ডাকাবুকো

ডাকাবুকো

নির্জন পোড়োবাড়ি। দোতলার একটা ঘরে মেঝের ওপর চাটাই পেতে গোল হয়ে বসেছিল ওরা চার জন— উদয়, বিক্রম, রাঘব আর রতন। একটা গভীর পরামর্শ করছিল ওরা।

উদয়ের চেহারা ছিপছিপে, তামাটে গায়ের রং, দু-চোখে শৃগালের ধূর্ততা। গায়ের জোরে না হোক, বুদ্ধিতে বাকি তিন জন ওর ধারেকাছেও ঘেঁষে না। তাই ওকে ওরা ‘গুরু’ বলে মেনে নিয়েছে!

ওর বাঁ-পাশে বসেছিল বিক্রম। মিশমিশে কালো চেহারা, শক্ত চোয়াল, দু-চোখে বেপরোয়া ভাব। নামের সঙ্গে অদ্ভুত মিল ওর আকৃতির ও প্রকৃতির।

উদয়ের মুখোমুখি বসেছিল রাঘব। ওর চেহারায় প্রস্থ আছে, দৈর্ঘ্য নেই। চওড়া বুকের ছাতি, কুতকুতে চোখ। ওকে দেখে মনে হয় শরীরসর্বস্ব, মাথায় কিছু নেই।

উদয়ের ডান পাশে বসেছিল রতন। ওদের ভেতর একমাত্র ওর চেহারায় এখনও মার্জিত ছাপ চোখে পড়ে, বাকি তিন জনের রুক্ষতা স্পর্শ করেনি ওকে।

ওরা সবাই প্রায় সমবয়সি, তিরিশের কাছাকাছি।

সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। লন্ঠনের আবছা আলোয় দেয়ালে ঠিকরে পড়া ওদের কালো কালো ছায়াগুলো ভূতের মতো দেখাচ্ছে! চারদিক ঝোপঝাড়ে ভরা এই পোড়োবাড়িটার ধার পাশ দিয়ে দিনের বেলাতেই লোকজন চলাচল নেই, রাত্তিরে গোটা এলাকাটাই এড়িয়ে চলে সবাই। দুর্নাম আছে বাড়িটার ভূতুড়ে বাড়ি বলে।

অনেকক্ষণ ধরে ওদের শলাপরামর্শ চলছিল।

উদয় বলল, ‘আমার খবর পাকা। ভদ্রলোক পাকা রুইয়ের মতোই ওজনে ভারী। এক লাখ খসলে এমন কিছু গরিব হয়ে যাবে না। আমি যে মতলবটা এঁটেছি, সে সম্বন্ধে কি বলিস তোরা?’

‘গ্র্যান্ড’, বিক্রম বলে ওঠে, ‘এমন একটা দাঁও মারতে পারলে পাঁচ-দশ বছর নিশ্চিন্তি।’

‘সত্যি গুরু’, বলল রাঘব, ‘তোর মাথায় ভগবান বুদ্ধির যন্তরটা এমন শান দিয়েছে যে মাঝে মাঝে হিংসে হয়।’

উদয় মুচকি হেসে রতনের দিকে তাকাল, ‘তুমি তো কিছু বলছ না রতনবাবু, তোমার কি ভালো লাগল না আমার মতলবটা?’

‘না, মতলবটা ভালোই’, একটু ভেবে জবাব দিল রতন। ‘কাজ হাসিল করতে পারলে অনেক টাকা আসবে আমাদের হাতে।’

‘হাসিল না করতে পারার কারণ দেখছি না আমি’, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে উঠল বিক্রম, ‘বুদ্ধি আর বল দুটোই আছে আমাদের।’

‘গোড়ার কাজটা কিন্তু তোমাকেই করতে হবে রতনবাবু’, উদয় বলল, ‘তোমার গা থেকে এখনও ভদ্দরলোক গন্ধ ছাড়চে! জালে মাছ পড়বে বলেই আমার মনে হয়।’

রতনকে ওরা কৌতুক করে ‘রতনবাবু’ বলে। ওর চেহারা আর কথাবার্তার ভদ্র ভাবটা এখনও সম্পূর্ণ মুছে যায়নি বলেই এই ঠাট্টা!

উদয়, বিক্রম আর রাঘব বেশ ক-বছর হল বেছে নিয়েছে জীবনের বাঁকা পথ। মনটাও ওদের এতদিনে হয়ে গেছে পাথরের মতো শক্ত। বিবেক, আবেগের ব্যাপারে ওরা এখন নিরুত্তাপ, যেন ছেলে-ভুলানো ছড়ার মতো ওগুলো মজার ব্যাপার।

রতন কিন্তু এখনও অতটা শক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। কলেজের পড়া শেষ করে চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ও যখন নিরাশ হয়ে পড়েছে, ঠিক তখুনি দৈবাৎ উদয়দের সঙ্গে ওর আলাপ। একটু একটু করে ওদের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে কখন যে ও জড়িয়ে ফেলেছে, তা ভাবতে গেলে ওর নিজেরই এখন অবাক লাগে।

‘তবে ওই কথাই রইল’, বলল উদয়। ‘রতন কাজ শুরু করে দিক, তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মারব আমরা।’

ওরা যখন উঠল, তখন চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক, আর মাঝে মাঝে অন্ধকারের বুক চিরে জ্বলে ওঠা জোনাকির আলো পোড়োবাড়িটা ঘিরে সত্যিই একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

‘হুপ! হুপ! হুপ!’

একটা বড়ো পেয়ারা গাছের মগডালে দাঁড়িয়ে ডালটা যে পা দিয়ে সজোরে নাড়াচ্ছিল আর মুখ দিয়ে অমন শব্দ করছিল, সে কিন্তু হনুমান নয়; বারো বছরের দুরন্ত মেয়ে কাকলি। যাকে লক্ষ করে শব্দটা সে করছিল, সেটা অবশ্য একটা হনুমান। কিন্তু ডাকাবুকো অমন একটা মেয়ের পাল্লায় পড়বে তা বোধ হয় ওটা ভাবতেও পারেনি। মেয়েটাকে ভয় দেখাবার জন্য ওটা নানারকম মুখভঙ্গি করছিল, আর মেয়েটিও সমানে ভেংচাচ্ছিল ওকে। অদ্ভুত দৃশ্য! গাছের নীচে ছোটো-বড়ো অনেকেই এসে ভিড় করেছে, বিস্ময়ে থ’ বনে গেছে সবাই। কী দুঃসাহস মেয়েটার!

‘শিগগির নেমে আয়’, কে একজন চিৎকার করে বলল। কিন্তু কে কার কথা শোনে! মেয়েটা দাপটে নাড়িয়ে যাচ্ছে ডালটা, আর সেই সঙ্গে মুখ দিয়ে শব্দ করছে, ‘হুপ হুপ’, মাঝে মাঝে আবার মুখ ভেংচিয়ে হনুমানটার ভেংচানোর জবাব দিচ্ছে! শেষপর্যন্ত গাছের নীচে অত লোকের সমাবেশ আর মেয়েটার দুস্পর্ধায়, পাকা পেয়ারার লোভ দমন করে হনুমান বাবাজি বোধ হয় চম্পট দেওয়াই সুবুদ্ধির কাজ মনে করল।

‘তোকে যদি হনুমানটা থাপ্পড় মারত?’ গাছ থেকে নেমে আসার পর কাকলিকে জিজ্ঞেস করল এক জন।

‘ইস!’ তেজের সঙ্গে জবাব দিল কাকলি, ‘আমিও কষিয়ে দিতুম না একটা থাপ্পড়!’

‘ধন্যি মেয়ে তুমি!’ এক জন বুড়ো ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, ‘ছেলেরাও হার মেনে যাবে তোমার কাছে।’

সত্যিই তাই। যেমন দুরন্ত তেমন দস্যি মেয়ে কাকলি, কিছুতেই যেন ভয়-ডর নেই। ওকে নিয়ে কম ভাবনা ওর মা-বাবার! কাকলি যে তা বোঝে না তা নয়, কিন্তু ওর স্বভাবটাই অমন। ওর মিষ্টি মুখে দুষ্টুমিভরা চোখ দুটো সবসময় কিছু একটা মতলব আঁটছে।

বাবা নেহাত ভালো মানুষ। রমেশ সেন বড়োলোক একথা যেমন সত্যি, তেমন তাঁর ভিতর যে একটা দরদি মন জেগে আছে সেকথাও সত্যি। যেমন বাবা কাকলির, তেমন মা। পাড়াপড়শির আপদেবিপদে তিনি সবসময়ে পাশে আছেন, পুজোয়, উৎসবে তাঁকে না হলে চলে না পাড়ার মানুষদের।

তাঁদের একমাত্র মেয়ে অমন দুরন্ত, ভাবাই যায় না। তা বলে মন্দ মেয়ে কাকলিকে কেউ বলবে না— যাদের মাথায় সবসময় দুষ্টুমি গিজগিজ করে তারা সময় সময় এমন ভালো কাজ করে বসে যা অবাক করে দেয় সবাইকে। কাকলিও ঠিক সেই ধরনের। দুষ্টুমিতে ও সেরা, কিন্তু কারু দুঃখ দেখলে মন ওর কেঁদে ওঠে।

শরতের নীল আকাশে তুলোটে মেঘের দল নোঙর ছাড়া নৌকোর মতো ভেসে চলেছে আপন খেয়ালে। সেদিকে তাকিয়ে ছিল কাকলি। ওর মনটাও কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। কী মজা ওই মেঘের! খুশিমতো উড়ে চলেছে, বাধা নেই। শিউলি গাছে টুনটুনি পাখিটার ওপর চোখ পড়ে ওর। দুগগা টুনটুনি। কেমন তুলতুলে পাখিটা, হাতের আঙুলের মতো ছোট্ট। গাঢ় শ্যাওলা রঙের পালক আর ঠোঁট দুটো ছুঁচলো কাঠির মতো সরু। অতটুকুন হলেও ডাকটা কী গম্ভীর, অনেক বড়ো পাখিকেও হার মানায়। কাকলির দু-ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। পাখিটার কাণ্ড দেখ, কিছুতেই যেন সুস্থির হয়ে একটা ডালে বসতে পারছে না। ঘুরে-ফিরে গুরুগম্ভীর গলায় ডাকছে আর চঞ্চলভাবে চারপাশে ঘুরছে, এ ডাল থেকে ও ডালে বসছে, যেন কি করবে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছে না।

তারপর একসময় ফুড়ুৎ করে উড়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল পাখিটা, আর ঠিক তখুনি জানলা বরাবর রাস্তায় লোকটির ওপর চোখ পড়ল কাকলির। ওর ভুরু কুঁচকে গেল। কালও সে লোকটাকে বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। কী মতলব ওর? লোকটা বোধ হয় ওকেই দেখছিল, চোখে চোখ পড়তেই কেমন তাড়াতাড়ি যেন মুখটা ফিরিয়ে নিল।

কাকলি ভালো করে দেখল লোকটিকে। বয়স তেমন বেশি নয়, চেহারা মোটামুটি ভদ্রলোকেরই মতো। একটা ছাই রঙের প্যান্ট আর চিত্তির-বিচিত্তির ছাপ মারা বুকখোলা শার্ট পরে আছে, পায়ে কাবলি চপ্পল। হঠাৎ যেন ব্যস্ততার ভান করে হনহন করে চলে গেল লোকটা।

পুজো এসে গেছে, আকাশে বাতাসে উৎসবের সুর। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠেছে চারদিক।

কাকলির আনন্দের শেষ নেই, অষ্টমীর রাতে ওদের পাড়ায় যাত্রা হবে এবার। নামকরা একটা দল আসছে, পালা হবে কর্ণার্জুন।

দেখতে দেখতে ষষ্ঠী এসে গেল, বেজে উঠল ঢাকের বাদ্যি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেল কাকলি, দম ফেলবার সময় নেই ওর।

অষ্টমীর রাতে পালা খুব জমে উঠেছে, তন্ময় হয়ে গেছে কাকলি। কী চমৎকার সাজপোশাক ওদের, ঠিক যেন রূপকথার জগতে এসে পড়েছে ও। অর্জুনের চাইতে কর্ণকে বেশি ভালো লাগছে ওর। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে কর্ণের কথাবার্তায়। কী দুঃখী কর্ণ! সব থেকেও যেন কিছু নেই! অত বড়ো বীর, কিন্তু কেমন যেন নিঃস্ব। বুকভরা হাহাকার কর্ণের। কর্ণ কুন্তীকে বলছে :

যে পক্ষের পরাজয়

সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে কোর না আহ্বান।

জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডব সন্তান—

আমি রব নিস্ফলের হতাশের দলে।

শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে,

জয়লোভে, যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,

বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।।

দু-চোখে জল এসে গেল কাকলির। আহা, কর্ণের কথাগুলো যেন ব্যথায় গলে গলে পড়ছে।

হঠাৎ কীসের একটা আকর্ষণে ও চোখ ফেরাল, আর তক্ষুনি দেখতে পেল সেই লোকটাকে। সেদিনের সেই লোকটা। ভিড়ের মধ্যে বসে আছে, আর একদৃষ্টিতে লক্ষ করছে ওকেই। লোকটার হাবভাব ভালো ঠেকছে না। বলে দেবে নাকি পাড়ার বড়োদের! দেবে ওরা ঘা কতক বসিয়ে, মজাটা টের পাবে বাছাধন। কিন্তু কী বলবে ও? লোকটা ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে? সেটা একটা হাসির ব্যাপার হবে। না, তার চাইতে লোকটার ওপর নজর রাখা যাক। ভীষণ রাগ হল কাকলির লোকটার ওপর। পালাটা এমন জমে উঠেছে…!

লোকটা কিন্তু তার দিকে আর তাকাচ্ছে না, যেন খুব মন দিয়ে যাত্রা দেখছে। ক্রমে কাকলির দৃষ্টিও ঘুরে গেল আসরের দিকে। তারপর হঠাৎ যখন খেয়াল হল, চোখ ফিরিয়ে লোকটাকে আর ও দেখতে পেল না। বোধ হয় ওর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে সরে পড়েছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই! চিন্তায় ভরে ওঠে কাকলির মন। লোকটার সত্যিই কি কোনো কুমতলব আছে, না সমস্ত ব্যাপারটাই একটা দৈবাৎ ঘটনা? হয়তো লোকটা কোনো একটা কাজে এ পাড়ায় ঘোরাঘুরি করছে। কিন্তু তাকে অমন করে দেখছিল কেন?

পরদিন বাচ্চুর কাছে ব্যাপারটা খুলে বলল কাকলি। বাচ্চু থাকে ওদের পাশের বাড়িতেই, ওরই সমবয়সি, আর দস্যিও ওরই মতো। ওদের দু-জনের খুব ভাব; দু-জনেই অনেকটা একই ধাতুতে গড়া কিনা তাই!

বাচ্চুর বাবা রেলের অফিসার, বেশ ভালো অবস্থা। বাচ্চুরা এক ভাই এক বোন, বাচ্চুই বড়ো।

সব শুনে বাচ্চু লাফিয়ে উঠল, ‘লোকটাকে অ্যাইসা ঠ্যাঙানি দেব যে নিজের নাম ভুলে যাবে।’

ওরা দু-জন লোকটাকে ধরার জন্য তক্কে তক্কে রইল। একদিন গেল, দু-দিন গেল, কিন্তু তার আর পাত্তা নেই। কাকলির মন দমে যায়। তবে কি তার সন্দেহ মিথ্যে? বাচ্চুর কাছে তার মাথা কাটা যাবে না? ও ভাববে সে মিছিমিছি ভয় পেয়েছিল। ভয়! ফুঃ! কাকলি মনে মনে ভাবল, ভয় পাবার মতো মেয়ে যেন সে!

তৃতীয় দিন বিকেলে ওরা পথের ওপর লক্ষ রাখছিল, হঠাৎ কাকলি লাফিয়ে উঠল!

‘ওই যে’, উত্তেজনায় ওর গলা কাঁপছে। ‘দেখেছিস বাচ্চু?’ আঙুল দিয়ে মোড়ের মাথায় একটা লোককে সে দেখায়। বাচ্চুও দেখল। লোকটাকে দেখে কিন্তু নিরীহ বলেই মনে হয়, ভদ্রগোছের চেহারা, পোশাকও মোটামুটি ভদ্রস্থ।

লোকটা ওদের দেখতে পায়নি। একটা পানের দোকানের সামনে সে দাঁড়াল, তারপর একটা পান কিনে নিশ্চিন্ত মনে ওটা চিবুতে চিবুতে সামনের দিকে এগুল। কাকলি আর বাচ্চু নিজেদের আড়াল করে ওর গতিবিধি লক্ষ করতে থাকে। লোকটা কাকলিদের বাড়ির কাছাকাছি এসে দোতলায় যে-ঘরে কাকলি থাকে সে-ঘরের একটা জানলার দিকে চোখ তুলে তাকাল।

‘দেখেছিস!’ ফিসফিস করে বলল কাকলি। ‘আমার ঘরের দিকে তাকাচ্ছে!’

‘হুঁ! ওর মতলব ভালো নয়’, বাচ্চুও ফিসফিস করে জবাব দেয়। ‘চল আমরা এবার ওকে পাকড়াও করি।’

ওরা দু-জন আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে লোকটার পেছনে এসে দাঁড়াল। তারপর বাচ্চুই বলল, ‘মতলবটা কী আপনার?’

লোকটা চমকে ফিরে তাকাল। ওদের দেখে ওর মুখটা কেমন যেন সাদা হয়ে গেল, যেন ভূত দেখেছে।

‘আমার পেছনে লেগেছেন কেন?’ কাকলি এবার বলল। ‘ক-দিন ধরেই দেখছি, ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছেন, আর আমি দেখে ফেললেই এমন ভান করছেন যেন কত ভালো মানুষ, ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না।’

সরাসরি এভাবে অভিযুক্ত হয়ে লোকটা থতমত খেল, একটু আমতা আমতা করল, তারপর বলল, ‘মানে… আমি ক-দিন ধরে…মানে…দেখ তোমাদের সত্যি কথাই বলছি… আমি একজন বেকার। অনেকদিন বি এ পাশ করে বসে আছি, কোথাও কাজ পাচ্ছি না। বাড়িতে অসুস্থ বাবা, তিন জন ছোটো ভাই বোন, এক বেলা ভাত জোটানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে।’ লোকটার গলা যেন ভেজা ভেজা। কাকলি হকচকিয়ে যায়। সে ভেবেছিল লোকটা বদ মতলবে ঘোরাঘুরি করছে, কিন্তু এ যে উলটো ব্যাপার। হয়তো ওর বাড়ির সবাই উপোস করে আছে। আহা!

‘কিন্তু তার জন্য এখানে কী মতলবে এসেছেন? কাকলির দিকে অমনভাবে তাকাচ্ছিলেনই বা কেন?’ বাচ্চু লোকটার কথায় ভিজেছে বলে মনে হয় না।

কাকলির একটু রাগ হয়! বাচ্চুটা যেন কী! লোকটার দুঃখের কথা শোনবার পরেও নরম হয়নি ওর মন।

লোকটা কিন্তু বাচ্চুর কথা শুনে কিছু মনে করল না। একটু থেমে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। আমি জানতে পেরেছি ওর বাবার একটা কারখানা আছে, অনেক লোক কাজ করে… আমাকে যদি দয়া করে উনি একটা চাকরি দেন, তাই এখানে ঘোরাঘুরি করছি। ওর বাবার সঙ্গে দেখা করে কথাটা পাড়তে সাহসে কুলোচ্ছিল না। ওকে বললে ও যদি ওর বাবাকে বলে আমার একটা হিল্লে করে দেয়—’

লোকটা কথা শেষ করে না, একটু কাঁচুমাচু ভাবে কাকলির দিকে তাকায়।

‘ও হরি!’ কাকলি ভাবে, এই তবে ব্যাপার, আর সে কতরকম উদ্ভট কল্পনা করে বসে আছে। লোকটার জন্য তার একটু মায়াই হয়। বাবাকে বললে তিনি নিশ্চয়ই ওকে একটা কাজ জুটিয়ে দেবেন।

‘ঠিক আছে’, ও বলল, ‘আমি বাবাকে বলব আপনার কথা।’

লোকটা কৃতজ্ঞতায় সরব হয়ে ওঠে, কাকলির এমন প্রশংসা শুরু করে যে তার মতো দস্যি মেয়েরও মুখ রাঙা হয়ে যায়, আর হাসির দমকে ফেটে পড়ে বাচ্চু।

শেষপর্যন্ত কথার স্রোত থামিয়ে লোকটি বলল, ‘তবে কাল সন্ধের সময় আমি এখানে আসব, তোমার বাবা কী বলেন শুনে যাব, কেমন?’

কাকলি ঘাড় কাত করে সায় দিল।

‘তুমিও থাকবে তো, খোকাবাবু?’ বাচ্চুর দিকে চোখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটি।

‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আর আমার নাম খোকাবাবু নয়, বাচ্চু, ভালো নাম তমাল।’

‘তাই তো, আমার ভুল হয়ে গেছে’, লোকটি জিভ কাটে, ‘খোকাবাবু বলা উচিত হয়নি আমার।’

‘আমার নাম কাকলি’, লোকটা যাতে তাকে খুকি বলে ডেকে না ওঠে, তাই আগেভাগেই বলে উঠল কাকলি।

‘তোমার নাম জানি আমি’, মৃদু হেসে বলল লোকটি।

‘আপনার নাম কিন্তু জানি না আমরা’, বাচ্চু বলে।

‘ওহো, আমার নামই তো বলা হয়নি। ইয়ে— রমেন… রমেন বোস। আচ্ছা, চলি তবে, কাল আবার দেখা হবে।’

একটু হেসে, ডান হাতটা শূন্যে নাড়িয়ে, বড়ো বড়ো পা পেলে চলে গেল রমেন বোস। যেন একটু তাড়াতাড়িই চলে গেল। ঠিক তখুনি কাকলির চোখ পড়ল হালকা নীল রঙের গাড়িটার ওপর, বাবা ফিরছেন অফিস থেকে।

সে-রাতেই বাবার কাছে কথাটা পাড়ল কাকলি। মেয়ের মুখে সব শুনে রমেশবাবু ভুরু কোঁচকালেন।

জানা নেই, শোনা নেই, একটা লোক অমন হুট করে কাকলিকে চাকরির উমেদারির জন্য ধরেছে এটা তাঁর ভালো লাগল না। দিনকাল ভালো নয়, কার মনে কী আছে কে জানে!

কাকলি বাবার মনের ভাব আঁচ করে।

‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে ভয় পাচ্ছে’, কাকলি বোঝায়। ‘আমরা ওকে চেপে ধরতেই এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল…’ খিলখিল করে হেসে ওঠে ও। ‘লোকটা ভারি ভীতু, তাই না বাবা?’

রমেশবাবু এবার হাসলেন, সস্নেহ হাসি। বললেন, ‘সবাই তো তোমার মতো সাহসী হয় না, মামণি। তবে ওর তোমাকে না ধরে আমার সঙ্গে দেখা করাই উচিত ছিল। আমাদের সব খোঁজখবর নিয়েছে দেখছি।’

‘হ্যাঁ, বাবা’, বড়ো বড়ো চোখ করে কাকলি বলে, ‘আমার নাম পর্যন্ত জানে।’

রমেশবাবু আবার ভুরু কুঁচকোলেন। খুঁতখুত করে উঠল মন।

‘কাল অফিস থেকে ফিরতে আমার দেরি হবে’, একটু ভেবে বললেন তিনি। ‘তুমি ওকে পরশু রাত আটটায় আমার সঙ্গে দেখা করতে বল। কথা বলে দেখি, যদি বুঝি খুব অভাবী, তবে একটা ব্যবস্থা করা যাবেখন।’

খুশিতে ঝলমল করে ওঠে কাকলি। একজন দুঃখী মানুষের উপকার করতে পারবে ভেবেই ওর এই আনন্দ।

পরদিন সন্ধেবেলা কাকলি আর বাচ্চু নির্দিষ্ট জায়গায় রমেন বোসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। একটা দমকা হাওয়ায় গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ওদের। একটু একটু করে অন্ধকার বাড়ে।

‘লোকটা বড়ো দেরি করছে তো’, অধৈর্য কণ্ঠে বলে বাচ্চু।

‘আর পাঁচ মিনিট দেখব, এর মধ্যে আসে ভালো, নইলে ওর কপালে চাকরি নেই’, কাকলিও বিরক্তির সঙ্গে বলে।

‘কপালটা আমার ভালোই।’

ওরা দু-জনেই চমকে ফিরে তাকায়! লোকটা কখন যে নিঃশব্দে ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি ওরা। মিটিমিটি হাসছিল ওদের দিকে তাকিয়ে রমেন বোস।

‘আপনি দেরি করে ফেলেছেন, আমরা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’ কাকলির কণ্ঠে অভিযোগের সুর।

‘তোমাদের জন্য দুটো গোলাপ ফুল আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল, সাহেব বাড়ির বাগানের গোলাপ।’

এবার ওদের চোখ পড়ল ওর হাতে ধরা ফুল দুটোর ওপর। টকটকে লাল গোলাপ, পাপড়িতে ঠাসা— ভারি সুন্দর।

কাকলির মন খুশিতে ডগমগ করে উঠল। ফুল ও খুব ভালোবাসে, বিশেষ করে গোলাপ— লাল গোলাপ। সাগ্রহে হাতটা বাড়িয়ে ফুলটা ও হাতে নেয়, তারপর তুলে ধরে নাকের কাছে। কী মিষ্টি গন্ধ! একটু যেন বেশিই মিষ্টি গন্ধটা? মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে কাকলির, পা দুটো টলমল করে। টাল সামলাতে না পেরে ও পড়ে যাচ্ছিল, একটা বলিষ্ঠ বাহু তাকে ঠিক সময় ধরে না ফেললে ও হয়তো পড়েই যেত। তক্ষুনি একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামে ওদের গা ঘেঁষে। গাড়ির একটা দরজা খুলে যায়, আর পরমুহূর্তে কাকলিকে কে যেন পাঁজাকোলা করে বসিয়ে দেয় গাড়ির পেছনের গদিমোড়া আসনে।

হকচকিয়ে যায় বাচ্চু। এ কী ব্যাপার! ভয়ানক একটা বিপদের অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলে ওকে। চিৎকার করার সুযোগ পর্যন্ত পায় না ও। একটা শক্ত থাবা চেপে ধরে ওর মুখ, তারপরই কে যেন মাটিছাড়া করে ওকে। স্তম্ভিত ভাবটা কাটতেই ও টের পেল গাড়িতে বসে আছে। একটা ঝাঁঝালো গন্ধে গুলিয়ে ওঠে ওর পেট, সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসে।

রমেশবাবু বাড়ি ফিরলেন রাত সাড়ে আটটায়। কাকলির মা বিমলাদেবীর উদবিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালেন তিনি, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

‘কাকলি এখনও বাড়ি ফেরেনি।’ গলা কেঁপে যায় বিমলাদেবীর।

‘সে কি! এত দেরি তো কখনো করে না ও। গেল কোথায়?’

‘কি জানি! আমি ভজুকে পাঠিয়েছি খোঁজ করতে।’

একটা অজানা আশঙ্কায় রমেশবাবু ঠোঁট কামড়ান। তাঁর মনে পড়ে যায় গত রাতে কাকলির সঙ্গে কথাবার্তার প্রসঙ্গ। এক জন অচেনা, অজানা লোক চাকরির সুপারিশের জন্য কাকলিকে ধরল, এটা কেমন যেন মনে হয়েছিল তাঁর। আজ সন্ধেবেলায় লোকটা কাকলির সঙ্গে দেখা করে খবর নিতে আসবে এমন কথাই যেন বলেছিল কাকলি। একটা অস্বস্তিতে ভরে যায় রমেশবাবুর মন।

ভজু এসে ঘরে ঢোকে। না, দিদিমণি আশেপাশে কোনো বাড়িতেই নেই। আরও একটা কথা জানা গেল ভজুর মুখে। বাচ্চুদের বাড়িতেও নাকি খোঁজ খোঁজ পড়ে গেছে, এখনও বাড়ি ফেরেনি ছেলেটা।

রমেশবাবুর মাথায় বাজ পড়ে। কাকলির মুখেই শুনেছিলেন লোকটার সঙ্গে কথাবার্তার সময় বাচ্চুও ছিল ওখানে। ওরা দু-জনেই বাড়ি ফেরেনি, ওই লোকটার সঙ্গে ওদের দু-জনেরই কি আজ দেখা করার কথা ছিল? বুকের ভিতর যেন হাপর পড়তে থাকে রমেশবাবুর। বিমলাদেবী তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন বুঝতে পেরে আরও বিব্রত বোধ করেন তিনি। মায়ের মন ভেঙে পড়বে এই ভয়ে তাঁর আশঙ্কার কথা খুলে না বলাই তিনি উচিত মনে করেন।

ভজু আবার ফিরে আসে। তার হাতে একটা লেফাফা। এক জন লোক এইমাত্র ওটা দিয়ে গেছে। বলেছে কর্তাবাবুর হাতে যেন দেওয়া হয়, খুব জরুরি চিঠি।

লেফাফাটা হাতে নিলেন রমেশবাবু। ওপরে কালির আঁচড়ে মোটা করে লেখা— ‘ব্যক্তিগত এবং জরুরি।’

লেফাফার মুখটা ছিঁড়ে ফেলার সময় তাঁর হাত কেঁপে গেল। ছোট্ট একটা চিঠি। এক বার—দু-বার—তিন বার, তিনি ওটা পড়লেন। চিঠিটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল, মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল তাঁর। ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

বিমলাদেবী অজানা আশঙ্কায় মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন চিঠিটা, চোখ বুলোলেন সেটায়

মহাশয়,

আপনার অনেক টাকা আর কাকলি আপনার একমাত্র সন্তান। মেয়ের জীবনের বিনিময়ে এক লাখ টাকা নিশ্চয়ই আপনার কাছে বড়ো নয়। কবে, কোথায় এবং কীভাবে টাকাটা দিতে হবে তা যথাসময়ে জানতে পারবেন। এটা জানিয়ে রাখি যে আমরা এখন থেকে আপনার ওপর নজর রাখছি। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে মেয়েকে আর ফিরে পাবেন না। এটা মিথ্যে হুমকি নয় জানবেন! বাচ্চুর বাবার কাছে আমরা আলাদা চিঠি দিচ্ছি।

নীচে কোনো স্বাক্ষর নেই। বিমলাদেবীর গলা ঠেলে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসতে গিয়ে আটকে যায়। রমেশবাবু চেয়ারে এলিয়ে আছেন, দু-চোখ বোজা, মাথাটা একদিকে হেলে গেছে। সমস্ত শরীর হিম হয়ে যায় বিমলাদেবীর। হায় ভগবান! এ কী হল! দু-হাতে মুখ গুঁজে ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

জ্ঞান হতেই ধড়মড় করে উঠে বসল কাকলি। একটা শক্ত বিছানায় ও শুয়ে আছে। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যায় না। বিছানাটা এত শক্ত কেন? কোথায় শুয়ে আছে ও?

আস্তে আস্তে সব কিছু মনে পড়ল কাকলির। একটা গোলাপ ফুল দিয়েছিল তাকে রমেন বোস, সেটা শোঁকার পরেই মাথা কেমন ঝিমঝিম করে উঠেছিল। ফুলের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু ছিল। রমেন বোস লোকটা আসলে তবে গুন্ডা। চালাকি করে তাকে এখানে ধরে এনেছে। কী বোকামিই না সে করেছে রমেন বোসকে বিশ্বাস করে!

অসংখ্য চিন্তা কিলবিল করে ওঠে ওর মাথায়। প্রথমে যে সন্দেহ করেছিল সেটাই ঠিক। রমেন বোস খারাপ মতলব নিয়েই ঘোরাফেরা করছিল। খুঁটিনাটি ব্যাপার একটু একটু করে মনে পড়তে থাকে কাকলির। লোকটা বলেছিল ওর বাবার সঙ্গে দেখা করতে ভয় পাচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখা উচিত ছিল। কীসের ভয়! বাবা কি বাঘ না ভালুক! খেয়ে ফেলতেন ওকে? যাত্রার আসরে লোকটার হাবভাবেই বোঝা উচিত ছিল ওর মতলব ভালো নয়। বেশ কয়েক দিন ধরে রমেন বোস ঘোরাফেরা করেছে তাদের পাড়ায়, তার চোখে চোখ পড়লেই এমন ভান করেছে যেন কিচ্ছু জানে না। সেটাই তো সন্দেহজনক।

আরও একটা চিন্তা ঝিলিক খেলে গেল কাকলির মাথায়। বাচ্চুও তো ওর সঙ্গে ছিল। ওকেও কি ধরে এনেছে? রমেন বোস জিজ্ঞেস করেছিল বাচ্চু ওর সঙ্গে পরের দিন থাকবে কিনা। নিশ্চয়ই জেনে নিতে চেয়েছিল কাকলি একা তার জন্য অপেক্ষা করবে, না বাচ্চুও সঙ্গে থাকবে। বাবার অসুখ, বাড়িতে ছোটো ছোটো ভাইবোনেরা না খেয়ে আছে, সবই মিথ্যে কথা। ভীষণ রাগ হল কাকলির। লোকটার সঙ্গে দেখা হলে আচ্ছা করে শুনিয়ে দেবে তাকে। ভীরু, কাপুরুষ কোথাকার।

তারপরই ভীষণ কান্না পেল কাকলির। ওর ভয় করছে। অন্ধকারকে ছোটোবেলা থেকেই বড়ো ভয় ওর, আর কিছুতে ভয় নেই। এতক্ষণ কথাটা খেয়াল ছিল না। এখন ও কী করবে!

হঠাৎ একটা গোঙানির মতো শব্দে চমকে উঠল কাকলি। শব্দটা আসছে খুব কাছ থেকেই। ওর বুকের ভেতরটা যেন হিম হয়ে গেল। আবার কে যেন গোঙিয়ে উঠল। একটা ক্ষীণ সন্দেহ জাগল কাকলির মনে। তবে কি…? তাই তো। বাচ্চুর গলাই তো মনে হচ্ছে। ওকেও নিশ্চয়ই ধরে আনা হয়েছে। কিন্তু ও অমন করছে কেন? বাচ্চুর গলা পেয়ে আবার সাহস ফিরে এল কাকলির। তক্তপোশ থেকে নেমে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলল যেদিক থেকে শব্দটা এসেছিল সেদিকে লক্ষ করে। কয়েক পা যেতেই ও বাধা পেল। আরও একটা তক্তপোশ। ওটার ওপর হাত দিতেই এক জনের গায়ে হাত লাগল। মুখটা নীচু করল কাকলি। একটা ওষুধ ওষুধ বিচ্ছিরি গন্ধ। মাথাটা কেমন করে উঠল কাকলির। বাচ্চুকে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছে। রাগে গা জ্বলে উঠল কাকলির। রমেন বোসটা কী শয়তান!

আবার গোঙানির শব্দ। না, আর কোনো সন্দেহ নেই। আস্তে আস্তে বাচ্চুকে ঠেলা দিতে লাগল কাকলি।

‘বাচ্চু, এই বাচ্চু।’

কয়েক বার ঠেলা দেবার পর ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন হল, ‘আমি কোথায়?’ বাচ্চুরই গলা।

‘আমাদের এখানে ধরে আনা হয়েছে’, সাহসের সঙ্গে বলল কাকলি। ‘রমেন বোস লোকটা আসলে একজন গুন্ডা, বুঝলি বাচ্চু।’

‘ধরে এনেছে কেন?’ এখনও সম্পূর্ণ ঘোর কাটেনি বাচ্চুর।

‘কি জানি কি মতলবে…’

অন্ধকারে কেউ কারু মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

‘তোকে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করেছিল’, আবার বলল কাকলি।

বাচ্চু এতক্ষণে উঠে বসে।

‘এখন আমার মনে পড়ছে’, ও বলল, ‘কে যেন রুমাল দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরেছিল… একটা বিচ্ছিরি গন্ধ…তারপর কিছু মনে নেই।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

‘তোর ভয় করছে, বাচ্চু?’ কাকলি জিজ্ঞেস করল।

‘তুই না থাকলে করত বোধ হয়।’

‘জানিস, আমারও ভীষণ ভয় ধরেছিল, তোর গলা পেয়েই তো ভয় কেটে গেল আমার।’

আবার চুপচাপ দু-জনে।

‘বুঝলি বাচ্চু’, হঠাৎ একটা কিছু আবিষ্কার করেছে এমনভাবে বলে উঠল কাকলি, ‘রমেন বোসের সঙ্গে প্রথম দিন বিকেলে যখন কথা বলছিলাম আমরা, ও হঠাৎ কেমন তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল, মনে আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখন বুঝতে পারছি কেন অমনভাবে চলে গিয়েছিল।’

‘কেন?’ বাচ্চুর গলায় একটু কৌতূহলের সুর ফুটে ওঠে।

‘মোড়ের মাথায় বাবার নীল গাড়িটা ও দেখতে পেয়েছিল, তাই পালিয়েছিল। তখন অতটা বুঝিনি।’

‘ঠিক বলেছিস’, সায় দিয়ে বলল বাচ্চু। ‘লোকটাকে গোড়া থেকেই আমার ভালো লাগেনি। ও যখন তোর কাছে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলছিল, তুই নরম হয়েছিলি, আমার কিন্তু বিশ্বাস হয়নি ওর একটা কথাও।’

কাকলির নিজেকে অপরাধী মনে হয়। রমেন বোসের কথা শুনে সত্যিই সে গলে গিয়েছিল। বাচ্চু কাঠখোট্টার মতো কথা বলছিল বলে ওর খারাপ লেগেছিল তখন। বাচ্চু ঠিকই সন্দেহ করেছিল। সেও যদি বাচ্চুর মতো সাবধান হত, তবে আর আজ তাদের এমনভাবে গুন্ডাদের হাতে বন্দি হতে হত না।

বাড়ির কথা মনে পড়ল কাকলির। মা-বাবার কথা ভেবে দু-চোখ ছলছল করে উঠল ওর। আজ রাতে নিশ্চয়ই ঘুম নেই ওঁদের চোখে। ওর জন্য ভেবে ভেবে কী কষ্টই না পাচ্ছেন ওঁরা। বাচ্চুর বাড়িতেও নিশ্চয়ই শোরগোল পড়ে গেছে, ওর মা-বাবাও কত ছুটোছুটি করছেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল কাকলি, তারপর জোর করে মনটাকে ফিরিয়ে আনল বর্তমানে।

‘শীত শীত করছে’, বাচ্চু হঠাৎ বলে ওঠে।

সঙ্গেসঙ্গে কাকলিও অনুভব করে একটা ঠান্ডা আমেজ। এতক্ষণ উত্তেজনায় অন্য কিছু বোধ ছিল না ওর।

‘ইস, লোকগুলো কী খারাপ দেখেছিস, আমাদের গায়ে দেবার কিছু দেয়নি’, ওর গলায় তীব্র ক্ষোভ।

‘আয়, আমরা বিছানার চাদর গায়ে জড়াই’, বাচ্চুই বলে, ‘খানিকটা আরাম পাওয়া যাবে তো।’

কাকলির মনে ধরে কথাটা। হাতড়ে হাতড়ে আবার ও ফিরে যায় নিজের বিছানায়, তারপর চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। তারপর একসময় ওদের চোখে নেমে আসে ঘুমের ঢল।

ওদের ঘুম যখন ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়েছে, ঘরের একমাত্র জানলা দিয়ে রোদ ঢুকে পড়েছে ভেতরে, বাইরেও ঝলমলে রোদ্দুর। ঘরে যে জানলা আছে, তা কাল রাতে বুঝতে পারেনি ওরা। নিশ্চয়ই জানলাটা বন্ধ ছিল, তাই অত অন্ধকার ছিল ঘরটা। কেউ তবে ঘরে এসেছিল সকালে। জানলা সে-ই খুলেছে।

ওরা জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। লোহার গরাদ জানলায়। ঘরটা দোতলায়, পালাবার কোনো উপায় নেই। খোলা জানলা দিয়ে যদ্দূর যায় দৃষ্টি মেলে দিল ওরা। শুধু জংলা ঝোপ আর বুনো গাছগাছড়া ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। বাড়িটা এমন জায়গায় কেন? —ওদের দু-জনের মনে একই প্রশ্ন জাগে। তবে কি আশেপাশে লোকজন নেই? মন দমে যায় ওদের দু-জনের। জানলা দিয়ে কাউকে ডেকে যে তাদের বিপদের কথা বলবে এমন সুযোগই তারা পাবে না হয়তো।

ভালো করে ঘরটার দিকে তাকাল ওরা। চুন-বালি খসে পড়ায় ইটগুলো যেন ভেংচি কাটছে দাঁত বার করে। কার্নিশ থেকে ঝুলছে কালো কালো ঝুল, দেয়ালের কোনায় মাকড়শার জাল। মেঝেটা কিন্তু অত নোংরা নয়। বোধ হয় ওদের এখানে রাখা হবে বলেই ঝাঁট পড়েছে ঘরে। তবু মেঝের অজস্র ফাটল আর ভাঙাচোরা, দগদগে ঘায়ের মতোই বিচ্ছিরি।

আবার জানলার দিকে ওরা মুখ ফেরাল। লোহার শিকগুলো মরচে পড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। কাকলি একটা শিক ঝাঁকিয়ে সেটার শক্তি পরখ করতে চাইল।

‘আহা-হা, করছ কী! জানলাটা ভেঙে ফেলবে নাকি?’ ওরা দু-জনে চমকে ফিরে তাকাল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের ষণ্ডামার্কা এক জন লোক।

‘দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়লে ঘাড় কি আর আস্ত থাকবে? এত কষ্ট করে তোমাদের ধরে আনার পরিশ্রমটাই পণ্ড হবে আমাদের।’ ঠাট্টার সুরে বলল বিক্রম।

লোকটার চেহারা দেখে কাকলির ভয় করছিল, কিন্তু সে মনে মনে ঠিক করল, প্রাণ থাকতে মনের আসল ভাব বাইরে প্রকাশ করবে না।

বিক্রম এগিয়ে আসে।

‘ওসব মতলব ছাড়’, আবার সে শুরু করে, ‘এখান থেকে লাফিয়ে মাটিতে পড়লে হাড়গোড় আর আস্ত থাকবে না। তা ছাড়া, জানলার শিক পুরোনো হলেও নাড়া দিলেই ভেঙে যাবে এমন নড়বড়ে নয় ওগুলো।’

‘আমাদের এখানে আনা হয়েছে কেন?’ জোর করে মনে সাহস এনে কাকলি জিজ্ঞেস করল কথাটা।

‘দুধ-ভাত খাওয়াবার জন্য নয় নিশ্চয়ই।’

‘দুধ-ভাত আমরা খাই না’, ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলে উঠল কাকলি।

‘তাই বুঝি!’ বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে বিক্রমের মুখে। ‘যাক সেকথা। শোনো, পালাবার চিন্তা মনে ঠাঁই দিয়ো না। পালাতে দেব বলে এত কষ্ট করে তোমাদের ধরে আনা হয়নি, বুঝেছ? তা ছাড়া এ বাড়িটার ভূতুড়ে বাড়ি বলে দুর্নাম আছে, তাই কেউ ঘেঁষে না এ বাড়ির ত্রিসীমানায়। তোমাদের বরাত ভালো থাকলে ভূতের দেখাও পেয়ে যেতে পার।’ খ্যাক খ্যাক করে হাসল বিক্রম।

কাকলির বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করে না মনের ভাব। আড়চোখে বাচ্চুর মুখটা ও দেখে নেয়। মনে মনে বাচ্চুর তারিফ না করে পারে না কাকলি। ওর মুখেও ভয়ের রেখা ফুটে ওঠেনি।

‘সুতরাং’, বিক্রম আবার শুরু করে, ‘বাইরের কোনো সাহায্য আশা করলে হতাশ হতে হবে তোমাদের। তা ছাড়া, আমাদের কেউ না কেউ সবসময়ই থাকবে তোমাদের পাহারায়, বুঝেছ?’

‘হ্যাঁ, বুঝেছি’, এবার জবাব দেয় বাচ্চু, ‘কিন্তু আমাদের ধরে আনা হয়েছে কেন, আটকেই বা রাখা হয়েছে কেন, তা বুঝতে পারছি না।’

‘হ্যাঁ, এবার সেটা তোমাদের জানা দরকার’, বিক্রম আরও একটু এগিয়ে আসে। ‘তবে তোমাকে ধরে আনার কোনো মতলব ছিল না আমাদের, পাকেচক্রে তুমিও জড়িয়ে পড়েছ। আসলে আমাদের নজর ছিল কাকলির ওপর। ওর বাবার অনেক টাকা… একমাত্র মেয়েকে নিশ্চয়ই ভালোবাসেন তিনি’, একটু মুচকি হাসে বিক্রম। ‘মেয়েকে ফিরে পাবার জন্য তিনি কি আর এক লাখ টাকা আমাদের হাতে তুলে দিতে গড়িমসি করবেন? নিশ্চয়ই করবেন না, কি বল কাকলি?’

‘আর বাবা যদি টাকা না দেন?’ প্রশ্ন করে কাকলি।

‘তবে তোমার মিষ্টি মুখ কোনোদিন দেখতে পাবেন না তিনি।’ আবার খ্যাক খ্যাক করে হাসল বিক্রম।

কাকলির বুকের ভেতরটা আবার কেমন করে ওঠে। শেষ পর্যন্ত সে সাহস রাখতে পারবে তো?

এবার বিক্রম তাকায় বাচ্চুর দিকে। ‘আমরা জানতে পেরেছি তোমার বাবা ভালো চাকরি করেন, ব্যাঙ্কে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছেন। এক লাখ না হোক, হাজার পনেরো টাকা নিশ্চয়ই তোমার জন্য খরচ করতে পারবেন তিনি।’

‘মোটেই না’, বাচ্চু সরবে প্রতিবাদ করে। ‘বাবা খুব হিসেবি মানুষ, পাড়ার দুর্গা পুজোতেই পাঁচ টাকা চাঁদা দিতে চান না, আর আপনাদের মতো ডাকাতদের হাতে অতগুলো টাকা তুলে দেবেন ভাবছেন? কক্ষনো না; বাবা পুলিশে যাবেন।’

‘তা যদি যান তবে তোমাকে আর জ্যান্ত ফিরে পাবেন না তিনি’, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল বিক্রম। ‘অবশ্য তোমার জন্য যদি তাঁর মায়া না থাকে, সেকথা আলাদা।’

‘আর আপনাদের বুঝি ফাঁসি হবে না?’ কাকলি যতটা ঝাঁঝের সঙ্গে পারে কথাটা বলে।

ঠিক এইসময় ঘরে ঢুকল রমেন বোস ওরফে রতন। সাফল্যের গর্বে একটু হাসি হাসি মুখেই ও ঘরে ঢুকেছিল, কিন্তু কাকলির চোখে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল। রাজ্যের ঘৃণা আর ভর্ৎসনা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে কচি মেয়েটা।

‘ছি, ছি, ছি!’ তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল কাকলি, ‘ছি, ছি, ছি!’

মুখটা যেন একটু কালো হল রতনের।

‘আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম আপনি লোক ভালো নন’, বাচ্চু টিপ্পনী কাটল, ‘কাকলি আপনার ভদ্দরলোকের মতো চেহারা আর ইনিয়েবিনিয়ে বলা কথা শুনে গলে গিয়েছিল।’

বিক্রম লক্ষ করছিল রতনকে। সে এবার হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘রতনবাবুকে কেন মিথ্যে লজ্জা দিচ্ছ তোমরা, দেখছ না মুখটা কেমন কালো হয়ে গেছে। আসলে ও বেচারি এখনও পোক্ত হয়ে ওঠেনি আমাদের মতো, দুধের গন্ধ ছাড়েনি গা থেকে।’

রতনের মুখ সত্যিই এবার কালো হয়ে যায়।

‘হ্যাঁ, কি বলছিলে তোমরা, ফাঁসি হবে আমাদের?’ বিক্রম বলল।

‘নিশ্চয়ই’, সতেজে জবাব দিল কাকলি, ‘কাউকে মেরে ফেললে তাই তো হয়।’

রতন অবাক হয় এদের সাহস দেখে। এত বড়ো বিপদে একটুও কি ঘাবড়ায়নি ওরা? ফাঁসি! গলার ভেতরটা শুকিয়ে আসে রতনের। যা বলছে ওরা তা কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না একেবারে। কত দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে তারা? কাকলির বাবা হয়তো টাকা দেবেন, কিন্তু বাচ্চু যা বলেছে তা যদি সত্যি হয়! ওর বাবা যদি সত্যিই পুলিশে যান! টাকা না পেয়ে এমনি ছাড়া যায় না ওকে। আবার খুন-টুনের খুব পক্ষপাতী ও নয়। ধরা পড়লে ওদের চুরি করে আনার জন্য বড়োজোর ক-বছর জেল হবে, কিন্তু খুন…। একটা অস্বস্তি অনুভব করে রতন।

সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে। দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ুক তা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। তা ছাড়া, এখন আর পরিণামের কথা ভেবে লাভ নেই। বন্দুকের গুলি এক বার ছোঁড়া হয়ে গেলে ওটা আর ফিরিয়ে আনা যায় না।

বিক্রমের কথায় চমক ভাঙে ওর।

‘রতনবাবুর ভদ্দরলোকের চেহারা আর ভদ্দরলোকের মতো হাবভাবের জন্যই তো তোমাদের মন ভুলোবার ভারটা ওকে দিয়েছিলুম আমরা।’ আবার খ্যাক খ্যাক করে হাসে বিক্রম।

যেন কাটা ঘায়ে নুন ছিটালো কেউ।

কাকলি আবার তাকাল রতনের দিকে। ওর চোখ দুটো ছোটো ছোটো হয়ে গেছে, নাকের দু-পাশ ফুলে উঠেছে। কাকলির মুখের এ চেহারা বাচ্চু চেনে। ভীষণ রেগেছে ও।

রমেশবাবুর বাইরের ঘরে বসে কথা হচ্ছিল।

বাচ্চুর বাবা তপেনবাবু উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘তবে কি আপনি বলতে চান অতগুলো টাকা গুন্ডা বদমাসের হাতে তুলে দেব আমরা?’

‘আর কি উপায় আছে বলুন?’ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন রমেশবাবু। এক রাতেই তিনি যেন বুড়িয়ে গেছেন, চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে একটা অসহায়তার ছাপ।

‘ওরা শাসিয়েছে বলেই পুলিশে খবর দেব না আমরা! এ কেমন কথা!’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন তপেনবাবু।

‘কিন্তু ওরা যদি মিথ্যে শাসিয়ে না থাকে? পুলিশে খবর দিলে আমার মেয়ে আর আপনার ছেলের কোনো ক্ষতিকরে যদি ওরা?’ ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন রমেশবাবু।

‘সেই ভয়ে অতগুলো টাকা ওদের হাতে তুলে দেব?’

‘ওদের ভালো-মন্দটা বড়ো না টাকাটা বড়ো, তপেনবাবু?’

‘না-না’, একটু লজ্জিত বোধ করেন তপেনবাবু, ‘সেকথা এক-শো বার। আমি বলতে চাইছি আইন-শৃঙ্খলা বলে কি কিছু নেই? কাপুরুষের মতো ওদের দাবি মেনে নিতে হবে আমাদের!’

‘সমস্ত ব্যাপারটাই তো কাপুরুষের মতো, তপেনবাবু’, একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়েন রমেশ সেন, ‘দুটো বাচ্চা ছেলে-মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়াটাই মস্ত কাপুরুষের কাজ। ওদের বন্দি করে রেখে মুক্তিপণ চাওয়াটা ঘৃণ্য কাপুরুষতা। অমন কাজ যারা করতে পারে, তাদের সঙ্গে বীরপুরুষের মতো ব্যবহার করে লাভ নেই কোনো, উলটো ফলই ফলবে।’

‘কিন্তু টাকা পেয়ে ওদের যে ছেড়ে দেবে ওরা, তাতেই বা বিশ্বাস কি?’ একটু ভেবে বললেন তপেনবাবু, ‘ছাড়া পাবার পর লোকগুলোর কেমন চেহারা তা নিশ্চয়ই বলবে ওরা, সেটা ওদের পক্ষে রীতিমতো বিপদের কথা— সারাজীবনের মতো। তা ছাড়া, কিছুদিন আগে একবার আমেরিকার একটা ঘটনার কথা পড়েছিলুম। গুন্ডারা এক কোটিপতির ছেলেকে গুম করে অনেক টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিল। ভদ্রলোক সরল বিশ্বাসে টাকাটা পৌঁছে দিয়েছিলেন ওদের হাতে, কিন্তু ছেলেকে জ্যান্ত ফিরিয়ে দেয়নি ওরা, দোরগোড়ায় ফেলে রেখে গিয়েছিল তার মৃতদেহ।’

বুকের ভেতর একটা অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করলেন রমেশবাবু। কোনোমতে নিজেকে সামলে তিনি বলেন, ‘আমেরিকার মতো অতটা খুনে ডাকাতের দেশ আমাদের নয়। তা ছাড়া, আর কি উপায় আছে বলুন? টাকা পেলে ওরা ওদের ছেড়ে দেবে, এ আশাই এখন আমাদের একমাত্র ভরসা।’

‘তবে আপনি বলছেন, পুলিশে না জানানোই ভালো?’

‘আমার তো তাই মনে হয়। পুলিশের হাতে আমরা যদি ব্যাপারটা ছেড়ে দিই, ওরা মরিয়া হয়ে উঠবে। যেটুকু আশা আছে ওদের ফিরে পাবার তাও থাকবে না।’

‘বেশ, তবে আপনার কথামতোই চলব আমি।’

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন রমেশ সেন।

শোবার ঘরে ফিরে এলেন তিনি। বিমলাদেবী চোখ বুজে শুয়েছিলেন। তাঁর সারা মুখে ক্লান্তি আর ভয়ানক একটা আশঙ্কার চিহ্ন ফুটে উঠেছে, চোখের নীচে কালি।

পায়ের শব্দে চোখ খুললেন তিনি, তারপর প্রশ্নভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন রমেশবাবুর দিকে।

‘তপেনবাবু পুলিশকে জানাতে চাইছিলেন…’

‘না…না…না’, রমেশবাবুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তীক্ষ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন বিমলাদেবী।

‘আমি ওঁকে বুঝিয়ে বলেছি’, বিমলাদেবীকে আশ্বস্ত করে বললেন রমেশ সেন। ‘উনি একটু কিন্তু-কিন্তু করছিলেন। আমি ওঁকে বলেছি টাকার চাইতে ছেলে-মেয়ের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। উনি রাজি হয়েছেন আমার কথায়।’

বিমলাদেবী একটু যেন আশ্বস্ত হলেন।

কিছুক্ষণ কেউ আর কথা বললেন না।

‘ওদের কাছ থেকে কবে আমরা খবর পাব?’ বিমলাদেবীর গলায় উদবেগের ছোঁয়া।

‘দু-এক দিনের মধ্যেই পাব’, গলাটা একটু সহজ করার চেষ্টা করেন রমেশ সেন।

‘কিন্তু টাকা পেয়েও যদি ওদের ফিরিয়ে না দেয় ওরা?’

তিরের মতো প্রশ্নটা রমেশবাবুর বুকে এসে বিঁধল। আর যেন নিজেকে সংযত রাখতে পারছেন না তিনি। অতি কষ্টে মুখে সহজভাব ফুটিয়ে তিনি বললেন, ‘না, না, মিথ্যে ভেবে ভেবে মন খারাপ করো না তুমি। টাকা পেলেই ওরা খুশি, ছেলে-মেয়ে দু-জনের ক্ষতি করে লাভ কি ওদের?’

আবার চোখ বুজলেন বিমলাদেবী।

কাকলির দুষ্টুমিভরা মুখটা যেন স্পষ্ট তাঁর চোখের সামনে ভাসছে।

খোলা জানলার সামনে দাঁড়িয়েছিল ওরা, দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল। ঘরে ঢুকল তিন জন, এক জনকে ওরা সকালেই দেখেছে। বাকি দু-জনের এক জনের চেহারাটা চিড়িয়াখানার হিপ্পোর মতো। দলে ওরা কতজন! একটা দারুণ হতাশায় ভরে যায় ওদের মন।

‘কী খবর খোকা-খুকুদের?’ ওদের লক্ষ করে ঠাট্টাটা ছুড়ে দিল বিক্রম।

‘যেমন দেখছেন বীরপুরুষেরা’, ঠাট্টাটা ফিরিয়ে দিল কাকলি।

‘ভারি ডেঁপো মেয়ে দেখছি!’ একটু রাগই প্রকাশ পেল বিক্রমের গলায়।

‘কেন? অন্যায়টা কি বলেছে ও?’ প্রতিবাদ করে ওঠে বাচ্চু। আমাদের মতো দু-জন ছেলেমানুষকে ধরে আনতে কম সাহসের দরকার! আপনার বীরপুরুষ না তো কে বলুন!’

‘ও বাব্বা! এ ছেলেটাও দেখি কম যায় না।’ রাঘব টিপ্পনী কাটে।

‘কেন, আপনারা কি ভেবেছিলেন খোকা-খুকুরা আপনাদের ভয়ে ভিরমি খাবে?’ কাকলির মুখে ফুটে ওঠে উপেক্ষার হাসি।

ওরা তিন জন একটু হোঁচট খায়। ছেলে-মেয়ে দু-জন যে ভীষণ ডাকাবুকো। সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ অবস্থায়, এ পরিবেশে এমন তেজ চাট্টিখানি কথা নয়!

‘বড্ড বাচাল দেখছি তোমরা’ কুতকুতে চোখ দুটো আরও ছোটো করে বলল রাঘব, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে জিভ টেনে উপড়ে ফেলব, বুঝলে?’

‘তাই বুঝি!’ বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কাকলি। ‘আমাদের এনেছেন টাকার জন্য। ভালোয় ভালোয় আমাদের ফিরিয়ে দিলে তবেই আমাদের মা-বাবারা টাকা দেবেন। জিভ উপড়ে ফেললে তাঁরা কি আর টাকা দেবেন?’

কাকলির যুক্তিতে ওরা থ বনে যায়।

কয়েক সেকেন্ড কথা বলে না কেউ, তারপরই হেসে ওঠে উদয়।

‘খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে তুমি, তাই না?’ কিন্তু টাকা পেলে তোমাদের ছেড়ে দেব একথা ভাবছ কেন?’

‘ছাড়বেন না তো কী করবেন?’ জিজ্ঞেস করল কাকলি।

‘ধর, টাকা পাবার পর যদি মেরে ফেলি তোমাদের?’

‘তবে টাকাও পাবেন না আপনারা’, এবার কথা বলে বাচ্চু।

‘তাই নাকি?’ হাসি হাসি মুখে উদয় তাকায় বাচ্চুর দিকে, যেন মজার একটা কথা শুনেছে। ‘কিন্তু তোমাদের ফিরে পাবার আশায় আগেই তো টাকাটা দিয়ে দেবেন তোমাদের মা-বাবা। টাকা না পেলে তোমাদের মেরে ফেলব একথা আমরা জানিয়ে দিয়েছি। ওঁরা কি অতটা ঝুঁকি নেবেন?’

‘টাকা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ছেড়ে দেবেন এমন কথা হয়েছে নিশ্চয়ই’, বাচ্চু নাছোড়বান্দার মতো বলে।

‘তা হয়েছে’, হাসে উদয়। ‘কিন্তু তোমরা আমাদের হাতে আছ, তাই সুবিধের পঁচানব্বই ভাগ আমাদের দিকে। আমরা যা বলব তা না শুনে উপায় নেই তোমাদের মা-বাবাদের। তোমাদের ছেড়ে দেব এই আশায় কথামতো যেখানে, যখন টাকা চাইব তাই মানতে হবে তাঁদের।’

‘ভেবেছেন পুলিশ আপনাদের ধরতে পারবে না?’ কাকলির গলা শুকিয়ে গেছে, তবু জোর করে বলে।

‘ও পথটা যে বন্ধ করে রেখেছি, খুকি’, উদয় আত্মপ্রসাদের কণ্ঠে বলল। ‘পুলিশের কাছে গেলে তোমাদের মেরে ফেলব তা আগেই জানিয়ে দিয়েছি। সুতরাং টাকাটা পকেটে পুরে তোমাদের যদি এখানেই গলা টিপে মেরে ফেলে আমরা চম্পট দিই, কে ধরবে আমাদের? তোমরা বেঁচে থাকলে তবেই তো আমাদের চেহারার কথা বলতে পারবে পুলিশের কাছে, তাই না?’

‘পুলিশ ঠিক আপনাদের খুঁজে বার করবে, দেখবেন’, বাচ্চুর গলাটা একটু যেন কেঁপে যায়।

‘আর তখন আপনাদের ফাঁসি হবে, টাকাটা কোনো কাজেই লাগবে না’, কাকলির গলায় আগের দৃঢ়তা যেন আর নেই।

উদয়ের মুখ কিন্তু কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘সে ভাবনা তোমাদের করতে হবে না।’

কাকলির মনে আবার সাহস ফিরে আসে।

‘সে কি! জানাশোনা লোকের ফাঁসি হবে, আর আমরা ভাবব না! আপনাদের মতো নিষ্ঠুর নই তো আমরা’, ঠেস দিয়ে বলল কাকলি।

‘মেয়েটা তো বড্ড পাকা’, বিক্রম মারমুখী হয়ে এক পা এগোয়। ‘দেব নাকি কয়েক ঘা লাগিয়ে?’ উদয়ের মুখের দিকে ও তাকাল।

উদয়েরও দুই ভুরু কুঁচকে যায়, কিন্তু কী ভেবে চোখের ইশারায় নিরস্ত করে বিক্রমকে।

‘পুলিশ আপনাদের খুঁজে বার করবেই’, বাচ্চু বলে ওঠে, ‘আমাদের মেরে ফেলুন আর নাই ফেলুন। ছেলেমানুষ পেয়ে আমাদের মিথ্যে কথায় ভুলিয়ে ধরে এনেছেন, আপনাদের কেউ ক্ষমা করবে না। আর আমাদের যদি মেরেই ফেলেন, তবে বিচারে নির্ঘাত ফাঁসি হবে আপনাদের।’

ছেলে-মেয়ে দু-জনের কথায় ওরা অবাক না হয়ে পারে না। কোথায় মেরে ফেলার কথায় ভয় পাবে তা নয়, দিব্যি ওদের কি সাজা হবে সে-কথাই বড়ো গলা করে বলছে!

ওদের কথাবার্তার শেষের দিকে রতন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল তা কেউই খেয়াল করেনি।

ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

১০

ওরা চার জন ফিরে এসেছে আগের ঘরটায়।

বিক্রম বলছিল, ‘আমি খুব ভালোভাবে খোঁজ নিয়েছি, পুলিশ আসেনি পাড়ায়, ছেলে-মেয়ে দু-জনের বাবাদের কেউই থানায় যাননি। কাল রাত থেকে বাড়ির বাইরে যাননি ওঁরা, ওঁদের বাড়িতেও কেউ আসেনি। শুধু সকালে বাচ্চুর বাবা কাকলিদের বাড়ি গিয়েছিলেন। বাইরের ঘরে বসে কথাবার্তা হয়েছিল ওঁদের, তারপর বাচ্চুর বাবা বাড়ি ফিরে যান।’

‘হুঁ!’ চিন্তাকুটিল হয়ে ওঠে উদয়ের মুখ। ‘ছেলে-মেয়ে দুটো উধাও হয়ে গেল, পাড়ায় একটা শোরগোল পড়ল না, আশ্চর্য!’

‘পড়েনি যে তা নয়, কিন্তু ওদের বাবারা নাকি বলেছেন ওরা যে-যার মামারবাড়ি গেছে।’

‘আমাদের হুমকির ফল’, রাঘব বলে ওঠে।

‘আরও দিন দুই লক্ষ রাখতে হবে আমাদের’, চিন্তিত মুখে বলল উদয়। ‘হালচাল বুঝে তবেই এগুবো! ওঁরা যদি টেলিফোনে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন তবে আমাদের হুমকির কথাও জানিয়েছেন নিশ্চয়ই। হয়তো পুলিশ সাদা পোশাকে নজর রাখছে পাড়ার ওপর। কাউকে অকারণে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই সন্দেহ করবে— সাবধানের মার নেই।’

‘কিন্তু আমাদের কাছ থেকে কোনো খবর না পেয়ে বাচ্চু আর কাকলির মা-বাবারা তো ধৈর্য হারিয়ে ফেলবেন, শেষপর্যন্ত পুলিশের কাছেই যাবেন।’ এবার বলল রতন।

‘হ্যাঁ, রতনের কথাটা ফেলার নয়’, স্বীকার করল উদয়। ‘আজই টেলিফোন করে জানিয়ে দেব ছেলে-মেয়ে দু-জনের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ নেই, আর কবে কোথায় টাকা দিতে হবে তাও দু-চার দিনের মধ্যেই জানতে পারবেন তাঁরা।’

‘একটা কথা’, রতন দোনামনা করে বলে, ‘আমার চেহারার কথা রমেশবাবু হয়তো জেনেছেন, কাকলি বলে থাকতে পারে।’

‘তারজন্য চিন্তার কোনো কারণ নেই’, কথাটা প্রায় উড়িয়েই দিল উদয়, ‘তোমার চেহারা আর পাঁচজন ভদ্রলোকের ছেলের মতোই সাদামাটা, মনে করে রাখার মতো এমন কিছু নেই তোমার চেহারায়। পুলিশের সাধ্য নেই তোমাকে খুঁজে বার করে।’

‘কিন্তু ওরা তো আমাদেরও দেখেছে’, এবার বলল রাঘব।

‘তাতে কী হয়েছে?’ বিস্ময়ের ভান করল উদয়।

‘বাঃ, আমাদের চেহারা তো আর রতনের মতো সাদামাটা নয়, পুলিশের পক্ষে খুঁজে বার করা তেমন কঠিন হবে বলে মনে হয় না।’

‘আমাদের কেমন চেহারা তা যাতে কোনোদিন ওরা বলতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে’, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দিল উদয়।

‘কেমন করে?’ রাঘব জানতে চায়।

‘ওদের মুখ চিরকালের মতো বন্ধ করে দেব আমরা’, হাসল উদয়।

‘তার মানে সত্যিই ওদের মেরে ফেলতে চাও?’ রতনের ভালো লাগে না এই সহজ সমাধান। কাকলি আর বাচ্চুর যুক্তি বেশ দাগ কেটেছে ওর মনে।

‘সেটাই সবচেয়ে সোজা উপায়’, জোর দিয়ে বলল উদয়। ‘টাকা পেয়ে ওদের ছেড়ে দিলে চিরকাল একটা ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে আমাদের। কি বলিস তোরা?’ উদয় তাকাল বিক্রম আর রাঘবের দিকে। ওরা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।

‘খুনখারাপির মধ্যে আমি নেই’, প্রতিবাদ করে উঠল রতন। ‘পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ওদের গুম করে টাকা আদায়ের জন্য বড়োজোর আমাদের ক-বছর জেল হবে; কিন্তু খুনের জন্য ধরা পড়লে ফাঁসি। অতটা বাড়াবাড়ি করা দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।’

‘তবে কী করতে চাও শুনি?’ ভুরু কুঁচকে তাকায় উদয়।

‘টাকাটা হাতিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারার পর আমার যে-যার গা ঢাকা দেব, সরে পড়ব বিহার, উড়িষ্যা কি আসামে। ওখানে গিয়ে ছোটোখাটো ব্যবসা শুরু করব। এক এক জনের ভাগে তো কম টাকা পড়বে না। কাকলিদের সঙ্গে কোনোদিন দেখা হবার সম্ভাবনাও থাকবে না, আর পুলিশও আমাদের খোঁজ পাবে না। অন্তত ফাঁসির দড়িটা মাথার ওপর ঝুলবে না অষ্টপ্রহর।’ বেশ জোর দিয়েই বলল রতন।

‘রতনবাবু বেশ ঘাবড়েছে মনে হচ্ছে’, বিদ্রূপ করে উঠল বিক্রম।

লাল হয়ে ওঠে রতনের মুখ। ‘না, ঘাবড়াইনি আমি’, বেশ উত্তপ্ত কণ্ঠে ও বলে। ‘অকারণ ঝুঁকি নেবার পক্ষপাতী আমি নই। তা ছাড়া নীতিগত ভাবে…’, কথাটা বলেই ও নিজের ভুল বুঝতে পারে।

জোরে হেসে ওঠে উদয়। ‘আরে আমাদের রতনবাবু যে নীতিবাগিশ হয়ে উঠেছে’, বিক্রম আর রাঘবকে লক্ষ করে ও বলে, ‘চোরের মুখে হরিনাম, এ্যাঁ!’

দু-কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে থাকে রতনের।

‘কচি কচি দুটো ছেলে-মেয়েকে মেরে ফেলা আমি সমর্থন করি না, তার কোনো দরকার আছে বলেও মনে করি না আমি। আর সাহস তোমাদের কারু চাইতে আমার কম আছে তা যদি ভেবে থাক তবে সেটা ভুল।’

উঠে পড়ে রতন। ‘আমাদের কাজ হাসিল নিয়ে কথা। ওদের সম্বন্ধে চরম সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমার কথাগুলো ভেবে দেখো তোমরা।’

ঘর থেকে ও বেরিয়ে যায়।

‘ওর মতিগতি সুবিধের মনে হচ্ছে না’, দরজার দিকে তাকিয়ে বলল বিক্রম।

‘ওর ওপর নজর রাখতে হবে’, উদয়ের কপালে ভাঁজ পড়ে। ‘ফাঁসিয়ে না দেয় আমাদের।’

শক্ত হয়ে ওঠে তিন জনের চোয়াল।

১১

নীল আকাশে হালকা মেঘের দল যেন লুকোচুরি খেলছে। সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে টুকরো টুকরো তুলোটে মেঘ, চোখের নিমেষে মিলিয়ে যাচ্ছে কোন সুদূরে। কাকলি এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সীমাহীন আকাশের দিকে, দেখছিল ওদের রঙ্গ। কেমন স্বাধীন ওরা, ভাবছিল কাকলি মনে মনে, যখন যেখানে খুশি যেতে পারে, আমাদের মতো কেউ ওদের বন্দি করে রাখতে পারে না।

বাচ্চু এসে দাঁড়াল ওর পাশে। দু-জন চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। কাকলিই কথা বলল প্রথম। ‘আচ্ছা, সত্যিই কি ওরা মেরে ফেলবে আমাদের?’

‘মেরে ফেলা অত সহজ নাকি!’ বাচ্চু জোর করে মনে সাহস আনতে চায়।

‘কিন্তু, ওই লোকটা যে বলছিল’, কাকলির গলায় কেমন উদাস ভাব। মা-বাবার কথা ভাবতেই চোখে জল এসে যায় কাকলির। ওঁদের নিশ্চয়ই ঘুম নেই চোখে, নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে। এক লাখ টাকা কত তা জানে না কাকলি, কিন্তু সে যে অনেক টাকা তা বুঝতে ওর কষ্ট হয় না। যত টাকাই হোক, তাকে ফিরে পাবার জন্য বাবা যেমন করে পারেন তা দেবেন।

‘ওরা নিশ্চয়ই ভয় দেখাচ্ছিল আমাদের।’

বাচ্চুর কথায় চমক ভাঙে কাকলির।

‘ভয়ই দেখাক আর কাজেই করুক’, কাকলি বড়ো বড়ো চোখ দুটো রাখল বাচ্চুর মুখের ওপর, ‘আমরা ভয় পেয়েছি এমন ভাব করব না কক্ষনো, বুঝলি?’

‘ঠিক বলেছিস’, জবাব দিল বাচ্চু, ‘ভয় পেয়েছি বুঝতে পারলে পেয়ে বসবে ওরা।’

দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল ওরা। ঘরে ঢুকল রতন। ওর এক হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার, অন্য হাতে দুটো কলাপাতা।

কলাপাতা দুটো মাটিতে বিছিয়ে ও বলল, ‘নাও, টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার নিয়ে বসে পড় চটপট, আমি জল নিয়ে আসছি।’

ওদের কিন্তু নড়বার লক্ষণ দেখা গেল না। রতন একটু অবাক হয়েই তাকাল আর দ্বিতীয় বার চমকাল। জ্বালাভরা দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। ওর জন্যই আজ ওদের এই দশা, এটাই যেন বলতে চাইছে ওদের দৃষ্টি। রাজ্যের ঘৃণা ঝরে পড়ছে ওদের চোখ থেকে। রতনের মতো মানুষও যেন কুঁকড়ে যায় ওদের দৃষ্টির সামনে, লুকোতে চায় মুখ।

মুহূর্তের স্তব্ধতা, তারপর রতনই বলল, ‘আমার ওপর রাগ করে না খেলে নিজেরাই কষ্ট পাবে। নাও, খেয়ে নাও।’

বিক্রম ঘরে ঢুকল।

এক নজরে ঘরের অবস্থাটা বুঝে নেবার চেষ্টা করে বলল, ‘দেরি করছ কেন? বসে যাও খেতে।’

‘কোথায় বসব?’ ঝংকার দিয়ে উঠল কাকলি। ‘পিঁড়ি নেই, আসন নেই…’

‘পিঁড়ি, আসন!’ হেসে উঠল বিক্রম। ‘এ কি বিয়ে বাড়ি পেয়েছ নাকি যে আসন বিছিয়ে খাওয়াব?’

‘তা বলে ওই ধুলোভরা মেঝের ওপর বসে খেতে হবে? আমরা কি ভিখিরি নাকি, যেখানে-সেখানে মাটি চেপে বসে পড়ব খেতে!’

‘তাও তো বটে, তাও তো বটে’, মুখটা গম্ভীর করে বলল বিক্রম, ‘তোমরা হচ্ছ রাজবাড়ির ছেলে-মেয়ে। দামি আসন, সোনার থালা-বাটি, এসব ছাড়া খেতেই পার না তোমরা, কি বল?’

‘আমরা আপনাদের বন্দি, যা খুশি তাই বলতে পারেন’, বেশ তেজের সঙ্গে বলল বাচ্চু, ‘তবে এটা খুব বীরপুরুষের কাজ নয়। আপনি যদি আমাদের বন্দি হতেন, তবে আমরাও যা খুশি বলতে পারতুম।’

বিক্রমের মুখের রংটা বেগুনি হয়। এক পা এগিয়ে আসে, মনে হয় এই বুঝি ও ঝাঁপিয়ে পড়বে বাচ্চুর ওপর। রতন তাড়াতাড়ি ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।

তারপর ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে তাকায়। কচি কচি দুটো মুখ। খিদে যে ওদের পেয়েছে তা ওদের শুকনো মুখ দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না। সেই কোন সকালে একটু চা আর বিস্কুট খেয়েছে, এখন বেলা প্রায় একটা। কেমন যেন মায়া হয় রতনের, একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে নাড়া দেয় ওর মন।

ও বেরিয়ে যায়। মিনিট দুয়েক পরেই ফিরে আসে দুটো খবরের কাগজ নিয়ে। কাগজ দুটো মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে বলে, ‘বোসো তোমরা, আমি জল আনছি।’

কাকলি বাচ্চুর দিকে তাকায়। রতন মাঝখানে এসে না দাঁড়ালে ওই লোকটা হয়তো বাচ্চুকে মেরেই বসত। রতনের ওপর ওদের বিরূপ ভাবটা কমে আসে একটু।

রতন আবার ঘরে ঢোকে, তার দু-হাতে জল ভরতি দুটো মাটির গ্লাস। ‘কী, এখনও বসনি তোমরা খেতে! নাও, নাও, বসে পড়ো, অনেক বেলা হয়ে গেছে।’

কাকলি আর বাচ্চু দু-জন দু-জনের মুখের দিকে তাকায়, চোখে চোখে ইশারা খেলে যায় ওদের, তারপর আর কোনো কথা না বলে খেতে বসে গেল ওরা। সত্যিই খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিল ওদের।

ওরা খেতে বসতেই বিক্রম বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ওর মুখটা থমথমে।

ভাত, ডাল আর মাছের ঝোল, মামুলি খাবার। এর চাইতে কত ভালো ভালো রান্না হয় কাকলিদের বাড়িতে, তবু খিদের মুখে ওই মোটা, দুর্গন্ধ ভাত আর জোলো ডাল অমৃত মনে হল কাকলির।

কড়াং করে একটা কাঁকরে কামড় পরতেই প্রায় লাফিয়ে উঠল ও।

‘ও…ও…ও’, কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা, ‘দাঁতটা ভেঙে গেল আমার।’

‘একটু দেখেশুনে খাও’, বলল রতন। কচি মেয়েটার ওপর কেমন যেন সহানুভূতি হয় ওর।

‘ভালো ভাত আনতে খুব কি বেশি পয়সা লাগত আপনাদের?’ মুখিয়ে উঠল কাকলি। ‘এতগুলো টাকা চেয়েছেন আমাদের জন্য আর খেতে দেবার বেলায় যত কিপটেমি!’ জল এসে গেছে ওর চোখে। ‘আচ্ছা, আচ্ছা’, রতন আশ্বস্ত করতে চায়, ‘ওবেলা ভালো ভাত আনব, এখন একটু দেখে খাও।’

মাছের ঝোল-ভাত একগ্রাস মুখে তুলেই লাফিয়ে উঠল কাকলি। ‘ওর বাবারে, গেছিরে’, ঘরের ভেতর দাপাদাপি শুরু করে দিল ও। ‘কী ঝাল! মুখ পুড়ে গেল! উঃ!’ সারা ঘর ছুটোছুটি করতে লাগল কাকলি আর মুখ দিয়ে ‘উঃ’, ‘আঃ’ শব্দ করে যেতে লাগল অনবরত।

রতন থ, বাচ্চুও হকচকিয়ে গেছে।

হতভম্ব ভাবটা কেটে যেতেই রতন তাড়াতাড়ি একটা মাটির গ্লাস তুলে এগিয়ে গেল।

‘জল খাও, ভালো লাগবে’, গ্লাসটা সে কাকলির মুখের কাছে তুলে ধরে।

ঢকঢক করে জলটা শেষ করল কাকলি।

‘আপনারা মেরে ফেলতে চান। উঃ! এত ঝাল খেতে পারে মানুষ!’

দিশেহারা হয়ে পড়ে রতন। মেয়েটার কথাগুলো ওর মনকে সজোরে নাড়া দেয়। দুঃখও হয় মেয়েটার জন্য। খিদের মুখে বেচারির মাথায় উঠেছে খাওয়া।

‘আচ্ছা, রাত্তিরে ভালো হোটেল থেকে খাবার আনব’, অনেকটা যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে ও বলে।

‘শুধু ভালো খাবার হলেই হবে না’ ঝংকার তোলে কাকলি। ‘বিছানায় পরিষ্কার চাদর দিতে হবে আর কাল রাতে শীত শীত করছিল। গায়ে দেবার কিছু ছিল না কেন?’

‘ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়’, ছোটো মেয়েটার দাপটে কৌতুকের সঙ্গে বিচিত্র এক অনুভূতি স্পর্শ করে রতনকে!

১২

সেদিন বিকেলেই রমেশবাবুকে ফোন করল উদয়।

‘হ্যালো’, রমেশবাবুর গলাটা একটু কেঁপে গেল। একটা চিঠি কিংবা ফোনের আশা করছিলেন তিনি।

‘আমি আপনার মেয়ের ব্যাপারে কথা বলছি’, উদয়ের গলার স্বর তীক্ষ্ন তিরের ফলার মতো কানে এসে বাজল রমেশবাবুর।

‘ও!’ তিনি যেন কথা বলতে পারছেন না। নিজেকে একটু সামলে তিনি বললেন, ‘কেমন আছে ও… মানে ওরা?’

‘ভালো, ওদের জন্য চিন্তা করবেন না।’

‘না— মানে… কাকলির মা একেবারে বিছানা নিয়েছেন, বাচ্চুর মায়েরও সেই দশা।’

‘তা তো হবেই’, গলায় কৃত্রিম সহানুভূতির সুর ফুটিয়ে বলল উদয়।

‘আপনারা তাড়াতাড়ি টাকা নিয়ে ওদের ছেড়ে দিন’, এবার একটু রাগত কণ্ঠেই বললেন রমেশবাবু। টাকার জন্যই আপনারা ওদের চুরি করেছেন, টাকাটা নিয়ে ছেড়ে দিন।’

চুরি কথাটায় কঠিন হয়ে উঠল উদয়ের মুখ।

‘আমরা আপনাদের ওপর নজর রাখছি’, হিমশীতল কণ্ঠে ও বলল, ‘পুলিশে ধরিয়ে দিতে চান কিনা, কিংবা অন্য কোনো মতলব আছে কিনা আপনাদের, তা যাচাই করে নিতে হবে আমাদের। টাকা নিতে গিয়ে যদি পুলিশের ফাঁদে পড়ি সেটা তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’

‘যদি নজর রেখে থাকেন তবে আপনাদের বোঝা উচিত ছিল যে, আমরা থানা-পুলিশ করিনি।

‘নিজেরা থানায় না গেলেও ফোনে খবর দিয়েছেন কিনা তা দেখতে হবে আমাদের।’

‘কী পাগলের মতো কথা বলছেন!’ রমেশবাবু এবার বেশ রেগে ওঠেন। ‘ফোনে খবর দিলেও পুলিশ বাড়ি আসত, উড়ো খবরে পুলিশ কিছুই করবে না।’

‘তবু আমাদের সাবধান হতে হবে’, জবাব দিল উদয়।

‘বাচ্চা দুটোর কথা একবারও ভাবছেন না আপনারা, আশ্চর্য!’ অভিযোগের সুর ফুটে ওঠে রমেশবাবুর গলায়। হঠাৎ একটা কথা বিদ্যুতের মতো তাঁর মাথায় ঝিলিক খেলে যায়। ‘আচ্ছা শুনুন’, ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠেন তিনি, ‘আমি যদি আপনাদের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিই, তবে ছেড়ে দেবেন ওদের?’

‘আপনার চাইতে আপনার টাকার মূল্যটাই আমাদের কাছে বেশি’, খ্যাক খ্যাক করে হাসল উদয়, যেন একটা দারুণ রসিকতার কথা বলেছে। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘দু-এক দিনের মধ্যেই জানতে পারবেন কোথায় আর কখন টাকাটা দিতে হবে। মনে রাখবেন, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বুঝতে পারলেই ছেলে-মেয়ে দুটোর গলা টিপে মেরে ফেলব।’

সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল রমেশবাবুর।

তপেনবাবুকেও ফোন করল উদয়।

‘কী ভেবেছেন আপনারা!’ উদয়ের পরিচয় ও উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন তিনি। ‘এভাবে টাকা আদায় করে চিরকাল পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন! কক্ষনো না। একদিন না একদিন পুলিশ ধরবেই আপনাদের, জেলে পচতে হবে তখন।’

‘সে ভাবনা আমাদের, আপনার নয়’, ধমকে উঠল উদয়। ‘বদ মতলব-টতলব ছাড়ুন, আমরা নজর রাখছি। পুলিশে গিয়েছেন কী ছেলেকে কেটে দু-টুকরো করে ফেলব বুঝেছেন?’

‘না…না…’, তোতলাতে থাকে তপেনবাবু, ‘তেমন কোনো মতলব নেই আমার। আসলে আমার মাথার ঠিক নেই। অতগুলো টাকা মানে বুঝতেই তো পারছেন, আজকালকার মাগগিগন্ডার দিনে আমার মতো ছা-পোষা মানুষ ক-টা টাকাই বা মাসে মাসে জমাতে পারে। আয়ের চাইতে ব্যয় বেশি। তাই বলছিলুম কি, টাকার অঙ্কটা যদি কমিয়ে দিতেন…’

‘না’, আবার ধমকে উঠল উদয়। ‘এক পয়সাও কম হবে না। আমরা খোঁজ নিয়েছি আপনি ভালো রোজগার করেন, আর খরচ করেন টিপেটিপে। ব্যাঙ্কে আপনার মোটা টাকা জমেছে। ভাবছি পনেরো হাজার খুব কম ধরা হয়েছে, ওটা বাড়িয়ে দেব।’

‘না…না’, আর্তনাদ করে ওঠেন তপেনবাবু। ‘মরে যাব, স্রেফ মারা পড়ব। আচ্ছা, আচ্ছা, পনেরো হাজারই সই। কবে দিতে হবে টাকাটা? তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলুন ব্যাপারটা… মানে এই মানসিক যন্ত্রণা এমন করে আর জিইয়ে রাখবেন না। পাগল হয়ে যাব।’

‘দু-একদিনের মধ্যেই খবর পাবেন’, ভারিক্কি চালে উদয় বলল।

‘ভালো কথা’, তপেনবাবু বললেন, ‘বাচ্চু কেমন আছে? কান্নাকাটি করছে না তো?’

‘ভালো আছে।’ দ্বিতীয় প্রশ্নটার আর জবাব দিল না উদয়, মনে মনে ভাবল, নিজের ছেলেকে এখনও চিনতে বাকি আছে ভদ্রলোকের।

ফোনটা ও ছেড়ে দিল।

১৩

রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার ভালো ব্যবস্থাই করল রতন। ওর ওপরেই ভার পড়েছে কাকলিদের দেখাশোনার, বাকি তিন জন সামলাচ্ছে অন্যান্য দিক। বিক্রম নজর রাখছে রমেশবাবুদের পাড়ার ওপর, উদয় ঠিক করতে গেছে একটা সুবিধামতো জায়গা— যেখানে টাকাটা হাত বদল হবে। রাঘব বাড়িতে পাহারায় আছে। দৈবাৎ যদি বাইরে থেকে কেউ এসে পড়ে।

‘এবেলা অসুবিধে হয়নি তো খেতে?’ রতন জিজ্ঞেস করল ওদের খাওয়া শেষ হবার পর।

‘না’, গম্ভীর মুখে জবাব দিল কাকলি। রতনের ওপর অপ্রসন্ন ভাবটা এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি ওদের। ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

রতন ওর গলার স্বরে চমকে ওঠে।

‘কী?’ ও জানতে চায়।

‘আমাদের এতগুলো মিথ্যে কথা বলে ধরে আনলেন, একটুও খারাপ লাগল না আপনার?’

রতন চুপ করে থাকে।

‘আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলুন তো’, এবার বলল বাচ্চু, ‘টাকা পাবার পর আপনারা আমাদের ছেড়ে দেবেন, না মেরে ফেলবেন?’

এ প্রশ্নের সে কী জবাব দেবে? ওরা প্রত্যাশিত ভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে জোর করে মুখে হাসি টেনে ও বলল, ‘মেরে ফেলব কেন, ছেড়েই দেব।’

‘কিন্তু ওই লোকটা যে বলছিল?’ কাকলি প্রশ্ন করল।

‘ওটা তোমাদের ভয় দেখাবার জন্য’, রতন ওদের আশ্বস্ত করতে চায়, যদিও নিজেই সে আশ্বস্ত নয় এ ব্যাপারে।

‘আচ্ছা, আপনারা এত নোংরা কাজ করেন, একটুও খারাপ লাগে না?’ হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠল কাকলি। ‘চুরি-ডাকাতির চাইতেও অনেক নোংরা কাজ এটা।’ রতনের প্রতি ওর বিরূপ ভাবটা আবার যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

আচমকা এই প্রশ্নে থতমত খায় রতন, মুখ লাল হয়ে ওঠে, একটু রাগও হয়, এই একরত্তি মেয়েটা তার কাছে কৈফিয়ৎ চাইছে, এটা হজম করতে একটু সময় লাগে। তবুও ওদের ধরে আনার জন্য সামান্য যে অপরাধবোধ ওর মনে জেগেছিল, সেটাও তার বক্তব্য প্রকাশের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না।

‘করি আর কোনো উপায় নেই বলে। আমার বাবা সত্যিই অসুস্থ, একটা সরকারি অফিসে কেরানির কাজ করতেন। রিটায়ারের মুখে বাঁ-দিকটা অবশ হয়ে যায়। সামান্য পেনশন পান। পেনশনের টাকায় দিন চলে না আমাদের। বি এ পাশ করার পর চাকরির জন্য অফিসে অফিসে আমি মাথা কুটে মরেছি, কিন্তু কোথাও পাইনি চাকরি। অসুস্থ বাবার দু-চোখের অসহায় চাউনি, খিদেয় ভাই-বোনদের গুমরে গুমরে কান্না, সবই আমাকে দেখতে হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হত গঙ্গায় ঝাঁপ দিই, কিন্তু বাড়ির সবাই আমার মুখ চেয়ে আছে ভেবেই ও চিন্তাটা দূর করতে হয়েছে মাথা থেকে।’ একটু থামে রতন, ওদের দু-জনের মুখের ওপর চকিতে দৃষ্টি বুলিয়ে আবার বলতে থাকে

‘আমার মনের যখন এই অবস্থা ঠিক তখুনি আলাপ হল উদয়ের সঙ্গে। কাজকর্মে সুবিধে করতে না পেরে বেশ ক-বছর ধরেই ওরা এপথে এসেছিল। আমার সব কথা শুনে ওরা আমাকে ওদের দলে যোগ দিতে বলল। আমিও ভেবে দেখলুম, যে সমাজ আমাকে ভদ্রভাবে বাঁচার সুযোগ দিল না, তার রীতিনীতি কীসের দুঃখে মানব আমি! সমাজ যদি আমাকে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা দিত, তবে না হয় একটা কথা ছিল। এত লেখাপড়া করে লাভটা কী হল তবে? দু-মুঠো অন্নসংস্থানের উপায় করে দিতে পারে না যে শিক্ষা, তার মূল্য কি!’

উত্তেজিত হয়ে ওঠে রতন। বয়সে ছোটো হলেও এই ছেলে-মেয়ে দুটোর কাছে তার পুঞ্জীভূত আবেগ প্রকাশ করতে পেরে অনেকটা যেন হালকা বোধ করছে সে।

হাঁ করে শুনতে থাকে ওর কথা কাকলি আর বাচ্চু।

‘শেষপর্যন্ত ওদের দলে যোগ দেয়াই ঠিক করলুম। আর কোনো উপায় ছিল না আমার’, একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল রতন। ‘ভালোভাবে চলবার, ভালোভাবে বাঁচবার ষোলো আনা ইচ্ছাই ছিল আমার, কিন্তু সে ইচ্ছেটাকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলা হয়েছে।’

ঠিক এইসময় ঘরে ঢুকল রাঘব, কাজেই রতনের আর কথাগুলো বলা হল না। আর সত্যি বলতে কী, এক বার যে মিথ্যা কথা বলে সে এদের বিশ্বাস হারিয়েছে, এবারে তারা ওর কথায় বিশ্বাস করবে সে ভরসা আছে কি?

রতন আর রাঘব বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, বাইরে থেকে তালা পড়ল। নিজের বিছানায় শুয়ে কাকলি মনে মনে ভাবছিল, লোকটাকে প্রথমে খারাপ মনে হয়েছিল, তারপর ভালো, তারপরে আবার খারাপ। এখন আবার লোকটা যেন তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে। আসলে লোকটা কীরকম?

১৪

ওরা দু-জন যে-যার বিছানায় শুয়ে আছে। অন্ধকার ঘর, বাইরেটাও অন্ধকার। বুনো ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে, মাঝে মাঝে প্যাঁচা ডাকছে। কেমন যেন একটা গা ছমছম করা ভাব। ওদের দু-জনের কারু চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ কাকলির তক্তপোশটা জোরে নড়ে উঠল, ভীষণ চমকাল বাচ্চু।

‘কী… কী হল?’ বাচ্চু যেন তোতলা হয়ে গেছে।

‘বাচ্চু, তোর ভূতের ভয় আছে?’

কাকলির প্রশ্নে অবাক না হয়ে পারে না বাচ্চু।

‘ভূত!’ একটু বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে ও বলল।

‘হ্যাঁ। এটা ভূতুড়ে বাড়ি বলছিল না ওই লোকটা! সত্যিই যদি ভূত আসে ঘরে…’ কাকলির গলায় একটা চাপা আতঙ্ক! ‘আমার কিন্তু বড্ড ভূতের ভয়, বুঝলি বাচ্চু। লোকটা যখন বলছিল তখন মুখ টিপে ছিলুম, কিন্তু অন্ধকার আর ভূত, দুটোতেই আমার ভীষণ ভয়।’

বাচ্চুর বুকের ভেতরটাও কেমন যেন শুকিয়ে আসে। ভূতের ভয় নেই এমন কথা জোর গলায় বলতে পারে কেউ! কাকলিটাও যেন কেমন! কথাটা ও ভুলেই গিয়েছিল, কী দরকার ছিল মনে করিয়ে দেবার!

‘কী, কথা বলছিস না কেন?’ কাকলির কণ্ঠে উদবেগ। ‘তুই অমন চুপ করে আছিস কেন, বাচ্চু?’

অন্ধকারের ভেতর দিয়ে মিথ্যে চোখ বুলোবার চেষ্টা করে বাচ্চু বলল, ‘আমারও খুব ভূতের ভয়, বুঝলি কাকলি! ভূত ছাড়া আর কিছুতে ভয় নেই আমার।’

‘আমারও তাই’, কাকলি সায় দিল।

বিছানা ছেড়ে মাটিতে নামল কাকলি, তারপর তক্তপোশটা টেনে নিয়ে এল বাচ্চুর কাছে। দু-জনে কাছাকাছি থাকলে তবু সাহস আসবে মনে। বাচ্চুও যেন ভরসা পায় অনেকটা। ডান হাতটা অন্ধকারে বাড়িয়ে দিয়ে কাকলিকে স্পর্শ করে, তারপর বলে, ‘আয়, আমরা হাত ধরাধরি করে শুয়ে থাকি।’

মাঝরাতে একটা আর্তনাদে ঘুম ভেঙে যায় কাকলির।

‘কী…কী হয়েছে?’ ধড়মড় করে উঠে বসল ও।

‘কে…কে…যে…ন আমার গালে হাত বু-লো-ল’, বাচ্চুর গলায় আতঙ্ক। কাকলির শরীরও যেন হিম হয়ে আসে। তবে কি ভূত এসেছে ঘরে!’

‘কা…ক…লি’ বাচ্চুর গলা ভীষণ কাঁপছে, ‘তু…ই কো…থা…য়!’

চাবুক খাওয়ার মতো জেগে উঠল ডাকাবুকো মেয়েটা। সঙ্গীর অবস্থা অন্তর দিয়ে ও অনুভব করল আর সেটাই কাজ করল মন্ত্রের মতো। বাচ্চুর কাতর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গলা যতটা সম্ভব সহজ করে ও বলল, ‘ভয় কী, বাচ্চু, এই তো আমি তোর পাশে আছি। তুই স্বপ্ন দেখছিলি, ঘুমো দেখি।’

ওর গলার নিশ্চিন্ততায় সাহস ফিরে পেল বাচ্চু, হয়তো একটু লজ্জাই পেল।

‘আমার মনে হল একটা নরম হাত আমার গাল ছুঁয়ে গেল’, একটু আমতা আমতা করে ও বলল।

‘নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিলি তুই, ঘুমের আগে আমরা ভূতের কথা বলছিলুম, তাই,’ কাকলি অভয় দিয়ে বলে। ওর মনকে ও শাসন করে ফেলেছে। বাচ্চুর হঠাৎ ভয় পাওয়াটাই যেন সাহস ফিরিয়ে এনেছে ওর।

‘তা হবে’, বাচ্চু বলল। আস্তে আস্তে ওর সাহসও ফিরে আসছে।

কিছুক্ষণ কারো মুখে কথা নেই।

তারপরই কাকলি একটা মৃদু নিশ্বাস অনুভব করল মুখের ওপর। সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল ওর, নড়বার ক্ষমতাও যেন ও হারিয়ে ফেলছে। অনুভূতিটা কাটতে না কাটতেই কী একটা নরম যেন ছুঁয়ে গেল ওর গাল। কাকলি চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না। একটা মৃদু ঝটাপট শব্দ। কাকলি বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে এবার।

ঠিক তখুনি জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকল একফালি চাঁদের আলো।

সেই আলোয় ও দেখল কালো মতো কী যেন একটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। শূন্যে ভর করে আসছে ওটা। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কাকলির। ওটা আসছে, আরও এগিয়ে আসছে, এখুনি মুখের উপর এসে পড়বে…।

তারপরই হেসে উঠল কাকলি, হাসির দমকে যেন ফেটে পড়বে।

‘কী হল, কী হল!’ চমকে, ঘাবড়ে হতবুদ্ধি বাচ্চু বলল।

‘ভূত’, অদম্য হাসির ফাঁকে কোনোমতে বলল কাকলি, ‘চামচিকে ভূত’।

এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারল বাচ্চু, ওর মুখেও ফুটে উঠল স্বচ্ছন্দ হাসি।

১৫

ওরা চার জন গোল হয়ে বসেছিল।

বিক্রমের হাতে একটা রিভলবার, সেটা লোফালুফি করছিল ও।

‘জায়গা পছন্দ করে এসেছি আমি’, উদয়ই প্রথম কথা বলল, ‘এখান থেকে পাঁচ মাইল উত্তরে ষষ্ঠীতলার মোড়, একটা পুরোনো মন্দির আছে মোড়ের মাথায়। মন্দিরে পুজোআর্চা আর হয় না এখন, এই পোড়োবাড়িটার মতোই অবস্থা। জায়গাটা বেশ নির্জন, রাত্তিরে তো কথাই নেই।’

‘জায়গা তুমি বেছে বার কর গুরু’, রাঘব না বলে পারে না, ‘এই পোড়োবাড়িটাও তোমার চোখেই পড়েছিল।’

হাসল উদয়, আত্মতৃপ্তির হাসি।

‘কাল রাত বারোটার সময় রমেশবাবু একটা চামড়ার ব্যাগে টাকাটা পুরে ওই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আজই ফোনে ভদ্রলোককে পাকা খবরটা দেব, সেইসঙ্গে কেমন করে এবং কোন পথে ওখানে যেতে হবে তারও নিশানা।’

‘জায়গাটা যা শুনলুম, বেশ দূর’, রিভলবারটা লোফালুফি করতে করতে বিক্রম বলল, ‘উনি হেঁটে ওখানে যাবেন, না গাড়িতে?’

‘নিজের গাড়িতে গেলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, বরং সেটাই ভালো। অতগুলো টাকা তো, আমাদের মতো ছিনতাই পার্টি পথেঘাটে হামেশাই ঘোরাফেরা করছে, তার ওপর অত রাত।’ নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল উদয়। রাঘবও যোগ দিল সেই হাসিতে।

‘কিন্তু ভদ্রলোকের সঙ্গে গাড়িতে যদি আরও লোক থাকে?’ বিক্রম আবার প্রশ্ন করে।

‘সে বিষয়ে সাবধান করে দেব। আমাদের শেষ খবর ওরা কেউ ব্যাপারটা পুলিশে জানাননি, শেষ মুহূর্তে জানাবেন বলে আমি মনে করি না। বিশেষ করে রমেশবাবু তো নয়ই, মেয়েকে ফিরে পাবার জন্য তিনি সর্বস্ব খোয়াতে রাজি আছেন, এক লাখ টাকা কোন ছার! তপেনবাবুও যাতে ব্যাগড়া না দেন সে দিকটা নিশ্চয়ই তিনি দেখবেন। যাহোক, ফোনে আমি আবার সাবধান করে দেব, চালাকি করতে গেলেই ছেলে-মেয়েদের মরা মুখ ওঁদের দেখতে হবে। আশা করি ওঁরা দু-জনেই কোনোরকম ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন না। এ তো আর গয়নাগাঁটি চুরি নয়।’ উদয় এমনভাবে হাসল যেন মস্ত দার্শনিকের মতো কথা বলেছে।

‘আমরাও কি গাড়িতে যাব?’ বিক্রম আবার প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ, সে কথায় আসছি। বিক্রম, তুই কালাচাঁদের গ্যারেজ থেকে কালো গাড়িটা আবার চেয়ে নিবি। আমরা ঠিক রাত দশটায় এখান থেকে রওনা দেব। একটু আগে যাওয়াই ভালো, কারণ চারদিক দেখেশুনে নিতে হবে তো। তা ছাড়া আগে গেলে লক্ষ রাখতে পারব, রমেশবাবু পুলিশ সঙ্গে আনেন কিনা।’

‘এখানে কে থাকবে?’ এবার জিজ্ঞেস করল রাঘব।

‘গাড়িতে আমি আর তুই যাব’, উদয় বলতে থাকে, ‘রতন আর বিক্রম এখানে পাহারায় থাকবে। যদি রাত একটার মধ্যে আমরা না ফিরি, তবে বুঝবি সব ভেস্তে গেছে’, বিক্রমের দিকে তাকিয়ে বলে উদয়। ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে তোরা তখন চলে যাবি আমাদের দুই নম্বর ডেরায়। আমাদের কাছ থেকে কোনো খবর না পাওয়া পর্যন্ত ওদের ছাড়বি না।’

‘আর কাজ হাসিল হলে পর?’ রাঘব জানতে চায়।

‘ভাগবাঁটোয়ারা’, ছোটো ছেলে-মেয়েরা অবুঝের মতো প্রশ্ন করলে বয়স্করা যেমন দৃষ্টিতে তাকায়, ঠিক তেমনভাবে ভ্রূকুটি করল উদয়।

‘ছেলে-মেয়ে দুটোর সম্বন্ধে কী ঠিক করলে?’ এতক্ষণে রতন মুখ খোলে।

উদয় তাকাল রতনের দিকে, সাপের মতো শীতল সে দৃষ্টি।

‘ওদের সম্বন্ধে কী ঠিক করেছি তা নিয়ে বার বার আলোচনা করতে আমার ভালো লাগে না, রতনবাবু।’ বরফের মতো ঠান্ডা ওর গলা।

রতন মনে মনে শিউরে উঠল। ওদের সঙ্গে ওর আলাপ বছর দুই, সে আলাপ আজ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হলেও মাত্র বছরখানেক হল ও হাত মিলিয়েছে ওদের সঙ্গে, তাই ওদের মতো হৃদয়ের সব আবেগ জলাঞ্জলি দিতে পারেনি এখনও। সূক্ষ্ম বিবেকের দংশন খচ খচ করে বেঁধে বুকে।

‘ওদের মেরে ফেলতে চাও, ওরা আমাদের দেখে ফেলেছে বলে! তা যদি হয় তবে টাকা নেবার পর রমেশবাবুকেও তো মেরে ফেলা উচিত, তিনি নিশ্চয়ই চোখ বন্ধ করে তোমাদের হাতে টাকা তুলে দেবেন না’, জোর করে ও বলে।

এবার একটু হাসল উদয়।

‘প্রশ্নটা মন্দ করোনি। যে জায়গাটা ঠিক করেছি সেখানে রাস্তায় আলো নেই, চারপাশে বড়ো বড়ো গাছ, রাত বারোটার সময় ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকবে। সবদিক দেখেশুনে ও জায়গাটা মনে ধরেছে আমার। রমেশবাবু আমাদের ছায়াই দেখতে পাবেন, কায়া নয়। তা যদি না হত তবে ভদ্রলোককেও স্বগ্যে পাঠাবার ব্যবস্থা করতুম’, হেসে উঠল উদয়। ‘আশা করি তোমার প্রশ্নের জবাব পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটোকে কীভাবে মারবে তা নিশ্চয়ই আমি জানতে পারি।’

‘তা জানাতে আপত্তি নেই আমাদের। ভয় নেই তোমার, বেশি কষ্ট দিয়ে মারব না। স্রেফ যেমনটি এখন আছে, তেমন তালাবন্ধ ঘরে ওদের আটকে রেখে আমরা চলে যাব এখান থেকে। কেউ ওদের উদ্ধার করতে আসবে এমন আশা না করাই ভালো। সুতরাং’, রতনের চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলল উদয়, ‘অনাহারে মৃত্যু, এমন তো আকছারই হচ্ছে আমাদের দেশে।’

বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে রতনের। কেন জানি না চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটো বোনটির মুখ। খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে ও যখন নির্জীবের মতো ঘুমিয়ে পড়ত তখন রতনের নিজেরও কী কান্নাটাই না পেত।

উদয় তাকিয়েছিল ওর দিকে, বোধ হয় লক্ষ করছিল ওর মুখের ভাবান্তর। ব্যঙ্গ কণ্ঠে ও বলে উঠল, ‘কি, পছন্দ হল না আমার প্রস্তাব! বল তো একটু কড়া দাওয়াই দিই তবে।’

রতন উঠে পড়ল, ভালো লাগছে না ওর।

চোখে চোখে ইশারা খেলে গেল বাকি তিন জনের।

১৬

ঝড় উঠেছে রতনের মনে। উদয়রা যে তাকে আর বিশ্বাস করছে না সেটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ওদের আচার-ব্যবহারে। একা রতনের জিম্মায় ছেলে-মেয়ে দুটোকে রেখে একসঙ্গে ওরা বাড়ি থেকে কখনো বেরোয় না, কেউ না কেউ থাকে বাড়ির পাহারায়। তা ছাড়া আরও একটা খটকা লেগেছে রতনের। ছেলে-মেয়ে দুটোর দেখাশোনা, খাওয়া-দাওয়া, সব কিছুর ভার গোড়া থেকেই তার ওপর। হালে ওদের ঘরে ও ঢুকলেই সঙ্গেসঙ্গে না হোক, একটু বাদেই অন্য কেউ কোনো-না-কোনো ছুতোয় ঘরে এসে ঢোকে। ওদের সঙ্গে একা কথা বলার সুযোগ আর সে পায় না বড়ো একটা। ব্যাপারটা যে কাকতালীয় নয় তা বুঝতে কষ্ট হয় না রতনের। কাল যখন টাকা আদায়ের জন্য উদয় আর রাঘব যাবে তখন বিক্রম থাকবে এ বাড়ির পাহারায়। কাকে পাহারা? রতন একাই তো ও কাজটা পারত!

একটা ক্রুদ্ধ আবেগ সজোরে নাড়া দেয় ওকে। কাকলি যে তার বাবার কাছে ওর চেহারার কথা বলেছে সেটা উড়িয়েই দিল উদয়, অথচ ওদের চেহারার বর্ণনা যাতে ভবিষ্যতে না দিতে পারে, তাই ব্যবস্থা হচ্ছে ছেলে-মেয়ে দুটোকে একটা ঘরে বন্ধ করে, খেতে না দিয়ে, তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার। এই খেতে পারার ব্যবস্থা করতে না পেরেই তো তারা আজ সোজা পথ থেকে দূরে সরে এসেছে! বাচ্চা দুটোকে অমনভাবে না খাইয়ে মারা রতন মেনে নিতে পারে না কিছুতেই।

আরও একটা সম্ভাবনা উঁকি মারে রতনের মনে। কাকলি তার চেহারার যে বর্ণনা দিয়েছে সেই সূত্র ধরে কোনোদিন যদি পুলিশ তাকে ধরে, তবে ওদের মৃত্যু ঘটানোর জন্য পুরোপুরি দায়ী করা হবে তাকেই, উদয়দের তিন জনকে নয়। যা কিছু প্রমাণ তার বিরুদ্ধেই, ওদের বিরুদ্ধে তার মুখের কথা ছাড়া কোনো প্রমাণ নেই, কেউ বিশ্বাসও করবে না ওর কথা। সুতরাং অপরাধবোধের বোঝাটা পুরোপুরি ওর ঘাড়েই চাপবে, আর তার ফল ভোগ করতে হবে ওকে একাই। হয়তো ফাঁসিই হবে তার। ঠোঁট কামড়ায় রতন। অবস্থাটা তার ভালো লাগে না। উদয়দের ও চিনেছে হাড়ে হাড়ে। সমাজ তাকে ভালোভাবে বাঁচবার সুযোগ দেয়নি, তাই বাধ্য হয়ে বাবা আর ভাই-বোনদের মুখ চেয়ে অপরাধের জীবন সে বেছে নিয়েছে, কিন্তু তা বলে ওদের মতো হৃদয়হীন কখনো সে হতে পারবে না। ওদের যা মতিগতি, হয়তো শেষপর্যন্ত টাকার ভাগের সময় ওকে বুড়ো আঙুল দেখাবে ওরা। এতদিন অবশ্য এ নিয়ে কোনো গোলমাল হয়নি, কিন্তু এই প্রথম এত বড়ো একটা কাজে ওরা হাত দিয়েছে। মতলবটা অবশ্য এসেছিল উদয়েরই মাথায়, সব কিছু পরিকল্পনা ওরই, কিন্তু ওকে আর বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে না। শেয়ালের মতোই ধূর্ত উদয়, আর রাঘব-বিক্রম তো ওর কথা বেদবাক্য বলে মানে।

একটা সংকল্প একটু একটু করে দানা বাঁধতে থাকে রতনের মনে। যেমন করে হোক এ অবস্থা থেকে বেরোতে হবে তাকে, সেই সঙ্গে বাঁচাতে হবে ছেলে-মেয়ে দুটোকে। তার পরিণাম হয়তো ভবিষ্যতে ভীষণ হয়ে দেখা দেবে তার জীবনে, উদয়রা চরম প্রতিশোধ নেবে, কিন্তু তবু এ ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে। যে উভয় সংকটে সে পড়েছে তার মধ্যে শেষেরটা অন্তত মন্দের ভালো— খুনের কলঙ্ক স্পর্শ করবে না তাকে, ফাঁসির দড়িটাও ঝুলবে না মাথার ওপর। অপরাধ করে জেল খাটা এক আর বাচ্চা দুটো ছেলে-মেয়েকে খুনের অপরাধে ফাঁসি যাওয়া অন্য।

কাকলি বাচ্চুর জন্য কেমন যেন মায়াই হয় রতনের। সমাজ তাকে প্রতারণা করেছে বলে আজ সে এত নীচুতে নেমে এসেছে, কিন্তু ওদের কী দোষ! ওরা তো তার কোনো ক্ষতি করেনি। আজ যদি তার ছোটো বোনটাকে কেউ আটকে রাখত, মেরে ফেলার পরিকল্পনা করত, তবে তার মনের অবস্থা কী হত? ছোটো বোনটার কথায় মনে পড়ে, একটা শাড়ি চেয়েছিল ও, শখ হয়েছে পরার। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে পড়ে রতন। সুপ্ত বিবেক ওর জেগে উঠছে আস্তে আস্তে।

ঘরের দরজায় টোকা পড়তেই চমকে ওঠে কাকলি আর বাচ্চু। টোকা দিচ্ছে কে! তারপরই বন্ধ দরজার তলায় যে সামান্য ফাঁক, তা দিয়ে বাইরে থেকে কেউ যেন একটা পাতলা কাগজ ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। ওরা তো হতভম্ব। কাকলিই ছুটে কুড়িয়ে নিল কাগজটা। কেউ তাড়াতাড়ি পেন্সিল দিয়ে লিখেছে

সাহস হারিয়ো না, পালাতে হবে। সাহায্য করব তোমাদের। পরে বিস্তারিত জানতে পারবে।

 বন্ধু।

পু — কাগজটা ছিঁড়ে ফেল।

কাকলি তাকায় বাচ্চুর মুখের দিকে, বাচ্চু কাকলির। একটা অবাক বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে ওদের মুখে।

‘কে লিখেছে এটা, বুঝতে পারছিস, বাচ্চু?’ কাকলি চাপা উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করে।

‘কে?’ বাচ্চু ফিসফিস করে বলে। উত্তেজনার ছোঁয়া স্পর্শ করেছে ওকেও।

বাচ্চুর কানের কাছে মুখ নিয়ে কানে কানে একটা নাম বলে কাকলি। দু-চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাচ্চুর।

‘ঠিক বলেছিস’, ও বলে, ‘আর কেউ হতে পারে না।’

কাগজটা টুকরো টুকরো করে জানলা দিয়ে ছুড়ে দেয় ওরা। বাতাসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ওগুলো।

১৭

পরদিন সকালেই রমেশবাবুর বাড়ির ফোনটা আবার বেজে উঠল। প্রায় ছুটে গিয়েই ফোনটা ধরলেন তিনি।

‘টাকা ঠিক করে রেখেছেন?’ ও পাশ থেকে প্রশ্ন করল উদয়।

‘হ্যাঁ’, কোনোমতে জবাব দিলেন রমেশবাবু।

‘তপেনবাবুর টাকা?’

‘হ্যাঁ, উনিও টাকা এনে রেখেছেন বাড়িতে।’

‘ভালো। আজ রাত বারোটায় টাকা দিতে হবে।’

‘কোথায়?’

উদয় সংক্ষেপে পথের নিশানা দিয়ে বলে, ‘আপনার গাড়িতেই একা আপনাকে আসতে হবে, সঙ্গে যেন কেউ না থাকে। বুঝেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমরা ওখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করব। গাড়ির ভেতরের আলো জ্বালিয়ে রেখে ব্যাগটা হাতে করে নেমে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।’

‘কিন্তু আপনারাই যে সেই লোক তা আমি বুঝব কেমন করে?’ রমেশবাবু জানতে চান।

‘সেটাও আমরা বুঝিয়ে দেব’, চাপা হাসি ভেসে আসে রমেশবাবুর কানে। একটা অজানা আতঙ্কে শিউরে ওঠেন তিনি!

‘টাকা পেলেই ওদের ছেড়ে দেবেন তো!’ কাকুতি ঝরে পড়ে রমেশবাবুর গলা থেকে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। ভালো কথা, চালাকি করার চেষ্টা করবেন না, তবে কিন্তু মেয়ের মরা মুখ দেখতে হবে আপনাকে।’

বুকের ভেতর বরফ-গলা জলের শিহরন অনুভব করেন রমেশবাবু। ‘কেন বার বার ও কথা বলছেন?’ অস্ফুট কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বলেইছি তো, আমরা থানা-পুলিশ করিনি।’

‘হ্যাঁ, মনে রাখবেন কথাটা, তপেনবাবুকেও সাবধান করে দেবেন। ভদ্রলোকের বড্ড টাকার মায়া, শেষপর্যন্ত যেন বিগড়ে না যায়।’

‘না, না’, বেশ জোর দিয়েই বলেন রমেশবাবু, ‘ওর সঙ্গে এ বিষয়ে আমার কথা হয়েছে।’

‘ভালো। তবু সাবধানের মার নেই। আমরা লক্ষ রাখব আপনাদের ওপর। আপনি রওনা হবার পর থেকে আপনাকে অনুসরণ করা হবে। যে জায়গায় টাকা দেবেন তার আশেপাশে সারাদিন ধরে আমাদের লোক পাহারায় থাকবে। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই ওরা আমাদের খবর দেবে। তেমন কিছু ঘটলে আমরা ফাঁদে তো পা দেবই না, উলটে ছেলে-মেয়ে দুটোকে কেটে আপনাদের দোরগোড়ায় ফেলে আসব।’

ফোন ছেড়ে দিল উদয়।

সকাল থেকেই একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে ওদের। উদয় যখন টেলিফোন করছে, বিক্রম তখন গেছে গাড়ির ব্যবস্থা করতে। রাঘব গুছিয়ে ফেলেছে বাড়ির সব কিছু। কাজ ফতে হলেই ওরা ছেড়ে যাবে এ বাড়ি, একটা খড়কুটোও ফেলে যাবে না সূত্র হিসেবে। রতনকে ওরা যেন উপেক্ষাই করছে।

ফোন করে ফিরে এল উদয়। এখুনি আবার বেরুবে, ঘুরে আসবে ষষ্ঠীতলা থেকে। বিক্রমকে বলা আছে গাড়ির ব্যবস্থা করেই রমেশবাবুদের পাড়াটা টহল দিয়ে আসবে এক বার। ভাবগতিক বুঝতে চেষ্টা করবে দু-বাড়ির লোকজনদের। ছদ্মবেশে যাবে বিক্রম, যাতে পাড়ার লোকজনের সন্দেহ না হয়।

বেরুবার আগে উদয় রতনকে ঠাট্টা করে বলল, ‘ছেলে-মেয়ে দুটোকে শেষবারের মতো ভালো করে খাইয়ে দাও রতনবাবু, ওদের ওপর তোমার তো খুব মায়া!’

রতন ওর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তোমরা ভুল বুঝেছ আমাকে। আমার মনে হয়েছিল ওদের ছেড়ে দিলেও চলত, আমরা টাকার ভাগ নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতুম অন্য কোথাও। যে টাকা এক জনের ভাগে পড়বে তা দিয়ে অনায়াসে আমরা কিছু একটা করতে পারতুম। কিন্তু তোমাদের যখন তা ইচ্ছে নয় তখন আমি আর বাদ সাধতে যাব কেন? আমিও তোমাদের দলে।’

ভুরু কোঁচকাল উদয়। রতনের কথাগুলো ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারপরই নিজেকে সামলে বলল, ‘এই তো চাই, পথে এসো স্যাঙাত। দয়া-মায়া আমাদের জন্য নয়, বুঝলে?’

ব্যস্তভাবে ও বেরিয়ে গেল। যাবার সময় রাঘবের কানে কানে কী যেন বলে গেল ফিসফিস করে। রাঘব তাকাল রতনের মুখের দিকে। আগের মতো সন্দিগ্ধ ভাবটা যেন আর নেই। যাক ওষুধে কাজ করেছে, মনে মনে হাঁপ ছাড়ল রতন।

একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ওর মনে এনে দিয়েছে দুর্জয় সাহস।

১৮

দুপুরে যথারীতি ওদের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল রতন। রাঘব অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল, হয়তো আগের মতো সন্দেহ করছে না।

রতনের মুখের দিকে তাকাল কাকলি আর বাচ্চু, কিন্তু সেখানে সহানুভূতির কোনো চিহ্নই চোখে পড়ল না ওদের। রীতিমতো হতাশ হল ওরা। একটা উত্তেজনায় ভরে আছে ওদের মন, মুক্তি পাবে এই আশায় বুক বেঁধেছে।

ওদের খেতে বসিয়ে দরজা দিয়ে বাইরেটা উঁকি মেরে দেখল রতন, তারপর এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘কাগজটা ছিঁড়ে ফেলেছ তো?’

সঙ্গেসঙ্গে দপ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওদের দু-জনের মুখ। ওদের অনুমান তবে মিথ্যে নয়। কাকলিই ঘাড় কাত করে জবাব দিল।

‘মন দিয়ে শোনো’, উত্তেজনায় রতনের গলা কেঁপে যায়, ‘আজ রাত বারোটার সময় টাকা দেবার কথা। ঠিক দশটার সময় ওদের দু-জন গাড়ি করে বেরিয়ে যাবে টাকা আনতে। এখানে থাকব আমি আর আর এক জন। জানলার একেবারে বাঁ-ধারের লোহার শিকটা নড়বড়ে, ক্ষয়ে এসেছে তলাটা। একটু চেষ্টা করলেই ওটা খুলে আসবে। ওরা দু-জন বেরিয়ে যাবার সঙ্গেসঙ্গে শিকটা খুলে ফেলবে তোমরা। তারপর তোমাদের বিছানার চাদর দুটো পাকিয়ে গিঁট মেরে পাশের শক্ত শিকের সঙ্গে বাঁধবে। জানলা দিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে দেবে পাকানো চাদরের অন্য দিকটা।’

রতন চুপ করে, তারপর আবার দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে।

‘চাদর বেয়ে নেমে পড়বে তোমরা, দুটো চাদর একসঙ্গে প্রায় মাটির কাছাকাছি পৌঁছুবে। ডান দিক ধরে তোমরা এগিয়ে যাবে, কাঁটা ঝোপঝাড় আছে, সাবধান। এবার সোজা পশ্চিম দিকে যাবে। সিকি মাইল গেলেই দেখবে একটা পাকা বাড়ি। ওটা একজন রিটায়ার্ড মেজরের বাড়ি। ভদ্রলোকের বাড়িতে ফোন আছে। ওখানে গিয়ে তোমাদের বিপদের কথা বলে তোমার বাবার কাছে তুমি ফোন করবে কাকলি। তোমার বাবারই টাকা নিয়ে যাবার কথা। এগারোটার মধ্যে গিয়ে পৌঁছোলে তোমার বাবাকে বাড়িতে পাবে বলে আমার মনে হয়। ওঁকে বলবে তোমরা নিরাপদে আছ, উনি যেন পুলিশ নিয়ে টাকা দেবার জায়গায় যান। যে দু-জন যাবে তারা ধরা পড়বে।’

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে রতন।

‘আর আপনার কী হবে?’ রুদ্ধ নিশ্বাসে জানতে চায় কাকলি।

‘পৌনে এগারোটার সময় আরেকজন যে এখানে থাকবে তাকে আমি বলব, ‘চল ওদের একবার দেখে আসি।’ ঘর খুলে আমরা দেখব তোমরা পালিয়েছ। তখন আমাদের পালানো ছাড়া উপায় থাকবে না, আর আমাকেও ওরা সন্দেহ করবে না। ভাববে তোমরা নিজেদের চেষ্টাতেই পালিয়েছ, আমার কোনো দোষ নেই। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।’ উত্তেজনার মধ্যেও একটু হাসবার চেষ্টা করে রতন।

‘কিন্তু আপনিই আমাদের ধরে এনেছিলেন, এখন পালাতে সাহায্য করছেন কেন?’ কাকলির গলায় একটু যেন সন্দেহের সুর।

‘সে অনেক কথা, এখন খুলে বলার সময় নেই’, একটু অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল রতন। ‘যা বললুম ঠিক সেভাবে কাজ করবে। এখান থকে বেরিয়ে যত তাড়াতাড়ি পার মেজরের বাড়ি পৌঁছুতে চেষ্টা করবে। দেরি হলে তোমার বাবাকে ধরতে পারবে না। মেজরের বাড়িটার হদিশ ওঁকেই জিজ্ঞেস করে বাবাকে বলবে। তিনি ওদের দু-জন ধরা পড়ার পরই যেন তোমাদের নিতে আসতে পারেন।’

পরমুহূর্তে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় ওদের সাবধান করে একটু জোরেই রতন বলে উঠল, ‘নাও, নাও, খোকা-খুকুরা, শেষবারের মতো আমাদের খাবার খেয়ে নাও। পরে বলতে পারবে না যে আমরা তোমাদের যত্ন করিনি।’

রাঘব এসে ঘরে ঢুকল। ওরা তখন গোগ্রাসে গিলছে।

‘আজই তো ওদের শেষ খাওয়া তাই ভালো করে খাইয়ে দিলুম, উদয় বলেছিল’, রাঘবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে রতন।

ঘরের সবার মুখের ওপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি বুলোয় রাঘব, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ে না।

‘তোমার সুবুদ্ধি হয়েছে এটা ভালো লক্ষণ’, রতনকে লক্ষ করে ও বলে। ‘ওদের তাড়াতাড়ি খাইয়ে এসো, আমার সঙ্গে হাত লাগাতে হবে।’

ও আবার বেরিয়ে যায়।

‘ভালো কথা’, রতন ফিসফিস করে বলে, ‘ওদের এক জনের কাছে একটা রিভলবার থাকবে। বাবাকে সে কথাটা বলতে ভুলো না। পুলিশ যেন তৈরি হয়েই যায়।’

কাকলি ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে চঞ্চল হয়ে ওঠে ওরা।

১৯

পোড়োবাড়ি। রাত পৌনে দশটা। কাকলিদের পাশের ঘরে ওরা চার জন তাস খেলছিল। রতনের আশ্চর্য লাগে। এত বড়ো একটা দুঃসাহসিক কাজ ওরা করতে যাচ্ছে, কিন্তু ওদের তিন জন যেন নির্বিকার। ও নিজে উত্তেজনা চাপতে পারছিল না শত চেষ্টা করেও, তাই বারবার খেলায় গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ হাতের তাস ছুড়ে ফেলে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে উদয় তাকাল রতনের দিকে!

‘কী ব্যাপার, রতনবাবু’, চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে ও বলল, ‘এত চঞ্চল কেন তুমি?’

রতনের বুকে যেন হাপর পড়তে থাকে। ওর মতলব ধরে ফেলল নাকি উদয়! যা ধূর্ত ও, ওর চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। একটু কষ্ট করেই মুখে হাসি টেনে রতন জবাব দিল, ‘তোমাদের মতো অতটা পোক্ত হয়ে উঠতে পারিনি তো এখনও, এত বড়ো একটা দাঁও, একটু ভয় ভয় করছে।’

সশব্দে হেসে উঠল বিক্রম আর রাঘব।

‘তাও তো আসল বিপদের জায়গায় তোমাকে যেতে হচ্ছে না’, বিদ্রূপ করে বলল রাঘব। ‘তাই যদি হত তবে তুমি হয়তো গুবলেট করে দিতে আমাদের প্ল্যান।’

‘তোমরাই কি প্রথম প্রথম এতটা সাহসী ছিলে?’ একটু যেন আহত কণ্ঠে বলল রতন। ‘তোমরা এ লাইনে অনেকদিন ধরে আছ তাই এসব ব্যাপার ডাল-ভাত হয়ে গেছে তোমাদের কাছে। আমারও হবে একদিন।’

‘কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলেনি’, উদয় সহজ গলায় বলল এবার। ‘আশা করি পোক্ত হয়ে উঠতে দেরি হবে না তোমার।’

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও রাঘবকে বলল, ‘চল, সময় হয়েছে!’

উঠে পড়ল ওরা দু-জন। চোঙা প্যান্টের ওপর আঁটো জামা চাপিয়েছে। পায়ে দিয়েছে সু আর মাথায় ফেলটের টুপি ভুরু পর্যন্ত নামানো। রতন মনে মনে ওদের সাবধানতাকে তারিফ না করে পারে না। অন্ধকারে মুখ দেখা যাবে না শুধু এই ভরসাতেই নেই ওরা। রিভলবারটা উদয় প্যান্টের পকেটে পুরল, তারপর যেন বেড়াতে যাচ্ছে এমনভাবে বেরিয়ে গেল গট গট করে।

ওরা যে দুঃসাহসী তার পরিচয় আগেই পেয়েছে রতন, কিন্তু এই প্রথম এত বড়ো একটা কাজে হাত দিয়েছে ওরা। ওদের হাবভাবে মনে হয় না এতটুকু বিচলিত হয়েছে। ভয়-লেশ, দয়ামায়াহীন পাথরের মানুষ।

গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ হল।

জানলার কাছে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা দু-জন। গাড়িটা দৃষ্টির আড়াল হতেই শিকটা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। কিন্তু যতটা সহজ ভেবেছিল তা নয়। নড়ছে শিকটা, কিন্তু খুলছে না। হতাশায় চোখে জল এসে যায় কাকলির, আর বাচ্চুও প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়।

আবার ওরা টানাটানি শুরু করে। একটু যেন আলগা হয়েছে মনে হয়। নতুন উৎসাহে ওরা প্রাণপণে নাড়াতে থাকে ওটাকে। মরচে পড়া শিকের তলাকার ক্ষয়ে আসা সরু অংশটা হঠাৎ ভেঙে যায়। ওদের যেন আর তর সয় না। আলগা শিকটাকে বার করাও সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু ওদের অদম্য চেষ্টায় হার মানে ওটা। পরিশ্রমে, উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে ওরা।

চাদর দুটোকে পাকিয়ে দু-প্রান্তে গিঁট দিতেই অনেকটা লম্বা হয়ে গেল। পাশের দুটো শিকের সঙ্গে জড়িয়ে একটা খুট শক্ত করে বাঁধল ওরা। শিকগুলোর কোনোটার অবস্থাই ভালো নয়। যদি দুর্ঘটনা ঘটে তাই একটা শিকের বদলে দুটো শিকের সঙ্গেই পেঁচিয়ে নিল একটা খুট। এবার চাদরের অন্য প্রান্তটা ওরা বাইরের দিকে ঝুলিয়ে দিল। প্রচণ্ড একটা উত্তেজনা অনুভব করে ওরা, ভীষণ দাপাদাপি শুরু হয়ে যায় বুকের ভেতর।

বাচ্চুই প্রথম বেরুল জানলা গলে। তারপর পাকানো চাদরটা দু-হাতে ধরে ঝুলিয়ে দিল শরীরটাকে। আস্তে আস্তে ও নামতে লাগল নীচে, ডান আর বাঁ-হাত পালা করে বদল করতে লাগল নামার সঙ্গে সঙ্গে।

শিকের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে থাকে কাকলি। আসন্ন মুক্তির আনন্দে ওর মন নেচে ওঠে।

বাচ্চু মাটি স্পর্শ করা মাত্র কাকলি জানলা গলে চাদর বেয়ে নামতে শুরু করল। অসম্ভব উত্তেজনায় ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে, হাত ঠিক রাখতে পারছে না। একটা আতঙ্কে পেয়ে বসে ওকে। ডাকাবুকো মেয়েটা হঠাৎ যেন হারিয়ে ফেলেছে সাহস।

অনেকটা নেমেছে, আর একটু হলেই মাটি। নীচ থেকে বাচ্চু ওকে তাড়াতাড়ি করতে বলছে। তারপরই হঠাৎ হাত ফসকে গেল কাকলির, আর সঙ্গেসঙ্গে ঘন ঘাসের ওপর ও আছড়ে পড়ল। ডান-পা-টা মচকে গেল কাকলির আর স্থান-কাল ভুলে ব্যথায় ককিয়ে উঠল ও। রাতের নিস্তব্ধতা যেন খান খান করে দিল ওর যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ।

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাচ্চু।

২০

শব্দটা দোতলার ঘরেও পৌঁছুল। একটা হিম শিহরন অনুভব করল রতন। কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এখুনি ভীষণ একটা কাণ্ড ঘটবে। কি করবে ভেবে পেল না ও।

শব্দটা কানে যেতেই বিক্রমের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে পালটে গেল। শান দেয়া বর্শার ফলার মতো ঝকঝক করে উঠল ওর দু-চোখের দৃষ্টি, মুখের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠল ইস্পাত-কঠিন রেখা।

এক লাফ মেরে উঠে পড়ল বিক্রম, তারপর লন্ঠনটা হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ঘোরটা কেটে যেতেই রতন ওর পিছু নিল। কাকলিদের ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকল বিক্রম। চারপাশে তাকাতেই জানলার দিকে চোখ পড়ল ওর। লোহার শিকের সঙ্গে বাঁধা চাদরের খুটটা দেখেই সমস্ত ব্যাপারটা ও বুঝে নিল এক লহমায়। বিদ্যুৎবেগে পেছন ফিরে ভাঙা, জীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নামতে লাগল ও। শিকারি নেকড়ের মতো ওর ছুটে চলার ভঙ্গি। রতন পড়ি-মরি ওর পিছু নিল।

ওরা দু-জনে পৌঁছে গেল জানলার ঠিক নীচে। কাকলি মাটিতে বসে ডান পায়ে হাত বুলোচ্ছে আর অল্প অল্প কাতরাচ্ছে। প্রথম ধাক্কাটা সামলে ও বুঝতে পেরেছে অবস্থাটা। ওর জন্যই ভেস্তে গেল সমস্ত পরিকল্পনা। চোট যতই না লেগেছিল তার চাইতে ভয়েই চেঁচিয়ে ফেলেছিল ও। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চু, যেন বজ্রাহত।

খপ করে বিক্রম বাচ্চুর একটা হাত চেপে ধরল। ওর বজ্রমুষ্টির চাপে আর্তনাদ করে উঠল কচি ছেলেটা। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রতনকে লক্ষ করে আদেশের কণ্ঠে বিক্রম বলল, ‘মেয়েটাকে তুলে নাও।’

রতন যেন পঙ্গু হয়ে গেছে! শেষ পর্যন্ত পারল না ছেলে-মেয়ে দুটোকে বাঁচাতে! তীরে এসে তরী ডুবল! এখন কী করবে ও!

‘কী হল দেরি করছ কেন?’ ধমকে উঠল বিক্রম। ওর গলার স্বরটা বড্ড কর্কশ ঠেকল রতনের কানে। ওর অন্তর বিদ্রোহী হতে চাইছে, ওকে হুকুম দেবার কে বিক্রম?

বাচ্চুকে এক ঠেলায় মাটিতে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এল বিক্রম। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘বুঝেছি, এ সবই তোমার মতলব। ওদের মাথায় এভাবে পালাবার বুদ্ধি কখনো আসত না। প্রথম থেকেই তোমার ওপর সন্দেহ হয়েছিল আমার।

ক্ষীণ চাঁদের আলোয় ওরা দু-জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

এক দলা থুথু ছিটালো বিক্রম রতনের মুখের ওপর।

সঙ্গেসঙ্গে ঘা খাওয়া পশুর মতো জেগে উঠল রতনের আদিম হিংস্রতা। কলেজে পড়ার সময় ব্যায়াম করে শুধু শরীরটাকেই মজবুত করেনি ও, বক্সিংয়েও খুব সুনাম কুড়িয়েছিল। জামার আস্তিনে মুখটা মুছে বিক্রমের মুখ লক্ষ করে ডান হাতের একটা ঘুসি চালাল রতন। মাথাটা পেছন দিকে একটু হেলে গেল বিক্রমের। এতটা ও আশা করেনি রতনের কাছে, নিজের দৈহিক ক্ষমতার ওপর পূর্ণ আস্থা আছে ওর।

একটা হিংস্র চিৎকার করে বিক্রম এগিয়ে এল, চট করে কখন পকেট থেকে বার করে নিয়েছে একটা ছোরা। কাকলি আর বাচ্চু আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেছে।

বিক্রম এগুচ্ছে এক পা, এক পা করে, আর ছোরা সমেত ডান হাতটা শূন্যে স্থির হয়ে আছে লক্ষ্যভেদের জন্য। রতন পেছুচ্ছে এক পা, এক পা করে, বিক্রমের দু-চোখের ওপর তার সতর্ক দৃষ্টি। সাপের ছোবলের আগে বেদের সতর্কতা।

তারপরই আঘাত হানল বিক্রম। রতন প্রস্তুত হয়েই ছিল। বাঁ-হাত দিয়ে বিক্রমের ছোরা সমেত ডান কবজিটা চেপে ধরার চেষ্টা করল। ধরল বটে কবজি, কিন্তু তার আগে তীক্ষ্ন ফলা চিরে দিল ওর হাতের অনেকটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল কাকলি আর বাচ্চু।

নিজের রক্ত দেখে আগুন জ্বলে উঠল রতনের মাথায়। অনমনীয় হয়ে উঠল ওর মনোবল। বাঁ-হাত দিয়ে ছোরা সমেত বিক্রমের কবিজিটায় ও মোচড় দিল আর সেইসঙ্গে চালাল ডান হাতের এক ঘুসি চোয়াল লক্ষ করে। ভাগ্য ভালো রতনের, ঘুসিটা মোক্ষম জায়গায় আঘাত হানল আর সঙ্গেসঙ্গে পায়ের তলার মাটি দুলে উঠল বিক্রমের। হাত থেকে খসে পড়ল ছুরিটা। পা দিয়ে লাথি মেরে ওটাকে দূরে সরিয়ে দিল রতন, তারপর এগিয়ে বাঁ-হাতের সোজা ঘুসি মারল বিক্রমের মুখ লক্ষ করে। এমনিতেই টলছিল বিক্রম, এবার চিতপাত হয়ে পড়ল মাটিতে। হাঁ করে নিশ্বাস নিতে লাগল।

পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে রতন হাতটা এগিয়ে দিল বাচ্চুর দিকে, বলল, ‘বেশ শক্ত করে বাঁধ।’ বাচ্চু যেন সংবিৎ ফিরে পেল। রুমালটা ক্ষতস্থানে পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধল।

কাকলির অস্ফুট চিৎকারে ফিরে তাকাল রতন। বিক্রম আবার উঠেছে। এগিয়ে আসছে তার দিকে ক্ষিপ্ত পশুর মতো। ওর দু-চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, খুন চেপেছে ওর মাথায়। রতন বুঝল সহজে বিক্রমকে কাবু করা যাবে না, শক্তিতে রতনের চাইতে ও অনেক শ্রেষ্ঠ, শুধু ঘুসোঘুসির সঠিক মারগুলো জানে বলেই আর ঠিকমতো মারতে পেরেছে, তাই প্রথম দফায় ও জিতেছে, কিন্তু এখনও শেষ পর্ব বাকি।

বিক্রম এগিয়ে আসতেই রতন আবার ডান হাতের সোজা ঘুসি চালাল, কিন্তু ফসকে গেল ঘুসিটা, আর সঙ্গেসঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বিক্রম। ওর গরম নিশ্বাস আগুনের মতো পড়ছে রতনের মুখে। ইস্পাতের মতো শক্ত হাত দুটো দিয়ে রতনকে জাপটে ধরল বিক্রম, তারপর এক ঝটকায় মাটি থেকে তুলে আছাড় মারল মাটিতে। অনেকদিনের অবহেলায় বড়ো বড়ো ঘাসের জঙ্গল বলে মাথাটা শক্ত মাটিতে ঠুকে গেল না রতনের। তা না হলে রক্ষে ছিল না আর। কিন্তু তবু রেহাই পেল না রতন।

সাক্ষাৎ যমের মতো তার ওপর লাফিয়ে পড়ল বিক্রম। বুকের ওপর বসে থাবার মতো দু-হাত দিয়ে গলা চেপে ধরল রতনের। বৃথাই চেষ্টা করতে লাগল রতন সেই বজ্রমুষ্টি শিথিল করবার। আস্তে আস্তে ওর দু-চোখে নেমে আসছে অন্ধকার। সব শেষ! তার আশা সফল হল না।

রুদ্ধ দৃষ্টিতে ওদের লড়াই দেখছিল কাকলি আর বাচ্চু। রতনের যে ভীষণ বিপদ সেটা উপলব্ধি করতে এতটুকু সময় লাগল না ওদের। রতনকে যদি মেরেই ফেলে লোকটা তবে তাদের পালাবার পথও নিশ্চয় বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কী করতে পারে ওরা! অমন দুর্ধর্ষ এক গুন্ডার কাছে তারা ফড়িঙের মতো।

হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসল কাকলি। পেছন থেকে বিক্রমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর ওর লম্বা চুলগুলো দু-হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে প্রাণপণে পেছন দিকে টানতে লাগল। অত জোরে চুলে টান পড়তেই আর্তনাদ করে উঠল বিক্রম। আরও যেন উৎসাহ পেয়ে গেল কাকলি। সজোরে আকর্ষণ করতে লাগল ওকে পেছনে। সত্যিই পেছন দিকে হেলে পড়ল বিক্রম, রতনের কণ্ঠনালী থেকে আলগা হয়ে গেল থাবা! সুযোগটুকু পুরোপুরি সদব্যবহার করল রতন। উঠে বসে পেছনে হেলে পড়া বিক্রমের মুখ লক্ষ করে ডান আর বাঁ-হাতের মুষ্টি বৃষ্টি করতে লাগল ও। এই শেষ সুযোগ, আর আসবে না।

লুটিয়ে পড়ল বিক্রম। রতন উঠে দাঁড়ায়। ও টলছে, ভীষণ হাঁপাচ্ছে। কিন্তু দমবার পাত্র নয় বিক্রম। আবার ও উঠে দাঁড়াল। দু-হাত বাড়িয়ে টলতে টলতে এগিয়ে এল আহত, ক্ষিপ্ত শার্দুলের মতো। সাবধান হয়ে গেল রতন। এবার আর ওর নাগালের মধ্যে নিজেকে ধরা দেবে না। বিক্রম কাছে আসতেই চট করে ও ডান পাশে সরে গেল আর সেইসঙ্গে ছুড়ে দিল বাঁ-হাতের এক ঘুসি। দাঁড়িয়ে পড়ল বিক্রম, ভীষণ টলছে। কষ বেয়ে নেমেছে ক্ষীণ রক্তের ধারা। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেল রতন, মারল ডান হাতের একটা ‘হুক’। মোক্ষম মার! কাটাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল বিক্রম, স্থির হয়ে গেল ওর শরীরটা।

রতন বসে পড়ল। একটু বমি করল।

কাকলির মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি এল একটা। বাচ্চুকে নিয়ে ছুটল আবার দোতলায়, লন্ঠনটা নিতে ভুলল না। যে ঘরে ওরা বন্দি ছিল সে ঘরে ঢুকে চাদরের খুঁটটা খুলে ফেলল ওরা জানলার শিক থেকে, ওটা ছুঁড়ে দিল নীচে মাটিতে। রতন বুঝতে পারল। একটা চাদর পাকিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধল বিক্রমকে, তার নড়বার চড়বার ক্ষমতা রইল না।

রতন উঠে দাঁড়াল, তাকাল ওদের মুখের দিকে। ঝলমল করছে ওদের মুখ, একটু আগে যে ভীষণ বিপদ ঘনিয়ে এসেছিল তা কেটে গেছে।

‘আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না’, রতনই বলল, ‘তুমি হাঁটতে পারবে তো কাকলি?’

‘বোধ হয় পারব।’

‘আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে, তুমি বরং আমার কাঁধে ওঠ।’

কাকলি মৃদু আপত্তি করলেও শেষপর্যন্ত রাজি হল। রতন উবু হয়ে বসল, কাকলি ওর দু-কাঁধের পাশ দিয়ে দু-পা গলিয়ে বসল আরাম করে। বাচ্চুকে ওর পিছন পিছন ছুটতে বলে রতন বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটা দিল।

২১

তারপর একসময় রাস্তায় এসে পড়ল ওরা। ওদের কী করতে হবে আর কী বলতে হবে তা আর এক বার বুঝিয়ে বলল রতন। নিজের সম্বন্ধে বলল, ‘মেজরকে বলবে তোমরা চাদর বেয়ে জানলা গলে পালাচ্ছিলে, কাকলি পড়ে ব্যথায় ককিয়ে উঠতেই যে তোমাদের পাহারায় ছিল সে ওখানে আসে। কাকলিকে ও যখন সামলাচ্ছে সেই ফাঁকে বাচ্চু ছুটে পালায়, রাস্তায় আমার সঙ্গে দেখা। আমাকে সব বলতেই আমি বাচ্চুকে সঙ্গে করে ওখানে যাই। গুন্ডাটার সঙ্গে আমার মারামারি হয়, শেষপর্যন্ত ওকে কাবু করে বেঁধে রেখে আমরা এসেছি।’

মেজরের বাড়ির কাছাকাছি এসে ওরা দেখল ওপরের একটা ঘরে আলো জ্বলছে। আনন্দে নেচে উঠল কাকলির মন। রতন ওকে কাঁধ থকে নামিয়ে বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি পার তোমার বাবাকে ফোন কর, বুঝলে? দেরি হলে হয়তো পাওয়া যাবে না ওঁকে।’

কাকলি আর বাচ্চু বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিল। ওদের চেঁচামেচিতে ওপরের ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মারলেন রাশভারী চেহারার এক ভদ্রলোক। ওরা ধরে নিল উনিই মেজর সাহেব।

‘শিগগির নীচে আসুন, আমাদের ভীষণ বিপদ’, চেঁচিয়ে বলল কাকলি।

অত রাতে দুটো ছোটো ছেলে-মেয়েকে অমনভাবে হাঁকডাক করতে দেখে মেজর সাহেব অবাক হলেন। কিন্তু সারাজীবন তিনি আর্মিতে ছিলেন, যেকোনো অবস্থাতেই মাথা ঠান্ডা রেখে কর্তব্য স্থির করতে তিনি অভ্যস্ত। নীচে নেমে এসে দরজা খুলতেই কাকলি এক নিশ্বাসে মুখস্থ পড়ার মতো সব কিছু খুলে বলল তাঁকে। বিপদের মুখে সৈনিকের কর্তব্যবোধ মুহূর্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল মেজর সাহেবের। এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে তিনি ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন, দেখিয়ে দিলেন টেলিফোনটা। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কাকলি দেখল এগারোটা বাজতে বারো মিনিট বাকি।

রমেশবাবুর বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং ক্রিং। বিমলাদেবী ঘরে পাষাণ প্রতিমার মতো বসেছিলেন। একটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল তাঁর! টেলিফোনের রিসিভার যে তুলে ধরবেন সে ক্ষমতাটুকুও পর্যন্ত যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। ওদিকে টেলিফোনটা বেজেই চলেছে অসহিষ্ণুভাবে!

কোনোমতে ওঠালেন। বিমলাদেবী রিসিভারটা কানে তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘হ্যালো।’

‘মামণি…’

‘কে? কে?’ গলা ভীষণ কেঁপে গেল বিমলাদেবীর।

‘আমি কাকলি…’

‘কাকু… কাকলি…’ হাতটা এত কাঁপতে থাকে বিমলাদেবীর যে রিসিভারটা ধরে রাখতে পারেন না, মাটিতে পড়ে যায়।

ওদিকে কাকলি অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে যাচ্ছে, ‘হ্যালো, হ্যালো।’

আবার রিসিভারটা তুলে ধরলেন বিমলাদেবী। ‘কাকু, সত্যি তুই?’ যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি কাকলি বলছি। বাবা কোথায়?’

‘উনি নীচে, এখুনি গাড়ি করে বেরুবেন টাকা নিয়ে।’

‘শিগগির ডাকো বাবাকে, মানা কর যেতে…, শিগগির…’

‘কেন কী হয়েছে? তুই কোথা থেকে কথা বলছিস?’

‘আঃ, সময় নষ্ট কর না, মামণি, এখুনি ডেকে দাও বাবাকে। একদম সময় নেই।’

বিমলাদেবী কিছুই বুঝলেন না, কিন্তু কাকলির গলায় একটা জরুরি সুর অনুভব করে রিসিভারটা টেবিলে নামিয়ে রেখে পড়িমরি করে ছুটলেন তিনি। রমেশবাবু সবে গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছিলেন। বিমলাদেবীর উদভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে থমকালেন তিনি।

‘শিগগির ওপরে এসো, কাকলি ফোন করছে’, ঝড়ের মতো বললেন বিমলাদেবী।

‘কে ফোন করছে?’ নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারেন না রমেশবাবু!

‘কাকু। শিগগির ওপরে এসো, ভীষণ দরকারি কথা আছে, বলছে।’

গাড়ির দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে পড়লেন রমেশবাবু, তারপর যুবকের মতো সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠতে লাগলেন।

‘হ্যালো’, রিসিভারটা কানে তুলে তিনি বললেন, গলা কাঁপছে তাঁর।

‘বাবা, বাপি, আমি কাকলি বলছি।’

‘কোথায় তুই?’

‘বলছি পরে। শোনো বাবা, আমরা পালিয়ে এসেছি। এক জন লোক আমাদের সাহায্য করেছে পালাতে। এখন এক জন মেজর সাহেবের বাড়ি থেকে ফোন করছি। এ জায়গাটা কোথায় উনি তোমাকে বলে দেবেন। তুমি এখুনি পুলিশ নিয়ে চলে যাও। যে দু-জনের টাকা নিতে যাবার কথা আছে, তাদের ধরে ফেল, বুঝেছ?’

‘হ্যাঁ’, কোনোমতে জবাব দিলেন রমেশবাবু।

‘আরেকজনকে আমরা বেঁধে রেখেছি। ওদের দু-জনকে ধরার পর পুলিশ নিয়ে তুমি এখানে চলে এসো। দেরি করো না। এখন মেজর সাহেবের কাছে এ জায়গাটা কোথায় তা জেনে নাও।’

রিসিভারটা কাকলি মেজর সাহেবের হাতে তুলে দিল। তিনি সংক্ষেপে কোন পথ ধরে তাঁর বাড়িতে আসতে হবে তা বলে দিলেন। আর বললেন, ছেলে-মেয়ে দু-জনের জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। তিনি ওদের ভার নিচ্ছেন। তাঁর কাছে রিভলবার আছে, দরকার বোধ করলে গুলি ছুড়বেন। রমেশবাবু তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে লাগলেন, কিন্তু মেজর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ভদ্রতা পরে করবেন, আপনার মেয়ের কথামতো এখুনি পুলিশের কাছে যান।’

মেজর সাহেবের কথায় কাকলির মনে পড়ে গেল বাবাকে সাবধান করে দেয়া হয়নি। রিসিভারটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে ও বলল, ‘বাপি, একটা কথা…’

‘কী, মামণি?’

‘ওদের এক জনের কাছে রিভলবার আছে, খুব সাবধান, বুঝলে?’

২২

মন্দিরের ভেতর থেকে পথের ওপর লক্ষ রাখছিল উদয় আর রাঘব। মস্ত একটা দাঁও মারবে, সে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে ওরা। রমেশবাবু যে কোনো চালাকি করবেন না সেটা ওরা ধরেই নিয়েছিল। ছেলে-মেয়ে দুটো যতক্ষণ ওদের জিম্মায় আছে ততক্ষণ তাদের ভয় নেই। ওদের মুখ চেয়েই পুলিশে যাবেন না ওদের বাবারা।

অধৈর্য হয়ে উঠেছিল রাঘব— বড়ো দেরি করছে ভদ্রলোক টাকা আনতে। প্রায় এক ঘণ্টার ওপর ওরা অপেক্ষা করছে, আর যেন তর সইছে না ওর। সামনেই একটা বড়ো গাছের মাথা থেকে একটা পেঁচা ডেকে উঠল— কী বিচ্ছিরি ডাকটা। পেঁচার ডাক নাকি অশুভ। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে রাঘব। আড়চোখে উদয়ের মুখটা দেখতে চেষ্টা করে, কিন্তু অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ে না।

হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। চঞ্চল হয়ে উঠল ওরা। গাড়িটা আস্তে আস্তে এগুচ্ছে। রিভলবারটা পকেট থেকে বার করে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল উদয়।

গাড়িটা মন্দিরের সামনে এসে থেমে গেল। ভেতরের আলো জ্বালিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে নামলেন রমেশবাবু। তাঁর হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেও তিনি ভাবলেন কাকলিরা তো এখন নিরাপদ আশ্রয়ে, সুতরাং তাঁর নিজের যদি কিছু ঘটে যায় তাতে যায় আসে না। এ চিন্তাটা সাহস ফিরিয়ে আনল তাঁর মনে। তিনি চারপাশে তাকালেন, ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না। মন্দিরটার গা বেয়ে উঠেছে বিরাট এক অশ্বত্থ গাছ; ওটাই সৃষ্টি করেছে জমাট অন্ধকার। এমনকী চাঁদের আলো পর্যন্ত ডালপাতা ভেদ করে ওখানকার মাটি স্পর্শ করতে হিমসিম খাচ্ছে।

হঠাৎ চমকে উঠলেন তিনি। তাঁর দু-পাশে দুটো ছায়া মূর্তি।

‘টাকা এনেছেন?’ বিকৃত কণ্ঠে ওদের এক জন জিজ্ঞেস করল।

নিরুত্তরে চামড়ার ব্যাগটা তিনি তুলে দিলেন ওদের হাতে।

‘পুরো টাকাটাই আছে তো?’ আবার জিজ্ঞেস করল সেই লোকটা।

‘হ্যাঁ।’

‘আমরা ফিরে গিয়ে গুণব, কম হলে বিপদ হবে।’

‘না, কম নেই।’ রমেশবাবুর সাহস ক্রমেই ফিরে আসছে।

‘ঠিক আছে, এবার গাড়িতে গিয়ে উঠুন!’ আদেশ হল।

‘কিন্তু ওদের কখন ছেড়ে দেবেন?’ একটু সময় নিতে চাইছেন রমেশবাবু, পুলিশদের সুবিধের জন্য।

‘টাকা গুণে ঠিক আছে দেখলেই বাড়ি পৌঁছে দেব ওদের, যান’, এবার যেন ধমকে উঠল লোকটা।

রমেশবাবু আর কথা না বাড়িয়ে গুটিগুটি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। আরেকটা গাড়ি এতক্ষণে তাঁর চোখে পড়ল।

কালো রঙের গাড়ি অন্ধকারের সঙ্গে যেন মিশেছিল এতক্ষণ।

রমেশবাবু গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলেন, তারপর খুব আস্তে আস্তে যে পথ ধরে এসেছিলেন সে পথ ধরে চলতে লাগলেন আবার।

ওরা দু-জন গাড়িতে উঠে বসল। উদয় ড্রাইভারের সিটে আর রাঘব তার পাশে। এক লাখ পনেরো হাজার টাকা। রাঘব মনে মনে হিসেব করছিল ওর ভাগে কত পড়বে। হঠাৎ পেছনের সিট থেকে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আঁকড়ে ধরল ওর গলা! এমন আকস্মিক আর অতর্কিতে ব্যাপারটা ঘটল যে কিছুই বুঝতে পারল না ও। আরও এক জোড়া হাত ততক্ষণে কবজা করে ফেলেছে উদয়কে। হঠাৎ টর্চের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ। গাড়িটা ঘিরে দাঁড়িয়েছে পুলিশ, তাদের হাতে উদ্যত রিভলবার। কে যেন ক্ষিপ্র দক্ষতায় ওদের দু-হাতে এঁটে দিল হাতকড়া। একটা হুইসল বেজে উঠল।

২৩

এদিকে মেজরের বাড়িতেও কেউ বসে নেই। মেজরের স্ত্রী ছেলে-মেয়ে দুটোকে খাওয়াচ্ছেন। কাকলির মুখে রতনের পরিচয় পেয়ে তার সাহসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন মেজর সাহেব। ক্ষতস্থানটা গরম জলে ধুয়ে, সিবাজল পাউডার দিয়ে নিজের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। রতন মনে মনে ভাবে, অত রাতে সে ওখান দিয়ে কোথায় যাচ্ছিল এ প্রশ্নটা যে মেজর সাহেবের মনে জাগেনি সেটা ভাগ্যের কথা।

রাত বারোটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। রতন ছটফট করতে থাকে। পুলিশ নিয়ে রমেশবাবু এসে পড়ার আগেই তাকে পালাতে হবে। মেজর সাহেবকে হয়তো ধাপ্পা দিয়ে সে পার পেতে পারে, কিন্তু পুলিশের কাছে তা ধোপে টিকবে না। জেরার মুখে বেরিয়ে পড়বে যে সেও দলের একজন।

কাকলি ওর উশখুশ ভাবটা লক্ষ করছিল। রতন সত্যিই উঠে দাঁড়াল। রাস্তাটা দেখে আসবার অছিলায় বেরিয়ে পড়ল একসময়। কাকলিও প্রায় ওর সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এল। রতন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল, বোধ হয় কি করবে মনস্থির করতে পারছিল না।

কাকলি ওর পাশে দাঁড়াল। রতন একটু হাসবার চেষ্টা করল।

‘একটা কথার জবাব দিন তো’, কাকলি বলল, ‘আপনি আমাদের পালাতে সাহায্য করলেন কেন?’

রতন একটুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, ‘ওরা টাকা পাবার পরও তোমাদের ছেড়ে দেবে না ঠিক করেছিল, আমি তাতে রাজি হইনি, এই নিয়ে ওদের সঙ্গে মন কষাকষি হয়েছিল আমার।’

‘ও!’ কাকলি বলে, ‘কিন্তু এবার কী করবেন আপনি?’

‘কী করব মানে?’ রতন বুঝতে পারেনি ওর প্রশ্নটা।

‘আপনি যেভাবে ফন্দি এঁটেছিলেন সেভাবে আমরা যদি পালাতে পারতুম তবে আপনাকে হয়তো ওরা সন্দেহ করত না, কিন্তু এখন তো জেনেই গেল যে আপনিই ওদের ধরিয়ে দিলেন, ওরা কি আপনাকে ছেড়ে দেবে?’

ম্লান হাসি হাসল রতন, বলল, ‘যা কপালে আছে তাই হবে।’

‘তা হয় না’, বেশ জোর দিয়েই বলল কাকলি, ‘আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন, আমরাও আপনাকে বাঁচাব।’

ওর কথার ধরনে কৌতুক বোধ না করে পারে না রতন। যতই দেখছে মেয়েটাকে ততই যেন অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। যেমন স্পষ্ট কথাবার্তা, তেমন সাহস। বিক্রমের সঙ্গে মারামারির সময় ও যদি বুদ্ধি করে তার চুল ধরে না টানত তবে আর এখন আকাশের নীচে মুক্তির নিশ্বাস নিতে হত না ওদের কাউকে।

‘কী করে বাঁচাবে?’ একটু ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করল রতন।

‘না, ঠাট্টা নয়’, কাকলি দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘আমার বাবার কারখানায় অনেক লোক কাজ করে, বাবাকে বলে আপনার একটা কাজ করে দেব। কারখানার কাছাকাছি একটা বাসাও ঠিক করে দিত বলব বাবাকে, তবে আর আপনার খোঁজ কোনোদিন পাবে না ওরা। পেলেও, কারখানার অন্য লোকেরা আপনার পাশে থাকবে।’

মেয়েটার বুদ্ধিতে তাজ্জব বনে যায় রতন। ইস, আগে যদি এমন একটা সুযোগ আসত তবে উদয়দের দলে ভিড়বার কোনো দরকারই হত না।

‘কী, কিছু বলছেন না যে?’ তাড়া দেয় কাকলি।

‘তোমার বাবা তো জানবেন, আমিই তোমাদের এত কষ্টের মূলে!’ রতন বলল।

‘তা কেন!’ কাকলি অধৈর্য কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘বাবাকে তাই বলব নাকি, খেপেছেন! মেজর সাহেবকে আমরা যা বলেছি তাই বলব। আপনি আমাদের গুন্ডার হাত থেকে বাঁচিয়েছন। বাবা অবিশ্বাস করবেন না, বড্ড ভালোমানুষ আমার বাবা।’ একটু গর্বের সঙ্গেই বলল কাকলি।

‘আচ্ছা ভেবে দেখি’, রতন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল। এত ভালো মেয়েটা, কী সর্বনাশ সে ওর করতে যাচ্ছিল!

এমন সময় মেজর সাহেব বেরিয়ে এলেন, তাঁর হাতে একটা রিভলবার। কাকলি ওই লোকটার সঙ্গে বাইরে একা একা কথা বলছে এটা তাঁর ভালো লাগছিল না। হলই বা লোকটা ওদের উদ্ধার করেছে, কিন্তু ওর পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

মেজর সাহেবকে দেখে রতন ব্যস্ত হয়ে উঠল। আর মিনিট কুড়ির মধ্যেই কাকলির বাবা পুলিশ নিয়ে উপস্থিত হবেন, তার আগেই ওখান থেকে সরে পড়া ভালো।

‘আপনি এদিকটা সামলান, আমি যাচ্ছি ওই পোড়োবাড়িতে যেখানে আরেকজন গুন্ডাকে বেঁধে রেখে এসেছি আমরা। আর দাঁড়াল না রতন, হনহন করে হাঁটা শুরু করে দিল।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন মেজর সাহেব।

রমেশবাবু কাকলিকে একেবারে কোলে তুলে চুমো খেতে লাগলেন, তাঁর দু-চোখে জল। কাকলির ভীষণ লজ্জা হল। বাবা যেন কী! সে কত বড়ো হয়ে গেছে না। এত বড়ো মেয়েকে কেউ কোলে তোলে!

বাচ্চুকেও সস্নেহে কাছে টেনে নিলেন রমেশবাবু।

থানার দারোগা সদলবলে সঙ্গে ছিলেন। উদয় আর রাঘবকে লক-আপে পুরে তাঁরা চলে এসেছেন এখানে। তিনি তাড়া দিতে লাগলেন।

ওঁরা সবাই চললেন পোড়োবাড়িটার দিকে, গাড়িতেই গেলেন। পোড়োবাড়িটার ডান হাতি যে পথটা কাঁচা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে, সেটাকে ঠিক পথ না বলে মাঠ, ঝোপঝাড়ই বলা যায়। তাই গাড়িগুলো কাঁচা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ওঁরা হেঁটেই চললেন। কাকলি এখনও একটু খোঁড়াচ্ছিল বলে রমেশবাবু ওকে কোলে নিতে চাইলেন, কিন্তু ও এবার বেঁকে বসল।

পুলিশ দেখে বিক্রম কিন্তু ঘাবড়াল না, ফাঁদে পড়া বাঘের মতোই গর্জন করে উঠল হিংস্রভাবে। ওকে গ্রেপ্তার করলেন দারোগাবাবু।

সব কাজ শেষ করে ওদের যেতে যেতে রাত দুটো বেজে গেল।

যাবার আগে কাকলি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে লক্ষ করে রমেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে খুঁজছ?’

‘আমাদের যে উদ্ধার করেছে সে বলেছিল এখানে থাকবে, কিন্তু তাকে তো আর দেখছি না?’ ওর গলায় একটা হতাশার সুর।

দারোগাবাবুর কানে কথাটা গেল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘বোধ হয় পুলিশের হাঙ্গামায় পড়তে চায় না বলেই গা ঢাকা দিয়েছে।’

মন খারাপ হয়ে যায় কাকলির। রতনের ওপর যেন কেমন মায়া পড়েছে। যাবার সময় দেখা হল না; ওর প্রস্তাবটা রতন নেবে কিনা তাও জানতে পারল না। কেন জানি না, দু-চোখ ছলছল করে উঠল কাকলির।

একটা বড়ো গাছের আড়াল থেকে রতন ওদের দেখছিল। যাক, ছেলে-মেয়ে দুটোকে শেষপর্যন্ত সে বাঁচাতে পেরেছে! একটু একটু করে একটা স্নিগ্ধ আভা ছড়িয়ে পড়ল ওর সারা মুখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *