ট মানুষেরই গড়া, ভগবানের কোনো হাত নেই তাতে। যারা অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী তাদের কটাক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :

কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস

হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।

রিক্ত যারা সর্বহারা সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,

গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ক্রীতদাস।

হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।

একটু থেমে ক্লাসের সবার ওপর চোখ বুলিয়ে সদানন্দ স্যার বললেন, ‘আমি শুরু করেছিলাম, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’ দিয়ে। সেই প্রসঙ্গেই এত কথা এসে গেল। এই যে আমাদের শহরে এত বড়ো একটা অন্যায় হল, তার বিরুদ্ধে সাময়িক জ্বলে ওঠা ছাড়া এখানকার মানুষ সংঘবদ্ধভাবে তেমন প্রতিবাদ করেনি। গুন্ডারা বুক ফুলিয়ে হাঁটছিল, পুলিশও ‘যা করেছি বেশ করেছি’ এমন একটা দম্ভ দেখাচ্ছিল। সমস্ত অন্যায়টা আমরা শহরবাসীরা যেন মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এই স্কুলের ছাত্ররা তা পারেনি, তাদের আহত অপমানটা সিংহের মতো গর্জে উঠেছিল। তারা শুধু ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদই করেনি, ভীরুতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছিল শহরবাসীকে। মানুষ যে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে তাই তারা প্রমাণ করেছে। এই কিশোর ছাত্ররা আমাদের গর্ব, আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

সদানন্দ স্যার চলে যাবার পরও ক্লাশে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করছিল। এমনিতে কোনো পিরিয়ড শেষ হলে পরের স্যার না আসা পর্যন্ত ক্লাসে যেন লঙ্কাকাণ্ড হয়। পরেই ছিল অঙ্কের ক্লাস। স্যার ক্লাসে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন, সবাই এত চুপচাপ কেন! ব্যাপার কী? তিনি তো আর জানেন না যে সদানন্দ স্যার সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে গেছেন।

আগের ডি এম ছিলেন পুরোনো আমলের মানুষ নিজের পদমর্যাদা সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সাধারণ মানুষকে মানুষ বলেই জ্ঞান করতেন না। নতুন যিনি ডি এম হয়ে এলেন, তিনি একেবারে আলাদা ধাতু দিয়ে গড়া। আই এ এস পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলেন। হাসিখুশি মিশুকে মানুষ। তাঁর স্ত্রীও বিদুষী, বিয়ের আগে খেলাধুলা, নাচ-গান, নাটক নিয়ে মেতে ছিলেন। তিনি এসেই ওখানকার মেয়েদের ইস্কুল কলেজে গেলেন, সবার সঙ্গে পরিচিত হলেন। মেয়েদের নিয়ে তিনি একটা নারী কল্যাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। অন্যান্য মেয়েরা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে তার জন্য নানারকম হাতের কাজ শেখাবার ব্যবস্থা হল সেখানে।

সুজিত আর অর্ণবের মাকেও তিনি টেনে নিলেন সমাজ সেবার কাজে। এখানে আসার আগেই তিনি সব ঘটনা শুনেছিলেন, সুজিত আর অর্ণব যে এই ঘটনায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল তাও তাঁর অজানা ছিল না। তিনি ওদের সম্বন্ধে মনে মনে খুব কৌতূহলী হয়েছিলেন, একদিন ওদের চায়ের নেমন্তন্ন করলেন।

ডি এম-এর মস্ত বাংলো। ওরা কোনোদিন ওখানে যায়নি, সাহসই হয়নি গেট পেরোতে। একটু ঘাবড়েই গেল ওরা। ডি এম-এর বউ কিন্তু, ‘এসো ভাই, আমি খুব খুশি হয়েছি তোমরা এসেছ’, এই প্রথম সম্ভাষণেই ওদের মন জয় করে নিলেন। ডি এম-এর বউয়ের নাম রীতা বসু। ফর্সা ছিপছিপে চেহারা, চোখ ফেরানো যায় না এমন রূপ। বয়স তিরিশও হয়নি।

তিনি ওদের নিয়ে ড্রইং রুমে বসলেন, ওদের মুখ থেকে সেই ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনলেন। উর্দিপরা খানসামা ট্রে করে চা, দামি বিস্কুট, নানারকম প্যাস্ট্রি আর রাজভোগ নিয়ে এল। রীতা বসু ওদের পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘আমি কিন্তু তোমাদের দিদি। একটুও লজ্জা করে খাবে না, তবে আমি রাগ করব।’

খুব সহজেই তিনি ওদের আপন করে নিলেন। ভগবান বোধ হয় এক একজন মানুষকে এমন ক্ষমতা দেন যার ফলে সেই মানুষটি অনায়াসে অপরের হৃদয়ে প্রবেশ করে আপনজন হয়ে ওঠেন। ওদের মুখেই তিনি শুনলেন সঞ্জয়ের কথা, সমস্ত পরিকল্পনা তার মাথা থেকেই এসেছিল শুনে তিনি অবাক হলেন। তেরো-চোদ্দো বছরের এক প্রতিবন্ধী ছেলের দুর্জয় মনের সাহস দেখে তিনি অভিভূত হলেন, ওর সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন। সুজিত বলল একদিন ওঁকে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি নিয়ে যাবে।

ওদের গল্পগুজবের শেষের দিকে ডিএম এসে যোগ দিলেন। গায়ের রং একটু কালো, কিন্তু দু-চোখ যেন সবসময় কথা বলছে। ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি। এক পেয়ালা চা নিয়ে তিনি বললেন, ‘কী আলোচনা হচ্ছে? আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয় তো!’

‘তুমি যদি তেমন কাজ কর তবে তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতেই পারে’, রীতা বসু জবাব দিলেন।

‘রক্ষে কর, আমি ওসবের মধ্যে নেই।’ একটু হেসে তিনি বললেন, ‘একে রাম লক্ষ্মণে রক্ষা নেই, তার ওপর বিভীষণ হাত মেলালে আমি যাই কোথায়!’

‘আমি বিভীষণ!’ রীতা বসু চোখ পাকালেন।

‘এই দু-জন মিলে যা কাণ্ডটা করল তার ওপর তুমিও যদি ওদের সহায় হও তবে আমি পালিয়ে পার পাব না’, ডিএম বললেন।

‘ওদের ওপরেও এক জন আছে’, রীতা বসু এবার বললেন, ‘তার সঙ্গে আমাকে ওরা আলাপ করতে নিয়ে যাবে।’

ডি এম সঞ্জয়ের কথা শুনে বললেন, ‘ভেরি স্যাড! একটু ভেবে তিনি বললেন, ‘আমি সরকার থেকে ওকে একটা হুইল চেয়ার দেবার চেষ্টা করতে পারি। দু-হাত দিয়ে ওটা চালাতে হয়, নিজে নিজেই ও ঘোরাফেরা করতে পারবে।’

‘ভালোই হল’, রীতা বসু বললেন। ‘মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যেদিন যাব, তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব।’

তিনি সুজিতদের সঙ্গে সত্যিই একদিন সদানন্দ স্যারের বাড়ি এলেন। আগেই বলা ছিল। সদানন্দ স্যার আর সঞ্জয়ের মা তাঁকে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

সঞ্জয়ের বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে তিনি বললেন, ‘তোমার কথা শুনেছি সুজিত আর অর্ণবের মুখে। খুব আলাপ করতে ইচ্ছে হয়েছিল।’

‘আমার সৌভাগ্য’, সঞ্জয় মৃদু হাসল।

ওর বিছানার চারপাশে ছড়ানো যত রাজ্যের বই। সেদিকে তাকিয়ে রীতা বসু বললেন, ‘এত বই পড় কখন?’ কথাটা বলেই তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।

‘আমার আবার সময়ের অভাব’, সঞ্জয় জবাব দিল। ‘সারাদিন তো শুয়ে বসেই থাকি। বই আমার একমাত্র সঙ্গী, সময় কাটাবার বন্ধু।’

‘শুনেছি তুমি লেখাপড়ায় খুব ভালো, প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবে। আজকাল তোমাদের জন্য লেখাপাড়ার নানারকম সুযোগসুবিধে আর স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়েছে’, রীতা বসু বললেন। ‘আমি চেষ্টা করব তুমি যাতে তেমন কোনো স্কলারশিপ পাও।’

‘তবে তো খুবই ভালো হয়’, সঞ্জয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘বাংলা ইংরেজি সাহিত্য সম্বন্ধে তোমার শুনেছি খুব পড়াশোনা। তোমার প্রিয় লেখকদের সম্বন্ধে কিছু বল, আমার জানতে ইচ্ছে করছে।’

‘বাংলায় রবীন্দ্রনাথ আমার সবচেয়ে প্রিয়। শুধু কবিতাই নয়, তাঁর গল্পগুচ্ছ পড়ে আমি মুগ্ধ। কী গভীর অনুভূতি। তার পরেই নজরুল আর সুকান্ত। শরৎচন্দ্রের পথের দাবী আমার কাছে বেদ। সুকুমার রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখক। আরণ্যক আমি বোধহয় দশ বার পড়েছি।’

সঞ্জয় কথা থামিয়ে সলজ্জভাবে একটু হাসল, তারপর বলল, ‘টলস্টয় টুর্গেনিভের কিছু কিছু ছোটো ছোটো গল্পের ইংরেজি অনুবাদ আমি পড়েছি। কী ভালো যে লেগেছে তা আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। চার্লস ডিকেন্স আমার খুব ফেভারিট, সব অবিশ্যি পড়িনি, অত বিদ্যে হয়নি। স্টিভেনসনের লেখাও আমার খুব ভালো লাগে, সুকুমার রায়ের মতো তিনিও অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। স্টিভেনসন চমৎকার ছড়াও লিখতেন, পড়েছেন?’

রীতা বসু লজ্জিতভাবে মাথা নাড়লেন।

‘শুনবেন?’ হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল সঞ্জয়।

‘হ্যাঁ’, রীতা বসু ঘাড় কাত করলেন।

সঞ্জয় চোখ বুজে আবৃত্তি করল :

‘In winter I get up at night

And dress by yellow candle-light.

In summer, Quite the other way

I have to go to bed by day.

‘The world is so full

of a number of things,

I’m sure we shall all

be as happy as Kings.

‘The rain is raining all around,

It falls on field and tree

It rains on the umbrellas here

And on the ships at sea.’

‘বাঃ সুন্দর! রীতা বসু বললেন। ‘তুমি কি নিজেই সব পড়?’

‘না, বাবা আমাকে সাহায্য করেন, শত কাজের মধ্যেও বাবা আমাকে নিয়ে বসেন। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বাবা কী বলেন জানেন?’

‘কী?’

‘হি ইজ অ্যান ইনস্টিটিউশন বাই হিমসেল্ফ।’

‘সত্যিই তাই, যদি তার চাইতেও বড়ো কিছু হয় তাও। তাঁর নিজের ভাষাতেই বলা যায়, ‘তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহৎ।’ একটু থেমে রীতা বসু বললেন, ‘তোমার মনের জোর দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’

‘কিন্তু মাঝে মাঝে আমার হতাশা আসে’, সঞ্জয় একটু বিষণ্ণ গলায় বলল। ‘কী আমার ভবিষ্যৎ, কী নিয়ে বেঁচে থাকব আমি?’

‘কেন, লেখাপড়া নিয়ে। ওটাই তোমার জীবনের প্রধান আলো’, রীতা বসু দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন। ‘তোমার মতো অসুবিধা সত্ত্বেও সব বাধা কাটিয়ে বিদ্বান হয়েছেন, বাড়িতে বসেই ছাত্র পড়াচ্ছেন, এমন কিছু মানুষের খবর আমি রাখি। একজনকে জানি যিনি সি এ ভালোভাবে পাশ করে বাড়িতে কোচিং ক্লাস খুলেছেন, মাসে পাঁচ হাজারের ওপর রোজগার।’

সঞ্জয় কোনো জবাব দিল না।

‘আমেরিকার উইলমা রুডলফ, সেই কালো মেয়েটির কথা মনে কর। ছোটোবেলায় পোলিও হয়ে বাঁ-পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। এগারো বছর পর্যন্ত ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারত না, কিন্তু অসাধারণ মনের জোরে সে শুধু সুস্থ হয়েই ওঠেনি, রোম অলিম্পিকে তিনটি স্বর্ণপদক জিতে একটা মস্তবড়ো কাণ্ডই করে বসেছিল।’

‘ওদেশের চিকিৎসা কত উন্নত’, সঞ্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘হ্যাঁ, সে-কথা অস্বীকার করছি না, কিন্তু সেইসঙ্গে মেয়েটির মনের জোরেরও প্রশংসা করতে হয়। এখানে তোমার তেমন চিকিৎসার সুযোগ নেই, কিন্তু যা আছে তার মধ্যেই যতটুকু ভালো হতে পার, সেটাকেই সম্বল করে তোমাকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। তোমার মেধা আছে, বুদ্ধি আছে। নিশ্চয়ই তুমি একদিন লেখাপড়ার জগতে নাম করবে, আমি বলে রাখলাম।’ একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে রীতা বসু হাসলেন, তারপর আবার বললেন, ‘এই মুহূর্তে একজনের কথা আমার মনে পড়ছে, স্টিফেন উইলিয়ম হকিং, কেমব্রিজের প্রবাদপুরুষ এই অধ্যাপক। সময়ের শুরু কোথায় আর শেষই বা আসবে কীভাবে, এই জটিল তত্ত্বে তাঁর গবেষণা আজ সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের টনক নড়িয়ে দিয়েছে। গ্যালিলিও, নিউটন আর আইনস্টাইনের সার্থক উত্তরসূরী বলা হয় তাঁকে। অথচ তিনি পক্ষাঘাতে পঙ্গু, অথর্ব, একপাশে হেলে আছে মাথা। নিজের শরীরের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই তাঁর। একটা হুইল চেয়ার আর সেবিকাই তাঁর একমাত্র ভরসা। স্টিফেন যদি তাঁর সাধনায় সফল হন তবে কীসের নিয়মে চলছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, জীবন আর জগৎ তা আর রহস্য থাকবে না। পদার্থ বিজ্ঞানের সেটাই হবে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার, কারণ তার পরেও পদার্থবিদ্যায় কাজ করার মতো তেমন জটিল কিছু থাকবে না। সারা শরীরে পক্ষাঘাত, শুধু তাঁর মাথাটা কাজ করে চলেছে। এমনকী তাঁর কথা বলার শক্তি পর্যন্ত নেই, কথা বলেন এক কম্পিউটার মেশিনের চাবি টিপে শব্দ বানিয়ে, ভাবা যায়!’

সদানন্দ স্যার আর সঞ্জয়ের মা ওদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এবার তাঁরা ঘরে এলেন। সঞ্জয়ের মায়ের হাতে একটা মস্ত রেকাবি তাতে টুকরো টুকরো করে কাটা নানারকম ফল আর মিষ্টি।

রীতা বসু অত খাবার দেখে আঁতকে উঠলেন, বললেন, ‘সর্বনাশ, আপনি কী আমাকে মোটা করবার চেষ্টা করছেন?’

সঞ্জয়ের মা হেসে ফেললেন, বললেন, ‘ওমা, এমনকী দিয়েছি।’

‘হ্যাঁ, চার জনের খাবার এক জনকে দিলে যদি এমন কিছু না হয় তবে আমার কিছু বলার নেই। ঠিক আছে আমরা চার জনেই এটা ভাগ করে খাব’, তারপরই সুজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি বল সুজিত?’

সুজিত যে খেতে পারে তা প্রথমদিনেই তিনি বুঝেছিলেন। সুজিত লজ্জা পেয়ে মুখ নামাল।

‘খেতে খেতে রীতা বসু হুইল চেয়ারের প্রসঙ্গ তুললেন। ডি এম চেষ্টা চরিত্র করে সরকারি গ্র্যান্ট পাইয়ে দেবেন। অমন একটা চেয়ারের অনেক দাম, অনুদান ছাড়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজ নয়।

সদানন্দ স্যার কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না, কিন্তু সঞ্জয়ের মুখ আনন্দে ভরে উঠল, ও বলল, ‘আমি নিজে নিজেই ওই গাড়ি চালিয়ে যেতে পারব?’

‘হ্যাঁ, তেমন ভাবেই ওগুলো তৈরি, পায়ের বদলে দু-হাত দিয়ে চালাতে হয়।’

‘সঞ্জয় হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘খুব মজা হবে, আমি একা একাই বাইরে বেরোতে পারব।’

অনেকদিন পর ওর মধ্যে ছেলেমানুষির উচ্ছ্বাস জেগে উঠল। ভবিষ্যতের একটা স্বপ্ন উঁকি দিল ওর মনে।

সুজিতদের ইস্কুলের সঙ্গে নেতাজি বিদ্যাভবনের ফুটবল খেলা। অনেকদিন থেকেই দুই ইস্কুলে খেলা নিয়ে রেষারেষি। তবে তা নিয়ে কখনো হাঙ্গামা হয়নি, রেষারেষিটা মাঠের মধ্যেই থেমে থেকেছে।

সুজিত ওদের দলের অধিনায়ক। ও খেলে মাঝ মাঠে, স্কিমার, সমস্ত দলটাকে খেলাবার দায়িত্ব বলতে গেলে ওর কাঁধেই। এ কাজটা ও ভালোভাবেই করে। বল নিয়ে সুন্দরভাবে নিজেদের খেলোয়াড়দের দেয়। আসলে খেলাটা ও ঠিক সময়ে ধরতে জানে। বিপক্ষ গোলে হানা যেন ওর পা থেকে দানা বাঁধে তেমন প্রতিপক্ষের আক্রমণ ব্যর্থ করে দিতেও ও ওস্তাদ।

খেলা ছিল শনিবার। বিদ্যাভবনের মাঠে। খেলা দেখতে বেশ ভিড় হয়েছিল। খোলা মাঠে খেলা, ভিড় তো হবেই। সুজিতদের ইস্কুলের ছেলেরা দল বেঁধে মাঠে গিয়েছিল, নিজেদের দলকে উৎসাহ দিতে হবে তো।

খেলা শুরু হতেই বিপক্ষ দল চেপে ধরল। ওদের ইস্কুলে এবার নতুন দুটি ছেলে এসেছে ট্রান্সফার নিয়ে, ভালো খেলে। এক জন রাইট ব্যাকে খেলে আর এক জন স্ট্রাইকারে। যে রাইট ব্যাকে খেলছিল সে বল নিয়ে চড় চড় করে উঠে এল। রাইট উইংগারকে কোণাকুণি বল ঠেলল, সে একটু ভেতরে ঢুকে সুন্দর সেন্টার করল। যে স্ট্রাইকারে খেলছিল তার ভুলচুক হল না, হাফভলি মেরে গোলে ঢুকিয়ে দিল বল। খেলা শুরু হতে-না-হতেই গোল। ব্যাস, ওদের সমর্থকদের উল্লাসের আর শেষ নেই।

সুজিতরা গুছিয়ে ওঠার আগেই গোল খেয়ে বেশ দমে গেল। গা-ই তখনও গরম হয়নি। আরও দু-দু-বার বিপক্ষ দল হানা দিল ওদের গোলে, তার যেকোনো একটা থেকে গোল হতে পারত। এবার সুজিতরা পালটা আক্রমণ শুরু করল। সুজিত কয়েকটা সুন্দর বল ঠেলল, যাকে বলে ডিফেন্স চেরা থ্রু, কিন্তু ওদের ফরোয়ার্ডদের কেউ সেগুলো কাজে লাগাতে পারল না। এর মধ্যে আবার ওদের সেই রাইট ব্যাক বিচ্ছিরি একটা ফাউল করল। যাকে মারল সে মাঠে পড়ে কাতরাতে লাগল। একটু উত্তেজনার ছোঁয়া লাগল মাঠে, তা ছড়িয়ে পড়ল দর্শকদের মধ্যে।

সুজিত শুধু ভালোই খেলত না, মারকুটে খেলোয়াড় বলে ওর নাম ছিল। ওদের নতুন ছেলেটি তা জানত না। সুজিত বল ধরে এগোল, দু-জনকে কাটিয়ে ওপরে উঠে গেল। ওদের রাইট ব্যাক বল কেড়ে নেবার চেষ্টা করতেই তাকেও কাটাল আর সেইসঙ্গে কনুই দিয়ে তার ডান পাঁজরে মারল মোক্ষম এক গুঁতো। ছেলেটি নাক টিপে বসে পড়ল, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন।

আবার উত্তেজনা মাঠে। দু-দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে এই বুঝি হাতাহাতি বেধে যায়। রেফারি ঘন ঘন হুইশল বাজিয়ে খেলোয়াড়দের ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি হাতাহাতি হল না। মফসসল শহর, সবাই সবার প্রায় মুখ চেনা। ওদের ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে সুজিতকে বলল, ‘কি হচ্ছে! খেলতে না চাস তো বল, হারছিস বলে মারামারি করে খেলা বন্ধ করে দিতে চাস তো তাই হোক।’

‘ওই ছেলেটা যখন আমাদের একজনকে মারল তখন তো তাকে কিছু বললি না!’ সুজিত বেশ রেগেই জবাব দিল।

‘ঠিক আছে, আমি আমাদের প্লেয়ারদের সামলাচ্ছি, তুইও তাই কর।’

সুজিতের তাতে আপত্তি নেই।

আবার খেলা শুরু হল। বিরতির সময় বিপক্ষ দল এক গোলে এগিয়ে।

অর্ণব অন্য ছেলেদের সঙ্গে মাঠের এক ধারে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল। সুজিতকে এসে ও বলল, ‘আমরা কি কালো মুখ করে ফিরব নাকি? জিততে পারলে একটা আস্ত ক্যাডবেরি।’

‘সত্যি।’

‘হ্যাঁ, সত্যি।’

ক্যাডবেরি চকোলেট সুজিতের ভীষণ প্রিয়, একটা আস্ত ক্যাডবেরির জন্য ও অনেক কিছু করতে পারে।

বিরতির পর খেলা শুরু হতেই সুজিতের দল তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ শুরু করল। ঢেউয়ের মতো হানা দিতে লাগল বিপক্ষ গোলে। কিন্তু গোল আর হয় না। ওদের গোলকিপারও খুব ভালো খেলছে, অব্যর্থ দুটো গোল বাঁচিয়েছে। এরই মধ্যে আর একটা গোল খেয়ে গেল সুজিতরা। দুর্ভাগ্যই বলা চলে, কারণ খেলাটা তখন বিপক্ষেরই গোলমুখেই সীমাবদ্ধ ছিল। গোল শোধের জন্য সুজিতদের দলের প্রায় সব খেলোয়াড় ওপরে উঠে এসেছিল। একটা জটলা থেকে বিপক্ষের রাইট ব্যাক বল ক্লিয়ার করতেই সেই স্ট্রাইকার একেবারে ফাঁকায় বল পেয়ে গেল, সামনে এক জন মাত্র বিপক্ষ খেলোয়াড়। তাকে কাটিয়ে জোরে ছুটল ছেলেটি, গোলকিপার উপায় না দেখে বেরিয়ে এসেছিল। তাকেও কাটিয়ে ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দিতেই গোল। আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিল বিদ্যাভবনের ছেলেরা, বড়োদের অনেকেও তাতে যোগ দিলেন।

সুজিত ওর খেলোয়াড়দের ডেকে জনে জনে বলল, ‘জান লড়িয়ে দে, হেরে আমরা ফিরব না।’

ওর কথায় ছেলেদের হতাশা ভাবটা কেটে গেল। আমিনুল খেলছিল লেফট হাফে, ওর দু-পায়েই শট আছে। সুজিত ওকে স্ট্রাইকারের জায়গায় নিয়ে এল, যে ওখানে খেলছিল তাকে পিছিয়ে খেলতে বলল। আমিনুলকে ও বলল, ‘তুই একটু ফাঁকায় ফাঁকায় থাকবি, আমি তোকে বল তৈরি করে দেব, তুই শুধু গোলে মেরে যা।’

আমিনুল ওর কথামতো ফিকিরে রইল, কয়েক মিনিট পরে সুজিত একটা বল ধরে লম্বা দৌড় শুরু করল, তারপর দু-জন বিপক্ষ খেলোয়াড়ের মাঝখান দিয়ে ঠেলে দিল বল। আমিনুলও সঙ্গে সঙ্গে দৌড়চ্ছিল। একেবারে সাজানো বল, ঠিক ওর সামনে ওই চলন্ত বলেই বাঁ-পায়ে জোরালো শট নিল আমিনুল, বল জড়িয়ে গেল জালে। হাসি ফুটে উঠল সুজিতের মুখে।

আরও কয়েক বার ও সুন্দর বল বাড়াল, কিন্তু বিপক্ষ খেলোয়াড়রা এখন আমিনুলকে কড়া পাহারায় রেখেছে, ও সুবিধে করতে পারছিল না। সুজিত অন্য চাল চালাল। বল ধরে এগিয়ে যেন আমিনুলকে দেবে এমন ভান করে নিজেই এক জনকে ভড়কি দিয়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়ল, তারপর ডান পায়ের গড়ানো প্লেসিং শটে পরাস্ত করল গোলকিপারকে।

দু-পক্ষই এখন সমান সমান। অর্ণব খুব চেঁচাচ্ছে, ওর সঙ্গে লাফাচ্ছে ওদের ইস্কুলের ছেলেরা।

দুটো গোলই শোধ হয়ে যাওয়াতে বিপক্ষ দল দমে গেল, আমিনুলের ওপর নজর শিথিল হল। সুজিত এটাই চাইছিল। ও আবার আমিনুলকে বল ঠেলতে লাগল। আমিনুল ওকে নিরাশ করল না, একটা দুর্দান্ত শটে কাঁপিয়ে দিল জাল। অর্ণবদের আনন্দ আর ধরে না। খেলা দারুণ জমে উঠেছে।

বিপক্ষ দল আবার চেপে ধরল, কিন্তু সুজিত একাই যেন এক-শো, যেখানে বল সেখানেই ও। সিংহের বিক্রমে খেলছে, ওকে কাটানো প্রায় অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত ওই তিন দুই গোলে জিতল ওরা।

বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন এসে সুজিতের হাতে হাত মিলিয়ে বলল, ‘দারুণ খেলেছিস।’

অর্ণব ওর হাতে একটা ক্যাডবেরি গুঁজে দিয়ে বলল, ‘নে, খা।’

ডি এম তাঁর কথা রাখলেন। চেষ্টা চরিত্র করে সঞ্জয়ের জন্য সরকারি অনুদানে একটা হুইল চেয়ার আনিয়ে দিলেন। সঞ্জয়ের সেদিন কী আনন্দ। ওটায় চেপে কয়েক দিন ও বাড়িতেই চলাফেরা অভ্যেস করল, তারপর বেরোল রাস্তায়। ওর দু-পাশে অর্ণব আর সুজিত। প্রথম প্রথম পথে একটা জড়তা আর ভয় হবে বলে ওরা দু-জন নিজে থেকেই প্রস্তাব দিয়েছিল কয়েক দিন ওরা সঙ্গে সঙ্গে থাকবে।

সদানন্দ স্যার কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন খুশি হলেন না। কারো কাছে হাত পাতা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না, সরকারি অনুদান তো আসলে দান ছাড়া আর কিছুই নয়। আত্মসম্মানী কোনো মানুষ পরের দান কখনো গ্রহণ করেন না, এই ছিল তাঁর মনের ভাব, কিন্তু প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে সঞ্জয়ের উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে তিনি চুপ করে গিয়েছিলেন। পঙ্গু ছেলের জন্য এটুকু করতে না পারায় নিজের অসহায়তাকে মনে মনে তিনি ধিক্কার দিয়েছিলেন।

তিনি ঠিক করলেন ডি এম-কে বলবেন কিস্তিতে কিস্তিতে যতটা সম্ভব টাকা তিনি সরকারকে শোধ করে দেবেন। সঞ্জয়ের চিকিৎসারও তিনি কোনো ত্রুটি রাখেননি। কলকাতায় বছরের পর বছর রেখে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। জলের মতো টাকা বেরিয়ে গিয়েছিল, তবু যদি ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠত কোনো খেদ থাকত না।

ডি এম-এর বাড়ি শহরের যেখানে সে অঞ্চলটা একটু নিরিবিলি। ডি এম, ডিস্ট্রিক্ট জজ, এসপি, সিভিল সার্জন এমন সব বড়ো বড়ো সরকারি অফিসারের কোয়ার্টার ওখানে। একদিন বিকেলে ডি এম-এর কোয়ার্টারে ওরা হাজির হল। ডি এম টুরে গেছেন। রীতা বসু হইহই করে ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। সঞ্জয়কে বললেন, ‘কি খুব খুশি তো?’

সঞ্জয় হাসল। সেই হাসিতে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছে। রীতা বসু বেয়ারাকে ওদের জন্য খাবারের কথা বলে জমিয়ে বসলেন। সঞ্জয়কে বললেন, ‘তোমার জন্য আমি কয়েকটা বই আনিয়েছি। দেখ তো পছন্দ হয় কিনা।’

সঞ্জয় লোভীর মতো হাত বাড়িয়ে বইগুলো নিল। রাশিয়ান লেখক ম্যাকারেঙ্কোর তিন খণ্ডে ইংরেজি অনুবাদ দ্য রোড টু লাইফ। নতুন বইয়ের গন্ধ বেরোচ্ছে মলাট থেকে। এই গন্ধটা সঞ্জয়ের খুব ভালো লাগে। ওর খুব শুঁকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সবার সামনে লজ্জায় তা আর পারল না।

‘আচ্ছা, টলস্টয়ের কিছু ছোটোগল্পের ইংরেজি অনুবাদ তুমি পড়েছ, বলেছিলে’, রীতা বসু কথায় কথায় বললেন। ‘ওঁর কোন গল্পটা তোমার মনে দাগ কেটেছে?’

‘সেই যে গল্পটা’, সঞ্জয় বলল। ‘এক জন মানুষের কতটা জমি দরকার। বেশি জমির লোভে লোকটি সারা দিন কী পরিশ্রমই না করল, শেষপর্যন্ত মরে গেল। তার কবরের জন্য দরকার হল মাত্র কয়েক হাত জমি। মানুষের প্রয়োজন সামান্য কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা আকাশছোঁয়া। গল্পটার মধ্যে এমন সুন্দর একটা অর্থ আছে যা মনকে নাড়া না দিয়ে পারে না।’

‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর গল্প’, রীতা বসু মাথা দোলালেন। ‘তুমি গোর্কির মাদার পড়েছ?’

‘না’, সঞ্জয় দু-পাশে মাথা নাড়ল।

‘আচ্ছা আমি ওটা তোমাকে দেব। অসাধারণ বই, এক বার পড়লে সারাজীবন মনে থাকবে। রোড টু লাইফ বইও খুব ভালো। বিপ্লবের পর রাশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা বিশৃঙ্খলা এসেছিল, অনাথ ছেলেমেয়েরা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নতুন রাশিয়ার একটা মস্ত সমস্যা, তাদের নিয়ে কাহিনি। ম্যাকারেঙ্কো নিজে এমন একটা আবাসিক ইস্কুলের ভার পেয়েছিলেন। ছেলে-মেয়েরা শুধু উচ্ছৃঙ্খল নয়, অনেকেই ছিল গুন্ডা প্রকৃতির। তাদের কেমন করে তিনি আস্তে আস্তে ঠিক পথে নিয়ে এসেছিলেন তারই সত্যি সব ঘটনা। ওই গুন্ডা ছেলেরাই পরে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অন্য উচ্ছৃঙ্খল ছেলেদের মোকাবিলা করেছিল, সফল করেছিল তাঁর সাধনা। বিপ্লবের ঠিক পরেই রাশিয়ার অবস্থার চমৎকার একটা ছবি ফুটে উঠেছে, কোথাও কোথাও তো রীতিমতো রোমাঞ্চকর— আমার খুব ভালো লেগেছিল।’

বেয়ারা ট্রেতে খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। মাংসের প্যাটিস আর স্যান্ডুইচ। সুজিতের তো দেখেই জিভে জল এসে গেল। এসব খাবার ওদের কপালে জোটে না। রীতা বসু ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘নাও, আর লজ্জা করতে হবে না। ভালোই হল তোমরা এসেছ। ডি এম সাহেব টুরে, আমি ভাবছিলাম এগুলোর কী গতি করা যায়।’

‘আপনাকেও আমাদের সঙ্গে খেতে হবে রীতাদি’, সঞ্জয় বলল।

‘বাঃ, এই তো দিদি বলে ডেকেছে’, রীতা বসু মিষ্টি করে হাসলেন। ‘আমি তো প্রথম দিনই বলেছি আমি তোমাদের দিদি। নাও শুরু কর, সব শেষ করতে হবে তোমাদের।’ তিনি নিজে একটা স্যান্ডুইচ তুলে নিলেন। দেখাদেখি ওরাও খাওয়া শুরু করল।

খেতে খেতে রীতা বসু সঞ্জয়কে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতা তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?’

‘এবার ফিরাও মোরে’, সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল সঞ্জয়।

‘ওর সব মুখস্থ’, অর্ণব এবার বলল। ‘বড়ো বড়ো কবিতা ওর ঠোঁটের ডগায়। আবৃত্তিও করে খুব ভালো।’

‘তাই নাকি!’ রীতা বসু বললেন। ‘এ গুণও আছে! শোনাও না একটা কবিতা।’

সঞ্জয় সামান্য ইতস্তত করে আবৃত্তি করতে লাগল :

সংসারের সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত

তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো

মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে

দূর বনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে

সারাদিন বাজাইলি বাঁশি।

প্রথম দিকের জড়তা কেটে যেতেই ওর গলার স্বর উদাত্ত হয়ে উঠল, সৃষ্টি হল এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ।

ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির

মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শতাব্দীর

বেদনার করুণ কাহিনি, স্কন্ধে যত চাপে ভার

বহি চলে মন্দগতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার—

সমস্ত কবিতাটা এক বারও না থেমে ও বলে গেল, কখনো গলা উচ্চগ্রামে উঠল আবার কখনো নামল খাদে। সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণ, আবেগ-মথিত কণ্ঠ, সমস্ত ঘরটা যেন গম গম করতে লাগল।

কয়েক মিনিট কেউ কথা বলল না। রীতা বসুই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, ‘বাঃ! এত বড়ো কবিতা এক বারও না আটকে বললে, তোমার স্মৃতিশক্তির তারিফ করতে হয়।’

‘কী যে বলেন!’ সঞ্জয় হেসে উঠল। ‘রঘুনাথ শিরোমণির কথা ভাবুন। গুরুর আশ্রমে পুঁথি থেকে কিছু লিখে আনা নিষেধ, তাই সম্পূর্ণ ন্যায়শাস্ত্রই কণ্ঠস্থ করে তিনি ফিরে এসেছিলেন, বুঝুন! একেই বলে স্মৃতিশক্তি।’

‘তুমি খুব বিনয়ী, তাই না?’ রীতা বসু হাসলেন। ‘যারা খুব মেধাবী, ছেলেবেলা থেকেই তাদের মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তুমিও একদিন খুব নাম করবে আমি বলে রাখলাম। সেদিন কিন্তু আমার কথা মনে রেখো।’ তারপরেই কিছু মনে পড়ায় বললেন, ‘ভালো কথা, তোমার স্কলারশিপের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছি, তোমাকে কিন্তু একটা পরীক্ষায় বসতে হবে।’

‘বসব’, সঞ্জয় মৃদু হেসে বলল।

ওখান থেকে বেরিয়ে একটু যেতেই একটা জিপ ওদের ঠিক পাশেই ব্রেক কষে থামল। ওটায় এস পি ছিলেন, ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল। এস পি গলা বাড়িয়ে সুজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে মেঘ না চাইতেই জল, তোমাকেই তো আমি মনে মনে খুঁজছিলাম।’ তারপর সবার ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘ব্যাপার কী! কোথায় যাওয়া হয়েছিল?’

‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়ি’, অর্ণব জবাব দিল।

‘উনি তো নেই, টুরে গেছেন’, এস পি একটু অবাক হয়ে বললেন।

‘আমরা ওঁর স্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম’, এবার জবাব দিল সঞ্জয়। ‘মানে উনি আমাদের রীতাদি।’

‘ও এর মধ্যে দিদি সম্পর্কও পাতিয়ে ফেলেছ’, এস পি হা হা করে হাসলেন। ‘তবে আমি কী দোষ করলাম, আমিও তোমাদের দাদা হয়ে যাই, কি বল?’

ওরা কোনো জবাব দিল না, শুধু হাসল।

‘কি প্রস্তাবটা পছন্দ হল না বুঝি?’ এস পি বললেন। ‘না, পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার ইচ্ছে নেই।’

‘না, না তা নয়’, অর্ণব একটু লজ্জা পেয়ে বলল।

‘ভালো-মন্দ সবার মধ্যেই আছে’, এস পি বললেন। ‘শুধু পুলিশ কেন, যারা সিভিল সার্ভিস করছে তারা সবাই কি সাধু! ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তবে পুলিশকে অনেক সময় অপ্রীতিকর কাজ করতে হয় বলে তাদের সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ভালো নয়।’

‘আপনি আমাকে খুঁজছিলেন বলছিলেন’, সুজিত এবার বলল।

‘হ্যাঁ, ডি এম-এর রিলিফ ফান্ডের জন্য আমরা একটা চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচের কথা ভাবছি। তুমি ডি এম-এর দলে খেলবে। এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে একটু আলোচনা করতে চাই। আমার আপিসে একদিন আসতে পারবে?’

‘হ্যাঁ’, লাফিয়ে উঠল সুজিত।

‘আরও কয়েক জনকে বলব, একটা মিটিং ডাকব ভাবছি’, এস পি বললেন। ‘ভালো খেলোয়াড়দের একটা লিস্ট চাই আমার, সে বিষয়ে তুমি আমাকে সাহায্য করবে।’

‘কবে যাব বলুন’, সুজিত সাগ্রহে বলল।

‘আমি তোমাকে খবর দেব। আচ্ছা চলি, আমাকে আবার এখুনি বেরোতে হবে।’

তাঁর গাড়ি স্টার্ট দিল।

‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’, সদানন্দ স্যার পড়াচ্ছিলেন। ‘পৃথিবীতে এমন সব ঘটনা ঘটে যা অলীক কাহিনিকেও হার মানায়। আবার সত্যের জন্য মানুষ অসম্ভবকেও সম্ভব করেছে, প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে এমন ঘটনাও বিরল নয়। একটা কথা আছে, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, আবার ইংরেজ কবি কীটস বলেছেন, ‘Beauty is truth, truth is beauty!’

‘কিন্তু সেটাই সত্যের একমাত্র ব্যাখ্যা নয়, ল্যাটিন ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, ‘ম্যাগনা ঈস্ট ভেরিটাস সেড রারা’— ট্রুথ ইজ গ্রেট বাট রেয়ার। আজ থেকে বহু বছর আগে এই কথাটা বলে গেছেন এক মনীষী। কত বড়ো সত্যি কথা। অন্যায় আর অসত্য আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সৎ মানুষকে সবাই কৃপার চোখে দেখে। সত্যের সূর্যকে গ্রাস করেছে রাহু। কিন্তু রাহু মুক্ত হয়ে সত্য একদিন আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবেই। মহাকবি মিলটন বলেছেন, ‘Truth is as impossible to be soiled by any outward touch as the sunbeam.’ সূর্যের রশ্মির মতোই সত্যকে কলুষ করা যায় না, আপন মহিমায় সে বিকশিত হবেই।’

একটু থেমে সদানন্দ স্যার বললেন, ‘তোমরা জর্জ ওয়াশিংটনের জীবনী পড়েছ?’

‘না স্যার’, সমস্বরে জবাব হল।

‘ছোটোবেলায় তিনি একটা অন্যায় কাজ করেছিলেন। তাঁর বাবার খুব বাগানের শখ ছিল। তিনি অনেক দামি দামি ফুলের চারা এনে বাগানে পুঁতেছিলেন। ওয়াশিংটন একদিন একটা বড়ো কাঁচি দিয়ে সেই চারাগুলি কেটে-ছেঁটে নষ্ট করে দিলেন। তাঁর বাবা খুব রেগে গেলেন, জানতে চাইলেন কে এমন অন্যায় কাজ করেছে, তাকে তিনি ভীষণ শাস্তি দেবেন। ওয়াশিংটনকে কেউ ও কাজ করতে দেখেননি, তিনি চুপ করে থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করলেন না। বাবার কাছে গিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি চাইলেন। ছেলের এই সততায় সন্তুষ্ট হয়ে বাবা তাঁকে ক্ষমা করলেন। বড়ো হয়ে জর্জ ওয়াশিংটনই হয়েছিলেন আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট। তাঁর নামেই আজ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর নাম।’

‘স্যার, সক্রেটিসকেও তো সত্যের জন্য বিষপানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল?’ অর্ণব উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

‘ঠিক বলেছ, তিনি ছিলেন মস্ত বড়ো দার্শনিক, গ্রিস দেশের মানুষ। যা সত্য বলে জেনেছিলেন তাই তিনি বলতেন। আর তার জন্যই রাজরোষে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর দার্শনিক মতবাদ পরে প্রচার করেছিলেন প্লেটো। এই প্রসঙ্গে ইতালির গ্যালিলিওর নামও বলতে হয়। তিনি ছিলেন মস্ত বৈজ্ঞানিক। কিন্তু পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, কোপারনিকাসের এই মতবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন বলে চার্চ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। ধর্মীয় বিশ্বাসে তিনি আঘাত করেছেন এই অপরাধে তাঁর বিচার এবং শাস্তি পর্যন্ত হয়েছিল। জীবনের শেষ আট বছর গৃহবন্দি হয়ে ছিলেন তিনি। অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তবু সত্যকে তিনি ত্যাগ করেননি। এঁরা সব ছিলেন খাঁটি মানুষ।’

ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে সদানন্দ স্যার বললেন, ‘তোমরা বাড়ি থেকে ”ট্রুথ অ্যান্ড অনেস্টি” এই বিষয়ের ওপর দুটো প্রবন্ধ লিখে আনবে, একটা ইংরেজিতে আর একটা বাংলায়। সহজ, সরল ভাষায় লিখবে। বাড়ির কাউকে দিয়ে লেখাবে না। আমি তোমাদের প্রত্যেকের খাতা দেখে কারেক্ট করে দেব। রাইটিং ইজ দ্য বেস্ট প্র্যাকটিস ফর লার্নিং, এ কথাটা সব সময় মনে রাখবে।

স্কলারশিপের জন্য পরীক্ষায় সঞ্জয় শুধু প্রথমই হল না, যা নম্বর পেল তা একটা রেকর্ড। সঞ্জয়ের এই সাফল্যে সদানন্দ স্যার আর সঞ্জয়ের মা তো খুশি হলেনই, সুজিত, অর্ণব এবং ওদের ইস্কুলের ছেলেরাও বেশ খুশি হল। সদানন্দ স্যারকে সবাই খুব সমীহ আর সম্মান করে, এমনকী মাস্টারমশাইরাও। ইংরেজি, বাংলা দুটোতেই তিনি এম এ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। কয়েকটা কলেজ থেকেও ডাক এসেছিল, কিন্তু মফসসল শহরের এই ইস্কুলটাকে তাঁর ভালো লেগেছিল।

দু-বছর আগে তাঁরই হেডমাস্টার হবার কথা ছিল, কিন্তু স্কুল বোর্ডের মেম্বারদের মন যুগিয়ে চলতে তিনি পারেননি, কয়েকটি ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে তাঁর মতান্তর ঘটেছিল, তাই সেই রোষটা তাঁর ওপর পড়েছিল, অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন তিনি।

ইস্কুল ছেড়ে দেবার কথা তিনি ভাবছিলেন, কিন্তু এই ঘটনায় ইস্কুলে বড়ো রকম একটা আন্দোলন দানা পাকিয়ে উঠছিল। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা ঠিক করেছিল ইস্কুলের সামনে সত্যাগ্রহ করবে, এমন অন্যায় তারা মেনে নেবে না। ছাত্রদের মধ্যে একটা সাজ-সাজ রব পড়ে গিয়েছিল, অভিভাবকদেরও সায় ছিল সেই আন্দোলনে। কিন্তু সদানন্দ স্যারই তা হতে দেননি। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইস্কুল বন্ধ থাকুক, ছেলেদের লেখাপড়ার ক্ষতি হোক এ আমি চাইনে। ছাত্ররা যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, আমার পাশে তারা রয়েছে, এটাই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ছাত্রদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা একজন শিক্ষকের কাছে শ্রেষ্ঠ সম্মান। হেডমাস্টার না হবার জন্য কোনো ক্ষোভ নেই আমার।’

সদানন্দ স্যার ওই আন্দোলনকে থামিয়ে ইস্কুল বোর্ডকে বেকায়দায় ফেলেছিলেন। তা না হলে বোর্ডের সদস্যরা এটা বলার অজুহাত পেতেন যে, সদানন্দ স্যার ছাত্রদের খেপাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রস্তাব আনবেন বলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন। উলটে তিনিই আন্দোলনের বিরোধিতা করলেন, নিজের স্বার্থের কথা ভাবলেন না, এ ব্যাপারটা বোর্ডের কয়েক জন সদস্যকে নাড়া দিয়েছিল। বোর্ডের পরের সভায় এ নিয়ে নাকি উত্তপ্ত বাদানুবাদও হয়েছিল। সদানন্দ স্যারের স্বপক্ষে কেউ কেউ জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন, কিন্তু দলে ভারী স্বার্থান্বেষীদের মন তাতে টলেনি। ওই সভার পরেই দু-জন বোর্ডের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন।

সদানন্দ স্যার ছিলেন অনেকটা নির্লিপ্ত মানুষ। লেখাপড়া নিয়েই থাকেন। ইচ্ছে করলে তিনি বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে ভালো রোজগার করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। বিদ্যা নিয়ে ব্যবসা করতে তাঁর প্রবৃত্তি হয়নি। তবে যেকোনো ছাত্রের কাছে তার বাড়ির দরজা ছিল অবারিত। কোনো ছাত্র যদি পড়া বুঝতে তাঁর কাছে আসত, তিনি খুশিই হতেন, যত্ন করে তাকে পড়াতেন। টাকাপয়সা তো নিতেনই না, উলটে ঘরে যা থাকত তাই তাকে খাইয়ে দিতেন। নির্লোভ, নির্লিপ্ত অথচ শক্ত ধাঁচের মানুষ।

সঞ্জয়ের মাও ঠিক ওর বাবার যোগ্যা সহধর্মিনী। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে, কোনো অভিযোগ নেই, সংসারের সব দিকে নজর, অভাবের জন্য কখনো তাড়না করেন না সদানন্দ স্যারকে। তাঁর একমাত্র দুঃখ সঞ্জয়ের জন্য। ভগবান এ শাস্তি কেন তাঁকে দিলেন! তিনি তো কখনো অন্যায় বা অধর্ম কাজ করেননি, সবসময় সবার ভালোই তিনি চেয়েছেন, তবে কেন এমন হল!

সঞ্জয় মায়ের এই দুঃখ বোঝে, কিন্তু ভগবান ওর হাঁটাচলার ক্ষমতা কেড়ে নিলেও অন্যদিকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এই বয়সে ওর বুদ্ধি, বিবেচনা অনেক বয়স্ক মানুষকেও হার মানায়। মাকে ও বুঝতে দিতে চাইত না ওই রোগটা ওকে অক্ষম করে দিয়েছে। কথায় কথায় মাকে হাসাত, খেপাত আর নিজেও হেসে কুটিকুটি হত। মা আর ছেলের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা মিষ্টি সম্পর্ক। সে দিক দিয়ে সদানন্দ স্যার অনেকটা সংযমী, ওই যে বলা হয়েছে নির্লিপ্ত তাই। ভেতরে ভেতরে কিন্তু ছেলের জন্য তাঁর সূক্ষ্ম একটা বেদনা, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর চিন্তা, কিন্তু বাইরে তা কখনো প্রকাশ পেত না, খুব চাপা মানুষ।

পরীক্ষার ফল বেরোবার পর একদিন ওদের রীতাদি এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে এলেন, আর ইংরেজিতে গোর্কির মাদার বইটা। রোড টু লাইফ-এর তিন খণ্ডই পড়া হয়ে গিয়েছিল সঞ্জয়ের। গুন্ডা ছেলেদের যে ভাবে মাস্টারমশাই শান্ত সুবোধ করে তুলেছিলেন, এমনকী পরে প্রতিকূল পরিবেশে যেভাবে তারা অন্যান্য উচ্ছৃঙ্খল ছেলেদের বিরুদ্ধে মাস্টারমশায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তা মনে রাখার মতো। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওই কাহিনি কাল্পনিক নয়। বইটা সঞ্জয়ের ভালো লেগেছে শুনে রীতাদি খুশি হলেন।

সঞ্জয়ের মা অনুরোধ করতেই তিনি সেদিন খেয়ে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। সঞ্জয়ের মা খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। সাধারণ রান্না, তাই খুব তৃপ্তি করে খেলেন ওদের রীতাদি। সঞ্জয় ঠাট্টা করে বলল, ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মেমসাহেব পিঁড়ি পেতে ইস্কুল মাস্টারের বাড়িতে ডাল-ভাত খাচ্ছেন, খবরটা জানাজানি হয়ে গেলে প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে।’

রীতাদি বললেন, ‘দূর বোকা ছেলে, এ হল সমাজতন্ত্রের যুগ। খবরটা প্রকাশ হলে তোমাদের ডি এম-এর কত বড়ো পাবলিসিটি হবে জানো! খবরের কাগজের রিপোর্টাররা ছবি তুলতে ছুটে আসবে।’

‘দুঃখ হয় কখন জানো’, রীতাদি বললেন। ‘তোমাদের ডি এম-কে যখন রাজনৈতিক মহলের চাপে অন্যায়কে মেনে নিতে হয়। প্রতিবাদ করলেই বদলি, অপমান। মাঝে মাঝে উনি এ চাকরি ছেড়ে দিতে চান, ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠেন। আমিই বোঝাই যে চাকরিতেই যাবে কম বেশি এই পরিবেশ এড়াতে পারবে না। অন্যায় নেই, সুস্থ, দুর্নীতিমুক্ত আবহাওয়া, এমন চাকরি কোথায় এখানে!’

‘কী বলেন উনি?’ সঞ্জয়ের জানতে ইচ্ছে করে।

‘বলেন বিদেশে চলে যাবেন, লেখাপড়ার কাজ নিয়ে থাকবেন। আমার কিন্তু তাতে আপত্তি। এ তো পালিয়ে যাওয়া। বরং এই পরিবেশের মধ্যেই যতটা সম্ভব লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। বদলি করবে, করুক। কত আর বদলি করবে!’ একটু থেমে তিনি বললেন, ‘এই স্বাধীনতার জন্যই কি হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছিল! স্বাধীনতার নামে কী পেয়েছে সাধারণ মানুষ! ওষুধে ভেজাল, খাবারে ভেজাল, বেবিফুডে পর্যন্ত ভেজাল। এ দেশের মানুষগুলিই ভেজাল হয়ে গেছে, শুধু মিথ্যে আশ্বাস আর মুখে বড়ো বড়ো কথা। ইংরেজিতে একটা সুন্দর কথা আছে, ‘ইউ ক্যান ফুল অল দি পিপল সাম অফ দি টাইম, অ্যান্ড সাম অফ দি পিপল অল দি টাইম, বাট ইউ কান্ট ফুল অল দি পিপল অল দি টাইম।’ কথাটা কে বলেছেন জান? এব্রাহাম লিঙ্কন।’

‘আমি লিঙ্কনের জীবনী পড়েছি’ সঞ্জয় বলল। ‘অসাধারণ এক মানুষ। রুপোর চামচ মুখে দিয়ে তিনি জন্মাননি, কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে জীবনে। সাধারণ মানুষের দুঃখ তাই তিনি বুঝতেন। আর এখানে রাজনীতিটা শুধু ক্ষমতার লড়াই। সাধারণ মানুষের ভালো হল কিনা বয়েই গেল নেতাদের।’

‘খুব খাঁটি কথা বলেছ তুমি’, রীতাদি বললেন। ‘রাজনীতিটা এখন একটা লোভনীয় পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

উঠে দাঁড়িয়ে তিনি হেসে বললেন, ‘আমার এসব কথা সরকারের কানে গেলে তোমাদের ডি এম-এর চাকরিটা নট হয়ে যাবে।’

তিনি চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল সঞ্জয়। আজকের আলোচনায় ওর মন কেমন যেন অশান্ত হয়ে উঠেছে। এব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনীটাই মনে পড়ছিল ওর। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম। অথচ অমন মানুষকেও প্রাণ হারাতে হয়েছিল এক জল্লাদের গুলিতে, সেই লোকটাকে জল্লাদ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারা যায় না।

১০

মানুষকে শান্তিতে না থাকতে দেয়াই বোধ হয় প্রকৃতির নিয়ম। কখন কোথায় যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বারুদের স্তূপে ঠিকরে পড়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে তার আভাস আগে পাওয়া যায় না।

বেশ চলছিল মানুষের জীবন। বড়ো শহর থেকে দূরে ছোটো ছোটো শহর গঞ্জে মানুষ জনের মধ্যে পরস্পরের প্রতি একটা সহযোগিতার মানসিকতা আছে; একে অপরের বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ সেই প্রীতির বাঁধন আলগা হয়ে গেল। সামান্য অতি তুচ্ছ কারণে।

শহরটার একদিকে দিন মজুরি করে সংসার চালায় এমন কয়েক-শো ঘর মানুষের বস্তি। কিছু নমশূদ্র, কিছু মুসলমান, কিছু উচ্চশ্রেণির হিন্দুদের বাস। এরা সবাই খেটে খায়। ঝুড়ি বোনা, লোহার চিমটা, চাটু, কাটারি বানানো, লেপ তোশক তৈরি করা এসব কাজে এ পাড়ার মানুষেরা দক্ষ কারিগর। এই বস্তিটার পাশে আছে একটা মস্ত পতিত জমি। ওটা নাকি ছিল অতীত কোনো জমিদারের বাগান। এখন শুধু নামটাই আছে ঘোষবাগান। জমিটা এখন সরকারের হাতে এসেছে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর। বাগানটা বোধ হয় এক কালে বেড়া দেওয়া ছিল। জমিটার চারপাশের সীমানা বরাবর নোনা আতার গাছ, নিম গাছ, সজিনা গাছের সারি তার সাক্ষ দেয়। বাগান আর নেই, এখানে-সেখানে বাবলা, আশশেওড়া, মনসা গাছের জঙ্গল। তারই মাঝখানে খানিকটা জায়গা একটু পরিষ্কার। এখানে ওই দিনমজুরি করা মানুষগুলোর ছেলেপিলেরা কাগজ আর ছেঁড়া কাপড়ের তৈরি বল নিয়ে ‘ফুটবল’ খেলে, ধাপসা খেলে, মেয়েরা এক্কা দোক্কা খেলে। আবার কখনো রাত্রে গ্যাসের আলো জ্বালিয়ে ‘জগাই মাধাই উদ্ধার’ যাত্রা করে। এই জমিতে এসব অনুষ্ঠানে জাত নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে হোলি খেলে, মহরমে হিন্দুরা ঢাল ঘোরায়, আনন্দটাই থাকে লক্ষ।

হঠাৎ শোনা গেল ওই জঙ্গল পরিষ্কার করে ওখানে নাকি তৈরি হবে স্টেডিয়াম, খেলার মাঠ। কয়লার আড়তদার ছুটলাল একদিন ও পাড়ার চরণ দাসকে ডেকে বললে, ‘চরণদাস, তোকে বেশ ক-দিন দেখিনি। কেমন আছিস? শোন কয়লার দরকার থাকলে নিয়ে যা কয়লা। আর দেখ, আমি ভাবছিলাম ওই ঘোষবাগানে আমি বড়ো করে কয়লার ডিপো করব, তাতে তোদের পাড়ার সবাইকার কত সুবিধা হবে, তা না করতে দিয়ে ওখানে খেলার মাঠ হবে গো। সেই স্টেডিয়ামে তোদের ছেলেদের খেলবার হুকুম নেই। তবে বুঝে দেখ তোদের কী লাভ হবে?’ চরণদাস কেমন যেন ধাঁধায় পড়ে বলে, ‘তা বাবু আমরা কী করব বল?’ ছুটলাল একটু হেসে বলে, ‘ওই তো তোদের দোষ, কী করব আমরা? কেন সবাই রুখে দাঁড়া জোর গলায় বল এ স্টেডিয়াম আমরা করতে দেব না। ব্যাস সরকার লেজ গুটিয়ে পালাবে। বন্ধ হবে স্টেডিয়াম। সবাইকে খবরটা দে আর তোল জিগির, স্টেডিয়াম করা চলবে না, চলবে না।’

চরণদাসকে বেশ উত্তেজিত দেখায়। উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধের গামছাটা দু-হাতে ধরে গলায় ফেলে ছুটলালকে প্রণাম করে বলে, ‘আপনি থাকতে আমাদের ভয় কী, দেখুন না কীরকম লড়াই করি।’ ছুটলাল চরণদাসের পিঠে হাত রেখে বলে, ‘এই তো চাই, দেখ-না কয়লার আড়তটা তোদের কত কাছে করে দেব, একটা কেরোসিনের ডিপোও করে দেব।’

দারুণ উত্তেজিত হয়ে চরণদাস চলে গেল। ছুটলালের মুখে ফুটে ওঠে কুটিল হাসি। কাজটা ঠিক পথেই চলতে আরম্ভ করবে মনে হচ্ছে। চরণদাস পাড়ায় গিয়ে সবাইকে ডেকে জানাল, ‘তোদের ছেলে-মেয়েরা যেন না খেলে, আমরা যাতে যাত্রা গান না করতে পাই তার জন্য ঘোষবাগানে হচ্ছে স্টেডিয়াম।’ সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘স্টেডিয়াম মানে কী?’ চরণদাস বিজ্ঞের মতো বলে, ‘সে একরকমের জেলখানা আর কী? কথা হচ্ছে জেলে পোরার জন্য এত লোক কোথা পাবে, তখন আমাদের সব ঢোকাবে আর কী। আমরা গরিব ছোটো জাতের, আমাদের কথা আর কে শুনবে।’ সবাই ভয় পায়, বলে, ‘তবে কী উপায় আছে গো, কী করব আমরা?’ চরণদাস ছুটলালের উপদেশের কথা বলে। সে-কথা শুনে সমবেত মানুষের গলায় চিৎকার ওঠে, ‘চলবে না, চলবে না।’

আপত্তি উঠল নমশূদ্রের, আপত্তি উঠল মুসলমানের, আপত্তি উঠল গরিব উচ্চশ্রেণির হিন্দুর। সভা সমিতি হল। বড়ো শহর থেকে একজন হরিজন দরদি এসে হুংকার তুললেন, ‘জো সামনে আয়েগা, চুর চুর হো জায়েগা।’ সেই দিনই সন্ধের দিকে কয়েকটা দোকানে লুঠ হল, বেশ কয়েকটা চালাঘর জ্বলে গেল আগুনে। অনেক জায়গায় হাতাহাতি হল। পা ভাঙল, মাথা ফাটল বেশ কিছু লোকের।

পরের দিন পুলিশ বেশ ক-জন দিনমজুরদের পাকড়াও করে নিয়ে গেল। অন্য পাড়া থেকেও সাত আট জনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে সারা শহরে, কিন্তু হরিজন পাড়াটা যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে বলে চরণদাসের মনে হল। সে গেল ওই পাড়ায় সবাইকার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। ওরা ফিশফিশ করে জানাল যে পুলিশ কেবল ওদের পাড়ার ক-জনকে ধরেছে, বড়োলোকদের দিকে হাত বাড়ায়নি। স্তিমিত জনে এ খবর আবেগ সঞ্চার করল। সন্ধ্যা হতেই আবার লুটপাট আরম্ভ হল।

ডি এম আর এস পি-র নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ সব অঞ্চলে আর প্রধান প্রধান রাস্তায় টহল দিচ্ছে। সন্ধে ছ-টা থেকে পরদিন ভোর ছ-টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে। লাঠি, বর্শা বা ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কেউই পথে চলাফেরা করতে পারবে না, তা ছাড়া আছে ১৪৪ ধারা জারি।

কলকাতা থেকে মন্ত্রীরা ছুটে এলেন, সর্বদলীয় বৈঠক বসল। সেই বৈঠকে অনেক কাদা ছোড়াছুড়ি হল, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দোষ দিল। শেষপর্যন্ত ঠিক হল শহরে শান্তি মিছিল বেরোবে, আর সব রাজনৈতিক দল যোগ দেবে সেই মিছিলে।

যে জমিটা কেন্দ্র করে এত গোলমাল, তার চারপাশে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করলেন জেলা শাসক। তবে সরকার যে তাদের সংকল্পে অবিচলিত এবং ওখানে স্টেডিয়ামই হবে তা পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হল। যাদের ঘরবাড়ি দোকান পুড়েছে তাদের ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করা হল। দিন কয়েকের উত্তেজনার পর শহরটা শান্ত হল আবার, কিন্তু মানুষের বিশ্বাসে যেন একটা চিড় ধরিয়ে গেল। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে আগের মতো চোখে আর দেখছে না, একটা অবিশ্বাসের কালো মেঘ যেন প্রীতির চাঁদনিকে ঢেকে দিল।

১১

স্কুল খোলার পর এই মনের পরিবর্তনটা সুজিত আর অর্ণবের নজর এড়াল না। ওদের ক্লাসের অনেক ছেলে যারা ওই পাড়া থেকে আসত তারা যেন কেমন অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গ এড়িয়ে চলছে। কেমন একটা থমথমে ভাব। আগের সহজসরল, হাসিখুশির দিনগুলো যেন এই ঘটনায় হারিয়ে গেল। সুজিত আর অর্ণবের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল শিবুদাসের ছেলে কালিদাসের আর আমিনুলের। ওরা দু-জনেই ক-দিন ধরে স্কুলে আসছে না। পরের রবিবার সুজিত আর অর্ণব গেল ওদের বাড়ি, ওরা কেন স্কুলে আসছে না তার খোঁজ নিতে।

আমিনুলের বাবা দরজা খুলে দিলেন। ওদের দেখে তাঁর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। আমিনুলের সঙ্গে ওরা দেখা করতে এসেছে শুনে ওদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভিতরের একটা ঘরে আমিনুল শুয়ে আছে ওর মাথায় জলপটি দেওয়া হচ্ছে।

‘কী হয়েছে ওর?’ সুজিত ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল।

‘দাঙ্গার দিন বিকালে বাড়ি ফিরছিল’, আমিনুলের বাবা গম্ভীর মুখে বললেন। ‘দাঙ্গাকারী কোনো দল থেকে ওকে পাথর ছুড়ে আহত করতে চেয়েছিল। ও দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে এসেছে এখানে কিন্তু রাত্রি থেকেই জ্বর এসেছে। ডাক্তারবাবুও এখানে আসতে চাইছেন না আর ওকেও আমরা এ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারছি না। মনে আঘাত পেয়েই বোধ হয় জ্বরটা এনেছে।’ সুজিত সঙ্গে করে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে আসবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল। সুজিত আর অর্ণব দু-জনেই বলে উঠল, ‘এই দুঃখজনক ঘটনার জন্য আমরা সবাই দায়ী। আমাদের সকলেরই এর জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত।’ আমিনুল অন্য দিকে মুখ ফেরাল। ওর বাবা বললেন, ‘তোমরা এখন এসো।’ ওরা বেরিয়ে গেল। একটা ঘোর লজ্জা ওদের বুকে চেপে বসেছে। যেন মনে হচ্ছে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত ওদেরই করতে হবে।

কালিদাসের বাড়ি গিয়ে ওরা দেখল তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। দাঙ্গার সময় ও সবজি কিনে বাড়ি ফিরছিল তখনই কারো ছোড়া পাথর লাগে ওর মাথায়। এখন ভালো আছে তবে ওর বাবা ভীষণ দুঃখ পেয়েছেন। ছেলেটা বেঁচে গেছে খুব। সুজিত ওদের বোঝাল ভালো করে। অবাক হল শুনে যে কে ওই পাড়ায় রটিয়েছে যে খেলার মাঠ হলে গরিবদের খেলতে দেওয়া হবে না। হরিজনদের আর মুসলমানের সেখানে কোনো স্থান হবে না। কে বলেছে সে-কথা কেউই বলতে পারছে না।

কুমুদ রায় বললেন, ‘এটা হিন্দু-হরিজন বা মুসলমানের প্রশ্ন নয়। কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোনো কূটবুদ্ধি মানুষ মিথ্যা প্ররোচনা দিয়ে দাঙ্গার শুরু করেছে। তার উদ্দেশ্য বোধ হয় ওই জমিটা দখল করা।’

এই দাঙ্গায় গরিব, বড়োলোক, হিন্দু, মুসলমান সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দাঙ্গাটা আরও চললে সেই কুচক্রীর লাভ হত।

সুজিত আর অর্ণব গোপনে খোঁজ করতে লাগল এই দাঙ্গা বাধার সঠিক কারণ কী? খোঁজ পেল হরিজন পাড়ায় সভার কথা। চরণদাসের কাছে শুনল কয়লার আড়তদার ছুটলালের কথা। সে-কথা রীতা দেবী শুনলেন। উনি ডি এম আর এস পি-কে এ নিয়ে তদন্ত করে কুচক্রীদের শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করতে বললেন।

ব্যাপারটা চাপা রইল না। একটা মিথ্যা কথা বলে এমন একটা ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়ে গেল। দাঙ্গা থেমে গেলেও যে প্রীতির সম্পর্কে একটা ফাটল ধরেছে সেটা মিলিয়ে গেল না। সুজিত আর অর্ণব ভাবে কী করলে এই চাপা সন্দেহটাকে মুছে ফেলা যাবে?

ছুটলালের আড়ত বন্ধ। ছুটলাল নাকি বৈষ্ণোদেবীর পূজা দিতে গেছেন যাতে ভবিষ্যতে দাঙ্গা না হয় আর সকলের মঙ্গল হয়। পুলিশ খুঁজে পেয়েছে তার লেখা আবেদনপত্রে যে ওই পতিত জমিটা নামমাত্র মূল্যে একে দেওয়া হোক। উনি ওখানে কয়লার আড়ত খুলবেন আর তার উদ্দেশ্য হল ওই পাড়ার লোকদের সাহায্য করা। উদ্দেশ্য বোঝা গেলেও চট করে ছুটলালকে আইনের আওতায় আনা সহজ ছিল না।

সুজিত, আমিনুল আর অর্ণব সদানন্দ স্যারের কাছে গেল। ওরা চাইছিল তাঁর কাছ থেকে জানতে এ সময়ে ছাত্রদের কর্তব্য কি? সদানন্দ স্যার বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে কিছু ভাবছিলেন। তাঁকে এত গভীরভাবে চিন্তা করতে ওরা আগে দেখেনি। আমিনুলকে দেখে বললেন, ‘তোকে নাকি আহত করেছে, কারা মেরেছিল?’

‘গুন্ডারা মেরেছিল’, ও জবাব দিয়েছিল।

সুধীনবাবু বলে একজন শিক্ষক বললেন, ‘এ তো সহজেই বোঝা যায় গুন্ডার কাজ, ভদ্রলোকেরা এসব কাজ করতেই পারে না। গুন্ডাদের জাত নেই, ওরা গুন্ডাই।’

সদানন্দ স্যারের মুখে ফুটে উঠল বিষণ্ণ হাসি। সুজিত বলে, ‘স্যার, যে সন্দেহরূপী কাঁটা গাছ আমাদের মাঝে বড়ো হয়ে উঠেছে তাকে সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। তাই ভাবছি শান্তি মিছিল বার করব সবাই মিলে।’

সদানন্দ স্যার বললেন, ‘মিছিল আর ধুনি দেওয়া রাজনীতির ফয়দা উঠিয়ে যারা নিজেদের গদি কায়েম করতে চান তাদের। আমি ভাবছি দোষ আমাদের। ওই পাড়ার মানুষেরা ঠিকমতো শিক্ষাই পায়নি, তাই তো স্বার্থবুদ্ধি ব্যবসায়ীরা ওদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙে। ওই পাড়ায়, অন্য পাড়ায়, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃত তথ্য প্রচার করতে হবে। বলতে হবে স্টেডিয়ামে থাকবে সব ভারতের নাগরিকের সমান অধিকার। সকলের খেলাধুলায় উন্নতি আর সুবিধার জন্য তৈরি হবে স্টেডিয়াম।

‘সাম্প্রদায়িক প্রীতির বাঁধন বাঁধতে হবে স্বাভাবিকভাবে। মিছিল অনেকটা হাউই এর মতো, খুব একটা বেগ আর আলোর দীপ্তি জ্বলে উঠেই হারায় অন্ধকারে। মোড়ে মোড়ে সভায় থাকবে সবাই শিবুদাসেরা, সুজিত অর্ণবেরা, আমিনুলরা। বলতে হবে একটা পাপড়িতে ফুল হয় না। অনেক পাপড়ি নিয়েই একটা ফুল।’

সদানন্দ স্যার সুজিত আর অর্ণবের পিঠে হাত রেখে সস্নেহে বললেন, ‘মিছিলে ধুনি দিয়ে চলার একটা উদ্দীপনা আছে। বহু লোকের সপ্রশংস দৃষ্টি মিছিলকারীদের উৎসাহ বাড়ায়, কিন্তু সত্যিকারের কাজ চলে সহজ পথে ঢাক ঢোল বাজিয়ে নয়। এ পথে মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, এ পথের বাধা ওইসব মানুষেরা, যাদের পথ দেখাতে যাবে। ওরা অবিশ্বাস করে ওরা যে বার বার ঠকে যায় তাই। তবে তোমাদের সেই পথে চলবার ধৈর্য্য আছে দৃঢ়তা আছে, তোমরা পারবে।’

এস পি সাহেব সুজিতদের ডেকে এখন ওই ধরনের পথসভা করার ঝুঁকির কথা বললেন আর পুলিশ মোতায়েন করার কথা বললেন, সুজিত বলল, ‘পুলিশের ব্যাটনের আড়ালে দাঁড়িয়ে এ ধরনের সভা সফল হবে না।’ এস পি বললেন, ‘ঠিক আছে তোমার সভায় পুলিশ থাকবে না তবে সাধারণ পোশাকে ওই পাড়ায় পাহারায় থাকবে।’

সুজিতরা অবাক হল পথসভায় সাধারণ মানুষের আগ্রহ দেখে। ওরা বুঝতে পারল ওই পাড়ার লোকেদের তাদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে স্বার্থবুদ্ধি মানুষ কীভাবে ওদের উত্তেজিত করে বিপথগামী করেছে। দু-এক জায়গায় ছুটলালের লোকেরা চেষ্টা করেছে সভা পণ্ড করবার কিন্তু জনতার চাপে তারা সরে পড়তে বাধ্য হয়েছে।

দু-চার দিন এভাবে কাজ করে উৎসাহিত হয়ে ওরা রবিবার সকালে গেল সদানন্দ স্যারের বাড়ি। ওঁর বাড়ির দরজার কাছে যেতেই শুনতে পেল স্যার প্রার্থনা করছেন। সেই কম্বুকণ্ঠের ধ্বনি যেন সকালের সোনালি সূর্যের আলোর মতো সব কিছুকে মঙ্গলের পরশ দিচ্ছিল— সর্ব্বেসাং মঙ্গলং সন্তু সর্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ!

ওরা সেই আরাধনায় বিঘ্ন ঘটাল না। দরজার বাইরে থেকে প্রণাম জানিয়ে চলে এল। তখন ওদের মনেও সেই মন্ত্রের ছোঁয়া— সকলের মঙ্গল হোক, সকলে সুস্থ থাকুক।

১২

জেলা শাসকের একাদশ বনাম অবশিষ্ট দলের খেলাটা শেষপর্যন্ত হল। দাঙ্গাহাঙ্গামার জন্য ওটা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসতেই এস পি উঠে পড়ে লাগলেন। জেলা শাসকের দলে সুজিত আর আমিনুল আরও সব বাছাই খেলোয়াড়। অবশিষ্ট একাদশও খুব ভালো দল হল।

মাঠের চারপাশে টিনের বেড়া, টিকিট করে খেলা। সব টাকা জমা পড়বে ডি এম-এর ত্রাণ তহবিলে, তা থেকে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করা হবে।

ভালো খেলা দেখার আশায় ভিড়ও হল বেশ। প্রথম থেকেই জমে উঠল খেলা। ডিএম আর তাঁর স্ত্রীও মাঠে ছিলেন। রীতা বসু একবার স্থান কাল ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই সুজিত, একী খেলা হচ্ছে!’ বলেই তিনি জিভ কাটলেন, ডি এম ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

সুজিত সত্যিই খেলতে পারছিল না। রীতাদির গলা কানে যেতেই ও যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। আমিনুলের সঙ্গে ওয়াল পাস খেলে উঠে গেল, তারপরই ওকে চমৎকার একটা থ্রু বাড়াল। ওই বল জালে পাঠাতে ভুলচুক করল না আমিনুল।

কিন্তু বিপক্ষও কম যায় না। একটু পরেই গোল শোধ করে বিরতির ঠিক আগে এক গোলে তারা এগিয়ে গেল। যে ইস্কুলের সঙ্গে সুজিতদের খেলা হয়েছিল সেই বিদ্যাভবনের স্ট্রাইকার ছেলেটিই খেলছিল বিপক্ষ দলে। দুটোর মধ্যে একটা গোল সেই দিল।

বিরতির সময় রীতা বসু সুজিতকে ডেকে পাঠালেন, বললেন, ‘তোমাদের ডি এম-কে কালো মুখ করে বাড়ি ফিরতে হবে নাকি?’

সুজিত মাথা চুলকাল। ডি এম ওর অবস্থা দেখে হাসলেন।

আবার শুরু হল খেলা। ডি এম-এর দল এবার চেপে ধরল। সুজিত ভালো ভালো বল করতে লাগল। আমিনুল গোলে দুটো শট নিয়েছিল। একটা ওদের গোলকিপার ডাইভ দিয়ে বাঁচিয়ে দিল, আর একটা ডান দিকের গোল পোস্টের কয়েক ইঞ্চি বাইরে দিয়ে জালে আছড়ে পড়ল। গোল আর হয় না। এদিকে ওদের গোলেও বিপক্ষ দল হানা দিতে ছাড়ছে না। আরেকটা গোল হতে হতে বেঁচে গেল। ডি এম-এর দলে টাউন ক্লাবের দু-জন ডিফেন্সের খেলোয়াড় ছিল, তারাই বার বার রুখে দিচ্ছিল বিপক্ষের আক্রমণ।

খেলা প্রায় শেষ। দু-মিনিট বাকি। সুজিত মনে মনে ভাবল রীতাদির কাছে বকুনি খেতে হবে। অমন করে বললেন, কিন্তু গোলটা শোধ করা গেল না।

সমাপ্তির বাঁশি বাজার আগের মুহূর্তে সুজিতরা ঠিক ডাইরেক্ট ফ্রি কিক পেল, বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের ঠিক বাইরে। আমিনুল বলটা সাজাল তারপর ছুটে বলটা মারতে এসেই দু-পা ফাঁক করে লাফ দিয়ে পাশে সরে গেল আর পেছন থেকে এসে গোলার মতো শট করল সুজিত। সবাইকে হতভম্ব করে বল গোলে ঢুকল আর সেইসঙ্গে বাজল খেলা শেষের বাঁশি। ওদিকে রীতা বসুও উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন, হাততালি দিচ্ছেন। ডি এম তাঁর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘কী হচ্ছে, বসে পড়।’

খেলার শেষে পুরস্কার বিতরণ। ডিস্ট্রিক্ট জজকে অনুষ্ঠানের সভাপতি করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি আসতে না পারায় ডি এমকেই পৌরহিত্য করতে হল। রীতা বসু পুরস্কার দিলেন। সুজিত পেল সেরা খেলোয়াড়ের পদক। ওর হাতে পদক তুলে দেবার সময় রীতা বসু এমন মিষ্টি করে হাসলেন যে সুজিতের সব পরিশ্রম সার্থক মনে হল।

১৩

আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার প্রতিবন্ধীদের এক সংস্থা পনেরো বছরের নীচে প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের জন্য ইংরেজিতে একটা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। পৃথিবীর যেকোনো দেশের প্রতিবন্ধী ছেলে বা মেয়ে ওই প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারবে। কোনো এন্টি্র ফি নেই। শুধু কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বা ইস্কুলের প্রধানের কাছ থেকে বয়সের একটা সার্টিফিকেট ওই প্রবন্ধের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে।

প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল, ‘কোনো বাধাই বাধা নয়।’

প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে সে পাবে ভারতীয় মুদ্রায় পঁচিশ হাজার টাকা, তা ছাড়া আমেরিকার এক হাসপাতালে তার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ভার নেবে ওই সংস্থা, আর যাতায়াতের খরচা পর্যন্ত।

দ্বিতীয় জন পাবে ভারতীয় মুদ্রায় পনেরো হাজার টাকা, তাকেও সব খরচ দিয়ে আমেরিকায় গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করা হবে। আর যে তৃতীয় হবে সে শুধু পাবে ভারতীয় মুদ্রায় কুড়ি হাজার টাকা। সবই কিন্তু আমেরিকার ডলারে।

সঞ্জয় কপালে ঠুকে একটা প্রবন্ধ পাঠিয়েছিল। সুজিতদের ইস্কুলের হেডমাস্টারমশাই ওর বয়সের সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। সঞ্জয় ওই ইস্কুলের ছাত্র হিসেবেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। স্কলারশিপ পাবার পর সেই ব্যবস্থাই হয়েছে ডি এমও এই ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলেন।

সারা বিশ্ব জুড়ে প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা। সঞ্জয় কোনো আশা করে প্রবন্ধ পাঠায়নি, নিছক কৌতূহলের বশেই পাঠিয়েছিল। ভুলেও গিয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু ফল যখন বেরোল, দেখা গেল ও দ্বিতীয় হয়েছে। আবার কাগজে কাগজে ওর ছবি ছাপা হল। ওর নানান গুণ ও কৃতিত্বের কথা ফলাও করে ছাপল পত্রপত্রিকায়। টিভি থেকে এসে ওর ইন্টারভিউ নিয়ে গেল। সে এক এলাহি কাণ্ড।

কলকাতার ‘স্বপ্নদীপ’ হল অল্পবয়সি প্রতিবন্ধীদের একটা আবাসিক আশ্রম। ওখানে তারা লেখাপড়া আর হাতের কাজ শেখে। সমাজের বড়ো বড়ো ডাক্তার, শিল্পী আর বুদ্ধিজীবীরা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। ওই আশ্রমের পক্ষ থেকে সঞ্জয়কে সম্বর্ধনা জানাবার আয়োজন করা হল আকাডেমি অফ ফাইন আর্টস ভবনে। রীতা বসুর অনুরোধে এস পি স্বয়ং ওকে পুলিশের গাড়িতে কলকাতায় নিয়ে গেলেন, ওর হুইল চেয়ারটাও সঙ্গে গেল।

সেই সভায় কলকাতার মেয়র থেকে শুরু করে অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষ এলেন। সঞ্জয়কে বড়ো বড়ো ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানাল ওই আশ্রমের ছেলে-মেয়েরা। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়ে সঞ্জয় আমেরিকায় যাচ্ছে, তাই ওরা গাইলঃ

জয়যাত্রায় যাও গো, ওঠো জয়রথে তবে।

মোরা জয়মালা গেঁথে আশা চেয়ে বসে রব।

মোরা আঁচল বিছায়ে রাখি পথধূলা দিব ঢাকি,

 ফিরে এলে হে বিজয়ী

 তোমারে হৃদয়ে বরিয়া লব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান। সঞ্জয়কে সংবর্ধনা জানাবে বলে আশ্রমের ছেলে-মেয়েরা এই গানটা নতুন শিখেছিল।

মেয়র এবং অন্যান্য অভ্যাগতরা সুন্দর বক্তৃতা দিলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক কিছু করা দরকার তা সবাই স্বীকার করলেন।

সবশেষে সঞ্জয়কে কিছু বলতে বলা হল। বসে বসে কথা বলার জন্য ও প্রথমেই সভার সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল। ও বলল, ‘প্রতিবন্ধী বলে আমাদের কিছুটা অসুবিধে আছে, তবে মনের জোরে আমরাও অনেক বাধাবিঘ্ন জয় করতে পারি। হয়তো কোনোদিন শোনা যাবে প্রতিবন্ধীরা এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছে, ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হচ্ছে। সে-দিনের বোধ হয় বেশি দেরি নেই।’ পৃথিবীতে যেসব প্রতিবন্ধীরা অসামান্য সাফল্য লাভ করেছে তাদের কথাও বলল। সব শেষে বলল, ‘সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আপনারা আমাদের করুণা করবেন না, আমরা আপনাদের করুণা ভিক্ষার প্রত্যাশী নই, আপনাদের আন্তরিক সহানুভূতিই আমাদের সংগ্রামের হাতিয়ার হোক।’

খুব হাততালি পড়ল। ওই আশ্রমের জন্য সভাতেই পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা উঠল। সঞ্জয় প্রতিশ্রুতি দিল ও আমেরিকা থেকে ফিরে এসে এই আশ্রমের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখবে, পুরস্কারের টাকা পেলে আশ্রমকে যা পারে দেবে।

একটা কথা বলা হয়নি, ওই প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়েছিল ম্যানিলার চোদ্দো বছরের একটি মেয়ে, জন্ম থেকেই সে পঙ্গু।

১৪

সঞ্জয়ের বিদেশযাত্রার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। আমেরিকার সেই সংস্থা থেকে চিঠি এসেছে। চেকও এসে গেছে। সঞ্জয়কে কোথায় কোন হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা হবে তা জানিয়ে ওর অসুখের পুরো ইতিহাস পাঠাতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে ও আমেরিকার মাটিতে পা দেবার মুহূর্ত থেকে ওর সব ভার নেবে ওই সংস্থা, কোনো চিন্তা নেই। ওর মা-বাবা ওকে একা পাঠাতে দ্বিধা করছিলেন, এই চিঠি পেয়ে আশ্বস্ত হলেন। কত তাড়াতাড়ি ওরা সব ব্যবস্থা করে ফেলল। আমাদের দেশ হলে কতদিন লাগত কে জানে!

দারুণ একটা উত্তেজনা অনুভব করছে সঞ্জয়। ও যে কোনোদিন বিদেশে যেতে পারবে এমন কল্পনাই ও করেনি। অর্ণব লেখাপড়ায় ভালো, মাধ্যমিক পরীক্ষায় ও যে ভালো রেজাল্ট করবে সে বিষয়ে মাস্টারমশাইদেরও সন্দেহ নেই। ওর মনে মনে ইচ্ছে এখানকার পড়া শেষ করে বিদেশে যাবে পড়তে। সঞ্জয়কে ও বলল, ‘ইস তোকে আমার খুব হিংসে হচ্ছে। আমি যদি তোর সঙ্গে যেতে পারতাম!’

ওদের রীতাদি সঞ্জয়ের যাবার আগে ওর সম্মানে তিন জনকেই একদিন নেমন্তন্ন করলেন। ওদের খাওয়াবেন বলে তিনি নিজের হাতে রান্না করেছিলেন। রুই মাছের কালিয়া, গলদা চিংড়ির মালাইকারি আর মাংসের কোর্মা। ওরা খুব প্রশংসা করল রান্নার। রীতাদি বললেন, ‘আমাকে খুশি করবার জন্য বলছ না তো?’

‘না, না’, সুজিত প্রতিবাদ করে উঠল। ‘এত ভালো রান্না কখনো খাইনি।’

‘তা যাই বল’, রীতাদি বললেন, ‘সঞ্জয়ের মার হাতের বড়ি দিয়ে সেই লাউ শাক আমি ভুলব না, কী যে স্বাদ হয়েছিল, এখনও যেন মুখে লেগে আছে।’

রীতাদির বর এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিল।

আমেরিকার সেই সংস্থা দিল্লিতে তাদের দূতাবাসকে জানিয়েছিল সঞ্জয়ের সব যাবার ব্যবস্থা যেন তাড়াতাড়ি করা হয়। দূতাবাস ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়মকানুন তাড়াতাড়ি সেরে ফেলার অনুরোধ করেছিল। ভারত সরকার আবার জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। ফলে শেষ পর্যন্ত ডি এম-এর ঘাড়েই এসে পড়েছে সব দায়িত্ব। সঞ্জয়কে দিল্লিতে আমেরিকার দূতাবাসে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা তাঁকেই করতে হচ্ছে, ওখান থেকে দূতাবাস সব ভার নেবে। আমেরিকা যাবার টিকিট, হাত খরচ সব ওখান থেকেই দেওয়া হবে।

‘আগামী মাসের গোড়ার দিকে তোমার চিকিৎসা শুরু করতে চাইছেন ওঁরা’, ডি এম বললেন। ‘এ মাসের শেষ সপ্তাহে তোমার দিল্লি যাবার ব্যবস্থা করেছি। তোমার বাবাও তোমার সঙ্গে দিল্লি পর্যন্ত যাবেন। আমি খোঁজখবর নিয়েছি, ওই সংস্থার খুব নাম, বিরাট বিরাট সব ধনী পৃষ্ঠপোষক। আসলে ওই সংস্থার যিনি চেয়ারম্যান তিনি আমেরিকার একজন ধনকুবের, কিন্তু তাঁর নিজের ছেলেই প্রতিবন্ধী। তাই প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ তিনি মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছেন। তাঁর দেখাদেখি আরও অনেক বিলিওনিয়ার এগিয়ে এসেছেন।’

‘বিলিওনিয়ার আবার কী?’ সুজিত জিজ্ঞেস করল।

ডি এম হেসে বললেন, ‘এক মিলিয়ন হল দশ লক্ষ, মিলিওনিয়র বলতে আমরা এ দেশে কোটিপতি বুঝি। আর বিলিয়ন হল এক হাজার মিলিয়ন, মানে দশ লক্ষ ইনটু এক হাজার, ইকোয়াল টু এক-শো কোটি। আরে এ হল আমেরিকা, ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা।’

ওদের হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন।

‘এক-শো কোটি!’ সুজিত বলল। ‘এমন ধনী ও দেশে আছে?’

‘একজন দু-জন নয়, অনেক’, ডি এম জবাব দিলেন। ‘ভালো কথা সঞ্জয় তুমি পোশাক বানিয়ে নাও, গরম পোশাক কিনতে হবে, একটা ওভারকোট হলে ভালো হয়।’

আমি ওর জন্য একটা ফুল হাতা সোয়েটার বুনেছি’, রীতাদি বললেন। ‘একটা টুপিও বোধ হয় লাগবে। ও দেশের মানুষ টুপি পরে শুনেছি।’

‘থাক’, সঞ্জয় গম্ভীর মুখে বললল। ‘আপনাকে আর আমাকে টুপি পরাতে হবে না।’

ওর কথা বলার ধরনে সবাই হেসে উঠল।

১৫

আজকাল সঞ্জয় হুইল চেয়ারে একাই বেরিয়ে পড়ে, ওকে তো স্বাবলম্বী হতে হবে। আর দিন পনেরো কুড়ি পরেই ওকে পাড়ি দিতে হবে বিদেশে। একটা অচেনা জগৎ, অজানা পরিবেশ, সেখানে আত্মনির্ভর না হলে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে।

সেদিন পথে জোরে বৃষ্টি নামল। বেচারা ভিজে একেবারে একাকার— ঠিক যেন ভেজা কাক। বাড়ি এসে ভালো করে মাথা মুছে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলল। ওর মা আদা দিয়ে গরম চা বানিয়ে দিলেন। ওর আবার ঠান্ডার ধাঁচ। একটুতেই সর্দি হয়, বুকে কফ বসে যায়।

সন্ধের দিকে অর্ণব এসেছিল, ও তখন হাঁচছে। গাও গরম হয়েছে।

‘যাবার আগেই সর্দি বাধিয়ে বসলি’, অর্ণব বলল।

‘আর বল কেন’, সঞ্জয় বলল। ‘এমন বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গেলাম, মাথা গোঁজবার একটা জায়গা ছিল না।’ আবার হাঁচল ও। ‘তবে এ আমার অভ্যেস আছে, দিন দুই ভোগাবে।’

রাত্রে জ্বর বাড়ল।

পরদিন ডাক্তার এলেন। পরীক্ষা করে বললেন, ‘বুকে একটু কফ বসেছে তাই জ্বর, আমি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি।’

ট্যাবলেট খেয়েও কিন্তু জ্বর কমল না, এদিকে যাবার দিন এগিয়ে আসছে। সদানন্দ স্যারের দুশ্চিন্তাই হল। যে ডাক্তার দেখছিলেন তিনি বয়সে নবীন। অন্য ডাক্তার ডাকবেন কিনা ভাবছিলেন সদানন্দ স্যার, হঠাৎ জ্বরটা বাঁকা পথ ধরল। জ্বরের সঙ্গে ভুল বকতে লাগল সঞ্জয়। সদানন্দ স্যার আর দেরি করলেন না, একজন প্রবীণ ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। তিনি ওর বুক পরীক্ষা করে আঁতকে উঠলেন, বললেন, ‘এ তো নিউমোনিয়া, দুটো লাংগসই অ্যাফেকটেড মনে হচ্ছে।’ তিনি তখুনি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করলেন, ওই ছোকরা ডাক্তারকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করলেন।

হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল। বিদেশ যাবে বলে বাড়িতে শোরগোল পড়েছিল, সেখানে নেমে এল দুশ্চিন্তার করাল ছায়া। সঞ্জয়ের মা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ছেলের মাথার কাছে বসে আছেন। সদানন্দ স্যার এর মধ্যেই ইস্কুলে যাচ্ছিলেন, তাঁর মুখ গম্ভীর। হেডমাস্টারমশাই জোর করে কয়েক দিনের ছুটি দিলেন।

সুজিত আর অর্ণব রোজই সঞ্জয়ের বাড়ি এসে খোঁজখবর করছিল। এটা ওটা করে দিচ্ছিল, বলছিল দরকার হলে রাত জাগবে। কিন্তু সঞ্জয়ের মা রাজি হননি, কাউকে কষ্ট দিতে তিনি চান না। রীতা বসুও একদিন এসে দেখে গেছেন।

সঞ্জয় বিকারের ঘোরে একটা কথাই বার বার বলছিল, ‘ওখানে গেলেই আমি ভালো হয়ে যাব। ওখানে কত বড়ো বড়ো ডাক্তার নিশ্চয়ই ভালো হব।’

আট দিনের মাথায় ভোর রাত্রে শেষ নিশ্বাস ফেলল সঞ্জয়, অকালে ঝরে গেল একটা সম্ভাবনাময় জীবন। ওর মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সঞ্জয় এই শহরের গর্ব, সকলের ভালোবাসার পাত্র। দলে দলে লোক ছুটে আসতে লাগল সদানন্দ স্যারের বাড়ি। সুজিত আর অর্ণবও এল। ওরা এসে দেখল বিছানায় চির শান্তিতে ঘুমোচ্ছে সঞ্জয়। ওর মা বুকের ওপর পড়ে আছেন, জ্ঞান নেই। পাশেই পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন সদানন্দ স্যার, চোখে একফোঁটা জল নেই।

ছুটে এলেন ওদের রীতাদি। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তারপর শান্ত হয়ে ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিলেন সঞ্জয়কে।

বাইরে প্রচণ্ড ভিড়। ইস্কুলের ছেলেরা তো আছেই, তা ছাড়া শহরের অনেকেই ছুটে এসেছেন, অনেক মহিলাও আছেন ও ভিড়ে। এস পি এলেন। জুতো পরে ঘরে ঢুকলেন না, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সঞ্জয়ের উদ্দেশে তিনি স্যালুট জানালেন। তারপর বাইরে এসে জনতাকে সুশৃঙ্খলভাবে শোক প্রকাশ করতে অনুরোধ করলেন। তাঁর কথায় কাজ হল।

শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হবে সঞ্জয়কে। যখন ফুলে, চন্দনে সাজিয়ে সঞ্জয়কে খাটিয়ায় তোলা হবে, ছুটে এল আমিনুল। সুজিতকে বলল, ‘আমি কি কাঁধ দিতে পারি? মানে আমি…’

সুজিত এক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘নিশ্চয়ই কাঁধ দিবি।’

‘স্যারকে এক বার জিজ্ঞেস করলে হত না?’ আমিনুল তবু ইতস্তত করছিল।

‘কোনো দরকার নেই’, সুজিত জবাব দিল। ‘স্যারকে আমি চিনি, তিনি কখনো না করবেন না। তা ছাড়া সঞ্জয়ের আত্মা তৃপ্ত হবে তুই কাঁধ দিলে। আমাদের সেই মিছিলে ”ধর্ম নয় মানুষ বড়ো” এই শ্লোগানটা ওর মাথা থেকেই এসেছিল।’

শ্মশানে শহরের গণ্যমান্য মানুষরা গিয়ে কিশোর ছেলেটির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। অর্ণবের বার বার কবিগুরুর সেই কবিতাটাই মনে পড়ছিলঃ

যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে,

যে নদী মরুপথে হারাল ধারা,

জানি হে জানি তাও হয়নি সারা।

পরদিন ছিল রবিবার। সারা শহর শোকদিবস পালন করল। কাগজে কাগজে এক কিশোর প্রতিভার অকালমৃত্যুর কথা ছাপা হল, সেই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি মুখের ছবি।

সোমবার সুজিতরা সঞ্জয়ের স্মৃতিতে ইস্কুল বন্ধ রাখার আবেদন করেছিল হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। কিন্তু তিনি বললেন সঞ্জয় ইস্কুলের নিয়মিত ছাত্র ছিল না, তাই ছুটি দিতে অসুবিধে আছে।

ক্লাসে কারও মন ছিল না, একটা বিষণ্ণতা যেন থম থম করছে। প্রথম পিরিয়ডের পরেই সদানন্দ স্যারের ক্লাস। সবাই জানত আজ তিনি ইস্কুলে আসবেন না, এত বড়ো শোক পেয়েছেন। কিন্তু সবাই চমকে উঠল। সদানন্দ স্যার ক্লাসে ঢুকছেন। উসকোখুশকো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এক রাতেই যেন তাঁর বয়স অনেক বেড়ে গেছে। শ্রান্ত, বিপর্যস্ত এক মানুষ।

ডায়াসে উঠে তিনি বই খুললেন। দাঁড়িয়ে পড়ানোই তাঁর বরাবরের অভ্যেস, আজও তাই করলেন। বই খুলে বললেন, ‘আজ তোমাদের বিদ্যাসাগরের জীবনী পড়াব। বিদ্যাসাগর শুধু বিদ্যা কিংবা করুণার সাগরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সাহস ও শৌর্যের সাগর। যে সময় ভারতবর্ষ ইংরেজদের উদ্ধত পদভারে কম্পমান, সেই সময় অমন এক তেজস্বী মানুষের কথা কল্পনাই করা যায় না। ছোটোখাটো ওই মানুষটির যেমন ছিল সিংহের বিক্রম তেমন ছিল তাঁর আত্মসম্মান জ্ঞান। অমন তেজস্বী, বিদ্বান আর দয়ালু মানুষ পৃথিবীতে কতজন জন্মেছেন তা বোধ হয় হাতে গোনা যায়। সঞ্জয় বলত, বিদ্যাসাগর যদি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ না করে ইউরোপের কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করতেন তবে তিনি নিজেই এক ইতিহাস হয়ে থাকতেন। সঞ্জয় আরও বলত, বিদ্যাসাগর আর বিবেকানন্দ যে মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই মাটিতে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, আমি ধন্য।’

তারপরই তাঁর যেন হুঁশ হল, বললেন, ‘আই অ্যাম সরি, কী যেন পড়াচ্ছিলাম?’

কেউ প্রথমে উত্তর দিল না। তারপর অর্ণব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজ আমরা পড়ব না স্যার।’

‘পড়বে না! কেন?’ সদানন্দ স্যার যেন একটু অবাক হলেন।

‘আমাদের পড়ায় আজ মন নেই, আমরা সঞ্জয়ের শোকদিবস পালন করব।’

‘কিন্তু হেডমাস্টারমশাই তেমন কোনো নোটিশ দেননি, ইস্কুল ছুটিও দেননি’, সদানন্দ স্যার বললেন।

‘আজ আমরা কারও কথা শুনব না’, অর্ণব উত্তেজিত হয়ে বলল। ‘আমরা আজ ক্লাস করব না, ইস্কুলের সব ছেলেকে ক্লাস থেকে ডেকে নেব, শোকসভা করব। হেড স্যার অনুমতি না দিলে আমরা তাঁর কথা মানব না।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’, সমস্বরে অনেকে বলে উঠল।

‘তোমরা তা পার না’, সদানন্দ স্যার বললেন। ‘ডিসিপ্লিন তোমাদের মানতেই হবে।’

‘আজকের মতো আমাদের মাপ করুন স্যার’, এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল সুজিত। ‘আজ আমরা ডিসিপ্লিন মানব না, তার জন্য যদি শাস্তি পেতে হয় তা আমরা মাথা পেতে নেব।’ তারপর ক্লাসের সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল, সবাই বাইরে জড়ো হও, বাকি সব ক্লাসের ছেলেদেরও ডেকে নিতে হবে। আমরা আমাদের প্রিয়তম এক কিশোর বন্ধুর স্মরণসভা করব।’

সবাই বেরিয়ে গেল।

সদানন্দ স্যার চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলেন। আজ প্রথম ছেলেরা তাঁর কথা অমান্য করল। শূন্য ক্লাসে তিনি বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। আস্তে আস্তে তাঁর দু-চোখের কোল বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। এতদিনের সংযম আজ আর বাধা মানছে না। তিনি বসে পড়লেন। টেবিলের ওপর মাথা রেখে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলেন কান্নার দমটাকে আটকাবার।

তাঁকে সেই অবস্থায় প্রথম দেখল ক্লাস সিক্সের একটি ছেলে, সে ছুটে এসে সুজিতদের খবরটা দিল। ওরা তখন শোকসভার আয়োজন করছিল।

সদানন্দ স্যার অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে মুখ তুললেন। কিন্তু এ কী! তাঁর ক্লাস আর ফাঁকা নেই, এমনকী বাইরের বারান্দাও ভরে গেছে ছেলেদের ভিড়ে। ছোটো বড়ো সব বয়সি ছেলেই আছে তাদের মধ্যে। তারা দাঁড়িয়ে আছে মাথা নীচু করে, নিঃশব্দে কাঁদছে। তাঁর চরম শোকে অকৃত্রিম কান্না দিয়ে শোক প্রকাশ করছে ইস্কুলের ছেলেরা। সদানন্দ স্যারেরও দু-চোখের কোল বেয়ে নামল ক্ষীণ জলের ধারা, ক্রমে তা আর বাধা মানল না, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল।

এক ছেলে তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু পেয়েছেন অ-নে-ক, অ-নে-ক ছেলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *