৩. জীবনপঞ্জি – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

জীবনপঞ্জি – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

(১৯২০-১৯৭৫)

১৯২০

গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রামের অদূরে বিখ্যাত মধুমতী নদী। এই নদীতে তখন স্টিমার চলতো এবং সেই স্টিমারে করে খুলনা হয়ে কলকাতা যাওয়া যেত। গোপালগঞ্জ তখন ফরিদপুর জেলার একটি মহকুমা শহর। পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ আদালতে সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন। মাতার নাম শেখ সায়েরা খাতুন।

১৯২৭

তিনি স্থানীয় গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

১৯২৯

তাঁকে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।

১৯৩০

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চাচাতো বোন বেগম ফজিলাতুননেছার (রেণু) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৩৪

অসুস্থতার কারণে পড়াশোনার সাময়িক ছেদ ঘটে।

১৯৩৭

‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ সংগঠনের মধ্য দিয়ে মুষ্টিচাল সংগ্রহ এবং দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য করা হতো।

১৯৩৮

তিনি তখন গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের ছাত্র। একবার অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে আসেন। স্কুলের ছাদ থেকে পানি পড়া এবং ছাত্রাবাসের সমস্যা তাঁদের নিকটে তুলে ধরে কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃভূমিকা গ্রহণ। এ নিয়ে স্থানীয় কংগ্রেসীদের সঙ্গে বিরোধ। তাদের ইন্ধনে ও মিথ্যা অভিযোগে জীবনের প্রথম কারাবরণ।

১৯৪০

গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের ছাত্র থাকাকালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি এক বছরের জন্য নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

 গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত।

 ফরিদপুর ছাত্রলীগের সম্মেলনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ প্রমুখকে আমন্ত্রণ। ১৪৪ ধারা সত্ত্বেও হুমায়ুন কবিরের বাড়িতে সফল সম্মেলন সম্পন্ন।

১৯৪২

কলকাতায় ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেক প্রমুখের নেতৃত্বে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনে অংশগ্রহণ।

 গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করার পর কলকাতা যান এবং কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ) আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় বেকার হোস্টেলে থাকাকালীন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন এবং মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন।

 পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে ফরিদপুর থেকে বিরাট কর্মীবাহিনী নিয়ে যোগদান।

১৯৪৩

পঞ্চাশের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) মন্বন্তরে কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক ও কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মীদের সঙ্গে মুসলিম লীগের যুবকর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটিতে যোগদান। দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্যার্থে লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন। গোপালগঞ্জে ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করেন।

 কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দেন এবং সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

 প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন উপলক্ষ্যে দিল্লি গমন এবং সম্মেলনে অংশগ্রহণ। তখন দিল্লির লালকেল্লা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, কুতুব মিনার, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ পরিদর্শন করেন।

১৯৪৪

গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের সম্মেলনে মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, তমিজউদ্দিন খান, খাজা শাহাবুদ্দিন প্রমুখের আগমন। গোপালগঞ্জের স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত৷ সম্মেলন সাফল্যমণ্ডিত হয়।

 কলকাতায় ফরিদপুরবাসীর উদ্যোগে গঠিত ‘ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন।

 কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন।

১৯৪৬

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ সময়ে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের নির্বাচনি প্রচারণায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

 ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগ আহূত প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে সূচিত কলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করেন। কলকাতা ও বিহারে দাঙ্গা-পীড়িত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ।

 শরণার্থী ও মোহাজেরদের সাহায্যার্থে প্রাণান্তকর পরিশ্রম; ময়রা ও মাধাইগঞ্জে ক্যাম্প স্থাপন এবং তাদের সুবন্দোবস্তে ব্যবস্থা গ্রহণ।

 জিন্নাহর আহ্বানে দিল্লিতে ৭, ৮, ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশনে বাংলাদেশের ছাত্রকর্মী হিসেবে ১০-১৫ জনসহ বঙ্গবন্ধুর যোগদান। এ উপলক্ষ্যে আজমীর শরীফ, তাজমহল, আগ্রা দুর্গ, লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি, সেকেন্দ্রা পরিভ্রমণ।

১৯৪৭

ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। পাঠ্যবিষয় ছিল ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

 ৬ই এবং ৭ই জুলাই সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোটে মুসলিম লীগের বিজয়ের পেছনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তখন তিনি পাঁচশত মুসলিম লীগ কর্মীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

 ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। তাতে ব্রিটিশ শাসিত বঙ্গ প্রদেশের পশ্চিম অংশ ভারতের মধ্যে এবং পূর্ব অংশ পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

 ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মীসম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির অন্যতম সদস্য। সম্মেলনে গঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত।

 বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান তথা পূর্ব-পাকিস্তান কালের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের শুরু ১৫০ নম্বর মোগলটুলির ‘পার্টি হাউস’ থেকে।

১৯৪৮

মুসলিম লীগ সরকারের গণবিরোধী ভূমিকার বিরোধিতা করে তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। ৪ঠা জানুয়ারি গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। নবগঠিত এ দলের ১০ দফা দাবির অন্যতম ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা, সামরিক বাহিনীতে জনসংখ্যার অনুপাতে বাঙালিদের নিয়োগ, বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা, পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তর প্রভৃতি। ২৩শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে ঘোষণা দিলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ২রা মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এ আন্দোলনে প্রথম সারির একজন। ১১ই মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

 প্রবল ছাত্র-আন্দোলনের মুখে ১৫ই মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন।

 ১৯শে মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১১ই সেপ্টেম্বর তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।

১৯৪৯

২৯শে এপ্রিল ১৯৪৯-২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ পর্যন্ত কয়েকবার কারা মুক্তিলাভ এবং একটানা কারারুদ্ধ হয়ে অসুস্থতা সত্ত্বেও রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন।

 পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত করার লক্ষ্যে এর নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে তা কার্যকর।

 ২১শে জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণির কর্মচারীগণ তাঁর নেতৃত্বে মার্চ মাসে ধর্মঘটের ডাক দিলে কর্তৃপক্ষ তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেন।

 এপ্রিল মাসে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

 ২৩শে জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। কারাবন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান এর যুগ্ম-সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং জুন মাসের শেষ দিকে মুক্তিলাভ করেন।

 সেপ্টেম্বর মাসে দেশে চরম খাদ্যসংকট দেখা দিলে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ফলে কয়েক দিনের জন্য তাঁকে বন্দি করা হয়। অক্টোবরের শেষ দিকে লিয়াকত আলী খানের কাছে প্রতিনিধি দল নিয়ে দেখা করার অপরাধে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তাঁকে কয়েক দিনের জন্য গ্রেফতার করা হয়।

১৯৫০

১লা জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকায় আগমনকালে আওয়ামী মুসলিম লীগ এক ভুখা মিছিল বের করে।

 পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় এবং রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সোচ্চার হওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের দমননীতির অংশ হিসেবে ১১ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। সেবার তাঁকে প্রায় দুই বছর জেলে আটক রাখা হয়েছিল।

১৯৫২

ভাষা আন্দোলনকে দুর্বল ও স্তিমিত করার লক্ষ্যে ১৪ই ফেব্রুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

 ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি অবস্থায় অনশন ধর্মঘট পালন করেন। অনশন ধর্মঘটরত অবস্থায় ১৮ই ফেব্রুয়ারি তাঁকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। ২৭শে ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তি পান।

 ২৭শে এপ্রিল ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

 পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ।

 অক্টোবরে শান্তি পরিষদের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে তিনি চীন সফর করেন এবং বাংলা ভাষার অধিকার সম্পর্কে মাও সে তুং-এর সঙ্গে আলাপ করেন।

১৯৫৩

৯ই জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

 পরবর্তী নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে ১৪ই নভেম্বর দলের আহূত কাউন্সিল অধিবেশনে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব পাশ করাতে সক্ষম হন।

১৯৫৪

মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া এলাকা থেকে বিপুল ভোটে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগের প্রার্থী প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামান।

 ১৪ই মে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

 ২৯শে মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করার পর ৩০শে মে তাঁকে বন্দি করা হয়। ২৩শে ডিসেম্বর তিনি ছাড়া পান।

১৯৫৫

৫ই জুন বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৭ই জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘোষণা করা হয়। ২৩শে জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন। ২৫শে আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন :

Sir, you will see that they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’ We have demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan. The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we have to go back to Bengal and ask them whether they accept it. So far as the question of One-Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What about joint electorate? What about autonomy? The people of East Bengal will be prepared to consider One-Unit with all these things. So, I appeal to my friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebiscite.

[অনুবাদ স্যার, আপনি দেখবেন ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কি না। এক ইউনিটের প্রশ্নটা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আপনারা এই প্রশ্নটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কি হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্নটারই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধেই বা কি ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নগুলোর সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাব তারা যেন আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ অথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।]

 ২১শে অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৬

৩রা ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে খসড়া শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান। ১৪ই জুলাই আওয়ামী লীগের সভায় প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন বঙ্গবন্ধু। ৪ঠা সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয়। চকবাজার এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে ৩ জন নিহত হয়। ১৬ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৫৭

সংগঠনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ৩০শে মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২৪শে জুন থেকে ১৩ই জুলাই তিনি চীনে সরকারি সফর করেন।

১৯৫৮

৭ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস জেলখানায় থাকার পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেটেই গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬০

৭ই ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। সামরিক শাসন ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ সময়ই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দ দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি মহকুমায় এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন।

১৯৬২

৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ২রা জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ই জুন বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ২৫শে জুন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন। ৫ই জুলাই পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহোর যান, এখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় মোৰ্চা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে সারা বাংলা সফর করেন।

১৯৬৩

সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে পরামর্শের জন্য লন্ডন যান। ৫ই ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে ইন্তেকাল করেন।

১৯৬৪

২৫শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। দাঙ্গার পর আইয়ুববিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ গ্রহণ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬৫

শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে মামলা দায়ের। এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

১৯৬৬

৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ১লা মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ৮ই মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ৭ই জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মনু মিয়াসহ ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়।

১৯৬৮

৩রা জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামিদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়।

 ১৯শে জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিচারকার্য শুরু হয়।

১৯৬৯

৫ই জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। পরে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআর-এর গুলিবর্ষণ, বহু হতাহতের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে আইয়ুব সরকার ১লা ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানায় এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দান করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তিদান প্রত্যাখ্যান করেন। ২২শে ফেব্রুয়ারি জনগণের অব্যাহত চাপের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিকে মুক্তি দানে বাধ্য হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার এই সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের ভাষণে ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।

 ১০ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে বলেন, ‘গণঅসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া কোন বিকল্প নেই।’ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ই মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করেন এবং ১৪ই মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। ২৫শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। ২৫শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তিন সপ্তাহের সাংগঠনিক সফরে লন্ডন গমন করেন।

 ৫ই ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, “একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুর চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। …একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। …জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি—আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।

১৯৭০

৬ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১লা এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৭ই জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১৭ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে ‘নৌকা’ প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধোলাইখালে প্রথম নির্বাচনী জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। ২৮শে অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশে বেতার-টিভি ভাষণে ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১২ই নভেম্বরের গোর্কিতে উপকূলীয় এলাকায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা বাতিল করে দুর্গত এলাকায় চলে যান এবং আর্তমানবতার প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের ঔদাসীন্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তিনি গোর্কি উপদ্রুত মানুষের ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে।

১৯৭১

৩রা জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্য থাকার শপথ গ্রহণ করেন। ৫ই জানুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তাঁর সম্মতির কথা ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮শে জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিন দিন বৈঠকের পর আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান।

 ১৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে জনাব ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।’

 ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩রা মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৩রা মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হবার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান।

 ৭ই মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সগ্রাম, জয় বাংলা’। ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। …রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।”

 তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। একদিকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অপরদিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ যেত, বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতেন। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসাবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ১৬ই মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য জনাব ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫শে মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার।

 বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন:

This may be my last message, from to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.

[অনুবাদ: এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।]

 এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিমলিখিত একটি বার্তা পাঠান :

পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।

 বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিন দিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।

 ২৬শে মার্চ জে. ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে।

 ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশে সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। তার আগে ৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিগামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাঁকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে।

১৯৭২

৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠানো হয়। ৯ই জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।

 জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছালে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারত যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

 ১লা মে তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ৩০শে জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর লন্ডন থেকে তিনি জেনেভা যান। ১০ই অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ৪ঠা নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ই মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন। ১৫ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। প্রশাসনিকব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, ১১,০০০ প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ, মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য নারী পুনর্বাসন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্প কারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যার মোকাবেলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চালানো হয়। অতি অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

১৯৭৩

জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ। ৩রা সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ই অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন।

১৯৭৪

২২শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন।

১৯৭৫

২৫শে জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ২৪শে ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন যার লক্ষ্য ছিল–দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করবার মানসে ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

 সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে আসে।

 নতুন আশার উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না।

 ১৫ই আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ কামাল, পুত্র লে. শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আবদুল নঈম খান রিন্টুসহ ১৬ জনকে ঘাতকরা হত্যা করে।

 ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হবার পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। কেড়ে নেয় জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার।

 বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার জন্য হত্যাকারীদের বিচারের বিধান রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য ২৬শে সেপ্টেম্বর এক সামরিক অধ্যাদেশ (ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স) জারি করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে এক কুখ্যাত কালো আইন সংবিধানে সংযুক্ত করে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করে। খুনিদের বিদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে।

 ১৯৯৬ সালের ২৩শে জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ২রা অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে হত্যার বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়। ১২ই নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। ১লা মার্চ ’৯৭ ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। ৮ই নভেম্বর ’৯৮ জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ৭৬ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১৪ই নভেম্বর ২০০০ সালের হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলে দুই বিচারক বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন এবং বিচারপতি এ.বি.এম খায়রুল হক দ্বিমতে বিভক্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর তৃতীয় বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। এরপর পাঁচজন আসামি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। ২০০৭ সালে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠিত হয়। ২০০৯ সালে ২৯ দিন শুনানির পর ১৯শে নভেম্বর প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচজন বিচারপতি রায় ঘোষণায় আপিল খারিজ করে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১০ সালের ২রা জানুয়ারি আপিল বিভাগে আসামিদের রিভিউ পিটিশন দাখিল এবং তিন দিন শুনানি শেষে ২৭শে জানুয়ারি চার বিচারপতি রিভিউ পিটিশনও খারিজ করেন। এদিনই মধ্যরাতের পর ২৮শে জানুয়ারি পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঘাতকদের একজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা গেছে এবং ছয়জন বিদেশে পলাতক রয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি ৩৪ বছর পর বাস্তবায়িত হলো।

 ১৫ই আগস্ট জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে বাঙালি জাতি পালন করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *